ত্র্যশীতিতম অধ্যায় – পরশুরামের উপাখ্যান
ঔৰ্ব বলিলেন,–কিছুকাল অতীত হইলে, মহাতপা জমদগ্নি স্বয়ং যত্নসহকারে, সুলক্ষণা বিদর্ভরাজ-তনয়া রেণুকাকে বিবাহ করিলেন। ১
রেণুকা, জমদগ্নিসংসর্গে রুষণ্বান, সুষেণ, বসু ও বিশ্বাবসু নামে চারিটি লোকপ্রিয় পুত্র প্রসব করেন। ২-৩
কার্তবীর্য-বধের জন্য ইন্দ্রাদি দেবগণ কর্তৃক প্রার্থিত হইয়া ভগবান্ মধুসূদন, সর্বশেষে তদীয় গর্ভে উৎপন্ন হইলেন, এই পঞ্চম তনয়ের নাম হইল রাম। ৪
তিনি পৃথিবীর ভারহরণার্থ পরশুসহ উৎপন্ন হন; সেই তাঁহার সহজ পরশু কদাচ তাহাকে ত্যাগ করে নাই। ৫
এই রাম, নিজ পিতামহীর চরুভোজন-বৈপরীত্যের ফলে ব্রাহ্মণ হইয়াও ক্ষত্রিয়াচার ও ক্রূরকর্মা হন। ৬
পরশুরাম, পিতার নিকট নিখিল বেদ এবং ধনুৰ্বেদ সৰ্ব্বতোভাবে শিক্ষা করিয়া বেদবিদ্যা-বিশারদতা-নিবন্ধন কৃতার্থম্মন্য হইলেন। ৭
একদিন রাম-জননী রেণুকা-স্নানার্থ গঙ্গাতে গিয়া দেখেন, উত্তম-মাল্যধারী পরম সুন্দর চন্দ্ৰসন্নিভ তরুণ রাজা চিত্ররথ, অনুরূপা রমণীগণের সহিত জল ক্রীড়া করিতেছেন। ৮-৯
রেণুকা, তাদৃশ নরপতিকে অবলোকন করিয়া অত্যন্ত কামার্তা হইয়া সেই সুন্দর রাজার প্রতি অভিলাষ করিলেন। ১০
অভিলাষ হইবামাত্র ক্লেদ নিঃসৃত হইল; কিন্তু তাহা তিনি জানিতে পারিলেন না। যাহা হউক, হঠাৎ মানসিক গতির দিকে লক্ষ্য হইল, অমনি সভয়ে সেই ক্লেদযুক্ত হইয়াই নিজ আশ্রমে গমন করিলেন। ১১
জমদগ্নি, দেখিবামাত্র রেণুকার মনোবিকার বুঝিতে পারিয়া “ধিক্ তোকে পাপীয়সি!–ধিকৃ” ইত্যাদিরূপে বারংবার নিন্দা করিতে লাগিলেন। ১২
অনন্তর, মুনি প্রথমে সেই রুষণ্বৎপ্রমুখ চারিপুত্রকে একে একে বলেন,– “এই পাপীয়সী ব্যভিচারিণী রেণুকাকে ছেদন কর;” কিন্তু তাঁহার মৃঢ় ও জড়ের ন্যায় রহিল। তাহারা পিতৃ-আজ্ঞা পালন করে নাই। ১৩
তখন, জমদগ্নি কুপিত হইয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় পুত্রদিগকে এই অভিসম্পাত দিলেন, “তোরা জড়বৎ বসিয়া রহিলি, আমার কথা শুনিলি না। ১৪
এই দোষে তোরা অবিলম্বে জড়ভাবাপন্ন এবং গোরুর ন্যায় জীবন ধারণ কর”। ১৫
অনন্তর অতিবীৰ্যশালী জামদগ্ন্য পরশুরাম তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জমদগ্নি তাহাকে বলিলেন, তোমার এই পাপীয়সী জননীকে ছেদন করিয়া ফেলো। ১৬
সেই মহাতেজা ভ্রাতৃগণকে পিতৃশাপে জ্ঞানবর্জিত অবলোকন করিয়া জননীকে কুঠারাঘাতে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ১৭
পরশুরাম রেণুকাকে ছেদন করিলেন দেখিয়া জমদগ্নি ক্রোধশূন্য হইলেন এবং সুপ্রসন্নভাবে এই কথা বলিতে লাগিলেন। ১৮
পুত্র! তোমার মঙ্গল হউক, তুমি যে আমার এই আজ্ঞা পালন করিলে, ইহাতে আমি প্রীত হইয়াছি; অতএব তুমি এখন আমার নিকট কতিপয় অভিলষিত বর প্রার্থনা কর। ১৯
পরশুরাম সাতটি বর প্রার্থনা করিলেন, জননীর পুনর্জীবন প্রথমেই প্রার্থনা করিলেন; অনন্তর হে নৃপশ্রেষ্ঠ! মাতাকে যে তিনি বধ করিয়াছেন, এ কথা মাতার বিস্মৃত হওয়া, ভ্রাতৃগণের শাপমোচন, মাতৃহত্যা পাপনাশ, সকল সময়ে জয় লাভ এবং কল্পান্ত পর্যন্ত আয়ু-পরশুরাম, যথাক্রমে এই কয়টি বর প্রার্থনা করিলেন। ২০
মহাতপা জমদগ্নি সকল বরই পরশুরামকে দিলেন, তখন রামজননী রেণুকা সুপ্তোত্থিতার ন্যায় উঠিয়া বসিলেন। ২১
পরশুরাম যে, তাঁহাকে বধ করিয়াছিলেন একথা রেণুকার স্মরণ হইল না। পরশুরাম তখনই যুদ্ধ-জয়-শক্তি এবং চিরজীবিতা লাভ করিলেন। ২২
পিতা জমদগ্নি, মাতৃহত্যা অপনয়নের জন্য তাহাকে বলিলেন;–বৎস রাম! বরদানমাত্রে মাতৃহত্যা-পাপ যায় না, অতএব ব্ৰহ্মপুত্ৰ-সলিলে স্নান করিবার জন্য তুমি তথায় গমন কর। ২৩-২৪
তথায় স্নান করিবামাত্র পাপমুক্ত হইয়া অবিলম্বে তুমি প্রত্যাগমন করিবে। ২৫।
পুত্র! তুমি জগতের হিতার্থে সত্বর ব্ৰহ্মপুত্ৰকুণ্ডে গমন কর। তখন পরশুরাম পিতৃ উপদেশে পুণ্যসলিল ব্ৰহ্মপুত্ৰকুণ্ডে গমন করিয়া তথায় পরশু প্রক্ষালনপূর্বক যথাবিধি স্নান করিবামাত্র দেখিলেন, মাতৃহত্যা-পাপ তাঁহার শরীর হইতে নিঃসৃত হইল। ২৬-২৮
পরশুরাম, সেই পরমতীর্থের প্রতি বিশ্বাসান্বিত হওয়াতে পরশুদ্বারা পথ প্রস্তুত করিয়া ব্ৰহ্মপুত্র নদকে প্রবাহিত করিয়া দিলেন। ২৯
পবিত্ৰ ব্ৰহ্মপুত্র নদ ব্ৰহ্মকুণ্ড হইতে নিঃসৃত হইয়া কৈলাস পর্বতের উপত্যকা লোহিত সরোবরে পতিত হয়। ৩০
তখন, মহাবল পরশুরাম লোহিত সরোবরের তীরে উঠিয়া কুঠারাঘাতে পথ প্রস্তুত করত ব্ৰহ্মপুত্ৰনদকে পূর্বদিকে প্রবাহিত করিলেন। ৩১
অনন্তর, জামদগ্ন্য কিয়দ্দূর পরে হেম-শৃঙ্গ গিরি ভেদ করিয়া, কামরূপ পীঠের মধ্য দিয়া এই নদকে প্রবাহিত করিলেন। ৩১
স্বয়ং ব্রহ্মা, তাঁহার নাম রাখিলেন লোহিত। লোহিত সরোবর হইতে নিঃসৃত বলিয়া উহার আর একটি নাম লোহিত্য। ৩৩
ব্ৰহ্মপুত্র নদ, জলরাশি দ্বারা সমস্ত কামরূপ পীঠপ্লাবিত ও সৰ্ব্বতীর্থ গোপন করিয়া দক্ষিণ সাগরের অভিমুখে চলিয়াছে। ৩৪
দিব্য যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের সহিত এক সঙ্গেই চলিয়াছিল; মধ্যে ব্ৰহ্মপুত্ৰকে ত্যাগপূৰ্ব্বক দ্বাদশযোকন গিয়া পুনরায় ঐ লৌহিত্য নদে মিলিত হইয়াছে। ৩৫
যে ব্যক্তি জিতেন্দ্রিয় হইয়া চৈত্রমাসের শুক্লাষ্টমীতে লৌহিত্যজলে স্নান করে, সে ব্ৰহ্মপদ প্রাপ্ত হয়। ৩৬
যে ব্যক্তি শুচি ও পবিত্র-চিত্ত হইয়া সমস্ত চৈত্র মাস ব্ৰহ্মপুত্ৰজলে স্নান করে, সে কৈবল্যপদ প্রাপ্ত হয়। ৩৭
হে রাজন! পূর্বকালে বীর জামদগ্ন্য যে জন্য মাতাকে বধ করেন ও যে জন্য ক্রূরকৰ্ম্মকারী হন, তাহা তোমার নিকট এই বললাম। ৩৮
যে ব্যক্তি, প্রত্যহ এই মহৎ আখ্যান শ্রবণ করে, সে চিরজীবী, নিত্যহর্ষ-যুক্ত এবং বলবান হইয়া থাকে। ৩৯
হে রাজন! পাৰ্বতী যেরূপে শিবের শরীরার্ধ গ্রহণ করিয়াছেন, বেতাল ভৈরব যাহাদিগের নাম। ৪০
বেতাল-ভৈরব যাঁহার পুত্র, যেরূপে তাহারা গণাধ্যক্ষতা প্রাপ্ত হন, তৎ সমস্তই তোমাকে এই বলিলাম। হে নৃপবর! এখন আর কি বলিব বল? ৪১
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–হে বিপ্রগণ! পার্বতীর শম্ভূশরীরাৰ্দ্ধ গ্রহণবিষয়ে মহাত্মা সগরের সহিত ঔর্বঋষির কথোপকথন হয়। ৪২
তৎসমুদয় এবং তোমাদিগের জিজ্ঞাসিত উত্তম বিবরণ ভৈরবোপাখ্যান, পীঠনির্ণয় বলিলাম। ৪৩
ভৃঙ্গি-মহাকালের উৎপত্তি, এ সমস্তও বলিলাম; এখন হে দ্বিজবরগণ! যাহা ইচ্ছা হয়, জিজ্ঞাসা কর, আর কি বলিতে হইবে? ৪৪
মন্ত্রবেদময় বহুতর ফলজনক, প্রাজ্ঞনিশ্চায়ক সকল তন্ত্রশ্রেষ্ঠ এই তন্ত্র যে ব্যক্তি প্রত্যহ পাঠ করে, সে ব্যক্তি, তত্ত্বমাত্র লক্ষ্য-ঔপনিষদ-জ্ঞান প্রাপ্ত হইয়া জগতের রক্ষাকর্তা হয়। ৪৫
ত্র্যশীতিতম অধ্যায় সমাপ্ত। ৮৩