2 of 2

৮০. সাপ্তাহিক ‘যুগান্তর’ পত্রিকা

সাপ্তাহিক ‘যুগান্তর’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে প্রাক্তন গুপ্ত সমিতির সদস্যরা একে একে জড়ো হতে লাগল। বারীনই পত্রিকাটির মূল সংগঠক, সম্পাদনার অনেকখানি দায়িত্ব নিয়েছে ভূপেন দত্ত। দেবব্রত, সত্যেন, কানাই, নরেন গোঁসাই, উপেন এরকম অনেকেই কিছু কিছু লেখে, কোনও লেখাতেই লেখকের নাম থাকে না। ভরত আর হেম নিয়মিত আসে। পত্রিকার অফিসে কাজের সঙ্গে সঙ্গে আড্ডাও চলে অবিরাম। সবাই মিলে দু পয়সা-তিন পয়সা চাঁদা দিয়ে আনানো হয় মুড়ি আর বেগুনি-ফুলুরি, সেই সঙ্গে ভাঁড়ের পর ভাঁড় চা।

 চাঁপাতলায় কানাই ধরের গলিতে একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। নীচের তলায় প্রেস, ওপরতলায় তিনটি ঘরের মধ্যে একটিতে অফিস, অন্যটিতে একটি চৌকির ওপর বিছানা পাতা, সে বিছানা কখনও গোটানো হয় না, বালিশ দুটি তেল চিটচিটে হয়ে গেছে, এই বিছানার ওপরে বসেই সকলে গল্প-গুজব-তকাতর্কি করে, অধিক রাত্রি হলে দু-তিনজন ওখানে থেকেও যায়। অন্য কুইরিটা কিছুটা রহস্যময়, সব সময় তালা বন্ধই থাকে, তার চাবি থাকে শুধু দেবব্রতর কাছে। ওই ঘরটি সম্পর্কে অন্যরা কৌতূহল প্রকাশ করেন, বারীন শুধু মুচকি হেসে দেবব্রতর দিকে তাকায়। দেবব্রত কিছুই বলে না।

ক্রমে জানা গেল, ওই বন্ধ কুঠুরিতে বন্দুক-পিস্তল সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে। উপযুক্ত সময়ে গোপনে গোপনে ওই সব অস্ত্র বিভিন্ন কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এইবার শুরু হবে সত্যিকারের বিপ্লব।

হেম বরাবরই নিজের কাছে পিস্তল রাখে। অস্ত্র আইন সে গ্রাহ্য করে না, আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতি তার খুব ঝোঁক। এখানে কী ধরনের অস্ত্র মজুত করা হচ্ছে, তা দেখার জন্য সে বারীনকে পীড়াপীড়ি করে। বারীন বলল, দেখো ভাই, এখানকার কথা পাঁচ কান হোক আমি তা চাই না। তা ছাড়া এসব জোগাড় করতে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, যদি কোনও বিপ্লবী এখান থেকে অস্ত্র নিতে চায়, তাকে দাম দিতে হবে। হেম সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমাদের মেদিনীপুর সমিতির জন্য একটা অস্ত্র চাই, আমি দাম দিতে রাজি আছি।

শুধু হেমের সামনে এক রাত্রে সেই ঘরের চাবি খুলল দেবব্রত। সে ঘরে কোনও আলো নেই। দেবব্রত একটা রিভলবার তুলে দিল হেমের হাতে। হেমের অভিজ্ঞতা আছে, হাতে নিয়ে বুঝল, সেটা বেশ পুরনো ধরনের, ঠিক মতন গুলি বেরুবে কি না সন্দেহ। তবু সে জিজ্ঞেস করল, আর নেই? বারীন বলল, যত চাও তৃত পাবে, তুমি তো একখানাই চেয়েছ! হেম বলল, না, আমার অন্তত চার-পাঁচখানা লাগবে, সব দাম আমি মিটিয়ে দেব। তখন বারীন আমতা আমতা করে বলল, এখনই তোমাকে দেখানো যাবে না। ঠিক আছে, তুমি অডার দিয়ে কিছু অগ্রিম দিয়ে যাও, কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে!

এই একটিমাত্র জং ব্রা রিভলবারের জন্য এত সতর্কতা! এই দিয়ে বিপ্লব শুরু হবে! হেম নিঃশব্দে হাসল। বারীন অতিশয়োক্তিতে ওস্তাদ।

আর কিছুদিন পরে কিন্তু বারীন তাক লাগিয়ে দিল। সকলকে ছাদে ডেকে নিয়ে দুটি গোলাকার লোহার বল দেখাল। এর নাম বোমা। বারীন সবিস্তারে বোঝাল, এই বোমা পুঁতে দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটালে রেললাইন উড়ে যাবে, কোনও বাড়ির মধ্যে ফাটালে সে বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে, সেখানকার কেউ প্রাণে বাঁচবে না।

এ রকম বোমা কেউ আগে দেখেনি। বারীন এ বোমা পেল কোথা থেকে? বারীন সব সময় রহস্য করতে ভালবাসে। মাথা দুলিয়ে বলল, সে এক জায়গা থেকে পেয়েছি। আরও পাওয়া যাবে, আরও তৈরি হবে।

একটু পরে সে নিজেই জানাল যে নেপালের রাজার অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কারখানার প্রধান মিস্তিরি একজন বাঙালি। তাকে হাত করে তার কাছ থেকে এই বিদ্যে সে মেরে দিয়েছে!

সেই মিস্তিরির কাছ থেকে এ বিদ্যে শিখে নিয়ে বারীন নিজেই বানিয়েছে? তা অবশ্য নয়। এক কলেজের কেমিস্ট্রির ছাত্রের সে সাহায্য নিয়েছে।

হেমের সন্দেহপ্রবণ মন। সে জিজ্ঞেস করল, এ বোমা যে ফাটবে, তার প্রমাণ কী?

বারীন একটা বোমা থেকে কিছুটা মশলা বার করে এনে দেশলাই কাঠি জ্বেলে দিল। অমনই সেই মশলা জ্বলে উঠল দপ করে। অনেকটা তুবড়ির বাজির মতন।

বারীন বলল, লোহার খোলের মধ্যে যখন ফাটবে, তখনই বিস্ফোরণ হবে। সেটা তো আর এখানে দেখানো সম্ভব নয়! যথাসময়ে দেখতে পাবে।

বারীন সেই বোমা দুটি কিছু কিছু ধনী ব্যক্তিকে দেখিয়ে মুগ্ধ-বিহ্বল করে দিয়েছে। হ্যাঁ। এবারে বাঙালির হাতে একটা অস্ত্র এসেছে বটে। এ দিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করা যাবে।

ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থেই রাজভক্ত হয়। কিন্তু ইদানীং স্বদেশি ভাবের জোয়ার এসেছে, কিছু কিছু ধনী ব্যক্তির মনেও ইংরেজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হয়েছে। সিপাহি বিদ্রোহের পর, মাঝখানের এতগুলি বছরে ইংরেজ সরকারের এমন হিংস্র রূপ দেখা যায়নি। অল্পবয়েসী ছাত্রদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চলছে গ্রামেগঞ্জে। এমনকী ভদ্রলোক, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতাদের ওপরও লাঠি চালিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। বরিশালের ঘটনায় অপমানিত বোধ করেছে সারা দেশবাসী। বরিশালে এখনও পিটুনি-কর চলছে। সাধারণ মানুষও এখন উত্তেজিত হয়ে আছে দেখে ধনী মানুষদেরও মনে হচ্ছে, ইংরেজের রাজত্ব শেষ হওয়ার পালা এখন শুরু হয়ে গেছে।

বারীনের ওই বোমা দেখে কয়েকজন ধনী ব্যক্তি বলেছে, তোমরা যদি ইংরেজের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারো, তা হলে টাকা পয়সার অভাব হবে না। আমরা সাহায্য করব। কেউ কেউ দু হাজার-পাঁচ হাজার টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সুরেন ঠাকুর অগ্রিম দিয়েছে এক হাজার টাকা।

‘যুগান্তর’ সাপ্তাহিকটি কয়েক সংখ্যার মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বেশ। ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই। গরম গরম উত্তেজক রচনা এতে প্রকাশিত হয়। বিপিনচন্দ্র পালও ইংরিজিতে ‘বন্দেমাতরম’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছেন, যার প্রধান লেখক অরবিন্দ ঘোষ। তিনি বারীনের কাগজেও লেখা দেন, তবে তিনি বাংলায় লিখতে পারেন না, তাঁর ইংরেজি লেখা অনুবাদ করে নেওয়া হয়।

‘যুগান্তর’-এর লেখকদের সাহস দিন দিন বাড়ছে। তীব্র সরকার-বিদ্বেষী সুর ফুটে ওঠে বিভিন্ন রচনায়। ভারতবর্ষ থেকে সম্পূর্ণভাবে ইংরেজ বিতাড়নের কথা কেউ আগে উচ্চারণ করেনি, এই লেখকরা জ্বলন্ত ভাষায় প্রকাশ করতে লাগল যে এ দেশের দুঃখ, দুর্দশা, দারিদ্রের মূল কারণ ইংরেজ শাসন। ইংরেজরা এ দেশকে পদানত করার আগে সকল মানুষেরই খাদ্যবস্ত্রের সংস্থান ছিল, শান্তি-শৃঙ্খলা ছিল, সমৃদ্ধি ছিল, এই মিথ্যে সুখচ্ছবিও ফোঁটানো হতে লাগল। দেশ স্বাধীন হলে নুনের ওপর ট্যাক্স থাকবে না, কাপড়ের ওপর ট্যাক্স থাকবে না, জিনিসপত্র সুলভ ও শস্তা হয়ে যাবে, সকলেই দু বেলা পেট ভরে খাবার পাবে, পরিধেয় বস্ত্র পাবে, তার চেয়েও বড় কথা আত্মসম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবে, এই সব বোঝানো হতে লাগল সাধারণ মানুষকে।

পত্রিকায় জ্বালাময়ী ভাষায় আর্টিকেল লিখে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কী হয়? ইংরেজ সরকারও এ সব লেখা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তারা কী ভাবছে, এ সবই দুর্বলের আস্ফালন! হেম মাঝে মাঝেই এ প্রশ্ন তোলে।

একদিন মধ্যরাত্রে বারীন একটা গোপন সভা ডাকল। সকলকে জানানো হয়নি, শুধু দেবব্রত, সত্যেন, হেম আর ভূপেন সেখানে উপস্থিত। বারীন বলল, তোমরা কিছু একটা শুরু করার জন্য অস্থির হয়ে আছ, আমি জানি। আমার নিজেরও একই অবস্থা। এইবার সময় এসেছে। আমি আমাদের প্রধান নেতার কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার অপেক্ষা করছিলাম, সেই নির্দেশ পেয়ে গেছি, আর দেরি করা চলবে না। তোমরা সবাই জানো, সারা বাংলা জুড়ে যে পুলিশি তাণ্ডব চলছে, তার মূলে কে! নতুন প্রদেশের গভর্নর ব্যামফিলড ফুলার। এমনকী পূর্ববঙ্গে যে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা, হচ্ছে, তার পেছনেও আছে সরকারের উস্কানি। নির্লজ্জভাবে তারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। ফুলার সাহেবকে এর শাস্তি পেতেই হবে। আমরা আজ এই সভায় তার প্রাণদণ্ড দেব!

সত্যেন বলল, ঠিক আছে। দিলাম তার প্রাণদণ্ড। তারপর সেটা একসিকিউট করা হবে কী করে?

বারীন বলল, আমরাই একসিকিউট করব।

দেবব্রত বলল, যে-সে লোক নয়। প্রথমেই গভর্নর। সব সময় সেপাই-সান্ত্রীরা তাকে ঘিরে থাকে। দুর্ভেদ্য সিকিউরিটি। তা ভেদ করে তার সামনে পৌঁছনো যাবে কী করে?

বারীন বলল, সে স্ট্র্যাটেজি আমি ঠিক করেছি, পরে বলছি। আগে বলল, তোমরা সবাই এই প্রাণদণ্ডের ব্যাপারে একমত কি না।

কেউ আপত্তি জানাল না। শুধু দেবব্রত বলল, আমারও অমত নেই। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। এ কাজে অনেক বিপদের ঝুঁকি নিতে হবে। সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। তারপরেও ধরা যাক আমরা সফল হলাম। কিন্তু একজন গভর্নরকে মেরে কী লাভ হবে? তার বদলে আর একজন নতুন গভর্নর আসবে। সে হয়তো আরও কঠোর দমননীতি চালাবে।

বারীন বলল, লাভ হবে এই যে, ইংরেজ বুঝবে, বাঙালির প্রত্যাঘাত করার সাহস ও শক্তি আছে। ইংরেজের দমননীতি আমরা সহ্য করব না। এত বড় ঘটনা সব সংবাদপত্রে ছাপা হবে, পাবলিসিটি হবে। সারা দুনিয়া জানবে। ইংরেজ তাতে ভয় পেতে বাধ্য হবে।

দেবব্রত বলল, সাহেব হত্যার পরিণাম কী হয় জানোনা নিশ্চয়ই। মহারাষ্ট্রে চাপেকর ভাইদের ফাঁসি হয়েছিল। ইংরেজ সরকার আমাদেরও খুঁজে বার করবে, কারুকে ছাড়বে না।

বারীন বলল, আমরা অনেক সাবধানতার সঙ্গে এগুবো। তবে ওদের একজনের প্রাণের বিনিময়ে আমাদেরও একজনকে প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। একজনের বদলে একজন। এবার আমাদের লাইন অব অ্যাকশন কী হবে জানাচ্ছি। প্রথমে একজন দূর থেকে ছোটলাট ফুলারকে অনুসরণ করবে কয়েকদিন ধরে। তার ডেইলি হ্যাঁবিট কী সেটা বুঝে নেবে। অর্থাৎ সে কখন বাড়ি থেকে বেরোয়, কোথায় যায়, গাড়িতে কে কে থাকে এই সব জানা দরকার। তারপর সে ঠিক কোন জায়গায় ছোটলাটের গাড়ির খুব কাছাকাছি যাওয়া যায়, সেটা ঠিক করে নেবে। তারপর তাকে সাহায্য করার জন্য আমাদের আর একজন যাবে। এই দ্বিতীয়জনকে অ্যাকচুয়াল খুনের কাজটা করতে হবে। একে স্থানীয় লোকেরা আগে দেখেনি, তাই তাকে কেউ চিনতে পারবে না। আর প্রথমজন কাজের আগেই সরে পড়বে।

সত্যেন বলল, তা হলে দ্বিতীয়জন, যে খুনটা করবে, তার হাতেনাতে ধরা পড়ার খুবই সম্ভাবনা। বারীন বলল, হ্যাঁ, তা ঠিক। ধরা পড়লেই তাকে আত্মহত্যার জন্য রেডি থাকতে হবে। ফাঁসির দড়িতে ঝোলার বদলে সে নিজেই দেশের জন্য প্রাণ দেবে। ওই যে বলোম, একজনের বদলে একজন! ফুলারকে যে মারবে, সে নিজে প্রাণ দিলেও চিরকালের জন্য ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে।

দেবব্রত বলল, ফুলার এখন শিলং-এ।

বারীন বলল, সেইটাই তো সুবিধে। গরমকালটা ওই হারামজাদা শিলং-এই থাকবে। শিলং-এ আমার সেজদার শ্বশুরবাড়ি, বউদি সেখানেই আছেন। সেজদা চিঠি লিখে দিলে আমি শরীর সারাবার অজুহাতে ওখানে গিয়ে থাকব কিছুদিন। এতে কারুর সন্দেহ করার কিছু নেই। আমি ফুলারের গতিবিধির সমস্ত খোঁজখবর নিয়ে তোমাদের জানালেই তোমরা একজনকে পাঠাবে। কাকে পাঠাবে, সেটা কি এখনই ঠিক করে ফেলা যায়?

দেবব্রত বলল, লটারি করলেই হয়। যার নাম উঠবে। বারীন বলল, হ্যাঁ, এটা একটা ভাল প্রস্তাব। তা হলে কারুর মনেই কোনও গ্লানি থাকবে না। চার বছর আগে আমরা যে কজন দেশের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেওয়ার শপথ নিয়েছিলাম, তাদের মধ্যেই লটারি হোক।

সত্যেন বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও, হুট করে ওরকম সিদ্ধান্ত নিয়ো না। ধরো যদি দেবব্রতদার নাম ওঠে, তাঁকে পাঠানো কি ঠিক হবে? দেবব্রতদা ধীরস্থির মানুষ, তাঁর কাছে কত ব্যাপারে আমরা পরামর্শ নিই। তাঁকে এক্ষুনি মরতে দেওয়া যায় না। এমন একজনকে ঠিক করা উচিত, যার মজবুত শরীর, বয়েস কম। জোরে ছুটতে পারবে, মারার সময় হাত কাঁপবে না। আমরা যারা পত্রিকাটি চালাচ্ছি, তাদের কারুর ওপর ও কাজের ভার দেওয়া ঠিক নয়।

বারীন বলল, তা হলে সে রকম কারুর খোঁজ করতে হয়। বরিশালে উল্লাসকর দত্ত নামে একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হল, খুব সাহসী আর জেদি, দেশপ্রেম বুকের মধ্যে টগবগ করছে, তার সঙ্গে যোগাযোগ করব?

সত্যেন বলল, তাতে সময় লাগবে। আমি একজনের নাম সাজেস্ট করতে পারি। মেদিনীপুরে ক্ষুদিরাম নামে একটা ছেলে আছে। দারুণ ডাকাবুকো ছেলে। ওর বাপ-মা নেই, কোনও পিছুটান নেই। সাহেবদের ওপরেও খুব রাগ। সে ছেলেটা এর মধ্যে কী কাণ্ড করছে জানো? ফেব্রুয়ারি মাসে মেদিনীপুরে একটা কৃষি-শিল্প মেলা হয়েছিল। সেই মেলার গেটে দাঁড়িয়ে ‘সোনার বাংলা নামে একটা নিষিদ্ধ প্যামফ্লেট বিলি করছিল ক্ষুদিরাম। সে প্ল্যামফ্লেটে দারুণ সব ইংরেজ-বিরোধী কথা ছিল। একজন হেড কনস্টেবল তার একখানা কাগজ পড়েই দৌড়ে এসে ক্ষুদিরামকে চেপে ধরল। টেনে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ক্ষুদিরামকে নিয়ে যাচ্ছে, সেই অবস্থায় ক্ষুদিরাম দুম করে একখানা ঘুষি চালিয়ে দিল হেড কনস্টেবলের মুখে। তখন আরও একজন সেপাই ছুটে এল। দৈবাৎ আমি সেখানে দিয়ে যাচ্ছিলাম, আমার মনে হল, এ ছেলেটা পুলিশকে ঘুষি মেরেছে, এবার তো ওকে পেটাতে পেটাতে শেষ করে দেবে! কিছু না ভেবেই আমি বলে উঠলাম, আরে আরে, উও ডিপটি সাহাবকা লেড়কা হায়, উসকো কেঁউ পাকড়ায়া? এ কথা শুনে সেপাইরা একটু হাত আলগা করতেই ক্ষুদিরাম টেনে দৌড় মারল। ছেলেটার দারুণ সাহস!

দেবব্রত বলল, এ ঘটনা আমিও শুনেছি। এর ফলে তোমার কেরানিগিরির চাকরিটা গেছে।

সত্যেন বলল, সে যাক। এই ক্ষুদিরাম ছেলেটার বুকের মধ্যে আগুন আছে। ওকে বড় কাজে লাগানো যায়।

বারীন বলল, ভাল কথা। তুমি ওকে রাজি করাতে পারবে?

সত্যেন বলল, আমি বললে, সে নিশ্চয়ই রাজি হবে।

বারীন বলল, ঠিক আছে, তা হলে তুমি ছেলেটাকে কলকাতায় আনিয়ে নাও! এই বয়েসের ছেলেরা অনায়াসে প্রাণ দিতে পারে।

হেম এতক্ষণ পরে বলল, এখানে আমার একটা বক্তব্য আছে। ক্ষুদিরামের নেহাতই অল্প বয়েস। এখনও কৈশোর ছাড়ায়নি, এই পৃথিবীর প্রায় কিছুই সে দেখল না, জানল না। বাপ-মা মরা ছেলে ভাল করে খেতেও পায়নি কখনও, জীবনের কিছুই সে উপভোগ করেনি, তাকে আমরা জেনেশুনে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেব?

বারীন বিস্মিতভাবে বলল, সে কী! দেশের জন্য প্রাণ দেবে, সেটা গৌরবের কথা নয়?

হেম বলল, হ্যাঁ, সেটা গৌরবের বিষয় হতে পারে অবশ্যই, তার আগে তো জানতে হবে, দেশ। কাকে বলে! মানুষ আদর্শের জন্য প্রাণ দেয়, সেই আদর্শটা কী তা জানতে হবে না? ক্ষুদিরাম তা জানে? ক্ষুদিরাম একটা দুরন্ত, ডানপিটে ছেলে, তার মধ্যে সেই আদর্শবোধ জাগাতে হবে না? হুট করে তাকে মৃত্যুর মুখে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা সবাই নিরাপদে দুরে বসে থাকব? আমি এটা কিছুতেই মানতে পারি না।

বারীন হতাশভাবে বলল, তা হলে তো সব কিছুই পিছিয়ে গেল। আগে সেরকম একজনকে তৈরি করে নিতে হবে।

হেম বলল, না পেছোবে না। তুমি শিলং-এ গিয়ে কাজ শুরু করে, খবর পাঠালেই আমি যাব।

সবাই সবিস্ময়ে হেমের দিকে ঘুরে তাকাল।

সত্যেন বলল, তুমি? পাগল নাকি! তোমার ছেলেপুলে আছে।

হেম বলল, একটু আগে লটারির কথা বলা হল। লটারিতে আমার নাম উঠতে পারত!

সত্যেন বলল, সেইজন্যই তো লটারির কথাটা বাতিল করেছি। অন্য ছেলে খুঁজতে হবে। তুমি বিয়ে করেছ, সংসারী মানুষ।

হেম বলল, হ্যাঁ, আমি বিয়ে করেছি বটে, ছেলেপুলেও হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই সংসারী হতে পারিনি। আমি চলে গেলেও ওদের কিছু ক্ষতি হবে না। ও কাজটা আমিই করব ঠিক করে ফেলেছি।

এবার সকলে আপত্তি জানাতে লাগল। শুরু হল তর্ক। হেমকে কিছুতেই বাগ মানানো যায় না। একসময় হেম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শোনো, আমি শেষ কথা বলছি। আমি নিজের সঙ্গে নিজে বাজি ধরেছি। ফুলার সাহেবকে যদি মারতে হয়, তা হলে আমাকেই যেতে হবে। তোমরা যদি রাজি না হও, বারীন যদি আমাকে সঙ্গে নিতে না চায়, তা হলে আমি একাই যাব। নিশ্চিত যাব। ক্ষুদিরামের মতন ছেলে তোমরা কজন পাবে? যে আগুন জ্বলবে এরপর, তাতে সংসারী লোকরাও বাদ যাবে না!

এরপর আর কোনও কথা চলে না।

দিন তিনেক বাদে ভোরবেলা হেম এল ভরতের সঙ্গে দেখা করতে। হেম এখন আর মেসে থাকে, তার এক ছেলে অসুস্থ বলে তার স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছে, সকলে মিলে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকে। পত্রিকা অফিসেও হেমকে কয়েকদিন দেখেনি ভরত।

শেষ রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, এ ঘরটার একটা জানলার কাঁচ ভাঙা, সেখান থেকে বৃষ্টির ছাঁট আসে। সে জন্য ভোরেই ভরতের ঘুম ভেঙে গেছে। কিন্তু ভাঙা কাঁচটা বন্ধ করার কোনও উপায় নেই।

ভরতের ঘরটি দোতলায়। পাশেই একটা একতলার ছাদ, ভরতের ঘরের জানলা দিয়ে সেটা দেখা যায়, কিন্তু সে ছাদে কারুকে ভরত কখনও যেতে দেখেনি, কীভাবে যাওয়া যায় তাও সে জানে না। অনেকে নিজেদের ঘর থেকে সেই ছাদটায় ছুঁড়ে ঘুড়ে আবর্জনা ফেলে। বাথরুমের অব্যবহৃত সেই ছাদটির আবর্জনার মধ্যে কয়েকটি গাছ গজিয়েছে, তাতে ফুটেছে ফুল। ভরত গাছপালা, ফুলফল বেশ চেনে। ওগুলো নয়নতারা ফুল। কী করে ওই আবর্জনার স্তূপে জন্মাল!

ভরত একমনে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ফুলগুলো দেখছে, কখন যে হেম তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে খেয়ালও করেনি, হেম তার কাঁধে হাত রেখে বলল, কী ব্রাদার, কী খবর? এত সাততাড়াতাড়ি উঠে পড়েছ যে!

ভরত মুখ ফিরিয়ে বলল, কে ও, তুমি! তুমিও তো এত সকালে বেরিয়ে পড়েছ? ছেলে কেমন আছে? জ্বর কমেছে?

হেম বলল, হাঁ, এখন ভাল আছে। ওদের মেদিনীপুরে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।

ভরত বলল, দেখো হেম, এই ছাদটা, দেখলেই বোঝা যায়, ওখানে অনেকদিন কেউ যায় না।

তবু ওখানে আপনি আপনি গাছ হয়েছে, কী সুন্দর ফুল ফুটেছে।

হেম অন্যমনস্কভাবে বলল, হুঁ।

ভরত বলল, আমি রোজ জানলা দিয়ে ওই ফুলগাছগুলো দেখি। এই কদিন একটানা রোদে ওরা কীরকম যেন ম্লান হয়েছিল। কাল যেই বৃষ্টি হয়েছে, ওদের রূপ কত খুলে গেছে। লতাগুলো চকচকে হয়েছে, আর ফুলগুলো যেন খুশিতে হাসছে। ঠিক যেন এক ঝাঁক বাচ্চা মেয়ে।

হেম বলল, ভরত, তোমার মেদিনীপুরে ফিরে যাওয়া উচিত। আমি তোমাকে আটকে রেখেছি। তুমি গাছপালা এত ভালবাস, এই রুক্ষ শহরে তোমার মাসের পর মাস থেকে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। তোমার খামারের গাছগুলোও তোমার বিরহে নিশ্চয়ই কাতর হয়ে আছে।

ভরত বলল, কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়। গাছের যে প্রাণ আছে, তা তো সবাই জানে। আমাদের জগদীশবাবু গাছপালার নানারকম চেতনার কথা যে বলেছেন, তা আমিও যেন অনুভব করেছি। গাছেরা মানুষদের লক্ষ করে, মানুষের মধ্যে কে তাদের বন্ধু, তাও চেনে। মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, আমার খামারের গাছগুলো আমায় ডাকছে। ও হেম বলল, তা হলে তুমি এখানকার পাট গুটিয়ে ফেল। আমাকেও একবার পূর্ববাংলায় যেতে হবে, একটা কাজ আছে, বেশ কিছুদিন কলকাতায় থাকব না।

ভরত জিজ্ঞেস করল, পূর্ববাংলায় তোমার কী কাজ? তুমিও কিছুদিনের জন্য মেদিনীপুর চলো।

হেম বলল, সেটা সম্ভব নয়। দু-চারদিনের মধ্যেই আমায় রওনা হতে হবে। তুমি আমার বাড়ির লোজনদের একটু দেখাশুনো কোরো।

এরপর চা এল। গল্প হল কিছুক্ষণ। হেম হঠাৎ পূর্বঙ্গে যাচ্ছে কেন, তা বুঝতে পারল না ভরত। কারণ হিসেবে হেম বলল বটে যে, ঝালকাঠিতে তার এক অসুস্থ আত্মীয়ের সেবা করতে যাবে, কিন্তু সেটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। হেমের নিজের ছেলেই বেশ রুগণ, তাকে ফেলে সে যাচ্ছে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সেবা করতে, এ কেমন মানুষ?

বিদায় নেওয়ার সময় হেম বলল, আবার কবে তোমার সঙ্গে দেখা হবে, জানি না। তুমি মেদিনীপুরের দিকটা সামলে রেখো। আমাদের সমিতির ছেলেরা যেন কাজকর্ম চালিয়ে যায়।

তিন দিন পরই শিলং থেকে হেমকে পাঠাবার জন্য বারীনের নির্দেশ এল। কয়েকটা জামাকাপড় ও দুটি রিভলবার একটা পুটুলিতে বেঁধে তৈরি হয়ে নিল হেম। বোমা দুটি বারীন সঙ্গে নিয়ে গেছে। সব ব্যাপারটাই অত্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে, মাত্র তিনজন ছাড়া অন্য বন্ধুরাও কিছু জানে না।

শিয়ালদা স্টেশনে হেমকে পৌঁছে দিতে এসেছে ভূপেন। এই ট্রেন গোয়ালন্দ পর্যন্ত যাবে, প্রতিটি কামরাতেই বেশ ভিড়। আগেই একটা কামরার ওপরের বাঙ্কে চাদর বিছিয়ে দখল বজায় রেখেছে হেম, কিন্তু ভেতরে এমন গুমোট ভাব যে বসে থাকা যায় না। ট্রেন ছাড়তে দেরি করছে, দুজনে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।

ভূপেন মাঝে মাঝেই অদ্ভুতভাবে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকছে হেমের দিকে। তাতে অস্বস্তি বোধ করছে হেম। একবার সে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, তুমি আমার মুখের দিকে কী দেখছ?

ভূপেন বলল, কেমন যেন বিচিত্র লাগছে। একজন বন্ধুকে চিরবিদায় জানাতে এসেছি! তোমার

সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না, এটা এখনও মেনে নিতে পারছি না।

হেম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ধ্যাৎ! ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না।

ভূপেন বলল, আমি এখনও বুঝতে পারছি না, তুমি কেন যাচ্ছ? তোমার অ্যাকশন যদি সাকসেসফুল হয়, সেই ভিক্টিমের কাছাকাছি অনেক গার্ড থাকবে, তারা মুহূর্তের মধ্যে তোমাকে ঘিরে ফেলবে, তারপর তোমার বাঁচার কোনও আশাই থাকবে না।

হেম হালকাভাবে বলল, সে তখন দেখা যাবে। মোট কথা, প্রাণ থাকতে আমি ধরা দেব না কিছুতেই।

ভূপেন বলল, সব জেনেশুনেই তুমি যাচ্ছ! এটা কি শুধুই দেশপ্রেম, না মৃত্যুবিলাস? কারুর ওপর তোমার অভিমান আছে?

হেম এবার হেসে ফেলে বলল, ওসব কিছুই না। কারুকে তো শুরু করতেই হবে! সেই প্রথম হবার অধিকারটা আমি ছাড়ি কেন?

ভূপেন বলল, তুমি হাসছ এখনও!

হেম বলল, কান্নাকাটি একদম বাদ। ফ্যাচফ্যাঁচানি আমি সহ্য করতে পারি না।

ভূপেন হেমের একটা হাত চেপে ধরে বলল, একটা কথা বলব, তুমি কিছু মনে করবে না?

হেম বলল, না, না, মনে করব কেন, তুমি বলো, যা খুশি বলো!

ভূপেন তবু বিহুলের মতন চুপ করে রইল।

হেম বলল, কী হল বলো? বলল! যা তোমার মনে আসে—

ভূপেন বলল, এই কথাটা অনবরত আমার মাথায় ঘুরছে। তোমাকে এভাবে বলা হয়তো উচিত নয়, তবু বলি। পরকাল বলে কি কিছু আছে? মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়? মৃত্যুর পর কোনও মানুষের কাছ থেকেই আর সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। তুমি একটা বন্ধুর কাজ করবে! তুমি তো মরতেই যাচ্ছ, মৃত্যুর পর যদি কিছু থাকে, তবে যে কোনও গতিকে আমাকে একবার তা জানিয়ে দেবে, এই প্রতিজ্ঞা করো।

হেম ঘোরর নাস্তিক। সে আত্মার অস্তিত্ব, পরকাল, স্বর্গ-নরক এর কোনও কিছুই বিশ্বাস করে না। সে হো-হো করে হেসে উঠতে যাচ্ছিল, ভূপেনের মুখে তীব্র ব্যাকুলতার ছাপ দেখে হাসি দমন করল। নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করল, তুমি পরকালে বিশ্বাস করো, না?

ভূপেন বলল, কেমন যেন সংশয় আছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, অথচ কেমন যেন….তুমি ঠিক খবরটা দিলে বুঝতে পারব।

হেম বলল, এ তো বড় আশ্চর্য ব্যাপার। তোমার দাদা স্বামী বিবেকানন্দ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মগুরু। তিনি সারা বিশ্বে ঘুরে ঘুরে আধ্যাত্মিকতা প্রচার করলেন, আত্মার অবিনশ্বরতার কথা বোঝালেন, আর তিনি নিজের ছোট ভাইয়ের মনের সংশয় ঘোচাতে পারলেন না।

গার্ড সাহেব হুইল দিলেন, ট্রেনের গা মুচড়ে উঠল। আর সময় নেই। হেম ভূপেনকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে আন্তরিক গলায় বলল, যদি পরকাল বলে কিছু থাকে, সেখানে গিয়ে সে কথা মর্ত্যলোকে জানালে যদি কিছু শাস্তির ব্যবস্থা থাকে, এমনকী যদি অনন্ত কুম্ভীপাকেও চিরকাল বাস করতে হয়, তবু কোনওক্রমে আমি সে কথা তোমাকে নিশ্চয়ই জানাব!

তারপর দৌড়ে সে চলন্ত ট্রেনে নিজের কামরায় উঠে পড়ল।

এরপর হেম খানিকক্ষণ মনে মনে হাসল। ভূপেনের মুখ থেকে এরকম কথা শুনবে সে আশা করেনি। যুগান্তরের অনেকেই বেশ ধার্মিক। জপ-তপ, পুজো-আচ্চা করে। এমনকী পত্রিকার অফিসেই কেউ কেউ প্রার্থনায় বসে যায়। বারীনের দাদা অরবিন্দ ঘোষ, প্রকৃতপক্ষে সকলের নেতা, তিনি ঘোরতর হিন্দু হয়ে উঠেছেন, বারীন তাঁর নির্দেশে এখন জপ করে। পত্রিকার মলাটে খাঁড়া হাতে কালীর ছবি। উপেন গেরুয়া পরে। নরেন গোঁসাইয়ের আচরণও সন্ন্যাসীর মতন। শুধু হেম আর ভরতের মতন দু-তিন জন ওসবের ধার ধারে না। ভূপেনও বরাবর যুক্তিবাদী। ভক্তি বনাম যুক্তি নিয়ে তর্ক হয় যখন তখন। কার্ল মার্কস নামে একজন দার্শনিকের কথা ভূপেন বলে মাঝেমাঝে। সমাজতন্ত্র নামে একটা নতুন ভাববাদে সে বিশ্বাস করে। সেই ভূপেনের মনেও পরকাল নামে সম্পূর্ণ কাল্পনিক এক রূপকথা সম্পর্কে একটু একটু বিশ্বাস আছে!

সারারাত ভাল করে ঘুম এল না হেমের। ভূপেনের কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছে। অনবরত সে একই দৃশ্য দেখছে। শিলং পৌদ্বার পর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে লাটসাহেবের মুখোমুখি হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে দুড়ম, দুড়ম! পর পর বারোখানা গুলি চালাবে, তারপর দুটো বোমা। লাটসাহেব খতম! তখনই হেম আত্মহত্যা করবে। সে সময়টুকুও যদি না পায়, তা হলে বডি গার্ডরাই তাকে গুলি করে মারবে। কিংবা আধমরা করে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাবে। সে না হয় হল, কিন্তু তারপর? তারপর কি কয়েকটা যমদূত তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে যমরাজের কাছে? থিয়েটারের ব্যাক ডুপে যেরকম স্বর্গের দৃশ্য আঁকে সে রকম কিছু সত্যিই আছে?

আধো ঘুমের মধ্যে হেম মাথা নেড়ে বলে, না, না, ওসব কিছু নেই। মৃত্যু মানেই সব শেষ! তবু ওই দৃশ্যটা ফিরে ফিরে আসে চোখের সামনে।

ট্রেন ভোরবেলা এসে পৌঁছল গোয়ালন্দে। লোকজনের ভিড়, চ্যাঁচামেচি, ঠেলাঠেলি। হেম চায়ের জন্য খোঁজাখুঁজি করছে, পেছন থেকে কেউ তার কাঁধে হাত রাখল।

মুখ ফিরিয়ে ভূত দেখার মতন চমকে উঠল হেম। ভরত!

সে বলল, এ কী! তুমি কোথা থেকে!

একগাল হেসে ভরত বলল, পূর্ববঙ্গে আমারও বিশেষ কাজ আছে।

হেম রীতিমতন রেগে গিয়ে বলল, চালাকি কোরো না! এ তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! তুমি জানলে কী করে? তার মানে, আরও অনেকে জেনে গেছে?

ভরত বলল, না। আমি নিজেই কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম। ফুলার সাহেবকে শাস্তি দেবার কথা মাঝে মাঝেই উঠেছে। ফুলার এখন শিলং-এ, বারীনও সেখানে গেছে। তুমিও যাচ্ছ। আমি দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছি। তারপর সত্যেনকে চেপে ধরেছি। সত্যেন বিশ্বাস করে আমাকে প্ল্যানটা জানিয়েছে।

হেম বলল, তবু তোমার এভাবে আশা উচিত হয়নি। তুমি পরের ট্রেনেই ফিরে যাও! ভরত মাথা নেড়ে বলল, উহুঃ; ফেরার প্রশ্নই উঠছে না। তোমাদের অ্যাকশন প্ল্যানে ভুল আছে। আততায়ী একজনের বদলে দু’জন রাখতে হয়। তা হলে নিশ্চিত হওয়া যায়। ধরো, ঠিক সময় বোমা ফাটল না, তোমার গুলি ফস্কে গেল। তখন দ্বিতীয়জন গুলি চালাবে! তোমার পাশে আমি থাকব। তা হলেই হান্ড্রেড পার্সেন্ট রেজাল্ট পাওয়া যাবে।

হেম বলল, এটা ছেলেখেলা নয় ভরত। জীবন-মরণের প্রশ্ন। তুমি কেন প্রাণ দিতে যাবে?

ভরত বলল, তুমি কেন যাচ্ছ?

হেম বলল, আমার কথা আলাদা। আমি নিজের সঙ্গে বাজি ধরেছি। যে কাজের দায়িত্ব নিয়েছি সেটা আমাকে পারতেই হবে। এটা আমার নিজস্ব চ্যালেঞ্জ। তুমি শুধু শুধু কেন মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে যাবে! তুমি ফিরে যাও। পরে তোমাকে অন্য দায়িত্ব নিতে হবে।

ভরত বলল, হেম, আমি কতবার মৃত্যুর কাছাকাছি গেছি, তা তুমি জানো না। আমার বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের। নিয়তি আমাকে নিয়ে এক অদ্ভুত খেলা খেলছে। বারবার ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর দিকে। এবার আমি নিজেই এগিয়ে যাব, দেখি কী হয়! তোমার বদলে আমার পক্ষেই এই ঝুঁকি নেওয়া স্বাভাবিক। এই বিশ্বসংসারে আমার কেউ নেই, আমার জীবনের কী দাম আছে! কেউ আমার জন্য কাঁদবে না। আমি হারিয়ে গেলেও কেউ আমার কথা মনে করবে না। তুমি দুটি সন্তানের বাবা, তোমার স্ত্রী রয়েছে, তাদের ফেলে তুমি কেন অকালে চলে যাবে? ফুলার সাহেবকে মারার পর আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকব, তুমি পালাবে। তোমাকে বাঁচতেই হবে। সেইজন্যই আমি এসেছি।

হেম বলল, আমাকে বাঁচাবার জন্য তুমি এসেছ? হঠাৎ তোমার এই আত্মত্যাগের সেন্টিমেন্ট উথলে উঠল কেন? তুমি গাছপালা ভালবাস, ওদের নিয়েই তো থাকলে পারতে!।

ভরত বলল, আমি গাছপালা ভালবাসি বলে মানুষকে ভালবাসতে পারব না? তুমি গোঁয়ারের মতন মরতে যাচ্ছ জেনেও আমি কোনও ফুলগাছের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকব!

স্টিমারঘাটায় কত রকমের মানুষ যাওয়া আসা করছে, এরই মধ্যে দুটি যুবক চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে কী বিষয়ে তর্ক করছে, তা কেউ ধারণাও করতে পারবে না। কে আগে প্রাণ দেবে, তার প্রতিযোগিতা। হেম কিছুতেই তার দাবি ছাড়তে চায় না, ভরতও তাকে আড়াল করে রাখার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর আগে বন্ধুত্বের ব্যাপারে এরা দুজন তেমন আবেগ দেখায়নি। তুমি থেকে তুই সমোধনেও নামেনি। আজই হঠাৎ প্রকাশ হয়ে পড়ল, এদের বন্ধুত্ব এমনই এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যে পরস্পরের প্রাণ বাঁচাবার জন্য দুজনেই নিজের জীবন দিতে রাজি।

এই গোয়ালন্দ থেকেই গৌহাটি যাবার স্টিমার ছাড়বে। আরও ঘণ্টা তিনেক বাকি আছে। স্টিমারটির নাম আসাম মেল, নোঙর করা আছে এক পাশে, সেদিকে তাকিয়ে ভরতের মনে পড়ল তার মায়ের কথা। স্মৃতিতে মায়ের কোনও মুখ নেই, আসামের মানচিত্রই যেন সেই মা। এই প্রথম ভরত আসামে যাচ্ছে। নিয়তিই তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে? মায়ের কোলে গিয়ে ভরত চিরঘুমে ঘুমোবে?

রাত্রে কিছু খাওয়া হয়নি, হেমের খিদে পেয়ে গেছে। পরপর সব হোটেল, ধোঁয়া বেরুচ্ছে কয়েকটা থেকে, এর মধ্যেই আঁচ পড়ল উনুনে। খানিক বাদে হেম বলল, স্টিমারে কী খাবার পাওয়া যাবে না যাবে কে জানে! এখানেই ভাত খেয়ে নিলে হয় না? অনেকেই তো হোটেলে ঢুকছে দেখছি।

ভরত বলল, গোয়ালন্দের হোটেলের ভাত আর ইলিশের ঝোল খুব বিখ্যাত শুনেছি। চলো খেয়ে নিই, আর তো কোনওদিন এখানে আসা হবে না। যা যা সাধ আছে মিটিয়ে নেওয়াই ভাল।

হেম বলল, হ্যাঁ চলে যাবার আগে একবার প্রাণ ভরে ইলিশ খেয়ে নেওয়া অবশ্যই উচিত।

মোটামুটি পছন্দ করে ওরা একটা হোটেলে ঢুকল। মাটির মেঝেতে চাটাই পাতা, সঙ্গে কলাপাতা। এর মধ্যেই আট-দশজন লোক খেতে শুরু করেছে। একটি ছোঁকরা ওদের খাতির করে বসাল। ভরত অডার দিল, দুখানা করে ইলিশ মাছ আর অনেক ঝোল আর ভাত, আর কিছু না। পেটির মাছ দেবে।

কলাপাতার ওপর লালচে রঙের চেঁকিছাটা চালের ভাত ঢেলে দিল এক রাশ। কলাই করা প্লেটে দুটি করে মাছ ও লাল টকটকে ঝোল।

হেম খুশি হয়ে বলল ওরেব্বাস! এত বড় বড় পেটির মাছ! আমাদের ওদিকে পাওয়া যায় না!

ভরত বলল, এ হল পদ্মার ইলিশ। এর স্বাদই আলাদা। কা

হেম সবটুকু ঝোল ভাতে ঢেলে দিয়ে মেখে নিল। এক গেরাস মুখে দিয়ে বলল বাঃ! সুন্দর রান্না।

দ্বিতীয় গেরাস মুখে দেবার পর চিবোতে ভুলে গেল। মুখের চেহারা বদলে গেল তার। চোখ দুটি বিস্ফারিত, মাথার চুল খাড়া হয়ে গেছে। সে কোনওক্রমে বলল, ওরে বাবা, কী ঝাল! ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। ওঃ ওঃ, জল, একটু জল খাব।

মাটির গেলাসে জল এনে দেওয়া হল, তাতেও তার ঝাল কমে না। সে মেদিনীপুরের লোক, সেখানকার রান্নায় মিষ্টি দেয়, ঝাল খাওয়ার একেবারে অভ্যেস নেই। ভরতের অসুবিধে হচ্ছে না।

হেম মাথা থাবড়াচ্ছে, অন্য খদ্দেররা হাসছে তাকে দেখে। দরজার কাছে ক্যাশ বাক্স নিয়ে বসে আছে ম্যানেজার, সেও হাসছে। হেম তার দিকে তাকিয়ে বলল, কী মশাই, এ কী বেঁধেছেন : এটা রান্না, না বিষ? এত ঝাল মানুষে দেয়! আমি মরে যাচ্ছি যে।

ম্যানেজার হাসি মুখে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ধমক দিয়ে বলল, মরিচ যদি না খাইবার পারস, তয় এহানে আইছ কিয়ত্তি? দ্যাখছস না এহানে এত্তগুলা লোক পত্তিদিন খাইছে, কই কেউ তো কহনও মরিচ খাইয়া মইর‍্যা যায় না! ধমক খেয়ে চুপসে গেল হেম। ভরত স্মিত হাস্যে তার দিকে চেয়ে বলল, না ব্রাদার, মরিচ খেয়ে মরে গেলে তো আমাদের চলবে না। ইলিশ মাছ মাথায় থাকুক, চলো আমরা মিষ্টি খাই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *