সন্ধের সময় একখানি বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল ভরত। এখনও তার ঘুমের ঠিক সময়-অসময় নেই, কখনও মাঝরাতে জেগে উঠে বসে থাকে, আর চক্ষু বুজতে চায় না, সেই অবস্থাতেই সে ভোরের পাখির ডাক শুনতে পায়। আবার কোনওদিন সকাল দশটাতেই ঘুমে চোখ টেনে আসে। এখন সে সংবাদপত্র পড়ে, বইও পড়ে, দ্বারিকা একগুচ্ছ বই পাঠিয়ে দিয়েছে তার জন্য। কিন্তু ভরত একটানা বেশিক্ষণ বইয়ের দিকে চেয়ে থাকতে পারে না, কিছুক্ষণ পরেই ক্লান্ত লাগে।
আজ সে চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়ের ‘উদ্ভান্ত প্রেম নামে গ্রন্থখানি পড়তে শুরু করেছিল। কেমন যেন অদ্ভুত ভাষা, ঠিক কবিতা নয়, কাহিনীর মতনও নয়। তিন-চার পৃষ্ঠার পরই ঘুমে ঢলে পড়েছিল সে। জেগে উঠল প্রায় তিন ঘণ্টা পরে। অসময়ের ঘুমে প্রহরজ্ঞান চলে যায়। ভরত প্রথমে বুঝতেই পারল না, এখন সকাল না বিকেল। তার ধারণা, ঘরের দরজাটা পায়ের দিকে, কিন্তু সেদিকে নিরেট দেওয়াল। তা হলে এ ঘরটা কার? তাকে কি স্থানান্তরিত করা হয়েছে?
সে উঠে বসে চোখ কচলিয়ে ভাল করে দেখল। না, সেই একই তো ঘর, দরজাটা ডান দিকে ঠিকই আছে। এক কোণে একটা লণ্ঠন জ্বলছে, তা হলে এখন রাত। কত রাত? সে ডেকে উঠল, ভূমি, ভূমি!
কেউ সাড়া দিল না।
জ্বরের ঘোর ও আচ্ছন্ন অবস্থাটা কেটে যাবার পর এই কয়েকটা দিন ভূমিসূতাকে ডাকলেই সাড়া পাওয়া তার অভ্যেস হয়ে গেছে। মেঝেতে একটা বিছানা পেতে ভূমিসূতা শুয়ে থাকে, তার ঘুম খুব পাতলা, ভরত জেগে উঠলেই কী করে যেন সে টের পেয়ে যায়। আজ সে গেল কোথায়? ভরত আবার দুবার ডাকল।
এবারে নীল পাড় শাড়ি পরা একজন পুরুষালি ধরনের স্ত্রীলোক দরজার কাছে এসে বলল, জল খাবেন? আপনার রাতের খাবার আনব?
ভরত চোখ সঙ্কুচিত করে তার দিকে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
স্ত্রীলোকটি বলল, আজ্ঞে আমি দাই। আমার নাম আন্নাকালী।
ভরত বলল, ভূমিসূতা কোথায়?
আন্নাকালী বলল, আজ্ঞে তা তো আমি জানি না। আমি এবেলা এসেছি। ওপরের দিদিমণি বলে দিয়েছেন, আপনি জেগে উঠলে আপনাকে খাবার দিতে। নিয়ে আসি?
জ্ঞান ফেরার পর থেকে ভূমিসূতার হাত থেকেই শুধু খেয়েছে ভরত। এক একসময় তার মনে হয়েছে, মাঝখানের এতগুলি বছর যেন অলীক, ভূমিসূতার সঙ্গে তার কোনওদিন বিচ্ছেদ হয়নি, নেহাতই দুঃস্বপ্ন, ভূমিসূতা সব সময় তার পাশে পাশে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
আন্নাকালী চলে যেতে ভরত পালঙ্ক থেকে নামল। এখন সে হাঁটতে পারে। চিকিৎসকরা তাকে দুবেলা ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তার শরীরের জীর্ণ-শীর্ণ ভাবটাও আর নেই, প্রতিদিন সকালে এক ক্ষৌরকার তার দাড়ি কামিয়ে দিয়ে যায়।
দরজার সামনেই একটা টানা বারান্দা, এক পাশ দিয়ে ওপরে ওঠার শ্বেত পাথরের সিঁড়ি। নীচের তলায় কিছু লোকজনের কথা শোনা যাচ্ছে। ভরত বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়াল। একটু পরেই একজন কর্মচারী ধরনের ব্যক্তি উঠে এল সিঁড়ি দিয়ে, ভরত তাকে ডেকে বলল, ও মশাই, একটু শুনবেন? দ্বারিকাবাবু কোথায়?
লোকটির খুব ব্যস্ত সমস্ত ভাব, বারান্দার অন্য কোণের একটি ঘরের বন্ধ দরজার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল, নামেননি এখনও? সময় হয়ে গেছে। আচ্ছা আমি খবর দিচ্ছি।
অবিলম্বেই সিঁড়িতে খটাস খটাস শব্দ করতে করতে নেমে এল দ্বারিকা। কোঁচানো ধুতির ওপর সিল্কের বেনিয়ান পরা, পায়ে খড়ম, কপালে রক্তচন্দনের তিনটি রেখা। ছাদে একটি ঠাকুর ঘর আছে, প্রতি সন্ধ্যায় দ্বারিকা সেখানে বেশ কিছুক্ষণ জপতপ করে। তারপর ছেলের সঙ্গে ক্যারাম খেলতে বসে, ফাঁকে ফাঁকে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনায়। ছেলের জন্য সকালে দুজন গৃহশিক্ষক আসে, সন্ধের সময় দ্বারিকা তার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবেই।
ভরতকে দেখে দ্বারিকা উৎফুল্ল হয়ে বলল, কী রে, ঘর থেকে বেরিয়েছিস? বন থেকে বেরুলো টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে! বাঃ দিব্যি দেখাচ্ছে। সেরেই তো উঠেছিস। আয় আমার সঙ্গে।
বারান্দার অপর দিকের কক্ষটির দরজা খুলল দ্বারিকা। তুলনায় এ কক্ষটি হোট, চামড়ার গদি মোড়া কয়েকটি সোফা রয়েছে, দেয়ালের গায়ে পর পর দুটি আলমারি। একটি আলমারি খুলতে খুলতে দ্বারিকা বলল, বোস। এটা আমার প্রাইভেট চেম্বার, এখানে আর কেউ ঢোকে না।
আলমারির তাকে সার সার বিলাতি মদের বোতল, কাট গ্লাসের গেলাস, ডিকান্টার। একটি বোতল বার করে গেলাসে সুরা ঢালতে ঢালতে দ্বারিকা বলল, রাত্রে ডিনারের আগে আমার এই কয়েক পাত্তর চড়ানো অভ্যেস হয়ে গেছে নইলে ঘুম আসে না। তুই একটু খাবি নাকি?
ভরত ক্ষমাপ্রার্থীর ভঙ্গিতে বলল, আমি তো আর ওসব খাই না।
দ্বারিকা বলল, এক সময় খেয়েছিস তো আমার সঙ্গে, মনে নেই? সেই উইলসন হোটেলে …. তারপর যাদুগোপালের সেই আবগারি জামাইবাবুর বাড়িতে, আহা সেই ভদ্রলোক বেঘোরে মারা গেছেন, তুই শুনেছিস সে ঘটনা?
ভরত সে বিষয়ে কোনও আগ্রহ না দেখিয়ে বলল, হ্যাঁরে দ্বারিকা, একজন শক্ত চেহারার স্ত্রীলোক আমায় খাবার দেবে কেন বলল?
মুখ ফিরিয়ে অট্টহাস্য করে দ্বারিকা বলল, শক্ত চেহারা! নরম মেয়েমানুষ হঠাৎ পাব কোথায়? চট করে ট্রেইল্ড নার্সও পাওয়া যায় না। মেডিক্যাল কলেজ থেকে এই একজন দাইকে আনিয়েছি, রাত্তিরে তোর যদি কিছু লাগে টাগে। একটু ব্র্যান্ডি খা, কোনও ক্ষতি হবে না। সোডা ওয়াটার মিশিয়ে দিচ্ছি, ভাল লাগবে। এ সব জিনিস একা একা ঠিক জমে না, একজন স্যাঙাত না হলে … আমি অবশ্য একাই খাই প্রায় দিনই … একটা চুরুটও ধরা, সেরে উঠেছিস, সেটা সেলিব্রেট করতে হবে না?
প্রায় অস্ফুট স্বরে ভরত বলল, ভূমিসূতা চলে গেছে?
দ্বারিকা বলল, হ্যাঁ, চলেই তো গেল।
ভরত জিজ্ঞেস করল, কেন?
দ্বারিকা দুটি গেলাস হাতে নিয়ে ভরতের মুখোমুখি সোফায় বসল। ভরতের চোখের দিকে বেশ কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বলল, কেন চলে গেল, তুই জানিস না? একটি মেয়ে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে এখানে পড়ে রইল, রাতের পর রাত জেগে তোর সেবা করল, সে হঠাৎ চলে যেতে চায় কেন, তুই বুঝিস না?
ভরত সরলভাবে মাথা নেড়ে বলল, না, জানি না।
দ্বারিকা বলল, অমন একটা গুণের মেয়ে, আমাদের কথা শুনে এক বস্ত্রে চলে এল, নিজের দিকে একবারও চায়নি, সর্বস্ব ঢেলে তোর যা সেবা করল, অতি আপনজন ছাড়া কেউ তেমন পারে না। তার বদলে তুই তাকে কী দিয়েছিস?
অসহায়ের মতন বিবর্ণ হয়ে গিয়ে ভরত বলল, আমি তাকে কী দেব? আমার তো কিছু নেই!
ভরতের হাতে একটা গেলাস তুলে দিয়ে দ্বারিকা বলল, নে, একটা চুমুক দে। মুখোনা অমন বেগুন ভাজার মতন করার দরকার নেই। ইডিয়েট! কিছু নেই মানে কী! আমি কি কোনও জিনিস দেবার কথা বলেছি? দ্যাখ ভরত, আমার বউটা প্রায় একটা পাগল! আমি অন্য কোনও স্ত্রীলোকের দিকে নজর দিইনি, তাকেই মনপ্রাণ সঁপেছি, তবু আজও আমি তার মতিগতির দিশা পাই না। আমার তুলনায় তুই দেখছি শিশু, নারীচরিত্র কিছুই বুঝিস না। একজন রমণীকে কী দিতে হয় জানিস না? দিতে হয় ভবিষ্যৎ!
ভরত বলল, আমাকে সে একবার বলেও গেল না?
দ্বারিকা বলল, সেটাও সে আমার গিন্নিকে বলে গেছে। সে চলে যাবার আগে তোকে যেন কিছু জানানো না হয়! শুনলুম তো, তুই যখন ঘুমুচ্ছিলি, তখন সে তোর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে গেছে। বিদায় নেবার সময় অনেক রকম আদিখ্যেতা হয়, হয়তো সেসব তার পছন্দ নয়।
ভরত আপন মনে বলল, আমাকে কালঘুমে পেয়েছিল!
দ্বারিকা বলল, তোর যে বন্ধুটি প্রায়ই আসে, হেমচন্দ্র, তার সঙ্গে নাকি তুই কদিন ধরে আলোচনা করছিস যে আর একটু সুস্থ-সবল হলেই তোরা আবার গুণ্ডামি শুরু করবি? আবার ডাকাতি করতে যাবি কিংবা কাকে মারবি! দেখিস বাবা, আমাকে জড়াস না। পুলিশের হুজ্জোত আমি সামলাতে পারব না। বাজারে জোর গুজব, আমি একজন সরকারি উঁকিলের কাছেও শুনেছি, তোদর ওই ‘যুগান্তর’ পত্রিকা অফিসে নাকি শিগগিরই পুলিশের হামলা হবে। যা সব গরম গরম লেখা বেরুচ্ছে, ইংরেজ সরকার তা আর কতদিন সহ্য করবে!
ভরত বলল, ভাই দ্বারিকা, তোকে জানাতে দোষ নেই। আমরা কয়েকজন মিলে তলোয়ার ছুঁয়ে অগ্নিসাক্ষী করে শপথ নিয়েছি, এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াবার জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেব! সে শপথ কি ভাঙা যায়? স্বাধীনতার ব্রত নিলে আর পিছিয়ে যাওয়া যায় না। সেটা কাপুরুষতা। আমি জীবনে আগে একবার চরম কাপুরুষের মতন কাজ করেছিলাম, আবার যদি সে রকম করি, তা হলে আমার বেঁচে থাকার কোনও মর্যাদা থাকবে না। হেম যদি আমাকে ডাকে, কিংবা নাও ডাকে, হেম কোনও পরিকল্পনা নিয়েছে যদি শুনতে পাই, তা হলে আমাকে যেতেই হবে। হেমের মতন খাঁটি মানুষ আমি আর দেখিনি। আমার জীবনের একটা সময়ে, যখন একেবারে দিশাহারা অবস্থা, কী করব, কোথায় যাব, বাকি জীবনটা কী করে কাটাব কিছুই ঠিক ছিল না, সেই সময় হেম আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। মেদিনীপুরে, হেমের সঙ্গে থেকে, ওর মনের জোর, ওর আত্মত্যাগের নিষ্ঠা দেখে আমি ওর সঙ্গে ছুটে গেছি। হেম যদি কিছু শুরু করে আবার, আমি ওর পাশে অবশ্যই থাকব।
দ্বারিকা বলল, আ মোলো যা! দেশের কাজ করবি তো কর না। কে বারণ করছে। আরও তো কত লোক দেশের জন্য ঝাঁপিয়েছে। কিন্তু তারা কি বিয়ে থা করে না, ঘর-সংসার করে না? সুরেন বাঁড়জ্যের বউ-ছেলেপুলে নেই? বিপিন পাল মশাই, তোদের অরবিন্দ ঘোষ, এমনকী তোর এত বন্ধু যে হেম, এরা সবাই তো বিয়ে থা করেছে। দ্যাখ ভরত, তোরও তো বয়েস কম হল না, তুই তো আর ছোঁকরাটি নোস্, কত আর ঘুরে ঘুরে বেড়াবি, এক জায়গায় থিতু হতে হবে না? ওই ভূমিসূতা মেয়েটা কতগুলো বছর তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে! থিয়েটারের মেয়ে হয়েও আর কোনও পুরুষের কাছে ধরা দেয়নি, এ কথা জনে জনে সাক্ষী দিয়েছে।
ভরত বিষণ্ণভাবে বলল, ঠিক বলেছিস, বয়েস হয়ে গেল, কতগুলি বছর এমনি এমনিই বৃথা কেটে গেল! অন্যদের সঙ্গে আমার একটা তফাত আছে, আমার যে অতিশয় দেরি হয়ে গেছে। আগামী মাসেই যদি আমাকে কোনও অ্যাকশানে যেতে হয়, আমি অনেকবার মরতে মরতে বেঁচে গেছি, কিন্তু প্রত্যেকবারই তো তা হবে না। দেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের মতন কিছু লোককে প্রাণ দিতেই হবে! ভূমিসূতাকে আমি কী দেব, আমার যে ভবিষ্যৎ বলেও কিছু নেই!
দ্বারিকা বলল, তোরা ইংরেজ তাড়াবি? কত বছর লাগবে? পঞ্চাশ, একশো, দুশো বছরেও এদের হঠানো যাবে?
ভরত বলল, তা জানি না। তবু লড়াইটা শুরু করতে তো হবে কোনও এক সময়। চিরকালের জন্য যারা পরাধীনতা মেনে নেয়, তারা কি পূর্ণ মানুষ হতে পারে? আমরা হয়তো তেমন কিছুই পারব না, এমনি এমনি প্রাণটা যাবে, তবু ইংরেজ শক্তির মতন এক বিশাল দৈত্যের অধীনতা মেনে নিইনি, আঘাত দিতে চেয়েছি, এই গবটুকু নিয়ে মরতে পারব। পরবর্তীকালের ছেলেরা সেটা বুঝবে না?
দ্বারিকার অনেক অনুরোধেও ভরত একবারের বেশি ব্র্যান্ডি নিল না। একটা চুরুট ধরিয়েও দু টান দিয়ে ফেলে দিল। মুখ এখনও বিস্বাদ হয়ে আছে। সারারাত তার ঘুম হল না। এপাশ ওপাশ করতে লাগল বারবার। বুকের মধ্যে অসম্ভব কষ্ট। ভূমিসূতাকে এতদিন পর এত কাছে পেয়েও আবার হারাতে হল। কিন্তু কোন আশ্বাসে সে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারত?
দ্বারিকার এখানেও আর বেশিদিন থাকা চলে না। দ্বারিকার ঔদার্যের তুলনা নেই, তবু তাকে বিপদে জড়ানো একেবারেই ঠিক নয়। উপকার যে নেয়, তারও কিছুটা বিবেচনা বোধ থাকা উচিত। একথা নিশ্চিত যে দ্বারিকা তাকে ছাড়তে চাইবে না। এরকম রাতের বেলায় সরে পড়তে হবে চুপি চুপি। দ্বারিকার স্ত্রী বসন্তমঞ্জরী আবার তাকে খুঁজে বার করবে? ওই রমণীটির অলৌকিক ক্ষমতার কথা ভাবলে, বিস্ময়ের সীমা থাকে না। অথচ বসন্তমঞ্জরী ভরতের সামনে আসে না, কথা বলে না তার সঙ্গে। এ বাড়িতে এসে সে একবারের জন্যও বসন্তমঞ্জরীর দর্শন পায়নি সজ্ঞানে।
না, চলে যেতেই হবে। কিন্তু কোথায় যাবে? এ শহরে আর কোনও আশ্রয় নেই ভরতের, পয়সা কড়িও নিঃশেষ। ভাঙা কালীমন্দির থেকে দ্বারিকা যখন তাকে উদ্ধার করে, তখন তার পকেটে ছিল একটি রিভলবার ও মাত্র বারোটি টাকা। রিভলবারটি দ্বারিকা বারীনদের দিয়ে দিয়েছে। নিজের শরীরের রক্তমাখা বারোটি টাকা রাখা আছে ভরতের বালিশের নীচে। এই তার শেষ সম্বল। মেদিনীপুরের খামার বাড়িটিও আর তার নিজের নেই। ফুলার বধের সংকল্প নিয়ে বেরুবার সময় নীলমাধব চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তির কাছে মাত্র পাঁচশো টাকায় সে খামার বন্ধক দিয়েছিল। সে বন্ধক ছাড়াবেই বা কী করে? এখনই অর্থ উপার্জনের চেষ্টাতেও সে লাগতে পারবে না, শরীর ততটা সমর্থ হয়নি, ওষুধ খেয়ে যেতে হবে আরও কিছুদিন। আবার কখনও সে আগের মতন শক্তি ফিরে পাবে কি না কে জানে!
অশক্ত শরীর, ভবিষ্যহীন একজন মানুষ, সে ভূমিসূতাকে কী দিতে পারে? তার মনের কথা সে কারওকে বলতে পারে না, কিন্তু যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকত, তা হলে ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলতে পারত, সে শুধু ভূমিসূতাকেই চায়। যদি মা বেঁচে থাকতেন, তা হলে মায়ের নামে দিব্যি দিয়ে বলত, ভূমিসূতার সঙ্গ না পেলে তার বাকি জীবনটা বিস্বাদ হয়েই থাকবে। তবু, এ চাওয়াও অর্থহীন, সে কিছুতেই ভূমিসূতাকে পাবার যোগ্য হয়ে উঠতে পারল না!
খ্যার খ্যার শব্দে একটা প্যাঁচা ডাকছে যেন কোথায়। এটা লক্ষ্মী প্যাঁচা না কাল প্যাঁচা? লক্ষ্মী প্যাঁচা নাকি সৌভাগ্যের ইঙ্গিত নিয়ে আসে। ভরত শয্যা থেকে নেমে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। প্যাঁচাটাকে দেখা গেল না। এ শহরে আর কোনও রাতপাখি ডাকে না। মেদিনীপুরে অনেক রাতেই একটা ‘চোখ গেল’ পাখির অশ্রান্ত ডাক শোনা যেত।
রাত্রির রাস্তা বেশি ঝকঝকে, পরিচ্ছন্ন দেখায়। গ্যাসের বাতির বদলে বিজলি-আলো জ্বলছে। একটাও গাড়ি ঘোড়া নেই। একটু পরে একজন তোক পথের ঠিক মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসতে লাগল। লোকটির কোনও ব্যস্ততা নেই, গুনগুন করে গান গাইছে। এত রাতে লোকটি কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে? ও যেন অনন্তকালের পথিক। ভরতের মনে হল, ওই মানুষটি সে নিজে। গন্তব্যহীন পথ চলাই তার নিয়তি।
বিছানায় ফিরে এসে সে ঠিক করল, মেদিনীপুরেই যেতে হবে, হেম সেখানে আছে। তার রাহা খরচ কুলিয়ে যাবে বারো টাকায়, হেমের কাছে তার কোনও চক্ষুলজ্জা নেই। এক হিসেবে দ্বারিকার চেয়েও হেমের কাছে সে বেশি সহজ হতে পারে। মাসের পর মাস সে হেমের সঙ্গে থেকেছে, স্টিমারে ঘুরেছে, এক অন্ন ভাগ করে খেয়েছে, এমনকী অনশনও ভাগাভাগি করেছে।
মেদিনীপুরে যাবার আগে একবারও কি ভূমিসূতার সঙ্গে দেখা হবে না?
ভরত চলে যাবার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে, এরই মধ্যে দিন চারেক পরে একটি অল্পবয়েসী ছেলে একটি চিঠি নিয়ে এল হেমের কাছ থেকে। সেই চিঠি পাঠ করে ভরত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। আবার সে দিকভ্রান্ত!
হেম লিখেছে :
ব্রাদার ভরত,
আমি চল্লাম, অনেকদিন আর আমার দেখা পাবে না। এই সব ছেলেখেলা আর আমার ভাল লাগছে না। বিপ্লবের নামে আমরা কী করছি? অজা যুদ্ধ, ঋষির শ্রাদ্ধ আর প্রভাতে মেঘডম্বরমের মতন সবই বহ্রারম্ভে লঘুক্রিয়া! আমাদের কোনও সত্যিকারের নেতা নেই, কেউ কারওকে মানে না, সবাই সবজান্তা! অথচ কেউই জানে না, কীভাবে গুপ্ত সমিতি গঠন করতে হয়। অস্ত্র চালনা বিষয়ে কারও কোনও জ্ঞান নেই। অরবিন্দবাবু যে বলেছিলেন, অন্যান্য রাজ্যে অনেক গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, তারা বিপ্লবের জন্য তৈরি, শুধু আমাদের সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য অপেক্ষা। কই, এ পর্যন্ত আর কারুরই তো কোনও সাড়া শব্দ নেই। এ সব আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে আমাদের আর কতদিন উত্তেজিত করে রাখবেন? কোমরের কষি যে আলগা হয়ে যাচ্ছে!
তাই আমি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই, নিজে কিছু পারি কি না। বিদেশে পাড়ি দিচ্ছি। হয়তো ফ্রান্সে যাব, কিংবা আমেরিকায় কিংবা রুশ দেশে। প্যারিস নগরীতে বহু দেশের গুপ্ত সমিতির আখড়া আছে বলে শোনা গেছে। তাদের কর্মপদ্ধতি দেখব, হাতেকলমে শিক্ষা নেব। বোমা বানানোনাও শিখে নিতে হবে। আমি কিছুদিন বিজ্ঞান পড়েছি, আমার পক্ষে খুব একটা শক্ত হবে না।
নিজের খরচ নিজেই চালাব, এ দেশের ধনীদের কাছে ভিক্ষা করতে আমার ঘৃণা হয়, তাই নিজের বাড়ি-জমি-সম্পত্তি সব বিক্রি করে দিয়েছি। মেদিনীপুরের পাটই তুলে দিয়েছি একেবারে, দারা-পুত্র-পরিবার, তুমি কার কে তোমার? সকলকে পাঠিয়ে দিয়েছি গৃহিণীর পিত্রালয়ে। ভাল কথা, তুমি শুনেছ কি না জানি না, মেদিনীপুরে কিছুদিন আগে এক মহা বিধ্বংসী ঝড় হয়ে গেছে, তাতে বহু লোকের বহু ক্ষতি হয়েছে। তুমি সাধ করে যে-সব গাছপালা লাগিয়েছিলে, তার অধিকাংশই সমূলে উৎপাটিত। বাড়িখানি মেরামতির অভাবে নড়ে ছিল, সেটি একেবারে বিধ্বস্ত। তুমি এসে দেখলে কষ্ট পাবে।
দেশান্তরে পাড়ি দিচ্ছি বলে ভেবো না পলায়ন করছি। দেশের জন্য প্রাণটা যখন একবার উৎসর্গ করে দিয়েছি, এ প্রাণের আর কোনও সাধ আহ্লাদ নেই। ফিরে আমি আসবই, তৈরি হয়ে আসব, সশস্ত্র হয়ে আসব। যে-ইংরেজ শাসকরা আমার দেশের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে, প্রতি বৎসর দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করছে, যারা ভারতীয়দের মানবেতর প্রাণী বলে মনে করে, আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বঙ্গভঙ্গ করে দিল, তাদের দুচারটিকে অন্তত হত্যা না করে আমি মরেও শান্তি পাব না। আমার এই শপথ সত্য হয় কিনা দেখো।
শরীরটাকে সারিয়ে তোলো। আমার অপেক্ষায় থেকো।
ইতি
তোমার হেম
পুনশ্চ : এই চিঠি পাঠ করা মাত্র ছিঁড়ে ফেলবে।
চিঠিখানি অন্তত তিনবার পড়ল ভরত। তারপর কুচি কুচি করতে করতে ভাবল, এরপর কী? তার নিয়তি এখন তাকে কোন দিকে নিয়ে যাবে?
আবার যেন দুর্বল হয়ে গেল শরীর। পরপর দু’দিন ভরত সক্ষণ শুয়ে কাটাল, আন্নাকালী তার জন্য খাবার নিয়ে আসে, তার কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। বই পড়ে না, মনটাও যেন কুয়াশাচ্ছন্ন।
এক সময় দ্বারিকা সে ঘরে উঁকি দিয়ে বলল, কী রে, ঘর থেকে আর বেরোস না কেন? সব সময় অন্ধকারে ভূতের মতন শুয়ে থাকিস। সন্ধেবেলা ডাকতে এসে দেখি তুই ঘুমোছিস। অসময়ের ঘুম মোটেও ভাল নয়। এক কাজ কর, বাইরে থেকে একবার ঘুরে আয়। মাথায় টাটকা বাতাস লাগুক। মনটা চাঙ্গা না হলে দেশের কাজ করবি কী করে?
দ্বারিকা প্রায় জোর করেই তাকে গৃহ থেকে নির্গত করে ছাড়ল। তাও একা যেতে দেবে না, ভাড়ার গাড়িতেও না, নিজের একটা একঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে দিল তাকে।
ভরত আর কোথায় যাবে, শহরের পথে পথে কি অনির্দিষ্টভাবে ঘোরা যায়, খানিকবাদে সে থামল যুগান্তর অফিসের সামনে। সেখানে আজ বিকেলে আড্ডা জমেনি, বারীন নেই, রয়েছে শুধু ভূপেন দত্ত আর উপেন বাড়জে, তারাও প্রফ সংশোধনে ব্যস্ত। তবু কিছুক্ষণ বসে রইল ভরত। কথায় কথায় জানা গেল, হেমচন্দ্র সত্যিই বাড়ি-জমি বিক্রি করে বিদেশে চলে গেছে, ওরাও সে সংবাদ জানে।
হেমের জন্য ভূমি তাকে কোনও প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি ভরত। হেম এখন নেই। ভূমিসূতাও তাকে ছেড়ে গেছে। সে আর একবারও ভরতের খবর নিতে আসেনি।
পরের সন্ধেবেলা দ্বারিকা আবার ভরতকে ধরল, নিয়ে গেল তার প্রাইভেট চেম্বারে। আজও সে ভরতকে জোর করেই ব্র্যান্ডি খাওয়াবে। তার ধারণা, ব্র্যান্ডি পান না করলে ভরতের এই জড়তা, মনের এই ক্লৈব্য কাটবে না।
দু’পাত্তর শেষ করার পর দ্বারিকা তাকে ধমক দিয়ে বলল, ভরত, তুই একটা কী রে, এমন অকৃতজ্ঞ মানুষে হয়? ওই যে নয়নমণি নামে মেয়েটি তোর সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেল, তুই তারপর আর তার কোনও খবরও নিলি না? এমন প্রাণ ঢালা সেবা করে গেল, তোকে সে-ই তো বাঁচিয়ে তুলল। বলতে গেলে, ডাক্তাররা তো এক সময় আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন, নয়নমণি, না না ভুল বলোম, ভূমিসূতা, সে যমের সঙ্গে লড়াই করেছে। তা সত্ত্বেও তুই তাকে দুটো ভাল কথাও বললি না?
ভরত শুষ্ক মুখে বলল, সে কোথায় থাকে তা আমি জানি না।
দ্বারিকা বলল, জানিস না তো আমাকে জিজ্ঞেস করিসনি কেন? লজ্জা? নাকি তোর মনটাই অসাড় হয়ে গেছে।
কার ণ ভরত বলল, তই তার বাড়ি চিনিস?
দ্বারিকা বলল, আলবাত চিনি। আমি আর যাদু অনেক কষ্টে তাকে খুঁজে বার করেছি। আমিই তাকে এখানে এনেছি। আমারও উচিত তাকে ধন্যবাদ জানানো। চল, এখনি যাই তার কাছে।
ঈষৎ নেশায় দ্বারিকা উত্তেজিত, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে গাড়ি তৈরি করার হুকুম দিল।
গঙ্গার ধারে সেই বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে বেজে গেল রাত সাড়ে আটটা। বাড়ির সামনে বেশ মজবুত লোহার গেট তালাবন্ধ, একজন নেপালি দ্বারবান বসে আছে, তার এক হাতে লোহা বাঁধানো লগুড়, কোমরে ভোজালি। বাড়ির মধ্যে বালিকাঁদের কলকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে।
দ্বারবানটি জেদি, সে তালা খুলবে না, এ সময় যে-কোনও লোকের প্রবেশ নিষেধ। কিছুটা তর্ক বিতর্কের পর সে জানাল যে মালিকানি বাড়িতে নেই, কলকাতাতেই নেই।
এর কথা বিশ্বাস করা যায় না। দ্বারিকার মনে আছে, আগের দিন সে একটি বয়স্কা মহিলাকে দেখেছিল বালিকাগুলির তত্ত্বাবধান করতে, ভূমিসূতা তাকে কিছু কিছু নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল। দ্বারবানটিকে সে বলল, আমরা ভেতরে ঢুকতে চাই না, মালিকানি নেই, আর যে একজন দিদিমণি আছে তাকে ডাকো। জরুরি কথা আছে।
বয়স্কা মহিলাটি এলেন বটে, তবু গেট খোলা হল না। দ্বারিকাঁদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি গেটের ওপাশ থেকেই জানালেন, ভূমিসূতা দু’দিন আগে কাশী চলে গেছে। কবে ফিরবে ঠিক নেই। কাশীতে সে কোথায় উঠবে, তা তিনি বলতে পারবেন না।
গাড়িতে উঠতে উঠতে দ্বারিকা বলল, ভালই হল। বেনারস অতি স্বাস্থ্যকর স্থান। তরিতরকারি যেমন টাটকা তেমনই চমৎকার স্বাদ। মালাই-রাবড়ি যত ইচ্ছে খাবি, শরীর খারাপ হবে না। সেবারে এলাহাবাদে তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল মনে আছে? সেখান থেকে কাশীতে এসে অনেকদিন ছিলাম। একটা ছোটখাটো বাড়িও কিনেছি। দশাশ্বমেধ ঘাটের প্রায় ওপরেই সেই বাড়ি, ছাদে দাঁড়ালে গঙ্গার দৃশ্য দেখতে পাবি। কবিরাজ মশাই কোন মহাপুরুষের কথা বলেছিলেন, একবার তাঁর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে পারিস। আমার বাড়িতে দুজন কর্মচারী আছে, তোর খাওয়া-থাকার কোনও অসুবিধে হবে না।
ভরত যেন দ্বারিকার পুরোপুরি বশ্যতা স্বীকার করেছে। আপত্তি জানাবার কোনও কারণও নেই। কলকাতায় সে শুধু বসে থেকেই বা কী করবে? যুগান্তর দলের নতুন কোনও পরিকল্পনা আছে বলেও মনে হল না। কাশীতে গেলে আর কিছু না হোক, দূর থেকে ভূমিসূতাকে অন্তত চোখের দেখাও তো দেখা যাবে!
পরদিনই সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। একজন কর্মচারী টিকিট কেটে হাওড়ায় ভরতকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে। দ্বারিকার সেদিন একটা মামলা আছে, সে নিজে যেতে পারবে না। ট্রেনে যাওয়ার জন্য ফল-মূল, চিড়ে গুড়ের একটা পুঁটলি বেঁধে দেওয়া হল। দ্বারিকা জোর করে একশোটি টাকা গুঁজে দিল ভরতের পকেটে। ভরত যে জামাকাপড় পরে আছে, তাও দ্বারিকার। অথচ দ্বারিকার কাছে কোনও কৃতজ্ঞতার কথা জানাতে গেলে সে প্রচণ্ড খমক দেবে।
যাত্রা করার আগে ভরত একবার ওপরের সিঁড়ির দিকে তাকাল। বসন্তমঞ্জরির কাছ থেকেও কি বিদায় নেওয়া উচিত নয়? কিন্তু সে নিজে থেকে একবারও দেখা করতে আসে না, দ্বারিকাও কিছু বলল না, ভরতের পক্ষে কিছু বলাও বোধ হয় শোভন নয়।
নীচে নামতে নামতে সে দ্বারিকার কাঁধ ছুঁয়ে বলল, তোর কাছে আর তোর বউয়ের কাছে চিরঋণী রয়ে গেলাম।
দ্বারিকা তার পিঠে চাপড় মেরে বলল, বাকি আছে, বাকি আছে। এর মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল নাকি? তুই আরও কত কীর্তি করবি, কে জানে!
দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে দ্বারিকার বাড়িটি সত্যি সুন্দর। তেমন কিছু বড় নয়, একতলায় তিনটি, দোতলায় দুটি কক্ষ, নীচের তলাটি খানিকটা স্যাঁতসেতে অন্ধকার মতো হলেও ওপরে প্রচুর আলোবাতাস। ওপর তলাটি মালিকপক্ষের ব্যবহার ছাড়া তালাবন্ধই থাকে। একেবারে সামনেই গঙ্গা।
বেনারসে এই সময় খুব ভিড়, প্রচুর জমিদার, রাজা-মহারাজরা এখানে আসেন। অনেকেই একটি করে শখের বাড়ি নির্মাণ করে রেখেছেন। এ শহর যেমন বিখ্যাত তীর্থস্থান, স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবেও নাম রটেছে। আবার তেমনি ফুর্তির স্থানও বটে। সন্ধে হলেই ডালমন্ডির বাঈজি পাড়া গমগম করে। সন্ধের পর ভরা গঙ্গায় অনেক বজরা ভাসে, তাতে বিলাসী পুরুষরা সুরার পাত্র হাতে নিয়ে গা এলিয়ে বসে থাকে, শোনা যায় নূপুর নিক্কণ। ভরত ছাদ থেকেও এ দৃশ্য দেখতে পায়।
যতই জনসমাগম হোক, কাশীতে বিশেষ কোনও মানুষকে খুঁজে পাওয়া শক্ত নয়। ভোরবেলা কিংবা অপরাহে বহিরাগতরা কোনও না কোনও ঘাটে আসবেই। ঘাটগুলি ঘুরে দেখলেই পরিচিত মুখ চোখে পড়বে। সবচেয়ে বেশি মানুষ আসে মণিকর্ণিকা আর দশাশ্বমেধ ঘাটে। বেণীমাধবের ধ্বজাতেও একবার না একবার সকলের ওঠা চাই।
কর্মচারী দু’জনের নাম সংগ্রাম সিং আর বিষ্ণুপদ মহান্তি। সংগ্রাম সিং মধ্যবয়সী, নামের সঙ্গে চেহারার মিল সামান্যই, তার মস্তবড় জুলফি দুটোই শুধু বীরত্বব্যঞ্জক, সে দু’খানা ঘর নিয়ে সপরিবারে থাকে। অপরজনের বাজপড়া তালগাছের মতন শরীর, চক্ষুদুটি চঞ্চল, দু’একটি কথা শুনলেই বোঝা যায়, এ লোকটির বুদ্ধি আছে। কর্মচারী হিসেবে বিষ্ণুপদ জুনিয়র, সে-ই ভরতের জন্য রান্না করে দেয়।
বিষ্ণুপদ রাঁধে ভালই, কিন্তু আহার্য পরিবেশনের সময় সে বড় বেশি কথা বলে। অনেক খবরাখবর রাখে সে। কিন্তু অত খবর জানার উৎসাহ নেই ভরতের। কেচ্ছাকাহিনীর দিকেই তার ঝোঁক। কোন রাজা কতগুলি রানি সঙ্গে নিয়ে এসেছে, দুজন বড় মানুষের বজরায় পাল্লা দিতে গিয়ে একটা ডুবে গেল, রাজস্থানের এক রাজকুমারী ভেগে গেছে এক মুসলমানের সঙ্গে … এইসব। তার কাছ থেকেই জানা গেল, গতবছর কাশীতে কংগ্রেসের অধিবেশন বসেছিল, সে কী এলাহি ব্যাপার, বড় বড় নেতারা ঝগড়া করেছেন খুব। হাতাহাতি হয় আর কি! স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতা এসেছিলেন, তাকে দেখে বিষ্ণুপদ মুগ্ধ, কী সুন্দর বাংলা কথা বলেন, তিনিই তো ঝগড়া থামালেন। সেই সিস্টার নিবেদিতা এবারেও কাশীতে এসেছেন, বিশ্বনাথের গলির কাছেই থাকেন।
ভগিনীর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি ভরতের। ইদানীং আর যোগাযোগ রক্ষা করাও হত না। সার্কুলার রোডের আখড়ার সময় ভগিনী অনেক বই জুগিয়েছেন, বিপ্লবী কাজকর্ম শুরু করার জন্য গোপনে পরামর্শ দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখালেখি করেন। কংগ্রেসের নেতারা যাওয়া-আসা করে তাঁর কাছে। ভরতের একবার ক্ষীণ ইচ্ছা হল ভগিনী নিবেদিতাকে প্রণাম জানিয়ে আসবে, একটু পরেই সে ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে দিল। থাক বরং, ভগিনী যদি কোনও দায়িত্ব দিয়ে দেন, তা পালন করার মতন মনের অবস্থা এখন নেই তার। দূর থেকে প্রণাম জানানোই ভাল।
গঙ্গার ঘাটগুলিতেই ভরত সময় কাটায়, পারতপক্ষে শহরের মধ্যে যায় না। গোধুলিয়ার মোড়ের কাছে অগণ্য মানুষ ও যানবাহনের ভিড়ে পথ চলা দায়। একেই তো বেনারস টাঙ্গায় টাঙ্গায় ছয়লাপ, তার ওপর নতুন উৎপাত হয়েছে মোটর গাড়ি, সেগুলি অনবরত ভেঁপু বাজায় আর ধোঁয়া ছাড়ে। কখন কাকে চাপা দেয় ঠিক নেই। কোনও হোমড়া-চোমড়া ব্যক্তি বা রাজা যখন যান, তাঁদের সঙ্গে থাকে প্রচুর সাঙ্গোপাঙ্গ, তাদের পথ ছেড়ে দেবার জন্য সেপাইরা সাধারণ পথচারীদের ডাভা তুলে হঠিয়ে দেয়।
ঘাটগুলিতে সারাদিন ধরে অনেক দৃশ্য বদল হয়। খুব ভোরে স্নান করতে আসে সাধুসন্ন্যাসী ও শহরের স্থায়ী অধিবাসীরা। একটু বেলা হলে আসে নবাগতের দল। তাদের কাছ থেকে অর্থ দোহন করার জন্য বহু লোক ব্যাপৃত। কেউ তেল মাখিয়ে দলাই মলাই করে দেয়, কেউ মানের পর কপালে ও বাহুতে চন্দন মাখায়, ছোট ছোট মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে পুরোহিত-পাণ্ডারা পুণ্য বিক্রি করার জন্য হাঁকাহাঁকি করে। এ ছাড়া রয়েছে ফিরিওয়ালা ও ভিখারি। স্নানপর্ব চলে বেলা তিনটে-চারটে পর্যন্ত, তারপর আসেন কথক ঠাকুররা, তারা রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী শোনান। বই দেখতে হয় না, সব তাঁদের কণ্ঠস্থ, এবং যে-যত নাটকীয়তা আনতে পারেন, তাঁর কাছে তত শ্রোতা জমে। কোথাও কোথাও বসে কীর্তন গানের আসর। নৌকো ভ্রমণে যায় অনেক যাত্রী। গঙ্গাবক্ষ থেকে বারাণসীর প্রাসাদমালা ঘাটের সিঁড়িগুলির দৃশ্য ভারী চিত্তহারী। বিলাসীদের বজরাও অগুন্তি। দূরে দেখা যায় রামনগর প্রাসাদের আলো।
ভূমিসূতাকে ভরত প্রথম দেখতে পেল এক সকালবেলা! সে বসেছিল মণিকর্ণিকাঘাটের সিঁড়িতে, পাশের শ্মশানে চিতা জ্বলছে, সে চেয়েছিল সে দিকে। স্ত্রী-পুরুষের স্নানের জন্য পৃথক ঘাট নেই। এখানে আব্রু রক্ষার জন্য কেউ ব্যস্ত নয়। এক জায়গায় বেশ কয়েকজন রমণী অবগাহন করছিল, তাদের মধ্য থেকে তিনজন এক সময় ওপরে উঠে এল। যাদের কাছাকাছি বাড়ি, তারা বাড়িতে গিয়েই কাপড় ছাড়ে, কেউ কেউ সিক্ত বস্ত্রেই পুজো দিতে যায়।
সেই তিনজনের দিকে একবার তাকিয়েই ভরতের বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। ওদের মধ্যে। যেজন যুবতী, সে ভূমিসূতা নয়? নিশ্চিত ভূমিসূতা। ভিজে শাড়ি শরীরে লেপ্টে আছে, এই অবস্থায় নারীদের দিকে চেয়ে থাকা অশোভন, তাই ভরত সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন কি সে ভূমিসুতাকে ডাকবে? এখন কথা বললে যদি নির্লজ্জতা মনে হয়? না, উচিত নয়।
সেই তিন রমণী এদিকেই আসছে। ভরত যদি মুখ ফিরিয়ে থাকে, কথা না বলে, তা হলে কি ভূমিসূতা মনে করবে যে সে ইচ্ছে করে ভূমিসূতাকে চিনতে চাইছে না? সে অপমানিত বোধ করবে? এই দোটানার মধ্যে কয়েক মুহূর্ত থেকেই ভত মনস্থির করে ফেলল। সে দ্রুত উঠে পড়ে চলে গেল ওপরের দিকে। একটা ঘটিবাটির দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ে গা-আড়াল দিল। তবু তার বুকের স্পন্দন থামে না। ভূমিসূতা কি তাকে দেখতে পেয়েছে? যদি দেখে থাকে, তবে নিশ্চয়ই ভাববে, ভরত কেন পলায়ন করল?
খানিকবাদে ভরত বুঝতে পারল, তার সিদ্ধান্তে ভুল হয়েছে। গঙ্গার ঘাটে সিক্ত বসনা নারীদের সঙ্গে অনেকেই কথা বলে। এখানে বিধবা স্ত্রীলোকদের সংখ্যা অগণ্য, তারা যে বয়েসেরই হোক, সায়া-সেমিজ কিছু পরে না, ভিজে শাড়িতে তাদের শরীরের সবকটি রেখা ফুটে ওঠে, তবু তাদের হায়া বলে কিছু নেই, সেই অবস্থাতেই তারা দোকানে দাঁড়িয়ে দর-দাম করে। কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। পরিচিতা নারীর সঙ্গে তো কথা বলাই যায়, ভরত কেন লজ্জা পেল?
ভূমিসূতা অপমানিত বোধ করতে পারে ভেবে সারা দিন বিমর্ষ হয়ে রইল ভরত।
পরদিন বিকেলেই সে আবার দেখতে পেল ভূমিসূতাকে। এবারে দশাশ্বমেধ ঘাটে এক কথক ঠাকুরের শ্রোতাদের মধ্যে। কথক ঠাকুরটির কণ্ঠস্বর বেশ জোরালো, প্রায় দেড়শো-দুশোজন শ্রোতাকে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। এখানে নারী ও পুরুষরা পৃথক ভাবে বসে। ভূমিসূতা বসে আছে অনেক স্ত্রীলোকের মাঝখানে। তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা শক্ত। ভরত অপেক্ষা করতে লাগল।
আসর যখন ভাঙল, তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। রাবণ সন্ন্যাসী বেশে এসেছে সীতাহরণ করতে, ইনিয়ে বিনিয়ে সে ভিক্ষা চাইছে, কিন্তু লক্ষ্মণের গণ্ডি সে পেরুবে না। সীতাও আসবে না গণ্ডির বাইরে। সন্ন্যাসীকে ভিক্ষা না দিয়ে ফিরিয়ে দিলে কতখানি পাপ হয় তা সবিস্তারে বলে গেল রাবণ, শেষ পর্যন্ত দুর্বল হয়ে গিয়ে সীতা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে গণ্ডি রেখার দিকে। এই পর্যন্ত বলেই থেমে গিয়ে কথক ঠাকুর হাতজোড় করে বললেন, বাবাসকল, মাঠাকরুণরা, অদ্য এখানেই সমাপন করি, আবার কাল হবে। অধমকে অনুমতি দিন, বাকিটা আগামীকাল শোনাব।
কথক ঠাকুরটি ভালই নাটক জানেন, সব শ্রোতাকে কাল আবার আসতেই হবে। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে একটি-দুটি পয়সা দিল পেতলের থালায়। ভরত তখনও ভূমিসূতাকে ডাকতে পারল না। কারণ সে আর চারজন বিভিন্ন বয়সী মহিলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার রাজ্যের লজ্জা পেয়ে বসল ভরতকে। গতকাল সকালে সে কেন ভূমিসূতার সঙ্গে কথা বলেনি, সেটা তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, কিন্তু অন্যদের সামনে সে পারবে না।
খানিকদূর গিয়ে অন্য মহিলারা নিশ্চয়ই যে-যার বাড়ির দিকে চলে যাবে, ভরত একটু দূরে থেকে ওদের পিছু নিল। ওরা আপন মনে গল্প করতে করতে চলেছে বাঙালিটোলার দিকে। অন্যদের বিদায় নেবার নাম নেই। সে বুঝতে পারছে যে এখানে যদি দ্বারিকা থাকত, তা হলে এক ধমক দিয়ে বলত, স্টুপিড, যা, দৌড়ে যা, ভূমিসূতার সামনে গিয়ে দাঁড়া, তা হলেই অন্য মেয়েলোকগুলো হটে যাবে। কিন্তু ভরত কিছুতেই সঙ্কোচ কাটাতে পারছে না।
পাশাপাশি দুটি বাড়ির একটির দরজা দিয়ে তিনজন রমণী ঢুকে গেল, অন্যটিতে ভূমিসূতার সঙ্গে একজন। আজ আর ভরতের ততটা অপরাধ বোধ হল না। ভূমিসূতার বাড়ি তো চেনা হয়ে গেল। এর পর একদিন এসে অনায়াসে দেখা করা যাবে। আজ রাত হয়ে গেছে। কিংবা কাল বিকেলে ভূমিসূতা ওই কথক ঠাকুরের কাছে যাবেই, তখন জড়তা কাটিয়ে ভরত নিশ্চিত ওর সঙ্গে কথা বলবে।
পরদিন সকালে বিষ্ণুপদ তাকে লুচি ও কুমড়োর ছক্কা খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, কাশীর ধারে কাছে কত দর্শনীয় স্থান আছে, আপনি কিছু দেখবেন না? বাবু যদি বলেন, আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি। আমি অনেকের গাইডের কাজ করেছি। হিষ্ট্রি, জিওগ্রাফি সব জানি।
এই বাক্যবাগীশ লোকটির সঙ্গে ভরতের ভ্রমণ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, তবে সারনাথ জায়গাটি দেখে আসা যেতে পারে। সে একাই যাবে, বেশি দূর নয়। বিকেলে কথকতা শুরুর আগেই ফিরে আসবে।
ভরত একটা এক্কা গাড়ি ভাড়া নিল। বড় বড় টাঙ্গা গাড়িগুলো একসঙ্গে অনেক যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে, তা দেখে ভরতের মনে পড়ল তার গৌহাটি থেকে শিলং যাত্রার কথা। ব্যামফিল্ড ফুলারের পেছনে কতই ছোটাছুটি করতে হয়েছিল, তার চুলের ডগাও স্পর্শ করা গেল না, মাঝখান থেকে ভরত প্রায় মরতে বসেছিল। ওই ভাবে প্রাণ দিলে তার প্রাণদান বৃথা হত। চাপেকর ভাইরা সাহেবদের মেরে তারপর মরেছে।
সারনাথে প্রচুর খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। এক একটা ঢিবির তলা থেকে পাওয়া যাচ্ছে নতুন নতুন সঙ্ঘারাম। আজ খুব চড়া রোদ, শোলার টুপি মাথায় দিয়ে কয়েকজন সাহেব তদারকি করছে খনন কার্যের। দর্শনার্থী এসেছে অনেক, তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা খুবই কম, শিশুরা রয়েছে, তারা ছোটাছুটি করছে চর্তুদিকে।
ভরত অন্যদের সংস্পর্শ এড়িয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখল। এখনও বেশি হাঁটলে বা অনেক সিঁড়ি ভাঙলে তার ক্লান্ত লাগে। মূল ভূপটি থেকে অনেকখানি দূরে সে একটা ঝাঁকড়া পিপুল গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিতে লাগল।
এই স্থানে গৌতম বুদ্ধ তাঁর বাণী প্রচার করেছিলেন। তিনি ঠিক কোথায় বসতেন? ভরত কল্পনা করার চেষ্টা করল। হয়তো এরকমই একটি বৃক্ষতলে পাথরের বেদিতে বসে থাকতেন বুদ্ধ। তাঁকে ঘিরে থাকত শিষ্যমণ্ডলী! বুদ্ধের কথা ভাবলেই ভরতের খুব বিস্ময় লাগে এই জন্য যে, কতকাল আগের কথা, প্রায় আড়াই হাজার বছর, তখনও সক্রেটিস আসেননি, যিশু আসেননি, মানব সভ্যতার ভাল করে বিকাশ হয়নি। সেই কালেও গৌতম বুদ্ধ এত সূক্ষ্ম দর্শনের অধিকারী হলেন কী করে? কী করে চিন্তা করলেন এমন এক ধর্মের কথা, যাতে ঈশ্বরের স্থান নেই? তখনও এই ভারতে কোনও বিদেশি আক্রমণ হয়নি, হয়তো শান্তি ছিল, সমৃদ্ধি ছিল, তাই জ্ঞানের চর্চা অত উন্নত হয়েছিল।
ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমে চক্ষু টেনে এল তার। গাছের তলায় অনেকখানি ছায়া, বাতাস বইছে, ঘুমটি বেশ গাঢ়ই হল। মাঝে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল, তাতেও তার ঘুম ভাঙল না। গাছটির ঘন পাতার ছাউনির জন্য তার গায়ে বেশি বৃষ্টি পড়েনি, তবু কিছু ছাঁট তো লেগেছে তাও সে টের পায়নি। গত রাতে অনেকক্ষণ সে ভূমিসূতার কথাই ভেবেছে, ভাল ঘুম হয়নি, তার মাথায় অনেক ঘুম জমে ছিল। সকল
ভরত যখন জেগে উঠল, তখন বিকেল হয়ে সূর্য ঢলে পড়েছে। অন্ধকার নামতে আর বেশি দেরি নেই। চর্তুদিক একেবারে শুনশান। দর্শনার্থীরা কেউ নেই, শ্রমিকরাও নেই। বৃষ্টির সময়ে সকলে নিশ্চয়ই চলে গেছে। সামনের রাস্তায় এসে ভরত আরও বিস্মিত হল। এখানে কয়েকটি দোকানপাট ও একটি ভাতের হোটেল ছিল, সব বন্ধ। দর্শনার্থীরা চলে গেলে আর কেউ থাকে না। টাঙ্গা বা এক্কাও নেই। ভরত এখন ফিরবে কী করে? সব কি মন্ত্র বলে উপে গেল?
দুপুরে কিছু খায়নি, সে উদরে যথেষ্ট ক্ষুধা টের পাচ্ছে। তার চেয়েও তার মন খারাপ লাগছে এই জন্য যে কথকতার আসরে সে পৌঁছতে পারবে না। আজও ভূমিসূতার সঙ্গে কথা হবে না।
বিষণ্ণভাবে সে হাঁটতে শুরু করল। এই শরীর নিয়ে আট-দশ মাইল পথ তার পক্ষে হাঁটা সম্ভব নয়। যদি পথে কোনও গাড়ি পাওয়া যায়। এ দিকে জনবসতি নেই, পথ অতি নির্জন। বিকেলের আলো ম্লান হয়ে আসছে আস্তে আস্তে।
ভরত যত এগোচ্ছে, কোনও গাড়ি-ঘোড়ার চিহ্নও দেখতে পাচ্ছে না। তা হলে এই পথের ধারেই আজ রাত কাটাতে হবে। এই ভেবে যখনই সে এক স্থানে বসার উপক্রম করল, তখনই শুনতে পেল একটা শব্দ। টাঙ্গা বা এক্কা নয়, মোটর গাড়ি। ধুলো উড়িয়ে আসছে। মোটর গাড়ি মানেই ধনী ব্যক্তিদের ব্যাপার, সে গাড়ি নিশ্চয়ই ভরতকে নেবে না। তা ছাড়া গাড়িটা আসছে কাশীর দিক থেকে।
গাড়িটা কাছাকাছি আসতেই ভরত রাস্তার একধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়িটা আসছে পথের বাম দিক ধরে, ভরত দাঁড়িয়েছে ডান দিকে, তবু গাড়িটা যেন হঠাৎ তার দিকে মুখ করে ছুটে আসতে লাগল। সত্যিই তাই। গাড়িটা তাকে চাপা দেবে নাকি?
ভরত দৌড়ে চলে গেল রাস্তার বিপরীত দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাও সেদিকে ঘুরে এল। ইচ্ছে করে তাকে চাপা দিতে চাইছে। আবার মৃত্যু ধেয়ে আসছে তার দিকে? কেন? কে আছে এই গাড়িতে? এ কি কোনও কৌতুকপ্রবণ মানুষের নিষ্ঠুর খেলা? এই জনশূন্য পথে ভরতকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করে গেলে কেউ কিছু টেরও পাবে না। কিন্তু কেন? ভরত তো কারুর কাছে কোনও অপরাধ করেনি।
রাস্তার দু’পাশে পাথুরে টিলা, তা বেয়ে ওঠার সময় নেই। গাড়িটা মাতালের মতন এদিক ওদিক করতে করতে তেড়ে আসছে তাকে, ভরত প্রাণভয়ে ছুটল, তার পায়ে বেশি জোর নেই, জোরে সে ছুটতে পারবে না বেশিক্ষণ। এক জায়গায় পাথরের একটু ফাঁক, সেখানে একটা জলাশয়, ভরত তার মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ল। গাড়িটা এঁকে বেঁকে এগোচ্ছে সামনের দিকে, কে যেন ভেতর থেকে চিৎকার করে কী বলছে। একটু পরেই গাড়িটা একটা বড় পাথরের চাঁইয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে এক দিকে কাত হয়ে গেল।
ভরত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, এবারেও বেঁচে গেলাম তা হলে? এক সময় গাড়িটা খুব কাছে এসে গিয়েছিল, দৌড়তে দৌড়তে একবার পিছু ফিরে দেখেছিল, গাড়ির সামনেটা যেন একটা হিংস্র রাক্ষসের মুখের মতন, দু পাশে দুটি জ্বলন্ত চোখ, আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাকে গ্রাস করবে! ভূমিসূতার সঙ্গে আর দেখা হবে না।
আস্তে আস্তে ভরত সেই পানাভরা পুকুরটি থেকে উঠে এল। শরীর এখনও থরথর করে কাঁপছে। তাকে নিয়ে মৃত্যুর এ কী ছেলেখেলা!
শ খানেক গজ দূরে গাড়িটা কাত হয়ে আছে, কৌতূহলী হয়ে ভরত গুটিগুটি সেদিকে এগিয়ে গেল। ভেতর থেকে কার যেন ক্ষীণ কাতর স্বর শোনা যাচ্ছে। মৃত্যুপথযাত্রীর কান্নার মতন। তাকে মারতে এসে কেউ নিজেই নিহত হল? ভরত দেখতে চায় সেই অজ্ঞাত আততায়ীর মুখ।
কাছে এসে দেখল, গাড়ির চালক ছাড়াও আর একজন রয়েছে পাশে। সেই পাশের লোকটি কোনও সাড়া শব্দ করছে না, গাড়ির চালকটি গোঙাচ্ছে, তার শরীর রক্তাক্ত। দু’জনেরই সম্রান্ত ব্যক্তিদের মতন পোশাক। তার মধ্যে চালকটিকেই বেশি পদমর্যাদাসম্পন্ন মনে হয়, তার গলায় তিন ছড়া খাঁটি মুক্তোর মালা ম্লান আলোতেও বোঝা যায়। স্টিয়ারিং-এর ওপর রাখা হাত দুটিতে অনেকগুলি আংটি।
কোনওরকমে দরজাটা খুলে ভরত প্রথমে পাশের লোকটিকে তুলে এনে পথের ওপর শুইয়ে দিল। এর শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই, নিশ্বাস পড়ছে, মনে হয় জ্ঞান হারিয়েছে। চালকটিকে বার করা শক্ত হল, তার বুকে জোর আঘাত লেগেছে, সারা বুক রক্তে মাখামাখি, নাক দিয়েও রক্ত পড়ছে। ভরত তাকে পাঁজা কোলা করে তুলে আনল, তারপর শুইয়ে দেবার আগে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে, ভরত অনড় হয়ে গেল। এ কার মুখ? কোনও ভুল নেই, এ তো ত্রিপুরার মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য! রক্তের সম্পর্কে তার ভাই।
রাধাকিশোর গাড়ি চাপা দিয়ে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল? কেন? ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে অন্তত কুড়ি বছর ভরতের কোনও সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে সেরাজ্যের কেউ তাকে দেখেনি, সে ত্রিপুরার কোনও ক্ষতি করেনি, তবু কেন এতগুলি বছর ধরে রাধাকিশোর তার ওপর জাতক্রোধ পুষে রেখেছে? কী সেই রহস্য!
হঠাৎ ভরতের শরীরটা যেন জ্বলে উঠল। এখুনি রাধাকিশোরের গলা টিপে সে খুন করে প্রতিশোধ নিতে পারে। পাশের লোকটার মাথায় একটা পাথর দিয়ে ছাচা মারলে আর জ্ঞান ফিরে পাবে না। সব শেষ হয়ে যাক! বিনা দোষে ওরা তাকে হত্যা করতে চেয়েছে। ওদের জন্যই তার সারাটা জীবন বিড়ম্বিত, বারবার সে দেখতে পায় মৃত্যুর উদ্যত থাবা। এবার সে কেন ঘুরে দাঁড়াবে না? সে কেন প্রতিশোধ নেবে না?
কোনও মৃত্যুপথযাত্রীকে খুন করার মনোবৃত্তি নিয়ে ভরত জন্মায়নি। শিক্ষা-দীক্ষায় পরিশ্রুত হয়েছে সে, রাজকীয় নিষ্ঠুরতা তার নেই। প্রতিশোধের কথা একবার মনে আসে মাত্র, তা আসে বুক ভরা অভিমান থেকে। রাধাকিশোরকে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিয়ে ভরত ছুটে গিয়ে পুকুর থেকে আঁজলা ভরে জল নিয়ে এল।
পাশের লোকটি এর মধ্যে জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসেছে। তার বিমূঢ় অবস্থা এখনও কাটেনি। এবার ভরত/ওকেও চিনতে পারল। মহিম ঠাকুর, সে আগের রাজা, ভরতের পিতার দেহরক্ষী ও বিশেষ অনুগত অনুচর ছিল। এই মহিম নিশ্চয়ই সব জানে।
মহিম মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, কী হল? কী হয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট। মহারাজ কোথায়, মহারাজ নেই?
ভরত অঙুলি নির্দেশ করে বলল, ওই যে! বেঁচে আছেন এখনও।
মহিম আর্তনাদ করে বলে উঠল, কী সর্বনাশ। আমি কত করে বারণ করেছিলাম, এখন কী হবে? মহারাজাকে কী করে নিয়ে যাব?
তারপর ভরতের হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ও মশাই, আমাদের বাঁচান। ইনি কে জানেন, যে-সে লোক নন, ত্রিপুরার মহারাজ, এর প্রাণ বাঁচাতেই হবে।
ভরত রাধাকিশোরের রক্ত ঢাকা চোখদুটি ধুইয়ে দিতে দিতে বলল, এঁকে আগেই চিনতে পেরেছি। কিন্তু একটা কথা বলুন তো, আপনারা আমাকে মারতে চেয়েছিলেন কেন? আমাকে কি আপনারা চেনেন?
মহিম বলল, মারতে চেয়েছিলুম? না, না! ও হাঁ, হ্যাঁ, আপনি আর একটু হলে চাপা পড়তেন, ঠিকই, মহারাজ নতুন গাড়ি চালানো শিখছেন, সামলাতে পারেননি, কিংবা কোনও যন্ত্রের গলদ হয়েছে, উনি গাড়িটা থামাতে পারছিলেন না। আপনাকে মারতে চাইব কেন? কেউ কি শুধু শুধু কোনও মানুষকে মারতে চায়? আপনাকে তো চিনিই না। এর আগেও একটা গাছে ধাক্কা লেগেছিল…
ভরত বলল, ওঁকে এক্ষুনি নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে, ডাক্তার দেখাতে হবে, কিন্তু নেবেন কীসে।
মহিম বলল, আপনি ভাই দয়া করে একটা ব্যবস্থা করুন। আমার এখনও মাথা ঝিমঝিম করছে, উঠে দাঁড়াতে পারছি না।
ভরত বলল, এখন গাড়ি কোথায় পাই। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় … এত রক্ত বেরিয়েছে।
রাধাকিশোরের গোঙানি থেমে গেছে, তাতে আরও ভয় হয়।
মহিম মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, এত করে নিষেধ করেছিলাম, কিছুতেই শুনলেন না। গোঁয়ারের মতন জেদ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এলেন। নিজে গাড়ি চালাবেন, ভাল করে শেখেননি। আপনি মহারাজাকে চেনেন বললেন, আগে দেখা হয়েছে বুঝি?
ভরত বলল, না, সে ভাবে নয়। রাজা-মহারাজদের লোকে যেমন দূর থেকে দেখে, সেই রকম।
ভরত আর একবার এক আঁজলা জল এনে রাধাকিশোরের মুখে ঢেলে দিল। তাতে কিছু ফল হল। এখনও প্রাণ আছে, শরীরটা মৃগী রোগীর মতন মাঝে মাঝে জোরে কেঁপে উঠছে।
ভরত মহিমকে বলল, আপনি তা হলে মহারাজের কাছে বসুন। আমি দেখি যদি কোনও গাড়ি জোগাড় করা যায়।
সৌভাগ্যবশত খানিকদূর এগিয়ে একটা টাঙ্গা পাওয়া গেল। পথের বাঁকে টাঙ্গাটা একটা গলিপথে ঢুকে পড়তে যাচ্ছিল, ভরত ছুটে গিয়ে টাঙ্গাওয়ালার হাত চেপে ধরল। সে টাঙ্গায় একজন যাত্রী আছে, তার কাছে কাকুতি মিনতি করে রাজি করিয়ে টাঙ্গাটির মুখ ফেরানো হল।
আগের যাত্রীটি বসল সামনে, মহারাজাকে শুইয়ে দেওয়া হল পেছনের মালপত্র রাখার জায়গায়, দু পাশে বসল মহিম আর ভরত। মহিম টাঙ্গাওয়ালাকে বলল, যত টাকা লাগে দেব, তুমি ভাই খুব জলদি আমাদের বেনারস পোঁছে দাও।
ভরতের হাত জড়িয়ে ধরে সে আবার বলল, ভগবান আপনাকে পাঠিয়েছেন। আপনি না থাকলে কী যে হত, আমরা কেউই বাঁচতাম না। মহাশয়ের নামটি জানতে পারি কী!
ভরত বলল, একেই বলে বোধ হয় নিয়তি। আমার নাম শুনে আর কী করবেন। বলতে গেলে মিথ্যে নাম বলতে হবে।
মহিম চমকিত হয়ে এক দৃষ্টিতে ভরতের মুখের দিকে চেয়ে রইল। আত্মগত ভাবে বলল, চেনা চেনা লাগে যেন, মুখের আদলে মিল আছে, আপনি কি ত্রিপুরার লোক?
ভরত বলল, মহিমদাদা, আমি ভরত। মনে আছে কি আমার কথা?
ভ্রূকুঞ্চিত করে মহিম বলল, ভরত? মানে, কোন ভরত?
তারপরই উচ্ছ্বসিত ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি সেই ভরত? এতদিনে তোমার সন্ধান পেলাম, তাও, এইভাবে, এই সময়ে? তোমার কথা প্রায়ই আমরা বলি। সেইজন্যই মনে হচ্ছিল, পরলোকগত মহারাজের সঙ্গে মুখের কিছুটা মিল আছে। তুমিও তো রাজকুমার!
ভরত বলল, না, আমি রাজকুমার নই। আমি কাছুয়ার সন্তান। আমার কোনও বংশ পরিচয় নেই!
মহিম বলল, তাও কি হয়? পিতার পরিচয়েই সন্তানের পরিচয়। স্বৰ্গত-মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের রক্ত বইছে তোমার শরীরে। আগরতলায় এখনও সবাই জানে, ভরত নামে একজন রাজকুমার নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। আশ্চর্য না, কী আশ্চর্য! ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের প্রাণ রক্ষা পেল।
ভরত ঈষৎ শ্লেষের সঙ্গে বলল, একটু এদিক হলে সেই ভাইয়ের হাতে এই ভাইয়ের প্রাণটাও যেতে পারত! বেঁচে গেছি শুধু এই জন্য যে আমার কপালে এখনও মৃত্যু লেখা নেই। মহারাজ কি আরও কারওকে চাপা দিয়েছেন নাকি?
মহিম বলল, টাকটুক লেগেছে কয়েক জায়গায়, কিন্তু মানুষ মরেনি। যন্ত্রপাতির ব্যাপার, কখন কী হয় বলা তো যায় না। নিশ্চয়ই হঠাৎ ব্রেকটা বিগড়েছে। হল কি জানো, আমাদের যে-ড্রাইভার, কাল রাত থেকে তার ধুম জ্বর। বিকেলে মহারাজের শখ চাপল গাড়ি নিয়ে হাওয়া খেতে বেরুবেন, তাই নিজেই চালাতে লাগলেন। রাজারাজড়ারা মানুষের ওপর হুকুম চালাতে পারেন, কিন্তু যন্ত্র কি হুকুম মানে? ভরত, শুধু তোমার প্রাণ কেন, আমার প্রাণটাও তো যেতে বসেছিল! আমি অনবরত দুর্গানাম জপেছি। মা ত্রিপুরেশ্বরী আমায় বাঁচিয়েছেন। এখন মহারাজকে যদি …
দুজনেই সংজ্ঞাহীন রাধাকিশোরের দিকে তাকাল স রাজাদের কত গাড়ি-ঘোড়া থাকে, কত হুকুমের চাকর থাকে, কুসুম-কোমল, দুগ্ধফেননিভ শয্যায় শোওয়া অভ্যেস, সে রকম একজন রাজা এখন পড়ে আছে টাকার পেছনে বেওয়ারিশ লাশের মতন, গর্তবহুল রাস্তায় টাঙ্গাটা মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠছে, তাতেও রাজার শরীরে কোনও স্পন্দন নেই, শুধু নাক দিয়ে এখনও রক্ত গড়াচ্ছে।
মহিম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল এতক্ষণ বাদে।
এই অবস্থাতেও ভরতের মনে পড়ল, আজ আর কথক ঠাকুরের আসরে পৌঁছনো যাবে না। দেখা হবে না ভূমিসূতার সঙ্গে।
রাজবাড়িতে পৌঁছনোর পর দারুণ শশারগোল পড়ে গেল। বাড়িতে অনেক লোক, সকলেই মহারাজের জন্য উদ্বিগ্ন ছিল, সেই মহারাজ ফিরে এলেন মুমূর্ষ অবস্থায়।
রাধাকিশোর মাণিক্য এমনিতে ধীর স্থির মানুষ, কখনও কোনও খেলাধুলোতেও উৎসাহ দেখাননি, শুধু ইদানীং এই মোটর গাড়ি নিয়ে শিশুর মতন মেতে উঠেছিলেন। এ খেলা তাঁর মানায় না, তাই এমন নির্মম পরিণতি।
ধরাধরি করে রাধাকিশোরকে দোতলার একটি কক্ষে শুইয়ে দেওয়া হল। শহরের খ্যাতনামা দুজন চিকিৎসককে নিয়ে আসা হল প্রায় জোর করেই। মহারাজের যা অবস্থা তাতে আজ রাতটাও কাটবে কি না বলা যায় না। বুকের বেশ কয়েকটা পাঁজরা ভগ্ন হয়েছে।
কাশীতে ভাল হাসপাতাল নেই, একটিই আছে সরকারি দাঁতব্য চিকিৎসালয়। ধনী ব্যক্তিদের নিজেদের বাড়িতেই চিকিৎসা হয়। তবু চিকিত্সক দু’জনের অভিমত, হাসপাতালে অপারেশনের ব্যবস্থা আছে, সেখানেই নিয়ে গেলে ভাল হয়। মহারাজের শিয়রের কাছে দণ্ডায়মান রাজপুরোহিত তাতে ঘোর আপত্তি জানালেন। স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজাকে সাধারণ মানুষের ব্যবহ্রার্য কোনও চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর আরও অনেক বছর আয়ু আছে, তিনি এখানেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। অন্তঃপুরের মহিলাদেরও সেই অভিমত।
মহিম কিছুতেই ভরতকে যেতে দিল না। ভরতের পোশাকও সম্পূর্ণ রক্তাক্ত, এই অবস্থায় সে যাবে কী করে? তাকে জোর করে স্নানের ঘরে পাঠিয়ে এক প্রস্থ পোশাক দেওয়া হল। তারপরেও মহিম তাকে বসিয়ে রাখল মহারাজের শয্যার পাশে।
রাধাকিশোরের জ্ঞান ফেরেনি। তাঁর সর্বাঙ্গ ধুইয়ে মুছিয়ে, ওষুধ প্রয়োগ করে, ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে পেরিয়ে গেল মধ্যরাত। ভরতের ওপরেও কম ধকল যায়নি, সে নিজেও যে সম্পূর্ণ সুস্থ নয়, তা তো কেউ জানে না এখানে। দৌড়োদৌড়ি করার ফলে তার পেটের ক্ষতস্থানের সেলাইয়ে একটু একটু ব্যথা শুরু হয়েছে। তা ছাড়া, তার ঘুম। ঘুমে টেনে আসছে তার চোখ, চুলে পড়েছে কয়েকবার। এ বাড়িতে সবাই এখনও জেগে আছে, এর মধ্যে তার ঘুমিয়ে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না।
এক সময় সে মহিমের হাত ধরে অনুনয় করে বলল, আমি এখন বাড়ি যাই। আবার প্রয়োজন হলে অবশ্যই আসব।
মহিম রাজি হল বটে, কিন্তু একলা ছাড়ল না। রাজবাড়ির একটি জুড়িগাড়ি তাকে পৌঁছে দিয়ে এল বাড়িতে।
পরদিন বিকেলের রোদ পড়ার আগেই জরুরি এত্তালা এল রাজবাড়ি থেকে। এক কর্মচারীর হাতে মহিম ঠাকুর চিঠি পাঠিয়েছে, ভরতকে এখুনি একবার আসতে হবে, সে যেন এক মুহূর্তও বিলম্ব করে!
ভরত একবার ভাবল, তবে কি রাধাকিশোরের অন্তিমকাল ঘনিয়ে এসেছে? এই সময় সে গিয়ে কী করবে? রক্তের সম্পর্কের ভাই চলে যাচ্ছে, কিন্তু ভরত কোনও টান অনুভব করছে না। রাজপরিবারের সকলে কান্নাকাটি শুরু করবে, ভরত তো তাদের কেউ না!
তবু এমন পত্র প্রত্যাখ্যান করা যায় না। একবার ভদ্রতার স্তরে উন্নীত হলে, মানুষ ভদ্রতার ক্রীতদাস হয়ে যায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভরত পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিল।
রাজবাড়িতে এসে দেখল অন্য চিত্র। দাস-দাসী, দ্বারবানরাও উৎফুল্ল। মহারাজের অবস্থার আশাতীত উন্নতি হয়েছে। তার জ্ঞান ফিরে এসেছে তো বটেই, তিনি খানিকটা সুরুয়া খেয়েছেন, কথা বলেছেন অনেকের সঙ্গে। রাজপুরোহিতের কথাই সত্য হয়েছে, মহারাজ এ যাত্রা বেঁচে যাবেন।
মহিম ঠাকুর ভরতকে নিয়ে এল রাজকক্ষে। চিকিৎসকরা এখন নেই, ঘর ভর্তি অনেক মানুষ, তার মধ্যে কয়েকজন নানা বয়সী মহিলাও রয়েছেন। সম্ভবত কয়েকজন রাধাকিশোরের পত্নী, কয়েকজন মাতা ও বিমাতা। অন্য পুরুষদের সামনে এই মহিলারা থাকেন না, কিন্তু এর মধ্যে নিশ্চিত ভরতের পরিচয় সকলকে জানানো হয়েছে। সে একজন রাজকুমার, তার কাছে আব্রু রক্ষার প্রয়োজন নেই।
ভরত এক মুহূর্তের জন্য ভাবল, এই মহিলাদের মধ্যে মনোমোহিনীও আছেন নাকি? এতদিন পর ভরত তাঁকে দেখলে চিনতেও পারবে না। সে শুনেছে, বৈধব্য বরণের আগে মনোমোহিনী অনেকগুলি সন্তানের জননী হয়েছেন।
মহারাজের শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি বালিকা, তিনি তাঁর সঙ্গে মৃদুস্বরে কথা বলছেন। মহিম ভরতকে কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, মহারাজ, এই দেখুন, ইনিই কুমার ভরতচন্দ্র।
মহারাজ তার একটা হাত দুর্বলভাবে তুলে বললেন, ভাই–
মহিম বলল, মহারাজ, কাল এঁর জন্যই আমরা রক্ষা পেয়েছি। ইনি না থাকলে যে কী হত!
ভরতের চোখে ভেসে উঠল গতকাল সায়াহ্নের সেই দৃশ্য। হিংস্র দানবের মতন গাড়িটা তেড়ে আসছে তার দিকে, সে প্রাণ ভয়ে ছুটছে। যন্ত্রের দোষ?
মহারাজ বললেন, আমি সব শুনেছি। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। আমার হাতখানি ধরো। তোমার কথা আমরা প্রায়ই বলি–
ভরত সেই হাত স্পর্শ করল।
মহারাজের চক্ষু দুটি জলে ভরে গেল। তারপর মাথাটা তোলার চেষ্টা করে বললেন, শশীমাস্টার, শশীমাস্টার বলেছিল, আমি তোমাকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলাম। মিথ্যা, মিথ্যা! মঙ্গলময় ঈশ্বর জানেন, এমন পাপের কথা আমি কখনও মনেও স্থান দিইনি। আজও যদি আমি মিথ্যা বলি, তবে যেন আমার নরকেও স্থান না হয়। গীতা নিয়ে এসো, আমি গীতা ছুঁয়ে বলব–
কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, মহারাজ, অত উত্তেজিত হবেন না। আপনি শান্ত হন।
মহিম বলল, সবাই জানে, আপনি কখনও মিথ্যা বলেন না। সেই ঘটনার অনেক তদন্ত করেছি আমরা, কোনও সদুত্তর পাইনি।
মহারাজ বললেন, তুমি আমার ভাই, আমাদেরই বংশের একজন।
মহিম বলল, রাজবংশতালিকায় ওর নাম উঠে গেছে।
মহারাজ বললেন, তোমার জন্য তিনশো টাকা মাসোহারা ধার্য আছে। তুমি যখন ইচ্ছে নিতে পাবো। কথা দাও, তুমি আমার সঙ্গে ত্রিপুরায় যাবে। উজ্জয়ন্ত প্রাসাদে থাকবে আপন অধিকারে। জিয়া এক সঙ্গে এত কথা বলে মহারাজ হাঁপাতে লাগলেন।
এরকম অবস্থার মধ্যে মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করা যায় না, কিন্তু কথাটা শোনা মাত্র ভরত ঠিক করে ফেলেছে, সে কোনও দিনই এই মাসোহারা নেবে না। তার নিজের উপার্জন-যোগ্যতা আছে। এতদিন পরে তার রাজকুমার সাজারও বিন্দুমাত্র সাধ নেই।
রাজপুরোহিত এসে মহারাজাকে কথা বলতে একেবারে নিষেধ করে দিলেন, মহারাজ তবু ভরতরে ছাড়লেন না। হাতের ইঙ্গিতে তাকে পালঙ্কের পাশে বসতে অনুরোধ করলেন। একটা কুরসি আন হল, তাতে উপবিষ্ট ভরতের দিকে মহারাজ তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টে। ভরতের পক্ষে খুব অস্বস্তিকর অবস্থা। সে যেন একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য বস্তু, অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে রমণীরাও তারে দেখছে। ভেতরে ভেতরে ক্রমশ বেশি উতলা বোধ করছে ভরত।
মহারাজ সম্পর্কে আর সকলে আশাবাদী, কিন্তু ভরতের মনে হল, রাধাকিশোর খুব সম্ভবত আ ত্রিপুরায় ফিরতে পারবেন না। তাঁর মুখে মৃত্যুর পাণ্ডুর ছায়া।
প্রায় একঘণ্টা পরে একজন চিকিৎসক আসতেই রমণীরা সকলে কক্ষ ছেড়ে চলে গেলেন। চিকিৎসককে বসার জন্য ভরত নিজের কুরসিটা ছেড়ে দিল এবং অন্যদের অলক্ষ্যে বেরিয়ে এল বাইরে।
বিকেল শেষ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে আসছে চারদিকে। ভরত দ্রুত পা চালিয়ে চলে এল দশাশ্বমেধ ঘাটে। গঙ্গার ওপরের আকাশের রক্তিমাভা মুছে যাচ্ছে একটু একটু করে। ভরত টের পেল তার শরীরটা বেশ হালকা লাগছে। যেন সে একটা অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দি ছিল, মুক্তি পেয়ে গেছে অকস্মাৎ। তার চক্ষে, ওষ্ঠে, এমনকী আঙুলের ডগাতেও অপরূপ মুক্তির স্বাদ। কীসের মুক্তি?
ত্রিপুরার রাজবাড়ির সঙ্গে সে আর সম্পর্ক স্থাপন করবে না। সে জীবন তার জন্য নয়। তবু একটা অন্যরকম বোধ তার মাথার মধ্যে কাজ করছে। জন্মভূমি থেকে সে ছিল নির্বাসিত, সব সময় যেন মাথার ওপর ঝুলত মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞার খাঁড়া। সেইজন্যই কি নানান ছদ্মবেশে মৃত্যু তাকে তাড়া করে ফিরেছে এতকাল! যেন কার অভিশাপ ছিল তার ওপর, আজ সেটা উঠে গেল।
হয়তো অভিশাপ-টভিশাপ কিছু নয়, সে ছিল রাজপ্রাসাদের কারও ঈর্ষা, ক্রোধ, ষড়যন্ত্রের শিকার। এরকম তো কতই হয়। তবু ভরত আজ সেইসব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে গেছে, এরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে ঠিকই!
কথক ঠাকুরের আসর কি ভেঙে গেছে এর মধ্যে? সেই চাতালটিতে এসে দেখল, প্রায়ান্ধকারেও তিনি দাপটের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন, চতুর্দিক ঘুরে ঘুরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন কাহিনী। সীতাহরণ পর্ব গতকাল শেষ হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ ধরে বলেছেন সবিস্তারে, আজ মাত্র পৌঁছেছেন জটায়ু বধে। প্রায় নেচে নেচে এমন আস্ফালন করছেন, যেন নিজেই তলোয়ার চালিয়ে কাটছেন জটায়ুর এক একটি ডানা।
শ্রোতাদের ঠিক মাঝখানে বসে আছে ভূমিসূতা। সে কি রামায়ণের গল্পের টানে একই কথকের কাছে আসছে প্রতিদিন? অথবা সে জানে যে ভরত আসবে এখানে? এর আগের দুদিন ভরত লক্ষ করেছে যে ভূমিসূতা গভীর মনোযোগর সঙ্গে কথকতা শোনে, এদিক ওদিক তাকায় না, সে ভরতকে দেখবে কী করে? বাড়ি ফেরার সময়ও সে একবারও চায় না পিছন ফিরে। সে জানে না, অথবা জেনেও ভরতের অস্তিত্বকে অবহেলা করে?
ভরত কথকতা কিছুই শুনছে না, এক দৃষ্টিতে শুধু দেখছে ভূমিসূতাকে। পাঁচ সাতজনের সমবেত সঙ্গীতের সময় শুধু একজনের মুখের দিকে যদি গভীরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে থাকা যায়, তা হলে যেমন সেই একজনের কণ্ঠস্বর আলাদা করে শোনা যায়, সেই রকমই ভরত একমাত্র ভূমিসূতাকেই দেখতে পাচ্ছে, তার আশেপাশে যেন আর কেউ নেই। এই জনবহুল গঙ্গার ঘাটেই যেন আর কেউ নেই, শুধু সে আর ভূমিসূতা।
গতকাল প্রায় এই সময়ে ভরত মৃত্যুর মুখ থেকে কোনওক্রমে বেঁচেছে। আর দু’এক মুহূর্ত দেরি হলে জ্বলন্ত চক্ষুওয়ালা ভয়ঙ্কর রাক্ষসটা তাকে গ্রাস করে নিত। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে মাঝে মাঝে এক চুলের ব্যবধান থাকে। ভরত মরে গেলে ভূমিসূতা হয়তো খবরই পেত না। সে ভাবত যে ভরত আবার কাপুরুষের মতন পলায়ন করেছে! ভরত যে অক্ষত শরীরে আজ এখানে বসে আছে, এটা যেন একটা অলৌকিক ঘটনা।
ভূমিসূতা উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ভরতও উঠে পড়ল। গৃহমুখী শ্রোতাদের ঠেলে ঠেলে এগোতে লাগল ভরত, সে অন্য কারুকে গ্রাহ্যই করছে না।
আজ ভূমিসূতার সঙ্গে একজনই সঙ্গিনী, একটি সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণা তরুণী। ভরত আজ আর কোনও দ্বিধা করল না, কাছে গিয়ে বলল, ভূমি, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে, তোমার কি সময় আছে?
ভূমিসূতা কয়েক মুহূর্ত নতমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সঙ্গিনীটিকে বলল, চারু, তুই একলা বাড়ি যেতে পারবি? একটা এক্কাগাড়ি নিয়ে নে, তোর কাছে পয়সা আছে?
চারুবালা বলল, হ্যাঁ, আমি চলে যেতে পারব। আমি বরং আগে গিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করি?
মেয়েটি চলে যাবার পর ভরত সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল। কোথায় একটু বসতে হবে। ঠিক কোথায়? এমন কোনও স্থান আছে, যেখানে প্রাণ খুলে সব কথা বলা যায়? এক একসময় সেরকম স্থান খুঁজে পাওয়া যায় না সারা বিশ্বে। তবু জলের প্রায় কাছাকাছি, নিরিবিলিতে এক জায়গায় সিঁড়িতে বসল ভরত, ভূমিসূতা তার পাশে নয়, বসল কয়েক ধাপ নীচে।
তখনি কথা এল না কিছু, বেশ কিছুক্ষণ ওরা নিস্তব্ধ হয়ে রইল। দূরে দূরে কয়েকটা নৌকোয় মিটিমিটি আলো জ্বলছে, শোনা যাচ্ছে নদীর জলোচ্ছুস।
এক সময় ভূমিসূতাই বলল, আপনি এখন কেমন আছেন?
ভরত বলল, ভাল, বেশ ভাল। ভূমি, তুমি হঠাৎ কাশীতে চলে এলে কেন?
ভূমিসূতা বলল, এলাম … কোথাও তো কখনও যাইনি, মনে হল, কাশীতে গিয়ে আপনার নামে পুজো দিই।
ভরত জিজ্ঞেস করল, আমিও যে কদিন আগে এখানে চলে এসেছি, তুমি জানতে? আমাকে দেখতে পেয়েছ।
ভূমিসূতা বলল, হ্যাঁ।
ভরত বলল, আমিও তোমাকে দেখেছি। কথা বলতে পারিনি, কেন জানো? শুনলে বোধ হয় তোমার বিশ্বাস হবে না। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিলাম।
ভূমিসূতা কিছু বলল না। তার পরনে একটা সাধারণ ডুরে শাড়ি, মাথার সব চুল খোলা, একটা হাঁটু উঁচু করে তার ওপর থুতনির ভর রেখেছে। আজকের আকাশ পরিষ্কার, এর মধ্যেই অনেক তারা ফুটেছে, নদীর তরঙ্গে দোল খাচ্ছে চাঁদ। আকাশের আলোয় ভূমিসূতার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে শুধু।
ভরত জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন আমার নামে পুজো দিতে এলে? দ্বারিকা বলছিল, ওদের এক ডাক শুনেই তুমি চলে এসেছিলে। আমার অসুখে প্রাণ ঢালা সেবা করেছ। কিন্তু আমি তোমায় কিছুই দিইনি। তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারি না। তবু তুমি কেন আমার জন্য পুজো দিতে
ভূমিসূতা খুব নরম গলায় বলল, আপনি দিয়েছেন।
ভরত বলল, কী দিয়েছি?
ভূমিসূতা তার উত্তর না দিয়ে চেয়ে রইল জলের দিকে।
তা হলে ভূমিসূতা আগেই দেখেছিল ভরতকে। প্রত্যেকবার? কাল যে ভরত আসেনি, তাও কি সে লক্ষ করেছে? সে অন্য দিকে তাকায় না। তার তৃতীয় চক্ষু দিয়ে খুঁজেছিল ভরতকে? ভরত যে তার সঙ্গে কথা বলেনি, সে জন্য রাগ কিংবা অভিমান হয়নি ওর? আজ এক কথাতেই ভরতের সঙ্গে বসতে রাজি হয়ে গেল।
ভরত বলল, চুপ করে রইলে কেন? বলল, কী দিয়েছি আমি তোমাকে? আমার যে দেবার মতন কিছুই নেই। তুমি কত উঁচুতে উঠে গেছ…আমি ভুল করেছি বারবার…
ভূমিসূতা বলল, তবু আমি পেয়েছি।
ভরত মুখ ঝুঁকিয়ে এনে জিজ্ঞেস করল, কী পেয়েছ? আমি জানতে চাই। সব সময় আমার মনের মধ্যে একটা নিঃস্বতা…
ভূমিসূতা বলল, সেই যে একদিন, ভবানীপুরের বাড়ি থেকে আপনি আমায় নিয়ে এলেন, তারপর রাস্তায় অনেক হাঙ্গামা হল, আমরা হারিয়ে গেলাম, খুব অন্ধকার ছিল, আমি একটা দোকানের সিঁড়িতে বসেছিলাম, আপনি এলেন খুঁজে খুঁজে, আমার একটা হাত ধরে বললেন, আর তোমাকে কখনও ছেড়ে যাব না–
ভরত অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমি তো সে কথা রাখিনি। আমি পারিনি। আমার বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল … শশীমাস্টার মশাই যখন এই কথা বললেন, আমার মনে হয়েছিল, তিনি তোমার যোগ্য, আমি তোমার মনের কথা বোঝার চেষ্টা করিনি, ছি ছি ছি ছি, সে যে তোমার কত অপমান, তখন বুঝিনি, যখন চৈতন্যোদয় হল, তখন আর তোমাকে খুঁজে পাওয়া গেল না!
ভূমিসূতা এবারও কিছু না বলে একটা আঙুল দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে লাগল।
আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে রইল দুজনে। এরই মধ্যে একজন লোক ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। দাপাদাপি করল খানিকটা।
সেই লোকটি উঠে যাবার পর ভরত বলল, ভূমি, তোমার কাছে আমার আরও কিছু স্বীকার করার আছে। আমরা দুজনে দুদিকে চলে গেছি। কতগুলো বছর চলে গেল। কতগুলো বছর। আমাদের যৌবনের অনেকখানি। এর মধ্যে সব সময়েই যে আমি তোমার কথা মনে রেখেছি তা নয়। মাঝে মাঝে ভুলে গেছি, আশা হারিয়ে ফেলেছি, ভেবেছি, তোমার সঙ্গে এ জীবনে আর আমার দেখা হবে না। তারপর আবার মনে পড়েছে, কষ্টও হয়েছে। তুমি বেঁচে আছ কি না তাও জানতাম না। এর মধ্যে একবার আমি বিয়েও করেছি। কেন জানো? সেও ওড়িশার মেয়ে, তার মুখের সঙ্গে তোমার মুখের একটু মিল ছিল। আমার নিয়তি, সেও বাঁচল না। আমাদের একটি ছেলেও আছে, সে কেমন আছে জানি না। বহুকাল তাকে দেখিনি।
ভূমিসূতা বলল, কেন তাকে বঞ্চিত করবেন? এইবার একবার তার কাছে যান।
ভরত বলল, হ্যাঁ, যাব। এখন যেতে পারি। তুমি … তুমি এতগুলো বছর … তুমি কেন একা ছিলে? তুমিও তো জানতে না আমি বেঁচে আছি কি না। অনেকেই বলেছে, তুমি থিয়েটারের নাম করা অভিনেত্রী ছিলে, অথচ তুমি কোনও পুরুষ … কেউ তোমার … তুমি কারওকেই চাওনি! কেন নিজেকে বঞ্চিত করেছ?
ভূমিসূতা বলল, সেই যে আপনি একবার আমার হাত ধরেছিলেন, তারপর আর … আমার ইচ্ছে করেনি, আমার মন চায়নি!
হঠাৎ মাথাটা তুলে, সোজা হয়ে বসে ভূমিসূতা বলল, না, ঠিক বলিনি। মন চেয়েছিল। আমি কোনও পুরুষকে স্পর্শ করিনি, কিন্তু মন দিয়েছিলাম একজনকে। দেবতাকে মানুষ যেমন ভালবাসে, সেইরকম আমিও একজন মানুষকে …
ভরত বলল, কে তিনি? তিনি ধন্য! নাম শুনলে কি চিনতে পারব?
ভূমিসূতা বলল,। তিনি একজন কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ভরত বিস্মিতভাবে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, রবীন্দ্রবাবু? তাঁর সঙ্গে? সরলা ঘোষালের বাড়িতে বুঝি তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল?
ভূমিসূতা বলল, না সেখানে একবারও দেখা হয়নি।
তারপর একটু থেমে আবার ধীর স্বরে বলল, আর কেউ জানে না, তবু আপনার কাছে স্বীকার : করতেই হবে, শুধু ভক্তি নয়, পুজো নয়, সে ছিল ভালবাসা, তাঁকে আমি মন দিয়েছিলাম, আমার এক এক সময় খুব কষ্ট হত, তাঁর লেখা পড়তে পড়তে…তিনি অবশ্য কিছুই জানেন না, তিনি দুতিনবার এসেছেন আমাদের থিয়েটারে, সেখানেই দেখেছি, একটা কথাও হয়নি, সবই শুধু এক দিক থেকে…
ভরত বলল, রবীন্দ্রবাবু আমারও খুব প্রিয়। কবিদের মন দেওয়া যায়।
তারপর যেন সে আর কথা খুঁজে পেল না। নদীর দিকে চেয়ে রইল। মুখ তুলে তাকাল আকাশের দিকে। নক্ষত্রপুঞ্জ দেখতে দেখতে আপন মনে বলে উঠল :
এই শান্ত স্তব্ধ ক্ষণে
অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে
চরম-বিশ্বাস ক্ষীণ ব্যর্থতায় লীন
জয়হীন চেষ্টার সঙ্গীত। আশাহীন
কর্মের উদ্যম– হেরিতেছি শান্তিময়
শূন্য পরিণাম….
বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গেল ভরত। মাথাটা ঝুঁকিয়ে আনল সামনের দিকে। বলল, ভূমি, একবার আমার দিকে তাকাও! এ কী, তোমার চোখে জল কেন?
ভূমিসূতা বলল, হ্যাঁ, চোখে জল এসে যাচ্ছে, কিন্তু আমি কাঁদছি না।
ভরত বলল, আমার চোখে কেন জল আসে না? ভেতরটা কি একেবারে শুকিয়ে গেছে? যারা ভালবাসতে পারে, তারাই কাঁদতে পারে। আমার খুব ইচ্ছে করে–
ভূমিসূতা বলল, পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই। ভাল দেখায় না।
ভরত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কতগুলো দিন কেটে গেল, কত বছর, আর কখনও দেখা হবে ভাবিনি। এখন মনে হয়, তুমি অনেক দূরের মানুষ, মাঝখানে দুস্তর ব্যবধান…
ভূমিসূতা বলল, আমি এই তো কাছে বসে আছি…
ভরত বলল, আমার ভবিষ্যতে কী আছে জানি না। ভূমি, সেই যে অনেক বছর আগে কলুটোলার কাছে দোকানের সিঁড়িতে তুমি বসেছিলে, আমি তোমার হাত ধরেছিলাম, তারপর এতগুলো বছর … আজ যদি তোমার হাতটা আবার ধরতে চাই, তুমি দেবে?
ভূমিসুতা নিজের ডান হাতের পাঞ্জার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল, প্রায় ফিসফিস করে বলল, এই হাত, শুধু একজনেরই জন্য—
ডানপাশ ফিরে সে বাড়িয়ে দিল হাতখানি। তারপর ওরা হাত ধরে চুপ করে বসে রইল। আর কোনও কথা নেই, সমস্ত কথার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। ওরা বসেই রইল। ঘাট ক্রমশ নির্জন হয়ে আসছে। বাতাস বইছে বেশ জোরে। বজরাগুলোও ফিরে যাচ্ছে। সবাই ঘরে ফিরছে। এই দুজনের যেন কোনও ঘরবাড়ি নেই, কোথাও ফিরতে হবে না। এরকম একটি অনন্তকালের দৃশ্য হয়ে ওরা বসেই থাকবে।