৮১-৯০. পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ক্রুশ

অধ্যায়

পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ক্রুশটার অবস্থান স্পেনে।

এল এস্করিয়ালের উপাসনালয়ের আট মাইল উত্তরে মাটি থেকে ৫০০ ফিট ওপরে এক পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত ক্রুশটা একশ মাইল দূর থেকেও দেখা যায়।

কুশটার নিচে অবস্থিত গিরিখাতে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ চিরন্দ্রিায় শায়িত। স্পেনের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে মারা যায় তারা। যথার্থই এই উপত্যকার নাম রাখা হয়েছে- ভ্যালি অব দি ফলেন। এখানে কী করছি আমি? রয়্যাল গার্ডের এজেন্টের সাথে পাহাড়ের তলদেশে একটা সমতল জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকেই জিজ্ঞেস করলেন হুলিয়ান। এরকম একটা জায়গায় বাবা দেখা করতে চান আমার সাথে?

তার পাশে থাকা ভালদেসপিনোর চেহারাতেও ফুটে উঠেছে বিভ্রান্তির ছাপ। কিছু বুঝতে পারছি না আমি, বললেন তিনি, আপনার বাবা এই জায়গাটা পছন্দ করেন না।

খুব কম মানুষই এমন একটা জায়গা পছন্দ করবে, ভাবলেন হুলিয়ান।

১৯৪০ সালে ফ্রাঙ্কো স্বয়ং এই জায়গাটাকে ঘোষণা করেন জাতির প্রায়শ্চিত্তের চিহ্ন হিসেবে। যুদ্ধে মৃতদের সম্মানার্থে একটা ব্যাসিলিকাও তৈরি করা হয় বিশাক ক্রুশটার পাদদেশে। কিন্তু ফ্রাঙ্কোর অন্যান্য কাজের মত এটাও সমালোচনার মুখে পড়ে কারণ নির্মাণকাজে অংশ নেয়া অনেকেই ছিল ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা রাজনৈতিক বন্দি। নির্মাণকাজ চলাকালীন অনাহারে মৃত্যুও হয় অনেকের। তৎকালীন কিছু সংসদ সদস্য জায়গাটাকে তুলনা করেন জার্মানদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোর সাথে। হুলিয়ানের ধারণা তার বাবাও নিশ্চয়ই অমনটাই ভাবেন। বেশিরভাগ স্প্যানিয়ার্ডদের মতে নিজের শাসনামলে স্মৃতিস্মারক হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল এখানকার সবকিছু। এমনকি ফ্রাঙ্কোর সমাধিও এখানে।

ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার এখানে ঘুরতে এসেছিল ও। তখন ওর উদ্দেশ্যে স্পেনের মহারাজা বলেন, এ সব একদিন তোমাকে ভেঙে ফেলতে হবে।

গার্ডিয়া রিয়েলের এজেন্টের পেছন পেছন পাহাড় কেটে বানানো একটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে এখন ওরা। এতক্ষণে হুলিয়ান ধরতে পারলেন কোথায় চলেছে ওরা। ব্রোঞ্জের তৈরি বিশাল একটা দরজা দেখা যাচ্ছে সামনে। ছোটবেলায় প্রথম যখন এখানে এসেছিলেন, দরজার পেছনের দৃশ্য দেখে চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল তার।

এই পাহাড়চূড়ার মূল আকর্ষণ বিশাল ক্রুশটা নয়, বরং সেটা পাহাড়ের ভেতরে অবস্থিত। মানব নির্মিত বিশাল একটা গুহা। নয়শ ফিট গভীর গুহাটার পুরোটাই হাতে খোঁড়া হয়। তবে গতানুগতিক গুহা বললে যেমনটা মনে হয় তার সাথে কোন মিল নেই এটার। ভেতরটায় ঝাঁ চকচকে, আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত, একটি উঁচু খিলানপথ চোখে পড়বে প্রথমেই।

একটা পাহাড়ের পেটের ভেতর আমি-প্রথমবার ভেতরে প্রবেশের পর ভেবেছিলেন হুলিয়ান। স্বপ্ন দেখছি না তো?

আজ অনেক বছর পরে একই জায়গায় ফিরেছেন হুলিয়ান।

আমার মৃত্যুপথযাত্রি বাবার নির্দেশে এখানে এসেছি আমি।

প্রবেশপথের বাইরে একটা মৃত জিশুকে কোলে নিয়ে থাকা কুমারি মেরির একটি সাদা মূর্তি, যার পরিচিত নাম পিয়েতার, সেটার দিকে চোখ পড়লো হুলিয়ানের। ওর পাশে দাঁড়িয়ে একবার মাথা নিচু করে ক্রুশ আঁকলেন বিশপ ভালদেসপিনো। তবে সেটা ধর্মিয় বিশ্বাস থেকে নাকি ভয় থেকে তা বুঝতে পারলেন না হুলিয়ান।

.

অধ্যায় ৮২

কন্সপিরেসিনেট.কম

ব্রেকিং নিউজ

রিজেন্টের পরিচয় কি?

আমাদের হাতে প্রমাণ এসেছে, গুপ্তঘাতক লুই আভিলা রিজেন্ট নামের একজনের আদেশ পালন করছিল।

কিন্তু রিজেন্ট নামের আড়ালে থাকা মানুষটার পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। তবে Dictionary.com-এর মতে রিজেন্ট (Regent) তাকেই বলা হয়, কোন সংগঠনের মূল নেতার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করে যে ব্যক্তি।

আমাদের ওয়েবসাইট ব্যবহারকারিদের অংশ নেয়া একটি জরিপ কে এই রিজেন্ট-এর মতে প্রধান তিন সন্দেহভাজন হচ্ছে :

১. বিশপ আন্তোনিও ভালদেসপিনো

২. পালমেরিয়ানদের একজন পোপ

৩. রাজার পক্ষ থেকে নিয়োগ দেয়া একজন স্প্যানিশ সামরিক কর্মকর্তা। আরও জানতে চোখ রাখুন এখানেই!

#কেএইরিজেন্ট

.

অধ্যায় ৮৩

অন্ধকারের কারণে বিশাল চ্যাপেলের ভেতরে অবস্থিত বার্সেলোনা সুপারকম্পিউটিং সেন্টারের প্রবেশদ্বারটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলো ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রার। অবশেষে পরিত্যাক্ত চার্চটার ঠিক মাঝখানে অত্যাধুনিক প্লেক্সিগ্নাসের ঘেরা একটি বাড়তি অংশ চোখে পড়লো ওদের। দেখে বোঝাই যাচ্ছে, অনেক পরে মূল দালানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে এই অংশটুক। প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক নক্সার মিশেল অদ্ভুত এক দ্যোতনার সৃষ্টি করেছে।

প্রবেশপথের ঠিক বাইরে বারো ফুট লম্বা এক প্রাচীন যোদ্ধার মূর্তি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো ওরা। একটা ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে এরকম ভাস্কর্য কী করছে সেটা ভেবে পেলো না ল্যাংডন। কিন্তু এডমন্ড যেখানে কাজ করেছে। সেখানে পরিবেশের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ভাস্কর্যের উপস্থিতি থাকবেই।

দ্রুত প্রবেশদ্বারের সামনে গিয়ে সেখানকার কল বাটনে চাপ দিলো অ্যাম্ব্রা। সাথে সাথে একটি সিকিউরিটি ক্যামেরা ঘুরে গেল ওদের দিকে। বেশ কয়েকবার ডানে বামে ঘুরে সময় নিয়ে ওদের পর্যবেক্ষণ করলো ওটা।

এরপর মৃদু একটা গুঞ্জন করে খুলে গেল দরজাটা।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো ওরা। শুরুতেই বিশাল একটা খোলা জায়গা। চার্চের প্রবেশদ্বারের পর রেলিং দিয়ে ঘেরা একটি স্থান, যেটাকে নাৰ্থেক্স বলে সেটার আধুনিকীকরণ করা হয়েছে যত্নের সাথে। ল্যাংডন ভেবেছিল কেউ ওদের স্বাগত জানানোর জন্যে অপেক্ষা করছে। এখানে-এডমন্ডের অধীনস্থ কোন কর্মি। কিন্তু পুরো লবিটাই খালি, কোথাও কেউ নেই।

কেউ নেই এখানে? ফিসফিসিয়ে ওর প্রশ্নটাই করলো অ্যাম্ব্রা।

এ সময় একটা ধর্মিয় সঙ্গিতের মৃদু মূৰ্ছনা কানে আসলো ওদের। সঙ্গিতটা চিনতে না পারলেও এরকম এক অত্যাধুনিক প্রাঙ্গণে ধর্মিয় সঙ্গিত বাজানোর বুদ্ধিটা যে এডমন্ডের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত ও।

ওদের সামনে একটি বিশাল লবি। আলো বলতে সেটার দেয়ালে ঝোলানো একটি প্লাজমা স্ক্রিন। স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে সেটিকে আদিমকালের কোন কম্পিউটার গেমের সাথেই তুলনা করা চলে। সাদা পর্দায় ছুটে বেড়াচ্ছে কালো কালো কিছু বিন্দু।

তবে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে বিন্দুগুলোর ছুটে বেড়ানোর মধ্যে পরিচিত একটি প্যাটার্ন আবিষ্কার করলো ল্যাংডন। কম্পিউটারে তৈরি এই বিন্দুগুলোর সমাহারকে বলা হয়-জীবন। এর আবিষ্কারক ইংরেজ গণিতবিদ জন কনওয়ে। কালো বিন্দুগুলো এক একটি কোষ, যেগুলো কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করার পর নিজেদের মধ্যে মিলিত হয়ে তৈরি করবে আরও বড় বড়

জটিল ধরণের নক্সা, যে নক্সাগুলো দেখা যায় প্রকৃতিতে। বিন্দুগুলো নড়াচড়া। করবে কিভাবে সেটার সাধারণ কম্যান্ড দিয়েছেন প্রোগ্রামার নিজেই।

কনওয়ের গেইম অব লাইফ, অ্যাম্ব্রা বলল। এটার ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি ডিজিটাল ইন্সটলেশন দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে, সেলুলার অটোম্যাটন অনুষ্ঠানে।

অ্যাম্ব্রাকে কনওয়ের গেইমটা চিনতে দেখে কিছুটা অবাকই হলো ল্যাংডন। ও নিজে ব্যাপারটা সম্পর্কে জানে কারণ প্রিন্সটনে ক্লাস নিতেন কনওয়ে।

আবারো ধর্মিয় সঙ্গিতটা কানে আসলো ল্যাংডনের। এটা শুনেছি আমি। রেনেসা ম্যাস বোধহয়, ভাবলো সে।

রবার্ট, স্ক্রিনের দিকে নির্দেশ করছে অ্যাম্ব্রা, দেখুন।

ডিসপ্লে স্ক্রিনে কালো কালো বিন্দুগুলো এতক্ষণ যেদিকে ঘুরছিলো তার বিপরীত দিকে ঘুরছে এখন। জটিল নক্সাগুলো সরল হতে হতে কয়েকটা মাত্র বিন্দুতে পরিণত হলো কিছুক্ষণের মধ্যে। বিন্দুগুলো এখন আর জোড়া লাগছে না, বরং আলাদা হয়ে যাচ্ছে একে অপর থেকে। অবশেষে একদম অল্প কয়েকটি বিন্দু রয়ে গেল। আটটা…চারটা…দুটা…এরপর…

একটা।

সেই বিন্দুটা মিটমিট করতে লাগলো স্ক্রিনে।

একটা শিহরণ বয়ে গেল ল্যাংডনের শরীরে। The Origin of Life। জীবনের উৎপত্তি।

একসময় সেই বিন্দুটাও মুছে গেল। পুরো স্ক্রিন এখন একদম সাদা।

গেইম অব লাইফ শেষ হয়ে যাবার পর সেখানে একটা লেখা ভেসে উঠতে শুরু করলো।

.

আমরা যদি একটা আদি কারণকে মেনেও নেই
তখনও আমাদের মন জানতে চাইবে,
কখন সেটা এলো, কিভাবে এসেছে।

ডারউইনের লেখা, আনমনে বলে উঠলো ল্যাংডন। এডমন্ড কিয়ার্শের করা প্রশ্নটারই একটু ঘোরানো রূপ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ডারউইনের বলা এই কথাগুলো।

এলেম আমরা কোথা থেকে? উত্তেজিত স্বরে বলল অ্যাম্ব্রা।

ঠিক ধরেছেন।

চলুন তাহলে ভেতরটা ঘুরে দেখি? ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল অ্যাম্ব্রা।

স্ক্রিনটার ডানদিকে চার্চের মূল অংশে যাওয়ার একটা খিলানপথের দিকে নির্দেশ করলো সে।

কিছু ইংরেজি শব্দ

ওদিকে পা বাড়াতে যাবে ওরা এমন সময় ডিসপ্লেতে কিছু ইংরেজি শব্দ ভেসে উঠতে লাগলো, ধীরে ধীরে অর্থবহ কিছু বাক্যাংশে রূপান্তরিত হতে লাগলো ওগুলো।

…growth…fresh buds…Beautiful ramifications…

ধীরে ধীরে শব্দগুলো একটি গাছের আদলে সজ্জিত হলো।

অবাক চোখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলো ওরা। ধর্মিয় সঙ্গিতটা আগে থেকে জোরে জোরে বাজছে এখন। ল্যাংডন ধরতে পারলো, গানের কথাগুলো ইংরেজিতে, ল্যাটিনে নয়।

হায় ঈশ্বর! অ্যাম্ব্রার কণ্ঠে বিস্ময়, শব্দগুলো তো গানের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে।

ঠিক বলেছেন, পুরনো শব্দগুলো মুছে গিয়ে সেখানে নতুন নতুন শব্দের আবির্ভাব ঘটতে লাগলো।

…by slowly acting causes…not by miraculors acts…

এখন আর সঙ্গিতটাকে ধর্মিয় সঙ্গিত বলা যাবে না মোটেও। সুরটা ধর্মিয় সঙ্গিতের ধরণের হতে পারে, কিন্তু কথাগুলো একদম বিপরীত।

Organic beings…Stongest live…weakest die…

হঠাৎ থমকে গেল ল্যাংডন।

আমি চিনি এটা!

কয়েক বছর আগে ওকে একটা সঙ্গিত অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিল এডমন্ড। চার্লস ডারউইন ম্যাস নামের সেই অনুষ্ঠানে খ্রিস্টিয় ধর্মিয় সঙ্গিতের ল্যাটিন শব্দগুলোর বদলে ব্যবহার করা হয়েছিল চার্লস ডারইনের লেখা অন দ্য অরিজিন অব স্পেসিস-এর কিছু শব্দ।

অদ্ভুত! ল্যাংডন বলল, ঠিক এটাই শুনেছিলাম আমি এডমন্ডের সাথে একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে। ওর খুব পছন্দ হয়েছিল গোটা ব্যাপারটা। এতদিন পরে কাকতালিয়ভাবে ঠিক একই জিনিস শুনতে হচ্ছে।

মোটেও কাকতালীয় নয়, একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠলো। এডমন্ড আমাকে অতিথিদের স্বাগতম জানানোর জন্যে তাদের পরিচিত কোন গান বাজাতে শিখিয়েছে। যাতে আলোচনার শুরুতে সে ব্যাপারে আলাপও করা যায়।

চোখে অবিশ্বাস নিয়ে স্পিকারগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলো অ্যাম্ব্রা আর ল্যাংডন। কণ্ঠটায় ইংরেজ টান স্পষ্ট।

আপনারা এখানে আসতে সমর্থ হয়েছেন দেখে খুবই ভালো লাগছে আমার, পরিচিত কৃত্রিম কণ্ঠটা বলল, কোনভাবে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না আপনাদের সাথে।

উইনস্টন! স্বস্তির সাথে বলল ল্যাংডন। একটা যন্ত্রের সাথে কথা বলতে যে এতটা উদগ্রীব হয়ে ছিল ও, সেটা আগে বুঝতে পারেনি।

দ্রুত সবকিছু উইনস্টনকে খুলে বলল অ্যাম্ব্রা।

আপনারা ঠিক আছেন এটাই অনেক, উইনস্টন বলল। এখন বলুন, যা খুঁজছিলেন সেটা কি পেয়েছেন?

.

অধ্যায় ৮৪

উইলিয়াম ব্লেক! ল্যাংডন বলল। দ্য ডার্ক রিলিজিয়ন্স আর ডিপার্টেড অ্যান্ড সুইট সায়েন্স রিস।

এক মুহূর্তের জন্যে থমকাল যেন উইনস্টন, তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতার শেষ পংক্তি। একদম মানানসই হয়েছে পাসওয়ার্ডটা, সেটা স্বীকার করতেই হবে, এটুকু বলে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো উইনস্টন, যেন হিসেব করছে কিছু একটা, কিন্তু এখানে তো সাতচল্লিশটা-

অ্যাম্পারস্যান্ডটাও হিসাবে নিতে হবে, ল্যাংডন বুঝিয়ে বলল এডমন্ডের ছোট চালাকিটা।

একদম এডমন্ডিয় কাজ, কৃত্রিম কণ্ঠস্বরটা বলে উঠলো হাসির ছলে।

তো উইনস্টন? অ্যাম্ব্রা বলল, এখন যেহেতু পাসওয়ার্ডটা জানো তুমি-প্রেজেন্টেশনের বাকিটুকু উন্মুক্ত করতে পারবে?

অবশ্যই পিরবো, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলল উইনস্টন। তবে সেজন্যে আগে আপনাদের মধ্যে একজনকে ম্যানুয়ালি পাসওয়ার্ডটা ইনপুট করতে হবে। এডমন্ড একটা ফায়ারওয়াল তৈরি করে রেখেছে ওর প্রজেক্টের তথ্যগুলোর চারপাশে। আমি সরাসরি অ্যাকসেস করতে পারবো না ওগুলোতে। কিন্তু আপনাদের ল্যাবের ভেতরে নিয়ে গিয়ে কোথায় পাসওয়ার্ডটা লেখতে হবে সেটা দেখাতে পারবো। এরপর পুরো প্রোগ্রামটা লঞ্চ করা মাত্র দশ মিনিটের ব্যাপার।

উইনস্টনের এরকম সোজাসাপ্টা উত্তর শুনে একটু হতাশই হলো অ্যাম্ব্রা। আর ল্যাংডন। আজ রাতে এত কষ্ট করে পাসওয়ার্ডটা উদ্ধার করার পর এরকম নির্মোহ মন্তব্য আশা করেনি ওরা।

রবার্ট, ওর কাঁধে হাত রেখে বলল অ্যাম্ব্রা, আপনার কারণেই সম্ভব হয়েছে সব। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

শুধু আমার নয়, আপনারও অনেক বড় অবদান আছে এর পেছনে। দলগত সাফল্য এটা।

আমি বলি কি, উইনস্টন বলল এই সময়, লবিতে বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরের ল্যাবে চলুন আপনারা। কারণ বাইরে থেকে এই অংশটুকু একদম স্পষ্ট দেখা যায়। আর আমি কিছু নিউজ রিপোর্ট পেয়েছি ইন্টারনেটে যেখানে লেখা আছে, আপনাদের এই অঞ্চলে দেখা যাওয়ার দাবি করা হয়েছে।

কথাটা শুনে অবাক হলো না ল্যাংডন। সামরিক একটা হেলিকপ্টার যদি কোন পার্কে অবতরণ করে তবে সেটা লোকজনের মনোযোগ আকর্ষণ করবেই।

কোথায় যেতে হবে বলল, অ্যাম্ব্রা বলল।

কলামগুলোর মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকুন, উইনস্টন জবাবে বলল, আমার কণ্ঠস্বর অনুসরণ করুন।

লবিতে ধর্মিয় সঙ্গিত বাজা বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ করেই। প্লাজমা স্ক্রিনটাও অন্ধকার হয়ে গেল। মূল প্রবেশদ্বারের দিক থেকেও কতগুলো ধাতব আওয়াজ ভেসে আসায় ল্যাংডন বুঝতে পারলো, ভেতর থেকে আবার বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে দরজাটা।

এডমন্ড নিশ্চয়ই একটা সংরক্ষিত দূর্গে রূপান্তরিত করেছিল জায়গাটাকে, মনে মনে বলল ল্যাংডন। লবির জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো একবার, কাউকে দেখতে পেলো না। এখনও কেউ ভিড় জমায়নি।

এ সময় লবির শেষভাগে একটা লাইট জ্বলে উঠতে দেখলো ল্যাংডন। একটা দরজা দেখা যাচ্ছে দুটো কলামের মাঝখানে। সেটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে। নিজেদের একটা বড় করিডোরে আবিষ্কার করলো অ্যাম্ব্রা আর ল্যাংডন। হলওয়ের শেষদিকে আবারো একটা লাইট জ্বলতে নিভতে শুরু করলে উইনস্টনের দেখানো পথ ধরে হাঁটতে লাগলো ওরা।

উইনস্টন কথা বলে উঠলো এসময়ে, আমার মনে হয় আমরা যদি এখন একটা প্রেস রিলিজ দিয়ে বলি যে, কিছুক্ষণের মধ্যে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা তাহলে দর্শকের সংখ্যা বেড়ে যাবে অনেক। গণমাধ্যম তখন নিজের হাতে তুলে নেবে প্রচারের কাজটা।

ভালো বুদ্ধি, হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে বলল অ্যাম্ব্রা। কিন্তু আমরা কতক্ষন অপেক্ষা করবো? কোন ঝুঁকি নেয়ার ইচ্ছে নেই আমার।

সতেরো মিনিট, জবাবে বলল উইনস্টন। তাহলে এখানকার স্থানীয় সময় অনুযায়ি রাত তিনটায় সম্প্রচার শুরু হবে প্রেজেন্টেশনটার। আর আমেরিকার প্রাইম টাইমে, অর্থাৎ রাত আটটা থেকে এগারোটার মধ্যবর্তি সময়ে।

বেশ, খুব ভালো হবে তাহলে।

তাহলে এখনই প্রেস রিলিজটা পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি, আর সতেরো মিনিটের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে প্রেজেন্টেশন।

উইনস্টনের ত্বরিত সিদ্ধান্তগুলোর সাথে তাল মেলাতে হিমশিম খেলো ল্যাংডন। ওর সামনে সামনে হাঁটছে অ্যাম্ব্রা।

এখানে কয়জন স্টাফ আছে এখন?

একজনও না, জবাব দিলো উইনস্টন। নিরাপত্তার ব্যাপারে অনেক কড়া ছিল এডমন্ড। সত্যি কথা বলতে, এখানে আসলে কোন স্টাফই নেই। আমিই সব কম্পিউটার নেটওয়ার্কগুলো পরিচালনা করি, সেই সাথে লাইটিং, এয়ার কন্ডিশনিং আর নিরাপত্তার ব্যাপারটাও দেখি। এডমন্ড মাঝে মাঝে মজা করে বলতো যে, এই স্মার্ট হাউজের যুগে সে তৈরি করেছে স্মার্ট চার্চ।

তবে উইনস্টনের কথায় তেমন মনোযোগ নেই ল্যাংডনের। হঠাই অন্য একটা ব্যাপার ভাবিয়ে তুলেছে তাকে, উইনস্টন, তোমার কি মনে হয়, এখনই একদম সঠিক সময় প্রেজেন্টেশনটা উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্যে?

থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা। অবশ্যই রবার্ট! এটাই একদম সঠিক সময়! এজন্যেই এত তাড়াহুড়ো করে এখানে আসা। পুরো পৃথিবীর মানুষ অপেক্ষা করছে। তাছাড়া কেউ আমাদের বাঁধা দেয়ার জন্যে আসছে কিনা সেটাও জানি না আমরা। এখনই করতে হবে কাজটা, বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই, এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল সে।

আমিও একমত এ ব্যাপারে, উইনস্টন তাল মেলালো, যদি শুধু উপাত্তের ভিত্তিতে বলতে হয়, আমি হিসেব করে দেখেছি, এই এডমন্ডের আবিষ্কারের খবরটা ইতোমধ্যেই গত এক যুগের সবচেয়ে বড় খবরে পরিণত হয়েছে। টেরাবাইটের পর টেরাবাইট ব্যবহৃত হচ্ছে এটার পেছনে। এর পেছনে অবশ্য অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোরও অনেক বড় অবদান আছে। গত দশ বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা।

রবার্ট? অ্যাম্ব্রা জিজ্ঞেস করল উদ্বিগ্ন স্বরে, কী ঘুরছে আপনার মাথায়, বলুন তো!

কথাটা কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারলো না ল্যাংডন। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে এই ভেবে যে, আজ রাতে নানা রকমের গুজবের ভিড়ে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা হারিয়ে না যায়! খুন, অপহরণ আর ষড়যন্ত্রতত্ত্বের কাছে। বরাবরই মার খেয়ে যায় বিজ্ঞানের খবর।

যুক্তি আছে আপনার কথায়, প্রফেসর, উইনস্টন বলল, কিন্তু আজ রাতের এইসব খুন, অপহরণ আর ভুয়া ষড়যন্ত্রতত্ত্বের কারণেই কিন্তু দর্শকের সংখ্যা এত বেশি। অনলাইনে প্রায় আটত্রিশ লক্ষ দর্শক দেখছিল আজ রাতের এডমন্ডের প্রেজেন্টেশন; কিন্তু গত কয়েক ঘন্টার ঘটনা প্রবাহের পর এখন প্রায় বিশ কোটি লোক নজর রাখছে! সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, টেলিভিশন এবং রেডিও চ্যানেলগুলোতেও তোলপাড় পড়ে গেছে।

সংখ্যাটা শুনে অবাক হয়ে গেল ল্যাংডন, ও আগে শুনেছিল, ফিফা বিশ্বকাপের ফাঁইনালের দর্শক ছিল বিশ কোটি। এর আগে পঞ্চাশ কোটি মানুষ একযোগে সাক্ষি হয়েছিল চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম পদার্পণের। তাও ইন্টারনেট যুগের অনেক আগে।

কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কিন্তু আগে এমনটা দেখা যায়নি, প্রফেসর, উইনস্টন বলল, পুরো পৃথিবীর কাছে ব্যাপারটা এখনও রিয়েলিটি শো এর মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে বা যারা এডমন্ডকে চুপ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে আজ রাতে, তারা সম্পূর্ণ বিপরীত ফলাফল পেয়েছে। ব্যাপারটা আমাকে আপনার লেখা ক্রিশ্চিনিয়াটি অ্যান্ড দি স্যাকরেড ফেমিন বইটাকে ভ্যাটিকান কর্তৃক সমালোচিত হবার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কারণ তার পরপরই বইটা বেস্টসেলারে পরিণত হয়েছিল।

পুরোপুরি বেস্টসেলার বলা যায় না এখনও, মনে মনে ভাবলো ল্যাংডন, কিন্তু উইনস্টন কী বোঝাতে চাচ্ছে সেটা ধরতে পারছে ও।

সর্বোচ্চ সংখ্যক দর্শকের সামনে প্রেজেন্টেশনটা উপস্থাপন করা এডমন্ডের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল আজ রাতে, উইনস্টন বলল।

ঠিক বলেছে ও, ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে বলল অ্যাম্ব্রা, আমি আর এডমন্ড যখন অনুষ্ঠানটার ব্যাপারে সব পরিকল্পনা করছিলাম তখন ও যত বেশি সম্ভব লোকের মনোযোগ আকর্ষণের কৌশলের ব্যাপারে সবসময় সচেষ্ট ছিল।

যেমনটা বললাম আমি, উইনস্টন বলল, এখনই প্রেজেন্টেশনটা লঞ্চ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়, তাহলে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ কোন না কোনভাবে সাক্ষি হতে পারবে আবিষ্কারটার।

বুঝতে পেরেছি, ল্যাংডন বলল, কী করতে হবে বলে আমাদের।

হলওয়ের বরাবর সামনে এগিয়ে গিয়ে একটি অনাকাঙ্খিত বাঁধার সম্মুখীন হতে হলো ওদের। করিডোরে এমনভাবে একটা মই রাখা যে ওটা না সরিয়ে সামনে এগোনোর উপায় নেই, নতুবা মাথা ঝুঁকে ওটার নিচ দিয়ে যেতে হবে।

এই মইটা, ল্যাংডন বলল, নামিয়ে ফেলবো?

না, উইনস্টন বলল, এডমন্ড ইচ্ছে করে ওটাকে ওখানে রেখেছে অনেক আগে।

কেন? অ্যাম্ব্রা জিজ্ঞেস করলো।

সকল প্রকার কুসংস্কারকে ঘৃণা করতো এডমন্ড। মইয়ের নিচ দিয়ে গেলে দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয় এই কথাটা যারা বলে তাদের মুখে ঝামা ঘষার জন্যেই প্রতিদিন এটার নিচ দিয়ে আসতো যেতো সে। যদি কোন অতিথি বা টেকনিশিয়ান এটার নিচ দিয়ে আসতে অস্বীকৃতি জানাতো তবে তাকে এখান থেকে বের করে দিতো সে।

এডমন্ড বলে কথা, হেসে মনে মনে বলল ল্যাংডন। এরকম একটা ব্যাপারে একবার ওকেও কথা শুনিয়েছিল এডমন্ড। সৌভাগ্যের জন্যে তার সামনে কাঠে টোকা দিয়েছিল ল্যাংডন, সাথে সাথে ওকে সেটা নিয়ে খোঁটা দেয়া শুরু করে পাগলাটে কম্পিউটার বিজ্ঞানী।

আর কথা না বাড়িয়ে ঝুঁকে মইটার নিচ দিয়ে অন্য পাশে চলে গেল অ্যাম্ব্রা। ল্যাংডনও অনুসরণ করলো তাকে।

অন্য পাশে আসার পরে ওদেরকে একটা বড় সুরক্ষিত দরজার সামনে নিয়ে আসলো উইনস্টন। দরজাটার পাশে দুটা ক্যামেরা আর বায়োমেট্রিক স্ক্যানার।

একটা হাতে তৈরি সাইন ঝুলতে দেখলো ওরা : রুম নং ১৩।

অপয়া সংখ্যাটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার হেসে উঠলো ল্যাংডন।

এটাই ল্যাবে ঢোকার মূল প্রবেশপথ, উইনস্টন বলল। ভাড়া করা কয়েকজন টেকনিশিয়ান বাদে খুব কম মানুষেরই প্রবেশাধিকার আছে এখানে।

মৃদু গুঞ্জনের শব্দ শোনার সাথে সাথে সময় নষ্ট না করে দরজার হাতল ধরে ভেতরের দিকে ঠেলা দিলো অ্যাম্ব্রা। কিন্তু চৌকাঠের ওপাশে এক পা দিয়েই একদম থমকে গেল সে। হা হয়ে গেছে মুখটা। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকানোর পরে ল্যাংডনেরও একই দশা হলো।

গোটা চ্যাপেলের দৈত্যাকার হলরুমটা ল্যাংডনের দেখা সবচেয়ে বড় কাঁচের বাক্সটা অবস্থিত। পুরো দোতলা জুড়ে আছে সেটা।

দেখে মনে হচ্ছে বাক্সটা দুটো তলায় বিভক্ত।

প্রথম তলায় শত শত রেফ্রিজারেটরের মত দেখতে সারি সারি মেটাল ক্যাবিনেট সাজানো। ঠিক যেমন একটা চার্চে মূল বেদির সামনে বেঞ্চ সাজানো থাকে। ক্যাবিনেটগুলোয় কোন দরজা না থাকায় ভেতরের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। লাল রঙের তারের কুন্ডলি বের হয়ে এসেছে প্রত্যেকটা থেকে, যেগুলো আবার নিজেদের মধ্যে সংযুক্ত। অনেকটা মানবদেহের শিরা বিন্যাসের মত দেখাচ্ছে।

প্রথম তলায় আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, ধারাভাষ্য দেয়ার ভঙ্গিতে বলল উইনস্টন, বিখ্যাত মেয়ার-নস্ট্রাম সুপারকম্পিউটার-যেটায় আটচল্লিশ হাজার আটশ ছেয়ানব্বইটি ইন্টেল কোর একে অপরের সাথে সংযুক্ত ইনফিনিব্যান্ড FDR10 নেটওয়ার্কের সহায়তায়। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির মেশিনগুলোর একটি। এডমন্ড যখন এখানে কাজ করতে আসেন তখন গোটা কম্পিউটারটাকে বাইরে না বের করে বরং সেটাকে কাজের অংশ করে নেন। ওপরের দিকে সম্প্রসারিত করেন প্রজেক্ট।

ল্যাংডন এবার খেয়াল করলো মেয়ার-নস্ট্রামের সবগুলো তার একত্রিত হয়ে বড় একটা শিরার মত উঠে গিয়েছে ছাদের দিকে।

দোতলার কাঁচের আয়তাকার বাক্সের ভেতরের দৃশ্য আবার ভিন্ন। সেখানে একটা উঁচু পাটাতনের ওপর

শোভা পাচ্ছে বিরাট বড় নীলাভ একটি বর্গাকৃতির ধাতব…বস্তু বলবে নাকি যন্ত্র বলবে ঠিক ভেবে পেলো না ল্যাংডন। তবে উইনস্টন যেভাবে প্রশংসার সুরে বিভিন্ন নাম না জানা যন্ত্রাংশ আর কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় সেটার গুণগাণ বর্ণনা করছে তার কোন প্রমাণ দৃশ্যমান হলো না ল্যাংডনের চোখে।

উইনস্টন বলেই যাচ্ছে : …কিউবিট প্রতিস্থাপিত বাইনারি ডিজিট…কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম…এবার ল্যাংডন বুঝতে পারছে, কেন সবসময় এডমন্ডের সাথে দেখা হলে চিত্রকলার ব্যাপারে আলাপ করতো ওরা। এইসব কথার কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর।

…এই দুটো একদম ভিন্ন মেশিনের সহায়তায় তৈরি হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালি সুপারকম্পিউটার, অবশেষে উইনস্টন শেষ করলো বলা।

হায় ঈশ্বর! বিড়বিড় করে বলল অ্যাম্ব্রা।

আসলে, তাকে ঠিক করে দিলো উইনস্টন, এডমন্ডের ঈশ্বর।

.

অধ্যায় ৮৫

কন্সপিরেসিনেট.কম

ব্রেকিং নিউজ

কয়েক মিনিটের মধ্যে সম্প্রচারিত হবে এডমন্ড কিয়ার্শের আবিষ্কার!

হ্যাঁ! সত্যিই সম্প্রচারিত হবে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশন। এডমন্ড কিয়ার্শের ক্যাম্প থেকে কিছুক্ষণ আগে জানানো হয়েছে, বিখ্যাত ফিউচারিস্টের মৃত্যুর কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া প্রেজেন্টেশনটা বার্সেলোনার স্থানীয় সময় রাত ৩টা থেকে সম্প্রচার করা শুরু। হবে।

প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলেছে আগ্রহি অনলাইন দর্শকদের সংখ্যা।

বিভিন্ন সূত্রে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, এ মুহূর্তে তরে জিরোনা চ্যাপেলের ভেতরে অবস্থিত বার্সেলোনা সুপারকম্পিউটিং সেন্টারে অবস্থান করছেন রবার্ট ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা ভিদাল। ধারণা করা হয় সেখানেই গত কয়েক বছর ধরে কাজ করে আসছিলেন এডমন্ড কিয়াশ।

এডমন্ড কিয়ারে প্রেজেন্টেশনের লাইভ স্ট্রিম দেখতে পাবেন এখানে।

.

অধ্যায় ৮৬

বিশাল দরজাটা দিয়ে পাহাড়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর কেমন যেন একটা দমবন্ধ করা অনুভূতি হতে লাগলো হুলিয়ানের, যেন এখান থেকে আর কোনদিন বের হতে পারবেন না তিনি।

ভ্যালি অব দ্য ফলেনের মত একটা জায়গায় কী করছি আমি?

ভেতরে এখন কোন আলো না থাকায় সাথের দুটো বৈদ্যুতিক টর্চই ভরসা। দরজার এ পাশটা একদম ঠাণ্ডা, বাতাসে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব।

একজন ইউনিফর্ম পরিহিত লোক একটা চাবির গোছা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে। হাত কাঁপছে লোকটার। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ কমিটির এই সদস্যের উদ্বেগের কারণটা ধরতে পারছেন হুলিয়ান; তার পেছনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে গার্ডিয়া রিয়েলের ছয়জন এজেন্ট। আমার বাবা আছেন এখানে। নিশ্চয়ই এই বেচারাকে মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে রাজার জন্যে দরজা খোলার নিমিত্তে এখানে ডেকে আনা হয়েছ।

একজন গার্ডিয়া এজেন্ট সামনে এগিয়ে এসে বলল, প্রিন্স হুলিয়ান, বিশপ ভালদেসপিনো-আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম আমরা। আমার। সাথে আসুন দয়া করে।

গার্ডিয়া এজেন্ট একটা বিশাল রট আয়রনের তৈরি গেটের সামনে নিয়ে আসলো ওদের-যেটার গায়ে খোদাই একটি বিশাল ফ্রাঙ্কোয়িস্ট প্রতীক-নাৎসি কায়দায় তৈরি দুই মাথাওয়ালা ঈগল।

এই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আছেন মহারাজ, তাদের সামনে এগোনোর অনুরোধ করে বলল এজেন্ট।

একে অপরের দিকে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন হুলিয়ান ও ভালদেসপিনো। আশেপাশে ফ্রাঙ্কোর শাসনামলের আরও নিদর্শন শোভা পাচ্ছে যার কোনটাই সুবিধের নয়।

সুড়ঙ্গটা মাদ্রিদের প্রাসাদের বলরুমের মতই সুসজ্জিত। চকচকে কালো মার্বেলের মেঝের ওপর দিয়ে হেঁটে চললেন ওরা। সুড়ঙ্গ দেয়াল থেকে ঝুলছে সারি সারি মশালদানি। সাধারণত বড় কোন উপলক্ষ্যেই আগুন জ্বালানো হয় ওগুলোতে। তবে মাঝরাতে রাজার আগমনও নিশ্চয়ই বড় উপলক্ষ গণ্য হয়েছে, কারণ গোটা সুড়ঙ্গকে আলোকিত করে রেখেছে ওগুলোই।

সেই আগুনের শিখা প্রতিফলিত হচ্ছে চকচকে কালো মেঝেতে। পুরো ব্যাপারটায় অতিপ্রাকৃতিক একটা ব্যাপার রয়েছে। এই সুড়ঙ্গটা খুঁড়তে গিয়ে মারা গিয়েছিল যেসব শ্রমিক তাদের উপস্থিতি যেন অনুভব করতে পারছেন হুলিয়ান। অনাহারে, ঠাণ্ডায় জমে মৃত্যু হয়েছিল তাদের, শুধুমাত্র একজন মানুষের আদেশ রক্ষার জন্যে। স্বৈরাচারি শাসক ফ্রাঙ্কোর সমাধিও এই পাহাড়েই অবস্থিত।

সব ঠিকমতো খেয়াল করো হুলিয়ান, ওর বাবা বলেছিল ওকে, একদিন সব গুঁড়িয়ে দিতে হবে তোমাকে।

সিংহাসনে বসার পরেও এই স্থাপনাটা গুঁড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা যে ওর থাকবে না, সেটা এখন থেকেই ধারণা করতে পারছেন হুলিয়ান। তবে মাঝে মাঝে ও এটা ভেবে অবাক হন যে, স্পেনের মানুষজন এরকম একটা স্থাপনা এতদিন টিকে থাকতে দিয়েছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সদস্যরা যখন সর্বাত্মক চেষ্টা করে তাদের অন্ধকার অতীতকে ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে। তবে আলোর পিঠে অন্ধকারের মত, এখনও এমন অনেককে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা আগের দিনগুলোতেই ফিরে যেতে চায়। সেজন্যেই প্রতি বছর ফ্রাঙ্কোয়িস্টরা দলবেঁধে এখানে হাজির হয় তাদের নেতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণের জন্যে।

প্রিন্স হুলিয়ান, বিশপ গম্ভীর স্বরে ডাক দিলেন ওকে, পাশাপাশি হেঁটেই চলেছে ওরা এখনও। আপনি কি জানেন, আপনার বাবা কেন এখানে ডেকে পাঠিয়েছে আমাদের?

মাথা ঝাঁকালেন হুলিয়ান। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি জানবেন সেটা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভালদেসপিনো বললেন, আমি নিজেও জানি না।

যদি বিশপ ভালদেসপিনো এ সম্পর্কে কিছু না জেনে থাকেন, হুলিয়ান ভাবলেন, তবে কারোরই জানার কথা নয়।

আশা করি ঠিক আছেন তিনি, মোলায়েম কণ্ঠে বললেন বিশপ, তার আজকে রাতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো অবাক…

যেমন হাসপাতালের বদলে একটা পাহাড়ের ভেতরে দেখা করতে বলা? বিশপের কথা শেষ হবার আগেই বললেন হুলিয়ান।

তা বলতে পারেন, মৃদু হেসে বললেন ভালদেসপিনো।

হুলিয়ান এটা ভেবে পেলেন না, কেন তার বাবাকে শরীরের এরকম নাজুক অবস্থায় হাসপাতাল থেকে এখানে নিয়ে আসতে রাজি হলো গার্ডিয়া রিয়েলের এজেন্টরা। তবে এ কথাও সত্য, গার্ডিয়া এজেন্টদের প্রশিক্ষনই এমনভাবে দেয়া হয় যে, আদেশ পালনে বাধ্য তারা। বিশেষ করে আদেশদাতা যখন স্বয়ং স্পেনের রাজা।

শেষ এখানে প্রার্থনা করেছি অনেক বছর আগে, আলোকজ্বল হলওয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন ভালদেসপিনো।

যে সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ওরা সেটা যে কেবলই একটা করিডোরের প্রবেশ পথ তা নয় কিন্তু একটা ক্যাথলিক চার্চের মূল উপাসনা কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এটি। সামনে সারি সারি পিউ চোখে পড়লো প্রিন্স হুলিয়ানের।

গুপ্ত ব্যাসিলিকা, ছোটবেলায় এ নামেই ডাকতেন এটাকে।

গ্রানাইট পাহাড়ের ভেতরের এই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় বিশাল একটা ভুর্গভস্থ ব্যাসিলিকা। গুজব আছে, রোমের সেন্ট পিটারস থেকেও বেশি মানুষ একসাথে প্রার্থনা করতে পারবে এখানে।

মূল উপাসনালয়ের কাছাকাছি পৌঁছে বিশাল জায়গাটায় চোখ বোলালেন হুলিয়ান। কিন্তু স্পেনের রাজাকে কোথাও দেখতে পেলেন না তিনি। পুরো খালি জায়গাটা।

কোথায় তিনি? উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন বিশপ।

হুলিয়ান নিজেও চিন্তায় পড়ে গেছেন এখন। বাবাকে কি এখানে একা? নিজেকেই প্রশ্ন করলেন।

আরও সামনে এগিয়ে গেলেন এবার। বেদির এপাশ থেকে ওপাশে হাঁটাহাঁটি করলেন কিন্তুকাউকে দেখলেন না।

অবশেষে ব্যাসিলিকার এক কোণে বিশাল পিলারের আড়ালে বাবাকে দেখতে পেলেন হুলিয়ান। থমকে গেলেন সাথে সাথে।

স্পেনের রাজা বর্তমানে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায়, ভারি কম্বল গায়ে একটা হুইলচেয়ারে বসে আছেন।

.

অধ্যায় ৮৭

পরিত্যাক্ত চ্যাপেলটার ভেতরে উইনস্টনের কৃত্রিম কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে দুই তলা জুড়ে অবস্থিত সুপারকম্পিউটারের একপাশে এসে পৌঁছাল ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা। কাঁচের মধ্যে দিয়ে একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, ভেতরের বিশাল যন্ত্রপাতি যে প্রতি মুহূর্তে জেগে আছে তার প্রমাণ। ল্যাংডনের মনে হলো যেন কোন ঘুমন্ত দৈত্যের দিকে তাকাচ্ছে ও।

উইনস্টনের ভাষ্যমতে এই শব্দগুলো মূলত সুপারকম্পিউটারের যন্ত্রপাতি ঠাণ্ডা রাখার কাজে ব্যবহৃত কুল্যান্ট পাম্প, সেন্ট্রিফিউগাল ফ্যান এবং হিট সিঙ্কগুলো থেকে নির্গত হচ্ছে।

ভেতরে শব্দে টেকা যায় না, উইনস্টন বলল। সৌভাগ্যবশত এডমন্ডের ল্যাবটা দোতলায়।

কাঁচের বহিরাবরণের গা ঘেঁষে একটা প্যাঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। উইনস্টনের নির্দেশানুযায়ী সেটা বেয়ে ওপরে উঠে নিজেদের একটা ধাতব প্ল্যাটফর্মে আবিষ্কার করলো ওরা। সামনে একটা কাঁচের রিভভিং ডোর।

মফস্বলের ছোট ছোট বাড়িগুলোর সদর দরজা যেভাবে সাজানো হয়, এডমন্ডের ল্যাবের দরজাটাও সেভাবেই সাজানো। একটা ওয়েলকাম ম্যাট, কৃত্রিম গাছ এবং একটা ছোট বেঞ্চের নিচে বাসায় পায়ে দেয়ার স্লিপার। ওটা নিশ্চয়ই এডমন্ডের, ভাবলো ল্যাংডন।

দরজার ওপরে একটা বার্তা ঝুলতে দেখা যাচ্ছে :

একের পর এক ব্যর্থতার পরও কোন উদ্যম না হারিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই সফলতা।
–উইনস্টন চার্চিল

আবারো চার্চিলের বাণী, অ্যাম্ব্রাকে লেখাটা দেখিয়ে বলল ল্যাংডন।

এডমন্ডের সবচেয়ে পছন্দের উক্তি, উইনস্টন জানালো ওদের। ওর মতে বাক্যটা কম্পিউটারের সবচেয়ে ভালো গুণটার যথার্থ উপস্থাপন।

কম্পিউটারের? জিজ্ঞেস করলো, অ্যাম্ব্রা।

হ্যাঁ, একটা কম্পিউটার কখনও হাল ছেড়ে দেয় না। কোনকিছুতে ব্যর্থ হলে হতাশও হয়ে পড়ে না, বরং সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত একই উৎসাহে কাজ করে যেতে থাকে। মানুষের ক্ষেত্রে এই কথাটা খাটে না।

ঠিক, ল্যাংডন স্বীকার করে নিলো, বড়জোর এক লাখ বার চেষ্টা করে দেখি আমি।

হেসে উঠে দরজাটার দিকে হেঁটে গেল অ্যাম্ব্রা।

ভেতরের মেঝেও কাঁচের তৈরি, রিভলিভং ডোরটা আপনা আপনি ঘুরতে শুরু করলে বলে উঠলো উইনস্টন, তাই দয়া করে জুতো খুলে নিন।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পায়ের জুতো খুলে খালিপায়ে রিভলিভং ডোরটা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো অ্যাম্ব্রা। তাকে অনুসরণ করলে ল্যাংডন। এডমন্ডের ওয়েলকাম ম্যাটে একটা অদ্ভুত বার্তা চোখে পড়লো ওর :

THERES NO PLACE LIKE 127.0.0.1

উইনস্টন, এই ম্যাটের লেখাটা বুঝতে পারছি না আ-

হোস্ট সার্ভার, জবাবে বলল উইনস্টন।

আবারো লেখাটা পড়লো ল্যাংডন। ওহ, উইনস্টন কু বোঝাতে চাইলো সেটা না বুঝেই বলল সে।

কাঁচের মেঝেটায় পা রেখেই একটু ভয় ভয় লাগতে লাগলো ল্যাংডনের। এরকম জায়গায় দাঁড়ালে যে কারোরই ভয় লাগার কথা, উপরন্তু নিচের মেয়ার-নস্ট্রাম সুপারকম্পিউটারের কলকজাগুলো সেই ভীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে। ওপর থেকে দৃশ্যটা দেখে ল্যাংডনের চায়নার বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক স্পট জিয়ান পিট-এর কথা মনে পড়ে গেল। যেখানে সারিতে সারিতে দাঁড়িয়ে আছে পোড়ামাটির তৈরি সৈনিকের দল।

জোরে একবার শ্বাস নিয়ে সামনের অদ্ভুত দৃশ্যের দিকে চোখ দিলো। ল্যাংডন।

এডমন্ডের ল্যাবটা মূলত আয়তাকার একটা কাঁচের ঘর, যেটার ভেতরে অবস্থান করছে কিছুক্ষণ আগে দেখা নীলাভ বর্ণের ধাতব কিউবটা। সেটায় প্রতিফলিত হচ্ছে আশপাশের সবকিছু। কিউবটার ডানপাশে ঘরের এক কোণায় একটা অত্যাধুনিক সাজানো গোছানো অফিস। ওখানে শোভা পাচ্ছে একটা অর্ধবৃত্তাকার ডেস্ক, তিনটা বিশাল এলসিডি স্ক্রিন এবং কিবোর্ড।

এখান থেকেই নিশ্চয়ই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়, ফিসফিসিয়ে বলল অ্যাম্রা।

ঘরটার অন্যপাশে একটা আর্মচেয়ার, একটা কাউচ এবং একটা ব্যায়াম করার সাইকেল সাজানো দামি কার্পেটের ওপর।

প্রজেক্টে কাজ করার সময় নিশ্চয়ই এখানেই এসে থাকতো এডমন্ড, মনে মনে ভাবলো ল্যাংডন। কী আবিষ্কার করেছিল সে এখানে? নিজেকেই প্রশ্নটা করলো সে। এখন ধীরে ধীরে কৌতূহল বাড়ছে ওর। এত শক্তিশালি একটা মেশিন এবং ওরকম তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন একটা মগজ যখন একসাথে কাজ করেছে তখন বিস্ময়কর কিছু আশা করা যেতেই পারে।

অ্যাম্ব্রা ইতিমধ্যে কিউবটার কাছে হেঁটে গিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ওটার নীলাভ বহির্ভাগের দিকে। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ল্যাংডন। দুজনের প্রতিবিম্বই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে সেখানে।

এটা একটা কম্পিউটার? ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবলো। নিচের মেশিনটার তুলনায় এটা একদম বিপরীত। কোন শব্দ নেই। নীল রঙের কিউবটা দেখে ৯০ দশকের ডিপ ব্লু নামের একটা সুপার কম্পিউটারের কথা মনে পড়ে গেল ল্যাংডনের। তৎকালীন দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি ক্যাসপারভকে হারিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল সেটা।

ভেতরটা দেখতে চান? ওপরের স্পিকার থেকে উইনস্টনের স্বর ভেসে এলো।

কিউবের ভেতরটা? সেটা সম্ভব? ওপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা।

কেন সম্ভব হবে না? পাল্টা প্রশ্ন করলো উইনস্টন। এডমন্ড থাকলে খুশি মনেই দেখাতো আপনাদের।

থাক, অ্যাম্ব্রা বলল। তারচেয়ে বরং প্রেজেন্টেশন লঞ্চিংয়ের প্রতি মনোযোগী হই আমরা। কিভাবে করতে হবে সেটা?

ওটা তো মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। আর আমাদের হাতে এখনও এগারো মিনিট আছে। একবার দেখুন ভেতরটা।

কিউবের একপাশের প্যানেল খুলে যেতে শুরু করলো আপনাআপনি। ভেতরে মোটা কাঁচ। সেটার গায়ে কপাল ঠেকিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা।

ল্যাংডন ভেবেছিলো ওকে হয়তো আবারও একগুচ্ছ তার এবং লাল নীল আলো দেখতে হবে, নিচের মেশিনগুলোর মতনই। কিন্তু ওরকম কিছুই নেই ভেতরে। বরং অবাক হয়ে খেয়াল করলো, কিউবের ভেতরটা প্রায় ফাঁকা এবং অন্ধকার। শুধুমাত্র একটা পাক খেতে থাকা সাদা ধোঁয়ার কুন্ডলি, যেমনটা দেখা যায় কোন হিমাগারে।

এখানে তো কিছুই নেই, বলল অ্যাম্ব্রা।

ল্যাংডনও কিছু দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু একটা মৃদু কম্পন অনুভব করতে পারছে। মনে হচ্ছে যেন কিউবের ভেতরেই সেই কম্পনের উৎপত্তিস্থল।

থেকে থেকে একটা স্পন্দন অনুভব করছেন না? উইনস্টন বলল, ওটা হচ্ছে পাস টিউব ডাইলুশন রেফ্রিজারেশন সিস্টেম। মানুষের হৃৎস্পন্দনের সাথে মিল আছে শব্দটার।

আসলেই, মনে মনে ভাবলো ল্যাংডন। একটা যন্ত্রকে মানুষের হৃৎপিণ্ডের সাথে তুলনা করার উপমাটা যদিও একটু অস্বস্তিকর ঠেকলো ওর কাছে।

ধীরে ধীরে লাল রঙের আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকলো কিউবের ভেতরে। প্রথমে শুধু সাদা ধোঁয়া এবং নিচের খালি জায়গাটা চোখে পড়লো ল্যাংডনের। এরপর, আলোর ঔজ্জ্বল্য বাড়লে কিছু একটা ভেসে থাকতে দেখলো মেঝের ওপরে। একটা জটিল নক্সার ধাতব সিলিন্ডার ছাদ থেকে ঝুলছে।

আর এটাকেই, উইনস্টন বলল, ঠাণ্ডা রাখছে কিউবটা।

ছাদ থেকে ঝুলে থাকা সিলিন্ডার সদৃশ যন্ত্রটা প্রায় পাঁচ ফিট লম্বা। ওটার চারদিকে সাতটা রিং, যেগুলো ওপর থেকে নিচে ছোট হয়ে এসেছে ক্রমশ। সেগুলো ভেতরে আবার সূক্ষ তারের কুন্ডলি পেঁচিয়ে রেখেছে কতগুলো ধাতব দন্ডকে। আর সবকিছু ঘিরে আছে হিমায়ক ধোয়ার কুন্ডলি।

ই-ওয়েভ, ঘোষণা করার শুরে বলল উইনস্টন, নাসা আর গুগলের ডি ওয়েভের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালি।

এরপর উইনস্টন ব্যাখ্যা করে বলল যে ডি-ওয়েভের নির্মাতারা দাবি করে সেটা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বপ্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটার। ওটার ক্ষমতা এতই বেশি যে, বিজ্ঞানীরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সবকিছু ঠিকমতো অনুধাবন করতে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার হচ্ছে এমন একটা কম্পিউটার যেটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিভিন্ন ধর্মকে সরাসরি কাজে লাগিয়ে সব সমস্যার সমাধান করে। প্রচলিত বা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে ডাটা প্রসেস করা হয় বাইটের আকারে। বাইট হলো তথ্যের একক ইউনিট। প্রতিটি বাইট একই সময় হয় ১ হতে পারে নয়ত হতে পারে ০। ক্লাসিক্যাল বাইটের যে কোন বিশাল সংগ্রহের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। এটাই হলো ডিজিটাল কম্পিউটেশনের ভিত্তি। কাজেই ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারকে কোন প্রশ্ন করা হলে তাকে উত্তর খোঁজার জন্য সুশঙ্খলভাবে অ্যালগরিদম অনুসরণ করে অগ্রসর হতে হয়। অন্যদিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলে কোয়ান্টাম বাইটে বা কিউবাইটে। সুপারপজিশন বা উপরিপাতনের সূত্রের বদৌলতে এর বাইটগুলো হতে পারে একই সঙ্গে ১ বা ০ এবং ১ ও ০। সুপারপোজড অবস্থায় একটা কোয়ান্টাম বাইট দুটি সমান সম্ভাবনা হিসাবে অস্তিত্বমান। একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে এই কম্পিউটার একই সঙ্গে দুটি লেভেলে কাজ করে, একটাতে ১, আরেকটাতে ০। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং হলো প্রথম প্রযুক্তি যেখানে দুটি সমান্তরাল দৃশ্যকল্পের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে কোন দরকারি কাজ সম্পাদন করা যায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত ও অসম্ভব মনে হতে পারে, তথাপি তা অবিশ্বাস্য রকমের কাজের। যদি কোন কোয়ান্টাম বাইট একই সঙ্গে বা সময়ে দুই অবস্থায় থাকতে পারে তাহলে একই সঙ্গে সেটি দুটি হিসাব সম্পাদন করতে পারে। দুটি কোয়ান্টাম বাইট একই সঙ্গে চারটি হিসাব, তিনটি কোয়ান্টাম বাইট নয়টি হিসাব করতে পারে। এইভাবে কোয়ান্টাম বাইটের সংখ্যা যত বাড়ে এর হিসাব করার ক্ষমতা তত অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে যায়। কোয়ান্টাম। কম্পিউটারের ডাটা যেহেতু একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে তাই এটা একাধিক কাজ এক এক করে না করে একই সঙ্গে করতে পারে। এই কম্পিউটারে এমন অনেক কাজ করা যায় যেগুলো সাধারণ কম্পিউটারে করা যায় না। যেমন পলিনমিয়াল টাইমে প্রাইম ফ্যাক্টরাইজেশন বা লিনিয়ার সার্চের কমপ্লিক্সিটি স্কয়ার রুট-এ নামিয়ে নিয়ে আসা, রাসায়নিক বিক্রিয়া সিমুলেট করা, ইত্যাদি।

উইনস্টনের এতক্ষণ বলে যাওয়া কথাগুলোর মধ্যে খুব কমই বুঝতে পারলো ল্যাংডন, তবুও মাথা নাড়তে লাগলো ওপর নিচে। এডমন্ডের কোয়ান্টাম কম্পিউটারটা, উইনস্টন বলল, গঠনগত দিক দিয়ে ডি-ওয়েভ থেকে অতটা ভিন্ন নয়। একমাত্র পার্থক্যটা হচ্ছে ওটাকে ঘিরে থাকা কিউবটা। কিউবের গা জুড়ে আছে অসমিয়াম-একটি বিরল ধাতুর আবরণ। এতে করে ভেতরের কম্পিউটারটার তাপ, হিম এবং চৌম্বকীয় সুরক্ষা বেড়ে যায় অনেকগুণে। তাছাড়া, এটা এডমন্ডের ব্যতিক্রমী চিন্তাধারারও একটা নিদর্শন বলতে পারেন।

হাসলো ল্যাংডন, বরাবরই নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবতে পছন্দ করতো এডমন্ড।

গত কয়েক বছর ধরে গুগলের কোয়ান্টাম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাব ডি-ওয়েভের মত কম্পিউটার ব্যবহার করে মেশিন লার্নিং-এর ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে আসছে, কিন্তু এডমন্ড এই গোপন প্রজেক্টের সহায়তায় ইতোমধ্যেই তাদের চেয়ে অনেক দূরে চলে এসেছিল। আর সেটা সম্ভব হয়েছে। কেবলমাত্র তার একটা সাহসি পদক্ষেপের জন্যে…এটুকু বলে নাটকীয় ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ থামলো উইনস্টন, বাইক্যামেরালিজম।

ভ্রু কুঁচকে গেল ল্যাংডনের। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের কথা বলছে নাকি?

মস্তিষ্কে মানুষের চিন্তার রাজ্য যেমন দুই ভাগে বিভক্ত, উইনস্টন, বাম হেমিস্ফিয়ার এবং ডান হেমিস্ফিয়ার।

এবারে বুঝতে পারছে ল্যাংডন। মানুষের ক্ষুরধার সৃজনশীলতার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ তার মস্তিষ্কের দুই ভাগের ভিন্ন ভিন্ন কাজের ধর্ম। বাম গোলার্ধের কাজ-যুক্তি, বিশ্লেষণমূলক আর যাচাইমূলক চিন্তা নিয়ন্ত্রণ আর ডান গোলার্ধের কাজ-নক্সা সনাক্তকরণ, অনুমান, সংবেদনশীলতা এবং সৃজনশীলতা।

এডমন্ড যে কৌশলটা অবলম্বন করেছে সেটা হলো, উইনস্টন বলেই চলেছে লেকচারের ভঙ্গিতে, মানব মস্তিষ্কের অনুরূপ একটা কৃত্রিম যান্ত্রিক মস্তিষ্ক তৈরি করা, যেটা ডান হেমিস্ফিয়ার এবং বাম হেমিস্ফিয়ারে বিভক্ত। অবশ্য এখানে সেটাকে আপনারা ওপরতলা এবং নিচতলা হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন।

কিউবটার থেকে পেছনে সরে এসে স্বচ্ছ মেঝের মধ্য দিয়ে নিচের বিশাল যন্ত্রাংশের দিকে তাকালো ল্যাংডন, এরপর নজর দিলো কিউবের ভেতরে সিলিন্ডার সদশ যন্ত্রটার দিকে। দুটো আলাদা আলাদা যন্ত্রের একীভবন করে। মানব মস্তিষ্কের রূপ দেয়া হয়েছে।

এই দুটো যন্ত্রকে যখন একসাথে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, উইনস্টন বলল, তখন একই সমস্যার সমাধানে দুইভাবে এগোয় তারা। মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরে যেমন দুই হেমিস্ফিয়ারের দ্বন্দ্বের মাধ্যমে কাজ এগোয়, এখানেও ঠিক তেমনটাই হয়। এতে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৃদ্ধির সাথে সাথে সম্মিলিত যন্ত্রটার সৃজনশীলতা এবং এক অর্থে একজন মানুষ কিভাবে চিন্তা করবে সেটার অনুধাবন ক্ষমতাও বেড়ে গিয়েছে। আমার ক্ষেত্রে বাড়তি উপকরণ হিসেবে এডমন্ড এমন কিছু প্রোগ্রাম যোগ করেছে যাতে গোটা। জগতটা নেটওয়ার্কের সহায়তায় নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারি আমি। যেমন কোনটা ভালো কোনটা খারাপ, নৈতিক চিন্তাভাবনা, কৌতুক বুঝতে পারা-এসব।

অবিশ্বাস্য! ল্যাংডন ভাবলো, তাহলে এই দ্বৈত কম্পিউটারটা আসলে…তুমি?

হেসে উঠলো উইনস্টন। শুধু আপনার মস্তিষ্কটা কোন পাত্রে রেখে বাইরে থেকে যদি পর্যবেক্ষণ করা হয়, সেটা কি আপনি হবেন? সে অর্থে বলতে পারেন, এই ওপরতলা এবং নিচতলা মিলিয়ে আমার মস্তিষ্কটাকে দেখছেন আপনারা। আমি আর আপনি হচ্ছি মস্তিষ্কের ভেতরে সংগঠিত ক্রিয়াকলাপের ফসল।

উইনস্টন, একটু অধৈৰ্য্য মনে হলো অ্যাম্ব্রাকে, আর কতক্ষন সময় আছে?

পাঁচ মিনিট তেয়াল্লিশ সেকেন্ড, জবাব দিলো উইনস্টন, আমরা কি প্রস্তুতি নেয়া শুরু করবো?

হ্যাঁ, সাথে সাথে বলল অ্যাম্ব্রা।

কিউবের প্যানেলটা আবার আগের জায়গার বসে গেল। অ্যাম্ব্রার পেছন পেছন এডমন্ডের কাজের জায়গায় চলে আসলো ল্যাংডন।

উইনস্টন, বলল অ্যাম্ব্রা, তুমি এখানে এডমন্ডের সাথে এতদিন ধরে কাজ করার পরেও যে ওর আবিষ্কারটা সম্পর্কে কিছু জানো না সেটা অবাক করছে আমাকে।

আপনারা এখন পর্যন্ত যা জানেন, কেবল সেটুকুই জানি আমি, বলল উইনস্টন, তবে কিছুটা আঁচ করতে পারছি বোধহয়।

কী সেটা? এডমন্ডের অফিসে একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা।

এডমন্ড দাবি করেছিল, সে এমন কিছু আবিষ্কার করেছে যেটা বদলে দেবে সবকিছু। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পৃথিবীতে এরকম যত আবিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে তার প্রত্যেকটাই কিন্তু আমাদের বিশ্বকে নতুনভাবে চিনতে শিখিয়েছে। যেমন পিথাগোরাসের সমতল পৃথিবীর ধারণা প্রত্যাখান করা, কোপার্নিকাসের সূর্যকে ঘিরে সব গ্রহের আবর্তনের দাবি, ডারউইনের বিবর্তনবাদ, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব।

ওপরের স্পিকারের দিকে মাথা তুলে তাকালো ল্যাংডন। তোমার ধারণা এডমন্ড এমন কিছু আবিষ্কার করেছে, গোটা বিশ্বকে নতুনভাবে দেখতে বাধ্য করবে সবাইকে?

যুক্তি তেমনটাই বলছে, উইনস্টন জবাব দিলো, মেয়ার-নস্ট্রামকে ধরা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকর মডেলিং কম্পিউটারগুলোর একটা, জটিল সব মডেল তৈরি করতে সক্ষম সে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো আলিয়া রেড-যেটা মূলত মানব হৃৎপিণ্ডের একটি ভার্চুয়াল প্রতিরূপ। অবশ্য মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চেয়েও অনেক সূক্ষ এবং জটিল নক্সার মডেল তৈরি করতে পারে মেয়ার-নাম। আর বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং যুক্ত হওয়াতে সেই ক্ষমতা বেড়ে গেছে কয়েক হাজার গুণ।

উইনস্টন কী বোঝাতে চাচ্ছে তা কিছুটা ধরতে পারছে ল্যাংডন। তবুও এটা বোধগম্য হলো না যে, কী এমন মডেল তৈরি করেছে এডমন্ড যেটা উত্তর দেবে-এলেম আমরা কোথা থেকে? যাচ্ছিই বা কোথায়?-এই প্রশ্ন দুটির।

উইনস্টন, এডমন্ডের ডেস্কের সামনে থেকে ডাক দিলো অ্যাম্ব্রা, এসব চালু করবো কিভাবে?

তিনটা এলসিডি স্ক্রিনই একসাথে জ্বলে উঠলো সাথে সাথে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা।

উইনস্টন…এখানে যা দেখানো হচ্ছে…ওগুলো কি এখনকার ছবি? অ্যাম্ব্রা জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, এখানকার সিকিউরিটি ক্যামেরার ফিডগুলো দেখতে পাচ্ছেন আপনারা। আপনাদের সতর্ক করার জন্যেই দেখালাম। বেশ কিছুক্ষণ আগে এসেছে তারা।

স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে চ্যাপেলের মূল প্রবেশ পথের বাইরে পুলিশের বেশ কয়েকটা গাড়ি এসে জড়ো হয়েছে। এ মুহূর্তে কল বাটনে চাপ দিয়ে ভেতরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে পুলিশ সদস্যরা।

চিন্তা করবেন না, উইনস্টন আশ্বস্ত করলো ওদের, ভেতরে ঢুকতে পারবে না কেউ। তাছাড়া প্রেজেন্টেশনটা লঞ্চ করতে আমাদের আর মাত্র চার মিনিট লাগবে।

এখনই সেটা লঞ্চ করে দেয়া উচিত আমাদের, অ্যাম্ব্রা বলল।

আমার বিশ্বাস এডমন্ড একদম ঘন্টার শুরুতেই সেটা লঞ্চ করার পক্ষপাতি হতো, উইনস্টন বলল, কারণ কথার বরখেলাপ পছন্দ ছিল না ওর। তাছাড়া আমি হিসেব রাখছি, এই মুহূর্তে বিশ্বের কতজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারি প্রেজেন্টেশনটা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছেন। প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে সেই সংখ্যা। এই হারে বাড়তে থাকলে আগামী চার মিনিটে ১২.৭ শতাংশ বেড়ে যাবে দর্শক সংখ্যা, কিছুক্ষণের জন্যে থামলো উইনস্টন, আজ রাতে এত ঝামেলার পরেও এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা একদম সঠিক সময়ে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। বেঁচে থাকলে আপনাদের প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞতা বোধ করতো ও।

.

অধ্যায় ৮৮

আর চার মিনিট, এডমন্ডের ডেস্কের সামনে বসতে বসতে ভাবলো ল্যাংডন। ওর দৃষ্টি এখন ঘরের এই দিককার বিশাল তিনটা এলসিডি প্যানেলের দিকে। সেখানে এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে, বাইরে পুলিশের লোকজন ক্রমশই অধৈর্য হয়ে উঠছে।

তুমি কি নিশ্চিত, ওরা ভেতরে ঢুকতে পারবে না? উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা। ল্যাংডনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সে।

ভরসা রাখুন, বলল উইনস্টন। নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিয়ে সবসময় অতিরিক্ত সচেতন ছিল এডমন্ড।

তারা যদি বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়? ল্যাংডন করলো প্রশ্নটা।

জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা আছে, আত্মবিশ্বাসি কণ্ঠে জবাব দিলো উইনস্টন, কেউ সমস্যার সৃষ্টি করতে পারবে না এই পর্যায়ে এসে। আপনাদের আশ্বস্ত করছি আমি।

ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাটালো না ল্যাংডন। আজ রাতে উইনস্টন একটাও ভুল কথা বলেনি এই পর্যন্ত। এ ব্যাপারেও নিশ্চয়ই জেনে শুনেই বলছে।

ঘোড়ার খুরাকৃতির ডেস্কটাতে বসে তার সামনে রাখা অদ্ভুত কিবোর্ডটার প্রতি দৃষ্টি দিলো এবার ল্যাংডন। গতানুগতিক কিবোর্ডের চেয়ে দ্বিগুণ বাটন দেখা যাচ্ছে এটায়। অক্ষর আর সংখ্যার পাশাপাশি এমন কিছু সংকেত দেখা যাচ্ছে যেগুলো সে নিজে সিম্বলজিস্ট হয়েও চিনতে পারলো না। কিবোর্ডটা আবার দুই ভাগে বিভক্ত।

একটু সাহায্য করতে হবে যে, ল্যাংডন অদ্ভুত বাটনগুলোর দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল।

ভুল কিবোর্ডের সামনে বসেছেন আপনি, উইনস্টন জবাব দিলো। এটা হচ্ছে ই-ওয়েভের মূল অ্যাকসেস পয়েন্ট। যেমনটা আপনাদের আগেই বলেছি আমি, এডমন্ড ওর প্রেজেন্টেশনটা সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলো, আমার কাছ থেকেও। অন্য একটা কম্পিউটার থেকে প্রেজেন্টেশনটা লঞ্চ করতে হবে। ডানদিকে একদম কিনারায় চলে যান।

ডানদিকে তাকিয়ে অনেকগুলো স্পিউটার চোখে পড়লো ল্যাংডনের। চেয়ার নিয়ে ওগুলোর কাছে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বেশ কয়েকটা কম্পিউটার একদম পুরনো মডেলের। যতই ডানে যাচ্ছে মডেল ততই পুরনো হচ্ছে।

এটা এখানে কেন, একটা পুরনো ওইগ DOS সিস্টেমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চিন্তা করলো ল্যাংডন। উইনস্টন, এগুলো কি?

এডমন্ডের ছোটবেলার কম্পিউটার, উইনস্টন জবাব দিলো। পুরনো স্মৃতি রোমন্থনের জন্যে এগুলো এখানে রেখে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে এগুলোর যেকোন একটা চালু করে পুরনো প্রোগ্রামগুলো ঘাটতেন। ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতেন প্রোগ্রামিংয়ে আগ্রহি হয়ে ওঠার দিনগুলোতে।

বাহ, ভালো লাগলো শুনে, ল্যাংডন বলল।

একদম আপনার মিকি মাউস ঘড়িটার মতন, উইনস্টন বলল।

অবাক হয়ে স্যুট জ্যাকেটের আস্তিনটা তুলে পুরনো হাতঘড়িটার দিকে তাকালো একবার ল্যাংডন। একদম ছোটকাল থেকে ওর সঙ্গি এই ঘড়িটা। উইনস্টন এই তথ্যটা জানে দেখে বেশ অবাকই হলো ল্যাংডন, অবশ্য এডমন্ডের সাথে একবার এ ব্যাপারে আলাপ করেছিল সে।

রবার্ট, অ্যাম্ব্রা বলল অধৈর্য কণ্ঠে, আমরা কি এবার কাজ শুরু করতে পারি? দেখুন আপনার ঘড়ির ইঁদুরটাও হাত নেড়ে তাড়া দিচ্ছ।

আসলেও মিকি মাউসের হাতটা এখন তার মাথার ওপরে নির্দেশ করছে। পরবর্তি ঘন্টা শুরু হতে আর তিনি মিনিট বাকি।

দ্রুত ডেস্কটার একদম কোণায় চলে আসলো ল্যাংডন। এখানকার কম্পিউটারটা ওর দেখা সবচেয়ে পুরনো মডেলের কম্পিউটারগুলোর একটা। ফ্লপি ডিস্ক এবং টেলিফোন মডেম এবং বারো ইঞ্চির মনিটরসমেত কম্পিউটারটা জাদুঘরেই ভালো মানাতো।

Tandy TRS-80, উইনস্টন বলল। এডমন্ডের প্রথম কম্পিউটার, সেকেন্ডহ্যান্ড কিনেছিলেন এটা। এরপর নিজের চেষ্টায় BASIC শিখেছিলেন আট বছর বয়সে।

আদ্যিকালের এই কম্পিউটারটাও চালু অবস্থায় দেখে খুশিই হলো ল্যাংডন। সাদা কালো মনিটরের ডিসপ্লেতে একটা বক্স দেখা যাচ্ছে। যেখানে বিটম্যাপ ফন্টে লেখা :

WELCOME, EDMOND.
PLEASE ENTER PASSWORD:

পাসওয়ার্ড শব্দটার পরে একটা কালো রঙের কার্সর টিপটিপ করছে।

এখানে পাসওয়ার্ডটা লিখলেই হয়ে যাবে? কাজটাকে বেশি সহজ মনে হচ্ছে ল্যাংডনের কাছে।

হ্যাঁ, উইনস্টন জবাব দিলো। একবার পাসওয়ার্ডটা দিলেই এই পিসি থেকে একটা স্বয়ংক্রিয় বার্তা চলে যাবে মূল কম্পিউটারে, যেখানে সংরক্ষিত অবস্থায় আছে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা। তখন সেটাকে অ্যাকসেস করতে পারবো আমি। এরপর শুধু ডাটাগুলো ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলগুলোতে ছড়িয়ে দিতে হবে ঘন্টার একদম শুরুতে, ব্যস।

উইনস্টনের বলা কথাগুলোর মূলভাবটা ধরতে পারলো ল্যাংডন। তবুও বিভ্রান্তি কাটলো না, আমি বুঝছি না, আজকের রাতটা নিয়ে এত পরিকল্পনার পর, ও এরকম একটা আদ্যিকালের কম্পিউটার আর টেলিফোন মডেমের সহায়তায় প্রেজেন্টেশনটা লঞ্চ করতো?

একমাত্র এডমন্ডের পক্ষেই এমনটা সম্ভব, বলল উইস্টোন। নিজের ব্যবহার করা প্রথম কম্পিউটার দিয়ে তার জীবনের সেরা কাজটা উন্মোচন করতে চলেছিল সে, ব্যাপারটা নিয়ে অনেক খুশিও ছিল, তার কৃত্রিম কণ্ঠে হাসির আভাস।

এডমন্ডের স্বভাবের সাথে ব্যাপারটা যায়, ভাবলো ল্যাংডন।

অবশ্য, উইনস্টন বলল, জরুরি অবস্থার জন্যে নিশ্চয়ই অন্য কোন পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন এডমন্ড। তবুও আমি বলবো, এরকম সহজ একটা কাজের জন্যে সহজ পদ্ধতিই অবলম্বনের পেছনে যুক্তি আছে। তাছাড়া এই আদ্যিকালের ধীরগতির প্রসেসরসম্পন্ন কম্পিউটারটা হ্যাক করতেও অনেক বেশি সময় লাগবে।

রবার্ট, তার কাঁধে হাত রেখে তাড়া দেয়ার ভঙ্গিতে বলল অ্যাম্ব্রা।

এইতো তৈরি আমি, পুরনো কম্পিউটারের কিবোর্ডটা টেনে নিয়ে বলল ল্যাংডন। ওটার পেছন থেকে যে তারটা বেরিয়ে গিয়েছে সেটা ল্যান্ডফোনের তারের মতনই পেঁচানো। কিবোর্ডের হাত রেখে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার ভূগর্ভস্থ ক্রিপ্টে ওদের আবিষ্কার করা হাতে লেখা কবিতার পংক্তিটার কথা চিন্তা করলো ল্যাংডন।

The dark religions are departed & sweet science reigns.

পাসওয়ার্ড হিসেবে উইলিয়াম ব্লেকের বিখ্যাত কবিতার শেষ পঙক্তিটা একদম সঠিক পছন্দ মনে হচ্ছে ওর কাছে। বিশেষ করে এমন একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উন্মুক্ত করার জন্যে, যেটা নাকি বদলে দেবে সবকিছু।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে পাসওয়ার্ডটা যথাস্থানে কোন স্পেস ছাড়াই লিখে দিলো ও। অ্যাম্পারস্যান্ড প্রতীকটার জায়গায় লিখলো et.

শেষ করে স্ক্রিনের দিকে তাকালো ও।

PLEASE ENTER PASSWORD:

……………….. ………………………

বিন্দুগুলো গুণে দেখলো-সাতচল্লিশটা।

সব ঠিকঠাক।

অ্যাম্ব্রার দিকে একবার তাকালো ল্যাংডন, আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো সে। আর অপেক্ষা না করে এন্টার বাটনে চাপ দিলো।

সাথে সাথে বি জাতীয় একটা আওয়াজ শুনতে পেলো।

INCORRECT PASSWORD.
TRY AGAIN.

ঘামতে শুরু করলো ল্যাংডন।

অ্যাম্ব্রা-সবকিছু একদম ঠিকঠাকই টাইপ করেছি আমি! চেয়ার ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল ও, ভেবেছিল, অ্যাম্ব্রার চেহারাতেও আতংকের ছাপ দেখতে পাবে।

কিন্তু মুখে হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে স্পেনের হবু রাণী।

প্রফেসরসাহেব, কিবোর্ডের দিকে দেখিয়ে বলল সে, ক্যান্স লক চালু করে রেখেছেন!

*

ঠিক সেই মুহূর্তে পাহাড়ের একদম ভেতরের ব্যাসিলিকায় একদম বিস্মিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন প্রিন্স হুলিয়ান। সামনের দৃশ্যটা অপার্থিব লাগছে তার কাছে। ওর বাবা, স্পেনের মহারাজ, ব্যাসিলিকার একদম বিচ্ছিন্ন এক কোণে স্থাণু ভঙ্গিতে হুইলচেয়ারের ওপর বসে আছেন।

একটা ভয় দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে ভেতর থেকে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ডেকে উঠলেন, বাবা?

তার কাছে হেঁটে গেলেন হুলিয়ান। ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ খুললেন রাজা, যেন সদ্য ঘুম ভাঙলো। স্বস্তির একটা হাসি ফুটলো তার চেহারায়। এখানে আসার জন্যে ধন্যবাদ বাবা, ওকে বললেন তিনি।

হুইলচেয়ারের সামনে হাঁটুগেড়ে বসলেন হুলিয়ান। তার বাবা এখনও জীবিত আছেন এটা দেখে যেমন স্বস্তিবোধ করছেন। বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন, গত কয়েকদিনে শরীর আরও ভেঙে পড়েছে তার। বাবা? কেমন আছেন?

একবার কাঁধ ঝাঁকালেন রাজা, এই অবস্থায় যতটা ভালো থাকা যায়, হেসে বললেন তিনি। তুমি কেমন আছে, সেটা বলো। আজকের দিনটা তো বেশ…ঘটনাবহুল।

আপনি এখানে কী করছেন? কী জবাব দেবেন ভেবে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন হুলিয়ান।

হাসপাতালে থাকতে আর ভালো লাগছিলো না।

তাই বলে এখানে? হুলিয়ান ভালো করেই জানেন ওর বাবা এই জায়গাটা একদমই পছন্দ করেন না।

মহারাজ! দ্রুত বেদির অন্য পাশ থেকে ওদের পাশে এসে হাঁপানো কণ্ঠে ডেকে উঠলেন বিশপ ভালদেসপিনো।

পুরনো বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দূর্বল একটা হাসি দিলেন রাজা। তুমিও এসেছো, আন্তোনিও।

আন্তোনিও? এর আগে কখনও বিশপ ভালদেসপিনোকে এই নামে ডাকতে শোনেননি হুলিয়ান।

রাজার এরকম আন্তরিক সম্ভাষণে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন বিশপ, জি…আপনি ঠিক আছেন?

একদম, চওড়া হাসি ফুটলো এবার রাজার চেহারায়, আমার সবচেয়ে পছন্দের দু-জন মানুষের সংস্পর্শে আছি এখন, ভালো থাকবো না কেন?

চোখে বিস্ময় নিয়ে হুলিয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার রাজার দিকে ফিরলেন বিশপ ভালদেসপিনো, মহারাজ, আপনি যেমনটা চেয়েছিলেন-আপনার ছেলেকে নিয়ে এসেছি আমি। এখন তাহলে আমি বিদায় নেই, আপনারা কথা বলুন?

না, আন্তোনিও, রাজা বললেন, আমি যা বলতে চলেছি সেটাকে একটা স্বীকারোক্তি বলা চলে। তাই আমার পাদ্রিকে আমার পাশে দরকার এখন।

মাথা ঝাঁকালেন ভালদেসপিনো, আমার মনে হয় না আপনাকে আজ রাতের সিদ্ধান্তগুলোর জন্যে কোন কৈফিয়ত দিতে হবে রাজপুত্রের সামনে। তিনি নিশ্চয়ই।

আজ রাতের? রাজা হেসে উঠলেন, না, আন্তোনিও। এমন একটা গোপন কথা বলতে চলেছি আমি যেটা সারাজীবন হুলিয়ানের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম।

.

অধ্যায় ৮৯

কন্সপিরেসিনেট.কম

ব্রেকিং নিউজ

চার্চে আক্রমণ

না, এডমন্ড কিয়ার্শ নয়-স্প্যানিশ পুলিশ আক্রমন চালিয়েছে চার্চের ওপর।

বার্সেলোনার তরে জিরোনা চ্যাপেলের সদর দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে স্থানীয় পুলিশের সদস্যরা। ধারণা করা হচ্ছে এই মুহূর্তে চ্যাপেলে ভেতরে অবস্থান করছেন রবার্ট ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা ভিদাল। সেখান থেকেই এডমন্ড কিয়ার্শের বহুল প্রতীক্ষিত প্রেজেন্টেশনটি লঞ্চ করতে চলেছেন তারা-যেটার আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি।

পপকর্ন হাতে নিয়ে বসে যান যে যেখানে আছেন!

.

অধ্যায় ৯০

ল্যাংডন দ্বিতীয়বারের মত পুরো পাসওয়ার্ড টাইপ করে এন্টার চাপার সাথে সাথে একটা আওয়াজ শুনতে পেলো ওরা। তবে আগেরবারের চেয়ে ভিন্ন। এবারেরটা। পর্দায় ভেসে উঠেছে :

PASSWORD CORRECT.

একটা ভারি পাথর যেন নেমে গেল অ্যাম্ব্রার বুক থেকে। ল্যাংডন উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে তাকে আন্তরিক ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরলো সে। এডমন্ড থাকলে আরও খুশি হতো।

দুই মিনিট তিরিশ সেকেন্ড, ঘোষণা করলো উইনস্টন।

ল্যাংডনের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দুজনেই একসাথে ওপরের এলসিডি স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকালো ওরা। মাঝখানের স্ক্রিনটার ডিসপ্লেতে একটা কাউন্টডাউন ঘড়ি দেখা যাচ্ছে, যেটাকে শেষবার অ্যাম্ব্রা দেখেছিল গুগেনহাইমে।

সরাসরি সম্প্রচার শুরু হতে বাকি-২ মিনিট ৩৩ সেকেন্ড
বর্তমানে এই প্রেজেন্টেশনটা দেখছেন-২২৭,২৫৭,৯১৪ জন

বিশ কোটিরও বেশি মানুষ? বিস্মিত হয়েছে বললে কম হয়ে যাবে অ্যাম্ব্রার জন্য। বার্সেলোনার একপাশ থেকে আরেকপাশে যখন ছুটে বেড়াচ্ছিল ওরা, পুরো পৃথিবীর মানুষ নজর রাখছিল আজকের ঘটনাপ্রবাহের ওপর।

কাউন্টডাউনটা যে স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে তার পাশের স্ক্রিনে চ্যাপেলের বাইরে অপেক্ষারত পুলিশদের কার্যক্রমের মধ্যে হঠাৎই পরিবর্তন লক্ষ্য করলো অ্যাম্ব্রা। যারা দরজা ধাক্কাচ্ছিল কিংবা ওয়াকি-টকিতে কথা বলছিল তাদের প্রত্যেকে একে একে নিজেদের স্মার্টফোন বের করে সেটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে এখন।

সবার কাজ থামিয়ে দিতে বাধ্য করেছে এডমন্ড, হঠাই নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন বলে মনে হলো অ্যাম্ব্রার। হাজার হলেও এখন যে সবাই মনোযোগ দিয়ে প্রেজেন্টেশনটা দেখার অপেক্ষা করছে সেটার পেছনে ওর অল্প হলেও অবদান আছে। তাছাড়া ও এখন যেখানে আছে সেখান থেকেই সম্প্রচারিত হবে ওটা। হুলিয়ানও নিশ্চয়ই দেখছে, ভাবলো ও। তবে দ্রুতই সেই ভাবনাটা দূরে সরিয়ে দিলো জোর করে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে প্রেজেন্টেশনটা, বলল উইনস্টন। এডমন্ডের কাউচে বসে পুরোটা উপভোগ করতে পারেন আপনারা।

ধন্যবাদ, উইনস্টন, বলল ল্যাংডন। এরপর এগিয়ে গেল বসার। জায়গার দিকে। খালিপায়ে কাঁচের মেঝের ওপর দিয়ে তার পেছন পেছন গেল অ্যাম্ব্রা। দামি কার্পেটের ওপর পা রাখার সাথে সাথে একটা আরামদায়ক অনুভূতি ছড়িয়ে গেল অ্যাম্ব্রার ক্লান্ত শরীরে। পা উঠিয়ে কাউচে বসে পড়লো ও। আশেপাশে তাকালো এডমন্ডের টেলিভিশনটার খোঁজে। কোথায় দেখবো আমরা?

ল্যাংডন ঘরের অন্য কোণায় কিছু একটা খুঁজতে যাওয়ায় তার প্রশ্নটা শুনলো না, কিন্তু অ্যাম্ব্রা তার উত্তর পেয়ে গেল যখন ঘরের পেছনের পুরো দেয়ালটা একটা বিশাল স্ক্রিনে পরিণত হলো। পরিচিত একটা ছবি ভেসে উঠলো সেখানে :

সরাসরি সম্প্রচার শুরু হতে বাকি-১ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড
বর্তমানে এই প্রেজেন্টেশনটা দেখছেন-২২৭,৫০১,১৭৩ জন

পুরো দেয়ালটাই একটা ডিসপ্লে?

*

দশ ফিট দূরে দাঁড়ানো ল্যাংডনেরও অ্যাম্ব্রার মতই বিহ্বল দশা। তবে তার দৃষ্টি বিশাল ডিসপ্লেটার দিকে নয় বরং একটা ছোট বস্তুর দিকে। জাদুঘরে কোন দামি জিনিস যেভাবে প্রদর্শন করা হয় ঠিক সেরকম একটা স্ট্যান্ডের ওপর রাখা আছে ওটা।

একটা ধাতব ডিসপ্লে কেসের ওপরে কাঁচের ভেতর রাখা আছে একটি টেস্টটিউব। একটা কর্ক দিয়ে মুখ আটকানো টেস্টটিউবটার গায়ে সেটার ব্যবহারকারি লিখে রেখেছিল কিছু একটা। ভেতরে বাদামি রঙের থকথকে তরল পদার্থ। প্রথমে ল্যাংডন ভাবলো, এটা হয়তো এডমন্ডের খুব দামি কোন ওষুধ হবে। এরপর ঝুঁকে লেবেলে লেখা নামটা পড়লো ও।

এটা অসম্ভব, নিজেকেই বলল ল্যাংডন, এখানে কিভাবে আসলো এই জিনিস?

পুরো পৃথিবীতে বিখ্যাত টেস্টটিউবের সংখ্যা হয়তো হাতেগোণা, তবে তার মধ্যে এটা একটা। এডমন্ড যে এরকম একটা জিনিস জোগাড় করেছিল সেটা বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার! নিশ্চয়ই অনেক খরচ করতে হয়েছে এটা জোগাড় করতে। কাসা মিলার পল গগ্যার ছবিটার মতনই।

হাঁটুগেড়ে বসে সত্তর বছর আগের টেস্টটিউবটার দিকে তাকালো ল্যাংডন। ওটার মাস্কিং টেপ লেবেলটা ঝাঁপসা হয়ে এসেছে, তবে দুটো নাম পড়া যাচ্ছে এখনও-মিলার-ইউরে।

হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল ল্যাংডনের।

মিলার-ইউরে।

হায় ঈশ্বর!…এলেম আমরা কোথা থেকে?

রসায়নবিদ স্ট্যানলি মিলার এবং হ্যারল্ড ইউরে ৫০-এর দশকে একটু যুগান্তকারি এক্সপেরিমেন্টের আয়োজন করেছিলেন এই প্রশ্নটার উত্তর পাবার জন্যে। তাদের সাহসি এই এক্সপেরিমেন্টটা অবশ্য সাফল্যের মুখ দেখেনি কিন্তু পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞান জগতে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তারা। সেই থেকেই ওটা মিলার-ইউরে এক্সপেরিমেন্ট নামে পরিচিত।

ল্যাংডনের মনে আছে, হাইস্কুলে থাকাকালীন জীববিজ্ঞান ক্লাসে বসে এই দুই বিজ্ঞানীর এক্সপেরিমেন্টটা সম্পর্কে প্রথম যেদিন ধারণা দিয়েছিলেন ওদের শিক্ষক সেদিন একদম হা হয়ে গিয়েছিল ওর মুখটা। বিজ্ঞানীদ্বয়ের মূল লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর একদম শুরুতে যেরকম পরিবেশ ছিল সেটার অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করে দেখা যে, জীবনের সৃষ্টি হয় কিনা (শুধুমাত্র বিজ্ঞানের সাহায্যে)।

অনেক ধরণের নির্জীব, উত্তপ্ত তরল রাসায়নিক পদার্থের সমুদ্র বলা চলে তখনকার পৃথিবীকে। একটা বাহারি নামও আছে-প্রিমর্ডিয়াল স্যুপ।

পৃথিবীর শুরুর দিককার সমুদ্রগুলোতে উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থের অনুরূপ পদার্থ এবং তখনকার পরিবেশে যা ছিল-পানি, মিথেন, অ্যামোনিয়া এবং হাইড্রোজেন, সেগুলো একত্রিত করে উত্তপ্ত করতে থাকেন মিলার এবং ইউরে। বজ্রপাতের আদলে স্পার্কেরও ব্যবস্থা করেন। শেষে ঠাণ্ডা করতে থাকেন মিশনটা। যেভাবে ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল পৃথিবীর সমুদ্রগুলো।

মিলার এবং ইউরে আশা করেছিলেন, তাদের রাসায়নিক মিশ্রণে হয়তো এক পর্যায়ে উদ্ভব ঘটবে আদিম অণুজীবের। কিন্তু নির্জীব বস্তু থেকে প্রাণের সৃষ্টি করার তাদের চেষ্টাটা বিফল হয়। শুধুমাত্র থকথকে তরল পদার্থ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদেরকে। এক্সপেরিমেন্টে ব্যবহৃত ভায়ালগুলো এখনও রাখা আছে স্যান ডিয়েগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আজ অবধি সৃষ্টিবাদিরা মিলার-ইউরে এক্সপেরিমেন্টের ব্যর্থতাকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে যে, ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ছাড়া পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি হয়নি।

তিরিশ সেকেন্ড, উইনস্টনের ঘোষণায় সম্বিত ফিরে পেলো ল্যাংডন।

উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকার চার্চটার চারপাশে নজর বোলালো সে। কয়েক মিনিট আগেই উইনস্টন বলছিল, বিজ্ঞানের নজিরবিহীন আবিষ্কারগুলো পুরো পৃথিবীকে অন্য আলোয় দেখতে বাধ্য করেছিল সবাইকে। সহজ কথায় পৃথিবীর নতুন মডেল-এর জন্ম দিয়েছিল। এটাও বলেছিল, মেয়ার-নস্ট্রাম সুপারকম্পিউটারের বিশেষত্বই হচ্ছে কম্পিউটার মডেলিংয়ে মাধ্যমে জটিল জটিল পরিস্থিতির ভার্চুয়াল অনুরূপ তৈরি করে সেগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করা।

মিলার-ইউরে এক্সপেরিমেন্টকেও, ভাবলো ল্যাংডন, একধরণে মডেলিং এর প্রচেষ্টা বলা চলে…আদিম পৃথিবীতে চলমান রাসায়নিক বিক্রিয়ার সিমুলেশন।

রবার্ট! রুমের অন্য পাশ থেকে ডাক দিলো অ্যাম্ব্রা, শুরু হচ্ছে প্রেজেন্টেশনটা।

আসছি, বলে কাউচটার দিকে এগিয়ে গেল ল্যাংডন। হঠাৎ করেই এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনের বিষয়বস্তুর ব্যাপারে নতুন এক সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে ওর মনে। এতক্ষণ যা দেখলো সেটার সাথে নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে ওটার।

সন্ধ্যার দিকে এডমন্ডের বলা কথাগুলো মনে পড়লো ওর-আজরাতে, আসুন আমরা সবাই প্রাচীনকালের অভিযাত্রিদের মতো হয়ে যাই, বলেছিল কিয়ার্শ, তাদের মতো, যারা সবকিছু পেছনে ফেলে রেখে বিশাল সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন…তাদের মতো যারা কখনও না দেখা দেশ প্রথম দেখতে পেয়েছিল…যারা বুঝতে পেরেছিল, দর্শন যতোটা কল্পনা করতে পারে তার চেয়ে এই পৃথিবী আরো অনেক বিশাল। নিজেদের পৃথিবী সম্পর্কে তাদের সুদীর্ঘকালের বিশ্বাস নতুন আবিষ্কারের ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছিল।

অ্যাম্ব্রার পাশে বসার সাথে সাথে চূড়ান্ত কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল স্ক্রিনে।

আপনি ঠিক আছেন তো, রবার্ট? অ্যাম্ব্রা জিজ্ঞেস করলো।

মাথা নেড়ে সায় জানালো ল্যাংডন। এই সময় প্রেজেন্টেশনটার শুরু হবার নাটকিয় শব্দ ভেসে এলো স্পিকারে। এডমন্ডের চেহারা ভেসে উঠলো বিশাল স্ক্রিনে। বিখ্যাত ফিউচারিস্টকে ক্লান্ত এবং দূর্বল দেখালেও মুখে চওড়া হাসি খেলা করছে তার।

এলেম আমরা কোথা থেকে? নাটকিয় ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করলো সে, কণ্ঠের উত্তেজনা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। যাচ্ছিই বা কোথায়?

শক্ত করে ল্যাংডনের হাত চেপে ধরলো অ্যাম্ব্রা।

এই দুটো প্রশ্নই একই গল্পের অংশ, এডমন্ড বলল, শুরু থেকে শুরু করা যাক, কী বলেন? একদম শুরু থেকে।

ক্যামেরার উদ্দেশ্যে একবার মাথা নেড়ে পকেট থেকে একটা ছোট কাঁচের তৈরি টেস্টটিউব বের করলো এডমন্ড। থকথকে তরলে ভর্তি টেস্টটিউবটার বাইরে লেবেলে দেখা যাচ্ছে দুটো নাম-মিলার-ইউরে।

একটা শিহরণ বয়ে গেল ল্যাংডনের মেরুদণ্ড বরাবর।

আমাদের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল অনেক আগে…খ্রিস্টেরও ৪০০ কোটি বছর পূর্বে…প্রিমর্ডিয়াল স্যুপে ভাসমান অবস্থায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *