৭-৯. শেষরাতে বাথরুমে

শেষরাতে একবার বাথরুমে গিয়েছিল সবুজ।

গলিতে দুটো কুকুরে মিলে কামড়া-কামড়ি, ঝগড়া-ঝগড়ি করছিল।

খোকা পাশের ঘরে কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়েছিল মাথার বালিশটাকে কোলবালিশ করে। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় শেষরাতে বেশ গা ম্যাজম্যাজ করছিল। উঠে গিয়ে পাখার রেগুলেটরে হাত দিয়ে ও খোকার ঘরের পাখার গতিটা কমিয়ে দিল।

তাও খোকাকে একটা আলাদা ঘর দিতে পেরেছে ও। বহুদিনের পুরোনো ভাড়াটে ওরা। চল্লিশ টাকায় বাড়িটা পেয়ে গিয়েছিলেন ওঁর বাবা। আজকে বাবা নেই, কিন্তু সবুজের গরিব বাবা তাকে শুধু, এই ফ্ল্যাটের ভাড়াটে-স্বত্ব দিয়ে গেছেন মরার সময়। ওর পক্ষে এটাও কম পাওয়া নয়। নইলে এ বাজারে ও যা মাইনে পায়, তাতে মাথা গোঁজার মতন এরকম একটা জায়গা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না।

কিন্তু খোকার প্রতি ওর কোনো মায়া-মমতা নেই। কেন যে নেই, তা ও জানে না। খোকা যত বড়ো হচ্ছে, ওর সঙ্গে ফণীর চেহারার, ফণীর মুখের আদলের, এমনকী ফণীর স্বভাবের সঙ্গেও বড়োবেশি মিল খুঁজে পাচ্ছে সবুজ। অথচ বিয়ের পর-পর হাসি যে, ফণী বলে কাউকে জানত, তাও অজানা ছিল সবুজের। ফণী এ-পাড়ায় মনোহারী দোকান করার পর-ই ওদের বাড়িতে তার যাওয়া-আসা আরম্ভ হয়েছে। তার আগেও যদি হাসির সঙ্গে তার যোগাযোগ থেকে থাকে, সেটা সবুজের অজ্ঞাতে। ঠাণ্ডামাথায় ভেবে-দেখলে সবুজ বুঝতে পারে যে, তার মনে সন্দেহটা হয়তো অমূলক, কিন্তু তবু, কার সন্দেহই বা কবে কখন সত্যনির্ভর ছিল? সন্দেহ হয়; সন্দেহ হয়।

হাসি উপুড় হয়ে শুয়েছিল। বুকের কাছে পা-দুটি গুটিয়ে নিয়ে। ঘুমের মধ্যে হাসিকে দেখে মনে হয়, ও ভাজামাছটি উলটে খেতেও জানে না। শিশুর মুখের পবিত্রতার মতো এক নরম শান্ত শিউলি ফুলের পবিত্রতা ওর সারামুখে ছেয়ে থাকে। সবুজ অনেকক্ষণ হাসির পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। হাসি ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। সবুজ কান পেতে শুনল, ফণীর নাম বলছে কি না হাসি।

কিন্তু হাসির এই ঘুমঘোরের অস্ফুট ভাষা বুঝতে পারল না সবুজ।

নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে শুয়ে ও ভাবল যে, পৃথিবীতে ও কাউকে, একজন কাউকেও ভালোবাসতে পারলে সুখী হত; কিন্তু ও পারল না। নিজের স্ত্রীকে, নিজের শরীরের শরিক একমাত্র ছেলেকেও ভালো লাগাতে পারল না। ও কি নিজেকে ভালোবাসে? একমাত্র নিজেকেই কি শুধু, ভালোবাসতে পারল ও?

নানাকথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল সবুজ। সকালে উঠে ও বাজারে যাবে। গলদা চিংড়ি আনবে বলেছে। গলদা-চিংড়ি খাওয়াবে হাসিকে আর হাসির পেয়ারের ফণীদাকে! খোকাকেও খাওয়াবে। নিজেও খাবে। কিন্তু ফণীকে শুধু গলদা-চিংড়ি খাইয়ে, নিজে গলদা চিংড়ির সঙ্গে আরও কিছু খাবে। সেই ‘কিছুর’ নাম জানে না সবুজ।

সবুজ ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে ভাবল যে, জীবনের সব অনুভূতির এখনও নামকরণ করতে পারেনি মানুষ। এ-পর্যন্ত ক-টা অনুভূতিরই বা ব্যাখ্যা আছে অভিধানে? ব্যাখ্যা করা গেছে?

সকালে যখন সবুজের ঘুম ভাঙল, তখন পুরো বাড়িটা, পুরো গলিটা জেগে উঠেছে। খোকার ঘর থেকে খোকার পড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে বাটনা বাটার গুব গুবানি। জমাদার উঠোন ঝাঁটাচ্ছে ঝপাং-কপাং করে জল ঢেলে। পাশের বাড়ির ট্রানজিস্টারে তারস্বরে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে। এই ন্যাকা সংগীত আজকাল ভালো লাগে না সবুজের। হেঁজি-পেঁজি-গেজি রোজ রোজ প্রায় এক-ই গান প্রায় একইসময়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে গায়। একটু পরেই আরম্ভ হবে পল্লিগীতি। তারও এক-ই সুর–রোজ এক-ই সুর–শুধু কথা অন্য। বাংলার কোন পল্লিতে যে, আজ এই গান গাওয়া হয় জানে না সবুজ। জানার ইচ্ছেও নেই।

ঘুলঘুলিতে বাসা-বাঁধা পায়রাগুলো বকবকম, বক বকম করে ঘুরে ঘুরে গলা ফুলিয়ে ডন-বৈঠকি মেরে ডাকছে।

সবুজ শুয়ে শুয়ে ডাকল, যদু।

যদু জানে এ ডাকের মানে।

এককাপ চা এনে যদু বিছানার ওপর রাখল। ডিশের ওপর চা চলকে পড়েছে আনতে গিয়ে। চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে হাঁটুর ওপর ডিশ গড়িয়ে চা পড়ে গেল। ভীষণ রাগ হল সবুজের। কিন্তু আর কত রাগ করবে? অনেক বছর ধরে, এ-সব কথা বলেছে ও। জানেই না, কী করে যে, মানুষকে চা দিতে হয় হাসি তা জানেই না। ছোটোবেলায় দেখলে তো জানবে?

সবুজ অবশ্য এ-সব দেখেনি। সবুজের পরিবারেও কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাকেই একটা মস্ত কৃতিত্ব, মস্ত পাওয়া বলে জেনে এসেছে সবুজ। তবে কমলাদের কথা আলাদা। মনে পড়ে না, কখনো কমলা এমনকী, কমলার ঝি পারুলও এমন করে চা দিয়েছে সবুজকে। কমলার বাড়িতে চায়ের কাপ হাতে করে বসে সবুজের মনে হয়েছে, চা একটা নিছক গা-করম করা পানীয় নয়। পেয়ালা-পিরিচের চেহারা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাইরের শুকনো খটখটে ভাব–আর ভেতরের উষ্ণ পানীয়–এ-সব, এ-সবের সামগ্রিক ফল হচ্ছে ‘চা। তা ছাড়া, যে হাতে করে আনে, তার মিষ্টি মুখ, তার নরম হাসি, এ-সব-ই ‘চা’। সবুজের মনে হয় কমলা জানে, কী করে সবুজের চা বানাতে হয়। এক চামচ চিনি, এক চামচ ভালোবাসা, আর এক চিলতে হাসি।

আধোশুয়ে কেতুর-চোখে চা খেতে খেতে সবুজ ভাবছিল, ও কি কমলাকে ভালোবাসে? কমলা তো ওকে ভালোবাসে। কিন্তু কমলা সেদিন পারফিউমটা হাতে নিয়ে বলেছিল, “এটা জাল তো কী? ভালোবাসাটা জাল না হলেই হল।” কথাটার মধ্যে কি, অন্য কোনো মানে ছিল? সবুজ কি একটা জাল লোক? ওর মধ্যে খাঁটি ব্যাপার কি একেবারেই নেই?

এ-সব ভাবনা বেশিক্ষণ ভাবা যায় না, তা ছাড়া না ভাবাই ভালো।

নিজেকে বলল সবুজ নিজে।

তারপর উঠে মুখ-হাত ধুয়ে আরও এককাপ বিস্বাদ চা গিলে থলে হাতে বাজারের দিকে চলল।

হাসি গতরাতে জিজ্ঞেস করেছিল,ব্যাপারটা কী? এত টাকা? হঠাৎ কোত্থেকে?

সবুজ বলেছিল, তোমার ফণীদার কাছ থেকে ধার করিনি। অনেকদিনের ব্যাক-পে জমেছিল, পেলাম একসঙ্গে।

ওঃ- বলেছিল হাসি।

হাসির এই স্বভাবটাও সবুজকে চিরদিন বিরক্ত করেছে–ওর এই নিস্পৃহতা, ওর এই সমস্ত ব্যাপারে ঔদাসীন্য, পৃথিবীর তাবৎ ব্যাপারে কৌতূহলের অভাব, ভালো লাগে না। সবুজের ভালো লাগে না মোটে।

আজ গলদা-চিংড়ি কিনবে ও। বহুদিন পর ও তাই আজ বাজারে যাচ্ছে। শেষ বোধ হয় খোকার ভাতের দিন গিয়েছিল। মাছ, মাছের স্বাদ, আজকাল প্রায় ভুলেই গেছে সবুজ। সবুজের মতো এবং সবুজের চেয়েও অনেক স্বচ্ছ লোকেরা মাছের চেহারাও দেখেনি বহুদিন।

মাসে এক দু-দিন অফিস ফেরতা বৈঠকখানা বাজার ঘুরে আসে সবুজ। নিজের জন্যে শুঁটকি মাছ কেনে। ওদের বাড়ি চাটগাঁয় না হলেও, চাটগাঁ আর নোয়াখালির বন্ধু-বান্ধবেরা ওকে এমাছ খেতে শিখিয়েছে। ভালো করে পেঁয়াজ-লঙ্কা-তেল-রসুন দিয়ে রাঁধলে এক থালা ভাত খাওয়া যায়। অথচ হাসি খায় না। কিন্তু রাঁধে। খোকাও হাসির দেখাদেখি খায় না। একদিন সবুজ খোকাকে মেরেও ছিল এজন্যে। কিন্তু তবু খোকা খায়নি। তাই হাসি আর খোকার জন্যে, সে দুশো গ্রাম কী আড়াইশো গ্রাম অন্য মাছ নিয়ে আসে কখনো-কখনো।

গলদা-চিংড়ি ভালো রাঁধতেন মা। নারকেল-কোরা, সরষে, কাঁচালঙ্কা দিয়ে–আঃ হলদে হলদে, নরম-নরমভাবা যায় না। এক-থালা ভাত খেত তখন শুধু চিংড়ির মালাইকারি দিয়ে। আর গলদা-চিংড়ির মাথা? বেসন দিয়ে ভাজা। টিপলেই জাফরান-রঙা ঘিলু বেরোত–তা দিয়েও এক-থালা ভাত খাওয়া যেত।

কত মাছ! কত মাছ খেয়েছে ছোটোবেলায়। দই-ইলিশ, ভাপের ইলিশ, সরষে-ইলিশ! ওর কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগত কাঁচালঙ্কা, কালোজিরে, লাউ ডগা দিয়ে রান্না-করা পাতলা ঝোল। বাটির ওপরে ঝোল টলটল করত– মিষ্টি লাউ-ডগার গন্ধ-ইলিশের ঝোলের গন্ধ– আঁশটে-আঁশটে–কী দারুণ।

পিসিমা রাঁধতেন তেল-কই। বড়ো বড়ো কই। তেল কাঁচালঙ্কা ধনেপাতা দিয়ে রাঁধা।

সেদিন অফিসে হারাধন বলছিল, চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাছের এসেন্সের ব্যবসা খুলবে। ছোটো ছোটো হোমিয়োপ্যাথি শিশিতে নানা রঙা মাছের এসেন্স বিক্রি করবে। কই, ইলিশ, গলদা-চিংড়ি, কুচো-চিংড়ি, রুই, পোনা ট্যাংরা–সব মাছের এসেন্স বিক্রি করবে। শিশির সঙ্গে ব্যবহার-বিধি, ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে ছাপা পাতলা কাগজে লেখা থাকবে–খেতে বসে, সাবধানে শিশির ছিপি খুলে দু-ফোঁটা ভাতে ফেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাত খেয়ে ফেলুন। খুশি না হলে পয়সা ফেরত। যারা খুব খুঁতখুঁতে, সেসব খদ্দেরের জন্য রাবারাইজড ফোম দিয়ে ইলিশের টুকরো, আস্ত চিংড়ি, এ-সমস্ত মাছ তৈরি করে, ঠিক সত্যি মাছের মতো রং করে সঙ্গে দেওয়া হবে। খাওয়ার সময় তারা সেই মাছকে টেপাটেপি করে আনন্দের সঙ্গে গরাস গরাস ভাত খাবেন। ব্যবহারের পর সেই মাছ সাবান দিয়ে ধুয়ে আবার হারাধনের কোম্পানিতে দিতে হবে।

হারাধন বলছিল, কে বলে দাদা দেশে সুযোগ নেই? এমন এমন সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে। আজ, যা কেবল অ-খয়েরি গুন্ডী আর মোহিনী পানের মতো অ-কৃত্রিম প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্রেই সম্ভব। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবার এমন একটা আইডিয়া। মাঠে মারা গেল সবুজদা, শুধু একজন ফিনানসিয়ারের অভাবে।

বাজারে ঢুকল সবুজ।

বাজারের এই গেট দিয়ে ঢুকলে সামনে ফুলের দোকান। তার মুখোমুখি মুদির দোকানগুলো। তারপর ঝাঁটা-থলে, ব্যাগ, ইত্যাদি ইত্যাদি দোকান। তারপর-ই মাছের দোকান। মাছের দোকানের মুখোমুখি মাংসের দোকান।

দূর থেকে মাছের দোকানগুলো দেখা যাচ্ছিল।

বাঃ! বেশ বড়ো-বড়ো গলদা চিংড়ি উঠেছে তো। সবুজ মনে মনে বলল। তারপর-ই ভেবে নিল, মাছের মাথা ভাজা, লাল-নীল ঠ্যাং-এর চচ্চড়ি, মালাইকারি! ইস। সবুজের জিভে জল এল। সবুজ বড়ো করে ঢোঁক গিলল একটা।

দোকানদারের বয়স সাতাশ-আঠাশ হবে। প্যান্ট আর হাওয়াইন শার্ট পরা, গোলগাল ফর্সা মুখ, গোঁফ আছে মুখে। যত্ন করে ছাঁটা।

সবুজ দূর থেকেই দেখল, অনেক লোক গলদা চিংড়ির কাছে ভিড় করছে, আর সরে যাচ্ছে। যেন শক লাগছে ইলেকট্রিকের।

সবুজের শক লাগবে না। তার পকেটে এক-শো টাকার নোট। মেহনতের নোট নয়, ফাঁকতালের নোট। বুকের একদিকে এই নোটটার জন্যে একটা গ্লানি বোধ করছে সবুজ, অন্যদিকে গলদা চিংড়ির আনন্দ। সবুজ জানে, যতই দাম নিক, পনেরো-কুড়ি করে কেজিই নিক। তবুও নেবে সবুজ।

মাছওয়ালার সামনে এসে দাঁড়াল ও।

আত্মপ্রত্যয়ের স্বরে বলল, কত করে দিচ্ছ?

মাছওয়ালা ওর দিকে অপাঙ্গে একবার চাইল।

তারপর মুখ নামিয়ে নিল। জবাব-ই দিল না।

এবার সবুজও নিজের দিকে অপাঙ্গে চেয়ে নিল একবার। আধ-ময়লা পায়জামা, পর পর তিন দিন অফিসে পরে-যাওয়া শার্ট। ঘামের গন্ধ শুকিয়ে উঠে পচা ইঁদুরের মতো গন্ধ ছাড়ছে। সেইমুহূর্তে নিজেকে ঘেন্না হল সবুজের। ঘেন্নায় নিজের প্রতিঘেন্নায় সেইমুহূর্তে সবুজ মরে যেত, যদি না, তার পকেটে আজকের দিনের সব ঘেন্নার, সব গ্লানির প্রতিষেধক একশো টাকার নোটটা থাকত।

সবুজ মাছওয়ালাকে আবার শুধোল, কী গো? কত করে দিচ্ছ?

মাছওয়ালা একটা অপমানজনক ভঙ্গিতে হাত নেড়ে সবুজকে বলল, যান যান কেন ভিড় বাড়াচ্ছেন?

সবুজের বাঙাল রক্ত মুহূর্তে মাথায় চড়ে গেল।

বলল, তার মানে?

মাছওয়ালা ওর দিকে চূড়ান্ত তাচ্ছিল্যের চোখে চাইল, তারপর পাশের মাছওয়ালাকে। সালিশি মেনে বলল, রোয়াব দেখ না। কত গলদা-চিংড়ি খানেওয়ালা রে! মাছ তো এ জিন্দেগিতে কিনবে না–তবু দর করার কত ঘটা!

তারপর আবার সবুজকে বলল, মাছ নেবেন? নেবেন না তো খামোখা ভিড় বাড়াচ্ছেন কেন?

সবুজের এ-পাশে, ও-পাশে বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরা বোধ হয় এ-রকম অপমানের শিকার রোজ-ই হন। তাই সবুজের প্রতি বিদ্রূপ নয়, এক নীরব মুখ-নোয়ানো সমব্যথীর সমবেদনার চোখে তাকিয়ে তাঁরা সরে গেলেন।

সবুজকে জেদে পেয়েছিল।

সবুজ বলল, দ্যাখো ছোকরা, মাছ কত করে, আমি তোমাকে তাই জিজ্ঞেস করছি।

মাছওয়ালাদের মধ্যে একটা হাসির রোল পড়ে গেল।

অন্যান্যরা বলল, দেখ নবা, এতদিনে তোর যোগ্য খরিদ্দার এসেছে।

নবা, ওরফে মাছওয়ালা ছোকরা বলল তিরিশ টাকা কেজি।

তারপর-ই সবুজের চোখের দিকে চেয়ে বলল, মাছ খাবার দম আছে?

প্রথমে সবুজের ইচ্ছে হল, ঠাস করে একটি চড় লাগায় ছোকরাটার গালে। মনে হল ওকে মাটিতে ফেলে, ওর বুকের ওপর চড়ে দাঁড়ায়, তারপর ওর জিভটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে।

পরক্ষণেই ও সামলে নিল নিজেকে। ওরা এক দল, আর ও একা। এদের কাছে বঁটি, ছুরি। আর ওর খালি হাত।

সবুজ ভাবল মাছ না কিনেই ফিরে যায়। পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে গেল, ফণীকে মাছ খাওয়াতে হবে। ফণী সেদিন ইলিশ মাছ কিনে এনেছিল। ওকে গলদা-চিংড়ি না খাওয়ালেই নয়। মাছওয়ালার কাছে অপমানিত হওয়ার যে দুঃখ, ফণীকে গলদা-চিংড়ি খাওয়ানোর দারুণ আনন্দের কাছে তা কিছুই নয়।

সবুজ ফস করে পাঁচটা এক-শো টাকার নোট বের করে বলল, মুখ সামলে কথা বলবে। দোকানদারি করছ, খরিদ্দার চেন না?

টাকার নোটগুলো দেখে মাছওয়ালা নবার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।

বলল, বাবু রসিকতা বোঝেন না কেন? রাগ করলেন নাকি আমার ওপর। কত দেব বলুন?

সবুজ রাগে কাঁপছিল।

বলল এক কেজি।

নবা-মাছওয়ালা যত্ন করে ওজন করে এককেজি মাছ সবুজের থলেতে ভরে দিয়ে পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিল। হাতজোড় করে নমস্কার করল। হেসে বলল, আবার আসবেন।

সবুজ ওর সামনে থেকে সরে গেল।

মনে মনে বলল, আর কখনো আসব না।

সবুজ নারকোলের দোকানে গিয়ে একটা বড়ো নারকোল কিনল। কিনেই বাজার থেকে বেরিয়ে পড়ল।

বাজারের বাইরে বেরিয়ে ট্রাম লাইনটা পেরোল। পেরিয়ে রাস্তায় পড়তেই ওর সামনে একটা ডাব পড়ে থাকতে দেখল। কী হল, কী হয়ে গেল জানবার আগেই সবুজ জোরে এক লাথি মারল ডাবটাকে। ডাবটা লাফিয়ে উঠে গড়াতে গড়াতে রাস্তা বেয়ে গিয়ে এক লাফে ফুটপাথে উঠে গেল।

একটি অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ফুটপাথ দিয়ে, তার পায়ে গিয়ে লাগল ডাবটা।

মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে দেখল। দেখে ঘৃণাভরে সবুজকে বলল, উজবুক।

বলেই চলে গেল।

সবুজের একইসঙ্গে আনন্দ এবং দুঃখ হল।

আনন্দ হল এইজন্যে যে, নবা-মাছওয়ালার মুখের সঙ্গে ডাবটার আশ্চর্য মিল ছিল। নবার মুখে লাথি না মারতে পেরে ও ডাবের মুখে লাথি মেরেছিল। ভুলে গিয়েছিল যে, ও রবারের চটি পরে আছে। আঙুলে খুব লেগেছিল, কিন্তু লাথিটা মারতে পেরে ওর খুব আনন্দ হয়েছিল।

দুঃখটা এইজন্যে যে, মেয়েটির পায়ে গিয়ে ডাবটা পৌঁছোনো একটা নিছক দুর্ঘটনা। তা ছাড়া মেয়েটি আঘাতও পায়নি। তার শাড়িতে আটকে গিয়েছিল ডাবটা। এই-ই মাত্র। তা ছাড়া মেয়েটিকে দেখে মনে হয়েছিল শিক্ষিতা। সুন্দরী তো বটেই। একজন শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়ের মুখেও ওরকম বিশ্রী ঘৃণার ভাব আর ওই উক্তি মোটেই মানাল না। সবুজের বড়ো খারাপ লাগল। ও জানে না, এই মেয়েটিকেও বোধ হয়, নবা-মাছওয়ালা কিংবা অন্য কেউ একটু আগে অপমান করেছে। মেয়েটিও নিশ্চয়ই ওর-ই মতো বিরক্ত, ক্লান্ত অপমানিত অবস্থার মধ্যে ছিল, নইলে এই সামান্য ব্যাপারে তার এত চটে ওঠার কারণ ছিল না।

সবুজ হাঁটতে হাঁটতে ওর চারদিকে, ওর পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, হেঁটে আসা বিভিন্ন নারী পুরুষের মুখের দিকে তাকাল। যারা ওর কাছের, ওর সমতলের মানুষ, তাদের মুখের দিকে কখনো ও এমনভাবে তাকায়নি এর আগে। প্রত্যেকের মুখেই কী যেন একটা জ্বালা, একটা অপারগতা; এই দিনের সঙ্গে, এই জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করার উপায়হীন অসহায়তার ফল–এক করুণ অপনোদনীয় ক্লান্তি। আঁকা রয়েছে এক-ই তুলিতে। যে তুলিতে ওর মুখও আঁকা।

সবুজ জানে, আজ সে বুঝে গেছে, কী করে এই নবাকে, নবার মতো শত শত নবাকে ঠাণ্ডা করে দেওয়া যায়। একা একা কিছুই করা সম্ভব নয়। আজকের জীবনে নির্দল প্রার্থীর দিন শেষ হয়ে গেছে। সবুজের একটা নিশান চাই। যেকোনো একটা নিশানের নীচে গিয়ে তাকে দাঁড়াতে হবে, তার নিজস্ব বোধ, নিজস্ব মতামত, নিজস্ব স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে তাদের খাতায় নাম লেখাতে হবে। তারপর গিয়ে বলতে হবে পার্টির দাদাকে–ক-দাদা, খ দাদা,গ-দাদা, কোনো দাদাকে, বলতে হবে যে, নবাকে ঠাণ্ডা করো। একদল ছেলে গিয়ে নবার ওপর পড়বে নেকড়ের মতো। নবা মৃত বোয়াল মাছের মতো, তার মাছের মধ্যে, মাছের গন্ধের মধ্যে, কাঁকড়ার দাঁড়ার মধ্যে মুখ হাঁ করে পড়ে থাকবে। নবা থাকবে না আর।

কিন্তু সবুজও তো থাকবে না। সেই প্রতিশোধ সেই দলবদ্ধতার মধ্যে সবুজের কোনো সবুজত্বই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এতদিন, যে-কোনোদিন ক-দাদা, খ-দাদা, গ-দাদা তাদের যূথবদ্ধ, নিষ্ঠুর হৃদয়হীন, বোধহীন, একমাত্র স্ব স্ব দলমতে অন্ধবিশ্বাসী নেকড়েদের হয়তো সবুজের বিরুদ্ধেই লেলিয়ে দেবে। নিজের-ই সৃষ্টিতে, নিজের রক্ষকের দ্বারা মূল্যহীন হয়ে যাবে সে, হয়ে যাবে স্বাধীনতারহিত। বেঁচে থাকলেও স্বমতের স্বাধীনতা ছাড়া, স্ব-ইচ্ছায় আনন্দ ছাড়া এক নিছক নিশ্বাস ফেলা ও প্রশ্বাস নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই বেঁচে থাকবে সে। সে বাঁচা কি বাঁচা হবে?

সেইমুহূর্তে সবুজের মনে হল যে, ও একা নয়। ওর সঙ্গে লক্ষ লক্ষ লোক আছে যারা একটা নিশান খুঁজছে, কিন্তু তার আশ্রয়ে গিয়ে দাঁড়াবার মতো কোনো নিশানের নিশানা পায়নি। বরং ওরা সমস্ত নিশানকেই ভয় পেতে আরম্ভ করেছে। নিশানের উলটোদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে পেয়ে ওরা গুটিয়ে কুঁকড়ে গেছে। ওরা নবা-মাছওয়ালার মতো প্রতিদিনের হাজার নবার অপমান সয়ে, অসম্মান সয়ে, তবুও নিজের নিজের স্বাধীনতার লোভে বাঁচার মতো বেঁচে থাকার দুর্মর লোভে ওরা বেঁচে আছে। আছে কি?

আপাতত কিছুই করার নেই। ভাবল সবুজ। এখন হারাধন ছাড়া আর গতি নেই। হারাধন যে-পথে তাকে এনেছে, সেই-ই এখন ওর পক্ষে মানুষের মতো বেঁচে থাকার একমাত্র পথ। পকেটে সব সময়ই একশো টাকার নোট রাখতে হবে সবুজকে। সে-টাকা কী করে পাবে, সেটা বড়োকথা নয়, কিন্তু রাখতে হবে। নবা, গবা, ধবা, যে-ই অপমান করবে, অপমান করতে চাইবে তাদের মুখে নোটটা ছুঁড়ে মারবে। নবারা অমনি হাতজোড় করবে, নমস্কার করবে; বলবে, আবার আসবেন বাবু।

আসবে। সবুজ দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল, আসবে সবুজ;কিন্তু একা নয়। যাদের কোনো দল নেই আজ, যারা পথেঘাটে, অফিস-কাছারিতে রোজ দু-বেলা ঠোক্কর খেয়ে বেড়াচ্ছে, একা একা, আলাদা আলাদা হয়ে, তারাও একদিন দলবদ্ধ হবে। এক নতুন নিশানের নীচে। সে নিশানের রং জানে না সবুজ।

আসবে, সবুজ ভাবে, একদিন এবং ওরা সকলেই ফিরে আসবে।

কিন্তু কবে?

ফুটপাথ ধরে সবুজ বাড়ির দিকে আসছিল। এমন সময় হঠাৎ দেখল ফণী উদ্রান্তের মতো দৌড়ে আসছে গলির ভেতর থেকে। ফণী দৌড়চ্ছে আর, তার পেছন পেছন একদল ছেলে।

এরা কারা সবুজ জানে না। জানতে চায় না। এরা সবাই-ই একইরকম। এরা কারা আপাতত সবুজের জানার ইচ্ছেও নেই। সবুজ এটুকু বুঝেছে যে, এরা ফণীর মিত্র নয়।

ফণী বড়ো রাস্তায় পড়েই সবুজকে দেখতে পেয়ে সবুজের দিকে দৌড়ে এল প্রথমে।

সবুজ কিছু বোঝার আগেই ফণী, একটা থেমে-থাকা বাসে লাফিয়ে উঠল।

সবুজ জানে না ও কেন তা করল,কিন্তু বাজারের থলে হাতে করে সেও ফণীর সঙ্গে সেই বাসে লাফিয়ে উঠল।

সবুজ ভেবেছিল, ফণী দৌড়ে এসে সবুজকে বলবে, সবুজবাবু আমাকে বাঁচান। আমাকে ওরা মারতে আসছে।

কিন্তু ফণী কিছুই করল না সেরকম।

বাসটা ছেড়ে দিল।

ছেলেগুলো বড়োরাস্তা অবধি এসে আবার ফিরে গেল।

ফণী হাসল। সবুজের দিকে চেয়ে। বলল, আপনি বাজারের থলি হাতে এদিকে কোথায় চললেন?

সবুজ জবাব দিল না।

তিন-চার স্টপেজ বাদে ফণী নামবার জন্যে দরজার দিকে এগোল। সবুজও সঙ্গে সঙ্গে এগোল। দু-জনে একইসঙ্গে নামল।

সবুজ বলল, কী ব্যাপার বলুন তো?

ফণী আবার হাসল। বলল কীসের কী ব্যাপার?

–ওই ছেলেগুলো কারা? ওরা আপনাকে তাড়া করল কেন?

ফণী বলল, আর যে-জন্যেই হোক, কারও পকেট মারিনি আমি। ছেলেগুলো সবাই-ই ভালো ছেলে। একটুক্ষণের জন্যে ওরা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমার ওদের ওপর অনেক ভরসা।

সবুজ হাসবার চেষ্টা করে বলল, এইসব বকা-বাউণ্ডুলে গুণ্ডা ছোঁড়াগুলোর মধ্যে ভালোত্বটা কী দেখলেন আপনি?

ফণী বলল ও আপনি বুঝবেন না।

-–ওরা একটুক্ষণের জন্যে খারাপ হয়ে গিয়ে আপনাকে গোরুতাড়া করল কেন?

ফণী হাসল। বলল, ওদের সঙ্গে আমার বিরোধ ঘটেছিল, তাই। কোনো ব্যক্তিগত ঝগড়া নয়। মত ও পথের ঝগড়া। ওরা ভাবে ওরাই ঠিক, আমি ভাবি–আমি। থাকগে, ওসব জেনে আপনি কী করবেন?

সবুজ বলল; চা খাবেন?

ফণী উদাসীন গলায় বলল, খেলে হয়।

ওরা দুজনে একটা সস্তার রেস্তরাঁয় ঢুকল।

সবুজ বলল; শুধু চা? সঙ্গে কিছু খান। ভেজিটেবল চপ টপ?

ফণী বলল, নাঃ শুধুই চা।

তারপর-ই বলল, আপনি খান না! আজ তো রবিবার। খেতে দেরি হবে নিশ্চয়ই।

সবুজ বলল, না, আমিও শুধু চা।

বলেই বলল, আপনার সঙ্গে সিগারেট আছে?

ফণী অবাক চোখে তাকাল। তারপর বলল, আমি তো সিগারেট খাই না।

সবুজ বলল, আমিও খাই না, হঠাৎ-ই খেতে ইচ্ছা করল।

ফণী বলল, বাইরে থেকে নিয়ে আসি? খাবেন?

–না, না। সবুজ বারণ করল।

চা খেতে খেতে সবুজ ভালো করে ফণীর চোখের দিকে তাকাল। ফণীর চোখ দুটো বড়ো বেশি উজ্জ্বল। তাকিয়ে থাকা যায় না। সমস্ত শরীর অনাহারে, অত্যাচারে যত শুকিয়ে যাচ্ছে তত উজ্জ্বল হচ্ছে চোখ দুটো।

একটু পর সবুজ বলল, আপনি কি পার্টি-ফার্টি করেন নাকি? জানতাম না তো!

ফণী কী-যেন বলতে গেল। তারপর থেমে গেল। হাসল শুধু।

–ওই ছেলেগুলোর অত রাগ কেন আপনার ওপর?

–এমনিই–হয়তো একা একা নিজের মত নিয়ে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই বলে, নিজের ঘামে, নিজের পরিশ্রমে। জানি না কেন। কারণ একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কারণটা ওদের নয়। কারণটা অন্য কারও। ওরা কার্য, কারণ নয়।

তারপর আবার স্বগতোক্তি করল, ছেলেগুলো ভালো। বাঙালি ছেলেগুলো হিরের টুকরো ওদের মধ্যে আগুন ছিল। সেই আগুনে কী পোড়াবে ঠিক করতে না পেরে নিজেরাই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

সবুজের একটু রাজনীতি করতে ইচ্ছে হল। রবিবার সকালে সবুজের মতো অনেক লেখা পড়া জানা বাঙালির-ই যেমন করতে ইচ্ছে হয়। চা খেতে-খেতে, খবরের কাজ পড়তে পড়তে।

সবুজ বলল, নেতাজির পরে বাংলায় একজনও লিডার হল না, এ দেশের কী হবে বলতে পারেন?

ফণীর চোখদুটো জ্বলে উঠল।

ফণী খুব নরম গলায়, মুখ নীচু করে বলল, কুকুরের বাচ্চার লিডার কখনো সিংহের বাচ্চা হয় শুনেছেন? আমরা যেমন, যেমন নেতা আপনি ডিসার্ভ করেন, নেতারাও তো তেমনিই হবে।

ফণীর কথাটায় যেন গালে চড় লাগল সবুজের।

ও মনে মনে বলল, রাজনীতি-ফীতি ভদ্রলোকের কাজ নয়। এসব নিয়ে আলোচনাও ভদ্রলোকের কাজ নয়। সবুজ ভাবল। তারপর মনে করবার চেষ্টা করল, কে যেন বলেছিলেন, পলিটিকস ইজ দা লাস্ট রিসর্ট অব স্কাউলেস।” মনে পড়ল না।

যাক, আপাতত ফণীর এইরকম কথায় ওর রবিবাসরীয় রাজনীতিচর্চার শৌখিনতা উবে গেল।

চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে একটা নেড়ি কুত্তাকে ল্যাজ নাড়িয়ে চলে যেতে দেখেই,

সবুজ দোকানের ভেতরে মুখ ঘোরাল।

ভাবল, এই লোকটা ডেঞ্জারাস, এর সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকাই ঠিক নয়। ভীষণ রাগ হল হাসির ওপর। প্রেম করার লোক পেল না আর।

চায়ের দাম দিতে দিল না ফণী সবুজকে।

নিজেই দিল। বলল; আপনার কাছে আমার অনেক ঋণ। এককাপ চা খাওয়ানোর আনন্দ থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না।

সবুজ বলল; আজ দুপুরে কিন্তু আপনি আমাদের ওখানে খাবেন। সেইজন্যেই আমি নিজে হাতে বাজার করতে এসেছিলাম।

ফণী খুব বিব্রত বোধ করল।

তারপর বলা উচিত কি না ভেবে বলল, আমার পক্ষে আজ যাওয়া মুশকিল। ছেলেগুলোর মাথা ঠাণ্ডা হলে যাব। ছেলেমানুষ তো। রাগের মাথার হয়তো এমন কিছু করে বসবে, যা করা উচিত নয় রাগটা পড়বার সুযোগ দেওয়া উচিত।

তারপর বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না। হাসিকে বলবেন।

একটু থেমে বলল, খোকা ভালো আছে? খোকা আপনার দারুণ ছেলে। অন্য দেশে জন্মালে কত সুযোগ পেত, আরও ভালো হবার কত সম্ভাবনা ছিল। ভাবলে খারাপ লাগে।

–অন্য ঘরে জন্মালেও হয়তো হত। বলল সবুজ।

–বড়োলোকের ঘরে বলছেন? ফণী শুধোল।

সবুজ বলল হ্যাঁ।

সবুজ জানে, সবুজের পক্ষে খোকাকে সব সুযোগ দেওয়া সম্ভব নয়, এ-কথাই ফণী বলতে চাইছে। কিন্তু ফণী জানে না, সবুজ আর সেসবকে ভয় করে না। সবুজের এখন হারাধন আছে। সব হারাতে বসেও, সর্বনাশের দরজাতে এসেও ও হারাধনের জন্যে বেঁচে যাবে। হারাধন-ই এখন লোকাল গার্জেন সবুজের। খোকাকে সে বড়োলোকের মতোই মানুষ করবে।

ফণী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি কিন্তু ও-কথা মানি না। বড়োলোকের ছেলেরাই তো, বেশি অকালকুষ্মান্ড হয়, আত্ম-সম্মানজ্ঞানহীন হয়। বড়োলোক গরিবলোকের কথা বলছিলাম না, ‘মানুষ’ হওয়া আর অমানুষ হওয়ার কথা বলছিলাম।

সবুজ মনে মনে বলল, ফণীর দিন ফুরিয়েছে। বড়োবেশি বাতেল্লা করছে ও। জ্ঞানে যেন ভরপুর।

শালা মনোহারী দোকানের ফিলসফার। খোকা কি তাহলে তোমার-ই ছেলে? খোকার প্রতি এত দরদ কীসের?

ফণী আবারও বলল, খোকা কিন্তু আপনাকে ভয় পায়। সেটা কিন্তু ভালো না। বাবাকে ভয় পাবে কেন? ভয় কাউকেই পাওয়া উচিত নয়। ভয় বুকে করে বাঁচাকে বাঁচা বলে না। জানি না, মনে হয় খোকা একদিন একথা জানাবে। বড়োখাঁটি ছেলে ও।

–পড়াশুনায় তো লবডঙ্কা সবুজ বলল।

ফণী হাসল। বলল, হ্যাঁ। স্কুলের পড়াশুনায়।

তারপর বলল, ওর হয়তো ভালো লাগে না। তা ছাড়া জীবন’-এর স্কুলে মানুষ যা শেখে, যা দেখে, সেই শিক্ষার সঙ্গে তো স্কুলের শিক্ষার কোনো মিল নেই। আসলে এই বয়সেই ওর ‘আত্মসম্মান’ জিনিসটা গড়ে উঠেছে, যা অনেক বুড়ো-বুড়ো লোকের মধ্যেও দেখি না।

তার নিজের ছেলে সম্বন্ধে (নিজেরই ছেলে?) পরের মুখে জ্ঞান শুনতে ভালো লাগছিল না সবুজের।

পথে নেমে সবুজ বলল, চললাম। আপনি তাহলে আসছেন না?

ফণী খুব অপরাধীর মতো হাসল।

বলল, কিছু মনে করবেন না। আমার বড়ো খারাপ লাগছে। উপায় থাকলে নিশ্চয়ই যেতাম। তারপর সবুজের হাত ধরে ফণী বলল, আপনি মানুষটি বড়োভালো সবুজবাবু। বড়ো উদার আপনি। আপনার মতো উদার লোক দেখিনি আমি।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি কী। বোঝাতে চাইছি?

সবুজ মাথা নাড়ল।

তারপর থলে হাতে রোদে হেঁটে বাড়ির দিকে আসতে আসতে বিড়বিড় করে বলল, তা আর বুঝিনি! বিলক্ষণ বুঝেছি। তোমার মতো রতনকে আমি না চিনলে আর কে চিনবে?

রোদে ঘেমে, তেতে হাঁটতে হাঁটতে, ফণীর ওপর একটা তীব্র ঘৃণায় সবুজের শরীর বেঁকে গেল। সবুজ মনে মনে কামনা করল, ফণীকে ওই ছোঁড়াগুলো ভালো করে ধোলাই দিক একদিন। যাকে বলে আড়ং ধোলাই। ফণীর বাতেল্লা বন্ধ হয়ে যাবে। ওই ফণীর জন্যেই আজ বহুবছর সবুজ যেন, একটা লাশকাটা ঘরের নিস্পন্দ উষ্ণতাহীন মৃতদেহের সঙ্গে একঘরে একঘাটে জীবন কাটাচ্ছে। সবুজ বেঁচে থেকেও মরে রয়েছে।

.

০৮.

হাজারিবাগ রোড স্টেশনে যখন শেষরাতের মুম্বই মেল থেকে নামল ওরা, তখনও বেশ রাত আছে। ঠাণ্ডাও আছে ভালো। পুজোর আর একমাসও দেরি নেই। এদিকে বেশ মিষ্টিঠাণ্ডা পড়ে গেছে।

মালপত্র সব নামানো হলে, কুমুদ বলল, কী সবুজবাবু, একটু চা-টার বন্দোবস্ত করুন। জমে গেলাম যে।

তারপর বলল, আপনি এগিয়ে গিয়ে চায়ের বন্দোবস্ত করুন, আমি মালপত্র সমেত যাচ্ছি। প্রধান মালটিকে আপনি সঙ্গে নিয়ে যান বলেই, কমলার দিকে দেখাল।

কমলা ঝেঝে উঠল। বলল, স্ত্রী সম্বন্ধে এরকম রসিকতা আমার ভালো লাগে না।

কুমুদ অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, সরি!

সবুজ আর কমলা ওভারব্রিজটায় উঠছিল।

ওভারব্রিজের মাথায় উঠে কমলা বলল, ‘কী শীত গো’–বলেই সবুজের গায়ের কাছে ঘন হয়ে এল। সবুজের বাহুতে কমলার পাতলা স্কার্ফের নীচের ঋজু অথচ নরম বুকের ছোঁয়া লাগল একমুহূর্তে। গা শিরশির করে উঠল সবুজের। এই শেষরাতের স্টেশনে আচমকা ভালো-লাগায় ভরে গেল ও।

ওভারব্রিজ থেকে নেমেই চায়ের দোকান। বাস দাঁড়িয়ে আছে পাশে। কনডাক্টর চেঁচাচ্ছে, বগোদর, বগোদর। হাজারিবাগ।

দেখতে দেখতে কুমুদ এসে গেল মালপত্ৰসমেত। মালটাল বাসে তুলে, সামনের দিকের সিটের ওপর টুকিটাকি জিনিসপত্র রেখে বাস থেকে নেমে এল।

বলল, কই? চা কোথায় সবুজবাবু?

সবুজ চায়ের ভাঁড় এগিয়ে দিল।

সবুজ আর কমলাও চা খাচ্ছিল। বেশ লাগছিল মিষ্টি মিষ্টি ঠাণ্ডায় ভোররাতে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ের সোঁদা সোঁদা গন্ধমাখা চা খেতে।

চা খাওয়া শেষ করে কুমুদ পানের বাটা বের করে গোটা চারেক পান একইসঙ্গে মুখে পুরে দিল। তারপর জর্দা খেল খানিকটা।

সবুজকে বলল, খাবেন নাকি একটা?

সবুজ বলল, দিন।

কমলা কুমুদকে বলল, কী যে, ছাগলের মতো পান খাও দিনরাত বুঝি না।

কুমুদ কখনো কমলার কথার জবাব দেয় না। বিশেষ করে এমন কোনো কথার, যে-কথার জবাব দিলে ঝগড়ার সূত্রপাত হতে পারে। বেশ লাগে সবুজের। কুমুদ জীবনে মিনিমাম এফর্টে কী করে সুখী হতে হয়, তা বেশ জেনে গেছে। সুখের বন্যা ওর জীবনে।

কিছুক্ষণ পর ওরা বাসে গিয়ে উঠল।

জানলা তুলে দিয়ে, ওরা একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। শেষরাতে ট্রেন থেকে নামার ঝামেলাটা পুষিয়ে নিতে চাইল।

জানলার পাশে কমলা, তার পাশে কুমুদ, কুমুদের পাশে সবুজ। কুমুদ ভাবছিল, গিয়েই বাজারে যাবে, কী তরিতরকারি পাওয়া যায় আনবে, মুরগি কিনবে। বিয়ার পাওয়া গেলে বিয়ার। সবুজবাবুকে নিয়ে বেড়াতে আসার মানে নেই। বিয়ার খায় না, তাস চেনে না, এক অদ্ভুত চিজ।

সবুজ ভাবছিল, কুমুদের কোনো সঙ্গী জুটে গেলে ভালো হয়, ও আর কমলা একটু একা থাকার, একা বেড়াবার সুযোগ পাবে। কুমুদটা আচ্ছা লোক–এত খরচখরচা করে, কলকাতার বাইরে এসে, সারাদিন দরজা বন্ধ করে বিয়ার খাবে, সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার করে জুয়া খেলবে তিনপাত্তি-এরা কেন যে, কলকাতার বাইরে আদৌ আসে তা, বোঝে না সুবজ ।

পরক্ষণেই ভাবে, ভাগ্যিস কুমুদ এসেছিল, নইলে ওরও কি আসা হত? হাজারিবাগের নাম শুনেছে কত, কিন্তু আসা হয়নি কখনো। এই কটা দিন তার মস্ত বড়োপ্রাপ্তি। একঘেয়ে, ক্লান্তি আর ক্লান্তি; ভীষণ ক্লান্তির জীবনে এ এক বিশেষ প্রাপ্তি। যেমন ফণীরও। ফণীর জন্যেও ও ময়দান ফাঁকা রেখে এসেছে। হাসি যদি জানতেও পারে যে, সবুজ অফিসের কাজে আসেনি, তাহলেও দুঃখিত হওয়ার কোনোই কারণ নেই তার।

দেখতে দেখতে সারিয়া থেকে বগোদরে এসে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড পেরিয়ে, বাসটা হু-হুঁ করে এগিয়ে চলল।

বাইরে ভোর ভোর হয়েছে। পুবের আকাশে হালকা সোনালি আভা দেখা যাচ্ছে। দু-পাশে বেশ জঙ্গল আরম্ভ হয়েছে এখন।

কুমুদ নাক ডাকতে আরম্ভ করেছে বসে বসে। কমলার চোখ বোজা। মাথা জানলার শার্সির ওপরে নোয়ানো। ঘুমোচ্ছে কি না বুঝতে পারছে না সুবজ।

কুমুদকে দেখে বেশ হিংসা হয় সবুজের। খুব সুখী কুমুদ। ওর সুখে কোনো ঘোরপ্যাঁচ, কমপ্লিকেশন কিছুই নেই। সুখী হতে হলে কুমুদের মতো সহজ সরল হতে হয়। পৃথিবীর সকলকে বিশ্বাস করতে হয়। স্ত্রীর প্রেমিককেও।

টাটিঝারিয়ায় এসে পন্ডিতের দোকানে চা, নিমকি ও কালোজাম খেল ওরা।

কুমুদ বলল, সবুজবাবু, আরও দুটো মিষ্টি নিন। দারুণ করেছে।

চা-টা সবুজের বেশি ভালো লাগল।

হাজারিবাগে এসে যখন ওরা পৌঁছোল, তখন বেশ বেলা। আসলে হাজারিবাগ শহর অবধি ওরা গেল না। কোরবার মোড়ে বাস থেকে নেমে পড়ে তিনটে সাইকেল রিকশা নিয়ে ক্যানারি পাহাড়ের দিকে চলল।

সামনের রিকশায় কুমুদ আর কমলা। সামাজিক সিলমোহর-মারা স্বামী-স্ত্রী। দিনের আলোয়, বাইরের লোকের সামনে এমনি করেই চলতে হয়, সব স্বামী-স্ত্রীকে। সবুজ হাসিকে, কমলা-কুমুদকে। হাসি পায় সবুজের। অথচ এটাই নিয়ম। নিয়মটাকে চ্যালেঞ্জ না করে, মেনে নেওয়াটাই খুশি হওয়ার সোজা রাস্তা।

প্রায় সোজা রাস্তাতেই চলেছে সাইকেল রিকশাগুলো। শেষেরটায় সবুজ।

ক্যাঁচোর-ক্যাঁচোর করে চলেছে, অসমান লাল মাটির পাথুরে রাস্তায়। ডান দিকে খখাওয়াই; জলপাওয়া সবুজ শালবন, ঘন হয়ে মিশেছে ক্যানারি পাহাড়ের গায়ে। তারপর পাহাড়কে অতিক্রম করে চলে গেছে। ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। ঘন, চাপ চাপ গাঢ় সবুজের সমারোহে।

মাথার উপর দিয়ে একদল বক দুলতে দুলতে উড়ে গেল। কীরকম এক, উদ্ভটস্বরে ডাকতে ডাকতে।

চারিদিকে চাইতে চাইতে সবুজ চলেছে। বর্ষাশেষের মিষ্টি হাওয়া লাগছে গায়ে। ভারি। ভালো লাগছে সবুজের।

সামনের রিকশা থেকে কমলা মুখ ফিরিয়ে বলল, কী দারুণ জায়গাটা, না? সবুজ বলল, দারুণ। কুমুদ বলল, আর কী? খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম। আমি কিন্তু রিল্যাক্স করতে এসেছি। বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি না।

সবুজ প্রথমে অবাক হল। তারপর খুশি হল। ভাবল, আশ্চর্য! কতরকমের মানুষ হয়। প্রত্যেক লোকের সঙ্গে প্রত্যেকের কত তফাত। ভাগ্যিস তফাত ছিল, নইলে সবুজের মধ্যে কমলা ভালো-লাগার মতো কিছুই দেখতে পেত না, যদি তার যা-কিছু ভালো লাগার সব-ই পেয়ে যেত কুমুদের মধ্যে। তারপর-ই হাসির কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে যেতেই ও কিছুতেই ফণীকে আর হাসিকে ক্ষমা করতে পারল না। ওদের সম্পর্কটা ক্ষমার অযোগ্য। কী করে, হাসি সবুজকে পেরিয়ে ফণীর দিকে হাত বাড়াল? ফণীর জন্যে সবুজকে নস্যাৎ করে দিল।

এমন সময় একটা সাদা মোটরগাড়ি সবুজের রিকশার পাশ কাটিয়ে লাল ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। কিন্তু গাড়িটা কুমুদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, কুমুদ কী-যেন বলে উঠল। গাড়িটা রিকশা থেকে অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে জোরে ব্রেক কষে দাঁড়াল। চেক-চেক হাওয়াইন শার্ট পরা একজন মোটাসোটা বেঁটেখাটো ভদ্রলোক নামলেন–গায়ের রং কালো–মুখটা ভোঁতা–সবুজের সমবয়সি।

ভদ্রলোককে দেখে কুমুদ রিকশা থেকে নেমে, গাড়ি অবধি হেঁটে গিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে কীসব কথা বলল।

সবুজের সাইকেল রিকশাটার চেন খুলে গিয়েছিল, তাই সবুজ অনেক দূরে থাকতে থাকতেই কুমুদের সঙ্গে কীসব কথাবার্তা বলে, ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন।

সবুজের রিকশা কাছে পৌঁছোতেই কুমুদ অতিকষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, কে জানেন? সবুজ শুধোল, কে?

-আরে, বিখ্যাত সাহিত্যিক মধুপ সেন। নাম শোনেননি?

সবুজ বলল, না।

–সে কী? কুমুদ অবাক গলায় বলল।

কমলা বলল, তুমি যেন কত লেখা পড়েছ, কত যেন সাহিত্যরসিক লোক!

কুমুদ স্বভাববিরুদ্ধভাবে কমলার প্রতিবাদ করে বলল, কেন? ‘ভালোবাসি’ সিনেমা দেখিনি?

কমলা বলল, হ্যাঁ, ওই বই, ছবি হয়েছিল বলেই দেখেছ।

কুমুদ একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমরা যেখানে উঠছি তার পাশেই উনি। আছেন। পুজোসংখ্যার উপন্যাস লিখতে এসেছেন।

সবুজ মুখে বলল, বাঃ।

মনে মনে বলল, জ্বালাবে।

তারপর বলল, মেয়েরা ছাড়া, আর কেউ কি এসব সাহিত্য-ফাহিত্য পড়ে? ছেলেদের তো সময়ই নেই। কার সময় আছে, অমন ঢাউস ঢাউস লেখা পড়বার?

কুমুদ বলল, তাও সুন্দরী মেয়েরা পড়ে না। তাদের সময় নেই। সব সময়ই তো হাতজোড়া, মনজোড়া-তাদের কত অ্যাডমায়ারার-এসব ফালতু লেখা পড়ার সময় কোথায় তাদের?

কমলা বলল, তাহলে পড়েটা কারা?

কুমুদ বলল, সেইটেই ভেবে পাই না!

সবুজ শুধোল, ভালো লেখেন?

কুমুদ বলল, তা কে জানে?

–তাহলে বললেন যে, বিখ্যাত সাহিত্যিক?

কুমুদ সবুজের নির্বুদ্ধিতায় ব্যথিত হয়ে বলল, আরে কত বড়ো বড়ো করে, ওঁর নাম বেরোয় দেখেন-না বিজ্ঞাপনে? ‘প্রচন্ড সাহিত্যিকের একান্ত উপন্যাস। তারমানেই, ভালো লেখেন। এ আবার লেখা পড়ে জানতে হবে নাকি? আপনি মশায় এক্কেবারে…

দূর থেকে বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল।

কুমুদ চেঁচিয়ে বলল, ওই যে, দেখা যাচ্ছে।

কুমুদ বড়ো চেঁচায়। তবু সবুজ তাকিয়ে দেখল। দূর থেকেই প্রথম দর্শনে ভালো লেগে গেল বাড়িটা। অনেকখানি জায়গা নিয়ে কম্পাউণ্ড–বড়ো বড়ো ইউক্যালিপটাস গাছ, সোনাঝুরি গাছ, অনেকটা ঝাঁটি জঙ্গল, বাড়ির মধ্যেই বিরাট বিরাট কালো-রং বিভিন্নাকৃতি পাথর। বেশ বসে আড্ডা দেওয়া যাবে। ছোট্ট ছিমছাম বাংলোটি।

মধুপবাবু বোধ হয় মালিকে বলে গিয়েছিলেন যাওয়ার সময়।

মালি ঘরদোর খুলে রেখেছিল ইতিমধ্যেই। একবেলার রান্নাও নাকি তার বউ করে রেখেছে কলকাতার মালিকের চিঠি পেয়ে।

সবুজ একেবারে কুয়োতলায় গিয়ে তেলটেল মেখে ভালো করে চান করল। যাওয়ার সময় কুমুদবাবুকে ডাকল। কুমুদবাবু বললেন, দুর মশাই, কলকাতার ছেলে আমরা, কখনো অমন করে চান করা অভ্যেস নেই। খালি গায়ে, খোলা জায়গায় দাঁড়ালে, আমার গায়ে হাওয়া লাগলেই সুড়সুড়ি লাগে।

খাওয়া-দাওয়ার পর সকলেই ‘একটু গড়িয়ে নিই’ বলে শুয়েছিল।

সবুজ এক ঘুম দিয়েই উঠে পড়েছিল। বিছানাতেই শুয়ে শুয়ে, ওর ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে চেয়েছিল। প্রথম শরতের নীল আকাশ। বিকেলের রোদ ইউক্যালিপটাসের পাতায় পিছলে যাচ্ছে। এই গাছগুলোর কান্ডগুলো মেয়েদের ফর্সা উরুর মতো। নিটোল, মসৃণ, দেখলেই গা শিরশির করে। হাওয়াতে মিষ্টি হালকা ঝাঁঝের গন্ধ উড়ছে। অসমান লাল জমি, পিটিস ঝোঁপ, খখাওয়াই এসব পেরিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে পিচের রাস্তাটা। এ রাস্তাটা নাকি রাজডেরোয়া ন্যাশনাল পার্ক হয়ে সোজা চলে গেছে বড়হি–ঝুমরি-তিলাইয়া।

হাতঘড়িতে সবুজ দেখল চারটে বাজে। মনটা একটু চা-চা করছে। এমন সময় হাতে চায়ের কাপ নিয়ে কমলা এসে ঢুকল।

হাসিমুখে বলল, কী? সবুজের সমারোহতে সুবজ দিশেহারা নাকি?

সবুজ বিছানায় উঠে বসল। বালিশটাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বসে বলল, এসো, এসো। এক্ষুনি চায়ের কথাই ভাবছিলাম।

তারপর-ই সবুজ শুধোল, কুমুদ কোথায়?

কমলা বলল, কুমুদ মধুপবাবুর বাড়ি গেছে জায়গাটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে।

কমলা এসে খাটের ওপর ওর পায়ের দিকটায় বসল।

চান করে উঠে একটা ফিকে সবুজ-রঙা ভয়েল শাড়ি পরেছিল ও–সঙ্গে ম্যাচ করা ব্লাউজ। গলায় একটা নীল পাথরের হার, কানে তিব্বতি নীল পাথরের দুল।

কমলার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে, কমলার বানানো চায়ে চুমুক দিতে দিতে, সবুজের মন কী-এক দারুণ ভালো-লাগায় ভরে উঠল। ওর নিজের কোনো দুঃখ, কোনো হীনম্মন্যতার কথাই এ মুহূর্তে আর মনে রইল না। ওর নিজের কথা, ওর পারিপার্শ্বিকের সমস্ত কথা ভুলে গিয়ে ও অনিমেষে কমলার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

কমলা বলল, চলো, বারান্দায় গিয়ে বসি। কী সুন্দর-না বারান্দাটা!

–হুঁ। সবুজ বলল।

বাড়ির লাগোয়া বাঁধানো বিরাট বারান্দা। বসার জায়গা করা আছে। ওরা দু-জনে গিয়ে বসল মুখোমুখি।

ততক্ষণে রোদ পড়ে গেছে। নানারকম পাখির ডাক, তিতিরের ডাক ভেসে আসছে ঝাঁটি জঙ্গল থেকে। একঝাঁক টিয়া তাদের ট্যাঁ ট্যাঁ আওয়াজে বুকের মধ্যে চমক তুলে ক্যানারি পাহাড়ের দিকে চলে গেল।

কমলা বলল, এই বারান্দা ব্যাপারটা আমার দারুণ লাগে। কলকাতার বাড়িতে বারান্দা নেই–আমার খুব ইচ্ছে করে একটা বারান্দাঅলা বাড়িতে থাকতে।

তারপর-ই একটু চুপ করে থেকে বলল, তোমাদের বাড়িতে কি বারান্দা আছে? আমার মনে নেই, কতদিন আগে একবার গিয়েছিলাম। ভাবলে অবাক লাগে, না? হাসিই ছিল আমার বন্ধু, তার সূত্রেই তোমার সঙ্গে আলাপ, আর এখন হাসির খবর-ই রাখি না; হাসি। সব জানলে কী মনে করত জানি না। কীরকম করে মানুষ একজনের কাছ থেকে সরে এসে, অন্যজনের কাছের হয়ে যায়। তাই না?

তারপর কমলা আবার শুধোল, বারান্দা নেই, না?

সবুজ মাথা নাড়ল। বলল, নেই।

কমলা হঠাৎ বলল, আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেও একটা করে বারান্দার বড়ো দরকার। ঘর মানেই একঘেয়েমি–সমাজের, কর্তব্যের দিন-গুজরানো, চলা-ফেরা সব-ই ঘরের মধ্যেই। মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে বড়ো ইচ্ছে করে–যেমন এইমুহূর্তে তুমি আর আমি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণের ভালো লাগা। তারপরেই যেই ভেতরের ডাক আসে, ঘরের মধ্যের ডাক, কর্তব্যের, অভ্যেসের, অমনি ঘরে ফিরে যেতে হয় আমাদের সকলকে। যেমন আমি যাব কুমুদের ঘরে, তুমি যাবে হাসির ঘরে।

সবুজ অবাক হয়ে শুনছিল।

কমলা একটু পরে বলল, জানো সবুজ, ঘরের মধ্যে পেতে পেতে, অনেকদিন থাকতে থাকতে, খুব দামি পাওয়াগুলোকেও বড়ো সস্তা বলে মনে হয়, মনে হয় এগুলোর বুঝি কিছুমাত্রও দাম নেই। বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালে, বাইরের হাওয়া, বাইরের জীবন, পাখির ডাক, লোকজন, এসবের ভালো লাগায় মন ভরে ওঠে। আশ্চর্য! বারান্দায় থেকে, বারান্দায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার ঘরে ফিরে গেলে, রোজকার টুকরো টুকরো, সস্তা মনে করা পাওয়াগুলোকে, হঠাৎ এক নতুন চোখে আবিষ্কার করা যায়। তারা যে, কতখানি দামি, তা বুঝি বুঝতে পারা যায়।

কমলা একসঙ্গে অনেক কথা বলে ফেলে চুপ করে রইল।

সবুজও চুপ করে দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়েছিল।

হঠাৎ সুবজ বলল, কমলা, তুমি কাছে এলে ভালো লাগায় মরে যাই কেন বলতে পারো? আমি যে, তোমাকে ভালোবেসে আমার ঘর নষ্ট করলাম; আমার বিবাহিত জীবন একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গেল, আমি যে, হাসির প্রতি আর কোনো আকর্ষণ-ই অনুভব করি না কেন? এর কি কোনো উপায় নেই? আমি তোমাকে পাওয়ার জন্যে সবকিছুই করতে পারি। তুমি আমার জন্যে কী করতে পারো? তুমি আমার জন্যে কুমুদকে ছাড়তে পারো? পারো?

কমলার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল একমুহূর্তের জন্যে।

ওর তীক্ষ্ণ নাক, খোলা চুলের ভার, ওর হালকা নীল শাড়ির নীলচে আভাসে মনে হল, ও যেন অনেক দূরে চলে গেছে সবুজের কাছ থেকে।

কমলা হাসল। সবুজের মনে হল, যেন অনেকক্ষণ পরে এবং অনেকক্ষণ ধরে ও হাসল। অদ্ভুত হাসি। সেরকম হাসি একমাত্র কোনো বুদ্ধিমতী মেয়ের পক্ষেই হাসা সম্ভব।

তারপর বলল, পারি না সবুজ। হয়তো চাইও না।

সবুজের গলায় অভিমানের সুর লাগল।

বলল, তোমার জন্যে আমি কিন্তু পারি। সব ছাড়তে পারি।

কমলা আবার হাসল। বলল, আমি জানি তা।

সবুজ অবাক হল। বলল, তুমি জানো? জেনেও, আমি যা পারি তা তুমি পারো না? তা তো পারবেই না–আমি তো তোমাকে কুমুদ যেমন করে রেখেছে, তেমন করে রাখতে পারব না। আমি তো অতসচ্ছল নই।

কমলা হাসল। বলল, তুমি বড়োবোকা!

তারপর-ই কথা ঘুরিয়ে বলল, আচ্ছা! তোমার কি ধারণা, ঘর না ছাড়লে কাউকে ভালোবাসা যায় না? তোমার কাছে ভালোবাসা ব্যাপারটা এখনও বড়ো ধোঁয়াটে আছে।

সবুজ অভিমানের গলায় বলল, তাই হয়তো কারও ভালোবাসা পেলাম না জীবনে।

কমলা খিলখিল করে হেসে উঠল।

বলল, পাগল! ভালোবাসা নিশ্চয়ই পেয়েছ তুমি–কিন্তু তুমি তা চিনতে পারোনি। তুমি নিজেকে এত ভালোবাসো, সব সময়ে, সে-ভালোবাসা তোমাকে এমন করে ঘিরে থাকে যে, অন্যের ভালোবাসার দাম বোঝোনি তুমি।

তারপর বলল, তুমি তো অনেক জানো সবুজ, তবু আমি সামান্য একজন ঘরের বউ হিসেবে তোমাকে একটা কথা বলছি, কথাটা মনে রেখো।

–কী? কী কথা?

ফুঁসে উঠে সবুজ শুধোল।

কমলা তখনও চোখ দিয়ে হাসছিল।

বলল, শোনো, আমার কাছ থেকে ভালোবাসার প্রথম পাঠ নাও। ভালোবাসা পাওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে নিজেকে না ভালোবাসা। অন্যকে, যাকে তুমি ভালোবাসো, তার সুখের মধ্যেই তোমার নিজের সুখকে দেখতে পাওয়া।

একটু চুপ করে থেকে কমলা আবার বলল, পারবে সবুজ? যদি পারো তো, ভালোবাসা পাবে, অনেক ভালোবাসা, অনেকের ভালোবাসা। যে, ভালোবাসা পেতে জানে, দিতে জানে, সে নিজের ঘরে এবং মাঝে-মধ্যে এই এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়েই তা নিতে ও দিতে জানে, ভালোবাসা খুঁজতে তাকে দেশান্তরী হতে হয় না। ঘর ছাড়তে হয় না। দেশান্তরী হলেও, প্রতিবছর তোমার মতো করে নতুন কাউকে ভালোবেসে, নতুন-নতুন ঘর বাঁধলেও, তুমি দেখতে পাবে যে, সে-ঘরে তোমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। দোষটা ঘরের নয়, তোমার ভালোবাসার জনেরও নয়; দোষটা তোমার; তোমার নিজের।

শেষের কথাগুলো একটু কঠিন করে বলল কমলা।

সবুজ দুঃখিত হল।

সবুজ কী-একটা বলতে যাচ্ছিল জবাবে, কিন্তু তার আগেই কমলা বলল তোমার এই, তুমিময় জগৎ ছেড়ে বাইরে আসতে হবে। নিজের কথা একটুও না ভেবে অন্যকে বিনা দ্বিধায় ভালোবাসতে শিখতে হবে–নইলে তুমি কখনো সুখী হবে না সবুজ। আমি তো একজন সামান্য কমলা। পৃথিবীর সব মেয়ে ও পুরুষ তোমাকে একসঙ্গে ভালোবাসলেও তোমাকে সুখী করতে পারবে না।

সবুজ এবার একইসঙ্গে অনেক বলতে যেতেই, গেটের কাছে কুমুদকে দেখা গেল।

কুমুদ আসছে। তার পেছনে পাহাড়-প্রমাণ বোঝা নিয়ে একজন কুলি।

কমলা শুধোল, এ কী! মোটে ঘণ্টাখানেক হল গেলে, এরই মধ্যে চলে এলে? বাজার কতদূর?

কুমুদ পান খাচ্ছিল। দিবানিদ্রা নিয়ে চোখমুখ ফোলা, চুলগুলো এলোমেলো, পাঞ্জাবির বুকে খানিকটা পানের পিক গড়িয়ে পড়েছে।

জর্দার ঢোক গিলে কুমুদ বলল, আরে, বুদ্ধি খরচ করতে হল। মধুপবাবুর গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি বললেন, যখন খুশি গাড়ি নিয়ে যাবেন, আমি তো সারাদিন-ই ব্যস্ত আছি এখন, বেরুবার সময় হয় না–সন্ধের পর আড্ডা মারি–চলে আসবেন।

তারপর কুমুদ বলল, ব্যস, আর কী? ওঁর গাড়িতে ওঁর ড্রাইভারকে ধরে, বোঁ করে বাজার ঘুরে এলাম।

কমলা বলল, তুমি বেশ হ্যাংলা আছ। পরের গাড়ি চেয়ে নিয়ে বড়োলোকি করার দরকার কী?

কুমুদ হাসল। বলল, আরে বড়োলোকি তো মনের ব্যাপার, সে কি আর গাড়িতে হয়? আমার মতো বড়োলোক কে? আমার কমলা আছে। ওদের কী আছে? আর কার কমলা আছে?

কমলা আড়চোখে একবার সবুজের দিকে তাকাল।

কুমুদ আবার বলল, দ্যাখো, দ্যাখো, কী দারুণ পেয়ারা এনেছি। তুমি পেয়ারা খেতে ভালোবাসো–মুরগি এনেছি–আলু, পেঁয়াজ, ডিম, ইসবগুলও; মাছ পাওয়া গেল না। কাল ভোরে চলে যাব রাঁচি রোডে, জলের ট্যাঙ্কের কাছে নাকি টাটকা মাছ আসে।

তারপরেই, সবুজের দিকে ফিরে বলল, কী মশাই? মুখ গোমড়া কেন? গিন্নির কথা মনে পড়ছে বুঝি? তা নিয়ে এলেই তো পারতেন বাবা! আমি তো মশাই গিন্নি-ছাড়া শুতেই পারি না। ঘুম-ই আসে না। পাশটা খালি-খালি লাগে।

কমলার মুখে এক চিলতে রক্ত এল।

কমলা বলল, থাক, বুড়ো বয়সে আর ঢং করতে হবে না।

সবুজের মনে হল, কথাটা ঢং নয়। ঢং হলে কমলা লজ্জা পেত না অমন করে।

সবুজ ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। ও বুঝতে পারল না, স্বামী-স্ত্রীতে এতই যদি প্রেম, তাহলে ওকে জোর করে, এমন করে নিয়ে আসার মানে কী? তখন তো কত। ন্যাকামিই করল কমলা, তুমি না গেলে যাব না, যেতেই হবে–এইসব।

আনাজ-পত্র বাজার সব ভেতরে নিয়ে গেল মালি। সঙ্গে কমলাও গেল।

কুমুদ বলল, নিন, একটা পান খান। ভালো জর্দা আছে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবুজ পানটা হাতে নিল। মুখে পুরল। তারপর বলল, আমি একটু হেঁটে আসছি।

কুমুদ বলল, আবার হাঁটাহাঁটি কেন? বেশ তো আছেন মশায়; সূর্যটা ডুবে যাক। আমি আছি আর সঙ্গে একটা রামের বোতল আছে। বারান্দায় জমিয়ে বসব, মধুপবাবুও আসবেন। উনি অবশ্য খান-টান না। ব্যাক-ডেটেড সাহিত্যিক। তবে সংস্কার-ফংস্কার নেই। রামের সঙ্গে সঙ্গে একটু, সাহিত্য-ফাহিত্য আলোচনা হবে। কলকাতায় ফিরে, বুঝলেন কিনা, অনেকদিন পর্যন্ত একটা ইনটেলেকচুয়াল নেশায় বুঁদ হরে থাকব।

সবুজ মনে মনে বলল, ইডিয়ট।

মুখে বলল, আমি সাহিত্য-ফাহিত্য বুঝি না। কোনো ইন্টারেস্ট নেই সাহিত্য অথবা সাহিত্যিক সম্বন্ধে।

কুমুদবাবু অবাক হয়ে বললেন, সে কী মশাই! বুঝি না তো আমিও, তা বলে ইন্টারেস্ট থাকবে না কেন? না থাকলেও, দেখাতে হবে। আরে বাঙালির ছেলে হয়ে জন্মেছেন, তিনটে নিয়ম মেনে চলবেন সব সময়।

বলেই, মুখে আর একটু জর্দা ফেলে বললেন, পয়লা নম্বর-বউকে ভয় পাবেন। আসলে ভয় না পেলেও, দেখাবেন যে, ভয় পাচ্ছেন; তারপর বাইরে যা-করার তা করে বেড়াবেন।

তারপর একটু থেমে, বলবেন, কী বলবেন না ভেবে নিয়ে বললেন, আমি তো মশাই নিয়মিত এদিক-ওদিক, বুঝলেন কি না–।

তারপর-ই গলার স্বর নামিয়ে বললেন, দেখবেন, বলে দেবেন না যেন। বললে কিন্তু যা কৃষ্ণলীলা আপনিও চালিয়ে যাচ্ছেন আমার স্ত্রীর সঙ্গে, তা বন্ধ করে দেব। বুঝলেন মশায়, আপনি চলেন ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। আমি সব-ই জানি। তবে, আমার বিশেষ আপত্তি-ফাপত্তি নেই। চালিয়ে যান। আমি বাইরে ঘুরেই সুখ পাই, বুঝলেন না, ঘরকা মুরগি ডাল বরাব্বর”। ঘরে আমার মন বসে না। ঘরের লোককে আপনি যদি একটু আধটু আনন্দ দিতে পারেন তো দিন। তবে তোক আপনি ডেঞ্জারাস নন। আপনার এলেম আমার জানা হয়ে গেছে। আপনার মতো মেয়েছেলে-মার্কা ব্যাটাছেলে সাহিত্য পড়েন না, এটাই আশ্চর্যের কথা। যাকগে, আমার কোনো ক্ষতি নেই। তবে, ঘুণাক্ষরে এ-কথা কমলা যেন না জানে। মানে, আমি যে, আপনার কেলোর-কীর্তি জানি–সেই কথাটা। আমি যে কথা বললাম আমার সম্বন্ধে, তাও যেন না জানে।

শেষের কথাটা রীতিমতো ভয় দেখিয়েই যেন বলল কুমুদ।

সবুজের ওইখানে কুমুদের সঙ্গে আর একটুও বসে থাকতে ইচ্ছে করল না। কী এক অপমানে, লজ্জায়, জ্বালায় তার কান দুটো ঝাঁঝাঁ করে উঠল। কমলার প্রতি, এক তীব্র সমবেদনায় ওর মন হু-হুঁ করে উঠল।

সবুজ বলল, আমি একটু হেঁটে আসি, বুঝলেন কুমুদবাবু!

কুমুদ অন্যমনস্ক হয়ে কী-যেন ভাবছিল।

–অত হাঁটার বাতিক কেন? ডায়াবেটিস আছে নাকি?

তারপর সবুজের কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, যান।

আসন্ন-সন্ধ্যায় এই বন-পাহাড়ের পটভূমিতে শেষ বিকেলের হালকা নরম রোদে ক্যানারি হিল রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সবুজের মনে হল, ও হাঁটছে না, ও যেন দৌড়োচ্ছে। ওর মনে হল ও এখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারলে সুখী হত।

এইমুহূর্তে, কমলার জন্যে ওর বড়ো দুঃখ হল। কমলার পরম সৌন্দর্যময়, ঐশ্বর্যময় অন্তরের মধ্যে ওর স্বামী সম্বন্ধে, ওর যে, চাপা গর্বটুকু ছিল, যে গর্বে ভর করে ও সহজে এতদিন সবুজকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, বলেছিল, কুমুদ আমাকে ভালোবাসে, কুমুদ জানলে দুঃখ পাবে, সেই গর্বটুকু যে, চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা কমলা জানে না। আন্তরিক ভালোবাসার এই কি প্রতিদান? এমন করে কি কেউ কাউকে ঠকায়?

ভাবতে ভাবতে সবুজের মাথা গরম হয়ে উঠল। ও বুঝতে পারছিল না যে, কী করে একজন মানুষ এতখানি ভন্ডামি, এতখানি অভিনয় নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে? অবশ্য এ-কথা সত্যি যে, ওই ভন্ডামির মূল্যে কুমুদ ঘরে এবং বাইরে সমান কৃতী। তার ভালোবাসার ঘর, কমলার স্নেহ-মমতা; ভালোবাসা, সব-ই সে পায়, উপরিও পায় বাইরের সস্তা জগতের কাছ থেকে, যেখানে কড়ি ফেলে কেউ কেউ ফুলেল তেল মাখে।

সবুজ ভাবছিল, ও নিজে কি কখনো, এতখানি ভন্ডামি করতে পারত? মানুষ মিথ্যাচার করলে, ভন্ডামি করলে কি, নিজের কাছেই বড়ো, ছোটো হয়ে যায়-না? ভেতরে ভেতরে কি, সে ক্ষয়ে যায় না? সমস্ত অন্তরের সরল, সত্য আন্তরিকতায়, এ-জীবনে যা পাওয়া যায় অথবা যা পাওয়া যায় না; তার সবকিছুরই একটা বিশেষ দাম আছে বলে সবুজ মনে করে। যে কারণে, ফণীকে হাসি ভালোবাসে, এ-কথা জানার পর থেকেই হাসির সম্পর্কে কখনো সহজ হতে পারেনি। আন্তরিকভাবে হাসিকে ভালোবাসতে পারেনি। কাছে টানতে পারেনি। কাছে টানতে না পেরে দুঃখ পেয়েছে নিশ্চয়ই। ফণীর কাছে হেরে গিয়ে পরাজয়ের গ্লানিও স্বীকার করেছে সত্যি। কিন্তু তবুও তো ওর নিজের মধ্যে, কমলার সঙ্গে ওর সম্পর্কর মধ্যে; ওর সত্য অনুভূতিতে ও বেঁচে আছে। এটা তো সত্যিই। ও নিজের মধ্যে তো, এমন করে মিথ্যা, ঠগ প্রবঞ্চক হয়ে যায়নি। এর কি কোনোই দাম নেই? জীবনে সুখী হতে গেলে কি ঠগ-ই হতে হয়? অভিনয় করতেই হয়? বিনা-অভিনয়ে কি কোনো কিছুই পাওয়া যায় না এখানে?

অন্ধকার হয়ে আসছিল। পথের পাশের পিটিসের ঝোঁপ-ঝাড়ে ছাতারে পাখিরা কেমন নড়েচড়ে বসছিল। একটা ছোটোপেঁচা পাহাড়তলির জঙ্গলে ‘কিচর কিচর কিচর–কিচি কিচি কিচর’ করে ডেকে ফিরছিল।

সবুজ সেই অন্ধকারের মধ্যে, অন্ধকারতর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওর বুকের মধ্যের অন্ধকারের ভার বোঝার চেষ্টা করছিল।

ও ভাবত কমলা অন্তত সুখী। কমলার সুখেও এত কাঁটা? আহা বেচারি! জানতে পারলে, কী জানি না করবে। হয়তো আত্মহত্যাই করে বসবে।

একটু পরে বেশ অন্ধকার হয়ে এল চারপাশ। তাড়াতাড়িতে, টর্চ নিয়ে বেরোয়নি ও। পথ ভালো দেখা যাচ্ছিল না।

সবুজ আবার বাড়ির দিকে ফিরল।

কমলা চান করে নিয়েছিল। চান করে পরিষ্কার হয়ে বাইরের বারান্দায় গিয়ে বসেছিল। সমস্ত অন্ধকার বারান্দা ওর সুস্নাত গায়ের গন্ধে, নানারকম ফুলের গন্ধে; ইউক্যালিপটাস পাতার গন্ধে ভরে ছিল।

সবুজ বারান্দায় উঠে ওর উলটোদিকে বসল।

অন্ধকার-ই ভালো। অন্ধকারে কমলা সবুজের মুখ দেখতে পাবে না। সবুজের মুখ দেখলে চমকে উঠবে কমলা। ভয় পেয়ে যাবে হয়তো।

কমলা নিজেই বলল, কুমুদ গেল মধুপবাবুর কাছে। বলল, আজকে আমিই যাই। কালকে ওঁকে নেমন্তন্ন করব ভাবছি।

–ও! সবুজ বলল।

তারপর-ই হঠাৎ বলল, কাল-ই ফিরে গেলে হয় না? আমার এখানে ভালো লাগছে না।

কমলা হাসল। বলল, জানি, তুমি আমার ওপর রেগে গেছ, আমি তোমার সঙ্গে হাঁটতে যাইনি বলে। কিন্তু গেলে কুমুদ কী মনে করত? ও তো তখন বাড়ি ছিল। তুমি বড়ো অবুঝ। তুমি কিছু বোঝো না।

–একটু কম বোঝাই ভালো।

সবুজ বলল।

–তা ছাড়া তুমি যাওয়ার সময় আমাকে একবার ডাক দিতেও তো পারতে। কমলা বলল।

সবুজ মনে মনে বলল, আমার ডাক কি তুমি শুনতে পাও? তোমাকে তো সব সময়ই ডাকি কমলা! তুমি কি তা বুঝতে পারো?

কমলা বলল, চলো! তোমার ঘরে চলো।

–কেন? সবুজ বলল।

–আহা! চলোই না।

তারপর, যেন অনেক দূরের থেকে বলল, আমার কী-ইবা দেওয়ার মতো আছে তোমাকে। তবুও, যেটুকু আছে, তার সমস্তটুকুই তোমাকে দেব আজ। তোমার অনেকদিনের বাসনা আজ পুরাব। তুমিই কিন্তু ঠকবে। আমি তো নতুন কিছু দিতে পারব না তোমাকে। হাসি যা দেয়, তার চেয়ে বেশি বা দামি তো আমার কিছু নেই। তবু, কেন যে, তুমি এমন কাঙালপনা করো, জানি না। যাকগে, তুমি যদি সুখী হও আমাকে পেয়ে, তাতেই আমার সুখ।

সবুজের কান্না পেল।

সবুজের সমস্ত মন বলতে চাইল, তোমাকে আমি ভালোবাসি কমলা। কিন্তু তোমার জন্যে আমার বড়োকষ্ট হচ্ছে। যে-প্রবঞ্চনার মধ্যে, তুমি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছ তাতে তোমাকে আমার করুণা করতে ইচ্ছে হয়। বিশ্বাস করো, আজ তোমার কাছে আমার কিছুমাত্র চাইবার নেই। বরং তোমাকে যদি আমি কিছু দিতে পারি, তোমার এই মিথ্যে-ফাঁপা সুখে যদি কোনো সত্যিকারের সুখের আনন্দ জাগাতে পারি, তাহলেই আমার অনেক পাওয়া হল বলে জানব আমি।

কিন্তু সবুজ চুপ করেই রইল। কিছুই বলতে পারল না।

কমলা উঠল। বলল, তুমি এখনও বুঝি রাগ করে আছ?

বলেই, অন্ধকার বারান্দায় সবুজের কাছে উঠে এসে, বাচ্চাদের যেমন করে আদর করে তেমন করে হঠাৎ সবুজকে জড়িয়ে ধরে গালে আদর করল সে।

কমলার গরম নিশ্বাস সবুজের মুখে লাগল। বুকে লাগল।

কমলা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল।

কমলা অস্ফুটে বলল, চলো। ভেতরে চলো।

সবুজের ঘরে ঢুকে, কমলা নিজের হাতে শিকল তুলে দিল। বাতিটাও নিবিয়ে দিল।

সবুজ শুধোল, কুমুদ?

কমলা বলল, ও রাত নটার আগে ফিরবে না।

তারপরেই বলল, এখন ওর কথা বোলো না।

বাগানের আলোটা ম্যাগনোলিয়া গ্লাণ্ডিফোরা গাছটার পাতার ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে বিছানায় এসে পড়েছিল। দূরে পাহাড়ের নীচে ‘টি-টি’ পাখি ডেকে বেড়াচ্ছিল। চমকে-চমকে বুকের মধ্যে চমক তুলে। আর ঝিঁঝির স্বর-একটানা চাপা ঝিম-ধরা ঝিঁঝির স্বর। সমস্ত চেতনার মধ্যে ও কী এক গভীর স্বর বেজে যাচ্ছিল; একটানা।

কমলা যে, এত সুন্দর সবুজের ধারণা ছিল না।

অন্ধকারের ওম-ধরা নীড়ে একটি নরম-লাজুক পাখিকে সবুজ আদর করছিল। বেড়ালে ধরা সাদা কবুতরের মতো ছটফট করছিল কমলা। কত সব আশ্চর্য, অস্ফুট, গা-শিউরানো আওয়াজ করছিল মুখে।

সবুজ কমলার নরম অথচ ঋজু শরীরের সঙ্গে মিশে গিয়ে বিড়বিড় করে বললঃ তোমারও ওষুধ আছে কুমুদ।

বলল, ফণী। তোকে এতদিনে হারালাম আমি। হারামজাদা।

কমলা চাপা গোঙানির স্বরে শুধোল, কী বলছ?

সুবজ বলল, কথা বোলো না। এখন কথা বোলো না।

খুব ভোরে উঠে সবুজ আর কমলা হাঁটতে বেরিয়েছিল।

সবুজ যখন বাথরুমে, তখনও বাথরুমের জানলা দিয়ে শুকতারাটা দেখা যাচ্ছিল। নানারকম পাখির কিচির-মিচির। বাথরুমের সামনে ঝোঁপের কাছে ছাতারে পাখিদের ডানার ফরর-ফরর শব্দ। ওদের গলার কর্কশ আওয়াজে সকালের শান্ত, অতীন্দ্রিয়, স্তব্ধ স্নিগ্ধতার আমেজটা যেন পেঁজা হয়ে যাচ্ছিল। ছাতারেগুলোর ওপর খুব রাগ হচ্ছিল সবুজের।

কুমুদ রাত করে ফিরেছিল কালকে। ন-টা নয়, প্রায় রাত এগারোটার সময়।

যখন ফেরে, তখন সবুজ কুমুদের মুখে একটা উৎকট গন্ধ পেয়েছিল। সবুজ বুঝেছিল, কুমুদ একটা নতুন কোনো জিনিস খেয়েছে। মহুয়া-ফহুয়া হবে। যে-গন্ধের সঙ্গে ও পরিচিত নয়। হারাধনের মুখ থেকেও গন্ধ পায় সবুজ মাঝে-মাঝে। এ-সব না খেলেও গন্ধ-টন্ধ চেনে ও। হারাধন ঠাট্টা করে বলে দাদা আমার গন্ধগোকুল।

তারপর খেতে বসে বিশেষ কথাটথা বলেনি কুমুদ কারও সঙ্গে। মাঝে মাঝে একটা সুর ভাঁজছিল, “কা করে ম্যায় হুঁওড়া-পুতানিয়া, হাম হ্যায় এক দুখিয়া”।

কমলা বিরক্তির গলায় বলেছিল, এ আবার কোন ছিরির গান!

কুমুদ খেতে খেতে, বাঁ-হাত নেড়ে বলেছিল এখানকার গান। এস-ও-এস-এর গান।

সবুজ শুধিয়েছিল, ‘এস-ও-এস’ মানে?

কুমুদ জড়িয়ে জড়িয়ে বলেছিল, সনস অফ দ্যা সয়েল।

সবুজেরও বিরক্তি লাগছিল। ভাবছিল, অতবড়ো সাহিত্যিক কি মহুয়া ছাড়া কিছু খাওয়াতে পারল না কুমুদকে? আজকাল এই মদ খাওয়া আর মাতলামি করা যে, কী এক ফ্যাশান হয়েছে তা ভাবা যায় না।

সবুজ হাঁটতে হাঁটতে শুধোল, কাল রাতে কুমুদবাবুর শরীর-টরীর খারাপ হয়নি তো?

কমলা বলল, না। দিব্যি মোষের মতো ঘুমোল ভোঁস-ভোঁস করে।

তারপর-ই সবুজের দিকে চেয়ে, কুমুদের পক্ষ টেনে বলল, মানুষটা বড়ো সরল। একেবারে ছেলেমানুষ। মাঝে-মধ্যে মদ খাওয়া ছাড়া, ওর অন্য কোনো দোষ নেই। থাকলেও বা আমার কী করার ছিল। ও যে, আমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। আমার প্রতি ওর সিনিসিয়ারিটি পুরোপুরি খাঁটি। যদি কেউ কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসে, ভালোবেসে থাকে, তবে শুধুমাত্র সেই ভালোবাসার গুণের জন্যেই যে, সে-ভালোবাসা পায় তার উচিত হল যে, তাকে ভালোবেসে তার সব দোষ ক্ষমা করে দেওয়া।

তারপর বলল, জানো সবুজ, জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসার কাছে অন্য সমস্ত কিছুই তুচ্ছ। নিক্তির একদিকে ভালোবাসা বসাও, আর অন্যদিকে আর সবকিছু। দেখবে ভালোবাসার দিকটা সব সময়ই ভারী।

সবুজ চুপ করেছিল।

এই সকালে, এই সুন্দর শারদ সকালে, শিশিরের গন্ধে, শিশিরে ভিজে থাকা গাছপালা, লতাপাতা, লাল মাটি, সবকিছুর গন্ধে তার নেশার মতো লাগছিল। কমলার জীবনের প্রচন্ড বঞ্চনাকেসে, এই সকালে বাইরে আনতে পারে না। যে-কমলা ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে এত আনন্দে আছে, যার ভালোবাসাটা মিথ্যে হলেও, যার কাছে আনন্দের তীব্রতাটা সত্যি, তাকে পথের ধুলোয় বসাতে পারে না ও! কমলা নিজেকে রানি মনে করে যদি সুখী হয় তা হোক না! সে যে, ভিখারিনি এ-কথা তাকে জানানোর দরকার-ই বা কী?

একটা বাচ্চাছেলে কতকগুলো মোষ নিয়ে পাহাড়ের দিকে চলেছে। মোষগুলোর গলার কাঠের ঘণ্টা থেকে গম্ভীর ডুগডুগানি আওয়াজ উঠছে। এই পরিবেশে শব্দটা বড়ো আশ্চর্যরকম মানিয়ে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে সবুজ ভাবছিল, কলকাতার এতকাছে যে, এত সুন্দর জায়গা আছে ও কখনো ভাবতে পারেনি। কমলার অনাবৃত শরীরের মধ্যে, সবুজের হাতের কাছেই যে, এত সৌন্দর্য ছিল, এত গভীর আনন্দের উৎস ছিল; তাও সবুজ কখনো ভাবতে পারেনি। কাল রাতের পর সবুজ যেন অনেক অন্যরকম হয়ে গেছে। ও অনেক উদার হয়ে গেছে। কাউকে অনেক অনেকদিন ধরে, অন্তরে-শরীরে কামনা করে, তাকে পাওয়ার যে-আনন্দ, সে আনন্দের বুঝি কোনো তুলনা নেই। আজ সবুজ জেনেছে সে আনন্দের মানে কী, তার মানে কতখানি! পানাপড়া পুকুরের মতো তার জীবনে, তার ঘরের বদ্ধতায়, তার গলির ছোটোমাপে, তার অফিসের পদমর্যাদার সামান্যতায়, সে এতদিন বড়োই ছোটোমাপের হয়েছিল। রাতারাতি সে তার, সমস্ত হীনম্মন্যতা কাটিয়ে এমন-ই এক বড়োমাপের মানুষ হয়ে উঠেছে যে, ওর ভয় হচ্ছে কলকাতায় ফিরে গিয়ে ও বুঝি নিজের জীবনের ফ্রেমে আর আঁটবে না। ওই জীবনে তাকে কুলিয়ে উঠতে পারবে না।

হঠাৎ সবুজ বলল আচ্ছা, কুমুদের বন্ধুর এই হাজারিবাগের বাড়িটা আমি যদি, দিন দুইয়ের জন্যে চাই, পাব?

কমলা অবাক হয়ে সবুজের দিকে তাকাল। বলল, কার সঙ্গে এসে থাকবে? আমাকে বুঝি সঙ্গে নেবে না?

সবুজ হাসল। বলল সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি। কমলাও হেসে বলল, কেন পাবে না? এ বাড়িটা কুমুদের বন্ধুর নয়। ও তো কোম্পানির পারচেজ ডিপার্টমেন্টের বড়োবাবুর। সাপ্লায়াররা তাই খাতির-টাতির করে। এ-বাড়িটা একজন সাপ্লায়ারের।

তারপর আবার বলল, কেন চাইছ বলো-না?

সবুজ বলবে কি না ভাবল। তারপর-ই সবুজের মনে হল, কাল রাতের পর থেকেই পৃথিবীর তাবৎ লোকের, তাবৎ অপরাধ ও ক্ষমা করে দিয়েছে। ক্ষমা করে দেবে বলে ও মনস্থ করেছে। এমনকী নিজের বুকের মধ্যেও, যে সমস্ত অপরাধ জমা ছিল, হাসির প্রতি, ফণীর প্রতি, খোকার প্রতি, যে সমস্ত অপরাধ আজ অবধি করেছে ও, তারজন্যে সবুজ নিজেকে ক্ষমা করে দিয়েছে। পুরোনো, হীন ক্ষুদ্রতার খোলস ছেড়ে ও এখন এক নতুন চকচকে সাপের শরীরের মতো নিজের মনকে চেকনাই দিয়েছে।

–বলো গো। কমলা আবার মেয়েলি কৌতূহলে শুধোল।

সবুজ হাসল। বলল, জানো আমার যেমন তুমি আছ, হাসিরও তেমনি একজন বন্ধু আছে। কমলা খুব খুশি হয়ে উঠল। ওর চোখদুটো ভালো-লাগায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, সত্যি? কই? আমাকে কখনো বলোনি তো আগে? কী যে, ভালো লাগছে না শুনে!

সবুজও হাসছিল।

সবুজও হাসতে হাসতে বলল, আছে। ভাবছি, হাসিকে আর তাকে টিকিট কেটে দিয়ে এ বাড়িতে দু-দিনের জন্যে পাঠাব। আমরা যেমন আনন্দে আছি, ওরাও তেমনি আনন্দে থাকবে।

তারপর বলল, দারুণ হবে, না?

–দারুণ হবে। কমলা বলল।

তারপর বলল, আহা! হাসিটা, বড়োভালো মেয়ে। ও আমার সবচেয়ে প্রিয়বন্ধু ছিল। খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। কিন্তু বড়ো চাপা। তবে ও মোটেই যাকে-তাকে ভালোবাসার মতো মেয়ে নয়। ওর মধ্যে চিরদিন-ই এমন একটা কিছু ছিল, যা ওকে সব সময় আমাদের মতো দশটা সাধারণ মেয়েদের থেকে আলাদা করে রাখত। ওকে পুরোপুরি কখনো বুঝে উঠতে পারিনি। আমি। শুধু আমি কেন, ওর কোনো বন্ধুই পারেনি।

তারপর বলল, যাকগে সেসব কথা, কিন্তু ভাবতেই ভালো লাগছে। ভালো লাগছে জেনে যে, হাসির জীবনেও একফালি বারান্দা আছে।

তারপরই হঠাৎ বলল, তুমি বুঝি এ-ব্যাপারটা ভালো চোখে দ্যাখো না? কী সবুজ?

সবুজ বলল, আমি নিজেকে বুঝি না। কোনোদিন-ই বুঝিনি। আমি কী করি, কেন করি; কিছুই বুঝে উঠতে পারি না।

কমলা বলল, ছিঃ। এটাকে তুমি খারাপ ভাবো যদি, তাহলে তো আমার সম্পর্কটাও খারাপ। আসলে, তা নিশ্চয়ই নয়। দ্যাখো সবুজ, আমার মনে এখন দুটো ঘর আছে। একটা তোমার। একটা কুমুদের। কুমুদের চাবিতে তোমার ঘরের তালা কখনো খুলবে না যেমন, তোমার চাবিতে খুলবে না কুমুদের ঘরের। আমি আমাকে দু-টুকরো করে তোমাদের দিয়েছি। না, তাও বলব না। বলব, কুমুদকে সবকিছু দেওয়ার পর অথবা অন্যভাবে বললে, কুমুদের কাছ থেকে সব কিছু পাওয়ার পর, আমার হাতে অনেক ছিল, তাই তোমার মধ্যে উপচে গেছি। কিন্তু এ-কথা আমার মতো করে আর কেউ জানে না, যখন আমি কুমুদের তখন আমার সমস্ত আমিই কুমুদের। আবার যখন তোমার, তখনও তাই-ই। মেয়েরা অনেক কিছু পারে, যা ছেলেরা পারে না। তোমাদের মধ্যে জমিদারি মনোবৃত্তিটা এখনও বড়োপ্রবল। তোমরা যাকে চাও তার সমস্তটুকু, অন্য সবাইকে বঞ্চিত করে চাও; তাকে পাইক-বরকন্দাজ দিয়ে বেঁধে রাখতে চাও মনের থাকে। কিন্তু তা কি হয় নাকি? মন বড়ো তরল জিনিস। তাকে কখনো বেঁধে রাখা যায় না, তাকে যত্ন করে দু-হাতের তেলের মধ্যে ধরে রাখতে হয় সর্বক্ষণ। হাত-একটুখানি কেঁপে গেলেই, এদিক-ওদিক হলেই মন গড়িয়ে যায় অন্যমনে। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, বুঝেছ? বোকা পুরুষ মানুষ?

সবুজ উত্তর দিল না। চুপ করেই থাকল।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা ক্যানারি হিলের বাংলোর কাছ অবধি এল। পথে একটা হরিণ দেখল, ছোটোজাতের পাটকিলে-রঙা হরিণ দৌড়ে ওদের সামনে দিয়ে রাস্তা পেরোল। বনমুরগি আর তিতির ডাকছিল জঙ্গলের ভেতর থেকে।

ফেরার সময় রোদ উঠে গিয়েছিল। কষ্ট হচ্ছিল না। ভোরের রোদে বরং ভালো লাগছিল।

সবুজ একগোছা জংলি ফুল পাড়বার জন্যে দাঁড়িয়েছিল। কমলা সবুজকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। সবুজ বড়ো বড়ো পা ফেলে সামনের দিকে এগোল।

কমলাকে দেখা যাচ্ছে পেছন থেকে। এই কমলার কিছুমাত্র অদেখা নেই আর সবুজের, অজানা নেই। স্বাদু শরীরের সব খাঁজ, সব ভাঁজ দেখেছে সবুজ। জেনেছে তার নিজের শরীরের শিহরনের মধ্যে। আজ সকালের পরিপূর্ণ পোশাকের কমলাকে দূর থেকে দেখে তাই খুব ভালো লাগছিল সবুজের। কাল রাতের পর ওদের সম্পর্কটা অনেক গাঢ় হয়ে গেছে। কমলার যে, কিছুই অদেয় নেই সবুজকে, তার ভালোবাসার স্বীকৃতি দিতে যে, তার কোনো কুণ্ঠা নেই,একথা জেনে বরাবর কমলার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠছে ওর।

বাড়ির কাছাকাছি এসে গেল ওরা।

কমলা বলল, এখন কী খাবে? লুচি করব? না পরোটা? সবুজ বলল, যা খুশি। তুমি যা খাওয়াবে তাই-ই খাব।

–বাঃ বাঃ। মুখ ফিরিয়ে কমলা বলল।

কুমুদ বাড়ির কম্পাউণ্ডের ভেতরে রাতে-পরা পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরে পায়চারি করছিল।

ওদের আসতে দেখে বলল, গুড মর্নিং। কতদূর বেড়িয়ে এলে?

কমলা বলল, অনেক দূর।

তারপর কুমুদকে শুধোল, চা খেয়েছ?

–এককাপ খেয়েছি। তবে এখন বারান্দায় সকলে মিলে রোদে বসে আর এক কাপ করে খেলে মন্দ হয় না।

কমলা বলল, এক্ষুনি আনতে বলছি।

তারপর বলল, পরোটা খাবে তো তুমি?

কুমুদ বলল, অন্নপূর্ণা যা দেবে তাই খাব।

কমলা হাসল। তারপর ভেতরে চলে গেল।

কুমুদকে দেখামাত্র, ওর প্রতি একটা তীব্র ঘৃণা বোধ করল সবুজ। কুমুদের ঘাড়ে চড়েই ও এসেছে। কুমুদও নিশ্চয়ই ওকে সিন্দবাদ নাবিক ছাড়া আর কিছুই ভাবে না।

সবুজ এসে বারান্দার চেয়ারে বসল। কুমুদও পিছু পিছু এল।

সবুজ বলল, কাল অতরাত করে ফিরলেন কেন? মধুপবাবু না এখানে লেখার জন্যে এসেছেন? সারারাত ধরে এইসব করলে লেখেন কখন উনি?

–তিনিই জানেন।

উদাসীন গলায় কুমুদ বলল।

তারপর এদিক-ওদিক দেখে গলা নামিয়ে বলল, রাত করে কেন ফিরলাম, তা আপনি জানেন না? আপনাকে সুযোগ দিলাম। আপনার নিজের দ্বারা কিছু হত না যে, তা আমি জানতাম। তবে কমলা নিশ্চয়ই সুযোগের সদব্যবহার করেছে। কী বলেন? সন্ধেটা ভালোই কেটেছিল আপনার। কী মশাই কাটেনি?

লোকটাকে যতই দেখেছে, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে সবুজ।

সবুজ চুপ করে রইল।

কুমুদ বলল, শি ইজ ভেরি গুড ইন বেড। আপনার ভালো লেগেছে নিশ্চয়ই।

সবুজ মুখ ঘুরিয়ে রইল। একজন স্বামী তার স্ত্রী সম্বন্ধে, অন্য একজনের কাছে কী করে এমন কথা বলে তাই ভাবছিল। ভাবছিল, লোকটা অদ্ভুত। এমন কোনো লোকের কথা ও শোনেওনি আগে কখনো।

আর এক কাপ করে চা, তারপর আবার পরোটা, ওমলেট ও আলুর তরকারি খাওয়ার পর কমলা বলল, আমি স্নানটা করে নিই।

কুমুদ বলল, চলুন সবুজবাবু, সাহিত্যিকের বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি। গাড়িটা পাওয়া গেলে বাজারে যাওয়া যাবে।

সবুজ বলল, আজকে কিন্তু আমি বাজার করব।

কুমুদ বলল, বেশ তো। অত উত্তেজনার কী আছে? করবেন।

কিছুক্ষণ পর মালির কাছ থেকে থলি চেয়ে নিয়ে, ওরা দু-জনে বেরিয়ে পড়ল। বেরোবার আগে কুমুদ গোটা চারেক পান আর জর্দা মুখে পুরে নিল।

ওদের বাড়ি ছেড়ে পর পর, পথের দু-পাশে অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বাড়ি! সবুজ প্রতি বাড়ির সামনে এসেই ওর চলার গতি কমাতে লাগল, ভাবল এইটেই বুঝি মধুপবাবুর বাড়ি হবে, মানে যেখানে উনি উঠেছেন।

কিন্তু একে একে ওরা ক্যানারি হিল রোডের প্রায় শেষপ্রান্তে চলে এল, পুলিশ-সুপারের বাড়িটাও ছাড়িয়ে এল, কিন্তু মধুপবাবুর বাড়ি তখনও এল না।

এমন সময় একটা রিকশা এল ওপাশ থেকে–খালি রিকশা।

কুমুদ রিকশা দাঁড় করিয়ে তাতে উঠে বসল। বলল, উঠে আসুন মশায়।

তারপর-ই বলল, আচ্ছা সতীনের অপোজিট জেণ্ডার কী? জানেন?

সবুজের কান গরম হয়ে উঠল।

বলল, জানি না।

কুমুদ পানের পিক গিলে বলল, সতীনের সঙ্গে সতীনের যা-সম্পর্ক শুনেছি, আমার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কিন্তু সেরকম নয়। বেশ কার্ডিয়াল। কী বলুন?

সবুজ সে-কথা এড়িয়ে গিয়ে কুমুদকে শুধোল, মধুপবাবুর বাড়ি গেলেন না?

কুমুদ অবাক হওয়ার চোখে তাকাল সবুজের দিকে।

বলল, কে মধুপবাবু?

সবুজ আশ্চর্য হয়ে বলল, তার মানে? সাহিত্যিক মধুপবাবু, যাঁর বাড়ি কাল রাত এগারোটা অবধি থেকে এলেন। এখনও কি নেশা কাটেনি আপনার?

–ও! কুমুদ বলল।

তারপরেই হেসে উঠল। বলল, ও হোঃ! তারপর হোঃ হোঃ করে হাসতে লাগল।

সবুজ বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাপারটা কী?

–ব্যাপারটা! বলে, আবার ঢোক গিলে কুমুদ বলল, মধুপবাবু নেই। মানে আছেন হয়তো, তবে এখানে নেই। তাঁকে আমি চিনি না।

সবুজ আকাশ থেকে পড়ল। বলল, সে কী? তাঁর সঙ্গে আপনি কথা বললেন যে, কোরবার মোড় থেকে আসবার সময়! বললেন-না? প্রথম দিন।

কুমুদ বলল, তা বললাম।

–তবে বলছেন যে, আপনি চেনেন-ই না?

–সত্যিই চিনি না। উনি মধুপবাবু নন।

সবুজ চোখ বড়ো বড়ো করে শুধোল, তবে উনি কে?

–কে জানে? ঠোঁট উলটে কুমুদ বলল।

তারপর বলল, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, আমি বললাম, ভালো তো?

ভদ্রলোক ভাবলেন নিশ্চয়ই চেনা লোক, তাই গাড়ি থামালেন। আমি অমনি এগিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, আরে, একদম ভুল হয়ে গেছে। আমার এক চেনা-ভদ্রলোক অবিকল আপনার মতো…।

ভদ্রলোক স্মার্টলি বললেন, তা হবে। ভদ্রলোক তো ভদ্রলোকের মতোই দেখতে হবে। ভুল হতেই পারে।

তারপর আবার শুধোলাম, ক্যানারি হিল বাড়িগুলো কতদূর?

উনি বললেন, বেশিদূর নয়। এগিয়ে যান। দেখবেন নাম লেখা আছে।

তারপর আমি হ্যাণ্ডশেক করার মতো হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। আর হাত বাড়ালে কোন-না ভদ্রলোক উত্তরে হাত বাড়ান? তিনিও হাত বাড়ালেন। হ্যাঁণ্ডশেক হয়ে গেল।

উনি চলে গেলেন, আমি ফিরে এলাম। কমলা কিছু বুঝতে পারেনি। আপনার রিকশার চেন টাইমলি ছিঁড়ে গেল। তারপর-ই মধুপবাবু।

সবুজের মনে হল, সে কোনো গোয়েন্দা কাহিনি শুনছে।

পরক্ষণেই বলল, কিন্তু কেন? এই মিথ্যা কথা কেন? কীসের জন্যে?

কুমুদ তার বাঁ-হাতের পাঁচখানা আঙুল সবুজের চোখের সামনে নেড়ে বলল, থামুন মশায়। সব জিনিসের-ই কারণ থাকে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে কুমুদ বলল, আপনি জার্মান রোমেলের নাম শুনেছেন?

–‘হ্যাঁ’ বোকার মতো সবুজ বলল।

–জানেন, রোমেল শত্রুপক্ষকে বোকা বানাবার জন্যে কত কিছু করতেন? ট্রাকগুলোকে মরুভূমির মধ্যে চক্কর খাইয়ে বাড়ি ওড়াতেন–যাতে শত্রুপক্ষ তার আসল মতলব বুঝতে না পারে। এও সেইরকম কিছু একটা। ধোঁকা দেওয়া, বোকা বানানো। আপনি তো এমনিতেই বোকা, কমলাকে বোকা বানাবার জন্যেই এটা করতে হল।

তারপর একটু চুপ করে থেকে কুমুদ বলল, ব্যাপারটা কী জানেন?

আমি এদিক-ওদিক যাই আর যাই-ই করি, কমলা আমার বউ। আমি কমলাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। আপনার মতো রোমান্টিক ভালোবাসা নয়। আমি ওর শরীরকে ভালোবাসি। ভালোবাসি কমলার শরীরের তুলনা নেই বলেই। আমি সবসময় তাকে পেতে চাই না। আমি ওকে নতুন করে রাখতে চাই। এদিক-ওদিক যাওয়াটা কমলাকে ভালোবাসার-ই একটা পেকাশ-বলেই বলল, সরি; প্রকাশ।

সবুজ চুপ করে রিকশায় বসেছিল।

রিকশাটা ততক্ষণে একটা বড়ো চৌমাথা পেরিয়ে কাছারির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।

কুমুদ যেন নিজের মনেই বলে উঠল, কমলা আপনাকে ভালোবাসে। আমি জানি যে, ভালোবাসে। আপনার সঙ্গে থেকে, বসে, শুয়ে ও যদি আনন্দিত হয়, তাহলে আমার কী? ও খুশি হলেই আমি খুশি। আপনিই বলুন? আমি যদি জলজ্যান্ত এই লাশ নিয়ে, কাল সন্ধ্যায় বসে থাকতাম বাইরের বারান্দায়, তাহলে কি আপনারা দুজনেই কাঁটা মনে করতেন না? আমার আয়ুক্ষয় হয়ে যেত। অনেক কষ্টে, অনেক ভালো-মন্দ খেয়ে এই লাশ বানিয়েছি মশায়, অত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। তার চেয়ে এই-ই ভালো নাকি? আমি কেয়ার-অফ মধুপবাবু হয়ে গেলাম। আমারও সম্মান বাঁচল, আপনারাও আমাকে আশীর্বাদ করলেন। এই দু-দিন দুনিয়ায় মশাই, কী লাভ এর-তার পেছনে লেগে? নিজে আনন্দে থাকো, অন্যকে আনন্দে রাখো, এমনি আনন্দ চালাচালি করতে করতে, একদিন হঠাৎ করে ফুটে যাও। এই-ই ভালো। আমি অন্তত এই-বুঝি।

তারপর বলল, আপনার কী মত?

সবুজের বাকরোধ হয়ে গিয়েছিল। সবুজ কোনো কথা বলল না। কুমুদ ওর কাঁধে থাপ্পড় দিয়ে বলল, এ কী মশাই, রাগ করার কথা তো আমার-ই। কিন্তু দেখছি আপনিই রাগ করে বসে আছেন আমার ওপর। বেড়ে লোক তো?

সবুজ বলল, না, রাগ করিনি। ভাবছি।

কুমুদ বলল, এই বেশি ভেবে-ভেবেই তো বাঙালিদের কিছু হল না। ভেবেই সারাদিন কাটাবে তো কাজ করবে কখন? আমি তো আগে যা করার, যাই-ই করার করে ফেলি, তারপর ভাবি। কবিদের মতো অত গালে হাত দিয়ে ভাবাটাবা আমার আসে না।

রিকশাটা বাজারের কাছে পৌঁছে গেল।

কুমুদ নেমে, রিকশা ভাড়া দিয়ে, থলে হাতে আবার পানের দোকানে দাঁড়াল, আবার চারটে পান খেল জর্দা দিয়ে, তারপর পান মুখে বলল, বাজার তো আপনি করবেন আজ, কী খাওয়াবেন বলুন তো মিস্টার গ্রিন? আজ তো আপনার শয্যা-তুলুনির খাওয়া। বলেই, হ্যাঁঃ হ্যাঁঃ করে হাসতে লাগল কুমুদ।

কয়েক ফোঁটা পানের পিক জর্দার পাতিসমেত সবুজের মুখে ছিটকে এসে লাগল।

সবুজের মুখ লজ্জায়, বিরক্তিতে লাল হয়ে উঠল।

কুমুদ বলল, ওই দ্যাখো, আপনি আবার লজ্জা পাচ্ছেন দেখছি।

তারপর বাজারের ভেতরের দিকে যেতে যেতে বলল, তাহলে আপনারও লজ্জা বলে কিছু আছে। অবাক করলেন আপনি।

সামনে সামনে হেঁটে যাওয়া কুমুদকে ওয়াড়-পরানো তাকিয়ার মতো দেখাচ্ছিল। তার পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে প্রচন্ড ধিক্কারে, নিজের ওপর এক প্রচন্ড বিদ্বেষে ওর মন ভরে উঠল। কেন যে ও কমলাকে ভালোবেসেছিল, কেন যে কাল কমলাকে পেয়েছিল, ও সেইসব ‘কেন’-র উত্তর হিসেবে নিজেকে মনে মনে লাথি মারছিল।

সবুজের চোখের সামনে হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ-ই বহু বহু বছর পরে হাসির মুখটা ভেসে উঠল। দৈনন্দিনতার গ্লানিমাখা, একটা ময়লা, সস্তা, খয়েরি-রঙা মিলের শাড়ি পরে হাসি জানলার গরাদ ধরে পথের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবুজের প্রতীক্ষায়। তার চোখে আর কোনো চাওয়া ছিল না, ও শুধু চেয়েছিল যে, সবুজের ভালো হোক, সবুজের ডি-এ বাড়ক, সবুজ সৎ থাকুক, তার নাম হোক কাজকর্মে। আজ এতবছর পরে, হঠাৎ-ই সবুজের মনে পড়ল, হাসি তার নিজের জন্যে কোনো কিছুই চায়নি সবুজের কাছ থেকে। এক কৌটো পাউডার নয়, একটা শাড়ি নয়, কোনো কিছুই চায়নি সবুজের কাছ থেকে। যা চেয়েছিল হাসি, তা সবুজের ভালোবাসা। সবুজের প্রতীক্ষায় চিরদিন দাঁড়িয়েছিল, অন্ধকার গলির অন্ধকারতর ঘরের জানলার গরাদে। সবুজ কখন ফিরবে, সেই অপেক্ষায়।

সবুজের মনে হল, বিদ্যুৎ-চমকের মতো হঠাৎ-ই মনে হল যে, একদিন সেই ঘরে, সেই কলকাতায় জল পড়ার শব্দ, সেই পাঁচিলের ওপরে বসা পাতিকাকের গলার পরিচিত স্বর, সেই গলির মধ্যের বেলের খোসা, ভাঙা-চুড়ি, ছেঁড়া-চিঠি, গলির সেই ফেরিওয়ালার হাঁক, সেইসমস্ত পরিবেশকে, চেনা লোককে হাসির বুকের গন্ধকে একদিন সবুজ ভালোবেসেছিল।

সবুজের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, আমি কেন এলাম এই হাজারিবাগে? আমি কেন এলাম–এত আলো, এত প্রাণ, এত খুশি, এত কদর্যতার মধ্যে আমি কেন এলাম?

হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল সবুজ।

সবুজ ভাবত, সে তার জীবনে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেছে ফণীকে। আজকে ওর মনে হল, ফণীর জায়গায় ও কুমুদকে বসাবে। আর ফণীকে বসাবে ফণীর নিজস্ব মর্যাদার আসনে! কুমুদের পটভূমিতে ফণীকে ওর দেবতা বলে মনে হল।

সবুজ ভাবল, কলকাতা ফিরেই ফণীর কাছে ক্ষমা চাইবে ও। ফণীকে এনে তার পাশাপাশি জায়গা করে দেবে–তাদের ঘরে তাদের মনে। ফণীকে দেখাবে, বোঝাবে যে, সবুজও ভালোবাসার মানে বোঝে। হাসির কাছে প্রমাণ করবে যে, হাসি ওকে যা ভাবে, ও তা নয়।

ফণীর কাছে অনেক অন্যায় জমে গেছে, কলকাতা ফিরেই ফণীর কাছে মাপ চাইবে সবুজ।

.

০৯.

হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্যাক্সিটা ছুটে যাচ্ছিল।

মাত্র তিনদিন কলকাতায় ছিল না, কিন্তু সবুজের মনে হচ্ছিল যে, কতদিন পর ও কলকাতায় এল। ব্রিজের ওপর বাস, ট্রাম,ট্যাক্সি, রিকশার ভিড়। যানবাহনের চলাচলে ব্রিজ থেকে ওঠা একটা চাপা গুমগুম প্রতিধ্বনি।

খুব ভালো লাগছিল সবুজের কলকাতায় ফিরে। আসলে কলকাতার এই আওয়াজ, চিৎকার, আবর্জনা, দুর্গন্ধ এরইমধ্যে কোথাও কিছুর সঙ্গে ওর নাড়ি বাঁধা আছে। ওর নাড়ি কাটা হয়েছিল একদিন চল্লিশ বছর আগে এই শহরের-ই এক ঘরে। আবার একদিন, এই শহরের বুকেই নরম পেলব পলিমাটি বয়ে আনা ঘোলারঙা ঘরোয়া নদীটির পারেই ও ছাই হয়ে যাবে। কলকাতাকে ভালোবাসতে হলে বুঝি, কলকাতা ছেড়ে দূরে যেতে হয় কোথাও, যে জায়গা কলকাতার চেয়ে অনেক সুন্দর। তারপর আবার পৃথিবীর এই বৃহত্তম বস্তিতে ফিরে আসতে হয়।

সবুজ ভাবল, কলকাতা–কলকাতা। কলকাতার কোনো বিকল্প নেই।

কুমুদরা এলগিন রোডের মোড়ে ওকে নামিয়ে দিল ট্যাক্সি থেকে।

কুমুদ সবুজের বাড়িতেই নামতে চেয়েছিল, কমলাই আপত্তি করেছিল। বলেছিল, কী দরকার! তোমার অফিস আছে তৈরি হয়ে বেরোতে বেরোতে দেরি হয়ে যাবে।

সবুজ বুঝল আসল কারণটা কী। হাসিকে মিথ্যে কথা বলে এসেছিল সবুজ। বলেছিল,অফিসের বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছে দেওঘর। কমলা তা জানত।

মালপত্র বলতে কিছুই ছিল না–একটা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ছাড়া।

ব্যাগটা কাঁধে ফেলে, একটা সিগারেট ধরিয়ে সবুজ নন্দন রোডে ঢুকে পড়ে, হরিশ মুখার্জি রোডে এসে পড়ল। তারপর হাঁটতে লাগল।

যে-গলিতে সবুজ ঢুকল, সে গলিটাতেই ফণীর দোকান। ফণীর দোকানের সামনে দিয়েই ওকে যেতে হবে।

হাজারিবাগে ফণী সম্বন্ধে হঠাৎ বড়ো উদার হয়ে উঠেছিল সবুজ। এখন কলকাতায় ফিরে মাথার মধ্যে, সেই হাজারিবাগি মহত্ত্বটা আর নেই। নেই যে, এ কথা ভেবে আশ্বস্ত হল ও, ফণীটা যে, একটা হারামজাদা এ বিষয়ে সবুজের নিঃসংশয়তাটা আবার ফিরে এসেছে। খামোখা ও কেন ফণীকে মাথায় তুলে নাচবে? যে যেমন ব্যবহারের যোগ্য, তার সঙ্গে তেমন ব্যবহার-ই করা উচিত। হাজারিবাগে কমলার কাছে অনেক কিছু পেয়ে, ওই চমৎকার ফাঁকা সুগন্ধি পরিবেশে তার মতিভ্রম হয়েছিল। এখন ও ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ও আবার ওর অভাব, ওর অভিমান, ওর অপ্রাপ্তি সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে। মেরেছ কলসীর কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না’-তে বিশ্বাস করে না ও। ফণীকে ও যে-চোখে দেখে, সেই চোখেই দেখবে। হাসিকেও। হাসির ঘোমটার তলায় খেমটা নাচনকে ও কোনোদিনও ভালো চোখে দেখতে পারবে না।

সবুজের আবারও মনে হল, তাহলে কমলা? কমলার সঙ্গে তার সম্পর্কটা?

ও নিজেকে বোঝাল, কমলা; কমলা। হাসি; হাসি! কার সঙ্গে কার তুলনা। কমলার সঙ্গে ওর ব্যাপারটা একটা আলাদা প্রেনের ব্যাপার, একটা পবিত্র ব্যাপার। এরমধ্যে দোষের কিছু দেখে না সবুজ। দোষ আবার কীসের। দোষ মনে করলেই দোষ। এতে দোষের কী আছে?

তারপর সবুজ ভাবল, কমলা কত কী জানে, কী সুন্দর কথা বলে কমলা। কমলার কাছে গেলেই ও পুনরুজ্জীবিত হয়। ওর বেঁচে থাকার জন্যে কমলাকে ওর চাই। কমলা না থাকলে ওর জীবনের কোনো মানেই নেই।

সাহেবকে ও বলেই এসেছিল যে, সোমবার আসতে দেরি হবে।

সাহেব বলেছিলেন, ঠিক আছে। এলেই হল।

সবুজ মনে মনে বলল, আজকালকার সাহেবদের এরকম হওয়াই ভালো। সেরকম কাজ, আজকাল সরকারি অফিসে কেই বা করে?–আর যারা করে, তারাও কাজের জন্যে কাজ করে না–চাকরিটাকে টায়-টায় বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে করে–নিজের নিজের ফায়দার জন্যে করে। শুধুই কাজ করার জন্যে, দায়িত্ববোধের জন্যে, আজকাল কিছু বোকারা ছাড়া আর কেউই কাজ করে না।

হাঁটতে হাঁটতে হারাধনের কথা মনে হল সবুজের। ভারি মজার মজার কথা বলে ছেলেটা–যতক্ষণ অফিসে থাকে, সবাইকে আমোদে রাখে–অফিসটাকে একটা জমজমাটআড্ডাখানা বানিয়ে রাখে। দেশে এখন হারাধনের মতো ছেলেদের-ই দরকার। প্র্যাকটিকাল, মূল্যবোধ টুল্যবোধ এসব বাজে বুকনি-ফুকনি নেই। ও ঠিক-ই বলে, টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে, শুধু ধরে নাও দাদা-খপাখপ ধরে নাও। এই কলকাতার বুকে বসে তামাম ভারতবর্ষের লোক লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছে, লাইফ এনজয় করছে, আর বাঙালিরা সেই মান্ধাতার আমলের সব আইডিয়া আঁকড়ে ধরে মার খাচ্ছে সকলের কাছে। হারাধন বলে, আপনার প্রতিযোগীরা যেরকম হবে, আপনাকেও তো সেরকম-ই হতে হবে। নইলে তো হেরে যাবেন-ই আপনি। প্রতিযোগীরা খারাপ বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকে কিংবা না খেয়ে শুকনো টিকটিকির মতো একদিন ঝুপ করে লাইফ থেকে খসে যাবেন? সেটা তো হেরে যাওয়া।

না, না। সবুজ আর হারবে না। অনেকদিন বোকা থেকেছে, মার খেয়েছে, হার স্বীকার করেছে। আর নয়। এবার থেকে সবুজ শুধুই জিতবে, চালাক হবে, চতুর হবে; হারাধনের কাছা ধরে বৈতরণী পার হবে সবুজ।

ফণীর দোকানটার যত কাছাকাছি আসতে লাগল সবুজ, ততই ওর চোয়ালটা শক্ত হয়ে আসতে লাগল। ঈর্ষা, ঘৃণা সবকিছু মিলিয়ে তার বুকের মধ্যে একটা জ্বালা অনুভব করতে লাগল ও। ও ঠিক করল, ফণীর দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে, কিন্তু ফণীকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনবে না। ফণী যে আছে, ফণী যে, তার জীবনে এমন জাজ্বল্যমান শত্রুতার প্রতীক হয়ে আছে, সেই জানাটাকে ও অগ্রাহ্য করবে।

সবুজ ফণীর দোকানের সামনে এসে দেখল দোকান বন্ধ; দোকানে তালা ঝুলছে।

আজ তো সোমবার। সোমবার তো দোকান বন্ধই থাকে। ভুলেই গিয়েছিল সবুজ। দোকানটা বন্ধ আছে বলেই, দোকানের সামনে দিয়ে মাথা উঁচু করে একটা সিগারেট ধরিয়ে সবুজ ধীরেসুস্থে হেঁটে গেল। ওর তাড়া ছিল না। ফণীকে ও হঠাৎ হারাবে না। তিলে তিলে হারাবে ওকে। সবুজ যেমন করে, ওর নিজের অসহায়তাকে, হীনম্মন্যতাকে, অপারগতাকে ওর বুকের অন্ধকার সোঁদা ঠাণ্ডাঘরে অনুভব করেছিল বহুবছর, তেমন করে অনুভব করাবে ফণীকে। ফণীকে সবুজ হ্যাঁণ্ডস-ডাউন হারিয়ে দেবে। হাসির কাছ থেকে, খোকার কাছ থেকে, তার সংসারের কাছ থেকে আর কিছু চাওয়ার নেই সবুজের। ওর যা পাওয়ার, তা ও কমলার কাছ থেকে, বাইরের জগতের আনন্দের মধ্যে নীলরঙা এক-শো টাকার বিনিময়ে রোজ রোজ পাবে। চাইনিজ খাবার, বেড়ানো-টেড়ানো, ট্যাক্সি-চড়া, দামি সিগারেট খাওয়া, সিনেমা থিয়েটার দেখা–এসবের মধ্যেই, এসব নিয়েই সুখী থাকবে। তা ছাড়া কমলা যা দিতে পারে, দিয়েছে সবুজকে, তেমন কিছু দেওয়ার কোনো ক্ষমতাই নেই হাসির। কমলা একাই এক-শো। কমলা তার জীবনে থাকলে হাসিকে আর ফণীকে সে তিল তিল করে টিপে টিপে মারবে।

সোমবার দোকান বন্ধ। তাহলে কি ফণী ওদের বাড়িতেই গেছে? এতক্ষণে কি ফণী তার-ই বিছানায়, তার-ই স্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি বসে গল্প করছে ঘন হয়ে? আরও কিছু কি করছে? এই দিনদুপুরে?

হতেও পারে।

এবার তাড়াতাড়ি পা চালাল সবুজ। বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগল।

বাইরের দরজাটা ভেজানো ছিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।

বাড়িতে ঢুকেই অবাক হল সবুজ। বাড়িতে কি কেউ নেই? কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই, রান্নাঘর থেকে কোনোই আওয়াজ আসছে না–মনে হচ্ছে ভূতের বাড়ি।

বসবার ঘর পেরিয়ে বারান্দায় ঢুকতেই সবুজের রক্ত মাথায় চড়ে গেল।

বারান্দায় এককোনায় ফণীর টায়ার সোলের মলিন ধুলোমাখা চটিজোড়া উলটে রয়েছে।

এই ফণীটা এইমুহূর্তে সবুজের তিনদিনের সযত্নে জমা-করা সব আনন্দ মাটি করে দিল। ওর সমস্ত জীবনটাই মাটি হয়ে গেল।

সবুজ ডাকল, যদু!

কেউ উত্তর দিল না।

সবুজ ডাকল, খোকা!

ডাকতেই, দুরন্ত ভেজা-হাওয়ার মতো খোকা ওর ঘর থেকে দৌড়ে এল–’বাবা, বাবা’–বলতে বলতে।

অনেক–অনেকদিন খোকার মুখে ও ‘বাবা’ ডাক শোনেনি। খোকার ডাকের মধ্যেকী-যেন ছিল, মেঘলা দুপুরে ছাদের ওপর একলা চড়ই-এর ডাকের মতো, সে ডাক বড়ো ভয় পাওয়ার ডাক, বড়ো পরের ওপর নির্ভর করার আকাঙ্ক্ষার ডাক।

খোকাকে যেন সবুজ চিনতে পারল না। খোকা যেন কীরকম হয়ে গেছে–ফ্যাকাশে, বিবর্ণ, উশকোখুশকো চুল।

খোকা দৌড়ে এসে সবুজের দুই ঊরু দু-হাতে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে উঠল। চিৎকার করে বলল, বাবা! ফণী মামা–।

খোকা আর কিছুই বলতে পারল না। ডুকরে কাঁদতে লাগল। ওর চোখের জলে সবুজের ধুতি ভিজে গেল ঊরুর কাছটায়।

এমন সময় খোকার ঘর থেকে যদু বেরিয়ে এল।

যদু কাঁদছিল। অনেকক্ষণ থেকেই সে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।

সবুজ ভাবল, ফণীটার মধ্যে কী এমন ছিল যে, বাড়ির কাজ করার লোকও এমনভাবে কাঁদে ওর জন্যে?

যদু ধরাগলায় বলল, ফণীবাবুকে খুন করেছে। ইস কী রক্ত বাবু, কী রক্ত! খুন করেছে।

খোকার হাত দুটো সবুজের ঊরু থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছিল। সবুজের মনে হল, খোকা বোধ হয় পড়ে যাবে মাটিতে, ও বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে যাবে।

সবুজ খোকাকে দু-হাতে জড়িয়ে বুকে তুলে নিল। তার আট বছরের রোগা জীর্ণ হাড় বের-করা ছেলেকে।

খোকা সবুজের কাঁধে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। অস্ফুটে বলল, বাবা বাবা, বাবা!

সবুজ দীর্ঘ ছ-সাত বছর পরে তার খোকাকে, তার শরীরের শরিক, তার রক্তজাত সন্তানকে কোলে তুলে নিল।

সবুজের জং-ধরা বুকের মধ্যে এমন এক বোধ বেজে উঠল, যা ওর বুকে ছিল বলে ও কখনো জানেনি। এই প্রথম সবুজের মনে হল, খোকার দিকে ও কোনোদিনও ভালো করে চেয়ে দেখার সময় পায়নি। নিজেকে নিয়েই বড়োব্যস্ত ছিল সবুজ। ওর মনে হল খোকা ওকে ভয় পায় না, ওকে ঘৃণা করে না, ভালোবাসে। আজ তার দুঃখের দিনে ওর গলা জড়িয়ে তার ছোট্ট উপেক্ষিত বাবার কাছ থেকে সান্ত্বনা চায়।

কী হয়ে গেল, সবুজ জানে না, সবুজের চোখ দুটো জলে ভরে গেল। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সবুজ আজ বহুবছর পরে কেঁদে ফেলল, একটুও সংকোচ না করে, লজ্জা না করে। নিজেকে, ওর অত্যন্ত পরিচিত নিজেকে ওর নিজের কাছেই, হঠাৎ সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে হল। এমন একজনের জন্যে ও হঠাৎ আজ কেঁদে ফেলল, যাকে সে চিরদিন কাঁদাতেই চেয়েছিল।

যদু বিড়বিড় করে কীসব বলছিল।

কিছু কথা কানে এল, কিছু এল না।

যদু বলছিল; ওরা সবাই একটু আগে শ্মশান থেকে ফিরেছে। ফণীকে পোড়াবার সময় ফণীর সেই বন্ধু, হাসি, যদু ও খোকা ছাড়া আর কেউই নাকি ছিল না। ফণীর আর কেউ ছিল না। খোকাই মুখে আগুন দিয়েছিল ফণীর।

সবুজ আত্মীয় ছিল না ফণীর। ফণীকে কখনো ওর আত্মার কাছে অনুভব করতে পারেনি ও। সবুজ কেউই হত না ফণীর। সবুজের থাকার কথা ছিল না শ্মশানে। থাকেনি।

ফণীটা তাকে বড়ো ঋণী রেখে, হঠাৎ না বলে-কয়ে চলে গেল। বাকিজীবনের জন্যেও হারিয়ে দিয়ে গেল সবুজকে হারামজাদা।

সবুজ খোকাকে কোলে নিয়ে শোয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

খোকা সবুজকে এমনভাবে জড়িয়েছিল যে, সবুজের মনে হল, ও কোনোদিনও ছাড়বে না। ওর বাবাকে।

.

সবুজ মনে মনে বলল, আমাকে ছাড়িস না রে খোকা, চিরদিন আমাকে এমনি করেই জড়িয়ে থাকিস। আমার বুকেও তোর ফণীমামার মতো অনেক ভালোবাসা ছিল রে, আছেও; অনেক দরদ আছে। আমি কখনো দেখাতে পারিনি। আমার বাইরের শক্ত উদাসীন খোলের মধ্যের নরম, ভীষণ নরম মানুষটা কখনো বাইরে আসতে পায়নি। তোরা কেউ কখনো তা দেখাবার সুযোগও হয়তো দিসনি। তুই দেখিস, আজ থেকে তোর জন্যে, তোর মায়ের জন্যে ওই ফণীদার, ফণীমামার বুকে যত ভালোবাসা ছিল, তার সঙ্গে আমার সব ভালোবাসা যোগ করে তোকে ভালোবাসব, তোদের ভালোবাসব। তুই দেখিস। আমাকে তোরা একটু সুযোগ দিস শুধু। তুই, তোর মা; তোরা আমাকে একটু ভালোবাসতে দিস। আমি অন্য আরও দশজন ভালো বাবার মতো, স্বামীর মতোই কত ভালো হয়ে যাব। সত্যিই রে। তোরা দেখিস।

সবুজ শোয়ার ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল।

হাসি চান করেছিল, কপালে বড়ো করে সিঁদুরের টিপ পরেছিল। ফণীর দেওয়া সেই শাড়িটা যত্ন করে পরে হাসি জানলার গরাদের সামনে দাঁড়িয়েছিল। পথের দিকে চেয়ে।

হাসির চোখে একটুও জল ছিল না, কিন্তু এক দারুণ জ্বালা ছিল। সবুজের চোখেমুখে যেন সেই আগুনের হলকা লাগছিল।

হাসি গরাদ ছেড়ে, ওর দিকে মুখ করে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ পূর্ণদৃষ্টিতে সবুজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অ–নেকক্ষণ।

তারপর হঠাৎ মুখ নামিয়ে নিষ্কম্প নীচু গলায় বলল;

‘তুমি বড়ো দেরি করে এলে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *