অষ্টম অধ্যায় – আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন কোন্দল ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
- জনাব তাজুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারছিল না অনেকেই।
- কোলকাতায় মন্ত্রণালয় এবং সচিবালয় সাজিয়ে বসলো প্রবাসী সরকার।
- প্রবাসী সরকার এবং রনাঙ্গনের সব পর্যায়ে খবরদারী এবং নজরদারীর জন্য ভারতীয় এজেন্ট নিয়েগ।
- খন্দোকার মোশতাক থিয়েটার রোড ছেড়ে সার্কাস এ্যাভেনিউতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরিয়ে আনলেন।
- দৈবক্রমে প্রবাসী সরকারের প্রধান কার্যালয় দু’টোই ছিল থিয়েটার রোডে এবং সার্কাস এ্যাভেনিউতে। অনেকের আচার-আচরণ ও ভাবসাবে মনে হত তারা যেন সত্যিই থিয়েটার ও সার্কাসের ক্লাউন।
- প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে।
- খন্দোকার মোশতাক ভারতীয়দের কাছে হয়ে উঠেন চোখের বালি।
- গুজব ছড়িয়ে পরে খন্দোকার মোশতাক নাকি সিআইএ-এর যোগসাজসে শেখ মুজিবের সম্মতিক্রমে পাকিস্তান সরকারের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করছেন।
- সেই সময়ে হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হওয়ায় গুজবটি কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়।
- সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা সব মহলেই আলোড়ন সৃষ্টি করে।
যুদ্ধে যোগ দেবার পর একটি জিনিস দেখে বারবার আমাকে অবাক হতে হয়েছে। যেখানেই গেছি, দেখেছি আত্মপ্রত্যয় আর মানসিক দৃঢ়তায় ভোরের সূর্যের দ্বীপ্তি নিয়ে হাজার হাজার তরুণ প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা হাসিমুখে লাইন করে দাড়িয়ে থেকেছে। নির্বাচিত না হতে পেরে অতৃপ্তির ব্যথা নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে অনেককেই। যুব শিবিরে অপেক্ষা করেছে তারা দিনের পর দিন, কখন জীবন দেবার ডাক আসে। যেখানেই গেছি, সবাই আমাকে ঘিরে ধরেছে। সবার মুখে একই প্রশ্ন, আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যেতে? কি সেই তাদের আকুতি। জীবন দেবার জন্য সবাই তৈরি। নিজেদের মাঝে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা কে কার আগে যুদ্ধে যেতে পারে। কি সহজভাবে যুদ্ধের ভয়াবহতাকে তুচ্ছ করে তারা সংগ্রামে যোগ দিতে আগ্রহী। তাদের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগের স্পৃহা, আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। রিক্রুটিং সেন্টারগুলোতে তরুণদের লাইন দেখেই আমি বুঝেছিলাম এই নিবেদিত প্রাণ তরুণদের রক্ত বিফল হবে না। কোন শক্তি কিংবা সময়ের দীর্ঘতা কোন কিছুই তাদের রুখতে পারবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য তারা ছিনিয়ে আনবেই। এমন স্বতঃস্ফুর্তভাবে যুদ্ধে যোগ দেবার স্পৃহা পৃথিবীর অন্য কোন জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসে নেই। গণচীন, রাশিয়া, প্রাচ্য ইউরোপীয় দেশগুলোর কারও ইতিহাসই এমন দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়নি। বেশিরভাগ দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতির পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু বাংলার তরুণরা কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া যেভাবে স্বতঃস্ফুর্তভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্য্য ও আত্মত্যাগের অতুলনীয় নিদর্শন রেখেছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর যে কোন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেই বিরল। এই সত্য আকাশের সূর্যের মতই উজ্জ্বল। এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
যদি কোন দল বা গোষ্ঠি এককভাবে মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্ব কিংবা জনগণের বিজয়কে নিজেদের বলে দাবি করে তবে সেটা হবে ইতিহাস বিকৃতির কদর্য প্রচেষ্টা এবং চরম ধৃষ্ঠতা। দীর্ঘ দিনের শোষণের তীব্রতাই আমাদের জাতীয়তাবোধ তীব্র করে তুলেছিল; আর সেই তীব্রতাই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করে তোলার প্রত্যয়কে দৃঢ়তা দান করেছিল। জাতীয় শোষণ থেকে সার্বিক মুক্তি পাবার চেতনাই জনগণ এবং তরুণ সমাজকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে শক্তি ও প্রেরণা যুগিয়েছে। তাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের ফলেই অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সব কৃতিত্বের দাবিদার সার্বিকভাবে দেশের জনগণ এবং তরুণ যোদ্ধারা। কোন ব্যক্তিবিশেষ অথবা দল নয়।
Guerilla Advisor to the Sector Commander হিসাবে গেরিলাদের রিক্রুটিং, ট্রেনিং থেকে সব দায়িত্বই আমাকে তুলে নিতে হয়েছিল নিজ হাতে গেরিলা বাহিনীর প্রশাসনিক এবং অভিযান নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত দায়িত্ব ছিল বিশেষ কষ্টকর গেরিলাদের থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থাই করতে হত নিজের উদ্যোগে। শত শত মুক্তিযোদ্ধাদের এলাকা ভিত্তিক ভাগ করে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে আলাদা ভাবে ব্রিফিং করতে হত। প্রত্যেক গ্রুপের জন্য অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, এবং রাহা খরচের ব্যবস্থাও করতে হত আমাকেই। ছেলেদের ভেতরে পাঠানোর জন্য শত্রুবাহিনীর তৎপরতা ও চলাচল সংক্রান্ত সর্বশেষ খবরা-খবর সংগ্রহ করতে হত নিজেদের ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। পাক সেনারা এবং টহলদার বাহিনী সর্বদা জায়গা পরিবর্তন করত তাই আমাদেরকেও সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব খবরাদি সংগ্রহের প্রচেষ্টা জারি রাখতে হত সর্বক্ষণ। ইনডাকশনের জন্য আমরা গাইডের বন্দোবস্ত করতাম। এদের বেশিরভাগই ছিল পূর্বতন স্মাগলার। বর্ডার এলাকার চোরা পথগুলো থাকত তাদের নখদর্পণে। তারা নিরাপদ রাস্তায় গেরিলাদের পূর্ব নির্ধারিত ঘাঁটিতে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন করত। ঘাঁটি থেকে ঘাঁটিতে নতুন আগন্তুকদের আগমন বার্তা আগে থেকেই দেয়া থাকত, সেখানে তাদের খাদ্য ও থাকার ব্যবস্থাও আগে থেকেই করা হত। তারপর থেকে গেরিলারা তাদের স্বীয় ব্যবস্থায় যার যার দায়িত্ব পালন করতো। প্রত্যেক গ্রুপের সদস্যদের নাম-ঠিকানা, তাদের পরিকল্পনা, চলাফেরার উপর নজর রাখা, ঘাঁটি, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদের হিসাব, ধ্বংসপ্রাপ্ত টার্গেট, কাপড়-চোপড়, রেশন, অন্যান্য সরবরাহ এবং সব খরচের হিসাব রাখার দায়িত্ব ছিল টিম-লিডার এর। নিয়মিত রিপোর্ট পরে তাকে পাঠাতে হত হেডকোয়াটার্সে। দেশের ভেতর অপারেশনরত প্রতিটি গ্রুপের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হত। তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা এবং নির্ধারিত দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করার ব্যাপারেও কমান্ডারদের তৎপর থাকতে হত। গেরিলা গ্রুপগুলো তাদের কর্মকান্ড এবং শত্রুপক্ষের গোপন ও প্রয়োজনীয় সব তথ্যাদি নিয়মিতভাবে আমাদের কাছে পাঠাত কুরিয়ারের মাধ্যমে। অনেক সময় প্রয়োজনে এ ব্যাপারে সাংকেতিক কোর্ডও ব্যবহার করা হত। অবস্থা এবং টার্গেটের গুরুত্ব বুঝে গেরিলা গ্রুপদের সাথে ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমেও যোগাযোগ ও খবরা-খবর সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হত; তবে সে সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। খবরা-খবর সংগ্রহের বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হয়েছিল প্রত্যেক কমান্ডারকে। এ ব্যাপারে অনেক রাজাকার, পিস্ কমিটির চেয়ারম্যান আমাদের সাহায্য করেছেন। অনেকে পরোক্ষভাবে গেরিলাদের অপারেশনেও সাহায্য করেছেন। তাদের থাকা-খাওয়া ও টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন এমন নজীরও অনেক রয়েছে। অতএব, যুদ্ধের সময় সব রাজাকার এবং সব পিস্ কমিটির সদস্য অথবা চেয়্যারম্যানরাই যে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন সেটা সত্য নয়। অনেকের ভূমিকা বরং ছিল প্রশংসনীয়। এভাবেই আমাদের আবর্তনমূলক কাজ চলতো দিনের পর দিন। চর্তুদিকে সবকিছু ২৪ ঘন্টা চালু রাখা ছিল আমাদের দূরহ দায়িত্ব। এর কোন একটা দিকে অবহেলা হলেই ছিল বিপদের সমূহ সম্ভাবনা।
যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ সামগ্রীর বন্দোবস্ত করার ওয়াদা প্রবাসী সরকার বার বার করে ব্যর্থ হলেও ফ্রন্টলাইন কমান্ডারদের ওপর সর্বদাই তাদের কাছ থেকে নির্দেশ আসতে থাকে যুদ্ধ আরো জোরদার করার। উপরওয়ালাদের সাহায্যের আশায় নিষ্ক্রিয় হয়ে না থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু অনবরত আঘাত হেনে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করে চলেছিল। তাদের হাতে বিপুল সংখ্যক শত্রু নিহত কিংবা আহত হয়েছিল প্রতিদিন। বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হয়েছিল তাদের মিল- ফ্যাক্টরি, অচল করে দেয়া হয়েছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং যাতায়াত ব্যবস্থা। নিজেরাও আত্মাহুতি দিয়েছিলেন অনেক। হতাহতের সংখ্যাও বেড়েছে দিনদিন। কিন্তু মুজিবনগর সরকার কিংবা উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে এ ত্যাগ ও বীরত্বের স্বীকৃতি কিংবা প্রশংসা তারা খুব একটা পাননি কখনোই। অবোধ্য কারণে তাদের সাফল্যকে ছোট করেই দেখার প্রবণতাও স্পষ্ট ধরা পড়েছে ক্ষেত্র বিশেষে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই প্রবাসী সরকার এবং আর্মি হেডকোয়াটার্সের হোমরা-চোমরাদের প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ক্ষুদ্ধ।
শত মাইল দুর্গম, পার্বত্য অঞ্চল ও নিবিড় বনানী পার হয়ে সমস্ত কিছু ফেলে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য যারা সীমান্ত পেরিয়ে এসেছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বেশিরভাগই তাদের ব্যাপারেও তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ট্রেনিং নেবার আশায় মাসের পর মাস তারা অপেক্ষা করেছে যুব শিবিরে অনাহারে, অর্ধহারে। রক্ত আমাশয়, জ্বরে মারাও গেছে অনেকে। তারা যে মহৎ উদ্দেশ্যে সব ছেড়ে ঘরছাড়া হয়েছিল তার স্বীকৃতিও কারো কাছ থেকে তারা পায়নি প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের দলীয় নেতারা সবাই কোলকাতায় অবস্থান করে বেশিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন শরনার্থী শিবির, মন্ত্রণালয়, সচিবালয় ও তাদের ভারতীয় কাউন্টার পার্টদের নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে প্যালেসক্লিক ও ক্ষমতার দরকষাকষির ব্যাপারেই তারা ছিলেন বেশি ব্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উপর তাদের অনাস্থাই ছিল এর মূল কারণ। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সব কমান্ডারকেই স্থানীয় অধিবাসী, সুহৃদ, সহানুভূতিপ্রবণ লোকজন এবং মুক্তাঞ্চল থেকে পাওয়া সাহায্য ও দান গ্রহণ করে যুদ্ধ চালাতে হয়েছে। কারণ, কোলকাতায় অবস্থিত মুজিবনগর সরকার তাদের দায়িত্বে ব্যর্থ হলেও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কোন অবকাশ ছিল না। নিজ নিজ সাধ্যে যতটুকু পেরেছেন আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন যোদ্ধাদের দাবি এবং চাহিদা পূরণ করতে। তাদের সেই আন্তরিকতাতেই তাদের কথায় হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা বিনা প্রশ্নে, নির্দ্বিধায়। সে সমস্ত শহীদ আত্মার সাথে করা প্রতিজ্ঞার কতটুকু আমরা অধিনায়ক হয়ে রক্ষা করতে পেরেছি সেটা আজও বিবেকে প্রশ্ন হয়ে জ্বলছে। যাদের রক্তে গড়া এই বাংলাদেশ সে বাংলাদেশ আজও অভিশপ্ত। কারণ শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানী করে কোন দেশ বা জাতি উন্নতি করতে পারে না। আল্লাহর গজব থেকেও মুক্তি নেই সে দেশ বা জাতির। আল্লাহর বিধান, অমোঘ নিরপেক্ষ। সেখানে চলে না কোন ছলচাতুরি, প্রতারণা। দেশও জাতিকে বাঁচাতে হলে আমাদের হতে হবে পাকা ঈমানদার, হতে হবে বিবেকবান। সত্যকে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতে হবে, উপযুক্তকে দিতে হবে তার ন্যায্য সম্মান। লাখো শহীদের চেতনার বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সত্যিকারের মুক্তির পথ।
মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ভারতীয় সরকারের তরফ থেকেও একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের একেকজনের অধিনে একটি কিংবা দু’টি করে সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ভারতীয় সেক্টর কমান্ডার এবং তাদের অফিসারদের সবাই ছিলেন কাউন্টার ইনসারজেন্সী এবং গোয়েন্দা বিভাগের বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্য। বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনীর সেক্টর, সাব- সেক্টর কমান্ডারদের কার্যকলাপ, প্রশিক্ষণ, রণকৌশল, ইনডাকশন প্রভৃতি ব্যাপারে তারা খুবই সতর্কদৃষ্টি রাখতেন সর্বক্ষণ। রিক্রুটিং এর ব্যাপারেও তাদের ছিল ভীষণ সতর্কতা। পাছে নকশালী অথবা বামপন্থী প্রগ্রেসিভ মাইন্ডের ছেলেরা রিক্রুটেড হয়ে মুক্তি বাহিনীর সদস্য না হয়ে পড়ে এ বিষয়ে তাদের সতকর্তা ছিল অবিশ্বাস্য। আমরা তাদের কড়া দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বামপন্থী দেশপ্রেমিক ছেলেদেরকেও আমাদের ক্যাম্পে জায়গা দিয়েছি। ট্রেনিং দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে তাদের ভেতরেও পাঠিয়েছি যুদ্ধ করতে। কিন্তু এ সমস্ত কিছু করতে হয়েছিল অতি গোপনে।
বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতের বিভিন্ন জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে যাতে কোন প্রকারে ইনফ্লুয়েন্স করতে না পারে কিংবা কোনরূপ সাহায্য তারা আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে নিতে না পারে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল ভারতীয় সরকার ও বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগগুলো। কিন্তু তাদের অতি সতর্কতা সত্ত্বেও আমাদের মুক্তি সংগ্রাম বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল পশ্চিম বাংলা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, আসাম, মনিপুর, পাঞ্জাব এবং দক্ষিনাঞ্চলের তামিলদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলোকে। তাড়াহুড়া করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমাপ্তি টেনে আনার জন্য এটা ছিল অন্যতম একটা প্রধান কারণ। দিল্লীর কেন্দ্রিয় শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য এ সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা দীর্ঘ দিন যাবৎ তাদের মুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য। তাই স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম তাদের মুক্তির চেতনা ও প্রেরণাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সাথে যে সমস্ত অফিসাররা জড়িত ছিলেন পরবর্তিকালে তাদের অনেকেই তাদের নিজস্ব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে যোগ দেন। শহীদ হ। অনেকেই। বিশেষ করে শিখদের খালিস্থান মুভমেন্টে তাদের অনেকেই যোগদান করেছিলেন : প্রাণ দিয়েছেন জেনারেল সবেক সিং, কর্নেল সূরজ সিং প্রমুখ বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাদের অনেকেই আজ অব্দি বীর বিক্রমে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। মুক্তিপাগল এ সমস্ত জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা :
ইতিমধ্যে কোলকাতায় অবস্থিত মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে পালিয়ে আসা আমলাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সচিবালয়। বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র, গণ সংযোগ ও বহিবিশ্বের সাথে যোগাযোগ বিভাগ প্রভৃতি। দপ্তর, পরিদপ্তরের ভারে মুজিবনগর সরকার কোলকাতায় ভীষণ ব্যস্ত। প্রতিটি দপ্তরের সাথে জড়িত রয়েছেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সদস্যরা। তাদের সকল ব্যস্ততা ও কর্মকান্ডের হদিস রনাঙ্গনে বসে আমরা কিছুই তেমন টের পাইনি। মাঝেমধ্যে নানা ধরণের খবর কিংবা গুজব ভেসে আসত আমাদের কানে। তাদের কর্মতৎপরতা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে কতটুকু অবদান রেখেছে সেটা নির্ধারন করার দায়িত্ব রইলো ঐতিহাসিকদের উপর। তবে তাদের তৎপরতার যুক্তিকতা অস্বীকার করে বেশ কয়েকজন আমলা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। তাদের মতে দেশের ভেতর থেকে মুক্তি সংগ্রামকে সংগঠনের সাথে সাথে মুক্তাঞ্চলে গঠিত হওয়া উচিত ছিল এ ধরণের প্রবাসী সরকার। রনাঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে সুদূর কোলকাতায় মন্ত্রণালয়, সচিবালয় সাজিয়ে বসার কোন যৌক্তিকতা নেই। কোলকাতায় বসে সবাই যার যার পদ ও মর্যাদা টিকিয়ে রাখতেই বিশেষভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ক্ষমতার কোন্দলে কলুশিত হয়ে উঠেছিল থিয়েটার রোড এবং সার্কাস এ্যাভেনিউর পরিবেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ তার মন্ত্রণালয় স্থাপন করলেন সার্কাস এ্যাভেনিউতে। পুরো মিশনটাই তখন থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান দপ্তর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিল। পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন জনাব মাহবুবুল আলম চাষী। খন্দোকার মোশতাক আহমদের একান্ত সচিব জনাব কামাল সিদ্দিকী। এ ছাড়া সার্কাস এ্যাভেনিউতে জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং জনাব মওদুদ আহমদ বহিবিশ্বের সাথে এবং বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য একটি তথ্য সেল খুলেছিলেন। সেটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগসাজসে পরিচালিত হত। আইনজীবি হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জনাব মওদুদ আহমদ আওয়ামী লীগের পক্ষে কৌসুলী হয়ে যথেষ্ট কাজ করেছিলেন তবুও প্রবাসী সরকারের কাছ থেকে তিনি তার উদ্যোগের কোন স্বীকৃতি পাননি। এ ব্যাপারে বিশেষ দুঃখ প্রকাশ করে জনাব মওদুদ আহমদ প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদকে একটি নিবেদন পত্রও লিখেছিলেন। তিনি চাইছিলেন স্বীয় উদ্যোগে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে তিনি যা কিছুই করছিলেন প্রবাসী সরকার তার স্বীকৃতি দিয়ে তাকেও কোন একটা বড়সড় পদে বহাল করুক। কিন্তু তার সে আশা পূরণ করেনি মুজিবনগর সরকার অজানা কোন কারণবশতঃ
ইতিমধ্যে থিয়েটার রোডের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতার কথা প্রকাশ হয়ে পড়তে থাকে। নীতিগত অনেক বিষয়েই জনাব তাজুদ্দিন ও তার পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মাঝে ব্যবধান গড়ে উঠতে থাকে। ভারতীয় সরকারও জনাব মোশতাকের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠে। বাজারে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ গোপনে সিআইএ এর মাধ্যমে আমেরিকার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। অস্থায়ী সরকারের অলক্ষ্যে আমেরিকার মধ্যস্থতায় তিনি নাকি পাকিস্তান সরকার ও শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাবার চেষ্টায় আছেন। তার এই উদ্যোগের পেছনে আওয়ামী লীগের দক্ষিনপন্থী বেশ একটা বড় প্রভাবশালী অংশের সমর্থনও নাকি রয়েছে। এ ধরণের গুজব ছড়িয়ে পড়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। তার এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হল। নেতাদের অনেকেই তখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ করে সহসা বা কোনদিনই দেশ স্বাধীন করা যাবে কিনা এ বিষয়ে বিশেষ সন্দেহ পোষণ করতেন।
তাদের মনোভাব ছিল এরূপ:- যা হবার তাতো হয়েই গেছে। আখের যতটুকু গোছাবার তাও বেশ গুছিয়ে ফেলা হয়েছে সেক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরতে না পারলে, গোছান সম্পদ ভোগ করা যাবে না। তাই ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমার সুযোগটা বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।