2 of 2

৭.৬ প্রেম ও পূজা

৭.৬ প্রেম ও পূজা

সেই প্রেম নিয়ে কথা বলছি যৌনতার সঙ্গে যার যোগ আছে। সমসাময়িক সমস্যা দিয়ে আলোচনা আরম্ভ করা যাক, শেষ হবে চিরন্তন কথায়।

আমাদের এই আধুনিক সমাজে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা আর ভুল বোঝাবুঝি বেড়ে চলেছে। মৌলবাদীরা মেয়েদের অন্তঃপুরে ফেরত পাঠাচ্ছেন। মেয়েরা-যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন এইখানেই ওরা সমস্যার মূল কারণ দেখছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই চাকরীজীবী মহিলাদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এর একটা লক্ষ্য আর্থিক পরিবারের আয়বৃদ্ধি। কিন্তু সেটাই একমাত্র কথা নয়। মহিলারা। অন্তঃপুরের আবদ্ধতায় আর থাকতে চাইছেন না। বাইরের বড় পৃথিবীর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ যতই বাড়ছে, তার বৈচিত্র্যে ও প্রাণচাঞ্চল্যে যতই তাঁরা অভ্যস্ত হচ্ছেন, ততই সেটা বাদ দিয়ে জীবন আর পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে না। যৌথ পরিবার টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। স্বামীস্ত্রীর ছোটো পরিবারের চার দেয়ালের মধ্যে স্ত্রী হাঁপিয়ে ওঠেন, বাইরের বিশ্বে তিনি মুক্তি খোঁজেন। সন্তানের সংখ্যা যতই কমছে, শুধু সন্তান প্রতিপালনে স্ত্রীকে আবদ্ধ রাখা ততই অযৌক্তিক হয়ে উঠছে। পৃথিবীজোড়া এই দিকে ঝোঁক।

এদেশেও ঘরের বাইরে নারীর বিচরণ ক্রমেই অবাধ হয়ে উঠেছে। এই বড় পরিবর্তনটা দ্রুত ঘটে গেছে গত অর্ধশতাব্দীতে। বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য ভেঙে পড়েছে। পুরুষ এই ব্যাপারটা ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। শাশুড়িরাও অনেকে পেরেছেন কি? বাইরের পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর মেলামেশায় স্বামী অভ্যস্ত নন। এই অবস্থায় অনেক স্বামীই সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেন। এটা আবার স্ত্রীর কাছে স্বাভাবিক কারণেই বিরক্তিকর। স্বামী বাইরের জগতের মহিলাদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, তাতে দোষ নেই, স্ত্রীর। মেলামেশাতেই দোষ, এটা মেনে নেওয়া আজকের নারীর পক্ষে কঠিন। সন্দেহ মাত্রা মেনে চলে না, মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়াটাই তার ধর্ম। অতিরিক্ত সন্দেহের শিকার হবার পর স্ত্রীর মনে একটা রোখ চেপে যায়। স্বামীও সন্দেহের শিকার হন, তখনও একই ব্যাপার ঘটে। এমনি করে গড়ে ওঠে একটা অবাধ্য চক্র। স্বামীস্ত্রীর ভিতর সম্পর্কে তিক্ততা বাড়তে থাকে। শ্রদ্ধাহীন সহাবস্থানের দণ্ড মাথায় নিয়ে উভয়ে বাস করেন।

পুরুষদের বহুগামিতা পুরনো ঐতিহ্যে মেনে নেওয়া হয়েছিল। অনেক স্ত্রীই সেটা সহ্য করতেন। অনেকেই ধরে নিতেন যে, পুরুষের পক্ষে ওটা স্বাভাবিক। কিন্তু স্ত্রীর কাছ থেকে দাবি করা হত অনড় অটল একগামিতা। অধিকারের এই অসাম্য আজকের নারীর। কাছে শ্রদ্ধেয় নয়, মান্যও নয়। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের কি কোনো পথ নেই?

মৌলবাদীদের কথা আগেই বলা হয়েছে। তাঁরা পরিত্রাণ খুঁজছেন নারীকে পুনর্বার অন্তঃপুরবাসিনী করবার পথে। কোনো কোনো দেশে এই নিয়ে জোরজুলুম চলেছে। কিন্তু এভাবে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। পুরুষের স্থান বাইরের পৃথিবীতে, সেখানে সে হবে প্রায়শ বহুগামী, আর নারীর স্থান ঘরে, সেখানে বিরাজ করবে। একগামিতা, এ বিধান চলবে না।

কেউ কেউ একটা সরল সমাধান দিচ্ছেন। ঘরে বাইরে সর্বত্রই নারীপুরুষ উভয়েরই স্থান থাকবে। আর উভয়েই হবেন একগামী। এই বিধানে উকট অসাম্য নেই। তাছাড়া স্বীকৃত নৈতিকতার সঙ্গে এর মিল আছে। স্বামীস্ত্রী উভয়েই যদি এটা মেনে চলেন তবে বাহ্যদৃষ্টিতে কোনো সমস্যা থাকে না।

কিছু দুঃখজনক জটিলতা তবু থেকেই যায়। এমন অনেক স্বামীস্ত্রী আছেন যাঁরা একগামী ঠিকই, কিন্তু যাঁদের যৌনসম্পর্কের ভিতর কোনো সৌন্দর্য নেই, কোমলতা নেই। স্বামী জান্তব তাড়না থেকে কাজটা করেন। স্ত্রী এ থেকে কোনো আনন্দ পান না। তিনি ব্যাপারটাকে ভয় করেন, এমন কি ঘৃণা করেন। কিন্তু তাঁর অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। ব্যাপারটা ঘটে তাঁর গভীর বিতৃষ্ণা এমন কি প্রকট প্রতিরোধ সত্ত্বেও একগামিতার সীমার ভিতরই চলে আইনসম্মত বলাৎকার। এই কদর্যতার উদাহরণ অসংখ্য। ঐতিহ্যের চোখে স্বামীর বলাৎকারে দোষ নেই, স্ত্রীর প্রতিরোধেই দোষ। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি নেই একগামিতার স্বীকৃত বিধানে।

দীর্ঘকাল এই অভিশাপ বহন করেই সংসার চলেছে। অন্তত বাহ্যদৃষ্টিতে ভাঙন দেখা দেয়নি। এখন সময় বদলেছে, পুরনো ধারায় আর চলছে না। মনান্তরের ছিদ্রপথে নানা জটিলতা এসে যোগ হচ্ছে। অনেক সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। চতুর্দিকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে অসহিষ্ণুতা ও নির্দয়তা। এটাই মূল সমস্যা। নৈতিকতার প্রচলিত পুরনো ধারণার ভিতর এর সমাধান নেই। পুরনো ধারণাকে আশ্রয় করেই পুষ্ট হচ্ছে নতুন মৌলবাদী আন্দোলন, আগেই যার উল্লেখ করেছি। এই আন্দোলনে অসহিষ্ণুতা আর নির্দয়তাই নীতির গৌরব পাচ্ছে। এই সব অতিক্রম করে যাবার পথ কোথায়?

বিবাহ নিয়ে নিয়ম ও ধারণা সমাজের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সমাজে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বিধান। আমদের পরিচিত ও প্রচলিত বিধানের মূলে সম্পত্তি ও সন্তানপালনের কথাটা বড়। কিন্তু আধুনিক মানুষকে ভিতরে ভিতরে কুরে। খাচ্ছে অন্য এক যন্ত্রণা। সে যুক্ত হতে চায়, কিন্তু সে বিচ্ছিন্ন। যাকে নম্র হয়ে পেতে হয়, তাকে সে দখল করে নিতে চায়। না পেলে সব কিছু ভাঙবার রোখ চাপে। এ থেকে নিস্তার নেই কোনো বাহ্য বিধানে, সম্পত্তি নিয়ে চিন্তায় তো নিশ্চয়ই নেই। বিধান কিছু প্রয়োজন বটে। কিন্তু তার সঙ্গে চাই অন্য এক ঔদার্য ও মূল্যবোধ।

কী সেই মূল্যবোধ? তাকে উচ্চারণ করা যাবে কোন ভাষায়? মানুষের সমাজ ও চেতনার বর্তমান স্তরে স্ত্রীপুরুষের যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বিধানকেই কি মূলবিধান বলে বিবেচনা করা যায়? এসব প্রশ্ন উপেক্ষণীয় নয়, তবু জবাব দিতে গিয়ে সতর্ক হতে হয়। যে-সব কথা একদিন তর্কাতীত ছিল তাও আজ তর্কসাপেক্ষ। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি স্ত্রীপুরুষের সহবাসের জন্য আবশ্যক কি না এ নিয়েও নতুন প্রজন্মের মনে গভীর সংশয় আছে। কী-যে মূল্যবান আর কী নয় এ নিয়ে আজ মতৈক্যে পৌঁছানোনা কঠিন কাজ। আমাদের নির্বাচন এমন হওয়া চাই যে, নতুন যুগের গভীরতর প্রতীতির সঙ্গে তার সামঞ্জস্য থাকে, আবার কিছু স্থায়ী মুল্যেরও তাতে স্বীকৃতি ঘটে। আমাদের চিন্তার ভিতর মূল্যবোধের সঙ্গে আরো থাকা চাই সেই নম্যতা যাতে সাধারণ সিদ্ধান্তকে খণ্ডন না করেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন পথে মুক্তির সন্ধান করতে পারে। এইসব শর্ত মেনে কোনো সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কি একেবারেই সম্ভব?

৷৷ দুই ৷৷

এইসব প্রশ্ন কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরিয়ে রেখে বিষয়টার আরো একটু গভীরে যাওয়া যাক।

যৌনবিচার ও অনুভূতির স্তরভেদ আছে। এ নিয়ে এইবার কয়েকটি কথা বলে নেওয়া আবশ্যক।

একস্তরে যৌনতার সঙ্গে মিশে আছে ভয় ও পাপবোধ। মানুষকে সে লুব্ধ করে। চরিত্রের সংযম ভেঙে দেয়। মনের সেই অভিনিবেশ নষ্ট হয়, যাকে হারালে কোনো বড় কাজই সুসম্পন্ন করা যায় না। সেই অসংযত যৌনতা মুক্তির পথ নয়, বরং বন্ধন। বাধা পেলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পীড়নের ভিতরই একরকম বিকৃত সুখ খোঁজে। যৌনতার এই এক ভয়ংকর রূপ। কামবোধ আর হিংসা এখানে মিলেমিশে গেছে।

এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই যে, একরকমের নৈতিকবিধানে জোর পড়েছে সংযমের ওপর। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একসময়ে ব্রহ্মচর্যের একটা বিশিষ্ট স্থান ছিল। বাড়ির বড় একটা শক্ত ভিত্তি দরকার, চরিত্রেরও সেইরকম। ভিত্তি দুর্বল হলে তার ওপর বড় কিছুই গড়ে তোলা যায় না। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, শিক্ষায় সংযম ও অনুশীলনের স্থান। থাকা আবশ্যক।

যৌনতার অন্য এক স্তর এবং অন্য এক রূপ আছে যেখানে সে সুন্দর। কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন যে, যৌনতারই এক উদ্‌গতির ফলে কবির চোখে পৃথিবী সুন্দর। কথাটা কিন্তু অন্যভাবে বলাই ভালো। মানুষের চেতনায় একটা প্রীতির শক্তি আছে, আত্মাকে প্রসারিত করবার শক্তি আছে, যেটা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হয়ে বিশ্বকে আনন্দরূপ করে তোলে। সেই শক্তিই আবার যৌনতায়ও সঞ্চারিত হয়, তাকে সুন্দর করে তোলে। এখানে একটা আরোহণ অবরোহণের ব্যাপার আছে। শুদ্ধ চেতনার আনন্দময়তার যেমন একটা ভূমিস্পশী অবরোহণের স্রোত আছে, তেমনি যৌনতার তেজে উদ্দীপ্ত হয়ে তার একটা আকাশবিহারী আরোহণের ধারাও আছে।

যৌনতাকে যখন আমরা পাপবোধের দ্বারা চিহ্নিত করি তখন মানুষের দেহ আমাদের চোখে পাপেরই প্রতীক হয়ে ওঠে। আবার যে-স্তরে যৌনশক্তি সুন্দরের ধারক সেখানে মানুষের দেহও সেই রূপ ধারণ করে। যুগে যুগে কবি ও শিল্পীরা মানুষের দেহকে, বিশেষত নারীদেহকে (অধিকাংশ কবি পুরুষ বলেই কি?), মুগ্ধ দৃষ্টিতে চিত্রিত করেছেন।

যে-দৃষ্টি নিয়ে কবি প্রকৃতির রূপময়তায় অবগাহন করেছেন, সেই দৃষ্টির স্পর্শে নারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গও রূপময় হয়ে উঠেছে। ভয় এবং পাপবোধের কদর্যতা থেকে মুক্ত করে যৌনতাকে ও মানুষের দেহকে সুন্দর বলে চিনে নেওয়ার জন্যও একরকমের শিক্ষার প্রয়োজন হয়।

মূল কথাটা এখানে দুভাগে ভাগ করে নিয়ে বলতে হবে।

শুধু পাপবোধের দাপটে হিংসা ও কদর্যতাকে কখনই ঠেকানো যায়নি, সংযমশিক্ষাও সম্পূর্ণ হয়নি। বরং পাপবোধ অনেক সময় এককমমের নির্দয়তাকেই আশ্রয় দিয়েছে। সৌন্দর্যশিক্ষার মধ্যেই সংযমশিক্ষারও স্থান আছে। আমরা যখন দৃষ্টি এবং স্পর্শকে লোভের তাড়না থেকে রক্ষা করতে শিখি তখনই সেই দৃষ্টিতে সুন্দরের চিত্ররেখা ধরা পড়ে, সেই স্পর্শে কোমলতার অনুভব রক্ষা পায়। সংযমের এটাই সদর্থ। এই হল প্রথম কথা।

এরপর একটা দ্বিতীয় কথা আছে। নেহাত নান্দনিকবৃত্তির ওপর যৌনতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলেও বিপদ থেকে যায়। তাতে যৌনতা একরকমের বিলাস হয়ে ওঠে, অন্তত সেই সম্ভাবনা প্রবল। এর অকাট্য প্রমাণ ছড়িয়ে আছে অভিজাতশ্রেণীর ইতিহাসের অধ্যায়ে অধ্যায়ে।

সুন্দরকে রক্ষা করবার জন্যও নিতান্ত সৌন্দর্যপ্রিয়তাকে অতিক্রম করে যেতে হয়। এই থেকেই আসে যৌনতার ও প্রেমের একটা তৃতীয় স্তরের কথা। এখানে ভোগটা প্রধান কথা নয়, পুজোটাই প্রধান। এ যেন আরতির ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে দেবীর মুখ দর্শনের মতো। সঙ্গমও সেখানে হয়ে ওঠে অঙ্গ দিয়ে অঙ্গের পুজো। রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতর যে বারবার প্রেম ও পূজার পার্থক্য মুছে যায় সেটা এইখানে অর্থবহ। প্রেমের স্পর্শে শুধু প্রেমাস্পদের নয়, বিশ্বেরই একটা রূপান্তর ঘটে। আলোরও রং বদলে যায়, সমস্ত আকাশ ঝুঁকে পড়ে আমাদের চোখে চোখ রাখে, হৃদয়ে প্রবেশ করে। সংযম, প্রেম, পুজো সবই সেখানে একাকার হয়ে যায়। তখন আর আলাদা করে সংযমরক্ষার ক্লেশে চরিত্র কঠিন হয়ে ওঠে না, বিচ্ছিন্ন ভোগতৃষ্ণায় মন ক্লান্ত হয় না। চেতনার এই অবস্থাকে আমরা স্থায়ীভাবে যদি-বা লাভ করতে না পারি তবু এটাকে সত্য বলে জানাতেই দিগভ্রান্তি দূর হয়।

মানুষের চেতনার বিবর্তনের এই এক বৈশিষ্ট্য যে জড়তার ভিত্তি থেকে যাত্রা শুরু তারপর স্তর থেকে শুরান্তরে গুণগত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে চেতনা অগ্রসর হয়ে চলে। কোনো স্তরকেই একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। তবু গতিরেখা সম্বন্ধে একটা বোধ চাই, তাকেই বলি দিগবোধ। দিগবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে সব বিধানই শেষ অবধি তার সদর্থ হারায়।

॥ তিন ॥

কিছুক্ষণ আগে কয়েকটি প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, সেইখানে আবার ফিরে যাওয়া যাক। স্ত্রীপুরুষের যৌনসম্পর্ক বিষয়ে স্থানীয় আচারবিচারে বিস্তর পার্থক্য আছে, আমাদের মূল জিজ্ঞাসা সেইসব নিয়ে নয়। এমন কিছু সাধারণ বিধানই আমাদের অনুসন্ধানের বস্তু যার সঙ্গে এ-যুগের প্রাগ্রসর চেতনা ও মূল্যবোধের সামঞ্জস্য আছে।

তিনটি বিধানকে বোধ করি এইরকম মূল বিধান বলে চিহ্নিত করা সম্ভব। বিবাহ বলে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি নাও থাকে তবু এইসব বিধানের যৌক্তিকতার তারতম্য ঘটে না। বিধান তিনটি এইরকম

নারী অথবা পুরুষ কেউই এমন কোনো অধিকার নিজের ন্য দাবি করবেন না অপরের জন্য যে-অধিকার তিনি মেনে নিতে রাজী নন।

পারস্পরিক প্রীতি ও সদিচ্ছার ভিত্তিতে ছাড়া যৌনসম্পর্ক শ্রদ্ধেয় নয়; যৌনতার নেশা অন্যসব নেশাগ্রস্ততার মতোই বন্ধনবিশেষ, অতএব সে বিষয়ে সতর্কতা আবশ্যক।

এই তিনটি শর্ত অথবা বিধান নিয়ে এবার সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।

জনজীবনে আজ নারী ও পুরুষের সমান অধিকার অন্তত সংবিধানে স্বীকৃত। যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই সাম এখনও মৌখিক স্বীকৃতিও লাভ করেনি। দীর্ঘ অভ্যাস ও ঐতিহ্য সাম্যের পথে বাধা হয়ে আছে। এইসব বাধা ক্রমে দুর্বল হয়ে আসছে। নতুন সংকটের সম্ভাবনা অস্বীকার না করেও বলা যায়, ইতিহাসের ঝোঁক সাম্যের দিকে।

প্রশ্ন উঠবে, স্ত্রী ও পুরুষের প্রকৃতিতে কি কোনো পার্থক্য নেই? কোনো ব্যক্তিই কিন্তু এক অবিমিশ্র ধাতুতে গঠিত নয়। প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দুই ভিন্ন ধাতুর মিশ্রণে গঠিত, যার একটিকে নারী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, অন্যটিকে পুরুষ। অবশ্য এই মিশ্রণ ঘটে বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে। সমান অধিকার লাভের পরও বিভিন্ন ব্যক্তি নিজ নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী আত্মপ্রকাশের ভিন্ন ভিন্ন উপায় বেছে নেবে এইরকমই আশা করা যায়। নারীপ্রকৃতি বলে যে-কোমলতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেটা মানবপ্রকৃতিরই একটা বিশেষ অঙ্গ, তার মূল্য অনেক। “পুরুষ হয়ে উঠবার অস্বাভাবিক অতিচেষ্টায় সমাজের অকল্যাণের সম্ভাবনা আছে। অধিকারের অসাম্য কিন্তু এই অস্বাভাবিক চেষ্টাকেই আজ প্ররোচিত করছে। নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছায় পরস্পরকে কিছু বিশেষ সুবিধা ছেড়ে দিতে। পারে, সেটা ভিন্ন কথা। বিশেষ অধিকার দাবি করতে গেলে এ-যুগে কলহই বাড়বে। সাম্যের বিধানই শ্রেয়।

মানুষে মানুষে সম্পর্ক যখন প্রীতি ও সদিচ্ছার আচ্ছাদনে আবৃত নয় তখন সেটা সুন্দর নয়, আনন্দবর্ধক নয়। এইরকম সম্পর্কও সংসারে কখনো কখনো রক্ষা করে যেতে হয়। অবস্থাবিশেষে সেটাই যুক্তিসঙ্গতও হতে পারে। যেমন, টাকা ধার নেবার পর প্রীতির সম্পর্ক না থাকলেও টাকা ফেরত দেবার কর্তব্যটা থেকেই যায়। কিন্তু প্রীতি ও সদিচ্ছা থেকে বিচ্ছিন্ন যৌনসম্পর্ক না রাখাই ভালো।

এমনও হতে পারে যে, প্রীতি সদিচ্ছা সবই আছে, তবু স্ত্রী যৌনসম্পর্ক ইচ্ছা করেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের ইচ্ছাটাই স্ত্রী মেনে নেন। তাতে অন্তত বাহ্যত সমস্যাটা থাকে না। তবে সব ক্ষেত্রে এমন হয় না। সাধারণ বিধান হিসেবে এটাই মান্য যে, অনিচ্ছুক স্ত্রীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক ত্যাগ করাই উচিত।

এর একটা বড় উদাহরণ লোকমুখে আমি শুনেছি। এদেশের একজন শ্রদ্ধেয় নেতার জীবনের কথা সেটা। তরুণ বয়সে তিনি বিবাহিত হন। বিবাহের পর বিদ্যাসংগ্রহের জন্য বিদেশে যান। স্ত্রী থেকে গেলেন গান্ধীজীর আশ্রমে। পুরুষটি ফিরে এসে দেখেন, স্ত্রী আজীবন ব্রহ্মচর্যব্রত গ্রহণ করবেন বলে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সব কথা শুনে স্বামী বললেন, তিনি নিজে যৌনসম্পর্কই ইচ্ছা করেন, সেটাই তাঁর চোখে সুন্দর; কিন্তু স্ত্রীর যদি অনিচ্ছা থাকে তবে সেই অনিচ্ছাকেই তিনি মান্য করে চলবেন। তিনি তাই করেছিলেন। এই নায়কটির সামনে অবশ্য অন্য একটি পথও খোলা ছিল। তিনি অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারতেন, তাতে দোষ হত না, গান্ধীজীরও তাতে অমত ছিল না। তবে সেই পথ তিনি বেছে নেননি। এই স্বামীস্ত্রীকে আমি দেখেছি। এঁদের ভিতর প্রীতি অথবা সদিচ্ছার অভাব ছিল না।

প্রীতি ও শ্রদ্ধাটাই আসল কথা। এরপর যৌনসম্পর্কেও দোষ নেই, ব্রহ্মচর্যেও দোষ। নেই। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি নিজ নিজ স্বভাব অনুযায়ী পথ বেছে নেবেন। অধিকাংশ মানুষের পক্ষে যৌনসম্পর্ক রক্ষা করাটাই স্বাভাবিক, সেটাই সুন্দর, মুক্তির পথে সহায়ক।

তবে সতর্কতা প্রয়োজন। যৌনতার ভিতর একটা নেশা আছে। সতর্কতার অভাবে সেটা বন্ধন হয়ে উঠতে পারে। অধিকাংশ নেশারই ধর্ম এটা। আরম্ভে সে সুখদায়ক। সেই সুখ মানুষকে আকৃষ্ট করে। তারপর তৃষ্ণা বেড়ে চলে। শেষে এমন হয় যে, তৃষ্ণাটাই প্রধান। নেশা থেকে তখন সুখ কতটা পাওয়া গেল সেটা ভাবনার ভিতর থাকে না, তৃষ্ণা না মিটলে যন্ত্রণা অসহ্য হয়ে ওঠে এটাই জরুরী কথা। এটাই নেশাগ্রস্ত মানুষের বন্ধনের দশা।

যৌনতাকে মুক্তির পথ হিসেবে পেতে হলে তাই কিছুটা অনাসক্তি প্রয়োজন। এইখানেই সংযমের সঙ্গে আনন্দের যোগ। জীবনে যা কিছু আকর্ষণীয় সেই সবই মনে মনে ত্যাগ করে, “ঈশ্বরের পায়ে সমর্পণ করে, তবেই ভোগ করবার কথা বলেছেন আমাদের প্রাচীন ঋষিরা। একটা মূল্যবান অন্তদৃষ্টিকে তাঁরা স্মরণীয় ভাষায় প্রকাশ করেছেন। যাঁরা নিরীশ্বরবাদী তাঁরা কথাটা অন্যভাবে বলতে পারেন। মূল কথাটা বুঝতে পারলেই হল, তা নইলে বিপদ।

চার

আমাদের এই যুগটা যন্ত্রের যুগ। চারিদিকে যন্ত্র ও যান্ত্রিকতার জয়জয়কার। মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর এর প্রবল প্রভাব আজ প্রশ্নাতীত।

যৌনতার ক্ষেত্রেও যান্ত্রিকতার প্রভাব এসে পৌঁছেছে। ক্রমেই দেখা যাচ্ছে যে, নতুন প্রজন্মের মানুষ যৌনসুখের জন্য বিপরীত লিঙ্গের ওপর একান্তভাবে নির্ভর করতে আর রাজী নয়। আসলে মানুষ অথবা মনুষ্যত্বের ওপর নির্ভর করতেই সে অনিচ্ছুক। যন্ত্রের সাহায্যেই লাভ করা যায় যৌনসুখ অথবা তার প্রতিকল্প। “অশ্লীল’ চিত্রও এইরকম যন্ত্রবিশেষ। আরো নানা উপায় আছে, কোনো কোনো নেশা যেমন। যন্ত্রের একটা বড়। সুবিধা এই যে, সে মানুষের দাস, কতার ইচ্ছাধীন। তাকে যখন খুশি ডেকে আনা যায়, যখন খুশি ফিরিয়ে দেওয়া যায়। বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মন আছে, স্বাধীন ইচ্ছা আছে, অতএব তার ওপর নির্ভরতায় নানা অনিশ্চয়তার দুঃখের ঝুঁকিও আছে। যন্ত্রে অভ্যস্ত। মানুষ দুঃখকে বড় ভয় করে।

কিন্তু যন্ত্রের একটা বিষম সীমাবদ্ধতা অগ্রাহ্য করা যায় না যন্ত্রের আত্মা নেই। যন্ত্র আমাদের ভোগসুখ দিতে পারে, তার বেশি কিছু দিতে পারে না। যদি পারে তবে সে যন্ত্র। নয়, যেমন সৃষ্টিধর্মী শিল্পসাহিত্য। ভোগসুখের বিপদ এই, সে তৃষ্ণা বাড়িয়ে তোলে, শেষ অবধি সুখের চেয়ে তৃষ্ণাটাই বড় হয়ে ওঠে। ভোগের যন্ত্র তখন আর দাস থাকে না, মানুষই যন্ত্রের দাস হয়। আত্মিক যোগের আনন্দের সঙ্গে দুঃখবেদনা মিশে আছে, তাকে গ্রহণ করতে জানলে তাতে চেতনার গভীরতা বাড়ে। যন্ত্রিক ভোগবাদ এই গভীরতাকে ব্যঙ্গ করে। মানুষের চেতনাকে সে কিন্তু শেষ অবধি একটা ক্লান্ত হতাশার দিকে ঠেলে দেয়।

এই ভোগবাদকে কী দিয়ে ঠেকাবো? অতীত থেকে এসেছে পাপবোধ। এ-যুগের যৌনবিচারে পৃথিবীময় যে-সংকট দেখা দিয়েছে তার মূলে আছে, প্রচণ্ড পাপবোধ আর তীব্র ভোগবাদের এক অস্থির সহাবস্থান। এদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যে সংযমকে মান্যতা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পাপবোধ অথবা দেহ নিয়ে লজ্জাবোধের প্রাবল্য সেখানে ছিল না। এদেশের আকাশের নিচে দিগম্বর জৈন আর অজন্তার নারীরা স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছে। মানুষ যে পাপী এই বিপরীত ভাবধারা এসেছে পরবর্তী কালে, বিশেষত আধুনিক যুগে। তারই পাশে পাশে ভোগবাদের জোয়ার কেঁপে উঠেছে দুনিয়াজোড়া। নতুন ভোগবাদ আজ আর অভিজাতবর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে আরো নিচের তলায় নিম্ন মধ্যবিত্তের ভিতরে, যেখানে মানুষ পাপবোধে অভ্যস্ত। এই দুই অসমঞ্জস ভাব পরস্পর পরস্পরকে উত্ত্যক্ত করে চলেছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে লোভ ও হিংস্রতা।

ভোগবাদকে পাপবোধ দিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। সেজন্য চাই অন্য এক সদর্থক জীবনদর্শন। করুণা, সংযম, প্রকৃতির কাছাকাছি আরো সরল জীবনযাপন, এইসব হতে পারে সেই সদর্থক দর্শনের মূল উপাদান। আমরা যারা এ-যুগে বাস করেছি, আমাদের ব্যর্থ সাধনের শিক্ষা এই। সেই প্রেমই উদ্ধার করে যে-প্রেম করুণা ও অনাসক্তিকে অন্তরে। গ্রহণ করেছে। সংকটের ভিতর দিয়ে আশা করা যায় মানুষের সমাজ অবশেষে এই উপলদ্ধির দিকেই যাবে। কিন্তু কতদিনে? আরো কত হতাশার শেষে?

আমাদের বাড়িতে শ্যামলী নামে মেয়ে কাজ করত। স্বামী তাকে ছেড়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে বাড়িতে যে-মহিলারা কাজ করেন তাঁদের অনেকেই স্বামীপরিত্যক্তা। তাঁদের অনেক কষ্ট। কিন্তু দুঃখ আছে শুধু গরিবের ঘরেই নয়। শ্যামলী একদিন বলেছিল, আমি অনেক বাড়িতে কাজ করেছি, দেখেছি বড়লোকের বাড়িতেও দুঃখ কম নয়, অশান্তি কম নয়। শ্যামলী নিজে দুঃখী। তাই ওর কথাটা আমার মনে থেকে। গেছে। দুঃখের কারণটা যখন কেবলই আর্থিক তখন তার সমাধান খুঁজে পাওয়া তত কঠিন নয়, যদিও সমাধানটাকে কার্যকর করে তোলা সহজ নয়। দুঃখের কারণ যখন প্রধানত আর্থিক নয় তখনই তার সমাধানও জটিল। তাই এত কথা বলা।

এই আলোচনা আরম্ভ হয়েছিল যৌনপ্রেমের কথা দিয়ে। ধাপে ধাপে আমরা পৌঁছে গেছি অনাসক্তি ও করুণার প্রসঙ্গে যাতে প্রেম দুর্গতি থেকে রক্ষা পায়। সেই শূন্যতায় প্রবেশলাভের প্রস্তাব এটা নয়, অধিকাংশের জন্য বিধান যেটা হতে পারে না। দেহাশ্রয়ী প্রেম ও দেহাতীতের ভিতর পুনঃপুনঃ আবর্তনপ্রত্যাবর্তনের পথের কথাই আমরা বলতে চেয়েছি, জীবনের গতিময়তাকে যা অর্থপূর্ণ করে তোলে, দান করে অশেষ মূল্য। দেশ, ৪ নভেম্বর (১৯৮৯)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *