2 of 3

৮৭. আর কী বাকি রাখলেন

৮৭

আর কী বাকি রাখলেন বলুন তো! নৌকো বাওয়া শিখলেন, মাছের জাল ফেলা শিখলেন, হাল চাষ শিখলেন! লেখাপড়া যা শিখেছিলেন সব তো ভুলে মেরে দেবেন এর পর।

শিখলাম আর কই? শুধু কায়দাটা শিখলেই কি হল? অভ্যাস করতে হবে না? নৌকো বাইতে বাইতে আর হাল চাষ করতে করতে যখন হাতে কড়া পড়বে, লোহার মতো শক্ত হয়ে যাবে তখন বুঝব যে শিখেছি।

আর লেখাপড়া যা শিখলেন তার গতি কী হবে? এই হাল চালানো, নৌকো বাওয়া বা মাছ ধরা এসব কি আপনার কাজ? এ শিখে কী হবে?

হেমাঙ্গ একটু হেসে বলে, এ শেখাটা তোমার কাছে কিছু নয় বুঝি?

এ তো সবাই পারে। কিন্তু মাথার কাজ তো সকলকে দিয়ে হয় না।

বাঁকা মিঞা, এ শেখার দাম তোমার কাছে না থাক, আমার কাছে অনেক। আগে বিচি দেখে গাছ চিনতে পারতাম না, কত বোকা আর অশিক্ষিত ছিলাম বলো তো? জীবনটাকে সাপটে ধরতে হলে এসবও দরকার হে।

আপনার দরকার আপনি বুঝবেন। কিন্তু বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে গেলে মা ঠাকরুন আমাকেই ধরে পড়বেন, ও বাঁকা, তোমার পাল্লায় পড়েই আমার এ ছেলেটা গোল্লায় গেল।

গোল্লায় আগে ভাল করে যাই তবে তো!

যেতে আর বাকিটা কী? গত সাত দিন কলকাতায় যাননি। কত কাজকর্ম বকেয়া পড়ে আছে ভাবুন তো!

সেসব আমার পার্টনাররা সামলে নেবে বাঁকা, ভেবো না। জীবনের একটা দিক আমার একদম অচেনা থেকে গিয়েছিল, সেইটে ভাল করে চেনা দরকার।

বাঁকা মিঞা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এ আবার চেনাচেনির কী আছে? চাষাভুষো, জেলে, মাঝির জীবনে কিছুই নেই। পেট আছে আর পেটের চিন্তা আছে। গতর খাটিয়ে চাট্টি খাওয়া। এর মধ্যে কোন মধু আছে?

সে তুমি বুঝবে না।

বুঝবে না বলে তো আমাকে ঠেকালেন, শেষে দায়টাও আমার ওপর পড়বে।

তা দায় তোমারও একটু আছে। এমন সুন্দর জায়গাটায় এনে ফেললে যে আমার যেতেই ইচ্ছে করে না।

মাঝে মাঝে না গেলে চলবে কেন? তা সেই যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তিনি কি চলে গেলেন?

হুঁ।

বিয়েটা হলে আপনার একটু ঘরমুখো ভাব হত।

হেমাঙ্গ হাসল, বিয়ের দরকার নেই বাঁকা মিঞা। বউ এসে আমার জীবনটাকে ছোট ফ্রেমে বাঁধিয়ে নেবে। তখন কি আর ইচ্ছেমতো চলে আসতে পারব? এই যে সাত দিন ধরে এক মুক্ত জীবন ভোগ করছি এ আর পারব?

আমারও তো সেই কথা। এ সব করার দরকারই বা কী?

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলল, তুমি কিছুতেই সেটা বুঝতে পারবে না। আচ্ছা বলল তো, এই জায়গাটাকে তুমি কি সুন্দর দেখ?

মুশকিলে ফেললেন। এখানেই আমার জন্ম।

আমারও জন্ম। আমি এখানে নতুন করে জন্মেছি। তুমি জন্মেছো বটে, কিন্তু এ জায়গা রোজ দেখেও দেখনি। তোমার চোখই যে পুরনো।

বাঁকা মিঞা মাথা নেড়ে বলে, নাঃ, আপনার রোগের চিকিৎসা নেই।

কথা হচ্ছিল দাওয়ায় বসে। একখানা মোড়ার ওপর বাঁকা মিঞা, আর জলচৌকিতে হেমাঙ্গ। বর্ষার পর শরতের আসি-আসি ভাবটা চারদিকে খুব টের পাওয়া যাচ্ছে। হেমাঙ্গর শিউলি গাছ দুটোয় দুটো চারটে ফুল হয় আজকাল। আকাশে মাঝে মাঝে মেঘের সঞ্চার হয়, হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘ কেটে গিয়ে এক আশ্চর্য রোদ্দুরে ঝলমল করতে থাকে চারদিক। কাশফুল ফোটে কাছেপিঠেই, নৌকো বেয়ে গিয়ে সেই কাশফুলের শোভা প্রায়ই দেখে আসে হেমাঙ্গ। স্পষ্টভাবে নয়, কিন্তু অস্পষ্টভাবে হেমাঙ্গ আজকাল এই জগতের সঙ্গে, এই মহাবিশ্বের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের একটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সূত্রকে টের পাচ্ছে। বাঁকা মিঞা সেই গভীর আবিষ্কারের খবর রাখে না। বাঁকা মিঞার কাছে তার এইসব আচার-আচরণ একটা মহাপতন, এক সাংঘাতিক সর্বনাশ।

তুমি আমাকে নিয়ে এত ভাবছ কেন বাঁকা?

ভাবছি, তার কারণ আছে। আজ কলকাতায় যাব। বিডন স্ট্রিটে আপনাদের বাড়িতেও একবার যেতে হবে। মাঠাকরুন সুন্দরবনের মধু চেয়েছিলেন। তা, তার জোগাড় হয়েছে। সেইটে নিয়েই যাব। গেলে পর আপনাকে নিয়ে কথা উঠবে। কী বলব তাই ভাবছি।

হেমাঙ্গ হাসল, আমাকে কি তুমি জোর করে ধরেবেঁধে রেখেছ এইখানে? আমি তো নিজের ইচ্ছেয় আছি।

সে তো ঠিকই। কিন্তু ইচ্ছেরও তো নানারকম ব্যাখ্যা হয়। দাড়ি লম্বা হচ্ছে, চুলে জট ধরছে, গায়ের রং তামাটে মেরে এল—এ তো ভাল লক্ষণ নয়। কিছু একটা হয়েছে আপনার, মুখে বলছেন না।

তা তো হয়েছেই। কী মনে হচ্ছে জানো? এই দুনিয়ায় জন্মে এতকাল দুনিয়াটাকে চিনবার চেষ্টাই করিনি, দুনিয়াটার ভাল-মন্দ নিয়ে ভাবিওনি কিছু, এত যে মানুষজন তাদের সঙ্গে সম্পর্কও তৈরি করিনি। অনেক বকেয়া পড়ে গেছে। দুনিয়াটাকে এখন নানাভাবে চিনবার চেষ্টা করছি।

বাঁকা মিঞা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। বলল, কলকাতা থেকে ফিরে কাল সকালে খবর দিয়ে যাব’খন।

খবর! না, কলকাতার খবরে আর দরকার কি আমার?

বাঁকা মিঞা অবাক হয়ে বলে, মা বাপ কেমন আছে সেটাও কি জানতে ইচ্ছে করে না আপনার?

ভালই আছে বাঁকা, তারা ভালই আছে।

বড্ড চিন্তায় ফেলে দিচ্ছেন।

সকালের নরম রোদে উঠোন ভরে আছে। বাঁকা চলে যাওয়ার পর তার ছোট উঠোনে রোদের লালচে নরম আলো আর গাছের চিকরি-মিকরি ছায়ার কাঁপন চোখ ভরে দেখছিল হেমাঙ্গ। কত পোকামাকড় আসে। কত অদ্ভুত ধরনের তাদের ওড়াওড়ি, ঘোরাঘুরি। আকাশের মেঘে কত আকার। আজকাল তার প্রকৃতিমুগ্ধতা এসে গেছে।

কী গো দাদা, বসে বসে হাঁ করে কী ভাবছ? চা খাওনি এখনও?

হেমাঙ্গ বাসন্তীর দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ রে, চা খাওয়ার এখন কী দরকার? ছেড়ে দিলেই তো হয়!

ওমা! ছাড়বে কেন? তোমার চা করতে গিয়ে আমিও যে একটু করে খাই।

হেমাঙ্গ হেসে বলল, তাহলে কর।

আজকাল বড্ড আনমনা থাকো। কী হয়েছে বলো তো!

হেমাঙ্গ একটু বিরক্ত হয়ে বলে, তুইও কি বাঁকা মিঞার মতো হলি! সব সময়ে কী হয়েছে, কী হয়েছে। মানুষ মাঝে মাঝে একটু একা থাকতে চায়, একটু ভাবনাচিন্তা করতে চায়। সেটা কি দোষের?

বাসন্তী আগে একটু সমীহ করত হেমাঙ্গকে। আজকাল আর একদম করে না। ঝংকার দিয়ে বলল, আহা, কী হয়েছে জানতে চাইলে বুঝি দোষ হয়? তোমার ভাল-মন্দ নিয়ে ভাবব না তো আর কে ভাববে? বাঁকা চাচা কি সাধে বলে বাবুর ঘাড়ে ভূত চেপেছে?

চোখ পাকিয়ে হেমাঙ্গ বলল, বলেছে?

হ্যাঁ বলেছে। তাতে হয়েছেটা কী? বাঁকা চাচা তোমাকে কত ভালবাসে জানো?

তোদের ভালবাসার জ্বালায় না আমাকে এ গাঁ ছাড়তে হয়।

ছেড়েই দেখ না। কলকাতায় গিয়ে ফের ধরে নিয়ে আসব।

তুই রাখতে চাস, আর বাঁকা তাড়াতে চায়। তার ধারণা হয়েছে আমি কলকাতায় না গেলে দুনিয়া অচল হয়ে যাবে। তোদের দুটিকে নিয়ে যে কী করি!

আর কিছু করতে হবে না, শুধু গোমড়া মুখে থেকো না। একটু কথাটথা কয়ো। আজ সকালেও নাকি আফজলের সঙ্গে নৌকো বাইতে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ তো। জাল ফেললাম।

মাছ পেয়েছ?

পেয়েছিলাম। আফজলকে দিয়ে দিয়েছি।

ওমা! কেন?

মাছে আজকাল আঁশটে গন্ধ পাই। আফজল নিয়ে গেল, কিছু খাবে, কিছু বেচে দুটো পয়সা পাবে।

বাসন্তী অসন্তোষের গলায় বলে, এই করে করে তোমার সব যাবে। মাছ আনলে আজ মাছের ঝাল করে তোমাকে খাওয়াতাম।

ডাল ভাত তরকারিই তো পেট ভরে খাচ্ছি।

তবে ধরারই বা কী দরকার? না-ই যদি খাবে তবে মাছ ধরা শিখছ কেন?

শিখে রাখা ভাল।

তোমার শুধু ওই কথা।

বাসন্তী একটু গনগন করতে করতে স্টোভ জ্বেলে চা করল। তারপর চা দিতে এসে হঠাৎ শিহরিত আতঙ্কিত একটা চিৎকার দিল, ই কী!

চমকে গিয়েছিল হেমাঙ্গ। কাপের চা খানিক চলকে গেল। অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?

তোমার নখগুলো দেখেছ? এ যে রাক্ষসের নখ হয়ে উঠেছে! মা গো!

হেমাঙ্গ নিজের নখগুলোর দিকে তাকাল। বাস্তবিকই অভদ্র রকমের বড় হয়ে গেছে। নেল কাটার নেই বলে কাটা হয়নি। লজ্জিত হয়ে বলল, কাটতে হবে।

আজই কাটবে। ছিঃ, ওরকম নখ নিয়ে কেউ থাকে? এর পর লোকে তোমাকে বলবে, পাগলা।

নেল কাটার নেই বলে কাটা হচ্ছে না।

আহা, কী কথা! নখ-কাটুনি নেই বলে আমরা বুঝি নখ কাটছি না? মদনদাকে খবর দিচ্ছি, এসে নরুন দিয়ে মুড়িয়ে কেটে দিয়ে যাবে।

নরুনকে হেমাঙ্গর বড় ভয়। যন্ত্রটাকে ছেলেবেলা থেকেই সে সুনজরে দেখে না। তা ছাড়া অন্যের হাতে নখ কাটানোর অভ্যাসও তার নেই। বলল, আচ্ছা, আমি নিজেই কেটে নেব’খন। মদনকে ডাকতে হবে না।

আজই কাটবে?

দেখছি। তুই যা তো, রুটি বানা। খিদে পেয়েছে।

বাসন্তী ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে নিজের নখগুলোর দিকে ফের চেয়ে রইল হেমাঙ্গ। বাস্তবিক নখগুলোর একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। আজকাল ভাতের থালায় হাত দিলে নখের শব্দ হয়। নখের গোড়ায় অস্বাস্থ্যকর নীল ময়লাও জমেছে।

নখ নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবল হেমাঙ্গ। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিল।

রুটি বেড়ে এনে বাসন্তী সামনে বসে বলল, হ্যাঁ দাদা, সেই সুন্দর মেয়েছেলেটার সঙ্গে বিয়ে হল না তোমার কেন বলো তো!

কতবার শুনবি?

আবার বললা। তোমার কথাগুলো এমন যে স্পষ্ট করে বোঝা যায় না। বারবার শুনলে বুঝতে পারব।

তুই জন্মেও বুঝবি না।

আচ্ছা, বিয়েটা হল না বলেই কি তুমি বিবাগী হয়ে আছ এখানে?

তাই ধরে নে।

না, স্পষ্ট করে বলো।

হেমাঙ্গ রুটি খেতে খেতে বলল, বিয়ে করে কোন বোকা? বিয়ে তো কয়েদখানা। এই বেশ আছি।

বেশ আছ না ছাই আছ। তোমার মুখচোখ মোটেই ভাল নয় বাপু। সব সময়ে দুঃখ-দুঃখ ভাব করে থাকো।

তাই বুঝি?

আচ্ছা, একটা কথা কইব?

বল না। তোর তো কথার শেষ নেই দেখছি।

কথা না কইলে বাপু আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। আমি নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও রাত-বিরেতে জোরে জোরে কথা বলি। সেইজন্য আমাদের বাড়িতে নাকি কখনও চোর ঢোকে না। বলে হি হি করে খুব হাসল বাসন্তী। হ্যাঁ, সেই কথাটা।

বলে ফেল।

আচ্ছা সেই যে রোগামতো মেয়েটা এসেছিল, কী নাম যেন!

আবার তাকে নিয়ে ভাবছিস কেন?

তার সঙ্গে কিন্তু তোমাকে খুব মানায়। নামটা ঝুমকি না কী যেন?

একটু স্তব্ধ হয়ে থাকে হেমাঙ্গ। বুকের অন্তঃস্থলে থিতানো জলে একটু নাড়া পড়ে কি?

হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ও সব ভাবিস না।

কেন, ভাবলে বুঝি দোষ?

বিয়ে করার প্রশ্নই নেই। করলেও শহুরে মেয়ে নয়।

বাসন্তী চোখ বড় বড় করে বলল, তো কি গাঁয়ের মেয়ে?

যদি কখনও বিয়ে করি তবে গাঁয়ের মেয়েকেই করব।

বাসন্তী হঠাৎ হেসে গড়িয়ে পড়ল, বলো কী গো! গাঁয়ের মেয়েরা যে ভীষণ বোকা আর ঝগড়ুটে হয়। কিছু স্টাইল জানে না। তোমার সঙ্গে মানাবে কেন?

আমি স্টাইল-জানা মেয়ে পছন্দ করি তোকে কে বলল?

লেখাপড়া জানে নাকি তোমার মতো?

লেখাপড়া না জানলেই ভাল। লেখাপড়া তো আর একটা আপদবিশেষ।

তোমাকে নিয়ে আর পারি না বাপু। তোমার ঘাড়ে ঠিক ভূত চেপেছে!

দুপুরে খাওয়ার পর হেমাঙ্গ বিনা ভূমিকায় তার ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিল।

বাসন্তী চেঁচাল, ও কি? কোথায় চললে?

কলকাতায়। নখ কাটতে।

বাসন্তী চোখ বড় করে বলে, নখ কাটতে কলকাতায়?

হেমাঙ্গ একটু হেসে বলে, নেল কাটার ছাড়া হবে না, বুঝলি? এবার যখন আসব যন্ত্রটা নিয়েই আসব। পায়ের নখ এত বড় হয়েছে যে, হোঁচট খেলে এক-আধটা নখ উল্টে যেতে পারে। রক্তারক্তি কাণ্ড হবে তখন।

বাসন্তী কপালে হাত দিয়ে বলে, পোড়া কপাল! বাবু নখ কাটতে কলকাতায় চললেন। তাহলে আর তুমি ইহজন্মে গাঁয়ের মানুষ হতে পারবে না। বুঝলে?

বুঝলাম। ঘরদোর দেখে রাখিস।

সে তোমাকে বলতে হবে না। কবে আসবে?

চলে আসব। খেয়াল হলেই চলে আসব।

আমি এদিকে পাত্রী দেখতে লেগে যাচ্ছি কিন্তু।

মাথায় চাঁটি খাবি। ফাজিল কোথাকার!

বাসন্তী হাসল না। একটু ছলো ছলে চোখ করে বলল, তুমি চলে গেলেই না এ জায়গাটা আমার বড্ড ফাঁকা লাগে। কী করি জানো? তোমার ঘরে এসে বসে থাকি। একা একা ভূতের মতো।

হেমাঙ্গর মনটা একটু মেদুর হয়ে গেল। বলল, দেখিস যেন তোকেও আবার ভূতে না পায়।

ঘাট অবধি এগিয়ে দিয়ে গেল বাসন্তী। বলল, তাড়াতাড়ি চলে এসো কিন্তু।

ভটভটিতে বসে হেমাঙ্গ ছেড়ে-আসা ঘাট আর নদীর ধারে তার ঘরখানার দিকে চেয়ে ছিল। বড় মায়া জন্মে গেছে। এটা কি ভাল? কলকাতার প্রতি তার কোনও টানই নেই। যেতে হচ্ছে বলে যাওয়া। কথাটা মিথ্যে নয় যে, তার অনুপস্থিতি ক্রমে ক্রমে কলকাতায় কিছু অনিশ্চিত শূন্যতার সৃষ্টি করছে। তার পার্টনাররা অস্বস্তিতে আছে। উদ্বিগ্ন তার মহাজন ক্লায়েন্টরা। অথচ সে কীই বা করতে পারে?

ফটিক তাকে দেখেই একগাল হাসল, এলেন তাহলে? না এলে কালই আমাকে সেই গাঁয়ে গিয়ে আপনাকে ধরতে হত।

সে কী! কেন?

চারুদিদি খবর পাঠাচ্ছেন বারবার। গতকাল এসে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে গেলেন। বললেন শুক্কুরবার গিয়ে যেন আপনাকে ধরে নিয়ে আসি। তাড়াতাড়ি তাঁকে ফোন করুন। বিডন স্ট্রিটের বাড়ি থেকেও খুব খোঁজ হচ্ছে।

এই খোঁজখবর, উদ্বেগ ইত্যাদি হেমাঙ্গর আর ভাল লাগে না। বিতৃষ্ণায় মনটা ভরে যায়। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অন্তরায় এইসব আত্মীয়তা।

হেমাঙ্গ আগে তার হাত আর পায়ের নখ কাটল। কফি খেল। বসে বসে অনেকক্ষণ ভাবল। সন্ধে সাড়ে সাতটার বাংলা খবর শুনল টিভিতে। যদিও খবর তাকে স্পর্শও করল না।

বিডন স্ট্রিটে প্রথম ফোনটা করল মাকে।

মা প্রথম কথাই বলল, তুই ভেবেছিসটা কী?

কিছু ভাবিনি মা। কয়েকটা দিন একটু—

একটু? একে একটু বলে?

শরীরটা একটু সারিয়ে এলাম।

তোর যে কী চেহারার ছিরি হয়েছে তা আমি জানি। টকটকে ফরসা রংটাকে জ্বালিয়ে দিয়েছিস। তারপর ওখানে নাকি নৌকো বাইছিস, জাল ফেলছিস, চাষ করছিস। এই এতক্ষণ সব বলে গেল বাঁকা মিঞা। তোকে আর গড়চার বাড়িতে থাকতে হবে না। কালকেই চলে আসবি। আমি তোর বাবাকে বলেছি ও বাড়ি বিক্রি করে দিতে।

হেমাঙ্গ আতঙ্কিত হয়ে বলল, শোনো মা, শোনো। আমি আর না হয় এরকম করব না।

না বাপু, এসব পাগলামিকে আমি সহ্য করব না। তোর বাবাই ভুলটা করেছেন। ও বাড়িতে তোকে পাঠানোটাই সব সর্বনাশের মূল। মায়ের কোলছাড়া হয়ে থেকে তোর এখন নানা বাই দেখা দিচ্ছে। এখন থেকে তোকে আমি নিজের কাছে রাখব।

শোনো মা, এটা কোনও পাগলামি নয়। কলকাতার ভিড় ছেড়ে ফাঁকায় যেতে ইচ্ছে করে না বলো! ঠিক আছে, সামনের শনিবার চলল, তোমাকে আর বাবাকে নিয়ে গিয়ে আমার গাঁয়ের বাড়িটা দেখিয়ে আনি। দেখলেই তোমার মত পাল্টে যাবে।

রক্ষে করো বাপু, আমার আর ওই ধাপধারা গোবিন্দপুরে গিয়ে কাজ নেই। তোর যাওয়াও আমি বন্ধ করব। বিয়ে না দিয়ে আমি আর তোকে বিডন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে দেব না। ফটিককে খবর পাঠাচ্ছি সে আজই জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখুক। কাল ট্রাক গিয়ে সব নিয়ে আসবে।

মা, আর একটা মাস সময় দাও।

এক মাস! এক মাসে কোন হাত-পা গজাবে তোর? বাঁকা মিঞাকেও বলে দিয়েছি খদ্দের দেখতে। গাঁয়ের বাড়িটাও বিক্রি করে দিবি।

সর্বনাশ!

কিসের সর্বনাশ? ওই গাঁ-ই তো তোকে খেল। বিয়েটা হয়ে থাকলে একটু নিশ্চিন্তি ছিল। সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেললি! অমন মেয়ে কি পড়ে থাকে? এই তো কেমন বিয়ের ঠিকঠাক হয়ে গেল।

কার কথা বলছ মা?

আবার কার কথা? রশ্মি কেমন বুদ্ধিমতী মেয়ে দেখ তো! বিলেত-বিদেশে একা থাকবে না বলে কেমন বর জুটিয়ে ফেলেছে। আর তুই হাঁ করে গাঁয়ে বসে আকাশ গিলছিস।

হেমাঙ্গ একটু স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল, এ খবর কে দিল?

খবর কি আর চাপা থাকে? সে নিজেই খবর দিয়েছে চারুকে। চারু আমাদের বলেছে। অমন চারচৌকো মেয়ে তোর বউ হলে সব দিক দিয়ে ভাল হত।

হেমাঙ্গর হাত-পা শিথিল লাগছিল। কেন যেন একটু অপমানও বোধ করছিল সে। বলল, মা, আমি কালকেই তোমার কাছে যাব, অফিসের পর। সব বুঝিয়ে বলব। এক মাস সময় দাও আমাকে। তাড়াহুড়ো কোরো না।

অফিসেও তোর কাজ পড়ে আছে। পার্টনাররা তোর বাবাকে জানিয়েছে, তোর নাকি কোথায় কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, যাসনি। তারা হয়রান হচ্ছে। এ সব কী পাগলামি বল তো?

আচ্ছা মা, কাল গিয়ে সব বলব।

কাল রাতে এখানেই খাবি। মনে থাকে যেন।

আচ্ছা মা।

হেমাঙ্গ ফোন রেখে স্তম্ভিত মাথায় বসে রইল কিছুক্ষণ।

এ কি সত্যি হতে পারে? এত তাড়াতাড়ি তার স্মৃতিকে মুছে ফেলে দিতে পারে রশ্মি? ঠিক কথা, হৃদয়াবেগ নিয়ে থাকার দিন চলে গেছে। কিন্তু তা বলে একটুখানি আবেগও কি থাকবে না? সামান্য সেন্টিমেন্ট?

ফোনটা আবার তুলে নিল হেমাঙ্গ।

চারুদি, কেমন আছিস?

কেমন আছি? তা দিয়ে তোর কি দরকার? আমাদের থাকা বা না-থাকায় তোর কী আসে যায়?

আমার খোঁজ করেছিলি কেন?

চারুশীলা একটু চুপ করে থেকে বলল, এখন আটটা বাজে। আসতে পারবি?

টায়ার্ড লাগছে। কেন যেতে বলছিস বল তো!

কথা আছে।

হেমাঙ্গ একটু হেসে বলল, বিলিতি বৃত্তান্ত নাকি? ওটা মায়ের কাছে শুনলাম।

কী শুনলি?

রশ্মি কাউকে বিয়ে করছে।

চারুশীলা দুঃখিত গলায় বলে, বলতে বারণ করেছিল।

গোপন করার বিষয় তো নয়। বলে ভালই করেছিস।

তুই কি একটু দুঃখ পেলি?

না। দুঃখ পাওয়ার কথাই তো নয়। আমিই রিফিউজ করেছিলাম, সুতরাং আমার তো কোনও দাবি থাকতে পারে না।

ওকে বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এখন একা থাকা যে কোনও মেয়ের পক্ষেই খারাপ। ও ভয় পাচ্ছে।

আমি জানি। ইটস্‌ এ গুড ডিসিশন।

কাল আসবি?

কাল হবে না। মা ক্ষেপে গেছে। এ বাড়ি বিক্রি করে দিতে চাইছে। আমাকে পুনর্মূষিক হয়ে বিডন স্ট্রিটে ফিরে যেতে বলছে।

যাবি?

সেটা বুঝিয়ে বলতেই কাল মায়ের কাছে যাব।

তাহলে আজই চলে আয়। এমন কিছু রাত হয়নি। কাছেই তো। ফটিককে রান্না চাপাতে বারণ করে আয়।

হেমাঙ্গ একটু ভেবে অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, আচ্ছা।

গাড়িতে পাঁচ মিনিটের পথ। পৌঁছে গিয়ে হেমাঙ্গ দেখল আজও চারুশীলার বাড়িতে অতিথি সমাগম। অতিথি ছাড়া ও থাকতেই পারে না।

চিনতে পারছেন তো! বলে মানি প্ল্যান্টের পাশ থেকে একটি হাসিমুখ এগিয়ে এল।

একটু চমকে উঠল কি হেমাঙ্গ? একটা বিট মিস করল তার হার্ট। একটু অবরুদ্ধ গলায় সে বলল, পারছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *