৭-৮. দৈত্যের আবির্ভাব

. দৈত্যের আবির্ভাব

পর পর দ্রুতগতিতে কয়েকটি অস্বাভাবিক ঘটনা সংঘটনের ফলে মানুষের অনুভূতি উত্তেজনার চরম শিখরে ওঠার পর যে নিষ্ক্রিয় জড়তা মৃত্যুর মতো সমস্ত দেহকে শীতল করে রাখে, তার চেয়ে বেদনাকর বোধহয় আর কিছুই নেই। মানুষ তখন আশা-ভরসা, জীবন-মৃত্যু, ভয়-ভাবনার অতীত। জাস্টিনের ফাঁসি হয়েছে, মৃত্যুর পরে সে শান্তি লাভ করেছে; কিন্তু ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আজও জীবিত, সমস্ত হৃদয় জুড়ে নৈরাশ্য আর বেদনা। তার চোখ থেকে ঘুম চলে গেছে। এক লক্ষ্যহীন প্রেতাত্মার মতো তিনি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। অবর্ণনীয় বীভৎস অন্যায় তিনি করেছেন এবং সেই পাপের ফলে ভবিষ্যতে আরো কত বীভৎস ঘটনা ঘটবে। অতীতের দিকে তাকিয়ে তিনি কোথাও এতটুকু খুশির আলো দেখতে পেলেন না, ভবিষ্যতে কোনো আশার স্বাক্ষর নেই। তাঁর সমস্ত মন ধীরে ধীরে আগ্রাসী বিমর্ষতায় অধিকার করল, নিজেকে মনে হল ঘৃণ্য অপরাধী–তারপর যে মানসিক অত্যাচার, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

মানসিক এই অবস্থায় তার শরীর ভেঙে গেল। বিজ্ঞান-সাধনার পুরস্কারের পরিবর্তে প্রথম রূঢ় আঘাতের পর থেকেই তিনি শারীরিক বিশেষ সুস্থ ছিলেন না। তিনি লোকের সঙ্গ এড়িয়ে যেতে লাগলেন। কোথাও কোনো আনন্দ বা কারুর এতটুকু আত্মপ্রসাদ তাঁর কাছে নির্যাতন বলে মনে হত! নির্জনতা–গভীর, অন্ধকার মৃত্যুর মতো নির্জনতা ছিল তার একমাত্র সান্ত্বনা।

বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে পরে প্রায়ই গভীর রাত্রে তিনি নৌকো নিয়ে লেকে একা অন্ধকারে ঘুরে বেড়াতেন। কখনো কখনো লেকের মাঝখানে এসে হাল তুলে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন–নৌকোটি নিজের খুশিমতো যেমন ইচ্ছ, যেখানে ইচ্ছা যাক। লেকের জলে তার কুৎসিত ছায়া দেখে ভাবতেন যে এত সুন্দর স্বর্গীয় পরিবেশের মধ্যে শুধু গুটিকয় ব্যাঙ বা বাদুড় ছাড়া তাঁর মতো অস্থির, তাঁর মতো কুৎসিত আর কেউ নেই। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা হত যে শান্ত শীতল লেকের জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে; লেকের নির্মল জলে তার সমস্ত ভয়, ভাবনা, দুঃখ, অশান্তির পরিসমাপ্তি এনে দিতে। কিন্তু তখনই মনে হত তাঁর বাড়ির লোকজনের কথা। নিজে আত্মরক্ষা করে আর সকলকে সেই শয়তানের নিষ্ঠুর হিংস্রতার মুখে ঠেলে দিয়ে যাবেন!

প্রতিদিন তিনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতেন যে, যেন তার মনে একবার শান্তি ফিরে আসে, যেন তিনি পরিবারের প্রত্যেককে সান্ত্বনা দিতে পারেন, সুখী করতে পারেন। কিন্তু তা হতে পারে না। মনস্তাপ সমস্ত আশা নির্মূল করে দিয়ে যায়। তিনি এক ঘৃণ্য পশু সৃষ্টি করেছেন। প্রতিদিন তিনি ভয়ে ভয়ে থাকতেন– আবার কখন সেই দৈত্যটি এমন এক নৃশংস কুকীর্তি করবে যা তার অতীতের সমস্ত নিষ্ঠুরতাকে ছাপিয়ে যাবে। যতদিন তার প্রিয়তমদের মধ্যে একজনও জীবিত থাকবে ততদিন এই ভীতি থাকবেই। যখনই তার অপরাধ আর বিদ্বেষের কথা তার মনে হত তখনই তার প্রতি ঘৃণায় আর তার কৃতকর্মের জন্য প্রতিহিংসায় তার সমস্ত মন-প্রাণ অস্থির হয়ে উঠত। যদি এন্ডিস পর্বতের সুউচ্চ চূড়া থেকে ফেলে দিয়ে তাকে হত্যা করা সম্ভব হত, তবে সেই দুর্গম পর্বতশিখরে ছুটে যেতে তিনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হতেন না। মাঝে মাঝে তাকে সামনাসামনি পাওয়ার জন্য তিনি অধীর হয়ে উঠতেন, এতগুলো লোককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার শাস্তি কীভাবে তাকে দেওয়া যায়–তা কল্পনা করতে না পেরে আরো অস্থির হয়ে উঠতেন।

এলিজাবেথ তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করত, কিন্তু বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গতা, স্বর্গ বা মর্তের সৌন্দর্য তাঁর আত্মাকে দুঃখের থেকে মুক্তি দিতে পারত না; বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, দয়া, মায়া, মমতা–তার বিকল হৃদয়ের কাছে বিফল। তাকে ঘিরে যেন এক কালো মেঘ, যাকে ভেদ করে কোনোকিছু ভালো কাছে যেতে পারে না। একটি আহত হরিণ যেমন নিজের অসাড় দেহকে টানতে টানতে এক নির্জন স্থানে এনে তার দেহ-বিদ্ধ তীরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে, তারও ঠিক সেই একই অবস্থা।

.

এই রকম মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে একদিন তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। আল্পস্ পাহাড়ের উপর উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে মানসিক অবসাদকে নিমগ্ন করে দিতে চাইলেন তিনি। সামুনি উপত্যকার দিকে তিনি পা বাড়ালেন। সারভক্স উপত্যকার মতো সুন্দর না হলেও এই উপত্যকা অপূর্ব মহিমময়। উঁচু তুষারমণ্ডিত পর্বত দিয়ে এই উপত্যকার সীমারেখা আঁকা, কোথাও পাহাড়ের উপর বিধ্বস্ত দুর্গের চিহ্ন নেই। বিরাট হিমানীপ্রবাহের পতনের গুরুগম্ভীর শব্দ আর তার যাত্রাপথ ধরে শীতল ধোয়া সকলকে বিস্ময়াভিভূত করে রাখে। সব ছাপিয়ে সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ মঁ ব্লাঁ–একেশ্বরের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।

বিমুগ্ধ নয়নে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেই নৈসর্গিক শোভা দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন দূর থেকে মানুষের চেহারার মতো কী একটা যেন অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে তার দিকে ছুটে আসছে। বিপদসঙ্কুল বরফের চাঁইয়ের উপর দিয়ে সে লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে, যা যে-কোনো মানুষের পক্ষেই বিপজ্জনক। তার মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। যতই সেই মূর্তিটি তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, ততই তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন যে সে আর কেউ নয়, তার সৃষ্ট সেই শয়তান। তার সঙ্গে চিরকালের মতো শেষ বোঝাঁপড়ার জন্য তিনি মনে-মনে তৈরি হলেন।

তিনি ছুটে গেলেন তার দিকে। চিৎকার করে উঠলেন–শয়তান! পিশাচ! তুই-ই আমার ছোটভাইকে খুন করেছিস! তোর জন্যই জাস্টিনের ফাঁসি হয়েছে। আমি তোক কী করতে পারি জানিস? আবার তুই আমার সামনে এসেছিস? চলে যা, দূর হ–

সে দাঁড়িয়ে রইল নির্বাক হয়ে। তারপর চলে যাওয়ার জন্য ফিরে দাঁড়াল। তিনি আবার বললেন–কোথায় যাচ্ছিস? আগে যাদের তুই খুন করেছিস, তাদের সকলকে ফিরিয়ে দিয়ে যা। নয়তো আমিই গড়েছি তোকে, আমিই আবার তোকে ভেঙে চুরমার করে দেব।

খানিকক্ষণ সে ব্যথিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তার পীতাভ চোখদুটো তুলে ধরল। বলল–যতখানি ব্যথা দেবে ভেবেছিলে, ততখানি পাইনি। আমি তোমার কাছে অনেকটা এইরকম ব্যবহার আশা করেছিলাম, ঠিক তাই-ই পেয়েছি। কিন্তু কেন আমাকে ঘৃণা করো?কেন আমাকে হত্যা করতে চাও?

ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের চোখদুটো অসহ্য রাগে জ্বলে উঠল, বললেন–কেন হত্যা করতে চাই। আমি তোক সৃষ্টি করেছিলাম অতিমানুষ করার জন্য, কিন্তু তুই অমানুষ হলি। তারপর তুই যথেচ্ছাচার করে চলেছিস। মানুষের রক্তে সারা পৃথিবী রাঙিয়ে দিয়ে তোর তৃপ্তি হল না, তার ওপর আমারই ছোটভাইকে হত্যা করেছিস? আমি তোর সৃষ্টিকর্তা–আর আমারই সংসারে তুই মৃত্যুর কালিমা এনে দিয়েছিস!

দৈত্যের চোখ বোধ হয় ছলছল করে উঠল, বলল তোমার ভাইকে হত্যা করার ইচ্ছা ছিল না আমার। সত্যি বলছি, হে আমার ভগবান, আমায় বিশ্বাস। করো। সব ঘটনাই তোমাকে একে একে বলছি, কিন্তু তার আগে তুমি আমায় ক্ষমা করো। বলো ক্ষমা করলে।

তিনি বিদ্রূপের হাসি হেসে উঠলেন–ক্ষমা! বলতে লজ্জা করে না? তুই এমন। এক সৃষ্টি-যে চারদিকে অশান্তি আনছে। যার নিছক আনন্দ হচ্ছে লোককে খুন করা। তুই আমার চোখের ঘুম নিয়েছিস, মুখের হাসি নিয়েছিস, মনের শান্তি নিয়েছিসতোকে ক্ষমা করব? শয়তান!

এবারে দৈত্যটি যেন সত্যিই কেঁদে ফেলল, বলল–আমি জানি, আমার জীবনের সমস্ত দুঃখময় কাহিনী শুনলে তুমি আমাকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে। তুমি আমার স্রষ্টা, কিন্তু তুমিই আমার সমস্ত দুঃখের কারণ। তাই আজ তোমাকেই আমি শুধু বলতে চাই, কেন আমি হিংসাবৃত্তি নিলাম। তুমি ততটুকু শুধু ধৈর্য ধর। তারপর তোমার যা খুশি তাই করো। শুধু আজ আমার একটু কথা শোনো–

.

. দৈত্যের কাহিনী

দৈত্যটি বলতে লাগল :

আমার জন্মকাহিনী তুমি তো আমার চেয়েও ভালো জানেনা, আমারই স্পষ্ট মনে নেই। ইচ্ছা হয়, কেন তুমি আমাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে আনলে তা জানতে। মৃত্যুর নিরন্ধ্র অন্ধকারে আমি নিমগ্ন ছিলাম। পৃথিবীর এত রূপ, এত সৌন্দর্য, এত আলো, এত হাসি–সব আমার চোখ থেকে চিরকালের জন্য দূর হয়ে গেছিল, কিন্তু হে আমার স্রষ্টা, হে আমার পিতা–তুমি আবার আমাকে নতুন করে জীবন দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে নিয়ে এলে। আমার এ আনন্দের কথা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারছি না। হে স্রষ্টা, তাই তোমাকে আমি আমার প্রাণের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। হে আমার দেবতা, আমার প্রণাম গ্রহণ করো।

হঠাৎ যেন লক্ষ লক্ষ বছরের ঘুম থেকে আমি জেগে উঠলাম। আলো দেখলাম। এই সুন্দর পৃথিবীকে যতই আমি দেখতে লাগলাম ততই আমার ভালো লাগল। সবই স্বপ্নের মতো সুন্দর–কত সুন্দর! কত ভালো লাগল–তাই মনের আনন্দে কথা বলতে চাইলাম। গলার ভিতর শুধু ঘড়ঘড় করে উঠল। কিছুই বলতে পারলাম না। তোমাকে দেখেই বুঝলাম, তুমিই আমার স্রষ্টা। তোমার চোখমুখ সবই তা জানাচ্ছিল।

ইচ্ছা করছিল লাফিয়ে, হেঁটে, চলে এবং কথা বলে আমার আনন্দ প্রকাশ করি। কিন্তু তখনো সে শক্তি আমার হয়নি, তাই ব্যথায় ছটফট করতে লাগলাম।

তারপর পেলাম আমার শক্তি। ভালো করে দেখলাম তোমাকে তোমাকে আমার অত্যন্ত ভালো লাগল। কিন্তু দেখলাম, তোমার সমস্ত মুখ কেমন বেদনায় পার হয়ে উঠেছে। আমার দিকে বিজাতীয় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তুমি ছুটে চলে গেলে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, কিন্তু বুঝলাম না কেন–কীজন্য তুমি আমায় ফেলে চলে গেলে।

মনে হল, তোমাকে আমার অনেক কথা বলা উচিত–অনেক কথা। তুমি আমার স্রষ্টা, আমার ভাগ্যবিধাতা, তোমার সঙ্গে কথা বলব না তো কার সঙ্গে বলব? তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাব না তো কাকে জানাব? গেলাম তোমার শোয়ার ঘরে। তোমার মশারি তুলে কথা বলতে গেলাম, কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই চমকে উঠলাম, দেখলাম–তুমি অসহনীয় ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলে।

মনের দুঃখে ঘরে ফিরে এলাম। কেন এই ঘৃণা! কেন? কেন? আমি কী করেছি? যদি ভালোবাসতেই না পারলে–যদি ঘৃণাই করবে, তবে হে বিধাতা, আমাকে জীবন দিলে কেন? যদি জীবনই দিলে তবে ভালোবাসবে না কেন? আমি তো তোমার কাছে জীবন চাইনি, তুমি তো স্বেচ্ছায় আমাকে সৃষ্টি করেছ। তবে আমার কিসের অপরাধ?

সমস্ত রাত একক নিঃসঙ্গতায়, প্রভু, তোমার কথাই ভেবেছি। মনকে এই বলে সান্তনা দিয়েছি যে দিনের আলোয় অন্ধকার কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রতি তোমার ঘৃণাও দূর হয়ে যাবে। আমাকে তুমি তোমার সন্তানের মতো বুকে তুলে নেবে।

হায়রে আশা ছলনাময়ী। সকাল হল, আকাশ রাঙিয়ে সূর্যদেব আকাশে উঠলেন–তুমি এলে না আমার খোঁজ নিতে। বারান্দায় পায়ের শব্দ শুনে উৎসুক হয়ে মুখ বের করে দেখতে গেলাম–তুমি কি না! কিন্তু যাকে দেখলাম সে আমাকে দেখে একমুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে ঘৃণা, আতঙ্ক ফুটে উঠল এবং পরমুহূর্তে সে পাগলের মতো ছুটে পালাল। আমারও তো প্রাণ আছে, আমারও তো চেতনা আছে। সমস্ত শরীর রাগে কাঁপতে লাগল–আমায় দেখে ঘৃণা! এত ঘৃণ্য আমি? এত কুৎসিত দেখতে আমাকে আমি তো ভালোই হতে চেয়েছি, আমি তো কারুর কোনো ক্ষতি করিনি।

তারপর মনে করে দেখ প্রভু, তোমরা সকলে মিলে আমার ওপর কী অকথ্য ও দুঃসহ অত্যাচার করেছ। চেয়ার দিয়ে আঘাত করেছ, কুকুর লাগিয়ে আহত করতে চেয়েছ, চাবুকে আমায় জর্জরিত করেছ, আগুন দিয়ে সমস্ত শরীরে জ্বালা ধরিয়েছ–কী দিয়ে তোমরা আমাকে শাসন করতে বাকি রেখেছ? নৃশংস অত্যাচারে আমার মত নিঃসহায় এক নতুন জীবকে তোমরা নবজন্মের প্রথম প্রভাতেই দুঃস্বপ্নের অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিলে। অজস্র অত্যাচারে আমাকে বারবার অজ্ঞান করেও তোমাদের আশা মেটেনি, তার ওপর আবার অনাহারে রেখেছিলে–একফোঁটা জলও পিপাসা মেটাতে দাওনি। প্রাণধারণের চেষ্টায় তাই তো আমাকে প্রথম মানুষ হত্যা করতে হয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, প্রভু, আমি তা চাইনি। তোমরাই চেয়েছিলে আমাকে হত্যা করতে। আমি আত্মরক্ষা করেছি মাত্র। যখন আমাকে অস্ত্রোপচার করতে উদ্যত হলে তখন আমার ভয়। হল। মনে হল–তোমরা আমাকে বাঁচতে দেবে না, অথচ আমি যে বাঁচতে চাই। এত সুন্দর পৃথিবী আমি প্রাণভরে দেখতে চাই। তাই শুধু আত্মরক্ষার জন্য তোমার সঙ্গীকে আমি হত্যা করেছি। নয়তো সত্যি বলছি, হত্যা করতে আমার নিজের কোনো ইচ্ছা ছিল না। হিংসাকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণাই করি।

তারপর ভয় হল, হয়তো আবার আমাকে শাসন করবে, অনিচ্ছাকৃত এই কুকীর্তির জন্য তুমি আমাকে ভর্ৎসনা করবে। তাই পালালাম ওখান থেকে। কয়েকদিন বনে বনে থেকে পৃথিবীতে বাঁচার সমস্ত উপায় প্রায় জেনে নিলাম। অনেক চেষ্টা করে কথা কইতেও শিখলাম।

মনে হল, তোমরা তো ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে চলে গেলে, দেখি–পৃথিবীর সব লোকই তোমাদের মতো কি না, কেউ আমাকে ভালোবাসে কি না। তাই আবার লোকালয়ে ফিরে এলাম।

একদিন খুব ভোরবেলা। তখনো কুয়াশা প্রায় সমস্ত জগৎ আচ্ছন্ন করে আছে। আমি একটি ছোট্ট বাগানের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে এলেন এক লোক আর একটি ছোট মেয়ে। লোকটি বাইরে চলে গেলেন আর ছোট্ট মেয়েটি গেল সামনে দিঘির ধারে। আমার মনে হল, এই ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করি। গেলাম তার কাছে। তখনো কুয়াশায় আমাকে স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল না। মেয়েটির কাছে গিয়ে বললাম-খুক, আমি তোমার সঙ্গে খেলতে চাই।

মেয়েটি বলল–বেশ তো, ওই ফুলগুলো পেড়ে দাও। তারপর আমরা ফুলগুলো জলে ভাসাব।

মনটা আনন্দে ভরে উঠল। এই মেয়েটি তবে আমায় ঘৃণা করে না। গাছের সমস্ত ফুল পেড়ে আমরা খেলতে শুরু করলাম। খেলতে খেলতে বেশ বেলা হয়ে এল। তখন আঁধার কেটে গিয়ে আলো ফুটে উঠেছে। হঠাৎ মেয়েটির চোখ পড়ল আমার ওপর।

ভয়ে মেয়েটি পাংশু হয়ে গেল। চিৎকার করে পালাতে গেল। আমি তাকে ধরে বলতে গেলাম, খুকু, ভয় নেই, আমি ভূত নই। কিন্তু হয়তো–হয়তো তার গলায় একটু জোরে চাপ পড়েছিল, তাই মেয়েটি মারা গেল। বিশ্বাস করো, আমার ভগবান, বিশ্বাস করো ওই ফুলের মতো ছোট্ট মেয়েটিকে আমি মারতে চাইনি। ওই মেয়েটিই তো প্রথম ভালোবেসে আমার সঙ্গে কথা বলেছে, খেলা করেছে।

নিজের শক্তির ওপর এক অবিশ্বাস, এক নিদারুণ ভয় এসে গেল। মনে হল আমার অপরিসীম শক্তিই আমার সাধারণ মানুষের সঙ্গে সখ্য’র প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটুকু আমি বুঝতে পারলাম যে ইচ্ছা করলে আমার শক্তি দিয়ে মানুষের ওপর নিরঙ্কুশ অধিকার স্থাপন করতে পারি; কিন্তু আমি তো তা চাই না। আমি চাই সকলের মতো সকলের সঙ্গে মিশতে–এই সুন্দর পৃথিবীর সবটুকু আনন্দ সকলের সঙ্গে সমানভাবে উপভোগ করতে।

তাই লোকালয় থেকে ছুটে পালিয়ে গেলাম। অনুশোচনায়, আত্মগ্লানিতে বনের অন্ধকারে নিজের মুখ লুকোতে চাইলাম। কিন্তু হে আমার স্রষ্টা, তা পারলাম না। এই শীত, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ–সবকিছুর থেকে আত্মরক্ষার জন্য সকলের মতো আমারও তো আশ্রয় চাই। সকলের মতো আমারও তো আহার চাই।

ঘুরতে ঘুরতে এক গ্রামের দূর কোণে একটি পোড়োবাড়ি পেলাম। কাছেই বন। আমার বাড়ির সামনে শুধু ছোট একটি বাড়িতে এক বৃদ্ধ, আর স্বামী-স্ত্রী থাকে। আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতাম, আর গভীর রাত্রে বনে গিয়ে ফলমূল সংগ্রহ করে আনতাম।

.

আমার ঘরের জানলার ছিদ্র দিয়ে সামনের বাড়ির লোকদের দেখতে আমার বড় ভালো লাগত। দেখতাম, প্রতিদিন সকালে লোকটি হাতে একটি কুড়োল নিয়ে চলে যেত। সন্ধ্যাবেলায় সে একবোঝা কাঠ নিয়ে আসত। মেয়েটি তার খাবার এনে দিয়ে গল্প করত। দুপুরবেলায় মেয়েটি বৃদ্ধ লোকটিকে বাইরে রোদে বসিয়ে দিয়ে যেত, আবার বিকেলবেলায় তাকে ধরে ঘরে নিয়ে যেত। কোনো কোনোদিন সন্ধ্যাবেলায় ছেলেটি আর মেয়েটি হাত-ধরাধরি করে বেড়াতে যেত। বৃদ্ধ লোকটিকে সব সময়েই দেখতাম একা বসে।

বৃদ্ধের জন্য আমার কষ্ট হত। বেশ বুঝতাম, তিনি ঠিক আমার মতোই নিঃসঙ্গ। প্রতিদিন স্থির করতাম, বাড়িতে কেউ যখন থাকবে না তখন আমি তার সঙ্গে গিয়ে আলাপ করব। কিন্তু সাহস হত না।

সেই ছেলেটির জন্যও মনে-মনে দুঃখ হত। সারাদিন সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সামান্য কাঠ সে মাত্র সংগ্রহ করে, অথচ আমার শক্তি দিয়ে সেই কাঠ আমি একটু সময়ে এনে দিতে পারি। তাই একদিন গভীর রাতে ছেলেটির কুড়োল নিয়ে কাঠ কেটে এনে তার বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে সেই ছেলেটি ও মেয়েটি বাড়ির সামনে স্তূপাকার কাঠ দেখে চমকে উঠেছিল। সেদিন আর সে বনে যায়নি, বাগানেই কাজ করেছিল। এরপর থেকে প্রতিদিন রাতে আমি তাদের কাঠ কেটে এনে দিতাম।

ধীরে ধীরে ওই পরিবারের ওপর আমার মমতা জন্মাতে লাগল। একদিন ছেলেটি ও মেয়েটি বাইরে চলে গেলে পর আমি সেই বৃদ্ধের কাছে গেলাম, তাঁর সঙ্গে অনেক কথা বললাম। দেখলাম, তিনি চোখে দেখতে পান না। সেদিন আনন্দে আমার মন ভরে উঠল।

তারপর সেই ছেলেমেয়ের অনুপস্থিতিতে প্রতিদিন আমি সেই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করতাম। বৃদ্ধও আমার সঙ্গে কথা বলে খুশি হতেন।

একদিন রাতে আমি তার সঙ্গে কথা বলছি, হঠাৎ সেই ছেলে ও মেয়েটি ফিরে এল। মেয়েটি আমাকে দেখেই ভয়ে চিৎকার করে উঠল।

বৃদ্ধ বললেন–কী হয়েছে? ইনিই তো সেই ভদ্রলোক যার কথা তোমাদের কাছে বলেছি।

সেই লোকটি একটা মোটা লাঠি হাতে নিয়ে আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে টেনে সরিয়ে নিল। তারপর লাঠি দিয়ে আমাকে আঘাত করল।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক চিৎকার করতে লাগলেন–তোরা কি পাগল হলি? এ ভদ্রলোককে তোরা মারধোর করছি কেন?

আমি জানতাম, সেই ভদ্রলোকটিকে আমি ইচ্ছা করলেই টেনে ছিঁড়ে মেরে ফেলতে পারি; কিন্তু মনে পড়ল বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথা! আমাকে তিনি ‘ভদ্রলোক’ বলেছেন, ভদ্র ব্যবহার করাই আমার উচিত। কোনো কথা না বলে আমি সমস্ত অপমান সহ্য করে ফিরে এলাম। বুঝতে পারলাম না–কী আমার এমন অপরাধ যে লোকে আমাকে ঘৃণা করে!

তারপর একদিন এক নদীর জলে আমার পৈশাচিক মূর্তি দেখে নিজেই শিউরে উঠলাম। মনে হল কেউ তো আমাকে ভালোবাসবে না। এই কুৎসিত মুখ, এই কুৎসিত দেহ–কেউ সহ্য করতে পারবে না। আমি অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। এই জীবনকে আমি বড় ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তাই বাঁচতে চাই, আমি ভালোবাসা চাই।

কিন্তু এই কুৎসিত কদাকার ভীষণ মূর্তি দেখে কেউ ভালোবাসে না, কেউ কাছে আসতে চায় না–দূরে সরে যায়। আমি একলা, একেবারে নিঃসঙ্গ। তুমি আমার প্রাণ দিয়েছ, কিন্তু রূপ দিলে না কেন? কেন আমায় এত কুৎসিত করে গড়ে তুললে? আর তোমার সৃষ্টিকে কেন তুমি ভালোবাসতে পারলে না?

প্রাণ দিলে, রূপ দিলে না। প্রাণ দিলে, সঙ্গী দিলে না। এই বিরাট পৃথিবীতে সকলে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করছে–আমি শুধু একা আমার দুঃখের বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তুমি কি বুঝতে পারো না যে, তুমিই তোমার সৃষ্টির ওপর মর্মান্তিক অবিচার করেছ।

তুমি কি জানো না যে, একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কতদূর অসহ্য। এই জীবন এখন এত দুর্বহ হয়ে উঠেছে যে, এক এক সময় ভাবি আত্মহত্যা করে সমস্ত জ্বালা জুড়োই। কিন্তু পারি কই? চোখে পড়ে এই পৃথিবীর আলো-বাতাস, গাছপালা, আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য! আর অনুভব করি আমার এই কুৎসিত দেহের মধ্যেকার সুন্দর প্রাণটিকে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি।

তাই আর আমার পক্ষে আত্মহত্যা করা সম্ভব হল না! ভাবলাম–এই পৃথিবীর ওপর, জাগতিক সমস্ত সৌন্দর্যের ওপর প্রতিশোধ নেব। প্রতিশোধের জন্য আমি বদ্ধপরিকর হলাম। বললাম–হে স্রষ্টা, তুমি আমাকে কুরূপ দিয়েছ, তুমি আমাকে নিঃসঙ্গ করে রেখেছ, আমিও লোকের জীবন সেইরকম নিঃসঙ্গ আর যন্ত্রণাময় করে তুলব। আমি তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলকে মরণের পরপারে পাঠিয়ে তাদের সমস্ত সুখ-আহ্লাদ চিরকালের জন্য দূর করে দেব। তাদের ঘৃণা আর আমার হত্যা–এই দুই একসঙ্গে সমান্তরালভাবে চলবে।

এই উদ্দেশ্য নিয়ে আমি অনেক জায়গা ঘুরেছি। কত লোক যে হত্যা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু দেখছি প্রতিহিংসায় মনে শান্তি পাই না। তুমি আমার ভগবান, আমার জীবনদাতা, আমার প্রভু, আমার স্রষ্টা–তাই তোমার কাছে আমি ফিরে এসেছি। তুমি আমার দিকে মুখ তুলে চাও। তোমার সৃষ্টির ওপর এই অসঙ্গত ব্যবহার তোমার শোভা পায় না। মানুষের সমস্ত অন্যায় যখন ভগবান ক্ষমা করেন, তখন তুমি আমার স্রষ্টা হয়ে কেন আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করবে না? যখন জীবনই দিলে সুখ এনে দাও, শান্তি এনে দাও।

তোমার ভাইকে হত্যা করেছি বলে তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। কিন্তু সে দোষ কি আমার তোমাকে দুঃখ দিয়ে আমিও কি দুঃখ পাইনি। আমি তো তাকে মারতে চাইনি, আমি তাকে ভালোবাসতেই চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সে ছোট ছেলে, হয়তো সে আমায় ঘৃণা করবে না–হয়তো আমাকে তার সঙ্গী করে নেবে। আমার স্রষ্টার ভাই সে, কত আশা করে তার কাছে গেছিলাম, কিন্তু সে-ও ঠিক তোমার মতো ভয়ে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। সে জোর করে আমার কাছে থেকে চলে যেতে চাইল।

তখন আমার ভয়ানক রাগ হল। ভাবলাম, যে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আমার এই দুর্দশা এই দুরদুষ্টের জন্য দায়ী, তারও কোনো সঙ্গী রাখব না। তাই তোমার ভাইকে। হত্যা করলাম। আর একটি স্ত্রীলোক–তোমাদের কেউ হবে–সে-ও একদিন আমাকে দেখে ভয় পেয়েছিল। তাকে শাস্তি দেব ঠিক করেছিলাম। তাই সে যখন নগরের বাইরে একটি ঘরে একা নিদ্রামগ্ন তখন তার পোশাকের মধ্যে রেখেছিলাম তোমার মৃত ভাইয়ের সোনার লকেট। পুলিশ তাকে হত্যাকারী বলে ধরে নিয়ে ফাঁসি দিয়েছে।

শোনো আমার কথা…

কিন্তু ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর শুনতে পারলেন না। রাগে, ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। এই পিশাচটি শুধু তার ভাইকে হত্যা করেই তৃপ্ত হয়নি, হত্যার অপরাধ তুলে দিয়েছে উইলিয়মের পরিচারিকা জাস্টিনের ঘাড়ে। এতদিন তার যা শুধু মনের ধারণা ছিল, আজ সেকথা সত্য প্রমাণিত হল। যদি একথা সে অস্বীকার করত, তবে সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করলেও তবু তার সান্ত্বনা একটু থাকত–হয়তো দৈত্যটি সত্যকথা বলছে। তবে জাস্টিনের মৃত্যুর জন্য তিনিও দায়ী হতেন না। কিন্তু আজ তিনি সত্য সত্যই নিরপরাধ জাস্টিনের হত্যাকারী।

আর সহ্য করতে পারলেন না, চিৎকার করে উঠলেন তিনি–না–না, তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার সম্মুখ থেকে তুই দূর হয়ে যা।

পিছন ফিরে তিনি পা বাড়ালেন।

পিছন থেকে আকুতি শোনা গেল–শোনো, আমার সব কথা শুনে যাও…

কিন্তু তিনি আর শুনলেন না। এগিয়ে চললেন।

পিছন থেকে ছলছল কণ্ঠে কয়েকটি কথা শোনা গেল।–চলে গেলে। বেশ, তবু আমি আশা ছাড়ব না। তুমি যেখানে যাবে সেখানে তোমার সঙ্গে আবার দেখা করব। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ; আমি জানি তুমি আমাকে দুঃখ দিতে পারবে না–আমার কথা ফেলতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *