অষ্টম সর্গ
যেখানে ঈশ্বর বা দেবদূত স্বর্গ থেকে নেমে এসে বন্ধুর মত মানুষের পাশে এসে কত কথাবার্তা বলেন, তার সরল সামান্য খাদ্য ভোজন করেন, সেখানে আমাদের মত মানুষের কোন কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। আমি শুধু এই ঘটনার মর্মান্তিক পরিণাম দেখাব। মানুষ কিভাবে বিধির বিধান লঙ্ঘন করে অবিশ্বাসী, আনুগত্যহীন ও ঈশ্বরদ্রোহী হয়ে ওঠে, আমি বলব তারই কথা।
মানুষের এই অবিশ্বস্ততা ও নিষিদ্ধ আচরণের জন্য তাকে ত্যাগ করে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান ঈশ্বর চিরতরে। ফলে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব বেড়ে যায়। উভয়পক্ষে ক্রমাগত চলতে থাকে ক্রোধ আর ভর্ৎসনার বাণবর্ষণ। অবশেষে ঈশ্বর বিচারের রায়দানের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে দুঃখ নেমে আসে চিরকালের জন্য। নেমে আসে পাপ আর মৃত্যুর করাল ছায়া। সত্যিই দুঃখের বিষয়। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়। ট্রয় যুদ্ধে শত্রুদের পশ্চাতে ধাবিত কঠোর একিলিসের মধ্যে যে রোষ দেখা গিয়েছিল, ঈনিসের প্রতি জুনো এবং ওডিসিয়াসের প্রতি সমুদ্রদেবতা পসেডন যে রোষ দেখান, ইতালির অধিপতি টার্নাস তার স্ত্রী ল্যাভিনিয়াকে হারিয়ে যে রোষে ফেটে পড়ে, সেই রোষ এইসব তর্কবিতর্কে প্রকাশিত হয়।
আমি এইসব কাব্যে প্রকাশ করার জন্য আমার স্বর্গীয় সাহায্যকারিণীর সাহায্য নিতে পারি। তিনি অযাচিতভাবে মাঝে মাঝে আমার নিদ্রার মধ্যেই আবির্ভূত হন। আমার স্বতোৎসারিত সকল কাব্যই তিনি আমাকে নিদ্রিত অবস্থাতে বলে দেন।
বহুদিন আগে হতেই এক বীরত্বপূর্ণ আখ্যানকাব্য রচনা করার প্রয়াস পেয়েছিলাম। কিন্তু শুধু বীরত্বের কথা মনঃপূত হয়নি আমার।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল মর্ত্যলোকে। ঘনীভূত হয়ে উঠছিল গোধূলির ছায়া, রাত্রির গোলার্ধে দিগন্তকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল।
এমন সময় যে শয়তানরাজ গ্যাব্রিয়েলের দ্বারা তাড়িত হয়ে ইডেন উদ্যানের সীমানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে আবার ফিরে এল। সে আবার তার পূর্বপরিকল্পিত প্রতারণা আর প্রতিহিংসাকে সজীব করে তুলল তার মনে। মানবজাতির ধ্বংসসাধনের উদ্দেশ্যে ও সংকল্পে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল সে। সে তারপর মধ্যরাত্রির অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে নির্ভীকভাবে ফিরে এল।
ইতিমধ্যে সে গোটা পৃথিবীটাকে পরিক্রমা করে এসেছে। ইউরিয়েল তাকে চিনতে পারার পর থেকে চেরাবজাতীয় দেবদূত প্রহরীদের সতর্ক করে দেয় সে। সে তাই সারাদিন ধরে দেবদূতদের প্রহরা এড়িয়ে অতি সন্তর্পণে ঘুরে বেড়িয়ে রাত্রির অন্ধকারে ফিরে আসে ইডেন উদ্যানে।
এর আগে পৃথিবী পরিক্রমাকালে সে শুধু পৃথিবীর নদী-সমুদ্র-পাহাড়-পর্বত সমম্বিত বিচিত্র ভূপ্রকৃতি দর্শন করেনি, সে তার বিচিত্র জীবজন্তুগুলিকেও বিভিন্ন জায়গায় ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে। সে দেখে কোন্ জীব তার উদ্দেশ্যসাধনের বেশি কাজে লাগবে। সব দেখার পর অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় সে যে, সাপই হলো সব জীবজন্তুর মধ্যে সবচেয়ে কুটিল। সে সর্পদেহ ধারণ করে তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধ করলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। অন্য জীবদেহ ধারণ করে এ কাজ সিদ্ধ করতে গেলে সন্দেহ জাগতে পারে অন্যের মনে। সে তাই মনে মনে ঠিক করল সর্পদেহের মধ্যে প্রবেশ করে তার কুটিল প্রতারণার গোপন বাসনাকে লোকচক্ষু হতে ঢেকে রেখে স্বচ্ছন্দে তা চরিতার্থ করতে পারবে সে।
সে তখন পৃথিবীকে সম্বোধন করে আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, হে পৃথিবী, তুমি স্বর্গলোকের শুভ অনুরূপ যদিও স্বৰ্গকেই সকলে পছন্দ করে বেশি। তথাপি তুমি দেবতাদের বসবাসযোগ্য, যদিও তোমাকে স্বর্গের পর দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হিসাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ঈশ্বর স্বর্গের সব স্থান সৃষ্টি করার পর কখনো তার থেকে খারাপ কিছু সৃষ্টি করতে পারেন না।
অনন্ত মহাশূন্যে যে সব ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্র, সূর্য ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলী নিয়ত নৃত্যশীল তাদের আলোক শুধু তোমার উপরেই পতিত হয়। তারা শুধু তোমাকেই আলোকিত করে। ঈশ্বর যেমন ত্রিভূবনের কেন্দ্রস্থলে বিরাজিত থেকে সর্বত্র তাঁর প্রভাব ও প্রভুত্ব বিস্তার করেন তেমনি তুমিও সমস্ত গ্রহের কেন্দ্রস্থলে থেকে সমস্ত সৌরজগতের শুভ প্রভাবগুলি আকর্ষণ করো। তাদের গুণগুলি তোমার গাছপালা ও ওষধিতে সঞ্চারিত হয় সফলভাবে। সেইসব গুণের প্রভাবেই তোমার মধ্যস্থিত প্রাণীগুলি জন্মলাভ করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ধীরে ধীরে। তাদের মধ্যে মানুষই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ প্রাণী, একমাত্র তারই মধ্যে জ্ঞানবুদ্ধি আছে।
হায়, আমি যদি হে পৃথিবী, তোমার অধিবাসী হতাম তাহলে তোমার মত সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়ে পাহাড়-উপত্যকা, নদী-সমুদ্র, সমতল ভূমি, অরণ্যরাজি দেখে কত আনন্দই না লাভ করতাম। কিন্তু তোমার মধ্যে এত সব কিছু থাকা সত্ত্বেও কোথাও আমার আশ্রয় নেই। কোথাও আমার বাসের স্থান নেই। আমার চারদিকে আমি এইসব আনন্দময় বস্তুগুলি যতই দেখি তই আমার অন্তজ্বালা বেড়ে যায়। আমার মধ্যে এমন কতকগুলি ঘৃণ্য বিপরীতমুখী ভাবধারা আছে যার জন্য সকল সুন্দর বস্তু অসুন্দর হয়ে যায় আমার কাছে। এমন কি স্বর্গলোকেও আরও শোচনীয় হয়ে উঠবে আমার অবস্থা। কিন্তু এই মর্ত্যলোকে অথবা স্বর্গলোকে আমি বাস করতে চাই না। আমি চাই শুধু স্বর্গের অধিপতিকে জয় করতে। তাঁর সব গৌরবকে খর্ব করে দিতে। কিন্তু আমার এই দুঃখময় অবস্থা তা শুধু একা ভোগ করতে চাই না, আমি অন্য সব সুখীদেরও আমার এই দুঃখের অংশভাগী করে তুলতে চাই। তাতে যদি আমার দুঃখ আরও বেড়ে যায় তো যাক।
ধ্বংসের মধ্যে সবচেয়ে শান্তিলাভ করে আমার বিক্ষুব্ধ চিন্তাগুলি। যাদের জন্য এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্ট হয়েছে তাদের ধ্বংস করা অথবা তাদের ক্ষতিসাধন করাই হলো আমার কাজ। তাহলে এর স্রষ্টাও দুঃখ পাবে। তাতেই আমি সমস্ত নরকবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে গৌরববোধ করব।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যে পৃথিবী ছয়দিন ছয়রাত ধরে সৃষ্টি করেছেন এবং তার আগেও কতদিন ধরে তার পরিকল্পনার চেষ্টা করেছেন তা আমি একদিন ধ্বংস করে দিতে চাই।
আমরা স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হবার পর আমাদের সংখ্যা পূরণের জন্য অথবা আমাদের প্রতি ঘৃণাবশত আমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করে তাদের উন্নতি সাধনের জন্য বিভিন্ন স্বর্গীয় গুণাবলীতে ভূষিত করেছেন। তাঁর ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছেন তিনি।
তিনি মানুষ সৃষ্টি করে সেই মানুষের জন্য এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে এই জগতের অধীশ্বররূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হায়, এইভাবে কী উপকারই না তিনি আমাদের করেছেন। স্বর্গের দেবদূতেরা সর্বদা পাখা মেলে এই মানুষের অধীনস্থ দাসের মত সেবা করে বেড়ায়। দেবদূত প্রহরীরা সারা পৃথিবী প্রহরা দিয়ে বেড়ায়। তাদের। প্রহরাকেই আমি সবচেয়ে ভয় করি। তাদের সেই প্রহরা এড়ানোর জন্যই আমি মধ্যরাত্রির কুয়াশা ও অন্ধকারের আবরণে গা ঢাকা দিয়ে গোপনে নিঃশব্দে এখানে প্রবেশ করেছি। কোথায় এক ঘুমন্ত সর্পকে দেখতে পাব এবং তার দেহে প্রবেশ করে আমার কুটিল কামনাকে চরিতার্থ করতে পারব তার জন্য প্রতিটি ঝোঁপঝাড় আমি অনুসন্ধান করে চলেছি।
যে আমি একদিন সর্বোচ্চ পদে অভিষিক্ত হয়ে দেবতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতাম, সেই আমি আজ বাধ্য হয়ে পশু হতে চলেছি। পশুর গুণাবলী ধারণ করতে চলেছি। কিন্তু উচ্চাভিলাষ পূরণ ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কে নীচে নামবেনা? যে উচ্চাভিলাষের আকাশে পাখা মেলে উড়তে চায় তাকে নীচে নামতেই হবে। যে প্রতিশোধ চায় তাকে আপাতমধুর সেই প্রতিশোধের তিক্ত ফল ভোগ করতেই হবে!
তাই হোক। যেহেতু সুউচ্চ স্বর্গলোকে গিয়ে আমি ঈশ্বরকে ধরতে পারলাম না, সেইহেতু সেই ঈশ্বরের পরেই যে আমার মনে ঈর্ষা জাগায়, যে ঈশ্বরের নূতন প্রিয় বস্তুরূপে আমাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আমাদের প্রতি ঘৃণাবশত যাকে ঈশ্বর সামান্য মাটি থেকে সৃষ্টি করে এমন উন্নত অবস্থায় উন্নীত করেছেন, সেই মাটির মানুষকে ঈশ্বরের নবজাত সন্তানকে ঘৃণা করতে চাই আমি। ঘৃণার শোধ ঘৃণার দ্বারাই নিতে হয়।
এই কথা বলার পর একরাশ কালো কুয়াশার মত গুঁড়ি মেরে প্রতিটি সিক্ত অথবা শুষ্ক ঝোঁপের মধ্যে সে একটি ঘুমন্ত সর্পের সন্ধান করে যেতে লাগল। অবশেষে সে এক জায়গায় দেখতে পেল ঘাসের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথা রেখে একটি সাপ নির্ভয়ে ঘুমোচ্ছে। শয়তান তার মুখের মধ্যে প্রবেশ করে তার পাশবিক কুটিল স্বভাবটি লাভ করল। তারপর তার বুদ্ধিকে সক্রিয় করে তুলল। কিন্তু তাতে সর্পটির ঘুমের কোন ব্যাঘাত হলো না। এইভাবে রাত্রি প্রভাত হবার অপেক্ষায় রইল।
তারপর যখন প্রভাতের শুচিস্নিগ্ধ আলো ইডেন উদ্যানের প্রস্ফুটিত ফুলগুলির উপর ঝরে পড়তে লাগল, তখন সেই সব ফুলগুলি হতে বিচিত্র সৌরভে আমোদিত হয়ে উঠল উদ্যান। পৃথিবীর সমস্ত সুগন্ধি বস্তুগুলি পরম স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নীরবে গৌরবগান করতে লাগল। তখন সর্পরূপী শয়তান দেখল সেই মানবদম্পতি ঈশ্বরের স্তোত্ৰগানে মুখর হয়ে উঠল। সমস্ত প্রকৃতি ও প্রাণীজগতের মধ্যে একমাত্র তারাই এই কণ্ঠস্বরের অধিকারী। ঈশ্বরের স্তবগানে সমর্থ। গান শেষে তারা প্রথমে প্রকৃতির রূপ, বর্ণ ও গন্ধ কিছুক্ষণ উপভোগ করল। পরে তারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করতে লাগল।
ঈভ তখন বলল, আদম, যতই আমরা এই উদ্যানের গাছপালা ও ফুলগুলির পরিচর্যা করছি ততই আমাদের কাজ বেড়ে যাচ্ছে। এতদিন আমরা দুজনে একসঙ্গে কাজ করে আসছি। একাজে আরও লোকের দরকার। যে সব গাছপালার অতিরিক্ত অংশ হেঁটে দিচ্ছি, একরাত্রির মধ্যেই তারা আবার বেড়ে উঠছে। তাই উপায়স্বরূপ একটি চিন্তা আমার মনে হয়েছে। এ বিষয়ে তোমার পরামর্শ চাই। আমি আমাদের শ্রমকে ভাগ করে নিতে চাই। আমরা দুজনে দু জায়গায় কাজ করব। তুমি পছন্দমত এক জায়গায় যেতে পার অথবা যেখান বেশি প্রয়োজন বুঝবে সেখানে যাবে। অথবা যেখানে আইভিলতাগুলি কোন গাছকে জড়িয়ে উঠতে পারছে না সেখানে গিয়ে তাদের উঠিয়ে দেবে। আর আমি ঐ গোলাপবনে গিয়ে তাদের পরিচর্যা করব বেলা দুপুর পর্যন্ত।
কিন্তু আমরা দুজনে যদি একই জায়গায় কাছাকাছি কাজ করি তাহলে পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময়, হাসাহাসি ও কথাবার্তায় সময় কেটে যায়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। সারাদিন বৃথাই কেটে যায়।
আদম তখন শান্তকণ্ঠে উত্তর করল, হে আমার একমাত্র সহচরী, সমস্ত প্রাণীর মধ্যে তুমিই আমার প্রিয়তমা, ঈশ্বরনির্দিষ্ট আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলি কিভাবে সুচারুরূপে সম্পন্ন হতে পারে সে বিষয়ে তুমি ঠিকই বলেছ। কাজ ঠিকমত না হওয়ার জন্য যাতে আমার কোন নিন্দা বা বিরূপ সমালোচনা না হয় সেদিকে তোমার লক্ষ্য আছে। পারিবারিক মঙ্গলসাধনই নারীর সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দান করে। পারিবারিক উন্নতির জন্য যথাসাধ্য কাজ করে যাওয়াই নারীর ধর্ম।
কিন্তু ঈশ্বর আমাদের উপর এমন কিছু কঠোর শ্রমের ভার চাপিয়ে দেননি যে আমরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুজনে একসঙ্গে বসে বিশ্রাম করে অথবা মধুর আলাপ-আলোচনার দ্বারা চিত্তবিনোদন করতে পারব না। যে হাসি মানুষের যুক্তিবোধ থেকে উৎসারিত হয়, সে হাসি পশুদের মুখে পাওয়া যায় না। নরনারীর মুখের সেই মিষ্টি হাসি ও মধুর বিশ্রম্ভালাপ মানবমনের খাদ্য। প্রেম হচ্ছে মানবজীবনের এক মহান লক্ষ্য, কোন হীনতম লক্ষ্য নয়।
কোন কষ্টকর বিরক্তিকর শ্রমের জন্য আমাদের সৃষ্টি হয়নি, আমাদের সৃষ্টি হয়েছে আনন্দের জন্য এবং এই আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তি। এইসব বনপথ ও কুঞ্জগুলি আমরা দুজনেই হাত দিয়ে পরিষ্কার রাখতে পারব। আমাদের বেড়াবার প্রশস্ত পথ থাকবে। পরে আমাদের সন্তানরা তাদের ছোট ছোট হাত দিয়ে সাহায্য করবে আমাদের কাজে।
তবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার দ্বারা তোমার মন যখন তৃপ্ত হবে তখন তুমি অল্প : কিছুক্ষণের জন্য অনুপস্থিত থাকতে পার। আমি তা সহ্য করতে পারব। কারণ নির্জনতা অনেক সময় উত্তম সাহচর্য বা সঙ্গদানের কাজ করে। স্বল্পকালীন বিরাম বা বিশ্রাম ভাল ফল দান করে।
তবে এ বিষয়ে আর একটি সংশয় আচ্ছন্ন করছে আমার মনকে। পাছে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র কোথাও গেলে তোমার কোন বিপদ ঘটে বা তোমার কোন ক্ষতি হয় তা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে আমার মন। আমাদের কিভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে তা তুমি জান। আমাদের কোন প্রতিহিংসাপরায়ণ শত্রু আমাদের সুখে ঈর্ষান্বিত ও তার হতাশায় বিক্ষুব্ধ হয়ে এক হীন চক্রান্ত ও অপকৌশলের দ্বারা আমাদের পতন ঘটিয়ে অন্তহীন দুঃখ, লজ্জা ও অপমানের গহুরে নিক্ষেপ করতে চাইছে। সে শত্ৰু নিশ্চয় আমাদের নিকটবর্তী কোন জায়গায় থেকে লক্ষ্য করছে, তার কু-অভিসন্ধি পূরণের সুযোগ খুঁজছে। দেখছে আমরা এক জায়গায় পাশাপাশি থাকলে সুবিধা হবে না। কারণ তাহলে একজনের প্রয়োজনে অন্যজন সাহায্য করতে পারব সঙ্গে সঙ্গে। সেই জন্য আমরা দুজনে ছাড়াছাড়ি হয়ে দূরে দূরে থাকলে তার সুবিধা হবে।
তার আসল উদ্দেশ্য হলো তার ঈর্ষার প্রধান বস্তু আমাদের এই সুখী জীবনের অবসান ঘটানো। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সে ঈশ্বরের প্রতি আমাদের আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা অথবা আমাদের দাম্পত্যপ্রেমে ব্যাঘাত ঘটাতে চায় সে। তবে সে যাই করুক, যে ঈশ্বর তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে আজীবন রক্ষা করে চলেছেন তার পক্ষ যেন ত্যাগ করো না। যেখানে স্ত্রীর বিপদ বা অপমানের আশঙ্কা থাকে, সেখানে সে স্বামীর কাছে নিরাপদে থাকে, সেখানে স্বামীই তাকে রক্ষা করে।
ঈভ তখন গম্ভীরভাবে বলল, হে ঈশ্বরের সন্তান এবং পৃথিবীর অধীশ্বর, আমাদের এমন একজন শত্রু আছে যে আমাদের সর্বনাশ ঘটাতে চায় তা তোমার কাছ থেকেই জানতে পেরেছি আমি। আমাদের সেই দেবদূত অতিথি বিদায় নেবার সময় এ বিষয়ে যা বলে যান তাও আমি আমাদের বনকুঞ্জের পিছনে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি।
কিন্তু আমাদের একজন শত্রু আমাদের প্রলোভিত করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে বলে তুমি যে ঈশ্বরের প্রতি ও তোমার প্রতি আমার বিশ্বস্ততা ও দৃঢ়তায় সংশয় প্রকাশ করবে এটা আমি আশা করতে পারিনি। তার শক্তিকে তুমি ভয় করো না। কারণ আমরা মৃত্যুযন্ত্রণার বশীভূত নই। মৃত্যু আমাদের আক্রমণ করতে পারবে না, তার সে আক্রমণকে আমরা প্রতিরোধ করতেও পারব না। তার প্রতারণাকে একমাত্র তুমিই ভয় করো। আর সেই ভয় থেকেই তুমি বিশ্বাস করো ঈশ্বরের প্রতি আমার বিশ্বস্ততা তোমার প্রতি আমার ভালবাসা তার প্রতারণার দ্বারা বিকম্পিত ও ব্যাহত হবে। যে তোমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় তার প্রতি এই চিন্তা কেমন করে পোষণ করো তুমি তোমার অন্তরে? কি করে সে চিন্তা প্রবেশ করল তোমার মনে?
আদম তখন উত্তর করল, হে ঈশ্বরসৃষ্ট মানবকন্যা, অমর ঈভ, জানি তুমি মৃত্যু, পিপ বা কোন দোষ থেকে মুক্ত। তুমি নিষ্পাপ, নির্দোষ ও কলুষমুক্ত তা জানি। তোমার কোন অপূর্ণতা বা ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য আমি তোমাকে আমার কাছ থেকে সরে যেতে দিচ্ছি না, আমাদের শত্রুর সম্ভাব্য প্রলোভনটাকে এড়াবার জন্যই তোমাকে নিষেধ করছি আমি। তার প্রলোভন বৃথা হলেও তোমার ধর্মবিশ্বাস প্রলোভনের অতীত নয় জেনে সে তোমার সম্মানকে কলুষিত করার চেষ্টা করবেই। তার সেই অন্যায় প্রচেষ্টা যত নিষ্ফলই মনে হোক না কেন, তুমি তা ঘৃণা ও ক্রোধের দ্বারা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। তাই আমি বলি তুমি একা এই প্রলোভনের সম্মুখীন হও এটা যদি আমি না চাই তাহলে কিছু মনে করো না। আমরা একসঙ্গে এক জায়গায় দুজনে থাকলে শত্রু তা করতে সাহস করত না। আর সাহস করলেও আমাদের উপরেই প্রথমে নেমে আসত তার সে আক্রমণ। যে শয়তান তার ছলনার দ্বারা দেবদূতদেরও প্রতারিত করে সে এমন সূক্ষ্মভাবে তার ছলনাজাল বিস্তার করবে যে তুমি তার সে ছলনা ও প্রতারণা ধরতে পারবে না। সুতরাং এ বিষয়ে অপরের সাহায্য অপ্রয়োজনীয় ভাবা ঠিক নয়।
আমি কিন্তু তোমার দৃষ্টির প্রভাবে অনেক গুণ ও জ্ঞান লাভ করি। তোমাকে দেখে মনে অনেক জোর পাই। কারণ বুঝি দরকার হলে তোমার সাহায্য পাব। অথচ তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন এতে? সব লজ্জা জয় করে তুমি তোমার জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে এটা বুঝতে পারছ না কেন যে আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকলে আমাদের শক্তি আরো বেড়ে যাবে। আমার উপস্থিতিতে তোমার গুণ ও মানসিক শক্তির পরীক্ষা হলে ভাল হবে।
তার স্ত্রীর প্রতি ভালবাসাবশত আদম এই কথা বললে ঈভ কিন্তু তার বিশ্বস্ততার নিষ্ঠা সম্বন্ধে কোন সংশয় না থাকায় সে আর কোন গুরুত্ব দিতে চাইল না সে কথায়।
ঈভ বলল, এই যদি আমাদের অবস্থা হয়, ছোট-বড় কোন শত্রুর ভয়ে এক সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে যদি আমাদের বাস করতে হয় এবং একা সে শত্রুর সম্মুখীন হওয়া যদি সম্ভব না হয় তাহলে কিসের আমরা সুখী? যদি বিপদের আশঙ্কায় আজও শঙ্কিত হতে হয় আমাদের তাহলে আমাদের সুখ কোথায়? কিন্তু কোন পাপ না করলে তো কোন ক্ষতি হতে পারে না? সে আমাদের দাম্পত্য প্রেমের নিবিড়তা বা অখণ্ডতাকে হীনজ্ঞান করতে পারে। কিন্তু তাকে হীনজ্ঞান মনে করলেই তো তা হীন বা অসম্মানিত হয়ে পড়বে না। সুতরাং আমরা পরস্পরের কাছ থেকে ছাড়াছাড়ি হলেও তাতে ভয়ের কি আছে?, বরং তার অনুমান মিথ্যা প্রমাণিত হলে এই ঘটনা থেকে দ্বিগুণ সম্মান লাভ করবে আমাদের প্রেম। কারণ আমরা ঈশ্বরের দ্বারা অনুগৃহীত। তাছাড়া বিশ্বাস, প্রেম প্রভৃতি গুণগুলি যদি কখনো প্রতিকূল ঘটনার আঘাতে সুরক্ষিত না হয়, যদি তারা একাকী আপন আপন প্রাণশক্তির দ্বারা আত্মরক্ষা করতে না পারে তাহলে সে সব ক্ষণভঙ্গুর গুণগুলির প্রয়োজন কি? সুতরাং আমাদের এই সুখী অবস্থার প্রতি কোন সংশয় পোষণ করা উচিত নয়। যদি তোমার ধারণা ঠিক হয় তবে বুঝতে হবে স্রষ্টা আমার সুখকে ক্ষণভঙ্গুর করেছেন যাতে আমরা একাকী সে সুখকে রক্ষা করতে পারি। তাহলে ঈশ্বরনির্মিত এই ইডেনই নয়, সামান্য সাধারণ এক উদ্যানমাত্র।
আদম তখন আবেগের সঙ্গে বলল, হে নারী, ঐশ্বরিক ইচ্ছায় সৃষ্ট সকল বস্তুই উত্তম। ঈশ্বর নিপুণহস্তে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার কোন কিছুই অপূর্ণ নয়। মানুষকেও তিনি অপূর্ণ করে সৃষ্টি করেননি। বাইরের যেকোন প্রতিকূল শক্তিকে প্রতিহত করে সে তার নিজের সুখের অবস্থাকে নিরাপদ বা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। তার যা কিছু বিপদ বা শত্রু তা আছে তার ভিতরে এবং সে বিপদ অতিক্রম করার ক্ষমতা তার নিজের মধ্যেই আছে। তার নিজের ইচ্ছা না থাকলে কোন ক্ষতিই হতে পারে না।
কিন্তু ঈশ্বর মানুষের ইচ্ছাকে স্বাধীন করে রেখেছেন। কারণ যা কিছু যুক্তিকে মেনে চলে তাই স্বাধীন। এই যুক্তি সব সময় সঠিক এবং ন্যায়ের পথ দেখায়। কিন্তু এই যুক্তি অন্তরে গোপন অবস্থায় থাকে। তবু ইচ্ছা কোন ভুল করলেই তাকে ঠিক পথে চালিত করার জন্য সব সময় খাড়া হয়ে থাকে। পাছে কোন আপাতসুন্দর বস্তু বা ব্যক্তি ভালর বেশ ধরে এসে তাকে ভুল পথে চালিত করে এবং ইচ্ছাকে ভুল তথ্য পরিবেশন করে তাকে ভুল বুঝিয়ে ঈশ্বরের দ্বারা নিষিদ্ধ কোন কাজ করতে বাধ্য করে তার জন্য সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখে চলে সে।
সুতরাং আমি ভালবেসে যে তোমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দিই তা যেন অবিশ্বাস করো না। আমরা আমাদের আদর্শে যত দৃঢ় বা অবিচল থাকি না কেন, সে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে পারি আমরা। কারণ যুক্তি অনেক সময় শত্রুর বিস্তৃত ছলনাজালে পড়ে তার প্রহরা শিথিল করে তার অজানিতেই প্রতারণার শিকার হয়ে পড়ে।
সুতরাং প্রলোভনকে ডেকে এনো না। তাই তাকে পরিহার করে চলা ও আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়াই ভাল। কখন কিভাবে বিপদ আসবে অপ্রত্যাশিতভাবে বলা যায় না। তুমি যদি মনেপ্রাণে বিশ্বস্ত হও তাহলে প্রথমে তোমার আনুগত্যের পরিচয় দিতে হবে।
যদি তুমি মনে করো আমরা একসঙ্গে থাকলেও বিপদ অতর্কিতভাবে আমাদের উপরেও এসে পড়তে পারে, যদি মনে করো তুমি তোমার শক্তিতে খুব বেশি আস্থাশীল হয়ে উঠেছ তাহলে যেতে পার। কারণ তুমি যদি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার কাছে থাক তাহলে তোমার সে উপস্থিতি অনুপস্থিতির থেকেও দুর্বিসহ হয়ে উঠবে। তাহলে তোমার সহজাত নির্দোষিতা এবং নিজস্ব গুণাবলীর উপর ভিত্তি করে চলে যাও। ঈশ্বর যেমন করে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, যে সব গুণাবলী দান করেছেন, তুমি সেই সব গুণানুসারেই চলবে।
আমাদের আদিপিতা এই কথা বললেও ঈভ জেদ করতে লাগল। সে বিরক্তির সঙ্গে বলল, তোমার অনুমতি নিয়ে এবং পূর্ব হতে সতর্কিত হয়ে আমি যাচ্ছি। তোমার দ্বারা উপস্থাপিত শেষ যুক্তিটি স্পর্শ করে আমার মনকে। আমরা একসঙ্গে থাকলেও আমাদের অপ্রস্তুত অবস্থাতেই অতর্কিতভাবে বিপদ এসে পড়তে পারে। সুতরাং আমি স্বেচ্ছায় যাচ্ছি। আমাদের দর্পিত শত্ৰু অতর্কিতে এসে আমাদের মধ্যে যে বেশি দুর্বল শুধু তারই খোঁজ করবে এটা আমি আশা করতে পারি না। ঈভকে এইভাবে অনমনীয় দেখে আদম ভাবল এরপর তাকে নিষেধ করতে হলে সেটা লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
ঈভ তার কথা বলা শেষ করেই আদমের হাত হতে তার নরম হাতটি ছাড়িয়ে নিল। হালকা বনপরীর মত সে বাতাসের বেগে তখনি চলে গেল।
বাগানের কাজ করার উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে ঈভ যখন আদমের কাছ থেকে অন্যত্র কাজ করতে যাচ্ছিল তখন তাকে দেখে রোমকদেবতা ভাতুমনাসকে ছেড়ে চলে যেতে থাকা তার প্রেমিকা পমোনার মত দেখাচ্ছিল।
তার পথপানে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে যতদূর দেখা যায় ততদূর দেখতে লাগল আদম। তার শুধু মনে হচ্ছিল ঈভ তার কাছে আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভাল হত। যাবার সময় সে ঈভকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলে দেয় বারবার। ঈভও তাকে জানিয়ে দেয় সে দুপুর হলেই ফিরে আসবে তাদের কুঞ্জে। তারা একসঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজন করবে এবং একসঙ্গে বিশ্রাম গ্রহণ করবে।
হে অতিপ্রতারিত, অতিব্যর্থ, ভাগ্যহীনা ঈভ, প্রতিকূল ঘটনার দ্বারা তোমার প্রস্তাবিত প্রত্যাবর্তন হবে কত কলুষিত। সেই প্রত্যাবর্তনের পরমুহূর্ত হতেই তুমি আহার ও বিশ্রামে আর কোন মাধুর্য বা আনন্দ পাবে না। কারণ শয়তান সকাল থেকেই তোমার পথে অতর্কিত আক্রমণে তোমার সকল নির্দোষিতা, ঈশ্বরবিশ্বাস ও স্বর্গীয় সুখ হতে চিরতরে তোমাকে বঞ্চিত করার জন্য সাপের রূপ ধরে ছায়াচ্ছন্ন ফুলবনে ওৎ পেতে লুকিয়ে আছে। যে দুটিমাত্র আদি মানব-মানবীর মধ্যে ভাবী কালের সমগ্র মানবজাতি নিহিত আছে সেই দুটি মানব মানবীই তার উদ্দিষ্ট শিকারের বস্তু।
মাঠে, বাগানে, কুঞ্জবনে কত খুঁজেছে তাদের। সে তাদের দুজনকেই কোন ঝর্ণা বা ছায়াচ্ছন্ন নদীতটে নির্জনে দেখতে চেয়েছে। তবে ঈভকে একা পেলেই ভাল হয়। কিন্তু ঈভকে সে তার স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একা পেতে ইচ্ছা করলেও সে ইচ্ছা পূরণ তার আশাতীত। কারণ তারা সব সময় দুজনে একসঙ্গে থাকে। একসঙ্গে কাজ করে অথবা বেড়ায়।
কিন্তু শয়তান তার গুপ্তস্থান থেকে ঈভকে সেদিন একাই দেখল। দেখল একটি ফুটন্ত গোলাপের ঝোঁপের পাশে একা একা দাঁড়িয়ে কাজ করছে ঈভ আপন মনে। গোলাপগাছের যে সব সরু সরু শাখাগুলি ফোঁটা ফুলের ভারে নুইয়ে পড়ছিল তাদের তুলে ধরে এক একটি অবলম্বন দান করছিল সে। গাছের আড়ালে থাকায় ঈভকে সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছিল না।
শয়তান এবার তার গুপ্তস্থান থেকে বেরিয়ে এসে গাছপালার মধ্যে দিয়ে ঈভের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সন্তর্পণে। গোলাপের গন্ধে আমোদিত ও তার রূপ সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ দেখে তার গাটাকে সত্যিই খুব মনোরম দেখাচ্ছিল। মুক্তবায়ুহীন শহরে দীর্ঘকাল আবদ্ধ থাকার পর কোন লোক যদি গ্রীষ্মের কোন এক সকালে গ্রামের মুক্ত বাতাসে ভরা খোলা মাঠে এসে পড়ে তাহলে সে গ্রামের প্রতিটি বস্তু ও শব্দদৃশ্য দেখেই আনন্দ পায়। নরকবাসী শয়তানরাজও তেমনি সেই গোলাপকুঞ্জের কাছাকাছি এসে অনুরূপ আনন্দ লাভ করল। দেখল ঈভও প্রস্ফুটিত ফুলের মতই সুন্দর। সকল আনন্দ যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে ঈভের চোখে।
সর্পরূপী শয়তান দেখল ঈভের চেহারাটা অনেকটা দেবদূতের মত, কিন্তু এক অপরূপ সৌন্দর্যসুষমায় মণ্ডিত নারীমূর্তি। তার চেহারার মধ্যে এমনই একটি স্বর্গীয় ছবি ছিল যা দেখে শয়তানের ভয়ঙ্কর অভিলাষ ও প্রতিহিংসার সকল ভীষণতাও যেন ভয় পেয়ে গেল।
ঈভকে দেখতে দেখতে ক্ষণকালের জন্য সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল শয়তান। ক্ষণকালের জন্য সে সমস্ত শত্রুতা, হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা ও প্রতিশোধ-বাসনার কথা সব ভুলে গিয়ে খুব ভাল হয়ে উঠল মনে মনে। হয়ে উঠল পবিত্রচিত্ত। ঈভকে দেখে এক সত্যিই বিশুদ্ধ আনন্দ লাভ করল।
কিন্তু সে শুধু ক্ষণকালের জন্য। তার বুকের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর নরকাগ্নি অনির্বাণভাবে জ্বলে চলছিল, সে অগ্নি প্রবল হয়ে উঠল আবার। সে আগুন মুহূর্তে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল তার আগুনের সকল শুচিতা ও আনন্দকে। এই ইডেন উদ্যানে যে সব মনোরম বস্তু তাদের ভোগের জন্য সৃষ্ট হয়নি, হয়েছে মানবজাতির জন্য, সেই সব জিনিস দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনের উপর দুঃখের পীড়ন বেড়ে যায়। প্রবলতর হয়ে ওঠে ঘৃণা, প্রতিহিংসা আর বিদ্বেষ। কলুষিত ও বিষাক্ত হয়ে ওঠে তার সকল চিন্তা।
নিজের চিন্তাভাবনাকে সম্বোধন করে উন্মাদের মত বলতে লাগল শয়তান, হে আমার চিন্তারাজি, তোমরা আমায় কোথায় নিয়ে এসেছ? কোন্ মায়াবলে আমাকে এমন এক মধুর বিস্মরণের মধ্যে ডুবিয়ে দিলে যাতে আমি আমার আসল উদ্দেশ্যটাকে ভুলে গেলাম! কোন ভালবাসা, স্বর্গলাভের আশা বা এখানকার উদ্যানসুলভ আনন্দ আস্বাদনের জন্য এখানে আসিনি আমি, আমি এসেছি এখানকার সব আনন্দ ধ্বংস করে দিতে।
আমি এখন কেবল ধ্বংস করেই আনন্দ পেতে চাই। অন্য যে কোন আনন্দ মিথ্যা আমার কাছে। যে সুযোগ সৌভাগ্যের রূপ ধরে সুপ্রসন্ন হয়ে উঠেছে আমার, প্রতি তাকে যেন ব্যর্থ হয়ে চলে যেতে দিও না। ঐ দেখ, সেই আদি মানবী এখন সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় কাজ করছে। আমার প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তোলার এই হলো সুবর্ণ সুযোগ। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি ওর স্বামী এখন অনেক দূরে আছে, তার কাছে নেই। তার উচ্চমনের বুদ্ধি, বীরত্বপূর্ণ চেহারা, তার শক্তি, সাহস সবই ভয়ের বস্তু আমার কাছে। ও এখন ঈশ্বরের অনুগ্রহে ধন্য বলে ওর দেহে কোন ক্ষত হবে না, কোন আঘাত মারাত্মক হয়ে উঠবে না তার পক্ষে। অথচ আমি আমার সেই দৈবী শক্তি হারিয়েছি। বর্তমানে আমি দীর্ঘদিন নরকযন্ত্রণা ভোগ করে করে ক্ষীণ হয়ে উঠেছি।
ঐ আদি মানবী সত্যিই সুন্দরী, এক স্বর্গীয় সুষমায় মণ্ডিত তার সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্য দেবতাদের ভালবাসার যোগ্য। কপট ভালবাসার এক ছলনাময় ক্ষীণ আবরণের মধ্যে প্রবলতম এক ঘৃণাকে ঢেকে রেখে আমি যাচ্ছি তার কাছে।
নিজের মনে এই কথা বলার পর মানবজাতির শত্রু শয়তানরূপী সর্প ঈভের দিকে এগিয়ে এল। মাটির উপর শুয়ে হেঁটে চলতে লাগল সে। তারপর নীচের দিকটা কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথাটা উঁচু করে তুলে রাখল ঘাসের উপর তরঙ্গায়িত ভঙ্গিতে এঁকেবেঁকে এল সে। তার আকারটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। ইতিলরিয়াতে থীবস-এর রাজা ক্যাডমাস ও তার রানী হার্মিওন যে সর্পদেহ ধারণ করে অথবা এপিডরাসে ওষুধের দেবতা এপিকনিপাম যে সর্পরূপ ধারণ করে রোমে প্লেগরূপ মহামারীর অবসান ঘটাতে যান, সেই সব সর্পরূপের থেকে সর্পরূপী শয়তানকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল।
নিয়ত পরিবর্তনশীল কোন বায়ুপ্রবাহের মত সর্পরূপী শয়তান তার দেহটাকে আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে ঈভের মন ভোলাবার চেষ্টা করছিল। তার মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিল।
ঈভ কিন্তু তার উপস্থিতির কথা কিছুই বুঝতে পারেনি। সে শুধু গাছপালার পাতার পতপত শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শুনতে পায়নি। বনের মধ্যে জীবজন্তু চলাফেরার সময় তাদের পায়ের এরকম শব্দ প্রায়ই হয়। তাই সে কিছু মনে করেনি।
এদিকে সর্পরূপী শয়তান সেখানেই থেমে রইল। সে তার সোনালী ঘাড়টা প্রায়ই উঁচু করছিল।
অবশেষে তার এই নীরব ক্রীড়াভঙ্গির প্রকাশ ঈভের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ঈভের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে শয়তান খুশি হয়ে তার কুটিল প্রলোভনজাল বিস্তার করার জন্য মানুষের মত বলতে লাগল, হে মর্ত্যলোকের অধীশ্বরী, আশ্চর্যান্বিত হয়ো না। ঘৃণামিশ্রিত ও কঠোর করে তুলো না তোমার দৃষ্টিকে। তুমি হচ্ছ বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি। সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতার রানী। আমি এখানে এসে মুগ্ধ ও অতৃপ্ত নয়নে তোমাকে অবলোকন করছি। এই দেখ, আমি একা হলেও তোমার কুটিকে ভয় পাচ্ছি না।– তোমার স্রষ্টার অনুরূপ সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ তোমার দেহ। এ জগতের সব বস্তুই তুমি পেয়েছ উপহার হিসাবে। এখানকার সব জীবন্ত প্রাণীই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তোমাকে দেখে। কিন্তু শুধু মুগ্ধ দৃষ্টির সার্থকতা কোথায় যদি না সে দৃষ্টির মুগ্ধতা প্রশংসা বা বন্দনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত না হয়?
এখানকার বন্য পশুরা তোমার স্বর্গীয় সৌন্দর্য শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে কিন্তু শুধুমাত্র একজন মানুষ ছাড়া আর কোন পশু বা প্রাণী তোমার এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মহিমার মর্ম বুঝতে পারে না। যিনি দেবতাদের মধ্যে মানবীর মত, যিনি অসংখ্য দেবদূতদের সেবালাভের যোগ্য তাঁকে সামান্য এক মানুষ প্রশংসা করে কি করবে?
এইভাবে প্রলোভনের জালবিস্তারকারী শয়তানের ছলনাময় কথাগুলি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ঈভের অন্তরে। সর্পের মুখে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে আশ্চর্য হয়ে উঠল সে। পরে বিস্ময়ের ঘরটা কাটিয়ে উঠে সে বলল, এর মানে কি? পশুর কণ্ঠে মানুষের কথা ব্যক্ত হচ্ছে আর মানুষের জ্ঞানের কথা প্রকাশিত হচ্ছে?
আমি তো জানতাম পশুরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। কারণ ঈশ্বর সৃষ্টিকালে পশুদের মূক হিসাবেই সৃষ্টি করেছিলেন। যদিও অদের সৃষ্টি ও কর্মের মধ্যে মানবিক যুক্তিবোধ ও জ্ঞানের অনেক পরিচয় পাওয়া যায়। হে সর্প, আমি জানতাম তুমি খুব চতুর একটি জীব, কিন্তু তুমি যে মানবসুলভ কণ্ঠস্বরের অধিকারী তা তো জানতাম না।
এখন বল, কিভাবে তুমি তোমার মূক অবস্থা থেকে এমন কণ্ঠস্বর লাভ করলে এবং কেমন করেই বা এখানকার অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে আমার প্রতি সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠলে? একথা বলে আমার বিস্ময়কে দ্বিগুণীকৃত করে দাও।
একথা শুনে সুচতুর প্রলোভনকারী বলল, সৌন্দর্যের সম্রাজ্ঞী, হে জ্যোতির্ময়ী ঈভ, তুমি যা বলতে আমাকে আদেশ করেছ সে কথা বলা খুবই সহজ আমার পক্ষে। তাছাড়া তোমার আদেশ মান্য করা আমার উচিত।
আমিও প্রথমে অন্যান্য প্রাণীর মত বনের ঘাসপাতা প্রভৃতি সামান্য খাদ্য খেয়ে বিচরণ করে বেড়াতাম। কোন্ খাদ্য ভাল বা মন্দ, কে নারী কে পুরুষ, কোন বিষয়েরই কোন বিশেষ জ্ঞান ছিল না আমার।
একদিন মাঠে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দূরে একটি সুন্দর গাছ দেখতে পেলাম। সোনালী ও লালে মেশানো অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ফলে ভরা গাছটি। গাছটিকে ভাল করে দেখার জন্য তার কাছে গেলাম আমি। সহসা গাছটির শাখাগুলি থেকে একঝলক গন্ধ বাতাসে ভেসে আসায় জাগ্রত হয়ে উঠল আমার ক্ষুধা। সেই মধুর গন্ধে মন আমার মাতোয়ারা হয়ে উঠল। আমি সেই ফল ভক্ষণ করে একই সঙ্গে আমার ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিরসনের সংকল্প করলাম। এরপর আমি শ্যাওলাধরা গাছের গুঁড়িটিকে জড়িয়ে ধরলাম। সেই গাছের ডালগুলো এত উঁচু ছিল যে আদমের মত লম্বা কোন মানুষ ছাড়া তা নাগাল পাবে না।
সেই গাছের তলায় আরো যে সব পশু ফল খাবার আশায় দাঁড়িয়ে ছিল তারাও তার নাগাল পেল না।
কিন্তু আমি সেই গাছটির উপর সর্পিল গতিতে উঠে গেলাম। দেখলাম আমার হাতের কাছে প্রচুর ফল ঝুলছে। তা আমি তখন পেড়ে মনের সাধ মিটিয়ে পেট ভরে খেতে লাগলাম। সেই রসাল ফল খেয়ে যে মধুর আস্বাদ আমি পেয়েছিলাম তার আগে কোন খাদ্য বা কোন ঝর্ণার জল খেয়ে সে আস্বাদ আমি পাইনি।
সেই ফল খাবার সঙ্গে সঙ্গে এক আমূল পরিবর্তন এল আমার অন্তরে। আমার মনের জোর বেড়ে গেল। আমার জ্ঞানবুদ্ধি ও যুক্তিবোধ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। আমার বাকশক্তি ফুরিত হলো। স্বর্গ, মর্ত্য দুইয়ের মধ্যবর্তী এই জগৎ সম্বন্ধে সব জ্ঞান স্পষ্টভাবে ধরা দিল আমার কাছে। আমি যেন ত্রিভুবনের সব কিছু দেখতে পেলাম। তবে আমার দেহটি তেমনই রয়ে গেল। বহিরঙ্গের কোন পরিবর্তন হলো না। কিন্তু এই ত্রিভুবনের মধ্যে তোমার মত সুন্দরী কোথাও দেখিনি। স্বর্গের সমস্ত অপ্রাকৃত জ্যোতি যেন মিলিত হয়েছে তোমার রূপের মধ্যে। সৌন্দর্য ও সততায় ত্রিজগতে তোমার তুলনীয় দ্বিতীয় একজন কেউ নেই।
এরজন্যই আমি এখানে এসে থেকে তাকিয়ে আছি তোমার দিকে। তোমাকে পূজা করতে ইচ্ছা করছে। হে আদি মানবমাতা, মানবী হয়েও তুমি দেবী।
চতুর সর্পরূপী শয়তান এই কথা বললে তার চাতুর্য ও ছলনা কিছু ধরতে না পেরে ঈভ বলল, সেই আশ্চর্য ফলের গুণ সম্বন্ধে তোমার অতি প্রশংসার কথা শুনে মনে সন্দেহ জাগছে আমার। বল, সে ফলের গাছ কোথায় আছে? এখান থেকে কত দূরে? কারণ এই স্বর্গদ্যানে ঈশ্বরের অনেক রকমের গাছ আছে এবং তাদের সংখ্যা এত বেশি যে অনেক গাছের ফল আমরা স্পর্শ করিনি এখনো পর্যন্ত। কারণ আমাদের পছন্দমত ফল হাতের কাছেই প্রচুর পেয়ে যাই। আরো অনেক মানুষ না আসা পর্যন্ত অনেক গাছের ফল ঝুলতে থাকবে, কেউ তাদের পাড়বে না।
তা শুনে সর্পরূপী শয়তান খুশি হয়ে বলল, হে রানী, পথ তো প্রস্তুত হয়েই রয়েছে এবং সে পথ দীর্ঘ নয়। কয়েকটা গাছের সারির পাশ দিয়ে গিয়ে একটা ঝর্ণার ধারে একটা সমতল জায়গা পাওয়া যাবে। সেখানে একটা ঝোঁপের ধারেই। আছে সেই গাছটা। তুমি চাইলে আমিই সেখানে তোমাকে নিয়ে যাব।
ঈভ বলল, তাহলে আমাকে সেখানে নিয়ে চল।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এক অদম্য আনন্দে বুকটা স্ফীত হয়ে উঠল শয়তানের। রাত্রির পুঞ্জীভূত একধরনের বাষ্প থেকে হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলেয়ার আলো যেমন নৈশপথিককে ভুল পথে চালিত করে তেমনি সেই আপাত-উজ্জ্বল চকচকে সর্পরূপ শয়তান আমাদের সরলতম আদিমাতাকে প্রতারিত করে সেই নিষিদ্ধ গাছটির কাছে নিয়ে গেল। সেই গাছই হলো মানবজাতির সকল দুঃখের মূল।
সে গাছ দেখে ঈভ বলল, হে সর্পরাজ, এখানে না এলেই ভাল হত। এ গাছে অনেক ফল থাকলেও আমার কাছে তা নিষ্ফল। এ গাছের ফলের গুণ তোমার কাছেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাক। তাতে আমার কোন প্রয়োজন নেই কারণ এ গাছের ফল আমরা স্পর্শ বা ভক্ষণ করতে পারব না। ঈশ্বরের আদেশ। আর সব বিষয়েই আমরা স্বাধীন হলেও এই একটা বিষয়ে তাঁর এই নিষেধাজ্ঞাকে মেনে চলতে হয় আমাদের। অন্য সব বিষয়ে আমাদের আইনের বিধান আমরাই রচনা করি। আমাদের যুক্তিই আমাদের আইন।
তখন সর্প বলল, তাই নাকি? এই বাগানের সব গাছের ফল খেতে ঈশ্বর তোমাদের তাহলে নিষেধ করেছেন?
নিষ্পাপ ঈভ তখন বলল, এই বাগানের মধ্যে এই একটিমাত্র গাছের ফল ছাড়া আর সব গাছের ফল আমরা খেতে পারি। ঈশ্বর শুধু বলেছেন এ গাছের ফল তোমরা খাবে না বা স্পর্শ করবে না। তাহলে তোমাদের মৃত্যু ঘটবে।
এই কথা শেষ হতে না হতে সর্পরূপী শয়তান একই সঙ্গে মানবজাতির প্রতি ভালবাসা এবং ঈশ্বরের অন্যায়ের প্রতি এক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের ভাব দেখাল। তারপর প্রাচীন এথেন্স বা রোমের কোন কুশলী বাগ্মীর মতো কোন ভূমিকা না করেই আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, হে পবিত্র প্রজ্ঞাসম্পন্না, জ্ঞানদাত্রী বৃক্ষলতা, সকল জ্ঞানবিজ্ঞানের জননী, এখন আমি তোমার শক্তি আমার সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি। তোমার প্রসাদে শুধু জাগতিক সমস্ত বস্তু ও ঘটনার কারণ জানতে পারা যায় না, তোমার দ্বারা যাদের আমরা পরম জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ বলে মনে করি সেই স্বর্গবাসী দেবতাদের জীবনযাত্রাপ্রণালী ও কর্মপদ্ধতির বা রীতিনীতিরও অনেক কিছু জানতে পারি আমরা।
হে বিশ্বজগতের রানী! বিধাতার কঠোর বিধানজনিত মৃত্যুর ভয় তুমি করো না। ও বিধানে বিশ্বাস করো না। মৃত্যু তোমার হতে পারে না। কেন মরবে তুমি? ঐ ফল খেয়ে? বরং তুমি ঐ ফল ভক্ষণ করে প্রভাপূর্ণ এক নবজীবন লাভ করবে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ, আমি ঐ ফল স্পর্শ করে ও ভক্ষণ করে এখনো বেঁচে আছি। শুধু তাই নয়, বিধির বিধানে যে জীবন আমি লাভ করেছিলাম তার থেকে পূর্ণতর এক জীবন লাভ করেছি। আমি আমার বিধিনির্দিষ্ট সীমাকে লঙঘন করে ঊর্ধ্বে হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করে এ জীবন লাভ করেছি। যে জ্ঞান পশুর কাছে উন্মুক্ত তা কি মানুষের কাছে রুদ্ধ থাকতে পারে? মৃত্যুযন্ত্রণার ভয়ের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল যে জ্ঞান, অদম্য নির্ভীক প্রচেষ্টার দ্বারা সে জ্ঞান তুমি লাভ করবে, ঈশ্বর তোমার উপর ক্রুদ্ধ হবেন না, বরং তোমার গুণের প্রশংসা করবেন, বরং তিনি স্বীকার করবেন, মৃত্যু যে পদার্থই হোক, তার যন্ত্রণা যত দুঃসহই হোক, তার দ্বারা নিবারিত না হয়ে তুমি সেই পরম বস্তু লাভ করেছ যা তোমাকে দেবে বৃহত্তর সুখের সন্ধান, যা দেবে ভালমন্দের পরম জ্ঞান। শুধু ভালর জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, যা কিছু মন্দ বা অশুভ, যা জীবনে একটি অতি বাস্তব ও অপরিহার্য ঘটনা, তার জ্ঞান যদি আমরা লাভ করতে না পারি তাহলে কেমন করে তাকে পরিহার করি বলতো?
সুতরাং ঈশ্বর তোমার কোন ক্ষতি করতে পারেন না, বরং তিনি ন্যায়সম্মত আচরণ করবেন। ঈশ্বর যদি ন্যায়পরায়ণ না হন তাহলে তিনি ঈশ্বরই নন। তাহলে কেন কে ভয় করবে? কেন তাঁকে মান্য করে চলবে? তোমার এই অর্থহীন মৃত্যুভয়ই অন্য সকল ভয় দূরীভূত করে দিচ্ছে।
একবার ভেবে দেখতো, এই ফল কেন নিষিদ্ধ হয়? কেন ভীতি প্রদর্শন করা য়? তুমি তার ভক্ত ও উপাসিকা হলেও নে তোমাকে নীচু ও অজ্ঞ করে রাখা হবে? তিনি জানেন যেদিন তুমি ঐ ফল ভক্ষণ করবে সেদিন তোমার ঐ ম্লান চক্ষুদুটি পরিষ্কার ও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং তুমি তখন দেবতাদের মতোই ভাল-মন্দ সব কিছুই জানতে পারবে। আমি যেমন পশু হলেও অন্তরের দিক থেকে মানুষের গুণ লাভ করেছি, মানুষের মতো কথা বলতে পারছি তেমনি মানুষ হয়েও তুমি দেবতাদের গুণ লাভ করবে। তাদের সব জ্ঞানের অধিকারিণী হবে। আর তাতে যদি তোমার মৃত্যুও ঘু অহলে সে মৃত্যুর অর্থ হবে তোমার এই মানবজীবন ও মানবদেহ ত্যাগ করে দৈবজীবন লাভ করা। সে মৃত্যু মোটেই খারাপ হবে না। দেবতাদের এমন কি গুণ আছে যা মানুষ লাভ করতে পারবে না? মানুষ তো দেবতাদেরই দেহের অনুরূপ। দেবতাদের খাদ্য তারাও কেন গ্রহণ করতে পারবে না?
তাছাড়া আমরাই দেবতাদের বড় করে দেখি। আমাদের বিশ্বাস তারা আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ। তারাই সব কিছু সৃষ্টি করে, দান করে। এই শ্রেষ্ঠত্বের সুযোগ নেয় তারা।
কিন্তু আমি এসব বিশ্বাস করি না। এই সুন্দর পৃথিবীতে সূর্যালোক পতিত হয়ে সব বস্তু সৃষ্টি করে, স্বর্গলোকে তা করে না। ঈশ্বর বা দেবতারাই যদি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, তাহলে ভালমন্দের জ্ঞানসমন্বিত এই জ্ঞানবৃক্ষ কে সৃষ্টি করল? যে বৃক্ষের ফল খেয়ে দেবতাদের অনুমতি ছাড়াই সব জ্ঞান লাভ হবে সে বৃক্ষ সৃষ্ট হলো কেন এবং কার দ্বারা? মানুষ যদি জ্ঞান লাভ করে, ভালমন্দের কারণ জানতে পারে, তবে তাতে অপরাধ কোথায়? তাতে ঈশ্বর বা দেবতাদেরই বা কি ক্ষতি হবে? আর সকল বস্তুই যদি ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট হয়, তাঁর বিধান মেনে চলতে বাধ্য হয় তাহলে এই বৃক্ষ কি শুধু অর সে বিধানের বাইরে? এ বৃক্ষ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেনই বা নিষিদ্ধ ফল দান করে? এখানে কোন বাধা নেই। আমি তো ইচ্ছামতো সে ফল তুলে খেয়েছি। এই বৃক্ষ তো আমায় বাধা দেয়নি। কোন অসম্মতি প্রকাশ করেনি। তবে কি শুধু মানবজাতির প্রতি ঈর্ষাবশতই ঈশ্বর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন? কিন্তু ঈর্ষা ঈশ্বরের মনে থাকবে কেন? যিনি সমস্ত গুণের আকর তিনি ঈর্ষার মত একটি কুটিল দোষকে লে পোষণ করে রাখবেন আঁর বুকে?
সুতরাং গেমার এই সুন্দর ফলভক্ষণের যে প্রয়োজন আছে সে প্রয়োজন সিদ্ধ করার পিছনে অনেক কারণ অনেক যুক্তি আছে। অতএব হে মানবরূপিণী দেবী, তুমি অবিলম্বে ঐ ফল অবাধে ভক্ষণ করে।
এই বলে থামল সেই সরূপী শয়তান। তার ছলনার কথাগুলি সহজেই প্রবেশ করুল ঈরে অন্তরে।
জ্ঞানবৃক্ষের ফলগুলির পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ঈভ। সেই সুন্দর ও সুগন্ধি ফলগুলি দেখামাত্রই লোভ আসছিল তার মনে, তার উপর শয়তানের প্ররোচনামূলক ও যুক্তিপূর্ণ কথাগুলি তখনো কানে বাজছিল তার। সে কথাগুলিকে সত্য বলে মনে হচ্ছিল তার।
এদিকে তখন বেলা দুপুর হয়ে ওঠায় ক্ষুধা জেগে উঠল তার মধ্যে। ফলগুলির মিষ্ট গন্ধ তার সে ক্ষুধাকে আরও বাড়িয়ে দিল। সে ফল খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে ইচ্ছা হলো তার। কামনাতুর হয়ে উঠল তার দৃষ্টি। তবু সেই বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে একবার ভাবতে লাগল ঈভ।
ঈভ তখন মনে মনে বলল, হে সর্বোত্তম ফরাজি, নিঃসন্দেহে তোমাদের গুণ কত মহান। তুমি মানুষের কাছে নিষিদ্ধ, তবু প্রশংসার যোগ্য। তোমার ঐন্দ্রজালিক আস্বাদ মূককে দিয়েছে বাকশক্তি, বাকশক্তিহীন পশুর জড় জিহ্বা মুখর হয়ে উঠেছে তোমার গুণগানে।
যে ঈশ্বর তোমাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন আমাদের কাছে, তিনিও তোমার গুণের কথা গোপন রাখেননি আমাদের কাছে। তাই তিনি তোমার নামকরণ করেছেন জ্ঞানবৃক্ষ। তোমার মধ্যে ভালমন্দের দুই জ্ঞানই আছে। তিনি তোমার সম্বন্ধে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন সেই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তোমার আলোকসামান্য গুণের কথাই প্রমাণিত হয়। তোমার আস্বাদনকারী জীবকে যে মঙ্গল দান করো সে মঙ্গলে আমাদের প্রয়োজন। আছে। কারণ শুধু মঙ্গলই যথেষ্ট নয়, মঙ্গলের জ্ঞানই হলো সবচেয়ে বড় কথা। যে ভাল বা যে মঙ্গল সম্বন্ধে আমাদের কোন জ্ঞান নেই সে জ্ঞান বা মঙ্গল লাভ করা বা না করা দুই-ই সমান আমাদের কাছে।
মঙ্গল-অমঙ্গলের এই জ্ঞানকে ঈশ্বর নিষিদ্ধ করেছেন আমাদের জন্য। আমরা জ্ঞানী হতে পারব না। এই নিষেধাজ্ঞা লঙঘন করা এখন এমন কিছু কঠিন নয়। এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে যদি মৃত্যু আমাদের গ্রাস করে তাহলে আমরা জ্ঞান বা অন্তরে স্বাধীনতা নিয়ে কি করব?
ঈশ্বর বলেছেন, যেদিন আমরা এই ফল ভক্ষণ করব সেইদিনই আমাদের মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু এই সর্পের মৃত্যু হলো না তো। সে এই ফল ভক্ষণ করেও এখনো বেঁচে আছে। যুক্তির সঙ্গে কথা বলছে, তার জ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছে। তাহলে এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে যুক্তি কোথায়?
তাহলে এ বিষয়ে মৃত্যু কি শুধু আমাদের জন্য উদ্ভাবিত হয়েছিল? তবে কি এই সব জ্ঞানগর্ভ ফলগুলি থেকে মানবজাতিকে বঞ্চিত করে পশুদের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে?
আমরা একে পশু বলছি বটে, কিন্তু এর আচরণ তো পশুর মতো নয়। পশু হলেও এর মনে কোন ঈর্ষা নেই। ফলভক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে যে শুভ ফল লাভ করেছে জীবনে, মানুষকে বন্ধুভাবে সেই ফলের গুণের কথা আনন্দের সঙ্গে বলতে এসেছে। তাহলে আমার ভয়ের কি আছে? ভাল-মন্দের জ্ঞানবিবর্জিত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে থাকাটাই তো সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। কিসের ভয়? ঈশ্বরের বিধানের ভয়? না কি অন্য কোন শক্তির ভয়?
এই স্বর্গীয় ফলের মধ্যেই আছে সকল ভয়, সকল উদ্বেগ হতে মুক্তি এবং শান্তি। এ ফল দেখতে যেমন সুন্দর, আস্বাদে যেমন মধুর, তেমনি গুণের দিক থেকে জ্ঞানদানের শক্তিসম্পন্ন।
সুতরাং এ ফল স্পর্শ করতে বাধা কোথায়? এ ফল ভক্ষণ করে কেন আমি দেহ ও মনকে পরিতৃপ্ত করব না?
এই কথা বলা শেষ হতেই সে সেই অভিশপ্ত মুহূর্তে হস্ত সঞ্চালন করে সেই জ্ঞানবৃক্ষ হতে ফল তুলে খেতে শুরু করল।
সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা বাজল পৃথিবীর বুকে। যেন এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হলো। বাতাস ও গাছপালার মধ্য দিয়ে দুঃখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পৃথিবী। পৃথিবী বুঝতে পারল আজ শেষ হয়ে গেল মানবজাতির ভবিষ্যৎ।
কুটিল সর্পরূপী শয়তান তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধ করে ঝোঁপের মধ্যে নিঃশব্দে প্রবেশ করল। এদিকে ঈভ সব কিছু ভুলে গিয়ে ফলের আস্বাদে মত্ত হয়ে শুধু ফল খেয়ে যেতে লাগল। এমন ফল জীবনে কোনদিন আস্বাদন করেনি সে।
আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠল সে। সে আনন্দের সঙ্গে ছিল জ্ঞানলাভের এক নিশ্চিত প্রত্যাশা। কোন ঈশ্বরচিন্তা ছিল না তার মনে। কোন মৃত্যুভয় ছিল না অন্তরে। সে শুধু অবাধে একান্ত অসংযতভাবে জ্ঞানবৃক্ষের নিষিদ্ধ ফলগুলি খেয়ে যেতে লাগল।
অবশেষে অতিমাত্রায় তৃপ্ত হয়ে আপন মনে সে বলতে লাগল, হে বৃক্ষদের রানী, এতদিন তোমার গুণ ও মূল্যের কথা জানা ছিল না। আজ বুঝলাম, গুণ ও মূল্যের দিক থেকে তুমি সকল বৃক্ষের শ্রেষ্ঠ। এতদিন তোমার শাখায় যে ফলগুলি ঝুলত তা আস্বাদন করতে পেতাম না আমরা। তাই কোন মূল্যই ছিল না তাদের আমাদের কাছে।
এবার থেকে প্রতিদিন তোমার ফল খেয়ে জ্ঞান বৃদ্ধি করব আমাদের। তোমার প্রশংসা ও গুণগান করব প্রতিদিন সকালে। তোমার শাখা-প্রশাখাগুলি সব সময় প্রচুর পরিমাণ ফলে পরিপূর্ণ হয়ে থাক। সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে তুমি।
যে বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে জ্ঞানের দিক থেকে পরিণতি লাভ করব আমরা সে বৃক্ষ দেবতারা আমাদের দান করেননি। এ বৃক্ষ তারা দান করতে পারেননি বলে ঈর্ষাবশত তার ফলকে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন আমাদের কাছে।
হে বৃক্ষ, তোমার দ্বারাই আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমার সকল জ্ঞানের জন্য তোমার কাছে ঋণী আমি। তুমিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক। তোমাকে এতদিন অনুসরণ করিনি বলেই আমি এতদিন অজ্ঞ ছিলাম। আজ জ্ঞানের পথকে উন্মুক্ত ও প্রসারিত করো আমার জীবনে। এই জ্ঞান গোপনতার গুহার মধ্যে নিহিত থাকলেও সেখানে আমাকে প্রবেশাধিকার দাও।
ঈশ্বর এই পৃথিবীর থেকে অনেক দূরে মনের ঊর্ধ্বে বিরাজ করেন। অসংখ্য চরদ্বারা পরিবৃত আমাদের মহান বিধাতাপুরুষ সদাজাগ্রত প্রহরীর মত এই মর্ত্যলোকের সব কিছু লক্ষ্য করলেও এখানকার অনেক ঘটনা হয়ত অজানিত রয়ে যায় তার কাছে।
কিন্তু আদমের কাছে আমি কিভাবে যাব? আমি কি তাকে আমার এই পরিবর্তনের কথা জানিয়ে আমার এই নবলব্ধ জ্ঞানসমৃদ্ধ সুখের সমান অংশ দান করব অথবা তাকে কিছুই না জানিয়ে এই জ্ঞানকে আমার শক্তির মধ্যে, আমার মধ্যে, আমার অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখব? তাকে আমার সহ অংশীদার করব না এ বিষয়ে? আমি তার সমান হয়েও নারী হিসাবে কি তার প্রেমাকর্ষণের জন্য আমার জ্ঞানগত স্বাধীনতা ও শ্রেষ্ঠত্বকে বজায় রেখে চলব? এটাই হয়ত ভাল হতে পারে।
কিন্তু যদি এই ঘটনা ঈশ্বর প্রত্যক্ষ করে থাকেন এবং যদি এর ফলে আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়? তাহলে আমি আর এ পৃথিবীতে থাকব না এবং আদম তখন আর একজন ঈভকে বিবাহ করে তাকে তার জীবন-সঙ্গিনী করে তুলবে। তখন আমার অবর্তমানে তাকে নিয়ে সুখে বাস করতে থাকবে সে। সুতরাং আমি নিশ্চিতরূপে দৃঢ়তার সঙ্গে স্থির করলাম আদমকেও আমি আমার এই পরম স্বর্গীয় সুখের সমান অংশ দান করব। আমি তাকে এত গভীরভাবে ভালবাসি যে আমি তার সঙ্গে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে পারব। কিন্তু তাকে ছেড়ে জীবনে বেঁচে থেকেও বাঁচার কোন আনন্দ পাব না।
এই বলে সেই বৃক্ষতল হতে তার স্বামীর সন্নিধানে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল ঈভ। কিন্তু যাবার আগে যে অলৌকিক বৃক্ষ দেবতাদের পানীয় অমৃত থেকে তার প্রাণরস আহরণ করে, তার অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি নত হয়ে শ্রদ্ধা জানাল।
এদিকে আদম সর্বক্ষণ ঈভের প্রত্যাগমন কামনায় উন্মুখ হয়ে অধীর আগ্রহের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছিল তার। তার একক শ্রমকে সম্মানিত করার জন্য উপহারস্বরূপ তার গলদেশকে শোভিত করবে বলে বাছাই করা বিচিত্র ফুল দিয়ে একখানি মালা গেঁথে রেখে দিয়েছিল সযত্নে। চাষীরা প্রায়ই ফসলের রানী বা দেবীর উদ্দেশ্যে এমনি করে মালা গেথে রাখে।
ঈভের দীর্ঘ বিলম্বিত প্রত্যাবর্তনে কতখানি আনন্দ ও সান্ত্বনা লাভ করবে আদম শুধু একা একা সেই কথাই ভাবছিল। তবে সেই সঙ্গে এক অজানিত আশঙ্কা মনটাকে পীড়িত করছিল তার।
এইসব ভাবতে ভাবতে আজ সকালে তার কাছে বিদায় নিয়ে যে পথে গিয়েছিল ঈভ সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল আদম। যেতে যেতে জ্ঞানবৃক্ষের কাছে আসতেই ঈভের দেখা পেয়ে গেল। তখন সবেমাত্র সেই জ্ঞানবৃক্ষের তলা থেকে ফিরছিল ঈভ। তার হাতে ছিল কতকগুলি উজ্জ্বল ফলে ভরা একটি সদ্যভগ্ন শাখা। অমৃতের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে।
ঈভ বলল, আমার দেরি হওয়াতে তুমি হয়ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলে। তোমার সাহচর্য হতে বঞ্চিত হওয়ায় তোমার অভাবটাকে দীর্ঘ মনে হচ্ছিল আমার। বিরহের বেদনা আজকের মত আর কখনো অনুভব করিনি। তবে এই শেষ। এ ভুল আর কখনো করব না আমি। বিচ্ছেদের বেদনা আর কখনো অনুভব করতে হবে না কাউকে। আর আমি হটকারিতার সঙ্গে আমার শক্তি পরীক্ষার জন্য আর কোথাও যাব না তোমাকে ছেড়ে।
তবে আমার বিলম্বের কারণটা বড় অদ্ভুত। আশ্চর্য হয়ে যাবে তা শুনে। আমাদের যা বলা হয়েছিল তা কিন্তু সত্য নয়। এই বৃক্ষের ফল আস্বাদন মোটেই বিপজ্জনক নয়। এ ফল ভক্ষণ করলে অজানিত কোন অশুভ শক্তি মুখব্যাদান করে গ্রাস করতে আসে না। বরং যারা এ ফল আস্বাদন করে তাদের দেবতাদের মত জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়ে যায়। একটি সর্প এই ফল ভক্ষণ করে মরেনি বরং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মত জ্ঞান ও কণ্ঠস্বর লাভ করেছে। অথচ আমাদের মৃত্যুভয় দ্বারা শাসানো হয়েছিল।
সর্পটি মানুষের মত যুক্তি খাড়া করে এমনভাবে ফলের গুণ সম্বন্ধে বোঝাতে লাগল যে আমিও এই ফল ভক্ষণ করে দেখলাম তার কথাই ঠিক। আমার জ্ঞানচক্ষু সত্যিই খুলে গেল। মনের তেজ বেড়ে গেল। আমার অন্তর প্রসারিত হলো। আমি দেবতাদের মত হয়ে উঠলাম। তখন তোমার কথা মনে পড়েছিল, কারণ যে সুখে তোমার অংশ নেই, সে সুখ তুচ্ছ আমার কাছে।
সুতরাং তুমিও এ ফল আস্বাদন করো। দুজনের ভাগ্য, আনন্দ, প্রেম এক হোক। আমাদের দুজনের মধ্যে যেন কোন পার্থক্য বা তারতম্য না থাকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে দুজনেই আমরা সমান দুঃখ ভোগ করব।
ঈভ তার গণ্ডদ্বয়কে আনন্দে উজ্জ্বল করে এই কথা বলল। কিন্তু অচিরেই সে গণ্ডদ্বয় ম্লান হয়ে গেল।
এদিকে আদম ঈভের এই মারাত্মক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের কথা শুনে বিস্ময়ে ও বেদনায় অভিভূত হয়ে পড়ল। প্রাণহীন প্রস্তরস্তম্ভের মত শূন্যদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল সে। এক হিমশীতল ভয়ের স্রোত শিরায় শিরায় বয়ে যেতে লাগল তার। ঈভকে পরাবার জন্য যে মালাটি হাতে ছিল তার, সে মালাখানি মাটিতে পড়ে গেল তার হাত থেকে।
অবশেষে সে সেই অস্বস্তিকর নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, হে সকল সৌন্দর্যের রানী, সব বিশ্বের সকল বস্তুর সারভৃতা সত্তা! আজ মুহূর্তের মধ্যে কিভাবে সকল মহিমা হারিয়ে ফেললে তুমি! আজ তুমি সকল সৌন্দর্য ও সকল সম্মান হতে বিচ্যুত হয়ে নিজের মৃত্যুকে নিজেই ডেকে আনলে। আজ তোমার সত্তার সকল মহিমা অপগত! কেমন করে লোভের বশবর্তী হয়ে ভুলে তুমি নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করলে? কেমন করে কোন্ সাহসে ঈশ্বরের নিষেধাজ্ঞা লঙঘন করলে? নিশ্চয় কোন অজাতশত্রু অলক্ষ্যে থেকে প্রভাবিত করেছে তোমাকে। নিজের সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার সর্বনাশ নিয়ে এলে। কারণ তোমার সঙ্গে আমিও মৃত্যুবরণ করার জন্য দৃঢ়সংকল্প।
তোমাকে ছাড়া কি করে আমি বাঁচব? তোমার মধুর কথাবার্তা, তোমার গভীর ভালবাসা, তোমার অবিরাম সাহচর্য সব হারিয়ে কেমন করে একা থাকব আমি এই বিশাল অরণ্যপ্রদেশে?
ঈশ্বর কি আর এক ঈভ সৃষ্টি করবেন আমার আর একটি পাঁজর থেকে? লু আমার অন্তর থেকে তোমার অন্তরের ক্ষত মুছে যাবেনা কখনো। হে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার অস্থিমজ্জার আর এক প্রতিমূর্তি, একই প্রকৃতির দ্বারা অবিচ্ছেদ্যভাবে আবদ্ধ আমরা। সুখ-দুঃখ যাই হোক, আর কখনই আমরা বিচ্ছিন্ন দ্য না পরস্পরের কাছ থেকে।
এই কথা বলে কিছুটা সান্ত্বনা পেল আদম। এরপর ঈভের দিকে ঘুরে আবার শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগল, হে দুঃসাহসী ঈত, তুমি ঐ নয়নমনোস্ত্র পবিত্র ফল আস্বাদন করে এক বিপজ্জনক কাজ করেছ। যে ফল স্পর্শ করা নিষিদ্ধ তা তুমি ভক্ষণ করেছ। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা আর ফিরবে না। হয়ত ঈশ্বর বা নিয়তি সর্বশক্তিমান নয়। হয়ত তুমি মরবে না। কাজটা হয়ত যতটা ভয়ঙ্কর ভেবেছিলে ততটা ভয়ঙ্কর নয়। সর্প তোমার আগেই সে ফল ভক্ষণ করায় সে ফল তার অলৌকিকত্ব হারিয়ে সাধারণের ভক্ষ্য হয়ে উঠেছে। তুমি বলছ সে এখনো জীবিত আছে এবং পশু হয়ে বাকশক্তি লাভ করেছে মানুষের মত। তাহলে এ ফল ভক্ষণ করে আমরাও সেই অনুপাতে উন্নততর জীবন লাভ করতে পারি। দেবতা অথবা দেবতার সমান দৈবীশক্তি লাভ করতে পারি। পরম স্রষ্টা ঈশ্বরের মত সর্বজ্ঞ আমাদের যতই ভীতি প্রদর্শন করুন ধ্বংস করবেন বলে, তিনি নিশ্চয়ই তাঁরই সৃষ্ট জীব আমাদের ধ্বংস করবেন না। শেষ পর্যন্ত। আমরা হচ্ছি তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, উদার মর্যাদাসম্পন্ন। আমাদের যদি পতন হয় তাহলে যে কাজের জন্য ঈশ্বর আমাদের নিযুক্ত করেছেন, সে কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। তাহলে ঈশ্বরকে নিজের হাতে তাঁর সৃষ্টিকে ধ্বংস করে তার সমস্ত শ্রমকে ব্যর্থ করে দিতে হবে নিজের হাতে। ঈশ্বর সম্বন্ধে এমন ধারণা আমরা পোষণ করতে পারি না। আবার নূন করে কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা ঈশ্বরের আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের উচ্ছেদসাধন করতে নিশ্চয়ইরমন চাইবেনা। তাহলে তার প্রতিপক্ষের জয় হবে এবং সে বলবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ কত চঞ্চল, কত অস্থায়ী। তিনি প্রথমে আমাকে ধ্বংস করে পরে মানবজাতিকে ধ্বংস করবেন। এরপর কাকে ধ্বংস করবেন? এইভাবে তাঁকে ঘৃণা করার সুযোগ তিনি ভঁর শত্রুকে দেবেন না নিশ্চয়। আমি তোমার সঙ্গে আমার ভাগ্যকে নির্ধারিত করে ফেলেছি। মৃত্যু বা ধ্বংসের অভিশাপ যদি নেমে আসে তাহলে দুজনে একসঙ্গে তা ভোগ করব। তোমার যদি মৃত্যু হয় তাহলে সে মৃত্যু জীবনে খুবই বরণীয় হয়ে উঠবে আমার কাছে। প্রকৃতির এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে এমনভাবে আবদ্ধ আছি আমরা যে আমাদের মধ্যে কেউ সে বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। আমরা হৃদয়ে এক, একই রক্তমাংসে গঠিত। তোমাকে হারানো মানেই আমার নিজেকে হারানো।
আদম এই কথা বললে ঈভ তাকে বলল, তোমার প্রেমাতিশয্যের কী অপূর্ব পরীক্ষা, কী উজ্জ্বল ও উচ্চমানের দৃষ্টান্ত! কিন্তু তোমার পূর্ণতার অংশ কেমন করে আমি লাভ করব আদম যাতে আমি তোমার পার্শ্বদেশ থেকে উদ্ভূত হয়েছি একথা আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি? তুমিই এমনি আমাদের অচ্ছে মিলনের কথা বললে। তোমার সংকল্পের কথা ঘোষণা করে আমাদের মিলন কত নিবিড় তার প্রমাণ দিলে। মৃত্যু বা মৃত্যুর থেকে ভয়ঙ্কর কোন শক্তিই আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। তুমি আমার প্রতি এক গভীর ভালবাসার বন্ধনে এমনভাবে বিজড়িত হয়ে আছ যে, এই ফল ভক্ষণের জন্য যদি কোন অপরাধ বা পাপ হয়ে থাকে আমার তাহলে সে অপরাধ ও সে পাপের শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি আছ তুমি। আজ এই ফলের আস্বাদ এক মহা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রেমের গুণ ও শক্তিকে অভ্রান্তভাবে প্রমাণ করে দিল যার কথা এর আগে কখনো জানতে বা বুঝতে পারিনি আমরা।
যদি তুমি তোমার প্রেমের এই সততা ও বিশ্বস্ততার কথা আজ এমন ভাবে ঘোষণা না করতে তাহলে আমার এই ফলভক্ষণের ফলে মৃত্যু এসে ভয়াবহরূপে উপস্থিত হলে আমি পরিত্যক্ত অবস্থায় একাকী সে মৃত্যুকে বরণ করে নিতাম। তোমার জীবনের শান্তিকে বিঘ্নিত করে তোমাকে আমার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করতে কোনভাবে প্ররোচিত করতাম না।
কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে আসল ঘটনা তা নয়। আমি ভাবছি অন্য কথা। কোন মৃত্যু নয়, এক পূর্ণ ও পরিণত জীবনের রূপ লাভ করতে চলেছি আমরা। এই ফলের স্বর্গীয় আস্বাদ আমার জ্ঞানচক্ষুকে উন্মীলিত করে দিয়েছে, এক নূতন আশা ও আনন্দের দিগন্তকে উন্মোচিত করে দিয়েছে আমাদের সামনে। সুতরাং আমার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে হে আদম, তুমিও এ ফল অবাধে ‘আস্বাদন করো। সমস্ত মৃত্যুভয় বাতাসে উড়িয়ে দাও।
এই কথা বলে আদমকে আলিঙ্গন করল ঈভ। আনন্দাশ্রু ঝরে পড়তে লাগল তার চোখ থেকে। আজ আদম তার প্রেমকে এক মহত্তর সুমন্নতি দান করেছে, সে তার সেই প্রেমের খাতিরে সমস্ত ঐশ্বরিক রোষ ও মৃত্যুকে বরণ করে নিতে চেয়েছে, এ কথা ভেবে আনন্দের সঙ্গে এক বিরল গর্ব অনুভব করল সে।
ঈভ জ্ঞানবৃক্ষের শাখাসহ যে ফল এনেছিল সে ফল সে উদার হাতে আদমকে দান করল। ঈভের থেকে সে অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী হলেও কোন কুণ্ঠা না করেই সে ফল খেয়ে নিল, ঈভের নারীসুলভ সৌন্দর্য ও সুষমায় সহজেই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ল সে।
পৃথিবীর নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত প্রবলভাবে কম্পিত হয়ে উঠল। সমগ্র প্রকৃতি যন্ত্রণায় দ্বিতীয়বার আর্তনাদ করে উঠল। মানবজাতির পাপ পূর্ণ হওয়ায় আকাশ বজ্রবৃষ্টিসহ অশ্রুবিসর্জন করতে লাগল।
আদম কিন্তু এ সব কিছুই জানল না। সে শুধু পেট ভরে তৃপ্তির সঙ্গে ফল খেয়ে যেতে লাগল। ঈভও আর তার নিষেধাজ্ঞা-লঙ্ঘনের কোন ভয় করল না। সে শুধু তার প্রেমময় সাহচর্যের দ্বারা সান্ত্বনা দিয়ে যেতে লাগল তার স্বামীকে। এক নৃতন মদ্যপানের ফলে মত্ত হয়ে এক উচ্ছল আনন্দের স্রোতে সাঁতার কাটতে লাগল যেন তারা। তাদের মনে হলো, যেন তারা এক দৈবশক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছে সেই নিষিদ্ধ ফল খেয়ে। এই পৃথিবীকে উপেক্ষা করে পাখা মেলে তারা যেন উড়ে যেতে পারবে আকাশে।
কিন্তু সেই নিষিদ্ধ ছলনাময় ফল ভক্ষণের প্রতিক্রিয়া শুরু হলো এবার। প্রথমে তাদের মোহগত জ্বলন্ত কামনাকে বাড়িয়ে দিল। আদম ঈভের পানে সকাম দৃষ্টিতে তাকাল। ঈভও সে দৃষ্টির প্রতিদান দিল। কামনার আগুনে জ্বলতে লাগল তারা।
আদম এবার ঈভকে বলল, ঈভ, তুমি যা বলেছ তা সব ঠিক। আজ তুমি যে আমাকে আস্বাদ দিলে তার জন্য তোমার প্রশংসা না করে পারছি না। এতদিন এই উপাদেয় ফল আস্বাদন না করে জীবনের কত আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমরা। আজ প্রথম আস্বাদন করে এর গুণ জানতে পারলাম। এই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে যদি এত আনন্দ পাওয়া যায় তাহলে সব ফলই নিষিদ্ধ হোক।
এখন তৃপ্তির সঙ্গে আহার করার পর দুজনে নর্মক্রীড়া করিগে চল। তোমাকে প্রথম দেখা ও বিবাহ করার পর থেকে তোমার রূপ-লাবণ্য এতখানি নিখুঁত ও পরিপূর্ণ বলে মনে হয়নি আমার। এই ফলের গুণেই যেন অনেক গুণ বেড়ে গেছে তোমার দেহসৌন্দর্য। সে সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য আজ এক অদম্য কামনার জ্বালা অনুভব করছি আমার মনে।
এই কথা বলে আর কোন ভণিতা না করে ঈভের হাত ধরে এক ছায়াচ্ছন্ন নিঝরিণীর তটভূমিতে নিয়ে গেল আদম। সে বেশ বুঝতে পারল যে কামনার আগুনে তার মনপ্রাণ জ্বলছে সে আগুন ঈভের মধ্যেও জ্বলছে, সে আগুনের আত্মা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার চোখে-মুখে।
সেই তৃণাচ্ছাদিত তটভূমির উপর, ভায়োলেট, এ্যাসফোডেল, হায়াসিনত্ প্রভৃতি ফুলের আস্তরণ পাতা ছিল কোমল শয্যার মত, তাদের মাথার উপরে ছিল ঘনসন্নিবদ্ধ বৃক্ষপত্রের সবুজ চন্দ্রাতপ। সেইখানে দুজনে শুয়ে প্রাণভরে সুরতক্রিয়ায় মত্ত হয়ে উঠল তারা। তাদের সকাম প্রণয়লীলার উচ্ছ্বসিত প্রবলতার দ্বারা তাদের পাপবোধকে মুছে দিতে চাইল, যেন ক্রমে এক নিবিড় রতিক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল তারা।
সেই ভ্রান্ত ফল তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এক নির্দয় বাষ্প উদগীরণের দ্বারা তাদের মত্ত করে তুলে তাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে বার করে আনে। তাই তারা দারুণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
ঘুম থেকে উঠে পরস্পরের পানে তাকাল তারা। তাদের জ্ঞানচক্ষু যে উন্মীলিত হয়েছে তা তারা এবার বুঝতে পারল। এক কুটিল কালিমায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তাদের মন। যে নিষ্পাপ সরলতা তাদের মনকে আবৃত করে রাখায় কোন কিছুতে অশুভ বা মন্দ কিছু দেখতে পেত না তারা, সে সরলতা অপগত হলো। ফলে এক সহজাত আত্মবিশ্বাস, ন্যায়নীতি ও মর্যাদাবোধ জেগে উঠল তাদের মধ্যে। তাদের দেহের নগ্নতায় লজ্জাবোধ করল তারা।
সঙ্গে সঙ্গে গাছের পাতা নিয়ে তার গোপনাকে আবৃত করল আদম। কিন্তু তাতে আরো প্রকট হয়ে উঠল তার নগ্নতা। এমন সময় চৈতন্য হলো আদমের। একদিন স্যামসন যেমন তার সব শক্তি হারিয়ে ব্যভিচারিণী নাস্তিক ডেলাইলার অঙ্কদেশ হতে উঠে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি গুণবর্জিত হয়ে উঠল আদম।
হতবুদ্ধি হয়ে ম্লান মুখে বসল তারা। বজ্রাহতের মত স্তম্ভিত বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইল। অবশেষে আদম ঈভের মত লজ্জায় অপ্রতিভ হয়ে বলল, হে ঈত, এক অভিশপ্ত মুহূর্তে তুমি সেই কপট কুটিল প্রাণীর ছলনায় মুগ্ধ হয়ে তার কথায় কান দিয়েছিলে। মানুষের নকল কণ্ঠস্বরে ভুল শিক্ষা দিয়েছিল সে তোমাকে। সত্য হয়ে উঠল আমাদের পতন, মিথ্যা হয়ে উঠল আমাদের উন্নতির আশ্বাস। আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়-অন্যায় বোধ জাগল আমাদের মধ্যে কিন্তু ন্যায়কে বর্জন করে শুধু অন্যায় ও অশুভকে গ্রহণ করলাম আমরা। এই যদি জ্ঞানের অর্থ হয় তাহলে এই জ্ঞানের ফল কত বিষময়। সরলতা, সততা, নির্দোষিতা, ধর্মবিশ্বাস, শুচিতা প্রভৃতি যে সব গুণগুলি আমাদের মনের অলঙ্কারস্বরূপ ছিল সেইসব গুণগুলিকে এই জ্ঞান কলুষিত, এ মন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় আমরা একেবারে নগ্ন হয়ে পড়েছি গুণের দিক থেকে। এক অশুভ লজ্জার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের। চোখে-মুখে। এই মুখ নিয়ে আমি কি করে ঈশ্বর অথবা দেবদূতের মুখ দেখব? যে বিশুদ্ধ অনাবিল আনন্দের আবেগ ছিল আমার মনে তা আজ কোথায়? সেইসব দেবদুতেরা এবার থেকে তাদের অত্যুজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা আমার এই পার্থিব চোখের সব দৃষ্টিকে অভিভূত করে দেবে। আমি তাদের সেই জ্যোতিকে সহ্য করতে পারব না।
হায়, আমি যদি এই নির্জন বনের গভীরতর কোন দুর্গম প্রদেশ যেখানে সূর্য বা কোন নক্ষত্রের আলো প্রবেশ করতে পারে না সেখানে বন্য পশুর মত জীবন যাপন করতে পারতাম তাহলে হয়ত ভাল হত। হে বনস্পতিবৃন্দ, হে দেবদারু ও পাইন বৃক্ষ, তোমরা তোমাদের পত্রবহুল শাখা-প্রশাখাদ্বারা আমাকে এমনভাবে ঢেকে রাখ যাতে আমি আর কখনো দেবদূতদের মুখ দেখতে না পাই।
এরপর আদম ঈভকে বলল, এখন আমাদের এই দুরবস্থার মধ্যে একটা উপায় খুঁজে বার করো যাতে আমাদের দেহের যে সব অংশগুলি পরস্পরের চোখে সবচেয়ে লজ্জাজনক বলে মনে হচ্ছে সেগুলি ঢেকে রাখতে পারি। কোন গাছের চওড়া পাতাগুলিকে সেলাই করে কৌপীণের মত পরে আমরা কটিদেশদুটিকে ঢাকতে পারি যাতে নবাগত লজ্জা আর সেখানে গিয়ে বসতে না পারে।
এই পরামর্শ দিল আদম। তারপর তারা দুজনে বনের গভীরে চলে গেল। সেখানে গিয়ে তারা একটি বিরাট বটবৃক্ষ বেছে নিল। সুপ্রাচীন বিশাল সেই বটবৃক্ষের দীর্ঘপ্রসারিত শাখাপ্রশাখাগুলি মাটিতে নুইয়ে পড়ে শিকড় গেড়ে বসে গিয়েছিল এবং তাদের থেকে আবার নূতন করে বটবৃক্ষ উগত হয়েছিল। এইসব বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় মালাবার ও ভারতের গোচারণরত রাখালরা খরতপ্ত দ্বিপ্রহরে আশ্রয় নেয়।
সেই বটবৃক্ষের কতকগুলি চওড়া পাতা পেড়ে সেগুলিকে তারা সেলাই করে তাদের কটিদেশ আবৃত করল। এইভাবে তারা তাদের নগ্নতা ও লজ্জা নিবারণের এক ব্যর্থ প্রয়াস পেল। তাদের যে নগ্নতা আগে ছিল গৌরবময়, এখন সে নগ্নতা লজ্জাজনক হয়ে উঠল তাদের কাছে।
কলম্বাস দক্ষিণ আমেরিকা আবিষ্কারকালে উপকূলগুলির বানঞ্চলে যে সব বন্য আদিবাসীদের যেভাবে পালক ও পাতা দিয়ে তাদের কটিদেশকে আচ্ছাদিত করতে দেখেছিলেন, আদম ও ঈভ সেইভাবে তাদের কটিদেশ আচ্ছাদিত করল। কিন্তু এতে তাদের লজ্জা আংশিক নিবারিত হলেও মনে শান্তি পেল না তারা।
তারা দুজনে বসে কাঁদতে লাগল। কিন্তু শুধু কান্না নয়, শুধু দরবিগলিত অবিচল অশ্রুধারা তাদের চোখ থেকে বয়ে যেতে লাগল না, আবেগের ঝড় বয়ে যেতে লাগল তাদের অন্তরে। একদিন তাদের যে শান্ত মনের ভূমিতে অখণ্ড প্রশান্তি বিরাজ করত সতত, আজ ক্রোধ, ঘৃণা, অবিশ্বাস, সংশয় ও অনৈক্য প্রভৃতি বিচিত্র কুটিল আবেগ ঝড়ের বেগে তাদের সে মনোভূমিকে আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত করে সকল শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।
তাদের দুজনের মধ্যে যে পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার ভাব ছিল তা বিনষ্ট হয়ে গেল। ন্যায়নীতি ও ধর্মের অনুশাসন মানতে চাইল না। দুজনেই ইন্দ্রিয়গত ক্ষুধার অধীন হয়ে পড়ল এবং সে ক্ষুধা যুক্তির অবিসংবাদিত প্রভুত্বকে অস্বীকার করে নিজের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করল।
আদমের অন্তরের বিক্ষোভ তার চোখের দৃষ্টি ও ভাবভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে লাগল। সে তখন ঈভকে বলল, সেদিনকার সেই অশুভ সকালে তুমি যদি আমার কথা শুনতে এবং আমি যা চেয়েছিলাম সেইমত আমার কাছে থাকতে তাহলে আমাদের এ অবস্থায় পড়তে হত না। কিন্তু জানি না কিসের মায়া ও মোহে আচ্ছন্ন হয়ে তুমি আমার কথা না শুনেই চলে গেলে। সেদিন আমরা কত সুখে ছিলাম। আর আজ সমস্ত সদগুণ হতে বিবর্জিত হয়ে এক লজ্জাজনক নগ্নতার শিকার হয়ে উঠেছি।
এখন থেকে কেউ যেন অকারণে তার ধর্মবিশ্বাসকে ভঙ্গ করে নিজের পতন নিজেই ডেকে না আনে।
দোষের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ঈভ বলল, তোমার মুখ থেকে কি কঠোর কথাই না নির্গত হলো আদম। তুমি বললে, আমি তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার জন্যই এইরকম হলো। আজ আমার দ্বারা যে বিপর্যয়ের উদ্ভব হলো তা তো তোমার দ্বারাও হতে পারত। আমার মতো তুমি যদি সেখানে একা থাকতে অথবা তুমি যেখানে ছিলে সেখানে যদি সর্প এসে তোমাকে একইভাবে প্ররোচিত বা প্রলোভিত করত তাহলে তুমি তার প্রতারণা বা ছলনাকে ধরতে পারতে না। সেই সর্পের সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা ছিল না। অকারণে সে আমার অমঙ্গলসাধন বা বঞ্চিত করবে তা কেমন করে বুঝব? তোমার কাছ ছেড়ে একা কোথাও যাবার কি কোন স্বাধীনতাই ছিল না আমার? তোমার পার্শ্বদেশের একটি পঞ্জর থেকে আমার জন্ম হওয়ার জন্য আমাকে কি চিরকাল একটি প্রাণহীন স্বাধীনতাহীন পঞ্জর হিসাবেই থাকতে হবে? তাই যদি হয়, আমার জন্য এখন বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তরে কেন তখন আমার যাওয়াকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে কঠোর আদেশ প্রদান করলে না? তোমার সে নিষেধের মধ্যে কঠোরতার অভাব এবং কুণ্ঠা ছিল কেন? তুমি তখন আমার কথায় নরম হয়ে আমাকে যেতে অনুমতি দিয়েছিলে। আমাকে সমর্থন করেছিলে। কিন্তু তখন যদি তুমি কঠোর এবং তোমার অসম্মতিতে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে তাহলে ঐশ্বরিক নিষেধাজ্ঞা আমি লঙ্ঘন করতাম না এবং আমার মনে হয় তুমিও তা করতে না।
আদম তখন রুষ্ট হয়ে বলল, হে অকৃতজ্ঞ ঈভ, এই কি আমার প্রেমের প্রতিদান? এই কি তোমার ভালবাসা? তোমার যখন পতন হয় তখন আমি আমার প্রেমকে অপরিবর্তনীয়রূপে ঘোষণা করেছিলাম। আমি তো তোমাকে ছেড়ে পরম সুখে আমার জীবন যাপন করতে পারতাম। কিন্তু তা না করে স্বেচ্ছায় তোমার সঙ্গে মৃত্যুকেই বরণ করে নিই। অথচ এখন আমাকেই তুমি তোমার ঐশ্বরিক বিধান লঙ্ঘনের কারণ বলে ভর্ৎসনা করছ?
অবশ্য তখন তোমাকে খুব কঠোরভাবে সংযত করিনি। কিন্তু আর কি আমি করতে পারতাম? আমি তোমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। মৃদু তিরস্কার করেছিলাম। বিশ্বাসের কথা বলেছিলাম। যে শত্রু সুযোগের অপেক্ষায় ওৎ পেতে বসে আছে তার কথাও বলেছিলাম। তোমার স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করতে বারবার নিষেধ করে দিয়েছিলাম।
কিন্তু অতিমাত্রিক আত্মবিশ্বাসে প্রবৃত্ত হয়ে কোন কথা না শুনে তুমি চলে গেলে। হয়ত ভেবেছিলে নিষিদ্ধ ফল খেলে কোন বিপদই হবে না অথবা তাতে কি হয় তা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলে।
অবশ্য আমিও তখন তোমার ভ্রান্ত পূর্ণতার লক্ষণ দেখে অতিমাত্রায় তোমার প্রশংসা করে ভুল করেছিলাম। ভেবেছিলাম এতে কোন বিপদ হবে না। এখন আমি আমার এই কাজের জন্য অনুশোচনা করছি। এটাই হলো আমার অপরাধ আর এই অপরাধে এখন তুমি অভিযুক্ত করছ আমাকে।
নারীদের উপর অতিরিক্ত আস্থা স্থাপন করে তাদের ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে পুরুষেরা ভবিষ্যতে এই অপরাধই বারবার করবে। কোন সংযম বা অনুশাসন নারী মানবে না। পরে নিজের ইচ্ছায় ক্ষয় হয়ে বিপদে পড়বে। পুরুষের দুর্বলতা বা প্রশ্রয়কে দায়ী করে অভিযুক্ত করবে তাকে।
এইভাবে পরম্পরকে অভিযুক্ত করে দুঃখের সঙ্গে কালযাপন করতে লাগল তারা। কেউ নিজের দোষ দেখল না, নিজেকে ধিক্কার দিল না। আত্মপ্রতিষ্ঠার চেষ্টাজনিত এই দ্বন্দ্বের কোন শেষ ছিল না।
অষ্টম সর্গ
যেখানে ঈশ্বর বা দেবদূত স্বর্গ থেকে নেমে এসে বন্ধুর মত মানুষের পাশে এসে কত কথাবার্তা বলেন, তার সরল সামান্য খাদ্য ভোজন করেন, সেখানে আমাদের মত মানুষের কোন কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। আমি শুধু এই ঘটনার মর্মান্তিক পরিণাম দেখাব। মানুষ কিভাবে বিধির বিধান লঙ্ঘন করে অবিশ্বাসী, আনুগত্যহীন ও ঈশ্বরদ্রোহী হয়ে ওঠে, আমি বলব তারই কথা।
মানুষের এই অবিশ্বস্ততা ও নিষিদ্ধ আচরণের জন্য তাকে ত্যাগ করে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান ঈশ্বর চিরতরে। ফলে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব বেড়ে যায়। উভয়পক্ষে ক্রমাগত চলতে থাকে ক্রোধ আর ভর্ৎসনার বাণবর্ষণ। অবশেষে ঈশ্বর বিচারের রায়দানের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে দুঃখ নেমে আসে চিরকালের জন্য। নেমে আসে পাপ আর মৃত্যুর করাল ছায়া। সত্যিই দুঃখের বিষয়। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়। ট্রয় যুদ্ধে শত্রুদের পশ্চাতে ধাবিত কঠোর একিলিসের মধ্যে যে রোষ দেখা গিয়েছিল, ঈনিসের প্রতি জুনো এবং ওডিসিয়াসের প্রতি সমুদ্রদেবতা পসেডন যে রোষ দেখান, ইতালির অধিপতি টার্নাস তার স্ত্রী ল্যাভিনিয়াকে হারিয়ে যে রোষে ফেটে পড়ে, সেই রোষ এইসব তর্কবিতর্কে প্রকাশিত হয়।
আমি এইসব কাব্যে প্রকাশ করার জন্য আমার স্বর্গীয় সাহায্যকারিণীর সাহায্য নিতে পারি। তিনি অযাচিতভাবে মাঝে মাঝে আমার নিদ্রার মধ্যেই আবির্ভূত হন। আমার স্বতোৎসারিত সকল কাব্যই তিনি আমাকে নিদ্রিত অবস্থাতে বলে দেন।
বহুদিন আগে হতেই এক বীরত্বপূর্ণ আখ্যানকাব্য রচনা করার প্রয়াস পেয়েছিলাম। কিন্তু শুধু বীরত্বের কথা মনঃপূত হয়নি আমার।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল মর্ত্যলোকে। ঘনীভূত হয়ে উঠছিল গোধূলির ছায়া, রাত্রির গোলার্ধে দিগন্তকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল।
এমন সময় যে শয়তানরাজ গ্যাব্রিয়েলের দ্বারা তাড়িত হয়ে ইডেন উদ্যানের সীমানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে আবার ফিরে এল। সে আবার তার পূর্বপরিকল্পিত প্রতারণা আর প্রতিহিংসাকে সজীব করে তুলল তার মনে। মানবজাতির ধ্বংসসাধনের উদ্দেশ্যে ও সংকল্পে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল সে। সে তারপর মধ্যরাত্রির অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে নির্ভীকভাবে ফিরে এল।
ইতিমধ্যে সে গোটা পৃথিবীটাকে পরিক্রমা করে এসেছে। ইউরিয়েল তাকে চিনতে পারার পর থেকে চেরাবজাতীয় দেবদূত প্রহরীদের সতর্ক করে দেয় সে। সে তাই সারাদিন ধরে দেবদূতদের প্রহরা এড়িয়ে অতি সন্তর্পণে ঘুরে বেড়িয়ে রাত্রির অন্ধকারে ফিরে আসে ইডেন উদ্যানে।
এর আগে পৃথিবী পরিক্রমাকালে সে শুধু পৃথিবীর নদী-সমুদ্র-পাহাড়-পর্বত সমম্বিত বিচিত্র ভূপ্রকৃতি দর্শন করেনি, সে তার বিচিত্র জীবজন্তুগুলিকেও বিভিন্ন জায়গায় ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে। সে দেখে কোন্ জীব তার উদ্দেশ্যসাধনের বেশি কাজে লাগবে। সব দেখার পর অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় সে যে, সাপই হলো সব জীবজন্তুর মধ্যে সবচেয়ে কুটিল। সে সর্পদেহ ধারণ করে তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধ করলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। অন্য জীবদেহ ধারণ করে এ কাজ সিদ্ধ করতে গেলে সন্দেহ জাগতে পারে অন্যের মনে। সে তাই মনে মনে ঠিক করল সর্পদেহের মধ্যে প্রবেশ করে তার কুটিল প্রতারণার গোপন বাসনাকে লোকচক্ষু হতে ঢেকে রেখে স্বচ্ছন্দে তা চরিতার্থ করতে পারবে সে।
সে তখন পৃথিবীকে সম্বোধন করে আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, হে পৃথিবী, তুমি স্বর্গলোকের শুভ অনুরূপ যদিও স্বৰ্গকেই সকলে পছন্দ করে বেশি। তথাপি তুমি দেবতাদের বসবাসযোগ্য, যদিও তোমাকে স্বর্গের পর দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হিসাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ঈশ্বর স্বর্গের সব স্থান সৃষ্টি করার পর কখনো তার থেকে খারাপ কিছু সৃষ্টি করতে পারেন না।
অনন্ত মহাশূন্যে যে সব ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্র, সূর্য ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলী নিয়ত নৃত্যশীল তাদের আলোক শুধু তোমার উপরেই পতিত হয়। তারা শুধু তোমাকেই আলোকিত করে। ঈশ্বর যেমন ত্রিভূবনের কেন্দ্রস্থলে বিরাজিত থেকে সর্বত্র তাঁর প্রভাব ও প্রভুত্ব বিস্তার করেন তেমনি তুমিও সমস্ত গ্রহের কেন্দ্রস্থলে থেকে সমস্ত সৌরজগতের শুভ প্রভাবগুলি আকর্ষণ করো। তাদের গুণগুলি তোমার গাছপালা ও ওষধিতে সঞ্চারিত হয় সফলভাবে। সেইসব গুণের প্রভাবেই তোমার মধ্যস্থিত প্রাণীগুলি জন্মলাভ করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ধীরে ধীরে। তাদের মধ্যে মানুষই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ প্রাণী, একমাত্র তারই মধ্যে জ্ঞানবুদ্ধি আছে।
হায়, আমি যদি হে পৃথিবী, তোমার অধিবাসী হতাম তাহলে তোমার মত সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়ে পাহাড়-উপত্যকা, নদী-সমুদ্র, সমতল ভূমি, অরণ্যরাজি দেখে কত আনন্দই না লাভ করতাম। কিন্তু তোমার মধ্যে এত সব কিছু থাকা সত্ত্বেও কোথাও আমার আশ্রয় নেই। কোথাও আমার বাসের স্থান নেই। আমার চারদিকে আমি এইসব আনন্দময় বস্তুগুলি যতই দেখি তই আমার অন্তজ্বালা বেড়ে যায়। আমার মধ্যে এমন কতকগুলি ঘৃণ্য বিপরীতমুখী ভাবধারা আছে যার জন্য সকল সুন্দর বস্তু অসুন্দর হয়ে যায় আমার কাছে। এমন কি স্বর্গলোকেও আরও শোচনীয় হয়ে উঠবে আমার অবস্থা। কিন্তু এই মর্ত্যলোকে অথবা স্বর্গলোকে আমি বাস করতে চাই না। আমি চাই শুধু স্বর্গের অধিপতিকে জয় করতে। তাঁর সব গৌরবকে খর্ব করে দিতে। কিন্তু আমার এই দুঃখময় অবস্থা তা শুধু একা ভোগ করতে চাই না, আমি অন্য সব সুখীদেরও আমার এই দুঃখের অংশভাগী করে তুলতে চাই। তাতে যদি আমার দুঃখ আরও বেড়ে যায় তো যাক।
ধ্বংসের মধ্যে সবচেয়ে শান্তিলাভ করে আমার বিক্ষুব্ধ চিন্তাগুলি। যাদের জন্য এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্ট হয়েছে তাদের ধ্বংস করা অথবা তাদের ক্ষতিসাধন করাই হলো আমার কাজ। তাহলে এর স্রষ্টাও দুঃখ পাবে। তাতেই আমি সমস্ত নরকবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে গৌরববোধ করব।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যে পৃথিবী ছয়দিন ছয়রাত ধরে সৃষ্টি করেছেন এবং তার আগেও কতদিন ধরে তার পরিকল্পনার চেষ্টা করেছেন তা আমি একদিন ধ্বংস করে দিতে চাই।
আমরা স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হবার পর আমাদের সংখ্যা পূরণের জন্য অথবা আমাদের প্রতি ঘৃণাবশত আমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করে তাদের উন্নতি সাধনের জন্য বিভিন্ন স্বর্গীয় গুণাবলীতে ভূষিত করেছেন। তাঁর ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছেন তিনি।
তিনি মানুষ সৃষ্টি করে সেই মানুষের জন্য এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে এই জগতের অধীশ্বররূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হায়, এইভাবে কী উপকারই না তিনি আমাদের করেছেন। স্বর্গের দেবদূতেরা সর্বদা পাখা মেলে এই মানুষের অধীনস্থ দাসের মত সেবা করে বেড়ায়। দেবদূত প্রহরীরা সারা পৃথিবী প্রহরা দিয়ে বেড়ায়। তাদের। প্রহরাকেই আমি সবচেয়ে ভয় করি। তাদের সেই প্রহরা এড়ানোর জন্যই আমি মধ্যরাত্রির কুয়াশা ও অন্ধকারের আবরণে গা ঢাকা দিয়ে গোপনে নিঃশব্দে এখানে প্রবেশ করেছি। কোথায় এক ঘুমন্ত সর্পকে দেখতে পাব এবং তার দেহে প্রবেশ করে আমার কুটিল কামনাকে চরিতার্থ করতে পারব তার জন্য প্রতিটি ঝোঁপঝাড় আমি অনুসন্ধান করে চলেছি।
যে আমি একদিন সর্বোচ্চ পদে অভিষিক্ত হয়ে দেবতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতাম, সেই আমি আজ বাধ্য হয়ে পশু হতে চলেছি। পশুর গুণাবলী ধারণ করতে চলেছি। কিন্তু উচ্চাভিলাষ পূরণ ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কে নীচে নামবেনা? যে উচ্চাভিলাষের আকাশে পাখা মেলে উড়তে চায় তাকে নীচে নামতেই হবে। যে প্রতিশোধ চায় তাকে আপাতমধুর সেই প্রতিশোধের তিক্ত ফল ভোগ করতেই হবে!
তাই হোক। যেহেতু সুউচ্চ স্বর্গলোকে গিয়ে আমি ঈশ্বরকে ধরতে পারলাম না, সেইহেতু সেই ঈশ্বরের পরেই যে আমার মনে ঈর্ষা জাগায়, যে ঈশ্বরের নূতন প্রিয় বস্তুরূপে আমাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আমাদের প্রতি ঘৃণাবশত যাকে ঈশ্বর সামান্য মাটি থেকে সৃষ্টি করে এমন উন্নত অবস্থায় উন্নীত করেছেন, সেই মাটির মানুষকে ঈশ্বরের নবজাত সন্তানকে ঘৃণা করতে চাই আমি। ঘৃণার শোধ ঘৃণার দ্বারাই নিতে হয়।
এই কথা বলার পর একরাশ কালো কুয়াশার মত গুঁড়ি মেরে প্রতিটি সিক্ত অথবা শুষ্ক ঝোঁপের মধ্যে সে একটি ঘুমন্ত সর্পের সন্ধান করে যেতে লাগল। অবশেষে সে এক জায়গায় দেখতে পেল ঘাসের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথা রেখে একটি সাপ নির্ভয়ে ঘুমোচ্ছে। শয়তান তার মুখের মধ্যে প্রবেশ করে তার পাশবিক কুটিল স্বভাবটি লাভ করল। তারপর তার বুদ্ধিকে সক্রিয় করে তুলল। কিন্তু তাতে সর্পটির ঘুমের কোন ব্যাঘাত হলো না। এইভাবে রাত্রি প্রভাত হবার অপেক্ষায় রইল।
তারপর যখন প্রভাতের শুচিস্নিগ্ধ আলো ইডেন উদ্যানের প্রস্ফুটিত ফুলগুলির উপর ঝরে পড়তে লাগল, তখন সেই সব ফুলগুলি হতে বিচিত্র সৌরভে আমোদিত হয়ে উঠল উদ্যান। পৃথিবীর সমস্ত সুগন্ধি বস্তুগুলি পরম স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নীরবে গৌরবগান করতে লাগল। তখন সর্পরূপী শয়তান দেখল সেই মানবদম্পতি ঈশ্বরের স্তোত্ৰগানে মুখর হয়ে উঠল। সমস্ত প্রকৃতি ও প্রাণীজগতের মধ্যে একমাত্র তারাই এই কণ্ঠস্বরের অধিকারী। ঈশ্বরের স্তবগানে সমর্থ। গান শেষে তারা প্রথমে প্রকৃতির রূপ, বর্ণ ও গন্ধ কিছুক্ষণ উপভোগ করল। পরে তারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করতে লাগল।
ঈভ তখন বলল, আদম, যতই আমরা এই উদ্যানের গাছপালা ও ফুলগুলির পরিচর্যা করছি ততই আমাদের কাজ বেড়ে যাচ্ছে। এতদিন আমরা দুজনে একসঙ্গে কাজ করে আসছি। একাজে আরও লোকের দরকার। যে সব গাছপালার অতিরিক্ত অংশ হেঁটে দিচ্ছি, একরাত্রির মধ্যেই তারা আবার বেড়ে উঠছে। তাই উপায়স্বরূপ একটি চিন্তা আমার মনে হয়েছে। এ বিষয়ে তোমার পরামর্শ চাই। আমি আমাদের শ্রমকে ভাগ করে নিতে চাই। আমরা দুজনে দু জায়গায় কাজ করব। তুমি পছন্দমত এক জায়গায় যেতে পার অথবা যেখান বেশি প্রয়োজন বুঝবে সেখানে যাবে। অথবা যেখানে আইভিলতাগুলি কোন গাছকে জড়িয়ে উঠতে পারছে না সেখানে গিয়ে তাদের উঠিয়ে দেবে। আর আমি ঐ গোলাপবনে গিয়ে তাদের পরিচর্যা করব বেলা দুপুর পর্যন্ত।
কিন্তু আমরা দুজনে যদি একই জায়গায় কাছাকাছি কাজ করি তাহলে পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময়, হাসাহাসি ও কথাবার্তায় সময় কেটে যায়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। সারাদিন বৃথাই কেটে যায়।
আদম তখন শান্তকণ্ঠে উত্তর করল, হে আমার একমাত্র সহচরী, সমস্ত প্রাণীর মধ্যে তুমিই আমার প্রিয়তমা, ঈশ্বরনির্দিষ্ট আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলি কিভাবে সুচারুরূপে সম্পন্ন হতে পারে সে বিষয়ে তুমি ঠিকই বলেছ। কাজ ঠিকমত না হওয়ার জন্য যাতে আমার কোন নিন্দা বা বিরূপ সমালোচনা না হয় সেদিকে তোমার লক্ষ্য আছে। পারিবারিক মঙ্গলসাধনই নারীর সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দান করে। পারিবারিক উন্নতির জন্য যথাসাধ্য কাজ করে যাওয়াই নারীর ধর্ম।
কিন্তু ঈশ্বর আমাদের উপর এমন কিছু কঠোর শ্রমের ভার চাপিয়ে দেননি যে আমরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুজনে একসঙ্গে বসে বিশ্রাম করে অথবা মধুর আলাপ-আলোচনার দ্বারা চিত্তবিনোদন করতে পারব না। যে হাসি মানুষের যুক্তিবোধ থেকে উৎসারিত হয়, সে হাসি পশুদের মুখে পাওয়া যায় না। নরনারীর মুখের সেই মিষ্টি হাসি ও মধুর বিশ্রম্ভালাপ মানবমনের খাদ্য। প্রেম হচ্ছে মানবজীবনের এক মহান লক্ষ্য, কোন হীনতম লক্ষ্য নয়।
কোন কষ্টকর বিরক্তিকর শ্রমের জন্য আমাদের সৃষ্টি হয়নি, আমাদের সৃষ্টি হয়েছে আনন্দের জন্য এবং এই আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তি। এইসব বনপথ ও কুঞ্জগুলি আমরা দুজনেই হাত দিয়ে পরিষ্কার রাখতে পারব। আমাদের বেড়াবার প্রশস্ত পথ থাকবে। পরে আমাদের সন্তানরা তাদের ছোট ছোট হাত দিয়ে সাহায্য করবে আমাদের কাজে।
তবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার দ্বারা তোমার মন যখন তৃপ্ত হবে তখন তুমি অল্প : কিছুক্ষণের জন্য অনুপস্থিত থাকতে পার। আমি তা সহ্য করতে পারব। কারণ নির্জনতা অনেক সময় উত্তম সাহচর্য বা সঙ্গদানের কাজ করে। স্বল্পকালীন বিরাম বা বিশ্রাম ভাল ফল দান করে।
তবে এ বিষয়ে আর একটি সংশয় আচ্ছন্ন করছে আমার মনকে। পাছে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র কোথাও গেলে তোমার কোন বিপদ ঘটে বা তোমার কোন ক্ষতি হয় তা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে আমার মন। আমাদের কিভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে তা তুমি জান। আমাদের কোন প্রতিহিংসাপরায়ণ শত্রু আমাদের সুখে ঈর্ষান্বিত ও তার হতাশায় বিক্ষুব্ধ হয়ে এক হীন চক্রান্ত ও অপকৌশলের দ্বারা আমাদের পতন ঘটিয়ে অন্তহীন দুঃখ, লজ্জা ও অপমানের গহুরে নিক্ষেপ করতে চাইছে। সে শত্ৰু নিশ্চয় আমাদের নিকটবর্তী কোন জায়গায় থেকে লক্ষ্য করছে, তার কু-অভিসন্ধি পূরণের সুযোগ খুঁজছে। দেখছে আমরা এক জায়গায় পাশাপাশি থাকলে সুবিধা হবে না। কারণ তাহলে একজনের প্রয়োজনে অন্যজন সাহায্য করতে পারব সঙ্গে সঙ্গে। সেই জন্য আমরা দুজনে ছাড়াছাড়ি হয়ে দূরে দূরে থাকলে তার সুবিধা হবে।
তার আসল উদ্দেশ্য হলো তার ঈর্ষার প্রধান বস্তু আমাদের এই সুখী জীবনের অবসান ঘটানো। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সে ঈশ্বরের প্রতি আমাদের আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা অথবা আমাদের দাম্পত্যপ্রেমে ব্যাঘাত ঘটাতে চায় সে। তবে সে যাই করুক, যে ঈশ্বর তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে আজীবন রক্ষা করে চলেছেন তার পক্ষ যেন ত্যাগ করো না। যেখানে স্ত্রীর বিপদ বা অপমানের আশঙ্কা থাকে, সেখানে সে স্বামীর কাছে নিরাপদে থাকে, সেখানে স্বামীই তাকে রক্ষা করে।
ঈভ তখন গম্ভীরভাবে বলল, হে ঈশ্বরের সন্তান এবং পৃথিবীর অধীশ্বর, আমাদের এমন একজন শত্রু আছে যে আমাদের সর্বনাশ ঘটাতে চায় তা তোমার কাছ থেকেই জানতে পেরেছি আমি। আমাদের সেই দেবদূত অতিথি বিদায় নেবার সময় এ বিষয়ে যা বলে যান তাও আমি আমাদের বনকুঞ্জের পিছনে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি।
কিন্তু আমাদের একজন শত্রু আমাদের প্রলোভিত করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে বলে তুমি যে ঈশ্বরের প্রতি ও তোমার প্রতি আমার বিশ্বস্ততা ও দৃঢ়তায় সংশয় প্রকাশ করবে এটা আমি আশা করতে পারিনি। তার শক্তিকে তুমি ভয় করো না। কারণ আমরা মৃত্যুযন্ত্রণার বশীভূত নই। মৃত্যু আমাদের আক্রমণ করতে পারবে না, তার সে আক্রমণকে আমরা প্রতিরোধ করতেও পারব না। তার প্রতারণাকে একমাত্র তুমিই ভয় করো। আর সেই ভয় থেকেই তুমি বিশ্বাস করো ঈশ্বরের প্রতি আমার বিশ্বস্ততা তোমার প্রতি আমার ভালবাসা তার প্রতারণার দ্বারা বিকম্পিত ও ব্যাহত হবে। যে তোমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় তার প্রতি এই চিন্তা কেমন করে পোষণ করো তুমি তোমার অন্তরে? কি করে সে চিন্তা প্রবেশ করল তোমার মনে?
আদম তখন উত্তর করল, হে ঈশ্বরসৃষ্ট মানবকন্যা, অমর ঈভ, জানি তুমি মৃত্যু, পিপ বা কোন দোষ থেকে মুক্ত। তুমি নিষ্পাপ, নির্দোষ ও কলুষমুক্ত তা জানি। তোমার কোন অপূর্ণতা বা ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য আমি তোমাকে আমার কাছ থেকে সরে যেতে দিচ্ছি না, আমাদের শত্রুর সম্ভাব্য প্রলোভনটাকে এড়াবার জন্যই তোমাকে নিষেধ করছি আমি। তার প্রলোভন বৃথা হলেও তোমার ধর্মবিশ্বাস প্রলোভনের অতীত নয় জেনে সে তোমার সম্মানকে কলুষিত করার চেষ্টা করবেই। তার সেই অন্যায় প্রচেষ্টা যত নিষ্ফলই মনে হোক না কেন, তুমি তা ঘৃণা ও ক্রোধের দ্বারা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। তাই আমি বলি তুমি একা এই প্রলোভনের সম্মুখীন হও এটা যদি আমি না চাই তাহলে কিছু মনে করো না। আমরা একসঙ্গে এক জায়গায় দুজনে থাকলে শত্রু তা করতে সাহস করত না। আর সাহস করলেও আমাদের উপরেই প্রথমে নেমে আসত তার সে আক্রমণ। যে শয়তান তার ছলনার দ্বারা দেবদূতদেরও প্রতারিত করে সে এমন সূক্ষ্মভাবে তার ছলনাজাল বিস্তার করবে যে তুমি তার সে ছলনা ও প্রতারণা ধরতে পারবে না। সুতরাং এ বিষয়ে অপরের সাহায্য অপ্রয়োজনীয় ভাবা ঠিক নয়।
আমি কিন্তু তোমার দৃষ্টির প্রভাবে অনেক গুণ ও জ্ঞান লাভ করি। তোমাকে দেখে মনে অনেক জোর পাই। কারণ বুঝি দরকার হলে তোমার সাহায্য পাব। অথচ তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন এতে? সব লজ্জা জয় করে তুমি তোমার জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে এটা বুঝতে পারছ না কেন যে আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকলে আমাদের শক্তি আরো বেড়ে যাবে। আমার উপস্থিতিতে তোমার গুণ ও মানসিক শক্তির পরীক্ষা হলে ভাল হবে।
তার স্ত্রীর প্রতি ভালবাসাবশত আদম এই কথা বললে ঈভ কিন্তু তার বিশ্বস্ততার নিষ্ঠা সম্বন্ধে কোন সংশয় না থাকায় সে আর কোন গুরুত্ব দিতে চাইল না সে কথায়।
ঈভ বলল, এই যদি আমাদের অবস্থা হয়, ছোট-বড় কোন শত্রুর ভয়ে এক সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে যদি আমাদের বাস করতে হয় এবং একা সে শত্রুর সম্মুখীন হওয়া যদি সম্ভব না হয় তাহলে কিসের আমরা সুখী? যদি বিপদের আশঙ্কায় আজও শঙ্কিত হতে হয় আমাদের তাহলে আমাদের সুখ কোথায়? কিন্তু কোন পাপ না করলে তো কোন ক্ষতি হতে পারে না? সে আমাদের দাম্পত্য প্রেমের নিবিড়তা বা অখণ্ডতাকে হীনজ্ঞান করতে পারে। কিন্তু তাকে হীনজ্ঞান মনে করলেই তো তা হীন বা অসম্মানিত হয়ে পড়বে না। সুতরাং আমরা পরস্পরের কাছ থেকে ছাড়াছাড়ি হলেও তাতে ভয়ের কি আছে?, বরং তার অনুমান মিথ্যা প্রমাণিত হলে এই ঘটনা থেকে দ্বিগুণ সম্মান লাভ করবে আমাদের প্রেম। কারণ আমরা ঈশ্বরের দ্বারা অনুগৃহীত। তাছাড়া বিশ্বাস, প্রেম প্রভৃতি গুণগুলি যদি কখনো প্রতিকূল ঘটনার আঘাতে সুরক্ষিত না হয়, যদি তারা একাকী আপন আপন প্রাণশক্তির দ্বারা আত্মরক্ষা করতে না পারে তাহলে সে সব ক্ষণভঙ্গুর গুণগুলির প্রয়োজন কি? সুতরাং আমাদের এই সুখী অবস্থার প্রতি কোন সংশয় পোষণ করা উচিত নয়। যদি তোমার ধারণা ঠিক হয় তবে বুঝতে হবে স্রষ্টা আমার সুখকে ক্ষণভঙ্গুর করেছেন যাতে আমরা একাকী সে সুখকে রক্ষা করতে পারি। তাহলে ঈশ্বরনির্মিত এই ইডেনই নয়, সামান্য সাধারণ এক উদ্যানমাত্র।
আদম তখন আবেগের সঙ্গে বলল, হে নারী, ঐশ্বরিক ইচ্ছায় সৃষ্ট সকল বস্তুই উত্তম। ঈশ্বর নিপুণহস্তে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার কোন কিছুই অপূর্ণ নয়। মানুষকেও তিনি অপূর্ণ করে সৃষ্টি করেননি। বাইরের যেকোন প্রতিকূল শক্তিকে প্রতিহত করে সে তার নিজের সুখের অবস্থাকে নিরাপদ বা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। তার যা কিছু বিপদ বা শত্রু তা আছে তার ভিতরে এবং সে বিপদ অতিক্রম করার ক্ষমতা তার নিজের মধ্যেই আছে। তার নিজের ইচ্ছা না থাকলে কোন ক্ষতিই হতে পারে না।
কিন্তু ঈশ্বর মানুষের ইচ্ছাকে স্বাধীন করে রেখেছেন। কারণ যা কিছু যুক্তিকে মেনে চলে তাই স্বাধীন। এই যুক্তি সব সময় সঠিক এবং ন্যায়ের পথ দেখায়। কিন্তু এই যুক্তি অন্তরে গোপন অবস্থায় থাকে। তবু ইচ্ছা কোন ভুল করলেই তাকে ঠিক পথে চালিত করার জন্য সব সময় খাড়া হয়ে থাকে। পাছে কোন আপাতসুন্দর বস্তু বা ব্যক্তি ভালর বেশ ধরে এসে তাকে ভুল পথে চালিত করে এবং ইচ্ছাকে ভুল তথ্য পরিবেশন করে তাকে ভুল বুঝিয়ে ঈশ্বরের দ্বারা নিষিদ্ধ কোন কাজ করতে বাধ্য করে তার জন্য সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখে চলে সে।
সুতরাং আমি ভালবেসে যে তোমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দিই তা যেন অবিশ্বাস করো না। আমরা আমাদের আদর্শে যত দৃঢ় বা অবিচল থাকি না কেন, সে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে পারি আমরা। কারণ যুক্তি অনেক সময় শত্রুর বিস্তৃত ছলনাজালে পড়ে তার প্রহরা শিথিল করে তার অজানিতেই প্রতারণার শিকার হয়ে পড়ে।
সুতরাং প্রলোভনকে ডেকে এনো না। তাই তাকে পরিহার করে চলা ও আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়াই ভাল। কখন কিভাবে বিপদ আসবে অপ্রত্যাশিতভাবে বলা যায় না। তুমি যদি মনেপ্রাণে বিশ্বস্ত হও তাহলে প্রথমে তোমার আনুগত্যের পরিচয় দিতে হবে।
যদি তুমি মনে করো আমরা একসঙ্গে থাকলেও বিপদ অতর্কিতভাবে আমাদের উপরেও এসে পড়তে পারে, যদি মনে করো তুমি তোমার শক্তিতে খুব বেশি আস্থাশীল হয়ে উঠেছ তাহলে যেতে পার। কারণ তুমি যদি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার কাছে থাক তাহলে তোমার সে উপস্থিতি অনুপস্থিতির থেকেও দুর্বিসহ হয়ে উঠবে। তাহলে তোমার সহজাত নির্দোষিতা এবং নিজস্ব গুণাবলীর উপর ভিত্তি করে চলে যাও। ঈশ্বর যেমন করে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, যে সব গুণাবলী দান করেছেন, তুমি সেই সব গুণানুসারেই চলবে।
আমাদের আদিপিতা এই কথা বললেও ঈভ জেদ করতে লাগল। সে বিরক্তির সঙ্গে বলল, তোমার অনুমতি নিয়ে এবং পূর্ব হতে সতর্কিত হয়ে আমি যাচ্ছি। তোমার দ্বারা উপস্থাপিত শেষ যুক্তিটি স্পর্শ করে আমার মনকে। আমরা একসঙ্গে থাকলেও আমাদের অপ্রস্তুত অবস্থাতেই অতর্কিতভাবে বিপদ এসে পড়তে পারে। সুতরাং আমি স্বেচ্ছায় যাচ্ছি। আমাদের দর্পিত শত্ৰু অতর্কিতে এসে আমাদের মধ্যে যে বেশি দুর্বল শুধু তারই খোঁজ করবে এটা আমি আশা করতে পারি না। ঈভকে এইভাবে অনমনীয় দেখে আদম ভাবল এরপর তাকে নিষেধ করতে হলে সেটা লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
ঈভ তার কথা বলা শেষ করেই আদমের হাত হতে তার নরম হাতটি ছাড়িয়ে নিল। হালকা বনপরীর মত সে বাতাসের বেগে তখনি চলে গেল।
বাগানের কাজ করার উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে ঈভ যখন আদমের কাছ থেকে অন্যত্র কাজ করতে যাচ্ছিল তখন তাকে দেখে রোমকদেবতা ভাতুমনাসকে ছেড়ে চলে যেতে থাকা তার প্রেমিকা পমোনার মত দেখাচ্ছিল।
তার পথপানে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে যতদূর দেখা যায় ততদূর দেখতে লাগল আদম। তার শুধু মনে হচ্ছিল ঈভ তার কাছে আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভাল হত। যাবার সময় সে ঈভকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলে দেয় বারবার। ঈভও তাকে জানিয়ে দেয় সে দুপুর হলেই ফিরে আসবে তাদের কুঞ্জে। তারা একসঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজন করবে এবং একসঙ্গে বিশ্রাম গ্রহণ করবে।
হে অতিপ্রতারিত, অতিব্যর্থ, ভাগ্যহীনা ঈভ, প্রতিকূল ঘটনার দ্বারা তোমার প্রস্তাবিত প্রত্যাবর্তন হবে কত কলুষিত। সেই প্রত্যাবর্তনের পরমুহূর্ত হতেই তুমি আহার ও বিশ্রামে আর কোন মাধুর্য বা আনন্দ পাবে না। কারণ শয়তান সকাল থেকেই তোমার পথে অতর্কিত আক্রমণে তোমার সকল নির্দোষিতা, ঈশ্বরবিশ্বাস ও স্বর্গীয় সুখ হতে চিরতরে তোমাকে বঞ্চিত করার জন্য সাপের রূপ ধরে ছায়াচ্ছন্ন ফুলবনে ওৎ পেতে লুকিয়ে আছে। যে দুটিমাত্র আদি মানব-মানবীর মধ্যে ভাবী কালের সমগ্র মানবজাতি নিহিত আছে সেই দুটি মানব মানবীই তার উদ্দিষ্ট শিকারের বস্তু।
মাঠে, বাগানে, কুঞ্জবনে কত খুঁজেছে তাদের। সে তাদের দুজনকেই কোন ঝর্ণা বা ছায়াচ্ছন্ন নদীতটে নির্জনে দেখতে চেয়েছে। তবে ঈভকে একা পেলেই ভাল হয়। কিন্তু ঈভকে সে তার স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একা পেতে ইচ্ছা করলেও সে ইচ্ছা পূরণ তার আশাতীত। কারণ তারা সব সময় দুজনে একসঙ্গে থাকে। একসঙ্গে কাজ করে অথবা বেড়ায়।
কিন্তু শয়তান তার গুপ্তস্থান থেকে ঈভকে সেদিন একাই দেখল। দেখল একটি ফুটন্ত গোলাপের ঝোঁপের পাশে একা একা দাঁড়িয়ে কাজ করছে ঈভ আপন মনে। গোলাপগাছের যে সব সরু সরু শাখাগুলি ফোঁটা ফুলের ভারে নুইয়ে পড়ছিল তাদের তুলে ধরে এক একটি অবলম্বন দান করছিল সে। গাছের আড়ালে থাকায় ঈভকে সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছিল না।
শয়তান এবার তার গুপ্তস্থান থেকে বেরিয়ে এসে গাছপালার মধ্যে দিয়ে ঈভের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সন্তর্পণে। গোলাপের গন্ধে আমোদিত ও তার রূপ সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ দেখে তার গাটাকে সত্যিই খুব মনোরম দেখাচ্ছিল। মুক্তবায়ুহীন শহরে দীর্ঘকাল আবদ্ধ থাকার পর কোন লোক যদি গ্রীষ্মের কোন এক সকালে গ্রামের মুক্ত বাতাসে ভরা খোলা মাঠে এসে পড়ে তাহলে সে গ্রামের প্রতিটি বস্তু ও শব্দদৃশ্য দেখেই আনন্দ পায়। নরকবাসী শয়তানরাজও তেমনি সেই গোলাপকুঞ্জের কাছাকাছি এসে অনুরূপ আনন্দ লাভ করল। দেখল ঈভও প্রস্ফুটিত ফুলের মতই সুন্দর। সকল আনন্দ যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে ঈভের চোখে।
সর্পরূপী শয়তান দেখল ঈভের চেহারাটা অনেকটা দেবদূতের মত, কিন্তু এক অপরূপ সৌন্দর্যসুষমায় মণ্ডিত নারীমূর্তি। তার চেহারার মধ্যে এমনই একটি স্বর্গীয় ছবি ছিল যা দেখে শয়তানের ভয়ঙ্কর অভিলাষ ও প্রতিহিংসার সকল ভীষণতাও যেন ভয় পেয়ে গেল।
ঈভকে দেখতে দেখতে ক্ষণকালের জন্য সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল শয়তান। ক্ষণকালের জন্য সে সমস্ত শত্রুতা, হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা ও প্রতিশোধ-বাসনার কথা সব ভুলে গিয়ে খুব ভাল হয়ে উঠল মনে মনে। হয়ে উঠল পবিত্রচিত্ত। ঈভকে দেখে এক সত্যিই বিশুদ্ধ আনন্দ লাভ করল।
কিন্তু সে শুধু ক্ষণকালের জন্য। তার বুকের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর নরকাগ্নি অনির্বাণভাবে জ্বলে চলছিল, সে অগ্নি প্রবল হয়ে উঠল আবার। সে আগুন মুহূর্তে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল তার আগুনের সকল শুচিতা ও আনন্দকে। এই ইডেন উদ্যানে যে সব মনোরম বস্তু তাদের ভোগের জন্য সৃষ্ট হয়নি, হয়েছে মানবজাতির জন্য, সেই সব জিনিস দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনের উপর দুঃখের পীড়ন বেড়ে যায়। প্রবলতর হয়ে ওঠে ঘৃণা, প্রতিহিংসা আর বিদ্বেষ। কলুষিত ও বিষাক্ত হয়ে ওঠে তার সকল চিন্তা।
নিজের চিন্তাভাবনাকে সম্বোধন করে উন্মাদের মত বলতে লাগল শয়তান, হে আমার চিন্তারাজি, তোমরা আমায় কোথায় নিয়ে এসেছ? কোন্ মায়াবলে আমাকে এমন এক মধুর বিস্মরণের মধ্যে ডুবিয়ে দিলে যাতে আমি আমার আসল উদ্দেশ্যটাকে ভুলে গেলাম! কোন ভালবাসা, স্বর্গলাভের আশা বা এখানকার উদ্যানসুলভ আনন্দ আস্বাদনের জন্য এখানে আসিনি আমি, আমি এসেছি এখানকার সব আনন্দ ধ্বংস করে দিতে।
আমি এখন কেবল ধ্বংস করেই আনন্দ পেতে চাই। অন্য যে কোন আনন্দ মিথ্যা আমার কাছে। যে সুযোগ সৌভাগ্যের রূপ ধরে সুপ্রসন্ন হয়ে উঠেছে আমার, প্রতি তাকে যেন ব্যর্থ হয়ে চলে যেতে দিও না। ঐ দেখ, সেই আদি মানবী এখন সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় কাজ করছে। আমার প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তোলার এই হলো সুবর্ণ সুযোগ। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি ওর স্বামী এখন অনেক দূরে আছে, তার কাছে নেই। তার উচ্চমনের বুদ্ধি, বীরত্বপূর্ণ চেহারা, তার শক্তি, সাহস সবই ভয়ের বস্তু আমার কাছে। ও এখন ঈশ্বরের অনুগ্রহে ধন্য বলে ওর দেহে কোন ক্ষত হবে না, কোন আঘাত মারাত্মক হয়ে উঠবে না তার পক্ষে। অথচ আমি আমার সেই দৈবী শক্তি হারিয়েছি। বর্তমানে আমি দীর্ঘদিন নরকযন্ত্রণা ভোগ করে করে ক্ষীণ হয়ে উঠেছি।
ঐ আদি মানবী সত্যিই সুন্দরী, এক স্বর্গীয় সুষমায় মণ্ডিত তার সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্য দেবতাদের ভালবাসার যোগ্য। কপট ভালবাসার এক ছলনাময় ক্ষীণ আবরণের মধ্যে প্রবলতম এক ঘৃণাকে ঢেকে রেখে আমি যাচ্ছি তার কাছে।
নিজের মনে এই কথা বলার পর মানবজাতির শত্রু শয়তানরূপী সর্প ঈভের দিকে এগিয়ে এল। মাটির উপর শুয়ে হেঁটে চলতে লাগল সে। তারপর নীচের দিকটা কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথাটা উঁচু করে তুলে রাখল ঘাসের উপর তরঙ্গায়িত ভঙ্গিতে এঁকেবেঁকে এল সে। তার আকারটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। ইতিলরিয়াতে থীবস-এর রাজা ক্যাডমাস ও তার রানী হার্মিওন যে সর্পদেহ ধারণ করে অথবা এপিডরাসে ওষুধের দেবতা এপিকনিপাম যে সর্পরূপ ধারণ করে রোমে প্লেগরূপ মহামারীর অবসান ঘটাতে যান, সেই সব সর্পরূপের থেকে সর্পরূপী শয়তানকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল।
নিয়ত পরিবর্তনশীল কোন বায়ুপ্রবাহের মত সর্পরূপী শয়তান তার দেহটাকে আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে ঈভের মন ভোলাবার চেষ্টা করছিল। তার মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিল।
ঈভ কিন্তু তার উপস্থিতির কথা কিছুই বুঝতে পারেনি। সে শুধু গাছপালার পাতার পতপত শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শুনতে পায়নি। বনের মধ্যে জীবজন্তু চলাফেরার সময় তাদের পায়ের এরকম শব্দ প্রায়ই হয়। তাই সে কিছু মনে করেনি।
এদিকে সর্পরূপী শয়তান সেখানেই থেমে রইল। সে তার সোনালী ঘাড়টা প্রায়ই উঁচু করছিল।
অবশেষে তার এই নীরব ক্রীড়াভঙ্গির প্রকাশ ঈভের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ঈভের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে শয়তান খুশি হয়ে তার কুটিল প্রলোভনজাল বিস্তার করার জন্য মানুষের মত বলতে লাগল, হে মর্ত্যলোকের অধীশ্বরী, আশ্চর্যান্বিত হয়ো না। ঘৃণামিশ্রিত ও কঠোর করে তুলো না তোমার দৃষ্টিকে। তুমি হচ্ছ বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি। সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতার রানী। আমি এখানে এসে মুগ্ধ ও অতৃপ্ত নয়নে তোমাকে অবলোকন করছি। এই দেখ, আমি একা হলেও তোমার কুটিকে ভয় পাচ্ছি না।– তোমার স্রষ্টার অনুরূপ সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ তোমার দেহ। এ জগতের সব বস্তুই তুমি পেয়েছ উপহার হিসাবে। এখানকার সব জীবন্ত প্রাণীই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তোমাকে দেখে। কিন্তু শুধু মুগ্ধ দৃষ্টির সার্থকতা কোথায় যদি না সে দৃষ্টির মুগ্ধতা প্রশংসা বা বন্দনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত না হয়?
এখানকার বন্য পশুরা তোমার স্বর্গীয় সৌন্দর্য শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে কিন্তু শুধুমাত্র একজন মানুষ ছাড়া আর কোন পশু বা প্রাণী তোমার এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মহিমার মর্ম বুঝতে পারে না। যিনি দেবতাদের মধ্যে মানবীর মত, যিনি অসংখ্য দেবদূতদের সেবালাভের যোগ্য তাঁকে সামান্য এক মানুষ প্রশংসা করে কি করবে?
এইভাবে প্রলোভনের জালবিস্তারকারী শয়তানের ছলনাময় কথাগুলি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ঈভের অন্তরে। সর্পের মুখে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে আশ্চর্য হয়ে উঠল সে। পরে বিস্ময়ের ঘরটা কাটিয়ে উঠে সে বলল, এর মানে কি? পশুর কণ্ঠে মানুষের কথা ব্যক্ত হচ্ছে আর মানুষের জ্ঞানের কথা প্রকাশিত হচ্ছে?
আমি তো জানতাম পশুরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। কারণ ঈশ্বর সৃষ্টিকালে পশুদের মূক হিসাবেই সৃষ্টি করেছিলেন। যদিও অদের সৃষ্টি ও কর্মের মধ্যে মানবিক যুক্তিবোধ ও জ্ঞানের অনেক পরিচয় পাওয়া যায়। হে সর্প, আমি জানতাম তুমি খুব চতুর একটি জীব, কিন্তু তুমি যে মানবসুলভ কণ্ঠস্বরের অধিকারী তা তো জানতাম না।
এখন বল, কিভাবে তুমি তোমার মূক অবস্থা থেকে এমন কণ্ঠস্বর লাভ করলে এবং কেমন করেই বা এখানকার অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে আমার প্রতি সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠলে? একথা বলে আমার বিস্ময়কে দ্বিগুণীকৃত করে দাও।
একথা শুনে সুচতুর প্রলোভনকারী বলল, সৌন্দর্যের সম্রাজ্ঞী, হে জ্যোতির্ময়ী ঈভ, তুমি যা বলতে আমাকে আদেশ করেছ সে কথা বলা খুবই সহজ আমার পক্ষে। তাছাড়া তোমার আদেশ মান্য করা আমার উচিত।
আমিও প্রথমে অন্যান্য প্রাণীর মত বনের ঘাসপাতা প্রভৃতি সামান্য খাদ্য খেয়ে বিচরণ করে বেড়াতাম। কোন্ খাদ্য ভাল বা মন্দ, কে নারী কে পুরুষ, কোন বিষয়েরই কোন বিশেষ জ্ঞান ছিল না আমার।
একদিন মাঠে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দূরে একটি সুন্দর গাছ দেখতে পেলাম। সোনালী ও লালে মেশানো অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ফলে ভরা গাছটি। গাছটিকে ভাল করে দেখার জন্য তার কাছে গেলাম আমি। সহসা গাছটির শাখাগুলি থেকে একঝলক গন্ধ বাতাসে ভেসে আসায় জাগ্রত হয়ে উঠল আমার ক্ষুধা। সেই মধুর গন্ধে মন আমার মাতোয়ারা হয়ে উঠল। আমি সেই ফল ভক্ষণ করে একই সঙ্গে আমার ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিরসনের সংকল্প করলাম। এরপর আমি শ্যাওলাধরা গাছের গুঁড়িটিকে জড়িয়ে ধরলাম। সেই গাছের ডালগুলো এত উঁচু ছিল যে আদমের মত লম্বা কোন মানুষ ছাড়া তা নাগাল পাবে না।
সেই গাছের তলায় আরো যে সব পশু ফল খাবার আশায় দাঁড়িয়ে ছিল তারাও তার নাগাল পেল না।
কিন্তু আমি সেই গাছটির উপর সর্পিল গতিতে উঠে গেলাম। দেখলাম আমার হাতের কাছে প্রচুর ফল ঝুলছে। তা আমি তখন পেড়ে মনের সাধ মিটিয়ে পেট ভরে খেতে লাগলাম। সেই রসাল ফল খেয়ে যে মধুর আস্বাদ আমি পেয়েছিলাম তার আগে কোন খাদ্য বা কোন ঝর্ণার জল খেয়ে সে আস্বাদ আমি পাইনি।
সেই ফল খাবার সঙ্গে সঙ্গে এক আমূল পরিবর্তন এল আমার অন্তরে। আমার মনের জোর বেড়ে গেল। আমার জ্ঞানবুদ্ধি ও যুক্তিবোধ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। আমার বাকশক্তি ফুরিত হলো। স্বর্গ, মর্ত্য দুইয়ের মধ্যবর্তী এই জগৎ সম্বন্ধে সব জ্ঞান স্পষ্টভাবে ধরা দিল আমার কাছে। আমি যেন ত্রিভুবনের সব কিছু দেখতে পেলাম। তবে আমার দেহটি তেমনই রয়ে গেল। বহিরঙ্গের কোন পরিবর্তন হলো না। কিন্তু এই ত্রিভুবনের মধ্যে তোমার মত সুন্দরী কোথাও দেখিনি। স্বর্গের সমস্ত অপ্রাকৃত জ্যোতি যেন মিলিত হয়েছে তোমার রূপের মধ্যে। সৌন্দর্য ও সততায় ত্রিজগতে তোমার তুলনীয় দ্বিতীয় একজন কেউ নেই।
এরজন্যই আমি এখানে এসে থেকে তাকিয়ে আছি তোমার দিকে। তোমাকে পূজা করতে ইচ্ছা করছে। হে আদি মানবমাতা, মানবী হয়েও তুমি দেবী।
চতুর সর্পরূপী শয়তান এই কথা বললে তার চাতুর্য ও ছলনা কিছু ধরতে না পেরে ঈভ বলল, সেই আশ্চর্য ফলের গুণ সম্বন্ধে তোমার অতি প্রশংসার কথা শুনে মনে সন্দেহ জাগছে আমার। বল, সে ফলের গাছ কোথায় আছে? এখান থেকে কত দূরে? কারণ এই স্বর্গদ্যানে ঈশ্বরের অনেক রকমের গাছ আছে এবং তাদের সংখ্যা এত বেশি যে অনেক গাছের ফল আমরা স্পর্শ করিনি এখনো পর্যন্ত। কারণ আমাদের পছন্দমত ফল হাতের কাছেই প্রচুর পেয়ে যাই। আরো অনেক মানুষ না আসা পর্যন্ত অনেক গাছের ফল ঝুলতে থাকবে, কেউ তাদের পাড়বে না।
তা শুনে সর্পরূপী শয়তান খুশি হয়ে বলল, হে রানী, পথ তো প্রস্তুত হয়েই রয়েছে এবং সে পথ দীর্ঘ নয়। কয়েকটা গাছের সারির পাশ দিয়ে গিয়ে একটা ঝর্ণার ধারে একটা সমতল জায়গা পাওয়া যাবে। সেখানে একটা ঝোঁপের ধারেই। আছে সেই গাছটা। তুমি চাইলে আমিই সেখানে তোমাকে নিয়ে যাব।
ঈভ বলল, তাহলে আমাকে সেখানে নিয়ে চল।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এক অদম্য আনন্দে বুকটা স্ফীত হয়ে উঠল শয়তানের। রাত্রির পুঞ্জীভূত একধরনের বাষ্প থেকে হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলেয়ার আলো যেমন নৈশপথিককে ভুল পথে চালিত করে তেমনি সেই আপাত-উজ্জ্বল চকচকে সর্পরূপ শয়তান আমাদের সরলতম আদিমাতাকে প্রতারিত করে সেই নিষিদ্ধ গাছটির কাছে নিয়ে গেল। সেই গাছই হলো মানবজাতির সকল দুঃখের মূল।
সে গাছ দেখে ঈভ বলল, হে সর্পরাজ, এখানে না এলেই ভাল হত। এ গাছে অনেক ফল থাকলেও আমার কাছে তা নিষ্ফল। এ গাছের ফলের গুণ তোমার কাছেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাক। তাতে আমার কোন প্রয়োজন নেই কারণ এ গাছের ফল আমরা স্পর্শ বা ভক্ষণ করতে পারব না। ঈশ্বরের আদেশ। আর সব বিষয়েই আমরা স্বাধীন হলেও এই একটা বিষয়ে তাঁর এই নিষেধাজ্ঞাকে মেনে চলতে হয় আমাদের। অন্য সব বিষয়ে আমাদের আইনের বিধান আমরাই রচনা করি। আমাদের যুক্তিই আমাদের আইন।
তখন সর্প বলল, তাই নাকি? এই বাগানের সব গাছের ফল খেতে ঈশ্বর তোমাদের তাহলে নিষেধ করেছেন?
নিষ্পাপ ঈভ তখন বলল, এই বাগানের মধ্যে এই একটিমাত্র গাছের ফল ছাড়া আর সব গাছের ফল আমরা খেতে পারি। ঈশ্বর শুধু বলেছেন এ গাছের ফল তোমরা খাবে না বা স্পর্শ করবে না। তাহলে তোমাদের মৃত্যু ঘটবে।
এই কথা শেষ হতে না হতে সর্পরূপী শয়তান একই সঙ্গে মানবজাতির প্রতি ভালবাসা এবং ঈশ্বরের অন্যায়ের প্রতি এক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের ভাব দেখাল। তারপর প্রাচীন এথেন্স বা রোমের কোন কুশলী বাগ্মীর মতো কোন ভূমিকা না করেই আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, হে পবিত্র প্রজ্ঞাসম্পন্না, জ্ঞানদাত্রী বৃক্ষলতা, সকল জ্ঞানবিজ্ঞানের জননী, এখন আমি তোমার শক্তি আমার সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি। তোমার প্রসাদে শুধু জাগতিক সমস্ত বস্তু ও ঘটনার কারণ জানতে পারা যায় না, তোমার দ্বারা যাদের আমরা পরম জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ বলে মনে করি সেই স্বর্গবাসী দেবতাদের জীবনযাত্রাপ্রণালী ও কর্মপদ্ধতির বা রীতিনীতিরও অনেক কিছু জানতে পারি আমরা।
হে বিশ্বজগতের রানী! বিধাতার কঠোর বিধানজনিত মৃত্যুর ভয় তুমি করো না। ও বিধানে বিশ্বাস করো না। মৃত্যু তোমার হতে পারে না। কেন মরবে তুমি? ঐ ফল খেয়ে? বরং তুমি ঐ ফল ভক্ষণ করে প্রভাপূর্ণ এক নবজীবন লাভ করবে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ, আমি ঐ ফল স্পর্শ করে ও ভক্ষণ করে এখনো বেঁচে আছি। শুধু তাই নয়, বিধির বিধানে যে জীবন আমি লাভ করেছিলাম তার থেকে পূর্ণতর এক জীবন লাভ করেছি। আমি আমার বিধিনির্দিষ্ট সীমাকে লঙঘন করে ঊর্ধ্বে হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করে এ জীবন লাভ করেছি। যে জ্ঞান পশুর কাছে উন্মুক্ত তা কি মানুষের কাছে রুদ্ধ থাকতে পারে? মৃত্যুযন্ত্রণার ভয়ের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল যে জ্ঞান, অদম্য নির্ভীক প্রচেষ্টার দ্বারা সে জ্ঞান তুমি লাভ করবে, ঈশ্বর তোমার উপর ক্রুদ্ধ হবেন না, বরং তোমার গুণের প্রশংসা করবেন, বরং তিনি স্বীকার করবেন, মৃত্যু যে পদার্থই হোক, তার যন্ত্রণা যত দুঃসহই হোক, তার দ্বারা নিবারিত না হয়ে তুমি সেই পরম বস্তু লাভ করেছ যা তোমাকে দেবে বৃহত্তর সুখের সন্ধান, যা দেবে ভালমন্দের পরম জ্ঞান। শুধু ভালর জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, যা কিছু মন্দ বা অশুভ, যা জীবনে একটি অতি বাস্তব ও অপরিহার্য ঘটনা, তার জ্ঞান যদি আমরা লাভ করতে না পারি তাহলে কেমন করে তাকে পরিহার করি বলতো?
সুতরাং ঈশ্বর তোমার কোন ক্ষতি করতে পারেন না, বরং তিনি ন্যায়সম্মত আচরণ করবেন। ঈশ্বর যদি ন্যায়পরায়ণ না হন তাহলে তিনি ঈশ্বরই নন। তাহলে কেন কে ভয় করবে? কেন তাঁকে মান্য করে চলবে? তোমার এই অর্থহীন মৃত্যুভয়ই অন্য সকল ভয় দূরীভূত করে দিচ্ছে।
একবার ভেবে দেখতো, এই ফল কেন নিষিদ্ধ হয়? কেন ভীতি প্রদর্শন করা য়? তুমি তার ভক্ত ও উপাসিকা হলেও নে তোমাকে নীচু ও অজ্ঞ করে রাখা হবে? তিনি জানেন যেদিন তুমি ঐ ফল ভক্ষণ করবে সেদিন তোমার ঐ ম্লান চক্ষুদুটি পরিষ্কার ও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং তুমি তখন দেবতাদের মতোই ভাল-মন্দ সব কিছুই জানতে পারবে। আমি যেমন পশু হলেও অন্তরের দিক থেকে মানুষের গুণ লাভ করেছি, মানুষের মতো কথা বলতে পারছি তেমনি মানুষ হয়েও তুমি দেবতাদের গুণ লাভ করবে। তাদের সব জ্ঞানের অধিকারিণী হবে। আর তাতে যদি তোমার মৃত্যুও ঘু অহলে সে মৃত্যুর অর্থ হবে তোমার এই মানবজীবন ও মানবদেহ ত্যাগ করে দৈবজীবন লাভ করা। সে মৃত্যু মোটেই খারাপ হবে না। দেবতাদের এমন কি গুণ আছে যা মানুষ লাভ করতে পারবে না? মানুষ তো দেবতাদেরই দেহের অনুরূপ। দেবতাদের খাদ্য তারাও কেন গ্রহণ করতে পারবে না?
তাছাড়া আমরাই দেবতাদের বড় করে দেখি। আমাদের বিশ্বাস তারা আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ। তারাই সব কিছু সৃষ্টি করে, দান করে। এই শ্রেষ্ঠত্বের সুযোগ নেয় তারা।
কিন্তু আমি এসব বিশ্বাস করি না। এই সুন্দর পৃথিবীতে সূর্যালোক পতিত হয়ে সব বস্তু সৃষ্টি করে, স্বর্গলোকে তা করে না। ঈশ্বর বা দেবতারাই যদি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, তাহলে ভালমন্দের জ্ঞানসমন্বিত এই জ্ঞানবৃক্ষ কে সৃষ্টি করল? যে বৃক্ষের ফল খেয়ে দেবতাদের অনুমতি ছাড়াই সব জ্ঞান লাভ হবে সে বৃক্ষ সৃষ্ট হলো কেন এবং কার দ্বারা? মানুষ যদি জ্ঞান লাভ করে, ভালমন্দের কারণ জানতে পারে, তবে তাতে অপরাধ কোথায়? তাতে ঈশ্বর বা দেবতাদেরই বা কি ক্ষতি হবে? আর সকল বস্তুই যদি ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট হয়, তাঁর বিধান মেনে চলতে বাধ্য হয় তাহলে এই বৃক্ষ কি শুধু অর সে বিধানের বাইরে? এ বৃক্ষ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেনই বা নিষিদ্ধ ফল দান করে? এখানে কোন বাধা নেই। আমি তো ইচ্ছামতো সে ফল তুলে খেয়েছি। এই বৃক্ষ তো আমায় বাধা দেয়নি। কোন অসম্মতি প্রকাশ করেনি। তবে কি শুধু মানবজাতির প্রতি ঈর্ষাবশতই ঈশ্বর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন? কিন্তু ঈর্ষা ঈশ্বরের মনে থাকবে কেন? যিনি সমস্ত গুণের আকর তিনি ঈর্ষার মত একটি কুটিল দোষকে লে পোষণ করে রাখবেন আঁর বুকে?
সুতরাং গেমার এই সুন্দর ফলভক্ষণের যে প্রয়োজন আছে সে প্রয়োজন সিদ্ধ করার পিছনে অনেক কারণ অনেক যুক্তি আছে। অতএব হে মানবরূপিণী দেবী, তুমি অবিলম্বে ঐ ফল অবাধে ভক্ষণ করে।
এই বলে থামল সেই সরূপী শয়তান। তার ছলনার কথাগুলি সহজেই প্রবেশ করুল ঈরে অন্তরে।
জ্ঞানবৃক্ষের ফলগুলির পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ঈভ। সেই সুন্দর ও সুগন্ধি ফলগুলি দেখামাত্রই লোভ আসছিল তার মনে, তার উপর শয়তানের প্ররোচনামূলক ও যুক্তিপূর্ণ কথাগুলি তখনো কানে বাজছিল তার। সে কথাগুলিকে সত্য বলে মনে হচ্ছিল তার।
এদিকে তখন বেলা দুপুর হয়ে ওঠায় ক্ষুধা জেগে উঠল তার মধ্যে। ফলগুলির মিষ্ট গন্ধ তার সে ক্ষুধাকে আরও বাড়িয়ে দিল। সে ফল খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে ইচ্ছা হলো তার। কামনাতুর হয়ে উঠল তার দৃষ্টি। তবু সেই বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে একবার ভাবতে লাগল ঈভ।
ঈভ তখন মনে মনে বলল, হে সর্বোত্তম ফরাজি, নিঃসন্দেহে তোমাদের গুণ কত মহান। তুমি মানুষের কাছে নিষিদ্ধ, তবু প্রশংসার যোগ্য। তোমার ঐন্দ্রজালিক আস্বাদ মূককে দিয়েছে বাকশক্তি, বাকশক্তিহীন পশুর জড় জিহ্বা মুখর হয়ে উঠেছে তোমার গুণগানে।
যে ঈশ্বর তোমাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন আমাদের কাছে, তিনিও তোমার গুণের কথা গোপন রাখেননি আমাদের কাছে। তাই তিনি তোমার নামকরণ করেছেন জ্ঞানবৃক্ষ। তোমার মধ্যে ভালমন্দের দুই জ্ঞানই আছে। তিনি তোমার সম্বন্ধে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন সেই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তোমার আলোকসামান্য গুণের কথাই প্রমাণিত হয়। তোমার আস্বাদনকারী জীবকে যে মঙ্গল দান করো সে মঙ্গলে আমাদের প্রয়োজন। আছে। কারণ শুধু মঙ্গলই যথেষ্ট নয়, মঙ্গলের জ্ঞানই হলো সবচেয়ে বড় কথা। যে ভাল বা যে মঙ্গল সম্বন্ধে আমাদের কোন জ্ঞান নেই সে জ্ঞান বা মঙ্গল লাভ করা বা না করা দুই-ই সমান আমাদের কাছে।
মঙ্গল-অমঙ্গলের এই জ্ঞানকে ঈশ্বর নিষিদ্ধ করেছেন আমাদের জন্য। আমরা জ্ঞানী হতে পারব না। এই নিষেধাজ্ঞা লঙঘন করা এখন এমন কিছু কঠিন নয়। এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে যদি মৃত্যু আমাদের গ্রাস করে তাহলে আমরা জ্ঞান বা অন্তরে স্বাধীনতা নিয়ে কি করব?
ঈশ্বর বলেছেন, যেদিন আমরা এই ফল ভক্ষণ করব সেইদিনই আমাদের মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু এই সর্পের মৃত্যু হলো না তো। সে এই ফল ভক্ষণ করেও এখনো বেঁচে আছে। যুক্তির সঙ্গে কথা বলছে, তার জ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছে। তাহলে এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে যুক্তি কোথায়?
তাহলে এ বিষয়ে মৃত্যু কি শুধু আমাদের জন্য উদ্ভাবিত হয়েছিল? তবে কি এই সব জ্ঞানগর্ভ ফলগুলি থেকে মানবজাতিকে বঞ্চিত করে পশুদের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে?
আমরা একে পশু বলছি বটে, কিন্তু এর আচরণ তো পশুর মতো নয়। পশু হলেও এর মনে কোন ঈর্ষা নেই। ফলভক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে যে শুভ ফল লাভ করেছে জীবনে, মানুষকে বন্ধুভাবে সেই ফলের গুণের কথা আনন্দের সঙ্গে বলতে এসেছে। তাহলে আমার ভয়ের কি আছে? ভাল-মন্দের জ্ঞানবিবর্জিত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে থাকাটাই তো সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। কিসের ভয়? ঈশ্বরের বিধানের ভয়? না কি অন্য কোন শক্তির ভয়?
এই স্বর্গীয় ফলের মধ্যেই আছে সকল ভয়, সকল উদ্বেগ হতে মুক্তি এবং শান্তি। এ ফল দেখতে যেমন সুন্দর, আস্বাদে যেমন মধুর, তেমনি গুণের দিক থেকে জ্ঞানদানের শক্তিসম্পন্ন।
সুতরাং এ ফল স্পর্শ করতে বাধা কোথায়? এ ফল ভক্ষণ করে কেন আমি দেহ ও মনকে পরিতৃপ্ত করব না?
এই কথা বলা শেষ হতেই সে সেই অভিশপ্ত মুহূর্তে হস্ত সঞ্চালন করে সেই জ্ঞানবৃক্ষ হতে ফল তুলে খেতে শুরু করল।
সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা বাজল পৃথিবীর বুকে। যেন এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হলো। বাতাস ও গাছপালার মধ্য দিয়ে দুঃখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পৃথিবী। পৃথিবী বুঝতে পারল আজ শেষ হয়ে গেল মানবজাতির ভবিষ্যৎ।
কুটিল সর্পরূপী শয়তান তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধ করে ঝোঁপের মধ্যে নিঃশব্দে প্রবেশ করল। এদিকে ঈভ সব কিছু ভুলে গিয়ে ফলের আস্বাদে মত্ত হয়ে শুধু ফল খেয়ে যেতে লাগল। এমন ফল জীবনে কোনদিন আস্বাদন করেনি সে।
আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠল সে। সে আনন্দের সঙ্গে ছিল জ্ঞানলাভের এক নিশ্চিত প্রত্যাশা। কোন ঈশ্বরচিন্তা ছিল না তার মনে। কোন মৃত্যুভয় ছিল না অন্তরে। সে শুধু অবাধে একান্ত অসংযতভাবে জ্ঞানবৃক্ষের নিষিদ্ধ ফলগুলি খেয়ে যেতে লাগল।
অবশেষে অতিমাত্রায় তৃপ্ত হয়ে আপন মনে সে বলতে লাগল, হে বৃক্ষদের রানী, এতদিন তোমার গুণ ও মূল্যের কথা জানা ছিল না। আজ বুঝলাম, গুণ ও মূল্যের দিক থেকে তুমি সকল বৃক্ষের শ্রেষ্ঠ। এতদিন তোমার শাখায় যে ফলগুলি ঝুলত তা আস্বাদন করতে পেতাম না আমরা। তাই কোন মূল্যই ছিল না তাদের আমাদের কাছে।
এবার থেকে প্রতিদিন তোমার ফল খেয়ে জ্ঞান বৃদ্ধি করব আমাদের। তোমার প্রশংসা ও গুণগান করব প্রতিদিন সকালে। তোমার শাখা-প্রশাখাগুলি সব সময় প্রচুর পরিমাণ ফলে পরিপূর্ণ হয়ে থাক। সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে তুমি।
যে বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে জ্ঞানের দিক থেকে পরিণতি লাভ করব আমরা সে বৃক্ষ দেবতারা আমাদের দান করেননি। এ বৃক্ষ তারা দান করতে পারেননি বলে ঈর্ষাবশত তার ফলকে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন আমাদের কাছে।
হে বৃক্ষ, তোমার দ্বারাই আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমার সকল জ্ঞানের জন্য তোমার কাছে ঋণী আমি। তুমিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক। তোমাকে এতদিন অনুসরণ করিনি বলেই আমি এতদিন অজ্ঞ ছিলাম। আজ জ্ঞানের পথকে উন্মুক্ত ও প্রসারিত করো আমার জীবনে। এই জ্ঞান গোপনতার গুহার মধ্যে নিহিত থাকলেও সেখানে আমাকে প্রবেশাধিকার দাও।
ঈশ্বর এই পৃথিবীর থেকে অনেক দূরে মনের ঊর্ধ্বে বিরাজ করেন। অসংখ্য চরদ্বারা পরিবৃত আমাদের মহান বিধাতাপুরুষ সদাজাগ্রত প্রহরীর মত এই মর্ত্যলোকের সব কিছু লক্ষ্য করলেও এখানকার অনেক ঘটনা হয়ত অজানিত রয়ে যায় তার কাছে।
কিন্তু আদমের কাছে আমি কিভাবে যাব? আমি কি তাকে আমার এই পরিবর্তনের কথা জানিয়ে আমার এই নবলব্ধ জ্ঞানসমৃদ্ধ সুখের সমান অংশ দান করব অথবা তাকে কিছুই না জানিয়ে এই জ্ঞানকে আমার শক্তির মধ্যে, আমার মধ্যে, আমার অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখব? তাকে আমার সহ অংশীদার করব না এ বিষয়ে? আমি তার সমান হয়েও নারী হিসাবে কি তার প্রেমাকর্ষণের জন্য আমার জ্ঞানগত স্বাধীনতা ও শ্রেষ্ঠত্বকে বজায় রেখে চলব? এটাই হয়ত ভাল হতে পারে।
কিন্তু যদি এই ঘটনা ঈশ্বর প্রত্যক্ষ করে থাকেন এবং যদি এর ফলে আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়? তাহলে আমি আর এ পৃথিবীতে থাকব না এবং আদম তখন আর একজন ঈভকে বিবাহ করে তাকে তার জীবন-সঙ্গিনী করে তুলবে। তখন আমার অবর্তমানে তাকে নিয়ে সুখে বাস করতে থাকবে সে। সুতরাং আমি নিশ্চিতরূপে দৃঢ়তার সঙ্গে স্থির করলাম আদমকেও আমি আমার এই পরম স্বর্গীয় সুখের সমান অংশ দান করব। আমি তাকে এত গভীরভাবে ভালবাসি যে আমি তার সঙ্গে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে পারব। কিন্তু তাকে ছেড়ে জীবনে বেঁচে থেকেও বাঁচার কোন আনন্দ পাব না।
এই বলে সেই বৃক্ষতল হতে তার স্বামীর সন্নিধানে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল ঈভ। কিন্তু যাবার আগে যে অলৌকিক বৃক্ষ দেবতাদের পানীয় অমৃত থেকে তার প্রাণরস আহরণ করে, তার অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি নত হয়ে শ্রদ্ধা জানাল।
এদিকে আদম সর্বক্ষণ ঈভের প্রত্যাগমন কামনায় উন্মুখ হয়ে অধীর আগ্রহের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছিল তার। তার একক শ্রমকে সম্মানিত করার জন্য উপহারস্বরূপ তার গলদেশকে শোভিত করবে বলে বাছাই করা বিচিত্র ফুল দিয়ে একখানি মালা গেঁথে রেখে দিয়েছিল সযত্নে। চাষীরা প্রায়ই ফসলের রানী বা দেবীর উদ্দেশ্যে এমনি করে মালা গেথে রাখে।
ঈভের দীর্ঘ বিলম্বিত প্রত্যাবর্তনে কতখানি আনন্দ ও সান্ত্বনা লাভ করবে আদম শুধু একা একা সেই কথাই ভাবছিল। তবে সেই সঙ্গে এক অজানিত আশঙ্কা মনটাকে পীড়িত করছিল তার।
এইসব ভাবতে ভাবতে আজ সকালে তার কাছে বিদায় নিয়ে যে পথে গিয়েছিল ঈভ সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল আদম। যেতে যেতে জ্ঞানবৃক্ষের কাছে আসতেই ঈভের দেখা পেয়ে গেল। তখন সবেমাত্র সেই জ্ঞানবৃক্ষের তলা থেকে ফিরছিল ঈভ। তার হাতে ছিল কতকগুলি উজ্জ্বল ফলে ভরা একটি সদ্যভগ্ন শাখা। অমৃতের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে।
ঈভ বলল, আমার দেরি হওয়াতে তুমি হয়ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলে। তোমার সাহচর্য হতে বঞ্চিত হওয়ায় তোমার অভাবটাকে দীর্ঘ মনে হচ্ছিল আমার। বিরহের বেদনা আজকের মত আর কখনো অনুভব করিনি। তবে এই শেষ। এ ভুল আর কখনো করব না আমি। বিচ্ছেদের বেদনা আর কখনো অনুভব করতে হবে না কাউকে। আর আমি হটকারিতার সঙ্গে আমার শক্তি পরীক্ষার জন্য আর কোথাও যাব না তোমাকে ছেড়ে।
তবে আমার বিলম্বের কারণটা বড় অদ্ভুত। আশ্চর্য হয়ে যাবে তা শুনে। আমাদের যা বলা হয়েছিল তা কিন্তু সত্য নয়। এই বৃক্ষের ফল আস্বাদন মোটেই বিপজ্জনক নয়। এ ফল ভক্ষণ করলে অজানিত কোন অশুভ শক্তি মুখব্যাদান করে গ্রাস করতে আসে না। বরং যারা এ ফল আস্বাদন করে তাদের দেবতাদের মত জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়ে যায়। একটি সর্প এই ফল ভক্ষণ করে মরেনি বরং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মত জ্ঞান ও কণ্ঠস্বর লাভ করেছে। অথচ আমাদের মৃত্যুভয় দ্বারা শাসানো হয়েছিল।
সর্পটি মানুষের মত যুক্তি খাড়া করে এমনভাবে ফলের গুণ সম্বন্ধে বোঝাতে লাগল যে আমিও এই ফল ভক্ষণ করে দেখলাম তার কথাই ঠিক। আমার জ্ঞানচক্ষু সত্যিই খুলে গেল। মনের তেজ বেড়ে গেল। আমার অন্তর প্রসারিত হলো। আমি দেবতাদের মত হয়ে উঠলাম। তখন তোমার কথা মনে পড়েছিল, কারণ যে সুখে তোমার অংশ নেই, সে সুখ তুচ্ছ আমার কাছে।
সুতরাং তুমিও এ ফল আস্বাদন করো। দুজনের ভাগ্য, আনন্দ, প্রেম এক হোক। আমাদের দুজনের মধ্যে যেন কোন পার্থক্য বা তারতম্য না থাকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে দুজনেই আমরা সমান দুঃখ ভোগ করব।
ঈভ তার গণ্ডদ্বয়কে আনন্দে উজ্জ্বল করে এই কথা বলল। কিন্তু অচিরেই সে গণ্ডদ্বয় ম্লান হয়ে গেল।
এদিকে আদম ঈভের এই মারাত্মক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের কথা শুনে বিস্ময়ে ও বেদনায় অভিভূত হয়ে পড়ল। প্রাণহীন প্রস্তরস্তম্ভের মত শূন্যদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল সে। এক হিমশীতল ভয়ের স্রোত শিরায় শিরায় বয়ে যেতে লাগল তার। ঈভকে পরাবার জন্য যে মালাটি হাতে ছিল তার, সে মালাখানি মাটিতে পড়ে গেল তার হাত থেকে।
অবশেষে সে সেই অস্বস্তিকর নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, হে সকল সৌন্দর্যের রানী, সব বিশ্বের সকল বস্তুর সারভৃতা সত্তা! আজ মুহূর্তের মধ্যে কিভাবে সকল মহিমা হারিয়ে ফেললে তুমি! আজ তুমি সকল সৌন্দর্য ও সকল সম্মান হতে বিচ্যুত হয়ে নিজের মৃত্যুকে নিজেই ডেকে আনলে। আজ তোমার সত্তার সকল মহিমা অপগত! কেমন করে লোভের বশবর্তী হয়ে ভুলে তুমি নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করলে? কেমন করে কোন্ সাহসে ঈশ্বরের নিষেধাজ্ঞা লঙঘন করলে? নিশ্চয় কোন অজাতশত্রু অলক্ষ্যে থেকে প্রভাবিত করেছে তোমাকে। নিজের সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার সর্বনাশ নিয়ে এলে। কারণ তোমার সঙ্গে আমিও মৃত্যুবরণ করার জন্য দৃঢ়সংকল্প।
তোমাকে ছাড়া কি করে আমি বাঁচব? তোমার মধুর কথাবার্তা, তোমার গভীর ভালবাসা, তোমার অবিরাম সাহচর্য সব হারিয়ে কেমন করে একা থাকব আমি এই বিশাল অরণ্যপ্রদেশে?
ঈশ্বর কি আর এক ঈভ সৃষ্টি করবেন আমার আর একটি পাঁজর থেকে? লু আমার অন্তর থেকে তোমার অন্তরের ক্ষত মুছে যাবেনা কখনো। হে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার অস্থিমজ্জার আর এক প্রতিমূর্তি, একই প্রকৃতির দ্বারা অবিচ্ছেদ্যভাবে আবদ্ধ আমরা। সুখ-দুঃখ যাই হোক, আর কখনই আমরা বিচ্ছিন্ন দ্য না পরস্পরের কাছ থেকে।
এই কথা বলে কিছুটা সান্ত্বনা পেল আদম। এরপর ঈভের দিকে ঘুরে আবার শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগল, হে দুঃসাহসী ঈত, তুমি ঐ নয়নমনোস্ত্র পবিত্র ফল আস্বাদন করে এক বিপজ্জনক কাজ করেছ। যে ফল স্পর্শ করা নিষিদ্ধ তা তুমি ভক্ষণ করেছ। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা আর ফিরবে না। হয়ত ঈশ্বর বা নিয়তি সর্বশক্তিমান নয়। হয়ত তুমি মরবে না। কাজটা হয়ত যতটা ভয়ঙ্কর ভেবেছিলে ততটা ভয়ঙ্কর নয়। সর্প তোমার আগেই সে ফল ভক্ষণ করায় সে ফল তার অলৌকিকত্ব হারিয়ে সাধারণের ভক্ষ্য হয়ে উঠেছে। তুমি বলছ সে এখনো জীবিত আছে এবং পশু হয়ে বাকশক্তি লাভ করেছে মানুষের মত। তাহলে এ ফল ভক্ষণ করে আমরাও সেই অনুপাতে উন্নততর জীবন লাভ করতে পারি। দেবতা অথবা দেবতার সমান দৈবীশক্তি লাভ করতে পারি। পরম স্রষ্টা ঈশ্বরের মত সর্বজ্ঞ আমাদের যতই ভীতি প্রদর্শন করুন ধ্বংস করবেন বলে, তিনি নিশ্চয়ই তাঁরই সৃষ্ট জীব আমাদের ধ্বংস করবেন না। শেষ পর্যন্ত। আমরা হচ্ছি তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, উদার মর্যাদাসম্পন্ন। আমাদের যদি পতন হয় তাহলে যে কাজের জন্য ঈশ্বর আমাদের নিযুক্ত করেছেন, সে কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। তাহলে ঈশ্বরকে নিজের হাতে তাঁর সৃষ্টিকে ধ্বংস করে তার সমস্ত শ্রমকে ব্যর্থ করে দিতে হবে নিজের হাতে। ঈশ্বর সম্বন্ধে এমন ধারণা আমরা পোষণ করতে পারি না। আবার নূন করে কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা ঈশ্বরের আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের উচ্ছেদসাধন করতে নিশ্চয়ইরমন চাইবেনা। তাহলে তার প্রতিপক্ষের জয় হবে এবং সে বলবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ কত চঞ্চল, কত অস্থায়ী। তিনি প্রথমে আমাকে ধ্বংস করে পরে মানবজাতিকে ধ্বংস করবেন। এরপর কাকে ধ্বংস করবেন? এইভাবে তাঁকে ঘৃণা করার সুযোগ তিনি ভঁর শত্রুকে দেবেন না নিশ্চয়। আমি তোমার সঙ্গে আমার ভাগ্যকে নির্ধারিত করে ফেলেছি। মৃত্যু বা ধ্বংসের অভিশাপ যদি নেমে আসে তাহলে দুজনে একসঙ্গে তা ভোগ করব। তোমার যদি মৃত্যু হয় তাহলে সে মৃত্যু জীবনে খুবই বরণীয় হয়ে উঠবে আমার কাছে। প্রকৃতির এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে এমনভাবে আবদ্ধ আছি আমরা যে আমাদের মধ্যে কেউ সে বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। আমরা হৃদয়ে এক, একই রক্তমাংসে গঠিত। তোমাকে হারানো মানেই আমার নিজেকে হারানো।
আদম এই কথা বললে ঈভ তাকে বলল, তোমার প্রেমাতিশয্যের কী অপূর্ব পরীক্ষা, কী উজ্জ্বল ও উচ্চমানের দৃষ্টান্ত! কিন্তু তোমার পূর্ণতার অংশ কেমন করে আমি লাভ করব আদম যাতে আমি তোমার পার্শ্বদেশ থেকে উদ্ভূত হয়েছি একথা আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি? তুমিই এমনি আমাদের অচ্ছে মিলনের কথা বললে। তোমার সংকল্পের কথা ঘোষণা করে আমাদের মিলন কত নিবিড় তার প্রমাণ দিলে। মৃত্যু বা মৃত্যুর থেকে ভয়ঙ্কর কোন শক্তিই আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। তুমি আমার প্রতি এক গভীর ভালবাসার বন্ধনে এমনভাবে বিজড়িত হয়ে আছ যে, এই ফল ভক্ষণের জন্য যদি কোন অপরাধ বা পাপ হয়ে থাকে আমার তাহলে সে অপরাধ ও সে পাপের শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি আছ তুমি। আজ এই ফলের আস্বাদ এক মহা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রেমের গুণ ও শক্তিকে অভ্রান্তভাবে প্রমাণ করে দিল যার কথা এর আগে কখনো জানতে বা বুঝতে পারিনি আমরা।
যদি তুমি তোমার প্রেমের এই সততা ও বিশ্বস্ততার কথা আজ এমন ভাবে ঘোষণা না করতে তাহলে আমার এই ফলভক্ষণের ফলে মৃত্যু এসে ভয়াবহরূপে উপস্থিত হলে আমি পরিত্যক্ত অবস্থায় একাকী সে মৃত্যুকে বরণ করে নিতাম। তোমার জীবনের শান্তিকে বিঘ্নিত করে তোমাকে আমার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করতে কোনভাবে প্ররোচিত করতাম না।
কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে আসল ঘটনা তা নয়। আমি ভাবছি অন্য কথা। কোন মৃত্যু নয়, এক পূর্ণ ও পরিণত জীবনের রূপ লাভ করতে চলেছি আমরা। এই ফলের স্বর্গীয় আস্বাদ আমার জ্ঞানচক্ষুকে উন্মীলিত করে দিয়েছে, এক নূতন আশা ও আনন্দের দিগন্তকে উন্মোচিত করে দিয়েছে আমাদের সামনে। সুতরাং আমার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে হে আদম, তুমিও এ ফল অবাধে ‘আস্বাদন করো। সমস্ত মৃত্যুভয় বাতাসে উড়িয়ে দাও।
এই কথা বলে আদমকে আলিঙ্গন করল ঈভ। আনন্দাশ্রু ঝরে পড়তে লাগল তার চোখ থেকে। আজ আদম তার প্রেমকে এক মহত্তর সুমন্নতি দান করেছে, সে তার সেই প্রেমের খাতিরে সমস্ত ঐশ্বরিক রোষ ও মৃত্যুকে বরণ করে নিতে চেয়েছে, এ কথা ভেবে আনন্দের সঙ্গে এক বিরল গর্ব অনুভব করল সে।
ঈভ জ্ঞানবৃক্ষের শাখাসহ যে ফল এনেছিল সে ফল সে উদার হাতে আদমকে দান করল। ঈভের থেকে সে অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী হলেও কোন কুণ্ঠা না করেই সে ফল খেয়ে নিল, ঈভের নারীসুলভ সৌন্দর্য ও সুষমায় সহজেই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ল সে।
পৃথিবীর নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত প্রবলভাবে কম্পিত হয়ে উঠল। সমগ্র প্রকৃতি যন্ত্রণায় দ্বিতীয়বার আর্তনাদ করে উঠল। মানবজাতির পাপ পূর্ণ হওয়ায় আকাশ বজ্রবৃষ্টিসহ অশ্রুবিসর্জন করতে লাগল।
আদম কিন্তু এ সব কিছুই জানল না। সে শুধু পেট ভরে তৃপ্তির সঙ্গে ফল খেয়ে যেতে লাগল। ঈভও আর তার নিষেধাজ্ঞা-লঙ্ঘনের কোন ভয় করল না। সে শুধু তার প্রেমময় সাহচর্যের দ্বারা সান্ত্বনা দিয়ে যেতে লাগল তার স্বামীকে। এক নৃতন মদ্যপানের ফলে মত্ত হয়ে এক উচ্ছল আনন্দের স্রোতে সাঁতার কাটতে লাগল যেন তারা। তাদের মনে হলো, যেন তারা এক দৈবশক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছে সেই নিষিদ্ধ ফল খেয়ে। এই পৃথিবীকে উপেক্ষা করে পাখা মেলে তারা যেন উড়ে যেতে পারবে আকাশে।
কিন্তু সেই নিষিদ্ধ ছলনাময় ফল ভক্ষণের প্রতিক্রিয়া শুরু হলো এবার। প্রথমে তাদের মোহগত জ্বলন্ত কামনাকে বাড়িয়ে দিল। আদম ঈভের পানে সকাম দৃষ্টিতে তাকাল। ঈভও সে দৃষ্টির প্রতিদান দিল। কামনার আগুনে জ্বলতে লাগল তারা।
আদম এবার ঈভকে বলল, ঈভ, তুমি যা বলেছ তা সব ঠিক। আজ তুমি যে আমাকে আস্বাদ দিলে তার জন্য তোমার প্রশংসা না করে পারছি না। এতদিন এই উপাদেয় ফল আস্বাদন না করে জীবনের কত আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমরা। আজ প্রথম আস্বাদন করে এর গুণ জানতে পারলাম। এই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে যদি এত আনন্দ পাওয়া যায় তাহলে সব ফলই নিষিদ্ধ হোক।
এখন তৃপ্তির সঙ্গে আহার করার পর দুজনে নর্মক্রীড়া করিগে চল। তোমাকে প্রথম দেখা ও বিবাহ করার পর থেকে তোমার রূপ-লাবণ্য এতখানি নিখুঁত ও পরিপূর্ণ বলে মনে হয়নি আমার। এই ফলের গুণেই যেন অনেক গুণ বেড়ে গেছে তোমার দেহসৌন্দর্য। সে সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য আজ এক অদম্য কামনার জ্বালা অনুভব করছি আমার মনে।
এই কথা বলে আর কোন ভণিতা না করে ঈভের হাত ধরে এক ছায়াচ্ছন্ন নিঝরিণীর তটভূমিতে নিয়ে গেল আদম। সে বেশ বুঝতে পারল যে কামনার আগুনে তার মনপ্রাণ জ্বলছে সে আগুন ঈভের মধ্যেও জ্বলছে, সে আগুনের আত্মা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার চোখে-মুখে।
সেই তৃণাচ্ছাদিত তটভূমির উপর, ভায়োলেট, এ্যাসফোডেল, হায়াসিনত্ প্রভৃতি ফুলের আস্তরণ পাতা ছিল কোমল শয্যার মত, তাদের মাথার উপরে ছিল ঘনসন্নিবদ্ধ বৃক্ষপত্রের সবুজ চন্দ্রাতপ। সেইখানে দুজনে শুয়ে প্রাণভরে সুরতক্রিয়ায় মত্ত হয়ে উঠল তারা। তাদের সকাম প্রণয়লীলার উচ্ছ্বসিত প্রবলতার দ্বারা তাদের পাপবোধকে মুছে দিতে চাইল, যেন ক্রমে এক নিবিড় রতিক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল তারা।
সেই ভ্রান্ত ফল তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এক নির্দয় বাষ্প উদগীরণের দ্বারা তাদের মত্ত করে তুলে তাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে বার করে আনে। তাই তারা দারুণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
ঘুম থেকে উঠে পরস্পরের পানে তাকাল তারা। তাদের জ্ঞানচক্ষু যে উন্মীলিত হয়েছে তা তারা এবার বুঝতে পারল। এক কুটিল কালিমায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তাদের মন। যে নিষ্পাপ সরলতা তাদের মনকে আবৃত করে রাখায় কোন কিছুতে অশুভ বা মন্দ কিছু দেখতে পেত না তারা, সে সরলতা অপগত হলো। ফলে এক সহজাত আত্মবিশ্বাস, ন্যায়নীতি ও মর্যাদাবোধ জেগে উঠল তাদের মধ্যে। তাদের দেহের নগ্নতায় লজ্জাবোধ করল তারা।
সঙ্গে সঙ্গে গাছের পাতা নিয়ে তার গোপনাকে আবৃত করল আদম। কিন্তু তাতে আরো প্রকট হয়ে উঠল তার নগ্নতা। এমন সময় চৈতন্য হলো আদমের। একদিন স্যামসন যেমন তার সব শক্তি হারিয়ে ব্যভিচারিণী নাস্তিক ডেলাইলার অঙ্কদেশ হতে উঠে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি গুণবর্জিত হয়ে উঠল আদম।
হতবুদ্ধি হয়ে ম্লান মুখে বসল তারা। বজ্রাহতের মত স্তম্ভিত বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইল। অবশেষে আদম ঈভের মত লজ্জায় অপ্রতিভ হয়ে বলল, হে ঈত, এক অভিশপ্ত মুহূর্তে তুমি সেই কপট কুটিল প্রাণীর ছলনায় মুগ্ধ হয়ে তার কথায় কান দিয়েছিলে। মানুষের নকল কণ্ঠস্বরে ভুল শিক্ষা দিয়েছিল সে তোমাকে। সত্য হয়ে উঠল আমাদের পতন, মিথ্যা হয়ে উঠল আমাদের উন্নতির আশ্বাস। আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়-অন্যায় বোধ জাগল আমাদের মধ্যে কিন্তু ন্যায়কে বর্জন করে শুধু অন্যায় ও অশুভকে গ্রহণ করলাম আমরা। এই যদি জ্ঞানের অর্থ হয় তাহলে এই জ্ঞানের ফল কত বিষময়। সরলতা, সততা, নির্দোষিতা, ধর্মবিশ্বাস, শুচিতা প্রভৃতি যে সব গুণগুলি আমাদের মনের অলঙ্কারস্বরূপ ছিল সেইসব গুণগুলিকে এই জ্ঞান কলুষিত, এ মন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় আমরা একেবারে নগ্ন হয়ে পড়েছি গুণের দিক থেকে। এক অশুভ লজ্জার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের। চোখে-মুখে। এই মুখ নিয়ে আমি কি করে ঈশ্বর অথবা দেবদূতের মুখ দেখব? যে বিশুদ্ধ অনাবিল আনন্দের আবেগ ছিল আমার মনে তা আজ কোথায়? সেইসব দেবদুতেরা এবার থেকে তাদের অত্যুজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা আমার এই পার্থিব চোখের সব দৃষ্টিকে অভিভূত করে দেবে। আমি তাদের সেই জ্যোতিকে সহ্য করতে পারব না।
হায়, আমি যদি এই নির্জন বনের গভীরতর কোন দুর্গম প্রদেশ যেখানে সূর্য বা কোন নক্ষত্রের আলো প্রবেশ করতে পারে না সেখানে বন্য পশুর মত জীবন যাপন করতে পারতাম তাহলে হয়ত ভাল হত। হে বনস্পতিবৃন্দ, হে দেবদারু ও পাইন বৃক্ষ, তোমরা তোমাদের পত্রবহুল শাখা-প্রশাখাদ্বারা আমাকে এমনভাবে ঢেকে রাখ যাতে আমি আর কখনো দেবদূতদের মুখ দেখতে না পাই।
এরপর আদম ঈভকে বলল, এখন আমাদের এই দুরবস্থার মধ্যে একটা উপায় খুঁজে বার করো যাতে আমাদের দেহের যে সব অংশগুলি পরস্পরের চোখে সবচেয়ে লজ্জাজনক বলে মনে হচ্ছে সেগুলি ঢেকে রাখতে পারি। কোন গাছের চওড়া পাতাগুলিকে সেলাই করে কৌপীণের মত পরে আমরা কটিদেশদুটিকে ঢাকতে পারি যাতে নবাগত লজ্জা আর সেখানে গিয়ে বসতে না পারে।
এই পরামর্শ দিল আদম। তারপর তারা দুজনে বনের গভীরে চলে গেল। সেখানে গিয়ে তারা একটি বিরাট বটবৃক্ষ বেছে নিল। সুপ্রাচীন বিশাল সেই বটবৃক্ষের দীর্ঘপ্রসারিত শাখাপ্রশাখাগুলি মাটিতে নুইয়ে পড়ে শিকড় গেড়ে বসে গিয়েছিল এবং তাদের থেকে আবার নূতন করে বটবৃক্ষ উগত হয়েছিল। এইসব বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় মালাবার ও ভারতের গোচারণরত রাখালরা খরতপ্ত দ্বিপ্রহরে আশ্রয় নেয়।
সেই বটবৃক্ষের কতকগুলি চওড়া পাতা পেড়ে সেগুলিকে তারা সেলাই করে তাদের কটিদেশ আবৃত করল। এইভাবে তারা তাদের নগ্নতা ও লজ্জা নিবারণের এক ব্যর্থ প্রয়াস পেল। তাদের যে নগ্নতা আগে ছিল গৌরবময়, এখন সে নগ্নতা লজ্জাজনক হয়ে উঠল তাদের কাছে।
কলম্বাস দক্ষিণ আমেরিকা আবিষ্কারকালে উপকূলগুলির বানঞ্চলে যে সব বন্য আদিবাসীদের যেভাবে পালক ও পাতা দিয়ে তাদের কটিদেশকে আচ্ছাদিত করতে দেখেছিলেন, আদম ও ঈভ সেইভাবে তাদের কটিদেশ আচ্ছাদিত করল। কিন্তু এতে তাদের লজ্জা আংশিক নিবারিত হলেও মনে শান্তি পেল না তারা।
তারা দুজনে বসে কাঁদতে লাগল। কিন্তু শুধু কান্না নয়, শুধু দরবিগলিত অবিচল অশ্রুধারা তাদের চোখ থেকে বয়ে যেতে লাগল না, আবেগের ঝড় বয়ে যেতে লাগল তাদের অন্তরে। একদিন তাদের যে শান্ত মনের ভূমিতে অখণ্ড প্রশান্তি বিরাজ করত সতত, আজ ক্রোধ, ঘৃণা, অবিশ্বাস, সংশয় ও অনৈক্য প্রভৃতি বিচিত্র কুটিল আবেগ ঝড়ের বেগে তাদের সে মনোভূমিকে আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত করে সকল শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।
তাদের দুজনের মধ্যে যে পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার ভাব ছিল তা বিনষ্ট হয়ে গেল। ন্যায়নীতি ও ধর্মের অনুশাসন মানতে চাইল না। দুজনেই ইন্দ্রিয়গত ক্ষুধার অধীন হয়ে পড়ল এবং সে ক্ষুধা যুক্তির অবিসংবাদিত প্রভুত্বকে অস্বীকার করে নিজের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করল।
আদমের অন্তরের বিক্ষোভ তার চোখের দৃষ্টি ও ভাবভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে লাগল। সে তখন ঈভকে বলল, সেদিনকার সেই অশুভ সকালে তুমি যদি আমার কথা শুনতে এবং আমি যা চেয়েছিলাম সেইমত আমার কাছে থাকতে তাহলে আমাদের এ অবস্থায় পড়তে হত না। কিন্তু জানি না কিসের মায়া ও মোহে আচ্ছন্ন হয়ে তুমি আমার কথা না শুনেই চলে গেলে। সেদিন আমরা কত সুখে ছিলাম। আর আজ সমস্ত সদগুণ হতে বিবর্জিত হয়ে এক লজ্জাজনক নগ্নতার শিকার হয়ে উঠেছি।
এখন থেকে কেউ যেন অকারণে তার ধর্মবিশ্বাসকে ভঙ্গ করে নিজের পতন নিজেই ডেকে না আনে।
দোষের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ঈভ বলল, তোমার মুখ থেকে কি কঠোর কথাই না নির্গত হলো আদম। তুমি বললে, আমি তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার জন্যই এইরকম হলো। আজ আমার দ্বারা যে বিপর্যয়ের উদ্ভব হলো তা তো তোমার দ্বারাও হতে পারত। আমার মতো তুমি যদি সেখানে একা থাকতে অথবা তুমি যেখানে ছিলে সেখানে যদি সর্প এসে তোমাকে একইভাবে প্ররোচিত বা প্রলোভিত করত তাহলে তুমি তার প্রতারণা বা ছলনাকে ধরতে পারতে না। সেই সর্পের সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা ছিল না। অকারণে সে আমার অমঙ্গলসাধন বা বঞ্চিত করবে তা কেমন করে বুঝব? তোমার কাছ ছেড়ে একা কোথাও যাবার কি কোন স্বাধীনতাই ছিল না আমার? তোমার পার্শ্বদেশের একটি পঞ্জর থেকে আমার জন্ম হওয়ার জন্য আমাকে কি চিরকাল একটি প্রাণহীন স্বাধীনতাহীন পঞ্জর হিসাবেই থাকতে হবে? তাই যদি হয়, আমার জন্য এখন বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তরে কেন তখন আমার যাওয়াকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে কঠোর আদেশ প্রদান করলে না? তোমার সে নিষেধের মধ্যে কঠোরতার অভাব এবং কুণ্ঠা ছিল কেন? তুমি তখন আমার কথায় নরম হয়ে আমাকে যেতে অনুমতি দিয়েছিলে। আমাকে সমর্থন করেছিলে। কিন্তু তখন যদি তুমি কঠোর এবং তোমার অসম্মতিতে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে তাহলে ঐশ্বরিক নিষেধাজ্ঞা আমি লঙ্ঘন করতাম না এবং আমার মনে হয় তুমিও তা করতে না।
আদম তখন রুষ্ট হয়ে বলল, হে অকৃতজ্ঞ ঈভ, এই কি আমার প্রেমের প্রতিদান? এই কি তোমার ভালবাসা? তোমার যখন পতন হয় তখন আমি আমার প্রেমকে অপরিবর্তনীয়রূপে ঘোষণা করেছিলাম। আমি তো তোমাকে ছেড়ে পরম সুখে আমার জীবন যাপন করতে পারতাম। কিন্তু তা না করে স্বেচ্ছায় তোমার সঙ্গে মৃত্যুকেই বরণ করে নিই। অথচ এখন আমাকেই তুমি তোমার ঐশ্বরিক বিধান লঙ্ঘনের কারণ বলে ভর্ৎসনা করছ?
অবশ্য তখন তোমাকে খুব কঠোরভাবে সংযত করিনি। কিন্তু আর কি আমি করতে পারতাম? আমি তোমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। মৃদু তিরস্কার করেছিলাম। বিশ্বাসের কথা বলেছিলাম। যে শত্রু সুযোগের অপেক্ষায় ওৎ পেতে বসে আছে তার কথাও বলেছিলাম। তোমার স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করতে বারবার নিষেধ করে দিয়েছিলাম।
কিন্তু অতিমাত্রিক আত্মবিশ্বাসে প্রবৃত্ত হয়ে কোন কথা না শুনে তুমি চলে গেলে। হয়ত ভেবেছিলে নিষিদ্ধ ফল খেলে কোন বিপদই হবে না অথবা তাতে কি হয় তা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলে।
অবশ্য আমিও তখন তোমার ভ্রান্ত পূর্ণতার লক্ষণ দেখে অতিমাত্রায় তোমার প্রশংসা করে ভুল করেছিলাম। ভেবেছিলাম এতে কোন বিপদ হবে না। এখন আমি আমার এই কাজের জন্য অনুশোচনা করছি। এটাই হলো আমার অপরাধ আর এই অপরাধে এখন তুমি অভিযুক্ত করছ আমাকে।
নারীদের উপর অতিরিক্ত আস্থা স্থাপন করে তাদের ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে পুরুষেরা ভবিষ্যতে এই অপরাধই বারবার করবে। কোন সংযম বা অনুশাসন নারী মানবে না। পরে নিজের ইচ্ছায় ক্ষয় হয়ে বিপদে পড়বে। পুরুষের দুর্বলতা বা প্রশ্রয়কে দায়ী করে অভিযুক্ত করবে তাকে।
এইভাবে পরম্পরকে অভিযুক্ত করে দুঃখের সঙ্গে কালযাপন করতে লাগল তারা। কেউ নিজের দোষ দেখল না, নিজেকে ধিক্কার দিল না। আত্মপ্রতিষ্ঠার চেষ্টাজনিত এই দ্বন্দ্বের কোন শেষ ছিল না।