অনেকক্ষণ ঘুমের প্রতীক্ষায় নিশ্চল হয়ে-থাকার পর মুহাম্মদ মুস্তফা উঠে পড়ে। ঘরের কোণে সুরাহি থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢক্ করে তা নিঃশেষ করে গ্লাসটি দেয়ালের পাশে ছোট একটি টেবিলে রেখে তার ওপর অকারণে তবারক ভুইঞার স্ত্রীর হাতে তৈরি পুঁতি ঝোলানো জালিটি রাখে, পুঁতিগুলি গ্লাসের গায়ে বাড়ি খেয়ে একটু বেজে ওঠে। হয়তো সে-অস্কুট ঝঙ্কার তাকে কী একটি কথা মনে করিয়ে দেয় সহসা। আলোর তেজ বাড়িয়ে সে বিছানায় ফিরে আসে এবং মশারির ভেতর থেকে পুঁতি ঝোলানো জালিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। জালিটির প্রান্তদেশ ঢেউ-খেলানো, যার ধার দিয়ে সবুজ সুতার রেখা; সেখান থেকে পুঁতিগুলি ঝোলে। জালিটি যে সযত্নে তৈরি করেছে তার কথা মুহাম্মদ মুস্তফা ভাবতে চেষ্টা করে, তবে যাকে দেখে নি তার বিষয়ে বেশি ভাবা সম্ভব হয় না। হয়তো একজোড়া কার্যনিযুক্ত হাত দেখতে পায় যে-হাত কোনো নির্দিষ্ট মানুষের নয়, হয়তো একটা ইচ্ছা বা একাগ্রতাও অনুভব করে কিন্তু সে ইচ্ছা বা একাগ্রতা কোনো বিশেষ আকার ধারণ করে না। তাছাড়া জালিটি যে তৈরি করেছিল তার মুখ নয়, আরেকজনের মুখই সে দেখতে পায়। মুখটি তবারক ভুইঞার; তবারক ভুইঞাই জালিটি বহন করে এনে তাকে দিয়েছিল। তেমন কিছু না, ক্ষুদ্র একটি উপহার, শ্রদ্ধা-সম্মানের যৎকিঞ্চিৎ নিদর্শন, সহৃদয়তার প্রমাণ। তাছাড়া তখন মুহাম্মদ মুস্তফা বেশ জ্বরে পড়েছে। আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবহীন অবিবাহিত নিঃসঙ্গ প্রতিবেশী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সেবাযত্বের ইচ্ছাটি স্বাভাবিকভাবেই জাগে। বিছানার পাশে পানি থাকলে রোগীর সুবিধা হয়, জালি ঢাকা পাত্রে কীটপতঙ্গ পড়ে না-এই মনে করে সেটি সে এনে দিয়েছিল। জিনিসটাই-বা কী! মণিমুক্তা নয়, পুঁতির মালা দিয়ে ঘেরা হাতের তালুর আকারের একটি জালি যা তৈরি করতে আধমণ সুতার প্রয়োজন হয় নি। ইতিমধ্যে মুহাম্মদ মুস্তফা এ-কথাও বুঝে নিয়েছিল যে একটি শহরের হাকিম হলে তাকে অনেক লোক অনেক কিছু দিতে চায়। এ-সবের পেছনে কখনো মোসাহেবি তোষামুদির ভাব বা মতলব-দুরভিসন্ধি থাকে, কখনো থাকে না : কেউ সরলচিত্তে নিঃস্বার্থভাবে পদমর্যাদার প্রতি সম্মান দেখায়, কেউ-বা শুধুমাত্র সামাজিক প্রথা পালন করে; হাকিম হলেও বর্তমানে সে কুমুরডাঙ্গার সমাজের একজন। কারো বাড়িতে গ্রাম থেকে ঝুড়িভরা আম লিচু এসেছে, কারো ঘরে ছেলের খাত্না উপলক্ষে মিঠাই-মণ্ডা তৈরি হয়েছে, কেউ আবার বিশেষ কোনো কারণে গরু-বকরি জবাই করেছ-এ-সব বাড়ি-বাড়ি বিতরণ করা সামাজিক প্রথা। সুখে-দুঃখে একটি মানুষ আরেকটি মানুষকে স্মরণ করে-এই তো সমাজ। তাই ক্ষুদ্র জালিটির মধ্যে সে অন্যায়জনক কিছু দেখতে পায় নি। তবে এখন পুঁতির মালা দিয়ে ঘেরা জালিটির দিকে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে মুহাম্মদ মুস্তফার মনশ্চক্ষে যে-মুখটি জেগে ওঠে সে-মুখটি হাসিখুশি সলচিত্ত সহৃদয় তবারক ভুইঞার হলেও সহসা একটি কথা তার মনে আসে : তার সুখ-সুবিধার জন্যে লোকটির এত উদ্বিগ্নতা সেবা-যত্নের জন্যে এত তৎপরতা-এ-সবের পশ্চাতে যেন গূঢ় অভিসন্ধি। সে যেন কিছু জানতে চায়, সরলতা সহৃদয়তার মধ্যেও কোথাও এক জোড়া চোখ সর্বক্ষণ তার ওপর নিবদ্ধ যে-চোখ তার অন্তরটা তছনছ করে খুঁজে দেখে। তার মধ্যে কী সে সন্ধান করে এমন করে? নিঃসন্দেহে সে দেখতে চায় মুহাম্মদ মুস্তফা বাড়ির লোকেদের কথা বিশ্বাস করেছে কিনা, এ-কথা মেনে নিয়েছে কিনা যে খোদেজা আত্মহত্যাই করেছিল, তারপর তার মনে অনুতাপ-অনুশোচনা দেখা দিয়েছে কিনা।
সে-রাতে সর্বপ্রথম তবারক ভুইঞার মনোভাব তাকে ভয়ানকভাবে ভাবিত করে, একটি অনাত্মীয় মানুষকে ঘরের কথা বলেছে বলে নিজের ওপর রাগও হয় তার। কেন বলেছিল কথাটি, বললার দরকারই-বা কী ছিল? মনে হয় মুখ থেকে এমনিই বেরিয়ে এসেছিল, পশ্চাতে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তবে সেটি সত্য নয়, ঠিক এমনিতে বেরিয়ে আসে নি, জ্বরঘোরে বলে থাকলেও বিলাপ বকেছিল তা নয়, যদিও জ্বরে না পড়লে হয়তো বলতে পারত না। বলেছিল এই জন্যে যে সমস্ত ব্যাপার শোনার পর তবারক ভুইঞা কী বলে তা জানার ইচ্ছা হয়েছিল হঠাৎ। সে বাড়ির লোক নয়, এ ধারে ও-ধারে কোনোদিকে তার টান নেই, নিঃসন্দেহে সে নিরপেক্ষ মত দেবে। মতটি যে কী হবে-সে-বিষয়েও তার সন্দেহ ছিল না, কারণ তার মনে হয়েছিল নিমেষের মধ্যেই কী সত্য কী অসত্য তা সে স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে। কিন্তু তা হয় নি, সব শুনেও সে বাড়ির লোকেদের পক্ষ নিয়েছে। কেন? সত্যের চেয়ে অসত্যের শক্তি কি বেশি?
তবারক ভুইঞার মনোভাব তার নিকট সর্বযুক্তিবিরুদ্ধ বলে মনে হয়। বাড়ির লোকেদের নিতান্ত ভিত্তিহীন কথাটি কেন তার বিশ্বাস হবে? অথচ সব কিছুই সে শুনেছে; সে তাকে সব কিছু খুলে বলেছে, কিছু ঢেকে রাখে নি। সে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলেছে কেন বাড়ির লোকেদের ধারণাটি সত্য হতে পারে না, কেন খোদেজার পক্ষে আত্মহত্যা করা সম্ভব নয়। মানুষ কত কথা বলে-দায়িত্বহীন কথা, উদ্ভট অবান্তর কথা। যা প্রথমে সুনিয়ন্ত্রিত ধারার মতো শুরু হয় তা-ও এক সময়ে সহসা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বন্যার পানির মতো দু-কূল ছাপিয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, সত্যের ক্ষেত্র ছেড়ে অসত্যের ক্ষেত্রে চলে যায়, বাস্তবের যুক্তিসঙ্গত সীমানা ত্যাগ করে অবাস্তবের উচ্ছল অর্থহীনতার মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে; প্রথমে গুঁড়ি বেয়ে শাখায় ওঠে, তারপর এ-শাখা থেকে সে-শাখা এ-ডাল থেকে সে-ডাল করে আচম্বিতে লাফিয়ে অন্য গাছে চলে যায়। মানষের কথা কোণাকুণিভাবে চলে, ছোটে তির্যকগতিতে, যেহেতু শীঘ্র যাত্রার উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে বা উদ্দেশ্যটি আর দেখতে পায় না সেহেতু কোথাও পৌঁছুতে পারে না এবং পৌঁছুতে পারে না বলে থামতেও পারে না : মানুষের কথায় যতি নেই। বিষয়বস্তু যা-ই হোক, মানুষ তার নিজের কথার বানে ভেসে যায়, কোনো ঘাটে পৌঁছুলেও কোথাও পৌঁছায় না, কারণ যেখানে থামে সেটি তার গন্তব্যস্থল নয়।
তবারক ভুইঞা কিছু বোঝে নি। কেন বোঝে নি?
তবে শেষরাতের দিকে মুহাম্মদ মুস্তফা তন্দ্রার মতো বোধ করে এবং তার অর্ধঘুমন্ত মনে অকস্মাৎ একটি প্রশ্ন দেখা দেয় : হয়তো তবারক ভুইঞা বাড়ির লোকেদের কথা বিশ্বাস করেছে কারণ সেটিই সত্য, খোদেজা আত্মহত্যাই করেছিল। চমকিত হয়ে জেগে উঠলে সহসা সে শুনতে পায় পাখির কলতান করতে শুরু করেছ। কিন্তু তা যে পাখিরই কলতান তা তার বিস্ময়াভিভূত মনে অনেকক্ষণ বুঝতে পারে নি।
তবারক ভুইঞা তখনো বিচিত্র কান্নার কথাই বলছিল। সে বলছিল, তার মতো অনেকেই ভেবেছিল কান্নাটি কানের ভুল বা কোনোরকমের খেয়াল হবে কিন্তু সে-কান্না যারা শুনতে পায় তাদের সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকে তেমনি কান্নার আওয়াজও দিনদিন স্পষ্টতর, উচ্চতর হয়ে ওঠে। একদিন উকিল কফিলউদ্দিন আর চুপ করে থাকতে পারে। প্রথমে কথাটি কানে তোলে নি; আজে-বাজে কথা সহজে সে কানে তোলে না। তাছাড়া স্টিমারের সর্বশেষ চিহ্ন অদৃশ্য হয়ে যাবার পর সহসা সে এমন একটি গভীর নিরাশায় সমাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে অন্যান্য কথায় মন দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় নি; ক দিন সে কেমন নিস্পৃহ নিস্তেজ হয়ে থাকে, মুখে-চোখে বার্ধক্যের এবং পরাজয়ের গভীর শ্রান্তি।
বিচিত্র কথাটি সম্যকভাবে বুঝতে পারলে সে প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে। শহরের লোকেরা কি মতিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তারপর হঠাৎ তার মনে একটা সন্দেহ দেখা দেয়। ওটা স্টিমারের লোকেদের কারসাজি নয় তো? যতই ভেবে দেখে ততই সন্দেহটা ঘনীভূত হয়। হয়তো তারা ধ্বনি-বিবর্ধক যন্ত্রের সাহায্যে কোনো গুপ্তস্থান থেকে একটা কান্নার শব্দ চতুর্দিকে ব্যাপ্ত করার ব্যবস্থা করেছে। যন্ত্রট না হলেও হয়তো ঘুষ দিয়ে কাউকে সে-কাজে লাগিয়েছে। তারা কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের বিশ্বাস করাতে চায় যে বাকাল নদীটি সত্যই মরতে বসেছে এবং সে-জন্যে ঘাট তুলতে তারা বাধ্য হয়েছে, তারা নির্দোষ।
গম্ভীর কণ্ঠে উকিল কফিলউদ্দিন বার-লাইব্রেরিতে ঘোষণা করে, ওদেরই কাজ হবে। তারা হাড়ে-হাড়ে শয়তান, নেমকহারামের দল।
স্টিমারের লোকেরা কান্নার জন্যে দায়ী তা কেউ বিশ্বাস করেছিল কিনা কে জানে, তবে সেটা যে কোনো মানষের দুষ্টামি নয় সে-বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য স্বয়ং দারোগার নেতৃত্বে একদল লোক শহরের অলিগলি ঝোপঝাপ তন্ন তন্ন করে তালাশ করে দেখেছিল, কিন্তু কোথাও কিছু খুঁজে পায় নি।
এবার শহরের মোল্লা-মৌলভিরাও কান্নার বিষয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে শুরু করে। আজগুবি কথাটি যেন সর্বমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। খোদার দুনিয়ায় নানা প্রকারের শব্দ হয়, কিন্তু সে-সব শব্দ কারো অজানা নেই, কেয়ামতের সময় যে-ভীষণ আওয়াজ একদিন সবাই শুনতে পাবে তা তাদের ভয়ানকভাবে ভীত করলেও বিস্মিত করবে না কারণ তার কথাও কেতাবে লিখিত। বস্তুত, খোদার দুনিয়ায় রহস্যের অন্ত না থাকলেও সে-রহস্যের আবার সীমা রয়েছে এবং যেখানে সে-সীমারেখা অতিক্রান্ত হয় সেখানে যা ন্যায্য বা সঙ্গত, জায়েজ বা অনুমোদিত-সে-সবেরও শেষ হয়। মানুষ যে-কান্নার সাহায্যে তার শোক-দুঃখ প্রকাশ করে থাকে, সে-কান্নার অনুরূপ যে-শব্দ শোনা যায় তার অর্থ কী, কোত্থেকেই-বা তা আসে? কিছু সভা-মজলিস আলাপ-আলোচনার পর তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে কান্নাটি শয়তানের কারসাজি হবে : শয়তান বহুরূপী। তারা স্থির করে কিছু একটা করতেই হবে যাতে কান্নাটির হাত থেকে কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা মুক্তি পায়। তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে ক্ষীণতম দ্বিধাও দূর হয় তাদের মন থেকে যখন তোবারক আলী মুন্সীর ঘোর পর্দানশীন স্ত্রী জয়নাব খাতুনের বিস্ময়কর আচরণের খবর শুনতে পায়। যে-জয়নাব খাতুন জীবনে কখনো বাইরের দরজার চৌকাঠ অতিক্রম করে নি সে-ই নাকি মধ্যরাতে বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মন্ত্রমুগ্ধ মানুষের মতো নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। মোল্লা-মৌলভিরা এবার রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়ে, আর বিলম্ব করে না। তারা শহরের বিভিন্ন স্থানে আজানের ব্যবস্থা করে যাতে তার আওয়াজ শহরের সর্বত্র পৌঁছায়, প্রত্যেক শহরবাসীর কর্ণগোচর হয়। সঙ্গে-সঙ্গে মিলাদ পড়ানো বা ছদকা শিরনি দেয়ার ব্যবস্থা করে। একদিন রাতে মসজিদে অনেক রাত পর্যন্ত বিশেষ নামাজেরও আয়োজন করে। তাতে শরিক হলে বিচিত্র কান্নার আওয়াজ বন্ধ হবে-এই বিশ্বাসে অসংখ্য লোক জড়ো হয় মসজিদে, অনেক রাত পর্যন্ত নামাজিদের সমবেত বলিষ্ঠ কণ্ঠধ্বনিতে রাতের আকাশ খণ্ডবিখণ্ড হয়।
তবে এসবের কোনো ফল হয় নি, এমনকি সেদিন রাতে নামাজে মগ্ন লোকেরাও দুর্বোধ্য, অত্যাশ্চর্য কান্নাটি ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি, প্রবল ঢেউয়ের মতো তা বার-বার এসে তাদের হৃদয়-তটে আছড়ে পড়েছিল। বিস্ময়-বিমূঢ় একজন নামাজি বলেছিল, এত মানুষের কণ্ঠধ্বনিও সে আওয়াজ ঢেকে রাখতে পারে নি।
নিঃসন্দেহে কোথাও কে যেন কাঁদে-তা কি আর অবিশ্বাস করা যায়? অবিশ্বাসটি ধীরে-ধীরে কমজোর হয়ে ওঠে, অবিশ্বাসীদের কণ্ঠস্বর সন্দেহের দোলায় দুর্বল হয়ে পড়ে, কেউ-কেউ আবার তা নীরবেই সহ্য করতে শুরু করে যেমন দুঃখকষ্টে মতিভ্রষ্ট মানুষের যুক্তিহীন বিলাপ অসহ্য মনে হলেও অনেকে নীরবে সহ্য না করে পারে না। হয়তো তাদের মনে হয়, রহস্যময় দুনিয়ার সব কিছু তারা জানে না। হয়তো সমস্ত যুক্তির বিরুদ্ধে সব মানুষের মনে একটি আশা লুকিয়ে থাকে যে হঠাৎ একদিন অলৌকিক কিছু দেখতে বা শুনতে পাবে; সে-আশাটিই হঠাৎ জেগে ওঠে। কাল্পনিক খাদ্যে মানুষের যেমন পেট ভরে না, তেমনি যা ধরতে পারে না ছুঁতে পারে না চোখ দিয়ে দেখতে সক্ষম হয় না-তাতে বিশ্বাস রেখেও মানুষের চিত্ত ভরে না।
যে-কান্না এত মানুষ শুনতে পায় সে-কান্নার কথা সত্যি অবিশ্বাস করা আর সম্ভব নয়; সে-কান্না সত্যের রূপই গ্রহণ করে-এমন একটি সত্য যা ব্যাখ্যা করা যায় না। অবিশ্বাস করা যায় না বলে ভয়টিও বাড়ে, মনের গভীর আশঙ্কাটি ঘনীভূত হয়। কে কাঁদে? মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে সকিনা খাতুন যে-বিস্ময়কর কথাটি বলেছিল তা সবাই যথা সময়ে শুনতে পেয়েছিল, কিন্তু তা কী করে সম্ভব হয়, নদী কী করে কাঁদে? এমন কথা বিশ্বাস্য কি অবিশ্বাস্য তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলাই নিছক বোকামির মতো মনে হয়। মানুষের মতো যৌবনকাল, তারপর প্রৌঢ়বয়স বার্ধক্য অতিক্রম করে একটি নদী মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে কিন্তু মানুষের মতো কাঁদবার ক্ষমতা রাখে না, ব্যথা, বেদনা প্রকাশ করতে পারে না, মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত হলেও ক্ষীণতম প্রতিবাদ জানাতে পারে না, যে-দুটি তীরের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করেছে অবিচ্ছিন্ন একাত্ম ঘনিষ্ঠতায় সে-দুটি তীরের দিকে তাকিয়ে বিদায়কালে অস্ফুট নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারে না; নদীর পক্ষে কাঁদা সত্যি সম্ভব নয়। কিন্তু কে কাঁদে, কোথায় সে-কান্নার উৎপত্তি, কোন ব্যথাক্লিষ্ট বিদ্যমান হৃদয় থেকেই-বা তা ধ্বনিত হয়? এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে বুকের ভেতরটা শীতল হয়েই-বা ওঠে কেন? তা যদি শয়তানের কারসাজি হয়ে থাকে তবে খোদার নামও তার বিচিত্র ধ্বনি স্তব্ধ করতে পারে নি কেন? একদিন কারো মনে ভয়ঙ্কর একটি কথা এসে দেখা দেয়। প্রথমে মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় নি, অবশেষে সহ্য করতে না পারলে সে বলেই ফেলে। বিস্ফারিত নেত্রে অস্ফুটকণ্ঠে বলে, হয়তো খোদাই কাঁদেন তার বান্দার জন্যে। কিন্তু তেমন কথাতেই-বা কেউ শান্তি পাবে কেন? যিনি বিশ্বচরাচর চাঁদ সূর্য তারা পাহাড়-পর্বত সাগর-সমুদ্র সৃষ্টি করেছেন, তিনিই যদি কাঁদতে শুরু করেন তবে মানুষের কী হবে, কোথায়-বা সে শক্তি পাবে?
হয়তো সকিনা খাতুনের বিচিত্র কথাটি বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না শেষপর্যন্ত। যে-প্রশ্নের উত্তর পায় না, দুর্বোধ্য কান্নার চেয়ে সে-প্রশ্নই অবশেষে তাদের নিকট অধিকতর ভয়জনক মনে হতে শুরু করে, তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার অন্য কোনো পথ তারা দেখতে পায় না, এবং মরিয়া হয়ে তারা অসম্ভব কথাটিই গ্রহণ করে : নদী কাঁদে, যে-কান্না শুনতে পায় তারা সে-কান্না মরণানুষ নদীর বেদনার্ত শোকাচ্ছন্ন অন্তর থেকেই জাগে। এমন একটি কথা বিশ্বাস করা দোষণীয় হতে যাবে কেন? মানুষ কত কিছুতে বিশ্বাস করে, প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও কত কিছু বিনাপ্রশ্নে সত্য বলে গ্রহণ করে। বিশ্বাসের সীমা-সীমান্ত নেই।
মোক্তার মোছলেউদ্দিনের মেয়ে ঠিকই বলে। কে আর কাঁদবে, নদীই কাঁদে। নদী মরতে বসেছে না? কাছারি-আদালতের সামনে অশ্বখগাছের ছায়ায় চা-এর দোকানের সামনে একটি টুলে বসে টাউট মনিরুদ্দিন সহসা অনেকটা আপন মনে বলে ওঠে। পেটের দায়ে টাউটগিরি করলেও লোকটি পরহেজগার মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, দিন গুণে রোজা রাখে। কথাটি স্বাভাবিকভাবে বলে এবং শোনামাত্র স্বাভাবিক মনে হয়। তাইতো, কে আর কাঁদবে অমনভাবে? এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে বাকাল নদীটি মরতে বসেছে। মরণোন্মুখ নদীটিই কাঁদে রাতদিন। এই সাধারণ কথা এতদিন তারা বিশ্বাস করতে চায় নি কেন?
যে-প্রশ্ন কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের মনে অজানা ভয়ের সৃষ্টি করত তার একটি উত্তর পেয়ে তারা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, সহসা তাদের মনে হয় যে-বিচিত্র কান্নাটি তারা শুনতে পায় তার পশ্চাতে ভয়াবহ কিছু নেই। যে-নদীর দিকে কখনো তাকায় নি সে-নদী এবার তার অশ্রুতে তাদের অন্তর ভাসিয়ে দেয় প্রবল বন্যার মতো, মনে-প্রাণে যে-গভীর স্বস্তি বোধ করে তা নদীর ব্যথায় আর্দ্র হয়ে ওঠে, অকস্মাৎ তাদের এ-ও মনে হয় তারা এমনই একটি দুঃখের সম্মুখীন হয়েছে যার তুলনায় মানুষের দুঃখ নিতান্ত তুচ্ছ: যে-নদী দীর্ঘপথ অতিক্রম করে সময়-কাল উপেক্ষা করে যুগযুগ ধরে প্রবাহিত হয়েছে সে-নদীর ব্যথা-বেদনার সামনে মানুষের নিদারুণ দুঃখও এক ফোঁটা অশ্রুমাত্র, একটি অশ্রাব্যপ্রায় দীর্ঘশ্বাস কেবল।
এবার আরেকটি বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটে। যে-কান্নার শব্দ এক সময়ে তাদের ভয়ানক ভীত করত সে-শব্দেই তারা অপরূপ ভাববেগে অভিভূত হয়ে পড়তে শুরু করে।
একদিন দর্জি করিম বক্স বেশ রাত করে লণ্ঠনের আলোয় পুরাতন সেলাই-এর কলে ঘর ঘর আওয়াজ তুলে সীবনকর্মে নিয়োজিত ছিল এমন সময়ে তার মনে হয় কোথাও যেন একটি বাণবিদ্ধ পাখি তীক্ষ্মস্বরে আর্তনাদ করছে। সেলাই-কাজ বন্ধ করে সে মনোযোগ দিয়ে শোনে, কারণ আওয়াজটি যে পাখির আর্তনাদ নয় তা বুঝতে তার দেরি হয় না। আওয়াজটি অবশেষে থামে, আহত পাখিটি যেন ডানা মেলে উড়ে গিয়ে দূর আকাশে চলে যায়। তার রেশটি কানের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে কি অমনি অত্যাশ্চর্য ধরনের অনুভূতিতে দর্জি করিম বক্সের মন-প্রাণ আপ্লুত হয়ে পড়ে। তার মনে হয়, দীর্ঘদিনের নির্বষণের ফলে শুষ্ক উত্তপ্ত হয়ে-ওঠা জমির মতো প্রাণে স্নিগ্ধশীতল পানি। এসে পৌঁছেছে যে-পানি ধীরে-ধীরে সমগ্র অন্তরে প্রবাহিত হয়ে তৃষ্ণা তো দূর করছেই, সমস্ত ময়লা-আবর্জনাও ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে কুচিন্তা হিংসাবিদ্বেষ ক্ষোভদুঃখ আফসোস।
যা শুনতে চাইত না, শুনলে ভয় পেত, তা-ই শুনবার জন্যে কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা অধীর হয়ে ওঠে সহসা। এমনকি, অনেকের কাছে তা শুনতে পাওয়া এটি পরম সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে হয় এবং অধীরচিত্তে শুনবার জন্যে অপেক্ষা করার পরও কিছু শুনতে না পেলে তাদের এই ধারণা হয় যে কোনো অজানা কারণে তা শোনার যোগ্য নয় তারা। অনেকে আবার তা শোনে নি স্বীকার করতে লজ্জা বোধ করে বলে শুনছে বলেই দাবি জানাতে শুরু করে বিবরণে কিছু রঙ লাগিয়ে; তাদের ভয় হয় অলঙ্কারশূন্য সংক্ষিপ্ত বিবরণে দাবিটির সত্যতা সম্বন্ধে শ্রোতার মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। ফলে বিচিত্র কান্নার রূপ যেমন ক্রমশ বিচিত্রতর হয়ে ওঠে। তেমনি কে শুনেছে কে শোনে নি-এ-বিষয়ে আর নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে কারো দাবি সত্য নয় মনে হলেও কেউ প্রশ্ন করে নাঃ কান্নাটি যেন এমনই এক স্তরে উপনীত হয়েছে যেখানে মানুষের বিশ্বাস অসীমের সঙ্গে মিশে যায়, দিকচক্রবাল পেরিয়ে নিয়ে অজানার সন্ধান করে কিন্তু পশ্চাতে দৃষ্টি দেয় না। বস্তুত কান্নাটি এক রকমের বিশ্বাসে পরিণত হয়; বিশ্বাসীর বিশ্বাসে সন্দেহ বা প্রশ্নের অবকাশ থাকে না।
নদীর দিক থেকে কী-একটা কান্না শুনতে পায়-তা কল্পনা হোক, কোনো প্রকারের ভ্রম হোক, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে এ-সময়ে শহরবাসীদের মধ্যে একটি বিষয় পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। দারোগা-পুলিশ হাকিম-সুবারা পরিবর্তনটি লক্ষ্য করেছিল, লক্ষ্য করে গভীরভাবে বিস্মিতও হয়েছিল, কারণ এ-সময়ে চুরি-ডাকাতি কমে গিয়েছিল, কাছারি-আদালতের সামনে ঘাঘু মামলাবাজদের ভিড়টাও পাতলা হয়ে উঠেছিল, এমন কি দু-একজন লোক সহসা বিপক্ষদলকে ক্ষমা করে বহুদিনের পুরানো মামলা পর্যন্ত তুলে নিয়েছিল। শত্রুরা তাদের শত্রুতা ভুলে গিয়েছিল, মানুষের মধ্যে অচিন্তনীয় ধরনের স্নেহপ্রীতি উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল বা লম্বট-চরিত্র মানুষের দুরাত্মপনায় ভাটা পড়েছিল-এ-সব সত্য, কল্পনা নয়। এ-সময়ে মানুষেরা সুখের কথাও ভাবতে পারে নি। দু-একটি পরিবার তাদের সন্তানসন্ততির বিয়ের পাকা ব্যবস্থা পর্যন্ত ভেঙ্গে দিয়েছিল এই বিশ্বাসে যে নদীর দুঃখের সময়ে সন্তানসন্তুটির সুখের কথা ভাবা অন্যায়।
এ-সব সত্যিই ঘটেছিল, তবারক ভুইঞা বলে।
মুহাম্মদ মুস্তফার কী হয়েছিল জানি না। হয়তো বাড়ির লোকেরা যা বলেছিল তা বিষের মতো দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ধীরে-ধীরে তার বুদ্ধিমত্তা, বিবেচনাশক্তি দুর্বল করে ফেলেছিল, হয়তো শত সাক্ষ্যপ্রমাণ সত্ত্বেও কোনো বিষয়ে মানুষ সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতে পারে না বলে দশজন যা বলেছিল তাই অবশেষে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল সে। অথবা খোদেজা নয়, অন্য কোনো কারণ ছিল যা তার অতীত জীবনের গহ্বরে লুক্কায়িত ছিল। এবং যা সে-ও বোঝে নি, আমিও বুঝি নি। কারণ যাই হোক, নানা অকাট্য যুক্তি দিয়ে গঠিত সুরক্ষিত যে-বাধের সাহায্যে বাড়ির লোকদের ভিত্তিহীন ধারণাটি ঠেকিয়ে রেখেছিল তা তারই অগোচরে ক্রমশ হীনবল হয়ে উঠে থাকবে এবং তবারক ভুইঞার ন্যায় নেহাৎ পরিচিত একটি লোকও বাড়ির লোকেদের মত পোষণ করে এই ধারণা হলে বালুর তৈরি জিনিসের মতো সেটি অতি সহজে ধসে পড়ে : যা এতদিন একেবারে অসত্য মনে হয়েছিল তাই সহসা মুহাম্মদ মুস্তফার চোখে অবিসংবাদিত সত্যের রূপ গ্রহণ করে।
খোদেজা আত্মহত্যা করেছিল-তা আমি কখনো বিশ্বাস করি নি। এ-কথা সত্য যে মেজো চাচা খেদমতুল্লা একদিন একটি ওয়াদা করেছিল, কিন্তু মানুষ কত সময়ে কত কিছু-না ওয়াদা করে। করে, কারণ সামনের পথ সে দেখতে পায় না, জানে না অদৃশ্য ভবিষ্যতে কার জীবন কী রূপ নেবে, কোন খাতে প্রবাহিত হবে। কল্পনায় সুদূর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল দেখালেও সে-ভবিষ্যতের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না, খুরধার স্রোতের বিরুদ্ধে যেতে-থাকা নৌকা যেমন হঠাৎ পেছন-মুখো হয়ে ঘুরে যায় তেমনি তার দৃষ্টি পশ্চাতের দিকে ফিরে আসে। ততদিনে খেদমতুল্লার মনে ছেলের বিষয়ে একটি উচ্চাশা দেখা দিয়ে থাকলেও তার পক্ষে ভবিষ্যৎটি পরিষ্কারভাবে দেখা সম্ভব ছিল না, সে ভাবতে পারে নি যে বাড়ির অন্যান্য ছেলেদের মতো মুহাম্মদ মুস্তফা গ্রাম্যজীবনের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সত্যিই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না। তেমনটা কি অসম্ভব ছিল? আমার বড় ভাই সোনা মিঞা কী করেছে? চাঁদবরণঘাটে গিয়ে মুড়িমুড়কির দোকান দিয়েছে। সে মুহাম্মদ মুস্তফারই সমবয়সী। ছোট চাচার একমাত্র সন্তান এবং নয়নের মণি হাতেম অলস বাপের পদাঙ্কনুসরণ করে জাত-আসেতে পরিণত হয়েছে, অন্নচিন্তাও তার কাছে শ্রমবাধ্য মনে হয়। আমিও অসময়ে পড়াশুনা বন্ধ করতে বাধ্য হই, যদিও দুই ক্রোশ হেঁটে পুকুরের ধারে দি মোসলেম খান হাই স্কুল নামক বিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বছর যাতায়াত করেছিলাম এবং আরেকবার চেষ্টা করলে হয়তো ম্যাট্রিক পাস দিতে পারতাম। ইচ্ছা ছিল, হয়ে ওঠে নি। মনে হয় দরিদ্র পরিবারে যাদের জন্ম তাদের জন্যে আর্থিক বিপত্তির চেয়ে আরেকটি জিনিস বিষম অন্তরায় সৃষ্টি করে। সেটি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে পশ্চাতে ফেলে যাওয়ার বিষয়ে দ্বিধা। জন্মদাতা যা পড়ে নি বা দেখে শোনে নি তা পড়তে বা দেখতে-শুনতে দ্বিধাই হয় এবং একদিন ঘরে ফিরে দেখবে জন্মদাতা একটি নেহাৎ অজ্ঞমুখ মানুষ-তা ভাবতেই কোথাও যাবার সাধ নিমিষে স্তিমিত হয়। হয়তো মুহাম্মদ মুস্তফাও তেমন একটি বাধা বোধ করেছিল। যদি সে সে-বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং একমনা দৃঢ়সংকল্প নিয়ে পায়ে-পায়ে এগিয়ে বহুদূরে চলে গিয়ে থাকে, তার কারণ ছিল; দলবদ্ধ নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে থেকে সহসা একটি নক্ষত্র যদি ছিটকে অন্য কোথাও চলে যায় তার পশ্চাতে কোনো একটা কারণ থাকেই। তার ক্ষেত্রে কারণটি ছিল তার বাপ খেদমতুল্লা যার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ছায়া থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্যেই এমন করে সে ধেয়ে চলে গিয়েছিল। হয়তো সে কোনো একটা পণও করেছিল-যে-পণ এমনভাবে তার সমস্ত চিন্তাধারা সমস্ত জীবন গ্রাস করেছিল যে একদিন তার বাপ সদ্য স্বামীহারা বোনের দুঃখে দুঃখিত হয়ে কী বলেছিল তা স্মরণ করে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। এবং সঙ্কল্প-দৃঢ় একাগ্রচিত্ত অনন্যমনা মুহাম্মদ মুস্তফার মুখের দিকে তাকিয়ে এক সময় অন্যেরা, এমনকি খোদেজাও সে বিষয়ে আর ভাবতে সাহস পায় নি। একসময়ে আমারও মনে হত, বাইরে দেখা না গেলেও হয়তো মুহাম্মদ মুস্তফা এবং খোদেজার মধ্যে বুঝি একটি স্নেহমমতার বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, হয়তো তারা কী-একটা অদৃশ্য কিন্তু গভীর যোগাযোগ বোধ করে। কিন্তু একদিন নিজেই বুঝতে পারি ধারণাটি সত্য নয়।
তবে সে-সময়ে আরেকটি কথাও বুঝতে পারি যা আমাকে বড় বিস্মিত করে। হয়তো আসলে সে জন্যেই খোদেজা যে মুহাম্মদ মুস্তফার জন্যে আত্মহত্যা করেছিল তা কখনো বিশ্বাস করতে পারি নি।
তখন ভরা গ্রীষ্ম, মুহাম্মদ মুস্তফা ছুটি উপলক্ষে বাড়ি এসেছে। সে-সময়ে আর্থিক সমস্যায় বাপজান বড় ব্ৰিত, তার ওপর গ্রামের ছদ্র শেখ নামক সমবয়সী একটি লোক বেশ পয়সার গরম দেখাতে শুরু করলে হিংসা বা ব্যর্থতাবোধের দরুন তার মনে সুখ ছিল না। কোনো প্রকারের সমস্যা-বিপত্তির সম্মুখীন হলে বাপজানের মেজাজ তিরিক্ষি ধরনের হয়ে ওঠে, খেদমতুল্লার মৃত্যুর পূর্বে কয়েক বছর ধরে যে নিদারুণ মেজাজ তার চরিত্রগত হয়ে পড়েছিল অনেকটা সে-রকম হয়ে ওঠে বাপজানের মেজাজ। তখন পান থেকে চুন খসলে সে খড়গহস্ত হয়ে ওঠে, নির্দোষীর সরল চেহারাও তার সহ্য হয় না, কেউ সামনে এলে ধমক খায়, আড়ালে গেলেও রেহাই পায় না। বস্তুত তার দাপটে হুঙ্কারে-তর্জনে বাড়ির সকলের শ্বাসরোধ হবার উপক্রম ঘটে। কী কারণে, খুব সম্ভব অকারণেই, একদিন দ্বিপ্রহরে বাপজান সর্বসমক্ষে খোদেজাকে ভয়ানক বকাবকি করে অবশেষে তার চুল ধরে টেনে দু-চারটে চড়-থাপড়ও লাগায়, এবং তারপর ভরা দুপুরে রোদ-মাথায় কোথাও বেরিয়ে যায়। প্রথমে খোদেজা টু শব্দ করে নি, তবে বাপজান বেরিয়ে গেলে বাড়ির পশ্চাতে লেবুগাছটার তলে বসে কাঁদতে শুরু করে চিকন কণ্ঠে, কী-একটা নিঃসঙ্গ ব্যথায়। তখন খোদেজার বয়স পনেরো কি ষোলো। গায়ের রঙ গাঢ় শ্যামল, মাথাভরা চুল। মুখটা যেন কদাচিৎই দেখা যেত, কারণ সব সময়ে সে এ-কাজে সে-কাজে নুয়ে থাকত। যা চোখে পড়ত তা তার সিঁথি যা কখনো ভাঙ্গত না অসংযত হত না যদিও তাতে চিরুনির স্পর্শ লাগত না তেমন; লম্বা ধরনের মাথায় পেছন থেকে শুরু হয়ে সে-সিথি নৌকার ছই-এর মতো বাঁকা হাল্কা কেশগুচ্ছবেষ্টিত ছোট কপালে এসে শেষ হত। কথাও তেমন বলত না। শুধু সে-সময়ে তার কণ্ঠের আওয়াজ শোনা যেত যখন সে উঠানের প্রান্তে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য-হয়ে-যাওয়া হাঁস-মোরগ-মুরগিদের ডাকত, তাঁর মিহি গলায় স্নেহমিশ্ৰিত অন্তরঙ্গতার ভাব; হাঁস-মোরগ-মুরগির সঙ্গে সে একটি গভীর মিতালি বোধ করত। ক্বচিৎ কখনো পিতৃহীনা মেয়েটি মুখ তুলে তাকালে তার ঈষৎ অসমান চোখদুটির বিষাদছায়া নজরে পড়ত; দুঃখের কোনো প্রতিকার নেই আপনা থেকে জেগে ওঠা এমন একটি জ্ঞান থেকে সৃষ্টি সে-বিষাদ অল্পবয়সেই তার চোখে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছিল।
খোদেজা কাঁদতেই থাকে : অনুচ্চকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ দ্বিপ্রহরের স্তব্ধতার মধ্যে একটি বিষণ্ণ সুরের সৃষ্টি করে। আমি কিছুটা বিস্মিত হই, কারণ বাড়ির মেয়েরা যেমন গোদা-আহ্লাদ করে না তেমনি এমনভাবে কাঁদেও না। এ-সব কেউ সহ্য করে না, এ সবের সময়ও নেই। দুনিয়া বড় কঠিন জায়গা। নানা প্রকারের দায়িত্ব এবং দুঃখকষ্টে নিপীড়িত বিড়ম্বিত মুরুব্বিরা কখনো হঠাৎ রাগের মাথায় বকাবকি বা মারধর করে কারো মনে যদি দুঃখের সৃষ্টি করে তা গাছের পাতার ওপর বৃষ্টির ফোঁটার মতোই ক্ষণস্থায়ী হয়; সে-সব কেউ মনে ধরে রাখে না, অন্তর্বেদনার বিষয়ে বিস্মৃত হয়ে অন্তহীন সাংসারিক কাজকর্মে পুনরায় মনোনিবেশ করতে দেরিও করে না। তবে সহসা আমার মনে হয়, খোদেজার অস্বাভাবিক আচরণের কারণ বুঝতে পেরেছি। মুহাম্মদ মুস্তফার জন্যেই আড়ালে গিয়ে অমনভাবে কাঁদছে সে, তাকেই তার ব্যথা-অপমানের কথা জানাচ্ছে। তাকে না জানিয়ে কাকে জানাবে, কেই-বা তাকে সান্ত্বনা দেবে, তার চোখের পানি মুছে দেবে?
মানুষের কল্পনা বিচিত্র জিনিস, একবার তা লাগাম হারালে পথে-বিপথে কোথায় যে চলে যায় তার ঠিক নেই। আমার এবার মনে হয় : খোদেজার প্রতি যতই উদাসীন হোক না কেন, বাগদত্তা মেয়েটির কান্নায় তার অন্তরে কোথাও সুপ্ত স্নেহমমতা নিশ্চয়ই উথলে উঠেছে, এবং শীঘ্র সে বেরিয়ে আসবে, তারপর উঠান অতিক্রম করে বাড়ির পেছনে গিয়ে স্নেহভরে খোদেজাকে অবোধ দেবে, মিষ্টি কথা বলে ব্যথা-বেদনা দূর করবে। মুহাম্মদ মুস্তফা ততক্ষণে দক্ষিণ-ঘরে গিয়ে কঞ্চি দিয়ে ঠেলে অর্ধউন্মুক্ত করে রাখা জানালার পাশে তার বিছানার ওপর বই-খাতাপত্র নিয়ে বসেছে। সে-ঘরের জানালার দিকে নয়, দরজার দিকে তাকিয়ে আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, বুকটা কেমন। দুরুদুরু করে কাঁপে। আমার আরো মনে হয়, বাড়ির সবাই আমারই মতো অপেক্ষা করছে, তারাও জানে মুহাম্মদ মুস্তফা চুপ করে খোদেজার কান্না শুনে যাবে না। মুহাম্মদ মুস্তফা বেরিয়ে আসছে না কেন? বাড়ির সবাই যে রুদ্ধশ্বাসে চোখ খুলে কান পেতে অপেক্ষা করছে-তা বুঝতে পেরে হয়তো সে সঙ্কোচবোধ করতে শুরু করেছে। কিন্তু তবু সে বেরিয়ে আসবে, তার অন্তরে খোদেজার জন্যে যে-স্নেহমমতা উথলে উঠেছে তাতে সে-সামান্য সঙ্কোচ ভেসে যাবে।
মুহাম্মদ মুস্তফা বেরিয়ে আসে নি।
তারপর কী কারণে জানি না আমিই সহসা যন্ত্রচালিতের মতো হাঁটতে শুরু করি এবং শীঘ্র উঠান অতিক্রম করে বাড়ির পশ্চাতে গিয়ে হাজির হই। বাড়ির পশ্চাদেশ স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে থাকা বাতাবি লেবুগাছটির তলে হাঁটুতে মাথা গুঁজে খোদেজা তখনো কাঁদছিল। বালিকা বয়সে সে-গাছের তলে বসে খোদেজা একা-একা খেলত। হয়তো সেখানে কল্পনার প্রাসাদ তৈরি করত, যে-প্রাসাদের কক্ষে-কক্ষে কত রাজপুত্র সখা-সখী এসে ভিড় করত। লেবুগাছের তলে ক্ষুদ্র একটি স্থান লেপেমুছে সাফ করে নিয়েছিল। স্থানটি এখনো যেন তকতক করে।
ঝোঁকের মাথায়, কী করছি তা না বুঝে খোদেজার সামনে উপস্থিত হলেও কয়েক মুহূর্ত কেমন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর কিছু বলেছিলাম। কী বলেছিলাম তা মনে নেই। হয়তো বলেছিলাম, আর কেঁদো না, ঘরে চলো। আমার কণ্ঠস্বর শুনে খোদেজা সহসা মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
সে-সময়েই বুঝেছিলাম। কখনো অতি সাধারণ কথা বুঝতে মানুষের কষ্ট হয়, আবার কখনো একটি বেশ দুর্বোধ্য কথা কী-কারণে নিমেষেই বুঝে ফেলে। তার জন্যে এক পলকের দৃষ্টি, ক্ষুদ্র একটি দীর্ঘশ্বাস, ঈষৎ একটি মুখভঙ্গিই যথেষ্ট। হয়তো বুঝতে পেরেছিলাম অন্য একটি কারণে। বাল্যকাল অবধি আমিও কি খোদেজার প্রতি একটা বিশেষ স্নেহমমতা অনুভব করতাম না?
আমরা কখনো অন্যায়জনক কিছু করি নি। বস্তুত, তার দিকে তাকাতে আমার সাহসও হত না। সে উঠান দিয়ে যাচ্ছে বা কিছু করছে-তা কী করে জানতাম, তাকাতাম না। এ-ও জানতাম, না তাকিয়ে খোদেজাও জানে আমি কোথায়, কী করছি। বাড়ি থেকে কোথাও গেলে বুকটা কেমন করত, তবে কী একটা তৃপ্তিই পেতাম এই নিশ্চিত জ্ঞানে যে, আমি বাড়ি নেই বলে সে সুখী নয়। পরে বাড়ি ফেরবার জন্যে অধীর হয়ে পড়তাম এবং বাড়ি ফিরলে কী করে বুঝতে পেতাম সে-ও আমার প্রত্যাবর্তনের জন্যে অধীরভাবে প্রতীক্ষা করেছিল। আমি প্রতিশ্রুতিটির কথাও কখনো ভুলতে পারতাম না; হয়তো প্রতিশ্রুতিটি কেবল আমার মনেই মহাসত্যের রূপে বিরাজ করত। ভাবতাম, মুহাম্মদ মুস্তফা খোদেজার প্রতি উদাসীন হলেও যথাসময়ে তাকে বিয়ে করবে, উপযুক্ত সময়ে যা তার প্রাপ্য তা দাবি করবে। তাদের একদিন বিয়ে হবে না তা যেমন ভাবতাম, তেমন চাইতামও না।
মুহাম্মদ মুস্তফার উদাসীনতার কথা ভালোভাবে জানলেও মধ্যে-মধ্যে খোদেজার বিষয়ে একটি সন্দেহ জাগত মনে। বাগদত্তা মেয়ের মনের কথা কি বলা সহজ? হয়তো সে মুহাম্মদ মুস্তফার প্রতি গোপনে-গোপনে কী একটা ভাব পোষণ করে যা ছেলেখেলার জিনিস নয়, যা অন্তঃসলিলার মতো অদৃশ্য। তবে তার মৃত্যুর মাসকয়েক পূর্বে খোদেজা কিছু বলে যার পর বুঝতে পারি সে-ধারণাটিও অহেতুক।
তখন অগ্রহায়ণ মাস, কাটা-ধান মাড়ানো-ধানের গন্ধে বাড়ি-ঘর মাঠ-ক্ষেত মাতোয়ারা। সেদিন সন্ধ্যায় পেছনের পুকুরের পাড় দিয়ে ঘরে ফিরছিলাম, এমন সময়ে কাঁচের চুড়ির মৃদু ঝঙ্কার শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। দেখি, খোদেজা। অনুচ্চ, বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করি, কী করছ এখানে?
ততক্ষণে নিজেই বুঝে ফেলেছিলাম যে গতকাল থেকে যে-সাদা মুরগিটি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে সে-মুরগিটি খুঁজতে এসেছে পুকুরের পাড়ে। সেখানে বুনো ফুলের বন, কিছু ঝোপঝাড়। তার বিশ্বাস বন-ঝোপঝাড়েই মুরগিটি লুকিয়ে রয়েছে কিসের ভয়ে। আমিও একটু খুঁজে দেখি, কিন্তু কোথায় মুরগি? বলি, শেয়ালে খেয়েছে।
হঠাৎ খোদেজা হাতে মুখ ঢেকে একটু শব্দ না-করে কাঁদতে শুরু করে। আমি কয়েক মুহূর্ত অপ্রস্তুতভাবে দাঁড়িয়ে থাকি, তারপর সহসা কী যেন ঘটে। হয়তো শীতের সন্ধ্যার গন্ধ নাকে এসে লাগলে মনে কী-একটা ভাবের সৃষ্টি হয়, হয়তো আবছা অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য-হয়ে-যাওয়া মুরগির ব্যথায় ব্যথিত মেয়েটির জন্যে বুকে বেদনা বোধ করি বা বাড়ির এত কাছে হলেও নির্জন পুকুরের পাড়ে সহসা মনে হয় খোদেজা এবং আমি ছাড়া সমগ্র দুনিয়ায় কেউ কোথাও নেই। হঠাৎ তার হাত ধরে তাকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করি, কিন্তু নিজেই সহসা কী-একটা উত্তাল ভাবে বিহ্বল হয়ে পড়ি। খোদেজাও এবার অসংযতভাবে কাঁদতে শুরু করে। এবারও কান্নার আওয়াজ শোনা যায় না, তার মুখও দেখা যায় না, কেবল সমগ্র দেহে সে থরথর করে কাঁপতে থাকে।
তারপর কথাটি বলে। প্রথমে বুঝতে পারি নি, তার মুখের শব্দ তার কান্না এবং দেহ-কম্পনের মধ্যে কেমন হারিয়ে গিয়েছিল।
কী বললে?
মুস্তফা ভাইকে বড় ভয় করে।
আমি বড় বিস্মিত হই : সাদা রঙের অদৃশ্য-হয়ে-যাওয়া মুরগি এবং মুহাম্মদ মুস্তফা তার মনে যে-ভাব জাগায়, এ-দুটির মধ্যে কী সম্বন্ধ? তারপর মনে হয়, যা বলেছে তা নয়, অন্য কোনো কথা আমাকে জানানো তার উদ্দেশ্য, কারণ মুহাম্মদ মুস্তফাকে ভয় করার কোনো কারণ নেই। ধরা গরায় জিজ্ঞাসা করি,
আমাকে ভয় করে না?
সজোরে মাথা নেড়ে সে উত্তর দেয়, না।
অনেক কথা হয়তো তাকে জিজ্ঞাসা করার বা বলার বাসনা জেগেছিল তখন, তবে আমি নির্বাকভাবে প্রস্তরবৎ মূর্তির মতো নিথর হয়ে থাকি, শুধু কোথাও কিছু ভয়ানকভাবে বাড়ি খেতে থাকে। হয়তো বুকচাপা কথা, হয়তো হৃৎপিণ্ড-কে জানে। গভীর নীরবতার মধ্যে পুকুরে কী-একটা শ্রান্ত মাছ ঘাই দেয়।
তারপর বলি, যাও। ভয় হয়, কখন কেউ এসে পড়বে।
খোদেজা চলে গেলে বাড়িতে না-ঢুকে পুকুরের ওপারে গিয়ে অনেকক্ষণ তেঁতুল গাছের নিচে বসে থাকি। যখন উঠি তখন টুপটুপ করে শিশির ঝরতে শুরু করেছে।
খোদেজা মুহাম্মদ মুস্তফার জন্যে আত্মহত্যা করেছে-তেমন কথা কী করে আমি বিশ্বাস করি?
অথচ সে-কথাই মুহাম্মদ মুস্তফার সহসা সত্য বলে মনে হয়, বিদ্রি চোখে রাত কাটাবার পর সকালের দিকে তাতেই তার বিশ্বাস জন্মে।
পরদিন সে বড় বিষণ্ণ বোধ করে, কী-একটা অস্থিরতাও তাকে থেকে-থেকে নিপীড়িত করে। তার মনে হয়, বাড়ির লোকদের কথাটি অস্বীকার করার সত্যি আর কোনো উপায় নেই। কী করে অস্বীকার করে তাদের কথা প্রথমত, একজোট হয়ে সকলে একটি সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা কাহিনী রচনা করেছে তা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, এও সম্ভব নয় যে মেয়েটি যতই গোপনকারী হোক না কেন, যারা রাতদিন তার সঙ্গে বসবাস করেছে তারা তার মনের কথা ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। বস্তুত মুহাম্মদ মুস্তফা কিছু লক্ষ্য না করলেও তারা সব লক্ষ্য করেছিল, সব জানতে পেরেছিল। মেয়েটি যে প্রতিশ্রুতির কথা ভোলে নি শুধু তাই নয়, তাতে সমস্ত আস্থা-ভরসা স্থাপন করেছিল। মানুষের মন অবুঝ। পিতৃহীনা, আশ্রিতা মেয়েটির সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা, সব স্বপ্ন স্নেহমমতা পরজীবী উদ্ভিদের মতো মুহাম্মদ মুস্তফাকে ঘিরে গজিয়ে উঠেছিল, তাকে জড়িয়েই বেঁচেছিল, সে মুহাম্মদ মুস্তফার যোগ্য কিনা বা মুহাম্মদ মুস্তফার মনে তার প্রতি কোন স্নেহমমতা ছিল কিনা-সে-সব প্রশ্ন একবারও তার মনে জাগে নি। সরলমনা মানুষ কিছুতে একবার বিশ্বাস করলে সে-বিশ্বাসে কোনো প্রশ্নের ক্ষীণতম তরঙ্গও জাগে না; সে-বিশাস নিরেট, নিশ্চিদ্র।
অনেক কথা সহজে সে বুঝতে সক্ষম হয়। বাড়ির লোকেরা যা লক্ষ্য করেছিল বা জানতে পেরেছিল-তা সে লক্ষ্য করে নি কেন, জানতে পারে নি কেন? কারণটা আর কিছু নয় : সে লক্ষ্য করতে চায় নি, জানতে চায় নি, ইচ্ছা করেই চোখ বুজেছিল সে। মেয়েটির দিকে কখনো তাকায় নি এই ভয়ে যে তার চোখে অনুচ্চারিত বিশ্বাসটি দেখতে পাবে, স্নেহমমতার আভাস নজরে পড়বে। প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করতে সাহস পায় নি এই কারণে যে সে জানত প্রতিশ্রুতিটি কখনো রক্ষা করবে না। তবে হয়তো সে-বিষয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারে নি। সেজন্যে বাড়ি আসবার সময় প্রতিবার খোদেজার জন্যে সে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে আসত যেন প্রতিশ্রুতির কথা সে ভোলে নি, যথাসময়ে তা রক্ষা করবে। তাই প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করত না-তা সত্য নয়। তবে স্মরণ করত এ-জন্যে যে কীভাবে তা ভাঙ্গতে পারে, কী করে তার হাত থেকে নিস্তার পেতে পারে-এসব নিয়ে তার চিন্তার অবধি ছিল না। তেমনি খোদেজার দিকে কখনো তাকাত না-তা-ও সত্য নয়। সে তাকাত, তবে তাকাত স্নেহমমতা নিয়ে নয়, কোনো আকাক্ষা নিয়ে নয়, শুধু এ-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হবার জন্যে যে অশিক্ষিতা গ্রাম্য মেয়েটি সত্যি তার জীবন-সঙ্গিনী হবার যোগ্য নয়; তার অযোগ্যতা সমন্ধে দৃঢ়নিশ্চয় হবার জন্যেই মধ্যে-মধ্যে চকিতে আড়চোখে তার দিকে দৃষ্টি দিত, এবং অযোগ্যতা সন্ধান করত বলে তার অগোচরেই সর্বপ্রকার দোষঘাট দেখতে পেত হয়তো খোদেজার মধ্যে।
মুহাম্মদ মুস্তফার মনে হয়, সবকিছুই সে সহসা বুঝতে পেরেছে।
শ্রোতাদের মধ্যে কেউ সহসা জিজ্ঞাসা করে, আপনি নিজের কানে কিছু শুনেছিলেন?
তবারক ভুইঞা উত্তর দিতে ঈষৎ দ্বিধা করে, তারপর বলে, না, আমি নিজে কিছু শুনি নি। তবে অনেকের সত্যিই মনে হয়েছিল তারা কিছু শুনতে পায়। একটু থেমে সে আবার বলে, কিন্তু কানে শোনাই কি বড় কথা?
তারপর কী হয়েছিল? লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করে।
উকিল কফিলউদ্দিনই গোলমাল বাধায়।
একদিন উকিল কফিলউদ্দিন স্থির করে, তার পক্ষে কুমুরডাঙ্গায় বাস করা আর সম্ভব নয়। তার মনে হয়, যে-শহরে আজীবন বসবাস করেছে সে-শহরই যেন তার সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অথচ একদিন কত-না আশা-ভরসা নিয়ে এই শহরে ওকালতি শুরু করেছিল। তারপর কঠিন শ্রম-অধ্যবসায়ের ফলে ধীরে-ধীরে পেশায় নাম-যশ করতে সক্ষম হয়, সমাজের শীষেও একটি বিশেষ স্থান দখল করে। সে-সময়ে এই আশাটিও দেখা দেয় যে একদিন কুমুরডাঙ্গারও উন্নতি হবে, সুনাম হবে। হয়তো আশাটি একেবারে নিঃস্বার্থ ছিল তা নয়, কিন্তু একটি মানুষ যে-স্থান তার কৃতকার্যতার পটভূমি বলে গ্রহণ করে নেয় তার জন্যে সে-স্থান কি অনেকটা আত্মীয়স্বজনের মতো নয়? একটি মানুষের কৃতকার্যতা যতই চমকপ্রদ হোক-না কেন, আত্মীয় স্বজন দারিদ্র বা বিফলতার মধ্য নিমজ্জিত হয়ে থাকলে তার কৃতকার্যতা সম্পূর্ণ হয় না, বরঞ্চ তা তাদের অসার্থকতায় নিয়ত ছায়াচ্ছন্ন হয়ে থাকে। অকৃতকার্য আত্মীয় স্বজন কৃতকার্য মানুষের সম্মান রক্ষা করতে পারে না। যেমন মাটির ভোজনপাত্র মোঘলাই খানার মর্যাদা দিতে পারে না। তবে কারণ যাই হোক, কুমুরডাঙ্গা শহরের উন্নতির জন্যে আগ্রহ-উদ্যম-সহকারে সে কত কিছু-না করেছে। তারই উদ্যোগে শহরে মিনারগম্বুজ শোভিত সুদৃশ্য একটি মসজিদ উঠেছে, মেয়েদের জন্যে একটি মাইনর স্কুল বসেছে, কাছারি-আদালতের সামনে একটি ক্লাব-ঘরের পত্তন হয়েছে যেখানে শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায় সন্ধ্যার পর তাস দাবা খেলে গল্পগুজব করে সংবাদপত্র-মাসিকপত্র নেড়েচেড়ে সময় কাটাতে পারে। সে-ই খেলাধুলার প্রতি শহরবাসীদের মন আকৃষ্ট করেছে এবং মরহুম ওয়ালেদের নামে যে-ফুটবল টুর্নামেন্টের প্রচলন করেছে তাতে প্রতিবছর আশেপাশের নানা জায়গা থেকে বিভিন্ন খেলোয়াড় দল এসে সোৎসাহে যোগদান করে। এ-অঞ্চলে প্রতি বছর মড়ক লেগে গৃহপালিত জীবজন্তু পালে-পালে ধ্বংস হত। সে-ই সরকারের কাছে জোরদার দাবি জানিয়ে কুমুরডাঙ্গায় পুশু-ডাক্তারের ব্যবস্থা করেছে। তবে এ-সব নয়, যা নিয়ে সত্যি সে গর্ব করতে পারে তা এই যে, তারই কড়া দৃষ্টির জন্যে শহরের নৈতিক চরিত্রের যেমন উন্নতি হয়েছে তেমনি সর্বপ্রকারের অনাচার-অনিয়ম শাসনে থেকেছে। কোনো সরকারি ডাক্তার বা দারোগা উৎকোচ-গ্রহণের ঈষৎ দুর্বলতা দেখাবামাত্র সে কুমুরডাঙ্গা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, কোনো হাকিম-মুনসেফের ন্যায়জ্ঞান বা নিরপেক্ষতা আদর্শনীয় মনে না-হলে সে-ও এ শহরে বেশিদিন টিকতে পারে নি। তবে এত কিছু করেও একটি জিনিস উকিল কফিলউদ্দিন ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় নিঃ কুমুরডাঙ্গার অবনতি। তার চোখের সামনে ধীরে-ধীরে অনিবার্যভাবে শহরটি কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। হয়তো একবার কোনো শহরের ভিতে ঘুণ ধরলে ফুটবল খেলে স্কুল-ক্লাব বসিয়ে অবনতির মারাত্মক কীটের ক্রম-অগ্রসর ঠেকিয়ে রাখা যায় না। তবু সে কখনো আশা ছাড়ে নি, চতুর্দিকে অবনতির স্পষ্ট প্রমাণ দেখতে পেলেও এই দৃঢ়বিশ্বাসে দিন কাটিয়েছে যে কোনো অত্যাশ্চর্য উপায়ে শহরটি সহসা জীবিত হয়ে উঠবে, তার ভাটা-পড়া স্রোতে জোয়ার আসবে, কোনো যাদু-যষ্টির স্পর্শে রূপকথার ঘুমন্তপুরীর মতো অকস্মাৎ জেগে উঠবে। সে-সব কিছু হয় নি, বরঞ্চ যে-টুকু অবশিষ্ট ছিল তা-ও শেষ হয়েছে এবং কুমুরডাঙ্গা এবার যেন মধ্যযুগে প্রত্যাবর্তন করেছে। এমন শহরে যশ-সুনামের মূল্য কী, সার্থকতারই-বা অর্থ কী?
তবে উকিল কফিলউদ্দিন সাহেব নিজেই বুঝতে পারে, এ-কারণেই যে সে স্থির করেছে কুমুরডাঙ্গায় আর থাকা সম্ভব নয়-তা নয়। আসল কারণ অন্য কিছু। সে-টি এই যে, হঠাৎ যদি মওতের ডাক এসে পৌঁছায় তবে তার আদুরে মেয়ে হোসনার মুখ না দেখেই তাকে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে। মৃত্যুর কথা সে ভাবতে ভালোবাসে না, তবু তার মনে হয় এবার না ভেবে উপায় নেই, এবং একবার তা ভাবতে শুরু করলে হোসনার স্নেহময় দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করার সম্ভাবনা সহসা তাকে ভয়ানকভাবে সন্ত্রস্ত করে তোলে। তারপর অকূল সমুদ্রের মধ্যে নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত মানুষ যেমন সে-দ্বীপ ত্যাগ করার জন্যে অধীর হয়ে ওঠে তেমনি কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে চলে যাবার জন্যে উকিল সাহেব অধীর হয়ে ওঠে।
কফিলউদ্দিন ঝোঁকের মানুষ : একবার কিছু ঠিক করলে ভালো-মন্দ বড় একটা ভাবে না। তাছাড়া যে-শহরে সে দীর্ঘদিন কাটিয়েছে, যে-শহর তার জন্মস্থান-সে-শহর ছেড়ে যাওয়ার পথে কোনো বাধাও দেখতে পায় না। কিসের বাধা? সে ভাবে, সে উকিল, যেখানে সে যাক না কেন তার সঙ্গে যাবে আইনের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান, ওকালতির ক্ষেত্রে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। সে আর যুবক নয়, যৌবনের শক্তি সামর্থ্য নেই, কিন্তু সে-সবের বদলে পেয়েছে জ্ঞান অভিজ্ঞতা। সুনামও-বা কম কী-যে সুনাম কুমুরডাঙ্গাতেই সীমাবদ্ধ নয়; সদরেও লোকেরা তাকে চেনে। সেখানে একবার গিয়ে বসলে দেখতে-না-দেখতে তার পসার গড়ে উঠবে। পসার না হলেও ক্ষতি কী? সাংসারিক সব দায়িত্ব শেষ হয়েছে ভালোভাবেই। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ছেলে দুটিও আর তার মুখাপেক্ষী নয়। এক ছেলে ঢাকায় ডাক্তারি করে, আরেক ছেলে ভালো সরকারি চাকরি নিয়ে এ-স্থানে সে-স্থানে ঘুরে বেড়ায়। তারা দুটি মাত্র মানুষ, সে এবং তার স্ত্রী, তাদের পসার বা পয়সার কোনোটারই প্রয়োজন নেই। তাছাড়া তাদের দু-জনেরই জীবন দিগন্তের দিকে হেলে পড়েছে : বাকি কয়েকটি দিনের জন্যে অত ভাবনা কী?
একবার দ্রুতসঞ্চারী একখণ্ড মেঘের ছায়ার মতো একটি কথা দেখা দেয় তার মনে। সে-টি এই যে, কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের প্রতি তার কি কোনো দায়িত্ব নেই? কিন্তু কথাটি মনে আসতেই সে আপন মনে রেগে ওঠে, যেন শহরবাসীদের কেউ প্রশ্নটি তুলেছে। দায়িত্ব আবার কিসের? সে কি সারা জীবন তাদের খেদমত করে নি, তাদের উন্নতির জন্যে ভালোর জন্যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নি, নিজের চিন্তা ছেড়ে তাদের চিন্তায় কত সময়ে বিনিদ্ররজনী কাটায় নি? তাছাড়া সমাজ বা ধর্ম যা দাবি করতে পারে তার কাছ থেকে সে-দাবি অনুযায়ী অক্ষরে-অক্ষরে সে তার কর্তব্য পালন করেছে। তাদের প্রতি দয়ামায়া বিবেচনা দেখিয়েছে, সাহায্য করেছে নানা উপায়ে, পাই-গণ্ড, হিসেব করে ছকা জাকা দিয়েছে, ফকির-মিসকিন খাইয়েছে। এর বেশি কেউ তার কাছে দাবি করতে পারে না-না ধর্ম না সমাজ।
তবে একটি কথা বেশ কিছুক্ষণের জন্যে তাকে কেমন বিষণ্ণ করে তোলে। কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে গেলে সে-শহরে তার সমস্ত পদচিহ্ন সহসা শেষ হয়ে যাবে না কি? হয়তো সেটা এক রকমের মৃত্যুই হবে যে-মৃত্যুর মধ্যে তার এতদিনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এত আশা-আকাক্ষা সাধ-স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যে-জীবন গড়ে তুলেছে সে জীবনে অকস্মাৎ যতি পড়বে, দীর্ঘকাল ধরে যে-একটি পথরেখা সৃষ্টি করেছে সে পথরেখা থেমে যাবে অকস্মিকভাবে। একবার বিষণ্ণ ভাবটি এমন ঘনীভূত হয়ে ওঠে যে তার মনে হয় জীবিত অবস্থাতেই সে যেন তার মৃত্যুশোকে সমাকুল হয়ে পড়েছে। তবে শীঘ্র সে মনের বিষণ্ণ ভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। মনকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে, কখনো-কখনো মানুষের জীবনের আচম্বিতে যতি পড়ে, যা নিতান্ত অটল-অনড় মনে হয় তাও নিমেষে চোরাবালিতে পরিণত হয়, নদীর যে-তীরে ভবিষ্যতের দিকে তাঁকিয়ে মানুষ স্নেহমমতার এবং আশ্রয়ের নীড় বাঁধে সে-তীরও হঠাৎ নদীগর্ভে অদৃশ্য হয়ে যায়। মানুষ তখন সুপরিচিত পথঘাট ছেড়ে বুকে কিছু ক্ষোভ ব্যথা বেদনা নিয়ে কিন্তু আবার নূতন আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নূতন পথ ধরে।
উকিল কফিলউদ্দিন অতিশয় ব্যস্তসমস্ত হয়ে যাবার উদ্যোগ-আয়োজন করতে শুরু করে, এবং তার প্রাসাদসম বাড়ির প্রথম মালিকের অনুকরণেই গ্রামের বাড়ি থেকে বিশ্বাসী কিন্তু অলসপ্রকৃতির একটি ভাইপোকে ডেকে পাঠায় শূন্য বাড়িটা পাহারা দেবার জন্যে। এবার কারো জানতে বাকি থাকে না যে উকিল কফিলউদ্দিন কুমুরডাঙ্গা ত্যাগ করে যাবে। তবে কেন একটি লোক বৃদ্ধবয়সে নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে-তা কেউ বুঝতে পারে নি। তাদের কেমন মনে হয়, কী-একটা অজানা কারণেই যেন সে কুমুরডাঙ্গায় আর ভরসা পাচ্ছে না।
একদিন দুপুরে উকিল কফিলউদ্দিন যখন সস্ত্রীক ঘাটে এসে উপস্থিত হয় ততক্ষণে সেখানে বিস্তর লোকের সমাগম হয়েছে। ইতিমধ্যে ভাড়া-করা একটি বজরা এবং একটি গয়না নৌকায় মালপত্র চড়ানো হয়েছিল। সংক্ষিপ্তভাবে বিদায় নিয়ে খোদার নাম উচ্চারণ করে উকিল কফিলউদ্দিন বজরায় উঠতে যাবে এমন সময়ে সর্পদষ্ট মানুষের মতো পা তুলে নেয় সে। কিছুক্ষণ সে বিমৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে এদিক-ওদিক তাকায় যেন কোথাও কিছু সন্ধান করে, তারপর কেমন স্তব্ধ নিথর হয়ে পড়ে। এবার ঘাটের সমবেত লোকের মনে হয়, নদীর দিকে তাকিয়ে সে যেন কী শুনছে। ক্রমশ তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, তারপর সমস্ত মুখ রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। অবশেষে অদৃশ্য কোনো হিংস্র জন্তুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যেই যেন আবার ক্ষিপ্ৰভঙ্গিতে বজরায় উঠবার চেষ্টা করে, কিন্তু এক পা মাত্র উঠিয়ে সহসা বেসামাল হয়ে ধরাশায়ী হয়-দেহের অর্ধেক পানিতে অর্ধেক জমিতে। কেউ যখন তাকে তুলবার চেষ্টা করে তখন উকিল কফিলউদ্দিনের ধড়ে আর প্রাণ নেই।
উকিল কফিলউদ্দিন নূতন একটি পথ ধরতে সক্ষম হয় বৈকি, কেবল সে-পথ জীবিতদের জানা নেই, সে-পথের ব্যথা-বেদনা বা আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই।
এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আবার রোদ ঝলমল করে উঠলে মুহাম্মদ মুস্তফা আপিস অভিমুখে রওনা হয়ে পড়ে। কিছুদূর গিয়েছে এমন সময়ে পথে একটি ক্ষীণতনু নারীমূর্তি দেখতে পেলে সে চমকে ওঠে। মাথার ওপর নত করে রাখা একটি মস্ত কালো ছাতার জন্যে মুখটি ঠিক দেখতে পায় না, তবু তার মনে হয় সে যেন খোদেজা : একই শারীরিক গঠন, একই হাঁটার ভঙ্গি, চিবুকের যে-অংশটি নজরে পড়ে তাও মৃত মেয়েটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই সাদৃশ্য তাকে ভয়ানক বিস্মিত করে, এবং নিষ্পলক দৃষ্টিতে ধীরপদে এগিয়ে-আসতে-থাকা মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এমনভাবে কোনো মেয়েমানুষের দিকে কখনো তাকায় নি বলে সে লজ্জা বোধ করে কিন্তু তবু দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারে না। শীঘ্র তার দিকে তাকিয়ে থাকতে তেমন বাধেও না, কারণ তার মনে হয় যে-মেয়ে দেখতে ঠিক খোদেজার মতো তার দিকে তাকালে ক্ষতি নেই। তাছাড়া, ক্ষতি আছে কি ক্ষতি নেই, কাজটি ঠিক কি বেঠিক-এ-সব ভাবা হয়তো সম্ভবও হয় না; মানুষের পক্ষে সব সময়ে ন্যায়-অন্যায়ের কথা ভাবা সম্ভব কি?
মেয়েটি ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসে, হাঁটার ভঙ্গিটা ঈষৎ মাজা-ভাঙ্গা ধরনের। ছাতার নিচে গভীর ছায়া, ছায়ার বাইরে উজ্জ্বল সূর্যালোক। ছায়ার মতো, মরীচিৎকার মতো সে এগিয়ে আসে মুখশূন্যভাবে। যতই নিকটে আসে ততই সে কেমন অস্পষ্ট হয়ে ওঠে : মুহাম্মদ মুস্তফা কেবল একটি আকার দেখতে পায়।
তবু এক সময়ে মুহাম্মদ মুস্তফা তাকে চিনতে পারে। প্রখর সূর্যালোকের মধ্যে কালো ছাতার নিচে যাকে ছায়ার মতো একটি অস্পষ্ট আকারের মতো দেখতে পায় সে কি মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে নয় যে স্কুলে শিক্ষয়িত্রীর কাজ করে, যে সর্বপ্রথম কী-একটা বিচিত্র কান্না শুনতে পেয়েছিল, এবং বাজারের পথে যাকে নিয়ে একদিন কী একটা ঘটনাও ঘটেছিল? সেদিন কে যেন মেয়েটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
তবে তাকে চিনতে পারলেও সে নিরাশ হয় না, যেন একই মেয়ের পক্ষে দুটি ভিন্ন। মানুষ হওয়া সম্ভব, যেন একটি সত্য হলে আরেকটি সত্য হবে না তার কোনো মানে নেই।
ছাতার তলে ছায়াটি নাচে, অস্পষ্টতা থেকে থেকে শূন্যতার মধ্যে মিলিয়ে যায়। তবে ছাতাটি ভেসেই থাকে স্রোতের ওপর ভাসমান বৃক্ষপল্লবের মতো। মেয়েটি আরো এগিয়ে আসে, পূর্ববৎ ধীর-মন্থর গতিতে, নিঃশঙ্কচিত্তে। দুজনের মধ্যে এখন কয়েক গজের ব্যবধান মাত্র।
নিজেরই অজান্তে মুহাম্মদ মুস্তফা কখন দাঁড়িয়ে পড়েছিল। একবার সে নড়বার চেষ্টা করে কিন্তু তা নিন্দ্রাচ্ছন্ন স্বপ্ন-দেখতে-থাকা মানুষের চেষ্টার মতো কোন ফল প্রদান করে না; তার নড়বার ক্ষমতা নেই, সে যেন মাটিতে শিকড় গেড়েছে। বুকে হৃৎপিণ্ড প্রচণ্ডভাবে আন্দোলিত হয়। মেয়েটি আরো কাছে এসে পড়লে তার সান্নিধ্য হাওয়ার মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো কিছু সৃষ্টি করে এবং তারই সূক্ষ্ম কণা সহস্র ধারায় অদৃশ্যভাবে মুহাম্মদ মুস্তফাকে আঘাত করে; সে কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে। অবশেষে সে যখন বুঝতে পারে পেছনের দিকে ছাতা হেলিয়ে মেয়েটি বিস্ময়ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তখন সে সহসা সমগ্র মনে একটি ভয় বোধ করে, কারণ তার মনে হয় কী-একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটবে। একটি আকস্মিক ঘটনা ঘটেও। কোথাও সে একটি প্রচণ্ড আওয়াজ শুনতে পায়, ক্ষণকালের জন্যে মনে হয় সে রোষমত্ত বজ্রনিনাদ শুনছে। তবে তার অতিশয় ভীতবিহ্বল মনও আওয়াজটি চিনতে পারে : প্রচণ্ড শব্দটি অদূরে একটি বাড়ির টিনের ছাদে বৃষ্টি পড়ার শব্দ, যা শিলাবৃষ্টির মতো উচ্চ-উৎকট আওয়াজ ধারণ করেছে। অপ্রত্যাশিতভাবে প্রবল বৃষ্টি নেবেছে মেঘশূন্য আকাশ থেকে বর্ষণের মতো। চমকিত হয়ে ওপরের দিকে তাকালে বড়-বড় কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি সোজাসুজি মুহাম্মদ মুস্তফার চোখে প্রবেশ করে এবং সহসা সে যেন দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। অবশ্য শীঘ্র দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে, মেয়েটিকে আবার দেখতে পায়, তবে স্পষ্টভাবে নয়, এবং এবার তার মনে হয় মেয়েটি যেন একটি ঝর্ণাধারার ওপাশে দাঁড়িয়ে। মুখটি ঠিক দেখতে পায় না, দেখতে পায় কেবল এক জোড়া স্থির চোখ। মানুষের চোখ সদা ঘোলাটে, সদা অপরিচ্ছন্ন, মানুষের চোখ যখন নির্ভাবনায় শূন্য হয়ে থাকে তখনো স্রোতহীন পানির মতো পঙ্কিলতায় ঘনীভূত হয়ে থাকে। তবে মেয়েটির চোখ যেন পরিস্রত, সর্বদোষ বিনিমুক্ত। এমন চোখে আবার ক্রোধ-বিদ্বেষ পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়ে। তার চোখে যেন ক্রোধ-বিদ্বেষ, হয়তো-বা ঘৃণাও।
ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ে, তবে কেমন নিঃশব্দেই পড়ে যেন; কোথাও যেন কোনো শব্দ নেই, অদূরে টিনের ছাদও যেন নীরব। মেয়েটিকে সে আর দেখতে পায় না, কারণ ততক্ষণে হয়তো বৃষ্টির জন্যে হয়তো কোনো কারণে আপনা থেকেই তার চোখ নিমীলিত হয়ে পড়েছে।
মুহাম্মদ মুস্তফা তখনো মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে-এমন সময় সাইকেলে করে একটি লোক হুড়মুড় করে প্রায় তাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে; বোধহয় প্রবল বৃষ্টির জন্যে সে তাদের দেখতে পায় নি। তাছাড়া কুমুরডাঙ্গা শহরে সাইকেলের তেমন প্রচলন নেই বলে যারা সাইকেল ব্যবহার করে তারা অনেকদিন চালিয়েও দুটি মাত্র চাকার ওপর দেহভার রক্ষা করার কায়দাটি কখনো করায়ত্ত করতে পারে না, এবং তাই তারা সামনের চাকার দিকে একাগ্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কেমন সর্পিলভঙ্গিতে অগ্রসর হয়; হয়তো তাদের ধারণা সামনের চাকাটির ওপর চোখ না রাখলে সেটি সহসা অবাধ্য ঘোড়ার মতো কোথাও ছুটে পালিয়ে যাবে।
সচকিত হয়ে মুহাম্মদ মুস্তফা লোকটির দিকে তাকায়, এবং সহসা তার চমক ভাঙ্গে বলে ঘোর বৃষ্টির মধ্যেও তাকে চিনতে পারে; সাইকেলের আরোহী কাছারির প্রসেস সার্ভার আব্দুল গনি।
প্রসেস সার্ভার আবদুল গনি কয়েক মুহূর্ত অপ্রস্তুতভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে এক পা অর্ধচক্রাকারে ঘুরিয়ে ঝুপ করে সিটে বসে প্রথমে বেসামালভাবে, তারপর অপেক্ষাকৃত সংযতভাবে কিন্তু বেশ দ্রুতগতিতে প্রস্থান করে।
নিজের আচরণে নিজেই ভয়ানকভাবে বিস্মিত হয়ে মুহাম্মদ মুস্তফা কাছারিতে হাজির হয়। কিছু সংযত হলে সে লজ্জা বোধ করে। তার মনে হয়, অপরিচিত মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার খবর প্রসেস সার্ভার আবদুল গনির মারফতে ইতিমধ্যে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা নিয়ে সকলে বলাবলি করতে শুরু করেছে। খারাপটাই সর্বপ্রথম মানুষের মনে আসে। কে জানে কীভাবে প্রসেস সার্ভার আব্দুল গনি খবরটি বিতরণ করেছে এবং নানা মুখে কী রঙ না পড়েছে তাতে। তবে লোকেরা কী বলাবলি করছে তা নয়, তার নিজের আচরণ আবার তাকে চিন্তিত করে। এর অর্থ কী? তাছাড়া এবার সে বুঝতে পারে, যে-মেয়েটির মধ্যে খোদেজার সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছিল সে তাকে কেমন ভীতিবিহ্বল করে তুলেছিল। তার অর্থই-বা কী?
সে কিছু বুঝতে পারে না। তবে শীঘ্রই এসব চিন্তা জোর করে মন থেকে দূর করে। এবার তার স্মরণ হয় বন্ধু তসলিমের চিঠির কথা। ক-দিন ধরে চিঠিটা পকেটে নিয়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত জবাব দেওয়া হয় নি। চিঠিটা বের করে পড়ে আরেকবার। তসলিম লিখেছে : স্টিমার বন্ধ হবার জন্যে এবং তারপর ভয়ানক জ্বরে পড়ার জন্যে তোমার যে আসা হয় নি তা আশরাফ হোসেন চৌধুরী সাহেব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন। তবু তোমার বিয়েতে দু-দুবার বাধা পড়েছে। সব কিছু বুঝলেও তিনি যেন সন্তুষ্ট নন, মনে যে খট্কা লেগেছে, সহসা যেন প্রথম বার বিয়ে স্থগিত রাখার কারণটি এখন আর বুঝতে পারছেন না; একবার মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দিলে পূর্বের নির্দোষ ঘটনাগুলিও সন্দেহের উদ্রেক করে থাকে। সে-দিন বলেই ফেলেছিলেন : হ্যাঁ, বাপ-মা ভাইবোন অন্য কথা, কিন্তু ফুফাতো বোনের মৃত্যুর জন্যে বিয়ের পাকা দিন ভাঙ্গার কথা কখনো শোনেন নি। থেকে-থেকে এ-ও বলছেন, এবার বিয়ের দিনটা তার পীরের উপদেশ নিয়েই স্থির করবেন। পীর আবার এ-দেশে থাকে না, তার বাস ভাগলপুর না বহরমপুর এমন কোনো জায়গায়। সত্য বলতে কী, লক্ষণটা ভালো মনে হচ্ছে না। আশরাফ হোসেন চৌধুরী সাহেবকে তেমন দোষও দেয়া যায় না। মেয়ের বিয়ের ধার্য দিন দু-দুবার ভাঙতে হয়েছে বলে লোকেরা নানা কথা তুলতে পারে-এই ভয়েও চিন্তিত হয়ে পড়বেন তা আশ্চর্য কী। তোমার সত্বর আসা দরকার, সামনাসামনি বাতচিত হলে তার মনের সব খটকা দূর হবে। : তসলিমের চিঠির উত্তর দেয় নি কেন? সে যা লিখেছে তা অতিশয় ন্যায্য, আশরাফ হোসেন চৌধুরী সাহেব অনেক সহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন যার জন্যে কৃতজ্ঞতা বোধ না করেও পারা যায় না। আর বিলম্ব করা সত্যিই সমীচীন হবে না। যা হবার হয়ে গিয়েছে, তা আর শোধরানো যাবে না। খোদেজা তারই জন্যে আত্মহত্যা করলেও সে আর কী করতে পারে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে সহসা তার রাগও হয় : সে প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গতে উদ্যত হয়েছে দেখেই খোদেজা আত্মহত্যা করবে এ কেমন কথা? তাছাড়া খোদেজা যদি নির্বুদ্ধির কাজ করে থাকে তবে সে-ই দায়ী হবে কেন? বুদ্ধিহীনা মেয়েটির প্রতি রাগ দেখা দিলে বিচিত্র উপায়ে সে সুস্থির বোধ করে। সে ঠিক করে, আগামীকাল ছুটির জন্যে দরখাস্ত করে দেবে এবং সম্ভব হলে দু-তিন দিনের মধ্যে ঢাকা রওনা হয়ে পড়বে। তার মনে এ-বিষয়ে সন্দেহ থাকে না যে সে যদি তৎপরতা না দেখায় তবে আশরাফ হোসেন চৌধুরী সাহেব সত্যিই বিগড়ে যাবেন।
সে-দিন সন্ধ্যায় সে বেশ উত্যল্প বোধ করে। একজন সহকর্মী টর্চ হাতে ছড়ি ঘুরিয়ে তার বাসায় উপস্থিত হলে সহকর্মীটির সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করে, তারপর সহকর্মীটি আবার টর্চ হাতে ছড়ি ঘুরিয়ে অন্য কোনো বাড়ির অভিমুখে রওনা হলে এবার সে রাতের খাওয়াদাওয়া সারে। পরে বারান্দায় গিয়ে বসেছে এমন সময় তবারক ভুইঞা এসে দেখা দেয়। আজ তার সঙ্গে সানন্দচিত্তেই কথা বলে, যেন তার প্রতি যে একটি জড়তার ভাব দেখা দিয়েছিল সে-ভাবটি কেটেছে।
এক সময়ে সে তবারক ভুইঞাকে বলে,
দু-তিন দিনের মধ্যে ঢাকায় যাব। ভালো দেখে একটা নৌকা ঠিক করে দেবেন।
কথাটি বলে মনে কেমন হাল্কা-হাল্কা বোধ করে। তবারক ভুইঞা কেমনভাবে যেন তার দিকে দৃষ্টি দেয়, কিন্তু তা তাকে বিব্ৰত করে না।
তারপর এক সময় তবারক ভুইঞা চলে যায়। এবার সে হয়তো তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং এক সময় কী-একটা আওয়াজে জেগে ওঠে। তবারক ভুইঞা আবার এসেছে নাকি? সে কিছুক্ষণ পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন সেখানে অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ একটি ছায়া জেগে উঠবে। তবে তেমন কিছু ঘটে না। হয়তো সে কিছু স্বস্তিই বোধ করে। একটু পরে দূরে আলো দেখা দেয়। আলোটি শীঘ্র নিকটে এলে দুটি মানুষের মূর্তি জেগে ওঠে, আলোটি লণ্ঠনের রূপ ধারণ করে; লণ্ঠনের আলোয় দ্রুতভঙ্গিতে হাঁটতে-থাকা দুটি মানুষের পায়ের কিছুটা এবং তাদের বস্ত্রের নিম্নাংশ নজরে পড়ে। অত রাতে কী অজানা কারণে দ্রুতভাবে হেঁটেই মানুষ দুটি বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যায়, আলোটিও এক সময়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। অন্ধকার আবার জমজমাট হয়ে ওঠে।
কিছুক্ষণ পরে সে-অন্ধকারের মধ্যে মুহাম্মদ মুস্তফা একটি চকিত, তীক্ষ্ম আওয়াজ শুনতে পায়। নিঃসন্দেহে পথের ওপাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটি ব্যাঙ, কোনো অপেক্ষমান, ক্ষুধার্ত সাপের নির্মম চোয়ালে ধরা পড়ে গিয়েছে। ব্যাঙের ভীত আর্তনাদটি তেমন জোরালো নয়, উন্মুক্তও নয়। সমগ্র মন দিয়ে মুহাম্মদ মুস্তফা অসহায় ব্যাঙটির আর্তনাদ শোনে যে-আর্তনাদ রহস্যময়ভাবে রাতের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ে; অন্ধকার কাঁপে হাওয়া-আন্দোলিত বাঁশের ডগার মতো; অদৃশ্য, নিঃশব্দ সাপটি কম্পমান সে-অন্ধকারের মধ্যে বিকট রূপ ধারণ করে। আওয়াজটি মুহাম্মদ মুস্তফার সুপরিচিত, তবু তার মনে হয় সাপের মুখে ধরা-পড়া ব্যাঙের আর্তনাদ কখনো সে শোনন নি, সাপের শীতল-কঠিন নির্দয়তাও এমনভাবে কখনো অনুভব করে নি। ব্যাঙের আওয়াজ তখনো থামে নি, তবে ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। তারপর সহসা আওয়াজটা থামে : সাপের মুখে নয়, সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যেই যেন ব্যাঙটির ক্ষুদ্র প্রাণের সমাপ্তি ঘটে। কেমন নিথর হয়ে মুহাম্মদ মুস্তফা পথের ওপাশে ঝোপঝাড়ের প্রতি তাকিয়ে থাকে। কে জানে হয়তো সাপের কবল থেকে ব্যাঙটি প্রাণ নিয়ে মুক্তি পেয়েছে, হয়তো আবার পায় নি; নীরব অন্ধকারের মধ্যে সে-প্রশ্নের উত্তর নেই। রাতের অন্ধকার তার অদৃশ্য হাতে সুন্দর সত্য নির্মম সত্য-সবই নিশ্চিহ্ন করে ফেলে।
এবার রাত যেন আদিম রূপ ধারণ করে; এমন রাত মানুষ চেনে না। দূরে দিগন্তের কাছে কয়েকবার বিদ্যুৎ ঝলক দিয়ে ওঠে, তবে নিঃশব্দ সে-বিদ্যুৎঝলক চোখ ঝলসে দিলেও কেমন অসত্য মনে হয়। একটু পরে একটি বাদুড় এসে নিকটে বার কয়েক ঘুরপাক খায়, তারপর রাতের অন্ধকারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
কখন মুহাম্মদ মুস্তফা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকবে, কারণ তার মনে হয় সে যেন কুমুরডাঙ্গা নামক একটি মফস্বল শহরের অন্যতম সরকারি বাড়ির বারান্দায় বসে নেই, বসে রয়েছে একটি নৌকার ওপর। নৌকা ঈষৎ দুলছে, থেকে-থেকে পানি থেকে ছলছল শব্দও আসছে। খালের পথ। তবে সে চাঁদবরণঘাটে স্টিমার ছেড়ে ছাপরশূন্য নৌকায় উঠেছে। দুপাশে সুপরিচিত মাঠ-ক্ষেত, দূরে গাছপালায় ঘেরা ছায়াশীতল গ্রাম। তারপর অনেক সময় কাটে পথটি যেন বেশ দীর্ঘ। শীঘ্র কোনো কারণে সে বিস্মিত হয়। সে ভাবে : চাঁদবরণঘাটে স্টিমার থেকে নেবে খালের এ-পথ দিয়ে চিরদিনই কি তাকে যেতে হবে? তবে তন্দ্রাচ্ছন্ন মানুষ বিস্ময়কর কথাও বেশিক্ষণ ভাবে না, ভাবছে মনে হলেও তার ভাবনা অগাধ পানির ওপর সীমরণ-আলোড়িত ঈষৎ তরঙ্গমালার মতো হাল্কাভাবে খেলা করে, নিচে তন্দ্রা অগাধ পানির মতোই স্থির হয়ে থাকে। কিন্তু খাল কোথায়? এ যে পুকুর, শ্যাওলা-আবৃত ডোবার মতো ছোট পুরু যার পাড় অসমান, যেন বিশালাকার কোনো প্রাণী নখাঘাতে পাড়টির ঐ অবস্থা করেছে। তবে পুকুরের পাড়ের দিকে বা পাড়স্থিত গাছপালার দিকে তার দৃষ্টি নেই। দৃষ্টি একটি মুখের ওপর যে-মুখ সে-পুকুরের পানি থেকে ভেসে উঠে এসেছে। সম্পূর্ণভাবে নয়, কারণ ওপরে এসেও আবার কিছু ডুবে রয়েছে যে-জন্যে তা অপরিচিত মনে হয়। তবু সে-মুখটি অপরিচিত অপরিচিত মনে হবে কেন? সে কি খোদেজার মুখ ইতিমধ্যে ভুলে গিয়েছে। শুধু তার মুখ নয়, ভাবভঙ্গিও অপরিচিত ঠেকে; এমন ভাবভঙ্গি খোদেজার মুখে কখনো লক্ষ্য করে নি। ঠোঁটের পাশে কেমন বিদ্রুপাত্মক হাসি, সামান্য তিরস্কারের আভাস-যা খোদেজার মুখে কখনো দেখে নি। না, বিদ্রুপাত্মক হাসি বা তিরস্কারের ভাব নয়, তার মুখে গভীর দরদের ছায়া, এবং যে-বড়-বড় চোখ খোদেজার চোখের মতো ঠিক নয় সে-চোখে উৎকণ্ঠা। তবে কি কিছুই হয় নি? সে কোনো অন্যায় করে নি, খোদেজারও মৃত্যু হয় নি? সবই কি দুঃস্বপ্ন মাত্র?
এ সময়ে কী একটা প্রবল ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে মুহাম্মদ মুস্তফার তন্দ্রা ভাঙ্গে। তবে বাস্তব জগতে প্রত্যাবর্তন করলে সে বুঝতে পারে দুঃস্বপ্নটি ঘুমতন্দ্রার জগতের নয়, আসল জীবনেরই একটি অংশ যার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব নয়। এবার সে তন্দ্রাহীন চোখে বসে থাকে অর্থ-উদ্দেশ্যহীনভাবে। তারপর এক সময় তার মনে হয় সে যেন একা নয়, অন্ধকারের মধ্যে কে যেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে নিস্পলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
কিছুক্ষণ তবারক ভুইঞার কণ্ঠস্বর যেন কানে পৌঁছায় নি, স্মৃতির চোখে যে নিরাকার নিচ্ছিদ্র অন্ধকার জেগে উঠেছিল সে-অন্ধকারে সমস্ত কিছু এমনকি মানুষের কণ্ঠস্বরও বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তবে শীঘ্র আবার সকর্ণ হই। তার কথা না-শুনে উপায় কি? এখনো সে মুহাম্মদ মুস্তফার বিষয়ে কিছু বলে নি বটে তবু হয়তো এমন এক সময় আসবে যখন তার কথা না-বলে পারবে না। হয়তো কুমুডাঙ্গার কাহিনীটা বলার উদ্দেশ্য অবশেষে মুহাম্মদ মুস্তফার সম্বন্ধে যা বলবে তারই জন্যে একটি উপযুক্ত আবহাওয়া সৃষ্টি করা, যথাযোগ্য পটভূমি তৈরি করা। অথবা তার বিশ্বাস কুমুরডাঙ্গা মুহাম্মদ মুস্তফাকে প্রভাবিত করেছিল, তাই সে-শহরে যা ঘটেছিল তা প্রথমে না বললে মুহাম্মদ মুস্তফার কথা সম্পূর্ণভাবে বোঝা যাবে না।
তবারক ভুইঞা কার মৃত্যুর কথা যেন বলে। শীঘ্র স্মরণ হয়, কুমুরডাঙ্গার গণ্যমান্য উকিল কফিলউদ্দিন শহর ছেড়ে যাবার জন্যে ঘাটে উপস্থিত হয়েও যেতে পারে নি, বজরায় উঠবার সময়ে হঠাৎ মৃত্যু ঘটে। তবারক ভুইঞা বলে, একটি বৃদ্ধ মানুষের আকস্মিক মৃত্যুও মানুষকে বিস্মিত করে না, কারণ বয়সের ভারে যার জীবনগতি শত রকমে ধীর-মন্থর হয়ে পড়েছে তার মৃত্যুর দিন যে আর দূরে নয় তা সকলে তাদেরই অগোচরে মেনে নেয়। তবে উকিল কফিলউদ্দিনের আকস্মিক মৃত্যুর খবর শহরময় প্রচারিত হলে সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে, যেন তার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, জরা-বার্ধক্য সে মৃত্যুর জন্যে দায়ী নয়। কাছারি-আদালতে, কাছারি-আদালতের সামনে ঘাসশূন্য ধুলাচ্ছন্ন মাঠে, বাজারের পথে, সে-পথের দুপাশে দোকানগুলিতে, মানুষের বাড়িতে উঠানে সর্বত্র একটি থমথমে ভাবের সৃষ্টি হয়। সকলের মনে একটি প্রশ্নই ঘোরাফেরা করে : বজরায় উঠতে গিয়ে উকিল সাহেব সর্পদষ্ট মানুষের মতো ক্ষিপ্রবেগে পা তুলে নিয়েছিল কেন, কীই-বা শুনতে পেয়ে এমন ভীতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল? ডাক্তার বোরহানউদ্দিন বলে, ঘাটে পৌঁছাবার পর বৃদ্ধ মানুষটির হৃৎপিণ্ড হঠাৎ বিকল হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এ-ব্যাখ্যায় কেউ সন্তুষ্ট হয় না। সবারই মনে হয়, ডাক্তার বোরহানউদ্দিন আসল কথাটা বুঝতে পারে নিঃ হৃৎপিণ্ড বিকল হলেও কেন হয়েছিল, সে-কথা। নিঃসন্দেহে উকিল সাহেব কিছু শুনতে পেয়েছিল, বজরায় উঠতে যাবে এমন সময়ে কী-একটা তীক্ষ্ম আওয়াজ তার কানে ফেটে পড়েছিল। এবং তা নদীর কান্না ছাড়া আর কী?
উকিল কফিলউদ্দিন বিচিত্র কান্নাটি শুনতে পেয়েছিল বলেই সর্পদষ্ট মানুষের মতো বজরা থেকে পা তুলে নিয়েছিল, সেজন্যেই তার চোখ বিস্ফারিত এবং মুখ রক্তশূন্য হয়ে পড়েছিল-সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলে কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের মনে পূর্বের। আশঙ্কাটি ফিরে আসে, কী-একটা কথা অস্পষ্টভাবে মনের প্রান্তে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করে।
পরদিন ফজরের নামাজের পর হবু মিঞা মুহুরি বাইরের ঘরে বসে ছিল। নিত্য এ সময়ে সে বাইরের ঘরে এসে বসে, রোগ-ব্যাধিতে শয্যাশায়ী না হলে, এ-নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না কোনোদিন। শীতের দিনে গায়ে আলোয়ান, গ্রীষ্মের দিনে নগ্ন গা, মাথার চুল এলোমেলো, ঈষৎ স্ফীত চোখে-মুখে গভীর প্রশান্তি, কিছু বিমনস্কভাব। দিন রাতের মধ্যে এ-সময়টাই তার সবচেয়ে প্রিয়। বাইরের ঘরে তখন ভালোমতো আলো প্রবেশ করে না, তবে যে-অন্ধকার তখনো জমে থাকে তা যেন রাতেরও নয় দিনেরও নয়; সে-অন্ধকার অনেকটা দিঘির গভীর তলদেশের অন্ধকারের মতো। সে-সময়ের নির্জনতাও বিশেষ ধরনের যা মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করা যায়, কারণ সে-নির্জনতাও যেন রাতের বা দিনের অংশ নয়; সে-নির্জনতার মধ্যে মানুষের মন ধীরে-সুস্থে কোথাও কোনো তাগিদ-তাড়া বোধ না করে দিঘির পানির গভীরে মাছের মতো শ্লথগতিতে অনায়াসে সঞ্চরণ করে। বস্তুত ফজরের এই সময়ে কিছুই সে ভাবে না, এমন কি যে ছেলেটি কোনোদিন আরোগ্য লাভ করবে না তার আসন্ন, অনিবার্য মৃত্যুও তার মনে কোনো ছায়া সঞ্চার করে না।
তবে আজ হবু মিঞা মুহুরির মনে গভীর অশান্তির জ্বালা; কী-একটা কথা সে সমগ্র মন দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করে, কিন্তু সক্ষম হয় না বলে মনে অস্থির-অস্থির বোধ করে।
যখন সে পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে সজ্ঞান হয় তখন সূর্য উঠেছে, ক্ষুদ্র বারান্দা অতিক্রম করে দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে রোদ লুটিয়ে পড়েছে ধুলাচ্ছন্ন ফাটলধরা মেঝের ওপর। নির্জন ঘরেই সে উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে, কান্নাটি শোনামাত্র উকিল সাহেব তার অর্থ বুঝতে পেরেছিল।
উকিল কফিলউদ্দিন কান্নাটির মধ্যে কী দেখতে পেয়েছিল সে-কথা অন্যেরা যখন জানতে পারে তখন তারা বিস্মিত হয় না। সে-কথা তারা নিজেরাই কি জানে না? জানে, সব বোঝে, কেবল একদিন নিজেদের ধোঁকা দেবার চেষ্টা করেছে কারণ এমতক্ষেত্রে আর কী করা যায়? তারা ভাবে কান্নাটি শুনবার জন্যে তাদের আগ্রহের সীমা নেই, তা শুনবার জন্যে অধীর হয়ে রয়েছে, কিন্তু আসলে তা শুনতে পাবে এই ভয়ে তারা কি সদা-সন্ত নয়? তারা ভাবে কান্নাটি শুনতে পেলে কী-একটা অপরূপ ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে, বা মেজর মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে সকিনা খাতুন যা বলে তা নিতান্ত উদ্ভট হলেও সম্ভব, বা কান্নাটি কোনোরকমের কানের ভুল কিম্বা বড়জোর একটি দুঃস্বপ্ন। কিন্তু এ-সব কি একটি নিদারুণ সত্য ঢেকে রাখার ফিকিরফন্দি নয়? কিন্তু কতদিন আর ঢেকে রাখা যায়? এ-সব কলাকৌশল বা মন ভুলানোর কারসাজিতে এ-কথা কি ঢেকে রাখা সম্ভব যে শীঘ্ৰ কুমুরডাঙ্গায় ভয়ানক কিছু ঘটবে এবং কান্নার আওয়াজটি তারই পূর্বসঙ্কেত?
কীভাবে, কী বিচিত্র যুক্তির সাহায্যে এমন একটি বিশ্বাস তাদের মনে বাসা বেঁধেছিল কে জানে, কিন্তু এবার তারা সহসা একেবারে নিশ্চিত হয়ে পড়ে যে নদীর দিক থেকে অনেকে যে-কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় তা ভয়ঙ্কর কোনো বিপদের পূর্বসঙ্কেত। হয়তো দুঃখকষ্টে জর্জরিত নিপীড়িত মানুষ তারই অগোচরে কেয়ামত বা এমন কিছু সর্বনাশী প্রলয়কাণ্ডের জন্যে অপেক্ষা করে কারণ চতুর্দিকে যা সে দেখতে পায় তার অস্তিত্বের মধ্যে কোনো অর্থ খুঁজে পায় না, এবং তাই তার ধ্বংসই কমনা করে।