ওয়েল্টেভ্রেদেনের গান রুমকে নিজের অপারেশন রুম বানিয়ে ফেলল গ্যারি।
অন্য আরো ডজন খানেক কোর্টনি কনফারেন্স সেন্টার কিংবা বোর্ড রুম থাকলেও এই রুমের মতো নিরাপদ পারিবারিক আবহ আর কোথাও নেই। তাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই ঘর।
“এটা পরিবারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাক। একান্ত প্রয়োজন না হলে বাইরে থেকে কাউকে ডাকা হবে না।” সবাইকে সর্তক করে দিল গ্যারি।
ডেস্কের দু’পাশে বড় বড় দুটো ইজেল এনে রাখল। একটাতে ঝুলছে আফ্রিকার মানচিত্র। দ্বিতীয় বোর্ডটাতে কয়েকটা ছবি ছাড়া আপাতত আর কিছু নেই।
নিকোলাসের সৈকতে ভোলা ছবিটা বোর্ডে পিন দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।
“এটাই আমাদেরকে মনে করিয়ে দেবে আসল গন্তব্য” জানাল গ্যারি। “মনের মাঝে গেঁথে নিতে চাই এই চেহারা। যেমনটা নানা জানিয়েছে, দ্যাট ফেইস, দ্যাট চাইল্ড। ব্যস আর কিছু না।”
ছবিটার উপর ঝুঁকে বলে উঠল গ্যারি, “অল রাইট ইয়াং নিকি, বল তো বাছা তুমি কোথায়?”
ডেস্কের উপর জেনে’স অল দ্য ওয়ার্ল্ডস এয়ারক্রাফট’র ভারী ভলিউম খুলে ডেস্কের ওপাশে বসে আছে বেলা।
“ও’কে বেলা। ধরে নিচ্ছি তুমি একটা রাশান মিলিটারি পরিবহন বিমানে করেই লুসাকা থেকে নিকি’র কাছে গেছ। দেখা যাক, এটা দেখতে কেমন।” বলে উঠল গ্যারি।” একের পর এক বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগল।
“এই তো” নির্দিষ্ট একটা ছবি দেখে বলে উঠল বেলা।
“তুমি নিশ্চিত?” কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে তাকাল গ্যারি।
“আই-লুশিন। ন্যাটো রিপোর্ট নেইম ক্যান্ডিড।” জোরে জোরে নামটা পড়ল গ্যারি।
নেভিগেশন প্যাডের উপর খসখস করে লিখে চলল গ্যারি। “ওকে, তুমি বলেছ কোর্স ছিল ৩০০ ডিগ্রি ম্যাগনেটিক আর ফ্লাইং টাইম দুই ঘণ্টা ছাপান্ন মিনিট। এছাড়াও আমরা জানি যে এটা আটলান্টিক উপকূলে অবস্থিত- চলো এবার চার্টে দেখা যাক।”
মানচিত্রের উপর ডিভাইডার আর প্রটেক্টর নিয়ে কাজ শুরু করে দিল গ্যারি।
“গ্যারি”-চিন্তায় পড়ে গেল বেলা, “নিকি গত বছর ওখানে ছিল, এর মানে তো এই নয় যে এ বছরেও এখানেই থাকবে?”
“অবশ্যই না।” চার্ট থেকে চোখ না ঘুরিয়েই উত্তর দিল গ্যারি। “কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে নিকি স্থায়িভাবেই ক্যাম্পে আবাস গড়েছে। ওখানকার স্কুলে যাচ্ছে বন্ধু বানাবার মতো দীর্ঘ সময় ধরে থেকেছে; এমনকি সকার প্লেয়ার হিসেবেও বিখ্যাত হয়ে গেছে পেলে। তাই না?”
বেলার দিকে তাকাল গ্যারি; চশমার ফাঁক দিয়ে হাস্যরত চোখ জোড়া মনে হলো গোল্ডফিশের মত। “ইস্রায়েল আর সাউথ আফ্রিকান গোয়েন্দা বিভাগের ধারণা তোমার বন্ধু এল জোরে এখনো অ্যাংগোলা’তেই আছে। মাত্র চৌদ্দ দিন আগেও লুয়ান্ডাতে দেখেছে এক সি আই-এ এজেন্ট। আর পরিকল্পনা শুরু করার জন্যও একটা জায়গা দরকার। তাই নিকি ওখানে নেই নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ধরে নিচ্ছি ওখানেই আছে।”
মানচিত্রের কাছে সরে এলো গ্যারি, “তাহলে মনে হচ্ছে জায়গাটা উত্তরে লুয়ান্ডা আর দক্ষিণে জায়ারে সীমান্তের মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গা। একে অনোর কাছ থেকে শ’খানেক দূরে দূরে ছয়টা নদী মুখ আছে।”
ডেস্কের কাছে ফিরে এসে দেখল বড় সড় একা আর্ট পেপারের উপর স্মৃতি হাতড়ে এয়ারস্ট্রিপ আর রিভার মাউথের ছবি এঁকেছে বেলা। মন দিয়ে দেখে মাথা নাড়ল গ্যারি, “মানচিত্রে দেখানো ছয়টা নদী মুখের যে কোনো একটা হতে পারে; কিছুই নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না।” আবারো খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করল মানচিত্র, ‘টারি, আমাবিক্স, কাটাকানহা, চিকাম্বা, মাবুবাস আর কুইকাবো-নামগুলো শুনে কোন কিছু মনে পড়ছে বেলা?”
মাথা দোলালো বেলা, “বেস টাকে নিকি টার্মিও নামে ডেকেছিল।”
“এটা কোনো কোড নেইম সম্ভবত।” দ্বিতীয় বোর্ডে নিকি’র ছবির পাশে বেলার স্কেচটাকে পিন দিয়ে আঁটকে রাখল গ্যারি। “আর কোনো মন্তব্য?” সেনটেইন আর শাসার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, “বাবা কী বলো?”
“আমাদের সবচেয়ে কাছাকাছি বন্ধু ভাবাপন্ন রাষ্ট্র নামিবিয়া থেকেও জায়গাটা প্রায় হাজার খানেক কি.মি দূর। তাই নিকি’র কাছে পৌঁছানোর জন্য স্থলপথের চিন্তা বাদ।”
“হেলিকপ্টারস?” সেনটেইনের প্রশ্ন শুনে গ্যারি আর শাসা একসাথে মাথা দোলালেন।
“আউট অব রেঞ্জ; রিফুয়েলিভেরও অপশন নেই।” গ্যারির মন্তব্যে একমত হলেন শাসা।
“যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দিয়ে উড়ে যেতে হবে। গোয়েন্দাদের তথ্যনুযায়ী নামিবিয়া সীমান্ত পর্যন্ত কিউবানদের সলিড রাডার চেইন আর বর্ডারের উত্তরে লুবাঙ্গো বেসে পুরো এক স্কোয়াড্রন মিগ-২৩ ফাইটারস আছে।”
“লিয়ার ব্যবহার করলে কেমন হয়?” সেনটেইনের কথা শুনে হেসে ফেললেন পিতা-পুত্র।
“মিগের হাত থেকে পালাতে পারব না। নানা।” বলে উঠল গ্যারি। “আর ওদের কাছে আমাদের চেয়ে বেশি অস্ত্র আছে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি চাইলে ওদের চারপাশে ঘুরে আটলান্টিকের উপর দিয়ে চলে আসতে পারো; আমি জানি ফাইটারস’রা বহু দূর দূরান্ত পর্যন্ত চলে যায় আর লিয়ার মরিশাসেও যেতে পারে।”
হাসি থামিয়ে একে অন্যের দিকে গকিয়ে রইলেন শাসা আর গ্যারি। “তোমার কি ধারণা সে এমনি এমনিতেই এত ধনী হয়েছে?” বাবার কাছে জানতে চাইল গ্যারী, তারপর সরাসরি তাকাল দাদি’র দিকে।
“আচ্ছা ধরে নিলাম আমরা লিয়রে চেপে ওখানে পৌঁছেও গেলাম, তারপর? আমরা না ল্যান্ড করতে পারব না টেক অফ-হাজার মিটার রানওয়ে ছাড়া লিয়ার একচুল নড়তে পারবে না। বেলার কথা মতো স্ট্রিপ’টা ছোট আর গেরিলা ট্রেনিং বেস হওয়াতে দক্ষিণ আমেরিকান, না, না, কিউবান প্যারাট্রুপার গার্ডস থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তর্কাতর্কি করা ছাড়া নিশ্চয়ই এমনি এমনি নিকি’কে আমাদের হাতে তুলে দেবে না।”
“হ্যাঁ, আমি জানি ফাইট করতে হবে” মাথা নাড়লেন সেনটেইন, “এবারে তাই শন’কে ডেকে পাঠাবার সময় হয়েছে।”
“শন?” চোখ পিটপিট করলেন শাসা, “অফকোর্স!”
“নানা, আই লাভ ইউ” তাড়াহুড়া করে টেলিফোন তুলে নিল বেলা।” ইন্টারন্যাশনাল, রোডেশিয়ার বুলাওয়েতে ব্যালান্টাইন ব্যারাকে আর্জেন্ট কল করতে চাই।”
উত্তর আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল। এরই মাঝে এয়ারপোর্টে ফোন করে পাইলটদের সাথে কথা বলে নিল গ্যারি। অবশেষে শন যখন লাইনে। এলো ততক্ষণে বুলাওয়ের দিকে উড়ে যাচ্ছে লিয়ার।
“আমাকে ওর সাথে কথা বলতে দাও” বলে ইসাবেলার হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে নিল গ্যারি। মিনিট খানেকের মধ্যে দুই ভাই চিৎকার চেঁচামেচি শেষ করতেই খেঁকিয়ে উঠল গ্যারি : “আমাকে অজুহাত দেখিও না শন। নেক্সট আওয়ারেই তোমাকে তুলে নেবার জন্য বুলাওয়েতে থাকবে লিয়ার দরকার হলে জেনারেল ওয়ালস কিংবা ইয়ান স্মিথের সাথেও কথা বলব। উই নিড ইউ। দ্যা ফ্যামিলি নিডস্ ইউ।”
ফোন রেখে সেনটেইনের দিকে তাকাল গ্যারি, “সরি নানা।”
“এই কথা আগেও শুনেছি।” বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন, “আর মাঝে মাঝে আসলে ঝাড়িতেই কাজ হয়।”
***
ওয়েল্টেভ্রেদেনের গান রুমে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে ভাগনের ছবি দেখছেন ব্যালান্টাইন স্কাউটস মেজর শন কোর্টনি। মাত্র তিন মাস হলো রোলান্ড ব্যালান্টাইনি তাকে ফুল টাইম রেজিমেন্টের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
“হুম, ওযে বেলা’র ছেলে তাতে কোনো সন্দেহই নেই। একেবারে বেলা’র মতো হয়েছে। উজবুক একটা।” বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল শন্।
ভাইকে জিভ বের করে ভেংচি কাটল বেলা। কিন্তু আসল কথা হলো শনকে দেখে আবার আশা ফিরে পেয়েছে। শন এতটা আত্মবিশ্বাসী পরিশ্রমী আর স্বাবলম্বী যে ওকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বেলা।
“ওরা আবার তোমাকে কবে নিকির কাছে যেতে দেবে?” শনের প্রশ্ন শুনে একটুক্ষণ চুপ করে রইল বেলা। সিনডেক্স-২৫ এর টেস্টের সফলতার কথা জানালেই যে সুযোগ পাবে সে কথা তো ওদেরকে বলা যাবে না; তাহলে স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে বেলা কতটা বিশ্বাসঘাতক।
“মনে হয় শীঘিই। প্রায় বছর খানেক হলো নিকি’কে দেখিনি। সপ্তাহ কিংবা দিনও হতে পারে।”
“তুমি যাবে না।” তাড়াতাড়ি বাধা দিল গ্যারি। “তোমাকে আর ওই বদমাশগুলোর খোঁয়ারে যেতে দেব না।”
“ওহ, শাট আপ গ্যারি” খেঁকিয়ে উঠল শন। “বেলা অবশ্যই যাবে তা না হলে নিকি কোথায় আছে আমরা কিভাবে জানব?”
“আমি ভেবেছিলাম…রাগে গন গন করছে গ্যারির মুখ।
“ওকে মেটি। চলো আগেই কিছু জিনিস ঠিক করে নেই। অপারেশনের ভার আমার-আর সমস্ত লজিস্টিকস আর ব্যক আপের দায়িত্ব তোমার। ঠিক আছে?”
“গুড!” তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন সেনটেইন। “এভাবেই সব হবে। শ এবারে জানাও তুমি রেসকিউ অপারেশন কিভাবে করবে?”
“ওকে। আপাতত এটুকুই ঠিক হলো। ডিটেইলস নিয়ে পরে আলোচনা করব। তবে প্রথমেই বলে রাখছি এটা কিন্তু পুরোপুরি একটা আফেন্সিভ অপারেশন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বিপক্ষ দল নরক নিয়ে হাজির হবে। ওরা আমাদেরকে নির্ঘাৎ খুন করতে চাইবে-তবে আমাদেরকেই আগে কাজ সারতে হবে। যদি নিকি’কে চাই। তাহলে ফাইট করতেই হবে। কিন্তু যদি কিছু গড়বড় হয় তো দেশে আর বিদেশে রাজনীতি আর আইনি বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। সন্ত্রাসী কিংবা হত্যাকাণ্ড যে কোনো কিছুর অভিযোগ উঠতে পারে আমাদের বিরুদ্ধে। এর জন্য কি প্রস্তুত আছি আমরা?”
চারপাশে মনোযোগী শ্রোতাদের দিকে তাকাল শন। কোনো দ্বিধা ছাড়াই সকলে একসাথে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
“গুড। তো তাহলে এদিকটা নিশ্চিত। এখন আসো প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপারগুলোতে। ধরে নিচ্ছি নিকি’কে উত্তর অ্যাংগোলার কোনো উপকূলীয় বেসে রাখা হয়েছে। যেমনটা প্রতিবার গেছে, এবারেও সেভাবেই যাবে বেলা। পজিশন মতো পৌঁছে গেলেই ও আমাদেরকে খবর পাঠাবে।”
“কিভাবে?” জানতে চাইল গ্যারি।
“এটা তোমার সমস্যা। পুরো কোর্টনি কম্যুনিকেশন ডিপার্টমেন্ট তোমার হাতে। ওদেরকে দিয়ে কোনো একটা মিনিয়েচার রেডিও কিংবা ট্রান্সপন্ডার বানিয়ে নাও। ভেতরে ঢুকেই বেলা এটাকে অ্যাকটিভেট করে দিলে আমরা সিগন্যাল পেয়ে যাবো।”
“ওকে।” রাজি হলো গ্যারি।
“আকাশ পথে জিওলজিক্যাল সার্ভে করার সময় যে ইলেকট্রনিক পজিশন মার্কার ব্যবহার করি সেগুলোর কোনো একটা নেয়া যাবে। কিন্তু বেলা এটা কিভাবে সাথে করে নিয়ে যাবে?
“আবারো বলছি এটা তোমার সমস্যা। কাট কাট করে জবাব দিল শন। “তত বেলা আমাদেরকে টার্গের এরিয়া জানালেই আমরা রওনা হয়ে যাব।”
“কিভাবে?” আবার প্রশ্ন করল গ্যারি।
“একটাই পথ আছে। সমুদ্র।” দক্ষিণ আটলান্টিক থেকে আফ্রিকা মহাদেশের মুখ পর্যন্ত আঙুল রেখে মানচিত্র দেখাল শন।
“ওয়ালবিস বে’তে আমাদের ট্রলিং অ্যান্ড ক্যানিং ফ্যাক্টরি আছে। তোমার নতুন লং রেঞ্জ ট্রলারগুলোর একটা গ্যারি, ওই যে যেটা ভীমা সী-মাউন্টে পাঠিয়েছিলে। ত্রিশ নট গতিতে চার হাজার মাইল যেতে পারে।”
“তাই তো ইয়েস!” খুশি হয়ে উঠল গ্যারি। “এই তো কদিন আগেই কেপ টাউন ড’কে ল্যান্সার মেরামতের কাজ শেষ হয়েছে। ওয়ালবিস বে’তে ফিরে যাবে। ওদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি রিফুয়েল করে যাত্রার জন্য তৈরি করে রাখতে। স্কিপার, ভ্যানডার বার্গের কোনো তুলনা হয় না।”
“ওদেরকে বলো সমস্ত অপ্রয়োজনীয় জিনিস যেন আনলোড় করে ফেলে।” যোগ করল শন।
“রাইট। ইনস্যুরেন্স পলিসিতে ওয়্যার আর অন্যান্য রিস্কগুলোকেও যোগ করে নেব। তুমি যে এগুলোর কী হাল করবে আমি ভালো ভাবেই জানি।” প্রশ্রয়ের হাসি হাসল গ্যারি। “গত বছর তো চারটা ল্যান্ডক্রুজারের দফা-রফা করেছ।”
“ব্যাস যথেষ্ট হয়েছে।” নাতীদেরকে খানিক বকনী দিলেন সেনটেইন-” শন এবারে বলো। তুমি কি এই নদীতেই ল্যান্সার নিয়ে চলে যাবে?”
“না, নানা। আউট বোর্ড মোটর লাগানো, ফোলানো ল্যান্ডি! ক্রাফট নিয়ে সৈকতে যাবো। সিমন্সটাউন-ন্যাভাল বেসের কাউকে চেনো তুমি?”
“ডিফেন্স মিনিস্টার আর অ্যান্ডমিরাল কেইটার’কে চিনি” আলোচনায় যোগ দিল বেলা।
“বিউটি!” মাথা নাড়ল শন “যদি তুমি বোট পাও তাহলে তো ডজন খানেক ভলান্টিয়ার ও যোগাড় করতে পারবে। কিছু একস্ট্রা কারিকুলার ফান গেমস হয়ে যাবে। ওদের কমান্ডোগুলো একেকটা হট বেবি তাই শয়তান কিউবানগুলোকে ছিঁড়ে খাওয়া কোনো ব্যাপারই না। এএনসি ট্রেনিং বেসের তলা ফুটো না করে আর আসছি না।”
মিনিস্টারকে আমিও চিনি। বেলা-র সাথে আমিও যাবো।” রাজি হলেন সেনটেইন। “স্পেশাল যত ইকুপমেন্ট দরকার তার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি। শুধু গিভ মি আ লিস্ট, শন।”
“কাল সকালের ভেতরে রেডি করে ফেলব।”
“কিন্তু অস্ত্র-আর সৈন্য?”
“স্কাউটস” ঘোষণা করল-শন।
“এর চেয়ে ভালো আর কোনো অপশন নেই। আমি নিজে ওদেরকে ট্রেনিং দিয়েছি। প্রায় বিশ জন হলেই হয়ে যাবে। জানি কাকে কাকে চাই। রোলান্ড ব্যালান্টইনের সাথে এখনি কথা বলব। রোডেশিয়াতে এখন বর্ষা থাকায় মনে হচ্ছে আপত্তি করবেন না। তবে তার একটা পা ভাঙ্গতে হতে পারে; কিন্তু দেবেন সমস্যা নাই। স্কাউটদেরকে কয়েকদিন বোট ট্রেনিং দেব; ব্যস, আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ তৈরি হয়ে যাবে।” এবারে ইসাবেলার দিকে তাকাল শন। “এখন সবকিছু তোমার উপরে ডিপেন্ড করছে বেলা; তুমিই আমাদের হান্টিং ভগ; ওদের কাছে নিয়ে চল, ল্যাস।”
***
এগারো দিন পরেই সিনডেক্স-২৫ এর সফল টেস্টের কোডেড কনফার্মেশন পাঠিয়ে দেয়ায় নিকোলাসের সাথে দেখা করার পারমিশন আর ইনস্ট্রাকশন পেয়ে গেল লাল গোলাপ। এবারের গন্তব্য কিনশাসা এয়ারপোর্ট।
“লুকিং গুড” মানচিত্রের উপর আঙুল রাখতেই শনের চেহারায় ফুটে উঠল হাসি, “এই যে কিনশাসা। এক্সপেকটেড টার্গেট এরিয়ার তিন থেকে চারশ কি.মি ভেতরে। শেষবারের মতো নাইরোবি কিংবা লুসাকা ঘোরাবে না। এবারে সরাসরি নিয়ে যাচ্ছে।” ইসাবেলার দিকে তাকাল শন, “তো তোমাকে পরের শুক্রবারের ফ্লাইট ধরতে বলেছে? তার মানে সবকিছু ঠিক ঠাক থাকলে শনিবার কিংবা রবিবারেই পজিশনে পৌঁছে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব ওয়াল ভিস বে’তে গিয়ে ল্যান্সার নিয়ে রওনা হয়ে যাব আমি। ছেলেরা তাদের ট্রেনিং শেষ করে ফেলেছে। সব ইকুপমেন্টস্ ভোলা হয়ে গেছে। প্রায় সপ্তাহ খানেক আলসের মতো ঘুরে বেড়ানোতে এবারে সবাই খুশিই হবে।”
আবারো ঝুঁকে পড়ে মনোযোগ দিয়ে মানচিত্র দেখল শন। তারপর ক্যালকুলেটরে খানিক খটখট করে জানাল, “বারো তারিখ সোমবারে কঙ্গো নদীমুখ থেকে একশ নটিক্যাল মাইল দূরের পজিশনে পৌঁছে যাব। ঠিক আছে গ্যারি?”
উঠে দাঁড়িয়ে মানচিত্রের কাছে গেল গ্যারি।” আমি লিয়ার নিয়ে উইন্ডহক এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করব। সোমবার রাতে প্রথম ফ্লাই করব। ফিরে আসার আগের অন্তত পাঁচশ মাইল ঘুরে আসতে হবে। দক্ষিণ অ্যাংগোলাতে এটাই কিউবান রাডার রেঞ্জ। লুবাঙ্গোর মিগ স্কোয়াড্রনের জন্যও এরেঞ্জ কোন ব্যাপার না।” মানচিত্রে কিউবান বেস্ স্পর্শ করল গ্যারি, “বেলা’র ট্রান্সপন্ডারের সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত কঙ্গো নদী মুখ ধরে দক্ষিণের উপকূল বরাবর সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে বেড়াব।”
“দাঁড়াও গ্যারি, এক মিনিট” বলে উঠলেন শাসা, “এটা কি সত্যিই কাজ করবে?”
“মাত্র কয়েকদিনের মাঝেই অসাধারণ কাজ দেখিয়েছে কোর্টনি ক্যুটিকেশনের ছেলেরা।” ব্রিফ কেস খুলল গ্যারি, “এই যে!”
“বাইসাইকেল পাম্প?” অবাক হয়ে গেলেন শাসা।
“সবাই জানি নিকি একজন সকার স্টার। বেলা’র কাছে নতুন বল চেয়েছে আর এও জানিয়েছে যে পুরোন বলটাকে শুধু পাম্প করতে হয়। তাই বলের সাথে পাম্প দেখলে কেউ কিছু সন্দেহ করবে না। কয়েকবার চাপ দিতেই হিস হিস করে বাতাস বেরোল পাম্পের মুখ দিয়।
“পাম্পের হ্যান্ডেলের ভেতরে ট্রান্সপন্ডারটা বসানো হয়েছে। ব্যাটারি লাইফ ত্রিশ দিন। হ্যাঁন্ডেলটাকে একটু মোচড় দিলেই অ্যাকটিভেট হয়ে যাবে।” সবাইকে কারসাজিটা দেখাল গ্যারি। তবে একটাই সমস্যা। হ্যান্ডেলের মতো ছোট জায়গায় বসানোতে সিগন্যালের পাওয়ার কমে গেছে। বারো কি.মি-এর ও কম সিগন্যাল রেঞ্জ। লিয়ারের সেন্সিটিভ অ্যান্টেনা নিয়েও এর বেশি কিছু করা যায় নি। তাই বারো কি.মি কাছাকাছি যেতে হবে। যেন সিগন্যাল ধরতে সমস্যা না হয়।”
“উত্তরের কিউবান ফাইটারদের কী অবস্থা? উদ্বিগ্নমুখে জানতে জানতে চাইলেন শাসা।
“সাউথ আফ্রিকান গোয়েন্দাদের মতে সবচেয়ে কাছের বেস্ হলো সোরিমো। উপকূর দিয়ে তাই দ্রুত ঘুরে আসতে হবে। বেলা’র সিগন্যাল পেলেই নাক ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে চলে আসব। খুব ভালোভাবে হিসাব করে দেখেছি; যদি অ্যাংগোলান এয়ারস্পেসে আমাকে পেয়ে কিউবান রাডার সোরিমো থেকে মিগ পাঠিয়ে দেয়, তারপরেও আমার ফিরে আসতে কোনো সমস্যা হবে না।”
“কিন্তু এস এ এম?” এখনো দ্বিধায় ভুগছেন শাসা।
“ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী কিউবান এসএএম রেজিমেন্টের আস্তানা এখন দক্ষিণে।”
“যদি ওদের রিপোর্ট ভুল হয়?”
“কাম অন বাবা শন আমার চেয়েও বেশি রিস্ক নিচ্ছে।”
“শনের কাজই এটা। আর তাছাড়া ওর তো তোমার মতো বউ আর এক পাল ছেলে-পেলে নেই।”
“আমরা কি নিকি’কে ফেরত আনতে চাই-নাকি? বাবা’র দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল গ্যারি।
“অল রাইট, কোথায় যেন ছিলাম? হ্যাঁ, বেলার সিগন্যাল পেলাম; ঘুরে গিয়েই সাথে সাথে কঙ্গো নদী মুখে থাকা ল্যান্সারকে রেডিওতে জানিয়ে দিব। ওদেরকে ঘাঁটির নির্দিষ্ট অবস্থানটা বলে দিয়েই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে।”
“আমার মনে হয়” নির্লিপ্ত স্বরে ঘোষণা করলেন শাসা,
“তোমার সাথে আমিও যাচ্ছি গ্যারি!”
“কাম অন, বাবা। তুমি সেই কবে যুদ্ধ ছেড়েছ। বয়সের কথাটাও ভাবো।”
“তোমাকে তো আমিই উড়তে শিখিয়েছি, মাই বয় আর সপ্তাহের যে কোনো দিন তোমার চারপাশে ঘুরে আসা এখনো আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না।”
সাপোর্টের আশায় নানা’র দিকে তাকাল গ্যারি। কিন্তু পাথরের মতো মুখ করে বসে আছেন দাদি। বাতাসে হাত ছুঁড়ে তাই হেসে ফেলল গ্যারি।
“ফ্লাইটে, স্বাগতম স্কিপার।”
***
“গুড বাই, নানা, শক্ত করে দাদীকে জড়িয়ে ধরল-”বেলা, “আমাদের জন্যে প্রার্থনা করো।”
“তুমি শুধু আমার প্রপৌত্রকে নিয়ে এসো সোনা। দু’জনে মিলে এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে।”
বাবা’র দিকে তাকাল বেলা, “আই লাভ ইউ ড্যাডি।”
“আমি যতটা ভালোবাসি ততটা নয়।”
“আমি এত বোকা। আরো আগেই আমার তোমার কাছে আসা উচিত ছিল।” ঢাক গিলল বেলা, “আমি অনেক ভয়ংকর সব কাজ করেছি, ড্যাডি। এখনো যা তোমাকে জানাইনি। জানি না শুনলে তুমি আমাকে মাফ করবে কিনা।”
“ইউ আর মাই গার্ল,” আবেগে কেঁপে উঠল শাসার গলা, “আমার সবচেয়ে আদরের ছোট্ট সোনা। নিজের খেয়াল রেখো-আর সাথে করে নানু ভাইকে নিয়ে এসো।”
বাবা’র গালে কিস্ করে জড়িয়ে ধরল বেলা। এরপরই কোনো কথা না বলে ঘুরে প্রায় দৌড় দিয়ে ঢুকে গেল এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার গেইটের ভেতরে।
বেলা চলে যাবার পরেও বহুক্ষণ ধরে ওদিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন আর শাসা। মাথার উপরে ফ্লাইটের নাম ঘোষণা করছে লাউডস্পিকার।
শাসার হাত ধরলেন সেনটেইন। কোনো কিছু নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করলে পায়ের ব্যথা বেড়ে যায়। এখনো লাঠির উপর ভর দিয়েই হাঁটছেন।
মেইন এন্টার কাছে অপেক্ষারত গাড়িতে গিয়ে বসলেন শাসা আর সেনটেইন।
“একটা ব্যাপারে আমাদের এখনো কথা বলা হয়নি।” শাসার দিকে তাকালেন সেনটেইন।
“হ্যাঁ। আমি জানি তুমি কি জিজ্ঞেস করবে। ওরা বেলা’কে দিয়ে কী করিয়েছে? বেলা তাদেরকে কতটা মূল্য দিয়েছে?”
“বাচ্চাটার জন্মের পর থেকে ও তাদের হয়ে কাজ করছে। এত বছর ধরে। আর এটা তো এখন স্পষ্ট।”
“আমি আসলে এটা নিয়ে ভাবতেই চাই না।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাসা। “কিন্তু জানি আজ না হয় কাল এর মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। এই জানোয়ারের বাচ্চাটা কেজিবি জেনারেল তার মানে বোঝাই যাচ্ছে কারা বেলাকে এতদিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে।”
“শাসা” প্রথমে খানিকটা দোনোমোনো করলেও স্পষ্ট স্বরে জানাতে চাইলেন-সেনটেইন, “তোমার স্কাইলাইট স্ক্যান্ডালের কথা মনে আছে?”
“আমি এটা কখনোই ভুলব না?”
“কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল-” একগুয়ের মতো বলে উঠল সেনটেইন।
“বেলা স্কাইলাইট সম্পর্কে কিছুই জানত না; আমি খুব সাবধানে ওকে এ ব্যাপারটা থেকে দূরে রেখেছিলাম।” খানিকটা উত্তপ্ত হলেন শাসা।
“ড্রাগনস্ ফাউন্টেনে আসা সেই ইস্রায়েলি বিজ্ঞানীর কথা মনে নেই? কী যেন নাম ছিল-অ্যারন বোধ হয়? বেলা উনার সাথে খানিকটা জড়িয়ে পড়েছিল। তুমিই তো বলেছিলে যে পেলিনডাবার সিকিউরিটি রেজিস্টারে ওর নাম ছিল। ও লোকটার সাথে রাত কাটিয়েছে।
“মা, তুমি কী বলতে চাইছ…” শেষ করতে পারলেন না শাসা।
“মাই গড চিন্তা করতে পারছ এত বছর ধরে ও তাহলে কতটা তথ্য পাচার করেছে? সিনেটর আর আমার অ্যাসিস্টান্ট হিসেবে আমর্সকোরের বেশির ভাগ সেনসিটিভ প্রজেক্ট ফাইলই ওর ডেস্ক ঘুরে এসেছে।”
“ক্যাপরিকর্নের সিনডেক্স প্রজেক্ট” মাথা নাড়লেন সেনটেইন। “মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই ও টেস্টও দেখেছে। এখন ওকে কেন নিকোলাসের কাছে যেতে দেয়া হলো? তোমার কী মনে হয়, কোনো স্পেশাল ইনফর্মেশন দিয়েছে নিশ্চয়?”
দীর্ঘ সময় ধরে চুপচাপ বসে রইলেন শাসা আর সেনটেইন। অবশেষে স্তব্ধ শাসা জানতে চাইলেন, “কোথায় রইল তাহলে পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ততা আর দেশের প্রতি দেশপ্রেম?
“আমার মনে হয় শীঘ্রিই তুমি আর আমি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হবো” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেনটেইন, “তবে আগের কাজ আগে সামলানো যাক।”
***
ওয়ালবিস বে’তে কোর্টনি ক্যানিং ফ্যাক্টরির পাশেই হসপিটাল জেটিতে বেঁধে রাখা হয়েছে ল্যান্সার। ল্যান্সার ২৫০ ফুট লম্বা একটা ট্রলার হলেও লাইন আধুনিক ক্রুশ লাইনারের মত। যে কোনো মহাসাগরে তীর বেগে ছুটতে পারে ল্যান্সার। মাছ ধরার কাজে মাসের পর মাস সমূদ্রে কাটাতে হলেও ফিরে আসে আবার একই গতি আর ছন্দ নিয়ে।
জেটিতে দাঁড়িয়ে ল্যান্সারের দিকে তাকাল শন্। উজ্জ্বল হলুদ পেইন্টওয়াকটা তেমন ভাল লাগছে না। বড্ড বেশি চোখে পড়ছে। কিন্তু ল্যান্ডিং উঠানো নামানোর পক্ষে ল্যান্সারের স্টার্ন একেবারে যুৎসই হওয়াতে রঙ নিয়ে আর মাথা ঘামাল না শন্।
ট্রলারের রেইল ধরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা স্কাউটেরা তাকে দেখেই কোরাম গেয়ে উঠল, “হোয়াই ওয়াজ হি বর্ন সো বিউটিফুল?”
আঙুল তুলে শাসাল শন; হতচ্ছাড়াগুলো একটুও শ্রদ্ধা দেখায় না! গ্যাংওয়ে ধরে উঠে গেল উপরে। সকলে মিলে ভিড় করে এলো শনের সাথে হাত মেলাবার জন্য; বোঝাই যাচ্ছে যে ওরা বেশ খুশি হয়েছে। কারণ দিনের পর দিন বসে থাকতে থাকতে একেবারে বোর হয়ে গেছে হাইলি ট্রেইনড় এসব যোদ্ধা।
সকলেরই-পরনে ট্রলারের নাবিকদের মতই রঙচটা ধূসর জিন্স। উলের জার্সি আর আটসাট পশমি টুপি।
ম্যাটাবেলে গোত্রের রক্তবহনকারী সার্জেন্ট মেজর ইসাড গনডেলে এর আগেও বহু বিপদজনক যুদ্ধে শনের সঙ্গী হয়েছিল। এবারে তাই বস’কে দেখে স্যালুট করল সাথে দাঁত বের করা হাসি।
“এখন তো তোমার শরীরে ইউনিফর্ম নেই ইসাউ, টেক ইট ইজি, ব্রাদার।” হাত ঝাঁকিয়ে জানাল শন!
শনে’র বাছাইকৃত বিশ জনের স্কাউটের বারোজনই ম্যাটাবেলে, বাকিরা তরুণ শ্বেতাঙ্গ রোডেশীয়।
স্কাউটদের মাঝে দেহতৃক নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। ইসাউ একবার শন’কে বলেছিল : বর্ণবাদ ঘোচাবার উপায় হলো কারো গুলির মুখে পড়া। ম্যান তখন এটা কোনো ব্যাপারই না যে কোন শালা তোমাকে বাঁচাতে এসেছে। কালো কিংবা ধলা যেই হোক না কেন ফটাস করে তাকে একটা কিস দিতে তোমার কোন সমস্যাই হবে না।”
শ’নের একমাত্র দুশ্চিন্তা হলো ফোলানো ল্যান্ডিং বোটগুলো হ্যাঁন্ডেল করতে সিমন্সটাউন থেকে আসা ন্যাভাল কমান্ডোরা। এরাও সকলেই তরুণ আফ্রিকান। হয়ত এরকম বহু গোত্রীয় দলে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে সমস্যায় পড়ে যাবে।
“রক স্পাইডারদের সাথে কেমন দিন কাটছে?” আফ্রিকান একটা স্ল্যাং বলে উঠল শন।
“তাদের কেউ কেউ এরই মাঝে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলেও এদের কারো সাথেই আমি আমার বোন বিয়ে দেব না।” মিটি মিটি হাসছে ইউ। “না, সিরিয়াসলি শন নিজেদের কাজ ওরা ভালই জানে। আমি বলেছি’ও যে আমাকে বাসি (Bassic) ডাকার দরকারই নেই; তা শুনে ওরা হাসে।”
“ওকে, সার্জেন্ট মেজর। রাত নামলেই আমরা বন্দর ত্যাগ করব। এখানকার কেউ হয়ত আমাদেরকে খেয়াল করছে না; তারপরও কোনো চান্স নিতে চাই না। পাল তোলার আগে তুমি আর আমি সব ইকুপমেন্ট চেক করে নেব; তারপর সমুদ্রে ভেসে যাবার পর ছেলেদেরকে সব জানাব।”
মেঝের টেবিল আর বাঙ্কে একসাথে জড়ো হয়েছে সব স্কাউটস আর কমান্ডোদের দল। বোট প্রেট্রোলিঙে সিদ্ধহস্ত শনের স্কাউটেরা আগেও লেক কারিবার পরিবর্তনশীল পানিতে ঘুরে বেরিয়েছে। কিন্তু এদের মাঝে মাতাতু নেই। তাই অপারেশনটা কেমন যেন একটু আজব ঠেকছে। পিচ্ছি নোভজারোবো মাতাতু শনের গুডলাক চার্ম। মনে হলো সেন্ট ক্রিস্টোফারকে ছাড়াই ভ্রমণে বেরিয়েছে। জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিল শন। তাকালো ভিড়ের দিকে।
বাল্কহেডের মাথায় লাগানো ম্যাপ ইশারা করল শন, “সবাই দেখতে পাচ্ছ?”
সমস্বরে হা শোনা গেল।
“আমরা এদিকে যাচ্ছি” মানচিত্রে গন্তব্য দেখাল শন্। “আর মিশনটা হচ্ছে দু’জন বন্দিকে উদ্ধার করা একজন নারী আর এক শিশু।”
কপট অসন্তুষ্টির চিৎকার শুনে হাসল শন।
“ইটস ওকে। ভয় পেও না। ওখানে অনেক মজা হবে। চারপাশে হট গানস পাবে জেন্টেলম্যান আর এটা ওপেন সিজন।”
আনন্দে হুল্লোড় করে উঠল সকলে। চিৎকার থামার জন্য অপেক্ষা করে শন আবার শুরু করল।
“এটা হচ্ছে টার্গেট এরিয়ার স্কেচ ম্যাপ। জায়গাটা বেশ রাফ হলেও বুঝতেই পারছ কী আছে সামনে। আশা করছি বন্দিদেরকে এই কম্পাউন্ডে আটকে রাখা হয়েছে। সম্ভবত এই কুঁড়েঘরে। রেসকিউ পার্টি আমি লিড করব। তিনটা বোট নিয়ে আমরা সৈকতে নেমে পড়ব; ঠিক আছে।”
দেখতে পেল দু’পাশে দু’জন দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাভাল কমান্ডো নিয়ে সিগারেট শেয়ার করে খাচ্ছে ইসাউ। কথা শুনতে শুনতে সিগারেটটা ঘুরছে তিনজনের হাতে। “কোথায় গেল বর্ণবাদ?” মনে মনে হেসে ফেলল শন।
“যদি কোনো সমস্যা থাকে তবে তা নেমে আসবে এই রাস্তা দিয়ে এয়ারস্ট্রিপের কাছের টেরোরিস্ট ক্যাম্প থেকে। এই যে এখানে আর এখানে। সাপোর্ট ইউনিটের নেতৃত্ব দেবে সার্জেন্ট মেজর গনডেল। বোড় ব্লকস তৈরি করে খেয়াল রাখবে যেন কোনো শালা এপাশে না আসতে পারে। প্রথম গুলির আওয়াজ পাবার পর ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরই মাঝে আমরা বন্দিদেরকে নিয়ে চলে আসব। এরপর তোমরাও পিছিয়ে দ্রুত পায়ে আরজে করে ল্যান্সারে চলে আসবে। বেশ সহজ ব্যাপার; কিন্তু খুব দ্রুত করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক সেকেন্ডও থাকা যাবে না। কিন্তু পথিমধ্যে যদি এক দুটাকে খতম করে দিতে হয় কেউ কিছু বলবে না। এবারে ডিটেইলে আলোচনা শেষ করে আগামীকাল পানির মাঝে বোট লঞ্চিং আর রিকোভারী প্র্যাকটিস হবে। প্রতিদিন এটা প্রাকটিস করতে হবে, সাথে উইপনস্ ড্রিল আর ইকুপমেন্ট চেস। তের তারিখ মঙ্গলবার রাতে সৈকতে নামছি; সুতরাং তারিখটাকে মনের মাঝে গেঁথে নাও।”
***
প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝে কিনশাসা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল কর্মাশিয়াল ফ্লাইট। প্লেন থেকে নেমে এয়ারপোর্টের বাসে উঠার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ভিজে একশা হয়ে গেল বেলা।
কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন ব্যারিয়ার থেকে বের হতেই দেখল সাধারণ খাকি ফ্লাইং ওভারঅল পরে দাঁড়িয়ে এক সুদর্শন তরুণ পাইলট। স্প্যানিশে বেলা’কে সম্বোধন করে উঠতেই কিউবান টান টের পেল বেলা। এয়ারপোর্টের মেইন বিল্ডিং থেকে ট্যাক্সিতে করে প্রাইভেট আর চাটার্ড সেকশনে আসতে আসতেই থেমে গেল বৃষ্টি সারা পৃথ ওর সাথে ফ্লার্ট করল তরুণ পাইলট। পুরো আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও বেশি ভ্যাপসা গরম হয়ে উঠেছে আবহাওয়া। এরই মাঝে ছোট্ট একটা সিংগল ইঞ্জিন এয়ারক্রাফটের ব্যাক কম্পার্টমেন্টে বেলা’র লাগেজ তুলে ফেলল পাইলট।
“এই আবহাওয়াতেই আমরা রওনা হবো?” জানতে চাইল বেলা, “কোনো বিপদ হবে না তো?”
“আহ্, সিনেরা, মারা গেলেও আমার হাতের উপর আপনার মৃত্যু হবে কতটা রোমান্টিক হবে, না?”
প্লেন আকাশে উঠতেই বেলা’র উরুতে হাত দিল পাইলট।
“হুইলের উপর হাত রাখো। সামনের রাস্তার দিকে চোখ দাও।” পাইলটের হাত সরিয়ে দিল বেলা। লোকটা এমন ভাবে দাঁত বের করে হেসে ফেলল যেন কোনো রাজ্য জয় করে ফেলেছে।
বেশিক্ষণ অবশ্য রাগ করে থাকতে পারল না বেলা। যতই সামনে এগুচ্ছে নিশ্চিত হচ্ছে যে গতবারের জায়গাতেই আছে নিকি।
দু’ঘণ্টা পরে উপকূল রেখা দেখে নিজ আসনে সিধে হয়ে বসল বেলা। চিনতে পেরেছে নদী মুখ। লাল কাদা মাটির স্ট্রিপে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে এয়ারক্রাফট।
নিকি, মনে মনে ভাবল বেলা, শীঘ্রিই আমরা আবার মুক্ত হয়ে যাব।
ট্র্যাক্সিং এর সময়ে জিপের সামনের সিটে ছেলেকে দেখতে পেল বেলা। না হলেও আরো দুইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে। চুলও বেশ বেড়ে গেছে কিন্তু চোখ দুটো ঠিক আগের মতই আছে। এতদূর থেকেও স্পষ্ট দেখা গেল সবুজাভ চোখের দ্যুতি। বেলা’কে উইন্ডস্ক্রিনের পেছনে দেখার সাথে সাথে মাথার উপর দুহাত তুলে নাড়তে শুরু করল নিকি। চমৎকার মুখখানায় ছড়িয়ে পড়ল হাসি।
জিপে নিকি’র সাথে কিউবান প্যারাট্রুপার আর ড্রাইভার জোসে’ও আছে। নিকি’র মতই হাসছে দু’জন।
লাফ দিয়ে জিপ থেকে নেমে দৌড়ে মায়ের কাছে এলো নিকি। এক মুহূর্তের জন্য বেলা’র মনে হলো হয়তো মায়ের বুকে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে ছেলেটা; কিন্তু না নিজেকে সামলে হাত এগিয়ে দিল নিকি।
“ওয়েলকাম মাম্মা” মনে হচ্ছে আবেগে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে বেলা, “তোমাকে দেখে ভাল লাগছে।”
“হ্যালো নিকি” কেঁপে উঠল বেলা’র গলা, “তুমি তো বেশ লম্বা হয়ে গেছ; আমি তো চিনতেই পারিনি। পাক্কা একটা পুরুষ।”
ঠিক কথাটাই বলেছে মা। বেল্টের মাঝে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে ড্রাইভার আর জোসের দিকে তাকাল নিকি, “এসো আমার মায়ের লাগেজ নিয়ে যাও।”
“এক্ষুণি যাচ্ছি, জেনারেল পেলে। কপট ভঙ্গিতে স্যালুট দিয়ে ইসাবেলার দিকে তাকাল জোসে, “গ্রিটিংস সিনোরা আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।”
আমি সবার ফেবারিট আন্টি হয়ে গেছি; মনে মনে হাসল বেলা।
নিজের বিশাল লটবহর থেকে ড্রাইভার আর জোসে’কে মার্লবোরো সিগারেটের দুইশ প্যাকেটের একেকটা কার্টন দিল আর যায় কোথায়। বেলার সুখ্যাতি বেড়ে গেল কয়েকশ গুণ।
গাড়ি চালাতে চালাতে খুশি মনে গল্প করে চলল নিকি। বেলাও আগ্রহ নিয়ে শুনল লাস্ট মিটিঙের পর থেকে নিকি’র করা যত কেচ্ছা কাহিনী; কিন্তু একই সাথে খুব সাবধানে চোখ বোলালো চারপাশে, যা আগে কখনো করেনি। বুঝতে পারল শ’নের জন্য যে স্কেচ ম্যাপ দিয়ে এসেছে সেখানে কত ভুল হয়েছে। ট্রেনিং এর ঘাটিটাও আগের চেয়ে বড় হয়ে গেছে। না হলেও কয়েক হাজার সৈন্য আছে এখানে; একই সাথে চোখে পড়ল ক্যামোফ্লেজ নেটের নিচে থাকা আর্টিলারী ভেহিকেল। লং ব্যারেল্ড অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান মনে হলো। পার্ক করা কিছু ট্রাকের উপরে ডিশ অ্যান্টেনার মতো রাডারও দেখা যাচ্ছে। ওহ, খোদা লিয়ার নিয়েই তো আসবে বাবা আর গ্যারি। এসব পরিবর্তনের ব্যাপারে ওদের সর্তক করার কোনো উপায় নেই।
সৈকতের কম্পাউন্ডে পৌঁছাতেই স্পিডোমিটারের দিকে তাকাল বেলা। এয়ারস্ট্রিপ থেকে সৈকত মাত্র ৩.৬ কি.মি-যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক কাছে। মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠল যে রেসকিউ অপারেশনটা কতটা বিপদজনক হতে যাচ্ছে। শ’নের ভাবনার চেয়েও দ্রুত পৌঁছে যাবে রিইনফোর্সমেন্ট।
গার্ড হাউজে লাগেজ নিয়ে গেল জোসে। আগের বারের দেখা দুই নারীই এবারো আছে। তবে তাদের অভিব্যক্তি আগের চেয়ে বেশ সহজ।
“আমি তোমাদের জন্য গিফট এনেছি। সুগন্ধের কথা না ভেবে সাইজ দেখেই মেয়ে দুটোর জন্য দুইটা পারফিউমের বোতল এনেছে বেলা। আনন্দের চোটে একে অন্যের গায়ে এমন স্প্রে করা শুরু করল যে রুমের বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়াই কষ্ট হয়ে পড়ল। বেশ কয়েক মিনিট পার করে তারপর বেলা’র লাগেজ সার্চ করতে আসল কেজিবি’র দুই নারী।
এবার ক্যামেরা নিয়ে কেউ কিছু বলল না; যদিও কসমেটিকস্ নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি করল। নিজের লিপস্টিক ট্রাই করে দিল বেলা। মেয়েরা তো যার পরনাই খুশি। ঠোঁটে লাগিয়ে আবার বেলা’র কম্প্যাক্টের আয়নায় চেক করে নিল। মনে হল যেন বহুদিনের পুরোন বান্ধবীরা আজ একত্রিত হয়েছে।
নিকোলাসের গিফট বক্স চেক করতে তাই তাদের তেমন আর আগ্রহ দেখা গেল না। সকার বল তুলে নিয়ে একজন শুধু বলল,
“আহ, পেলে এটা বেশ পছন্দ করবে।” পাম্পে হাত দিতেই বেলার বুক ধুকপুক করে উঠল।
“বলের জন্য।” বুঝিয়ে দিল।
“বুঝতে পেরেছি। বাতাস ভরার জন্য, তাই তো।” খানিক বার কয়েক চাপ দিয়ে আবার বক্সে রেখে দিল পাম্প।
‘“আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য দুঃখিত সিনোরা। আমরা কেবল আমাদের ডিউটি পালন করছি।”
“অফ কোর্স। কোন সমস্যা নাই, আমি বুঝতে পেরেছি।” একমত হলো বেলা।
“আপনি দু’সপ্তাহ থাকবেন। ভালই হলো। আপনি আসবেন শুনে পেলে তো বেশ উত্তেজিত। ও খুব ভালো ছেলে। সবাই ওকে বেশ পছন্দ করে। ওকে নিয়ে গর্ব করে।”
ঘর পর্যন্ত বেলা’র লাগেজ বয়ে আনতে সাহায্য করল মেয়েটা। গতবারেও এই ঘরেই ছিল বেলা।
এরই মাঝে সুইমিং ট্যাঙ্ক পরে বিছানার উপর বসে আছে নিকোলাস।
“কাম। মাম্মা। চলো সাঁতার কেটে আসি।”
ভোদরের মতো সাঁতার কাটছে নিকি; ওর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বেলা’র জান বের হয়ে গেল।
সন্ধ্যায় মাতা-পুত্র দুজন একসাথে বসার পর গিফট বক্স খুলল বেলা। সকার বলটা বেশি পছন্দ করলেও মায়ের আনা বই আর কাপড়-চোপড় দেখেও খুশি হল নিকি। সনি ক্যাসেট প্লেয়ার আর মিউজিক ক্যাসেটও নিয়ে এসেছে বেলা।
“রক এন রোল করতে পারো?” জানতে চাইল বেলা। প্লেয়ারে বাজিয়ে দিল জনি হ্যাঁলিডে।
আদ্রা এসে ডিনারে ডাকার আগ পর্যন্ত বাদিং স্যুট পরেই খুব নাচল মা আর ছেলে। আদ্রা বরাবরের মতই চুপচাপ থাকলেও পাত্তা দিল না বেলা। নিকি’কে শোনাবে বলে একগাদা হাতির জোকস শিখে এসেছে।
নিকি’কে একটা শোনানোর পর ছেলে মাকে পাল্টা একটা জোকস বলল। জোসের কাছ থেকে শিখেছে। শুনে তো বেলা’র ভিরমি খাবার জোগাড়। “তুমি জানো এর মানে কী?” ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল বেলা। “অফকোর্স। স্কুলে বড় একটা মেয়ে আমাকে দেখিয়েছে।” সোজা সাপ্টা উত্তর দিল নিকি। এ নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই সমীচিন, ভাবল বেলা।
নিকি ঘুমোতে যাবার পর আদ্রা’র কাছে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল বেলা : “রামোন কোথায়, দ্য মারকুইস? এখানে আছে?”
উত্তর দেবার আগে খুব সাবধানে চারপাশ দেখে নিল আদ্রা, “না। তবে শীঘিই আসবে। মনে হয় আগামী কাল কিংবা তার পরের দিন। তবে বলেছেন যে, আসবেন। এও জানিয়েছেন যে আপনাকে অনেক ভালোবাসেন।
নিজের ঘরে একাকী শুয়ে বেলা বুঝতে পারল যে রামোনের সাথে দেখা। হবে ভাবতেই কতটা ভয় লাগছে। কারণ এখন জানে ও’কে সহজভাবে আচরণ করতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু রামোন যদি একবার ওর পরিবর্তন টের পায় তাহলে নির্ঘাৎ নিকি’কে সরিয়ে বেলা’কে বন্দি করে ফেলবে।
“প্লিজ গড, রামোনোর আগে যেন শন এসে পড়ে। শন না আসা পর্যন্ত ও’কে দূরেই রাখো।” সে রাতে আর ঘুমোতেই পারল না বেলা। মনে হলো এই বুঝি চলে আসে রামোন।
পরের দুটি দিনও আগের মতই সাঁতার কেটে মাছ ধরে আর সৈকতে টুয়েন্টি সিক্সের সাথে খেলা করে কাটিয়ে দিল নিকি আর বেলা। কুকুর ছানাটা এখন নিক্রির সাথে এক বিছানাতেই ঘুমায়। কিন্তু মানা করতে পারে না বেলা।
সোমবার রাতে, নিকোলাস বিছানায় ঘুমাতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে; এমন সময় স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উঠে গিয়ে শেঙ্ক থেকে বাইসাইকেল পাম্পটা তুলে নিল বেলা। হ্যাঁন্ডেল ঘোরাতেই ট্রান্সপন্ডার অন হবার হালকা একটা ক্লিক শুনতে পেল। আবার আগের জায়গায় রেখে দিল পাম্প। কেপ টাউন থেকে আনা পিপারমিন্ট টুথপেস্টের গন্ধ ছড়িয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো নিকি।
বিছানার উপর মশারি ঠিক করতে গেল বেলা। হঠাৎ করে উঠে বসে দু’হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল নিকি। “আই লাভ ইউ মাম্মা।” লাজুক স্বরে। ফিসফিস করল নিকোলাস। ছেলের গালে কিস্ করল বেলা।
স্নেহের ভারে উদ্বেল হয়ে উঠল হৃদয়। কিন্তু নিজের আচরণে নিকি নিজেই এত লজ্জা পেয়ে গেল যে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে ফিরে গলা অব্দি চাদর টেনে নাক ডাকার ভান করল।
“স্লিপ ওয়েল, নিকি।
আই লাভ ইউ টু-উইদ অল মাই হার্ট।” ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল বেলা।
নিজের ঘরে ফিরে আসতে আসতে শুনল গুরুগম্ভীর মেঘের ঢাক; রাতের আকাশ চিরে দিল বিদ্যুৎতের চমক। মুখ তুলে তাকাতেই কপালের ঠিক মাঝখানে পড়ল উষ্ণ বৃষ্টির ফোঁটা।
***
একেবারে নিশ্চুপ হয়ে আছে লিয়ারের ককপিট। চল্লিশ হাজার ফুট উপরে আকাশে ভেসে আছে বিশাল এয়ারক্রাফট।
“শত্রু উপকূল সামনেই!” নরম স্বরে ঘোষণা করলেন শাসা, শুনে হেসে ফেলল গ্যারি।
‘কাম অন, বাবা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুভিগুলোতে মানুষ এসব সংলাপ বলে।”
মেঘের দেশের বহু উপরে চাঁদের আলোয় ভাসছে লিয়ার। নিচের মেঘের স্তূপ ঠিক আল্পসের তুষারের মতই অদ্ভুত সাদা দেখাচ্ছে।
“কঙ্গো নদীমুখ থেকে একশ নটিক্যাল মাইল দূর।” স্যাটেলাইট ন্যাভ সিস্টেমের পর্দায় নিজেদের পজিশন চেক করলেন শাসা, “আমরা ঠিক ল্যান্সারের মাথার উপরে আছি।”
“ওদের একটা কল দিয়ে দেখো, তাহলে।”
গ্যারি’র কথা শুনে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক করলেন শাসা। “হ্যালো ডোনাল্ড ডার্ক। ম্যাজিক ড্রাগন বলছি, শুনতে পাচ্ছো?”
“হ্যালো, ড্রাগন। ডাক বলছি। জবরদস্ত শুনছি। বলে যাও।”
উত্তরটা এত দ্রুত এলো যে বড় ছেলের কণ্ঠস্বর শুনে হাসলেন শাসা।
“শন বোধহয় বোতামের উপর বুড়ো আঙুল দিয়েই বসেছিল” বিড়বিড় করতে করতে মাইক্রোফোনের কী-তে চাপ দিলেন শাসা, “স্ট্যান্ড বাই ডাক, আমরা ডিজনীল্যান্ড যাচ্ছি।”
“হ্যাভ আ নাইস ট্রিপ। ডাক বসেই আছে।”
কো-পাইলটের আসনে বসে প্যাসেঞ্জার কেবিনের দিকে ঘুরে গেলেন শাসা। ইকুপমেন্টের উপর ঝুঁকে বসে আছে কোর্টনি কমুনিকেশনের দুই টেকনিশিয়ান। দশ দিন ধরে সমস্ত স্পেশাল ইলেকট্রনিকস ইনস্টল করেছে এই দুজন। তারপর লিয়ারের কেবিনে স্ট্যাম্প আর ভ্রু দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। ডিসপ্লে প্যানেলের সবুজ আলো পড়াতে একেক জনের চেহারা দেখাচ্ছে ডাইনীর মতো আর বিশাল হেডফোন লাগানোতে মাথা দুটোও হয়ে গেছে বিকট।
ইন্টারকমের সুইচ টিপলেন শাসা, “হাউ ইউ ডুয়িং লেন?”
চোখ তুলে তাকাল হেড ইঞ্জিনিয়ার, “কোনো বাড়ার পিছু নেয়নি। কিংবা টাগের্ট থেকেও সিগন্যাল পাচ্ছি না। কেবল নর্মাল রেডিও ট্রাফিক
“ক্যারি অন।” আবারো সামনের দিকে তাকলেন শাসা! জানেন চিন্তার কিছু নেই। লিয়ারের পেটে থাকা অ্যান্টিনা কোনো শত্রু রাডারের দেখা পেলে তাদেরকে আগেই সাবধান করে দেবে। স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষতা থাকাতে লেনকে নির্বাচন করা হয়েছে। কিউবান রেডিও ট্রাফিকও সাথে সাথে মনিটর করতে পারবে।
“ওকে, গ্যারি, ছেলের হাত স্পর্শ করলেন শাসা। “কঙ্গো নদীমুখের উপরে চলে এসেছি। তোমার নতুন হোডিং হচ্ছে ১৭৫।”
সম্মত হয়ে উপকূল রেখা বরাবর প্লেন ভাসিয়ে দিল গ্যারি।
লিয়ারের নিচের মেঝের স্তূপে হঠাৎ করেই দেখা দিল গভীর একটা গর্ত। মাথার ঠিক উপরে থাকা চাঁদ দুদিন পরেই পূর্ণ হয়ে যাবে। চল্লিশ ফুট নিচে চাঁদের আলোতে চকচক করছে প্লাটিনামের মতো স্বচ্ছ পানি। দেখা যাচ্ছে আফ্রিকান উপকূলের গাঢ় অবয়ব।
“চার মিনিটের মাঝে আমব্রিজ নদী মুখে পৌঁছে যাবো।” সতর্ক করলেন
“টার্গেট সিগন্যালের জন্য আমরা সার্চ শুরু করেছি” হেডফোনে কনফার্ম করল লেন।
“ওভারহেড আমব্রিজ” ঘোষণা করলেন শাসা।
“কোনো সিগনাল নেই।”
“কান্টাকানহা নদীমুখ ছয় মিনিট দূর।” আবারো জানালেন শাসা।
কিন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন শাসা। তাদের নাক বরাবর সোজা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কালো মেঘের বিশাল এক পর্বত। উচ্চতায় না হলেও ষাট থেকে সত্তুর হাজার ফুট।
“এই চার্লিকে দেখে কী মনে হচ্ছে?” গ্যারি’র কাছে জানতে চাইলেন শাসা। মাথা নেড়ে ওয়েদার রাডার সেটে চোখ নামাল গ্যারি। ভয়ংকর এক টকটকে লাল ককন্টের ন্যায় স্ক্রিন জুড়ে দেখা যাচ্ছে ট্রপিক্যাল থান্ডারস্টর্ম।
“এখনো ছিয়ানব্বই মাইল দূর হলেও ব্যাটা সত্যিকারের বদশাম। ঠিক আমাদের টার্গেট রিভার মাউথ চিকাঘার উপর গিয়ে বসে আছে।”
“যদি তাই হয় তাহলে তো বেলার ট্রান্সপন্ডারের সিগন্যাল ধুয়ে মুছে ফেলবে।” চিন্তায় পড়ে গেলেন শাসা।
“এটার মধ্য দিয়ে তো যাওয়ার কোনো উপায়ই দেখছি না।” ঘোৎ ঘোৎ করে উঠল গ্যারি।
“কাটাকানহার উপরে চলে এসেছিলেন কিছু পেলে?”
“নেগেটিভ মিঃ কোর্টনি।” আর তার পরই পাল্টে গেল লেনের গলা, “হোল্ড অন! ওহ শিট! কেউ একজন পেছনে রাডার জুড়ে দিয়েছে।”
“গ্যারি” ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন শাসা, “ওরা আমাদেরকে পেয়ে গেছে।”
“ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিকোরেন্সির সুইচ অন্ করে শোন” জানাল গ্যারি।
বরফের মতো জমে গেল সকলে যার যার আসনে বসে। হঠাৎ করেই ক্যারিয়ার ব্যান্ড হিস হিস করে উঠতেই শোনা গেল, “আনআইডেন্টিফায়েড এয়ারক্রাফট। লুয়ান্ডা কন্ট্রোল। তোমরা সংরক্ষিত আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছ। এখনি নিজের পরিচয় জানাও। আবারো বলছি, এটা সংরক্ষিত আকাশ সীমা অঞ্চল।”
“লুয়ান্ডা কন্ট্রোল, এটি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ফ্লাইট বিএ ০৫১। আমাদের ইঞ্জিনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। পজিশনের জন্য রিকোয়েস্ট করছি।” লুয়ান্ডার সাথে আলোচনা শুরু করলেন শাসা। এতে যতটুকু সময় পাওয়া যায়। ততটুকুই লাভ। প্রতিটি সেকেন্ড এখন গুরুতুপূর্ণ। লুয়ান্ডাতে নামার জন্য ক্লিয়ার্যান্স চাওয়ার পাশাপাশি এমন একটা ভাব করলেন যেন তাদের কথার বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারছেন না।
“এতে তাদের মন গলেনি মিঃ কোর্টনি। “মিলিটারি ফ্রিকোয়েন্সি ধরতে পেরে সতর্ক করে দিল লেন। “সারিমো এয়ারফিল্ড থেকে মিগ আসছে আমাদেরকে ধরতে।”
“চিকাম্বা পার হতে কতক্ষণ বাকি আছে?” জানাতে চাইল গ্যারি।
“চৌদ্দ মিনিট।” সাথে সাথে উত্তর দিলেন শাসা।
“ওয়েল ঈশ্বর, ঈশ্বর!” হেসে ফেলল গ্যারি। তার মানে মিগ ও ঠিক সামনে থেকেই আসছে। বেশ মজাই হবে কী বলো।”
রুপালি চাঁদের আলোয় ভেসে দক্ষিণে উড়ে চলল লিয়ার।
“মিঃ কোর্টনি, আমার মনে হয় মিগ আমাদেরকে ওদের অ্যাটক রাডারে পেয়ে গেছে।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, লেন। আর এক মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড গেলেই চিকাম্বা নদী।”
“মিঃ কোর্টনি” আতঙ্কিত লেনে’র গলা কাঁপছে, “মিগ লিড়ার টার্গেট কনফার্ম করছে। আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে স্যার।”
“আমার মনে হয় তুমি বলেছিলে যে ওরা আমাদেরকে দেখতেই পারবে না” নরম স্বরে গ্যারিকে জানালেন শাসা। “আমি ভেবেছিলাম আমরা বোধহয় ওদের অপারেশন্যাল রেঞ্জের বাইরে থাকব।”
“হেল, ড্যাড। বাদ দাও। যে কেউই তো ভুল করতে পারে।”
“মিঃ কোর্টনি” ভয়ে লেনে’র আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার জোগাড়। “খানিকটা দুর্বল হলেও টার্গেট সিগন্যাল পাচ্ছি সামনে। ছয় কি.মি দূর।”
“তুমি নিশ্চিত লেন?”
“এটা আমাদের ট্রান্সপন্ডার, কোনো ভুল নেই!”
“তার মানে চিকাম্বা নদী মুখ। বেলা এখন চিকাষা তে!” চিৎকার করে উঠলেন শাসা। “চলো গ্যারি, এবার এই নরক থেকে বেরোও।”
“মিঃ কোর্টনি মিগ উইপনস্ ফ্রি হয়ে গেছে। অ্যাটাক করতে আসছে।”
“হোল্ড অন্” ঘোষণা করল গ্যারি, “গ্রাব ইউর হ্যাটস!”
লিয়ার নিয়ে ডাইভ দিল গ্যারি।
“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?’ কো-পাইলটের সিটু আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে উঠলেন শাসা, “এখনি নাক ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে যাও।”
“এক মাইলও যেতে পারব না, তার আগেই খতম করে দেবে।”
“ক্রাইস্ট গ্যারি। লিয়ারের পাখা খসে যাবে।”
এয়ারস্পিড ইনডিকেটর দ্রুত উপরে উঠে “নেভার এক্সিড” ব্যারিয়ার ছুল।
“কোনটা চাও বেছে নাও বাবা। লিয়ারের পাখা ভাঙ্গবে নাকি মিগের তো খাবে?”
“মিঃ কোর্টনি মিগ লিডার মিসাইল লক করার রিপোর্ট দিচ্ছে।” আতঙ্কে প্রায় উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে লেন।
“কী করবে গ্যারি?” গ্যারি’র হাত ধরলেন শাসা।
“আমি ওখানে যাবো।” থান্ডারস্টার্মের পাহাড়টাকে ইশারা করল গ্যারি। “মেঘের ভেতরে বাতাস অনেক জোরে বইছে। ঝড়ের ঠিক মাঝখানে গজরাচ্ছে বিদ্যুতের ঝলকানি।
“ইউ আর ক্রেজি” ফিসফিস করে উঠলেন শাসা।
“এর ভেতরে কোন মিগ আমাদেরকে ধরতে আসবে না।” জানাল গ্যারি। “চারপাশের এত এনার্জি আর ইলেকট্রিকাল ডিসচার্জের ভেতরে কোনো মিসাইল পাত্তা পাবে না।”
“মিঃ কোর্টনি মিগ লিডার একটা মিসাইল ছুঁড়েছে-আর আরেকটা। দুটো মিসাইল একসাথে আসছে…”
“প্রে ফর আস, সিনারস।” লিয়ার নিয়ে যেন মৃত্যুর মাঝে ঝাঁপ দিল গ্যারি। “আমারও তাই মনে হচ্ছে।” শাসার কথা শুনেই কিনা কে জানে কিছু একটা এসে লিয়ারকে ধাক্কা দিল। ঝড়ের মুখে ঢুকে গেল লিয়ার।
সাথে সাথে মুছে গেল সমস্ত দৃশ্য। চারপাশে কেবল তুলোর বলের মতো ধূসর রঙা মেঘ। সেফটি হার্নেসের ভেতরেও ঝাঁকি খাচ্ছে সকলে। লিয়ার নিয়ে যেন খেলছে কোনো হিংস্র পশু।
মরা পাতার মতই বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে লিয়ার। কন্ট্রোল প্যানেলের ইনস্ট্রমেন্টগুলো আপনা থেকেই ঘুরছে।
***
শূন্যে পড়ে ইয়ো-ইয়ো করছে অলটিমিটারের কাটা। হঠাৎ করেই লিয়ারের উচ্চতা নেমে গেল মাত্র দুই হাজার ফুট।
বজ্রপাতে এয়ারক্রাফটের ধাতব শরীরে নাচছে নীল আলোর শিখা, যেন লিয়ারে আগুন ধরে হেছে। ঝড়ের প্রচণ্ড শক্তি মনে হচ্ছে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে লিয়ার।
অসহায়ের মতো বসে আছে গ্যারি। জানে নিজের জান বাঁচাতে লড়ছে লিয়ার। হালকা করে স্পর্শ করে রেখেছে কন্ট্রোল হুইল। যেন ভালবাসা দিয়ে উৎসাহিত করতে চাইছে তার প্রিয় লিয়ার’কে আর চেষ্টা করছে নাকটা যাতে কোনভাবে সোজা রাখা যায়।
“এই তো ডার্লিং, হিম্মত রাখো। ইউ ক্যান ডু ইট” ফিসফিস করে লিয়ারকে শোনাল গ্যারি।
নিজের আসনের হাতল চেপে ধরে অলটিমিটারের দিকে তাকিয়ে আছেন শাসা। পনের হাজার ফুট নেমে গেছেন; তার পরেও থামছে না পতন। আর কোন ইলুট্রমেন্ট কোনো কাজ করছে না।
একদৃষ্টে অলটিমিটার দেখছেন শাসা। দশ হাজার সাত, চার হাজার। এখনো বাড়ছে ঝড়ের শক্তি। সমানে আগু পিছু করছে সবার মাথা; ভয় হচ্ছে স্পাইন্যাল কর্ড না ভেঙে যায়। সোল্ডার স্ট্রাপ গেঁথে বসাতে ব্যথা করছে মাংস।
এরই মাঝে ফিউজিলাজের সাথে লেগে কিছু একটা ভেঙে যাবার শব্দ হলো। সেদিকে না তাকিয়ে অলটিমিটারের ফোকাস করলেন শাসা।
দুই হাজার ফুট, এক হাজার জিরো। নিশ্চয় তারা মাটিতে নেমে গেছে; কিন্তু বায়ুমণ্ডলের প্রচণ্ড পবির্তনের ফলে ঝড়ের মুখে রিডিং কোনো কাজ করছে না।
হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেল লিয়ার। থেমে গেল ঝড়। রাডার আর স্টিকে চাপ দিল গ্যারি। সাড়া দিল লিয়ার। মেঘের পেট থেকে বের হয়ে এলো এয়ার-ক্রাফট।
অভূতপূর্ব এই পরিবর্তন। ঝড়ের কোনো শব্দই নেই আর; কেবল জেট প্লেনের মৃদু গুঞ্জন, ককপিট ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয় দেখে অবাক হয়ে গেলেন শাসা। কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
সমুদ্রের ঠিক উপরে মাছের মতো ভাসছে লিয়ার। আর মাত্র শখানেক ফুট নিচে নামলেই এতক্ষণে পৌঁছে যেতেন সবুজ আটলান্টিকের অতল তলে।
“ভালোই কাজ দেখিয়েছে বাছা” ককশ শব্দে বলে উঠলেন শাসা। হাসতে চেষ্টা করলেন কিন্তু চোখের পট্টি ঢিলে হয়ে কানের নিচে ঝুলছে। কাঁপা কাঁপা পট্টি আঙুলে আবার জায়গামতো বসিয়ে দিলেন শাসা।”কাম অন, নেভিগেটর” মিটিমিটি হাসলেও গ্যারি নিজেও ভয় পেয়েছিল। “একটা কোর্স তো বলো।”
“নতুন কোর্স ২৬০ ডিগ্রী।
“কী অবস্থা বেটির?”
“বাতাসের মতই।” নতুন হেডিংয়ে ঘুরে গেল গ্যারি। আটলান্টিকের উপর দিয়ে তীর বেগে উড়তে লাগল লিয়ার।
“লেন” সিটে বসেই ঘুরে গিয়ে কেবিনের দিকে তাকালেন শাসা, টেকনিশিয়ানদের পান্ডুর চেহারা থেকে এখনো পুরোপুরি কাটেনি ভয়। “মিগগুলোর কী খবর, কিছু জানো নাকি?”
পেঁচার মতো চোখে তাকিয়ে রইল লেন; বুঝতে পারছে না বেঁচে আছে না কি?”
“আরে হলো টা কি তোমার?” শাসা’র ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি কন্ট্রোল প্যানেলেনের উপর উপুর হয়ে পড়ল লেন।
“হ্যাঁ, এখনো কনট্যাক্ট পাওয়া যাচ্ছে। মিগ লিডার টার্গেট ডেস্ট্রয়েডের রিপোর্ট করছে। ফুয়েল শর্টেজের কারণে ঘটিতে ফিরে যাচ্ছে।”
“বিদায় ফিদেল। থ্যাংস লর্ড।” বিড়বিড় করল গ্যারি। লিয়ারকে নিচেই রাখল যেন তীর থেকে কোনো রাডার সহজে খুঁজে না পায়। “ল্যান্সার কোথায়?”
“নিশ্চয় ঠিক সামনে।” মাইক্রোফোনে বুড়ো আঙুল চেপে ধরলেন শাসা।
“ডোনাল্ড ডাক, ম্যাজিক ড্রাগন বলছি।”
“গো এহেড, ড্রাগন।”
“চিকাম্বা। আবারো বলছি চিকাম্বা। ডু ইউ কপি দ্যাট? ওভার।”
“রজার, চিকাম্বা। আবারো বলছি চিকাম্বা। কোনো সমস্যা হয়েছিল নাকি? দক্ষিণ পূর্বে পম পম এয়ার ট্রাফিকের শব্দ শুনেছি। “ওভার।”
“তেমন কিছু না। সানডে স্কুল পিকনিক। এবারে তোমার পালা। যাও ডিজনি ল্যান্ড ঘুরে এসো। ওভার।”
“উই আর অন আওয়ার ওয়ে, ড্রাগন।”
“পা ভেঙে দিও, ডাক। ওভার অ্যান্ড আউট।”
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে পাঁচটায় লিয়ার নিয়ে উইন্ডহক এয়ারপোর্টে নামল গ্যারি। সিঁড়ির পাদদেশে এসে গোল করে দাঁড়ালো পুরো দল। এখনো কাটেনি। হতভম্ব ভাব। কাছের ইঞ্জিনটার দিকে এগিয়ে গেল গ্যারি।
“বাবা, এসে একটা জিনিস দেখে যাও।” শাসা’কে ডাকল গ্যারি।
টার্বো ফ্যান ইঞ্জিনের গায়ে অদ্ভুত আর অচেনা একটা ধাতব জিনিসের দিকে তাকিয়ে দেখলেন শাসা। তীরের মতো দেখতে লম্বা টিউবটার রং হলুদ।
“এটা আবার কী?” জানতে চাইলেন শাসা।
“এটা হলো” শাসার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে লেন, “একটা সোভিয়েত অ্যাটোল মিসাইল যেটা বিস্ফোরিত হতে পারে নি।”
“ওয়েল গ্যারি” বিড়বিড় করলেন শাসা, “ফিদেল একেবারে আহাম্মক নয়, কী বলো।”
“রাশান কারিগররা দীর্ঘজীবী হোক।” হেসে উঠল গ্যারি, “কিন্তু বাবা, একটু আগে ভাগে হয়ে গেলেও এক গ্লাস শ্যাম্পেন খাবে নাকি?”
‘তা আর বলতে।” জানালেন শাসা।
***
চিকাম্বা নদী” কাঁধে কাধ ঠেকিয়ে চার্ট টেবিলের উপর ঝুঁকে আছে শন আর ইসাউ গনডেলে।
“এই তো এখানে।”
বিশেষতৃবিহীন ছোট্ট একটা লাইনের উপর আঙুল রাখল শন, “কাটাকানহার ঠিক দক্ষিণে।” ট্রলার স্কিপারের দিকে চোখ তুলে তাকাল। ভ্যান দার বার্গা’কে দেখাচ্ছে ঠিক সুমো কুস্তিগীরদের মত; এতটাই ভারি আর চওড়া শরীর।
“চিকাম্বা সম্পর্কে কী জানো ভ্যান?” জানতে চাইল শন। “এতটা কাছে কখনো যাইনি।” কাঁধ ঝাঁকাল ভ্যান। কিন্তু আপনি যতটা কাছে চান। নিয়ে যাবো।”
“শৈলশিরা থেকে মাইলখানেক দূর হলেই চলবে।”
“তাই হবে” প্রমিজ করল ভ্যান। “
“কখন?” জানতে চাইল ভ্যান। “কালকের ভেতরে দিগন্তের নিচ পর্যন্ত গেলেই ভালো। তারপর রাত নামলে ভেতরে নিয়ে যাবে। ০২০০ আওয়ার।”
স্কাউটদের জন্য রাত দুটো হলো সবচেয়ে আদর্শ সময়। ঠিক এসময়ে শত্রু তার মানসিক আর শারীরিক শক্তির সর্বনিম্ন সীমানায় থাকে।
রাত একটায় ল্যান্সারের মেসে ক্রুদেরকে ফাইনাল ব্রিফিং করল শন। সবাইকে পৃথক পৃথকভাবে চেক করে দেখল। সকলেরই পরনে জেলেদের নেভি ব্লু জার্সি জিন্স আর কালো ক্যানভাসের বাবার সোল কমব্যাট বুটস্। মাথায় কালো উলের টুপি আর ক্যামো ক্রিম কিংবা নিজস্ব রঙের প্রভাবে সকলেরই চেহারা আর হাত দুটো একেবারে কুচকুচে কালো।
ইউনিফর্ম বলতে দক্ষিণ অ্যাংগোলাতে বন্দি কিউবানদের কাছ থেকে পাওয়া বেল্ট ঝুলছে সকলের কোমরে। অস্ত্র হিসেবে প্রত্যেকের কাছে আছে সোভিয়েট একে এম অ্যাসল্ট রাইফেলস, তোকারেভ পিস্তল আর বুলগেরিয়ান এম ৭৫ অ্যান্টি-প্যার্সোনেল গ্রেডেন। ইসাউ গনডেলের সেকশনের তিনজনের কাছে থাকবে আর পি জি ৭ অ্যান্টি ব্যাঙ্ক রকেট লঞ্চার। দক্ষিণ আফ্রিকানদের সহযোগিতা পাবার ক্ষেত্রে একটা চুক্তি হলো কিছুতেই যেন তাদেরকে চিহ্নিত না করা যায়।
এবারে একজন একজন করে টেবিলের উপর রেখে গেল সমস্ত ব্যক্তিগত অলংকার আর ব্যবহার্য জিনিস। যেমন আংটি, ওয়ালেট। প্রত্যেকের জিনিস আলাদাভাবে খামে পুরে সবাইকে একটা করে ডিজিটাল রিস্টওয়াচ দিল ইসাউ গনড়ে।
এরই ফাঁকে ব্রিজ থেকে ইন্টারকমে খবর দিল ট্রলার ক্যাম্পের : “আমরা নদীমুখে থেকে সাত নটিক্যাল মাইল দূরে আছি। পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে বালুচর সময়ের চেয়ে কয়েক মিনিট আগেই পজিশনে পৌঁছে যাব।”
“গুড অন্ ইউ।” জানাল শন। এরপরই তাকাল কালো কালো মুখগুলোর দিকে। “ভেরি ওয়েল জেন্টলম্যান। জানো আমরা কিসের পেছনে ছুটছি। শুধু ব্যস্ততার ভেতরে কারো গলা কাটার সময়ে মেয়েটা আর বাচ্চাটার দিকে খেয়াল রাখবে। ও আমার বোন।” মুহূর্তখানেক সময় দিল সবার মনে কথাটা গেঁথে নেয়ার জন্য।
“দ্বিতীয় বিষয় হল, তোমাদেরকে যে স্কেচ ম্যাপ দেখিয়েছি তা সত্যের চেয়ে কল্পনা বেশি। এর উপর ভরসা করো না। তৃতীয় ব্যাপার হলো, ফিরে আসার সময় কেউ সৈকতে থেকে যেও না। চিকাম্বা হলিডে কাটাবার জায়গা না। খাবার আর আবাসস্থল সবই জঘন্য।” বাঙ্ক থেকে নিজের রাইফেল তুলে নিল শন’ “তো আমার বাছারা, চলো দেখি ব্যাটারা কী করছে।”
নিভিয়ে দেয়া হয়েছে ল্যান্সারের সব বাতি। রাডার আর আর ডেপথ সাউন্ডারের উপর ভর করে এগিয়ে চলেছে তীরের দিকে। ইঞ্চিন বন্ধ থাকায় ভরসা কেবল ক্যাপ্টেনের দক্ষতা। সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সামুদ্রিক শৈল শ্রেণির উপর আছড়ে পড়া সফেন তরঙ্গপুঞ্জ দেখতে পেল শন। তীরের উপরেও কোন আলো দেখা গেল না। ঘুমিয়ে আছে যেন পুরো ঘাঁটি। আকাশে নিশ্চিদ্র মেঘের আস্তরণ থাকাতে নেই কোনো তারা কিংবা চাঁদের আলো।
রাডার হুড থেকে সিধে হয়ে বসল ভ্যান ডার বার্গ, “এক মাইল দূর” আস্তে করে ঘোষণা করল ক্যাপ্টেন। “পানির গভীরতা ছয় ফ্যাদম আর বালুচর আছে।”
গাছের গুঁড়ির মতো ভাসছে ল্যান্সার। “থ্যাংকস ভ্যান” জানাল শন্। “তোমার জন্য চমৎকার কোনো একটা উপহার নিয়ে আসব।” হালকা পায়ে কম্প্যানিয়নওয়ে ধরে মেইন ডে’কে নেমে এলো শন।
নিজ নিজ কালো রাবারের ল্যান্ডিং বোট নিয়ে স্টার্নের কাছে অপেক্ষা করছে প্রতিটা দল। বাতাসে মাদকের গন্ধ পাওয়াতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল শন্। সে পছন্দ না করলেও এটা স্কাউটদের ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। হামলা করার আগে “বুম” করা চাই।
“সার্জেন্ট-মেজর, স্মোকিং লাইট আউট হয়ে গেছে” শনের কথা শুনে স্কাউটেরা যার যার ক্যানাবিস সিগারেট ডে’কের উপর পিষে নিভিয়ে ফেলল। শন বুঝতে পারে যে ধূমপানের মাধ্যমে ভয় কাটিয়ে উঠে বেপরোয়া সাহসী হয়ে উঠে তার ছেলেরা; কিন্তু সে নিজে কখনো এর চর্চা করেনি। বরঞ্চ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে এ ভয়; রক্তে মিশে গিয়ে মাথার মাঝে সবর্দা তাড়না জাগায়। মরণের মুখে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার আগেই যেন নিজেকে বড় বেশি জীবিত বলে মনে হয়। তাই এই নিখাদ ভয়ের শিখাকে আড়াল করার কোনো চেষ্টাই করে না।
মসৃণভাবে পানির মাঝে নেমে গেল একের পর এক রাবারের বোট। সাথে ইকুপমেন্ট আর স্কাউটেরা। টয়েটো আউটবোর্ড চালু করে অন্ধকারে কলকল করতে লাগল নাবিকেরা। বাতাসহীন নিঃশব্দ রাতেও এ শব্দ শ’খানেক গজের বেশি পৌঁছাবে না।
লম্বা কালো একটা সাপের মতো এগিয়ে চলল বোটের সারি নিজের শ্রেষ্ঠ তিন সঙ্গীকে নিয়ে সবার আগে আছে শন। স্টানের উপর ঢাকনিঅলা একটা পেন লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে যেন প্রতিটি রাবার বোট আলো দেখে পিছু নিতে পারে।
স্টার্নের কাছে দাঁড়িয়ে আছে শন্। গলার কাছে ছোট্ট লুমিনাসে কম্পাস ঝুললেও নাইটস্কোপের উপর ভরসা করেই সকলকে তীরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে অনেকটা প্লাস্টিক কোটেড বাইনোকুলারের মত।
জিইস লেন্সের ভেতরে দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মেঘের গাঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছের সারি। সামনেই নদীর খোলা মুখ। পাশে চলে এলো ইসাউ গনডেন্সর বোট। “এই যে পেয়ে গেছি” খানিকটা ঝুঁকে ম্যাটাবেলে’কে ফিসফিস করে জানাল শন্।
“আমিও দেখতে পাচ্ছি।”
নিজের চোখের নাইটসস্কোপ ঠিক করে নিল গনডেল। “চলো ব্যাটাদের তেল বার করি।” পাশাপাশি চলল তিনটা অ্যাটাক বোট। ল্যান্ডের দিকে এগিয়ে হারিয়ে গেল নদীর মাঝে। মাটির সাথে সমান্তরাল পথে ছুটে চলল।
বোটম্যানের কানে ফিসফিস করতেই আড়াআড়ি সৈকতের দিকে ছুটল শনের বোট। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারপাশ দেখছে শন। নদীমুখ থেকে আধা মাইল দূরে থাকতেই পাম বিথীর মাঝে কুঁড়ে ঘরের চৌকোণা আউটলাইন চোখে পড়ল। এর পেছনেই আছে দ্বিতীয়টি। “এটা বেলা’র বণনার সাথে মিলে যাচ্ছে।” নিশ্চিত হলো শন্।
সৈকতের দিকে ধেয়ে চলল রাবার বোটের আরোহীরা। কাছাকাছি কুঁড়েঘরের উপর দেখা গেল ধাতব ক্রিস্টমাস ট্রি অ্যানটেনা আর ডিশ। স্যাটেলাইট কমুনিকেশন সেন্টার।
“তার মানে, এটাই। কোন ভুল নেই।”
বালিতে গেঁথে গেল রাবার বোটের মসৃণ তলা। হাঁটু সমান পানিতে নেমে পড়ল শনে’র দলবল। তীরের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল শন। সৈকতের বালি এতটাই সাদা যে কাঁকড়াগুলোকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাভার নিল প্রত্যেকে; তাল গাছের সারির নিচে হাই ওয়াটার রিজের কাছে।
বিয়ারিং চেক করার জন্য কয়েক মিনিট সময় নিল শন। বেলা’র প্রথমবার ভ্রমণের স্মৃতি অনুযায়ী কম্যুনিকেশন সেন্টারেই ওকে সার্চ করেছিল দুই তিনজন নারী অপারেটর। সেন্টারটাও তারাই চালায়। পেছনের ব্যারাকেই থাকে প্রায় বিশ জন প্যারা গার্ডস।
সূর্যাস্তের সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে যায় কম্পাউন্ডের দরজা। এব্যাপারে বার বার সাবধান করে দিয়েছে বেলা। একজন সেন্ট্রি থাকে। প্রতি চার ঘণ্টার বদল হয় পাহারাদার।
“ওই যে মহাশয় আসছেন” তারের বেড়ার পেছনে সেন্ট্রির গাঢ় অবয়ব দেখতে পেল শন। নাইটস্কোপ নামিয়ে পাশেই শুয়ে থাকা স্কাউটকে ফিসফিস করে জানাল; “বিশ কদম সামনে পোর্কি, বাম থেকে ডানে যাচ্ছে।”
“বুঝেছি।” পর্তুগিজ রোডেশিয়ান গোর্কি শোভস্ এর বিশেষত্ব হলো সে ছুঁড়ে মারতে ওস্তাদ। পঞ্চাশ মিটার দূর থেকে ঘুঘুর পাখা খসিয়ে দিতে পারে। দশ মিটার দূর থেকে ওর ছোঁড়া স্টিলের বল-বিয়ারিং যে কোনো মানুষের খুলি’র ভেতর ঢুকে যাবে কোনো সমস্যা ছাড়াই।
এক হাঁটু গেড়ে উঠে দাঁড়াল পোর্কি। কিউবান সেন্ট্রি সমান্তরালে আসতেই ডাবল সার্জিকাল রাবারের দড়ি লাগানো গুলতি ছিটকে উঠল। একটুও শব্দ না করে সাদা বালির উপর ঢলে পড়ল সেন্ট্রি। “গো!” নরম স্বরে আদেশ দিল শ আর তার কান্টার মেশিন নিয়ে ছুটে গেল দ্বিতীয় স্কাউট। টুংটাং গানের মতো শব্দ করে কেটে গেল কাটা তারের বেড়া! খোলা মুখ দিয়ে দৌড় দিল শন্।
পেছনে আসা প্রতিজন স্কাউটের কাঁধে চাপড় মেরে যার যার টার্গেট দেখিয়ে দিল সকলকে। দু’জন গেল মেইন গেইটের সেন্ট্রিদের খবর নিতে। দু’জন গেল কমুনিকেশন সেন্টার বন্ধ করতে; বাকিদের কাজ হলো কম্পাউন্ডের পেছন দিকের ব্যারাক আর গ্যারিসন গার্ডদের মুন্ডপাত করা।
প্রথমবারের সমস্ত কিছু যদি ঠিকঠাক থাকে তাহলে রেডিও রুমের ডানদিকে প্রথম ঘরটাতেই বেলা’র রুম। দ্বিতীয়টাতে কিউবান নার্স আদ্রার সাথে থাকে নিকি। শ’নের ধারণা অনুযায়ী নার্সটা হলো আসল শয়তান। তাই প্রথম সুযোগেই ওর গলা কাটতে চায় শন।
কুঁড়ে ঘরের সারির দিকে দৌড় দিল শন। কিন্তু পৌঁছাবার আগেই কমুনিকেশনস রুমে চিৎকার শুরু করল এক নারী কণ্ঠ। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো চিৎকার করছে কেউ; শুনে মনে হলো সহ্য করতে পারবে না। শন্। সাথে সাথে অটোমেটিক ফায়ারের শব্দে চাপা পড়ে গেল চিৎকার।
হেয়ার উই গো! শুরু হল জীবন মরণ বাজি রাখার যুদ্ধ। রাতের আকাশ চিরে দিল আগ্নেয়াস্ত্রের শিখা।
***
ইসাবেলার ঘুম হলো চমৎকার। কিন্তু মাঝরাতের খানিক আগে বজ্রপাত আর মাথার উপরে জেট ইঞ্জিনের আওয়াজে ভেঙে গেল ঘুম। মশারি থেকে বের হয়ে দুদ্দাড় করে ছুটে এলো বাইরে।
দক্ষিণ দিক থেকে বইছে শক্তিশালী ঝড়ো হাওয়া। বাতাস আর মেঘের মাঝে হারিয়ে গেল জেট ইঞ্জিনের শব্দ। বেলা’র কাছে মনে হলো আকাশে একটা নয় বরঞ্চ তার চেয়েও বেশি এয়ারক্রাফট উড়ে বেড়াচ্ছে। আশা করল। অন্তত একটাতে থাকবে বাবা আর গ্যারি।
“তোমরা কী সিগন্যাল পেয়েছ?” নিকষ কালো আকাশের দিকে মুখ তুলে সবিস্ময়ে ভাবলো বেলা; “আমার কথা শুনতে পাচ্ছ ড্যাডি? জানো আমি এখানে?”
কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না; ছোট্ট একটা তারাও না। আস্তে আস্তে মিইয়ে গেল মাথার উপরে ইঞ্জিনের আওয়াজ। চারপাশে কেবল শো শো শব্দে বইছে ঝড়ো বাতাস।
আবারো শুরু হল বৃষ্টি। দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এলো বেলা। মাথা আর পা মুছে জানালাতে গিয়ে তাকিয়ে রইল সৈকতের দিকে।
“প্লিজ গড। ওদেরকে জানিয়ে দাও যে আমরা এখানে। শকে সাহায্য করো যেন আমাদেরকে খুঁজে পায়।” সকালবেলা নাশতার সময় নিকোলাস জানাল : “আমি তো আমার নতুন সকার বলটা খেলার সুযোগই পেলাম না।”
“কিন্তু আমরা তো প্রতিদিনই এটা দিয়ে খেলছি নিকি।”
“হ্যাঁ, কিন্তু…মানে ভালো খেলেয়ারদের সাথে।” আর তারপরই বুঝতে পার কী বলে ফেলেছে, “তুমিও ভাল খেলো-মেয়ে হিসেবে। আমার মনে হয় আরেকটু প্র্যাকটিস করলেই তুমি ভালো গোলকীপার হতে পারবে। কিন্তু মাম্মা, আমি আমার স্কুলের ফ্রেন্ডদের সাথে খেলতে চাই।”
“আমি তো জানি না।” আদ্রার দিকে তাকাল বেলা। “তোমার বন্ধুরা এখানে আসে?” আদ্রা উড-স্টোভ থেকে তাকালো না পর্যন্ত। শুধু জানাল, “জোসে’কে জিজ্ঞেস করুন। হয়ত অনুমতি মিলবে।”
সেদিন বিকেলেই জিপ ভর্তি কৃষাঙ্গ বাচ্চা ছেলেদের নিয়ে কম্পাউন্ডে চলে এলো জোসে আর নিকি। তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটা ম্যাচ হলো সৈকতে।
জোসে আর ইসাবেলা এসে তিনবার ছেলেদের যুদ্ধ থামাল। কিন্তু প্রতিবার আবার এমনভাবে খেলা শুরু হল যেন একটু আগে হাতাহাতি কিংবা মারামারির কোনো ঘটনাই ঘটে নি।
বিপ্লবের পুত্রদের গোলকীপার হলো ইসাবেলা। কিন্তু পাঁচ গোল খাওয়ার পর ক্যাপ্টেন নিকোলাস এসে কৌশলে জানালো, “মাম্মা তুমি বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, একটু রেস্ট নাও।” ফলে সাইড লাইনে চলে আসল বেলা।
অতঃপর ফলাফল হত ২৬ : ৫ অর্থাৎ ছাব্বিশ গোলে জিতে গেল বিপ্লবের পুত্র’রা। ওই পাঁচটা গোল খাওয়াতে মনে মনে অপরাধ বোধ ভোগল বেলা। ফাইনাল হুইসেল বাজার পর নিজের গিফট বক্স খুলে দুই কিলো টফি আর চকোলেট বিলিয়ে দিল দোষ ঢাকার জন্য। দুই দলই অবশ্য সাথে সাথে তাকে মাফ করে দিল।
ডিনারের সময়েও সহজভাবেই গল্প করল নিকি। বেলা নিজেও স্বাভাবিক থাকতে চাইল; কিন্তু চোখ বারবার চলে যাচ্ছে জানালার দিকে। মন পড়ে আছে সৈকতে; শন্ যদি আসে, তো আজ রাতেই আসবে। এদিকে বেলা বুঝতে পারল যে আদ্রাও তাকে খেয়াল করছে।
তাই নিকির কথায় মনোযোগ দিতে গিয়ে ভাবতে লাগল আদ্রা’র কথা।
মহিলাকে কি সাথে করে নিয়ে যাবে? আদ্রা যদি না আসতে চায়? সবসময় এত গোমড়া হয়ে থাকে যে ওর মনের কথা বেলা কখনোই আঁচ করতে পারেনি। তবে নিকি’কে জান প্রাণ দিয়ে ভালবাসে এতে কোন সন্দেহ নেই।
আচ্ছা আদ্রা’কে কি রেসকিউ অপারেশনের কথা বলবে নাকি? আপন মনেই ভাবল বেলা। একবার জিজ্ঞেস করবে নাকি? হয়ত যেতে চাইবে। এত বছর দেখ ভাল করার পরে এখন ওর কাছে থেকে নিকি’কে এভাবে নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? কিন্তু কেবল নিকি কিংবা বেলা’র ভয় নয় তাহলে ওর ভাই আর সেসব সাহসী সৈন্যগুলোকেও যদি কোনো চড়া মূল্য দিতে হয়?
এভাবে খেতে খেতে বহুবার আদ্রার সাথে কথা বলতে চাইল বেলা; কিন্তু প্রতিবারই সরে গেল আদ্রা।
নিকি’কে বিছানায় তুলে দিতে এসে ছেলে’র গালে চুমো খেল বেলা। মুহূর্তখানেক শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল নিকি।
“তুমি আবারো চলে যাবে, মাম্মা?”
“যদি সম্ভব হয় তুমি আসবে আমার সাথে?” পাল্টা প্রশ্ন করল বেলা।
“পাদ্রে আর আদ্রা’কে ছেড়ে?” গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল নিকি এবারেই প্রথম রামোনের কথা বেলা’কে বলল নিকি বেলা নিজেও চিন্তায় পড়ে গেল। ছেলেটার গলার স্বরে কি ভয় নাকি শ্রদ্ধা নিশ্চিত হতে পারল না বেলা।
তাড়াহুড়া করে শুধু বলল : “নিকি আজ রাতে-যদি কিছু হয় তুমি ভয় পেওনা, ঠিক আছে?”
“কী হবে?” আগ্রহ নিয়ে উঠে বসল নিকি
“জানি না। হয়ত কিছুই না।” নিরুৎসাহিত হয়ে আবার বালিশের উপর শুয়ে পড়ল নিকি।
“গুড নাইট, নিকি।”
ঘরগুলোর মাঝখানের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল আদ্রা। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল বেলা।
‘আদ্রা।” ফিসফিস করে বলে উঠল, “আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই, আজ রাতে…” শেষ করতে পারল না বেলা।
“আজ রাতে?” আদ্রা বেলা’কে তাড়া দিলেও কোনো কথা না শোনায় বলে উঠল : হ্যাঁ, আজ রাতে উনি আসবেন। উনি জানিয়েছেন যেন আপনি অপেক্ষা করেন। আগে আসতে না পারলেও আজ রাতে অবশ্যই আসবেন।”
হঠাৎ করেই তীব্র আতঙ্কে হেঁয়ে গেল মন। “ওহ গড় তুমি নিশ্চিত?” এরপরই সামলে নিল নিজেকে-”যাক ভালই হলো, আমি অনেকদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলাম।
আদ্রা’কে রেসকিউ অপারেশনের বিষয়ে সাবধান করার সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে দূর হয়ে গেল। মনের মাঝে কেবল একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে-কেমন করে রামোনের মুখোমুখি হবে?
“আমাকে এখন যেতে হবে” আবারো অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে গেল আদ্রা। বেলা ভেবেছিল নাইটড্রেসের নিচে জিন্স আর জার্সি পরে তৈরি হয়ে বসে থাকবে। কিন্তু এখন আর তার উপায় নেই। নগ্ন আতঙ্কে প্রায় জমে যাবার দশা।
অন্ধকারে মশারির ভেতরে শুয়ে অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে মনে হলো, না রামোনের আগে হয়ত শন চলে আসবে; নতুবা তোর এসে বাঁচাবে ও’কে।
হঠাৎ করেই বুঝতে পারল এসে গেছে রামোন। রামোনের কথা শোনার আগেই ওর দেহের ঘ্রাণ পেল বেলা। শক্ত হয়ে গেল শরীরের সব মাংস পেশি। মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে বুঝি।
কুঁড়েঘরের মেঝেতে শুনতে পেল রামোনের পদশব্দ আর তারপরই বিছানাতে ওর স্পর্শ।
“রামোন” ফুস করে বেরিয়ে গেল বুকের সব বাতাস।
“হ্যাঁ, আমি।” রামোনের গলা শুনে যেন প্রচণ্ড ঠাক্কা খেল বেলা।
মশারি তুলছে রামোন। শক্ত হয়ে পড়ে রইল বেলা। মুখে রামোনের হাতের ছোঁয়া পেতেই মনে হলো গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। বুঝতে পারছে না কী বলবে, কী করবে। “ও জেনে যাবে” বেলা বুঝতে পারলেও বড় বেশি ভয় পাচ্ছে। তাই নড়াচড়া কিংবা কথা বলার সাহস পেল না।
“বেলা?” কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে রামোন। এস্ত পায়ে হঠাৎ করেই উঠে বসে ওকে জড়িয়ে ধরল বেলা।
“কথা বলো না” তীব্র স্বরে জানাল বেলা, “আমি আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারব না-আমাকে আদর করো, রামোন।”
জানে ও অস্বাভাবিক কিছু করছে না। অতীতের সুখের দিনগুলোতে প্রায়ই রামোনের কাছে এমন আবদার জুড়ে দিত বেলা-একটুও দেরি সহ্য করতে পারত না।
উঠে বসে রামোনের বুকে কান্না শুরু করে দিল বেলা। ও যেন কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না পায়। এমন ভাব করতে হবে যেন কিছুই বদলায়নি।
ভয়ে বুক কাঁপতে থাকলেও কিছুই বুঝতে দিল না বেলা। রামোন ওর নাইট ড্রেস খুলে নিয়ে নিজেও নিরাভরণ দেহে শুয়ে পড়ল বেলার পাশে।
“বেলা, ফিসফিস করে উঠল রামোন, “আমিও কতদিন ধরে তোমার প্রতীক্ষা করছি।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেহের খেলায় মেতে উঠল বেলা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই নিষ্ঠুর জানোয়ারটার সাথেও রতিক্রিয়া তেমন খারাপ লাগল না। আর সবশেষে নিজের উপরই ঘেন্যা হতে লাগল। মনে হলো রামোনের দেহের ভার আর তার নিজের অপরাধবোধ মিলে এখন গলা টিপে বেলা’কে মেরে ফেলবে।
“আগে তো আর কখনো এমন হয়নি” ফিসফিস করে জানাল রামোন, “আগে তো কখনো এমন করে ভালবাসনি।”
উত্তর দেবার সাহস করল না বেলা। ভয় হলো না জানি কী বেরিয়ে আসে মুখ ফসকে। বুঝতে পারল কতটা উন্মাদ হয়ে গেছে-তারপরও শর মতো সাড়া দিল রামোনের স্পর্শ পেয়ে।
বেলা’র পাশে শুয়ে নরম স্বরে কথা বলছে রামোন। জানালো ও বেলাকে কতটা ভালবাসে। বলল ভবিষ্যতের কথা; যখন ওরা তিনজন মিলে চলে যাবে কোনো নিরাপদ আর গোপন জায়গায়। এত সুন্দর করে মিথ্যে বলে রামোন; একের পর এক কল্পনা ভেসে বেড়াল বেলা’র চোখে। জানে এগুলোর এক বর্ণও সত্যি নয়। তারপরেও কেন জানি মন চাইল বিশ্বাস করতে
অবশেষে বেলা’র নগ্ন বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল রামোন। ওর কোকড়ানো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে নিজের জন্য দুঃখই করল বেলা। এতটাই হতাশায় ডুবে গেল যে ভুলে গেল বাকি সবকিছু। আর তখনই হঠাৎ করে নারী কণ্ঠের চিৎকারে খান খান হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা।
জেগে গেল রামোন। আর সাথে সাথেই উলঙ্গ দেহে ঠিক একটা জংলী বিড়ালের মতই লাফ দিয়ে নামল বিছানা থেকে। বিছানার পাশের মেঝে থেকে হোলস্টার খুলে পিস্তল বের করল রামোন। ধাতব একটা ক্লিক শব্দ শুনতে পেল বেলা। বিস্ফোরণের আলোতে রাতের আকাশ যেন জ্বলছে। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আসা আলোতে রামোনের দিকে তাকাল বেলা। চোখ বরাবর পিস্তল ধরে আকাশের দিকে তাক করে রেখেছে রামোন; যে কোনো মুহূর্তে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত।
এরপরই জানালার বাইরে শনে’র অতিপ্রিয় কণ্ঠস্বর শুনতে পেল বেলা, অন্ধকারে বোনে’র নাম ধরে ডাকছে : “বেলা, কোথায় তুমি?”
জানালার কাছে নড়ে উঠল রামোনের দেহ। গ্রেনেডের আলোয় নিশানা ঠিক করল রামোন। দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠল বেলা : “লুক আউট, শন! ম্যান উইদ আ গান!”
দু’বার গুলি করল রামোন। কিন্তু জানালার কাছ থেকে কোনো প্রতি উত্তর এলো না। বেলা বুঝতে পারল শন্ বেলা আর নিকি’র কথা ভেবে গুলি করার সাহস পাচ্ছে না।
বিছানা থেকে গড়িয়ে নেমেই মেঝেতে হামাগুড়ি দিতে লাগল বেলা। কোনো কিছু না ভেবেই কেবল দরজার দিকে যাচ্ছে। ওকে নিকি’র কাছে পৌঁছাতেই হবে।
মাঝপথেই টের পেল গলা’র উপর পিছন থেকে চেপে বসেছে রামোনের হাত। জোর করে দাঁড় করিয়ে দিল বেলা’কে। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল বেলা : “শন! ও আমাকে ধরে ফেলেছে।”
“কুত্তী” কানের কাছে হিসহিস করে উঠল রামোন, “আমার সাথে চালাকি!” আর তারপরেই গলা উঁচিয়ে শনকে শোনাল, “আমি ওকে মেরে ফেলব! গুলি করে মাথা উড়িয়ে দেব!”
টানতে টানতে বেলা’কে নিয়ে জোর করে সিঁড়ির উপর বসিয়ে দিল রামোন, “আগে বাড়, শয়তানি” হাঁটতে থাক। আমি জানি শন কে। তোকে শিল্ড হিসেবে ধরলেও গুলি করবে না। মুভ!” রামোন গলা টিপে ধরাতে নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হল। কিন্তু বেলা অসহায়। রামোন ওকে ধরে নিকি’র ঘরের দিকে দৌড়াচ্ছে। কমুনিকেশন রুমে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। রাতের আকাশে টাওয়ারের মতো উঁচু হয়ে গেল খড়ের ছাউনির শিখা।
দৌড়ে গিয়ে নিকির ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল মেঝেতে মাঝখানে বসে আছে আদ্রা আর নিকি। নিজের শরীর দিয়ে নিকি’কে ঢেকে রেখেছে আদ্রা।
“পাদ্রে!” ভয়ে আর্তচিৎকার শুরু করল নিকি।
“আদ্রা’র সাথে এসো।” খেঁকিয়ে উঠল রামোন।” ওর কাছেই থাকবে, আমার পিছু পিছু এসো।”
দল বেঁধে ঘর থেকে বের হয়ে কারপার্কের কাছে গেল রামোন। পিছন থেকে বেলা’কে ধরে রেখেছে রামোন আর মুক্ত হাত দিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে রেখেছে পিস্তল। “আমি ওর খুলি উড়িয়ে দেব” নাচতে থাকা তাল গাছের ছায়ার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল রামোন, “সুতরাং দূরেই থাকো।”
“প্লিজ পাদ্রে, মাম্মা’কে মেরো না” ফুঁপিয়ে উঠল নিকি। “চুপ, একদম চুপ!” আবারও খেঁকিয়ে উঠল রামোন। এরপর বলে উঠল, “তোমার কুত্তাগুলোকে ডেকে পাঠাও শন, যদি বোন আর বোনপো’কে মারতে না চাও।”
মুহূর্তখানেক পর অন্ধকার থেকে শোনা গেল শ’নের কণ্ঠস্বর : “হোল্ড ইউর ফায়ার স্কাউটস! ব্যাক অফ স্কাউটস।”
সবাইকে হটিয়ে জিপের কাছে নিয়ে গেল রামোননিঃশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করছে বেলা। কানের কাছে পিস্তলের নল এত ঠেসে বসে গেছে যে নরম চামড়া কেটে গলা অব্ধি রক্ত গড়িয়ে পড়ল।
“প্লিজ। আমি ব্যথা পাচ্ছি’ হাঁপাতে হাঁপাতে কোনো রকমে বলল বেলা।
“মামাকে মেরো না” চিৎকার করেই আদ্রা’র হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিল নিকি ইসাবেলা’র পাশে চলে আসতেই এক মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল আদ্রা।
পেছনের অন্ধকারে জ্বলে উঠল হলুদ আলোর ফুল। বিশ গজ খোলা জায়গা পেরিয়ে ছুটে এলো একটামাত্র বুলেট।
উড়ে গেল আদ্রা’র মাথার একপাশ। দু’হাত ছড়িয়ে পেছন দিকে পড়ে গেল আদ্রা।
“আদ্রা!” চিৎকার করে উঠল নিকি। কিন্তু ও দৌড় দেয়ার আগেই নিকি’রকোমর ধরে ফেলল রামোন।
“না, আদ্রা থাকুক। এখন আমার কাছাকাছি থাকো নিকি।”
ওদের তিনজন ব্যতীত আশেপাশে জীবিত আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জ্বলন্ত দালানের দেয়ালে কাত হয়ে পড়ে আছে এক কিউবান নারী সিগন্যালারের মৃতদেহ; কম্পাউন্ডের গেইটে শুয়ে আছে দু’জন প্যারাট্রুপার।
যদি কোন প্যারাট্রুপার এখনো বেঁচে থাকে সেই আশাতে স্প্যানিশে অর্ডার দিল রামোন; কিন্তু জানে এর সম্ভবনা নেই বললেই চলে। আক্রমণকারীদের সামর্থ্যও ভালোই জানা আছে। ইসাবেলা’র মুখে শোনার সাথে সাথেই ওর ভাইয়ের নাম চিনতে পেরেছে রামোন। স্কাউটদেরকে চিৎকার করে আদেশ দেয়ার সময় শনে’র গলা শুনে আরো নিশ্চিত হয়েছে। এতক্ষণে প্যারাট্রুপাররা নিশ্চয় সব শেষ হয়ে গেছে। সম্ভবত আক্রমণের শুরুতেই প্রাণ হারিয়েছে সকলে।
এরা যে কুখ্যাত ব্যালান্টাইন স্কাউটস্ এতে কোনো সন্দেহই নেই; কিন্তু রামোন অবাক হলো এই ভেবে যে এখানে তারা এলো কেমন করে। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে যে কোনো না কোনোভাবে বেলাই তাদেরকে ডেকে এনেছে। ছায়ার পেছনেই লুকিয়ে আছে স্কাউটেরা, রামোন জানে সামান্যতম সুযোগ পেলেই আদ্রার মতো দ্রুত আর নির্ভুল একটা বুলেট পাঠিয়ে মেরে ফেলবে তাকে।
তাই তার একমাত্র ভরসা হলো সময়। জানে রালেই তাবাকা গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেই এয়ারফিল্ড থেকে রিলীফ গেরিলা সৈন্য নিয়ে রওনা দিয়ে দেবে। কয়েক মিনিটের মাঝেই পৌঁছে যাবে এখানে। সবচেয়ে কাছেই পার্ক করে রাখা তিনটা জিপের কাছে চলল রামোন।
একে এমের সাইটস দিয়ে ওদেরকে দেখছে শন। একটা তাল গাছের নিচে শুয়ে আছে এখন। এই রেঞ্জ থেকে চল্লিশ গজ দূরে কারো খুলিতে দুই ইঞ্চি গর্ত করে দেয়া কোনো ব্যাপারই না অ্যাসল্ট রাইফেলের কাছে। আদ্রার নাক বরাবর নিশানা করে বাম কানে গুলি করেছে। খুলির একপাশ তছনছ করে দিয়ে গেছে শনে’র বুলেট।
কিন্তু রামোন মাচাদোর ক্ষেত্রে এমন নিশ্চিন্তে কিছু করার উপায় নেই। বক্সারের মতো মাথা নিচু করে বেলা আর নিকির আড়ালে হাঁটছে রামোন। তাই ঠিকমতো ওর মাথাই দেখতে পাচ্ছে না শন।
তবে বোনের নগ্ন দেহ দেখে যারপর নাই বিরক্ত। জানে স্কাউটেরাও তাকিয়ে আছে। যুদ্ধের এই জাড়াডোলের ভেতরও রামোন মাচাদো বেলাকে নিজের উলঙ্গ শরীরের সাথে এমনভাবে লেপ্টে ধরে আছে যে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই গুলি করে বসে। একটা শট নিতে চাইলেও বেলা’র কাঁধে মাথা লুকিয়ে জিপে চড়ে বসল রামোন।
কোন মতে ড্রাইভারের সিটে বসেই বেলা আর নিকি’কে টেনে নিল পাশে। গর্জে উঠল ইঞ্জিন, গেইটের কাছে ছুটতেই পেছনের হুইল থেকে ছিটকে উঠল বালির ফোয়ারা। ফায়ার করল শন। কাছাকাছি থাকা পেছনের হুইলের নিকে। লাগল গুলি। ব্যারিয়ার গেইটের কাছে গিয়ে দুলে উঠল জিপ। ধাক্কা লাগাতে উঠে গেল একটা পোল। দুমড়ে মুছড়ে গেল গেইট। ভাঙ্গা আর্বজনা নিয়েও রাস্তায় নেমে এলো জিপ। পেছনে ভাঙ্গা পোল আর তারের বেড়া সান্টার স্নেই গাড়ির মতো ঝুলছে।
লাফ দিয়ে উঠে দ্বিতীয় জিপের দিকে ছুটল শন্। স্কাউটদের চারজনও একইভাবে দৌড়ে এসে গাদাগাদি করে উঠে বসতেই ইঞ্জিন চালু করল শন। বৃত্তাকারে ঘুরে গিয়েই ছুটল ভাঙ্গা গেইটের দিকে। রামোন আর তার বন্দিদের পিছু নিল।
যদি ইসাবেলা’র স্কেচ ম্যাপ সত্যি হয় তাহলে নদী বরাবর এই রাস্তাটা চলে গেছে এয়ারস্ট্রিপের দিকে; সেখানে রোড় ব্লক বসিয়েছে ইসাউ গনডেল।
রাস্তা দিয়ে ধেয়ে আসা যে কোনো গাড়িকে উড়িয়ে দেবে ইসাউ; সেটা যেদিক থেকেই আসুক না কেন। একটা আর পিজি রকেট ইসাবেলা আর তার ছেলেকে মাংসের তাল বানিয়ে ছাড়বে।
হর্ণের গায়ে হাতের তাল চেপে ধরল শন্। আশা করল এত দীর্ঘ হর্ণ শুনে ইসাউ হয়ত বুঝতে পেরে রকেট ছোঁড়া বন্ধ রাখবে। কিন্তু এতটা আশা করতেও ভয় হচ্ছে। গাঁজা খেয়ে শরীর গরম করে আসা স্কাউটদের হাতগুলো নিশপিশ করছে ট্রিগারের উপর।
তাই রামোনদেরকে ওভারটেক করতে হবে। হঠাৎ করেই পথটা ডান দিকে ঘুরে যাওয়ায় গতি ধীর করল শন্।
মোড়ে ঘুরে যেতেই বদলে গেল বাতাসের গতি। একপাশে সরে গেল বালি। মাত্র পঞ্চাশ গজ সামনে দেখা গেল রামোনের জিপের আলো।
সামনের সিটে বসে একহাতে গাড়ি চালাচ্ছে রামোন। অন্য হাত দিয়ে বাঁকিয়ে ধরে রেখেছে বেলা’র কাঁধ। ঘাড়ের সাথে ঝুলছে বেলা’র মাথা। এলোমেলো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে; চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে তীব্র ভয়। চিৎকার করে কিছু একটা বললেও বাতাসের তোড়ে কিছুই শুনতে পেল না রামোন।
ইসাবেলা’র সিট আঁকড়ে ধরে পিছনে বসে আছে নিকি। পরনে সাদা টি-শার্ট আর শটস্। চোখ ঘুরিয়ে বারবার পিছনের জিপের দিকে তাকানোতে মায়ের সাথে ছেলেটার চেহারার এত মিল দেখে অবাক হয়ে গেল শন্। ওদেরকে বিপদে ফেলেছে। যে লোকটা তাকে হাতের কাছে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।
এরপরই খেয়াল করল যা একপাশে কেমন যেন কাৎ হয়ে পড়ছে রামোনের জিপ। পেছনের টায়ার ফুটো করে দিয়েছে ওর গুলি। সাথে করে নিয়ে আসা ভাঙ্গা গেইটের অংশ আর বেড়া থাকায় পথের ধুলা আর বালিতে গতি হয়ে পড়ল আরো ধীর।
দ্রুত ওদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে শন। এবারে সৈকত থেকে দূরে সরে গেছে রাস্তা। ছুটছে খাড়া নদী তীর ধরে। দ্রুতগামী দুটো গাড়ির আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্থির কালো পানি।
কাঁধের উপর দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে মাত্র তিন ফুট দূরে থাকা জিপটাকে দেখল রামোন। সাথে সাথে আবার মাথা নামিয়ে বেলা’কে ছেড়ে দিল। কোলের কাছে থাকা পিস্তল ছোঁ মেরে তুলে শ’নের মাথায় নিশানা করল। রেঞ্জ বারো ফুটেরও কম। কিন্তু এবড়ো খেবড়ো রাস্তাতে দুটো জিপে-ই সমানে ঝুঁকি দিচ্ছে। উইন্ডস্ক্রিনের সাইড পোস্টে লেগে অন্ধকারে হারিয়ে গেল বুলেট।
পাল্টা গুলি করার জন্য রাইফেল তাক করল একজন স্কাউট; কিন্তু ব্যারেল আকাশে তুলে দিল শন।
“হোল্ড ইউর ফায়ার” চিৎকার করে আদেশ দিয়েই ছুটল রামোনের পিছু পিছু।
শনের জিপের গুতো খেতেই দুলে উঠল রামোনের জিপ। শূন্যে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছনের সিটে গিয়ে বাড়ি খেল নিকি।
“জ্যাম্প” ইসাবেলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল শন। কিন্তু বেলা নড়ে উঠার আগেই আবার ওকে ধরে ফেলল রামোন।
আবার এসে রামোনের জিপের পিছনে ধাক্কা দিল শন। টেইল গেইট চুড়মাড় হয়ে যাওয়ায় রাস্তা থেকে খানিক সরে এলো রামোনের জিপ।
এক হাত দিয়ে জিপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রামোন। পেছনদিক পুরোপুরি ঝুলছে। ধুলার মেঘ এসে মনে হল শন’কে অন্ধ করে দিবে। ওদিকে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে বেলা আর পেছনের সিটে উবু হয়ে বসে আছে নিকি। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে চেহারা।
আরেকটা মোড় এসে পড়াতে গাড়ির উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা শুরু করল রামোন। শন দেখল এইই সুযোগ; নিজের গাড়ি নিয়ে রামোনের পাশেই চলে এলো। সেকেন্ড খানেকের জন্য পাশাপাশি ছুটল দুটো গাড়ি।
ছয় ফুট দূরত্বে পরস্পরের দিকে তাকাল রামোন মাচাদো আর শ কোর্টনি। বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো ঝলকে উঠল একে অন্যের প্রতি তীব্র ঘৃণা। এটা এমন এক আদিম অনুভূতি যে প্রতাপশালী দু’জন পুরুষই উপলব্ধি করল যে অপরজনকে মেরে ফেলতে হবে।
হুইলের উপর চাপ দিয়ে বাম দিকে রামোনের জিপের গায়ে নিজের গাড়ি উঠিয়ে দিল শন। একইভাবে পিছিয়ে এসে শন’কে আঘাত করল রামোন। তাল গাছের গুঁড়িতে লাগায় উঠে গেছে রামোনের জিপের পেইন্টওয়াক।
আবারো ইসাবেলাকে ছেড়ে দিল রামোন। ছোঁ মেরে কোলের কাছে পড়ে থাকা পিস্তল তুলে গুলি ছুড়ল শ’নের মুখে। ক্রোধে জ্বলছে রামোনের চেহারা।
কিন্তু একপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্টিয়ারিং হুইল ধরে ফেলল বেলা। রামোন ফায়ার করতেই সর্বশক্তি দিয়ে পিস্তল টেনে ধরল বেলা। রাতের আকাশে উড়ে গেল বুলেট। বিপদজনক গতিতে ঝাঁকি খেল জিপ; ধুপ করে পড়ে গেল নদীর তীরে।
গাড়িটা উধাও হবার আগ পর্যন্ত বেলা আর রামোন’কে দুজনকেই উইন্ডস্ক্রীনের ওপারে দেখতে পেল শন আর পেছনের সিট থেকে নিকির ছোট দেহটা শূন্যে উঠে আবার অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এরপরই জায়গাটা পেরিয়ে এলো শ’নের জিপ। কিন্তু প্রচণ্ড কষ্ট করে ব্রেক কষে গাড়িটার উপর কন্ট্রোল এনে গিয়ার লিভারকে পেছনে ঘোরাল শন্ আর গর্জন করতে করতে পিছিয়ে এলো রামোনের গাড়ির সন্ধানে।
আকাশে এখনো ভাসছে ধূলিকণা, টায়ারের ঘর্ষণে এখনো ডেবে আছে কিনারার মাটি। ড্রাইভারের সিট থেকে লাফ দিয়ে পড়ে তীরের দিকে দৌড় দিল শন। নিচেই নদীতে পড়ে আছে বেলা’র জিপ। ডুবে যাওয়া চাঁদের মতো এখনো দেখা যাচ্ছে হেডলাইটের আলো। পানির একেবারে কিনারে নদীতীরে পড়ে আছে নিকি’র ছোট্ট শরীর।
আস্তে আস্তে নামতে শুরু করল শন। হোঁচট খেতে খেতেও সামলে নিল নিজেকে। বিড়ালের মতো মাটি আঁকড়ে নেমে এলো লং ক্লিন রেসিং ডাইভ দেবার মতো দুরত্ব পর্যন্ত তারপর অলিম্পিক রেসারের মতই পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল শন্।
এক ডুবে একেবারে গভীর পর্যন্ত চলে গেল। পানির নিচে তেমন ভালো দেখা যাচ্ছে না। পানির নিচে জিপের ডুবে যাওয়া দেহের ভেতরে চলে গেল শন। ফুয়েল ট্যাংকের বাতাস পেয়ে তলাতে গিয়ে ঠেকার হাত থেকে বেঁচে গেছে জিপ।
সামনেই লম্বা মতন কী একটা দেখে হাত বাড়াল শন্। ইসাবেলার লম্বা চুলের মুঠি ধরে টেনে ওকে বের করে উপরে নিয়ে এলো। নিচে পড়ে রইল জিপের ধ্বংসস্তূপ।
পানির উপরে উঠে বেলা’কে দুর্বলভাবে নড়ে উঠতে দেখে স্বস্তি পেল শন। নদী তীরে বেলা’কে নামিয়ে দিল। স্কাউটদের একজন আবার তাৎক্ষণিক বুদ্ধি খাঁটিয়ে জিপ চালিয়ে নিয়ে এসেছে একেবারে তীরের ডগায়। ফলে হেডলাইটের আলোতে নিচ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠল।
হামাগুড়ি দিয়ে ভেজা গায়ে নিকি’র কাছে চলে এলো বেলা। ছেলেকে কোলে তুলে নিল। ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল নিকি।
“মাই ফাদার” ফোঁপাতে লাগল নিকি। “মি পাদ্রে!”
হাঁটু পর্যন্ত কাদায় দাঁড়িয়ে নিচের পানির দিকে তাকাল শন্। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে ওখানেই আটকে রেখে দিয়েছে জিপ আর গভীরে হেডলাইট দুটো এখনো জ্বলছে।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও রামোন মাচাদোকে খোঁজার তাগিদ অনুভব করলন শন। ভাল করেই জানে যে এতক্ষণে গেরিলা ক্যাম্প থেকে রওনা হয়ে গেছে বাড়তি সৈন্য। হয়ত মাত্র কয়েক মিনিট মাত্র আছে হাতে। ঘুরে দাঁড়িয়েই বেলা’র কাছে যাবে শন এমন সময় পানির মাঝে কী যেন একটা নড়ে উঠল। তার আর হেডলাইটের আলোর মাঝ দিয়ে যেন চলে গেল গাঢ় একটা ছায়া।
বাস্টার্ড! তীরে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের স্কাউটদেরকে আদেশ দিল শন : “আমার রাইফেলটা দাও।”
একজন সাথে সাথে নেমে এলো। কিন্তু শনের হাতে একে এম দেবার আগেই পানির মাঝে আলোড়ন শুরু হল। বেশ খানিকটা দূরে ভেসে উঠল রামোনের মাথা।
“ধরো ওকে!” গর্জন করে উঠল শন। “বাস্টার্ডটাকে ধরো।”
চোখের উপর লেপ্টে আছে রামোনের চুল। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে চেহারা থেকে গড়িয়ে নামছে জলের ধারা। নদীতীর থেকে একজন স্কাউটের ছোঁড়া গুলি রামোনের মাথার চারপাশ থেকে পানির ফোয়ারা বানিয়ে দিল। গভীরভাবে দম নিয়ে আবার পানির মাঝে ডুবে গেল রামোন।
“বাস্টার্ড! বাস্টার্ড!” চিৎকার করে একে এম টেনে নিল শন। রামোন যেখানে হারিয়ে গেছে সেখানে বুলেট বৃষ্টি সৃষ্টি করল শন্। কিন্তু রামোন মাচাদো’র গায়ে একটাও লাগলো না। উধাও হয়ে গেছে কেজিবি কর্নেল জেনারেল।
আবারো রামোনোর মাথা ভেসে উঠার বৃথা আশা করল শন। ম্যানগ্রোভের বনে রামোনের লুকোবার জায়গার অভাব নেই।
আরেকটা মিনিট কেটে যাবার পর শন্ বুঝতে পারল যে হাওয়া হয়ে গেছে রামোন। নিজের ঘৃণা আর হতাশা চেপে বেলার দিকে তাকাল শন। ভেজা শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে। উইন্ডস্ক্রিনের কাঁচে কেটে গেছে হেয়ারলাইন।
কাঁধ থেকে নিজের ভেজা জার্সি খুলে বোনের গায়ে পরিয়ে দিল শন।
হাত ঢুকাতে ঢুকাতে ফোঁপাতে লাগল বেলা। “রামোনের কী হয়েছে?”
“বাস্টার্ডটা পালিয়ে গেছে।” বেলাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল শন। ‘সময় নষ্ট হচ্ছে, আমাদেরকে এখান থেকে সরে পড়তে হবে।”
মায়ের হাত ছাড়িয়ে পানির দিকে দৌড় দিতে চাইল নিকি, “মাই ফাদার আমি আমার বাবাকে ছেড়ে যাব না।”
এক হাত দিয়ে নিকিকে জাপটে ধরল শন, “কাম অন নিকি?” ঘুরে দাঁড়িয়েই শ’নের কব্জিতে কামড় দিল নিকি।
“ইউ লিটল সোয়াইন” খোলা হাত দিয়ে নিকি’র মাথাকে তুলে ধরল শন। “তোমার এসব ফাজলামো বাদ দাও, বন্ধু।”
কাঁধের উপর বস্তার মতো নিকি’কে ফেলে নিয়ে হাঁটা ধরল শন। ওদিকে নিকি সামনে হাত-পা ছুঁড়ছে। “আমি যাবো না, আমি আমার বাবার সাথে থাকতে চাই।”
ইসাবেলা’র হাত ধরে এগোতে লাগল শন। হঠাৎ করে জিপের চারপাশে আরো কয়েকজনকে দেখে আচমকা বুঝতে পারল না লোকগুলো কারা। বেলা কে ছেড়ে দিয়ে আবার একে এম তুলে নিল শন্।
“হোল্ড ইট, শন” দৌড়ে এসে ওকে শান্ত করতে চাইল ইসাউ। “তুমি আবার কোত্থেকে এলে?”
“আরেকটু হলেই তুমি আমাদের অ্যামবুশের মাঝে পা দিতে।” জানাল ইউ। “আর এক সেকেন্ড এগোলেই পিছনে আর পিজির রকেটের বাড়ি খেতে। আমরা এখানেই ছিলাম।” রাস্তার দিকে ইশারা করল ইসাউ।
“তোমাদের নৌকা কই?”
“নদীতে দুইশ গজ দূর।”
“তোমার লোকগুলোকে নিয়ে এসো-তোমার সাথে আমরাও ফিরে যাবো।” মাথা উঁচু করে তাকাল শন।
“লাইটগুলোকে নিভিয়ে দাও” নিজের একজন লোককে আদেশ দিল ইসাউ। পার্ক করা জিপের গায়ে ঝুঁকে সুইচে হাত লাগাতেই নিভে গেল হেডলাইট।
চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কান পাতল সকলে।
“এয়ারস্ট্রিপের দিক থেকে দ্রুত নেমে আসছে ট্রাক।”
“আরো কয়েকটা বাঞ্চোত” ঘোষণা করল ইসাউ।
“নৌকায় চলো” আদেশ দিল শন।
দল বেঁধে একসঙ্গে এগোল সবাই। একশ গজ যাবার পর হুইসেল দিল ইসাউ; সামনের অন্ধকার থেকে একইভাবে উত্তর পাওয়া গেল। কিন্তু রোড ব্লক দেবার জন্য পথের মাঝখানে টেনে আনা মরা তাল গাছের গুঁড়ির গায়ে পা। বেঁধে হোঁচট খেল শন।
“কাম অন রাস্তা থেকে ডেকে পাঠাল ইউ। “নৌকা এইদিকে।”
কথা বলার মাঝখানেই সামনের গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে হেডলাইটের আলো দেখা গেল। এয়ারস্ট্রিপ থেকে নেমে আসছে পুরো এক কনভয়।
শনের হাতের মাঝে সমানে নড়ছে নিকি। ওকে থামানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে বেলা। “ঠিক আছে নিকি ডার্লিং, এরা সকলে আমাদের বন্ধু। ওরা আমাদেরকে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।”
“এটাই আমার ঘর-আমি বাবাকে চাই। ওরা আদ্রাকে মেরে ফেলেছে। আই হেইট দেইম! আই হেইট ইউ! আই হেইট দেইম!” স্প্যানিশে চিৎকার করে উঠল নিকি।
এবারে রেগে গিয়ে নিকি’কে খুব জোরে ঝাঁকি দিল শন। “আর একটাও যদি কোনো কথা বলে, তোমার ঘাড় থেকে ছোট্ট মাথাটা আলাদা করে দেব কিন্তু।”
“এই পথে এসো।” রোড ব্লক থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এলো ইসাউ। আর পঞ্চাশ গজ গেলেই পৌঁছে যাবে নোঙ্গর করে রাখা নৌকাগুলোর কাছে।
চট করে একবার পিছনে তাকিয়ে রাস্তার মোড়ে পৌঁছে যাওয়া গাড়ি বহরের দিকে তাকাল শন। হেডলাইটের আলো দেখা গেলেও নদীর কিনার শ’দেরকে আড়াল করে রেখেছে। প্রতিটি ট্রাকের পেছনে গাদাগাদি করে থাকা সশস্ত্র লোকগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পেল শন।
সবচেয়ে কাছের বোটে বেলা’কে তুরে দিল শন। পায়ের চারপাশে ঝুলতে থাকা ভেজা জার্সিতে পা বেঁধে উল্টে পড়ে গেল বেলা।
বিরক্তিতে ঘোৎ ঘোৎ করে ওর পাশেই নিকিকে নামিয়ে দিল শন। কিন্তু বড় একটা ভুল করে ফেলল।
রাবার বলের মতো গোল হয়ে শ’নের হাতের নিচ দিয়ে তীরে নেমেই দৌড় দিল নিকি।
“ইউ লিটল ডেভিল” ঘুরে দাঁড়িয়েই ওর পিছু নিল শন্।
“মাই বেবি” কাঁদতে কাঁদতে নৌকা থেকে লাফিয়ে নামল বেলা কাদার ভেতর পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়িয়ে দু’জনের পিছনে দৌড় দিল সেও।
“ফিরে এসো নিকি-ওহ্ প্লিজ ফিরে এসো।”
বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা কনভয়ের দিকে এগোচ্ছে নিকি। খরগোশের মতই আঁকাবাকা হয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে শন’কে। রাস্তা থেকে মাত্র বিশ ফুট দূরে থাকতেই শূন্যে ডাইভ দিয়ে নিকি’র পা ফেলল শন। সেকেন্ডখানেক পরেই ওদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল বেলা।
হেডলাইটের আলো সোজা এসে ওদের উপর পড়লেও ছোট একটা কাটাঝোঁপের আড়ালে শুয়ে থাকায় তিনজনকে দেখতে পেল না প্রথম ট্রাকের সৈন্যরা। আবারো চিৎকার করে বেরিয়ে যেতে চাইল নিকি; কিন্তু এক হাত দিয়ে মুখ চেপে বজ্রমুষ্টিতে ওকে আটকে রাখল শন।
ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল ট্রাক। কিন্তু তাল গাছের গুঁড়ি দেখে বাধ্য হলো রাস্তার মাঝে থেমে যেতে। অন্ধকারে শন বোন আর বোনপো’কে নিয়ে যেখানে লুকিয়ে আছে তা থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে গেরিলা ভর্তি ট্রাক।
নিকি’কে ধরে রেখেই ইসাবেলা’র মুখখানা মাটিতে চেপে ধরল শন। অন্ধকারে এতক্ষণ আয়নার মতই চকচক করছিল ইসাবেলা’র ফর্সা চেহারা।
ট্রাকের ক্যাব থেকে একজন লাফিয়ে নেমে রোড ব্লক দেখে এলো; তারপর চিৎকার করে কোন একটা আদেশ ও দিল। সাথে সাথে কমব্যাট ক্যামোফ্লেজ পরিহিত ডজন খানেক গেরিলা ট্রাক থেকে নেমে গাছের গুঁড়ি ধরে টানাটানি শুরু করে দিল।
একটু পরেই রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যেতেই আদেশ দাতা’র চেহারার উপর পড়া হেড লাইটের আলোতে লোকটাকে দেখে চিনে ফেলল বেলা। এই চেহারা একবার দেখলে কখনো ভুলে যাবার মতো নয়। এই লোকটাকেই সৎ ভাই বেন আফ্রিকার সাথে ভ্যানে বসে থাকতে দেখেছিল বেলা। বেন আর এই লোকটা মিলেই মাইকেল কোর্টনির সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। আর আরেকটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে এতটা সুদর্শন আর কোনো কৃষাঙ্গ তরুণ দেখেনি বেলা। লম্বা-চওড়া রাজকীয় চেহারার অধিকারী যুবক ঠিক একটা শকুনের মতই হিংস্র।
মাথা ঘুরিয়ে এদিকেই তাকাল কৃষাঙ্গ তরুণ আর মনে হল ঠিক বেলার চোখে চোখে তাকিয়ে আছে। আর তারপরই আবার ঘুরে নিজের লোকদের দিকে ফিরে গেল। রাস্তা পরিষ্কার হবার সাথে সাথে ট্রাকে উঠে চলে গেল সকলে।
এরপর বাকি ট্রাকগুলোও একের পর এক চলে গেল বেলা’র সামনে দিয়ে। শেষ জোড়া হেডলাইটের আলো দূরে চলে যেতেই নিকি’কে হাতের নিচে ধরে বেলা’কে তুলে দাঁড় করাল শন। তারপর নিয়ে এলো নদী তীরে।
নৌকাতে উঠেও নিকি’র ঘাড় ছাড়ল না শন। জ্বলন্ত কুড়ে ঘরগুলোর শিখা’র ছায়া পৌঁছে গেছে মেঘের পেট অব্দি। আউটবোর্ড মোটরের শব্দ ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছে চিৎকার আর অটোমেটিক গান ফায়ারের আওয়াজ।
“ওরা কা”কে গুলি করছে?” ভাইয়ের উষ্ণ বুকে আশ্রয় নিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইল বেলা।
“হয়তো ছায়ার দিকে-কিংবা একে অন্যের গায়ে নরম স্বরে হাসল শন।
অনুকূল স্রোত পাওয়াতে দ্রুত হৃদের মুখে পৌঁছে গেল নৌকা বহর। নিজের নাইটস্কোপ লাগিয়ে তীর থেকে ছুটে আসা অপর বহর টাকে দেখতে পেল ইসাউ গনডেল। শৈলশিরার কাছে এসে পাশাপাশি হয়ে গেল দুই দল। তারপর সারি বেঁধে চলল খোলা সমুদ্রে।
মাত্র আধা মাইল দূরেই চকচক করে জ্বলছে হলুদ রঙা ল্যান্সার।
সর্বশেষে বোটের আরোহীরা উপরে উঠে আসার সাথে সাথেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন। খোলা আটলান্টিকের দিকে ছুটল ল্যান্সার।
ইসাউ গনডেলের দিকে তাকাল শন, “এবারে লাভ-লোকসানের হিসাব দাও সার্জেন্টমেজর গনডেল।
“আমরা একজনকে হারিয়েছি মেজর কোর্টনি” স্বাভাবিকভাবেই রিপোর্ট দিল গনডেল, “জেরেমিয় মাসোগা। আমাদের সাথে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি।” স্কাউটেরা কখনো মত সঙ্গীকে ফেলে আসে না।
সেই চির পরিচিত শূন্য হয়ে যাবার, অনুভূতিটা বোধ করল শন; আরেকটা ভালো মানুষ চলে গেল। জেরেমিয়ের বয়স ছিল মাত্র উনিশ। ওকে সেকেন্ড স্ট্রাইপ দেয়ার ব্যাপারে এরই মাঝে মনস্থির করে ফেলেছিল শন। কিন্তু সে সুযোগ আর পাওয়া গেল না। কেন যে কদিন আগেই করল না কাজটা। মৃতদের কাছে তো ক্ষমা চাইবারও কোনো সুযোগ নেই। “তিনজন আহত; তবে এতটা ব্যথা পায়নি যে আজ রাতের পার্টি মিস করবে।”
“রেফ্রিজারেটেড হোন্ডে জেরেমিয়’কে রেখে দাও।” আদেশ দিল শন। “কেপ টাউনে পৌঁছাবার সাথে সাথেই ওকে ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় জেরেমিয়কে সমাহিত করা হবে।”
টেবিল বে থেকে দুইশ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকতেই শন, ইসাবেলা আর নিকি’কে তুলে নেবার জন্য কোর্টনি হেলিকপ্টার পাঠালেন সেনটেইন কোর্টনি। গ্রেট-গ্র্যান্ডসনকে দেখার জন্য বুড়ি’র কিছুতেই তর সইছে না।
***