মৌ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সামনের আরব সাগর; কখনও কখনও দৃষ্টি গুটিয়ে এনে দেখছিল, মেরিন ড্রাইভ দিয়ে অজস্র গাড়ির ছোটাছুটি। কখনো কখনো এইসব দৃশ্য বিভোর হয়ে দেখতে আপনমনে হাসে।
সত্যি কত সিনেমায় এই দৃশ্য দেখেছি! আর আজ? আমিই সেই দৃশ্যের মুখোমুখি।
হঠাৎ শান্ত পিছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, কী দেখছিস?
মেরিন ড্রাইভের ওপাশেই আরব সাগর, সত্যি ভাবা যায় না। সত্যি ওয়ান্ডারফুল!
আর যে জড়িয়ে ধরেছে?
সে তো আমার আনন্দের মহাসাগর।
আর কিছু না?
সে আমার হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা, আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই একান্ত আমার।
সত্যি?
এক শ’বার সত্যি।
আমাকে দেখবি না?
আমি ঘুমের মধ্যেও তোমাকে দেখতে পাই, তা জানো?
শান্ত আলত করে ওর হাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসে ওকে কোলে বসিয়ে বলে, এখানে এসে তোর কেমন লাগছে?
এই স্বপ্নই তো দেখছিলাম বেশ কিছু দিন ধরে।
মৌ মুহূর্তের জন্য থেমে আলতো করে ওর ঠোঁটে ঠোঁট চুঁইয়ে বলে, সত্যি বলছি, এখনো যেন মনে হচ্ছে, স্বপ্ন দেখছি।
আমিও তোকে ছেড়ে আর থাকব না।
শান্ত বুক ভরে একবার নিশ্বাস নিয়ে বলে, সেই ছোটবেলা থেকে তুই ছিলি আমার একমাত্র খেলার সাথী আবার আমি ছিলাম তোর একমাত্র বন্ধু আর খেলার সাথী।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই।
আবার একটু বড় হবার পর থেকেই দু’জনের চোখেই রঙীন নেশা, রঙীন স্বপ্ন, তাই না মৌ?
তুমি ঠিক বলেছ।
মৌ না থেমেই বলে, স্কুল-কলেজে যাবার পথে যেসব ছেলেরা ভাব জমাবার চেষ্টা করতো, তাদের দেখলেই কি রাগ হততা! তুমি ছাড়া আর কোন ছেলেই আমার মনে দাগ কাটতে পারলো না।
তারপর?
এম. এ. পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক’টা বছর পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই হতো কিন্তু এম.এ. পরীক্ষা শেষ হবার পর তোমার কথা ভাবতে গেলেই নানা দুঃশ্চিন্তার জন্য মন খারাপ হতো।
কী দুশ্চিন্তা?
কখনো মনে হতো, তুমি কী আমাকে ভুলে গেলে। আবার কখনো সন্দেহ হতো, আচ্ছা শান্তদা কি অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করেছে…
আমি তো ভাবিনি, তুই অন্য ছেলেকে বিয়ে করে বেশ ভাল আছিস।
এখন তুমি যাই বলল, ক’বছর তুমি আমাদের তিনজনকে খুবই দুঃশ্চিন্তার মধ্যে রেখেছিলে।
শান্ত একটু হেসে বলে, ঐ অধ্যায়টা বাদে এখন বল, গত সপ্তাহটা তোর কেমন কেটেছে?
মৌ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলে, দারুণ! ফ্যানটাস্টিক।
তাই নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ও সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করে, লাস্ট উইক তোমার কেমন কেটেছে?
সে আর কি বলব? একটা মডার্ন উর্বশী আমার এতদিনের ব্রহ্মচর্য ব্রত ভঙ্গ করে দিলো!
মৌ হাসতে হাসতে বলে, আহা হা! কি ভাল ছেলে রে!
সত্যি বলছি, যুবক-যুবতীদের লীলা খেলার বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না কিন্তু উর্বশীর উন্মত্ত যৌবন আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
মৌ ওর কোল থেকে নেমেই বলে, এখানে যতদিন থাকব, তুমি আমাকে স্পর্শ করবে না।
স্পর্শ করব না কিন্তু তোর প্রতি কর্তব্য পালন তো করব।
কর্তব্য? কিসের কর্তব্য?
তোর সব রকমের প্রয়োজন, চাহিদা, ইচ্ছা ইত্যাদি তো মিটাতে হবে।
মৌ হাসতে হাসতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, লিওপার্ড কান্ট চেঞ্জ ইট স্পটস্। নেকড়ের কালো কালো ছোপ কিছুতেই তুলে ফেলা যায় না, তাই না?
.
সেই কোন কালে যাযাবর লিখেছিলেন, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। কথাটি ষোল আনার উপরে আঠারো আনা সত্য। বিমান যাত্রায় দূর দূরান্তর পৌঁছনো যায় খুবই অল্প সময়ে কিন্তু আগে-পরে হ্যাপা কম নয়।
বারোটার প্লেন? এয়ারপোর্ট পৌঁছতে হবে পাক্কা দুঘন্টা আগে। তারপর? বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক নিয়মে সব বিমানযাত্রীই সন্দেহজনক। তাইতো সবাইকেই আত্মসমর্পণ করতে হবে দেশপ্রেমিক সিপাহীদের কাছে একাধিকবার।
অতঃপর?
যাও খোকা-খুকি বিমানে বসো।
বিজ্ঞান যে বেগ দিয়ে আবেগ কেড়ে নিয়েছে তার জ্বলন্ত জীবন্ত প্রমাণ পাবেন বিমান সেবিকাদের শুকনো প্রাণহীন সেবাযত্নে।
যাইহোক এইসব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে গন্তব্যে পৌঁছবার পরও মুক্তি নেই। তিন-চারশ’ যাত্রীর মালপত্তরের সঙ্গে লাইন দিয়ে আপনার সুটকেশ-ব্যাগটির জন্য হা-হুঁতাশ করে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে।
শুধু কী তাই?
মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, পরনে লুঙ্গি গেঞ্জি পরে স্বচ্ছন্দে বনগাঁ বা ব্যান্ডেল লোকালে যাতায়াত করা সম্ভব হলেও বিমান যাত্রায় আপনাকে সেজেগুজেই যেতে হবে; তারজন্য কী কম সময় লাগে?
তাই তো মৌ সত্যি ক্লান্তবোধ করছিল।
শান্তদা, সত্যি বড় টায়ার্ড লাগছে; তাছাড়া ঘুমও পাচ্ছে। আমি শুতে যাচ্ছি; প্লীজ তুমি ডিসটার্ব কোরো না।
না, না, ডিসটার্ব করব না; তুই শুতে যা।
মৌ বেডরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলে, তুমি একটু বিশ্রাম করবে না?
হ্যাঁ, করব একটু পরে।
পরে কেন এখনই এসো।
কয়েকটা টেলিফোন করেই আসছি।
বেশি দেরি কোরো না।
না, না, দেরি করব না।
মৌ শোয়র সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে।
শান্ত কর্ডলেস টেলিফোন হাতে নিয়েই টেলিফোন করতে শুরু করে।
.
বেশ কিছুক্ষণ ঘুমুবার পর মৌ-এর ঘুম পাতলা হয়েছে; ঠিক তখনই ওর কানে আবছা আবছা ভেসে আসে এক মহিলার সঙ্গে শান্তদার কথাবার্তা। ও একটু কান খাড়া করতেই বুঝতে পারে, হ্যাঁ, শান্তদা এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছে।
মৌ বিছানা থেকে নেমে ড্রইং-ডাইনিং রুমে পা দিয়েই একজন বয়স্কা মহিলাকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। মহিলাও ওকে একবার দেখেই শান্তকে বলে, ইনি কে?
শান্ত এক গাল হেসে বলে, আমার স্ত্রী।
মহিলা মৌ-কে একবার ভাল করে দেখেই এক গাল হেসে বলে, তোমার স্ত্রী তো দারুণ সুন্দরী।
মহিলা দৃষ্টি ঘুরিয়ে শান্তকে বলে, এবার কী কলকাতা গিয়েছিলে বিয়ে করতে?
না, না; আমাদের বিয়ে হয়েছে অনেক দিন আগে।
তাহলে ওকে এতদিন এখানে আনোনি কেন?
ও পড়াশুনা করছিল।
তাই বলে স্বামীর ঘর করবে না?
মহিলা মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, এতকাল ওকে না এনে খুব ভুল করেছ।
বাঈ, ও তো আবার কলকাতা ফিরে যাবে।
কেন? কেন?
ও তো কলেজে পড়ায়।
তুমি কী বউকে খেতে-পরতে দিতে পারবে না যে ওকে কলকাতার কলেজে চাকরি করতে হবে?
শান্ত গম্ভীর হয়ে বলে, ওর কোন ভাইবোন নেই; তাছাড়া মা-বাবার বয়স হয়েছে। তাই ও আর কিছুদিন কলকাতায় থাক; তারপর ওকে এখানে নিয়ে আসব।
এবার বাঈ মৌ-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শান্তর উদ্দেশে বলে এমন সুন্দরী বউকে ছেড়ে থাকো কী করে?
শান্ত একটু হেসে বলে, সত্যি বলছি, বাঈ, ওকে ছেড়ে থাকতে সত্যি খুব খারাপ লাগে। বাধ্য হয়েই ওকে কলকাতায় রেখেছি, তবে খুব বেশি দিন আর ওকে ওখানে ফেলে রাখব না।
শান্ত মৌ-এর পাশে দাঁড়িয়ে বলে, জানো বাঈ, একে কে পছন্দ করেন?
কে?
আমার মা।
মা-জী ঠিক মেয়েকেই পছন্দ করেছেন। আমি তোমার বউকে দেখেই বুঝেছি, ও খুব ভাল মেয়ে।
এবার শান্ত মৌ-কে বলে, বাঈ মা-র সময় থেকে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। মা ওকে সব রকম বাঙালী রান্না করতে শিখিয়েছেন।
মৌ একটু হেসে বলে, তাই নাকি?
শুধু তাই না। বাঙ্গ যেমন মশলা দোসা বানাতে পারে, সেইরকমই মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেনও খুব ভাল করে।
মৌ অবাক হয়ে বলে, বাঈ এত রকম রান্না জানে?
মা থাকতেই বাঈ সংসার চালায়। আলমারী থেকে টাকা নিয়ে ও বাজার-হাট করে, অন্য কাজের মেয়েটাকে খেতে দেয়, মাইনে দেয়…
এবার বাঈ মৌ-কে বলে, কী করব? মা-জীর শরীর ভাল ছিল না বলে আমাকেই সব সামলাতে হতো। তাছাড়া উনি আমাকে খুবই বিশ্বাস করতেন।
বাঈ না থেমেই বলে, মা-জী আমার ছোট মেয়ের বিয়েতে কি দিয়েছিলেন জানো?
কী দিয়েছিলেন?
নিজের একটা ভাল হার পালিশ করে আমার মেয়েকে দেন; তাছাড়া আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, মা ঐরকমই ছিলেন।
তোর স্বামীও কম কিছু করেনি।
ও কী করেছিল?
মেয়ের বিয়ের বেনারসী শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট আর জামাইয়ের জন্য গরদের ধুতি-কুর্তা, হাতের ঘড়ি সোনার আংটি আর কুর্তার জন্য সোনার বোতাম দিয়েছিল।
বাঈ না থেমেই একটু হেসে বলে, আমি ওকে এত করতে বারণ করেছিলাম কিন্তু ওর পাগলামীর তো নেই।
মৌ পাশে দাঁড়ানো শান্তকে একটা চিমটি কেটেই একটু হেসে বলে, এর পাগলামীর পরিচয় আমি খুব ভালভাবেই পেয়েছি।
তবে বিবিজি, তোমার স্বামী সত্যি খুব ভাল ছেলে।
বাঈ রান্নাবান্না করে চলে যাবার সময় মৌ-কে বলে, বিবিজি, টেবিলের উপর সবকিছু সাজিয়ে রেখেছি; তবে খাবার আগে একটু গরম করে নিও।
হ্যাঁ, নেব।
ভাল করে খাবে আর তোমার পাগলা স্বামীকেও ভাল করে খাওয়াবে।
মৌ হাসতে হাসতে বলে, ও খাবার আগে পাগলামী করবে না তো।
বাঈ গম্ভীর হয়ে বলে, তুমি সোজা বলে দেবে, আগে খেয়ে নাও, তারপর যা ইচ্ছে পাগলামী কোরো।
বাঈ আর দাঁড়ায় না; সেদিনের মতো চলে যায়।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে মৌ-কে জড়িয়ে ধরে বলে, শুনলে তো, বাঈ কী বলল?
বাঈ তো অনেক কথাই বলল।
সব শেষে বলল, খাওয়া-দাওয়ার পর যা ইচ্ছে পাগলামী করতে।
মৌ হাসতে হাসতে ওর পিঠে আলতো একটা ঘুষি মেরে বলে, যা ইচ্ছে পাগলামী করো কিন্তু আজ তুমি আমাকে টাচ্ করবে না।
টাচ্ করব না?
নো স্যার।
তাহলে তুমি আমাকে টাচ …
মাই ডিয়ার মি. সরকার, আই উইল অলসো নট টাচ্ ইউ।
শান্ত দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে বলে, মৌ, আজ তো আমাদের ফুলশয্যা; আজই তো প্রথম রাত যখন আমরা দু’জনে এক সঙ্গে…
মৌ হাসতে হাসতে বলে, আমাকে বাথরুমে যেতে দাও; গায় একটু জল ঢেলে আসি।
.
মৌ বাথরুম থেকে বেরিয়ে পোশাক বদলে চুল আঁচড়ে ফেস টাওয়েল দিয়ে আরেকবার মুখ পরিষ্কার করে। তারপর ড্রেসিং টেবিলের বিরাট আয়নার সামনে একটু ঘুরে-ফিরে নিজেকে দেখতে দেখতে একটু হাসে।
মৌ এ ঘরে-ও ঘরে উঁকি দিয়ে শান্তকে দেখতে না পেয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখে, ও বারান্দায় বসে আছে। একটু কাছে যেতেই বুঝতে পারে, শান্ত স্নান করার পর পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছে।
মৌ ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই শান্ত বলে, সন্ধের পর আলো জ্বললে মেরিন ড্রাইভ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, তাই না?
শান্তর একটা হাত দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে, সত্যি অপূর্ব।
আমাদের দেশে সমুদ্রের ধারে তো কত শহরই রয়েছে কিন্তু আর কোথাও এই অপরূপ দৃশ্য দেখা যাবে না।
.
আরব সাগরের কোল ঘেষে ধনুকের মতো বেঁকে গিয়েছে মেরিন ড্রাইভ; অন্যদিকে বাড়ির পর বাড়ি। রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি সবই আলোয় আলো। ’গোল্ডেন নেকলেস’ একেই বলে।
শুধু কী তাই?
সামনে আরব সাগরের অসংখ্য লঞ্চ আর নৌকায় আলো জ্বলে উঠেছে বলে যেন মনে হয়, অসংখ্য পুণ্যার্থী জলে ভাসিয়েছেন অসংখ্য প্রদীপ।
এই পরিবেশে ভাল লাগা, ভালবাসা জন্ম নেবেই। তাই তো সব বয়সেরই নারী-পুরুষ হাত ধরাধরি করে হাঁটছেন মেরিন ড্রাইভের ফুটপাথ ধরে।
এইসব দেখতে দেখতে মৌ যেন নিজেকে নিজের মধ্যে হারিয়ে ফেলে; খেয়ালই করেনি, কখন সে শান্তদার কোলে বসে দু হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে মুখের পর মুখ রেখেছে।
এই অনন্ত রহস্যময় পৃথিবীর কোন কোন পরিবেশে মানুষের মন সঙ্কুচিত হয়, আবার কোন কোন বিশেষ পরিবেশে মানুষ নিজেকে বিলিয়ে না দিয়ে তৃপ্তি পায় না। ঘটনাচক্রে আজ সেই বিশেষ পরিবেশের সোনাঝরা মুহূর্ত, যখন এই প্রাচীন পৃথিবীর নবীন দুই যাত্রী নিজেদের বিলিয়ে দেবার নেশায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। তারপর? একটা বিচিত্র পূর্ণতার স্বাদে শান্ত আর মৌ-এর মন ভরে ওঠে।
.
পরদিন অফিসে গিয়ে শান্ত ডাইরেক্টর মি. পাতিলকে বলে, স্যার, আমার একটা প্রস্তাব আছে।
ইয়েস টেল মী।
স্যার, আমি চাইছি, ডিস্ট্রিবিউটর-এজেন্টদের প্রতিনিয়ত চাপে রাখার জন্য একজন পার্টটাইম প্রোমেশন অফিসার রাখতে।
নট এ ব্যাড আইডিয়া কিন্তু এই অফিসারের মাইনে কত দিতে হবে? স্যার, আমরা ওকে মাইনে দেব না; শুধু ফিক্সড অ্যালাউন্স দেব আর ঘুরাঘুরির খরচ দেওয়া হবে।
কত অ্যালাউন্স দিতে চাও?
স্যার, প্রথম বছরের জন্য পনের হাজার টাকা; তারপর ওর কাজ দেখে পরের বছর কিছু বাড়িয়ে দেবেন।
এই কাজের জন্য কোন ছেলে বা মেয়েকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ, স্যার, সদ্য এম.এ পাস একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছে।
ও কোন এরিয়া দেখাশুনা করবে?
স্যার, গ্রেটার ক্যালকাটা; ফ্রম কল্যাণী টু ঠাকুরপুকুর।
এই মেয়েটি কাজ শুরু করলে তুমি ক্যালকাটা যাওয়া কমিয়ে দেবে না তো?
শান্ত একটু হেসে বলে, না, স্যার, আমাকে তো প্রত্যেক মাসেই দু’ এক সপ্তাহের জন্য ওদিকে যেতে হবে।
তাহলে ঠিক আছে।
স্যার, আপনি কী মেয়েটির ইন্টারভিউ নিতে চান?
আমি কী পার্ট-টাইমারের ইন্টারভিউ নিতে পারি?
মি. পাতিল মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলেন, মেয়েটি যখন তোমার আন্ডারে কাজ করবে, তুমিই ওকে ডেকে পাঠাও, দু’ এক সপ্তাহ ওকে ব্রীফ করো, তারপর ওকে নিয়ে কলকাতায় গিয়ে এজেন্ট-ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে পরিচয় করাবার পর ওকে বলে দাও, কীভাবে কাজ করবে—দ্যাটস্ অল।
স্যার, আপনি কী মি. ডি কস্টাকে বৃলেঞ্জবেন, মেয়েটিকে পার্ট-টাইমার হিসেবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিতে?
তুমি ওকে একটা নোট দাও যে আমার সঙ্গে আলোচনা করে সবকিছু ঠিক হয়েছে। আর হ্যাঁ, মেয়েটির সিকিউরিটির কথা ভেবে ও যেন সব সময় আমাদের ট্রান্সপোর্ট অপারেটরের গাড়িতে যাতায়াত করে; মেয়েটির সই করা পেপার্স পাঠালেই অপারেটরকে এখান থেকে চেক পাঠিয়ে দেবে।
স্যার, আর একটা কথা।
হ্যাঁ, বল।
মেয়েটিকে কী ট্রেনে আসতে বলব?
নেভার! একটা মেয়েকে একলা দু’তিন দিন ধরে ট্রেনে আসতে বলা যায়? ওকে আসা-যাওয়ার প্লেন ভাড়া দেবে আর আমাদের জুনিয়ার অফিসারদের রেটে ডেলি অ্যালাউন্স আর ডেলি দু’শ টাকা করে ট্রান্সপোর্ট…
স্যার, অশেষ ধন্যবাদ।
.
অফিসের পর শান্ত বাড়ি ফিরতেই মৌ এগিয়ে আসে।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, বল সুন্দরী, কোন পাড়ে ভিড়াব তোমার সোনার তরী?
মৌ হাসতে হাসতে বলে, কী হল? এত খোস মেজাজে?
আগে আমার ওষ্ঠে তোমার ওষ্ঠের বিষ ঢেলে দাও, তার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি হাতে একটা বিশেষ কিছু পাবে।
আগে হাতে কিছু পাই, তারপর পুরস্কারের কথা চিন্তা করব।
ঠিক হ্যায় মেমসাহাব! লিজিয়ে নাম্বার ওয়ান।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে ওর হাতে অ্যাপয়েন্ট লেটার তুলে দেয়।
চিঠিটার উপর দিয়ে চোখ বুলিয়েই মৌ খুশিতে চিৎকার করে ওঠে, ও মাই গড! তুমি তো দারুণ লোক।
মেমসাহাব, তোমার প্লেনে আসা-যাওয়ার খরচ এগার হাজার টাকা।
কী হচ্ছে কি?
মেমসাহাব, আমাদের কোম্পানীর নিয়ন্ট অনুযায়ী এখানে পনের দিন থাকার খরচ–দিন প্রতি পাঁচ শ’ পঁচাত্তর হিসেবে আটহাজার ছ’শ পঁচিশ টাকা।
শান্তদা, তুমি কী গৌরী সেনের কোম্পানীতে চাকরি করো?
মেমসাহাব, দৈনিক দুশ’ টাকা হিসেবে পনের দিন অফিস যাতায়াতের খরচ এই তিন হাজার।
শান্ত একটু হেসে বলে, ব্যস, দ্যাটস্ অল।
কী ব্যাপার বল তো? রাম না জন্মাতেই রামায়ণ?
মৌ না থেমেই বলে, কাজে যোগ দেবার আগেই তোমাদের কোম্পানী আমাকে এত টাকা দিল কেন?
ওহে সুন্দরী, ভুলে যেও না, ভারতের অন্যতম বিখ্যাত কোম্পানীর একজন হতে চলেছ তুমি; কোম্পানীর নিয়ম অনুসারেই তোমাকে টাকা দিয়েছে।
সত্যি অবাক হচ্ছি।
দু এক মিনিট চুপ করে থাকার পর মৌ এগার হাজার টাকা ওর হাতে দিয়ে বলে, তুমিই আমাকে প্লেনে এনেছ, আবার তুমিই আমাকে নিয়ে যাবে; এই টাকাটা তোমার।
এখন তুই টাকাটা রেখে দে; পরে নেব।
.
তিন দিন পরের কথা।
মৌ শান্তর সঙ্গে ওদের অফিসে পা দিয়েই অবাক। এত সুন্দর, এত ঝকঝকে; তাছাড়া প্রত্যেক কোনে সবুজের সমারোহ। দেয়ালে অপূর্ব পেন্টিং। সিকিউরিটি গার্ড, দ্বাররক্ষকদের স্যালুট। লিফট-এরূধ্যে সরোদের মৃদু আওয়াজ।
বারো তলায় লিফট্ থামল।
শান্তর পিছন পিছন মৌ ওর ঘরে পা দিয়েই বলে লাভলি!
সামনেই আরব সাগর আর সীমাহীন আকাশ। ওদিকে পিছন ফিরেই শান্ত বসে তার গদীওয়ালা বিরাট চেয়ারে। সামনে বিরাট টেবিল। একদিকে চার রঙের চারটে টেলিফোন। অন্যদিকে কমপিউটার। ঘরের এক কোনে ভারি সুন্দর কাঁচের গণেশ মূর্তি।
শান্ত চেয়ারে বসতে না বসতেই একজন বয়স্কা মহিলা ঘরে ঢুকেই একটু হেসে বলেন, স্যার, গুড মর্নিং!
ইয়েস দিদি, মর্নিং!
শান্ত সঙ্গে সঙ্গেই মৌ-কে দেখিয়ে ওকে বলেন, দিদি, দিস ইজ মহুয়া চৌধুরী…
নমস্কার! নমস্কার!
দু’জনের নমস্কার বিনিময়ের পর শান্ত বলেন, মহুয়া, দিদি হচ্ছেন মিসেস যশোদা যোশী, আমার সেক্রেটারী।
মিসেস যোশী হাসতে হাসতে মৌ-কে সুন্দর বাংলায় বলেন, স্যার ভারি বিচিত্র মানুষ। অফিসের সব সিনিয়র অফিসারদের সেক্রেটারীরা ইয়াং স্মার্ট সুন্দরী মেয়েরা কিন্তু ওদের কাউকে না রেখে…
মৌ এক গাল হেসে বলে, আপনি এত সুন্দর বাংলা শিখলেন কী করে? আমার বাবা রেলের অফিসার হিসেবে অনেক দিন কলকাতায় ছিলেন; আমি নব নালন্দা থেকে হায়ার সেকেন্ডারী পাস করেছি।
বুঝেছি।
আমি স্যারের সামান্য সেক্রেটারী কিন্তু উনি আমাকে দিদি বলেন বলে আমি খুব অস্বস্তিবোধ করি।
আপনি দিদির মতো বলেই উনি দিদি বলেন।
মৌ না থেমেই বলে, তাছাড়া আপনি কখনই সামান্য সেক্রেটারী না; সেক্রেটারীদের সাহায্য ছাড়া কী কোন অফিসার ঠিক ভাবে কাজ করতে পারবেন?
এবার শান্ত বলেন, দিদি, মহুয়ার ব্যাপারটা আপনি জানেন?
হ্যাঁ, স্যার, জানি কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে।
কী প্রশ্ন?
যে মেয়ে ইকনমিক্স নিয়ে এম.এ পাস করেছে তা সরাসরি অফিসার না করে কেন…
শান্ত একটু হেসে বলেন, বুঝেছি।
এক নিশ্বাসেই উনি বলেন, আপনি তো জানেন, আমাদের কোম্পানীতে অফিসার নিয়োগের ব্যাপারে কত রকমের নিয়ম-কানুন; তারপর ছ’মাসের ট্রেনিং। তাই…
হ্যাঁ, স্যার, বুঝেছি।
দিদি, আমি মহুয়াকে একবার মি. পাতিলের কাছে নিয়ে যেতে চাই; প্লীজ দেখুন তো উনি ফ্রী আছেন কি না।
হ্যাঁ, স্যার, দেখছি।
মিসেস যোশী নিজের ঘরে যান কিন্তু তিন-চার মিনিট পরই ফিরে এসে বলেন, হ্যাঁ, স্যার, আপনি এখনই যেতে পারেন।
.
শান্ত মহুয়াকে নিয়ে ডাইরেক্টর সাহেবের ঘরে ঢুকতেই মি. পাতিল এক গাল হেসে বলেন, শান্ত, সো দিস ইজ ইওর মহুয়া?
ইয়েস স্যার।
মি. পাতিল ওদের দুজনকেই বলেন, প্লীজ বসুন।
ওরা সামনের চেয়ারে বসতেই মি. পাতিল বলেন, মহুয়া, টেল মী ওয়ান থিং; আপনি কলেজের লেকচারার না হয়ে আমাদের কোম্পানীর কাজ করবেন কেন?
স্যার, একই সিলেবাস মতো বছরের পর বছর পড়াবার চাইতে একটু চালেনজিং কাজ করতে চাই।
রিয়েলী?
ইয়েস স্যার, আই মীন ইট।
ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু ভেবেছেন?
মৌ এক গাল হেসে বলে, স্যার, ইফ অল ইজ ওয়েল, তাহলে কোন কোম্পানীর ইকনমিক প্ল্যানিং বা ইকনমিক সার্ভে সম্পর্কে কাজ করতে চাই।
ইকনমিক প্ল্যানিং বা সার্ভের ব্যাপারে কী বলতে চান?
স্যার, যাস্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
হ্যাঁ, বলুন।
আমাদের দেশে এমন শহর আছে, যেখানে সব চাইতে কম দামী আইসক্রীম বিক্রি হয় নব্বই টাকায়, প্রত্যেকটি বাড়ির কাজের মেয়ের মোবাইল ফোন আছে আর লাখ দুয়েক টাকা সেলামী ছাড়া পঁচিশ হাজার টাকার কমে অত্যন্ত সাধারণ এলাকায় দু’ঘরের বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না, সেখানে কী এক টাকা বা দু টাকা দামের শ্যাম্পুর পাউচ বিক্রি করার প্ল্যান করা উচিত?
লাভলি।
মি. পাতিল সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বললেন, শান্ত, আপনি সত্যি একটা ভাল মেয়েকে সিলেক্ট করেছেন। এই মেয়েকে আমরা কখনই মাসে মাসে মাত্র পনের হাজার দিতে পারি না; উই মাস্ট পে হার অ্যাটলিস্ট টোয়েন্টি ফাঁইভ থাউজ্যান্ড…
মৌ সঙ্গে সঙ্গে বলে, স্যার, প্লীজ আগে দেখুন আমি কাজ করতে পারি কিনা; তারপর না হয়..
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মি. পাতিল বলেন, আজ আমি বলে দিচ্ছি, ভবিষ্যতে আপনি হয়তো আমাদের কোম্পানীর ডাইরেক্টর হবেন।
.
বাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই শান্ত মৌ-কে কোলে তুলে নিয়ে দু’চার পাক চক্কর দিয়েই দু’হাত দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে দীর্ঘ চুম্বন দেয়।
মৌ শুধু হাসে।
তোর কথা শুনে মি. পাতিল প্রায় হিপনোটাইজড হয়েছিলেন।
মৌ দু’হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, সবই তো তোমার জন্য; দেখছি, তুমি আমার পরশ পাথর। তোমার ছোঁয়াতেই সব সোনা হয়ে যাচ্ছে।
আসলে তুই হচ্ছিস, সোনার টুকরো মেয়ে; এবার থেকে তুই শুধু এগিয়ে যাবি।
তুমি কী জ্যোতিষ যে এই কথা বলছ?
জ্যোতিষ কেন হব? তুই দেখিস, আমার কথা বর্ণে বর্ণে ফলতে বাধ্য।
মৌ ওর দুটো হাত ধরে বলে, শান্তদা, আমি তোমার পিছনে থাকতে পারলেই সুখী হব।
একটু পরই ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে বাঈ আসতেই মৌ জিজ্ঞেস করে, ব্যাগে কী আছে?
তোমাদের সংসারের জিনিসপত্র নিয়ে এলাম।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, বাঈ, ভুলে যেও না, আমার মা এই সংসারের ভার তোমার হাতে তুলে দিয়েছেন; এই সংসার তোমার।
এখন তোমার বউ এসেছে; এখন এই সংসার সে চালাবে।
মৌ বলে, বাঈ, আমি কখনই সংসার চালাতে পারব না; তুমি যেমন সংসার চালাচ্ছো সেইরকমই চালাবে।
আমার বয়স হচ্ছে না?
তুমি এখনো একশ’ বছর বাঁচবে।
কথাটা বলেই শান্ত হো হো করে হেসে ওঠে।
বাঈ একটু হেসে মৌ-কে বলে, বউ, এবার তোমার স্বামী আমার হাতে মার খাবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাঈ, তুমি সত্যি ওকে মারো তো; ওকে শাসন করা খুবই দরকার।
বাঈ আর কথা না বাড়িয়ে হাসতে হাসতে কিচেনের দিকে যায়।
মৌ আর শান্তও ওদের ঘরের দিকে যায়।
তারপর ওরা বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পোশাক বদলে ঘর থেকে বেরুতেই বাঈ বলে, তোমাদের খেতে দিয়েছি; গরম গরম খেয়ে নাও।
কী খেতে দিয়েছ?
বউ, তোমার স্বামী একই খাবার পর পর দুদিন খায় না; সাহেবের সবকিছু নিত্য নতুন চাই। তাই তো আজ দিয়েছি মোগলাই পরোটা।
মৌ হাসতে হাসতে বলে, ও আবার আমাকে বাতিল করে নতুন বউ আনবে না তো?
ও বহু ভাগ্য করে তোমার মতো বউ পেয়েছে, দেখব তো ওর কত বড় সাহস, তোমার বদলে নতুন বউ আনে।
.
ঘণ্টা বারো ডিউটি করে ক্লান্ত অবসন্ন অর্কদের বিশ্রাম করতে গিয়েছেন অনেক আগেই। আরব সাগরের আকাশে শুক্লা পঞ্চমীর এক টুকরো চাঁদ। চির চঞ্চলা মেরিন ড্রাইভ যেন পরমা সুন্দরী বাঈজীর মতো ঘাঘরা-চোলি
পরে গলায় এক গোছ মুক্তোর মালা জড়িয়ে নাচতে শুরু করেছে।
মেরিন ড্রাইভ সত্যি যেন মায়াবিনী উর্বশী-রম্ভা।
শান্তর কাঁধে মাথা রেখে মৌ বলে, তোমাদের এই মেরিন ড্রাইভে কি যেন রহস্য আছে; মনের মধ্যে কেমন যেন নেশা ধরে যায়।
হ্যাঁ, সত্যি বড় রোমান্টিক পরিবেশ; তাছাড়া এই সময় বারান্দায় বসে চারদিক দেখতে দেখতে সমস্ত পৃথিবীকেই ভালবাসতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, শান্তদা, ঠিক বলেছ।
.
দু’ এক মিনিট চুপ করে থাকার পর শান্ত আলতো করে মৌ-কে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে বলে, মা যখন বেশ অসুস্থ, তখনও এইরকম সন্ধের পর আমি মাকে বারান্দায় বসিয়ে বলতাম, মা, চারপাশ তাকিয়ে দেখো, পৃথিবী কি সুন্দর।…
ক্ষীণ কণ্ঠে মনিকা দেবী বলেন, হ্যাঁ, বাবা, সত্যি খুব সুন্দর।
মা, আমাদের সবার সৌভাগ্য যে আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে জন্মেছি, তাই না?
উনি শুধু একটু মাথা নাড়েন।
মা, আমরা সবাই অনেক অনেক দিন এই পৃথিবীতে থাকব, ভালভাবে থাকব, তাই না?
আবার সেই ক্ষীণ কণ্ঠে উনি বলেন, হ্যাঁ, সবাই ভাল থাকুক।
তুমিও ভাল থাকবে?
মনিকা দেবী খুব আস্তে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমার তো উপর থেকে ডাক এসে গেছে…
.
জানিস মৌ, ঠিক পরের দিনই মা চলে গেলেন।
কথাটা বলেই শান্ত কেঁদে ওঠে।
মৌ ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, কত ছোট ছোট বাচ্চারাও তো মা-কে হারায়; তোমার ভাগ্য ভাল বলে এত বছর ধরে মায়ের আদর ভালবাসা পেয়েছ। তাছাড়া কারুর মা-বাবাই তো চিরকাল বেঁচে থাকেন না।
শান্ত কোন কথা বলে না।
মৌ আবার বলে, তুমি কী জানো না, আমরা কেউই অমর না; আমাদের সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শান্ত বলে, মা চলে যাবার পর এই ফ্ল্যাটে আমি কিছুতেই একলা থাকতে পারছিলাম না। রাতের পর রাত আমি পায়চারি করে কাটিয়েছি।
ও না থেমেই মৌ-এর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তারপর কী করলাম জানিস?
কী করলে?
রোজ ড্রিঙ্ক করা শুরু করলাম।…
তুমি ড্রিঙ্ক করো?
শুধু অফিসের পার্টিতে করি; তাছাড়া কদাচিৎ কখনও…
মা মারা যাবার পর তুমি একলা একলাই ড্রিঙ্ক করতে?
হ্যাঁ। তারপর শান্ত মৃদু হসে বলে, আকণ্ঠ হুইস্কী গিলে নেশার ঘোরে বিছানায় লুটিয়ে পড়তাম।
তখন কলকাতায় আমাদের কাছে আসার কথা মনে হয়নি?
বার বার মনে হয়েছে, ভাল মা-র কাছে ছুটে যাই কিন্তু ঠিক তখনই আমাকে ক’মাসের জন্য চিফ মার্কেটিং ম্যানেজারের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হল বলে…
বুঝেছি।
কথায় কথায় রাত হয়। তারপর খেয়েদেয়ে ওরা শুতে যায়। মৌ ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শান্তও শান্তিতে ঘুমুতে দেরি করে না।
.
দুটো সপ্তাহ দেখতে দেখতে কেটে গেল।
সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠা, তারপর দু’এক কাপ চা খেতে খেতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার পাতাগুলো একটু উল্টে দেখা…হাতের ঘড়িতে পৌনে আটটা দেখেই চল বাথরুম। প্রথম পাঁচ-দশ মিনিট শাওয়ারের তলায়, তারপর ভালভাবে সাবান মাখা…
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের লম্বা আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে সাজগোজ, চুল আঁচড়ানো, আলতো করে খোঁপা বাঁধা।
ততক্ষণে শান্তও টাইয়ের নট বাঁধতে বাঁধতে ডাইনিং টেবিলে হাজির; পাশের চেয়ারে বসে মৌ। বাঈ ব্রেকফাস্ট দেয়।
তারপর আবার মৌ ড্রেসিং টেবিলের লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আঁচল ঠিক করে, ফেস টাওয়েল দিয়ে মুখ পরিষ্কার করার পর ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিক বুলিয়ে নেয় ঠোঁটে।
মৌ, আয়াম রেডি।
সো অ্যাম আই।
এর পর অফিস।
শান্ত ওর চেম্বারে যায়, মৌ যায় ট্রেনিং অ্যান্ড ব্রিফিং রুমে।
দিনের শেষে আবার মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে।
সন্ধের পর ব্যালকনিতে দু’জনে পাশাপাশি বসে আরব সাগর আর মেরিন ড্রাইভের মায়াবী পরিবেশে কত মনের কথা বলে।
রাত আরো গম্ভীর হয়।
দু’জনে দু’জনের নিবিড় সান্নিধ্যে চির রহস্যময় আনন্দ-সাগরে ভেসে যায়।
.
০৮.
শান্ত মৌ-কে নিয়ে কলকাতা আসে কিন্তু একটা রাতও এখানে কাটায় না। ভাল কাকা ভাল মা-র সঙ্গে দু’এক ঘণ্টা কথাবার্তা বলেই আবার এয়ারপোর্ট যায় গুয়াহাটির প্লেন ধরতে।
শান্ত রওনা হবার আগে মৌ জিজ্ঞেস করে, তুমি কী বোম্বে ফেরার পথে দু একদিন এখানে থাকবে?
ঠিক বলতে পারছি না। আমাকে নর্থ ইস্টের সাতটা রাজ্যেই যেতে হবে। যদি চট পট কাজকর্ম শেষ হয়, তাহলে হয়তো এখানে এক-আধদিন কাটাতে পারি; তা না হলে গুয়াহাটি থেকে সোজা বোম্বে যেতে হবে।
শান্ত প্রায় না থেমেই বলে, তুই সোমবার থেকে কাজকর্ম শুরু করে দে; দিদি খুব রেগুলারলি তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।
হ্যাঁ, দিদি বলেছেন।
মৌ সারাদিন ধরে মা-বাবাকে বোম্বের গল্প করে; বিশেষ করে ‘দিদি’ আর ‘বাঈ’-এর কথা শুনে ওরা খুব খুশি হন।
জানো মা, তোমরা ভাবতে পারবে না, মেরিন ড্রাইভের উপর শান্তদার ফ্ল্যাটটা কি সুন্দর আর কত বড়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ মা; তিনটে বিরাট বিরাট বেডরুম ছাড়াও একটা ভারি সুন্দর গেস্টরুম। প্রত্যেক ঘরের সঙ্গে ব্যালকনি; ওখানে বসে মেরিন ড্রাইভ আর আরব সাগর দেখতে কি ভাল লাগে, আর কি বলব।
তাই নাকি?
ও মা, তুমি যদি সন্ধের পর ঐ ব্যালকনিতে বসো, তাহলে একদিকে ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া মেরিন ড্রাইভের আলো আর সামনের দিকে তাকালে দেখবে, আকাশে এক টুকরো চাঁদ আর এক ঝাঁক তারা, নীচে আরব সাগরের কালো জলে অসংখ্য ছোট-বড় প্রদীপের ভেসে যাওয়া দেখে তুমি মুগ্ধ হতে বাধ্য।
কারা ছোট বড় প্রদীপের আলো সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়?
মৌ হাসতে হাসতে বলে, আসলে ওগুলো ছোট-বড় লঞ্চের আর নৌকার আলো কিন্তু দূর থেকে মনে হবে…
অনুপমা দেবী এক গাল হেসে বলেন, বুঝেছি।
উনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তাহলে তুই ভালই ছিলি?
হ্যাঁ, মা, সত্যি খুব ভাল ছিলাম।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিমলবাবু বলেন, শান্ত তো আমাদেরও ছেলে; সে তো মৌ-কে ভাল রাখবেই।
.
সোমবার।
ঠিক ন’টায় ট্রান্সপোর্ট এজেন্টের গাড়ি আসে। মৌ বেরুবার আগে মা-বাবাকে প্রণাম করতেই অনুপমা দেবী বলেন, তুই কখন ফিরবি?
আশা করছি, দেড়টা-দুটোর মধ্যেই ফিরে আসব।
তাহলে তুই এলেই আমি খাব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা এক সঙ্গেই খাব।
শুরু হয় মৌ-এর কর্মজীবন।
কোন খবর না দিয়েই মৌ হাজির হয় নন্দলাল জালানের অফিসে।
কোম্পানীর অফিসারের এমন অপ্রত্যাশিত আগমনে মি. জালান কয়েক মুহূর্তের জন্য একটু ঘাবড়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে এক গাল হেসে দু হাত জোড় করে বলেন, কি সৌভাগ্য! অফিস খুলতে না খুলতেই আপনার দর্শন লাভ…বসুন, ম্যাডাম বসুন।
মৌ সামনের চেয়ারে বসেই একটু হেসে বলে, কেমন আছেন?
ম্যাডাম, আপনাদের কৃপায় ভালই আছি।
ব্যবসার খবর?
ঠিকই আছে।
ঠিকই আছে মানে? বিক্রি বেড়েছে, নাকি কমেছে?
ম্যাডাম বাজার কখনই এক রকম থাকে না; কখনও একটু বাড়বে, কখনও আবার একটু কমবে–এভাবেই তো বাজার চলে।
স্যাটারডে ক্লোজিং-য়ের রিপোর্ট দেখি।
ম্যাডাম, পুরো রিপোর্ট এখনও তৈরি হয়নি।
কেন? চার-পাঁচটা সেন্টার থেকে রিপোর্ট আসেনি।
মৌ বেশ বিরক্ত হয়ে বলে, আপনি তো ভাল করেই আমাদের কোম্পানীর নিয়ম-কানুন জানেন..
হ্যাঁ, ম্যাডাম, খুব ভাল করেই জানি।
কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করবেন অথচ ঠিক মতো রিপোর্ট তৈরি করবেন না, তা চলবে না।
মৌ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আজকের মধ্যেই রিপোর্ট…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ম্যাডাম, আজই রিপোর্ট রেডি হয়ে যাবে।
হলেই ভাল; তা না হলে তো পরের সপ্তাহে সাপ্লাই আটকে যেতে পারে। আচ্ছা নমস্কার।
কথাটা শুনেই মি. জালানের মুখ শুকিয়ে যায়; তবু বলেন, নমস্কার!
বেশি না, তিনজন ডিস্ট্রিবিউটার আর এজেন্টদের কাছে যেতেই দিকে দিকে বার্তা রটে গেল ক্রমে।
.
জানেন পাইনদাদা, নতুন ম্যাডাম বড় কড়া অফিসার আছেন। কাজের কথা ছাড়া একটাও অন্য কথা বলেন না। তাছাড়া ঠিক মতো রিপোর্ট না পেলেই পরের সপ্তাহে সাপ্লাই বন্ধ হতে পারে বলেন।
বলেন কী? এই মহিলাকে তো ঠাণ্ডা করার দরকার।
কি যে বলেন দাদা? উনি এক কাপ চা-কফি পর্যন্ত খান না; অন্য কিছু করতে গেলে হয়তো আমরা ব্ল্যাক লিস্টেড হব।
তাহলে তো সত্যি চিন্তার ব্যাপার।
দেখছি, রিপোর্ট তৈরির জন্য একটা আলাদা লোক রাখতেই হবে।
তাহলে আমিও রিপোর্ট তৈরির জন্য একটা লোক রাখি, কি বলেন?
মি. জালান একটু হেসে বলেন, আমরা যখন বছরে প্রায় কোটি টাকা প্রফিট করি, তখন একটা নতুন লোক রাখার জন্য বছরে অন্তত ছত্রিশ হাজার খরচ করতে আপত্তি কী?
না, না, আপত্তির কিছু নেই।
বেশি দিন না, মাস খানেকের মধ্যেই কোম্পানী বুঝতে পারলো, গ্রেটার ক্যালকাটা এরিয়ায় বিক্রি বাড়ছে। শান্তও টেলিফোন করে জানালো, মৌ, তুই জয়েন করার পর থেকেই বিক্রি বাড়ছে বলে মি. পাতিল খুব খুশি।
.
মৌ চাকরি পাওয়ায় সংসারের চেহারাও বদলে গেল। যে রাধা মাসি বরাবর আনাজ কাটা আর রাত্রে খাবার জন্য রুটি-তরকারি করতো, সে এখন দিনেও রান্না করে। মেয়ের তাগিদেই বিমলবাবু আর অনুপমা দেবী রোজ বিকেলে সাদার্ন এভিন্যুতে বেড়াতে যান। হাজার হোক সারাজীবন অধ্যাপনা করেছেন বলে বিমলবাবু বরাবরই পড়াশুনা করে সময় কাটান। মাসে দু’বার গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরী থেকে তিনটে করে বই আনেন পড়ার জন্য। আগে সংসারের কাজকর্মের জন্য অনুপমা দেবী শুধু খবরের কাগজ পড়তেন; অন্য বইটই পড়ার সময় পেতেন না। এখন তার অনেক সময়, তাইতো আবার আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ পড়া শুরু করেছেন।
শুধু তাই না।
কত আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ আসে বিমলবাবুর কাছে; কখনও কোন পুরনো সহকর্মীর নাতি-নাতনীর বিয়ে, আবার কখনো প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে। আমন্ত্রণ আসে অন্যান্য কারণেও; কখনো কারুর গৃহপ্রবেশ বা বিয়ের পঁচিশ-পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে। এইসব ধারে-কাছে হলে সস্ত্রীক বিমলবাবু সেই সব নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেও একটু দূরে হলেই অক্ষমতা জানাতেন।
এখন?
মৌ গাড়ির ব্যবস্থা করে বলে পুরনো দিনের প্রিয় ছাত্রী শীলার মেয়ের বিয়েতে নৈহাটি যেতেও দ্বিধা করলেন না বা পুরনো সহকর্মী দ্বিজেনবাবুর নাতির পৈতে উপলক্ষে শ্রীরামপুর ঘুরে এলেন।
এইভাবেই কেটে গেল তিনটে মাস।
.
দিন পনের পরের কথা; হঠাৎ মিসেস যোশীর ফোন।
মহুয়া, আমি মিসেস যোশী বলছি।
মৌ একটু হেসে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন।
পাতিল সাহেব আপনাকে এই সপ্তাহের মধ্যেই দেখা করতে বলেছেন।
উনি হঠাৎ দেখা করতে বলছেন কেন?
তা আমি জানব কেমন করে।
মিসেস যোশী মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, স্যার হয়তো জানেন, কেন পাতিল সাহেব আপনাকে দেখা করতে বলেছেন; আপনি স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন?
হ্যাঁ, দিন।…
শান্ত রিসিভার তুলেই বলে, বল, মৌ, কী খবর?
দিদি বললেন, পাতিল সাহেব আমাকে এই সপ্তাহেই দেখা করতে বলেছেন।
হ্যাঁ, দিদি ঠিকই বলেছেন।
কিন্তু কেন?
তা বলতে পারব না, তবে এইটুকু বলতে পারি, উনি তোর কাজে খুবই সন্তুষ্ট।
মৌ একটু থেমেই বলে, ওখানে ক’দিন থাকতে হবে, তা কী উনি বলেছেন?
আমাকে উনি শুধু বলেছেন, তোকে খবর দিতে আর বলেছেন, কয়েক দিন সময় হাতে নিয়ে আসতে।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, তুই কবে আসতে পারবি?
বুধবারের আগে পারব না।
আমি কী পাতিল সাহেবকে বলব, তুই বুধবার আসবি?
হ্যাঁ, বলতে পারো।
তুই কোন ফ্লাইটে আসছিস জানলে আমি এয়ার পোর্টে তোকে রিসিভ করব।
আমি কালকেই তোমাকে জানিয়ে দেব।
ঠিক আছে।
.
শান্তর সঙ্গে ওকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মি. পাতিল এক গাল হেসে বলেন, ইয়েস মিস চৌধুরী, ওয়েলকাম টু আওয়ার হেড অফিস।
মৌ না হেসে পারে না।
বসুন, বসুন।
ওরা দু’জনে সামনের চেয়ারে বসতেই মি. পাতিল বলেন, মিস চৌধুরী, আগে বলুন, কেমন আছেন।
স্যার, ভাল আছি।
আমাদের কাজ করতে কেমন লাগছে?
স্যার, বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে।
দ্যাটস্ ভেরি গুড।
মি. পাতিল একটু থেমেই হাত দিয়ে শান্তকে দেখিয়ে বলেন, মি. সরকার ইস্টার্ন রিজিয়নের গত মাসের যে রিপোর্ট আমাকে দিয়েছেন, তা দেখে বুঝলাম, আপনার এরিয়ায় ভালই সেলস্ বেড়েছে।
হ্যাঁ, স্যার, একটু বেড়েছে।
মি. পাতিল একটু হেসে বলেন, আপনি যাকে একটু বেড়েছে বলছেন, আমাদের কাছে তা ভেরি পজিটিভ সাইন।
উনি একবার নিশ্বাস নিয়েই বলেন, আমরা চাই, আপনাকে আরো একটু দায়িত্ব দিতে।
স্যার, যদি পরিষ্কার করে বলেন, তাহলে ভাল হয়।
আমরা চাই, আপনি প্লীজ নর্থ বেঙ্গল আর সিকিমেরও দায়িত্ব নিন।
স্যার, আমি কী এত দায়িত্ব নেবার উপযুক্ত?
আমরা মনে করি, আপনি অনেক বড় দায়িত্ব নেবার উপযুক্ত।
মৌ চুপ করে চিন্তা করে।
কি হল মিস চৌধুরী।
স্যার, আমাকে কী প্রত্যেক সপ্তাহে ঐসব এলাকায় যেতে হবে?
নট অ্যাট অল; মাসে একবার করে গেলেই যথেষ্ট। তবে মাঝে মাঝে টেলিফোন করে ওখানকার ক্লায়েন্টদের একটু চাপে রাখবেন।
স্যার, মি. সরকার কী এইসব এলাকা আর দেখবেন না?
ওর কথা শুনে শান্ত শুধু হাসে।
মি. পাতিল বলেন, ও এখন কয়েক মাস নর্থ-ইস্ট নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকবে; তবে ওয়েস্ট বেঙ্গল-সিকিমও ওর দায়িত্ব।
স্যার, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি।
ভেরি গুড।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই এক গাল হেসে বলেন, এখন থেকেই আপনি স্পেশাল প্রমোশন অফিসার ফর ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যান্ড সিকিম হলেন এবং কোম্পানীর অফিসার হিসেবে মাইনে, অ্যালাউন্স ও অন্যান্য সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
স্যার, অশেষ ধন্যবাদ।
মি. সরকার কাল আপনাকে আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের চিঠি দিয়ে দেবে। এর পর মি. মাথাইয়ের ডিপার্টমেন্ট আপনার নতুন এরিয়া খুব ভাল করে বুঝিয়ে দেবে।
স্যার, ওদের ব্রিফিং সত্যি খুব ভাল; তাছাড়া কাজে খুব হেলপ করে।
.
সন্ধেবেলায় মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে ঢুকেই দু’জনে দু’জনকে জুড়িয়ে ধরে কয়েক মিনিট ধরে চুম্বন পর্ব চলে।
দু হাত দিয়ে শান্তর গলা জড়িয়ে ধরে মৌ বলে, প্রায় মাস খানেক তোমার সঙ্গে মহানন্দে কাটাবার পর এই তিন মাস যে কি করে কাটিয়েছি, তা শুধু আমিই জানি।
মৌ, বিশ্বাস কর, তোকে কাছে না পাবার জন্য আমিও নিঃসঙ্গতার জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে মরেছি। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারিনি।
আমারও তো একই অবস্থা। আমি আমার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শোবার পরই শুধু কেঁদেছি। তোমাকে যতদিন কাছে পাইনি, ততদিন অন্যরকম দুঃখ ছিল কিন্তু তোমার কাছে অত আদর ভালবাসা আর আনন্দ পাবার পর এই বিচ্ছেদ সত্যি অসহ্য।
হ্যাঁ, মৌ, ঠিক বলেছিস।
একটু পরই বাঈ আসে। মৌ-কে দেখেই ও এক গাল হেসে বলে, এতদিন পর এলে কেন?
মৌ গম্ভীর হয়ে বলে, সবই আমার কপাল! আমার স্বামী চায় না, আমি এখানে বেশি আসি।
বাঈ মাথা নেড়ে বলে, না, না, তুমি ঠিক বললে না। তুমি অনেক ভাগ্যের জোরে এই রকম স্বামী পেয়েছ। তুমি চলে যাবার পর অনেকদিন ওর মুখে হাসি দেখিনি; তাছাড়া খাওয়া-দাওয়াও করতো না ঠিক মতো।
.
সন্ধের পর সেই ব্যালকনিতে বসা। আলোয় ঝলমল মেরিন ড্রাইভ যেন বিয়ের কনের মতো সালঙ্করা আর আসন্ন নব বসন্তের জন্য সারা মুখে চাপা হাসি। ওদিকে চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে। আরব সাগরের জলে উছলে পড়ছে তার খুশি। আলোয় ঝলমল ছোট্ট ছোট্ট লঞ্চগুলো যেন এক দল আত্মহারা শিশু খেলতে মত্ত; আর ছোট্ট ছোট্ট নৌকাগুলো যেন মুগ্ধ হয়ে ওদের খেলা দেখছে।
দু’জনে পাশাপাশি বসে, হাতে হাত, শান্তর বুকের উপর মাথা রেখে মৌ বলে, এই পরিবেশ আর তোমার বুকে মাথা রাখলেই যেন মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
তোকে কাছে পেলে আমিও বড় শান্তি পাই।
রাত্রে খেতে বসে শান্ত একটু হেসে বলে, মৌ, তুই অফিসার হিসেবে এবার থেকে অফিস তোকে অনেক টাকা দেবে; কী করবি অত টাকা দিয়ে?
অফিস থেকে কত টাকা পাবো?
প্রভিডেন্ড ফান্ড কাটাকুটির পরও তুই প্রায় আশি হাজার হাতে পাবি; তাছাড়া গাড়ি, টেলিফোন, বাড়ি ভাড়া, এন্টারটেনমেন্ট অ্যালাউন্স, ট্রাভেলিং অ্যালাউন্স…
মৌ একটু জোরেই হেসে উঠে বলে, থাক, থাক, আর বলতে হবে না।
ও সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে বলে, বড় বড় প্রাইভেট কোম্পানীগুলো কর্মচারী আর অফিসারদের এত বেশি মাইনে দেয় বলেই তো ওদের তৈরি জিনিসপত্রের দাম এত বেশি হয়।
তা খানিকটা হয় বৈকি।
.
খাওয়া-দাওয়ার পর মৌ ঘরে গিয়েই শাড়ি ছেড়ে নাইটি পরে।
শান্ত ঘরে ঢুকেই ওকে নাইটির বোতাম লাগাতে দেখে বলে, অফিস থেকে এসেই তো নাইটি পরতে পারো।
নাইটি হচ্ছে রাতের পোক; এই পোষাক কী বাঈ-এর সামনে পরা যায়?
শান্ত আর কোন কথা না বলে শুতে যায়।
মৌ সযত্নে মুখে ক্রীম মাখে, হাতেও ক্রীম লাগায়; আলতো করে চুলের উপর দিয়ে চিরুনি টানে কয়েকবার।
তারপর?
বিছানায় যেতে না যেতেই শান্ত দু’হাত দিয়ে ওকে টেনে নেয়।
.
কী হল মৌ? কথা বলবি না?
এত আনন্দ, এত ভাললাগার পর কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মৌ বলে, শান্তদা, আমার একলা থাকতে একটুও ভাল লাগছে না। এবার আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করো।
সত্যি বলছি, আমারও একলা থাকতে ভাল লাগে না কিন্তু অফিসের জন্য আমাকে বছর খানেক অপেক্ষা করতেই হবে।
কেন?
বছর খানেকের মধ্যেই পাতিল সাহেব কোম্পানীর চেয়ারম্যান হবেন আর ওর জায়গায় আমাকে যেতে হবে।
এ তো দারুণ খবর।
কিন্তু তার আগে আমাকে তিন-চার মাস করে দিল্লী, নাগপুর, হায়দ্রাবাদ আর চেন্নাইতে থাকতে হবে।
বোম্বে ফিরে আসার পর আমাদের বিয়ে হবে তো?
নিশ্চয়ই হবে।