কবি যদি হতেন নিছক কল্পনা-বিলাসী কিংবা বাস্তব-বিমুখ, সংসারের নানানমুখী স্রোতের মধ্যেও নিজস্ব একটা দ্বীপ নির্মাণ করে যদি থাকতেন স্বেচ্ছা নির্বাসিত, তা হলে তিনি অনেক সমস্যা এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তেমন কোনও অনাসক্ত ব্যক্তির পক্ষে কি কবিতা রচনা সম্ভব? কুসুমগন্ধ, চন্দ্রকিরণ আর দখিনা পবন সেবন করে কবিরা বাঁচতে পারে না, যদিও জনসাধারণের সে রকমই ধারণা। সব কবিকেই অনেক সময় জল-কাদার পথ হেঁটে পার হতে হয়, পারিপার্শ্বিকের লোভ, বঞ্চনা, শোষণ, দারিদ্রের আঁচ শরীরে অনুভব করতে হয়, সমসাময়িক বাস্তবতার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হয় কখনও কখনও। দেশ ও সমাজের সংকটে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে যদি নাও পারেন, তবু তিনি অতন্দ্র পর্যবেক্ষক। কবিতা বা গদ্য যা-ই লিখুন, সবই মনুষ্যজীবনের ইতিহাস।
অন্যান্য কবিদের তুলনায় রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে পড়েছেন অনেক বেশি। একসঙ্গে অনেকগুলি দায়িত্বের বোঝা তাঁর কাঁধে। জমিদারি দেখাশুনোর সব ভারই এখন তাঁর ওপর, আয় বাড়াবারও চিন্তা করতে হয়, বাবামশাই গত হয়েছেন, তাঁর কাছ থেকে জমিদারি পরিচালনার প্রণালী রবীন্দ্রনাথই বেশি শিখেছেন। অন্য দিকে আছে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়। তার ব্যবস্থাপনার খুঁটিনাটি, শিক্ষক নিয়োগ, অর্থের জোগান, এই সব কিছুই তো দেখতে হয় তাঁকে। শান্তিনিকেতনে হঠাৎ ছাত্রের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। কারণ, স্বদেশি আন্দোলনের জন্য ছেলেরা বয়কট করেছে সরকারি স্কুল, অরবিন্দ ঘোষের অধ্যক্ষতায় স্থাপিত হয়েছে জাতীয় বিদ্যালয়, বউবাজার স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে। কিছু কিছু অভিভাবক সন্তানদের সরকারি স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন বটে, কিন্তু জাতীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে সাহস পাচ্ছেন না। সেটা সরাসরি সরকার-বিরোধিতা। সেইসব অভিভাবকদের চোখ পড়েছে শান্তিনিকেতনের দিকে। এ বিদ্যালয় সরকারিও নয়, জাতীয় বিদ্যালয়ের আওতার মধ্যেও পড়ে না। ছাত্রসংখ্যা বাড়লে সমস্যাও বাড়ে।
শুধু শান্তিনিকেতনের ওই রূপ একটি বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়াই একজন মানুষের পক্ষে যথেষ্টরও বেশি, উপরন্তু রবীন্দ্রনাথ আরও অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত। তিনি সংসার থেকেও মুক্ত পুরুষ নন, মাতৃহীন ছেলেমেয়েগুলিকে সামলাতে হয় তাঁকেই। আপাতত জ্যেষ্ঠপুত্র রথীকে কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে আমেরিকায়, তার খবরাখবর রাখতে হয়। মাধুরীলতা স্বামীর ঘর করছে, মাঝেমাঝে তার শরীর ভাল থাকে না। মীরা বেশ ডাগরটি হয়ে উঠেছে, এবার তার বিবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ছোটছেলে শমী থাকে শান্তিনিকেতনে, সে ছিল তার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান, বাবারও অতি আদরের। শমীর ভাবভঙ্গি অবিকল তার বাবার মতন, অনেকে বলে রবি ঠাকুরের ছেলে শমী ঠাকুর। এর মধ্যেই সে ভাল গান গায়, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। রবীন্দ্রনাথ এই কনিষ্ঠ পুত্রটিকে বেশি সঙ্গ দিতে পারেন না। তাঁকে অনবরত ঘুরে বেড়াতে হয়, তবু শমীর পড়াশুনোর যাতে ক্ষতি না হয় সেই চিন্তা সর্বক্ষণ তাঁর মন জুড়ে থাকে।
এ ছাড়া রয়েছে দেশের চিন্তা। আর কোনও লেখক মাতৃভূমির ভাবমূর্তি এবং দেশের মানুষের অপমান ও দুর্দশা নিয়ে এতখানি ভাবিত নন। ইংরেজদের যে-কোনও দুষ্কর্ম যেন তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করে। বঙ্গভঙ্গ তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। বাঙালি জাতিকে এই ভাবে দু ভাগ করে দিলে এক সময় বাংলা ভাষার ওপরেও খগাঘাত হবে। তাঁর অতি প্রিয় বাংলা ভাষা!
কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রোধের আন্দোলন যে-দিকে বাঁক নিয়েছে, তাও তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। নেতাদের মধ্যে দলাদলির প্রকট রূপ দেখে তিনি কষ্ট পান। প্রত্যেকের ভিন্ন মত। ভারতের দুভাগ্য এই। এমন কোনও সর্বভারতীয় নেতা নেই, যাঁর নির্দেশ সকলে মেনে চলতে পারে। দাদাভাই নৌরজী, ফিরোজ শা মেটা, বদরুদ্দীন তায়েবজী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুর রসুল, বিপিন পাল, রানাডে, তিলক, গোখলে, আবদুস শোভান চৌধুরী, লালা লাজপৎ, এঁরা কেউই সর্বজনগ্রাহ্য নন। রবীন্দ্রনাথ সুরেন্দ্রকে দেশনায়ক করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। সুরেন্দ্রনাথও সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে নিজের রিপন কলেজের স্বার্থ দেখছেন বলে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন অনেকখানি।
বিদেশি রাজতন্ত্র, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য একজন নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে ভারতীয়রা শেখেনি। সে রকম নেতাই বা কোথায়? ইংরেজ ভারতীয়দের এই দুর্বলতা জেনে গেছে বলেই আরও বিভেদ নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়, ভারতের সব দুর্দশার জন্য শুধু ইংরেজকে দায়ি করা ঠিক নয়, এ আমাদেরই পাপ। আমরা এখনও ক্ষুদ্র স্বার্থ আর অহমিকা নিয়ে মত্ত।
অল্পবয়েসীরা, ছাত্র ও তরুণ দল ইদানীং তিলকের খুব ভক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথও এক সময় তিলককে সমর্থন করেছেন, তিলক কারারুদ্ধ হবার সময় তাঁর মামলা চালাবার জন্য সাহায্য করেছেন। এখন আর উৎসাহ পান না, বরং মনে হয়, তিনি ভুল করেছিলেন, অন্যের কথায় মেতে উঠে শিবাজী উৎসবের মতন কবিতা লেখা তাঁর উচিত হয়নি। বালগঙ্গাধর তিলক যদি সর্বভারতীয় নেতা হয়ে ওঠে, তা হলে আরও বিপদ আসন্ন। মহাতেজা ওই লোকটি উগ্র হিন্দু, হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে ধরে তিনি জাতীয় আন্দোলন থেকে মুসলমানদের আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছেন! মহারাষ্ট্রের গণেশ উৎসব, শিবাজী উৎসবকে তিলক নিয়ে এসেছেন বাংলায়, অনেকেই মেতে উঠেছে তা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের একেবারেই পছন্দ হয় না। পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায়ই হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর শোনা যায়। এতকাল প্রতিবেশী থেকেও মুসলমানরা যে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করতে পারে, হিন্দুরা মুলসমানদের নারী-শিশুর ওপর অত্যাচার করতে পারে, এটাই তো অবিশ্বাস্য! এই বিভেদের বীজ কোথায় সুপ্ত ছিল? ইংরেজ শাসকরা যে নিজেদের স্বার্থে এই বীজকে সযত্নে লালন করছে, তা হিন্দুরাও বুঝছে না, মুসলমানরাও বুঝছে না।
এত সব দায়িত্ব ও চিন্তা থাকলে কি কবিতা রচনা করা যায়? কবি ভাববিলাসী নন, আবার নিরন্তর কর্মযোগী হয়ে থাকলেও তাঁর শিল্প-সত্তা চাপা পড়ে যায়। পলায়নবাদী নন কবি, কিন্তু সৃষ্টির সময়টাতে তাঁকে পলাতক হতেই হয়। সে সময়ই পাচ্ছেন না রবীন্দ্রনাথ, তাই কবিতা লেখাও হচ্ছে না তেমন, ইদানীং একটার পর একটা প্রবন্ধ লিখছেন, তাতে প্রকাশ করছেন দেশকাল-সমাজ নিয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তা। কিন্তু এসব পড়ে বা ক’জনের চৈতন্য উদয় হবে কে জানে!
আপাতত কন্যার বিবাহের চিন্তাটাই প্রাধান্য পাচ্ছে। মীরার বয়েস তেরো পেরিয়ে গেছে, আর দেরি করা যায় না, পাত্রের অনুসন্ধান চলছে নানা স্থানে। অনেক পাত্রপক্ষ নিজেরাই প্রস্তাব নিয়ে আসে। চর্তুদিকে রটে গেছে, ঠাকুরবাড়ির কোনও কন্যাকে বিবাহ করলে, রাজকন্যা ও অর্ধেক রাজত্বের মতন, একটি সুন্দরী বধু ও ইংলন্ডে গিয়ে পড়াশুনোর খরচ পাওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ির খরচে বিলাতে গিয়ে ব্যারিস্টার হবার লোভে অনেক যুবকই উঁকিঝুঁকি মারে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ঠিক করে রেখেছেন, এবার আর তিনি কিছুতেই পণ দেবেন না। বিদেশে পাঠাবার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে জামাই আনবেন না। রেণুকার বিয়ের ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে! সত্যেন্দ্র এখনও জ্বালিয়ে চলেছে তাঁকে। সত্যেন্দ্রর অপদার্থতায় রেণুকার মন ভেঙে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সে আর বাঁচলই না।
বন্ধুরা কিছু কিছু পাত্রের সন্ধান আনছেন, কোনওটি বোম্বাইয়ের, কোনওটি লাহোরে। বিভিন্ন রাজ্যের, ভিন্ন ভাষাভাষীর ছেলেমেয়েদের বিবাহের কিছু কিছু চল হয়েছে, সরলার যেমন বিবাহ হয়ে গেল পঞ্জাবের এক অধিবাসীর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ মেয়েকে খুব দূরে পাঠাতে চান না, মাঝে মাঝে তাকে দেখতে চান।
একদিন বরিশালের বামনদাস গাঙ্গুলির এক ছেলে একটি চিঠি নিয়ে এল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সে এসেছে ব্রাহ্ম সমাজ সম্পৰ্কীয় কাজে, কিন্তু তাকে দেখেই রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়ে গেল। সতেরো-আঠারো বছর বয়সী সদ্য কৈশোর উৰ্ত্তীর্ণ যুবক, বেশ দীর্ঘকায় ও গৌরবর্ণ, সুঠাম স্বাস্থ্য, মুখমণ্ডলে বেশ একটা তেজস্বী ভাব আছে। তার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে আরও মুগ্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথ, এ যেন দৈব যোগাযোগ। ছেলেটির নাম নগেন, সে ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান, আবার গঙ্গোপাধ্যায় বংশীয় বলে খাঁটি ব্রাহ্মণ। যাকে বলে সোনায় সোহাগা।
রবীন্দ্রনাথ বামনদাসের চিঠির উত্তরে কাজের কথা লেখার পর নগেন্দ্রর সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ প্রস্তাব জানালেন। যথাসময়ে উত্তর এল, বামনদাস জানালেন যে একে তো সুবিখ্যাত ঠাকুর পরিবার, তার ওপরে প্রখ্যাত কবি ও ব্রাহ্ম সমাজের নেতা রবীন্দ্রবাবুর কন্যার সঙ্গে নিজের পুত্রের বিবাহ দেওয়া তো অতি ভাগ্যের কথা। কিন্তু শ্রীমান নগেন্দ্র এখন বিবাহে ইচ্ছুক নয়, সে ব্রাহ্ম সমাজের কাজ করতে চায় ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহী। রবীন্দ্রনাথ আবার লিখলেন, ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারকার্য ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, দুটিই বিশেষ সমর্থনযোগ্য, তবে এর সঙ্গে বিবাহ করতে বাধা কী? বামনদাসের কাছ থেকে এবারে উত্তর এল যে তিনি বুঝিয়ে সুঝিয়ে পুত্রকে রাজি করিয়েছেন, কিন্তু শ্রীমানের একটি শর্ত আছে, সে উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা যাবে বলে মনস্থির করেছে। জাহাজ ভাড়া ও সেখানে পড়াশুনোর ব্যয় জুগিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তার পিতার নেই। সুতরাং মহাশয় যদি জামাতাকে পুত্রবৎ মনে করে আমেরিকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, তবেই এ বিবাহ সম্ভব হতে পারে।
ঘুরেফিরে সেই একই প্রস্তাব। তবে ইংল্যান্ড নয়, আমেরিকা, ভাড়া অনেক বেশি। রবীন্দ্রনাথ নিজের জেদ আঁকড়ে থাকতে পারলেন না, পাত্রটি তাঁর এমনই মনোমতন যে তিনি ওকে হাতছাড়া করতে চান না। তিনি আবার ভুল করলেন, তিনি ওই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন।
ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতা আছে। কিন্তু পদবিতে ব্রাহ্মণ হলেও নগেন্দ্র ব্রাহ্মণত্ব কিছুই মানে না, হিন্দুয়ানিরই ঘোর বিদ্বেষী। এই বয়েসেই সে গোঁড়া ব্রাহ্ম, তাও সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের, আদি সমাজের সঙ্গে তাদের দূরত্ব অনেকখানি। প্রথম দর্শনে রবীন্দ্রনাথ তাকে মনে করেছিলেন তেজস্বী, আসলে সে স্বভাবে উদ্ধত ও গোঁয়ার। বিবাহের রাতেই তার আচরণে সে প্রমাণ পাওয়া গেল।
বিবাহের ব্যবস্থা হয়েছে শান্তিনিকেতনে। এর আগে শান্তিনিকেতনে বড় রকমের কোনও পারিবারিক উৎসব হয়নি, রবীন্দ্রনাথ আত্মীয় বন্ধুবান্ধব অনেককে আমন্ত্রণ জানালেন। এই তাঁর শেষ কন্যার বিবাহ, সেজন্য বেশ বড় রকমের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হল, পাত্রপক্ষ সদলবলে এক দিন আগেই উপস্থিত।
বিবাহের দিনে সকাল থেকেই শোনা গেল, নগেন্দ্র নাকি বলেছে, মেয়েদের পায়ে আলতা দেওয়া ও মাথায় সিঁদুর পরা সে দু’চক্ষে দেখতে পারে না, ওসব নাকি হিন্দুয়ানি! যাকে তাকে সে টিপ টিপ করে প্রণাম করতেও পারবে না। হিন্দুরা যে কোলাকুলি করে, তাও তার অপছন্দ, ব্রাহ্মদের ওসব মানতে নেই। কথাগুলি রবীন্দ্রনাথেরও কানে গেল, তিনি মৃদু হাসলেন। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অল্পবয়েসী ছেলে ছোঁকরারা তো কিছুটা বাড়াবাড়ি করে, তিনি জানেন। নগেন্দ্রকে পরে বুঝিয়ে বললেই হবে। তিনি নিজে সিঁদুর-আলতা পরা বা কোলাকুলিকে সমর্থনও করেন না, আবার পরিত্যজ্যও মনে করেন না। এগুলি কোনও ধর্মের অঙ্গ নয়, লোকাঁচার, স্থানীয় সংস্কৃতি। এক একটি অঞ্চলে এরকম কিছু কিছু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকে, তার বিরুদ্ধাচরণ করাও হাস্যকর গোঁড়ামি। যা অনেক মানুষে চায়, যা একটা সামাজিক প্রথা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, তা শুধু শুধু অবজ্ঞা করতে চাওয়া হবে কেন? কোনও মেয়ে যদি পায়ে আলতা পরে কিংবা কপালে একটা লাল টিপ পরে আনন্দ পায় তো পাক না, এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।
সকালবেলাতেই নগেন্দ্র গায়ে হলুদে আপত্তি জানাল। তাতে কেউ বিশেষ আমল দিল না, খানিকটা হলুদবাটা বরের অঙ্গে চুঁইয়ে কনের কাছে পাঠিয়ে দিতে হয়, তা এমনি পাঠিয়ে দেওয়া হল। তবে গোলমাল বাধল বিবাহবাসরে। আদি ব্রাহ্ম সমাজের রীতি অনুসারে ব্রাহ্মণকে উপবীত ধারণ করতেই হয়। যদি কারুর উপবীত না থাকে, তা হলে পুরোহিতমশাই সেখানেই গ্রন্থি দিয়ে বরকে দ্বিজত্বে উন্নীত করেন। নগেন্দ্রর উপনয়ন তো হয়নি বটেই, সে প্রস্তাব শুনেই সে বলে উঠল, আমি পৈতে পরব না!
উপবীত ধারণের প্রশ্ন নিয়েই প্রথম ব্রাহ্ম সমাজে ভাঙন ধরে। এখন সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজই বেশি সক্রিয় ও শক্তিশালী, তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-শুদ্র ইত্যাদি জাতিভেদ নেই, পৈতে দিয়ে আলাদা করে ব্রাহ্মণকে চিহ্নিত করা তাদের কাছে উপহাসের ব্যাপার। নগেন্দ্র আদি ব্রাহ্ম সমাজের এক কন্যাকে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছে বলে গলায় পৈতে পরতে হবে, এমন পাত্র সে নয়। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ওসব আমার দ্বারা হবে না।
পুরোহিত মশাই পড়লেন মহা ফাঁপরে। উপবীত না ছুঁয়ে মন্ত্র পড়লে সে বিবাহ সিদ্ধ হয় না, এ দিকে ভাবী বর বেঁকে বসেছে। তিনি নরমভাবে মিনতি করে বললেন, বাবাজীবন, কিছুক্ষণের জন্য অন্তত উপবীতটি ধারণ করো, তারপর কাজ চুকে গেলে না হয় খুলে ফেলল। বেশিক্ষণের ব্যাপার তো নয়।
তিনি নগেন্দ্রর কণ্ঠে নয় পাক দেওয়া পৈতেটি পরিয়ে দিতেই সে উঠে দাঁড়াল, পৈতেটি ছিঁড়ে নিক্ষেপ করল দূরে। কর্কশ কণ্ঠে বলল, এই সব জঞ্জাল ছাড়া বিয়ে হয় কি না বলুন! নইলে..
কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন একটু দূরে। যেন একটা নিথর মূর্তি, নিশ্বাসও পড়ছে না।
কবিরও কি কখনও ক্রোধ হয় না? কিন্তু এখানে ক্রোধ সংবরণ করা ছাড়া উপায় নেই।
সতেরো-আঠারো বছরের এই অশিষ্ট যুবকটিকে এখন জোর ধমক দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কেউ তা দেবে না। নগেন্দ্রর বাড়ির লোকজন যেন মজা দেখছে। হিন্দু সমাজে একটা অদ্ভুত রীতি চালু আছে, আদি ব্রাহ্ম সমাজও তার থেকে মুক্ত নয়। বিবাহ বাসরে বরপক্ষ যেমন খুশি অভদ্র, অন্যায় আচরণ করতে পারে, কিন্তু তার প্রতিবাদ করতে পারে না কন্যাপক্ষ। বিবাহবাসরে পণের টাকা পুরোপুরি পাওয়া যায়নি কিংবা প্রতিশ্রুত স্বর্ণালঙ্কার সব দেওয়া হয়নি, এই অজুহাত দেখিয়ে বিবাহ সম্পূর্ণ না করেই পাত্রকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায় বরপক্ষ, এরকম ঘটনা সারা বাংলায় অহরহ ঘটছে। কন্যাপক্ষ তখন অসহায়, কারণ পূর্বনির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট লগ্নে যদি কন্যার বিবাহ না হয় তা হলে সে লগ্নভ্রষ্টা হয়ে যায়। সে অতি কলঙ্কের কথা, সে কন্যার আর বিবাহ হয় না। সেই জন্য কন্যাপক্ষ তখন সেই সব লোভী, কুৎসিত ব্যবহারকারী পাত্রপক্ষের কাছে হাতজোড় করে কাকুতি-মিনতি করে, পা ধরতেও বাকি রাখে না।
নগেন্দ্র কাব্য-সাহিত্য পাঠের ধার ধারে না। তার ভাবী শ্বশুর যে একজন কবি এবং সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি, তা সে গ্রাহ্য করল না। যেন এ পরিবারের একটি মেয়েকে বিয়ে করে সে ধন্য করে দিচ্ছে। প্রথম দিনেই তার আচরণ দেখে বোঝা যায়, তার সহবত জ্ঞান নেই, রুচি নিম্নস্তরের, এ যুবক ঠাকুরবাড়ির যোগ্য জামাতা হতে পারে না। মীরা যে সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বর্ধিত হয়েছে, তাতে সে শ্বশুর পরিবারে গিয়ে স্বস্তি বোধ করতে পারবে না। এখনও এ বিবাহ বন্ধ করে দেওয়া যায়।
কিন্তু কবির মন দ্বিধান্বিত। এ বিবাহ সম্পন্ন না হলে যদি মীরাকে অনূঢ়া অবস্থায় কাটাতে হয় সারা জীবন? তখন তো আত্মীয় বন্ধুরা মীরার পিতাকেই দুষবে। অনুপযুক্ত স্বামীর সঙ্গে সহবাস, না সারা জীবন কুমারী থাকা, কোনটা বেশি কাম্য?
সবাই চুপ করে আছে। পুরোহিত মশাই অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছেন, রবীন্দ্রনাথের দিকে। রবীন্দ্রনাথ দু’বার মাথা নোয়ালেন। উপবীত ছাড়াই মন্ত্রপাঠ হোক!
বাকি সময় আর রবীন্দ্রনাথ সে আসরে রইলেন না। বন্ধুদের মধ্যে জগদীশ আসেননি, লোকেন পালিতও আসতে পারেননি, এই সময় কথা বলার মতন কেউ নেই। বিদ্যালয়ের ঘরগুলিতে অতিথিদের খাওয়া দাওয়া চলছে, রবীন্দ্রনাথ সেদিকেও গেলেন না। তাঁর বাড়ির পেছন দিকে নির্জন স্থানে পায়চারি করতে লাগলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের আকাশ একেবারে পরিষ্কার, মেঘের চিহ্ন নেই, অসংখ্য তারা দেখা যায়। যখন মনের মধ্যে সংকট থাকে, তখন রবীন্দ্রনাথ আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্তি পান। কী বিপুল, কী অনন্ত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, সেদিকে মাথাটা উঁচু করলে মনে হয়, এর মধ্যে মানুষের সুখ-দুঃখ কত তুচ্ছ!
আমি বিশ্ব-সাথে রব সহজ
বিশ্বাসে
আমি আকাশ হতে বাতাস নেব
প্রাণের মধ্যে নিঃশ্বাসে।
পেয়ে ধরার মাটির
স্নেহ
পুণ্য হবে সর্ব দেহ…
হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ একটা আর্ত চিৎকার শুনতে পেলেন। যেন প্রাণান্তকর কোনও নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। খুব কাছেই! রবীন্দ্রনাথের বুক কেঁপে উঠল। মীরা, এ তো মীরা। ঝোঁকের মাথায় মীরা একটা সাঙ্ঘাতিক কিছু করে বসল নাকি! ঘোমটায় মুখ ঢেকে সে বসেছিল, তবু সে বাবার অপমানের ব্যাপারটা টের পেয়েছে, সে কি আত্মঘাতিনী হল?
রবীন্দ্রনাথ দৌড়ে ঢুকে গেলেন বাড়ির মধ্যে। আওয়াজ এসেছে স্নানের ঘর থেকে। আরও কয়েকজন এরই মধ্যে জড়ো হয়েছে সেখানে। প্রথমে রবীন্দ্রনাথ কিছুই বুঝতে পারলেন না। স্নানঘরের দরজা খোলা, ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে মীরা, অঙ্গে নববধুর বেশ, ডায়নামো দিয়ে বিজলি বাতি জ্বালানো হয়েছে, তাই ভেতরটা বেশ আলোকিত। মীরা গলায় দড়িও দেয়নি, গায়ে আগুনও ধরায়নি, তার চক্ষু বিস্ফারিত, সে থরথর করে কাঁপছে।
তারপর রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেলেন সাপটাকে। ঠিক চৌকাঠের ওপর আধাআধি, বাকি অর্ধেক উঁচু হয়ে ফণা মেলে রয়েছে, একটা গোখরো সাপ, এত বড় গোখরা সচরাচর দেখা যায় না। ফণা মেলে দুলছে সেই সাপ।
এক নজর দেখেই মনে হল, মীরাকে বাঁচানো যাবে না। সাপটাকে মারতে গেলেই সেটা স্নানঘরের মধ্যে ঢুকে পড়বে। মীরা বেরিয়ে আসতে পারবে না। গোখরো সাপ এমনিতেই বদমেজাজি হয়, সামনে পেয়ে প্রথমেই মীরাকে দংশন করবে। সবাই হতবুদ্ধি হয়ে আছে। এ কবিকে কখনও কখনও লাঠিও হাতে নিতে হয়। কয়েকজন লাঠিসোটা নিয়ে এসেছে, অগ্রসর হতে সাহস পাচ্ছে না। কবি একজনের হাত থেকে একটা লাঠি নিয়ে নিলেন। তাঁকে যদি কামড়ায় তো কামড়াক, তবু মেয়েকে বাঁচাতেই হবে। অতটুকু বয়েস, জীবনের কিছুই জানবে না? তিনি তো তবু অনেক কিছু পেয়েছেন।
কোনওদিন কোনও প্রাণীকে আঘাত করেননি কবি, আজ তিনি দৃঢ়মনস্ক। একটা শক্ত ঘা দিতে হবে। তাতে সাপকে একেবারে ঘায়েল করা যায় না, তবু তার মনোযোগ মীরার দিক থেকে ফিরবে, সে ক্রুদ্ধ হয়ে এ দিকে ছোবল দিতে আসবে। লাঠিটা উচিয়ে এক পা এক পা করে এগোতে লাগলেন কবি।
সাপটির পরমায়ু আরও কিছুদিন বাকি ছিল, এবং পিতা-পুত্রীরও। অকস্মাৎ সে ফণাটা নিচু করে নিল, তারপর প্রায় বিদ্যুৎ গতিতে চৌকাঠের এক পাশের গর্তে ঢুকে পড়ল। সকলে হই হই করে উঠল এক সঙ্গে।
মীরা ছুটে এসে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুহাতে তাকে ব্যেপে রইলেন রবীন্দ্রনাথ। অমঙ্গলের আশঙ্কায় তাঁর হৃদয়ে মোচড় লাগল। আর কোনও ছেলেমেয়ের বিবাহের রাতে এরকম সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটেনি। এটা কীসের সূচক! তবে যাই ঘটুক না কেন, তিনি তাঁর কন্যাকে সব সময় এ রকম আগলে রাখবেন।
বিবাহ-পরবর্তী পরিকল্পনা নগেন্দ্র আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। নবোঢ়া পত্নীকে নিয়ে মধুযামিনী উপভোগ করার বাসনা তার নেই। অবিলম্বে সে আমেরিকায় যাবার ব্যবস্থা করতে চায়। তার আগে সে একবার বরিশালে গিয়ে স্ত্রীকে সেখানেই রেখে আসবে কিছুদিনের জন্য।
বিবাহের পর পিত্রালয় ছেড়ে যাবার সময় সব মেয়েই কান্নাকাটি করে। কিন্তু মীরার কান্না থামতেই চায় না। বাবাকে ছেড়ে আগে সে কোথাও যায়নি, মায়ের মৃত্যুর পর সে-ই সাধ্যমতন বাবার সেবা করেছে, এখন বাবা একলা থাকবেন কী করে? রবীন্দ্রনাথ কত করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মীরা একেবারে অবুঝ। দেবেন্দ্রনাথের আমলে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বিয়ের পরেও বাপের বাড়িতেই থাকত, স্বামীরা ঘর-জামাই হত। কিন্তু সময় বদলে গেছে, গোষ্ঠীপতি দেবেন্দ্রনাথ নেই, ঠাকুরবাড়ির সেই আগেকার জাঁকজমকও নেই, এখন ভাইয়েরা যে-যার নিজস্ব অংশে থাকে, পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রমশ আলগা হয়ে আসছে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে তো যেতেই হয়, মীরার দিদি মাধুরীলতা যায়নি মুঙ্গেরে?
শেষ পর্যন্ত মীরার পীড়াপীড়িতে রবীন্দ্রনাথকেও বরিশাল যেতে হল। কন্যাকে তিনি তার শ্বশুরালয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে আসবেন। সেই প্রাদেশিক সম্মেলনের সময় ফুলার সাহেবের নির্দেশে পুলিশি অত্যাচারের বিবরণ শুনে রবীন্দ্রনাথ নৌকা ছেড়ে বরিশাল শহরে পদার্পণ করেননি। তারপর এই আবার বরিশালে আসা। তাঁর আগমনবার্তা অঘোষিতই রয়ে গেল।
গাঙ্গুলি পরিবারটির ধরন-ধারণ তাঁর কেমন মনঃপূত হল না। কথাবার্তার সুর কেমন যেন রুক্ষ। নগেন্দ্রর ভাইগুলি আরও বেশি কট্টর, হিন্দু সংস্কৃতির অনেক কিছু নিয়েই তারা ঠাট্টাতামাশা করে। ব্রাহ্মদের এই বাড়াবাড়ি রবীন্দ্রনাথের পছন্দ নয়। তিনিও নিরাকার ব্রহ্মে বিশ্বাসী তা বলে কি তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বিরহ কাহিনী উপভোগ করতে পারবেন না! এ কাহিনীর মধ্যে যে চিরন্তনতা আছে, তা কোনও বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে আবদ্ধ নয়।
মীরাকে তিনি অবশ্য কিছুই বুঝতে দেন না, তার শ্বশুর কুলের সকলের নামেই বিস্তর প্রশংসা করেন। স্বামী বিদেশে গেলে মীরা পড়াশুনো করার অনেক সময় পাবে। তিনিও কন্যাকে নিয়মিত চিঠি লিখবেন।
একদিন চট্টগ্রামের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এসে তাঁকে ধরলেন। কবি কখনও চট্টগ্রামে যাননি, সেখানকার অধিবাসীরা কবিকে একবার নিজেদের মধ্যে পেতে চায়। তাঁকে সংবর্ধনা জানাবে। বেশি অনুরোধ করতে হল না। রবীন্দ্রনাথ রাজি হয়ে গেলেন। বরিশাল থেকেই কলকাতায় ফিরতে তাঁর মন চাইছিল না। মীরা থাকবে না, জোড়াসাঁকোর বাড়িটা তাঁর কাছে শুন্য মনে হবে।
মীরা অবশ্য বরিশালের মতন অচেনা স্থানে, শ্বশুরবাড়ির প্রায় অপরিচিত লোকজনদের সঙ্গে একা কিছুতেই থাকতে রাজি হল না। রবীন্দ্রনাথ চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এসে দেখলেন নগেন্দ্রর সঙ্গে মীরাও ফিরে এসেছে। আর কয়েকদিন পরই নগেন্দ্র আমেরিকা যাত্রা করবে, মীরা তখন চলে যাবে শান্তিনিকেতনে।
রবীন্দ্রনাথ আবার প্রবন্ধ রচনা ও বক্তৃতায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নিজেকে তিনি ব্যস্ত রাখতেই চান, নইলে এক একদিন যেন বুকের মধ্যে আকাশজোড়া শূন্যতা ঢুকে পড়ে। মনে হয়, তিনি যা কিছু করে যাচ্ছেন, সবই যেন অর্থহীন। জীবন যেন প্রতিদিন শুষ্ক থেকে শুষ্কতর হয়ে উঠছে। সম্পূর্ণ নারীবর্জিত জীবন। একটুও মধুর রসের ছোঁয়া নেই। কোনও পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে তিনি পুরোপুরি মন খুলে দিতে পারেন না, শুধু কোনও কোনও নারীর কাছেই তিনি সহজ হতে পারেন। এটা তাঁর স্বভাব। বিবির বিয়ে হবার পর যোগাযোগ অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে। আর কোনও নারীকে তিনি চিঠিও লেখেন না। সেইজন্যই কি কবিতা লেখাও কমে আসছে?
একমাত্র প্রিয়ংবদার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়, সে সাহিত্যগত প্রাণ, কবিতা ভালবাসে, নিজেও কবিতা লেখে, সে নিজের কবিতা শোনায়। কিন্তু প্রিয়ংবদার সঙ্গে ঘন ঘন দেখা হওয়ার সামাজিক অসুবিধে আছে। তা ছাড়া আরও একটা অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে, একসময় হঠাৎ খুব টাকার টানাটানি পড়েছিল, শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের খেতে না পাওয়ার মতন অবস্থা, শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছিল না, রবীন্দ্রনাথ সে সময় হন্যে হয়ে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন প্রিয়ংবদা কী করে যেন তাঁর প্রিয় কবির অত দুশ্চিন্তার কথা শুনে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঋণ দিয়েছিলেন দশ হাজার টাকা। রবীন্দ্রনাথ প্রতি মাসে কিছু কিছু সেই টাকা শোধ করছেন। কোনও রমণীর কাছে যদি অর্থ-ঋণ থাকে, কোনও অধমর্ণ পুরুষ কি তার সঙ্গে মধুর ভাবের কথা বলতে পারে! কবির এই সঙ্কোচের কথা জেনে প্রিয়ংবদা আরও পাঁচশো টাকা পাঠালেন শান্তিনিকেতনের জন্য, এটা ঋণ নয়, দান। তাতে কৃতজ্ঞতার বোঝা আরও বেড়ে গেল।
দু-একজন বন্ধু মাঝে মাঝে ইঙ্গিত দেয়, বিপত্নীক কবির আবার বিবাহ করা উচিত। তাঁর বয়েস এখন মাত্র ছেচল্লিশ, শরীর অটুট, অদম্য কর্মক্ষমতা, তবে তিনি আর একজন জীবনসঙ্গিনী বেছে নেবেন না কেন? এই বয়েসের অনেক পুরুষই আকছার বিয়ে করে। এতে দোষের কিছু নেই। সাংসারিক দায়দায়িত্ব থেকেও তিনি অনেকখানি মুক্ত। কেউ কেউ একটু বাঁকা সুরে বলে, রবিবাবু নিজে আবার বিয়ে করবেন বলেই বুঝি ছোট মেয়েটির তড়িঘড়ি করে বিয়ে দিয়ে দিলেন?
এসব কথাই কবির কাছে খুব অরুচিকর মনে হয়। মৃণালিনী চলে যাবার পর আবার বিবাহের কথা তিনি স্বপ্নেও কখনও চিন্তা করেননি। তিনি পাঁচটি সন্তানের পিতা, তাদের মধ্যে জীবিত রয়েছে চারজন, সম্পূর্ণ এক অচেনা নারীকে তারা মা বলে ডাকবে? এ কখনও হতে পারে! এ রকম নির্লজ্জতার কাজ তিনি করতে পারেন, এমন কথা লোকে ভাবে কী করে!
তবু নারীসঙ্গলিপ্সা রয়ে গেছে তাঁর মধ্যে। নারীর সৌন্দর্য, নারীর হৃদয় রহস্য পুরুষকে সৃষ্টির প্রেরণা দেয়। স্ত্রী নয়, সংসারসঙ্গিনী নয়, কোনও নারী কি শুধু বন্ধু হতে পারে না? সখী হতে পারে না? তেমন নারীই বা কোথায়?
একদিন ত্রিপুরার মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্যের কাছ থেকে দূত এল। তিনি কবির সাক্ষাৎপ্রার্থী।
রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরের প্রতি খানিকটা অপ্রসন্ন হয়ে আছেন। ত্রিপুরা রাজ্যে গোলমাল লেগেই আছে, কিছুতেই সামলাতে পারছেন না রাধাকিশোর। পিতার চরিত্রের দার্চ তাঁর মধ্যে একেবারেই নেই। বীরচন্দ্র মাণিক্যের আমলে রাজ্যশাসনের ব্যবস্থাপনার অনেকখানি দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর সচিব রাধারমণ ঘোষ। সে কাজে তিনি ছিলেন অতীব দক্ষ, আগেকার মহারাজ অনেকখানি নির্ভর করতেন তাঁর ওপর। এখন সে রকম একজন সুযোগ্য প্রশাসক দরকার, তাই রবীন্দ্রনাথ পাঠিয়েছিলেন তাঁর বিশ্বাসভাজন রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়কে। কিন্তু রমণীমোহনের বিরুদ্ধে মহারাজের পারিষদরা চক্রান্তে মেতে উঠেছে, একজন বহিরাগতকে তারা সহ্য করবে না। রাজকার্যের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিকে যে-কোনও স্থান থেকে আনানো যায়, কিন্তু রাধাকিশোর শক্তভাবে সমর্থন দিতে পারছেন না তাঁর এই সচিবকে। রমণীমোহন আর টিকতে পারবে না ত্রিপুরায়। এর মধ্যেই এক ইংরেজকে চাকলা রোশনাবাদের ম্যানেজার নিযুক্ত করা হয়েছে, অথচ রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছিলেন, কোনও ইংরেজকে যেন ঢুকতে দেওয়া না হয়। এই করে ইংরেজরা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ত্রিপুরা গ্রাস করবে।
ত্রিপুরা রাজ্যটির প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিশেষ দুর্বলতা আছে। অনেকদিন থেকে তিনি জড়িয়ে আছেন এর সঙ্গে। এই রাজপরিবারটির তিনি মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, বীরচন্দ্রের মৃত্যুর পর যখন সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদ বেধেছিল, তিনি রাধাকিশোরকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানিয়েছেন। ত্রিপুরার এই রাজপরিবার বাংলা ভাষার বিশেষ পৃষ্ঠপোষক। এই রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরও বিস্তার ঘটতে পারে। উপজাতীয়রাও বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করছে। কিন্তু রাধাকিশোর রবীন্দ্রনাথের আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারছেন না। তাঁর পিতা ভেবেছিলেন, বৈষ্ণব পদাবলীর একটি নির্ভরযোগ্য সঙ্কলন প্রকাশ করবেন, একটা আধুনিক উন্নত প্রেসও খুলবেন, সেখান থেকে প্রকাশিত হবে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনার শোভন রাজ সংস্করণ। রাধাকিশোর পিতার অসমাপ্ত বাসনা পরিপূর্ণ করার কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছেন না। আগরতলায় নতুন রাজপ্রাসাদ বানাবার জন্য ব্যয় করছেন প্রচুর অর্থ।
তবু এই সাক্ষাৎ প্রার্থনা একেবারে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মহারাজকে আমন্ত্রণ জানালে অনেক আয়োজন করতে হয়, এখন সে রকম লোকবল নেই। রবীন্দ্রনাথ নিজেই গেলেন।
তিনি যখন উপস্থিত হলেন, রাধাকিশোর সেই মুহূর্তে প্রাসাদের বাইরে একটি নতুন, চকচকে মোটর গাড়িতে উঠছেন। কবিকে দেখে মহারাজ দুবাহু বাড়িয়ে বললেন, আসুন, আসুন রবিবাবু, আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন। চলুন, এই গাড়িতে চেপে একটু গঙ্গার পবিত্র সমীরণ উপভোগ করে আসা যাক।
রবীন্দ্রনাথ গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ির চালকের অঙ্গে খাকি রঙের পোশাক, মাথায় পাগড়ি। তার সামনে একজন বন্দুকধারী দেহরক্ষী। রাধাকিশোর বললেন, রবিবাবু, এ গাড়িটি সদ্য বিলেত থেকে এসেছে, দেখেছেন ইঞ্জিনের একটুও শব্দ নেই। মোটর গাড়ি হচ্ছে এ যুগের জাদু গালিচা, আকাশে ওড়ে না বটে, কিন্তু আপনি বসলেন, আপনার ইচ্ছে মতন যে-কোনও জায়গায় নিয়ে যাবে। রবিবাবু, আপনি গাড়ি চালাতে জানেন? আমি শিখব ভাবছি।
ঠাকুরবাড়িতেও গোটা দু-এক গাড়ি কেনা হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ জুড়িগাড়ি বাতিল করে এখন মোটর গাড়ি চাপছেন। এখন আর মোটর গাড়ি অভিনব কিছু নয়। কিন্তু রাধাকিশোর শিশুর মতন উচ্ছ্বসিত, অনবরত গাড়ির গুণপনার কথা বলে চলেছেন।
এক সময় তিনি বললেন, এই গাড়ির আরোহী হয়ে বেনারস পর্যন্ত যাব ঠিক করেছি। শের শাহের আমলের যে রাস্তা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, সেই পথে সরাসরি যাওয়া যায়। আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?
রবীন্দ্রনাথ বললেন, এখন তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শান্তিনিকেতনে নতুন স্কুলবাড়ি নির্মাণ করতে হচ্ছে, নিজে তদারকি করতে চাই—
মহারাজ আরও দু’একবার পীড়াপীড়ি করলেন, রাজি হলেন না কবি। অন্য কোনও প্রসঙ্গ উঠছে দেখে তিনি একটু পরে নেমে পড়লেন।
পরদিন জাতীয় শিক্ষা পরিষদে তাঁর বক্তৃতা, বিশ্বসাহিত্য। জনসমাগম হয়েছিল অনেক, কিন্তু বাড়ি গিয়েও মন প্রসন্ন হল না। তিনি কি প্রবন্ধ লেখক আর বক্তৃতাবাজ হিসেবে খ্যাত হবেন? সবাই বেশ ভারিক্কি ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁকে ভক্তি শ্রদ্ধা করবে? কবিতা কোথায়!
মাথায় গুনগুন করছে নটমল্লারের সুর। ‘মোরি নই লগন লাগিরে…’। এটাকে ভেঙে তিনি নিজস্ব কথা বসালেন ‘মোরে বারে বারে ফিরালে…’। শেষ করার পর দু-তিনবার গেয়ে খানিকটা হালকা বোধ করলেন। এরপর একটা কবিতা লিখলে হয় না? আগে এরকম কতবার হয়েছে, একই সঙ্গে দু-তিনটি গান ও দু-তিনটি কবিতা রচনা করে গেছেন বিভোর হয়ে। তখন জগতের আর। কোনও কিছু সম্পর্কে খেয়াল থাকে না।
একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করেও মন অন্য দিকে চলে গেল। ওষ্ঠে একটা তিক্ত স্বাদ। একটা নতুন অভিযোগ উঠেছে, তাঁর কবিতা দুবোধ্য। শুধু তাই নয়, তিনি ইচ্ছে করে অর্থহীন, ধোঁয়াটে কবিতা লিখে পরবর্তী তরুণ কবিদের মাথা খাচ্ছেন, এতে বাংলা কাব্যের চরম ক্ষতি হবে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বন্ধু ছিলেন এক সময়, তিনি হঠাৎ বিরোধী হয়ে বিশ্রী ভাষায় আক্রমণ করছেন, লোকেন পালিতও নাকি সমর্থন জোগাচ্ছেন তাঁকে। সবচেয়ে আক্রমণের লক্ষ্য তাঁর ‘সোনার তরী নামের কবিতাটি, ওর নাকি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা সমেত চার-পাঁচ রকমের ব্যাখ্যা হয়। এক কবিতার যদি বিভিন্ন পাঠকের কাছে বিভিন্ন অর্থ প্রতিভাত হয়, দ্বিজুবাবুর মতে সেটা নাকি খুব খারাপ। রবীন্দ্রনাথ এসব তর্কে প্রকাশ্যে কিছুতেই জড়াতে চান না। সোনার তরী’ নিয়ে ওদের এত মাথাব্যথার কারণটা কী! এ সমস্ত ব্যাখ্যাকে ধিক! কবিতার রস যদি কোনও ব্যাখ্যার ওপরেই নির্ভর করে, তবে সে কবিতা বৃথাই লেখা হয়েছিল। ওরা কেন ভাবে না যে ‘সোনার তরী’ কবিতাটির বিশেষ কোনও অর্থই নেই, কেবল বর্ষা, নদীর চর, কেবল মেঘলা দিনের ভাব, একটা ছবি, একটা সঙ্গীত মাত্রই হয়, তাতেই বা কী ক্ষতি?
এই সব মাথার মধ্যে ঘুরলে নতুন কবিতা আসে।
পরদিনই রবীন্দ্রনাথ একটা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। কয়েকটি ছাত্র এল দেখা করতে। তিরিশে আশ্বিন বঙ্গভঙ্গের বার্ষিকী। এবারও ওই দিনটিতে রাখিবন্ধন উৎসব হবে, সারা বাংলায় পালিত হবে অরন্ধন, মিছিল হবে কলকাতার রাজপথে, এবার আরও জোরদার করতে হবে প্রতিবাদ। সেই উৎসব ও মিছিলের পূর্ব পরিকল্পনা তারা রবীন্দ্রনাথকে শোনাল। মিছিলের পুরোভাগে অবশ্যই থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। এবারে তিনি ওই উপলক্ষে নতুন গান লিখবেন না?
সব শুনে রবীন্দ্রনাথ সংক্ষিপ্ত ভাবে বললেন, না। আমি আর মিছিলে যেতে চাই না। ছাত্ররা বলল, সে কী! ‘রাখিবন্ধন আপনারই পরিকল্পনা, আপনি যাবেন না, তা কি হয়? আমরা প্রেরণা পাব কার কাছ থেকে?
রবীন্দ্রনাথ রাখিবন্ধন সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, তোমরা যাও, আমি আর ওর মধ্যে নেই। মিছিলে যাওয়া:কবির কাজ নয়। কবির অস্ত্র লেখনী। আমি আর কোনওদিনই কোনও মিছিলে যাব না।
একটি ছাত্র কাতরভাবে বলল, কবিবর, আমাদের অবস্থাটা একটু ভেবে দেখুন। আমরা কার কথা শুনব? সুরেনবাবু এক কথা বলছেন, বিপিনবাবু অন্য কথা। ‘বন্দেমারতম’ পত্রিকায় অরবিন্দবাবু সরাসরি উস্কানি দিচ্ছেন রাজদ্রোহে। তিলক বলছেন হিন্দুরাজ্য স্থাপনের কথা। সরলাদেবী নেই। আমাদের কে সঠিক পথ দেখাবে? আমরা সবাই আপনাকে মান্য করি। আপনি নেতৃত্বভার গ্রহণ করুন, আপনি সারা দেশবাসীকে ডাক দিন, আমরা আপনার পেছনে এসে দাঁড়াব!
রবীন্দ্রনাথ খানিকটা উষ্ণভাবে বললেন, কী, আমাকে নেতা হতে বলছ। জননেতা? সভায় দাঁড়িয়ে বাগাড়ম্বর করব? অপরকে হেয় করে নিজেকে বড় বলে প্রমাণিত করতে হবে? দলাদলি, মিথ্যাচার, ব্যক্তিস্বার্থ, এর নাম রাজনীতি! আগে অন্যদের বলেছি, এখন তোমাদেরও জানাচ্ছি, ওসব যাঁরা পারেন, তাঁরা করুন। আমি রাজনীতির সঙ্গে কোনও সংস্রব রাখতে চাই না। নেতা সাজবার আমার বিন্দুমাত্র সাধ নেই। আমি নিজের কাজ করে যাব। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় চালানোই এখন আমার প্রধান কাজ। এই দেশ, এই দেশের মানুষের জন্য আমার যেটুকু সাধ্য লিখে যাব, তোমরা আমাকে অন্য অনুরোধ কোরো না।
কলকাতার আসন্ন কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে গানও গাইবেন না। তিনি চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। কলকাতার চেয়ে শান্তিনিকেতনেই তাঁর নিজস্ব আশ্রয়। এখানে সবাই তাঁকে গুরুদেব বলে। তিনি জননেতা হতে চান না, কিন্তু বাকি জীবন তাঁকে গুরুদেব হয়ে থাকতে হবে।