2 of 3

৮১. আপার মা আর বাবা

৮১

আপার মা আর বাবা দুজনেই শান্ত মানুষ। শান্ত এবং স্থির। তাঁদের দুজনের মধ্যে কখনও ঝগড়াঝাঁটি বা কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয় না। দুজনেই খুব ধার্মিক। পুজো-আচ্চা তাদের বাড়িতে লেগেই থাকে। আপার বাবা মস্ত সরকারি অফিসার, কিন্তু ঠাঁটঠমক বিশেষ নেই। কাজ-অন্ত প্রাণ। আপার দুই দাদার একজন আই আই টি-তে ইনজিনিয়ারিং-এর ফাইনাল ইয়ার পড়ছে খড়গপুরে। অন্য জন দিল্লিতে ম্যানেজমেন্ট শিখছে।

বিমলাকে সন্ধেবেলা যখন ঘরে তুলে আনল আপা তখনও তার বাবা ফেরেননি। মা একটু আতঙ্কিত হয়ে বললেন, এসব কী ব্যাপার?

আপা সংক্ষেপে সব বলল, মায়ের কাছে সে প্রায় কিছুই গোপন করে না।

মা শুনলেন এবং শান্তভাবে বললেন, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় বাইরের লোকের ঢুকে পড়াটা বিপজ্জনক। বিমলাকে ভিতরের ঘরে নিয়ে যাও। যশবীর এলে তুমি বেরিও না। যা বলবার আমি বা তোমার বাবা বলব।

কেন মা, যশবীরকে তো আমি ভয় পাই না।

ভয় পাওয়ার কথা বলছি না। তুমি কাউকেই ভয় পাও না, তা আমি জানি। কিন্তু তুমি হয়তো গরম গরম কথা বলবে, তোমার বয়স তো অল্প। আমরা বুঝিয়ে বলতে পারব।

যশবীর যদি বিমলাকে নিয়ে যেতে চায়?

যাতে না নেয় তা দেখব। তবে তুমি নিশ্চয়ই চাও না যে, ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাক?

চাই মা। বিমলার যা অবস্থা করেছে তাতে তো ও মরেই যেত। এর পর হয়তো সত্যিই মেরে ফেলবে। যশবীর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।

তুমি তো দূরবীন দিয়ে দুনিয়াকে দেখছ, তাই এমন মনে হচ্ছে। যাকগে, তুমি বিমলাকে ভিতরের ঘরে নিয়ে শুইয়ে দাও। তুমি আজ ওর সঙ্গেই থাকবে। যশবীরকে আমরা সামলাবো। যশবীরকে আমি চিনি, আমাকে আন্টি বলে ডাকে।

বিমলাকে নিজের ঘরে নিয়ে এল আপা। তার খাটটা বেশ বড়। দুজনের অনায়াসে হয়ে যাবে। বিমলা বাথরুম থেকে চোখেমুখে জল দিয়ে এসে বসল, তারপর বলল, কেন ঝামেলা পাকালে? তোমার বোঝা হয়ে তো থাকা যাবে না।

আপা বলল, কেউ কারও বোঝা নয় বিমলা। কিন্তু বিপদে পড়লে একে অন্যের ওপর নির্ভর না করলে কি হয়?

আন্টি আর আঙ্কলকেও বিপদে ফেলা হল।

ওসব ভেবো না। আমাদের পরিবারটা একটু অন্যরকম। আমরা নিজেদের নিয়ে থাকতে ভালবাসি না। আমাদের ভয়ডরও একটু কম। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারটা আমাকে বলবে?

বিছানায় গুটিসুটি হয়ে অসহায়ের মতো বসেছিল বিমলা। খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। চোখ দুটিতে গভীর একটা হতাশা। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, বলতে গেলেই আমার খুব কান্না পাবে।

কাঁদবে কেন? মনটাকে শক্ত করার সময় এসেছে বিমলা। এই টরচার সহ্য করো কি করে? কী চায় যশবীর?

যশবীর চায় অল অ্যাটেনশনস্। যখন বাড়ি আসবে তখনই আমাকে অ্যালার্ট থাকতে হবে। সে সময়ে বাইরে কোথাও গেলে রেগে যায় ভীষণ। অসম্ভব পজেসিভ। আমাকে অনেকটা পুতুল বানিয়ে রাখতে চায়। সাজো-গোজো, টি ভি দেখ, মার্কেটিং করো, ঘর সাজাও, কিন্তু গণ্ডির মধ্যে থাকো। যেন আমার আলাদা মত নেই, সত্তা নেই, চরিত্র নেই। আমি দাসী না পুতুল, বলো তো!

তুমি কোনোটাই নও, যশবীরকে সেটা বুঝিয়ে দেব।

প্লিজ! ওর সঙ্গে কনফ্রন্টেশনে গিয়ে বিপদে পড়ো না, ও কিন্তু খ্যাপাটে আছে।

আপা হাসল, তোমার মতো আমি ভিতু নই।

জানি আপা, তোমার খুব সাহস। কিন্তু যশবীর তো পশুর মতো হয়ে গেছে। সাবধান হওয়া ভাল।

কাল রাতে কী হয়েছিল?

রোজই হচ্ছে। ইদানীং ওর মাথায় এসেছে, আমি উইমেন্স লিব করছি। ওকে ঠিকমতো দেখভাল করছি না। কি করব বলো? লেডিজ গ্রুপের হয়ে আমাকে কিছু কাজ করতে হচ্ছে। সাবস্ক্রিপশন, অ্যাকাউন্টস, মিটিং-এ কিছু সময় দিতে হয়। ইদানীং ফিরতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। প্রথম তাই নিয়ে ঝগড়া। বাঙালি মেয়েদের মতো স্বাধীন তো নই আমরা। আমাদের স্বামীসেবা করতেই হয়। সেটাতে ঢিলেমি দেখা দিলেই মুশকিল। কিন্তু আমার আর ভাল লাগে না। যশবীরের তো কোনও কালচার নেই। সারা দিন লরি, ট্রাক, খালাসি, ড্রাইভারদের সঙ্গে কাটায়, বাড়ি ফিরে হুইস্কি আর হিন্দি সিনেমা, তারপর খাওয়া আর শোওয়া। ছুটির দিনে মাঝেমধ্যে একটু আউটিং বা সিনেমায় যাওয়া। লোকটাকে আমার আর একদম ভাল লাগছে না। জীবনের কত দিকে কত কী ঘটে যাচ্ছে, ও তার কোনও খবরই রাখে না। ওর অন্য সব ভাড়াটে মেয়ের সঙ্গেও সম্পর্ক আছে। ওর এক বন্ধু কিছুদিন আগে মারা গেছে। সেই বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গেও আছে। এগুলো কিন্তু সন্দেহ নয়, সব সত্যি।

ডাক্তার এলেন। বিমলার হাতপায়ের বাঁধনের জায়গা, মুখে স্টিকিং প্লাস্টারের দাগ সবই লক্ষ করলেন। গম্ভীর মুখে নাড়ি, বুক সব পরীক্ষা করে দেখে আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেরি শকিং। কী হয়েছিল?

পাড়ার চেনা ডাক্তার, আপা মৃদু স্বরে বলল, ওর স্বামী ওকে নিজের পৌরুষ আর কর্তৃত্ব দেখিয়েছে। ওর কেমন অবস্থা ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার দাশগুপ্ত গম্ভীর মুখে বললেন, এমনিতে ঠিক আছে। কিন্তু যশবীরটা যে এরকম অমানুষ তা তো জানতাম না।

আপা বলল, ওর মাথায় হঠাৎ যেন ভূত চেপেছে।

ডাক্তারবাবু মাথা নেড়ে বলেন, তাহলে আপাতত ওদের সেপারেট থাকাই ভাল। একসঙ্গে হলেই আবার গণ্ডগোল হবে। আজকাল খুনোখুনিও হচ্ছে।

ডাক্তার একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে গেলেন। বললেন, রেস্ট নিতে বলল। একটু ঘুমের ট্যাবলেট দিয়ে গেলাম। ওটা কিন্তু অবশ্য খাওয়াবে। কোনওরকম উত্তেজনা বারণ।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর বিমলা বলল, ওর সব অত্যাচার আধিপত্য মেনে নিচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মনে হতে লাগল, এতে আমার কী লাভ হচ্ছে? আমি কী পাচ্ছি ওর কাছ থেকে? অকেশনাল সেক্স আর শাড়ি গয়না বা প্রেজেন্টেশন। এসব দিয়ে কী হবে? আমি কি শুধু যশবীরের বউ? এ ছাড়া কি আমার অন্য পরিচয় কিছু নেই? আমাদের লেডিজ গ্রুপে এইসব নিয়েই তো কথা হয়। তাই ইদানীং আমি ওর মেজাজমর্জিকে বেশি পাত্তা দিচ্ছিলাম না। ফলে ঝগড়া হতে লাগল, বুঝতে পারছিলাম ও আমার স্বাধীনতা, স্বাধীন চিন্তা, বাইরের কাজ সহ্য করতে পারছে না। ও চায় আমি সারা দিন ওর ধ্যান করি। কিন্তু ধ্যান করার মতো মানুষ তো আগে ওকে হতে হবে! ও তো একটা পয়সা কামানোর যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়।

বেশির ভাগ মানুষই তাই। তুমি কি কিছু ভাবছ?

কিসের কথা বলছ?

যশবীরের সঙ্গে থাকবে, না আলাদা হবে?

ডিভোর্স? আমার বাপের বাড়ি খুব রক্ষণশীল পরিবার। তারা আমাকে ডিভোর্স করতে দেবে না।

তাহলে?

আমি সেপারেট থাকতে চাই। আমার লেডিজ গ্রুপ আমাকে হেল্প করবে।

আমরাও সাহায্য করব।

আপা, তোমার ওপর যশবীরের খুব রাগ। ও তোমাকে দেখতে পারে না। হি ইজ এ ডেনজারাস ম্যান। আমাকে তোমাদের বাড়িতে এনে তুমি নিজের বিপদ ডেকে আনছ। আমি জানি তুমি খুব সাহসী মেয়ে। কিন্তু পুরুষের ইগো যে কী সাতিক হয় তা তো তুমি জানো না।

আমি এ সবই শিখছি। জানছি। মানুষ ধীরে ধীরে শেখে। যশবীর যে আমাকে পছন্দ করে না তা আমি জানি।

তবু রিস্ক নিচ্ছ?

রিস্ক না নিলে কি জানতে পারব? তুমি অত ভেবো না। এ পাড়ায় আমার কিছু বন্ধু আছে। পিছনের বস্তির লোকজন। আমি তেমন দরকার হলে তাদের ডাকতে পারি। আশা করি ততটা করতে হবে না। তুমি কিছু খেয়ে নাও। তারপর ওষুধ খেয়ে ঘুমোও। খুব টেনশন গেছে তোমার।

পাড়ার দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে এসে আপা দেখল, বিমলা খেতে বসেছে। কিন্তু কিছু খেতে পারছে না। বলল, ভমিটিং টেন্ডেন্সি হচ্ছে। কি করে খাবো?

মা বললেন, আচার দিয়ে খাও। ভাল আচার আছে।

বিমলা মাথা নেড়ে বলে, না আন্টি। আমি বরং শুধু ঘোলটা খাই। সলিড ফুড ভিতরে যাচ্ছে না।

তাই খাও।

ওষুধ খেয়ে বিমলা শুলো। আপা দরজা টেনে দিল বাইরে থেকে।

মা খাবার টেবিল গোছাতে গোছাতে বললেন, তোমার এসব সোশ্যাল ওয়ার্কের জের আমাকে আর কত টানতে হবে?

আপা একটুও হাসল না। গম্ভীর মুখে বলল, আমাকে তো অনেক টানতে হবে মা। সমাজটা এত পচা-গলা।

মা তার দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বললেন, তোমার বিচার খুব একপেশে। যশবীর কিন্তু খুব খারাপ লোক নয়। মদ খায়, সে তো বহু মানুষ খায়। কিন্তু তার স্বভাব বা কথাবার্তা আমার তো খারাপ লাগে না। বিমলা কি খুব শান্তিপ্রিয় মেয়ে ভেবেছ? রোজ যশবীর ফিরলেই অশান্তি করে।

এটা কী হচ্ছে মা, তুমি যশবীরের পক্ষ নিচ্ছ? আজ সকালেই আমাকে ও ধাক্কা দিয়েছে। বিমলাকে তো প্রায় মেরেই ফেলেছিল।

মা গম্ভীর মুখে বলেন, ঘটনা ভাল করে জানো, তারপর বিচার কোরো। আমার ধারণা বিমলাকে যশবীর খুব ভালবাসে। আর ভালবাসার মধ্যে একটু দখলদারি থাকেই, নইলে ভালবাসা কিসের? যেমন আমাকে তুমি বলো, আমার মা। ওই আমার মা কথার মধ্যে একটু দখলদারি থাকে না কি?

এটা সে জিনিস নয় মা।

মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কি জানি কি! আজকাল সব পাল্টে যাচ্ছে।

হ্যাঁ মা, পাল্টে যাচ্ছে। পরিবর্তনটা তুমি বুঝতে পারছ না কেন?

তুমি কি বিমলাকে স্বাধীন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছ? ডিভোর্সের কথা বলেছ শুনলাম। কাজটা ভাল করনি। স্বাধীন হয়ে বিমলার লাভ হবে না। আরও কষ্টে পড়বে।

তুমি কি বলো ও অত্যাচারী স্বামীর পা ধরে থাকবে?

মা ব্যাজার মুখে বলেন, যশবীরকে আমার অত্যাচারী বলে মনে হয় না। হতে পারে ওর মাথা গরম। তারও কারণ বিমলাই। তুমি বোধ হয় এবার আমাকে নারীমুক্তির কথা শোনাবে! শোনো বোকা মেয়ে, নারীমুক্তি বলে কিছু নেই। প্রতি মুহূর্তেই পুরুষকে তার দরকার। কোনও মেয়ে যদি তার স্বামীকে না মানে, স্বাধীন হয়, তবে অন্য পুরুষরা তাকে ছিড়ে খাবে। স্বাধীন মেয়ের মতো এমন সহজ ভোগ্যবস্তু পুরুষের আর কী আছে? বহুভোগ্যা হলে কি স্বাধীন হওয়া হয়?

তাহলে মা, তুমিই স্বীকার করছ যে, পুরুষেরা পশুর মতোই। সুযোগ পেলেই মেয়েদের ছিঁড়ে খায়? তাহলে এই জাতকে মেয়েরা প্রভুর আসন দেবে কেন?

উপায় নেই বলে। পৃথিবীতে মেয়েদের আর কোনও উপায় নেই, তাই ওই নিয়ম মানতে হয়। মেয়েতে মেয়েতে তো আর বিয়ে হয় না!

আজকাল তাও হয় মা।

যা গম্ভীর মুখে বলেন, হয় যে তা আমিও শুনেছি। তোমার বাবা আমাকে মাঝে মাঝে সেসব খবর শোনায়। তুমি কি চাও সেইটেই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠুক? ওটা তো কুৎসিত একটা বিকৃতি। তাও যদি মেনে নিই, তাহলেও জেনো, মেয়েতে মেয়েতে বা পুরুষে পুরুষে বিয়ে হলে কোনওদিনই আর সন্তান হবে না। প্রকৃতিকে কি এতটা অস্বীকার করা যায়?

আপা একটু অবাক হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে রইল। তার শান্ত মা এত কথা কদাচিৎ বলে। আজ বলছে, তার কোনও কারণ আছে।

হ্যাঁ মা, যশবীর কি তোমাকে ঘুষ দেয়? কী ঘুষ দেয় বলো।

মা হাসলেন না। গোমড়া মুখেই বললেন, আমি যশবীরের পক্ষ নিচ্ছি না। সে অন্যায় করেছে। কিন্তু আগে ভাল করে দেখ, সেই অন্যায়ের পিছনে, আর কারও আর একটা অন্যায় আছে কি না।

ডোরবেল বাজতেই একটু চমকে উঠেছিল আপা। কিন্তু দরজা খুলে দেখা গেল, না, কোনও হামলাকারী নয়। আপার বাবা। দীর্ঘকায়, কালো, মজবুত চেহারা, কাঁচা-পাকা চুলের মানুষটি খুবই শান্ত ও দৃঢ় প্রকৃতির। কেন্দ্রীয় সরকারের মস্ত অফিসার। সকাল থেকে অনেক রাত অবধি নিবিষ্ট মনে অফিসে কাজ করে।

জামাকাপড় পাল্টানোর আগেই ভদ্রলোককে আপা ও তার মায়ের কাছ থেকে ঘটনাটা আদ্যোপান্ত শুনতে হল। আপা প্রশ্ন করল, বলো বাবা, আমি অন্যায় করেছি?

আপার বাবা ভ্রূ কুঁচকে বললেন, আমি কোনও অন্যায় দেখছি না। আমি চাই তুমি এরকম কাজই করো। কিন্তু কখনও যেন ভুল সিদ্ধান্ত নিও না।

তাহলে কি এটা ভুল হল?

যশবীর না ফিরলে তো বোঝা যাবে না। অপেক্ষা করো।

অপেক্ষা অবশ্য অনেকক্ষণই করতে হল। যশবীর ফিরল না।

রাত দুটো অবধি অপেক্ষা করল আপা। তারপর বাইরের ঘরে সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

যশবীর ফিরল সকালে। উসকোখুসকো চুল, রক্তবর্ণ চোখ, ক্লান্ত। প্রথমে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল, কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে সোজা আপাদের বাসায় এল। দরজা খুলল আপা-ই।

কী চাই?

যশবীর যেন সংকুচিত, ভীত। অপরাধী মুখ করে বলল, সি ইজ নট দেয়ার। বাট থ্যাংক ইউ। আই ওয়ান্ট হার ব্যাক।

আপা দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, বিমলা যাবে না। কোনওদিনই যাবে না।

একটু যেন অবাক হয়ে চেয়ে রইল যশবীর। শুধু প্রতিধ্বনি করল, যাবে না?

না। আপনার নামে পুলিশ কেস করা উচিত।

যশবীর কেমন যেন গুটিয়ে গেল। মাথা নিচু করে একটু ভেবে বলল, বিমলার সঙ্গে আমার একবার দেখা হতে পারে কি?

না। বিমলা আপনার সঙ্গে দেখা করবে না।

নিঃশব্দে পিছনে মা এসে দাঁড়িয়েছেন, টের পাচ্ছিল আপা। মা বুদ্ধিমতী। তাকে টপকাতে চেষ্টা করলেন না। শুধু পিছনে আড়ালে থেকেই বললেন, ওদের দেখা হওয়াটা কিন্তু দরকার আপা।

আপা কঠিন মুখ করে নীরব রইল।

যশবীর তার দিকে তাকাল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু স্বরে বলল, তুমি ওকে নিয়ে এসেছ বলে থ্যাংকস দিচ্ছি আপা। ঠিকই করেছ। আমার সঙ্গে বিমলার আর না-থাকাই ভাল। আমি ভীষণ জেলাস। আই লাভ হার ভেরি মাচ। টু মাচ। হয়তো সেই কারণেই আমার দিক থেকে ওর বিপদও বেশি। আই অ্যাম সরি ফর এভরিথিং।

এই বলে চলে গেল যশবীর। সে যে কোনও নাটক করল না, চেঁচামেচি করল না, গায়ের জোর দেখানোর চেষ্টা করল না এতে একটু অবাক হল আপা। হয়তো নিজের অপরাধের গুরুত্ব বুঝতে পেরে ভয় পেয়েছে। হয়তো ভেবেছিল, বিমলা মরে পড়ে আছে ফ্ল্যাটের মধ্যে, তাই মুখে অপরাধী ভাব। কিন্তু লোকটা যে আদ্যন্ত হৃদয়হীন তা তো মিথ্যে নয়।

আপা দরজা বন্ধ করে ফিরতেই মায়ের মুখোমুখি।

তুমি একটু মেজাজি আছ আপা।

আপা সামান্য রাগের গলায় বলল, আমি খুব ভাল মেয়ে মা, তাই ওকে পুলিশে দিইনি। ও তো খুনের চেষ্টাই করেছিল বিমলাকে।

ঠিক আছে। এখন বিমলাকে ঘুম থেকে তুলে খাওয়াও। ওর যে এখন কী হবে তাই ভাবছি।

স্বামী ছাড়াও মেয়েরা বাঁচে। তুমি ভেবো না।

মা আর কথা বাড়ালেন না।

বিমলা ওষুধের গাঢ় ঘুম থেকে উঠল বেলা ন’টায়।

ইস! কত বেলা হয়ে গেছে!

আপা বলল, তাতে কি? তোমার তো এখন রেস্ট-ই দরকার। কেমন আছ?

গায়ে হাতে-পায়ে কোমরে দারুণ ব্যথা। রাতে কিছু হয়নি তো!

না। যশবীর সকালে ফিরেছে। এসেছিল। তাড়িয়ে দিয়েছি।

বিমলা একটু চমকে উঠল, সহজে গেল?

গেল। ওর ভয় হয়েছে। বোধ হয় ভেবেছিল সকালে এসে তোমাকে মরা অবস্থায় দেখবে।

তাহলে কী করত?

কাপুরুষরা কী করে? তারা বউ খুন করে ফেরার হয়।

উঃ! বলে বিমলা দু’হাতে মুখ ঢেকে রইল কিছুক্ষণ।

তুমি যশবীরের কথা ভেবো না। তাতে শরীর খারাপ হবে।

আমি শুধু ওর নিষ্ঠুরতার কথা ভাবছি। ও যে আমাকে এত শাস্তি দিতে পারে তা আমার ধারণাই ছিল না। ওর কথা ভাবলেই আমার এত ভয় করছে!

সাড়ে ন’টা নাগাদ ফোনটা এল।

আমি একটু কৃষ্ণমূর্তিজীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

আপার বাবার আজ ছুটির দিন। শনিবার, পুজো-আচ্চা সেরে সবে সকালের জলখাবার খেতে বসেছিলেন। উঠে এসে ফোন ধরলেন। কি একটু শুনে নিয়ে বললেন, আচ্ছা, আসছি।

ফোনটা রেখে আপার দিকে চেয়ে বললেন, যশবীর কিছু বলতে চায়। আমি আসছি।

প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে বাবা ফিরলেন। বললেন, যশবীর চলে গেল।

মা বললেন, তার মানে?

বাবা অনুত্তেজিত গলায় বললেন, ওর একটা অদ্ভুত ধারণা হয়েছে যে, বিমলাকে ও হয়তো হঠাৎ ইমপালসের মাথায় কোনওদিন খুন-টুন করে ফেলতে পারে। ও নিজের বশে নেই। বলে গেল যে, ওর ফ্ল্যাটে বিমলা একাই থাকতে পারে। জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের পাসবই আর চেকবই দিয়ে গেল। আর ফ্ল্যাটের চাবি। আরও বলেছে, বিমলাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। যদি ও চায়।

বিমলা ভিতরের ঘর থেকে উঠে এসেছে। সব শুনে বলল, ওর কথায় বিশ্বাস কী? রাতে যদি ফিরে আসে?

কৃষ্ণমূর্তি শান্ত চোখে বিমলার দিকে চেয়ে বললেন, আমার চেয়ে তুমিই ওকে বেশি চেনো। কাজেই কোনটা করা ভাল হবে তা তুমিই ঠিক করো। তবে আমার মনে হল, যশবীরের মন খুব খারাপ। বেশ ভেঙেও পড়েছে। এক ড্রাইভারের অসুখ হওয়ায় কাল ট্রাক চালিয়ে আসানসোল গিয়েছিল। সারারাত ট্রাক চালিয়ে আজ সকালে এসে পৌঁছেছে। খুব টায়ার্ডও ছিল।

বিমলা মৃদু স্বরে বলল, আমি ওকে বিশ্বাস করি না আঙ্কল। আফটার ইয়েস্টারডেজ এক্সপিরিয়েন্স ওকে আর বিশ্বাস করা যায় না। আপা বুদ্ধি করে ফ্ল্যাটে না ঢুকলে আজ আমার ডেডবডিই পাওয়া যেত।

যশবীরও তাই বলছিল। খুব রিপেন্টেন্ট। যাই হোক, নিজের জিনিসপত্র ও নিয়ে গেছে। ফ্ল্যাটটা তোমার জন্য রেখে গেছে। বলেছে, ও তোমাকে আর কখনও ডিস্টার্ব করবে না।

বিমলা একটা শ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল, টু বি অন দি সেফ সাইড আমি আরও দু’ দিন আপনাদের শেলটার চাই। ওর মতলবটা এখনও আমার বোঝা বাকি আছে।

ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম। তুমি আমাদের কাছেই এখন থাকো। তোমার চিকিৎসা এবং বিশ্রামও দরকার। যশবীরকেও ওয়াচ করা যাক। ডোন্ট ওরি।

আপা সব শুনল। দাবার খেলায় প্রতিপক্ষ যেন প্রত্যাশিত চালটা দিল না। এমন কূট চাল দিল যে আপা খেলাটা বুঝতে পারছে না।

সোমবার স্কুলে যেতেই বন্ধুরা ঘিরে ধরল, যশবীরের কী হল আপা? বলো তো আমরা গিয়ে ধোলাই দিয়ে আসি।

আপা গম্ভীর মুখে বলল, তার দরকার হবে না। যশবীর হার মেনে নিয়েছে।

বুবকা হতাশার গলায় বলল, যাঃ, তাহলে তো অ্যাডভেনচারটা মাটি হয়ে গেল। হার মানল কেন?

স্ট্র্যাটেজিক রিট্রিট হতে পারে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। যাই হোক, এখন আর তোমাদের কিছু করার নেই।

আরও তিন দিন বাদে বিমলাকে সঙ্গে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিল আপা। ফ্ল্যাটের ভিতরে একটু ধুলো পড়েছে আর সোঁদা গন্ধ জমেছে একটু। আর সব ঠিকই আছে।

আপা বিমলাকে ঘরদোর পরিষ্কার করতে সাহায্য করল। তারপর বলল, এখন তুমি স্বাধীন।

বিমলা আপার দিকে চিন্তিত মুখে চেয়ে বলল, আপা, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

কী বিশ্বাস হচ্ছে না?

যশবীর ঠিক এরকম নয়। এত মিক্‌লি ও আমাকে রেহাই দেবে সেরকম মানুষ কি যশবীর?

তোমার কি এখনও ভয় করছে?

না। আর ভয় করছে না। এখন একটু চিন্তা হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *