2 of 2

৮৮. পাহাড়ে দ্রুত উঠতে নেই

পাহাড়ে দ্রুত উঠতে নেই, সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়তে হয়, তবু আমি জেদ করে তাড়াতাড়িই উঠেছিলাম। জলাপাহাড়ের ওপরটাতে কোনও দিন ওঠা হয়নি, আজ উঠবই। ঘোড়া নিইনি। কয়েক দিন ঘোড়ায় চড়ে দেখেছি, ভালো লাগে না, জোরে ঘোড়া ছোটাতে না পারলে আনন্দ নেই।

বিশ্রাম নেবার জন্য একটা কচ্ছপের পিঠের মতন পাথরের ওপর বসে সিগারেট ধরাতেই চোখে পড়ে শ্বাসরোধকারী দৃশ্য। বহু নীচে উপত্যকায় আমার সিগারেটের ধোঁয়ার মতনই হালকা কিন্তু বিপুল পরিমাণে ধোঁয়ার মতন মেঘ কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরছে, যেন জীবন্ত। পুরু সবুজ গালিচার মতন অরণ্য মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ে যায়, আবার যখন দৃশ্যমান হয়, তখন মনে হয়, সবকিছুই যেন অপরূপ ভালোবাসার মতন স্তব্ধ হয়ে আছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করি, জমাট মেঘের আড়াল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা জেগে উঠেছে কিনা। জাগেনি। অথচ মাথার ওপরে আকাশ এত নীল।

পথ ঘুরে গেছে নীচে। অনেক নীচে কয়েকটি ঘোড়ার পিঠে দুটি রমণী ও একজন পুরুষ। এত দূর থেকেও চিনতে অসুবিধে হয় না।

সিগারেটটা শেষ করে আমি আবার উঠতে শুরু করি। একটা লজেন্স পুরে দিই মুখে। টক-মিষ্টি স্বাদটা ভালো লাগে। আজ সবকিছুই ভালো লাগছে। আজ আমি নিজেকেও ক্ষমা করতে পারি। এই সমূহ প্রকৃতির মধ্যে এত নিবিড় ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে এমন অসম্ভব মায়া জেগে ওঠে যে, ইচ্ছে হয় নিজের জীবনটাকে নিজেই আদর করি।

অথচ আমি ভেবেছিলাম, প্রকৃতির কাছে আমার কোনও সান্ত্বনা নেই। এর রূপও আমাকে মুগ্ধ করতে পারবে না। এই আকাশ ও পটভূমিকার গম্ভীর পাহাড়–এ-সবই তো পুরনো। উপত্যকার অরণ্য কিংবা খেলনার শহর অথবা এই সঞ্চরমান মেঘ এসবই তো বহুকালের পুরনো দৃশ্য। যা পুরনো, তা আমাকে আনন্দ দেবে কী করে! তবু এই জলাপাহাড়ে এসে যুক্তি হার মেনে যায়। ভালো যে লাগছে, প্রকৃতির মধ্যে এসে প্রায়। অতিপ্রাকৃত ভালোলাগা, অস্বীকার করি কী করে?

দার্জিলিংয়ে না আসতেও পারতাম এই সময়ে। যেমন, মানুষ হয়ে না জন্মাতেও পারতাম, কিংবা অন্য কোনও বাবা-মায়ের সংসারে, অন্য রকম মানুষ হয়ে, আর এক রকম কাহিনীর মধ্যে জীবনটা কাটতে পারত। আমার পুরী যাবার কথা ছিল। হঠাৎ দার্জিলিং চলে আসা।

না, আসলে এই রকম নির্জনে, নিজের কাছেও সত্যি কথাটা প্রকাশ করতে দ্বিধা হয়। রেণুরা দার্জিলিং বেড়াতে আসছে শুনেই কি আমি পুরী যাওয়ার পরিকল্পনাটা বদলাইনি? আমি আজ মনে মনে বলেছিলাম, রেণুরা যাচ্ছে তো কী হয়েছে। আর কেউ কি দার্জিলিং যেতে পারে না? কাকে এই কথাটা বোঝাচ্ছিলাম, আমাকে তো কেউ দার্জিলিং আসতে বারণ করেনি! এই এক রকমের লুকোচুরি খেলা। আমি রেণুকে এড়িয়ে যাই, আবার দূর থেকে ওকে দেখি। রেণুকে আমার ঠিকানা জানাই না, অথচ ইউনিভার্সিটির ছুটির পর দূর থেকে রেণুকে একঝলক দেখে নেবার জন্য ছটফট করি। আমার এই ছেলেমানুষিতে আমিই অনেক সময় ভ্রুকুটি করেছি কিংবা হেসেছি। একই শরীরের মধ্যে আমি ছেলেমানুষ এবং সমালোচক। এ রকম হয় না বুঝি?

একটা পাথরের গায়ে কারা যেন নাম লিখে গেছে। কয়েকটি নাম বেশ টাটকা, পার্থ প্লাস ব্রততী; মিনা প্লাস শীতল; ঝুমু, কুমু, ঝরনা এবং খোকন; একজন লিখেছে স্বপ্ন আমি তোমাকে–। তারপর একটি অসভ্য শব্দ। খড়ির লেখা, আমি ওই শব্দটা হাত দিয়ে মুছে ফেললাম। যে লিখেছে সে বোকা, ওই শব্দটা এত প্রকট ভাবে বলার তো দরকার নেই। শুধু আমি তোমাকে বললেই তো সব কিছু বোঝা যায়। পাথরটার সামনে একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট, পুরনো খবরের কাগজ ও একটি মেয়েদের চুলের কাটা পড়ে আছে, যেন একটা গল্প। আমি চুলের কাটাটা তুলে নিলাম, মনে হয়। রুপোর তৈরি কিংবা জার্মান সিলভারেরও হতে পারে। আসল রুপো না জার্মান সিলভার–এ-সমস্যার মীমাংসা করার বদলে অনেক সহজ কাটাটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। আমি তাই দিলাম, অনেক দূরে, উপত্যকার দিকে, কোনও পাহাড়ি মেয়ে একদিন ওইটা কুড়িয়ে পেয়ে খুশি হবে হয়তো, আমি দেখতে পেলাম সেই মেয়েটির উৎফুল্ল মুখ। কাটাটা হাতে নেওয়ার ফলে আমার হাতে কী একটা মিষ্টি গন্ধ লেগে গেছে, আমি পাচ্ছি। যেন, কিংবা কল্পনা।

আজ যে এখানে আর কোনও লোকজন নেই, এটা একটা বেশ ভালো ব্যাপার। বেশি লোকজন থাকলে একটুও আরাম পেতাম না। একা থাকা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। মায়ের মৃত্যুর পর আমার আর কোনও বন্ধন নেই। এবার বিদেশে যাবলুকিয়ে চুরিয়ে নয়, বিমানবন্দরে সবাই আমাকে বিদায় জানাতে আসবে। অসংখ্য রুমাল উড়বে, বিদায়, বিদায়।

বাবা হরিদ্বারে থাকেন। আমৃত্যু ওইখানেই থাকতে চান। সেটাই সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। কলকাতায় থাকার আর তো কোনও যুক্তি নেই। একমাত্র আকর্ষণ ছিল বাড়িটা। বাবা ভেবেছিলেন, সূর্যদার অবর্তমানে ওই বাড়িটা আমাদের হয়ে যাবে। তার মতন সংসারে ব্যর্থ মানুষেরও ওইটুকু বিষয়বুদ্ধি থাকে। মৃত্যুর আগে মা এই বিশ্বাস নিয়েই গেছেন যে, তার স্বামী ও পুত্রের একটা নিজস্ব বাড়ি হয়েছে। মা খুশি মনেই গেছেন, কিন্তু বাবাকে নিরাশ হতে হয়েছে। সূর্যদা ব্যবসা করার ঝোঁকে তার বন্ধুদের প্ররোচনায় মাত্র দশ হাজার টাকায় বাড়িটা বন্ধক দিয়েছিল। আমার তো মনে হয়, ভালোই করেছিল। সর্বস্ব উড়িয়ে দেবার নেশায় পেয়ে বসেছিল সূর্যদাকে, যে তার জীবনটাকে ওই রকম ভাবে খরচ করে দিতে পারে, সে কেন এ বাড়িটাকে রাখতে যাবে? এতেই সূর্যদাকে মানিয়েছে। কিন্তু বাবা ওই বন্ধকের খবর জানতে পেরেও আশা করেছিলেন, দশ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে বাড়িটা পেয়ে যাবেন। কিন্তু কোন অধিকারে বাবা সূর্যদার উত্তরাধিকারী হবেন? বাবা এই নিয়ে মামলা মোকদ্দমা করতে গিয়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বাড়িটা ছেড়ে আসার পরও দু-এক দিন ওই বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটেছি। সেই সময় মনের মধ্যে যে এক রকম দুঃখ দুঃখ ভাব হয়, সেটা আসলে আরামদায়ক। না হলে স্বেচ্ছায় ওই দিকে যাওয়া কেন?

আমি পাহাড় শিখরে উঠব। আর কত দূর?

আমাকে উঁচুতে উঠতে হবে। যে-জায়গায় আছি, তার চেয়েও উঁচুতে। যেখানেই যাই, মনে হয়, আরও দূরে কোথাও আরও সুন্দর জায়গা আছে। এই জীবনের বদলে অন্য রকম জীবন।

অশ্বারোহীরা অনেকটা এগিয়ে এসেছে। আমি দ্রুত পা চালালাম। তবু বাধা পড়ে। এই সুন্দর ঘাসফুলটা ছিঁড়ব না? পাহাড় শিখরে যারা দ্রুত উঠতে চায়, তারা কি কখনও কয়েক মুহূর্ত থেমে একটা ফুলের গন্ধ নিতে চায় না? এই প্রশ্নটা আমাকে একটা দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেয়।

সেখানে, সেই ফুলটার সামনে দাঁড়াতেই অকস্মাৎ মনে হয়, এত নির্জন জায়গায় আমি জীবনে কখনও আসিনি। এই পাহাড়, আকাশ, মেঘরাশি ও অরণ্য কী অদ্ভুত নিস্তব্ধ। হয়ে আছে। দূরের শহরের কোনও আওয়াজ এখানে এসে পৌঁছোচ্ছে না। এখানে আমাকে কেউ দেখছে না, এখানে ক্ষমা চাওয়া যায়।

আমি হাত জোড় করে বললাম, হে দশ দিক, আমি ক্ষমা চাইছি। হে দশ দিক, আমাকে ক্ষমা করো।

কীসের জন্য ক্ষমা? আমি তো কোনও অন্যায় করিনি? দোষ না করলে বুঝি ক্ষমা চাওয়া যায় না? এই বিরাট সুন্দরের কাছে এসে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে? এই পৃথিবীতে জন্মেছি অথচ তার এই বিপুল রূপরাশির যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি আমি, এ জন্যও তো ক্ষমা চাইতে হয়।

একটু পরে, একজন অশ্বারোহিণী চিৎকার করে ডাকল, বাদলদা–

আমার প্রথম ইচ্ছে হল, সাড়া না দিয়ে তরতর করে আরও ওপর দিকে উঠে যাওয়া। কিংবা লুকিয়ে পড়া। এখানে লুকোবার অনেক জায়গা আছে। তবু আমি তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে সাড়া দিলাম, এই যে

বোধহয় শুনতে পায়নি, আবার ডাকল, বাদলদা—

আমি আরও জোরে বললাম, রেণু, আমি দাঁড়িয়ে আছি, আয়–

আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি ঠিকই তবু আমার চিত্ত খুব চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগল। যেন এটা ঠিক সেই জায়গা নয়, যেখানে দাঁড়িয়ে সত্যের সম্মুখীন হওয়া যায়। এখনও লুকিয়ে পড়ার সময় আছে।

অংশু, অংশুর স্ত্রী আর রেণু আমার কাছাকাছি এসে পৌঁছোল অল্পক্ষণের মধ্যেই। আমি ছুটে গিয়ে সহিসের মতন রেণুর ঘোড়ার জিন ধরে থামালাম।

অংশু বলল, কী রে বাদলা, এখানে একা একা কী করছিস? পদ্য লিখছিস?

আমি বললাম, তোরা কবে এসেছিস রে অংশু?

এটা মিথ্যে কথা। রেণুরা কবে দার্জিলিংয়ে এসেছে আর কোথায় উঠেছে, সবই আমি জানি। তবু এ রকম মিথ্যে কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।

অংশু বলল, লাস্ট শনিবার। তুই কোথায় উঠেছিস?

রেণু বলল, তোমাকে তো আমরা অনেক আগেই দেখতে পেয়েছি। কতক্ষণ ধরে ডাকছি, শুনতে পাওনি?

আমি বললাম, শুনতে পেলে কি দাঁড়াতাম না?

অংশুর স্ত্রী হাঁপিয়ে গেছে। এই শীতের মধ্যেও তার মুখে অল্প অল্প ঘাম। সে বলল, কী উৎকট শখ বাপু তোমাদের। শুধু শুধু এতটা ওঠার কোনও মানে হয়?

আমি তাকে বললাম, অলকা, তুমি নামবে না? ঘোড়া থেকে নেমে একটু জিরিয়ে নাও।

অলকা বলল, এবার ফেরো। আপনিও ফিরবেন তো আমাদের সঙ্গে?

না, আমি আর একটু থাকব।

অংশু বলল, আর এখানে থেকে কী করবি? আমাদের সঙ্গে চল। আমাদের বাড়িটা দেখিসনি তো।

আমি এখানে আর একটু থাকব। তোরাও থাক না।

অলকা বলল, আমি তো বাবা আর একটুও দেরি করতে পারব না। আমার বাচ্চা দুটোকে বাড়িতে রেখে এসেছি।

অংশুও তার স্ত্রীর সঙ্গে একমত। আমি জানতাম অংশু আর থাকতে চাইবে না, সেই জন্যই ওকে থাকতে বলছিলাম। রেণুর দিকে ফিরে বললাম, আমি শেষ পর্যন্ত যাব।

রেণু জিজ্ঞেস করল, আমি যাব না?

অংশু বলল, না, না, খুকি, তুই চল আমাদের সঙ্গে। আবার একদিন আসা যাবে’খন।

আমি বললাম, অংশু, তোরা যা–আমি রেণুকে পৌঁছে দেব।

রেণু বলল, আমিও শেষ পর্যন্ত না গিয়ে ফিরব না।

অংশু রেণুর দাদা হলেও সে রেণুকে ভয় পায়। রেণুর জেদকে সবাই ভয় পায়। রেণুকে জোর করে কোনও কথা কেউ বলতে পারে না। অংশু অপ্রসন্ন ভাবে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু ও জানে, আমাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেও কোনও লাভ নেই, সেই জন্য রেণুকে বলল, বেশি দেরি করিস না কিন্তু–।

ওরা ফিরে গেল। রেণুর ঘোড়াটাও দিয়ে দিলাম ওদের সঙ্গে। নীচে নামবার সময় বেশি পরিশ্রম নেই। ওরা দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম সেইখানে। তারপর বললাম, চল–

কয়েক পা নিঃশব্দে হাঁটার পর রেণু জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন আছ?

ভালো। আর তুই?

ভালো। এখনও রাগ আছে?

কীসের রাগ?

রাগ নেই? আমার কিন্তু এখনও খুব রাগ আছে তোমার ওপরে। তুমি এ রকম অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছ কেন? আমার মোটেই এসব পছন্দ হয় না।

তা হলে কেন এলি আমার সঙ্গে। এখনও ফিরে যেতে পারিস।

আমি ফিরে যাব?

যেতে পারিস। আমি খানিকটা রাস্তা এগিয়ে দেব।

তুমি আমাকে আর চাও না!

এ-কথার মানে কী?

আমাকে তোমার আর ভালো লাগে না?

রেণু, এ রকম প্রশ্ন আমাকে করা চলে না।

তুমি উত্তর দেবে না?

শোন রেণু, পৃথিবীতে যত সত্য আছে, তার চেয়েও বড় সত্য এই যে, আমি শুধু তোকেই চাই। সারা জীবনের মতন এটা ঠিক হয়ে গেছে। আমি তোকে পাব কি পাব না, তুই আমাকে অগ্রাহ্য করিস কিংবা ভুলে যাস–এসব কিছুর ওপরেই আমার চাওয়াটা নির্ভর করে না।

তা হলে আমার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করছ কেন এক বছর ধরে? আমি ভেবেছিলাম, তুমি প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলেছ।

ওই যে বললাম, আমার দিকটা সারা জীবনের মতন ঠিক হয়ে গেছে। তোর দিকটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি বলেই দূরে সরে গিয়েছিলাম।

আমার দিকটায় তুমি অন্য রকম কী বুঝলে? আমি বুঝি খারাপ?

রেণু, তুই কখনও খারাপ হতে পারিস না। আমি তোর অযোগ্য বোধহয়, সব সময়েই আমার এই কথাটা মনে হয়–

রেণু একটু থমকে দাঁড়াল, তার মুখে হালকা মেঘের ছায়া। না ছায়া নয়, এখন সত্যিকারের মেঘ ঘিরে আছে আমাদের। আমরা পরস্পরের কাছে একটুক্ষণের জন্য অস্পষ্ট হয়ে যাই। সেই মেঘের মধ্যেই রেণু তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুমি আমার হাত ছুঁয়ে আবার প্রতিজ্ঞা করো, আর কোনও দিন এ রকম কথা ভাববে না।

আমি রেণুর হাতটা নিজের মুঠোয় নিলাম। বড় ঠান্ডা, জিজ্ঞেস করলাম, তোর শীত করছে?

রেণু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না।

রেণু শাড়ির ওপরে একটা লাল রঙের স্টোল পরে আছে। আমার গায়ে ওভারকোট, সেই প্রভাস জামাইবাবুর যে কোটটা নিয়ে আমার বিদেশে যাবার কথা ছিল। আমি কোটের বোতামগুলো খুলতে লাগলাম।

রেণু বলল, আমরা অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে ডাকছি। তুমি সাড়া দাওনি, তুমি যদি শেষ পর্যন্ত সাড়া না দিতে কিংবা কোথাও লুকিয়ে পড়তে তা হলে সারা জীবনে আর কখনও আমার মুখ দেখতে পেতে না।

কেন পালাব কেন?

তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছ কেন?

একটু আগে আমি বললাম যে পৃথিবীর সব সত্যেরও চেয়েও বড় সত্য এই যে আমি রেণুকে চাই। তবু আমি রেণুর কাছ থেকে পালাতে চাইছিলাম, এটাও ঠিক। এবং এখন আমি তাকে মিথ্যে কথা বলছি। আমি মুখে হাত দিয়ে চোখ দুটো ভালো করে রগড়ে নিলাম। দেখতে চাইলাম যেন। এখানে আমিই দাঁড়িয়ে আছি কিংবা অন্য কেউ।

মেঘটা সরে গেছে। ঝট করে এক ফালি রোদ এসে গায়ে পড়ল। কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনেকার জমাট মেঘও পাতলা হতে শুরু করেছে। মুহূর্তে মুহূর্তে এই মেঘ ও রৌদ্রের খেলাটাই বড় মজার। আমি কোটটা ফাঁক করে বললাম, এটা বেশ ঢলঢলে আছে, তুই এর মধ্যে চলে আয়, তা হলে আর শীত করবে না।

রেণু বলল, ওই তো আমরা সবচেয়ে উঁচু জায়গাটায় প্রায় এসে গেছি, চলো ওই পর্যন্ত আগে যাই।

রেণুর হাত ধরে আমি ছুটতে ছুটতে চলে এলাম সেখানে। এখন আমাদের নিশ্বাসের সঙ্গেও ধোঁয়া বেরোচ্ছে, কত উচ্চতা এখানে? সাত হাজার কি সাড়ে সাত হাজার ফিট? তবু মনে হচ্ছে যেন আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। সমস্ত দুনিয়াটা আমাদের পদানত।

রেণু শীতে রীতিমতন কাঁপছে। আমি ওকে নিয়ে এলাম আমার কোটের মধ্যে। পকেটে হাত দিয়েও থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, রেণু, আর একটা সিগারেট খেতে পারি?

ঠিক যেন সেই কলেজ জীবনের মতন আমি রেণুর সামনে সিগারেট খেতে ভয় পাচ্ছি। রেণুও সেটা বুঝতে পেরে একটু হাসল। তাপর বলল, আচ্ছা খাও!

আমি সিগারেটটা ধরিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলাম রেণুর চুলের মধ্যে। আস্তে আস্তে ধোঁয়াগুলো ওর গুচ্ছ গুচ্ছ চুল ভেদ করে বেরোচ্ছে।

রেণু জিজ্ঞেস করল, চুলে গন্ধ হয়ে যাবে না?

আমি বললাম, হোক।

পুনরায় ধোঁয়া ছেড়ে আমি বললাম, এই এক বছর তোর কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়ে খুব ভালো করেছি। তাই তো এত সুন্দর জায়গায় তোকে ফিরে পেলাম।

ফিরে পাওয়ার কথাটা খুব হালকা শোনায়। যেন এটা ঠিক আমার ভাষা নয়। আমি একটু লজ্জিত ভাবে আবার বলি, তোকে এত কাছে পেলাম।

আমার মা তোমাকে বকেছিলেন, তাই না?

সে কিছু না। মাসিমা আমাকে ভালোবাসেন। শুধু ওঁর মনে একটু ভয় ঢুকেছিল।

তুমি কেন আমাকে বলোনি? সেই জন্যই তুমি আমাদের বাড়িতে আর আসতে না, আমি টেলিফোন করলে কিংবা তোমাদের বাড়িতে গেলে তুমি আমাকে এড়িয়ে গেছ– তুমি আমাকে অনেক কিছুই বলোনি।

রেণুকে চুপ করাবার জন্য আমি ওর থুতনিটা উঁচু করে ধরলাম, তারপর ওর ঠোঁটে ছোঁয়ালাম ঠোঁট। রেণু প্রথমে মুখটা সরিয়ে নিচ্ছিল, আবার এগিয়ে এল, আমি ওকে এক কল্পান্ত সময় নিয়ে চুমু খেলাম। যেন ওর ঠোঁটটা গলে গলে যাচ্ছে আমার ঠোঁটের মধ্যে। আমার জিভটা ওর জিভটাকে খুঁজে বার করে আলিঙ্গন করে রইল। এর আগে রেণুকে জোরজার করে বা তাড়াহুড়ো করে কয়েক বার চুমু খেয়েছি বটে, কিন্তু এটাই আসলে আমাদের জীবনের প্রথম চুম্বন।

চুম্বন মুক্ত হবার পর রেণু দু হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা রেখে বলল, আর কখনও পালিয়ে যেয়ো না।

আমার ওষ্ঠের সুস্বাদ উপভোগ করার জন্য আমি একটুক্ষণ চুপ করে থাকি। একটু একটুও দুঃখও হয়। জীবনের কত সুন্দর সময় নষ্ট হয়ে গেছে। রেণু আমাকে পালিয়ে যাবার কথা বলে, আমার ইচ্ছে হয় ওকে আমার শরীরের মধ্যে একেবারে মিশিয়ে দিতে।

আমি বললাম, রেণু, আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে তোকে দেখতে?

দেখতে পাচ্ছ না?

কী জানি, মনে হচ্ছে, কখনও তোকে দেখিনি। তুই এত নতুন হয়ে উঠলি কী করে?

আমি সেই রকমই আছি।

তোকে সম্পূর্ণ দেখতে চাই।

দেখো না।

জামাকাপড় ছাড়া।

রেণু মুখ সরিয়ে বলল, এই শীতের মধ্যে? তুমি কি পাগল? আমাকে মেরে ফেলতে চাও?

আমি এই শীতের মধ্যে সমস্ত জামাকাপড় খুলে এক ঘণ্টা দু ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। আমার এত আনন্দ হচ্ছে। আমি এখন সব পারি।

না, লক্ষ্মীটি এ রকম কথা বোলো না! আমার কী রকম গা শিরশির করছে।

তা হলে তোর বুকে মাথা রাখি?

আচ্ছা রাখো!

আমি রেণুর স্টোল ও শাড়ির আঁচল সরিয়ে ওর বুক খুঁজে বার করলাম। আমার রূপপিপাসু চোখ শরীরের রূপের মধ্যে বেশি আনন্দ পায়। নদী, ফুল, পর্বত শিখরের চেয়েও এই সদ্য-যুবতী রমণীর স্তনদ্বয়কে আমার বেশি আকর্ষণীয় সুন্দর বলতে দ্বিধা নেই। যে-প্রকৃতির দৃশ্য দেখে একটু আগে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, এখন আর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ হয় না। ব্লাউজ সরিয়ে রেণুর গোলাপি আভাময় দুই বুকের দিকে আমি কিছুক্ষণ নিৰ্ণিমেষে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ একবার মনে হয়, রেণুর বুকে যেন একটা জল রঙের মাছ আঁকা আছে। কীসের যেন সাংকেতিক চিহ্ন। দৃষ্টিবিভ্রম হয় আমার, তবু সেই চিহ্নটা আবার দেখি, সেটার মানে বোঝার চেষ্টা করি। তারপর সেখানে মুখটা রেখে গরম গরম নিশ্বাস ফেলে রেণুর শীত তাড়িয়ে দিই। মনে হয়, পৃথিবীতে এই আমার একমাত্র আশ্রয়।

সেখানে মুখ রেখেই আমি ফিসফিস করে বললাম, রেণু, সূর্যদার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী নই।

রেণু চমকে উঠল। আমার মুখটা জোর করে তুলে ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, আর ওকথা এক বারও উচ্চারণ কোরো না।

আমি ওর আঙুলটা সরিয়ে বললাম, না, বলতে হবে। এই তো শ্রেষ্ঠ জায়গা এইসব কথা বলার। তুই ভেবেছিলি—

রেণু আমাকে বাধা দিয়ে বলল, আমি ভুল ভেবেছিলাম। তুমি আমাকে শুধরে দিতে পারোনি? একটা কথাও না বলে চলে গেলে–

সূর্যদার আকস্মিক মৃত্যুর কথা শুনে রেণু এমন আঘাত পেয়েছিল যে আমাকে বলে উঠেছিল, তুমি কেন সূর্যদাকে দীপ্তিদিদের সন্ধান দিলে? ওখানে যদি না যেত–

রেণু সত্যিই ভুল করেছিল। আমি সূর্যদাকে দীপ্তিদির বিষয়ে একটাও কথা বলিনি কখনও। দীপ্তিদি একজন মন্ত্রীর স্ত্রী, একথা সূর্যদা কোনও না কোনও উপায়ে ঠিকই জেনে যেত। সেই ভাবেই জেনেছে। এতে আমার কোনও ভূমিকা নেই।

তবু একটা সূক্ষ্ম অপরাধবোধ আমাকে সব সময় খোঁচা দিয়েছে। আমি সূর্যদাকে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অন্তত একবার ভেবেছিলাম, সূর্যদাকে আমিই বলে দেব দীপ্তিদির কথা। সে-সময়ে আমার মাথার ঠিক ছিল না। বাড়িতে অশান্তি, মায়ের অসুখ, অনিচ্ছুক চাকরি-জীবন–তার ওপরে আবার রেণুর মা আমাকে ডেকে বারণ করে দিয়েছিলেন রেণুর সঙ্গে মিশতেতখন আমার মনে হয়েছিল, সবাই সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে আমার কাছ থেকে। তার ওপর সূর্যদার মতি পরিবর্তনের জন্য রেণু এগিয়ে গেল, সূর্যদার গায়ে হাত রাখল–তখন আমার সব রাগ পড়েছিল সূর্যদার ওপরে, আমি ভেবেছিলাম, যে-খবরের কাগজে দীপ্তিদি আর শংকর বোসের ছবি বেরিয়েছে, সেই কাগজখানা সূর্যদার সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বলব, এই নাও, এই দেখো তোমার নিয়তি! শুধু আমি কষ্ট পাব কেন সূর্যদাও পাক।

কিন্তু কাগজটা আমি দিইনি শেষ পর্যন্ত, ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, তবু যে মনে এসেছিল সেই কথাটা–রেণু বোধহয় আমার মুখ দেখে সেটা পড়ে ফেলেছিল। এ জন্য রেণুর অভিযোগ শোনার পর অনেক দিন আমি নিজেকে দায়ী করেছিলাম, চিন্তারও তো একটা পাপ আছে। কিন্তু আজ, এই প্রকৃতি ও রেণুর নগ্ন বুকের সামনে এসে মুহূর্তে আমার উপলব্ধি হয়, শুধু একটা চিন্তার জন্য মানুষ মরে না। তা ছাড়া, মৃতদের থেকে জীবিতরা

অনেক বেশি মনোযোগের যোগ্য।

রেণু আমার অন্যমনস্ক মুখখানা নিজের করতলে নেয়। তারপর বলে, এবার আমি তোমার বুকে একটু মাথা রাখি?

আমার একটু লজ্জা করে। আমার বুকে লোম আছে, রেণু তা দেখবে। আমি ওকে সামান্য বাধা দিতে যাই। রেণু হাসল। তারপর বলল, আমার থিয়েটার করা তোমার। পছন্দ হয়নি। সে কথা তখন বলনি কেন? বারণ করলে কি আমি যেতাম ওখানে? তুমি কেন নিজেকে লুকোও?

আমি রেণুর বুকে আবার হাত রাখলাম যেন প্রতিজ্ঞা করছি কিছু একটা। তবু মনে হয়, মাঝখানে একটা দেওয়াল উঠে গেল। রেণু এখনও অনেক দূরে–ওর কাছেও আমি সব কথা বলতে পারি না। সত্যি নিজেকে লুকোতে হয়। কেন?

ও নিজেই আমার জামার বোতাম খোলে। আমার লোমশ বুকে ওর মুখখানা চেপে ধরে। ওর পিঠের ওপর হাত রেখে আমার মনে হয়, রেণুর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। রেণু কি কঁদছে?

সেটা দেখা গেল না। হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামল। বেশ তো রোদ উঠেছিল, এখন আর একটুও রোদের চিহ্ন নেই, মেঘে সব দিক ঢেকে গেছে–তবে তো এই বৃষ্টি সহজে থামবে না। যেটাকে আমি দেওয়াল ভেবেছিলাম, সেটা আসলে মেঘ–আমাদের মাঝখানে কখন আবার এসে গেছে। রেণুর হাত ধরে আমি নীচের দিকে ছুট লাগালাম।

রেণুরা উঠেছে বিষ্ণুদের বাড়িতে। বিষ্ণুদের কেউ অনেককাল আর এদিকে আসে না, বাড়িটা খালিই পড়ে থাকে। সে বাড়ির জানলার রঙিন কাঁচের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। অনেক বছর আগে বিষ্ণুর সঙ্গে আমার এই বাড়িতে আসবার কথা ছিল, বাবা আসতে দেননি। পাতলা অভিমানে মনটা ভিজে যায়। সারা শরীর আগেই বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে।

রেণু বলল, বাড়ির মধ্যে আসবে না?

আমি রাজি হলাম না। এক্ষুনি অংশুর সঙ্গে কথাবার্তা বলার ইচ্ছে আমার একটুও নেই। রেণুর সৌরভটা অনেকক্ষণ ধরে লালন করতে চাই। অংশু বড় বাজে কথা বলে।

আমি বললাম, তুই আয় না আমাদের হোটেলে! আমি তোকে লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে চলে যাব।

রেণু উজ্জ্বল মুখে বলল, বেশ হয় তা হলে না? তোমার ঘরটা কি রাস্তার দিকে না পাহাড়ের দিকে।

পাহাড়ের দিকে জানলা আছে একটা। সেখানে তোর জন্য আমি ম্যাজিকে একটা স্বর্গের দৃশ্য এনে দিতে পারি।

কিন্তু আমার শাড়িটা যে একেবারে ভিজে গেছে? শাড়ি বদলে আসব? তুমি চলে যাও, আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছি। আমাকে ঢুকতে দেবে?

তোকে কেউ কখনও কোথাও আটকাতে পেরেছে? তোর কথা শোনেনি, এমন কেউ আছে?

রেণু হাসল। দরজায় হেলান দিয়ে বলল, একজন ছিল। না, দু’জন। সূর্যদা আর তুমি। তোমরা দুজনে একই রকম।

সূর্যদার সঙ্গে আমার কোনওই মিল নেই। আর কেউ কখনও বলেনি একথা, শুধু রেণুই বলল আমরা দুজনে এক রকম। হোটেলের ঘরে ফিরে এই কথাটাই আমার মাথায় ঘুরতে লাগল। সূর্যদা আর আমি যদি একসঙ্গে কোনও কাজে নামতে পারতাম! আমার অনেক আশা ছিল, সূর্যদা কিছুতেই আমাকে সঙ্গে নিল না।

রেণুর জন্যই সূর্যদার কথা আজ নতুন করে মনে পড়ে। সূর্যদার মৃত্যুর পর বেশ আলোড়ন হয়েছিল। একজন মন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টায় চারদিকে বেশ সাড়া পড়ে যায়। অনেকে বলেছিল, সূর্যদা আর সি পি আই-এর মেম্বার। সেই পার্টি থেকে আবার প্রতিবাদ করা হয়। শংকর বোসকে সূর্যদা পিস্তল হাতে নিয়ে বাংলোর মাঠে তাড়া করেছিল, এই দৃশ্যটা সূর্যদার চরিত্রের সঙ্গে মানায় বটে তবু আমরা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। সূর্যদা খুনজখমের লাইন ছেড়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া, ব্যক্তিগত কারণে যারা খুন করে তারা খুনি, সূর্যদা সে-চরিত্রের নয়। বড়দিও বিশ্বাস করেনি। বড়দি বলেছিল, বেয়াল্লিশ সালে যে-সময় সূর্যদা আশ্রয় নিয়েছিল ওদের বাড়িতে, সেই সময়ই বড়দি ওর পিস্তলটা সরিয়ে নেয়। সূর্যদা তো আর কোনও দিন সেটার খোঁজ করেনি। সেটা বহু দিন পড়েছিল বড়দির কাছে, বছর তিনেক আগে বড়দি সেটা গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। সূর্যদার মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়েছিল বড়দি–হঠাৎ বুড়ি হয়ে গেল। আমি দীপ্তিদিকেও দোষ। দিতে পারি না। হঠাৎ একটা আগুনের গোলা ছুটে এলে সবাই ছুটে বাঁচবার চেষ্টা করে। দীপ্তিদিও বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিংবা, তিনি তাঁর নিজস্ব উপায়ে বাঁচাতে চেয়েছিলেন সূর্যদাকে। যে ভালোবাসা দূরে ঠেলে দেয় তার দহন অনেক বেশি। শুনেছি, দীপ্তিদিকে এখন বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দীপ্তিদি এখন বুঝতে পারবেন, শুধু মৃত্যু নয়, অনেক সময় বেঁচে থাকাও কত মর্মহীন। সূর্যদার চেয়ে দীপ্তিদির জন্য আমার বেশি কষ্ট হয়।

রেণু আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই আসবে। কতক্ষণ পর সেই আধ ঘণ্টা শেষ হবে। আমি জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রইলাম। জানলার ঠিক নীচেই পাহাড়িদের একটা বস্তি। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে খেলা করছে সেখানে। একটা কুকুর তাদের পাশে পাশে এমন। ভাবে ঘুরছে, যেন সে বলতে চায়, আমায় খেলাতে নিচ্ছ না কেন? বৃষ্টির জল নানা ধারায় গড়িয়ে পড়ছে। রোদ উঠে গেছে আবার। অলৌকিক দৃশ্যের মতন জেগে ওঠে দূরের পাহাড়। রেললাইন ঝকঝক করছে, দুটি তরুণী মেয়ে ঠিক লাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে, মুখে তারা শব্দ করছে ঝিকঝিক ঝিকঝিক।

হঠাৎ মনে পড়ল, মৃত্যুর আগে বড়বাবু বলেছিলেন, দেখে গেলাম। একটা বিরাট বৈচিত্র্যময় জীবন কাটিয়ে এসে তিনি শেষ মুহূর্তে উচ্চারণ করেছিলেন তার উপলব্ধি। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রেণুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার মনে হয়, বড়বাবু ঠিকই বলেছিলেন, দেখে যাওয়া ছাড়া আর কী!

–o–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *