৭.৫ সারা

সারা

বৈরুতের অবরোধ খৃস্টানরা নয়, আমার ঈমান নিলামকারী ভাইয়েরা ব্যর্থ করেছে- সুলতান আইউবী তার সালারদের বললেন- আমি পারস্পরিক খুনাখুনি, রক্তারক্তি থেকে বিরত থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সম্ভব মনে হচ্ছে না।

বৈরুত অবরোধের ব্যর্থতা ছিলো সুলতান আইউবীর দ্বিতীয় পরাজয়। এই ব্যর্থতায় তিনি কিছুই হারাননি বটে, তবে অর্জনও হয়নি কিছুই। এ কারণে এই ব্যর্থতাকে তিনি পরাজয় বলেই ধরে নেন। তিনি না হোন, তার ইন্টেলিজেন্স এখানে অবশ্যই পরাজিত হয়েছে। বৈরুতের খৃস্টান বাহিনী সময়ের আগেই তথ্য পেয়ে গিয়েছিলো, সুলতান আইউবী বৈরুত অবরোধ করতে আসছেন। খৃস্টানরা এ সংবাদ পেয়েছে কায়রো থেকে। অথচ সুলতান তাঁর হাইকমান্ডের সালারগণ ব্যতীত কাউকে তার পরিকল্পনা জানতে দেননি।

একে আপনি পরাজয় বলবেন না- সুলতান আইউবীর হতাশা দেখে এক সালার বললেন- বৈরুত যেখানে ছিলো সেখানেই আছে এবং সেখানেই থাকবে। আমরা নগরীটা পুনরায় আক্রমণ করবো।

এতো বড় একটা শিকার আমার হাত থেকে বেরিয়ে গেছে- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন- আমি নগরীটা অবরোধ এবং দখল করতে এসেছিলাম। কিন্তু ফল হলো বিপরীত। আমি নিজেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়লাম এবং অবরোধ প্রত্যাহার করে পেছনে সরে আসতে বাধ্য হলাম। এটা পরাজয় নয় তো কী? আমাদেরকে মেনে নেয়া উচিত এটা পরাজয়। আমার সালার-উপদেষ্টাদের মধ্যেও গাদ্দার আছে।

তাঁবুতে নীরবতা নেমে আসে। কারো মুখে টু-শব্দটি নেই। সে সময়ে সুলতান আইউৰী নাসীবা নামক স্থানে সেনা ছাউনিতে অবস্থান করছিলেন। বহু দিন কেটে গেছে। বাহিনী অনেক ক্লান্ত। বহু জখম ও আছে। সুলতান তাঁর এই বাহিনীকে কায়রো থেকে বৈরুতে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিয়ে এসেছিলেন। বাহিনী কয়েক মাসের পথ কয়েক দিনে অতিক্রম করে এসেছে। গন্তব্যে এসে পৌঁছানোর পরপরই খৃস্টানদের অবরোধ থেকে বের হওয়ার জন্য তাদেরকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লড়তে এবং পরক্ষণেই দ্রুতগতিতে পিছনে সরে আসতে হয়েছিলো। বাহিনীকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম দেয়ার জন্য সুলতান আইউবী নাসীবা নামক স্থানে ছাউনি স্থাপনের নির্দেশ দেন। কিন্তু বিশ্রাম ছিলো শুধু বাহিনীর জন্য। সুলতানের নিজের কোন বিশ্রাম নেই। চোখে ঘুমটি পর্যন্ত নেই তাঁর। দিনে হয় তাঁবুতে পায়চারি করছেন কিংবা বাইরে বের হয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছেন। সালারদের সাথেও তেমন কথা বলছেন না। ঠিক এমন এক অবস্থায় এক সালার তাকে বললেন, আপনি একে পরাজয় বলবেন না। সুলতানের উত্তর শুনে সালার নিশ্চুপ হয়ে যান। সুলতান তাঁবুতে পায়চারি করতে থাকেন। সেখানে আরো একজন সালার ছিলেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত উভয়ে নীরব থাকেন। লতান আইউবীর মেজাজে রাগ বলতে ছিলো না। তথাপি সালারগণ তার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতেন।

তোমরা দুজনে কী চিন্তা করছো? সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন।

আমি ভাবছি, আপনি যদি এভাবে হতাশা ও ক্ষুব্ধ অবস্থায় থাকেন, তাহলে আপনার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত আরো ক্ষতিকর হতে পারে- এক সালার বললেন- রামাল্লার পরাজয়ের সময়ও আমি আপনাকে এই অবস্থায় দেখিনি। আপনি ঠাণ্ডা হোন এবং এই আবেগময় অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন।

আর আমি ভাবছি- অপর সালার বললেন- কাফেররা আমাদের মূলে ঢুকে পড়েছে। এই মুহূর্তে আমরা যে ভূখণ্ডে অবস্থান করছি, এটি আমাদেরই ভূমি। আমাদের যুদ্ধ খৃষ্টানদের সঙ্গে। আর আমাদের লক্ষ্য ফিলিস্তীনের স্বাধীনতা। অথচ মুসলিম আমীরদের একজনও আমাদের সঙ্গে আসেনি। ইযযুদ্দীন-ইমাদুদ্দীন কোথায়? তারা কি আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়নি যে, প্রয়োজনের সময় তারা আমাদেরকে সৈন্য দেবে? তাদের এই আচরণ প্রমাণ করে, এখনো তারা খৃস্টানদের হাতের পুতুল। তো আমরা কি এভাবেই পরস্পর লড়াই করতে থাকবো?

সুলতান আইউবী তাঁবুতে পায়চারি করছিলেন। তিনি দাঁড়িয়ে যান। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- আমার রাসূলের উম্মতের পতন শুরু হয়ে গেছে। মুসলমান যখন বিজাতির অনুসরণ শুরু করে, তার পরিণতি এটাই হয়, আমরা এখন যা প্রত্যক্ষ করছি ও ভুগছি। ইহুদী-খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে তাদের গোলাম বানানোর জন্য মানব স্বভাবের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটাকে কাজে লাগায়। তা হচ্ছে লোভ। ক্ষমতার লোভ, রাজা-রাজপুত্র হওয়ার লোভ এবং আমি তুলার ন্যায় নরম পালিচার উপর দিয়ে হাঁটবো আর সাধারণ মানুষ খালি পায়ে আমার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকবে এই লোভ। এসব লোভ যখন মানুষের অন্তরে ঢুকে পড়ে, তখন হৃদয় থেকে ঈমান চলে যায়। বিবেকের উপর এমন আবরণ পড়ে যায় যে, তার কাছে জাতীয় চেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধ বলতে কিছু থাকে না। এমন মানুষ অর্থ, ক্ষমতা আর বিলাসিতা ছাড়া কিছুই বুঝে না। একজন মানুষ যখন এই চরিত্র ধারণ করে, তখন সে নিজ ধর্ম ও দেশ-জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাকে গৌরবজনক চরিত্র মনে করে। খৃস্টানরা আমাদের অধিকাংশ আমীরকে এই স্তরে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। তারা তাদের সভ্যতার বেহায়াপনাকে মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের সভ্যতা যখন বদলে যায়, তখন ধর্ম একটা দুর্বল খোলসে পরিণত হয়, যা খুলে ছুঁড়ে ফেলা যায় এবং জাতিকে ধোকা দেয়ার জন্য গায়ে জড়িয়েও নেয়া যায়।

উভয় সালার চুপচাপ সুলতান আইউবীর বক্তব্য শুনছেন। সুলতান থেমে থেমে বলছিলেন। এবার থেমে যান। আবার গভীর একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন- তোমরা বুঝতে পারছে না, আমি কর্মক্ষেত্রের পুরুষ, এখন কিনা তাবুতে দাঁড়িয়ে নারীর ন্যায় কথা বলছি। এটিও আমার পরাজয়। এই মুহূর্তে আমাকে বাইতুল মুকাদ্দাস থাকার কথা ছিলো। আমার কপাল মসজিদে আকসয় সেজদা করতে ছটফট করছে। যেসব মুজাহিদ ফিলিস্তীনের মর্যাদা ও আযাদীর জন্য জীবন ত্যাগ করেছে, আমাকে তাদের রক্তের বদলা নিতে হবে।

সুলতান আইউবীর কণ্ঠে আক্রোশ চড়ে গেছে। তিনি পায়চারি করতে করতে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন- তোমরা কি সেই শিশুদের মুখ দেখাতে পারবে, যাদেরকে আমার নির্দেশ ও প্রত্যয় এতীম করেছে? তোমরা কি সেই নারীদের সম্মুখে গিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে, যাদের স্বামীরা আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুলে আমাদের সঙ্গে এসেছিলো এবং তাদের রক্তাক্ত দেহ ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয়েছে? তোমরা সেই সুদর্শন যুবকদের কীভাবে ভুলতে পারবে, যারা আমাদের থেকে বহু দূর দুমশনের অঞ্চলে গিয়ে শহীদ হয়েছে? আমি তো তাদের মায়েদের সম্মুখে যেতে ভয় পাই। ভয়টা এই জন্য যে, যদি কেউ বলে বসে, হয় আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও, নতুরা আমাকে প্রথম কেবলায় নিয়ে চলো। ওখানে গিয়ে আমি আমার পুত্রের শাহাদাঁতের শুকরিয়া নামায আদায় করবো। তখন আমি সেই মাকে কী জবাব দেবো?

শহীদদের মুক্ত বৃথা যাবে না মাননীয় সুলতান- কণ্ঠটা কমান্ডো বাহিনীর অধিনায়ক সারেম মিসরীর, যিনি সুলতান আইউবীর তাবুর দরজায় এসে দাঁড়িয়ে ভেতরের কথোপকথন শুনছিলেন।

কোন শহীদের মা নিজ পুত্রের রক্তের হিসাব চাইবেন না। রাসূলের কালেমা পাঠকারী মায়েদের দুধ যমযমের পানির চেয়ে পবিত্র ও মর্যাদাবান। সেই দুধে প্রতিপালিত পুত্ররা আপনার নির্দেশে নয়- আল্লাহর আদেশে যুদ্ধ করছে। তাদের রক্তের দায় আপনি নিজ কাঁধে তুলে নেবেন না। আপনি গাদ্দারদের রক্তের কথা বলুন। আমাদের তারবারী গাদ্দারদের রক্তের পিয়াসী।

তুমি আমার মনোবলে জীবনদান করেছে সারেম- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন- আমার এই দুই বন্ধুও আমাকে বলছিলো, আপনার হতাশ ও আবেগপ্রবণ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

কোনই প্রয়োজন নেই- সারেম মিসরী বললেন- পরাজয় পরাজয়ই। কিন্তু স্থায়ী নয়। আমরা এই পরাজয়কে বিজয়ে পরিবর্তন করে ফেলতে পারি এবং তা করে দেখাবো ইনশাআল্লাহ।

বিষয়টা যদি রণাঙ্গনের হতো, তাহলে একটি বাহু কাটা গেলেও আমি নিরাশ ও পেরেশান হতাম না- সুলতান আইউবী বললেন- সমস্যা তো হলো দুশমন মাটির নীচে চলে গেছে। ইহুদী-খৃস্টানরা আমাদের জাতির মাঝে এমন সব বিষাক্ত প্রভাব বিস্তার করছে, যা অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও যাদুময়। দেশের জনগণ ও সেনাবাহিনী সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত। সৈনিক ও সাধারণ জনগণ এসব প্রভাব গ্রহণ করে না। এই বিষ বরণ করে নিচ্ছে এমন গুটিতক মানুষ, জাতির উপর যাদের প্রভাব বিদ্যমান। এরা হচ্ছে আমীর ও শাসক গোষ্ঠী। কতিপয় ধর্মীয় নেতাও এদের অন্তর্ভুক্ত। আছে কিছু সালারও, যারা প্রজাতন্ত্রের শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এরা ঈমান নিলামকারীদের দল, যারা সহজ-সরল মানুষগুলোকে ধর্মের ধোকা দিয়ে তাদের মাঝে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করছে এবং তাদের মুসলমান ভাইদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছে এবং নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। বিজাতিরা এ জাতীয় মুসলিম আমীর ও শাসকদেরকে তাদের অনুগত বানিয়ে নিচ্ছে এবং তাদের দ্বারা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী কাজ করাচ্ছে। এরা সাধারণ মানুষকে ধর্মের ধোকা দিয়ে নিজেদের চরিত্রটাকে আড়াল করে রাখছে।

কিন্তু আমরা আলেম নই- এক সালার বললেন- আমরা মসজিদের খতিব-ইমাম নই যে তরবারী ফেলে দিয়ে আমরা জনসাধারণকে ওয়াজ করে বেড়াবো। আমাদেরকে এই সমস্যার সমাধান তরবাররি মাধ্যমেই করতে হবে। এই পাথরগুলোকে ঘোড়ার পায়ের তলায় পিষে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলতে হবে।

এরা কুরআন অস্বীকারকারী- সুলতান আইউবী বললেন- কুরআনের নির্দেশ অত্যন্ত স্পষ্ট যে, তোমরা কাফেরদেরকে বন্ধু ভেবো না। তাদের কথা শোনো না। তোমরা জানো না, তাদের অন্তর আমাদের বিরুদ্ধে পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ।

এরা নামের মুসলমান- সারেম মিসরী বললেন- কুরআনের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।

এই পরিস্থিতি অত্যন্ত ক্ষতিকর যে, তারা কুরআনও হাতে তুলে রেখেছে, আবার কাফেরদের ইশারায়ও নাচছে- সুলতান আইউবী বললেন- জাতি সবসময় এমন নেতাদের হাতেই প্রতারিত হয়েছে, যাদের হাতে কুরআন আর অন্তরে ক্রুশ। এরা আযানের শব্দ শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায়। কিন্তু তাদের হৃদয়ে বাজে গীর্জার ঘণ্টা। জাতি তাদের আসল রূপ দেখতে পায় না, তাদের হৃদয়ের আওয়াজ শুনতে পায় না। এ কারণেই আমরা একটি গৃহযুদ্ধে একে অপরের রক্ত ঝরিয়েছি এবং আরেকটি গৃহযুদ্ধের তরবারী আমাদের ঘাড়ের উপর ঝুলছে।

এই তুফান আমরা প্রতিহত করবোই- এক সালার বললেন- আপনি আমাকে এ কথা বলার অনুমতি দিন যে, এখন আর আমরা কোন সন্ধি চুক্তি করবো না। আমাদেরকে আপন ভাইদের রক্ত ঝরাতে হবে এবং তাদের হাতে আমাদেরকে প্রাণও দিতে হবে।

সুলতান আইউবীর চেহারা মলিনতায় ছেয়ে যায়। তার চোখ দুটো যেনো দিগন্তে কিছু একটা দেখছে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, তার দৃষ্টি অনাগত শতাব্দীগুলোর বুক বিদীর্ণ করে ফিরছে। তাঁবুতে পুনরায় গভীর নীরবতা নেমে আসে। তিন সালার তাদের সুলতানের এই প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত আছেন।

আমার প্রিয় বন্ধুগণ!- সুলতান আইউবী বললেন- আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার রাসূলের উম্মত আপসে লড়াই করে করে নিঃশেষ হয়ে যাবে। ইহুদী-খৃস্টানরা তাদেরকে আজীবন গৃহযুদ্ধে লিপ্ত করে রাখবে। ক্ষমতার মোহ ভাইকে ভাইয়ের শত্রুতে পরিণত করে রাখবে। ফিলিস্তীন রক্তে লাল হতে থাকবে। মুসলিম শাসকগণ শতধা বিভক্ত হয়ে বিলাসিতায় ডুবে থাকবে। আমাদের প্রথম কেবলা আল্লাহর রাসূলের উম্মতকে চীৎকার করে ডাকতে থাকবে; কিন্তু কোন মুসলমান সাড়া দেবে না। কেউ যদি ফিলিস্তীনের মাটিকে মুক্ত করাতে উঠে দাঁড়ায়, তো সে হবে আমাদেরই ন্যায় কোন এক পাগল। এই পাগলদেরকে তাদেরই মুসলিম শাসকগণ ধোকা দেবে এবং তলে তলে বন্ধু হয়ে থাকবে। তোমরা বলেছে, আমরা এই ঝড় প্রতিহত করতে পারবো। কিন্তু আমাদের মৃত্যুর পর এই ঝড় পুনরায় উত্থিত হবে।

তখন আবার আরেকজন সালাহুদ্দীন জন্মলাভ করবেন- সালার সারেম মিসরী বললেন- তখন আরেকজন মূরুদ্দীন জঙ্গীর আবির্ভাব ঘটবে। মুসলিম মায়েরা মুজাহিদ জন্ম দিতে থাকবে।

আর এই মুজাহিদরা বিলাসী শাসকদের হাতের খেলনা হয়ে থাকবে সুলতান আইউবী খানিকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন- আর সেই সময়টাও এসে যাবে, যখন সেনাবাহিনীও বিলাসী সৈনিকে পরিণত হবে এবং তাদের সালার কাফেরদের হাতে খেলতে থাকবে।

বলতে বলতে সুলতান আইউবী এমন ধারায় থেমে যান, যেনো তার কিছু মনে পড়ে গেছে। তিনি পালাক্রমে তিন সালারের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন- কিন্তু আমরা কততক্ষণ পর্যন্ত এভাবে কথা বলতে থাকবো? আমরা চারজন একে অপরকে বক্তব্য শোনাচ্ছি। আল্লাহর সৈনিকরা বক্তৃতা করে বেড়ায় না। আমাদেরকে কাজ করতে হবে। আমরা কর্মক্ষেত্রের পুরুষ। সারেম! তুমি নিশ্চয়ই আমার প্রথম নির্দেশনা মোতাবেক তোমার গেরিলা বাহিনীকে আমার বর্ণিত স্থানগুলোতে ছড়িয়ে রেখেছে। আর তুমি তো জানো, আমাদের এই ছাউনি অঞ্চল কিরূপ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ভালোভাবেই জানি, মুহতারাম সুলতান!- সারেম মিসরী উত্তর দেন আমরা বৈরুতের অবরোধ প্রত্যাহার করে যখন এদিকে চলে আসি, তখন আমাদের প্রত্যাশার বিপরীতে খৃস্টানরা আমাদের ধাওয়া করতে ফৌজ প্রেরণ করেনি। কিন্তু আমরা এই আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হইনি যে, খৃস্টানরা আমাদেরকে ক্ষমা করবে। আমি পূর্ণ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি, তারা আমাদের উপর প্রকাশ্যে আক্রমণ করবে না। আমাদের উপর তারা আমাদেরই ধারায় গেরিলা আক্রমণ চালাবে। বরং তাদের গেরিলা ও কমান্ডো আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। ছাউনি অঞ্চলের অনেক দূর থেকে ফিরিঙ্গি ও আমাদের টহল বাহিনীগুলোর ঘোট ঘোট সংঘাতের সংবাদ আসতে শুরু করেছে। আমি আমার গেরিলা ইউনিটগুলোকে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে রেখেছি। আমার সন্দেহ, কাফেরদের আস্তানা বাইরে কোথাও নয়, মসুলেই বিদ্যমান এবং মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীন তাদের আশ্রয় ও সাহায্য প্রদান করছেন।

তা-ই যদি হয়ে থাকৈ, আমি সংবাদ পেয়ে যাবো- সুলতান আইউবী বললেন- ক্রুসেডারদের গোপন আস্তানা যদি মসুলেই হয়ে থাকে, তাহলে আমি তার ব্যবস্থা করবো।

সুলতান আইউবী অন্যান্য সালারদের উদ্দেশে বললেন- মুসলিম আমীরদের দুর্গগুলো মসুল ও হাবের মধ্যখানে অবিস্থত। আমারেকে সেগুলো দখল করতে হবে। আমি এই শহর দুটিকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাই। তাহলে তারা একে অপরকে সহযোগিতা দিতে পারবে না। তাদের দূতরাও চলাচলের পথ পাবে না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, যাতে আমার তরবারী কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে খাপ থেকে বের না হয়। কিন্তু তাতে আমি সফল হইনি। আমি সেই শাসক ও আমীরদের খতম করে ছাড়বো, যারা খৃষ্টানদেরকে বন্ধু বানিয়ে রেখেছে। যেসব আমীর-শাসক জাতিকে বিভ্রান্ত করছে, আমি তাদের ঘাড় মটকে তবে ক্ষান্ত হবা।

সুলতান আইউবী মানচিত্রটা বের করে সালারদের দেখাতে শুরু করেন।

***

সম্রাট বল্ডউইন বৈরুতে তার প্রাসাদে সকল সেনা অধিনায়ক এবং জনাচারেক খৃষ্টান সম্রাটকে নিমন্ত্রণ করেছেন। সকলে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বিশাল ভোজের আয়োজন। অসংখ্য খৃস্টান অতিথির মাঝে দুজন মুসলমানও মদের পেয়ালা হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে। মদ পরিবেশনকারী মেয়েগুলো এরূপ পাতলা পোশাক পরিহিত, যেনো তারা বিবস্ত্র। মদের ক্রিয়া যতোটা বাড়ছে, মেয়েগুলোর সঙ্গে অতিথিদের অসদাচরণ ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেয়েগুলোও ধীরে ধীরে অধিক থেকে অধিকতর বেহায়াপনা প্রদর্শন করে চলছে। অন্যদের তুলনায় মুসলিম অতিথি দুজনের প্রতি মেয়েদের মনোযোগ বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষভাবে দুটি মেয়ে তাদের আশপাশে ফাং ফাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোশাক ও আকার-গঠনে এই অতিথিদেরকে রাজপরিবারের সদস্য বলে মনে হচ্ছে।

এক খৃস্টান এসে বললো, সম্রাট বল্ডউইন আপনাদেরকে তার কক্ষে যেতে বলেছেন। মদের পেয়ালা রেখে দিয়ে তারা বল্ডউইনের কক্ষে গিয়ে প্রবেশ করে। তাদেরকে যে সরু গলিটি অতিক্রম করে বন্ডউইনের কক্ষে যেতে হয়েছে, তাতে এক ব্যক্তি বর্শা হাতে সামরিক কায়দায় টহল দিচ্ছিলো। বিশেষ ধরনের পোশাক পরিহিত লোকটা। কোমরে তরবারী ঝুলছে। মাথায় সীসার চকমকে শিরোম্রাণ। প্রাসাদে এ ধরনের আরো কয়েকজন লোক বুক টানটান করে বিশেষ ভঙ্গিতে টহল দিয়ে ফিরছে দেখা যাচ্ছে। এরা প্রাসাদের খাস কর্মচারি, যাদের দায়িত্ব সালারদের কক্ষের সম্মুখে উপস্থিত থেকে পাহারা দেয়া এবং নিমন্ত্রণের সময় বারান্দা ও গলিপথে টহল দেয়া। প্রদীপের আলোতে তাদের পোশাক ও চাল-চলন ভালোই লাগছে। এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকও বটে।

এই যে লোকটি মুসলমান দুজনকে বল্ডউইনের কক্ষের দিকে যেতে দেখলো, তার গায়ের রং গৌর। সে দাঁড়িয়ে গিয়ে লোকগুলোর যাওয়া দেখতে থাকে। তারা বল্ডউইনের কক্ষে ঢুকে পড়লে কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দরজার সামনে তারই ন্যায় পোশাকের আরো দুজন লোক দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। তাদের একজন তাকে বললো- হ্যালো জ্যাকব! এদিকে ঘোরাফেরা করছো কেন? ওদিকে গিয়ে পরীদের নাচ দেখো। আমরা তো এখান থেকে এক পাও নড়তে পারছি না।

জ্যাকর রসিকতার ছলে উত্তর দেয়- এই যে দুজন লোক ভেতরে প্রবেশ করলো, মুসলমান বলে মনে হচ্ছে। এরা কারা?

তোমার প্রয়োজন কী?

প্রয়োজন তেমন কিছু নেই- জ্যাকব উত্তর দেয়। মুসলমানদের প্রতি আমাদের প্রচণ্ড ঘৃণা তো। কেউ আবার ঠুস করে দেয় কিনা। তাই জিজ্ঞেস করলাম। অতিথি হিসেবে তো আমাদের তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আছে। এরা মুসলমান অঞ্চলের মুসলমান- সঙ্গী উত্তর দেয়- আমি যতোটুকু জানি, এরা মসুল থেকে এসেছে। খুব সম্ভব ইযযুদ্দীনের দূত।

সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে সাহায্য প্রার্থনা করার জন্য এসেছে বোধ হয়- জ্যাকব বললো- এই দূতদের কে বলবে সালাহুদ্দীন আইউবীর শেষ হয়ে গেছে। রামাল্লায় পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসে বৈরুত অবরোধ করতে এসেছে। তার নৌ-বহর সামনে অগ্রসর হওয়ারই সাহস পায়নি। আমার আজীবন আক্ষেপ থাকবে, আমাদের বাহিনী আইউবীর বাহিনীকে ধাওয়া করেনি। অন্যথায় আইউবী আজ আমাদের কারাগারে থাকতো।

নিজের কাজ করো দোস্ত!- এক প্রহরী তাচ্ছিল্যের সুরে বললো সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বন্দি হলে তার সাম্রাজ্যের তুমি মালিক হবে না। সম্রাট বল্ডউইন মৃত্যুবরণ করলেও বৈরুতের রাজত্ব তোমার নামে লিখে দেয়া হবে না।

জ্যাকব ওখান থেকে সরে আসে। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই বদ্ধ কক্ষটি দেখতে থাকে, যার অভ্যন্তরে মুসলমান অতিথি দুজন হারিয়ে গেছে।

***

লোক দুজন মসুলের গভর্নর ইযযুদ্দীনেরই দূত। পূর্বে উল্লেখ করেছি, সুলতান আইউবী যখন বৈরুতের অবরোধ প্রত্যাহার করে মসুলের দিকে চলে গিয়েছিলেন, তখন ইযযুদ্দীন কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদকে বাগদাদের খলীফার নিকট এই আবেদন নিয়ে প্রেরণ করেছিলেন, যেনো তিনি সুলতান আইউবীর সঙ্গে তাকে সন্ধি করিয়ে দেন। সহজ কথায়, ইযযুদ্দীন আবেদন করেছিলেন, যেনো তাকে সুলতান আইউবী থেকে রক্ষা করা হয়। খলীফা দায়িত্বটা শাইখুল উলামার হাতে অর্পণ করেন এবং সুলতান আইউবী ইযযুদ্দীনকে ক্ষমা করে দেন। ইযযুদ্দীন বাহ্যত সুলতান আইউরীর সম্মুখে অস্ত্র সমর্পণ করে চুক্তি করে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তলে তলে খৃস্টান সম্রাট বল্ডউইনের নিকট দুজন দূত পাঠিয়ে দেন। সেই দূত দুজনই এখন বল্ডউইনের কক্ষে উপবিষ্ট।

মসুলের গভর্নর বলেছেন, আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীকে ধাওয়া না করে বিরাট ভুল করেছেন- বল্ডউইনের উদ্দেশে এক দূত বললো আপনি তার বাহিনীকে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমাদের গবর্নর বলেছেন, আমি ইচ্ছে করলে লিখিত বার্তা দিতে পারতাম। কিন্তু পথে ধরা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি, আপনি দামেশক অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করুন এবং নগরীটা অবরোধ করে দখল করে নিন। আপনার বাহিনী যেনো এমন পথে এবং এতা দ্রুত দামেশক পৌঁছে যায় যে, সালাহুদ্দীন আইউবী সময় মতো দামে পৌঁছুতে না পারে। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনার আক্রমণের সংবাদ শুনে সালাহুদ্দীন আইউবী যখন এখান থেকে রওনা হবে, তখন মসুল ও হালবের বাহিনী মুখোমুখি এসে লড়াই করার পরিবর্তে আইউবীর বাহিনীর উপর কমান্ডো আক্রমণ চালাতে, থাকরে। এতে আইউবীর অগ্রযাত্রা অনেক মন্থর হয়ে যাবে আর আপনি সহজে দামেশক জয় করে ফেলতে পারবেন। আমাদের অঞ্চলগুলোতে ছোট ছোট যে কজন আমীর আছেন, আমি তাদেরকে দলে ভিড়িয়ে নেবো। আপনি তাদের দুর্গ ব্যবহার করতে পারবেন। আমি আপনার বাহিনীকে মসুলের অভ্যন্তরে অবস্থান করার অনুমতি দিতে পারি না। কারণ, তাতে প্রমাণিত হয়ে যাবে আপনার ও আমার মাঝে ঐক্য আছে। আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে বুঝ দিয়ে রেখেছি, আমি তার বন্ধু।

দূত যখন বার্তাটা বলে শোনাচ্ছিলেন, তখন বল্ডউইনের সঙ্গে তার দুজন সেনাপতিও ছিলো। ইযষুদ্দীনের দূতও সামরিক উপদেষ্টা। যুদ্ধ-বিগ্রহের ব্যাপার-স্যাপার তার ভালোভাবেই জানা আছে। বল্ডউইন তার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে থাকেন। তিনি বুঝে ফেলেছেন, এই মুসলমানরা তার জালে এসে পড়েছে। তিনি শর্ত আরোপ করতে শুরু করেন।

ইযযুদ্দীনের বোধ হয় খবর নেই, সালাহুদ্দীন আইউবীকে অসতর্ক অবস্থায় ঝাঁপটে ধরা তার পক্ষে সম্ভব হবে না- বল্ডউইন বললেন আমরা দামেশক অবরোধ করে ফেললে তিনি বিদ্যুতিতে অগ্রযাত্রা করে আমাদের উপর পেছনে এদিক থেকে আক্রমণ করবেন। আমরা দামেশক অভিমুকে অভিযান পরিচালনা করবো আর আইউবী তা জানবে না এ হতে পারে না। আইউবী চিল-শকুনের ন্যায় বহুদূর থেকে শিকার দেখে ফেলেন এবং এমনভাবে ছোঁ মারেন যে, পেছনে সরে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমরা এখনো মুখোমুখি যুদ্ধ করার ঝুঁকি মাথায় নিতে পারি না। আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আপাতত ব্যবস্থা এটুকু করেছি যে, আমরা কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা সালাহুদ্দীন আইউবীকে শান্তিতে বসতে দেবে না। এসব বাহিনীর জন্য আমাদের স্বতন্ত্র আস্তানা দরকার। আপনারা যদি এই ব্যবস্থাটা করে দেন, তাহলে সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীকে এদের দ্বারাই হেস্তন্যাস্ত করে দিতে পারি। তখন তিনি না যুদ্ধ করতে সক্ষম হবেন, না পালাতে পারবেন। আপনারা আমাদের বাহিনীগুলোকে আশ্রয়, সাহায্য ও খাদ্য ইত্যাদি সরবরাহ করতে থাকবেন। আমরা সরবরাহ করবে অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম। হাবের গবর্নর ইমাদুদ্দীনকেও বলে দেবেন, তিনি যেনো আমাদের উপর আস্থা রাখেন এবং আমাদের গেরিলা ইউনিটগুলোকে প্রয়োজনের সময় আশ্রয় ও সাহায্য দিতে থাকেন। অন্যান্য আমীর ও দুর্গপতিদেরও আপনাদের সঙ্গ দেয়া উচিত। নজর রাখতে হবে, তাদের কেউ যেনো সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে ঐক্য গড়তে না পারে।

ঐক্যের শর্তাদি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ইযযুদ্দীন তার দূতদের পূর্ণ অধিকার দিয়েছিলেন যেনো তারা শর্ত চূড়ান্ত করে আসে এবং খৃষ্টানদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়া সমীচীন মনে হবে দিয়ে আসবে। তারা একটি মাত্র স্বার্থে তাদের ঈমান একজন খৃস্টান সম্রাটের নিকট বন্ধক রেখে এসেছে, তাদের শাসন ক্ষমতা নিরাপদ থাকবে। কাজ সমাধান করে দূতরা ভোজসভায় অংশগ্রহণের জন্য উঠে চলে যায়। মনটা তাদের মূলত মদ আর মদ পরিবেশনকারী মেয়েদের সঙ্গেই ঝুলে আছে।

এই মুসলমানদের উপর বেশি আস্থা রাখবেন না- এক সেনাপতি বল্ডউইনকে বললো- প্রয়োজন হলে তারা আপনাকে কিছু না জানিয়ে সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে ঐক্য গড়তে সময় লাগবে না।

আমার একটা আস্তানা দরকার- বল্ডউইন বললেন- মসুল আমার আস্তানা হয়ে গেলে আমি ধীরে ধীরে পুরো বাহিনীই সেখানে নিয়ে যাবো এবং ইযযুদ্দীনকে সেখান থেকে উৎখাত করবো। আমাদের সকলের পরিকল্পনা এই হওয়া উচিত, আমরা মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেবো না। আমরা তাদেরকে আপসে লড়াতে থাকবো এবং ধীরে ধীরে তাদের ভূখণ্ডগুলো দখল করে নেবো। আমরা দেখেছি, মুসলমানদেরকে ভোগ বিলাসিতার ও ক্ষমতার লোভ দেখালে তারা তাদের ব্যক্তিত্ব ও ধর্ম আমাদের পায়ের উপর রেখে দেয়। ইযযুদ্দীন-ইমাদুদ্দীন ও অন্যান্য ছোটখাট মুসলমান আমীরগণ শুধু এ কারণে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরোধী যে, তারা প্রত্যেকে স্বাধীন শাসক হতে এবং বিলাসী জীবন লাভ করতে আগ্রহী। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবীর মধ্যে ভোগ-বিলাসিতা ও ক্ষমতার লোভ নেই। তিনি সকলকে এক রণাঙ্গনে ঐক্যবদ্ধ করে আমাদেরকে ফিলিস্তীন থেকে উৎখাত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু তিনি যাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাচ্ছেন, তারা যুদ্ধ-বিগ্রহে ভয় পায়। আমি আশাবাদী, ইযযুদ্দীন ও সাঙ্গরা আমাদের হাত থেকে বের হবে না। কেউ যদি বের হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে আমরা তাকে হাশিশিদের দ্বারা হত্যা করিয়ে ফেলবো।

বল্ডউইন তার সেনাপতিদের আরো কতিপয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করে বললেন- ইষুদ্দীনের এই দূতদেরকে এতো খাতির-যত্ন করো, যেনো তাদের বিবেক মরে যায় এবং তাদের জাতি-ধর্মের কথা ভুলে যায়। বল্ডউইন যে বিষয়টি কঠোরভাবে পালন করতে আদেশ করেন তাহলো, এই কক্ষে দূতদের সঙ্গে যা যা আলোচনা, কথোপকথন ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেনো তা কক্ষের বাইরে না যায়। বল্ডউইন বললেন- বৈরুতে সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা আছে।

উভয় দূত মদ ও নারীর নেশায় মাতাল হতে চলেছে। অতিথিগণ এদিক ওদিক ছড়িয়ে মদপান ও গালগল্প করছে। জ্যাকব এই দূত দুজনকে খুঁজে ফিরছে। হঠাৎ সে তাদের একজনকে আলাদা পেয়ে যায়। জ্যাকব তাকে সামরিক কায়দায় সালাম জানায় এবং জিজ্ঞেস করে- আপনি বোধ হয় মসুলের মেহমান? আমরা মসুলবাসীদের অনেক ভালোবাসি।

আমরা মসুলের শাসক ইযুদ্দীনের দূত- দূত মদমাতাল ঢুলু ঢুলু কণ্ঠে বললো- আমরা জানতে এসেছি, বৈরুতের খৃস্টানদের অন্তরে মসুলের মুসলমাদের কী পরিমাণ ভালোবাসা আছে। দূতের কণ্ঠটা যেমন টলমল করছে, তেমনি পা দুটোও কাঁপছে। লোকটা এতো বেশি পান করেছে যে, পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে জ্যাকবের কাঁধের উপর সজোরে হাত মেরে বললো- মদের এই এক গুণ যে, মানুষের অন্তর থেকে ধর্ম বেরিয়ে যায় এবং তদস্থলে ভালোবাসা এসে স্থান করে নেয়। আমি ক্রুশ ভালোবাসি। তোমার এই বর্শাটার প্রতি আমার ভালোবাসা আছে। যেদিন এই বর্শা সালাহুদ্দীন আইউবীর বুকে বিদ্ধ হবে, সেদিন আমি প্রধান সেনাপতি হয়ে যাবো।

জ্যাকব ওখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ডিউটি তো তার টহল দেয়া। সে ইযুদ্দীনের দূতকে নড়বড়ে অবস্থায় ফেলে সরে আসে। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পায়, দূতকে দুজন লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ইযযুদ্দীনের মুসলমান দূত অধিক মদপান করে চৈতন্য হারিয়ে ফেলেছে।

এখন মধ্যরাত। জ্যাকবের ডিউটি শেষ। নাচ-গান চলছে। জ্যাকব ও তার সঙ্গীদের স্থানে অন্য লোক এসে পড়েছে। জ্যাকব নিজ কক্ষে চলে যায়। ডিউটির পোশাক খুলে সাধারণ পোশাক পরিধান করে। লোকটা অনেক ক্লান্ত। এখনই তার শুয়ে পড়া উচিত। কিন্তু জ্যাকব বাইরে বেরিয়ে যায়। গতি তার অন্যদিকে। কিন্তু হঠাৎ কী যেনো ভেবে মহলের মেয়েরা যেখানে থাকে, সেদিকে চলে যায়।

এটি একটি ভবন। এর একটি অংশ এতোই সুন্দর ও মনোরম, যেনো এটি রাজকন্যাদের আবাস। এটি সেই মেয়েদের আবাস, যাদেরকে গুপ্তচরবৃত্তি, নাশকতা এবং মুসলিম আমীর-সালার ও শাসকদেরকে ক্রুশের জালে ফাঁসানোর জন্য মুসলমানদের অঞ্চলে প্রেরণ করে থাকে। খৃষ্টানদের দখলকৃত মুসলিম ভূখণ্ডের মুসলমান গোয়েন্দাদের ধরার জন্যও এদেরকে ব্যবহার করা হয়।

এই ভবনেরই অপর এক অংশে নর্তকী-গায়িকারা বাস করে। তাদের মূল্য মর্যাদা গোয়েন্দা মেয়েদের সমান না হলেও রূপ-সৌন্দর্যে কোন অংশেই কম নয়। মহলে নিমন্ত্রণ ও ভোজসভায় নেচে-গেয়ে অতিথিদের মনোরঞ্জন করা তাদের দায়িত্ব। বাইরে থেকে মেহমান আসলে নাচ-গান ছিলো অবধারিত। আজ রাত মসুলের দূতদের সম্মানে যে ভোজের আয়োজন হয়েছিলো, তাতেও নাচ-গানের ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু সারা এই অনুষ্ঠানে ছিলো না। অত্যন্ত সুন্দরী এক মেয়ে সারা। মেয়েটার গাত্রবর্ণ ও চুল-চোখের রং ইউরোপিয়ান মেয়েদের মতো নয়। বোধ হয় বৈরুতের মেয়ে। মিসর কিংবা ইউনানেরও হতে পারে। তবে কেউ জানে না, সারার বাড়ি কোথায়।

জ্যাকব যাচ্ছিলো অন্য একদিকে। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় আজ যারা নাচ-গান করলো, তাদের মধ্যে তো সারা ছিলো না। ব্যাপার কী! হতে পারে মেয়েটা অসুস্থ কিংবা এই পেশায় সে বিরক্ত। তাই পালিয়ে রয়েছে। জ্যাকব জানে, এই পেশায় সারা খুশি নয়। কারণ, এ কাজে সে নিজে আসেনি, ভুল বুঝিয়ে আনা হয়েছে। জ্যাকবও এই ভবনের কাছেই এক স্থানে থাকে এবং মহলে ডিউটি করে। একদিন এমনি এক ভোজসভায় হঠাৎ সারার সঙ্গে জ্যাকবের দেখা হয়েছিলো। সকলের দৃষ্টিতে সারা অহংকারী মেয়ে। কারো সঙ্গে কথা বলে না। কী কারণে কে জানে জ্যাকবকে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। জ্যাকবেরও সারাকে বেশ ভালো লাগে।

এক রাতে সারা মহলের কাজ-কর্ম শেষ করে নিজ কক্ষের দিকে যাচ্ছিলো। পথে জ্যাকবের দেখা পেয়ে যায়। সারা বললো- একাকী যাচ্ছি, আমাকে কক্ষে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসো।

একা যেতে ভয় পাচ্ছো বুঝি?- জ্যাকব বললো- এখান থেকে তোমাকে কেউ অপহরণ করে নিয়ে যেতে পারবে না।

এখন আর আমি অন্যের দ্বারা অপহৃত হওয়ার ভয় করি না- সারা বললো- আমার নিজেই নিজেকে অপহরণ করার পালা এসে গেছে। আমার সঙ্গে চলো। একা যেতে ভয় করি না বটে, তবে তোমার সঙ্গ কামনা করি।

সারার মতো একটি সুন্দরী মেয়ের জ্যাকবকে ভালোবাসা বিস্ময়কর কোন ঘটনা নয়। এমন সুশ্রী, সুদর্শন যুবককে কার ভালো না লাগে। আরো কয়েকটি মেয়ে ভালোবাসার ডালি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো। কিন্তু জ্যাকব কাউকে পাত্তা দেয়নি। কারণ, এ্যাকব জানে এরা অপবিত্র ও সম্ভ্রমহারা মেয়ে। জ্যাকব তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিজের দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। প্রথম সাক্ষাতে জ্যাকব সারাকেও তেমনি চরিত্রহীন মেয়ে মনে করেছিলো। কিন্তু সারার চাল-চলন, রং-ঢং তার ভালো লেগে যায়। সারা যখন জানতে পারে জ্যাকব মদপান করে না, তখন তাকে আরো ভালো লাগতে শুরু করে। একদিন সারা জ্যাকবের মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শোনার জন্য বললো- তুমি কোনদিন আমার নাচের প্রশংসা করোনি। অন্যরা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে আমার বিদ্যা ও দেহের তারিফ করে।

তুমি আমার মুখ থেকে তোমার বিদ্যার প্রশংসা কখনো শুনবে না জ্যাকব উত্তর দেয়- তবে তোমার দেহে যাদুর ন্যায় ক্রিয়া আছে। ভালো শরীর। খোদা তোমার চেহারায় যে আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন, তা তার বান্দাদের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করে ফেলে। কিন্তু নাচের অবস্থায় এই দেহটা মোটেও ভালো লাগে না। তুমি যখন কাউকে আঙ্গুলের ইশারায় নাচাও, তখনো তোমাকে ভালো লাগে না। তোমার এই দেহটা যদি কোন একজন পুরুষের মালিকানায় চলে যেতো, সে ছয় কালেমা পাঠ করে এই দেহটা সম্মান ও মমতার সঙ্গে আবৃত করে নিয়ে যেতো,তাহলে এর উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হতো। তুমি তো খোদাকে অপমান করছে।

জ্যাকব!- সারা বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- তুমি কোন্ ছয় কলেমার কথা বলছো? তাছাড়া খৃস্টানরা তো বধূদেরকে আবৃত করে নেয় না! তুমি কী বললে?

জ্যাকব ভয় পেয়ে যায়। পরক্ষণে হঠাৎ খিল খিল হেসে ওঠে বললো আমার মন-মস্তিষ্কে সবসময় মুসলমান সাওয়ার থাকে। নিজে তো বিয়ে করিনি, মুসলমানদের বিয়ে দেখেছি।

জ্যাকব বুঝাতে চেষ্টা করে ছয় কলেমা কথাটা তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সারা তার প্রতি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েই থাকে। তারপর সারা চুপসে গিয়ে ফ্যাল ফ্যাল চোখে শূন্যে অকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর অস্থিরের ন্যায় জ্যাকবের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে- তুমি মুসলমান নও তো জ্যাকব? আমার বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, তুমি গুপ্তচর। হতে পারে চাকরির খাতিরে নিজেকে খৃস্টান পরিচয় দিয়ে রেখেছো কিংবা ইসলাম ত্যাগ করে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছে।

জ্যাকব নামের মানুষ মুসলমান হয় না সারা- জ্যাকব বললো- আমার নাম গলবার্ট জ্যাকব। তুমি এতো অস্থির হয়েছে কেন সারা! মনে হচ্ছে, তোমার হৃদয়ে মুসলমানদের প্রতি এত ঘৃণা যে ছয় কলেমা উচ্চারণটাও শুনতে চাচ্ছে না।

আমি তোমাকে একটি গোপন কথা বলে দিচ্ছি- সারা বললো বিষয়টা হয়তো তোমার ভালো লাগবে না। আমার কাছে মুসলমান খুবই ভালো লাগে। তার কারণটা বোধ হয় এই যে, মুসলমান ছয় কলেমা পড়িয়ে বধূদেরকে আবৃত করে নিয়ে যায়। সারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো নারীকে যখন বিবস্ত্র করে ফেলা হয়, তখন সে অনুভব করে আবৃত হওয়ার মধ্যে তার যে আত্মিক শান্তি ও স্থিরতা ছিলো, তা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। নারীর নাচে কোন স্বাদ নেই এবং রূপের যাদু প্রয়োগ করে পুরুষদেরকে আঙ্গুলের ইশারায় নাচানোর মধ্যেও শান্তি নেই। আমি যখন একাকী আয়নার সামনে দাঁড়াই, তখন আয়নায় নিজেকে একজন ঘৃণ্য নারী বলে মনে হয়। নিজের প্রতিবিম্বকে আমি আবৃত করতে পারি না। তার উপর পর্দা চড়াতে পারি না। তবে আমার আত্মার উপর কালো আবরণ পড়ে গেছে।

পেশাটার প্রতি তোমার এতোই যখন ঘৃণা, তো পালিয়ে যাও না কেন? জ্যাকব বললো।

কোথায় যাবো?- সারা বললো- এখান থেকে পালাবো তো বেশ্যালয়ে চলে যাবো। আচ্ছা, তুমি আমাকে ভালোবাসো, নাকি আমার নাচ?

আমার সেই সারাকে ভালো লাগে, যে নাচ-গানের পেশাকে ঘৃণা করে এবং এর জন্য বেজায় বিরক্ত ও অস্থির থাকে- জ্যাকব বললো- আমি তো বলেছি, তুমি খোদাকে অপমান করছে।

আচ্ছা, তুমি ফৌজে এসেছো কীভাবে?- সারা বললো- তোমাকে গ্রামগঞ্জের কোন এক গীর্জার পাদ্রী হওয়ার প্রয়োজন ছিলো। প্রতিদিন কী পরিমাণ মদপান করো?

মদের ঘ্রাণকেও আমি ঘৃণা করি।

 তাহলে তুমি মুসলমান- সারা দৃঢ়কণ্ঠে বললো- তুমি নও তো তোমার পিতা মুসলমান ছিলেন। তুমি নারীকে আবৃত দেখতে চাও। নাচ পছন্দ করো না। মদের প্রতি তোমার প্রচণ্ড ঘৃণা। আর সম্ভবত এ কারণেই আমাকে তোমার ভালো লাগে। আমাকে তো যেই দেখে ভোগের চোখে দেখে। তুমি আমার হৃদয়ের ব্যথা বুঝো না?

বুঝি সারা- জ্যাকব বললো- এই ব্যাথাটা আমার হৃদয় অনুভব করেছে।

এরপর কয়েকবার সারা-জ্যাকবের সাক্ষাৎ ঘটে। সারা জ্যাকবের সঙ্গে হৃদয়ের কথা বলতে থাকে। মেয়েটি জ্যাকবকে একাধিকবার বলেছে, তোমার চাল-চলন ও চিন্তা-চেতনা মুসলমানদের মতো। জ্যাকব সারাকে জিজ্ঞেস করেছে, মুসলমানদের তুমি এতো বেশি পছন্দ করো কেন? সারা কখনো সন্তোষজনক উত্তর দেয়নি। তবে উভয়ে এটুকু অবশ্যই অনুভব করেছে, তারা একে অপরের হৃদয়ে ঢুকে পড়েছে।

***

জেয়াফতের রাতে জ্যাকব যখন ডিউটি শেষ করে একদিকে যাচ্ছিলো, তখন মাঝপথে সে গতি পরিবর্তন করে সারার বাসভবনের দিকে হাঁটা দেয়। জেয়াফতে সারার অনুপস্থিতির কারণ হতে পারে, সে অসুস্থ। তাই খবরটা নেয়া দরকার। উক্ত ভবনে কারো যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। তারপরও জ্যাকব ঝুঁকিটা এ জন্য বরণ করে নেয় যে, মেয়েরা সকলে আসরে চলে গেছে। চাকরানী মহিলারাও এ সময়ে ভবনে নেই। জ্যাকব অন্ধকার দিক থেকে হাঁটা দেয়। সারার কক্ষ তার জানা ছিলো। পা টিপে টিপে সে কক্ষের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দরজায় হাত লাগালে কপাট খুলে যায়। একটি কক্ষ অতিক্রম করে অপর কক্ষে চলে যায় জ্যাকব। ওখানে একটি বাতি জ্বলছে, যার ক্ষীণ আলোতে সারা শুয়ে আছে দেখা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে মেয়েটাকে একটা দুগ্ধপোষ্য নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় মনে হলো জ্যাকবের। জানালাটা খোলা। য়োম উপসগারের শীতল বায়ুর তীব্র ঝাঁপটায় সারার মাথার বিক্ষিপ্ত চুলগুলো ধীরে ধীরে নড়ছে। গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে সারা। জ্যাকব সারার কপালে হাত রাখে। এই বয়সের একটা ঘুমন্ত মেয়ের কপাল যতোটুকু গরম থাকার কথা, তার চেয়ে বেশি গরম নয়। অতএব, সারার জ্বর হয়নি।

তুমি গুলবাগিচার ফুল, যে ফুল রাজা-বাদশাহদের শয়ন কক্ষে এসে শুকিয়ে যায়- জ্যাকব মনে মনে সারাকে উদ্দেশ করে বললো- তুমি ভোরের তারকা, যেটি সূর্যের আলোতে নির্বাপিত হয়ে যায়, রাত এলে আবার জ্বলে ওঠে। তোমার জীবন রাতের আঁধারে ঘুরপাক খাচ্ছে। তোমার ভাগ্য অন্ধকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তোমাকে আমার ভালো লাগে কেন? তুমি আমাকে বারবার কেন জিজ্ঞেস করছে, আমি ছয় কলেমার উল্লেখ কেন করেছি? তুমি কোন মুসলিম মায়ের কোলে জন্মলাভ করেনি তো? তোমার শিরায় কোন মুসলমান পিতার রক্ত নেই তো? এই রহস্য উন্মোচন করবে কে? আমি তোমার জন্য রহস্য। তুমিও আমার জন্য রহস্য।

জ্যাকবের মনে পড়ে যায়, খৃস্টান সৈন্যরা মুসলমানদের কাফেলা লুণ্ঠন করে থাকে। মুসলিম মেয়েদের তুলে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে নিজেদের রঙে রঙিন করে গুপ্তচরবৃত্তি, বেহায়াপনা ও নাচ-গানের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। সারাও এমনি এক হতভাগী মেয়ে হতে পারে। অন্যথায় এই খৃস্টান জাতিটা তো অনুভূতি ও চেতনার দিক থেকে মৃত হয়ে এবং বেহায়াপনার মধ্যে পুরোপুরি জীবিত থাকতে পারে। কিন্তু সারা পারছে না কেন? জ্যাকব ভুলে যায়, সে কোথায় দাঁড়িয় আছে। কোন পুরুষের এই ভবনের দিকে পা বাড়ানোর অনুমতি নেই। কিন্তু জ্যাকব এখন সারার কক্ষে তার শিয়রে দাঁড়িয়ে। সারা তার হৃদয়ে এমনভাবেই ঢুকে পড়েছে যে, কোন ঝুঁকিই ঝুঁকি বলে মনে হচ্ছে না জ্যাকবের। জ্যাকব বাতিটা নিভিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সারার চোখ খুলে যায়।

জ্যাকব সারার সন্ত্রস্ত কণ্ঠ শুনতে পায় কে?

জ্যাকব।

এ সময়ে তুমি এখানে কেন?- সারা এমন কণ্ঠে বললো যাতে প্রেমও আছে, সমবেদনাও আছে- কেউ দেখে ফেললে সোজা কারাগার, ছাড়া উপায় থাকবে না। আমাকে বাইরে ডেকে নিলেই পারতে!

জেয়াফতে তোমাকে না দেখে ভাবলাম, তোমার অসুখ-টসুখ হলো কিনা। তাই ঝুঁকি মাথায় নিয়ে চলে এলাম- জ্যাকব অন্ধকারে সারার খাটের উপর বসতে বসতে বললো- কেউ যাতে দেখতে না পায় তাই বাতিটা নিভিয়ে দিলাম। অন্য কোন উদ্দেশ্যে আসিনি সারা। জানি না, কী আকর্ষণ আছে, যা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তোমার কোন অসুখ হয়নি তো?

আমার আত্মা অসুস্থ- সারা বললো- আমি যখনই আসরে জেয়াফতে নাচি, আমার হৃদয় সঙ্গে থাকে না। আমার দেহ নাচে বটে; কিন্তু আত্মা মরে যায়। আজ যখন আমাকে জানানো হলো মসুল থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুজন মেহমান এসেছেন, শুনে আত্মার সঙ্গে আমার দেহটাও নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। শুনে আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। এই রাজা-বাদশাহদের যুদ্ধ, শান্তি ও বন্ধুত্বের চুক্তিতে আমার কোন আন্তরিকতা নেই। কিন্তু যখন কানে আসলো, মসুল থেকে দুজন মেহমান আসছেন, তখন আমার মনে হলো, খৃস্টান ও মুসলমানদের দুপক্ষের কোন এক পক্ষের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমি ঠিক করে ওঠতে পারিনি, আমার আত্মিক সম্পর্কটা আসলে কার সঙ্গে। শুধু এই অনুভূতিটা জেগে ওঠলো, আমি এই আসরে নাচতে পারবো না। আমি …লের মেহমানদের মুখোমুখি হতে পারবো না। হতে পারে আমাকে দেখে তারা ওখান থেকেই পালিয়ে যাবে।

কেন?- জ্যাকব জিজ্ঞেস করে- মসুলের লোকদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী?

বলতে পারবো না- সারা বললো- আমি তো নিজেকেও বলতে ভয় পাচ্ছি, মসুলবাসীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?

সারা- জ্যাকব সারার একটা হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো আমার থেকে মনের কথা কেন গোপন করছো? তোমাকে কি কোন কাফেলা থেকে অপহরণ করা হয়েছিলো? তুমি কোন্ পিতার কন্যা?

সারা কোন উত্তর দিতে পারে না। হঠাৎ জ্যাকব খানিকটা চকিত হয়ে ওঠে। উভয়ে খোলা জানালার দিকে তাকায়। জানালায় একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। সারা জ্যকবের কানে কানে বললো- খাটের নীচে চলে যাও। জ্যাকব অন্ধকারকে কাজে লাগিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। তারপর নিঃশব্দে ধীরে ধীরে খাটের নীচে চলে যায়। সারা শুয়ে পড়ে।

সারা- জানালায় দণ্ডায়মান ছায়াটির কণ্ঠ ভেসে আসে। এক বৃদ্ধ মহিলার কণ্ঠ। নর্তকী-গায়িকাদের দেখাশোনা করা তার দায়িত্ব।

সারা কোন উত্তর দেয়নি যেনো ডাকটা শোনেনি। মহিলা আবারো ডাক দেয়- সারা! সারা এবারও নিশ্চুপ। যেনো গভীর ঘুমে আচ্ছন। এবার মহিলা বিজ্ঞোচিত কণ্ঠে বললো– আমি জানি সারা! তুমি সজাগ আছো। উত্তর দাও। বাতি নেভানো কেন?

সারার মুখ থেকে এমন শব্দ বেরিয়ে আসে, যেনো সে বিড় বিড় করে জেগে ওঠেছে। কণ্ঠটাকে ঘুমজড়িত করে বললো- কে? কী হয়েছে?

ওদিক থেকে এসে বলছি কী হয়েছে- মহিলার ছায়াটা জানালা থেকে সরে যায়। দরজার দিক থেকে আসতে চাচ্ছে সে। সারা অবনত হয়ে জ্যাকবকে বললো- বেটি অন্যদিক থেকে আসছে। তুমি বেরিয়ে এসে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ো।

না সারা- জ্যাকব খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে এসে বললো- আমি তাকে জানি। আসতে দাও। আমি ওর মুঠো গরম করে দেবো; তো খুশি মনে চলে যাবে।

না, বড় বজ্জাত মহিলা- সারা বললো- গোপনে গোপনে মেয়েদের দালালী করে বেড়ায়। তুমি এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও। অন্যথায় আমার মিথ্যাচার আমাকে মেরে ফেলবে। তুমি চলে যাও, আমি ওকে সামলে নেবো।

মহিলা সবেমাত্র দরজায় এসে পৌঁছেছে। জ্যাকব জানালা দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যায়। সারা বাতি জ্বালিয়ে দেয়। মহিলা ভেতরে প্রবেশ করে। দৈহিক দিক থেকে মহিলা যতোটা না নারী, তার চেয়ে বেশি পুরুষ। এসেই সারার সঙ্গে বুঝাঁপড়া শুরু করে দেয়। সারা তাকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করে, এই কক্ষে অন্য কেউ ছিলো না। সম্ভবত ঘুমের ঘোরে কথা বলছিলো। মহিলা বললো, স্বপ্নে নারীর কণ্ঠ পুরুষের ন্যায় হয়ে যায় না। আমি তোমার কক্ষে পুরুষ কণ্ঠও শুনেছি।

এটা কী? মহিলা ঝুঁকে খাটের সন্নিকটে মেঝেতে পড়ে থাকা একটা রোমাল তুলে নিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে। রোমালটা হাত দুয়েক লম্বা এবং ততোখানি চওড়া একখণ্ড কাপড়, যা কিনা পুরুষরা গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাথায় ব্যবহার করে থাকে। লোকটা কে ছিলো? তার থেকে তুমি কতো মূল্য নিয়েছো?

আমি বেশ্যা নই- সারা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললো- আমি নর্তকী। তুমি জানো, আমি কোন পুরুষের গায়ে মুখ লাগাই না।

শোন সারা!- মহিলা সারার পাশে বসে পড়ে এবং তার কাঁধে হাত রেখে স্নেহমাখা কণ্ঠে বললো- আমিও জানি, তুমি নর্তকী। কিন্তু তুমি জানো না একজন নর্তকী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক কিংবা দেশের শাসক সম্রাট নয়। আমি শুধু এটুকু বলে দেবো, রাতে তোমার কাছে একজন পুরুষ এসেছিলো। ফল কী হবে তুমি ভালোভাবেই জানো। এমন ধারায় কথা বলো না যে তুমি শাহী নর্তকী। এখানে তোমার কোন মর্যাদা নেই।

আসল কথা বলো- সারা বরলো- যে দয়াটা করতে চাচ্ছো, তার বিনিময় কী নেবে বলো, আমি এখনই পরিশোধ করে দিচ্ছি।

তোমার থেকে আমি কিছুই নেবো না- মহিলা বললো- বিনিময়টা আমি অন্য কারো থেকে উসুল করবো। তুমি শুধু হা বলল।

সারা মহিলার মতলব বুঝে ফেলে। বাইরে থেকে শাহী মেহমান আসছেই কেবল। তাদের মধ্যে খৃস্টানও আছে। আছে মুসলমানও। এই সম্মানিত অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য মেয়েরা প্রস্তুত থাকে। কিন্তু তাদের সঙ্গে যে আমলারা আসে, তাদের জন্য এ জাতীয় কোন বিলাসী আয়োজন হয় না। এই মহিলা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তাদের নিকট মেয়ে সরবরাহ করে থাকে এবং মোটা অংকের পুরস্কার লাভ করে থাকে। এটা তার গোপন ব্যবসা। কোন কোন রাজ অতিথি সরকারীভাবে প্রদত্ত মেয়ের দ্বারা তৃপ্ত না হয়ে এই মহিলার শরণাপন্ন হয়। মহিলা তাদের চাহিদা পূরণ করে থাকে। সারা এ যাবত কখনো তার হাতে আসেনি। কিন্তু এখন মেয়েটি তার জালে ফেঁসে গেছে। যদি বলে, তার কাছে জ্যাকব এসেছিলো এবং তাদের দুজনের সম্পর্কটা পবিত্র, তো মহিলা বিশ্বাসও করবে না এবং জ্যাকবও বিপদে পড়ে যাবে।

সারা!- মহিলা বললো- যদি নিজের ভয়ানক পরিণতি থেকে রক্ষা পেতে চাও, তাহলে আমার প্রস্তাব মেনে নাও। বাইরে থেকে দুজন মেহমান এসেছেন। অনেক ধনী। পরশু থেকেই তারা কর্মচারিদের বলে আসছেন, তাদের ভালো দুটো মেয়ে দরকার। এটা মূলত তাদের অভ্যাস। নিজেদের হেরেমে তাদের বিশ-ত্রিশটি করে মেয়ে থাকে। কাল তুমি তাদের একজনের কাছে চলে যাবে।

তারা কারা?- সারা জিজ্ঞেস করে- মুসলমান হলে আমি যাবো না।

 তাহলে কয়েদখানায় যাও- মহিলা বললো- মাথা ঠিক রেখে চিন্তা করে কথা বলল! নিজের প্রতি তাকাও। তুমি কী? নিজের পেশাটা দেখো। ভদ্র সাজবার চেষ্টা করো না। তারা মন খুলে পুরস্কার দেবে। তুমিও ভাগ পাবে।

আর যদি ধরা পড়ে যাই, তাহলে? সারা বললো।

যারা তোমাকে ধরবে আমি তাদের হাত বেঁধে রাখি- মহিলা বললো কাল রাতে প্রস্তুত থাকবে। আমার আর জানবার প্রয়োজন হবে না, তোমার কাছে কে এসেছিলো।

মহিলা চলে যায়। সারার চোখ থেকে অশ্রু বেরুতে শুরু করে।

***

জ্যাকব পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়। কিন্তু সারা বিপদে পড়ে যাবে ভয়ে বেরিয়ে গেলো। তার আশা ছিলো সারা মহিলাকে সামলে নিতে সক্ষম হবে। কারণ, সে নিজেও নোংরা জগতের মেয়ে। জানালা টপকে বেরিয়ে জ্যাকব শহরের দিকে যাচ্ছে। তার মন-মস্তিষ্কে শুধুই সারা। সারার সঙ্গে এখন তার আন্তরিক ভালোবাসার সম্পর্ক। থেকে থেকে তার কেবলই ধারণা হচ্ছে, সারা কোন মুসলমান পিতার কন্যা। জ্যাকব হাঁটতে হাঁটতে নগরীর সরু ও অন্ধকার গলিপথে ঢুকে পড়ে। গলির মোড় ঘুরে ঘুরে একটি গৃহের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এবং দরজায় করাঘাত করে।

খানিক পর দরজা খুলে যায়।

কে?

হাসান। জ্যাকব উত্তর দেয়।

এতো রাতে কেন?- যে লোকটি দরজা খুললো সে জিজ্ঞেস করে ভেতরে এসে পড়ো। কেউ দেখেনি তো?

না- জ্যাকব উত্তর দেয়- কাফেরদের জেয়াফত থেকে এই মাত্র অবসর হলাম। জরুরি এক সংবাদ নিয়ে এসেছি।

জ্যাকব ভেতরে ঢুকে পড়ে। দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এখন সে জ্যাকব নয়- হাসান আল-ইদরীস। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর। এক বছর আগে নিজেকে খৃস্টান পরিচয় দিয়ে এবং গলবার্ট জ্যাকব নাম ধারণ করে খৃস্টান বাহিনীতে চাকরি নিয়েছিলো। গৌর বর্ণের যুবক। প্রশিক্ষণ মোতাবেক অত্যন্ত চতুর ও বাকপটু। দেহের আকার-গঠনের সুবাদে উক্ত প্রাসাদের বিশেষ দায়িত্বের জন্য নিযুক্ত হয়। এখান থেকে কায়রোতে তথ্য সরবরাহ করতে থাকে। তার দলনেতার নাম হাতেম। জ্যাকব এসে এখন যে ঘরে প্রবেশ করলো, হাতেম এ ঘরেই থাকে।

মসুলের দুজন দূত বল্ডউইনের নিকট এসেছে- হাসান আল-ইদরীস তার নেতাকে বললো- আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, তারা মসুল থেকে এসেছে এবং মুসলমান। বল্ডউইন তাদেরকে নিজ কক্ষে নিয়ে যান। তারা যে মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীনের বার্তা নিয়ে এসেছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই।

আর সেই বার্তাটা হচ্ছে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে চুক্তির বার্তা- নেতা বললো- তা উভয় পক্ষের মাঝে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তা কি জানতে পেরেছো? সুলতান তো, এখন পর্যন্ত ধোকায় রয়েছেন যে, ইযযুদ্দীন ও ইমাদুদ্দীন আমাদের বন্ধু কিংবা অন্তত পক্ষে আমাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করবে না।

তাদের আলাপ-আলোচনা রুদ্ধ কক্ষে হয়েছে হাসান বললো- আমার ধারণা, যা কিছু সিদ্ধান্ত হওয়ার ছিলো হয়ে গেছে। আমি তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে বেশ আনন্দিত দেখা গেছে। অভাগা এতো মদপান করেছিলো যে, নেশার ঘোরে বলে দিয়েছে, তারা মুসলমান এবং মসুল থেকে এসেছে। আমাকে বলেছিলো, সে আমাদের অর্থাৎ খৃস্টানদের ভালোবাসা দেখতে চায়। লোকটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, লুটিয়ে পড়লো।

মসুল থেকে দুজন লোক এসেছিলো সুলতানকে শুধু এটুকু সংবাদ প্রেরণ করা যথেষ্ট হবে না- হাতেম বললো- আমরা সুলতানের নিকট অত্যন্ত লজ্জিত, তাঁর কাছে এই সংবাদটা পৌঁছাতে পারলাম না যে, আপনি বৈরুত অবরোধের পরিকল্পনা ত্যাগ করুন। কেননা, বল্ডউইন আপনার এই পরিকল্পনার সংবাদ জেনে গেছে।

তাতে আমাদের কোন ত্রুটি ছিলো না- হাসান বললো- ইসহাক তুর্কি যথাসময়ে রওনা হয়ে গিয়েছিলো। সে তো ধোকা দেয়ার মতো মানুষ ছিলো না। পথে হয়তো মরুভূমির নির্মম আচরণের শিকার হয়েছে, নয়তো ধরা পড়েছে।

বৈরুত অবরোধে সুলতান আইউবীর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, আমাদের তার প্রতিকার করতে হবে- হাতেম বললো- তার জন্য এই সংবাদটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, মসুল বৈরুতের সঙ্গে বন্ধুত্বের চুক্তি করছে। কিন্তু চুক্তিতে কী কী শর্ত আরোপ করা হয়েছে এবং পরিকল্পনা কী ঠিক হয়েছে, পুরো তথ্যই সুলতানকে জানানো প্রয়োজন। এ মুহূর্তে সুলতান আইউবী বড় ঝুঁকির মধ্যে বসে আছেন। হয়তো ভাবছেন, তিনি বন্ধুদের মাঝে নিরাপদ রয়েছেন। কিন্তু আসলে তিনি শত্রুর বেষ্টনীর মধ্যে ছাউনি ফেলেছেন। হাতেম হাসানকে জিজ্ঞেস করে- ভেতরের সংবাদ সংগ্রহের কোন ব্যবস্থা করা যায় না?

আলোচনা হয়েছে রুদ্ধ কক্ষে- হাসান উত্তর দেয়- বল্ডউইন তার সালার কিংবা উপদেষ্টাদের তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না। মসুলের দুব্যক্তির বক্ষ থেকে তথ্য বের করার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমি উপায় বের করার চেষ্টা করবো। তাতে কাজ না হলে অন্য পন্থা অবলম্বন করবো। তারা যখন ফেরত রওনা হবে, তখন তাদের অপহরণ করে কথা বের করবো। তারপর প্রয়োজন হলে মেরে ফেলবো।

তাদের মেরে ফেললে তো আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না- হাতেম বললো- আমাদের বল্ডউইন ও ইযযুদ্দীনের পরিকল্পনা জানা আবশ্যক।

আমি সে চেষ্টাই করবো- হাসান বললো- তথ্য বের করতে না পারলে তাদেরকে সুলতান আইউবীর নিকট পাঠিয়ে দেবো।

ঠিক আছে চেষ্টা চালাও- হাতেম বললো- সফল হলে যত তাড়তািড়ি সম্ভব আমাকে জানাও। আমি ভোরেই সুলতানের নিকট লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। তুমি যতো স্বল্প সময়ে সম্ভব তথ্য নেয়ার চেষ্টা করো।

দুআ করুন যেনো সফল হতে পারি। হাসান উঠে বেরিয়ে যায়।

***

খৃস্টান কমান্ডোদের জীবিত ধরার চেষ্টা করবে- সালার সারেম মিসরী তার গেলিরা বাহিনীর কমান্ডারদের নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। তবে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলো না। যেখানেই আক্রমণ করবে, কার্যকর আঘাত হানবে এবং নিরাপদে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবে। আক্রান্ত হলে দৃঢ়পদে লড়াই করবে এবং শত্রুকে বেরিয়ে যেতে দেবে না। এই এতোগুলো সৈনিক তোমাদের উপর ভরসা করে ঘুমায় আর এতোগুলো খাদ্যসামগ্রীর নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব তোমাদেরই।

নিজ কর্তব্যের পুরোপুরিই অনুভূতি আছে সারেম মিসরীর সৈন্যদের। সুলতান আইউবী তাঁবু অঞ্চল থেকে বেশ দূরে বিভিন্ন টিলার উপর বিশ থেকে চল্লিশজন সৈনিকের কয়েকটি চৌকি স্থাপন করে রেখেছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও তাঁবু অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধান করা তাদের দায়িত্ব। এমনি একটি চৌকি দুশমনের নিশানায় পরিণত হয়ে যায়। চৌকিটির পেছনে কয়েকটি উঁচু পর্বত এবং একটি উপত্যকা। এই উপত্যকার মধ্যদিয়ে বাহিনী অতিক্রম করতে পারে। এই লুকানো পথটির উপর দৃষ্টি রাখার জন্যই এই চৌকিটি স্থাপন করা হয়েছিলো। দুজন আরোহী দুটি ঘোড় নিয়ে সেখানে সর্বদা প্রস্তুত থাকতো। এখন সেখানে নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গেছে যে, প্রতিদিন সূর্য অস্ত্র যাওয়ার পর তিন-চারটি তীর ছুটে আসছে এবং এক-দুজন সৈনিককে শেষ করে দিচ্ছে। একদিন সন্ধ্যাবেলা একটি ঘোড়ার গায়ে একসঙ্গে তিনটি তীর এসে বিদ্ধ হয় এবং ঘোড়াটি ছটফট করে মারা যায়। তীর নিকটের পাহাড় থেকে আসতো এবং পরক্ষণেই অন্ধকার ছেয়ে যেতো। সে কারণে তীর নিক্ষেপকারীদের খুঁজে বের করা যেতো না।

একদিন সন্ধ্যার আগে চৌকির দুজন সৈনিক পাহাড়ের এক স্থানে লুকিয়ে বসে যায়। সূর্য অস্ত্র যাচ্ছে বলে। দুটি তীর ধেয়ে আসে। দুটিই এই দুসৈনিকের গায়ে-পিঠে আঘাত হানে। দুজনই শহীদ হয়ে যায়। ভোরে তাদের আধখাওয়া লাশ তুলে আনা হলো। রাতে নেকড়েরা লাশের অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছে। স্পষ্ট বুঝা গেলো, এটা খৃস্টান গেরিলাদের কাজ।

একদিন দশ সৈনিকের একটি টহল দল অনুসন্ধানের জন্য প্রেরণ করা হলো। তারা পার্বত্য অঞ্চলে ঢুকে পড়ে চারজনের দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। একস্থানে দশ-বারো বছরের একটি কিশোর দেখা গেলো। ছেলেটা সৈনিকদের দেখে দৌড়ে একটি উঁচু টিলার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। ছেলেটা রাখাল হতে পারে। কিন্তু ওখানে কোন ভেড়া-বকরি বা উট কিছুই ছিলো না। সৈনিকরা সে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছুলে টিলার অভ্যন্তরে ছোট্ট একটি গুহা দেখতে পায়। ছেলেটি তারই ভেতরে ঢুকে গিয়ে থাকবে।

সৈনিকরা গুহার মুখে কান লাগায়। ভেতর থেকে ফিস ফিস কথা বলার শব্দ শুনতে পায়। একটি কিশোরের গুহার ভেতরে ঢুকে যাওয়া বিস্ময়কর কোন ঘটনা ছিলো না। কিন্তু সৈনিকরা ছেলেটাকে খৃস্টান গেরিলাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলো। তারা অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া আসছে না। সৈনিকরা হুমকি দেয়, ভেতরে যে ই আছো বেরিয়ে আসো। অন্যথায় আমরা ভেতরে ঢুকে সবাইকে হত্যা করে ফেলবো। এবার ভেতর থেকে এক যুবতী বেরিয়ে আসে। সে স্থানীয় ভাষায় সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। পরে কেঁদে ফেলে বললো, আপনারা আমাকে হত্যা করে ফেলুন। বিনিময়ে আমার সন্তানদের ক্ষমা করে দিন। মেয়েটির দুটি সন্তান। একটির বয়স দশ-বারো বছর, যে বাইরে থেকে ছুটে এসে গুহায় ঢুকেছে। অপরটির বয়স কয়েক মাস। মহিলা তাকে ভেতরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে।

সৈনিকরা তাকে বললো, আমরা মুসলিম সৈনিক। আমরা তোমার কোন ক্ষতি করবো না। কিন্তু মেয়েটি একদিকে তাদের গালাগাল করছে, অপরদিকে অনুনয়-বিনয় করছে। সে জানালো, দুদিন আগে এই পাড়ায় পনের-ষোলজন সৈনিক আসে এবং পাড়াটা দখল করে নেয়। তারা পাড়ার প্রতিটি ঘর তল্লাশি করে। আমার স্বামীকে তারা হত্যা করে ফেলে। খৃস্টান সৈন্যরা পাড়ার সকল শিশু-যুবক-বৃদ্ধ ও মহিলাদের এক স্থানে একত্রিত করে বললো, কেউ যেনো জানতে না পারে এই গ্রামে সৈন্য আছে। তারা তাদের এবং তাদের ঘোড়াগুলোর পানাহারের দায়িত্ব গ্রামবাসীর উপর চাপিয়ে দেয়। তাদের কমান্ডার তরবারী বের করে। আমার স্বামী সকলের সামনে দাঁড়ানো ছিলো। কমান্ডার তাকে বাহু ধরে টেনে আরো সম্মুখে নিয়ে তরবারীর এক আঘাতে তার মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর কমান্ডার সকলকে হুঁশিয়ার করে দেয়, কেউ আমার আদেশ অমান্য করলে তাকেও এমনি পরিণতি বরণ করতে হবে।

খৃস্টানরা গ্রামবাসীকে তাদের জন্য তিন-চারটি ঘর, খালি করে দিতে বাধ্য করে এবং মেয়েদের ডেকে নিয়ে তাদের সেবা করাতে শুরু করে। এই মেয়েটি রাতে সুযোগ পেয়ে বাচ্চাদের নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। এখন সে জানে না, খৃস্টান সৈনিকরা এখনো এখানে আছে কিনা।

গ্রামটির অবস্থান এখান থেকে খানিক দূরে। মুসলিম সৈনিকরা মেয়েটিকে এখানেই রেখে গ্রামের দিকে চলে যায়। পাহাড়ী অঞ্চলের বাইরে বিস্তৃত একটি মাঠ। ওখানেই পনের-বিশটি কুঁড়ে ঘরের একটি পল্লী। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এই টহল দলটি অশ্বারোহী। তারা ঘোড়া হাঁকিয়ে গ্রামে গিয়ে উপনীত হয়। দখলদার খৃস্টান সৈনিকরা এখনো গ্রামে অবস্থান করছে। তারা সম্ভবত পাহারার ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। অশ্বারোহী মুসলিম সৈনিকরা গ্রাম থেকে সামান্য দূরে থাকতেই সকল খৃষ্টান সৈন্য বেরিয়ে আসে। তাদের সম্মুখে কয়েকটি শিশু ও অনেকগুলো মহিলা। তারা শিশু ও নারীদেরকে একস্থানে একত্রিত করে দাঁড় করিয়ে রাখে এবং নিজেরা উন্মুক্ত তরবারী হাতে নিয়ে তাদের চতুর্পাশ্বে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে যায়। একজন সুলতান আইউবীর সৈনিকদের উদ্দেশে চীৎকার করে বললো- তোমরা যদি আর এক পা অগ্রসর হও, তাহলে আমরা এই শিশু ও নারীদের হত্যা করে ফেলবো।

মুসলিম সৈনিকরা বিশ-পঁচিশ পা দূরে দাঁড়িয়ে যায়। তারা মুসলিম শিশু ও নারীদেরকে খৃষ্টানদের হাতে খুন করাতে চাচ্ছে না।

ওহে কাপুরুষগণ!- সুলতান আইউবীর গেরিলা দলটির কমান্ডার বললো- তোমরা যদি ক্রুশের খাতিরে লড়াই করতে এসে থাকে, তাহলে পুরুষের ন্যায় সম্মুখে এসে লড়াই করো। কাপুরুষের ন্যায় নারী ও শিশুদের ঢালের পেছনে দাঁড়িয়ে আছো কেন?

তোমরা ফিরে যাও- খৃস্টান কমান্ডার বললো- আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাব।

খৃস্টান সৈনিকরা যে শিশু ও নারীদের পণ বানিয়ে রেখেছিলো, তাদের মধ্যে থেকে এক মহিলা সুলতান আইউবীর সৈনিকদের উদ্দেশে উচ্চকণ্ঠে বললো- ইসলামের সৈনিকগণ! তোমরা দাঁড়িয়ে গেলে কেন? আমাদেরকে তোমাদের ঘোড়ার পদতলে পিষে ফেলল। এই কাফেরদের একজনকেও জীবিত ফিরে যেতে দিও না। আমরা শিশুদেরসহ মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত আছি।

খৃস্টান কমান্ডার পূর্ণ শক্তিতে তরবারীর এক আঘাত হানে। মহিলার মাথাটা কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যায়। সুলতান আইউবীর টহল সেনাদলের কমান্ডার তার সৈনিকদেরকে তীর-ধনুক বের করে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয়। তারা মুহূর্ত মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যায়। সব কজন খৃস্টান সৈনিক নারী ও শিশুদের পেছনে বসে পড়ে।

মিথ্যা ধর্মের পুজারীগণ!- মুসলিম কমান্ডার বললো- সৈনিকরা নারী শিশুদের পেছনে লুকায় না।

খৃস্টান সৈনিকরা বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলো, পাড়ায় পুরুষ মানুষও আছে। তারা লোকগুলোকে অনেক সন্ত্রস্ত করে রেখেছিলো। তারাও তাদের নারী-শিশুদের জীবনহানির ভয়ে তটস্থ। ইতিমধ্যে এক নারী হুংকার ছেড়ে বললো- এই কাফেরগুলো তো কাপুরুষ। তোমরা আমাদের জীবনের ভয় করছো কেন? মহিলা তার সম্মুখে দণ্ডায়মান তিন-চার বছর বয়সের একটা শিশুকে তুলে সম্মুখে মাটিতে ছুঁড়ে বললো- আমি সন্তুষ্টচিত্তে আমার এই সন্তানটিকে কুরবানী দিচ্ছি। তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়ো। দশজন কাফেরের জীবন হরণ করার লক্ষ্যে আমি আমার এই সন্তানকে কুরবান করছি।

এক খৃস্টান তরবারী উঁচু করে মহিলাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু অতটুকু সুযোগ সে পেলো না। পেছন থেকে পাড়ার সকল পুরুষ বর্শা, লাঠি এবং যে যা হাতে পেয়েছে নিয়ে এসে খৃস্টান সৈনিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। খৃস্টান সেনারা আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নারী ও শিশুদের পেছনে বসেছিলো। এবার তারা গ্রামবাসীদের মোকাবেলার জন্য উঠে দাঁড়ায়। অমনি মুসলিম সৈনিকরাও তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুতিনজন সৈনিক চীৎকার করে বলতে থাকে। মহিলারা পালিয়ে যাও। শিশুদেরকে একদিকে সরিয়ে নাও। মুসলিম সৈনিকদের ঘোড়াগুলো মরুঝড়ের ন্যায় ধেয়ে আসে। মহিলারা শিশুদের তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। দুপক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অল্পক্ষণের মধ্যে দুখৃস্টান সৈনিক ছাড়া সকলে মারা যায়। গ্রামবাসীরা তাদের লাশগুলো ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। তারা জীবিত খৃস্টানদেরকেরও নিজ হাতে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। কিন্তু মুসলিম সেনাদলের কমান্ডার তাদের বড় কষ্টে বুঝাতে সক্ষম হয়, এদের মাধ্যমে এদের অন্যান্য সঙ্গীদের তথ্য বের করতে হবে। কাজেই এদের জীবিত বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন।

জীবিত দুখৃস্টান সেনাকে সুলতান আইউবীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের নায়েব হাসান ইবনে আবদুল্লাহর হাতে তুলে দেয়া হলো। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তাদের বললেন, ভালোয় ভালোয় তোমাদের অন্যান্য গেরিলাদের সব তথ্য বলে দাও। তারা ধরা খাওয়া পরাজিত সৈনিক। হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে সকল তথ্য বলে দেয়। এরা বল্ডউইনের বাহিনীর গেরিলা সৈনিক। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক কমপক্ষে এক হাজার গেরিলা সুলতান আইউবীর ফৌজ ও রসদের ক্ষতিসাধনের লক্ষ্যে বৈরুত থেকে প্রেরণ করা হয়েছে। এখনো তাদের স্থায়ী কোন আস্তানা গড়ে ওঠেনি। তারা সমগ্র অঞ্চলে দলে দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এভাবে ছোট পাড়া-পল্লী দখল করে সেখান থেকে খাদ্য ইত্যাদি সগ্রহ করতে এবং সুলতান আইউবীর সৈনিকদের কোণঠাসা করে রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

জীবিত দুই সেনাকে সুলতান আইউবীর সম্মুখে নিয়ে যাওয়া হলো। সুলতান তাদের বক্তব্য শুনেন এবং নির্দেশ দেন- দূরে কোথাও নিয়ে এদের হত্যা করে ফেলল। এরা খুনী ও লুটের অপরাধে অপরাধী।

সুলতান তার সালারদের বললেন- এতে প্রমাণিত হচ্ছে খৃস্টান গেরিলাদের মসুল কিংবা অন্য কোন দুর্গে অবস্থান গ্রহণের অনুমতি মেলেনি। অন্যথায় এই গ্রামটাকে আস্তানা বানাতো না। সুলতান নির্দেশ দেন। এ ধরনের প্রতিটি গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করে খোঁজ নাও। সৈনিকদেরকে কঠোরভাবে বলে দেবে, যেনো তারা গ্রামবাসীদের সঙ্গে কোন প্রকার দুর্ব্যবহার না করে। তারা তাদের ও ঘোড়র খাদ্য ফৌজের রসদ থেকে সংগ্রহ করবে। গ্রামবাসীদের থেকে একটি দানাও যেনো গ্রহণ না করে।

***

গোয়েন্দাদেরকে ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কাজ করতে হয়। তথ্য সংগ্রহে তাদের অসাধ্য সাধনও করতে হয় আবার চেষ্টা করতে হয়, যাতে ধরা না পড়ে। হাসান গোয়েন্দা। এ মুহূর্তে তাকে যোগ্যতার পুরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে। তার সারার সেই কথাগুলো মনে পড়ছে, যার দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে, মেয়েটা মুসলমানদের ভালোবাসে। হাসান এও অনুভব করেছে যে, সারার মনে সন্দেহ জেগে গেছে, হাসান মুসলমান। ভাবতে ভাবতে হাসানের মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

দূর থেকে ফজরের আযান কানে আসতে শুরু করেছে। আযানের অর্থবহ সুললিত বাক্যগুলো তার মন-মস্তিষ্কে ইসলাম ও মহান আল্লাহর মহত্ত্ব জাগিয়ে তোলে। আল্লাহই তাকে সাহায্য করতে পারেন। হাসান ওঠে অজু করে কক্ষের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। খৃস্টানদের এই জগতে হাসান মুসলমান নয়- খৃস্টান। হাসান আল ইদরীস নয়- গলবার্ট জ্যাকব।

ছোট্ট একটি কক্ষে একা থাকে হাসান। কক্ষে ক্রুশের সঙ্গে হযরত ঈসার প্রতিকৃতি ঝুলানো থাকে। দেয়ালে কোন চিত্রকরের আঁকা মেরির ছবি। হাসান প্রতিকৃতি, ছবি ও ক্রুশ দেয়াল থেকে সরিয়ে খাটের নীচে রেখে দেয়। দরজার ভেতর দিকের শেকলটা আটকে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে শুরু করে। হাসান প্রতিদিনই এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে নামায পড়ে থাকে। কিন্তু আজ ফজরের নামাযে যে আবেগময় অবস্থার সৃষ্টি হলো, তেমনটি অতীতে কোনদিন হয়নি। হাসানের চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে আসে। হাসান তেলাওয়াত করছে। আজ আবেগ তার নিয়ন্ত্রণ মানছে না। ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতায়ীন (আমি কেবল তোমারই ইবাদত করছি এবং একমাত্র তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি) বলার সময় তার কণ্ঠটা বেশ উঁচু হয়ে যায়। জীবনে তার এই প্রথমবার অনুভব হলো যেনো আল্লাহ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং এতে নিকটে যে ইচ্ছা করলে সে আল্লাহকে স্পর্শ করতে পারে।

নামায় শেষ করে হাসান দুআর জন্য হাত তুলে। চক্ষু বন্ধ হয়ে যায়। মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে আসে- মুসলমানের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসার খোদা! তোমার নাম উচ্চারণকারী, তোমার রাসূলের কালেমা পাঠকারী মুসলমান কাফেরদের ভয়ে তোমার মসজিদে আকসায় তোমার সমীপে সেজদাবনত হতে ভয় পাচ্ছে। তোমার প্রথম কেবলা আজ বিরান হয়ে গেছে। যে ভূখণ্ড তোমার রাসূলের পদধূলিতে পবিত্র ও বরকতময় হয়েছিলো, তার উপর আজ ক্রুশের ছায়া পড়ে আছে। যে বনী ইসরাইলকে তুমি বিতাড়িত করে দিয়েছিলে, তারা আজ তোমার প্রথম কেবলাকে হাইকেলে সুলায়মানী বলছে। হে আমার আল্লাহ! আমাকে তুমি তোমার বড়ত্বের প্রমাণ দাও। বললো, তুমি মহান নাকি ইহুদীদের খোদা মহান। বলল, ঈসা তোমার কাছে আছেন নাকি ক্রুসেডারদের ক্রুশের উপর ঝুলছেন। আমাকে তোমার মহত্ত্বের প্রমাণ, দাও। তোমার কুরআনের মহত্ত্বের প্রমাণ দাও। তোমার রসূলের মহত্ত্বের প্রমাণ দাও। আমাকে, ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে তোমার রাসূল ও কুরআনের মহত্ত্ব বুঝাবার যোগ্যতা দান করো। যে পাহাড়গুরো সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এবং তোমার প্রথম কেবলার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে, আমাকে সেগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়ার যুক্তি ও সাহস দান করো। আমাকে তুমি আলো দান করো, যেনো এই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে আমি আমার কর্তব্যের গন্তব্য দেখতে পাই। আমাকে তুমি এমন কঠিন পরীক্ষায় নিক্ষেপ করো, যেনো আমার জীবন তোমার নামে কুরবান হয়ে যায়। তবে প্রতিশ্রুতি দাও, আমার জীবন বৃথা যাবে না। আমাকে তুমি সেই সাহস ও আলো দান করে, যার মাধ্যমে আমি তোমার জন্য শাহাদাতবরণকারী মর্দে মুজাহিদদের প্রতি ফোঁটা রক্তের প্রতিশোধ নিতে পারি। আমাকে তুমি সাহস দান করো, যেনো আমি কুফরের প্রতিটি দুর্গকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে পারি। তুমি আমাদের সকলকে সাহস ও হেদায়াত দান করো, যেনো আমরা আমাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারি, যেনো অনাগত প্রজন্ম বলতে না পারে আমরা আত্মমর্যাদাহীন মানুষ ছিলাম। আজ পাথরের মূর্তিরাও তোমার নামে ঠাট্টা করছে। তুমি আমাকে বীরত্ব দান করো, যেনো আমি এই মূর্তিগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তোমার নাম সমুন্নত করতে পারি। হে আমার আল্লাহ! অন্যথায় তুমি আমার দেহের রক্তগুলো পানি করে দাও। আমাকে এমন আত্মমর্যাদাহীন করে দাও, যেন আমি ভুলেই যাই আত্মমর্যাদা কাকে বলে। তুমি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে নিয়ে নাও, যেনো আমি ইসলামের কন্যাদের নির্লজ্জ ও বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে না পাই। তুমি আমার শ্রবণশক্তি ফিরিয়ে নাও, যেনো আমি তোমার নাম শুনতে না পাই। যেনো আমি সেই মুসলমানদের ফরিয়াদ গুনতে না পাই, যারা ফিলিস্তীনে ইহুদী-খৃষ্টানদের গোলাম হয়ে আছে।

হাসানের কণ্ঠ উঁচু হয়ে যায়- তুমি কোথায়? তুমি কি আছো, নাকি নেই? বলো আমার আল্লাহ! বলল, আমাকে বাশক্তিদানকারী আল্লাহ! বলো, ইসলাম সত্য, নাকি ক্রুশ সত্য। অন্যথায় আমাকেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দাও, সত্য কে ইসলাম না কুশ। বলল, বলল।

কণ্ঠটা ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে হাসান আল-ইদরীসের। খোদার দরবারে আকুতির চূড়ান্তে পৌঁছে গেছে লোকটা। এখন মনে হচ্ছে যেনো ছাদটা দুলছে। পরক্ষণেই এমন বিকট শব্দে আকাশে বজ্রপাত ঘটে, যেনো হাসানের কক্ষটা দুলে ওঠে। হাসান কক্ষের দরজায় বিজলির ঝলকানি দেখতে পায়। এবার সে কণ্ঠটা আরো উঁচু করে বলে ওঠে- হে আল্লাহ! এই বত্র দ্বারা আমাদের মসজিদে আকসাকে ভস্ম করে দাও। মুসাফির মনযিল উভয়কে তুমি ধ্বংস করে দাও।

আবারো বজ্রপাত ঘটে। বৈরুতের সমুদ্রোপকূল নিকটেই ছিলো। ঋতুটা নদ-নদীর শান্ত থাকার। কিন্তু এক্ষুণে সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের পাহাড়সম ঊর্মিমালার ভয়ানক গর্জন এমন ধারায় হাসানের কানে এসে প্রবেশ করছে, যেনো রোম উপসাগরের ক্ষেপে যাওয়া ঢেউগুলো তার কক্ষের দেয়ালের সঙ্গে আছড়ে পড়ছে। বিজলীর চমক, বজ্রের গর্জন এবং সমুদ্রের উতলা একত্রিত হয়ে মহাপ্রলয়ের রূপ ধারণ করেছে। হাসানের কণ্ঠ আরো বেশি উঁচু হয়ে যায়।

এমনি একটি ঝড় আমার মধ্যে তুলে দাও, যেন আমি কুফরের প্রতিটি চিহ্নকে উড়িয়ে ও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারি। মসজিদের আকসার আঙ্গিনায় তুমি আমার খুন বইয়ে দাও। আমি লজ্জিত যে, প্রথম কেবলার মহান প্রহরী, সুলতান সালাহুদ্দীন এখানে তোমাদের সৈনিকদের নিয়ে এলেন আর আমি তাকে সতর্ক করতে পারলাম না, আপনি আসবেন না; বৈরুতে আপনার জন্য ফাঁদ প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। আমি অক্ষম ছিলাম। তবুও স্বীকার করি, এটা আমার মস্তবড় গুনাহ। তুমি আমাকে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সাহস ও বীরত্ব দান করো। অন্যথায় আমার বিবেক আমাকে দংশন করবে যে, তোমার খোদা বলতে আসলে কেউ নেই। আমাকে তুমি এই মূর্তিগুলোর সম্মুখে লজ্জিত করো না। তুমি যদি আমার দুআ কবুল না করো, তাহলে কেয়ামতের দিন আমার মৃতদেহে জীবন দিও না। অন্যথায় আমি তোমার কলার ধরে ফেলবো এবং তোমার সৃষ্টিকে বলবো, এই সেই খোদা যিনি আপন রাসূলের লাজ রক্ষা করেননি।

ইনি এমন এক খোদা, যদি রাসূলের অনুসারীদেরকে এতে অক্ষম ও অসহায় করে তুলেছিলেন যে, প্রথম কেবলা বিরান হয়ে গিয়েছিলো এবং তার উপর ক্রুশের অপচ্ছায়া পতিত হয়েছিলো।

আকাশটা আবারো গর্জে ওঠে। হাসানের কক্ষের দরজা-জানালা ও ছাদ সজোরে কেঁপে ওঠে। ছাদের উপর এমন শব্দ হতে শুরু করে, যেনো ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ঝড়-বৃষ্টিতে আকাশ-জমিন কাঁপছে। ভয়ে আবেগে হাসানের পক্ষে আর স্থির থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে-মধ্যে মনে হচ্ছে, যেনো সে স্বপ্ন দেখছে। হাসান আল্লাহর সঙ্গে এভাবে কখনো কথা বলেনি। চুপচাপ নামায আদায় করে সংক্ষেপে দুআ করে জ্যাকবে পরিণত হয়ে যেতো হাসান।

আজ রাত হাতেমকে রিপোর্ট করে যখন হাসান ফিরে এলো, তখন তার মনের অবস্থা ছিলো অন্যদিনের চেয়ে ব্যতিক্রম। তার ঘুম পাচ্ছিলো। কিন্তু সম্মুখে এমন একটি সমস্যা যে ভাবতে ভাবতে হাসান পাগলের মতো হয়ে যেতে শুরু করে। তার জন্য সহজ পথ এই ছিলো, যে সমস্যার কোন সমাধান নেই, তা মাথা থেকে ফেলে দিতো। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী, আলী বিন সুফিয়ান এবং তার নেতা হাতেম তো জানতেন না ইযযুদ্দীনের দূত বল্ডউইনের নিকট এসেছে এবং কিছু একটা চুক্তি হচ্ছে। নিজে চুপ থাকলেই হতো। চাকরির বেতন-ভাতাটা তো ঘরে বসে পিতা-মাতা ঠিকই পেয়ে যাচ্ছেন। বৈরুতে নিজে থাকছে রাজার হালে। কিন্তু হাসান আল ইদরীস একজন মর্দে মুমিন। কর্তব্যকে নামায-রোযারই মতো গুরুত্বপূর্ণ আমল মনে করে হাসান। হাসান মনে করে, জাতির প্রতিজন সদস্য যদি ভাবে কাজটা অন্য কেউ করবে, আমি না করলেও চলবে, তাহলে পরাজয়ই জাতির ভাগ্যলিপি হয়ে যেতে বাধ্য।

***

হাসান রাতে একতিল ঘুমায়নি। এখন জায়নামাযেই ঘুম চেপে ধরেছে তাকে। এই আবেগময় অবস্থায় তার ঘুম না পাবারই কথা ছিলো। কিন্তু এই নামায ও দুআর পর হাসান এমন শান্তি ও স্বস্তি অনুভব করে যে, তার শান্তিময় আত্মা অস্থির দেহ ও মস্তিষ্ককে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। হাসান সেখানেই কাৎ হয়ে পড়ে থাকে। জায়নামাযটা লুকিয়ে ঈসার মূর্তি, মরিয়মের ছবি এবং ক্রুশটা খাটের নীচ থেকে তুলে এনে আপন আপন জায়গায় রেখে দেবে, সেই সুযোগটাও পেলো না। একটা সুখনিদ্রা এসে ঝাঁপটে ধরেছে যেনো তাকে। প্রয়োজন ছিলো, ভেতরে সব ঠিকঠাক করে দরজাটা খুলে রেখে জ্যাকবের বেশে শুয়ে পড়া।

হাসান স্বপ্নের জগতে চলে যায়। স্বপ্নে মসজিদে আকসা দেখে। এই মসজিদটা সে একবার দেখেছিলো। যখন বাইতুল মুকাদ্দাসে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছিলো, তখন। মসজিদটা অনাবাদ ছিলো। তার উন্মুক্ত দরজাগুলো চোখ মেলে নামাযীদের চেয়ে চেয়ে দেখছিলো। কিন্তু মুসলমানরা নামায পড়ছে অন্যান্য মসজিদে কিংবা নিজ নিজ ঘরে। ইহুদী খৃস্টানদের সন্তানরা মসজিদের আঙ্গিনাটাকে খেলার মাঠ বানিয়ে রেখেছিলো। সেখানে অসংখ্য ছেলেমেয়ে জুতা পায়ে খেলা করছিলো। খৃষ্টানরা সেখানকার মুসলমানদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছিলো। হাসান মসজিদে আকসার পবিত্র ভূমি এবং মুসলমানদের জন্য তার গুরুত্ব ভালোভাবেই জানতো। সেখানে তার নাম ছিলো রেফ নেকালসন।

এখন হাসান বৈরুতে স্বপ্নে মসজিদে আকসা দেখছে। মসজিদের গম্বুজের উপর অনেকগুলো পায়রা বসে আছে। সবগুলো পায়রা একসঙ্গে উড়ে শূন্যে উঠে স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়ে যায়। ফুলিঙ্গগুলো মসজিদে আকসার আশপাশে পড়তে শুরু করে। খৃস্টান ও ইহুদীদের একটি ভিড় বেরিয়ে আসে। তাদের প্রত্যেকের গায়ের পোশাকে আগুন ধরে গেছে। তারা সকলে এদিক-ওদিক পালিয়ে যাচ্ছে। তারা চীৎকার ও হৈ-হুঁল্লোড় করছে। কিন্তু কারো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ স্ফুলিঙ্গগুলো রং-বেরঙের পাখিতে পরিণত হয়ে যায়। পাখিগুলো মসজিদে আকসার সবুজ গম্বুজের উপর গিয়ে বসতে শুরু করে। এখন মসজিদে না কোন ইহুদী আছে, না খৃস্টান।

হাসান ধীরে ধীরে মসজিদের দিকে হাঁটা দেয়। আকাশটা নীল। দিনের আলোতেও নীল। মসজিদের দরজায় এমন চাকচিক্য দেখা যাচ্ছে যেনো বড় একটি আয়নার উপর সুর্যের কিরণ এসে পড়েছে।

হাসানের চোখ ধাধিয়ে যায়। সে চোখ দুটো বন্ধ করে আবার খোলে। কিন্তু এখন আর সেখানে সেই আলোর ঝিলিক নেই। দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। সারা। সারা মিটিমিটি হাসছে। হাসান বিস্ময়াভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারা মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাঁদের ন্যায় সাদা চাদরে আবৃতা। শুধু মুখমণ্ডল আর হাত দুটো দেখা যাচ্ছে। তার হাসি মুখের দাঁতগুলো এতো শ্বেত-শুভ্র দেখাচ্ছে, যে শুভ্রতা এই পৃথিবীর মানুষ কখনো দেখেনি। সারা তার বাহু দুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে দেয়। ঠোঁট দুটো বন্ধ। কিন্তু হাসান তার সুরেলা কণ্ঠ শুনতে পায়- এসো পড়ো, মসজিদে আকসা আমাদের। যে কাফের এই মসজিদে প্রবেশ করবে, আকাশ তার উপর আশুন বর্ষণ করবে। যে মুসলমান এই মসজিদের পবিত্রতা ভুলে গেছে, তারও উপর আগুন বর্ষিত হবে। আমি তার আঙ্গিনাকে যমযমের পানি দ্বারা ধুয়ে দিয়েছি। আমার সব পাপ মুছে গেছে। আসে- আসো।

হাসানের চোখ খুলে যায়। সে আবার চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। এই সুখময় স্বপ্ন থেকে ফিরে আসতে চাইছে না হাসান। কিন্তু মুদিত চোখে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না। হাসান বাস্তব জগতে ফিরে এসেছে। ছাদের উপরে এবং এদিক-ওদিক মুষলধারা বৃষ্টির কানফাটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে উত্তাল সমুদ্রের ভয়ানক গর্জন। সমুদ্রটা এখন পূর্বের তুলনায় বেশি ক্ষিপ্ত। ঝড়-বৃষ্টি এবং রোম উপসাগরের এই তর্জন গর্জনের মধ্যেই হঠাৎ হাসানের মনে হলো, কে যেনো দরজায় করাঘাত করেছে। এটা তার কল্পনাও হতে পারে। তবু হাসান শয্যা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়। ক্রুশ ও ঈসা-মরিয়মের প্রতিকৃতি দুটো নিজ নিজ স্থানে ঝুলিয়ে রাখে। দরজায় আবারো করাঘাত পড়ে। হাসান জায়নামাযটা ভাজ করে লুকিয়ে রেখে দরজা খুলে দেয়।

দরজায় দাঁড়িয়ে সারা হাসছে। এতে মুষলধারা বৃষ্টি পড়ছে যে, বারান্দার বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সারার গায়ের পোশাক আর মাথার চুল থেকে টপ টপ করে পানি ঝরছে।

এই ঝড়ের মধ্যে তুমি আমার নিকট এসেছো? সারাকে ভেতরে আসতে বলে হাসান বললো।

না, জ্যাকব!- সারা উত্তর দেয়- আমি অন্য একজনের নিকট গিয়েছিলাম। পাইনি। গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে। সারাটা রাত মদপান করেছে আর ফস্টিনষ্টি করেছে। এখন লাশের মতো ঘুমাচ্ছে। জাগবে সেই সন্ধ্যায়। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিরাশ মনে এদিকে চলে এসেছি। ঝড় আমাকে সামনের দিকে হাঁটতে দিচ্ছিলো না। তোমার কাছে দিনের বেলা আসতে তো কেউ আমাকে ঠেকাতে পারে না।

হাসান একটা কাপড় হাতে নিয়ে সারার মাথার উপর ছড়িয়ে দেয়। তারপর নিজ হাতে সেই কাপড় দ্বারা তার চুলগুলো মুছে দিতে শুরু করে। হাসানের এই অকৃত্রিম আচরণ সারার ভালো লাগে। হাসান তার মুখটাও মুছে দেয়। তারপর একটা চাদর ধরিয়ে দিয়ে বললো- আমি ওদিকে ফিরে থাকছি, তুমি ভেজা কাপড়টা খুলে এটা পেঁচিয়ে নাও।

সারা পরিধানের ভেজা পোশাকটা খুলতে গিয়ে ভাবে, আমার প্রতি লোকটার ভালোবাসা এতই আত্মিক যে, আমার দেহটার সঙ্গে এই প্রেমের কোনই সম্পর্ক নেই নাকি তার অন্তরটা একেবারেই মৃত? সারা যখন হাসানকে বললো, আমি কাপড় পরিবর্তন করেছি, তখন হাসান অন্যদিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে আনে এবং সারার ভেজা কাপড়টা বারান্দায় নিয়ে চিপে শুকাতে দেয়।

এবার বলো, কোথায় গিয়েছিলে?- হাসান জিজ্ঞেস করে- আর রাতে আমার চলে যাওয়ার পর কী হয়েছিলো? মহিলা কি ভেতরে এসেছিলো?

সে সূত্রেই এদিকে এসেছিলাম- সারা উত্তর দেয়- মহিলা কক্ষে প্রবেশ করে শর্ত সাপেক্ষে আমাকে ক্ষমা করার প্রস্তাব দেয়। তুমি আমার কক্ষে এসেছিলে আমি স্বীকার করিনি। তার শর্তটা শুধু এই জন্য মেনে নিয়েছি যে, না হলে তোমার কথা বলতে হতো। তখন আমার সঙ্গে তোমাকেও শাস্তি ভোগ করতে হতো। আর তুমি জানো, শাস্তিটা কতো ভয়ানক হতো। আমি কোন পবিত্র মেয়ে নই। তারপরও মসুলের অতিথি কিংবা অন্য কারো শয়নকক্ষে যাওয়া আমার ভালো লাগে না। আমি নর্তকী ঠিক, কিন্তু বুড়িটা আমাকে যেভাবে খেলনা বানিয়ে রাখতে চায়, আমি তা মেনে নিতে পানি না। আমার নিজের একটা পছন্দ-অপছন্দ আছে। জীবনে বহু পাপ করেছি। কিন্তু কারো উপার্জন কিংবা অন্য কারো পাপের মাধ্যম হতে পারি না। মহিলা আমাকে বললো, এ কাজে তুমিও বিনিময় পাবে। চুপি চুপি দেবো, কেউ টের পাবে না। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, ঠিক আছে, তোমার কথামতো আজ রাতে আমি মসুলের একজন মেহমানের নিকট চলে যাবে। কিন্তু এখন চেষ্টা করছি, সম্রাটদের বলে দেবো, এই মহিলা মহলে গোপন ব্যবসা চালু করেছে।

আর সে বলে দেবে, রাতে তোমার কক্ষে পুরুষ মানুষ যাওয়া-আসা করছে। হাসান বললো।

বলুক- সারা বললো- আমি এখন যে কোন শাস্তি মাথা পেতে বরণ করে নিতে প্রস্তুত আছি। প্রয়োজনে আত্মহত্যা করতেও প্রস্তুত। মহিলাটার মুখোশ আমি খুলেই ছাড়বো। আমি নর্তকী। বেশ্যাবৃত্তি আমি করবো না। আচ্ছা, নাকি আমিই এগিয়ে গিয়ে বলে দেবো, রাতে তোমার কক্ষে আমি গিয়েছিলাম?- হাসান বললো- বলবো, তোমার সঙ্গে আমার দৈহিক নয়- আবেগের সম্পর্ক রয়েছে।

এ কথাটা যদি বলা যেতো, তাহলে আমি নিজেই বলে দিতাম, আমার কক্ষে জ্যাকব এসেছিলো- সারা বললো- কিন্তু এ তথ্য স্বীকার করা আর নিজেকে ঘোড়ার পেছনে বেঁধে ঘোড় হাঁকানো সমান। কেউই মেনে নেবো না, তোমার-আমার মাঝে আত্মিক সম্পর্ক আছে। এরা মানুষের আবেগ চেতনা সম্পর্কে অবহিত হয়। এদের কাছে সম্পর্ক মানেই দৈহিক। তুমি এ্যালবার্তুকে চিনে থাকবে। ইতালির নাগরিক। একজন সৎ ও হৃদয়বান অফিসার। বল্ডউইনের উপর তার বেশ প্রভাব আছে। শুধু এই একজন অফিসার আছেন, যিনি আমার প্রতি পবিত্র চোখে তাকিয়ে থাকেন। আমি তাকে রাতের ঘটনা শোনাবো এবং নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করার চেষ্টা করবো। যদি আমার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, তাহলে আমি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবো। সমুদ্র যদি আমার লাশটা উগরে দেয়, তাহলে হয়তো তুমি আমাকে দেখবে। অন্যথায় এখনই বিদায়। রোম উপসাগরের মাছ খেলে তাতে আমার দেহের ঘ্রাণ পাবে।

সারা!- হাসান বললো- তুমি খৃস্টান নও। তোমার সহকর্মীদের মধ্যে একটি মেয়েও এমন নেই, যে দৈহিক বিলাসিতা এবং উপহার-উপঢৌকনের প্রস্তাবকে তোমার ন্যায় প্রত্যাখ্যান করবে। আজ অবধি তুমি আমার সঙ্গে যেসব কথাবার্তা বলেছে, তাতে আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি, তোমার শিরায় মুসলমানের রক্ত আছে। সেই রক্তই আজ তোমার মধ্যে টগবগ করছে। বলো, আমি কি মিথ্যে বলছি?

সারা হাসানের প্রতি তাকায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো- শোনো জ্যাকব!…

আমি জ্যাকব নই সারা!- হাসান বললো- আমার নাম হাসান আল ইদরীস। বাড়ি সিরিয়া। এখানে এসে জ্যাকব গলবার্ট হয়েছি।

গোয়েন্দা?

অন্য কোন কারণও হতে পারে- হাসান বললো- গুপ্তচরবৃত্তিই একমাত্র কারণ নয়। দেখো, আমরা দুজন একজন অপরজনের আত্মায় ঢুকে পড়েছি। তার কারণ, আমরা উভয়ে মুসলমানের সন্তান। জ্যাকব গোপন একটা জায়গা থেকে জায়নামাযটা বের করে। একস্থান থেকে একটি পাথর সরিয়ে তার পেছন থেকে ছোট্ট এক কপি কুরআন হাতে নেয়। জায়নামায ও কুরআনখানা সারাকে দেখিয়ে বললো- এগুলো ছাড়া আমি থাকতে পারি না। এই মূর্তি, এই ছবি, এই ক্রুশ প্রতারণা মাত্র।

আমি যদি কাউকে বলে দিই, তুমি খৃষ্টান নও মুসলমান, তাহলে কী করবেঃ- সারা হেসে জিজ্ঞেস করে- তুমি গোয়েন্দা হতে পারো না। গোয়েন্দারা নিজেদেরকে এভাবে প্রকাশ করে না।

বলে দাও- হাসান বললো- আমি তোমার চোখের সামনে এই ঝড় তুফানের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তবে সারা! আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তুমি বলবে না।

হাসান আরো সম্মুখে অগ্রসর হয়ে নিজের হাত দুটো পেয়ালার মতো করে সারার মুখমণ্ডলটা তাতে নিয়ে কাছে টেনে আনে। তার চোখে চোখ রেখে ক্ষীণ অথচ ক্রিয়াশীল ও যাদুময় কণ্ঠে বললো- আমি জানি, তুমি কাউকে বলবে না লোকটা জ্যাকব নয়- হাসান। তুমি বলতে পারবেই না। আমাদের শিরায় আল্লাহর রাসূলের প্রেমিকদের রক্ত আছে। এই রক্ত সাদা হতে পারে না। এই রক্ত কাউকে ধোকা দিতে পারে না।

হাসানের চোখ দুটো সারার চোখে আটকে যায়। সারা অনুভব করতে শুরু করে, যেনো এই সুদর্শন যুবকটা সুন্দর একটা ভূতের ন্যায় তার মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের উপর জেঁকে বসেছে। হাসান বলছে- তুমি নাচের জন্য নয় মসজিদে আকসাকে কাফেরদের দখল থেকে মুক্ত করতে জন্মলাভ করেছে। আল্লাহ আমাকে সুসংবাদ দিয়েছেন। এখন আর বলো না তুমি মুসলমান নও। বলতে পারবেই না। কথা বলো সারা! আমি তোমাকে আমার তথ্য দিয়েই দিয়েছি। আমাকে তুমি তোমার তথ্য দিয়ে দাও। তোমার দেহের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তোমার আত্মাটাকে আমি পবিত্র দেখতে চাই।

সারার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। টল টল করে অশ্রু ঝরতে শুরু করে। ক্ষীণ স্বরে বললো- হ্যাঁ হাসান! আমি মুসলমান। আমি আমার পিতার পাপের শাস্তি ভোগ করছি। আমি সারা নই- সায়েরা।

পাপটা যারই থাকুক- হাসান বললো- আজ পর্যন্ত আমি তোমার যেসব কথাবার্তা শুনেছি এবং তুমি যে ধারায় কথা বলছিলে, তাতেই আমি ধরে নিয়েছি সেই পাপ তোমাকে দংশন করছে। তুমি খৃস্টানদের বিরুদ্ধে মৃণা এবং মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করছিলে। তাতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে এই দংশন তোমাকে অস্থির করে রাখছে।

যখন থেকে তুমি আমার আত্মাটাকে পবিত্র ভালোবাসায় ধন্য করেছে, আমার কাছে ভোগ-বিলাসিতার এই জীবনটা জাহান্নামের চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক অনুভব হতে শুরু করেছে। আমি পাপের মধ্যে লালিত-পালিত হয়ে বড় হয়েছি এবং পাপের মধ্যেই যৌবন লাভ করেছি। সেই পাপের সৌন্দর্য আজ বিষাক্ত নাগিনী হয়ে আমাকে দংশন করছে। এখন আর আমি বেঁচে থাকতে চাই না।

নিজের জীবন হরণ করাও পাপ- হাসান বললো- আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। এটা তার ওয়াদা। তুমি পাপের কাফফারা আদায় করো। তোমার সকল অস্থিরতা-অশান্তি শান্তিতে পরিবর্তন হয়ে যাবে।

বল, কী করবো?- সারা চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে বললো- নামায পড়বো? দুনিয়াত্যাগী হয়ে যাবো? বলল হাসান! আমি কিভাবে পাপের কাফফারা আদায় করবো?

গুপ্তচরবৃত্তি- হাসান উত্তর দেয়- মাত্র একবার প্রথম ও শেষবার। আগে লক্ষ্য বুঝে নাও। মানুষের লক্ষ্য যতো মহৎ হয়, মানুষ ততো মহান হয়। জানো, নূরুদ্দীন জঙ্গীর লক্ষ্য কী ছিলো? সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর লক্ষ্য কী? এতো অনেক বড় লোকদের কথা। তাদের মোকাবেলায় আমি কিছুই না। তারপরও তুমি আমার ব্যক্তিসত্ত্বায় এবং আমার চোখে এমন প্রভাব দেখে থাকবে, যা তোমার থেকে সত্য বের করিয়ে ছেড়েছে। এটা মূলত আমার ব্যক্তিত্বের ক্রিয়া নয়। এটা আমার জীবনের লক্ষ্যের ক্রিয়া, যা আমার নিকট ঈমানের চেয়েও বেশি প্রিয়। আমার লক্ষ্যের মহত্ব এবং পবিত্রতার কারণেই তোমার এই রূপ-যৌবন আমার উপর ক্রিয়া করতে পারেনি। কেন পারেনি। কারণ, আমি মানুষ ও বস্তুকে আত্মার চোখে দেখে থাকি।

আমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর লক্ষ্য ভালোভাবে জানি- সারা বললো- আমি এও জানি, খৃষ্টান শাসকবর্গ মুসলিম আমীর ও শাসকদেরকে সাহায্য এবং বিলাসিতার উপকরণ দিয়ে তাদেরকে সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাচ্ছে। আমি আরো জানি, ক্রুসেডাররা ইসলামী জগতটাকে ক্রুশের ছায়ায় নিয়ে আসতে চাচ্ছে। হাসান। সুলতান সালাহুদ্দীন ও খৃস্টানদের এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আমি এখানে এসে জানতে পেরেছি। অন্যথায় আমিও ক্রুশের বানে ভেসে গিয়েছিলাম। এই বান আমাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। শোনো হাসান! আজ কিছুদিন হলো মসজিদে আকসা আমার হৃদয়ের উপর জয়ী হয়ে আছে। দুরাত আমি স্বপ্নে মসজিদে আকসা দেখেছি। আমি, এ যাবত চর্মচক্ষে এই মসজিদটি দেখিনি। আমি জানি না, মসজিদে আকসা দেখতে কেমন। স্বপ্নে দেখেছি। ভেতরে গিয়েছি। মসজিদটা শূন্য এবং বিরান। আমি একটি কণ্ঠ শুনতে পেলাম- এটি তোমার খোদার ঘর। তুমি একে আবাদ করো। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে শুরু করলাম, শব্দটা কোন্ দিক থেকে আসলো। এমন সময় আমার চোখ খুলে যায়। শব্দটা আমার হৃদয়ে গেঁথে যায়। আচ্ছা, আমি কি একেই আমার লক্ষ্য বানাতে পারি না?

এটা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য- হাসান বললো- কিন্তু এর জন্য বহু কুরবানী দিতে হবে। আমি বৈরুতে প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকি। যেদিন ধরা পড়বে, সেদিনটি হবে আমার জীবনের শেষ দিন।

আমি কুরবানী দিতে প্রস্তুত আছি- সারা বললো- আমাকে কর্তব্য বুঝিয়ে দাও।

ঐ বৃদ্ধা তোমাকে মসুলের যে দূতের বিনোদনের জন্য যেতে বলেছে, তুমি তার নিকট চলে যাও। হাসান বললো।

সারা বিস্ময়াভিভূত অপলক নয়নে হাসানের প্রতি তাকিয়ে থাকে, যেনো তার চোখ দুটো আটকে গেছে।

হ্যাঁ সারা!- হাসান বললো- এই ত্যাগ তোমাকে দিতেই হবে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী গুপ্তচরবৃত্তির জন্য মেয়েদের কোথাও প্রেরণ করেন না। তিনি বলে থাকেন, এক নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য আমি একটি শক্ত দুর্গ শত্রুকে দিয়ে দিতে রাজি। আমরা নারীর সম্ভ্রমের সংরক্ষক। কিন্তু সারা! তুমি এখানে উপস্থিত আছে। এই মুহূর্তে আমাদেরকে যে কাজটি না করলেই নয়, সেটি কেবল তোমার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন হতে পারে। কোন পুরুষের বিনোদনের উপকরণ হওয়া তোমার পক্ষে নতুন কোন বিষয় নয়। আমি তোমাকে দুএকটি কৌশল বলে দেবো, যার মাধ্যমে তুমি বৃদ্ধের বক্ষ থেকে তথ্য বের করে আনতে পারবে এবং নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারবে। তোমার লক্ষ্য অতিশয় পবিত্র ও মহান। আমি আশাবাদী, আল্লাহ তোমার ইজ্জতের হেফাজত করবেন।

বলো কী করতে হবে- সারা বললো- আমি একটা কুলটা মেয়ে। আল্লাহ যদি আমার থেকে এই কুরবানী নিয়ে খুশি হন, তাহলে আমি দিতে প্রস্তুত আছি।

মনোযোগ সহকারে শোনো- হাসান বললো- এই দূত দুজন মসুলের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীনের পক্ষ থেকে এসেছে। আমি নিশ্চিত, তারা বল্ডউইন থেকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে সাহায্য নিতে এসেছে। এ সময়ে আমাদের বাহিনী নাসীবা নামক স্থানে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছে। সুলতান এই আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত যে, তিনি তাঁর বন্ধুদের মাঝে অবস্থান করছেন। কিন্তু আসলে তিনি তার মুসলিম শত্রুদের বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছেন। খৃষ্টানরা কিরূপ সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে এবং মসুল, হাল্ব ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে, এসব ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে সুলতানকে জানাতে হবে।

হাসান বিস্তারিত বিবরণের মাধ্যমে সারাকে কর্তব্য বুঝিয়ে দেয় এবং শেষে বললো- তুমি আত্মহত্যা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে না। আমি তোমাকে পবিত্র ও আনন্দময় জীবনে অনুপ্রবেশ করাচ্ছি। তুমি নির্যাতিত মেয়ে। সম্ভবত শৈশবে কোন কাফেলা থেকে খৃস্টানরা তোমাকে অপহরণ করে এনেছিলো। তারাই তোমাকে পাপের জীবনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

না হাসান!- সারা বললো- আমি নিজেই নিজেকে অপহরণ করেছিলাম। সেই কাহিনী পরে একসময় শোনাবো। এখন আমাকে কাজ করতে দাও। দুআ করো আল্লাহ যেনো আমাকে সফল করেন এবং আমি আমার জীবনের সব পাপের কাফফারা আদায় করতে পারি।

বৃষ্টি থেমে গেছে। সারা নিজের পোশাক পরিধান করে হাসানের কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। যে ভবনটিতে তার কক্ষ, সেই ভবনে প্রবেশ করামাত্র বৃদ্ধাকে পেয়ে যায়। বৃদ্ধা সারাকে দেখে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো রাতে প্রস্তুত থাকবে। আমার লোকেরা মসুলের এক দূতের সঙ্গে কথা পাকা করেছে। আজ রাত না কোথাও নাচ-গান হবে, না জেয়াফত আছে। আমি তোমাকে তার কক্ষে দিয়ে আসবে।

আমি প্রস্তুত থাকবে। সারা হাসিমুখে বললো।

 ***

মসুলের দূত দুজন যেনো ক্ষুধার্ত নেকড়ে। তারা নিজেদের ও ইযুদ্দীনের ঈমান বিক্রি করতে এখানে এসেছে। এসেছে গাদ্দারীতে সফল হওয়ার জন্য খৃস্টান সম্রাট বল্ডউইনের সাহায্য নিতে। এই সম্রাট নিজের স্বার্থ এবং মুসলিম শাসকদেরকে পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়ে রাখার লক্ষ্যে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। এই মুসলমান দূতদের মাঝে ঈমান অবশিষ্ট আছে, না ব্যক্তিগত ও জাতীয় মর্যাদার অনুভূতি। সম্রাট বল্ডউইনের মদদে পুষ্ট হয়ে বিলাসী জীবন লাভ করাই এখন তাদের একমাত্র সাধনা। বন্ডউইনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সন্ধি-চুক্তি সম্পাদনের পর বৈরুত নগরী এবং সমুদ্র ভ্রমণের জন্য এখনো তারা রয়ে গেছে। এই সময়ে মহলের মেয়েদের নেত্রী বৃদ্ধা মহিলা একজন লোক মারফত প্রস্তাব পাঠায়, আপনারা চাইলে এমন এক রূপসী মেয়ের ব্যবস্থা করে দেবো, যেমনটি জীবনে কখনো দেখেননি। প্রস্তাব পেয়ে তাদের জিতে পানি এসে যায়। বিনিময় নির্ধারণের মাধ্যমে মুক্তি পাকাঁপোক্ত হয়ে যায়। তাদের একজনের নিকট পাঠানোর জন্য সারাকে প্রস্তুত করা হয়।

রাতে কালো চাদরে আবৃত করে সারাকে মসুলের এক দূতের কক্ষে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। দূত- যে কিনা মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীনের সামরিক উপদেষ্টাও পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধ- গত রাতে মাত্রাতিরিক্ত মদপান করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আজ নিজ কক্ষে বসে ধীরে ধীরে অল্প অল্প পান করছেন। কক্ষে বসে বসে সে এমন এক নর্তকীর আগমনের অপেক্ষা করছে, যার রূপের বিবরণ শুনে তার মাথাটা গরম হয়ে আছে।

দূতের কক্ষের দরজা খুলে যায়। একটি মেয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। মেয়েটি আপাদমস্তক কালো চাদরে আবৃত। দরজা বন্ধু হয়ে যায়। দূত মেয়েটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম হয় এবং তার মুখমণ্ডল আবরণমুক্ত হওহ্মার আগেই অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করে তাকে জড়িয়ে ধরে। নিজের বয়সের কথা ভুলে যায় বৃদ্ধ।

সারা তার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গায়ের কালো চাদরটা খুলে দূরে ফেলে দেয়। দূতের মুখের প্রতি তাকায়। সহসা মেয়েটির মুখ বিস্ময়ে পাংশু হয়ে যায়। মাথাটা অবনত করে পেছন দিকে সরে যেতে শুরু করে। সরতে সরতে তার পিঠ দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে যায়। সারার অনাবৃত মুখটা দেখার পর দূতও হঠাৎ চমকে ওঠে মনে মনে বলে উঠে- সায়েরা!

সারার মুখে কোন কথা নেই, যেনো তার বাকশক্তি হারিয়ে গেছে। ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধের প্রতি। দূত ভয়জড়িত এবং বিশ্বায়ভিভূত কণ্ঠে বলে ওঠে- সায়েরা! তুমি সায়েরা? পরক্ষণে মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো- না, মানে আমার এক মেয়ে দেখতে ঠিক তোমার মতো। তার নাম সায়েরা। তোমাকে দেখে হঠাৎ মনে হলো, তুমিই বুঝি সায়েরা।

আমিই আপনার কন্যা সায়েরা- হঠাৎ সারার জবান খুলে যায়। মৃণায় দাঁত কড়মড় করে বললো- আমিই আপনার কন্যা। যারা মহলে মহলে অন্যের মেয়েদের নাচিয়ে বেড়ায়, তাদের মেয়েরাও নাচতে পারে। আমি এক আত্মমর্যাদাহীন পিতার আত্মমর্যাদাহীন কন্যা।

ইযযুদ্দীনের দূত অকস্মাৎ কেঁপে ওঠে। খাটের উপর লুটিয়ে পড়ার মতো করে বসে পড়ে। মুখে কোন কথা নেই। সারা তার কন্যা। পিতা-কন্যার বিরহ ঘটেছে দুবছর হয়েছে।

ঈমান নিলামকারীদের কন্যারা ঈমান নিলামকারীই হয়ে থাকে সারা অগ্রসর হয়ে পিতার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘৃণায় দাঁত কড়মড় করতে শুরু করে। বললো- আজ নিজের আত্মমর্যাদা ও ইয্যতের পরিণতি দেখো। আজ তুমি নিজ কন্যার সম্মুমের খদ্দের। তোমার মেয়ে তোমারই শয্যায় ভাড়ায় রাত কাটাতে এসেছে। সারা বিদ্যুতিতে নিজের একটা হাত সম্মুখে এগিয়ে ধরে বললো- দাও, আমার পারিশ্রমিক বের করো। আমি তোমার সঙ্গে রাত কাটাতে এসেছি।

তু… তু…- সারার পিতার মুখ দিয়ে কথা সরছে না- তুমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলে। আমি নই- তুমিই আত্মমর্যাদাহীন।

যে পিতা নিজ যুবতী কন্যার সামনে কন্যার বয়সী মেয়েদের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করতে পারে এবং আপন কন্যার বয়সী মেয়েদেরকে নাচাতে ও মদপান করে মাতাল হয়ে তার সঙ্গে কন্যার সম্মুখে অসদাচরণ করতে পারে, সেই পিতার কন্যা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে না। তার কন্যাও নর্তকী কিংবা বেশ্যা হতে বাধ্য। পিতা যদি সেই কন্যাকে বিবাহও দিয়ে দেয়, তো সে স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করে এবং তলে তলে একাধিক পুরুষের শয্যায় রাত কাটায়। আমি তোমাকে তোমার অতীত আর আমার নিজের বর্তমান বলছি। আমি দামেশকে তোমার ঘরে যখন বুঝমান হই, তখনই তোমাকে নারী নিয়ে ফুর্তি করতে দেখি। নূরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর তুমি আল-মালিকুস সালিহর সঙ্গে হাল্ব পালিয়ে গিয়েছিলো। আমাকে ও মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলে। হালবে গিয়ে মদও পান করতে শুরু করেছিলে। তখন আমি কিশোরী ছিলাম। তোমার নিকট খৃস্টানরা আসতে শুরু কয়েছিলো। তোমার ঘরে মদ এবং নাচ-গানের আসর বসতে শুরু হয়েছিলো। খৃলনরা আমার সঙ্গে অসদাচরণ শুরু করলে তুমি খুশি হয়েছিলো।

তারপর আল-মালিকুস সালিহ মারা গেলেন। তোমার নিকট খৃস্টানদের আনাশোনা আরো বেড়ে গেলো। তুমি আগের চেয়ে বেশি বিলাসী হয়ে ঈমানদী কোন উঠেছিলে। ইযযুদ্দীন তোমাকে অনেক বড় পদমর্যাদা দান করলেন। আমি তোমার নর্তকী মেয়েদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে লাগলাম। তাদের থেকেই আমি নাচ শিখেছি। তুমি জানতে পেয়ে খুশি হয়েছিলে। খৃস্টানরা তোমার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। তুমি আপত্তি করোনি। তার কারণ; তারা আমার পরিবর্তে তোমাকে ইউরোপের একটি মেয়ে দান করেছিলো। তুমি তোমার ঈমান বিক্রি করে ফেলেছে। সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছো। তোমার নীতি-নৈতিকতা সব শেষ হয়ে গেছে। নিজের মেয়েটাকে পর্যন্ত পাপের পথে ছেড়ে দিয়েছে। তারপর খৃস্টানরা আমাকে সবুজ বাগান দেখায়। আমি তোমার গৃহকে বিদায় জানিয়ে স্বপ্নের স্বর্গের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আজ রাতের ন্যায় এরূপ আর কজনের শয়নকক্ষে রাত কাটিয়েছি আমাকে সে প্রশ্ন করো না। সেই খৃস্টান আমাকে ভালোবাসার ধোকা দিয়ে বিক্রি করে ফেলে। আমি তোমার ন্যায় বিপুল সম্পদের মালিকদের বিনোদনের উপকরণ হয়ে বৈরুত এসে পৌঁছি। এখানে আমি রাজ নর্তকী। আজ আমার পিতা আমার সম্ভ্রমের গ্রাহক।

ইযুদ্দীনের দূত মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। শরীরটা তার কাঁপছে।

আজ তুমি তোমার ঈমানের মূল্য উসূল করতে এসেছো- সারা তাচ্ছিল্যমাখা কণ্ঠে বললো- তুমি ফিলিস্তীন ও প্রথম কেবলা বিক্রি করতে এসেছে। নিজ কন্যার মূল্য আদায় করতে এসেছে। সারার কণ্ঠ তুঙ্গে উঠে যায়। এটি আমার জীবনের শেষ রাত। আমি পিতার পাপের শাস্তি ভোগ করে এই জগত থেকে বিদায় নিচ্ছি।

সারার পিতা ধীরে ধীরে মাথা উঠায়। তার দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে গণ্ডদেশ ভিজিয়ে ফেলেছে। উঠে দাঁড়িয়ে দেয়াল থেকে ঝুলন্ত তরবারীটা খুলে হাতে নেয়। খাপ থেকে বের করে তরবারীটা সারার দিকে এগিয়ে ধরে বলে- এই নাও, নিজ হাতে আমাকে শেষ করে দাও। সম্ভবত এতে তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে।

সারা পিতার হাত থেকে তরবারীটা নিয়ে নেয় এবং বলে- আজ আল্লাহর রাসূলের উম্মত এমন এক অবস্থানে এসে উপনীত হয়েছে যে, পিতা কন্যার হাতে তরবারী দিয়ে যাও প্রথম কেবলাকে এই তরবারী দ্বারা মুক্ত ও আবাদ করে না বলে বলছেন, নাও, এই তরবারী দ্বারা আমাকে খুন করো, আমার পাপের কাফফারা আদায় করো। পিতার আবেগময় অবস্থা এবং অশ্রুসজল চোখ দেখে সারার বলার ধরন পাল্টে যায়। হৃদয়ে পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ফিরে আসে। কণ্ঠটা শান্ত করে বললো- মৃত্যুবরণ করে গুনাহের কাফফারা আদায় করা যায় না। একটা পন্থা এও আছে, বেঁচে থাকুন এবং দুশমনকে হত্যা করুন। বলবো কী করবেন?

পিতা পরাজিতের ন্যায় মেয়েরে প্রতি তাকায়।

সম্রাট বল্ডউইনের সঙ্গে আপনার যে চুক্তি হয়েছে এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করার লক্ষ্যে যে পরিকল্পনা প্রস্তুত ও স্থির, হয়েছে, তা আমাকে বলে দিন- সারা বললো- আমি সুলতানকে এই তথ্য পৌঁছিয়ে দেবো। এর চেয়ে বড় পুণ্য আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহ আপনার সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন।

পিতা নীরবে কথা শুনছে। সারা বললো- অন্যথায় আসুন আমরা উভয়ে এখান থেকে পালিয়ে মুক্তি লাভ করি এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট গিয়ে আপনি তাকে সব খুলে বলবেন।

আমি প্রস্তুত- পিতা বললো- কিন্তু এখান থেকে আমরা বের হবো কীভাবে?

ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সারা বললো।

পিতা কন্যাকে বুকে জড়িয়ে নেয় এবং ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।

বৃদ্ধা বেজায় আনন্দিত, সে অনেক মোটা একজন খদ্দের পেয়ে গেছে এবং সারার মতো রূপসী মেয়ে তার শয্যায় রাত কাটাতে চলে গেছে। এখন মনে তার শুধুই আনন্দ। মহিলা জানে, সারা সকালে ফিরে আসবে। কিন্তু সারা রাতের বাকি অংশটুকু অতিবাহিত করেছে হাসান আল ইদরীসের কক্ষে পরিকল্পনা প্রণয়নে। সারা হাসানকে বললো- রাত কাটাতে যার নিকট গিয়েছিলাম, তিনি আমার পিতা। শুনে হাসানের মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। সারা হাসানকে তার পিতার চরিত্র ও নিজের ইতিবৃত্ত শোনায়। সারা জানায়, তিনি এখান থেকে পালিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট চলে যেতে প্রস্তুত আছেন।

আমি তোমাকে বলেছিলাম, তোমার লক্ষ্য পবিত্র- হাসান বললো আমি আশাবাদী আল্লাহ তোমার সম্ভ্রম রক্ষা করবেন। আমি তোমার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো এবং প্রস্তুত থাকতে বলবো।

দিনের বেলা হাসান সারার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সাবধানে কথা বলে। তার আত্মমর্যাদা উস্কে দেয়। হাসান অনুভব করলো, লোকটা অত্যন্ত অনুতপ্ত। হাসান তাকে পালাবার সহজ পন্থা বলে দেয়।

সারার পিতাকে পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে হাসান সারার সঙ্গে দেখা করে। সারার পিতা তার মেজবানদের কাছে আকাঙ্খ ব্যক্ত করে, আমি একাকী একটু বেড়াতে যেতে চাই। তাকে ঘোড়া দেয়া হলো। সঙ্গী দূতকে বলে যান, আমি সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসবো। ঘোড়ায় চড়ে তিনি শহর থেকে বেরিয়ে যান। হাসান ঘোড়ায় চড়ে এক স্থানে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সারা লুকিয়ে আছে অন্য এক স্থানে। তিনজন একত্রিত হয়। সারার পিতা তাকে নিজের ঘোড়ায় বসিয়ে নেন। তিনজন নাসীবা অভিমুখে রওনা হয়ে যায়।

তারা অতি সাবধানে পথ চলতে থাকে। অনেক পথ অতিক্রম করার পর এবার দ্রুতবেগে ঘোড়া হাঁকায়। সফর অনেক দীর্ঘ ছিলো। কিন্তু এই পথ তারা একদিন ও একরাতে অতিক্রম করে ফেলে।

সম্রাট বল্ডউইন আকাশটা মাথায় তুলে নেন। বৈরুতের গোয়েন্দাদের জন্য তিনি গজবরূপে আবির্ভূত হন। মসুলের এক দূত পালিয়ে গেছে। এক রাজ নর্তকী- যার সঙ্গে বল্ডউইনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিলো- নিখোঁজ। গলবার্ট জ্যাকব নামক এক নিরাপত্তা কর্মীও উধাও। তিনজনের একজনেরও কোন সন্ধান মিলছে না। বৃদ্ধার জবানও বন্ধ। সারাকে সে রাতে পালিয়ে যাওয়া দূতের কক্ষে প্রেরণ করেছিলো, এ তথ্য দিতে ভয় পাচ্ছে মহিলা।

বৈরুতে মাত্র এক ব্যক্তি জানে এই তিন ব্যক্তির কী হয়েছে এবং কোথায় আছে। তার নাম হাতেম। কিন্তু হাতেম তো অখ্যাত একজন মুচি। তাকে তারাই চেনে, যারা তার দ্বারা ছেঁড়া জুতায় তালি লাগায়। আর চেনে মুচি হিসেবে। কেউ কি জানে, এই ছা-পোষা নিরীহ মানুষটা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একজন গোয়েন্দা নেতা, যিনি বৈরুতের সব খবরাখবর পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন,আইউবীর কানে? কোন কিনারা করতে ব্যর্থ হয় বৈরুতের গোয়েন্দারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *