০৮.
আফ্রিকার সম্মানিত আমীর মুসা বিন নুসাইরের আন্দালুসিয়া আগমনের কথা শুনে তারিক বিন যিয়াদ অত্যন্ত খুশী হন। আনন্দের আতিশয্যে তিনি সবাইকে ডেকে বলছিলেন:
‘আমার আধ্যাত্মিক নেতা সম্মানিত মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়া এসে পড়েছেন। এখন আমি আমার মাঝে আরও বেশি করে আধ্যাত্মিক শক্তি অনুভব করছি। আমি আমার মনিবের পদতলে টলেডুর সওগাত পেশ করতে চেয়েছিলাম। এখন আমি আন্দালুসিয়ার আরও বিস্তৃত অঞ্চল তার কদম মুবারকে পেশ করব।’
এ সময় তারিক বিন যিয়াদ টলেডুতে অবস্থান করছিলেন। টলেডুর আশ-পাশের যেসব অঞ্চল তখনও বিজিত হয়নি, সেগুলো সম্পর্কে তিনি সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। তার সামনে ছিল তিনটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহর–মায়েদা, মায়া ও গ্ল্যাশিয়া। তারিক বিন যিয়াদ এই শহর তিনটি বিজিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য তিনি যে রাস্তা নির্বাচন করেন, সেটি ছিল অসংখ্য জলাভূমিতে পরিপূর্ণ অত্যন্ত দুর্গম একটি রাস্তা।
‘কিন্তু ইবনে যিয়াদ! জুলিয়ান বললেন। সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য আপনি যে রাস্তা নির্বাচন করেছেন, সেটি এতটাই দুর্গম যে, সে রাস্তা অতিক্রম করা কিছুতেই সম্ভব নয়।’
‘আমি জানি, সহজ রাস্তা কোনটি। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আপনারও নিশ্চয় জানা আছে যে, রাস্তাটি সহজ হলেও অনেক দীর্ঘ। আমি সফরের মধ্যে এত দীর্ঘ সময় নষ্ট করতে চাই না। জলাভূমির রাস্তাটি দুর্গম হলেও গন্তব্যে পৌঁছতে অর্ধেকের চেয়েও কম সময় লাগবে। আমার বাবার মুজাহিদগণ এই দুর্গম রাস্তা সহজেই অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। আমি আরও অনেক এলাকা বিজিত করে আমীর মুসা বিন নুসাইরের সাথে মিলিত হতে চাই। আমি তাকে এ কথা বলতে চাই না যে, আমি এ জন্য সামনে অগ্রসর হয়নি, কারণ সামনের রাস্তা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। আমি সহজ রাস্তা অনুসন্ধান করছিলাম।’
‘সম্মানিত বন্ধু আমার!’ আউপাস বলল। এই রাস্তা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, অনেক সিপাহীর প্রাণহানীও ঘটতে পারে। এই সম্ভাবনাও আছে যে, সৈন্যবাহিনী গোলকধাঁধায় আটকা পড়তে পারে।’
‘আউপাস!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এমন কোন বিপদ অবশিষ্ট আছে কি, যা আমাদের সামনে আসেনি? রডারিক এক লাখ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করেছিল। তার বাহিনীর অর্ধেক ছিল অশ্বারোহী। আউপাস! এটা কি আমাদের জন্য কম বিপদজ্জনক বিষয় ছিল? সে সময় আমাদের কাছে কী ছিল? মাত্র বার হাজার সৈন্য ছিল আমাদের কাছে। তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছিল অশ্বারোহী, আর সকলেই ছিল পদাতিক। আশা করি, আপনাদের সকলেরই মনে আছে যে, টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা শুনে সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি নিজে আতঙ্কিত হয়ে বলেছিলাম যে, এই শহর জয় করা এত সহজ হবে না। আমরা যদি এ কথা ভেবে বসে থাকতাম যে, আমরা মানুষের গড়া এমন দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাঙ্গতে সক্ষম হব না তাহলে এই শহরে আমরা কখনই প্রবেশ করতে পারতাম না। কিন্তু আমরা কী দেখলাম? যখন আমরা আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে সামনে অগ্রসর হলাম তখন আমরা শহরের ফটক খেলা দেখতে পেলাম। আউপাস! আমরা আল্লাহর ফরমাবরদার সম্প্রদায়। আল্লাহ তাকেই পথের সন্ধান দান করেন, যে নির্ভয়ে তার পথ অবলম্বন করতে চায়।’
জুলিয়ান ও আইপাস তারিক বিন যিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছিল, তারা তারিক বিন যিয়াদের মস্তিষ্কের সুস্থতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছিলেন।
***
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী জলাভূমির সীমানায় প্রবেশ করল। জুলিয়ান ও আউপাস তাদের সাথেই ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ টলেডুর প্রশাসনিক কাজের জন্য যেসকল প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল ইহুদি। তারিক বিন যিয়াদ মুসলিম প্রশাসকদের মত ইহুদি প্রশাসকদেরকেও সমান মর্যাদা প্রদান করেছিলেন। তিনি ইহুদিদেরকে মুসলমানদের বন্ধু ও হিতাকাক্ষী মনে করতেন। তিনি এখনও জানতে পারেননি যে, ইহুদিরা ইসলাম বিদ্বেষের কারণে তাদের শয়তানী কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটাচ্ছে এবং তারা অনেক শহরেই বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে সক্ষম হয়েছে।
উত্তর আফ্রিকা আর আরবের মরুভূমির মাঝে লালিত-পালিত হওয়া মুজাহিদ বাহিনী যখন জলাভূমির বিশাল-বিস্তৃত এলাকায় প্রবেশ করল তখন এই জলাভূমিকে তাদের কাছে পৃথিবীর স্বর্গ মনে হল। চার দিকে থরে থরে সাজানো সবুজের নিসর্গ আর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তাদের ক্লান্ত দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল। ঘোড়াগুলো পর্যন্ত ‘দুলকি চালে চলতে লাগল।
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী সামনে অগ্রসর হলে একটি নদী দেখতে পেল। নদীটি তেমন একটা গভীর ছিল না। মাঝখানে কমর পানি হবে। নদী পার হওয়া মুজাহিদদের জন্য তেমন কঠিন কোন বিষয় ছিল না। কিন্তু এই পাহাড়ী নদীটি এতটাই খরস্রোতা যে, কোন শক্তিশালী মুজাহিদের পক্ষেও পাও জমিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল। অস্বাভাবিক স্রোতস্বিনী হওয়ার সাথে সাথে নদীর পানি এতটাই হীমশীতল ছিল যে, শরীরে লাগলে মনে হত, এখনই রক্ত জমে বরফ হয়ে যাবে। পানিতে পা রাখার সাথে সাথে ঘোড়াগুলো পর্যন্ত ঠাণ্ডার প্রচণ্ডতায় ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। মুজাহিদদের সামানপত্র গাধার উপর রাখা ছিল। ঘোড়াগাড়ি বা গাধাগাড়ি সাথে আনা হয়নি। কারণ, তারিক বিন যিয়াদকে বলা হয়েছিল, জলাভূমিতে রাস্তা এতটাই সংকির্ণ হবে যে, গাড়ি নিয়ে পথ চলা সেখানে কিছুতেই সম্ভব হবে না।
চারজন অশ্বারোহী আগে আগে চলছিল। একজন আরেকজনের থেকে এতটা দূরতৃবজায় রেখে নদী পার হচ্ছিল, যাতে অন্যদের আওয়াজ শুনতে পারে। সবার আগে যে ছিল, সে কোন অসুবিধা দেখলে তার পিছনের সিপাহীকে আওয়াজ দিত। আর সে আওয়াজ দিত তার পিছনের জনকে। এভাবে সর্বশেষ ব্যক্তি পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছে যেত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক, সিপাহী জানতে পারত, সামনে কোন বাঁক থাকলে কীভাবে তা পার হতে হবে।
অনেক কষ্ট স্বীকার করে মুজাহিদ বাহিনী খরস্রোতা এই নদী পার হয়ে বড় জোর দুই মাইল পথ অতিক্রম করে দেখেন, সামনে পূর্বের ন্যায় আরেকটি খরস্রোতা নদী। মুজাহিদগণের কাপড় তখনও ভেজা ছিল। কাপড় থেকে ফুটা ফুটা পানি ঝরে পড়ছিল। নদীর গভীরতা পূর্বের নদীর মতই কমর পর্যন্ত। কিন্তু স্রোত পূর্বের নদীর চেয়েও অনেক বেশি। এই নদীটিও মুজাহিদ বাহিনী হাত ধরাধরি করে পার হয়ে গেলেন। অশ্বারোহীগণ অনেকটা সহজে তাদের অশ্বগুলোকে নদী পার করে নিতে সক্ষম হলেন। কিন্তু একেকটি গাধাকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে নদী পার করতে গিয়ে কয়েকজন নওজোয়ান মুজাহিদকে রীতিমত গলদঘর্ম হতে হল। তারপরও চার-পাঁচটা খচ্চর নদীর মাঝখানে এসে আর স্থির থাকতে পারল না। পানির তীব্র স্রোতে সেগুলো ভেসে গেল। কোন একজন সালার পেছন থেকে চিৎকার করে বললেন, যেসব খচর ভেসে গেছে, সেগুলোকে উদ্ধারের চেষ্টা করো না, অন্যথায় তোমরাও ভেসে যাবে। জলাভূমির রহস্যময় সৌন্দর্য প্রথম আঘাতেই চারটি জীবন ছিনিয়ে নিল।
***
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী যত সামনে অগ্রসর হচ্ছিল জলাভূমির রহস্যময় সৌন্দর্য ততই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছিল। জলাভূমির স্থানে স্থানে কাঁটাদার বৃক্ষের ঘন ঝোঁপ-ঝাড় ছিল। কোন কোন স্থানে এসব কাঁটাদার ঝোঁপ-ঝাড় এতই ঘন ছিল যে, সেগুলো অতিক্রম করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। এসব ধন ঝোঁপ-ঝাড়ের কারণে সূর্যের কিরণ মাটি পর্যন্ত পৌঁছতে পারত না। মাটি এতটাই আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে ছিল যে, পদাতিক সৈন্যদের চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। এই কাঁটাদার ঘন ঝুপ-ঝাড় পেরোতে মুজাহিদ বাহিনীর পূর্ণ দুই দিন লেগে গেল। সমতল ভূমিতে এই বাহিনী দুই দিনে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল পথ অতিক্রম করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু কাঁটাশুলের জঙ্গলে দুই দিনে দশ মাইল পথ অতিক্রম করাও সম্ভব হয়নি। তার উপর দুই দিনের মধ্যবর্তী রাতে মুজাহিদ বাহিনীকে যাত্রা বিরতি করতে হয়েছে।
জলাভূমির পুরো এলাকায় কেবলমাত্র কাঁটাগুলোর জঙ্গলই ছিল না, বরং স্থানে স্থানে ছোট-বড় পাহাড়ী টিলা আর বড় বড় পাথরে চাইও ছিল। খানাখন্দ আর চড়াই-উতরাইও ছিল ভয়াবহ রকমের। মুজাহিদ বাহিনী একবার উপরে উঠছিল, আরেকবার নিচে নামছিল। পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল পদে পদে। ঘোড়াগুলো তো কোন রকমে পা জমিয়ে চলে যাচ্ছিল; কিন্তু পদাতিক মুজাহিদগণের অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তারা একজন আরেকজনকে ধরে ধরে চড়াই-উতরাই পার হচ্ছিল।
সিপাহসালার তারিক বিন যিয়াদ এমন ভীতিকর ও অপ্রতিকূল অবস্থায় কেবলমাত্র নিজ বাহিনীকেই নয়; বরং গোটা উম্মতে মুহাম্মদীকে এক নতুন পথের দিশা দিচ্ছিলেন। তিনি তার বাহিনীর সাথে নীরবে পথ চলছিলেন না, বরং তিনি বাহিনীর প্রথম ব্যক্তি থেকে শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত ঘোড়া দৌড়িয়ে যেতেন এবং চিৎকার করে সকলের মনোবল চাঙ্গা করতেন। তিনি তার বাহিনীর প্রত্যেক নওজোয়ানকে লক্ষ্য করে বলছিলেন :
‘এই খরস্রোতা নদী, আর নদীর হীম-শীতল পানি তোমাদেরকে আটকে রাখতে পারবে না।’
পাহাড়ের বুক চিরে বের হয়ে যাওয়ার মত ক্ষমতা তোমাদের আছে।’
‘আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন।’
হে আল্লাহর সিংহ-শার্দুল! তোমাদের মনযিল অতি নিকটে।
‘তোমরা তো জান্নাতের দিকে পথ চলছ।’
‘গোটা আন্দালুসিয়া তোমাদের। আন্দালুসিয়ার ধন-ভাণ্ডার তোমাদের।’
‘মুখে আল্লাহর নাম আর বুকে হিম্মত নিয়ে এগিয়ে চল।’
তারিক বিন যিয়াদের কথাগুলো এতটাই মর্মস্পর্শী আর আন্তরিক ছিল যে, জীবনবাজি রাখা এই অভিযানে প্রত্যেকজন মুজাহিদের চেহারা ছিল আনন্দে উজ্জ্বল আর ঠোঁটে ছিল মুচকিহাসি। তারিক বিন যিয়াদের উদ্দীপনামূলক কথার উত্তরে সকল মুজাহিদ এক সাথে বলছিল :
‘তারিক! আমরা তোমার সাথে আছি।‘
মুহুর্মুহু আল্লাহ আকবার ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী সামনে এগিয়ে চলছিল। তারিক-বাহিনীর এই অভিযানের বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অভিযান এতটাই ভয়ঙ্কর ও লোমহর্ষক ছিল যে, এর আদ্যোপান্ত একত্রিত করা হলে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থের রূপ ধারণ করবে। এমন ভয়াবহ অভিযানে গোটা বাহিনী না হলেও প্রায় অর্ধেক বাহিনীর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে এই লোমহর্ষক অভিযানের দুই-একটি ঘটনা উল্লেখ করা হল।
***
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী চলতে চলতে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছল যেখানের মাটি অদ্ভুত রকম ঘাস দ্বারা ঢাকা ছিল। এই এলাকায় কোন গাছ ছিল না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই এলাকার আয়তন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় এক মাইল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই এক মাইল এলাকায় শুধুমাত্র ঘাসই ছিল। ঘাসগুলো এক থেকে চার ফিট পর্যন্ত লম্বা ছিল। এলাকাটি বড় বড় গাছ আর উঁচু উঁচু টিলা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। বিভিন্ন প্রকার গাছ-গাছালি টিলাগুলোকে ঢেকে রেখেছিল। রাস্তা তো দূরের কথা পায়ে হাঁটার সরু কোন পথও সেই এলাকায় ছিল না। মুজাহিদ বাহিনী ছয়-সাতটি সারিতে বিন্যস্ত হয়ে পথ চলছিল। প্রত্যেক সারির অগ্রভাগের মুজাহিদগণ সরাসরি সেই উঁচু ঘাসের বনে ঢুকে পড়লেন। অগ্রভাগের সকলেই ছিলেন অশ্বারোহী।
ঘোড়ার পদাঘাতে কর্দমাক্ত মাটি থেকে পানি ছিটকে পড়ছিল। অশ্বারোহী মুজাহিদগণ এই সামান্য পানির পরোয়া না করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাদের পিছনে পদাতিক বাহিনীও ঘাসের বনে প্রবেশ করে সামনের দিকে চলতে লাগল। হঠাৎ সারির একেবারে প্রথম দিকের অশ্বারোহীদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনা গেল। তারা এলোপাথারী ছুটাছুটি শুরু করে দিল। তারা কিছুটা গভীর পানিতে চলে গিয়েছিল। ঘোড়াগুলো অত্যন্ত জোরে জোরে চিৎকার করছিল, আর আরোহীর নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল। মনে হচ্ছিল, ঘোড়াগুলো মহাবিপদ আক্রান্ত হয়েছে।
পদাতিক মুজাহিদদের মধ্যে যারা ঘাসের বনে কিছু দূর অগ্রসর হয়েছিল, তারা পিছন দিকে ফিরে ভাগতে শুরু করল। তাদের কয়েকজন কাদায় লুটোপুটি খাচ্ছিল, আর ভয়ঙ্করূপে চিৎকার করে বলছিল, বাঁচও! বাঁচাও! আমাদেরকে বাঁচাও!!!
তাদের সামনে তিন-চারটি ঘোড়া এমনভাবে চিৎকার করছিল যে, মনে হচ্ছিল ঘোড়াগুলো হায়েনার কবলে পড়েছে।
‘কুমির। কুমির!!’ কেউ একজন চিৎকার করে বলল। ঝাঁকে ঝাঁকে কুমির।
স্যাঁতসেঁতে মাটি আর পানি জমে থাকার কারণে ঘাসগুলো অনেক উঁচু হয়ে গিয়েছিল। এগুলো ঘাস নয়; বরং ঘাসের মত দেখতে এক ধরনের জলজ-উদ্ভিদ। এগুলো এত ঘন যে, নিচে পানির চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায় না। সামনের দিকে পানি কিছুটা গভীর। অশ্বারোহী আর পদাতিক মুজাহিদগণ সামনে অগ্রসর হলে কুমিরগুলো তাদের উপর আক্রমণ করে বসে। কুমির সাধারণত এমনই আর্দ্র ও সঁতসেঁতে মাটিতে বসবাস করে। কুমিরের সংখ্যা দেড়-দুইশ’র চেয়ে কম ছিল না। কুমিরগুলো একাযোগ আক্রমণ করে কয়েকটি ঘোড় ও কয়েকজন পদাতিক মুজাহিদকে টেনে-হেঁচড়ে গভীর পানিতে ধরে নিয়ে যায়। অন্যরা পড়িমড়ি করে কোন রকমে জান নিয়ে পালিয়ে এলো। অগত্যা মুজাহিদ বাহিনী রাস্তা পরিবর্তন করে পাহাড়ী পথ ধরে সামনে অগ্রসর হল।
***
নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হয়ে মুজাহীদ বাহিনী নিয়মিত যাত্রা বিরতি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের মানসিক অবস্থা পূর্বের মতই চাঙ্গা ছিল। কিন্তু তাদের দৈহিক অবস্থা ছিল একেবারে শোচনীয়। তারিক বিন যিয়াদের উৎসাহ উদ্দীপক কথা আর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার বদৌলতে গোটা বাহিনী দীপ্ত কদমে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। মুজাহিদ বাহিনী যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছিল, পথের দুর্গমতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
এক দিনের কথা। মুজাহিদ বাহিনী সামনে অগ্রসর হচ্ছিল এমন সময় সম্ভব দিক থেকে চারটি ঘোড়া এগিয়ে এলো। দুটি ঘোড়র উপর দুজন সওয়ারী ছিল। তৃতীয় ঘোড়ার উপর একজন মুজাহিদকে এমনভাবে রাখা ছিল যে, তার মাথা এক দিকে, আর পাও আরেক দিকে ঝুলছিল। তার কাপড় ছিল রক্তে রঞ্জিত। চতুর্থ ঘোড়র উপর একটি সিংহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সিংহটির দেহে তিনটি তীর বিদ্ধ হয়ে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল যে, এই চারজন মুজাহিদ তাদের বাহিনীর চেয়ে অনেক আগে আগে পথ চলছিল। চারজনের মধ্যে সকলের পিছনে যে ছিল, তার উপর সিংহ আক্রমণ করে বসে। ঘোড়া ভয় পেয়ে গতি বাড়িয়ে দেয়। সিংহও ঘোড়াকে লক্ষ্য করে দৌড়াতে থাকে। ঘোড়া এত তীব্র গতিতে ছুটে চলছিল যে, ঘোড়ার আরোহী ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। অন্য তিনজন সিংহকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারে। সিংহ মরতে মরতে আরেকজনের উপর আক্রমণ করে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। যে দুইজন সিংহের আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়েছিল, তারা শহীদ মুজাহিদের জানাযা আদায় করে সেখানেই তাকে দাফন করে দেয়। তারপর আহত মুজাহিদকে ঘোড়ায় উঠিয়ে মূল বাহিনীর সাথে এসে মিলিত হয়।
এ জঙ্গলে এটাই ছিল মানুষের প্রথম পদচারণা। হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের জন্য এটা ছিল একটি অভয়ারণ্য। হঠাৎ মানুষের বিশাল এক বাহিনী জঙ্গলে প্রবেশ করার কারণে জম্ভগুলো ভয়ে এদিক-সেদিক চলে যাচ্ছিল। তারপরও কয়েকটি ঘোড়া ও খচ্চর হিংস্র জন্তর আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে গোটা বাহিনীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। কেউ যেন একা একা কোথাও না যায়।
জলাভূমির এই অভিযানে তারিক-বাহিনীর দেড় মাসের মতো সময় লেগে গেল। কিন্তু এখনও জলাভূমি শেষ হওয়ার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না। অভিযানের এই পর্যায়ে ঐতিহাসিকগণ যে বিবরণ তুলে ধরেছেন, তা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক ও এ্যাডভ্যাঞ্জারপূর্ণ।
এ পর্যন্ত পৌঁছে মুজাহিদ বাহিনী অত্যন্ত সরু ও অত্যধিক উঁচু একটি রাস্তার সম্মুখীন হন। মুজাহিদ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল। এখান থেকে শুরু হয় মুজাহিদ বাহিনীর আরও ভয়ঙ্কর ও লোমহর্ষক এক অভিযান।
সামনে অগ্রসর হওয়ার একটি মাত্র পথই খোলা ছিল। পথটি ছিল অত্যন্ত সরু ও অত্যধিক উঁচু। একটি পাহাড়কে কেন্দ্র করে পথটি উপরের দিকে উঠে গেছে। পথটি যতই উপরের দিকে উঠেছে, ততই অপ্রশস্ত ও সরু হয়ে গেছে। পথের শেষ দিকে একজন মানুষ বা একটি ঘোড়র পক্ষে সামনে অগ্রসর হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। উপায়ন্তর না দেখে মুজাহিদ বাহিনী সেই পথ ধরে সামনে অগ্রসর হতে শুরু করে।
কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর দুই-তিনটি খচর পা পিছলে চোখের পলকে পাহাড়ের গভীর খাদে পড়ে যায়। খচ্চরগুলোকে কিছুতেই বাঁচানো সম্ভব ছিল না। মুজাহিদ বাহিনী সামনের দিকে এগিয়ে চলল। চলতে চলতে তারা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছল, যেখানে পাহাড়গুলো এক সাথে মিশে সুউচ্চ এক দেয়ালের রূপ ধারণ করেছে। পিছনের মতো সরু কোন রাস্তার চিহ্নও চার দিকে দেখা যাচ্ছিল না।
মুজাহিদ বাহিনীর গন্তব্য ছিল এই পাহাড়ের শীর্ষচূড়া। গন্তব্যে পৌঁছতে হলে পাহাড়ের এই দেয়াল বেয়ে উপরে উঠা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এই রাস্তা অবলম্বন করার আগে পূর্ণ একদিন যাত্রা বিরতি দিয়ে রাস্তা খোঁজার জন্য চার দিকে লোকজন পাঠানো হল। কিন্তু চার দিকে উঁচু উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের গভীর খাদ, আর পাহাড়ী নদী ছাড়া কোন কিছুই দেখা গেল না। অগত্যা এই পাহাড়ী দেয়ালের খাঁজ বেয়ে উপরে উঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। মুজাহিদগণ দম বন্ধ করে পাহাড়ের খাজে খুঁজে পাও রেখে অগ্রসর হলেন। সামান্য পা পিছলে গেলেই শত শত ফুট গভীর খাদে পতন সুনিশ্চিত। ঘোষণা করে দেওয়া হল, কেউ যেন ডানে-বামে না তাকায়।
রাস্তা খুবই সংকীর্ণ। আর উচ্চতা এত বেশি যে, নিচের দিকে তাকালে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যেত, মাথা ভন ভন করে ঘুরে উঠত। গোটা বাহিনী সন্তর্পণে পাথরের খাঁজ বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। হঠাৎ দুটি ঘোড়ার পা পাথর থেকে সামান্য সরে গেলে ঘোড়া দুটি ভয় পেয়ে কেঁপে উঠল। পর মুহূর্তেই পাহাড়ের খাদ বেয়ে গড়িয়ে ডিগবাজি খেয়ে আরোহীসহ দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। তার পর আরও দুই-তিনজন মুজাহিদের পরিণতিও এমনই হল। তাদের চিৎকার আর আর্তনাদের আওয়াজ ধীরে ধীরে বহু দূরে মিলিয়ে গেল। পরক্ষণেই ভয়াবহ এই পাহাড়ী পথে ভুতুড়ে নীরবতা নেমে এলো।
প্রায় সকল ঐতিহাসিকই ভয়ঙ্কর এই রাস্তার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তারা সকলেই লেখেছেন, একমাত্র তারিক বিন যিয়াদের পক্ষেই সম্ভব, এমন ভয়াবহ ও বিপদজ্জনক পথে সেনাবাহিনী পরিচালনা করা। তিনি যদি তার বাহিনীকে এই বিপদজ্জনক পথ অতিক্রম করার নিয়ম-কানুন না বলে দিতেন তাহলে তার বাহিনীর অধিকাংশ সিপাহী আর ঘোড়া আত্মঘাতী হয়ে যেত।
অত্যন্ত সরু আর অস্বাভাবিক উঁচু এই রাস্তা মাত্র দুই দিনে অতিক্রম করা সম্ভব হল। রাতের বেলাও অভিযান অব্যাহত ছিল। এমন স্থানে যাত্রা বিরতি করা আত্মহত্যা করার শামিল। সামান্য সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি করলেও ক্লান্তি কারণে ঝিমুনি এসে পড়ত। আর এই ঝিমুনি গোটা বাহিনীকে পাহাড়ের গভীর খাদের দিকে ঠেলে দিত। মুজাহিদগণ পাহাড়ের খাদ বেয়ে গড়িয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হতেন। তাই যাত্রা বিরতি না করে রাতের বেলাও অভিযান অব্যাহত রাখা হল। রাতে পথ চলার জন্য মশাল জ্বালানো হত।
মুজাহিদ বাহিনীর চলার গতি একেবারেই কমে গিয়েছিল। পরদিনও একই গতিতে মুজাহিদ বাহিনী এগিয়ে চলল। মুজাহিদ বাহিনী যতই গ্রসর হচ্ছিল, রাস্তা ততই উঁচু আর সংকীর্ণ হচ্ছিল। মুজাহিদগণের কাছে মনে হচ্ছিল, তারা স্বপ্নে পথ চলছে। তাদের দু’চোখ জোড়ে ছিল ঘুমের আধিক্য, আর সারা শরীর জোড়ে ছিল সফরের ক্লান্তি। তার উপর অজানা বিপদের আশঙ্কা তাদের মন-মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সবচেয়ে বড় কথা হল, দুদিন যাবত মুজাহিদগণ ক্ষুধার্ত ছিলেন। খাওয়ার মতো কোন কিছুই তারা পাননি। গত দুই দিনে ঘোড়া আর খচ্চরগুলোকেও কোন কিছু খাওয়ানো হয়নি। জীব-জন্তুগুলো বেকাবু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। আরোহীদের কৃতিত্ব স্বীকার করতে হয় যে, তারা জগুলোকে আয়ত্বে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে রাস্তা ধীরে ধীরে প্রশস্ত হয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর এই রাস্তা এক পাহাড়ের সাথে মিশে গেছে। সেখান থেকে বাঁক নিয়ে সামান্য অগ্রসর হয়ে রাস্তা এক প্রশস্ত উপত্যকার সাথে একাকার হয়ে গেছে। উপত্যকা এতটাই প্রশস্ত ছিল যে, গোটা মুজাহিদ বাহিনী সহজেই সেখানে অবস্থান করতে পারত।
তারিক বিন যিয়াদ তার বাহিনীকে এই উপত্যকায় যাত্রা বিরতি করার নির্দেশ দিলেন। উপত্যকাটি ছিল সবুজ-শ্যামল। ঘোড়া ও খচরগুলোকে লাগামমুক্ত করে দেওয়া হল। মুজাহিদগণের অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, তারা প্রশস্ত জায়গা পেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। যে যেখানে বসেছিলেন, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
***
তারিক বিন যিয়াদের নির্দেশে মুজাহিদ বাহিনী দুই দিন এই উপত্যকায় অবস্থান গ্রহণ করল। দুই দিন বিশ্রাম নেওয়ার পর মুজাহিদ বাহিনী নতুন উদ্যমে সামনে চলতে শুরু করল। মুজাহিদ বাহিনী যেসব এলাকা অতিক্রম করছিল, সেগুলো সমতল ছিল না ঠিক; কিন্তু পূর্বের এলাকাগুলোর মত তেমন দুর্গমও ছিল না। মুজাহিদ বাহিনী অনেকটা নির্ভয়ে পথ চলছিল।
সামনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ছোট ছোট কয়েকটি দল আগে আগে পথ চলছিল। তাদের দু-একটি দল পিছিয়ে এসে তারিক বিন যিয়াদকে সংবাদ দিল, আর মাত্র এক দিনের পথ অতিক্রম করলেই আমরা একটি শহরে পৌঁছতে পারব। শহরের নাম মায়েদা।
সংবাদ পেয়ে তারিক বিন যিয়াদ গোটা বাহিনীকে সেখানেই অবস্থান করার নির্দেশ দিলেন, যাতে পূর্ণ একদিন বিশ্রাম নিয়ে নতুন উদ্যমে মুজাহিদ বাহিনী শহরে প্রবেশ করতে পারে।
যে রাস্তা অবলম্বন করে তারিক বিন যিয়াদ এই লোমহর্ষক অভিযান পরিচালনা করছিলেন ইতিহাসে সেই রাস্তাটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে সাব্যস্ত হয়েছিল যে, পরবর্তীতে ‘তারিক সরণি’ নামে পরিচিত লাভ করে। আজ শত শত বছর পরও মানুষ সেই রাস্তাটিকে ‘তারিক সরণি’ নামেই চিনে।
মাত্র একদিনের দূরত্বে তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী বিশ্রাম করছিল। মায়েদার অধিবাসীরা মুসলিম বাহিনীর আগমন সম্পর্কে পূর্বেই জানতে পেরেছিল। এত দ্রুত আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তাদের ছিল না। তার পরও তারা প্রস্তুত হয়েই ছিল। দুর্গের ফটক বন্ধ করে মায়েদার সিপাহীরা দুর্গ প্রাচীরের উপর ওঁতপেতে রইল। মুসলিম বাহিনী ফটক বন্ধ দেখে দুর্গ অবরোধ করল।
আন্দালুসিয়ার বড় বড় শহরের মধ্যে মায়েদাও একটি। ভূ-রাজনৈতিক ও অনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মায়েদার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি।
শহর রক্ষা প্রাচীরের উপর সিপাহীরা তীর-ধনুক আর বর্শা-বল্লম নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা মুসলিম বাহিনীকে লক্ষ্য করে হুঙ্কার দিচ্ছিল। তাদের হম্বিতম্বি দেখে মনে হচ্ছিল, তারা মায়েদার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে আছে। তারিক বিন যিয়াদ ঘোড়ায় চড়ে শহরের চতুর্দিকে চকর লাগালেন। দুর্গের দেয়াল তাঁর কাছে খুবই মজবুত মনে হল। জনসাধারণ আর সিপাহীদের মনোভাব দেখে মনে হল, তাদের মনোবল শহর রক্ষা-প্রাচীরের মতই মজবুত।
তারিক বিন যিয়াদ স্থানীয় ভাষায় ঘোষণা করালেন, “তোমাদের জন্য উত্তম হল, দুর্গের ফটক খুলে দেওয়া। তোমরা যদি ফটক খুলে দাও তাহলে আমরা তোমাদেরকে দোস্ত মনে করব। তোমাদের থেকে কোন রকম টেক্স বা জরিমানা নেওয়া হবে না। আর যদি শক্তি প্রয়োগ করে আমাদেরকে ফটক খুলতে হয় তাহলে তোমাদের সাথে এমন আচরণ করা হবে, যেমন দুশমন দুশমনের সাথে করে থাকে।
তারিক বিন যিয়াদের ঘোষণার জবাবে দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে তীর বৃষ্টি শুরু হল। সেই সাথে হুঙ্কার ভেসে এলো–হিম্মত থাকলে নিজেরাই ফটক খুলে নাও।’
অগত্যা তারিক বিন যিয়াদ ফটকের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন। সারাদিন সমান তালে ফটকের উপর হামলা করা হল, কিন্তু দিন শেষে আশানুরূপ কোন ফলাফল দৃষ্টিগোচর হল না।
***
পরদিন সকালে গত দিনের মত হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। এমন সময় দুর্গের প্রধান ফটক খুলে গেল। চারজন অশ্বারোহী দুর্গ থেকে বের হয়ে এলো। একজন অশ্বারোহীর হাতে আছে সফেদ ঝাণ্ডা। অশ্বারোহী দলটি মুসলিম বাহিনীর কাছে এসে বলল, তোমাদের সিপাহসালার কোথায়? আমরা সন্ধির জন্য কথা বলতে এসেছি।
তাদেরকে তারিক বিন যিয়াদের নিকট পৌঁছে দেওয়া হল। সন্ধির জন্য দুর্গরক্ষক স্বয়ং এসেছিল।
‘সিপাহসালার!’ দুর্গরক্ষক বলল। এটা কি সত্য কথা যে, আপনি আপনার বাহিনীকে নিয়ে জলাভূমি অতিক্রম করে এখানে এসেছেন?
‘কেন?’ তারিক বিন যিয়াদ মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন। ‘তুমি কি এ কথা শুনে অবাক হচ্ছ যে, আমি জলাভূমি অতিক্রম করে এসেছি?
‘হা…।’ দুর্গরক্ষক বলল। শুধু আমি নই, যেই এ কথা শুনবে, সেই অবাক হবে। এই জলাভূমি একমাত্র সেই অতিক্রম করতে পারে, যে জিন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বা কারও প্রেতাত্মা। কোন মানুষের পক্ষে সুস্থ অবস্থায় জীবন নিয়ে এই জলাভূমি অতিক্রম করা সম্ভব নয়। কয়েক মাসের পথের দূরত্ব অতিক্রম করতে আমরা রাজি আছি, কিন্তু এই জলাভূমি অতিক্রম করতে রাজি নই।’
‘চোখ খুলে দেখে নাও বন্ধু!’ তারিক বিন যিয়াদ দৃপ্তকণ্ঠে বললেন। আমি ও আমার বাহিনী সুস্থ ও জীবিত তোমার সামনে উপস্থিত। ভেবে দেখ, যে ব্যক্তি তার বাহিনীকে জিন ও প্রেতাত্মাদের জলাভূমি থেকে জীবিত বের করে আনতে পেরেছে, তার জন্য এ শহরের ফটক খোল তেমন কঠিন কোন কাজ নয়। মানুষের রক্তপাত যদি তোমার কাছে কাক্ষিত বিষয় হয় তাহলে আমি তোমার সেই আকাঙ্ক্ষাকেও পূর্ণ করব। তবে মনে রেখ, তারপরও তুমি জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। তার উপর এ শহরের প্রত্যেক সিপাহী ও প্রত্যেক নাগরিককে অনেক বেশি পণ ও জরিমানা দিতে হবে।’
‘আমি রক্তপাত পছন্দ করি না।’ দুর্গরক্ষক বলল। আমি এ কথা স্বীকার করছি, যে ব্যক্তি জলাভূমি অতিক্রম করে আসতে পারে, তার পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।’
‘ঠিক আছে, তোমাদের প্রস্তাব আগে শুনি। তারিক বিন যিয়াদ বললেন।
‘আমরা প্রত্যেক নাগরিকের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর জামানাত চাই। দুরক্ষক বলল। আমরা চাই, কোন নাগরিকের ঘর যেন লুণ্ঠন করা না হয়।’
‘এটা তোমাদের শর্ত নয়। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এটা সেই মহান ধর্মের শর্ত যে ধর্ম আমরা সাথে করে নিয়ে এসেছি। আমরা এখানে লুটতরাজ করতে এবং অসহায় মানুষের ইজ্জত লুণ্ঠন করতে আসিনি। আমরা মানুষের সে সম্মান ফিরিয়ে দিতে এসেছি, যে সম্মান আল্লাহ মানুষকে প্রদান করেছেন। তোমরা নিশ্চিন্ত মনে শহরে গিয়ে শহরের ফটক খুলে দিতে পার।
কোন রকম রক্তপাত ছাড়াই তারিক বিন যিয়াদ মায়েদা দখল করে নেন। মায়েদার প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব পালন করার জন্য লোক নিয়োগ করে তারিক বিন যিয়াদ গ্ল্যাশিয়া অভিমুখে রওনা হন। গ্লাশিয়া মায়েদার চেয়ে ছোট্ট একটি শহর। মামুলি বাধা অতিক্রম করে তারিক বিন যিয়াদ এই শহরটি দখল করে নেন। গ্ল্যাশিয়ার মত তালবিরা নামক অন্য একটি শহরও অতি সহজে মুসলিম বাহিনীর হাতে বিজিত হয়।
এটা ৭১৪ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। তালবিরা জয় করার পর তারিক বিন যিয়াদ তার বাহিনীকে দীর্ঘ বিশ্রামের সুযোগ প্রদান করেন।
মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনুল কওতিয়া লেখেন, তারিক বিন যিয়াদ লৌহকঠিন মনোভাবের অধিকারী এবং বাস্তবধর্মী একজন সিপাহসালার ছিলেন। কিন্তু মাঝে মধ্যে তার উপর শিশুসুলভ চপলতা ও সরলতা ভয় করত। তিনি তখন ঘোট ছোট বাচ্চাদের মত আচরণ করতেন। একদিনের ঘটনা। তিনি তার জেনারেলদেরকে ডেকে হাসতে হাসতে বললেন, যেসব গনিমতের মাল আমরা অর্জন করেছি, সেগুলো আমার সামনে উপস্থিত কর। নির্দেশ অনুযায়ী গনিমতের মূল্যবান বস্তুসামগ্রী কয়েকটি খচ্চরের উপর বোঝাই করে নিয়ে আসা হল। গনিমতের এসব সামগ্রী অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। এগুলোর মধ্যে একটি টেবিল ছিল সবচেয়ে মূল্যবান। বলা হয়, এটি ছিল হযরত সুলায়মান আলাইহিসসালামের টেবিল।
‘এটি আমি আমিরুল মুমিনীন ওলিদ বিন আবদুল মালেকের খেদমতে পেশ করব। তারিক বিন যিয়াদ ছোট বাচ্চাদের মত আনন্দের সাথে বলে উঠলেন।
‘আমিরুল মুমিনীনের জন্য সবচেয়ে উত্তম উপহার তো আন্দালুসিয়াই। একজন সালার বললেন।
‘আন্দালুসিয়াকে তো আমি আল্লাহ তাআলার খেদমতে পেশ করে দিয়েছি। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এই রাজ্য আল্লাহর রাসূলের জন্য। কে জানে, কখন দুশমনের কোন তীর আমাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট পৌঁছে দেয়। তাই আমি আগেই আমর উপহার আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট পৌঁছে দিয়েছি।
স্বর্ণ-রূপার তৈরী এসকল বস্তুসামগ্রী আর হিরা-মতি-পান্নার মত মহামূল্যবান পাথর হল, দুনিয়াদারদের জন্য। জীবিত লোকদের জন্য।
পরক্ষণেই তারিক বিন যিয়াদ আবেগ থেকে বের হয়ে শিশুদের মত প্রতিটি বস্তুকে পৃথক পৃথক করে রাখতে শুরু করলেন। তিনি প্রতিটি বস্তু পৃথক পৃথক করে রাখছিলেন, আর বলছিলেন, এটা মুসা বিন নুসাইরের জন্য। এটা আমি আমীরুল মুমিনীনকে দেব…।’
তারিক বিন যিয়াদের জানাই ছিল না যে, আন্দালুসিয়ার যেসকল এলাকা তিনি জয় করে এসেছিলেন, সেগুলোতে কী ভয়াবহ বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়েছে। বড় বড় প্রায় সকল শহরেই বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল। অপর দিকে তারিক বিন যিয়াদ তার বানিহীকে ভয়ঙ্কর এক জলাভূমিতে প্রবেশ করিয়ে তাদেরকে জীবন-মৃত্যুর সম্মুখীন করে দিয়ে ছিলেন। আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে উভয় বিপদই কেটে গিয়েছিল।
***
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী যখন তালবিয়ায় বিশ্রাম করছিল সেই সময় আবদুল আযীয মুসা বিন নুসাইরের নিকট মেরিডার রিপোর্ট পেশ করছিলেন। তিনি কীভাবে বিদ্রোহ দমন করেছেন এবং কতজন বিদ্রোহী নেতাকে হত্যা করেছেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানাচ্ছিলেন। এ সময় তার স্ত্রী এজেলুনা তার সাথেই ছিল।
‘বিদ্রোহ দমনের সব কৃতিত্ব এজেলুনার।’ আবদুল আযীয মুসা বিন নুসাইরকে বললেন, এজেলুনা কীভাবে বিদ্রোহ নেতাদেরকে এক স্থানে একত্রি করেছিল। যদি এজেলুনা আমাদেরকে সহযোগিতা না করত তাহলে তখনই আমরা বিদ্রোহীদের সম্পর্কে জানতে পারতাম যখন বিদ্রোহীরা বড় শহরগুলোর উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হত। আর তখন বিদ্রোহ দমন করা কোনভাবেই সম্ভব হত না।
‘আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন, আমি কেন আমার ধর্ম ত্যাগ করেনি? এজেলুনা বলল। আমি যদি মুসলমান হয়ে যেতাম তাহলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। আমি একজন খ্রিস্টান এবং রডারিকের বিধবা স্ত্রী হওয়ার কারণে তারা সকলেই আমার জালে ধরা দিয়েছিল। আমি আবারও বলছি, আমাকে আমার ধর্ম ত্যাগ করতে বলবেন না। সবচেয়ে গুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইহুদিদেরকে মোটেই বিশ্বাস করা যাবে না। তারা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে তারিক বিন যিয়াদকে যতই সহযোগিতা করুক না কেন, মূলত তারা নিজেদের স্বার্থের জন্যই এই সহযোগিতা করছে। তারা বাদশাহ রডারিকের সিংহাসন উল্টে দিতে চেয়েছিল। কারণ, শাহ রডারিক ইহুদিদেরকে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায় এবং শয়তানের গোষ্ঠী মনে করত। তার রডারিককে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে। এখন তারা চেষ্টা করছে, যেন আপনাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করতে না পারে।
এজেলুনা অতিঅল্প সময়ের মধ্যে যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে, সে জন্য আমীর মুসা বিন নুসাইরের পক্ষ থেকে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা আবশ্যক ছিল। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর এই রূপসী নারীর প্রতি এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি এদিকে খেয়ালই করেননি, এই নারী তার পুত্রবধূ হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ব্যাপারে এতটা অনাগ্রহী কেন? অদূর ভবিষ্যতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কোন আগ্রহ তার মাঝে নেই কেন?
‘তারিক বিন যিয়াদকেও সতর্ক করে দেওয়া উচিত।’ আবদুল আযীয মুসা বিন নুসাইরকে বললেন। সে এখনও ইহুদিদেরকে তার বন্ধু এবং সমর্থক মনে করছে। সে এখন একা, ইহুদিদের ধোঁকায় পড়ে যেতে পারে।’
‘তারিক বিন যিয়াদকে আমি আর কী সতর্ক করব?’ মুসা বিন নুসাইর রাগতস্বরে বললেন। ও একটা অবাধ্য, নাফরমান। ধোঁকার শিকার হয়ে যখন সব কিছু হারাবে তখন বুঝতে পারবে। আমি তার কাছে সংবাদ পাঠিয়ে ছিলাম, সে যেখানে আছে সেখানেই যেন অবস্থান করে। কিন্তু সে আমার হুকুমের কোন পরোয়া করেনি। গতরাতে আমি সংবাদ পেয়েছি, সে টলেডু থেকে বের হয়ে এমন এক পাহাড়ী এলাকার দিকে অগ্রসর হয়ে পড়েছে, যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও বিপদজ্জনক।
‘টলেডু থেকে কেউ কি এসেছে? আবদুল আযীয জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি কাসেদ পাঠিয়েছিলাম।’ মুসা বিন নুসাইর মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন। ‘আমি তার কাছে সংবাদ পাঠিয়ে ছিলাম, সে যেন টলেডুতে অবস্থান করে আমার আগমনের অপেক্ষা করে। আমি যে কোন সময় টলেডু এসে উপস্থিত হব। গতরাতে কাসেদ ফিরে এসেছে। সে বলেছে, আরও তিন দিন আগেই তারিক বিন যিয়াদ টলেড় থেকে বের হয়ে গেছে। টলেডু পৌঁছে কাসেদ জানতে পেরেছে, তারিক বিন যিয়াদ যে রাস্তা অবলম্বন করেছে, তা অত্যন্ত ভয়াবহ আর বিপদজ্জনক। জুলিয়ান আর আউপাস তারিক বিন যিয়াদকে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু সে কারও কোন কথাই শুনেনি। এখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার কাছে পয়গাম পাঠাব, সে যেন টলেডু এসে আমার সাথে সাক্ষাত করে।
‘আপনি কোথায় পয়গাম পাঠাবেন।’ আবদুল আযীয বললেন। কাসেদ তারিক বিন যিয়াদকে কোথায় পাবে?’
‘তারিক বিন যিয়াদ যে জলাভূমির দিকে রওনা হয়েছে, তা পার হয়ে এলে মায়েদা নামে একটি শহর পড়ে। মুসা বিন নুসাইর বললেন।
‘গ্লাশিয়া ও তালবিরা নামক শহর দুটিও সে পথেই পড়ে।’ এজেলুনা মুসা বিন নুসাইরের কথার মাঝে বলে উঠল। সেই ভয়ঙ্কর পাহাড়ী জলাভূমির পর এ রকম তিন-চারটি বড় শহর আছে। শাহ রডারিকের সাথে আমি তিন-চারবার সেসব এলাকা সফর করেছি। সেখানে আমরা সিংহ শিকার করেছি। একবার সেখান থেকে আমরা একটি কুমির ধরে এনছিলাম। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এক জলাভূমি এটি। নিরাপদ রাস্তা এই জলাভূমির বাহির দিয়ে গেছে।’
‘কাসেদ নিরাপদ রাস্তা দিয়ে যাবে।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘তারিক বিন যিয়াদের একবার আমার সামনে আসা দরকার। আমি তার লাগাম টেনে ধরতে চাই।’
‘সম্মানিত পিতা!’ আবদুল আযীয মুসা বিন নুসাইরকে ক্রোধান্বিত দেখে বললেন। তারিক বিন যিয়াদকে তিরস্কার করার সময় এ কথা আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, সে আন্দালুসিয়ার সর্বপ্রথম বিজেতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এটা সুনিশ্চিত যে, আন্দালসিয়ার প্রথম আমীর তারিক বিন যিয়াদই হবে।’
‘আমি তারিক বিন যিয়াদকেই আন্দালুসিয়ার সর্বপ্রথম বিজেতা মনে করি। মুসা বিন নুসাইর বললেন। কিন্তু তার মত একজন অবাধ্য ও একরোখা লোককে এই রাজ্যের আমীর নিযুক্ত করতে পারি না। সে এই রাজ্য জয় করেছে ঠিক; কিত বিজয়ের পর পরই তার বিজীত সকল এলাকায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে।
‘সম্মানিত পিতা! আপনি এমন ধারণা পোষণ করছেন না তো যে, তারিক বিন যিয়াদ আপনার গোলম ছিল।’ আবদুল আযীয বললেন। ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে, আপনার এমন ধারণাই তারিক বিন যিয়াদের প্রতি আপনার মনকে বিষিয়ে তুলছে।’
‘না প্রিয় পুত্র আমার। মুসা বিন নুসাইর বললেন। আজাদকৃত গোলামকে তুচ্ছ মনে করা ইসলামী বিধানের পরিপন্থী। আমি আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়সাল্লামের কোন নির্দেশ অমান্য করার দুঃসাহস করতে পারি না। আমি প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রাযি.-এর ইন্তেকালের কিছু দিন পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেছি। আমি হযরত ওমর রাযি.-এর খেলাফতের যুগ দেখেছি। স্বপ্নের মত সে যুগের কথা আমার মনে আছে। সে সময় আমি খুব ছোট ছিলাম। আমি এই মহান খলীফার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতে চাই। তুমি নিশ্চয় শুনেছ যে, হযরত খালিদ বিন ওলিদ রাযি.-কে দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাযি. সিপাহসালারের পদ থেকে অপসারণ করেছিলেন। তুমি কি জান, খালেদ বিন ওলিদ কত বড় সিপাহসালার ছিলেন?
‘জানি, সম্মানিত পিতা!’ আবদুল আযীয বললেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালেদ বিন ওলিদ রাযি.-কে আল্লাহর তরবারী উপাধি দিয়েছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পরপরই ধর্ম ত্যাগের ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ইসলামের বিরুদ্ধে সেটা ছিল সুসংগঠিত বিশাল এক ফেতনা। দূরদূরান্ত পর্যন্ত সেই ফেতনার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। খালেদ বিন ওলিদ রাযি. ইসলাম-দ্রোহী এই ফেতনার মূলোৎপাটন করেছিলেন।
‘শুধু তাই নয়, বৎস! মুসা বললেন। রোম ও পারস্যের পরাশক্তিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইসলামী সালতানাতের সীমানা বহুদূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছিলেন তিনি। মামুলি একটি হুকুম অমান্য করার কারণে হযরত ওমর রাযি. তাকে সিপাহসালারের পদ থেকে অপসারিত করেন। ইসলাম ধর্ম খলীফা, আমীর, ইমাম ও যিম্মাদারের আদেশ অমান্য করাকে বরদাশত করে না, যদি সেই আদেশ আল্লাহ তাআলার হুকুমের বিরোধী না হয়।’
‘আপনি তারিক বিন যিয়াদকে শস্তি দিতে পারেন। আবদুল আযীয বললেন। কিন্তু তাকে তার এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না যে, সেই আন্দালুসিয়ার প্রথম আমীর হওয়ার যোগ্য।’
‘প্রিয়, মহামান্য আমীরের সাথে তর্ক করা আপনার জন্য সমীচীন নয়। এজেলুনা হঠাৎ আবদুল আযীয়কে লক্ষ্য করে বলে উঠল। সে এতক্ষণ পিতা-পুত্রের কথাবার্তা শুনছিল।
‘আপনার পিতা হলেন সর্বাধিনায়ক। কাকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করা হবে, সে দায়িত্ব তার। তিনি আপনার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। তিনি যাকে যোগ্য মনে করবেন, তাকেই আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করবেন। তারিক বিন যিয়াদ আন্দালুসিয়ার বিজয়ী হতে পারেন। হতে পারেন, অনেক বড় একজন সিপাহসালার। বাস্তবেও তিনি অনেক বড় মাপের একজন সিপাহসালার। রডারিককে পরাজিত করা মামুলি কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু কোন রাজ্যের আমীর হওয়ার জন্য যেসকল গুণাবলী আর যোগ্যতার প্রয়োজন, সেগুলো তারিক বিন রিয়াদের মাঝে নেই। সেগুলো একমাত্র আপনার মাঝেই বিদ্যমান আছে।
‘আমার মাঝে!?’ আবদুল আযীয আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ, প্রিয়তম!’ এজেলুনা বলল। আপনার মাঝেই আন্দালুসিয়ার আমীর হওয়ার যোগ্যতা আছে। আপনি এক মহান পিতার সন্তান। এমন মহানুভব পিতার তো খলীফা হওয়া উচিত। তিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব অনুযায়ী আপনাকে প্রতিপালিত করেছেন। আমি স্বীকার করছি, ইসলাম সমতা বিধানের নির্দেশ দেয়। ইসলামে গোলাম আর মনিবের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি গোলামির শৃঙ্খল পায়ে জড়িয়ে বড় হয়েছে, তাকে যদি আপনি মুক্তও করে দেন এবং তাকে মাথার উপর বসিয়ে দেন, তাহলে সে হয়তো আপনার জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেবে, কিন্তু কোন দিন মনিব হতে পারবে না। মনিব হওয়ার সকল গুণাবলী থেকে সে চিরকাল বঞ্চিত থাকবে।’
এজেলুনা সুরের মুর্ছনা ছড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছিল। আর মুসা বিন নুসাইর তন্ময় হয়ে তার কথা শুনছিলেন। এজেলুনা এমনিতেই অত্যন্ত রূপসী ছিল। তার উপর তার কথা বলার ভঙ্গি এতটাই হৃদয়গ্রাহী আর আকর্ষণীয় ছিল যে, মনে হত-তার মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দ শ্রোতার হৃদয়ে সুরের ঝঙ্কার তুলছে।
মুসা বিন নুসাইর বয়োঃবৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি গভীর দৃষ্টিতে এজেলুনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি এই সুশ্রী চেহারার রহস্য উদাটনের চেষ্টা করছিলেন।
আবদুল আযীয নওজোয়ান ছিলেন। এজেলুনার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করেছিলেন। তিনি এই পূর্ণযৌবনা নারীর হাতে মনঃপ্রাণ সপে দিয়েছিলাম। তার উপর বিদ্রোহীদেরকে ধ্বংস করে এজেলুনা আবদুল আযীযের অন্তরে এক ধরনের শ্রদ্ধার আসন গড়ে নিয়েছিল। আর এ জন্যই এজেলুনার আন্তরিকতা মিশ্রিত ও জোরালো বক্তব্যের সামনে আবদুল আযীয কোন কথা খুঁজে পেলেন না।
রাত গম্ভীর হয়ে এসেছিল। মুসা বিন নুসাইর তার শয়নগৃহে চলে গেলেন। আবদুল আযীয এজেলুনাকে নিয়ে তাদের শয়নগৃহের দিকে রওনা হলেন। এজেলুনার কথার কোন উত্তর দিতে না পেরে আব্দুল আযীয মনে মনে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করছিলেন। কামরায় প্রবেশ করেই আবদুল আযীয এজেলুনাকে বুকের উপর টেনে নিয়ে বললেন,
‘প্রিয়তমা, আমি তারিক বিন যিয়াদের বিরুদ্ধে কোন কথাই বরদাশত করতে পারি না। তুমি তাকে এখনও গোলাম মনে কর? তুমি আমাকে তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ মনে কর? আমি লক্ষ্য করছি, আরব আর বার্বারদের দুটি ভিন্ন সম্প্রদায় কোন দিকে চলছে। আরবরা নিজেদেরকে বার্বারদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও অধিক সম্মানের অধিকারী মনে করে। বাস্তবতা হল, যে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছে, তার অন্তর থেকে উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ দূর হয়ে গেছে। আল্লাহর দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী সেই, যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে।’
এজেলুনা শুধু রূপসীই ছিল না, বরং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছলনাময়ী নারীরাও তার কাছে খেলার পাত্রী ছিল। তার মুখের কথায় জাদুর প্রভাব ছিল। সে ভাল করেই জানত, কোন সময় কোন ধরনের অভিনয়ের প্রয়োজন হয়। এজেলুনা দেখতে পেল, আবদুল আযীয তারিক বিন যিয়াদের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। তাই সে তার চাল পাল্টে দিল। প্রকৃত অর্থে এজেলুনা মন থেকেই চাচ্ছিল যে, আন্দালুসিয়ার প্রথম আমীর হবে তার স্বামী আবদুল আযীয। আবদুল আযীয নিজেও বিয়ের সময় এজেলুনাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সে কোন সাধারণ ঘরণী হবে না, রাজরানী হবে।
‘আমি অন্তর থেকে তারিক বিন যিয়াদের বিরোধী নই, প্রিয়! এজেলুনা আবদুল আযীযকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল। আমি তাকে ততটাই সম্মান করি, যতটা তুমি কর। তোমার সামনে তার কোন প্রশংসা করতে আমি ভয় করি। হয়তো তুমি সন্দেহ করবে, তোমার চেয়েও তারিক বিন যিয়াদ আমার কাছে বেশি প্রিয়। আমি তারিক বিন যিয়াদকে নীচু শ্রেণীর মানুষ মনে করি না।’
আবদুল আযীয এজেলুনার রেশমের মত শরীরের উত্তাপ অনুভব করছিল। দক্ষিণা বাতাসের ঝাঁপটা এজেলুনার মসৃণ চুলকে উড়িয়ে নিয়ে বারবার আবদুল আযীযের চেহারা ঢেকে দিচ্ছিল। এজেলুনার চুলের সুগন্ধি আবদুল আযীযকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দিল। এজেলুনার নেশা ছড়ানো ক্ষীণ আওয়াজ, আর তার প্রায় উলঙ্গ শরীরের একেকটি অঙ্গভঙ্গি আবদুল আযীযকে উন্মাদ করে দিচ্ছিল।
এজেলুনার এমন শারীরিক উত্তাপের কাছেই রডারিকের মত লৌহপ্রাণ মানুষও মোমের মত গলে যেত। সামান্য সময়ের ব্যবধানেই আবদুল আযীয একেবারে বশীভূত হয়ে গেলেন।
‘মনে রেখ, এজেলুনা কথার জাদু ছড়িয়ে অবশেষে বলল।’তোমার পিতাজি যদি তোমাকে আন্দালুসিয়ার আমীর বানাতে চান তাহলে আবার বলে বসো না যে, এটা তারিক বিন যিয়াদের হক। আমি তোমাকে আন্দালুসিয়ার সিংহাসনের উপর বসা দেখতে চাই।’
‘তুমি যা বলবে, তাই হবে, এজেলুনা!’ আবদুল আযীয নেশাগ্রস্তের মত জড়ানো আওয়াজে বললেন।
***
এক দিন এজেলুনা তার ঘরে আবদুল আযীযের কাছে বসেছিল। এ ঘরটি দেখতে মহলের মত। খ্রিস্টান গভর্নর ইতিপূর্বে এখানেই থাকত। এ সময় একজন খাদেমা ঘরে প্রবেশ করে এজেলুনাকে সংবাদ দিল, তার একজন পুরনো খাদেমা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়।
‘সে তার নাম কি বলেছে? এজেলুনা জানতে চাইল। সে বলেছে, যদি আমার নাম বলি তাহলে রানী আমাকে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেবেন না। সে আরও বলেছে, “রানী যদি সাক্ষাৎ করার অনুমতি না দেন তাহলে ক্ষতি তারই হবে।
‘তাকে পাঠিয়ে দাও।’ এজেলুনা বলল।
খাদেমা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পঁচিশ-ত্রিশ বছরের একটি দীর্ঘাঙ্গিনী যুবতী মেয়ে ঘরে প্রবেশ করল। মেয়েটি দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। ঘরে প্রবেশ করেই সে মাথা নুইয়ে সালাম পেশ করল।
‘তুমি?’ এজেলুনা ভর্ৎসনার সুরে বলল। নাদিয়া। তুমি কি মনে করেছ, আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছি? তুমি খাদেমাকে এ কথা কেন বললে যে, আমি যদি তোমাকে সাক্ষাতের অনুমতি না দেই তাহলে আমারই ক্ষতি হবে। আমার কী ক্ষতি হবে?
‘আমি ক্ষমা চাওয়ার জন্য আসিনি, রানী! নাদিয়া বলল। আমি আমার বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে এসেছি। যদি আপনি আমাকে কথা বলার অনুমতি দেন। তাহলে আমি বলতে পারি।’
‘তার অপরাধ কি? এজেলুনা!’ আবদুল আযীয জিজ্ঞেস করলেন।
‘শাহ রডারিক যখন গোয়াডিলেট নদীর অভিমুখে রওনা হচ্ছিলেন তখন আমি এই মেরিডা চলে এসেছিলাম।’ এজেলুনা বলল। শাহ রডারিকের পরাজয় ও নিহত হওয়ার সংবাদ এখানে পৌঁছলে রাজেলিউ আমাকে পাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠে। সে এতটাই আবেগ প্রবণ হয়ে আমার সামনে তার ভালোবাসা প্রকাশ করে যে, আমি তার ভালোবাসা গ্রহণ করতে বাধ্য হই। কিন্তু আমি তাকে বলি, আগে মেরিডাকে মুসলমানদের হাত থেকে বাঁচাও, এই শহরকে রাজধানী বানাও এবং আন্দালুসিয়া থেকে মুসলমানদেরকে বের করে দাও, তাহলেই আমি তোমার হব…।
রাজেলিউ এই শহরকে বাঁচানোর জন্য জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে। আমি নিজেও সেনাবাহিনী এবং শহরের অধিবাসীদেরকে লড়াই করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। এ সময় নাদিয়া আমার একান্ত খাদেমা ছিল। আমি তাকে আমার মনের কথা বলার সাথী বানিয়ে নিয়েছিলাম। এক রাতে আমি শহরের নেত্রিস্থানীয় লোকদেরকে একতিত্র করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলাম, কীভাবে জনসাধারণকে এবং নারীদেরকে লড়াই করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এই আলোচনায় রাজেলিউ উপস্থিত ছিল না। সে অযুহাত দেখাল, তার পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা করছে।
আমি আলোচনা শেষ করে রাজেলিউর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তার কামরার দিকে রওনা হলাম। পথিমধ্যে অন্য একজন খাদেমা আমাকে বলল, নাদিয়া অনেকক্ষণ হয় রাজেলিউর কামরায় আছে। সে আমাকে আরও বলেছে, সে চিলেকোঠার ছিদ্রপথে উভয়কে বিশেষ অবস্থায় দেখেছে। চিলেকোঠা থেকে নেমে এসে খাদেমা একটি জানালার সাথে কান লাগিয়ে তাদের সব কথা শুনেছে। নেশার ঘোরে তারা এতটাই উঁচু আওয়াজে কথা বলছিল যে, তাদের কথা বাইরে থেকে স্পষ্ট শুনা যাচ্ছিল। খাদেমা আমাকে বলেছে, তাদের কথা থেকে বুঝা যাচ্ছিল, রাজেলিউ গুপ্তচরবৃত্তির জন্য নাদিয়াকে আমার পিছনে লাগিয়ে রেখেছে। নাদিয়ার মাধ্যমে সে জানতে পারত, আমি কোন কোন জেনারেলের সাথে দেখা করি এবং কারও সাথে আমার বিশেষ কোন সম্পর্ক আছে কি না?
খাদেমার কথা শুনে আমি আমার কামরায় চলে আসি। কিছুক্ষণ পর নাদিয়া আমার কামরায় আসে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, কোথায় ছিলে? সে আমার সাথে মিথ্যা কথা বলে। আমি লক্ষ্য করি সে তখনও নেশার ঘোরে ছিল। আমি তাকে শুধু এতটুকু বলি যে, এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে যাও। আর কখনই যেন তোমাকে এই শহরে না দেখি। সে চলে যাওয়ার সময় বলে যে, রাজেলিউর তাকে জোর করে তার কামরায় নিয়ে গেছে এবং তাকে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে মদ পান করিয়ে তার সাথে…।
‘শাহী খান্দানে এটাতে কোন আপত্তিকর বিষয় নয়?’ আবদুল আযীয বললেন। সে যদি রাজেলিউর কথা না শুনত তাহলে তো রাজেলিউ তাকে হত্যা করে ফেলত। তুমি রাজেলিউকে কিছু বলোনি?
‘না।’ এজেলুনা বলল। আমি তাকে বুঝতেই দেইনি যে, আমি বিষয়টি জানি। নাদিয়াকে বের করে দিয়ে আমার কোন আফসোস হয়নি। আমাকে আরও অনেকেই বলেছে, খাদেমা হিসেবে নাদিয়া উপযুক্ত হলেও, সে ছিল রাজেলিউর হাতের পুতুল।’
‘যা হওয়ার তা হয়েছে। আবদুল আযীয বললেন। এখন তাকে জিজ্ঞেস কর, সে কেন এসেছে? সে বলছে, সে তার বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার জন্য এসেছে।
‘ঠিক আছে, বল, তুমি কি বলতে চাও।’ এজেলুনা নাদিয়াকে লক্ষ্য করে বলল। কী প্রমাণ পেশ করতে এসেছ? … বসো, ওখানেই বসো।
***
‘আমি ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে আসেনি।’ নাদিয়া বলল। আমি এ কথা বলতেও আসিনি যে, আমাকে আপনার খেদমতের জন্য পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হোক। আমি এটাও বলব না যে, আমি নিরপরাধ ছিলাম। আমি আপনার কৃতজ্ঞতা আদায় করব। কারণ, আপনি আমাকে শুধু খাদেমাই মনে করতেন না, বরং আমাকে আপনার বান্ধবী মনে করতেন। আপনি সবসময় আমাকে মূল্যবান কাপড় পরিয়েছেন এবং আমাকে এই অনুমতি প্রদান করেছিলেন, যেন আমি শাহজাদীদের মত সাজগোছ করে চলি। আপনি আমাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, মেরিডার গভর্নর রাজেলিউ আমাকে পছন্দ করতে শুরু করে। সে প্রায়ই আমাকে তার কামরায় ডেকে পাঠাত। সে আমাকে আপনার বিরুদ্ধে। গুপ্তচরবৃত্তি করতে বলেছিল, কিন্তু আমি কখনও তাকে এমন কোন কথা বলিনি, যা আপনার বিরুদ্ধে যায়। আমি আপনার সাথে প্রতারণা করতে চাইনি।’
‘এখন কি জন্য এসেছ?’ আবদুল আযীয বললেন।
‘রানী এজেলুনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। নাদিয়া বলল। আর এ জন্য আমাকেই প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমাকে যেভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে, সে কথা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
‘তুমি ধীরস্থিরভাবে তোমার কথা বল।’ আবদুল আযীয বললেন। আমরা তোমার কথা শুনছি।’
‘আমি মেরিডা থেকে দূরে এক গ্রামে বসবাস করি। নাদিয়া বলল। ‘সেখানের অনেক বড় এক জমিদারের ঘরে আমি কাজ করি। তার বাচ্চাদের দেখা-শুনা করি। সেই জমিদারকে আমি বলেছিলাম, আমি রানী এজেলুনার বিশেষ খাদেমা ছিলাম। একদিন সেই জমিদার আমাকে বলল, আমার সাথে চল, আমি তোমাকে একজন জাদুকরের কাছে নিয়ে যাব। সে তোমার ভাগ্য বদলে দেবে। তুমি আবারও রাজমহলে চাকুরি করতে পারবে। আমি তার সাথে চলতে শুরু করলাম। জাদুকর সেই গ্রামেই থাকত। আমি ইতিপূর্বে তাকে সেই গ্রামে দেখিনি। অল্প কয়েক দিন হল, সে এই গ্রামে এসেছে। সে আমাকে তার সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি কী চাই? আমি তাকে বললাম, আমি রানী এজেলুনার বিশেষ খাদেমা ছিলাম। সামান্য ভুলের জন্য রানী আমাকে মহল থেকে বের করে দিয়েছেন। আমি চাই, রানী আমাকে পুনরায় তার খেদমতে বহাল করুন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আমি আমার ইচ্ছা মনের মাঝে গোপন রেখেছিলাম। ইতিপূর্বে কাউকে এ ব্যাপারে কোন কিছু বলেনি। জানি না, আমার এই জমিদার মনিব আমার প্রতি এতটা সদয় কেন হলেন যে, তিনি নিজে যেচে এসে আমাকে বললেন, এই জাদুকরের মাধ্যমে এমন জাদু করাব যে, তুমি শাহীমহলে তোমার পূর্বের মর্যাদা ফিরে পাবে। আমি আমার মনের ইচ্ছাকে এ জন্যও গোপন রেখেছিলাম যে, রানী এজেলুনা এখন আর রানী নন এবং আন্দালুসিয়ার সকল বড় বড় শহর মুসলমানদের হস্তগত হয়ে গেছে। বাদশাহ রডারিক মারা গেছে। তারপরও আমি রানী এজেলুনার কাছে আসতে চাচ্ছিলাম। আমার জমিদার মনিবের আন্তরিকতা দেখে আমি মনে মনে খুব খুশী হলাম।
জাদুকর আমার মনের ইচ্ছার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি তার কাছে আমার মনের কথা বলে দেই। জাদুকর আমার কথা শুনে আমার কপালের দুইপাশে আস্তে আস্তে আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে লাগল। সেই সাথে সে তার আংটি ধীরে ধীরে আমার কপালে ছোঁয়াতে লাগল। জাদুকর আমাকে বলল, তার এই জাদুর প্রভাব উল্টা হয়ে থাকে। সে যা বলবে, তার বিপরীত ফল হবে। সে আমাকে তার বলা কথাগুলো উচ্চারণ করতে বলল। সে আমাকে বলল, রানী এজেলুনার চেহারা কল্পনা কর। তুমি তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাক। তার কথা অনুযায়ী আমি রানীর চেহারা আমার চোখের সামনে আনলাম এবং তার চোখে চোখ রাখলাম। জাদুকর আমাকে বলল, এখন তুমি বল, এই নারী আমার দুশমন। আমি তাকে ঘৃণা করি। সে যদি আমার সামনে আসে তাহলে আমি তাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলব।
আমি কয়েকবার এই বাক্যগুলো বলতে লাগলাম। জাদুকর আমাকে বলল, রানী এজেলুনার চেহারা কল্পনা করে এই বাক্যগুলো এমনভাবে বলতে থাক, যেন বাস্তবেই সে তোমার দুশমন। তুমি তাকে ঘৃণা কর এবং তুমি তাকে হত্যা করতে চাও।
আমি এই বাক্যগুলো বারবার বলছিলাম, কিন্তু আমি আমার মনে রানীর প্রতি প্রকৃত ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারছিলাম না। আমি জাদুকরকে বললাম, এটা আমার জন্য অসম্ভব। আমি আমার মনে রানীর প্রতি কিছুতেই ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারব না। যে রানী আমাকে এত বেশি সম্মান দিয়েছেন, তাকে আমি কীভাবে আমার দুশমন মনে করতে পারি?
জাদুকর আমাকে এমন ভাব ও ভঙ্গির মাধ্যমে তার চিন্তা ব্যাখ্যা করে বুঝালো যে, এটা মূলত ঘৃণা নয়, বরং মহব্বত। আমি তার কথা মেনে নিলাম। সে আমাকে আগেই বলেছিল, তার জাদু শব্দের বিপরীত ফলাফল বয়ে আনবে।
জাদুকর পুনরায় আমার কপাল ও কপালের দুই পাৰ্শ আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে ঘষতে শুরু করল। আমার দুই চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। হঠাৎ রানীর চেহারা আমার সামনে এমনভাবে ফুটে উঠল যে, মনে হল, এটা কল্পনা নয়; বাস্তব। বাস্তবেই রানী এজেলুনা আমার সামনে বসে আছেন। আমার মনে হল, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি পার্থক্য করতে পারছিলাম না যে, এটা স্বপ্ন নাকি কল্পনা? আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে, রানী এজেলুনা আমার সামনে ঘুরাফিরা করছেন। আমার ভিতর এই ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হয়ে গেছে যে, এই নারীকে আমি পছন্দ করি না। তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
কিছুক্ষণ পর এই স্বপ্ন বা কল্পনা শেষ হয়ে গেল। আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলাম। আমি জাদুকরকে বললাম, আমার উপর কি ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। সে বলল, যদি এ অবস্থা সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে তুমি সফল হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার জাদুও সফল হবে। তোমার কাজ হল, তুমি প্রতি রাতে এই সময় আমার কাছে চলে আসবে। তোমাকে পাঁচ-ছয় রাত আসতে হবে। তার পর একদিন এজেলুনা নিজে তোমার কাছে চলে আসবে। সে পূর্বের চেয়েও অধিক মহব্বতের সাথে তোমাকে তার মনের মাঝে জায়গা করে দেবে। তুমি তার সাথে থাকতে পারবে।
সবকিছুই আমার কাছে আশ্চর্যজনক লাগছিল। আমি নিজের মাঝে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম না, এটা কিসের পরিবর্তন? আমার মনিব আমাকে সেখান থেকে নিয়ে এলো। আমি এ কথা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছিলাম যে, এই লোক আমার প্রতি এতটা সহানুভূতিশীল হয়ে গেল কেন? সে এতটা নিঃস্বার্থ হল কীভাবে যে, আমার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমাকে এই জাদুকরের কাছে নিয়ে এসেছে। আমার সন্দেহ হল, আমার প্রতি এই অনুগ্রহের বিনিময়ে সে আমার কাছে অস্বাভাবিক কিছু কামনা করবে। কিন্তু সে সহানুভূতি প্রকাশ করা ছাড়া আমার সাথে আর কোন কথাই বলল না।
পরদিন রাতে আমার মনিব আমাকে আবারও সেই জাদুকরের কাছে নিয়ে গেল। জাদুকর পূর্বের রাতের ন্যায় আমার উপর তার জাদু প্রয়োগ করল। সে আমাকে পূর্বের রাতের বাক্যগুলো বারবার উচ্চারণ করতে বলল। আমি তার বলা কথাগুলো মোহগ্রস্তের ন্যায় বলে যেতে লাগলাম–এই নারী আমার দুশমন। আমি তাকে ঘৃণা করি। সে যদি আমার সামনে আসে তাহলে আমি তাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলব।’
আমি এ কথাগুলো উচ্চারণ করছিলাম, আর জাদুকরের কথা অনুযায়ী রানী এজেলুনার চেহারা কল্পনা করছিলাম। এ সময় জাদুকর আমার চেহারা দুই হাত দ্বারা ধরে সামান্য উঁচু করল। সে আমাকে বলল, আমি যেন তার চোখে চোখ রাখি। আমি তার চোখের দিকে তাকানোর সাথে সাথে আমার মনে হল, আমি আমার চোখ তার চোখ থেকে পৃথক করতে পারব না। তার ঠোঁট দুটি অনবরত নড়ছিল। আমার মনে হল, তার চোখ দুটি যেন দুটি আয়না। সেই আয়নায় আমি রানী এজেলুনার চেহারা স্পষ্টরূপে দেখতে পাচ্ছি। আমার মুখ নিঃসৃত কথা আমি নিজ কানে শুনতে পারছিলাম। আমি বলছিলাম :
‘এই নারী আমার দুশমন। আমি তাকে ঘৃণা করি। সে যদি আমার সামনে আসে তাহলে আমি তাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলব।’
এই বাক্যগুলো আমার মনে একটি সংকল্প হিসেবে স্থান করে নিচ্ছিল। জাদুকর আজকের মত তার জাদুকর্ম এখানেই মুলতবী করল। সে আমার কপাল এবং কপালের উভয় পার্শ্ব তার আঙ্গুল দ্বারা ঘষতে ঘষতে বলল, খুব দ্রুতই তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
সে রাতে আমি আমার মনিবের সাথে ঘোড়াগাড়িতে চড়ে ফিরে আসছিলাম। পথে আমি মনিবকে বললাম, আমার বুঝে আসছে না, আমার ইচ্ছা কীভাবে পূর্ণ হবে? কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, এজেলুনা আমার দুশমন। আমার উচিত, তাকে ঘৃণা করা। আমার মনিব হাসতে হাসতে বলল, এই জাদুকর্মের রহস্য বুঝার চেষ্টা করো না। তোমার এই বিশ্বাস রাখা উচিত যে, তোমার মনে ঘৃণার যে অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে, সেটাই এজেলুনার মনে তোমার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করছে। মনিবের কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম।
গতরাতে মনিব আমাকে আবারও সেই জাদুকরের নিকট নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে অন্য একটি কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে জাদুকরের সাথে আরও দুইজন লোক বসছিল। তারা মুচকি হেসে আমাকে স্বাগত জানাল এবং সহানুভূতি জ্ঞাপক দু-একটি কথা বলল। জাদুকর আমাকে পাশের কামরায় গিয়ে বসতে বলল। আমি পাশের কামরায় চলে গেলাম। এই কামরায়-ই আমার উপর জাদু প্রয়োগ করা হচ্ছিল। আমি উভয় কামরার দরজার মাঝখানে বসে পড়লাম।
তারা দরজা ভিড়িয়ে রেখেছিল। দরজা পুরোপুরি বন্ধ করেনি। তাদের কথা আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। তারা হিব্রুভাষায় কথা বলছিল। হিব্রু ইহুদিদের ভাষা। তাদের ধারণা ছিল, আমি তাদের ভাষা বুঝি না। সম্ভবত এ কারণেই তারা উঁচু আওয়াজে কথা বলছিল। রানী ভাল করেই জানেন যে, আমি ইহুদিদের ভাষা বুঝি এবং বলতেও পারি।
তারা অনেক কথাই বলছিল। সবচেয়ে জরুরি কথা, যা আমি আপনাকে শুনাতে এসেছি। তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েকে দিয়ে এই কাজ করাতে পারবে? জাদুকর উত্তর, দিল, আমি এখন নিশ্চিত যে, এই মেয়েকে দিয়েই কাজ হবে। মাত্র দুইবারের আমল দ্বারাই তার মাঝে সেই প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, যা আমি চাচ্ছিলাম। আমার ধারণা ছিল, এই প্রভাব চতুর্থ দিন সৃষ্টি হবে।
আমার মনিব জিজ্ঞেস করল, আসল কাজ কত দিনে হবে? জাদুকর উত্তর দিল, সপ্তম বা অষ্টম দিনে। অন্যজন জিজ্ঞেস করল, এটা কীভাবে হবে?
জাদুকর বলল, যেভাবে আপনাকে প্রথমে বলেছি, সেভাবে হবে। এই মেয়ে এজেলুনার কাছে যাবে এবং তাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলবে।
অন্যজন জিজ্ঞেস করল, যদি ধরা পরে তাহলে বলে দেবে না যে, তুমি তার উপর জাদু প্রয়োগ করেছ?
জাদুকর বলল, তার স্বাভাবিক বিবেক-বুদ্ধি লোপ পাবে। সে কিছুই বলতে পারবে না। যাকে দেখবে, তার উপর পাখির মত আক্রমণ করবে। তখন তাকে হত্যা করে দেওয়া হবে। এ নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
আরেকজন বলল, আমরা এটাই জানতে এসেছিলাম।
আমার মনিব বলল, এজেলুনাকে জীবিত রাখা ঠিক হবে না। সে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করিয়েছে।
জাদুকর বলল, আমি তোমাদের উপর কোন অনুগ্রহ করতে আসিনি। আমি প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে এখানে এসেছি। ইহুদিরা এই রাজ্যে নিজেদের জন্য সম্মানজনক জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। মুসলমানরা ইহুদিদেরকে সম্মানজনক পদমর্যাদা দিয়েছিল। বিভিন্ন জায়গিরদারীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর এ জন্য দায়ী হল, শয়তান এজেলুনা। এই বদনসীবের জানা নেই যে, ইহুদিরা মাটির নিচ দিয়ে আক্রমণ করে। আমরা অবশ্যই বিজয়ী হব। এখানে আবারও কুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের বিজয়ের নিদর্শন হল, আমরা এমন একজন মেয়ে পেয়ে গেছি, যে কোন রকম বাধা ছাড়াই এজেলুনা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে।’
আবদুল আযীযের চেহারা রাগে রক্তবর্ণ ধারণ করল। এজেলুনার হাত কাঁপতে লাগল।
‘তার পর কি হয়েছে?’ আবদুল আযীয জিজ্ঞেস করলেন। তাড়াতাড়ি বল, আমরা তোমাকে পুরস্কৃত করব।
কিছুক্ষণ পর নাদিয়া চুক গিলে বলতে শুরু করল। “জাদুকর আমার কামরায় প্রবেশ করল। আমার অবস্থা এই দাঁড়িয়ে ছিল যে, ভয়ে আমার শরীর কাঁপছিল। প্রথমে আমি চিন্তা করেছিলাম, জাদুকর আসার আগেই আমি পালিয়ে যাব। পরে ভেবে দেখলাম, আমি যদি পালিয়ে যাই তাহলে তারাও সরে পড়বে। জাদুকর এসে প্রতিদিনের ন্যায় আমার উপর তার জাদু প্রয়োগ করতে শুরু করল। সে আমাকে বলল, এজেলুনার চেহারা কল্পনায় তোমার সামনে উপস্থিত কর। তখন রানীর চেহারা কল্পনায় আনলাম না। অন্যান্য দিনের মত আজও সেই বাক্যগুলো উচ্চারণ করলাম ঠিকই; কিন্তু নিজেকে পূর্ণরূপে সজাগ রাখলাম। কিছুক্ষণ পর জাদুকরের আমল শেষ হল।
এটা গত রাতের ঘটনা। সকালে আমি আমার মনিবের কাছে শহরে আসার অনুমতি চাইলাম। সে কোচওয়ানসহ ঘোড়া দিয়ে দিল। আমি কোচওয়ানকে শহরের প্রধান ফটক হতেই বিদায় করে দিয়েছি। তাকে বলেছি, আমি সন্ধ্যার সময় ফিরে আসব। কোচওয়ানকে আরও বলেছি, মনিবকে বলবে, প্রতিদিন আমরা যেখানে যাই, সেখানে যাওয়ার অনেক আগেই আমি এসে পড়ব।
আমি আপনাদের দুজনকে এ সংবাদ দেয়ার জন্যই এসেছি। আমি রানীকে এই অনুরোধ করব না যে, তিনি আমাকে পুনরায় তার খেদমতে নিয়োজিত করুন। আমি রানীর মহব্বত ও ভালোবাসার প্রতিদান দিতে এসেছি। রানী আমার প্রতি অনেক অনুগ্রহ করেছেন। আমি যে অন্যায় করেছি, তার শাস্তি হিসেবে রানী ইচ্ছে করলে আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারতেন। কেউ তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেসও করত না। কিন্তু তিনি তা করেননি, বরং তিনি আমাকে নিরাপদে শহর থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন। রানীর প্রতি আমার মনে যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে, তা কোন দিন নিঃশেষ হবে না এবং বিন্দুমাত্র কমবেও না। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র …।
‘তুমি সন্ধ্যার পূর্বেই ফিরে যাবে।’ আবদুল আযীয নাদিয়াকে বললেন। ‘আমি তোমাকে আমার সওয়ারী দিতে পারি; কিন্তু তাতে তোমার উপর সন্দেহ সৃষ্টি হবে। তুমি আমাদেরকে সে গ্রামের রাস্তা এবং যে ঘরে জাদুকর বাস করে তার ঠিকানা বলে দাও। তুমি সন্ধ্যার পর তোমার মুনিবের সাথে জাদুকরের কাছে পৌঁছে যাবে। বাকী কাজ আমাদের উপর ছেড়ে দাও।
‘নাদিয়া!’ এজেলুনা বলল। তুমি আমার ভালোবাসা ও মহব্বতের হক আদায় করেছ। আমিও তোমার মহব্বতের হক আদায় করব।’
***
সেদিন রাতে নাদিয়া জাদুকরের সামনে বসেছিল। নাদিয়ার মনিব পাশের কামরায় তিন-চারজন লোকের সাথে বসে গল্প করছিল। জাদুকর তার জাদু প্রয়োগ করছিল। এমন সময় দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হল। এক ব্যক্তি উঠে দরজা খুলে সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। বাহির থেকে এত জোরে দরজায় ধাক্কা দেওয়া হল যে, বিকট শব্দে দরজা খুলে গেল। যে ব্যক্তি দরজা বন্ধ করতে চাচ্ছিল, সে দরজার ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। বিশ-পঁচিশজন জানবাজ মুজাহিদ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে সকলকে ঘিরে ফেলল। পুরো গ্রামে এই বাড়িটি ছিল সবচেয়ে বড় এবং জাঁকজমক পূর্ণ। মুজাহিদ বাহিনী গোটা গ্রাম অবরোধ করে নিয়েছিল। মুজাহিদ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং আবদুল আযীয়।
জাদুকরসহ ঘরে যেসব লোক ছিল সকলকে গ্রেফতার করা হল। জাদুকরের জাদুর বাক্স থেকে মানুষের মাথার খুলি, আর কয়েকটি হাড়গোড় বের হল। কিছু তেলেসমাতির সামানপত্রও বের হল, যা সকল জাদুকরের কাছেই পাওয়া যায়। নাদিয়াকেও তাদের সাথে গ্রেফতার করা হল, যাতে কারও সন্দেহ না হয় যে, নাদিয়ার কারণেই সকলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নাদিয়াকে সবধরনের সন্দেহ থেকে মুক্ত রাখার জন্য গ্রামের গণ্যমান্য কয়েকজন ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করা হল। গ্রেফতারের পর তাদের সকলকে মেরিডার জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হল।
‘আবুল হাসান!’ আবদুল আযীয তার একজন পুলিশ অফিসারকে ডেকে বললেন। একজন ইহুদি জাদুকর এবং একজন খ্রিস্টান জায়গিরদার থেকে তাদের অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করতে হবে।’
আবদুল আযীয পুলিশ অফিসারের সাথে তাদের অপরাধের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। পুলিশ অফিসার আবুল হাসান তাদেরকে জেলখানার ভূ-গর্ভস্থ একটি কুঠরীতে নিয়ে গেল। কোন রাজা-বাদশাহ বা গণ্যমান্য ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলে এ সকল ভূ-গর্ভস্থ কুঠরীতে আটকে রেখে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিয়ে তাদেরকে মেরে ফেলা হয় বা অপরাধের কথা স্বীকার করানো হয়। যাকে একবার ভূ-গর্ভস্থ কুঠরীতে নেওয়া হত, তার পক্ষে জীবন নিয়ে ফিরে আসা একেবারে অসম্ভব ছিল।
ইহুদি জাদুকর ভূ-গর্ভস্থ কুঠরীর নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে জবানবন্দি দিতে সম্মত হয়ে বলল, আমি আমার অপরাধের কথা সালার আবদুল আযীযের সামনে স্বীকার করব। আমার অনেক কথা আছে, যা আমি শুধু তার সাথেই বলতে চাই।’
***
পরদিন সকালে জাদুকরকে আবদুল আযীযের সামনে উপস্থিত করা হল।
‘আমি একজন ইহুদি।’ জাদুকর বলল। আমি তাই করেছি, যা একজন ইহুদির করা উচিত। এজেলুনার অপরাধ কোন ইহুদি ক্ষমা করতে পারে না। সেই আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। ধোঁকা দিয়ে সে আমাদের সকল নেতাকে হত্যা করিয়েছে। এই নারীকে হত্যা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। কিন্তু কেউই তাকে হত্যা করতে প্রস্তুত হচ্ছিল না। তাছাড়া কেউ প্রস্তুত হলেও তাকে হত্যা করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। আমরা ভাল করেই জানি, এজেন জীবনের ভয়ে কিছু দিনের জন্য বাইরে বের হবে না। তাই তাকে হত্যা করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমার একমাত্র সম্বল হল, জাদু। এজেলুনাকে হত্যা করার জন্য এমন একজন নারী বা পুরুষের প্রয়োজন ছিল, যে কোন রকম বাধা ছাড়াই এজেলুনা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।’
জাদুকর আবদুল আযীযের নিকট পূর্ণ বৃত্তান্ত বর্ণনা করল। কীভাবে তারা নাদিয়াকে পেল। নাদিয়ার মনিবের সাথে তাদের সম্পর্ক কি? তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? এবং নাদিয়ার উপর কোন ধরনের জাদু প্রয়োগ করা হচ্ছিল? জাদুকর বলল, নাদিয়ার উপর ‘হেপনাটিজম’ জাতীয় জাদু প্রয়োগ করা হচ্ছিল। তাদের এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত আরও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির নাম সে উল্লেখ করল।
‘আমার শান্তি কি?’ জাদুকর জানতে চাইল।
‘মৃত্যু।’ আবদুল আযীয বললেন।
‘যদি আমি এমন কিছু তথ্য আপনাকে দেই, যা আপনাকে অনাগত বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে তাহলে কি আপনি আমাকে আমার জীবন ফিরিয়ে দেবেন? জাদুকর এ কথা জিজ্ঞেস করে সামান্য সময়ের জন্য নীরব থেকে আবার বলল, ‘আমি ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারি। আমি মানুষের ভাগ্যলিপি পড়তে পারি।
‘তোমার ভবিষ্যদ্বাণী যদি আমার এবং ইসলামী সালতানাতের কোন উপকারে আসে তাহলেই তোমার বেঁচে থাকা সম্ভব হতে পারে। আবদুল আযীয বললেন।
‘আমি ওয়াদা করছি।’ জাদুকর বলল। যদি আমার জীবন ভিক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে আমি এমন কোন কাজ করব না, যা আপনার সালতানাত বা কোন মুসলমানের সামান্য ক্ষতির কারণ হয়।’
‘তাহলে তুমি বলতে পার।’ আবদুল আযীয বললেন।
‘সম্মানিত সালার।’ জাদুকর বলল। প্রথম কথা হল, কোন ইহুদিকে বিশ্বাস করবেন না। কোন মুসলমানের উচিত নয়, কোন ইহুদিকে বিশ্বাস করা। আন্দালুসিয়ার ইহুদিরা মুসলমানদেরকে যে সযোগিতা করেছে, তা তাদের নিজেদের ফায়দার জন্য। নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য করেছে। দ্বিতীয় কথা হল, যে মাটিতে আপনারা আপনাদের রাজত্ব কায়েম করতে এসেছেন, সেই মাটি এক রহস্যময় মাটি। এই মাটির ইতিহাস রক্ত দ্বারা লেখা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও রক্ত দ্বারাই লেখা হবে।’
‘এটা কোন নতুন কথা নয়।’ আবদুল আযীয বললেন। যে দেশে হামলা করা হয় সে দেশের সেনাবাহিনী লড়াই করে, ফলে হানাদার ও রক্ষিবাহিনীর মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষেই জান-মালের সমূহ ক্ষতি হয়। উভয় বাহিনীর লোকজনই মারা পড়ে।
‘আমি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের কথা বলছি না।’ জাদুকর বলল। কোন দেশ শত্রু বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলে সে দেশের জনগণ জীবনবাজি রেখে লড়াই করবে–এটাই স্বাভাবিক। হানাদার ও দেশপ্রেমিক–উভয় পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকে। আমি সেই খুন-খারাবির কথা বলছি, যা এই রাজ্যের বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে ঘটিয়ে আসছে।
এই রাজ্যের মাটি খুবই রহস্যময়। মনে হয়, আন্দালুসিয়ার উপর প্রেতাত্মাদের কুদৃষ্টি পড়েছে। নিকট অতীতের ঘটনা। রডারিক গোথ বাদশাহ অর্টিজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাকে হত্যা করে এবং সিংহাসন দখল করে নেয়। রডারিক হিরাক্লিয়াসের দুর্গ খুলেছিল। ধর্মযাজকগণ তাকে সেই দুর্গ খুলতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু রডারিক এতটাই আত্মঅহমিকায় ভোগছিল যে, সে নিজেকে মহাপরাক্রমশালী ও অপরাজেয় মনে করত। সে মনে করত, পৃথিবীর সকল রহস্য সে উদঘাটন করতে পারবে। সে কারও কোন কথা না শুনে দুর্গ খুলে ফেলে। ফলে সে এমনভাবে পরাজিত হয় যে, তার বিশাল বড় বাহিনী ছোট্ট একটি বাহিনীর কাছে চরমভাবে ধ্বংস হয়ে যায় এবং সে নিজে এমনভাবে লাপাত্তা হয়ে যায় যে, তার কোন হদিসই পাওয়া যায়নি…।
রডারিকের মৃত্যু আজও এক রহস্য হয়ে আছে। রডারিকের ন্যায় অনেক গুম ও হত্যার ঘটনা এই মাটিতে ঘটেছে, যার রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। এই মাটিতে একের পর এক বাদশাহকে হত্যা করা হয়েছে। আমি আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, নিজের বিবেক-বুদ্ধির উপর কখনও কোন নারীর মতকে প্রাধান্য দেবেন না। আপনি যাকে বিবাহ করেছেন, সে খুবই সুন্দরী। আমি তাকে একবারমাত্র দেখেছি। তার চোখে জাদু আছে। সে যার প্রতি দৃষ্টি দেয়, সেই তার গোলাম হয়ে যায়। কিন্তু নেশা ছড়ানো তার সেই চোখ দুটিতে রক্তের দাগ রয়েছে। সে রডারিকের বিবি হবার পর রডারিক মারা গেছে। বিদ্রোহীদের অনেক বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ নেতাই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল, তারা সকলেই মারা গেছে। এখন সে আপনার…’
‘তুমি কি এজেলুনার কথা বলছ?’ আবদুল আযীয জাদুকরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন।
‘হা…’ জাদুকর বলল। আমি তার কথাই বলছি।
‘তুমি ইহুদি।’ আবদুল আযীয বললেন। মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখেও তুমি ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিচ্ছ। তুমি কি বেঁচে থাকতে চাও না?’
‘আমিও আপনাকে এই প্রশ্নই করতে চাই।’ জাদুকর বলল। আপনি কি বেঁচে থাকতে চান না? আমি জানি, আপনি কী জবাব দেবেন। আপনাকে সতর্ক করছি, আপনার মাথা বেশিদিন আপনার শরীরের সাথে থাকবে না। এজেলুনা বেঁচে থাকবে। আমি আপনাকে বলছি, আন্দালুসিয়া মুসলমানদের হাতে আসবে ঠিক; কিন্তু মুসলমান বাদশাহ একে অপরের রক্ত ঝরাবে। আমার এই সত্য কথায় যদি আপনি দুঃখ পেয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে হত্যা করার নির্দেশ দিন।’
‘আমাদের ধর্ম ইহুদিদের ভবিষ্যদ্বাণী ও জাদুকে বিশ্বাস করে না। আবদুল আযীয বললেন। আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি। একমাত্র তারই ইবাদত করি। যদি আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি তাহলে আমি মুশরিক হয়ে যাব।’
‘এটা ধর্মের বিষয় নয়, সম্মানিত সালার। জাদুকর বলল। এই বিশ্বজগতের অমোঘ রহস্যের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক, তার সাথে ধর্মের কোন সংযোগ নেই। আমি আমার কথা আপনাকে বিশ্বাস করাতে পারব না, তবে আমি আপনাকে সতর্ক করে দিলাম।
আবদুল আযীয মনে করলেন, ইহুদি জাদুকর এজেলুনাকে তার হাতে হত্যা করাতে চায়। অথবা জাদুকরের ইচ্ছা হল, আবদুল আযীয এজেলুনাকে তালাক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিক। আবদুল আযীয এসব কথা চিন্তা করে নির্দেশ দিলেন, যেন অতিসত্বর জাদুকর ও জায়গিরদারসহ সকল বন্দীকে হত্যা করে ফেলা হয়।
***
তালবিরা অবস্থান করার সময়ই তারিক বিন যিয়াদের নিকট মুসা বিন নুসাইরের পয়গাম এসে পৌঁছে। তারিক বিন যিয়াদ এমন নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। পয়গাম পৌঁছা মাত্রই তিনি তার রক্ষিবাহিনীর কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে সাথে নিয়ে টলেডোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। গনিমতের যেসব মূল্যবান তোহফা খলীফা ও আমীর মুসা বিন নুসাইরকে দেওয়ার জন্য তিনি পৃথক করে রেখেছিলেন, সেগুলোকে কয়েকটি খচ্চরের উপর বোঝায় করে নিয়ে আসছিলেন।
তারিক বিন যিয়াদ তালবিরা থেকে সোজা পথে টলেডোর দিকে রওনা হন। তিনি পথে খুব সামান্য সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি দিয়ে খুব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি টলেডো এসে পৌঁছেন। তারিক বিন যয়াদ যন শহরের ফটক দিয়ে প্রবেশ করছিলেন তখন মুসা বিন নুসাইরকে তাঁর আগমনের সংবাদ দেওয়া হল। সংবাদ পাওয়ামাত্র মুসা বিন নুসাইর চাবুক হাতে নিয়ে বের হয়ে এলেন।
তারিক বিন যিয়াদ মুসা বিন নুসাইরকে দেখামাত্র ঘোড়া থেকে নেমে দ্রুত পায়ে মুসা বিন নুসাইরের সামনে এসে বিনিত ভঙ্গিতে দুই বাহু প্রসারিত করে দিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, তার বিজয়ে সন্তুষ্ট হয়ে মুসা বিন নুসাইর তাকে বুকে টেনে নিবেন। তার কপালে চুমু খেয়ে তাকে শোকরিয়া জানাবেন। কিন্তু মুসা বিন নুসাইরের আচরণ দেখে উপস্থিত সকলেই নির্বাক হয়ে গেল। ইতিহাসের বুকে আগুনের হরফে সে আচরণের কথা চিরকাল লেখা থাকবে।
তারিক বিন যিয়াদ কাছে আসতেই মুসা বিন নুসাইর সর্বশক্তি দিয়ে তারিক বিন যিয়াদকে লক্ষ্য করে চাবুক দিয়ে আঘাত হানেন। মুহূর্তেই তারিক বিন যিয়াদ পাথরের মূর্তির ন্যায় নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মনে হল, সময়ের গতি থমকে গেছে। আশে-পাশে যারা ছিল তারা সকলেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
চারদিকে এতটাই নীরবতা ছেয়ে গেল যে, মনে হল, গাছে গাছে কোলাহলরত পাখিগুলো আচমকা বাকহীন হয়ে গেছে।
‘নাফরমান!’ মুসা বিন নুসাইরের তীব্র চিৎকারে নীরবতা ভেঙ্গে গেল। তিনি আবারও তারিক বিন যিয়াদকে চাবুক দিয়ে আঘাত করে বললেন, ‘আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম, যেখানে আছ সেখানেই থাক। সামনে অগ্রসর হওয়ার দরকার নেই।
মুসা বিন নুসাইর আরেকবার চাবুক দিয়ে আঘাত করে বললেন, কিন্তু তুমি গোটা রাজ্য জয় করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলে, আমার নির্দেশের কোন পরওয়াই করলে না?’
তারিক বিন যিয়াদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাবুকের আঘাত সহ্য করছিলেন। আর মুসা বিন নুসাইর একের পর এক আঘাত করে চলছিলেন। তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বললেন, “আমি তোমাকে এই মুহূর্তে সিপাহসালারের পদ থেকে বরখাস্ত করছি।’
মুসা বিন নুসাইর তার সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিয়ে আশ-পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সালারদেরকে হুকুম দিলেন। একে কয়েদখানায় নিয়ে যাও। আমি একে মুক্ত দেখতে চাই না।’
দু’জন সিপাহী সামনে অগ্রসর হল। একজন তারিক বিন যিয়াদের ডান বাহু, আর অপরজন বাম বাহু ধরে তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে গেল।
ইবনে যিয়াদ! আমাদেরকে ক্ষমা করবেন।’ চলতে চলতে একজন সিপাহী বলল। আমরা আমীরের নির্দেশ মানতে বাধ্য।
‘এমন আচরণ করা আমীরের উচিত হয়নি।’ অপর সিপাহী বলল।
বন্ধুগণ! আমি আল্লাহ তাআলার হুকুম মানতে বাধ্য। তারিক বিন যিয়াদ কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বললেন। আল্লাহ তাআলার হুকুম হল, আমীরের আনুগত্য করা। অন্যথায় আমি যদি বার্বারদের ইশারা করি তাহলে আরবদের নাম-নিশানাও পাওয়া যাবে না। আমার ভয় হচ্ছে, বার্বার সম্প্রদায় আমার এত বড় অপমান সহ্য করতে পারবে না। আমাকে যদি বন্দী করে রাখা হয় তাহলে তোমরা এবং আমীর মুসা কেউই বার্বারদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
***
তারিক বিন যিয়াদ তো আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। তাঁর সেই আশঙ্কা বাস্তব রূপ লাভ করতে শুরু করে দিয়েছিল। টলেডোতে অবস্থানরত যে সৈন্যই জানতে পারছিল, আন্দালুসিয়ার অর্ধেকের বেশি অংশের বিজেতা তারিক বিন যিয়াদকে আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইর খোলা ময়দানে সকলের সামনে চাবুক দিয়ে আঘাত করেছেন, তার মনেই এই প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছিল যে, মুসা বিন নুসাইর এমনটি কেন করলেন? তারিক বিন যিয়াদের অপরাধ-ই বা কি ছিল?
কারো কাছেই এ প্রশ্নের কোন উত্তর ছিল না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়ল। এ নিয়ে একজন আরেকজনের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ল। টলেডোর সেনাবাহিনীর প্রায় নব্বই ভাগই ছিল বার্বার সম্প্রদায়ের। বাবার সম্প্রদায়ের সৈন্যদের মাঝে দাবানলের ন্যায় ক্রোধের আগুন ছড়িয়ে পড়ল। সৈন্যবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা রাগে-ক্ষোভে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন।
তারিক বিন যিয়াদ তালবিয়ায় যে বাহিনী রেখে এসেছিলেন তাদের সকলেই ছিল বাবার সম্প্রদায়ের। টলেডোর সেনাসদস্যদের মাঝে এ গুঞ্জন স্পষ্টই না যাচ্ছিল যে, যেসকল বার্বার সৈন্য সামনে অগ্রসর হয়ে গেছে, তাদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছে দাও, ‘মুসা বিন নুসাইর অন্যায়ভাবে তারিক বিন যিয়াদকে সকলের সামনে বেত্রাঘাত করেছেন।’
বিদ্রোহের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা তারিক বিন যিয়াদের পক্ষ তেকেই ছিল। তাঁকে বন্দী করে সেই কারাগারে রাখা হয়েছিল, যেখানে তারই নির্দেশে আন্দালুসিয়ার বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তারা তারিক বিন যিয়াদকে বন্দী অবস্থায় দেখে উপহাস করতে শুরু করল। তাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপের কারণে তারিক বিন যিয়াদের মনে দুঃখ-যন্ত্রণার যে ঝড় বইছিল, তা অনুমান করা কারো পক্ষেই অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তারিক বিন যিয়াদ ছিলেন সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। কথায় বা কাজে কোনভাবেই তিনি কোন কিছুর প্রতিবাদ করলেন না। তার চেহারা দেখে বুঝাই যাচ্ছিল না, তিনি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন?
তারিক বিন যিয়াদ এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে মুক্তি পেলেন–সে ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মাঝে বিস্তর মতপার্থক্য দেখা যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্প্রিংগার, লেনপুল ও ডোজি লেখেছেন যে, মুসা বিন নুসাইর খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেককে সম্পূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য একজন কাসেম দামেস্কে পাঠিয়েছিলেন। সেই কাসেদ মারফত খলীফা পয়গাম পাঠিয়ে ছিলেন যে, তারিক বিন যিয়াদকে সেনাপ্রধানের পদে পুনর্বহাল করা হোক।
অন্য তিনজন ঐতিহাসিক লেখেছেন, তারিক বিন যিয়াদ কারাগার থেকে গোপন তৎপরতার মাধ্যমে তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে দামেস্ক পাঠিয়ে দেন। সেই ব্যক্তিকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যে, সে খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করে তার সামনে তরিক বিন যিয়াদের বিজয়-অভিযান সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করবে। তারপর বলবে, মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে সকলের সামনে চাবুক মেরে শুধু অপমানই করেননি, বরং তিনি তাঁকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। মোটকথা, এই ব্যক্তির উপর দায়িত্ব ছিল, তিনি খলীফাকে বুঝাবেন যে, তারিক বিন যিয়াদের সাথে এই আচরণ করার কারণ হল, তিনি বাবার সম্প্রদায়ের লোক। মুসা বিন নুসাইর চান আন্দালুসিয়ার মাটিতে শুধুমাত্র আরবদের প্রাধান্য বিস্তার লাভ করুক। তিনি আন্দালুসিয়ার বিজয়ের কৃতিত্ব এককভাবে নিজের দখলে রাখতে চান।
একজন ঐতিহাসিক এ দাবি করেছেন, যে ব্যক্তিকে দামেস্ক পাঠানো হয়েছিল, তাকে প্রচুর ঘুষ প্রদান করা হয়েছিল। সে দামেস্ক পৌঁছে খলীফার কাছ থেকে তারিক বিন যিয়াদের মুক্তির নির্দেশ নিয়ে আসে।
বাস্তবতার নিরিখে এ দুটি বিবরণকেই অসহ্য মনে হয়। কারণ, কোন্ডে ও স্পর্থের মতো ইতিহাসবিদদ্বয় নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা সাব্যস্ত করেছেন যে, খলীফাকে অবহিত করার জন্য মুসা বিন নুসাইর কোন কাসেদ পাঠাননি এবং তারিক বিন যিয়াদও কাউকে ঘুষ দিয়ে মুক্তির জন্য কোন রকম গোপন তৎপরতা চালাননি। তাদের যুক্তি হল, ঘোড়ায় চড়ে টলেডো থেকে দামেস্ক যেতে ও আসতে কয়েক মাস লেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, তারিক বিন যিয়াদকে অপসারণ করার অল্প কয়েক দিন পরই মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদের সম্মিলিত নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনীকে ফ্রান্সের সীমান্ত এলাকায় অভিযান পরিচালনা করতে দেখা গেছে।
এটা তা বিশ্বাসই করা যায় না যে, তারিক বিন যিয়াদ কাউকে ঘুষ দিয়ে দামেস্ক পাঠাতে পারেন। তারিক বিন যিয়াদের কৃতিত্বকে খাট করতে পারে এমন কোন পদক্ষেপের নাম-গন্ধও তার কর্মকাণ্ডে ছিল না। তারিক বিন যিয়াদের সুউচ্চ মানসিকতার পরিচয় এ থেকেই পাওয়া যায় যে, তিনি তার আমীরের হাতে একর পর এক চাবুকের আঘাত নীরবে সহ্য করেছেন। তিনি যদি কোন ভুল পদক্ষেপ নিতে চাইতেন তাহলে তখনি বাবার সম্প্রদায়কে মুসা বিন নুসাইরের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে পারতেন। সেনাবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যা ছিল বাবার সম্প্রদায়ের। তারা চাইলে এক দিনেই আরবদের থেকে হাতিয়ার ছিনিয়ে নিয়ে আন্দালুনিয়ার বিজয়ী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত। কিন্তু তারিক বিন যিয়াদ এমন কোন পদক্ষেপের কথা চিন্তাই করেননি।
একজন ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিক বাজোৰ্থ স্মিথ আরব ইতিহাসবিদ এবং তৎকালীন সময়ের অপ্রকাশিত কিছু নথিপত্রের বরাত দিয়ে লেখেছেন যে, তারিক বিন যিয়াদ তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সুউচ্চ মানসিকতার পরিচয় তো দিয়েছিলেনই; কিন্তু মুসা বিন নুসাইরও নীচু মানসিকতা সম্পন্ন কোন ব্যক্তি ছিলেন না। তারিক বিন যিয়াদ মুসা বিন নুসারিকে তাঁর বাবার মতো শ্রদ্ধা করতেন। মুসা বিন নুসাইরও তারিক বিন যিয়াদকে আপন সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। তারিক বিন যিয়াদের প্রতি মুসা বিন নুসাইরের এই রাগ বেশি দিন বহাল ছিল না।
এক রাতে মুসা বিন নুসাইরকে জানানো হল, বার্বার সিপাহীরা আরব সিপাহীদের বিরুদ্ধে এমনিতেই ক্ষেপে আছে। তারিক বিন যিয়াদের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে, তার জের ধরে যে কোন মুহূর্তে তারা বিদ্রোহ করে বসতে পারে। মুসা বিন নুসাইরের প্রশাসন সম্পর্কে বার্বারদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। কোন আরব সেনাপতি বা উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তা যদি বার্বারদের বিরুদ্ধে কোন রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। গৃহযুদ্ধ লাগলে বার্বারদেরই বিজয় হবে। বার্বার মুজাহিদগণ তারিক বিন যিয়াদকে তাদের আধ্যাত্মিক রাহবার মনে করে।
‘মিসর ও আফ্রিকার আমীর! জুলিয়ান মুসা বিন নুসাইরকে লক্ষ্য করে বললেন। আপনার কোন সিদ্ধান্তের উপর কোন রকম হস্তক্ষেপ করা আমরা সঠিক মনে করি না, তবে আমি ও আউপাস যেভাবে আপনার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে আন্দালুসিয়া নিয়ে এসেছি, আউপাস যেভাবে জীবনবাজি রেখে গোথ ও ইহুদি সম্প্রদায়কে রডারিকের বাহিনী থেকে পৃথক করে তাদেরকে রডারিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে, তাতে করে আমরা মনে করি, আমাদের এই অধিকার আছে যে, আমরা আপনার এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারি।’
‘সম্মানিত আমীর!’ আউপাস বললেন। “গোয়াডিলিটের বিভীষিকাময় রণাঙ্গণে সহস্রাধিক গোথ সিপাহী স্বপক্ষ ত্যাগ করে তারিক বিন যিয়াদের সাথে যদি মিলিত না হত তাহলে গোয়াডিলিটের যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন রকম হত। আমার কথার উদ্দেশ্য এই নয় যে, গোথ সৈন্যদের কারণেই মুসলিম বাহিনী জয় লাভ করেছে, বরং তারিক বিন যিয়াদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর অসম সাহিসকতাই যুদ্ধ জয়ের কারণ ছিল। তারিক বিন যিয়াদের জায়গায় যদি দুর্বল মনের অন্য কোন জেনারেল থাকত, আর তার সাথে এর চেয়েও দ্বিগুন গোথ সিপাহী এসে মিলিত হত তাহলেও রডারিকের বাহিনীকে পরাজিত করতে পারত না। একমাত্র তারিক বিন যিয়াদের পক্ষেই সম্ভব ছিল রডারিকের মত অভিজ্ঞ যুদ্ধবাজ জেনারেলকে পরাজিত করা।’
‘আমরা আশা করি, জুলিয়ান বললেন। আপনি এমন একজন মহামূল্যবান ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দেবেন না।’
‘সম্মানিত আমীর! সালার মুগিস আর-রুমি বললেন। আপনাকে তো এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে যে, যত আশঙ্কা বার্বারদের পক্ষ থেকেই। প্রকৃত তথ্য হল, বার্বারদের পক্ষ থেকে আশঙ্কার বিষয়টি শুধু কথার কথা নয়। তারা বাস্তবেই কোন না কোন অঘটন ঘটিয়ে বসবে। আপনি তাদের ব্যাপারে ভালভাবেই অবগত আছেন। আমি বার্বারদের নেতৃত্ব দিয়েছি। আমি জানি, রণাঙ্গণে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কতটা বিপদজনক। তারা রণাঙ্গণ থেকে পালাতে জানে না। পালিয়ে বাঁচার পরিবর্তে হাসি মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়। শত্রুকে সামনে পেলে উন্মাদ হয়ে যায়। শত্রুকে টুকরো টুকরো করা ব্যতীত তারা শান্ত হয় না।
আমার কথার উদ্দেশ্য হল, তারা যদি বিদ্রোহ করে বসে তাহলে কী পরিণতি হবে, তা আপনি সহজেই অনুমান করতে পারেন। আন্দালুসিয়ার বাহিনী তাদের সাথে মিলে যাবে। তখন আমরা বাঁচতে পারব না, বার্বাররাও বাঁচতে পারবে না। বিজিত আন্দালুসিয়া আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে। আমি রাতের বেলা গোপনে বার্বারদের কথা শুনেছি। আমি আপনাকে সতর্ক করছি, তারিক বিন যিয়াদকে মুক্ত করে স্বপদে ফিরিয়ে না আনলে বার্বাররা বাস্তবেই বিদ্রোহ করে বসবে। আমি আপনাকে আরও বলতে চাই যে, আরব সেনাকর্মকর্তা ও মুজাহিদগণও তারিক বিন যিয়াদের অপসারণে সম্ভষ্ট নয়।
‘আমি আপনাকে বলতে চাই, তারিক বিন যিয়াদ কেন আপনার হুকুম মানেননি।’ সালার আবু জুরুয়া তুরাইফ বললেন।
‘সে কথা আমি তোমাদের মুখে নয়, স্বয়ং তারিক বিন যিয়াদের মুখেই শুনতে চাই।’ মুসা বিন নুসারি বললেন। “তোমরা কি মনে করছ, তোমরা যে আশঙ্কার কথা বলছ, তা আমি জানি না? তোমরা কি জান না যে, ইসলাম আমীরের নির্দেশ অমান্যকারীকে ক্ষমা করে না। তোমরা কি আমাকে বেয়াকু মনে করছ? তোমরা কীভাবে ধারণা করলে যে, আমি তারিক বিন যিয়াদের বিজয়ের কৃতিত্বকে ধুলিসাৎ করে দেব। তার কৃতিত্ব আমার নিজের কৃতিত্ব বলে চালিয়ে দেব? আল্লাহই ভাল জানেন, কার কৃতিত্ব কতটুকু। আমি মানুষকে আমার কৃতিত্ব দেখাতে চাই না। আমি শুধু আল্লাহর দরবারে আমার কর্মফল পেশ করতে চাই। তারিক বিন যিয়াদকে আজকের দিন আর রাতটি কয়েদখানায় থাকতে দাও। কাল সকালে তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমাদেরকে আরও সামনে অগ্রসর হতে হবে। সামনে ফ্রান্স। আমি জানতে পেরেছি, সেখানকার সৈন্যরা আন্দালুসিয়ার সৈন্যদের চেয়েও বেশি লড়াকু।
‘সম্মানিত আমীর! মুগীস আর-রুমি জিজ্ঞেস করলেন। এই এক দিন, এক রাত বার্বারদেরকে কীভাবে শান্ত রাখা যায়?
‘তাদেরকে বলে দাও; বরং সেনাবাহিনীর মাঝে ঘোষণা করে দাও, তারিক বিন যিয়াদের মুক্তি বা শাস্তির ফায়সালা আগামীকাল হবে।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন।
ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, সেনাবাহিনীর মাঝে যখন এ ঘোষণা করা হল তখন বার্বার সৈন্যরা শ্লোগান দিতে শুরু করল। তাদের সেই শ্লোগান শুধু শ্লোগান ছিল না; বরং আল্টিমেটাম ছিল।
‘আমরা তারিক বিন যিয়াদের মুক্তি চাই।’
‘আমরা তারক বিন যিয়াদের সাথে এসেছিলাম, তারিক বিন যিয়াদের সাথেই ফিরে যাব।’
‘তারিক বিন যিয়াদ যেখানে আমরাও সেখানে।
‘আমরা কিস্তি জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছি, আন্দালুসিয়ার সব কিছু আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে যাব।’
‘তারিক বিন যিয়াদ নেই তো আমরাও নেই।
বার্বারদের এ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মুসা বিন নুসাইরকে অবহিত করা হল।
***
পরদিন সকালে হাত-পায়ে বেড়ি পরা অবস্থায় তারিক বিন যিয়াদকে মুসা বিন নুসাইরের সামনে উপস্থিত করা হর। ঘোড়াগাড়িতে করে তারিক বিন যিয়াদকে নিয়ে আসা হল, যাতে কেউ তারিক বিন যিয়াদের এই অবস্থা দেখতে না পারে। মুসা বিন নুসাইর প্রথমেই তারিক বিন যিয়াদের হাত-পায়ের বেড়ি খুলে দেওয়ার হুকুম দিলেন।
বেড়ি খুলার পর মুসা বিন নুসাইর তারেক বিন যিয়াদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যখন তোমাকে সামনে অগ্রসর হতে নিষেধ করেছিলাম তখন তুমি আমার সেই হুকুম কেন অমান্য করেছিলে?
সেখানে জুলিয়ান ও আউপাসসহ চারজন সালার উপস্থিত ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ সকলের দিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বললেন।
‘আমার সাথীরা এখানে উপস্থিত রয়েছেন, তাই অন্য কোন সাক্ষীর প্রয়োজন হবে না। যখন আপনার হুকুম আমার নিকট এসে পৌঁছে তখন আন্দালুসিয়ার বাহিনী আমাদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পলায়ন করছিল। অর্ধেকেরও বেশি সৈন্য নিহত হয়ে রণাঙ্গণে পড়েছিল। বাদশাহ রডারিক মৃত্যুবরণ করেছিল। অবশিষ্ট সৈন্যরা আশ-পাশের শহর-পল্লীতে আশ্রয় নিচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে আমি আমার সালারদেরকে জিজ্ঞেস করি, আমাদের আমীরের হুকুম মান্য করা আমাদের উচিৎ হবে কি না?
তারা সকলেই আমাকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, আমরা যদি শত্রুদের পিছু ধাওয়া না করি তাহলে তারা বিভিন্ন দুর্গে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধের জন্য পুনরায় প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হবে। এই সম্ভাবনাও ছিল যে, পলায়নরত সিপাহীরা কোন স্থানে একত্রিত হয়ে যাবে, আর বিভিন্ন শহর থেকে তাদের কাছে যুদ্ধ-রসদ পৌঁছে যাবে।
অপর দিকে আমার বাহিনীর সিপাহীরাও যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আপনি খুব সামান্য যুদ্ধ-রসদ পাঠিয়েছিলেন। আমি চাচ্ছিলাম, শত্রু বাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে এবং কোন ভাবেই যেন তাদের কাছে যুদ্ধরসদ না পৌঁছে। আমার সকল সারারগণও আমাকে এই পরামর্শই দিয়েছিলেন।
জুলিয়ানও জোরালোভাবে বলেছিলেন, এখানে অবস্থান করা কিছুতেই ঠিক হবে না; বরং এতে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। আমি নিজেও সামনে অগ্রস হওয়া উন্নত মনে করছিলাম। আর এ কারণে আমি যে সাফল্য অর্জন করেছি, তা হল আন্দালুসিয়ার দারুল হুকুমত এখন আপনার পদানত। আপনি যদি আমাকে কথা বলার সুযোগ দিতেন তাহলে আমি প্রথমেই আপনার সামনে এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা পেশ করতাম। কিন্তু আপনি আমাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করাই বেশি জরুরি মনে করেছেন।
‘তুমি যে সাফল্য অর্জন করেছ, তা আমি স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। মুসা বিন নুসাইর বললেন। এ জন্য আমি তোমাকে শোকরিয়া জানাচ্ছি। তবে তোমার ভুল হল, তুমি পূর্বেই এ ব্যাপারে আমাকে অবহিত করনি? তুমি যদি আমাকে অবহিত করতে তাহলে আমি তোমার জন্য রসদ পাঠিয়ে দিতাম। অথচ স্বয়ং আমাকেই এখানে আসতে হয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, তুমি আবেগের বশবর্তী হয়ে এমনভাবে ফেঁসে যাবে যে, সেখান থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না।’
‘ইবনে নুসাইর!’ জুলিয়ান বললেন। “ইবনে যিয়াদ যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণরূপে সত্য। আমি তাঁকে বলেছিলাম, এই পদক্ষেপের কারণে আফ্রিকার আমীর যদি নাখোশ হন তাহলে আমি তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হব। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, আপনাকে অবহিত করার বিষয়টি আমাদের কারও মাথায়ই আসেনি। আমরা সকলেই আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
‘ক্ষমা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘আমি তারিককে চাবুক দিয়ে যে আঘাত করেছি, তার অর্থ হল আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’
জুলিয়ান! আপনি জানেন না, ইসলামের বিধি-বিধান কতটা কঠিন। আপনি হয়তো শুনেছেন, খালেদ বিন ওলিদ রাযি. আপন সৌর্য-বীর্য আর রণকৌশলের কারণে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিকে চিরতরে খতম করে দিয়েছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্রের যতটা বিস্তৃতি তিনি ঘটিয়ে ছিলেন, অন্য কারও পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। অত্যন্ত মামুলি একটি বিষয়ে হযরত ওমর রাযি. তাকে মসজিদে বসিয়ে সকলের সামনে তিরস্কার করেছিলেন। দ্বিতীয়বার তেমনি তুচ্ছ একটি বিষয়ে তাকে সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। অন্যান্য রাজা-বাদশাহরা এত বড় মাপের একজন সেনাপতির বড় বড় দোষ-ত্রুটিগুলোকেও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন, কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।
মুসা বিন নুসাইর এ জাতীয় আরও দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করলেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তারিক বিন যিয়াদ আর কিছুই বললেন না। তবে তখন তিনি যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম হল, মুসা বিন নুসাইরকে আমি শুধু আমার আমীরই মনে করি না। তাকে আমি বাবার মতই শ্রদ্ধা করি। মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে আরও কিছুক্ষণ তিরস্কার করে ক্ষমা করে দিলেন।
তারিক বিন যিয়াদ সামনে অগ্রসর হয়ে মুসা বিন নুসাইরের ডান হাত তার দুই হাতের মধ্যে নিয়ে পরম ভক্তিভরে চুমু খেলেন এবং চোখে স্পর্শ করলেন।
‘ইবনে যিয়াদ।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। এমন একদিন আসবে যেদিন তোমার অস্তি-মজ্জা মাটির সাথে মিশে যাবে। হয়তো তোমার কবরের কোন চিহ্ন সেদিন অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু যতদিন এই পৃথিবীর বুকে আন্দালুসিয়ার অস্তিত্ব থাকবে ততদিন তোমার নাম অবশিষ্ট থাকবে।’
মুসা বিন নুসাইরের কণ্ঠে তারিক বিন যিয়াদের কৃতিত্বের প্রতি স্নেহমিশ্রিত স্বীকৃতি ঘোষিত হওয়ার পর মুহূর্তে সম্পূর্ণ পরিবেশ একেবারে পাল্টে গেল। মনে হল, ঈশান কোণে জমে থাকা কালো মেঘের ভেলা সরে গিয়ে সেখানে সূর্যের আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ল।
ইউরোপিয়ান বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও পর্যবেক্ষক আরদাফ্রেঞ্চ তার লিখিত ‘ফ্যালকন অফ স্পেন গ্রন্থে লেখেছেন, মুসা বিন নুসাইরের কথার স্বরে এমন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল যে, মনে হল, তারিক বিন যিয়াদ তার ঔরসজাত সন্তান। মুসা বিন নুসাইর সুনির্দিষ্ট কোন অভিলাষ নিয়েই আন্দালুসিয়া এসেছিলেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর অভিপ্রায় পরিবর্তন করে নিলেন। সম্ভবত তিনি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, তারিক বিন যিয়াদকে ছাড়া জয়যাত্রা অব্যাহত রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। অবশ্য এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আন্দালুসিয়া বিজয়ের ক্ষেত্রে মুসা বিন নুসাইরেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি যখন এই ইচ্ছা ব্যক্ত করেন যে, ফ্রান্সকেও ইসলামি সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করবেন তখন তার উচ্চমার্গিয় চিন্তা-ভবনা আর দূরদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়।
মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে ক্ষমা করার পর পরই আন্দালুসিয়ার অবিজিত অঞ্চলসমূহে অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা শুরু করে দেন।
‘সম্মানিত আমীর। তারিক বিন যিয়াদ মুসা বিন নুসাইরকে বললেন। আমি আপনার খেদমতে এখানকার তোহফা পেশ করতে চাই।’
মুসা বিন নুসাইর অনুমতি দিলে তারিক বিন যিয়াদ তোহফা নিয়ে আসতে বললেন। তিনি তালবিরা থেকে এই তোহফা সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। ‘আন্দালুসিয়ার ইতিহাস নামক গ্রন্থে অসংখ্য ঐতিহাসিকদের বরাত দিয়ে লেখা আছে যে, তারিক বিন যিয়াদের নিয়ে আসা মহামূল্যবান উপহার সামগ্রী দেখে মুসা বিন নুসাইরের চোখে-মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠে।
অধিকাংশ উপহার সামগ্রীই ছিল স্বর্ণের। সেগুলোর সাথে নানা বর্ণের অতিমূল্যবান উজ্জল নুড়ি পাথর আর হীরা-জহরত জড়ানো ছিল। এমন দুর্লভ আর মহামূল্যবান সামগ্রী কেবল রাজা-বাদশাহদের মহলেই শুভা পেয়ে থাকে।
তারিক বিন যিয়াদ একেকটি তোহফা দেখাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘এটা আপনার জন্য…, এটা আমিরুল মুমিনীনের জন্য।
অবশেষে তারিক বিন যিয়াদ সেই টেবিল বের করে মুসা বিন নুসাইরের সামনে রাখেন, যা তিনি টলেডো থেকে পলায়নরত ধর্মযাজকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে রেখেছিলেন। এই টেবিলটি ছিল স্বর্ণের তেরি। টেবিলের পায়া আর চতুর্দিক ছিল উপর থেকে নিচ পর্যন্ত হীরা-জহরত আর দুর্লভ মণি-মাণিক্যে জড়ানো।
‘এই টেবিল সম্পর্কে বেশ কিছু কিংবদন্তি প্রচারিত আছে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। প্রথমটি হল, কোন এক যুগে টাইটিস নামক কোন এক বাদশাহ জেরুজালেমের উপর আক্রমণ করেছিলেন। সেখানকার সবচেয়ে বড় উপাসনালয় থেকে তিনি এই টেবিল হস্তগত করেছিলেন।
দ্বিতীয়টি হল, এই টেবিল হযরত সুলায়মান আলাইহিসসালামের মালিকানাধীন।
তৃতীয়টি হল, ধর্মজাযকরা বলেছেন, এই টেবিলের মালিকানা যে দাবি করবে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। সে অসহনীয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্যে অসহায়ের মত মৃত্যু বরণ করবে।’
‘আমি এই টেবিলের মাঝে আরেকটি আশ্চর্য বিষয় দেখতে পাচ্ছি।’ মুসা বিন নুসাইর টেবিলটির চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে বলে উঠলেন। এই টেবিলের তিনটি পায়া দেখা যাচ্ছে, চতুর্থ পায়াটি তো দেখতে পাচ্ছি না।’
‘সম্মানিত আমীর! এই টেবিলের পায়াগুলো অনায়াসে খোলা যায় আবার লাগানো যায়। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এত পুরাতন একটি টেবিল, কে জানে, কত রাজ্যে আর কত বাদশাহর দরবারেই না ছিল? কেউ হয়তো একটি পায়া খুলে নিয়েছেন। কিংবা কোথাও হয়তো হারিয়ে গেছে।
উপস্থিত সকলেই দেখতে পেল যে, টেবিলের একটি পায়া নেই। উপস্থিত লোকদের মধ্যে তারাও ছিল যারা পুর্বেও এই টেবিলটি দেখেছিল। জুলিয়ান আর আউপাসও টেবিলটি দেখেছিলেন। সকলেরই মনে হচ্ছিল, টেবিলের চারটি পায়াই টেবিলের সাথে অক্ষত অবস্থায় ছিল। অথচ এখন তারা দেখতে পাচ্ছেন, চতুর্থ পায়াটি নেই। কিন্তু তাদের কেউই এ ব্যাপারে মুখ খুললেন না। কেউই বললেন না যে, টেবিলটি যখন এখানে নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন তার চারটি পায়াই অক্ষত ছিল। কিন্তু সকলেই এ ব্যাপার নীরব কেন ছিল, ইতিহাস থেকে এর কোন সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। তাদের সকলের নীরবতা তারিক বিন যিয়াদের কথারই সমর্থন করছিল।
প্রফেসর ডোজি লেখেছেন, সকলের নীরবতার একটি কারণ এটিও হতে পারে যে, এই টেবিল সম্পর্কে ধর্মজাযকদের কাছ থেকে রহস্যময় ও লোমহর্ষক অনেক কথাই শোনা গিয়েছিল। তারা হয়তো মনে করছিলেন, চতুর্থ পায়াটি নিজে নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিংবা হয়তো অদৃশ্য হয়নি; কিন্তু তারা কেউই সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। আর তাই সুনিশ্চিতভাবে কেউ কিছু বলতেও পারছিলেন না।
‘আমি এই টেবিলের সাথে চতুর্থ পায়া লাগিয়ে দেব।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। অন্য পায়াগুলোতে যেরকম হীরা-জহরত আর চুণিপাথর জড়ানো আছে, সেগুলো হয়তো পাওয়া যাবে না। তাতে কী হয়েছে? আমি স্বর্ণ দিয়ে চতুর্থ পায়াটি তৈরি করা। তারপর এই টেবিল আমি আমিরুল মুমিনীনের নিকট তোহফা হিসেবে পেশ করব। শহরের সবচেয়ে অভিজ্ঞ স্বর্ণকারকে ডেকে নিয়ে এসো। তাকে বল, অন্যান্য পায়ার মত দেখতে আরেকটি পয়া স্বর্ণ দিয়ে বানিয়ে দিতে। এমনভাবে পায়াটি বানাতে হবে, যাতে সহজেই সেটি টেবিলের সাথে লাগানো যায় এবং পৃথক করা যায়।’
ডন পাস্কেল নামক জনৈক ইতিহাসবিদ তঙ্কালীন নথিপত্রের বরাত দিয়ে লেখেছেন, অর্জিত গনিমতের মালের মধ্যে স্বর্ণের কোন কমতি ছিল না। চতুর্দিকে স্বর্ণের স্তূপ লেগে গিয়েছিল। মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশ অনুযায়ী অভিজ্ঞ স্বর্ণকারকে ডেকে এন টেবিলের অন্য পায়াগুলো দেখানো হল। অল্প কয়েক দিনের মেহনতেই স্বর্ণকার টেবিলের চতুর্থ পায়া তৈরি করে লাগিয়ে দিল।
এর কয়েক দিন পরের ঘটনা। মুজাহিদ বাহিনী আরাগুনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এই বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন দুইজন। মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ। মুসা বিন নুসাইর জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আর তারিক বিন যিয়াদ পৌঁছেছেন যৌবনের শেষ প্রান্তে। কিন্তু আবেগ আর উদ্যম, সংকল্প আর সাহসিকতায় উভয়কেই নওজোয়ান মনে হচ্ছিল। তারা মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যে পথ অতিক্রম করে চলছিলেন, সেটা কোন সহজ পথ ছিল না; বরং সেখানে কোন পথই ছিল না। মুজাহিদ বাহিনী দিগন্ত বিস্তৃত বিপদসংকুল ভয়ঙ্কর এক উপত্যকা অতিক্রম করে চলছিল।
মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদের গন্তব্য ছিল আরাগুন রাজ্যের কেন্দ্রীয় শহর সারগোসা। এই গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছতে অসাধারণ হিম্মত আর অসম সাহসিকতার প্রয়োজন ছিল। এই শহরে পৌঁছার জন্য সর্বসাধারণ যে রাস্তা ব্যবহার করত, তা ছিল খুবই দীর্ঘ। কম করে হলেও এই রাস্তার দূরত্ব ছিল এক মাসের। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর বিকল্প পথ হিসেবে উপত্যকা দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন।
এই উপত্যকা ছিল ‘হিজারা উপত্যকার মতোই দুর্গম আর বিপদসংকুল। এই উপত্যকায় সমতল ভূমিও ছিল। কিন্তু ঝোঁপ-জঙ্গল, আর উঁচু-নিচু টিলার সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। খানাখন্দ, খাল-বিল আর নদ-নদীর সংখ্যাও ছিল প্রচুর। কোন কোন নদী ছিল খুবই গভীর।
সৈন্যবাহিনীর সদসামগ্রী গরু-গাড়ি বা ঘোড়া-গাড়ির পরিবর্তে খচ্চরের উপর বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কোন ধরনের গাড়ি নিয়ে এই এলাকা অতিক্রম করা ছিল একেবারেই অসম্ভব। সমগ্র বাহিনীর জন্য এক সাথে খানা তৈরি করার মত কোন পাত্রও সাথে করে নেওয়া হয়নি। প্রত্যেক সওয়ারীকে একটি করে তামার পাত্র দেওয়া হয়েছিল। সেই পাত্রে সে খানা তৈরি করত এবং পানি পান করত। প্রত্যেক সওয়ারীর কাছে একটি করে পানির মশক আর একটি করে শুকনো খাবারের থলি ছিল। পদাতিক সৈন্যদের পক্ষে কোন কিছু বহন করা সম্ভব ছিল না। পদাতিক সৈন্যের কাছে হাতিয়ার ছাড়া আর কোন কিছুই ছিল না। সওয়ারী সৈন্যদের বলে দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন পদাতিক সৈন্যদেরকে তাদের পানাহারে শরিক করে। একজন সওয়ারী সৈনিক আরেকজন পদাতিক সৈনিকের সাথে মিলে যেন খানা খায়।
হিজারা উপত্যকা অতিক্রম করার সময় তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী যেমন বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল এই বাহিনীও পদে পদে তেমনি বিপদের সম্মুখীন হতে লাগল। গভীর নদীগুলো পার হতে গিয়ে দুই-চারজন মুজাহিদ স্রোতের টানে হারিয়ে গেল। জঙ্গলের যেখানে ছাউনি স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে কয়েকজন মুজাহিদ বিষাক্ত সাপের ছোবলে প্রাণ হারাল। কোন কোন মুজাহিদ কমর পর্যন্ত চোরাবালিতে ডেবে গেল। রশি ছুঁড়ে মেরে তাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হল।
সবচেয়ে বড় ধৈর্যের পরীক্ষা ছিল একদিন একরাত যাবত বয়ে যাওয়া পাহাড়ী সাইক্লোন আর জীবনসংহারী ঝবায়ুর মাঝে তাদের টিকে থাকা। পাহাড়ী সাইক্লোন বিশাল বিশাল গাছগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলছিল। মোটা মোটা ডালগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছিল। চার-পাঁচটি ঘোড়া একটি বড়সড় গাছে নিচে দাঁড়ানো ছিল। টর্নেডোর আঘাতে ঘোড়াগুলো এক মুহূর্তে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল। পূর্ণ একদিন একরাত অনবরত টর্নেডোর আঘাত মুজাহিদদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিছুক্ষণ পর পর বজ্রপাতের বিকট শব্দ বোমা বিস্ফোরণের মতো মনে হচ্ছিল।
মুজাহিদ বাহিনীর কাছে কোন তবু ছিল না। তারা বজ্রপাতের ভয়ে গাছে নিচে আশ্রয় নিত না। তারা জানত গাছের উপরই বজ্রপাত ঘটে। তারা টিলা আর বালিয়াড়ির আড়ালে আশ্র নিল। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ীবায়ু আর পাহাড়ী সাইক্লোনের আক্রোশ থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। খচ্চর আর ঘোড়াগুলো শীতের তীব্রতায় ঠক ঠক করে কাঁপছিল।
নদী-নালার সুতীব্র স্রোত বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছিল। পাহাড়ী টিলা আর বড় বড় পাথরের মাঝখান দিয়ে বৃষ্টির পানি বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত ছুটে চলছিল। মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন যিয়াদ, আর অন্যান্য সালারদের অবস্থা ছিল একেবারেই শোচনীয়। কিন্তু তারা কোথাও আশ্রয় তালাশ করছিলেন না। তারা সকলেই পৃথক পৃথকভাবে ঘোড়ায় চড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া বাহিনীর সদস্যদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করছিলেন। তাদেরকে উজ্জেবিত রাখার জন্য তাদের সাথে হাসি-কৌতুক করছিলেন। তাদের এই হাস্যরস আর কৌতুক শীতে কম্পমান মুজাহিদদের শরীরে উত্তাপ সৃষ্টি করছিল।
প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ু আর বজ্রের বিকট আওয়াজকে উপেক্ষা করে মুসা বিন নুসাইর এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটে যাচ্ছিলেন, আর হুঙ্কার ছেড়ে বলছিলেন :
‘উত্তাল সমুদ্র তোমাদেরকে প্রতিহত করতে পারেনি।’
‘আন্দালুসিয়ার স্রোতস্বিনী নদী আর দুর্ল পাহাড় তোমাদেরকে আটকাতে পারেনি।’
‘আন্দালুসিয়ার সুশৃঙ্খল সৈন্যবাহিনী তোমাদেরকে পরাস্ত করতে পারেনি।
‘তোমরা এখানকার পাহাড়সম দুর্গগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছ।
“এই তুফানও তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’
প্রত্যেক সালারই মুজাহিদদের হিম্মত বাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। মুসা বিন নুসাইর প্রত্যেক মুজাহিদকে লক্ষ্য করে এ কথাগুলো বারবার বলছিলেন।
‘আমাকে দেখ, আমার বয়সের প্রতি লক্ষ্য কর, এই বয়সে বার্ধক্যের কারণেই শরীর কাঁপতে থাকে। কিন্তু হীম শীতল ঝঞ্ঝাবায়ুর মাঝেও আমি আমার শরীরকে কাঁপতে দিচ্ছি না।’
এসবই ছিল, কথার কথা। বাস্তবতা হল, সকলেই শীতের তীব্রতায় কাঁপছিলেন। কিন্তু কেউই হীনমন্যতা, ভীরুতা আর কাপুরুষতার পরিচয় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তারা সকলেই তাদের আধ্যাত্মিক শক্তির বলে নিজেদেরকে অটল-অবিচল রেখেছিলেন।
***
সাইক্লোনের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল। তুফানী ঝঞ্ঝাবায়ুর প্রচণ্ডতা একসময় শক্তিহীন হয়ে পড়ল। নিশুতি রাতের অন্ধকার দূর হয়ে আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটে উঠল। সূর্যের আলোতে চতুর্দিক আলোকিত হলে দেখা গেল, গোটা বাহিনীর অবস্থা সেই জাহাজের মত হয়েছে, যা সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবো পাহাড়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। আর জাহাজের টুকরোগুলো ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
মুজাহিদ বাহিনীর কারও পক্ষেই সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। বেশ কয়েকজন মুজাহিদ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। গোটা বাহিনীকে মাত্র একদিন-একরাতের জন্য বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হল।
পরদিন মুজাহিদ বাহিনী সামনের দিকে চলতে শুরু করল। যেসকল মুজাহিদ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাদেরকে ঘোড়ার উপর তুলে নেওয়া হল। ফজরের নামায আদায় করেই মুজাহিদ বাহিনী চলতে শুরু করল। যেখানে তারা নামায আদায় করেছিল, সেখানের মাটি ছিল সঁতসেঁতে। চতুর্দিক থেকে গাছের পাতা বেয়ে বৃষ্টির পানি ঝড়ে পড়ছিল। নামাযের পর মুসা বিন নুসাইর মুজাহিদদের লক্ষ্য করে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণ প্রদান করেন। সে ভাষণ আজও ইতিহাসের পাতায় সোনালী হরফে লেখা আছে।
‘আল্লাহ যাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তাদেরকে জীবনবিধ্বংসী তুফান থেকে নিরাপদে বের করে নিয়ে আসেন। নূহ আলাইহিসসালামের যুগের সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড় থেকে আল্লাহ তাআলা তাদেরকেই বের করে এনেছিলেন, যারা নূহ আলাইহিসসালামের অনুগত ছিল। এতে কোন সন্দেহ নেই, যারা স্বীয় কৃতকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে পুরস্কৃত করবেন।
তোমরা এই কুফরিস্তানে আল্লাহ ও তার রাসূলের পয়গাম নিয়ে এসেছ। নিঃসন্দেহে তোমাদের পদভার, তোমাদের সেজদার চিহ্ন, আর শহীদদের লাল রক্তের স্পর্শ এই অপবিত্র মাটিকে পবিত্র করে দিয়েছে। আযানের সুমধুর আওয়াজ এখানকার আকাশ-বাতাসকে সুরভিত করে তুলেছে।
নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ওয়াদা করেছেন, যদি তোমরা ঈমানদার হও এবং সত্যের উপর অটল-অবিচল থাক তাহলে তোমাদের দশজন একশজনের বিপরীতে, আর একশজন এক হাজারের বিপরীতে জয়লাভ করবে। মনে রেখ, তোমরা হলে মুসলমান। তোমাদের মাঝে উঁচু-নীচুর কোন ভেদাভেদ নেই। তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে আল্লাহর রাস্তায় জানমাল কুরবানি করার জযবা রাখে। সগ্রামী বন্ধুগণ! আল্লাহ আমাদের সাথেই আছেন।’
মুসা বিন নুসাইরের তেজোদ্দীপ্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর গোটা বাহিনী নতুন উদ্যমে দ্বিগুণ উৎসাহে একের পর এক মনযিল অতিক্রম করে আগুনের কেন্দ্রীয় শহর সারগোসা এসে পৌঁছল। সারগোসার আশপাশের এলাকাগুলো ছিল খুবই দৃষ্টিনন্দন। শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত মজবুত।
মুসা বিন নুসাইর শহর অবরোধ করার আগে একজন সালারকে এই পয়গাম দিয়ে পাঠালেন যে, দুর্গের লোকদের বল, কোন রকম রক্তপাত ছাড়াই তারা যেন দুর্গের ফটক খুলে দেয়। যদি তারা মোকাবেলা করে, আর আমরা দুর্গ ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করি তাহলে একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। আর যদি তারা নিজেরাই দুর্গ খুলে দেয় তাহলে সবধরণের সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকবে এবং তাদের সাথে উত্তম আচরণ করা হবে।’
মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশ অনুযায়ী সালার সামনে অগ্রসর হয়ে ঘোষণা করলেন।
‘তোমরা যদি এখান থেকেই চলে যাও তাহলে আমরা তোমাদের পিছু ধাওয়া করব না।’ দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে উত্তর এলো। এ দুর্গ পদানত করার স্বপ্ন সাথে নিয়ে ফিরে যাও।’
‘আমরা চাই না রক্তপাত হোক। সালার বললেন।
‘আমরা তোমাদের রক্ত ঝড়াতে চাই।’ উপর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো। ঐ রডারিক মারা গেছে, যাকে তোমরা পরাজিত করেছ। এখানে কোন রডারিক নেই।’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রাচীরের উপর থেকে সম্মিলিত কণ্ঠের অট্টহাসি শুনা গেল।
‘ফিরে এসো। মুসা বিন নুসাইর বজ্রকণ্ঠে সালারকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন।
শহর অবরোধ করা হল। আন্দালুসিয়ার সৈন্যরা দুর্গ থেকে হঠাৎ করে বের হয়ে অতর্কিত হামলা করত। তারা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে আক্রমণ করে মুজাহিদদেরকে পিছু হটিয়ে দিত। তাদের রণকৌশল ছিল, তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৈন্যদলে বিভক্ত হয়ে দুর্গ থেকে বের হয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করে আবার দুর্গে প্রবেশ করে ফটক বন্ধ করে দিত। সমগ্র আন্দালুসিয়ার সৈনিকদের এই একই রণকৌশল ছিল। সারগোসার সৈন্যরাও এই কৌশল অবলম্বন করে যুদ্ধ করছিল। এই পদ্ধতিতে তারা মুজাহিদদের যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হল।
অবশেষে এই রণকৌশলই সারগোসার সৈন্যদের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তবে বিজয় ছিনিয়ে আনতে বেশ কয়েকজন মুজাহিদকে জানের নাযরানা পেশ করতে হল। ইতিহাসে তাদের সংখ্যা লেখা হয়েছে পঞ্চাশ থেকে ষাটজন। পর্তুগালের জনৈক ইতিহাসবিদ লেখেছেন, তাদের সংখ্যা একশ থেকে কিছু বেশি হবে। তাদের প্রকৃত সংখ্যা যাইহোক না কেন–এটা দেখার বিষয় নয়; দেখার বিষয় হল, অবরোধের অষ্টম কি নবম দিন যখন সারগোসার সৈন্যরা দুর্গের ফটক খোলে বের হতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মূহুর্তে মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী তাদের উপর তীর বৃষ্টি শুরু করে দিল। একটি ফটক দিয়ে প্রায় চারশ ঘোড়সওয়ার আর অপর ফটক দিয়ে প্রায় তিনশ পদাতিক সৈন্য বের হয়ে এলো। তাদের পিছনে শত শত ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক সৈন্য বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল।
প্রথম সুযোগেই তীরন্দাজ বাহিনী তুমুল আক্রমণ শুরু করে দিল। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা তীরের আঘাতে প্রথম সারির সকল ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অন্য সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে পিছন দিকে ছুটতে শুরু করল।
পিছনে হটে আসা সৈন্যরা ফটক থেকে বের হয়ে আসা সৈন্যদের উপর হুড়মুড়িয়ে পড়ল। তারা ভিতরে ঢুকে ফটক বন্ধ করে দিতে চাচ্ছিল। এই সুযোগে পঞ্চাশ থেকে একশ মুজাহিদ জীবনবাজি রেখে এক অসাধারণ বীরত্বের ইতিহাস রচনা করল। তারা পিছু হটে আসা ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক সৈন্যদের সাথে মিশে দুর্গের ভিতর চলে এলো। তৎক্ষণাৎ মুসা বিন নুসাইর দুই ডিভিশন মুজাহিদকে ফটকের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন। আন্দালুসিয়ার সৈন্যদের সাথে মিশে যে মুজাহিদগণ ফটকের ভিতর প্রবেশ করেছিলেন তারা অসম বীরত্ব প্রদর্শন করে ফটক বন্ধ করতে দেননি। আন্দালুসিয়ার বাহিনীর সাথে লড়াই করতে করতে তারা ফটকের উপরেই শহীদ হয়ে যান। ফটক খোলা পেয়ে মুজাহিদ বাহিনী এক যোগে দুর্গের উপর আক্রমণ করে ভিতরে ঢুকে পরেন। দুর্গের সৈন্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পাল্টা আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর বীরত্ব আর তব্রতার সামনে তারা কিছুতেই টিকতে পারল না। অনেক রক্তপাতের পর দুর্গ মুসলমানদের পদানত হল।
জীবত সকল সৈন্য ও সালারদের বন্দী করা হল। তাদেরকে সবধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হল। শহরবাসীদের উপর জিযয়া-টেক্স আরোপ করা হল। মুসা বিন নুসাইর অতিদ্রুত একজন করিঙ্কৰ্মা প্রশাসক ও কয়েকজন কর্মকর্তা নিযুক্ত করে শহরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেন। প্রশাসক ও কর্মকর্তাদের সকলেই ছিলেন মুসলমান। কোন ইহুদি বা খ্রিস্টানকে প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রদান করা হল না। হুসাইন বিন আবদুল্লাহকে প্রাদেশিক গভর্নর নিযুক্ত করা হল। হুসাইন বিন আবদুল্লাহ গভর্নর থাকাকালীন সারগোসায় বিশাল এক মসজিদ নির্মাণ করেন। ইতিহাসে আজও তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
***
মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদের মাঝে আক্রমণাত্মক নেত্রিত্বের আর যুদ্ধজয়ের উন্মাদনা দেখতে পেয়ে তাঁকে প্রধান সিপাহসালার নিযুক্ত করেন। তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী সারগোসা থেকে সামনে অগ্রসর হয়ে কাতলুনা আর ওয়েলনেশিয়া নামক দুটি বড় শহর বিজিত করেন। আন্দুসিয়ার আরও দুটি প্রদেশ তখনও বিজিত হয়নি। একটি গ্ল্যাশিয়া, অন্যটি এলেরিয়াস। গুপ্তচর মারফত জানা যায় যে, এই প্রদেশ দুটির খ্রিস্টান গভর্নরগণ স্বায়ত্ব শাসন কায়েম করে রেখেছেন। কার্যত এখানকার শাসন ক্ষমতা ছিল পাদ্রিদের হাতে। তারা জনসাধারণকে ধর্মীয় উন্মাদনার মাঝে নেশাগ্রস্ত করে রেখেছিলেন।
অভিযান পরিচালনা করার ক্ষেত্রে এই এলাকাগুলোও ছিল হিজারা ও আরাগুন উপত্যকা দু’টির মতোই দুর্গম আর বিপদসংকুল। অসংখ্য খরস্রোতা নদী, ছোট-বড় খাল-বিল, নিশ্চিদ্র ঘন বন-জঙ্গল, দিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু প্রান্তর, আর দুর্লজ্জনীয় পাহাড়ের সারি–এগুলোই ছিল এসব এলাকার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাধারণ চিত্র। আবহাওয়ার স্থায়ী কোন নিয়ম-কানুন ছিল না। কোথাও প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় মুজাহিদদের চলার পথে বিষের কাটা হয়ে দাঁড়াত। কোথাও সাইক্লোন আর টর্নেডোর আচমকা আক্রমণ মুজাহিদদেরকে হীনবল করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ কত। খাল-বিল-নদ-নদীর সুতীব্র স্রোত, আর ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে থাকা চোরাবালি মুজাহিদ বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু মুজাহিদ বাহিনী আল্লাহু আকবারের বিদ্যুৎমক আর বজ্রকঠিন হুঙ্কারের মাধ্যমে বাধার সকল বিন্দাচল দু’পায়ে মাড়িয়ে দৃপ্তকদমে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে গেছেন। মুজাহিদ বাহিনী যেখানেই গেছেন সেখানের মাটিই শহীদ-গাজীর তাজা খুনে রঞ্জিত হয়েছে। সেখানেই শান্তির শুভ্র হেলালী-ঝাণ্ডা আকাশে দ্যুতি ছড়িয়েছে।
মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনীর অগ্রযাত্রা এতটাই অবিশ্বাস্য আর অকল্পনীয় ছিল যে, ইউরোপের অতি সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদগণও বিস্ময়াভিভূত হয়ে মুজাহিদ বাহিনীর বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
ইতিহাসজগতের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসবিদ মি, গিবন লেখেছেন, মুসলিম জাতি তাদের সংকল্প পুরণে এতটাই আবেগপ্রবণ আর উন্মাদ ছিল যে, হাজার রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মহাশক্তিধর সুশৃংখল সামরিক-শক্তি তাদের সামনে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতেই পারেনি। তারা আন্দালুসিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে ফ্রান্সের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে তাদের অভিযান মুলতবী করেছে।
‘প্রিয় বৎস! মুসা বিন নুসাইর একদিন তারিক বিন যিয়াদকে লক্ষ্য করে বললেন। আন্দালুসিয়ার কোন শহর, কোন দুর্গ কি এমন আছে, যা আমরা এখনও বিজিত করিনি?’
‘না, সম্মানিত আমীর!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আন্দালুসিয়ার এমন কোন শহর, এমন কোন দুর্গ অবশিষ্ট নেই–যেখানে ইসলামের ঝাণ্ডা সগৌরবে মাথা উঁচু করে উড়ছে না।’
‘ইবনে যিয়াদ, আল্লাহর কসম!’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। “তুমি নিশ্চয় আমাকে সমর্থন করবে যে, আমাদের উচিত ফ্রান্স আক্রমণ করা।
“ইসলামী সাম্রাজ্যের কোন সীমানা নেই, সম্মানিত আমীর। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমাদের উচিত ফ্রান্সের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া।’
নওয়াব যুলকদর জঙ্গ বাহাদুর স্বীয় গ্রন্থ ‘খেলাফতে আন্দালুস’-এর মাঝে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের বরাত দিয়ে লেখেছেন, মুসা বিন নুসাইর ফ্রান্সের সীমান্ত এলাকায় কিছু দিন অবস্থান করেন, যেন যুদ্ধক্লান্ত মুজাহিদগণ কিছুটা বিশ্রাম নিতে পারেন এবং আহত মুজাহিদগণ সুস্থ হতে পারেন।
বিশ্রামের এই দিনগুলোতে মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ গোটা ইউরোপ জয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার পর একদিন ভোরের আলো ফুটার আগেই মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী একটি এলাকায় আক্রমণ করে বসেন।
‘খেলাফতে আন্দালুস’-এর মাঝে আরও আছে যে, মুসলিম বাহিনী ফ্রান্সের বড় দুটিই শহর বারসেলুনা, আর নারবুন কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়া জয় করে। নেন। নারবুন টলেডু থেকে এক হাজার পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত একটি শহর। সেই তখন থেকে এই শহর দুটি আন্দালুসিয়ার অংশ হয়ে আছে। অনেক ঐতিহাসিকগণই লেখেছেন যে, ফ্রান্সের সৈন্য বাহিনী মুসলিম বাহিনীর সামনে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
আর এমনটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ ফ্রান্সের বাহিনী আন্দালুসিয়ার বাহিনীর চেয়েও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল।
সামনেই ছিল ফ্রান্সের দুর্গম পাহাড়ীসারি পাইরেন্স। মুসলমানগণ এর নাম দিয়েছিল জাবাল আল-বারাত। এই পাহাড়গুলোর কোন কোনটির চূড়া ছিল খুবই উঁচু। ঐতিহাসিক গিবন তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘রোম সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন’র মাঝে লেখেছেন, মুসা বিন নুসাইর পাইরেন্সের এক সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ফ্রান্সকে তার পদতলে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি আমার বাহিনীতে আরও সৈন্য সমাবেশ করে ইউরোপ জয় করে ‘কনোস্টন্টিনোপল পর্যন্ত পৌঁছব। সেখান থেকে স্বীয় রাজ্য সিরিয়ায় প্রবেশ করব।’
গিবন আরও লেখেন, যদি এই মুসলিম জেনারেল সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেতেন তাহলে আজ ইউরোপের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও স্কুলসমূহে বাইবেলের পরিবর্তে কুরআন পড়ানো হত। আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবুওয়াতের পাঠ প্রদান করা হত। ইউরোপে পোপের পরিবর্তে শায়খুল ইসলামের নির্দেশে বিধান কার্যকর হত।
মুসা বিন নুসাইর ফ্রান্সের এই শহর দুটি জয় করে সামনে কেন অগ্রসর হননি–এই প্রশ্নের উত্তর একটি বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। বিবরণটি অনেক ঐতিহাসিকের লেখাতেই এসেছে। বিবরণটি হল এই :
মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ ফ্রান্সের লিউন শহর বিজিত করে সামনে অগ্রসর হন। পথে তারা বিস্তীর্ণ এলাকা জোড়ে জীর্ণ-শীর্ণ পরিত্যাক্ত কিছু ইমারত দেখতে পান। তারা উভয়ে সৈন্যদের থেকে পৃথক হয়ে ইমারতগুলো পরিদর্শনে বের হন। দেখতে দেখতে তাদের দৃষ্টি একটি স্তম্ভের উপর আটকে যায়। স্তম্ভের উপর খোদাই করে লেখা ছিল–’হে ইসমাইলের বংশধর, এই পর্যন্ত তোমরা পৌঁছে গেছ। এখান থেকেই ফিরে যাও।’
স্তম্ভের অপর দিকে লেখা ছিল–যদি তোমরা এখান থেকে সামনে অগ্রসর হও তাহলে তোমাদের মাঝে বিদ্রোহ দেখা দেবে। এই বিদ্রোহ তোমাদের ঐক্য-সংহতি আর শক্তি বরবাদ করে দেবে।
ঐতিহাসিকগণ লেখেন, দেয়ালের লেখা পড়ে মুসা বিন নুসাইর গভীর চিন্তায় পড়ে যান। তিনি সালারদের সাথে জরুরীভিত্তিতে পরামর্শে বসেন। সালারদের সকলেই তাঁকে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তারা বলেন, আমরা যে রাজ্য জয় করেছি, সেখানে যথার্থরূপে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এমন যেন না হয় যে, আন্দালুসিয়ায় আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি দেখা দেয়। সকলের পরামর্শ অনুযায়ী মুসা বিন নুসাইর ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ফ্রান্স থেকে ফিরে আসা বা সামনে অভিযান পরিচালনা না করার আরেকটি কারণও পাওয়া যায়। কারণটি হল, মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অভিযান পরিচালনা করছিলেন। মুসা বিন নুসাইর ছিলেন ফ্রান্সের ‘লিউগো শহরে, আর তারিক বিন যিয়াদ ছিলেন সেখান থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত উরগা শহরে। এমন সময় একদিন দামেস্ক থেকে খলীফার বিশেষ দূত আবু নসর মুসা বিন নুসাইরের নিকট এই পয়গাম নিয়ে হাজির হন যে, পয়গাম পৌঁছা মাত্রই অভিযান মুলতবী করে তিনি এবং তারিক বিন যিয়াদ যেন তৎক্ষণাৎ দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য দরবারে খেলাফতে হাজির হন।
‘আমীরুল মুমিনীন কি জানেন, আমি আর তারিক বিন যিয়াদ যদি এখান থেকে চলে যাই তাহলে বিজিত আন্দালুস আমাদের হাত ছাড়া হয়ে যাবে? মুসা বিন নুসাইর আবু নসরকে লক্ষ্য করে বললেন।
‘আমিরুল মুমিনীন কী জানেন, আর কী জানেন না–এটা আমার জানার বিষয় নয়। আবু নসর বললেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যদ্রুত সম্ভব মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ যেন দামেস্ক চলে আসে।’
কোন কোন ঐতিহাসিক লেখেছেন, খলীফা ওলিদ বিন আব্দুল মালেক পূর্বেও মুসা বিন নুসাইরকে দামেস্ক ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অভিযান পরিচালনায় আর নতুন নতুন শহর জয়ের নেশায় এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন যে, দামেস্কের পয়গাম ভুলেই গিয়েছিলেন। খলীফা ওলিদের সাথে মুসা বিন নুসাইরের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। খলীফা অসন্তুষ্ট হতে পারেন এমন কোন আশঙ্কা তার মনে ছিল না। কিন্তু খলীফা তার বিশেষ দূত মারফত এই কঠিন নির্দেশ পাঠান যে, পত্র পাওয়ামাত্রই দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবে।
মুসা বিন নুসাইর কালবিলম্ব না করে একজন বার্তাবাহককে এই বলে তারিক বিন যিয়াদের নিকট পাঠিয়ে দিলেন, যতদ্রুত সম্ভব ‘লিউগো চলে এসো। সংবাদ পেয়ে অতিঅল্প সময়ের মধ্যেই তারিক বিন যিয়াদ লিউগো এসে পৌঁছলেন। মুসা বিন নুসাইর তাকে বললেন, আমিরুল মুমিনীনের বার্তাবাহক এসেছেন, আগামী কাল ফজরের নামায পড়েই আমাদের রওনা হতে হবে।’
‘সম্মানিত আমীর!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এমন কি হতে পারে না যে, আমিরুল মুমিনীনকে …।
‘ইবনে যিয়াদ!’ আবু নসর তারিক বিন যিয়াদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন। ‘আমিরুল মুমিনীন কোন অযুহাত গ্রহণ করবেন না। তাঁর রোষানলের তীব্রতা সম্পর্কে আমি ভালভাবেই অবগত আছি।’
“বেটা তারিক! আমাদেরকে যেতেই হবে। দামেস্ক যাওয়াই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
মুসা বিন নুসাইরের এই কথাগুলো ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত হয়ে আছে।
‘আমি কখনই আমার নিজের মঙ্গলের কথা চিন্তা করিনি। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। ইসলামী সালতানাতের মঙ্গল কামনাই আমার একমাত্র চিন্তা।
‘বৎস! তুমি আমার হুকুম অমান্য করেছিলে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমিরুল মুমিনীন তার হুকুম অমান্যকারীকে ক্ষমা করবেন না। যাও, প্রিয় বৎস! দামেস্ক যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ কর। আমরা আবারও ফিরে আসব। ফ্রান্সের এই সুউচ্চ পর্বতমালা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ দামেস্ক যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। তাদের মনে এতটুকু সন্দেহও সৃষ্টি হল না যে, তারা যাচ্ছেন তো ঠিকই; কিন্তু আর কোন দিন এখানে ফিরে আসতে পারবেন না। দামেস্কের কয়েদখানা মুসা বিন নুসাইরের জন্য, আর চিরদিনের ‘গুমনামী তারিক বিন যিয়াদের জন্য অপেক্ষা করছে।