৮ম হিজরীর ঘটনাবলী
আমর ইবনুল আস, খালিদ ইবন আল-ওয়ালীদ ও উছমান ইবন তালহার ইসলাম গ্রহণ
ইবন ইসহাকের বরাতে পঞ্চম হিজরীর ঘটনাবলীর আলোচনায় এর আংশিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
হাফিয বায়হাকী– আমর ইবনুল আস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “আমি ছিলাম ইসলামের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন।’ মুশরিকদের পক্ষে বদরে উপস্থিত ছিলাম; কিন্তু সে যুদ্ধে প্রাণে রক্ষা পেয়ে যাই। এরপর উহুদে অংশ নেই এখানেও রক্ষা পেয়ে যাই। এরপর খন্দকের যুদ্ধে হাযির হই। তখনও বেঁচে যাই। মনে মনে বলতে লাগলাম, কত আর অপমানিত হব। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদ কুরায়শদের উপর অবশ্যই বিজয় লাভ করবেন। তখন আমার যা কিছু আছে তা নিয়ে কয়েক সদস্যের একটি ক্ষুদ্র দলের সাথে মিশে গেলাম এবং লোকজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করাও কমিয়ে দিলাম। যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) হুদায়বিয়া গমন করলেন ও সন্ধি করে ফিরলেন এবং কুরায়শরাও মক্কায় প্রত্যাবর্তন করল, তখন আমি বলতে লাগলাম, “আগামী বছর মুহাম্মাদ (সা) তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে বিজয়ীর বেশে মক্কা প্রবেশ করবেন। তাই মক্কা বা তায়েফ কোথায়ও অবস্থানের জন্য অনুকূল থাকবে না। ইসলামের জন্যে বেরিয়ে পড়াই এখন উত্তম। আর আমি বুঝি ইসলাম থেকে বহু পিছনে পড়ে রয়েছি। আবার মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যদি কুরায়শরা সকলেই মুসলমান হয়ে যায় তাহলেও আমি মুসলমান হব না। তাই আমি মক্কা আগমন করলাম এবং আমার গোত্রের কিছু লোককে একত্রিত করলাম! আর তারাও আমার সিদ্ধান্তে একাত্মতা ঘোষণা করল । তারা আমার অত্যন্ত অনুগত ছিল। আর কোন সমস্যা দেখা দিলে তারা আমাকেই পুরোভাগে রাখতো। একদিন তাদেরকে আমি বললাম, তোমরা আমাকে তোমাদের মাঝে কিরূপ মনে কর? তারা বলল, “আপনি আমাদের মাঝে বুদ্ধিমান এবং জীবন রক্ষার এবং সাফল্য অর্জনে আপনিই আমাদের প্রধান।” তিনি বলেন, “আমি তাদেরকে বললাম, আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদের ব্যাপারটি এখন আমাদের কাছে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং তার ব্যাপারটি আমাদের সমস্ত কাজ কারবারকে দারুণ প্রভাবিত করছে। সুতরাং আমি তোমাদের কাছে একটি প্রস্তাব রাখতে চাই। তারা বলল, সেটা কী? আমি বললাম, চল, আমরা নাজ্জাশীর সাথে যোগ দেই এবং তার সাথে আমরা থাকি। যদি মুহাম্মাদ বিজয় লাভ করেন, তাহলে আমরা নাজ্জাশীর কাছে থাকব এবং নাজ্জাশীর অধীনে থাকব যা আমাদের জন্যে মুহাম্মদের অধীনে থাকার চাইতে অনেকগুণে ভাল। আর যদি কুরায়শরা জয়লাভ করে, তাহলে আমরা যে তাদের সংগে আছি এটা তো তারা জানেই। তারা সমস্বরে বলল, এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমি আবার বললাম, চল যাওয়ার কালে নাজ্জাশীর দরবারে আমাদের দেশ হতে কিছু উপঢৌকন নিয়ে যাই। আমাদের দেশ থেকে যেসব হাদিয়া সাধারণত ঐ দেশে যায় এগুলোর মধ্যে চামড়াই হল প্রধান ও তাঁর কাছে অতিপ্রিয়। এই সিদ্ধান্ত মুতাবিক আমরা বহু চামড়া সংগ্রহ করলাম এবং বের হয়ে পড়লাম ও নাজ্জাশীর ওখানে গিয়ে পৌঁছলাম। আল্লাহর শপথ, আমরা যখন তার কাছে পৌঁছলাম, তখন সেখানে ছিল আমর ইবন উমাইয়া আদ-দিমারী। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে একটি পত্র সহকারে নাজ্জাশীর নিকট প্রেরণ করেছিলেন তাতে আবু সুফিয়ান (রা)-এর কন্যা উম্মে হাবীবার বিয়ের প্রস্তাব ছিল। তারপর তিনি নাজ্জাশীর কাছে গেলেন এবং পরে বের হয়ে আসলেন। আমি আমার সাথীদেরকে বললাম, ইনি হচ্ছেন আমর ইবন উমাইয়া আদ-দিমারী। যদি আমি কিছুক্ষণ পূর্বে নাজ্জাশীর কাছে প্রবেশ করতে পারতাম এবং তাকে বলতে পারতাম তাহলে তিনি তাকে আমার হাতে সোপর্দ করতেন এবং আমি তাকে হত্যা করতে পারতাম। যদি আমি তা করতে পারতাম। তাহলে কুরায়শরা আমাদের প্রতি প্রসন্ন হত। আমি তাদের থেকে বাহবা পেতাম এবং মুহাম্মাদের দূতকে হত্যা করতে পারতাম। এরপর আমি নাজ্জাশীর কাছে প্রবেশ করলাম এবং আমাদের প্রথা অনুযায়ী তাকে সিজদা করলাম। তিনি বললেন, স্বাগতম স্বাগতম হে আমার বন্ধু! তোমার দেশ হতে কি কোন হাদিয়া নিয়ে এসেছ? আমি বললাম, জ্বী হ্যাঁ, রাজন! আপনার জন্য অনেকগুলো চামড়া হাদিয়া স্বরূপ নিয়ে এসেছি। তারপর এগুলো আমি তাঁর কাছে পেশ করলাম। তিনি এগুলো খুবই পসন্দ করলেন এবং তার সভাসদদের মধ্যেও কিছুটা ভাগ করে দিলেন। আর বাকীগুলো একটি স্থানে রাখতে বলেন এবং তালিকাভুক্ত করে সংরক্ষণের জন্যে নির্দেশ দিলেন। যখন আমি তাকে খোশ মেজাযে দেখতে পেলাম তখন বললাম, রাজন! আমি একটি লোককে দেখতে পেলাম আপনার কাছ থেকে বের হয়ে গেল। সে আমাদের শত্রুর দূত। সেই শত্রু আমাদের উপর যুলুম করেছে এবং আমাদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করেছে। তাই লোকটাকে আমার হাতে তুলে দিন যাতে করে আমি তাকে হত্যা করতে পারি। এ কথা শুনে নাজ্জাশী রেগে গেলেন এবং আমার উপর হাত উঠালেন। তিনি আমার নাকে এত জোরে আঘাত করলেন যে, আমার মনে হয়েছিল যেন তা ভেঙ্গে গেছে। নাক দিয়ে জোরে রক্ত পড়তে লাগল । আর আমি আমার কাপড় দ্বারা তা মুছতে লাগলাম। আমি এত অপমানিত বোধ করলাম যে, যদি আমার জন্যে ভূমি বিদীর্ণ হয়ে যেত তাহলে আমি মাটির ভিতর ঢুকে পড়তাম। এরপর আমি বললাম, হে রাজন! যদি আমি ধারণা করতে পারতাম যে, আমি যা বলেছি তাতে আপনি ক্ষুদ্ধ হবেন, তাহলে আমি কোনদিনও এ কথা মুখে উচ্চারণ করতাম না। নাজ্জাশী তাতে একটু লজ্জিত হলেন এবং বললেন, হে আমর! তুমি আমার কাছে আবেদন করছ এমন লোকের দূতকে হত্যা করার জন্যে, তোমার হাতে তুলে দেয়ার জন্যে যার কাছে নামুসে-আকবর’ আসা যাওয়া করেন। যেমন তিনি আসা যাওয়া করতেন হযরত মূসা (আ)-এর কাছে এবং যিনি হযরত ঈসা (আ)-এর কাছেও আসতেন। আমর বলেন, এরপর আল্লাহ তা’আলা আমার অন্তরে যা কিছু ছিল তা পরিবর্তন করে দিলেন। আমি আমার নিজেকে সম্বোধন করে বলতে লাগলাম, আরব ও অনারব সকলেই যে সত্যটি উপলব্ধি করেছে, তুমি তার বিরোধিতা করছ? এরপর আমি বাদশাকে বললাম, হে বাদশা, আপনি কি এটার সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছেন? তিনি বললেন, “হা, হে আমর! আমি এটা সম্পর্কে আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দিচ্ছি। সুতরাং তুমি আমার অনুকরণ কর এবং তার আনুগত্য স্বীকার করে নাও। কেননা, আল্লাহর শপথ! তিনি সত্যের উপর রয়েছেন। আর যারা তার বিরোধিতা করছে তাদের উপর তিনি জয়লাভ করবেন। যেমন মূসা (আ) ফিরআন ও তার সৈন্যদলের উপর জয়লাভ করেছিলেন। আমি বললাম, আপনি কি আমার ইসলামের বায়আত গ্রহণ করবেন? তিনি বললেন, “হ্যাঁ, এবং এ বলে তাঁর হস্ত প্রসারিত করেন। আর আমাকে ইসলামের বাইয়াত গ্রহণ করান। এরপর তিনি একটি চিলিমচী চেয়ে পাঠালেন এবং আমার রক্ত ধুয়ে দিলেন। আর আমাকে উত্তম জামা-কাপড় পরতে দিলেন। আমার কাপড়গুলো রক্তে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। আমি সেগুলো ফেলে দিলাম। এরপর আমি আমার সাথীদের কাছে ফিরে আসলাম। তারা আমার পরনে নাজ্জাশী প্রদত্ত জামা-কাপড় দেখতে পেয়ে খুশী হলো এবং বললো, তুমি কি তোমার বন্ধুর নিকট কাক্ষিত বস্তুটি হাসিল করতে পেরেছ? উত্তরে আমি তাদেরকে বললাম, “প্রথমবারে তার কাছে এ ব্যাপারে কথা বলাটা ভাল মনে করিনি। পুনরায় তার কাছে যাব।” তারা বলল, “তুমি যা ভাল মনে করে তাই করবে। এরপর আমি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছে যেন আমি অন্য কোন দরকারে কোথায় যাচ্ছি। সুতরাং আমি জাহাজ ঘাটের দিকে অগ্রসর হলাম, লক্ষ্য করলাম একটি জাহাজ যাত্রীতে পূর্ণ হয়ে গেছে ও ছেড়ে যাচ্ছে। আমি যাত্রীদের সাথে জাহাজে উঠলাম। মাল্লারা জাহাজ ছেড়ে দিল। যখন তারা দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি অবতরণস্থলে পৌঁছলো তখন আমি জাহাজ থেকে অবতরণ করলাম। আমার সাথে আমার পথ-খরচের অর্থ-সম্পদ ছিল। আমি একটি উট খরিদ করলাম এবং মদীনার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লাম। মারুয যাহরান নামক স্থানে গিয়ে আমি পৌঁছলাম। তারপরেও চলতে লাগলাম। যখন আল-হুঁদা নামক স্থানে পৌঁছলাম তখন দেখি দুই ব্যক্তি আমার কিছুক্ষণ পূর্বে সেখানে পৌঁছেছে এবং সেখানে অবতরণের ইচ্ছা পোষণ করছে। তাদের একজন তাবুর ভিতরে প্রবেশ করেছে এবং অন্য একজন দুইটি যান বাহনকে ধরে রয়েছে। এরপর আমি তাকিয়ে দেখি খালিদ ইব্ন ওয়ালীদকে। তাকে বললাম, “কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছ? সে বলল, “মুহাম্মাদের কাছে লোকজন ইসলাম গ্রহণ করে চলছে। সুরুচিপূর্ণ কেউ একটা বাকী নেই। আল্লাহর শপথ! যদি আমি নিষ্ক্রিয় থাকি তাহলে মুহাম্মাদ (সা) আমাদেরকে এমনভাবে ধরবে, যেমন হায়েনাকে তার গুহায় আটক করা হয়। আমি বললাম, আল্লাহর শপথ! আমিও মুহাম্মাদ (সা)-এর উদ্দেশ্যে যেতে এবং ইসলাম গ্রহণ করতে চাই। উছমান ইব্ন তালহা (রা) তাবু থেকে বের হয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন। আমরা সকলেই এ মানযিলে অবতরণ ও অবস্থান করলাম। এরপর আমরা একত্রে মদীনায় আগমন করলাম। মদীনায় আমরা যত লোকের সাথে সাক্ষাত করেছি আবু উতবা এর ন্যায় আর কেউ আমাদেরকে এত উচ্চস্বরে স্বাগত জানায়নি। দেখামাত্র তিনি উচ্চস্বরে ইয়া রাবাহ! ইয়া রাবাহ! ইয়া রাবাহ! স্বাগতঃ ধ্বনি বলতে লাগলেন। তাঁর কথায় আমরা শুভ লক্ষণ মনে করলাম এবং অত্যন্ত খুশী হলাম। এরপর তিনি আমাদের দিকে তাকালেন এবং তাকে বলতে শুনলাম। তিনি বলছিলেন, “এ দুজনের ইসলাম গ্রহণের পর নেতৃত্ব মক্কায় চলে যাচ্ছে।” এ দুজন দ্বারা আমাকে এবং খালিদ ইবন ওয়ালিদকে বুঝাতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি দৌড়িয়ে মসজিদে চলে গেলেন। আমি ধারণা করলাম যে, সম্ভবত তিনি আমাদের আগমনের সংবাদ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে জানাবার জন্যে গিয়েছেন। আমি যা ধারণা করেছিলাম তা-ই হল। আমরা হারায় অবতরণ করলাম ও আমাদের উত্তম পোষাক পরিধান করলাম। এরপর আসরের সালাতের জন্যে আযান দেওয়া হয়। আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দিকে ধীর পদে অগ্রসর হলাম। তার চেহারা ছিল উজ্জ্বল। মুসলমানগণ চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে রেখেছেন। আমাদের ইসলাম গ্রহণে তারা অত্যন্ত খুশী হলেন। এরপর খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) এগিয়ে আসলেন এবং বায়আত হলেন। এরপর উছমান ইবন তালহা (রা) এগিয়ে আসলেন। তিনিও বায়আত হলেন। এরপর আমি অগ্রসর হলাম। আল্লাহর শপথ! আমি তার সামনে বসার পর তার দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না। তারপর আমি বায়আত গ্রহণ করলাম এ শর্তে যে, আমি পূর্বে যা গুনাহ করেছি তা ক্ষমা করে দেওয়া হবে, আর যা এখন করছি তার জন্যে আমাকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “ইসলাম তার পূর্বের সব কিছু মিটিয়ে দেয় আর হিজরতও তার পূর্বের সবকিছু মিটিয়ে দেয়।” আল্লাহর শপথ! যতদিন থেকে আমরা মুসলমান হয়েছি আমাদের দলের কাউকে দলীয় কাজে আমার ও খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা)-এর ন্যায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) বেশী মর্যাদা দান করেননি। এ মাযিলে আমরা হযরত আবু বকর (রা)-এর সান্নিধ্যে ছিলাম এবং হযরত উমর (রা)-এর নিকটবর্তী ছিলাম। তবে উমর (রা) খালিদ (রা)-এর ক্ষেত্রে মৃদু ভৎর্সনাকারীর ন্যায় ছিলেন। ওয়াকিদীর ওস্তাদ আবদুল হামীদও– আমর ইবন আল-আস (রা) হতে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
আল্লামা ইব্ন কাছীর (র) বলেন, মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকও অনুরূপভাবে– আমর ইবন আল আস (রা) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আবু রাফি’ নিহত হবার পর ৫ম হিজরীতে সংঘটিত ঘটনাদিরও একটি বর্ণনা দেন। তবে ওয়াকিদীর বর্ণনা বিস্তারিত ও অধিকতর প্রাণবন্ত। তিনি আমর (রা) খালিদ (রা) ও উছমান ইবন তালহা (রা)-এর আগমনের তারিখ ৮ম হিজরীর সফর মাসের ১ তারিখ বলে উল্লেখ করেছেন। মুসলিম শরীফে হযরত আমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সুমধুর ব্যবহার এবং মৃত্যুর অবস্থা ও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ইনতিকালের পর কর্তব্য সম্পাদনকালে ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্যে অনুশোচনা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে।
খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ
ওয়াকিদী– খালিদ ইব্ন ওয়ালীদ (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা যখন আমার প্রতি কল্যাণের ইচ্ছা করলেন, তখন আমার অন্তরে ইসলামের প্রতি ভালবাসা ঢেলে দিলেন ও আমাকে সঠিক পথ অবলম্বনের তাওফীক দিলেন। মনে মনে আমি বলতে লাগলাম, মুহাম্মাদ (সা)-এর সব ঘটনাইতো অবলোকন করলাম প্রত্যেকটি ঘটনাতেই তিনি সফলকাম। তবে আমি কেন ভ্রান্ত পথে চলছি। মুহাম্মাদ (সা) অবশ্য অচিরেই জয়লাভ করবেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন হুদায়বিয়ায় আগমন করেন তখন আমি মুশরিকদের সৈন্য দলকে নিয়ে উসফানে যাই। সেখানে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তার সাহাবীদের সাথে আমাদের সাক্ষাত হয়। আমি তার মুকাবিলায় দাঁড়ালাম এবং তাঁর সামনে বাধার সৃষ্টি করলাম তখন তিনি আমাদের সামনেই তাঁর সাহাবীগণকে নিয়ে যুহরের সালাত আদায় করেন। আমরা তখন তাদের উপর হামলা করতে মনস্থ করলাম; কিন্তু তিনি আমাদের প্রতি হামলার আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। আর এটাতে ছিল মহাকল্যাণ। তবে তিনি আমাদের মনোভাব আঁচ করতে পেরে তার সাথীবর্গকে নিয়ে আসরের সালাত, সালাতে-খাওফ’ হিসেবে আদায় করলেন। এটা আমাদের মাঝে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করল। আমি মনে মনে বললাম, ইনি তো অত্যন্ত সুরক্ষিত মনে হচ্ছে। তাই আমরা সরে দাঁড়ালাম। তিনিও আমাদের সেনাবাহিনীর গতিপথ থেকে অন্য দিকে ফিরলেন ও ডান দিকের রাস্তা ধরলেন। যখন তিনি হুদায়বিয়ায় কুরায়শদের সাথে সন্ধি করলেন এবং কুরায়শরা তাকে এবার চলে যেতে ও পরের বছর আগমন করতে অনুমতি দিল, তখন আমি মনে মনে বললাম, এখন আর কি বাকী থাকল? এখন আমি কোথায় যাব? নাজ্জাশীর কাছে? তিনিত মুহাম্মাদের আনুগত্য অবলম্বন করেছেন এবং মুহাম্মাদের সাহাবীগণ তার কাছে নিরাপদে রয়েছেন। তাহলে কি হিরাক্লিয়াসের কাছে চলে যাব? তাহলেত নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে খৃস্টান কিংবা ইয়াহুদী হতে হবে। তাহলে কি আমি অনারব দেশে বসবাস করব? অথবা আমার দেশেই আমি অবশিষ্ট লোকদের সাথে থেকে যাবো? এরূপ চিন্তা ভাবনার মধ্যে ‘আমি দিন কাটাতে লাগলাম। এর মধ্যে কাযার উমরা পালনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কা প্রবেশ করলেন। আমি আত্মগোপন করলাম। তাঁর প্রবেশ করার দৃশ্যটি আমি অবলোকন করলাম না। আমার ভাই ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে কাযার উমরা পালন করার জন্যে মক্কা প্রবেশ করে। সে আমার খোঁজ করল; কিন্তু সে আমাকে পেল না। এরপর সে আমাকে একটি পত্র লিখল। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ : “পরম দাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। বাদ সংবাদ এই; ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করার তোমার অভিমত ও সিদ্ধান্তে আমি অত্যন্ত অবাক বোধ করছি। তোমার বুদ্ধিমত্তার আশ্রয় গ্রহণ কর। ইসলামের মত ব্যাপার কি কারো কাছে অবিদিত থাকতে পারে? তোমার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন। আমাকে বলেছেন, খালিদ কোথায়? আমি প্রতি উত্তরে বলেছি, আল্লাহ্ তাকে আসার তাওফীক দেবেন। তিনি বলেন, তার মত লোক কি ইসলামকে উপেক্ষা করতে পারে? নিজের শৌর্য-বীর্যের মোহ ও অহংকার ছেড়ে যদি সে মুসলমানদের সাথে মিশে যেত তাহলে এটা তার জন্যে মঙ্গলজনক হত। আর আমরা তাকে অন্যের চাইতে বেশী মর্যাদা দিতাম।” হে আমার ভাই! তোমার যেসব সুযোগ সুবিধা চলে গেছে সে সবের ক্ষতি পুষিয়ে নাও।”
খালিদ ইব্ন ওয়ালীদ (রা) বলেন, “যখন আমার ভাইয়ের পত্র আমার হস্তগত হল, তখন আমি ঘর থেকে বের হবার উৎসাহ পেলাম। ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পেল। আমরা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রশ্ন আমাকে আরো বেশী খুশী করে। আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি যেন একটি অনুর্বর ও সংকীর্ণ ভূমিতে অবস্থান করছি। এরপর আমি একটি বিস্তীর্ণ চির সবুজ ভূমিতে নেমে এসেছি। আমি মনে মনে বললাম, এটা একটি স্বপ্ন বটে। যখন আমি মদীনায় আসলাম, মনে করলাম যে, আমি আবু বকর (রা)-এর কাছে এ স্বপ্নের কথা উল্লেখ করব। আবু বকর (রা) বললেন, “তোমার বিস্তীর্ণ সবুজ ভূমিতে নেমে আসার অর্থ হচ্ছে, ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে তোমার আশ্রয় নেয়ার জন্যে আল্লাহ তোমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন। আর সংকীর্ণতার অর্থ হচ্ছে তোমার শেরেকী ও কুফরীতে লিপ্ত থাকা।” খালিদ বলেন, “যখন আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে যাওয়ার সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলাম তখন ভাবলাম, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে যেতে কে আমার সাথী হবে? এরপর আমি সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার সাথে সাক্ষাৎ করলাম। আমি বললাম, হে ওহাবের পিতা! তুমিত আমাদের করুণ অবস্থা দেখতেই পাচ্ছ। আমরা পেষকদন্তের ন্যায় । মুহাম্মাদ আরব ও অনারবের উপর বিজয় লাভ করেছেন। অমিরা যদি মুহাম্মাদের দলভুক্ত হই এবং তার আনুগত্য স্বীকার করি তাহলে মুহাম্মাদের মর্যাদাই হবে আমাদের মর্যাদা। কিন্তু সে কঠোরভাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল এবং বলল, “আমি ব্যতীত যদি আর কেউ মুসলমান হওয়া ছাড়া বাকী না থাকে তবু কখনও আমি তাঁর আনুগত্য স্বীকার করব না।” একথা শোনার পর আমি তার থেকে বিদায় নিলাম এবং নিজের মনে বললাম, এ এমন একজন লোক যার ভাই ও পিতা বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছে। এরপর আমি ইকরামা ইবন আবু জাহলর সাথে সাক্ষাত করলাম এবং সাফওয়ানকে যা বলেছিলাম তাকেও অনুরূপ বললাম; কিন্তু সেও সাফওয়ানের ন্যায় জবাব দিল। এরপর আমি মনে মনে বললাম, “এটা গোপন থাকাই আমার জন্যে ভাল । আমি এটা আর কারো কাছে উল্লেখ করব না। আমি আমার ঘরে গেলাম এবং বাহন প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলাম। আমি সাওয়ারী নিয়ে বের হয়ে পড়লাম এবং উছমান ইবন তালহার সাথে সাক্ষাত করলাম। মনে মনে বলতে লাগলাম, ইনিত আমার বন্ধুই, যা ইচ্ছে তার কাছে উল্লেখ করতে পারি। এরপর তার বাপ দাদাদেরও নিহত হওয়ার বিষয়টি স্মরণে আসল তখন তার কাছে সব কিছু উল্লেখ করা সমীচীন মনে করলাম না। আবার মনে মনে ভাবলাম । এতে আমার কি? এখনই আমি চলে যাচ্ছি। কাজেই আমি তার কাছে উল্লেখ করব যা হবার হবে। এরপর আমি বললাম, “দেখ আমরা গর্তের শিয়ালের ন্যায়, যদি এ গর্তে বেশী পরিমাণে পানি ঢালা হয় তাহলে আমরা বের হয়ে আসতে বাধ্য হবো। আমার পূর্বের দুই বন্ধুর কাছে যা বলেছিলাম তৃতীয় বন্ধুর কাছেও তাই বললাম। এবং তিনি সাথে সাথেই আমার অনুকূলে সাড়া দিলেন। তাকে আমি বললাম, আজকে আমি এখানে আছি। আগামী কাল ভোরে মুহাম্মদের কাছে পৌঁছার ইচ্ছা রাখি। আমার সাওয়ারী তৈরী রয়েছে। ইয়াজিজে পৌঁছার জন্যে আমি ও আমার বন্ধুটি তৈরী হতে লাগলাম। সিদ্ধান্ত হল সে আমার পূর্বেই পৌঁছলে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। আর আমি তার আগে পৌঁছলে আমি তার জন্যে অপেক্ষা করব। এরপর আমরা শেষরাতে সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। তখনও ভোর হয়নি। ইয়াজিজে আমরা একে অন্যের সাথে মিলিত হলাম। আমরা আল-হুঁদায় পৌঁছলাম এবং সেখানে আমর ইবনুল আস (রা)-কে দেখতে পেলাম। আমর বললেন, “তোমাদেরকে স্বাগতম।” আমরা বললাম, “তোমাকে স্বাগতম।” আমর (রা) বললেন, “তোমাদের গন্তব্যস্থল কোথায়? আমরা বললাম, “তুমি কিসের অভিযানে বের হয়েছ?” তিনি বললেন, “তোমরা কিসের অভিযানে বের হয়েছ?” আমরা বললাম, “ইসলামে প্রবেশ করার জন্যে এবং মুহাম্মাদের আনুগত্য স্বীকার করার জন্যে আমরা এসেছি।” তিনি বললেন, “ঐ একই উদ্দেশ্যে আমিও এসেছি।” আমরা সকলে মিলে ভোরে মদীনায় প্রবেশ করলাম । হারায় আমাদের কাফেলা থামল। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আমাদের আগমনের সংবাদ দেওয়া হল । তিনি আমাদের আগমনে খুশী হলেন। আমি আমার ভাল জামা কাপড় পরিধান করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমতে পৌঁছার জন্যে রওয়ানা হলাম। আমার ভাই আমার সাথে সাক্ষাত করলেন এবং বললেন, তাড়া–তাড়ি কর, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তোমার আগমনের খবর দেওয়া হয়েছে। তোমার আগমনে তিনি খুশী হয়েছেন। তিনি তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাড়াতাড়ি চল। আমি রাসূলুল্লাহ (সা)
৪১৮
-এর দরবারে পৌঁছলাম। তিনি আমাকে দেখে মুচকি হাসি হাসলেন। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং তাকে নবী বলে উল্লেখ করে সালাম দিলাম। প্রসন্ন বদনে তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন। এরপর আমি বললাম, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “এসো এসো।” এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আল্লাহর জন্যে সমস্ত প্রশংসা যিনি তোমাকে হিদায়াত দান করেছেন। তোমার বুদ্ধিমত্তার উপর আমার আস্থা ছিল। আমি আশা করতাম যে, তোমার বুদ্ধি বিবেচনা তোমাকে কল্যাণের দিকে পরিচালিত করবে। আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনার মাহাত্ম আমি উপলব্ধি করেছিলাম ঠিকই; কিন্তু বিদ্বেষবশত সত্যের বিরোধিতা করে আপনার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানগুলোতে আমি অংশ নিয়েছিলাম। আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করুন আল্লাহ্ তা’আলা যেন আমাকে মাফ করে দেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “পূর্বের সব গুনাহ্ ইসলাম মিটিয়ে দেয়। আমি বললাম, এরপরও আপনি একটু দু’আ করুন ইয়া রাসূলাল্লাহ্! রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে আল্লহ্ আল্লাহর রাস্তা থেকে বিরত করণজনিত খালিদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করুন! খালিদ (রা) বলেন, তারপর উছমান ও আমর অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করলেন। তিনি আরো বলেন, আমাদের এ আগমন ছিল ৮ম হিজরীর সফর মাসে। আর তার গোষ্ঠির অন্য কোন সাহাবীকেই রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সমতুল্য মনে করতেন না।
বনূ হাওয়াযিনের প্রতি প্রেরিত শুজা ইবন ওহাব আল-আসাদীর অভিযান
ওয়াকিদী–উমর ইবনুল হাকাম (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ২৪ জনের একটি দলকে শুজা ইবন ওহাব (রা)-এর নেতৃত্বে বনূ হাওয়াযিনের প্রতি প্রেরণ করেন এবং তাদের উপর অতর্কিতে হামলা করার নির্দেশ দেন। সে মতে তিনি বের হয়ে পড়লেন। তিনি রাতে ভ্রমণ করতেন এবং দিনে শক্রর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্যে ওঁৎপেতে থাকতেন। তিনি শত্রুর কাছে আসলেন এবং তাদের প্রতি আক্রমণ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর আসহাবকে নির্দেশ প্রদান করতেন যেন তারা শত্রুর পশ্চাদ্ধাবনে বাড়াবাড়ি না করেন। তারা প্রচুর উট ছাগল লাভ করলেন। এগুলোকে তারা হাঁকিয়ে নিয়ে মদীনায় এসে পৌঁছলেন। তাঁদের প্রত্যেকের অংশে পড়েছিল ১৫টি করে উট। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তারা কিছু সংখ্যক বাদী–দাসীও লাভ করেছিলেন । দলপতি তাদের মধ্য হতে একটি সুন্দরী নারীকে তার নিজের জন্যে পসন্দ করেছিলেন। ঐ সম্প্রদায়ের লোকজন ইসলাম গ্রহণ করে। তাদেরকে ফেরত প্রদানের ব্যাপারে দলপতি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে পরামর্শ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাতে সম্মতি দিলেন। তাই তাদের সকলকে ফেরত দেওয়া হল। আর দলপতির কাছে যে দাসীটি ছিল তাকে ইখতিয়ার দেওয়া হয়। সে তার কাছে থাকাটাই পসন্দ করে। এ অভিযান সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র)– আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “একদা রাসূলুল্লাহ্ (সা) নজদের দিকে একটি ক্ষুদ্র অভিযান প্রেরণ করেন। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা)ও ছিলেন। তিনি বলেন, “এ অভিযানে আমরা অনেক উট লাভ করেছিলাম এবং আমাদের প্রত্যেকের অংশে উট পড়েছিল ১২টি করে। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের প্রত্যেককে একটি করে অতিরিক্ত উটও প্রদান করেছিলেন।” ইমাম মালিক (র)-এর বরাতে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও এ বর্ণনাটি পাওয়া যায়। আবার মুসলিম ও এককভাবে আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা) হতে অনুরূপ বর্ণনা করেন। আবু দাউদ (র)— আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) নজদের দিকে একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল প্রেরণ করেন। আমিও এ অভিযানে অংশ নিয়েছিলাম। আমরা বহু সম্পদ লাভ করেছিলাম। আমাদের নেতা আমাদের প্রত্যেককে একটি একটি করে উট বেশি প্রদান করলেন। এরপর আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে আগমন করলাম। তিনি আমাদের মাঝে গণীমতের মাল বন্টন করেন। খুমুস পৃথক করার পর আমাদের প্রত্যেকের অংশে ১২টি করে উট পড়েছিল। আর আমাদের নেতা আমাদেরকে যা দিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার কোন হিসাব নিলেন না এবং নেতা যা করেছেন তারও কোন দোষ ত্রুটি ধরলেন না। অতিরিক্ত একটিসহ আমাদের প্রত্যেকের অংশে ১৩টি করে উট পড়েছিল।
বনূ কুযাআর বিরুদ্ধে প্রেরিত কাব ইবন উমায়র (রা)-এর অভিযান
ওয়াকিদী, মুহাম্মাদ ইব্ন আবদুল্লাহ যুহরী (র) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “১৫ জনের একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদলের নেতৃত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) কা’ব ইবন উমায়র আল-গিফারী (রা)-কে প্রেরণ করেন। তারা যখন সিরিয়ার যাতে ইত্তালা” নামক জায়গায় পৌঁছলেন তারা সেখানে একটি বিরাট সৈন্য দলের মুখোমুখি হলেন। তখন তারা তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান করলেন। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সংগীগণ যখন এরূপ অবস্থা দেখলেন তাদের সাথে ভীষণ যুদ্ধে লিপ্ত হলেন এবং শাহাদত বরণ করলেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মারাত্মক আহত ব্যক্তিকে পাওয়া গেল এবং তাঁকে উঠিয়ে তাঁবুতে আনা হল। যখন রাত গম্ভীর হল, তখন তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আনা হল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) শত্রুদের বিরুদ্ধে অন্য একটি ক্ষুদ্র সৈনাদল পাঠাবার মনস্থ করলেন; কিন্তু খবর আসল যে, তারা অন্যত্র চলে গেছে। তাই আর সৈন্যদল পাঠানো হল না।
মূতার যুদ্ধ
যায়দ ইবন হারিছা (রা)-এর অভিযান
সিরিয়ার বাল্কা এলাকায় প্রেরিত এ বাহিনীতে ছিলেন তিন হাজারের মত সৈন্য
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, কাযার উমরা পালনের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যিলহাজ্জ মাসের বাকী কয়েকদিন মদীনায় অবস্থান করেন। আর মুশরিকরা এ হজ্জের তত্ত্বাবধান করে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ৮ম হিজরীর মুহাররম, সফর, রবিউল আউয়াল ও রবিউস ছানী মদীনায় অবস্থান করেন। আর জুমাদাল উলা মাসে সিরিয়ায় সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন। তাঁরা মূতা নামক স্থানে শত্রু সৈন্যের মুকাবিলা করেন।
উরওয়া ইবন যুবায়র (রা) বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ৮ম হিজরীর জুমাদাল উলা মাসে রাসূলুল্লাহ (সা) মূতায় একদল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে আমীর নিযুক্ত করেন। আর বলেন, “যদি যায়দ (রা) শহীদ হয় তাহলে জাফর ইবন আবু তালিব (রা) নেতৃত্ব দেবে। আর যদি জাফর (রা) শহীদ হয়, তাহলে আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) নেতৃত্ব দান করবে। লোকজন প্রস্তুতি নিতে লাগলেন এবং বের হবার চূড়ান্ত উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। সংখ্যায় তারা ছিলেন তিন হাজার।
ওয়াকিদী–… হাকাম (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “নুমান ইবন ফিহাস নামক ইয়াহূদী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আসল এবং তার সামনে লোকজনের সাথে বসল। তিনি বললেন, “যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে সৈন্যদলের আমীর নিযুক্ত করা হল। যদি যায়দ (রা) শহীদ হয়ে যায় তাহলে জাফর ইব্ন আবু তালিব (রা) আমীর হবে। আর যদি জাফর (রা) শাহাদত বরণ করে তাহলে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) আমীর হবে। আর যদি আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) শাহাদত বরণ করে তাহলে মুসলমানগণ নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে একজনকে আমীর নির্ধারণ করবে।” নু’মান বলে উঠল, “হে আবুল কাসিম! তুমি যদি নবী হও, তাহলে তুমি যাদের নাম উল্লেখ করেছ, কম হোক আর বেশী হোক, তারা সকলেই শাহাদত বরণ করবে। কেননা, বনূ ইসরাঈলের নবীগণ যখনই জাতির কাছে কোন কোন ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করতেন এবং বলতেন যে, অমুক অমুক শাহাদত বরণ করবে তারা শাহাদত বরণ করতেন। একশ’ জনের ব্যাপারে এরূপ মন্তব্য করলে তাদের সকলেই শহীদ হতেন। এরপর যায়দ (রা)-কে লক্ষ্য করে ইয়াহুদী লোকটি বলল, “হে যায়দ! জেনে রেখো মুহাম্মাদ যদি নবী হয়ে থাকেন তাহলে তুমি কোনদিনও আর ফিরে আসবে না।” যায়দ (রা) বলেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি অবশ্যই একজন সত্য নবী এবং পুণ্যবান।” এটি বায়হাকীর বর্ণনা।
ইবন ইসহাক বলেন, “যখন সৈন্যদলের রওয়ানা হবার সময় ঘনিয়ে আসল, লোকজন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিয়োগপ্রাপ্ত আমীরদের বিদায় দিলেন ও তাদের প্রতি সালাম বিনিময় করলেন। অন্যান্যদের সাথে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) যখন বিদায় নিলেন তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেন কাঁদছেন হে ইব্ন রাওয়াহা? উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! আমার কাছে দুনিয়ার কোন মমতা নেই কিংবা তোমাদের প্রতিও আমার কোন আকর্ষণ নেই; কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে কিতাবুল্লাহর একটি আয়াত পড়তে শুনেছি যার মধ্যে জাহান্নামের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন : অর্থাৎ “এবং তোমাদের প্রত্যেকেই এটার (জাহান্নামের) উপর দিয়ে অতিক্রম করবে, এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।” অথচ আমি জানি না কেমন করে আমি সেখান থেকে উঠে আসব। তখন মুসলমানগণ বলেন, আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন, শত্রু থেকে হিফাযত করুন এবং আমাদের মাঝে তোমাদেরকে আল্লাহ তা’আলা নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন! এরপর আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) কবিতার ছন্দে বলেন :
وضربة ذات فرع تقذف الزبدا بحربة تنقد الأحشاء والكيدا
لكنى أسأل الرحمن مغفرة طعنه بیدی حران مجهزة
أرشده الله من از وقد رشدا
حتى يقال إذا ما على جدى
কিন্তু আমি পরম দাতা আল্লাহ্ তা’আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রু পক্ষ থেকে এমন একটি প্রচণ্ড বহুমুখী আঘাত প্রার্থনা করছি যা রক্তের মারাত্মক বুদবুদ সৃষ্টি করবে অথবা যুদ্ধাস্ত্রে সুসজ্জিত দক্ষ হাতের বর্শা কিংবা তীরের আঘাত প্রার্থনা করছি যা আমার নাড়িভুড়ি কলিজা ভেদ করে যাবে। আর আমার কবরের পাশ দিয়ে কেউ অতিক্রম করার সময় যেন বলেন, এ ছিল একজন খাঁটি মুজাহিদ। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন এবং তিনিও সঠিক পথে চলেছেন।
ইবন ইসহাক বলেন, “এরপর বের হবার জন্যে সকল সৈন্য তৈরী হল। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আসেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বিদায় দেন। তারপর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) বলেন :
تشبيت موسی و نصرا كالذي نصروا الله يعلم انی ثابت البصر والوجه منه فقد از ری به القدر
يثبت الله ما أنا من حسن اني تفرست فيك الخير نافلة أنت الرسول فمن يحرم نوافله
“হে রাসূলাল্লাহ্! যে সৌন্দর্য আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন মূসা (আ)-এর ন্যায় তার স্থায়িত্বও যেন তিনি আপনাকে দান করেন। আপনাকে আল্লাহ্ সাহায্য করুন যেমন সাহায্য সাহাবীরা আপনাকে করেছেন। আমি আপনাকে কল্যাণের আধাররূপে প্রত্যক্ষ করেছি। আর আল্লাহ্ জানেন যে, আমি প্রখর দৃষ্টির অধিকারী। আপনি ঋটি ও যথার্থ রাসূল। যে ব্যক্তি এ রাসূলের গুণাবলী থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখল এবং তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল তার তাকদীর যেন তাকে কলুষিত করল।
ইবন ইসহাক বলেন, সৈন্যদল বের হলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের বিদায় সম্ভাষণ জানাতে এগিয়ে গেলেন। এরপর তাদেরকে বিদায় দিয়ে ঘরের দিকে মুখ করলেন তখন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) বলেন, “হে আল্লাহ! এমন ব্যক্তির উপর তুমি তোমার রহমত বর্ষণ চিরস্থায়ী কর যাঁকে আমি বিদায় জানিয়েছি। খেজুর বাগানে আর তিনিই হলেন সর্বোত্তম বিদায় সম্ভাষণকারী ও খাঁটি বন্ধু।
ইমাম আহমদ (র)– ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ্ (সা) মূতায় একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন এবং হযরত যায়দ (রা)-কে আমীর নিযুক্ত করেন। আর তিনি বলেন, যদি যায়দ (রা) নিহত হয় তাহলে আমীর হবে জাফর (রা)। আর যদি জাফর (রা) নিহত হয় তাহলে আমীর হবে ইবন রাওয়াহা (রা)। সৈন্যদলের সকলে রওয়ানা হয়ে গেলেন; কিন্তু আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) পিছে রয়ে গেলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে জুমুআর সালাত আদায় করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে দেখলেন এবং বললেন, “তুমি কেন পিছনে রয়ে গেলে?” তিনি বললেন, “আমি আপনার সাথে জুমুআর সালাত আদায় করার জন্যে।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “আল্লাহর পথে জিহাদে এক সকাল কিংবা এক বিকাল বেলা অবস্থান করা, দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়েও শ্রেয়।”
ইমাম আহমদ (র) অন্য এক সনদে ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) একদা আবদুল্লাহ্ ইব্ন রাওয়াহা (রা)-কে একটি সৈন্যদলের সাথে প্রেরণ করেন। ঘটনাক্রমে ঐ দিবসটি ছিল জুমুআর দিন। তাঁর সংগীগণ রওয়ানা হয়ে গেল; কিন্তু তিনি মনেমনে বলেন, “আমি পিছনে থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে জুমুআর সালাত আদায় করে পরে তাদের সাথে মিলিত হব। যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) জুমুআর সালাত আদায় করে তাকে দেখলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার সাথীদের সাথে রওয়ানা হতে কিসে তোমাকে বারণ করল” । তিনি উত্তরে বলেন, “আমি ইচ্ছে করেছিলাম যে, আপনার সাথে জুমুআর সালাত আদায় করে তাদের সাথে মিলিত হব। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “সারা পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা যদি তুমি খরচ করে ফেলতে তবু তুমি তাদের সাথে সকালে রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পুণ্য লাভ করতে পারতে না। উপরোক্ত বর্ণনার ব্যাপারে তিরমিযী মধ্যস্থিত একজন বর্ণনাকারী সম্বন্ধে অভিযোগ পেশ করায় গ্রন্থকারের অভিমত হচ্ছে, এখানে এ বর্ণনাটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রমাণ করা যে, মূতার উদ্দেশ্যে ইসলামী সৈন্যদলের রওয়ানা হওয়ার দিন ছিল শুক্রবার বা জুমুআর দিন।
ইবন ইসহাক বলেন, এরপর সৈন্যদল চলতে লাগল এবং সিরিয়ার মা’আন নামক স্থানে অবতরণ করল। তাদের কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, হিরাক্লিয়াস রোম সম্রাট খোদ এক লাখ রোমান সৈন্য নিয়ে বালকা নামক এলাকায় পৌঁছে গিয়েছেন। বনূ লাখাম, জুযাম, বালকীন, রাহরা ও বালী ইত্যাদি মিলে আরো এক লাখ সৈন্য রোমানদের সাথে যোগ দেয়। বালী গোত্রের সৈন্য রোমানদের সাথে যোগ দেয়। বালী গোত্রের এক ব্যক্তি তাদের নেতৃত্বে ছিল। তারপর তাদের নেতৃত্বে আসীন হয় আহমদ রাশা ওরফে মালিক ইবন রাফিলা।
ইবন ইসহাকের অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, মুসলমানদের কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, হিরাক্লিয়াস রোমান সৈন্য এক লাখ ও আরব ভূখণ্ডে বসবাসকারী অনারব সৈন্য আরো এক লাখ নিয়ে মা’আনে পৌঁছে গেছেন। যখন মুসলমানদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছল তখন তারা মা’আনে অবস্থান করে দুইদিন পর্যন্ত আলোচনা ও পর্যালোচনা চালিয়ে যান। তাঁরা বলাবলি করতে লাগলেন, আমাদের দুশমনের সংখ্যা অবগত করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে পত্র লিখা দরকার। রাসূলুল্লাহ্ (সা) লোক লস্কর প্রেরণ করে আমাদের সাহায্য করবেন অথবা যা কিছু আমাদেরকে করতে বলবেন আমরা তাই করব। রাবী বলেন, আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) সৈন্যদলকে উৎসাহিত করতে লাগলেন এবং বললেন, হে আমার দলের লোকেরা! আল্লাহর শপথ, তোমরা যে শাহাদতের জন্যে বের হয়েছ এটাকে তোমরা এখন অপসন্দ করছো! আমরা সংখ্যা ও শক্তির কথা চিন্তা করে জিহাদ করিনা। আমরা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি একমাত্র দ্বীনের জন্যে যার দ্বারা আল্লাহ্ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। চল, আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি! এতে রয়েছে। আমাদের জন্যে দুটি মংগলের যে কোন একটি। হয় বিজয়, না হয় শাহাদত। রাবী বলেন, লোকেরা বলতে লাগল, আল্লাহর কসম, ইবন রাওয়াহা (রা) যথার্থই বলেছেন। তাই তারা অগ্রসর হতে লাগল। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) তাদের সেই অবস্থান স্থলে বলেন : “আমরা আমাদের সৈন্যদলের জন্যে বিভিন্ন জাতির ঘোড়া সংগ্রহ করেছি, যেগুলো ঘরেও বাইরে সংরক্ষিত ঘাসে চরে বেড়ায়। সংরক্ষিত জায়গা থেকে এগুলোকে কয়েদীদের মত আমরা হাঁকিয়ে নিয়ে এসেছি । প্রত্যেকটি এত অনুগত ছিল যে, মনে হয় এগুলো নিছক চামড়ার তৈরী। সৈন্যদল মাআন নামক স্থানে দুই দিন দ্বিধাগ্রস্তভাবে অবস্থান করল। এরূপ বিরতির পর তারা দলে দলে ছুটতে লাগল। এরপর আমরা অগ্রসর হলাম। চিহ্নিত অশ্বরাজির নিঃশ্বাসে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছিল। শপথ আমার পিতার, আমরা অচিরেই মাআবে পৌঁছব যদিও সেখানে আরব ও রোমান শত্রু সৈন্য রয়েছে। আমরা দুশমনের জন্যে মারাত্মক সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্যে তৈরী করেছি। ঘোড়গুলো ধূলিধূসরিত লেজে যুদ্ধ ময়দানে উপস্থিত। এগুলো ধূলাবালি উড়িয়ে চলছে প্রশস্ত রাস্তায়। যেন সেনাবাহিনীর মাথার লোহার টুপিগুলো তারকার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। তখন এগুলো আমি পার্থিব জগতের আয়েশ আরাম ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করেছি। কেননা, তা কাউকে আনন্দ দেয় আবার কাউকে ধ্বংস করে দেয়।
ইবন ইসহাক– যায়দ ইবন আরকাম (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি ইয়াতীম অবস্থায় আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা)-এর তত্ত্বাবধানে ছিলাম। তিনি আমাকে তার কোন একটি ভ্রমণে তাঁর সাওয়ারীতে সহ আরোহী করে নিলেন। আল্লাহর শপথ, তিনি রাতে ভ্রমণ করতেন এবং তাকে আমি নিম্নে বর্ণিত কবিতাগুলো আবৃত্তি করতে শুনতাম। তিনি বলতেন?
تغر من الحشيش لها العكوم
جلبنا الخيل من أجأ وفرع
أزل كأن صفحته أديم
حذرناها من الصوان سبتأ
فأعقب بعد فترتها لجموم
أقامت ليلتين على معان
تنفس في مناخرها سموم
فرخنا والجياد مسؤمات فلا وأبی مأب لنأتيها وإن كانت بهاعرب وروم
عوابس والغبار لایریم
ف أنا أعتها فجاءت
اذا برزت قوانستها النجوم
بذی (لجب) كأن البيض فيه
اسنتنافتنك أو (تئيم)
فراضية المعيشة طلقتها
হে রাত! তুমি আমাকে তথা মুজাহিদদেরকে গন্তব্যস্থলের নিকটবর্তী করেছ এবং হাসা পর্বতের পর চার দিনের পথ আমার সাওয়ারীকে বহন করে নিয়েছ। অতএব, তোমার এ কাজটি অতি উত্তম। আর তোমার সাথে সহযোগিতা না করা অবশ্যই নিন্দনীয়। আমি আমার রেখে আসা পরিবারবর্গের কাছে আর কখনও ফিরে যাব না। মুসলমান মুজাহিদগণ এসেছেন তারা যুদ্ধ করবেন এবং আমাকে তারা সিরিয়া ভূখরে প্রত্যন্ত এলাকায় শহীদ হিসেবে ছেড়ে যাবেন। তোমার মধ্যে অবতরণ করেছে প্রতিটি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান, যারা ভাই-বেরাদরকে ছেড়ে পরম দাতা ও দয়ালু আল্লাহর সান্নিধ্যের প্রত্যাশী। এখানে আমি শত্রুদের আগমনকে ভয় করি না এবং শত্রু সেনার নিকৃষ্ট সদস্যরা জিহাদ জিহাদ উৎসব মুখর পরিবেশকে বিনষ্ট করতে সক্ষম হবে না।
রাবী বলেন, “যখন আমি এ কবিতাগুলো তার থেকে শুনলাম, তখন আমি কাঁদতে লাগলাম । তখন তিনি একটি ছোট বেত দিয়ে আমাকে শাসন করলেন এবং বললেন, হে বোক। যদি আল্লাহ তা’আলা আমাকে শাহাদত দান করেন তাতে তোর কী? তুই সকলের সাথে আমার সাওয়ারীকে ফেরত নিয়ে যাবি। এরপর কোন এক যুদ্ধ সফরে তিনি যুদ্ধ কবিতা হিসেবে নিম্নবর্ণিত কবিতাটি পাঠ করেন।
مسيرة أربع بعد الحساء
أذا أدنيتني وحملت رحلي
ولا أرجع الى أهلي ورائی
فشك أنعم وخلاك دم
بأرض الشام مشتهى الثواء
وجاء المسلمون وغادروني
إلى الرحمن منقطع الإخاء
وردك كل ذي نسب قريب هنالك لا أبالي طلع بغل ولا نخل
أسافلها رواء
“হে যায়দ! সাওয়ারীসমূহের জন্যে রক্ষিত শুকনো ঘাসের রক্ষক যায়দ! তোমার জন্যে রাত দীর্ঘ হয়ে গেছে। অবশেষে তুমি সঠিক পথের সন্ধান পেলে। এখন যুদ্ধের জন্যে সাওয়ারী হতে অবতরণ কর।”
ইবন ইসহাক বলেন, মুসলিম সেনাবাহিনী অগ্রসর হতে লাগলেন। যখন বালকার সীমানায় পৌঁছলেন তখন তারা বালকার অন্যতম গ্রাম মুশারিফে হিরাক্লিয়াসের আরব ও রোমান বাহিনীর এক অংশের মুখোমুখি হন। এরপর শত্রু সৈন্যরা আরো নিকটবর্তী হতে লাগল এবং মুসলিম সৈন্যরা মৃতা নামক একটি জনপদের দিকে অগ্রসর হল। এখানেই উভয় পক্ষে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম সৈন্যগণ বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। তখন তারা বনূ আর এক ব্যক্তিকে সেনাবাহিনীর ডান পাশে নিযুক্ত করলেন যার নাম ছিল কুতবা ইব্ন কাতাদা এবং বাম পাশে নিযুক্ত করলেন আনসারের অন্য এক ব্যক্তিকে যার নাম ছিল এবায়া ইবন মালিক।
ওয়াকিদী– আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “মৃতার যুদ্ধে আমি অংশ গ্রহণ করেছিলাম। মুশরিকরা যখন আমাদের নিকটবর্তী হল, তখন তাদের সৈন্য সামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র, ভারবাহী জন্তু জানোয়ার, সোনা রূপা ও রেশমী পোষাকাদি এত অধিক পরিমাণে পরিলক্ষিত হয় যে, তাদের মুকাবিলা করা কারো পক্ষে সম্ভবপর হবে না বলে মনে হচ্ছিল। আমার চোখ ঝলসে গেল। তখন ছাবিত ইব্ন আরকাম (রা) আমাকে লক্ষ্য করে বলেন, হে আবু হুরায়রা (রা)! তুমি মনে হয় এটাকে বিরাট এক সেনাবাহিনী মনে করছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, “তুমিত আমাদের সাথে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ কর নাই। আমরা সংখ্যায় আধিক্যের দরুন জয়লাভ করি নাই। এটি বায়হাকী (র)-এর বর্ণনা।
ইন ইসহাক বলেন, “এরপর দুই পক্ষ মুখোমুখি হল এবং তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। যায়দ ইবন হারিছা (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রদত্ত ঝাণ্ডা নিয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করলেন। এরপর জাফর (রা) ঝান্ডা হাতে নিলেন। শত্রুর বিরুদ্ধে প্রচন্ড যুদ্ধ করে তিনিও শাহাদত বরণ করলেন। শাহাদতের পূর্বে তিনি তার ঘোড়ার পা কেটে দেন। তিনিই ছিলেন ইসলামের মধ্যে প্রথম যে যুদ্ধে নিজ বাহনের পা কেটে দেয়।
ইন ইসহাক– আব্বাদ ইব্ন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র বর্ণনা করেছেন। তিনি বনূ মূরা ইবন আউফের লোক ছিলেন। তিনি মূতার যুদ্ধে অংশ গ্রহণকরেছিলেন। তিনি বলেন, “আল্লাহর শপথ, আমি যেন জাফর (রা)-এর দিকে তাকিয়ে আছি। যখন তিনি তার শক্তিশালী অশ্বটির পা কেটে দিলেন। এরপর শত্রু সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রচন্ড যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করলেন। যুদ্ধের সময় তিনি নিম্নবর্ণিত কবিতাটি আবৃত্তি করছিলেন।
হে জান্নাত! তুমি কতই না সুন্দর! তোমার সান্নিধ্য সুখের, তোমার পানীয় সুশীতল। রোমকরা উন্মাদ। তার শাস্তি আসন্ন। তারা কাফির ও অজ্ঞাত কুলশীল। তাদের মুকাবিলায় প্রচণ্ড আঘাত হানা আমার জন্যে অপরিহার্য।
উপরিউক্ত বর্ণনাটি আবু দাউদ (র) ও বর্ণনা করেছেন, তবে তিনি কবিতাটি উল্লেখ করেননি। উপযুক্ত ঘটনা থেকে দুশমনের উপকৃত হবার আশংকা থাকলে জন্তু জানোয়ার হত্যা করা বৈধ বলে প্রমাণিত হয়। যেমন আবু হানীফা (র) বলেন, “ভেড়া বকরী যদি বহন করা সম্ভব না হয় এবং দুশমন তার দ্বারা উপকৃত হবার আশংকা থাকে তাহলে এগুলোকে যবেহ করে পুড়িয়ে ফেলা বৈধ, যাতে করে ভেড়া বকরীও শক্রর মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। আল্লাহ্ তা’আলাই অধিক জ্ঞাত।
সুহায়লী (র) বলেন, কেউ জাফর (রা)-এর এ কাজের নিন্দা করেননি। এতে এটা বৈধ বলে প্রমাণিত হয়; কিন্তু যদি দুশমনের হস্তগত হওয়ার আশংকা না থাকে, তাহলে তা বৈধ নয়। উপরোক্ত ঘটনা বিনা কারণে জন্তু জানোয়ার হত্যার আওতায় পড়েনা।
ইবন হিশাম বলেন, বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ, জাফর (রা) প্রথমত ডান হাতে ঝাণ্ড ধারণ করেন। ডান হাত কেটে যাওয়ায় বাম হাতে ঝাণ্ডা ধারণ করেন। বাম হাত কেটে যাওয়ায় দুই বাহুর দ্বারা ঝাণ্ডা ধারণ করেন এরপর শাহাদত বরণ করেন। তখন তার বয়স ছিল ৩৩ বছর। এজন্যে আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাতে তাকে দুটি পাখা দান করেন যার দ্বারা তিনি যেখানে ইচ্ছে ভ্রমণ করেন। কথিত আছে যে, একজন রোমান মূতার যুদ্ধের দিন তাকে একটি প্রচন্ড আঘাত করেছিল যার দরুন তিনি একেবারে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিলেন। ইবন ইসহাক আব্বাদের পিতার বর্ণনায় বলেন, জাফর (রা) যখন শাহাদত বরণ করলেন তখন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিলেন। এরপর এ ঝাণ্ডা নিয়ে তিনি ঘোড়ায় চড়ে অগ্রসর হলেন। নিজকে ধিক্কার দিতে লাগলেন এবং দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিরসন কল্পে বললেন :
أقسمت يانفس لتنزلنه لتنزلن أو لتكرهه
مالي أراك تكرهين الجنه
إن أجلب الناس وشدوا الرئه
قد طال ماقد کنت مطمئنه هل أنت إلا نطفة في شه
হে আমার আত্মা, আমি শপথ করেছি তুমি নিশ্চয়ই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে বটে। তুমি সন্তুষ্ট চিত্তে তা কর বা অসন্তুষ্ট চিত্তেই কর। শত্রুরা যখন যুদ্ধের মাঠে উপস্থিত এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত তখন আমি কেন তোমাকে জান্নাতের প্রতি ধাবিত হতে অসন্তুষ্ট লক্ষ্য করছি? তোমার শান্তিতে বসবাসের সময়কাল দীর্ঘ হয়ে গিয়েছে। তুমিত কোন এক সময় অপবিত্র বীর্য আকারে ছিলে।
তিনি আরো বলেন, হে আমার আত্মা, তুমি যদি এখন নিহত না হও, তাহলে একদিনত অবশ্যই তুমি মৃত্যুমুখে পতিত হবে। এ যুদ্ধ তোমার জন্যে মৃত্যুর দ্বার খুলে দিয়েছে। যা দিয়ে তুমি সহজেই জান্নাতে প্রবেশ করতে পার। তুমি জীবনে যা চেয়েছিলে তোমাকে তা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। এখন যদি তুমি তোমার দুই সাথীদের ন্যায় শাহাদত বরণ করতে পার, তাহলে তুমি সঠিক পথের সন্ধান পেলে। দুই সাথী বলতে যায়দ (রা) ও জাফর (রা)-কে বুঝানো হয়েছে।
এরপর তিনি ঘোড়া হতে অবতরণ করলেন। তাঁর অবতরণের পর তার চাচাতো ভাই তার জন্যে একটি হাডিড নিয়ে আসলেন ও তাঁর হাতে দিলেন এবং বললেন, এটা খেয়ে তোমার মেরুদন্ড শক্ত কর । বিগত দিনগুলোতে ক্ষুধার যন্ত্রণা যা ভোগ করার ছিল তাতে করেছই। তখন তিনি এটা তাঁর ভাইয়ের হাত থেকে গ্রহণ করলেন এবং দাঁতে একটু কেটে নিলেন। এরপর তিনি লোকজনের গুঞ্জরণ শুনতে পেলেন। অর্থাৎ যুদ্ধের জন্যে মানুষ কলরব করে অগ্রসর হচ্ছে। তখন তিনি বলতে লাগলেন, হে আমার আত্মা! তুমি দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত। এরপর হাড্ডিটি হাত থেকে ফেলে দিলেন এবং তলোয়ার হাতে ধারণ করলেন। এরপর অগ্রসর হলেন এবং প্রচণ্ড যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করলেন।
রাবী বলেন, “এরপর বনূ আজলানের এক ব্যক্তি ছাবিত ইবন আরকাম (রা) ঝাণ্ডাটি ধরলেন এবং বললেন, হে মুসলমানগণ! তোমাদের মধ্য হতে একজনকে ঝান্ডা উঠিয়ে ধরার জন্যে মনোনীত কর।” তারা বললেন, “তুমিই ঝান্ডা ধারণ কর।” তিনি বললেন, “আমি তা করতে পারবো না। জনগণ খালিদ ইব্ন ওলীদ (রা)-কে মনোনীত করলেন। ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে তিনি লোকজনকে বিন্যস্ত করলেন। তাদেরকে নিয়ে পুনরায় সুশংখলভাবে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে লাগলেন।
ইবন ইসহাক বলেন, “যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, যায়দ ইবন হারিছা (রা) ঝাণ্ডা ধারণ করেছে এবং প্রচন্ড যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেছে। তারপর জাফর (রা) ঝাণ্ডা হাতে নিয়েছে এবং সেও প্রচণ্ড যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেছে।” রাবী বলেন, “এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। তাতে আনসারদের চেহারা মলিন হয়ে গেল এবং তাঁরা ধারণা করতে লাগলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা)-এর ব্যাপারে হয়ত খারাপ কিছু ঘটে গেছে। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) ঝাণ্ডা হাতে ধারণ করেছে এবং প্রচণ্ড যুদ্ধ করার পর সেও শাহাদত বরণ করেছে। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তাদেরকে জান্নাতে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। নিদ্রিত ব্যক্তি তাদেরকে স্বর্ণের খাটে স্বপ্নে দেখতে পারে; কিন্তু আমি আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা)-এর খাটটি তাঁর দুই সাথীর খাটের তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রম দেখতে পেলাম । আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন এরূপ ব্যতিক্রম? উত্তরে আমাকে বলা হল, তারা দুইজন যুদ্ধ ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় অংশ গ্রহণ করেন; কিন্তু আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) একটু ইতস্তত করেছিল ও পরে অংশ গ্রহণ করেছিল। উপরোক্ত বর্ণনাটি ইবন ইসহাক বিচ্ছিন্ন সনদেও বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (র)– আনাস ইবন মালিক (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “যায়দ (রা), জা’ফর (রা) ও আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা)-এর মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁদের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যায়দ (রা) ঝাণ্ডা ধরেছে এবং শাহাদত বরণ করেছে। এরপর জা’ফর (রা) ঝান্ডা উত্তোলন করেছে এবং সেও শাহাদত বরণ করেছে। এরপর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) ঝাণ্ডা উত্তোলন করেছে এবং সেও শাহাদত বরণ করেছে। তখন তার দুটো চোখ থেকেই অশ্রু ঝরছিল। এরপর আল্লাহ্ তা’আলার তলোয়ার সমূহের মধ্য হতে একটি তলোয়ার ঝাণ্ডা হাতে নিয়েছে এবং আল্লাহ তা’আলা তার মাধ্যমে বিজয় দান করেছেন। এটি বুখারীর একক বর্ণনা। অন্য এক বর্ণনায় বুখারী (র) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন মিম্বরে ছিলেন এবং বললেন, “তারা আমাদের কাছে থেকে আনন্দ পায়না।”
বুখারী (র)– আবদুল্লাহ্ ইব্ন উমার (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মূতার যুদ্ধে যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে আমীর নিযুক্ত করেন এবং বলেন, যায়দ (রা) যদি নিহত হন তাহলে জাফর (রা) আমীর হবেন। আর যদি জাফর (রা) নিহত হন তাহলে আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) আমীর হবেন।” আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) বলেন, এ যুদ্ধে আমিও অংশ গ্রহণ করেছিলাম। আমরা জাফর ইবন আবু তালিব (রা)-কে খোঁজ করলাম। তাকে আমরা নিহতদের মধ্যে পেলাম এবং তার শরীরে ৯৩-এর অধিক তলোয়ার ও বর্শার আঘাত দেখতে পেলাম।
অন্য এক সনদে ইমাম বুখারী (র) আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ঐদিন তিনি জাফর ইবন আবু তালিব (রা)-কে নিহত অবস্থায় দেখতে পান এবং বলেন, “আমি তার শরীরে ৫০টি তলোয়ার ও বর্শার আঘাত গণনা করেছিলাম। এগুলোর মধ্যে একটিও পিছনের দিকে ছিলনা। উপরোক্ত দুইটি বর্ণনাই ইমাম বুখারীর একক বর্ণনা।
উপরোক্ত দুটি বর্ণনার পার্থক্যের নিরসনকল্পে বলা যায়, “ইবন উমর (রা) তাঁর বর্ণিত সংখ্যা সম্বন্ধে অবগত হয়েছিলেন। আর অন্যান্যরা এর থেকে অধিক সংখ্যা সম্বন্ধে অবগত হয়েছিলেন বিধায় অধিক সংখ্যা সম্বলিত বর্ণনা পেশ করেছেন। অথবা কম সংখ্যক আঘাত তিনি প্রাপ্ত হয়েছিলেন সামনের দিকে নিহত হবার পূর্বে। আর তিনি নিহত হওয়ার পর মুশরিকরা তার পিছনের দিকে আঘাত করেছে। নিহত হওয়ার পূর্বে সামনের দিকে যেসব আঘাত তিনি শত্রুদের থেকে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ইবন উমর (রা) তা গণনা করেছিলেন।
ইবন হিশাম উল্লেখ করেন যে, জাফর (রা)-এর ডান হাত কেটে যাওয়ার পর তিনি বাম হাতে ঝাণ্ডা ধারণ করেন এবং পরে তাও কাফিররা কেটে ফেলে। এ প্রেক্ষিতে ইমাম বুখারী (র)– আমির (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন ইবন উমর (রা) জাফর (রা)-এর ছেলেকে সালাম দিতেন তখন তিনি বলতেনঃ অর্থাৎ “হে দুই পাখার অধিকারী শহীদের ছেলে! তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” নাসাঈ (র)ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
বুখারী (র)– খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “মূতার যুদ্ধের দিন আমার হাতে নয়টি তলোয়ার ভেঙ্গে যায়, শুধুমাত্র একটি ইয়ামানী তলোয়ার আমার হাতে বাকী থাকে। ইমাম বুখারী (র) অন্য এক সনদে খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “মূতার যুদ্ধের দিন আমার হাতে নয়টি তলোয়ার ভেঙ্গে গিয়েছিল। শুধুমাত্র একটি ইয়ামানী তলোয়ার আমার হাতে বাকী ছিল। এ বর্ণনাটি বুখারীর একক।
বায়হাকী (র)– খালিদ ইবন সুমায়র (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “আবদুল্লাহ ইবন রাবাহ আল-আনসারী (রা) আমাদের কাছে আগমন করলেন। আনসারগণ তাঁকে জানত। লোকজন তার কাছে ভিড় করল এবং আমিও তার কাছে আসলাম। আবু কাতাদা (রা) বলেন, “ইনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অশ্বারোহী।” তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমীরদের সৈন্যদল প্রেরণ করেন এবং বলেন, “যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে তোমাদের আমীর নিযুক্ত করা হল।” আরও বলেন, “যদি যায়দ (রা) নিহত হয় তাহলে জা’ফর তোমাদের আমীর হবে। আর যদি জাফরও নিহত হয়, তাহলে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তোমাদের আমীর হবে। রাবী বলেন, জাফর (রা) উত্তেজিত হলেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা)! আমি এত ভীরু নই যে, আপনি যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে আমার পূর্বে আমীর নিযুক্ত করবেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, যা বলেছি তা হতে দাও, কেননা, তুমি জান না কোনটা ভাল । এরপর আমীরগণ সৈন্য সহকারে যুদ্ধ ক্ষেত্রে চলে গেলেন এবং যতদিন আল্লাহর ইচ্ছা তারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবস্থান করেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) মিম্বরে উঠলেন। নির্দেশ দিলেন যেন সালাতের জন্যে ঘোষণা দেওয়া হয়। লোকজন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সমবেত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “এখন আমি তোমাদেরকে তোমাদের সেনাবাহিনীর সংবাদ সম্পর্কে অবহিত করব। তারা রওয়ানা হয়ে চলে যায়। এরপর দুশমনের মুখোমুখি হয়। “যায়দ (রা) শাহাদত বরণ করেছে।” রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এরপর জাফর (রা) ইসলামী ঝাণ্ডা উত্তোলন করে। সে শক্রর উপর আক্রমণ চালায় এবং শাহাদত বরণ করে।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার শাহাদত বরণের সাক্ষ্য দেন এবং তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরপর আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা ঝাপ্তা হস্তে ধারণ করে অবিকলভাবে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করে।” রাসূলুল্লাহ (সা) তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
এরপর খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) ঝান্ডা হাতে নেন। কিন্তু পূর্বে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক আমীর নিযুক্ত হন নাই। উপস্থিত সাহাবায়ে কিরামের প্রস্তাব ও সমর্থনে তিনি নিজেকে আমীর ঘোষণা করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “হে আল্লাহ! খালিদ তোমার তলোয়ারসমূহের মধ্য হতে একটি তলোয়ার। তাঁকে তুমি সাহায্য কর।” ঐদিন থেকেই খালিদকে বলা হয় সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তলোয়ার।
ইমাম নাসাঈ (র) ও অনুরূপ বর্ণনা করেন। এ বর্ণনায় কিছু অতিরিক্ত আছে সেটা হল, “যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে লোকজন সমবেত হলেন তখন তিনি বললেন, ‘শুভ লক্ষণ! শুভ লক্ষণ! এবং হাদীছটি আনুপূর্বিক বর্ণনা করেন।
ওয়াকিদী–আবদুল্লাহ ইব্ন আবু বকর ইবন আমর ইবন হাযাম (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, লোকজন যখন মূতা যুদ্ধে শত্রুর মুকাবিলা করছিলেন, সে সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) মিম্বরের উপর উপবিষ্ট ছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা সিরিয়া ও তার মধ্যকার আড়াল দূর করে দেন। তিনি তখন তাদের যুদ্ধাবস্থা অবলোকন করছিলেন। তখন তিনি বলে উঠলেন? যায়দ ইবন হারিছা (রা) ইসলামী ঝান্ডা ধারণ করে রয়েছে। শয়তান তার কাছে আসে, পার্থিব জীবনকে তার কাছে প্রিয় করে তোলে এবং মৃত্যুকে অপ্রিয় বন্ধু হিসেবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। দুনিয়াকে তার কাছে প্রিয় করে তোলে। সে বলল, “আমি মুমিনদের অন্তরে ঈমানকে সুদৃঢ় করার চেষ্টা করছি আর তুই (হে শয়তান) আমার কাছে দুনিয়াকে প্রিয় করে তুলতে প্রয়াস পাচ্ছিস? তারপর সে অবিচলভাবে এগিয়ে গেল এবং শাহাদত বরণ করলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার জন্যে দু’আ করলেন এবং বললেন, “তার জন্যে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর। সে জান্নাতে শহীদবেশে প্রবেশ করেছে।
ওয়াকিদী– আসিম ইবন উমর ইব্ন কাতাদা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “যখন যায়দ (রা) নিহত হন তখন জাফর ইবন আবু তালিব (রা) ঝাণ্ডা ধারণ করল। তারপর শয়তান তার কাছে আগমন করল এবং পার্থিব জীবনকে তাঁর কাছে প্রিয়, মৃত্যুকে অপ্রিয়, আর দুনিয়াকে তার কাছে প্রিয় পাত্র করে তোলার প্রয়াস পেল। জাফর ইব্ন আবু তালিব (রা) বলল, “আমি মুমিনদের অন্তরে ঈমানকে সুদৃঢ় করার চেষ্টা করছি আর তুই (হে শয়তান) দুনিয়াকে আমার কাছে প্রিয় পাত্র করে তুলতে চাস?” তারপর সে অবিকলভাবে এগিয়ে গিয়ে শাহাদত বরণ করল। রাসূলুল্লাহ (সা) তার জন্যে দু’আ করলেন এবং বললেন, “তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর! কেননা, সে শহীদ এবং জান্নাতে প্রবেশ করেছে। সে জান্নাতে দুটি ইয়াকূতের পাখায় ভর করে জান্নাতের যেখানে ইচ্ছে ভ্রমণ করতে থাকবে।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) তারপর বললেন, এবার আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) ঝান্ডা ধারণ করেছে এবং শাহাদত বরণ করেছে। এরপর সে কাৎ হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করল। এটা আনসারগণের মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলল। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে প্রশ্ন করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! কাৎ হয়ে কেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) আহত হয়ে পিছনে হটে আসে। তারপর সে নিজেকে ভর্ৎসনা করে এবং সাহসের সাথে এগিয়ে গিয়ে শাহাদত বরণ করে ও জান্নাতে প্রবেশ করে। তাতে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা খুশী হয়ে যায়।
ওয়াকিদী– আবদুল্লাহ্ ইবন হারিছ ইবন ফুযাইল (রা) হতে বর্ণনা করেন যে, হারি! বলেন, যখন খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) পতাকা হাতে নিলেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “এখন তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে।”
ওয়াকিদী–ইতাফ ইবন খালিদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) বিকাল বেলা নিহত হন। রাত শেষে ভোর বেলায় খালিদ (রা) অগ্রভাগের সৈন্যদেরকে মধ্য ভাগে এবং মধ্য ভাগের সৈন্যদেরকে অগ্রভাগে, ডান দিকের সৈন্যদেরকে বাম দিকে এবং বাম দিকের সৈন্যদেরকে ডান দিকে পুর্নবিন্যস্ত করেন। রাবী বলেন, তাতে শত্রু সৈন্যরা যেসব পরিস্থিতি ও পতাকার সাথে পরিচিত ছিল তা না দেখে নতুন পতাকা ও পরিস্থিতি দেখতে পেয়ে মনে করে যে, মুসলমানদের কাছে সাহায্যকারী বাহিনী এসে পৌঁছেছে। তাই তারা ভীত হয়ে পড়ে এবং পরাস্ত হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র পরিত্যাগ করে। রাবী বলেন, এসময় তারা এত বিপুল সংখ্যায় নিহত হল যা কোন যুদ্ধে কেউ দেখেনি।
উপরোক্ত বর্ণনাটি মূসা ইব্ন উকবার বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি তাঁর মাগাযী গ্রন্থে বর্ণনা করেন, “হুদায়বিয়ার উমরার পর রাসূলুল্লাহ (সা) ছয় মাস মদীনায় অবস্থান করেন। এরপর তিনি মূতায় সৈন্যদল প্রেরণ করেন এবং যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে আমীর নিযুক্ত করেন। এসময় তিনি বলেন, যদি সে নিহত হয় তাহলে জা’ফর ইবন আবু তালিব (রা) আমীর হবে। আর যদি জাফর (রা) নিহত হন তাহলে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) আমীর হবে।” তারপর সেনা বাহিনী রওয়ানা হয়ে যায় এবং মূতায় ইবন আবূ সাবুরা আল গাস্সানীর মুখোমুখি হয়। সেখানে ছিল রোমান ও আরব খৃস্টানদের একটি বিরাট শত্রু বাহিনী এবং তানূখ ও বাহরা সম্প্রদায়ের সেনাবাহিনী। ইবন আবূ সাকূরা মুসলিম সেনাবাহিনীর মুকাবিলায় তার দুর্গ তিন দিন তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখে। এরপর তারা পাকা ফলপূর্ণ মাঠে মুকাবিলায় অবতীর্ণ হয়। সেখানে তারা ভীষণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যায়দ ইবন হারিছা (রা) ইসলামী ঝাণ্ডা ধারণ করেন ও নিহত হন। এরপর জাফর (রা) ৰাভা হাতে ধারণ করে তিনিও নিহত হন। এরপর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) ঝাঞ্জ ধারণ করেন ও নিহত হন। তারপর মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিযুক্ত আমীরগণের নিহত হওয়ার পর খালিদ ইবন ওয়ালীদ আল-মাখযুমী (রা)-কে তাদের সেনাপতি নির্বাচন করেন। এরপর আল্লাহ্ তা’আলা দুশমনদেরকে পরাজিত করেন এবং মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেন। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ৮ম হিজরীর জুমাদাল উলা মাসে এ সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন।
মূসা ইবন উকবা বলেন, ঐতিহাসিকগণ বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, “জাফর (রা) ফেরেশতাদের সাথে আমার সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করে। ফেরেশতাদের ন্যায় সে-ও উড়ে যাচ্ছিল এবং তার ছিল দুটো ডানা। ঐতিহাসিকগণ আরো বলেন যে, ইয়াল ইব্ন উমাইয়া (রা) একদিন মূতার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সংবাদ পরিবেশন করার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে আগমন করেন। তিনি তাকে বললেন, যদি তুমি ইচ্ছা কর সংবাদ পরিবেশন কর, আর যদি তুমি ইচ্ছা কর তাহলে আমিই সংবাদ পরিবেশন করব। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনিই বরং সংবাদ পরিবেশন করুন! রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইয়াল (রা) ও উপস্থিত জনতার সম্মুখে মূতার যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের সম্পর্কে যাবতীয় সংবাদ পরিবেশন করলেন। ইয়াল (রা) বলেন, ঐ সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন তাদের সম্বন্ধে আপনি একটি শব্দও উল্লেখের বাকী রাখেননি। তাদের ব্যাপারটি এরূপই, যেরূপ আপনি বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আল্লাহ্ তা’আলা উক্ত ভূমিকে আমার সামনে নিয়ে তুলে ধরেছিলেন যাতে আমি তাদের যুদ্ধ দেখতে পাই।
মূসা ইবন উকবার উপরোক্ত বর্ণনাটিতে বহু তথ্য রয়েছে যা ইবন ইসহাকের বর্ণনাতে নেই। আর কিছুটা বৈপরিত্যও পরিলক্ষিত হয়। ইবন ইসহাক বলেন, খালিদ ইব্ন ওয়ালীদ (রা) সেনাবাহিনীকে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে রোমান ও আরব খৃষ্টানদের খপ্পর থেকে রক্ষা করেন। অন্যদিকে মূসা ইব্ন উকবা ও ওয়াকিদী স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, মুসলিম সেনাবাহিনী রোমান ও আরব খৃস্টানদেরকে পরাজিত করেছেন। পূর্বোক্ত আনাস (রা) বর্ণিত মারফু হাদীছটি এ বর্ণনার সমর্থক। তাতে আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন। এরপর আল্লাহ তাআলার তলোয়ারসমূহ হতে একটি তলোয়ার ঝান্ডা হাতে নিল এবং তার হাতেই আল্লাহ তাআলা বিজয় দান করলেন। বুখারী ও হাফিয বায়হাকী উপরোক্ত বর্ণনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
আমার মতে, ইবন ইসহাক ও অন্যান্যদের বর্ণনার মধ্যে পরিলক্ষিত পার্থক্যের সমাধান নিম্নরূপে সম্ভব। আর তা হচ্ছে, খালিদ ইব্ন ওয়ালীদ (রা) যখন ইসলামী পতাকা হাতে নিলেন তখন তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীকে নিয়ে কৌশলের আশ্রয় নেন এবং তাদেরকে রোমান ও আরব বংশোদ্ভূত কাফির সেনাবাহিনীর খপ্পর হতে রক্ষা করেন। রাত শেষে যখন ভোর হল তখন তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীর অবস্থান পরিবর্তন করেন। ডান দিকের সৈন্যদেরকে বাম দিকে এবং বাম দিকের সৈন্যদেরকে ডান দিকে, আর অগ্রভাগের সৈন্যদেরকে মধ্যভাগে এবং মধ্য ভাগের সৈন্যদেরকে অগ্রভাগে বিন্যাস করেন, যেমনটি ওয়াকিদী উল্লেখ করেছেন। সেনাবাহিনীকে নতুনভাবে বিন্যাস করার পর রোমান বাহিনী ধারণা করে যে, মুসলিম সেনাবাহিনীর সাহায্যার্থে নতুন বাহিনী আগমন করেছে। যখন খালিদ (রা) তাদের উপর আক্রমণ করেন তখন আল্লাহর হুকুমে তারা তাদেরকে পরাজিত করেন। আল্লাহ-ই অধিক পরিজ্ঞাত।
ইবন ইসহাক, মুহাম্মাদ ইব্ন জাফর ও উরওয়া (রা) থেকে বর্ণনা করেন। মূতার যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারিগণ যখন মদীনা প্রত্যাবর্তন করে তখন তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও মুসলমানগণ স্বাগত জানান। রাবী বলেন, ছেলে মেয়েরা উত্তেজিত অবস্থায় তাদের সাথে সাক্ষাত করে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সকলের সাথে একটি সাওয়ারীতে আরোহণ করে আগমন করেন। আর তিনি বলেন, “ছেলেমেয়েদেরকে সাওয়ারীতে উঠিয়ে নাও। আর জাফর (রা)-এর ছেলেটিকে আমার কাছে দাও।” আবদুল্লাহকে আনয়ন করা হল এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে নিজ সাওয়ারীতে সামনে উঠিয়ে নিলেন। ছেলেমেয়েরা যোদ্ধাদের প্রতি ধুলো নিক্ষেপ করতে লাগল এবং বলতে লাগল, হে পলায়নকারীরা তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ থেকে পলায়ন করে এসেছ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “তারা পলায়নকারী নয়, তারা ইনশাআল্লাহ পুনরায় হামলাকারী। এ বর্ণনাটি মুরসাল এতে কিছু বিরল তথ্য রয়েছে।
আমার বক্তব্য হল, ইবন ইসহাক মনে করেছেন যে, সমগ্ৰ সেনাবাহিনীর অবস্থা এরূপ ছিল। আসলে তা নয়, বরং কতিপয় সৈন্য যারা শত্রুর মুখোমুখির সময় শক্রর অধিক সংখ্যা পরিলক্ষিত হওয়ায় ভয় পেয়ে যায় এবং পলায়ন করে। এখানে তাদেরই উল্লেখ করা হয়েছে। বাকী সৈন্যরা পলায়ন করেনি; বরং তারা জয়লাভ করেছিল। আর এ সংবাদটি রাসূলুল্লাহ (সা) মিম্বরে বসা অবস্থায়ই বলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এরপর আল্লাহর তলোয়ারসমূহ হতে একটি তলোয়ার ঝান্ডা ধরল এবং আল্লাহ্ তা’আলা তার হাতে বিজয় দান করলেন। তারপর আর মুসলমানগণ তাদেরকে ফেরারী বলে আখ্যায়িত করেননি; বরং তাদেরকে ইজ্জত-সম্মান সহকারে স্বাগত জানান। দোষারোপ করা ও ধুলো নিক্ষেপণ ছিল তাদের জন্য যারা পলায়ন করেছিল এবং সাধারণ সেনাবাহিনীকে সেখানে ছেড়ে আগেই চলে এসেছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আবদুল্লাহ ইবন উমর (র)।
ইমাম আহমদ (র)– আবদুল্লাহ ইব্ন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, প্রেরিত ক্ষুদ্র সৈন্যদলগুলোর মধ্য হতে একটি ক্ষুদ্র দলে আমি অংশ গ্রহণ করেছিলাম। এরপর মুকাবিলার সময় লোজন পলায়ন করল। আমিও তাদের একজন ছিলাম। আমরা বলতে লাগলাম, আমরা কেমন করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সাক্ষাত করব। কেননা, আমরা যুদ্ধ থেকে পলায়ন করেছি ও অভিশাপ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেছি। এরপর আমরা মনে মনে বলতে লাগলাম, যদি আমরা মদীনায় পৌঁছি তাহলে আমাদের হত্যা করা হবে। আবার বলতে লাগলাম, যদি আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে আত্মসমর্পণ করি, তাহলে যদি আমাদের জন্যে তওবা কবুল হয় তাহলে ভাল কথা। আর যদি তা না হয় তাহলে আমাদের মরণ । তবু আমরা যাব। সুতরাং আমরা ফজরের সালাতের পূর্বে মদীনা পৌঁছলাম । রাসূলুল্লাহ্ (সা) সংবাদ পেয়ে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন, তোমরা কারা?” আমরা বললাম, “আমরা ফেরারী।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “না, “তোমরা বরং পুনরায় আক্রমণকারী। আমি তোমাদের দলে আছি এবং আমি মুসলমানের দলে আছি।” রাবী বলেন, “এরপর আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে আগমন করলাম এবং তার হাত চুম্বন করলাম। অন্য এক বর্ণনায় ইব্ন উমর (রা) বলেন, “আমরা একটি অভিযানে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। আমরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে আসি এবং সামুদ্রিক জাহাজে সওয়ার হয়ে বিদেশে চলে যাবার মনস্থ করেছিলাম। এরপর আমরা এ মনোভাব ত্যাগ করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে পৌঁছলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো পলায়নকারী। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “না, তোমরা বরং পুনঃ আক্রমণকারী।” তিরমিযী এবং ইবন মাজাও এটি বর্ণনা করেন। তিরমিযী এটাকে হাসান বলে অভিহিত করেছেন।
ইমাম আহমদ (র)— আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে একটি অভিযানে প্রেরণ করেন। আমরা যখন দুশমনের মুকাবিলা করলাম আমরা প্রথম আক্রমণেই হেরে গেলাম। তাই আমরা কয়েকজন রাতের বেলায় মদীনায় আগমন করলাম এবং লুকিয়ে রইলাম। আমরা মনে মনে ভাবলাম, যদি আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে সাক্ষাত করি এবং ওযর পেশ করি তাহলে হয়ত তিনি আমাদের ক্ষমা করে দিতে পারেন। অতএব, আমরা গিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করলাম। আমরা বললাম, “আমরা পলায়নকারী।” তিনি বললেন, ‘না, তোমরা পুনঃ আক্রমণকারী। আমি তোমাদের দলে আছি।” রাবী আসওয়াদ বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “আমি প্রত্যেক মুসলমানের সাথে আছি।”
ইবন ইসহাক– আমির ইবন আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সহধর্মিণী উম্মে সালামা (রা) সালামা ইবন হিশাম ইবন মুগীরার স্ত্রীকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, কী হল, আমি সালামা (রা)-কে রাসূলুল্লাহ (সা) ও মুসলমানদের সাথে সালাত আদায় করতে যে দেখিনা। তিনি বললেন, সালামা (রা) ঘর থেকে বের হতে পারেন না। যখনই তিনি বের হন, লোকজন বলতে থাকে, হে পলায়নকারী! তুমি আল্লাহর পথে জিহাদ হতে পালিয়ে এসেছে। এ জন্যই তিনি ঘরে বসে থাকেন, বের হন না। তিনি মূতার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
গ্রন্থকার বলেন, দুই লক্ষ বলে বর্ণিত শত্রু সৈন্য সংখ্যা অবলোকন করে সম্ভবত মূতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুজাহিদগণের একটি ক্ষুদ্র দল যুদ্ধ ক্ষেত্র পরিত্যাগ করেছিলেন। সৈন্য সংখ্যার এরূপ তারতম্যের বেলায় পলায়ন করা বৈধ। যখন এই দল পলায়ন করেন বাকী সৈন্যগণ দৃঢ়তা অবলম্বন করেন এবং তাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা বিজয় দান করেন। ঐসব কাফিরের হাত হতে তারা নিজেকে রক্ষা করেন এবং শত্রু সৈন্যের এক বিরাট অংশকে হত্যা করেন।
ওয়াকিদী ও মূসা ইবন উকবা যেমনটি বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত অভিমতের পক্ষে ইমাম আহমদ (র)– আউফ ইবন মালিক আল-আশজায়ী (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মূতার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্যে আমিও যায়দ ইবন হারিছা (রা)-এর নেতৃত্বে মুসলমানদের সাথে ঘর থেকে বের হলাম। আমার সাথে ছিলেন ইয়ামানের একজন ছুরি নির্মাতা। তার সাথে তার একটি তলোয়ার ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। একজন মুসলমান একটি উট যবাই করল । তখন ছুরি নির্মাতা তার কাছে এক টুকরা চামড়া চেয়ে নিল। তিনি তাকে তা দিলেন। তখন ছুরি নির্মাতা এটাকে একটি ঢালের ন্যায় তৈরী করলেন এবং আমরা সকলে যুদ্ধ ক্ষেত্রে গমন করলাম। আমরা রোমানদের বিশাল বাহিনীর মুখোমুখী হলাম । তাদের মধ্যকার এক ব্যক্তি তার একটি অত্যন্ত সুন্দর ঘোড়ায় সওয়ার ছিল। ঘোড়াটির গদী ছিল সোনালী এবং তার অস্ত্রশস্ত্র সবই ছিল সোনালী। রোমান যোদ্ধাটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত ছিল। ছুরি নির্মাতা তার জন্যে একটি বিরাট পাথরের আড়ালে ওঁৎপেতে বসে গেল। যখনই রোমান সৈনাটি তার পাশ দিয়ে অত্যন্ত গর্বসহকারে শির উঁচু করে অতিক্রম করছিল, এমন সময় ছুরি নির্মাতা অতর্কিতে লোকটির হাঁটুর পশ্চাদ্ভাগে শিরা কেটে দেন। তাতে সে ঢলে পড়ে, ছুরি নির্মাতা তার উপর চড়াও হয় ও তাকে হত্যা করে। এরপর সে তার ঘোড়া ও অস্ত্র নিয়ে নিল। যখন আল্লাহ্ তা’আলা মুসলমানদের বিজয় দান করলেন, তখন খালিদ ইব্ন ওয়ালীদ (রা) তাঁর কাছে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন যাতে সে তার থেকে পরিত্যক্ত অস্ত্র নিয়ে আসে। আউফ (রা) বলেন, আমি তখন খালিদের কাছে আসলাম এবং বললাম, হে খালিদ! তুমি কি জানো যে, রাসূলুল্লাহ (সা) নিহত ব্যক্তির পরিত্যক্ত অস্ত্রাদি হত্যাকারীর ব্যক্তিগত সম্পদ বলে ঘোষণা দিয়েছেন? খালিদ () বলেন, হ্যাঁ, তবে আমি এটাকে তার জন্যে অতিরিক্ত মনে করি। আমি বললাম, “তার জন্যে?” এরপর আমি বললাম, “তুমি এটা তাকে ফেরত দেবে অন্যথায় আমি বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে উত্থাপন করব। খালিদ (রা) তাকে এটা ফেরত দিতে অস্বীকার করলেন। আউফ (রা) বলেন, “আমরা সকলে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট জমায়েত হলাম । আমি ছুরি নির্মাতার ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করলাম এবং খালিদ (রা) যা করেছেন তাও আমি বর্ণনা করলাম। রাসূলুল্লুাহ (সা) বললেন, “হে খালিদ! তার থেকে যেটা তুমি নিয়েছ তাকে সেটা ফেরত দাও।” আউফ (রা) বলেন, আমি বললাম, “হে খালিদ! এখন কেমন হলো। আমি কি তোমাকে আগেই বলিনি?” রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “এটা আবার কী?” আউফ (রা) বলেন, আমি আদ্যোপান্ত রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললাম, রাসূলুল্লাহ্ (সা) রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, “হে খালিদ! তাকে এটা ফেরত দেবে না। তোমাদের উপর আমার নিয়োগকৃত আমীরদেরকে কি তোমরা তাদের পসন্দমত কাজ করতে দেবে না? আর তারা শুধু দায়িত্বই পালন করে যাবে?” রাবী ওয়ালীদ ও মুসলিম ও আবু দাউদ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত বর্ণনাগুলোর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুসলিম আমীরগণ শত্রুদের থেকে গনীমত লাভ করেছেন, তাদের সম্মানিত ব্যক্তিদের পরিত্যক্ত সম্পদ অর্জন করেছেন এবং তাদের আমীরদেরকে হত্যা করেছেন।
ইমাম বুখারী (র)-এর বর্ণনা পূর্বে পেশ করা হয়েছে যে, খালিদ (রা) বলেন, “মূতার যুদ্ধে আমার হাতে নয়টি তলোয়ার ভেঙ্গে যায়, শুধুমাত্র একটি ইয়ামানী তলোয়ার আমার হাতে বাকী ছিল। আর এরূপ যদি আমীরগণ না করতেন তাহলে কাফিরদের হাত থেকে মুসলমানদেরকে তারা রক্ষা করতে পারতেন না। মূসা ইবন উকবা, ওয়াকিদী, বায়হাকী ও ইবন হিশাম অনুরূপ অভিমত পেশ করেছেন।
বায়হাকী (র) বলেন, মূতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের পলায়ন কিংবা দলের সাথে মিশে যাওয়া সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, তারা পলায়ন করেছিলেন, আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, মুসলমানগণ মুশরিকদের উপর জয়লাভ করেছিলেন এবং মুশরিকগণ পরাস্ত হয়েছিল।
বায়হাকী (র) আনাস ইবন মালিক (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেন, এরপর খালিদ (রা) পতাকা হাতে নেন এবং আল্লাহ তাআলা তার হাতে বিজয় দান করেন। এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানগণ মুশরিকদের উপর জয়লাভ করেছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলাই অধিক জ্ঞাত।
ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন যে, মূতার যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যদের ডান পাশের সেনাদলের প্রধান কুতবা ইবন কাতাদা আল-আরী (রা) আরব খৃষ্টানদের সর্দার মালিক ইবন যাফিলা কিংবা রাফিল এর উপর হামলা করেন ও তাকে হত্যা করেন। এ ব্যাপারে তিনি গর্ব করে তার ছন্দে আবৃত্তি করেন :
برمح مضى فيه ثم انحطم
ابن رافل بن الاراش
طعن ضربت على جيده ضربه فمال كما مال من السلم وسقنا نساء بني عمه غداة (رقوقين) سوق العم
“ইন রাফিলা ইবন আল-আরাশ এর প্রতি আমি বর্শা নিক্ষেপ করলাম, বর্শা তাকে বিদ্ধ করল ও সে নীচে পড়ে গেল। তার গর্দানে জোরে তলোয়ার মারলাম সে সুলাম বৃক্ষের শাখার ন্যায় ঢলে পড়ল। আমরা পরদিন তার গোত্রের রমণীদেরকে বন্দী করে জানোয়ারের দলের ন্যায় কিয়ে নিয়ে এলাম।”
উপরোক্ত কবিতাগুলো আমাদের অভিমতকে সমর্থন ক, কেননা, সেনাবাহিনীর প্রধান যখন নিহত হয় তার সঙ্গিগণ সাধারণত পলায়ন করে। কবিতায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, তার শত্রুদের রমণীদেরকে বন্দী করেছিলেন। অরি এটাই আমাদের অভিমতের পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ। আল্লাহ্ই অধিক জ্ঞাত। তবে ইবন ইসহাক অভিমত পেশ করেন যে, মূতার যুদ্ধে ছিল কৌশল প্রয়োগ ও রোমান সৈন্যদের খপ্পর থেকে পরিত্রাণ অর্জন। আর এটাকে বিজয় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এ হিসেবে যে, তারা দুশমন কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়েছিলেন আর দুশমনরা ছিল সংখ্যায় অনেক বেশী। তারা একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। তাই তাঁরা যখন তাদের থেকে রক্ষা পেলেন তাদের জন্যে এটাই ছিল বড় বিজয়। এটাও যথার্থ হতে পারে। তবে এটা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর (অর্থাৎ তাদের উপর্ব আলাহ বিজয় দান করলেন উক্তির পরিপন্থী।
আসলে ইবন ইসহাক তার অভিমতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে প্রমাণ স্বরূপ নিম্ন বর্ণিত কবিতাগুলো উল্লেখ করেছেন। কায়স ইবন মুহাস্সার আল-ইয়ামারী জনগণের অবস্থা, খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা)-এর শত্রুদের সাথে কৌশল অবলম্বন, সেনা বাহিনী নিয়ে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি সম্পর্কে তার ও জনগণের কৃত কর্মের জন্য ওরখাহী করে বলেন :
সুতরাং আল্লাহর শপথ, আমার অবস্থানের জন্যে আমার বিবেক সর্বদা আমাকে ভর্ৎসনা করছে। সেনাবাহিনী পূর্ব হতেই ছিল অগ্রগামী । আমি সেখানে দপ্তয়মান ছিলাম। যারা তুমুল যুদ্ধ করছে তাদের আমি সাহায্যকারী নই, পরিচালনাকারী নই এবং প্রতিরোধকারীও নই। কেননা, আমি খালিদ (রা)-এর অনুসরণ করেছি। আর জঙ্গণের মধ্যে খালিদের কোন তুলনা নেই । মূতার যুদ্ধে যখন যুদ্ধের ভয়াবহতার জন্যে কোন বর্শা, বর্শা নিক্ষেপকারীকে উপকার করতে পারছিল না, তখন জাফরের বীরত্ব প্রদর্শনে আমার বিবেক উচ্চকিত হয়ে উঠল। এরপর খালিদ যেন আমাদের সেনাবাহিনীর উভয় দিককে একত্র করলেন (বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলেন, তার শত্রুদের দৃষ্টিতে) যাতে তারা পরবর্তীতে পৃথক সত্তা নিয়ে আক্রমণ করতে না পারে। তারা একে অন্যের কাজে অংশ নেবে না এবং কেউ কাউকে ভর্ৎসনাও করবে না। অর্থাৎ খালিদ (রঃ) মুসলিম সেনাবাহিনীকে পুনর্বিন্যাস করলেন ।
ইবন ইসহাক বলেন, “ঐতিহাসিকগণ যা নিয়ে মতবিরোধ করেছেন কায়স তাঁর কবিতায় স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছেন যে, সেনাবাহিনীর সদস্যরা পলায়ন করেছে এবং মৃত্যুকে তারা খারাপ মনে করেছে। আবার খালিদের সাথে যারা ছিল তাদেরকে নিয়ে খালিদের প্রত্যাবর্তনও কবিতার দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে। ইবন হিশাম বলেন, তবে ইমাম যুহরী বলেন, আমাদের কাছে যা প্রমাণিত হয়েছে তাহলো যে, মুসলমানগণ খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা)-কে তাঁদের আমীর মনোনয়ন করেন, এরপর্ব আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে বিজয় দান করেন। মদীনায় প্রত্যাবর্তন করা পর্যন্ত তিনি তাদের আমীর রূপেই ছিলেন ।
অধ্যায় :
ইবন ইসহাক– আসমা বিন্ত উমায়স (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “যখন জাফর (রা) ও তার সংগীর শাহাদত বরণ করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা) আমার ঘরে আসেন। আমি ইতোমধ্যে চল্লিশটি কাঁচা চামড়া পাকা করেছি, আটার খামীর তৈরী করেছি এবং আমার ছেলে মেয়েদের গোসল করিয়েছি। তেল দেই ও তাদেরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করি। ব্যাসহ (সা) বলেন, “জাফর (রা)-এর ছেলে মেয়েদেরকে আমার কাছে নিয়ে আস।” আমি তাদেরকে তার কাছে নিয়ে আসলাম। তিনি তাদের ঘ্রাণ নিলেন তখন তাঁর দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। তখন আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি আমার মা বাপ কুরবান হোন, আপনার কাঁদার কারণ কী? জাফর (রা) ও তাঁর সংগীদের কোন সংবাদ আপনার কাছে পৌঁছেছে নাকি?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আজ তারা শাহাদত বরণ করেছে।” আসমা (রা) বলেন, আমি উঠে দাঁড়ালাম, চীৎকার করতে লাগলাম এবং অন্যান্য মহিলাদেরকে আমার কাছে জড়ো করে ফেল্লাম। রাসূলুল্লাহ (সা) তার পরিবারের কাছে চলে গেলেন এবং বললেন, “জাফর (রা)-এর পরিবার-পরিজনের জন্যে খাদ্য তৈরী করতে তোমাদের যেন ভুল না হয়। কেননা, তারা তার ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত।” অনুরূপ বর্ণনা ইমাম আহমদ থেকেও পাওয়া যায়। প্রথম বর্ণনায় (উম্মে জাফর) বলা হয়েছে আর এ সনদে (উম্মে আউন) বলা হয়েছে।
ইমাম আহমদ (র)– আবদুল্লাহ ইব্ন জাফর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “জাফর (রা)-এর মৃত্যুর সংবাদ যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে পৌঁছে তখন তিনি বলেন, “জাফর (রা)-এর পরিবার পরিজনের জন্যে খাদ্য তৈরী কর। কেননা, তাদের কাছে এমন একটি দুঃসংবাদ এসেছে যার জন্য তারা আজ শোক বিহ্বল।” অনুরূপ বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী, আবূ দাউদ ও ইবন মাজা (র)। তিরমিযী বর্ণনাটিকে হাসান বলেছেন।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক–…. আইশা (রা) হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, “যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে জাফর (রা)-এর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে তখন আমরা তার চেহারায় বিষাদের চিহ্ন দেখতে পেলাম। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে একজন লোক প্রবেশ করল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! মহিলারা আমাদেরকে কান্নাকাটি ও আহাজারি দ্বারা বিরক্ত করছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, যাও তাদেরকে চুপ করতে বল। আইশা (রা) বলেন, “লোকটি চলে গেল । আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে আসল এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পূর্বের ন্যায় বলল। আইশা (রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে বললেন, যাও তাদেরকে চুপ করতে বল যদি তারা তোমার কথা অমান্য করে তাহলে তাদের চেহারায় ধুলো নিক্ষেপ কর।’ আইশা (রা) বলেন, “আমি মনে মনে বললাম, তোমাকে আল্লাহ তা’আলা রহমত থেকে দূরে রাখুন, আল্লাহর শপথ, তুমি নিবন্ত হচ্ছে না এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হুকুম তামিলও করতে পারছে না।” আইশা (রা) বলেন, “আমি জানতাম যে, সেতো তাদের মুখে মাটি নিক্ষেপ করতে পারবে না। ইবন ইসহাক এ সনদে একক। ইমাম বুখারী (র) আইশা (রা) হতে অনুরূপ বর্ণনা করেন।
তাতে আরো আছে : আইশা (রা) বলেন, আমি মনে মনে বললাম, তোমার নাকে মাটি লাগুক, আল্লাহর শপথ, তুমিও এ কাজটি করতে পারবে না, আবার অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তুমি বার বার বিরক্ত করছ। অনুরূপ বর্ণনা করেছেন, ইমাম মুসলিম (র), আবু দাউদ (র) ও নাসাঈ (র)।
ইমাম আহমদ (র)– আবদুল্লাহ ইবন জাফর (রা) হতে ঘটনাটি অনুপূর্বিক বর্ণনা করেন। তাতে আরো আছে : রাবী বলেন, এরপর জাফর (রা)-এর পরিবার-পরিজনকে শোক প্রকাশের জন্য তিন দিন সময় দিলেন এবং তাদের কাছে আসলেন ও বললেন, আজকের পর আর তোমরা তোমাদের সাথীর জন্যে ক্রন্দন করবে না। আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েদেরকে আমার কাছে ডাক। নাৰী আবদুহ ইবন জাফর (রা) বলেন, আমাদেরকে আনা হলো যেন, আমরা মুরগীর হানাস্বরূপ। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, নাপিতকে ডেকে আন। নাপিতকে ডেকে আনা হৃল সে আমাদের মাথা মুণ্ডন করল। এরপর রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, মুহাম্মাদ ইবন জাফর আমাদের চাচা আবু তালিবের ন্যায়। আর আবদুরূহ শরীরের গঠনে ও চরিত্রে আমার ন্যায়। এরপর তিনি আমার হাত ধরালেন এবং উপরের দিকে উঁচিয়ে বললেন, হে আল্লাহ্! তাকে জাফর (রা)-এর পবিবারের প্রতিনিধি হিসেবে কবুল করুন। আবদুল্লাহর কাজ কারবারে বরকত দান করুন! এ বাক্যটি তিনি তিন তিন বার উচ্চারণ করেন। আবদুল্লাহ (রা) বলেন, এরপর আমাদের মা আসলেন এবং আমাদের ইয়াতীম অবস্থার কথা উল্লেখ করলেন ও তাঁর সামনে তার মর্মবেদনা প্রকাশ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি কি তাদের দারিদ্রের ভয় করছ, অথচ আমিই দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের অভিভাবক?
উপরোক্ত বর্ণনার আংশিক আবু দাউদ ও পূর্ণভাবে নাসাঈ (র) বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে তিন দিন কান্নাকাটি করার অনুমতি দিয়েছেন এবং তিন দিনের বেশী কান্নাকাটি করতে নিষেধ করেছেন।
ইমাম আহমদ (র)– আসমা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, জাফর (রা) শাহাদত বরণ করার পর রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে (আসমাকে) বলেছেন, তুমি তিন দিন কান্নাকাটি করতে পার। তারপর তুমি যা ইচ্ছে করতে পার। সম্ভবত রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে বিশেষ করে অনুমতি দিয়েছিলেন। কেননা, তিনি জাফর (রা)-এর শোকে অত্যন্ত বিহ্বল ছিলেন। সম্ভবত রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে তিন দিন শোক পালন করার জন্যে অনুমতি দিয়েছিলেন। এরপর তিনি যা ইচ্ছে করতে পারেন যেমন অন্যান্য নারীগণ স্বামীর জন্যে শোক পালন করার পর যা ইচ্ছে তা করতে পারে। অন্য বর্ণনায় বুঝা যায় তাকে তিন দিন ধৈর্যধারণ করার জন্যে বলেছিলেন। এটা অবশ্য অন্যান্য বর্ণনা থেকে ভিন্ন। আল্লাহ্ তা’আলাই অধিক জ্ঞাত।
ইমাম আহমদ–… আসমা বিন্ত উমায়স (রা) থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, জাফর (রা) নিহত হবার তিন দিন পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমার নিকট আগমন করেন এবং বলেন, “আজকের পর আর তুমি শোক পালন করবে না। সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, যে নারী আল্লাহ্ তা’আলা ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার জন্যে স্বামী ব্যতীত অন্যের জন্যে তিন দিনের বেশী শোক পালন করা বৈধ নয়। আর স্বামীর ক্ষেত্রে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। অতএব, উভয় হাদীছের সামঞ্জস্য বিধানে বলা যায় যে, আসমা (রা)-কে বিশেষভাবে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল অথবা শোক তাপের মধ্যে তিন দিন অতিরিক্ত করার জন্যে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহই অধিক পরিজ্ঞাত।
আসমা বিন্ত উমায়স (রা) তাঁর স্বামীর জন্যে আর্তনাদ করার সময় নিম্নবর্ণিত কবিতা আবৃত্তি করেন :
عليك ولا ينفك جندى أغبر–
فاليت لاتنفك نفسي حزينه
“আমরা তোমার জন্যে ক্রন্দন করছি। আমার মনটা সব সময় তোমার জন্যে ভারাক্রান্ত। আমার দেহটা সব সময় ধূলি-ধূসরিত। আল্লাহ্ তা’আলা কি কাউকে এরূপ চোখ দান করেছেন যার দ্বারা সে এ যুবকের ন্যায় যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর, সহনশীলতা ও শত্রুর উপর পুনঃপুনঃ হামলাকারী যুবককে দেখেছে?
এরপর তাঁর ইদ্দত শেষ হবার পর আবু বকর সিদ্দীক (রা) বিয়ের প্রস্তাব দেন ও তাঁদের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। আবু বকর সিদ্দীক (রা) বিয়ের ওলীমা করেন। ওলীমায় লোকজন হাযির হন। তাদের মধ্যে আলী (রা)-ও ছিলেন। যখন ওলীমা শেষে লোকজন চলে যায়, আলী (রা) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) হতে অনুমতি নিয়ে পর্দার আড়ালে আসমা (রা)-এর সাথে কথা বলেন ও রহস্য করে বলেন, এ কবিতাটি কে বলতেছিল?
عليك ولا ينفك جلدي أغبر–
قالت لا تنفك نفسي حزينة
অর্থাৎ আমি তোমার জন্যে ক্রন্দন করছি। আমার মনটা সব সময় তোমার জন্যে ভারাক্রান্ত। আমার দেহটা সব সময় ধূলি-ধূসরিত।
আসমা (রা) বলেন, “হে আবুল হাসান! আমাকে তুমি আমার অবস্থায় থাকতে দাও। নিঃসন্দেহে তুমি একজন রসিক ব্যক্তি। আবু বকর (রা)-এর ঔরসে তাঁর গর্ভে মুহাম্মাদ ইবন আবু বকর (রা)-এর জন্ম হয় মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে। বৃক্ষতলায় তিনি সন্তান প্রসব করেন যখন রাসূলুল্লাহ (সা) বিদায় হজ্জ পালনরত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে গোসল করার পর ইহরাম বাধার অনুমতি দিয়েছিলেন। তারপর আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর ইন্তিকাল হলে আলী (রা) আসমা বিনত উমায়স (রা)-কে বিয়ে করেন। তাঁর ঔরসেও কয়েকজন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তাদের সকলের প্রতি আল্লাহ তা’আলা রাষী থাকুন!
জাফর পরিবারের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সদয় আচরণ
ইসহাক ইবন– উরওয়া ইবন যুহায়র (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “মূতার যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুজাহিদগণ প্রত্যাবর্তনকালে মদীনার নিকটবর্তী হলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)ও অন্যান্য মুসলমানগণ তাদেরকে স্বাগত জানান। রাবী উরওয়া ইবন যুবায়র (রা) বলেন, ছেলেমেয়েরা উত্তেজিত অবস্থায় তাদের সাথে সাক্ষাত করে রাসূলুল্লাহ (সা) জনগণের সাথে একটি সাওয়ারীতে আগমন করেন। তিনি বলেন, ছেলে-মেয়েদেরকে ধর ও তাদেরকে সাওয়ারীতে উঠিয়ে নাও। আর জাফর (রা)-এর ছেলেকে আমার কাছে দাও। আবদুল্লাহ ইবন জা’ফর (রা)-কে আনয়ন করা হল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে সাওয়ারীর সামনে উঠিয়ে নিলেন। রাবী বলেন, “জনতা সেনাবাহিনীর উপর ধুলো ছুঁড়তে লাগল ও বলতে লাগল, হে পলায়নকারীরা! তোমরা আল্লাহর পথ থেকে পলায়ন করেছ। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তাঁরা পলায়নকারী নয় তারা ইনশাআল্লাহ্ পুনরায় হামলা করবে।
ইমাম আহমদ (র– আবদুল্লাহ ইবন জা’ফর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) যখন সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করতেন তখন আহলে বায়তের ছেলেমেয়েরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে স্বাগত জানাতেন। একদিন তিনি সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করলে সকলের আগে আমি তার কাছে পৌঁছলাম। তিনি আমাকে সাওয়ারীর সামনে উঠিয়ে নিলেন । তারপর বললেন, “বনূ ফাতিমার কোন একজন হাসান কিংবা হুসায়নকে নিয়ে আস। তখন তিনি তাদের একজনকে সাওয়ারীতে তার পিছনে বসালেন। আমরা তিনজন সাওয়ারীর উপর উপবিষ্ট অবস্থায় মদীনায় প্রবেশ করলাম। মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবন মাজা। এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন!
ইমাম আহমদ (র)– আবদুল্লাহ ইবন জাফর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বাল্যকালে একদিন আমি ও আব্বাস (রা)-এর দুই পুত্র কুছাম এবং উবায়দুল্লাহ্ খেলছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) একটি সাওয়ারীর উপর চড়ে আমাদের কাছে আগমন করলেন। তিনি আমার দিকে ইংগিত করে বললেন, ‘একে আমার কাছে উঠিয়ে দাও, ‘তখন তিনি আমাকে তার সাওয়ারীর সামনে উঠিয়ে নিলেন। আর কুহামের দিকে ইংগিত করে বললেন, ‘একেও আমার কাছে উঠিয়ে দাও। তিনি তাকে তার পিছনে বসালেন অথচ উবায়দুল্লাহ আব্বাস (রা)-এর কাছে কুছামের চাইতে অধিকতর প্রিয় সন্তান ছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার চাচার পসন্দ অপসন্দের কোন প্রকার খেয়াল না করে উবায়দুল্লাহকে না নিয়ে কুছামকেই উঠিয়ে নিলেন। আবদুল্লাহ ইবন জাফর (রা) বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তিনবার আমার মাথা মাসেহ করলেন এবং মাসেহ এর সময় প্রতিবার বললেন : ১,Tail;। অর্থাৎ হে আল্লাহ্! জাফর (রা)-এর বংশধরদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ (রা)-কে জাফর (রা)-এর স্থলাভিষিক্ত কর । রাবী বলেন, আমি আবদুল্লাহকে বললাম, কুছাম কী করলো? শাহাদত বরণ করেছিল? আমি বললাম, “আল্লাহ্ ও রাসূল (সা) সে সম্বন্ধে ভাল জানেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, নাসাঈও এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন তার ‘আমালুল ইয়াওমে ওল্লাইলে।
উপরোক্ত ঘটনাটি ছিল মক্কা বিজয়ের পরের, কেননা, আব্বাস (রা) মক্কা বিজয়ের পর মদীনায় এসেছিলেন।
ইমাম আহমদ (র)– আবদুল্লাহ ইবন জা’ফর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি একদিন আবদুল্লাহ্ ইব্ন যুবায়র (রা)-কে বলেন, “তোমার কি এ ঘটনাটি স্মরণ আছে যে, তুমি আমি ও ইবন আব্বাস (রা) একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে সাক্ষাৎ করছিলাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ, এরপর আমাদেরকে তিনি সাওয়ারীতে উঠিয়ে নিলেন আর তোমাকে ছেড়ে গেলেন। এ ঘটনাটিও মক্কা বিজয়ের পরের ঘটনা।
যায়দ (রা), জাফর (রা) ও আবদুল্লাহ্ (রা)-এর ফযীলত
যায়দ (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আযাদকৃত গোলাম। তার বংশ পরম্পরা নিম্নরূপ :
ইবন হারিছা ইবন শুরাহীল ইবন কা’ব ইব্ন আবদুল উযযা ইবন ইমরুল কায়স ইবন আমির ইবন নুমান ইবন আমির ইবন আবদূদ ইবন আউফ ইবন কিনানা ইব্ন বকর ইবন আউফ ইবন উহ ইবন যায়দ আল-লাত ইবন বুফায়দা ইবন ছাওর ইবন কাব ইবন উবারাহ ইবন সা’লাব ইবন হুলওয়ান ইবন ইমরান ইব্ন আলহাফ ইবন কুদায়াহ আল-কালবী আল কুযায়ী।
তাঁর মা একদিন তাঁকে নিয়ে তাঁর পরিবার-পরিজনদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে রওয়ানা হলেন। পথে তাদের কাফেলায় ডাকাত হামলা করে। ডাকাতরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর হাকীম ইব্ন হিযাম তার ফুফু খাদীজা বিন্ত খুয়ায়লিদ (রা)-এর জন্যে তাকে খরিদ করেন। কেউ কেউ বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজেই তাকে খরিদ করেছিলেন। নুবুওয়াতের পূর্বে খাদীজা (রা) তাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর খিদমতে সমর্পণ করেন। তারপর তাঁর পিতা তার সন্ধান পান। কিন্তু তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে থাকাটাই পসন্দ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে আযাদ করে দিয়ে পালক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। তাই তাঁকে যায়দ ইবন মুহাম্মাদ বলে ডাকা হত। আর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আযাদকৃত দাসদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম মুসলমান হয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কুরআনের একাধিক আয়াত নাযিল হয় :
১. সূরা আহযাব : ৪ অর্থাৎ তোমাদের পোষ্য পুত্র, (যাদেরকে আল্লাহ্) তোমাদের পুত্র করেন নাই।
২. সূরা আহযাব : ৫ অর্থাৎ তোমরা তাদেরকে ডাক তাদের পিতৃ পরিচয়ে; আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা অধিকতর সংগত।
৩. সূরা আহযাব : ৪০ অর্থাৎ মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন।
৪. সূরা আহযাব : ৩৭ অর্থাৎ “স্মরণ কর, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছ তুমি বলছিলে, তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর। তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন রেখেছিলে আল্লাহ্ তা প্রকাশ করে দেবেন : তুমি লোককে ভয় করছিলে অথচ আল্লাহই ভয়ের অধিকতর হকদার। এরপর যায়দ যখন যয়নবের সাথে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করে দিলাম।”
মুফাসসিরগণ এ ব্যাপারে একমত যে, উপরোক্ত আয়াতসমূহ তাঁরই সম্বন্ধে নাযিল হয়েছে। ‘আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন’ এর অর্থ হচ্ছে ইসলাম দান করার মাধ্যমে আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন। আর তুমি অনুগ্রহ করেছ’ এর অর্থ হচ্ছে, আযাদ করার মাধ্যমে তুমি তার প্রতি অনুগ্রহ করেছ। আমরা তাফসীরে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, আল্লাহ্ তা’আলা যায়দ (রা) ব্যতীত অন্য কোন সাহাবীর নাম কুরআন মজীদে উল্লেখ করেননি। তাঁকে আল্লাহ্ তা’আলা ইসলামের প্রতি পথ প্রদর্শন করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে আযাদ করে দিয়েছিলেন এবং তার আযাদকৃত দাসী উম্মে আয়মানের সাথে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। উম্মে আয়মানের নাম ছিল বারাকা। তার গর্ভে জন্ম নেন উসামা ইবন যায়দ (রা)। উসামা (রা)-কে বলা হত আল-হিব্ব ইবনুল হিব্ব। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার ফুফাতো বোন যয়নব বিন্ত জাহাশ (রা)-কে তার সাথে বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার চাচা হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা)-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে তাকে আবদ্ধ করে দেন। মূতার যুদ্ধে তার চাচাতো ভাই জাফর ইবন আবু তালিব (রা)-এর পূর্বে। তাকে যুদ্ধের আমীর নিযুক্ত করেন।
ইমাম আহমদ (র) ও আবু বকর ইবন আবূ শায়বা (র)– আইশা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে কোন অভিযানে প্রেরণ করতেন তখন তাঁকেই তাদের আমীর নিযুক্ত করতেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) পরে তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাকেই তার স্থলাভিষিক্ত করতেন। ইমাম নাসাঈ (র)ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনাটির সনদ উত্তম, তবে এতে বিরলতা রয়েছে ।
ইমাম আহমদ (র) আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “একদা রাসূলুল্লাহ্ (সা) একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন এবং উসামা ইবন যায়দ (রা)-কে আমীর নিযুক্ত করেন। কেউ কেউ তাঁর নেতৃত্বের প্রতি কটাক্ষ করেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরা যারা তাঁর নেতৃত্বের প্রতি কটাক্ষ করছ তারা পূর্বেও তাঁর পিতার নেতৃত্বের প্রতি কটাক্ষ করেছিল। আল্লাহর শপথ, সে (যায়দ) ছিল নেতৃত্বের যোগ্য। আর আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি। তার পরে তাঁর সন্তান উসামা (রা)ও আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয়।” সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) হতে অনুরূপ বর্ণনা এসেছে।
বাযার (র)– আইশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন যায়দ ইবন হারিছা (রা) শাহাদত বরণ করলেন এবং উসামা ইবন যায়দ (রা)-কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সামনে আনা হল, তখন তাঁর দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। তারপর সে চলে গেল এবং পরদিন আবার তাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সামনে হাযির করানো হল তখন তিনি বললেন, “আজকে তোমার সাথে যেরূপ আনন্দ চিত্তে মুলাকাত করছি গতকাল এরূপ আনন্দ ছিল না। এটা একটা তায়ীব পর্যায়ের হাদীছ।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে উল্লেখ রয়েছে যেমন পূর্বেও বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের শাহাদতের কথা উল্লেখ করার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) মিম্বরে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি বলছিলেন, যায়দ (রা) পতাকা ধারণ করেছে এবং শাহাদত বরণ করেছে। এরপর জাফর পতাকা ধারণ করেছে ও শাহাদত বরণ করেছে। তারপর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা পতাকা ধারণ করেছে এবং সেও শাহাদত বরণ করেছে। তারপর আল্লাহর তলোয়ার সমূহ হতে একটি তলোয়ার (খালিদ ইবন ওলীদ) পতাকা ধারণ করেছে এবং আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর হাতে বিজয় দান করেছেন। রাবী বলেন, আর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দুটো চোখ হতে অশ্রু ঝরছিল। তিনি বললেন, তারা এখন আর আমাদের নিকট থেকে সুখ ও আনন্দ পায়না। অন্য এক হাদীছে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁদের শাহাদতের বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। সুতরাং তারা ঐসব ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত যাদের জন্যে নিঃসন্দেহে জান্নাত রয়েছে। যায়দ ইবন হারিছা (রা) ও ইবন রাওয়াহা (রা)-এর জন্যে হাস্সান ইবন ছাবিত শোকগাথা রচনা করেন যা নিম্নরূপঃ
وانگري في الراء أهل القبور
عين جودی بدمعك السمنزور
يوم راحوا في وقعة الغوير
واذكرى مؤتة وما كان فيها
نئم مأوى الضريك و المأسور
حين راحوا و غادروا ثم زيدا
سيد الناس حبه في الصدور
حب خير الأنام ظزأ جميقا
ذاك زنی له ما وسروری
ذاكم أحمد الذي لا سواه
ليس أمر المكب المغرور
إن زيدا قد كان منا بأمر ثم جودي للخزرجی بدمع سدا كان ثم غیر نزور
بزن تبيت غير سرور
قد أتانا من قتلهم ما كفانا
হে আমার নয়ন! সামান্য অশ্রুতে তুমি অশ্রুসিক্ত। নরম ও বিস্তীর্ণ ভূমিতে সমাহিত কবরবাসীদেরকে তুমি স্মরণ কর। মূতাকে তুমি স্মরণ কর আর যা কিছু ঐ ভূমিতে ঘটে গিয়েছে তাও তুমি স্মরণ কর- সেদিন মুসলমানগণ বিরাট এক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন তাঁরা সকাল ও সন্ধ্যায় অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। এরপর যুদ্ধের আমীর যায়দ (রা)-কে স্মরণ কর। অর্থাৎ তাদের জন্যে অশ্রুপাত কর। আমীর ছিলেন অসহায় ও কয়েদীদের জন্যে উত্তম আশ্রয়স্থল। (তার মধ্যে ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসা ।) উত্তম সৃষ্টি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রেম-প্রীতি ভালবাসাই সব কিছুর উৎস ও সারবস্তু। তিনি ছিলেন সকলের সর্দার ও প্রধান। সুতরাং তাঁর প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসা প্রত্যেকের অন্তরে বিরাজ করুক। রাসূলুল্লাহ (সা) বা আহমদ (সা) তোমাদের মৃত্যুর সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে পরিবেশন করেন। তাই তাঁর তুলনা হয় না। এ সংবাদে সুখ-দুঃখ মিশ্রিত। (তাকে হারিয়ে ফেলা আমার জন্যে দুঃখের বিষয় আর তার জান্নাত প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে একটি মহাসুখের সংবাদ।) নিশ্চয়ই যায়দ (রা) আমাদের সমাজে একটি বিরাট সম্মান নিয়ে বসবাস করতেন। তার এ সম্মান ও ইযযত কোন মিথ্যাবাদী কিংবা কোন প্রতারকের ভেল্কিবাজী নয়। এরপর আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা আনসারী খাযরাজীর জন্যে অশ্রুপাত কর, হে আমার নয়ন! কেননা, তিনি ছিলেন একজন সর্দার ও সম্মানিত। তাঁর জন্যে প্রচুর অশ্রুপাত করাই সঙ্গত। তাদের শাহাদত বরণের সংবাদ আমাদের কাছে প্রচুর কল্যাণ ও বরকত নিয়ে দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত । তবে আমরা আপাতত আনন্দহীন দুঃখ বেদনা নিয়ে কালাতিপাত করছি।
জাফর ইবন আবু তালিব (রা) ইবন আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিম ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চাচাত ভাই। বয়সে তিনি তাঁর ভাই আলী (রা) হতে দশ বছরের বড় ছিলেন। তাঁর ভাই আকীল ছিলেন জাফর (রা) হতেও দশ বছরের বড়। আর তাঁর ভাই তালিব ছিলেন আকীল হতেও দশ বছরের বড়। জাফর (রা) ইসলামের প্রথম অবস্থায় মুসলমান হন এবং মদীনায় হিজরতের পূর্বে তিনি হাবশায় হিজরত করেন। সেখানে তাঁর ছিল খ্যাতিপূর্ণ অবস্থান, প্রশংসনীয় মান-মর্যাদা, প্রশ্নের সঠিক ও গ্রহণযোগ্য উত্তর প্রদানকারী এবং তিনি ছিলেন সহজ-সরল পথে প্রদর্শিত । হাবশার হিজরতের অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। খায়বার বিজয়ের দিন তিনি হাবশা থেকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে আগমন করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “আমি জানিনা আমার এই দুই খুশীর মধ্যে কোনটি বড়-জাফর (রা)-এর আগমন, না খায়বার বিজয়?” রাসূলুল্লাহ্ (সা) দাঁড়িয়ে তার সাথে কোলাকুলি করেন এবং তার কপালে চুম্বন করেন। কাযার উমরা পালনের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বলেন, “অবয়বে ও চরিত্রে তুমি আমার ন্যায়। কথিত আছে যে, তখন তিনি অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন এবং খুশীর নিদর্শন হিসেবে হাবশায় নাজ্জাশীর ন্যায় এক পায়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করেছিলেন। আর তাঁকে যখন মূতার যুদ্ধে প্রেরণ করা হয়, তখন নেতৃত্বে যায়দ ইবন হারিছার পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে তাকে মনোনীত করা হয়। যখন তিনি শহীদ হন তখন তাঁর শরীরে ৯৩টির অধিক তলোয়ার বর্শা ও তীরের আঘাত দেখতে পাওয়া যায়। আর এগুলো সবই ছিল সামনের দিকে। এগুলোর একটাও পিছনে ছিল না। প্রথমত তার ডান হাত কেটে যায়। তারপর বাম হাত। তবু তিনি উভয় বাহুর দ্বারা কোন রকমে পতাকা উঁচিয়ে রাখেন। আর এ অবস্থায়ই তিনি শাহাদত বরণ করেন। কথিত আছে যে, একজন রোমান সৈন্য তাঁকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সংবাদ পরিবেশন করেন যে, তিনি শাহাদত বরণ করেছেন। আর তিনি ঐ সমস্ত লোকের অন্তর্ভুক্ত পদের জন্যে নিঃসন্দেহে জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে। হাদীসসমূহের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তার নাম দেয়া হয়েছিল অর্থাৎ দুই ডানাওয়ালা।
ইমাম বুখারী (র) ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি যখন জাফর (রা)-এর পুত্র আবদুল্লাহ (রা)-কে দেখতেন তখন বলতেন, অর্থাৎ হে দু পাখাওয়ালার পুত্র! তোমার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক! কেউ কেউ এটা স্বয়ং উমর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তবে বিশুদ্ধ বর্ণনাটি হচ্ছে হয়রত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। ওলামায়ে কিরাম বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা হযরত জাফর (রা)-কে তাঁর দুটি হাতের পরিবর্তে জান্নাতে দুটি পাখা দান করেছেন।
হাফিয আবু ঈশা তিরমিযী (র)– আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “আমি জাফর (রা)-কে জান্নাতে দেখেছি সে ফেরেশতাদের সাথে উড়ে বেড়াচ্ছে । শাহাদতের সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৩ বছর। ii]। কিতাবে ইবনুল আছীর (র) বলেন, তাঁর বয়স ছিল ৪১ বছর। কেউ কেউ আবার অন্যরূপ বলেছেন।
আমি বলি, জাফর (রা)-এর বয়স আলী (রা) থেকে ১০ বছর বেশী হওয়ায় বুঝা যায় যে, জাফর (রা) যেদিন নিহত হন তার বয়স ছিল ৩৯ বছর। কেননা, আলী (রা) যখন মুসলমান হন তখন তার বয়স ছিল প্রসিদ্ধ মতে আট বছর। এরপর তিনি মক্কায় অবস্থান করেন ১৩ বছর। তারপর যখন হিজরত করেন তখন তার বয়স ছিল ২১ বছর। ৮ম হিজরীতে ছিল মূতার যুদ্ধ। আল্লাহ্ তা’আলা অধিক জ্ঞাত। জাফর (রা) শাহাদত বরণ করার পর তাকে তাইয়ার বলা হয়। কেননা, তিনি তার স্বর্গীয় পাখা দ্বারা ফেরেশতাদের সাথে ঘুরে বেড়ান বলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাদীছে প্রকাশ। তিনি ছিলেন উদারচেতা, দাতা, দয়ালু ও প্রশংসিত। ফকীর মিসকীনদের প্রতি তাঁর বদান্যতার দরুন তাকে আকূল মাসাকীন বলা হত ।
ইমাম আহমদ (র)– আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এরপর জাফর ইবন আবু তালিব (রা) হতে উত্তম কোন পুরুষ জুতা পরিধান করেনি, সাওয়ারীতে চড়েনি এবং কাপড় চোপড় ও পরিধান করেনি। আবু হুরায়রা (রা) সম্ভবতঃ তাঁকে বদান্যতার কারণেই তার এরূপ প্রশংসা করেছেন। কেননা, ধর্মীয় অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে এটা সার্বজনীন স্বীকৃত যে, সর্বপ্রথম ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেন আবু বকর সিদ্দীক (রা), তারপর উমর (রা), তারপর উছমান (রা) এবং তারপর আলী (রা) কিংবা হযরত আলী (রা) ও হযরত জাফর (রা) সমপর্যায়ের। অথবা আলী (রা)-ই শ্রেষ্ঠ। উপরোক্ত বর্ণনার পক্ষে ইমাম বুখারী (র)-এর একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি– আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, লোকজন বলাবলি করতে যে, আবু হুরায়রা (রা) অনেক বেশী হাদীছ বর্ণনা করে থাকেন। আমি সর্বদা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে থাকতাম। ক্ষুধায় কষ্ট পেতাম, রুটি রোযগারের জন্যে কোথায়ও বের হতাম না, মূল্যবান কাপড় চোপড় পরিধান করতাম না। কোন পুরুষ কিংবা মহিলাও আমার খিদমত করত না। ক্ষুধার কষ্ট লাঘব করার জন্যে আমি পেটে পাথর বেঁধে রাখতাম। উপস্থিত লোকজনের কাছে কুরআনের আয়াত পড়তাম যাতে আমার দিকে ফিরে তাকায় ও আমাকে অন্ন দান করে। মিসকীনদের জন্যে সৰ সর্বোত্তম ছিলেন জাফর ইবন আবূ তালিব (রা)। তিনি আমার দিকে ফিরে তাকাতেন ও তার ঘরে যা কিছু থাকত তার থেকে আমাকে অনুদান করতেন, এমনকি কিছু না থাকলে ছোট খাদ্য পাত্র আমার কাছে পাঠাতেন এবং আমি তা চেটে চেটে খেতাম। এটি ইমাম বুখারীর একক বর্ণনা।
জাফর (রা)-এর শোকগাথায় হাসান ইবন ছাবিত বলেন : জাফর (রা)-এর আত্মাহুতির স্থানের সম্মানের শপথ, আমি তার জন্যে ক্রন্দন করেছি। তিনি সারা বিশ্বে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অতিপ্রিয়। আমি উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছি। হে জাফর! আমার কাছে যখন তোমার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে, তখন আমি বলেছিলাম, যখন আঘাত করার জন্যে তলোয়ারকে কোষমুক্ত করা হয়েছে ও তীরের আনাগোনা অব্যাহত রয়েছে তখন লৌহ শিরস্ত্রাণ পরে ও ঢাল নিয়ে ঈগল ও তার ছায়ার কাছে জল্লাদের ভূমিকা আঞ্জাম দিতে পারবে লোকদের মধ্যে এমন কে আছে? ফাতিমা (রা)-এর সুযোগ্য পুত্রের পর জাফর (রা) হচ্ছেন সকল সৃষ্টির সেরা, সকল সৃষ্টির সবচেয়ে বেশী বিপদগ্রস্ত, সামষ্টিক ও দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অত্যন্ত পারদর্শী, অত্যাচার উৎপীড়নের কালে অত্যন্ত ধৈর্যশীল। যখন। সত্যের উপর বিপর্যয় নেমে আসে তখন সত্যের প্রতি অত্যন্ত অনুগত ও অবিচল। মিথ্যার কাছে আপোষহীন, অত্যন্ত শক্তিশালী, কটুবাক্য প্রয়োগে অত্যন্ত বিরল, বদান্যতার ক্ষেত্রে সকলের চেয়ে অগ্রগামী, দানের দিক দিয়ে অধিক সিক্ত, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা) ব্যতীত বিশ্বের জীবিতদের মধ্য হতে কেউ তার সমতুল্য নেই।
আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) ইবন সা’লাবাহ ইবন ইমরুল কায়স ইবন আমর ইবন ইমরুল কায়স ইবন মালিক ইবন আল-আগার, ইবন সা’লাবা ইবন কা’ব ইবন খাযরাজ ইবন হারিছ ইবন খাযরাজ আবু মুহাম্মাদ। কেউ কেউ বলেন, অবৃি রাওয়াহা । আবার কেউ কেউ বলেন, আবূ আমর আল-আক্সারী আল-খারাজী। তিনি নুমান ইবন বাশীরের মামা তার বোন আমরা বিনত রাওয়াহা (রা)। তিনি ইসলামের প্রথম যুগে মুসলমান হন এবং আকার শপথে উপস্থিত ছিলেন। ঐ রাতে তিনি হারিছ ইবুন খাযরাজ গোত্রের একজন নকীব নিযুক্ত হয়েছিলেন । বদর, উহুদ, খন্দক, হুদায়বিয়া ও খয়বারের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে খায়বারের ফসলাদির পাওনা নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রেরণ করতেন। তিনি কাযার উমরা পালনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং ঐ দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উস্ত্রীর লাগাম ধরে মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। আর তিনি সমর সঙ্গীত আবৃত্তি করছিলেন–
অর্থাৎ হে কাফিরের গোষ্ঠী! রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর রাস্তা থেকে সরে পড়— মূতার যুদ্ধে যেসব আমীর শাহাদত বরণ করেছিলেন তিনি তাঁদের মধ্যে একজন। যখন মুসলমানগণ হামলা করার ব্যাপারে সলা-পরামর্শ করছিলেন তখন রোমানদের মুকাবিলার জন্য তিনি মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করেছিলেন এবং নিজকেও উদ্দীপ্ত করেছিলেন। তাই তাঁর পূর্বতী দুইজন সেনাপতি নিহত হওয়ার পরও তিনি সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধে অবতরণ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার শাহাদতের সাক্ষ্য দিয়েছেন কাজেই যারা জান্নাতে প্রবেশের নিশ্চয়তা পেয়েছেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।
বর্ণিত রয়েছে যে, মূতার যুদ্ধের প্রাক্কালে বিদায়কালে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন : আল্লাহ তা’আলা আপনাকে যে উত্তম জিনিস দান করেছেন তার মধ্যে যেন আপনাকে দৃঢ়তা দান করেন। যেমন মূসা (আ)-কে দৃঢ়তা দান করা হয়েছিল। আর আপনাকেও অনুরূপ সাহায্য প্রদান করা হয় যেমন সাহায্য প্রদান করা হয়েছিল হযরত মূসা (আ)-কে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, তোমাকেও যেন আল্লাহ্ তা’আলা দৃঢ়তা প্রদান করেন । হিশাম ইবন ওরওয়া (রা) বলেন, সত্যি সত্যি আল্লাহ্ তা’আলা তাকে দৃঢ়তা দান করেন ও তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন।
হাম্মাদ ইবন যায়িদ– আবদুর রহমান ইব্ন আবু লায়লা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) খুতবা দিচ্ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) মসজিদে উপস্থিত হলেন এবং শুনতে পেলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলছেন, তোমরা বসে পড়।’ তিনি মসজিদের বাইরে তার নিজ জায়গায় বসে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) খুতবা শেষ করলেন এবং আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা)-এর ঘটনা জানতে পারলেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূল (সা)-এর আদেশ মানার জন্যে তোমার আগ্রহ আল্লাহ্ যেন আরো বৃদ্ধি করে দেন। বুখারী তার সহীহ্ গ্রন্থেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (র)— আনাস ইবন মালিক (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) যখন কোন সাহাবীর সাথে সাক্ষাত করতেন তখন বলতেন, ‘এসো, আমরা এক ঘন্টার জন্যে আমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনি। একদিন এক ব্যক্তিকে তিনি এরূপ বলায় লোকটি রেগে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে এসে নালিশ করলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি জানেন, আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) লোকজনকে আপনার প্রতি ঈমানের স্থলে এক ঘণ্টার ঈমানের দিকে উৎসাহিত করছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ইবন রাওয়াহা (রা)-এর প্রতি আল্লাহ্ রহম করুন, সে ঐসব মজলিস কেই পসন্দ করে যেটা নিয়ে ফেরেশতাগণ গর্ব করে থাকেন। এটা একটা অত্যন্ত বিরল বর্ণনা।
বায়হাকী (র)– আতা ইবন য়াসার (র) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) একদিন তার এক সাথীকে বললেন, ‘চল আমরা এক ঘণ্টার জন্যে ঈমান আনি। সাথীটি বলল, ‘আমরা মু’মিন নই? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তবে আমরা একটু আল্লাহর যিক্র করব ও ঈমানকে বৃদ্ধি করব ।
হাফিয আবুল কাসিম আল-লাকারী– শূরায়হ্ ইবন উবায়দ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) সাহাবীদের মধ্য হতে কারো হাতে ধরতেন এবং বলতেন চল, আমরা এক ঘণ্টার জন্য ঈমান আনি এবং যিকরের মজলিসে বসি। এটা একটি মুরসাল বর্ণনা।
বুখারী (র) আবু দারদা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “একবার আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে প্রচন্ড গরমের মধ্যে সফরে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা)ও আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) ব্যতীত আমাদের মধ্যে আর কেউ রোযাদার ছিলেন নাআর আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) প্রসিদ্ধ কবি সাহাবীদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে তাঁর রচিত নিম্নবর্ণিত কবিতাসমূহ ইমাম বুখারী (র) উদ্ধৃত করেছেন :
إذا انشق معروف من الفجر ساطع إذا استثقلت بالمشركين المضاجع به موقنات أن ماقال واقع
وفينا رسول الله نتلوا كتابه يبيت يجافی جنبه عن فراشه أتي بالهدى بعد العمى فقلوبنا
আমাদের মধ্যে রয়েছেন আল্লাহর রাসূল (সা)। যখন ফজরের কল্যাণময় আলো রাতকে ভেদ করে উদ্ভাসিত হয়, তখন আমরা তার আনীত কিতাব তিলাওয়াত করি। তিনি রাত যাপন করেন তবে বিছানা হতে নিজকে পৃথক করে রাখেন। অথচ তখন মুশরিকদের জন্যে শয্যা ত্যাগটা দুরূহ হয়ে পড়ে। ব্যাপার বটে! গোটা পৃথিবী মূর্খতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার পর তিনি হিদায়াতের জ্যোতি নিয়ে এসেছেন। অতএব, আমাদের অন্তরসমূহ তাঁর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করেছে এ জন্যে যে, তিনি যা কিছু বলেন তা বাস্তবেও প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
ইমাম বুখারী (র)– নুমান ইব্ন বশীর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “একদিন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) বেহুশ হয়ে যান। তখন তাঁর বোন আম্রা (রা) কান্নাকাটি করছিলেন। আর বলছিলেন, “হে আমার পাহাড়! হে আমার অমুক! ইত্যাদি বিভিন্ন গুণের কথা স্মরণ করছিলেন। যখন হুশ ফিরে আসলো তখন তিনি বোনকে বললেন, ‘তুমি আমার যতগুলো গুণের কথা উল্লেখ করেছ সবগুলোর ক্ষেত্রে আমাকে বলা হয়েছে যে, তুমি কি বাস্তবেও এরূপই?”
ইমাম বুখারী (র) অন্য এক সনদে নুমান ইবন বশীর হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা একদিন বেহুঁশ হয়ে পড়েন— এরপর যখন তিনি শহীদ হলেন, তখন তার বোন আর তার জন্যে কান্নাকাটি করেননি। হাস্সান ইবন ছাবিত (রা) তার মৃত্যুতে শোকগাথা রচনা করেন- যা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। মৃতার যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তনকারীদের অন্যতম একজন মুসলিম কৰিও তাঁর সম্পর্কে বলেন, “আমি মূতার যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তন করেছি এটাই আমার জন্যে মর্মপীড়ার জন্যে যথেষ্ট। জাফর (রা), যায় (রা) ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) রয়ে গেলেন মূতার কবরস্থানে। তারা তাদের জীবনকাল পূর্ণ করেছেন যখন তারা তাদের পথে চলে গেছেন। পক্ষান্তরে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে মুসীবত ভোগ করার জন্যে আমি পেছনে রয়ে গেলাম।
উক্ত তিনজন আমীর সম্পর্কে হাস্সান ইব্ন ছাবিত (রা) ও কা’ব ইব্ন মালিক (রা)-এর রচিত শোকগাথা পরবর্তীতে উল্লেখ করা হবে।
মূতার যুদ্ধে যারা শাহাদত বরণ করেন
মুহাজিরগণের মধ্যে
১. জাফর ইবন আবু তালিব (রা), তাঁদের আযাদকৃত গোলাম।
২. যায়দ ইবন হারিছা আল-কাবী (রা)।
৩. মাসউদ ইব্ন আসওদ ইবন হারিছা ইব্ন নাযলা আল-আদভী (রা)। ওহাব ইবন সা’দ ইবন আবৃসহ (রা) ।
আনসারগণের মধ্যে
(১) আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা আল-খাযরাজী। (২) আব্বাদ ইবন কায়স আল-খারাজী। (৩) হারিছ ইবন নুমান ইবন আসাফ ইবুন নাফ নাজ্জারী। (৪) সুরাকা ইবন আমর ইবন আতীয়্যা ইবন খাসা মাযিনী।
মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যে সর্বমোট উক্ত আটজন শহীদ হন। এ সংখ্যাটি ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন। তবে ইবন হিশাম মূতার যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারীদের নাম বৃদ্ধি করে বলেন : (৯) আবু কুলায়ব (১০) জাবির উক্ত দুইজন আমর ইব্ন যায়দ ইবন আউফ ইবন মাল আল-মাযুনী এর পুত্র ছিলেন। তারা দুইজন সহোদর ছিলেন। (১১) আমর (১২) আমির উক্ত দু’জনই সা’দ ইবন হারিছ ইব্ন আব্বদ ইবন সা’দ ইব্ন আমির ইবন সা’লাবা ইবন মালিক ইবন আফসা এর পুত্র ছিলেন। আল্লাহ্ তাঁদের সকরলে প্রতি সন্তুষ্ট হন। এ চারজনও আনসারগণের মধ্যে। কাজেই দুটো অভিমত অনুযায়ী মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১২। এটা একটি বড় সফলতা। কেননা, দুটি সেনাদল তুমুল যুদ্ধ করেছেন। একদল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেন তাদের সংখ্যা মাত্র তিন হাজার। আর অন্য দলটি কাফির তাদের সংখ্যা দুই লাখ-এক লাখ রোমান এবং এক লাখ আরব খৃষ্টান। তাদের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয়। মুসলমান পক্ষে ১২ জন ছাড়া আর কেউ নিহত হননি। পক্ষান্তরে মুশরিক পক্ষে নিহতের সংখ্যা ছিল প্রচুর। একা খালিদ (রা)-এর হাতেই নয়টি তলোয়ার ভেঙ্গে ছিল। আর তাঁর হাতে মাত্র একটি ইয়ামানী তলোয়ার বাকী ছিল। এ থেকেই অনুমান করা যায়, এ নয়টি তলোয়ার কত শত্রু সৈন্যকে ঘায়েল করেছে। অন্যান্য মুজাহিদদের কথা আর এখানে উল্লেখ করার দরকার পড়েনা। কাফিরদের উপর সব সময়ই আল্লাহ্ তা’আলার অভিসম্পাত। আল্লাহ তা’লার বাণী :
অর্থাৎ দুটি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। একদল আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছিল, আর অন্য দল কাফির ছিল। কাফিররা মুসলমানদেরকে চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় এটাতে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকের জন্য শিক্ষা রয়েছে। (৩ আলে-ইমরান : ১৩)। এ যুদ্ধের ব্যাপারেও প্রযোজ্য।
এ সৈন্যদলের আমীরদের মাহাত্ম্য সম্পর্কে একটি হাদীছ
আমীরগণ হলেন : যায়দ ইবন হারিছ, জা’ফর ইবন আবু তালিব এবং আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা)।
ইমাম আবু ঘুরআ’– আবু উমামা বাহিলী (রা) হতে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, “একদিন আমি নিদ্রিত ছিলাম। স্বপ্নে দেখি, দুইজন লোক আমার কাছে আসলেন এবং আমার দুই বাহু শক্ত করে ধরলেন। আর আমাকে একটি অসমতল পাহাড়ে নিয়ে গেলেন এবং দুজনে আমাকে বললেন, এটাতে আপনি আরোহণ করুন! আমি বললাম, আমি আরোহণ করতে পারবো না। তারা বললেন, আমরা এ ব্যাপারটি আপনার জন্যে সহজ করে দেবো।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “আমি পাহাড়ে চড়লাম । যখন পাহাড়ের মাঝামাঝি পৌঁছলাম তখন বিকট চীৎকার শুনতে পেলাম, আমি বললাম, এগুলো কিসের চীৎকার?’ দুই ফেরেশতা বললেন, এগুলো হচ্ছে জাহান্নামীদের আর্তনাদ। এরপর তারা আমাকে নিয়ে অগ্রসর হলেন। দেখলাম, একটি দলকে তাদের গ্রীবা ধমনী দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের ক্ষতবিক্ষত চোয়ালদ্বয় দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, এরা কারা? উত্তরে তারা বললেন, ‘এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত লোক যারা রোযা ভঙ্গ করত। তারপর তারা আমাকে আরো সামনে নিয়ে গেলেন। দেখলাম, একদল লোকের মৃত দেহ ফুলে গিয়ে ভীষণ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তাদের সে দুর্গন্ধ বিষ্টার দুর্গন্ধের ন্যায় অস্বস্তিকর। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? ফেরেশতাগণ বললেন, এরা কাফিরদের মধ্যকার নিহত ব্যক্তিবর্গ। তারপর আমাকে নিয়ে তারা আরো অগ্রসর হলেন। এখানেও কতিপয় লোকের দেহ দেখতে পেলাম যেগুলো ফুলে গিয়ে বিষ্টার মত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। আমি বললাম, এরা কারা? ফেরেশতাগণ উত্তরে বললেন, এরা ব্যভিচারী পুরুষ ও নারী। তারপর আমাকে আরো সামনে নিয়ে গেলেন তাঁরা। দেখলাম, এমন কতিপয় নারী যাদের স্তনে সর্প দংশন করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? এদের অবস্থা এরূপ কেন? ফেরেশতাগণ উত্তরে বললেন, এরা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে তাদের দুধ পান করতে দেয়নি। এরপর তারা দুইজন আমাকে সম্মুখে নিয়ে চললেন। দেখলাম, কতগুলো বালক যারা দুটি সাগরের মধ্যে খেলাধুলা করছে। আমি বললাম, এরা কারা? ফেরেশতাগণ বললেন, ‘এরা মু’মিনদের নাবালক অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী সন্তান। এরপর তারা আমাকে একটি উঁচু জায়গায় নিয়ে গেলেন। তিনজনের একটি দলকে দেখলাম যারা জান্নাতী সূরা পানরত। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘এরা কারা? ফেরেশতাগণ জবাব দিলেন, এঁরা হচ্ছেন, জা’ফর ইবন আবূ তালিব যায়দ ইবন হারিছ এবং আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা)। তারপর তারা আমাকে অন্য একটি উঁচু জায়গায় নিয়ে গেলেন। সেখানেও দেখলাম তিনজনের একটি দল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তাঁরা বলেন, এঁরা হচ্ছেন, ইব্রাহীম, মূসা এবং হযরত ঈসা (আ)। আর তারা আপনার জন্যে প্রতীক্ষায় রয়েছেন।
মূতার যুদ্ধ সম্পর্কে কথিত কবিতামালা
ইবন ইসহাক বলেন, মূতার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের শোকগাথা রচনা করেছেন কবি হাস্সান ইবন ছাবিত। কবি বলেন :
تأو بني ليل بيثرب أعسر وهم إذا ما نؤم الناس مسه
سفوحا و أسباب البكاء التذگر
الذكرى حبيب هيجت لي عبرة بلى إن فقدان الحبيب بلية وكم من كريم يبتلي ثم يصبر
شعوبا وخلفأبعدهم يتأخر
رأيت خيار المسلمين تواردوا
بمؤتة منهم ذو الجناحين جعفر
فلا يبعدن الله قتلی تتابعوا
جميا و أسباب المنية تخطر
وزيد وعبد الله حين تتابعوا
إلى الموت ميمون النقيبة أزهر
غداة مضوا بالمؤمنين يقودهم
أبي إذا سيم الظلامة مجسر
أغر كضوء البدر من آل هاشم
بمعترك فيه القنا متكسر
فطاعن حتى مال غير مؤسد
جنان وملتف الحدائق أخضر
فصار مع المستشهدين ثوابه
وكنا نرى في جعفر من محمد وفاء و أمرا حازما حين يأمر وما زال في الاسلام من آل هاشم دعائم عز لأيزنن و مفر هموا جبل الاسلام والناس حولهم رضام الي طود يروق ويبهر
على ومنهم أحمد المتخر
بها ليل منهم جعفر وابن أمه
عقيل وماء العود من حيث يعصر
وحمزة والعباس منهم ومنهموا
ماس إذا ما ضاق بالناس مصدر
بهم فرج اللأواه في كل مأزق
عليهم، وفيهم ذا الكتاب المطهر
هم أولياء الله أن….زل حكمة
রাত আমাকে মদীনায় বিষণও চিন্তিত অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে। অন্যদিকে জনগণ যোদ্ধাদের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় বিনিদ্র রজনী পালন করছে। আমি আমার বন্ধুর স্মরণে অশ্রুপাত করছি । কারো জন্যে ক্রন্দনের কারণগুলোর মধ্যে তার স্মরণ অন্যতম। হ্যাঁ এটা সকলের কাছে স্বীকৃত যে, বন্ধুর মৃত্যু একটি নিদারুণ বিপদ। কতইনা সম্মানিত লোককে পরীক্ষা করা হয়। তারপর তাকে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হতে আমি দেখেছি। আবার তাদের উত্তরসূরীদেরকে তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতেও দেখেছি। সুতরাং আল্লাহ্ যেন মূতায় পরপর নিহত ব্যক্তিদের উত্তরসূরীদেরকে তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত না করেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন দুই ডানার বিশিষ্ট জা’ফর, যায়িদ ও আবদুল্লাহ (রা)। তাঁরা সকলেই পর পর শাহাদত বরণ করেছেন। তাঁদের মৃত্যুর পরিস্থিতি ছিল ভীতিপূর্ণ। প্রত্যুষে তারা যেন মুসলিম বাহিনীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। তবে নেতৃত্ব ও পরিচালনার পুরস্কার অত্যন্ত সুখময় এবং পূর্ণিমার চাঁদের আলোর ন্যায় সমুজ্জ্বল। আর এ নেতৃত্ব হাশিম বংশের একজন তরুণ থেকে এমন সময় এসেছে যখন ভূমণ্ডল ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন । এরপর তিনি হামলা করেন ও অগ্রসর হন। আর যুদ্ধ বিগ্রহের কোন ভয়াবহতাই তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। কোন প্রতিরোধ তাকে থমকে দিতে পারেনি। তিনি শাহাদতকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলেন। তাঁর কার্যকলাপের সওয়াব হল জান্নাতসমূহ, চিরসবুজ ঘন বৃক্ষাদি বিশিষ্ট উদ্যানরাজি। আমরা জা’ফরের মধ্যে মুহাম্মাদ (সা)-এর কয়েকটি গুণের সমাহার দেখতে পাই, এগুলো হচ্ছে ওয়াদা পালন, নির্দেশ প্রদান, নেতৃত্বে দক্ষতা ও পারদর্শিতা। বনূ হাশিমের বহু সদস্য সব সময় ইসলামের গর্ব এবং চিরস্থায়ী সম্মানিত স্তম্ভ হিসেবে পরিগণিত। তাঁরা পাহাড়ের ন্যায় ইসলামের খাঁটি কর্ণধার । আর জনগণ তাদের চতুর্দিকে বিভিন্ন স্তরবিশিষ্ট বড় বড় সৌন্দর্যময় ও রাতের বেলায় সমুজ্জ্বল পাথরের স্তূপের ন্যায়। বনূ হাশিমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জাফর ও তার ভাই আলী (রা)। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কল্যাণকামী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী আহমদ মুস্তফা (সা)। তাদের মধ্যে রয়েছেন হামযা, আব্বাস, আকীল (রা) যেখান থেকে কোন কোন সময় কাষ্ঠ খণ্ডের সাহায্যেও পানি নিংড়ানো হয়। যখন জনগণের জন্যে রহমতের উৎস সংকীর্ণ হয়ে যায় এরূপ প্রতিটি সংকটে তাঁদের সুপারিশে বালা মুসীবত দূর হয়। তাঁরাই আল্লাহর বন্ধু। তাঁদের উপরই আল্লাহ তা’আলা জ্ঞান-বিজ্ঞান অবতীর্ণ করেছেন এবং তাদের মধ্যেই রয়েছেন মহা পবিত্র কিতাবের ধারক ও বাহক।
কাব ইবন মালিক (রা) বলেন :
خر
سحا كما وكف الطباب المخضل
نام العيون ودمع عينك يهمل في ليلة وردت على همومها طورا أخ وتارة أتمهل
ببنات نعش والسماك موكل
واعتادنی حزن فبت كأنني
مماتاوبني شهاب مدخل
وكأنما بين الجوانح والحشا
يوما بمؤتة أسندوا لم ينقلوا
وجدا على النفر الذين تابعوا
وسقى عظامهم الغمام المسبل
صلى اله عليهم من فتية
حذر الردى ومخافة أن ينكلوا
صبروا بمؤتة للأله نفوسهم
فنق عليهن الحديد المرفل
فمضوا أمام المسلمين كأنهم إذ يهتدون بجعفر ولوائه حيث التقى و عث الصفوف مجدل
والشمس قد سفت وكادت تافل
فتغير القمر المنبر لفقده قرم علی بنيانه من هاشم فرعا أشم وسؤددا ماينقل
وعليهم نزل الكتاب المنزل
قوم بهم عصم الاله عباده
وتغمدت أحلامهم من يجهل
فضلوا المعاشر عزة وتكرما
وترى خطيبهم بحق يفصل
لا يطلقون الى السفاه حباهموا
تندى اذا اعتذر الزمان الممحل
بيض الوجوه ترى بطون أكفهم ويهديهم رضي الإله لخلقه وبجهم نصر البى المرسل
সকলেই ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে অন্যদিকে তোমার নয়ন অশ্রু ঝরাচ্ছে। আর তা এতই বেশী অশ্রুপাত করছে যে, কোন সফলকাম চিকিৎসকও তা বন্ধ করতে সক্ষম নয়। এ অশ্রুপাত ঘটেছে এমন একরাতে যে রাতে আমার উপর দুঃখ নেমে এসেছে। কোন কোন সময় আমি সশব্দে কাঁদি আবার কোন কোন সময় আমি তাতে বিরতি দেই। আমাকে উদ্বিগ্ন এতই নাজেহাল করেছে যে, বিনিদ্র রাত যাপন করার সময় আমি যেন সপ্তর্ষিমণ্ডল ও মীন রাশির দায়িত্বে নিয়োজিত। আর পাঁজর ও নাড়িভুড়ির মধ্যভাগে অবস্থান করছে একটি উল্কা (নকশা) যা আমাকে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য করেছে এবং ক্রোধান্বিত করেছে ঐ সমস্ত লোককে যারা মূতার যুদ্ধে সেনাপতির আদেশের অনুগত ছিল, আদেশ পালনে নিষ্ঠাবান ছিল এবং বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। আল্লাহ্ তা’আলা এরূপ তরুণদের উপর রহমত বর্ষণ করুন এবং বৃষ্টিতে পরিপূর্ণ মেঘখণ্ড তাদের নেতাদেরকে তৃপ্ত করুক। তারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে মূতার যুদ্ধে ধৈর্য ধারণ করেছিলেন। নিজেদের ধ্বংসকে প্রতিহত করা এবং পালিয়ে আসার ভয়ে তারা প্রাণপণ যুদ্ধ করেছেন। সাহসী সেনারা সাধারণ মুসলিম সেনাদের সম্মুখভাগে অগ্রসর হলেন। তারা যেন দুঃখের পর শাহাদতের সুখ ভোগ করতে লাগলেন। তাঁদের পরনে ছিল প্রলম্বিত লৌহবর্ম । যারা জাফর (রা) ও তাঁর হাতে ধারণকৃত পতাকার দ্বারা সঠিক পথের দিশা পেয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন সামনের দিকে অগ্রগামী দলের সম্মুখে। সেই অগ্রগামী দল কতই না উত্তম দল। এরপর যুদ্ধরত বুহ্যগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। যেখানে সৈন্যের সারিগুলো ভীষণ যুদ্ধে রত ছিল, সেখানে জা’ফরও এ ভয়াবহ যুদ্ধে যোগদান করেন এবং শাহাদতবরণ করেন। তাঁর শাহাদতের কারণে উজ্জ্বল নক্ষত্র যেন বিবর্ণ হয়ে পড়ল, সূর্য গ্রহণে পতিত হল ও অস্ত যাওয়ার উপক্রম হল । তিনি ছিলেন বনূ হাশিমের সম্মানিত ব্যক্তি, গর্বের বস্তু, সুদক্ষ প্রধান, যার কোন বিকল্প নেই। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিলেন আল্লাহর এমনি পিয়ারা বান্দা যাদের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বান্দাদেরকে সুরক্ষিত করেছেন। তাদের উপর কুরআনুল করীম অবতীর্ণ হয়েছে। তারা সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন। যারা সমাজের অজ্ঞ তাদেরকে তারা চারিত্রিক মাধুর্যে গড়ে তুলেছিলেন এবং তাদেরকে অজ্ঞতার অন্ধকারে থাকতে দেননি। তারা তাদেরকে প্রেমপ্রীতি বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। তুমি তাদের বক্তাকে দেখবে যে সত্যকেই জনগণের কাছে তুলে ধরে। তারা জ্যোতির্ময় চেহারার অধিকারী। যখন দেশে অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন তুমি তাঁদেরকে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করতে দেখবে। প্রতিপালকের সন্তুষ্টিই তাঁর মাখলুকের হিদায়াতের জন্যে তাদেরকে উৎসাহিত করে এবং প্রেরিত নবীর সাহায্যের জন্যেই তারা প্রচেষ্টায় রত থাকেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসকদের কাছে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পত্র ও দূত প্রেরণ
ওয়াকিদী উল্লেখ করেন যে, ব্যাপারটি হুদায়বিয়ার উমরা পালনের পর ৬ষ্ঠ হিজরীর শেষ, যিলহজ্জ মাসে সংঘটিত হয়েছিল। বায়হাকী মূতার যুদ্ধের পর এ অধ্যায়টি উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ অধিক পরিজ্ঞাত। তবে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই যে, এটি মক্কা বিজয়ের পূর্বে এবং হুদায়বিয়ার পর সংঘটিত হয়েছে। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হল যে, আবু সুফিয়ানকে রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াস যখন জিজ্ঞেস করেন, তিনি কি চুক্তি ভঙ্গ করেন :’ তখন আবু সুফিয়ান বলেন, ‘না, তবে আমরা তাঁর সাথে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অংগীকারাবদ্ধ আছি, সে ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে কতটুকু পালন করবে তা আমি জানি না । ইমাম বুখারীর ভাষায় এ ঘটনাটি ঘটেছিল ঐ সময়ে যখন আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, এ ঘটনাটি ঘটেছিল হুদায়বিয়া এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ওফাতের মধ্যবর্তী সময়ে। আমরা এ ঘটনাটি এখানেই বর্ণনা করব। ওয়াকিদীর মত সঠিক হওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আল্লাহই অধিক পরিজ্ঞাত।
মুসলিম– আনাস ইবন মালিক (রা) হতে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মূতার যুদ্ধের পূর্বে পারস্যের সম্রাট কিসরা, রোমের সম্রাট কায়সার, নাজাশী ও প্রতিটি প্রতাপশালী শাসককে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে পত্র দিয়েছেন। উল্লিখিত নাজাশী ঐ নাজাশী নয় যার জানাযা রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আদায় করেছিলেন।
ইউনুস ইবন বুকায়র– আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আবু সুফিয়ান নিজ মুখে আমার নিকট বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “আমরা ছিলাম ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং যুদ্ধ ছিল আমাদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। আর আমাদের সম্পদ ছিল প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এরপর যখন রাসূলুল্লাহ (সা) ও আমাদের মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদিত হল ঐ মুহূর্তে আমরা কারো থেকে নিরাপত্তা পেলেও আমরা কাউকে নিরাপত্তা দিতাম না। সন্ধির পর আমি কুরায়শদের কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ীসহ ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হলাম । আল্লাহর শপথ, আমার জানামতে মক্কায় এমন কোন নারী পুরুষ বাকী ছিল না যার ব্যবসা সামগ্রী আমার সাথে ছিল না। সিরিয়া অঞ্চলে ফিলিস্তীনের গাঁজা এলাকায় ছিল আমাদের বাণিজ্য কেন্দ্র। আমরা সেখানে উপস্থিত হলাম। সে সময় রোম সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যে অবস্থিত বিদ্রোহী পারস্য বাসীদের উপর জয়লাভ করেছিলেন। ও তাদেরকে দখলকৃত এলাকা থেকে বহিষ্কার করেন এবং তারা সম্রাটকে তার প্রধান ক্রুশ ফেরত দান করে যা তারা পূর্বে তার নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যখন সম্রাট তা ফেরত পেলেন, তখন তিনি তাঁর তখনকার অবস্থানস্থল সিরিয়ার হিমস থেকে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে পদব্রজে বায়তুল মুকাদ্দাসে রওয়ানা হন। তাঁকে সেখানে স্বাগত জানানো হয় এবং তার উপর পুষ্পবৃষ্টি করা হয়। তিনি ইলিয়ায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং সেখানে তিনি সালাত আদায় ও রাতযাপন করলেন। সকালে তিনি বিমর্ষ হয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। নজর তার আকাশের দিকে ছিল। তার চেহারা মলিন দেখে পাদ্রীরা বললেন, জাহাপনা আপনাকে যে বিমর্ষ মনে হচ্ছে! হিরাক্লিয়াস জবাব দিলেন : হ্যাঁ। তারা তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন : গত রাতে তারকারাজি পর্যবেক্ষণ করে আমি দেখতে পেলাম যে, খাতনাকারীদের বাদশাহ্ আত্মপ্রকাশ করেছেন। উপস্থিত সভাসদগণ বললেন, ‘আপনার ভয়ের কোন কারণ নেই। কেননা, আমরা জানি যে, শুধু ইয়াহূদীরাই খাতনা করে। তারা কোন শক্তিশালী জাতি নয়। তারা আপনার অধীনস্থ প্রজা মাত্র। তারপরেও যদি আপনি তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার আশংকাবোধ করেন, তাহলে সারা দেশে লোক প্রেরণ করে সকল ইয়াহুদীকে হত্যা করে আপনি স্বস্তি বোধ করতে পারেন। তারা যখন নিজেদের মধ্যে এরূপ সলা পরামর্শ করছিল তখনই বুশরার শাসনকর্তার একজন দূত আরবের এক ব্যক্তিকে নিয়ে ম্রাটের নিকট আগমন করল । দূত বলল, হে সম্রাট! এ লোকটি আরব থেকে এসেছে। তারা বকরী ভেড়া উট ইত্যাদির মালিক। তাদের দেশে এক নতুন ঘটনা ঘটে গেছে আপনি তাকে জিজ্ঞেস করলে সে তার বর্ণনা দেবে । লোকটি যখন সম্রাটের কাছে আগমন করল তখন সম্রাট দোভাষীকে বললেন, তাকে প্রশ্ন কর, তার দেশে কী ঘটনা ঘটে গেছে? তাকে প্রশ্ন করা হল। উত্তরে সে বলল, আরব দেশের কুরায়শ বংশের এক ব্যক্তি নিজেকে নবী বলে দাবী করেন। কিছু সংখ্যক লোক তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং অন্যান্যরা তার বিরোধিতা করে। বহু জায়গায় তাদের মধ্যে সংঘর্ষ সংঘটিত হয় । তারা এরূপ অবস্থায় আছে । আমি তাদেরকে এ অবস্থায় রেখেই আমি আপনার নিকট এসেছি । এ সংবাদ দেয়ার পর সম্রাট তাকে বিবস্ত্র করার হুকুম দিলেন। দেখা গেল তার খাতনা করা হয়েছে। সম্রাট বললেন, আল্লাহর শপথ, এটাই আমি স্বপ্নে দেখেছি। তোমরা যা বলছ তা ঠিক নয়। তাকে তার বস্ত্র ফেরত দাও। হে আগন্তুক! তুমি তোমার কাজে চলে যাও। তারপর তিনি তার পুলিশ প্রধানকে ডাকলেন এবং সমগ্র সিরিয়ায় খোঁজাখুজি করে তার গোত্রের এমন একজন লোককে খুঁজে আনার জন্যে হুকুম দিলেন যে, ঐ কথিত নবী সম্বন্ধে সবকিছু বলতে পারবে । আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমি আমার সাথীদের সহ গাঁজায় অবস্থান করছিলাম। আমাদের কাছে একজন এসে আমাদেরকে প্রশ্ন করলেন, তোমরা কোথাকার লোক? ‘আমরা তাকে আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানালাম। তিনি তখন আমাদের সকলকে সম্রাটের কাছে নিয়ে গেলেন। আমরা সকলে সম্রাটের কাছে গেলাম। আল্লাহর শপথ, আমি তাকে অত্যন্ত চিন্তিত দেখতে পেলাম। আমরা যখন তাঁর কাছে পৌঁছলাম, তখন তিনি আমাদেরকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আত্মীয়তার দিক দিয়ে, কে ঐ ব্যক্তির সর্বাধিক ঘনিষ্ট?” আবু সুফিয়ান (রা) উত্তরে বললেন, “আমি”। সম্রাট বললেন, তাকে আমার নিকটে নিয়ে এসো।’ তখন তিনি আমাকে নিজের সামনে বসালেন এবং আমার সংগীদেরকে আমার পিছনে বসাবার হুকুম দিলেন আর তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘যদি তোমাদের সংগী মিথ্যা বলে তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। আবু সূফিয়ান বলেন, “আমি জানতাম যে, যদি আমি মিথ্যে বলি তাহলে আমার সংগীরা প্রতিবাদ করবে না, কিন্তু আমি ছিলাম একজন সর্দার ও নেতৃস্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তি। কাজেই আমি মিথ্যা বলাটাকে লজ্জাজনক মনে করলাম। আমি আরো জানতাম যে, মিথ্যার মত সামান্য কিছু ত্রুটিও যদি তারা আমার মধ্যে দেখতে পায়, তাহলে তারা এটা নিয়ে মক্কায় সমালোচনা করবে, এজন্যে আমি মিথ্যা বলিনি।
তারপর সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মধ্যে যিনি নুবুওতের দাবী করেছেন তার সম্বন্ধে আমাকে বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশন কর’। আবু সুফিয়ান বলেন, আমি তাকে খাটো করে দেখাবার প্রয়াস পেলাম। তাই আমি বললাম, আপনার যা কিছু জানার দরকার মনে করেন, তা জিজ্ঞেস করতে পারেন।’ তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে তাঁর বংশ মর্যাদা কেমন?’ উত্তরে আমি শুধুমাত্র বললাম, আমাদের মধ্যে তাঁর বংশ মর্যাদা উত্তম। তিনি বললেন, ‘আমাকে তুমি সংবাদ দাও যে, তার পরিবারের মধ্যে পূর্বে কেউ এরূপ দাবী করেছিল কি না? তাহলে বুঝা যেত যে, তিনি তার অনুকরণ করছেন। আমি বললাম, না। তিনি বললেন, ‘অমাকে সংবাদ দাও যে তার কোন রাজত্ব ছিল কি না-যা তোমরা তাঁর থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছ? সুতরাং এটাকে তোমাদের থেকে ফেরত নেবার জন্যে তিনি নুবুওতের দাবী করছেন। আমি বললাম, ‘না’ । তিনি বললেন, তাহলে তার অনুসারীদের ব্যাপারে আমাকে সংবাদ দাও যে তারা কারা? আমি বললাম, কিশোর, দুর্বল এবং নিঃস্ব গোত্রের লোকেরা। তবে তাদের মধ্যে যারা ভদ্র ও উচ্চ বংশের তারা তাকে বিশ্বাস করছেনা।’ তিনি বললেন, “আমাকে সংবাদ দাও যে, তার অনুসারীরা তাকে ভালবাসে এবং সম্মান করে কি না? নাকি তাকে ঘৃণা করে কিংবা তার থেকে পৃথক হয়ে যায়? আমি বললাম, এমন কোন অনুসারী তার নেই যে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’ তিনি বললেন, ‘এখন আমাকে তুমি তোমাদের ও তাঁর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের খবর দাও।’ তখন আমি তাকে বললাম, ‘যুদ্ধ হচ্ছে একটি পানির বালতির ন্যায় কখনও আমাদের দখলে থাকে আবার কখনও তাঁর দখলে থাকে। অর্থাৎ পালাক্রমে জয় পরাজয় চলছে।’ তিনি বললেন, আমাকে সংবাদ দাও তিনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন কি?’ আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, ‘তাকে ওয়াদা ভংগকারী হিসেবে চিহ্নিত করার কোন সুযোগ না পেয়ে শুধুমাত্র বললাম, না তবে আমরা তার সাথে একটি চুক্তির মধ্যে আছি, এ ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা নেই যে, তিনি কোন প্রকার ওয়াদা ভংগ করবেন না । আল্লাহর শপথ, রোম সম্রাট আমার এ কথার প্রতি কোন কর্ণপাতই করলেন না।’ আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, তারপর আবার তিনি কথা শুরু করলেন এবং বললেন, তুমি বলেছ তিনি তোমাদের মধ্যে উত্তম বংশের সন্তান। এরূপে আল্লাহ্ তা’আলা নবীগণকে উত্তম বংশ হতে মনোনীত করেন। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম যে তাঁর পরিবার-পরিজনের মধ্যে কেউ কি তাঁর মত এরূপ দাবী করেছে? তাহলে বুঝতাম যে, তিনিও অনুরূপ বলছেন । তুমি বলেছ, ‘না’ আবার তোমাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম তার কি কোন রাজত্ব আছে যা তোমরা তাঁর থেকে ছিনিয়ে নিয়েছ? সুতরাং তিনি তাঁর রাজত্ব ফিরে পাবার জন্যে নুবুওয়াতের দাবী করছেন। তুমি উত্তরে বলেছ ‘না’ । তোমাকে আমি তাঁর অনুসারীদের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছি। উত্তরে তুমি বলেছ, তারা কিশোর, দুর্বল ও নিঃস্ব গোছের লোকজন। আর সকল যুগের নবীদের অনুসারীরা এরূপই ছিলেন। আবার আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি যে, যারা তাঁর অনুসারী তারা কি তাকে ভালবাসে এবং সম্মান করে? না তাকে ঘৃণা করে ও তার থেকে পৃথক হয়ে যায়? তুমি বলেছ, যারা তার সাথী হয়েছে তাদের কেউই তার থেকে পৃথক হয়ে যায়নি। আর এরূপই হচ্ছে ঈমানের স্বাদ। যদি একবার অন্তরে প্রবেশ করে তাহলে তা বের হয়ে যায় না। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি, তাঁর আর তোমাদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের খবর কী? তুমি বলেছ, তা একটি পানির বালতির ন্যায় কিছুদিন এটা তোমাদের দখলে থাকে আবার কিছুদিন তার দখলে থাকে। আর এরূপই হয়েছিল নবীদের যুদ্ধ। পরিণামে তাদেরই জয় হয়। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি কি ওয়াদা ভংগ করেন : তুমি বলেছ, তিনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। যদি আমার কাছে সব সত্য কথা বলে থাকো, তাহলে মনে রেখো, তিনি আমার দুপায়ের তলা পর্যন্ত জয় করে নেবেন। আমার ইচ্ছে হয় যে, আমি যদি তার কাছে পৌঁছতে পারি তাহলে তাঁর পা ধুইয়ে দেই। এরপর তিনি বললেন, তুমি তোমার কাজে চলে যাও। আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, ‘আমি দাঁড়িয়ে গেলাম এবং এক হাতকে অন্য হাত দ্বারা আঘাত করলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর বান্দাগণ! চেয়ে দেখো, আয়ূ কাবসার ছেলের ব্যাপারটি কী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বনুল আসফাবের (রোম) শাসকরাও তাঁর দরুন তাদের রাজত্বের জন্যে ভয় করছে।”
ইবন ইসহাক বলেন, যুহরী আমাকে বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর যুগের খৃস্টানদের এক ধর্মযাজক আমাকে বলেছেন যে, দিহইয়া ইবন খলীফা (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর একটি পত্র নিয়ে রোমক সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে আগমন করেন। পত্রের পাঠ ছিল নিম্নরূপ :
بسم الله الرحمن الرحيم– من محمد رسول الله إلى هرقل عظيم الروم ،
سلام علی من اتبع الهدى أما بعد ، فأسلم تسلم يؤتك الله أجرك مرتين ، فان
أبيت فان إثم الأكاريين عليك *
পরমদাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা) হতে রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। যে হিদায়াতের পথ অনুসরণ করে তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এরপর ইসলাম গ্রহণ কর, নিরাপত্তা লাভ করবে। তোমাকে আল্লাহ্ তা’আলা দ্বিগুণ ছওয়াব দান করবেন। আর তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার কর, তাহলে তোমাকে কৃষক প্রজাদের গুনাহ্ ও তোমার উপর বর্তাবে। যখন তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পত্র পোঁছল, তখন তিনি এটা পড়লেন এবং ধরে রাখলেন। তারপর পত্রটি কোমরও উরুর মধ্যবর্তী জায়গায় হিফাযত করে রাখলেন। তারপর তিনি তাঁর একজন রোমীয় বন্ধুর কাছে পত্র লিখলেন। তার বন্ধুটি হিব্রু ভাষা জানতেন। তার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পক্ষ থেকে যে পত্রটি এসেছিল তার অর্থ অনুধাবন করে। তারপর সে তার পত্রের উত্তরে লিখে যে, তিনি সত্য নবী যার জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে। তার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। তাই তাঁর অনুসরণ কর ।
এরপর রোমের সম্রাট, রোমের শাসনকর্তাদেরকে আদেশ দিলেন, তারা যেন তাঁর সাম্রাজ্যের দ্বাররুদ্ধ একটি প্রাসাদে সমবেত হয়। প্রাসাদে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। আর তিনি দোতলার একটি কামরা থেকে তাদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তিনি তাদেরকে অনেক ভয় করতেন। এরপর তিনি বলেন, হে রোমানগণ! আহমদের পক্ষ হতে আমার কাছে একটি পত্র এসেছে। নিশ্চয়ই তিনি এমন একজন নবী আমরা যার অপেক্ষা করছি, যার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমাদের কিতাবে রয়েছে এবং আমরা যাকে তাঁর যুগ ও তাঁর বিশেষ বিশেষ নিদর্শনসমূহের সাহায্যে সহজেই চিনতে পারি। সুতরাং তোমরা সকলে মুসলমান হয়ে যাও এবং তাঁর অনুসরণ কর। তাহলে তোমরা দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি লাভ করতে পারবে। তখন তারা একই লোকের ন্যায় সমস্বরে চীকার করতে লাগল এবং প্রাসাদের দরজার দিকে ধাবিত হল । তবে এগুলোকে তারা পিছন থেকে বন্ধ দেখতে পেল। সম্রাট তাতে ভড়কে গেলেন এবং বললেন, তাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল। তখন তিনি তাদেরকে বললেন, “হে রোমানগণ! আমি কেবল তোমাদেরকে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে এ কথাটি বলছি যেন তোমরা তোমাদের ধর্মে কতটুকু দৃঢ় আছ তা আঁচ করতে পারি। এখন আমি তোমাদেরকে এ অবস্থা দেখে খুশী হলাম।” তখন তারা তার সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। তারপর তাদের জন্যে প্রাসাদের দ্বার খোলা হল এবং তারা বের হয়ে গেল।
ইমাম বুখারী (র) হিরাক্লিয়াসের সাথে আবু সুফিয়ান (রা)-এর ‘টনাটি কিছু বর্ধিত কলেবরে বর্ণনা করেছেন। আমি সহীহ বুখারীর উপস্থাপিত সনদ ও শব্দ উল্লেখ সহকারে ঘটনাটি বর্ণনা করার আশা পোষণ করি। যাতে দুই ঘটনার মধ্যে পূর্বাপর পার্থক্য ও এগুলোর মধ্যে সন্নিবেশিত তথ্যাদি প্রকাশ পায়।
বুখারী (রা) সহীহ্ কিতাবে ঈমান অধ্যায়ের পূর্বে তার বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। তিনি আবুল ইয়ামান আল-হাকাম–… আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আবু সুফিয়ান (রা) তাঁর কাছে বর্ণনা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই রোমক সম্রাট হিরাক্লিয়াস তার কাছে একজন লোককে প্রেরণ করেন। তিনি কুরায়শের একটি কাফেলায় ছিলেন। কাফেলার সদস্যগণ ছিলেন সিরিয়ার ব্যবসায়ী । আর সময়টি ছিল রাসূলুল্লাহ (সা) এবং আবু সুফিয়ান (রা) ও কুরায়শদের কাফিরদের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তির মেয়াদের মধ্যে। তারা তখন সম্রাটের কাছে আগমন করলেন। সম্রাট তার সভাসদবর্গ নিয়ে ইলিয়ায় অবস্থান করছিলেন। সম্রাট আরবদেরকে তাঁর মজলিসে ডাকলেন। আর তার পাশেই ছিল রোমের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। এরপর দোভাষীকেও ডাকলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন : তোমাদের মধ্যে কে ঐ লোকটির বংশের দিক দিয়ে সর্বাধিক নিকটবর্তী যিনি নবী বলে দাবী করেছেন : আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, আমি বললাম, ‘আমি বংশের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে তার নিকটতম । সম্রাট বললেন, তাকে আমার আরো নিকটে আনয়ন কর এবং তার সাথীদেরকেও নিকটে নিয়ে এসো ও তাঁর পিছনের দিকে বসাও। এরপর তিনি দোভাষীকে বললেন যে, তাদেরকে বলে দাও যে, আমি তাকে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করব যিনি নবী বলে দাবী করেন। যদি সে আমার কাছে মিথ্যা বলে তাহলে যেন তারা আমাকে বলে দেয় যে, সে মিথ্যা বলছে। আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, আল্লাহর শপথ, যদি তারা আমাকে মিথ্যুক বলে প্রচার করবে এরূপ আশংকা না থাকত, তাহলে আমি অবশ্যই মিথ্যা বলতাম । এরপর প্রথম যে প্রশ্নটি সম্রাট আমাকে করেছিলেন, তাহল যে, তোমাদের মধ্যে তার বংশ মর্যাদা কীরূপ? আমি বললাম, তিনি আমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশের অধিকারী। তিনি বললেন, তার পূর্বে তোমাদের মধ্যে কি কেউ এরূপ নুবুওয়াতের দাবী করেছিল? আমি বললাম, ‘না’ । তিনি বললেন, তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কি কেউ রাজা ছিল?’ আমি বললাম, ‘না। তিনি বললেন, সম্ভান্তবংশের লোকেরা তার অনুসরণ করে, না কি তাদের মধ্যকার দুর্বলরা? আমি বললাম, বরং দুর্বলরাই তার অনুসরণ করছে। তিনি বললেন, তাঁরা কি দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে, না কমছে? আমি বললাম, বরং তারা দিন দিন বাড়ছে। তিনি বললেন, ‘তাদের মধ্যে কি কেউ তাঁর ধর্মে প্রবেশ করার পর নারাজ হয়ে ধর্ম ছেড়ে দিচ্ছে?’ আমি বললাম, ‘না’ । তিনি বললেন, ‘তোমরা ঐ ব্যক্তিকে নুবুওয়াতের দাবী করার পূর্বে মিথ্যার কোন অপবাদ দিতে পেরেছিলে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, “সে কি ওয়াদা ভঙ্গ করে?’ আমি বললাম না, তবে আমরা তার সাথে একটি চুক্তির মধ্যে আছি, জানিনা সে এটার মধ্যে কী করবে? আবু সুফিয়ান বলেন, উপরোক্ত বাক্যাংশ ছাড়া আর আমি কিছুই তার বিরুদ্ধে বলতে পারিনি। তিনি বললেন, তোমরা কি তাঁর সাথে যুদ্ধ করেছ?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’ । তিনি বললেন, তাহলে তার সাথে যুদ্ধ করার ফলাফল কী? আমি বললাম, তার ও আমাদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধটি বালতির ন্যায়। কোন সময় তা আমাদের হাতে আবার কোন সময় তার হাতে থাকে। অর্থাৎ কোন সময় আমাদের আবার কোন সময় তারই জয় হয়। তিনি বললেন, তিনি তোমাদেরকে কিসের আদেশ দেন? আমি বললাম, তিনি আমাদেরকে বলেন, তোমরা শুধুমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সাথে আর কাউকে শরীক করবে না। আর তোমাদের পিতৃপুরুষের রীতিনীতি পরিহার কর। তিনি সালাত আদায় করা, সত্য কথা বলা, সৎ হওয়া, এবং আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখার জন্যে আমাদেরকে নির্দেশ দেন।’ দোভাষীকে সম্রাট বলেন, তুমি তাকে বলে দাও যে, তোমাকে আমি তাঁর বংশের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছি আর তুমি বলেছ যে, সে তোমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশের অধিকারী, এরূপে রাসূলগণকে তাদের সম্প্রদায়ের সম্ভান্ত বংশেই প্রেরণ করা হয়ে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, ঐ ব্যক্তির নুবুওয়াতের দাবীর পূর্বে কি তোমাদের মধ্যে কেউ এরূপ দাবী করেছিল? উত্তরে তুমি বলেছ যে, ‘না’ । তাই আমি বলব, যদি কেউ এই কথা আগে বলে থাকতো তাহলে আমি বলতাম, লোকটি তার পূর্বের লোকের কথার অনুসরণ করছে। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি, তার পিতৃ-পুরুষের মধ্যে কেউ কি রাজা ছিল? তুমি উত্তরে বলেছ, না’। আমি বলব, যদি তাঁর পিতৃপুরুষদের মধ্যে কেউ রাজা থাকত তাহলে আমি বলতাম যে, সে তার পিতৃপুরুষের রাজত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, এ নুবুওয়াতের দাবীর পূর্বে তাকে কি তোমরা মিথ্যার অপবাদ দিতে পেরেছিলে? উত্তরে তুমি বলেছ, ‘না’ । সুতরাং আমি বুঝতে পেরেছি যে, তিনি মানুষের মধ্যে মিথ্যার প্রসার ঘটাননি, তাই তিনি আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করতে পারেন না। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি যে, তাদের মধ্যে ক্ষমতাবান লোকেরা তাঁর অনুসরণ করছে, না দুর্বল লোকেরা? উত্তরে তুমি বলেছ, দুর্বল লোকেরা। তার অনুসরণ করছে। আসলে দুর্বলরাই নবী রাসূলগণের অনুসরণকারী হয়ে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, তাঁর অনুসারীরা দিন দিন বাড়ছে, না কমছে? উত্তরে তুমি উল্লেখ করেছ যে, তারা সংখ্যায় দিন দিন বাড়ছে। ঈমানের ব্যাপারটি এরকমই। পরিপূর্ণতা অর্জন পর্যন্ত তা বাড়তেই থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, তাদের মধ্যে ধর্মের প্রতি নারায হয়ে কেউ ধর্মত্যাগী হচ্ছে কি না? আর উত্তরে তুমি উল্লেখ করেছ যে, ‘না’ । ঈমান বস্তুটি এরূপই যে, যখন তার ছোঁয়া অন্তরে লাগে তখন সে আর বের হয় না। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি যে, সে কি ওয়াদা ভঙ্গ করে? উত্তরে তুমি উল্লেখ করেছ, না’! আসলে রাসূলগণ কোনদিনও ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, তিনি তোমাদেরকে কিসের নির্দেশ দেন? তুমি জবাব দিয়েছ যে, তিনি আদেশ দেন তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সাথে কাউকে অংশীদার করবে না। আর তিনি তোমাদেরকে মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে সালাত আদায় করতে, সত্য কথা বলতে এবং সৎ হতে আদেশ করেন । তুমি যা বলছ তা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তিনি আমার এ দুই পায়ের নীচের ভূমি পর্যন্ত অধিকার করে নেবেন। আমি জানতাম যে, তিনি আবির্ভুত হবেন, তবে আমি ধারণাও করতে পারিনি যে, তিনি তোমাদের মধ্য হতে হবেন। আর আমি যদি জানতাম যে, আমি তার কাছে পৌঁছতে পারব, তাহলে তার সাথে সাক্ষাতের আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। আর যদি আমি তার কাছে পৌঁছতে পারতাম, তাহলে আমি তাঁর পদযুগল ধুয়ে দিতাম। তারপর তিনি পত্রটি তলব করলেন যা রাসূলুল্লাহ্ (সা) দেহ্ইয়া (রা)-এর মারফত বুসরার শাসকের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। আবার বুসরার শাসনকর্তা তা’ রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। পত্রে লিখা ছিল ।
بسم الله الرحمن الرحيم– من محمد بن عبد الله ورسوله إلى هرقل عظيم الروم ، سلام علی من اتبع الهدى أما بعد ، فأني أدعوك بدعاية الاسلام أسلم تسلم يؤتك الله أجرك مرتين ، فان توليت فان عليك اثم الأريسيين *
পরম দাতা পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি, মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট হতে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। যিনি হিদায়াতের অনুগত তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এরপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন এবং নিরাপদ থাকুন। আল্লাহ্ আপনাকে দ্বিগুণ পুণ্য দান করবেন। আর যদি অন্যথা করেন তা হলে আপনার প্রজা কৃষককুলের পাপ আপনারই উপর বর্তাবে।
يا أهل الكتاب تعالوا اللى كلمة سواء بيننا وبينكم أن لا تعبد الا الله ولا شرك به شيئا ولا يتخذ بعضنا بعضا أربابا من دون الله فان تولوا فقولوا
اشهدوا بأنا مسلمون
অর্থাৎ “তুমি বল, হে কিতাবীগণ! এস সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান; যেন আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত কারো ইবাদত না করি, কোন কিছুকেই তার শরীক না করি এবং আমাদের কেউ কাউকেও আল্লাহ্ ব্যতীত প্রতিপালক রূপে গ্রহণ না করি। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বল, তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা মুসলিম।” (৩- আল ইমরান ও ৬৪)।
আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, যখন তিনি তাঁর বক্তব্য এবং পত্র পাঠ শেষ করলেন, তখন তাদের মধ্যে গোলমাল প্রচণ্ড আকার ধারণ করল এবং উচ্চস্বরে বাকবিতণ্ডা চলতে লাগল। তখন আমাদেরকে বের করে দেওয়া হল। আমাদের বের হয়ে আসার পর আমি আমার সাথীদেরকে বললাম, আবু কাবশার ছেলের ব্যাপারটিত বিরাট আকার ধারণ করেছে। বনুল আস্ফারের সম্রাট ও তাকে ভয় করছে। আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, তখন হতে আমি দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ করেছিলাম যে, অচিরেই তিনি জয়ী হবেন। এরপর আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দান করেন। আবু সুফিয়ান (রা) বলেন, “ইলিয়ার শাসনকর্তা, হিরাক্লিয়াসের বন্ধু এবং সিরিয়ার খৃস্টানদের বিশপ ইবুন নাতুর বর্ণনা করেন, একদা রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস ইলিয়ায় এসে রাত যাপন করলেন এবং ভোরে তিনি বিমর্ষ অবস্থায় ঘুম থেকে উঠেন। চেহারা মলিন দেখে যাজকদের কেউ কেউ বললেন, জাহাপনা! আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে! ইবন নাতূর বলেন, ‘হিরাক্লিয়াস একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি তারকারাজি পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। তিনি তার সভাসদবর্গকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তারকারাজি পর্যবেক্ষণ করে আমি দেখতে পাচ্ছি যারা খাতনা করায় তাদের বাদশাহর আবির্ভাব হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন্ জাতির লোকেরা খাতনা করে থাকে? সভাসদবর্গ বললেন, ‘ইয়াহূদীরা ব্যতীত অন্য কেউ খাতনা করেনা । আর তাদের ব্যাপারে আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা, তারা একটি শক্তিশালী জাতি নয়। আপনার ক্ষমতা দখল করার মত তাদের কোন শক্তি নেই। আপনার রাজত্বের বিভিন্ন শহরে নির্দেশ জারী করুন যেন তথাকার ইয়াহুদীদেরকে হত্যা করা হয়। তারা এরূপ চিন্তা ভাবনায় ছিল এমনি সময়ে হিরাক্লিয়াসের কাছে ‘গাসসানের শাসনকর্তার প্রেরিত একজন লোক এসে পৌঁছল । যিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্বন্ধে সংবাদ পরিবেশন করলেন। হিরাক্লিয়াস যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্পর্কে
জানতে পারলেন তখন বললেন, “তোমরা পরীক্ষা করে নাও এ দূতটির খাতনা করানো আছে কিনা। তারা পরীক্ষা করে দেখল এবং সম্রাটকে সংবাদ দিল যে, দূতটি খাতনাকৃত। সম্রাট দূতকে আরবদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। দূত সংবাদ দিলেন আরবরা খাতনা করান। হিরাক্লিয়াস বলেন, ইনিই এ উম্মতের বাদশাহ এবং তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। এরপর তিনি তার এক রোমীয় বন্ধুর কাছে একটি পত্র লিখেন, যিনি জ্ঞানে গরিমায় তাঁর সমকক্ষ ছিলেন। হিরাক্লিয়াস হিমস ভ্রমণ করেন এবং হিমস পৌঁছতেই তিনি তাঁর বন্ধু থেকে পত্র পেলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে একই অভিমত জানতে পারলেন। তারপর হিরাক্লিয়াস রোমের প্রধানদেরকে হিস এ অবস্থিত একটি প্রাসাদে জমায়েত হবার জন্যে নির্দেশ প্রদান করেন। প্রাসাদের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়ারও হুকুম দিলেন । তাই দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল। তারপর তিনি তাদের প্রতি দৃষ্টি দিলেন এবং বললেন, “হে রোমের বাসিন্দারা! তোমরা যদি কল্যাণ ও মুক্তি চাও এবং তোমাদের সাম্রাজ্য বহাল রাখতে চাও তাহলে এ নবীর হাতে বায়আত গ্রহণ কর।” তার এ ধরনের বক্তব্যে সবাই চীৎকার করে উঠল এবং বন্য গাধার ন্যায় দরজার দিকে ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ পেল! যখন হিরাক্লিয়াস তাদের অসন্তুষ্টি লক্ষ্য করলেন এবং তাদের ঈমান আনা সম্পর্কে নিরাশ হলেন তখন বললেন, তাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে এস। তিনি বললেন, এইমাত্র যা বলেছি, তা কেবল তোমাদের ধর্মে তোমরা অটল আছ কিনা তা যাচাই করার জন্যে। হিরাক্লিয়াসের একথা শুনে সবাই তাকে সিজদা করল এবং তার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করল । আর এটাই ছিল রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সর্বশেষ অবস্থান। ইমাম বুখারী (র) তাঁর কিতাবের বিভিন্ন জায়গায় এ হাদীছটি বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন। ইবন মাজা ব্যতীত অন্যান্য সিহাহ সংকলকগণ আবু সুফিয়ান (রা) ও হিরাক্লিয়াসের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আমার লিখিত বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থে এই সম্পর্কে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
ইবন লাহী’আ ওরওয়া (রা)-এর সনদে বলেন, কুরায়শের কিছু ব্যবসায়ীকে সাথে নিয়ে আবু সুফিয়ান (রা) ইব্ন হারব ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় যান। এদিকে হিরাক্লিয়াসের কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাব খবরও পৌঁছল। তাই তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) সম্বন্ধে জানার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং সিরিয়ায় তার একজন আরব শাসকের কাছে লোক প্রেরণ করেন ও বলে পাঠান যে, আরব থেকে কিছু সংখ্যক লোক যেন সিরিয়ায় পাঠানো হয় যাতে করে তিনি তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। তিনি তখন তার কাছে ত্রিশ জন লোককে প্রেরণ করেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন, আবু সুফিয়ান (রা) ইবন হারব। তারা ইলিয়ার একটি গির্জায় হিরাক্লিয়াসের সাথে সাক্ষাত করেন। হিরাক্লিয়াস তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, আমি তোমাদের কাছে লোক প্রেরণ করেছি যাতে তোমরা আমাকে মক্কার এ লোকটি সম্পর্কে বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশন কর। তারা বলেন, লোকটি জাদুকর, মিথ্যুক এবং সে নবী নয়। তিনি বলেন, “তোমরা আমাকে বল, তোমাদের মধ্যে কে তার সম্বন্ধে বেশী জানে ও আত্মীয়তার দিক দিয়ে কে তার কাছে অধিকতর নিকটবর্তী? তারা বললেন, এই আবু সুফিয়ান (রা) তার চাচাতো ভাই । তিনি তার সাথে যুদ্ধ করেছেন। যখন তারা এরূপ বলল, তখন হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ান ব্যতীত সকলকে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন এবং আবু সুফিয়ান হতে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে তাঁকে তাঁর কাছে বসালেন এবং বললেন, হে আবু সুফিয়ান! তুমি আমাকে বিস্তারিত সংবাদ জানাও। আবু সুফিয়ান উত্তরে বললেন :সে জাদুকর ও মিথ্যুক। হিরাক্লিয়াস বললেন, ‘আমি চাইনা যে তুমি তাকে গালি দাও। তবে তুমি আমাকে তোমাদের মধ্যে তাঁর বংশ মর্যাদা কী রূপ তা বল। আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, আল্লাহর শপথ, সে কুরায়শ বংশের লোক। হিরাক্লিয়াস বললেন, তার বুদ্ধি বিবেচনা কেমন? আবু সুফিয়ান (রা) বললেন, তার বুদ্ধির ঘাটতি আমরা কখনও লক্ষ্য করিনি। হিরাক্লিয়াস বললেন, “সে কি মিথ্যা শপথকারী, মিথ্যুক ও কাজে কর্মে প্রতারণাকারী? আবু সুফিয়ান বললেন, ‘না। আল্লাহর শপথ, তিনি কখনও এরূপ ছিলেন না। হিরাক্লিয়াস বললেন, সম্ভবত তিনি রাজত্ব বা উচ্চ পদমর্যাদা অর্জন করতে চান যা তার পরিবারের কেউ পূর্বে অর্জন করেছিল? আবু সুফিয়ান বললেন, না। এরপর হিরাক্লিয়াস বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা তার অনুসরণ করে তাদের মধ্যে কি কেউ কোন দিন তোমাদের মধ্যে আবার ফিরে এসেছে? তিনি বললেন, ‘না’ । হিরাক্লিয়াস আবার বললেন, তিনি যখন ওয়াদা করেন তাকি তিনি কখনও ভঙ্গ করেন : আবু সুফিয়ান বললেন, না। তবে আশংকা আছে এ চুক্তির কালে ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারেন। হিরাক্লিয়াস বললেন, এ চুক্তির কালে তোমরা কি নিয়ে আশংকা করছ? তিনি বললেন, “আমার সম্প্রদায়ের লোকজন তার মিত্রের বিরুদ্ধে তাদের মিত্রকে সাহায্য করেছে আর তিনি ঐসময় ছিলেন মদীনায়। হিরাক্লিয়াস বললেন, এভাবে তোমরা যদি প্রথম শুরু করে থাক তাহলে তো তোমরাই চরম ওয়াদা ভঙ্গকারী। আবু সুফিয়ান রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, “তিনি আমাদের বিরুদ্ধে মাত্র একবার জয়লাভ করেছেন আর ঐদিন আমি অনুপস্থিত ছিলাম, এটা ছিল বদরের দিন। এরপর আমি তাঁর বিরুদ্ধে দুই দুই বার তাদের ঘরে গিয়ে লড়েছি। মরালাশের পেট, কান, নাক ইত্যাদি চিরেছি, বিদীর্ণ করেছি ও কর্তন করেছি।” হিরাক্লিয়াস বললেন, তুমি তাকে মিথ্যুক মনে কর, না সত্যবাদী মনে কর? আবু সুফিয়ান বললেন, ‘বরং সে মিথ্যুক। হিরাক্লিয়াস বললেন, যদি তোমাদের মধ্যে নবী এসে থাকেন তাহলে তোমরা তাকে হত্যা করো না। কেননা, এ কাজটি বেশী বেশী করে করেছে ইয়াহূদীরা। এরপর আবু সুফিয়ান তার ঘরে ফিরে যান।
এ বর্ণনায় বিরলতা পরিলক্ষিত হয়। তবে এর মধ্যে অনেক তথ্য রয়েছে যা ইবন ইসহাক বা বুখারীর বর্ণনায় নেই । মূসা ইবন উকবার বর্ণনা এ বর্ণনার কাছাকাছি।
ইবন জারীর তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের বরাতে বলেন, তিনি কিছু জ্ঞানী লোকের বরাতে বলেছেন, যখন দেহইয়াতুল কালবী (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পত্র নিয়ে হিরাক্লিয়াসের কাছে আগমন করলেন তখন তিনি বললেন, “আল্লাহর শপথ, আমি জানি যে, নিশ্চয়ই তোমাদের সাথী একজন প্রেরিত নবী (সা)। যার জন্যে আমরা প্রতীক্ষারত । আমাদের কিতাবে তার বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু আমি রোমানদের পক্ষ থেকে আমার প্রাণের আশংকা করছি । তা না হলে আমি অবশ্যই তার আনুগত্য স্বীকার করতাম। তুমি এখন বিশপ যাগাতিরের কাছে যাও এবং তার কাছে তোমাদের সাথীর কথা উল্লেখ করো। আল্লাহর শপথ, রোম দেশে তিনি আমার চেয়ে বড় এবং তার কথা আমার কথার চাইতে তাদের কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য। গিয়ে দেখ, তোমাকে তিনি কী বলেন : রাবী বলেন, দেহইয়া (রা) তাঁর কাছে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বার্তা এবং দাওয়াত সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত অবহিত করেন। যাগাতির বললেন, আল্লাহর শপথ, তোমার সাথী একজন প্রেরিত নবী, তাঁর গুণাবলী সম্বন্ধে আমরা অবগত রয়েছি। আমাদের আসমানী কিতাবে আমরা তার নাম পেয়েছি। তারপর তিনি ঘরের ভিতর গেলেন। তার পরিহিত কালো কাপড় ছেড়ে সাদা পোশাক পরিধান করলেন। এরপর তার লাঠিটা হাতে নিলেন এবং রোমের একটি গির্জায় আগমন করলেন ও বললেন, “হে রোমের বাসিন্দাগণ! আহমদ (সা)-এর পক্ষ হতে আমাদের কাছে একটি পত্র এসেছে যার মাধ্যমে আমাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা হয়েছে। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং আহমদ আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল।” রাবী বলেন, “উপস্থিত রোমানরা তাঁর উপর একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাঁকে মারতে লাগল, এমনকি তারা তাঁকে হত্যা করে ফেলল। এরপর দেহইয়া কাবী (রা) হিরাক্লিয়াসের কাছে প্রত্যাবর্তন করেন ও তাকে এ বিষয়ে অবহিত করেন। হিরাক্লিয়াস বললেন, দেখুন, আপনাকেও বলেছি যে, তারা আমার প্রাণ নাশ করে ফেলবে তাদের এ আশংকা করছি। যাগাতির তাদের কাছে আমার চাইতে অধিক শ্রদ্ধাবান ছিলেন এবং আমার কথার চাইতে তার কথার দাম তাদের কাছে বেশী ছিল।
তাবারানী (র)— দেহূইয়া কালবী (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে একটি পত্রসহ রোমের সম্রাটের কাছে প্রেরণ করেন। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে দারওয়ানকে বললাম, ‘আল্লাহর রাসূলের দূতের জন্যে অনুমতি প্রার্থনা কর। সে সম্রাটের কাছে ভিতরে গেল এবং সংবাদ দিল যে, প্রাসাদের দরজায় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন এবং তিনি তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দূত বলে পরিচয় দিচ্ছেন। এ সংবাদ শুনে ভিতরের লোকজন ভীত হয়ে পড়ল। সম্রাট বললেন, তাকে ভিতরে আসতে দাও। আমাকে ভিতরে নেয়া হল। তাঁর কাছে তাঁর সভাসদবর্গ হাযির ছিলেন। আমি তার কাছে পত্রটি সমর্পণ করলাম। পত্রে লিখা ছিল? ‘পরম দাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ হতে রোমের শাসনকর্তা কায়সার এর প্রতি। তখন সম্রাটের নীলাভ চোখ বিশিষ্ট গৌর বর্ণের জনৈক ভাতিজা চীঙ্কার দিয়ে বলতে লাগল, আজকে এ পত্রটি পড়বেন না; কেননা, পত্র প্রেরক পত্রের শুরুতে নিজের নাম উল্লেখ করেছে। আর রোমের সম্রাট কথাটি না লিখে রোমের শাসনকর্তা লিখা হয়েছে। রাবী বলেন, “পরে তিনি পত্রটি পড়লেন এবং যখন পত্র পড়া শেষ হল তখন তিনি সভাসদবর্গকে বের হয়ে যেতে বললেন। তারা বের হয়ে গেলে আমার কাছে তোক প্রেরণ করলেন। আমি প্রবেশ করলাম। আমাকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করলেন আর আমি তাকে বিস্তারিত সংবাদ দিলাম। এরপর তিনি প্রধান বিশপের কাছে লোক প্রেরণ করেন। তিনি আসলেন। তিনি ছিলেন তাদের পরামর্শদাতা। তাঁর কথা ও পরামর্শ তারা মান্য করতো। যখন তিনি পত্রটি পড়লেন তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, তিনিও ঐ ব্যক্তি যার সম্বন্ধে মূসা ও ঈসা (আ) অমাদেরকে সুসমাচার দিয়ে গেছেন। আর যার জন্যে আমরা প্রতীক্ষারত। কায়সার বললেন, তাহলে আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দিচ্ছেন? বিশপ বললেন, তবে আমি তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করি এবং আমি তার অনুসারী । কায়সার বললেন, “আমিও জানি যে, তিনি এরূপই। তবে আমি তা করতে পারছি না। যদি আমি তা করি, তাহলে আমার রাজত্ব চলে যাবে এবং রোমানরা আমাকে হত্যা করবে ।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক, খালিদ ইবন ইয়াসারের বরাতে সিরিয়ার একজন প্রবীণ অধিবাসী হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্বন্ধে হিরাক্লিয়াসের কাছে যখন সংবাদ পৌঁছল, তখন তিনি সিরিয়া ভূমি থেকে কনষ্টান্টিনিপলে চলে যেতে মনস্থ করেন। তার প্রাক্কালে রোমের বাসিন্দাদের জমায়েত করে তিনি বললেন, “হে রোমের বাসিন্দারা! আমি তোমাদের কাছে একটি বিষয় উপস্থাপন করছি। তোমরা আরো মনোযোগ সহকারে শোন! তারা বলল, “বলুন, তা কী?” তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, তোমরা জান যে, ইনি একজন প্রেরিত নবী। আমাদের কাছে তাঁর যে সমস্ত গুণ বর্ণনা করা হয়েছে এগুলোর মাধ্যমে আমরা তাকে চিনতে পেরেছি। চল, আমরা সকলে তার অনুসরণ করি, তাহলে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি লাভ করব।” তারা বলল, আমরা আরবদের অধীনস্থ হয়ে পড়ব অথচ আমাদের দেশ তাদের চেয়ে বড় দেশ এবং জনসংখ্যা তাদের থেকে অধিক আর আমাদের শহর তাদের থেকে অনেক দূরবর্তী । তিনি বললেন, তাহলে চল, আমরা তাকে বার্ষিক জিযিয়া কর প্রদান করি তাহলে তাঁর আক্রোশ হ্রাস পাবে। আর এর বিনিময়ে তার আক্রমণ থেকে আমরা শান্তিতে থাকতে পারব। তারা বলল, “আমরা আরবদেরকে খারাজ বা কর দেব এবং আমাদের থেকে তা তারা গ্রহণ করবে অথচ আমরা তাদের চেয়ে জনসংখ্যার দিক দিয়ে অধিক, দেশ হিসাবে তাদের দেশ থেকে বড় এবং শহর হিসেবে অধিক সুরক্ষিত? না, তা হতে পারে না। আল্লাহর শপথ, আমরা কোন দিনও এরূপ করব না।” হিরাক্লিয়াস বললেন, তাহলে চল, আমরা তাঁর সাথে এ মর্মে সন্ধি করি যে, আমরা মুহাম্মাদ (সা)-কে (দক্ষিণ সিরিয়া) ভূখণ্ড ছেড়ে দেব এবং তিনি আমাদেরকে শামে (উক্ত সিরিয়ায়) থাকতে দেবেন। রাবী বলেন, ঐসময়কার সিরিয়ায় অন্তর্ভুক্ত ছিল ফিলিস্তীন, জর্দান, দামেস্ক, হিল্স ও সীমান্তবর্তী গিরিপথের এপার । গিরিপথের বাইরের অংশ ছিল তখনকার শাম । এরপর তারা বলল, আমরা মুহাম্মাদ (সা)-কে সিরিয়ার ভূখণ্ড ছেড়ে দেব অথচ আপনি জানেন সিরিয়ার ভূখণ্ডটি শামেরই অংশ। আমরা এটা কোন দিনও ছাড়বো না। যখন তারা তার কাছে অস্বীকৃতি জানাল, তখন তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, তোমরা তোমাদের শহরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে নিজেদেরকে সফলকাম বলে ভাবতে পসন্দ করছো, এর বেশি আর কিছু নয়। রাবী বলেন, “এরপর তিনি তার একটি খচ্চরে সওয়ার হয়ে রওয়ানা দিলেন। সীমান্ত গিরিপথের নিকটে এসে তিনি সিরিয়া ভূখণ্ডের দিকে মুখ করে বললেন : –”হে সিরিয়া ভূমি! তোমার উপর রহমত বর্ষিত হোক, তোমাকে বিদায়ী সালাম!” এরপর দ্রুত চলতে লাগলেন এবং কনষ্টান্টিনিপাল শহরে প্রবেশ করলেন। আল্লাহই অধিক জ্ঞাত ।
সিরিয়ার আরব খৃস্টান শাসনকর্তার নিকট পত্র প্রেরণ
ইবন ইসহাক বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বনূ আসাদ ইবন খুযায়মা গোত্রের শুজা ইবন ওছারকে পত্র সহ দামেস্কের শাসনকর্তা মুনযির ইব্ন হারিছ ইব্ন আবু শুমর গাসসানীর কাছে। প্রেরণ করেন।
ওয়াকিদী বলেন, পত্রটি ছিল এরূপ : যে হিদায়াতের পথ অনুসরণ করবে ও ঈমান গ্রহণ করবে তার প্রতি সালাম। আমি তোমাকে আহ্বান করছি তুমি যেন এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, যার কোন অংশীদার নেই। তাহলে তোমার রাজ্য তোমার কাছেই থাকবে। শুজা তার কাছে গেলেন এবং পত্রটি পড়ে শুনালেন। তখন সে বলল, “কে আমার রাজ্য ছিনিয়ে নেবে? আমি অচিরেই তাঁর দিকে রওয়ানা দিচ্ছি।
পারস্য সম্রাট কিার কাছে পত্র প্রেরণ
ইমাম বুখারী (র)–ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর পত্রসহ এক ব্যক্তিকে কির কাছে প্রেরণ করেন এবং আদেশ করেন যেন পত্রটি বাহরায় নের শাসনকর্তাকে দেওয়া হয়। বাহরায়নের শাসনকর্তা পত্রটি কিার কাছে হস্তান্তর করেন। যখন কি পত্রটি পড়ল সে পত্রটি ছিঁড়ে ফেলে। রাবী বলেন, সম্ভবত ইবনুল মুসাইয়িব বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের প্রতি অভিশাপ দিয়েছিলেন, তারা যেন একেবারে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
আবদুল্লাহ্ ইবন ওহব– আবদুর রহমান ইবন আবদুল কারীর বরাতে বলেন, “একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) খুতবা দেয়ার জন্যে মিম্বরে দাঁড়ালেন। তারপর আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তাশাহ্হুদ পাঠ করলেন এবং বললেন, অনারব দেশের রাজাদের কাছে আমি তোমাদের কাউকে কাউকে পত্র সহকারে প্রেরণ করতে চাই। তোমরা আমার সাথে এ ব্যাপারে কোন মতবিরোধ করবেনা যেরূপ বনূ ইসরাঈল ঈসা ইবন মরিয়ম (আ)-এর সাথে করে ছিল । মুহাজিরগণ উত্তরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কখনও আপনার সাথে কোন ব্যাপারে মতবিরোধ করব না। সুতরাং আপনি আমাদেরকে আদেশ করুন এবং প্রেরণ করুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন সুজা ইবন ওহব (রা)-কে কিার কাছে প্রেরণ করেন। কিরা তার দরবার হল সাজানোর জন্যে হুকুম দিল। তারপর পারস্যের প্রধানদেরকে দরবারে প্রবেশের অনুমতি দিল। এরপর সে সুজা ইবন ওহবকে প্রবেশের অনুমতি দিল। তিনি প্রবেশ করার পর তার থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পত্র হস্তগত করার জন্যে কি অন্য একজনকে আদেশ দিল; কিন্তু সুজা ইবন ওহব (রা) বললেন, ‘না’ আমি অন্যের হাতে পত্র দেব না। আমি শুধু আপনার হাতেই অর্পণ করবো, যেমনটি রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে আদেশ করেছেন। কি তখন বলল, একে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ তিনি নিকটে গেলেন এবং তাকে পত্রটি হস্তান্তর করলেন। তারপর কি হীরাহবাসী তাঁর এক সচিবকে ডাকলেন । সে পত্রটি পড়ে শুনাল। পত্রে লিখা ছিল : আবদুল্লাহর পুত্র ও আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ-এর পক্ষ হতে পারস্যের শাসনকর্তা কিরার নিকট। রাবী বলেন, পত্রের শুরুতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নাম দেখে সে রাগান্বিত হল, গর্জে উঠল এবং পত্রের মধ্যে কী আছে তা জানার পূর্বেই পত্রটি ছিঁড়ে ফেলল এবং সুজা (রা)-কে দরবার থেকে বের করে দেওয়ার হুকুম দিল । তিনি এরূপ অবস্থা লক্ষ্য করে সাওয়ারী চড়ে চলে গেলেন। তারপর তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পত্র পৌঁছে দেওয়ার পর আমার আর কোন ভাবনা রইল না যে, আমি কোন্ পথে যাবো। রাবী বলেন, কিার রাগ পড়ে গেলে সুজাকে ডাকার জন্য সে লোক প্রেরণ করে; কিন্তু তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হীরা নামক স্থান পর্যন্ত লোক পাঠানো হল; কিন্তু তিনি তা অতিক্রম করে চলে গিয়েছিলেন। সুজা যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আগমন করেন তখন কিসরার দরবারে সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে অবগত করলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পত্র ছিঁড়ে ফেলার কথাটিও তিনি উল্লেখ করলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, কিরা তার সাম্রাজ্যকেই টুকরো টুকরো করে দিল।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক– আবু সালামা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবদুল্লাহ ইবন হুযাফাঁকে তার পত্র সহকারে কিসরার নিকট প্রেরণ করেন। সে তা পাঠ করে ছিঁড়ে ফেলে। এ খবর যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে পৌঁছল তখন তিনি বললেন, “সে তার নিজের সাম্রাজ্যকেই ছিঁড়ে ফেলেছে।”
ইন জারীর– যায়দ ইবন আবু হাবীব থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবদুল্লাহ ইবন হুযাফা ইবন কায়স ইবন আদী ইব্ন সাঈদ ইবন সাহাম (রা)-কে তাঁর পত্র সহকারে পারস্য সম্রাট কিস্ ইবন হুরমু এর কাছে প্রেরণ করেন। তাতে লিখা ছিল?
بسم الله الرحمن الرحیم. من محمد رسول الله إلى كسرى عظيم فار س ، سلام علی من اتبع الهدى أما بعد ، وآمن بالله ورسوله وشهد أن لا اله الا الله وحده لا شريك له وأن محمدا عبده ورسوله
পরম দাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) হতে পারস্য সম্রাট কিরার প্রতি। যে হিদায়াতের পথ অনুসরণ করে, আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই । মুহাম্মাদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল, তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি তোমাকে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করছি, আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল সমস্ত জনগণের প্রতি, যাতে আমি জীবিতকে ভয় দেখাতে পারি এবং কাফিরদের উপর আল্লাহ্ তা’আলার বাণী বাস্তবে পরিণত হয়। যদি তুমি ইসলাম কবুল কর শান্তি পাবে। আর যদি অস্বীকার কর তাহলে অগ্নিপূজকদের পাপ তোমার উপর বর্তাবে। রাবী বলেন, যখন সম্রাট পত্রটি পড়ল অমনি ছিঁড়ে ফেলল । আর বলল, সে আমার দাস হয়ে আমার উদ্দেশ্যে এভাবে লিখে? তারপর সম্রাট ইয়ামানে নিয়োজিত তার প্রতিনিধি বামকে পত্র লিখে হুকুম দিল “হিজাযের লোকটির কাছে দুইজন শক্তিশালী লোককে পাঠাও, যারা তাকে ধরে নিয়ে আসবে।” এরপর বাযাম তার হিসাব রক্ষক ও সচিবকে পারস্যের পত্র সহকারে প্রেরণ করলো এবং তার সাথে খরখুরা নামী পারস্যের একটি লোককে প্রেরণ করলো। তাদের দুইজনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে একটি পত্র লিখে যার মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে এ দুজনের সাথে কিসরা সম্রাটের কাছে আগমন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে বাযাম আবু যুওয়াহকে বলেছিলেন, ‘ঐ ব্যক্তির শহরে তুমি আগমন করবে, তার সাথে তুমি কথা বলবে এবং তার সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর নিয়ে আসবে। ইতোমধ্যে পূর্বের প্রেরিত দু’ব্যক্তি বের হয়ে গেল এবং তায়েফে গিয়ে পৌঁছল। তারা তায়েফের ভূখণ্ডে কুরায়শের এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করল এবং তাকে রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল । সে বলল যে, তিনি মদীনায় আছেন। তায়েফবাসী ও কুরায়শের উল্লিখিত ব্যক্তি আগন্তুক দুই জনকে পেয়ে খুবই খুশী হল এবং একে অন্যকে বলতে লাগল, শুভ সংবাদ গ্রহণ কর, কেননা, সম্রাট কিসরা তাকে লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করেছেন, এটাই ঐ ব্যক্তির শায়েস্তা হবার জন্যে যথেষ্ট। উক্ত দুই ব্যক্তি তায়েফ থেকে বের হয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আগমন করল। আবূ যুওয়াহ [টীকা : বর্ণনান্তরে বাবুয়েহ বা বাবুইয়া আছে।–সম্পাদক] রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে কথা বলল এবং সংবাদ দিল যে, শাহানশাহ রাজাধিরাজ কি শাসনকর্তা বাযামের কাছে পত্র লিখেছেন। পত্রে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তিনি যেন আপনার কাছে এমন কোন ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন যে আপনাকে নিয়ে তার কাছে যাবে। আর আমাকে পাঠানো হয়েছে যেন আপনি আমার সাথে চলেন। যদি আপনি তা করেন তাহলে তিনি সম্রাটের কাছে পত্র লিখবেন যাতে করে আপনার উপকার হয়। আর এটাই আপনার মঙ্গলের জন্যে যথেষ্ট । অন্যদিকে যদি আপনি যেতে অস্বীকার করেন, তাহলে আপনি ইতোমধ্যে জেনে নিয়েছেন যে এটা হবে আপনার, আপনার সম্প্রদায় ও দেশের জন্যে মারাত্মক বিপর্যয় ও ধ্বংসের কারণ । তারা দু’জন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আগমন করলেন। তারা দুজনই দাড়ি মুণ্ডিত ছিল এবং বড় গোঁফধারী ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের দিকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখলেন এবং বললেন, সর্বনাশ, কে তোমাদেরকে এরূপ করতে বলেছে?” তারা বলল, “আমাদের মনিব কি আমাদেরকে এরূপ করতে বলেছেন।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “কিন্তু আমার প্রতিপালক দাড়ি বৃদ্ধি করতে ও গোঁফ ছাঁটতে হুকুম দিয়েছেন। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “তোমরা ফিরে যাও, আগামীকাল আবার এসো।” রাবী বলেন, “আসমান থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সংবাদ আসল যে, আল্লাহ্ তা’আলা কিরার বিরুদ্ধে তার ছেলে শিরওয়েহকে আধিপত্য দান করেছেন । সে তার পিতাকে অমুক মাসে ও অমুক রাতে হত্যা করেছে।” রাবী বলেন, তাদের দু’জনকে ডেকে এ সংবাদটি দিলেন । তারা বললো, “আপনি কি জানেন আপনি কী বলছেন? আমরা আপনার প্রতিশোধ নেব, তবে হালকাভাবে। আমরা আপনার এ মন্তব্যের ব্যাপারে কি শাসনকর্তা বাযামকে অবহিত করবো। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “হা তোমরা আমার পক্ষ থেকে তাকে এ সম্পর্কে জানিয়ে দাও। আর তাকে তোমরা বলে দাও আমার প্রচারিত ধর্ম ও আধিপত্য কিসরার মত খ্যাতি লাভ করবে এবং পৃথিবীর আনাচে-কানাচে পৌঁছবে। আবার তোমরা তাকে বল, যদি তুমি ইসলাম কবুল কর তাহলে তোমার রাজত্ব ও আধিপত্য তোমার হাতেই থাকতে দেওয়া হবে । এরপর খরখুসরা কে একটি স্বর্ণরৌপ্য খচিত কমরবন্দ দেওয়া হল আর তা তিনি কোন এক রাজার পক্ষ থেকে উপঢৌকন স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। উপরোক্ত দুই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দরবার থেকে বের হয়ে বাযামের কাছে আগমন করল এবং তাকে বিস্তারিত ঘটনা জানাল। বাযাম বললেন, “আল্লাহর শপথ, এটা কোন রাজা-বাদশার কথা নয়। তিনি নিশ্চয়ই আমার মতে একজন নবী যেমন তিনি নিজে বলেছেন। আর তিনি যা বলছেন তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। আর এ খবরটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তিনি সত্যিকার প্রেরিত রাসূল। আর তাঁর সংবাদ যদি সত্যি না হয়, তাহলে আমরা তার সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত নেব। কিছুদিনের মধ্যে বাযামের কাছে শিরওয়ের পত্র পৌঁছল । তাতে লিখিত ছিল, আমি কিরাকে হত্যা করেছি। আর তা করেছি কেবল পারস্যবাসীদের স্বার্থেই। কেননা, তিনি পারস্যের সম্ভ্রান্ত লোকদেরকে ও সীমান্ত পাহারাদারদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছেন। তোমার কাছে যখন আমার এ পত্রটি পৌঁছবে তখন তুমি তোমার লোকদের থেকে আমার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করবে। আর ঐ ব্যক্তির কাছে গমন করবে যার কাছে কিরা পত্র লিখেছিলেন। এ ব্যাপারে তোমার কাছে আমার পরবর্তী আদেশ না আসা পর্যন্ত তাকে আর কোন প্রকার বিব্রত করবে না। বামের কাছে যখন শিরওয়ের পত্র পৌঁছল তখন তিনি বলতে লাগলেন, নিশ্চয়ই ইনি আল্লাহর রাসূল । এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং ইয়ামানস্থ পারসিক কর্মকর্তারা সকলে ইসলাম কবুল করে নিলেন। রাবী বলেন, বাবুইয়া বাযামকে বলেছিল, আমি তার মত এত প্রতাপশালী কোন ব্যক্তির সাথে আজ পর্যন্ত কথা বলি নাই। বাম তাকে বললেন, তার সাথে কি কোন সাস্ত্রী থাকে? সে বললো, না”।
ওয়াকিদী বলেন, ৭ম হিজরীর জুমাদাল আখিরা মাসের তের তারিখে রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে কি তার ছেলের হাতে নিহত হয়।
আমি বলি, কোন কোন কবির কবিতায় দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, মুহাররম মাসে তাকে হত্যা করা হয়েছিল । একজন কবি বলেন :
“তারা কিকে রাতের বেলায় নিষিদ্ধ মাসে হত্যা করেছিল । হত্যাকারিগণ তাকে ফেলে গেল। তার দাফন কাফনে তারা কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি।”
আবর কবিদের কোন একজন বলেন : কিরাকে তার পুত্ররা তলোয়ার দ্বারা এমনভাবে টুকরা টুক্রা করে হত্যা করেছিল যেমন কসাই মাংসকে টুক্রা টুক্রা করে থাকে। এমন একদিন তার জন্যে মৃত্যু প্রকাশ পেল যেদিন প্রত্যেক গর্ভবর্তীই তার গর্ভস্থিত সন্তানকে প্রসব করে থাকে। (অর্থাৎ এ রাতটি তের তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ ১৪ তারিখ যাকে আরবী ভাষায় ‘লাইলুত তামাম’ বলা হয়। আবার দুঃখের রাতও বলা হয়।
হাফিয বায়হাকী— আবু বকর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “একদিন পারস্যের এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আগমন করে। তিনি তাকে বললেন, “আমার রব্ব গতকাল রাত তোমার মনিবকে হত্যা করেছেন।” রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সামনে জনৈক ব্যক্তি বললেন, “তাঁর কন্যা নাকি তার উত্তরাধিকারী হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “ঐ সম্প্রদায় সফলকাম হবে না, যাদের রাষ্ট্রীয় কর্ণধার হবে স্ত্রী লোক।
বায়হাকী বলেন, দিহইয়া কালবীর বর্ণনায় এসেছে যে, যখন তিনি কায়সারের নিকট থেকে ফেরত আসলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দরবারে কিস্রার দূতদেরকে দেখতে পেলেন। কিসরা সা’আর শাসককে লিখেছিলেন, তোমার রাজ্যে যে লোকটির আবির্ভাব হয়েছে এবং সে আমাকে তার প্রচারিত ধর্ম গ্রহণ করার জন্যে আহ্বান জানিয়েছে। তার খোঁজখবর নাও এবং তাকে দমন করার চেষ্টা কর; নচেৎ তোমার বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাই ঐ শাসনকর্তা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে লোক প্রেরণ করে। রাসূলুল্লাহ (সা) দূতদের লক্ষ্য করে। বলেন, “তোমাদের যিনি প্রেরণ করেছেন তাকে সংবাদ দাও যে, গতরাত আমার রব্ব তার মনিবকে হত্যা করেছেন। বাস্তবে তাই ঘটেছে বলে পরে তারা জানতে পায় ।
ইমাম বায়হাকী– আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “একদিন সা’দ (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “সা’দের কাছে নিশ্চয়ই কোন সংবাদ আছে। সা’দ (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! কি ধ্বংস হয়েছে।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, কিরার প্রতি লা’নত। সে পারস্যের প্রথম নিহত ব্যক্তি। এরপর আরবদের পালা ।
আমি বলি বলা বাহুল্য, ইয়ামানের শাসক বাযামের পক্ষ থেকে যে দুই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে এসেছিল যাদের কাছে তিনি কিস্র নিহত হওয়ার সংবাদ দিয়েছিলেন, ঐ সংবাদটি যখন দেশ দেশান্তরে প্রচারিত হল, তখন হযরত সা’দ ইবন আবু ওক্কাস (রা)-ই প্রথম তা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে শুনান। বায়হাকী (রা) এভাবেই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।
তারপর বায়হাকী (র)– আবু সালামা ইবন আবদুর রহমানের বরাতে বলেন, কিরা যখন তার প্রাসাদে বসবাস করছিল তখন তার কাছে সত্যের বাণী বিভিন্নভাবে পৌঁছতে থাকে। একদিন সে এক আগন্তুকের উপস্থিতিতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আগন্তুকের হাতে ছিল একটি লাঠি । কিস্রাকে লক্ষ্য করে আগন্তুক বলল, “হে কিসরা! এ লাঠি তোমার মাথায় ভাঙ্গার পূর্বে কি তুমি ইসলাম গ্রহণ করবে? কি বললেন, হ্যাঁ, আপনি আমার মাথায় লাঠি মারবেন না । আগন্তুক চলে গেলেন। কি দারোয়ানকে ডেকে বললেন, “এ আগন্তুককে আমার কাছে আসার জন্যে কে অনুমতি দিল? তারা বলল, “আপনার কাছেতো কেউ আসেনি।” কিরা বললেন, “তোমরা মিথ্যা বলছ।” রাবী বলেন, “ কিসরা তাদের উপর রাগান্বিত হলো। তাদেরকে কঠোরভাবে ধমক দিল। তারপর তাদেরকে ক্ষমা করে দিল। যখন বছর শেষ হবার পথে, পুনরায় ঐ ব্যক্তি লাঠি নিয়ে আগমন করলেন এবং বললেন, হে কি! তোমার মাথায় এ লাঠি ভাঙ্গার পূর্বে কি তুমি ইসলাম গ্রহণ করবে? উত্তরে কি বলল, “হ্যাঁ, আপনি আমার মাথায় লাঠি মারবেন না। এবারও আগন্তুক চলে গেলেন। কি দারোয়ানদের ডেকে প্রথমবারের ন্যায় ধমক দিল ও তাদের প্রতি অত্যন্ত রাগান্বিত হল। পরবর্তী বছর যখন আসল, তখন আগন্তুক ও লাঠি নিয়ে পূর্বের ন্যায় আগমন করলেন এবং বললেন, হে কিস্! তোমার মাথায় এ লাঠি মারার পূর্বে তুমি ইসলাম গ্রহণ করবে? তখন কি বললেন, ‘না, লাঠি মারবেন না, না লাঠি মারবেন না। কিন্তু আগন্তুক তার মাথায় লাঠি মারলেন। এরপর আল্লাহ্ তা’আলা কিস্রাকে ধ্বংস করে দিলেন।
ইমাম শাফিঈ (র)– আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, বর্তমান কি ধ্বংস হবার পর আর কোন কিরা হবে না এবং বর্তমান কায়সার ধ্বংস হবার পর আর কোন কায়সার হবে না। যে সত্তার হাতে আমার জান, তাঁর শপথ করে বলছি, “তোমরা তাদের গুপ্তধন পরবর্তীতে আল্লাহর রাস্তায় দান করবে।” [এ উক্তিতে আর কোন কিসরা বা কায়সার হবে না বলতে তাদের মত এত প্রতাপশালী শাসক আর হবে না বুঝানো হয়েছে।–সম্পাদকদ্বয়] মুসলিম (র) ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম শাফিঈ (র) আরো বলেন, “যখন কিসরার কাছ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পত্র উপস্থাপন করা হল, সে তা ছিঁড়ে ফেলে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন বললেন, তাঁর সাম্রাজ্যও এরূপ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে । অন্য দিকে কায়সার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পত্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন, পত্রটিকে মিশুক আম্বরের কৌটোয় পুরে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তাঁর সাম্রাজ্য টিকে থাকবে ।
ইমাম শাফিঈ (র) ও অন্যান্য উলামায়ে কিরাম বলেন, “আরব কাফিররা যখন ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া ও ইরাক আসত তখন তাদের মধ্যে যারা সুযোগ পেত মুসলমান হয়ে যেত। ইরাক ও সিরিয়ার মাধ্যমে আরব কাফিররা তাদের জনবল হ্রাস পাওয়ার ভীতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে অনুযোগ করল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “যখন কিরা ধ্বংস হয়ে যাবে, তারপর আর কোন কিরা হবে না এবং যখন কায়সার ধ্বংস হয়ে যাবে তারপর আর কোন কায়সার জন্ম নেবে না।” রাবী বলেন, “কালক্রমে কিরাদের রাজত্ব চিরদিনের জন্যে বিলুপ্ত হয়ে গেল। আর সিরিয়া থেকে কায়সারদের রাজত্বও চিরদিনের জন্যে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেল, যদিও কিছুদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পত্রের সম্মান করায় তাঁর দু’আর বরকতে টিকে ছিল। আল্লাহই অধিক পরিজ্ঞাত।
এখানে একটি বড় শুভ সংবাদ এই যে, রোমান রাজত্ব আর কোন দিনও সিরিয়া ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হবে না । যিনি রোমের উপদ্বীপটিসহ সিরিয়ার শাসনকর্তা হন তাকে আরবরা কায়সার বলে। যিনি পারস্যের শাসনকর্তা হন তাকে আরবরা কি বলে । যিনি হাবশার শাসনকর্তা হন তাকে আরবরা নাজাশী বলে । যিনি আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা হন তাকে আরবরা মুকাওকিস বলে! যিনি মিসরের শাসনকর্তা হন তাকে আরবরা ফিরআউন বলে এবং হিন্দুস্থানের যিনি শাসনকর্তা হন তাকে আরবরা ‘বাতলীমূস’ বলে। এরূপে এগুলি ব্যতীত অন্যান্য দেশের অন্যান্য নাম তাদের কাছে ছিল সুপরিচিত। অন্যত্র এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
মুসলিম– জাবির ইবন সামুরা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেন : “মুসলমানদের একটি দল কিত্সার শুভ্র প্রাসাদে সুরক্ষিত সুপ্ত সম্পদ অধিকার করবে। অন্য একটি সনদেও জাবির ইবন সামুরা হতে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে এটাতে অতিরিক্ত রয়েছে, জাবির ইবন সামুরা বলেন, “মুসলমানদের এ দলের মধ্যে আমার পিতা ও আমি ছিলাম এবং আমাদের ভাগে পড়েছিল এক হাজার দিরহাম।
আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা মুকাওকিস জুরায়জ ইবন মীনা আল-কিবতীর কাছে পত্র প্রেরণ
ইউনুস ইবন বুকায়র– আবদুল্লাহ্ ইবন আবদুল কারীর বর্ণনায় বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাতিব ইব্ন আবূ বাল্তাআ (রা)-কে আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা মুকাওকিস-এর কাছে পত্র সহকারে প্রেরণ করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পত্রটিকে চুম্বন করলেন, হাতিব ইবন আবু বালতাআ (রা)-কে সম্মান করলেন, তাঁকে উত্তম আতিথ্য প্রদান করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) উত্তম উপঢৌকনসহ তাকে বিদায় দিলেন। হাতিব ইবন আবু বাতাআ (রা)-এর সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্যে প্রেরিত উপঢৌকন সামগ্রীর মধ্যে ছিল বস্ত্র, জীনসহ একটি খচ্চর এবং দুইজন দাসী- একজন নবী তনয় ইব্রাহীম এর আম্মা। দ্বিতীয় জনকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুহাম্মাদ ইবন কায়স আল-আবদীকে দান করেন।
বায়হাকী— হাতিব ইবন আবূ বালতাআ (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা মুকাওকিসের নিকট প্রেরণ করেন। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পত্র নিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে তার বাড়ীতে থাকতে দিলেন এবং আমি সেখানে অবস্থান করলাম। তারপর তিনি আমার কাছে লোক পাঠালেন এবং তাঁর সভাসদবর্গকে জমায়েত হবার আদেশ দিলেন। এরপর আমাকে বললেন, ‘আমি তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করব । আমি চাই যে, তুমি আমার কাছে এটাৰ ব্যাখ্যা দান করবে। আমি বললাম, ‘বলুন’! তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমাকে তোমার কর্তা সম্বন্ধে বল, তিনি কি একজন নবী নন?’ আমি বললাম, “তিনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল।’ তিনি বললেন, “তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে তার সম্মান নেই কেন? তারা কেন নিজেদের দেশ হতে তাকে বের করেদিল?” তিনি বললেন, আমি বললাম, “আপনি কি সাক্ষ্য দেননা যে, ঈসা (আ) একজন নবী ছিলেন?” তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর কোন মর্যাদা দিলনা তারা তাকে পাকড়াও করতে চেয়েছিল। তাকে শূলে চড়াতে মনস্থ করেছিল; কিন্তু তাদেরকে ধ্বংস করার জন্যে আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে তিনি কোন অভিশাপ দিলেন কেন? বরং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলা তাকে প্রথম আসমানে উঠিয়ে নিলেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি বিজ্ঞ ব্যক্তি এবং তুমি বিজ্ঞজনের কাছ থেকেই এসেছ। এ সামান্য উপঢৌকন আমি তোমার সাথে মুহাম্মাদ (সা)-এর জন্য প্রেরণ করছি। আর তোমার সাথে আমার কয়েকজনসান্ত্রীকে প্রেরণ করছি যাতে তারা তোমাকে তোমার নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দেয়। রাবী বলেন, “তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে তিনটি দাসী প্রেরণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ছেলে ইবরাহীমের মাতা। আর একজন দাসী রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাস্সান ইবন ছাবিত আনসারীকে দান করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে একটি উত্তম খচ্চরও প্রেরণ করেছিলেন।
ইবন ইসহাকের বর্ণনায় চারটি দাসীর উল্লেখ রয়েছে। তাদের একজন হলেন মারিয়া (রা) ইবরাহীমের মাতা। অন্য একজন হলে সীরীন যাকে হাসান ইবন ছাবিত (রা)-কে দান করেন তার গর্ভে আবদুর রহমান ইবন হাস্সান জন্ম নেন ।
এ উপহার সামগ্রীর মধ্যে ছিল একটি খোঁজা দাস যার নাম ছিল মাবূর, দুটি নকশাবিহীন কালো মোজা, একটি সাদা খচ্চর যার নাম দুলদুল । মাবূর যে খোঁজা ছিলেন এ ব্যাপারটি কেউই জানতনা। তিনি হযরত মারিয়া (রা)-এর ঘরে অবাধে যাতায়াত করতেন। যেমনটি মিসরে এরূপ অবাধ প্রবেশের প্রচলন ছিল। এজন্য কেউ কেউ তাদের দুজন সম্বন্ধে নানারূপ কটুক্তি করতে লাগল অথচ তারা প্রকৃত ঘটনা জানতনা। কেউ কেউ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আলী ইবন আবু তালিব (রা)-কে তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আলী (রা) খোঁজা দেখতে পেয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন। সহীহ মুসলিমেও এ ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়।
ইন ইসহাক বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) বনূ আমির ইবন লু’য়ীর সদস্য সালীত ইবন আমর ইবন আবদূদ (রা)-কে ইয়ামামার শাসনকর্তা হাওয়া ইবন আলীর নিকট প্রেরণ করেন। আর ‘আলা ইবন হাদরামী (রা)-কে ওমানের শাসক জায়ফার ইবন আল-জালান্দি আল ইদী এবং আম্মার [অন্য বর্ণনায় তার নাম আবদ বলে উল্লিখিত হয়েছে] ইব্ন আল-জালান্দি আল- ইযুদীর নিকট প্রেরণ করেন।
যাতুস্ সালাসিল যুদ্ধ [একে যাতুস সুলাসিলও বলা হয়ে থাকে। –সম্পাদকদ্বয়]
হাফিয বায়হাকী মক্কা বিজয়ের পূর্বে এ যুদ্ধটির ঘটনা উল্লেখ করেন এবং মূসা ইবন উকবা ও উরওয়া ইবন যুবায়র (রা)-এর বরাতে তিনি বলেন যে, তারা দুইজন বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) সিরিয়া এলাকায় অবস্থিত বনূ বালীও বনূ কু’আর বাসভূমির অন্তর্গত যাতুস সালাসিল নামক স্থানে আমর ইবন আস (রা)-কে প্রেরণ করেন। উরওয়া ইবনুয যুবায়র (রা) বলেন, ‘বনূ বালী ছিল ‘আস ইবন ওয়ায়েলের মাতুল বংশ। যখন আমর ইবন ‘আস (রা)-এর সেনাবাহিনী সেখানে পৌঁছল, তখন তারা দুশমনের সংখ্যা অধিক হওয়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে লোক প্রেরণ করে সাহায্য প্রার্থনা করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রথমদিকের মুহাজিরগণকে যুদ্ধে যাবার জন্যে ডেকে পাঠালেন । শীর্ষস্থানীয় মুহাজিরগণের একটি দল যার মধ্যে আবু বকর এবং উমর (রা) ও ছিলেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে সাড়া দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা)-কে তাদের আমীর নিযুক্ত করলেন। মূসা ইবন উকবা বলেন, নতুন সৈন্যদল যখন আমর (রা)-এর কাছে আগমন করেন তখন তিনি বলেন, “আমি তোমাদের আমীর। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলাম । মুহাজিরগণ বললেন, আপনি আপনার সাথীদের আমীর। আর আবু উবায়দা (রা) মুহাজিরগণের আমীর। আমর (রা) বললেন, “আপনারা আমার সাহায্যকারী। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। আবু উবায়দা (রা) ছিলেন নম্র, ভদ্র ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তিনি এরূপ পরিস্থিতি লক্ষ্য করে বললেন, “হে আমর! তুমি জেনে রেখো, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে সর্বশেষ নির্দেশে বলেছেন, যখন তুমি তোমার সাথীর কাছে পৌঁছবে, তখন তোমরা মিলে মিশে থাকবে।” এখন তুমি যদি আমার কথা অমান্যও কর তবু আমি তোমার কথা মেনে চলব। এভাবে আবু উবায়দা (রা) আমর ইবন আস (রা)-এর নেতৃত্ব মেনে নিলেন।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক, মুহাম্মাদ ইবন আবদুর রহমান এর বরাতে বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমর ইবন আসকে প্রেরণ করেন যাতে তিনি আরবদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেন। প্রকাশ থাকে যে, ‘আস ইবন ওয়ায়েলের মা ছিলেন বনূ বালী গোত্রের। এজন্যই আমর ইবন ‘আস (রা)-কে রাসূলুল্লাহ্ (সা) উক্ত গোত্রে পাঠালেন যাতে তিনি ইসলামের স্বপক্ষে তাদের মন জয় করতে পারেন। তাই আমর (রা) বনূ জুমের জলাশয় সালাসিলের নিকট পৌঁছলেন। এ কূয়ার নামানুসারে এ যুদ্ধের নাম যাতুস সালাসিল হয়েছে। রাবী বলেন, তিনি উক্ত জায়গায় পৌঁছে শত্রু সৈন্যের আধিক্যে ভীত হয়ে পড়েন। তাই তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবু উবায়দা ইবন জাররাহ্ (রা)-কে শীর্ষস্থানীয় মুহাজিরগণ সহ প্রেরণ করলেন। তাঁদের মধ্যে আবু বকর (রা) ও উমর (রা)-ও ছিলেন। বিদায়কালে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবূ উবায়দা (রা)-কে বলে দিয়েছিলেন তোমরা পরস্পর মতবিরোধ করোনা। এরপর আবু উবায়দা (রা) রওয়ানা হলেন এবং যখন আমর (রা)-এর কাছে পৌঁছলেন তখন আমর (রা) বললেন, আপনি আমাকে সাহায্য করতে এসেছেন। আবূ উবায়দা (রা) তাঁকে বললেন, না, বরং আমি আমার সৈন্যদল নিয়ে আছি আর আপনি আপনার সৈন্যদল নিয়ে আছেন। আবু উবায়দা (রা) ছিলেন নরম, সরল ও ভদ্র মেয়াজের। পার্থিব আধিপত্যের ব্যাপারটি ছিল তার কাছে গৌণ। এরপর আমর (রা) তাঁকে বললেন, আপনি আমার সাহায্যকারী। আবু উবায়দা (রা) বললেন, হে আমর! নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে বলে দিয়েছেন, “তোমরা মতবিরোধ করবে না। তাই আপনি আমার কথা অমান্য করলেও আমি আপনার কথা মেনে চলব। আমর তখন তাঁকে বললেন, “আমি আপনার আমীর । আর আপনি আমার সাহায্যকারী। আবু উবায়দা (রা) বললেন, তাহলে আপনিই নেতৃত্ব গ্রহণ করুন। তারপর আমর ইবন আস মুসলমানদের নামাযে ইমামতি করতে থাকেন।
ওয়াকিদী– ইয়াযীদ ইব্ন রূমান হতে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, নিশ্চয়ই যখন আবু উবায়দা (রা) আমর ইব্ন আস (রা)-এর সাথে যোগ দেন তখন তাদের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়িয়ে ছিল ৫০০ তে। তারা দিনরাত সফর করে বনূ বালীর এলাকা ও তৎসংলগ্ন এলাকা অতিক্রম করেছিলেন। যখনই তারা কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছতেন তখনই শুনতে পেতেন যে, শত্রু সেনারা কিছুক্ষণ আগেও এখানেই অবস্থান করছিল। তারা মুসলিম সেনাদের উপস্থিতি আঁচ করতে পেরেই পালিয়ে যেতো । এরূপে তারা বনূ বালীর এলাকার শেষ প্রান্তে উযরা ও বালকীন অঞ্চলে পৌঁছে একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদলের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। আর এ সংঘর্ষ কিছু সময় পর্যন্ত চলতে থাকে। তারপর কিছুক্ষণ উভয় বাহিনী তীর বিনিময় করে। ঐদিন আমির ইবন রাবীয়া’ অন্ধ হয়ে যায় ও তার একটি হাত হারান। মুসলমানগণ কাফিরদের উপর হামলা করেন ও তাদেরকে পরাজিত করেন। শত্রুসেনারা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে ও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সেখানে যা কিছু পাওয়া গেল আমর (রা) তা সবই দখল করে নেন। সেখানে মুসলিম সৈন্যরা কিছু দিন অবস্থান করেন। যখনই কোন জায়গায় শত্রু সেনা জমায়েত হয়েছে বলে খবর আসত সেখানেই তারা ঝটিকা অভিযান চালাতেন ও তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিতেন। তাঁরা চতুর্দিকে তাদের অশ্বারোহী সৈন্যদের পাঠাতেন। তারা গনীমতের পশুপাল নিয়ে আসতেন ও এগুলো যবাই করে খেতেন। এর অতিরিক্ত তারা ওখানে আর কিছু লাভ করতে পারেননি। বণ্টন করার মত কোন প্রকার গনীমত পাওয়া যায়নি।
আবু দাউদ (র)– আমর ইবন আস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যাতুস সালাসিল যুদ্ধে অত্যন্ত ঠাণ্ডা রাতে আমর স্বপ্নদোষ হয়। যদি গোসল করি তাহলে জীবন নাশের ভয় ছিল। তাই আমি তায়াম্মুম করলাম। তারপর আমার সাথীদেরকে নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করলাম। আমার সঙ্গীগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে আমর! তুমি কি অপবিত্র অবস্থায় তোমার সাথীদের নিয়ে সালাত আদায় করেছ? তিনি বললেন, যে বস্তুটি আমার গোসল করার মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল আমি এ সম্বন্ধে তাঁকে সংবাদ দিলাম এবং বললাম, আমি শুনেছি আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন,
অর্থাৎ এবং তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে হত্যা করবে না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। (৪ নিসা : ২৯) রাসূলুল্লাহ (সা) হেসে দিলেন। তাঁকে আর কিছু বললেন না।
মুহাম্মাদ ইবন সালামা– আমর ইবন আস (রা)-এর আযাদকৃত দাস আবু কায়স (রা) হতে অনুরূপ হাদীছ বর্ণনা করতে গিয়ে অতিরিক্ত বলেন, “এরপর তিনি লজ্জাস্থান ধৌত করেন, সালাতের জন্যে উযূ করেন এবং উপস্থিত সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে নালাত আদায় করেন। এ বর্ণনায় তিনি তায়াম্মুমের কথা উল্লেখ করেননি। তবে আবু দাউদের বর্ণনায় তায়াম্মুমের উল্লেখ আছে।
ওয়াকিদী– আবু বকর ইবন হাযাম (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যুদ্ধ থেকে ফেরত আসার পথে অত্যন্ত ঠাণ্ডা রাতে সেনাপতি আমর ইবন আস (রা)-এর স্বপ্নদোষ হয়। তিনি তার সাথীদেরকে বললেন, আমার স্বপ্নদোষ হয়েছে তোমরা কী বল? যদি আমি গোসল করি, তাহলে আমার মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারপর তিনি পানি আনিয়ে লজ্জাস্থান ধৌত করলেন, উযূ করলেন এবং তায়াম্মুমও করলেন। তারপর তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন, তারপর সর্বপ্রথম আওফ ইবন মালিক (রা)-কে সংবাদ বাহকরূপে মদীনায় প্রেরণ করেন। আওফ (রা) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে ভোর রাতে সাক্ষাত করলাম। তিনি ঘরে সালাত আদায় করছিলেন। সালাত শেষে আমি তাকে সালাম দিলাম। তিনি বললেন, “কে? আওফ ইবন মালিক (রা) নাকি?” আমি বললাম, “জ্বী হা”। “আমি আওফ ইবন মালিক ইয়া রাসূলাল্লাহ্।” তিনি বললেন, যবাইকারী আওফ?” উত্তরে আমি বললাম, “জ্বী হ্যাঁ। এরপর তিনি অতিরিক্ত আর কিছু বলেননি। তারপর বললেন, তারপর সংবাদ কী? “আমি আমাদের সফরকালে যে যে ঘটনা ঘটেছিল, আবূ উবায়দা (রা) ও আমর ইবন আস (রা)-এর মধ্যে মতবিরোধ এবং আবু ওবায়দা (রা) কর্তৃক আনুগত্য স্বীকার ইত্যাদি সবিস্তারে বর্ণনা করলাম । রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “আবু উবায়দা ইবনুল জারাহ এর প্রতি আল্লাহ্ রহমত বর্ষণ করুন! রাবী বলেন, এরপর আমি সংবাদ দিলাম যে, আমর (রা) জানাবাত অবস্থায় লোকজনকে নিয়ে সালাত আদায় করেছেন। তার কাছে পানি ছিল। তিনি শুধুমাত্র লজ্জাস্থান ধৌত করেন এবং উযূ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) নীরব থাকলেন। যখন আমর (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আগমন করেন। তখন তিনি তাকে তার সালাত সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। তখন তিনি বললেন, যে সত্তা আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, যদি আমি সেদিন গোসল করতাম তাহলে আমি মারা যেতাম। এ ধরনের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর আমি কোন দিন দেখিনি। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন : অর্থাৎ এবং তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে হত্যা করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। (৪- নিসা : ২৯)।
রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এতে হেসে দিলেন। আর এর অতিরিক্ত কোন কিছু বলেছেন বলে আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই।
ইবন ইসহাক– আওফ ইবন মালিক আল আশজাঈ (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “যে যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমর ইবনুল আস (রা)-কে প্রেরণ করেছিলেন সে যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। তা হচ্ছে যাতুস সালাসিলের যুদ্ধ। আমি আবু বকর (রা) এবং উমর (রা)-এরও সঙ্গী ছিলাম । তারপর আমি এমন একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে আগমন করলাম যারা একটি উট যবাই করেছে; কিন্তু চামড়া পৃথক করা ও গোশত টুকরা টুকরা করা তারা জানতো না। আমি ছিলাম একজন দক্ষ কসাই। আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা কি আমাকে এক-দশমাংশ গোশত প্রদান করবে? আমি তোমাদের মধ্যে গোত কেটে বণ্টন করে দেবো। তারা বলল, ‘হা। এরপর আমি ছুরি হাতে নিলাম এবং গোশত বানিয়ে দিলাম ও একাংশ আমি নিলাম । আমার সাথীদের কাছে এ গোশত নিয়ে আসলাম, রান্না করলাম ও আমরা সকলে মিলে তা খেলাম। আবু বকর (রা) ও উমর (রা) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ গোশত তুমি কোত্থেকে পেলে হে আওফ? উত্তরে আমি তাদেরকে সব খুলে বললাম । দুই জনই বললেন, ‘না, আল্লাহর শপথ, তুমি আমাদেরকে এ গোশত খেতে দিয়ে ভাল কাজ করনি । তারপর তারা পেটের ভিতর হতে গোশত বের করার জন্যে বমি করতে চেষ্টা করলেন। এ সফর থেকে যখন লোকজন ফেরত আসল তাদের মধ্যে আমি ছিলাম প্রথম ব্যক্তি আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে সাক্ষাত করলাম। তিনি তখন তাঁর ঘরে সালাতে রত ছিলেন। সালাতান্তে আমি বললাম, আস্সালামু আলাইকুম ইয়া রাসূলাল্লাহু ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু। তিনি বললেন, কে আওফ ইবন মালিক নাকি? আমি বললাম, জ্বী হ্যাঁ, আপনার প্রতি আমার মাতাপিতা কুরবান হোন। তখন তিনি বললেন, যবাইকারী আওফ? এরপর তিনি আর কিছু অতিরিক্ত বললেন না।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক অন্য এক একাধিক রাবী বিচ্ছিন্ন সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেন ।
বায়হাকী– আওফ ইবন মালিক (রা) হতে অনুরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আওফ ইবন মালিক (রা) বলেন, আমি গোশত সগ্রহের বিষয়টি উমর (রা)-এর কাছে উত্থাপন করলাম। তিনি এ সম্বন্ধে আমাকে জিজ্ঞেস করায় আমি তাকে বিস্তারিত জানালাম। তিনি বললেন, তুমি তোমার পরিশ্রমের পারিশ্রমিক নেয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেছ। (অর্থাৎ বিষয়টির বৈধতা সম্বন্ধে তোমার কাউকে জিজ্ঞেস করে সঠিক পন্থা অবলম্বন করা উচিত ছিল। এখন যা করেছ, তা বৈধ নয়।” সুতরাং তিনি আর এ গোশত খেলেন না।
হাফিয বায়হাকী– আমর ইবন আস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে যাতুস সালাসিল বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে প্রেরণ করেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে আবু বকর (রা) এবং উমর (রা)-ও ছিলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, আবু বকর (রা) ও উমর (রা)-কে সেনাপতি না করে আমাকে সেনাপতি করেছেন সম্ভবত সকলের চাইতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে আমার মর্যাদাই বেশী। তাই তার কাছে আমি আগমন করলাম এবং তাঁর সামনে বসলাম ও বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে প্রিয়তম ব্যক্তিটি কে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আইশা। আমি বললাম, আমি আপনার পরিবার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছিনা। তখন তিনি বললেন, ‘আইশার পিতা। আমি বললাম, এরপর কে? তিনি বললেন, উমর । আমি বললাম, তারপর? এভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন, এরপর মনে মনে বলতে লাগলাম, আর কোনদিন এ ধরনের প্রশ্ন করব না।’
এ হাদীছটি সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমেও অনুরূপ বর্ণিত রয়েছে।
আমর (রা) বলেন, এরপর আমি চুপ করে গেলাম, এই ভয়ে যে, আমার নাম না সর্বশেষে তিনি উল্লেখ করেন।
সাগর সৈকতে প্রেরিত আবু উবায়দা (রা)-এর অভিযান [একে সীকুল বাহার অভিযান বলা হয়ে থাকে।– সম্পাদকদ্বয়]
ইমাম মালিক (র)– জাবির (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাগর সৈকতের দিকে একটি সেনাদল প্রেরণ করেন। তাঁদের আমীর ছিলেন আবু উবায়দা ইবনুল জারাহ্ (রা)। সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন শ’। আমিও তাদের মধ্যে ছিলাম । আমরা ঘর থেকে বের হলাম বটে; কিন্তু রাস্তায় এসে আমাদের পাথেয় শেষ হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর সকল সদস্য তাদের কাছে রক্ষিত খাবার সেনাপতি আবু ওবায়দা (রা)-এর আদেশ মুতাবিক তার কাছে জমা দিলেন। সেনাপতি প্রতিদিন কিছু কিছু করে সেনা সদস্যদেরকে খাবার দিতে লাগলেন। খাবার ফুরিয়ে গেলে দৈনিক মাথা পিছু শুধু মাত্র একটি খেজুর বণ্টন শুরু হল। পরবর্তী রাবী জাবির (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, একটি খেজুর দিয়ে আপনাদের কীভাবে চলত? তিনি বললেন, যখন খাবার শেষ হয়ে গেল, তখন এই একটি খেজুরও আর জুটলনা। তারপর আমরা সাগর সৈকতে গেলাম এবং আমরা পাহাড়ের ন্যায় একটি সামুদ্রিক মাছ দেখতে পেলাম।
রাবী বলেন, সেনাবাহিনী এটাকে আঠার দিন যাবত খেলেন। তারপর একদিন আবু উবায়দা (রা) মাছটির পাঁজরের দুইটি বৃহৎ হাড় নিয়ে দাঁড় করাতে নির্দেশ দিলেন। এ দুটো হাঁড়ের নিচ দিয়ে একজন সৈনিক তাঁর সাওয়ারী নিয়ে পার হয়ে গেল, কিন্তু এ দুটো হাড়কে স্পর্শ করল না।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে তাদের ভাষায় জাবির (রা)-এর ভাষ্য নিম্নরূপ : “রাসূল (সা) আমাদেরকে তিনশ’ অশ্বারোহী সহ এক অভিযানে প্রেরণ করেন । আমাদের আমীর ছিলেন আবু উবায়দা ইবনুল জারাহ (রা)। আমরা কুরায়শদের একটি কাফেলার অপেক্ষায় ছিলাম। এরপর আমরা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লাম। খাদ্যের অভাবে আমরা গাছের পাতা খেতে বাধ্য হলাম । তাই এই সেনাবাহিনীকে খাতের যুদ্ধ বলা হয়। [খাবত অর্থ গাছের পাতা] রাবী বলেন, এক ব্যক্তি প্রথম দিন তিনটি উট যবেহ করলেন, দ্বিতীয় দিন আরো তিনটি উট যবেহ করলেন এবং তৃতীয় দিন আরো তিনটি উট যবেহ করলেন। এরপর আবু ওবায়দা (রা) তাঁকে উট যবাই করতে নিষেধ করলেন। রাবী বলেন, ‘সাগর থেকে একটি বিশাল মাছ উঠে আসল, যাকে বলা হয় আম্বর। এই মাছটি আমরা ১৫ দিন পর্যন্ত খেলাম এবং আমরা তার থেকে তেল সংগ্রহ করে শরীরে মাখলাম। ফলে আমাদের শরীর সুস্থ হয়ে উঠল । এরপর পাঁজরের অস্থির ঘটনা বর্ণনা করা হয়। উপরোক্ত হাদীছের মধ্যে উল্লিখিত, “আমরা কুরায়শদের একটি কাফেলার অপেক্ষায় ছিলাম’ এ বাক্যটির দ্বারা বুঝা যায় যে, এ অভিযান প্রেরণের ঘটনাটি ছিল হুদায়বিয়ার পূর্বেকার ঘটনা। আল্লাহ্ তা’আলা অধিক পরিজ্ঞাত। যে ব্যক্তিটি উট যবেহ করেছিলেন তাঁর নাম ছিল কায়স ইবন সা’দ ইবন উবায়দা (রা)।
হাফিয বায়হাকীর উদ্ধৃত– জাবির (রা)-এর বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে। আমাদের পাথেয় ছিল কেবল এক ঝুড়ি খেজুর। এছাড়া আমাদের খাওয়ার মতো কোন কিছুই ছিলনা। তাই আবু উবায়দা (রা) আমাদেরকে একটি একটি খেজুর দৈনিক খেতে দিতেন। আমরা ঐ একটি খেজুর চুষতে থাকতাম যেমন শিশুরা করে থাকে। তারপর আমি পানি পান করতাম। এতে আমাদের একটি দিবারাত চলে যেত। আর আমরা আমাদের লাঠি দ্বারা গাছের পাতায় পাতায় আঘাত করতাম। সেই পাতা পানির মধ্যে ভিজিয়ে রাখতাম। এরপর আমরা উক্ত পাতা খেতাম। রাবী বলেন, এরপর আমরা সাগরের তীরে চলে গেলাম এবং বিরাট বালির স্তূপের ন্যায় একটি প্রকাণ্ড মাছ সাগরের তীরে আমাদের জন্যে ভেসে আসল । এটার নিকট এসে দেখি এটা একটি বিরাট প্রাণী যাকে বলা হয় আম্বর । আবু উবায়দা (রা) বললেন, এটাতো মৃত, তাই এটা খাওয়া যাবে না। এরপর তিনি বললেন, “না বরং আমরা আল্লাহর রাসূল (সা)-এর দূত, আমরা আল্লাহর রাস্তায় রয়েছি আর আমরা নিরুপায় অবস্থায় আছি, কাজেই তোমরা তা খেতে পর। রাবী বলেন, আমরা এখানে প্রায় একমাস অবস্থান করলাম। আমরা ছিলাম তিনশ’ জন। আমরা মোটা তাজা হয়ে গেলাম। মাছের চোখের উপরিভাগ থেকে আমরা মটকার সাহায্যে তেল সংগ্রহ করতাম। আর প্রতিদিন একটি ষাঁড়ের পরিমাণ অংশ কেটে নেয়া হত। আবু উবায়দ। (রা) আমাদের মধ্য হতে তের জনকে মাছের চোখের উপর বসিয়ে দিলেন এবং পাঁজরের হাড়গুলো হতে একটি হাড় হাতে নিলেন ও দাঁড় করালেন। তারপর সবচেয়ে বড় সাওয়ারীটিকে তার নীচে দিয়ে যাবার আদেশ দিলেন। আমরা তা থেকে কিছু অংশ রান্না করে পাথেয় হিসেবে সংগে নিলাম। যখন আমরা মদীনায় আগমন করলাম তখন রাসূল (সা)-এর দরবারে হাযির হয়ে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলাম। তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা দয়া করে তোমাদের জন্যে খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তার কিছু অংশ কি তোমাদের কাছে আছে এবং আমাকে খেতে দিতে পার? রাবী বলেন, আমরা কিছু অংশ তাঁর খিদমতে পেশ করলাম এবং তিনি তা খেলেন। ইমাম মুসলিম ও উপরের হাদীছটি জাবির আনসারী (রা)-এর বরাতে উল্লেখ করেছেন।
উপরোল্লিখিত অধিকাংশ হাদীছের আলোকে বুঝা যায় যে, অভিযানটি ছিল হুদায়বিয়া সন্ধির পূর্বেকার ঘটনা। কিন্তু ইমাম বায়হাকীর অনুকরণে তা এখানে উল্লেখ করা হল। কেননা, তিনি এ ঘটনাটি মূতা যুদ্ধের পর ও মক্কা বিজয়ের পূর্বে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলাই অধিক পরিজ্ঞাত।
ইমাম বুখারী (র) মূতা যুদ্ধের পর জুহায়না গোত্রের হরুকাত এলাকায় উসামা ইবন যায়দ (রা)-এর অভিযানের বর্ণনার পরে উল্লেখ করেছেন। উসামা (রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে হুরুকাত এলাকার অভিযানে প্রেরণ করেন। আমরা ভোর বেলায় শত্রুর উপর হামলা করি ও তাদেরকে পরাজিত করি । আমিও আমার এক আনসারী ভাই দুশমনদের এক লোককে আক্রমণ করি। যখন তাকে আমরা কাবু করে ফেললাম তখন লোকটি বলে উঠল : আনসারী ভাই তাকে আঘাত করা থেকে নিবৃত্ত থাকলেন; কিন্তু আমি বর্শা নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করলাম। যখন আমরা মদীনায় ফিরে এলাম তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে ঘটনাটি উল্লেখ করা হলে তিনি বললেন, হে উসামা! তুমি কি তাকে [ ] বলার পরও হত্যা করেছ? আমি বললাম, সে ছিল আশ্রয়গ্রহণকারী অর্থাৎ এটা ছিল তার আত্মরক্ষার একটি অজুহাত মাত্র। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর বাক্যটি বারবার বলছিলেন। এমন কি আমি মনে মনে ইচ্ছা পোষণ করতে লাগলাম যে, ঐ দিনের ঘটনার আগ পর্যন্ত যদি আমি মুসলমান না হতাম তাহলে কতইনা ভাল হত। এ হাদীছটি প্রয়োজনীয় মন্তব্য ও ব্যাখ্যাসহ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
এরপর ইমাম বুখারী (র) সালামা ইবনুল আকওয়া (রা)-এর বরাতে হাদীছ উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে সাতটি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। আর যেসব জায়গায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) গমন না করে সৈন্যদল প্রেরণ করেছেন এরূপ নয়টি অভিযানে আমি অংশ নিয়েছি। কোন কোন সময় আবু বকর (রা) ছিলেন আমাদের আমীর। আবার কোন কোন সময় উসামা (রা) ছিলেন আমাদের আমীর।
এরপর বায়হাকী হাবশার শাসনকর্তা নাজ্জাশীর মুসলমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ, তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে মুসলমানদের কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংবাদ পরিবেশন ও তার জানাযার সালাত আদায়ের ঘটনা উল্লেখ করেন। আবু হুরায়রা (রা)-এর বরাতে তিনি বলেন, যেদিন নাজ্জাশী ইনতিকাল করেন, সেদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-তাঁর মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করেন এবং মুসলমানদেরকে নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন ও চার তাকবীরসহ তার জানাযার সালাত আদায় করেন। বুখারী এবং মুসলিম আবু হুরায়রা (রা)-এর বরাতে অনুরূপ হাদীছ বর্ণনা করেন। বুখারী ও মুসলিম জাবির (রা)-এর বরাতে বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেন, আজকে একজন পুণ্যবান ব্যক্তি ইনতিকাল করেছেন। তোমরা আশহামার (নাজ্জাশীর শাসনকর্তা) জানাযার সালাতে অংশ গ্রহণ কর। এ হাদীছটি পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে।
বলাবাহুল্য যে, মক্কা বিজয়ের বহু পূর্বেই নাজাশী ইনতিকাল করেছিলেন। সহীহ মুসলিমে একটি বর্ণনা আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন রাজা বাদশাহদের কাছে পত্র লিখেছিলেন তখন নাজ্জাশীর কাছেও একটি পত্র দিয়েছিলেন। সে নাজ্জাশী মুসলমান ছিলেন না। অবশ্য, ওয়াকিদী প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, তিনি তখন মুসলমান ছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলাই অধিক পরিজ্ঞাত।
বায়হাকী– উম্মে কুলসূম (রা) হতে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন উম্মে সালামা (রা)-কে বিবাহ করেন তখন উম্মে সালামা নাজ্জাশীর কাছে কিছু পরিমাণ মিক ও একজোড়া কাপড় হাদিয়া স্বরূপ পাঠান। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমার ধারণা, নাজ্জাশী মৃত্যু বরণ করেছেন। এবং তার কাছে প্রেরিত হাদিয়া অচিরেই ফেরত আসবে। এরপর এগুলো আমি তোমাদের মধ্যে বণ্টন করব অথবা তোমাকে দিয়ে দেব। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যা বলেছিলেন, বাস্তবে তাই ঘটল । নাজ্জাশী ইনতিকাল করেন তাই হাদিয়াও ফেরত আসে । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর এক সহধর্মিণীকে কিছু পরিমাণ মিশক দান করলেন, কাপড় জোড়াসহ বাকী সবটাও উম্মে সালামাকে দিয়ে দিলেন। আল্লাহই অধিক পরিজ্ঞাত।