৮। বার্তা
‘গতরাত্রে এক বড়ই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি রাজন। এমন কিছু আগে দেখিনি কখনও। দেখলাম কুন্দিনাপুরী নগর ধ্বংস হয়ে গেছে। পথের মধ্যে পুরুষ, নারী, শিশুর মৃতদেহ। এই রাজপ্রাসাদ ভেঙে পড়েছে। প্রাসাদের সামনে দুটি সুউচ্চ স্তম্ভ যেন কোনও মন্ত্রবলে তৈরি হয়ে গেছে। স্তম্ভের গাত্রে খোদাই করা আছে দুই সিংহকে। হিংস্র তাদের মুখ, কেশরগুলি গুটিয়ে রয়েছে। সিংহের পিঠে ঈগলের মতো ডানা। সিংহের মুখে আবার মানুষের মতো শ্মশ্রুগুম্ফের অবস্থান। এমন ভয়ানক স্বপ্ন দেখেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন ভোর রাত। তারপর আমি লোপামুদ্রা এবং উপলকে এই দুঃস্বপ্নের কথা বলি।’
এইখানে অগস্ত্যকে থামিয়ে দিয়ে উপল বলে, ‘মহর্ষি অগস্ত্য স্বপ্নে যা দেখেছেন তা আংশিক সত্যি। মহাদেবের আশীর্বাদে কুন্দিনাপুরী এখনও সুরক্ষিত। কিন্তু অগস্ত্যর দেখা সিংহগুলি বাস্তবিকই আছে। আমি নিজের তাদের চাক্ষুস করেছি।’
‘কী বলছেন! এমন অদ্ভুত দর্শন জন্তু এই পৃথিবীতে আছে!’
‘না রাজা, এই জীব মানুষের কল্পনার ফসল, এর শরীরে প্রাণ নেই। অসিরিয় সভ্যতার যে পুরাণ তাতে এই জীবের উল্লেখ আছে। অসিরিয়দের রাজধানী কাহলু নামের এক শহর। সেই শহরে আমি বাণিজ্যের উদ্দেশে বেশ কিছুবার গমন করেছি। শহরের প্রবেশ দ্বারের দু’পার্শ্বে শ্বেতশুভ্র পাথর দিয়ে তৈরি এর বিকট দর্শন মূর্তি দুটিকে দেখেছি আমি।
‘তাহলে অগস্ত্য স্বপ্নে কীভাবে তাদের দেখলেন?’
অগস্ত্য মন্দ্র স্বরে বলল, ‘এর কারণ আমার বোধের বাইরে রাজা। অসিরিয়দের দেশে আমি কখনও যাইনি। তাদের রাজধানীর এমন মূর্তির গল্পও আমি শুনিনি কখনও। অথচ স্বপ্নে যেন আমি তাদের স্পষ্ট দেখতে পেলাম!’
বাইরে সূর্যের প্রথম কিরণ যখন হয়তো সবেমাত্র এই পৃথিবীকে স্পর্শ করেছে তখনই রাজা বসুমানের শয়নকক্ষের দরজায় অস্থির আঘাতের শব্দ শোনা যায়। নিদ্রাজড়িত চোখে রানি কঙ্কাবতী দরজা খুলে দিলে পর দ্রুতপদে ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে অগস্ত্য, লোপামুদ্রা এবং উপল। তিনজনের চোখে মুখেই উৎকণ্ঠার ছাপ ছিল স্পষ্ট। ততক্ষণে রাজাও ঘুম ভেঙে পালঙ্কের উপরে উঠে বসেছেন। হতচকিত চোখে তিনি তাকিয়েছিলেন অগস্ত্যদের দিকে। বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে অগস্ত্য রাজাকে তার দুঃস্বপ্নের কথা জানায়।
রাজার মুখ এখন গম্ভীর। দিনটির শুরুই হল খারাপ সংবাদ দিয়ে। মহাত্মা অগস্ত্য মিথ্যা কথা বলেন না, তিনি ঈশ্বরের দূত। তার এমন দুঃস্বপ্ন কি বিদর্ভের বুকে অভিশাপকে ডেকে আনবে?
উপল এবার বলল, ‘অগস্ত্যর এমন স্বপ্নকে আমাদের তরল ভাবে গ্রহণ করা সমীচিন হবে না। স্বয়ং মহাদেব, যিনি এই কুন্দিনাপুরীর রক্ষাকর্তা, তিনিই হয়তো মহর্ষির চেতনায় এই বার্তা এনে দিতে চেয়েছেন। অসিরিয়দের আমি চিনি। এই পৃথিবীতে তাদের তূল্য যুদ্ধবাজ আর কেউ নেই। সামান্য কারণবশত পাশের রাষ্ট্রে রক্তের নদী বইয়ে দিতে দু-দণ্ডও ভাবে না তারা।
অসিরিয়দের রাজা এখন এনলিল-নাসির। সাম্রাজ্য বিস্তারে তাঁর বিশেষ আগ্রহ। রাজা হওয়ার প্রথম তিন বছরের মধ্যেই তিনি মিতানি এবং হিতাইতদের হারিয়ে তাদের ভূখণ্ডের দখল নিয়েছেন। কয়েকবছর আগে যখন আমি কাহলু শহরে উপস্থিত হই তখন একটি ব্যাপার আমাকে অবাক করেছিল। রাজা বিশাল অর্থব্যয়ে বেশ কিছু রণতরী বানাচ্ছিলেন। অথচ কাহলু শহর থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী নৌচলাচল যোগ্য নদীটিও শত যোজন দূরে, তবে সেই নদী পথে সমুদ্রে এসে পড়া যায়। আমার আশঙ্কা যদি সত্য হয় তাহলে রাজা ভারতবর্ষ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
উপলের এমন কথায় বসুমানের হৃদয় কম্পিত হল। অসিরিয়দের হিংস্রতার কথা তিনি আগে বহুবার শুনেছেন। তাদের সৈন্যদল নাকি যে পথে গমন করে সেই পথে একটি জীবের শরীরেও আর প্রাণ থাকে না। বসুমান বললেন, ‘কিন্তু কুন্দিনাপুরীই কেন? এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে সম্রান্তশালী রাজ্য দুটি হল মগধ এবং কোশল। ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে তো অসিরিয় রাজাকে সেই রাজ্যদুটিকে জয় করতে হবে।’
‘আপনার কথা সম্পূর্ণ সঠিক রাজা। কিন্তু অসিরিয়রা জলপথে এলে কোন পথে ভারত আক্রমণ করবে ভেবে দেখুন। সোপারার বন্দরের দিকে লক্ষ তাদের। সেখানে পৌঁছনোর পর প্রথম বড় রাজ্য তো এই বিদর্ভই। মহারাজ বসুমানের সৈন্যদলের সাহস এবং শৌর্যের প্রতি বিন্দুমাত্র অসম্মান না করেই বলছি, অসিরিয়দের অযুত লক্ষ দানবিক সেনাদের সামনে তারা তুচ্ছ। বিদর্ভ ধ্বংস করেই রাজা এনলিল উত্তরে অগ্রসর হবেন। মগধ এবং কোশলের পতন তখন কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা।’
উপলের কথা শুনতে শুনতে রাজা বসুমান অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন। তাঁর শির ছিল মাটিতে নিবদ্ধ, এবার মাথা তুলে উপলের দিকে চাইলেন, ‘তাহলে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আমি আজই আমার সেনাধিপতি রৌরবের সঙ্গে আলোচনায় বসব। উত্তরের রাজ্যগুলিতেও দ্রুত খবর পাঠাতে হবে। যদি আমরা সব শক্তিকে একত্র করতে পারি তাহলে অসিরিয়দের আটকানো সম্ভব হবে বলে কি আপনার মনে হয় না?’
‘না রাজন।’
অগস্ত্য দু’পা এগিয়ে এল, ‘সেই মহাযুদ্ধে ভারতভূমির জয় হবে কি না তার উত্তর একমাত্র সময়ই দিতে পারবে। আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। কিন্তু একটি ব্যাপার নিশ্চিত। যুদ্ধে লক্ষ মানুষের রক্ত ঝরবে। বেশ কিছু শহর ধ্বংস হবে, কত ধন সম্পত্তির যে ব্যয় হবে এই যুদ্ধের কারণে তার কোন হিসাব থাকবে না। একবার ভেবে দেখুন রাজন, এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হলেও বিদর্ভের সমৃদ্ধি কি ক্ষুণ হবে না? অগনিত প্রাণক্ষয়ের মূল্যধারণ কি আদৌ সম্ভব?’
‘তাহলে তোমার কী প্ৰস্তাব?’
‘কূটনীতি। উন্মত্ত হস্তীর সম্মুখীন হলে আত্মরক্ষার তাগিদে সর্বশক্তি দিয়ে তাকে আক্রমণ করার প্রয়োজন হয় বটে, কিন্তু বুদ্ধিমান মাহুত সুকৌশলে তাকে শান্ত করে, কেবলমাত্র তার হাতে থাকা ছোট্ট শূলটির মাধ্যমে। আপনি আমাকে একটা সুযোগ দিন। উপল অসিরির পথ চেনে।
‘আমি তার সঙ্গে সেই দেশে যাই রাজদূত হিসাবে। রাজা এনলিলের সঙ্গে ভারতভূমির সন্ধিস্থাপনের চেষ্টা করি। যদি কূটনৈতিক পদ্ধতিতে দু’দেশের সদ্ভাব বজায় রাখা যায় তাহলে তার চেয়ে উত্তম তো আর কিছু হয় না, আর যদি রাজা এনলিল আমার প্রস্তাবকে উপেক্ষা করেন তাহলে যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবীই ধরে নেওয়া যাবে না হয়। কিন্তু একবার চেষ্টা করা যাক।’
‘কিন্তু মহর্ষি, তারা যদি আপনার কোন ক্ষতি করে?’
‘তা হবে না রাজা,’ উপল বলল, ‘অগস্ত্যের চমৎকারী কার্যকলাপের কথা সাগর পেরিয়ে অসিরিয়দের কাছেও পৌঁছেছে। তারা মহাজ্ঞানী অগস্ত্যের প্রাণনাশের কথা স্বপ্নেও ভাববে না। আর তা ছাড়া রাজা এনলিল নির্মম হলেও বর্বর নন। বিদর্ভের রাজদূতের ক্ষতি সাধন তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন না।
‘কিন্তু সে চাইলেই তো অগস্ত্যকে বন্দি করে রাখতে পারে।’
‘হুম, তার একটা সম্ভাবনা আছে বটে, সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ ব্যতীত আর কোন উপায় থাকবে না।’
‘আচ্ছা, তবে তাই হোক।’
ইরতেনসেনু এতক্ষণ ওই ঘরেই ছিল, সে চুপ করে শুনছিল সব কথা। এবার মুখ খুলল, ‘পিতা, এই যাত্রায় আমিও অগস্ত্যর সঙ্গী হতে চাই। ও এমন দুরূহ অভিযানে থাকা কালীন আমি এখানে এই প্রাসাদে আরামে নিশ্চিন্ত দিনযাপন করতে পারব না। আমি ওদের সঙ্গে অসিরি যাব, কিন্তু রাজধানীতে প্রবেশের আগে ছদ্মবেশ ধারণ করে শহরের জনগনের মধ্যে মিশে থাকব। যদি দেখি অগস্ত্য এবং উপল রাজা এনলিলের প্রাসাদে প্রবেশের একদিন পরেও বাইরে আসছে না, তখন আমিই আপনার কাছে দ্রুত খবর পাঠাব।’
রাজা মৌন থেকে শুধু মাথা সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালেন। লোপামুদ্রাকে তিনি কোন কর্মে বাধা দেন না। তিনি জানেন এই কন্যাটি বুদ্ধিমতি। অসিচালনা এবং অশ্বারোহে বিশেষ পারদর্শীও বটে। মহর্ষি অগস্ত্যর তুলনায় কোন অংশে সে কম নয়। নিজের আত্মরক্ষা সে নিজেই করে নিতে পারবে।
অগস্ত্য এবং লোপামুদ্রা রাজাকে অভিবাদন জানিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। তাদের পিছন পিছন উপলও বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার কাছে এসে ঘুরে দাঁড়াল, তারপর কয়েক পা এগিয়ে গেল রাজার দিকে। প্রণাম জানিয়ে করজোড়ে বলল, ‘আমরা আর কিছুক্ষণ পরেই যাত্রা করব রাজন। তার আগে আমার কিছু বলার ছিল।’
‘নির্ভয়ে বলুন উপল। যাত্রাপথে আপনাদের যে কোন রকমের প্রয়োজনের জন্য রাজকোষ উন্মুক্ত।’
‘না, আপনার আশীর্বাদে যশ-অর্থের অভাব নেই আমার। তবে অন্য কিছু চাওয়ার ছিল। আপনার কাছে আমার একটি বর প্রাপ্য আছে।’
‘অবশ্যই আছে উপল, আমি ভুলিনি। বলুন কী চান।’
উপল এবার সসঙ্কোচে মাথা নীচু করে বলল, ‘আপনার উষ্ণীষের মণিটি।’
রাজা অবাক হলেন, ‘এ তো আপনিই আমাকে এনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এই পৃথিবীতে এমন রত্ন অতি দূর্লভ।’
‘সত্যই তাই রাজন। এমন নক্ষত্রের তুল্য টুকরোটি আপনার উষ্ণীষেই শোভা পায়। কিন্তু আমি এটি আপনার থেকে ধার চেয়ে নিতে চাই। অসিরির উদ্দেশে যাত্রাপথে একটি বিশেষ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে আমাদের গমন করতে হবে, তিনদিনের পথ মাত্র একদিনেই সাঙ্গ করা সম্ভব হবে সেই পথে গেলে।
‘তবে সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। কেবলমাত্র রাজা এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামীদেরই সেই পথ ব্যবহার করার অনুমতি মেলে। সেই পথের দোরে পাহারা দেয় দোর্দণ্ডপ্রতাপ অসিরিয় সেনাবাহিনী। বিদর্ভের রাজচিহ্ন স্বরূপ আপনার উষ্ণীষের এর মহামূল্যবান রত্নটিকে দেখালে সেই পথ আমাদের জন্য খুলে যাবে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এই যাত্রা শেষে দেশে ফিরেই এটিকে আবার আপনার চরণপ্রান্তে নিবেদন করব। আমার প্রাণ দিয়ে রক্ষা করব রত্নটিকে।’
কোন বাক্যব্যয় না করে রাজা নীলকণ্ঠ রত্নটি উষ্ণীষ থেকে খুলে উপলের হাতে দিলেন। উপল সযত্নে রত্নটিকে একটি কাপড়ে মুড়ে কাপড়টি নিজের কোমরবন্ধে গুঁজে নিল। রাজাকে অভিবাদন জানিয়ে রাজসভা থেকে বেরিয়ে এল উপল। সে জানে এই মণি তার কোন কাজে আসবে না, তবুও অসিরি যাত্রার গল্পের ভিত্তি এতে আরও দৃঢ় হল। সে যখন ঘরে ফিরে এল অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু তখন তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যাত্রার জন্য।
অগস্ত্যর কক্ষে ঢুকেই ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল উপল। তারপর হেসে অগস্ত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বণিকের বুদ্ধিতে কাজ করে কেমন সুফল পেলে দেখলে তো? আজ আমি না থাকলে তোমরা হয়তো মধ্যরাত্রে রাজপুরী ছেড়ে পালানোর কথা ভাবতে। সেই কাজটা কিন্তু মোটেই অগস্ত্যচিত হতো না। তবে তোমার এই অক্লেষে মিথ্যা বলার ক্ষমতা আমাকে বিস্মিত করছে বন্ধু! যত দিন যাচ্ছে ততই যেন তুমি এতে আরও দক্ষ হয়ে উঠছ!’
গতকাল রাত্রের কথা।
নূপুরের আওয়াজ লক্ষ্য করে ঘুরে তাকাতেই অগস্ত্য আর উপল এক নারীকে দেখে দ্রুত পদচারণায় তাদের দিকে এগিয়ে আসতে। নারীদেহটি সামনে এসে দাঁড়াবার পর তাকে চিনতে পারে দুজনে, ইরতেনসেনু। ইরতেনসেনুর চোখে মুখে তখন চাপা অধীরতা লেগে রয়েছে। অগস্ত্য তাকে বলল, ‘কী হয়েছে লোপামুদ্রা? তুমি এত রাতে এখানে? আমরা আবাসকক্ষের দিকেই আসছিলাম, রাজার সঙ্গে অষ্টপদ খেলতে গিয়ে দেরি হল।’
ইরতেনসেনু একবার অগস্ত্য এবং উপলের চোখের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলার খুব প্রয়োজন।’
তাড়া যে আছে তা অগস্ত্য বুঝতেই পেরেছিল। অন্যসময় তাকে ডাকবার জন্য ইরতেনসে কোন দাসীকে প্রেরণ করে। কিন্তু এখন সে নিজেই এসে উপস্থিত, তার সাবধানি গলার স্বর বুঝিয়ে দিচ্ছে কারণটি জরুরি এবং গোপনীয়। অগস্ত্য বলল, ‘হ্যাঁ চলো, ঘরে গিয়ে কথা বলি।
‘না, সেখানে যাওয়া যাবে না। দাসীরা আশেপাশেই থাকবে। বরং গবেষণাগারের দিকে চলো।’
প্রাসাদের পিছনের দিকের একটি পরিত্যক্ত আস্তাবলকে গবেষণাগারে পরিণত করা হয়েছে। সেখানে প্রবেশের অনুমতি শুধুমাত্র অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনুর। তারা সেই ঘর ব্যবহার না করলে সেখানে বড় একটি তালা ঝোলে। তার একটি মাত্র চাবি, সেটি থাকে ইরতেনসেনুর কাছে
কোমরের কটিবন্ধের আড়াল থেকে চাবিটিকে বার করে সামান্য ঝুঁকে তালা খুলতে লাগল ইরতেনসেনু। তার পিছনে দাঁড়িয়ে রইল অগস্ত্য এবং উপল। উপলের সঙ্গে ইরতেনসেনুর আলাপ হয়েছে আজ সকালেই, তবে তার কথা অগস্ত্যর মুখে বহুবার শুনেছে সে। উপল যে অগস্ত্যের নিজের ভাইয়ের মতো তা সে জানে, অতএব কথা যতই গোপনীয় হোক না কেন, উপল শুনলে কোন ক্ষতি নেই এই বিশ্বাস ইরতেনসেনুর মনে আছে।
গবেষণাগারে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দ্বার বন্ধ করল ইরতেনসেন। দেওয়ালে লাগানো মশালটি জ্বালানো হতেই ছোট অন্ধকার ঘরটির প্রতিটি কোণে আলো ছড়িয়ে পড়ল। ঘরটি চৌকাকৃতির। ঘরের বাঁ-পাশে রাখা আছে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে কিছু রাসায়নিক দ্রব্য এবং ছোট ছোট যন্ত্রের সমাহার। ঘরের ডান পাশে স্তুপাকারে রাখা আছে অসংখ্য শুকনো বাঁশপাতায় লেখা পুঁথি। এদের বেশ কিছুতে অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু তাদের গবেষণার পদ্ধতি এবং ফলাফল লিখে রাখে।
বেশ কিছু পুঁথি আবার ভারতবর্ষের উত্তরের রাজ্যগুলির গ্রন্থাগার থেকে আনা। কিছু মাস নিজেদের কাছে রাখার পরে তাদের ফেরত দিয়ে দিতে হয়। এমন কিছু পুঁথি অগস্ত্যরাও পাঠায় উত্তরে। ঘরের মাঝখানে একটি বড় চারপায়া রাখা আছে। সেগুন কাঠের তৈরি সেই আসবাবটির গায়ে লেগে রয়েছে বিভিন্ন গবেষণার ছাপ। কোন এক জায়গা পুড়ে কালো হয়ে গেছে আবার কিছু জায়গা কোন রাসায়নিকের প্রভাবে সাদাটে রঙ ধারণ করেছে। সেই চারপায়ার একদিকে দাঁড়িয়ে আছে ইরতেনসেনু, অন্যদিকে অগস্ত্য এবং উপল। অগস্ত্যের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে ইরতেনসেনু এবার তার হাতে একটি ছোট বস্তু তুলে দিল। তার মুখ থমথমে।
বস্তুটা লোহার তৈরি, চোঙাকৃতির। দৈর্ঘ্যে কনিষ্ঠ আঙুলের থেকে ছোট। তার গায়ে কয়েকটি ছবি খোদাই করা আছে। অগস্ত্য ছবিগুলির দিকে একবার তাকিয়েই ইরতেনসেনুর চোখের দিকে তাকাল। ছবিগুলি আসলে একটি বর্ণমালার হরফ, অগস্ত্য এই ভাষা পড়তে অক্ষম হলেও এই ছবিগুলিকে পাশাপাশি থাকতে বহুবার দেখেছে সে। এরা যে শব্দকে বহন করছে তা সে জানে।
নীলনদের দেশ মিশরের সর্বময়ী কর্ত্রী রানি হাতসেপসুতের নামের শীলমোহর এটি!
চোঙাটির একটি প্রান্ত অপর প্রান্তটির মতো ঢালাই করা নয়। এই প্রান্তটিকে খোলা যায়। ঢাকনাটি খোলার পর ভিতর থেকে ছোট্ট একটি প্যাপিরাসের খণ্ড বেরিয়ে এল। প্যাপিরাসটি অগস্ত্যর হাত থেকে নিয়ে দেখল উপল। এই ভাষা তারও রপ্ত নয়। বাণিজ্যের কারণে সে বেশ কয়েকবার মিশরে গেছে, তাই তাদের ভাষার বেশ কিছুটা সে জানে।
কিন্তু এই হরফ সাধারণের জন্য নয়। এই হরফ পড়তে পারেন সমগ্র মিশর দেশের গুটিকয় মানুষ। এই ভাষা দেবতার ভাষা। মন্দিরে গাত্রে খোদাই করা থাকে, মন্দিরের পুরোহিত ছাড়া আর একমাত্র যে মানুষটির এই হরফ ব্যবহার করার অধিকার রয়েছে তিনি হলেন স্বয়ং ফারাও। এই পত্রটি তাহলে সরাসরি ফারাও হাতসেপসুতের কাছ থেকেই এসেছে! কী লিখেছেন তিনি?
পত্রটি ইরতেনসেনুর হাতে তুলে দিল উপল। ইরতেনসেনু এটিকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার পড়ে ফেলেছে। তার কিছুটা পত্রে থাকা নির্দেশকে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য, কিছুটা নিজের দেশের প্যাপিরাসের প্রতি মায়াবশত। অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু যখন মিশর ছেড়ে ভারতবর্ষের উদ্দেশে যাত্রা করে তখন রানির একটি অনুরোধ তাদের রাখতে হয়েছিল। তাদের সমগ্র যাত্রাপথে সঙ্গী ছিল একটি বাজপাখি। দূরদর্শী রানি বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে হয়তো কখনও এই দুই মহাগুণী মানব-মানবীর প্রয়োজন হতে পারে, তাই সঙ্গের বাজপাখিটিকে পাঠানো।
পাখিটি আকাশপথে তাদের দীর্ঘ যাত্রার সঙ্গী হয়েছিল। তারা বিদর্ভে পৌঁছবার পর সে আবার ফিরে যায় মিশরে। এই যাত্রাপথের নকশা তখন তার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। বাজপাখির স্মৃতি অসাধারণ, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, শক্তিশালী দুই ডানার বলে কয়েকমাসের পথ অক্লেশে পার করতে পারে সে। তাই মিশরে দূরবর্তী অঞ্চলের মধ্যে খবর আদান প্রদানের জন্য বাজের ব্যবহার প্রচলিত। ভারতবর্ষের আবার এই পাখিটি অপ্রতুল। এখানকার আকাশে আকারে সামান্য ছোট চিলের দেখা মেলে। উপলের হাত থেকে পত্রটি নিয়ে ইরতেনসেনু বলল, ‘ফারাও হাতসেপসুত বিপদে পড়েছেন। আমাদের সত্ত্বর মিশরে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন।
‘কী বিপদ!’
অগস্ত্য এবারে ইরতেনসেনুর উৎকণ্ঠার কারণ বুঝতে পারে।
‘সে ব্যাপারে কিছু লেখা নেই। তবে বিপদ যে খুব সামান্য কিছু নয় বুঝতে পারছি, তা না হলে এই এত হাজার যোজন দূরে আমাদের কাছে বার্তা পাঠাতেন না।
‘হুম, সেটা ঠিক বলেছ। আমাদের তবে সত্ত্বর যাত্রা করা উচিত।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু ভারতবর্ষ থেকে মিশরের পথ কম নয়। সেখান থেকে এই দেশে আসতে অন্তত একটি মাস লেগেছিল আমাদের।’
ইরতেনসেনুর মুখ চিন্তান্বিত।
‘যে নাবিক তোমাদের নিয়ে এসেছিল তাকে বলো আমার কাছে শিক্ষানবিশি করতে।’
উপল এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবারে এই কথায় তার দিকে তাকাল বাকি দুজন।
‘কোন প্রমোদতরণী এই পথ পাড়ি দিতে একমাস সময় নিতে পারে। কিন্তু আমার সিন্ধুযান নয়।’
যে সভ্যতার মাধ্যমে এই ভারতবর্ষে বাণিজ্যের সূচনা হয়েছিল তাকে মনে রেখে উপল তার নৌকাটির নাম রেখেছে সিন্ধযান। নৌকাটি এই ভারত ভূখণ্ডের সমস্ত বাণিজ্যপোতগুলির মধ্যে দ্রুততম। এর বলে উপল একবছরের মধ্যে তিন চারটি বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করে আসতে পারে। উপল বলল, ‘আমি যে পথ দিয়ে মিশরে যেতে পারব তার কিছুটা দুর্গম হলেও অগম্য নয়। সেই পথ আমার হাতের তালুর মতো চেনা। আমরা যদি আগামীকাল যাত্রা করি তাহলে সামনের অমাবস্যার আগেই তোমাদের আমি সেই দেশে পৌঁছে দিতে পারব।’
উপলের দাবি যে অসত্য নয় তা অগস্ত্য ভালোমতোই জানে। উপলকে সে তার বাল্যকাল থেকে চেনে। সমুদ্রের সঙ্গে উপলের এক অন্যরকমের সখ্যতা আছে। অগস্ত্য বলল, ‘কিন্তু উপল, আমি তোমাকে এই যাত্রায় সঙ্গে নিতে পারব না। তুমি সদ্য এক ক্লান্তিকর বছর কাটিয়ে দেশে ফিরেছ।
অগস্ত্যের কথার মাঝে ইরতেনসেনু তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বলল, ‘আর আমাদের এই মিশর অভিযানের ভবিষ্যত কী তা আমরা নিজেরাই জানি না। জানি না সেখানে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে থাকবে। রানি হাতসেপসুতের বিপদে আমরা দু’জন তাঁর পাশে দাঁড়াবই। কিন্তু তোমাকে আমরা আমাদের ভবিতব্যের সঙ্গে টেনে আনতে পারব না।’
এবারে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল উপল, ‘স্বামী-স্ত্রী দু’জনে একসুরে কথা বলছ দেখছি। দু’জনকে পাশাপাশি দেখে তো মনে হয় প্রেমে জারিত কপোত-কপোতী, তোমাদের দাম্পত্যকলহ হয় কখনও? সেই সময়টা আমার পক্ষে বেশ উপভোগ্য হবে। আমার তোমাদের সঙ্গে যেতে চাওয়ার এটা একটা কারণ ভাবতে পারো। তবে অন্য কারণগুলোও শুনে রাখো হে। আমি ছাড়া মাত্র বারোদিনে তোমাদের আর অন্য কেউ মিশরে নিয়ে যেতে পারবে না।
‘যদি রানির সত্যই বিপদ ঘটে থাকে তাহলে এখন থেকে প্রতিটা মুহূর্ত অমূল্য। নিশ্চয় একমাস কোন নৌকায় তোমরা কাটাতে চাইবে না। দ্বিতীয়ত, আমার নিদ্রা সবচেয়ে ভালো হয় আমার সিন্ধযানের খোলের মধ্যে থাকা ছোট বিছানাতে, ঢেউয়ের দোলায়। রাজার অতিথিশালার নরম শয্যায় আমার গায়ে ব্যথা হয়ে যাবে। আর সর্বশেষ কারণটা হল অগস্ত্যর জন্য। সামান্য এক নদীতে সে যেভাবে হাবুডুবু খেল সেটা দেখার পর উত্তাল সমুদ্রে আমি তাকে আর একা ছাড়ব না। তাই আমি যাবই, তোমাদের কোন অজুহাতই আমি শুনব না। এত আর তোমাদের মধুচন্দ্রিমা নয় যে একান্তে থাকতে চাইবে।’
এবার এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও ইরতেনসেনুর মুখে হাসি ফুটল। উপলের কথায় না হেসে পারা যায় না। প্রাণখোলা এই মানুষটিকে তার পছন্দ হয়েছে বেশ। সে বলল, ‘আচ্ছা, তবে তাই হোক। তাহলে আমরা কবে যাত্রা শুরু করতে পারি?’
‘বিলম্বে কাজ নেই। আগামীকালই আমরা যাত্রা করব। সোপারার বন্দরে সিন্ধযানের নোঙর ফেলা আছে, কয়েক সপ্তাহের খাদ্য আর পানীয়ের রসদ নিয়ে নিলেই হল। কিন্তু হে অগস্ত্য, রাজাকে এবারে কী বলবে? প্রজাপতি ব্রহ্মা আবার স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন?’
ব্রহ্মার স্বপ্নাদেশের কথা অগস্ত্যকে বলতে হয়নি। উপলের বুদ্ধিতে অসিরিয় রাজের বিদর্ভ আক্রমণের শঙ্কাজড়িত স্বপ্নের কথা রাজাকে বলে অগস্ত্য। দৈবে বিশ্বাসী রাজাকে নিজের অলীক স্বপ্নের কথা বিশ্বাস করাতে বেশি বেগ পেতে হয়নি অগস্ত্যকে। এবারে তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে উপল, গতকালের রাত্রের মতো তাকে কঠিন প্রশ্নের মুখে একা ছেড়ে দেয়নি। খুব দ্রুত অগস্ত্যরা তৈরি হয়ে নিচ্ছিল।
মাঝারি আকৃতির ঝোলায় পরনের বস্ত্রাদি নেওয়া ছাড়াও একটি কাঠের বাক্সের মধ্যে প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে নিল অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু, এগুলির সবই তাদের গবেষণাকেন্দ্রে আবিষ্কৃত। কখন কীসের প্রয়োজন হয় তা তো কেউই বলতে পারবে না। ইরতেনসেনুর বুক দুরুদুরু করছিল কোন এক অজানা আশঙ্কায়। ফারাও নিশ্চয়ই এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তার জন্য। ইরতেনসেনুর কানে যেন বাজতে লাগল থীবস নগরীর দামামা। সেই দ্রিমদ্রিম সুর মিশে যেতে থাকল তার দ্রুত লয়ে চলতে থাকা হৃদস্পন্দনের সঙ্গে।