2 of 2

৮১. জাহাজ ছাড়বে কোচিন থেকে

জাহাজ ছাড়বে কোচিন থেকে। পঙ্কজকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে একদিন আমার প্যাসেজ বুক করে এলাম। পঙ্কজকে সব কথা খুলে বলতেই হয়েছে। একা একা সবকিছুর ব্যবস্থা করা আমার সাধ্যাতীত হয়ে উঠছিল। অন্তত আলোচনা করার জন্যও তো একজন কারোকে দরকার। রেণু এখন থিয়েটার নিয়ে খুব ব্যস্ত।

পঙ্কজের সঙ্গে কিছু দিন আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর পঙ্কজের সঙ্গে আর দেখাই হত না। পঙ্কজ ভালো ছাত্র হিসেবে খুব সুনাম করেছে, রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে ঘুরে বেড়ানোকে সে বাজে সময়। নষ্ট বলে মনে করে। আগেকার তুলনায় পঙ্কজ এখন অনেক গম্ভীর। অন্যান্য সঙ্গীদের হারিয়ে আমাকে আবার আমার এক বাল্যবন্ধুর কাছেই ফিরে যেতে হল।

পঙ্কজ প্রথমে আমার সমস্ত পরিকল্পনাটাই উড়িয়ে দিয়েছিল ছেলেমানুষি বলে। ধমক দিয়ে বলেছিল, বোকার মতন এম. এ.-টা কমপ্লিট করলি না কেন? তা হলে কোনও কলেজে লেকচারারের কাজ পেয়ে যেতিস। বিদেশে গিয়ে কী হাতি ঘোড়া হবে?

কিন্তু আমার কাছে বিদেশযাত্রা মানে শুধু জীবিকার্জন নয়। আমার মনে হচ্ছে, এর মধ্যেই রয়েছে আমার মুক্তির পথ। এই বদ্ধ গণ্ডি ভেঙে আমাকে বেরোতেই হবে।

পঙ্কজ ইচ্ছে করলেই একটা স্কলারশিপ জুটিয়ে অন্য দেশে পাড়ি দিতে পারত। কিন্তু পঙ্কজ বিদেশ-বিমুখ। আমাকে আবার বলল, অন্য দেশে গিয়ে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে থাকতে তোর ভালো লাগবে? আমি তো ভাবতেই পারি না।

আমি বললাম, কোনও একটা দেশেই আমি বেশি দিন থাকব না। ঘুরে ঘুরে বেড়াব। নাগরিকত্ব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এখানেই বা কী ভালো আছি?

বেশ কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর সঙ্কজ আমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। পঙ্কজের মাথা ঠান্ডা, সে সব দিক চিন্তা করতে পারে। কোনও রকম কাজকর্ম না জুটিয়ে হঠাৎ জার্মানি চলে যাওয়ার প্রস্তাবটা ও বাতিল করে দিল প্রথমেই। অজানা অচেনা দেশে ও রকম ভাবে গিয়ে কোনও লাভ নেই। আমি অবশ্য বলেছিলাম যে, আমি দরকার হলে কুলিগিরি করতেও পারব। পঙ্কজ হেসে উঠেছিল সেই কথা শুনে। বলেছিল, এ তো আর কলকাতা শহর নয় যে, যে ইচ্ছে সেই এসে যা খুশি করবে! ও-সব দেশে কুলিগিরি করতে গেলেও সরকারের অনুমতি লাগে। আর, নিজেকে চিনতে শেখ। দরকার হলে যারা কুলিগিরিও করতে পারে, তারা অন্য টাইপের মানুষ। তুই পারবি না। তুই না খেয়ে কিংবা অভিমান করে মরবি।

পঙ্কজ বলল, প্রথমে আমার ইংলন্ডে যাওয়া উচিত। ওখানে বিষ্ণু আছে, তার কাছে। থাকতে পারব কয়েক দিন। বিষ্ণু অনেক রকম সাহায্য করতে পারবে, দরকার হলে জার্মানিতে চিঠিপত্র লিখে কাজের ব্যবস্থাও করে দিতে পারবে। মোট কথা, দেশের বাইরে গিয়ে প্রথমেই অকূল পাথারে পড়ব না।

এই উপায়টিই যে যুক্তিসঙ্গত, তা মেনে নিতেই হয়। তবে, একটা জিনিস আমি দৃঢ় ভাবে ঠিক করে রেখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ইংলন্ডে আমি কিছুতেই থাকব না। ইংরেজ জাতটার ওপর আমার জাতক্রোধ রয়ে গেছে, ওদের কাছে গিয়ে কোনওক্রমেই কৃপা চাইব না। যদি প্রচুর টাকা নিয়ে বেড়াতে যেতে পারতাম, সে আলাদা কথা।

বিষ্ণুকে চিঠি লেখার পর অতি দ্রুত উত্তর চলে এল। বিষ্ণুর দারুণ উৎসাহ। বিষ্ণু ইদানীং ওর সব চিঠিতেই ক্যারল নাম্নী একটি মেয়ের কথা লেখে। সেই ক্যারল নাকি ওর কবিবন্ধুকে দেখার জন্য দারুণ এক্সাইটেড। আমি যেন ক্যারলের জন্য খাঁটি দার্জিলিং পিকো চা নিয়ে যাই কয়েক পাউন্ড।

পঙ্কজের চেষ্টাতেই একটা কারগো জাহাজের টিকিট কাটা হল সস্তায়। পঙ্কজের সাহায্য না পেলে পাসপোর্টও অত সহজে হত না। পঙ্কজরা কলকাতার পুরনো লোক, অনেক রকম জানাশুনো। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে এবং পুলিশ বিভাগে ছড়িয়ে আছে। সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করার জন্য আমার পুলিশ ভেরিফিকেশনে গোলমাল দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, আর একজন বাদল মুখার্জির সন্ধান পাওয়া গেল যে বরানগরের বাসিন্দা এবং দু’ বছর জেল খেটেছে। পুলিশ এই দুই বাদল মুখার্জির রেকর্ড গুলিয়ে ফেলেছিল, আমার নামে ছিল জেল খাটার অভিযোগ–পঙ্কজের এক পুলিশ আত্মীয়ের সহায়তায় সেই অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়ায় আমার অন্য অসুবিধেগুলোও দূর হয়ে যায়। দুর্বল গণতন্ত্রের স্বভাবই এই, যার ঘুষ দেবার ক্ষমতা আছে কিংবা ওপর মহলে চেনাশুননা আছে, তার কোনও ব্যাপারেই কোনও অসুবিধে হয় না।

আমাকে টাকা খরচ করতে হচ্ছিল টিপে টিপে। রেণুর টাকাটা এখনও ছুঁইনি। টিউশানির টাকা থেকে জমিয়ে জমিয়ে ন’শো টাকা পুঁজি করেছিলাম বইটই বিক্রি করে আরও দু’শো টাকা জুটল। পঙ্কজ ধার দিয়েছে সাতশো টাকা, খড়্গপুরে ভাস্করের কাছে চিঠি লিখে আরও পাঁচশো টাকা পাওয়া গিয়েছিল। লন্ডনে যখন নামব, তখন আমার হাতে কয়েক পাউন্ড মাত্র অবশিষ্ট থাকবে।

পঙ্কজ টাকা বাঁচাবার আর একটা ব্যবস্থা করে দিল। কারগো জাহাজ ঠিক নির্দিষ্ট দিনে নাও ছাড়তে পারে। তা হলে আমাকে কোচিনে কয়েক দিন হোটেলে থাকতে হবে। পঙ্কজের এক জামাইবাবু থাকেন মহীশূরে, বিরাট চাকরি করেন, একটা ওষুধ কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার। আমি জাহাজ এর কয়েক দিন আগেই মহীশূরে গিয়ে পৌঁছোব। জামাইবাবুকে অফিসের কাজে প্রায়ই গাড়ি নিয়ে উটকামন্ড, এনাকুলাম যেতে হয়। উনি ঠিক দিনে আমাকে কোচিনে জাহাজে তুলে দেবেন। একজন চেনা কেউ জাহাজে ওঠার সময় আমার পাশে থাকবেন, এটা ভেবে আমি একটু ভরসা পাই। কখনও একা একা দূরে কোথাও যাইনি।

আর আট দিন পরে যাত্রা। বাড়ি ফিরেই শুনলাম, রেণু এসে অনেকক্ষণ বসেছিল। মা বললেন, এইমাত্র তো গেল, তোর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়নি?

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, না।

প্রায় এক ঘণ্টা বসে ছিল বেচারা।

কোনও দরকার ছিল?

তিনখানা টিকিট দিয়ে গেছে আমাদের। ও কী একটা থিয়েটার করছে, আমাদের সবাইকে বিশেষ করে যেতে বলেছে। তার বাবা যাবে কি না জানি না, তুই আমাকে নিয়ে যাবি তো?

আমি কার্ডটা দেখলাম। যে-দিন রেণুদের থিয়েটার, তার আগের দিনই আমি হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপব। রেণু যখন মঞ্চের ওপর কৃত্রিম কাহিনীর দুঃখের দৃশ্য কাঁদবে, সেই সময় আমি দু-তিনটে প্রদেশ পার হয়ে গেছি।

খুব উৎসাহ দেখিয়ে মাকে বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই নিয়ে যাব।

মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, রেণুরা যে নাটক করছে, তুই নেই তার মধ্যে? তুই কিছু করছিস না?

মা ধরেই নিয়েছিলেন, আমাকে বাদ দিয়ে রেণু কখনও কিছু করতেই পারে না। অনেকগুলো বছর ধরে এই রকমই হয়ে আসছে।

মায়ের চোখের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরালাম। এখনও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারি না। মায়েদের কী একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে, যাতে, সন্তানের মিথ্যে কথা অনায়াসেই ধরে ফেলতে পারে।

অবহেলার সুর ফুটিয়ে বললাম, আমাকে অনেক করে ধরেছিল, কিন্তু আমার একদম সময় নেই। মাঝে মাঝে রিহার্সালে যেতে হয় অবশ্য।

সময় নেই? কী এমন রাজকার্য করছিস?

খাবার দাও না, খিদে পেয়েছে। খুব কড়াইশুটির কচুরি খেতে ইচ্ছে করছে।

ইচ্ছে করছে তো দোকান থেকে কিনে নিয়ে আয়!

কেন, তুমি বানাতে পারবে না? আগে তো বানাতে—

আহা-হা! বললেই হল কিনা!

একমাত্র খাবারের কথা তুলেই মাকে অন্যমনস্ক করে তোলা যায়। আমি কিছু খেতে চাইলে মা শত অসুবিধে সত্ত্বেও সেটা করে দেবেনই। বাড়ির বেকার ছেলে সাধারণত খাবারদাবারের জন্য বায়নাক্কা করতে লজ্জা পায়। আমারও লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কয়েক দিন ধরে আমি ছোট ছেলের মতন আদুরে স্বভাবের অবুঝ হয়ে উঠছি। নিজে মনে মনে বুঝতে পারলেও দমন করতে পারি না। আমার যা যা প্রিয় খাবার, তা এক এক দিন এক একটা তৈরি করে দেবার জন্য আবদার তুলছি। এখন চালতা পাওয়া যায় না। তবু আমি কয়েক দিন ধরে চালতার ডালের কথা বলায়-মা শিয়ালদা বাজারে বাবাকে পাঠিয়ে চালতা খুঁজে আনিয়েছেন। আমি নির্লজ্জের মতন সেই ডাল এক বাটি খেয়ে আর এক বাটি চেয়েছি।

এইসব খাবার খেয়েও ঠিক তৃপ্তি হয় না, মনটা বিষাদে ভরে যায়। বার বার মনে হয়, আমি চলে যাব। আমি আর সারা জীবনে কখনও চালতার ডাল খাব না। অন্তত মায়ের হাতের রান্না আর খেতে পাব না। যদিও আমার চলে যাওয়া মানে চিরবিদায় নয়, তবু এই রকম মনে হয়।

ভেতরে ভেতরে আমার অসম্ভব উত্তেজনা, তবু বাইরে সেটা লুকিয়ে রাখার জন্য আমি সদাসতর্ক। একটু এদিক-ওদিক হলেই মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাব। তবু মা মাঝে মাঝে আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকান। কিছু সন্দেহ করেছেন কি? কিংবা আমারই চোখের ভুল।

প্রস্তুতি চলছে অত্যন্ত গোপনে। একটা সুটকেস কিনে পঙ্কজের বাড়িতে রেখেছি। প্রভাস জামাইবাবু যে ওভারকোটটা দিয়েছিলেন, সেটাও একদিন সরিয়ে দিয়েছি পঙ্কজের সঙ্গে। পাসপোট টাসপোর্ট কিছুই বাড়িতে আনিনি। একটা সুটও করাতে হয়েছে। গরম গেঞ্জি, গ্লাভস, ড্রয়ার অন্যদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে জোগাড় হয়েছে। আমার মধ্যে এখনও বাঙালত্ব রয়ে গেছে, কী কী বিছানাপত্তর নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম–পঙ্কজ খুব ঠাট্টা করেছে তাই নিয়ে। বিলেতে কেউ বেডিং নিয়ে যায়, শুনেছিস? বাঙাল কোথাকার!

রেণুর সঙ্গে আমার ঝগড়া চলছে। প্রতিদিন একখানা করে চিঠি বিনিময় হয়। কোনও কোনও দিন রেণু একসঙ্গে দুটো চিঠিও লেখে। চিঠিগুলো ডাকে আসে, অনেক দিন রেণুর সঙ্গে দেখা হয়নি। যাবার আগে রেণুর সঙ্গে দেখা না করে চিঠিতেই সব কথা জানিয়ে যাব ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু সেই চিঠিটা আর কিছুতেই মনঃপুত হয় না। অনেক বার লিখে লিখে ছিঁড়ে ফেলতে হল। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম, খুব সংক্ষিপ্ত চিঠিতেই আসলে সবচেয়ে বেশি কথা বলা যায়। রেণু, আমি চলে যাচ্ছি। আবার দেখা হবে। ভালো থেকো। ইতিবাদল।

একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজের পৃষ্ঠার ঠিক মাঝখানে এই তিন লাইনের চিঠিটা লিখে ফেললাম। বেশ পছন্দ হল। ভালো দেখাচ্ছে। রেণু সব বুঝতে পারবে। রেণুকে আমার মনের সব কথা খুলে বোঝাতে হবে কেন? ওর তো নিজে নিজে বুঝে যাওয়া উচিত।

অনেক স্থির সিদ্ধান্তই দু’-এক মুহূর্ত পরে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। চিঠিখানা লিখে, স্ট্যাম্প সেঁটে ডাকে ফেলার জন্য তৈরি হবার পরও আমি অন্ধের মতন ছুটে গেলাম মল্লিকাদের। বাড়ির সামনে। যেখানে রেণুদের নাটকের রিহার্সাল হবার কথা। সেখানে ওরা নেই। আজ ওদের স্টেজ রিহার্সাল হচ্ছে স্টার থিয়েটারে। রাস্তা পেরিয়ে চলে এলাম স্টার থিয়েটারে। যেন আর এক ঘণ্টা বা দু ঘণ্টাও অপেক্ষা করা চলবে না–এই বিশেষ মুহূর্তেই রেণুর সঙ্গে দেখা করা দরকার।

দেবুদা আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। এই যে ভাই, আপনি এসে গেছেন। খুব ভালো হয়েছে। আপনি গোটা নাটকটা দেখে একটু অনেস্ট ওপিনিয়ান দিন তো! মনরাখা কথা বলবেন না, অনেস্ট ওপিনিয়ান চাই কিন্তু। যদি কিছু সাজেশান থাকে

দেবুদা ভাড়ে চা খাচ্ছিলেন। একজন কাকে ডেকে বললেন, এই বাদলবাবুকে চা দে রে!

দেবুদার সঙ্গে মাঝে দু-তিন বার দেখা হয়েছে। প্রত্যেক বারই ওঁর ব্যবহারে অতিরিক্ত খাতিরের ভাব থাকে মনে হয়। ওঁর বন্ধুর ছোটভাই হিসেবে আমাকে এতটা। মূল্য দেবার তো কোনও কারণ নেই। তা হলে, উনি আমাকে নিয়েছেন রেণুর বন্ধু হিসেবে। উনি আমাকে রাগাতে চান না। অত্যন্ত চতুর লম্পটরা এ রকম হয়।

এসব বুঝেও আমি অসহায়। কেউ বেশি খাতির করলেই আমি অতি বিনয়ে একেবারে বিগলিত হয়ে যাই। মুখ দিয়ে একটাও সত্যি কথা বেরোয় না। আমি বললাম, আপনার নাটক তো দুর্দান্ত হচ্ছে, আমি যেটুকু রিহার্সাল দেখেছি…

উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে রেণু আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল মঞ্চের ওপর উঠে আসার জন্য। তখন বিরতি চলছে। অডিটোরিয়ামে কয়েক জন লোকের সঙ্গে দেবুদা গল্প করায় ব্যস্ত। মঞ্চটা ফাঁকা।

আমি একটু লজ্জিত ভাবে এদিক-ওদিক তাকালাম। আমি ওপরে উঠে গেলে কেউ কিছু মনে করবে না তো! পরমুহূর্তেই সাহস সঞ্চয় করে ওপরে উঠে এলাম।

রেণুকে রাজেন্দ্রানীর মতন দেখাচ্ছে। রেণুকে আমি বেশি সাজগোজ করতে কখনও দেখিনি। নাটকে জমিদার-দুহিতা সেজেছে বলেই এত জমকালো পোশাক। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, কখন এসেছ?

অনেকক্ষণ। তোমাদের অভিনয় দেখছিলাম। নাটকটা সত্যিই খুব দারুণ হচ্ছে– মানে, সকলেরই বেশ ভালো–অ্যামেচার গ্রুপ হিসেবে এত ভালো প্রোডাকশান–

বেশ কয়েক মিনিট আমি নাটক সম্পর্কে কথা বলে গেলাম।

রেণু বলল, কার্ড দিয়ে এসেছি। মাসিমা, মেলোমশাই আসবেন তো?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসবেন। মায়ের তো দারুণ আগ্রহ–শোনো তোমরা খবরের কাগজের লোকদের কার্ড দিয়েছ? ‘পরিচয়’ পত্রিকায় আমার এক বন্ধু আছে, তাকে বলে দিতে পারি–

আমার ঔদাসীন্য দেখে রেণু যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, সেই জন্যই আমি বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছিলাম। যদিও আমার বুকটা ঈর্ষায় হা হা করে জ্বলে যাচ্ছিল। সেই ঈর্ষার কী প্রচণ্ড উত্তাপ! কোনও ব্যক্তিবিশেষকে নয়, এমনকী দেবুদাকেও নয় সমগ্র নাট্যজগৎকে আমি ঈর্ষা করছিলাম–কেন তারা রেণুকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে? যাবার আগে কয়েকটা দিন কি রেণুকে আমার সর্বক্ষণের জন্য পাওয়া উচিত ছিল না? ঠিক এই সময়েই রেণুকে নাটকের রিহার্সাল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে? তবু আমার মুখে হাসি মাখানো।

নাটকের কথায় রেণু আনন্দ পাচ্ছিল। ওর বাড়ির দমবন্ধ পরিবেশ থেকে একটু মুক্তির জন্য রেণু যেন এই নাটকটাকে পেয়েছে।

পরের সিন কখন আরম্ভ হবে?

রেণু হেসে বলল, একটু দেরি আছে। একটা বন্দুকের শব্দ করতে হবে–কিছুতেই শব্দটা ঠিক হচ্ছে না।

আমি বললাম, আচ্ছা, স্টেজের পাশে কোথাও একটা গ্রিনরুম থাকে না? আমি কখনও দেখিনি। ঘরটা কি সত্যিই সবুজ?

রেণু আবার হাসতে হাসতে বলল, গ্রিনরুম দেখবে? এসো আমার সঙ্গে।

বাঁ দিকের উইংসের পাশ থেকে মঞ্চের ওপর দিয়েই রেণু আমাকে ডান দিকে নিয়ে এল। মঞ্চের ওপর দিয়ে যাবার সময় আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। আগে কখনও আমি মঞ্চে উঠিনি, এই প্রথম, অথচ আমি অভিনেতা নয়। আমি বাদল হলেও আমার পাশে রেণু নেই–ও এক জমিদার নন্দিনী। আমি একবার রেণুর মুখের দিকে আর একবার অডিটোরিয়ামের দিকে তাকালাম। এখানে আমি কী বিশ্রী রকমের বেমানান!

মঞ্চের ওপর দিয়ে যেতে যেতেই রেণু জিজ্ঞেস করল, তোমার বাইরে যাওয়ার কিছু ঠিক হয়েছে?

আমি বললাম, এখনও বিশেষ কিছুই ঠিক হয়নি।

মঞ্চের ওপর তো মানুষ মিথ্যে কথাই বলে।

ডান দিকের উইংসের পাশে অনেকে চা খেতে খেতে জটলা করছিল। দেওয়ালে গিরিশ ঘোষের একটা মস্ত বড় ছবি। রেণু আমাকে নিয়ে এল গ্রিনরুমে। সৌভাগ্যবশত সেখানে কেউ ছিল না। একটা রঙের তুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ আমি ফিরে দাঁড়ালাম। বিদ্যুৎবেগে রেণুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম।

রেণু আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। রেণু আমি যত বারই চুমু খেয়েছি, রেণু আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। আমাকেও এমন সব অসম্ভব জায়গা ও সময় বেছে নিতে হয়! যখন ইচ্ছে তখনই রেণুকে পাই না বলেই যে আমি এ রকম করি, তা কি রেণু বোঝে না?

ত্রাস ও ক্ষোভ মেশানো গলায় রেণু বলল, তুমি কি কিছুতেই এসব ছাড়বে না?

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

তুমি যদি এই রকম ব্যবহার করো…

আমি আবার হাত তুলতেই রেণু সরে গিয়ে দরজার কাছে এমন জায়গায় দাঁড়াল, যাতে ওকে বাইরে থেকে দেখা যায়। যাতে আমি ওকে আর ধরতে না পারি।

আমি বললাম, ভয় নেই, আমি আর কিছু করব না। আমি ক্ষমা চাইছি। রেণু, আমাকে একটা কথা দেবে? আমাকে এক দিন তোমার বুকে জড়িয়ে ধরবে?

আবার ওই সব কথা? আমি ওসব কিছু শুনতে চাই না।

আজ নয়। কোনও একদিন তুমি আমাকে তোমার বুকে জড়িয়ে ধরবে? শুধু কথা দাও তা হলেই হবে।

আচ্ছা, সে দেখা যাবে।

রেণু, আমার বাইরে যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে গেছে।

কবে?

আমি ইচ্ছে করেই দিন দশেক পরের একটা তারিখ বললাম। রেণু অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল। ওর নাটকের ফাঁইনাল অভিনয়ের আগে কোনও রকম বিঘ্ন ঘটাতে আমি চাই না।

তোমার যাওয়ার দিন আমি স্টেশনে যাব!

রেণু জানে না, আজই ওর সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়ে গেল।

.

আমার ট্রেন বিকেলবেলা। সকাল থেকে হঠাৎ বিমর্ষ বোধ করতে লাগলাম। শেষ মুহূর্তে মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাব না তো? জানতে পারলে মা কিছুতেই যেতে দেবেন। একমাত্র ছেলে হওয়ার অনেক ঝামেলা। কত লোক দিব্যি টিকিট কেটে প্রকাশ্যে আনন্দ করতে করতে বিদেশে যায়। বাড়ির সব লোক স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসে। আমার বেলায় এত লুকোচুরি, গোপনতা। শেষ সময়টুকুও সুখের হবে না।

বাবা খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি কোথায় বেরিয়ে গেলেন। সে-দিনকার সেই চাকরির ঘটনার পর থেকে বাবার সঙ্গে আমার কথাবার্তা খুবই কমে গেছে। বাবাকে এখন সব। সময়েই চিন্তাক্লিষ্ট মনে হয়। বাবার কাছ থেকে আমার বিদায় নেওয়া হল না।

মা-ও শুয়ে পড়লেন একটু বাদে। দু দিন ধরে মায়ের ডান পায়ের পাতাটা একটু ফুলেছে। ইদানীং বাতের কষ্ট পাচ্ছেন। আমি মায়ের ঘরের পাশে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। পঙ্কজরা অপেক্ষা করছে। আমার এক্ষুনি যাওয়া উচিত, তবু যেতে পারছি না। এর আগে বাইরে কোথাও গেলে মাকে প্রণাম করেছি। আজ প্রণাম করার প্রশ্নই উঠে না। একটা কথা অন্তত বলা উচিত, কিন্তু কী বলব? যে-কোনও কথা বলাই বিপজ্জনক। বুদ্ধ কিংবা চৈতন্য যখন গৃহত্যাগ করেছিলেন–তখন কারওর সঙ্গে একটিও কথা বলে যাননি। আমি তা জানি, কিন্তু আমি তো সন্ন্যাসী হতে পারিনি!

মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি প্রণাম করে পালাতে পারতাম। কিন্তু মা মরণের পরপারে’ নামে একখানা বই খুলে শুয়েছেন। এই বই পড়তে পড়তে কারওর ঘুম আসে?

বার বার উঁকি দিয়ে যাচ্ছি। একবার দেখলাম, মা সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছেন। বইখানা ওলটানো। কিন্তু আমি ঘরে পা দিতেই মা বললেন, কী রে? কিছু চাইছিস?

না।

কোথাও বেরোবি নাকি?

আমার আর সময় নেই। মাথায় একটা বুদ্ধি এল সেই মুহূর্তে। পকেট থেকে রুমালটা বার করে মুখ মোছার ছলে সেটা ফেলে দিতে চাইলাম মায়ের পায়ের ওপর। দূর ছাই, সেটা ঠিক পায়ের ওপর পড়ল না। সেটা তুলতে গিয়ে মায়ের পায়ের সঙ্গে আমার পা ছুঁয়ে গেল। গুরুজনদের পায়ে পা ঠেকলে প্রণাম করতে হয়। এর মধ্যে অস্বাভাবিক তো কিছু নেই। টপ করে মাকে প্রণাম করে বললাম, মা আমি একটু ঘুরে আসছি!

আর কোনও কথা না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম একবস্ত্রে। পঙ্কজের বাড়িতে ভাস্করও অপেক্ষা করছিল। ভাস্কর দু’দিন ধরে কলকাতায় আছে। ওর এখন ছুটি নেই– ভাস্কর যে আমাকে ট্রেনে তুলে দেবার জন্যই কলকাতায় থেকে গেছে আমি জানি। কিন্তু ও সে কথা কিছুতেই স্বীকার করবে না। মুখে বলছে, ওর কত সব জরুরি কাজ আছে, বাড়ির ব্যাপার। ভাস্কর কারওর কাছেই নিজের কোনও রকম দুর্বলতা দেখাতে চায় না।

আমি পোঁছোতেই ভাস্কর ধমক দিয়ে বলল, তুই কি ডোবাবি নাকি? আর মাত্র এক ঘণ্টা বাকি! আমি তো ভাবছিলাম, তোর বদলে আমিই চলে যাব।

আমার গলা ভারী হয়ে আছে, সহজে কথা বলতে পারছি না। ভাস্কর নিজেই দৌড়োদৌড়ি করে ট্যাক্সি ডেকে আনল। পঙ্কজ জিনিসপত্র সব তুলে দিয়ে বলল, চল, চল, ট্রেন না মিস করিস।

ট্যাক্সি ছাড়ার আগে ভাস্কর জিজ্ঞেস করল, আর কেউ যাবে না? আর কারোকে। বলিসনি?

না।

রেণুকেও না?

পঙ্কজ বলল, চল, এখন আর ওসব ভাববার সময় নেই। বলেইনি যখন–এখন আর কী করা যাবে!

ভাস্কর আমার সঙ্গে রেণুর ব্যাপারটা জানে। ভেংচি কেটে বলল, ইডিয়েট, এই সময় মান-অভিমান করার কোনও মানে হয়? এখনও যথেষ্ট সময় আছে, যদি চাস তো রেণুকে বাড়ি থেকে তুলে নিতে পারি।

আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে না না বলতে লাগলাম। ভাস্কর আপন মনে হেসে উঠল।

হাওড়া স্টেশনে যখন পোঁছোলাম, তখন সত্যিই বেশি সময় ছিল না। জায়গা রিজার্ভ করাও ছিল না। ভাস্কর আর পঙ্কজ উঠে পড়ে ঠেলাঠেলি করে থার্ড ক্লাস কামরায় আমার জন্য জানলার ধারেই একটা জায়গা ঠিক করে ফেলল। বন্ধুরা না থাকলে আমি কী করতাম?

আমাকে বসিয়ে দিয়েও ওরা প্ল্যাটফর্মে নেমে ছোটাছুটি করতে লাগল। পঙ্কজ কিনে আনল কমলালেবু আর আমার পছন্দ মতন এক গাদা সিগারেটের প্যাকেট। ভাস্কর কয়েকটা গুলিসুতো আর সুচ কিনে এনে একটা প্যাকেটে মুড়ে দিয়ে বলল, রেখে দে, দেখবি অনেক দরকারে লাগবে। হঠাৎ যদি প্যান্টের বোতাম ছিঁড়ে যায়–

হুইল দেবার পর ট্রেন নড়ে উঠল। আমি ওদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। পঙ্কজ বলল, মাইশোরে পৌঁছেই একটা চিঠি দিস। জামাইবাবুকে বলিস–

ভাস্কর চালাক ছেলে। ও ঠিক বুঝেছিল, শেষ মুহূর্তে আমার চোখে জল আসবে। সেই জন্যই ওর নাকের ওপর দু’হাতের আঙুল জুড়ে, যাকে পাক দেওয়া বলে, সেই রকম অদ্ভুত ভঙ্গি করতে লাগল। আমি না হেসে পারলাম না।

.

ট্রেন ছাড়ার পরই মনে হল, শেষ হয়ে গেল আমার জীবনের একটা অংশ। এরপর থেকে আমার কাছে সবকিছুই নতুন। জীবনের এই কটা বছর ধরে যেসব মানুষজন সংগ্রহ করেছিলাম, তাদের কারওর সঙ্গেই আমার আর দেখা হবে না। রেণুকে একদিন গঙ্গার ঘাটে খুঁজে পেয়েছিলাম, আজ আবার হারালাম।

প্রথম কয়েক ঘণ্টা আড়ষ্ট হয়ে বসেছিলাম ট্রেনে। কোনও সহযাত্রীর সঙ্গে একটাও কথা বলিনি। যেন, আমি কথা বললেই ওরা জেনে ফেলবে, আমি পালিয়ে যাচ্ছি। কী। অকারণ এই ভয়! জীবনটা তো আমারই, এ-জীবন নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি! আজ থেকে আমি স্বাধীন, তবু স্বাধীনতা পেয়েও কেন এত অবশ হয়ে থাকে? মানুষ কী রকম স্বাধীনতা চায়?

মহীশূরে পঙ্কজের জামাইবাবুর বাড়িতে পৌঁছে মনটা আরও দমে গেল। দারুণ সাজানো-গোছানো বিরাট প্রাসাদ একেবারে। অচেনা লোকের কাছে আমি কিছুতেই সহজ হতে পারি না। এ রকম আড়ম্বরপূর্ণ বাড়িতে এলে সব সময় মনে হয়, প্রতি মুহূর্তেই যেন আমি কোনও নিয়মকানুনের ভুল করে ফেলছি। যেসব ঘরে কার্পেট পাতা থাকে, সে-সব ঘরে কি জুতো পরে ঢুকতে হয়? কোনও কোনও বাড়িতে জুতো বাইরে রাখার প্রথা, আবার কোনও কোনও বাড়িতে কেউ জুতো খোলে না।

গেট পর্যন্ত পৌঁছেও একবার মনে হয়েছিল ফিরে যাই। কোনও একটা ছোটখাটো হোটেলে থাকলে ক্ষতি কী? আমি কখনও একলা কোনও হোটেলে থাকিনি। কিন্তু ফিরে যাওয়া হল না, পঙ্কজের জামাইবাবু আমাকে দেখতে পেয়ে গেলেন।

ওঁর নাম সুব্রত মৈত্র। খুব রোগা আর লম্বা মতন মানুষটি, বাংলা সিনেমার নায়িকাদের বাবার মতন ড্রেসিং গাউন পরা এবং মুখে পাইপ। সাহেবি ধরনের মানুষ। তবে, ওঁর কথা শুনে আমাকে চমকে উঠতে হল। উনি দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে বললেন, আরে আসো আসো ট্রেন ল্যাট ছিল কয় ঘণ্টা?

সুব্রতদা কাঠ-বাঙাল। বাংলা কথার উচ্চারণ একেবারে যাচ্ছেতাই-উনি শোধরাবার চেষ্টাও করেন না। স্বাধীনতার পর বাঙালরা এদিকে দলে ভারী হয়ে ওঠার ফলে, উচ্চারণ নিয়ে আর মোটেই লজ্জা পায় না। সুব্রতদার মতন এমন সাহেবি ধরনের বাঙাল আমি আগে কখনও দেখিনি। চায়ের স্বাদ একটু খারাপ হলে উনি কাপ সরিয়ে রাখেন, নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথাবার্তাতেও প্লিজ আর থ্যাংক ইউ যোগ করেন, কুকুরের সঙ্গে কথা বলেন ইংরেজিতে–কিন্তু বেড়ালকে বলেন বিলোই।

সুব্রতদা খুব সহজেই আমাকে আপন করে নিলেন। ওঁর স্ত্রী সুধাদি একটু গম্ভীর ধরনের হলেও যথেষ্ট স্নেহশীলা। প্রথম প্রথম সুধাদিকে দেখে একটু ভয় ভয় করছিল, মনে হয়েছিল, উনি বোধহয় বাড়িতে অতিথি আসা পছন্দ করেননি। পরে বুঝেছিলাম, ওঁর স্বভাবই কম কথা বলা–মানুষকে যত্ন করার ব্যাপারে ওঁর কোনও ত্রুটি নেই। ওঁদের তিনটি ছেলেমেয়ে। ছেলেটি ছোট, পাঁচ-ছ’ বছরের, আর মেয়েদুটির বয়স পনেরো আর যোলো, হঠাৎ দেখলে যমজ বলে মনে হয়। একই রকমের পোশাক, একই ধরনের বেণী। ঝোলানো, দু’জনেই বাড়িতে সব সময় লাল রঙের চটি পরে থাকে। ওদের নাম যমুনা আর সরস্বতী, ছেলেটির নাম সুভাষ। সুভাষের সঙ্গেই আমার ভাব হল আগে।

আমাকে থাকতে দেওয়া হল একতলার একটি ঘরে। সেই ঘরে বিছানা থেকে আরম্ভ করে বাথরুমের তোয়ালে সাবান পর্যন্ত সবই আগে থেকে সাজানো, এটা ওদের বাড়িতে গেস্ট রুম। কোনও বাড়িতে যে এ রকম ঘর সাজানো থাকে, আগে আমার জানা ছিল না।

সুব্রতদা আগেই খবর নিয়ে রেখেছিলেন, আমার জাহাজ ছাড়তে আরও ছ’দিন দেরি আছে। এই কদিন আমাকে বিলেতি আদবকায়দায় দীক্ষা দেবার জন্য সুব্রতদা উঠে পড়ে লাগলেন। সুব্রতদা সাত বছর লন্ডনে ছিলেন–অনেক দিন বাদে তার প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা শোনাবার মতন একজন শ্রোতা পেয়েছেন। সব বিলেতফেরতই বিলেতের গল্প করতে ভালোবাসে। হ্যাঁন্ড শেক করার সময় ঠিক কতটা হাত কঁকাতে হবে এবং হাউ ডু ইউ ডুর উত্তরে যে হাউ ডু ইউ ডু-ই বলতে হয়–এসব আমি মনোযোগী ছাত্রের মতন শিখতে লাগলাম।

একসময় সুব্রতদা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বিলাতে কী পড়তে যাইত্যাছো?

আমি বললাম, পড়তে তো যাচ্ছি না। চাকরি করতে—

সুব্রতদা ভুরু কুঁচকে বললেন, চাকরি? চাকরির জন্য অত দূরে যাওয়া ক্যান?

আমি বললাম, কী করব বলুন। এ-দেশে তো আর চাকরি পেলাম না। আমাদের দেশ তো আমাদের দেশের ছেলেদের চাকরি দিতে পারে না।

সুব্রতদার কথাটা পছন্দ হল না। সুব্রতদার মতে ইউরোপীয়রা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে আছে–সুতরাং ওদের কাছে সে-সব শেখার জন্য যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ওদের অধীনে চাকরি করা, ছি ছি–এটা বড় হীনতার কাজ।

আমার কাছে এখন এসব কথার আর কোনও মূল্যই নেই। আমি চুপ করে রইলাম।

সুব্রতদা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে চাকরি করবে? আমার অফিসে তোমাকে এক্ষুনি একটা চাকরি দিতে পারি।

এ রকম হয়। যখন প্রয়োজন থাকে না, তখন অনেকেই কিছু দিতে চায়। আমি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, নাঃ, এ-দেশে আর আমি থাকব না।

সুব্রতদার চাকরিটা ভারী আরামের। অফিস না গেলেও চলে। অফিসের লোকেরাই বাড়িতে কাগজপত্তর নিয়ে আসে। এ ছাড়া অসংখ্য টেলিফোন আসে, সারা দিনে সুব্রতদা নিজেও অন্তত ছ’টা-সাতটা ট্রাঙ্ক কল করেন। বাড়িতে বসে টেলিফোনে কাজ সেরেও এত বড় চাকরি পাওয়া যায়!

বিকেলের দিকে পর পর তিন দিন সুব্রতদা আমাকে অনেক জায়গায় বেড়িয়ে নিয়ে এলেন। ছেলেমেয়েরাও সঙ্গে আসে। সুধাদি বেড়াতে ভালোবাসেন না। এই ভাবে আমার চামুন্ডী পাহাড় এবং বৃন্দাবন গার্ডেনস দেখা হয়ে গেল। একদিন বেড়াতে গেলাম চন্দনের বনে। হাত দিয়ে একটা চন্দন গাছ প্রথম ছুঁয়ে শরীরে রোমাঞ্চ হয়। ঠিক যেন একটা অলৌকিক সৌভাগ্যের মতন। আগে তো কখনও ভাবিনি, আমি একদিন এই রকম ভাবে চন্দন গাছের ছায়ায় পঁড়াব। কাবেরী নদীর কাছে গিয়েও অনেকটা এই রকমই মনে হয়েছিল। আর কিছুই নয়, অন্য যে-কোনও নদীর মতনই তো–তবু কাবেরী নামটা যেন শুধু কবিতার মধ্যেই ছিল–হঠাৎ সেই নামের নদীর কাছে চলে এলে মনে হয়, এটা যেন ঠিক কোনও বাস্তব ঘটনা নয়।

যমুনা আর সরস্বতী এই দুই বোনের মধ্যে সরস্বতী একটু বেশি লাজুক। যমুনা আমার– সঙ্গে অনেক গল্প করে–কিন্তু বার বার আমার চোখ চলে যায় সরস্বতীর দিকে। এক এক সময় বুকটা কেঁপে ওঠে। মনে হয়, সরস্বতাঁকে যেন অবিকল রেণুর মতন দেখতে। যদিও ঠিক ঠিক বিচার করলে, রেণুর সঙ্গে ওর বিশেষ কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না– ওর মুখের গড়ন আলাদা, নাক-চোখও অন্য রকম, তবু সরস্বতীর মুখের কোনও একটা। রেখায়, কিংবা তাকানোর ভঙ্গিতে দপ করে রেণুর কথা মনে পড়ে যায়। ট্রেনে আসবার সময় এই রকম আরও দু-তিনটি মেয়েকে দেখে ঠিক রেণুর মতন মনে হয়েছিল। রেণু কথা ভুলতে চাইছি বলেই বোধহয় রেণু বার বার নানা চেহারায় আমার চোখের সামনে এসে হাজির হচ্ছে।

বৃন্দাবন গার্ডেনস দেখতে গিয়ে যে-দিন আমরা কাবেরী নদীর ধারে দাঁড়িয়েছিলাম, সে-দিন সরস্বতী বলেছিল, দিদির নামের সঙ্গে মিলিয়ে আমার নাম কাবেরী রাখলে অনেক ভালো হত। ঠাকুর দেবতার নাম আমার একটুও ভালো লাগে না!

ও জানে না যে সরস্বতী নামেও নদী আছে। আমি ওকে বললাম, তুমি এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গমের কথা শোনোনি? সেখানে গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতী–এই তিনটে নদী একসঙ্গে মিশেছে?

যমুনা জিজ্ঞেস করল, আপনি এলাহাবাদে গেছেন?

মেয়েদের সামনে মিথ্যে কথা বলতে আমার একটুও আটকায় না। আমি ঘাড় হেলিয়ে বললাম, হ্যাঁ–

কী রকম দেখতে সেই জায়গাটা? যেখানে তিনটে নদী একসঙ্গে মিশেছে?

কল্পনা করা এমন কিছু শক্ত নয়। তা ছাড়া নদীর বর্ণনা দেওয়া আর এমন কী কথা। মনশ্চক্ষে আমি প্রয়াগের ত্রিবেণীসঙ্গম দেখতে পেলাম, সেখানে দুর্গের ছায়া পড়েছে। সুব্রতদা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার বর্ণনা শুনে খুব হাসতে লাগলেন।

যমুনা-সরস্বতী প্রায় জন্মকাল থেকেই প্রবাসে আছে। ওদের ব্যবহার অনেক সহজ, শাড়ির বদলে স্কার্ট পরে। যমুনা আমার হাত ধরে বলল, বাদলদা, একটা জিনিস দেখবেন আসুন। আসুন না–

একটা গাছের পাতায় একটা পরিত্যক্ত বোলতার বাসা–ঠিক একটা বড় কদম ফুলের মতন–যমুনা আমাকে সেটা দেখতে আনে। জিনিসটা সত্যি সুন্দর। কাছাকাছি কোনও বোলতা নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি সেটাকে ভেঙে নিয়ে এলাম। সেটাকে দেখবার জন্য অত্যন্ত ঔৎসুক্যবশে যমুনা আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল–ওর শরীরের গরম স্পর্শ আমি টের পেলাম। সেই মুহূর্তেই আমার মুখখানা অপরাধীর মতন বিবর্ণ হয়ে গেল। যেন আমি রেণুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। যে কয়েক বারই যমুনা সাধারণ সরলতায় আমার হাত ধরেছে কিংবা শরীরের সঙ্গে ছোঁয়া লেগে গেছে প্রত্যেক বারই আমার এ রকম মনে হয়েছে। রেণু ছাড়া অন্য কোনও মেয়েকে আমি স্পর্শ করতে পারি না। কদাচিৎ অন্য কোনও মেয়ের বুকের অনাবৃত অংশের দিকে আমার চোখ পড়ে গেলেও আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। নারীর কাছ থেকে আমার যা কিছু পাবার–তা সবই রেণুর কাছে গচ্ছিত রয়েছে। মাঝে এ রকম কথাও আমার মনে হয়েছে যে থিয়েটারের সেই দেবুদা যদি রেণুর গায়ে হাত দিয়ে কথা বলতে পারে, তা হলে আমিই বা অন্য কোনও মেয়েকে ছুঁতে পারব না কেন? কিন্তু আমার এ-বিদ্রোহ বেশি দূর দানা বাঁধেনি। এখন রেণুর কাছ থেকে দূরে আছি বলেই যেন আমার কঠোরতা আরও বেড়ে যায়।

আমার কোচিন যাবার আগের দিন এ বাড়িতে একটা ছোটখাটো উৎসব হয়ে গেল। উৎসবের উপলক্ষটা আমি সারা দিনের মধ্যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত জানতে পারিনি কিংবা আমার কাছে গোপন করে রাখা হয়েছিল। সেদিন সরস্বতীর জন্মদিন–আমি যাতে উপহার টুপহার কিনে টাকা খরচ করে না ফেলি, সেই জন্য সুব্রতদা আমাকে বলতে চাননি। সন্ধ্যাবেলা সুভাষ দৌড়োতে দৌড়োতে এসে আমাকে খবর দিয়ে গেল, এবার দিদির নামে কেক কাটা হবে–আপনি শিগগির আসুন!

ওপরে গিয়ে দেখলাম সরস্বতী একটা উজ্জ্বল লাল রঙের শাড়ি পরেছে। তার প্রথম শাড়ি। তার লাজুকতার সঙ্গে ওই লাল রং মানিয়েছে ভারী চমৎকার। ওর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, ঠিক যেন রেণুকে দেখছি। রেণুর জন্মদিনটা যেন কবে? আমার কিছুতেই মনে থাকে না। গত বছর রেণুর জন্মদিনে আমি কোনও উপহার দিইনি, রেণুই আমার জন্য একটা বই কিনে এনেছিল।

কারোকে কিছু না বলে টুক করে এক ফাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। উপহার কেনার অভ্যাস নেই, কী কিনব জানি না। বই কেনার কথাই প্রথমে মনে পড়ে। কিন্তু সুব্রতদার বাড়ি-ভরতি বই। অনেক ভেবেচিন্তে এখানকার বিখ্যাত সাবান কিনে ফেললাম এক বাক্স। আশ্চর্য ব্যাপার, দোকানদারের হাত থেকে যখন সাবানের বাক্সটা নিচ্ছি– তখনও আমার মনে হচ্ছে, যেন রেণুই এই সাবান মাখবে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বাথরুমে রেণু…। এই ক’দিনে বাবা-মা’র কথাও আমার তেমন করে মনে পড়েনি, রেণুর স্মৃতিই জ্বালাতন করছে সবচেয়ে বেশি।

সুব্রতদার পরিচিত কিছু নারী-পুরুষ এসেছিলেন নেমন্তন্ন খেতে। বাইরের সবাই চলে যাবার পর আমরা দোতলার বড় হলঘরটাতে বসে গল্প করছিলাম। সুব্রতদা খুব রাগাবার। চেষ্টা করছিলেন সুধাদিকে। মিঃ আয়েঙ্গার নামে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি নাকি সুধাদির প্রেমে পড়েছেন। ছেলেমেয়ের সামনেই সুব্রতদার এই ধরনের রসিকতার ব্যাপারটা আমার বেশ ভালো লাগে। সুব্রতদা যমুনাকে জিজ্ঞেস করলেন, খুকু তুই দেখিসনি, আয়েঙ্গার তোর মায়ের দিকে কী রকম ঢুলুঢুলু চোখে তাকাচ্ছিল? তোর মা-ও কী রকম লজ্জা লজ্জা ভাবে–

এই সময় ঝনঝন করে টেলিফোন বেজে উঠল। সুব্রতদা উঠে গিয়ে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে চিৎকার করে কথা বলতে লাগলেন। অর্থাৎ ট্রাঙ্ক কল। একটু বাদেই সুব্রতদা আমার দিকে ফিরে বললেন, বাদল, তোমার। তারপর হাসতে হাসতে সকলকে জানালেন, বাদলের আর যাওয়া হল না। ওর বাড়ি থেকে ডাক এসেছে–

আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময়ের। আমাকে এখানে কে টেলিফোন করবে! আমার বাড়ির কারওর পক্ষে জানা তো অসম্ভব! আমার দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া হল, কঠিন প্রতিজ্ঞার। যাই হোক না কেন, আমি কিছুতেই ফিরে যাব না। কিছুতেই না। টেলিফোন তুলে দৃঢ় গলায় বললাম, হ্যালো–।

এটাই আমার ভুল হল। টেলিফোন যন্ত্রটা হাতে নেওয়াই আমার ঠিক হয়নি। আমার উচিত ছিল সুব্রতদাকে দিয়েই বলানো যে আমি চলে গেছি।

ট্রাঙ্ক কল করেছেন বাবা। আমাকে ধমকালেন না, কান্নাকাটি করলেন না। খুব শান্ত গলায় বললেন, তোমার বাবা বলছি। তোমার মায়ের খুব অসুখ। তিনি তোমাকে বার বার দেখতে চাইছেন। তোমার ইচ্ছে হলে আসতে পারো। তবে তুমি আসবে কি না আসবে, তা তুমিই ঠিক করবে। আমি শুধু খবরটা জানিয়ে দিলাম, না হলে তোমার মা শান্ত হচ্ছিলেন না।

আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথার মধ্যে প্রবল বেগে অনেক কিছু ঘুরছে। বাবা আমাকে সত্যিই চমকে দিয়েছেন। যে-সব ছেলে বাড়ি থেকে চলে যায়, তাদের সকলেরই মায়েরা গুরুতর অসুখে শয্যাশায়ী হয়। এটা নতুন কিছু নয়। এই খবরে আমি বিচলিত হতাম না। কিন্তু বাবার ওই শান্ত কণ্ঠস্বরে আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছি। আমাকে ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ বা আদেশ না করে এ রকম ভাবে কথা বলার মানে কী? ফিরব কিনা তা আমাকেই ঠিক করতে হবে। এই অসুখের ফলে যদি মা মারা যান, তা হলে আমিই হব সেই মৃত্যুর জন্য দায়ী। যেন সবাই মিলে একটা ষড়যন্ত্র করছে আমার বিরুদ্ধে। মায়ের অসুখটাও সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। পরিবার এবং সমাজ নামে দুটি অদ্ভুত প্রতিষ্ঠান আমাকে বলতে চাইছে, তোমাকে দায়িত্ব নিতে হবে, তোমাকে পালাতে দেব না আমরা। তোমার মায়ের মৃত্যুর দায়িত্ব তুমি নেবে কি না তা এখনও ভেবে দেখো! আমার ইচ্ছে হল টেলিফোনটা আছড়ে ভেঙে ফেলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *