৮০. হাসিবের হত্যাকারী

অধ্যায় ৮০

নুরে ছফা বিস্ময়ে চেয়ে আছে পিএসের দিকে। তার ধারণা ছিলো, ভদ্রলোক নিজের বড় বোনের ছেলে হাসিবের হত্যাকারীকে ধরতে চায়, মৃত্যুপথযাত্রি বোনকে শেষ একটি সুসংবাদ দিতে চায়-তার ছেলের হত্যাকারী ধরা পড়েছে।

কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে, ব্যক্তিগত আবেগও হেরে যায় মানুষের লোভ আর স্বার্থের কাছে! যৌবন দীর্ঘায়িত করা কিংবা আয়ুবৃদ্ধির আকাঙ্খার মতো লালসা দ্বিতীয়টি আছে কিনা ছফা জানে না। কেএস খানের সতর্ক বাণীটার কথা আরেকবার মনে পড়ে গেলো তার। অভিজ্ঞ ইনভিস্টিগেটর যেনো দিব্যদৃষ্টিতে সব কিছু আগেভাগে দেখতে পেয়েছিলো।

আক্ষেপে মাথা দোলালো। মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার পর, বিগত তিন বছরে হাতে গোণা কয়েক বার ফোন করেছিলো প্রধানমন্ত্রীর পিএস, এছাড়া খুব একটা তাড়া দেয়নি। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রি বোনের কাছ থেকে মুশকানের যৌবন দীর্ঘায়িত করার রহস্যের কথা জানতে পেরে কেন উঠে পড়ে লাগলো-এবার সেটা পরিস্কার হয়ে উঠেছে তার কাছে।

সুস্মিতা নামের বন্দী মেয়েটি মুশকান জুবেরি কিনা সেটা নিশ্চিত হবার জন্য এই তথ্যটা নাকি জানতে চেয়েছিলো আশেক মাহমুদ-ছফার কাছে এটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। সুস্মিতা যে মুশকান সেটা প্রমাণ করার কিছু নেই। ছফা নিশ্চিত হয়েই কলকাতা থেকে এসেছে।

“আমাকে অনেক টর্চার করেছে এরা, শ্যামলকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে…অবশেষে বাধ্য হয়েই বানিয়ে টানিয়ে কিছু একটা বলে দিয়েছি।”

পিএসের মুখ কঠিন হয়ে গেলেও পরক্ষণেই অভিব্যক্তি পাল্টে হাসিমুখে বললো, “দেখলেন তো…আবার ভোল পাল্টে ফেলেছে!”

মাথা নেড়ে সায় না দিয়ে পারলো না ডিবির ইনভেস্টিগেটর। “তাহলে তুমি বলতে চাইছো, তুমি মুশকান জুবেরি নও?”

“অবশ্যই না! আমি সুস্মিতা সমাদ্দার। ডাক্তার আসকার আমার বাবা!”

আক্ষেপে মাথা দোলালো নুরে ছফা। পিএস আশেক মাহমুদ আর তার গানম্যান আসলাম মুচকি হাসছে।

“তাহলে প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিক আর সুকুমার রঞ্জনকে হত্যা করেছে কে?” প্রশ্নটা না করে পারলো না।

গভীর করে দম নিয়ে নিলো সুস্মিতা।

“আমি সব জানি। সুকুমার রঞ্জনের নিখোঁজ কেসে কলকাতার পুলিশ সল্টলেকের বাড়িতে গিয়েছিলো তোমাকে ইন্টেরোগেট করার জন্য। কিন্তু তারা দ্বিতীয়বার সেখানে যাবার আগেই তুমি পালিয়ে যাও।”

সুস্মিতা বিস্মিত হলো, নিজের অভিব্যক্তি লুকাতে পারলো না পুরোপুরি।

“অবশ্য ডিপি মল্লিককে যে তুমিই হত্যা করেছে সেটা এখনও তারা জানে না।” একটু থেমে বন্দীর চোখে চোখ রেখে জোর দিয়ে বললো সে, “কিন্তু আমি জেনে গেছি।”

কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বললো না। ঘরে নেমে এলো নীরবতা।

“এসবের কী ব্যাখ্যা আছে তোমার কাছে?”

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো সুস্মিতা। “আমি না…মুশকান জুবেরি! ও খুন করেছে সুকুমারকে!”

নুরে ছফা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। একই অবস্থা পিএস আর আসলামেরও।

“সব দোষ বাপাইর!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো বন্দী। “ওর জন্যই আজকে আমার এই অবস্থা।”

“কে? কার কথা বলছো?” বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো ছফা।

“আমার বাবা…ডক্টর আসকার।”

মাথা দোলালো আক্ষেপে। “আমার তো মনে হয় ডাক্তারের প্রতি তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। উনিই তোমাকে কলকাতায় আশ্রয় দিয়েছেন…এতো কিছু করেছেন!”

ভুরু কুঁচকে তাকালো সুস্মিতা। “আমাকে আশ্রয় দিয়েছে? হোয়াট দ্য হেল ইউ আর টকিং! এই জেনে এসছেন কলকাতা থেকে?” রাগেক্ষোভে মাথা দোলালো সে। “ওটা আমার মায়ের বাড়ি…সব্বাই জানে!”

বাঁকা হাসি দিলো ছফা। “তাহলে মুশকান জুবেরি অন্য একজন? আর তুমি তাকে চেনো?”

গভীর করে নিশ্বাস নিলো সুস্মিতা। “হ্যাঁ, আমি ওকে চিনি।”

বন্দীর কাছ থেকে আরো কিছু শুনতে চায় ছফা। দেখতে চায়, মুশকান জুবেরির নতুন কৌশলটা কী রকম।

“আপনি যাকে খুঁজে বের করেছেন সে মুশকান জুবেরি? আমি না! ও-ই যত নষ্টের মূল। রুটস অব ইভিল!” চোখমুখ বিকৃত করে বললো।

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো ছফা। “কী বলতে চাইছো, তুমি?!”

আবারো গভীর করে দম নিয়ে নিলো বন্দী। “বাপাই ওই মহিলাকে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েই যতো বিপদ ডেকে এনেছে।”

নুরে ছফার মনে হলো আবারো একটা গোলকধাঁধায় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাকে। ঘন সাদা ধোঁয়াময় এক অন্ধকার!

“ও চালাকি করছে,” আস্তে করে বললো পিএস। “ওর কথা বিশ্বাস করবেন না।”

ছফা মাথা নেড়ে সায় দিলেও জানতে চাইলে বন্দীর কাছে, “তাহলে প্লাস্টিক সার্জনকেও তুমি চিনতে? সুকুমার রঞ্জনকেও?”

“সার্জনকে আমি চিনি না, কিন্তু সুকুমারকে চিনতাম…ও আমার ফ্রেন্ড ছিলো।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো ছফা।

“কিন্তু মুশকান ওকে কী করেছে জানি না। মহিলা আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরই পুলিশ আসে, ওরা সুকুমারের নিখোঁজ হবার জন্য আমাকেই সন্দেহ করতে শুরু করে।”

“তুমি তাহলে জানো না মুশকান জুবেরি ওকে কী করেছে?” ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো ছফা।

“প্রথম দিকে কিছুই জানতাম না। বাড়িতে পুলিশ আসার পর বাপাইর কাছে জানতে চেয়েছিলাম…বাপাইও কিছু জানে না এ ব্যাপারে। তবে মুশকান পালিয়ে গেলে বুঝতে পারি কাজটা ও-ই করেছে। আমার কাছে সবটাই পরিস্কার হয়ে ওঠে তখন।”

“এই ডাইনি সব নাটক করছে, ছফা!” রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালো পিএস। “ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না। একেক সময় একেক কথা বলে বিভ্রান্ত করছে।”

ছফার কাছে অবশ্য তা মনে হচ্ছে না, তবে সে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চায়।

“সুকুমারের সাথে ঐ মহিলার ঠিক কী নিয়ে ঝামেলা হয়েছিলো আমি কিছু জানি না। বিশ্বাস করুন। প্রায় কেঁদেই ফেললো সে। “আমি যে সত্যি বলেছি, সেটা এক সময় না এক সময় ঠিকই বুঝতে পারবেন আপনারা। আর যখন বুঝতে পারবেন, খুবই পস্তাবেন!” বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো কথাগুলো। “আপনারা ভুল মানুষকে ধরে এনে কী সব উল্টাপাল্টা কথা জানতে চাইছেন!”

ছফা ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো বন্দীর দিকে। এই মেয়ে দাবি করছে, প্লাস্টিক সার্জন আর সুকুমারের গুমের ব্যাপারে সে কিছু জানে না। তারপরই ছফার মনে হলো, সে এই মেয়ের সব কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। কিন্তু মেয়েটার কথায় কিছু ফাঁক আছে। নড়েচড়ে বসলো সে।

“তোমার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতায় ডাক্তার আসকারের শ্বশুড় বাড়ির দারোয়ান দু-জন মেয়ের কথা কেন বলেনি?” ছফা স্থিরচোখে তাকিয়ে রইলো বন্দীর দিকে।

“আমার সব কথা আগে শুনুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।”

“বলো, কী বলবে।”

আশেক মাহমুদ আর আসলাম অসন্তুষ্ট হলেও কিছু বললো না।

চোখ বন্ধ করে ফেললো সুস্মিতা, গভীর করে শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো : “বছরখানেকেরও বেশি হবে, হুট করেই লন্ডন থেকে কলকাতায় চলে আসি আমি, বাড়িতে এসে দেখি তিন তলায় এক মহিলা এসে উঠেছে। বাপাই বললো, তার এক বন্ধুর মেয়ে। তো, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগেনি। আমি খুব প্রাইভেসি সচেতন, আর আমাদের বাড়িটা আসলে ডুপ্লেক্স, অনেক পরে ছাদের এক অংশে একটা রুম বানিয়েছিলো পারমিতা মাসি…আমার মায়ের বড় বোন।” একটু থেমে আবার বললো, “মাসি মারা। যাবার পর ওটা খালিই ছিলো, ওখানে পরিবারের বাইরে কাউকে থাকতে দেয়াটা আমার পছন্দ হয়নি। তবে বাপাইর কারণে আমি এ নিয়ে কিছু বলিনি।”

ছফা মনে করার চেষ্টা করলো। সুকুমারের কেসটা যে অফিসার তদন্ত করছে, সে বলেছিলো, তিন তলায় সুস্মিতার এক কাজিন থাকতো। সুস্মিতা পালিয়ে যাবার পর সেই মহিলাও বাড়ি ছাড়ে। তাহলে কি ওটাই মুশকান ছিলো? মেয়েটা সত্যি বলছে?

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেললো সে। “তোমার বাবা তখন কোথায় ছিলেন?”

ছফার দিকে তাকালে বন্দী। “বাপাই তো আজ এখানে কাল ওখানে…সেই ছোটোবেলা থেকেই এমনটা দেখে আসছি। মাঝেমধ্যে আসতো…ক-দিন থেকে আবার চলেও যেতো।”

কিছু বললো না ছফা।

“একই বাড়িতে থাকার কারণে ওই মহিলার সাথে রোজই দেখা হতো। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠলো। আমার বাড়িতে যেহেতু বন্ধুবান্ধবের আড্ডা হতো, ওই মহিলার সাথে আমার কিছু বন্ধুর ভালোই সখ্যতা গড়ে ওঠে এক সময়। সুকুমারের সাথেও বেশ ভালো জানাশোনা ছিলো ওর।”

ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। কেউ মিথ্যে কথা বললে সেটার ধরার মতো প্রশিক্ষণ তার আছে, সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, মেয়েটার কথা কতোটুকু সত্যি।

“এক দিন হুট করেই, কাউকে কিছু না বলে ঐ মহিলা আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেলো, তারপরই বাসায় এলো পুলিশ। জানালো, সুকুমারকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তখনও বুঝতে পারিনি কিছু। আর সুকুমার যে ঐদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলো সেটাও জানতাম না, তাই পুলিশকে বলেছি, ওইদিন ও আমাদের বাড়িতে আসেনি।”

“তারপর?”

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো সুস্মিতা। পুলিশ আসার কথা বাপাইকে বলার পরই ও আমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে, দ্রুত লন্ডন থেকে চলে আসে কলকাতায়। বাপাই-ই আমাকে কনভিন্স করে, তদন্ত এগোতে থাকলে নাকি আমি ফেঁসে যাবো, কেননা সুকুমার আমার বন্ধু ছিলো। পুলিশকে যদি এখন মুশকানের কথা বলিও তারা এটা বিশ্বাস করবে না। ভাববে, নিজেকে বাঁচানোর জন্য এমন এক ভুতের অবতারণা করছি যার অস্তিত্বই নেই।”

“কেন, তোমার বাড়ির দারোয়ান সাক্ষি দিতে পারতো, তোমাদের বাসায় আরেকজন মহিলা থাকতো তিন তলায়?”

মাথা দোলালো সুস্মিতা। “ঐ মহিলা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর পর পুরনো দারোয়ানকে চাকরি থেকে বিদায় করে দেয় বাপাই। নতুন দারোয়ান ঐ মহিলার ব্যাপারে কিছুই জানতো না।”

ছফা বুঝতে পারলো, মুশকানকে বাঁচানোর জন্য ডাক্তার আসকার এসব করেছেন-অবশ্যই ঐ মহিলার নির্দেশমতো। মেয়েটার কথা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হচ্ছে এখন। এখনকার দারোয়ানও ইন্সপেক্টর অতনুর কাছে স্বীকার করেছিলো, সে এমন কি সুস্মিতাকে দেখেওনি। তার কথা শোনেনি। মুশকান তো দূরের কথা! ইন্সপেক্টর অতনু যা কিছু জেনেছে পুরনো দারোয়ানের কাছ থেকেই জেনেছে।

“এ দেশে ঢোকার পর তুমি কি সরাসরি সুন্দরপুরেই চলে গেছিলে?”

“না। আমি ঢাকায় থেকেছি কয়েক মাস…হাপিয়ে উঠেছিলাম এখানে। এ শহরে বাপাই ছাড়া আমার কোনো পরিচিত মানুষজন ছিলো না, শহরটাও আমার একদম ভালো লাগতো না। তাছাড়া, বাপাইও বাইরে যাবে বলে আমাকে একা রাখতে চায়নি এখানে। ও ঠিক বুঝতে পারছিলো না কী করবে। এরকম সময়ে একদিন আমাকে নিয়ে সুন্দরপুরে গেলো স্কুলটা দেখতে, জায়গাটা ভীষণ ভালো লেগে গেলো আমার। তখনই বাপাই বলেছিলো, চাইলে এখানে গানের টিচার হিসেবে জয়েন করতে পারি আমি। অফারটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই।”

ছফার লাই-ডিটেক্টিং প্রশিক্ষণ কাজে দিলো না। ধন্দে পড়ে গেলো সে। মেয়েটা সত্যি বলছে নাকি মিথ্যে সিদ্ধান্তে আসতে পারলো না। কিছু বলতে যাবে, অমনি তার ফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে বের করলো সেটা, কলার আইডি দেখে কিছুটা অবাকই হলো। এই অসময়ে কেএস খান তাকে ফোন দিয়েছে! একান্ত অনিচ্ছায় কলটা রিসিভ করলো।

“হ্যালো, স্যার?”

পিএস, আসলামসহ সুস্মিতাও আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকলে তার দিকে।

একটু ইতস্তত করে ছফা বললো, “জি, স্যার।” ওপাশের কথা শুনে গেলো সে। খুব দ্রুত তার অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো, রীতিমতো চমকে উঠলো যেনো। “কি?!”

.

অধ্যায় ৮১

মুশকান জুবেরিকে শিয়রে দেখতে পেয়ে কেএস খান তার জীবনে সবচাইতে বড় ভয়টা পেয়েছিলো। ভুত দেখলেও হয়তো এতোটা ভড়কে যেতো না সাবেক এই ইনভেস্টিগেটর। যে মহিলা মানুষ খেয়ে ফেলে তার সঙ্গে কি ভুতের তুলনা চলে? ভুত কখনও মানুষ খেয়েছে বলে জানা নেই তার!

মহিলাকে দেখে মি. খানের ভয়ে জমে যাবার আরো কারণ ছিলো-মানুষখেকো মুশকান জুবেরির হাতে পিস্তলও আছে!

“একদম আওয়াজ করবেন না,” শান্তকণ্ঠে বলেছিলো মিসেস জুবেরি। “আপনার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”

“আইনস্টাইরে কী করছেন?” ঢোঁক গিলে প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে জানতে চেয়েছিলো কেএস খান।

ভুরু কুঁচকে ফেলেছিলো মহিলা। “কার কথা বলছেন?!”

ভুলটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিলো, “ঐ পোলাটা…দরজা খুইলা দিছে যে।”

“ওহ্,” মুশকান জুবেরি বুঝতে পেরে বলেছিলো। “ওর নাম আইনস্টাইন?”

আবারো ঢোঁক গিলে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলো মি. খান। “হ…আমি দিছি…নামটা।”

“সুন্দর নাম!” প্রশংসার সুরে বলে ওঠে মুশকান। তারপর দেয়ালে টাঙানো আইনস্টাইনের জিভ বের করে রাখা কৌতুককর ছবিটার দিকে তাকায়।

খোদাদাদ শাহবাজ খান বুঝতে পারছিলো না, নুরে ছফা তাহলে কোন্ মুশকানকে খুঁজে পেয়েছে কলকাতায় গিয়ে? আর সুন্দরপুরেই বা গেলো কাকে ধরতে? ছফা তাকে জানিয়েছে, এই মহিলা কলকাতায় গিয়ে এক প্লাস্টিক সার্জনকে দিয়ে নিজের চেহারাটাই বদলে ফেলেছে! শুধু তা-ই নয়, সেই সঙ্গে নতুন পরিচয় আর সুস্মিতা সমাদ্দার নাম নিয়ে ফিরে গেছে সুন্দরপুরে! ছফার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তার সামনে এখন যে আছে সে কে?

এই মহিলাকে মুশকান হিসেবে মেনে নিতে কোনো দ্বিধা নেই তার। কদিন আগেই মহিলার ছবি তাকে দেখিয়েছিলো ছফা। ঐ ছবির সাথে এই মহিলার চেহারা একদম…

“ওকে নিয়ে ভাববেন না।”

মুশকানের কথায় কেএস খানের চিন্তায় ছেদ পড়ে। “কার কথা কইতাছেন?”

“আইনস্টাইন। ওকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ও এখন ঘুমাচ্ছে,” কথাটা বলে হাতঘড়িতে সময় দেখে নেয়। “আধঘণ্টা পর ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।”

“ওরে আপনে কী করছেন?” আতঙ্কের সাথে জানতে চায় সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

স্মিত হাসে মুশকান। “ও ঘুমিয়ে আছে, পাশের ঘরে বিছানায় রেখে এসেছি।”

“ঘুমায়া আছে!” আতঙ্কের সাথে বলেছিলো সে।

“ভয়ের কিছু নেই। এক ধরণের হার্ব ব্যবহার করেছি, তা-ও সামান্য পরিমাণের… ক্লোরোফর্ম ইউজ করিনি। ওর কোনো ক্ষতিই হবে না।”

কী ঔষধি গাছের নির্যাস ব্যবহার করেছে সেটা জানতে চায়নি সাবেক ডিবি অফিসার, তবে একটা দৃশ্য কল্পনা করতে পেরেছিলো সে : ছোট্ট আইনস্টাইন দরজা খুলে দেখতে পেলো অপরিচিত এক মহিলা। সে কে, কী চাই জিজ্ঞেস করেছিলো সম্ভবত। কিন্তু মুশকান জুবেরি সে প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলো কিনা কে জানে, ঝট করে ছেলেটার মুখ চেপে ধরেছিলো ভেষজ ওষুধ মাখানো রুমাল দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আইনস্টাইন অচেতন হয়ে ঢলে পড়ে, তাকে কোলে তুলে নিঃশব্দে পাশের ঘরের বিছানায় রেখে পিস্তলটা হাতে নিয়ে চলে আসে তার শিয়রে-সে তখন বইয়ের জগতে ডুবে ছিলো। যখন টের পেলো, ততোক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

“আমার কাছে কী চান আপনে?” মাথা থেকে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আসল প্রসঙ্গে চলে এসেছিলো কেএস খান।

কথাটা শুনে মুচকি হেসেছিলো মুশকান। “খুব সামান্য একটা জিনিস।” তারপর একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। “নুরে ছফাকে ফোন দিন।”

কেএস খান ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিলো কথাটা শুনে। “ওরে ফোন দিয়া কী বলবো?”

“এই যে, আমি এখন আপনার এখানে আছি।”

মি. খান বিশ্বাস করতে পারছিলো না, সামান্য এই কাজের জন্য মুশকান জুবেরি তার ডেরায় ‘হানা দিয়েছে। “খালি এইটাই বলবো?” অবিশ্বাসে বলেছিলো সে।

“উমম…” একটু ভেবে নেয় মুশকান। “ছফাকে বলুন, যে মেয়েটাকে তারা আটকে রেখেছে ওকে ছেড়ে দিতে।”

“আমি কইলেই কি সে ছাইড়া দিবো?” সাহস করেই কথাটা বলেছিলো কেএস খান।

“না, তা কেন করবে। মনে হয় না এতো সহজে ছেড়ে দেবে।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মি, খান।

“ওকে বলবেন, ঐ মেয়েটাকে না ছাড়লে আমি আপনাকে আর আইনস্টাইনকে মেরে ফেলবো।”

কথাটা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য খোদাদাদ শাহবাজ খানের হৃদস্পন্দন থমকে গিয়েছিলো।

“ভয় পাবেন না,” আশ্বস্ত করে বলেছিলো মুশকান। “এটা ছফাকে কনভিন্স করার জন্য বলবেন, আমি আপনাদের কিছু করবো না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”

কথাটা অন্য কেউ বললে হয়তো বিশ্বাস করতো, কিন্তু মানুষটা যখন মুশকান জুবেরি তখন বিশ্বাস করা কঠিন।

আমার বয়স কি তার টার্গেট হওনের উপযুক্ত? এই ভাবনাটা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিলো তার। আর আইনস্টাইন?

সম্ভবত ছফা বলেছিলো, মহিলা যুবক-তরুণদেরকে টার্গেট করে। তাছাড়া, সে হলো সার্বক্ষণিক অসুস্থ একজন মানুষ, সেদিক থেকে দেখলে আইনস্টাইন আর সে, দু-জনেই এই মহিলার শিকার হবার জন্য উপযুক্ত নয়।

“ফোন করুন…আমার হাতে সময় খুব বেশি নেই।”

কেএস খান আর দেরি করেনি, সেলফোনটা হাতে নিয়ে ছফাকে কল দেয়। যেমনটা আন্দাজ করেছিলো, তার কাছ থেকে কথাটা শুনে থ বনে গেছে ছফা। কয়েক মুহূর্ত কিছুই বলতে পারেনি।

কিন্তু মি, খান যদি এ সময় মুশকানের দিকে তাকাতে তালে দেখতে পেতো, তাদের কথাবার্তা শুনে তার চেয়ে কম অবাক হয়নি ঐ মহিলা।

“আপনি কী বলছেন, স্যার!” অবশেষে নুরে ছফা বলেছিলো তাকে।

“সত্যিই বলতাছি, ছফা,” আশ্বস্ত করে বলেছিলো। “মুশকান জুবেরি এখন আমার সামনে বইসা আছে।”

“আ-আপনি তাকে চিনলেন কিভাবে?” হতবহ্বল ছফা জানতে চাইলো।

গাল চুলকে নিয়েছিলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর। “কয়দিন আগে আপনে তার একটা ছবি দেখাইছিলেন আমারে…ভুইলা গেছেন?”

ওপাশ থেকে নীরবতা নেমে আসে।

“আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর, আমার সামনে যে বইসা আছে সে-ই মুশকান জুবেরি।”

ছফা হতভম্ব হয়ে গেছিলো।

“ভুল মানুষরে ট্র্যাক করছেন আপনে, এই ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নাই এখন।”

“মাই গড!” অস্ফুটস্বরে বলে উঠেছিলো ছফা। “…আপনার কাছে কেন এসেছে?…কী চায় সে?”

“যারে ধরছেন তারে যে আপনে ছাইড়া দেন। আর যদি না দেন…” গলা ধরে আসে কেএস খানের। “আমারে আর আইনস্টাইরে…বুঝবারই

তো পারছেন, তার কাছে একটা পিস্তলও আছে!”

“ওহ্!” জোরেই বলেছিলো ছফা, তারপরই জানতে চায়, “আইনস্টাইন কোথায় এখন, স্যার?”

“ওরে অজ্ঞান কইরা ফালাইছে।”

“ছফাকে বলুন, এই ফোন কলটা যেনো কেটে না দেয়, কেএস খানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে মুশকান। “কল কেটে দিলেই আপনাদের দুজনকে আমি শেষ করে দেবো।”

মি, খান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আতঙ্কভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিলো মুশকানের দিকে।

“ফোনটা ওকে দিন, স্যার,” ছফা বলেছিলো। আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।”

“ছফা আপনের সাথে কথা বলতে চাইতাছে।”

মুচকি হেসে মুশকান ফোনটা হাতে নিয়ে বেশ শান্ত কণ্ঠেই বলে, “হ্যালো, নুরে ছফা!”

.

অধ্যায় ৮২

ছফার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে ফোনের ওপাশে আছে মুশকান জুবেরি যাকে সে হন্যে হয়ে খুঁজছে বিগত তিন বছর ধরে। তার চেয়েও বড় কথা, কলকাতায় গিয়ে মাত্রই সে আবিষ্কার করেছে, এই মহিলা নিজের চেহারা পাল্টে, সুস্মিতা সমাদ্দার সেজে সুন্দরপুরের নতুন স্কুলে গানের শিক্ষকতা করছে! সেই সুস্মিতা সমাদ্দার এখন তাদের হাতেই বন্দী!

ছফার মনে হচ্ছে, তিল তিল করে বানানো বিশাল বড় একটি ভবন গুঁড়িয়ে পড়ছে চোখের নিমেষে-তাসের ঘরের মতো! নিজেকে পরাবাস্তব জগতে আবিষ্কার করলো সে। যে অসম্ভব গল্পের সন্ধান পেয়েছিলো সেটা যেনো মুখ থুবড়ে পড়েছে।

“আমাকে ভেবে তুমি সুস্মিতাকে আটকে রেখেছো!” ফোনের ওপাশ থেকে কথাটা বলেই হেসে ফেললো মুশকান।

ছফার চোখেমুখে একইসাথে বিস্ময় আর বিব্রত হবার অভিব্যক্তি। কয়েক মুহূর্তের জন্য হতবুদ্ধিকর হয়ে পড়লো সে। বন্দীর দিকে তাকালো। সুস্মিতা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, বোঝার চেষ্টা করছে কিছু। আর আশেক মাহমুদ, আসলাম কৌতূহল নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।

“আমি জানি তুমি এখন ওর সামনেই আছো…ওকে ছেড়ে দাও!” শান্ত কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুরে বললো মুশকান। “মি, খান আর বাচ্চা ছেলেটা প্রাণে বেঁচে যাবে।”

নুরে ছফা কী বলবে ভেবে পেলো না।

“এই কলটা কেটে গেলে ধরে নেবো তুমি চালাকি করছো, পুলিশকে ইনফর্ম করার চেষ্টা করছো, একটু থেমে কণ্ঠটা আরো গম্ভীর করে বললো, “এটা কোরো না, করলে আমি বাধ্য হবো ওদেরকে শেষ করে দিতে।”

“ওদের কিছু করবে না, খবরদার!” দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো ছফা।

এ কথা শুনে ঘরের সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকালো তার দিকে।

“সেরকম কিছু করার ইচ্ছেও নেই আমার, কিন্তু চালাকি করলে সেটা করতে বাধ্য হবো আমি।” ফোনের ওপাশ থেকে বললো মুশকান।

পিএস ইঙ্গিতে জানতে চাইলো কার সাথে কথা বলছে ছফা। এক হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করে বললো, “আমাকে একটু সময় দিতে হবে।”

“কীসের জন্যে?”

“সিদ্ধান্ত নিতে।”

“তুমি নিজে কি যথেষ্ট নও? সুস্মিতা কি তোমার কাছে বন্দী নয়?”

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ছফার ভেতর থেকে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

“চালাকি কোরো না। আমি জানি ও তোমার কাছেই আছে। এক্ষুণি সুস্মিতাকে ফোনটা দাও, আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই…এক মিনিট।”

ছফা সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না।

“আমার হাতে সময় খুব কম!” ফোনের ওপাশ থেকে তাড়া দিলো মুশকান।

মন্ত্ৰতাড়িতের মতো সুস্মিতার কাছে গিয়ে ওর কানে ফোনটা চেপে ধরে দাঁতে দাঁতে পিষে বললো ছফা, “কথা বলো।”

“কী করছেন?” পিএস আৎকে উঠলো। আসলাম অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

“প্লিজ,” হাত তুলে পিএসকে থামিয়ে দিলো ছফা, মুখে আঙুল তুলে চুপ থাকার ইশারা করলো।

“হ্যালো? কে বলছেন?” সুস্মিতা বলে উঠলো। তারপর ফোনের ওপাশে যে আছে তার কথা শুনে গেলো চুপচাপ। মেয়েটার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সামান্য। “হুম…” বললো সে। “ঠিকাছে।” কথাটা বলেই ফোন থেকে কানটা সরিয়ে নিলো।

ওদের কথা শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পেরে ফোনটা আবার নিজের কানে ঠেকালো ছফা।

“আরেক জনের কণ্ঠ শুনলাম…ওকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব তোমার। এই কলটা না কেটেই তুমি সুস্মিতাকে মুক্তি দেবে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম তোমাকে।”

“আমাকে কথা বলতে হবে, এতো কম সময়ে হবে না,” রেগেমেগে বলে উঠলো নুরে ছফা।

“এক মুহূর্তও নষ্ট কোরো না। মনে রেখো, পাঁচ মিনিট।”

ছফা ফোনটা নামিয়ে পিএসের দিকে তাকালো। “এই মেয়ে মুশকান জুবেরি না, স্যার।”

“কি?!” বিস্ময়ে বলে উঠলো আশেক মাহমুদ।

“আমরা ভুল মানুষকে ধরেছি।”

হতভম্ব হয়ে তাকালো পিএস। “কিন্তু আপনি তো কলকাতা থেকে সব জেনে এসেছেন!”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো ছফা। তার পুরো তদন্তটা যে এভাবে হাস্যকর হয়ে উঠবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। “আমার হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেছে…মনে হচ্ছে।”

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো পিএস। “কী বলছেন এসব!”

আসলামও সন্দেহভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।

“ওকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মুক্তি না দিলে আমার এক সিনিয়র রিটায়ার্ড অফিসার কেএস খান আর তার কাছে থাকা এক বাচ্চা ছেলেকে মুশকান মেরে ফেলবে! ও ওদেরকে জিম্মি করে রেখেছে।”

“ফাজলামি করেন আমার সাথে!?” অবিশ্বাসে বলে উঠলো আশেক মাহমুদ।

“ওকে ছেড়ে দেবো? পুরোপুরি কনফার্ম না হয়ে?”

“স্যার, দাঁতে দাঁত পিষে বললো ছফা। “আমি কনফার্ম হয়ে বলছি, এই মেয়ে মুশকান জুবেরি না। মুশকানের সাথে এইমাত্র আমার ফোনে কথা হয়েছে, এখনও লাইনে আছে সে।”

আশেক মাহমুদ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো ছফার দিকে। “ফাইন!” তারপর হাসিমুখে বলে উঠলো, “তাহলে ঐ মুশকানকে বলে দিন, সে ধরা দিলে আমরা একে মেরে ফেলবো!”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো ছফা।

“ওই ডাইনিকে ধরা দিতে হবে আমাদের হাতে, নইলে এই মেয়েটার সাথে খুব খারাপ কিছু করা হবে।”

“স্যার, মুশকান ধরা দেবে না, বোঝার চেষ্টা করুন!” জোর দিয়ে বললো ছফা। “আমরা ভুল একজনকে ধরেছি। ওকে ছেড়ে না দিলে দুটো মানুষের জীবন-”

“দুটো কেন, চার-পাঁচটা মানুষ মরে যাক, আমার কী!” আশেক মাহমুদ কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো। আমি ওকে ছাড়ছি না।”

ছফা চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলো। পিএস যে এরকম কথা বলবে একদমই বুঝতে পারেনি। “আপনি বোঝার চেষ্টা করুন, স্যার!”

“এই মেয়েকে ছেড়ে দেবার চিন্তা বাদ দিন। আপনি ঐ মুশকানকে ট্র্যাক করুন। এক্ষুণি!” হুকুমের স্বরে বললো আশেক মাহমুদ।

“আমার হাতে সময় নেই।”

“কে আপনাকে সময় বেঁধে দিয়েছে? ঐ মহিলা? ঐ ডাইনিটা?” রেগেমেগে বললো পিএস।

ছফা নিশূপ রইলো।

“আই সে, ট্র্যাক হার ডাউন!” প্রায় গর্জে উঠলো পিএস।

আক্ষেপে মাথা দোলালো সে, ডান হাত থেকে মোবাইলফোনটা বাঁ হাতে নিয়ে নিলো, তারপর ঝট করে কোমর থেকে তুলে নিলো পিস্তলটা, সোজা তা করলো আশেক মাহমুদ আর আসলামের দিকে। কয়েক পা পিছিয়ে গেলো দু-জনকে নিশানায় রাখার জন্য।

“সরি, স্যার। আমার কিছু করার নেই।”

“হাউ ডেয়ার ইউ আর!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো আশেক মাহমুদ। রাগে রীতিমতো কাঁপছে।

আসলাম যেনো বিস্ফোরিত হবে, তেড়ে আসতে চাইলো সে।

“খবরদার!” পিস্তলটা তার দিকে তাক করে বললো ছফা। “একদম নড়বে না।”

.

অধ্যায় ৮৩

ডাক্তার আসকার অরিয়েন্ট হাসপাতালের নিজের অফিস রুমে বসে আছেন। তার শরীর আগের চেয়ে ভালো তা বলা যাবে না। যদিও মনে হচ্ছে, রাত শেষ হবার আগেই তার নাজুক হৃদপিণ্ড এতো বেশি মানসিক চাপ সহ্য করতে পারবে না। সুস্মিতা নিরাপদে আছে-এটা না জানা পর্যন্ত বুকের এই ব্যথার উপশম হবে না।

সুস্মিতা এখন ক্ষমতাবান একজন মানুষের হাতে বন্দী। না জানি কতোটা অত্যাচার আর নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা! সন্তানকে এই বিপদে ফেলে দেয়ার জন্য তিনি নিজেই দায়ি! মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবেন না।

ছফার আগমণ টের পেয়ে নিজের সেলফোনটা ভেঙে কমোডে ফ্ল্যাশ করে দেন, আর সিমটা খুলে লুকিয়ে রাখেন কার্পেটের নীচে। ফলে, মেয়েটাকে জানাতেই পারেননি তিনি সুস্থ আছেন। সত্যি বলতে, সুস্মিতা যে তার খোঁজ করে, তাকে না পেয়ে ওয়াহাবকে ফোন দিতে পারে-এটা মাথায়ই ছিলো না। অসুস্থতার ভাণ করতে গিয়ে ওয়াহাবকে তিনি সত্যিটা জানাননি। ছেলেটাকে সেজন্যে দোষ দেয়া যাচ্ছে না। সে যা দেখেছে তা-ই বলেছে সুস্মিতাকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আসকার। শুভমিতা আর তার লাভচাইল্ড এই মেয়ে। তার জন্যই শুভমিতার সাথে বন্ধনটা পাকাপাকি করতে হয়েছিলো। কতোই না আদরের, কতোই না যত্নে বড় করেছেন। আর আজ, সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করেও কিছুই করতে পারছেন না। ঘুণাক্ষরেও যদি জানতেন, মুশকানকে সাহায্য করতে গেলে নিজের সন্তানের উপর এতো বড় বিপদ নেমে আসবে তাহলে কি তিনি কখনও কলকাতায় মুশকানকে আশ্রয় দিতেন?

আরেকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। মুশকানের সাথে তার বন্ধুত্ব সুদীর্ঘ কাল ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে যখনই দরকার পড়েছে, তারা একে অন্যেকে সাহায্য করেছে। তাদের বন্ধুত্বের এই শক্ত বন্ধন কখনও নড়বড়ে হয়নি, বরং দিনকে দিন সেটা পোক্ত হচ্ছে!

তার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা শুভমিতার আগমণ মুশকানের কল্যাণেই। লন্ডনে আসার পর শুভমিতার সাথে মুশকানের বন্ধুত্ব হয় খুব দ্রুত। তারা দুজনেই ছিলো রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত। ভালো গাইতেও পারতো। মুশকানই একদিন তার সঙ্গে শুভমিতার পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রথম দেখাতেই আসকারের মনে হয়েছিলো, সত্যিকারের ভালোবাসার সন্ধান পেয়ে গেছেন। মুশকানকে যখন কথাটা জানালেন, সে তো হেসে খুন। এতো দ্রুত? এতে স্বল্প সময়ে? লজ্জা পেয়েছিলেন আসকার। তবে গল্প-সিনেমার মতোই তাদের সম্পর্কটা প্রেমের দিকে গড়ায়, আর এক্ষেত্রে মুশকানের অবদানই ছিলো বেশি।

অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে আসতে চাইলেন ডাক্তার। তিন বছর আগে, ঐ কেএস খানের কথার ছলচাতুরিতে পড়ে নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হয়ে যদি মুশকানের আন্দিজের ঘটনার কথাটা না বলতেন, তাহলে এতো কিছু হতো কিনা কে জানে! যদিও তার এই ভুলের মাশুল তিনি শুধরেছেন কয়েক দিন আগে ছফাকে আরেকটি নতুন উপাখ্যান শুনিয়ে। অবশ্য এই উপাখ্যানটির জন্ম হয়েছিলো আরো অনেক আগে, যখন আমেরিকা থেকে অরিয়েন্ট হাসপাতালে এক ডাক্তার এসে মুশকানের সম্পর্কে গা শিউরে ওঠা কথা বলতে থাকে। তখনই জন্ম নেয় রুখসান আর মুশকানের গল্পটার। এটা মুশকানেরই আইডিয়া ছিলো। তাকে বলেছিলো, ঐ ডাক্তারকে যেনো এই গল্পটা বলা হয়। বলাই বাহুল্য, বেশ ভালোভাবেই ওটা কাজে দিয়েছিলো। গল্পটা বিশ্বাস করেছিলো ভদ্রলোক। কিন্তু ছফা সম্ভবত বিশ্বাস করেনি। সবটা শোনার পর সে-ও কিছুক্ষণ ধন্দে পড়ে গেছিলো, তারপরই সমস্ত সন্দেহ কাটিয়ে ওঠে।

আরেকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আসকারের ভেতর থেকে। মুশকানকে তিনি যেমন সাহায্য করেন সব সময়, সে-ও তার যেকোনো বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। কলকাতায় সুস্মিতা যে দুর্ঘটনাটা ঘটিয়েছিলো, সেটাও মুশকানই সামাল দিয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়। তাই সব কিছুর জন্য নুরে ছফা আর প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদকেই দায়ী করছেন তিনি-মুশকানকে নয়।

এই লোকটা ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে সে। ঐ পিএস নাকি তার বোনের ছেলে হাসিবের নিখোঁজের জন্য মুশকানকে দায়ী মনে করে। ডিবি অফিসার ছফাও তাকে বলেছে, এই লোকের বড় বোন সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকায় মুশকানের প্রতিবেশী ছিলো।

ভাবা যায়, কতোটা কাকতালীয় ঘটনা!

মুশকানের সাথে কিছুক্ষণ আগে কথা হয়েছে তার, ঐ ভদ্রমহিলাকে চিনতে পেরেছে সে। শুধু প্রতিবেশীই নয়, তারা বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলো।

সেই মহিলা, হাসিবের মা এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। মরণাপন্ন বোনের শেষ ইচ্ছা, তার সন্তানকে যে গুম করেছে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে দেখবে-সেজন্যেই পিএস তার ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে যাচ্ছে।

মুশকান তাকে আশ্বস্ত করেছে, সুস্মিতাকে যে করেই হোক মুক্ত করবে সে। কিন্তু তার কথায় পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছেন না তিনি। বিরাট ক্ষমতাবান একজনের সাথে কী করে পেরে উঠবে মুশকান, তার মাথায় ঢুকছে না। ওর কাছে এমন কিছু নেই যে, পিএসকে বাধ্য করতে পারবে সুস্মিতাকে ছেড়ে দিতে।

নিজের ডেস্কের চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ ভেবে গেলেন তিনি। সত্যি বলতে, তার মাথা কাজ করছে না আর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুললেন। রাত গাঢ় হচ্ছে, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মুশকানের কাছ থেকে কোনো ফোন আসেনি এখনও। মনে হচ্ছে না খুব শিগগির কোনো সুখবর পাবেন। মুশকানকে কোনোভাবে যদি সাহায্য করা যেতো!

আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ডেস্কের দিকে তাকালেন ডাক্তার। অনেকগুলো ফাইল পড়ে আছে সেখানে দীর্ঘদিন থেকেই, একটাও ছুঁয়ে দেখেননি। তবে এই ফাইলগুলো জরুরী কিছুও নয় যে, পড়ে থাকলে হাসপাতালের কাজকর্মে কোনো ব্যাঘাত হবে। প্রায় তিন বছর ধরে হাসপাতালে অনিয়মিত তিনি, সেজন্যে এই প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ, পরিবর্ধন, নতুন নিয়োগ, নতুন বিভাগ চালু করা, আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা-এরকম অসংখ্য প্রপোজালের ফাইল পড়ে আছে দীর্ঘদিন থেকেই। আরো কতোদিন পড়ে থাকবে কে জানে!

আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যে-ই না চোখ সরাবেন, তখনই একটা ফাইলের দিকে চোখ গেলো তার।

হসপিস!?

সঙ্গে সঙ্গে একটা ভাবনা খেলে গেলো তার মাথায়।

.

অধ্যায় ৮৪

লোকটা কি পাগল হয়ে গেলো?

পিএস আশেক মাহমুদের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে নুরে ছফার মতো ডিবির একজন ইনভেস্টিগেটর তার দিকে পিস্তল তাক করতে পারে। এই আত্মঘাতী কাজটা তাকে এবং তার সেই সিনিয়র কলিগ, কাউকেই রক্ষা করতে পারবে না, এটা বোঝার মতো বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে।

আসলামও অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছে ছফার দিকে, রাগে ফেটে পড়বে যেনো।

হাত-পা বেঁধে চেয়ারে বসিয়ে রাখা সুস্মিতা বিস্ফারিত চোখে একবার ছফার দিকে তো আরেকবার পিএস আর আসলামের দিকে তাকাচ্ছে। ঘটনা কোন্ দিকে মোড় নিচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

“পিস্তলটা নামান, ছফা, চোয়াল শক্ত করে বললো আশেক মাহমুদ।

“সরি, স্যার,” জবাব দিলো সে। “আমার হাতে সময় নেই। ভুল একজন মানুষের জন্য আমি দু দুটো প্রাণ শেষ হতে দিতে পারি না।” সুস্মিতার দিকে ইঙ্গিত করে বললো, “আমি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত, ও মুশকান না!”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো পিএস। “আপনি এখান থেকে এই মেয়েটাকে নিয়ে বের হতে পারবেন না। খামোখা কেন এসব করছেন!”

আসলামের দিকে তাকালো ছফা। পিস্তলটা এখন তার দিকেই তাক্‌ করা। কাঁধ তুললো সে। “দু-জন মানুষকে বাঁচানোর জন্য আমাকে এটা করতেই হবে। কেউ বাঁধা দিলে আমার কিছু করার থাকবে না।”

বাঁকা হাসি দিলো পিএস। “আপনি কি আমাকেও গুলি করবেন?”

ছফা এ কথার কোনো জবাব দিলো না। হঠাৎ তার মনে হলো পাঁচ মিনিট সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এততক্ষণ খেয়ালই ছিলো না, ফোনে মুশকান জুবেরি আছে। সঙ্গে সঙ্গে বামহাতে থাকা ফোনটা কানে চেপে ধরলো। “হ্যালো?”

“হ্যা…বলো?” ওপাশ থেকে জবাব দিলো মুশকান।

হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। “আমাকে আরেকটু সময় দিতে হবে, প্লিজ!”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুশকান। “ঠিক আছে…তবে কলটা কেটে দিও না। আর একটু সতর্ক থেকো।”

ছফা কিছু না বলে ফোনটা আবার নামিয়ে রাখলো। আসলামের দিকে তাকালো সে। সুস্মিতাকে ইঙ্গিত করে বললো, “ওর হাতে-পায়ের বাঁধন খুলে দাও।”

গানম্যান অবিশ্বাসে চোখ কুঁচকে ফেললো। “তুই আমাকে অর্ডার দেবার কে?” রেগেমেগে বললো সে।

ছফা কিছু বলতে গিয়েও বললো না। সে নিজেই এগিয়ে গেলো সুস্মিতার কাছে। মেয়েটার কোলে ফোনটা রেখে আসলামের দিকে পিস্তল তা করেই এক হাতে বন্দীর বাঁধন খুলতে শুরু করলো।

“আপনি বিরাট বড় ভুল করছেন, ছফা।” শান্ত কণ্ঠে বললো পিএস। “এখনও সময় আছে, এসব বাদ দিন। আমি বুঝতে পারছি, আপনি ঐ লোকটাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া, কিন্তু এভাবে ঐ ডাইনির দাবি মেটানো ঠিক হবে না।”

ছফা কথাগুলো কানেই তুললো না। সে সুস্মিতার বাঁধন খুলতেই মনোযোগি। এক হাতে কাজটা করতে বেশ বেগ পাচ্ছে সে।

“ঐ ডাইনিটাকে পাবার একটাই উপায় আছে,” আশেক মাহমুদ। সুস্মিতার দিকে ইঙ্গিত করলো। “এই মেয়েটাকে আমাদের কজায় রাখা। মুশকান নিজের দুর্বলতা দেখিয়ে দিয়েছে, এটা কি আপনি বুঝতে পারছেন না?”

“বুঝতে পেরেছি,” সুস্মিতার বাঁধন খুলতে খুলতেই বললো ছফা। “কিন্তু কেএস খান আর ঐ বাচ্চা ছেলেটার জীবন…” কথা শেষ করলো না সে।

পিএস হতাশ হলো এ কথা শুনে। “এই মেয়েকে ছেড়ে দিলেই যে ঐ ডাইনি ওদেরকে হত্যা করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?”

কথাটা শুনে থমকে গেলো ছফা, পিএসের দিকে স্থিরচোখে তাকালো সে।

“কোনো গ্যারান্টি নেই,” বেশ জোর দিয়ে বললো আশেক মাহমুদ। “কাজ বাগিয়ে নেবার পর ঐ মহিলা তার কথা রাখবে না, ছফা। বোঝার চেষ্টা করুন।”

কথাটা একটু বিবেচনা করে দেখলো সে। পিএস যে খুব ভুল বলছে তা নয়। কাজশেষে মুশকান তার কথা না রাখলে কী করার থাকবে?

কিন্তু মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আবারো সুস্মিতার হাতের বাঁধন খোলার দিকে মনোযোগ দিলো। মুশকানের দাবি মেটালে সে খুনখারাবি করতে যাবে না-এরকম বিশ্বাস তার আছে। সুতরাং এ মুহূর্তে এসব ভেবে সময় নষ্ট করার মানে দু দুটো মানুষের জীবন…

হঠাৎ চোখের কোণ দিয়ে কিছু একটা ধেয়ে আসতে দেখতে পেয়ে চমকে তাকালো ছফা, কিন্তু ততোক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে!

.

অধ্যায় ৮৫

প্রবল উত্তেজনায় কানে ফোন চেপে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে মুশকান।

এতোক্ষণ ছফার সাথে পিএসের কথোপকথনের সবটাই শুনেছে সে, বুঝতে পেরেছে ঘরে আরেকজন আছে-খুবই ষণ্ডা প্রকৃতির একজন মানুষ। আর সেই মানুষটাই সম্ভবত নুরে ছফার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটু আগে। ধস্তাধস্তির শব্দ আর সুস্মিতার চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। তার প্ল্যানটা যে ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছে। ঘুনাক্ষরেও ধারণা করতে পারেনি, ছফা ছাড়া আরো কিছু মানুষ থাকবে-যারা ছফার চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখে!

মুশকানের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। ডাক্তার তাকে জানিয়েছে, সুস্মিতাকে অপহরণ করার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর পিএস জড়িত। নিজের বোনের ছেলের সাথে যা ঘটেছে তার প্রতিশোধ নিতে চাইছে লোকটা।

মুশকান জানে, সুস্মিতাকে মুক্ত করার জন্য কেএস খানকে জিম্মি করাটা একেবারেই যথার্থ ছিলো-ভুল একজন মানুষকে আটকে রেখে ছফা এ দু জন নিরীহ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দেবে না। তার ধারণাই ঠিক, কথামতোই কাজ করেছিলো ছফা, কিন্তু পিএস তাতে বাগড়া দিয়ে বসে, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, এটা করা একদমই ঠিক হবে না।

“একদম নড়বি না কুত্তারবাচ্চা! গুলি করে মাথা উড়িয়ে দেবো।”

ছফার উপরে যে লোক হামলে পড়েছে তার কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে প্রচণ্ড হতাশ হলো মুশকান। ছফা পারেনি! পরাস্ত হয়ে গেছে ষণ্ডাটার কাছে। একটা গোঙানি শোনা গেলো ফোনের ওপাশ থেকে। সম্ভবত ছফারই হবে সেটা।

“ঐ খানকি, একদম নড়বি না!”

একই কণ্ঠ এবার হুমকির সুরে বললো। অবশ্যই সুস্মিতাকে!

“হ্যালো…মুশকান জুবেরি!”

অন্য একটা কণ্ঠ বলে উঠলো ফোনে, চমকে উঠলো সে। বুঝতে পারলো, এটা পিএসের কণ্ঠই হবে।

“তোর পাঁচ মিনিট তো মনে হয় শেষ হয়ে গেছে, তাই না?”

মুশকান কোনো জবাব দিলো না। “এখন চাইলে, তুই ওদের মেরে ফেলতে পারিস।”

“না!” ফোনের ওপাশ থেকে নুরে ছফার আর্তনাদ শোনা গেলো।

“এবার তোকে আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি…মন দিয়ে শোন,” একই কণ্ঠটা বললো। “তুই যদি আমার কাছে ধরা না দিস, তাহলে এই মেয়েটাকে কী করবো জানিস?” একটু থেমে আবার বললো। “তিন তিনটা বাঘের কাছে একটা হরিণ ছেড়ে দিলে যা হয় আর কি!”

গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলো মুশকান। “ওর কিছু হলে অনেক পস্তাতে হবে…সবাইকে!” মুখ খুললো অবশেষে।

হা-হা-হা করে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লো ওপাশে যে আছে। “তুই কিছুই করতে পারবি না। ধরা তোকে পড়তেই হবে। ভালো হয়, নিজে এসে ধরা দিলে, তাহলে অন্তত এই নিরীহ মেয়েটা বেঁচে যাবে।”

গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলো মুশকান। টলে যাওয়া চিন্তাভাবনা সুস্থির করা দরকার।

“একটা ব্যাপারে আমি গ্যারান্টি দিতে পারি-তুই ধরা দিলে এই মেয়েকে কিছুই করবো না।” একটু থেমে আবার বললো, “তোর মতো মানুষখেকো নই আমি, আমাকে বিশ্বাস করতে পারিস।”

চকিতে সাবেক ইনভেস্টিগেটর কেএস খানের দিকে তাকালো সে। এই লোককে নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। দেখেই বোঝা যায়, কোনো রকম ঝামেলা করার চেষ্টা করবে না। প্রখর বুদ্ধিই তার একমাত্র শক্তি। এখন পর্যন্ত কোনো কথা না বলে চুপচাপ তাকে দেখে যাচ্ছে। শুধু তার চোখদুটোতে রাজ্যের যতো কৌতূহল।

এভাবে বোকার মতো নিজেকে সমর্পণ করার কথা সে ভাবতেও পারে না, আবার সুস্মিতার কিছু হোক সেটাও চাইছে না–কঠিন এক সঙ্কটে পড়ে গেলো মুশকান।

“আমি জানি, তুই কোথায় আছিস,” বললো কণ্ঠটা। “তাই তোকে আমি এক ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। এর এক মিনিটও বেশি না।”

মুশকান আবারো তাকালো কেএস খানের দিকে। ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। বোঝার চেষ্টা করছে পরিস্থিতিটা কি।

“গুলশানে এসে এই নাম্বারে ফোন দিবি…এক ঘণ্টার মধ্যে। যদি না আসিস, এই মেয়েটার এমন হাল করবো…” শেষ কথাটা দাঁতে দাঁত পিষে বললো।

নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো মুশকান, হ্যাঁ-না কিছুই বললো না।

“এক ঘণ্টা…ঠিক আছে?”

কলটা কেটে গেলে মুশকান চেয়ে দেখলো কেএস খান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“কী হইছে?” সাবেক ইনভেস্টিগেটর কৌতূহল দমন করতে না পেরে জানতে চাইলো।

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাশের ঘরের দিকে তাকালো মুশকান। “ওখানে চলে যান। কোনো রকম শব্দ করবেন না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো কেএস খান, আস্তে করে উঠে পাশের ঘরে চলে গেলো।

তার সিদ্ধান্ত যাই হোক, এখানে থাকার কোনো মানেই হয় না। সবার আগে এখান থেকে বেরুতে হবে।

পিস্তল আর কেএস খানের মোবাইলফোনটা পার্সে ভরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো মুশকান।

সাবেক ডিবি অফিসারের বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলো সে-কেন, কী উদ্দেশে কিছুই জানে না। কেএস খানকে নিয়ে তার কোনো দুর্ভাবনা নেই। ঐ লোক তাকে অনুসরন করার চেষ্টা করবে না। বাচ্চা ছেলেটার জ্ঞান ফিরলো কি ফিরলো না সেটা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকবে। হয়তো স্থানীয় কোনো ডাক্তারও ডাকতে পারে।

মি. খানের ফোনটা ট্র্যাক করে তার অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে পারে ঐ পিএস, তাই সতর্কতার অংশ হিসেবে ফোনটা বের করে অফ করে দিলো সে।

সুস্মিতাকে মুক্ত করার একমাত্র সুযোগটি যে এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, উল্টো সে নিজেই ফাঁদে পড়ে যাবে, ভাবেনি।

মাসখানেক আগে, এক জাতীয় দৈনিকে আমাদের শার্লক হোমস নামে সাবেক ডিবি অফিসারের উপরে বেশ তথ্যবহুল একটি ফিচার পড়েছিলো। সেখান থেকেই জানতে পারে, লোকটা থাকে পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের পৈতৃক বাড়িতে। অল্প বয়সী এক ছেলে ছাড়া নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে। তিন বছর আগেই সে জেনেছিলো, সাবেক এই ডিবি অফিসার ছফার খুবই ঘনিষ্ঠজন। এর পরামর্শ নিয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। ছফা যখন সুন্দরপুরে, তখন আসকারকে এই লোকই জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। সে যখন ছফাকে কাবু করে ফেলে তখন এই লোকই ফোন দিয়েছিলো। তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠটা শুনেছিলো তখন।

নুরে ছফার আর কোনো দুর্বলতা আছে কিনা, সে জানে না। থাকলেও সেটা বের করে সদ্ব্যবহার করাটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হতো। কিন্তু তার দরকার ছিলো দ্রুততম সময়ে কিছু একটা করার-এসব কারণে সময় নষ্ট না করেই মুশকান তার নিরাপদ আশ্রয় থেকে সোজা চলে এসেছিলো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই তারা কেএস খানের বাড়িটা দেখিয়ে দেয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুশকান দেখতে পেলো, সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলটা পেরিয়ে বাহাদুরশাহ পার্কের কাছে চলে এসেছে। কোথায় যাবে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। জীবনে খুব কম সময়ই এমন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। এরইমধ্যে দশ মিনিট ফুরিয়ে গেছে। বাকি সময়টাতে কিছু করতে পারবে না। সুস্মিতাকে রক্ষা করার একটা মাত্রই উপায়ই আছে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার। কিন্তু সেটা সে করতে পারে না। করলেও, সুস্মিতা যে মুক্তি পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফোনটা বেজে উঠলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কলার আইডি দেখে কয়েক মুহূর্ত ভেবে পেলো না কী করবে-কী বলবে আসকারকে এখন!

“হ্যালো?” বেশ কয়েকবার রিং হবার পর অনেকটা বাধ্য হয়েই কলটা রিসিভ করলো সে। নইলে আসকার আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে।

উদ্বিগ্ন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলেন সুস্মিতার কী অবস্থা এখন। তার মুক্তির ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা। অনেকক্ষণ ধরে মুশকান তাকে ফোন করেনি বলে খারাপ কিছুর

আশঙ্কা করছেন তিনি।

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মুশকান। দুঃসংবাদটা শোনানোর কোনো ইচ্ছে তার নেই, কিন্তু না বলেও পারছে না। এতে ধকলও হয়তো সামলাতে পারবে না বেচারি। তাই তাকে আরেকটু অপেক্ষা করতে বললো। খুব বেশি চিন্তা যেনো না করে।

এ কথা শোনার পর ফোনের ওপাশে কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো, তারপর আস্তে করে ডাক্তার জানালেন, তিনি একটা তথ্য জানতে পেরেছেন, বুঝতে পারছেন না এ মুহূর্তে এটা তেমন কোনো কাজে লাগবে কিনা।

মুশকান খুব একটা আগ্রহী না হলেও জানতে চাইলো। এরপর আসকার ইবনে সায়িদ এক নাগারে বলে গেলেন, হাসপাতালের হসপিস সার্ভিস সম্প্রসারণের জন্য যে প্রজেক্ট ফাইলটা ছিলো সেটা দেখে তার একটা বিষয় মনে পড়ে যায় একটু আগে, তারপর খোঁজ নিয়ে যা জানতে পেরেছেন তাতে বেশ অবাক হয়েছেন তিনি। তার কাছে মনে হয়েছে, এই তথ্যটা হয়তো কোনোভাবে তার সাহায্যে আসতে পারে।

তথ্যটা পাবার পর মুশকান কয়েক মুহূর্ত মূর্তির মতো জমে রইলো। তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে এটা। একটু আগেও রীতিমতো চোখে অন্ধকার দেখছিলো সে। সিদ্ধান্তহীনতার চরম সঙ্কটে ভুগছিলো।

গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলো এবার। এখন তাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হবে। কোনো ভুলই করা যাবে না। চিন্তাভাবনা গুছিয়ে নিয়ে দ্রুত একটা পরিকল্পনা করে ফেললো সে। শান্ত কণ্ঠে আসকারকে বলে দিলো, কী করতে হবে। তার হাতে যেটুকু সময় আছে, এ কাজের জন্য যথেষ্ট।

ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করার পর গুলশানে গন্তব্য ঠিক করে নিয়ে একটা উবার ডাকলো। ড্রাইভারকে ফোন করে বলে দিলো বাহাদুরশাহ পার্কের কথা। জায়গাটা চিনতে বেগ পেলো ড্রাইভার। মুশকান অবশ্য খুব একটা অবাক হলো না এতে। পুরনো নাম ভিক্টোরিয়া পার্ক বললে অবশ্য চিনতে পারলো ড্রাইভার। তাকে জানালো, সে এখন খুব কাছেই আছে-সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে।

কলটা শেষ করে আরেক বার নিজের পরিকল্পনাটা গুছিয়ে নিলো মুশকান। রাতের এ সময় কোনো জ্যাম নেই, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে বড়জোর চল্লিশ মিনিট লাগবে। এই সময়ে আসকার বাকি সব কিছুর ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে বলে তার বিশ্বাস।

বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে আসতেই দেখতে পেলেউবার প্রিমিয়ারের সিলভার রঙের প্রাডো গাড়িটা পার্কের মেইনগেটের সামনে চলে এসেছে। গাড়ির রঙটা তার কাছে অন্য অর্থ বহন করলো এ মুহূর্তে।

সিলভার লাইন ইন দ্য স্কাই!

একটু আগে টলে যাওয়া আত্মবিশ্বাসটা ফিরে পেয়েছে মুশকান।

.

অধ্যায় ৮৬

ছফার ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে, মেঝেতে বসে আছে এখন। আসলামের মতো বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী নয় সে, তাই বলে সশস্ত্র অবস্থায় নিরস্ত্র একজনের সাথে পেরে উঠতে পারবে না, তা মেনে নিতে কষ্টই হচ্ছে।

কিন্তু সেটাই হয়েছে। কারণটাও তার জানা। সুস্মিতার হাতের বাঁধন খুলতে গিয়ে তাকে একটু উপুড় হতে হয়েছিলো, কোনোভাবে হয়তো পিস্তল তা করে রাখা হাতটা সরে গিয়েছিলো। আর আসলাম সুযোগ পেয়েই সদ্ব্যবহার করে ফেলেছে, চোখের নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার উপর। ছফাকে নিয়ে আছড়ে পড়েছিলো মেঝেতে। আসলামের টার্গেট ছিলো তার ডান হাতটা, সেই হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে ফেলে শূন্যের মধ্যেই, মেঝেতে পড়ার পর তাই ছফার পিস্তলটা বেহাত হয়ে যায়।

এরপর পিএসের গানম্যান পর পর দুটো ঘুষিতেই কাবু করে ফেলে তাকে। ছফা তেমন প্রতিরোধ করার সুযোগই পায়নি। প্রথম ঘুষিটা লেগেছিলো ডান কানের পাশে, ঘুষিটা পড়তেই চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। এরপরই কোনো রকম সময়ক্ষেপন না করে ক্ষিপ্রতার সাথে দ্বিতীয় ঘুষিটা মারে তার মুখ বরাবর, ফলে ঠোঁট কেঁটে রক্ত বের হয় যায়। এখনও সেখান থেকে রক্ত ঝরছে।

ছফার পিস্তলটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে তার দিকে তাক করে রেখেছে আসলাম। কিছুক্ষণ আগে আশেক মাহমুদ সুস্মিতার কোল থেকে ফোনটা নিয়ে মুশকান জুবেরিকে পাল্টা আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছে-এক ঘণ্টার মধ্যে ধরা না দিলে ডাক্তারের মেয়ের পরিণাম হবে ভয়াবহ। ছফা অবশ্য জানে না, মুশকান এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছে কিনা।

এখন ফোনটা সোফার উপরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পিএস ঘৃণাভরে তাকালো। “দেখলেন তো কিভাবে ডিল করতে হয়, পাশার দান উল্টে দিতে হয়!”

ছফা রক্তমাথা থুতু ফেললো মেঝেতে। তিক্ততায় নাকি আক্ষেপে বোঝা গেলো না।

“এতোদিন ধরে ডিবি’তে চাকরি করে এই শিখেছেন!” ভৎসার সুরে বললো এবার।

এসব কথার জবাব দিলো না ছফা। সে এখন ভূপাতিত। পরাজিত। আস্তে করে আশেক মাহমুদের দিকে তাকালো। লোকটার চোখেমুখে বিরক্তি। আসলামের ঠোঁটে লেগে রয়েছে তাচ্ছিল্যের হাসি।

“এরে কী করবো, স্যার?” পিএসের কাছে জানতে চাইলো গানম্যান।

নুরে ছফা অবিশ্বাসে তাকালো আশেক মাহমুদের দিকে। লোকটা কী বলবে বুঝতে পারছে না, তবে খারাপ কিছুর আশঙ্কা করছে সে। এই লোক নিরীহ এক ছেলেকে গুম করে ফেলেছে এরইমধ্যে, তাকেও যে ওরকম কিছু করবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে।

একটু গাল চুলকে নিলো পিএস, যেনো কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। “ওকে–”

অমনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো একজন। তাকে দেখে আশেক মাহমুদ আর আসলাম চমকে গেলো।

“কি হয়েছে, বদরুল?”

“স্যার, বাড়িতে পুলিশ আসছে!”

*

গুলশান থানার এসআই মিজান দাঁড়িয়ে আছে পিএসের গোপন আস্তানার সেই বাড়িটার সামনে। টহল পুলিশের একটি ইউনিট আছে তার সঙ্গে। আজকে তার রাতের ডিউটি পড়েছে, বিরক্তি নিয়েই টহলের মতো একঘেয়েমির কাজটা শুরু করেছিলো, কিন্তু একটু আগে থানা থেকে স্বয়ং ওসিসাহেব তাকে ফোন করে বলে দিয়েছেন, গুলশানের এই বাড়িতে রেইড দিতে হবে। বিরাট বড়সর একটি ক্রাইম সংঘটিত হচ্ছে এখানে। এক মেয়েকে নাকি আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে-এক্ষুণি তাকে উদ্ধার করতে হবে।

সাধারণত গুলশান এলাকায় এরকম ক্রাইম হয় না। অভিজাত এলাকার অভিজাত মানুষগুলোর ক্রাইমের ধরণও হয়ে থাকে বেশ আলাদা। তার চেয়েও বড় কথা, এখানকার প্রায় সব অপরাধীই ভিআইপি! যাকেই ধরা হোক না কেন, তার সাথে কোনো না কোনো ক্ষমতাবানের সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়। কাউকে ধরে শান্তি নেই। ফোনের পর ফোন আসবে, অনুরোধ করবে আসামি ছেড়ে দেয়ার জন্য। এমন কি পুলিশকে হুমকি-ধমকিও দিয়ে বসে অনেকে।

কিন্তু এখন যে বাড়িটার সামনে চলে এসেছে সেখানকার দারোয়ান যা বলছে সেটাকে তার কাছে মনে হচ্ছে ধাপ্পাবাজি।

প্রাইমিনিস্টারের পিএসের বাড়ি!

রাগে তার গা কাঁপছে। ইচ্ছে করছে বদমাশ দারোয়ানকে কষে একটা চড় মারতে। গেটটা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে সে। লোকটার সাহস দেখে অবাক হচ্ছে। তাদেরকে এ বাড়িতে ঢুকতে বাধা তো দিচ্ছেই, সেই সাথে বলছে, অপেক্ষা করতে, স্বয়ং পিএস নাকি ফোন দেবে একটু পর।

মিজানের ইচ্ছে করছে দারোয়ানকে কিলঘুষি মেরে পুলিশ নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়তে, কিন্তু জায়গাটা গুলশান, এখানে কার সাথে যে কোন মন্ত্রী এমপির কানেকশান আছে বোঝা মুশকিল। তাই ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে সে। তবে আরেকটু দেখবে, তারপর যা করার করবে।

এমন সময় তার মোবাইলফোনটা বেজে উঠলো। ওসিসাহেব ফোন দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করলো এসআই। “স্যার?”

“মিজান, ঐ বাড়িতে ঢুইকো না…চইল্যা আসে এক্ষুণি।”

ওসির কষ্ঠ কেমন ভয়ার্ত শোনাচ্ছে। “জি, স্যার?”

“খবরটা ভুয়া ছিলো। বুঝছো?”

“জি, স্যার…বুঝতে পারছি।” ওসিসাহেব কলটা কেটে দিলে তিক্তমুখে বাড়িটার দিকে তাকালো গুলশান থানার এসআই। যা ভেবেছিলো তা-ই। আরেকটা হোমরাচোমরার আস্তানা!

“কী হইছে, স্যার?” একজন কনস্টেবল জানতে চাইলো আগ্রহভরে।

“কিছু না…সবাই গাড়িতে ওঠো,” বলেই গেট থেকে সরে পিকআপ ভ্যানের দরজায় হাত রাখলো।

বাড়ির গেট ফাঁক করে যে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে তার মুখে হাসি হাসি ভাবটা দেখে পিত্তি জ্বলে গেলো এসআইর। ক্ষমতার দাপট দেখাতে পেরে খুব মজা পাচ্ছে হারামজাদা।

কনস্টেবলরা কেউ কিছু না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসআই মিজান যে-ই না পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতে যাবে অমনি বাড়ির ভেতর থেকে মেয়েলী কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেলো!

.

অধ্যায় ৮৭

ছফার মনে হচ্ছে কিছু একটা করা উচিত, কিন্তু কী করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।

একটু আগে নীচতলা থেকে বদরুল নামের একজন এসে বলে, বাড়িতে পুলিশ এসেছে।

“কেন এসেছে? কি চায় তারা?”

পিএসের এমন প্রশ্নে বদরুল কিছু জানাতে পারেনি।

“ওদেরকে ঢুকতে দিও না। তুমি নীচে যাও, আমি দেখছি।” কথাটা বলেই পিএস ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বদরুলকে নিয়ে।

একটু পরই ফিরে এলে আসলাম জানতে চায়, পুলিশ কেন এসেছিলো।

চোয়াল শক্ত করে ফেলে আশেক মাহমুদ। “যে ছেলেটাকে আটকে রেখেছিলে, ও-ই পুলিশে খবর দিয়েছে।”

আসলাম খুবই অবাক হয়েছিলো, সেই সাথে শরমিন্দাও। ছফা আর সুস্মিতাও কথাটা শুনে বিস্মিত হয়েছে। শ্যামল যে বেঁচে আছে, তার জন্যে পুলিশ ডেকে নিয়ে এসেছে, এতে আশার আলো দেখতে পায় মেয়েটি।

“চিন্তার কিছু নেই,” আসলামকে আশ্বস্ত করে বলে পিএস। “ওরা চলে যাবে।”

এ কথা শোনার পরই সুস্মিতা চিৎকার দিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে আসলাম তার মুখ চেপে ধরে। ছফা মেঝে থেকে উঠতে যাবে, অমনি পিস্তলটা তার দিকে তাক করে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, একদমই যেনো না নড়ে।

সুস্মিতার মুখটা এখনও শক্ত করে চেপে ধরে আছে আসলাম। পেছনে দু-হাত বেঁধে রাখার কারণে মেয়েটা কিছুই করতে পারছে না। পেছন থেকে একহাতে তার মুখটা শক্ত করে ধরে নিজের বুকের কাছে চেপে রেখেছে গানম্যান।

রেগেমেগে সুস্মিতার দিকে তাকালো পিএস। “চিৎকার করলেও কেউ তোকে বাঁচাতে আসবে না, বুঝেছিস!” তারপর ফোনটার দিকে তাকালো। কারোর কলের জন্য অপেক্ষা করছে সে। “আর একটা আওয়াজ করবি তো…” দাঁতে দাঁত পিষে রাগ দমন করার চেষ্টা করলো।

“খানকি মাগি!” এবার আসলাম ফিসফিসিয়ে বললো। “মুখ খুললেই শেষ করে দেবো।” পিস্তলটা এবার সুস্মিতার কপালে ঠেকালো। “বুঝতে পারছিস?”

“এখান থেকে পালিয়ে এক এমপিকে দিয়ে পুলিশ পাঠিয়েছে,” বললো আশেক মাহমুদ। “গুলশান থানাকে বলে দিয়েছি, এ বাড়ির ত্রিসীমানায় যেনো পুলিশ না ঘেষে।”

হাসি ফুটে উঠলো আসলামের মুখে।

পিএসের ফোনটা বেজে উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করা হলো। “হ্যা…বলুন?” ওপাশ থেকে শুনে গেলে কিছুক্ষণ। “ওরা কিছুই শোনেনি…ওকে?” একটু থেমে আবার বললো, “আপনি আপনার লোকজনকে এ বাড়ির সামনে থেকে চলে যেতে বলুন। এক্ষুণি। পরে আপনাকে সব বলবো, ঠিক আছে?” ওপাশ থেকে আরো কিছু কথা শোনার পর বললো, “আচ্ছা।”

“স্যার, এর মুখ বেঁধে রাখি?” সুস্মিতাকে ইঙ্গিত করে বললো আসলাম।

“হুম,” সায় দিলো।

পিএস এবার আরেকটা নাম্বারে ফোন দিলো। “ওরা কি চলে গেছে, বদরুল?” ওপাশের কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। “তুমিও সেলিমের সাথে গেটের কাছে থাকো, চোখকান খোলা রাখবে, ঠিক আছে?” ফোনটা কান থেকে সরিয়ে আসলামের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো।

গানম্যান ঘরের এক কোণ থেকে একটা স্কচটেপ নিয়ে এসে সুস্মিতার মুখটা পেঁচিয়ে দিলো দক্ষতার সাথে। এবার ছফার দিকে তাকালো সে। “স্যার? এর মুখটাও বন্ধ করা দরকার।”– মাথা দোলালো পিএস। “দরকার নেই। অস্ত্র ছাড়া সে কীই বা করতে পারবে!” যেনো ছফার অযোগ্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা হয়ে গেছে তার। “তবে উল্টাপাল্টা কিছু করলে সোজা গুলি করে দেবে।” শেষ কথাটা খুবই শীতল কণ্ঠে বললো আশেক মাহমুদ।

ছফার কাছে কথাটা আতঙ্কের চেয়ে অপমানের মতোই বেশি শোনালো। তবে সে কিছুই বললো না। কেএস খান আর নিরীহ ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য যা করার দরকার তা-ই করেছে, এ নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের কী হলো কিছুই বুঝতে পারছে না।

“স্যার, আমার ফোনটা…” শুধু এটুকুই বললো ছফা।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো আশেক মাহমুদ।

“কেএস খান আর ঐ ছেলেটার কী হলো…” এবারও কথা শেষ করতে পারলো না।

“একদম চুপ মেরে থাকুন!” ধমকের সুরে বললো পিএস। “আপনি আর কোনো কথা বলবেন না।”

একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। সুস্মিতার দিকে তাকালো। মেয়েটা ভয়ে পাথরের মতো জমে আছে।

“ওই ডাইনি যদি না আসে, এরে কী করবো, স্যার?” সুস্মিতাকে ইঙ্গিত করে বললো আসলাম।

“তোমার যা খুশি তা-ই কোরো, ঠিক আছে?”

পিএসের কথায় আসলামের চোখদুটো চকচক করে উঠলো।

আৎকে উঠলো সুস্মিতা। ছফা অবিশ্বাসে তাকালো আশেক মাহমুদের দিকে।

সোফায় গিয়ে বসে হাতঘড়িতে সময় দেখলো পিএস। সোফার উপর থেকে ছফার ফোনটা পকেটে ভরে নিলো এবার। “আর ওর পিস্তলটা আমাকে দাও।”

আসলাম চুপচাপ ছফার পিস্তলটা পিএসকে দিয়ে দিলে ওটা হাতে নিয়ে কোলের উপরে রেখে দিলো সে।

আবারো হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো পিএস। বোঝাই যাচ্ছে উত্তেজনার চোটে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছে। “আপনি অনেক ভালো একজন ডিবি অফিসার,” ছফার উদ্দেশে বললো। “কলকাতায় মুশকান জুবেরিকে ট্র্যাক করতে গিয়ে এতো বড় ভুল কী করে করলেন?”

ছফা কিছুই বললো না। পুরো বিষয়টা তার কাছে এখনও ধোঁয়াশা।

“এই মেয়েটা,” বন্দীকে দেখিয়ে বললো। “আপনি ভেবেছিলেন ওই মুশকান! প্লাস্টিক সার্জন দিয়ে চেহারা বদলে সেই সার্জনকে মেরে ফেলেছে। নতুন চেহারার সাথে নতুন নাম-পরিচয় নিয়ে সুন্দরপুরে ফিরে গেছে! খুব বেশি সিনেমাটিক হয়ে গেলো না?”

এবারও ছফা কিছু বললো না। কলকাতায় গিয়ে নিখোঁজদের তালিকা থেকে মুশকানের সম্ভাব্য দুটো শিকার ঠিকই খুঁজে বের করেছিলো সে। সল্টলেকের ঐ বাড়িতেই যে মুশকান ছিলো সেটাও সত্যি। অথচ এখন দেখতে পাচ্ছে, মুশকান তার চেহারা পাল্টায়নি।

প্রথমবার মুশকান জুবেরি তাকে বোকা বানিয়ে সটকে পড়েছিলো। তিন বছর পর তাকে রীতিমতো হতবুদ্ধিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।

যাই হোক, মুশকানকে এসব করতে সহায়তা করেছেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। তার সাহায্য না পেলে কোনোভাবেই এসব করা সম্ভব হতো না ওর পক্ষে। একজন অপরাধীকে সাহায্য করার প্রতিদান তিনি এখন পাচ্ছেন-তার নিদোষ মেয়েটা পিতার অপকর্মের শাস্তি ভোগ করছে।

“আপনার সবচে বড় দুর্বলতা কি জানেন? পিএস বললো। “আপনার মনটা বড্ড নরম। এতো নরম মন নিয়ে কী করে যে ডিবি’তে আছেন, বুঝি না।”

বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো ছফার ঠোঁটে। “আপনার মতো পলিটিক্স করলে হয়তো অতোটা নরম থাকতাম না।”

আসলাম তেড়ে আসতে চাইলে কথাটা শুনে। সামান্য ডিবি অফিসারের এমন আস্পর্ধা দেখে বিস্মিত সে-বিশেষ করে তার হাতে মার খাওয়ার পরও।

আশেক মাহমুদ মাথা দুলিয়ে আসলামকে নিরস্ত করলো। তার মুখে হাসি। “অযোগ্যরা সব সময়ই অজুহাত দেয়।”

কথাটা হজম করে নিলো ছফা, কিছু বলতে গিয়েও বললো না। সুস্মিতার দিকে তাকালো সে। তাদের দুজনের চোখাচোখি হলো অল্প সময়ের জন্য। মুখে স্কচটেপ লাগানো আর হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা-অসহায় মেয়েটির চোখদুটো ছল ছল করছে অজানা আশঙ্কায়।

আশেক মাহমুদ আবারো হাতঘড়ি দেখলো। “আসলাম, মনে হচ্ছে মুশকান জুবেরি আসবে না। এখান থেকে আমাদের চলে যেতে হবে। এ জায়গায় আর কিছু করা ঠিক হবে না। তুমি-”

আশেক মাহমুদ কথা শেষ করতে পারলো না। ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে উঠলো। অবাক হয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডিসপ্লের দিকে তাকালো সে। কলার আইডি দেখে বুকটা ধক করে উঠলো তার। এতো রাতে হাউজনার্স তাকে ফোন দিয়েছে?!

এর একটাই অর্থ–খারাপ কোনো সংবাদ আছে!

বুবুর কিছু হয়েছে।

মুহূর্তে চোখেমুখে শেকগ্রস্ত অভিব্যক্তি জেঁকে বসলো তার। এই দুঃসংবাদটি শোনার প্রস্তুতি থাকলেও আজকের জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না।

পিএস কলটা রিসিভ করে দুর্বল আর ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, “ক্‌-কি হয়েছে?” সামান্য তোতলালে সে।

“হ্যালো, বুল্লা!” ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো একটি নারী কণ্ঠ।

.

অধ্যায় ৮৮

নিথর দেহ নিয়ে শয্যাশায়ী রোগী পড়ে আছে। দেখলে মনে হবে না দেহে প্রাণ আছে, কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত এই মৃত্যুপথযাত্রির প্রাণবায়ু এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

প্রাণঘাতী ক্যান্সার যে হাল করেছে তাতে করে আজ এতো বছর পর তাকে দেখলে কেউ চিনতে পারবে না। ক্রমশ কঙ্কালে রূপান্তরিত হচ্ছে যেনো। মৃত্যুর করাল গ্রাসে প্রায় নিঃশেষিত একজন।

আর্জুমান্দ বেগমের চোখে আই মাস্ক থাকায় দেখতে পাচ্ছে না তার শিয়রে, একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে একজন। আধ-ঘুম আধো জাগরনে ধরেই নিয়েছে, ঘরে আছে হাউজনার্স মেয়েটি। কিন্তু সে যদি চোখ মেলে তাকাতো, তাহলে দেখতে পেতো অনেক কাল আগের এক সুহৃদকে!

সালোয়ার-কামিজ আর চুরিদারের উপরে ডাক্তারদের সাদা অ্যাপ্রোন পরা মুশকান জুবেরি স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে আর্জুমান্দ বেগমের দিকে। তার ইচ্ছে করছে অসুস্থ এই রোগীর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে, কিন্তু ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে হলো, পাছে ঘুম থেকে জেগে ওঠে।

এই রোগীর প্রতি তার কোনো ক্ষোভ নেই। যদিও চল্লিশ বছরেরও বেশি আগের পুরনো একটি ক্ষতের সৃষ্টি করেছিলো সে। যে কারণে আমেরিকা ছেড়ে গ্রেট বৃটেনে পাড়ি দেয় মুশকান।

ভুল নাকি ইচ্ছেকৃত? সত্যি বলতে, মুশকান জানে না ঠিক কী কারণে তার এক কালের বান্ধবী ওরকম কাজ করলো।

আমেরিকায় আর্জুমান্দ বেগম আর সে থাকতে পাশাপাশি বাড়িতে। প্রতিদিন দেখা হতো। সপ্তাহে একদিন একসাথে ডিনার করাটা রীতিতে পরিণত হয়েছিলো এক সময়। আর্জুমান্দ বেগমের স্বামী স্থপতি রাগিব আহমেদ খুবই প্রাণখোলা মানুষ ছিলেন। মুশকানের সাথেও তার ছিলো ভালো সম্পর্ক। একসাথে তারা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ইয়েলোস্টোন্স ফরেস্ট, নায়াগ্রা ফল্স, লাস ভেগাস, ডিজনিল্যান্ডসহ কতো জায়গায় বেড়াতে গেছে।

ঘনিষ্ঠতার কারণেই বিশ্বাস করে মুশকান তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের কথাটা আর্জুমান্দ বেগমকে একদিন বলে ফেলেছিলো। সবটা শোনার পর সমব্যথিও হয়েছিলো তার বান্ধবী, কিন্তু কদিন পরই বুঝতে পারে, বিরাট বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। তার আন্দিজ থেকে বেঁচে আসার গল্পটা বাঙালি কমিউনিটিতে জানাজানি হয়ে গেছে। প্রথমে তাদের নেইবারহুড়ে এটা চাউর হলেও সাদা চামড়ার মানুষগুলো এটা শোনার পর তার প্রতি আরো বেশি করে সহানুভূতি দেখায়। কেউ বিরূপ আচরণ করেনি কিংবা বাঁকা চোখে তাকায়নি। কিন্তু স্বজাতিদের কাছে মুশকান রাতারাতি হয়ে উঠলো অস্পৃশ্য একজন-মানুষের মাংস খেয়ে বেঁচেছিলো! যেনো এরচেয়ে ভালো আর মর্যাদাপূর্ণ ছিলো না খেয়ে মরে যাওয়াটা! ওদের বিরূপ আচরণ তার জীবনটাই বিষিয়ে তুললো এক সময়। প্রথমে রাজ্য পাল্টালো, অল্প কদিন পরই দেখলো, ওখানকার বাঙালি কমিউনিটিও তার এই নরমাংস ভক্ষণ করে বেঁচে থাকার কথা জেনে গেছে। শেষে বাধ্য হয়েই আমেরিকা ছাড়ে।

আর্জুমান্দ বেগম কেন এ কাজ করেছিলো সেটা নিয়ে অনেক ভেবে দেখেছে সে, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারেনি। তার কেনজানি মনে হয়, এর পেছনে ছিলো ঈর্ষা! নিজের স্বামীর সাথে মুশকানের নিখাদ বন্ধুত্ব আর তার ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্যই এই ঈর্ষা সৃষ্টি করে সম্ভবত। হয়তো স্বামীর কাছ থেকে মুশকানের প্রশংসা শুনে শুনে ঈর্ষার আগুনে পুড়ছিলো সে। হয়তো স্বামীকে মুশকানের সাথে অতিরিক্ত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে দেখেও আক্রান্ত হয়েছিলো সুতীব্র ঈর্ষায় নিশ্চিত করে কিছুই জানার উপায় নেই এখন। সে শুধু জানে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আর্জুমান্দ বেগম মুশকানের নরমাংস খেয়ে বেঁচে থাকার কথাটা রটিয়ে দিয়েছিলো।

তবে বিশ্বাস করো, মনে মনে বলে উঠলো মুশকান। আমি যদি জানতাম হাসিব তোমার ছেলে, তাহলে ভুলেও…একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। এটা একেবারেই কাকতালীয় ব্যাপার…ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে! আমি প্রতিশোধ নেবার জন্য এ কাজ করিনি। তুমি কেন আমার অতো বড় ক্ষতি করেছিলে আমি জানি না। তবে আমি এর শোধ তোলার কথা কখনও ভাবিনি। অন্তত এভাবে তো নয়ই!

মাথা থেকে এসব ভাবনা দূর করে মনোযোগ দিলো বর্তমানে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে একটু পরই সুস্মিতা মুক্তি পাবে। আর্জুমান্দ বেগমের ছোটোভাই, সেই বুল্লাই যে প্রধানমন্ত্রীর পিএস, সেটাও এ ঘরে ঢোকার পরই বুঝে গেছিলো-শোবার ঘরে বারো-তেরো বছরের বুল্লা আর আর্জুমান্দ বেগমের একটি ছবি আছে। পিএসকে তার আদুরে নাম ধরে ডেকে ভড়কে দিয়েছে মুশকান। এখন এই ক্ষমতাশালী মানুষটি সুস্মিতাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য।

যদিও মুশকান ভাগ্যে বিশ্বাস করে না, বরং বিশ্বাস করে সাহসী আর আত্মবিশ্বাসি মানুষের কাছেই সৌভাগ্য ধরা দেয়। আজকে আরেকবার সেটা প্রমাণিতও হয়েছে। হাল ছেড়ে না দেয়ার মানসিকতা মানুষকে কঠিন পরিস্থিতিতেও বাঁচিয়ে রাখে-জীবনের শুরুতেই এই শিক্ষাটা পেয়ে গেছিলো সে। তারপরও, একটু আগে কেএস খানের বাড়ি থেকে বের হবার সময় ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি আশাব্যঞ্জক কিছু ঘটবে। বলতে গেলে হাল ছেড়েই দিয়েছিলো, ভেঙে পড়তে শুরু করেছিলো তার নার্ভ। তারপরই ডাক্তারের ফোনকল আর দুর্লভ একটি তথ্য পুরো দৃশ্যপট বদলে দেয় মুহূর্তে।

মুশকানের ফোনটা এ সময় ভাইব্রেট করে উঠলে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের এককোণে গিয়ে কলটা রিসিভ করলো সে। কণ্ঠ যতোটা সম্ভব নীচু করে কথা বললো, “হুম…আমি এখন অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে…ওর সামনেই আছি…চিন্তা কোরো না…আমার সাথে কথা হয়েছে…” অন্য হাতে হাউজনাসের ফোনটা দেখলো সে। ওটার কল এখনও কেটে দেয়নি, তবে মিউট করে রেখেছে। “সুস্মিতাকে এখনই ছেড়ে দেবে।”

.

অধ্যায় ৮৯

মাত্র ঘণ্টাখানেক ‘হসপিস সার্ভিস ইভালুয়েশন অ্যান্ড এক্সপানশান ফাইলটা দেখার পর ডাক্তার আসকার মূল্যবান একটি তথ্য জেনে নিয়েছেন।

অরিয়েন্ট হাসপাতালই এ দেশে প্রথম হসপিস সার্ভিস চালু করে। এখনও একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই সার্ভিসটি তারা দিয়ে আসছে। ক্যান্সারসহ কিছু অনিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্ত যে-সব রোগী নির্ঘাত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, তাদের জীবনের শেষ সময়গুলো যাতে অপেক্ষাকৃত কম যন্ত্রণাময় হয় তার জন্য সারা বিশ্বের অনেক হাসপাতালেই হসপিস সার্ভিস রয়েছে। অরিয়েন্ট হাসপাতালে মাত্র দুটো বেড আর পাঁচজন প্রশিক্ষিত নার্সের সমন্বয়ে গড়া ছোট্ট এই ডিপার্টমেন্টটি কয়েক বছর আগে শুরু হলেও প্রথম দিকে তেমন লাভজনক না হলেও ডাক্তার আসকারের আগ্রহের কারণে সার্ভিসটি বহাল থাকে।

সারা বিশ্বে হসপিসের রোগীদের প্রায় ষাট শতাংশ নিজেদের বাড়িতেই এই সার্ভিসটি নিয়ে থাকে, এদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই অন্যান্য দেশের মতো, হসপিস অ্যাট হোম সার্ভিসও অরিয়েন্ট হাসপাতাল দিয়ে আসছে শুরু থেকে। বর্তমানে তাদের ক্লায়েন্টের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে, সেই তুলনায় প্রশিক্ষিত নার্স আর বেডের সংখ্যা অপ্রতুল। তাই কয়েক দিন আগে এই সার্ভিসটি সম্প্রসারণ করার জন্য হাসপাতাল পরিচালনা কমিটি থেকে প্রপোজাল দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু ফাইলটা ডাক্তারের চোখে পড়েনি। তিনি হাসপাতালে খুব একটা সময়ও দিতে পারছিলেন না আজকাল। সম্প্রসারণের মতো কাজ যেহেতু মালিকপক্ষের অনুমোদন ছাড়া পাস হয় না, তাই ডাক্তারের বিবেচনার জন্য অনেক দিন থেকেই ফাইলটা পড়ে আছে তার ডেস্কে।

এই ফাইল দেখেই ডাক্তারের মনে পড়ে যায়, পিএসের বোনের কথা। নুরে ছফা তাকে বলেছিলো, পিএসের বোন-সতুরের দশকে যে কিনা মুশকানের প্রতিবেশী ছিলো আমেরিকায়-এখন মৃত্যুপথযাত্রি। পিএস তাকে নিজের ফ্ল্যাটে রেখেই চিকিৎসা করাচ্ছে জীবনের শেষ দিনগুলো একটু কম যন্ত্রণা ভোগ করার জন্য।

হসপিস সার্ভিস নিচ্ছে না তো?

প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তারের মনে উঁকি দেয়। যদি তা-ই হয়, তাহলে এ দেশে একমাত্র তারাই এই সার্ভিস দিয়ে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডমিনে ফোন করে তিনি জানতে চান, ‘হসপিস সার্ভিস অ্যাট হোম সেবাটি বর্তমানে ক-জন নিচ্ছে-তাদের সমস্ত ডিটেইল তার লাগবে।

হাসপাতালটি কম্পিউটারাইড বলে অ্যাডমিন থেকে এই তথ্যটি ডাক্তারের অফিসের পিসিতে পাঠাতে মাত্র তিন-চার মিনিট সময় লেগেছিলো। আসকার ইবনে সায়িদ অবাক হয়েই দেখতে পান, বর্তমানে দু-জন রোগী এই সার্ভিসটি নিচ্ছে। তাদের একজন দেশের নামকরা শিল্পপতি, ডাক্তার তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন।

আর অন্যজন আর্জুমান্দ বেগম!

তবে রোগীর ছোটোভাই আশেক মাহমুদই তাদের ক্লায়েন্ট, সে-ই যাবতীয় খরচ বহন করে। আসকার ইবনে সায়িদ আরো দেখতে পান, আর্জুমান্দ বেগমকে দু-জন নার্স পালাক্রমে সেবা দিয়ে থাকে তাদের একজন তরুণী, অন্যজন অপেক্ষাকৃত মাঝবয়সী।

ডাক্তার দ্রুত অ্যাডমিনে ফোন করে জেনে নেন, আজকের রাতে কোন্ নার্স ডিউটিতে আছে। সেই নার্সের কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা নিয়ে নেন তিনি-তরুণী নার্সের নাম জেবুন্নেসা খাতুন।

সঙ্গে সঙ্গে মুশকানকে ফোন দিয়ে এই তথ্যটা জানিয়ে দেন ডাক্তার। সব শুনে মুশকান তাকে বলে, এখন ঠাণ্ডা মাথায় কিছু কাজ করতে হবে তাকে, আর এটা করতে পারলে সুস্মিতা খুব দ্রুতই মুক্তি পাবে বন্দীদশা থেকে।

ডাক্তার বুঝতে পারেন, তিনি একেবারে সঠিক সময়ে মূল্যবান একটি তথ্য দিয়েছেন।

এরপরই মুশকানের পরিকল্পনা অনুযায়ি জেবুন্নেসা নামের নার্স মেয়েটাকে ফোন দেন ডাক্তার। হাসপাতালের একজন অ্যাডমিন পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল হসপিস সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড মনিটরিং অর্গানাইজেশন থেকে ডেইজি হক নামের একজন ইন্সপেক্টর একটু পরই আর্জুমান্দ বেগমের অ্যাপার্টমেন্টে যাবে ইন্সপেকশন করার জন্য। তাকে যেনো যথাযথ সহযোগীতা করা হয়। ঐ মহিলার রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জেবুন্নেসা যেনো কোনো রকম ত্রুটি না রাখে, দ্রুত সব কিছু গুছিয়ে নেয়। আর অরিয়েন্ট হাসপাতাল থেকে যে তাকে আগেভাগে এটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে সেটা যেনো ঘুণাক্ষরেও ঐ মহিলা জানতে না পারে। জেনে গেলে পুরো ইন্সপেকশনটি বাতিল করা হবে, বিশাল অঙ্কের জরিমানা গুণতে হবে হাসপাতালকে। এমন কি, তাদের হসপিস সার্ভিসটিও বন্ধ করে দেয়া হতে পারে সাময়িক।

সব শুনে নার্স মেয়েটি সতর্ক হয়ে ওঠে। যদিও তার বিস্ময় টের পেয়েছিলেন ডাক্তার। সেটাই স্বাভাবিক। এরকম ইন্সপেকশন করার কথা মেয়েটি কখনও শোনেনি তার দেড় বছরের চাকরি জীবনে। তার চাইতেও বড় কথা, এতো রাতে ইন্সপেকশন করা হচ্ছে বলে বেশ অবাক হয়েছে। সেজন্যে ডাক্তার তাকে আরো জানান, এই অর্গানাইজেশন গঠিত হয়েছে মাত্র আটমাস আগে। তাদেরকে সব রোগীর ডেটা সরবরাহ করার নিয়ম আছে। আর তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই ইন্সপেকশনের কাজ করে থাকে। তবে ওখানে ডাক্তারের ঘনিষ্ঠ একজন কাজ করে বলে তিনি আগে থেকে জেনে নিতে পেরেছেন। হসপিস ইন্সপেকশনটি সাধারণত রাতেই বেশি করা হয়, কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় এই সার্ভিসে নিযুক্ত নার্সেরা রাতের বেলায় ঢিলেমি দিয়ে থাকে।

এসব বলে জেবুন্নেসাকে পুরোপুরি ‘কনভিন্স করতে সক্ষম হয়েছিলেন ডাক্তার।

একটু আগে মুশকানকে ফোন করে আশ্বস্ত হয়েছেন তিনি, তাদের প্ল্যানটা ঠিকমতোই এগোচ্ছে। মুশকান এখন পিএস আশেক মাহমুদের অ্যাপার্টমেন্টে তার বোন আর্জুমান্দ বেগমের সামনে আছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *