৮০. পুরনো ঢাকার আইজি গেট

অধ্যায় ৮০

জেফরি বেগ মোটরসাইকেলে করে ছুটে চলছে পুরনো ঢাকার আইজি গেট নামক এলাকার দিকে। বাইকটা চালাচ্ছে জামান।

একটু আগে জামানকে মোটরসাইকেল নিয়ে হোমিসাইড থেকে তার বাড়িতে চলে আসতে বলেছিলো। স্থানীয় থানার পুলিশের কাছে মিলনের ডেডবডিটা বুঝিয়ে দিয়ে জামানকে সাথে নিয়ে বের হয়ে যায় সে।

তার সহকারীকে পুরো ঘটনা খুলে বলে নি, বলার সুযোগও পায় নি। এখন তাকে অনেক জরুরি একটা কাজ করতে হবে। হাতে একদম সময় নেই।

তবে জামান ব্যাপারটা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছে। তুর্যকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা হয়তো মিলনের কাছ থেকে জেনে নিতে পেরেছে তার বস। কিন্তু জামান জানে না এই মূল্যবান তথ্যটা তার বসকে দিয়েছে বাস্টার্ড নামের পেশাদার সেই খুনি? জানলে সে দারুণ অবাক হতো।

একটু আগে হোমিসাইড থেকে ফোন করে জানিয়েছিলো মিলন এখন জেফরির বাড়ির সামনে অবস্থান করছে। জামান যখন প্রথম ফোন করে তখন সে টয়লেটে ছিলো। প্রস্তুতি নিচ্ছিলো হোমিসাইডে যাওয়ার জন্য। টয়লেট থেকে বেরিয়ে দেখে জামান পর পর দু’বার ফোন করেছে। কলব্যাক করতেই সহকারী অনেকটা হাফ ছেড়ে বাঁচে। সে খারাপ কিছুর আশংকা করেছিলো-মিলন হয়তো এরইমধ্যে কিছু একটা করে ফেলেছে। জেফরি কল করতে একটু দেরি করলেই জামান স্থানীয় থানায় ফোন করে বসততা, সে নিজেও ছুটে আসতো তার বাড়িতে। জেফরির ফোনটা তাকে এক ধরণের স্বস্তি এনে দিয়েছিলো।

জামানের কাছ থেকে সব শুনে জেফরি বেগ দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। মিলনকে সে একা একাই মোকাবেলা করবে। শিকার যখন নিজে থেকেই এসে পড়েছে শিকারটা সে একাই করবে।

দেরি না করে পুরো ফ্ল্যাটের বাতি নিভিয়ে দিয়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। রাস্তার ওপারে, পার্কের ঝোঁপের আড়ালে ছোট্ট একটা লালচে আলো দেখে ধারণা করে ওখানেই হয়তো মিলন দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে যায় নাইটভিশন গগলসটা এখন তার ড্রয়ারে, কারণ সামনের সপ্তাহে শুটিংরেঞ্জে দ্বিতীয় সেশনের প্র্যাকটিস করার কথা।

গগলসটা বের করে পরে নেয় তারপর অন্ধকার ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পায় রাস্তার ওপারে পার্কের ঝোঁপের কাছে এক লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে।

ক্লোজেট থেকে পিস্তলটা বের করে নেয়, সেই সাথে বাড়তি সতর্কতার জন্য হোমিসাইডের স্টোররুম থেকে আনা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটাও পরে নেয় জেফরি বেগ। বিছানায় কোলবালিশটার উপর কম্বল মেলে রেখে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে মিলনের জন্য।

“স্যার, আমার মনে হয় ব্যাকআপ ছাড়া ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না।” মোটরবাইকটা চালাতে চালাতে জোরে জোরে বললো জামান।

“ব্যাকআপ টিম রেডি করার মতো সময় এখন নেই,” পেছন থেকে বললো জেফরি। “তাছাড়া হুট করে ব্যাকআপ টিম ডেকে এনে এরকম একটি কাজ করাও যাবে না। পুরো ব্যাপারটা তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে। আমি এক পার্সেন্ট ঝুঁকিও নিতে চাচ্ছি না। ওরা টের পেয়ে গেলেই জিম্মিদের খুন করে পালানোর চেষ্টা করবে। এতোক্ষণে ছেলেটা জীবিত আছে কিনা কে জানে।”

এবার বুঝতে পারলো জামান। অপহরণ কেস খুবই সাবধানে সামলাতে হয়। ব্যাকআপ টিমে যারা থাকে তাদেরকে আগে থেকেই ব্রিফ করে বুঝিয়ে দিতে হয় পুরো পরিকল্পনাটা। এক্ষেত্রে অতোটা সময় তারা পাবে না। তার বস হয়তো জানতে পেরেছে খুব জলদিই রঞ্জুর লোকজন তুর্যকে খুন করে গুম করে ফেলবে।

“তাছাড়া লোকাল থানাকে আগেভাগে জানাতে চাচ্ছি না আমি।”

লুকিংগ্লাসের মধ্য দিয়ে জেফরির সাথে চোখাচোখি হলো জামানের।

“এই ঘটনায় মিনিস্টারের পিএস আলী আহমেদও জড়িত আছে।”

“কি!?” সঙ্গত কারণেই অবাক হলো জেফরির সহকারী।

“তারচেয়েও বড় কথা, ঢাকার অনেক থানায় রঞ্জুর পেইড-এজেন্ট রয়েছে।”

জামানের খুব জানতে ইচ্ছে করলো পিএসের জড়িত থাকার কথাটা জেফরি কিভাবে জানতে পারলো।

“আমি চাই ওরা যেনো কিছু টের না পায়। টের পেয়ে গেলেই সব শেষ, বুঝলে?”

জামান একটু চুপ থেকে বললো, “কিন্তু এরকম একটি কাজের জন্য আমরা দুজন কি যথেষ্ট, স্যার?”

“দু’জন না…একজন।”

“কি?!” বিস্মিত হলো জামান।

“শুধু আমি যাবো।”

.

প্রায় অন্ধকার একটি ঘর, মৃদু লালচে আলো জ্বলছে। ঘরের দরজার সামনে। দাঁড়িয়ে বাবলু দেখতে পেলো দূরে একটি ফ্রেঞ্চ জানালার সামনে হুইলচেয়ারে বসে আছে এক লোক।

রঞ্জু!

একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাইরে। একেবারে স্থির।

কয়েক মুহূর্ত বাবলু দাঁড়িয়ে রইলো দরজার সামনে। কিছু একটা টের পেয়ে দরজার দিকে তাকালো রঞ্জু।

“কেয়া হুয়া?” জানতে চাইলো শান্তকণ্ঠে। অন্ধকারে বুঝতে পারে নি কে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।

বাবলু আস্তে করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। তার হাটার মধ্যে অস্বাভাবিক ধীরস্থিরতা বিরাজ করছে।

“কে?” ব্ল্যাক রঞ্জু যেনো বিপদের গন্ধ টের পেয়ে গেলো। সামনে এগিয়ে আসা অবয়বটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে এখন।

বাবলু জানে চোখ জোড়া ছাড়া তার মাথা আর মুখের সবটাই ঢাকা মাঙ্কিক্যাপে।

“কে?” প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলো রঞ্জু। “অর্জুন?…উপেন?”

মাথা দোলালো বাবলু। আরো কয়েক পা এগিয়ে গেলো সে।

চোখেমুখে ভয় আর বিস্ময় নিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো রঞ্জু, “কে?”

“আমি!” শান্তকণ্ঠে বললো বাবলু।

আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলো সে। রঞ্জু থেকে মাত্র পাঁচ-ছয় ফুট দূরে এখন। ঘরের এদিকটায় বিশাল ফ্রেঞ্চ জানালা দিয়ে বাইরে থেকে আলো এসে পড়েছে। মুখের উপর থেকে মাঙ্কিক্যাপটা এক টানে খুলে ফেললো।

বিস্ফারিত চোখে রঞ্জু চেয়ে রইলো তার দিকে। এ জীবনে এতোটা বিস্মিত কখনও হয় নি। তার সেই বিস্ময়ের প্রাবল্যে ঢাকা পড়ে গেলো আচমকা জেঁকে বসা ভীতি। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য।

বাবলুর ঠোঁটে বাঁকা হাসি। আরেকটু এগিয়ে এলো সে।

ব্ল্যাক রঞ্জুর দু’ঠোঁট কেঁপে উঠলো।

“বাস্টার্ড!”

অধ্যায় ৮১

জেফরি বেগ আর জামান মোটরসাইকেলে করে পুরনো ঢাকার আইজিগেটের ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় এসে পড়লো। এই হাউজিং এলাকার দক্ষিণ দিকে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদী। এখানে নৌকায় করে নদী পারাপারের জন্য ছোটোখাটো একটি ঘাটও রয়েছে।

জেফরির এক স্কুল বন্ধু থাকতো এখানে। কলেজ জীবন পর্যন্ত এই এলাকায় প্রচুর এসেছে। ভালো করেই জায়গাটা চেনে। পুরো আবাসিক এলাকাটি নিরব। কিছু কিছু বাড়ি থেকে টেলিভিশনের শব্দ ভেসে আসছে।

তারা মোটরসাইকেলে করে সোজা চলে এলো ঘাটের কাছে। প্রায় আট নয় ফুট উঁচু কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে নদীর তীর ঘিরে ফেলা হয়েছে এখন। ঘাটে যাবার জন্য সেই কংক্রিটের দেয়ালের মাঝে পাঁচ-ছয় ফুটের একটি খোলা অংশ আছে।

জেফরি মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়লো।

“স্যার, আপনি তাহলে একাই যাবেন?” মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ করে বললো জামান।

সহকারীর কাঁধে হাত রাখলো জেফরি। এর আগে মিলনকে ধরতে গিয়ে গুলি খেয়েছিলো ছেলেটা। এখন আর তাকে কোনো রকম ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাচ্ছে না। যা করার একাই করবে। তারচেয়েও বড় কথা, কাজটা একা করলেই বেশি ভালো হবে।

“চিন্তা কোরো না, তোমার সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে। মোবাইল ফোনটা চালু রেখো।”

একান্ত অনিচ্ছায় মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান।

“আমি যখন যা করতে বলবো শুধু তাই করবে…এর বেশি না। ঠিক আছে?” বলেই সহকারীর কাঁধে চাপড় মারলো।

“বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা আছে। চিন্তা কোরো না।”

ঘাটের দিকে পা বাড়ালো জেফরি বেগ।

.

বিশাল ঘরটা এখন আলোকিত। বাবলু একটু আগে বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখনও ফ্রেঞ্চ জানালার সামনে হুইলচেয়ারটায় বসে আছে রঞ্জু, তার চোখেমুখে বিস্ময়ভাবটা যেনো স্থায়ী হয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ পর চোখমুখ শক্ত করে বলে উঠলো পঙ্গু সন্ত্রাসী : “ওদের সবাইকে মেরে ফেলেছিস?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। যে চারজনকে তার বাড়িতে পাঠিয়েছিলো তারা সবাই এখন মৃত। মাইক্রোবাসে চারজনের লাশ বয়ে নিয়ে এসেছে। তার চিলেকোঠায় ছিলো দুটো লাশ, ওগুলো ফেলে আসাটা ঠিক হতো না। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসতো ঘরটা বাংলাদেশ দূতাবাস ভাড়া নিয়েছে। বিরাট কেলেংকারীর ব্যাপার হয়ে যেতো সেটা।

“শুধু তুই আর আমি…আর কেউ নেই।” কথাটা বলেই রঙুর খুব কাছে চলে এসে মুচকি হাসি দিলো বাবলু।”

রাগে কাঁপতে লাগলো সন্ত্রাসী, কিছু বলতে পারলো না। আড়চোখে ল্যাপটপের দিকে তাকালো। যে কারণে ল্যাপটপটা রেখেছিলো এখন সেটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে।

সাইলেন্সর পিস্তলটা রঞ্জুর কপালে ঠেকালো বাবলু। “বুঝতেই পারছিস তোর সময় শেষ!”

বাবলু যে-ই না টুগারে আঙুল রাখবে অমনি তার চোখ আটকে গেলো ঘরের এককোণে ছোটো টেবিলটার দিকে। ল্যাপটপের পদায় একটা ছবি দেখে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। চট করে তাকালো রঙুর দিকে।

রঞ্জুর মুখ ফসকে বের হয়ে গেলো : “উ-উমা!”

কথাটা শুনেই বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো হুইলচেয়ারে বসা লোকটার দিকে। তার গলা দিয়ে কোনো কথা বের হলো না।

“উমা!” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো আবারো। “এখন আমার লোকদের হাতে বন্দী!”

অধ্যায় ৮২

রাতের এমন সময়ে কোনো যাত্রি নেই, তারপরও দু’তিনটা নৌকা ঘাটে ভেড়ানো আছে। জেফরিকে দেখে মাঝিগুলো নড়েচড়ে উঠলো। একসাথে সবাই ডেকে উঠবে-এটাই নৌকাঘাটের পরিচিত দৃশ্য। তাই হলো, দু’তিনজন মাঝি হাক দিলে মাঝিদের দিকে তাকালো সে। দু’জনের বয়স অনেক বেশি, এরা কোনো রকম ঝুঁকি নিতে রাজি হবে না। একজনের বয়স বেশ কম। বড়জোর বাইশ-তেইশ হবে।

বাই-তেইশের নৌকায় উঠে বসলো সে। নৌকাটা ঘাট থেকে বেরিয়ে নদী পার হবার জন্য এগিয়ে যেতেই জেফরি দেখতে পেলো সামনের ডান দিকে বেশ কিছুটা দূরে নদীর বুকে একটি লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। লঞ্চটা ডকইয়ার্ডের কাছে থাকলেও একদম তীরে ভেড়ানো নেই। বলতে গেলে নদীর বুকেই রাখা আছে সেটা। শুধু উপরের ডেকে আলো জ্বলছে। তাছাড়া পুরো লঞ্চে কোনো বাতি জ্বলছে না।

মাঝির সাথে কথা বললো সে।

“নাম কি?”

“আমির হোসেন, স্যার,” বৈঠা বাইতে বাইতে বললো মাঝি।

“সুন্দর নাম,” বলেই পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের করে মাঝির দিকে বাড়িয়ে দিলো। “পুরোটাই রাখো।”

মাঝি অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।

“আমাকে তুমি ঐ লঞ্চটার কাছে নিয়ে যাবে…” আঙুল তুলে নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা লঞ্চটার দিকে ইঙ্গিত করলো।

মাঝি কিছু বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো।

“ভয়ের কিছু নেই, আমি পুলিশের লোক।”

ঢোক গিললো মাঝি। তারপর মাথা নেড়ে সায় দিলো।

“রাখো,” টাকাটা মাঝির সামনে রেখে বললো জেফরি।

নৌকায় একটা হ্যারিকেন জ্বলছে, সেটা হাতে তুলে নিয়ে নিভিয়ে দিলো। “ভয়ের কিছু নেই…তুমি শুধু আমাকে ঐ লঞ্চের কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে, ঠিক আছে?”

আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো তরুণ মাঝি।

“ভয় পেয়েছো?” হেসে জানতে চাইলো জেফরি, কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারছে না তার হাসি অন্ধকার নদীর বুকে দেখা গেলো কিনা।

“না, ডরামু ক্যান,” বললো আমির নামের মাঝি ছেলেটা। “আপনে তো পুলিশের লোক…গুণ্ডাবদমাইশ অইলে না হয় কথা আছিলো।”

মুচকি হাসলো সে। নিজেকে বহুকষ্টে শান্ত রাখতে পেরেছে। একটু পর একদল ভয়ঙ্কর লোকের ডেরায় ঢুকতে যাচ্ছে সে। তার এমন বেপরোয়া ভাবভঙ্গি দেখে জামান ছেলেটা যে খুব বিস্মিত হয়েছে সেটা বুঝতে পারছে।

গভীর করে দম নিয়ে মাঝির দিকে ফিরলো। “এমনভাবে যাবে লঞ্চের লোকগুলো যেনো টের না পায় আমরা আসছি।”

“ঠিক আছে, স্যার,” বলেই নৌকাটা ডান দিকে ঘুরিয়ে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চললল। লঞ্চটা এখন তাদের বাম দিকে একশ’ গজ দূরে। কোনো লোকজন দেখা যাচ্ছে না। মাঝি আস্তে আস্তে বৈঠা বাইতে লাগলো যেনো ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা পর্যন্ত না হয়।

“ওই লঞ্চটার লগে একটা স্পিডবোট বান্দা আছে, স্যার,” চাপাকণ্ঠে বললো ছেলেটা।

“তাই নাকি,” বললো জেফরি বেগ। সে অবশ্য অবাক হয় নি। তারা তো এরকমই ধারণা করেছিলো।

“হ, স্যার,” মাঝি তার গলা নামিয়ে আবারো বললো, “লঞ্চটার কাম অইতাছে…মনে হয় ইঞ্জিনে টেরাবল আছে।”

“তুমি কিভাবে জানলে?”

“কি যে কন না…আমি সারাদিন নদী পারাপার করি না?” হেসে বললো আমির হোসেন। “লাইনের লঞ্চে টেরাবল দিলে নদীর উপর রাইখ্যা দেয়। চালু লঞ্চ অইলে তো টিরিপ মারতো।”

 “হুম,” বলেই লঞ্চের দিকে তাকালো। এখন সেটা মাত্র ত্রিশ গজ দূরে আছে। নিঃশব্দে তাদের নৌকাটা এগিয়ে চলছে ধীরে ধীরে।

.

তুর্যের হাত এখন খোলা। মুখও বাধা নেই কারণ একটু আগে বহু কষ্টে হাতের বাধনটা খুলে ফেলেছে সে।

আজ যেনো পরিস্থিতি আচমকা পাল্টে গেছে। সকালে একটু খাবার দেয়ার পর দীর্ঘক্ষণ ধরে কোনো খাবারও দেয়া হয় নি তাকে। কয়েক ঘণ্টা আগে চাপদাড়ি এসে তার ঘর থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে এই যে গেছে তারপর আর কারোর দেখা নেই।

ক্ষিদের চোটে হাত-পা কাঁপছে। তারচেয়েও বড় কথা মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। লোকগুলো তাকে মেরে ফেলবে, এরকম একটি আশংকা জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। কিছুক্ষণ আগে বন্ধ দরজার ওপাশে তাদের কথাবার্তার কিছু অংশ শুনে ফেলেছে সে।

লোকগুলোর কথা শোনার পর থেকে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সিদ্ধান্ত নেয় শেষ একটা চেষ্টা করে দেখবে। এভাবে লোকগুলোর হাতে খুন হবার চেয়ে পালানোর চেষ্টা করাই ভালো। সিনেমাতে কতো দেখেছে, বন্দী অবস্থা থেকে তার চেয়েও কম বয়সী ছেলেমেয়েরা ভয়ঙ্কর সব লোকজনকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে। তাহলে সে পারবে না কেন?

বয়সের তুলনায় সে নিজেকে অনেক বেশি বড় মনে করে। এই বয়সেই তার গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা অগুণতি। তাদের অনেকের সাথেই তার দৈহিক সম্পর্ক হয়েছে। বন্ধুবান্ধবরা তাকে হিংসে করে এজন্যে। তাদের কাছে সে স্মার্ট একটা ছেলে। তার মতো একটা ছেলে কি পারবে না এই লোকগুলোকে ফাঁকি দিয়ে সটকে পড়তে?

অবশ্যই পারবে, মনে মনে বলে সে। তার হাত দুটো দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাধা। অনেক চেষ্টা করে হাত দুটো পায়ের নীচ দিয়ে সামনে নিয়ে আসতে পারে, তারপর খুব সহজেই দাঁত দিয়ে দড়িটার গিট খুলে ফেলে সে।

এখন তার হাত-মুখ খোলা। বন্ধ দরজাটা কিভাবে খুলবে, কিভাবে ভয়ঙ্কর লোকগুলোকে ফাঁকি দিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাবে, ভাবতে লাগলো।

কিছুক্ষণ আগে হাতটা খোলার পর দরজা খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলো, সফল হয় নি। খালি হাতে সফল হবার কথাও নয়।

যখন বাতি জ্বালিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসিয়ে তার ভিডিও রেকর্ড করা হতো তখন সে দেখেছে, এই ঘরের দরজার লকটা পুরনো ধাঁচের। অনেকটা স্টিলের খিড়কির মতো। এরকম খিড়কি তাদের পুরনো বাড়ির দরজাগুলোতে ছিলো। তার বয়স যখন আট-নয় তখন দুষ্টুমি করলে তার মা একটা ঘরে আটকে রাখতো, আর সেই ছোট্ট তুর্য একটা প্লাঞ্জের সাহায্যে দরজাটার খিড়কি ভেতর থেকে খুলে চুপিসারে বাইরে চলে আসতো।

তো সেরকম খিড়কি দেখে চেষ্টা করেছিলো। ভেতর থেকে খিড়কিটার তিনটি নাট-বল্ট দেখা যায়। ছয় ইঞ্চি দূরত্বে দু’পাশে দুটো নাট, আর তার ঠিক তিন-চার ইঞ্চি নীচে তৃতীয় নাটটি। অনেকটা ত্রিভূজের আকার গঠন করেছে। সে জানে, নীচের নাটটা খুলে ফেলতে পারলেই খিড়কিটা অনায়াসে খোলা যাবে কিন্তু সেটা খালি হাতে সম্ভব নয়। চেষ্টা করে দেখেছে কিন্তু হাতের আঙুল থেতলে গেলেও নাটটা একটুও ঘোরাতে পারে নি।

আঙটার মতো কিছু থাকলে কাজে দিতে কিন্তু এ ঘরে সেরকম জিনিস কই?

একটু শীত শীত লাগলে তোষকের উপর গিয়ে শুয়ে পড়লো সে। কম্বলটা গায়ে টেনে দিলেও শীত মানছে না। শরীরটা কুকড়ে পকেটে হাত ঢোকাতেই টের পেলো একটা জিনিস। বেশ কয়দিন হলো সে বন্দী হয়ে আছে এখানে অথচ জিনিসটার অস্তিত্ব টের পেলো এইমাত্র!

অধ্যায় ৮৩

ব্ল্যাক রঞ্জু হুইলচেয়ারসহ মেঝেতে পড়ে আছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বাবলু। টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপের পদায় ইয়াহু মেসেঞ্জারের ভিডিওবক্সে ভয়ঙ্কর একটি ছবি দেখা যাচ্ছে : হাত-মুখ বাধা উমা বসে আছে একটা চেয়ারে।

মেয়েটা এখন রঞ্জুর লোকজনের হাতে বন্দী।

তার বুঝতে অসুবিধা হলো না কতো ভয়ঙ্করভাবে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলো এই পঙ্গু সন্ত্রাসী। প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত রঞ্জু চেয়েছিলো বাবলুকে খুন করার আগে তার চোখের সামনে উমাকে খুন করে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা দেবে। এক পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠবে।

ল্যাপটপের পদায় বন্দী উমার ছবিটা দেখার পর কয়েক মুহূর্ত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলো সে, তারপরই রঞ্জুকে এলোপাথারি ঘুষি মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়। পিস্তল তাক করে জানতে চায়, উমা এখন কোথায়।

পঙ্গু সন্ত্রাসী কিছুই বলে নি, এখনও বলছে না।

উমার ভিডিওটা দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। বাবলু বুঝতে পারছে না কী করবে। তবে ল্যাপটপের ইনবিল্ট ওয়েবক্যামটা বন্ধ করে দিয়েছে যাতে করে তার ছবি ব্রডকাস্ট না হয়।

“আমি জানি তুই আমাকে মেরে ফেলবি,” মেঝেতে পড়ে থাকা রঞ্জু বললো।

বাবলু পেছন ফিরে তাকালো তার দিকে। তার চোখেমুখে ক্রোধ উপচে পড়ছে।

“আমার আর বেঁচে থাকার কোনো চান্স নেই।”

বাবলু কিছু বললো না। তার দিকে কঠিন দৃষ্টি হেনে চেয়ে রইলো শুধু।

“…তাহলে আমি কেন উমার খোঁজ তোকে দেবো?” বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো রঞ্জুর ঠোঁটে।

বাবলু বুঝতে পারলো জীবনে এই প্রথম মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারছে না। ধীরস্থিরভাবে কোনো কিছু ভাবতেও পারছে না সে। কিন্তু ভালো করেই জানে, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য খুব সহজ একটি পথ আছে কিন্তু সেটা তার মাথায় আসছে না।

“তুই আমাকে যতোই টর্চার করিস, যতোই ভয় দেখাস, আমি কিছু বলবো না!” কথাটা বলেই উন্মাদগ্রস্তের মতো হাসি দিতে শুরু করলো সে।

বাবলু চেয়ে রইলো পঙ্গু সন্ত্রাসীর দিকে। তার ইচ্ছে করছে এক্ষুণি পিস্তলের সবগুলো গুলি বদমাশটার বুকে খরচ করে ফেলতে, কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো।

রঞ্জুর মধ্যে মৃত্যুভয়ও জেঁকে বসেছে। বিকারগ্রস্তের মতো আচরণ করছে এখন।

বাবলু জানে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। কখন কে চলে আসে তার কোনো ঠিক নেই।

একটু আগে যখন ব্ল্যাক রঞ্জুর সামনে চলে এলো তখন ভেবেছিলো তাদের মোকাবেলাটা বড়জোর পাঁচ-দশ মিনিটের মতো স্থায়ী হবে। তারপরই জঘন্য সন্ত্রাসীটাকে চিরতরের জন্য স্তব্ধ করে দিয়ে চলে যাবে এখান থেকে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে গেছে। রঞ্জুকে খুন করতে পারছে না সে। অন্তত উমার ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু না জেনে রঞ্জুকে কিছু করতে পারছে না।

“উমাকে কোথায় আটকে রেখেছিস?” বেশ শান্ত কণ্ঠে বললো এবার।

খিকখিক করে হাসলো রঞ্জু। “আমি যদি বলি কোথায় আটকে রেখেছি তাহলে তুই কি করবি?” মাথা দোলালো সে। “কিছু করতে পারবি না। এখান থেকে ওকে কিভাবে বাঁচাবি?”

“তাহলে তোকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি?” পিস্তলটা তাক করলো বাবলু।

রঞ্জু একটুও ঘাবড়ালো না। মনে রাখিস, আমি মরলে উমাকে আর বাঁচাতে পারবি না।”

“তার মানে তোকে বাঁচিয়ে রাখলে উমা বেঁচে থাকবে?”

“সেটা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি…আলোচনা করতে পারি!”

বাবলু চেয়ে রইলো মেঝেতে পড়ে থাকা সন্ত্রাসীর দিকে।

“হুম,” কথাটা বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সে।

“কোথায় যাচ্ছিস?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানতে চাইলো রঞ্জু।

দরজার সামনে থেকে ফিরে তাকালো বাবলু। “কথা বলতে!”

অধ্যায় ৮৪

মাঝির দিকে তাকালো জেফরি বেগ, অন্ধকারেও ছেলেটার চোখেমুখে রোমাঞ্চ দেখতে পেলো সে। “আস্তে করে লঞ্চটার গায়ের সাথে ভেড়াবে…”

মাঝি একহাত তুলে জেফরিকে আশ্বস্ত করলো। সাবধানে বৈঠা বাইতে বাইতে লঞ্চের গায়ের সাথে ভিড়িয়ে দিলো তার ছোট্ট খেয়া নৌকাটা। তারপর জেফরির উদ্দেশ্যে ইশারা করলো উঠে পড়ার জন্য।

ছেলেটার দিকে হাত তুলে বিদায় জানিয়ে লঞ্চের চারপাশে যে কার্নিশের মতো রিম থাকে সেটার উপর উঠে বসলো সে। মাঝি ছেলেটা নিঃশব্দে নৌকা ঘুরিয়ে চলে গেলো।

কার্নিশ সংলগ্ন সারি সারি খোলা জানালা। নীচের ডেকে উঁকি মারলো জেফরি। কাউকে দেখতে পেলো না। ভেতরটা ঘন অন্ধকার। আবছা আবছা দেখতে পেলো এখানে সেখানে মালপত্র স্তূপ করে রাখা আছে। সাইডব্যাগ থেকে নাইটভিশন গগলসটা বের করে পরে নিলো সে।

এবার নীচের ডেকটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। পুরো ডেকটা জুড়ে বড় বড় বাক্স আর মালপত্র রেখে দেয়া হয়েছে।

নীচের ডেকে নেমে পড়লো সে। ঘন অন্ধকার এখন তার বাড়তি সুবিধা। কোমর থেকে নাইন এমএমের পিস্তলটা হাতে তুলে নিলো। আজকের জন্যে সে সাইলেন্সর ব্যবহার করবে।

পিস্তল হাতে জেফরি বেগ সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে চললো নীচের ডেকের পেছন দিকে। জামানের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে, এই লাইনের লঞ্চগুলোর কোথায় কি থাকে।

লঞ্চের পেছনে একটা বড়সড় ঘর, সেটার ভেতর থেকে মেশিনের শব্দ ভেসে আসছে। জেফরি বেগ দরজা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। নাইটভিশন গগলসের সবুজাভ আলোয় দেখতে পেলো একটা মাঝারিগোছের জেনারেটর চলছে।

.

পকেট থেকে জিনিসটা বের করে আনলো তুর্য : তার স্কুলের আইডিকার্ডটা। প্লাস্টিকের এই কার্ডটার সাথে লম্বা একটা চেইনও আছে গলায় ঝুলিয়ে রাখার জন্য। কার্ডটা বের করে অন্ধকারেই হাতরালো সে। কার্ডটা চেইনের সাথে আটকে রাখার জন্য একটা ধাতব আঙটার মতো ক্লিপ আছে। ক্লিপটা দিয়ে কি নাটটা খোলা যাবে? সঙ্গে সঙ্গে তুর্য ছুটে গেলো দরজার কাছে। চাপ দিয়ে কার্ড থেকে ক্লিপটা খুব সহজেই খুলে ফেললো। ক্লিপটার অন্য মাথা চেইনের সাথে লাগানো। সেটা না খুললেও চলবে। তুর্যের দরকার ক্লিপের সেই অংশটি, যেটা দিয়ে কার্ডটা আটকে রাখা হয়।

দরজার নীচ দিয়ে একটা বাল্বের আলো এসে পড়েছে। সেই আলোতে আবছা আবছা দেখতে পেলো নাটটা। ধাতব ক্লিপ দিয়ে নাটটা শক্ত করে ধরে একটা মোচড় দিলো সে। অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলো ক্লিপটা ঘুরে গেছে একটুখানি। উত্তেজনায় রীতিমতো কেঁপে উঠলো তার শরীর। নাটটা খুলতে পারলেই ধাতব খিড়কিটা খুলে ফেলতে পারবে, আর খিড়কিটা খুলে যাবার অর্থ দরজা খুলে যাওয়া।

কিন্তু এখন এ কাজটা করা যাবে না। বাইরে যদি লোকগুলো থাকে তাহলে ধরা পড়ে যাবে। তাকে আগে নিশ্চিত হতে হবে, লোকগুলো আশেপাশে নেই। হাতের কাছে একটা অস্ত্র থাকার পরও তুর্য বসে বসে ভেবে গেলো কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে। সে জানে, ধরা পড়লে তাকে খুন করে ফেলবে বদমাশগুলো।

ঠিক তখনই দরজার নীচ দিয়ে তাকিয়ে দেখলো বাতিটা জ্বলছে না। সঙ্গে সঙ্গে দরজার নীচে মাথাটা পেতে দিয়ে তাকালো। ঘন অন্ধকার।

লোডশেডিং হচ্ছে? ভাবলো তুর্য।

.

নীচের ডেক থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা লঞ্চের প্রায় মাঝখানে অবস্থিত। জেনারেটরের সুইচ অফ করার একটু পরই লোহার সিঁড়িটা দিয়ে কারো নেমে আসার শব্দ শুনতে পেলো সে। শব্দটা আরো জোড়ালো হচ্ছে। একটু পর দেখা গেলো ভারি শরীরের এক লোক টর্চলাইট হাতে নেমে আসছে নীচের ডেকে। তার মুখে সিগারেট।

জেফরি বেগ চুপচাপ জেনারেটররুমের বন্ধ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আস্তে করে খুলে গেলো জেনারেটর রুমের দরজাটা 1 সতর্ক হয়ে উঠলো সে।

সিগারেট মুখে লোকটা ঘরে ঢুকেই উপুড় হয়ে টর্চের আলো ফেললো জেনারেটরের উপর।

এখনই! নিজেকে তাড়া দিলো জেফরি। সে জানে এটাই মোক্ষম সময়। কিন্তু কী করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। ঠাণ্ডা মাথায় পেছন থেকে কাউকে খুন করার মতো নার্ভ তার নেই। সে একজন ইনভেস্টিগেটর, পেশাদার কোনো খুনি নয়। তার পক্ষে নির্বিচারে মানুষ খুন করা অসম্ভব।

তার ইচ্ছে পেছন থেকে আঘাত করে ঘায়েল করা কিন্তু লোকটা যদি চেঁচিয়ে ওঠে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। গুলি করতে দ্বিধাগ্রস্ত সে।

লোকটা হয়তো বুঝে গেছে জেনারেটরের সুইচ অফ। একটু অবাক হয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো : “সুইচ বন্ধ করলো কে?”

জেফরি বেগ এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। ভালো করেই জানে যা করার এখনই করতে হবে।

উপুড় হয়ে থাকা লোকটা হয়তো কিছু একটা টের পেয়ে গেলো। সম্ভবত জেফরির নিঃশ্বাসের শব্দ, কিংবা অন্য কিছু। হঠাৎ করে জমে গেলো সে। তারপর আচমকা ঘুরে দাঁড়ালো টর্চ হাতে। তার টর্চের তীব্র আলো এসে পড়লো জেফরির মুখের উপর। নাইটভিশন গগলস থাকার কারণে টর্চের আলো ঝলসে দিলো তার চোখ।

“কে?” অস্ফুট আর ভয়ার্তস্বরে বলে উঠলো লোকটা।

নাইটভিশন গগলসের সবুজাভ আলোয় একজোড়া বিস্ফারিত চোখ দেখতে পেলো জেফরি। চোখমুখ খিচে আছে সে। হয়তো অদ্ভুত দর্শনের গগলসটা তাকে ভুত দেখার মতো ভড়কে দিয়েছে।

জেফরি বেগ বুঝতে পারলো না সে গুলি করছে কিনা। গুলি করলে থুতু ফেলার মতো ভোলা একটি শব্দ হবার কথা কিন্তু তার বদলে শুনতে পেলো অন্য কিছু।

তার সামনের লোকটা ঢলে পড়ে গেলো।

টের পেলো তার পকেটে থাকা মোবাইলফোনটা ভাইব্রেট করছে। নিশ্চয় জামান ফোন করেছে। এরকম সময় ফোন করার কোনো মানে হয়! ছেলেটার উপর বিরক্ত হয়ে বুটুথ ইয়ারফোনের বাটন চেপে কলটা রিসিভ করলো সে।

ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো : “মি: বেগ?”

অধ্যায় ৮৫

দেরি না করে কাজে নেমে পড়লো তুর্য। বিদ্যুৎ চলে আসার আগেই তাকে পালাতে হবে। ক্লিপটার সাহায্যে একটা নাট আটকে ঘোরাতে শুরু করলো। মাত্র পাঁচ-ছয়বার ঘোরানোর পরই নাটটা আলগা হয়ে এলে হাতের আঙুল দিয়েই খুলে ফেললো সে।

এখন আঙুল দিয়ে ধাক্কা মারলেই তালাসহ আঙটাটা খিড়কি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাইরের দরজার নীচে পড়ে যাবে। কিন্তু তুর্য সেটা করলো না। সে জানে আঙটাটা ভারি তালাসহ মেঝেতে পড়লে প্রচণ্ড জোরে শব্দ হবে। শব্দ হলেই লোকগুলো টের পেয়ে যাবে।

না। এটা করা যাবে না। মাথা খাটাতে লাগলো সে। মেঝে আর দরজার নীচে আধ ইঞ্চির মতো একটা ফাঁক আছে। দ্রুত ভাবতে লগলো তুর্য। ঘরে একটা কম্বল আছে।

হ্যাঁ, কম্বল! কম্বলটা নিয়ে দরজার কাছে চলে এলো সে। কম্বলের চার কোণার এককোণের কিছু অংশ ঢুকিয়ে দিলো দরজার নীচ দিয়ে। তালাসহ আঙটাটা যেনো কম্বলের ওইটুকু অংশের উপর পড়ে সেটা নিশ্চিত হয়ে আঙটাটা আঙুল দিয়ে ধাক্কা দিতেই ধুপ করে ছোট্ট একটা শব্দ হলো কেবল।

এবার ফুটোটার ভেতরে কড়ে আঙুল ঢুকিয়ে খিড়কির ডান্ডাটা বাম দিকে ঠেলতে লাগলো যতোক্ষণ না দরজাটা খুলে যায়। দরজাটা একটু ফাঁক হতেই তুর্যের সারা শরীর উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো। সে পারবে। সে পেরেছে। এখন ঘর থেকে বের হয়ে তাকে পালাতে হবে। অন্ধকার থাকতে থাকতেই পালাতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বের হয়ে এলো না সে। একটু অপেক্ষা করলো। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো আশেপাশে কেউ আছে কিনা।

না, নেই, ভাবলো তুর্য। ঐ বদমাশগুলো হয়তো আশেপাশে কোথাও নেই। কোথায় গেছে কে জানে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে বুকে সাহস সঞ্চয় করলো তুর্য। গভীর করে দম নিয়ে দরজাটা খুলে যে-ই না বের হবে অমনি কারো পায়ের শব্দ পেয়ে তার রক্ত হিম হয়ে গেলো। ঠিক তার দরজার কাছে আসছে লোকটা। তুর্য জানে তার পালানোর শেষ সুযোগটা নষ্ট হয়ে গেলো। বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো তার।

.

হাজার মাইল দূর থেকে বাবলু ফোন করেছে জেফরি বেগকে। তার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা।

এক সময়কার ঠাণ্ডা মাথার খুনি বাস্টার্ড মানসিকভাবে ভেঙে পড়া প্রেমিকের মতো উদভ্রান্ত হয়ে জানায় উমা নামের নার্স মেয়েটি এখন রঞ্জুর লোকদের হাতে বন্দী!

কথাটা শুনে জেফরি যারপরনাই অবাক হয়। উমাকেও রর লোকজন কিডন্যাপ করেছে! ঐ পঙ্গু সন্ত্রাসী নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য অপহরণের মতো অস্ত্র ব্যবহার করেছে, আর বলাবাহুল্য সেটা ভালোমতোই ব্যবহার করতে পেরেছে সে।

“তুমি কিভাবে এটা জানলে?” তাকে জিজ্ঞেস করে জেফরি।

“রঞ্জুর ওখানে ল্যাপটপে দেখেছি।”

রঞ্জুর ওখানে! তাহলে তার ধারণাই ঠিক, ব্ল্যাক রঞ্জুর গোপন আস্তানায় ঢুকে পড়েছে বাবলু। খুব সম্ভবত এই পেশাদার খুনির হাতে রঞ্জুর দলের বাকিরা এরইমধ্যে খুন হয়ে গেছে। হুইলচেয়ারের সন্ত্রাসীটাকে নিজের কজায় নেবার পরই এটা সে জানতে পেরেছে।

“ল্যাপটপে দেখেছো মানে?”

“বানচোতটার কাছে ল্যাপটপ আছে…ইয়াহু মেসেঞ্জারে উমার ভিডিও দেখেছি। রঞ্জুর লোকজন তাকে আটকে রেখেছে।

সর্বনাশ! জেফরি বেগ কয়েক মুহূর্ত ভেবে যায়। “রঞ্জু এখন তোমার কজায়, তাই না?”

“হুম।”

“ওর কাছ থেকে বের করতে পারো নি উমাকে কারা আটকে রেখেছে, কোথায় রেখেছে?”

“না। বানচোতটা কিছুই বলছে না…ওর কাছে কোনো ফোনও নেই,” বাবলু একটু থেমে আবার বলে, “তার ডানহাত ঝন্টুও এখন বেঁচে নেই…নইলে তার কাছ থেকে জেনে নিতে পারতাম।”

ওহ, জেফরি বেগ মনে মনে বলে উঠেছিলো।

“আমার ধারণা মিলন জানে উমাকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে।”

“মিলন মারা গেছে,” আস্তে করে বলে জেফরি বেগ।

ওপাশ থেকে নীরবতা নেমে আসে।

“একটু আগে…আমার হাতেই…”

“তাহলে এখন কিভাবে জানা যাবে?” জানতে চায় বাবলু।

জেফরি বেগ একটু ভাবে। কিন্তু বুঝতে পারে না কী বলবে। সে নিজে এমন এক জায়গায় আছে, বেশি কিছু ভাবতেও পারছে না।

কয়েক মুহূর্ত এভাবে কেটে যাবার পর ওপাশ থেকে বাবলু তাড়া দিলো। “মি: বেগ?”

“শোনো, আমি এখন ঐ লঞ্চে আছি,” সম্বিত ফিরে পেয়ে বললো জেফরি। ল্যাপটপের কথা শুনে একটা ব্যাপার অনুমান করলো সে। “তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমার মনে হচ্ছে উমাকেও এই লঞ্চে আটকে রেখেছে ওরা।”

“আপনি নিশ্চিত?” আশান্বিত হয়ে বললো বাবলু।

“আমার তাই মনে হচ্ছে। রঞ্জুকে কিছু কোরো না…যতোক্ষণ না”

ঠিক তখনই শুনতে পেলো কেউ একজন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছে। চুপ মেরে গেলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।

একটা বাজখাই কণ্ঠ হাঁক দিলো সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে। “ওই শালার কালা…জেনারেটরের কি হইছে?”

“কেউ আসছে,” ফিসফিসিয়ে বললো জেফরি। “আমি তোমাকে পরে ফোন করছি। রঞ্জুর কিছু কোরো না, প্লিজ।”

লাইনটা কেটে দিয়ে জেফরি বেগ সতর্ক হয়ে উঠলো। জেনারেটর রুমের সামনে থেকে সরে গিয়ে চট করে বড় বড় কিছু বাক্সের পেছনে লুকিয়ে পড়লো সে।

রাগে গজ গজ করতে করতে জেনারেটর রুমের দিকে এগিয়ে এলো লোকটি। তার হাতে কোনো টর্চ নেই।

জেফরি বেগ বাক্সগুলো থেকে উঁকি মেরে নাইটভিশন গগলস দিয়ে দেখতে পেলো লোকটার বাম হাতে একটা পিস্তল।

জেনারেটর রুমের কাছে এসে অন্ধকারের মধ্যেই আশেপাশে তাকালো লোকটা। ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে ডিসপ্লের আলোতে দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো সে।

“কালা?” কিছু আন্দাজ করতে পেরে একটু সতর্ক হয়ে উঠলো। পিস্তলটা তাক করে জেনারেটর রুমের দরজায় পা দিয়ে ধাক্কা মারতে যাবে অমনি পেছন থেকে একটা ভোতা শব্দ হলে হুরমুর করে সামনের দিকে পড়ে গেলো সে।

এবার আর জেফরি বেগ দ্বিধা করে নি। পেছন থেকে লোকটাকে সাইলেন্সার পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে, কারণ লোকটার হাতে পিস্তল ছিলো। একদিনে দু’দুজন লোককে গুলি করে মারলো। যদিও ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না এখনও। নিজেকে প্রবোধ দিলো : এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।

মুখ থুবরে পড়ে থাকা লোকটার হাত থেকে মোবাইলফোনটা নিয়ে সেটা অফ করে দিয়ে জেফরি বেগ আর দেরি না করে উপরের ডেকের দিকে পা বাড়ালো। কারণ উপরে যারা আছে তারা একটু পরই সন্দেহ করতে শুরু করবে।

উপরের ডেকে উঠে দেখতে পেলো জায়গাটা একদম ফাঁকা। কিন্তু মাথার উপরে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। লঞ্চের কেবিনগুলো উপরের ফ্লোরেই অবস্থিত।

জেফরি যতোটা সম্ভব নিঃশব্দে তৃতীয় ফ্লোরে চলে এলো। বাবলু তাকে যে তথ্য দিয়েছে তাতে লঞ্চে মোট চারজন থাকার কথা। এরইমধ্যে দু’জন তার হাতে প্রাণ হারিয়েছে। বাকি আছে আরো দু’জন। সম্ভবত!

লঞ্চের ডান দিকের রেলিং ধরে এগোতে লাগলো এবার। সারি সারি কেবিন চলে গেছে কিন্তু কোন কেবিনে জিম্মিদের আটকে রাখা হয়েছে সেটা তার জানা নেই।

নীচের ফ্লোরগুলোর মতোই এ জায়গাটাও অন্ধকারে ঢেকে আছে। এই বাড়তি সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো সে। জামান তাকে বলেছে এ ধরণের লঞ্চের পেছন দিকে অপেক্ষাকৃত বিশাল সাইজের দু’তিনটি কেবিন থাকে মালিকপক্ষ কিংবা ভিআইপি লোকজনের ব্যবহারের জন্য। সে নিশ্চিত, এরকম কোনো কেবিনেই জিম্মিদের আটকে রাখা হয়েছে।

সাধারণ কেবিনগুলো বেশ ছোটো, জামানের মতে আট বাই ছয় ফুটের বেশি হবে না। তবে ভিডিওতে যে রুমটা তারা দেখেছে সেটা নিঃসন্দেহে আরো বড়। সেখানে টেবিল-চেয়ার পাতা আছে। আট বাই ছয় ফুটের ঘরে এসবের সংকুলান হবে না।

লঞ্চের একেবারে শেষের দিকে এসে জেফরি দেখতে পেলো বড় বড় তিনটি দরজা। এগুলোই কি ভিআইপি কেবিন? হতে পারে।

কিন্তু এইসব কেবিনের কোনটাতে তুর্য আর উমাকে আটকে রাখা হয়েছে সেটা বুঝতে পারলো না।

হঠাৎ খেয়াল করলো একটা ঘরের দরজা একটু ফাঁক হয়ে আছে। আস্তে করে সেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

অধ্যায় ৮৬

চাপদাড়ির মেজাজ খারাপ। জেনারেটরটা আচমকা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্ধকারে ঢেকে আছে পুরো লঞ্চটা। তার খুব ইচ্ছে ছিলো বাতি জ্বালিয়ে কাজটা করবে। সেটা বোধহয় হচ্ছে না।

রইস আর কালাকে পাঠিয়েছে জেনারেটরটা দেখে আসার জন্য কিন্তু তাদেরও কোনো খবর নেই। সব ক’টা হারামির বাচ্চা আছে মউজ করার তালে। বিশেষ করে কালা আর ভোটলাল এই মেয়েটাকে খুন করার আগে ফুর্তি করার জন্য অস্থির হয়ে আছে। তাদের আর তর সইছে না। অন্ধকারের মধ্যেই কেবিনের এককোণে তাকালো সে। কিছুই দেখতে পেলো না।

তর তো তারও সইছে না। সেও তো মউজ-ফুর্তি করতে চায়।

মেয়েটাকে ধরে আনার পর থেকেই শরীরের মধ্যে এক ধরণের শিহরণ বয়ে গেছিলো। সদ্য যুবতী একটা মেয়ে। দেখতেও বেশ। তাদের বস মিলনের কারণেই অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এতোদিন।

ইচ্ছেমতো ভোগ করার পর কালা আর ভোটলালের মতো হারামির বাচ্চার হাতে তুলে দেবে মেয়েটাকে। তারা যে কী করবে ভাবতেই গা শিউড়ে উঠলো। অবশ্য রইস এসবের মধ্যে নেই, তার মানে এই নয় যে সে তাদের চেয়ে ভালো কিছু। বরং বাকিদের চেয়ে সে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর, আস্ত একটা পিশাচ। অনেকদিন আগে এক দুর্ঘটনায় পুরুষত্ব হারিয়েছে সে। এরপর থেকে মেয়েমানুষ তার জন্য হারাম হয়ে গেছে।

অন্ধকারে বসে হুইস্কি গিলছে চাপদাড়ি। একটু পর যে কাজটা করবে তার জন্য রক্তের মধ্যে নেশা ধরানো চাই। স্বাভাবিক অবস্থায় এসব কাজ করা খুব কঠিন।

তাদের কাজ তো প্রায় শেষই। এখন ক্লিয়ার করার সময় এসে গেছে। তার আগে একটু ফুর্তি করে নিলে দোষ কি? কেউ তো আর জানতে পারবে না মেয়েটাকে খুন করে গুম করার আগে তারা সবাই মিলে ভোগ করে নিয়েছে।

চাপদাড়ি মদের বোতলটা একপাশে রেখে বেল্ট খুলতে শুরু করলো। যদিও অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু তার মনে হচ্ছে হাত-মুখ বাধা মেয়েটি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে।

এক পাও এগোয় নি অমনি কেবিনের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ।

মেজাজটা আবার বিগড়ে গেলো তার।

“কে?”

.

একটু আগে যে ভয় পেয়েছিলো সেটা কেটে গেছে এখন। গভীর করে দম নিয়ে নিলো তুর্য। কিছুক্ষণ আগেও তার কাছে মনে হয়েছিলো ধরা পড়ে গেলো বুঝি। কিন্তু না। যে লোকটার পায়ের আওয়াজ পেয়েছিলো সে কালা নামের একজনকে ডাকতে ডাকতে নীচের ডেকে চলে গেছে। জেনারেটরটায় বোধহয় সমস্যা দেখা দিয়েছে।

আচ্ছা, এজন্যেই বিদ্যুৎ চলে গেছে তাহলে! ভাবলো তুর্য। নতুন করে সাহস সঞ্চয় করে দরজাটা খুলে ফেললো আস্তে করে। আবছা আবছা দেখতে পেলো দরজার সামনে দিয়ে একটা প্যাসেজ চলে গেছে। কারো কোনো শব্দ শুনতে পেলো না। আবারো দম নিয়ে নিলো, যেভাবেই হোক এখান থেকে তাকে পালাতে হবে। এই অন্ধকারে যদি লোকগুলোকে ফাঁকি দিতে না পারে তাহলে আর কখনও পারবে না।

দরজা খুলে বাইরে পা রাখলো সে। আরেক পা বাড়ানোর আগেই টের পেলো শক্ত একটা হাত তাকে জাপটে ধরেছে। অন্য হাতটা তার মুখ চেপে ধরার কারণে চিৎকার দিতে পারলো না।

মা! আমাকে মেরে ফেলবে! মনে মনে চিৎকার করে কেঁদে ফেললো সে। ধরা পড়ে গেছে। এখান থেকে আর পালানোর সুযোগ সে পাবে না।

কানের কাছে লোকটার তপ্ত নিঃশ্বাসের আঁচ টের পেলো। তারপরই ফ্যাসফ্যাসে চাপাকণ্ঠটা।

“একদম চুপ!”

অধ্যায় ৮৭

চাপদাড়ি দরজা খুলে দেখলো ভোটলাল দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা ছোটো টর্চলাইট। লাইটের আলোটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই তার জননেন্দ্রিয়ের দিকে প্রক্ষেপ করলো সে। বেল্ট খোলা দেখে তার মুখে ফুটে উঠলে হাসি।

“কি হইছে?” একটু রেগেমেগে বললো চাপদাড়ি।

“ল্যাপটপের ব্যাটারিতে চার্জ আছিলো না…অফ হয়া গেছে, ভাই।”

চাপদাড়ি জানে হাজার মাইল দূর থেকে রঞ্জু নিশ্চয় গালাগালি করছে তাদেরকে। বার বার বলে দিয়েছিলো কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইয়াহু মেসেঞ্জারটা চালু রাখতে। কিন্তু জেনারেটরের সমস্যা করবে কে ভেবেছিলো।

“জেনারেটরে টেরাবল দিছে, রইস আর কালা ঠিক করতাছে। একটু ওয়েট কর।”

“রঞ্জু ভায়ে তো রাইগা বোম অয়া আছে মনে অয়।”

“রঞ্জু ভায়েরে লইয়া তোর চিন্তা করা লাগবো না। আমি পরে বুঝায়া

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো ভোটলাল।

“আর কিছু কইবি?” বললো চাপদাড়ি।

“না, মাইনে,” ইতস্তত করলো ভোটলাল। “অনেক রাইত অয়া যাইতাছে, একটু পরই তো সব ক্লিয়ার করতে অইবো…তাই কইছিলাম…”

“বুঝছি,” কপট রাগ দেখিয়ে বললো চাপদাড়ির। “তর সইতাছে না।”

ভোটলাল নিঃশব্দ হাসি দিলো।

“লাইন আয়া পড়লে করিস। একটু ওয়েট কর।”

“আমি কি নীচে গিয়া দেইহা আমু ওরা কি করতাছে?”

চাপদাড়ি একটু ভাবলো। “ঠিক আছে, যা।”

ভোটলাল আর কিছু না বলে ঘুরে চলে যেতেই পেছন থেকে তাকে ডাকলো আবার। “আমারে আর ডিস্টার্ব করিস না।”

ভোটলালের চোখেমুখে খুশির যে ঝিলিক দেখা গেলো সেটা অন্ধকারে দেখতে পেলো না চাপদাড়ি। “ঠিক আছে, ভাই,” বলেই চলে গেলো সে।

দরজাটা ভিরিয়ে দিলো চাপদাড়ি। উত্তেজনার চোটে খিড়কি বন্ধ করতে ভুলে গেলো সে। ঝটপট প্যান্ট আর টি-শার্টটা খুলে ফেললো। তার সামনেই হাত-মুখ বাধা এক তরতাজা যুবতী মেয়ে ঘরের এককোণে পড়ে আছে। যদিও দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু সে জানে মেয়েটা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। মেয়েটার করুণ চোখ তাকে দেখতে হচ্ছে না বলে খুশিই হলো। আজ অনেকদিন পর ইচ্ছেমতো নরীদেহ ভোগ করবে।

“কুনো আওয়াজ করবি না…আওয়াজ করলে খুন কইরা ফালামু,” মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললো।

জাপটে ধরলো মেয়েটাকে। দু’গালে চুমু খেতে শুরু করলো ক্ষুধার্ত পশুর মতো কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মেয়েটা মরা লাশের মতো পড়ে রইলো। কোনো প্রতিরোধ করলো না। জোরে কামড় বসিয়ে দিলো মেয়েটার গালে। তারপরও মেয়েটা নিথরই রইলো। শালি নড়ে না কেন? মনে মনে বললো চাপদাড়ি।

.

তুর্যকে বাগে আনতে তেমন কষ্ট করতে হলো না। জাপটে ধরার পরই অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছে সে। ছোটার জন্য একটু হাসফাস করলে জেফরি তার কানের কাছে মুখ এনে বলেছে চুপ থাকতে। তারপরই নিজের পরিচয়টা দিলে ছেলেটা আর ছোটার চেষ্টা করে নি। একদম শান্ত হয়ে যায়।

তুর্য এখন আবারো সেই কেবিনে যেখানে তাকে কয়েক দিন ধরে আটকে রাখা হয়েছে। তবে এখন তার সাথে রয়েছে হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। ছেলেটা জানতোই না এতোদিন একটা লঞ্চের কেবিনে তাকে আটকে রাখা হয়েছিলো।

একটু আগে পাশের কেবিনের দরজায় জোরে জোরে টোকা মারার শব্দ শুনতে পেয়ে জেফরি বেগ সতর্ক হয়ে ওঠে।

তারপর দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখে ডান দিকের শেষ কেবিনটার দরজার সামনে এক লোক টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কারো সাথে কথা বলেই লোকটা ঘুরে চলে যায় নীচের ডেকে।

“তুমি এখানেই থাকো, ঘর থেকে বের হবে না। কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশ এসে পড়বে। ঠিক আছে?”

“আপনি কোথায় যাবেন?” ভয় মেশানো কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো তুর্য।

পিস্তলটা হাতে নিয়ে বললো সে, “আমি এক্ষুণি চলে আসবো।” তারপর ছেলেটার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বের হয়ে গেলো। দরজাটা বন্ধ করে বাইরে আসতেই পাশের কেবিন থেকে একটা নারীকণ্ঠের চাপা গোঙানি শুনতে পেলো সে।

উমা!

থমকে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলো একটু আগে যে কেবিনের সামনে লোকটা কথা বলেছিলো সেখান থেকেই আওয়াজটা আসছে। উমা তাহলে ঐ কেবিনেই আছে।

আবারো মুখ চাপা আর্তনাদ ভেসে এলো কেবিনের ভেতর থেকে।

জেফরি বেগ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলো কেবিনের সামনে। দরজাটা আস্তে করে ধাক্কা দিলো। ভেতর থেকে বন্ধ করা নেই। একটু ফাঁক হয়ে গেলো। স্পষ্ট শুনতে পেলো ভেতরে একজন পুরুষ মানুষের কণ্ঠ। আদিম উল্লাস। নারী কণ্ঠের চাপা গোঙানি।

তার আর বুঝতে বাকি রইলো না বন্দী উমার সাথে কি আচরণ করা হচ্ছে।

দরজাটা আস্তে করে ধাক্কা মারতেই খুলে গেলো সেটা। প্রচণ্ড উত্তেজনার চোটে খিড়কি লাগাতে ভুলে গেছে হয়তো।

জেফরি বেগ ঘরে ঢুকে পড়লো আস্তে করে। নাইটভিশন গগলসে স্পষ্ট দেখতে পেলো কেবিনের মেঝেতে এক লোক উপুড় হয়ে আছে, তার নীচে এক মেয়ে ছটফট করছে ছোটার জন্য। লোকটার সবল দু’হাত মেয়েটার দু’হাত ঠেসে রেখেছে মেঝের সাথে। লোকটার কারণে মেয়েটার মুখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও জেফরি বেগ জানে এটা উমা।

একটু উপুড় হয়ে লোকটার মাথায় পিস্তলের বাট দিয়ে সজোরে আঘাত করলো। পর পর দুটো। একটা অস্ফুট শব্দ করে অচেতন হয়ে গেলো জানোয়ারটা। তার নীচে থাকা মেয়েটা কিছু বুঝতে না পেরে ছটফটানি থামিয়ে দিলো। জেফরি জানে উমা হয়তো কিছু বুঝতে না পেরে চিৎকার দিতে পারে।

“আমি জেফরি বেগ, উমা,” চিৎকার কোরো না।” ফিসফিসিয়ে বললো সে। |||||||||| মেয়েটা তার শরীরের উপর থেকে অচেতন লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলে জেফরি সাহায্য করলো। কিন্তু লোকটার শরীর সরাতেই নাইটভিশন গগল্‌সে যে চেহারাটা দেখতে পেলো সেটা একেবারেই অচিন্তনীয়। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার কাছে মনে হলো সে ভুল দেখছে।

“তুমি কে?” বিস্ময়ে বলে উঠলো জেফরি বেগ।

অধ্যায় ৮৮

বাবলু দাঁড়িয়ে আছে ল্যাপটপের সামনে। তার ঠিক পেছনে হুইলচেয়ারের পাশে মেঝেতে পড়ে আছে রঞ্জু। একটু আগে জেফরি বেগকে ফোন করে ফিরে এসেছে ঘরে। রঞ্জু যেনো তাদের ফোনের কথাবার্তা শুনতে না পায় সেজন্যে ঘরের বাইরে গিয়ে ফোন করেছিলো।

ঘণ্টাখানেক আগে ঝন্টুর কাছ থেকে কিছু তথ্য জেনে নিয়ে জেফরি বেগকে দিয়েছিলো। সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে ঐ ইনভেস্টিগেটর এখন তুর্যকে উদ্ধার করার জন্য লঞ্চে ঢুকে পড়েছে। তার ধারণা উমাকেও ঐ লঞ্চে আটকে রাখা হয়েছে। একটু অপেক্ষা করলেই সব জানা যাবে।

এখন সে অপেক্ষা করছে। জেফরি বেগ তাকে ফোন করে জানাবে ঘটনা কি। কিন্তু তার মন বলছে খুব বেশি সময় এই বাড়িতে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। যেকোনো সময় লোকজন চলে আসতে পারে। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। এক ধরণের সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেছে সে।

মাথা থেকে এসব চিন্তা বাদ দেবার চেষ্টা করলো। এই জীবনে প্রথমবারের মতো প্রার্থনা করলো, জেফরি বেগ যেনো সফল হয়। সে যেনো উমাকে উদ্ধার করতে পারে।

ঘরে ফিরে এসে দেখতে পাচ্ছে ইয়াহু মেসেঞ্জারটা অফলাইনে চলে গেছে। হয়তো নেটওয়ার্কের সমস্যা, কিন্তু তার মনে খারাপ আশংকাও উঁকি দিচ্ছে। ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালো জঘন্য লোকটার দিকে।

“ইয়াহু মেসেঞ্জারটা অফলাইনে চলে গেলো কেন?” জানতে চাইলো সে।

রঞ্জু ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইলো তার দিকে। তবে মনে মনে সে খুশি, যেকোনো কারণেই হোক কিছুক্ষণ আগে বাস্টার্ড যখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো তার পর পরই ঐ অ্যাকাউন্টটা অফলাইনে চলে যায়।

“আমি তো বুঝতে পারছি না,” বললো রঞ্জু।

“তুই কিছু করেছিস?”

“আমি কিভাবে করবো?” বিস্মিত হয়ে বললো রঞ্জু।

“ওটা তো আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।”

বাবলু একটু ভাবলো। পঙ্গু সন্ত্রাসীটা যেখানে পড়েছিলো সেখানেই আছে, সুতরাং নেটওয়ার্কের সমস্যাই হবে।

মি: বেগের সাথে ফোনে কথা বলার পর তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছিলো। খুবই সহজ সরল একটি কৌশল। ইয়াহু মেসেঞ্জারের ওয়েবক্যাম বন্ধ করে চ্যাটবক্সে রঞ্জুর লোকগুলোর সাথে যোগাযোগ করবে। হাজার মাইল দূর থেকে তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারবে না কার সাথে যোগাযোগ করছে। মেসেঞ্জারটা অফলাইনে চলে যাওয়াতে বুঝতে পারছে না এখন কী করবে।

তার মনে হচ্ছে যেকোনো সময় এই বাড়িতে আরো লোকজন চলে আসতে পারে। কিছুক্ষণ আগে রঞ্জুকে মারপিট করে জানতে চেয়েছিলো অন্য কেউ আসবে কিনা। যদিও বদমাশটা বলেছে কেউ আসবে না কিন্তু বাবলুর আশংকা রঞ্জু মিথ্যে বলেছে। যা করার দ্রুত করে চলে যেতে হবে এখান থেকে। কিন্তু জেফরি বেগ তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে।

মেঝেতে পড়ে থাকা ব্ল্যাক রঞ্জুর দিকে তাকালো সে। বদমাশটা চুপ মেরে আছে।

.

নাইটভিশন গগলস থাকার কারণে গাঢ় অন্ধকারেও জেফরি বেগ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার সামনে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সে উমা নয়, আঠারো-উনিশ বছরের এক তরুণী। তার ধারণা ছিলো এই লঞ্চেই উমাকে আটকে রাখা হয়েছে।

মেয়েটা এতোক্ষণে জেনে গেছে জেফরির পরিচয়। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে তার একটা হাত ধরে রেখেছে।

জেফরি তাকে অভয় দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের করে নিয়ে এলো পাশের কেবিনে। অন্ধকারে তুর্য গুটিসুটি মেরে বসে আছে। দরজা খুলতেই ছেলেটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, “কে?”

“আমি জেফরি বেগ,” চাপা কণ্ঠে বললো সে।

অন্ধকারেও তুর্য বুঝতে পারলো জেফরির সাথে একটা মেয়ে আছে।

“আপনার সাথে কে?” জানতে চাইলো তুর্য।

অমনি পর পর তিনটি গুলির শব্দ। সেইসাথে জান্তব গোঙানি। তারপরই কতোগুলো পায়ের শব্দ। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসছে।

ভড়কে গেলো জেফরি। এরা আবার কারা?

তুর্য আর মেয়েটাকে মেঝের এককোণে ঠেলে দিয়ে চাপাকণ্ঠে বললো সে, “চুপচাপ বসে থাকো। এই ঘর থেকে বের হবে না। আমি আসছি।”

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো সে। একটু আগে যে লোকটা নীচে চলে গেছে তার হাতে কোনো পিস্তল দেখে নি, তাহলে গুলি করলো কে?

জেফরির মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কয়েক পা সামনে এগোতেই দেখতে পেলো টর্চের আলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লো একটা সাধারণ কেবিনের গা ঘেষে। হাতের পিস্তলটা কক করে নিলো। কিন্তু ভালো করেই জানে একদল অস্ত্রধারীর সাথে কোনোভাবেই সে পেরে উঠবে। তার মনে হলো ব্যাকআপ ছাড়া এখানে চলে আসাটা বিরাট বোকামি হয়ে গেছে। জামানের কথা মনে পড়ে গেলো। ছেলেটা ব্যাকআপ নিয়ে আসতে বলেছিলো তাকে। আক্ষেপে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো এখন।

হঠাৎ রেলিংয়ের শেষ মাথায় কতোগুলো সবুজাভ অবয়ব দেখতে পেলো নাইটভিশন গগলসে।

তাদের সবার হাতেই অস্ত্র, তবে সামনের লোকটার হাতে টর্চও আছে।

সবাই নিজেদের পিস্তল তাক করে রেখেছে সামনের দিকে আই লেভেল বরাবর।

জেফরি তার পিস্তলটা তুলে গুলি চালাতে যাবে অমনি একটা কণ্ঠ বলে উঠলো : “স্যার?”

অধ্যায় ৮৯

“আমি জানি উমাকে তুই কোথায় আটকে রেখেছিস,” অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো বাবলু।

রঞ্জু চেয়ে রইলো তার দিকে, তবে কিছু বললো না। শুধু ঠোঁটের কোণে দেখা গেলো বাঁকা হাসি। কথাটা বিশ্বাস করছে না সে।

“বুড়িগঙ্গা নদীতে…”

রঞ্জু কিছুটা চমকে উঠলো কথাটা শুনে, তবে সঙ্গে সঙ্গে অভিব্যক্তি লুকিয়ে ফেললো।

“…একটা লঞ্চে।”

কথাটা বলেই স্থিরচোখে চেয়ে রইলো বাবলু। লঞ্চের কথা শুনে একটু চমকে গেলো বদশামটা। “মিনিস্টারের ছেলেকেও ওখানে রেখেছিস।”

মাথা দোলালো রঞ্জু। তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি, যেনো বাবলু প্রলাপ বকছে।

“মারা যাওয়ার আগে ঝন্টু আমাকে সব বলে গেছে…”

ব্ল্যাক রঞ্জুর ঠোঁটে এখনও হাসিটা লেগে রয়েছে।

“ভেবেছিস উমা আর তুর্যকে কেউ বাঁচাতে পারবে না?”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো রঞ্জু।

“ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ…” কথাটা বলে রঞ্জুর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য থামলো বাবলু।

ভুরু কুচকে গেলো পঙ্গু সন্ত্রাসীর। তার চোখেমুখে অবিশ্বাস।

“…সে তার দলবল নিয়ে এখন ঐ লঞ্চে আছে!”

“তুই ওকে বলেছিস?!” বিস্ময়ে জানতে চাইলো রঞ্জু।

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু।

“তোর মতো খুনির কথা ওই লোক বিশ্বাস করবে?”

আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

“অসম্ভব-”

রঞ্জুর কথাটা শেষ হবার আগেই ল্যাপটপটা বিপ্ করে উঠলো। সেদিকে তাকালো বাবলু। ইয়াহু মেসেঞ্জারটা অনলাইনে চলে এসেছে আবার। সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপের কাছে ছুটে গেলো সে।

ইয়াহু মেসেঞ্জারটায় নতুন একটা মেসেজ এসেছে। সেইসাথে চ্যাটবক্সের ওয়েবক্যাম ভিউয়িংয়ের ইনভাইটেশন। ওটা অ্যাকসেপ্ট করতেই ভেসে উঠলো জেফরি বেগের ছবিটা।

একটু দূরে মেঝেতে পড়ে থাকা রঞ্জু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখছে। অসম্ভব একটি দৃশ্য।

জেফরি বেগ ক্যামেরার দিকে ঝুঁকে আছে। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা, ইনভেস্টিগেটরের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে উমা। একেবারে অক্ষত।

বাবলুর সারা শরীরে এক ধরণের শিহরণ বয়ে গেলো। তার ইচ্ছে করলো চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করতে।

পিস্তলটা ল্যাপটপের পাশে রেখে সঙ্গে সঙ্গে চ্যাটবক্সে টাইপ করলো সে।

.

জেফরি বেগ উপুড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ল্যাপটপের সামনে, তার পাশে উমা। ঘরে আরো আছে জামান, তুর্য, অজ্ঞাত পরিচয়ের এক তরুণী আর নৌপুলিশের কিছু সদস্য।

অনেকক্ষণ পর জেফরির কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে জামান অস্থির হয়ে উঠেছিলো। হঠাৎ করেই নদীতে নৌপুলিশের টহল দেখে তার মাথায় একটা আইডিয়া চলে আসে। টহলরত নৌপুলিশকে ডেকে জানায় ভয়ঙ্কর এক খুনি আছে লঞ্চটাতে। এক্ষুণি ওটা ঘিরে ফেলতে হবে। মিনিস্টারের ছেলে তুর্যকে যে আটকে রাখা হয়েছে এ কথা বলে নি।

নৌপুলিশ লঞ্চে উঠতেই ভোটলালের সাথে গোলাগুলি হয়। অবশ্য ভোটলাল পিস্তল বের করলেও গুলি করতে পারে নি। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে সে।

একটু আগে জেনারেটরটা চালু করা হয়েছে, লঞ্চে এখন বাতি জ্বলছে।

জেফরি এখন যে রুমটায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা তিন নাম্বার কেবিন। এখানেই উমাকে আটকে রাখা হয়েছিলো। জামান চলে আসার পর এই কেবিন থেকে হাত-মুখ বাধা উমাকে উদ্ধার করে তারা।

থ্যাঙ্কস।

হাজার মাইল দূর থেকে বাবলুর লেখাটা চ্যাটবক্সে ভেসে উঠলো।

জেফরি বেগ দ্রুত টাইপ করলো :

সবাই ঠিক আছে। তুর্যকে উদ্ধার করা গেছে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উমা পদায় বাবলুকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললো।

পর্দায় দেখা গেলো বাবলুর মুখে হাসি। হাত তুলে উমাকে অভয় দিলো

জেফরি বেগের মুখেও হাসির আভাস ফুটে উঠলো। শেষ পর্যন্ত সবাই অক্ষত থাকাতে তার অন্য রকম এক অনুভূতি হচ্ছে। জীবনে এতোটা সফল আর আনন্দিত বোধ করে নি।

.

হাজার মাইল দূরে, দিল্লির মাদার তেরেসা স্ট্রিটের বিরাণ এক বাড়িতে বাবলুর মধ্যেও একই রকম অনুভূতি হচ্ছে। ল্যাপটপের পদায় যখন হাত-মুখ বাধা উমাকে দেখলো তখন তার ভেতরটা কেমন করে উঠেছিলো সে বোঝাতে পারবে না।

ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগের প্রতি কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই। এই লোকটাই তাকে আগেভাগে খবর দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তারপর ব্ল্যাক রঞ্জুর ডেরায় ঢুকে শুধু মিনিস্টারের অল্পবয়সী ছেলেটাকেই উদ্ধার করে নি, সেইসাথে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে উমাকে।

রঞ্জু কোথায়?

ল্যাপটপের পর্দায় জেফরি বেগের লেখাটা ভেসে উঠলে বাবলুর ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখা দিলো। সে জানে এই ইনভেস্টিগেটর এখন কি বলবে রঞ্জুকে যেনো খুন করা না হয়।

হাসিমুখে মাথা দোলালো সে। টাইপ করার আগে পেছন ফিরে তাকাতেই তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো।

ব্ল্যাক রঞ্জু নেই!

“বাস্টার্ড!” ফ্যাসফ্যাসে গলায় রঞ্জু বলে উঠলো তার খুব কাছ থেকে।

বাবলু ল্যাপটপের বাম পাশে তাকাতেই বুঝতে পারলো। পিস্তলটা ওখানে নেই। তার বাম পাশে, পায়ের কাছে ব্ল্যাক রঞ্জু বসে আছে। তার হাতে সাইলেন্সার পিস্তলটা। জঘন্য সন্ত্রসী সেটা তাক করে রেখেছে তার দিকে। মুখে ঝুলে রয়েছে কুৎসিত একটা হাসি।

ল্যাপটপে চ্যাট করার সময় বাবলু খেয়ালই করে নি তার অগোচরে পঙ্গু সন্ত্রাসী কখন হামাগুড়ি দিয়ে কাছে চলে এসেছে। হাতে তুলে নিয়েছে পিস্তলটা।

বাবলু বুঝতে পারলো মুহূর্তের অসতর্কতায় সব কিছু শেষ হতে চলেছে। নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেললো সে। রঞ্জুর চোখমুখ বলছে এক্ষুণি ট্রিগারে চাপ দিয়ে সব শেষ করে দেবে।

বিশ্রী একটা হাসি দিলো পঙ্গু লোকটি।

“গুডবাই বাস্টার্ড!” মৃত্যু থেকে এক মুহূর্ত দূরে দাঁড়িয়ে থেকে উমাকে দেখতে ইচ্ছে করলো তার। আস্তে করে ল্যাপটপের দিকে তাকালো। জেফরি বেগ আর উমা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।

তারপরই ক্লিক করে একটা শব্দ হলো শুধু।

.

জেফরি বেগ আর উমা কিছুই বুঝতে পারছে না। দিল্লিতে থাকা বাবলুর সাথে ভিডিও চ্যাট করছিলো তারা। একটু আগে দেখতে পেয়েছে হঠাৎ করে বাবলুর হাসিমুখের অভিব্যক্তিটা বদলে গেলো। একপাশে তাকিয়ে আছে সে। তার দৃষ্টিতে আতঙ্ক।

জেফরি বেগ দ্রুত টাইপ করলো : কি হয়েছে?

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বাবলু একপাশে তাকিয়ে আছে এখনও। জেফরি বেগের মনে হলো ছেলেটার দৃষ্টি মেঝের দিকে। কিন্তু তারা যে ভিডিওটা দেখছে সেটার ফ্রেমে বাবলু ছাড়া অন্য কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

কপালের বাম পাশটা চুলকালো জেফরি বেগ। দ্রুত ভেবে গেলো, ঘটনা কী।

তারপরই মনের ভেতর একটা আশংকা উঁকি দিলো। বাবলু এখন অস্ত্রের মুখে আছে। কেউ হয়তো তার দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে। কিন্তু কে?

সঙ্গে সঙ্গে যে জবাবটা তার মাথায় এলো সেটা রক্তহিম করা।

ব্ল্যাক রঞ্জু?!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *