টাঙ্গা ছাড়ল সাড়ে দশটায়, সন্ধের আগেই শিলং পৌঁছে যাবে। পেছন দিকে বসেছে দুটি বোরখা পরা রমণী, আরও তিনজন পুরুষ সমেত একটি মুসলমান পরিবার, একজন ফলের ব্যাপারি, ভরতকে নিয়ে মোট সাতজন। ভরত বসেছে টাঙ্গা চালকের পাশে।
গৌহাটিতে বেশ গরম, চিটচিটে ঘাম হয়। খানিক দুরে পাহাড়ে উঠলেই বাতাস ক্রমশ শীতল হবে। ঘোড়ার পায়ের কপ কপ আওয়াজ শুনতে বেশ লাগে। সামনে বসলে ধুলো সহ্য করতে হয় বটে, তবু এই জায়গাটাই ভরতের বেশ পছন্দ হল। এক এক সময় সে জামার তলায় গোঁজা রিভলবার দুটো হাত দিয়ে অনুভব করছে, তাতে যেন বলবৃদ্ধি হচ্ছে শরীরে। যেন সে একটা যুদ্ধে যাচ্ছে, এ যুদ্ধে কিছুতেই হারলে চলবে না। মনে মনে সে বলছে, ব্যামফিল্ড ফুলার, তোমার নিয়তি ঘনিয়ে এসেছে, আর নিস্তার নেই!
বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের সংবাদ আসছে প্রায়ই। কয়েক জায়গায় স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কোথাও কোথাও বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে ছাত্রদের পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাথা ফেটে রক্তগঙ্গা বয়েছে। বয়কট ভাঙার জন্য দাঙ্গার উসকানি দিচ্ছে পুলিশ। এর পরেও ফুলারের মৃত্যুদণ্ডকে অনৈতিক বলা যাবে না।
ভরতের হঠাৎ মনে পড়ল, তার একটি সন্তান আছে কটকে। এতদিনে সে বেশ বড় হয়ে গেছে মনে হয়। কখনও তাকে দেখতে যাওয়া হয়নি, মহিলামণির পিত্রালয়ের সঙ্গে ভরত কোনও যোগাযোগও রাখেনি। ওড়িশাতে তার আর যেতেই ইচ্ছে করে না, তার জীবনের ওই অধ্যায়টা যেন মুছে গেছে। আসলে কিন্তু মুছে যায় না। অনেক দিন পর হঠাৎ ফিরে আসে ছবি। ভরত শিশুদের সঙ্গে ভাব জমাতে পারে না। এখানে রাস্তার ধারে অল্পবয়েসী ছেলেদের দেখে কেন মনে পড়ছে নিজের ছেলের কথা? এই শিশুদের কাছে ডেকে আদর করতে ইচ্ছে হয়। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে সে নিজের সন্তানের কপালে একটা চুমো দিয়ে যাবে না?
ভরতেরই মতন তার সন্তানও ভাল করে জ্ঞান হবার আগেই মাতৃহীন। বাবাকেও নিশ্চয়ই তার মনে নেই। তার বাবা বেঁচে আছে কি না তাও সে জানে না। এখন সত্যি সত্যি পিতৃহীন হলেই বা এমনকী উনিশ-বিশ হবে? ভরতের কিছু সম্পত্তি আছে। খামার বাড়িটা শুধু বন্ধক দেওয়া আছে, উত্তরাধিকার সূত্রে ওই খামার তার সন্তানের পাওয়া উচিত। হেমকে সেরকম কিছু বলে আসা হয়নি। হেম ভরতের আগেকার জীবনের কথা কিছুই জানে না। যাক, তার ছেলে মামারবাড়িতে ভালই আছে, মামারা বেশ সচ্ছল, ওই সম্পত্তি তার না পেলেও চলবে।
কল্পনায় ছেলের মুখোনা যেন অস্পষ্টভাবে দেখতে পায় ভরত, কিন্তু মহিলামণির মুখ তার মনে পড়ে না। তার অবয়ব আছে, মুখ নেই। নিজের স্ত্রীকে সে ভুলে গেছে? খুব তীব্রভাবে চিন্তা করলে মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে অন্য একটি মুখ। ভূমিসূতার মুখ। ভূমিসূতার মুখশ্রীর সঙ্গে মহিলামণির মুখের কিছুটা মিল ছিল। সরলা ঘোষালের বাড়িতে বহুদিন পর ভূমিসূতাকে দেখেও ভরত এই মিল পেয়েছিল। ভূমিসূতা! সে এখন অন্য জগৎবিহারিণী, মঞ্চের আলোয় তার জীবন ঝলমল করছে, সে ভরতের কেউ নয়। ভূমিসূতা শুধু বুকের মধ্যে একটা কাঁটা হয়ে রয়ে গেল। আর তার সঙ্গে দেখা হবে না। আর কলকাতায় ফেরা হবে না। ত্রিপুরায় কেউ তার কথা জানবেও না। একটা মূল্যহীন জীবন! অবাঞ্ছিত জন্ম, ভাগ্য তাকে বারবার বিড়ম্বিত করেছে। সুখের ছবি দেখিয়ে কেড়ে নিয়েছে বারবার। মৃত্যু তাড়া করে ফিরেছে। এভাবে বেঁচে থাকারই বা অর্থ কী? যদি ভূমিসূতা একবার তার দিকে চোখ তুলে চাইত, সেদিন সরলা ঘোষালের বাড়িতে…।
হঠাৎ ভরতের চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল। যেন বিশ্বচরাচর একেবারে কুচকুচে কালো। কোথাও আলোর রেখা নেই। মুখের মধ্যে অদ্ভুত তিক্ত স্বাদ। শরীরটা একটু একটু কাঁপছে। এ কী হল? অকস্মাৎ কি অন্ধ হয়ে গেল সে? কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সে চিৎকার করতে চাইছে, স্বর ফুটছে না কণ্ঠে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আবার সব কিছু স্বাভাবিক। এই তো ঘোড়ার গাড়ি ছুটে চলেছে, রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, রাস্তার দু’পাশে অপরূপ প্রকৃতি। তা হলে কী হয়েছিল একটু আগে! এই কি মৃত্যুর মহড়া! প্রাণ হারাবার সময় এরকম হয়! এর পর ভরতের খুব ইচ্ছে হল, চলন্ত গাড়িটা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ার! এ আবার কী! সে নিজেই নিজের ইচ্ছের মর্ম বুঝতে পারছে না।
ভরত বিড়বিড় করে বলতে লাগল, পাখি সব করে রব, পাখি সব, পাখি সব, পাখি সব, ভরত নেমে পড়ো! পালাও! পালাও! এখনও সময় আছে। কোথায় যাচ্ছ, কেন যাচ্ছ, পাখি সব, পাখি সব, বাঁচতে হবে, বাঁচতে হবে, পালাও!
বুকের ভেতর থেকে কাঁপুনি উঠছে, যেন সে ছিটকে পড়ে যাবে। ভরত মুঠোয় চেপে ধরল নিজের মাথার চুল। এ কী হচ্ছে! সে ভয় পেয়েছে? এতখানি ভয় বুকের মধ্যে জমে ছিল? সে আসলে কাপুরুষ! দেশের জন্য বা কিছুর জন্যই সে জীবন দিতে চায় না। শেষ মুহূর্তটা পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে বাঁচতে চায়। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ!
যে কটা দিন হেমের সঙ্গে ছিল, তখন এসব মনে পড়েনি। হেমকে বাঁচাবার জন্যই সে এসেছে। হেম পাশে থাকলে হেমকে পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে সে নিজে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত নিশ্চিত। অন্য কেউ সঙ্গে থাকলে নিজেকে বেশি সাহসী হিসেবে প্রমাণ করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু একা একা সে বিষম দুর্বল হয়ে পড়ছে। অত্যন্ত তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে লাফিয়ে নেমে পড়ে দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যেতে। আর কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। জঙ্গলের মধ্যে জংলি হয়ে বেঁচে থাকবে। দু’বেলা খাদ্য না জুটলেও ক্ষতি নেই, তবু তো বেঁচে থাকা হবে! নিজের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে সে বলতে চাইছে, হ্যাঁ, আমি কাপুরুষ, আমি বাঁচতেই চাই!
আরও কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে এইরকম দ্বন্দ্ব চলল। মুসলমান পরিবারটি নিজেদের মধ্যে গল্প করছে কারুর আসন্ন শাদি বিষয়ে। গাড়োয়ানটি মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে দেখছে ভরতকে। কেউই টের পাচ্ছে না এই মানুষটির মুখে কেন ফুটে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চক্ষু দুটি উন্মাদের মতন।
রাস্তা এক জায়গায় বাঁক নিতেই দেখা গেল সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে লাল পাগড়ি মাথায় পুলিশ। এখানে এত পুলিশ কেন? কয়েকজন পুলিশ রাস্তার মাঝখানে এসে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। এ গাড়ির গাড়োয়ান দ্রুত ঘোড়ার রাশ টেনে ধরতেই ঘোড়াটা চি চি শব্দ করে উঠল। ভরতের সমস্ত শরীর এখন সজাগ, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। প্রথমেই তার মনে হল, বারীন আর হেম কি বোমা সমেত ধরা পড়ে গেছে? কোনও রকমে খবর পেয়ে পুলিশ ভরতকে ধরার জন্য ফাঁদ পেতেছে এখানে?
একজন দারোগা শ্রেণীর পুলিশ গট গট করে হেঁটে আসছে এই গাড়ির দিকে। ভরত রিভলবারে হাত ছোঁয়াল। তার সব দুর্বলতা অন্তর্হিত হয়ে গেছে। রাগে শক্ত হয়ে উঠেছে চোয়াল। সে ঠিক করল, তাকে গ্রেফতার করতে এলেই সে গুলি চালাবে। একজনকে অন্তত না মেরে সে মরবে না। রিভলবারগুলোর অনেক দাম, অনেক কষ্টে জোগাড় করতে হয়, এমনি এমনি সে পুলিশের হাতে তুলে দেবে নাকি?
দারোগাটি রুক্ষ স্বরে বলল, সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াও। গাড়িটাকে রাস্তার পাশে মাঠের মধ্যে রাখো। এখন কোনও গাড়ি যাবে না। এখান দিয়ে লাট সাহেবের কনভয় পাস করবে।
ভরতের বুকটা ধড়াস করে উঠল। যাঃ! ফুলার সাহেব শিলং থেকে ফিরে আসছে এরই মধ্যে? সাহেবদের দেখার জন্য কিছু কৌতূহলী লোক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দু’পাশে। ভরত তাদের মধ্যে মিশে গেল। এখানেই ফুলারকে হত্যা করার চেষ্টা করা যায়? চলন্ত গাড়ির পাদানিতে উঠে জানলা দিয়ে গুলি চালালে কেমন হয়? তারপর পুলিশরা ভরতকে ঝাঁঝরা করে দেয় তো দিক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, দূরে দেখা যাচ্ছে একসঙ্গে গোটা পাঁচেক গাড়ি আসছে, তার মধ্যে কোন গাড়িতে ফুলার আছে, তা বোঝা যাবে কী করে! গাড়িগুলো ছুটছেও বেশ জোরে।
ভরতের চোখের সামনে দিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে বেরিয়ে গেল লাটসাহেবের কনভয়। আর এখন শিলং যাওয়া অর্থহীন। উল্টোদিকের ফেরার গাড়িগুলি সবই ভর্তি। তবু একজন গাড়োয়ানকে অতিরিক্ত পয়সা কবুল করে ভরত উঠে পড়ল।
বাড়ি ফেরার পর সংবাদ শুনে বারীন বেশ উৎফুল্ল হলেও হেম গম্ভীর। সে বলল, ভরত এখন আমরা তিনজনে রয়েছি। সব সিদ্ধান্ত তিনজনে মিলেই নিতে হবে। একা কেউ কোনও গোপন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আমাদের না জানিয়ে রিভলবার দুটো নিয়ে গিয়ে তুমি ঘোরর অন্যায় করেছ!
বারীন বলল, অস্ত্র দুটো নিয়ে গিয়েছিল নাকি? সে কী! এসব ব্যাপারে কিন্তু আমার কথাই ফাঁইনাল। এ জন্য ভরতকে শাস্তি পেতে হবে। দলের মধ্যে ডিসিপ্লিন রাখাটা খুব বড় কথা।
ভরত চুপ করে রইল।
বারীন বলল, কী শাস্তি পাবে তা ভেবে দেখতে হবে। আপাতত মুলতুবি রইল।
পরদিনই খবর পাওয়া গেল, ফুলার সাহেব সদলবলে চলে গেছে রংপুর!
বারীনরা খানিকটা দমে গেল। সে যে অনেক দূর। উত্তরবঙ্গের ওদিকটায় এরা কেউই কখনও যায়নি। বারীনের ইচ্ছে আপাতত কলকাতায় ফিরে যাওয়া হোক, এবারের মতন ফুলার রক্ষা পেয়ে গেল। হেম তাতে রাজি নয়। সে শেষ পর্যন্ত দেখতে চায়। রংপুরের স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই সাহায্য পাওয়া যাবে।
রংপুরে এসে দেখা গেল, এখানকার পরিবেশ বরিশালের থেকে ভিন্ন। এখানে কোনও সর্বজনপ্রিয় নেতা নেই, কিন্তু বারংবার পুলিশি অত্যাচারের ফলে এখানকার কিছু যুবকের মধ্যে একটা প্রতিরোধের মনোভাব গড়ে উঠেছে। তারা একটা কিছু করতে চায়। কলকাতা থেকে তারা কোনও সাহায্য পায় না। কয়েকজন এর মধ্যেই কলকাতার কয়েকজন নেতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, নেতারা শুধু লম্বা-চওড়া বুলি আউড়েছেন। তাঁরা এমন ভাব দেখিয়েছেন, যেন মফস্বলের লোকেরা কিছু বোঝে না, তাঁরাই সবজান্তা। যথাসময়ে তাঁরা রংপুরে নির্দেশ পাঠাবেন। এতে রংপুরের যুবকরা কলকাতার নেতৃত্বের প্রতি বেশ বিরক্ত হয়ে আছে। এইসময় বারীনের দলটি পৌঁছনোয় তারা খুব সদয়ভাবে গ্রহণ করল না। তারা জেরা করতে লাগল নানারকম। বারীনের কাছে যে অস্ত্রসম্ভার আছে, সে সম্পর্কেও তারা সন্ধিগ্ধ।
হেম বলল, সকলের সামনে আমি অস্ত্রগুলি দেখাতে চাই না। আপনারা একজন প্রতিনিধি ঠিক করুন, কোনও নির্জন জায়গায় তাকে আমাদের অস্ত্রের কার্যকারিতা বুঝিয়ে দেব।
সেইরকমই ব্যবস্থা হল। শহরের বাইরে একটি বিস্তৃত জলাশয়ের পাশে ঝোঁপজঙ্গল। সন্ধেবেলা সেখানে গিয়ে বারীনরা নিজেদের পুঁটুলি সমেত বসে রইল। জায়গাটায় অসম্ভব মশা, অনবরত চাপড় মারতে হচ্ছে গায়ে। হেম আর বারীন একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলেছে, কারুর দেখা নেই। চাঁদনি রাত, প্যাচা ডাকছে, শেয়ালের হুক্কাহুয়াও শোনা যাচ্ছে বেশ কাছেই। সিটি
অনেকক্ষণ পর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে এল একজন। বেঁটে, ষণ্ডমার্ক চেহারা, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। লোকটির নাম যোগেন্দ্রমোহন দাস, সবাই জগুদা বলে ডাকে। মুখে নানারকম অভিজ্ঞতার ছাপ আছে, কয়েকবছর সে জাহাজের খালাসি হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরেছে।
অস্ত্রগুলো দেখার পর সে একটা বোমা হাতে তুলে খানিকটা অবহেলার সঙ্গে বলল, এটা ছুঁড়ে মারলে ঠিকমতন ফাটবে কি না তা পরীক্ষা করে দেখেছেন?
বারীন সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, দেখা আছে। সেই
কাঁচ জগু বলল, আমার সন্দেহ আছে। ছুঁড়ে দেখব ফাটে কি না?
সে হাতটা উঁচু করতেই বারীন হা-হা করে তাকে বাধা দিয়ে বলল, এখানে ছুঁড়বেন কি মশাই? আমাদের কাছে দুটো মাত্র আছে, দুটোই কাজে লাগবে!
মা জগু বলল, ধরুন, বোমা ছোঁড়া হল, ফাটল না। তখন কী হবে?
আমার ধারণা, এগুলো বোমা নয়, সাধারণ পটকা।
বারীন বলল, সেকেন্ড লাইন অফ অ্যাকশানও ঠিক করা আছে। বোমা যদি না ফাটে তা হলে আমাদের দু’জন রিভলবার নিয়ে একেবারে লাটসাহেবের সামনে এগিয়ে যাবে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালাবে।
জগু বলল, লাটসাহেবের কাছাকাছি তিন-চারজন বডিগার্ড থাকে। তারা তো সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালিয়ে সে দু’জনের খুলি উড়িয়ে দেবে।
বারীন বলল, দেবে তো দেবে! তাতে কী আসে যায়? এই দুজন তো প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত
হয়েই যাবে। দে হ্যাঁভ অলরেডি ডেডিকেটেড দেয়ার লাইভস! ও জগু কৌতূহলী চোখে ভরত আর হেমের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর খুব
মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনারা প্রাণ দিতে চান কেন?
এক কথায় কী উত্তর দেওয়া যায় তা ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল দুজনেই। সি জগু বলল, কাযযাদ্ধারের আগেই যারা প্রাণ দেবার জন্য রেডি হয়ে থাকে, তারা কী ধরনের বিপ্লবী? একজন সাহেবকে মারতে গিয়ে দু’জন প্রাণ দেবে? প্রাণের ঝুঁকি থাকবে ঠিকই। কিন্তু বাঁচার পথ, পালাবার পথ চিন্তা করে রাখা হবে না কেন?
বারীন বলল, দু’জন প্রাণ দিলে শত শত ছেলে ইনস্পায়ার্ড হবে!
জগু বলল, ধরুন, দুজনে একেবারে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে বুক চিতিয়ে সাহেবের সামনে এগিয়ে গেল। এ যা পুরনো ধরনের রিভলবার দেখছি, এতেও ঠিকমতন গুলি বেরুলে ভাগ্য বলতে হবে। ধরুন সাহেবের গায়ে গুলি লাগল না। সাহেব মরল না, কিন্তু এই দুজনের প্রাণ গেল। তাতে সাহেবরা হাসবে না? বলবে, ভেতো বাঙালিরা অস্ত্র ধরতে জানে না, রিভলবার হাতে নিয়ে ভয়ে কেঁপেছে, তাতেই গুলি অন্যদিকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে। প্রাণ দেওয়া সোজা, কাজ উদ্ধার করা অনেক শক্ত! যে কাজের জন্য যাওয়া, তাতে যাতে সেন্ট পারসেন্ট সফল হওয়া যায়, সে জন্য পাকাঁপোক্ত প্ল্যান করা দরকার নয় কী? আপনারাই বলুন না। স বার নজসক
বারীন বলল, আমরা আটঘাট বেঁধেই এগুব।
অনেকের জও একটা বিড়ি ধরিয়ে দুটান দেবার পর জিজ্ঞেস করল, আলফ্রেড নোবেল নামে সুইডেনের এক বৈজ্ঞানিক ডায়নামাইট নামে এক ধরনের বোমা আবিষ্কার করেছেন, সে বিষয়ে কিছু জানেন? বোমাটা এক জায়গায় পুঁতে তার সঙ্গে একটা তার জুড়ে দেওয়া হয়। সেই তারটা অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে কল টিপে বোমাটা ফাটানো যায়। এইভাবে পাহাড়ও ফাটানো যায়, কারুর গায়ে কিছু লাগে না।
হেম বলল, এই বোমার বিষয়ে আমি পড়েছি।
জগু বলল, ধরুন, লাটসাহেব কোন ট্রেনে আসছে, আগে থেকে খবর নেওয়া গেল। ট্রেন লাইনের মাঝখানে একটা ওই ডায়নামাইট বোমা পুঁতে রাখা হল, ট্রেন এসে পড়ার পর লাটসাহেবের কামরাটা ওই জায়গায় পৌঁছালে দূর থেকে কল টিপে সেটা উড়িয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবীদের চম্পট দেবারও অনেক সময় পাওয়া যাবে। ধরা পড়ার প্রশ্ন নেই। যাকে বলে, সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।
বারীন বলল, সে রকম বোমা আমরা কোথায় পাব?
জগু বলল, কিছু কিছু মশলা জোগাড় করতে পারলে সে রকম বোমা বানানো খুব শক্ত কিছু নয়। আমিও আপনাদের সাহায্য করতে পারি। আমার মশাই সাতটা ছেলেমেয়ে, দুটো বউ, বুড়ো বাপ-মাও বেঁচে আছে, সব আমার ঘাড়ের ওপর, আমি নিজে সামনা-সামনি যাব না, তবে আড়াল থেকে যতদূর সম্ভব সাহায্য করতে রাজি আছি।
তারপর সে ভরতের কাঁধে হাত রেখে বলল, খামোখা মরতে চান কেন? পৃথিবীতে বুঝি ভালবাসার কেউ নেই?
ভরতের মনে হল, এমন মধুর কথা সে আগে কখনও শোনেনি। প্রাণ দেওয়াটা যে কত গৌরবের, এই তত্ত্বটাই মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বলছে বাঁচার কথা। সত্যিই তো, কাজ উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাঁচার পথটাই বা খোলা রাখা হবে না কেন? অত বড় একজন সাহেবকে মেরেও যদি ধরা না দেওয়া যায়, পালানো যায়, সেটাই তো বেশি বীরত্বের।
রংপুরে কেউ এই তিনজনকে নিজেদের বাড়িতে আতিথ্য দেয়নি। তবে একজন একটা ফাঁকা বাড়ি ওদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। সেখানে ওরা রান্না করে খায়। রান্না করতে হয় ভরতকে। এটা তার শাস্তির অঙ্গ। ডাল আর ভাত আলাদা রান্না করার বদলে ভরত প্রায় রোজই খিচুড়ি বানায়, সঙ্গে কিছু ভাজাভুজি। এখানে ঝিঙে-বেগুন শস্তা, আলু-পেঁয়াজের বেশ দাম, পটল পাওয়া যায় না।
পয়সা ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি। স্টিমারের ভাড়া দিয়ে কারুর কাছেই আর তেমন কিছু নেই। নতুন বোমাটা বানাতেও বেশ কিছু টাকা লাগবে। তা হলে উপায়? একটাই শুধু আশার কথা, ফুলার সাহেব রংপুরে বেশ কিছুদিন থাকবে। এটা খুব নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ সংগ্রহের জন্য বারীন কলকাতায় চলে গেল। ভরত আর হেম বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোয় না। জগু সাবধান করে দিয়েছে, এখানে ওদের পক্ষে বেশি লোকের সঙ্গে মেলামেশা না করাই ভাল। ফুলার সাহেব বেশ কিছুদিনের জন্য আস্তানা গেড়েছে বলে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, তার মধ্যে কিছু টিকটিকিও মিশে আছে। নতুন লোক দেখলে খোঁজখবর নিচ্ছে। জগু নিজে অবশ্য প্রায়ই ওদের কাছে এসে নানান দেশের গল্প করে।
সময় কাটাবার কোনও সমস্যা নেই। এ বাড়িতে একটা আলমারির মধ্যে বেশ কিছু পুরনো বই রয়েছে, বাংলা-ইংরেজি মেশানো। দেখে মনে হয়, অনেক দিন সেই আলমারি খোলা হয়নি। হেম সারা দিন শুয়ে শুয়ে বই পড়ে। ভরতও চটপট রান্না সেরে নিয়ে পছন্দমতন বই খোঁজে। তার মনোভাব এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে, তাকে সবসময় বেশ উৎসাহী ও হাসিখুশি দেখায়। রংপুরে আসার আগে পর্যন্ত মৃত্যুচেতনা মাথার ওপর ভূতের মতন চেপে বসেছিল। দেশের কাজ করা কিংবা পরাধীনতার অপমানবোধের চেয়েও প্রধান হয়ে উঠেছিল নিজেদের প্রাণদান। যেন মৃত্যু অবধারিত। এখন মনে হয়, দেশের কাজ করতে হবে, অত্যাচারী ফুলারকে শাস্তি দিতে হবে, এ সবই ঠিক, সেইসঙ্গে নিজের প্রাণ বাঁচাবারও সবরকম চেষ্টা করতে হবে। সব মানুষই বাঁচতে চায়, আগে থেকেই নিজে নিজেকে মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা দিয়ে বসবে কেন? ভরত ধরেই নিয়েছে, নতুন বোমাটা বানানো হলে তাদের কার্যসিদ্ধি তো হবেই, নিজেরাও প্রাণে বাঁচতে পারবে। সে রকম বেগতিক দেখলে সুদূর পাঞ্জাব বা সিন্ধু প্রদেশে পালিয়ে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে কিছুদিন। যতই অচেনা পরিবেশ হক, যত দূরই হোক, তবু তো বেঁচে থাকা! এখন প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর সূর্যের আলো দেখার পরই মনে হয়, এই পৃথিবী কত সুন্দর! কয়েকটা টুনটুনি পাখি ডাকাডাকি করে, তাও মনে হয় কত মধুর! পাগল ছাড়া এই পৃথিবী কেউ এমনি এমনি ছেড়ে যেতে চায়!
আপাতত বেঁচে থাকার অন্য একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। বারীন দু-তিন দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে বলেছিল, এক সপ্তাহ কেটে গেল, তার পাত্তা নেই। কোনও চিঠিপত্রও লেখেনি। টাকা-পয়সাও নিঃশেষ, রান্নাঘরে চাল-ডালও বাড়ন্ত, এর পর খাওয়া জুটবে কী করে? ভরতের কাছে শেষ যেকটি টাকা ছিল তা বারীনের যাওয়ার ভাড়ার জন্য দিতে হয়েছে, এখন উপায়? বারীন কি অসুস্থ হয়ে পড়ল? বারীন যদি আর না আসে? ওরা দুজন এখান থেকে ফিরবেই বা কী করে?
আজ শুধু খিচুড়ি, আলু-বেগুনও জোটেনি। দুপুরে দুটো কলাপাতায় খিচুড়ি বেড়ে দিয়ে ভরত বলল, চাল-ডাল আজ শেষ। কয়েকটা ঝিঙে পড়ে আছে। ও বেলায় শুধু তার ঝোল হবে। কাল কী করে চলবে আমি জানি না। হেম, তোমার কাছে আর পয়সা আছে?
হেম বলল, আমার শেষ সিকিটা তো পরশু খরচ করে ফেলোম! আশা করি বারীন আজ এসে পড়বে!
ভরত বলল, যদি না আসে? ভদ্দরলোকের ছেলে, কারুর কাছে তো ভিক্ষেও চাইতে পারব না!
হেম বলল, এখানে আমাদের ভদ্দরলোক হিসেবে ক’জন চেনে? চুলে ধুলোবালি মেখে, খালি গায়ে, শুধু লুঙ্গি পরে যদি বাজারের কাছে বসি, কেউ ভিক্ষে দেবে না!
ভরত হেসে বলল, না, কেউ দেবে না। তুমি বা আমি যদি ভিখিরি সেজে বসি, লোকে বলবে, আ মর মিসে, খেটে খেতে পারিস না? অমন তাগড়া চেহারা নিয়ে ভিখ মাঙছিস লজ্জা করে না?
হেম বলল, তা হলে কুলিগিরির চেষ্টা করতে হবে। রেলের লাইন সারানো হচ্ছে দেখেছি।
ভরত বলল, স্থানীয় কুলিরা ঠেঙিয়ে আমাদের তাড়াবে! দুর্ভিক্ষের ধাক্কায় বহু চাষা-মজুর শহরে এসে ভিড় করেছে।
সে রাতেও বারীন ফিরল না। পরদিন আর উনুন ধরাবার প্রশ্ন নেই। কাছে যখন টাকাকড়ি থাকে, তখন একটা বেলা, কিংবা একটা গোটা দিনও কিছু না খেলে তেমন কষ্ট হয় না। কিন্তু আজ সকাল থেকেই পেট ছুঁই ছুঁই করছে, একটাই কথা মনে পড়ছে, কী খাব, আজ কী খাব?
দুজনে দুটি বই খুলে চৌকিতে শুয়ে রইল। চোখ মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছে সদর দরজার দিকে, কান এমনই উৎকর্ণ যে শালিক পাখির পায়ের আওয়াজও শুনতে পাচ্ছে। যদি বারীন আসে, সে এসে পড়তে পারে যে-কোনও মুহূর্তে। হেম পড়ছে বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ’, আর ভরত পড়ছে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, সে বইটার সামনের কয়েকখানা পাতা ছেঁড়া।
পড়তে পড়তে একসময় ভরত হো-হো করে হেসে উঠল। হেম পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করল, কী হে, এত হাসির কী হল?
ভরত বলল, এই জায়গাটা শুনবে? ‘মা শুনে বড় খুসী হতেন ও কখন কখন আমাদের উৎসাহ দেবার জন্য ফি পয়ার পিছু একটি করে সন্দেশ প্রাইজ দিতেন; অধিক মিষ্টি খেলে তোৎলা হতে হয়, ছেলেবেলায় আমাদের এ সংস্কার ছিল; সুতরাং কিছু আমরা আপনারা খেতুম, কিছু কাগ ও পায়রাদের জন্যে ছাদে ছড়িয়ে দিতুম। আর আমাদের মঞ্জুরী বলে দিশি একটি সাদা বেড়াল ছিল (আহা কাল সকালে সেটি মরে গ্যাছে–বাচ্চাও নাই) বাকী সে প্রসাদ পেতো।’
পড়া থামিয়ে ভরত বলল, কতকাল সন্দেশ খাইনি। এই সাদা বেড়ালটাকেও ভাগ্যবান মনে হচ্ছে না?
আর হেম বলল, সন্দেশ খেতে চাও, তোমার বাবুয়ানি তো কম নয়! দেখো ভাই, সারা দিন যদি ভাত-টাত নাও জোটে, পেটে কিল মেরে থাকতে পারি, কিন্তু এক কাপ চা না হলে যে চলে না। বিড়ি-সিগ্রেটও ফুরিয়ে গেছে। আমাদের প্রতিবেশী নলিনীবাবুর বাড়িতে গেলে কি এক পেয়ালা চা দেবে না?
ভরত বলল, উনি ভুরু কুঁচকে কথা বলেন। বাগানে দাঁড়ালে দেখা হয়, কোনওদিন বাড়ির মধ্যে যেতে বলেননি। ওঁর বাড়িতে দুটি সোমত্ম মেয়ে আছে, তাই বোধহয় আমাদের সন্দেহ করেন!
হেম সোৎসাহে উঠে বসে বলল, এই তো একটা উপায় খুঁজে পেয়েছি। বারীন যদি না-ই ফেরে, তা হলে তোমায় একটি বিয়ে দেব এখানে। তুমি পাত্র হিসেবে খারাপ নয়, লেখাপড়া জানো, চেহারাপত্তর ভাল। তুমি জাতে তো কায়স্থ! নলিনীবাবুরাও কায়স্থ, আপত্তি হবে না বোধকরি।
ভরত বলল, আমি কায়স্থ না চাঁড়াল, বুঝবে কী করে? তোমার মুখের কথায় বিশ্বাস করবে? আমার চালচুলো নেই, আর কারুর কাছে যে খোঁজ নেবে, তারও উপায় নেই। তুমিই বরং আর একটা বিয়ে করে ফেল!
হেম বলল, আমার একটি যে গৃহিণী আছে, তাতেই রক্ষা নেই! সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের একটি সাঙ্ঘাতিক অস্ত্র দিয়েছেন, তার নাম কান্না। তাতেই আমি কুপোকাত হয়ে গেছি কতবার! আর একটা বিয়ে করার বদলে আমি ফাঁসি যেতেও রাজি আছি!!
এরূপ আলোচনা চলতে চলতেই দরজার বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল! বারীন নয়, এসেছে জগু। খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলার পর জগু জিজ্ঞেস করল, আজ রান্নার আয়োজন দেখছি না যে! বেলা তো প্রায় বারোটা বাজে!
হেম বলল, কালকের বাসি অনেক খাবার ছিল, সকাল সকাল খেয়ে নিয়েছি।
জগু বলল, তাই নাকি? কী খেলেন?
ভরত বলল, বেশ খানিকটা ঘি-ভাত ছিল। আর খাসির মাংস। মাংস রান্না বাসি হলেই ভাল জমে। চিংড়ি মাছও ছিল গোটা কয়েক। আর কামরাঙার অম্বল।
জগু বলল, আহা-হা, এ তো অতি উপাদেয়। আগে এলে একটু চেখে দেখতাম। সঙ্গে দই ছিল না! রংপুরের দই বিখ্যাত, আর পাতক্ষীর।
হেম বলল, তাই নাকি? ও বেলা আনিয়ে খাওয়া যাবে।
জগু একটা বিড়ি ধরাল, হেম লোভীর মতন তাকিয়ে রইল তার দিকে। বিড়ির গন্ধে তার মন আনচান করছে। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় চাইতে পারল না।
জগু বলল, স্নান করবেন না?
ভরত বলল, সকালেই সারা হয়ে গেছে।
জগু বলল, তা হলে উইন, কামিজ পরে নিন। আমার অর্ধাঙ্গিনী আজ আপনাদের নেমন্তন্ন করেছেন। এত জলদি জলদি যে এতসব ভাল ভাল খাদ্য খেয়ে বসে থাকবেন তা তো বুঝিনি আগে। চলুন, শুধু দুটি ডাল-ভাত খাবেন, একটু না হয় দেরি করেই খেতে বসব।
ভরত ও হেম পরস্পরের সঙ্গে চোখাচোখি করে একসঙ্গে হেসে উঠল। জগু না হেসে গম্ভীরভাবে ভরতকে বলল, আপনি তো মশাই ম্যাজিক জানেন। কাল সন্ধেবেলা দেখলাম ঝিঙের তরকারি বেঁধেছেন। আজ সেটা হয়ে গেল বাসি মাংস!
হেম বলল, তা হলে দিন, আগে একটা বিড়ি দিন। ভাত খাওয়ার আগে আপনার বাড়িতে চা খাব।
বারীন ফিরল পরের দিন। কিন্তু সে দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। চেষ্টা করেও সে মাত্র পঁচিশ টাকার বেশি জোগাড় করতে পারেনি। সে টাকাও দিয়েছেন অরবিন্দ ঘোষ, তিনি বলেছেন, তাঁর কাছে আর টাকা নেই। সত্যিই তো, তিনি বেশি টাকা পাবেন কোথায়? যে-সব বড় মানুষেরা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা কেউ পাত্তা দেয়নি। আসল ব্যাপারটি এই। ফুলার বধের পরিকল্পনা নিয়ে এই দলটি অনেক দিন বাইরে রয়েছে, তাতে কলকাতার নেতাদের ধারণা হয়েছে যে এরা কাজের কাজ কিছুই না করে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। সেজন্য আর কেউ টাকা দেবে না। একটা বড় রকমের অ্যাকশন করে দেখাতে পারলে অনেক অর্থ সাহায্য আসবে!
পঁচিশ টাকায় বিপ্লব? নতুন বোমা বানাবার খরচই বা আসবে কোথা থেকে, ওদের খাওয়া-দাওয়াই বা কীভাবে চলবে। তবে কি এবারের মতন এ পরিকল্পনা বাতিল করে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়? ভরত ফিরে যাওয়ার পক্ষে, বারীনও নিমরাজি। কিন্তু হেম জেদ ধরে রইল। সে কিছুতেই ব্যর্থতা স্বীকার করে নেবে না।
দুদিন ধরে তর্কাতর্কি চলার পর তৃতীয় দিন উপস্থিত হল আর একজন। নরেন গোঁসাই। তাকে অরবিন্দবাবু পাঠিয়েছেন বিশেষ এক বার্তা দিয়ে। বারীনরা ফিরে যাক, এটা অরবিন্দবাবু চান না। কলকাতা থেকে আর অর্থ সংগ্রহের আশা নেই। এই রংপুর থেকেই টাকা তুলতে হবে। এমনিতে কেউ দেবে না। বারীনদের কাছে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে, সেগুলোকেই কাজে লাগাতে হবে। ইতালি
অর্থাৎ ডাকাতি। হেম আর বারীন রাজি হয়ে গেলেও এই ব্যাপারটা ভরতের মনঃপূত নয়। চার বছর আগে যতীন বাড়জ্যের আখড়ায় জমায়েত হবার সময় কয়েকবার ডাকাতি করে টাকা তোলা হয়েছিল, সেই টাকার কোনও হিসেব নেই, সব নয়-ছয় হয়ে গেছে! এ কাজ অনৈতিক। বিপ্লবীদের নামে কলঙ্ক লাগবে। দেশের মানুষের ওপর ইংরেজরা অত্যাচার চালাচ্ছে, তার ওপর বিপ্লবীরাও অত্যাচার চালাবে?
নরেন বলল, তোমার এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই ভুল। আমরা তো নিজেদের স্বার্থে কিছু করছি না। দেশের কাজের জন্যই টাকা চাই। সে টাকা তো দেশের মানুষই দেবে। যদি স্বেচ্ছায় দিতে না চায়, তা হলে আপাতত জোর করে আদায় করতে হবে। সে টাকার পাই-পয়সা পর্যন্ত হিসেব রাখা হবে এবার। বেশি বড় দল দরকার নেই, আমরা চারজনই যথেষ্ট।
ভরত বলল, একটা কথা আমি ভোলাখুলি বলতে চাই। আমার কাছে রিভলবার আছে বলেই আমি দেশের মানুষকে মারতে পারব না। সেটা পাপ। ডাকাতি করতে গিয়ে যদি বাধা আসে, তখন কী হবে?
নরেন বলল, মানুষ মারতে হবে না, ভয় দেখালেই যথেষ্ট। ফাঁকা আওয়াজ করব। কেউ কাছাকাছি এসে পড়লে বড়জোর পায়ে গুলি চালাব। দেশের কাজের জন্য কোনও কিছুই পাপ নয়!
শুরু হল ডাকাতির পরিকল্পনা। ভরত একটা ব্যাপারে অবাক হল, অরবিন্দবাবু নরেনকে এ কাজের জন্য পাঠালেন কেন? সে জমিদারের ছেলে। এককালে বাংলার সব জমিদারই নাকি ডাকাত ছিল, কিন্তু ইংরেজ আমলে তাদের জারিজুরি ভেঙে গেছে, ইংরেজরা নিজেরাই সবচেয়ে বড় ডাকাত বলে অন্য সব ডাকাতদেরই ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। এখনকার জমিদাররা অলস, ভোগবিলাসে মত্ত। নরেনের দুধ-ঘি-মাখন খাওয়া চেহারা। সন্ন্যাসীদের মতন গেরুয়া পোশাক পরে। তবু ডাকাতির ব্যাপারে তারই সবচেয়ে বেশি উৎসাহ। অবশ্য আনন্দমঠের বিপ্লবীরাও সন্ন্যাসী ছিল।
ঠিক হল নবগ্রাম নামে একটি জায়গার এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ডাকাতি করাই সুবিধাজনক। সে ব্রাহ্মণটি অতি কৃপণ ও সুদে টাকা খাটায়। খাতকদের নানাভাবে হেনস্থা করে, জমি নিলাম করিয়ে দেয়। লোকটি অতি বদ, তার টাকা কেড়ে নেওয়ায় দোষ নেই। তার পরিবারে লোকসংখ্যাও বেশি নয়।
রংপুরের দুটি যুবককে নানাভাবে পরীক্ষা করে দলে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় লোক ছাড়া সব খবরাখবর সংগ্রহ করা যায় না। তাদের মধ্যে একজনের মামাবাড়ি ওই নবগ্রামে। সে আগের রাতে সেখানে চলে যাবে। এই দলটি ঠিক রাত একটায় পৌঁছলে সে সংকেত দেবে।
সবাই দিনের বেলা ভাল করে ঘুমিয়ে নিল। বিকেলবেলা ভাল করে চা, নিমকি ও পাতক্ষীর খাওয়া হল, তারপর দলটি রওনা দিল সন্ধের অন্ধকার নেমে আসার পর। পথ দেখাবে স্থানীয় অন্য যুবকটি। আগের রাতে তুমুল বৃষ্টি হয়ে গেছে, সমস্ত রাস্তাই কাদা। নিঃশব্দে হাঁটতে গেলেও ছপছপ শব্দ হয়। লোকবসতি এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে হচ্ছে। সাপখোপের ভয় পদে পদে। একটা ব্যাঙের ওপর পা পড়তে ভরত আতঙ্কে প্রায় চিৎকার করে ফেলছিল আর একটু হলে!
চার বছর আগে এই রকম অভিযানে দলে লোকসংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ডাকাতের বড় দলবল দেখলেই গ্রামবাসীরা ভয় পায়। এবারে অন্য কৌশল ঠিক করা হয়েছে। মহাজন ব্রাহ্মণটি যে বালিশ মাথায় দিয়ে শোয়, সেই বালিশের মধ্যেই তার জমানো টাকা, সোনা-দানা থাকে। টাকার গরম ছাড়া তার ঘুম হয় না। কোনওক্রমে সেই বালিশটি কেড়ে নিতে হবে। বেশি লোককে সে বিশ্বাস করে না, একজন নমঃশুদ্র পাহারাদার শুয়ে থাকে তার দরজার বাইরে। লাঠি ছাড়া কাছে আর কোনও অস্ত্র থাকে না। রিভলবারের ভয় দেখিয়ে তাকে কাবু করতে হবে। বুড়োর কাছ থেকে বালিশটা কেড়ে নিয়ে পালাতে হবে ঝটাপট।
বাড়ির মধ্বে ঢোকারও একটা উপায় পাওয়া গেছে। গোয়ালঘরের গা ঘেঁষে রয়েছে একটা বড় চালতাগাছ। সেই গাছ বেয়ে খড়ের চালে নামা যায়। সেখান থেকে উঠোনে। কিন্তু বুড়ো তো নিজের ঘরের দরজা খুলে ঘুমোবে না, সেই দরজা ভাঙা যাবে কী করে? ভাঙতে গেলে প্রচণ্ড শব্দ হবেই। যদি বর্মা টিকের দরজা হয়, তা ভাঙাও সহজ কর্ম নয়। না ভেঙেও কার্য উদ্ধার করা যায়, তাতে ধৈর্য লাগবে। ব্রাহ্মণটি রাত্তিরে তিনবার অন্তত প্রস্রাব করবার জন্য বাইরে আসে। সেরকম একবারের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
তা হলে, প্রথমে একজন চালতাগাছ বেয়ে উঠোনে নামবে। নেমেই সে সদর দরজা খুলে দেবে ভেতর থেকে। এ কাজের ভার নেবে হেম। সবসময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নেবার জন্য সে বদ্ধপরিকর। দরজা খোলা পেয়ে অন্যরা ভেতরে ঢুকে পাহারাদারটিকে কাবু করবে। আর যদি সদর দরজার ভেতর থেকে তালা দেওয়া থাকে? তা হলে হেম সঙ্কেত দেবে, অন্যদেরও ওই চালতাগাছ বেয়েই যেতে হবে অন্দরে।
ভরত জিজ্ঞেস করেছিল, পাহারাদারটি যদি আগেই জেগে উঠে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে? এদের লাঠির জোর সাঙ্ঘাতিক হয়।
বারীন উত্তর দিয়েছিল, অগত্যা তা হলে ওকে মারতেই হবে। একটা গুলিই যথেষ্ট।
নরেন বলেছিল, না না। খুন করার দরকার হবে না। গ্রামের লোকেরা সাহেবদের কাছে ছাড়া বন্দুক-পিস্তল দেখেইনি। সাহেবদের অস্ত্র হিসেবে এগুলোকে ওরা যমের মতন ভয় পায়। দেখালেই থরথরিয়ে কাঁপবে। বড়জোর হাতে বা পায়ে গুলি চালাতে হবে।
হেম বলেছিল, গুলি চালালে শব্দ হবে। তাতে বুড়োটা ঘর থেকে বেরুবে কেন। আগে দেখতে হবে, লোকটা ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে। কোন পজিশনে শুয়ে আছে। আস্তে আস্তে গিয়ে পেছন দিক থেকে ওকে জাপটে ধরে মুখ বেঁধে দিতে হবে। আমার ওপর সে ভার ছেড়ে দাও, সেটা আমি পারব।
বারীন বলেছিল, যেমন করেই হোক, বুড়োর বালিশটা আমাদের চাই-ই। তাতে দু-একজন ঘায়েল হয় তো হোক, এ ব্যাপারে আমাদের মন শক্ত করতে হবে। কিছুতেই খালি হাতে ফিরব না।
পুকুরধারে পাশাপাশি দুটো ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছ, সেখানে এসে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে দেশলাই জ্বেলে দেখছে বারীন, একটা প্রায় বাজে। জায়গাটাতে অসম্ভব মশা, কাছেই শ্মশান ছিল কিনা কে জানে। বিকট পচা গন্ধ আসছে একদিক থেকে।
একটা বেজে গেল, তবু কোনও সাড়াশব্দ নেই। যে যুবকটি আগে থেকেই এখানে আছে, সে কি ঘুমিয়ে পড়ল? কিংবা ভয় পেয়ে গেল? আগে সে খুব সাহস দেখিয়েছিল। মশার কামড়ে এখানে আর তিনো যাচ্ছে না। ছেলেটি সংকেত না দিলে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে? টাকা চাই, টাকা চাই! ফুলার বধ আর কতদিন বিলম্বিত করা যায়? আজ রাত্তিরেই যা হোক একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে হবে।
এর মধ্যে চাঁদ উঠে গেল। যাঃ, কোন তিথি তা হিসেব করে আসা হয়নি। কাল রাতে অত মেঘ ছিল, আজ একেবারে আকাশ পরিষ্কার, ফটফট করছে জ্যোৎস্না।
অন্যরা জ্যোত্সা দেখে উদ্বিগ্ন হলেও হেম বলল, ভালই হল, খড়ের চালে বসে বাড়ির ভেতরটা মোটামুটি দেখে নেওয়া যাবে। কিন্তু ছেলেটি না এলে বুড়োর বাড়ি চেনাবে কে?
অন্য যুবকটি বলল, সে বাড়ি আমিও চিনি। কিন্তু কিছু কি গণ্ডগোল হল?
হেম বলল, চলো, তা হলে যাওয়া যাক।
বারীন বলল, বালিশটা আমার কাছে থাকবে। ফেরার সময় আমরা আলাদা আলাদা ফিরব। যে যেদিকে পারে। দু-একদিনের মধ্যে রংপুর শহরে না ফিরলেও ক্ষতি নেই।
একটা বাঁধের মতন উঁচু রাস্তা, দুপাশে মাঠ। তারপর একটি পাড়া। ব্রাহ্মণের বাড়িটি ফাঁকা জায়গায় নয়, দূরে কাছে কয়েকটি বাড়ি আছে, শারগোল উঠলেই অন্য প্রতিবেশীরা জেগে উঠতে পারে। এদের একমাত্র ভরসা আগ্নেয়াস্ত্র। ভরত অনুভব করল, আজকের পরিকল্পনায় যুক্তির বদলে দুঃসাহসই বেশি। অন্য যুবকটি এল না কেন? ঠিক ভয় নয়, বুকের মধ্যে একটা অস্বস্তি বোধ, কিছু যেন ভুল হয়ে গেছে।
আপাতত বাড়িগুলি ঘুমন্ত নিঝুম, কোথাও বাতি জ্বলছে না। ব্রাহ্মণের বাড়িটি বেশ সুরক্ষিত, উঠোনটা উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। গোয়ালঘরটি মূল বাড়ি থেকে অনেকটা তফাতে, মাঝখানে উঠোন। একটা কুকুর ওদের সঙ্গে সঙ্গে এসে অনবরত ডেকে চলেছে। স্থানীয় যুবকটি মাটি-ঢেলা ছুঁড়ে সেটাকে তাড়াতে চাইলেও সেটা খানিক দূরে গিয়ে ফিরে আসছে আবার।
হেম ধুতির বদলে হাফপ্যান্ট পরে এসেছে, কোমরে রিভলবার বাঁধা, চালতাগাছ বেয়ে উঠতে শুরু করল। বেশ স্বাস্থ্যবান, বড় গাছ, ঘন পাতায় ঢাকা, খসখস শব্দ হচ্ছে পাতায়। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা লম্বা ডাল ধরে দোল খেতে খেতে হেম লাফিয়ে নামল খড়ের ঢালু চালে। সেখানে বসে রইল কয়েক মিনিট, তারপর ঠিক একটা বাঘের মতন গুঁড়ি মেরে মেরে এগুতে লাগল। একটু পরে তাকে আর দেখা গেল না।
এ পর্যন্ত ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। হেম লাফিয়ে নেমেছে মাটিতে? পাহারাদারটি ঘুমন্ত না জাগ্রত? হেম আগে দরজা খুলে দেবে, না আগে পাহারাদারটিকে একাই কাবু করতে যাবে? অধীর প্রতীক্ষা। একটা একটা করে মুহূর্ত গোনা হচ্ছে।
হেম দরজা খুলে দেবার আগেই কিছুটা দূরে অকস্মাৎ বহু মানুষের চিৎকার শোনা গেল। কারা যেন ইতস্তত ছোটাছুটি করছে, জ্বলে উঠল কয়েকটি মশাল। এদিকেই ছুটে আসছে, মার মার, ডাকাত ডাকাত রব শোনা যাচ্ছে। কী হল ব্যাপারটা? এখানে কেউ জাগেনি এখনও, অত দূরে ওরা ডাকাতির কথা টের পেল কী করে? আগের যুবকটি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? এদের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে?
সত্যি সত্যি ক্রুদ্ধ জনতা ছুটে আসছে এদিকেই। এরই মধ্যে কাকে যেন ধরে ফেলে মার শুরু করেছে। শোনা গেল তার আর্ত চিৎকার। কিছু লোক তাড়া করছে, কিছু লোক ছুটে পালাচ্ছে। ওরা কারা?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল ব্যাপারটা। এ বাড়ির ডাকাতদের কথা কেউ এখনও টের পায়নি। কিন্তু এমনই ভাগ্যের পরিহাস, আজই, এই একই সময়ে এ গ্রামের অন্য একটি বাড়িতে, ডাকাত পড়েছে। তারা সত্যিকারের ডাকাত দল, যে বাড়িতে তারা হামলা করতে গিয়েছিল, সেটা নায়েবের বাড়ি, তার বরকন্দাজদের সঙ্গে গ্রামের লোকও লাঠি-সোঁটা নিয়ে ডাকাতদের পিছু নিয়েছে।
তা হলে তো আর এখানে থাকা চলে না। বারীন চেঁচিয়ে বলল, রিট্রিট, রিট্রিট।
ভরত বলল, হেম? হেম যে এখনও ভেতরে?
হেমের জন্য অপেক্ষা না করে দলের অন্যরা দিকবিদিক ভুলে দৌড় দিল। ভরত তবু না নড়ে গলা ফাটিয়ে ডাকল, হেম, হেম! বেরিয়ে এসো!
কোনও উত্তর নেই। কিন্তু জনতার অগ্রবর্তী কয়েকজন ভরতের গলা শুনতে পেয়েছে। দুজন লোক বলল, ওই তো এক শালা!
ভরত এবার দৌড়েও বেশি দূর যেতে পারল না। সেই দুজন দুদিক দিয়ে তাকে প্রায় বেষ্টন করে ফেলেছে। ওদের হাতে বর্শা। ভরত রিভলবারটা বার করে বলল, সাবধান! গুলি খেয়ে মরবি, হটে যা!
একজন ভরতের দিকে বশ ছুঁড়ে মারল। ভরত গুলি চালাতে দ্বিধা করল তবু। তার হাত কাঁপছে। সে মানুষ মারবে? সে না মারলে এরা তাকে মেরে ফেলবে। সে নলটা ওপরের দিকে করে ট্রিগার টিপল দু’বার, সেই শব্দে কাজ হল। তার অনুসরণকারীরা গুলি না খেয়েই আছড়ে পড়ল মাটিতে, তারপর হ্যাঁচোড় প্যাচোড় করে পালাতে লাগল।
অন্য কোথাও আরও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভরত দৌড়চ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে জানে না, ঢুকে পড়েছে একটা জঙ্গলে। জ্যোৎস্না রয়েছে, তবু মাঝে মাঝে চোখে অন্ধকার দেখছে কেন? পেটে এত ব্যথা, এ কী পেটে একটা বর্শা গেঁথে আছে, তার মস্ত বড় ডান্ডাটা নিয়েই সে ছুটছে এতক্ষণ? বর্শাটা কখন লাগল সে টেরও পায়নি। এতক্ষণ ব্যথাও করেনি। এটা আগে তুলে ফেলা দরকার। ডান্ডাটা ধরে টানাটানি করতে সেটা ভেঙে গেল মট করে। ফলাটা গেঁথে রইল পেটে।
ভরত ছুটছে। তাকে বাঁচতেই হবে। হেমের কী হল, ওই বাড়ির মধ্যে আটকা পড়ে গেছে? হেম সহজে ধরা দেবার পাত্র নয়, হেমের মাথায় ঝটিতি বুদ্ধি খেলে। হেম যদি চালতাগাছটার ওপরে বসে থাকে, কেউ তার অস্তিত্ব টের পাবে না। সেটাই সবচেয়ে ভাল উপায়। লোকজন সরে গেলে সে চুপি চুপি নেমে সরে পড়তে পারবে। বারীনরা আগেই ছুটে গেছে, ভরতেরই একটু দেরি হয়ে : গেল। এই সব চিন্তা বিদ্যুতের মতন মাথায় আসছে বটে, তার মধ্যেই ভরত অনবরত ভেবে যাচ্ছে, তাকে বাঁচতেই হবে, যে-কোনও উপায়ে বাঁচতেই হবে। ক্রুদ্ধ জনতা ধেয়ে আসছে তার দিকে, রক্তপিপাসু কণ্ঠে তারা চিৎকার করছে, ধরো, ধরো, মারো শালাকে।
প্রকৃতপক্ষে অনুসরণকারীরা জঙ্গলে ঢোকেনি, চলে গেছে অন্য দিকে। তবু ভরত শুনতে পাচ্ছে সেই শাসানি, শুনতে পাচ্ছে বহু মানুষের পায়ের আওয়াজ, তার কানে তালা লেগে যাচ্ছে। যেন স্বয়ং মৃত্যু সহস্র মানুষের রূপ ধরে কেড়ে নিতে আসছে তার প্রাণ। ভরত ছুটছে, মাঝে মাঝে আছাড় খেয়ে পড়ছে, আবার উঠে ছুটছে, পেটের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে অবিরাম, তার খেয়াল নেই, যন্ত্রণায় দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে আসছে, তবু যেন তার যন্ত্রণাবোধ নেই, তাকে পালাতেই হবে।
একটা ছোট নদীতে হাঁটুজল, তাও ভরত ছপছপিয়ে পার হয়ে গেল। এপারে জঙ্গল পাতলা হয়ে আসছে, এখনও কোনও জনবসতি আসেনি। হাপরের মতন বুকটা ওঠানামা করছে ভরতের, গলা শুকিয়ে কাঠ, সে আর দম নিতে পারছে না। কীসে যেন পা লেগে ভরত আবার পড়ে গেল, এখনও সে শুনতে পাচ্ছে অনুসরণকারীদের হিংস্র গর্জন। এক্ষুনি এসে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। ভরত মুখ তুলে দেখল, অদুরেই একটা সিঁড়ি, সে বুকে হেঁটে এগিয়ে গেল সেদিকে, কয়েক ধাপ সিঁড়ি ওঠার পর একটা আধো অন্ধকার ঘর। সেটার মধ্যে ঢুকেই ভরত প্রাণপণে আবার উঠে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করে দিতে গেল, দরজার একটা পাল্লা ভাঙা, বন্ধ করার উপায় নেই, ভরত লুকোতে চাইল ঘরের এক কোণে, আর একবার কোনও কঠিন বস্তুতে পুঁতো খেয়ে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাল।
বেশিক্ষণ নয়, ফের উঠে বসল ভরত। এখন সব দিক দারুণ নিস্তব্ধ। আর কোনও চিৎকার সে শুনতে পাচ্ছে না কেন? তবে কি ইতিমধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে গেছে! তার শরীর থেকে বেরিয়ে এসেছে আত্মা! ভরত নিজের শরীরে হাত বুলিয়ে দেখল, না। শরীরটা সে অনুভব করতে পারছে, পেটে ঢুকে আছে বর্শার ফলা। এটা কোন জায়গা? এটা একটা পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দির, ওপরের ছাদ খানিকটা নেই, সেখান দিয়ে এসে পড়েছে একটুকু চাঁদের আলো। ভরত দেখতে পেল, মাঝখানে একটি কালী প্রতিমার সঙ্গে সে ধাক্কা খেয়েছিল।
সে সেই দেবীমূর্তির পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে তীব্র ব্যাকুলতার সঙ্গে বলতে লাগল, মা, মা, আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও! ওরা আমাকে মারতে আসছে, তুমি রক্ষা করো। মা, মা…
ভরত সেই প্রার্থনা জানাতে জানাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে কিছুতেই মরতে চায় না। এখন একমাত্র কোনও দৈব ক্ষমতাই তাকে বাঁচাতে পারে।
এক সময় তার অণু নিঃশেষ হয়ে গেল। চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছে না। চোখের সামনে একটা অন্ধকার পর্দা দুলছে। ভরত নিজেই বুঝতে পারছে, তার শরীর থেকে চলে যাচ্ছে সব ক্ষমতা। এর নামই মৃত্যু। পেটে বর্শার ফলা ঢুকলে কেউ বাঁচে? সেই অল্প বয়েস থেকে মৃত্যু তাকে তাড়া করে আসছে, এবার সফল হল। ভরত ভাবল, বেছে বেছে শুধু তাকেই কেন? জীবনের কাছে সে। কী অপরাধ করেছে? কত মানুষ ভালবাসা পায়, সংসার পায়, ছোট ছোট আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকে। মৃত্যু তাকে কিছুই দিল না। এইভাবে মরতে হবে? সবাই জানবে, সে এক ঘৃণ্য ডাকাত! অন্য ডাকাত দলের একজন মনে করবে। যে অপরাধ সে করেনি, সেই অপবাদ নিয়ে তাকে চলে যেতে হবে পৃথিবী থেকে।
চোখে চরম ঘুম নেমে আসছে। সেই অবস্থাতেও ভরত মাটির মূর্তির পা ধরে ঝাঁকানি দিতে দিতে এক জীবনব্যাপী অভিমান ও বেদনার সঙ্গে বলতে লাগল, কেন, কেন, আমাকে বাঁচতে দিলে না। তুমি মিথ্যে, মিথ্যে! সব মিথ্যে! কেউ আমাকে একটুও ভালবাসল না।
কয়েকবারের ঝাঁকানিতে সেই পুরাতন মাটির মূর্তি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ভরতের ওপর। ভরতের শরীর নিথর হয়ে গেল।