জুড়িগড়ি থেকে দুলালের সাহায্য না নিয়ে নিজেই নামলো নবীনকুমার। হাতে তার পিতার রূপে-বাঁধানো ছড়ি। কোঁচানো শান্তিপুরী ধুতির ওপর রেশমী বেনিয়ান, মাথার চুল এখন কদম ফুলের মতন, কখনো কখনো সে একটি জরির টুপী পরিধান করে। তার শরীর আগের তুলনায় শীর্ণ, গৌরবর্ণ মুখখানি ঈষৎ ধূসর, তাকে অনেকটা ইংলণ্ডীয় কবি জর্জ বায়রনের মতন দেখায়।
দুলাল, ভুজঙ্গধর ও আরও কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে সে ধীর পদে সম্মুখে অগ্রসর হলো। বিস্তীর্ণ জলাভূমির এক পাশে একটি খাপরার চালার কুটির, মধ্যে মধ্যে কিছু গাছ। সকলে গিয়ে কুটিরটির সামনে উপস্থিত হবার পর একজন লোক বললো, ঐ যে হুজুর, সামনে যে তালগাছটা দেকচেন, ঐ পর্যন্ত হলোগে একদিকের সীমানা। আর ডাইনে-বাঁয়ের সীমানা মাপ-জোক কত্তে হবে।
ভুজঙ্গধর জিজ্ঞেস করলো, কতখানি জমি?
—উনপঞ্চাশ বিঘে। নবীনকুমার বললো, জমি কোতায়? এ তো জলা। আমি কি মাছের চাষ কত্তে চাইচি নাকি?
লোকটি বললো, জল বেশী নেই, হুজুর, একটু ছেচলেই ডাঙ্গা জেগে উঠবে। ঐ দেকুন না, এদিকে ওদিকে ধান চাষ হচ্ছে।
স্থানটি রসাপাগলা গ্রামের সন্নিকটে। এদিকে ওদিকে দুচারটি মাত্র বাড়ি দেখা যায়, আর সবই জলাভূমি আর ধানজমি আর নল খাগড়ার বন। এ স্থানের নাম বালিগঞ্জ। দিনের বেলাতেই ঝাঁক ঝাঁক মশা তেড়ে এলো আগন্তুকদের প্রতি।
নবীনকুমার ছড়িটি তুলে বললো, ওদিকে কি খাল কিংবা নদী আচে? আমার খানিকটে জলও দরকার, তবে বহতা জল হলে ভালো হয়।
—নদী বলতে সেই আদি গঙ্গা। সে তো কিছুটা দূরে, হুজুর।
নবীনকুমার ভুজঙ্গধরকে জিজ্ঞেস করলো, কী, পছন্দ হয়?
ভুজঙ্গধর দুদিকে মাথা নেড়ে জানালো, না।
নবীনকুমার বললো, হুঁ, আমিও তাই মনে কচ্চি। বহতা জল নেই, আর এই কাদা জমিতে তাড়াতাড়ি বালি তোলার অনেক হ্যাপা। একশো জনের থাকবার মতন বাড়ি বানাতে হবে, তা ছাড়া চাই মাস্টারদের কোয়াটার আর গুদোম ঘর—
জমির দালালটি বললো, দর অতি সস্তা হুজুর, এক্কেবারে জলের দাম বলতে পারেন, আপনি রাবিশ মাটি দিয়ে ভরাট করলেও খর্চা অনেক কম পড়বে—
নবীনকুমার ফেরার জন্য উদ্যত হয়ে বললো, চলো, অন্য কোতায় আর কোন জমি সন্ধানে আচে তাই দেকাও।
ভুজঙ্গধর বললো, আমি কই কি ছোটবাবু, নদীয়ায় আমাগো ঐখানে আপনের চাষের ইস্কুল খুলেন।
নবীনকুমার বললো, হবে, সেখেনেও হবে। সব জেলায় জেলায় হবে। কিন্তু আগে আমি কলকেতায় খুলবো কৃষি বিদ্যালয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের চেয়েও সেটা বড় হবে। ওরা হাফ এড়ুকেটেড কেরানী বানাচ্চে, আমি শিক্ষিত চাষা বানাবো। তারা শুধু চাষ শিখবে না। সেই সঙ্গে নাম সই আর সরল অঙ্কও শিখবে।
ফিরে এসে গাড়িতে ওঠবার পর নবীনকুমার খুব সন্তপণে তার বক্ষের বাম দিকে হাত রাখলো। কিছু বোঝা গেল না। তখন সে তার বেনিয়ানের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ব্যাণ্ডেজটি স্পর্শ করলো। একটু যেন ঠাণ্ডা, ভিজে ভিজে লাগছে। নবীনকুমার হাতটি বার করে চোখের সামনে মেলে ধরলো। না, কোনো রক্তের দাগ নেই। তখন নিশ্চিন্ত বোধ করলো সে।
চিকিৎসকরা অনেক যত্নে তার বুকের ক্ষতটি বুজিয়েছে বটে, কিন্তু সে স্থানটি স্বাভাবিক হয়নি। মাটির ঢিবির মতন সেখানে লাল মাংস উঁচু হয়ে আছে, এখনো যখন তখন সেখান থেকে ঘামের মতন বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরিয়ে আসে। তাই সর্বক্ষণ ব্যাণ্ডেজ বেঁধে রাখতে হয়। কতদিন আর সে শয্যাশায়ী থাকবে। তাই চিকিৎসকরাও তাকে অনুমতি দিয়েছেন সাবধানে চলা ফেরার। পুরো দস্তুর পোশাক করে নবীনকুমার যখন পথে বার হয়, তখন তাকে দেখে বোঝা যায় না যে তার পোশাকের নিচে রয়েছে ব্যাণ্ডেজ, যা প্ৰায়শই রক্তে ভিজে যায়।
শহরে এখন নবীনকুমারের নামে লোকে নানা কথা বলে, তার সম্পর্কে লোকের বিস্ময়বোধটাই বেশী। সকলেই জেনে গেছে যে ধনকুবের রামকমল সিংহের সন্তান নবীনকুমার সিংহ এখন ঋণগ্রস্ত। বেঙ্গল ক্লাব সমেত বড় বড় অট্টালিকাগুলি বিক্রয় হয়ে গেছে। জমিদারিও হাতছাড়া। মাত্র এই কয়েকটি বৎসরে এই অতুল বৈভব। একজন মানুষের পক্ষে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব? নবীনকুমার এখন যুবা, সামনে তো কত বয়স পড়ে আছে। একসময় যার কাছ থেকে কোনো প্রার্থী ফিরে আসতো না, এখন সেই নাকি হুণ্ডি কাটছে অনবরত। এর পর বসতবাড়ি পর্যন্ত বাঁধা না পড়ে।
গঙ্গানারায়ণ কিছুদিন নবীনকুমারকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিল। এখন সে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এই জমিদারি বা বিষয় সম্পত্তিতে তার কোনো অংশ নেই, বিম্ববতীর প্রতিনিধি হয়েই সে যেন বিষয়ের মোহে বাঁধা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার নিজস্ব তো কোনো প্রয়োজন নেই। অনাড়ম্বর জীবনে সে অভ্যস্ত। ছোট্কু যদি তার খেয়াল চরিতার্থ করবার জন্য সব উড়িয়ে দিতে চায় তো দিক। এ বিষয়ে সে কুসুমকুমারীর মতামত নিয়েছে। কুসুমকুমারীও নবীনকুমারকে বাধা দেবার পক্ষপাতী নয়।
আত্মীয়-বন্ধুদের ধারণা নবীনকুমারের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। মহাভারত অনুবাদের মতন মহৎ পুণ্যকর্ম যে করেছে, সে এখন মেতে উঠেছে অদ্ভুত সব কাণ্ড কারখানায়। চাষাভুষোদের ইস্কুল। চাষীরা জমিজমা, চাষবাস ফেলে পড়তে আসবে কলকাতায়? সাহেব মাস্টাররা নাকি চাষীদের ধান চাষ শেখাবে? শুনলে হাস্য সংবরণ করা যায়?
যে-সব পণ্ডিত মহাভারত অনুবাদের কাজে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা কয়েক বৎসর ছিলেন দিব্যি খাতির যত্নে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নবীনকুমারকে বললেন, আপনি যে রামায়ণ, গীতা ইত্যাদি অনুবাদেরও পরিকল্পনার কথা পূর্বে জানিয়েছিলেন, তার কী হলো? নবীনকুমার প্রত্যেককে থোক কিছু অর্থ দান করে বলেছেন, আপনাবা যদি পারেন তো করুন, আমি আর ওসবের মধ্যে নেই! যদি অনুবাদ সম্পূর্ণ করতে পারেন, তা হলে সে গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব আমার!
ভুজঙ্গধর ফিরে গেছে নদীয়ায়, সেখানে সে ছোট আকারে একটি কৃষি শিক্ষা কেন্দ্র চালু করে দিয়েছে। কলকাতাতেও জমি পছন্দ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত। তিলজলার সন্নিকটে একটি খালি সমেত বাহান্ন বিঘা জমি ও একটি ছোট কুঠি বাড়ি। পৌনে দু-লক্ষ টাকা দিয়ে সে সম্পত্তি কিনে ফেললো নবীনকুমার। সেখানে দ্রুত আবাস নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। আয়াল্যাণ্ডে চিঠি লিখে সেখান থেকে দু-জন অভিজ্ঞ চাষীকে আনবার ব্যবস্থাও পাকা। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছে যে আইরিশ চাষীরা আলু চাষেই বেশী দক্ষ, আমেরিকাতে ভালো ধান হয়, সুতরাং সেখান থেকেও দু-একজন চাষাকে আনালে হয়। নবীনকুমার তাতেও রাজি। রাইমোহন নেই বটে, কিন্তু তার শূন্য স্থান পূরণ করার জন্য মানুষের অভাব হয় না। নবীনকুমারের কাছাকাছি এরকম কয়েকজন উপদেষ্টা জুটে গেছে, তারা এই সুযোগে কিছু টাকা পয়সা লুটেপুটে নিচ্ছে।
যখনই একা থাকে, তখনই নবীনকুমার তার হৃৎপিণ্ডের ওপর হাত রাখে। এক এক সময় তার হাতে লেগে থাকে রক্ত।
একদিন কৃষি বিদ্যালয়ের কাজের তদারকিতে যাচ্ছে নবীনকুমার, এমন সময় পথের পাশে একজনকে দেখে সে চমকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচিয়ে উঠলো, ওরে রোখি, রোখি, গাড়ি রোখ!
গাড়িটা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো! সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লো নবীনকুমার। একটা নিম গাছ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নিমপাতা পাড়ছে উনিশ-কুড়ি বৎসর বয়স্ক এক ছোঁকরা। তার মাথায় একটিও চুল নেই, দু-চোখে ভুরুও নেই। নবীনকুমার ঠিক চিনতে পেরেছে, এ সেই চন্দ্রনাথের চ্যালা সুলতান।
ছড়ি উঁচিয়ে নবীনকুমার ডাকল, ওহে, এদিকে একটু শোনো তো—।
সুলতান মুখ ফিরিয়ে নবীনকুমারকে দেখেই চঞ্চল হয়ে উঠলো। এদিক ওদিক চেয়ে ছুটি লাগালো বিপরীত দিকে।
নবীনকুমার বললো, দুলাল, ধর তো ওকে।
সুলতান বেজীর মতন একেবেঁকে ছুটতে লাগল বিদ্যুৎ গতিতে। তবু দুলাল তাকে ধরে ফেললো এক সময়। টানতে টানতে নিয়ে এলো নবীনকুমারের কাছে।
মাটির দিকে চোখ রেখে ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো সুলতান।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো। কী হে, আমি তোমায় ডাকলুম, আর তুমি পোঁ পোঁ করে ছুটলে কেন? আমায় চিনতে পেরেচো?
সুলতান কোনো উত্তর দিল না।
—তোমার বাবু কোতা? সেই চন্দ্রনাথ ওঝা?
—জানি না!
—জানো না মানে? তুমি কি এখন একলা থাকো? সেই আগুন লেগে তোমাদের বাড়ি পুড়ে গেসলো, তোমাদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি, আমি ঠিক জানতুম, তোমরা কোতাও লুকিয়েচো। সেদিন কে তোমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছিল?
—জানি না।
—আমাকে তোমার ভয় কী? তোমার বাবুর সঙ্গে আমার একটা দরকার আচে—।
সুলতান বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে চাইলো না। খুব নরমভাবে তাকে অনেক বোঝাবার পর সে তাদের বাসস্থান দেখিয়ে দিতে রাজি হলো।
মারহাট্টা ডিচের ওপারে কিছু গোলপাতার ঘরের বস্তি, তার মধ্যে দুতিনটি মাঠকোঠা। খালের ওপরে একটা নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। নবীনকুমার সেই সাঁকোর ওপর পা দিতেই দুলাল কাতরভাবে বললো, ছোটবাবু, আপনি ওদিকে যাবেন না।
নবীনকুমার বিস্মিতভাবে বললো, কেন রে?
দুলাল বললো, কেন যাচ্ছেন? ওসব নোংরা জায়গায় যাওয়া কি আপনাকে মানায়?
দুলাল যেন বলতে চায়, ও রকম বস্তিতে নবীনকুমারের মতন মানুষের তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি, তার সঙ্গী হিসেবে দুলালেরও যাওয়াটা মানায় না। মাত্র কয়েকদিন আগে নবীনকুমারের দেওয়া বরানগরের বাড়িটির দখল নিয়ে দুলাল সেখানে স্ত্রী-পুত্রকে রেখে সংসার স্থাপন করেছে। এখন সেও একজন মধ্যবিত্ত।
নবীনকুমার বললো, ঐ চন্দ্রনাথ ওঝার সঙ্গে আমার একবার দেখা করার বিশেষ দরকার।
—আপনি যাবেন কেন? হুকুম করুন, পাইক গিয়ে তাকে ডেকে আনবে!
—হুকুম করলে সে আসবে না। আমি জানি, সে মানুষটা বড দেমাকী।
নবীনকুমার সাঁকোর ওপর এক পা এগোতেই দুলাল কাকুতি-মিনতি করে বললো, আপনি যাবেন না, ছোটবাবু! আপনার শরীর ভালো নেইকো—
—তুই সর, দুলাল!
জেদী নবীনকুমার নিজের মতের বিরুদ্ধে কোনো কথা সহ্য করে না। অন্য যে-কোনোদিন সে দুলালের এরকম ব্যবহার দেখলে হাতের ছড়ি তুলে কয়েক ঘা কযিয়ে দিত। কিন্তু আজ তার শরীরে ক্ৰোধের উষ্ণতা এলো না, সে দুলালের চক্ষের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীর, উদাসীন কণ্ঠে বললো, সরে যা, দুলাল। তুই যা, তোকে আমি মুক্তি দিলাম। আজ থেকে তোকে আর আমার প্ৰয়োজন নেই।
—আমি আপনাকে কক্ষনো ছেড়ে যাবো না, ছোটবাবু! ওখানে যাবেন না, গৈলে আপনার আবার বিপদ হতে পারে—।
—আমার আবার কিসের বিপদ! তুই সর! এই সুলতান, চলো আগে আগে—।
খালটি কচুরিপানায় ভর্তি, তার নিচে কত জল আছে বোঝা যায় না। সেই সাঁকো কোনোক্রমে পেরিয়ে এ পারে চলে এলো নবীনকুমার।
বস্তির মধ্যে একটা দোতলা মাঠকোঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রনাথ। তাকে পূর্বেকার চন্দ্রনাথ হিসেবে চেনা খুবই দুষ্কর। যে সুঠাম সুপুরুষটি সর্বক্ষণ সাহেবী পোশাক পরিধান করে থাকতো, এখন তার পরণে একটি চৌখুপ্পি লুঙ্গি, উন্মুক্ত বক্ষে, মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। চন্দ্রনাথের একটি চক্ষু কানা, বাম বাহুতে চারটি আঙুল নেই, দক্ষিণ হস্তটি অবশ্য দারুণ সবল, সেই হাতে একটি লাঠি ধরা। প্রবল কোনো প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েও সে এখনো বেঁচে আছে।
ক্ষুদ্র দলটিকে দেখেই চন্দ্রনাথ হুংকার দিল, সুলতান!
সুলতান কচুমাচু হয়ে বললো, আমি আনতে চাইনি, এই ছায়েবরা জোর করে আইলেন।
খালের ধারে রাজকেরা ধপধপ শব্দে কাপড় কাচিছে। এই মাঠকোঠাটির ঠিক পাশেই গরু-মহিষের খাটাল, বৃহৎ জন্তুগুলি ফ-র-র ফ-র-র শব্দে নিশ্বাস ফেলছে এবং ভেসে আসছে বিকট দুৰ্গন্ধ। কিছু দূরে একজন স্ত্রীলোক পুরুষের ভাষায় অশ্রাব্য গালমন্দ করছে যেন কাকে। সমগ্র পরিবেশটি যেন ছাই ছাই রঙে ঢাকা।
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে এক পা এক পা করে উঠতে লাগলো নবীনকুমার। প্রতিটি পদক্ষেপই যেন বেশী ভারি লাগছে, চাপা উত্তেজনায় কাঁপছে তার শরীর।
চন্দ্ৰনাথ কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কী চাই?
নবীনকুমার চন্দ্রনাথের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্তভাবে বললো, সে কোথায়?
–কে?
—তুমি জানো…যে তোমার সঙ্গে ছিল…
–কামুক কুকুর, গন্ধ শুকে শুকে এতদূর পর্যন্ত এসেছে?
চন্দ্রনাথ হাতের লাঠিটি উঁচু করে তুলতেই দুলাল এগিয়ে এসে বললো, এই সাবধানে কতা বলবে!
নবীনকুমার বললো, তুই চুপ কর, দুলাল।
তারপর আর এক পা এগিয়ে এসে সে বললো, চন্দ্ৰনাথ ওঝা, এই দেশ-কাল আর সমাজের ওপর তোমার রাগ হয়েছে, আমি বুঝি। কিন্তু তুমি একলা একলা লড়তে চাও কেন? এ ভাবে একা কি তুমি জিততে পারবে? দাখো, আজ তোমার কী অবস্থা! এ তো মুখের গোঁয়ার্তুমি। তুমি আমার সঙ্গে যোগ দাও, আমরা দুজনে মিলে—
—তুমিই তো আমার প্রধান শত্ৰু!
–আমি?
–নিশ্চয়ই! তুমিই আমার এই চোখ নষ্ট করেচো, তুমিই আমার ঘরে আগুন লাগিয়েচো।
—না, না, চন্দ্রনাথ, এ তোমার ভুল! আমি তোমার সুহৃদ হতে চেয়েছিলুম। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করার কতা চিন্তাও করিনি—
—আমি মোটেই ভুল বুঝিনি! তোমাদের হাতে কোতোয়ালি। সব স্ত্রীলোক তোমাদের ভোগের বস্তু! আমার সঙ্গে জোরে না পারলে তুমি পুলিস ডেকে এনে আমায় ধরিয়ে দেবে, আমার ঘরের মেয়েমানুষকে তুমি জোর করে কেড়ে নেবে, ভাড়াটে পায়াদারা আবার এ বাড়িতে আগুন জ্বলিয়ে দেবে–
–না, না, না।
—বাঁচতে চাও তো, এখেন থেকে দূর হয়ে যাও!
–চন্দ্ৰনাথ ওঝা, তোমাকে আমি নিজের বাড়িতে স্থান দেবো, আমি সেইজনাই এসিচি—
–তোমার দয়ার ওপর এই আমি থুতু ফেললুম! থুঃ!
এই সময় ঘরের দ্বার খুলে গেল। নবীনকুমার চক্ষু তুলে দেখলে সেই রমণীকে। একটা কস্তা পেড়ে বিবৰ্ণ শাড়ী তার অঙ্গে জড়ানো, মুখখানি ধূলিমলিন। কিন্তু সেই চোখ, সেই ওষ্ঠের রেখা, সেই চিবুক, পিঠজোড়া দীঘল চুল, যেন অবিকল যৌবনের বিম্ববতীর প্রতিমূর্তি।
সহসা নবীনকুমারের চক্ষে জল, বুকে রক্ত এবং সারা শরীরে স্বেদ নির্গত হতে লাগলো। সে অপলক চেয়ে রইলো সেই রমণীর দিকে। কী করে এমন হয়, জননীকে কতকাল ভুলে ছিল নবীনকুমার, প্রবাসে অনাত্মীয় পরিবেশে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তবু সেই জননী মূর্তি কেন এমনভাবে ফিরে আসে? এই ক্লেদাক্ত পরিমণ্ডলে, এমন হীন অবস্থায়!
একটিও কথা বলতে পারলো না। নবীনকুমার; দু হাত দিয়ে সে তার মুখ ঢেকে ফেললো।
রমণীটি চন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে কী যেন বললো, তা নবীনকুমারের কৰ্ণে প্রবেশ করলো না। সে যেন তার দু পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, এখনি চেতনা হারিয়ে ফেলবে। তবু প্ৰাণপণ মানসিক শক্তিতে সে স্থির থাকতে চাইলো, সে মনে মনে ভাবতে চাইলো, কেন আমি এমন দুর্বল হয়ে পড়ছি। শুধু শারীরিক সাদৃশ্য, তা ছাড়া আর কিছুই নয়, তার জন্য এতখানি বিচলিত হওয়া তো শোভা পায় না। তবু গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকের এক রহস্যময়ত তাকে ব্যাপ্ত করে ফেলছে।
বিপরীত দিকে ফিরে সে ধরা গলায় বললো, চল, দুলাল!
চন্দ্রনাথ বললো, দাঁড়াও নবীনবাবু, এতই যখন তোমার সাধ, তুমি নিয়ে যাও একে!
নবীনকুমার দু হাতে কান চাপা দিল।
চন্দ্রনাথ বললো, আমি নিজের ভোগের জন্য একে আনিনি। পথের মধ্যে কয়েক কুলাঙ্গারের হাত থেকে একে উদ্ধার করিচিলুম। তারপর এ আর আমার সঙ্গ ছাড়তে চায় না। তোমার যখন এতই লোভ, তুমি নিয়ে যাও, আমি ছেড়ে দিচ্ছি—
নবীনকুমারের আর কথা বলারও সাধ্য নেই। দু হাতে কান চেপে সে দুদ্দাড় করে নামতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে। তারপর ছুটলো বাঁশের সাঁকোর দিকে।
সাঁকোতে পা দেবার আগেই দুলাল এসে তাকে ধরে ফেলে বললো, ছোটবাবু, কী কচ্চেন! আপনার হয়েছে কী!
নবীনকুমারের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। সে ঢলে পড়লো দুলালের বুকে। ব্যাণ্ডেজ ছাপিয়ে তার পিরানে ফুটে উঠেছে রক্তের ছোপ।
ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর যখন দেখতে এলেন, তখন নবীনকুমারের জ্ঞান নেই। কয়েকদিন ধরেই এমন চলেছে, অল্প কিছুক্ষণের জন্য তার জ্ঞান ফেরে, আবার সে তলিয়ে যায় অচৈতন্যের আঁধারে। তার বুকের ক্ষত আবার উন্মুক্ত হয়েছে, এবার বুঝি সত্যিই বেরিয়ে আসছে তার হৃৎপিণ্ড। রক্তপাতের বিরাম নেই। যেটুকু সময় তার জ্ঞান ফেরে, তখন নিশ্চয়ই তার অসহ্য যন্ত্রণা বোধ হয়, কিন্তু মুখ দিয়ে সে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না।
বিদ্যাসাগর যখন এলেন, তখন তিনজন চিকিৎসক সেখানে উপস্থিত। তাঁদের মুখে ঘোর ছায়া। বিদ্যাসাগরের নিজেরও শরীর ভালো নয়, শিরদাঁড়ায় ব্যথা, মনেও নানারূপ অশান্তি। তবু তিনি নবীনকুমারের গুরুতর পীড়ার সংবাদ শুনে এসেছেন। এই ছেলেটির কোনো কোনো ব্যবহারে তিনি এক এক সময় বিরক্ত হয়েছেন বটে। আবার এর সম্পর্কে তাঁর বেশ দুর্বলতাও আছে। এই চপলা, চঞ্চল যুবকটি কোনোদিন ধরা-বাঁধা পথে চলেনি। এর অর্থব্যয়ের মধ্যে এমন একটা রাজকীয়তা আছে, যা তিনি আর কোনো বড় মানুষের মধ্যে দেখেন নি। কৃষ্ণদাস পাল তাঁকে বলে এসেছিলেন যে নবীনকুমার বিদ্যাসাগরকে অত্যন্ত ভক্তি করে, তিনি গিয়ে দুটো কথা বললে এই ব্যাধির সময় সে সান্ত্বনা পাবে। কিন্তু তিনি কী কথা বলবেন এই নীরব অচৈতন্যের সঙ্গে।
তিনি নবীনকুমারের কপালে নিজের দক্ষিণ হস্তটি রাখলেন। উত্তাপ বেশ স্বাভাবিক। বিদ্যাসাগরের মনে হলো, তা হলে চরম আশঙ্কা নেই। তিনি চিকিৎসকদের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভালো হয়ে উঠবে, তাই না?
ডাক্তার সূৰ্যকুমার বললেন, তাই তো আশা করি।
বিদ্যাসাগর বললেন, এ ছেলেটি কোনো কাজ একবার ধরলে অসমাপ্ত রাখে না। মহাভারত যেমন শেষ করেছে, তেমন পরে যে কাজে হাত দিয়েছে, তাও নিশ্চয় শেষ করে যাবে।
ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে আসবার পর গঙ্গানারায়ণ তাঁর পদধূলি নিল। তারপর মৃদুস্বরে বললো, আপনি যদি দয়া করে একবার অন্দর মহলে আসেন…আমার পত্নী একবার আপনাকে প্ৰণাম করবে।
বিদ্যাসাগর বললেন, বেশ তো!
গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে তিনি গেলেন ভেতরের প্রকোষ্ঠে। গলায় আঁচল দিয়ে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে কুসুমকুমারী তার মাথা বিদ্যাসাগরের পায়ে ছুঁইয়ে প্ৰণিপাত জানালো। বিদ্যাসাগর অস্ফুট আশীর্বাদ করলেন হাত তুলে। তারপর কুসুমকুমারী মুখ তোলবার পর সেদিকে চেয়ে তিনি ঈষৎ চমকিত হলেন। কিছু যেন তাঁর মনে পড়ে গেল। তাঁর দ্বারা প্রবর্তিত বিধবা বিবাহের সবচেয়ে সার্থকতম জুটি এই দুজন। নবীনকুমারই ছিল এই বিবাহের প্রধান উদ্যোক্তা।
তিনি গঙ্গানারায়ণকে বললেন, তোমাদের দুই ভাইয়ের কাছ থেকে এই দেশ আরও অনেক কিছু আশা করে।
সে গৃহ থেকে নিৰ্গত হয়ে পাল্কিতে ওঠবার পর তিনি উড়নির প্রান্ত দিয়ে চক্ষু মুছলেন। কান্না তাঁর এক রোগ। কখন যে কান্না এসে যায়, তার ঠিক নেই।
আরও অনেকেই দেখতে এলো নবীনকুমারকে। দেখা শুধু এক পক্ষের, কারণ নবীনকুমার প্রায় অধিকাংশ সময়ই অজ্ঞান, কখনো জ্ঞান ফিরলেও সে মানুষ চিনতে পারে না। কোনো কথা বলে না। শহরে তাকে নিয়ে গুজবের অন্ত নেই। কেউ বলে, অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য তার যকৃৎ দুম ফটাস হয়ে গেছে। কেউ বলে, এক অবিদ্যার বাড়িতে রাত্রি যাপন করতে গেলে এক দুশমন। তাকে ছুরি মেরেছে। কেউ বলে, এক পাগল মরণ কামড় দিয়ে তার কলিজার আধখানা খেয়ে ফেলেছে। আবার কেউ বলে, ঋণের অপমান থেকে মুক্তি পাবার জন্য নিজেই বিষ পান করেছে সে।
চতুর্থ দিন কেটে যাবার পর বিকারের ঘোরে নানা কথা বলতে লাগলো নবীনকুমার। কখনো তার চক্ষু মুদিত, কখনো খোলা থাকলেও শূন্য দৃষ্টি। গঙ্গানারায়ণ এবং সরোজিনী খুব কাছ থেকে সেই সব কথা শোনবার চেষ্টা করে। ওরা কেউ কোনো প্রশ্ন করলে নবীনকুমার কোনো উত্তর দেয় না। এক এক সময় নবীনকুমারের কণ্ঠস্বর খুব স্তিমিত, আবার কখনো বেশ সাবলীল। তার কথাগুলি এই রকম :
…মায়ের গায়ের গন্ধ, আমি যখন নদীর ধারে শ্ৰাদ্ধ কত্তে বসেচিলুম…আগুনের ধোঁয়ায় আমার চোকে জল, আবার সেই আগুনেই মায়ের গায়ের গন্ধ…ঠিক যেমন ছোটবেলায় বুকের পাশটিতে শুয়ে থাকতুম…আমার সেই বেড়ালটা…
…কৃষ্ণকমল, কৃষ্ণকমল, তুমি ঠিক বলেচিলে, এত সব টাকা কোতা থেকে আসে…আচ্ছা কৃষ্ণ ভায়া, তুমিই কি চন্দ্রনাথ? যাই বলো, আমি তো মন্দির বানাইনি…
…গোলদিঘিতে ফড়িং ধরে বেড়াতুম দুপুরে-আক কষতে ভালো লাগে না, এক দুইগুলো যেন ডেঁয়ো পিঁপড়ের মতন তাড়া করে আসে, তবে কি না ইংরিজি, হ্যাঁ, ইংরিজি তো শিকেচি বটেই, রাজার জাত বলে কতা। কিন্তু এমন দেশও আচে, যেখানে প্ৰজারাই রাজত্ব চালায়, হ্যাঁ, আচে, সত্যি আচে—
…সধবার একাদশী…অনেকটা আমার নকশার মতন, সেই পোস্ট অফিসের বাবুটি লিকেচেন, নীলদর্পণ বড় খাসা, কত তেজ, আর এতে শুধুই রগড়…উনি একদিন আমায় দেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, কেন এত রাগ?
…আমার অনেক কাজ, আরও অন্তত তিরিশটা বচ্ছর বাঁচতে হবে, গুপুস গুপুস করে একশোটা তোপ পড়বে, নতুন সেঞ্চুরি আসবে, তখন দেকবে, সাহেবরাও ফরফরিয়ে বাংলা কতা বলচে-
বাড়ির ছাদে বট-অশথ গাছ আপনা-আপনি গজিয়ে ওঠে, এমন তো আপনা আপনি গোলাপ ফুল গাছ গজায় না। এ ভারি অন্যায় ব্যাভার গাচেদের–
…হ্যাঁ, ভুল হয়েছেল, ভুল হয়েছেল, জানি হয়েছেল, সেইজন্যই তো বুকে এমন ব্যথা।
…ওকে আমি পাগল বলে বুঝতে পারিনি, ভেবেচিলুম। একজন সাধু-টাধু হবে বোধহয়…তাই কামড়ে দিলে। তুমি কেন আমায় কামড়ে দিলে? আমি তো আর জমিদার নই! সব গ্যাচে! ভালোই হয়েচে। আমার ছেলেপূলেও নেই, জমিদারিও নেই…তা কামড়ে দিয়েচে, দিয়েচে, তা বলে দুলাল, তুই ওকে পিটিয়ে মেরে ফেললি?
…একদিন আমি থাকবো না, তুমি থাকবে না, কেউ থাকবে না, অন্য মানুষ আসবে, পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হয়ে যাবে==
…কে কাঁদে? সারা রাত রাস্তায় রাস্তায় কে কেঁদে বেড়ায়? নাকি ও হাওয়ার শব্দ? হাওয়াও কাঁদে তা হলে?
…সরোজ, আমি তোমায় কোনো সন্তান দিইনি। আমার মতন মানুষের বংশধর থাকতে নেই, জানো না? সরোজ, আমি মলে বিদ্যেসাগরমশাই তোমার আবার বে দেবেন। তখন তুমি সুখী হবে।
এই বাক্যটি শুনে সরোজিনী ডাক ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। নবীনকুমারের কথা তবু থামে না। সে নানারকম কথা বলেই চলে, তাকে যেন কথায় পেয়ে বসেছে!
পঞ্চম দিনে সে হঠাৎ আবার চুপ করে গেল। তার চক্ষু দুটি খোলা। কোনো পথ্য তো সে এ-কদিন গ্রহণ করেই নি, ঝিনুকে করে ওষুধ খাওয়াতে গেলেও তা কষ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। নবীনকুমারের ডান হাতখানি তার বুকের ক্ষতস্থানের ওপর রাখা।
সরোজিনী সব সময় কাঁদাকাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়ে থাকে, ওষুধ খাওয়াতে গেলে তার নিজেরই হাত কাঁপে।। তাই কুসুমকুমারী গেল নবীনকুমারের মুখে ওষুধ দিতে।
তখন অপরাহ্ন। কাল, সূর্য ঢলে এসেছে, সারা আকাশ ছায়া-মেদুর। নবীনকুমারের কক্ষের জানালাগুলি খোলা, সেখান দিয়ে আসছে তাপহীন, কোমল বাতাস।
নবীনকুমার চোখ চেয়ে আছে দেখে কুসুমকুমারী বললো, ঠাকুরপো, একটু ওষুধ দি?
নবীনকুমার দেখলো, তার সামনে রাত্ৰিবেলার গন্ধরাজ পুষ্পের মতন একটি মুখ, দুটি নীল রঙের চক্ষু, নদীতটের মতন কপাল, ভ্ৰমরকৃষ্ণ, কুঞ্চিত চুল। সেই দৃষ্টিতে যেন আলো…
নবীনকুমার নিজের মুখটা ফিরিয়ে নিল এক পাশে। বুক ভর্তি নিশ্বাস টেনে সে খুব আস্তে আস্তে বললো, ব-ন-জ্যোৎ-স্না!
তারপর তার ঘাড় ঢলে গেল।