সাতচল্লিশে শুধু দেশই টুকরো টুকরো হলো না, অসংখ্য পরিবারও টুকরো টুকরো হলো। ভয়ে ভীতিতে, আশঙ্কায় অথবা সদ্যসৃষ্ট স্বর্গের বাসিন্দা হবার জন্য ঘর-সংসার তুলে নিয়ে গেলেন একদিক থেকে অন্যদিকে কিন্তু সবার পক্ষে কী তা সম্ভব?
–না।
সীমান্তের দুদিকেই এমন হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ মানুষ আছেন, যাদের পরম প্রিয়জনদের অনেকেই রয়েছেন সীমান্তের অপর দিকে। শ্যাম-দোয়েল-কোয়েলের ডাক শুনে আর মাটির সোঁদা গন্ধের দোষেই বোধহয় দুই বাংলার মানুষই কেমন একটু ভাবপ্রবণ হয়। হবেই। অতি বাস্তববাদী বাঙালীও প্রিয়জনের চোখে দুফোঁটা জল দেখলে বা কোকিলের ডাক শুনলে অন্তত কয়েক টুকরো মুহূর্তের জন্য আনমনা হবেনই। তাই তো তারা সুখে বা দুঃখে প্রিয়জনের সান্নিধ্য লাভ না করে থাকতে পারেন না। পাসপোর্ট-ভিসা-চেকপোস্টের ঝামেলার চাইতে এই সান্নিধ্যের আকর্ষণ অনেক অনেক বেশী।
হরিদাসপুর-বেনাপোল দিয়ে যারা যাতায়াত করেন, তাদের বারো আনাই পারিবারিক পুনর্মিলনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পার হয়ে যান।
-না, না, আব্বা, এখানে কিছু খাব না।
হামিদ সাহেব অবাক হয়ে বলেন, সে কিরে? তোর খিদে পায় নি?
সঞ্জিদা বলল, এখানে খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। দুলা ভাই নিশ্চয়ই ইভনিংশোর টিকিট কেটে রেখেছেন। এখন তাড়াতাড়ি চলো।
–সেই কখন বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছিস!
–তা হোক।
সত্যি, হরিদাসপুর চেকপোস্ট পার হবার পরই সঞ্জিদা আর ধৈর্য ধরতে পারে না। খুলনা থেকে কলকাতার আমীর আলি এভিন্যু মাত্র একশ পাঁচ-দশ মাইল হলেও মনে হয় কত দূর! কিন্তু বেনাপোল ছাড়িয়ে হরিদাসপুর পার হবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়, এই তো এসে গেছি। ইলেকট্রিক ট্রেনে তো মাত্র দুঘণ্টার পথ শিয়ালদ’। তারপর ট্যাক্সীতে? বড়জোর দশ-পনের মিনিট।
বড় বোন সবিতার বিয়ের পর সঞ্জিদা গত দুবছর ধরে এই সময় মাস খানেকের জন্য কলকাতা আসে। তার আগেও দুএক বছর অন্তর এসেছে ছোট চাচার বাড়ি। তাই তো কলকাতা ওর কাছে ঠিক বিদেশ না।
বনগাঁ থেকে শিয়ালদ’ যাবার পথে অনেক স্টেশন পড়ে কিন্তু তাদের নাম ওর মনে থাকে না বা রাখে না। তবে জানে দমদম এলেই শিয়ালদ’ নামার উদ্যোগ-আয়োজন শুরু করতে হয়।
একলা একলা ও আমীর আলি এভিন্য যেতে না পারলেও এন্টালী মার্কেট ছাড়ালেই কেমন চেনা চেনা মনে হয় সবকিছু। ট্যাক্সী সার্কুলার রোড থেকে পার্ক স্ট্রীটে ঘুরতেই ও উত্তেজিত না হয়ে পরে না। বলে, আব্বা, এসে গেছি। ঐ তো ট্রাম ডিপোর কাছে ডান দিকে ঘুরলেই ..
হামিদ সাহেব হেসে বলেন, তুই এদিকটা বেশ চিনে গেছিস, তাই না?
-শুধু এদিক কেন, নিউ মার্কেট-চৌরঙ্গী গড়িয়াহাট, আরো কত জায়গা চিনি। সঞ্জিদা চোখ দুটো বড় বড় করে হামিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে, দুলা ভাই অফিসে বেরুবার পরই তো আমি আর আপা বেরিয়ে পড়ি।
হামিদ সাহেব মেয়ের কথা শুনে হাসেন।
সঞ্জিদা বলে যায়, কোনদিন নিউ মার্কেট, কোনদিন গড়িয়াহাট, কোনদিন আবার ছোট চাচির কাছে যাই। দুটো-তিনটের আগে কোনদিন আমরা বাড়ি ফিরি না। তারপর সন্ধ্যের পর আমার দুলা ভাইয়ের সঙ্গে কোনদিন সিনেমা, কোনদিন থিয়েটার দেখতে যাই।
অষ্টাদশী সঞ্জিদা ভাবাবেগে, আনন্দের আতিশয্যে এসব কথা বলে যায় কিন্তু মধ্যবয়সী হামিদ চুপ করে থাকলেও তিনি মনে মনে চাপা আনন্দ ও উত্তেজনার স্বাদ অনুভব করেন। করবেন না কেন? যে কলকাতায় আসতে আজকে তার পাসপোর্ট-ভিসা লাগে, সীমান্তের দুদিকে বাক্স-পেটরা খুলে দেখাতে হয়, সেই কলকাতার মীর্জাপুর স্ট্রীটেই তো ওর জন্ম। শুধু ওর কেন? ওরা পাঁচ ভাইবোনেই তো ঐ বাড়িতে জন্মেছেন।
হরিদাসপুর সীমান্ত পার হবার পর ফেলে আসা সেই সোনালী দিনগুলোর স্মৃতিতে হামিদ সাহেবের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। কত কি মনে পড়ে ওর! বিছানায় শুয়ে শুয়ে শিয়ালদ’ স্টেশনের রেল ইঞ্জিনের হুইসেলের আওয়াজ কী ভাল লাগত শুনতে! শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে ফুটবল খেলা, ভাইবোনে মিলে কলেজ স্কোয়ারে বেড়াতে যাওয়া ও এক এক পয়সার নকুলদানা খাওয়া!
সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে হামিদ সাহেব আপন মনেই হেসে ওঠেন।
আরো কত কি মনে পড়ে! হরিদাসপুর চেকপোস্টের পাশেই রিকশা চড়ার সঙ্গে সঙ্গেই উনি যেন চোখের সামনে পুরনো দিনের কলকাতাকে দেখতে পান। সেই গ্যাসের আলো, সেই ভোরবেলায় রাস্তায় জল দেওয়া, ফিটন গাড়ি, অক্টারলনী মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা।
সেন্ট পলস্ স্কুল-কলেজের সহপাঠী কুমুদ এখন রাইটার্স বিল্ডিং-এ ডেপুটি সেক্রেটারী। উনি হামিদ সাহেবকে বলেন, জানিস হামিদ, এখন আর সে কলকাতা নেই। সবকিছু এত বদলে গেছে যে সেসব দিনের কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
হামিদ সাহেব একটু ম্লান হেসে বলেন, আগে পাকিস্তানী ছিলাম, এখন বাংলাদেশী হয়েছি, খুলনায় কত বড় বাড়ি করেছি, কত দামী মোটর গাড়িতে চড়ি কিন্তু তবু কলকাতায় এসে ট্রাম দেখেই মনে হয়, লাফ দিয়ে উঠে পড়ি।
কুমুদবাবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
হামিদ সাহেব বলে যান, কলকাতা যে সে কলকাতা নেই, তা আমিও জানি কিন্তু তবু তো এই শহরে জন্মেছি, এখানেই তো লেখাপড়া শিখেছি। উনি মুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে বলেন, তাছাড়া এই শহরের মাটিতেই তো আম্মাকে আমরা গোর দিয়েছি।
–তোর মা মারা যাবার কথা আমি জীবনে ভুলব না। সত্যি, অমন মৃত্যু আমি আর দেখি নি।
-আমার আম্মা সত্যি ভাগ্যবতী ছিলেন। আম্মাকে সাদি করার পরই আব্বার যত উন্নতি। আর আম্মা মারা যাবার এক বছরের মধ্যেই আমাদের মীর্জাপুরের বাড়ি ছেড়ে খুলনায় চলে যেতে হলো।
এই কলকাতায় এসে হামিদ সাহেবের কাছে খুলনা যেন কত দূর, কত অপরিচিত মনে হয়।
স্রোত কখনই একমুখী হয় না, হতে পারে না।
হরিদাসপুর সীমান্ত পার হয়ে বেনাপোলের কাস্টমস কাউন্টারে মালপত্র রেখেই মধুসূদন চৌধুরী একজন কাস্টমস ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞেস করেন, হান্নান কী এখন ডিউটিতে নেই?
ইন্সপেক্টরটি একবার ভাল করে বৃদ্ধ মধুবাবু ও তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে দেখে নিয়ে বলেন, উনি একটু ব্যস্ত আছেন।
–কাইন্ডলি ওকে একটু বলুন যে প্রফেসর চৌধুরী এসেছেন।
তরুণ ইন্সপেক্টরটি একটু চিৎকার করে বললেন, এই রশিদ, হান্নান সাহেবকে একটু ডাক দাও তে।।
একটু পরেই হান্নান এসে প্রফেসর চৌধুরী ও তার স্ত্রীকে প্রণাম করতেই বৃদ্ধ অধ্যাপক ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো তোমরা?
-আমরা ভালই আছি স্যার। আপনারা কেমন আছেন?
প্রফেসর চৌধুরী হেসে বললেন, তুমি তো জানো আমি চিরকালই ভাল থাকি আর তোমার খালা ঠিক আম্মার মতই সব সময়…
স্বামীকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়েই ওর স্ত্রী বলেন, হান্নানের কাছে আর আমার নিন্দা করতে হবে না। ও তোমার স্বভাব চরিত্র খুব ভাল করেই জানে।
কাস্টমস কাউন্টারের সবাই ওদের কথা শুনে হাসেন।
হান্নান হাসতে হাসতে বলেন, আগে কোয়ার্টারে চলুন। তারপর কথাবার্তা হবে।
প্রফেসর চৌধুরী বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই চলো। আয়েষার হাতে চা না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।
হান্নান ওদের দুটো পাসপোর্ট এক বন্ধুর হাতে দিয়ে বললেন, ছাপটাপ মেরে পাঠিয়ে দিস। আমি স্যার আর খালাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি।
কে এই অধ্যাপক মধুসূদন চৌধুরী? আর কে এই হান্নান? বাইরের জগতের মানুষ তো দূরের কথা, হরিদাসপুর-বেনাপোল চেকপোস্টের কেউই জানতে পারলেন না ওদের কথা। ওদের কথা শুধু ওরাই জানেন।…
একদিন সাত সকালে এক ভদ্রলোক প্রিন্সিপ্যালের কোয়ার্টারে এসে হাজির। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বাড়ির ভিতর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই উনি বললেন, স্যার, আমি জেলা স্কুলের একজন শিক্ষক। বড় ভাই হঠাৎ মারা যাওয়ায় তার ফামিলি আমাকেই দেখতে হয়। তাই সকাল-বিকেল ছাত্র পছাই কিন্তু অন্যের ছেলেদের মানুষ করতে গিয়ে নিজের ছেলেদের কিছুই দেখতে পারি না।
মনসুরুদ্দীন সাহেব একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, ছোটবেলায় বড় ছেলেটা সত্যি ভাল ছিল কিন্তু এই কবছরে গোল্লায় গেছে।
–ও কী পড়ে?
-ম্যাট্রিক পাস করেছে কিন্তু থার্ড ডিভিশনে।
-কলেজে ভর্তি করেছেন?
–সেইজন্যই তো আপনার কাছে এসেছি স্যার। উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, গরীব স্কুল মাস্টারের ছেলেরা যদি লেখাপড়া না শেখে, তাহলে
–কাল দশটার সময় ছেলেকে নিয়ে কলেজে দেখা করবেন।
মনসুরুদ্দীন সাহেব পরের দিন ছেলেকে নিয়ে প্রিন্সিপ্যালের সামনে হাজির হয়ে বললেন, ওকে শুধু ভর্তি করলেই হবে না; আপনাকে একটু দেখতে হবে।
প্রিন্সিপ্যাল একটু হেসে বললেন, দেখতে হবে মানে?
-এত খারাপ হয়েছে যে আপনি খুব কড়া হাতে
উনি হাসতে হাসতে বললেন, কোন ছেলে আবার খারাপ হয় নাকি?
ইসাক সেদিন প্রিন্সিপ্যালের কথা শুনে শুধু অবাক হয় নি, মনে মনে খুশিও হয়েছিল।
দুবছর পর মনসুরুদ্দীন সাহেব বিরাট এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে মধুসূদনবাবুর কোয়ার্টারে এসে বলেছিলেন, আপনার দয়ায় আমার ঐ ছেলে ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করল।
-খবরদার ও কথা বলবেন না। পড়াশুনা করল আপনার ছেলে, পরীক্ষা দিল আপনার ছেলে আর কৃতিত্ব হবে আমার?
রসগোল্লার হাড়ি ফেরত দিয়ে উনি বলেছিলেন, এত সহজে আমাকে খুশি করতে পারবেন না। ইসাক যেদিন ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে এম.এ. পাস করবে, সেদিন আমি যা চাইব, আমাকে তাই দিতে হবে।
মনসুরুদ্দীন সাহেব মাথা নেড়ে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সত্যি ভাবতে পারেন নি এমন দিন আসবে।
সময় স্থির থাকে নি; আপন গতিতেই সে এগিয়ে চলেছিল। দেখতে দেখতে দিনগুলো যেন হাওয়ায় উড়ে যায়। নতুন ক্যালেণ্ডার, ডায়েরী পুরানো হয়। একের পর এক।
চার বছর পর মনসুরুদ্দীন সাহেব আনন্দে খুশিতে ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে মধুসূদনবাবুকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, দাদা, গরীব স্কুল মাস্টারের জীবনে যে এমন দিন আসবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
মনসুরুদ্দীন সাহেবের চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে প্রিন্সিপ্যাল চৌধুরী বললেন, কেঁদে ভুললে চলবে না মনসুরুদ্দীন। আমি যা চাইব, তা আমাকে দিতে হবে।
নিশ্চয়ই দেব দাদা।
-ইসাক আমার কাছেই থাকবে।
-একশ বার থাকবে দাদা।
ইসাক পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। প্রিন্সিপ্যাল ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ইসাক অযথা সময় নষ্ট না করে কাল থেকেই ক্লাস নেওয়া শুরু করো। আমি নরেশবাবুকে বলে দিয়েছি।
ইসাক বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর জীবনদেবতার দিকে তাকাতেই মধুসূদন বাবু বললেন, ইসাক, তুমি কর্মজীবন শুরু করার আগে শুধু একটা কথাই বলব।
ইসাক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই উনি বললেন, Be so true to tbyself as thou be not false to others. ফ্যান্সিস বেকনের এই কথাটা মনে রাখলে জীবনে কোনদিন তুমি কষ্ট পাবে না।
সেদিন বিকেলের দিকে ওদের সুপারিনটেনডেন্ট রহমান সাহেবের ঘরে বসে গল্প করতে করতে হান্নানই আমাকে মধুসূদনবাবুর কথা শোনাচ্ছিলেন। বললেন, আমরা তিন ভাইই স্যারের হাতে গড়া। আমরা বোধহয় আব্বার চাইতেও স্যারকে বেশি ভক্তি-শ্রদ্ধা করি।
আমি হাসি।
-আর আমার আব্বা-আম্মার কাছে তো স্যার স্বয়ং দেবতা। স্যারের সঙ্গে পরামর্শ না করে তারা কোন কাজ করেন না।
আমি জিজ্ঞেস করি, উনি কী মাঝে মাঝেই দেশে যান?
হান্নান হেসে বললেন, স্যার বা খালা কী কলকাতায় শান্তিতে থাকতে পারেন?
-দেশে কী ওঁর আত্মীয়-স্বজন আছেন?
–কিছু কিছু আত্মীয়-স্বজন আছে ঠিকই কিন্তু উনি যান ওঁর গ্রামের স্কুল আর ঐ কলেজের টানে।
হান্নান একটু থেমে বলেন, যাত্রাপুরের হাইস্কুলটা উনিই প্রতিষ্ঠা করেন। আর ঐ কলেজের প্রিন্সিপ্যাল তো আমার সেই বড় ভাই।
-তাই নাকি?
হান্নান হেসে বলেন, হ্যাঁ। উনি আবার একটু থেমে আবার একটু হেসে বলেন, স্যারের নাতি-নাতনীরা ওঁকে এত ঘন ঘন দেশে যেতে বারণ করলে উনি কি বলেন জানেন?
-কী?
–স্যার বলেন, ইসাক কেমন কলেজ চালাচ্ছে, তা না দেখলে চলে?
কথাগুলো বলতে বলতে গর্বে হান্নান সাহেবের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হঠাৎ উনি একটু জোরে হেসে উঠে বললেন, স্যার কিন্তু স্মাগলিংও করেন।
তার মানে?
কলেজের এক বুড়ো জমাদারের জন্য উনি এক থলি ভর্তি বিড়ি নিয়ে যান।
–বিড়ি?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিড়ি। আমাদের দেশে তো কাগজের বিড়ি। তাই আমাদের দেশে ইণ্ডিয়ান বিড়ির দারুণ চাহিদা!
আমি হো-হো করে হেসে উঠি।
.
০৮.
কাস্টমস কলোনী সত্যি ভাল লাগল। হরিদাসপুর সীমান্ত চেকপোস্টের কলকাকলি থেকে বেশ দূরে স্নিগ্ধ গ্রাম্য পরিবেশে সুন্দর ও আধুনিক এই কলোনী। কটেজের মত ছোট ছোট কোয়ার্টার। স্বচ্ছন্দে থাকার মত সব সুযোগ-সুবিধাই আছে। কলোনীর এক দিকে যশোর রোড। অন্য তিন দিকেই সবুজের মেলা। ভারত সরকারের নথিপত্রে কর্মচারীদের শ্রেণী বৈষম্যের উল্লেখ থাকলেও এই কলোনীর বাসিন্দাদের মধ্যে তার নগ্ন প্রকাশ নেই।
সন্ধ্যের পর সুপারিটেনডেন্ট সাহেব ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে একটু জোরেই বলেন, কী বিভা, তোমাদের কী চা খাওয়া হয়ে গেছে?
তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে ইন্দিরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলেন, আসুন স্যার, ভিতরে আসুন। বিভাদি এই মাত্র বাথরুমে ঢুকল।
ছোট্ট দুখানি ঘরের কোয়ার্টার। চারজনে মিলে মিশে থাকেন। ড্রইংরুম বলে কিছু নেই। প্রয়োজনও নেই, সম্ভবও না। সুপারিটেন ডেন্ট সাহেব একটা তক্তপোশের উপর বসেই ইন্দিরাকে জিজ্ঞেস করেন, আজ কে রান্না করছে?
রেখা।
–ও! উনি একটু থেমে জিজ্ঞেস করেন, কেয়া কোথায়?
–তেওয়ারীদা তো ডিউটিতে গিয়েছেন। তাই ও মুন্নীকে নিয়ে ঘুরছিল তো!
সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বললেন, তাহলে মুন্নী না ঘুমোন পর্যন্ত ও আসছে না।
ইন্দিরাও একটু হাসেন। বলেন, আমাদের ভিতরের ঘরে ঘোষদার বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে। ওকে ঘুম পাড়াবার জন্যই তো বিভাদি এত দেরিতে বাথরুমে গেল।
–জয়শ্রীর কী শরীর খারাপ?
-না, না জয়শ্রী বৌদি আর ঘোষদার বোন একটু কেনাকাটা করতে বনগাঁ গেছেন বলে বাচ্চাটাকে আমাদের কাছে ..
সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব হেসে বলেন, ওরা বেশ আছে। যখন তখন বাচ্চাদের তোমাদের কাছে রেখে ঘুরছে ফিরছে।
ইন্দিরাও একটু হেসে বলেন আমাদেরও এমন অভ্যাস হয়েছে যে একটা না একটা বাচ্চা না থাকলে কোয়ার্টারটা বড় খালি খালি লাগে।
রেখা চা নিয়ে আসেন। একটু পরে বিভাও আসেন। সবাই মিলে গল্পগুজব করে আরো পনের-বিশ মিনিট কেটে যায়।
খাকি পোশাক পরে সারাদিন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কন্টোল অর্ডার আর ব্যাগেজ রুলস্-এর গায়ত্রী জপ করলেও ইন্সপেক্টর অমিত সরকার সন্ধোর পর প্রায় শেষের কবিতার অমিত রায় হয়ে যান
যারা কথা বলে তাহারা বলুক,
আমি কাহারেও করি না বিমুখ,
তারা নাহি জানে-ভরা আছে প্রাণ।
তব অকথিত বাণীতে।
ঠিক সেই মুহূর্তে নিবেদিতা বাইরের ঘরে পা দিয়েই স্বামীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে
নীরবে নিয়ত রয়েছ আমার
নীরব হৃদয়-খানিতে
কোনদিন স্বামী-স্ত্রীতে মিলে কবিতা বা গান নিয়েই কাটিয়ে দেন সারা সন্ধ্যেবেলা। কোনদিন আবার অজয় ঘোষ, বিমান ব্যানার্জী, জয়শ্রী, বিভার এলে গান-বাজনা নাটক-নভেল কবিতা নিয়ে তর্ক বিতর্কের আসর জমে ওঠে। অরূপ ঘরে ঢুকলেই উল্টোদিকে স্রোত বইতে শুরু করে!
অরূপ নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে, চাপা হাসি হেসে বলে, ওহে নন্দনকাননবাসিনী সুন্দরী, স্বামীকে নিয়ে তো মত্ত হয়ে আছ কিন্তু মহাপ্রভু আজ কী করেছেন জানো?
সবাই ওর দিকে তাকায়।
নিবেদিতা বলে, আপনি না বললে জানব কী করে?
–ঢাকার বিখ্যাত শিল্পপতি আশরাফউদ্দীন আমেদের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ?
–হ্যাঁ, দুএকবার শুনেছি।
–ওঁর স্ত্রী রামপুরের নবাববাড়ির মেয়ে, তা কী জানো?
-না, তা জানি না।
–তা না জানলেও বেগম সাহেব যে পরমা সুন্দরী, তা তো জানো?
–না, তাও জানি না।
অরূপ একটা মোড়ায় বসতে বসতে বলে, যাই হোক আশরাফউদ্দীন আমেদ ও তার ফ্যামিলির অনেকেই আমাদের এদিক দিয়ে যাতায়াত করেন, তা তো জানো?
নিবেদিতা একবার এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে বলে, অত শত না জানলেও আশরাফউদ্দীন সাহেব আপনাদের সবাইকে খুব ভালবাসেন, তা জানি।
অরূপ মাথা নেড়ে বলল, ভেরী গুড! পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, অদ্য অপরাহ্ন তিন ঘটিকার সময় আশরাফউদ্দীন সাহেবের এক পরমা সুন্দরী কন্যা আমাদের দেশে পদার্পণ করেন।
ওর কথায় অনেকেই মুখ টিপে হাসে। নিবেদিতা বলল, কত সুন্দরী, কত কুৎসিতই তো আসছে; তাতে আমার কী?
–তোমার কিছু ব্যাপার না থাকলে কী শুধু শুধুই এ খবর দিচ্ছি? ও একবার ভাল করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, শুধু এই কথাটাই আপনাকে জ্ঞাত করতে চাই যে ঐ পরমা সুন্দরীর সঙ্গে শ্রীমান অমিতের ভালোবাসা না হইলেও গভীর ভাব হইয়াছে, সে বিষয়ে কাহারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।
চাপা হাসির গুঞ্জন ওঠে চারদিক থেকে, নিবেদিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ও! এই!
-আজ্ঞে হ্যাঁ, এই!
-সুন্দরীর সৌন্দর্ষসুধায় যে পুরুষ মুগ্ধ হয় না, সে আবার পুরুষ নাকি?
জয়শ্রী বলল, ঠিক বলেছ!
এই কাস্টমস কলোনীর অস্থায়ী বাসিন্দা হয়েও আমিও নানা জনের কোয়ার্টারে ঘুরে বেড়াই। চা খাই, গল্প করি, ওদের কথা শুনি।
মেয়েদের মধ্যে কেয়াই সব চাইতে বেশী দিন এখানে আছে। কথায় কথায় আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বছরের পর বছর ধরে পোটলা-পুটলি বাক্স বিছানা খুলে দেখতে বা এটা-ওটা নিতে পারবেন না বলতে বিরক্ত লাগে না?
কেয়া একটু হেসে বলল, একঘেয়েমি বা বিরক্ত যে লাগে না, তা বলব না; তবে বৈচিত্র্যও তো আছে।
–বৈচিত্র্য মানে নানা ধরনের মানুষ দেখা তো?
–মানুষ ছাড়াও কী কম বৈচিত্র্য? কেয়া কলোনীর সামনে যশোর রোডের উপর আমার সঙ্গে পায়চারি করতে করতে বলে, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা কটা জিনিস দেখতে পারে বা জানতে পারে? কিন্তু এই কবছর কাস্টমস-এ কাজ করে আমি কত রকমের কত কি যে দেখলাম ও জানলাম, তার ঠিক-ঠিকানা নেই।
আমি মাথা নেড়ে বলি, তা ঠিক।
কেয়া একটু হেসে বলে, আগে জানতাম মদ বলে একটা তরল পদার্থ আছে, যা খেলে নেশা হয় কিন্তু তার বেশী কিছু জানতাম না।
আমি একটু হেসে জিজ্ঞেস করি, আর এখন?
-এখন আমি পঞ্চাশ-ষাট রকমের হুইস্কি-ভদকা-জিন, কনিয়াক লিকুয়্যার-পোর্ট-শেরী ইত্যাদির নাম শুধু গড় গড় করে বলতে পারি না, কার কি রকম বোতল ও দাম, তাও মুখস্থ।
আমি শুধু হাসি।
-সত্যি বাচ্চুদা, এই হরিদাসপুর বর্ডারের কাস্টমস-এ চাকরি করতে গিয়ে সারা পৃথিবীর কত কি জানলাম আর দেখলাম। কেয়া একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এইসব দেখা জানা ছাড়াও কত রকমের মানুষ দেখি।
-তা ঠিক।
–কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে তা আমাদের এমন ভাব হয়ে গেছে যে তারা আত্মীয়ের চাইতেও অনেক বেশী।
-তাই নাকি?
–হ্যা বাচ্চুদা। কেয়া একটু থেমে বলে, ব্যবসাদার ছাড়াও দুদিকের বেশ কিছু মানুষই নিয়মিত এখান দিয়ে যাতায়াত করেন। তাদের প্রায় সবাইকেই আমরা চিনি, আর কয়েকজন সত্যি আমাদের আত্মীয় বন্ধু হয়ে গেছেন।
সেদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর কেয়া এদেরই একজনের কথা আমাকে বলেছিল।
হরিদাসপুর-বেনাপোল সীমান্ত সেই ভোরবেলা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত প্রায় সব সময়ই সরগরম থাকে। আসা-যাওয়া লেগেই আছে। তবু মাঝে মাঝে কখনও-সখনও হঠাৎ একটু ঝিমিয়ে পড়ে। কোন অদৃশ্য অজানা কারণে এই নিত্য ব্যস্ত সীমান্ত দিয়ে হঠাৎ মানুষের আসা যাওয়া থেমে যায়। দুদিকের সীমান্তের কাস্টমস ও চেকপোস্টের সব কর্মীদের কাছেই এই অপ্রত্যাশিত অবসর বড়ই প্রিয়, বড়ই মধুর।
হবে না কেন? সরকারী অফিসে কাজ করলে নির্বিবাদে বলা যায়, আপনার ফাইল এখনও ফিনান্স থেকে আমাদের কাছে আসে নি। আপনি কাইন্ডলি সামনের সপ্তাহে একবার আসবেন। ভদ্রলোককে অত ঘোরাতে না চাইলে স্বচ্ছন্দে বলা যায়, আপনি লাঞ্চের পর আসুন। আশাকরি, তার মধ্যে চিঠিটা তৈরী হয়ে যাবে।
সীমান্ত চেকপোস্টে এসব বিলাসিতার কোন অবকাশ কর্মীদের নেই। শুধু তাই নয়। এদের ক্যালেণ্ডারে লালএর স্পর্শ নেই। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষদের জন্মদিন মৃত্যুদিন, কোন ধর্মীয় উৎসব, স্বাধীনতা-প্রজাতন্ত্র দিবস থেকে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হলেও সীমান্তের কাস্টমস-ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ঝাঁপ বন্ধ হয় না। এক কথায় ছুটি বা লাঞ্চ ব্রেক বলে কোন শব্দ এদের ডিক্সনারীতে থাকে না। দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে অবশ্য সবার আগে সীমান্তের দরজায় তালা পড়ে।
যাই হোক, এমনই এক অবসরের সময় ওরা সবাই মিলে চা খেতে খেতে গল্প করছিলেন। হঠাৎ একজন মহিলা ধীর পদক্ষেপে কাস্টমস কাউন্টারে ঢুকে হাতের ব্যাগটা নীচে রেখে একবার কেয়ার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। কেয়া চা খেতে খেতেই হাত বাড়িয়ে বলল, পাসপোর্টটা দিন।
ভদ্রমহিলা পাসপোর্ট ওর হাতে দিয়েই বললেন, আপনারা চা খেয়ে নিন। আমি অপেক্ষা করছি।
চা খেতে খেতেই আমাদের কাজ করতে হয়।
-আমার জন্য ব্যস্ত হবেন না। পাঁচ-দশ মিনিট অপেক্ষা করলে আমার কোন ক্ষতি হবে না।
এ ধরনের কথা তো কেউ বলেন না। কেয়া একটু অবাক হয়। খুশি হয়ে বলে, তাহলে আপনিও একটু চা খান।
-না, না, তার কি দরকার?
সামান্য এক কাপ ছাড়া তো কিছুনয়, অত আপত্তি করছেন কেন?
এইভাবেই প্রথম আলাপ। দিন পনের বাদে উনি আবার দেশে ফেরার পথে সীমান্তে হাজির। সেদিনও কেয়া ডিউটিতে।
–কী, এরই মধ্যে দেশে ফিরে যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ, ভাই।
-কোথায় কোথায় ঘুরলেন?
–আমি তো শুধু আজমীঢ় শরীফ আর কলকাতার জন্যই এসেছিলাম।
কেয়া চা-বিস্কুট আনতে দিয়ে আবার প্রশ্ন করে, আজমীঢ় যখন গিয়েছিলেন, তখন দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর নিশ্চয়ই দেখেছেন?
-না ভাই; আমি আর কিছু দেখিনি।
কেয়া অবাক হয়ে বলে, সে কী? এত কষ্ট, এত খরচ করে আজমীঢ় গেলেন অথচ দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর দেখলেন না?
আয়েষা একটু ম্লান হেসে বললেন, ট্রেন বদলাতে হবে বলে আসা যাওয়ার পথে দুরাত দিল্লীতে থেকেছি ঠিকই কিন্তু কোন কিছু দেখি নি।
-কেন? কেয়া বিস্ময়ের সঙ্গে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, দেশ বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ লালকেল্লা কুতুবমিনার দেখতে আসে আর আপনি দিল্লীতে দুরাত কাটিয়েও…
আয়েষা একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, না ভাই, ওসব দেখতে আর ইচ্ছে করে না।
না, কেয়া আর প্রশ্ন করে না। উচিত মনে করে না। কিন্তু মনে মনে ভাবে, এই বয়সেই এমন বৈরাগ্য কেন? কত বয়স হবে? তিরিশ-বত্রিশ। খুব বেশী হলে চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ। বোধহয় অত হবে না। হয়ত বিয়েও করেননি। তাছাড়া অমন রূপ!
শুধু কেয়া না, অন্য মেয়েরাও ওর দিকে না তাকিয়ে পারে না। অতি সাধারণ একটা ছাপা শাড়ী আর সাদা ব্লাউজ। মাথায় আলতো করে বাঁধা একটা খোঁপা। না, কানে-গলায়-হাতে কোন অলঙ্কার নেই। বাঁ হাতে একটা বড় ঘড়ি। ব্যস! আর কিছু নেই।
বাহুল্য তো দূরের কথা। তবু ওকে এমন অপরূপা মনে হয় যে দুটো চোখ টেনে নেবেই। সুন্দর ও সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্যই এখানে। চাপা চামেলী-জুই যেখানেই থাকুক, তাদের সৌন্দর্য-সৌরভে অন্তত মুহূর্তের জন্যও মানুষ একটু আনমনা হবেই।
কেয়া ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। দুএক মিনিটের মধ্যেই কাস্টমস-এর কাজ শেষ হয়। বিদায়ের প্রাক্কালে কেয়া শুধু বলে, আবার আসবেন।
–আসব বৈকি! এখানে না এসে আর কোথায় যাব? আয়েষা একটু হেসেই জবাব দেন কিন্তু সামান্য হাসিতেও ঐ মুখে যে ঔজ্জ্বল্য কেয়া আশা করেছিল, তা দেখা গেল না। ভোল্টেজ কম থাকলে দুশ একশ পাওয়ারের বালবও যেমন টিমটিম করে জ্বলে, ঠিক তেমন আর কি!
কেয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রথম কয়েকবার যাতায়াত করার সময় কিছুই জানতে পারিনি। শুধু পাসপোর্ট দেখে জেনেছিলাম, উনি বহুদিন বিদেশে ছিলেন। আর উনি ডাক্তার।
–আর কিছুই জানতে পারো নি?
-না। একটু থেমে বলল, তবে ওকে দেখে এইটুকু আন্দাজ করেছিলাম, কোথায় যেন একটা ব্যথা লুকিয়ে আছে কিন্তু উনি প্রকাশ করতে চান না।
দিন চলে যায়, মাস ঘুরে যায়। কত শত সহস্র যাত্রী হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত করেন। ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে তাদের পাসপোর্টে ছাপ পড়ে। কাস্টমস-এর লোকজনের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা জমাতে চান। যাত্রীদের সঙ্গে অহেতুক বকবক করতে চেকপোস্ট-কাস্টমস-এর কর্মীদেরও তেমন গরজ হয় না কিন্তু কখনো কখনো ব্যতিক্রম ঘটে বৈকি!
–আরে আপনি! কেয়া আয়েষাকে দেখেই হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায়।
কাউন্টারের উপর হ্যাণ্ডকাপ রেখেই আয়েষা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছেন ভাই?
–ভাল। মুহূর্তের জন্য একটু থেমেই কে জিজ্ঞেস করে, আপনি?
খুব ভাল আছি। কৃষ্ণপক্ষের গভীর অন্ধকার রাত্রে কোন চিরদুঃখীর বেহালায় যে কান্নার সুর ভেসে আসে, আয়েষার কথায় ঠিক তেমনি বেদনার ছোঁয়া পায় কেয়া। একবার ওর দিকে তাকায়। বোধহয় ওর বেদনার ইঙ্গিত পাবার চেষ্টা করে। না, না, অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চায় না। তাই শুধু জিজ্ঞেস করে, এবারও কী আজমীঢ় যাচ্ছেন?
-না, ভাই, এবার শুধু কলকাতায় যাচ্ছি।
–কিছুদিন থাকবেন তো?
কেয়ার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে উনি বলেন, শুধু কালকের দিনই থাকবে। পরশুই ফিরব।
কেয়া অবাক হয়ে বলে, সেকি? মাত্র একদিনের জন্য কলকাতা যাচ্ছেন?
আয়েষা ঠোঁটের কোণায় ঈষৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে বলেন, কালকেই আমার কাজ। তারপর শুধু শুধু কী করতে থাকব? একটু থেমে কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, তাছাড়া একলা একলা কী করব বলুন?
কেয়া কিছু বলার আগেই উনি আবার বলেন, আপনি চলুন আমার সঙ্গে। দুচারদিন বেশ একসঙ্গে কাটান যাবে।
এ সংসারে সবাই কিছু কিছু মানুষের সান্নিধ্য পাবার জন্য কাঙাল। মনের এই বাসনা কখনো পূর্ণ হয়, কখনো হয় না, কখনো কেউ প্রকাশ করে, কখনো আবার অপ্রকাশিতই থেকে যায়। মনের ইচ্ছা মনের মধ্যেই চাপা থাকে। আয়েষার সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হবার সাধ কেয়ার মনের মধ্যে নিশ্চয়ই ছিল। তাই তো সে দুএকজন ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কথা বলেই দৌড়ে সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের কাছে গেল।
কয়েক মিনিট পরেই কেয়া ঘুরে এসে বলল, আপনি যদি বিকেলের দিকে যান, তাহলে আমিও যেতে পারি। ও একটু থেমে বলল, আমিও বহুদিন কলকাতায় যাই না।
আয়েষা বললেন, আপনি যদি যান, তাহলে কেন বিকেলে যাব? আজ রাত্তিরের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছলেই হলো।
.
ফুল আর মালা নিয়ে তিলজলার কবরখানায় ঢোকার আগেই আয়েষা মনে মনে বললেন, আস্সালাতত ইয়া আহলুল করবে হে পবিত্র কবরবাসীরা, তোমাদের প্রতি ঈশ্বর শান্তি বর্ষণ করুন।
তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে ফুল আর মালায় ঢেকে দিলেন সারা কবরটা। জ্বেলে দিলেন ধূপ। হাঁটু ভেঙে বসে দুহাত পেতে মোনাজাত করলেন কতক্ষণ। মোনাজাত শেষ হবার পরও উনি ওঠেন না। উঠতে পারেন না। নীরবে চোখের জল ফেললেন আরো কতক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে কেয়াকে বললেন, চলুন, ভাই।
কেয়া সঙ্গে সঙ্গে এগুতে পারে না। ঐখানে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল, এটা কার কবর?
–আমার শত্রুর।
কেয়া কোন কথা না বলে ওর দিকে তাকাতেই উনি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, যে আমার সারা জীবনের সমস্ত আনন্দ কেড়ে নিয়েছে, যার জন্য আমাকে চিরকাল শুধু চোখের জল ফেলতে হবে, সে শত্রু না?
কেয়া আর কোন প্রশ্ন করে নি কিন্তু মর্মে মর্মে অনুভব করেছিল ওর মনের ব্যথা ও ভালবাসার গভীরতা।
তিলজলা কবরখানা থেকে ফেরার পরও বিশেষ কোন কথা হয় নি; তবে সেদিন রাত্রে আর আয়েষা না বলে পারে নি।-ফাইন্যাল এম. বি. বি এস-এ রেজাল্ট ভালই হলো। তাছাড়া সার্জারীতে একটা গোল্ড মেডালও পেলাম। আয়েষা একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আর ঐ গোল্ড মেডাল পাওয়াই আমার কাল হলো।
-কেন?
–কেন আবার? আমাকে এফ. আর. সি. এস. পড়াবার জন্য সবাই মেতে উঠলেন।
সত্যি আয়েষার বিলেত যাবার তেমন ইচ্ছে ছিল না। হাজার হোক বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ওদের ছেড়ে অত দূরে যেতে মন চাইছিল না। কিন্তু আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ডাঃ করিম পর্যন্ত এমন করে বললেন যে আয়েষা অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে রাজী হলো। তারপর একদিন অপরাহ্ন বেলায় ঢাকা থেকে রওনা হয়ে করাচী-রোম-প্যারিস ডিঙিয়ে লণ্ডন হাজির হলো।
সময় তো কোন কারণেই অপেক্ষা করতে জানে না, পারে না। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল কত দিন কত মাস। আয়েষা সত্যি সত্যি একদিন এডিনবরা থেকে এফ. আর. সি. এস. হয়। রেজাল্ট বেরুবার পরদিন সকালেই ডাঃ ম্যাক্সওয়েল ওকে বললেন, নো, নো, আয়েষা, আমি এখনই তোমাকে ঢাকা ফিরতে দেব না। তুমি অ্যাট লিস্ট বছর দুই আমার সঙ্গে কাজ করবে।
পৃথিবী বিখ্যাত অত বড় সার্জেনের এমন আমন্ত্রণে আয়েষা নিজেকে ধন্য মনে করে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার জন্য মনপ্রাণ বাকুল হয়ে ওঠে।
–লুক হিয়ার আয়েষা, আমি ডেফিনিটলি জানি বছর দুয়েক আমার সঙ্গে কাজ করলে তুমি রিয়েলি আউটস্ট্যাণ্ডিং সার্জেন হবে।
আয়েষা শুধু বলেছিল, অ্যাজ ইউ প্লীজ স্যার!
ডাঃ ম্যাক্সওয়েল দুহাত দিয়ে ওর ডান হাতটা চেপে ধরে বলছিলেন, আমি জানতাম, তুমি আমার রিকোয়েস্ট টার্ন ডাউন করবে না।
লণ্ডনের অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত সেন্ট টমাস হাসপাতালে আয়েষার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
আয়েষা খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেয়াকে বলল, জানো ভাই, ঐ লণ্ডনে এসেই আমার সর্বনাশ হলো।
-কেন?
বাঙালীদের নববর্ষ অনুষ্ঠানে কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার পরই একজন ইয়াংম্যান আমাকে এসে কী বলল জানো?
-কী বললেন?
ঘন কালো মেঘের ফাঁক দিয়েও যেন ঈষৎ সূর্যরশ্মি দেখা দেয়। আয়েষা একটু হাসে। বোধহয় সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করেও একটু সুখের পরশ অনুভব করে।
–শুনলাম ডাঃ ম্যাক্সওয়েলের আণ্ডারে সেন্ট টমাস হসপিট্যালে কাজ করছেন?
–হ্যাঁ।
উনি আয়েষার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, আল্লা আর কি কি গুণ আপনাকে দিয়েছেন বলতে পারেন?
ওর কথায় আয়েষা একটু না হেসে পারে না। জিজ্ঞেস করে, তার মানে?
— এমন রূপ যে তাকাতে ইচ্ছে করে না, এমন বিচ্ছিরি গান গাইলেন যে কেউ হাততালি দিল না, তার উপরে হাতুড়ে ডাঃ ম্যাক্সওয়েলের জুনিয়র!
যে বাঙালী ছেলেমেয়েরা দেশে থাকতে সহজভাবে মেলামেশা করতে পারে না, তারাই বিদেশে গিয়ে কত পাল্টে যায়। যাবেই। পরিবর্তিত সামাজিক পরিবেশে এই পরিবর্তন নিতান্তই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিতও। তাই ওর কথায় আয়েষা বিস্মিত হয় না। তবে মনে মনে ভাবে, এত মানুষ গান শুনলেও ঠিক এই ধরনের অভিনন্দন তো আর কেউ জানালেন না।
কেয়াকে অত্যন্ত আপনজন ভেবেই আয়েষা বলেন, বিশ্বাস করো কেয়া, সেদিনের আগে কোনদিন কখনও এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি, কাউকে ভালোবাসি বা এমন কাউকে দেখিনি যাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করেছে। সেদিন সেই মুহূর্ত থেকে আমি রশীদের ভালোবাসায় ভেসে গেলাম।
কেয়া একটু হেসে বলল, কোন না কোনদিন তো মানুষের জীবনে বাঁধ ভাঙবেই ভাই।
-তা ঠিক, কিন্তু আগে তো তা ভাবতাম না।
-তারপর?
আয়েষা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বেশীদিন না, বছর দেড়েক মাত্র। স্বপ্ন দেখতে দেখতেই কেটে গেল।
.
লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের ছাত্র হয়েও রশীদ যে এমন গান পাগল হবে, তা আয়েষা ভাবতে পারে নি। পার্লামেন্ট হিল-এ বসে অনেকক্ষণ অনেক কথা বলার পর রশীদ আয়েষার একটা হাত আলতো করে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, জানো বেগম, আমি কী স্বপ্ন দেখি?
–কী?
রশীদ একটু চুপ করে থাকে। তারপর সবুজের মেলায় দৃষ্টি ছড়িয়ে প্রায় আনমনেই বলে, আমি মারা যাবার পাঁচ-দশ মিনিট পর তুমি মারা যাবে।
আয়েষা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ এ কথা বলছ কেন?
–কেন আবার? মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি, তখন মরতে তো হবেই। রশীদ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কিভাবে বেঁচে থাকব, তা যদি ভাবা যায়, তাহলে মারা যাবার বিষয়েই বা ভাবতে বাধা কী?
কিন্তু তুমিই বা আগে মরবে কেন আর আমিই বা তার পাঁচ দশ মিনিট পর মরব কেন?
-কেন আবার? মরবার সময় তোমার গান শুনব না? রশীদ নির্বিকারভাবে বলে।
আয়েষা ওর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়। বিস্মিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি যখন মারা যাবে, তখন আমি গান গাইব?
-হ্যাঁ, বেগম, আমি মারা যাবার সময় তুমি গাইবে, জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।
-বাদশা, তুমি একটা বদ্ধ পাগল!
বর্ষণক্লান্ত শ্রাবণ সন্ধ্যার আকাশে মুহূর্তের জন্য বিদ্যুতের আলোর মত আয়েষার মুখেও ঈষৎ হাসির রেখা একবার যেন উঁকি দেয়, বলে, সত্যি কেয়া, বাদশা একটা আস্ত পাগল ছিল। এক একদিন কী বলত জানো?
কেয়া মুখে কিছু বলে না, শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
-বলতো, বেগম, আজ কোন কথা বলব না, শুধু তোমাকে প্রাণভরে দেখব। আবার কতদিন ও গান শোনার পর কিছু খাওয়া দাওয়া না করেই ঘুমিয়ে পড়তো।
-কেন?
–কেন? ও বলতো, রবি ঠাকুরের এইসব গান শুনলে এমন মন ভরে যায় যে আর খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছই করে না।
-উনি রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিলেন, তাই না?
-হ্যাঁ, ভাই। আয়েষা ওর ক্ষণস্থায়ী বসন্তের স্মৃতি রোমন্থন করে প্রচ্ছন্ন গর্বের হাসি হেসে বলে, বাদশা তোমাদের কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজের অত্যন্ত নামকরা ছাত্র ছিল। তাছাড়া এম. এ তে সেবার ও একাই ফার্স্ট ক্লাস পায়। এল-এস-ই-তে ভর্তি হবার পর অবসর সময় শুধু সঞ্চয়িতা পড়েই কাটাত।
কেয়া একটু হাসে।
-হাসছ কী ভাই? আমার সঙ্গে আলাপ হবার আগে ঐ বিদেশে সঞ্চয়িতাই ছিল ওর একমাত্র বন্ধু। মদ তো দূরের কথা, বাদশাকে কোনদিন একটা সিগারেট পর্যন্ত খেতে দেখি নি।
আয়েষা একটু থেমে বলে, ওর দেড় বছর বয়েসের সময় ওর আব্বা মারা যান। আম্মা অনেক দুঃখে কষ্টে ওকে বড় করেন। তাই তো আম্মা দুঃখ পান, এমন কোন কিছু ও করত না কিন্তু ..
আয়েষা হঠাৎ থেমে যায়। মুখ নীচু করে কি যেন ভাবে। কেয়াই প্রশ্ন করে, কিন্তু কী?
আয়েষা মুখ না তুলেই মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করে, ছোটবেলা থেকে আম্মাকে কোনদিন কোন ব্যাপারে দুঃখ দাও নি বলেই বোধহয় এক আঘাতেই সব পাওনা মিটিয়ে দিলে; তাই না?
অনেকক্ষণ কেউই কোন কথা বলে না। বোধহয় এইভাবেই দশ পনের মিনিট কেটে যায়। তারপর কেয়া জিজ্ঞেস করে, আম্মা কোথায় আছেন?
–তিলজলার কবর থেকে ফেরার পর আম্মা আর বেনেপুকুরের বাড়িতে ফিরে যান নি।
–আর ফিরে যান নি?
এবার আয়েষা মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলে, না ভাই, আম্মা আজো ফিরে আসেন নি। খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আম্মা নিশ্চয়ই ছেলের কাছেই চলে গেছেন, নরক যন্ত্রণা ভোগ করছি শুধু আমি।
হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে দুদেশের কত অসংখ্য নারী পুরুষ যাতায়াত করেন কিন্তু তাদের মনের কথা, প্রাণের দুঃখের হদিস পায় না চেকপোস্ট কাস্টমস-এর কর্মীরা। সম্ভবও নয়। সুখ দুঃখের কথা জানাবার বা জানবার গরজই বা কার হয়?
কদাচিৎ কখনও ব্যতিক্রম ঘটে বৈকি! হাজার হোক সবাই তো মানুষ!
যাত্রীদের মত চেকপোস্ট-কাস্টমস-এর লোকজনদেরও তো হৃৎপিণ্ড ওঠা-নামা করে। সুখ দুঃখ প্রেম ভালোবাসা বিরহ বেদনার অনুভূতি তো সব মানুষেরই আছে। রক্ত মাংসের দেহ তো এর উর্ধ্বে যেতে পারে না!
কথায় কথায় অনেক রাত হয়েছিল। দুজনেই শুয়ে পড়ে। মুখোমুখি শুয়ে থাকলেও কেউ কোন কথা বলে না, বলতে পারে না। নিশুতি রাতের কোলে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।
হঠাৎ কী কারণে যেন কেয়ার ঘুম ভেঙে যায়। বারান্দা থেকে ভেসে আসে
জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।
এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে…
না, আয়েষা আর পারে না, হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে, বাদশা, আমাকে তুমি কাছে টেনে নাও লক্ষ্মীটি! আমি আর পারছি না বাদশা…
কেয়া এক চুল নড়তে পারে না। সাহস হয় না। প্রাণহীন মর্মর মূর্তির মত বিছানায় বসে বসেই শুধু চোখের জল ফেলে।
.
০৯.
অধিকাংশ মানুষই মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে অরণ্য-পর্বত সমুদ্রের কাছে ছুটে যায় শান্তির আশায়, আনন্দের লোভে, বৈচিত্রের সন্ধানে। কিন্তু মানুষের কাছে যে শান্তি, যে আনন্দ ও বৈচিত্র্য কখনও কখনও পাওয়া যায়, তা কি অন্যত্র সম্ভব?
প্রকৃতির লীলাক্ষেত্রে মৌনী হিমালয়, আকাশচুম্বী বনানী, অশান্ত দুরন্ত সমুদ্র নিশ্চয়ই এক একটি বিস্ময় কিন্তু সব বিস্ময়ের শেষ কী মানুষ না? আমাদের আশেপাশেই চেনা, অচেনা মানুষই তো পরম বিস্ময়।
লণ্ডন না, নিউইয়র্ক না, রোম, প্যারিস মস্কোও না, দিল্লী বা হাতের কাছের করাচীতেও না, এই হরিদাসপুর বেনাপোল সীমান্ত চেকপোস্টের দুএকটি রাত কাটিয়ে সেই চিরসত্যকে আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম।
বাংলাদেশ যাবার সময় নিত্য যখন আমাকে ফেরার পথে এখানে কয়েকদিন কাটাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, তখন প্রস্তাবটি বিশেষ লোভনীয় মনে হয় নি। বোধহয় মনে মনে একটু হাসিও পেয়েছিল। ভেবেছিলাম, একি দার্জিলিং, না ওটি বা নৈনিতাল যে নিত্য এমন করে আমন্ত্রণ করছে?
মনে মনে ইচ্ছা অনিচ্ছার দোল খেতে খেতেই বেনাপোলের ওসি সাহেবের কাছে পাসপোর্ট ছাপ লাগাবার জন্যই গিয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাসপোর্টের ছাপকে ম্লান করে মনের ছাপই অনেক অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সীমান্তের পাশে দুটি দিন কাটাবার পর আজ মনে হচ্ছে, এই ত এলাম। মাত্র এই দুটি দিনের মধ্যেই কী সীমান্তের দুদিকের খাকি পোশাক পরা মানুষগুলোকে ভালবেসে ফেলেছি?
জানি না। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, এদের সান্নিধ্য আমার ভাল লাগছে। এদের ছেড়ে যেতেও ঠিক উৎসাহ বোধ করছি না। একেই কি ভালবাসা বলে? নাকি বন্ধুত্বের লোভ, সান্নিধ্যের মোহ?
নিত্য এই দুদিন আর ওদের ব্যারাকে থাকেনি; ডিউটির সময়টুকু ছাড়া আমার সঙ্গে থাকারই চেষ্টা করেছে। রাত্রে আমার সঙ্গেই কাস্টমস কলোনীর গেস্ট হাউসে থাকে। দুটো খাটে মুখোমুখি শুয়ে আমরা কত গল্প করি।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিত্যকে চুপ করে বসে থাকতে দেখেই জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো? সকালে উঠেই কী এত ভাবছ?
-ভাবছি জয়ন্তীর কথা।
–জয়ন্তীর কথা? -হঠাৎ ওর কথা ভাবছ কেন?
ও আগের মত গম্ভীর হয়েই বলল, পাঁচ সাত তারিখের মধ্যেই ফিরবে বলেছিল কিন্তু ..
নিত্য কথাটা শেষ না করেই কি যেন ভাবে।
আমিও জয়ন্তীর কথামতই সাত তারিখে এসেছি। ও না বললে হয়ত দুএকদিন এদিক ওদিক কাটিয়ে আসতাম। মনে মনে কোন স্বপ্ন না দেখলেও ওর সান্নিধ্যের লোভ নিশ্চয়ই ছিল। এই দুদিন নানাজনের সান্নিধ্যে সব সময় ওর কথা মনে করার সুযোগ না পেলেও বার বার বহুবার ওর কথা ভেবেছি। ভাবতে ভাল লেগেছে। না ভেবে পারিনি।
মনে মনে কত কি ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম প্রায় নির্জন যশোর রোডের আলোয় ছায়ায় আমরা দুজনে কত ঘুরব, কত কথা বলব আর শুনব। হয়তো আরো কিছু ভেবেছিলাম।
না, না, ভালবাসিনি কিন্তু শীতের আগে হেমন্তের শেষে শিশির ভেজা সকালে যেমন সামান্য শিহরণ অনুভূত হয়, অনেকটা সেই রকম চাপা ভাল লাগার ক্ষীণ অনুরণন বোধহয় মনের এক নিভৃত পল্লীতে জেগে উঠেছিল।
ওর মধ্যে কার যেন একটা প্রতিচ্ছবি, কোন এক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির এমন প্রতিবিম্ব দেখেছি যে তারই আশায় কী সোনার হরিণের পিছনে আমার মন ছুটেছে?
মনের মধ্যে যাই হোক, আমি কখনও কিছু প্রকাশ করিনি, করা সম্ভব নয়। তাই তো একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেই নিত্যকে বললাম, হাজার হোক বাবা-মার কাছে গেছে। কবে ফিরবে, তার কি কোন ঠিক-ঠিকানা আছে?
-না, না, ও সাত তারিখেই ফিরবে বলছিল। নিত্য একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাছাড়া ও জানে, আমি একজনের খবরের জন্য বসে আছি।
এবারও যেন নিত্য পুরো কথাটা বলল না। মনে হলো, কিছু কথা ওর মনের মধ্যেই লুকিয়ে রইল। আমিও ওকে কোন প্রশ্ন করলাম না।
সকালবেলায় নিত্য কোনদিনই গল্পগুজব করার বিশেষ সময় পায় না। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করার জন্য দুদিনই সকালে উঠতে দেরি হয়েছে। তাই আজকেও ও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চেকপোস্টে চলে গেল।
নিত্য চলে যাবার পর একটা সিগারেট শেষ করার আগেই অমিত আর নিবেদিতা হাসতে হাসতে আমার ঘরে ঢুকল। আমি ওদের দেখেই প্রশ্ন করি, সকালে ঘুম থেকে উঠেই দাদার কথা মনে পড়ল?
অমিত বলল, আজ থেকে তো আমার নাইট ডিউটি শুরু। তাই বাড়িতে বসে না থেকে আপনার এখানে চলে এলাম।
নিবেদিতা ফ্লাস্ক ভর্তি চা এনেছিল। ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, আপনাকে তো রোজ রোজ পাব না, তাই ভাবলাম, একটু বিরক্ত করে আসি।
-আমি সকাল থেকে মাঝ রাত্তির পর্যন্ত তোমাদের সবাইকে বিরক্ত করছি। তাতেও কী তোমার আশ মেটে নি?
নিবেদিতা আমার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে একটু হেসে বলল, আপনার বিরক্ত করার দৌলতে তবু আমরা একঘেয়েমি থেকে একটু মুক্তি পেয়েছি।
অমিত বলল, ঠিক বলেছ।
চা খেতে খেতে আমরা তিনজনে কথা বলি। আমার আর অমিতের পেয়ালা খালি হতেই নিবেদিতা আবার ভরে দেয়। ঐ পেয়ালার চা শেষ হতে না হতেই একটা টিফিন বক্স আর ফ্লাস্ক হাতে নিয়ে রেখা নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই তো ভারী স্বার্থপর! আমাকে না ডেকেই নিজের বরকে নিয়ে দাদার কাছে চলে এলি?
অমিত বলল, দোষটা ওর নয়, আমার। আমিই ওকে…
রেখা টেবিলের উপর টিফিন বক্স আর ফ্লাস্ক রাখতে রাখতে বলল, সে আমি জানি। আপনার সংসর্গে যে নিবেদিতা দিন দিন খারাপ হচ্ছে, তা কী আমরা জানি না।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, দুঃখ করো না রেখা। আমার সংসর্গে তোমরা সবাই খারাপ হয়ে নিবেদিতার সমান সমান হয়ে যাবে।
ওরা তিনজনে হাসতে হাসতে প্রায় একসঙ্গেই বলে, না, না, দাদা, আপনি কাউকেই খারাপ করবেন না।
রেখার আজ ছুটি। তাই সকালবেলাতেই আড্ডাটা বেশ জমে ওঠে। ওরই মধ্যে চিড়ের পোলাও আর একবার চা হয়ে যায়। ডিউটিতে যাবার পথে অরূপ শাসিয়ে যায়, বাচ্চুদা, সন্ধ্যে ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত আমি আর আপনি দরজা বন্ধ করে গল্প করব। কোন আলতু-ফালতু ছেলেমেয়ে সেখানে ঢুকতে পারবে না।
রেখা হাসি চেপে বলল, ঠিক বলেছ অরূপদা! নিবেদিতার মত আজেবাজে মেয়েকে আমাদের আড্ডায় ঢুকতে না দেওয়াই উচিত।
-থাক, থাক, আর ন্যাকামি করতে হবে না। কথাটা শেষ করতে না করতেই অরূপ ঘরের বাইরে পা বাড়ায়।
আমাদের আসর আবার জমে ওঠে। কোথা দিয়ে যে একদেড় ঘণ্টা সময় পার হয়ে যায়, তা আমরা কেউই টের পাই না। হঠাৎ হাসতে হাসতে নিত্যকে ঘরে ঢুকতে দেখেই অবাক হয়ে যাই। সকালবেলায় যাকে গম্ভীর মুখে অফিস যেতে দেখলাম, তার মুখে এত হাসি দেখে অবাক হব না? আমি কিছু বলার আগেই ও পিছন ফিরে বলল, দেখুন, দেখুন, বাচ্চু কি রকম আড্ডা জমিয়েছে।
ঘরের দরজায় পা দিয়েই জয়ন্তী এক পলকের জন্য আমার দিকে তাকিয়েই নিত্যকে বলল, আপনার বন্ধু এখানে আছেন, তা তো এতক্ষণ বলেননি?
–সরি।
যাবার দিনই অমিতের সঙ্গে জয়ন্তীর পরিচয় হয়েছিল। তাই অমিত নিবেদিতা আর রেখার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেয়। রেখা সঙ্গে সঙ্গে ওকে এক কাপ চা দিয়েই বলে, চিড়ের পোলাও ফুরিয়ে গেছে বলে দিতে পারলাম না বলে রাগ করবেন না।
এবার জয়ন্তী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, বেশ সুখেই আছেন দেখছি।
–আপনি ছিলেন না বলেই সুখে ছিলাম।
ভয় নেই, আজ দুপুরের ট্রেনেই পালাচ্ছি।
নিত্য চা খেতে খেতে বলল, আজকে তোমাদের কাউকেই ছাড়ছি না। কাল সকালের ট্রেনে দুজনেই এক সঙ্গে চলে যেও।
জয়ন্তী সঙ্গে সঙ্গে ওকে বলল, আমি না হয় আপনার মেয়ের খবর এনে দিয়েছি বলে খাতির পেতে পারি কিন্তু ওকে আটকাচ্ছেন কেন?
আমি জয়ন্তীর কথা শুনে অবাক হয়ে নিত্যর দিকে তাকিয়ে বলি, তোমার মেয়ের খবর উনি আনলেন কী করে?
নিত্য জবাব দেবার আগেই জয়ন্তী ওকে বলেন, সে কী? আপনি আপনার বন্ধুকেও মেয়ের কথা বলেন নি?
নিত্য একটু লজ্জিত হয়েই বলে, না, বলা হয় নি।
জয়ন্তী বললেন, থাক, আপনাকে আর বলতে হবে না, আমিই ওকে বলব।
কদিন ধরেই দিনরাত বৃষ্টি হচ্ছিল। শনিবার বিকেলের দিকে সেই সঙ্গে শুরু হলে তুমুল ঝড়। সীমান্তের দুদিকেই যে কত বড় বড় গাছপালা ভেঙে পড়ল তার ঠিক ঠিকানা নেই। আশেপাশের গ্রামের অধিকাংশ কাঁচা বাড়িরই চাল উড়ে গেল। বহু পাকা বাড়িরও কম ক্ষতি হলো না।
চেকপোস্টের শিবুবাবু তিন সপ্তাহ পর গত বৃহস্পতিবার বাড়ি গিয়েছেন। অফিসের কাজেই এসআই পৃথ্বীশবাবুকে শুক্রবার সকালে কলকাতা পাঠাতে হয়েছে। ওদের দুজনেরই শনিবার বিকেলের মধ্যে ফেরার কথা কিন্তু সন্ধ্যে পর্যন্ত তাদের কোন পাত্তা নেই।
সন্ধ্যে ঘুরে যাবার পর এ-এস-আই নিরঞ্জনবাবু নিত্যকে বললেন, স্যার, ওদের দুজনের কেউই তো এখনও এলেন না।
নিত্য একটু চিন্তিত হয়েই বলল, হ্যাঁ, তাইতো দেখছি। -মনে হয়, এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ওরা ফিরতেও পারবেন না।
–কোথাও হয়ত তার-টার ছিঁড়ে গেছে। তাই ট্রেন চলছে কিনা, তাই বা কে জানে!
–তাও হতে পারে স্যার!
ঠিক এমন সময় খুব জোরে বাজ পড়তেই আলো নিভে গেল। নিত্য বলল, বোধহয় বনগাঁ শহরের কাছাকাছিই বাজ পড়ল। কার সর্বনাশ হলো কে জানে।
কনস্টেবলরা সঙ্গে সঙ্গে লণ্ঠন জ্বেলে দেন। নিরঞ্জনবাবু এবার বলেন, স্যার, ওরা দুজনের কেউই যদি না আসেন তাহলে রাত্রে কী আমরাই থেকে যাব?
-হা হা, আমিই দেব। এবার ও একটু হেসে বলে, রাত্রে আপনার ডিউটি দিলে সকালেই আপনাদের হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
কিছুক্ষণ পর নিত্য একবার ওপারে গিয়ে চেকপোস্টে ওসি সাহেব ও কাস্টমস্ এর সবাইকে বলে এলেন, শিববাবু আর পৃথ্বীশবাবু ফিরে আসেন নি, বলে রাত্রে আমিই ডিউটিতে থাকব। মনে হয় না, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কেউ আসবে। তবু ভাই, আপনারা একটু খেয়াল রাখবেন।
ওরা সবাই ওকে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বললেন, কোন পাগল ছাড়া আর কেউ আজ ঘর থকে বেরুবে না।
নিত্য হাসতে হাসতে বলে, পাগল এলে তো আমাদের কাজ আরো বেড়ে যাবে।
নিত্য খেয়েদেয়ে ডিউটিতে আসার পর ঝড়ের বেগ সামান্য একটু কমলেও আরো জোরে বৃষ্টি শুরু হলো। ঘরের দরজা আগেই বন্ধ ছিল কিন্তু এবার জানালা খুলে রাখাও অসম্ভব হয়ে উঠল। টেবিলটা আরো খানিকটা দূরে সরিয়ে রথীন বললেন, স্যার, জানালা দিয়ে বড় বেশি জল আসছে।
–কী আর করা যাবে? জানালা বন্ধ করলে তো কিছুই দেখা যাবে না।
কনস্টেবল রথীন একটু হেসে বললেন, স্যার, আজকে জানালার সামনে দিয়ে কেউ গট গট করে হেঁটে গেলেও আমরা তাকে দেখতে পাব না।
নিত্যও হাসে। বলে, তা ঠিক।
রাত সাড়ে-দশটা-এগারোটা নাগাত বাঞ্ছা কোনমতে এক মগ ভর্তি চা পৌঁছে দিয়েই বলল, স্যার, ঘরে এত জল পড়ছে যে আর চা তৈরী করা সম্ভব হবে না।
–ঠিক আছে। কি আর করা যাবে।
রাত এগিয়ে চলে। ঝড়-বৃষ্টির মাতলামিও সমান তালে চলতে থাকে। নিত্য চেয়ারে বসে টেবিলের উপর দুটো পা তুলে দিয়ে সিগারেট টানে। দুজন কনস্টেবল চুপচাপ বসে বসে ক্লান্ত হয়। মাঝে মাঝে একটু ঝিমুনিও ধরে। সময় যেন কাটতে চায় না।
তবু সময় এগিয়ে চলে।
লণ্ঠনের আলোয় একবার হাতের ঘড়িটা দেখে নিত্য একটু জোরেই বলে, কী রথীন, ঘুমুলে নাকি? মোটে তো পৌনে বারোটা বাজে।
–না স্যার, ঘুমোই নি।
–আলো থাকলে তবু একটু গল্পের বই-টই পড়া যেতো।
–হ্যাঁ, স্যার।
অন্য কনস্টেবলটি বললেন, পঞ্চার দোকানটা খোলা থাকলে তবু একটু চা পাওয়া যেতো।
নিত্য একটু হেসে বলে, কপাল যখন মন্দ হয়, তখন এইরকমই হয়।
বড় জোর আধঘণ্টা হবে। নিত্য একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ রথীনের চিৎকার শুনেই ও লাফ দিয়ে উঠল। চার ব্যাটারীর তিনটে টর্চের আলোর সামনে মেয়েটি পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে পড়ল কিন্তু কে একজন যেন ঐ অন্ধকারের মধ্যেই দৌড়ে পালাল।
জয়ন্তী একটু থামে। একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। তারপর বলে, আপনার বন্ধু এক লাফে মেয়েটির সামনে হাজির হতেই ও হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওর দুটো পা জড়িয়ে ধরল…
..আপনি আমাকে বাঁচান। আপনি আমার আব্বু, আপনি, আমার আম্মা! আপনি আমাকে বাঁচান।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর নিত্য বলল, সত্যি বাচ্চু, এমন নিষ্পাপ করুণ মুখ আমি জীবনে দেখিনি।…
জয়ন্তী বললেন, ঠিক বলেছেন। আমিও ওকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এবার উনি নিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, সেদিন আপনি রাবেয়াকে না বাঁচালে ওর কপালে যে কি দুঃখ ছিল, তা ভগবানই জানেন।
এবার আমি প্রশ্ন করি, সেদিন রাত্রে ওর কী হয়েছিল?
নিত্য বেশ গম্ভীর হয়েই বলে, ভাই, আমাদের এইসব দেশে সরল মেয়েদের সর্বনাশ করার লোক কী কম? ও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই আবার বলে, ও হারামজাদাটাকে তো ধরতে পারলাম না কিন্তু আম্মার কাছে সব শুনে মনে হলো, ও একটা অতি বদমাইশ স্মাগলারের খপ্পরে পড়েছিল।
-তাই নাকি?
-তাই তো মনে হয়।
–কিন্তু ওরা ওভাবে পালাচ্ছিল কেন?
–ও হতচ্ছাড়ার একটা ইণ্ডিয়ান পাসপোর্ট ছিল। সেই পাসপোর্ট দেখিয়েই ও বেনাপোল পার হয় কিন্তু আম্মার তো পাসপোর্ট ছিল না।
–ও!
–ও আম্মাকে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রেখে ওপারের চেকপোস্ট-কাস্টমস এর কাজ সেরে নেয়। চেকপোস্ট-কাস্টমস এর কেউ ভাবতেও পারেনি ওর সঙ্গে আর কেউ আছে।…
–তাছাড়া ঐ দুর্যোগের রাত্তির।
-হা; তাই তো ওরা কেউ বাইরের দিকে নজর দেয় নি। নিত্য একটু থেমে বলে, তাছাড়া সে রাত্রের যা অবস্থা ছিল, তাতে বাইরে কেউ থাকলেও কিছুই দেখতে পেতো না।
আইন বলে, অমনভাবে কেউ কোন দেশে ঢুকলে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। থানা পুলিস-হাজতের হুজ্জোত পার হবার পর শুরু হবে কোটকাছারির পর্ব। তারপর লাল উঁচু পাঁচিল দেওয়া সরকারী অতিথিশালায় কিছুকাল সরকারী আতিথ্য উপভোগের পর একদিন ওপারের পুলিসের হাতে তুলে দিতে হবে। যারা চুরি করে যাতায়াত করেও ধরা পড়ে না, তাদের কথা আলাদা কিন্তু ধরা পড়লেই এই দীর্ঘ নরক যন্ত্রণা!
না, চেকপোস্টের ও-সি হয়েও নিত্য আইন মানতে পারে নি। একে কিশোরী, তারপর ঐ নিষ্পাপ করুণ দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে নিত্য ভুলে গিয়েছিল ও চেকপোস্টের ও-সি। আইন-কানুনের ধারা উপধারার কথা মুহূর্তের জন্যও মনে আসে নি। রাবেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বার বার শুধু একটা কথাই মনে হলো, মেয়েটা বেঁচে থাকলে বোধহয় এর মতই সুন্দর, এর মতই বড় হতো।
আপনি আমায় মারবেন না, আপনি আমায় জেলে দেবেন না। আব্বা, আপনি আমায় বাঁচান।
ওর চোখের জল দেখে নিত্যর চোখেও জল এসেছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, তোমাকে আমি মারব কেন মা? আমি না তোমার আব্বা? তুমি আমার আম্মা?
চেকপোস্টের ও-সি হয়েও নিত্য সেই মহাদুর্যোগের রাত্রিতেই চোরের মত লুকিয়ে লুকিয়ে হাজির হয়েছিল ওপারের ওসি সাহেবের কোয়ার্টারে। তারপর ওর দুটি হাত ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, দাদা, আমার মেয়েকে আপনি বাঁচান। আপনি না বাঁচালে তাকে আত্মহত্যা করে মরতে হবে।
নিত্যকে শান্ত করে সবকিছু শোনার পর উনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আপনার মেয়ের কী আমি কেউ হই না? দাদা বলে যখন ডাকেন, তখন অত ভাবার কী আছে? পুলিসে চাকরি করি বলে কী আমিও মানুষ না?
সেই দুর্যোগের রাত্রিতে দুদেশের আইন-কানুনই অসংখ্য সরকারী নথিপত্রের মধ্যে কোথায় যে পড়ে রইল। তা কেউ জানতেও পারলেন না। রাবেয়া দুরাত বেনাপোলে কাটাবার পর আবার ও রংপুরের বাড়িতে ফিরে গেল।
এদিক দিয়ে রংপুরের কেউ গেলেই নিত্য ওর মেয়ের জন্য কিছু না কিছু পাঠাবেই। এবারও জয়ন্তীর সঙ্গে খুব সুন্দর একটা শাড়ি পাঠিয়েছে। সুযোগ পেলে রাবেয়াও তার নতুন আব্বা আর বড় চাচার জন্য কিছু পাঠাতে ভুলে যায় না।
সব শোনার পর আমি নিত্যকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি মেয়েকে দেখতে যাও?
নিত্য ম্লান হাসি হেসে মাথা নেড়ে বলল, আমরা শুধু মানুষের আসা-যাওয়া দেখি; নিজেরা কখনও যাই না।
–সেকি! মেয়েকে দেখতেও যাওনি?
-না ভাই! নিত্য হঠাৎ একটু উজ্জ্বল হাসি হেসে বলল, মেয়েকে বলেছি, নাতি কোলে করে আসতে।
নিত্য আমার আর জয়ন্তীর সামনে বসে থাকলেও মনে হলো, সে যেন কোন স্বপ্নরাজ্যে, আনন্দের অমরাবতীতে চলে গেছে। ঘুষখোর পুলিস অফিসার হয়েও নিত্যর চোখের কোণায় দুফোঁটা জল চিকচিক করছে দেখে আনন্দে খুশিতে আমার মন ভরে গেল।
.
পরের দিন সকালে বনগাঁ লোক্যালে চড়বার সময় নিত্য আমার কানে কানে বলল, এই কদিন অনেকের অনেক কিছুই তো শুনলে কিন্তু তুমি তোমাদের বিষয়ে কিছু বললে না।
ওর কথা শুনে আমার হাসি পায়। বলি, আমি আবার কী বলব?
এবার নিত্য হাসতে হাসতে একটু জোরেই বলে, দেখ বাচ্চু, সবকিছু চোখেও দেখা যায় না, কানেও শোনা যায় না কিন্তু তবু তারা ঘটে। ঘটবেই।
আমি শুধু হাসি।
ওর মুখে তখনও হাসি। বলে যায়, ওরে বাপু, ইচ্ছে করি না বলেই সব ক্রিমিন্যালকে ধরি না কিন্তু তার মানে এ নয় যে ক্রিমিনালদের আমরা চিনতে ভুল করি।
আমি কিছু বলবার আগেই জয়ন্তী জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার দাদা?
নিত্য জবাব দেবার আগেই ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। গাড়ির চাকা ঘুরতে শুরু করে। নিত্য ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে এগুতে এগুতে ওকে বলে, বাচ্চু সব বলবে। আর হ্যাঁ, নেমন্তন্ন করতে ভুলবেন না।
জয়ন্তী চাপা হাসি হাসতে হাসতে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।