৮ম হিজরী সন – রমজান মাস

বিজয়ের শ্রেষ্ঠ ঘটনা : মক্কা বিজয়

অষ্টম হিজরীর রামাযান মাস

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :

অর্থাৎ “তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়; তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ অন্যদের অপেক্ষা যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ্ উভয়ের জন্য কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।” (৫৭- হাদীদ : ১০)

আল্লাহ্ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন :

اذا جاء نصر الله والفتح ور آیت الناس يدخلون في دين الله أفواجا فسبح

بحمد ربك واستغفره انه كان تاباه

অর্থাৎ যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবে তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তিনি তো তাওবা কবূলকারী (১১০- নাসর ও ১-৫)

হুদায়বিয়ার পর অনুষ্ঠিত মহা বিজয়ের কারণ সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে ইবন ইসহাক– মিসওয়ার ইবন মাখরামা (রা) ও মারওয়ান ইবনুল হাকাম (রা) হতে বর্ণনা করেন। তারা দুজনেই বলেন, হুদায়বিয়ার সন্ধির একটি শর্ত ছিল? কেউ ইচ্ছা করলে সন্ধিতে মুহাম্মাদ (সা)-এর পক্ষ নিতে পারে। আবার যে কেউ ইচ্ছা করলে সন্ধিতে কুরায়শদের পক্ষ ও অবলম্বন করতে পারে । বনু খুযাআর লোকজন বলল, আমরা সন্ধিতে মুহাম্মাদ (সা)-এর পক্ষ অবলম্বন করছি। অন্যদিকে বনূ বকর বলল, “আমরা সন্ধিতে কুরায়শদের পক্ষ অবলম্বন করছি। উপরোক্ত সন্ধি তারা সতের কিংবা আঠার মাস পর্যন্ত মেনে চলে। তারপর বনূ বকর মক্কার নিকটবর্তী ওয়াতীর নামক জলাশয়ের নিকট রাতের বেলায় বনু খুযাআর উপর আক্রমণ চালায় । কুরায়শরা ভাবল যে, মুহাম্মাদ (সা) আমাদের সম্পর্কে জানতে পারবেনা, কেননা, এটা রাতের ঘটনা তাই আমাদেরকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। সুতরাং কুরায়শরা বনূ বকরের লোকদেরকে অস্ত্রশস্ত্র ও বাহন দিয়ে সাহ য্যি করল এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে বৈরিতাবশত তারা হত্যাকান্ডে যোগ দিল । ওয়াতীরে বনূ খুযাআ ও বনূ বকরের মধ্যে সংঘটিত ঘটনার পর আমর ইবন সালিম মদীনায় রওয়ানা হলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে পৌঁছে যাবতীয় সংবাদ জানালেন। তিনি এ সম্পর্কে কয়েকটি পংক্তি রচনা করেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আগমন করে তিনি এগুলো তাঁকে আবৃত্তি করে শুনালেন–

حلف أبيه وأبينا الأتلدا

أسلمنا فلم ننزع يدا

ثم وادع عباد الله يأتوا مددا إن سیم خسفا وجهه تربدا إن قريشا أخلفوك الموعدا وجعلوا لي في كداء رصدا فهم أذل وأقل عددا وقتلونا را وسدا

يارب اني ناشد محمدا قد كنتموا ولسا وكنا والدا فانصر رسول الله نصرا أبدا فيهم رسول الله قد تجردا في فيلق كالبحر يجري مزبدا ونقضوا ميثاق المؤگدا وزعموا أن لست أدعو أحدا هم بتونا بالوتير هجدا

হে আমার রব্ব! আমি মুহাম্মাদ (সা)-কে তাঁর ও আমাদের মহা সম্মানিত পিতৃপুরুষদের ওয়াদা অংগীকার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আপনারা ছিলেন আমাদের সন্তানতুল্য আর আমরা ছিলাম আপনাদের পিতৃতুল্য। আমরা এরপর ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমরা ইসলাম হতে আমাদের হাত গুটিয়েও নেইনি। সুতরাং হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের সাহায্য করুন। হে আল্লাহর রাসূল! আমা–দেরকে সাহায্য করুন এবং আমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে আল্লাহর বান্দাদেরকে আহ্বান করুন। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যেই আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। কিন্তু তিনি তাদের মধ্যে অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অন্যায় দেখলে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তখন তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ফেনিলযুক্ত প্রবহমান সাগরের ন্যায় এগিয়ে যান। হে নবী! কুরায়শরা আপনার সাথে ওয়াদা খেলাফ করেছে। তোমার সাথে কৃত মযবূত ওয়াদা তারা ভঙ্গ করেছে। আমাকে হত্যা করার জন্যে তারা কাদা অঞ্চলে ওঁৎ পেতে রয়েছে এবং তারা মনে করে যে, আমি কাউকে সাহায্যের জন্যে পাব না। প্রকৃতপক্ষে তারাই অবমানিত ও সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। দুশমনেরা ওয়াতীর জলাশয়ের নিকট বিদ্রি রজনী যাপন করেছে ও আমাদেরকে রুকু-সিজদারত অবস্থায় হত্যা করেছে ।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, হে আমর ইবন সালিম! আমি অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব। এমন সময় আসমানে একখণ্ড মেঘ দেখা গেল যা মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এমনকি এই মেঘখণ্ডও অবশ্যই বনূ কাবের সাহায্য ঘোষণা করছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) লোকজনকে যুদ্ধের তৈরীর হুকুম দেন; কিন্তু কোথায় অভিযান পরিচালনা করবেন তা তাদের কাছে গোপন রাখেন এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন যেন কুরায়শদের কাছে এ খরবটি প্রকাশ না পায় যাতে আকস্মিকভাবে তাদের জনপদে আক্রমণ করা যায়।

ইন ইসহাক বলেন, তাদের আক্রান্ত হবার কারণ ছিল এই যে, আসওয়াদ ইবন রিযানের মিত্র মালিক ইবন আব্বাদ নামক বনু হাদরামীর এক ব্যক্তি ব্যবসার জন্যে ঘর থেকে বের হয়ে যখন খুযাআ গোত্রের এলাকায় পৌঁছে তখন তারা তার উপর হামলা করে তাকে হত্যা করে ও তার মালপত্র হস্তগত করে নেয়। তাই বনূ বকর ও বনু খুযাআর এক ব্যক্তির উপর হামলা করে তাকে হত্যা করে। এরপর ইসলামের পূর্বে বনূ খুআও আসওয়াদ ইবন রিযান আদ-দায়লীর পুত্রদের উপর হামলা করে। তাঁরা ছিলেন সালামা, কুলসূম ও যুওয়াইব। আর তাঁরা ছিলেন বনূ কিনানার খুবই গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তাদেরকে আরাফাতের হারমের সীমানা স্তম্ভগুলোর সামনেই হত্যা করা হয়। ইবন ইসহাক বলেন, দায়লি গোত্রের এক ব্যক্তি বর্ণনা করে যে, জাহেলিয়াতের যুগে আমাদের একটি রক্তপণের পরিবর্তে বনূ আসওয়াদ ইবন রিযান দুইটি রক্তপণ আদায় করত। বনূ বকর ও বনূ খুযাআর বিরোধপূর্ণ এরূপ অবস্থায় ইসলামের আবির্ভাব হয়। যখন হুদায়বিয়ার সন্ধি সংঘটিত হয় তখন বনূ বকর কুরায়শদের পক্ষে যোগ দেয় এবং বনু খুযাআ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পক্ষে যোগ দেয়।

বনূ বকরের একটি অংশ বনূ দায়ল হুদায়বিয়ার সন্ধিরকালে বনূ খুযাআর লোকদের থেকে প্রতিশোধ নিতে মনস্থ করে। বনূ দায়লের সর্দার নওফল ইবন মু’আবিয়া আদ-দায়লী আল-ওয়াতীর জলাশয়ের নিকট বনূ খুযাআর উপর রাতের বেলা হামলা করে তাদের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ও অন্যদের লুটপাট করে। বনূ বকরের লোকেরা তাদের সাহায্য করে এমনকি কুরায়শরাও অস্ত্র দিয়ে তাদের সাহায্য করে। কুরায়রা রাতের বেলায় গোপনে তাদের সাথে এ আক্রমণে অংশগ্রহণ করে, এমনকি বনূ খুযাআকে হারাম শরীফে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। বনূ বকরের সর্দারকে অন্যান্য সদস্যরা বলতে লাগল আমরা হেরেমে এসে গেছি, তোমাদের সামনে তোমাদের উপাস্য, থেমে যাও। তখন তাদের সর্দার বিজয়ের জোশে একটি জঘন্য কথা বলে ফেলে, সে বলল, হে বনূ বকর, আজকের দিনে কোন উপাস্য নেই । আজ প্রতিশোধ নেবার দিন । তোমরা হারমে চুরি করতে পার আর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারবে না? শেষ পর্যন্ত বনূ খুযাআ মক্কায় অবস্থিত বুদায়ল ইবন ওরাকার ঘরে ও তাদের আযাদকৃত গোলাম রাফি’র ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই অবস্থার বর্ণনা দিয়ে আখযার ইবন লাত আদ-দায়লী কবিতার ছন্দে বলেন : “কুরায়শের দূরবর্তী লোকেরা কি সংবাদ পায়নি যে, আমরা বনূ কা’বকে বর্শাফলকের উপরিভাগের আঘাতে আঘাতে কুয়ার স্থান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি এবং গোলাম রাফি’ এর ঘরে তাদেরকে অবরুদ্ধ করেছি? আর কিছুক্ষণের জন্যে নেতা বুদায়লের ঘরেও তাদেরকে অবরোধ করা হয়েছে। তাদের কিছু সংখ্যক লোককে বর্শা পতিত হওয়ার স্থানে হত্যা করে আমাদের মনের ঝাল মিটিয়েছি। তাদের অবশিষ্টদেরকে অত্যাচারী ও নিতান্তহীন ব্যক্তির ঘরে আমরা অবরোধ করে রেখেছি। তাদের অবরোধ দীর্ঘায়িত হল তখন আমরা ধ্বনি দিতে লাগলাম যাতে প্রতিটি গোত্র থেকে বহু সংখ্যক লোক তাদের শোচনীয় অবস্থা দেখার জন্যে জমায়েত হতে পারে। আমরা তাদেরকে তোয়ার দিয়ে যবাই করেছিলাম যেমন সিংহকূল বকরীগুলোকে তাদের নখর দিয়ে খন্ডবিখন্ড করে ফেলে। তারা আমাদের প্রতি যুলুম করেছে, তাদের কর্মকান্ডে তারা সীমালংঘন করেছে। আর হারমের পাথর ফলকগুলোর সম্মুখে ছিল তাদের প্রথম ঘাতক ব্যক্তিটি। যখন তাদেরকে তাড়ানো হয়েছিল বনূ কাবের লোকেরা ভয়ে এমনভাবে ছুটাছুটি করেছিল যেমন কেউ উটপাখির ছানাদের তাড়াচ্ছিল।

রাবী বলেন, আখরের উত্তরে বুদায়ল ইবন আবদে মানাত ইব্‌ন ছালামা ইবন আমর ইবন আল আজব যাকে বুদায়ল ইবন উম্মে আরামও বলা হয়। কবিতায় বলেন

“একটি সম্প্রদায় সন্ধিতে আবদ্ধ হয়েছে এজন্য তারা গর্ব করছে। তাদের জন্যে কোন সর্দারকে আমরা অবশিষ্ট রাখিনি যে (যুদ্ধজয়ী হয়ে) গনীমত বিতরণ করবে। তুমি কি পূর্বোক্ত সম্প্রদায়ের ভয়ে তাদেরকে ঘৃণা করে, ভয়ে ভয়ে নিরাশ হয়ে ওয়াতীর অতিক্রম কর? আমরা প্রতিদিনই কারো না কারো রক্তপণ শোধ করে থাকি। অথচ আমাদেরকে কোন রক্তপণ দেওয়া হয়না। (কেননা, আমাদের কেউ নিহত হয় না, ফলে রক্তপণ পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আমরা আমাদের তলোয়ার সহকারে সকালে তোমাদের এলাকায় পৌঁছেছি। আমাদের তলোয়ার ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনার পরোয়া করে না। এবং আশে পাশের গোত্রগুলোকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। গামীমের যুদ্ধের নিনে যখন তোমাদের একজন পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমাদের এক বীর অশ্বারোহীর মাধ্যমে আমরা তার দফা-রফা করেছি। আল্লাহর ঘরের কসম, তোমরা যুদ্ধ শুরু করোনি, তা সত্য নয়। তোমরা মিথ্যা বলেছ । তোমরা যদি কাউকে হত্যা করে থাক, তবে আমরাও তোমাদেরকে কঠিন বিপর্যয়ে ফেলার ব্যবস্থা করছি।”

ইবন ইসহাক বলেন, বনূ খুযাআর কিছু সংখ্যক লোক নিয়ে বুদায়ল ইবন ওরাকা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দরবারে আগমন করলেন এবং তাদের কত লোক নিহত হয়েছে ও তাদের বিরুদ্ধে বনূ বকরের কুরায়শদের সাহায্য করার ব্যাপারটি সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বিস্তারিত জানালেন। এরপর তারা মক্কা প্রত্যাবর্তন করেন। রাস্তায় উছফান নামক স্থানে আবু সুফিয়ান (রা)-এর সাথে তাদের মুলাকাত হয়। সন্ধি নবায়ন ও সন্ধির সময় বৃদ্ধি করার জন্যে কুরায়শরা তাঁকে মদীনা প্রেরণ করেছিল । আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, হে বুদায়ল! তুমি কোথা থেকে আগমন করলে? আর তিনি ধারণা করলেন যে, বুদায়ল সম্ভবত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে গিয়েছিলেন। বুদায়ল বললেন, ‘বনূ খুযাআর এলাকা পর্যন্ত আমরা গিয়েছিলাম। রাবী বলেন, আবু সুফিয়ান (রা) বুদায়ল ও তাঁর সাথীদের উটের মাল পরীক্ষা করে বললেন, আল্লাহর শপথ, বুদায়ল ও তাঁর সাথীরা মদীনায় মুহাম্মাদ (সা)-এর নিকট গিয়েছিল। এরপর আবু সুফিয়ান (রা) মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সা)–এর কাছে আগমন করেন এবং নিজের কন্যা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সহধর্মিণী উম্মে হাবীবা (রা)–এর ঘরে প্রবেশ করেন। যখন তিনি বিছানায় বসতে চান তখন উম্মুল মু’মিনীন উম্মে হাবীবা (রা) বিছানা গুটিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, হে আমার কন্যা! আমি কি এ বিছানার উপযুক্ত নই? না এ বিছানা আমার উপযুক্ত নয় বলে তুমি মনে করছ? তিনি বলেন, এটা আল্লাহর রাসূলের বিছানা। আর তুমি মুশরিক ও নাপাক। তাই আমি চাই না যে, তুমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিছানায় বস । আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, হে আমার কন্যা! আল্লাহর শপথ, আমি চলে যাবার পর তোমার অমঙ্গল হবে। একথা বলে তিনি উম্মে হাবীবা (রা)-এর ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর ঘরে গেলেন ও কথা বললেন! যাতে আবু বকর সিদ্দীক (রা) আবু সুফিয়ান (রা)-এর পক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে সুপারিশ করেন। কিন্তু তিনি বললেন, ‘আমি একাজ করতে পারবনা।’ এরপর তিনি উমর (রা)-এর কাছে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে তার জন্যে সুপারিশ করার অনুরোধ করলেন। ওমর (রা) বললেন, আমি তোমার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সুপারিশ করব? এটা হতেই পারে না। আমিত কোন তাবস্থায়ই তোমাদের সাথে যুদ্ধ বাদ দিতে রাজী নই। এরপর তিনি আলী (রা) ইবন আবু তালিবের ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁর কাছে ফাতিমা বিনত রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও উপস্থিত ছিলেন। আর বালক হাসান (রা) তাদের সামনে খেলা করছিলেন। তিনি বললেন, হে আলী! তুমিত আমাদের লোকজনের প্রতি খুবই সদয় এবং তাদের কাছে বংশের দিক দিয়ে আমার চাইতেও ঘনিষ্টতর আমি একটি দরকারী কাজে এসেছিলাম। আমি কি অকৃতকার্য হয়ে চলে যাব? তুমি আমার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে একটু সুপারিশ করবে? তিনি বললেন, হে আবু সুফিয়ান! আল্লাহর শপথ, তুমি জেনে রেখো, আমাদের মধ্যে কারো শক্তি নেই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলে। এরপর আবু সুফিয়ান (রা) ফাতিমা (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেন, হে মুহাম্মাদের কন্যা! তুমি কি তোমার এ ছেলেকে অনুমতি দিতে পার যে, সে জনগণকে নিরাপত্তা দেবে, এরপর সে শেষযুগ পর্যন্ত আরবের সর্দার হিসেবে পরিগণিত হবে? তিনি বললেন, প্রথমত আমার ছেলের এত বয়স হয়নি যে, সে জনগণকে নিরাপত্তা প্রদান করবে। দ্বিতীয়ত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মতের বিরুদ্ধে কেউ জনগণকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে এগিয়ে আসবে না। তারপর আবু সুফিয়ান (রা) আলী (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেন, হে আবুল হাসান! আমি দেখছি যে, ব্যাপারটি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। তুমি আমাকে উপদেশ দাও আমি এখন কি করতে পারি? তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমিও জানি না কি করলে তোমার এ মিশন কৃতকার্য হবে? তবে আমার মনে হয়, একটি কাজ করা যায়, তাতে তোমার কতদূর উপকার হবে তাও আমার জানা নেই। তুমিত বনূ কিনানার সর্দার, তুমি দাঁড়িয়ে যাবে ও জনগণকে নিরাপত্তা দেয়ার ঘোষণা দেবে। তারপর নিজের দেশে চলে যাবে। তিনি বললেন, তুমি কি মনে কর যে এতে কোন উপকার হবে? আলী (রা) বললেন, ‘না আল্লাহর শপথ, এটাতে কোন উপকার আমি দেখছিনা তবে এটা ছাড়া অন্য কোন পথও তোমার জন্যে আমি দেখতে পাচ্ছি না। আবু সুফিয়ান মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং দাঁড়িয়ে বললেন, “হে জনগণ! আমি তোমাদেরকে নিরাপত্তার ঘোষণা দিচ্ছি।” তারপর তিনি তার উটে সওয়ার হয়ে চলে যান। যখন তিনি কুরায়শদের কাছে গমন করলেন, তখন তারা বললেন, “কী হল?” তিনি বললেন, মুহাম্মাদের কাছে গিয়েছিলাম, তার সাথে কথা বললাম, আল্লাহর শপথ, তিনি কিছুই বললেন না। তারপর ইব্‌ন আবু কুহাফা (রা)-এর কাছে গেলাম । আল্লাহর শপথ, তার মধ্যেও কোন মঙ্গলের লক্ষণ দেখতে পেলাম না। এরপর উমরের কাছে গেলাম । তাকে দুশমনদের মধ্যে সেরা দুশমনরূপে পেলাম। এরপর আলী এর কাছে গেলাম । তাকে কিছুটা নরম দেখা গেল। আলী একটি কাজের পরামর্শ দিলেন। আর সে কাজটি আমি করেও এসেছি। আল্লাহর শপথ, আমি জানি না, এতে আমাদের কোন কাজ হবে কিনা? তারা বলল, সে কাজটা কী? তিনি বললেন, আলী বললেন, আমি যেন জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা ঘোষণা করি । আর আমি তা করে এসেছি। তারা বলল, মুহাম্মাদ কি তোমাকে এ কাজটি করার জন্যে অনুমতি দিয়েছিলেন? তিনি বললেন, ‘না। তারা বলল, তোমার জন্যে আফসোস, আলী তোমার সাথে উপহাস করার জন্যেই এ পরামর্শ দিয়েছেন। তুমি যা বলেছ এতে আমাদের কোনই উপকার হবে না। তিনি বললেন, ‘না’ তবে এ ছাড়া আমার কিছু করণীয়ও ছিল না ।

সুহায়লী এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। এ হাদীছে উল্লিখিত ফাতিমা (রা)-এর উক্তিটি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। যাতে ফাতিমা (রা) বলেছিলেন, কেউ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ঘোষণা করবে না, অথচ হাদীছে রয়েছে :

অর্থাৎ মুসলমানদের একজন সাধারণ লোকও নিরাপত্তা ঘোষণা করতে পারে। তিনি বলেন, এদুই হাদীছের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যায় এভাবে যে, শেষোক্ত হাদীছে ব্যক্তি বিশেষ কিংবা কয়েকজনকে নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ফাতিমা (রা)- এর হাদীছে ইমামের যুদ্ধ নীতির বিরুদ্ধে বৃহত্তর জনতাকে নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কারোর জন্যে নিরাপত্তা প্রদানের অধিকার নেই। সাহনূন ও ইবনুল মাজিশুন বলেন, স্ত্রীলোকের নিরাপত্তা প্রদান ইমামের অনুমতির উপর নির্ভরশীল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) উম্মে হানীকে বলেছিলেন :

“হে উম্মে হানী! তুমি যাকে নিরাপত্তা দিয়েছ আমিও তাকে নিরাপত্তা দিলাম।” রাবী বলেন, উপরোক্ত হাদীছটি আমর ইবন আস (রা) এবং খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে।

আবু হানীফা (র) বলেন, কোন গোলাম নিরাপত্তা প্রদানের অধিকার রাখে না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বাণী : asic, অর্থাৎ “তাদের মধ্যে সাধারণ ব্যক্তিও নিরাপত্তা দিতে পারে। এর মধ্যে গোলাম এবং মহিলাও অন্তর্ভুক্ত বলে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ্ তা’আলাই অধিক পরিজ্ঞাত।

বায়হাকী– আবূ হুরায়রা (রা) হতে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, বনূ কা’ব (আমর ইবন সালিম বিরচিত কবিতা আবৃত্তি করে) বলে? “হে আল্লাহ্! আমি মুহাম্মাদ (সা)-কে তাঁর ও আমাদের মহাসম্মানিত পিতৃপুরুষদের ওয়াদা অঙ্গীকার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। হে রাসূল! আপনি আমাদেরকে সাহায্য করুন! আল্লাহ আপনাকে তওফীক দিন এবং আমাদের সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসতে আপনি আল্লাহর বান্দাদেরকে আহ্বান করুন।

মক্কা বিজয়ের বর্ণনায় মূসা ইব্‌ন উকবা বলেন । এরপর বনূ আদ-দায়ল-এর অংশ বনূ নুফাসাহ বনু কা’ব-এর উপর লুটপাট চালায়। তাদের এ ঘটনা রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও কুরায়শদের মধ্যে অনুষ্ঠিত সন্ধির সময়ে সংঘটিত হয়েছিল। বনূ কা’ব রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সন্ধিবদ্ধ ছিল । অন্যদিকে বনূ নুফাসাহ ছিল কুরায়শদের সাথে সম্পৃক্ত। তাই কুরায়শদের মিত্র বনূ বকর বন্দু নূফাসাকে সাহায্য করে। আবার তাদেরকে কুরায়শরাও অস্ত্র শস্ত্র এবং গোলাম দিয়ে সাহায্য করে। কিন্তু বনূ মুদলিজ তাদের থেকে পৃথক থাকে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সম্পাদিত সন্ধি মেনে চলে। বন্‌ আদ-দায়লের দুইজন সর্দার সালামা ইবনুল আসওদ ও কুলদূয ইবনুল আসওদ আর তাদের সাহায্যকারী সাফওয়ান ইবন উমাইয়া, শায়বা ইবন উসমান এবং সুহায়ল ইবন আমর, তারা সকলে মিলে বনূ আমরের সাধারণ জনতার উপর লুটতরাজ চালায়। তাদের মহিলা, ছেলেমেয়ে ও দুর্বল পুরুষদের কিছু সংখ্যককে তারা হত্যা করে এবং অবশিষ্টদেরকে মক্কায় অবস্থিত বুদায়ল ইব্‌ন ওরাকা-এর ঘরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। তাই বনূ কা’বের একটি কাফেলা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে এসে তাদের মধ্যে যারা নিহত হয়েছে এবং কুরায়শরা তাদের বিরুদ্ধে দুশমনকে যে সাহায্য করেছে এসব সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে অবহিত করে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে বলেন, তোমরা ফিরে যাও এবং বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে । অন্যদিকে আবু সুফিয়ান (রা) পূর্বোক্ত ঘটনার কারণে মক্কা থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আগমন করে এবং বলে, হে মুহাম্মাদ! মেয়াদের পরেও সন্ধি নবায়ন করুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, এজন্যে কি তুমি এসেছ? তোমাদের মধ্যে কি কেউ সন্ধি ভঙ্গ করেছে? তিনি বললেন, আল্লাহ রক্ষা করুন! আমরা হুদায়বিয়ার সন্ধি মেনে চলছি। আমরা তা পরিবর্তন করব না। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ঘর থেকে বের হলেন ও আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর ঘরে গেলেন এবং বললেন, সন্ধিটি নবায়ন এবং তার সময় বৃদ্ধির ব্যবস্থা কর । আবু বকর (রা) বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিরাপত্তাই আমার নিরাপত্তা। আল্লাহ্ শপথ, আমি যদি একটি পিপড়াকেও তোমাদের রিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখি, তাহলে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করব। এরপর তিনি বের হয়ে গেলেন এবং উমর (রা)-এর কাছে গিয়ে তার সাথে কথা বললেন। তিনি জবাব দিলেন, আমাদের সন্ধি যদি নতুনও হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ্ তা’আলা এটাকে পুরনো করে দিন। আর যদি কোনটা মযবূত হয়ে থাকে তাহলে তিনি তা ছিন্ন করে দিন। আবার যদি কোনটা কর্তিত হয়ে থাকে তাহলে তিনি এটাকে যেন আর কখনও সংযুক্ত না করেন। আবু সুফিয়ান তাঁকে বললেন, আত্মীয়তার বন্ধনের তুমি কোন মূল্যই দিলে না! তারপর তিনি উছমান (রা)-এর ঘরে প্রবেশ করেন এবং তাঁর সাথে কথা বলেন। উছমান (রা) বললেন, আমার নিরাপত্তা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিরাপত্তার মধ্যেই নিহিত। তারপর তিনি মুসলিম কুরায়শদের গণ্যমান্য লোকদের সাথে সাক্ষাত করলেন ও তাদের সাথে কথা বললেন। তাঁদের সকলে জবাব দিলেন আমাদের সন্ধি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সন্ধির সাথে সম্পৃক্ত। যখন তিনি তাঁদের থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন তখন ফাতিমা বিনত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ঘরে প্রবেশ করেন ও তার সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি একজন মহিলা। আর এটা হচ্ছে একান্তই রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ব্যাপার। তখন তিনি ফাতিমা (রা)-কে বললেন, তোমার একটি ছেলেকে এরূপ হুকুম কর! তিনি বললেন, “তারা একান্তই ছেলে মানুষ। তাদের মত অল্পবয়স্করা কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারে না।” তিনি বললেন, তাহলে আমাকে আলী (রা)-এর সাথে কথা বলার সুযোগ করে দাও। তিনি বললেন, যান আপনি নিজে তার সাথে কথা বলুন। তিনি আলী (রা)-এর সাথে কথা বললেন। আলী (রা) বললেন, হে আবু সুফিয়ান! রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহাবীগণের মধ্যে কেউই রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মুকাবিলায় নিরাপত্তা নিয়ে গোপনে কথা বলবেন না । আর আপনি কুরায়শদের সর্দার, তাদের মধ্যে সবচাইতে প্রবীণ ও প্রতাপশালী । আপনি আপনার সমাজকে নিরাপত্তা দিন । তিনি বললেন, তুমি ঠিক বলেছ, আমি এরকমই একজন সর্দার। এরপর তিনি বের হয়ে গেলেন এবং চীৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন, শুনে রাখুন, আমি জনগণকে নিরাপত্তা দিচ্ছি । আল্লাহর শপথ! আমি ধারণা করি না যে, কেউ আমার এ নিরাপত্তার অংগীকার ভংগ করবে।” তারপর আবু সুফিয়ান (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে প্রবেশ করলেন এবং বলতে লাগলেন, “হে মুহাম্মাদ! আমি জনগণকে নিরাপত্তা প্রদান করেছি। আল্লাহর শপথ, আমি ধারণা করিনা যে, কেউ আমার এ নিরাপত্তার অংগীকার ভঙ্গ করবে এবং আমার নিরাপত্তাকে কেউ প্রত্যাখ্যান করবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “হে আবূ হানযালা! এটা শুধু তুমিই বছ।” তখন আবু সুফিয়ান (রা) এ কথার উপর বের হয়ে গেলেন। ইতিহাসবিদগণ বলেন, (আল্লাহ্ অধিক পরিজ্ঞাত) যখন আবু সুফিয়ান (রা) চলে যাচ্ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, “হে আল্লাহ্! তাদের শোনার ও দেখার শক্তি রহিত করে দিন। তারা যেন আমাদেরকে আকস্মিকভাবে দেখে ও অতর্কিতে আমাদের কথা শোনে। এদিকে আবু সুফিয়ান (রা) মক্কায় ফিরে গেলেন। কুরায়শরা প্রশ্ন করল, খবর কী? মুহাম্মাদ (সা) হতে কি কোন চুক্তিনামা বা অঙ্গীকার নিয়ে আসতে পারলেন? তিনি বললেন, ‘না’, আল্লাহর শপথ, তিনি তাতে স্বীকৃত হননি। এরপর আমি তাঁর সাহাবীদের সাথে পরপর কথা বলেছি। আমি এরূপ কোন সম্প্রদায় আর দেখিনি যারা তাদের শাসনকর্তার প্রতি এদের চাইতে বেশি অনুগত। শুধূমাত্র আলী (রা) আমাকে বলেছেন, তুমি তোমার লোকজনের কাছে নিরাপত্তা চাও! তুমি তোমার সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা কেন দিতে যাবে? তুমি কুরায়শদের সর্দার, তুমি তাদের সকলের চাইতে প্রবীণ এবং তুমি সকলের চেয়ে বেশী হকদার যে, তোমার নিরাপত্তা অঙ্গীকার কেউই ভঙ্গ করবে না। আবু সুফিয়ান বলেন, আমি নিরাপত্তার ঘোষণা দিলাম এবং পরে আমি মুহাম্মাদের কাছে গেলাম । আর আমি তার কাছে উল্লেখ করলাম যে, আমি জনগণকে নিরাপত্তা দান করেছি এবং এও বললাম, আমার মনে হয় না, কেউ আমার নিরাপত্তা ভঙ্গ করবে।’ তিনি বললেন, “হে আবু হানযালা! তুমিই শুধু এটা বলছ।” তারা তখন আবু সুফিয়ানের প্রতিউত্তরে বলল, “তার সম্মতি ছাড়াই আপনি নিজে নিজে সম্মত হয়ে এসেছেন । আর আপনি এমন বস্তু নিয়ে এসেছেন যার মধ্যে আমাদের বা আপনার কোন উপকার নেই। আলী (রা) আপনার সাথে উপহাস করেছেন। আল্লাহর শপথ! আপনার নিরাপত্তার ঘোষণা বৈধ নয়। আর এ নিরাপত্তা ঘোষণার বর খেলাপ করা তাদের জন্যে খুবই সহজ। এরপর আবু সুফিয়ান তাঁর স্ত্রীর কাছে গেলেন এবং তার কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে আল্লাহ তোমার চেহারা কুৎসিত করুন। তুমি কোন মঙ্গলই নিয়ে আসতে পারনি। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) একটি মেঘখণ্ড দেখে বলেছিলেন, “এ মেঘ খণ্ডটিও বনূ কাবের সাহায্যে বর্ষিত হবে।” আবু সুফিয়ান (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছ থেকে বের হয়ে আসার পর যতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা আল্লাহর মঞ্জুর ছিল ততদিন পর্যন্ত তিনি অপেক্ষায় রইলেন। এরপর তিনি তৈরী হতে লাগলেন। আইশা (রা)-কে তৈরী হতে নির্দেশ দিলেন। আর তা গোপন রাখতেও বললেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) মসজিদের দিকে বের হয়ে গেলেন অথবা কোন প্রয়োজনে কোথায়ও গেলেন। আবু বকর (রা) আইশা (রা)-এর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং দেখতে পেলেন আইশা (রা) গম পরিষ্কার করছেন। তিনি তাকে বললেন, “হে আমার কন্যা! এ খাবার কেন তৈরী করছ?” তিনি চুপ করে রইলেন। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কি কোন যুদ্ধে যেতে মনস্থ করেছেন : তিনি নিরুত্তর রইলেন। আবু বকর (রা) আবারো বললেন, তিনি কি বনুল আসফার অর্থাৎ রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবেন? তিনি চুপ করে রইলেন। তিনি আবার বললেন, হয়ত নজদবাসীদের উদ্দেশ্যে অভিযানে যাবেন? আইশা (রা) এবারও চুপ করে রইলেন। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, সম্ভবত কুরায়শদের বিরুদ্ধে তিনি এবার যুদ্ধ করবেন? আইশা সিদ্দীকা (রা) এবারও চুপ করে রইলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) ঘরে প্রবেশ করলেন। আবু বকর সিদ্দীক (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি কি কোথায়ও যুদ্ধে যাচ্ছেন? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। এরপর তিনি বললেন, আপনি হয়ত বনুল আসফারের দিকে অভিযান পরিচালনা করবেন? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, না। তিনি বললেন, “তাহলে কি নজদবাসীদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন?” তিনি বললেন, “না।” এরপর তিনি বললেন, “সম্ভবত কুরায়শদের বিরুদ্ধে আপনি যুদ্ধ করবেন?” রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “হ্যাঁ।” আবু বকর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার মধ্যে ও তাদের মধ্যে একটি সন্ধি রয়েছে না? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তুমি কি জানো, তারা বনূ কাবের সাথে কী আচরণ করেছে? রাবী বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাধারণ্যে যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন। হাতিব ইবন আবূ বাতা’আ (রা) কুরায়শদের উদ্দেশ্যে একটি পত্র লিখেন; কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এ বিষয়ে অবহিত করে দিলেন।

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক– আইশা সিদ্দীকা (র) থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, ‘আবু বকর সিদ্দীক (রা) আইশা সিদ্দীকা (রা)-এর ঘরে প্রবেশ করলেন। দেখলেন, তিনি গম চালছেন। তিনি বললেন, এটা কী? রাসূলুল্লাহ্ (সা) কি তোমাকে প্রস্তুতির হুকুম দিয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আবু বকর (রা) বললেন, ‘কোথায়? আইশা (রা) বললেন, “তিনি আমার কাছে জায়গার নাম বলেননি, শুধু আমাকে তৈরী হতে বলেছেন।”

ইবন ইসহাক বলেন, “এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) জনগণকে অবহিত করলেন যে, তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। তাই তিনি তাদেরকে তৈরী হতে বললেন। তিনি আরো বললেন, হে আল্লাহ! কুরায়শ থেকে খবরটি গোপন রাখ যাতে আমরা তাদের শহরে পৌঁছে তাদেরকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করতে পারি। তারপর লোকজন তৈরী হল । জনগণকে উৎসাহিত করার জন্যে বনূ খুযাআর উপর আপতিত মুসীবতের বর্ণনায় হাস্সান ইবন ছাবিত বলেন :

আমার উটের লাগাম আমার হাতে, আমি তৈরী কিন্তু আমি এখনও মক্কার বাতহায় পৌঁছতে পারিনি। সেখানে বনূ কাবের লোকদের গলা কাটা হয়েছে এমন লোকদের দ্বারা যারা প্রকাশ্যে শত্রুর বিরুদ্ধে তলোয়ার কোষমুক্ত করেনি। এতবেশী লোক তারা হত্যা করেছে যাদেরকে যথারীতি কাপড় দিয়ে উত্তমরূপে কাফন দেয়া সম্ভব হয়নি। আফসোস, যদি আমি জানতে পারতাম যখন আমার সাহায্য সুহায়ল ইবন আমরের বিরুদ্ধে পৌঁছবে। কেননা, সে যুদ্ধকে ভড়কে দিয়েছিল এবং যুদ্ধের ঘটিকে উত্তপ্ত করেছিল। আমার সাহায্য কি কাপুরুষ সাফওয়ানের বিরুদ্ধে পৌঁছবে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে এখনই যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধের জন্যে তৈরী হওয়ার সময়। হে উম্মে মুজালিদের পুত্র (ইকরামা ইবন আবু জাহল)! আমাদের হাত থেকে তুমি নিজেকে নিরাপদ মনে করোনা যখন যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করবে। চেঁচামেচি করে লাভ হবে না। আমাদের তলোয়ারগুলো যুদ্ধের প্রারম্ভেই ভীষণ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে প্রস্তুত।

হাতিব ইবন আবূ বালতা’আর ঘটনা

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) উরওয়া ইবন যুবায়র (রা) প্রমুখ আলিমগণ থেকে বর্ণনা করেন, তারা বলেন, ‘যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কা অভিযানে যেতে মনস্থ করলেন তখন হাতিব ইব্ন আবু বালতা’আ (রা) কুরায়শদের কাছে একটি পত্র লিখেন। তাতে তিনি লিখেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কা অভিযানে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারপর তা তিনি একজন মহিলার কাছে সমর্পণ করেন। মুহাম্মাদ ইবন জাফর বলেন, এ মহিলাটি মুযায়না গোত্রের। অন্যান্যরা মনে করেন যে, মহিলাটির নাম সারা। যে ছিল বনূ আবদুল মুত্তালিবের কারোর দাসী। কুরায়শদের কাছে এ পত্রটি পৌঁছিয়ে দেয়ার বিনিময়ে তিনি তাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিকও দেন। সে পত্রটি তার মাথার চুলে রেখেছিল এবং চুল দিয়ে তার সাথে বেণী বেঁধেছিল। হাতিব (রা)-এর এ ব্যাপারটি সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আসমান থেকে খবর আসে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আলী ইবন আবু তালিব (রা) ও যুবায়র ইবন আওয়াম (রা)-কে প্রেরণ করেন এবং বলেন, তোমরা দুজনে একজন মহিলাকে পাবে যার দ্বারা হাতিব ইবন আবু বালতাআ (রা) কুরায়শদেরকে একটি পত্র লিখেছে। তাদের প্রতি আক্রমণ করার জন্যে আমরা যে মনস্থ করেছি এ সম্বন্ধে সে এ পত্রে তাদেরকে হুঁশিয়ার করেছে। তারা দুজন বের হয়ে গেলেন এবং সে মহিলাকে তাঁরা বনূ আবু আহমদের হুলাইফায় (তৃণভূমিতে) পেলেন। তাঁরা দুজন তাকে অবতরণ করতে অনুরোধ করলেন এবং তার বাহনের হাওদায় তল্লাশী চালালেন; কিন্তু তাতে কোন কিছু পেলেন না। আলী (রা) তাকে বললেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মিথ্যা বলেননি। আর আমরাও মিথ্যা বলছিনা। তুমি আমাদের কাছে এ পত্রটি সমর্পণ কর নচেৎ আমরা তোমার কাপড় খুলে তল্লাশী চালাব। যখন মহিলাটি তাদের দৃঢ় প্রত্যয় দেখতে পেল, তখন বলল, আপনি অন্য দিকে মুখ ফিরান। তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরালেন। তখন মহিলাটি তার মাথার খোঁপা থেকে পত্রটি বের করে দিল। আলী (রা) ও যুবায়র (রা) এ পত্রটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর খিদমতে পেশ করলেন। তিনি হাতিব (রা)-কে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, “হে হাতিব! একাজ করতে তোমাকে কিসে প্ররোচিত করল? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি । আমি আমার বিশ্বাস ও ধর্ম পরিবর্তন করিনি; কিন্তু আমি এমন এক ব্যক্তি যার মক্কাবাসীদের কাছে কোন গোত্রগোষ্ঠী নেই এবং আপন জন বলতেও কেউ নেই। কিন্তু তাদের মাঝে আমার স্ত্রী পুত্ররা রয়ে গেছে। তাই আমি তাদের একটু ইহসান করতে ইচ্ছে করেছিলাম যাতে তারা পরিবারবর্গের প্রতি একটু লক্ষ্য রাখে। উমর ইবন খাত্তাব (রা) বলে উঠলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এ মুনাফিককে হত্যা করার জন্যে আমাকে অনুমতি দিন! কেননা, এতো মুনাফিকী করেছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “হে উমর (রা)! তুমি কি জানো বদরের যুদ্ধের দিন আল্লাহ্ তা’আলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের উপর সদয় হয়ে বলেছিলেন। তোমরা যা ইচ্ছে করতে পার। আমি তোমাদের মার্জনা করে দিয়েছি?”

হাতিব (রা) সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন :

يأيها الذين آمنوا لا تتخذوا عدوی وعدوم أولياء تلقون اليهم

كفروا بما جاءكم من الحق يخرجون الرسول وایاگم آن

بالمودة و

অর্থাৎ হে মুমিনগণ! আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে না। তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করছ অথচ তারা তোমাদের নিকট যে সত্য এসেছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে, রাসূলকে এবং তোমাদেরকে বহিষ্কার করেছ এ কারণে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহতে বিশ্বাস কর। (৬০- মুমতাহিনা ১-৬)।

ইবন ইসহাক (র) উপরোক্ত ঘটনাটি মুরসালরূপে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। সুহায়লী উল্লেখ করেন যে, হাতিব (রা) তাঁর পত্রে লিখেছিলেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (সা) বিশাল বাহিনী নিয়ে তোমাদের দিকে রওয়ানা হয়েছেন। প্লাবনের গতিতে তারা এগিয়ে চলেছেন। আল্লাহর শপথ করে আমি বলছি, তিনি যদি একাই এ অভিযান পরিচালনা করেন তাহলে আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের বিরুদ্ধে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। কেননা, তার ওয়াদা তিনি অবশ্যই পূর্ণ করবেন। রাবী বলেন, ইবনে সালামের তাফসীরে আছে যে, হাতিব (রা) লিখেছিলেন যে, মুহাম্মাদ (সা) ঘর থেকে বের হয়ে পড়েছেন, জানি না তোমাদের দিকে, না কি অন্য কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছেন? তবে তোমাদের উচিত সাবধানতা অবলম্বন করা।

ইমাম বুখারী (র)– আলী (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) একদিন আমাকে যুবায়র (রা) ও মিকদাদ (রা)-কে প্রেরণ করলেন এবং বললেন, “তোমরা চলতে থাকবে যতক্ষণ না তোমরা রওযায়ে খাখ নামক স্থানে পৌঁছ। ঐখানে তোমরা একজন আরোহিণীকে পাবে, তার সাথে একটি পত্র রয়েছে। তার থেকে পত্রটি উদ্ধার করে নিয়ে আসবে।” আলী (রা) বলেন, আমরা এরপর চলতে লাগলাম। আমাদেরকে নিয়ে আমাদের সওয়ারী খুব দ্রুত চলতে লাগল যতক্ষণ না আমরা রও্যায়ে খাখে পৌঁছি। সেখানে পৌঁছে আমরা একজন আরোহিণীকে পেলাম। তখন আমরা তাকে বললাম, পত্রটি বের করে দাও! সে বলল, আমার কাছে কোন পত্র নেই। আমরা তাকে বললাম, পত্র বের করে দেবে নচেৎ আমরা তোমার কাপড় খুলে তল্লাশী করতে বাধ্য হবো। রাবী বলেন, এরপর সে চুলের খোঁপা থেকে পত্রটি বের করে দিল । পত্রটি নিয়ে এসে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সমর্পণ করলাম। পত্রে লিখা ছিল, হাতিব ইবন আবু বালতাআ হতে মক্কার মুশরিক জনগণের প্রতি। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কিছু কর্মকান্ড সম্বন্ধে সে মুশরিকদেরকে খবর দিচ্ছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাতিবকে (রা) বললেন, হে হাতিব (রা)! এটা কী? তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! দয়া করে আমার সম্বন্ধে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি কুরায়শদের সাথে জড়িত ছিলাম। আমি তাদের মিত্র ছিলাম। কিন্তু আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না । আপনার সাথে যেসব মুহাজির আছেন তাদের নিকট আত্মীয় রয়েছে যারা তাদের পরিবার ও মালপত্র রক্ষা করতে পারে। আমার এ ধরনের বংশগত কোন সম্পর্ক না থাকার দরুন আমি চেয়েছিলাম তাদের আমি কিছু উপকার করব, যাতে করে তারা আমার পরিবার-পরিজনকে হিফাযত করে। আর আমি এটা ধর্মান্তরিত হয়ে বা ইসলামের পর পুনরায় কুফুরীকে পসন্দ করেও করিনি।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, এ ব্যক্তি তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলেছে। উমর (রা) বলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ মুনাফিককে হত্যা করার অনুমতি দিন! “রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “এ ব্যক্তি বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে আর আল্লাহ তা’আলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্বন্ধে বলেছেন, “তোমরা যা ইচ্ছে কর, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। এরপর আল্লাহ্ তা’আলা অত্র আয়াতটি অবতীর্ণ করেন :

أيها الذين آمنوا لا تتخذوا عدوی وعدوم أولياء تلقون اليهم بالمودة وقد كفروا بما جاءكم من الحق يخرجون الرسول واياكم أن تؤمنوا بالله

অর্থাৎ হে মুমিনগণ! আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে না। তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করছ অথচ তারা তোমাদের নিকট যে সত্য এসেছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে, রাসূলকে এবং তোমাদেরকে বহিষ্কার করেছে এ কারণে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহতে বিশ্বাস কর। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্যে আমার পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে থাক তবে কেন তোমরা তাদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করছ? তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্রকাশ কর তা আমি সম্যক অবগত। তোমাদের যে কেউ এটা করে, সে তো বিচ্যুত হয় সরল পথ হতে।” (৬০- মুমতাহিনা : ১-৮)

উপরোক্ত হাদীছটি ইবন মাজা ব্যতীত সিহাহ্ সিত্তার অন্যান্য সংকলকগণ বর্ণনা করেছেন । তিরমিযী বলেন, “এ হাদীছটি হাসান ও সহীহ্।

ইমাম আহমদ (রা)–… জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘হাতিব ইবন আবু বালতাআ (রা) মক্কাবাসীদের কাছে একটি পত্র লিখে তাদেরকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের সাথে যুদ্ধ করার মনস্থ করেছেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) মহিলাটির কথা বলে দিলেন যার সাথে পত্রটি ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) মহিলাটির কাছে লোক প্রেরণ করেন যে, তার মাথা থেকে পত্রটি উদ্ধার করে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাতিব (রা)-কে ডেকে আনেন ও জিজ্ঞেস করেন। হে হাতিব! তুমি কি এটা করেছ? তিনি বললেন, ‘হা। তিনি আরো বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ধোঁকা দেয়ার জন্যে কিংবা প্রতারণা করার জন্যে এটা করিনি। আমি জানি যে, আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে অবশ্যই বিজয় দান করবেন এবং তাঁর মিশনকে পূর্ণ করবেন। তবে আমি মুশরিকদের মধ্যে অবস্থানকারী একজন অসহায় ব্যক্তি ছিলাম। আমার মা এখনো তাদের মধ্যে রয়েছেন। এজন্যই আমি চেয়েছিলাম তাদের একটি উপকার করতে। উমর (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, আমি কি একে হত্যা করতে পারি? “রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “তুমি কি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একজনকে হত্যা করতে চাও? তুমি কি জান, আল্লাহ্ তা’আলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্বন্ধে কী বলেছেন : আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “তোমরা যা ইচ্ছে কর ।”

উপরোক্ত সনদে ইমাম আহমদ (র) একমাত্র বর্ণনাকারী। সনদটি ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী। হাম্দ শুধু আল্লাহর জন্যে।

মক্কা অভিযানের তারিখ ও সফরে রোযা ভাঙ্গা

ইবন ইসহাক– আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সফরে বের হলেন এবং মদীনার আবু রুহম কুলসূম ইবন হুসায়ন ইবন উতবা ইবন খাফ আল-গিফারী (রা)-কে প্রতিনিধি রেখে গেলেন। রমযান মাসের ১০ তারিখে তিনি রওয়ানা হলেন। তিনি রোযা রাখেন এবং সাহাবীগণও তাঁর সাথে রোযা রাখেন। এরপর তিনি উছফান ও আমাজ নামক স্থানদ্বয়ের মধ্যবর্তী জায়গা কাদীদে পৌঁছে তিনি রোযা ভঙ্গ করলেন ও সামনে অগ্রসর হলেন। দশ হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি মাররুয যাহরান পৌঁছেন। উরওয়া ইবন যুবায়র (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে বার হাজার সৈন্য ছিল। ইমাম যুহরী ও মূসা ইবন উকবা অনুরূপ বলেছেন। সুলায়ম গোত্রের সৈন্য সংখ্যা ছিল সাত শ’। মতান্তরে এক হাজার। মুয়ায়না গোত্রের সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার। প্রতিটি গোত্রের যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা সকলেই যুদ্ধে যোগদান করেন। আর মুহাজির ও আনসারদের সকলেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তাদের মধ্য থেকে কেউ অনুপস্থিত ছিলেন না। ইমাম বুখারী (র) ও অনুরূপ বর্ণনা করেন।

বায়হাকী (র)– আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) রমযান মাসে মক্কা বিজয়ের অভিযান করেছিলেন। রাবী বলেন, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (র) বলেছেন, আমি জানি না, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কি শাবান মাসের শেষের দিকে মদীনা ত্যাগ করেন ও রামাদান মাসে মক্কায় পৌঁছেন নাকি রমযান মাস আসার পর ঐ মাসেই মক্কায় পৌঁছেন। তবে আমাকে উবায়দুল্লাহ্ ইব্‌ন আবদুল্লাহ (রা) সংবাদ দিয়েছেন যে, আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) রোযা রেখেছিলেন এবং কুদায় ও উছফানের মধ্যবর্তী কাদীদ জলাশয়ের নিকট পৌঁছার পর তিনি রোযা ভঙ্গ করেন। আর মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত কোন রোযা রাখেননি।

ইমাম বুখারী (র) ও অনুরূপ বর্ণনা করেন। তবে তিনি শা’বান ও রমযান মাসের মধ্যে সন্দেহের উল্লেখ করেননি।

ইমাম বুখারী (র)– ইব্‌ন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) রমযান মাসে সফর করেন। তিনি রোযা রাখেন। উছফান নামক স্থানে পৌঁছে তিনি পানি চাইলেন এবং লোকজনকে দেখাবার উদ্দেশ্যে সকলের সামনে দিনের বেলায় পানি পান করলেন। মক্কা পৌঁছা পর্যন্ত তিনি আর রোযা রাখেননি।” রাবী বলেন, ‘ইবন আব্বাস (রা) বলতেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সফরে রোযা রাখতেন। আবার কোন কোন সময় রোযা ভেঙ্গেও ফেলতেন। যার ইচ্ছে রোযা রাখবে, আর যার ইচ্ছে রোযা ভেঙ্গে ফেলবে।

ইউনুস (র)– ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিজয়ের সফরে বের হলেন এবং আবূ রুহম কুলসূম ইবন আল-হুঁসায়ন আল-গিফারী (রা)-কে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। রমযানের ১০ তারিখে তিনি রওয়ানা হন। তিনি রোযা রাখেন । আর তার সাথে লোকজনও রোযা রাখেন। উছফান ও আমাজ নামক স্থানদ্বয়ের মধ্যবর্তী জায়গা আল-কাদীদে পৌঁছার পর তিনি রোযা ভঙ্গ করলেন এবং তাঁর সাথে যারা ছিলেন তারাও রোযা ভঙ্গ করলেন। সফরে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর রোযা ভঙ্গ করাটাই ছিল শেষ আমল। পূর্বের প্রচলিত রোযা রাখার বিধানটি রহিত হয়ে যায়। বায়হাকী (র) বলেন “রমযানের দশ তারিখ কথাটা হাদীছের মধ্যে মুদরাজ হিসেবে গণ্য, অর্থাৎ পরবর্তীতে কোন রাবী নিজের তরফ থেকে তা সংযোজন করেছেন। ইবন ইসহাক (র) হতে আবদুল্লাহ্ ইবন ইদরীস ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী অন্য এক সনদে ইবন ইসহাক হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ৮ম হিজরীর ১০ রমযান রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কা অভিযানে বের হয়েছিলেন। অন্য এক সনদে বায়হাকী আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রমযান মাসের তের তারিখ মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়েছিল। বায়হাকী বলেন, আসলে এটা ইমাম যুহরীর কথা।

বায়হাকী– যুহরী (র) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে রমযান মাসে অভিযানে বের হয়েছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন দশ হাজার মুসলমান। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মদীনা আগমনের সাড়ে আট বছরের মাথায় এ ঘটনাটি ঘটেছিল। আর রমযান মাস শেষ হওয়ার তেরদিন বাকী থাকতেই বিজয় অর্জিত হয়েছিল। বায়হাকী অন্য এক সনদে আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) রমযান মাসে মক্কা অভিযানে বের হন। তাঁর সাথে ছিল দশ হাজার মুসলিম সৈন্য। তিনি রোযা রাখেন। কাদীদ নামক স্থানে পৌঁছে তিনি রোযা ভঙ্গ করেন। যুহরী (র) বলেন, “এটাই ছিল সর্বশেষ আমল এবং এটাকেই গ্রহণ করতে হবে । যুহরী (র) আরো বলেন, “রমযানের তের তারিখ রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কায় পৌঁছেন।

বায়হাকী– আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) রমযানের দুই তারিখে আমাদেরকে বিজয়ের বছর অভিযানে বের হওয়ার ঘোষণা দিলেন। আমরা রোযার অবস্থায় অভিযানে বের হলাম। কাদীদ পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে রোযা ভঙ্গ করার নির্দেশ দেন। কিছু সংখ্যক লোক রোযাদার ছিলেন। আর কিছু সংখ্যক রোযাবিহীন ছিলেন। তবে যখন আমরা শত্রুর সাথে মুকাবিলার মনযিলে পৌঁছলাম, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের আবারো রোযা ভঙ্গের হুকুম দেন। তখন আমরা সকলে রোযা ভঙ্গ করলাম।

ইমাম আহমদ (র)– আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন ।

ইমাম যুহরী (র) উল্লেখ করেছেন যে, রমযানের তের তারিখ বিজয় সূচিত হয়েছিল। আর আবু সাঈদ খুদরী (রা) উল্লেখ করেছেন যে, তারা রমযানের দুই তারিখে মদীনা থেকে অভিযানে রওয়ানা করেন। তাতে দেখা যায় যে, মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী জায়গায় তারা এগার দিন ভ্রমণে ছিলেন। তবে বায়হাকী– যুহরী প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেন। তারা বলেন, ৮ম হিজরীর রমযান মাসের দশদিন বাকী থাকতে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়।

আবু দাউদ আত-তায়ালিসী (র)– আবদুল্লাহ্ (রা) হতে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, বিজয়ের বছর রাসূলুল্লাহ (সা) রোযার অবস্থায় অভিযানে বের হন যখন তিনি কুরাউল গামীম নামক জায়গায় পৌঁছলেন, তখন লোকজন পব্রজে ও সাওয়ারীতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে ছিলেন। এটা ছিল রমযান মাস। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আরয করা হল, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! রোযায় লোকজনের খুবই কষ্ট হচ্ছে। আর তারা দেখার জন্যে অপেক্ষায় আছেন যে, আপনি কি করছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন এক গ্লাস পানি চাইলেন ও তা পান করলেন। আর লোকজন তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এরপরও কিছু সংখ্যক লোক রোযা রাখলেন এবং কিছু সংখ্যক লোক রোযা ভঙ্গ করলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, কিছু সংখ্যক লোক রোযাদার রয়েছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “তারা হুকুম অমান্য করেছে।”

ইমাম আহমদ– আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বিজয়ের বছর রাসূলুল্লাহ্ (সা) রমযান মাসে অভিযানে বের হন। তিনি রোযা রাখেন এবং তাঁর সাথে সাহাবীগণও রোযা রাখেন। কাদীদে পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক পিয়ালা পানি চাইলেন। তিনি ছিলেন সাওয়ারীর উপর আরোহী। তিনি যে রোযা ভাঙ্গলেন তা সকলকে দেখিয়ে দেয়ার জন্যে পানি পান করলেন। আর লোকজন তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এরপর মুসলমানগণ রোযা ভাঙ্গলেন। এটা ইমাম আহমদ (র)-এর একক বর্ণনা।

আব্বাস ও আবু সুফিয়ান ইবন হারিছ প্রমুখের ইসলামগ্রহণ

রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চাচা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা) ও তার চাচাতো ভাই আবু সুফিয়ান ইবন আল-হারিছ ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা), উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা (রা)-এর ভাই আবদুল্লাহ্ ইবন আবূ উমাইয়া ইবন আল-মুগীরাহ আল-মাখযুমী (রা) ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দিকে রওয়ানা হন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মক্কার পথে তখন তার সাথে তাদের সাক্ষাত হয়।

ইবন ইসহাক বলেন, “আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা) রাস্তায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সাক্ষাত করেন।”

ইবন হিশাম বলেন, “আব্বাস (রা) তাঁর পরিবার-পরিজনসহ হিজরত করার পথে জুহফা নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে মিলিত হন। এরপূর্বে তিনি মক্কায় অবস্থান করছিলেন। ইবন শিহাব যুহরী বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। কেননা, তিনি মক্কায় অবস্থান করে হাজীদের পানির ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন।

ইবন ইসহাক বলেন, “আবু সুফিয়ান ইবন আল-হারিছ ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা) ও আবদুল্লাহ ইবন আবু উমাইয়া মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী নাইকুল উকাব’ নামক জায়গায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তাবুতে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাঁদের এ দুইজনের ব্যাপারে উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার চাচার ছেলে, আপনার ফুফু ও শ্বশুরের ছেলে আপনার সাথে দেখা করতে চান। তিনি বলেন, “এ দুজন দিয়ে আমার কোন কাজ নেই। আমার চাচার ছেলে ইতোমধ্যে আমার ইত নষ্ট করেছে। আর আমার ফুফুর ছেলে মক্কায় তার যা কিছু বলার ছিল তা আমাকে সে বলেছে।” সুহায়লী (র) বলেন, “সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলেছিল, “আল্লাহর শপথ, আমি তোমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করব না যতক্ষণ না তুমি আকাশে একটি সিঁড়ি লাগাবে যার সাহায্যে তুমি আকাশে চড়বে আর আমি তাকিয়ে দেখব। এরপর তুমি একটি দলীল ও চারজন ফেরেশতা নিয়ে আসবে যারা সাক্ষ্য দেবে যে, তোমাকে আল্লাহ্ তা’আলা প্রেরণ করেছেন।”

রাবী বলেন, যখন তাঁদের কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মন্তব্যের খবর “পৗঁছল, আবু সুফিয়ানের সাথে তার দু পুত্র ছিল তখন সে বলল, “আল্লাহর শপথ, আমাকে অবশ্যই তিনি অনুমতি দেবেন নচেৎ আমার এ ছোট ছেলের হাত ধরে আমরা পৃথিবীতে ভবঘুরের ন্যায় ঘুরে বেড়াব এবং ক্ষুধাও তৃষ্ণায় মরুভূমিতে মৃত্যুবরণ করব। তাদের এই শপথের কথা যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে। পৌঁছল তখন তিনি তাদের প্রতি সদয় হলেন এবং তাদেরকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তাঁবুতে প্রবেশ করেন ও ইসলাম গ্রহণ করেন। নিম্নবর্ণিত কবিতার মাধ্যমে আবু সুফিয়ান তার ইসলাম গ্রহণের পূর্ববর্তী ভুল-ত্রুটির জন্যে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কবিতায় বলেন :

لتفلب خيل اللات خيل محمد

العمرك أني يوم أحمل راية

فهذا أواني حين أهدى و أهتدي

لكما لملج الحيران أظلم ليله

مع الله من طردت كل مطرد

هذا بي هاد غير نفسي ونالني

وأدعي وإن لم أنتسب من محمد

وأنأى جاهدا عن محمد

أم

وإن كان ذا رأى فيلم ويفتد

همواما هموا من لم يقل بهواهم

مع القوم مالم أهد في كل مقعد

أريد لأرضيهم ولست بلائط

وقل لثقيف تلك عيري أو عدی

فقل لثقيف لا أريد قتالها فما كنت في الجيش الذي نال عامر وما كان عن جري لسانی و لایدی

نزائ جاءت من سهام وسرد ،

قبائل جاءت من بلاد بعيدة

তোমার জীবনের শপথ, নিশ্চয়ই আমি যেদিন ঝাণ্ডা উত্তোলন করেছিলাম মুহাম্মাদ (সা)-এর সৈন্যদলের উপর লাত-এর সৈন্যদল জয়লাভ করবে। এই উদ্দেশ্যে সেদিন আমি ছিলাম রাতের অন্ধকারে দিশেহারা ভ্রমণকারী। এখন সময় এসেছে ফলে আমাকে ঠিক পথে পরিচালিত করা হচ্ছে এবং আমি সঠিক পথে চলছি। এই যে আমার জন্য রয়েছেন একজন পথ প্রদর্শক আমার নিজ প্রবৃত্তি নয়। যিনি আমাকে উঠিয়ে দিয়েছেন হিদায়াতের রাজপথে। এটি আমার গোত্রের প্রত্যেকটি পথভ্রষ্ট ব্যক্তিকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম করে তুলেছেন। আমি অতীতে ছিলাম প্রতিরোধকারী ও মুহাম্মাদ (সা) থেকে বিরত রাখার জন্যে কঠোর প্রচেষ্টায় রত। মুহাম্মাদ (সা)-এর দিকে দাওয়াত দেয়ো হলেও আমি তার সাথে সংশ্লিষ্ট হইনি। আমার সাথী কাফিরদের ইচ্ছেমত যারা পথ চলেনি বা অন্যায় কথা বলেনি। তাদের বিরুদ্ধে যা করবার তারা তা সবই করেছে যদিও তিনি ছিলেন সঠিক বিবেকের অধিকারী । তবু তারা তাকে বুদ্ধিভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি হিদায়াত পাইনি ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে প্রতিটি বৈঠকে শরীক থেকে তাদেরকে খুশী করতে প্রয়াস পেয়েছি। যদিও আমি অভিশপ্ত ছিলাম না। ছাকীফ গোত্রকে বলে দাও, আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে চাই না। আবারও ছাকীফকে বলে দাও, আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে তারা ভয় দেখাক। আমি এমন সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলাম না যারা আমিরকে হত্যা করেছে। কেউই আমার রসনা বা হাতের অনিষ্টের শিকার হয়নি। দূরদূরান্তের জনপদসমূহ হতে সিহাম ও সুরদুদ থেকে এসে এরা সমবেত হয়েছে।

ইবন ইসহাক বলেন, ইতিহাসবিদগণ বলেন, যখন আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে কবিতা পাঠের মধ্যে বললেন, আমি যাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম তিনিই আমাকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করলেন । রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাত দ্বারা তার বুকে মৃদু আঘাত করে বললেন : অর্থাৎ তুমিই তো আমাকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করেছিলে ।

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মক্কায় প্রবেশ

রাসূলুল্লাহ্ (সা) মাররুয যাহরানে পৌঁছে সেখানে অবতরণ করলেন ও সেখানে অবস্থান করলেন।

ইমাম বুখারী (র)– জাবির (রা) হতে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে মাররুফ যাহ্রানে কাবাস নামী বুনো ফল সংগ্রহ ছিলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সা) বলছিলেন, “এগুলোর মধ্যে যেগুলো কালো সেগুলো তোমরা সংগ্রহ কর। কেননা, এগুলো সুস্বাদু।” তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি কখনও মেষ চরিয়েছিলেন? তিনি বললেন, “হ্যাঁ, প্রত্যেক নবীই মেষ চরিয়েছেন।”

বায়হাকী (র)– আবুল ওয়ালীদ সাঈদ ইবন মীনা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মক্কার মুসলমানগণ যখন কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন তখন মক্কা প্রবেশের বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ইচ্ছের উপর ছেড়ে দেন! মাররুয যাহরানের শেষ প্রান্তে পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ (সা) আকাবায় অবতরণ করেন। তারপর তিনি কাবাস ফল সংগ্রহকারীদেরকে তা’ চয়ন করে নিয়ে আসতে প্রেরণ করলেন । রাবী বলেন, আমি রাবী সাঈদকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কী ফল? তিনি বললেন, এগুলো হচ্ছে আরকি গাছের ফল! যারা ফল সংগ্রহ করতে গেলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ইবন মাসউদ (রা)। তিনি বলেন, যদি কেউ একটি সুস্বাদু ফল পেত, তখনই তা সে মুখের মধ্যে পুরে দিত। তারা সকলে ইবন মাসউদের পায়ের সরু গোছার দিকে লক্ষ্য করছিলেন। তিনি যখন গাছে আরোহণ করছিলেন তখন সকলেই তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “তোমরা কি তার পায়ের সরু গোছার দিক লক্ষ্য করে হাসছিলে? যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ করে বলছি, “তার এ পা দু’খানি হাসরের বিচারের দিনে উহুদ পাহাড় থেকেও বেশি ভারী বলে গণ্য হবে।” আর ইবন মাসঊদ (রা) কাবাস ফলের যা কিছু সংগ্রহ করতেন তা সবগুলোই নিয়ে আসবেন এবং তার উত্তমগুলো রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাতে তুলে দিতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন :

ان كل جان يده الى فيه .

هذا جنائي وخياره فيه

অর্থাৎ এটা আমার চয়নকৃত ফল; তার উত্তমগুলো এটার মধ্যে রয়েছে। অথচ প্রত্যেক সংগ্রহকারীর হাত রয়েছে তার মুখে।

সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আনাস (রা) হতে বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেন, “আমাদের সামনে দিয়ে একটি খরগোশ দৌড়ে যায়। আমরা ছিলা মাররুয যাহরানে। লোকজন তার পিছনে দৌড়াতে লাগল এবং অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এরপর এটাকে আমি পেয়ে গেলাম ও ধরে ফেললাম এবং আবূ তালহা (রা)-এর কাছে নিয়ে আসলাম। তিনি এটাকে যবেহ করলেন এবং তার একটি রান রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে প্রেরণ করলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তা গ্রহণ করলেন।

ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মারুয যাহরান অবতরণ করেন। কুরায়শদের কাছে এ খবরটি গোপন রয়ে গেল । রাসূলুল্লাহ (সা) হতেও কোন সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছছিল না। আর তারাও জানতো না যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কী করতে যাচ্ছেন? এ দিনগুলোর মধ্যেই আবু সুফিয়ান ইবন হারব, হাকীম ইবন হিযাম এবং বুদায়ল ইবন ওরাকা ঘর থেকে বের হলেন যাতে তারা কোন খবর সংগ্রহ করতে পারেন কিংবা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে কিছু অবগতি অর্জন করতে পারেন ।

ইবন লাহিয়া— উরওয়া (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মুশরিকদের গুপ্তচরদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কিছু গুপ্তচর প্রেরণ করেন। খুযাআ গোত্রের লোকেরা তাদের পাশ দিয়ে যারাই অতিক্রম করছিল তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ না করে ছাড়তো না। আবু সুফিয়ান (রা) ও তার সংগীরা যখন মুসলমানদের কাফেলায় আসেন তখনই মুসলমান ঘোড়সওয়ারগণ তাঁদেরকে গ্রেফতার করে ফেলেন এবং উমর (রা) তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হন। তবে আব্বাস (রা) আবূ সুফিয়ান (রা)-কে নিরাপত্তা দান করেন। আর আব্বাস (রা) ছিলেন আবু সুফিয়ান (রা)-এর বন্ধু!

ইবন ইসহাক বলেন : আব্বাস (রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মারুয যাহরান অবতরণ করেন তখন আমি মনে মনে বললাম, কুরায়শরা চিরদিনের জন্যে ধ্বংস হয়ে যাবে যদি তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে নিরাপত্তা গ্রহণ করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাদা খচ্চরে আরোহণ করলাম ও আল-আরাক নামক স্থানে পৌঁছলাম এবং মনে মনে বলতে লাগলাম, হয়ত বা কোন কাঠুরিয়া, গোয়ালা কিংবা

অন্য কোন পেশার লোক পেয়ে যাবো, যে মক্কাবাসীদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আগমন সম্বন্ধে খবর দেবে। যাতে করে তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মক্কায় বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করার পূর্বে তার থেকে নিরাপত্তা গ্রহণ করতে পারে । আল্লাহর শপথ, আমি খচ্চরের উপর সওয়ার হয়ে চলছিলাম আর এরূপ আশা পোষণ করছিলাম। হঠাৎ আবু সুফিয়ান (রা) ও বুদায়ল ইবন ওরাকার আওয়ায শুনতে পেলাম। তারা দুইজনই বাদানুবাদ করছিল। আবু সুফিয়ান (রা) বলছিলেন, আজকের রাতের মত এত আগুন ও সৈন্যদল আর কখনো আমি দেখিনি। আব্বাস (রা) বলেন, বুদায়ল (রা) বলছিল, আল্লাহর শপথ, এরা সব বনূ খুযাআর লোক। যুদ্ধ তাদের উন্মাদ করে তুলেছে।’ আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, “খুয়া’আর লোক সংখ্যা কম ও দুর্বল। কাজেই এরা খুযাআর লোক হতে পারে না এবং এটা খুযাআর আগুন হতে পারেনা।” আব্বাস (রা) বলেন, “আমি আবু সুফিয়ান (রা)-এর গলার স্বর চিনতে পারলাম এবং বললাম, “কে আবু হানালা নাকি?” সেও আমার গলার স্বর চিনতে পেরে বলল, “কে আবুল ফযল নাকি?” আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, “ব্যাপার কী? তোমার উপর আমার মা বাপ কুরবান হোন!” আব্বাস (রা) বললেন, আমি বললাম, “হে আবু সুফিয়ান! তোমার দুর্ভাগ্য, এইতো আল্লাহর রাসূল, লোকজন নিয়ে হাযির!” আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, “আল্লাহর শপথ, কুরায়শদের ধ্বংস অনিবার্য। তোমার উপর আমার মাতা পিতা কুরবান হোন! তাহলে এখন উপায় কী?” আব্বাস (রা) বলেন, আমি বললাম, “যদি কেউ তোমাকে কাবুতে পেয়ে যায়, সে তোমাকে নিশ্চয়ই হত্যা করবে। কাজেই এ খচ্চরের পিঠে চড়ে বস! আমি তোমাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে যাব এবং তার কাছে তোমার নিরাপত্তার আবেদন করব।” আব্বাস (রা) বলেন, তারপর সে আমার পিছনে সওয়ার হলো ও তার দু’জন সাথী ফিরে চলে গেলো। উরওয়া (রা) বলেন, বরং তারা দু’জন সাথীও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আগমন করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁদের দু’জনের কাছ থেকে মক্কাবাসীদের সম্বন্ধে খবরাখবর নেন।” ইমাম যুহরী (রা এবং মূসা ইব্‌ন উকবা বলেন, “বরং তারা হযরত আব্বাস (রা)-এর সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমতে হাযির হয়েছিলেন।”

ইবন ইসহাক বলেন, আব্বাস (রা) বলেন, “তারপর আমি তাকে নিয়ে যখন মুসলমানদের কোন তাবুর আওতার পাশ দিয়ে যাই, উপস্থিত লোকজন জিজ্ঞেস করে, ইনি কে? যখন তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর খচ্চর ও আমাকে তার উপর সওয়ার দেখতে পেতো, তখন তারা বলতো, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চাচা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খচ্চরের উপর সওয়ার।” এমনকি যখন আমি উমর (রা)-এর আগুনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন “ইনি কে?” আমার প্রতি লক্ষ্য করে যখন আবু সুফিয়ান (রা)-কে খচ্চরের পিঠে আমার পিছনে দেখতে পেলেন, তখন বলে উঠলেন, আল্লাহর দুশমন আবু সুফিয়ান! আল্লাহর অসংখ্য প্রশংসা যে, কোন চুক্তি ও অংগীকার ব্যতিরেকেই আল্লাহ্ তোমাকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছেন!” উরওয়া ইবন যুবায়র (রা) বলেন, ‘উমর (রা) আবু সুফিয়ান (রা)-এর ঘাড়ে আঘাত করেন এবং হত্যা করার মনস্থ করেন; কিন্তু আব্বাস (রা) তাঁকে বারণ করেন।

অনুরূপভাবে মূসা ইবন উবাবা ইমাম যুহরী হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর গুপ্তচরেরা তাদের উটের রশি ধরে ফেলেন এবং জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কে? তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে প্রেরিত প্রতিনিধি।” এরপর আব্বাস (রা) তাদের সাথে মুলাকাত করেন এবং তাদেরকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) দরবারে প্রবেশ করেন। এরপর আব্বাস (রা) তাঁদের সাথে সারা রাত কথা বলেন এবং ভোর বেলায় তাদেরকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু কালিমার দাওয়াত দিলেন। তারা সাক্ষ্য দিলেন। “আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল।” হাকীম এবং বুদায়লও অনুরূপ সাক্ষ্য দিলেন। আবু সুফিয়ান (রা) রাতে বলেছিলেন, “আমি এসব জানিনা, কিন্তু ভোরবেলা ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা তিনজন মিলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে কুরায়শদের জন্যে নিরাপত্তার আবেদন করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঘোষণা করেন, “যে আবু সুফিয়ান (রা)-এর ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ!” আর আবু সুফিয়ান (রা)-এর ঘর ছিল মক্কার উচ্চ ভূমিতে। “যে হাকীম ইবন হিযাম (রা)-এর ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।” হাকীম ইবন হিযাম (রা)-এর ঘর ছিল মক্কার নিম্ন ভূমিতে। “আর যে ব্যক্তি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে সেও নিরাপদ!” এগুলো ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ঘোষণা । আব্বাস (রা) বলেন, “এরপর উমর (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে পৌঁছার জন্যে দ্রুত রওয়ানা হলেন। আমিও খচ্চরে সওয়ার হয়ে খচ্চরকে দ্রুত হাঁকাতে লাগলাম । আমি তার আগে পৌঁছে গেলাম । কেননা, ধীরগতির মানুষকে ধীর গতির জানোয়ার অতিক্রম করে যায়।” আব্বাস (রা) বলেন, “আমি খচ্চর থেকে অবতরণ করে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ঘরে প্রবেশ করলাম সাথে সাথে উমর (রা)-ও ঘরে প্রবেশ করলেন । তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এই আবু সুফিয়ান, আল্লাহ্ তা’আলা কোন চুক্তি ও অঙ্গীকার ব্যতিরেকেই তাকে আমাদের আয়ত্বে এনে দিয়েছেন। তাকে হত্যা করার জন্যে আমাকে অনুমতি দিন!” আব্বাস (রা) বলেন, “আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। আমি কিন্তু তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে বসলাম এবং তার মাথা ধরে বললাম, আল্লাহর শপথ, আজকের রাতে আমি ব্যতীত আর অন্য কোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে কানে কানে কথা বলতে পারছে না। যখন উমর (রা) আবু সুফিয়ান (রা)-এর সম্বন্ধে বেশী বেশী পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, তখন আমি বললাম, থামো হে উমর (রা)! আল্লাহর শপথ, যদি সে বনূ আদী ইব্‌ন কা’বের কোন ব্যক্তি হত তাহলে তুমি এরূপ বলতেনা, কিন্তু তুমি জান যে, আবু সুফিয়ান (রা) হচ্ছে বনূ আবদে মান্নাফের একজন । তাই তুমি এরূপ বলছ । উমর (রা) বললেন, থামুন, হে আব্বাস! আল্লাহর শপথ, যেদিন আপনি মুসলমান হয়েছিলেন যদি সেদিন আমার পিতা খাত্তাবও মুসলমান হতেন তাহলে আপনার ইসলামই আমার পিতার ইসলামের চাইতে আমার কাছে অধিকতর প্রিয় হত। তার কারণ হচ্ছে, আমি জানি যে, আপনার ইসলাম গ্রহণ খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণের চাইতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে অধিকতর প্রিয় । রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে আব্বাস! একে নিয়ে আপনি এখন আপনার আবাস স্থলে চলে যান। ভোর বেলায় আপনি তাকে নিয়ে আসবেন। আব্বাস (রা) বলেন, আমি তাকে নিয়ে আমার আবাস স্থলে গেলাম। সে আমার কাছে রাত যাপন করে। পরদিন ভোরে আমি তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে হাযির হলাম। তিনি তাকে দেখে বললেন, “হে আবু সুফিয়ান! তোমার জন্যে দুর্ভোগ, এখনও কি তোমার সময় আসেনি যে, তুমি জানবে আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই?” উত্তরে তিনি বললেন, “আপনার উপর আমার মা-বাপ কুরবান হোন! আপনি কতইনা ধৈর্যশীল! আপনি কতইনা সম্মানিত এবং আপনি কতই না আত্মীয়তার প্রতি লক্ষ্য রাখেন! আল্লাহর শপথ, আমার বিশ্বাস, আল্লাহর সাথে যদি অন্য কোন মা’বুদ থাকত তাহলে সে আমাকে কিছু না কিছু সাহায্য করতে।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “তোমার দুর্ভোগ, এখনও কি তোমার সময় আসেনি যে, তুমি আমাকে আল্লাহর রাসূল বলে জানবে?” আবু সুফিয়ান বলল, আপনার উপর আমার মা-বাপ কুরবান হোন! আপনি কতইনা ধৈর্যশীল! আপনি কতইনা সম্মানিত এবং আপনি কতই না আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী। তবে আল্লাহর শপথ, এখনও এ ব্যাপারে আমার অন্তরে কিছু দ্বিধা রয়েছে। আব্বাস (রা) তখন তাকে বললেন, “তোমার দুর্ভোগ, তোমার গর্দান কাটা যাওয়ার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ কর এবং সাক্ষ্য দাও আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল।” রাবী বলেন, “এরপর আবু সুফিয়ান এ সাক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে মুসলমান হয়ে গেলেন। আব্বাস (রা) বলেন, এরপর আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। নিঃসন্দেহে আবু সুফিয়ান এমন একজন মানুষ যে গৌরব পসন্দ করে। তাকে গৌরবজনক কিছু একটা দান করুন! রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।” রাবী উরওয়া (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “যে হাকীম ইবন হিযাম এর ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ।” মূসা ইব্‌ন উকবা, ইমাম যুহরী হতে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আরো বলেছিলেন, “যে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে সেও নিরাপদ। আর যে মসজিদে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ।” যখন তিনি বিদায় হবার আবেদন পেশ করলেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “হে আব্বাস (রা)! তাঁকে নিয়ে গিরিসংকটের নিকট সংকীর্ণ জায়গায় রেখে একটু থামাবেন । ওখান দিয়ে আল্লাহর লস্করসমূহ অতিক্রম করার সময় সে যেন দেখতে পায়।

মূসা ইবন উকবা ইমাম যুহরী (র) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই আবু সুফিয়ান (রা), বুদায়ল (রা) ও হাকীম ইবন হিশাম (রা) আব্বাস (রা)-এর সাথে গিরি সংকটে দণ্ডায়মান ছিলেন। তিনি আরো বলেন, “সা’দ (রা) যখন আবু সুফিয়ান (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেন, “আজকের দিন যুদ্ধের দিন, আজকের দিনে হারামকে হালাল করা হবে।” আবু সুফিয়ান (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে অনুযোগ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এজন্য সা’দকে আনসারের পতাকা বহন থেকে অব্যাহতি দিলেন এবং যুবায়র ইবন আওয়াম (রা)-কে আনসারের পতাকা অর্পণ করেন। তিনি তা নিয়ে মক্কার উচ্চ ভূমি হয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন এবং হাজ্জন নামক স্থানে পতাকাটি স্থাপন করেন। খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) নিম্নভূমি দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। তাঁর সাথে সাক্ষাত হয় বনূ বকর ও হুযায়ল গোত্রদ্বয়ের। বনূ বকরের ২০ জন এবং হুযায়লের ৩/৪ জনকে তিনি হত্যা করেন। তাদেরকে তিনি পরাজিত করেন ও হাশূরায় তাদেরকে হত্যা করেন। তাদের এ হত্যাকাণ্ড মসজিদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে ছিল।

আব্বাস (রা) বলেন, “আমি আবু সুফিয়ান (রা)-কে নিয়ে অতিক্রম করার সংকীর্ণ জায়গায় উপস্থিত হলাম যেখানে তাকে নিয়ে উপস্থিত থাকার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন, “গোত্রসমূহ তাদের ঝাণ্ডা নিয়ে অতিক্রম করছিল । যখনই একটি গোত্র অতিক্রম করতো আবু সুফিয়ান (রা) আব্বাস (রা)-কে বললেন “হে আব্বাস (রা)! এরা কারা?” তখন তিনি জবাব দিলেন, এরা বনূ সুলায়ম । আবূ সুফিয়ান (রা) বললেন, “আমারও বনূ সুলায়মের মধ্যেত কোন শত্রুতা নেই। এরপর আরো একটি গোত্র অতিক্রম করল তখন সে বললেন, “হে আব্বাস! এরা কারা? আমি বললাম, “এরা মুযায়না গোত্র ।” আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, “আমরাও মুযায়নার মধ্যে কোন খারাপ সম্পর্ক নেই।” এরূপে অন্যান্য গোত্রগুলো অতিক্রম করল। আবু সুফিয়ান প্রশ্ন করতো এরা কারা? আমিও তার উত্তর দিতাম। সে বলতো যে, আমার ও অমুক গোত্রের মধ্যে কোন প্রকার মনোমালিন্য নেই। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার সবুজ বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুহাজির ও আনসারগণ। তাঁরা সকলে বর্ম পরিহিত ছিলেন । আবু সুফিয়ান (রা) বলল, “সুবহানাল্লাহ্, হে আব্বাস (রা)! এরা কারা?” তিনি বলেন, “আমি বললাম, ইনিতো মুহাম্মাদুর রাসূলাল্লাহ, যিনি মুহাজির ও আনসারদের পরিবেষ্টিত হয়ে আগমন করেছেন।” সে বলল, এদের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি কারোর নেই । আল্লাহর শপথ, হে আবুল ফযল! তোমার ভাইপো তো বড় বাদশা হয়ে গেছেন।’ আব্বাস (রা) বললেন, আমি বললাম “হে আবু সুফিয়ান (রা)! এটা নিঃসন্দেহে নুবুওতের নিদর্শন। সে বলল, “তাহলে তো এটা উত্তমই বলতে হয়। তিনি বলেন, আমি বললাম, তোমার সম্প্রদায়ের মুক্তির ব্যবস্থা কর। যখন আবু সুফিয়ানের সম্প্রদায় কুরায়শদের প্রতি অগ্রসর হলো তখন উচ্চস্বরে ঘোষণা দিতে লাগলো, “হে কুরায়শের লোকেরা! মুহাম্মাদ এসেছেন। তাঁর মুকাবিলা করার শক্তি তোমাদের নেই; সুতরাং আত্মসমর্পণ কর। যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ।” তাঁর স্ত্রী হিন্দা বিনত উতবা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল এবং রাগে তাঁর গোঁফ ধরে বলল, “এ ভুড়িওয়ালা হতভাগাকে তোমরা হত্যা কর । সে কতই না মন্দ প্রতিনিধি! আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, “তোমাদের জন্যে দুর্ভোগ, তোমরা নিজেকে নিয়ে আর অহংকার করোনা। কেননা, তিনি এসেছেন তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে আজকের দিন তার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তোমাদের মধ্যে নেই। তাই যে আবু সুফিয়ান (রা)-এর ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।” জনগণ বলল, “আল্লাহ্ তোমায় ধ্বংস করুক, তোমার ঘর আমাদের কত কাজে লাগবে?” সে বলল, “যে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে, সে নিরাপদ। আর যে মসজিদে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ। লোকজন তাদের ঘরে ও মসজিদে চলে গেল।

উরওয়া ইবন যুবায়র (রা) উল্লেখ করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন আবু সুফিয়ান (রা)-এর কাছ দিয়ে অন্যান্য গোত্র সহকারে অতিক্রম করছিলেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, “আমি অনেক লোককেই দেখছি যাদেরকে চিনতে পারছি না। এসব লোক আমাদের জন্যে অতিরিক্ত বলেই মনে হয়।” জবাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “তুমি ও তোমার সম্প্রদায় বহু কিছু করেছ। তোমরা যখন আমাকে মিথ্যাবাদী ঠাওরিয়েছ। এ লোকগুলো তখন আমাকে সত্যবাদী বলে বরণ করেছে। তোমরা যখন আমাকে দেশছাড়া করেছ। তখন তারা আমাকে সাহায্য করেছে।”

যখন আবু সুফিয়ান (রা) সাদ ইবন উবাদা (রা)-এর কথা নিয়ে অভিযোগ করেন। সা’দ ইবন উবাদা (রা) যখন আবু সুফিয়ান (রা)-এর সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, “হে আবু সুফিয়ান! আজকের দিন যুদ্ধের দিন, আজকের দিনে হারামকে হালাল করা হবে। অর্থাৎ বায়তুল্লাহর হুরমত আজ আর মানা হবে না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “সাদ মিথ্যা বলেছে বরং আজকের দিন, এমন একটি দিন যে দিনে আল্লাহ্ তা’আলা কাবাকে ইযযত দান করবেন। আর আজকের দিনে কা’বাকে গিলাফ পরানো হবে।”

উরওয়া (রা) উল্লেখ করেন, যে রাতে আবু সুফিয়ান (রা) আব্বাস (রা)-এর কাছে ছিলেন, পরদিন ভোরে তিনি লোকজনকে দেখতে পান যে, তারা সালাত আদায়ের দিকে মনোযোগী হয়েছেন এবং পবিত্রতা অর্জনের জন্যে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছেন এতে তিনি ভীত হয়ে পড়েন এবং আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করেন তাদের কী হয়েছে :” আব্বাস (রা) বললেন, “তারা আযানের ধ্বনি শুনেছেন এবং তাঁরা সালাত আদায়ের জন্যে ছড়িয়ে পড়েছেন। তারপর যখন সালাত শুরু হল তখন তিনি তাদেরকে দেখলেন যে, তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর রুকুর সাথে রুকূ করছেন এবং তার সিজদার সাথে তারাও সিজদা করছেন। তখন তিনি বললেন, “হে আব্বাস! তিনি যেই কাজেরই তাদেরকে আদেশ করেন সেই কাজই কি তারা করেন :” আব্বাস (রা) বললেন, “হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ, যদি তিনি তাদেরকে খাবার ও পানীয় ছেড়ে দিতে বলেন, তাহলেও তারা অবশ্যই তার আনুগত্য করবে।

মূসা ইব্‌ন উকবা ইমাম যুহরী হতে বর্ণনা করেন । যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঐদিন উযু করলেন, তখন তারা উযূর পানি হাতে হাতে নিয়ে নিলেন। আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, হে আব্বাস (রা)! গত রাতের ঘটনার ন্যায় আমি কি ও কায়সারের দরবারেও কখনো দেখিনি।

 ইমাম বায়হাকী (র)— ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আবু সুফিয়ান (রা)-কে নিয়ে আব্বাস (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে আগমন করলেন। এরপর রাবী সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করেন, তবে একথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে যেদিন ভোরে তিনি আগমন করেন তার পূর্ব রাতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবার এ কথাও উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন তাঁকে বললেন, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।’ আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, ‘আমার ঘরতো অতটা প্রশস্ত নয়।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “যে ব্যক্তি কা’বা ঘরে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ।” তখন তিনি বলেন, “কা’বা ঘরওতো অত প্রশস্ত নয়।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন বললেন, “যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ।” তখনও তিনি বললেন, “মসজিদও তো অত প্রশস্ত নয় ।” তখন তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে, সেও নিরাপদ! আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, “হ্যাঁ, এতে স্থান সঙ্কুলান হতে পারে।”

ইমাম বুখারী (র)– হিশামের পিতা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মক্কা বিজয়ের বছর উক্ত অভিযানে বের হন ও এ খবর কুরায়শদের কাছে পৌঁছে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্বন্ধে বিস্তারিত সংবাদ সংগ্রহের জন্যে আবু সুফিয়ান ইবন হারব, হাকীম ইবন হিযাম ও বুদায়ল ইবন ওরাকা ঘর থেকে বের হলেন। তারা সামনে অগ্রসর হয়ে মারুয যাহরান পৌঁছেন, তখন তারা সেখানে অত বেশী পরিমাণে অগ্নি লক্ষ্য করলেন, যেমনটা আরাফাতের ময়দানে দেখা যায় । আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, এগুলো কি? মনে হয় যেন আরাফাত ময়দানের আগুন। বুদায়ল ইবন ওরাকা (রা) বললেন, এগুলো সম্ভবতঃ বনূ আমরের প্রজ্বলিত আগুন। আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, তারা সংখ্যায় এর চেয়ে অনেক কম। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কয়েকজন প্রহরী তাদেরকে দেখে ফেলেন এবং তাদেরকে গ্রেফতার করে ফেলেন। তাদেরকে নিয়ে তখন তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হন। তখন আবু সুফিয়ান (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর যখন তিনি চলে যাবার অনুমতি চাইলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আব্বাস (রা)-কে বললেন, “আবু সুফিয়ানকে পাহাড়ের প্রবেশ মুখে সংকীর্ণ স্থানে নিয়ে যাও, যাতে সে মুসলিম সৈন্যদের প্রতি লক্ষ্য করতে পারে । আব্বাস (রা) তাঁকে ওখানে নিয়ে গেলেন। গোত্রসমূহ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে দলে দলে আবু সুফিয়ানের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। একটি গোত্র যখন অতিক্রম করল তখন আবু সুফিয়ান (রা) আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কারা?” তিনি উত্তরে বললেন “এরা গিফার গোত্র।” তখন তিনি বললেন, “আমার ও গিফার গোত্রের মধ্যে কী সম্পর্ক?” অর্থাৎ তারাতো আমাদের শত্রু নয়। এরপর জুহায়না গোত্র অতিক্রম করে। তাদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ কথোপকথন হয়। এরপর সা’দ ইব্‌ন হুযায়ম গোত্র অতিক্রম করে। তাদের সম্পর্কেও অনুরূপ কথোপকথন হয়। তারপর সুলায়ম গোত্রের ব্যাপারে অনুরূপ কথোপকথন হয়। তারপর এমন একটি সৈন্যদল আসল যাদের ন্যায় পূর্বে আর কখনও দেখা যায়নি। আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, “এরা কারা? আব্বাস (রা) বললেন, “এরা আনসার যাদের আমীর হলেন সা’দ ইবন উবাদা (রা) যার সাথে রয়েছে পতাকা। সা’দ ইবন উবাদা (রা) বললেন, “হে আবু সুফিয়ান! আজকের দিন যুদ্ধের দিন, আজকের দিনে কা’বাকে নিষেধমুক্ত গণ্য করা হবে। তারপর আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, “হে আব্বাস (রা)! সামনে বিরাট গণ্ডগোল মনে হচ্ছে! এরপর একটি স্বল্প সংখ্যক সৈন্যের বাহিনী আসল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আল্লাহর রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবীগণ। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পতাকাবাহী ছিলেন যুবায়র ইবনুল আওয়াম (রা)। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন আবু সুফিয়ান এর সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলেন, “আপনি কি জানেন, সা’দ ইবন উবাদা (রা) কী বলছেন?” তিনি বললেন, “কী বলেছে?” তখন তিনি উত্তরে বললেন, এরূপ এরূপ।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, সা’দ (রা) সঠিক বলেনি, বরং আজকের দিনে আল্লাহ্ তা’আলা কা’বাকে সম্মান দান করবেন, আজকের দিনে কাবাকে গিলাফ পরানো হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) হজুনে তার ঝাণ্ডা স্থাপন করার জন্যে আদেশ করলেন।

উরওয়া (রা) আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। আব্বাস (রা) যুবায়র ইবনুল আওয়াম (রা)-কে জিজ্ঞেস করেন, এখানে কি পতাকা স্থাপন করার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নির্দেশ দিয়েছেন?” তিনি বললেন, ‘া’। তিনি বললেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদ (রা)-কে মক্কার উঁচু ভূমি কাদা দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) খোদ প্রবেশ করেছেন কুদা’ অঞ্চল দিয়ে। খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা)-এর বাহিনীর দুই ব্যক্তি হুনায়শ ইবন আল-আশআর ও কুরূ ইবন জাবির আল-ফিহরী ঐ দিন শহীদ হন।

আবু দাউদ (র)– আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “মক্কা বিজয়ের বছর আবু সুফিয়ান ইবন হারব (রা)-কে নিয়ে আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আগমন করেন। আবু সুফিয়ান মারুয যাহরানে ইসলাম গ্রহণ করেন । রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে লক্ষ্য করে আব্বাস (রা) বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! নিশ্চয়ই আবু সুফিয়ান (রা) এমন এক ব্যক্তি যিনি গৌরব পসন্দ করেন। আপনি যদি তার জন্যে গৌরবের একটি কিছু করতেন! রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “ঠিক আছে। যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ান (রা)-এর ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। আর যে ব্যক্তি আপন ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে, সেও নিরাপদ।”

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মক্কায় প্রবেশ

বুখারী ও মুসলিম শরীফে আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মাথায় লৌহ শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থায় মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি মাথা থেকে শিরস্ত্রাণ খুলতেই এক ব্যক্তি এসে বললো, ইবন খাতাল কাবার গিলাফ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তাকে হত্যা কর । ইমাম মালিক (র) বলেন, আমাদের ধারণা মতে সেদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইহরাম পরা

অবস্থায় ছিলেন না। ইমাম আহমদ আফফান– জাবির (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) কাল পাগড়ী পরিহিত অবস্থায় মক্কায় প্রবেশ করেন। এ হাদীছটি তিরমিযী নাসাঈ, আবু দাউদ ও ইবন মাজা হাম্মাদ ইবন সালামা সূত্রে রিওয়ায়াত করেছেন এবং তিরমিযী একে ‘হাসান সহীহ্’ বলে মন্তব্য করেছেন। ইমাম মুসলিম কুতায়বা ও ইয়াহয়া ইবন ইয়াহয়া– জাবির সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় প্রবেশকালে কাল পাগড়ী পরিহিত ছিলেন। তখন তিনি ইহরাম অবস্থায় ছিলেন না। ইমাম মুসলিম আবূ উসামা সূত্রে– আমর ইব্‌ন হুরায়ছ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি যেন এখনও দেখতে পাচ্ছি, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মাথায় মেটে কাল রং এর পাগড়ী পরা ছিল, যার শামলা দুই কাঁধের মাঝখানে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ গ্রন্থসমূহে হযরত জাবির বর্ণিত হাদীছে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তিনি কাল পাগড়ী পরিহিত ছিলেন। সুনানে আরবাআ (অর্থাৎ তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ ও ইবন মাজার) গ্রন্থকারগণ ইয়াহয়া ইবন আদম সূত্রে— জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, মক্কায় প্রবেশকালে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পতাকা ছিল সাদা। ইবন ইসহাক হযরত আইশার হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন যে, মক্কা বিজয়কালে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পতাকার রং ছিল সাদা এবং ব্যানারের রং ছিল কাল। পতাকার নাম ছিল ‘উকাব’। একটা পশমী চাদর কেটে এটা তৈরি করা হয়েছিল । বুখারী শরীফে আবুল ওয়ালীদ সূত্রে– আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মুগাফফাল থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাঁর উষ্ট্রীর উপর সওয়ার অবস্থায় সূরা ফাতহ তারজী করে (টেনে টেনে) পড়তে শুনেছি। বর্ণনাকারী মুআবিয়া ইব্‌ন কুরুরাতা বলেন, আমার চারপাশে লোকজ সমবেত হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকলে আবদুল্লাহ্ ইবন মুগাফফাল যেভাবে রাসূলের ‘তারজী’ নকল করে আমাকে শুনিয়েছিলেন, আমিও সেভাবে ‘তাজী’ করে শুনাতাম। ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর আমার নিকট বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যী তুয়া পর্যন্ত পৌঁছে আপন বাহনের উপর থেমে যান। তখন তিনি ছিলেন ইয়ামনী লাল বর্ণের চাদরের পাগড়ী পরিহিত। আল্লাহ্ তাঁকে বিজয় দান করে যে গৌরব দান করেছেন- সে কথা স্মরণ করে আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হয়ে মাথা এতই ঝুঁকিয়ে দেন যে, তাঁর দাড়ি মুবারক হাওদার সাথে প্রায় লেগে যায়। হাফিয বায়হাকী আবু আবদুল্লাহ্ আল-হাফিযের একটি সূত্রে— হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। মক্কা বিজয়ের দিনে শহরে প্রবেশ করার সময় বিনয়ভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর থুতনী মুবারক বাহনের পিঠের সাথে মিশে যায়। তার আর একটি সূত্রে– ••– ইবন মাসঊদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কা বিজয়ের দিন এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে আলাপ করছিল। তখন (ভয়ে) তার দেহে কাঁপন ধরে যায়। তিনি বললেন, স্বাভাবিক হও! (ভয়ের কোন কারণ নেই। কেননা, আমি এমন একজন কুরায়শী মহিলার সন্তান যিনি সংরক্ষিত শুকনো গোশত খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। বায়হাকী বলেন, এ হাদীছটি ইসমাঈল ইবন আবুল হারিছ থেকে মুত্তাসিল এবং ইসমাঈল ইবন কায়স থেকে মুরসালভাবে বর্ণিত হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, মক্কা বিজয় অভিযানে মক্কায় প্রবেশকালে এই বিশাল তেজদীপ্ত সৈন্য বাহিনীর সাথে থেকে এ রকম বিনয় প্রকাশ করা, বনী ইসরাঈলের নির্বোধদের সেই ঘটনার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র- যেখানে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রবেশ দ্বার অতিক্রমকালে রুকু-সিজদারত অবস্থায় মাথা নত করে যাওয়ার জন্যে এবং মুখে ‘হিত্তাতুন (ক্ষমা চাই) শব্দ উচ্চারণ করতে, কিন্তু তারা মাথা উঁচু রেখে নিতম্বের উপর ভর করে তা মাটিতে ঘেঁষতে ঘেঁষতে প্রবেশ করে। এবং হিত্তাতুন শব্দ পরিবর্তন করে ‘হিতাতুন ফী শাঈরাতিন’ (যবের মধ্যে গম) বলতে থাকে। বুখারী কাসিম ইবন খারিজা— আইশা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। মক্কা বিজয়ের বছর নবী (সা) মক্কার উঁচু এলাকা কাদা’ এর দিক থেকে প্রবেশ করেন। আবু উসামা এবং ওহাবও তাঁর পিছে পিছে ‘কাদা’ এর দিক থেকে প্রবেশের কথা বর্ণনা করেছেন। উবায়দ ইবন ইসমাঈল– হিশাম তার পিতা থেকে বর্ণিত যে, মক্কা বিজয়ের বছর নবী (সা) মক্কার উঁচু এলাকা অর্থাৎ কাদা’ নামক স্থান দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। মুরসাল হাদীছ যদি মুসনাদ হাদীছ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হয় তা হলে প্রথম বর্ণনা থেকে দ্বিতীয় বর্ণনাটি অধিক বিশুদ্ধ। নচেৎ প্রসিদ্ধতর ও সঠিক মত অনুযায়ী মক্কার উঁচু এলাকাকে বলা হয় কাদা (1&) এবং মক্কার নিম্ন ভূমিকে বলা হয় (২২) কুদা। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি এবং সহীহ বুখারীর বর্ণনায়ও এসেছে যে, সে দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) খালিদ ইবন ওয়ালীদকে মক্কার উঁচু এলাকা (কাদা) দিয়ে প্রবেশ করার জন্যে প্রেরণ করেন এবং নবী করীম (সা) নিজে মক্কার নিম্ন এলাকা কুদার দিক থেকে প্রবেশ করেন। আল্লাহই ভাল জানেন। বায়হাকী বলেন, আবুল হুসায়ন ইবন আবদান— ইব্‌ন উমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন মহিলারা এসে অশ্বগুলোর মুখের ধুলাবালি মুছে দিতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুচকি হেসে আবূ বকরকে বললেন, আবূ বকর! হাসানের কবিতাটা কী? তখন আবু বকর (রা) হাসানের নিম্নোক্ত কবিতাংশ আবৃত্তি করেন : ইয়াহ্ইয়া ইয়াহইয়া

تشير النقع من كتفي كداء

بالخمر النساء

يلطمه

عدمت بنیتی ان لم تروها يناز عن الاعنة مسرجات

অর্থ : তোমরা যদি লক্ষ্য না রাখ, তা হলে আমি আমার প্রিয় অশ্বগুলো হারাব। যেগুলো কাদা নামক স্থানের দুই প্রান্তের ধুলাবালি উড়িয়ে চলছিল । যীন পরান অবস্থায় সেগুলো লাগামের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। আর মহিলারা তাদের ওড়না দিয়ে সেগুলোর ধুলাবালি ঝেড়ে দিচ্ছিল।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হাস্সান যেভাবে বলেছে সেভাবে একে অন্তর্ভুক্ত কর ।

ইন ইসহাক বলেন, ইয়াহয়া ইবন আববাদ ইবন আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়র তাঁর পিতার সূত্রে, তার দাদী আসমা বিনত আবু বকর থেকে আমার নিকট বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন যী তুওয়ায় অবস্থান করেন, তখন আবু কুহাফা তাঁর কনিষ্ঠতম কন্যাকে ডেকে বললেন, হে আমার কন্যা! আমাকে আবু কুবায়স পাহাড়ে নিয়ে চলো। আসমা বলেন, তখন তাঁর দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল। সে অবস্থায় কন্যাটি তাঁকে নিয়ে পাহাড়ে আরোহণ করল । আৰূ কুহাফা বললেন, হে আমার কন্যা! তুমি কি দেখতে পাচ্ছো? মেয়েটি বললো, আমি এক বিশাল জনসমষ্টি দেখতে পাচ্ছি। আবু কুহাফা বললেন, এরা অশ্বারোহী বাহিনী । মেয়েটি আরো বললো, আমি এক ব্যক্তিকে উক্ত জনসমষ্টির আগে পিছে অত্যন্ত তৎপর দেখতে পাচ্ছি। আবু কুহাফা বললেন, হে আমার কন্যা! ঐ ব্যক্তিই বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং আগে আগে থাকছে। তারপর মেয়েটি বললো, আল্লাহর কসম, জনতা এখন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। আবূ কুহাফা বললেন, আল্লাহর কসম, তা হলে অশ্বারোহী বাহিনীকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে চলো। তখন মেয়েটি তাকে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসে। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছবার আগেই তিনি অশ্বারোহীদের সামনে পড়ে যান। আসমা বলেন, মেয়েটির গলায় স্বর্ণের একটি হার ছিল, এক ব্যক্তি অগ্রসর হয়ে তার গলা থেকে হারটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আসমা বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মক্কায় আসেন এবং মসজিদে প্রবেশ করেন। তখন আবু বকর তাঁর পিতাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে দেখেই বললেন, মুরব্বিকে বাড়ি রেখে আসলে না কেন? আমিই বাড়িতে গিয়ে তাকে দেখে আসতাম। আবু বকর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার নিজে গিয়ে দেখে আসার চাইতে আপনার কাছে তাঁর আসাটাই অধিকতর মানানসই। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে সম্মুখে বসিয়ে তার বুকে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ইসলাম কবূল করুন! বৃদ্ধ আবু কুহাফা তখন ইসলাম গ্রহণ করলেন। আসমা বলেন, আবু বকর যখন পিতাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মাথাটি কাশফুলের মত শ্বেত শুভ্র দেখাচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তার চুল রাঙ্গিয়ে দাও! তারপর আবু বকর তার বোনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে বললেন, আল্লাহর দোহাই! ইসলামের দোহাই! আমি আমার এই বোনের স্বর্ণের হারটি ফেরত চাই। কিন্তু কারও থেকে কোন উত্তর পাওয়া গেল না। তখন আবু বকর বললেন, শুনো বোন! নিজের হার নিজেই সামলে রাখবে । আল্লাহর কসম! লোকদের মধ্যে আজ আর তেমন আমানতদারী নেই। আজ’ বলতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক ঐ দিনকেই নির্দিষ্ট করে বুঝিয়েছেন। কেননা, সে দিন সৈন্যসংখ্যা ছিল বিপুল। বিক্ষিপ্তভাবে থাকার কারণে কেউ কারও খোঁজ রাখতে পারছিল না। আর যে ব্যক্তি হার ছিনিয়ে নিয়েছে হযরত সিদ্দীক হয়তো মনে করেছেন যে, সে ব্যক্তি হয়তো শত্রু পক্ষের কেউ হবে । হাফিয বায়হাকী বলেন, আবদুল্লাহ্ আর হাফিয— জাবির (রা) থেকে বর্ণিত। উমর ইবন খাত্তাব আবু কুহাফাঁকে হাতে ধরে নবী করীম (সা)-এর কাছে নিয়ে যান। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, একে পরিবর্তন করে দাও, অর্থাৎ তাঁর দাড়ি রাঙ্গিয়ে দাও, তবে কাল করো না। ইবন ওহাব— যায়দ ইবন আসলাম থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু বকরের পিতা ইসলাম গ্রহণ করায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবু বকরকে মুবারকবাদ জানান। ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন নাজীহ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন তার সৈন্য বাহিনীকে যী তুওয়া থেকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে মক্কায় প্রবেশের আদেশ দেন, তখন যুবায়র ইবনূল আওয়ামকে একটি দল নিয়ে কাদার দিক থেকে প্রবেশ করার হুকুম দেন। যুবায়র বাহিনীর বাম অংশের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। আর সা’দ ইব্‌ন উবাদাকে আর একটি দল নিয়ে কুদার দিক থেকে প্রবেশের নির্দেশ দেন। ইবন ইসহাক বলেন, কোন কোন আলিম বলেছেন যে, সা’দ ইবন উবাদ মক্কায় প্রবেশের জন্যে যাত্রাকালে বলেছিলেন ।

اليوم يوم الملحمة اليوم تستحل الحرمة

“আজকের দিন কঠিন যুদ্ধের দিন! আজ বায়তুল্লাহর হুরমতকে হালাল করার দিন!”

জনৈক ব্যক্তি তার এ কথাটি শুনে ফেলেন । ইবন হিশামের মতে, তিনি ছিলেন উমার ইবন খাত্তাব (রা)। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! সা’দ ইবন উবাদা কি বলছে শুনুন! কুরায়শদের উপর সে যে হামলা করবে না সে ব্যাপারে আমরা তার উপর ভরসা করতে পারছি না। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আলীকে ডেকে বললেন : তুমি ওর কাছে যাও এবং তার নিকট থেকে পতাকা নিজ হাতে নিয়ে তা নিয়ে তুমিই বরং নগরে প্রবেশ কর।

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ব্যতীত অন্য একজন বর্ণনাকারী ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, সা’দ ইবন উবাদা আবু সুফিয়ানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, হে আবু সুফিয়ান! “আজকের দিন সংঘাতের দিন । আজকের দিন বায়তুল্লাহর হুরমাতকে হালাল বিবেচনার দিন”। তখন আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট সাদ এর উক্তির বিরুদ্ধে

অভিযোগ পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) জবাবে বললেন :না, বরং আজকের দিন কা’বার সম্মান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিন। তিনি সা’দ ইবন উবাদাকে সৌজন্য শিক্ষা দেয়ার জন্যে তাঁর হাত থেকে আনসারদের পতাকা নিয়ে নেয়ার আদেশ দেন। কথিত আছে যে, সা’দ এর নিকট থেকে পতাকা নিয়ে তা’ তাঁরই পুত্র কায়স ইবন সা’দের হাতে ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু মূসা ইবন উকবা যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, সাদ এর হাত থেকে পতাকা নিয়ে যুবায়র ইবন আওয়ামের হাতে প্রদান করা হয়। আল্লাহই ভাল জানেন।

হাফিয ইবন আসাকির ইয়াকূব ইবন ইসহাক ইবন দীনারের আলোচনায় আবদুল্লাহ্ ইবন সুররী এন্তাকী ও মূসা ইব্‌ন উকবা সূত্রে জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাদ ইবন উবাদার হাতে পতাকা প্রদান করেন। সাদ পতাকা নেড়ে নেড়ে বলছিলেন “আজকের দিন রক্তপাতের দিন। আজ কা’বর হুরমত হালাল করার দিন। বর্ণনাকারী বলেন, সাদের এ কথাটি কুরায়শদের মনে প্রচণ্ড আঘাত করল এবং তাদের আত্মমর্যাদায় খুব লাগলো। বর্ণনাকারী বলেন : এ সময় জনৈক মহিলা তার গতি-পথে সম্মুখে আসে এবং নিম্নের কবিতাটি আবৃত্তি করে :

قريش ولات حين لجاء

يانبي الهدى اليك لجاحيي

اض و عاداهم أله السماء

حين ضاقت عليهم سعة الار

م ونودوا بالصيلم الصلعاء)

(والنقت حلقتا البطان على القو

ربأهل الحجون والبطحاء

إن سعدايريد قاصمة الظها

ظ رمانا بالنسر والعواء

خزرجي لويستطيع من الغی

ود والليث والغ في الدماء)

(فانهينه فانه الاسد الاس

يا حماة اللواء أهل اللواء

فلئن أقحم اللواء ونادى

بقعة القاع في اكف الاماء

لتكونن بالبطاح ق ريش

ي صموت كالحية الصماء)

إنه مصلت يريد لها الرا

অর্থ : হে সঠিক পথের সন্ধান দানকারী নবী! কুরায়শ জনগণ আপনার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেছে এবং আশ্রয় গ্রহণকালে সংবাদ প্রদান করেছে।

তারা আশ্রয় নিয়েছে এমন সময়, যখন প্রশস্ত ভূ-খণ্ড তাদের উপর সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আর আসমানের প্রভু তাদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন।

এ কওমের অবস্থা অতি শোচনীয় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। এক জন-মানবশূন্য ধূসর প্রান্তর তাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

সা’দ এখন চাচ্ছে, এ উপত্যকার দুর্বল অধিবাসীদের কোমর ভেংগে দিতে।

সে তো খাযরাজ গোত্রের লোক; ক্রোধের আতিশয্যে সে আমাদেরকে শকুন ও কুকুরের খাদ্য হিসেবে নিক্ষেপ করতেও ত্রুটি করবে না। আপনি তাকে বাধা দিন। না হলে সে তো রক্ত পিপাসু সিংহ ও নেকড়ের ভূমিকা গ্রহণ করবে।

সে যদি স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে পতাকা ধারণ করে এবং পতাকার অধিকারী ও সংরক্ষণ কারীদের আহ্বান করে, তাহলে কুরায়শদের এ উপত্যকা দাসীদের হাতে শূন্য মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে ।

সে এমন বীর-বাহাদুর যে, বিষাক্ত মূক সর্পের ন্যায় এ উপত্যকায় তার নীরব সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চায়।

এ কবিতা শুনার পর তাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সহানুভূতির সঞ্চার হল এবং তার নির্দেশক্রমে সা’দ ইবন উবাদার হাত থেকে পতাকা নিয়ে তাঁরই পুত্র কায়স ইবন সা’দের হাতে তুলে দেয়া হলো। বলা হয়ে থাকে যে, মহিলাটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগ্রহ সহকারে মিনতি জানালে তিনি যেমন তাকে নিরাশ করতে চাননি, তেমনি সাদিকেও অখুশী করতে চাননি। তাই তিনি সাদের হাত থেকে পতাকা নিয়ে তারই পুত্রের হাতে তা অর্পণ করেন।

ইবন ইসহাক বলেন : ইব্ন আবু নাজীহ তার বর্ণনায় আরও উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশে খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ কিছু লোক নিয়ে মক্কার নিম্নাঞ্চল ‘লায়ত’ দিয়ে প্রবেশ করেন। খালিদ ছিলেন ডান দিকের বাহিনীর অধিনায়ক। আর এ বাহিনীতে ছিল আসলাম, সুলায়ম, গিফার, মুযায়না ও জুহায়নাসহ আরবের আরও কতিপয় গোত্র। অপর দিকে আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা) মুসলমানদের এক সারি লোকসহ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্মুখ দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। আর স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা) আযাখির হয়ে মক্কার উঁচু এলাকায় উপনীত হন এবং সেখানেই তার জন্যে তাঁবু স্থাপন করা হয়। বুখারী যুহরী আলী ইবন হুসায়ন– উসামা ইবন যায়দ সূত্রে বর্ণনা করেন : মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে উসামা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আগামীকাল কোথায় অবস্থান করবেন? তিনি বললেন, আকীল কি আমাদের জন্যে কোন জায়গা-জমি অবশিষ্ট রেখেছে? তারপরে তিনি বললেন : কাফির মুমিনের ওয়ারিশ হয় না এবং মু’মিন ও কাফিরের ওয়ারিশ হয় না। এরপর বুখারী আবুল ইয়ামান সূত্রে–আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা) বলেন, আল্লাহ্ আমাদেরকে বিজয় দান করলে ইনশাআল্লাহ্ আমাদের অবস্থান স্থল হবে খায়ফে- যেখানে কাফিররা কুফরীর উপর পরস্পর শপথ গ্রহণ করেছিল। ইমাম আহমদ ইউনুস সূত্রে— আবু হুরায়রা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন : ইনশাআল্লাহ্ আগামীকাল আমাদের অবস্থানস্থল হবে ‘খায়ফে বনূ কিনানায়’- যেখানে কুরায়শরা কুফরীর উপরে শপথ করেছিল। ইমাম বুখারীও ইবরাহীম ইবন সা’দ সূত্রে আবু হুরায়রা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

ইন ইসহাক বলেন : আবদুল্লাহ্ ইবন আবু নাজীহ্ ও আবদুল্লাহ্ ইবন আবু বকর আমার নিকট বর্ণনা করেন যে, সাফওয়ান ইবন উমাইয়া, ইকরিমা ইবন আবূ জাল ও সুহায়ল ইবন আমর যুদ্ধের উদ্দেশ্যে খানদামা নামক স্থানে কিছু সৈন্য সমাবেশ করে। অপর দিকে বনূ বকর গোত্রের হিমাস ইবন কায়স ইবন খালিদ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মক্কা প্রবেশের আগে তার অস্ত্রে শান দিতে শুরু করে। তা দেখে তার স্ত্রী তাকে বলে? এসব প্রস্তুত করা হচ্ছে কিসের জন্যে? জবাবে সে বলে : মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের জন্যে। তার স্ত্রী তাকে বললো : আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের মুকাবিলায় কিছুই করতে পারবে বলে তো আমার মনে হয় না। হিমাস বললো? আল্লাহর কসম! আমিতো আশা করছি তাদের কাউকে অবশ্যই তোমার সামনে হাযির করতে পারবো । তারপর সে কবিতায় বললো :

هذا سلاح كامل واله

ان يقبلو اليوم فمالی عله

وذو غرارين سريع السلة

অর্থাৎ– আজ যদি তারা মুকাবিলার জন্যে এগিয়ে আসে তবে কোন পরোয়া করি না। কেননা, আমার কাছে এই যে রয়েছে পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র, রয়েছে বর্শা ও দু’ধারী তরবারি যা শত্রু বধ করতে দ্রুত কার্যকর।

তারপর সে খানদামায় গিয়ে সাফওয়ান, ইকরামা ও সুহায়লের সংগে মিলিত হয়। খালিদ ইব্‌ন ওলীদের বাহিনীর কতিপয় মুসলমানের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। এবং দু-পক্ষের মধ্যে সামান্য সংঘর্ষও হয়। এতে বনূ মুহারিব ইবন ফিহর গোত্রের কুর ইব্‌ন জাবির ও বনূ-মুনকিযের মিত্র হুনায়শ [ইবন হিশাম ও তায়মুরিয়ার মতে তার নাম ছিল খুনায়স। কিন্তু সুহায়লী বলেন, সঠিক হলো হুনায়শ] ইবন খালিদ ইবন রাবীআ ইবন আসরাম শহীদ হন। এঁরা দুজনই ছিলেন খালিদের বাহিনীভুক্ত । খালিদের অবলম্বিত পথ ছেড়ে অন্য পথ ধরে চলায় তাঁদের এ বিপর্যয় ঘটে এবং একই সাথে উভয়ে নিহত হন। তবে হুনায়শ নিহত হওয়ার একটু আগে কুর্য নিহত হন। আবদুল্লাহ্ ইবন আবু নাজীহ ও আবদুল্লাহ্ ইবন আবু বকর বলেন : ঐ দিন খালিদের অশ্ব বাহিনীর মধ্য থেকে সালামা ইবন মায়লা জুহানীও নিহত হন। অপর দিকে মুশরিক বাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। এ সময় তাদের বারজন কি তেরজন মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। ওদিকে হিমাস পালিয়ে বাড়ি চলে যায় এবং ঘরে প্রবেশ করে স্ত্রীকে ডেকে বলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও। স্ত্রী তাকে বললো, তোমার সে বাহাদুরী কথা গেল কোথায়? হিমাস তখন কবিতায় বলে?

اذ فرصفوان وفر عكرمة واستقبلتهم بالسيوف المسلمة ضربا فلا يسمع الا غمغمة لم تنطقي في اللوم ادنی کلمه

انك لو شهدت يوم الخندمة وابو يزيد قائم كالمؤتمة يقطعن كل ساعد وجمجمة لهم نهيت خلفنا وهمهمسه

অর্থাৎ ওহে! তুমি যদি খানদামার যুদ্ধে তথায় উপস্থিত থাকতে, তবে সাফওয়ান ও ইকরামার পলায়নের অবস্থা দেখতে পেতে। সেদিন আবু ইয়াযীদ (সুহায়ল) স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়েছিল। আমি তাদের মুকাবিলা করেছি অনুগত তরবারি দ্বারা। তরবারিগুলো হাতের কব্জি ও মাথার খুলি ছেদন করে যাচ্ছিল। যুদ্ধের ঘনঘটায় গুমগুম আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। তাদের রণ-হুংকারে আমি দূরে পশ্চাতে ফিরে আসি। তুমি যদি ওসব দেখতে তবে তিরস্কারমূলক একটি কথাও বলতে না।

ইবন হিশাম বলেন : কবিতাগুলো মূলত : রিয়াশ হুযালির বলে বর্ণিত।

সংকেত ও মক্কা বিজয়, হুনায়ন ও তায়েফের যুদ্ধে মুসলমানদের সাংকেতিক চিহ্নসমূহ ছিল নিম্নরূপ :

মুহাজিরদের সংকেত : হে আবদুর রহমানের গোত্র!

খাযরাজীদের সংকেত : হে আবদুল্লাহর গোত্র!

আওস গোত্রীয়দের সংকেত : হে উবায়দুল্লাহর গোত্র!

তাবারাণী আলী ইবন সাঈদ রাযী– ইব্‌ন আব্বাস সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : আল্লাহ্ যে দিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন সে দিন থেকে এ শহরকে ‘হারম’ করেছেন। এবং যে দিন তিনি সূর্য ও চন্দ্র স্থাপন করেন সে দিনই এ শহর স্থাপন করেন। এ শহরের সমান্তরালে অবস্থিত আকাশকেও তিনি হারর্ম করেছেন। আমার পূর্বে কখনও এ শহর কারও জন্যে হালাল করা হয়নি। কেবল আমার ক্ষেত্রে দিবসের স্বল্পক্ষণের জন্যে হালাল করা হয়েছে। এবং স্বল্পক্ষণ পরেই পূর্বের ন্যায় আবার এর হুরমত বহাল করা হয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জানান হল যে, এই তো খালিদ ইবন ওয়ালীদ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন একজনকে ডেকে বললেন : তুমি যাও খালিদকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বল। লোকটি এসে খালিদকে বললো : নবী করীম (সা) বলেছেন, যাকেই নাগালের মধ্যে পাও তাকেই হত্যা করতে থাক। খালিদ সেদিন সত্তর জন ব্যক্তিকে হত্যা করেন। লোকটি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে এ সংবাদ তাঁকে জানায়। তখন তিনি খালিদকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করেন, আমি কি তোমাকে নর হত্যা করতে নিষেধ করিনি? খালিদ জবাব দিলেন, অমুক ব্যক্তি আমাকে গিয়ে বলেছে যাকেই আমি নাগালে পাই তাকেই যেন হত্যা করি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সে লোকটিকে ডেকে এনে বললেন : আমি কি তোমাকে যুদ্ধ বন্ধ করার হুকুম দিইনি? লোকটি বললো : আপনি এক প্রকার চেয়েছেন, আর আল্লাহ্ চেয়েছেন অন্য প্রকার। আপনার ইচ্ছার উপর আল্লাহর ইচ্ছাই বলবত হয়েছে। তাই যা হওয়ার ছিল তার অন্যথা আমি করতে পারিনি। তার জবাব শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নীরব থাকলেন এবং তাকে কিছুই বললেন না।

ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সেনাধ্যক্ষদের নিকট থেকে এই মর্মে অংগীকার নিয়েছিলেন যে, তাঁরা তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসা লোকদের ব্যতীত অন্য কারও সংগে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন না। তবে তিনি নাম উল্লেখ করে বিশেষ কিছু লোককে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। এমনকি যদি তাদেরকে কাবার গিলাফের নীচেও পাওয়া যায় তবু । তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ ইবন সা’দ ইব্ন আবু সারাহ্ ছিল অন্যতম। সে বাহ্যত ও ইসলাম গ্রহণ করে ও ওহী লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু পরে সে মুরতাদ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কায় প্রবেশ করে তাকে হত্যার ঘোষণা দিলে সে পালিয়ে উছমান (রা)-এর কাছে আশ্রয় নেয়। সে ছিল উছমানের দুধভাই। উছমান তাকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে নিয়ে আসেন। তিনি দীর্ঘক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ উছমানের সাথে তার ফিরে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) উপস্থিত সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বললেন : তোমাদের মধ্যে এমন একজন সুবুদ্ধিসম্পন্ন লোকও কি ছিল না, যে আমার নীরব থাকা অবস্থায় তাকে হত্যা করে দিত। সাহাবীগণ বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদেরকে একটু ইংগিত দিলেন না কেন? তিনি বললেন, ইংগিত দিয়ে কাউকে হত্যা করান নবীর জন্যে শোভনীয় নয়। অন্য একটি বর্ণনায় আছে- তিনি তখন বলেছিলেন : কোন নবী চোখের খিয়ানত করতে পারেন না।

ইবন হিশাম বলেন : লোকটি পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং খাঁটি মুসলমান হয়। হযরত উমর তাকে গর্ভনরও নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে হযরত উছমানও তাকে গভর্নর বানান ।

আমি বলি, উক্ত আবদুল্লাহ্ ইবন সা’দ নিজ গৃহে ফজরের নামাযে সিজদারত অবস্থায় কিংবা নামায শেষ হওয়ার সাথেই ইনতিকাল করেন।

ইবন ইসহাক বলেন : বনূ তায়ম ইব্‌ন গালিব গোত্রের আবদুল্লাহ ইবন খাতালকেও রাসূলুল্লাহ (সা) হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার নাম আবদুল উযযা ইবন খাতালও বলা হয়। সম্ভবত এ রকমই ছিল। পরে ইসলাম গ্রহণ করলে আবদুল্লাহ্ নাম রাখা হয় । [সুহায়লী বলেন : কারও মতে তার নাম ছিল হিলাল। কারও মতে তার ভাইয়ের নাম হিলাল এবং দুই ভাইকে এক সংগে খাতলান বলা হত।] ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে যাকাত উশুল করার জন্যে পাঠান। তার সাথে একজন আনসারীকেও দেন। তার নিজের আযাদকৃত গোলামও সাথে ছিল । কোন এক কারণে গোলামের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে সে হত্যা করে ফেলে। তার পরে সে পুনরায় পৌত্তলিকতায় ফিরে যায়। আবদুল্লাহ্ ইবন খাতালের দুটি গায়িকা দাসী ছিল ।

একজনের নাম ফারতানী। অপর জন তারই আরেক সংগিনী। এরা দুজনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও মুসলমানদের কুৎসামূলক গান গেয়ে বেড়াত। এ কারণে তিনি ইবন খাতাল ও তার দু গায়িকাকে হত্যার নির্দেশ দেন। ফলে কাবার গিলাফ ধরে থাকা অবস্থায় তাকে হত্যা করা হয়। আবূ বুর আসলামী এবং সাঈদ ইবন হুরায়ছ সম্মিলিতভাবে তাকে হত্যা করেন। গায়িকাদ্বয়ের মধ্যে এক জনকে হত্যা করা হয় এবং অপরজনকে নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। বর্ণনাকারী বলেন : হুয়ায়রিছ ইবন নুকায়ছ [আসাহহুস্ সিয়ারে এ নামটি হুয়ায়রিছ ইবুন নুকায়দ-নুকায়য নয়।-সম্পাদক] ইবন ওহব ইবন আবদে কুসায়্যও এ তালিকার অন্যতম ব্যক্তি। এ লোকটিও মক্কায় নানাভাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জ্বালাতন করত। হিজরাতের প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কন্যা ফাতিমা ও উম্মে কুলছুমকে হযরত আব্বাস যখন মদীনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্যে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এই হুয়ায়রিছ তাঁদের পশ্চাদ্ধাবন করে এবং যে উটে তারা আরোহণ করে যাচ্ছিলেন সে উটকে বল্লম দিয়ে খোঁচা দেয়। ফলে তারা দুজনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হুয়ায়রিছকে হত্যা করার আদেশ দিলে আলী ইবন আবু তালিব তাকে হত্যা করেন ।

ইন ইসহাক বলেন : এ তালিকায় মিয়াস ইবন সুবাবাও ছিল। এক ব্যক্তি তার ভাইকে ভুলক্রমে হত্যা করে। এ জন্যে সে যথারীতি রক্তপণ গ্রহণ করে করে। কিন্তু পরে সে হত্যাকারীকে হত্যাও করে এবং মুরতাদ হয়ে মুশরিকদের দলে ভিড়ে যায় । তাকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হলে তারই গোত্রের নুমায়লা ইবন আবদুল্লাহ্ তাকে হত্যা করেন। ইবন ইসহাক বলেন : বনূ আবদুল মুত্তালিব ও ইকরামা ইবন আবু জাহলের দাসী সারাও এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল । কেননা, সে মক্কায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে নানা ধরনের কষ্ট দিত।

আমি বলি, ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সারা হাতিব ইবন আবূ বালতাআর চিঠি বহন করেছিল । এবং হয়তো তার অপরাধ ক্ষমা করা হয়েছিল। অথবা হতে পারে সে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপরে তাকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট তার জন্যে নিরাপত্তা প্রার্থনা করা হয়। তিনি তাকে নিরাপত্তা দেন। খলীফা উমর (রা)-এর সময় পর্যন্ত

সে জীবিত থাকে। ঘটনাক্রমে এক ব্যক্তির ঘোড়ার পদতলে দলিত হয়ে সে মারা যায়। সুহায়লী বলেছেন : ইবন খাতালের গায়িকা দাসী ফারতানী [আসাহহুস সিয়রে এ নামটি কারতানা এবং অপর গায়িকাটির নাম কুরায়বা বলা হয়েছে। দ্র. আসাহহুস সিয়ার পৃ. ২৬৫—জালালাবাদী] ও পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে। ইবন ইসহাক বলেন : ইকরামা ইবন আবু জাহল ইয়ামানে পালিয়ে যায়। তার স্ত্রী উম্মু হাকিম বিত হারিছ ইবন হিশাম ইসলাম গ্রহণ করেন । তিনি তার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট নিরাপত্তার আবেদন জানান। আবেদন মঞ্জুর হলে স্বামীর খোঁজে তিনি ইয়ামানে গিয়ে তাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে নিয়ে আসেন।

তখন ইকরামাও ইসলাম গ্রহণ করেন। বায়হাকী– আবু তাহির— মাসআব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন : মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) চারজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা ব্যতীত অন্যান্য সকলের জন্যে নিরাপত্তা প্রদান করেন। ঐ ছয় ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি ঘোষণা দেন যে, কা’বার গিলাফ জড়িয়ে ধরে থাকা অবস্থায় পেলেও ওদেরকে হত্যা করবে। পুরুষ চারজন হল –ইকরামা ইবন আবু জাহল, আবদুল্লাহ্ ইবন খাতাল, মিয়াস ইবন সুবাব’ ও আবদুল্লাহ্ ইবন সা’দ ইবন আবূ সারাহ্ । এর মধ্যে আবদুল্লাহ্ ইবন খাতালকে কাবার গিলাফ ধরে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে দেখে সাঈদ ইবন হুরায়ছ এবং আম্মার ইবন ইয়াসির (রা) দৌড়ে অগ্রসর হন। সাঈদ বয়সে অপেক্ষাকৃত যুবক হওয়ায় আম্মারকে পিছে ফেলে আগে পৌঁছে যান এবং সেখানেই তাকে হত্যা করেন। মিয়াসকে মুসলমানগণ বাজারের মধ্যে পেয়ে সেখানেই তাকে হত্যা করেন। ইকরামা মক্কা থেকে পালিয়ে যান। সমুদ্র পাড়ি দেয়ার জন্যে তিনি নৌকায় আরোহণ করেন। কিছুদূর অগ্রসর হলে সমুদ্রে ভীষণ ঝড় ওঠে। তখন নৌকার মাঝি আরোহীদেরকে জানাল, তোমরা দেব-দেবীর প্রভাব থেকে অন্তরকে মুক্ত করে খাঁটি মনে এক আল্লাহকে ডাক। কেননা, তোমাদের ওসব দেব-দেবী এখানে কোন কাজেই আসবে না। তখন ইকরামা বললো : আল্লাহর কসম! সমুদ্রে যদি আল্লাহ ছাড়া আর কেউ মুক্তি দিতে না পারে তা হলে স্থলেও তিনি ছাড়া অন্য কেউ মুক্তি দিতে পারবে না। তারপরে তিনি দু’আ করলেন– হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এই অংগীকার করছি যে, এই বিপদ থেকে যদি আপনি আমাকে মুক্তি দেন, তবে আমি মুহাম্মাদের কাছে গিয়ে তাঁর হাতে নিজেকে সোপর্দ করবো। আমি অবশ্যই তাকে দয়ালু ও ক্ষমাশীল হিসেবে পাব। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। আবদুল্লাহ্ ইবন সা’দ ইবন আবু সারাহ্ হযরত উছমান ইবন আফফানের নিকট আত্মগোপন করে থাকে। পরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন ঈমানের উপর বায়আত গ্রহণ করার জন্যে লোকদের আহ্বান করেন তখন হযরত উছমান আবদুল্লাহ ইবন সা’দকে সাথে এনে নবী (সা)-এর সামনে উপস্থিত হন এবং তাকে বায়আত করার আবেদন জানান। রাসূলুল্লাহ (সা) চক্ষু তুলে তার দিকে তাকান আবার চক্ষু ফিরিয়ে নেন। এভাবে তিনবার করেন; কিন্তু তার বায়আত নিলেন না। তিনবার তাকাবার পর তাকে বায়আত করান। এরপর সাহাবাদের সম্বোধন করে বলেন : তোমাদের মধ্যে কি এমন একজন বিচক্ষণ লোক নেই, যে আমাকে বায়আত করা হতে বিরত থাকতে দেখে তাকে হত্যা করে দিত? সাহাবাগণ বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার মনের কথা আমরা কি করে বুঝবো; আমাদের প্রতি আপনি চোখ দিয়ে একটু ইশারা করলেন না কেন? তিনি বললেন, নবীর জন্যে খিয়ানতকারী চোখ থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। আবু দাউদ ও নাসাঈ এ হাদীছটি আহমদ ইবন মুফাযযাল সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম বায়হাকী– আবু আবদুল্লাহ হাফিয আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন : মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) চার ব্যক্তি ব্যতীত অন্য সকলের জন্যে নিরাপত্তা ঘোষণা করেন। চারজন হল- আবদুল উযযা ইবন খাতাল, মিয়াস ইব্‌ন সুবাবা, আবদুল্লাহ্ ইবন সা’দ ইবন আবু সারাহ্ এবং উম্মে সারা। আবদুল উযযা ইবন খাতালকে কাবার গিলাফ ধরে থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়। আবদুল্লাহ্ ইবন সা’দ ইবন আবু সারাহকে দেখামাত্র হত্যা করার জন্যে এক ব্যক্তি মানত (প্রতিজ্ঞা করে । আবদুল্লাহ্ ছিল উছমান ইবন আফফানের দুধ ভাই। তিনি তার পক্ষে সুপারিশ করার জন্যে তাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে নিয়ে আসেন। তাকে আসতে দেখে ঐ আনসারী তরবারি নিয়ে বেরিয়ে আসলেন। কিন্তু তিনি এসে দেখলেন যে, আবদুল্লাহ্ রাসূলের মজলিসে বসে পড়েছে। এ অবস্থায় আনসারী সংশয়ে পড়ে যায় এবং অগ্রসর হতে ইতস্ততা বোধ করে। এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাত বাড়ালে সে বায়আত হয়ে যায়। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আনসারীকে বললেন, তুমি তোমার মানত পূরণ করবে বলে আমি অপেক্ষা করছিলাম। তিনি বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি তো দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, আপনি আমাকে একটু ইংগিত করলেন না কেন? তিনি বললেন, ইংগিত করা নবীর জন্যে শোভা পায় না। মিয়াস ইবন সুবাবা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সে একজন মুসলমানকে হত্যা করে মুরতাদ হয়ে যায় । উম্মু সারা ছিল কুরায়শ গোত্রের দাসী। সে নবী করীম (সা)-এর নিকট এসে তার অভাবের কথা জানালে তিনি তাকে সাহায্য স্বরূপ কিছু প্রদান করেন। ফিরে যাওয়ার সময় এক লোক মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠি তার কাছে দেয়। এরপর বায়হাকী হাতিব ইব্‌ন আবূ বালতাআর ঘটনা বর্ণনা করেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক– ইবন হাম থেকে বর্ণনা করেন, বনু মুসতালিকের যুদ্ধে মিয়াস ইবন সুবাবার ভাই হিশামকে মুশরিক

মনে করে জনৈক মুসলমান হত্যা করে। এ ঘটনার পর মিকয়াস নিজেকে মুসলমান হিসাবে প্রকাশ করে ভাইয়ের রক্তপণ আদায়ের জন্যে এগিয়ে আসে। রক্তপণ গ্রহণ করার পর সে তার ভাইয়ের হত্যাকারীকে হত্যা করে এবং পুনরায় মুশরিক হয়ে মক্কায় চলে যায়। মক্কা বিজয়ের দিন তাকে হত্যার ঘোষণা দিলে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী জায়গায় তাকে হত্যা করা হয়। ইবন ইসহাক ও বায়হাকী উল্লেখ করেছেন যে, মিয়াস তার ভাইয়ের হত্যাকারীকে হত্যা করার সময় নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করছিল–

يضرج توبيه دماء الاخادع

شفي النفس من قد بات بالقاع مسندا

تلم وتنسيني وطاء المضاجع

وكانت هموم النفس من قبل قتله قتلت به فهرا وغرمت عقله سراة بني النجار ارباب فارع

وكنت الى الاوثان اول راجع

حللت به نذری و ادركت ثورتي

অর্থ : যে ব্যক্তি দূর প্রান্তরে গিয়ে রাত্রি যাপন করেছে, তার হৃদয় প্রশান্তি লাভ করেছে তখন, যখন তার পোশাক-পরিচ্ছদ অহংকারীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে।

তাকে হত্যা করার পূর্ব পর্যন্ত আমার অন্তর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন ছিল, নিজেকে তিরস্কৃত মনে হচ্ছিল এবং শয্যা গ্রহণ পর্যন্ত আমি ভুলে বসেছিলাম।

আমি আমার ভাইয়ের বিনিময়ে বনূ ফিহরের একজনকে হত্যা করেছি এবং বনু নাজ্জারের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সর্দারদের থেকে রক্তপণ আদায় করতে সক্ষম হয়েছি।

এ হত্যা-প্রতিশোধ দ্বারা আমি আমার মানত পূরণ করেছি, সম্পদ লাভ করেছি এবং সর্বাগ্রে মূর্তি দেবতার কাছে প্রত্যাবর্তন করেছি।

আমি বলি, কারও কারও মতে যে দুজন গায়িকাকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয় তারা ছিল এই মিয়াস ইবন সুবাবারই দাসী। আর সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে হত্যা করা হয়। মিকইয়াসের চাচাত ভাইকে। কোন কোন লেখক বলেছেন, ইব্‌ন খাতালকে হত্যা করেছিলেন যুবায়র ইবন আওয়াম (রা)। ইবন ইসহাক বলেন, সাঈদ ইবন আবূ হিন্দ আমার নিকট আকীল ইব্ন আবু তালিবের গোলাম আবু মুরূরা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আবু তালিবের কন্যা উম্মু হানী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মক্কার উঁচু এলাকায় অবতরণ করেন, তখন মাখযুম গোত্রের আমার দেবর সম্পর্কীয় দুব্যক্তি পালিয়ে আমার নিকট চলে আসে। ইবন হিশাম বলেন, ঐ দু’ ব্যক্তির নাম- হারিছ ইবন হিশাম ও যুহায়র ইবন আবূ উমাইয়া ইবন মুগীরা। ইবন ইসহাক বলেন, উম্মু হানী ছিলেন মাখতূম গোত্রের হুবায়রা ইব্‌ন আবু ওহবের স্ত্রী। তিনি বলেন, এমন সময় আমার ভাই আলী ইবন আবু তালিব আমার ঘরে আগমন করেন। তাদের দু’জনকে দেখেই তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম! আমি এদেরকে হত্যা করবই। তখন আমি তাদেরকে আমার ঘরে আবদ্ধ করে দরজা বন্ধ করে দিলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট মক্কার উঁচু ভূমিতে ছুটে গেলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, তখন তিনি এমন একটি মটকা থেকে পানি নিয়ে গোসল করছেন, যাতে আটার চিহ্ন লেগে ছিল এবং তার কন্যা ফাতিমা তখন তাঁকে কাপড় দিয়ে আড়াল করে রেখেছেন। গোসল শেষ করে তিনি কাপড় পরলেন। তারপর আট রাকআত চাশতের নামায আদায় করলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন : স্বাগতম হে উম্মু হানী! কী মনে করে আসলে? তখন আমি তাকে ঐ দু’ব্যক্তি ও আলীর সংবাদ জানালাম । শুনে তিনি বললেন, তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছ, আমরাও তাকে আশ্রয় দিলাম; তুমি যাকে নিরাপত্তা দিয়েছ আমরাও তাকে নিরাপত্তা দিলাম। আমরা ওদেরকে হত্যা করবো না। ইমাম বুখারী বলেন, আমার নিকট হাদীছ বর্ণনা করেছেন আবুল ওলীদ— ইব্ন আবু লায়লা সুত্রে। ইবন আবু লায়লা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে চাশতের নামায পড়তে দেখেছেন- এ কথা একমাত্র উম্মু হানী ব্যতীত আর কেউ আমাদের নিকট বর্ণনা করেন নি। তিনি মক্কা বিজয় যুদ্ধের উল্লেখ প্রসংগে বলেন : নবী করীম (সা) তাঁর ঘরে গোসল সম্পন্ন করে আট রাকআত নামায পড়েন। উম্মু হানী আরও বলেন, তিনি এ নামায এতো সংক্ষেপে পড়লেন- যেমনটি আমি আর কখনও দেখিনি। তবে রুকু-সিজদা যথারীতি আদায় করেছেন। সহীহ মুসলিমে– (আকীলের গোলাম) আবু মুরুরা সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। তবে তাতে আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর গোসল ও চাশতের নামায আদায়ের পূর্বেই তাদেরকে নিরাপত্তা দানের ঘোষণা দেন। তাকে আশ্রয় দিলাম ।

মুসলিমের আর একটি বর্ণনায় আছে যে, উম্মু হানী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে যখন যান, তখন তিনি গোসলরত ছিলেন এবং তাঁর কন্যা ফাতিমা একখানা কাপড় আড় করে পর্দা করে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, এ আগন্তুক কে? উত্তরে ফাতিমা জানালেন উম্মু হানী। তিনি বললেন, উম্মু হানীকে স্বাগতম। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি দুজন পুরুষকে আশ্রয় দিয়েছি কিন্তু আলী ইবন আবু তালিবের মায়ের পুত্র (আলী) তাদেরকে হত্যা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে উম্মু হানী! তুমি যাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। আমরাও তাদেরকে আশ্রয় দিলাম। উম্মু হানী বলেন, এরপর তিনি আট রাকআত নামায পড়লেন। আর এটা ছিল চাশতের সময়। এ কারণে বহু সংখ্যক আলিম মনে করেন যে, এ নামায ছিল চাশতের নামায। কিন্তু অন্যান্য আলিমগণ বলেন, এটা ছিল বিজয়ের নামায। এ ব্যাপারে স্পষ্ট বর্ণনা এসেছে যে, ঐ নামাযে প্রতি দু’ রাকআতের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সালাম ফিরিয়েছেন । এ বর্ণনাটি সুহায়লীসহ ঐসব আলিমদের মতের বিরোধী যারা বিজয়ের নামায একই সালামে আট রাকআত পড়ার কথা বলেন। বর্ণিত আছে, সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস পারস্য সাম্রাজ্যের মাদায়েন শহর জয় করার পর কিসরার রাজপ্রাসাদে আট রাকআত নামায পড়েছিলেন এবং প্রতি দু’রাকআতের পর সালাম ফিরিয়েছিলেন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই।

ইবন ইসহাক বলেন : মুহাম্মাদ ইবন জাফর …. সাফিয়্যা বিন্‌ত শায়বা সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় অবতরণের পর যখন লোকজনের মধ্যে স্বস্তির ভাব ফিরে আসে তখন তিনি নিজ অবস্থান থেকে বের হয়ে বায়তুল্লায় আসেন এবং বাহনের উপর বসা অবস্থায়ই সাতবার তাওয়াফ করেন। তাওয়াফকালে তিনি তাঁর হাতের ছড়ি দ্বারা বায়তুল্লাহর রুকন স্পর্শ করে চুম্বনের কাজ সমাধা করেন। তাওয়াফ শেষে তিনি উছমান ইবন তালহাকে ডেকে তার নিকট থেকে কা’বার চাবি গ্রহণ করেন। কা’বার দরজা খোলা হলে তিনি তাতে প্রবেশ করেই একটি কাষ্ঠ নির্মিত কবুতর মূর্তি দেখতে পান। তিনি নিজ হাতে তা ভেঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দেন। তারপর কাবার দরজায় এসে দাঁড়ান। ইতোমধ্যে তাঁর আগমনে মসজিদে প্রচুর লোকের সমাবেশ ঘটে। মূসা ইবন উকবা বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) দু’বার সিজদা করে যমযম কূপের কাছে যান। সেখানে তিনি পানি আনিয়ে পান করেন ও উযূ সম্পন্ন করেন। সাহাবীগণ তাঁর উযূর ব্যবহৃত পানির কিছু অংশ বরকত হিসেবে লওয়ার জন্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। মুশরিকরা এ দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়ে বলাবলি করছিল- আমরা এমন একজন সম্রাট জীবনে কখনও দেখিনি বা তার কথা শুনিনি- যাকে তার ভক্তরা এত ভক্তি করে। তিনি আজ বায়তুল্লাহর সংলগ্ন নিজ জায়গায় বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করলেন। ইবন ইসহাক বলেন, আমার নিকট জনৈক আলিম বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) কা’বার দরজায় দাঁড়িয়ে নিম্নরূপ ভাষণ দেন

لا اله الا الله وحده لا شريك له صدق وعده ونصر عبده وحزم الاحزاب وحده الا كل مأثرة او دم او مال يدعي فهو موضوع تحت قدمی هتين الا سدانة البيت وسقاية الحاج– الا وقتيل الخطأ شبه العمد بالسوط والعصا ففيه الدية مغلظة ماية من الابل اربعون منها في بطونها او لادها يا معشر قريش ان الله قد أذهب عنكم نخوة الجاهلية و تعظمها بالاباء الناس من آدم آدم من تراب

অর্থাৎ : এক আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি একক, তার কোন শরীক নেই।

তিনি তাঁর ওয়াদা পূরণ করেছেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন। তিনি একাই সকল বাহিনীকে পরাস্ত করেছেন।

জেনে রেখো! জাহিলিয়াত যুগের সকল আভিজাত্যের অহংকার, রক্ত বা সম্পদের প্রতিশোধ দাবি আমার এ দু’পায়ের নীচে আজ দলিত।

তবে বায়তুল্লাহর সেবা ও হাজীদের পানি পান করানোর ব্যবস্থাপনা এর ব্যতিক্রম। জেনে রেখো! ভুলক্রমে হত্যার বিষয়টা ছড়ি অথবা লাঠি দ্বারা ইচ্ছাকৃত হত্যার অনুরূপ। এর জন্যে গুরুতর রক্তপণ দিতে হবে অর্থাৎ– একশ উট, যার মধ্যে চল্লিশটি থাকবে গর্ভবতী।

হে কুরায়শ সম্প্রদায়! আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের থেকে জাহিলিয়াত যুগের অহমিকা ও বংশ-গৌরবের অবসান ঘটিয়েছেন।

মানুষ মাত্রই আদম থেকে সৃষ্ট। আর আদম সৃষ্ট মাটি থেকে। তারপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন :

يا أيها الناس انا خلقناكم من ذكر و أنثى وجعلناكم شعوبا وقبائل

التعارفوا إن أكرمكم عند الله أتقاكم إن الله عليم خبيره

অর্থাৎ- “হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী ‘থেকে। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিকতর মুত্তাকি। আল্লাহ্ সবকিছু জানেন। সমস্ত খবর রাখেন।” (৪৯- হুজুরাত : ১৩)।

তারপর তিনি বললেন, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! — তোমাদের ব্যাপারে আমি কী আচরণ করবো বলে তোমরা মনে কর? তারা বললো : –আমরা উত্তম ধারণা রাখি, কেননা, আপনি একজন মহান ভাই ও মহৎ ভাইপো। তখন তিনি বললেন : –যাও, তোমরা আজ মুক্ত স্বাধীন। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) মসজিদে গিয়ে বসলেন। তখন আলী ইবন আবু তালিব কাবা ঘরের চাবি হাতে করে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! বায়তুল্লাহর সেবায়েতের দায়িত্ব এবং হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব দুটোই আমাকে দান করুন। আল্লাহ্ আপনার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন বললেন : উছমান ইবন তালহা কোথায়? তাকে ডেকে আনা হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “এই লও তোমার চাবি, হে উছমান! আজকের দিন হচ্ছে সদাচার ও প্রতিশ্রুতি পালনের দিন।”

ইমাম আহমদ— সুফিয়ান ইবন উমর (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) বায়তুল্লাহর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিম্নোক্ত খুতবা পেশ করেন :

“প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তাঁর ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই সমস্ত বাহিনীকে পর্যুদস্ত করছেন।

জেনে রেখো! ছড়ি বা লাঠি দ্বারা অনিচ্ছাকৃত হত্যায় একশ’ উট দিতে হবে। তার অন্য বর্ণনায় গুরুতর রক্তপণের কথা আছে। যার মধ্যে চল্লিশটি হবে গর্ভবতী।

জেনে রেখো! জাহিলী যুগের সকল অহমিকা ও রক্তের প্রতিশোধের দাবী (আর এক বর্ণনা মতে মালের দাবী) আমার এ দু পায়ের নীচে দলিত ।

তবে হাজীদের পানি পান করান ও বায়তুল্লাহর সেবা এ দুটি ব্যাপার ভিন্ন । কেননা, এ দুটি বিষয়ের দায়িত্ব যাদের হাতে ছিল তাদেরকেই বহাল রাখা হয়েছে । আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবন মাজা আলী ইবন যায়দ– ইবন উমর (রা) সূত্রে এ হাদীছটি অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইবুন হিশাম বলেন : কতিপয় আলিম আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বায়তুল্লায় প্রবেশ করে তার মধ্যে ফেরেশতার ও অন্যান্য কিছু জিনিসের ছবি দেখতে পান। তিনি আরও দেখতে পান যে, ইবরাহীম (আ)-এর একটি ছবি, হাতে তীর নিয়ে তিনি ভাগ্য নির্ণয় করছেন। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ্ ওদেরকে ধ্বংস করুন! ওরা আমাদের মহান নেতাকে তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয়কারী বানিয়ে ছেড়েছে। অথচ, ঐ সব ভাগ্য নির্ণয়ের তীরের সাথে ইবরাহীম (আ)-এর কী সম্পর্ক?

ما كان إبراهيم يهوديا ولا نصراني ولكن كان حنيفا مسلما . وما كان من

المشركين *

“ইবরাহীম তো য়াহূদী বা নাসারা ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলমান। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।” (৩- আলে ইমরান : ৬৭)।

এরপর তিনি ছবিগুলো মুছে ফেলার নির্দেশ দেন এবং সেমতে সেগুলো মুছে ফেলা হয়। ইমাম আহমদ বলেন : আমার নিকট সুলায়মান— জাবির সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : কা’বা ঘরের অভ্যন্তরে কতিপয় ছবি ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) উমর (রা)-কে সেগুলো মুছে ফেলতে নির্দেশ দেন। তখন উমর (রা) একখানা কাপড় নিয়ে সেগুলো মুছে দেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) কা’বা ঘরে প্রবেশ করেন। তখন ঘরের মধ্যে আর কোন ছবি অবশিষ্ট ছিল না। ইমাম বুখারী সাদকা ইবন ফযল আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ সূত্রে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় প্রবেশ করেন। তখন বায়তুল্লাহর চারপাশ ঘিরে তিনশ ষাটটি মূর্তি স্থাপিত ছিল। তিনি হাতে একটি লাঠি নিয়ে মূর্তিগুলোকে আঘাত করতে থাকলেন, আর মুখে বলতে লাগলেন : –”হক এসেছে বাতিল দূরীভূত হয়েছে।” হক এসেছে বাতিলের আর উদ্ভব বা পুনরুদ্ভব ঘটবে না। ইমাম মুসলিম এ হাদীছটি ইবন উআয়না সূত্রে বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী ইবন ইসহাক সূত্রে– আবদুল্লাহ্ ইবন আবু বকর– আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কায় প্রবেশ করেন। তখন কাবা গৃহে তিনশ’ প্রতিমা স্থাপিত ছিল। তিনি হাতে একটি লাঠি নিয়ে এক একটি প্রতিমার কাছে যেতে থাকেন, আর অমনি সে প্রতিমা মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকে। এভাবে সব ক’টি প্রতিমা তিনি অতিক্রম করেন। এরপর বায়হাকী সুওয়ায়– ইবন উমর সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেন। তাতে অতিরিক্ত এতটুকু আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) লাঠি দ্বারা কোন প্রতিমাকে স্পর্শ করেননি; বরং ইংগিত করতেই প্রতিটি প্রতিমা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তারপর বায়হাকী বলেন, এ হাদীছের সনদটি যদিও দুর্বল, কিন্তু পূর্বের হাদীছের সমর্থনে তা শক্তিশালী হয়েছে। হাম্বল ইবন ইসহাক– ইবন আব্য সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মক্কা জয় করেন তখন মাথার চুল কুঁকড়ান জনৈক হাবশী মহিলা মুখে রং মেখে ধ্বংস কামনা করতে করতে আগমন করে। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : ঐ যে বিলাপকারিণী মহিলা- সে এ কারণে হতাশ হয়ে পড়েছে যে, তোমাদের এ শহরে আর কখনও পূজিত হবে না।

ইবন হিশাম বলেন : ইবুন শিহাব যুহরী উবায়দুল্লাহ্ ইবন আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস সূত্রে আমার জনৈক আস্থাভাজন আলিম আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর বাহনে চড়ে মক্কায় প্রবেশ করেন এবং বাহনের উপর থেকে বায়তুল্লাহ্ তাওয়াফ করেন। তখন বায়তুল্লাহর চারপাশে শীসা বাঁধানো অনেকগুলো মূর্তি ছিল । নবী করীম (সা) তাঁর হাতের ছড়ি দ্বারা মূর্তিগুলোর দিকে ইংগিত করে যাচ্ছিলেন এবং মুখে বলছিলেন : “সত্য সমাগত, মিথ্যা বিলুপ্ত, মিথ্যা বিলুপ্তই হয়।” যেসব মূর্তির মুখমন্ডলের দিকে তিনি ইংগিত করছিলেন সেগুলো চিৎ হয়ে পড়ছিল। আর যেগুলোর পশ্চাদ্ভাগের দিকে ইংগিত করছিলেন সেগুলো উপুড় হয়ে পড়ছিল। এভাবে সব কটি মূর্তিই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তামীম ইব্‌ন আসাদ আল-খুযাঈ এ প্রসংগে তার কবিতায় বলেন :

لمن يرجو الثواب او العقابا

وفي الاصنام معتبرو علم

‘মূর্তির প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস কেবল তারই থাকতে পারে, যে তাদের কাছে পুরস্কার ও শাস্তির আশা করে।”

সহীহ মুসলিমে সিনান ইবন ফাররুখ– আবু হুরায়রা সূত্রে বর্ণিত। মক্কা বিজয় সম্পর্কিয় হাদীছে তিনি বর্ণনা করেন :– এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) হাজরে আসওদের নিকটবর্তী হয়ে তাকে চুম্বন করলেন এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করলেন। এরপর তিনি বায়তুল্লাহর পার্শ্বে রক্ষিত একটি মূর্তির কাছে এলেন, যাকে তারা উপাসনা করতো। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাতে একটি ধনুক ছিল। তিনি তার এক প্রান্ত ধারণ করেছিলেন। মূর্তিটির কাছে এসে তিনি ধনুকের দ্বারা তার চোখ খোঁচাতে লাগলেন এবং বললেন :

جاء الحق وزهق الباطل ان الباطل كان زهوقا ۔

“সত্য আগমন করেছে, মিথ্যা বিদায় নিয়েছে। মিথ্যার বিদায় অবধারিত।”

বায়তুল্লাহর তাওয়াফ শেষে তিনি সাফা পাহাড়ের দিকে গমন করলেন। এরপর তাতে আরোহণ করে বায়তুল্লাহর দিকে তাকালেন এবং দুহাত উঁচু করে আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং যা প্রার্থনা করার ছিল তিনি তা প্রার্থনা করলেন। বুখারী বলেন : আমার নিকট ইসহাক ইবন মানসূর– ইকরামা সূত্রে ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় আগমন করে তাৎক্ষণিকভাবে বায়তুল্লায় প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকেন। কেননা, বায়তুল্লাহর মধ্যে তখন অনেকগুলো মূর্তি ছিল। তিনি এগুলোকে বের করে ফেলার আদেশ দেন। ফলে মূর্তিগুলো বের করা হল। বহিষ্কৃত মূর্তির সাথে দেখা গেল ইবরাহীম (আ) ও ইসমাঈল (আ)-এর মূর্তিও বেরিয়ে এসেছে। আর তাদের উভয়ের হাতে রয়েছে ভাগ্য গণনার কয়েকটি তীর । তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : আল্লাহ্ ওদেরকে ধ্বংস করুন। তারা অবশই জানতো যে, ইবরাহীম (আ) ও ইসমাঈল (আ) কখনও তীর দিয়ে ভাগ্য গণনার কাজ করেননি। এরপর তিনি বায়তুল্লাহর ভিতরে প্রবেশ করেন এং প্রত্যেক কোণে গিয়ে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দেন। কিছু সময় পর তিনি বেরিয়ে আসেন এবং ঘরের ভিতরে নামায পড়েননি। এ হাদীছটি শুধু বুখারীতে আছে, মুসলিমে নেই। ইমাম আহমদ বলেন : আমার নিকট বর্ণনা করেছেন আবদুস সামাদ। আব্বাস সূত্রে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কাবা ঘরে প্রবেশ করেন। তখন তাতে ছিল ছয়টি স্তম্ভ। তিনি প্রতিটি স্তম্ভের কাছে গিয়ে দাঁড়ান এবং দু’আ করেন; কিন্তু কা’বা ঘরের ভিতরে নামায পড়েননি। ইমাম মুসলিমও এ হাদীছ শায়বান ইব্‌ন ফাররুখ, হাম্মাম ইবন ইয়াহয়া আওযী ও আতা থেকে সনদ পরম্পরায় অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ বলেন : আমার নিকট হারূন ইবন মা’রূফ– ইবন আব্বাস সূত্রে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) বায়তুল্লায় প্রবেশ করে ইবরাহীম (আ) ও মারয়াম (আ)-এর ছবি দেখতে পান। এ দৃশ্য দেখে তিনি বলেন : তারা তো শুনেছে যে, ফেরেশতাগণ ঐ গৃহে প্রবেশ করে না। যে গৃহে ছবি থাকে। অথচ নবী ইবরাহীম (আ)-এর এই ছবি! আর তীরের সাহায্যে ভাগ্য নির্ণয়ের তো কোন প্রশ্নই উঠে না। বুখারী ও নাসাঈ ইবন ওহব সূত্রে এ হাদীছটি অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ বলেন : আমার নিকট আবদুর রায্যাক– ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বায়তুল্লায় প্রবেশ করে ভিতরে বিভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে দু’আ করে ঘরের বাইরে এসে দু রাকআত নামায আদায় করেন। ইমাম আহমদ একাই এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ বলেন : ইসমাঈল– ইবন উমার সনদে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বায়তুল্লাহর অভ্যন্তরে দু রাকআত নামায পড়েছেন। বুখারী বলেন : লায়ছ— আবদুল্লাহ ইবন উমর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) সওয়ারীতে আরোহণ করে এবং উসামা ইবন যায়দকে নিজের পিছনে বসিয়ে মক্কা নগরীর উঁচু এলাকার দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। তাঁর সংগে ছিলেন বায়তুল্লাহর চাবি রক্ষক উছমান ইবন তালহা। তিনি মসজিদে হারামের সামনে এসে সাওয়ারী থামালেন এবং কা’বার চাবি এনে দরজা খোলার আদেশ করলেন। দরজা খোলা হলে তিনি কাবা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর সংগে ছিলেন উসামা ইবন যায়দ, বিলাল এবং উছমান ইবন তালহা। সেখানে তিনি দিবসের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অবস্থান করার পর বেরিয়ে আসেন। তখন অন্যান্য লোকজন দ্রুত ছুটে এলো- কা’বার ভিতরে প্রবেশের জন্যে। আবদুল্লাহ ইবন উমার সেখানে সর্বাগ্রে প্রবেশ করলেন। তিনি বিলালকে দরজার পাশে দাঁড়ানো পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) কোন্ জায়গায় নামায পড়েছেন? তখন বিলাল তাকে তার নামায পড়ার জায়গাটি ইশারা করে দেখিয়ে দিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) কত রাকআত আদায় করেছেন, বিলালকে আমি এ কথাটি জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। ইমাম আহমদ এ হাদীছটি হুশায়ম– ইবন উমার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) কা’বার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তাঁর সংগে ছিলেন ফযল ইব্‌ন আব্বাস, উসামা ইব্‌ন যায়দ, উছমান ইব্‌ন তালহা ও বিলাল। তখন বিলালকে আদেশ করলে তিনি দরজা টেনে বন্ধ করে দেন। তারপর যতক্ষণ। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ততক্ষণ তিনি ভিতরে থাকার পর বেরিয়ে আসেন। ইবন উমার বলেন ও এরপর তাদের মধ্যে বিলালের সাথে আমার সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ হয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম রাসূলুল্লাহ্ (সা) কোন্ জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায আদায় করেছেন : তিনি আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন- এই দুই খুঁটির মাঝখানে।

আমি বলি, সহীহ্ বুখারী ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কাবার অভ্যন্তরে প্রাচীর পশ্চাতে রেখে দরোজার দিকে মুখ করে নামায আদায় করেছেন। দুটি স্তম্ভ ছিল ডান দিকে, একটি ছিল বা দিকে এবং পশ্চাৎ দিকে ছিল আরও তিনটি স্তম্ভ । কাবা ঘর তখন ছয়টি স্তম্ভের উপর স্থাপিত ছিল। তার ও পশ্চিম পাশের দেওয়ালের মাঝে মাত্র তিন হাত পরিমাণ দূরত্ব ছিল। ইমাম আহমদ ইসমাঈল– ইবন উমার (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বায়তুল্লায় দু রাকআত নামায আদায় করেছিলেন। ইবন হিশাম বলেন : আমার নিকট কোন কোন আলিম বর্ণনা করেছেন যে, মক্কা বিজয়ের বছর রাসূলুল্লাহ্ (সা) কাবায় প্রবেশ করেন। তখন তার সংগে ছিলেন বিলাল। তিনি বিলালকে আযান দেয়ার নির্দেশ দেন। আবু সুফিয়ান ইবন হারব, আত্তাব ইবন উসায়দ ও হারিছ ইবন হিশাম তখন কা’বার আংগিনায় উপবিষ্ট ছিল। আযান শুনে আত্তাব বললো, আল্লাহ্ আমার পিতা উসায়দকে সম্মানিত করেছেন যে, তাকে এ জিনিস শুনতে হয়নি। কেননা, এ সব শুনলে তিনি ক্ষেপে যেতেন। হারিছ ইবন হিশাম বললো, আল্লাহর কসম! আমি যদি জানতে পারতাম যে, এ ব্যক্তি সঠিক পথে রয়েছে তবে আমি অবশ্যই তার অনুসরণ করতাম। আবু সুফিয়ান বললো, আমি এ সম্পর্কে মুখ খুলবো না। কেননা, আমি যদি কিছু বলি, তবে এ কংকরগুলোই আমার এ সংবাদ (তাকে) পৌঁছে দেবে। এমন সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন : তোমরা যা যা বলেছ, তা সবই আমি জেনে গেছি। তিনি তাদেরকে সেসব কথা পুনরাবৃত্তি করে শুনিয়ে দেন। হারিছ ও আত্তাব সহসা বলে উঠলো :-”আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল” । আল্লাহর কসম! আমাদের কাছে কেউ ছিল না যে, বলবো– সে জেনে আপনাকে জানিয়ে দিয়েছে। ইউনুস ইবন বুকায়র বলেন : আমার পিতার নিকট জুবায়র ইবন মুঈম বংশের জনৈক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কায় প্রবেশ করে বিলালকে আযান দেয়ার নির্দেশ দেন। বিলাল তখন কাবা ঘরের ছাদে উঠে নামাযের জন্যে আযান দিলেন। আযান শুনে সাঈদ ইবন আস গোত্রের এক ব্যক্তি বললো, কা’বার ছাদে চড়ে এই কৃষ্ণাংগের আযান শুনার পূর্বে মৃত্যু দিয়ে আল্লাহ্ সাঈদকে সম্মানিত করেছেন। আবদুর রাযযাক– ইব্‌ন আবূ মুলায়কা সূত্রে বলেন : বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) বিলালকে আযান দেয়ার নির্দেশ দিলে তিনি কা’বার ছাদে চড়ে আযান দেন। তখন কুরায়শ গোত্রের এক ব্যক্তি হারিছ ইবন হিশামকে বলে, দেখছেন না! এই ক্রীতদাস কোথায় উঠেছে? হারিছ তাকে বললো, থাম! আল্লাহ্ যদি তাকে অপসন্দ করেন তবে অচিরেই তার পরিবর্তন ঘটাবেন। ইউনুস ইবন বুকায়র প্রমুখ বর্ণনাকারিগণ উরওয়া সূত্রে বলেন : বিজয়ের বছর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিলালকে আযান দিতে নির্দেশ দিলে তিনি কা’বার ছাদে উঠে আযান দেন । মুশরিকদের মর্মপীড়া সৃষ্টিই ছিল এর উদ্দেশ্য। মুহাম্মাদ ইবন সা’দ– আবু ইসহাক সূত্রে বর্ণনা করেন : মক্কা বিজয়ের পর আবু সুফিয়ান ইব্ন হারব একাকী বসে ভাবছিল হায়! যদি মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী সংগঠিত করতে পারতাম? সে এই কথা মনে মনে ভাবছিল– অমনি রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার দুই কাঁধের মাঝে থাপ্পড় মেরে বললেন : তা হলে আল্লাহ্ তোমাকে লাঞ্ছিত করে ছাড়তেন। আবু সুফিয়ান মাথা তুলে দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার শিয়রে দন্ডায়মান। তখন সে বললো, আমি এর আগে বিশ্বাস করতাম না যে, আপনি সত্য নবী। বায়হাকী– আবু আবদুল্লাহ্ হাফিয– ইবন আব্বাস সূত্রে ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন য, আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহর পিছনে পিছনে লোক ছুটতে দেখে মনে মনে ভাবছিল যে, এ লোকটির বিরুদ্ধে যদি একটি যুদ্ধ বাধাতে পারতাম! এ সময়ে আচম্বিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এসেই তার বুকে এক থাপ্পড় মেরে বললেন, “তোমাকে তাহলে আল্লাহ্ লাঞ্ছিতই করতেন।” আবু সুফিয়ান বললো, আমি যা বাজে বকেছি সে জন্যে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই- মাফ চাই। এরপর বায়হাকী ইবন খুযায়মা— সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, মক্কা বিজয় করে মুসলমানগণ নগরে প্রবেশ করার পর যখন রাতের আগমন হল, তখন রাতভর তারা তাকবীর ধ্বনি ও কালেমার আওয়াজে চারিদিক মুখরিত করে রাখলেন। এভাবে সকাল হয়ে গেল। তখন আবূ সুফিয়ান স্ত্রী হিন্দকে ডেকে বললো– দেখনা, এ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হচ্ছে। হিন্দ বললো, হ্যাঁ- এ আল্লাহর পক্ষ থেকেই। এরপর আবু সুফিয়ান অতি প্রত্যুষে উঠে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গিয়ে উপস্থিত হল। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : তুমি হিন্দকে বলেছিলে “দেখনা-এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে হচ্ছে। আর হিন্দ বলেছিল, হা- এ আল্লাহর পক্ষ থেকে।” তখন আবু সুফিয়ান বললো, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি- আপনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। সেই আল্লাহর কসম, যার নামে কসম খাওয়া হয়, আমার এ কথা হিন্দ ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি শুনেনি, ইমাম বুখারী ইসহাক– মুজাহিদের সূত্রে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, যে দিন আল্লাহ্ আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সে দিন থেকেই তিনি মক্কা নগরীকে হারম’ (সম্মানিত) করেছেন। সুতরাং আল্লাহর সম্মান দেয়ার কারণে এর হুরমত কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকবে। আমার পূর্বে তা কারো জন্যে হালাল ছিল না এবং আমার পরেও তা কারো জন্যে হালাল করা হবে না। কেবল এক দিনের সামান্য সময়ের জন্যে আমার জন্যে হালাল করা হয়েছিল। এখানকার কোন শিকারকে তাড়ান যাবে না। কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ কর্তন করা যাবে না। এখানকার ঘাস কাটা যাবে না। এখানে রাস্তায় পড়ে থাকা জিনিস উঠান যাবে না; তবে হারান বিজ্ঞপ্তি দেয়ার জন্যে উঠান যাবে। একথা শুনে আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইযখির ব্যতীত? কেননা, ইখির ঘাস দাফনের কাজে ও ঘরের ছাউনিতে লাগে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হ্যাঁ, ইখির ব্যতীত- এটা হালাল। ইবন জুরায়জ এ হাদীছটি আবদুল করীম ইকরিমা ইব্‌ন আব্বাস সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন । আবু হুরায়রা (রা) ও রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। প্রথম বর্ণনা মুরসাল এবং দ্বিতীয় বর্ণনা মুত্তাসিল । যারা বলেন, মক্কা যুদ্ধের মাধ্যমে জয় হয়েছে তারা এই হাদীছ ও অনুরূপ অন্যান্য হাদীছ এবং পূর্বোল্লিখিত খানছামার ঘটনা থেকে প্রমাণ গ্রহণ করেন। এ ছাড়া মক্কা বিজয়ের দিন মুশরিক ও মুসলমান মিলে বিশ জন লোক নিহত হয়। এটা স্পষ্টভাবেই সংঘর্ষের প্রমাণবহ। জমহরে উলামা এ মতই পোষণ করেন। কিন্তু ইমাম শাফিঈর প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে মক্কা সন্ধির মাধ্যমে বিজিত হয়। কেননা, মক্কার ভূমি সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করা হয়নি। তাছাড়া বিজয়ের রাত্রে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঘোষণা করেছিলেন : “যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে তারা নিরাপদ, যারা হারমে অবস্থান নিবে তারা নিরাপদ এবং যারা নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে তারা নিরাপদ। এ বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ কিতাবুল আহকামে করা হবে। ইনশা আল্লাহ্। ইমাম বুখারী– সাঈদ ইব্‌ন শারজীল আবূ শুরায়হ্ খুজাঈ সূত্রে বর্ণনা করেন। (মদীনার শাসক) আমর ইবন সাঈদ যখন মক্কা অভিমুখে সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করছিলেন। তখন আবূ শুরায়ই তাকে বলেছিলেন, হে। আমাদের আমীর! আমাকে একটু অনুমতি দিন, তা হলে আমি আপনাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর একটি বাণী শুনাব যা তিনি মক্কা বিজয়ের পরের দিন বলেছিলেন। সে বাণী আমার দু’কান শুনেছে, আমার হৃদয় সংরক্ষণ করে রেখেছে এবং যখন তিনি বলছিলেন তখন আমার দু’চোখ তাঁকে দেখেছে । তিনি প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করেছেন। তারপরে বলেছেন : আল্লাহ নিজেই মক্কাকে হারম’ ঘোষণা করেছেন, কোন মানুষ তাকে হারম’ বানায়নি। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাসী তার জন্যে সেখানে রক্তপাত ঘটান কিংবা তথাকার গাছপালা কর্তন করা অবৈধ। যদি কেউ আল্লাহর রাসূলের লড়াই এর কথা বলে নিজের এ সুযোগ গ্রহণ করতে চায়, তবে তোমরা তাকে বলে দিও- আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে অনুমতি দিয়েছিলেন । তোমাদেরকে অনুমতি দেননি। আর আমাকেও অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এক দিনের মাত্র কিছু সময়ের জন্যে। এবং সে দিনেই তা পুনরায় হারাম করে দেওয়া হয়েছে, যেমন আগের দিন হারাম ছিল। উপস্থিত লোকজন যেন অনুপস্থিত লোকদের কাছে এ কথাটি পৌঁছিয়ে দেয়।

আবু রায়হ্ এর নিকট একদা জিজ্ঞেস করা হয় যে, আমর (এ বাণীটি শুনার পর আপনাকে কী বলেছিলেন : তিনি বললেন, আমর আমাকে বলেছিলেন- এ হাদীছ সম্পর্কে আমি তোমার চাইতে অধিক অবগত। হে আবূ শুরায়হ্! হারম শরীফ কোন অপরাধীকে বা পলায়নকারী খুনীকে কিংবা জিযিয়া থেকে পলায়নকারীকে আশ্রয় দেয়না। এ হাদীছটি বুখারী ও মুসলিম কুতায়বা লায়ছ ইবন সা’দ সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন যে, ইবনূল আছওগ নামক মক্কার এক ব্যক্তিকে খিরাশ ইবুন উমাইয়া হত্যা করে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “হে খুযাআ গোত্রের লোকজন! হত্যা থেকে তোমাদের হাত গুটিয়ে ফেল। খুনোখুনি তো অনেকই হয়েছে; কিন্তু এতে কোন ফায়দা আসেনি। তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছ আমি তার রক্তপণ আদায় করে দেব।” ইবন ইসহাক বলেন, আবদুর রহমান ইবন হারমালা আমার নিকট সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব এর বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, খিরাশ ইবন উমাইয়ার ঘটনা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি বলেছিলেন : খিরাশ বড়ই রক্তপিপাসু। ইবন ইসহাক বলেন, আমার নিকট সাঈদ ইব্‌ন আবু সাঈদ মাকবেরী আবু শুরায় খুযাঈ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আমর ইব্‌ন যুবায়র [সুহায়লী বলেন, ইবন হিশাম নিজের ধারণা মতে এই নাম লিখেছেন। আসলে তিনি আমর ইবন যুবায়র ছিলেন না। তিনি ছিলেন আমর ইবন সাঈদ ইবনুল আস ইবন উমাইয়া, তাকে আশাক বলা হত। আবু উমাইয়া তার কুনিয়াত, লকব লাতীমুশ শায়তান। সে ছিল ভীষণ যুদ্ধবাজ। খলীফা আবদুল মালিকের আশঙ্কা হয় যে মক্কার নিরাপত্তা তার দ্বারা বিঘ্নিত হবে। ফলে এক বাহানায় তাকে হত্যা করেন।] তার ভাই আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়রের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে যখন মক্কায় আসেন, তখন আমি তার নিকট উপস্থিত হয়ে বললাম, শুনুন ভাই! মক্কা বিজয়কালে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে ছিলাম। বিজয়ের পরের দিন খুযাআ গোত্রের লোকজন হুযায়ল গোত্রের জনৈক মুশরিককে হত্যা করে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন : হে জনমণ্ডলী! আল্লাহ্ যে দিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেন সে দিনই তিনি মক্কাকে হারম’ ঘোষণা করেছেন। সুতরাং আল্লাহ্ কর্তৃক ‘হারম’ ঘোষণার ফলে কিয়ামত পর্যন্ত তার হুরমত বা সম্মান বলবত থাকবে। তাই যে লোক আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার জন্যে এখানে রক্তপাত ঘটান কিংবা এখানকার গাছপালা কর্তন করা বৈধ নয়। আমার পূর্বে কারও জন্যে তা বৈধ করা হয়নি, আর আমার পরে কারও জন্যে বৈধ করা হবে না। আমার জন্যেও বৈধ নয়; তবে এখানকার অধিবাসীদের প্রতি ক্রোধের কারণে এই সামান্য কিছু সময়ের জন্যে আমার জন্যে বৈধ করা হয়েছে। জেনে রেখো, বিগত দিনের ন্যায় এর হুরমত আবার ফিরে এসেছে। তোমাদের মধ্যে যারা উপস্থিত আছ তারা অনুপস্থিতদের নিকট তা পৌঁছিয়ে দেবে। সুতরাং কেউ যদি তোমাদেরকে বলে, আল্লাহর রাসূল তো এখানে লড়াই করেছেন, তাহল তোমরা বলে দেবে, আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের জন্যে বৈধ করেছেন, তোমাদের জন্যে বৈধ করেননি। হে খুযাআ সম্প্রদায়! খুন-খারাবী থেকে সংযত হও। খুন-খারাবী বহু হয়েছে; কিন্তু কোনই লাভ হয়নি। তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছ, আমি নিজে এর রক্তপণ আদায় করে দেব । আমার এ আদেশের পর কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, তবে নিহতের অভিভাবকগণ প্রতিশোধ গ্রহণের দু’টি পন্থার যে কোন একটির সুযোগ নিতে পারবে। যদি তারা চায় তবে ‘কিসাস’ হিসেবে ঘাতককে হত্যা করতে পারবে। কিংবা চাইলে তার থেকে রক্তপণ গ্রহণ করতে পারবে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) ঐ নিহত ব্যক্তির রক্তপণ আদায় করেন যাকে খুযাআ গোত্রের লোকজন হত্যা করেছিল। এসব বক্তব্য শুনার পর আমর ইবন যুবায়র আয়ূ শুরায়হূকে বললো, ও বুড়ো! তুমি যাও এখান থেকে। মক্কার হুরমত ও মর্যাদা সম্পর্কে আমরা তোমার চাইতে ভালই অবগত আছি। মক্কার হুরমত কোন রক্তপাতকারী, আনুগত্য বর্জনকারী কিংবা জিযিয়া দিতে অস্বীকারকারীকে শাস্তি দিতে বাধা দেয় না। আবু শুরায়হ্ তখন জবাবে আমরকে বললেন, আমি সেদিন উপস্থিত ছিলাম, আর তুমি ছিলে অনুপস্থিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, উপস্থিতরা অনুপস্থিতদের কাছে এ কথা পৌঁছিয়ে দেবে। আমি তাই তোমাকে সে কথা পৌঁছিয়ে দিলাম। এখন তুমি কি করবে সে সিদ্ধান্ত তোমার।

ইবন হিশাম বলেন, আমার নিকট এই বিবরণ পৌঁছেছে যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) সর্ব প্রথম যে নিহতের রক্তপণ আদায় করেন সে হচ্ছে জুনায়দাব ইবনুল আকওয়া। বনূ কাবের লোকজন তাকে হত্যা করে। একশ’ উষ্ট্ৰী দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার রক্তপণ আদায় করেন। ইমাম আহমদ বলেন, আমার নিকট ইয়াহয়া– শুআয়ব থেকে বর্ণনা করেন যে, মক্কা বিজয় হয়ে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঘোষণা দিলেন। সবাই অস্ত্র সংবরণ কর; তবে খুযাআ গোত্র যদি বনূ বকর থেকে প্রতিশোধ নিতে চায় তা তাদের জন্যে অনুমতি আছে। আসরের সালাত আদায়ের পর খুযাআ গোত্রকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, এখন থেকে তোমরাও অস্ত্র গুটিয়ে ফেল। পরের দিন খুযাআ গোত্রের এক ব্যক্তি বনূ বকর গোত্রের এক ব্যক্তিকে মুযদালিফায় দেখতে পেয়ে হত্যা করে। এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি কাবা ঘরের গায়ে হেলান দিয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অধিক লংঘণকারী সে, যে হারম সীমার মধ্যে কাউকে হত্যা করে অথবা কিসাস বিহীন কাউকে হত্যা করে কিংবা জাহিলী যুগের প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কাউকে হত্যা করে । বর্ণনাকারী পুরা হাদীছই উল্লেখ করেছেন। তবে হাদীছটি একান্তই গরীব পর্যায়ের। সুনান গ্রন্থকারগণ এ হাদীছের কিছু কিছু অংশ উল্লেখ করেছেন। তবে বিজয়ের দিন বনূ বকর থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে বনু খুযাআকে আসর পর্যন্ত অনুমতি দেয়ার উল্লেখ এ হাদীছ ব্যতীত অন্য কোথাও নেই। হাদীছটি সহীহ্ হলে এর ব্যাখ্যায় বলা যায় যে, “লায়লাতুল ওয়াতীরে” [ওয়াতীর একটি কূপের নাম । এ কূপের কাছেই এক রাত্রে কুরায়শদের মিত্র বনূ বকর মুসলমানদের মিত্র বনু খুযাআর উপর আক্রমণ করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল- যার ফলে মক্কা আক্রমণ অনিবার্য হয়ে পড়ে।] বনূ বকর বনূ খুযাআর উপর যে যুলুম করেছিল, তারই বদলা হিসেবে এ অনুমতি ব্যতিক্রমী নির্দেশ স্বরূপ। কেবল তাদেরকে দেয়া হয়েছিল। তবে আসল রহস্য আল্লাহই ভাল জানেন।

ইমাম আহমদ ইয়াহয়া ইবন সাঈদ– হারিছ ইব্‌ন মালিক ইবন বারসা খুঈ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, “আজকের পর কিয়ামত পর্যন্ত আমরা এখানে আর যুদ্ধ করব না। তিরমিযী বুনদার সূত্রে এ হাদীছটি বর্ণনা করে একে হাসান ও সহীহ্ বলে অভিহিত করেছেন।

আমি বলি, এ উক্তি যদি নিষেধসূচক হয় তা হলে কোন প্রশ্ন থাকে না। আর যদি না সূচক হয় তবে বায়হাকী তার ব্যাখ্যায় বলেন, এখানকার অধিবাসীদের কুফরী কাজে লিপ্ত হওয়ার সাথে এ হুকুম সংযুক্ত। সহীহ মুসলিমে– যাকারিয়া ইবন আবু যায়েদা ইবনুল আসওয়াদ আদাবী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) ঘোষণা করেন ও আজকের দিনের পর কিয়ামত পর্যন্ত কুরায়শগণকে ধর্মত্যাগের অপরাধে ও যুদ্ধে হত্যা করা হবে না।

ইবন হিশাম বলেন, আমার নিকট এ তথ্য পৌঁছেছে যে, মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন সেখানে প্রবেশ করেন, তখন তিনি সাফা পাহাড়ে আরোহণ করে আল্লাহর নিকট দু’আ করতে থাকেন। আনসারগণ তাঁর চার পাশে জড়ো হয়ে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো । তোমাদের কী ধারণা, আল্লাহ্ যখন তাঁর রাসূলকে নিজ দেশে ও শহরে বিজয় দান করেছেন, তখন কি তিনি এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন? দু’আ শেষ করার পর তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কী বলাবলি করছিলে? তারা বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তেমন কিছুই না। তিনি যখন পীড়াপীড়ি করলেন, তখন তাঁরা সে কথাটি তাঁকে জানালেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : “আল্লাহর পানাহ্! জীবনে মরণে আমি তোমাদের সাথেই থাকবো।” এ হাদীছটি ইবন হিশাম মুআল্লাকরূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ইমাম আহমদ ইব্‌ন হাম্বল তাঁর গ্রন্থ মুসনাদে সনদসহ বুহ ও হাশিম– আবদুল্লাহ্ ইবন রাবাহ্ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন : একবার একটি প্রতিনিধি দল মুআবিয়ার কাছে যায় । আমি ও আবু হুরায়রা ঐ দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। সে সময়টা ছিল রমযান মাস । আমাদের মধ্যে একে অন্যের জন্যে খানা পাকাতো। তবে অধিকাংশ সময় আবু হুরায়রাই আমাদেরকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। আবদুল্লাহ ইবন রাবাহ্ বলেন, আমি ভাবলাম –আমি কেন অন্যদেরকে আমার বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়াবো না? তাই আমি খানা পাকাতে নির্দেশ দিলাম। বিকেল বেলা আবু হুরায়রার সাথে সাক্ষাৎ করে বললাম- আজ রাত্রে আমার বাড়িতে আপনার দাওয়াত । আবূ হুরায়রা বললো, আজ আপনি আমার পূর্বেই দাওয়াত দিয়ে দিলেন। আমি বললাম, হ্যাঁ। এরপর আমি অন্যদেরকেও দাওয়াত দিলাম। সকলে আমার বাড়িতে এসে সমবেত হল। তখন আবু হুরায়রা বললেন, হে আনসার সম্প্রদায়! আমি কি তোমাদের নিকট তোমাদের বিষয়ে একটি হাদীছ বর্ণনা করবো না? তারপর তিনি মক্কা বিজয়ের ঘটনা বর্ণনা করা শুরু করলেন। তিনি বললেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কার দিকে অগ্রসর হলেন এবং শেষ পর্যন্ত সেখানে গিয়ে উপনীত হলেন। এরপর যুবায়রকে মক্কার এক দিকে এবং খালিদকে অপর দিকে প্রেরণ করলেন। আর আবু উবায়দাকে পদাতিক বাহিনীর নেতা বানিয়ে প্রেরণ করলেন। তারা (বাতনে-ওয়াদীর) পথ অবলম্বন করে চললো। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা) ছিলেন একটি ছোট সেনাদলের মধ্যে। এ দিকে কুরায়শরাও তাদের বিভিন্ন গোত্রের লোক এনে একত্রিত করলো। বর্ণনাকারী বলেন, তারা বললো, আমরা তাদেরকে আগে প্রেরণ করলাম । যদি তাদের ভাগ্যে কিছু জুটে যায়, তবে আমরাও তো তাদের সংগেই আছি। আর যদি তারা বিপদের সম্মুখীন হয়। তবে আমাদের কাছে যা চাবে তাই দিয়ে দিব। আবূ হুরায়রা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকালেন এবং আমাকে দেখে বললেন, হে আবু হুরায়রা! আমি বললাম, আমি উপস্থিত, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আনসারদেরকে আমার কাছে আসার জন্যে আহ্বান কর এবং আনসার ব্যতীত অন্য কেউ যেন আমার কাছে না আসে। অতএব, আমি তাদেরকে আহ্বান করলাম। তারা এসে রাসূলুল্লাহর চারপাশে জমায়েত হলেন । তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, তোমরা কি কুরায়শের বিভিন্ন গোত্রের লোক এবং তাদের অনুগতদেরকে দেখতে পাচ্ছ? এরপর তিনি তাঁর এক হাত অপর হাতের উপর রেখে বললেন :শত্রু সামনে পেলে নির্মূল করে দিবে এবং সাফা পাহাড়ে তোমরা আমার সাথে মিলিত হবে। আবু হুরায়রা বলেন, আমরা সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলাম। আমাদের মধ্যে যে কেউ কোন শত্রুকে হত্যা করতে চেয়েছে সে তা সহজেই সম্পন্ন করেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই আমাদের উপর আক্রমণ করতে সাহস পায়নি। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আবু সুফিয়ান এসে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আজ কুরায়শদের রক্ত হালাল করে দেয়া হয়েছে। আজকের পরে আর কোন কুরায়শের অস্তিত্ব থাকবে না। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে ভিতরে অবস্থান করবে সে নিরাপদ। যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর জনগণ আপন আপন ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো । রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাজরে আসওদের নিকটবর্তী হয়ে তা চুম্বন করলেন এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাতে তখন একটি ধনুক ছিল, তিনি উহার এক প্রান্ত ধরে রেখেছিলেন। তাওয়াফকালে তিনি বায়তুল্লাহর পার্শ্বে রক্ষিত একটি মূর্তির নিকটবর্তী হলেন, যাকে তারা পূজা করতো। তিনি ধনুক দ্বারা মূর্তিটির চোখ খুঁচাতে লাগলেন এবং বললেন : “সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসারিত, মিথ্যার অপসারণ অবধারিত।” তাওয়াফ শেষে তিনি সাফা পাহাড়ের দিকে গমন করেন এবং তাতে আরোহণ করেন। সেখান থেকে বায়তুল্লাহর দিকে তাকিয়ে দু হাত তুলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং প্রাণ খুলে দু’আ করেন। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আনসারগণ সাফা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান করছিল। তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো যে, লোকটিকে স্ব-দেশের প্রেম ও স্ব-সম্প্রদায়ের ভালবাসা পেয়ে বসেছে। আবূ হুরায়রা বলেন, ঐ সময় ওহী অবতীর্ণ হল। আর ওহী যখন অবতীর্ণ হত তা আমাদের নিকট গোপন থাকতো না । তখন রাসূলুল্লাহর দিকে চোখ তুলে দেখার সাধ্য কারোর হতো না। যতক্ষণ না ওহী অবতরণ শেষ হতো। হাশিম বলেন, ওহী অবতরণ শেষ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) মাথা উঠিয়ে বললেন, হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা কি এ কথা বলেছে যে, লোকটিকে স্ব-দেশ প্রেম ও স্ব-সম্প্রদায়ের ভালবাসা পেয়ে বসেছে? তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা এ কথা বলেছি। তিনি বললেন, তা হলে আমার নামের স্বার্থকতা কি? কক্ষণও না, আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল । আমি হিজরত করেছি আল্লাহর দিকে ও তোমাদের নিকটে। সুতরাং আমার জীবন-মরণ তোমাদের জীবন-মরণের সাথে জড়িত। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আনসারগণ রাসূলুল্লাহর দিকে ফিরে কাঁদতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন : আল্লাহর কসম! আমরা যা বলেছি তা কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি দুর্বলতার কারণেই বলেছি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমাদের উত্তর সত্য বলে গ্রহণ করেছেন এবং তোমাদের ওযর গ্রহণ করেছেন। এ হাদীছ মুসলিম সুলায়মান ইবন মুগীরা ও হামমাদ ইবন সালামা থেকে এবং নাসাঈ সুলায়মান ইবন মুগীরা ও সালাম ইবন মিসকীন থেকে, পরে এ তিনজনই ছাবিতের মাধ্যমে বসরার প্রবাসী আবদুল্লাহ ইবন রাবাহ্ সূত্রে আবু হুরায়রা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইবন হিশাম বলেন : আমার নিকট জনৈক বিজ্ঞ আলিম বর্ণনা করেছেন যে, মক্কা বিজয়ের দিন বায়তুল্লাহর তাওয়াফকালে ফুযালা ইবন উমায়র ইবন মাহ্ (লায়ছী) নবী করীম (সা)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকটবর্তী হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে, ফুযালা না কি? জবাবে সে বললো, জ্বী হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি ফুযালা। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি মনে মনে কি বলছিলে? সে বললো, অন্য কিছু না– আমি তো আল্লাহর যিক্র করছিলাম। তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ হেসে দিয়ে বললেন : আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। তারপর তিনি তাঁর পবিত্র হাত ফুযালার বক্ষের উপর রাখেন। সাথে সাথে তার অন্তর শান্ত-শীতল হয়ে যায়। তারপর ফুযালা প্রায়ই বলতো, আল্লাহর কসম। তাঁর পবিত্র হাত আমার বুকের উপর থেকে সরাতেই অবস্থা এমন হল যে, পৃথিবীতে তাঁর চেয়ে অধিকতর প্রিয় আমার কাছে আর কেউ থাকলো না। ফুযালা বলেন, তারপর আমি আমার পরিবারবর্গের মধ্যে ফিরে যাই এবং স্ত্রীর সাথে আলাপ আলোচনায় নিমগ্ন হই। স্ত্রী বললো, আমাকে কিছু নতুন বিষয় শুনাও। ফুযালা বললেন, নতুন কোন খবর নেই। এ কথা বলে তিনি নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করলেন :

یابی عليك الله والاسلام بالفتح يوم تكسر الاصنام والشرك يغشى وجهه الاظلام

قالت هلم إلى الحديث فقلت لا لو ما رأيت محمدا و قبيله الرأيت دين الله اضحی بینا

অর্থাৎ– স্ত্রী বললো, আমাকে তুমি নতুন কিছু শুনাও। আমি বললাম, না। তুমি যদি দেখতে মুহাম্মাদ ও তাঁর সংগীদেরকে বিজয়ের দিন– যে দিন মূর্তিগুলো ভেংগে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। তবে তুমি অবশ্যই দেখতে যে, আল্লাহর দীন সত্যিই সুস্পষ্ট ও যুক্তিযুক্ত। আর শিরক তার নিজ মুখমণ্ডলকে অন্ধকারে কালিমা লিপ্ত করে রেখেছে।

ইবন ইসহাক বলেন : মুহাম্মাদ ইব্‌ন জা’ফর– আইশা (রা) সূত্রে আমার নিকট বর্ণনা করেন : সাফওয়ান ইবন উমাইয়া জিন্দা থেকে জাহাজ যোগে ইয়ামানে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়ে। উমায়র ইবন ওহব বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর গোচরে আনেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর নবী! সাফওয়ান ইবন উমাইয়া হচ্ছে তার সম্প্রদায়ের নেতা– সে আপনার ভয়ে নিজেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাচ্ছে। ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি তাকে নিরাপত্তা দিন। আল্লাহ্ আপনার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন! রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হল। উমায়র বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন একটি নিদর্শন দিন, যার দ্বারা বুঝা যায় যে, আপনি তাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) তার নিকট নিজের পাগড়ীটি দিয়ে দিলেন। যা মাথায় দিয়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। উমায়র পাগড়ীটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং এমন অবস্থায় তাকে পেয়ে যান যখন সে সমুদ্রে পাড়ি দেয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। উমায়র তাকে ডেকে বললেন, হে সাফওয়ান! আমার পিতামাতা তোমার জন্যে উৎসর্গ হোন! আল্লাহকে ভয় কর, নিজেকে ধ্বংস করোনা। এই যে আমি রাসূলুল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্যে নিরাপত্তা সনদ নিয়ে এসেছি। সাফওয়ান বললো, তোমার সর্বনাশ হোক! তুমি আমার নিকট থেকে দূর হও। আমার সাথে কোন কথা বলো না । উমায়র বললেন, সাফওয়ান । তোমার জন্যে আমার পিতামাতা উৎসর্গ হোন! দেখ, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মানবকুলের সর্বোত্তম ব্যক্তি। মানবজাতির মধ্যে সর্বাধিক সদাচারী লোক, মানব গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী সহিষ্ণু পুরুষ এবং সমগ্র মানবমণ্ডলীর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তি। তিনি তো তোমার পিতৃব্য-পুত্র। তার সম্মান তোমারই সম্মান। তার গৌরব তোমারই গৌরব, তাঁর রাজত্ব তোমারই রাজত্ব। সাফওয়ান বললো, আমি নিজের জীবনের ব্যাপারে তাকে ভয় করি । উমায়র বললেন, তাঁর সহিষ্ণুতা ও মহানুভবতা এর অনেক উর্ধ্বে। এরপর সাফওয়ান উমায়রের সাথে ফিরে আসে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন সাফওয়ান বললো, ও দাবী করছে, আপনি নাকি আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, সে সত্য কথাই বলেছে। সাফওয়ান বললো, তা হলে এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে আমাকে দু’ মাসের অবকাশ দিন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, যাও, চার মাসের অবকাশ দেওয়া হল, (ভালরূপে চিন্তা-ভাবনা কর)। ইবন ইসহাক যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, সাফওয়ানের স্ত্রী ফাখৃতা বিনত ওয়ালীদ এবং ইকরামা ইবন আবু জাহলের স্ত্রী উম্মু হাকীম বিন্ত হারিছ বিনত হিশাম (ইসলাম গ্রহণ করে)। মুসলমানগণ মক্কা দখল করার সাথেই ইকরামা পালিয়ে ইয়ামানে চলে যায়। পরে তার স্ত্রী উম্মু হাকীম ইয়ামান থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে আনেন। মক্কায় পৌঁছে ইকরামা ইসলাম গ্রহণ করে। ইকরামা ও সাফওয়ান উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের স্ত্রীদের সাথে পূর্বের বিবাহ বহাল রাখেন। ইবন ইসহাক বলেন, সাঈদ ইবন আবদুর রহমান ইবন হাসসান ইবন ছাবিত আমার নিকট বর্ণনা করেন যে, নাজরানে অবস্থানরত ইব্‌ন যাবা’রীর উদ্দেশ্যে হাস্সান একটি মাত্র পংক্তি ছুঁড়ে মারেন, তার বেশী কিছু বলেননি। পংক্তিটি হলো–

لا تعد من رجلا احلك بغضه نجران في عيش احد لئيم

অর্থাৎ– “সে লোকটিকে তুমি হারিয়ো না, যার প্রতি অন্তরের বিদ্বেষ তোমাকে নাজরানে নিয়ে নিক্ষেপ করেছে। যেখানে তুমি নিকৃষ্টতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছ।”

– ইব্‌ন যাবা’রীর নিকট এ কবিতা পৌঁছা মাত্র সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ছুটে আসে এবং ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলাম গ্রহণকালে সে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করে–

راتق ما فتقت اذ انا بور بی و من مال ميله مثبور ثم قلبي الشهيد أنت النذير من لؤي وكلهم مفرور

یا رسول المليك أن لسانی از ابارى الشيطان في سن الغيی أمن اللحم والعظام لربي انني عنك زاجر ثم حيا

অর্থাৎ– হে রাজাধিরাজের প্রেরিত রাসূল! আমার রসনা সর্বদা সংযত ছিল। যখন আমি ধ্বংসের পথে ছিলাম, তখনও কুৎসা রটাতে আমি আমার মুখ খুলিনি।

যখন আমি বিভ্রান্তির অলি-গলিতে শয়তানের অগ্রগামী ছিলাম। আর যে ব্যক্তি শয়তানের পথে অগ্রসর হয় সে মূলত ধ্বংসের দিকেই অগ্রসর হয়।

আমার অস্থিমাংস আমার প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছে। তারপর আমার অন্তরও সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আপনি সতর্ককারী রাসূল ।

আমি আপনার পক্ষ থেকে লুয়াই গোত্রকে সাবধান করছি। আর তারা তো সকলেই প্রতারণার শিকার।

ইবন ইসহাক বলেন, ইসলাম গ্রহণকালে আবদুল্লাহ ইবন যাবা’রী আরও বলেছিল :

والليل معتلج الرواق بهيم

منع الرقاد بلابل وهموم

فيه فبت كانني محموم

مما اتاني ان احمد لا مني

غير انه سرح اليدين غشوم

يا خير من حملت على اوصالها

اسديت اذ انا في الضلال اهيم

انسى لمعتذر اليك من الذي ایام تأمرني باغوی خطة سهم وتأمرني بها مخزوم

امر الغواة وامرهم مشؤوم

وأمد اسباب الردى ويقودنی

قلبي و مخطئ هذه محروم

فاليوم أمن بالنبي محمد مضت العداوة وانقضت اسبابها ودعت او اصر بيننا وحلوم

زللي فانك راحم مرحوم

فاغفر فدى لك والدي كلاهما و عليك من علم انمليك علامة نور اغر وخاتم مختوم

شرفا وبرهان الاله عظيم

اعطاك بعد محبة برهانه

حق وانك في المعاد جسیم

ولقد شهدت، بان دينك صادق

مستقبل في الصالحين کریم

والله يشهد ان احمد مصطفی

فدع تمكن في الذری واروم

قوم علا بتيانه من هاشم

অর্থাৎ- “বিভিন্ন রকম দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা আমার ঘুম কেড়ে নিল। অথচ রাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। কারণ, আমার নিকট সংবাদ এলো যে, নবী আহমদ (সা) আমাকে ধিক্কার দিয়েছেন। ফলে আমি রাত কাটালাম এমনভাবে যেন আমি একজন জ্বরের রোগী।

হে সর্বোত্তম ব্যক্তি, যার অংগ-প্রত্যংগ অত্যন্ত সবল ও সুঠাম, যিনি এমন প্রত্যয়দীপ্ত অভিযাত্রী, যার কখনও গতি রোধ হয় না।

আমি আমার পথভ্রষ্ট জীবনের কৃত অপরাধসমূহের জন্যে আপনার নিকট লজ্জিত ও অনুতপ্ত ।

সে জীবনে আমাকে সাহম গোত্রের লোকেরা এক ধরনের গোমরাহীর পথে উদ্বুদ্ধ করতো তো মাখযুম গোত্রের লোকেরা আহ্বান জানাতো আর এক ধরনের গোমরাহীর পথে।

আমি নিকৃষ্ট জাতীয় উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে চলছিলাম। আর পথভ্রষ্ট লোকদের কার্যাবলী আমাকে সে দিকেই টেনে নিচ্ছিল। তাদের কার্যাবলী সর্বদা অমংগলই হয়ে থাকে।

আজ আমার অন্তর নবী মুহাম্মাদের উপর ঈমান এনেছে এবং এ ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্তকারীরা হচ্ছে চিরবঞ্চিত।

আমাদের মধ্যকার শত্রুতার অবসান ঘটেছে এবং শত্রুতার কারণসমূহও বিদুরিত হয়েছে। এখন আমাদের পারস্পরিক সৌজন্য-সম্প্রীতি ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা আমাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছে।

আমার পিতামাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন! আপনি আমার পদস্খলনসমূহ ক্ষমা করুন। কেননা, আপনি দয়ালু এবং দয়াপ্রাপ্ত।

আপনার মাঝে রাজাধিরাজ মহান আল্লাহর দেওয়া জ্ঞানের সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। আপনি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। আপনি শেষ নবী এবং আপনার মাধ্যমে নবুওয়াত মহৱাংকিত করা হয়েছে।

তিনি আপনাকে ভালবেসে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন প্রমাণাদি দান করেছেন। আর আল্লাহর প্রমাণাদি অতি মহান।

আমি এ মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনার আনীত জীবন বিধান সত্য । আর মানব কুলের মধ্যে আপনার ব্যক্তিত্ব অতি বিশাল।

আল্লাহই সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, আহমদ মুস্তাফা পুণ্যবান লোকদের জন্যে আদর্শ ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ।

তিনি এমন এক কওমের সন্তান যার ভিত্তি বনূ হাশিম। তার মূল ও শাখা সর্বজন বিদিত। ইবন হিশাম বলেন, কোন কোন পণ্ডিতের মতে এ কবিতাগুলো যাবারীর নয়।

আমি বলি, আবদুল্লাহ ইবন যাবা’রী আসোহমী ছিল ইসলামের একজন ঘোর শত্রু। সে ছিল ঐসব কবিদের দলভুক্ত যারা তাদের কাব্য প্রতিভাকে মুসলমানদের কুৎসা প্রচারে নিয়োজিত রেখেছিল। এরপর এক পর্যায়ে আল্লাহ্ তার প্রতি সদয় হন। ফলে সে তওবা করে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইসলামের সাহায্য সহযোগিতায় নিজেকে নিবেদিত করে ।

অনুচ্ছেদ

ইবন ইসহাক বলেন : মক্কা বিজয় অভিযানে মুসলমানদের সর্বমোট সংখ্যা ছিল দশ হাজার। তার মধ্যে সুলায়ম গোত্রের সাতশ’ (কারও মতে এক হাজার), গিফার গোত্রের চারশ’, (আসলাম গোত্রের চারশ), মুযায়না গোত্রের এক হাজার তিন জন। অবশিষ্ট সকলেই ছিলেন কুরায়শ, আনসার ও তাদের মিত্র এবং আরবের তামীম, কায়স ও আসাদ গোত্রের লোক। কিন্তু উরওয়া, যুহরী এবং মূসা ইব্‌ন উা বলেন, মক্কা বিজয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সংগী মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বার হাজার ।

ইন ইসহাক বলেন, কথিত আছে যে, মক্কা বিজয়ের দিন হাস্সান ইব্‌ন ছাবিত নিম্নের কবিতাটি আবৃত্তি করেন :

الى عذراء منزلها خلاء

عفت ذات الأصابع فالجواء

تعفيها الروامس والسماء

دیار من بني الحسحاس قفر وكانت لايزال بها انیس خلال مروجها نعم وشاء

يؤرقني اذا ذهب العشاء

فدع هذا ولكن من لطيف

فليس لقلبه منها شفاء

الشعثاء التي قد تيمته

یکون مزاجها عسل وماء

كان خبيئة من بيت راس

فهن لطيب الراح الفداء

اذا ما الاشربات ذکرن يوما

اذا ما كان مغت او لحخاء

نوليها الملامة ان المنا

واسدا ما ينهنها اللقاء

ونشربها فتتركنا ملوكا

مدمنا خيلنا ان لم تروها تثير النقع موعدها كداء يناز عن الاعنة مصفيات على اكتافها الاسل الظماء تظل جيادنامتمطرات يلطمهن بالخمر النساء فاما تعرضوا عنا اعتمرنا وكان الفتح وانكشف الغطاء والا فاصبروا لجلاد يوم يعز الله فيه من يشاء وجبريل رسول الله فينا وروح القدس ليس له كفاء وقال الله قد ار سنت عبدا يقول الحق ان نفع البلاء شهدت به فقوموا صدقوه فقلتم لا نقوم ولا نشاء وقال الله قد سدد ديرت جندا هم الانصار عرضتها اللقاء لنا في كل يوم من معد سباب او قتال او هجاء فنحكم بالقوا في من هجانا ونضرب حين تختلط الدماء الا ابلغ ابا سفيان عنی مغلغلة فقد برح الخفاء بان سيوفنا تركتك عبدا وعبد الدار سادتها الاماء هجوت محمدا فاجبت عنه وعند الله في ذات الجزاء اتهجوه ولست له بكفء فشر كما لخير كما الفداء هجوت مبار کا برا حنيفا امین الله شيمته الوفاء امن يهجو رسول الله منكم ويمدحه وينصره سواء فان ابی و والده وعرضي لعرض محمد منكم وقاء لسانی صارم لا عيب فيه ولبحرى لاتكدره الدلاء

অর্থাৎ : যাতুল আসাবি’ ও জাওয়া থেকে আরম্ভ করে আযরা পর্যন্ত সমগ্র এলাকা জনশূণ্য হয়ে গিয়েছে এখানকার ঘরবাড়িগুলো খালি পড়ে আছে।

বনূ হাসহাসের (বনূ আসাদ) বাড়িঘরগুলো খাঁ-খাঁ করছে– এ যেন ধূসর প্রান্তর। বায়ুর প্রবাহ এর বৃষ্টির বর্ষণ এর নিশানা মিটিয়ে দিয়েছে।

অথচ একদা এখানে ছিল লোকজনের বিচরণ। আর এর চারণভূমিতে চরে বেড়াত উট ও

এখন এসবের চিন্তা ছেড়ে দাও, এবং বল আমার প্রেমাস্পদের খরব কি? যে ইশার পরে এসে আমাকে ঘুম থেকে জাগায়।

আমার প্রিয়া শা’ছার জন্যে যে তাকে পাওয়ার কামনা করেছে। কিন্তু এতে করে তার অন্তর শান্তি লাভ করবে না।

তার জন্যে আমার সে প্রেমের স্বাদ ঠিক ‘বায়তে রাসে’ তৈরি মদের ন্যায়–যা মধু ও পানি মিশ্রিত করে প্রস্তুত করা হয়।

যে দিন সে মদের গুণাগুণ আলোচনা করা হয়, সে দিন এ মদের সু-ঘ্রাণে আত্মহারা হতে হয়।

আমরা মদের জন্যে তাকে ভর্ৎসনা করি। আর এ ভর্ৎসনা চূড়ান্ত হয় যখন এর সাথে থাকে হাতের দ্বারা প্রহার ও মুখের গালমন্দ।

আমরা সে মদ পান করি। তারপর আমাদেরকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেয় যে, কোন রাজা-বাদশা কিংবা কোন সিংহের সাথে সাক্ষাৎ করতেও আমাদেরকে বাধা দেয় না।

আমরা আমাদের ঘোড়াগুলো হারাবো যদি তোমরা তাদের প্রতি লক্ষ্য না রাখ । পথের ধুলি উড়াতে উড়াতে সেগুলো মক্কার নিকটবর্তী কিদা নামক স্থানে পৌঁছবে।

ঘোড়াগুলো লম্বা ও শক্ত লাগাম থেকে ছুটার জন্যে কঠিনভাবে চেষ্টা করে। আর সেগুলোর কাঁধে ঝুলান রয়েছে তৃষ্ণার্ত ধারাল তলোয়ার।

আমাদের ঘোড়াগুলো সে দিন ছিল ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রসরমান। আর মহিলারা ওড়না দ্বারা সেগুলোর গায়ের ধুলাবালি ঝেড়ে দিচ্ছিল।

সুতরাং হয় তোমরা আমাদের প্রতিবন্ধকতা উঠিয়ে লও, যাতে আমরা উমরা আদায় করতে পারি। ফলে বিজয় এসে যাবে এবং কাবার গিলাফ উন্মুক্ত হবে।

নচেৎ একদিনের কঠোরতা (যুদ্ধ) গ্রহণের জন্যে ধৈৰ্য্য ধারণ কর! সে ক্ষেত্রে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা মর্যাদা (বিজয়) দান করবেন।

আল্লাহর দূত জিবরাঈল ফেরেশতা আমাদের মাঝে অবস্থান করছেন। আর রূহুল কুদস পবিত্র আত্মা জিবরাঈলের সমকক্ষ কেউ নেই।

আল্লাহ্ বলেন, আমি এক বান্দাকে আমার রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছি। সে সত্য কথা বলছে। যদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায় তবেই ভাল।

আমি তাঁর সত্যতার সাক্ষ্য দিয়েছি। তোমরাও তাঁর সত্যতার সাক্ষ্য দাও। কিন্তু তোমরা বললে, না, আমরা তা করবো না; এবং আমরা তা চাইও না।

এদিকে আল্লাহ্ বললেন, আমি আমার এক বাহিনীকে প্রেরণ করেছি। তারা (মুসলমানদের) সাহায্যকারী। তাদের লক্ষ্য হলো শত্রুর মুকাবিলা করা ।

মা’আদ গোত্রের পক্ষ থেকে প্রতি দিনই আমাদের জন্যে আসছে গালমন্দ অথবা যুদ্ধের হুমকি অথবা নিন্দাবাদ।

সে কারণে যারা আমাদের কুৎসা গায় ও নিন্দাবাদ করে, আমরা কাব্য-ছন্দ দ্বারা তাদের প্রতিহত করার ফয়সালা নিই। আর যখন যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়। তখন আমরা তাদেরকে তলোয়ার দ্বারা আঘাত করি ।

হে আবু সুফিয়ান! তুমি আমার পক্ষ থেকে সে ব্যক্তির নিকট এ বার্তা পৌঁছে দাও যে পাশ কাটিয়ে দূরে পড়ে আছে।

বার্তাটি এই যে, আমাদের তরবারি তোমাকে দাসে পরিণত করে ছেড়েছে। আর বনূ আবদুদ্দারের সর্দারগণ পরিগণিত হয়েছে দাসরূপে।

তুমি মুহাম্মাদ (সা)-এর নিন্দামূলক কবিতা ছড়িয়েছ আমি তার পক্ষ থেকে জবাব দিয়েছি। আল্লাহর নিকট এ জন্যে রয়েছে প্রতিদান ।

ওহে তুমি- আবু সুফিয়ান তার নিন্দা কর। অথচ কোন দিক দিয়েই তুমি তার সমকক্ষ নও। সুতরাং তোমাদের দুজনের মধ্যে নিকৃষ্টজন উৎকৃষ্টজনের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে।

তুমি এমন এক মহৎ ব্যক্তির নিন্দা করেছ, যিনি কল্যাণের প্রতীক, পূত-পবিত্র ও একনিষ্ঠ বান্দা। তিনি আল্লাহর একান্ত বিশ্বস্ত এবং দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করা যার স্বভাব।

জেনে রেখো, আমার পিতা ও তার পিতা এবং আমার মান-মর্যাদা সবকিছু মুহাম্মাদ (সা)-এর মান-মর্যাদাকে তোমাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে নিবেদিত।

আমার রসনা নিংসৃত কবিতা এমন এক শানিত তলোয়ার স্বরূপ– যাতে কোন ত্রুটি নেই। এবং তা এমন এক সমুদ্র, যাতে বারবার বালতি মারলেও তার পানি ঘোলা করতে পারে না। ইবন হিশাম বলেন, হাস্সান ইবন ছাবিত এ কবিতাটি মক্কা বিজয়ের পূর্বে আবৃত্তি করেছিলেন।

আমি বলি, এ কাসীদার মধ্যে যা কিছু বলা হয়েছে তা ইবন হিশামের মন্তব্যকে সমর্থন করে । আর কবিতায় উল্লিখিত আবু সুফিয়ান হচ্ছে হারিছ ইবন আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আবু সুফিয়ান ইবন হিশাম বলেন : আমার নিকট যুহরী সূত্রে এ কথা পৌঁছেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন দেখলেন যে, মহিলারা তাদের ওড়না দিয়ে ঘোড়ার গায়ের ধুলাবালি ঝেড়ে দিচ্ছে, তখন তিনি আবু বকরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। ইবন ইসহাক বলেন : আমর ইবন সালিম খুযাঈ যখন আনাস ইবন যুনায়ম দুআলীর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আবেদন করেন, তখন আনাস রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ওযর পেশ করে নিয়োক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন :

بل الله يهديهم وقال لك اشهد

انت الذي تهدي معد بامره

ابر و اوفي ذمة من محمد

و ما حملت من ناقة فوق رحلها

اذا راح كالسيف الصقيل المهند

احث على خير واسبغ نائلا

واعطى لرأس السابق المتجرد

واکسی لبرد الخال قبل ابتذاله

وان وعيدا منك كالاخذ باليد

تعلم رسول الله انك مذر کی

على كل صرم متهمين ومنجد

تعلم رسول الله انك قادر

هموا الكاذبون المخلفوا كل موعد

تعلم ان الركب ركب عويمر ونبوا رسول الله اني هجوته فلا حملت سوطى الى اذن يدي

اصيبوا بنحس لا بطلق واسعد كفاء فعزت عبرتی وتبلدي بعبد بن عبد الله و ابنة مهود جميعا فان لاتدمع العين اکمد واخوته وهل ملوك كاعبد هرقت تبين عالم الحق واقصد

سوى انني قد قلت ويل ام فتية اصابهموا من لم يكن لدمائهم وانك قد اخبرت انك ساعيا ذؤيب و كلثوم وسلمى تتابعوا وسلمى وسلمى ليس حي كمثله فاني لا ذنبا فتقت ولا دما

অর্থ : আপনি কি সে ব্যক্তি, যিনি মা’আদ গোত্রকে তাদের আচরণের সঠিক পথ দেখাচ্ছেন? বরং আল্লাহই তাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন। আর তিনি আপনাকে বলেছেন– সাক্ষী থাকুন।

কোন উষ্ট্রীই এমন কোন সওয়ারকে তার হাওদায় বহন করেনি– যে মুহাম্মাদ (স) থেকে অধিক পুণ্যবান এবং ওয়াদা পালনে অধিকতর নিষ্ঠাবান।

যে কল্যাণকর কাজে তার চাইতে অধিকতর উৎসাহদানকারী এবং তার চাইতে বেশী বদান্যশীল ।

যখন তিনি কোন মঙ্গলময় কাজের উদ্দেশ্যে বের হন, তখন এত দ্রুত অগ্রসর হন। যেমন দ্রুত চলে ভারতীয় তীক্ষ্ণ তলোয়ার। এবং যিনি ইয়ামানী মূল্যবান চাদর নিজের কাজে ব্যবহার করার পূর্বেই অন্যকে পরিধান করার জন্যে দান করেন। আর দ্রুতগামী দামী ঘোড়া অপরকে দান করতে খুবই পারঙ্গম।

জেনে রাখুন হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমার উপর কর্তৃত্বশীল। আপনার পক্ষ থেকে ঘোষিত সতর্কবাণী –সে তো হাতে হাতে পাওয়ারই শামিল।

জেনে নিন হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সকল নিম্নভূমি ও উচ্চভূমির ঘরবাড়ির উপর এককভাবে নিয়ন্ত্রণকারী।

আপনি জেনে রাখুন, ঘৃণিত আমরের দলভুক্ত লোকজন হচ্ছে সেই সব লোক যারা মিথ্যাবাদী ও প্রতিশ্রুতি ভংগকারী।

তারা আল্লাহর রাসূলকে এই সংবাদ দিয়েছে যে, আমি নাকি তাঁর নিন্দাবাদ করেছি। তা যদি সত্য হতো তা হলে আমি নিজ হাতে নিজেকে বেত্রাঘাত করতাম। তবে এ কথা আমি বলেছি যে, সেই সব কিশোরদের মায়েদের জন্যে দুর্ভাগ্য যারা পাহাড়ের পাদদেশে নিরুপায় ও সৌভাগ্য বঞ্চিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।

তাদেরকে হত্যা করেছে এমন সব লোক যারা তাদের রক্তপণ শোধ করতে পারবে না কোন ক্রমেই (অথবা ওদের রক্তের সম মর্যাদাপূর্ণ নয়। তাই আমি অশ্রু প্রবাহিত করছি ও শোক প্রকাশ করছি।

আর আপনি এই সংবাদ দিয়েছেন যে, আব্‌দ ইবন আবদুল্লাহ, মুহাব্বিদের কন্যা যুওয়ায়ব, কুলছুম ও সুলমা এদের সকলকে নির্মূল করার জন্যে আপনি চেষ্টা করছেন। এতে আমার চক্ষু যদি অশ্রু নাও বহায় তবে আমার অন্তর তো ব্যথিত হবেই ।

আর সুলমা ও তার ভাইদের কথা বলছি- যে সুলমার সমতুল্য কোন লোকই হতে পারে না। রাজা-বাদশাহরা কি কখনও দাসদের মত হয়?

আমি কোন অপরাধ সংঘটিত করিনি এবং কাউকে হত্যাও করিনি। আপনি বাস্তব জগতকে উঘাটন করুন ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।

ইবন ইসহাক বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন বুজায়র ইবন যুহায়র ইব্‌ন সুলমা নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন :

نفی اهل الحبلق كل فبح مزينة غدوة وبنو خفاف

بالبيض الخفاف

بي الخير

ضربناهم بمكة يوم فتح النب صبحناهم بسبع من سليم والف من بني عثمان واف

ورشقا بالمريشة

اللطاف

نطا اكتافهم ضرباوطعنا

كما انصاع الفواق من الرصاف

ترى بين الصفوف لها حفيفا فرحنا والجياد تجول فيهم بارماح مقومة

الثقاف

وآبوا نادمين على الخلاف

فابنا غانمين بما اشتهينا واعطينا رسول الله منا مواتقنا على حسن التصافي

غداة الروع منا بانصراف

وقد سمعوا مقالتنافهموا

অর্থ : বিজয়ের দিন প্রত্যুষকালে মুযায়না ও বনূ খুফাফ গোত্রের লোকজন সাত সকালে তাদের বসতি এলাকার প্রতিটি রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলো।

শ্রেষ্ঠ নবীর মক্কা বিজয়ের দিন আমরা হালকা ধরনের তলোয়ার দ্বারা তাদেরকে আঘাত করেছি।

প্রভাত বেলায়ই আমরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম- সুলায়ম গোত্রের সাত শ’ ও বনূ উছমানের পূর্ণ এক হাজার লোক নিয়ে, তাদের উপর তলোয়ারের আঘাতে, বর্শার খোঁচায় ও হালকা তীর নিক্ষেপে আমরা তাদের স্কন্ধসমূহ রক্তাক্ত করে দিলাম।

পালক বিশিষ্ট তীরের ফলক বাট থেকে বেরিয়ে যখন দ্রুত বেগে শত্রু বুহ্য ভেদ করে যাচ্ছিল তখন তুমি তার শন শন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলে।

সোজা ও পরিপাটি করা বল্লমগুলো নিয়ে অশ্বগুলো যখন তাদের মাঝে চক্কর কাটছিল তখন আমরা খুবই উৎফুল্ল বোধ করছিলাম ।

তারপর আমরা আমাদের কাংখিত গনীমতের মাল নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলাম। পক্ষান্তরে তারা লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে ফিরে গেল ।

আমরা অতি সন্তুষ্ট চিত্তে আল্লাহর রাসূলকে আমাদের পক্ষ থেকে অংগীকার প্রদান করলাম । সেই ভয়াল দিনে তারা আমাদের পারস্পরিক কথাবার্তা শুনেই পালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম।

ইবন হিশাম বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন আব্বাস ইবন মিরদাস সুলামী নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন :

منا بمكة يوم فتح محمد الف تسيل به البطاح مسوم

وشعارهم يوم اللقاء مقدم

نصروا الرسول وشاهدوا آياته

ضنك كأن الهام فيه الحنتم

في منزل ثبتت به اقدامهم

حتى استقام لها الحجاز الادهم

جرت سنابكها بنجد قبلها

وأذله حكم السيوف لنا وجد مزحم

الله مكه

له عود الرياسة شامخ عرنينه متطلع ثغر المكارم خضرم

অর্থ : মুহাম্মাদ (সা)-এর মক্কা বিজয়ের দিন আমাদের এক হাজার চিহ্নিত বীর যোদ্ধার পদভারে মক্কাভূমি প্রকম্পিত হয়।

তারা আল্লাহর রাসূলকে সাহায্য করে ও তাঁর নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করে । আর যুদ্ধের দিন তাদের নিশানগুলো সবার আগে ছিল।

যে সংকীর্ণ স্থানে তাদের পা দৃঢ়ভাবে জমে যেত, সেখানে (শত্রুদের) মাথার খুলি কদুর খোলে নির্মিত মটকার মত পড়ে থাকত।

ইতঃপূর্বে এসব যোদ্ধাদের পদচারণা নদ ভূমিতেও হয়েছে। এরপর মিশমিশে কালো হিজাজ ভূমিও তাদের অবস্থান কামনা করেছে।

আল্লাহ্ তাঁকে হিজাযে ক্ষমতাসীন করেছেন এবং তলোয়ারের ফায়সালা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা এ ভূমিকে আমাদের পদানত করে দিয়েছে।

তারা শাসন ক্ষমতার যোগ্য, মর্যাদার অধিকারী, সদাচারী, আতিথেয়তা ও বদান্যতায় তারা অভ্যস্ত।

ইবন হিশাম আব্বাস ইবন মিরদাসের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর পিতা মিরদাস একটি পাথরের মূর্তির পূজা করতো। মূর্তিটির নাম ছিল যিমার। মিরদাসের মৃত্যু সময় উপস্থিত হলে সে তার পুত্র আব্বাসকে ঐ মূর্তির ব্যাপারে যত্নশীল থাকার উপদেশ দিয়ে যায়। একদা আব্বাস মূর্তিটির সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। হঠাৎ মূর্তির পেটের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা এক আওয়াজ তিনি শুনতে পান। আওয়াজের মধ্যে নিম্নের কবিতাটি ছিল?

اودی ضمار وعاش اهل المسجد بعد ابن مريم من قريش مهتدی

قل للقبائل من سليم كلها ان الذي ورث النبوة والهدی

قبل الكتاب الى النبي محمد

اودی ضمار وكان يعبد مدة

অর্থ : সুলায়ম গোত্রের সকল শাখা-গোত্রকে জানিয়ে দাও যে, যিমার ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এবং মসজিদবাসীরা জীবন লাভ করেছে।

মরিয়মের পুত্র (ঈসা (আ)-এর পর কুরায়শ গোত্রের যে ব্যক্তি নুবুওয়ত ও হিদায়াতের উত্তরাধিকারী হয়েছেন, তিনি সঠিক পথের উপর আছেন ।

যিমার ধ্বংস হয়েছে। অথচ নবী মুহাম্মাদের নিকট কিতাব নাযিল হওয়ার পূর্বে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তার উপাসনা করা হয়েছে।

ইবন হিশাম বলেন, এরপর আব্বাস যিমার মূর্তিটি পুড়িয়ে ফেলেন নবী করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ ঘটনা ইতিপূর্বে জিনদের অদৃশ্য আওয়াজ ও আকৃতি পরিবর্তন সংক্রান্ত অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সমস্ত প্রশংসা ও অনুগ্রহ আল্লাহরই।

মক্কা বিজয়ের পর খালিদ ইবন ওয়ালীদকে বনু জুযায়মা ইবন কিনানার উদ্দেশ্যে প্রেরণ

ইবন ইসহাক বলেন, হাকীম ইবন হাকীম ইবন আববাদ ইবন হানীফ আমার নিকট আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবন আলী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, মক্কা বিজয় হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) খালিদ ইবন ওলীদকে আল্লাহর পথে আহ্বানকারীরূপে প্রেরণ করেন; যোদ্ধা হিসেবে প্রেরণ করেননি। তাঁর সাথে তখন সুলায়ম ইবন মনসূর, মুদলিজ ইবন মুররা প্রভৃতি আরব গোত্রসমূহও ছিল । তারা গিয়ে বনূ জুযায়মা ইব্‌ন আমির ইবন আব্‌দ মানাত ইবন কিনানার উপর চড়াও হয়। ঐ গোত্রের লোকজন তাকে আসতে দেখে অস্ত্র ধারণ করে। তখন খালিদ বললো, তোমরা অস্ত্র সংবরণ কর।

ইবন ইসহাক বলেন : বনূ জুযায়মার কোন কোন বিজ্ঞ আলিম আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, খালিদ যখন আমাদেরকে অস্ত্র সংবরণের নির্দেশ দেয়, তখন আমাদের গোত্রের জাহ্দাম নামক এক ব্যক্তি বলে উঠলো : হে বনূ জুযায়মা! তোমাদের সর্বনাশ হবে, এ যে খালিদ! আল্লাহর কসম, অস্ত্র সংবরণ করলেই বন্দী হতে হবে। আর বন্দী হওয়ার পরই তোমাদের গর্দান কাটা হবে । আল্লাহর কসম! আমি কিছুতেই অস্ত্র সংবরণ করবো না। তখন তার গোত্রের কিছু লোক তাকে ধরে নিয়ে বললো, হে জাহদাম! তুমি কি চাও, আমাদের রক্ত প্রবাহিত হোক? লোকজন ইসলাম গ্রহণ করেছে। যুদ্ধ থেমে গেছে এবং মানুষ নিরাপদ হয়ে গেছে। গোত্রের লোকজন তাকে এ বিষয়ে পীড়াপীড়ি করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার অস্ত্রপাতি কেড়ে নেয় এবং গোটা সম্প্রদায় খালিদের কথামত অস্ত্র সংবরণ করে। ইবন ইসহাক বলেন : হাকীম ইবন হাকীম আমার নিকট আবু জাফর সূত্রে বর্ণনা করেন : যখন তারা অস্ত্র সংবরণ করলো, তখন খালিদের নির্দেশে তাদের বেঁধে ফেলা হলো। তারপরে তলোয়ারের মুখে তাদের অনেককেই হত্যা করা হল। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট যখন এ সংবাদ পৌঁছলো, তখন তিনি তাঁর হস্তদ্বয় আকাশের দিকে উঠিয়ে বললেন :

اللهم اني ابرأ اليك مما صنع خالد بن الوليد–

 “হে আল্লাহ্! খালিদ ইবন ওয়ালীদ যা কিছু করেছে তার সাথে আমি সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করছি।”

ইবন ইসহাক বলেন : আমার নিকট কোন কোন আলিম বর্ণনা করেছেন যে, গোত্রের এক ব্যক্তি ছুটে এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ঘটনার বিবরণ জানালো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেউ কি খালিদকে এ কাজে বাধা দেয়নি? লোকটি বললো, হ্যাঁ, দিয়েছে- একজন ফর্সা চেহারা বিশিষ্ট লোক বাধা দিয়েছিল। কিন্তু খালিদ তাকে এক ধমক দিলে সে চুপ হয়ে যায় । তাছাড়া আরও একজন দীর্ঘকায় লোকও তাকে কঠিনভাবে বাঁধা দেয় এবং উভয়ের মধ্যে তীব্র বাক-বিতন্ডা হয়। এ সময় উমার ইবন খাত্তাব বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এদের মধ্যে প্রথমজন আমার পুত্র আবদুল্লাহ, আর দ্বিতীয় জন আবু হুযায়ফার মুক্ত গোলাম সালিম।

ইবন ইসহাক বলেন : হাকীম ইবন হাকীম আবু জাফর সূত্রে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আলী ইব্ন আবু তালিবকে ডেকে বললেন, হে আলী! তুমি ঐসব সম্প্রদায়ের নিকট যাও এবং তাদের বিষয়টি ভালকরে দেখ। তারপর জাহিলী যুগের রীতি-নীতিকে তোমার পদতলে মথিত কর। আলী বের হয়ে গেলেন এবং তাদের কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি তার সাথে রাসূলুল্লাহ (সা) প্রদত্ত অর্থ-সম্পদও নিয়ে গেলেন। তিনি ঐ অর্থ দ্বারা তাদের রক্তপণ আদায় করলেন ও নষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পদের ক্ষতিপূরণ দিলেন। এমন কি কুকুরের পানি খাওয়া পাত্রের ক্ষতিপূরণ শোধ করলেন। তাদের রক্তপণ ও মালের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরও তার হাতে প্রচুর অর্থ অবশিষ্ট থেকে যায়। তখন আলী (রা) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আর কারও রক্তপণ বা সম্পদের ক্ষতিপূরণ বাকী আছে কি? তারা বললো, ‘জ্বী, না। তখন তিনি বললেন :রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দেয়া দায়িত্ব পালনে সতর্কতা স্বরূপ “এই অবশিষ্ট মালও আমি তোমাদেরকে দিয়ে যাচ্ছি।” এ বিষয়টা তিনিও জানেন না, তোমরাও জান না। তারপর তিনি সে রকমই করলেন এবং কাজ শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে এসে বিস্তারিতভাবে সবকিছু জানালেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : –তুমি ঠিক করেছ এবং বেশ করেছ। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত অনেক উর্ধ্বে তুলে ধরলেন, এমন কি তাঁর উভয় বগলের নীচের অংশ দেখা যাচ্ছিল। আর তিনি তখন বলছিলেন : “হে আল্লাহ! খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদ যে কান্ড করেছে তা থেকে আপনার কাছে আমার সম্পর্কহীনতার কথা ঘোষণা করছি।” এরূপ তিনি তিনবার বললেন।

ইবন ইসহাক বলেন : কেউ কেউ খালিদকে এ ব্যাপারে নির্দোষ মনে করেন। তারা বলেন, খালিদ এ কথা বলেছেন যে, আবদুল্লাহ ইবন হুযাফা সাহমী আমাকে না বলা পর্যন্ত আমি যুদ্ধে লিপ্ত হইনি। কেননা, আবদুল্লাহ ইবন হুফা আমাকে বলেছিল যে, তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তবে তুমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। ইবন হিশাম বলেন : আবু আমর মাদীনী বলেছেন, খালিদ ইবন ওয়ালীদ ঐ সম্প্রদায়ের নিকট পৌঁছলে তারা বলেছিল আমরা ধর্মান্তরিত হয়েছি। আমরা ধর্মান্তরিত হয়েছি। (অর্থাৎ সাবেয়ী গ্রহণ করেছি), [মূল কিতাবের পাদটীকায় এর অর্থ দেয়া হয়েছে,”আমরা সাবেঈ ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছি।–সম্পাদক] এ বর্ণনাটি মুরসাল ও মুনকাতি’ (সনদ বিচ্ছিন্ন)।

ইমাম আহমদ বলেন : আমার নিকট আবদুর রায্যাক— আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) খালিদ ইবন ওলীদকে আমার যতদূর মনে পড়ে জুযায়মা গোত্রে প্রেরণ করেন। তিনি সে গোত্রের লোকজনকে ইসলাম গ্রহণ করার আহ্বান জানান কিন্তু তারা স্পষ্টভাবে এ কথা বলেনি যে, “আমরা ইসলাম গ্রহণ করলাম’ বরং তারা এ কথা বলে যে, আমরা ধর্মান্তরিত হলাম। আমরা ধর্মান্তরিত হলাম। ফলে খালিদ তাদেরকে বন্দী ও হত্যা করার জন্যে পাকড়াও করেন। ইবন উমর (রা) বলেন, খালিদ আমাদের প্রত্যেকের কাছে। একজন করে বন্দীকে তুলে দেন। পরের দিন সকাল বেলা আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ বন্দীকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। জবাবে আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি আমার বন্দীকে হত্যা করবো না এবং আমার যারা ভক্ত আছে তারাও কেউ তাদের বন্দীকে হত্যা করবে না। ইবন উমার (রা) বলেন, এরপর সকলে নবী করীম (সা)-এর কাছে ফিরে এসে খালিদের কর্মকাণ্ড সবিস্তারে তাকে জানায়। তখন নবী করীম (সা) দু’হাত উঠিয়ে দু’আ করেন : “হে আল্লাহ্! খালিদ যে কাজ করেছে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই”। এ কথাটি রাসূলুল্লাহ (সা) দু’বার বলেন। বুখারী ও নাসাঈ আবদুর রাযযাক সূত্রে, আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) থেকে এ হাদীছটি অনুরূপ বর্ণনা করেন। ইবন ইসহাক বলেন : খালিদ যখন তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু করেন, সে দৃশ্য দেখে জাহদাম বলেছিল, ওহে বনী জুযায়মা! লড়াই বৃথা গেল, তোমরা এখন যে অবস্থায় পড়েছ- আমি পূর্বেই সে ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করেছিলাম।

|||||||||| ইবন ইসহাক বলেন : আমার নিকট এ সংবাদ পৌঁছেছে যে, ঐ দিনের ঘটনার ব্যাপারে খালিদ ও আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। আবদুর রহমান খালিদকে বলেছিলেন, তুমি ইসলামের মধ্যে এসে একটা জাহিলী যুগের কাজ করলে । জবাবে খালিদ বলেন : আমি তোমার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছি। আবদুর রহমান বললেন, তুমি মিথ্যা বলছো । আমার পিতার হত্যাকারীকে তো আমি হত্যা করেছি। তুমি বরং তোমার চাচা ফাঁকিহ ইবন মুগীরার হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। এ বিতণ্ডা শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি করে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট যখন এ সংবাদ পৌঁছলো তখন তিনি বললেন :

مهلا يا خالد دع عنك اصحابی– فوالله لو كان لك أحد ذهبا ثم انفقته في

سبيل الله ما ادركت غدوة رجل من اصحابی ولا روحته–

“ধীরে, খালিদ! ধীরে। আমার সাহাবীদের ব্যাপারে সাবধান! আল্লাহর কসম, যদি তোমার কাছে উহুদ পরিমাণও স্বর্ণ থাকে, আর তা তুমি আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দাও, তা হলেও তুমি আমার সাহাবীদের এক সকাল কিংবা এক বিকালের পুণ্য লাভেও সমর্থ হবে না।”

তারপর ইবন ইসহাক খালিদ ও আবদুর রহমানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের মূল ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন : তিন ব্যক্তি যথা :-(১) খালিদ ইবন ওয়ালীদের চাচা ফাঁকিহ্ ইব্‌ন মুগীরা ইবন আবদুল্লাহ ইবন উমার ইবন মাখযুম, (২) ‘আওফ ইবন আবদ ‘আওফ ইবন আবদুল হারিছ ইব্‌ন যুহরা। আওফের সাথে তার পুত্র আবদুর রহমানও ছিল (৩) আফফান ইবন আবুল আস ইবন উমাইয়া ইবন আবদে শামস। আফফানের সাথে তার পুত্র উছমানও ছিল। উক্ত তিন ব্যক্তি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইয়ামানে গমন করে। বাণিজ্য শেষে তারা দেশের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। বনূ জুযায়মার এক ব্যক্তি ইয়ামানে গিয়ে মারা যায়। তার মালামাল ওয়ারিছদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্যে ঐ তিন জন সাথে করে নিয়ে আসে। তারা মাল নিয়ে জুযায়মা গোত্রে পৌঁছলে ঐ মৃত ব্যক্তির ওয়ারিছদের নিকট অর্পণ করার পূর্বেই একই গোত্রের খালিদ ইবন হিশাম নামের এক ব্যক্তি উক্ত মালামালের দাবী করে। কিন্তু তারা তাকে মাল দিতে অস্বীকার করে। ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে আওফ ও ফাঁকিহ নিহত হয় এবং তাদের দুজনের অর্থ-সম্পদ ও তারা লুট করে নিয়ে যায়। আওফের পুত্র আবদুর রহমান তাঁর পিতার ঘাতক খালিদ ইবন হিশামকে হত্যা করে তার প্রতিশোধ নেন। আফফান ও তাঁর পুত্র উছমান প্রাণে বেঁচে যান এবং পালিয়ে মক্কায় চলে আসেন। কুরায়শরা এ ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে বনূ জুযায়মার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করে। বনূ জুযায়মা কুরায়শদের নিকট এই মর্মে ওর পেশ করে সংবাদ পাঠায় যে, আমাদের গোটা গোত্র ও নেতৃবৃন্দ তোমাদের লোকদের সংগে সংঘর্ষ বাঁধায়নি। তারা নিহত দু’কুরায়শীর রক্তপণ পরিশোধ করে এবং তাদের অর্থ-সম্পদও ফিরিয়ে দেয়। এভাবে একটি ঘনায়মান যুদ্ধের অবসান ঘটে।

এ কারণেই খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদ আবদুর রহমান ইবন আওফকে বলেছিলেন, তোমার পিতাকে বনূ জুযায়মা হত্যা করেছিল, আজ আমি সেই হত্যার প্রতিশোধ নিলাম। আর আবদুর রহমান তার জবাবে বলেছিলেন, আমার পিতার হত্যার প্রতিশোধ আমিই নিয়েছি এবং পিতার ঘাতককে আমিই হত্যা করেছি। খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদের দাবির প্রতিবাদ করে আবদুর রহমান বলেন যে, সেতো তার চাচা ফাকিহ ইবন মুগীরার হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। কেননা, বনূ জুযায়মা তার চাচাকে হত্যা করে ও মালামাল কেড়ে নেয় ।

বস্তুতপক্ষে খালিদ ও আবদুর রহমান প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধারণায় সঠিক ছিলেন। তর্কের ক্ষেত্রে এ জাতীয় বক্তব্য স্বাভাবিক। কেননা, এ যুদ্ধে খালিদের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের ও মুসলমানদের সাহায্য করা, যদিও তার ঐ পদক্ষেপটি ছিল ভুল। এ ছাড়া খালিদ মনে করেছিলেন। যে, বনু জুযায়মারা “ধর্মান্তরিত হয়েছি। ধর্মান্তরিত হয়েছি” বলে ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করছে। এ কথার দ্বারা তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, খালিদ তা বুঝতে পারেন নি। সে কারণে তিনি তাদের বিপুল সংখ্যক লোককে হত্যা করেন এবং অবশিষ্টদের বন্দী করেন। আবার বন্দীদের মধ্যে বেশীরভাগকে পরে হত্যা করে ফেলেন। এতদ্সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে সেনাধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করেননি; বরং পরবর্তী অভিযানের জন্যেও তাকে এ পদেই বহাল রাখেন। অবশ্য তার এ তৎপরতার জন্যে তিনি আল্লাহর নিকট নিজের দায়িত্ব মুক্তির কথা ব্যক্ত করেন। অপর দিকে তাঁর ভুলের জন্যে রক্তপণ ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন । রাষ্ট্র প্রধান বা সেনা প্রধানের ভুলের ক্ষতিপূরণ তার নিজের অর্থ থেকে যাবে না, বায়তুল-মাল থেকে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে উলামাদের এক অংশের মত হল- বায়তুল মাল থেকে দেওয়া হবে । খালিদের উপরোক্ত ঘটনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক ক্ষতিপূরণ আদায় করা ঐ সব আলিমের মতের পক্ষে বলিষ্ঠ দলীল। রিদ্দার যুদ্ধে খালিদ ইবন ওয়ালীদ মালিক ইব্‌ন নুওয়ায়রাকে হত্যা করে তার স্ত্রী উম্মে তামীমকে নিজে গ্রহণ করলে উমার ইবন খাত্তাব (রা) খলীফা আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর নিকট খালিদের অপসারণ দাবি করেন এবং বলেন : –তার তরবারির মধ্যে যুলুম আছে। কিন্তু খলীফা আবু বকর (রা) তাকে অপসারণ করেননি এবং বলেন : “– যে তরবারি আল্লাহ্ মুশরিকদের উপর কোষমুক্ত করেছেন, সে তরবারি আমি কোষবদ্ধ করবো না ।

ইবন ইসহাক বলেন : আমার নিকট ইয়াকূব ইব্‌ন উতবা ইবন মুগীরা ইব্‌ন আখনাস যুহরীর সূত্রে ইবন আবূ হাদরাদ আসলামী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একদা আমি খালিদ ইবন ওয়ালীদের অশ্বারোহী বাহিনীর মধ্যে ছিলাম। তখন আমার সমবয়সী বনূ জুযায়মার এক যুবক যার হাত দু’গাছি রশি দিয়ে ঘাড়ের সাথে বাঁধা এবং তার থেকে অল্প দূরেই কতিপয় মহিলা সমবেত, এ অবস্থায় সে আমাকে সম্বোধন করে বললো : ওহে যুবক! আমি বললাম, তুমি কি চাও? সে বললো, তুমি কি এই রশি ধরে আমাকে ঐ মহিলাদের কাছে নিয়ে যেতে পার? তাদের কাছে আমার কিছু প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন শেষে তুমি আবার আমাকে ফিরিয়ে আনবে। তারপরে তোমাদের যা মনে চায় তাই করবে। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, তুমি যা চাইছে তা তো একেবারে মামুলী ব্যাপার। এরপর আমি রশি ধরে তাকে নিয়ে গেলাম এবং মহিলাদের সামনে হাযির করলাম। সে সেখানে দাঁড়িয়ে বললো :

اسلمي حبيش على نفد العيش ۔

“আমার জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তুমি শান্তিতে থাক হে হুবায়শ ।”

بحلية او الفيتكم بالخوانق

اريتك ان طالبتكم فوجد كم

تكلف ادلاج السري والوادائق

ان ينول عاشق

الم يك اه

اثيبي بود قبل احدى الصفائق

فلا ذنب لي قد قلت اذ اهلنا معا

وينأى الامير بالحبيب المفارق

اثیبی بود قبل ان يشحط النوي فاني لا ضيعت سر امانة ولاراق عيني عنك بعدك رائق

عن الود الا ان يكون التوامق

سوی آن مانال العشيرة شاغل

অর্থ : (হায়রে হুবায়শ!) তুমি কি লক্ষ্য করনি, আমি যখনই তোমাদেরকে খুঁজেছি, তখনই পেয়েছি হয় হিলিয়ায়, না হয় পেয়েছি খাওয়ানিকে।

ঐ প্রেমিক কি কিছু পাওয়ার যোগ্য হয়নি, যে অন্ধকার রাত্রে ও প্রচন্ড গরমে সফরের কষ্ট বরণ করেছে?

আমার কোন অপরাধ নেই। কেননা, আমার লোকজন যখন একত্রে ছিল, তখন আমি বলেছিলাম- কোন একটা বিপদ ঘটার আগেই তুমি প্রেমের বদলা দাও।

আমি আরও বলেছিলাম- আমাকে তুমি ভালবাসার বিনিময় দাও, দুর্যোগ এসে দূরত্ব সৃষ্টি করার আগেই। কেননা, বিরহী বন্ধুর কারণে নিজ পরিবারের কর্তাও দূরে চলে যায়।

কেননা, আমি গোপন আমানত ফাঁস করে দিয়ে খিয়ানত করিনি। আর তোমার পরে আর কোন সুন্দরীকে আমার চক্ষু তোমার চেয়ে আকর্ষণীয় পায়নি।

তবে সমাজ সম্প্রদায়ের কারণে ভালবাসায় কখনও বা সাময়িকভাবে ভাটা পড়তে পারে । তবে উভয় দিক থেকে ভালবাসা থাকলে কোন অসুবিধা হয় না।

কবিতা শোনার পর মহিলাটি বললোঃ আমি তো মাঝে মাঝে বিরতিসহ উনিশ বছর এবং বিরতিহীনভাবে আট বছর যাবত তোমার ডাকে সাড়া দিয়েছি। আবূ হাদরাদ বলেন, আমি লোকটিকে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম ও তার গর্দান উড়িয়ে দিলাম ।

ইবন ইসহাক বলেন : আবু ফারাস ইবন আবু সুনবুলা আসলামী তাঁর কতিপয় প্রত্যক্ষদর্শী শায়খের উদ্ধৃতি দিয়ে আমার নিকট বর্ণনা করেন, ঐ যুবকটির গর্দান যখন উড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল, তখন তার সেই প্রেমিকা সেখানে দাঁড়িয়ে তা প্রত্যক্ষ করছিল। তারপর সে তার প্রেমিকের উপর উপুড় হয়ে পড়ে এবং তাকে চুম্বন করতে করতে সেও সেখানে প্রাণ বিসর্জন দেয়। হাফিয় বায়হাকী হুমায়দী সূত্রে– ইসাম মুযায়নী থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) কোন অভিযানে সৈন্য প্রেরণকালে উপদেশ দিতেন যে, কোথাও কোন মসজিদ দেখলে কিংবা কোন মুয়াযিনের আযান শুনতে পেলে তথাকার কাউকেও হত্যা করবে না। একবারের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে এক অভিযানে প্রেরণ করেন। যাত্রাকালে তিনি আমাদেরকে অনুরূপ নির্দেশ দিলেন। আমরা তিহামার দিকে যাত্রা করলাম। পথিমধ্যে দেখলাম একজন পুরুষ একটি মহিলা কাফেলার পশ্চাতে ছুটছে। আমরা তাকে ডেকে বললাম, ওহে, ইসলাম গ্রহণ কর! সে বললো, ইসলাম কী? আমরা তাকে ইসলামের ব্যাখ্যা জানালে সে তা বুঝতে ব্যর্থ হলো। সে আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করলো। তোমরা যা কর, আমি যদি তা না করি তবে আমার কী হবে? আমরা বললাম, তা হলে আমরা তোমাকে হত্যা করবো। তখন সে বললো, আমাকে ঐ মহিলা কাফেলার সাথে মিলিত হওয়ার একটু অবকাশ দেবেন কি? আমরা বললাম, হ্যাঁ, তোমাকে অবকাশ দেওয়া হলো। তবে তুমি যেতে থাক। আমরাও তোমার কাছে আসছি। বর্ণনাকারী বলেন, লোকটি যেতে যেতে মহিলা কাফেলার নাগাল পেল। সে তাদের একজনকে উদ্দেশ্য করে বললো :– ওগো হাবায়শ! তুমি সুখে থাক, আমার আয়ু ফুরিয়ে যাওয়ার পূর্বে। অপরজন বললো, বিরতিসহ উনিশ বছর এবং বিরতিহীন আট বছর (এর প্রেম বিনিময় নিয়ে) তুমিও শান্তিতে থাক। বর্ণনাকারী এরপর উপরোল্লিখিত কবিতা [ ] পর্যন্ত উল্লেখ করলেন। এরপর লোকটি সেখান থেকে ফিরে এসে আমাদেরকে বললো : এবার তোমাদের যা ইচ্ছা করতে পার। আমরা তখন অগ্রসর হয়ে তার গর্দান উড়িয়ে দিলাম। এ সময় ঐ মহিলাটি তার হাওদা থেকে বেরিয়ে এসে লোকটির দেহের উপর উপুড় হয়ে পড়লো এবং এ অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়ে গেল। এরপর ইমাম বায়হাকী আবু আবদুর রহমান নাসাঈ সূত্রে– ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) একবার এক অভিযানে একটি ক্ষুদ্র সেনাদল প্রেরণ করেন। সে অভিযানে তারা প্রচুর গনীমত লাভ করেন। আটককৃত বন্দীদের মধ্যে এমন একজন লোক ছিল, যে মুসলিম সৈন্যদের নিকট নিবেদন করলো, আমি তোমাদের শত্রুপক্ষের লোক নই। আমি এখানকার এক মহিলাকে ভালবাসি। তার সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি। সুতরাং আমাকে একটু অবকাশ দাও, আমি তাকে শেষ বারের মত একটি বার দেখে আসি। তারপরে তোমাদের যা মনে চায় তা করো। বর্ণনাকারী বলেন, দেখা গেল লোকটি গিয়ে এক দীর্ঘকায় সুন্দরী মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলছে : ওহে হুবায়শ! “তুমি শান্তিতে থাক, আমার আয়ু শেষ হওয়ার পূর্বে।” এরপর সে এ জাতীয় অর্থবোধক কবিতার দু’টি পংক্তি আবৃত্তি করলো। তখন মহিলাটি তার জবাবে বললো : হ্যাঁ, আমি তো তোমাকে আমার জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছি। এরপর মুসলিম সেনারা তার নিকট এগিয়ে গিয়ে তার গর্দান উড়িয়ে দিল । তখন মহিলাটি দৌড়ে এসে নিহত লোকটির উপর উপুড় হয়ে পড়লো এবং একবার অথবা দু’বার চিৎকার ধ্বনি দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। অভিযান শেষে মুসলিম সেনাগণ ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এ ঘটনা ব্যক্ত করলে তিনি বললেন : “তোমাদের মধ্যে কি একজন দয়ার্দ্র হৃদয় লোকও নেই?”

উয্‌যা মূর্তি ধ্বংসে খালিদ ইবন ওয়ালীদকে প্রেরণ

ইবন জারীর বলেন : উযযা মূর্তিকে ধ্বংস করা হয়েছিল ঐ বছরের রমযান মাস শেষ হওয়ার পাঁচ দিন অবশিষ্ট থাকতে। ইবন ইসহাক বলেন : মক্কা বিজয়ের পর উযযা মূর্তি ধ্বংস করার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) খালিদ ইবন ওয়ালীদকে প্রেরণ করেন। নাখলা নামক স্থানে একটি মন্দিরে উযযা বিগ্রহ স্থাপিত ছিল। কুরায়শ, কিনানা ও মুদার গোত্র এর পূজা করতো। এবং সেবাযত্ন ও পাহারাদারীর দায়িত্ব ছিল বনু হাশিমের মিত্র ও বনূ সুলায়মের শাহাগোত্র বনূ শায়বানের উপর। সুলামী দারোয়ান যখন খালিদ ইবন ওলীদের আগমনবার্তা শুনতে পেল, তখন সে তার তলোয়ার মূর্তির গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে ঐ পাহাড়ে দ্রুত আরোহণ করলো যে পাহাড়ে মূর্তি অবস্থিত ছিল । যেতে যেতে সে নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করলো ।

على خالد القي القناع وشمري فبوئی باشم عاجل او تنصري

ایا عز شدی شدة لا شوي لها ایا عز ان لم تقتلى المرء خالدا

অর্থ : হে উযযা! তুমি খালিদের উপর প্রচণ্ড আঘাত হান, যাতে সে পংগু হয়ে যায় । আর ঘোমটা ফেলে দিয়ে চাদর পেঁচিয়ে লও।

হে উযযা! তুমি যদি খালিদকে হত্যা করতে না পার, তবে দ্রুত পাপের বোঝা কাঁধে নিয়ে ফিরে এসো; অথবা নাসারা-ধর্ম গ্রহণ কর।

খালিদ যখন সেখানে পৌঁছলেন, তখন মূর্তিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে তবে ছাড়লেন এবং কাজ সম্পাদন করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে এলেন। ওয়াকিদী ও প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রমযান মাস শেষ হওয়ার পাঁচ দিন বাকি থাকতে খালিদ উযযা ধ্বংস করার জন্যে গমন করেন। ধ্বংস-ক্রিয়া সম্পন্ন করে ফিরে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে অবহিত করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সেখানে কী দেখলে? খালিদ বললেন, কিছুই দেখিনি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে পুনরায় সেখানে যেতে নির্দেশ দিলেন। খালিদ যখন দ্বিতীয়বার সেখানে গেলেন, তখন দেখলেন, ঐ মন্দিরের মধ্য থেকে কৃষ্ণকায় কোঁকড়ান এলোকেশী এক মহিলা তলোয়ার উঁচু করে বেরিয়ে আসছে এবং কবিতার ছন্দে বলছে :

يا عزي كفر انك لا سبحانك إني رأيت الله قد اهانك

“হে উযযা! আমি তোমার অবাধ্যতার ঘোষণা দিচ্ছি। তোমার পবিত্রতার ঘোষণা দিচ্ছি না। আমি প্রত্যক্ষ করলাম, আল্লাহ্ তোমাকে কিভাবে অপদস্থ করেছেন।”

এরপর খালিদ ঐ মন্দিরও ধ্বংস করে দেন, যাতে উযযার বিগ্রহ ছিল এবং মন্দিরের মালপত্র যা ছিল সব কিছু নিয়ে আসেন। খালিদ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে সমস্ত ঘটনা শুনালে তিনি বললেন : –ঐ হলো উযযা, তার পূজা আর কখনও হবে না। ইমাম বায়হাকী মুহাম্মাদ ইবন আবু বকর ফকীহ– আবুত তুফায়ল থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কা বিজয়ের পর খালিদ ইবন ওলীদকে নাখলায় প্রেরণ করেন। কারণ, তথায় উযযা মূর্তি স্থাপিত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশ পেয়ে তিনি সেখানে গমন করেন। সে মূর্তি তিনটি মূল্যবান কাঠের পায়ার উপর স্থাপিত ছিল। খালিদ ঐ পায়াগুলি কেটে দেন এবং যে ছাদের নীচে মূর্তি ছিল সে ছাদও ধ্বসিয়ে দেন। এরপর তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে সবকিছু অবহিত করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বললেন, পুনরায় ফিরে যাও, তুমি কিছুই করতে পারনি। সুতরাং খালিদ আবার সেখানে ফিরে গেলেন। উযযা মূর্তির সেবায়েতগণ খালিদকে দেখেই ভীত বিহ্বল হয়ে পাহাড়ে গিয়ে উঠলো । পালাবার সময় তারা বলতে লাগলো : ওহে উযযা! ওকে নিশ্চল করে দাও। ওকে অন্ধ করে দাও। যদি তা না পার, তবে নিজে লাঞ্ছিত হয়ে মরে যাও। রাবী বলেন, খালিদ মূর্তির কাছে পৌঁছলে দেখেন, এক উলংগ এলোকেশী নারী, মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে মাথায় ও মুখে মাখছে। খালিদ তাকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করলেন। তারপর তিনি ফিরে এসে নবী করীম (সা)-কে ঘটনা জানালে তিনি বললেন : এটাই প্রকৃত উযযা ।

মক্কায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অবস্থান-কাল

মক্কা বিজয়ের পর রমযান মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো রাসূলুল্লাহ্ (সা) সেখানেই কাটান। এ সময়ে তিনি যে নামায কসর পড়েন ও রোযা রাখেননি এ ব্যাপারে কারও কোন দ্বিমত নেই। এটা সেসব আলেমদের মতের স্বপক্ষে দলীল যারা বলেন, মুসাফির যদি কোথাও অবস্থান (ইকামত) করার দৃঢ় সংকল্প না করে, তবে আঠার দিন পর্যন্ত সে নামায কসর করতে পারবে। অবশ্য এ আলিমদের আর একটি মত যথাস্থানে লিপিবদ্ধ আছে। ইমাম বুখারী আবু নুআয়ম— আনাস ইবন মালিক সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে দশ দিন অবস্থান করেছিলাম। এ সময়ে তিনি নামাযে কসর করতেন। সিহাহূসিত্তার অন্যান্য সংকলকগণ ইয়াহয়া ইব্ন আবু ইসহাক হাদরামী আল-বসরী সূত্রে আনাস (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। বুখারী, আবদান– ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) (মক্কায়) উনিশ দিন অবস্থান করেন এবং দু’রাকআত করে নামায আদায় করেন। এ হাদীছ বুখারী অন্য সূত্রেও বর্ণনা করেছেন। বুখারী ও আবু হুসায়ন উভয়ে এবং আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবন মাজা এ হাদীছটি আসিম ইবন সুলায়মান– ইবন আব্বাস সূত্রে কিছুটা অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন। তবে আবু দাউদের ভাষ্যে অবস্থানকাল সতের দিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আহমদ ইবন ইউনুস– ইবন আব্বাস সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন : আমরা কোন এক সফরে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে উনিশ দিন একই স্থানে অবস্থান করি। তখন আমরা নামাযে কসর করেছি । ইবন আব্বাস (রা) বলেন, এ কারণেই আমরা যখন কোন স্থানে উনিশ দিন পর্যন্ত অবস্থান করি তখন নামায কসর পড়ি। কিন্তু উনিশ দিনের বেশী অবস্থান করলে নামায পুরোপুরি পড়ি । আবু দাউদ ইবরাহীম ইবন মূসা– ইমরান ইবন হুসায়ন সূত্রে বর্ণনা করেন । তিনি বলেছেন : আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে থেকে যুদ্ধ করেছি। মক্কা বিজয়ে তাঁর সাথে থেকেছি। তিনি তথায় আঠার রাত পর্যন্ত অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি দু’রাকআত করে নামায পড়েছেন। তার চেয়ে বেশী পড়েননি। তিনি পরিষ্কার বলে দিতেন : “হে মক্কার অধিবাসীরা! তোমরা নামায চার রাকআত পড় । আমরা তো মুসাফির।” ইমাম তিরমিযী এ হাদীছ আলী ইবন যায়দ ইবন জাদআন থেকে অনুরূপ বর্ণনা করে মন্তব্য করেছেন যে, এ হাদীছ হাসান পর্যায়ের। এরপর ইমাম তিরমিযী এ হাদীছ মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক যুহরী আবদুল্লাহ ইবন আবদুল্লাহ সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কা বিজয়ের পর সেখানে পনের রাত অবস্থান করেন এবং নামাযে কসর করেন। এরপর তিরমিযী বলেন, এ হাদীছ ইবন ইসহাক থেকে একাধিক রাবী বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তারা কেউ ইব্‌ন আব্বাসের উল্লেখ করেননি। ইবন ইদরীস মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক থেকে, তিনি যুহরী ও মুহাম্মাদ ইবন আলী ইবন হুসায়ন, আসিম ইবন আমর ইবন কাতাদা, আবদুল্লাহ্ ইবন আবু বকর, আমর ইবন শুআয়ব ও আরও কতিপয় রাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় পনের রাত অবস্থান করেন ।

মক্কায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কতিপয় নির্দেশ

বুখারী বলেন, আমার নিকট আবদুল্লাহ্ ইবন মুসলিম– আইশার সূত্রে নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেন, অন্য সনদে লায়ছ– আইশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন : উতবা ইবন আবু ওয়াক্কাস তদীয় ভ্রাতা সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাসকে ওসীয়াত করে যান যে, তিনি যেন যামআর বাদীর পুত্রটিকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেন। উবা বলেছিলেন যে, ছেলেটির জন্ম আমারই ঔরসে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিজয়কালে যখন মক্কায় আসেন, তখন সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস এক সুযোগে যামআর বাদীর পুত্রটিকে নিজের আয়ত্বে এনে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হন। তার সাথে যামআর পুত্র আব্দও আসে। সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস দাবী করলেন যে, এ আমার ভাতিজা । আমার ভাই ওসীয়ত করে গিয়েছেন যে, এ সন্তানটি তারই ঔরসজাত। প্রতি উত্তরে আব্‌দ ইবন যামআ বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ আমার ভাই । এ যামআর পুত্র। তার বিছানায় এর জন্ম হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন যামআর বাদীর পুত্রের প্রতি লক্ষ্য করে দেখলেন যে, তার দৈহিক গঠন ও চেহারা উবা ইবন আবু ওয়াক্কাসের সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে আবদ ইবন যামআ! তুমিই এর অধিকারী। এ তোমারই ভাই । কেননা, সে তারই বিছানায় জন্ম গ্রহণ করেছে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সহধর্মিণী সাওদা বিত যামআকে বললেন, তুমি এর থেকে পর্দা করবে। কারণ, তিনি দেখেছেন যে, উতবা ইবন আবু ওয়াক্কাসের সাথে তার সাদৃশ্য রয়েছে। ইবন শিহাব বলেন, আইশা (রা) বলেছেন যে, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : বিছানা যার সন্তান তার, আর ব্যভিচারীর জন্যে পাথর। অর্থাৎ প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড। ইবন শিহাব বলেন, আবূ হুরায়রা এ বাক্যটি প্রায়ই উচ্চঃস্বরে বলতেন। এ হাদীছটি মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী এবং বুখারী ও কুতায়বার সূত্রে লায়ছ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইবন মাজা ও বুখারী মালিক সূত্রে যুহরী থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

এরপর ইমাম বুখারী বলেন, আমাদের নিকট মুহাম্মাদ ইব্‌ন মুকাতিল …- উরওয়া ইবন যুবায়র সূত্রে বর্ণনা করেন যে, বিজয় যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপস্থিত কালে জনৈক মহিলা চুরি করে ধরা পড়ে। এতে তার গোত্রের লোকেরা ভীত হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সুপারিশের জন্যে উসামা ইবন যায়দের কাছে ছুটে আসে। উরওয়া (রা) বলেন, উসামা যখন ঐ মহিলার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে আলাপ করছিল, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি উসামাকে বলেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তির বিধান (হদ) এর ব্যাপারে আমার কাছে সুপারিশ করছো? তখন উসামা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। এরপর সন্ধ্যা হলে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে দণ্ডায়মান হলেন। প্রথমে আল্লাহর যথোপোযুক্ত প্রশংসা করলেন। তারপরে বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহ এ কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে যে, তাদের কোন অভিজাত লোক চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত; কিন্তু কোন দুর্বল লোক চুরি করলে তার উপর দণ্ড প্রয়োগ করতো। “সেই সত্তার কসম! যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন- যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করতো তা হলে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।” তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশক্রমে সে মহিলার হাত কেটে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তার এ তাওবা উত্তম প্রমাণিত হয়েছে এবং অন্য এক পুরুষের সাথে তার বিবাহ হয়েছে। আইশা (রা) বলেন, এরপর সে প্রায়ই আমার কাছে আসতে। এবং আমি তার আবেদন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পেশ করতাম। বুখারী তাঁর গ্রন্থের অন্য স্থানে এবং মুসলিম ইবন ওহবের সূত্রে– আইশা (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

সহীহ মুসলিম গ্রন্থে সাবুরা ইবন মা’বাদ জুহানী সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, বিজয়ের বছর মক্কা প্রবেশকালে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে মুতআ (সাময়িক বিবাহ)-এর অনুমতি দেন। এরপর তার মক্কা থেকে বের হয়ে আসার পূর্বেই এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন। মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, আজকের এই দিন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত মুতআ হারাম ঘোষণা করা হলো। মুসনাদে আহমদ ও সুনান গ্রন্থসমূহের এক বর্ণনা মতে কিয়ামত পর্যন্ত হারাম হওয়ার এ ঘোষণা বিদায় হজ্জে দেয়া হয়েছিল । সহীহ্ মুসলিমে আবু বকর ইবন আবূ শায়বা সূত্রে– সালামা ইবন আওয়া (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ও আওতাসের বছর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে মহিলাদের সাথে মুতআ করার অনুমতি দিয়েছিলেন তিন দিনের জন্যে। এরপর তিনি আমাদেরকে এ থেকে বারণ করে দেন। বায়হাকী বলেন, আওতাসের বছর ও বিজয়ের বছর একই। তাই উক্ত হাদীছ ও সাবুরা বর্ণিত হাদীছ অভিন্ন।

আমি বলি, যে সব আলিম খায়বারের যুদ্ধে মুতআ হারাম হওয়া প্রমাণ করেন তাঁদের মতে মুআ দু’বার মুবাহ করা হয়েছে এবং দু’বার হারাম করা হয়েছে। ইমাম শাফিঈ প্রমুখ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণের অবতারণা করেছেন। কারও কারও মতে দু’ বারের চেয়েও অধিক বার একে মুবাহ ও হারাম করা হয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন। কারও মতে এটা একবারই মুবাহ করার পর হারাম করে দেওয়া হয়েছে। আর তা হয়েছে মক্কা বিজয়ের কালে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, প্রয়োজনের তাকিদে এটা মুবাহ করা হয়েছে। এ মত অনুযায়ী যখনই প্রয়োজন দেখা দেবে তখনই তা মুবাহ হয়ে যাবে। ইমাম আহমদ থেকে এরূপ একটি মতের কথা জানা যায় । কারও কারও মতে মুতআ আদৌ হারাম করা হয়নি; বরং তা এখনও মুবাহ আছে। ইবন আব্বাস এই মত পোষণ করেন বলে প্রসিদ্ধ আছে। এ ছাড়া তার শিষ্যবর্গ এবং কতিপয় সাহাবীও এই মত পোষণ করেন। আহকাম বা বিধি-বিধানের অধ্যায়ই এ আলোচনার উপযুক্ত স্থান।

অনুচ্ছেদ

ইমাম আহমদ বলেন : আমার নিকট আবদুর রাযযাক– মুহাম্মাদ ইবন আসওদ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তাঁর পিতা আসওদ রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বিজয়ের দিন লোকদেরকে বায়আত করতে দেখেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বায়তুল্লাহর করুণ’ এর নিকট তাঁকে সম্মুখে রেখে উপবেশন করেন। এরপর লোকদের নিকট থেকে ইসলাম ও শাহাদতের উপর বায়আত গ্রহণ করেন । রাবী ইবন জুরায়জ তার শায়খ আবদুল্লাহ ইবন উছমানের নিকট জিজ্ঞেস করেন “কিসের শাহাদত?” জবাবে আবদুল্লাহ বলেন, মুহাম্মাদ ইবন আসওদ ইবন খালফ আমাকে জানিয়েছেন যে, তিনি লোকদেরকে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও 19 (111 auty : + al ); 41s 1sa১–এর উপর বায়আত গ্রহণ করেন । আহমদ এ পর্যন্ত এককভাবে বর্ণনা করেছেন। বায়হাকীর বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ছোট ও বড়, নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে আগমন করে। তখন তিনি তাদের থেকে ইসলাম ও শাহাদতের উপর বায়আত গ্রহণ করেন। ইবন জারীর বর্ণনা করেন। এরপর লোকজন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ইসলামের উপর বায়আত গ্রহণের উদ্দেশ্যে মক্কায় সমবেত হয়। আমার জানা তথ্য মতে রাসূলুল্লাহ (সা) সাফা পাহাড়ের উপর অবস্থান নেন। তার থেকে কিছু নীচে উমর ইবন খাত্তাব (রা) ছিলেন । এরপর তিনি লোকজনের কাছ থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা শ্রবণ করা ও সাধ্যমত আনুগত্য করার উপর বায়আত নেন। পুরুষদের থেকে বায়আত নেয়ার পর তিনি মহিলাদের থেকে বায়আত গ্রহণ করেন । মহিলাদের দলে হিন্দু বিন্ত উত্যও ছিল। হামযার প্রতি তার আচরণের ঘটনায় লজ্জিত হয়ে অবগুণ্ঠন টেনে মুখমণ্ডল ঢেকে সে তথায় উপস্থিত হয়। ঐ ঘটনার কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আজ তাকে পাকড়াও করতে পারেন বলে সে আশংকা করছিল । বায়আতের উদ্দেশ্যে মহিলারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আসলে তিনি বলেন : তোমরা আমার নিকট এই মর্মে বায়আত গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবে না।

হিন্দ বললো, আল্লাহর কসম! আপনি আমাদের থেকে এমন অংগীকার নিচ্ছেন, যা পুরুষদের থেকে নেননি।

তোমরা চুরি করবে না।

তখন হিন্দ বললো, আল্লাহর কসম! আমি যে প্রায়ই আবু সুফিয়ানের মাল-সম্পদ না বলে নিয়েছি (তার কি হবে?)। ঐ মাল আমার জন্যে বৈধ কি না তা আমি জানতাম না। আবু সুফিয়ান তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং হিনদের সব কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন, পূর্বে যা কিছু তুমি নিয়েছে তা সব মাফ। তার উপর আমার কোন দাবী নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, কি হে! তুমি কি উত্ত্বার কন্যা হিন্দু নাকি? সে জবাব দিল, হ্যাঁ, তবে পূর্বে যা কিছু হয়েছে, সে জন্যে আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন! আল্লাহ্ আপনার মংগল করবেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন :

ব্যভিচার করবে না। হিনদ বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! স্বাধীন (সম্ভ্রান্ত) মহিলারা কি ব্যভিচার করতে পারে? তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না।

হিন্দ বললো, আমরা তাদেরকে শিশুকালে লালন-পালন করেছি। কিন্তু তারা বড় হবার পর আপনি ও আপনার সাহাবীরা তাদেরকে বদর প্রান্তরে হত্যা করেছেন। এ কথা শুনার পর উমার ইবন খাত্তাব উচ্চঃস্বরে হাসলেন।

–আর জেনে-শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে অপবাদ দেবে না।

হিন্দ বললো, আল্লাহর কসম! মিথ্যা অপবাদ দেওয়া তো অতিশয় নিন্দনীয় ব্যাপার। কখনও কখনও ক্ষমা করে দেওয়াটা অধিকতর উত্তম। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন :

আর মহিলারা যেন আমার আদেশ লংঘন না করে। তখন হিন্দ বললো, অর্থাৎ ভাল কাজে লংঘন করবে না।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন উমরকে বললেন : তুমি এদের থেকে বায়আত গ্রহণ কর এবং তাদের জন্যে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অতিশয় ক্ষমাশীল ও দয়াময়। তারপর উমর (রা) তাদের থেকে বায়আত গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের মধ্য থেকে কোন মহিলার সাথে মুসাফাহা করেননি এবং কাউকে স্পর্শও করেননি। তবে যাদেরকে আল্লাহ্ তাঁর জন্যে হালাল করেছেন কিংবা মুহরিম- তাদের কথা ভিন্ন। সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এ ব্যাপারে আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাত কখনও কোন নারীর হাত স্পর্শ করেনি। এক বর্ণনায় আছে যে, তিনি কেবল মৌখিকভাবে কথার মাধ্যমে মহিলাদের বায়আত করতেন। তিনি বলতেন, একজন মহিলার নিকট আমার কথা বলা, একশ’ মহিলার সাথে কথা বলার সমান। বুখারী ও মুসলিমে আইশা (রা) থেকে বর্ণিত। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিন্ত উতবা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে জানাল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আবু সুফিয়ান একজন অতিশয় কৃপণ লোক। সে আমার ও আমার সন্তানের প্রয়োজনীয় খরচ দেয় na। এ অবস্থায় আমি যদি তার অগোচরে তার মাল-সম্পদ থেকে কিছু সরিয়ে নেই, তাকে কি আমার অন্যায় হবে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : যতটুকু মাল-সম্পদে তোমার ও সন্তানের প্রয়োজন পূরণ হবে, ততটুকু মাল তুমি সঙ্গতভাবে নিতে পার। (ইমাম বায়হাকী ইয়াহয়া ইবন বুকায়রের সূত্রে– আইশা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হিনদ বিনত উতবা এসে বললো : হে আল্লাহর রাসূল! ভূ-পৃষ্ঠে যত তাঁবুবাসী আছে, সেগুলোর মধ্যে আপনার তাঁবুর অধিবাসীদের যে পরিমাণ অপমান ও অকল্যাণ আমি কামনা করতাম, তেমনটি আর কোন তাঁবুবাসীর ক্ষেত্রে করতাম না। পক্ষান্তরে আজকের অবস্থা এই যে, পৃথিবীতে আপনার তাবুর অধিবাসীদের সম্মান ও কল্যাণ কামনার চেয়ে অধিকতর পসন্দনীয় তাঁবুবাসী আর নেই। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : সেই সত্তার কসম! যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তুমি যথার্থই বলেছ। হিন্দ বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আবু সুফিয়ান অত্যধিক কৃপণ। তার সম্পদ থেকে আমি যদি কিছু নেই। তবে কি কোন দোষ হবে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : সঙগত পরিমাণ নিলে কোন দোষ নেই। ইমাম বুখারী এ হাদীছটি ইয়াহয়া ইব্‌ন বুকায়র সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ সংক্রান্ত বর্ণনা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

আবূ দাঊদ বলেন : আমাদের নিকট উছমান ইবন আবূ শায়বা— ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে আর হিজরত নেই, তবে জিহাদ ও নিয়্যত চালু থাকবে। আর যখন তোমাদেরকে জিহাদে যাওয়ার জন্যে আহ্বান করা হয় তখন তোমরা সে আহ্বানে সাড়া দেবে। এ হাদীছ ইমাম বুখারী উছমান ইব্‌ন আবূ শায়বা থেকে এবং ইমাম মুসলিম ইয়াহয়া ইব্‌ন ইয়াহয়া, জারীর থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ বলেন, আমার নিকট আফফান— সাফওয়ান ইবন উমাইয়া সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, সাফওয়ান ইবন উমাইয়াকে জনৈক ব্যক্তি বললো, হিজরতকারী ব্যতীত অন্যরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। সাফওয়ান বলেন, আমি তাকে বললাম, এ কথাটা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত আমি নিজ গৃহে ফিরে যাব না। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে সে বিষয়টির উল্লেখ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : মক্কা বিজয়ের পর হিজরতের আর প্রয়োজন নেই; বরং জিহাদ ও হিজরতের নিয়্যত রাখার প্রয়োজন আছে। আর যখন তোমাদেরকে জিহাদের জন্যে আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা জিহাদে গমন করবে। এ হাদীছ ইমাম আহমদ এককভাবে বর্ণনা করেছেন। বুখারী বলেন : মুহাম্মাদ ইবন আবু বকর, ফুযায়ল ইবন সুলায়মান— ইবন মাসউদ সনদে বর্ণিত, মুজাশি বলেন, আমি আবূ মা’বাদকে হিজরতের উপর বায়আত গ্রহণ করাবার উদ্দেশ্যে নবী করীম (সা)-এর নিকট নিয়ে যাই। তখন তিনি বললেন : যারা ইতিপূর্বে হিজরত করেছে, তাদের মাধ্যমে হিজরতের যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন আমি ইসলাম ও জিহাদের উপর তার বায়আত গ্রহণ করবো। রাবী আবু উছমান নাহদী বলেন : এরপরে আমি আবূ মা’বাদের সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, মুজাশি’ সত্যই বলেছে। অনা সনদে খালিদ আবু উছমান সূত্রে মুজাশি’ থেকে বর্ণিত যে, তিনি তাঁর ভাই মুজালিদকে নিয়ে এসেছিলেন। অপর এক বর্ণনায় ইমাম বুখারী বলেন : আমর ইব্‌ন খালিদ–মুজাশি’ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের পর আমি আমার ভাইকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার ভাইকে আপনার নিকট নিয়ে এসেছি, যেন আপনি তার থেকে হিজরতের উপরে বায়আত গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : হিজরতকারিগণ হিজরতের সমুদয় ছওয়াব লুটে নিয়েছেন, সে সুযোগ আর নেই। আমি বললাম, তা হলে কিসের উপর তার বায়আত গ্রহণ করবেন? তিনি বললেন : আমি তার কাছ থেকে বায়আত গ্রহণ করবো ইসলাম, ঈমান ও জিহাদের উপর । রাবী আবু উছমান বলেন, পরে আমি আবূ মা’বাদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি ছিলেন তাঁদের দু’জনের মধ্যে বয়সে বড়। তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, মুজাশি’ ঠিকই বর্ণনা করেছে। বুখারী বলেন, মুহাম্মাদ ইবন বাশশার– মুজাহিদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবন উমর (রা)-কে জানালাম যে, আমি সিরিয়ায় হিজরত করার সংকল্প করেছি। তিনি বললেন, এখন আর হিজরত নেই। তবে ফিরে গিয়ে চিন্তা করে দেখ- যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখতে পাও, তাই কর, নচেৎ ফিরে থাক। অন্য সনদে আবু নাসর– মুজাহিদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবন উমরকে বললাম। তিনি উত্তর দিলেন : এখন আর হিজরতের প্রয়োজন নেই! অথবা তিনি বলেছেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর যুগের পর হিজরতের প্রয়োজন নেই। এরপর তিনি উল্লিখিত হাদীছের অনুরূপ বর্ণনা করেন । ইসহাক ইবন ইয়াযীদ– আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : মক্কা বিজয়ের পর হিজরতের প্রয়োজন নেই। বুখারী বলেন, ইসহাক ইবন ইয়াযীদ– আতা ইবন আবু রাবাহ্ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উবায়দ ইবন উমায়রকে সাথে নিয়ে আইশা (রা)-এর সাথে সাক্ষাত করি। উবায়দ তাঁকে হিজরত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি বলেন, আজ আর হিজরতের কোন প্রয়োজন নেই। যেহেতু পূর্বে মু’মিনদের এ অবস্থা ছিল যে, ফিনায় পড়ার আশংকায় তারা তাদের দীন-ঈমান রক্ষার জন্যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নিকট (মদীনায়) পালিয়ে যেত। কিন্তু আজ অবস্থা এই যে, আল্লাহ্ ইসলামকে বিজয় দান করেছেন। তাই এখন একজন মু’মিন যেখানে ইচ্ছা করে সেখানেই তার প্রভুর ইবাদত করতে পারে। তবে বর্তমানে জিহাদ ও হিজরতের নিয়্যত করা যেতে পারে।

এ সব হাদীছ ও সাহাবীগণের উক্তি এ কথাই প্রমাণ করে যে, পূর্ণাঙ্গ কিংবা মোটামুটি যাকে হিজরত বলা চলে, তা মক্কা বিজয়ের পর শেষ হয়ে গিয়েছে। কেননা, মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছে। আল্লাহর দীন বিজয় লাভ করেছে এবং ইসলামের রুকন ও ভিত্তিসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে কারণে হিজরতের প্রয়োজনীয়তা আর অবশিষ্ট নেই। তবে প্রতিবেশী অমুসলিম শত্রুদের কারণে এবং তাদের নিকট দীন প্রকাশে শক্তিহীনতার কারণে যদি হিজরত করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে সে অবস্থায় দারুল ইসলামে হিজরত করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে আলিমগণের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। তবে এ হিজরত মর্যাদার দিক দিয়ে কখনই মক্কা বিজয়ের পূর্বেকার হিজরতের মতো হবে না। যেমন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও অর্থ-ব্যয়ের ব্যাপারে নির্দেশ ও কিয়ামত পর্যন্ত চালু রাখার প্রতি উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও তা মক্কা বিজয়ের পূর্বের জিহাদ ও অর্থ-ব্যয়ের সমতুল্য কিছুতেই হবে না। এ সম্পর্কে আল্লাহর বাণী নিম্নরূপঃ

لا يستوى منكم من أنفق من قبل الفتح وقاتل أولئك أعظم درجة من

الذين أنفقوا من بعد وقاتلوا– وك” وعد الله الحسنى

অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়; তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ ওদের অপেক্ষা যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে। তবে আল্লাহ্ উভয়েরই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। (৫৭-হাদীদ : ১০)।

ইমাম আহমদ বলেন : মুহাম্মাদ ইবন জাফর– আবু সাঈদ খুদরী (রা) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন : যখন এ সূরাটি নাযিল হল- (a); a ‘ .131 (যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসলো) তখন রাসূলুল্লাহ (সা) সূরাটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করে বললেন : লোকজন বেশ আছে, আর আমিও আমার সাহাবীরা বেশ আছি। এরপর তিনি আরো বললেন : মক্কা বিজয়ের পর আর হিজরত নেই। তবে জিহাদ ও নিয়্যত আছে। (এ কথা শুনে মারওয়ান তাকে বললো, তুমি মিথ্যা বলছো)। এ সময় তার কাছে রাফি’ ইব্‌ন খাদীজ ও যায়দ ইবন ছাবিত এক সাথে খাটের উপরে বসা ছিলেন। আবু সাঈদ বললেন, এ দু’ব্যক্তি ইচ্ছা করলে এ বিষয়ে আপনাকে বলতে পারবেন। কিন্তু এ লোকের আশংকা আছে যে, সে কথা বললে আপনি তাকে সমাজের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেবেন। আর ঐ লোকের আশংকা আছে যে, আপনি তাকে যাকাত উত্তোলনকারীর পদ থেকে বরখাস্ত করবেন। এ কথা শুনার পর মারওয়ান আবু সাঈদের উপর কোড়া উত্তোলন করলো। তখন তারা দু’জনে এ অবস্থা দেখে বলে ফেললেন- আবু সাঈদ সত্যই বলেছেন। এটা ইমাম আহমদের একক বর্ণনা।

বুখারী বলেন, মূসা ইবন ইসমাঈল– ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন : উমর (রা) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রবীণগণের সাথে আমাকেও অন্তর্ভুক্ত করতেন। এ কারণে কারও কারও অন্তরে ক্ষোভের উদ্রেক হল। একজন তো বলেই ফেললো, আপনি কেন তাকে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করেন : তারমত তো আমাদের ছেলেরাও রয়েছে। উমর (রা) বললেন, সে কেমন লোকদের মধ্য থেকে তা তো তোমরাও জান। সুতরাং এক দিন তিনি তাদেরকে ডাকলেন এবং ইবন আব্বাসকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করলেন। ইবন আব্বাস বলেন, আমি বুঝতে পারলাম । আজকে তিনি আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এ জন্যে যে, তিনি তাদেরকে (আমার বিদ্যা-বুদ্ধি) দেখাবেন। তিনি তাদেরকে বললেন, আল্লাহর বাণী : –এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে তোমরা কী বল? তখন তাঁদের মধ্যে কেউ বললো ও আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসলে আল্লাহর প্রশংসা করতে ও তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যরা চুপ থাকলেন, কিছুই বললেন না। এরপর তিনি আমাকে বললেন, হে ইব্‌ন আব্বাস! তুমিও কি তাই বল? আমি বললাম, জ্বী না। তিনি বললেন, তা হলে তুমি কী বলতে চাও? আমি বললাম, এটা রাসুলুল্লাহ্ (সা)-এর মৃত্যু সংবাদ। আল্লাহ তাকে এ সূরার মাধ্যমে তা জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেছেন : “আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসলে”- এটিই হবে তোমার মৃত্যুর আলামত। “তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর । তিনি তো তওবা কবুলকারী” তখন উমার (রা) বললেন, “এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সে যা বলেছে, আমিও তার বাইরে কিছু জানি না।” এটা বুখারীর একক বর্ণনা। এ ছাড়া আরও একাধিক সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইনতিকালের সময়ের ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি উল্লিখিত ঘটনা বর্ণনা করেন। ইবন আব্বাস ও উমর ইবন খাত্তাবের ন্যায় মুজাহিদ। আবুল আলিয়া যাহহাক প্রমুখও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত হাদীছটি এ ক্ষেত্রে সঠিক নয়। তিনি মুহাম্মাদ ইবন ফুয়ায়ল– আতা– সাঈদ ইবন যুবায়র সনদে ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন : যখন [ ] সূরা নাযিল হল, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : এর মধ্যে আমার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, আমি এ বছরের মধ্যে মারা যাব। এ হাদীছটি ইমাম আহমদ এককভাবে বর্ণনা করেছেন। তার সনদে উল্লিখিত আতা ইবন আবু মুসলিম খুরাসানী একজন দুর্বল রাবী। হাদীছ শাস্ত্রের একাধিক ইমাম তার ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন। হাদীছের মূল বক্তব্যও একান্তই অগ্রহণযোগ্য। বলা হয়েছে তিনি ঐ বছরের মধ্যে ইনতিকাল করবেন। এ কথাটি সম্পূর্ণ ভুল ও বাতিল । কেননা, মক্কা বিজয় হয়েছিল অষ্টম হিজরীর রমযান মাসে। এ ব্যাপারে কারও কোন দ্বিমত নেই। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ইনতিকাল হয়েছিল একাদশ হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে। এ ব্যাপারেও কারও কোন বিরোধ নেই। হাফিয আবুল কাসিম তাবারানী কর্তৃক বর্ণিত হাদীছটিও সমালোচিত হয়েছে । তিনি ইবরাহীম ইবন আহমদ ইবন উমর ওকী সূত্রে– ইবন আব্বাস সূত্রে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, গোটা কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা হল [ ] এ হাদীছের বক্তব্যও অগ্রহণযোগ্য। এর সনদও সমালোচিত। তবে এরূপ ব্যাখ্যাও হতে পারে যে, পূর্ণাংগ সূরা হিসাবে এটাই সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা। তাফসীর গ্রন্থে এ সূরার ব্যাখ্যায় আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বুখারী বলেন, সুলায়মান ইবন হারব, আমর ইবন সালামা সূত্রে বর্ণিত। আইয়ুব বলেন, আবৃ কিলাবা আমাকে বললেন : তুমি আমর ইবন সালামার সাথে সাক্ষাৎ করে তার ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না কেন? আকূ কিলাবা বলেন, এরপর আমি আমর ইবন সালামার সাথে সাক্ষাৎ করে তার ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, উত্তরে আমর বললেন, আমরা মানুষের যাতায়াতের পথে এক ঝর্ণার নিকট বসবাস করতাম। আমাদের পাশ দিয়ে আরোহীরা অতিক্রম করতো। আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করতাম, লোকজনের কী হয়েছে : ঐ সব লোকদের কী অবস্থা? আর ঐ লোকটিরই বা অবস্থা কী? তারা বলতো, সে দাবী করছে যে, তাকে নাকি আল্লাহর রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন এবং এ জাতীয় ওহী প্রেরণ করেছেন। আমি তাদের মুখ থেকে শুনে ওহীর সে সব বাণী মুখস্ত করে ফেলতাম। সেগুলো আমার দিলে যেন গেঁথে থাকতো। আরবরা তাদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি বিজয়ের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। তারা বলতো, তাকে তার গোত্রের লোকদের সাথে বুঝাঁপড়া করার জন্যে ছেড়ে দাও। তিনি যদি তাদের উপর জয়ী হন তবে প্রমাণিত হবে যে, তিনি সত্য নবী। এরপর যখন মক্কা বিজয়ের ঘটনা ঘটলো, তখন প্রতিটি গোত্র ইসলাম গ্রহণের জন্যে এগিয়ে আলো । আমার গোত্রের লোকজন ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বেই আমার পিতা অগ্রগামী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন । ইসলাম গ্রহণ করে বাড়ী ফিরে এসে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমি একজন সত্য নবীর কাছ থেকে তোমাদের নিকট এসেছি। তিনি বলে দিয়েছেন যে, অমুক সময়ে অমুক নামায এবং অমুক সময়ে অমুক নামায আদায় করবে। যখন নামাযের সময় হবে তখন তোমাদের একজন আযান দেবে এবং যার অধিক পরিমাণ কুরআন মুখস্থ আছে সে ইমামতি করবে। তারা উপযুক্ত ইমাম খুঁজতে লাগলো। কিন্তু দেখা গেলো, আমার চেয়ে অধিক কুরআন মুখস্তকারী আর কেউ নেই। কারণ, আমি পূর্বেই বিভিন্ন কাফেলার থেকে কুরআন মুখস্ত করেছিলাম। সুতরাং তারা আমাকেই ইমামতির জন্যে আগে বাড়িয়ে দিল। অথচ আমি তখন মাত্র ছয় কি সাত বছরের বালক। আমার পরিধানে ছিল একটি চাদর মাত্র। যখন সিজদায় যেতাম তখন চাদরটি উপরে উঠে যেত। এ দেখে গোত্রের এক মহিলা বললো, তোমরা তোমাদের ইমামের পশ্চাৎভাগ আমাদের দৃষ্টি থেকে আবৃত করে রাখনা কেন? তখন তারা কাপড় কিনে আমাকে একটি জামা তৈরি করে দিল । ঐ জামা পেয়ে আমি এতটা খুশী হলাম, যতটা খুশী অন্য কিছুতে হইনি। এ হাদীছ শুধু বুখারীতে আছে, মুসলিমে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *