০৭.
এই খুকি, এটা ধর।
সন্তোষ রসগোল্লার হাঁড়িটা ওর হাতে দিতেই খুকি জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার সন্তোষদা?
সন্তোষ ওর কথার জবাব না দিয়েই জিজ্ঞেস করে, কাকিমা কোথায়?
খুকি জবাব দেবার আগেই মালতী দেবী রান্নাঘরের ভিতর থেকে দরজার সামনে এসে বলেন, এই তো আমি। কিছু বলবে?
সন্তোষ ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেই একটু হেসে বলে, কাকিমা, আমি পাশ করেছি।
মালতী দেবী ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, খুব ভাল খবর বাবা। আমি জানতাম, তুমি ঠিকই পাশ করবে।
জানেন কাকিমা, আমাদের ফ্যামিলিতে আমিই প্রথম গ্র্যাজুয়েট হলাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, কাকিমা।
সন্তোষ মুহূর্তের জন্য থেমে একটু হেসে বলে, আমার বড় চাচার ছেলে ক্লাশ নাইনে এ ওঠার পর স্কুল ছাড়তে চায়নি বলে তো তাকে মারতে মারতে বাড়ি থেকেই বের করে দেওয়া হয়।
খুকি অবাক হয়ে বলে, সত্যি বলছ সন্তোষদা?
মালতী দেবী ওকে একটু বকুনি দিয়ে বলেন, ও কি মিথ্যে বলছে?
সন্তোষ বলে, আমার বাবার একদম মত ছিল না আমি কলেজে ভর্তি হই।
আমি জানি।
মালতী দেবী একটু থেমে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ সোল আনা সামলেই যে তোমাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে, তা আমি খুব ভালভাবেই জানি।
সন্তোষ একটু হেসে বলে, সত্যি কথা বলতে কি, আপনি ছাড়া কেউই আমাকে পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়নি।
আমি তোমাকে কি আর উৎসাহ দিয়েছি।
উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমি যদি সত্যি উৎসাহ দিতে পারতাম, তাহলে আমার ছেলেমেয়েরা কি এমন অপদার্থ হতো?
পরিস্থিতিটা একটু সামাল দেবার জন্যই সন্তোষ সঙ্গে সঙ্গে বলে, দুঃখ করছেন কেন কাকিমা? আমি কি আপনার ছেলে না?
মালতী দেবী ওর মাথায় হাত দিয়ে বলেন, হ্যাঁ, বাবা, তুমি নিশ্চয়ই আমার ছেলে।
সত্যি বলছি কাকিমা, আপনি ছাড়া কেউ আমাকে পড়াশোনা করতে বলেনি।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর খুকি এক গাল হেসে বলে, জানো সন্তোষদা, মার ধারণা তোমার মতো ছেলে নাকি লাখে একটা হয় না।
মালতী দেবী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ঠিকই তো বলি।
সন্তোষ হাসতে হাসতে উপরে চলে যায়।
.
বছর পাঁচেক আগেকার কথা।
রাম মিত্তির সেদিন রাত্তিরে বাড়িতে পা দিতে না দিতেই বেশ উল্লসিত হয়ে স্ত্রীকে বললেন, বুঝলে মালতী, তোমার মেয়ের বিয়ের টাকার ব্যবস্থা করে এলাম।
ব্যবস্থা করে এলাম মানে?
মালতী দেবী অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন।
রাম মিত্তির তির্যক দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, শেষ পর্যন্ত রেসের মাঠের এক বন্ধুই এই ব্যবস্থা করে দিল।
মালতী দেবী একটু বিরক্ত হয়েই বলেন, অত হেঁয়ালি না করে বলতে পারছে না। কী করে এলে?
দোতলাটা আমার এক বন্ধুর বন্ধুকে ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি।
মিনিট খানেক চুপ করে থাকার পর রাম মিত্তির সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, ঐ গুপ্তাজিই পনের হাজার অ্যাডভান্স দেবেন।
পনের হাজার?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কত টাকায় ভাড়া দিলে যে পনের হাজার অ্যাডভান্স দিচ্ছেন?
মালতী দেবী প্রায় না থেমেই বলেন, নাকি বাড়ির অর্ধেক অংশ বেচে দিতে..
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই রাম মিত্তির গলা চড়িয়ে বলেন, ওরে বাপু, বেচতে যাবো কোন দুঃখ? কাল সকালে গুপ্তাজি এলে তাকেই জিজ্ঞেস করো।
হ্যাঁ, তাই করব।
তবে দোহাই তোমার! ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু ভাল ব্যবহার করো।
কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, তা মনোরঞ্জন বোসের মেয়েকে অন্তত তোমায় শেখাতে হবে না।
পরের দিন সাত-সকালেই সস্ত্রীক গুপ্তাজি এসে হাজির। ভদ্রলোকের পরনে ফিনফিনে মিলের ধুতি, গায় সিল্কের পাঞ্জাবি; মুখে পান, কপালে চন্দন ফোঁটা। বেশ নাদুসনুদুস চেহারা। তুলনায় ওঁর স্ত্রী অনেক সাদাসিধে এবং বেশ দোহারা চেহারা। কপালে বিরাট সিঁদুরের টিপ। সব মিলিয়ে বেশ স্নিগ্ধ শান্ত সুন্দর চেহারা।
দোতলার ঘরদোর দেখেই গুপ্তাজি বললেন, হ্যাঁ, ঠিক এই ধরনের বাড়িই আমি চাইছিলাম।
গুপ্তাজির স্ত্রী মালতী দেবীকে বললেন, ছেলেরা যখন ছোট ছিল, তখন মুক্তারামবাবুর স্ট্রিটের দেড়খানা ঘরেই বেশ চলে যেত কিন্তু এখন তো ছেলেরা বড় হয়েছে! তাই ওখানে আর কিছুতেই কুলোচ্ছে না।
মালতী দেবী এক গাল হেসে বললেন, আপনি তো ঠিক আমাদেরই মতো বাংলা বলতে পারেন।
গুপ্তাজির স্ত্রী হাসতে হাসতে বলেন, আমি তো এখানেই জন্মেছি, এখানেই বড় হয়েছি। বাংলা বলতে পারব না কেন?
এবার গুপ্তাজি একটু হেসে বলেন, আমার তিনটে ছেলেই তো একেবারি বাঙালি হয়ে গেছে। বড় ছেলে মাছ-মাংস না খেলেও অন্য দুটো তো আপনাদের মতো সবই খায়।
রাম মিত্তির ছত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলেন, কিষণাদের কাছে আপনার কথা শুনেই তো আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
গুপ্তাজি বললেন, দেখুন মিত্তিরবাবু, আমার বাড়ি চাই আর আপনার বাড়ি আছে কিন্তু মেয়ের বিয়ের টাকা নেই। তাই তো আমরা হাত মেলালে দুজনেরই উপকার হচ্ছে।
হ্যাঁ, সে তো একশবার সত্যি।
হাতের ঘড়ি দেখেই গুপ্তাজি বললেন, আমার স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে আমাকে দোকানে যেতে হবে; তাই আর দেরি করবো না। সন্ধের পর আমার বড় ছেলে বা মেজ ছেলে এসে আপনাকে পনের হাজার টাকা দিয়ে যাবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছে।
ওরা বেরুবার জন্য পা বাড়াতেই পা বাড়াতেই মালতী দেবী গুপ্তাজির স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, দিদি, আপনারা কি এক তারিখেই আসবেন?
আপনার মেয়ের বিয়ে তো তিন তারিখে, তাই না?
হ্যাঁ।
বিয়ের সময় তো আপনার ঘরদোর দরকার হবে।
হ্যাঁ, তা হবে ঠিকই। তবে আশেপাশের বাড়িতে বললে তারা অনেকেই বিয়ের দু এক দিনের জন্য দুএকটা ঘর ঠিকই ছেড়ে দেবেন।
না, না, আপনার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাক। আমরা বরং কদিন পরই আসব।
রাম মিত্তির সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তাহলে তো ওখানে আবার এক মাসের ভাড়া দিতে হবে। আপনারা এক তারিখেই…
গুপ্তাজি হাসতে হাসতে বললেন, ও বাড়ি কি আমরা ছাড়ছি নাকি? আমরা আট দশ তারিখেই আসব।
মালতী দেবী বললেন, হ্যাঁ তাই আসবেন, কিন্তু আমার মেয়ের বিয়ের বিয়েতে আপনাদের আসতেই হবে।
গুপ্তাজি হাসতে হাসতে বললেন, মিত্তিরবাবু নেমন্তন্ন করলে নিশ্চয়ই আসব।
রাম মিত্তিরও হাসতে হাসতে জবাব দেন, আপনাদের নেমন্তন্ন করবো না, তাই কখনো হয়?
গুপ্তাজিরা চলে যেতেই রাম মিত্তির ওর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ওঁদের কেমন লাগল?
ভালই।
মালতী দেবী মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তবে ছেলেগুলো যদি বাপ-মায়ের মতো না হয়, তাহলেই…..
উনি কথাটা শেষ না করলেও ওর স্বামী হাসতে হাসতে বললেন, গুপ্তাজিরা হাতে থাকলে ছেলেদের নিয়ে কোন চিন্তা নেই।
না থাকলেই ভাল।
উনি একটু থেমে বললেন, তোমার মেজমেয়েও তো কচি বাচ্চা নেই। তাই চিন্তা
রাম মিত্তির একটু হেসে বলেন, মিনুর মতো রানুকে নিয়ে তোমার ভুগতে হবে না। ও অতি হুঁশিয়ার মেয়ে।
ভগবান জানেন, আমার কপালে কী আছে।
যাই হোক সন্ধের পর পরই গুপ্তাজির মেজছেলে রমেশ এসে হাজিব।
ও দুহাত জোড় করে নমস্কার করে বাম মিত্তিরকে বলে, কাকু, আমি রমেশ গুপ্ত। বাবা আমাকে পাঠিয়েছেন।
এসো, এসো, ভিতরে এসো।
রাম মিত্তির মুখ ঘুবিয়ে একটু গলা চড়িয়েই বলেন, মালতী, মালতী, এদিকে এসো। গুপ্তাজির ছেলে এসেছে।
মালতী দেবী ঘরে ঢুকতেই রমেশ হাত জোড় করে নমস্কার করার পরই ব্রিফকেস খুলে নোট ভর্তি একটা মোটা খাম বাম মিত্তিবের হাতে দিয়ে বলে, কাকু, প্লিজ দেখে নিন।
কী আর দেখব? তোমার বাবা কি কম পাঠাবেন?
রমেশ একটু হেসে বলে, না, না, কাকু, প্লিজ দেখে নিন। আমাদেরও তো ভুল হতে পারে।
রাম মিত্তির একটু হেসে বলেন, কোনো ব্যবসাদারই টাকা কম দেয়ও না, নেয়ও না।
তা ঠিক; তবু দেখে নেওয়াই উচিত।
রাম মিত্তির শেষ পর্যন্ত টাকা গুনতে শুরু করতেই মালতী দেবী বললেন, রমেশ, বাবা তুমি চা খাও তো?
হ্যাঁ, কাকিমা, খুব চা খাই।
টাকা গোনা শেষ হতে না হতেই মালতী দেবী চা আর একটা প্লেটে দুটো সিঙাড়া, দুটো রসগোঙ্গা এনে রমেশের সামনে রেখে বলেন, নাও বাবা, খেয়ে নাও।
আবার সিঙাড়া-মিষ্টি দিলেন কেন?
সারাদিন কাজকর্ম করে এলে; শুধু চা খাবে কেন?
রমেশ সিঙ্গাড়া-মিষ্টির প্লেট হাতে তুলে নিয়েই বলে, কাকিমা, কাকু চা খাবেন না?
হা হা, ওঁর চা আনছি।
দুএক মিনিটের মধ্যেই মালতী দেবী স্বামীকে চা এনে দেন।
রমেশ জিজ্ঞেস করে, কাকিমা, কোন দিদির বিয়ে?
মালতী দেবী একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ ওকে ডাকছি।
উনি সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে গিয়ে বড় মেয়েকে ডেকে আনেন।
মালতী দেবী বলেন, রমেশ, এই মিনুরই বিয়ে।
মিনা মুহূর্তের জন্য রমেশের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি গুটিয়ে নেয়।
রমেশ হাসতে হাসতে বলে, আরে দিদি, আমার কাছে লজ্জা করার কী আছে? এখন থেকে আমরা তো একই ফ্যামিলির লোক হয়ে গেলাম।
রাম মিত্তির বললেন, নিশ্চয়ই এক ফ্যামিলির লোক হয়ে গেলে।
রমেশ হাসতে হাসতেই বলে যায়, দিদি, জামাইবাবুকে আমাদের সঙ্গেই আড্ডা দিতে হবে, সিনেমায় যেতে হবে।
ওর কথা শুনে সবাই একটু হাসেন।
এবার রমেশ মালতী দেবীব দিকে তাকিয়ে বলে, কাকিমা, আপনার অন্য ছেলেমেয়েরা বাড়ি নেই?
আমার বড়ছেলে তো দুর্গাপুরে থাকে আর ছোট ছেলে এখন বাড়ি নেই।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, অন্য দুই মেয়ে অবশ্য বাড়িতেই আছে।
রমেশ কিছু বলার আগেই রাম মিত্তির স্ত্রীকে বললেন, ওদের ডাক দাও না।
হ্যাঁ, ডাকছি।
মালতী দেবী ভিতরে গিয়ে দুই মেয়েকে ডেকে এনে রমেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, এই হচ্ছে বীণা, আর এই হচ্ছে খুকু।
রমেশ ওদের দুজনকে একবার দেখে নিয়েই বলে, কাকিমা, বীণাকেও কি দিদি ডাকতে হবে?
না, না, ওকে আবার দিদি বলবে কেন? ও তো তোমার চাইতে অনেক ছোট।
রাম মিত্তির বললেন, ও তোমার চাইতে চার-পাঁচ বছরের ছোট তো হবেই। তুমি ওকে একশবার নাম ধরে ডাকবে।
রমেশ বলে, আমার বয়স ঠিক তেইশ বছর। বীণা নিশ্চয়ই আঠারো-উনিশের বেশি হবে না?
মালতী দেবী একটু হেসে বললেন, তার মানে তুমি ঠিক মিনুর বয়সী।
তাহলে তো ওকে দিদি বলে ডেকে ভুল করলাম।
বীণা একটু চাপা হাসি হেসে বলে, একবার যখন ওকে দিদি বলে ডেকেছে, তখন তো আর নাম ধরে ডাকতে পারবেন না।
রমেশ ওর চোখের উপর চোখ রেখে একটু হেসে বলে, ওকে দিদি বললেও তোমাকে মেজদি বলব না।
মালতী দেবী বললেন, বীণা তোমার চাইতে ঠিক তিন বছরের ছোট। ওকে নিশ্চয়ই তুমি নাম ধরে ডাকবে।
রাম মিত্তির রমেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, মিনুর বিয়ের দিন সকাল থেকেই তোমাদের থাকতে হবে।
কাকু, সেদিন তো দোকান বাজার খোলা থাকবে, তাই সবাই সকাল থেকে না থাকতে পারলেও আমি নিশ্চয়ই আসবো।
আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে রমেশ চলে যাবার পরই রাম মিত্তির স্ত্রীকে বললেন, ছেলেটা বেশ মিশুকে আছে, তাই না মালতী?
হ্যাঁ, তাই তো মনে হলো।
খুকু বলল, মা, রমেশদাকে দেখতেও বেশ সুন্দর, তাই না?
হ্যাঁ।
নেমন্তন্নর কার্ড ছাপিয়ে আসতেই রাম মিত্তির স্ত্রীকে বললেন, মালতী, কাল সকালেই তুমি আর আমি গুপ্তাজিদের নেমন্তন্ন করতে যাবো।
সকালে মানে?
সাতটার মধ্যেই বেরুতে হবে।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বললেন, বেশি দেরি করলে তো গুপ্তাজি দোকানে চলে যাবেন।
মালতী দেবী বললেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে।
পরের দিন সকালে ওঁরা যেতেই গুপ্তাজি ও তার স্ত্রী বেশ আন্তরিকতা ও সমাদরের সঙ্গেই ওঁদের অভ্যর্থনা করলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন বড় ছেলে সুরেশ ও তার স্ত্রীর সঙ্গে।
রামবাবু জিজ্ঞেস করলেন, রমেশ নেই?
গুপ্তাজি বললেন, ও একটু জরুরি কাজে বর্ধমান গেছে।
. মালতী দেবী গুপ্তাজির স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছোটছেলেও কি বাড়ি নেই?
ও মাস্টারজির কাছে পড়তে গেছে।
রাম মিত্তির নেমন্তন্নর চিঠিটা গুপ্তাজির হাতে দিতেই উনি বললেন, আরে মিত্তিরবাবু, কার্ড দিয়ে কী হবে? আমরা ঠিকই যাবো।
মালতী দেবী বললেন, শুধু আপনারা দুজনে গেলে হবে না। সবাইকে নিয়ে যেতে হবে।
মিত্তিরবাবু, আমরা ব্যবসাদার লোক। ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝামেলা সামলে সবাই মিলে কোনো বিয়েবাড়িতেই যেতে পারি না।
কিন্তু রমেশকে তো সকাল থেকেই থাকতে হবে।
হ্যাঁ, তা থাকতে পারে কিন্তু আমরা দুজনে সন্ধের পরই যাবো।
মালতী দেবী বললেন, অন্তত ছোটছেলে আর বড়ছেলের বউকে তো নিয়ে যাবেন।
গুপ্তাজির স্ত্রী বললেন, ছোটছেলেকে নিয়ে যেতে পারি কিন্তু আমাদের বউ সেদিন অন্য একটা বিয়েবাড়ি যাবে।
ওঁদের মধ্যে টুকটাক আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা হবার পরই গুপ্তজির স্ত্রী মালতী দেবীকে নিয়ে অন্য ঘরে গেলেন।
কোনো ভূমিকা না করেই গুপ্তাজির স্ত্রী ওঁকে জিজ্ঞেস করলেন, বিয়ের সব বন্দোবস্ত মানে টাকাকড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেছে?
মালতী দেবী সলজ্জ দৃষ্টিতে ওঁর দিকে একবার তাকিয়েই দৃষ্টি গুটিয়ে নিয়ে বলেন, না, দিদি, সব হয়নি; তবে চেষ্টা করছি।
শুনুন ভাই, মেয়ের বিয়ের কি ঝামেলা, তা আমি খুব ভাল করেই জানি।
উনি মালতী দেবীর একটা হাত ধরে হেসে বললেন, আপনার স্বামীর হাতে বেশি টাকা দিতে গুপ্তাজি চাননি। তাই উনি বলেছেন, আপনার স্বামীকে না জানিয়ে আপনার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিতে।
মালতী দেবী বিস্ময়-মুগ্ধ, ওঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, দিদি, টাকাটা পেলে সত্যি খুব উপকার হবে।
গুপ্তাজির স্ত্রী বললেন, আর আমি আপনার মেয়ের গলার হার দেব কিন্তু তা যেন গুপ্তাজি বা আমার ছেলেরা না জানতে পারে।
মালতী দেবী দুহাতে দিয়ে ওঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, দিদি, আপনি যে কী উপকার করলেন, তা আমি বলে বোঝাতে পারব না।
গুপ্তাজির স্ত্রী একটু হেসে বললেন, আমার নিজের কোনো মেয়ে না থাকলেও আমরা পাঁচ বোন। আমি তো জানি, আমাদের বিয়ের সময় বাবাকে কত ঝামেলা আর অপমান সহ্য করতে হয়েছে।
উনি একটু থেমে বলেন আপনাদের সঙ্গে আমাদের থাকতে হবে আর আপনার মেয়ের বিয়েতে আমরা কিছুই করব না, তাই কি কখনও হতে পারে?
দিদি, আপনার ঋণ আমি সারাজীবনেও শোধ করতে পারব না।
গুপ্তাজির স্ত্রী একটু স্নান হাসি হেসে বললেন, হাজার হোক আমিও তো মেয়েমানুষ। তাই তো আপনার মুখখানা দেখেই আমি বেশ বুঝতে পেরেছি, আপনার মনে কত দুঃখ, কত চিন্তা জমে রয়েছে। এর পরেও কি আমি চুপ করে থাকতে পারি?
গুপ্তাজির স্ত্রী পরের দিন দুপুরেই মিত্তিরবাড়ি গিয়ে মিনার গলায় হার পরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পছন্দ হয়েছে তো?
মিনা একগাল হাসি হেসে বলল, হ্যাঁ, খুব পছন্দ হয়েছে।
বীণা চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল, দিদি, তোকে যা সুন্দর দেখাচ্ছে না…
খুকি বলল, রিয়েলি দিদি, তোকে দারুণ দেখাচ্ছে।
গুপ্তাজির স্ত্রী একটু চাপা হাসি হেসে ওদের বললেন, বিয়ের সময় তোমাদেরও খুব সুন্দর দেখাবে।
ওদের সবার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর গুপ্তাজির স্ত্রী একটু লুকিয়ে চুরিয়ে মালতী দেবীর হাতে পাঁচ হাজার টাকাও দিয়ে দেন।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মিনার বিয়ে মোটামুটি ভালভাবেই হয়ে গেল। বিয়ের পরদিন মেয়ে-জামাই চলে যাবার পর কান্নাকাটির পর্ব থামলে মালতী দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ভগবান যে এভাবে আমাকে বিপদমুক্ত করবেন, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
এবার উনি রমেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার মেয়ের বিয়েতে আমার অন্য ছেলেমেয়েরা খাটবে, এ তো খুবই স্বাভাবিক কিন্তু তুমি যে অমানুষিক পরিশ্রম করেছ, তা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।
রাম মিত্তির সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ঠিক বলেছ মালতী।
রমেশ চাপা সলজ্জের হাসি হেসে বলল, মন্টু আর ওর বন্ধুরাও তো দারুণ খেটেছে।
মন্টু হাসতে হাসতে বলে, কিন্তু ভাইয়া, তুমি আমাদের লিডার ছিলে বলেই আমরা কাজ করতে পেরেছি।
খোকা ছোটভাইকে সমর্থন করে বলে, ঠিক বলেছিস মন্টু, রমেশ না থাকলে মিনুর বিয়ে কখনই এত ভালভাবে হতো না।
এই বিয়ের দৌলতে একদিনের মধ্যেই রমেশ এই পরিবারের সবার কাছেই আপনজন, প্রিয়জন হয়ে উঠেছে। তাই তো ও হাসতে হাসতেই বলে, এই বীণা, এই শুকনো প্রশংসা আর ভাল লাগেছে না। চটপট চা খাওয়াও।
বীণা একগাল খুশির হাসি হেসেই উঠে যায়।
চা খেতে খেতেও গল্পগুজব হয়।
খোকা বলে, মিনুর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে বেশ ভাল লাগল কিন্তু কয়েকজন বরযাত্রী এত বদ ছিল যে…
ওর কথার মাঝখানেই মন্টু বলে, রমেশ ভাইয়ার বদলে আমি হলে তো ওদের ঠেঙিয়ে দূর করে দিতাম।
রমেশ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়েই একটু হেসে বলে, দেখো মন্টু, সব বিয়েবাড়িতেই দেখবে, বরযাত্রীদের মধ্যে দু-পাঁচজন শুধু গণ্ডগোল করার জন্যই আসে কিন্তু তাই বলে কি মেয়ের বাড়ি লোকেদের মাথা গরম করলে চলে?
মালতী দেবী বললেন, ঠিক বলেছ রমেশ।
রমেশ বলে যায়, আমরা দোকানে বসেও দেখি, অধিকাংশ খদ্দের ভাল হলেও দুচারটে খদ্দের বড্ড ঝামেলা করে কিন্তু দোকানদার মাথা গরম করলে তো ভাল খদ্দেরাও চলে যাবে।
রাম মিত্তির এতক্ষণ পর মাথা দুলিয়ে একগাল হাসি হেসে বললেন, রমেশ, তুমি তো দারুণ দামী কথা বললে।
খোকা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা রমেশ, তুমি ঐ বদমায়েশ বরযাত্রীগুলোকে ঠাণ্ডা করলে কী করে?
রমেশ হাসতে হাসতে বলে, বিশেষ কিছুই করতে হয়নি। বীণা আর ওর দুতিনজন বন্ধুকে লাগিয়ে দিলাম ওদের দেখাশুনা করতে; তাছাড়া কয়েকটা গোন্ড ফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট ওদের পকেটে পুরে দিলাম।
মালতী দেবী বললেন, যাই হোক বাবা, তুমি খুব সামলে দিয়েছে; তা না হলে যে। কি কেলেঙ্কারি হতো, তা ভগবানই জানেন।
যাই হোক, মিনুর বিয়ের রাতে রমেশ কত খেটেছে, কত ঝামেলা সামলেছে, তা সবাই জানলেও কেউ জানতে পারলেন না এই এক রাত্তিরের মধ্যেই বীণার সঙ্গে ওর মেলামেশা বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে।
.
বিয়ে-বৌভাতের সব ঝামেলা মিটে যাবার কদিন পর গুপ্তাজিরা মিত্তিরবাড়িতে এসে গেলেন মেজ আর ছোটছেলেকে নিয়ে। বড়ছেলে সুরেশ আর তার স্ত্রী মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের বাড়িতেই থাকল। গুপ্তাজির বড় দুই ছেলে দোকানে বেরুলেও ছোটছেলে তখন ক্লাশ নাইন-এ-পড়ে।
গুপ্তাজি মাঝে মাঝেই বলেন, জানেন মিত্তিরবাবু, তিনটে ছেলে তিনটে ব্যবসায় ঠিকমতো লেগে গেলেই আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে কাশী চলে যাব।
উনি একটু থেমে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সেই বারো-তেরো বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে দোকানে যাওয়া শুরু করে এখন যেন আর ভাল লাগে না।
রাম মিত্তির একটু হেসে বলেন, আইডিয়া তো ভালই কিন্তু আপনি না থাকলে কী ছেলেরা ঠিকমতো ব্যবসা চালাতে পারবে?
গুপ্তাজি একটু হেসে বলেন, মিত্তিরবাবু, আমাদের রক্তে ব্যবসা। বড় ছেলে তো বাগড়ি মার্কেটের দোকান ভালই চালাচ্ছে। আর চীনাবাজারের দোকানে আমি থাকলেও রমেশই সবকিছু সামলায়।
উনি একটু থেমে বলেন, তবে ছোট ছেলেটা ব্যবসা-বাণিজ্য তত পছন্দ করে না।
মালতী দেবী পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। উনি বললেন, সন্তোষের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, বি এ-এম এ পাস না করে ও কিছুই করতে চায় না।
গুপ্তজি হাসতে হাসতে বলেন, বহিনজি, ওসব পাশ করে কী লাভ বলুন? যখন ব্যবসাই করতে হবে, তখন শুধু শুধু হাজার হাজার টাকা আর চার-পাঁচ বছর সময় নষ্ট করে কী লাভ বলুন?
মালতী দেবী বলেন, লেখাপড়া শিখলে তো ব্যবসা বাণিজ্য আরো ভাল করে করতে পারবে।
না না, তা হয় না।
গুপ্তাজি মুহূর্তের জন্য থেমে একটু চাপা হাসি বলেন, বি এ-এম এ পাশ করলে যদি ভাল করে ব্যবসা করা যেতো, তাহলে তো সব ব্যবসাই আপনাদের বাঙালিদের হাতে থাকতো আর আমরা না খেয়ে মরতাম।
রাম মিত্তির সঙ্গে সঙ্গে ওকে সমর্থন করে বলেন, খুব সত্যি কথা বলেছেন।
গুপ্তাজি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, মিত্তিরবাবু, আপনি শুনলে অবাক হবেন, আমার বাবা ক্যানিং স্ট্রিটের বণিকবাবুদের দোকানে আঠারো বছর কুলিগিরি করার পর পাশের চীনাবাজারে মদন দার দোকানের দরজায় একটা শো-কেস ঝুলিয়ে কালি-কলম ছোট নোট বই বিক্রি করতে শুরু করেন।
সামনে চেয়ারে বসে রাম মিত্তির আর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মালতী দেবী ওঁর কথা শোনেন।
ঐ শো-কেসএর সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি কাজ করতে শুরু কবলাম বারো তেরো বছর বয়সে।
আর আপনার বাবা?
বাবা চীনাবাজার ক্যানিং স্ট্রিট থেকে সস্তায় মাল কিনে এক একবার এক এক জায়গায় বিক্রি করতেন।
এই কলকাতায় মধ্যেই?
না, না।
গুপ্তাজি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, বাবা কোনোদিন যেতেন বারাসত-বসিরহাট, কোনোদিন কালনাকাটোয়া নবদ্বীপ অথবা যশোর-খুলনা।
স্বামী টুকটাক প্রশ্ন করলেও মালতী দেবী অবাক হয়ে ওঁর কথা শোনেন।
জানেন মিত্তিরবাবু, এইভাবে আঠারো বছর ব্যবসা করার পর আমরা এক লাখ বত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে মদনবাবুর দোকান কিনে নিই।
তখন আপনারা কোথায় থাকতেন?
আমি আর বাবা পুরো আঠারো বছর ঐ ক্যানিং স্ট্রিটে বণিকবাবুদের দোকানের সামনের বারান্দায় থেকেছি।
খাওয়া-দাওয়া?
সকালে দোকান খোলার আগেই ঐ বারান্দায় বসেই আমরা চাপাটি-সবজি বনিয়ে নিতাম। আর রাত্তিরে তো ক্যানিং স্ট্রিটের রাস্তার উপরই উনুন জ্বালিয়ে আমাদের মতো অনেকেই রান্না করতো।
উনি একটু থেমে বলেন, মদনবাবুর দোকান কেনার পর আমরা ঐ দোকানের মধ্যেই শুতাম।
গুপ্তাজি একটু হেসে বলেন, আপনারা শুনলে অবাক হবেন, আমি জীবনে কখনও বায়োস্কোপ-সিনেমা দেখিনি, বিড়ি-সিগারেট-মদ খাইনি।
রাম মিত্তির একটু হেসে জিজ্ঞেস করেন, বছরের পর বছর কোনোরকম আনন্দ না করে জীবন কাটাতে ভাল লাগে?
গুপ্তাজি হাসতে হাসতেই জবাব দেন, ভালভাবে ব্যবসা করে হাজার-হাজার লাখ লাখ টাকা লাভ করে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা কি সিনেমা দেখে বা মদ খেয়ে জুয়া খেলে পাওয়া যায়?
উনি প্রায় না থেমেই বলেন, তবে মনে রাখবেন, বাবা ঐরকম কষ্ট করেছিলেন বলেই আমি অনেক ভাল আছি; আবার আমি আলতু-ফালতু খরচ না করে ব্যবসা করেছি বলেই আমার ছেলেরা অনেক ভাল আছে।
.
দিনে দিনে দুটি পরিবারের হৃদ্যতা বাড়ে। প্রতি মঙ্গলবার হনুমানজির পূজা করেই গুপ্তাজির স্ত্রী সিঁড়ি মাথায় দাঁড়িয়েই বলেন, এই বীণা! এই খুকু! প্রসাদ নিয়ে যাও।
বীণা ঘর থেকে বেরিয়েই লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। গুপ্তাজির স্ত্রী ওর হাতে প্লেটভর্তি মিষ্টি দিতেই ও অবাক হয়ে বলে, মাসিমা, এত মিষ্টি দিচ্ছেন কেন?
যা দিচ্ছি, নিয়ে যাও। তোমরা সবাই ভাগ করে খাবে।
শুধু কি মঙ্গলবারের হনুমানজির পুজো? উনি যে আরো কত পুজো-পার্বণ ব্রত করতেন, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এইসব উপলক্ষে দোতলা থেকে একতলায় আসতে নানা রকমের ফল আর মিষ্টি। কখনও আবার শাড়ি আর কয়েকটা টাকা।
মালতী দেবী কিছু বললেই গুপ্তাজির স্ত্রী একটু হেসে বলতেন শ্বশুরবাড়ির নিয়ম মেনে চলব না?
কিন্তু প্রত্যেকবার আমাদের…
আরে ভাই, আমি যদি আপনাদের দিয়ে মনে শান্তি পাই, তাহলে আপনাদের আপত্তির কী আছে?
মালতী দেবী মুখে না বললেও বেশ বুঝতে পারেন, নিছক সাহায্য করার জন্যই উনি এইসব দেন।
এই সংসারটা যে কীভাবে চলে, তা মালতী দেবী ছাড়া আর কেউ জানেন না।
বিখ্যাত উকিল দেবীপ্রসন্ন মিত্তিরের একমাত্র পুত্রের স্ত্রী হয়ে আসার পর উনি কত স্বপ্ন দেখেছিলেন কিন্তু এখন এই সংসারই ওঁর দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে। উকিল-ব্যারিস্টার হওয়া তো দুরের কথা, স্বামী রামপ্রসন্ন কর্পোরেশনের কেরানিও হতে পারলেন না। যে ছেলে বিশ-বাইশ বছর বয়স থেকেই রেস খেলে, সে সিনেমা হলের বুকিং ক্লার্ক ছাড়া। আর কী হবে? তাছাড়া ঐ চাকরি করে যা মাইনে পান, তার অর্ধেকও তো সংসার চালাবার জন্য মালতী দেবীর হাতে আসে না।
সংসারের শত কাজকর্মের ফাঁকে সামান্য অবসর পেলেই মালতী দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে কত কী ভাবেন।
কত মেয়ের কপালে তো স্বামীর সুখ জোটে না কিন্তু তাদের অনেকেই তো ভাল ছেলেমেয়ের মা হয়ে সব দুঃখ ভুলতে পারেন কিন্তু আমার কপালে সে সুখও কেন জুটল না?
সত্যি চিন্তা করতে বসলে মাথা ঘুরে যায়।
আমার বড়ছেলে মিস্ত্রী? ছি! ছি! মা হয়ে আমারই ভাবতে ঘেন্না হয়। আমার ছোটছেলে লেখাপড়া না করে দিনরাত্তির পার্টির কাজ করে, ভাবতেও অবাক হয়ে যাই। ওরে বাপু মিছিল-মিটিং-বিক্ষোভ-বক্তৃতা দিয়ে সত্যি সত্যি দেশের কল্যাণ হতো, তাহলে এই কলকাতা শহরের সব রাস্তা সোনা দিয়ে তৈরি হয়ে যেতো। যারা যত বেশি কাজ করে, তারা তত বেশি উন্নতি করে–এই সামান্য কথাটাও কি তোরা জানিস না?
মালতী দেবী নিজের মনেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন।
ছেলে দুটো অপাদার্থ হলেও চরিত্রহীন বদমায়েশ হয়নি কিন্তু দুটো মেয়ে অত খারাপ হলো কেন? মিনু তো চোদ্দ-পনের বছর বয়স থেকেই প্রেম করতে শুরু করল। তাছাড়া কি ভীষণ সিনেমা দেখার নেশা! বাপরে বাপ! যে ছেলে সিনেমা দেখাতে চেয়েছে, দেখিয়েছে, তার সঙ্গেই ও ভিড়ে গেছে। ওরে বাপু, তুই জানিস না, যার-তার সঙ্গে এভাবে মেলামেশা করলে কী বিপদ ঘটতে পারে? আশে-পাশে তোর বয়সী মেয়ের তো অভাব নেই কিন্তু তাদের মধ্যে কে তোর মতো আলতু-ফালতু ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করছে বলতে পারিস?
মালতী দেবী ওকে কত বুঝিয়েছেন।
দ্যাখ মিনু, দুদিন পরই তোর বিয়ে হবে। তখন স্বামীর সঙ্গে যা খুশি আনন্দ করিস। কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু এখন তুই যেরকম বেপরোয়াভাবে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করছিস, তার জন্য সারা পাড়ায় আমি মুখ দেখাতে পারি না।
তারপর উনি ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কত আদর করে বলেছেন, বিশ্বাস কর মিনু, আমি দুএক বছরের মধ্যেই তোর বিয়ে দেব। এখন একটু ভালভাবে থাক। দেখবি, তুই খুব সুখী হবি।
. কিন্তু কে কার কথা শোনে?
কথায় আছে, কপাল যার নড়া দশা, কুবুদ্ধি হয় সর্বনাশা।
মিনুরও হলো তাই।
হতভাগী হাজারটা মিথ্যে কথা বলে মাকে কোনমতে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মালাদের সঙ্গে দিঘা যাচ্ছি বলে শেষ পর্যন্ত চক্ৰবেড়ের ঐ বাঁদর ছেলেটার সঙ্গে দার্জিলিং চলে গেল। তা সে শুভ সংবাদ আবার জানা গেল বিশ্বনিন্দুক বাঁড়ুজ্যেদের মেজবউয়ের কাছে।
কীরে মালতী, কেমন আছিস?
পান চিবুতে চিবুতে চাপা হাসি হেসে বাঁড়ুজ্যেদের মেজবউ বলে যায়, তুই যে আজকাল আমাদেরও ভুলে গেলি! কী ব্যাপার রে?
মালতী দেবী বলেন, কাউকেই আমি ভুলিনি। সংসারের কাজকম্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকি বলে কারোর কাছেই যেতে পারি না।
তোর কর্তার কী খবর?
কী আর খবর? যেমন ছিলেন, তেমনই আছেন।
তুই নিশ্চয়ই হরদম সিনেমা দেখতে যাস?
মেজবউ মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, নিশ্চয়ই যাবি। তোর যখন টিকিট লাগে না তখন…
ওকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়েই মালতী দেবী বলেন, সিনেমা দেখার শখও আমার নেই, সময়ও নেই।
আচ্ছা মালতী, মেয়ের বিয়ে দিলি অথচ একটা খবরও দিলি না?
কে বলল, মেয়ের বিয়ে দিয়েছি?
মেজবউ হঠাৎ একটু জোরে হেসে উঠেই বলে, তবে কি তোর মেয়ে বিয়ের আগেই চক্ৰবেড়ের ঐ চায়ের দোকানের ছেলেটার সঙ্গে হনিমুন করতে দার্জিলিং গেছে?
খবরটা শুনে চমকে উঠলেও মালতী দেবী কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, কে বলল আমার মেয়ে দার্জিলিং গিয়েছে? মিনু তো কাল আমার ছোট পিসির সঙ্গে কালনা গেল। ও দার্জিলিং যাবে কেমন করে?
তা তো জানি না বাপু। ঠাকুরপো আজ সকালে দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে বলল, মিনু আর ঐ ছোঁড়াটা ক্যাভেন্টার্সের দোকানে বসে চা-টা খেতে খেতে খুব হাসাহাসি ঢলাঢলি করছিল।
মেজবউ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েই বলে, যাই মালতী। ঠাকুরপোকে গিয়ে বলি, আজই চোখের ডাক্তারের কাছে যাও।
রাগে দুঃখে, অপমানে মালতী দেবী সেদিন সারা রাত্তির শুধু আকাশ-পাতাল ভেবেছেন। এক মিনিটের জন্যও ঘুমুতে পারেননি। অস্বস্তিবোধ করেছেন দিনের পর দিন।
শুধু কি তাই?
মেয়ের এই কেলেঙ্কারি চাপা দেবার জন্য ওঁর মত মানুষকেও কতজনের কাছে মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে, কিন্তু কী করবেন? না বলে তো কোনো উপায় ছিল না।
ওঁর পেটের ছেলে মেয়েরা যে কী করে এত অধঃপাতে গেল, তা নিয়েও মালতী দেবী কত কী ভাবেন!
মাঝে মাঝে মনে হয়, গ্রীষ্মের তাপ, শ্রাবণের ধারা আর মাঘের হিম না পেলে যেমন কোনো বীজ অঙ্কুরিত হয়ে সুন্দর পল্লবিত হয়ে উঠতে পারে না, সেইরকম প্রতি শিশুরও চাই স্নেহ-মমতা-ভালবাসা আর সর্বোপরি সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ। আমাদের ছেলেমেয়েরা কি তা কোনোদিন পেয়েছে?
তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে।
শৈশব-কৈশোর পার করে যৌবনের স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেমেয়েরা কত নতুন স্বপ্ন দেখে! কত নতুন আশা-প্রত্যাশায় মন ভরে ওঠে। যদি সহজ স্বাভাবিকভাবে সেসব প্রশ্ন, আশা-প্রত্যাশা পূর্ণ না হয়, তাহলে ছেলেমেয়েরা আদর্শভ্রষ্ট পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। আমার ছেলেমেয়েরা তাই কি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না?
রাতের একেবারে শেষ প্রহরে মালতী দেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনেই বলেন, শেষ পর্যন্ত যে মিনুকে একটা মোটামুটি ভাল ছেলের হাতে তুলে দিতে পেরেছি, সেই আমার পরম সৌভাগ্য।
.
গুপ্তাজিরা সবাই এই পরিবারের সবকিছু না জানলেও এই কমাসের মধ্যেই জেনে গেছে, এরা নিত্য অর্থাভাবে কষ্ট পায়। গুপ্তাজির স্ত্রী আর রমেশ খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছেন, সামান্য কিছু খাবার-দাবার বা উপহার পেলে বীণা আর খুকু বড় খুশি হয়।
গুপ্তাজি রোজ অন্ধকার থাকতেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে পাঁচটার মধ্যেই মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়ে পড়েন। তারপর ফিবে এসে স্নান আর পুজো করেই খেতে বসেন। ঠিক নটায় বেরিয়ে পড়েন চীনারাজারের দোকানে যাবার জন্য; ফিরে আসেন সাতটায়। নটা-সাড়ে নটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
রমেশ বেরোয় দেরি করে, ফেরেও দেরি করে। দোকানের সব ঝামেলা মিটিয়ে ওর ফিরতে ফিরতে সাড়ে আটটানটা হয়ে যায়। কোনো কোনদিন আরো দেরি হয়। তবে যখনই ফিরে আসুক, বেশ কিছুক্ষণ একতলায় আড্ডা না দিয়ে ও কখনই উপরে যায় না।
রমেশ যখন ফিরে আসে, তখন রাম মিত্তির থাকেন হল-এ আর মন্টু বাড়ি থাকে। খুকুও তখন লেখাপড়া করে। তাই রমেশ আড্ডা দেয় মালতী দেবী আর বীণার সঙ্গে।
তখন রান্নাবান্নার কাজ শেষ। হয় না বলে মালতী দেবী কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেই রান্নাঘরে চলে যান। চা খেতে খেতে রমেশ বীণার সঙ্গেই গল্পগুজব হাসি-ঠাট্টা করে। রান্নাঘরে বসেও মালতী দেবীর কানে ওদের হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। উনি বেশ বুঝতে পারেন, এই সময় রমেশের সঙ্গে আড্ডা দেবার জন্য বীণা বেশ উদগ্রীব হয়ে থাকে।
অবশ্য না হবারও কোনো কারণ নেই। হাজার হোক রমেশ সুদর্শন সুপুরুষ স্বাস্থ্যবান যুবক। দুহাতে টাকা রোজগার করে। তার চাইতেও বড় কথা, ছেলেটা যেমন মিশুকে, তেমনই প্রাণবন্ত। এদিকে বীণাকে দেখতে তো বেশ ভাল। তাছাড়া যৌবন!
আরো কারণ আছে।
রমেশ প্রায়ই কিছু না কিছু হাতে নিয়ে আসে।
এই বীণা, এই নাও।
প্যাকেটটা হাতে নিয়েই বীণা জিজ্ঞেস করে, প্যাকেটে কী আছে?
কেক। রমেশ একটু হেসে বলে, আমার এক বন্ধু একটা বড় কাগজের কোম্পানির এজেন্সি পেয়েছে বলে…
তা আমাকে দিচ্ছেন কেন? উপরে নিয়ে যান।
বাড়ির প্যাকেটা বাবার সঙ্গেই পাঠিয়ে দিয়েছি।
ও!
.
এইভাবেই চলতে চলতে হঠাৎ একদিন মালতী দেবী বীণাকে বললেন, একটা কাজ করতে পারবি?
কী কাজ? মালতী দেবী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পেলে বলেন, হাতে কিছু নেই। গোটা পঞ্চাশেক টাকা না হলে তো এ কটা দিন কিছুতেই চালাতে পারব না।
বীণা সঙ্গে সঙ্গে বলে, রমেশদার কাছে চাইব?
খুব গোপনে চাইতে পারবি?
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, ওর বাবা-মা যেন জানতে না পারেন।
বীণা একটু হেসে বলল, না না, কেউ জানবে না।
ও আধঘণ্টা পরে উপর থেকে ঘুরে এসে হাসতে হাসতে হাসতে মালতী দেবীর হাত একটা একশ টাকার নোট দিয়ে বলল, ওর কাছে খুচরো নেই বলেই এই একশ টাকার নোটটা দিল।
টাকাটা ভাঙিয়ে এখনই কি বাকি পঞ্চাশ টাকা ওকে দিয়ে আসবি?
না, না, এখন দিতে হবে না।
রাম মিত্তিরের সংসার চালাবার জন্য শুধু ঐ একবার না, প্রায় প্রত্যেক মাসেই দুএকবার রমেশের কাছে হাত পাততে হয়।
মালতী দেবী নিজেই ওকে টাকাটা ফেরত দিতে গেলে রমেশ হাসতে হাসতে বলে, কাকিমা, ব্যবসা করি চীনাবাজারে, এখানে না। না, না, এই সামান্য কয়েকটা টাকা আপনাকে ফেরত দিতে হবে না।
মালতী দেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ভগবান তোমার মঙ্গল করুন বাবা।
.
কথায় আছে–মানুষের কুটুম দিলে থুলে, গরুর কুটুম চাটলে চুটলে।
প্রত্যেক মাসেই যদি মেয়েকে পাঠিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে রমেশের কাছ থেকে টাকা আনতে হয় আর সে টাকা যদি কখনই ফেরত দিতে না হয়, তাহলে ছেলেটাকে কুটুমের মতো আপনজন না ভেবে কি পারা যায়?
অন্তত মালতী দেবী পারেন না।
রমেশ দোতলায় উঠতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে বলে, এই বীণা, চন্দননগর দেখেছিস?
বীণা একটু হেসে বলে, চন্দননগর তো দূরের কথা, আমি শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনও দেখিনি।
ও মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, আমার দৌড় দক্ষিণেশ্বর আর বেলুড় মঠ। আর কিছু দেখিনি।
রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মালতী দেবী একটু ম্লান হেসে বলেন, ওদের বাবা কি কোনো জন্মে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথাও গেছে?
উনি একটু থেমে বলেন, আচ্ছা রমেশ, চন্দননগরের গঙ্গার ধার খুব সুন্দর, তাই না?
হ্যাঁ, কাকিমা, খুব সুন্দর।
রমেশ একটু হেসে বলে, হাজার হোক, ও শহরটা তো ফরাসিরা তৈরি করেছে। তাই অনেক কিছুই খুব সুন্দর।
বীণা রমেশের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কি চন্দননগর যাচ্ছো?
হ্যাঁ।
কবে?
কাল।
রমেশ প্রায় না থেমেই বলে, দুপুরে গিয়ে রাত্তিরেই ফিরব। তুই যাবি?
বীণা ওর কথায় জবাব না দিয়ে মালতী দেবীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, মা, যাব?
মালতী দেবীর রমেশকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার ফিরতে কি বেশি রাত হবে?
না, না বেশি রাত হবে না; বড়জোর সাড়ে আটটানটা হবে।
তুমি নিশ্চয়ই কাজে যাচ্ছো?
হা, কাকিমা, কাজেই যাচ্ছি।
বীণার তোমার সঙ্গে গেলে তোমার কাজের ক্ষতি হবে না?
না, না।
রমেশ একটু থেমে বলে, ও গেলে বরং ট্রেনে গল্পগুজব করে সময়টা বেশ কেটে যাবে।
মালতী দেবী বলেন, তাহলে আর আপত্তির কী আছে?
রমেশ দোকান থেকে ফিরতে না ফিরতেই গুপ্তজিদের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটে যায়। ছেলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের দুএকটা কথা বলেই ওরা স্বামী-স্ত্রী শুয়ে পড়েন। দশটা বাজতে না বাজতেই সন্তোষও শুয়ে পড়ে। হাজার হোক ওকে ভোরে উঠে ছটার সময় মাস্টারজির কাছে পড়তে যেতে হয়। তাই ও আর বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকে না।
রমেশ দোকান থেকে ফিরে বাবার সঙ্গে কিছু জরুরি কথাবার্তা বলেই স্নান করতে যায়। ইতিমধ্যে গুপ্তাজির স্ত্রী ওর খাবার-দাবার ওর ঘরের কোণের টেবিলে ঢেকে রেখে শুতে যান। রমেশ কোনোদিন বাথরুম থেকে বেরিয়েই খেতে বসে, কোনোদিন আবার পরে খায়।
তারপর পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই গল্পগুজব করার জন্য বীণা এসে হাজির হয়। বাবা ফিরে আসার আগেই চলে আসে। ততক্ষণে খুকুর মাঝরাত্তির। বীণা রোজই বাবা-মার সঙ্গে খেতে বসে।
সেদিন বীণা যেন একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এলো।
মা, রমেশদা তোমাকে একটা কথা বলতে বলল।
কী?
বলল, আমি যে ওর সঙ্গে চন্দননগর যাচ্ছি, তা যেন আর কেউ জানতে না জানে।
আমি আবার কাকে জানাতে যাচ্ছি?
বীণা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, বাবা বা খুকু কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবে?
মালতী দেবী একটু বিরক্ত হয়েই বলেন, যা বলার তা বলব; তোকে ভাবতে হবে না।
মুখে যাই বলুন না কেন, উনি মনে মনে কত কী ভাবেন। না ভেবে পারেন না। হাজার হোক, বীণা আর কচি খুকি নেই; পুরো একুশ বছর বয়স হলো। তাছাড়া যা বাড়বাড়ন্ত শরীর! মাঝে মাঝে হঠাৎ ওর শরীরে দিকে তাকিয়ে মালতী দেবী চমকে ওঠেন। সারা শরীরে যেন যৌবনের ঢল নেমেছে। এর উপর যা কাপড়-চোপড় পরার ছিরি! উনি কতবার বলেছেন, হারে বাজারে কি এর চাইতে ভদ্র-সভ্য ব্লাউজ পাওয়া যায় না?
নিজের বুকের দিকে একবার তাকিয়ে বীণা বলে, এই ব্লাউজ কিনে কী অন্যায় করেছি?
অর্ধেক বুকই যদি দেখা গেল, তাহলে আর ব্লাউজ পরার দরকার কী?
তুমি কী চাও, আমি ঠাকুর-দিদিমাদের মতো সেমিজ পরে ঘুরে বেড়াই?
মালতী দেবী কিছু না বললেও বীণা বলে, আজকাল সব মেয়েই এইরকম ব্লাউজ পরে।
মালতী দেবী মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলেন, এইজন্যেই তো ছেলেরা পথে ঘাটে তোদের সঙ্গে বাঁদরামি করে।
পরের দিন এগারটা নাগাদ বীণা বেরিয়ে যেতেই মালতী দেবীর মনের মধ্যে নানা ভাবনা-চিন্তা ভিড় করে। রমেশ যত ভদ্র-সভ্যই হোক, ও তো দেবতা না। ওর সঙ্গে সারাদিন মেয়েটাকে কাটাতে দিয়ে কি ভুল করলাম? ও কি সত্যি কাজে চন্দননগর গেল? নাকি বীণাকে নিয়ে নিছক সারাদিন কাটাবার জন্য অন্য কোথাও গেল?
আবার মনে হয়, যদি দুজনে মিলে নিছক ঘুরে-ফিরে বেড়ায়, তাহলে কিছু বলার নেই। তাছাড়া যে ছেলেটা সব সময় সব রকম সাহায্য করে, তার অনুরোধ বা ইচ্ছাকে কী উড়িয়ে দেওয়া যায়?
অসম্ভব।
কিন্তু…
মালতী দেবী ভাবতে গিয়েও যেন থমকে দাঁড়ান।
রমেশের তো পয়সার অভাব নেই। তাই ও যদি চন্দননগর না গিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে কলকাতাতেই কোনো একটা হোটেলে বা অন্য কোথাও সারাদিন কাটায়?
ভাবতে গিয়েও শিউরে ওঠেন।
দুপুরে খেতে বসে রামপ্রসন্ন বলেন, আচ্ছা মালতী, তুমি কী ভাবছ বলো তো!
আমার ভাবনা-চিন্তার কি শেষ আছে?
তা হতে পারে কিন্তু অন্য দিন তো ঠিক এত চিন্তিত মনে হয় না।
আমার চিন্তা-ভাবনার কথা ছেড়ে দাও। তুমি খাও।
দুএক মিনিট পর রামপ্রসন্ন জিজ্ঞেস করেন, আজ মেজখুকি এত সেজে-গুঁজে কোথায় গেল?
পিকনিকে।
পিকনিকে?
হ্যাঁ।
ও আবার কাঁদের সঙ্গে পিকনিকে গেল?
তুমি কি ওর সব বন্ধুদের জানো?
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, ও ওর স্কুলের পুরনো কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে পিকনিকে গেছে।
কোথায় পিকনিক করতে গেছে?
বারাসতের ওদিকে কি একটা গ্রামে।
ও!
খেয়ে-দেয়ে ওঠার মুখে রামপ্রসন্ন একটু জিজ্ঞেস করেন, তোমার ছোটপুত্রকে তো সকাল থেকেই দেখলাম না।
তিনি দেশ উদ্ধারের কাজে বারুইপুর গিয়েছেন।
গুড।
.
হাসিতে খুশিতে ভরপুর হয়ে বীণা নটা বাজতে না বাজতেই ফিরে আসে।
ওকে দেখেই খুকু ছুটে আসে।
হারে ছোড়দি, কেমন পিকনিক হলো রে?
ওর কথা শুনে বীণা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারে না। একবার মুহূর্তের জন্যে মালতী দেবীর দিকে তাকিয়েই বলে, দারুণ হলো।
আমার পড়া হয়ে গেলে, সব গল্প বলবি। বুঝলি তো?
আচ্ছা, সে দেখা যাবে।
খুকু ভিতরের ঘরে চলে যেতেই বীণা মাকে দুহাত জড়িয়ে ধরে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ!
ন্যাকামি করিস না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বেশ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করেন, চন্দননগর কেমন লাগল?
খুব ভাল।
খেলি কোথায়?
যে ভদ্রলোকের কাছে রমেশদা গিয়েছিল, তাঁর বাড়িতেই খেলাম।
বীণা একটু থেমে বলে, ওঁরা দারুণ খাইয়েছেন।
ওখানে কী কী দেখলি?
ফরাসিদের তৈরি সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি-পার্ক আর গঙ্গার ধারের…
ও কথাটা শেষ করার আগেই মালতী দেবী জিজ্ঞেস করেন, রমেশ কোথায়?
দোকানে গেল।
আরো অনেক কথা, অনেক প্রশ্ন মনে এলেও মালতী দেবী আর কোন কথা না বলে রান্নাঘরে চলে যান।
.
এর ঠিক মাসখানেক পরের কথা।
দশটা বাজতে না বাজতেই রামপ্রসন্ন বাড়ি ফিরে আসতেই মালতী দেবী একটু চাপা হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে?
রামপ্রসন্নও চাপা হাসি হেসে জবাব দিলেন, তোমাকে একটু কাছে পাবার জন্য মনটা ছটফট করছিল বলে…
ঢং দেখে মরে যাই।
মালতী দেবী একটু কৌতুক মেশানো হাসি হেসে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি গঙ্গায় দাঁড়িয়ে শালগ্রাম শিলা মাথায় করেও যদি বল, আমার জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলে, তাও আমি বিশ্বাস করতে পারব না।
একটা সিঁড়ি টেনে নিয়ে রান্নাঘরের মধ্যেই স্ত্রীর সামনে বসেই রামপ্রসন্ন বলেন, আমাকে নিয়ে তোমার দুঃখের শেষ নেই, তা আমি জানি কিন্তু একটা কথা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে।
কী স্বীকার করতে হবে?
আমি লেখাপড়া শিখিনি, একটা থার্ড ক্লাশ চাকরি করি, রেস খেলে টাকা ওড়াই কিন্তু আমি চরিত্রহীন না।
আমি কি তাই বলেছি?
তোমার জন্য কি এনেছি, দেখেছ?
কী এনেছ?
ডান দিকে তাকিয়ে দেখো।
মালতী দেবী ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকিয়েই এক গাল হাসি হেসে বললেন, কী ব্যাপার? হঠাৎ দই নিয়ে এলে?
তুমি গাঙ্গুরামের দই ভালবাস না?
সে কথা তোমার মনে আছে?
মনে না থাকলে কি নিয়ে আসতাম?
হঠাৎ একটা খুশির ঝলকে মালতী দেবীর মন ভরে যায়।
দুএর মিনিট চুপ করে থাকার পর উনি স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি এখনই খাবে?
খুকুর খাওয়া হয়ে গেছে?
না; এখনও পড়ছে।
মেজখুকি কোথায়?
উপরে গেছে।
ও এলে সবাইকেই এক সঙ্গে খেতে দাও।
রামপ্রসন্ন রান্নাঘর থেকে বেরুতে না বেরুতেই খুকু রান্নাঘরে আসে।
মালতী দেবী জিজ্ঞেস করেন, পড়া হয়েছে?
হ্যাঁ।
তাহলে উপর থেকে ছোড়দিকে ডেকে আনতে।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, বলবি, বাবা এসে গেছে। আমরা সবাই এক সঙ্গে খেতে বসব।
বইপত্তর গুছিয়ে রেখে যাচ্ছি।
যাই হোক, খুকু উপরে উঠে দেখে, গুপ্তাজি আর সন্তোষের ঘরের দরজা বন্ধ। বারান্দাতে টিম টিম করে একটা আলো জ্বলছে। ডান দিকে ঘুরে দেখে, রমেশের ঘরের দরজায় মোটা পর্দা ঝুলছে। ও ঘরে টিউব ল্যাম্প জ্বলছে না। পর্দার তলা দিয়ে যেটুকু আলো আসছে, তা দেখে মনে হলো, শুধু টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে। খুকুর মনে হয়, রমেশদা বোধ হয় কোনো লেখাপড়ার কাজ করছে কিন্তু পর্দা সরিয়েই ও চমক ওঠে। লজ্জায় তাড়াতাড়ি একটু পিছিয়ে আসে। একবার মনে হয়, ছুটে নিচে চলে যায়। মাকে বলে, শিগগির দেখবে এসো, রমেশদা আর ছোড়দি কী কাণ্ড করছে।
কিন্তু না, খুকু তা পারে না। কিশোরী হলেও সে জানে, এসব কথা বাবা-মাকে বলতে নেই।
ওরা খুকুকে দেখতে না পেলেও খুকু পর্দাটা সামান্য একটু ফাঁক করে দেখে, রমেশদা ছোড়দিকে কোলে বসিয়ে আদর করছে; আর ছোড়দিও দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে আছে।
খুকু ওকে ডাকার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না।
কয়েক মুহূর্ত পর একটু সাহস করে একটু জোরেই বলে, এই ছোড়দি! বাবা এসে গেছে। মা…
ও কথাটা শেষ করার আগেই ওরা চমকে ওঠে। বীণা বোধহয় কাপড়-চোপড় ঠিক করার জন্যই এক লাফে বড় আলমারির ওপাশে চলে যায়।
রমেশও এক লাফে দরজার কাছে এসে খুকুর হাত ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়।
খুকু, প্লিজ কাউকে কিছু বলল না। তুমি যা চাইবে, আমি তাই দেব।
খুকু মুখ নিচু করে একটু হাসে। মুখে কিছু বলে না, বলতে পারে না।
রমেশ আবার বলে, কি খুকু, কাউকে কিছু বলবে না তো?
খুকু আগের মতোই মুখ নিচু করে কোনোমতে বলে, না।
রমেশ ওর দুটো হাত ধরে বলে, আমি জানতাম, তুমি আমার কথা রাখবে। আমি কালই তোমাকে একটা দারুণ প্রেজেনটেশন দেব।
খুকু ওর দিকে তাকিয়ে শুধু একটু হাসে।
সিঁড়ি দিয়ে দুএক ধাপ নামতেই বীণাও খুকুর দুহাত ধরে বলে, প্লিজ, কাউকে কিছু বলিস না। আমি সারাজীবন তোর গোলাম হয়ে থাকব।
বলেছি তো বলব না।
ওরা দুজনে রান্নাঘরে ঢুকতই মালতী দেবী বললেন, কীরে তোদের এত দেরি হলো?
খুকু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, রমেশদার সঙ্গে একটু কথা বলছিলাম।
.
অন্যদিন বীণা যখন শুতে আসে, তখন খুকু অঘোরে ঘুমোয়। আজ দুই বোনে একই সঙ্গে শুতে যায়।
বীণা ওর গলা জড়িয়ে শুতেই খুকু একটু হেসে ফিসফিস করে বলে, আজ হঠাৎ আমার গলা জড়িয়ে ধরলি যে!
তোকে আদর করতে ইচ্ছে করছে, তাই।
অন্যদিন তো আদর করিস না।
আমি রোজই তোর গলা জড়িয়ে শুই।
ইস! রোজ গলা জড়িয়ে শোয়!
খুকু মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, কেন মিথ্যে কথা বলছিস?
সত্যি কথাটা শেষ হবার আগেই খুকু জিজ্ঞেস করে, হারে ছোড়দি, তুই রমেশদাকে ভালবাসিস?
হ্যাঁ।
রমেশদাও তোকে ভালবাসে?
হ্যাঁ।
রমেশদা তোকে রোজ আদর করে?
না, না, রোজ না।
ইস! আবার মিথ্যে কথা বলছিস?
মা কালীর নামে বলছি, রোজ আদর করে না; তবে মাঝে মাঝে করে।
তুই নিশ্চয়ই রোজ রমেশদাকে আদর করিস?
বীণা কোনো মতে হাসি চেপে বলে, করলেও এক-আধ মিনিটের জন্য।
দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পর খুকু বলে, আচ্ছা ছোড়দি, রমেশদা যে তোকে ঐভাবে আদর করছিল বলে তোর লজ্জা করছিল না?
কীভাবে আদর করছিল?
ইস! আমি যেন দেখিনি।
বীণা একটু বিরক্ত হয়েই বলে, আর বকবক না করে এবার ঘুমোতে দে।
ঠিক আছে বকবক করব না কিন্তু তোরা দুজনেই বড় অসভ্য।
খুকু, পাকামি বন্ধ করবি?
তোরা অসভ্যতা করবি আর বললেই পাকামি হয়ে গেল, তাই না?
এবার বীণা রেগেই বলে, বেশ করেছি অসভ্যতা করেছি।
ও এক নিঃশ্বাসেই বলে যায়, যাকে বিয়ে করব, তার সঙ্গেই অসভ্যতা করেছি; কোনো রাস্তার ছেলের সঙ্গে তো…।
খুকু অবাক হয়ে বলে, তুই রমেশদাকে বিয়ে করবি?
হ্যাঁ, করব।
মাকে বলেছিস?
কখন কাকে বলব, তা নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না।
খুকু মাথা না ঘামালেও কিছুদিনের মধ্যে ওদের ব্যাপার নিয়ে সবাইকেই মাথা ঘামাতে হলো।
.
হঠাৎ গুপ্তাজির বড়ছেলে সুরেশ সস্ত্রীক এসে রামপ্রসন্ন আর মালতী দেবীকে নেমন্তন্ন করায় ওঁরা একটু অবাকই হলেন কিন্তু নেমন্তন্ন গ্রহণ না করে পারলেন না।
পরের রবিবার দুপুরে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের বাসায় রামপ্রসন্ন স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হতেই শুধু সুরেশ না, ওর বাবা-মাও ওঁদের অভ্যর্থনা করলেন।
গল্পগুজব খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ হবার পর স্বয়ং গুপ্তাজিই রামপ্রসন্ন আর মালতী দেবীকে বললেন, আপনাদের দুজনের সঙ্গেই জরুরি কথা বলার জন্য এখানে টেনে এনেছি।
ওঁর কথা শুনে রামপ্রসন্ন ঘাবড়ে গেলেও মুখে বলেন, হ্যাঁ, বলুন।
দেখুন মিত্তিরবাবু, আপনাদের বাঙ্গালি সমাজের মতো আমাদের সমাজ ঢিলেঢালা না। সমাজের নিয়ম মেনে না চললে আমাদের অনেক খেসারত দিতে হয়। তাই তো বীণার সঙ্গে রমেশের শাদি হলে আমার ভাতিজিদের বিয়ে-শাদি দিতে বহুত ঝামেলা হবে।
ঘরের পরিবেশ বেশ থমথমে হলেও রামপ্রসন্ন একটু হেসে বলেন, হাজার হোক আজকালকার ছেলেমেয়ে। যদি ওরা নিজেরাই বিয়ে করে, তাহলে…
গুপ্তাজি একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, তা করতে পারে কিন্তু তাহলে রমেশ আমার ব্যবসা বাণিজ্য টাকাকড়ির ফুটো পয়সাও পাবে না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, এই আমার বড়ছেলের সামনেই বলছি, ওরা দুভাই যতই ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশুনা করুক, ওরা কেউই মালিক না। যোল আনা মালিক আমি।
গুপ্তাজি একবার সুরেশের দিকে তাকিয়ে বলেন, তবে হ্যাঁ, ওরা সবাই ঠিকঠাকমতো চললে আমি ঠিক সময় তিন ছেলের মধ্যে সবকিছু বাঁটোয়ারা করে দেব।
রামপ্রসন্ন আর মালতী দেবী মুখ নিচু ওঁর কথা শোনেন। একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না।
শুনুন মিত্তিরবাবু, এবার আসল কথা বলি।
গুপ্তাজি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলে যান, চটপট আপনাকে বীণার শাদি দিতে হবে। আর সেজন্য আমি সব রকম সাহায্য করতে রাজি।
এতক্ষণ পর মালতী দেবী বললেন, দাদা, বললেই কি মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়?
গুপ্তাজি একটু হেসে বললেন, বহিনজি, মেয়ের বিয়ে দিতে হলে ছেলে দেখতে হবে, টাকাকড়ির ব্যবস্থা করতে হবে, তা কি আমি জানি না?
উনি একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলে যান, আমার অ্যাকাউন্টসবাবুর ছেলে আছে। বি. কম. পাশ করে রেল কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। আমি অ্যাকাউন্টসবাবুর সঙ্গে কথাও বলে রেখেছি। আমার পছন্দমতো মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে ওঁর কোনো আপত্তি নেই।…
মালতী দেবী জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ছেলেটিকে দেখেছেন?
হাজার বার দেখেছি।
সুরেশ বলল, ছেলেটিকে আমিও খুব ভাল করে চিনি। ছেলেটি বেশ ভদ্র-সভ্য।
গুপ্তাজি বললেন, মিত্তিরবাবু, যদি দেরি না করে ঐ ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন, তাহলে আমি বিয়ের খরচের জন্য দশ-পনের হাজার টাকা ব্যয় করতে পারি।
না, এইটুকু বলেই উনি থামলেন না। প্রায় এক নিঃশ্বাসেই বললেন, আর যদি আপনাদের আপত্তি থাকে, তাহলে সামনের রবিবারই আপনার বাড়ি আমি ছেড়ে দেব।
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত এই ছেলের সঙ্গেই বীণার বিয়ে হলো। কিন্তু মজার কথা, তার ঠিক এক সপ্তাহ আগে রমেশ বালিগঞ্জে তার ভাবী শ্বশুরের নতুন ফ্ল্যাটে চলে গেল।
.
০৮.
ইদানীং সময় সুযোগ পেলেই বড়বউ স্বামীকে বলেন, আচ্ছা, তুমি কি শুধু ব্যবসা বাণিজ্য নিয়েই মেতে থাকবে? মেয়েটা যে ধেই ধেই করে বড় হচ্ছে, তা কি দেখতে পাও না?
নরোত্তম মলিক একটু হেসে বলেন, ওরে বাপু, এখন আর সে যুগ নেই। পনের যোল বছরে মেয়ের বিয়ে দিলেও কেউ কিছু বলবে না।
এসব বিলেতফেরত জজ-ব্যারিস্টারের ঘরে হতে পারে। আমাদের সমাজে তা হয় না।
বড়বউ মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, মেয়েটা তের বছরে পা দিল। এখনই উঠে-পড়ে লাগলেও হয়তো চোদ্দ-পনের পার হয়ে যাবে।
নরোত্তম বড়বউ-এর একটা হাত ধরে একটু হেসে বলেন, আমার উপর বিশ্বাস রাখো; আমি ঠিক সময়েই তোমার মেয়ের বিয়ে দেব।
বিশ্বাস কেন রাখব না?
বড়বউ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, একটু দেখেশুনে ভাল ঘরে মেয়েটাকে না দেওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি পাব না।
বড়বউ ভুলে যেও না, নরোত্তম মল্লিকের মেয়েকে পেয়েও অনেক পরিবার ধন্য হয়ে যাবে।
উনি একটু থেমে বলেন, তাড়াহুড়ো করে যার-তার হাতে তো মেয়েটাকে তুলে দিতে পারি না।
মাঝে মাঝেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই ধরনের কথাবার্তা হয়।
হ্যাঁগো, আর দেরি করো না। মেয়েটার বিয়ে দেবার জন্য এবার একটু উঠে-পড়ে লাগো।
বড় বউ একবার নিঃশ্বাস নিয়েই আবার বলেন, মেয়েটা এমন সোমত্ত হয়ে উঠেছে যে….
ওঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই নরোত্তম বলেন, বড়বউ, ইতিমধ্যেই তিন-চারটে পাত্রের খবর পেয়েছি। খোঁজ-খবর নেবার জন্য লোকজনও লাগিয়েছি। দেখি, কী হয়।
বড়বউ এক গাল হাসি হেসে, কই, আমাকে তো কিচ্ছু বলোনি।
নরোত্তম মল্লিক একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, আগে জাল গুটিয়ে নিই। তারপর ঠিকই খবর পাবে।
.
দিন পনের পরই একদিন দুপুরের দিকে হঠাৎ জগদীশ ভট্টাচার্য প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে বড়বউকে বললেন, এখুনি খবর এলো, পাইকপাড়ার রায়বাড়ির বড়কর্তা আজ বিকেলেই তোমার মেয়েকে দেখতে আসবেন।
আজই?
হ্যাঁ।
জগদীশ ভট্টচাজ একটু থেমে বলেন, পাইকপাড়ার রায়রা অনেক জমিদারদের চাইতেও বেশি টাকাকড়ি, বিষয়-সম্পত্তির মালিক।
কেন? ওরা কীসের ব্যবসা করে?
ওরা জাহাজের ব্যবসা করে?
জাহাজের?
তবে কি এমনি বললাম, ওরা অনেক জমিদারদের চাইতেও…
তা ওঁরা কজন আসবেন?
বোধহয় পাঁচ-সাতজন।
বড় বউ মুহূর্তের জন্য একটু ভেবে-চিন্তে বলেন, ঠিক আছে। আমি এদিকে সব বিধিব্যবস্থা করছি কিন্তু আপনি বাগবাজার বা রামবাগান থেকে ভাল মিষ্টি আনার ব্যবস্থা করবেন।
মিষ্টির কথা আগেই বলে দিয়েছি। ওসব বিকেলের মধ্যেই এসে যাবে।
.
সন্ধের পরপরই পাইকপাড়ার রায়বাড়ির বড়কর্তা নিত্যানন্দ রায় সদলবলে এসে হাজির হন। আদর-আপ্যায়নের পর্ব শেষ হতেই নিত্যানন্দ রায় হাসতে হাসতে বলেন, মল্লিকমশাই, আপনার কন্যা দেখতে আসার জন্য যদি এইভাবে-আপ্যায়ন করেন, তাহলে বিয়ের দিন কী করবেন?
নরোত্তেম মল্লিক সলজ্জ হাসি হেসে বলেন, আজ্ঞে, আপনার সম্মান রাখার জন্য কী আর করতে পারলাম যে এভাবে বলে লজ্জা দিচ্ছেন।
মল্লিকমশাই, আপনি তো বড় বিনয়ী।
যাই হোক, মাধুরীলতাকে দেখে সবার সামনেই নিত্যানন্দ রায় বললেন, মল্লিকশই, আপনার মেয়ে তো সাক্ষাৎ মা দুর্গা।
উনি এক নিঃশ্বাসে বলে যান, আপনি আমার ছেলেকে দেখুন। যদি পছন্দ হয়, তাহলে যেদিন বলবেন, সেইদিনই আমি আমার মা দুর্গাকে বরণ করে ঘরে তুলব।
আপনার ছেলেকে আবার কী দেখব?
না, না, মল্লিকমশাই, ও কথা বলবেন না। যার হাতে এমন মা জননীকে তুলে দেবেন, তাকে দেখবেন না, তাই কখনো হয়?
দিন দশেক পর শুধু জগদীশ ভটচাজকে সঙ্গে নিয়ে নরোত্তম মল্লিক নিত্যানন্দ রায় এর কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীমান জগনারায়ণকে দেখে এসে বড়বউকে বললেন, তোমার জামাইকে দেখতে তো সাক্ষাৎ কার্তিক ঠাকুর।
বড়বউ এক গাল হাসি হেসে বলেন, দেখতে এত ভাল?
সত্যি বলছি, বড়বউ, এমন সুপুরুষ ছেলে হঠাৎ চোখে পড়ে না।
জগদীশ ভটচাজ দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বললেন, শুধু রূপের কথা কেন বলছ? ছেলেটার গুণের কথা বলল।
নরোত্তম বললেন, আমি বললেই মনে করবে বাড়াবাড়ি করছি। যা বলার আপনিই বলুন।
ভটচাজমশাই বললেন, আশু মুখুজ্যের মতো জাঁদরেল জজ যে বিশ্ববিদ্যালয় চালায়, সেখান থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রি পাওয়া কি ছেলেখেলার ব্যাপার?
বলেন কী ভটচাজমশাই?
তবে আর বলছি কী?
ভটচাজমশাই একটু থেমে বলেন, শ্রীমান আবার আইনের ডিগ্রি নেবে বলে ঠিক করেছে।
বড়বউ একটু হেসে বলেন, এত লেখাপড়া জানা জামাইয়ের সঙ্গে কীভাবে যে কথা বলব, তাই তো ভেবে পাচ্ছি না।
নরোত্তম বললেন, বুঝলে বড়বউ, একে রায় পরিবারের ছেলে, তার উপর এত পাশ করেছে কিন্তু এমন ভদ্র-সভ্য-বিনয়ী যে আমরা দুজনেই অবাক হয়ে গেছি।
.
যাই হোক, বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হবার পরই নরোত্তম মল্লিক জগদীশ ভটচাজকে বললেন, হাতে মাত্র আড়াই মাস সময়। বিয়ে-টিয়ে টিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ব্যবসা বণিজ্যের কোনো ব্যাপারেই আমি সময় দিতে পারবো না। সবকিছু আপনিই সামলাবেন।
জগদীশ ভটচাজ একটু হেসে বলেন, হাজার হোক আমি তোমার কর্মচারী। আমার উপর সব ছেড়ে দিলে হয়তো তোমার পরিবারের লোকজনই অসন্তুষ্ট হবে।
দেখুন ভটচাজমশাই, কে কোথায় সন্তুষ্ট-অসন্তুষ্ট হলো, তাতে নরোত্তম মল্লিকের কিছু যায়-আসে না। আপনি ছাড়া আর কাউকেই যে বিশ্বাস করি না, তা তো আপনি খুব ভাল করেই জানেন।
নরোত্তম একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, এখন বলুন, আমি মেয়ের বিয়েতে কত খরচ করতে পারি।
দশটি নয়, পাঁচটি নয়, তোমার একটিই মেয়ে। তারপর বিয়ে দিচ্ছো অমন বিখ্যাত পরিবারের অত গুণী ছেলের সঙ্গে।
ভটচাজমশাই একটু হেসে বলেন, তাছাড়া তোমার মতো ধনী ব্যবসায়ীই বা কলকাতায় কজন আছে। তাই টাকাকড়ি নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমরা। স্বামী-স্ত্রী মিলে যা চাইবে, তা নিশ্চয়ই হবে।
তবু আপনি একটু ভেবে দেখবেন, কত টাকা পর্যন্ত খরচ করলে ব্যবসাবাণিজ্য চালাতে অসুবিধে হবে না।
হ্যাঁ, দেখব।
আর হ্যাঁ, লিভারপুলের জাহাজ কবে এসে পৌঁছবে?
সামনের রবিবার; তবে মাল ছাড়াতে হবে মঙ্গলবার।
কত টাকার মাল আসছে?
মোটামুটি তিরিশ লাখ টাকার মাল আসছে। তবে মাল ছাড়াতে মাত্র লাখ দশেক লাগবে।
তার মানে কুড়ি লাখই আগে পাঠিয়ে দিয়েছেন?
এক পার্সেন্ট বেশি কমিশন পাওয়া যাবে বলে…
নরোত্তম হাসতে হাসতে বলেন, তার মানে তিন লাখের জায়গায় তিন লাখ তিরিশ হাজার আমরা পাচ্ছি?
হ্যাঁ।
উনি একটু থেমে একটু হেসে বলেন, তোমার মেয়ের বিয়ের আগে যে আরো তিনটে জাহাজে আমাদের যা মাল আসবে, তার থেকে মোটামুটি লাখখানেক অতিরিক্ত কমিশন পেয়ে যাবে।
বাঃ! দারুণ খবর শোনালেন।
তাই তো বলছিলাম, নিজের সম্মান প্রতিপত্তি অনুযায়ী বিয়ের ব্যবস্থা করো। টাকাকড়ির জন্য ভাবতে হবে না।
সেদিন রাত্রেই নরোত্তম বড়বউকে জিজ্ঞেস করলেন, বলল, মেয়ের বিয়েতে কী দিতে চাও, কী করতে চাও।
আমি আবার কী বলব? তুমি যা ভাল মনে করো, তাই করবে।
হাজার হোক আমাদের একটাই মেয়ে। তার বিয়েতে তোমার কী দিতে ইচ্ছে করছে। বা কি করতে চাও, তা তো বলবে।
আমি মেয়েটাকে গহনা দিয়ে ভরিয়ে দিতে চাই।
বোধহয় পরশু দিন বিকেলেই নাদুবাবু ডিজাইনের বই নিয়ে আসবেন। তোমার পছন্দমতো সব গহনাই উনি গড়িয়ে দেবেন।
হীরের গহনাগুলোর কথাও কি ওঁকে বলব? নাকি তোমাদের…
সব গহনার দায়িত্ব নাদুবাবুর। তবে উনি বলেছেন, হীরের গহনাগুলো বোম্বাই থেকে তৈরি করিয়ে আনবেন।
হ্যাঁ, আমিও তাই চাইছিলাম।
নরোত্তম একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, বড় বউ, আমি কি জানি না, এখানকার তৈরি হীরের গহনা তোমার ভাল লাগে না?
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তবে কাপড়-চোপড়ের জন্য তিন-চারজনকে বলে দেব। একজনের কাছে সব পছন্দমতো শাড়ি নাও পেতে পারো।
তবে কাঞ্জিলালবাবুকে আগে আসতে বলল।
হ্যাঁ, বলব।
বড়বউ একটু হেসে জিজ্ঞেস করেন তুমি জামাইকে কী দিচ্ছো?
নরোত্তম একটু গম্ভীর হয়েই বললেন, বিয়ের দানসামগ্রী হিসেবে যা দেওয়া উচিত তা নিশ্চয়ই দেব। তাছাড়া আর কী দেওয়া যায়, তাই ভাবছি।
আর কী দেওয়া যায় মানে?
এবার উনি মুখ তুলে বড়বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, হাজার হোক অত বড় বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি। ওরা যেন না ভাবে, আমার মেয়েটা কোনো আলতু-ফালতু পরিবার থেকে এসেছে।
বড়বউ চুপ করে থাকলেও নরোত্তম একটু পরে আবার বলেন, পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই ঠিক করব, কী দিলে ও বাড়িতে আমার মেয়েটার সম্মান থাকে।
পাঁচ-সাত দিন না, দিন পনের পর জগদীশ ভটচাজের সঙ্গে পরামর্শ করে নরোত্তম ঠিক করলেন, বেশ কয়েক বছর আগে মিসেস শিলটনের কাছ থেকে কেনা ধর্মতলার একটা বাড়ি মেয়ে-জামাইয়ের নামে দানপত্র লিখে দেবেন।
খবরটা বড়বউকে জানিয়ে নরোত্তম মুচকি হেসে বললেন, সম্প্রদান হয়ে যাবার পর মেয়ে-জামাই-এর হাতে এই দানপত্র তুলে দিলে ঐ জাহাজের কারবারি নিত্যানন্দ রায় পর্যন্ত হাঁ হয়ে যাবে।
কেন? বাড়িটা কি খুব বড়?
ধর্মতলার সাহেবপাড়ায় দেড় বিঘে জমির উপর তিনতলা বাড়ি। ওখানে এখন বোধহয় ঘণ্টায় ঘণ্টায় জমির দাম বাড়ছে।
তাই নাকি?
তবে কী?
নরোত্তম আবার একটু হেসে বলেন, বড়বউ, একদিন হয়তো কালীঘট-ভবানীপুরও আমাদের বাগবাজার-আহিরীটোলার মতো জমজমাট হবে। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর বছর পরে হয়তো বেহালা বা টালিগঞ্জের মতো গ্রাম-গঞ্জগুলোতেও হাজার হাজার পাকা বাড়ি উঠে। শহর হয়ে যাবে কিন্তু ধম্মতলা চিরকালই ধম্মতলা থাকবে।
বড়বউ চুপ করে ওঁর কথা শোনেন।
বুঝলে বড়বউ, তুমি বা আমি অনন্তকাল বেঁচে থাকব না। তবে আমি বলে দিচ্ছি, এই একটা সম্পত্তির জন্যই তোমার নাতিরা বা তার ছেলেরা তোমাকে আর আমাকে পুজো করবে।
এতক্ষণ পর বড়বউ একটু হেসে বলেন, কিন্তু তার আগেই যদি তোমার মেয়ে জামাই ঐ সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়?
নরোত্তম দুহাতের দুটো বুড়ো আঙুল ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, তা হবে না বড়বউ। সেসব রাস্তা বন্ধ না করে কি এই সম্পত্তি ওদের হাতে তুলে দেব? নরোত্তম। মল্লিক অত কাঁচা কাজ করার মতো পাত্র না।
সারা কলকাতায় তখন জাহাজরড়ির ছেলের সঙ্গে নরোত্তম মল্লিকের মেয়ের বিয়ের আলোচনা। এমনকি বেঙ্গল ক্লাবের আড্ডাখানায় পর্যন্ত সাহেবরা ঐ একই বিষয় নিয়ে কথাবার্তা না বলে পারেন না।
বেঙ্গল গভর্নমেন্টের হোম সেক্রেটারি মিঃ গোল্ডস্মিথকে দেখেই বেঙ্গল চেম্বারের প্রেসিডেন্ট স্যার আর্থার এগিয়ে গিয়ে একটু হেসে বললেন, হ্যালো গোল্ডস্মিথ, হঠাৎ একদিন পর ক্লাবে এলে কেন?
ইচ্ছে তো হয় রোজই ক্লাবে আসি কিন্তু রাইটার্স থেকে বেরিয়ে রোজই একবার গভর্নমেন্ট হাউসে যেতে হয়। তাই আর…
গভর্নর কী ক্যালকাটার বাইরে যে আজ ক্লাবে আসার সুযোগ পেলে?
ইতিমধ্যে ওঁদের চারপাশে আরো অনেকেই জড় হয়েছেন।
মিঃ গোল্ডস্মিথ হাসতে হাসতে বললেন, আজ ক্লাবে এসেছি ভেরি ফানি কারণে।
সবাই অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকাতেই হোম সেক্রেটারি বললেন, হিজ একসেলেনসিই আমাকে ক্লাবে পাঠালেন আপনার মতো দুএকজনের সঙ্গে কথা বলতে।
এনিথিং সিরিয়াস?
নো স্যার আর্থার, নাথিং সিরিয়াস…
তবে?
আজ গভর্নমেন্ট হাউসে যেতেই হিজ একসেলেনসি একটু হেসে বললেন, গোল্ডস্মিথ, তোমার মতো আমিও ক্যালকাটায় নতুন। তাই বেঙ্গলি অ্যারিস্টোক্র্যাট সোসাইটির সোস্যাল কাস্টমস জানি না। সো, গো টু ক্লাব, টক টু ও ক্যালকাটা হ্যাঁন্ড লাইক স্যার আর্থার। জিজ্ঞেস করবে, বেঙ্গলিদের বিয়েতে কী উপহার দেওয়া যায়।
স্যার আর্থার হুইস্কির গেলাসে একেটু চুমুক দিয়েই হাসতে হাসতে বললেন, গভর্নর কি রয়দের রিসেপসনে যাবেন? নাকি…
ইয়েস, ইয়েস, হি ইজ গোয়িং দেয়ার।
আর বেঙ্গল চেম্বারের আমরা প্রায় সবাই যাচ্ছি মিঃ মালিকের বাড়ি।
মাই গড!
মিঃ গোল্ডস্মিথ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, হু ইজ দিস মালিক?
ক্যালকাটার চার-পাঁচজন বিখ্যাত ব্যবসায়ীদের একজন।
আই সি।
গোল্ডস্মিথ সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, অ্যান্ড রয় ফ্যামিলি?
ওরা ইস্ট-ওয়েস্ট শিপিং কোম্পানীর মেজর শেয়ার হোল্ডার।
নাউ আই আন্ডারস্টান্ড হোয়াই হিজ একসেলেনসি উইল বি গোয়িং দেয়ার।
স্যার আর্থার হুইস্কির গেলাসে শেষ চুমুক দিয়ে বলেন, হোয়াইটওয়ে লেডলর মিঃ বল্ডউইনকে বললেই উনি গভর্নরের জন্য প্রোজেনটেশন পছন্দ করে পাঠিয়ে দেবেন। এর জন্য আপনাদের কিছু চিন্তা করতে হবে না।
মিঃ গোল্ডস্মিথ ওঁকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ভেরি গুড আইডিয়া।
সো ইউ আর নাউ ফ্রি টু এনজয় ড্রিঙ্কস?
অব কোর্স!
কৌন হ্যায়? জলডি হুইস্কি লে আও!
.
এধরনের বিয়ে বা উৎসব কলকাতায় বছর বছর হয় না। একমাত্র গভর্নরের পার্টি ছাড়া এ ধরনের ব্যবসার সুযোগও গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল বিশেষ পায় না। তাই তো গ্রেট ইস্টার্নের ম্যানেজার মিঃ ব্রেইলি দুতিনজন ভারতীয় সহকারীকে নিয়ে ছুটে এসেছিলেন নরোত্তম মল্লিকের বাড়ি।
ঘণ্টা দুয়েক ধরে আলাপ-আলোচনার পর নরোত্তম বললেন, মিঃ ব্রেইলি, আপনি বুঝতে পারছেন, কী ধরনের অতিথিরা আমার মেয়ের বিয়েতে আসছে?
স্যার, গভর্নরের পার্টিতে যাঁরা আমন্ত্রিত হন, তারা সবাইই আপনার মেয়ের বিয়েতে আসছেন।
তাই আমি আশা করি, আপনি বেস্ট ড্রিঙ্ক, বেস্ট ফুড, বেস্ট সার্ভিস দিয়ে ওঁদের যোল আনা খুশি করবেন।
স্যার, আমি কথা দিচ্ছি, গ্রেট ইস্টার্ন তার ঐতিহ্য ও আপনার মর্যাদা রক্ষা করতে ত্রুটি করবে না।
আর হ্যাঁ, আই আমার অফিস থেকে পঁচিশ হাজার টাকর একটা চেক নেবার ব্যবস্থা করবেন।
সরি স্যার! আপনার মতো বিখ্যাত ও সম্মানিত মানুষের কাছ থেকে এক পয়সাও অ্যাডভান্স নিতে পারব না। আমাকে মার্জনা করবেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
মেয়ের বিয়ে তো নয়, এ যেন অশ্বমেধ যজ্ঞ। নরোত্তম মল্লিকের প্রায় নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ নেই। শুধু উনি কেন, জগদীশ ভটচাজ থেকে শুরু করে ষাট-সত্তরজন কর্মচারীরও একমুহূর্ত ফুরসত নেই। থাকবে কী করে? একে জাহাজবাড়ির লোকজন। আত্মীয় বন্ধুদের কাছে পরিবারিক সম্মান, তার উপর গণ্যমান্য-বরেণ্য ইংরেজ অতিথিদের খুশি করে ভবিষ্যত ব্যবসা বাণিজ্যের পথ সুগম করা।
নরোত্তম কোনো দিক দিয়েই কোনো ত্রুটি রাখছে না। বিয়ের দান-সামগ্রী দেখে শুধু বড় বউ-এর না, সবারই চক্ষুস্থির হয়ে গেছে। আশেপাশের প্রতিবেশীরা বলছেন, কোনো বিয়ে বাড়িতে এত বড় ম্যারাপ বাঁধা হয়নি কোনোদিন। বিয়ের আসরে সানাই বাজাতে আসছেন কাশীর বিখ্যাত ওস্তাদ নাসিরুদ্দীন খাঁ সাহেব। বৌভাতের দিন লাটসাহেব জাহাজবাড়ি যাবেন বলে নিত্যানন্দ রায় কলকাতা পুলিশের ব্যান্ড পার্টির ব্যবস্থা করেছেন শুনেই নরোত্তম বেঙ্গল চেম্বারের প্রেসিডেন্ট স্যার আর্থারকে ধরে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে মিলিটারি ব্যান্ড পার্টি আনার ব্যবস্থা পাকা করেছেন। তবে হ্যাঁ, তার জন্য উনি হাসিমুখে সৈনিক কল্যাণ ফান্ডে দশ হাজার টাকা দান করেছেন।
কিন্তু বিয়ের মাত্র তিন দিন আগে যে ছোটবউ এমন অশান্তি করবেন, নরোত্তম তা স্বপ্নেও ভাবেননি।
সকালের ডাকে বিলেত থেকে বেশ কয়েকটি চিঠি এসেছে। তার মধ্যে দুতিনটে ব্যবসা বাণিজ্যের চিঠি; বাকি সবগুলোই মেয়ের বিয়ের ব্যপারে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অনেকে। প্রায় সব চিঠির সঙ্গেই শখানেক পাউন্ডের একটা করে চেক।
নিছক সৌজন্যের খাতিরে এদের আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছিল কিন্তু তারা যে এভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে চিঠি লিখবেন ও চেক পাঠাবেন, তা নরোত্তম স্বপ্নেও ভাবেননি।
যাই হোক, এই চিঠিগুলো পড়ার সময় কখন যে ছোটবউ এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন, তা উনি খেয়ালই করেননি।
বলি, তুমি কী ভেবেছ বলল তো?
হঠাৎ ছোটবউ-এর কথা শুনেই নরোত্তম মুখ তুলে তাকান।
দুনিয়ায় আর কি কেউ কোনোদিন মেয়ের বিয়ে দেয়নি? এভাবে হরির লুঠের মতো টাকা উড়িয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে তুমি কি আমার ছেলে দুটোকে পথের ভিখিরি করে দিতে চাও?
ছোটবউ-এর কথা শুনে নরোত্তমের গা জ্বলে যায়। তাই তো উনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেন, আঃ! কি আজেবাজে বকবক করছো?
হঠাৎ ছোটবউ হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলেত থেকে আসা চিঠিপত্র চেকগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিয়েই পাগলের মতো চিৎকার করে বললেন, এই মেয়ের বিয়েতে যত ব্যয় করছে, ঠিক তার ডবল টাকা আমার ছেলেদের বিয়ের জন্য এখনই দিতে হবে। তা না হলে….
না, নরোত্তম মল্লিক আর সহ্য করতে পারেননি। উনিও সঙ্গে সঙ্গে ছোটবউ-এর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ঘরের বাইরের দিকে পা বাড়িয়েই চিৎকার করে বললেন, হারামজাদি, বড্ড বেশি বেড়ে গেছিস। আমি কি তোর বাপের টাকা খরচ করছি যে তোকে জবাব দিতে হবে। আজ আমি তোকে দূর করে না দিয়ে জলগ্রহণ করব না।
ওঁর ঐ চিৎকার শুনে সারা বাড়ির লোকজন চমকে ওঠে। বিয়ে বাড়ির হাজার কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও সবাই কাজকর্ম থামিয়ে কর্তাবাবুর ঘরের দিকে এগিয়ে আসে।
নরোত্তম চিৎকার করে ওঠেন, এই গণেশ! এই হরিদাস! কোথায় গেলি তোরা?
হরিদাস ছুটতে ছুটতে বারান্দার কোনায় হাজির হয়ে কর্তাবাবুকে ছোট গিন্নিমার চুলের মুঠি ধরে লাথি মারতে মারতে কি যা তা গালাগালি দিতে দেখেই ভয়ে কাঁপতে থাকে।
হরিদাস হঠাৎ লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেই নরোত্তম গর্জে ওঠেন, এই হারামজাদা, পালাচ্ছিস কোথায়? মথুরা সিংকে এখুনি গাড়ি বের করতে বল। এই হারামজাদিকে এখুনি ওর চোদ্দ পুরুষের বাপের বাড়ি বিয়ে করতে হবে।
না, ছোটবউও চুপ করে থাকেন না। উনিও কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করেই বলেন, যেখানে খুশি পাঠাও কিন্তু আমি খালি হাতে যাবো না, যাব না, যাব না।
তুই যাবি না তোর বাপ যাবে।
নরোত্তম আবার একটা লাথি মেরে ছোট বউকে শাসান।
ছোটবউ কাঁদতে কাঁদতেই চিৎকার করেন, আমাকে মেরে ফেললেও আমি ছেলেদের পাওনা না নিয়ে যাব না যাব না…
ওরে হারামজাদি, আমি তোর চোদ্দ পুরুষের পাওনা মিটিয়ে দিচ্ছি।
দূর থেকে কর্মচারীরা এই দৃশ্য দেখলেও কেউ এগিয়ে আসতে সাহস করে না। এরই মধ্যে কে যেন খবর দেয় জগদীশ ভটচাজ আর বড় দাদাবাবু সুবলকে।
সুবল দৌড়ে এসে বাবার হাত টেনে ধরে বলে, কী করছেন আপনি? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে ছোট মা-কে এভাবে…
এই ডাইনীকে আর ছোট মা বলে ডাকতে হবে না। এই হারামজাদি সব্বনাশ করার জন্যই..
আঃ বাবা! চুপ করুন।
সুবলও চিৎকার করে ওঠে।
ইতিমধ্যে বুড়ো ভোলানাথের মন্দিরে পুজো দিয়ে বড়বউ এসে হাজির হতেই সুবল চিৎকার করেই বলে, মা, শিগগির ছোট মা-কে নিয়ে যাও।
বড়বউ অবাক হয়ে বলেন, কী ব্যাপার কী? তোর বাবা আর ছোট মার…
ওর কথাটা শেষ হবার আগেই নরোত্তম গর্জে ওঠেন, এই হারামজাদিকে এখনই ঝাটা মেরে দূর করে দাও।
ছোটবউও সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলেন, নিজে বেশ্যা মাগীদের জন্য দুহাতে টাকা ওড়াবেন, মেয়ের বিয়েতে লাখ লাখ খরচ করবেন আর আমার ছেলে দুটো কি রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াবে?
আমি সব সম্পত্তি দেবোত্তর করে দেব কিন্তু তোকে একটা তামার পয়সাও দেব না।
এবার বড়বউ চিৎকার করে ওঠেন, তোমরা দুজনে চুপ করবে নাকি আমি গলায় দড়ি দেব?
উনি মুহূর্তের জন্য না থেমেই সুলকে বলেন, বড় খোকা, তোর বাবাকে ঘরে নিয়ে যা।
সুবল ওর বাবাকে জোর করে ঘরের মধ্যে নিয়ে যাবার পর পরই বড়বউ কোনোমতে ছোট সতীনকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন।
.
ব্যাপারটা তখনকার মতো থেমে গেলেও সমস্যাটা যে মিটল না, তা সবাই বুঝলেন। এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে মাধুরীলতার বিয়ে নিয়ে যে আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তা আর রইল না। সমস্ত বাড়ির মানুষগুলোর মুখ থেকে হঠাৎ হাসি-খুশির ভাব হারিয়ে গেল।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মাধুরীলতার বিয়ে বেশ ভালভাবেই মিটে গেল। বিয়ের পরদিন সন্ধের সময় পুত্র আর পুত্রবধুকে নিয়ে যাবার আগে পাইকপাড়া জাহাজবাড়ির বড়কর্তা স্বয়ং নিত্যানন্দ রায় নরোত্তম মল্লিকের দুহাত ধরে বললেন, মকিমশাই, কি বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো, তা ভেবে পাচ্ছি না। তবে শুধু এইটুকু বলে যাই, কাশিমবাজার বা বর্ধমানের মতো দুচারজন রাজা-মহারাজারাও বোধহয় এভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারতেন না।
নরোত্তম সকিনয়ে একটু হেসে বলেন, কি যে বলেন বেয়াইমশাই, রাজা মহারাজাদের সঙ্গে কি আমার মতো চুনো-পুঁটি ব্যবসাদারের কোনো তুলনা হয়?
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আপনাদের সম্মান-মর্যাদা রাখার মতো তো কিছুই করতে পারলাম না।
না, না মল্লিকমশাই, ও কথা বলবেন না।
নিত্যানন্দ রায় হাসতে হাসতে বলে যান, আপনি মেয়ে-জামাইকে যে দান-সামগ্রী দিয়েছে, অতিথিদের আদর-আপ্যায়নের জন্য যে সুন্দর বিধিব্যবস্থা করেছিলেন, যে ধরনের গণ্যমান্য অতিথি সমাগম হয়েছিল, সেসব দেখে আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেছে। আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাবো, তা ভেবে পাচ্ছি না।
না, না, বেয়াইমশাই, ধন্যবাদ জানাবেন কেন? আমি তো আমার কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করেছি মাত্র।
নরোত্তম একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, আপনি বাবাজীবনের পিতৃদেব। যদি আপনি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তা হলেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।
একশবার আমি খুশি হয়েছি।
হঠাৎ কান্নার আওয়াজ শুনেই ওঁরা দুজনে আর কোনো কথা বলেন না।
নরোত্তম পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন, মাধুরীলতা আর বড়বউ দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছে। কাঁদছে আরো অনেকে। সুবল তো কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ভিতরেই চলে গেল।
ঐসব কান্নাকাটি দেখতে দেখতে নরোত্তম একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ মাধুরীলতাকে আবার খুব জোরে কেঁদে উঠতে শুনেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, ছোটবউ এর ছোট ছেলে সুশীলকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ও বলছে, ছোড়দা, আমি তোকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।
সুশীলও পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলছে, মাধু, তোকে ছেড়ে আমিও থাকতে পারবো না।
তবু গোধূলির আলো মিলিয়ে যেতে না যেতেই মাধুরীলতা স্বামীর সংসারে চলে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক বিচিত্র শূন্যতা ও নীরবতায় ডুবে যায় মল্লিকবাড়ি।
.
ক্লান্ত বিষণ্ণ নরোত্তম মল্লিক সদরের বৈঠকখানায় তাকিয়া হেলান দিয়ে চুপচাপ শুয়েছিলেন আর আকাশ-পাতাল ভাবছিলেন।
হঠাৎ বড়বউ পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, অনেক রাত হলো। ঘরে যাবে না?
ও! তুমি?
নরোত্তম ওঁকে দেখেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বড়বউ, মাধু চলে গেলেও মনটা খুশিতে ভরে গেছে।
অমন পরিবারের একটা ভাল ছেলের হাতে মেয়েকে দিতে পারলাম বলে আমিও খুব খুশি।
হ্যাঁ, বড়বউ, জগন্নারায়ণ ছেলেটি সত্যি ভাল।
সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বড়বউ একটু হেসে বলেন, ছেলেটার কথাবার্তা শুনে আমার বুক জুড়িয়ে গেছে।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, জামাই দেখে তো আত্মীয়-স্বজনের চক্ষুস্থির হয়ে গেছে।
কেন?
কেন আবার?
বড়বউ এক নিঃশ্বাসেই বলে যান, একে অমন বিখ্যাত বাড়ির ছেলে, তার উপর রূপে-গুণে এত ভাল জামাই যে আমাদের কপালে জুটবে, তা কেউ ভাবতেই পারেনি।
বড়বউ, তুমি বা আমিই কি ভাবতে পেরেছিলাম, মাধুকে এমন গুণী ছেলের হাতে তুলে দিতে পারব?
নরোত্তম মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সবই মা সিদ্ধেশ্বরীর কৃপা।
সে তো একশবার সত্যি। মার কৃপা না হলে কি এসব হয়?
তবে বড়বউ, আমি আরো একটা কারণে খুব খুশি।
বড়বউ একটু অবাক হয়েই বলেন, আবার কী কারণে খুশি?
নরোত্তম বেশ গম্ভীর হয়েই বলেন, মাধু চলে যাবার সময় মেজখোকা আর ছোট। খোকার কান্নাকাটি দেখে বুঝলাম, ছোটবউ চেষ্টা করলেই বোধহয় আমার সংসারটা ভাঙতে পারবে না।
বড়বউ একগাল খুশির হাসি হেসে বলেন, তুমি তো সংসারের কোনো খবরই রাখো না। তাই তো জানো না, এই এত বড় হলেও ছোটখোকাকে এখনও আমার ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়।
তাই নাকি?
তবে আর বলছি কি?
বড়বউ প্রায় না থেমেই বলে যান, আমি ওর গায়-মাথায় হাত না দিলে ওর ঘুমই আসে না। আর তাই নিয়ে মাধু ওকে কি ঠাট্টাই করতো!
সতের-আঠারো বছরের ছেলেরও গায়-মাথায় হাত না দিলে ঘুম আসে না?
বড়বউ চাপা হাসতে হাসতে বলেন, এই কবছর আগে পর্যন্ত তো তুমি ছোটবউকে কাছে না পেলে ঘুমুতে পারতে না। তাই তো মাধুর মতো ছোট খোকাও…
ছোটবউ কিছু বলতো না?
আবার বড়বউ চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলেন, ছোট তো তোমাকে ছাড়া ঘুমতো পারত না। তাই তো…
এবার নরোত্তম একটু হেসে বলেন, শুধু ছোটবউকে কেন দোষ দিচ্ছে কি? এর আগে তুমিও কি আমাকে ছাড়া ঘুমুতে পারতে?
স্বামীর কাছে শুতে কোন মেয়ের ইচ্ছে করে না?
বড়বউ স্বামীর একটা হাত ধরে সামান্য একটু টান দিয়ে বলেন, চল, চল, ভিতরে শোবে চল।
নরোত্তম উঠে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করেন, আজ কি তোমার কাছে পোব?
না, না, আমার কাছে শুতে হবে না।
উনি না থেমেই বলে যান, যাও, যাও, ছোটর ঘরে যাও। তুমি একটু আদর-টাদর করলেই ওর রাগ চলে যাবে।
.
পরের দিন সকালে স্বামী আর তিন ছেলেকে জলখাবার খেতে দিচ্ছিলেন বড়বউ। স্নান করে ছোটবউ সেখানে এসেই সবার সামনে বললেন, দিদি, মাধুর ফুলশয্যার তত্ত্ব আমি সাজাব। তুমি নাক গলাতে পারবে না।
বড়বউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি বলে যান, এমন সাজিয়ে-গুছিয়ে তত্ত্ব পাঠাব যে জাহাজবাড়ির কর্তা-গিন্নিদের মাথা ঘুরে যাবে।
বড়বউ আপনমনে একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুইই ও সব সাজাবি। আমি ওসব পারি নাকি?
এবার ছোটবউ হুকুম করেন, এই বড় খোকা, তত্ত্ব সাজাবার জন্য আজ বিকেলে আমাকে কিছু জিনিস এনে দিতে হবে।
সুবল মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, ছোট মা, এনে দেব।
নরোত্তম আর ছেলেরা খেয়েদেয়ে চলে যেতেই বড়বউ সতীনের গাল টিপে আদর করে একটু চাপা গলায় বলেন, কাল রাত্তিরে মলিকমশাই বোধহয় একটু বেশি আদর করেছে, বেশি আনন্দ দিয়েছেন, তাই না রে?
ছোটবউও হাসতে হাসতে বলেন, মল্লিকমশায়ের সোহাগ করার ধরন বুঝি তুমি জানো না, তাই না দিদি?
সে সব অল্প বয়সের কথা। এখন কি সেসব মনে আছে!
ইস! ভুলে গেছি!
ছোটবউ একটু থেমে একটু হেসে বলে, এসব কথা কি কেউ কোনোদিন ভুলে যায়?
বড়বউ দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলেন, যাই বল ছোট, মল্লিকমশাই বেশ রসিক লোক, তাই না রে?
ছোটবউ একগাল হাসি হেসে বলেন, লোকটা যেন দিন দিন আরো বেশি রসিক হচ্ছে।
কাল রাত্তিরে উনি যে একটু বেশি রসিকতা করেছেন, তা তোর চোখ-মুখ দেখেই বুঝেছি।
হাসতে হাসতে কথাটা বলেই বড়বউ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, দ্যাখ ছোট, তোকে একটা কথা বলি।
ছোটবউ ওঁর দিকে তাকাতেই উনি বলে যান, মল্লিকমশাই একটু আনন্দ-ফুর্তি করতে ভালবাসেন ঠিকই কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে, এই মানুষটা একা শুধু বুদ্ধির জোরে ব্যবসা বাণিজ্য এমন বাড়িয়েছেন যে বড় বড় সাহেবরা পর্যন্ত তাঁকে খাতির না করে পারে না।
সে তো ঠিকই।
তাই তো বলছি, আমরা দুজনের কেউই যেন এমন কিছু না করি, যাতে ওঁর ব্যবসা বাণিজ্য বা সম্মান নষ্ট হয়।
না, না, দিদি, আমি তা কখনই করবো না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আমার বৌদি আমার মন বিষিয়ে না দিলে সেদিনের মতো কেলেঙ্কারি কখনই…
সেদিনের কথা তুই ভুলে যা।
বড়বউ ওর দুটি হাত ধরে বলে যান, দ্যাখ ছোট, মল্লিকমশাই আর চারটে ছেলেমেয়ে নিয়েই তোর আর আমার সংসার। এই সংসারের ভাল-মন্দ নিয়েই তো আমাদের থাকতে হবে। আমাদের সংসারের ব্যাপারে বাইরের কাউকে নাক গলাতে দিলে কী তোর আর আমার সম্মান বাড়বে, নাকি তিনটে ছেলে সুখে থাকতে পারবে?
ছোটবউ দুহাত দিয়ে ওঁর গলা জড়িয়ে ধরে বলেন, দিদি, সত্যি বলছি, এই সংসার নিয়ে তোমার মতো আমি এত কিছু কোনোদিনই ভাবিনি। তাই তো দিনের পর দিন দাদা-বৌদির কথা শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল….
কী মনে হয়েছিল, তা আর তোকে বলতে হবে না।
বড়বউ একগাল হেসে ওকে বলেন, এবার থেকে তোর সব দুঃখের কথা আমাকে বলিস। তারপর আমি যদি তোর দুঃখ দুর করতে না পারি, তাহলে যাকে ইচ্ছে বলিস।
না, না, দিদি, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমাদের সংসারের ব্যাপারে বাইরের কারোর সঙ্গে আর কোনদিন কথা বলবো না।
এবার ছোটবউ একগাল হাসি হেসে বলেন, দিদি, তুমি বড্ড ভাল। আজ সারারাত ধরে তোমার গলা জড়িয়ে শুয়ে তোমাকে প্রাণভরে আদর করবো।
দূর হতভাগী।
বড়বউও হাসতে হাসতেই বলেন, অমন রসিক স্বামীকে ফেলে কোন দুঃখে আমার গলা জড়িয়ে শুবি?
.
মল্লিকবাড়ি আবার হাসি-খুশিতে ভরে উঠলেও নরোত্তমের মন থেকে সন্দেহের মেঘ দূর হয় না। হাজার হোক টাকা দেখতে গোল, থাকলে গোল, না থাকলেও গোল। তাইতো ভবিষ্যতে যে কোনো কেলেঙ্কারি ঘটবে না বা তার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংসার টুকরো টুকরো হয়ে যাবে না, তার কি কোনো ঠিকঠিকানা আছে?
নরোত্তম আপনমনেই বলেন, এত বছর ধরে পাগলের মতো পরিশ্রম করে যে বিষয় সম্পত্তি-টাকাকড়ি করেছি, তা নিয়ে ছেলেরা ছিনিমিনি খেলবে, সে আমি কখনই হতে দেব না।
কিন্তু ঠিক কী করা উচিত, তা ঠিক ভেবে পান না। তাছাড়া ভালভাবে ভাবনা-চিন্তা করার মতো অবকাশও ওঁর হয় না। তাইতো উনি মনে মনে ঠিক করেন, ব্যবসা বাণিজ্যের শত কাজ থাকলেও কয়েক দিনের জন্য বাইরে কোথাও যেতে হবে।
কয়েক দিন পর উনি জগদীশ ভটচাজমশাইকেই প্রথম বলেন, ভটচাজ মশায়, একটা বিশেষ জরুরি কাজে আমাকে কয়েক দিনের জন্য বাইরে যেতে হবে। তাছাড়া শরীরটাও বিশেষ সুবিধার নেই। তাই ভাবছি, বাইরে যখন যেতেই হবে, তখন দুচারদিন বিশ্রাম নিয়েই ফিরব।
তোমাকে তো কতদিন ধরেই বলছি, দিন কয়েক পুরী বা কাশী ঘুরে এসো, কিন্তু…
হ্যাঁ, আপনি অনেকবারই বলেছেন কিন্তু যখনই যাবো ভাবি, তখনই এমন সব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে কলকাতার বাইরে পা বাড়াতেই পারি না।
তুমি কতদিনের জন্য বাইরে যাবে?
স্যার আর্থারের অনুরোধে যাচ্ছি, তাই ঠিক বলতে পারছি না, কদিনের মধ্যে ফিরব।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, তবে দিন দশেকের বেশি লাগবে বলে মনে হয় না।
দিন দশেকের মধ্যে ফিরে এলে ঠিকই আছে কিন্তু তার বেশি হলে হয়তো এম্পায়ার টেক্সটাইলের কাপড়-চোপড়ের জাহাজটা এসে হাজির হবে। তখন তো তোমাকে…
ও জাহাজ কি রওনা হয়েছে?
দুএকদিন আগে হয়তো রওনা হয়েছে অথবা দুএকদিনের মধ্যেই রওনা হবে বলেই তো ওরা জানিয়েছিল। আশা করছি আজকালের মধ্যেই টেলিগ্রাফ এসে যাবে।
ও জাহাজ পৌঁছবার আগে আমি নিশ্চয়ই ফিরে আসব।
তাহলে তুমি নিশ্চিন্ত মনে যেতে পার।
পরের দিন সকালে জলখাবার খেতে খেতে নরোত্তম বড়বউ-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, জরুরি কাজে আমাকে কয়েক দিনের জন্য বাইরে যেতে হবে।
কয়েক দিন মানে?
ঠিক জানি না; তবে বোধহয় সাত-দশ দিন লেগে যাবে।
বড়বউ মুহূর্তের জন্য চাপা হাসি হেসে সতীনের দিকে তাকিয়েই বলেন, যাবে যাও কিন্তু ছোটকে সঙ্গে নিয়ে যাও। ও না থাকলে কে তোমার দেখাশুনা করবে?
আমি কি বেড়াতে যাচ্ছি যে ওকে সঙ্গে নিয়ে যাবো?
নরোত্তম না থেমেই বলে যান, আমি দুজন সাহেবের সঙ্গে জরুরি কাজে বাইরে যাচ্ছি।
বড়বউ এবার অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলেন, তা তো তুমি আগে বলেনি; তাই…
সেদিনই সন্ধে ঘুরতে না ঘুরতেই নরোত্তম সাবিত্রীর কাছে হাজির।
সাবিত্রী তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ওঁর একটা হাত ধরে বলল, এসো, এসো। দুতিন দিন ধরে শুধু তোমার কথাই ভাবছিলাম।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই নরোত্তম জিজ্ঞেস করেন, আমার কথা কেন ভাবছিলি? কোনো দরকার….
না গো না।
নরোত্তম ফরাসের উপর বসে তাকিয়ে হেলান দিতে না দিতেই সাবিত্রী ওঁর বুকের উপর লুটিয়ে পড়ে বলে যায়, ভাবছিলাম, মেয়ের বিয়ের ঝক্কি সামলাতে গিয়ে আবার শরীরটা খারাপ হলো না তো!
সত্যি কি ঝক্কি যে গেল, তা আর তোকে কি বলব! শরীরটা বড় কাহিল হয়ে গেছে।
নরোত্তমের মাথায় মুখে হাত দিতে দিতে সাবিত্রী বলে, সাধারণ মানুষই মেয়ের বিয়ে দিতে হিমশিম খেয়ে যায় আর তোমার মেয়ের বিয়েতে তো সারা কলকাতা শহর তোলপাড় হয়ে গেছে।
নরোত্তম একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বলেন, তুই ঠিকই বলেছিস। সত্যি মাধুর বিয়েতে সারা কলকাতা শহর তোলপাড় করে দিয়েছি।
সব সাহেবরা এসেছিল?
সব্বাই।
নরোত্তম একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, এমনকি বিলেত থেকে কত সাহেব চিঠি আর টাকা পাঠিয়েছে, তা তুই ভাবতে পারবি না।
সাবিত্রী দুহাত দিয়ে ওঁর গলা জড়িয়ে ধরে গদগদ হয়ে বলে, শালা সাহেবরা বেনের জাত। ওরা খুব ভাল করেই জানে, এখানে তোমার মতো মালদার পার্টি বিশেষ নেই। তাই….
তা ঠিক। তবে এবার কাজের কথা শোন।
না না, আজ কোনো কাজের কথা শুনতে চাই না। আজ শুধু প্রাণভরে তোমাকে আদর করবো।
এবার নরোত্তম ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেন, ওরে মাগী, তুই আর আমি প্রাণভরে ফুর্তি করব বলেই একটা প্ল্যান করেছি।
শুনি কী প্ল্যান করেছ।
চল, আমরা কোথাও বেড়াতে যাই।
কথাটা শুনেই সাবিত্রী আনন্দে খুশিতে ভরে ওঠে। বলে, সত্যি আমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে?
নরোত্তম অত্যন্ত বিষাদের সুরে বলেন, মাঝে-মাঝে দুএক ঘণ্টার জন্য তোকে কাছে পেয়ে কি মন ভরে? তাইতো ভাবছি, দিন কয়েকের জন্য তোকে নিয়ে বাইরে চলে যাই।
কোথায় যাবে? কাশী?
না না, কাশী বা পুরী যাব না। ও দুটো জায়গায় কলকাতার লোকজন যখন-তখন গিয়ে হাজির হয়।
তাহলে কোথায় যাবে?
তুই বল।
আম কী বলব? আমি কি কোথাও গেছি?
তুই কোথায় যেতে চাস? পাহাড়ে? জঙ্গলে? নাকি সমুদ্রের ধারে?
সাবিত্রী মুহূর্তের জন্য একটু ভেবে-চিন্তেই একগাল হাসি হেসে বলে, চল, চল, পাহাড়ে যাই। আমি কোনোদিন পাহাড় দেখিনি।
ঠিক আছে, তোকে পাহাড়েই নিয়ে যাব।
কবে আমরা যাব?
বেশি দেরি করব না। একটু বিধিব্যবস্থা করেই রওনা দেব।
নরোত্তম একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় স্বগতোক্তি করেন, আমার আর এখানে ভাল লাগছে না।
হ্যাঁ হ্যাঁ, চল। কদিন প্রাণভরে তোমাকে আদর-যত্ন সেবা করি।
চা-জলখাবারের বিধিব্যবস্থা করার জন্য উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সাবিত্রী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুধু টাকা রোজগার আর পরিবার প্রতিপালন ছাড়া কোনদিন নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তো নজর দিলে না।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই।
নরোত্তম মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বলেন, প্রায় নেশার ঘোরে বছরের পর বছর পাগলের মতো কাজ করে গেছি কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম নেবার দরকার।
যাই হোক, সেদিন বিদায় নেবার আগে নরোত্তম বলেন, তুই বাক্স-টাক্স গোছাতে শুরু কর।
বিছানাপত্র কি তুমি নেবে?
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, ওরে মাগী, বিছানাপত্র নিতে হবে না। জামাকাপড় ছাড়া সঙ্গে কিছু নিতে হবে না।
সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েক ধাপ নেমে যাবার পর উনি আবার উঠে এসে একটু চাপা গলায় বলেন, আমার কোথায় যাচ্ছি, তা যেন তোর কাজের লোকজনও না জানে।
না না, কেউ জানবে না।
.
নরোত্তম মল্লিক অসম্ভব হিসেবী কিন্তু কৃপণ না। বউ-ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে কর্মচারীরা পর্যন্ত বলতে পারবে না, উনি তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে রাখেন না বা তাদের প্রতি কর্তব্য করেন না। জগদীশ ভট্টচাজকে বলা আছে, যে কোনো কর্মচারীর ছেলেমেয়ের বিয়েতে আড়াই শ টাকা আশীর্বাদী পাঠাবেন। পুজোর সময় বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক কর্মচারীকেও একখানি করে ধুতি দেওয়ার রীতি ছিল। তবে হ্যাঁ, কাজকর্মের ব্যপারে পানের থেকে চুন খসলেই সর্বনাশ!
এইতো বছর তিনেক আগেকার কথা। প্রতি বছরের মতো সেবারও উনি দুই বউ আর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে মধুপুর গিয়েছেন। সঙ্গে জনা পাঁচেক কাজের লোক। ওদের মধ্যে মাখনের কাজ বাজার-হাট করা আর ফাঁইফরমায়েশ খাটা।
সকালবেলায় দুই বউয়ের সঙ্গে কথা বলে ভটচাজমশাই ফর্দ করে টাকাকড়ি দিয়ে মাখনকে বাজার পাঠাতেন। সকালে গোয়ালা বাড়ির সামনে গরু এনে দুধ দুইয়ে দিত কিন্তু বিকেলে মাখনই দুধ আনতে গোয়ালার ওখানে যেত।
সেদিন মাখন বাজার থেকে ফিরতেই নরোত্তম ওকে জিজ্ঞেস করলেন, ফর্দ মতো সব এনেছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
দেখি ফর্দটা।
মাখন ওঁর হাতে ফর্দ দিতেই মল্লিকমশাই চিৎকার করে বললেন, এই মদন দাঁড়িপাল্লাটা নিয়ে আয়।
মদন দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আসতেই মাখন হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নরোত্তমের দুটি পা জড়িয়ে ধরে বলে, কর্তাবাবু, জীবনে আর কখনো চুরি করব না। দয়া করে এবারের মতো ক্ষমা করে দেন; তা না হলে….
নরোত্তম মল্লিক এক লাথি মেরেই চিৎকার করে উঠলেন, হারামজাদা, আমি দুধ কলা দিয়ে এতকাল সাপ পুষেছি! তোকে আমি জেল খাঁটিয়ে তবে ছাড়ব।
উনি প্রায় এক নিঃশ্বাসেই বলেন, ভটচাজমশাই, এখনই থানায় খবর দিন।
হঠাৎ বড়বউ এগিয়ে এসে বললেন, আজ মেজখোকার জন্মদিন। আজ আর থানা পুলিশ করো না।
উনি একটু থেমে বলেন, এই মাখন, কর্তার পা ধরে ক্ষমা চা।
মাখন বার বার ক্ষমা চাইবার পর নরোত্তম বললেন, ঠিক আছে তোকে পুলিশে দেব না কিন্তু তুই তিন মাস মাইনে পাবি না।
.
যাই হোক নরোত্তম মল্লিক তার এক স্ত্রীকে নিয়ে দার্জিলিং-এ বিশ্রাম নিতে যাবেন বলে অনেক সাহেবই হাসিমুখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। ইন্টার ক্লাস–সেকেন্ড ক্লাস না, একেবারে ফার্স্ট ক্লাসে ওদের যাবার ব্যবস্থা হলো। রেল কোম্পানির চিফ এঞ্জিনিয়ার মিঃ হাওয়ার্ড স্বয়ং হুকুম দিলেন, মিঃ ও মিসেস মালিকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য দৃষ্টি রাখতে। বেঙ্গল চেম্বারের সাহায্যে দার্জিলিং-এ সরকারি ইন্সপেকশন বাংলোয় থাকারও বিধিব্যবস্থা হবার পর নরোত্তম মুখ টিপে হাসতে হাসতে সাবিত্রীকে বললেন, তুই বোধহয় দার্জিলিং থেকে আর ফিরে আসবি না।
ফিরে আসব না কেন?
ওরে মাগী, এত আরামে থাকবি যে আর এই বউবাজারে ফিরে আসতে মন চাইবে না।
সাবিত্রী চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, দার্জিলিং-এ গিয়ে কি আমি মহারানী হয়ে যাব, যে ঐ রাজত্ব ছেড়ে আর আসতে চাইব না?
আগে চল; তারপর বলিস।
.
হ্যাঁ, দার্জিলিং-এ পৌঁছে সাবিত্রী এক গাল হাসি হেসে বলেছিল, সত্যিকারের মহারানীরাও বোধহয় এত সুখে, এত আরামে থাকে না। মাত্র দুটো লোকের জন্য এতগুলো চাকর-বাকর! সত্যি ভাবা যায় না।
নরোত্তম চাপা হাসি হেসে বললেন, ওরে মাগী, তোর ভাল লাগছে কিনা, তাই বল।
সাবিত্রী দুপা এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে ওঁর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, দারুণ ভাল লাগছে। কলকাতায় আর কোনো মিনসে নেই, যে আমাকে এত সুখে রাখতে পারে।
প্রথম দুটো দিন শুধু খাওয়া-দাওয়ার সময় ছাড়া নরোত্তম সাবিত্রীর সঙ্গে শুধু রঙ্গরস আমোদ-ফুর্তি করেই কাটিয়ে দিলেন। পরের দিন থেকে একটু-আধটু ম্যালের দিকে বেড়াতে যাওয়া ছাড়া নরোত্তম বাংলো ছেড়ে বেরুতেন না। সাবিত্রীকে নিয়ে প্রাণভরে আনন্দ করার মাঝে মাঝেই নরোত্তম অপলক দৃষ্টিতে দূরের হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
দুএকদিন পরই সাবিত্রী জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁগো, তুমি যখন তখন কি এত ভাব বল তো?
না, না, তেমন কিছু না।
না বললেই আমি মেনে নেব? আমি কি তোমায় নতুন দেখছি?
সাবিত্রী প্রায় না থেমেই বলে যায়, তোমাকে এভাবে ভাবনা-চিন্তা করতে দেখলে কি আমার ভাল লাগে? তুমি ভাল না থাকলে যে আমিও ভাল থাকতে পারব না, তা কি বুঝতে পার না?
নরোত্তম এবার মুখ তুলে ওর দিকে তাকালেও মুখে কিছু বলেন না।
সাবিত্রী ওঁকে কোলের উপর শুইয়ে মাথায়-মুখে হাত দিতে দিতে বলে, আমি তোমার বিয়ে করা বউ না হলেও আমি যে তোমাকে ভালবাসি, তা কি তুমি বুঝতে পারো না, নাকি বিশ্বাস কর না?
আমি কি তাই বলেছি?
সাবিত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বেশ গম্ভীর হয়েই বলে, দ্যাখো মল্লিকমশাই, আমি সতী-সাবিত্রীনা। মুখের মিষ্টি বুলি আর এই শরীরটাকে খেলিয়েই তোমাদের মতো কামুক মানুষকে খুশি করে খেয়ে-পরে টিকে আছি। কিন্তু তাই বলে কি আমার মন বলে কিছু নেই?
হাজার হোক সাবিত্নী একজন বারবণিতা। ছলে-বলে কৌশলে পুরুষের দুর্বলতার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই ওদের মতো মেয়েরা জীবন কাটায়। আবেগ-ভালবাসায় ওরা কখনই নিজেদের জড়ায় না। কিন্তু আজ সাবিত্রীর কথা শুনে নরোত্তমের হঠাৎ মনে হয়, এই পৃথিবীর অন্যান্য মানুষের মতো সাবিত্রীও তো রক্ত-মাংসের মানুষ! তারও সুখ দুঃখ স্নেহ-প্রীতি-ভালবাসা থাকাই তো স্বাভাবিক। ভাগ্যের বিড়ম্বনায়, পেটের দায়ে বারবণিতা হয়েছে বলে কি সে কোনো না কোনো পুরুষকে ভালবাসতে পারে না?
নরোত্তম মুখে কিছু বললেন না। শুধু মুগ্ধ অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সাবিত্রী ওঁকে আদর করতে করতেই বলে, বল, তোমার কী হয়েছে! আমি তোমাকে সাহায্য করব।
ও একটু হেসে বলে, আমি তোমাদের মতো সংসারী না হলেও আমারও সাংসারিক বুদ্ধি আছে। ভাল-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা না থাকলে কি আজ তুমি আমার কোলে এভাবে শুয়ে থাকতে? নাকি মহারানীর মতো এত আরামে থাকতে পারতাম?
এবার আর নরোত্তম চুপ করে থাকেন না। মাধুরীলতার বিয়ের তিন দিন আগে ছোটবউ কি কেলেঙ্কারি করেছিল তা গড়গড় করে বলার পর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সেদিন থেকেই মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেছে।
কীসের ভয়?
এত বছর ধরে এত কষ্ট করে যে ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়-সম্পত্তি করেছি, তা রেখে যেতে পারব তো?
সাবিত্রী একটু হেসে বলে, কদাচিৎ কখনও সব সংসারেই এই ধরনের অশান্তি হয়, কিন্তু তাই বলে কি সব সংসারই ভেঙেচুরে ছারখার হয়ে যায়?
কিন্তু টাকাকড়ি বিষয়-সম্পত্তি বড় খারাপ জিনিস। সামান্য বিবাদ-বিসম্বাদ বা সন্দেহের জন্য চোখের সামনে কত বড় বড় পরিবারের সর্বনাশ দেখেছি বলেই ভয় হয়।
তা ঠিক।
একটু চুপ করে থাকার পর সাবিত্রী বলে, তিন ছেলেকে বিষয়-সম্পত্তি ভাগ করে দেবার কথা ভেবেছ কি?
না।
কেন?
বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য ভাগাভাগি করে দিলেই সাহেবরা ভাববে, আমরা ডুবতে বসেছি। তাই ওরা আর আমাদের বিশেষ পছন্দও করবে না, সাহায্যও করবে না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তাছাড়া আমার সব ব্যবসা থেকেই লাখ লাখ টাকা আয় হয়। সেই সব ব্যবসা ছেলেদের হাতে পড়লে কি ওরা মাথা ঠিক রাখতে পারবে?
সাবিত্রী মনে মনে কী যেন ভাবে। তারপর জিজ্ঞেস করে, তুমি কী চাও?
যতদিন আমার শরীর ঠিক থাকবে, ততদিন আমিই সবকিছু নিজের হাতে রাখতে চাই। তারপর অবস্থা বুঝে, ছেলেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেব।
তিন ছেলেকে সমানভাবে ভাগ করে দিতে চাও না?
চাই কিন্তু…
নরোত্তম কথাটা শেষ করেন না।
সাবিত্রী বলে, থামলে কেন? কথাটা শেষ কর।
নরোত্তম অসহায়ের মতো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, বড় ছেলেটাকে নিয়েই আমার ভয় হয়।
সাবিত্রী অবাক হয়ে বলে, ভয় হয় মানে!
ও প্রায় এক নিঃশ্বাসেই বলে, বড়বউ-এর ছেলেকে নিয়ে তো কোনো দুঃশ্চিন্তা হবার কথা নয়।
নরোত্তম একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, বড়বউ ভাল হলে কি হবে ও তো আমারই ঔরসে জন্মেছে।
তাতে কী হলো?
আমারই মতো ওরও মেয়েছেলের রোগে ধরেছে।
উনি প্রায় না থেমেই বলেন, তবে আমার এ রোগ ধরেছিল ব্যবসা বাণিজ্য করে টাকাকড়ি রোজগারের পর, আর ঐ হতভাগাকে….
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সাবিত্রী জিজ্ঞেস করে, বড় খোকার কত বয়স হলো।
এইতো কুড়িতে পড়ল।
ও কি এরই মধ্যে আমাদের মতো খারাপ মেয়েদের কাছে যেতে শুরু করেছে?
না, না। নরোত্তম একটু থেমে বলেন, সে সাহসও নেই, টাকাও নেই।
তবে?
সে এক কেলেঙ্কারির ব্যাপার।
বাড়ির কোনো ঝি-এর সঙ্গে…
না, না, ঝি-টি না।
তবে?
হতচ্ছাড়া ওর এক মাসির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।
মাসি? আপন মাসি?
না, না, আপন মাসি না; ছোটবউ-এর দূর সম্পর্কের এক মাসতুতো বোনের সঙ্গে…
ওদের বিয়ে দেওয়া যায় না?
মেয়েটা তো বিধবা।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, বিয়ের ছমাসের মধ্যেই বিধবা হয়ে মেয়েটা বাপের বাড়ি চলে আসে কিন্তু তাদের অবস্থা খারাপ বলে ছোটবউ তার এই বোনকে নিজের কাছে এনে রেখেছে।
মেয়েটার বয়স কত?
আঠারো, উনিশ বা কুড়ি হতে পারে। তবে মেয়েটা কি অসম্ভব সুন্দরী তা তুই ভাবতে পারকিনা।
একটু চুপ করে থাকার পর সাবিত্রী জিজ্ঞেস করে, তুমি ওদের ব্যাপারটা জানলে কী করে? বড়বউ বা ছোটবউ বলেছে?
না, না, ওরা দুজনের কেউই জানে না।
ওরা জানে না, অথচ তুমি জেনে গেলে?
ওদের না জানার কারণ আছে।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, পিছনের দিকে তিনতলার তিনখানা ঘর আমাদের তিনজনের।
মানে তোমার আর দুই বউয়ের?
হ্যাঁ।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, দোতলায় অনেকগুলো ঘর।…
অনেকগুলো ঘর?
হ্যাঁ; মানে বারান্দার দুপাশে তিনখানা করে ছখানা ঘর আছে।
ওগুলো কি ছেলেমেয়েদের ঘর?
হ্যাঁ।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আত্মীয়-স্বজনরা এলে ঐ দোতলার দুটো-একটা ঘরে থাকে।
যাই হোক এবার আসল কথা বল।
নরোত্তম বলেন, রাত্তির বেলায় শোবার সময় মাধু আর ছোটখোকা বরাবরই বড়বউ এর কাছে শোয়। তাই দোতালায় বড়খোকা-মেজখোকা ওদের ঘরে থাকতো।
সাবিত্রী মুখ টিপে হেসে বলে, আর তুমি বুঝি ছোটবউকে নিয়ে রাত কাটাও?
একজন কাছে না থাকলে যে ঘুম আসে না। বড়বউ আজকাল আসতে চায় না বলে বাধ্য হয়েই ছোটবউকে নিয়ে…
ন্যাকামি করো না।
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, আমার কথা বাদ দাও; এখন আসল কথা শোন।
হ্যাঁ বল।
ছোটবউ-এর ঐ বিধবা বোন দোতালার কোনার দিকের একটা ঘরে থাকে। একটু বেশি রাত হলেই বড়খোকা ওর ঘরে যায়।
তোমাকে কে বলল, বড়বউ? নাকি ছোটবউ?
না না; বললাম তো ওরা এসব কিছুই জানে না।
তাহলে কে তোমাকে এ খবর দিল?
আমাদের এক বুড়ি ঝি।
সাবিত্রী একটু ভেবে বলে, সে তোমার বউদের কাউকে না বলে হঠাৎ তোমাকে বলল কেন?
হয়তো বউরা জানলে ঝগড়া-ঝাটি হই-হুঁল্লোড় শুরু হয়ে যাবে ভেবেই…
ঐ ঝি-টা কী খুবই বিশ্বাসী?
হ্যাঁ, খুবই বিশ্বাসী। তাছাড়া ও অনেক বছর ধরে আমাদের সংসারে আছে বলে সব ছেলেমেয়েই ওকে বড়মাসি বলে ডাকে।
তা অত রাত্তিরে ঐ বুড়ি জেগে ছিল কেন?
অত-শত জানি না।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, একদিন চুপি চুপি ও আমাকে শুধু বলল, বড়খোকা একটু বেশি রাত্তিরে ছোটবউ-এর বোনের ঘরে যাতায়াত শুরু করেছে; তবে এ খবর আর কেউ জানে না।
বড়খোকা আর ঐ মেয়েটার হাবভাব-চালচলন দেখে কী মনে হচ্ছে?
আমি যতটুকু দেখি, তাতে তো ওদের মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখতে পাই না।
আগে থেকেই এত ভাবছ কেন? বুড়ি ঘুমের ঘোরে কী দেখতে কী দেখেছে, তা কে জানে!
দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পর নরোত্তম বলেন, কিন্তু বড়খোকা সম্পর্কে ও আজেবাজে কথা বলার লোক না। ঐ বুড়িই তো বড়খোকাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে।
অত যদি ভাবনা-চিন্তার কারণ হয়, তাহলে ঐ মেয়েটাকে সরিয়ে দাও।
না, না, সে অসম্ভব?
কেন?
একে মেয়েটি অসহায়, তার উপর ছোটবউ নিজে ওকে এনেছে।
উনি একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, তাছাড়া বড়বউ মেয়েটিকে নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসে। ওকে চলে যেতে বলা অসম্ভব।
একটু চুপ করে থাকার পর সাবিত্রী জিজ্ঞেস করে মেয়েটির নাম কী?
করুণা।
স্বভাব-চরিত্র?
বড়বউ তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
তুমি তো বল, তোমার ছেলেরাও খুব ভাল।
এখনো পর্যন্ত তো ওদের কারুর মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি।
নরোত্তম একটু থেমে বলে যান, বড়থোকা এনট্রান্স পাশ করার পর আর পড়াশুনো না করলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের যে কোনো কাজই করুক না কেন, তা বেশ ভালভাবেই করে। তাছাড়া ছেলেটা এত সাদাসিধে থাকে যে অপরিচিত লোকজনরা তো ওকে অনেক সময় আমার কর্মচারী মনে করে।
অন্য দুই ছেলে?
ওরা দুটোই লেখাপড়ায় বেশ ভাল।
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, মেজখোকা বুঝি মাঝে মাঝেই ওর মা আর বড় মাকে। বলে, বি.এ. পাশ করার পরই ও ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত চলে যাবে।
সাবিত্রী একটু হেসে বলে, ছেলেরা যখন এত ভাল, তখন তোমার ভাবনা কী?
তাছাড়া ছোটবউকে নিয়েও মাঝে মাঝে ভয় হয়।
ওকে নিয়ে আবার কী ভয়?
হয়তো আবার কোনোদিন বলবে, সম্পত্তি ভাগাভাগি করে দাও।
ও বললেই তুমি করবে কেন?
সাবিত্রী একটু থেমে বলে, আগে ছেলেরা উপযুক্ত হোক, তারপর যাকে যা দেবার নিশ্চয়ই দেবে। এখন ওদের হাতে বিষয়-সম্পত্তি টাকাকড়ি এলে কার কী মতিগতি হয়, তার কি ঠিকঠিকানা আছে!
ও প্রায় না থেমেই বলে, তবে মল্লিকমশাই, একটা কথা বলে দিই। বউবা ছেলেরা যেন তোমার বিষয়-সম্পত্তি বা টাকাকড়ির খুব বেশি খবর জানতে না পারে। ওদের মাথায় যদি ঢুকে যায়, তোমার অনেক টাকা আছে, তাহলে..
ঠিক বলেছিস। আমি সবকিছু বলে ফেলেই ভুল করি।
উনি একটু থেমে বললেন, তুই আজ যা বললি, সে কথা ভটচাজমশাই অনেক আগেই বলছিলেন, কিন্তু আমি শুনিনি। সত্যি, এখন থেকে একটু সাবধান হতে হবে।
তবে একটা কথা মনে রেখো, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ বাড়ি থেকে করলে বউ বা ছেলেরা সব জেনে যাবেই।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি দুএক মাসের মধ্যেই লালবাজারে অফিস খুলব। বাড়ি থেকে এত বড় ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ চালানো সত্যি খুব অসুবিধে।
সাবিত্রী একটু হেসে বলে, দেখ মল্লিকমশাই, আমি এই সাতাশ বছরের জীবনে যে পাঁচজন বাবুকে নিয়ে ঘর করলাম, তারা প্রত্যেকেই ব্যবসাদার, প্রত্যেকেই…।
নরোত্তম হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, আমি বুঝি তোর পাঁচ নম্বর বাবু?
হ্যাঁ।
আমার আগে তো সরকারবাড়ির বড়কর্তা তোর বাবু ছিলেন।…
হ্যাঁ।
তার আগে?
সে এক পাটের দালাল।
তার আগে?
সে এক জমিদারের ব্যাটা।
তোর প্রথম বাবু কে ছিলেন?
আমার জামাইবাবু।
নরোত্তম অবাক হয়ে বলেন, তোর জামাইবাবু?
হ্যাঁ। তোর নিজের জামাইবাবু?
হ্যাঁ নিজেরই মতন আর কি!
নিজেরই মতন মানে?
ও শালা আমার বড়জ্যাঠার ছোটজামাই ছিল।
সাবিত্রী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ঐ হারামজাদা আমাকে নিয়ে বছর খানেক ফুর্তি করার পর হাজার টাকা নিয়ে আমাকে ঐ জমিদারের ব্যাটার কাছে বিক্রি করে।
নরোত্তম চুপ করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন না।
সাবিত্রী বলে, আমার মতো হতভাগীর কথা শুনে কী হবে? যা বলতে চাইছিলাম, তাই শোন।
হ্যাঁ বল।
সাধারণ লোকের ধারণা, মদ আর মেয়েছেলের খপ্পরে পড়েই সবার সর্বনাশ হয়, কিন্তু তা কখনই হয় না। যারা লাখ লাখ টাকা রোজগার করে, তারা আমার মতো খারাপ মেয়েছেলের হাতে কখনই সব টাকা তুলে দেয় না বা লাখ টাকারই মদ খায় না, খেতে পারে না।
নরোত্তম মাথা নেড়ে বলেন, সে তো একশবার সত্যি!
মদ-মেয়েছেলের পিছনে তোমরা কত ব্যয় কর? বড় জোর দুপাঁচশ বা দুপাঁচ হাজার। তার বেশি কখনই নয়।
নরোত্তম মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।
. খেয়াল-খুশির জন্য এই টাকা ব্যয় করে তোমাদের মতো লক্ষপতিরা কখনই পথের ভিখারি হয় না।
সাবিত্রী একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়-সম্পত্তি নষ্ট হয় তোমাদেরই পারবারিক গণ্ডগোলে, আমাদের মতো মেয়েদের জন্য না।
খুব দামী কথা বলেছিস।
তাইতো বলছি, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো নিজের সংসারের দিকেও নজর দাও। বউ ছেলেমেয়েকে খুশি না রেখে কি ভালভাবে ব্যবসা করা যায়?
নরোত্তম অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলেন, তুহি বলছিস, বউ-ছেলেমেয়েকে খুশি রাখতে?
হ্যাঁ বলছি।
সাবিত্রী একটু থেমে একটু হেসে বলে, মল্লিকমশাই, তোমার মনে শান্তি না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে মন দেবে কী করে? আবার ব্যবসা-বাণিজ্য ভালভাবে না চললে আমাকে পুষবে কী করে?
নরোত্তম ওকে বুকের কাছে টেনে বলেন, মাগী, তুই তো দারুণ বুদ্ধিমতী মেয়ে।
সাবিত্রী উদাস দৃষ্টিতে দূরে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে খুব ধীরে-স্থিরভাবে বলে, মল্লিকমশাই, আগেকার বাবুদের শুধু শরীরটা দিয়েছি কিন্তু তোমাকেই প্রথম শরীর আর মন দুই-ই দিয়ে দিলাম। তাই তো তোমার কোনো ক্ষতি হলে আমি সইতে পারব না বলেই আজ তোমাকে এত কথা বললাম।
নরোত্তম মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন কিন্তু ঠিক যেন চিনতে পারেন না। না না, এ তো কামনা-লালসার প্রতিমূর্তি না; এ সাবিত্রী যেন দূরের চিরতুষারাবৃত হিমালয়ের মতোই স্নিগ্ধ, শান্ত, পবিত্র।
Khub sundar