অধ্যায় ৮০
অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে কিসিঞ্জার।
তিক্ততার সঙ্গেই বুঝতে পারছে, অন্য অনেক রাতের মতোই আজকের রাতটা ঘুমহীন যাবে। বিগত এক বছর ধরে ঘুম তার কাছে বিরল ব্যাপার হয়ে গেছে। স্লিপিং পিল নেবে কি না ভাবলো, যদিও ইচ্ছে করছে না। এতো ওষুধ আর নিতে পারে না। কী হবে এসব খেয়ে!
একটু আগে অমূল্যবাবুর একটা কথা তাকে চমকে দিয়েছিল।
তুমি অসুস্থ।
লোকটার অন্তদৃষ্টি আছে, অনেক কিছুই বুঝতে পারেন ভদ্রলোক, দেখতে পারেন তারচেয়েও বেশি। তবে সে নিশ্চিত না, বাবু আসলে কী বুঝিয়েছেন!
তাকে দেখে? নাকি তাকে বুঝে!
এরপর আর কথা বলেনি, চলে আসে বাবুর সামনে থেকে। তার সহচর আবু সালামকে বলে এসেছে, বাবুকে যেন বেডরুমে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঘুমানোর জন্য।
রাত পোশাকে আছে সে, চোখ বন্ধ করে রাখলো কিন্তু সমস্যা হলো, চোখ বন্ধ করে থাকলেই শত শত, হাজার হাজার দৃশ্য ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। কতো স্মৃতি, কতো কাহিনি, কতো ঘটনা! ওসবের ভিড়ে ঘুম আর আসে না। মাঝে মাঝে সে ভাবে, তার জীবনটা নিয়ে আস্ত একটা উপন্যাস লেখা যেতে পারে। ভালো কোনো লেখকের হাতে পড়লে দারুণ গল্পই হবে সেটা। কম তো আর উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে যায়নি! জিরো থেকে হিরো হয়েছে-আবার লুডু খেলার মতোই নেমে গেছে তলানীতে।
কী ঘটেনি তার জীবনে! একজন মানুষের জীবন এতো ঘটনাবহুল হয় কি না, সে জানে না।
স্কুল-কলেজ জীবনে মোটামুটি মানের ছাত্র ছিল, কিন্তু ক্লাসের ফার্স্টবয় সেকেন্ড বয় না হলেও সে জানতো, তার বুদ্ধিসুদ্ধি বাকিদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। স্কুল শিক্ষক সুনীল পোদ্দার একবার বলেছিলেন, তার দেহটা পনেরো বছরের হলেও মাথাটা পাক্কা ত্রিশ বছরের।
স্যার তাকে চিনতে পেরেছিলেন।
ঠাণ্ডা মাথা আর ক্ষুরধার মস্তিষ্কের কারণে ঠিক কখন থেকে যে তাকে কিসিঞ্জার বলে ডাকতে শুরু করে তার ক্লাসমেটরা, আজ আর মনে করতে পারে না। কেউ যদি মনে করে তার আনার নামটার সাথে মিল আছে বলেই এক কালের আলোচিত মার্কি কূটনীতিক কিসিঞ্জারের নামটা দেয়া হয়েছে, তাহলে ভুল করবে।
এই দেশ, সমাজ কিভাবে চলে সেটাও বুঝে গেছিল সেই অল্প বয়সেই। যেকোনো পরিস্থিতি আগেভাগে বুঝতে পারতো। চট করে অনেক জটিল ঘটনাও পরিস্কার দেখতে পেতো সে। বুঝতে পারতো কোন চালটা দিলে কী হতে পারে। তবে এক সময় এসে বুঝে যায়, কেবল বুদ্ধির উপরে ভর করে দুনিয়া চলে না। মস্তিষ্ক যেখানে কাজ শেষ করে সেখানেই ব্যবহার করতে হয় পেশীশক্তির।
ক্ষমতায় তখন সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ। পুরান ঢাকার কয়েকটি কলেজে তার পোষ্য একটি ছাত্র সংগঠনের দৌড়াত্ম ছিল। এ রকমই এক ছাত্রনেতা খায়রুল তার ছোটভাইকে কী এক কারণে বেদম মার মারে। তার বাপ মরে গেছে সেই ছোটবেলায়, অভাবের সংসারটা টিউশনি করে চালাতো, পনেরো বছর বয়স থেকে তাদের পরিবারের কর্তা হয়ে ওঠে সে, অভিভাবক-বড়ভাই হিসেবে খুবই ক্ষিপ্ত হয়, দেখা করে খায়রুলের সঙ্গে।
“আমার ভাই যদি কোনো বেয়াদপি কইরা থাকে, আমারে বলতা, আমি ওর বড়ভাই, বিচার করতাম…মারলা ক্যান?”
নেশায় ঢুলু ঢুলু চোখে রেগেমেগে তাকিয়েছিল খায়রুল। “মারছি তো কী হইসে! কি করবেন আপনে আমার?”
“তুমি আমারে চেনো না? জানো না আমি কে? তারপরও আমার ভাইয়ের গায়ে হাত তুলো?”
“তুই আমার বাল!” চোখমুখ খিচে বলেছিল খায়রুল। তারপর তাকে হতবাক করে দিয়ে কলার ধরে বসে। “মাস্তানি চোদাইতে আইসোস আমার লগে, চুতমারানির পোলা!”
ঠাণ্ডা মাথার মানুষ হলেও তখন আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি, খায়রুলকে একটা চড় মেরে বসে। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় খুন চেপে যায় ঐ ছাত্রনেতার, তাকে পাল্টা চর-থাপ্পড় মারে। হতভম্ব হয়ে যায় সে। চরম অপমানে, রাগেক্ষোভে চলে আসে নিজের বাড়িতে। সারা রাত আর দুচোখে ঘুম আসেনি।
সেই রাতেই পণ করে বসে, খায়রুলকে কঠিন শিক্ষা দিতে হবে, যেন কেউ তার গায়ে হাত তোলার কথা স্বপ্নেও না ভাবে। তবে প্রাচীন স্প্যানিশ প্রবাদের মতো সে-ও অপেক্ষা করে প্রতিশোধ যতো দেরিতে নেয়া যায়, ততই সুস্বাদু হয়-নিজের কাছে করা এই পণটার কথা কাউকে আর বলেনি।
তাদের এলাকায় কিরণ নামের এক বড়ভাই ছিল, লোকটা এক মন্ত্রীর এপিএস হবার পরই রাতারাতি যেমন ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, তেমনি অর্থবিত্তের মালিক বনে যায়। কিরণ যেন তার জীবনের আশার আলো হয়ে দেখা দেয়। বয়সে তার চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড়, ডিগ্রি পাস করেই এপিএস বনে গেছে। তাহলে সে কেন ডিগ্রি পাস করে চাকরির দরখাস্ত বিলি করে যাচ্ছে?
কিরণ ভাইয়ের পেছনে ঘুরে মাত্র এক বছরের মাথায় অমূলবাবুর সুপারিশে মন্ত্রী কায়সার আহমেদের এপিএস-এর চাকরি পেয়ে যায়। সম্ভবত সহানুভূতি পাবার জন্য বাবুকে তার অভাবী সংসারের কথা বলেছিলেন কিরণ ভাই। তো চাকরি পাবার পর পরই সে উঠেপড়ে লাগেনি প্রতিশোধ নেবার জন্য। সবার আগে নিজের চাকরিটা সুসংহত করে নেয়। ভালো করেই জানতো, পায়ের নিচে শক্ত মাটি থাকলে দৌড়ানোও যাবে, লাফানোও যাবে।
মানুষ ক্ষমতাবানদের তোষামোদী করে, বিপদ-আপদে তাদের দ্বারস্থ হয়। তার কাছেও অনেকে আসততা। এরকমই একদিন এক ছেলে আসে দেখা করতে। ছেলেটাকে সে চিনতো আগে থেকেই-মধুমিতা সিনেমা হলে টিকেট ব্ল্যাক করতো। একই এলাকায় থাকতো বলে মুখচেনা ছিল, বন্ধু বান্ধব নিয়ে সিনেমা দেখতে গেলে তার কাছে বাড়তি টাকা নিতো না। এ একটা কারণে ছেলেটার প্রতি প্রসন্ন ছিল সে। তো ছেলেটা এসে জানায়, চাঁদাবাজির মামলায় সূত্রাপুর থানার পুলিশ তাকে খুব দিকদারি করছে, সে যদি পুলিশকে বলে দেয় তাহলে হয়তো নিস্তার পাবে। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, এখন সে টিকেট ব্ল্যাক করে না, গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনের আশেপাশে ছিঁচকে মাস্তানি করে বেড়ায়। কিসিঞ্জার তাকে আশ্বস্ত করে সাহায্য করার জন্য।
লোকাল থানার পুলিশ আর ছেলেটাকে দিকদারি করেনি।
“ভাই আপনের জন্য কিছু করতে পারলে কইয়েন আমারে,” কৃতজ্ঞ ছেলেটি বলেছিল।
তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল কিসিঞ্জার। কৃতজ্ঞতা খুব ভালো জিনিস কিন্তু সেটা বুদ্বুদের মতোই ক্ষণস্থায়ী, বেশিক্ষণ টিকে থাকে না। তাই স্প্যানিশ প্রবাদ নয়, বাংলা প্রবাদ অনুসরণ করে এবার : লোহা গরম থাকতেই আঘাত করে সে।
খায়রুলের কথা শোনার পর ছেলেটি তাকে বলেছিল, ধরে এনে মার টার দিলে আরেক বিপদ, ঐ ছাত্রনেতা আবারো বেয়াদপি করবে তার সঙ্গে। অপমান করবে। হয়তো আরো খারাপ কিছুও করতে পারে।
কিসিঞ্জার সায় না দিয়ে পারেনি। “তাহলে সাপ মারতে হবে…লাঠি ভাঙা যাবে না, আওয়াজও হবে না!”
তার ইশারাটা ধরতে পেরেছিল ছেলেটি। এরপরই সেই ছেলেটি তার এক চ্যালাকে লাগিয়ে দেয় খায়রুলের পেছনে, সপ্তাহখানেক পর এক রাতে নেশা করে বাড়ি ফেরার সময় খায়রুলকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনের পাশে এক আস্তানায়। জায়গাটা তখন বেশ নিরিবিলি ছিল। রাত এগারোটার পর সেখানে গিয়ে কিসিঞ্জার দেখে, খায়রুলকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। নেশাগ্রস্ত খায়রুলকে সেই ছেলে আর তার এক চ্যালা মিলে বেদম মার মারতে শুরু করে। আয়েশ করে সিগারেট খেতে খেতে সেটা দেখতে থাকে কিসিঞ্জার।
“খানকির পোলা, তোরে আমি কী করুম তুই জানোস না!” মার খেয়ে তাকে দেখে নেবার হুমকি দিয়েছিল খায়রুল।
মিটিমিটি হেসে শান্তকণ্ঠে বলেছিল সে, “মরা মানুষ কিছু করতে পারে না।”
এ কথা শুনে ভড়কে যায় খায়রুল। ঘরের মানুষগুলোর দিকে উদভ্রান্তের মতো তাকায়, তারপরই গগনবিদারী চিৎকার দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু ক্ষিপ্রতার সঙ্গেই ব্ল্যাকার ছেলেটি তার পেছন থেকে ডানহাতের বাহু দিয়ে গলা পেচিয়ে ধরে, বাঁ-হাতে চেপে ধরে মুখটা। মুক্ত হাতদুটো দিয়ে খামচে ধরার চেষ্টা করেছিল ঐ ছাত্রনেতা। ছেলেটা তখন তার চ্যালাকে বলে, হাত দুটো যেন মুচড়ে দিয়ে কাঁধের জয়েন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এভাবে দুটোহাত নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়।
“খানকির পোলা, মরণের সময় এতো দিকদারি করোস ক্যান!” বলেছিল ছেলেটি। “পুরা কই মাছের মতোন…কাইট্টা ফালানের পরও লাফায়!”
তীব্র যন্ত্রণায় চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে যায় খায়রুলের। সাবেক টিকেট ব্ল্যাকার তার গলা আর মুখটা শক্ত করে ধরে রাখে।
কিসিঞ্জার চেয়ার টেনে খায়রুলের দিকে একটু ঝুঁকে খুবই শান্ত কণ্ঠে তখন বলেছিল : “আমার ভাইটারে মারলি, আমার গায়ে হাত তুললি, আমার মায়েরেও গালি দিলি! তোরে আমি বাঁচায়া রাখি ক্যামনে!”
খায়রুল বিস্ফারিত চোখে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। তার সমস্ত চিৎকার ভোঁতা গোঙানি হয়ে ঘুরে বেড়ায় বদ্ধ ঘরের ভেতরে।
উঠে দাঁড়িয়েছিল কিসিঞ্জার, সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল, “ওর লাশটা ভ্যানিশ কইরা দিতে হইবো।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল ছেলেটি।
“লাশ পাওয়া না গেলে মিসিং কেস হইবো। এই দেশে মিসিং কেস কোনো কেই না।”
খায়রুল তখনও মরেনি, এ কথা শুনে চোখেমুখে সুতীব্র মৃত্যুআতঙ্ক জেঁকে বসেছিল তার। ওর গলা পেঁচিয়ে ধরেই বলেছিল ছেলেটি, “এই হালার লাশ মেনহোলের ভেতরে ফালায়া দিমু, ভাই।”
প্রসংশার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কিসিঞ্জার।
“তার বাদে দুই মণ চুন দিয়া দিলেই…” দম নিয়ে আরো জোরে চেপে ধরে খায়রুলের গলাটা। অ্যাাঁক করে ওঠে মৃত্যুপথযাত্রি। “…কয়েক দিনের মইদ্যে হাড়ি-মাংস পানি হইয়া যাইবো।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল কিসিঞ্জার। আইডিয়াটা পছন্দ হয়েছিল তার।
এরপর প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়া খায়রুলের মাথার তালুর চুলগুলো এক হাতের মুঠোয় নিয়ে, অন্য হাত দিয়ে চোয়ালটা ধরে জোরে একটা মোচড় দেয় ছেলেটি, কটমট করে ঘাড় মটকে যাবার শব্দ হয় তখন। পুরোপুরি নিথর হয়ে পড়ে খায়রুল, তার দেহটা থপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
বাকি কাজটাও দারুণভাবেই করতে পেরেছিল ছেলেটি।
পরদিন খায়রুলকে এলাকায় দেখতে না পেয়ে লোকজন স্বস্তিই পেয়েছিল। তার সাঙ্গপাঙ্গরাও এ নিয়ে খুব বেশি হাউকাউও করেনি।
কিসিঞ্জারের চাকরির বয়স দেড় বছর পেরোনের আগেই কায়সার আহমেদের সরকার নব্বইর ছাত্র-গণ আন্দোলনের মুখে পড়ে যায়। এরশাদশাহী এই আন্দোলন দমনের জন্য আন্দোলনরত নেতাদের অনেককে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করে, ভয়ভীতিও দেখায় কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। আন্দোলনটা মূলতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক ছিল, ছাত্ররাই ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। সেই ছাত্রদেরকে দমন করার জন্য পথ খুঁজছিল সরকার। এমন সময় কিসিঞ্জার তার মন্ত্রীর মাধ্যমে মোক্ষম একটি বুদ্ধি দেয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দখলে নিতে পারলে আন্দোলন দমানো যাবে সহজেই। আর কাজটা করতে পারবে ওখানকার কিছু জাঁদরেল ছাত্রনেতা, যারা আন্দোলন শুরুর অনেক আগে থেকেই জেলে বন্দি হয়ে আছে।
কায়সার আহমেদ সরকারের উচ্চ পর্যায়কে এটা জানায়। বলতে গেলে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচার এরশাদ আর তার ডানে-বাঁয়ের লোকজন বুদ্ধিটা লুফে নেয়। অচিরেই জেলে থাকা ছাত্র নেতাদেরকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলা হয়। ঐসব নেতারা দীর্ঘদিন ধরে জেলে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিল ততদিনে।
এক সকালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুক্তি পেয়ে যায় পাঁচ-ছয়জন জাঁদরেল ছাত্রনেতা। তাদেরকে সরকার টাকা-পয়সা আর অস্ত্র দিয়ে সব ধরণের সহায়তায় দেয়। তবে সেইসব অস্ত্র চালানোর মতো অতো লোকবল তাদের ছিল না। কিসিঞ্জার তখন সাবেক টিকেট ব্ল্যাকারকে আবারো ডেকে আনে সে, তার অধীনে থাকা তিন-চারজনের একটি দলকে ভিড়িয়ে দেয় ঐ সব ছাত্রনেতাদের সঙ্গে।
কিসিঞ্জার তাকে বলেছিল, আজ থেকে তার নাম ব্ল্যাকার রঞ্জু না-ব্ল্যাক রঞ্জু। এই নামেই পরিচয় দেবে সবার কাছে, নইলে জাঁদরেল সব ছাত্রনেতা আর ক্যাডারদের চোখে সমীহ আদায় করা যাবে না। তাকে রাস্তার ছিঁচকে সন্ত্রাসি ছাড়া কিছুই ভাববে না। ব্ল্যাক’ শব্দটা যেমন স্মার্ট তেমনি ভীতিকর। এটা তার গায়ের রঙের সাথেও মিলে যায়।
এছাড়াও আরেকটা কাজও করতে বলে তাকে : শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে এখন থেকে। তাহলে ঐসব ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে অপরাধ জগতের মানুষও তাকে আলাদা চোখে দেখবে।
শুরু হয় ব্ল্যাক রঞ্জুর পথ চলা।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়া ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়ে ওঠে রঞ্জু। কিন্তু শুরু থেকেই আন্দোলনরত ছাত্রনেতারা সন্দেহ পোষণ করতে থাকে। সরকার যেখানে আন্দোলন দমন করার জন্য তাদেরকে গ্রেফতার করতে মরিয়া সেখানে সিনিয়র নেতাদেরকে ঠিক কি কারণে মুক্তি দেয়া হলো–এ প্রশ্নের সহজ-সরল জবাব তাদের কাছে ছিল : আন্দোলন নস্যাৎ করার পায়তারা এটি। ফলে জেল থেকে বের হওয়া নেতাদের সঙ্গে দ্রুতই বিরোধ বেঁধে যায় তাদের সঙ্গে। সরকার এবং পুলিশের সহায়তায় তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দখল করে ফেলে অনায়াসে।
তবে আন্দোলরত ছাত্ররা হাল ছেড়ে দেয়নি, দ্রুতই সুসংগঠিত হয়ে, জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্যাম্পাস পুণরুদ্ধারে নামে তারা। তিন-চারদিনের বন্দুকযুদ্ধের এক পর্যায়ে রিক্সায় করে যাবার সময় নিহত হোন ডাক্তার মিলন নামের এক পেশাজীবি নেতা। গুজব রটে যায়, সরকার সমর্থিত গুণ্ডাদের গুলিতেই নিহত হয়েছেন তিনি। এই ঘটনার পর আন্দোলন বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। গণঅভূত্থানের পক্ষে থাকা ছাত্র-জনতা ক্যাম্পাস আবার দখলে নিয়ে নেয়। সরকার এমন বেকায়দায় পড়ে যে, এই ঘটনার পর মাত্র এক কি দু সপ্তাহ টিকতে পেরেছিল। অবশ্য তার মন্ত্রী কায়সার আহমেদ আগেই দেশ ত্যাগ করেছিলেন। ক্যাম্পাসের গোলাগুলির সময় রঞ্জু সামান্য আহত হয়েছিল, তাকেও ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার পরামর্শ দিয়েছিল কিসিঞ্জার।
কিন্তু সে নিজে গা ঢাকা দেয়নি, দিব্যি নিজের বাড়িতে কাটিয়ে দেয় ঐ সময়টা। গোপনে আন্দোলনের পক্ষের লোকজনের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছিল সে। কারণ গণঅভূত্থানের এক সপ্তাহ আগে কায়সার আহমেদ তাকে নিয়ে অমূল্যবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। বাবুর কাছে মন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, তার সরকার টিকে থাকতে পারবে কি না। গম্ভীর কণ্ঠে বাবু বলেছিল, “ডুবন্ত জাহাজ থেকে সবার আগে ইঁদুর লাফিয়ে পড়ে।”
এরপরই তার মন্ত্রী বিদেশে চলে যায় আর সে বিরোধীপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করে দেয়। সরকারের পতন ঘটলেও তিন-চার মাস বেকার থাকা ছাড়া তার কিছু হয়নি।
কয়েক মাস পর যে নির্বাচন হয়েছিল, তার আগে দিয়ে সে বুঝতে পারছিল না, কে ক্ষমতায় আসবে। সেটাও বাবুর সঙ্গে দেখা করে আগেভাগে জেনে নিয়েছিল। তখন থেকেই গোপনে যোগাযোগ রাখতে শুরু করে দিয়েছিল ঐ দলটির সঙ্গে। বাবুর কথা-ই ফলেছিল, নির্বাচনে ওই দলটি জিতে সরকার গঠন করে ফেলে। সেই সরকারের এক মন্ত্রী পিএস হিসেবে
বেছে নেয় তাকে।
তার ঐ গণতান্ত্রিক মন্ত্রীর সঙ্গে নিজ দলের বেশ কিছু মন্ত্রী-নেতার রেষারেষি ছিল। তাদেরই একজনের ছত্রছায়ায় পাঁচজন শীর্ষ সন্ত্রাসি মিলে তৈরি করেছিল ফাইভস্টার গ্রুপ নামের একটি সন্ত্রাসি চক্র। তখন সে নিজের মন্ত্রীকে পরামর্শ দেয়, তারও এ রকম একটি গ্রুপ থাকতে হবে। বুদ্ধিটা লুফে নেয় মন্ত্রী। ব্ল্যাক রঞ্জুকে দিয়ে সে গড়ে তোলে ভয়ঙ্কর একটি সন্ত্রাসি চক্র। কিছুদিনের মধ্যেই তার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ব্ল্যাক রঞ্জু হয়ে ওঠে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক নাম্বার ডন-তার গোপন মারণাস্ত্র-যে অস্ত্র ব্যবহার করে খুব দ্রুত অঢেল টাকা-পয়সা আর জমি-জিরাতের মালিক বনে যায়।
পাঁচ বছর পর সরকার বদলে গেলেও নতুন সরকারের আরেক মন্ত্রী তাকে পিএস হিসেবে নিয়োগ দেয়। ততদিনে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিল। এভাবে পর পর তিনটি ভিন্ন সরকারের মন্ত্রীর পিএস হবার অভূতপূর্ব নজীর সৃষ্টি করেছিল-যা আজো অক্ষুণ্ণ আছে।
তার মাথাটা সাদা-কালো দাবার বোর্ডের মতোই আশেপাশের চরিত্র আর ঘটনাগুলোকে ঘুটি বানিয়ে খেলতে পারে। কোন চালে কে কি করবে, কোন পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, বুঝতে পারে।
তারপরও জীবনের বড় বড় বিপর্যয় থেকে একটা সত্যি শিখেছে : বুদ্ধির খেলাই সব নয়। এই জগত অনেক বেশি জটিল, অনেক বেশি অনিশ্চিত। কারণ, বেশিরভাগ মানুষ যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে পরিচালিত হয় না। কে কখন যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, আবেগের তাড়নায় নেবে কিংবা ভুল করে বসবে-জানার উপায় থাকে না। তার উপরে আছে অসংখ্য কাকতাল আর ঘটনাচক্র। তাই দুনিয়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটিও তার চারপাশের খুব কম জিনিসই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যতো নির্ভুল হিসেবই করা হোক না কেন, তাতে ভুল থাকেই।
তার হিসেবেও কিছু ভুল ছিল। অল্প কিছু ভুলের জন্য নিজেকে দায়ি করে, কিন্তু বেশিরভাগ ভুলের জন্য দায়ি কাছের মানুষজনের বোকামী আর বিশ্বাসঘাতকতা। বোকামীকে মাফ করে দেয়া যায় কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা ক্ষমার অযোগ্য।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। এখনও যখন মনে পড়ে, বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এ জীবনে যতো টাকা কামিয়েছিল, তার বিরাট একটি অংশ কানাডার মন্ট্রিলে স্ত্রীর নামে বাড়ি আর সুপার মলে দোকান কেনায় ব্যয় করেছিল। আর কেউ না জানুক, সে জানে, কানাডার মন্ট্রিলে যে ‘বেগম পাড়া’ নিয়ে মানুষ এখন কথা বলে, তার সূচনা করেছিল সে। পরে তার দেখাদেখি ওখানে বাড়ি-গাড়ি কিনতে শুরু করে আমলা ব্যবসায়ি-রাজনীতিকেরা।
মি. টেন পার্সেন্ট গ্রেফতার হলে সে আর ঝুঁকি নেয়নি, দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে যায়, তারপরই দেশে তার সব সহায়-সম্পত্তি বিশ্বস্ত পার্টনার আর প্রতিপক্ষরা গ্রাস করে ফেলে। কিন্তু কানাডায় গিয়ে বুঝতে পারে, সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকটি এখানে থাকে!
সে যেহেতু কানাডার সিটিজেন ছিল না, তাই সবটাই কিনেছিল স্ত্রীর নামে, সেই স্ত্রী এ দেশ থেকে মাইগ্রেট করা এক ছোকরা গায়কের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। তার অনুপস্থিতিতে, তারই কেনা বাড়িতে তাকে নিয়ে থাকতো!
এতোটা নেকমহারামী সহ্য করতে পারেনি। এ নিয়ে বচসা হলে তার চতুর স্ত্রী কানাডার আইনের সুযোগ নেয়, তাকে অপদস্ত করার জন্য নিজের হাত কেটে ট্রিপল নাইনে ফোন করে তার বিরুদ্ধে ডামেস্টিক ভায়োলেন্সের অভিযোগ আনে। গ্রেফতার হয়ে তিন মাস জেল খাটতে হয়েছিল তাকে, পরে আইনজীবির পরামর্শে আদালতের বাইরে স্ত্রীর সঙ্গে আপস রফা করতে বাধ্য হয়, ডিভোর্স দিতে হয় স্ত্রীকে। কানাডায় থাকা সমস্ত সম্পত্তি বেহাত হয়ে যায় চিরকালের জন্য।
জেল থেকে বের হয়ে তীব্র অপমানবোধে আক্রান্ত হয়েছিল সে, কানাডায় আর থাকতে চায়নি কিন্তু দেশে ফেরাও সম্ভব ছিল না, ফিরে গেলেই অসংখ্য মামলায় জেলে যেতে হতো। তবে সত্যিকারের ভয়টা ছিল, বেঈমানদের নিয়ে-ওরা তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতো না।
রঞ্জুর সঙ্গে তার সব সময়ই যোগাযোগ ছিল। সে-ও তখন দেশ ছেড়ে আস্তানা গেড়েছে কলকাতায়। স্ত্রীর কাছে বেঈমানির শিকার হবার কথা শুনে রঞ্জু তাকে কলকাতায় চলে আসতে বলে। উপায়ন্ত না দেখে সেটাই করে সে। কলকাতায় গিয়ে বেশ ভালোই ছিল। রঞ্জু অসম্ভব শ্রদ্ধা করতো তাকে। একমাত্র সে-ই তার সঙ্গে কখনও বেঈমানি করেনি, সব সময় কৃতজ্ঞ ছিল।
এক পর্যায়ে রঞ্জু তাকে দিল্লিতে যেতে বলে, ওখানে এক লোকের মাধ্যমে ব্যবসা করতে শুরু করেছিল সে। তার কাছেও মনে হয়েছিল, কলকাতার চেয়ে দিল্লি বেশি ভালো হবে। কলকাতার পথেঘাটে প্রায়শই দেশের মানুষজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতো। বিশেষ করে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত যারা তাদের সঙ্গে দেখা হলে কেউ কেউ এমন ভাব করতো, যেন রাজা থেকে ফকির হয়ে গেছে সে। তাই এসব থেকে দূরে থাকার জন্যই দিল্লিতে চলে যায়, ওখানকার ব্যবসার দেখভাল করতে শুরু করে।
দিল্লিতে ভালোই ছিল সে-ক্ষমতার কেন্দ্রের বাইরে থাকা একটি জীবন। প্রতি মাসে কয়েকবার দিল্লি-কলকাতা করতো। ইন্ডিয়া বিরাট দেশ, সময় পেলেই ঘুরে বেড়াতো এখানে ওখানে। কিন্তু পানি ছাড়া মাছ যেমন থাকতে পারে না, তেমনি দীর্ঘ সময় ক্ষমতার মধ্যে বাস করার পর সে-ও রাজনীতি আর ক্ষমতাহীন থেকে হাঁপিয়ে ওঠে এক সময়। জীবনটা কেমন অর্থহীন আর অপাংক্তেয় বলে মনে হতে থাকে। ফিরে যেতে চাইতো সেই যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। খুব করে চাইতো পরাজয়ের শোধ নিতে।
একদিন ঘটনাচক্রে কলকাতায় দেখা হয়ে যায় মিস্টার টেন পার্সেন্টের ঘনিষ্ঠ এক লোকের সঙ্গে। অনেকগুলো দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলায় লোকটা তখন জেলে। ওদিকে তার স্ত্রী, সাবেক প্রাইমিনিস্টার দুর্নীতিবাজ স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারটা আবার পরিশুদ্ধ করতে চাইছে। ডিভোর্স হয়ে গেলে লোকটা ভয়ানক বিপদে পড়ে যাবে, তাই মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এ ব্যাপারে তার কাছে পরামর্শ চাইলে সে জানায়, এই সঙ্কটের উপায় জানা আছে তার, তবে কথাটা খোদ টেন পার্সেন্টকেই বলবে, অন্য কাউকে না। ভালো করেই জানতো, আইডিয়া এমনই এক জিনিস, জানিয়ে দিলে বেহাত হয়ে যায়।
এ কথা শুনে টেন পার্সেন্টের ঘনিষ্ঠ লোকটি ঢাকায় ফিরে গিয়ে বন্দিকে তার আইনজীবির মাধ্যমে জানায় কথাটা। এরপরই লোকটার আইনজীবি তার মক্কেলকে অসুস্থ দেখিয়ে হাসপাতালের প্রিজন সেলে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করে। সেখানে এক ডাক্তারকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে সরাসরি রঞ্জুর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়া হয়।
দুটো কারণে সরাসরি সে ডিলটা করেনিঃ প্রথমত, সতর্কতা। যদিও সে নিশ্চিত ছিল, পরিকল্পনাটি কাজ করবে দারুণভাবেই, তারপরও, পাছে যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। দ্বিতীয়ত, ব্ল্যাক রঞ্জুর মতো সন্ত্রাসির সঙ্গে সরাসরি ডিল করার একটাই অর্থ, পরবর্তিকালে ক্ষমতায় গেলে, চাইলেও যেন ওয়াদার বরখেলাপ করতে দশবার ভাবে টেন পার্সেন্ট। তাছাড়া, রঞ্জুর মাধ্যমে ডিল করার আরেকটি বাড়তি সুবিধাও ছিল : সুসম্পর্কের কারণে টেন পার্সেন্টের সঙ্গে খুব বেশি দরকষাকষি করতে পারতো না সে।
জেলে থেকে ততদিনে মরিয়া হয়ে উঠেছিল টেন পার্সেন্ট। সম্ভবত আরো বেশি কিছু চাইলেও রাজি হয়ে যেতো। রঞ্জু চেয়েছিল, কাজটা সফল হলে সে-সহ তার দলের সবাইকে মামলা থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার পাশাপাশি ঢাকায় তাকে সব ধরণের প্রটেকশান দিতে হবে।
এরপরই শুরু হয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। নির্বাচনের আগে দিয়ে বিরোধী দলের নেত্রীকে হত্যা করা হলে জনগণ ধরে নেবে, হেরে যাবার ভয় থেকেই বিরোধীদলের নেত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। ফলে জনগণের আবেগকে পুঁজি করে নির্বাচনে জিতে যাবে বিরোধীদল, সেই দলের ভেতরে টেন পার্সেন্টের লোকজন তখন সক্রিয় হয়ে উঠবে, জেল থেকে বের করে নিয়ে আসবে তাকে। পরিবারতন্ত্রের দেশে স্ত্রীর স্থলাভিষিক্ত হবে স্বামী-টেন পার্সেন্ট কেবল দুর্নীতির মামলা থেকেই রেহাই পাবে না, বনে যাবে প্রধানমন্ত্রী!
হিসেবটা ছিল সহজ, পরিকল্পনাটি ছিল অব্যর্থ। রঞ্জুর জন্য কাজটা তেমন কঠিনও ছিল না। অভিজ্ঞ কিলার দিয়ে সঠিক সময়েই আঘাত হানতে পারতো।
কিন্তু সব কিছু নস্যাৎ করে দেয় বাস্টার্ড।
আর আজ এতো বছর পর সে জানতে পারছে, এসবের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে তার পরমপূজনীয় অমূল্যবাবু!
হোমমিনিস্টারের ছেলেকে কিডন্যাপ করে জেল থেকে রঞ্জুকে মুক্ত করার বুদ্ধিটাও আদতে তার-ই ছিল। এখন বুঝতে পারছে, বাস্টার্ডকে মুক্ত করার পেছনেও ছিল বাবু।
মুক্তি পেয়ে রঞ্জু যখন জানতে পারলো বাস্টার্ড আছে দিল্লিতে, তার মাথায় খুন চেপে গেল। ভেবেছিল, দিল্লিতে তার লোকজন আছে, খুব সহজেই ওখানে বাস্টার্ডকে কাবু করতে পারবে।
সেটা অবশ্য হয়নি।
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। তখন যদি দিল্লিতে থাকতো, হয়তো সব কিছু অন্য রকম হতো। কিন্তু ঐ সময়ে আগরতলা দিয়ে সঙ্গোপনে ঢাকায় চলে এসেছিল মৃত্যুশয্যায় থাকা মাকে শেষবার দেখার জন্য। বেশ সতর্ক থাকতে হয়েছিল তখন।
ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলে স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে এলো কিসিঞ্জার। চোখ মেলে তাকালো সে। বালিশের পাশে ফোনটার ডিসপ্লে দেখে অবাক হলো খুব। বিছানায় উঠে বসলো আবার।
কিসমত??
এতো রাতে তাকে ফোন দিচ্ছে! তা-ও সরাসরি! অশনি সংকেত বেজে উঠল তার মনে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আর্তনাদ করে উঠল কিসমত : “ভাইজান, ঐ লোকটারে ছেড়ে দেন! নইলে আমাদের মেরে ফেলবো!”
“কে মারবে?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।
কয়েক মুহূর্ত ওপাশ থেকে কোনো কথা ভেসে এলো না, তারপরই শান্ত একটা কণ্ঠ বলে উঠল : “অমূল্যবাবুকে ছেড়ে দিতে হবে…এক্ষুণি!”
অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে গেল কিসিঞ্জারের। বাস্টার্ড?!
অধ্যায় ৮১
ফোনটা কানে চেপে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে বাস্টার্ড, পিস্তলটা তা করে রেখেছে সামনের দিকে। তীব্র আতঙ্কে সোফায় বসে আছে কিসমত আরা।
যে কণ্ঠটা কথা বলছে, সে রঞ্জু না!
অন্য একটা কণ্ঠ!
অন্য একজন!
“আহ, বাস্টার্ড!”
ভুরু কুঁচকে গেল তার। “আপনি কে?” অবিশ্বাসের সাথেই জানতে চাইলো সে।
মনে হলো ফোনের ওপাশের জনও একটু অবাক হয়েছে। “আমি কে?!”
কিসমত আরার দিকে তাকালো বাস্টার্ড। হাত নেড়ে ইশারায় জানতে চাইলো-কে এই লোক।
ঢোক গিলল কিসমত আরা। “ক্-কিসিঞ্জার…ভাইজান।”
ভীষণ অবাক হলো বাস্টার্ড। কয়েক মুহূর্ত কিছুই বুঝতে পারলো না। ভেবেছিল, ভাইজান বলতে কিসমত আরা তার ভাই রঞ্জুকেই বুঝিয়েছে। একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেল। অমূল্যবাবুকে কিসিঞ্জার নামের একজন ধরে নিয়ে গেছে! তাহলে তার ধারনাই ঠিক, রঞ্জু নেই! ওর দলটা চালায় অন্য কেউ। এই লোকটা!
ওপাশে যে আছে তার মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেল এবার। “আমার ব্যাপারে জানতে চাইছে…আমি কে?”
বাস্টার্ড বুঝে গেল এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। সময় নষ্ট না করে বলল, “আপনি যে-ই হোন না কেন, অমূল্যবাবুকে ছেড়ে দিতে হবে…এক্ষুণি।”
“আচ্ছা,” ফোনের ওপাশ থেকে একদম নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বলল কিসিঞ্জার।
লোকটার কণ্ঠ অস্বাভাবিক রকমেরই স্বাভাবিক। “নইলে-”
“নইলে কী করবে?” তার কথা শেষ হবার আগেই বলল ফোনের ওপাশ থেকে। মনে হলো এখনও হাসছে লোকটা।
ভুরু কুঁচকে গেল বাস্টার্ডের। লোকটার অস্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠ তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
“তুমি মনে করছে, ওখানে যেয়ে ওদের জিম্মি করে পাশার দান উল্টে দিতে পারবে?” একটু থেমে আবার বলল, “উঁহু…হিসেবে ভুল করে ফেলেছো তুমি।”
গভীর করে দম নিয়ে নিলো বাস্টার্ড। কিসমত আরার দিকে তাকালো সে, ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।
“ধরো, আমার কাছে তোমার পাঁচশ টাকা আছে, আর আমার দুশ টাকা আছে তোমার কাছে। তুমি যদি বলো, তোমার পাঁচশ টাকা ফেরত না দিলে আমার দু’শ টাকা ফেরত দেবে না, সেটা কি ঠিক হবে?” আবারো মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এলো ফোনের ওপাশ থেকে। “বাবুকে কিভাবে ছেড়ে দেবো, সেটা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি।”
“আপনি কী বলতে চাইছেন?”
“আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।”
ভুরু কুঁচকে গেল বাস্টার্ডের। “কি কাজ?”
“যে কাজ তুমি টাকার বিনিময়ে করো!”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার।
“আমার ধারনা কাজটা তুমি করবে…বাবুর জন্যই করবে।” একটু থেমে আবার বলল, “তার জন্য তুমি রঞ্জুকে খুঁজতে ওখানে চলে গেছো, একটু থেমে আবার বলল, “আর এটা তো সে তুলনায় মামুলী কাজ।”
বাস্টার্ড কী বলবে ভেবে পেলো না।
“আমি সব ইনফো পাঠিয়ে দিচ্ছি।” একটু থেমে আবার বলল, “আছো?”
“হুম।”
“আরেকটা কথা তোমার জেনে রাখা দরকার, ধীরস্থির কণ্ঠেই বলল ফোনের ওপাশ থেকে। “আমি কোথায় থাকি, বাবু এখন কোথায় আছে…ওরা জানে না। ওদেরকে মেরে ফেললেও আমার খোঁজ দিতে পারবে না।”
গভীর করে শাস নিয়ে নিলো বাস্টার্ড। চিন্তাভাবনাগুলো গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলো। আমি বাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
“আহ্,” যেন তৃপ্ত হলো রঞ্জুদের ভাইজান। “অপেক্ষা করো।”
কলটা কেটে দেয়া হলো ওপাশ থেকে।
তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, এখানে এসে রঞ্জুর বোনকে জিম্মি করে উল্টো ফাঁদে পড়ে গেছে। সে যে অমূল্যবাবুর জন্য অনেক কিছু করতে পারে, এটা বুঝে গেছে ঐ লোক। কিন্তু এই ফাঁদ থেকে বের হবে কী করে, বুঝতে পারছে না।
এখন তার সামনে দুটো পথ খোলা আছে-অমূল্যবাবুকে জীবিত ফিরে পাবার আশা করলে লোকটার প্রস্তাবে রাজি হতে হবে, নয়তো এখান থেকে দ্রুত সটকে পড়তে হবে তাকে। যেকোনো সময় রঞ্জু গ্রুপের লোকজন চলে আসতে পারে। ঐ ধূর্ত লোকটা ফোন না দিয়ে একদল সন্ত্রাসি পাঠিয়ে দিতে পারে এখানে!
প্রচণ্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। যা-ই করুক, দ্রুত করতে হবে। সময় নষ্ট করা যাবে না। এমন সময় তার নিজের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। ডিসপ্লেতে দেখতে পেলো একটা অপরিচিত নাম্বার। এমন সময় কে তাকে ফোন দেবে? নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো, অবশেষে কলটা রিসিভ করলেও বরাবরের মতোই কিছু বলল না-যে কল দিয়েছে সে-ই আগে কথা বলবে। কয়েক মুহূর্ত ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ পেলো না, তারপরই একটা কণ্ঠটা বলে উঠল : “লাইনটা কেটে দিও না, বাবলু…জরুরি কথা আছে।”
কণ্ঠটা চেনা চেনা লাগলেও ধরতে পালো না।
“রঞ্জুকে যদি পেয়ে থাকো, ওকে মারবে না। ওকে জীবিত ধরাটা খুবই জরুরি।”
জেফরি বেগ! ভীষণ অবাক হলো সে। তার নাম্বারটা ট্রেস করে ফেলেছে।
ঠিক তখনই দূর থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল : “কিসমত?”
চমকে তাকালো বাস্টার্ড। ভুরু কুঁচকে গেল তার। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখলো, এরপর জেফরি বেগ তাকে কী বলল শুনতে পেলো না।
অধ্যায় ৮২
ঠিক কতোক্ষণ পর সে জানে না, মাথায় চিনচিনে একটা ব্যথার কারণে পাতলা ঘুমটা ভেঙে গেছিল।
এতোদিন পরও এক গাঁদা ওষুধ খেতে হয়, কী এক যন্ত্রণাকাতর জীবন! এই পোড়া মুখ নিয়ে বাইরেও যেতে ইচ্ছে করে না। মানুষজন কেমন করে তাকায়। সেই সব চোখে থাকে ভীতি আর করুণা-সহমর্মিতার বালাইও থাকে না। সানগ্লাস পরে, চাদর দিয়ে মাথাসহ নাকের নিচ থেকে মুখ ঢেকে বের হতে হয়। তারপরও লোকজন ঠিকই বুঝে ফেলে আগুনে ঝলসে গেছে তার মুখটা।
আগুনের পোড়ার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মাথার আঘাতটা। বলা নেই কওয়া নেই তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়, চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে অবিরাম। তখন মনে হয়, নিজের মাথাটা থেতলে দিতে পারলে ভালো হতো। কিংবা পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করলে!
এটা করার আগে যে তার এই অবস্থা করেছে, সেই বাস্টার্ডকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আয়েশ করে তারিয়ে তারিয়ে মারবে সে।
তিক্তমুখে আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে পড়েছিল। একটু আগে ঐ হারামজাদার সঙ্গে তার কথা হয়েছে, বানচোতটার কণ্ঠে কোনো রকম উদ্বেগই ছিল না! থাকার কথাও নয়। ঐ বুড়ো তার আসল বাপ না। বাস্টার্ডের আবার কীসের বাপ? তারপরও বুড়োকে মারলে যে বাস্টার্ড কষ্ট পাবে সেটা সে জানে।
মাথা ব্যথা যখন শুরু হয় তখন সামান্য বিষয়েও মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। একটু হুইস্কি খেলে ভালো হতো, সেই সাথে সিগারেট। সেজন্যেই উঠে ড্রইংরুমে গেছিল, ফ্রিজ থেকে হুইস্কির বোতলটা বের করে এক ঢোক পানও করেছে, সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখে, মাত্র একটা আছে, ওটা ধরিয়ে অন্ধকার ড্রইং রুমের সোফায় বসে টানছিল সে, তখনই অবাক হয়ে শুনতে পায়, দূর থেকে কথা বলার শব্দ ভেসে আসছে!
“কিসমত?” বেশ জোরেই ডাকলো আবার। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। কার সাথে কথা কস?”
দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। কান পাতার চেষ্টা করলো। তার পরই দরজা খোলার শব্দটা কানে গেল, আস্তে করে খুলে গেল সেটা। অবিশ্বাসের সাথেই দেখতে পেলো, দরজার ওপাশে কিসমত আরা দাঁড়িয়ে আছে, আর তার পেছনে ঋজু ভঙ্গিতে পিস্তল হাতে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে আর কেউ না, বাস্টার্ড!
বজ্রাহত হলো সে। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, মাথার যন্ত্রণার চোটে দৃষ্টি বিভ্রমের শিকার হয়েছে।
কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারলো, এটা কোনো বিভ্রম নয়।
সম্বিত ফিরে পেতেই তড়িঘড়ি দরজাটা বন্ধ করতে উদ্যত হলো, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।
বাস্টার্ডের পিস্তল থেকে একটা ভোঁতা শব্দ হতেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল, তীব্র যন্ত্রণায় ঝাঁকিয়ে উঠল সে। তার মনে হলো দম বন্ধ হয়ে আসছে। এর আগেও গুলি খেয়েছে, এরকম যন্ত্রনা পায়নি!
হাত-পা অসাড় হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো সঙ্গে সঙ্গে, দেখতে পেলো সেই খুনি পিস্তল হাতে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
“বা-স্টার্ড!” জ্ঞান হারানোর আগে শুধু এটাই বলতে পারলো সে।
.
মেঝেতে পড়ে থাকা নিথর দেহটার দিকে তাকালো বাস্টার্ড। তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে, আগুনে পুড়ে যাওয়া বীভৎস মুখের লোকটা ব্ল্যাক রঞ্জু!
একটু আগেও তার মধ্যে যে সামান্যতম সন্দেহ আর অবিশ্বাস ছিল, সবই এক লহমায় দূর হয়ে গেছে এখন। নিথর হয়ে পড়ার আগে তার নাম ধরে ডেকেছে!
অথচ নিজের হাতে ওকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল! হুইলচেয়ারসহ জীবন্ত দাহ হচ্ছে জ্বলন্ত চিতায়-দৃশ্যটা এখনও স্মৃতির চোখে পরিস্কার দেখতে পায়।
তার পরও বেঁচে গেল?!
মুখটার দিকে তাকানো যায় না, ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে গেছে। ঘরে তেমন আলো নেই, পাশের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে যেটুকু আলো আসছে, তাতেই কেমন বীভত্স দেখাচ্ছে। আর এই বীভৎসতা নিজের কীর্তি বলে বেশিক্ষণ মুখটার দিকে তাকাতে পারলো না।
রঞ্জুর বোন কিসমত আরা মুখে হাতচাপা দিয়ে থর থর করে কাঁপছে। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে মৃত্যুভয়ে কাঠ হয়ে আছে সে।
এমন সময় আবারো তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। জেফরি বেগ আবারও কল করেছে তাকে। কলটা রিসিভ করলো না। দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। চট করে পিস্তল ধরা হাতটা উঠে এলো আবার। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চিৎকার দিলো কিসমত আরা।
আবারো গুলি চালালো। প্রায় শব্দহীন গুলি!
দু-হাত তুলে গুলির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলো মহিলা, গুলিটা লাগলো তার তলপেটে। তীব্র যন্ত্রণায় চোখমুখ বিস্ফারিত হলো যেন। তারপরই লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।
অধ্যায় ৮৩
জেফরি বেগ কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখলো।
হুট করে বাস্টার্ডের নাম্বারে ফোন দেয়ায় তার সহকারি জামান যার পর নাই বিস্মিত হয়েছে। ভালো করেই জানে, তার বস্ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল।
“কী বলল, স্যার?” জিজ্ঞেস করলো জামান। বাইকটা এখন রাস্তার পাশে দাঁড় করানো।
“কিছু বলেনি,” জবাব দিলো জেফরি বেগ। “কলটা কেটে দিয়েছে… ফোনও ধরছে না।”
“ব্যাকআপ টিমকে কখন বলবেন, স্যার?” এভাবে যেতে ভয় পাচ্ছে। সে।
“ওখানে পৌঁছার পর।”
একটু আগে হোমিসাইড থেকে বের হয়েই ফারুক স্যারকে ফোন দিয়েছিল জেফরি, কিন্তু তাকে পায়নি। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল তার। কিন্তু ডিজি স্যারকে এজন্যে দোষও দিতে পারে না। তার তো আর জানার কথা নয়, এতো রাতে সে রঞ্জুকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। সেজন্যে ঠিক করেছে, লোকাল থানা থেকেই ব্যাকআপ নেবে তবে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর তাদেরকে জানাবে, তার আগে না।
আবারো বাইকে উঠে বসলো জেফরি। এখন তারা আছে হাতির ঝিলের ঢোকার মুখে, আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে নিকেতনে পৌঁছে যাবে।
জেফরি বেগ জানতো, রঞ্জুর লোকেশনে পৌঁছানোর আগেই বাস্টার্ড সেখান থেকে সটকে পড়বে। কোনো রকম প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই তাদের আগে কিভাবে ওখানে চলে গেল ঐ পেশাদার খুনি, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও ধারনা নেই তার। এর আগেও কয়েক বার এভাবে এগিয়ে থেকে বাস্টার্ড প্রমান করেছে, তার কাজ করার পদ্ধতিটা বেআইনী হতে পারে কিন্তু অনেক বেশি কার্যকরী। তাই বাইকে করে নিকেতনে পৌঁছার আগেই অল্প সময়ের মধ্যে তাকে কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তার মনের একটা অংশ বলছিল, বাস্টার্ডকে ফোন দিতে। অন্য অংশটা যথারীতি আদর্শিক ছিল-পেশাদার খুনির সঙ্গে কোনো ধরণের আলাপের দরকার নেই। তার কাছে রঞ্জুর মতো বাস্টার্ডও একজন অপরাধী।
কিন্তু পৃথিবীটা নিখুঁত নয়। সাকাসের দড়ির উপর দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে হেঁটে যাওয়ার মতোই ভালো-মন্দের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয় এখানে। কখনও কখনও বেশি খারাপকে মোকাবেলা করার জন্য কম খারাপকে ছেড়ে দিতে হয়-ছাড় দিতে হয়!
তাই বাস্টার্ডকে ফোন করার মতো অভাবনীয় সিদ্ধন্তটা না নিয়ে পারেনি। ব্ল্যাক রঞ্জুকে মৃত নয় জীবিত দরকার। নইলে রঞ্জুর লিগ্যাসিটা শেষ হবে না এতো সহজে।
জেফরির মনে ক্ষীণ আশা, বাস্টার্ড তার কথা রাখবে।
রাত অনেক বেশি হওয়ায় নিকেতনের দুই নাম্বার গেট দিয়ে ঢোকার সময় গার্ডদের কাছে পরিচয় দিতে হলো তাদেরকে। রঞ্জু যেখানে থাকে, সেই ভবনের মেইন গেটের সামনে বাইকটা থামতেই জেফরি বেগ নেমে পড়লো।
“লোকাল থানাকে কল দেবো এখন?” বাইকটা স্ট্যান্ডের উপরে রাখার সময় জানতে চাইলো জামান।
“হুম।” জেফরি বেগ চারপাশে তাকালো। সাত নাম্বার রোডের দু পাশে অল্প কিছু প্রাইভেট কার পার্ক করে রাখা আছে। ভবনের মেইনগেটের দিকে এগিয়ে গেল সে।
“স্যার, ব্যাকআপ টিম-”
হাত তুলে জামানকে থামিয়ে দিলো। “ভেতরে যাচ্ছি না, সিকিউরিটির সঙ্গে কথা বলবো।” ভবনের মেইনগেটের পাশে সিকিউরিটি বক্সের বন্ধ জানালায় জোরে জোরে টোকা মারলো।
আস্তে করে বক্সের জানালাটা খুলে গেল, উঁকি দিলো ভয়ার্ত মুখের দারোয়ান। “আপনারা কি পুলিশ?”
অবাক হলো জেফরি বেগ। “হ্যাঁ।”
“খাড়ান, স্যার,” বলেই মেইন গেটটা খুলে দিলো। “..পাঁচতলায় চইল্যা যান।”
ভুরু কুঁচকে গেল জেফরি বেগের।
“আপনাগোর যে লোকটা পথম আইছিল হেয় এটু আগে যাওনের সময় কইছে, আপনারা যে উপরে চইল্যা যান।”
বিস্মিত হলো সে। “ওই লোক একা-ই বের হয়েছে এখান থেকে?”
“হ, স্যার।”
জামানের দিকে ফিরে তাকালো সে। বাইকটা রেখে চলে এসেছে তার পেছনে, হাতে তুলে নিয়েছে পিস্তল।
“অমূল্যবাবু তাহলে কোথায়?”
সহকারির প্রশ্নটা জেফরিকেও ভাবাচ্ছে। “পাঁচতলায় কারা থাকে?” দারোয়ানের কাছে জানতে চাইলো।
“সুরভী ম্যাডাম আর তার হাজব্যান্ড।”
“একটাই ফ্ল্যাট?”
“হ, স্যার।”
কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো জেফরি। “দরজা খোলো।”
“স্যার!” আৎকে উঠল জামান। “আরেকটু ওয়েট করি…ব্যাকআপ টিম এসে পড়বে।”
দারোয়ান গেট খুলে দিলে জেফরি বেগ তার পিস্তলটা হাতে নিয়ে ঢুকে পড়লো ভবনের ভেতরে। একান্ত অনিচ্ছায় তার পেছন পেছন ঢুকে পড়লো জামানও।
“উপরে যাওয়াটা ঠিক হবে না, স্যার…একটু ওয়েট করি?” লিফটের সামনে আসার পর আবারো বলল।
“দারোয়ান বলছে মাত্র দু-জন থাকে ওখানে,” বলল জেফরি বেগ। “জায়গাটা নিরাপদ না হলে বাস্টার্ড ওকে বলে যেতো না আমাদেরকে উপরে চলে যাওয়ার জন্য।”
কথাটা জামানের পছন্দ হলো না। বাস্টার্ডের মতো একজনের কথা তার বস্ এতো গুরুত্ব দিচ্ছে কেন! একটু আগে আবার ঐ খুনিকে ফোন করে অনুরোধও করেছে! খুবই অদ্ভুত লাগছে তার কাছে।
লিফটের দরজা খুলতেই উঠে গেল জেফরি বেগ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও জামান তাকে অনুসরণ করলো। পাঁচতলায় এসে লিফটটার দরজা খুলতেই চমকে গেল তারা দুজন।
ফ্ল্যাটের মেইন দরজাটা খোলা, ভেতরে বাতি জ্বলছে। পিস্তল উঁচিয়ে সতর্ক পদক্ষেপে ভেতরে ঢুকে পড়লো জেফরি বেগ আর জামান। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়লো ড্রইংরুমের এক পাশে একটা দরজার কাছে এক মহিলা পড়ে আছে, আর দরজার ওপাশে পড়ে আছে পোড়া মুখের এক পুরুষ!
অবিশ্বাসে জেফরির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।
রঞ্জুকে মেরে ফেলেছে।
অধ্যায় ৮৪
কিসিঞ্জারের মুখে পরিহাসের হাসি, সেই সাথে আছে কাউকে জব্দ করার প্রচ্ছন্ন আত্মতৃপ্তিও।
বাস্টার্ড ভেবেছিল কিসমতদেরকে কজায় নিলেই পাশার দান উল্টে দিতে পারবে। এতোক্ষণে সে বুঝে গেছে তার হিসেবে কতো বড় ভুল আছে। এখন চাইলেও অমূল্যবাবুর জন্যে ওদের কিছু করতে পারবে না। তারচেয়েও বড় কথা, নিজের ফাঁদে পড়ে গেছে বাস্টার্ড-যে কাজ সে করে, তেমনি একটা কাজ করতে দেবে তাকে, তবে টাকার বিনিময়ে না, এবার অমূল্যবাবুর জীবনের বিনিময়ে করবে সেটা।
অমূল্যবাবুর ব্যাপারে বাস্টার্ডের মনোভাব কী রকম, সেটা এখন একদম পরিস্কার তার কাছে। লোকটার জন্য সে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওদেরকে খুঁজে বের করার মতো অসম্ভব কাজটাও করতে পেরেছে। বাস্টার্ড যদিও হ্যাঁ-না কিছুই বলেনি, তারপরও সে অনেকটা নিশ্চিত, বাবুর জীবন বাঁচাতে কাজটা করবে। সে যে বাবুর কোনো ক্ষতি করবে না, এটা তো আর বাস্টার্ড জানে না!
কিসিঞ্জার খুবই বিস্মিত হয়েছে, নিকেতনের খোঁজ কিভাবে পেলো বাস্টার্ড! এমন না যে, ওদেরকে সুরক্ষিত দুর্গে রেখেছিল। এসবের কোনো দরকারই ছিল না। বাড়াবাড়ি রকমের সিকিউরিটি আর গোপনীয়তা সহজেই মনোযোগ আকর্ষন করে, তাই একেবারে স্বাভাবিক পরিবেশে রেখেছিল ওদেরকে স্বামী-স্ত্রী সাজিয়ে।
আগুনে পুড়ে দগ্ধ হওয়া একজন অসুস্থ মানুষ, সারাক্ষণ নিজের ফ্ল্যাটেই থাকে। অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের কারোর সন্দেহ হবার কারনই নেই। তারা জানে, লোকটার বিশাল গার্মেন্টসে আগুন লেগে ত্রিশ-চল্লিশজন শ্রমিক মারা যায়, মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয় মালিক নিজেও। মানুষের কৌতূহল সরিয়ে সহমর্মিতা পাবার জন্য এই গল্পটাই যথেষ্ট।
ঈদের ছুটিতে প্রায় সবাই দেশের বাড়িতে গেছে নয়তো ছুটি কাটাচ্ছে কোথাও, এমন সময় অপারেশন চালাতে সে কখনও রাজি হতো না। তাছাড়া মুনেম হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনি উঠেপড়ে লেগেছে তাদের পেছনে, সতর্ক অবস্থায় আছে তারা। অনেক দিন ধরেই সব ধরণের অপারেশন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তারপরও, বাস্টার্ডকে ধরে আনার অপারেশনটা করতে রাজি হয়েছিল সে।
লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর মতো একজন প্রবাসী দেশে এসেছে ঈদ করতে-গত পরশু যদি এই তথ্যটা না জানতো, তাহলে কি এতো সহজে সায় দিতো বাস্টার্ডের বাপকে তুলে আনার জন্য?
মুচকি হাসলো সে। ফোনটা হাতে নিয়ে কিসমত আরার ফোনে একটা ছবি আর বাকি ইনফর্মেশনগুলো পাঠিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল-বাস্টার্ডকে দেখাতে হবে, বাবু বেঁচে আছে।
পাশের রুমের দরজায় টোকা দিলো। “সালাম…ঘুমিয়ে গেছিস?”
“না, ভাই,” সঙ্গে সঙ্গেই জবাবটা এলো ঘরের ভেতর থেকে।
অধ্যায় ৮৫
ব্ল্যাক রঞ্জু!
পোড়া মুখের লোকটার পরিচয় নিয়ে জেফরির মনে কোনো সন্দেহ নেই, তবে বিস্ময় আছে-ওভাবে আগুনে পুড়েও বেঁচে গেছিল এই সন্ত্রাসি!
মহিলাটি নিঃসন্দেহে রঞ্জুর বোন কিসমত আরা।
বাস্টার্ডকে সে অনুরোধ করেছিল, রঞ্জুকে যেন খুন না করে। ঐ পেশাদার খুনি কথা রাখেনি। তিক্ততায় ভরে উঠল জেফরির মুখ। অবশ্য তাকে এজন্যে খুব বেশি দোষও দেয়া যায় না। বহুকাল আগেই ব্ল্যাক রঞ্জু আর বাস্টার্ড এমন এক খেলায় নেমেছে, যে খেলাটা ওদের যেকোনো একজনের মৃত্যুর আগে শেষ হতো না। দীর্ঘদিন থেকে তারা দুজন দু জনকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে ছিল। আজকে রাতেও সোয়ান লেকে একটি হিট টিম পাঠিয়ে বাস্টার্ডকে মারার চেষ্টা করেছিল রঞ্জ।
নিথর দেহদুটোর দিকে তাকালো সে। দু-জনের বুকেই ছোট্ট একটা লাল ছিদ্র-বুলেট হোল। সেখান থেকে খুব বেশি রক্তপাত হয়নি। এটা অস্বাভাবিক! রক্তে ভেসে যাবার কথা!
“বেঁচে আছে তো!” জেফরি কিছু বলার আগেই জামান বলে উঠল। “শাস নিচ্ছে!”
জেফরি আর জামান ওদের কাছে গিয়ে দেখলো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এখনও বেঁচে আছে তারা! নিশ্বাস নিচ্ছে।
“পালস আছে, স্যার,” নাড়ি দেখে বলল জামান। “অজ্ঞান হয়ে আছে…দু-জনেই।”
ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। বুলেট হোলটা আবারো দেখলো। প্রচলিত বুলেটের মতো নয়। প্রচুর বুলেটবিদ্ধ লাশ দেখেছে হোমিসাইডে কাজ করার সুবাদে, এমনটা কখনও দেখেনি। বুলেটটা পুরোপুরি শরীর ভেদ করেনি। আজব। তারপরই অবিশ্বাসের সাথে বলে উঠল জেফরি বেগ, “ট্রাঙ্কুলাইজার গান ইউজ করেছে?!”
“বলেন কি, স্যার!” অবাক হলো জামানও।
বাবলু ওদেরকে অজ্ঞান করে রেখে গেছে! মনে মনে বলল জেফরি। তার কথা রাখার জন্য? কিন্তু এটা কী করে সম্ভব! বাবলু কী করে আগে থেকে জানবে, সে এমন অনুরোধ করতে পারে!
আজকাল তাহলে সাইলেন্সার ব্যবহার না করে ট্রাঙ্কুলাইজার গান ব্যবহার করছে সে?
হিসেবে মিলছে না। একা একজন মানুষ ব্ল্যাক রঞ্জুর ডেরায় হানা দিয়েছে ট্রাঙ্কুলাইজার গান নিয়ে?! অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে তার কাছে।
“স্যার?”
জামানের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো জেফরি। একটা ফোন হাতে নিয়ে চেয়ে আছে সে।
“এই ফোনের সিগন্যাল অ্যাপসে একটা মেসেজ পাঠানো হয়েছে। এইমাত্র!”
“কার ফোন এটা?”
নিথর দেহের মহিলার দিকে ইঙ্গিত করলো তার সহকারি।
কাছে এসে ডিসপ্লেটা দেখলো, কলার আইডির জায়গায় লেখা : ভাইজান।
“এটা আবার কে?” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল জেফরি বেগ। “মেসেজটা ওপেন করো।”
জামান তাই করলো, ডিসেপ্লেটা বাড়িয়ে দিলো জেফরির দিকে।
“এটা কি? কে এই ভাইজান?”
জামানও বুঝতে পারছে না। লালমাটিয়ার ব্লক ডি’র একটা হোল্ডি নাম্বার আর ফ্ল্যাট নাম্বার দেয়া আছে, সেই সঙ্গে দেয়া আছে এক লোকের ছবি।
“স্যার, এই লোকটাকে সম্ভবত আমি চিনি।”
সহকারির দিকে অবাক হয়ে তাকালো জেফরি বেগ। “কে এই লোক?”
“এক সময় গানটান করতো…ভালোই গাইতো।”
“এর ছবি কেন পাঠালো? ঠিকানাই বা দিলো কেন?”
কাঁধ তুলল জামান। “কিছুই বুঝতে পারছি না।”
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো জেফরি। “ব্যাকআপ টিমের কি খবর?”
“এসে পড়ার তো কথা…দেখছি আমি,” বলেই জামান তার ফোনটা বের করতে যাবে এমন সময় আবারো চমকে উঠল। “স্যার, ঐ ভাইজান ভিডিও কল দিয়েছে!”
নড়েচড়ে উঠল জেফরি বেগ।
“কী করবো, স্যার?”
ভাবনায় পড়ে গেল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। দ্রুত কিছু একটা ভেবে নিলো। ক্যামেরাটা ব্লক করে রিসিভ করো,” অবশেষে বলল সে। “কিন্তু কিছু বলবে না। লোকটার চেহারা দেখবো আমরা।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে তার সহকারি তাই করলো। ফ্রন্ট ক্যামেরাটা বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে ঢেকে কলটা রিসিভ করলো সে।
পর্দায় ভেসে উঠল অমূল্যবাবুর চেহারাটা!
অধ্যায় ৮৬
অমূল্যবাবু কিছুই বলেনি।
তাতে অবশ্য অবাক হলো না কিসিঞ্জার। বাস্টার্ডকে কিছু বলার দরকারও নেই-বাবু বেঁচে আছে, এটা জানাই যথেষ্ট ঐ খুনির জন্য, তাহলেই সে কাজটা করার তাগিদ অনুভব করবে।
মুচকি হাসলো। বাস্টার্ড চায়নি ওর চেহারা দেখে ফেলুক সে। ক্যামেরাটা হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিল।
অমূল্যবাবুর দিকে তাকালো। বাবুর মুখটা নির্বিকার থাকলেও তাতে প্রচ্ছন্ন একটা অভিব্যক্তি আছে।
“কি হয়েছে?” ভুরু কুঁচকে বলল কিসিঞ্জার।
“তোমাকে বলেছিলাম, ওর পেছনে লেগো না।”
থুতনী চুলকে স্মিত হাসি দিলো। “কাজটা যাতে করে সেজন্যেই ওকে দেখালাম আপনি বেঁচে আছেন…ঠিকঠাক আছেন।”
একটা ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমূল্যবাবু।
পেছনে ফিরে তাকালো কিসিঞ্জার। বুকের কাছে দু-হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে তার বিশ্বস্ত সহচর আবু সালাম, তাকে ইশারা করলো, বাবুকে আবারো বেডরুমে নিয়ে যাবার জন্য।
অমূল্যবাবু চুপচাপ চলে গেল লোকটার সঙ্গে।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে গেল কিসিঞ্জার। বাস্টার্ড ওদেরকে কী করেছে, জানতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সিগন্যাল অ্যাপসে কল দিলো, কিন্তু রিং হলেও তার কলটা রিসিভ করা হলো না। এরপর আরেকটা নাম্বারে কল দিলো। একই অবস্থা। ফোনগুলো চালু আছে কিন্তু তার কলটা রিসিভ করছে না কেউ!
চিন্তার ভাঁজ পড়লো তার কপালে। ঐ খুনি কী করেছে ওদের, বুঝতে পারছে না।
*
ব্যাকআপ টিম চলে এসেছে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা ব্ল্যাক রঞ্জু আর খুব সম্ভব তার বোন কিসমত আরার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে ফেলা হয়েছে। ডেকে আনা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স, তাদেরকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য।
ব্ল্যাক রঞ্জুকে ধরার মতো বিরাট বড় ঘটনা ঘটে গেলেও জেফরি বেগের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। একটু আগে অমূল্যবাবুকে ভিডিও কলে কয়েক মুহূর্ত দেখেছে সে আর জামান। এমনটা তারা ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি। ভেবেছিল, ঐ ভাইজান নামধারী লোকটাকে দেখতে পাবে।
এদিকে ভিডিও কলটা শেষ হবার পর পরই ঐ লোক সিগন্যাল অ্যাপসে দুবার কল দিয়েছিল মহিলা আর রঞ্জুর ফোনে। জেফরি সেটা রিসিভ করেনি।
সমস্যাটা হলো, সিগন্যাল অ্যাসে কল দিয়েছে বলে লোকটার অবস্থান বের করা যাবে না, তাই ব্যাকআপ টিম আসার আগে থেকেই ফোনদুটো ঘাঁটতে শুরু করেছিল তারা দুজন। জেফরি দেখতে পায়, মহিলার ফোন থেকে একটু আগে ভাইজান নামের একটি কন্ট্যাক্টে কল করা হয়েছিল! আর সেটা সিগন্যাল অ্যাপসে না-দেশিয় টেলিকমের নাম্বারে।
রঞ্জুর ফোন থেকেও একই নাম্বার পাওয়া গেছে সেটাও ভাইজান নামেই সেভ করা!
জেফরি বেগ ঐ নাম্বারটা মনীষকে দিয়েছে লোকেশন ট্র্যাক করার জন্য।
“ঐ লোকের কজায় আছে অমুল্যবাবু!” বিড়বিড় করে বলল জেফরি।
“ভাইজানটা কে হতে পারে, স্যার?”
কাঁধ তুলল সে। তার কোনো ধারনাই নেই। “বুঝতে পারছি না।”
“ঐ লোককে ট্র্যাক করার পর কি রেইড দেবো আমরা?”
“অবশ্যই।” জামানকে আজ অনেক বেশি ভীতু বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। “ব্যাক-আপ থাকবে, চিন্তা কোরো না।” আশ্বস্ত করলো তাকে।
অধ্যায় ৮৭
নিকেতনে রঞ্জুর ফ্ল্যাট থেকে বের হয়েই তার ফোন থেকে তিনটি নাম্বার মুখস্ত করে নিয়েছিল সে।
মাইক্রোবাসটা নিয়ে দ্রুত আবাসিক এলাকা থেকে বের হয়ে যাবার পর, একটু এগোতেই হাতিরঝিলের লেকে ছুঁড়ে মারে নিজের ফোনটা। জেফরি বেগ তাকে এই ফোন দিয়েই খুঁজে পেয়েছে, সে একদম নিশ্চিত। কিভাবে খুঁজে পেয়েছে, সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় নেই এখন। এই মোবাইলফোন যে কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি কেউ জানে না।
এখনও সে কালো রঙের মাইক্রোবাসটা ছাড়তে পারেনি। ওটা নিয়েই ছুটে চলেছে আরেক গন্তব্যে।
তায়েবের কাছ থেকে কিমত আরার ফ্ল্যাটের কথা জানার পর সে একদম নিশ্চিত ছিল, অমূল্যবাবুকে উদ্ধার করতে পারবে। কিন্তু নতুন সত্য জানতে পেরেছে এখন : অমূল্যবাবুকে অপহরণ করেছে অন্য একজন রঞ্জুদের ভাইজান। এই ভাইজানই রঞ্জুর দলটা এখন চালায়। এই লোক, যার নাম কিসিঞ্জার, সে কিসমত কিংবা রঞ্জুকে মোটেও পরোয়া করে না। এটা সে দুশো আর পাঁচশো টাকার হিসেবে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। উল্টো তাকে একটা খুন করার প্রস্তাব দিয়েছে লোকটা!
ঐ মুহূর্তে তার মাথা একদমই কাজ করছিল না। কী বলবে, কী করবে-কিছুই বুঝতে পারছিল না। তারপরই জেফরি বেগের ফোন কলটা আসে। এই ফোন পেয়ে যার পর নাই বিস্মিত হয়েছিল। বুঝতে পারছিল, কিসমত আরার ফ্ল্যাটে এক মুহূর্তও থাকা সম্ভব নয়। কিসিঞ্জারও জেনে গেছে সে কোথায়। যেকোনো সময় রঞ্জুর গ্রুপের অস্ত্রধারীরাও হানা দেবে ফ্ল্যাটে।
ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ কিসমতকে ডাকতে শুরু করে। আজকে, কয়েক ঘণ্টা আগে এই কণ্ঠটাই শুনেছিল সে।
ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, কিসমত আরার ফ্ল্যাট থেকে পাশের ফ্ল্যাটে যাতায়াতের দরজা আছে, আর সেই ফ্ল্যাটেই থাকে ব্ল্যাক রঞ্জু।
জেফরি বেগের প্রথম কলটা রিসিভ করার মাঝপথেই রঞ্জুর আবির্ভাব ঘটে, আর সেটা তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ তৈরি করে দেয়। কলটা কেটে দিয়ে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট না করে ট্রাঙ্কুলাইজার গান দিয়ে গুলি করে রঞ্জুকে।
ঐ সন্ত্রাসি জ্ঞান হারানোর আগে তার নাম ধরে ডেকেছিল!
জেফরি বেগ আবারো তাকে কল দিয়েছিল, সেই কলটা আর রিসিভ করেনি, কিসমত আরাকে গুলি করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়ে সে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছিল-আর সেটা তার কাছে সব দিক থেকে ভালোই মনে হয়েছে। জেফরি বেগের কথাও রাখা হলো, রঞ্জু এবং কিসমত আরাকে আইনের হাতে তুলে দেয়াও গেল। এমনিতেও সে কিসিঞ্জারের কথামতো কাজ করতো না। এজন্যে করতো না, কাজটা করলেও অমূল্যবাবুকে ফিরে পাবার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ফলে রঞ্জুদের ফ্ল্যাট থেকে বের হবার সময় ওদেরকে এমনি এমনি ছেড়ে আসাটা হতো বিরাট বড় বোকামি। আবার ওদেরকে খুন করলে ঐ লোক অমূল্যবাবুকে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলতো।
রঞ্জু আর কিসমত আরাকে শুট করার সিদ্ধান্তটি নেবার পেছনে আরেকটি ভাবনাও কাজ করেছে তার মধ্যে : অমূল্যবাবুকে উদ্ধার করার শেষ একটা সুযোগ আছে তার।
সেজন্যেই এখন ছুটে চলেছে পান্থপথের দিকে।
অধ্যায় ৮৮
নেশায় বুঁদ হয়ে আছে উজ্জ্বল।
বিছানায় নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে ইমরুল, পাশেই প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে এক মেয়ে। একটু দূরে সোফায় বসে ওদের দেখছে সে।
দীর্ঘকাল ধরে সে ফেন্সিডিলে আসক্ত। আজকাল সবাই নতুন নেশায় মজেছে। ছোট্ট একটা ট্যাবলেট, অথচ অনেক পাওয়ার! একেবারে নতুন জীবন দিয়ে দেয়। অনেকেই বলে, ফেন্সিডিল ওটার কাছে শিশু। কিন্তু উজ্জ্বল পুরনো প্রেম ছাড়তে পারেনি এখনও, তার রোজ দুই থেকে তিন বোতল ডাইল চাই-ই চাই।
একট আগে তার বন্ধ ইমরুলের সঙ্গে মিডিয়ার এই মেয়েটা ওসব করার আগে ইয়াবা খেয়ে নিয়েছে। তবে ইমরুল গাঁজা আর মদ ছাড়া কিছু খায় না। গাঁজা খেয়ে উন্মাতাল সেক্স করেছে মেয়েটার সঙ্গে। ওসব দেখে দারুণ মজা পেয়েছে উজ্জ্বল। শুরুর দিকে ইমরুল তার সামনে এসব করতে লজ্জা পেতো, এখন আর লজ্জা-টজ্জা পায় না, এমনভাবে কাজটা করে, যেন ঘরে তৃতীয় কোনো মানুষ নেই।
ব্যাঙ্কের চাকরিটা হারানোর পর অনেকটা সময় তাকে রীতিমতো বন্দির মতো থাকতে হয়েছে। সব কিছুই করতে হয়েছে কিসিঞ্জারের কথামতো। প্রায় দুটো সপ্তাহ ধরে বন্দি জীবন যাপন করার পর আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। তার চাকরি হারানোর ক্ষতি পূরণ করেছে কিসিঞ্জার। এখন থেকে সে প্রতি মাসে আরো বেশি টাকা পাচ্ছে। তবে এর বিনিময়ে তেমন কিছুই করতে হচ্ছে না–গোপন ব্যবসার টাকা-পয়সার হিসেব রাখা বাদে। কিন্তু এই মোসোহারাও তার পোয় না। এই টাকা সে এক রাতেই উড়িয়ে দিতে পারে। সমস্যা হলো কিসিঞ্জারকে তো আর বলতে পারে না, জয়া খেলার জন্য তার অনেক টাকা চাই!
আজকে সে রঞ্জুকে বিরাট বড় উপহার দিয়েছে। ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বাস্টার্ডের দেখা পেয়ে যাবে। বানচোতটা এতোক্ষণে হয়তো পরপারে চলে গেছে।
না, রঞ্জু তাকে তারিয়ে তারিয়ে মারবে-এমনটাই বলেছে। পুড়িয়ে মারবে সম্ভবত। কারণ তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল এই হারামজাদা।
পাঁচ-ছয় মাস আগে যখন ঢাকায় এলো, তখন একবার ভিডিও কলে কথা বলেছিল তার সঙ্গে। মাথার উপরে একটা চাদর জড়িয়ে রেখেছিল সে, মেয়েদের মতো ঘোমটা দিয়ে। মুখের কম অংশই দেখতে পেয়েছিল তখন। চোখে সব সময় সানগ্লাস পরে থাকে, আলো সহ্য করতে পারে না, গল গল করে পানি পড়ে চোখ দিয়ে। আজকেও ফোনে কথা বলার সময় একই অবস্থা দেখেছে।
এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে বিছানার দিকে তাকালো। মেয়েটা দু-বার করার পরই সেই যে মরার মতো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে, আর কোনো খবর নেই। একটু বেশিই নেশা করে ফেলেছে মনে হয়। আগের মতো আর তেজ নেই। এখন খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এসবে আর আগ্রহ পায় কি না কে জানে।
শালি! গালি দিলো মনে মনে। মিডিয়াতে কাজ করলেও এই মেয়ের আসল রোজগারটা আসে দেহব্যবসা থেকে। ইমরুল একজন প্রযোজক, প্রচুর টাকা খাটায় মিডিয়ায়, মেয়েটার সঙ্গে বেশ ভালো খাতির তার।
মাঝেমধ্যেই সে ভাবে, এই শালার মিডিয়াতে যে কী আছে কে জানে! মেয়েটা শিক্ষিত। ভালো দেখে চাকরি করে, ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে করে সংসারি হতে পারতো, কিন্তু উই পোকার মতো আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। এখন সেই আগুনে পুড়ে শেষ! এর জীবন বলতে আর কিছু বাকি নেই। আজ থেকে পাঁচ বছর পর এরে ষাট বছরের বুড়োও চুদবে না।
মেয়েটার দিকে তাকালো সে। আবারো ওসব দেখতে ইচ্ছে করছে তার। দু-তিন বছর ধরেই নতুন একটা বাতিকে আক্রান্ত হয়েছে-চোখের সামনে দু-জন নরনারীকে সঙ্গম করতে দেখলে অন্য রকম অনুভূতি হয়। ফেন্সির নেশার চেয়েও এটা বেশি পেয়ে বসেছে তাকে। ইমরুল অবশ্য তার মতো না, ওসব করতে ওস্তাদ সে।
হারামজাদা পারেও!
বন্ধুকে ডাকলো, “ওই, ঘুমায়া গেছোস না কি?”
ইমরুল একটু আড়মোড়া দিলো চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে। “কী হইসে?”
“আবার লাগা ওইটারে!”
“ধুর!” বিরক্ত হলো। “দেখতাছোস না, ঘুমাইতাছে?”
“ঐ শালির পাছায়-”
ঠিক তখনই ফ্ল্যাটের ইন্টারকমটার রিং বেজে উঠলে অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকালো উজ্জ্বল।
“কোন শালায় এতো রাইতে ফোন চোদায়?” বিছানায় শুয়েই বলল ইমরুল। “ধরোস না ক্যান?”
উজ্জ্বল কিছু না বলে ইন্টারকমটা তুলে নিলো হাতে। “কে?”
“স্যার,” ভবনের দারোয়ান বলে উঠল আতঙ্কিত কণ্ঠে। “আপনাগো গাড়ির ভিতর থিকা পোড়া গন্ধ বাইর হইতাছে…আগুন লাগছে মনে অয়।”
বিস্মিত হলো উজ্জ্বল। ইমরুল তার গাড়িতে করে এই মেয়েটাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
“আইতাছি,” বলেই ইন্টারকমের রিসিভারটা রেখে দিলো। “তুই কি গাড়ির ভিতরে সিগারেট ফালাইছোস? ভিতর থেইকা না কি পোড়া গন্ধ বাইর হইতাছে।”
লাফ দিয়ে উঠে বসলো ইমরুল। মাত্র দু’মাসও হয়নি ত্রিশ লাখ টাকা দিয়ে গাড়িটা কিনেছে। “কস্ কি!” টেনে টেনে চোখ খুলল সে। “আমি তো সিগারেট খাই নাই,” তার পর পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। “এই শালি খাইছিল। কিন্তু সিগরেট তো গাড়ির অ্যাস্ট্রেতেই ফালাইছে।”
“নিচে গিয়া দেখ, কী হইছে…গাড়ির ভিতরে আগুন লাগছে মনে হয়।”
“আমার অবস্থা দেখতাছোস না? তুই গিয়া দেখ না, কী বালটা হইসে!”
উজ্জ্বলের চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল। ইমরুল এখন দিগম্বর, জামা কাপড় পরে নিচে যেতে সময় লাগবে। উঠে দাঁড়ালো সে। “চাবি দে।”
বেডসাইড টেবিল থেকে চাবিটা নিয়ে ছুঁড়ে মারলো ইমরুল। চাবির গোছাটা লুফে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল উজ্জ্বল। ফ্ল্যাটের মেইন দরজা খুলে লিফটে করে নিচে নেমে আসার সময় বিরক্ত হলো। শালার নেশাটাই কেটে গেছে।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফটা থামলো, দরজা খুলতেই পা বাড়ালো সে। “কাহিনি কি-” তার বাঁ-দিকে ডিবির ভেস্ট পরা একজনকে দেখে থমকে গেল। লোকটার হাতে পিস্তল! কিন্তু যে চেহারাটা দেখতে পেলো, সেটা তার হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।
হায় আল্লাহ!
অধ্যায় ৮৯
নিকেতন থেকে রওনা দেবার পরই ডিবি’র ভেস্টটা পরে নিয়েছিল বাস্টার্ড।
রাত বেশি বলে পথে পুলিশি চেকিং হতে পারে, আর সেটা হলে কী করবে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। প্রথমে স্বাভাবিকভাবেই মোকাবেলা করবে। জানাবে, সে জরুরি একটা কাজে যাচ্ছে। খুব কম সম্ভাবনা ছিল, পুলিশ তাকে সন্দেহ করবে। যদি সে রকম কিছু হতো, চেক করতে চাইতো, তার আইডি কার্ড দেখাতে বলতো, তাহলে সোজা পিস্তল বের করে নিবৃত্ত করতো তাদেরকে।
কিন্তু সে রকম কিছুই করতে হয়নি।
রাতের এ সময় পথ-ঘাট পুরোপুরি ফাঁকা বলে দ্রুতই নিকেতন থেকে পান্থপথে চলে আসে। গাড়ির গতি কমিয়ে পথের বাঁ-দিকের ভবনগুলো এক এক করে পেরিয়ে অবশেষে নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে কালো রঙের মাইক্রোবাসটা থামায় সে।
নুর হাভেন।
গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সে। তার মাথায় ক্যাপ আর গায়ে ডিবির ভেস্ট দেখে দারোয়ান একটুও সন্দেহ করেনি, উল্টো ভয়ে তটস্থ হয়ে যায়।
“তিনতলার লিফটের ডান দিকের ফ্ল্যাটটা কার?” জানতে চেয়েছিল সে।
“ফ্ল্যাটটা ইমরুল স্যারের কিন্তু রেগুলার থাকেন উজ্জ্বল স্যার,” ঢোক গিলে বলেছিল দারোয়ান।
নওরিন খান এমনটাই বলেছিল। উজ্জ্বল এখন এখানেই বেশি থাকে।
“আজকে কে আছে ওখানে?”
আবারো ঢোক গিলেছিল সিকিউরিটি গার্ড। এই ফ্ল্যাটে রাত-বিরেতে প্রায়ই মেয়েছেলে নিয়ে আসা হয়। মালিকের এসব কর্মকাণ্ড শুধু দেখে যায় সে, এ নিয়ে কোনো কথা বলা তার সাজে না। কিন্তু এই লোকটা ডিবির, তার কাছ থেকে কিছু লুকালে কপালে চড়থাপ্পড় জুটবে, এমন কি যাকে ধরতে আসছে তার সঙ্গে তাকেও নিয়ে যাবে থানায়।
“স্যারগো লগে আইজকা একজন মেহমানও আছে, স্যার।”
দারোয়ানের ভাবভঙ্গি দেখে কিছুটা সন্দেহ হয় বাস্টার্ডের। “মেয়ে?”
“জি, স্যার।”
তিনজন আছে! একটু ভেবে নেয় বাস্টার্ড। “কখন এসেছে ওরা?”
“উজ্জ্বল স্যার আগেই আসছেন, ইমরুল স্যার আসছেন এগারোটার দিকে…গাড়িত কইরা।”
গাড়ি!
বাস্টার্ড বুঝতে পারে, ফ্ল্যাটের মালিক আর উজ্জ্বল মেয়েমানুষ নিয়ে এসেছে ফুর্তি করার জন্য। পার্টি চলছে!
এখানে আসার পথে দারোয়ানকে কী বলবে, কোন কারণ দেখিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকবে, ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু ফ্ল্যাটের মালিকের গাড়ি আছে, আর মানুষের সংখ্যা তিনজন বলে চট করেই পরিকল্পনাটা বদলে ফেলে।
“শালার ইয়াবা ব্যবসায়ি!” বেশ জোরেই বলেছিল কথাটা। তারপর পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে কানে দেয়। “ঐ ইয়াবা ব্যবসায়ি লোকটা ফ্ল্যাটে আছে, স্যার। দারোয়ান আমাকে কনফার্ম করলো…সঙ্গে মেয়েটাও আছে। আপনারা চলে আসুন। এক্ষুণি ধরতে হবে ওদের।” ফোনটা রেখে দারোয়ানের দিকে তাকায় সে। “যে গাড়িতে করে এসেছে, সেটা কোথায়?”
পার্কিং এরিয়ায় থাকা প্রাইভেট কারটা দেখিয়ে দেয় দারোয়ান। আবারো চিন্তা করার ভান করে সে-ঠিক যেভাবে ফোনে কথা বলার ভান করেছিল। “আমি চাই না এখানে এতো রাতে হাউকাউ হোক। কাজটা চুপচাপ করতে হবে, এখানকার কেউ যেন টের না পায়।”
মাথা নেড়ে সায় দেয় দারোয়ান।
“তুমি ওই ফ্ল্যাটে ফোন দিয়ে বলবে, ওদের গাড়ির ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে…আগুন লেগেছে।” একটু আগে এ রকম কৌশলই খাঁটিয়েছিল কিসমত আরাকে নিচে নামিয়ে আনার জন্য। সে জানে, এক চালাকি দুইবার খাটে না, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন দু-জনের সঙ্গে নিশ্চয়ই খাটে!
মিথ্যে কথা বলে ফ্ল্যাটের মালিককে ডিবির হাতে অ্যারেস্ট করানোর পরিণাম কী হতে পারে সেটা ভেবে ঢোক গিলেছিল দারোয়ান, কিন্তু বাধ্য হয়েই ইন্টারকমটা তুলে ফ্ল্যাটে কল দেয় সে। যেভাবে তাকে বলা হয়েছিল, সেভাবেই সব কিছু বলে।
ইন্টারকমটা রাখতেই লোকটার পিঠে চাপড় মেরে তাকে সাবাশি দিয়ে। লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাস্টার্ড। একটু পরই দেখে লিফটা নিচে নেমে আসছে। পিস্তল হাতে লিফটের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।
লিফটের দরজা খুলে যেতেই বের হয়ে আসে রঞ্জুর লোকটা, সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারে দরজার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চমকে তাকায় সে। আজ রাতে দ্বিতীয় বারের মতো তাকে দেখে পুরোপুরি ভড়কে যায়।
রঞ্জুর হিট টিম যে তাকে মারতে পারেনি, সেটা হয়তো এই লোকের জানা ছিল না, ফলে ভুত দেখার মতোই অবস্থা হয়েছিল।
“একদম শব্দ করবি না,” মৃত্যুবৎ শীতল কণ্ঠে বলেছিল সে।
উজ্জ্বল কী বলবে বুঝতে পারেনি, তাদের এই ফ্ল্যাটের কথা বাস্টার্ড কিভাবে জানতে পারলো? তারা যে এখানে আছে সেটাই বা জানালো কে?
পিস্তলটার নল দিয়ে গুঁতো মেরে তাকে নিয়ে আবার লিফটে ঢুকে পড়ে বাস্টার্ড, দরজা বন্ধ করার বাটনটা প্রেস করে দেয়।
“আমার হাতে সময় নেই,” লিফটের দরজা বন্ধ হবার পরই পিস্তলটা উজ্জ্বলের পেটে ঠেকিয়ে বলেছিল। “এই অস্ত্রটা দিয়ে গুলি করলে কোনো শব্দ হয় না।”
“ব্-বিশ্বাস করেন,” বলেছিল উজ্জ্বল। “রঞ্জু কই থাকে আমি জানি না।”
মুচকি হেসেছিল সে। “রঞ্জুর খোঁজ আমি জানি।”
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে উজ্জ্বল। বিশ্বাসই হয়নি তার।