2 of 2

৭.৭ হে মহাজীবন! হে মহামরণ!

৭.৭ হে মহাজীবন! হে মহামরণ!

মাঝে মাঝে চিঠি পাই। বন্ধুদের চিঠি। কিছুই ফেলে দিতে ইচ্ছে করে না। চিঠি পীকৃত হতে থাকে। চিঠির স্কুপে লিখবার টেবিল ভরে যায়। কাগজপত্র ছড়িয়ে বসে স্বচ্ছন্দে লিখবার জায়গা থাকে না। টেবিল থেকে সরিয়ে চিঠির জন্য স্থান করতে হয় বাক্সে। ক্রমে বাক্স ভরে ওঠে। এর পর কোথায় রাখি! কিছু চিঠিকে বিদায় না দিলেই আর নয়।

একটি ছোটো ছেলের মুখের কথায় সেদিন আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমারই পুরনো ছাত্রের ছেলে। কিছুই বয়স হয়নি। পরিবারে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে, তিনি আমার ছাত্রের কাকা। বাড়িতে শোকের ছায়া। ছোটো ছেলেটি বলল, খুব দুঃখের কথা অবশ্যি, খারাপ লাগছে ঠিকই, তবে ওঁরা চলে না গেলে আমাদের জন্য জায়গা হবে কী করে? জানি না এই চিন্তা ওর মনে এলো কী ভাবে আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয়তো একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়!

কিন্তু কথাটা তো ভুল নয়। এ জীবন শুধু রাতের রেলগাড়ি নয়। গাড়ি চলছে দিনরাত। স্টেশনে স্টেশনে লোক উঠছে নামছে। যদি কেউ না নামতো, যদি স্টেশনে স্টেশনে লোক শুধু উঠতেই চাইতো! প্রথমে ধাক্কাধাক্কি বাড়তো। তারপর ধাক্কাধাক্কি করেও কিছুতেই জায়গা হতো না। ভাগ্যিস কিছু লোক নামে!

পৃথিবীটাও তো ঐরকমই। তার অন্তহীন সূর্য প্রদক্ষিণের পথে মানুষ জন্মাচ্ছে, মরছে। যদি শুধু জন্মাতো, যদি কেউ জায়গা ছেড়ে না দিতো! অমরদের জন্য স্বর্গেই জায়গা ভালো। সেখানে সম্ভবত স্থানাভাব নেই। তা ছাড়া ওঁদের কি দেহ আছে? দেহী মানুষদের আছে এই মাটির পৃথিবী, সীমাবদ্ধ পৃথিবী। এখানে জন্মমৃত্যু তাল রেখে চলছে। এক দরজা দিয়ে কেউ বেরোচ্ছে, অন্য দরজা দিয়ে ঢুকছে। সংসারের প্রদর্শনী চলছে নিরন্তর।

চিঠির বেলায় বাছবিচার করবার স্বাধীনতা ছিল। কোনটা রাখবো আর কোনটাকে বিদায় দেব, সেই নির্বাচনের ভার আমার হাতে, অন্তত খানিকটা স্বাধীনতা তো আছেই। সব চিঠির মূল্য সমান নয়। সংসারের খেলায় কিন্তু ব্যাপারটা অন্য রকম। কে থাকবে কে যাবে তার ওপর আমাদের ইচ্ছা কতটুকু খাটে! মৃত পুত্রের শিয়রে বসে মা কেঁদে বলেন, ‘ও কেন চলে গেল, আমার আয়ু কেন ফুরোয় না!

তবু আমাদের মতামতের অপেক্ষা না রেখেই মৃত্যু আসে, এটাই হয়তো শেষ বিচারে ভালো। মনে করুন একটি অসহ্য দৃশ্য। মাঝ দরিয়ায় ডুবতে বসেছে সবাই, নৌকোতে। মায়ের সঙ্গে দুই ছেলে। মাঝি বললো, একজনকে বিসর্জন দিতেই হবে। মা তুমি বলে দাও কোন ছেলেটি যাবে, কাকে তুমি রাখবে।’ এর চেয়ে হৃদয়বিদারক অবস্থা আর কী হতে পারে? কেউ যায়, অনিবার্য বলে সেটা মেনে নিই। কিন্তু আমরা যাদের ভালোবাসি তাদের ভিতর কে যাবে, কে থাকবে, এ যদি স্থির হতো আমাদেরই ইচ্ছায় তবে সেই ভয়ংকর ইচ্ছার স্বাধীনতার আঘাতেই কি আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ হত না।

কেউ যায় আগে, কেউ পরে, যে-নিয়মে এই নির্বাচন ঘটে আমরা তা সম্পূর্ণ বুঝি না। সেটা যেহেতু বিশ্বের নৈর্ব্যক্তিক নিয়ম তাই কঠিন জেনেও তাকে মেনে নেওয়া সহজ। মৃত্যুর এই এক শিক্ষা। এ বিশ্বসংসারের সঙ্গে আমাদের হৃদয় জড়িত, কিন্তু এ আমাদের ইচ্ছায় চলে না। যে নিয়মে চলছে এই বিশ্বজগৎ, গ্রহ নক্ষত্র যে নিয়মে বাঁধা, আমাদের। ব্যক্তিগত ইচ্ছার অধীনতা থেকে সে মুক্ত, এই সত্য নম্রভাবে মেনে নিতে হবে। মৃত্যুর। মতো ঘনিষ্ঠ ভাবে, অভ্রান্ত ভাবে আর কেউ কি দিতে পারে এই শিক্ষা? মৃত্যুর ছায়ায় দাঁড়িয়ে কবি বলেন, ‘সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।

আমরা সবাই কবির মতো করে ভাবতে পারি না। কিন্তু মৃত্যুর একটা জাদু আছে। অতি সাধারণ জীবনে সেই জাদু বার বার দেখেছি। মৃত্যুর পটে ব্যক্তির ছবি হঠাৎ কেমন পালটে যায়। জীবনে যাকে নিয়ে কঠোর বিতর্কের ঝড় উঠেছে, মৃত্যুর পর শুক্রমিত্র সবাই তাকে দেখেছে অন্য এক স্নিগ্ধ আলোতে! অথবা ধরুন সেই বৃদ্ধের কথা, যার কথা আপনারা সবাই জানেন। অথর্ব হয়ে বেঁচে ছিল সে অনেক দিন। ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল কাছের মানুষদের প্রাত্যহিক সেবার একঘেয়েমিতে। বুড়ীর মুখেও শোনা যেত, ‘বুড়ো গেলে বাঁচি।’ মানুষটি অবশেষে যেদিন গেল সেদিন কিন্তু অনেকেরই চোখের কোণ চিক চিক করছিল। এটা কি শুধুই কপটতা? কাপট্য থেকে কিন্তু কারো কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিল না সেদিন। কপট সহানুভূতিই বা কেন তবে?

যাঁরা প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন জনজীবনে, তাঁদের বেলায়ও মৃত্যুর জাদু কাজ করে অন্য এক ভাবে। নানা পথের নানা নেতা। যতদিন এঁরা জীবিত ছিলেন ততদিন এঁদের ভিতর দ্বন্দ্বটাই প্রধান ছিল। জনতাও বিভক্ত ঐ পক্ষে ও পক্ষে। পথেঘাটে লড়াই বাধে মাঝে মধ্যে মৃত্যুর পর এঁদের বিরোধটা আর উত্তাপ সৃষ্টি করে না। মানুষের মনে বিচিত্র ছবির মতো এঁরা শ্রদ্ধার স্থান পেয়ে যান পাশাপাশি। মনে হয় যে কোনো খেলায় বিরোধী দুই দলের নেতা হয়ে এরা খেলতে নেমেছিলেন। খেলাটাই স্মরণীয়। অর্জুন ও কর্ণ উভয়েই বরেণ্য।

এইসব থেকে একটা মূল কথা বুঝি। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের একটা গাঢ় রহস্য মৃত্যু অনাবৃত করে।

যে মানুষটা বেঁচে ছিল সে আমাদের সঙ্গী, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। সংসারের যে সব সম্পদ পরিমাণে সীমাবদ্ধ, যেমন খাদ্য অথবা অর্থ, সে সব তো একজন বেশি পেলে অন্যের জন্য অবশিষ্ট থাকে কম। অনটনের বস্তুর ওপর যে ভাগ বসায় সেই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। দেহী মানুষের তাই দেহী মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব শুধু অর্থের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়েই নয়। ক্ষমতা নিয়ে, পদাধিকার নিয়ে, এমন কি সুনাম নিয়েও। জীবিত মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিতর এসে পড়ে এই সাংসারিক দ্বন্দ্বের জটিলতা, ঈর্ষা লোভ কুটিল চক্রান্ত।

কিন্তু মানুষটি যখন চলে গেল তার সঙ্গে তখন আর আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রইল না। দেহমুক্ত স্মৃতির সঙ্গে আমাদের বিবাদের সাংসারিক কারণ নেই। সেই স্মৃতিকে আমরা তখন নতুন করে এক অমর সূক্ষ্ম দেহে প্রতিষ্ঠিত করি নিরীশ্বরবাদীরাও তো শ্রদ্ধেয় পুরোগামীর ছবি সামনে রেখে জন্মতিথি উদ্যাপন করে। যে মানুষটিকে নিয়ে জীবনে আমাদের অভিযোগের অন্ত ছিল না, মৃত্যুর পর যে তার জন্য অশ্রুপাত করি, এইখানে পাওয়া যাবে সেই রহস্যের কিছুটা সমাধান।

এতেও কিন্তু সবটা বলা হল না। একদিন যে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আজ সে নেই। জীবন থেকে সে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। এখানেই যদি কথা ফুরোতো তবে এর পর সেই মানুষটার প্রতি উদাসীন হয়ে যাওয়াই তো স্বাভাবিক হত। তাকে স্মরণ করে তবে বিষণ্ণতা কেন? আসলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আড়ালে সঙ্গী মানুষের প্রতি আমাদের একটা একাত্মতা থাকে। সাংসারিক বিবাদে, বৈষয়িক বাসনার ধূলায় সেটা ঢাকা পড়ে যায়।

মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের রহস্যটা এইখানে। মানুষ ভালোবাসা চায়, ভালোবাসতে চায়। এই যে একাত্মতার আকাঙ্ক্ষা, এইটাই শুদ্ধ চৈতন্যের স্বভাব, এ জন্য। অন্য কারণের প্রয়োজন হয় না। প্রতিদ্বন্দ্বী বাসনা, বহু আশংকা আর ভুল বোঝাবুঝির কালো মেঘে স্বচ্ছ প্রীতির আকাশ আবৃত হয়ে পড়ে। মৃত্যু এসে আবরণটা সরিয়ে দেয়। কদাচিত কেউ মৃতের প্রতিও দুর্মর বিরূপতা বহন করেই চলে। কিন্তু সেটাই অস্বাভাবিক। এতে মৃত্যুর সত্যকে অস্বীকার করা হয়। সেই সত্যকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করবার পর বিদ্বেষের আবরণ আর থাকে না। মৃত্যুর কাছে তাই কবির প্রার্থনা “যা-কিছু মলিন, যা-কিছু কালো, যা-কিছু বিরূপ তোক তা ভালো-ঘুচাও ঘুচাও সব আবরণ ॥”।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘মৃতের কাছে আমাদের অন্য কোনো দায় নেই, আছে শুধু সত্যের দেনা। সত্য বলতে এখানে কী বোঝায়? কেউ বলবেন, মৃত ব্যক্তির বিষয়ে তথ্যের পরিবেশনে যেন ভুল না থাকে এই চাই, এর বেশি নয়। মৃত্যুর শিক্ষা আরো উদার। তথ্য নির্ভুল হওয়া জরুরী। কিন্তু এটাই সব নয়। যে-দৃষ্টি নিয়ে আমরা প্রতিবেশীর দিকে তাকাই তথ্য তারই অনুগামী হয়। মৃতের প্রতি চাই শুদ্ধ সহানুভূতি। সত্যের সঙ্গে এই শুদ্ধতার বিরোধ নেই। কিন্তু ক্ষুদ্র সাংসারিক সত্যের চেয়ে এটা বড়। মৃত্ম বার বার আমাদের এই কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়।

আবারও কথাটাকে টেনে নিয়ে যেতে হয় সামনের দিকে। মৃত্যুর করুণায় আমরা যে-দৃষ্টি লাভ করি তাকে শুধু মৃতের কাছে দেনা হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে, তাকে জীবনের মূলধন বলে জানা চাই। অর্থাৎ, তাকে যদি আমরা জগতে ব্যাপ্ত না করি, কেবল। মৃতের স্মৃতির জন্য চিহ্নিত একটা আলাদা প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে রাখি, তবে তার মূল্য দ্রুত ক্ষয়ে যায়।

বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর খাতায় তার প্রথম কৈশোরের রচনায় একটি আশ্চর্য বাক্য দেখেছিলাম, ‘মৃত্যুর পর এত সমারোহ কেন! বাক্যটি যদিও সূর্যাস্তের লগ্নে পশ্চিম আকাশকে স্মরণ করে লেখা তবু এর অর্থ এবং গূঢ় জিজ্ঞাসা অনিবার্যভাবে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের সমাজজীবনে আর মৃত্যুর আনুষঙ্গিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। এ মেয়েটির জিজ্ঞাসার সাধারণ উত্তর আমাদের একেবারে অজানা নয়। জীবনের প্রয়োজনেই এই সমারোহ।

মৃত্যুর চিন্তাকে মন থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রেখেই পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই প্রাত্যহিক জীবন যাপন করি। পরিবারের সেই কৃত্রিম নিশ্চিন্ততার মধ্যে যখন মৃত্যুর আকস্মিক আবির্ভাব ঘটে তখন কাছাকাছি সমস্ত মানুষের ভিতরই একটা আবেগাপ্লুত বিপন্নতার বোধ দেখা দেয়। সব কিছুই অনিত্য এই ভাবটা সাময়িকভাবে সবাইকে। মুহ্যমান করে। বিধ্বস্ত আত্মপ্রত্যয়ের সেই ভগ্নপ থেকে পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধার সূত্র ধরে পরিবার ও সমাজকে সুস্থ আত্মবিশ্বাসের পথে আবার ফিরিয়ে আনবার আনুষ্ঠানিক প্রয়াসই শ্রাদ্ধের একটি মূল কথা। পিতৃপুরুষদের নাম উচ্চারণ করে আমরা মনের ভিতর এই উপলব্ধিটি জাগ্রত করি যে, আমাদের পরিবার ও সমাজের শিকড় দীর্ঘ অতীতের মাটিতে বিস্তৃত হয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে স্থায়িত্ব দান করছে। আমরা স্মরণ করি যে, আমাদের পরিবারে এটাই মৃত্যুর প্রথম আবিভাব নয়, মৃত্যুকে অতিক্রম করে জীবন এগিয়ে গেছে বার বার। মৃত্যু যেমন ধ্রুব সত্য জীবনও তেমনি, শ্রাদ্ধের মন্ত্র ও সঙ্গীতের সকরুণ গাম্ভীর্যের ভিতর দিয়ে এই প্রত্যয়টিকেই যৌথ জীবনে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

সামাজিক স্তরে শ্রাদ্ধের তাৎপর্য এই। কিন্তু যৌথ শোক আর ব্যক্তিগত বিরহবেদনা। এক বস্তু নয়। রবীন্দ্রনাথের শিল্পচেতনার মূলে যে বেদনার সন্ধান পাওয়া যায়, নৈরাশ্যকে অতিক্রম করবার যে সাধনা সেখানে প্রচ্ছন্ন, সেটা একান্ত ব্যক্তিগত। তাতে নিহিত আছে। শিল্পসৃষ্টির একটি রহস্যময় তবু সামান্য সত্য। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতারও একটি মূল। ভিত্তি এইখানে। মৃত্যুর শিক্ষাকে যেমন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়োজন আছে তেমনি ব্যক্তির নিজস্ব চেতনার ভিতর দিয়ে তাকে বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত করবারও একটা ব্যাপার আছে। রবীন্দ্রচিন্তায় মৃত সেই সিংহদ্বার যেখান দিয়ে ব্যক্তিচেতনার প্রবেশ ঘটে শিল্পে ও ধর্মের জগতে, সেই শিল্প ও ধর্ম যার ব্যাপ্তি বিশ্বময়।

রবীন্দ্রনাথ মাতৃহীন হন অল্প বয়সে, ১৮৭৫ সালে। কিন্তু কবির জীবনে প্রথম দুঃসহ মৃত্যুশোক আসে আরো কয়েক বছর পরে, ১৮৮৪ সালে। “বউঠাকুরাণী’র মৃত্যু কবির জীবনে সেই আদি শোক যার তাৎপর্য গভীর। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপনের পর তাঁর জীবনে পারিবারিক বিরহের আঘাত এসেছে দুঃসহ পৌনঃপুনিকতায়। ১৯০২ সালে তিনি স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে হারান; ১৯০৩ সালে মৃত্যু ঘটে প্রিয় কন্যা রেণুকার; ১৯০৫ সালে কবি পিতৃহীন হন; ১৯০৭ সালে বিদায় নেয় প্রিয় পুত্র শমীন্দ্রনাথ। ১৮৮৪ সালের সেই আদি শোকই কবিকে প্রস্তুত করেছে, পরবর্তী প্রতিটি বিরহবেদনার জন্য। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “ আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে-পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে।”

মৃত্যুশোক কবির জন্য শুধু অশ্রুর মালা গাঁথেনি, সংখ্যাহীন গৃহীর ঘরে প্রতিদিন যেমন সে গাঁথে। মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে চেতনার অন্য এক স্তরে। এই উত্তরণের মূল কথাটি এবার লক্ষ করা যাক। ১৮৮৪-র মৃত্যুর ভিতর দিয়ে কবি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন সেটা সামাজিক বিপন্নতার অভিজ্ঞতা নয়। ব্যক্তিগত নাস্তিত্বের বোধ সেটা, যার দৃষ্টিহীন কালো গহ্বর থেকে অস্তিত্বকেই পুনরুদ্ধার করতে হয়। মাত্র কিছুকাল আগে কবির চেতনায় সারা বিশ্ব ধরা দিয়েছিল একটি অখণ্ড আলোকিত শিহরিত আনন্দের মতে, “নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’-এ যার প্রকাশ। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর আঘাতে নেমে এলো বিশ্বময় অন্ধকার। সেই অন্ধকার থেকে রবীন্দ্রনাথের আবারও যাত্রা। আলোর সন্ধানে। এরই ভিতর দিয়ে কবি লাভ করেন সেই নবজন্ম, তাঁর শিল্প ও ধর্মচিন্তার মূল সুরটি যেখানে বাঁধা।

অস্তিত্বের পুনরুদ্ধারের সেই অভিজ্ঞতার কথা রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষাতেই একবার। শুনে নেওয়া যাক। জীবনস্মৃতির পাতায় তিনি লিখেছেন : “চারাগাছকে অন্ধকার বেড়ার মধ্যে ঘিরিয়া রাখিলে, তাহার সমস্ত চেষ্টা যেমন সেই অন্ধকারকে কোনোমতে ছাড়াইয়া আলোকে মাথা তুলিবার জন্য পদাঙ্গুলিতে ভর করিয়া যথাসম্ভব খাড়া হইয়া উঠিতে থাকে, তেমনি মৃত যখন মনের চারিদিকে হঠাৎ একটা নাই’-অন্ধকারের বেড়া গাড়িয়া দিল, এখন সমস্ত মনপ্রাণ অহোরাত্র দুঃসাধ্য চেষ্টায় তাহারই ভিতর দিয়া কেবলই ‘আছে’-আলোকের মধ্যে বাহির হইতে চাহিল।”

এই দুঃসাধ্য চেষ্টার ভিতর দিয়েই কবি অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তীর্ণ হন। মৃত্যুর দুয়ার দিয়ে কবি নবজন্মে প্রবেশ করেন।

বিশ্বকে আমরা যখন প্রথমবার আলোর মতো লাভ করি, সেটা শিশুর আলোকপ্রাপ্তির মতো। তাতে কোনো কঠিন সাধনার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মৃত্যুশোক অতিক্রম করে বিশ্ব যদি আবারও ব্যক্তির দৃষ্টিতে ‘আলোয় আলোকময় হয় তবে সেটা সাধনলব্ধ ধন। প্রথম ভালোবাসায় থাকে চিরকাল পাবার আশা। মৃত্যু অন্য এক শিক্ষা দেয়।

ভালোবাসার মুহূর্তেই সমস্ত অধিকার মনে মনে ত্যাগ করে যেন ভালোবাসি, যমরাজের এই শিক্ষা। অথবা অন্যভাষায় বলা যায়, ভালোবাসার অধিকারই আমাদের আছে, নেই চিরস্বত্ব অধিকার! যদি তেমন করে দিতে পারি, সংসার আমাদের দান গ্রহণ করবে। কিন্তু গ্রহণ করবে না সেই ছোটো ‘আমি’কে, যে সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে দিতে রাজী নয়। আমাদের যে অহং সংসারকে পাকে পাকে জড়িয়ে আছে, যে কিছুই ছাড়তে রাজী নয়, তাকে ত্যাগ করেই সংসারকে লাভ করতে হবে। এই চিন্তাকে কবি পেয়েছিলেন মৃত্যুর কাছ থেকে, রেখেছিলেন জীবনের ভিত্তিতে। “তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা, উপনিষদের পরিচিত বাণী তাই রবীন্দ্রনাথের প্রিয়। এই অধ্যাত্মদৃষ্টি কিন্তু তাঁকে কখনও সংসারবিরোধী করে তোলেনি।

সংসারকে প্রকৃতপক্ষে আমরা পাই দুই ___ রূপে। _____, অনিত্য সংসার অন্যটি চিরন্তন সংসার। অসংখ্য ‘আমি’র হাসিকান্না মান অভিমান নিয়ে অনিত্য সংসার। এই ছোটো ছোটো ‘আমি’রা একে একে সব মৃত্যুর মুখে গিয়ে পড়ছে। চিরন্তন সংসারের গতি কিন্তু তাতে এক মুহূর্তের জনাও থেমে যাচ্ছে না। জন্মমৃত্যুর অবিচ্ছিন্ন ধারায় সে চিরপ্রবাহিনী। ব্যক্তির মৃত্যুতে রুদ্ধ হয় না যুগ যুগ ব্যাপী বিশ্বমানবের যাত্রা।

অর্থাৎ, সংসার, চিরন্তন সংসার, পদ্মপত্রে নীর নয়, মিথ্যা নয়। রবীন্দ্রনাথ তাই বলছেন যিনি গেলেন তিনি গেলেন বটে, কিন্তু সংসারে তো ক্ষতির লক্ষণই দেখি নে।

অফুরান সংসারের ধারা আজও পূর্ণ বেগেই চলেছে।

“আমি বলে যে কাঙালটা সব জিনিষকেই মুঠোর মধ্যে পেতে চায়, মৃত্যু কেবল তাঁকেই ফাঁকি দেয়; তখন সে মনের থেকে সমস্ত সংসারকেই ফাঁকি বলে গাল দিতে থাকে, কিন্তু সংসার যেমন তেমনিই থেকে যায়, মৃত্যু তার গায়ে আঁচড়টি কাটতে পারে না।”

অতএব মৃত্যুর শিক্ষা এই নয় যে, সংসার মিথ্যা। বরং মৃত্যু আর সংসার পরস্পরের পরিপুরক। অনিত্য সংসারের যা কিছু শ্রেষ্ঠ ফল, চিরন্তন সংসারে সবই জমা হয়ে থাকে। মৃত্যু আমাদের দৃষ্টিকে ডেকে নিয়ে যায় অনিত্য থেকে চিরন্তনের দিকে, যেখানে এই দুয়ের ভিতর নতুন করে সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় সংসারের সঙ্গে বিরোধ নেই আত্মার। তিনি বলছেন, “আত্মা..দিতে চায়…সংসার তার দানের ক্ষেত্র এবং অহং তার দানের সামগ্রী।”

আমাদের হিসেবী মনে এর পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। চিরন্তন সংসারে কী জমা রইল, কী রইল না, তাতে ব্যক্তি মানুষের কী এসে যায়? আমরা তো একটি মাত্র জীবনের অধিকার নিয়েই এসেছি, এই জীবনে কী পেলাম? সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে যা দেওয়া গেল তাতে আমার কী লাভ? এই রকম কিছু সংশয় দেখা দেয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনই কি নয় এই সব সংশয়ের উত্তর? যেমন বিজ্ঞানের সত্যকে আমাদের প্রয়োজন এই জগতেই, তেমনি আধ্যাত্মিকতার সত্য থেকেও প্রাপ্তি ঘটে ইহজন্মেই। সমস্ত মহং উপলব্ধির প্রভাব বিস্তৃত হয় এই জীবনেই। মৃত্যুর সত্যকে সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিয়ে যখন যতটা দেওয়া যায় আমাদের মন তখন ততটাই অসত্যের এবং ভয়ের শাসন থেকে মুক্ত হয়। ‘অহং’কে ত্যাগ করে আমরা যে সংসার থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়াই তাতে সংসারকে ফিরে পাই অন্য এক রূপে।

ব্যক্তিত্বের বিনাশে নয় বরং তার উন্মোচন ও উত্তরণেই মৃত্যুর শিক্ষারও পূর্ণতা। আমরা যখন ত্যাগ করতে প্রস্তুত, আমাদের গ্রহণটাও তখন ছোটো ছোটো আশঙ্কায় খণ্ডিত নয় বলেই সম্পূর্ণ। এরপরও আমরা সংসারেই থাকি, হাসিকান্না সবই থাকে; তবু কান্নায় থাকে না করাতের ধার, হাসিতে থাকে না মিথ্যা অহঙ্কার। সংসার তার আপন গতিতে চলে, কিন্তু চিত্তের ‘আকাশ থেকে একটা মেঘ কেটে যায়। অন্তত এই বোধ থাকে, মেঘের ওপারে নিষ্কম্প সুনীল আকাশ এখনও আছে। আবারও ভালোবাসার আলোতে পৃথিবী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

‘অলৌকিক ডাকপিওন’ তারপর ‘রোদ্দুরের চৌকো খামগুলি মাঝে মাঝেই আমাদের দুয়ারে পৌঁছে দেয়। আমরা খুশি হয়ে সেই চিঠি তুলে নিই, ভালোবেসে পড়ি। তবু জানি, এই মুহূর্তের আলো নিবে যেতে পারে পর মুহূর্তেই। আবারও আলো ফিরে আসবে এই বিশ্বে, আমার দৃষ্টির আলো হয়তো ততক্ষণে ফুরিয়ে গেছে। মৃতার শাসন থেকে কিছুই মুক্ত নয়, নির্মোহ এই জানাতেই মুক্তি! মৃতকে প্রণাম করে এবার আমরা জীবনের পথে চলি, অসংখ্য মৃত্যুকে অতিক্রম করে যে জীবন এগিয়ে চলেছে।

সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি (১৯৮৭)।

.

উল্লেখপঞ্জী

১। Reason and Religion: The Complete Works of Swami Vivekananda, Mayavati Memorial Edition, Volume I, Sixteenth Edition, p. 367.

২। The Autobiography of Bertrand Russell 1914-1944, p. 116, Bantanı, New York.

৩। আইয়ুবের জন্মতিথির আশি বছর পূর্ণ হল ১৯৮৬ সালে। একই বৈশাখে পূর্ণ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের একশ পঁচিশ বছর। কাব্য ও কাব্যচিন্তার সূত্রে দুজনের যোগ, কাব্যচিন্তা তথা শিল্পচিন্তা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *