2 of 2

৮৪. নাটক সদ্য শেষ হয়েছে

নাটক সদ্য শেষ হয়েছে। সাজঘরে রং তুলছে অমরেন্দ্রনাথ। মন মেজাজ একেবারেই ভাল নেই। আজ দর্শক সংখ্যা খুবই কম ছিল, অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে অমরেন্দ্রনাথ দেখছিল, সামনের আসনগুলি প্রায় সব ফাঁকা। এইসব দিনে তার অভিনয়েও মন লাগে না। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ থাকবে। কিছু লোক টিকিট না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাবে, তবে না দাপট দেখানো যাবে মঞ্চে। অভিনয়ে যত অমনোযোগী হচ্ছে অমরেন্দ্রনাথ, ততই কমে যাচ্ছে দর্শক। এখন নৈরাশ্য কাটাবার জন্য এক একটা দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে নিজের ঘরে গিয়ে অমরেন্দ্রনাথ মদের বোতলে চুমুক দিয়ে আসে। ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনয়, এমনকী মহড়ার সময়েও কেউ মদ্যপান করতে পারবে না, অমরেন্দ্রনাথ এই কঠোর নির্দেশ জারি করেছিল, সে নির্দেশ সে নিজেই ভেঙেছে অনেকদিন!

অতি দর্পে হতা লঙ্কা! এক সময় অমরেন্দ্রনাথ দৰ্প করে বলেছিল, সে জঙ্গলে গিয়ে নাটক করলে সেখানেও দর্শকরা তার অভিনয় দেখতে ছুটে যাবে! কোথায় গেল সেইসব দিন? আগে দশ বারোটা ক্ল্যাপ বাঁধা ছিল, এখন যে ক’জন দর্শক আসে, তারাও যেন হাততালি দিতে ভুলে গেছে। দর্শক। টানবার জন্য মরিয়া হয়ে অমরেন্দ্রনাথ ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটক নামাল। মিনার্ভায় ওরা ‘সিরাজদৌল্লা খুব জমিয়েছে, ক্লাসিকেও সেই একই নাটক, চলুক প্রতিযোগিতা। এখানে নাম ভূমিকায় অমরেন্দ্রনাথ স্বয়ং, মিনার্ভায় দানি। আশ্চর্য ব্যাপার, দর্শকরা তবু মিনার্ভাতেই গিয়ে ভিড় করছে! অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দানির তুলনা হয়? দানির কাঁপা কাঁপা গলায় টানা টানা সুরের সংলাপও লোকে পছন্দ করল? ওরা অবশ্য তারাসুন্দরীকে পেয়েছে। ক্লাসিকে তেমন কোনও আকর্ষণীয় নায়িকা নেই। নয়নমণি ছেড়ে চলে যাবার পর কুসুমকুমারী ও অন্যান্যরা বিদায় নিয়েছে। অমরেন্দ্রনাথ কাজ চালাবার জন্য ক্রমাগত নতুন মেয়েদের আনছে, ‘সিরাজদৌল্লা’য় লুৎফার ভূমিকায় অভিনয় করছে বিনোদিনী। এক কালের মঞ্চসম্রাজ্ঞীর সঙ্গে নামের মিল থাকলেও এ মেয়েটির ডাক নাম হাঁদি, থিয়েটারের সবাই তো বটেই, দর্শকরাও তার ওই নাম জেনে ফেলেছে। নামেও হাঁদি, কাজেও হাঁদি। রংটাই যা ফর্সা। চক্ষু দুটি গরুর মতন, তার অভিনয় দেখতে দেখতে এক এক সময় অমরেন্দ্রনাথেরই চড় কষাতে ইচ্ছে হয়!

মন ভেঙে গেলে শরীরও ভেঙে যায়। ইদানীং কিছুটা বেশি মদ্যপান করলেই অমরেন্দ্রনাথের হাত কাঁপে, এক একসময় এমন কাশির দমক ওঠে যে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। মঞ্চে অভিনয় করতে করতে হঠাৎ হঠাৎ পা দুটি এমন দুর্বা হয়ে যায় যে মনে হয় বেশিক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। সেই সুঠাম সুন্দর শরীরের এখন ভগ্নদশা, অথচ বয়েসের দিক থেকে যৌবন এখনও যায়নি।

রং তোলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, নারকোল তেল দিয়ে মুখোনা ঘষছে অমরেন্দ্রনাথ, একটি ছোঁকরা উঁকি দিয়ে বলল, বড়বাবু, দু’জন ভদ্দরলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

অমরেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে খেঁকিয়ে উঠল, এখন আবার কে? না না, বলে দে, এখন দেখা-টেখা হবে না।

আগে অভিনয়ের পর উচ্ছ্বসিত হয়ে অনেকে সাজঘরে ফুল দিতে আসত, বড় মানুষেরা মেডেল দিতে চাইতেন, সাধারণ ভক্তদের গদ গদ স্তুতিবাক্য উপভোগ করত অমরেন্দ্রনাথ। এখন আর সেরকম কেউ আসে না। এখন কেউ দেখা করতে চাইলেই মনে হয় পাওনাদার। চতুর্দিকে ঋণ, অমরেন্দ্রনাথের সর্বাঙ্গ ঋণের দায়ে জর্জরিত। ক্লাসিক থিয়েটার এখন রিসিভারের হাতে। এককালে অমরেন্দ্রনাথ এর মালিক ছিল, এখন যে সে বেতনভোগী ম্যানেজার মাত্র, সে কথা তার মাঝে মাঝে মনে থাকে না। টিকিট বিক্রি কমে যাচ্ছে বলে রিসিভারের সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বাধে। এরপর একদিন ক্লাসিক থেকে অমরেন্দ্রনাথের বিতাড়িত হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়।

ছোঁকরাটি বলল, ওঁদের মধ্যে একজন ব্যরিস্টারবাবু আছেন, তাকে আপনি চেনেন।

অমরেন্দ্রনাথ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তা হলে আলাদা কথা, উঁকিল ব্যারিস্টারদের চটানো যায় না। শত্রু পক্ষের উঁকিল হলেও তাকে মিষ্ট বচনে তুষ্ট করার চেষ্টা করতে হয়। এখন যা অবস্থা, পাওনাদার পক্ষের কোনও উঁকিল তাকে জেলে ভরে দিতে পারে।

অমরেন্দ্রনাথ বলল, ঠিক আছে, আসতে বল। আর একখানা কুরসি দিয়ে যা।

মনোবল বাড়াবার জন্য সে হুইস্কির বোতলে আর একটা চুমুক দিয়ে নিল।

আগন্তুদ্বয় যে বিশিষ্ট ব্যক্তি তা তাদের পোশাক ও মুখভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়। যাদুগোপাল ও দ্বারিকা। প্রথমজনকে অমরেন্দ্রনাথ চেনে, সে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানাল। দ্বারিকার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যাদুগোপাল বলল, অমরবাবু, আমরা কোনও মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপারে। আসিনি, অসময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করা হল। আমার এই বন্ধুটি বিশেষ প্রয়োজনে একজনের খোঁজ নিতে এসেছেন, যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন।

অমরেন্দ্রনাথ দ্বারিকার দিকে তাকাল। দ্বারিকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ভূমিসূতা নামে একটি মেয়ে আপনার এখানে অভিনয় করত। শুনলাম সে এখন ছেড়ে দিয়েছে। সে কোথায় থাকে বলতে পারেন?

অমরেন্দ্রনাথ বলল, ভূমিসূতা? আমার চোদ্দো পুরুষে এই নাম শুনিনি। কোনও বাঙালি মেয়ের যে এই নাম হয়, তাও জানতুম না। আপনারা ভুল জায়গায় এসেছেন।

যাদুগোপাল বলল, ওহে দ্বারিকা, আমাদেরও ভুল হয়েছে। ওর ওই নামটা অনেকেই জানে না। স্টেজে সে অন্য নাম নিয়েছিল। নয়নমণি।

অমরেন্দ্রনাথ দপ করে জ্বলে উঠে বলল, তার একটা অন্য নামও ছিল? কোনওদিন বলেনি। নিজের সম্পর্কে কক্ষনও মুখ খুলত না। আপনারা কী বললেন, সে ক্লাসিক ছেড়ে দিয়েছে? মোটেও না। আমি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি, দূর করে দিয়েছি। গলা ধাক্কা দিয়ে গেটের বার করে দিয়েছি। কেন জানেন? তার বড় বাড় বেড়েছিল। অহংকারে মটমট করত। আমাকেও সে উপদেশ দিতে আসে! আমাকে ভয় দেখায়! ফুঃ, ওরকম বাঁদরি আমি কত দেখেছি। কতজনকে হাতের আঙুলে নাচিয়েছি! কতজন এসে কেঁদে কেঁদে আমার পায়ে লুটিয়েছে। আমি অমর দত্ত, স্টেজে মাগি নাচিয়ে পয়সা রোজগার করি না। থিয়েটারে নতুন ধারা এনেছি। একটা মেয়েছেলে না থাকলেও নিজের একার অভিনয়ের জোরে নাটক দাঁড় করিয়েছি। কোথাকার কে নয়নমণি, আমার শেখানো পার্ট করেই তো সে দর্শক মজিয়েছে, সে আমার মুখে মুখে কথা বলার আস্পর্ধা দেখায়! এক কথায় বিদায়! দূর হয়ে যা। আমি কারুর পরোয়া করি না!

দ্বারিকা বলল, মশাই, আপনাদের মধ্যে কী হয়েছিল, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে চাই না। মেয়েটির সন্ধান পাওয়া খুব দরকার। সে কী অন্য বোর্ডে গেছে? সে কোথায় থাকে বলতে পারেন?

অমরেন্দ্রনাথ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আপনারা বুঝি নতুন থিয়েটার খুলবেন? ওর কাছে গিয়ে পায়ে ধরে সাধবেন? ওই ঠেটি খুঁড়িকে নিয়ে আপনাদের কোনও লাভ হবে না। বাগ মানাতে পারবেন না। আমি কি কম চেষ্টা করেছি? বাগান বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যদি ফুর্তি করার কথা ভেবে থাকেন, সে গুড়ে বালি! ও মেয়ের রক্ত ঠাণ্ডা। সতীপনার দেমাক আছে। বলে কিনা, কোনও পুরুষকে ছোঁবে না, এই ব্রত আছে। আসলে কী জানেন, কাঁপের জোর নেই, ব্যাটাছেলেদের ভয় পায়। আরে মশাই, নাচতে নেমে ঘোমটা দিলে চলে!

যাদুগোপাল হেসে বলল, দত্তমশাই, আপনি ভুল করছেন, আমরা থিয়েটারও খুলতে যাচ্ছি না, বাগান বাড়িতে আসর জমাবার মতলবও করিনি। আমরা দুজনেই ও লাইনের লোক নই। বিশেষ একটি ব্যক্তিগত কারণে নয়নমণির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করা দরকার।

অমরেন্দ্রনাথ ধমকের সুরে বলল, কেন আমাকে ওই নামটা মনে করিয়ে দিলেন? রাত্তিরটা বরবাদ হয়ে গেল। নয়নমণি! শুয়ার কি বাচ্চী! সে আমার সর্বনাশ করে গেছে।

বোতলটা তুলে ঢক ঢক করে অনেকখানি গলায় ঢালল অমরেন্দ্রনাথ, তারপরই তার কথার সুর সম্পূর্ণ বদলে গেল। ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে সে স্বগতোক্তির মতন বলতে লাগল, নয়নমণি, নয়নমণি, সে ছিল আমার লক্ষ্মী! যতদিন সে ছিল, ক্লাসিক থিয়েটার রমরমিয়ে চলেছে। সে ছিল দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। কেউ তার গায়ে হাত দেবার সাহস করেনি। এমনকী আমি পর্যন্ত তাকে বুকে জড়াতে পারিনি! ওরে তুই আমার বাইরেটাই দেখলি, আমি মুখে যা-তা কথা বলি, এক একসময় আমার মাথার ঠিক থাকে না, যাদের বন্ধু বলে ভেবেছি, তারা আমায় কুপরামর্শ দিয়েছে, কত টাকা নষ্ট করেছি, নেশার ঝোঁকে মানীর মান রাখতে পারিনি। কিন্তু, নয়ন, তুই আমার ভেতরটা দেখলি না? আমি যে তোকে কত ভালবেসেছিলাম, তুই আমাকে ঠিকঠাক পথে চালাতে চেয়েছিলি, আমার বুদ্ধি ভ্রংশ হয়েছিল, তাই শুনিনি। রবিবাবুর নাটকে আমি খ্যামটা নাচ ঢোকাতে চেয়েছিলুম, তা তুই কিছুতেই নাচতে চাসনি, তুই চলে গেলি, তখন যদি তোর কথা শুনতুম, তা হলে আজ আমার এ দশা হত না! নয়ন, একবার দেখে যা, আমি পাঁকে ডুবে যাচ্ছি, এক সময় থিয়েটারের রাজা ছিলুম, এখন ছুঁচো-চামচিকেরাও আমায় লাথি মেরে যাচ্ছে…না, নয়ন আসবে না, কোনওদিন সে আর থিয়েটারে আসবে না, আমি পায়ে ধরে সাধতে গেলেও সে আমার মুখ দর্শন করবে না, ওঃ ওঃ, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরছি গো…

যাদুগোপাল আর দ্বারিকা এক সময় উঠে পড়ল। অমরেন্দ্রনাথ পুরোপুরি মাতাল হয়ে অসংলগ্ন কথা বলে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে নুয়ে পড়ছে কাশির দমকে, কেঁদে কেঁদে বুক চাপড়াচ্ছে, এর কাছ থেকে আজ আর কোনও সাহায্য পাবার আশা নেই, সে কোনও কথাই শুনতে চায় না।

বাইরে বেরিয়ে এসে আফশোসের শব্দ করে যাদুগোপাল বলল, ইস, লোকটির কী দশা হয়েছে! ভাল বাড়ির ছেলে, আগে দেখেছি তো, কী তেজ ছিল, চোখে মুখে প্রতিভার জ্যোতি ছিল, থিয়েটারে নতুন অনেক কিছু করার সাহস দেখিয়েছিল। কী-ই বা বয়েস, এর মধ্যে একেবারে শেষ হয়ে গেল!

দ্বারিকা জিজ্ঞেস করল, ওর এমন অধঃপতন হল কেন? টাকা পয়সা তো কম করেনি এক সময়। থিয়েটারে যারা আসে তারাই এমন নষ্ট হয়ে যায়? লাইনটাই খারাপ। আমাকেও দু একজন টাকা ঢালার প্রস্তাব দিয়েছিল।

যাদুগোপাল বলল, থিয়েটারের কী দোষ? এখানে এসে যারা মাথার ঠিক রাখতে পারে না, তারাই মরে। গিরিশবাবুকে দেখো, কতকাল ধরে ঠিক চালিয়ে আসছেন, এখনও বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখাচ্ছেন। অর্ধেন্দুশেখর, অমৃতলাল বোস, এঁরাও টিকে আছেন বহুকাল। অমর দত্তর ব্যাপারটা কী হল জানো, সে যুগধর্ম ঠিক বুঝতে পারেনি। এখন আমরা টুরেন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতে বাস করছি, গত সেঞ্চুরিতে আমাদের দেশের অধিকাংশ বড় মানুষ মদ খেয়ে গড়াগড়ি দিত, রক্ষিতার বাড়িতে রাত কাটাত, কে কোন সুন্দরী মেয়েকে রক্ষিতা রাখবে তা নিয়ে রেষারেষি চালাত, আর বুলবুলির লড়াই, বেড়ালের বিয়ে কিংবা কার্তিক ঠাকুরের পুজো উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ টাকা অপব্যয় করত। এ সবই ছিল হঠাৎ-নবাবদের বালখিল্যতা। আস্তে আস্তে সে সব দিনকাল বদলেছে। এখন ধনীর দুলালরাও লেখাপড়া শেখে, পাঁচটা সামাজিক কাজে বিশিষ্ট ভূমিকা নেয়, ব্যক্তিগত চরিত্রও ন্যক্কারজনক নয়। এখন মদ খেয়ে মাতলামি করাটাকে কেউ পৌরুষ মনে করে না, অসহায় মেয়েদের জোর করে ধরে এনে শয্যাসঙ্গিনী করার মধ্যেও পৌরুষ নেই, টাকার মূল্য না বুঝে মুঠো মুঠো টাকা খরচ করা কিংবা অপাত্রে দান করাটাও উদারতার পরিচয় নয়, মূখার্মি। অমর দত্ত ঠিক তাই করেছে। ওর অনেক কীর্তিই আমার কানে এসেছে। যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন থিয়েটারের কত না উন্নতি ঘটাতে পারত, তা না, আরও মদ গিলতে লাগল, শয্যাসঙ্গিনীর সংখ্যা নিয়ে গর্ব করে বেড়াতে লাগল, আর বদ মোসাহেবদের পাল্লায় পড়ে বহু টাকা জলে দিয়েছে। ওর পতন কে আটকাবে?

দ্বারিকা বলল, ভূমিসূতাকে ও তাড়িয়ে দিয়েছে শুনে আমার এমন রাগ হচ্ছিল।

যাদুগোপাল বলল, যতদূর শুনে মনে হল, সে নিজেই ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু গেল কোথায়? একবার গিরিশবাবুর কাছে খোঁজ করা যাক। থিয়েটারের জগতের নাড়ি-নক্ষত্র উনি জানেন—

পরদিন দুই বন্ধুতে যখন মিনার্ভায় পৌঁছল, তখন সদ্য নাটক শুরু হয়েছে। এখন গিরিশবাবুর সঙ্গে দেখা করা যাবে না, দু’খানা বক্সের টিকিট কেটে দুজনে ঢুকে পড়ল ভেতরে। মিনার্ভায় এখনও সগৌরবে চলছে ‘সিরাজদ্দৌলা’। আট আনা-একটাকার একটি আসনও খালি নেই।

মাসের পর মাস মাইনে পাচ্ছিলেন না বলে ক্লাসিক ছেড়ে এসে মিনার্ভায় যোগ দিয়েছেন গিরিশচন্দ্র। এসেই তিনি ঝিমিয়ে পড়া মিনার্ভাকে চাঙ্গা করে তুললেন। কেউ কেউ অবশ্য বলতে শুরু করেছিল যে, গিরিশবাবুকে আর এনে কী হবে, উনি আর আগের মতন পার্টও করতে পারেন না, নাটকগুলোও একঘেয়ে হয়ে গেছে। ওঁর নতুন নাটক সম্পর্কে দর্শকদের আর আগ্রহ জাগে না।

এই সব সমালোচনা কানে এলেই গিরিশচন্দ্র যেন ঘুমন্ত সিংহের মতন হুংকার দিয়ে জেগে ওঠেন। তাঁর নতুন নাটক ‘বলিদান’ অভূতপূর্ব সাড়া জাগাল। নিন্দুকরাই বলতে লাগল, এত ভাল নাটক গিরিশচন্দ্র নিজেও আগে লেখেননি। বাংলার কলঙ্ক হল পণপ্রথা, তারই একটি মর্মস্পর্শী চিত্র এই নাটক। এই বিষয়বস্তু যেমন সত্য, তেমনই সমসাময়িক। হিন্দু পরিবারের বিবাহে কন্যাদের সম্প্রদানই যেন বলিদান।

পরের নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’। সমসাময়িক বাস্তবতা ও শিল্পীর দায়বদ্ধতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর আগে অনেক পৌরাণিক কাহিনী, হিন্দুদের ধর্মীয় পুনর্জীবন ও বীরত্ব নিয়ে অনেক নাটক লেখা হয়েছে। সেগুলিরও প্রয়োজন ছিল, অধিকাংশ হিন্দু তাদের অতীত গৌরবের কথা ভুলেই গিয়েছিল, ইংরেজদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে হীনম্মন্যতায় ভুগত। মুঘল-পাঠানদের আমলে বড় বড়। নবাববাদশাদের জীবন কাহিনী ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস নিকট-স্মৃতি, সেই তুলনায় হিন্দুদের গৌরব যুগ তলিয়ে গিয়েছিল বিস্মৃতিতে। নাট্যকাররা সেই সব গৌরব কাহিনী ফিরিয়ে আনছিলেন।

বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে যখন হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে দূরত্ব ও বিরোধ ঘটাবার চেষ্টা চলছে নানা দিকে, সেই সময় গিরিশচন্দ্র বেছে নিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত বিষয়টি। সিরাজ উপলক্ষ মাত্র, মূল কথা, বাংলার স্বাধীনতা হরণ। ইতিহাসে সিরাজের চরিত্রে নানা কলঙ্ক, অদূরদর্শিতা, হঠকারিতা, চারিত্রিক অসংযমের কথা আছে বটে, কিন্তু বাংলার এই তরুণ শেষ স্বাধীন বাবটি তার সময়েরই শিকার। গিরিশচন্দ্র তাকে এমন একটি ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যাতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তার প্রতি সহানুভূতি জানাবেই। এই সহানুভূতিই দুই ধর্মের মানুষকে পরস্পরের কাছে টানতে পারে আবার।

নাটকটি দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে গেল যাদুগোপাল ও দ্বারিকা। যেমন মঞ্চসজ্জা, তেমন সম্মিলিত অভিনয়। সিরাজের ভূমিকায় দানির গলা কাঁপানো এই চরিত্রের পক্ষে মোটেই বেমানান লাগছে না। গিরিশবাবু স্বয়ং একটি ছোট্ট ভূমিকায় তাক লাগিয়ে দিলেন। অর্ধেন্দুশেখর বরাবরই ছোট ছোট চরিত্রেই বেশি কৃতিত্বের পরিচয় দেন, এই নাটকে তিনি দানসা ফকির আর গিরিশচন্দ্র করিমচাচা। একটি দৃশ্যে, নবাব সিরাজদ্দৌলা পালাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে বহুমূল্য পোশাক থাকলে ধরা পড়ে যাবেন, তাই নবাব করিমচাচার সঙ্গে পোশাক বদল করে নিলেন। নবাব পরলেন ধূলিমলিন লুঙ্গি ও ফতুয়া, আর করিমচাচা ভূষিত হলেন হিরে-মুক্তো খচিত নবাবি পোশাকে। সেই অবস্থায় চলে যেতে গিয়েও ফিরে তাকিয়ে করিমচাচা সিরাজ-পরিত্যক্ত বাংলার মসনদকে যখন তিনবার কুর্নিশ করলেন, তখন বহু দর্শকই অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি।

গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে দ্বারিকা বা যাদুগোপালের প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই। তবে হাইকোর্টের এক উঁকিল মহেন্দ্র মিত্র এখন মিনার্ভার আংশিক মালিক, তিনি যাদুগোগালকে বিলক্ষণ চেনেন। সেই সূত্রে, অভিনয় সাঙ্গ হবার পর গিরিশবাবুর সঙ্গে ওরা সাজ ঘরে দেখা করতে এল।

ইজিচেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে গিরিশচন্দ্র গড়গড়া টানছেন, একটি বালক ভৃত্য তাঁর অঙ্গ মার্জনা করছে। গাঁটে গাঁটে ব্যথা, এখন মঞ্চে লাফানো ঝাঁপানো তাঁর ঠিক সহ্য হয় না। যাদুগোপাল ও দ্বারিকার মুখে প্রচুর প্রশস্তি শুনে গিরিশচন্দ্র মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বললেন, আপনারা শিক্ষিত লোক, আপনারা এ নাটকের মর্ম ঠিকই বুঝবেন। সাধারণ দর্শক বুঝলে তবেই না সার্থক।

নাটকের কথা বাদ দিয়ে দেশের কথা উঠল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে গিরিশচন্দ্র আগ্রহী। কিছুক্ষণ পর যাদুগোপাল আসল প্রসঙ্গটি তুলল।

গিরিশচন্দ্র ভ্রুকুঞ্চিত করে বললেন, নয়নমণি? হ্যাঁ, সে কোথায় এখন? শুনেছিলুম, মহেন্দ্র তাকে মিনার্ভায় আনতে চেয়েছিলেন, সে আসেনি। শুনেছি, ক্লাসিক ছাড়ার পর সে কোনও বোর্ডেই যোগ দেয়নি। মেয়েটা বেশ ক্ষেপী ধরনের, বুঝলেন। একবার নাকি সে আমার জন্য অমরের সঙ্গে ঝগড়া করেছিল। শেষ পর্যন্ত অমরকে দিয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইয়েছিল। থিয়েটারের মেয়েরা হচ্ছে জলের মতন। যখন যে-পাত্রে রাখবে, তখন সেই রকমটি হয়ে থাকবে! শ্রদ্ধা, গুরুভক্তি, এসব কথার কথা। ও মেয়েটা আলাদা। ভাল নাচে, গান ভাল জানে, অ্যাকটিংও ভাল করে, সে হঠাৎ সব ছেড়েছুঁড়ে চুপচাপ বসে রইল কেন? কোনও শাঁসালো বাবু ধরেছে?

দ্বারিকা বলল, ওর বাসা কোথায়, তা কি বলতে পারেন? তা হলে আমরা নিজেরাই খোঁজ নিয়ে দেখতুম।

গিরিশচন্দ্র চোখ নাচিয়ে বললেন, মশাই, আমার কি আর সে বয়েস আছে যে অ্যাকট্রেসদের বাড়িতে রাত কাটাতে যাব? নেশাভাঙও অনেক কমিয়ে দিয়েছি, নিজের বিছানায় শুলেই আরাম। হয়। এখন আমার একমাত্র শয্যাসঙ্গিনী হচ্ছে পাশবালিশ!

তারপর বললেন, দাঁড়ান দেখি সাহেব কিছু জানে কি না।

তিনি দুবার সাহেব সাহেব বলে ডাকতেই পাশের ঘর থেকে এসে অর্ধেন্দুশেখর উঁকি মারলেন। গিরিশচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, সাহেব, তুমিই তো নয়নমণিকে প্রথম থিয়েটারে এনেছিলে। সে ঘুড়িটা গেল কোথায়? কোন খাঞ্জা খাঁ তাকে হরণ করে নিয়ে গেল? এনারা তার খোঁজ করতে এসেছেন।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, অনেকদিন তার পাত্তা নেই। থিয়েটার ছেড়ে সে বাবু ধরবে, এসব মনে হয় না। আমি আগে অনেকবার তাকে বাজিয়ে দেখেছি। সে অনেকটা যোগিনী যোগিনী টাইপ। যৌবনে যোগিনী। তুমি তাকে নিয়ে একটা নাটক লিখে ফেলতে পারো। প্রথম তাকে কোথায় কুড়িয়ে পেয়েছিলুম জানো? নিমতলা ঘাট শ্মশানে। জানোই তো আমার শ্মশানে মশানে ঘোরার বাতিক আছে। মেয়েটা ঝুলিঝুলি ছেঁড়া কাপড় পরে এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে থাকত, সবাই পাগলি মনে করত! আমিও প্রথম প্রথম মাথা ঘামাইনি। একদিন টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছিল, শ্মশানে লোকজন বিশেষ ছিল না, হঠাৎ শুনলুম মেয়েটার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে। প্রথমে মনে। হয়েছিল কান্না, তারপর বুঝলুম, গুনগুনিয়ে গাইছে, কী গান জানো? আজও আমার মনে আছে। ‘শ্মশান ভালবাসিস বলে শশ্মশান করেছি হৃদি/শ্মশানবাসিনী শ্যামা নাচবি বলে নিরবধি/আর কোনো সাধ নাই মা চিতে/চিতার আগুন জ্বলছে চিতে…’

গিরিশবাবু পরের পঙক্তিটি গেয়ে উঠলেন, ‘ও মা, চিতাভস্ম চারি ভিতে, রেখেছি মা আসিস যদি…’।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, শুনেই বুঝলুম, এর গানের একেবারে তৈরি গলা। গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, হা গা, তুমি কাঁদের বাড়ির মেয়ে? এখানে কেন পড়ে থাকো? প্রথমে উত্তর দিতেই চায় না। ভয়ে। কুঁকড়ে যুঁকড়ে থাকে। কিন্তু আমি পাগল চরাতে ভালই পারি।

গিরিশবাবু বললেন, তা পারবে না কেন, তুমি নিজেই যে একটা পাগল!

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, তারপর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার পেটের কথা বার করে দেখি, সে মোটেই পাগল নয়। অবস্থার গতিকে শ্মশানে আশ্রয় নিয়েছে। আগের কথা কিছুতেই জানাবে না। কিন্তু বোঝা গেল, মেয়েটা শুধু গান জানে না, কথাবার্তায় শিক্ষার ছাপ আছে। শ্মশান থেকে তুলে এনে কিছুদিন তাকে আমার বাড়িতে রাখলুম। আমার স্ত্রী তাকে ধুইয়ে মুছিয়ে একটা ভাল শাড়ি পরিয়ে দিতেই একটি ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে বেরিয়ে এল। থিয়েটারে এনেও তাকে বিশেষ তালিম দিতে হয়নি। দেখতে দেখতে কেমন তরতরিয়ে ওপরে উঠে গেল।

গিরিশবাবু বললেন, আমাদের কত ছাইগাদায় এমন মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে, কে তার খোঁজ রাখে? দারিদ্র রাক্ষুসীই সব কিছু খেয়ে নেয়, তুমি তবু একজনকে তুলে এনেছিলে।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, আবার তার মাথায় বোধহয় পাগলামি চেপেছে। নইলে এত ডিমান্ড থাকতেও কেউ স্টেজ ছেড়ে দেয়! আগেও সে দু-একবার এ রকম করেছে।

গিরিশচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, সে কোথায় থাকে তুমি জানো?

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, আমাদের সেই গঙ্গামণিকে মনে আছে? বউবাজারে সেই একটা বাড়ি করেছিল। সেইখানে থাকত নয়নমণি, আমাকে একবার যেতে হয়েছিল। গঙ্গামণি পটল তোলার আগে নয়নমণিকে সেই বাড়িটা দিয়ে গেছে। শুনছি তো নয়নমণি সে বাড়িও বিক্রি করে দিয়ে কোথায় চলে গেছে। ও বাড়িতে থাকলে থিয়েটারের লোকেরা তাকে বিরক্ত করত।

গিরিশচন্দ্র হতাশভাবে বললেন, যাঃ! আর কোথায় তার খোঁজ করবেন?

যাদুগোপাল বলল, সে বাড়ি সে অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছে, তা আমিও জানি।

থিয়েটারের অন্য কয়েকজনকেও ডেকে জিজ্ঞেস করা হল। কেউই সঠিক নয়নমণির সন্ধান জানে না। তবে টগর নামে একটি মেয়ে বলল, সে কাশী মিত্তিরের ঘাটে তিন-চারবার নয়নমণিকে দেখেছে। নয়নমণি ওখানে নিয়মিত গঙ্গাস্নান করতে আসে, কাঙালি-ভিখিরিরা তাকে দেখলেই ঘিরে ধরে। সে সবাইকে পয়সা দেয়।

তা হলে কাশী মিত্তির ঘাটের কাছাকাছি কোথাও নয়নমণির নতুন আস্তানা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সব গঙ্গার ঘাটেই নারী ও পুরুষদের স্নানের জায়গা পৃথক। মেয়েদের ঘাটের অংশটি দেওয়াল ঘেরা, কাপড় ছাড়ার জন্য ঘরও আছে। রাস্তার দু’পাশে সার বেঁধে থাকে কাঙালিরা। যেখানে সেখানে মন্দির, সেই সব মন্দিরের পূজারীরা বুভুক্ষুর মতন স্নানযাত্রীদের ডাকাডাকি করে। অন্যদের পুণ্য পাইয়ে দেবার জন্য তারা ব্যাকুল। পাশেই শ্মশান, কোনও বড় মানুষের শবদেহ এলে সঙ্গে প্রচুর সাঙ্গোপাঙ্গ থাকে, তখন সারা অঞ্চলটা জমজমাট হয়। এককালে এই সব শ্মশানে বড় বড় হাড়গিলে পাখির খুব উপদ্রব ছিল, এখন সেগুলিকে মেরে মেরে প্রায় শেষ করা হয়েছে।

স্নান সেরে কাশী মিত্তির ঘাট থেকে বেরিয়ে এল ভূমিসূতা, সঙ্গে দুটি সাত-আট বছরের বালিকা। ভূমিসূতা পরে আছে কালো পাড় সাদা সুতির শাড়ি, অঙ্গে কোনও অলঙ্কার নেই, ভিজে চুল পিঠের ওপর খোলা। কাঙালিরা তাকে চেনে, দেখা মাত্র হই হই করে লাইন ছেড়ে ধেয়ে এল। ভূমিসূতা নিজের হাতে পয়সা বিলোয় না, সঙ্গের মেয়েদুটি প্রত্যেককে দিতে লাগল একটি করে আনি।

সকাল সাতটা, আকাশ মেঘে থমথমে হয়ে আছে। গঙ্গার ওপর অনবরত শোনা যাচ্ছে স্টিমারের ভোঁ। একটা অশ্বথ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে ভূমিসূতাকে দেখছে দ্বারিকা আর যাদুগোপাল। একটু পরে কাঙালিদের ভিড় পাতলা হতে তারা কাছে এগিয়ে এল।

 যাদুগোপাল ধীর স্বরে বলল, কেমন আছ, ভূমিসূতা? অনেকদিন তুমি আমাদের বাড়িতে আসোনি।

 ভূমিসূতা চমকে উঠলেও ঠিক বোঝা গেল না। আয়ত নয়নে যাদুগোপালের মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বলল, নমস্কার। আপনি এখানে?

যাদুগোপাল বলল, তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। কোথায় বাড়ি জানি না, কালও এসেছিলাম এই ঘাটে, খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল।

দ্বারিকা আর ভনিতার সময় না দিয়ে বলে উঠল, ভূমি, বিশেষ কারণে তোমার কাছে এসেছি। আমাদের বন্ধু ভরত, সে খুবই অসুস্থ, মানে খুবই, চিকিৎসকরা ভরসা দিতে পারছেন না, তুমি যদি তাকে শেষ দেখা দেখতে চাও, মানে, তুমি একবার গেলে ভাল হয়। বেশি দেরি করা যাবে না

ভূমিসূতা এ কথা শুনেও চাঞ্চল্য দেখাল না, বরং যেন নিথর হয়ে গেল। পাথরের প্রতিমা। চক্ষুদুটি মাটির দিকে স্থির নিবদ্ধ। যেন পথের ধূলিকণার সঙ্গে তার গভীর আত্মীয়তা।

কিছু পরে সে প্রায় অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল, তিনি কি আমায় ডেকেছেন?

যাদগোপাল বলল, হ্যাঁ। সে তোমার জন্য…

দ্বারিকা তাকে বাধা দিয়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কী, সে রকম ভাবে ডাকেনি। তার কথা বলার ক্ষমতা নেই। প্রায় সময়েই তার জ্ঞান থাকে না। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফেরে, তখনও কথা বলে না, কিংবা বলতে পারে না। মানুষ চিনতে পারে না, ডাকলেও সাড়া দিতে চায় না। একদিন অজ্ঞান অবস্থায়, খুব জ্বর, একশো পাঁচ ডিগ্রি, তখন প্রলাপ বকছিল, কয়েকটা নাম ভাল করে বোঝা যায়নি, আমি নিজেও শুনিনি, আমার বউ শুনেছে, তার মধ্যে একবার বোধহয় …। আমায় স্ত্রীই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ভূমি কে? আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারিনি। আমি তো তোমাকে বেশি দেখিনি, তা ছাড়া তোমার নয়নমণি নামটাই মনে আসে। আমার স্ত্রীও তোমার এই নাম জানে না, তোমাকে চেনে না। সে যখন বলল, ভূমি কে, তার মানে ভরতের মুখেই শুনেছে।

যাদুগোপাল বলল, দ্বারিকা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তখনই আমার মনে পড়ে গেল, তোমার কথা। তুমি মাঝে মাঝে আসতে আমাদের বাড়িতে, আমার স্ত্রী তোমাকে খুব পছন্দ করেন, তোমার বউবাজারের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে জানা গেল, সেখানে অন্য লোক থাকে, তোনার নতুন ঠিকানা জানে না।

মাটি থেকে চোখ না তুলেই ভূমিসূতা বলল, আমি থিয়েটারে ছিলাম। সবাই জানে, থিয়েটারের মেয়েরা অশুচি, আমাদের কি রুগির ঘরে যেতে আছে?

যাদুগোপাল বলল, এসব কী বলছ ভূমি? আমরা ওই সব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাই? তুমি আমাদের বাড়িতে গেছ, কেউ অযত্ন করেছে?

দ্বারিকা হেসে বলল, তুমি এক সময় শ্মশানে ছিলে, আমি শুনেছি। আমার স্ত্রী-ও এক সময় .. যাক সে সব কথা পরে শুনবে। সে তোমাকে নিমেষে আপন করে নেবে।

ভূমিসূতা তবু বলল, রুগির ঘর … তিনি চোখ মেলে আমাকে দেখে যদি অপছন্দ করেন? যদি তাতে আরও খারাপ হয়? বোধহয় আমার দূরে থাকাই ভাল।

যাদুগোপাল অস্থিরভাবে বলল, তুমি বুঝতে পারছ না, ভূমি, ভরত এখন যে-অবস্থায় আছে, তার থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না। আর দেরি কোরো না।

এবার ভূমিসূতা আঁচলে চোখ ঢেকে ফেলল। কাঁপছে তার সর্বাঙ্গা।

কাশী মিত্তিরের ঘাটের অদূরেই একটা দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে ভূমিসূতা। সে বাড়িতে আর এগারোটি বালিকা থাকে। এরা সবাই অনাথ-আতুর, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা মেয়ে। একজন বয়স্কা রমণীকে রাখা হয়েছে তাদের দেখাশুনো করবার জন্য। তাকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে অতি দ্রুত তৈরি হয়ে নিল ভূমিসূতা।

রংপুর থেকে জীবন্মৃত ভরতকে কলকাতায় নিয়ে আসার পর যাদুগোপালের পরামর্শে তাকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে নিজের বাড়িতেই এনে রেখেছে দ্বারিকা। ভরতের পেটে একটা বর্শার ফলা গেঁথেছিল, এই ধরনের ব্যাপার পুলিশকে জানানো কর্তব্য। দ্বারিকা বাইরে বাইরে থাকে, সেই তুলনায় যাদুগোপাল বেশি খবর রাখে। ভরত ‘যুগান্তর’ সাপ্তাহিকীর সঙ্গে জড়িত ছিল, ওই পত্রিকার দফতরটি যে উগ্রপন্থিদের আচ্ছা, তা যাদুগোপালের কানে এসেছিল। রংপুর অঞ্চলে ভরত কী করতে গিয়েছিল, যাদুগোপাল তা না জানলেও অনুমান করেছিল যে সে কোনও মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিল নিশ্চিত, সন্ধান পেলে পুলিশ তাকে নিয়ে টানাটানি করতে পারে।

বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক কেশব চক্রবর্তী ভরতের চিকিৎসার ভার নিয়েছেন। কেশব চক্রবর্তী যাদুগোপালের ভায়রাভাই, তিনি গোপনীয়তা রক্ষা করবেন অবশ্যই। দ্বারিকার মানিকতলার বাড়িতে কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া আর কেউ থাকে না, ভরতকে রাখা হয়েছে দোতলার একটি কক্ষে, দুজন নার্স নিযুক্ত হয়েছে তার জন্য। বসন্তমঞ্জরী রংপুর থেকে আসার পথে ভরতের যথাসাধ্য সেবা করেছে, কিন্তু কলকাতায় সেবার ভার নার্সদের ওপর, সন্ধের পর সে একবার মাত্র দেখতে আসে। দ্বারিকা তাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছে, ভরত বাঁচবে কি না তুই বল? ভবিষ্যতের দৃশ্য দেখতে পায় যে বসন্তমঞ্জরী, সে কিন্তু এই ব্যাপারে অসহায়, মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলেছে, জানি না, জানি না!

অস্ত্রোপচার করে পেট থেকে বর্শার ফলাটা বার করে ফেলা হয়েছে বটে, কিন্তু কিছুতেই ভরতকে পুরোপুরি সজ্ঞানে আনা যাচ্ছে না, কিছু খেতেও পারছে না সে। নাকে নল ঢুকিয়ে তরল খাদ্য খাওয়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ডাক্তার, এরই মধ্যে ভরত প্রায় কঙ্কালসার হয়ে গেছে, মিশে গেছে বিছানায়।

ভূমিসূতাকে এনে প্রথমেই পাঠিয়ে দেওয়া হল অন্দরমহলে বসন্তমঞ্জরীর কাছে। কলকাতায় ঢাকা গাড়ি ছাড়া বাইরে বেরোয় না বসন্তমঞ্জরী, তাও কদাচিৎ, বাড়িতেও বাইরের লোকের সামনে আসে না। কিন্তু নিছক অন্তঃপুরিকা হয়ে থাকতে পারে না সে, তিনতলায় একটি বারান্দায় দিনের অধিকাংশ সময় কাটায়। এখান থেকে দেখা যায় পথের চলমান দৃশ্য, দেখা যায় অনেকখানি আকাশ, দূরের গাছপালা। নারকেলডাঙার দিকে ঝোঁপ জঙ্গলই বেশি, মধ্যে মধ্যে কয়েকটা বড় বাড়ি। খাল দিয়ে নৌকো চলে, সুন্দরবন থেকে কাঠ বোঝাই করে আনে। এক একদিন রাস্তায় দেখা যায় ষাঁড়ের লড়াই, দুটি অতিকায় বলীবর্দ পথের ঠিক মাঝখানে তোতি করে, গাঁক গাঁক শব্দ করে, পথচারীরা ভয়ে দূরে পালিয়ে যায়, স্তব্ধ হয়ে যায় যানবাহন। দুপুরের দিকে কোনও কোনও দিন হয় বাঁদর নাচ কিংবা মাদারির খেলা, ওপর থেকে পয়সা ছুঁড়ে দেয় বসন্তমঞ্জরী। এই বারান্দা থেকেই সে বাইরের জগৎটাকে কাছে পায়।

ভূমিসূতাকে দেখে বসন্তমঞ্জরী বহুকালের পরিচিতার মতন অন্তরঙ্গ স্বরে বলল, এসো ভাই। ও মা, তুমিই ভূমিসূতা? তোমাকে তো আমি থিয়েটারে দেখেছি।

ভূমিসূতার এখন চোখ শুক। তেমনই শুষ্ক কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, তিনি কোথায়?

বসন্তমঞ্জরী বলল, যাবে, আমি নিয়ে যাব। তার আগে বলো তো, কেন তাকে ওই দূর দেশে মরতে পাঠিয়েছিলে? নিজের কাছে ধরে রাখতে পারোনি?

ভূমিসূতা কোনও উত্তর দিতে পারল না।

বসন্তমঞ্জরী বলল, প্রথম যেদিন দেখি, সেদিনই মনে হয়েছিল, মানুষটা কেমন যেন দিশেহারা। এক-একজন মানুষের মুখে কী যেন থাকে, মনে হয় চেনা চেনা, আগে কোথাও দেখেছি, মুখোনা মনে গেঁথে যায়। অন্য কিছু ভেবো না যেন, কাশীর গঙ্গায় একজন নৌকার মাঝিকে দেখেও আমার এ রকম মনে হয়েছিল। আর একটা শিমুল গাছ, বিহারে ট্রেনে যেতে যেতে, মাঠের মধ্যে মহারাজের মতন একলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, লাল ফুলে ভরা, কাছাকাছি আর কিছু নেই, আমার বুকটা ধক করে উঠল, মনে হল, ওমা, ঠিক এই শিমুল গাছটাকেই তো আমি আগে একবার দেখেছি, অথচ সেই প্রথম আমার ট্রেনে যাওয়া, তবে কী করে আগে দেখলাম? হয়তো গত জন্মে। আমার এমন হয়।

তারপর ভূমিসূতার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তোমার এত দুঃখ কেন গো? থিয়েটারে তোমার কত নাম, এমন তোমার রূপ, তবু হাত ছুঁয়েই বোঝা যায়, তুমি বড় দুঃখী। অবশ্য মেয়েমানুষ হয়ে জন্মালে সবাইকেই দুঃখ পেতে হয়। দুঃখই আমাদের ললাট লিখন। তবে, বলতে নেই, আমি বেশ সুখে আছি, আমার উনি কোনও অভাব রাখেননি। এক একসময় ভাবি, এত সুখ নিয়েই বা আমি কী করব? যদি কারুকে ভাগ দেওয়া যায়।

একটু পরে বসন্তমঞ্জরী বুঝল, এখন এই রমণীটির সঙ্গে তার ভাব জমবে না। সে কোনও কথাই বলতে চাইছে না।

উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলো, সেই ঘরে নিয়ে যাই। আগে মনটা তৈরি করে নাও। হয়তো প্রথমটায় চিনতেই পারবে না। শরীরটা শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে। যমে-মানুষে টানাটানি চলছে, তুমি কিছুতেই যমকে জিততে দিয়ো না। আমি যমকে স্বচক্ষে দেখেছি, জানো! স্টিমারে যখন ওঁকে নিয়ে আসছি কলকাতায়, একদিন দেখি যে সন্ধেবেলা কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন দণ্ডধারী যমরাজ, এত বড় বড় চক্ষু গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ছাড়, তুই ছেড়ে দে ওকে! আমি ছাড়িনি। কিন্তু আর আমার ক্ষমতা নেই, আমি যে অন্যের স্ত্রী, সব সময় একটা সীমারেখা দেখতে পাই, এখন থেকে তোমার ওপর সব ভার। ডাক্তার যা পারবে না, তোমাকে তা পারতে হবে।

দোতলায় রোগীর ঘরে দিনের বেলার নার্স একটা টুলে বসে কুরুশ কাঠি দিয়ে লেশ বুনছে। ঘরটি বেশ বড়, মোট পাঁচটি জানলা। মাঝখানে একটি পালঙ্কে চোখ বুজে শুয়ে আছে ভরত, ঘুমন্ত না অচেতন বোঝা যায় না। নিশ্বাসের সঙ্গে বুক সামান্য উঠছে নামছে, সেইটুকুই প্রাণের চিহ্ন, সত্যিই মুখ দেখে পূর্বেকার ভরতকে চেনার উপায় নেই। শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে। ওদের দেখে নার্সটি উঠে দাঁড়াল, বসন্তমঞ্জরী চোখের ইঙ্গিতে তাকে বলল, ঘরের বাইরে যেতে। তারপর ভূমি তাকে বলল, এই নাও ভাই, তোমার জিনিস তোমার হাতে তুলে দিলাম। মেঝেতে বিছানা পেতে দেব, এখন থেকে তুমি এ ঘরেই থাকবে।

ভূমিসূতার মুখের দিকে একটুক্ষণ গাঢ় ভাবে চেয়ে রইল বসন্তমঞ্জরী। আপন মনে, খুব অস্ফুট স্বরে বলল, তোমাকে আগে চিনিনি, এখন দেখে বুঝতে পারছি, তুমি আর আমি হুবহু এক। তুমিই যেন আমি, কিংবা আমিই যেন তুমি। ভাগ্যের দিক থেকে আমরা যেন যমজ।

ভূমিসূতা একথার অর্থ বুঝতে পারল না।

বসন্তমঞ্জরী বলল, আজ বুঝলাম, কেন ওই মানুষটাকে আমি বারবার দেখতে পেয়েছি। তোমার জন্য! এখন যাই, পরে আবার কথা হবে।

বসন্তমঞ্জরীও ঘর থেকে বিদায় নেবার পর ভূমিসূতা আস্তে আস্তে এসে ভরতের শিয়রের কাছে দাঁড়াল।

কতকাল পরে দু’জনের মিলন হল। মাঝখানে একটা যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এ কেমন ধারা মিলন? ভূমিসূতার বুক কাঁপছে, দুশ্চিন্তায় নয়, আশঙ্কায়। ভরত যদি চক্ষু মেলে, যদি তাকে চিনতে পারে, তখন কী হবে তার প্রতিক্রিয়া? যদি ভূমিসূতাকে অবাঞ্ছিত মনে করে? যদি বলে, তুমি, তুমি কেন এসেছ? জ্বরের ঘোরে প্রলাপের মধ্যে ভরত একবার ভূমিসূতার নাম বলেছিল, তার অর্থ কী? হয়তো সে বলতে চেয়েছিল, ভূমিসূতাকে ডেকো না, তাকে আমি চাই না, সে নষ্ট হয়ে গেছে!

খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে ভরতের দিকে চেয়ে রইল ভূমিসূতা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চক্ষুদুটি কোটরগত, শীর্ণ মুখে খাড়া হয়ে আছে নাকটা। ওষ্ঠ বিবর্ণ। সব মিলিয়ে বড় অসহায় আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। নাকের নল দুটি আপাতত ভোলা।

ভরত একবারই, একটি ক্ষুদ্র চিঠি পাঠিয়েছিল ভূমিসূতাকে। সে চিঠি শশিভূষণের হাতে পড়লেও পরে ভূমিসূতা সেটি সংগ্রহ করে রেখেছিল। কতবার যে পড়েছে, তার ঠিক নেই। প্রতিটি শব্দ তার মুখস্থ। তারপর দুজনেরই জীবন বাঁক নিল কত বিচিত্র দিকে। তবু সে চিঠির কথাগুলি কি মিথ্যে হয়ে গেছে?

যদি জ্ঞান ফেরার পর ভরত তাকে দেখে বিরক্ত হয়, তাকে চলে যেতে বলে, সে বিনা প্রতিবাদে চলে যাবে। জীবনের কাছ থেকে তার কোনও প্রত্যাশা নেই। অনাথা ছোট ছোট মেয়েদের নিয়ে সময় কাটাতে তার বেশ লাগে। তা ছাড়া তার দেবতা আছেন।

এ যাবৎ ভূমিসূতা স্বেচ্ছায় কোনও পুরুষ মানুষকে স্পর্শ করেনি। আর কারুর সম্পর্কে তার তেমন ইচ্ছেও হয়নি, শুধু এই একজনকে ঘিরেই এক সময় তার সাধ-স্বপ্ন গড়ে উঠেছিল। জীবনে একবারও কি সে সাধ মিটবে না? দুরু দুরু বক্ষে, খানিকটা ঝুঁকে ভূমিসূতা ভরতের কপালে একটি হাত ছোঁয়াল। একজন সংজ্ঞাহীন পুরুষ, কিছু দেখছে না, বুঝছে না, তবু তাকে স্পর্শ করলেই শরীরে এমন বিদ্যুৎ প্রবাহের অনুভব হয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *