2 of 3

৮২. দাড়ি আর গোঁফের কতগুলো অসুবিধের দিক

৮২

দাড়ি আর গোঁফের কতগুলো অসুবিধের দিক আছে। দাড়ি নেমে বুক পর্যন্ত ঝুলে পড়তে চায়। গোঁফ ঢেকে ফেলে দুটো ঠোঁটকেই। শিখরা দাড়ি জাল দিয়ে বেঁধে রাখে, কিন্তু সেরকমটা করতে যাওয়ার হ্যাপা আছে। তার চেয়ে কি একটু ট্রিম করে নেওয়া বেশি সুবিধেজনক? গোঁফ নিয়েও কিছু অসুবিধে হচ্ছে হেমাঙ্গর। বিশেষ করে খাওয়ার সময়। চা খেতে গিয়ে সে প্রায় দেখছে, চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ানোর আগেই তার গোঁফ গিয়ে চায়ে ডুব দিচ্ছে।

অনেক ভেবেচিন্তে সে এক শুক্রবার সকালে ম্যাগনিফায়িং আয়না, চিরুনি আর কাঁচি নিয়ে বসল দাড়ি-গোঁফকে ভদ্রস্থ করতে। কিন্তু ছাঁটতে গিয়ে দেখল, তার সেই কৃতবিদ্যতা নেই যা দিয়ে সুদক্ষ নাপিত গোঁফটোফ ছেটে একটা ব্যালান্স নিয়ে আসতে পারে। তার হাতে বানরের রুটি ভাগের মতো বাঁ দিকের গোঁফ ছোট তো ডান দিকেরটা বড় হয়ে যাচ্ছে। ফের ডান দিকেরটা ছোট তো বাঁ দিকটা বড় থেকে যাচ্ছে। ডেবিট ক্রেডিট সমান হচ্ছে না, ব্যালান্স-শিট মিলছে না।

মাঝপথে হাল ছেড়ে দিল হেমাঙ্গ। যা হয়েছে তাই থাক। যা হল তা অবশ্য নয়নসুখকর নয়। আঁচড়ানোর পর দেখা গেল, নাকের নিচে দুদিকে দুটো ছোটখাটো ঝাঁটা উঁচিয়ে রয়েছে। গোঁফের এই ছিরি নিয়েই তাকে আজ বিকেলের ফ্লাইটে দিল্লি যেতে হবে, অফিসের কাজে।

ফটিককে ডেকে বলল, গোঁফটা কেমন হল বলল তো ফটিকদা!

ফটিক খুব ভাল করে নিরীক্ষণ করার পর বলল, ভালই দেখাচ্ছে। মিলিটারিদের মতো।

তার মানে কি?

আজ্ঞে ভালই।

তুমি গোঁফের কিছু বোঝো?

ফটিক এক গাল হেসে বলল, আপনিই কি আগে বুঝতেন? আজকাল গোঁফদাড়ি রেখে মুখখানা সোঁদরবন বানিয়ে কি সুখ হচ্ছে তাও তো ভেবে পাই না। দিন না ও আপদ নিকেশ করে। কামিয়ে ফেলুন।

হেমাঙ্গ আঁতকে উঠে বলে, ও বাবা! কামাবো কি? গোঁফদাড়ি এখন আমার খুব দরকার।

সে দরকার হয় ফেরারিদের। খুনটুন করে যারা গা ঢাকা দেয়। আপনার ওসব কি দরকার? সুন্দর মুখখানার কি যে ছিরি করে রেখেছেন!

নাঃ, তুমি এর মর্ম বুঝবে না।

দিল্লি যাবে বলে আজ অফিসে যাওয়ার কথা নয় তার। কিন্তু ঘরে শুয়ে বসে সময় কাটাতেও তার আজকাল ভাল লাগে না। কোথাও যাওয়ারও নেই তেমন। এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন খানিকক্ষণ ঘুরে আসা যায় মাত্র।

পোশাক পরে বেরোতে যাবে ঠিক এমন সময়ে চারুশীলার ফোন এল।

ওরে হেমাঙ্গ, এবার আমি পাগল হয়ে যাবো।

সে তো তুই আছিসই একটু। নতুন করে হওয়ার কিছু নেই।

শোন, পিন্টু সাইকেলের জন্য ভীষণ বায়না করছে। সামলাতে পারছি না। তুই নাকি ওকে সাইকেল কেনার টাকা দিয়েছিস?

সাইকেল! সাইকেলের জন্য বায়না করছে তো কিনে দে না, এর জন্য পাগল হওয়ার কি আছে?

তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? পিন্টু দু’ চাকার সাইকেল চাইছে। বলছে এখন থেকে সাইকেলেই স্কুলে যাবে।

মাই গড!

তুই-ই ওকে লাই দিয়ে মাথায় তুলছিস। কেন যে টাকাটা ওকে দিতে গেলি। এখন এসে ভাগ্নেকে সামলা।

খুব জেদ ধরেছে নাকি?

ভীষণ।

ও তত জেদী ছেলে নয়। ঠাণ্ডা, শান্ত, বাধ্যের ছেলে।

কি জানি, কাকে দেখে যেন মাথায় ভূত চেপেছে। ওর এক ক্লাসমেট নাকি রোজ সাইকেলে স্কুলে যায়। তার মা-বাবারও বলিহারি বাবা, ওইটুকু দুধের শিশুকে সাইকেলে কলকাতার অসভ্য বাস মিনিবাস ট্যাক্সির মুখে ছেড়ে দিচ্ছে। একটু ভয় নেই! এখন তুই এসে যদি কিছু করতে পারিস।

পিন্টুকে খুবই ভালবাসে হেমাঙ্গ। আর একটু যখন ছোট ছিল তখন দেবশিশুর মত লাগত। এখনও সুন্দর, তবে লম্বা হয়েছে একটু। সামান্য এক পর্দা ফারাক হয়েছে। আজকাল আর কোলে চড়ে না, হামি দেয় না, বন্ধুবান্ধব আর খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পিন্টু এখনও তার ভীষণ প্রিয়।

চারুশীলার বাড়িতে হাজির হয়ে সোজা দোতলায় উঠে হেমাঙ্গ হাঁক মারল, কোথায় রে পিন্টু?

নিজের পড়ার ঘর থেকে পিন্টু বেরিয়ে দরজায় দাঁড়াল। মুখে সলজ্জ হাসি।

বায়না করেছিলি?

পিন্টু মুখ লুকিয়ে ফেলল। তারপর বলল, মা সবসময়ে এত ভয় পায় কেন বলো তো!

তোর মায়ের চেয়ে আমি বেশি ভয় পাই।

রাজ্যের অবাক বিস্ময় চোখে নিয়ে তার দিকে ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে পিন্টু বলল, তাহলে যে তুমি কিনতে বললে?

আমার দোষ কি জানিস? অর্ধেক কথা বলতে ভুলে যাই। আমি তোকে বলতে চেয়েছিলাম, সাইকেল কিনে নিস আঠারো বছর বয়স হলে। ওই আঠারো বছরটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।

আঠারো বছর বয়স হলে কেন?

কারণ আছে। আঠারো বছরে লোকে অ্যাডাল্ট হয়।

পিন্টু একটু হাসল, সত্যি?

সত্যি।

তাহলে টাকাটা তুমি নিয়ে নাও, আঠারো বছর বয়স হলে দিও।

না না, কিছু দিয়ে ফেরত নিলে কালিঘাটের কুকুর হয়। এক কাজ কর, টাকাটা মাকে দিয়ে দে।

মা কিনে দেবে না কিন্তু।

মা কিনে দেবে না, জানি। কিন্তু তোর আঠারো বছর বয়স হলে আমিই ও টাকা তোর মার কাছ থেকে নিয়ে কিনে দেবো।

মা আমাকে খুব বকেছে।

সেইজন্যেই তো তোর মায়ের সঙ্গে আমি ঝগড়া করতে এসেছি। আজ দারুণ ঝগড়া করব। ফাটাফাটি হয়ে যাবে। শুনবি নাকি ঝগড়াটা?

হি হি। তুমি তো হেরে যাও।

তোর মা আমার দিদি তো, বয়সে বড়, তাই মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে হেরে যাই। কিন্তু আজ দারুণ ফাইট দেবো। দেখবি?

পারবে? মাও খুব ভাল ঝগড়া করতে পারে।

রোজ করে নাকি?

সবাইকে বকে তো। সেটাই তো ঝগড়া, না?

হ্যাঁ, বটেই তো।

পিন্টুর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে ছেড়ে দিল হেমাঙ্গ। পিন্টু পড়তে গেল।

তার পর দেয়ালে মস্ত অয়েল পেন্টিংটার দিকে নজর পড়ল হেমাঙ্গর। এটা আগে ছিল না তো! কাছে গিয়ে দেখল, একটি গ্রাম্য বাড়ির উঠোনে নানা ধরনের গৃহকর্মে রত কয়েকজন মহিলার ছবি। সকালের রোদ, গাছের সবুজ, উঠোনের মেটে রং, ঘাগরা, চোলি সব আলাদা উজ্জ্বল রঙে দক্ষ হাতে আঁকা। সমস্ত ছবিটার মধ্যে একটা নৃত্যপর আনন্দের আভাস রয়েছে। দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যায়। একটু ঝুঁকে ছবির নিচে ডান ধারে শিল্পীর স্বাক্ষর দেখে বিস্ময়ে ভ্রূ উঁচু হল তার। হুসেনের ছবি! এর তো অনেক দাম। পাওয়াও কঠিন। হুসেনের ছবি তো আঁকার আগেই আগাম বিক্রি হয়ে যায়। এ বাড়িতে ছবির সমঝদারই বা কে আছে?

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনেই বলল, হুঁ।

একটি ওরিজিন্যাল হুসেনের দাম নিশ্চয়ই লক্ষাধিক টাকা। বা তারও অনেক বেশি। হয়তো ডবল। কোনও কালেক্টরের কাছ থেকে কিনতে গেলে আরও বিচ্ছিরি রকমের বেশি।

খুঁজতে খুঁজতে চারুশীলাকে এই বিচিত্র বাড়ির আড়াইতলার একটা চাতালে পাওয়া গেল। একখানা চৌকো, প্রায় প্যানোরামিক জানলার চওড়া সিল-এর ওপর বসবার গদি পাতা। মুখোমুখি বসে খুব হাসাহাসি করছে চারুশীলা আর অন্য একটা মেয়ে।

এই যে! কখন এলি?

হেমাঙ্গ ভ্রূ কুঁচকে বলল, গত আধঘণ্টা ধরে এই ভুলভুলাইয়াতে তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

মিথ্যুক! আমি জানালার ধারে বসে রাস্তার দিকে লক্ষ রাখছি। তোর গাড়ি এলে দেখতে পেতাম।

গাড়ি আসেনি। তবে আমি যে এসেছি সেটা তো মিথ্যে নয়! পিন্টুর সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিলাম।

কি হল শুনি!

ও টাকাটা তোর কাছে জমা দেবে। আঠারো বছর বয়স হলে সাইকেল কিনবে। আমাকে কথা দিয়েছে।

বাঁচলাম বাবা। যা সমস্যায় ফেলেছিল।

না, এখনও বাঁচিসনি। তোর আরও একটা ফাঁড়া আছে।

কিসের ফাঁড়া? বলে অকৃত্রিম বিস্ময়ে চাইল চারুশীলা।

হলঘরের ছবিটা কে কিনেছে?

কেন, আমি!

তুই!

কেন, আমি কিনতে পারি না?

তুই শকুনের ডিমও কিনতে পারিস, কিছু অবিশ্বাসের নেই। কিন্তু ছবির তুই কী বুঝিস?

ইস, ছবি যেন তুই বড় বুঝিস!

হয়তো আমিও বুঝি না। কিন্তু আমার মক্কেলরা তাদের ব্ল্যাকমানি দিয়ে আজকাল ছবি কিনে রাখছে। সেটাও ব্যবসা। আর্ট না বুঝলেও ছবির কমার্সটা আমি জানি। তোর কি ব্ল্যাকমানি প্রবলেম? টাকাটা লগ্নি করে রাখলি?

কী পাজি আর জংলি তুই! আমি বুঝি তোর পেটমোটা, লোভী, জোচ্চোর মক্কেলদের মতো? ওরকম আনকালচার্ড, নভিস, আনএডুকেটেড?

তুই যে ছবির ছ-ও বুঝিস তা তো জানতাম না। জীবনে একটাও এগজিবিশনে যেতে দেখিনি, ছবি নিয়ে কোনওদিন একটাও কথা বলিসনি। কবে সমঝদার হলি বল তো!

আমার বাড়িতে কত আর্টের বই আছে জানিস!

জানি। তুই সেগুলোর পৃষ্ঠাও উল্টে দেখিস না কখনও। বইগুলো সুব্রতদার। ভদ্রলোক আর্কিটেক্ট, তাকে আর্টের খোঁজখবরও রাখতে হয়। কিন্তু তুই! তোর কবে থেকে আর্টের নেশা হল? নাকি স্ট্যাটাস সিম্বল। আজকাল ঘরে পেইন্টিং ঝোলানো অবশ্য একটা ফ্যাশান হয়েছে।

চারুশীলা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল, একটা পেইন্টিং কিনেছি বলে কেমন হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছে দেখ। তুই যে গুচ্ছের আজেবাজে জিনিস কিনে ঘরে জঙ্গল বানাচ্ছিস!

হেমাঙ্গ ব্যথিত হয়ে বলল, আজকাল কিনি না। আমার বৈরাগ্য আসছে। কিন্তু তুই সত্যিই পয়সা খরচ করে হুসেনের ছবি কিনেছিস এটা ভাবা যাচ্ছে না। ওটার অনেক দাম।

ভাল জিনিসের দাম একটু হবেই।

হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সত্যিই আজকাল আমি তোকে আর বুঝতে পারছি না। তুই রহস্যময়ী হয়ে যাচ্ছিস।

যে মেয়েটা চারুশীলার মুখোমুখি বসে আছে সে হাঁটুর ভাঁজে মুখ লুকিয়ে একটু হাসছে। মুখটা চেনা। ঠিক চিনতে পারছিল না হেমাঙ্গ। সে বেশি তাকায়ওনি। মেয়েদের দিকে সে কমই তাকায়।

চারুশীলা মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল, শুনলি তুই ওর কথা? আমি নাকি আর্ট বুঝি না, ছবি কেনা নাকি আমার ইনভেস্টমেন্ট! অ্যাকাউন্ট্যান্সি করে করে আর বদ লোকদের চুরির কাজে হেলপ করে করে ওর মনটাই হয়ে গেছে পিশাচের মতো। সবাইকেই সন্দেহ করে।

মেয়েটা মুখ তুলল না।

চারুশীলা নেমে পড়ল সিল থেকে। অগোছালো চুল খোঁপায় বাঁধতে বাঁধতে বলল, তোর চেহারাটা দিন দিন ট্রাফিক পুলিশের মতো হয়ে যাচ্ছে কেন রে? ইস, কি বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে! একটুও ভদ্রলোকের মতো নয়।

ওটা দৃষ্টিভঙ্গির তফাত। পৌরুষ জিনিসটা তুই তো বুঝিস না।

পৌরুষ বুঝি আজকাল দাড়ি-গোঁফে গিয়ে ঢুকেছে?

হেমাঙ্গ সামান্য অনুতপ্ত গলায় বলে, গোঁফটা আজ ছাঁটতে গিয়ে ডেবিট ক্রেডিট ঠিক মিলল না।

তাই বল! গোঁফ ছেঁটেছিস! তাই কেমন পাগলা মেহের আলি বলে মনে হচ্ছে।

মেহের আলি কে?

চারুশীলা হঠাৎ নাটুকে গলায় হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল, তফাত যাও! তফাত যাও! সব ঝুট হায়!

ওঃ! ক্ষুধিত পাষাণ!

যাক। আমি ভেবেছিলাম এটাও বুঝি ধরতে পারবি না। তোর পড়াশুনো এত কম। ঝুমকির সামনে কী লজ্জায় পড়তে হত তাহলে!

ঝুমকি! বলে অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল হেমাঙ্গ। তারপর বলল, ইনি কোন ঝুমকি?

ওমা, আমার কাছে আবার আর কোন ঝুমকি আসবে? তোর মাথাটাই গেছে দেখছি। নাকি চোখের দোষ!

ঝুমকি মুখ তুলে হাসি মুখে বলল, উনি সেদিন মিস্টার বিশ্বাসের বাড়িতেও আমাকে প্রথমে চিনতে পারেননি।

হেমাঙ্গ লজ্জা পেয়ে বলল, তা নয়। আপনার চেহারা পাল্টে যাচ্ছে।

তাই নাকি? কই আমি তো বুঝতে পারি না।

একটা শ্বাস ফেলে হেমাঙ্গ বলল, হয়তো কসমেটিক সার্জারি কিংবা যোগ, কিংবা আর কিছু করেছেন আপনি।

ঝুমকি এত হাসল যে ফের মুখ চাপা দিতে হল তাকে।

চারুশীলা তার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, বুদ্ধ আর কাকে বলে!

হেমাঙ্গ সত্যিই একটু অবাক হয়েছে। এ মেয়েটা যে ঝুমকিই তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু ওর চেহারায় যে একটা পরিবর্তন হয়েছে সেটাও মিথ্যে নয়। কিন্তু পরিবর্তনটা কিরকম তা সে ধরতে পারছে না।

চারুশীলা বলল, ঝুমকি, হয়তো এ বোকাটা খুব একটা ভুলও বলেনি। হিসেবী চোখ তো। তোর চেহারা যে একটু ভাল হয়েছে সেটা ওর চোখ দিয়েই পরীক্ষা হয়ে গেল। চার কেজি ওজন বাড়া সার্থক হল।

ওজন! বলে হেমাঙ্গ একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। কিন্তু মুখে আর কোনও কথা এল না। ঠিকই, কৃষ্ণজীবনের বাড়িতেও মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার এবং প্রথম দর্শনে সে কয়েক পলক চিনতে পারেনি একে। মেয়েটা একটু ঠেস দিয়ে কি এক-আধটা কথা বলেছিল তাকে। আর ঘুরে ঘুরে তাকে দূর থেকে লক্ষ করেছিল।

দোতলার হলঘরে এসে বসল তারা। কফি এল। হেমাঙ্গর অবাধ্য চোখ বারবার ঝুমকির মুখের ওপর এবং চারদিকে ওড়াউড়ি করছিল। মাত্র চার কেজি মাংস বা চর্বি বাড়লে এতটা পাল্টে যায় মানুষ। ডেবিট ক্রেডিট আজ কিছুতেই সমান হতে চাইছে না। হিসেবের গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। ব্যালান্স শিট মিলছে না।

একটু আনমনা ছিল হেমাঙ্গ, চারুশীলা হঠাৎ বলল, তুই ঝুমকিকে অত লজ্জা পাচ্ছিস কেন বল তো!

হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, লজ্জা! লজ্জার কী আছে?

লজ্জার অবশ্য তোর একটা কারণ আছে। তুই ঝুমকিকে একটা চাকরি করে দিতে পারিসনি।

হেমাঙ্গ বিব্রত হয়ে বলল, উনি তো মোটে একবারই আমাকে অ্যাপ্রোচ করেছিলেন, তারপর আর কখনও বলেননি। আমি ধরে নিয়েছিলাম হয় উনি চাকরি পেয়ে গেছেন, নয়তো দরকার নেই।

ঝুমকি নিজের যোগ্যতাতেই একটা চাকরি পেয়ে গেছে। সামনের মাসে জয়েন করবে। খুব ভাল চাকরি অবশ্য নয়। মাইনে খুব কম। তবে পরে বাড়াবে।

হেমাঙ্গ ঝুমকির দিকে একঝলক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কফির কাপে মুখ দিতে দিতে বলল, ভালই তো। তবে আজকাল চাকরির বকলমে নানারকম এক্সপ্লয়টেশন হয়। সেটা সম্পর্কে একটু কেয়ারফুল থাকবেন।

ঝুমকি বলল, কিরকম এক্সপ্লয়টেশন?

এক্সপ্লয়টেশনের ভ্যারাইটি এবং ম্যাগ্নিচুড এত বেশি যে স্পেসিফাই করা মুশকিল। কখনও সূক্ষ্ম, কখনও স্থূল।

চারুশীলা একটা ধমক দিল, ওর কথা শুনিস না তো ঝুমকি! নিজে একটা চাকরি দিতে পারেনি, এখন জ্যাঠামশাইয়ের মতো উপদেশ দিতে লেগেছে।

হেমাঙ্গ একটু দম নিয়ে বলল, সেটা ওঁর ইচ্ছে। তবে তুই এত সুখের মধ্যে থেকে তো ওয়ার্কিং গার্লদের সমস্যা বুঝতে পারবি না। গোলাপি চশমা দিয়ে দুনিয়া দেখছিস।

আমার বর যদি আমাকে সুখে রেখে থাকে তাতে তোর হিংসে হয় কেন রে? বেশ করব গোলাপি চশমা দিয়ে দুনিয়া দেখব।

যত খুশি দেখ, কিন্তু ওঁকে গোলাপি চশমাটা পরানোর চেষ্টা না করাই ভাল।

ঝুমকি এবার মৃদুস্বরে বলল, হেমাঙ্গবাবু ঠিকই বলেছেন মাসি। দেয়ার আর প্রবলেমস্‌। তবে আমি এত ভয় পাই না। আমাকে সহজে এক্সপ্লয়েট করা যাবে না।

হেমাঙ্গ জানে, সব মেয়েই এরকম ভাবে। কিন্তু চারদিকে এত সূক্ষ্ম জাল আর ফাঁদ থাকে যে, শেষ অবধি সামাল দিতে পারে না। কিন্তু সে আর এ নিয়ে কথা বলল না। চুপ করে রইল।

চারুশীলা কোনও মুডই বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। হঠাৎ বলল, এই, তুই অমন গোমড়া মুখ করে আছিস কেন রে? দু’ চক্ষে গোমড়া মুখ দেখতে পারি না। আজ মাছের রোস্ট হচ্ছে, একটু খেয়ে যা।

আমার খিদে নেই।

ডায়েটিং করছিস নাকি? চেহারা তো হাড়গিলের মতো হচ্ছে।

চেহারা! চেহারা নিয়ে তারাই ভাবতে পারে যাদের হাতে অঢেল সময় আছে। আমাদের ফালতু সময় নেই।

জানা আছে। বেশি বকিস না। যখন সুন্দরবনে গিয়ে বিরহী যক্ষের মতো বসে থাকতি তখন সময় হয়েছিল কি করে?

সেটা অন্য ব্যাপার।

কাওয়ার্ড কোথাকার! সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেললি। এখন দাড়ি রেখে দেবদাস সাজছে।

হেমাঙ্গ হেসে ফেলল। বলল, দেবদাস দাড়ি রাখত নাকি?

তা কে জানে! তোর ওপর এত রাগ হয় আমার!

সন্ধে সাতটার দিল্লি ফ্লাইটে প্লেনের আইল সিটে বসে হেমাঙ্গ খুব আনমনে এক কাপ কফি খেল। খাবারটা নিলই না। কেন কে জানে আজ নিজেকে সে ঠিক বুঝতে পারছে না। যেন একই শরীরে দু’জন বসে আছে। চেনা হেমাঙ্গ আর অচেনা হেমাঙ্গ।

দিল্লিতে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে পাঁচতারা ঝলমলে হোটেলে পৌঁছনো, পাঁচতলায় ওঠা, ঘরে ঢোকা, জামাকাপড় পাল্টানো, ক্লায়েন্টকে ফোন করে পৌঁছ-সংবাদ দেওয়া সবই যেন ঘটছিল একটা ঘোরের মধ্যে। এই হোটেলের ভাড়া, ডিনার-লাঞ্চ-ব্রেকফাস্টের পয়সা সবই দেবে তার ক্লায়েন্ট। তবু ডিনারটা সে খেল না। ফ্রিজ থেকে একটা কোল্ড ড্রিংক বের করে খুব আস্তে আস্তে খানিকটা খেল। তারপর বাতি নিবিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল সে।

মনটা বিষণ্ণ।

কখন ঘুমিয়ে পড়ল, টেরও পেল না সে।

রবিবার সকালের ফ্লাইটে তার ফেরার কথা ছিল। কিন্তু সে ফিরে এল শনিবার রাতেই। তার মনের মধ্যে একটা ভীষণ তাড়াহুড়ো, একটা তীব্র অস্থিরতা। যেন সময় বয়ে যাচ্ছে, যেন এখনই কী একটা কাজ তাকে সেরে ফেলতে হবে।

রবিবার ভোর রাতে উঠে সামান্য জিনিসপত্র গুছিয়েই সে বেরিয়ে পড়ল। ক্যানিং, নদী, নৌকো, তার পরই তার নদীর ধারের ঘরখানা। আঃ, কী আনন্দ! কী স্বস্তি!

বাসন্তী যেন হাওয়ার মুখে খবর পেয়ে ছুটে এল, ওমাঃ তুমি এসে গেছ? এবার কতদিন পর এলে বলো তো! আমি তো ফি শনিবার ভাবি, আজ আসবেই আসবে।

হেমাঙ্গ অকপট হেসে বলল, ভাবিস?

ভাবব না? ও কি, দাঁড়াও দাঁড়াও, হুট করে বিছানায় উঠো না। ঘরদোর পরিষ্কার করি, বিছানা ঝেড়ে দিই, কাচা চাদর পাতি, তবে না! যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো ভাল করে।

আজ কী খাবো রে? বাজার তো নেই।

সে তোমাকে ভাবতে হবে না। দশটা টাকা দাও সব নিয়ে এসে রান্না করে দিই। ততক্ষণ জিরোও।

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলল, জিরোবো না। নৌকো করে একটু ঘুরে আসি। উঃ, কী যে ভাল লাগছে এসে!

হেমাঙ্গ বেরিয়ে পড়ল। বিশাল নদী, বিশাল আকাশ, বিশাল ব্যাপ্ত চরাচর যেন কোল পেতে আছে তার জন্য। বাতাস এসে সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, খেলা করছে এলোমেলো চুলে, দাড়িতে।

নৌকো করে অনেক দূর গেল হেমাঙ্গ। রূপমুগ্ধ দুটি চোখ দিয়ে পৃথিবীকে পান করতে লাগল। ভিতরে কী তেষ্টাটাই না জমে ছিল তার!

যখন দুপুরে স্নান করে খেতে বসেছে তখন বাঁকা মিঞা এল।

আবার এলেন! এবার বেশ দেরি করে এলেন। আমি তো ভাবলাম শখ মিটে গেছে।

হেমাঙ্গ হাসল। বলল, না, শখ আরও বেড়েছে। আবার ঘন ঘন দেখতে পাবে আমাকে।

বিয়েটিয়ে কি শিকেয় তুলে রাখলেন?

হেমাঙ্গ ফিচেল হাসি হেসে বলল, ভাবছি এদিককারই কোনও গাঁয়ের মেয়েকে বিয়ে করব। এখানেই থাকব। তুমি বরং পাত্রী খোঁজ করতে লেগে যাও।

বাঁকা মিঞার বাক্য হরে গেল। তারপর খুব হাসতে লাগল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *