৭.৩ ধর্ম ও যুক্তি
১
ধর্ম এবং যুক্তির ভিতর একটা দ্বন্দ্ব চলেছে। কখনো এরা সমন্বয়ে পৌঁছয়, কখনো নতুন করে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর একটা বাইরের রূপ আছে, একটা ভিতরের রূপ। সংসারে কিছু মানুষ ধর্মবিশ্বাসী, কেউ বা ধর্মকে সন্দেহের চোখে দেখেন। এটা বিভেদের বাহ্যরূপ। মনের মধ্যে ধর্মবিশ্বাস ও যুক্তিবাদের যে বিতর্ক দেখা দেয়, সংশয়ের ঝড় ওঠে, সেটা বাইরের রূপ। কারো ক্ষেত্রে ঈশ্বরে বিশ্বাস জয়ী হয়েছে, কেউ হন নিরীশ্বরবাদী। দুটোই বিশ্বাসের এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু বিশ্বাসেরই নয়, দ্বন্দ্বেরও মূল্য আছে। মনের ভেতর যে সংশয় আমাদের অস্থির করে, তারও নিজস্ব মহত্ত্ব আছে। যাঁরা চিন্তাশীল ও সূচেতনাসম্পন্ন, তাঁদের অনেকেরই মানসলোক একটা তীব্র দ্বন্দ্বের দ্বারা সমৃদ্ধ। বিশ্বাস ও সংশয় দুয়েরই মূল্য আছে। এদের কী করে মেলানো যায়, সেটাই সমস্যা।
বিষয়টা স্পষ্ট করবার জন্য দুয়েকটি উদাহরণ যথেষ্ট। বেট্র্যাণ্ড রাসেল এ-যুগের। প্রখ্যাত নাস্তিক বলে পরিচিত। কিন্তু কী গভীর বেদনায়, কত তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে, সেই নাস্তিক্য বিধৃত, আমরা অনেকেই সে-কথা মনে রাখি না। ১৯১৬ সালের ২৩শে অকটোবরের একান্ত ব্যক্তিগত একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন–The centre of me is always and eternally a terrible pain….a searching for something beyond what the world contains, something transfigured and infinite the beatific vision God. I do not find it, I do not think it is to be found…’ঈশ্বরের অনস্তিত্বের এই ঘোষণা এমন আর্তনাদের ভাষায় এখানে ধ্বনিত হয়েছে যে, সিদ্ধান্তের চেয়েও তার পিছনে যে-বেদনা আছে সেটাই স্মরণীয় হয়ে উঠেছে। এ কোনো আত্মসন্তুষ্ট নিরীশ্বরবাদ নয়। আবার নিশ্চিত নিঃসংশয় ঈশ্বরবাদ সম্বন্ধে আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনের মন্দিরভাষণ থেকে কয়েকটি বাক্য শোনা যাক। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। ‘সংশয়ের যে বেদনা সেও যে ভালো। কিন্তু যে প্রকাণ্ড জড়তার কুণ্ডলীর পাকে সংশয়কেও আবৃত করে থাকে, তার হাত থেকে যেন মুক্তিলাভ করি।’ রাসেল অথবা রবীন্দ্রনাথ, কে কখন কোন সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌঁছেছিলেন, সেটাই একমাত্র উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। চেতনার ভিতরে যে দ্বন্দ্ব তাঁরা আজীবন বহন করেছেন, তার তাৎপর্য গভীর। সিদ্ধান্তের চেয়েও জিজ্ঞাসার গুরুত্ব বেশি, প্রশ্নই চেতনাকে দেয় গতি। প্রশ্নের গভীরতায় বিশ্বাসও গভীরতা পায়।
ধর্ম ও যুক্তির যে দ্বন্দ্ব তার আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা এরপর উল্লেখ করা প্রয়োজন। দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে ধর্ম ও যুক্তি দুয়েরই চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু কোনোটিরই বিনাশের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দ্বন্দ্ব দুই রকমের হয়। একরকমের দ্বন্দ্ব বিনাশাত্মক; অর্থাৎ একপক্ষের সম্পূর্ণ বিনাশই সেখানে লক্ষ্য। আরো একরকমের দ্বন্দ্ব আছে। সেখানে ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে দুই পক্ষের সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু কোনো। পক্ষই বিনষ্ট হয় না। বরং দুই পক্ষই সম্ভবত দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে সমৃদ্ধ হয়। এই রকমের। দ্বন্দ্বকে বলা যেতে পারে সমন্বয়মুখী। কোনো বিশেষ দ্বন্দ্বকে আমরা কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি সেটা জরুরি প্রশ্ন। কারণ সমগ্র দৃশ্যপটই দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভর করছে।
সম্প্রতি কম্যুনিস্ট-শাসিত সমাজেও ধর্মের প্রতি নতুন করে আগ্রহ দেখা দিয়েছে। পৃথিবী থেকে ধর্মবিশ্বাসীরা দূর হয়ে যাবেন, এমন ধরনের নাস্তিক্যের স্বর্গ প্রতিষ্ঠিত হবার বাস্তব সম্ভাবনা নেই। যুক্তিবাদীরাও থেকেই যাবেন। এঁদের সবাইকে পাশাপাশি বাস করতে হবে। সহাবস্থান যেখানে অনিবার্য সেখানে পরস্পরকে বুঝাইবার একটা ঐকান্তিক প্রয়াস বাঞ্ছনীয় এমনকি আবশ্যক। শ্রদ্ধাহীন সহবাসের মতো বিড়ম্বনা কমই আছে।
ধর্মের যাঁরা মিত্র তাঁরা নিশ্চিতভাবে যুক্তির শত্রু, এর রকমের কোনো প্রত্যয় থেকে আলোচনা শুরু করা অন্যায় হবে। যাঁরা ধর্মবিশ্বাসী, তাঁরা সবাই যুক্তিবিরোধী নন। অনেকেই যুক্তির প্রয়োজন মানেন। অন্তত যুক্তির প্রতি একটা উভয়বলতা, একই সঙ্গে মান্যতা ও সাবধানতা, তাঁদের ভিতর উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যায়। এই ব্যাপারটা একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করা দরকার।
রাজা রামমোহন রায় ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তাঁকে কোনোমতেই যুক্তিবিরোধী বলা যায় না। বরং যুক্তিবিচারের একটা ধারা তাঁর চিন্তায় ও কর্মে প্রত্যক্ষ। বঙ্কিমের ধর্মতত্ত্ববিষয়ে আলোচনায় যুক্তির সুর সুস্পষ্ট। তাঁর সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ বর্জন যাই করি না কেন, একথা মেনে নিতে হয় যে, বাঙলা প্রবন্ধসাহিত্যে এমন যুক্তিধর্মী লেখা বেশি দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ভিতরও একটা স্পষ্ট যুক্তিবাদী প্রত্যয় লক্ষণীয়, এ বিষয়ে অন্যত্র আলোচনা করেছি।
এইমাত্র যে উভয়বলতার উল্লেখ করা হয়েছে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বামী বিবেকানন্দ। রাজযোগ নিয়ে আলোচনায় বিবেকানন্দ বলেছেন–We find one fact held in common by all the great teachers of religion the world ever had. They all calim to have got their truths from beyond… The Yogi teaches that the mind itself has a higher state of existence, beyond reason, a superconscious state, and when the mind gets to that higher state, then this knowledge, beyond reasoning, comes to man.’ অর্থাৎ চেতনার একটা স্তর আছে, যেটা যুক্তিকে অতিক্রম করা যায়। ধর্মের সত্য বা আধ্যাত্মিক উপলব্ধি সেই স্তর থেকেই লাভ করা যায়। তবে কি মেনে নিতে হবে যে, যুক্তিবিচারের অধিকারের বাইরে ধর্মের প্রতিষ্ঠিা? বিবেকানন্দ কিন্তু সেকথাও বলছেন না। বরং আশ্চর্য এক বিপরীত উক্তি আমরা তাঁর মুখে শুনি। যুক্তি ও ধর্ম (Reason and Religion) এই নামে ইংল্যাণ্ডে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন “Is religion to justify itself by the discoveries of reason, through which every other science justifies itself? Are the same methods of investigation, which we apply lo sciences and knowledge outside, to be applied to the science of Religion? In my opinion this must be so, and I am also of the opinion that the sooner it is done the better. If a religion is destroyed by such investigation it was then all the time useless, unworthy superstition; and the sooner it goes the better …All that is dross will be taken off, no doubt, but the essential parts of religion will emerge triumphant out of this investigation.’–উপরের উদ্ধৃতি দুটি কি পরস্পরবিরোধী? নাকি দুইয়ের ভিতর সামঞ্জস্য সম্ভব? সেই আলোচনায় পরে অগ্রসর হওয়া যাবে, আপাতত একটি কথাই বিশেষভাবে লক্ষ করতে হবে। বিবেকানন্দ বলেছেন। যুক্তিকে ত্যাগ করা চলবে না। যুক্তির আলোতে ধর্মেরও বিচার চাই। সেই বিচারের ভিতর দিয়ে ধর্ম শুদ্ধ হয়ে উঠবে, যা-কিছু কেবলই কুসংস্কার, তা সবই পরিত্যক্ত হবে। এমনই হওয়া আবশ্যক। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন-’বেদের যতখানি অংশ যুক্তিযুক্ত, আমি ব্যক্তিগতভাবে ততখানি গ্রহণ করি।’
অতএব রামমোহন থেকে শুরু করে গত শতকের ধর্মজিজ্ঞাসার ধারায় যুক্তির প্রয়োজন বারবার স্বীকৃত হয়েছে। এমন কারো মনে হতে পারে যে, পাশ্চাত্ত্য যুক্তিবাদের সঙ্গে রফা করবার জন্য এদেশের উনিশশতকী ধর্মসংস্কারকরা যুক্তিকে এক অনিচ্ছুক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু একথা বললে রামমোহনের মতো মানুষের প্রতি অবিচার করা হয়। কোনো এক আন্তরিক প্রেরণা থেকেই এঁরা ধর্ম ও যুক্তির ভিতর সামঞ্জস্যস্থাপন করতে। চেয়েছিলেন। তা ছাড়া, এই প্রেরণা একান্তভাবে আধুনিক এমন বলা যাবে না। রামমোহন প্রাচীন শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, কেবল শাস্ত্রকে আশ্রয় করে অন্ধভাবে কোনো বিনিশ্চয়ে উপনীত হওয়া কর্তব্য নয়; যুক্তিহীন বিচারে সত্যলাভ হয় না; বরং ধর্মহানি ঘটে। বুদ্ধি ও বিচারকে ত্যাগ করে বিবেক গঠিত হতে পারে না। এই প্রত্যয় বুদ্ধ, বৃহস্পতি কিংবা আদি শঙ্করের মতো প্রাচীনদের বাণীতে বারবার বহুরূপে ধ্বনিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক প্রেরণার ভিতরই কোথাও এর স্থান আছে, এ-কথা মেনে নিয়েই আলোচনায় অগ্রসর হওয়া ভালো।
অর্থাৎ ধর্ম ও যুক্তিকে অনড়ভাবে দুই বিপরীত শিবিরে স্থাপন করে একরকমের অন্ধ ধর্মযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু সার্থক আলোচনার তাতে সম্ভাবনা অল্প। যদিও এই দুয়ের পার্থক্য স্বীকার্য, মতের সম্পূর্ণ ঐক্য যদিও আশা করা যায় না, তবু ধর্ম ও যুক্তির ভিতর সংলাপের প্রয়োজন আছে। এদের সংলাপ ফলপ্রসূ হতে পারে, এই বিশ্বাস অমূলক নয়। সব সার্থক আলোচনারই ন্যূনতম শর্ত হল, নিজের প্রতি বিশ্বস্ততা আর। অপরের প্রতি সামান্য সহানুভূতি।
সহানুভূতির সঙ্গে স্বানুভূতির বিরোধ নেই। এদের যোগ ছিন্ন হলে ব্যক্তির উচ্চারণে সততা থাকে না। ধর্ম নিয়ে কথা বলতে গেলে আবাক্য যতই সহায়ক হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত নিজের উপলব্ধির প্রতি বিশ্বস্ততার বিকল্প নেই। আমারই চিন্তা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অনিবার্যভাবে সীমাবদ্ধ এই আলোচনা, সেই সীমা অতিক্রম করবার অধিকার আমার নেই। ভূমিকায় এই স্বীকারোক্তি করে নেওয়া সঙ্গত।
(খ)
বিশ্বের কয়েকটি প্রধান ও বহু আলোচিত ধর্মে ঈশ্বর থেকে শুরু হয় ধর্মের কথা। আদিতে ঈশ্বর স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, বাইবেলের আরম্ভেই পাই এই বাক্য। আল্লার নাম নিয়ে উচ্চারিত হয়েছে কোরানের বাণী। ঈশ্বর ছাড়া ধর্মের ভিত্তি নেই। যাঁদের এই ধারণা তাঁদের কাছে নাস্তিক, অধার্মিক, নিরীশ্বরবাদী, এইসব শব্দ সমার্থক। অন্য রকমের। প্রত্যয়ের ওপরও ধর্মের প্রতিষ্ঠা সম্ভব, সে কথায় পরে যাব।
যুক্তি অথবা দার্শনিক বিচার দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত করবার চেষ্টা বহুদিন থেকেই চলেছে। আমরা সেই ইতিহাসে ঢুকব না। আঠারো শতকে ইউরোপে যখন। যুক্তিবাদের জোয়ার এল, সেই সময়কার একটু উল্লেখ তবু আবশ্যক। সে সময়ে পাশ্চাত্ত্যদেশে যুক্তি ও ঈশ্বরচিন্তার ভিতর সমম্বয়সাধনের এক তাৎপর্যময় প্রয়াস দেখা যায়, বাঙলাদেশের প্রাগ্রসর ধর্মচিন্তায় উনিশ শতকে যার প্রভাব এসে পৌঁছেছিল।
সতেরো শতক থেকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের অগ্রগতি দ্রুত হয়ে উঠল আর তারই সঙ্গে যোগ নতুন যুক্তিবাদের। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়মে বাঁধা। সবকিছুই চলমান আর বিশ্বের অংশস্বরূপ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ কিছুই নিয়মের বাইরে চলে না। সৌরমণ্ডলের সূর্যসহ পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ যে পরস্পর সম্পর্কে যুক্ত, এই যোগের সূত্রগুলি যে গণিতের। ভাষায় যথাযথভাবে প্রকাশ করা যায়, অযুতনিযুত বৎসর ধরে সূর্যপ্রদক্ষিণের পথে এই নিয়মই যে ঘোষিত হয়ে চলেছে, এই আবিষ্কার মানুষের চেতনায় একটা দিব্য বিস্ময়ের। মতো এসেছিল। সৌরমণ্ডলের যে ছবি বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে ধরা পড়ল, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুর অভ্যন্তরেও দেখা গেল যেন তারই প্রতিচ্ছবি। আবার সৌরমণ্ডলও যে-বিশ্বজগতের অতিক্ষুদ্র অংশ, সেই মহাবিশ্বে আছে নিয়মের রাজত্বের সীমাহীন সম্প্রসারণ।
এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সঙ্গে সুর মিলিয়ে পাওয়া গেছে ঈশ্বর সম্বন্ধে একটা ধারণা। অতি প্রকাণ্ড, অতি সূক্ষ্ম এক যন্ত্রের মতো চলেছে এই মহাবিশ্ব, যার ক্ষুদ্ৰবৃহৎ প্রতিটি অঙ্গ যেন এক বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। মানুষের তৈরি কোনো নিখুঁত যন্ত্রের মতোই এই বিশ্বপ্রকৃতি নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবে প্রভেদ এইখানে যে জ্যোর্তিমণ্ডলের প্রকাণ্ডতায়, পরমাণুর ক্ষুদ্রতায়, তার সর্বব্যাপী গূঢ় সামঞ্জস্যের অব্যর্থ নৈপুণ্যে, মহাবিশ্ব এক অতুলনীয় পরমাশ্চর্য সৃষ্টি। এই সৃষ্টির ভিতরই প্রচ্ছন্ন আছে স্রষ্টার পরিচয়।
ধর্ম নিয়ে একটি সংলাপ (Dialogues Concerning Natural Religion) রচনা করেছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক হিউম। সেই সংলাপের অংশবিশেষ এইরকম Look round the world, contemplate the whole and every part of it; you will find it to be nothing but one great machine, subdivided into an infinite number of lesser machines… All these various machines, and even their most minute parts, are adjusted to each other, with an accuracy which ravishes into admiration all men who have ever contemplated them. … the Author of nature is somewhat similar to the mind of man, though possessed of much larger faculties, proportional to the grandeur of the work which he has executed.’—এইভাবে সম্পূর্ণ যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে একটা যুক্তি উপস্থিত করা হয়েছে। যুক্তিটা মূলত এই : মহাবিশ্ব যন্ত্রের মতো চলেছে। এর অভ্যন্তরে এতই সামঞ্জস্য, অগণিত অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে এতই সূক্ষ্ম যোগাযোগ ও পরস্পরনির্ভরতা, যে এ সবের পেছনে একটা তুলনাতীত শক্তিসম্পন্ন বুদ্ধি ও সৃষ্টিকৌশল নেই–এমন ভাবা যায় না। ঈশ্বরই স্রষ্টা, অতি সূক্ষ্ম নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই জগতের স্রষ্টা।
ঈশ্বর সম্বন্ধে এই ধারণা কিন্তু যুক্তিবাদী গ্রহণ করতে বাধ্য নন। বিশ্বপ্রকৃতি নিয়মের অনুবর্তী, কার্যকারণের সূত্রে বাঁধা, একথা বৈজ্ঞানিক মানবেন, যেহেতু বিশ্বপ্রকৃতির নিয়মের অনুসন্ধানই বৈজ্ঞানিকের সাধনা। নিয়ম যদি না থাকত, তবে তো নিয়মের অনুসন্ধান অর্থহীন হত। কিন্তু জগতের এবং জাগতিক নিয়মসমূহের স্রষ্টা হিসাবে জগদীশ্বরের কল্পনা বৈজ্ঞানিকদের পক্ষে আবশ্যক নয়। কোনো-কোনো বৈজ্ঞানিক ঈশ্বর মানেন, কেউ-কেউ মানেন না। যাঁরা মানেন না, তাঁদের সেই কারণে বৈজ্ঞানিক সাধনায় কোনো অসুবিধা ঘটে এমন দেখা যায় না। অর্থাৎ ঈশ্বর সম্বন্ধে উপকল্প বিজ্ঞানের পক্ষে অনাবশ্যক। রামমোহন বলেছিলেন, বিভিন্ন ধর্মের ভিতর যেখানে মিল, যেখানে সামঞ্জস্য, ধর্মের মূলবস্তু সেইখানেই, যেখানে অমিল, ধর্মের সারবস্তু সেখানে নয়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এইরকম বিচার অন্যায় হবে না। নিয়মে বিশ্বাস আছে সব বিজ্ঞানচর্চায়, সেটা বিজ্ঞানের সার। ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের ভিতর বিভেদ আছে; সেটা বিজ্ঞানের সারবস্তু নয়।
এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা এসে যায়। রামমোহন নিজে ব্ৰহ্মবিশ্বাসী ছিলেন। অক্ষয়কুমার দত্ত, যিনি বহু বৎসর যাবৎ “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন, মূলত প্রকৃতির নিয়মেই বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। তিনিও অবশ্য একসময় বলেছিলেন,-জগতের নিয়ম জগদীশ্বরের সাক্ষাৎ আজ্ঞা। সেই সঙ্গে যুক্তিবাদী হিসেবে তিনি যোগ করেছিলেন, জগদীশ্বর ‘কদাপি কাহারও স্তব বা প্রার্থনার অনুরোধে কোনো নিয়ম অতিক্রম করেন না। এখানেই একটা মৌল প্রশ্ন আবার এসে যায়। ঈশ্বর সম্বন্ধে বিশ্বাস যদি বিজ্ঞানচর্চার পক্ষে অত্যাবশ্যক না হয়, আর জগতের নিয়মের কারণস্বরূপ প্রকল্পিত জগদীশ্বরের কাছে প্রার্থনাও যদি নিরর্থক হয়, তবে বাস্তব দৃষ্টিতে ঈশ্বরের প্রয়োজন কোথায়? প্রকৃতিবিজ্ঞানকে ভিত্তি করে ঈশ্বরের যে কল্পনা, তার মূল্য সম্বন্ধে তাই থেকেই যায়।
আজকাল অনেকে বলছেন যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জড়পদার্থ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক ধারণায় একটা গভীর পরিবর্তন এসে যাচ্ছে, চেতনা ও জড়পদার্থের ভিতর দূরত্ব ক্রমেই যেন মুছে যাচ্ছে। কেউ কেউ এইখানে ঈশ্বর-বিশ্বাসের এক নতুন ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছেন। মূল প্রশ্ন তবু থেকে যায়। গণিতই এই বিজ্ঞানের ভাষা। অর্থাৎ যা পরিমাপ করা যায়, তাই নিয়ে বিজ্ঞানের কাজকর্ম। ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে বিজ্ঞানীর ধ্যেয় বিশ্বের একটা মৌল ভেদ আছে। ঈশ্বর অপরিমেয়। শিখধর্মের ভাষায় তিনি ‘অকাল’ অর্থাৎ কালাতীত। প্রকৃতিবিজ্ঞানের পরিধির ভিতর এই ঈশ্বরের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব? প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ঈশ্বর প্রকৃতির ঊর্ধ্বে এবং তিনি সর্বশক্তিমান। প্রাকৃতিক শক্তির বাইরে এরকম কোনো ঐশ্বরিক শক্তির অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দিয়ে প্রমাণ করা যায়–একথা যুক্তিবাদী মানবেন না।
ঈশ্বর থেকেই ধর্মচিন্তা শুরু করতে হবে এমন কোনো বাধ্যতা কিন্তু নেই। অন্তত ভারতীয় ঐতিহ্যে ভিন্ন দৃষ্টান্ত আছে। বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম ঈশ্বরচিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। দূঃখ আছে, এই সত্য থেকে বুদ্ধের ধর্মোপদেশ শুরু হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তর্ক সম্ভব; দুঃখের অস্তিত্ব অস্বীকার করা কঠিন। সংশয়বাদীরাও দুঃখের অস্তিত্ব বিষয়ে নিংসংশয়।
প্রেমোবাদীদের লক্ষ্য, যথাসম্ভব সুখের বর্ধন। যা কিছুতে মানবসমাজে সুখের সর্বাধিক বৃদ্ধি ঘটে, সেটাই নীতি হিসেবে গ্রাহ্য, সুনীতি। নিরীশ্বরবাদীরা বহুকাল থেকেই সুখবাদ বা প্রেয়োবাদের প্রতি আকৃষ্ট। আবার বঙ্কিমচন্দ্রও এই সুখবাদ থেকে আলোচনা শুরু করে ধর্মের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। ধর্মতত্ত্ব-নামে দীর্ঘ আলোচনার তৃতীয় অধ্যায়ে, ধর্ম কি? এই প্রশ্নের উত্তরে গুরু বলছেন, ধর্মের ফল ইহকালে সুখ ও যদি পরকাল থাকে, তবে। পরকালেও সুখ। ধর্ম সুখের একমাত্র উপায়। ইহকালে কি পরকালে, অন্য উপায় নাই।’ সুখবাদ থেকে আলোচনা আরম্ভ করবার একটা সুবিধা এই যে এতে করে ঈশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদীরা একত্রে যাত্রা করতে পারেন। তবে সেই যাত্রা বঙ্কিমচন্দ্রের নির্দিষ্ট পথেই অগ্রসর হবে–এমন কোনো কথা নেই।
একরকমের সুখ আছে যা ইন্দ্রিয়নির্ভর। জৈবসুখের এটাই ভিত্তিভূমি। ‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ’ যাঁরা বলেন, তাঁদের কথা শুরু হয় ঐ ভিত্তি থেকে। কিছু অবস্থা জৈবসুখের অনুকূল, কিছু প্রতিকূল। প্রতিটি ব্যক্তি স্বভাবত এমন চেষ্টাই করে থাকে, যাতে অবস্থা যথাসম্ভব নিজ সুখের অনুকুল হয়।
প্রেয়োবাদী দর্শনে মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে এইরকম একটা ধারণা প্রচলিত আছে। এই মতবাদ কি মানুষকে সুখের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে?
প্রেয়োবাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর মূল সমালোচনা যেটা শোনা যায় তা হল এই যে, সুখেরও প্রকারভেদ আছে। নানা রকমের সুখের ভিতর গুণগত তারতম্য আছে, কাজেই তাদের মধ্যে তুলনামূলক বিচার করে সর্বাধিক সুখ নির্ণয় করা কঠিন। আমাদের কিন্তু মনে হয় যে, গুণবিভাগের তাত্ত্বিক আলোচনায় সরাসরি না গিয়ে বরং সংসারের বাজারটা প্রথমে একবার ঘুরে এলে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত সম্ভবত আরো একটু নির্ভরযোগ্য হবে। শেষ অবধি বিচার অনিবার্যভাবে সূক্ষ্ম হয়ে উঠবে তবে ভূমির স্পর্শ থেকে আরম্ভ করাই ভালো।
প্ৰেয়োবাদী প্রত্যয় মেনে নিলে একটা ___ সমস্যা ____। প্রতি ব্যক্তি নিজ-নিজ সুবৃদ্ধির চেষ্টায় নিযুক্ত। কিন্তু এক ব্যক্তির সুখবৃদ্ধির চেষ্টায় অন্যব্যক্তির সুখের হনি ঘটতে পারে। সামগ্রিকভাবে সমাজের সুখবৃদ্ধিই সুনীতির উদ্দেশ্য। কোনো বিশেষ মানুষের নয়, বরং সকল মানুষের সুখের যোগফল বৃদ্ধি করাই সমাজের কর্তব্য। যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের সুখের জন্যই ব্যস্ত, সেখানে সকলের সুখের ব্যবস্থা কী করে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে কয়েকটি কথা পরপর বলা সম্ভব।
মানুষের অনেক কাজই ব্যক্তিগত স্বার্থে হয়ে থাকে। এইরকম সব কাজই অপরের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর এমন নয়। পারস্পরিক স্বার্থে আবদ্ধ হয়ে আমরা এমন কাজ করি, যেসব কাজ সকলের পক্ষেই কমবেশি লাভজনক। যেমন বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতা প্রত্যেকেই নিজ-নিজ স্বার্থের অনুসরণ করে। তবু এই ক্রয়বিক্রয়ের ভিতর দিয়ে সকলেরই কমবেশি স্বার্থসিদ্ধি হয়। উভয়পক্ষের স্বার্থসিদ্ধি সম্ভব বলেই উভয়পক্ষই বাজারে উপস্থিত হয়। অবশ্য বিক্রেতা অন্যায়ভাবে ক্রেতাকে ঠকাতে পারে, তেলে ভেজাল তার এক উদাহরণ। এইরকম অনায় ঠেকাবার জন্য রাষ্ট্রকে আইন তৈরি করতে হয়, অন্যান্য ব্যবস্থাগ্রহণও আবশ্যক হয়ে ওঠে। আইন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে সমাজে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চাই, যে পরিবেশের ভিতর বিভিন্ন মানুষের স্বার্থসন্ধানী চেষ্টা মোটের ওপর ক্ষতিকর না হয়ে হিতকর হবে। স্বার্থবুদ্ধিকে উপযুক্ত আইন ও প্রতিষ্ঠান দিয়ে ঘিরে দিতে পারলেই আমরা বাঞ্ছিত সমাজের যথাসম্ভব কাছাকাছি চলে যাব। এককালে প্রেয়োবাদীরা এইরকম বলতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এমন আইন ও প্রতিষ্ঠান কি রচনা করা সম্ভব, যাতে ছিদ্র নেই, পাপের প্রবেশপথ নেই? আইনের ভিতরও ত্রুটি থেকেই যায়। তাছাড়া আইনের উদ্দেশ্য ভালো হলেও স্বার্থসন্ধানী মানুষ আইন ফাঁকি দেবার নানা কৌশল উদ্ভাবন করে। সমস্যাটা আসলে আরো গভীর। ফাঁকির সব পথ যদি বন্ধ করা যেত তবু কিন্তু সেটা বাঞ্ছনীয় অবস্থা হত না। নিচ্ছিদ্র আইন এবং আইনের প্রহরী দিয়ে বেষ্টিত সেই সমাজ হয়ে উঠত একটা বৃহৎ কারাগার।
যদি স্বার্থবুদ্ধি অথবা বাইরের নিয়ম ও প্রতিষ্ঠান অথবা এ দুই-এর কোনো প্রকার সমাবন্ধের দ্বারা মানুষের দুঃখনিবারণ সম্ভব হত, তবে ধর্মের প্রয়োজন সহজেই অস্বীকার করা যেত। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। বাইরের কোনো নিয়ম ও ব্যবস্থাই বিবেক ও সদিচ্ছার বিকল্প হতে পারে না। এইখানেই অনেকে ধর্মের প্রয়োজন দেখেন। স্বার্থান্বেষী মানুষকে কর্তব্যবোধে ও পরার্থচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য ধর্মের একটা ভূমিকা। আছে, এইরকম অনেকে বলেন। ধর্মের সপক্ষে এটাই সরল যুক্তি। মানুষের সমাজকে একসঙ্গে ধরে রাখবার জন্য স্বার্থ অথবা ব্যক্তিগত সুখের অন্বেষণের অধিক কিছু মূল্যবোধ আবশ্যক। ধর্ম এই সমাজধারক মূল্যবোধের আধার।
এমন অনেক যুক্তিবাদী আছেন, যাঁরা এইরকম মূল্যবোধের প্রয়োজন অস্বীকার করবেন না। কিন্তু এজন্য ধর্মের দ্বারস্থ হতেও সম্মত হবেন না। শুধু ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের অন্বেষণ নয়, অন্যের প্রতি সহানুভূতি, অপরের দুঃখে দুঃখবোধ–এইসবও মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি। এই পরার্থমুখী বৃত্তির বিকাশ ও প্রয়োগের ভিতর দিয়ে একরকমের গভীর সুখ অনুভব করা যায়। স্বার্থপরতাই সুখলাভের শ্রেষ্ঠ পথ নয়। ভাষান্তরে বলা যেতে পারে, স্বার্থেরও স্তরভেদ আছে। উচ্চতর সুখের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে এক উচ্চতর স্বার্থ। যুক্তিবাদী এই পর্যন্ত স্বীকার করবেন। কিন্তু তিনি হয়ত বলবেন যে, যুক্তিই আমাদের এই উচ্চতর স্বার্থের পথে চালিত করতে পারে। এজন্য ধর্মের পরিভাষা নিষ্প্রয়োজন।
নাম অথবা পরিভাষা দিয়ে তর্ক আপাতত স্থগিত থাক। মূল কথাটার দিকে আবারও দৃষ্টি ফেরানো যাক। এইমাত্র যাকে মানুষের উচ্চতর সুখ ও স্বার্থ বলা হল, কীভাবে তার সাধন সম্ভব? বঙ্কিমচন্দ্র পূর্ণ মনুষ্যত্বের বিকাশের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল, এই পথেই মানুষের সুখও পূর্ণতা লাভ করে। এজন্য প্রয়োজন-অনুশীলন। বঙ্কিমচন্দ্রের এই ভাষা। এইখানে দাঁড়িয়ে তিনি ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ব্যাখ্যার অনুপুঙ্খে আমরা প্রবেশ করব না।
সমাজসংস্কারক ও বিপ্লবী দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত অনুশীলনের চেয়েও সামাজিক পরিবর্তনের গুরুত্ব বেশি। সাম্যবর্ধক একটা সামাজিক কাঠামো, আইনের শাসন ও মানুষের কিছু বিধিবদ্ধ অধিকার, এইসব প্রয়োজন। প্রতি মুহূর্তের স্বার্থবুদ্ধি নয়, মানুষের অধিকারের। স্বীকৃতি আরো মৌল ও মূল্যবান। একথা স্বীকার করে নেবার পরও প্রশ্ন থেকে যায়, এসবই কি যথেষ্ট?
এই শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে একটা কথা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পরিবর্তন। যদিও কাম্য তবু শাসনব্যবস্থার কোনো অবস্থান্তরই শেষ অবধি মানুষের আশা পূর্ণ করে না। কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনই সুখ ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সোভিয়েত সাম্যবাদী দেশে আজ শিক্ষার বিস্তারের পরও ধর্মের প্রতি আগ্রহ বেড়ে উঠেছে। এর নিশ্চয়ই একাধিক কারণ আছে। বাইরের তন্ত্র, শাসন ও উপকরণের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষের আশানুরূপ হিতসাধন ঘটে না, এই কষ্টার্জিত উপলদ্ধি সম্ভবত ধর্মের প্রতি আগ্রহবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। চেতনার স্তরেও পরিবর্তন আবশ্যক।
এখানে একটা আপত্তি অনুমান করা যায়। চেতনার পরিবর্তন তো আপনি ঘটে না, সেটা ঘটে বাস্তব পরিস্থিতির চাপে, অতএব বাস্তব পরিস্থিতির পরিবর্তনটাই হচ্ছে প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন। এইরকম একটা কথা অধিকাংশ জড়বাদীর মুখে শোনা গেছে। কথাটা কিন্তু অর্ধসত্যের বেশি কিছু নয়। চেতনার ভেতরই একটা শক্তি আছে, বেগ ও গতি আছে, যেটা তাকে স্তর থেকে শুরান্তরে ঠেলে দেয়। পরিস্থিতি কখনো এই গতির গথে সহায়ক হয়, কখনো প্রতিবন্ধক। কিন্তু কোনো বাধাই শেষ অবধি এই গতিকে সম্পূর্ণ রুদ্ধ করতে পারে না। আবার বাইরের কোনো সহায়তায়ও সাফল্য পূর্ণতা লাভ করে না। বাস্তব উপকরণের সাহায্য নিয়ে তবেই মানুষের মুক্তি ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব, এই চিন্তা অবস্থাবিশেষে এমন-কী প্রতারক হয়ে ওঠে। উপকরণই আবদ্ধ করে, উপকরণের হাত থেকেও চেতনার মুক্তি প্রয়োজন।
মানুষের ধর্ম এই, সে নিজেকে বারবার অতিক্রম করে যায়। এই অতিক্রমণের ব্যাপারে যুক্তির ভূমিকা যে সহায়ক হয় একথা স্বীকার্য। কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য একটা কথাও আছে যুক্তির একক শক্তিতে মানুষের বিশ্ববোধ ও মূল্যবোধের উল্লম্ফন ঘটে না। অন্য কোনো পথে ব্যক্তির চেতনায় নতুন অনুভূতি ও অন্তর্দৃষ্টির উদয় ঘটে। যুক্তি নিজস্ব বিচারপদ্ধতিতে তাকে শনাক্ত করে, মূল্য ও স্থায়িত্ব দেয়। এমনকি গণিত ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও উচ্চতর সৃজনশীল কাজে এইরকম লক্ষ করা গেছে। শিল্প ও ধর্মের বেলায় এটা আরো স্পষ্ট। স্বজ্ঞা ও যুক্তির যুগ্ম ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার পথে এইভাবে যে ব্যাপারটা ঘটে তার পরিচয় দিতে গিয়ে পরিভাষা নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়া আশ্চর্য নয়, তর্কেরও তাই শেষ নেই। ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াটা বুঝে নেওয়াই আসলে জরুরি। যুক্তির ভূমিকার গুরুত্ব আছে। স্বজ্ঞার নাম নিয়ে অনেক মিথ্যা দাবি ও অন্ধসংস্কার এসে পড়ে। যুক্তি সেখানে প্রয়োজনীয় দ্বাররক্ষী আবার আলোচনার মূল্যবান মাধ্যম। কিন্তু স্বজ্ঞা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুক্তি সত্যের পথে বেশি দূর আরোহণ করতে পারে না!
সুখদুঃখের প্রশ্ন নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে আমরা সুনীতিনীতির বিষয় ধরে কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। গোড়ার কথায় আবার ফিরে আসা যাক। চার্বাক সুখ চেয়েছিলেন; বুদ্ধ চেয়েছিলেন দুঃখ দূর করতে। অথচ চাবাক ও বুদ্ধের ভিতর পার্থক্য অনেক। বুদ্ধ দুঃখের কারণ খুঁজেছিলেন মানবপ্রকৃতিতে এবং বিশ্বপ্রকৃতির কিছু মৌল বৈশিষ্ট্যে। চার্বাকের মতে সুখের চাবি আছে বাইরের সম্পদে, বাহ্য পরিস্থিতিতে। এ যুগের প্রেয়োবাদীরা জগতে সুখের বৃদ্ধি চান। চাবাকের সঙ্গে এঁদের কিছুটা মিল আছে। মার্কসবাদীরা alienation অর্থাৎ ‘পারক্য বা বিচ্ছিন্নতাবোধের কথা বলেন। দুঃখের আলোচনায় এইখানে অন্য একটা মাত্রা যোগ হয়েছে। সমাধানের চিন্তায় তবু পুরনো প্রশ্নটাই থেকে গেছে। মার্কসীয় ধারণায় বিচ্ছিন্নতাবোধের মূল কারণগুলি পাওয়া যাবে মানুষ্যসমাজের বাহ্য অবস্থায়। Towards Max পুস্তকে প্রবীণ মার্কসবাদী অধ্যাপক সুশোভন সরকার যথার্থই বলেছেন “Marx thought that the root of alienation lay not in the nature of man, not in his ideas, but in the concrete conditions of social life. The corollary follows that, by changing social life, in an appropriate way, inan can overcome alienation.’ at 5:73 19 cena মানবপ্রকৃতিতে অথবা বিশ্বপ্রকৃতির কোনো বৈশিষ্ট্যে। দুঃখ ও বিচ্ছিন্নতাবোধের কারণ নিহিত আছে বাহ্য সামাজিক অবস্থায়। কাজেই বহু জড়বাদীর এই বিশ্বাস যে সামাজিক ব্যবস্থার যথাযোগ্য পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে পৃথিবীতে সুখের প্রতিষ্ঠা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের দূরীকরণ সম্ভব। এই বিশ্বাসকে কিন্তু নিত্যসত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না।
দারিদ্র্য যে অনেক দুঃখের কারণ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু দারিদ্র্য দূর হলেও দুঃখ দূর হয় না। সমাজে বহু অন্যায় ব্যবস্থা আছে, যার অবসান আবশ্যক। দুঃখ দূর হোক বা না হোক, অন্যায়কে সমর্থন করা যায় না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন এ যুগের এক। প্রধান কীর্তি, এদেশের এক প্রধান কর্তব্য। এসবই স্বীকার্য। কিন্তু তারপরও একথাটা। মেনে নেওয়াই ভালো যে, দুঃখের ও বিচ্ছিন্নতাবোধের কোনো সমাজসর্বস্ব ব্যাখ্যাই যথেষ্ট। নয়। সমাজের কোনো প্রকার পরিবর্তনেই দুঃখের সমস্ত মৌল কারণ দূর করা সম্ভব নয়। এ কথাটা না বোঝা অবধি এই বিশ্বপ্রকৃতিতে মানুষের অবস্থাটা ঠিক বোঝা হয়ে ওঠে না। ধর্মান্ধতা থেকে যেমন পারলৌকিক মোহের সৃষ্টি হয়, দুঃখনাশের সমাজসর্বস্ব পথের প্রতিশ্রুতিও তেমনি একরকম লৌকিক মোহের কারণ হয়ে ওঠে। একটি মোহ অন্যটিকে ব্যঙ্গ করে চলেছে।
(গ)মানুষের সুখদুঃখের অনেকটা প্রেম, জরা ও মৃত্যুতে আশ্রিত। সমাজের কোনো পরিবর্তনের ফলেই মানুষকে অমর করা যাবে না, গৃহে-গৃহে প্রিয়জনের মৃত্যুকে রোধ করাও সম্ভব হবে না। মানুষের আয়ু অবশ্য আরো দীর্ঘ করা যেতে পারে। কিন্তু যেখানে প্রেম নেই, সেখানে আয়ুর দীর্ঘায় সান্ত্বনা সামান্যই। জরা ও মৃত্যু আছে শুধু দেহেরই নয়, ভালবাসারও। একদিন যে-ভালবাসা ছিল উষ্ণ ও স্বতস্ফূর্ত, ক্রমে সে তার উষ্ণতা হারায় অভ্যস্ত প্রিয় সম্ভাষণ হয়ে ওঠে যান্ত্রিক, সততাশূন্য ও অর্থহীন। দুটি প্রেমকে জরা গ্রাস করে না একই গতিতে, একটি ক্ষয়িষ্ণু হৃদয়ের অনিবার্য শীতলতার সাক্ষী হয়ে থাকে অন্য এক অসহায় ও বেদনাবিদ্ধ ভালোবাসা। মানুষের অনেক কঠিনতা ও অনেক কান্নারই মূল এইখানে।
জরা ও মৃত্যুর বাইরেও ব্যর্থতার অন্ত নেই। মানুষের চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে কোনো বাহ্য কৌশলেই অসামঞ্জস্য দূর করা যায় না। আমরা প্রত্যেকেই যেমন অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই, তেমনি আকাঙ্ক্ষা করি নিজের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের মূল্যের স্বীকৃতি। সেই মূল্য সম্বন্ধে নিজের বিচার আর অপরের বিচারের ভিতর মিল হয় না। যদিবা স্বীকৃতি আসে, তবু কতবার দেখা যায় তারও পিছনে আছে স্বীকৃতিদাতারই স্বার্থ। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যোগ অপূর্ণ থেকে যায়।
এসব কিছুই ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, প্রকৃতির এইরকমই নিয়ম। আমরা এসব জানি আর মনে-মনে সাবধান হয়ে উঠি, কিন্তু সাবধানতায়, অন্তরে অন্তরে আমরা আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। আধুনিক মনের এক প্রধান যন্ত্রণা–একাকিত্ব। যুক্তি দিয়ে একে ঠেকানো যায় না, বাইরের সাফল্য দিয়েও নয়। আমরা তাই বিস্মিত হই না, যখন রাসেলের আত্মজীবনীতে পাঠ করি এই স্বীকারোক্তি Always the secptical intellect, when I have most wished it silent, has whispered doubts to me. Underlying all occupations and all pleasures I have felt since early youth the pain of solitude.’ যুক্তি কিংবা সতর্ক বুদ্ধির অভাবে নয়, বরং তার প্রভাবেই, রাসেল নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রথম যৌবন থেকেই। একাকিত্বের যে বেদনা তিনি অন্তরে বহন করেছিলেন, সেটা নিতান্ত ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা নয়। বরং তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব এই যে, সেই বেদনাকে তিনি একটা সার্থকতার দিকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। আরো অগণিত মানুষ শুধু ক্ষতবিক্ষত হয়, অসহ্য কষ্টে বিকৃত হয়, অন্তরের সেই বোবা যাতনায়।
আধুনিক সুখবাদের ভিত্তিতেই সংলগ্ন হয়ে আছে একটা অনিবার্য সমস্যা। প্রেমোবাদ শিক্ষা দেয় সুখদুঃখের ব্যাপারটাতে হিসেব করে চলতে, হিসেব করে দুঃখ এড়াতে এবং সুখ বাড়াতে। কিন্তু এই হিসেবী দৃষ্টিভঙ্গিই আবার হেপ্রেমের শক্তিকে একেবারে মূলে দুর্বল করে দিতে পারে। প্রয়োগবাদী জীবনদর্শনের প্রভাবে আমরা অতিমাত্রায় কৌশলে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। আমরা আবদ্ধ হয়ে পড়ি পদ্ধতিনির্ভরতায় ও সাফল্যের আকাঙ্ক্ষায়। কিছু বাহ্য সাফল্য হয়তো ঐভাবে লাভ করা যায়। কিন্তু আমাদের চেতনা হারায় অন্য এক গুণ। সাফল্যের আকাঙ্ক্ষাতেই আমরা প্রতিবেশী ও সহকর্মীর কাছ থেকে ভিতরে ভিতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, আমাদের সংবেদনশীলতা সংকীর্ণ হয়ে আসে। যেখানে কৌশলের প্রশ্নটা প্রধান, সেখানে সবকিছুই হয়ে ওঠে উদ্দেশ্যসাধনের উপকরণস্বরূপ। এর ফলে বিশ্বের সঙ্গে ঘটে আমাদের অনাত্মীয়তা। ব্যক্তির সত্তাকে গ্রাস করে নেয় এমন এক শূন্যতাবোধ যাকে কোনো কৌশলেই আর ঠেকানো যায় না। আধুনিক সুখবাদ ও প্রয়োগবাদী দৃষ্টি যদিও নিজেকে বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন বলে দাবি করে তবু এইভাবে মানুষকে সে শেষ অবধি অস্তিত্বের এক গভীর সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
এই সংকট এ যুগে ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠেছে। একে ছোটো করে দেখা ভুল। বাইরের সমস্ত সাফল্য সত্ত্বেও মানুষকে এতে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে আত্মহননের দিকে। এটা সার্বিক বিনাশের পথ। এরই ভিতর থেকে আবার ঠেলা দিয়ে উঠছে এমন একটা প্রশ্ন, মানুষের আধ্যত্মিক সত্তার যেটা এক মূল প্রশ্ন। বিশ্বের সঙ্গে আন্তরিক পারক্যবোধের সীমা কি অতিক্রম করা যায় না? এই অতিক্রমণের পথে কি মানুষ লাভ করে না অন্য এক সত্য? সেই সত্যই কি অবশেষে মানুষকে ভয় ও বিনষ্টি থেকে রক্ষা করে না?
স্বার্থ ও সাংসারিক উদ্দেশ্যনির্ভর যে-দৃষ্টি, সেটাই একমাত্র দৃষ্টি নয়। একরকমের নিরাসক্ত দৃষ্টিতেও বিশ্বের দিকে তাকানো যায়। স্পিনোজো সেইভাবে তাকাতে চেয়েছিলেন। তাঁকে কেউ-কেউ ঈশ্বরমত্ত বলেছেন। এই বর্ণনা সঙ্গত বলে মনে হয় না। বরং একরকমের শুদ্ধ যুক্তিনির্ভর আধ্যাত্মিকতার স্বাক্ষর তাঁর চিন্তায়। সেইভাবে তাকিয়ে তিনি দেখেছিলেন বিশ্বময় সামঞ্জস্য, কোথাও কোনো অসামঞ্জস্য নেই, নিয়মের কোনো ব্যত্যয় নেই। আমরা ক্ষুদ্ধ হই, কাতর হই, কারণ আমাদের স্বার্থে আঘাত পড়ে। কিন্তু যদি ভাবি যে, এই বিশ্ব তো আমার জন্য হয়নি, যদি ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে বিশ্বের অন্তহীন পথপরিক্রমার দিকে তাকাই, তবে বিশ্বজোড়া সামঞ্জস্যময়তা আমাদের অন্য এক বিস্ময়ে আবিষ্ট করে। চিত্তকে যে-মুহূর্তে মানুষ ব্যক্তিগত বাসনা থেকে মুক্ত করে, সেই মুহূর্তে অন্য এক অপ্রত্যাশিত অনাস্বাদিত আনন্দে চিত্তের সেই শূন্যতা পূর্ণ হয়ে ওঠে। সাংসারিক সুখদুঃখের সঙ্গে এই আনন্দের মৌল প্রভেদ আছে। এইখানেই আমরা আধ্যাত্মিকতা ও চিত্তশুদ্ধির যে-ধারণা পাই তার সঙ্গে যুক্তির কোনো বিরোধ নেই।
আপত্তি উঠতে পারে, সাংসারিক আকাঙ্ক্ষাবর্জিত এই দৃষ্টি সাধারণ মানুষের আয়ত্তের ভিতর নয়। কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। জ্যামিতিক প্রমাণের ভিতর আবদ্ধ করে স্পিনোজা তাঁর বিশ্বদৃষ্টিকে যে বিশেষ রূপ দিয়েছেন, সেই দার্শনিক উচ্চতা ও প্রসার নিশ্চয়ই অসামান্য। কিন্তু সাংসারিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বজগতের দিকে তাকানোটাই মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, আর কিছুই স্বাভাবিক নয়, এই ধারণা সংসারী মানুষের একটা অভ্যস্ত সংস্কার। আসলে মনুষ্যপ্রকৃতি ও বিশ্বপ্রকৃতির ভিতর যে-সম্পর্ক তাতে। স্বাভাবিকভাবেই নানা উপাদান মিশ্রিত হয়ে আছে। শিশু জন্ম থেকেই সংসারী হয়ে ওঠে না। সে শিশুর দৃষ্টি নিয়েই বিশ্বের দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টিতে একটা সরল বিস্ময় আছে। ক্ৰমে নানা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সে সাবধানী হতে শেখে। শিশুরও চেতনা মিশ্র উপাদানে গঠিত। একদিকে সে সবকিছুকে সহজে আপন করে নেয়; অন্যদিকে সে খামখেয়ালি, অনায়াসে নিষ্ঠুর। বড়ো হয়ে উঠবার সঙ্গে-সঙ্গে সামাজিক আচারে আর হিসেবি সতর্কতায় সে অভ্যস্ত হয়। হিংসাকে সে গোপন করতে শেখে, আর সেই সঙ্গে সবকিছুকে আপন করবার শক্তিও সাবধানতার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে যায়। তবু বিশ্বের প্রতি ঐ সহজ বিস্ময়বোধ এবং আত্মার আত্মীয়তাবোধ সাংসারিকার শত আক্রমণেও মানুষের মন থেকে একেবারে লুপ্ত হতে চায় না। অতিসাধারণ মানুষের ভিতরও এইসব কিছু কিছু থেকে যায়।
শৈশবই মনুষ্যত্বের জনক। ধর্মের সঙ্গে এর একটা গূঢ় সংযোগ আছে। যীশুখ্রীষ্ট শিশুদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত রাখতে বলেছিলেন। সেটা শুধু বাইরের দ্বার নয়, ভিতরের দ্বারও। সংসারী মন পৃথিবীকে চেনে লাভক্ষতির হিসেব দিয়ে। বয়স্কদের জীবনের অনেকখানি জুড়ে আছে ঐ হিসেবি মন। তবু এরই ভিতর আমরা কখনো কখনো অকারণে আনন্দিত হয়ে উঠি। শুধু চোখ মেলে আলোর দিকে চাওয়ার মধ্যেই একটা চির নতুনের আনন্দ আছে। ‘আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো। আসলে শৈশব শুধু একটা বিশেষ বয়সেরই নাম নয়, একটা প্রতীকী অর্থেরও দুতি আছে ঐ শব্দের মধ্যে। যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে। দু-হাত দিয়ে বিশ্বেরে দুই শিশুর মতো হেসে। এইসব গান যে আমাদের মনের ভিতর কোথাও একটা স্পন্দন জাগাতে পারে, তাতেই প্রমাণ হয় যে, অন্য এক অনুভূতির পৃথিবী এখনও আমাদের মধ্যে মৃত নয়। শৈশব ও কৈশোরের উপাদানে গঠিত এই পৃথিবী, উপেক্ষিত হয়েও মূল্যবান। এ যদি না থাকত, সংসার তবে ভিতরে ভিতরে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। সংসার বেঁচে আছে এক উপেক্ষিত অকারণ প্রেমের অলক্ষিত সিঞ্চনে। এরই অভাবে সমৃদ্ধির মধ্যেও আমরা শুনি হাহাকার, জাগতিক সাফল্যের মধ্যেও দেখি বিস্তৃত এক ব্যর্থতাবোধ।
শৈশব যদিও জড়ত্বনাশী, তবু মানুষের ধর্ম এই দিয়ে পূর্ণ হয় না। শিশুর ভিতর যে অকারণ আনন্দ ও বিস্ময়ের শক্তি আছে, সে মূল্যবান হয়েও আত্মরক্ষায় অসমর্থ। নিজের ভিতর যে অমূল্য সম্পদ আছে, শিশু তাকে মূল্যবান বলে চেনে না। মনুষ্যত্বের রক্ষার জন্য তাই শৈশবকে অতিক্রম করে যেতে হয়। শিশুর মধ্যে স্থিরতা নেই, সহজে সে নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে। সংসারের নানা কাঠিন্য ও সমস্যার ভিতর দিয়ে আশা ও উদ্যম রক্ষা করবার জন্য প্রয়োজন হয় অন্য এক দৃঢ়তা, বিশ্বাস ও সাধনা। মানুষের কত শ্রেষ্ঠ প্রয়াস তো ব্যর্থ হয়েছে বারবার। আমাদের ভিতর যাঁরা সবচেয়ে শ্রদ্ধেয়, তাঁদেরও মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয়েছে বিদ্রুপের কণ্টকের মুকুট। এইসব সাময়িক অথচ অনিবার্য ব্যর্থতা ও ধিক্কারের ভিতরও বিশ্বাস রক্ষা করা যাবে কোন্ শক্তিতে?
মানুষের যা কিছু শ্রেষ্ঠ প্রয়াস তা ব্যক্তিবিশেষের কর্মে আবদ্ধ নয়। তার সঙ্গে যোগ আছে মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসের। আজকের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর কাজের পিছনে আছে অতীতের বহু বিজ্ঞানীর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পর্যায়ক্রমে সাধনা। যে ভাষায় আমরা নিজেকে প্রকাশ করি, সেই ভাষা কণায়-কণায় গড়ে উঠেছে বহু প্রজন্মের ভিতর দিয়ে। কালের পরীক্ষায় কিছু রক্ষা পেয়েছে, কিছু পরিত্যক্ত। যে-সব আদর্শ আজ আমাদের অনুপ্রাণিত করে তার পিছনেও আছে দীর্ঘযুগ ধরে অনেক মানুষের সাধনা ও আত্মত্যাগ। কোনো বড়ো উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা সমসাময়িক মানুষের কাছে প্রশংসা ও ধিক্কার যাই লাভ করুন না কেন, তাঁদের বিশ্বাসের ভিত্তি সমকালকে অতিক্রম করে যায়। মনে-মনে তাঁরা যুক্ত হন বৃহত্তর এক সত্তার সঙ্গে। সেই সত্তা যে মানুষের সমগ্র ইতিহাসকেই ব্যাপ্ত করে আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তারও পিছে আরো কী আছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠনের সঙ্গে মানুষের আদর্শের যোগ কতখানি–সেবিষয়ে তর্ক সম্ভব। তার কোনো মীমাংসা আশা করা যায় না। প্রমাণ-অপ্রমাণের সম্ভাবনাশূন্য সেই তর্কে আমরা আপাতত প্রবেশ করছি না। যে-কথা অনেকখানি নিঃসংশয়ে তবু বলা যায়, সে কেবল এই ইতিহাসের ধারায় বাহিত যা-কিছু শক্তি সবই সঞ্চারিত হয়েছে মানুষে। মানুষের অন্তরে তার অধিষ্ঠান। আধ্যাত্মিকতার যে ধারণা এইসব নিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার সঙ্গে মানবতাবাদের বিরোধ থাকবার কথা নয়। বেদান্ত বিষয়ে ১৮৯৬ সালের এক বক্তৃতায় বিবেকানন্দ একবার বলেছিলেন যেখানেই মানুষ আছে, সেখানেই ধর্ম যদি তাহার সহায়ক না হয়, তবে তাহাতে বিশেষ প্রয়োজন নাই। …প্রাচীন ধর্ম বলিত, যে। ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করে সে নাস্তিক। নৃতন ধর্ম বলিতেছে, যে আপনাতে বিশ্বাস স্থাপন না করে সে-ই নাস্তিক।’ এইখানে মানবতাবাদীদের সঙ্গে বিবেকানন্দের মিল উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বের অনন্ত বিস্ময়কর, নিয়মে বিধৃত নিপুণ সামঞ্জস্য আর ভ্রান্তিশীল মানুষের বহু নিদারুণ ব্যর্থতার ভিতর দিয়েও অন্ধকার থেকে আলোতে উত্তীর্ণ হবার অদম্য প্রয়াস, এইসব মিলে উদ্ভাসিত হয় কারুণ্যে ও লাবণ্যে মিশ্রিত অন্য এক জগৎ, যাকে মূল্য দিতে। শিখে আমরা জীবনের মূল্য খুঁজে পাই। এর বেশি অতিপ্রাকৃত যা-কিছু দাবি করা হয়, সেইসব ছাড়াই ধর্ম সম্ভব। ধর্মের নামে প্রবঞ্চনার নিদর্শন তো ইতিহাসময় ছড়িয়ে আছে। তবু যে মানুষ ধর্মের কাছে ফিরে-ফিরে গেছে সেটাকে কেবলই কুসংস্কার বললে মানুষের প্রতি অন্যায় করা হয়। সাংসারিক ও নিতান্ত ব্যক্তিগত সুখদুঃখ, আশা-নৈরাশ্যের ঊর্ধ্বে মানুষের উচ্চতর আদর্শ ও প্রয়াসের যদি কোনো আশ্রয় থাকে, তবে তাকেই মহত্তর অর্থে ধর্ম বলা যেতে পারে। এই ধর্ম মানবধর্ম। সম্প্রদায়বিশেষকে ধারণ করে এর কাজ সম্পূর্ণ হয় না। বরং মনুষ্যজাতির সঙ্গে যুক্ত করে ব্যক্তিকে ধারণ করে এই ধর্ম। যে ধর্মে এ কাজ হয় না তার সঙ্গে যুক্তির বিবাদ থাকাই ভালো। শুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে নিঃস্বার্থ যুক্তির বিরোধ নেই।
২
ক
ধর্মের মূলে একটা বিচিত্র সংকট আছে। সে বিষয়ে সবাই সচেতন নয়। বিশ্বাসের সারল্য ধর্মের এক প্রধান উপাদান। সেই সরলতা মূল্যবান। ৩বু বয়স্ক প্রজ্ঞার জন্য আরো কিছু প্রয়োজন। প্রথমে সহজ বিশ্বাসের ভিতরও যে সত্য আছে সেই কথাটা ধরে সংক্ষেপে কিছু বলে নেওয়া যাক। তারপর ধর্মসংকটের চরিত্র নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক হবে।
এ কথা আবারও ব্যাখ্যা করে বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ভারতীয় ঐতিহ্যে ধর্ম বলতে সর্বত্র ঈশ্বরবিশ্বাস বোঝায় না, বরং মুক্তি অথবা নিবাণ সম্বন্ধে একটা বিশেষ ধারণাই আরো মৌল। সাংসারিক সুখ-দুঃখকে অতিক্রম করে অন্য এক আনন্দ বা দুঃখনিবৃত্তি ভারতীয় ধর্মের মূল কথা।
অভিজ্ঞতার এই যে অন্য স্তর, এ সম্বন্ধে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাবে কিছু অতিরিক্ত ভেদমূলক চিন্তা সমাজে এসে গেছে। এমন মনে করা হয় যে, উচ্চতর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা শুধু ব্রাহ্মণের পক্ষেই সম্ভব। আমাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই কিন্তু অনুভূতির নানা স্তর আছে। বিভিন্ন স্তরের অনুভূতির ভিতর গুণগত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। মুক্তি বলতে যে অভিজ্ঞতা বোঝায়, অন্তত কিছু পরিমাণে সেটা সাধারণেরও লভ্য। ধর্মকে কতিপয় অসাধারণ মানুষের পথ বলে মেনে নেওয়া, অথবা অধিকাংশ মানুষ পরীক্ষায় ফেল করেও কয়েকজন মহান্তের মধ্যস্থতায় কোনোক্রমে পাশ করে যাবে এই রকম বিশ্বাস করা, ধর্মের ভবিষ্যতের পক্ষে বিপজ্জনক। বাস্তব ঘটনা এই যে, একই মানুষ অভিজ্ঞতার একাধিক স্তরে বাস করে, তবে অনেক সময় মূল্যবান অভিজ্ঞতাকে সে মূল্যবান বলে চিনে নিতে পারে না। ধর্ম যদি কিছু পরিমাণেও সাধারণ মানুষের জীবনে এই মূল্যবোধের সংস্থাপনে সাহায্য করে তবেই ভবিষ্যতের সমাজের দৃষ্টিতে সেই ধর্ম মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে। ধর্মকে সাধারণের লভ্য করতে গিয়ে যদি তাকে কুসংস্কার করে তোলা হয়, তবে সেই যুক্তিহীন ধর্মকে বিবেকানন্দের ভাষায় “unworthy superstition” বলে বিদায় দেওয়াই শ্রেয়। ধর্মের সঙ্গে যুক্তির মেলবন্ধনের প্রয়োজন এইখানেই।
ধর্মের মূলে যে আধ্যাত্মিক অনুভূতি আছে, এ দেশের ভক্তিআন্দোলনের সম্ভরা তাকে বলেছেন, প্রেম। শুধু এ দেশের নয়, সবদেশের ধর্মেই এটা একটা প্রধান কথা। আধ্যাত্মিক প্রেমের কিছু বিশেষ লক্ষণ আছে। এজন্য বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিত্বে বিশেষ বিশেষ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন পাশ্চাত্য আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে পাই ‘agape শব্দটি, সেটা ‘eros’ থেকে পৃথক। ঐতিহ্য আশ্রিত শব্দ ক্রমে অতিশয় রহস্যাবৃত হয়ে পড়ে। এই আবরণ থেকে উন্মুক্ত করে বিষয়টা সহজ ভাবে বুঝবার চেষ্টা করা দরকার।
আধ্যাত্মিক প্রেম জৈব উদ্দেশ্য দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়, সারা জগতে ছড়িয়ে পড়াই তার স্বভাব। বিজ্ঞানীর জিজ্ঞাসা যেমন বিশ্বের প্রতি প্রসারিত এও সেইরকম। যে প্রেমের এই গুণ নেই, ঈষা যার ছায়া, তাকে বিশ্বপ্রেম বলা যাবে না। সন্তরা বলেছেন, সকল জগৎ “আমাতে” এসে মিলেছে, অথবা ভাষান্তরে, “তাতে” মিলেছে। বিশ্বের সঙ্গে এই একাত্মবোধ, এই মিলনমুক্তি আধ্যাত্মিক ভাবের বৈশিষ্ট্য। সন্তদের প্রেম, বিশ্বপ্রেম।
প্রথম দৃষ্টিতে একে অবাস্তব মনে হতে পারে। বিশ্বপ্রেম সাধারণের লভ্য নয়, এইরকম বোধ হতে পারে। কিন্তু বিশ্বকে জানবার ইচ্ছা যেমন মানবশিশুর মনে সুপ্ত থাকে, যদিও কয়েকজন প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিকের ভিতর তার বিশেষ বিকাশ ঘটে, বিশ্বকে ভালোবাসার ইচ্ছাও সেইরকম। সদর্থক ধর্মবিশ্বাসের সহজ ভিত্তি বলে একে চিনে নেওয়া যায়। আমাদের সকলের জীবনেই মাঝে মাঝে এইরকম মুহূর্ত আসে যখন সকলের প্রতি আমরা শুভেচ্ছা বোধ করি। আমরা যখন সাংসারিকতায় লিপ্ত, তখন যে ব্যক্তি আমাদের সাংসারিক স্বার্থের সহায়, তাকেই ভালো চোখে দেখি, আর যে-ব্যক্তি বিরোধী তাকে মন্দ ভাবি। কিন্তু এমন মুহূর্তও আসে যখন আমরা আর স্বার্থের জালে তেমনভাবে আবদ্ধ নই। বিদ্বেষমুক্ত সেইসব মুহূর্তে মনে আর কোনো তিক্ততা থাকে না। এ যদি না হত তবে সংসার থেকে উত্থিত বিষাক্ত বাম্পের মতো গ্লানিতে অনেক আগেই মানুষের মৃত্যু হত। মনের একটা স্বাভাবিক শক্তি আছে, তিক্ততা থেকে নিজেকে মুক্ত করবার, সহজ আনন্দে বিশ্বের দিকে ফিরে তাকাবার। এই শক্তি দুর্বল হয়ে গেলে অন্য কোনো সুখই মানুষকে বাঁচাতে পারে না। একে তাই বিশেষ মূল্য দিয়ে রক্ষা করা আবশ্যক।
ধর্মে এর স্বীকৃতি আছে। বিভিন্ন ধর্মে আনুষ্ঠানিকভাবে এক-একটি দিন চিহ্নিত থাকে যখন শত্ৰুমিত্র নির্বিশেষে, অভ্যন্ত ভেদাভেদ ভুলে, সবাই সবাইকে আলিঙ্গন করবে এইরকম বিধি। মিলনের উৎসবও অবশ্য অনেক সময় তার গূঢ় অর্থ হারিয়ে প্রাণহীন। আচারে পরিণত হয়। কিন্তু সে কথা ভিন্ন। মূল ভাবটাকে নতুন করে বুঝে নেওয়া দরকার। স্বার্থ ও ভেদাভেদ অতিক্রম করে শুদ্ধ মিলনের একটা আনন্দ আছে। সাধারণ সাংসারিক অভিজ্ঞতাকে সেটা অতিক্রম করে যায়। তাঁর কম বয়সের এক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “হৃদয় আজি মোর কেমন গেল খুলি, জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি। “ আরো বহু বছর আগে মানক বলেছিলেন, “না কো বৈরী ন হী বেগানা। সগল সংগ হম কো বন আই ॥” শুদ্ধ মিলনের এই-যে অনুভূতি একে আধ্যাত্মিক অনুভূতি বললে অসত হয় না।
বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতার যে অভিজ্ঞতা, তার আরেকটি লক্ষণ উল্লেখযোগ্য। এতে নিজের ভিতর একটা ভয়শূন্যতা এবং বিশেষ শক্তির সঞ্চার অনুভব করা যায়। ছোটো ছোটো দেয়ালগুলি যখন ভেঙ্গে যায় আর বৃহত্তর এক সত্তার সঙ্গে আমরা মিলিত হই, তখন এটা ঘটে। অবশ্য ক্রোধের আবেশেও দেহে অন্য এক রকমের শক্তি আসে। ধর্মের ভাষায়, ক্রোধের সেই শক্তিকে যদি বলি দানবিক, তবে আধ্যাত্মিক মিলনের শক্তিকে বলতে হয় দিব্য। এসব কিছুই প্রকৃতির বাইরে ঘটে না। প্রকৃতির ভিতরই বিভিন্ন স্তর আছে। আর বিভিন্ন স্তরের গুণগত পার্থক্যকে স্বীকার করবার জন্য ভাষার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
মনে রাখা ভালো যে, প্রকৃতিতে এই সবই মিলে মিশে যায়। কখনো তৈরি হয়, যাকে রবীন্দ্রনাথ শেষজীবনে বলেছেন, “মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ।” বুদ্ধের শিক্ষা, অতন্দ্র থাকতে হবে। অতন্দ্রতার বিকল্প নেই। সন্দেহগ্রস্ততা নয়, যা আমাদের শুধুই ক্লান্ত করে। বরং সেই সজাগতা যাতে মিথ্যা বিশ্বাসে আমরা ধরা পড়ি না, তবু বিশ্বের সঙ্গে যোগের আনন্দকে সহজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে নিই। আনন্দ ও অভয় আধ্যাত্মিক অনুভবের দুটি প্রধান লক্ষণ।
খ
ভগবদ্গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে চিত্তের সেই “আত্যন্তিক সুখ” ও স্থিতির কথা বলা হয়েছে, “যং লধ্বা চাপরং লাভং মনতে নাধিকং ততঃ”, অর্থাৎ, যাকে লাভ করে অপর কোনো লাভকেই তার অধিক মনে হয় না। সেই অবস্থায় দুঃখানুভূতি থাকে না এমন নয়; তবু কঠিন দুঃখবোধেও চিত্ত আর অতিশয় বিচলিত হয় না, “যস্মিন্ স্থিতো না দুঃখেন গুরুণাপি বিচালাতে। “ ব্যক্তির পক্ষে এটাই তো মোক্ষলাভ। কিন্তু মোক্ষ এবং ধর্ম এক বস্তু নয়। যিনি মোক্ষ লাভ করেছেন তিনি সংসারের ঊর্ধের্ব একটি স্থিতি লাভ করেছেন। তবু ধর্মাচরণের জন্য সংসারে প্রত্যাবর্তন আবশ্যক। দুঃখপ্ত জীবের সেবা এবং সমাজজীবনে নীতির পরিপোষণ ধার্মিকের কর্তব্য।
শিল্পের সঙ্গে ধর্মের একটা প্রধান পার্থক্য এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা ভালো। শিল্প অথবা সাহিত্যের স্বাদকে ব্ৰহ্মস্বাদের সহোদর বলা হয়েছে। এইখানে ধর্মের সঙ্গে তার মিল। কিন্তু শিল্পীকে আর্তজীবের সেবা করতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই। যদি তিনি আর্তের সেবা করেন তবে তিনি সাধুর কিছুটা কাছাকাছি চলে আসেন। সাধুরই কিন্তু সেটা স্বধর্ম, শিল্পী এব্যাপারে স্বাধীন। শিল্পীকে সেবাধর্মের নিয়ম মেনে চলতে হবে–এমন কোনো কথা নেই।
সাংসারিকতার ঊর্ধ্বে আরোহণ আর তারপর সংসারে অবরোহণ, এ দুয়ের কোনো একটি বাদ পড়লেই ধর্ম অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই অর্থে ধর্ম সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সংসারকে একেবারে ত্যাগ করে মোক্ষ যদি সম্ভব, ধর্ম নয়। সমাজ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে; ধর্মও পরিবর্তনহীন নয় ঈশ্বর যদি বা কালাতীত, ধর্ম কালের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রভাব গিয়ে পড়ে ধর্মব্যবস্থার। ওপর। সামাজিক অন্যায়ও ধর্মের সমর্থন খোঁজে। এই থেকে দেখা দেয় ধর্মের বহু জটিলতা। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলা যুক্তিশীল সমালোচনার অন্যতম কর্তব্য। ধর্মের অধঃপতন রোধ করবার জন্য এই সমালোচনার প্রয়োজন আছে। এদেশে রামমোহনের মতো লোকেরা এই কাজটা করতে চেয়েছেন ধর্মের ভিতর থেকে। আর মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মত লোকেরা করেছেন বাইরে থেকে। ধর্মের স্বাস্থ্যের জন্য এইসব সমালোচনা উপকারী।
বিজ্ঞানীর কিছু মূল বিশ্বাস আছে, যেমন, বিশ্বজগৎ নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই বিশ্বাস থেকে বিজ্ঞানী সহজে সরবেন না। কিন্তু এর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সব তত্ত্ব তৈরি হচ্ছে, তাদের ক্রমাগত বিচার চলেছে এবং সংশোধন হচ্ছে। ধর্মবিশ্বাসীর কিছু মূল প্রত্যয় আছে, অহিংসা প্রেম এই সব নিয়ে। তার ওপর ভিত্তি করে শাস্ত্র ও সামাজিক বিধান তৈরি হচ্ছে, অন্তত শাস্ত্রকারদের দাবি এইরকম। ধর্মের মূল প্রত্যয় সহজে বদলাবার নয়। কিন্তু সামাজিক বিধানগুলির বিচার ও পরিবর্তন প্রয়োজন। পাঁচ বছরের ছেলের জন্য যে-বিধান তৈরি হয়, পঁচিশ বছরে সে সব প্রযোজ্য নয়। অবশ্য পাঁচ বছরের ছেলের পক্ষেও প্রচলিত বিধানে ভুল থাকতে পারে। কিন্তু সেগুলি যদি নির্ভুলও হয় তবু পঁচিশ বছরের জন্য ভিন্ন বিধান প্রয়োজন হবে। হাজার বছর আগের সমাজের জন্য যে বিধান ছিল, আজকের সমাজে সে সব চলবে না। প্রজাকে রাজা সন্তানের মতো দেখবেন, এই অনুশাসন কোনো এক যুগে হয় তো তেমন মন্দ ছিল না। অন্য এক যুগে পৌঁছে তবু বলা প্রয়োজন হয়, প্রজাই হবে রাজা।
ধর্মের ব্যাপারে মুশকিলটা এই যে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষার কিছু কিছু স্বীকৃত পদ্ধতি আছে, কিন্তু ধর্মীয় বিধানের জন্য তেমন কোনো পরিষ্কার বিচারপদ্ধতি নেই। উপরন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের ভেতরই এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যার ফলে ধর্মের সামাজিক অপপ্রয়োগের সমূহ সম্ভাবনা। বিষয়টা এইখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা অনুচিত হবে না।
সাধারণ সাংসারিক অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ভিতর গুণগত পার্থক্যের কথা আগেই বলা হয়েছে। অভিজ্ঞতার গুণগত ভেদ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও আছে, যেমন দোকানদারির সঙ্গে কাব্যরসানুভূতির পার্থক্য। তবে ধর্মের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা দেখা দেয় যেটা কাব্যে অনুপস্থিত। কবিরা শাস্ত্রকারদের মতো সরাসরি সামাজিক বিধান প্রণয়নের কাজে অগ্রসর হন না। শাস্ত্রকার অভিজ্ঞতার প্রকল্পিত ভেদকে ভিত্তি করে সামাজিক স্তরভেদকে নায্যতা দিয়েছেন এমন উদাহরণের অভাব নেই। এছাড়া আধ্যাত্মিক। অভিজ্ঞতার ভিতর একটা রহস্যের ভাব আছে, যেটাকে নানাভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। সেই ভাবটি যদি নেশার মতো যুক্তিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলে তবে শেষ অবধি তাতে আধ্যাত্মিকতারও ক্ষতি, সমাজেরও। আবার বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতার অনুভবের মধ্যে যে শক্তিসঞ্চারী গুণ দেখা যায়, তার অপপ্রয়োগ সহজ। এইসব প্রলোভন ঠেকানো। কঠিন। বলা বাহুল্য, এ জাতীয় বিপদ ধর্মেই সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানেরও অপপ্রয়োগ ঘটে, রাজনীতির তো বটেই। তবে ধর্মের ক্ষেত্রে আদর্শ আর বাস্তবের মধ্যে অসামঞ্জস্য বড় ভীষণ হয়ে ওঠে। সেইজন্য সতর্কতার বিশেষ প্রয়োজন। উদাহরণ দিয়ে কথাটা পরিষ্কার করা যাক।
১৯৪৩ সালে রানডের ১০১তম জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এক বক্তৃতায় আম্বেডকর হিন্দুধর্মের ভেতর অসামঞ্জস্য নিয়ে কিছু স্মরণীয় মন্তব্য করেন। একদিকে বেদান্তদর্শনে। ব্রহ্মকেই পরম সত্য বলে মানা হয়েছে। সকল জীবের মধ্যেই পরমাত্মার বিকাশের কথা। বলা হয়েছে। হিন্দুদর্শনে সাম্যের একটা আধ্যাত্মিক ভিত্তি আছে। অন্যদিকে মনুর বিধানে সামাজিক অসাম্য অতি কঠোরভাবে বিধিবদ্ধ। আম্বেডকর বলেছেন, “The Hindu philosophers had both their philosophy and their Manu held apart in two hands, the right not knowing what the left had.” চূড়ান্ত দার্শনিক সাম্য এবং প্রচণ্ড সামাজিক অসাম্যের এই সুপ্রাচীন সহাবস্থানে আমরা এমনই অভ্যস্ত যে, এ দুয়ের অসামঞ্জস্য আমাদের বিব্রত করে না, এমনকি আমরা তা লক্ষ করতেও ভুলে গেছি।
বলা বাহুল্য, অসাম্য সব সমাজেই আছে। কিন্তু হিন্দুসমাজে এই অসাম্য যেভাবে আছে, একরকমের বিকৃত ধর্মের সহায়তা ছাড়া সেটা সম্ভব হত না। শুচিতা সম্বন্ধে এক মানবতাহীন ধারণা এই সমাজের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে আছে। শূদ্রের স্পর্শমাত্রে, এমনকি তার সান্নিধ্যে, ব্রাহ্মণ অপবিত্রতায় আক্রান্ত হয়, এমন হৃদয়হীন এবং মনুষ্যত্বের পক্ষে অপমানজনক ধারণা ধর্মীয় গ্লানি ও কুসংস্কার ছাড়া সম্ভব হত না। হিন্দুর বহু মন্দিরে নিচুজাতের মানুষের প্রবেশ নিষেধ, কারণ তাতে না কি মন্দির অপবিত্র হবে। অথচ ব্ৰহ্ম সর্বব্যাপ্ত, সারা পৃথিবীই ঈশ্বরের মন্দির। সেই মন্দিরের ভিতরই শুদ্রের বাস, তা হলে পৃথিবী তো অপবিত্র হয়েই আছে। মানুষের তৈরি দেওয়ালে গাঁথা কয়েকটি মন্দিরকে যদি পবিত্র রাখতে হয় তবে তার উপায় অন্য। আসলে আমাদের মন্দির অপবিত্র করে তুলবে শূদ্রের এতটা শক্তিসামর্থ্য নেই; মন্দির নিত্য অপবিত্র হচ্ছে উচ্চবর্ণের কিছু মানুষের কুসংস্কারে, অহমিকায় ও লুব্ধতায়। সেই অপবিত্রতা যে আমাদের হিন্দুসমাজে আজও সমর্থিত হয়ে চলেছে, এটাই অতি লজ্জাজনক বাস্তব ঘটনা।
শুচিত-অশুচিতার এই প্রশ্নটা হিন্দু ধর্মে যেমন আছে, মুসলমানের ধর্মে তেমন নেই। মুসলমান সমাজেও আমীর আর গরীবের পার্থক্য প্রকট। কিন্তু সেখানে মানুষের স্পর্শে মানুষ এমন অশুচি হয়ে ওঠে না। এদেশে কোটি কোটি হিন্দু যে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ। করেছে, সেটা প্রধানত মুসলমান শাসকের অসিবলের কাছে নতি স্বীকার করে নয়, বরং অনেকখানি হিন্দুসমাজের নিতান্ত অপমানজনক বৈষম্যের তাড়নায়। উত্তর ভারতের। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে আজ তথাকথিত নিচুজাতের হিন্দুদের বিদ্রোহ মাথা তুলে উঠেছে। বঙ্গদেশে যে বর্ণসংঘর্ষ এখনো তেমন প্রবল নয়, তার একাধিক কারণ আছে। একটা কারণ সম্ভবত এই যে, নিচুজাতের যে বাঙ্গালিরা এই বিদ্রোহে আজ অংশ নিতে পারত, তারা বহুসংখ্যায় অনেক আগেই মুসলমান হয়ে গেছে। জাতি সংঘর্ষের অনেকখানি বিদ্বেষী শক্তি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের রূপ নিয়ে বাংলাদেশটাকেই দুভাগ করে ফেলেছে। মনে রাখা ভালো যে, উঁচুজাতের হিন্দুর কাছে মুসলমানও ছিল অস্পৃশ্য। তারা যে হিন্দুর সঙ্গে একই রাজ্যে বাস করতে চায়নি, সেজন্য শুধু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। অবশিষ্ট বাংলাদেশে, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে, জাতিভিত্তিক দ্বন্দ্ব দুর্বল। কিন্তু সেই সংঘর্ষ এইখানেও ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছে। শহরবাসী উঁচুজাতের হিন্দুরা সে বিষয়ে। উদ্বিগ্ন নয়, এমনকি অনেকটা আত্মসন্তুষ্ট। কিন্তু এটা একরকম নিবোধের স্বর্গে বাস। হিন্দু ধর্ম ও সমাজের একটা আমূল পরিবর্তন ছাড়া সংকট এড়ানো যাবে না। এই সামাজিক সংকটের পটভূমিকা উপেক্ষা করে হিন্দুধর্মের একতরফা মাহাত্ম্যকীর্তন অযৌক্তিক।
শুচিতা-অশুচিতার ভেদ নিয়ে যে-প্রশ্নটা হিন্দুসমাজকে ভিতর থেকে বিভক্ত করেছে, খ্রীষ্টান চেতনায় সেটা সমস্যা সৃষ্টি করেছে অন্যভাবে। খ্রীষ্টধর্মে একটা গভীর পাপবোধ আছে, একদিকে ঈশ্বরের পুত্র নিষ্পাপ যীশু খ্রীষ্ট, আর অন্যদিকে পাপী মানুষ। এ থেকে কিছু অনুতপ্ত নিরহংকার মানুষ আমরা পাই বটে। কিন্তু পাপবোধের তাড়না থেকেই আবার একরকমের আত্মনিগ্রহ এবং নির্দয়তা বেড়ে ওঠে। যারা নিজেকে কশাঘাত করতে অভ্যস্ত তারা অন্যকেও মাত্রাহীন আতিশয্যে অকাতরে কশাঘাত করে।
পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের ভাব ও সংহতিবোধ মুসলমান ধর্মের একটা বড় জিনিস। হিন্দুর সংহতি ততটা স্বাভাবিক নয়; অনেকটা ইসলামী সংহতির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। একক সাধকের একান্ত ভজন ও আরাধনা হিন্দুর ধর্মসাধনায় অনেকটা স্থান জুড়ে আছে। মুসলমানের ধর্মে সাম্প্রদায়িক উপাসনার স্থান তুলনায় বেশি। পৃথিবীর সব মুসলমান একই দিকে মুখ ঘুরিয়ে আল্লার জয়গান করছে, এ থেকে একটা সামূহিক ঐক্যবোধ প্রবল হয়ে ওঠে। অবশ্য মুসলমানদের ভিতরও ছোটো বড় নানা সম্প্রদায় ও তাদের বিভেদ আছে। তবু মোটের ওপর মুসলমানের সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে হিন্দুর চেয়ে বেশি। শিখদের ভিতরও সাম্প্রদায়িক সংহতি উল্লেখযোগ্য।
এর ভালোমন্দ দুদিকই আছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংহতিবোধের তুলনামূলক বিচার আমার উদ্দেশ্য নয়। ধর্ম সাধারণভাবে এইরকম সংহতিবোধের সহায়ক হয়, একথাই স্বীকার্য। যেখানে যুক্তিবাদী ঐতিহ্য কোনো না কোনো কারণে দুর্বল, সেখানে এই সংহতিবোধের ভিতর একটা উগ্ৰ অসহিষ্ণুতা সহজেই এসে পড়ে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিতর বিরোধ বৃদ্ধি পায়। ধর্মীয় কারণ যোগ হলে বিরোধের হিংস্রতা আরো বাড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশে এর তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে যত রক্তপাত আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে তত আর সম্ভবত অন্য কিছুতে নয়। এই উপমহাদেশর অনেক বুদ্ধিমান ও সুরুচিসম্পন্ন মানুষ যদি এই কারণে ধর্মের বিরুদ্ধে বিরক্তি বোধ করেন তবে তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই।
তবু এই ধরনের হিংস্রতা ও রক্তপাতের জন্য ধর্মকে দায়ী করবার আগে অন্য দুয়েকটি কথা বিবেচনা করে দেখা উচিত, তা নইলে বিচারে ত্রুটি থেকে যায়। মানুষের অবচেতনায় একটা হিংস্রতা আছে যার কোনো ধর্ম নেই। হিটলার ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন না, স্তালিন তো নিশ্চয়ই নয়। এরা যে-পরিমাণ বর্বরতা ও রক্তপাতের জন্য দায়ী, এ যুগে তার তুলনা পাওয়া কঠিন। জঙ্গী জাতীয়তাবাদকে সাধারণ অর্থে ধর্মের সঙ্গে সমার্থক ধরা যায় না। কোনো কোনো দেশে এই রকম সমীকরণ করা হয়েছে বটে, কিন্তু সব দেশে নয়, কোনো দেশেই সম্পূর্ণ ভাবে নয়। বিশ্বমানবের সঙ্গে ঐক্যবোধ এক জিনিস; আর মানবজাতির এক খণ্ডিত অংশের সঙ্গে ক্রুদ্ধ সংহতিবোধ বিপরীত জিনিস। যুথবদ্ধ অন্ধ অহংকার এ যুগে কেবল মাত্র ধর্মের নামেই সৃষ্টি করা হয়েছে এমন কথা বললে ইতিহাসের সাক্ষ্যকে ‘অমান্য করা হবে। ধর্মের ভয়াবহ অপব্যবহার সম্ভব এ কথা অবশ্য স্বীকার্য এবং এ সম্বন্ধে সাবধান থাকা প্রয়োজন। নিরীশ্বরবাদও যে সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতার উর্ধ্বে নয়, সে কথাও বিনয়ের সঙ্গে মনে রাখা ভালো। বুদ্ধ যে অহিংসার ওপর জোর দিয়েছিলেন, ঈশ্বরবাদ বা নিরীশ্বরবাদের ওপরে নয়, তার কিছু ভালো কারণ ছিল।
গ
এদেশে শুভচিন্তক বহু মানুষের ভেতর একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, সব ধর্মেরই সার কথা এক ও অভিন্ন। এই ধারণা সম্পূর্ণ সত্য বলে মনে হয় না। নানা ধর্মের বাহ্য বিধানে তো পার্থক্য আছেই, যেমন কোনো ধর্মে বিশেষ বিশেষ শর্তে চার স্ত্রী গ্রহণ করা। যায়, কোনো ধর্মে যায় না। এইসব পার্থক্য তুচ্ছ বা অগভীর মনে হতে পারে। কিন্তু ধর্মের মেজাজে ও মূল বিশ্বাসেও বিভিন্নতা লক্ষ করা যায়। আমরা আগেই দেখেছি যে, ঈশ্বরবিশ্বাস কোনো কোনো ধর্মে মৌল বস্তু, কিন্তু সব ধর্মে নয়। আবার যে সব প্রধান ধর্ম ঈশ্বরবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেই সব ধর্মের ভিতরও ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণায় ভিন্নতা আছে। খ্রীষ্টধর্মে ঈশ্বর সম্বন্ধে যে ‘ট্রিনিটারিয়ান ধারণা আছে, মুসলমানের কাছে সেটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এইসব পার্থক্যের বিশদ আলোচনায় আমরা যাব না। কিন্তু একটা বিষয়ের প্রতি তবু বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করব। কিছুক্ষণ আগে যে-ধরনের সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা গেছে, অন্তত বিবেকবান মানুষের পক্ষে তাকে আদর্শভ্রষ্টতার সমস্যা বলে। চিনে নেওয়া কঠিন নয়। অন্য কিছু সূক্ষ্ম সমস্যা কিন্তু আছে, যার মূলে পাওয়া যাবে আদর্শভ্রষ্টতা নয়, বরং আদর্শেরই দ্বন্দ্ব। শ্রীমুকুন্দীলাল শ্রীবাস্তবের সম্পাদিত ‘জ্ঞান শব্দ কোষ’-এ ইংরেজি dileima-র পরিভাষা দেওয়া হয়েছে ধর্ম-সংকট। শব্দটি অর্থবহ। অধ্যাত্মচিন্তার গভীর স্তরেও ‘ডিলেমা আছে। যেমন জীবনের গভীরে তেমনি ধর্মজীবনে কিছু মৌল সংকট, কিছু আদর্শের দ্বন্দ্ব, দেখা যায়। বিভিন্ন ধর্মে এই দ্বন্দ্বের প্রধান রূপ বিভিন্ন। কুসংস্কার যদিও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা যায়, ‘ধর্মসংকট’ যায় না। বরং এ বিষয়ে চিন্তনের ফলে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন সম্বন্ধে আমাদের বোধ গভীরতা লাভ করে, তুলনামূলক ধর্মের পাঠ অন্য এক বৈচিত্র্যের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়। দুয়েকটি উদাহরণের ভিতর দিয়ে বিষয়টি এবার ব্যাখ্যা করা যাক।
প্রাচীন ইহুদী ধর্ম ও পরবর্তীকালে ইসলামের একটি প্রধান আদর্শ হল, ন্যায়বিচার। এই ন্যায়বিচারের মূলকথা, অপরাধ ও দণ্ডের ভিতর তুল্যমূল্য। রক্তের বদলে রক্ত চাই, চাই আমাদের পরিচিত এই ধ্বনি যতই ক্ষমাহীন মনে হোক না কেন, ন্যায়বিচারের প্রাচীন ধারণার সঙ্গে এর অনেকটা মিল আছে। হত্যাকারীর জন্য চাই মৃত্যুদণ্ড, দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ। “He that smiteth a man, so that he die, shall be surely put to death.” “Eye for eye, tooth for tooth.’’–এই হল ঈশ্বরের আদিষ্ট নিয়ম। দয়া বা করুণার কথা সেখানে নেই এমন নয়, তবু কঠোর ন্যায়বিচারের সুরটাই প্রাধান্য পেয়েছে। এর প্রতিধ্বনি আছে কোরানের সেই অংশে যেখানে চৌর্যের শাস্তি হিসাবে চোরের হাত কেটে ফেলবার কথা বলা হয়েছে।
ন্যায়দণ্ডের পাশাপাশি আশ্চর্যভাবে শোনা গেল করুশার বাণী। ইহুদী ঐতিহ্যের ভিতরই জন্ম নিয়েছিলেন যীশু খ্ৰীষ্ট। বাইবেলের পুরনো বিধানের সঙ্গে তিনি পরিচিত। সেই বিধান তিনি ভাঙতে আসেননি, বরং পূর্ণ করতে এসেছেন। ম্যাথুকথিত সুসমাচারের পঞ্চম অধ্যায়ে দেখি যীশু বলছেন, “Think not that I am come to destroy the law; or the prophets: I am not come to destroy, but to fulfil,’’ আমাদের বিস্মিত করে একই অধ্যায়ে কিছুক্ষণ পরেই তিনি বলেন “Ye have heard that it hath been said, An eye for an eye, and a tooth for a tooth: But I say unto you, that ye resist not evil; but whosoever shall smite thee on thy right cheek, turn to him the other also. যীশুর উচ্চারণে কোন অস্পষ্টতা নেই। তোমরা শুনেছ চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত এই কথা, কিন্তু আমি বলছি, প্রতিরোধ করো না, বরং যদি কেউ তোমার এক গালে আঘাত করে, তাকে অন্য গাল এগিয়ে দাও। হিংসাকে জয় করতে হবে ক্ষমা দিয়ে, যীশুর এই বাণী।
আদর্শের দ্বন্দ্বটা এর চেয়ে স্মরণীয়ভাবে বলা সম্ভব ছিল না। এ কোনো তুচ্ছ উভয়সংকট নয়। কেউ হয়তো বলবেন, বিচার ও দণ্ডের চেয়ে ক্ষমাই নিশ্চিতভাবে উচ্চতর ধর্ম। এইভাবে বললে কিন্তু সংকটের সমাধান অতি বেশি সরল করে ফেলা হয়। এতে দ্বন্দ্বের গভীরতর তাৎপর্য বোঝা হয় না। সম্যক দৃষ্টি নিয়ে তাকালে দেখা যায়, দ্বন্দ্বটা অটলভাবে, অনিবার্যভাবে, বাস্তবে প্রোথিত। বিশ্বপ্রকৃতি একদিকে নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত, প্রতিটি কার্যের পরিণাম নিয়মের দ্বারা কঠিনভাবে নির্ধারিত। অন্যদিকে সৃষ্টি আনন্দে বিধৃত, প্রেমের ভিতর দিয়েই সেই সত্য আবিষ্কার করা সম্ভব, প্রেম ছাড়া পথ নেই। বিশ্বজগতের এই যে দ্বৈত, তারই প্রতিফলন সংসারেও। ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজ রক্ষা পাবে না। আবার প্রেম ছাড়া গতি নেই। ধর্মের এই এক মূল রহস্য।
এই রহস্য ইসলামেও স্বীকৃত। কোরানে যে আল্লার বন্দনা করা হয়েছে, তিনি একদিকে পরম করুণাময়, ‘রাহমানির রাহীম, করুণাময়, অন্যদিকে তিনি শেষবিচারের দিনের সর্বশক্তিমান বিচারপতি, মালেকে য়াওমিদ্দীন’। ক্ষমায়ধর্মের এই সংযোগ সম্বন্ধে একটা সূক্ষ্ম সচেতনতা না থাকলে মানুষের নৈতিক জীবন তার গতি ও গভীরতা হারায়।
ভারতীয় কোনো কোনো আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে ধর্মসংকটের অন্য একদিক সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে বোধিবৃক্ষের নিচে উপবিষ্ট সত্যান্বেষী সিদ্ধার্থ মারের প্রচণ্ড আক্রমণ ও নানা প্রলোভনের সম্মুখীন হয়েছিলেন সেটা ছিল কঠিন পরীক্ষা; কিন্তু তাতে কোনো নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। মারের আক্রমণ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করাই তো প্রশ্নাতীত কর্তব্য। বুদ্ধত্বপ্রাপ্তির পর সিদ্ধার্থ অন্য যে প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন সেটা কিন্তু এক মৌল প্রশ্ন। সিদ্ধার্থ এখন দুঃখের কারণ জেনেছেন, দুঃখকে অতিক্রম করবার পথও। সে পথে একাই ভ্রমণ করা তার পক্ষে সম্ভব। কিন্তু সংসারে আরো সংখ্যাতীত দুঃখতপ্ত মানুষ আছে, যারা বোধি থেকে বঞ্চিত। বুদ্ধ কি তাদের পথের সন্ধান দেবার জন্য সংসারে ফিরে যাবেন? তিনি সেই দুঃখী মানুষদের ভিতরেই ফিরে গিয়েছিলেন। এটাই বুদ্ধের করুণা। যিনি স্বচ্ছন্দে নিবাণে প্রবেশ করতে পারতেন, তিনি দুঃখে আবদ্ধ মানুষদের পথ দেখাবার জন্য থেকে গেলেন। এদেশের ধর্মের ঐতিহ্যে এটা এক স্মরণীয় ঘটনা।
মুক্তিপথের সন্ধানে ব্যাকুল সাধক সংসার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ধ্যানে প্রবেশ করেন, নিজেকে নিয়ে কঠিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, এটা কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। কিন্তু পথের সন্ধান পাবার পর তিনি সংসারে প্রত্যাবর্তন করবেন কিনা, এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে যায়। এই দ্বিধা অনেকের কাছে অর্থহীন, এমন কি হৃদয়হীন, মনে হতে পারে। মানুষের মাঝে ফিরে আসবার বিরুদ্ধে যুক্তি কোথায়? জীবে দয়াই তো স্বাভাবিক ধর্ম। কিন্তু এইভাবে দেখলে আসল প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানোই হয় না। সমস্যার মূল খুঁজতে হবে। অনত্র।
প্রত্যেক মানুষকেই কি নিজের মুক্তির পথ নিজেই খুঁজে নিতে হয় না? পেলদ্ধ সত্যের আলোতে সাধক নিজের জীবনচর্যা নিজে নির্ধারিত করে নেন। আর সেটাই অন্যের কাছে একটা উদাহরণস্বরূপ হয়ে ওঠা সম্ভব। মুক্তির পথে কেউ কি কারো জন্য। এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারে? এইরকম কিছু প্রশ্ন দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব এদেশের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে অবিস্মরণীয় ভাবে আঁকা হয়ে আছে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, বিবেকানন্দের জীবনেও একটা মুহূর্ত এসেছিল যখন তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যে, তিনি একক মুক্তির পথে অগ্রসর হবেন, না পীড়িত মানুষের সেবার জন্য সংসারে থেকে যাবেন। দ্বিতীয় পথই তিনি বেছে নিয়েছিলেন।
আর্তের সেবায় সাধক আত্মনিয়োগ করবেন কি না, আসল প্রশ্ন সেটা নয়। তিনি ধর্মগুরু হয়ে সংসারে ফিরে আসবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন। আর এ প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক শুধু ধর্মের ক্ষেত্রেই নয়, জীবনদর্শনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। গুরু যিনিই হোন, যীশু খ্রীস্ট অথবা মহামতি মার্কস, সেই ভূমিকার কিছু সাধারণ পরিণাম এড়ানো কঠিন গুরুকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, সেটা তাঁর কাম্য হোক না হোক। প্রতিষ্ঠানের ভিতর সাংগঠনিক নিয়ম, অতএব নিয়মানুবর্তিতার বাধ্যবাধকতা আর সাংগঠনিক ঐক্যরক্ষার কিছু যান্ত্রিক পদ্ধতি অনিবার্য ভাবে এসে যায়। সেই সঙ্গে দেখা দেয় সংগঠনের ভিতর পদাধিকার নিয়ে নানা সমস্যা। সাধক কিংবা সত্যসন্ধানী যখন সংসারে প্রত্যাবর্তন করেন অজ্ঞ মানুষকে পথ দেখাতে, তখন পথ-দেখাবার বাইরেও এইরকম অন্য এক ইতিহাসের সূত্রপাত হয়। এই পরিণামের সঙ্গে আমরা পরিচিত–ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তির ফলে। তবু একে ঠেকানো যায়নি।
গৌতম বুদ্ধ কি চেয়েছিলেন কোনো সংগঠিত ধর্মসম্প্রদায় এ বিষয়ে কিছু মতভেদ আছে। অনুবর্তীদের জন্য তিনি রেখে গিয়েছিলেন এই অন্তিম উপদেশ–আত্মদীপ হও। অর্থাৎ, নিজ আত্মার আলোতে পথ চিনে চলো। এটা গুরুবাদ নয়। তবু তিনি গুরু হয়েই উঠেছিলেন। প্রধান প্রধান সব ধর্মেই এইরকম হয়েছে।
সংসারে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নটা বুঝতে হবে এই সমগ্র ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে। কোনো বুদ্ধই কি সংসারে ফিরে আসতে পারেন ধর্মগুরু না হয়ে? তিনি কি ধর্মগুরু হতে পারেন সংগঠন ও সম্প্রদায় সৃষ্টি না করে? সংগঠিত ধর্ম কি লালন করে না অসহিষ্ণুতা ও দুর্নীতি? এরপরও হয়তো প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্তটাই সঠিক। কিন্তু সিদ্ধ মানবের সেই মুহূর্তের ঐ দ্বিধাটাকে এরপর আর তুচ্ছ বলা যাবে না, সেটা চিহ্নিত হয়ে থাকবে এক নতুন ঐতিহাসিক মহত্ত্বে।
.
ঘ
ধর্মের বিবর্তনে যুক্তির ভূমিকা অতএব গুরুত্বপূর্ণ দুই দিক থেকে। বাইরের দিক, যেখানে সংগঠনের প্রশ্নটা বড়, আর ভিতরের দিক, যেখানে অধ্যাত্মচেতনার উন্মোচনটাই প্রধান কথা। এইসব আগেই ইঙ্গিত করা আছে। আরো দুয়েকটি কথা এইবার যোগ করা যাবে। সাংগঠনিক আধ্যাত্মিক দুই সংকটের ভিতর দিয়ে ধর্মকে পৃথ কেটে যেতে হয়।
প্রথমে সংগঠনের কথা। স্যাঁ সিমঁর পুরনো বিশ্লেষণ খানিকটা বদলে বলা যায়, সমাজ ও ধর্মের বিবর্তনে দুটি পর্যায় ঘুরে ঘুরে আসে; এক পর্যায়ে সংগঠনের প্রাধান্য, অন্য। পর্যায়ে প্রতিবাদ। সমাজ সংগঠনের জন্য ধর্মের প্রয়োজন হয়, অন্তত এইরকমই ঘটেছে। কিন্তু সংগঠন যতই প্রবল হয়ে ওঠে, ততই তার ভিতর দুর্নীতি জমে ওঠে। বৃহত্তর সমাজের কায়েমী স্বার্থের সঙ্গে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের একটা যোগ গড়ে ওঠে। এটাই স্বাভাবিক। ন্যায়বিচারের প্রশ্ন ধর্মের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বৃহত্তর সমাজের ক্ষমতার কাঠামোকে উপেক্ষা করে কোনো বিধানকেই কার্যকর করা সম্ভব নয়। কাজেই প্রতিযুগে সেই সময়ের ক্ষমতার বিন্যাসকে মেনে নিয়েই ন্যায়নীতির বিধান রচিত হয়। ধর্ম বলে বটে, বিচারকে দয়ার স্পর্শ বিনম্র কর, হিংসাকে সংযত কর। কিন্তু সেই সংযমের সীমানাও নির্ধারিত হয়ে যায় ক্ষমতার স্বীকৃত কাঠামো দিয়ে। তাছাড়া, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভিতর কিছু নিজস্ব দুর্নীতি দেখা দেয়, তাকে পরানো হয় পুষ্পিত বাক্যের মুখোশ। প্রাচীন ধর্মের আরেক দোষ, সে আচারসর্বস্ব হয়ে ওঠে। দুর্নীতির চেয়েও এই আচারসর্বস্বতা সমাজের উন্নতির পথে বড় বাধা।
ধর্ম ও সমাজের এই জীর্ণতার ছবি আমাদের কাছে পরিচিত। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধরনটাও কম পরিচিত নয়। প্রতিবাদী আন্দোলনের রূপভেদ আছে, কোথাও ভক্তি প্রধান, কোথাও যুক্তি। যুক্তি ও বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দিলে নাস্তিক্য দেখা দিতে পারে। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে রামচন্দ্র ভরতকে আত্মীক্ষিকী সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আম্বীক্ষিী নাস্তিকের দিকে নিয়ে যায়, প্রাচীনদের এই সন্দেহ একেবারে অমূলক ছিল না। প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে অনেক সময়েই প্রাধান্য দেখা গেছে। ভক্তির। এদেশে মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের বহু প্রসিদ্ধ সাধক সমাজের নিচুস্তর থেকে এসেছেন। অবশ্য এইরকম সবসময়ে ঘটেছে, এমন নয়।
গৌতমবুদ্ধের জন্ম রাজবংশে। এ যুগে ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা অধিকাংশই উচ্চবর্ণের। এই আন্দোলনে ভক্তি ও যুক্তির সমন্বয়ের দিকে ঝোঁক উল্লেখযোগ্য। রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে প্রোটেষ্ট্যান্ট প্রতিবাদেও ভক্তি ও যুক্তির একটা নতুন সমন্বয়ের চেষ্টা দেখা গেছে। সেটা ঘটেছে এক নতুন অর্থনৈতিক যুগসন্ধিতে, যার প্রভাব এসে পড়েছে এই প্রতিবাদী আন্দোলনে। এখানে লক্ষ করা যেতে পারে যে, ধর্মের বিরুদ্ধে বার বার প্রতিবাদ দেখা দেয় ধর্মের ভিত্তিতেই। নতুন আন্দোলনের নেতারা পুরনো ধর্মের মূলে ফিরে যান। তাঁদের যুক্তি শুরু হয় সেইখান থেকে।
প্রতিবাদী আন্দোলন থেকে জন্ম নেয় নতুন সংগঠন। সংগঠন-প্রতিবাদ-সংগঠন, এইভাবে বললে একটা চক্রাকার গতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অধ্যাত্মচেতনার ভিতর অগ্রগতির ধারণা এ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। সেইদিকে এবার দৃষ্টিপাত করা যাক।
অধ্যাত্মচেতনার একটা লক্ষণ এই যে, এতে ধরা পড়ে বিশ্বের সমগ্রতার প্রতি ব্যক্তিসত্তার একটা সাড়া। রাম শ্যাম অথবা যদু সম্বন্ধে আমরা কী ভাবছি সেটা এখানে তেমন প্রাসঙ্গিক নয়, মানুষ সম্বন্ধে কী ভাবছি সেটাই প্রাসঙ্গিক। আমরা বিশেষ বিশেষ ভালো অথবা মন্দ জিনিস কী ভাবে গ্রহণ করছি সেটা মূল প্রশ্ন নয়। ভালোয় মন্দে মিশ্রিত এই সমগ্র বিশ্বটাকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করছি সেটাই আরো মূল কথা।
এই পৃথিবীর কিছুটা আমাদের জানা, অনেকটাই অজানা। জানা অজানায় মেশানো মহাবিশ্বের প্রতি মানুষের একটা অন্ধ ভয় আছে, আবার একটা পরিব্যাপ্ত প্রেমও আছে। আদিম অধ্যাত্মচেতনায় এই ভয় এবং প্রেম মিলে মিশে গেছে। সমালোচকরা বলেন, ধর্মের ভিত্তিতে ভয়টাই হল আসল। ঈশ্বরকে মানুষ তৈরি করে নিয়েছে তার ভয়ার্ত চিত্তের প্রার্থনা জানাবার জন্য। কথাটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। ভয় এবং প্রেম দুইই আছে ধর্মের ভিত্তিতে। ভয়ের কুপ্সটিকার ভিতর থেকে রূপ গ্রহণ করেছে অন্য এক আলোকিত বিস্ময়।
বিশ্বের প্রতি মানুষের যে অন্ধ ভয় তার কারণ বোঝা কঠিন নয়। আমাদের জৈব সত্তা নানা দিক থেকে সতত বিপন্ন। একটি মানুষকে সংকটে ফেলবার জন্য বন্যা, ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাতের মতো বড় কোনো দুর্ঘটনার প্রয়োজন হয় না। অতি তুচ্ছ কারণ থেকে। অঙ্গহানি ঘটে, মনের স্থৈর্য ভেঙ্গে চুরমার হয়। ব্যাধি, জরা, মৃত্যুর হাত থেকে মানুষের নিস্তার নেই। সব সুখই অনিশ্চিত। কাজেই বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি মানুষের শৈশব থেকেই একটা ভীতি থাকা স্বাভাবিক। বিশ্বের প্রতি প্রেমের কারণটাই বুঝিয়ে বলা কঠিন। প্রকৃতির কাছ থেকে আমরা সুখকর অনেক কিছু পাই বটে, কিন্তু এইসব খণ্ড খণ্ড সুখকর। বস্তুকে অতিক্রম করেও তারায় ভরা আকাশের প্রতি, অন্ধকার রাতের প্রতি, জগৎজোড়া এই অন্তহীন নাট্যের প্রতি মানুষের একটা অকারণ প্রেম আছে।
আদিম বিশ্বচেতনায় ভয়ের ভাটার প্রাধান্য ছিল। তাই থেকে মানুষের সংস্কৃতিতে বহু নিষ্ঠুর আচার-অনুষ্ঠান এসে গেছে। আমরা মাঝে মাঝেই চারিদিকে অসংখ্য ডাইনীর অস্তিত্ব আজও অনুভব করি, আর তাদের কিছুতেই মেরে শেষ করে উঠতে পারি না।
এই যে তামসিক ভয়ের শাসন, এ থেকে চেতনাকে ক্রমে মুক্ত করা আধ্যাত্মিক উন্নতির এক প্রধান শর্ত। আর এইখানেই যুক্তি ও বিজ্ঞানের একটা বড় ভূমিকা দেখা দেয়। আমাদের কালে, রবীন্দ্রনাথের লেখায় ও অরবিন্দের পরিণত দর্শনে এ কথা স্বীকৃত। যে আধ্যাত্মিকতা যুক্তিকে নিজের অঙ্গীভূত করে নেয়নি তার একটা দুর্বলতা থেকে যায়। বিশ্বপ্রকৃতি সম্বন্ধে অন্ধ ভয়ের প্রভাব থেকে নিজেকে সে সহজে মুক্ত করে নিতে পারে না। আধ্যাত্মিকতার নামে একটা প্রচণ্ড তামসিকতা তখন মানুষকে অধিকার করে বসে, অন্ধকারকেই আলোক বলে ভ্রম হয়। এইখানে যুক্তির প্রয়োজন। বিবেকানন্দ যখন বলেছিলেন যে, যুক্তি দিয়ে ধর্মের যে-অংশকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করা যায়, তাকে মিথ্যা। বলে মেনে নেওয়াই ভালো, তখন তিনি ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার পক্ষে একটি অতি মূল্যবান কথাই বলেছিলেন।
শুদ্ধ বিজ্ঞানের মূলে আছে বিশ্ব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা। এ থেকে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা সংসারের নানা প্রয়োজনে লাগে। কিন্তু বিজ্ঞানীর জিজ্ঞাসা সংসারের প্রয়োজন দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। তেমনি শুদ্ধ ধর্মের মূলে আছে বিশ্বের প্রতি প্রেম। সে প্রেমও জৈব প্রয়োজনকে অতিক্রম করে যায়। এই অতিরিক্ত জিজ্ঞাসা ও অতিরিক্ত প্রেমের ভিতর কোনো বিরোধ নেই। যদিও সংসারের অভ্যস্ত হিসেবে এদের প্রয়োজনাতিরিক্ত মনে হয়, তবু এরা সংসারকে রক্ষা করে আছে।
সাংসারিকতার এমন শক্তি নেই যে সংসারে সঞ্জাত লোভ ভয় ও ক্রোধকে সে যথেষ্ট সংযত করতে পারে। ধর্ম, যদি সে সত্যধর্ম হয়, তবে সেই শক্তি তাতে আছে। সেই ধর্মে সংগঠনের চেয়েও চেতনার প্রাধান্য সেই চেতনায় ভয় নয়, প্রেমের প্রাধান্য। যে। অনাসক্তি ও চিত্তশুদ্ধির কথা ধর্মে বলা হয়, আধ্যাত্মিকতাকে ভয় থেকে মুক্ত করার জন্যই তার প্রয়োজন। সেই আধ্যাত্মিকতা যদি অন্য ভয় জয় করবার পর যুক্তিকে ভয় করে, তবে জানতে হবে যে সেটা শুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা নয়।
.
৩
ক
মানুষের জন্যই এই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে, একথা মনে করা সম্ভবত একটা মোহ। এমন কোনো মোহ না রেখেও কিন্তু বিশ্বকে ভালবাসা যায়। সাংসারিক প্রত্যাশাহীন এই নিমোহ ভালবাসা মানুষের মনে একটা বিশেষ রসের সঞ্চার করে, যাকে অন্য কোনো সুখের সঙ্গে তুলনা করা যায় না, তবু যাকে বলা হয়েছে আনন্দ। এযুগে রবীন্দ্রনাথের গানে ও ভাষণে এই আনন্দের কথা বারবার আমরা শুনেছি। আনন্দাদ্ধ্যে খন্বিমানি ভূতনি জয়ন্তে, এই বচনটি যে রবীন্দ্রনাথের এত প্রিয় ছিল তার কারণ নিশ্চয়ই এই যে, তাঁর নিজস্ব কোনো বিশেষ অনুভূতিরই প্রতিধ্বনি তিনি শুনেছিলেন উপনিষদের ঐ শব্দগুচ্ছে। অথচ কবির ভিতর বেদনাবোধও কত যে তীব্র ছিল সে কথায় আমরা পরে আসব।
এই বিশ্বকে মানুষ নানা ভাবে দেখে, নানা ভাবে জানে। আমরা যখন সংসারে আবদ্ধ তখন একে দেখি সাংসারিক উদ্দেশ্য নিয়ে। বস্তুর সেই সব গুণই তখন আমাদের কাছে গ্রাহ্য, সংসারে যে-সব প্রয়োজন লাগে। যেমন বস্তুকে তেমনি ব্যক্তিকেও তখন আমরা ঐ ভাবেই চিনি। কাকে দিয়ে আমাদের কী দরকার, কখন কার কাছে কোন কাজে যেতে হবে, তাই দিয়ে সম্পূর্ণ হয় ব্যক্তির পরিচয়। এইভাবে একটা প্রয়োজনের জগৎ তৈরি হয়ে যায়, আর সব কিছুকেই আমরা সাজিয়ে নিই, সব কিছুরই মূল্য ঠিক হয়ে যায় ঐ ব্যবহারিক প্রয়োজনের সঙ্গে মিলিয়ে। বাজারে যেমন প্রত্যেক জিনিসের একটা বাজারদর নির্দিষ্ট হয়, এটাও সেই রকম। এই হল আমাদের ব্যবহারিক জগত্যেক বস্তুর ও ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারিত হচ্ছে স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়ে।
অন্যের ক্ষেত্রে এই পরিচয় দিয়ে কাজ তো চলে যায়। কিন্তু নিজের জন্য এই পরিচয়টাকেই কি আমরা যথেষ্ট মনে করি? যাদের আমরা কাছের মানুষ–অন্তরঙ্গ বলে। জানি, অন্তত তাদের কাছ থেকে কিন্তু এর অতিরিক্ত কিছু আশা থাকে আমাদের, অন্য এক পরিচয়, অন্য কোনো মূল্য। বাইরের জগতে ভালবাসা আর সাংসারিক স্বার্থ জট পাকিয়ে যায় ঠিকই, ভিতর থেকে আমরা তবু এদের আলাদা বলে অনুভব করি। যদি দেখি কেউ। আমাদের অন্তরঙ্গতা দেখাচ্ছে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে, বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য, তবে। সেটাকে আমরা বলি কপট ভালোবাসা। ঐ রকম স্বার্থাশ্রিত ভালোবাসায় আমাদের ভিতরের নিঃসঙ্গতা পূর্ণ হয় না। আমরা চাই অন্য এক প্রীতি, হৃদয় থেকে যে বলতে পারে, তোমার কাছ থেকে আমি অন্য কিছুই চাই না, তোমাকেই চাই, তুমি থেকো এইটুকুই চাই। অর্থাৎ, যাকে আমরা সত্যি ভালোবাসি তার অস্তিত্ব–শুধু অস্তিত্বই–আমাদের আনন্দিত করে। সে যদি অন্য কোনো উপহার নিয়ে আসে তবে সেটা উপরি পাওনা। সে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এটাই একটা মধুর প্রাপ্তি। “দাঁড়াও আমার আঁখির আগে। তোমার দৃষ্টি হৃদয়ে লাগে।” শুদ্ধ ভালোবাসার ভাষা এই। দুটি সত্তার মিলনের অনুভবই এখানে একমাত্র কথা।
বিশ্বকেও এই দৃষ্টিতে দেখা যায়। সেও পারে শুধু অস্তিত্বের চমৎকারিত্ব দিয়েই আমাদের রোমাঞ্চিত করতে। সতর্ক ‘আমি’র সীমানা ভেঙ্গে বৃহতের সঙ্গে তখন ঘটে একাত্মতার অনুভব। বিশ্বপ্রকৃতি তো আমাদের জৈব প্রয়োজনে নানা কাজে লাগে ঠিকই। নিতান্ত লৌকিক অর্থেই প্রকৃতি আমাদের বাঁচায় এবং মারে। কিন্তু এইসব লাভক্ষতির বাইরেও বিশ্বের অন্য এক আকর্ষণ ও বিস্ময়করতা আছে। তারই স্পর্শে কবির উচ্চারণ হয়ে ওঠে প্রার্থনার মতো। “এই যে ধরণী চেয়ে বসে আছে ইহার মাধুরী বাড়াও হে।” কী সেই মাধুরী? সেই মাধুর্যের মূলে আছে, শুদ্ধ সত্তার সঙ্গে শুদ্ধ সত্তার মিলনের অনুভূতি। কার কাছে প্রার্থনা, “ইহার মাধুরী বাড়াও হে?” সেই ঈশ্বরের কাছে যিনি কবিরই অন্তঃস্থিত এক প্রেমের শক্তির অন্য নাম। সেই শক্তি আছে মানুষেরই ভিতর, মানুষ তাকে পেয়েও হারায়, হারিয়ে আবার খোঁজে।
শংকরের বেদান্তদর্শনে ব্যবহারিক জগতের সঙ্গে প্রতিতুলনায় পারমার্থিক সত্যের কথা বলা হয়েছে। সেই দর্শন এবং তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আমাদের অভিমত যাই হোক না কেন, একটা কথা বোধ হয় মেনে নেওয়া দরকার। সাংসারিক স্বার্থের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাদের প্রয়োজনের মাপে যেমন জগৎটাকে একভাবে জানা যায়, তেমনি আবার। স্বার্থশূন্য শুদ্ধ ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকালে বিশ্বকে অন্য একভাবে লাভ করা যায়। এই দুয়ের ভিতর প্রভেদ এমনই আশ্চর্য যে, সাংসারিক দৃষ্টির সঙ্গে প্রতিতুলনায় অন্যটিকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টি বলা অসঙ্গত নয়।
এই অন্য দৃষ্টি সম্বন্ধে এবার তিনটি কথা অতি সংক্ষেপে পর পর বলে নেওয়া যাক।
প্রথম কথা, আধ্যাত্মিকতা সব মানুষের ভিতরই অল্পবিস্তর আছে; তবে অনেকের ভিতরই এটা সুপ্ত, আত্মসচেতন নয়। যেমন কাব্যশক্তি কোনো মানুষের মধ্যে বিশেষ মাত্রায় থাকলে তবেই তাঁকে কবি বলা হয়, আধ্যাত্মিক শক্তির বেলাতেও সেইরকম। অল্প মানুষকেই আমরা আধ্যাত্মিক গুণসম্পন্ন বলে জানি।
দ্বিতীয় কথা, সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টির সহাবস্থানই মানুষের জীবনের স্বাভাবিক অবস্থা। এই দুয়ের ভিতর প্রায়ই একটা কলহ অথবা ভুল বোঝাবুঝি দেখা যায়। সামগ্রিক জীবনবোধের দিক থেকে কিন্তু কোনোটাই ত্যাজ্য নয়। আসলে এদের সম্পর্ক একই সঙ্গে দ্বান্দ্বিক অথচ পরিপূরক। ব্যবহারিক দৃষ্টি সত্যমিথ্যার সংজ্ঞাটাকে এমনভাবেই নির্ধারিত করে নেয় যে, আধ্যাত্মিক অনুভবকে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অতএব অবাস্তব, এইরকম বোধ হয়। আবার আধ্যাত্মিক দর্শনও ব্যবহারিক ধারণাগুলিকে নিতান্তই সাময়িকপ্রয়োজননির্ভর, অতএব আপেক্ষিক, খণ্ডিত, পরস্পসামঞ্জস্যহীন ও অসত্য মনে করে। ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়া যে মানুষের পক্ষে জীবনধারণ সম্ভব নয় এটা বোঝা সহজ। সেই সঙ্গে কিন্তু অন্য একটা কথাও আছে, যেটা বুঝতে একটু সময় লাগে। শুধু সাংসারিকতা দিয়ে সংসার রক্ষা পায় না। মানুষের ভিতর একটা অকারণ আনন্দ ও নিঃশব্দ ক্ষমার শক্তি আছে সেটা না থাকলে সাংসারিকতা থেকে উত্থিত ক্ষোভ ও হিংসার সঞ্চিত বিষে সংসার কিছুদিনের ভিতর ছারখার হয়ে যেত। সাংসারিক ও আধ্যাত্মিকতার ভিতর একটা নিত্য আরোহণ অবরোহণের ধারা চলেছে, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতোই যেটা মানুষকে ক্রমাগত প্রাণদান করে।
এরই সঙ্গে যুক্ত হয়ে চলে আসছে একটা তৃতীয় কথা। শুদ্ধ আধ্যাত্মিক সত্যকে সাংসারিক দৃষ্টিতে যতই ‘অবাস্তব মনে হোক না কেন, যুক্তি দিয়ে তাকে খণ্ডন করা যায় না। প্রত্যাশার ব্যর্থতা থেকেই কোনো ধারণাকে আমরা ভ্রান্ত বলে পরিত্যাগ করে থাকি। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য জগৎ সম্বন্ধে যেসব চিন্তাভাবনা তৈরি হয়ে ওঠে, সেই সবই জাগতিক সাফল্য বা ব্যর্থতা দিয়ে ভ্ৰমমুক্ত বা ভ্রমযুক্ত বলে প্রতিপন্ন হয়। আধ্যাত্মিকতায় ব্যর্থতা। নেই। ক্ষমা থেকেও যদি আমাদের কোনো প্রত্যাশা থাকে তবে সেই ক্ষমা শুদ্ধ নয়। প্রত্যাশাহীন ক্ষমায় অনিবার্যভাবে চিত্তশুদ্ধি ঘটে। বলা বাহুল্য, শুদ্ধ আধ্যাত্মিক দৃষ্টি একটা। লক্ষ্য বা আদর্শ মাত্র। যুক্তিও একটা লক্ষ্যই। তাকে যে আমরা জীবনে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারি না তাতে তার মূল্য কমে না।
যুক্তি দিয়ে যেসব বিশ্বাসকে প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যায় ধর্মের মৌল প্রত্যয় তার পরিধির ভিতর পড়ে না। কাজেই শুধু ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার পক্ষ থেকে যুক্তিকে ভয় করবার কোনো কারণ নেই! একথা ধর্মে কখনো স্বীকৃত হয়েছে, আবার কখনো হয়নি। স্বীকৃতির বিভিন্ন রকমের উদাহরণ পৃথিবীর নানা ধর্ম থেকে দেওয়া কঠিন নয়। দৃষ্টান্ত বাড়াতে গেলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে পড়বে, কাজেই একটি দৃষ্টান্তই এখানে দেওয়া যাচ্ছে। দৃষ্টান্তটি ব্রীষ্টধর্ম থেকে নেওয়া হয়েছে। “Summa Contra Gentiles’ নামে বিখ্যাত গ্রন্থে খ্রষ্টধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মগুরু সেন্ট টমাস একুইনাস বলেছেন–
Although the truth of the Christian faith surpasses the capacity of the reason, nevertheless that truth which the human reason is naturally endowed to know cannot be opposed to the truth of the Christian faith.
মূল কথা, আধ্যাত্মিক সত্য যুক্তিকে অতিক্রম করে যায়, কিন্তু যুক্তির সঙ্গে তার বিরোধ থাকতে পারে না। এই প্রতিজ্ঞার গূঢ় অর্থ খ্রীষ্টীয় সমাজে সব সময় অনুধাবন ও অনুসরণ করা হয়নি। কিন্তু সেটা ভিন্ন কথা। আসল কথা, যুক্তি দিয়ে যদি কিছু খণ্ডন করা যায় তবে সেটা আধ্যাত্মিক সত্যের অংশ হতে পারে না। উদাহরণত বলা যায় যে, চোরের কী শাস্তি হওয়া উচিত এ নিয়ে যুক্তিতর্কের অবকাশ অবশ্যই আছে, সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে বিচারের পরিবর্তন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু, পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়, এই রকমের বাক্য যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা যায় না। যে-প্রেমের কোনো “হেতু নেই সেই অহৈতুকী প্রীতি যুক্তির অতিরিক্ত, কিন্তু যুক্তিবিরোধী নয়।
তবু যে যুক্তি ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কলহ দেখা যায় তার একাধিক কারণ আছে। একটি কারণ খুবই সহজ। ধর্ম অথবা আধ্যাত্মিক সত্যের নামে এমন অনেক কথা উপস্থিত করা হয় যে-সব আসলে শুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার পরিধির ভিতর পড়ে না। এই রকমের। অনেক অনুশাসন শাস্ত্রের অনুমোদন নিয়ে আসে এবং তারপর যুক্তির উর্ধ্বে একটা প্রতিষ্ঠা দাবি করে বসে। যুক্তির দৃষ্টিতে এই দাবি অমান্য। এইসব ক্ষেত্রে গান্ধীর একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন।
My belief in the Hindu Scriptures does not require me to accept every word and every verse as divinely inspired…I decline to be bound by any interpretation, however learned it may be, if it is repugnant to reason or moral sense. অর্থাৎ, কোনো কিছু শাস্ত্রে লেখা আছে বলেই সেটা আধ্যাত্মিকতায় অনুপ্রাণিত এমন মনে করবার কারণ নেই। যদি কোনো অনুশাসন মানুষের যুক্তি নৈতিকবোধের বিরুদ্ধে যায় তবে সেই বিধান যতই পাণ্ডিত্যের সঙ্গে ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, তাকে মেনে নেওয়া উচিত নয়।
এ থেকেই অন্য একটা কথা এসে পড়ে। কোনো বচন শাস্ত্রে স্থান পেয়েছে এটাই যদি তাকে গ্রহণ করবার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি না হয়, তবে শাস্ত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার প্রয়োজন। সেই বিচার একই সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণ ও সতর্ক হবে। শ্রদ্ধাপূর্ণ এইজন্য যে, কিছু আধ্যাত্মিক সত্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের অভিজ্ঞতাকে স্পর্শ করে প্রধান প্রধান ধর্মে স্থান পেয়েছে। সতর্ক এইজন্য যে, সংসারের নানা স্বার্থ শাস্ত্রীয় অনুমোদন লাভের জন্য সুব্ধ। তাছাড়া কোনো মানুষই ভ্রান্তির সম্ভাবনার ঊর্ধ্বে নয়। কাজেই শাস্ত্রের বৃহৎ অবয়বের ভিতর। যেসব বচন ও অনুশাসন স্থান পেয়েছে তাদের ভিতরও ভালোমন্দের ভেদ থেকেই যায়।
বিশেষত এযুগে, আঠারো শতক থেকে শুরু করে, শাস্ত্রের এইরকম সশ্রদ্ধ ও সতর্ক পাঠের বহু উদাহরণ আছে। বাইবেল নিয়ে এইরকম কাজ হয়েছে। উপনিষৎ নিয়েও হয়েছে। ধর্ম ও যুক্তির ভিতর যাঁরা সেতু বাঁধতে চাইবেন তাঁরা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই এইরকম শাস্ত্ৰবিচারে আগ্রহী হবেন। যদি কোনো ধর্মে এই কাজ তেমনভাবে শুরু না হয়ে থাকে তবে ধরে নিতে হবে যে, সেই ধর্ম এখনো আধুনিক যুগে এসে পৌঁছায়নি।
কথাটা আরো একটু পরিষ্কার করে বলা যাক। ধর্মের সঙ্গে যুক্তিতর্ককে মেলাবার কথা আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রেও বলা আছে। কিন্তু তার সঙ্গে আধুনিক বিচারপদ্ধতির পার্থক্য উপেক্ষা করা যায় না। পনেরো বছর আগে, ১৯৭৩ সালে, ভাটপাড়ার পণ্ডিত শ্রীশ্রীজীব ন্যায়তীর্থ মহাশয়ের সঙ্গে কিছু ধর্মালোচনার সুযোগ হয়েছিল। তিনি তখন মনুসংহিতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করে শোনালেন
“আর্ষং ধর্মোপদেষঞ্চ বেদশাস্ত্রাবিরোধিনা।
যস্তর্কেণানুসন্ধত্তে স ধর্মং বেদ নেতরঃ ॥”
অর্থাৎ, বেদশাস্ত্রের অবিরোধী তর্কের দ্বারা যিনি ঋষিদের ধর্মোপদেশকে অনুসন্ধান করেন তিনিই ধর্ম জানেন, অন্যে জানে না। এখানে তর্ক অর্থাৎ যুক্তিপ্রয়োগের কথা বলা হয়েছে বটে, কিন্তু যুক্তির সাহায্যে শাস্ত্রকেই সমর্থন করতে হবে, শাস্ত্রের বিরোধিতা করা যাবে না। আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচার এরকম নয়। যুক্তি প্রয়োগের দ্বারা শাস্ত্রের প্রতিটি বাক্য খণ্ডন করতে হবে এমন সংকল্প ঠিক নয়, আবার প্রতিটি বাক্য সমর্থন করতে হবে এমনও নয়। ঐরকম কোনো পূর্বসংকল্প ত্যাগ করেই বিচার আরম্ভ করতে হরে। আগেই বলেছি, সেই বিচার হবে সশ্রদ্ধ অথচ সতর্ক।
রামমোহন লক্ষ করেছিলেন যে, বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীতে গৃহীত নানা ধর্মশাস্ত্রের ভিতর কিছু মিল আছে, আবার অমিলও আছে। যদি প্রতিটি মানবগোষ্ঠী এইরকম প্রতিজ্ঞা নিয়ে বিচার আরম্ভ করে যে, নিজ সমাজে গৃহীত শাস্ত্রের প্রতিটি বাক্য যুক্তিতর্ক দিয়ে সমর্থন করে যেতে হবে, তবে ধর্মালোচনায় বাদবিসম্বাদ বাড়বে, বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীকে পারস্পরিক প্রীতিতে আবদ্ধ করবার কাজ কঠিন হয়ে উঠবে। এইখানেই রামমোহনের যুক্তিশীলতার সঙ্গে আজকের দক্ষিণ এশিয়ার দিকে দিকে প্রসারিত অসহিষ্ণু মৌলবাদের গভীর দ্বন্দ্ব। প্রথমটা ছিল সমন্বয়সন্ধানী, দ্বিতীয়টা সাম্প্রদায়িক বিভেদবুদ্ধি দিয়ে চালিত। রামমোহন প্রধান প্রধান ধর্মের সেই সব তত্ত্ব ও উপদেশের ওপরই জোর দিতে চেয়েছিলেন যেখানে বিরোধের নয়, ঐক্যের দিকটাই প্রধান। অবশ্য সব ধর্মকে এক অভিন্ন তত্ত্বে এনে মেলাতে হবে, এমন পূর্বসংকল্পও অসঙ্গত। তবে যুক্তিবিচারের ফলে বিভিন্ন ধর্ম ক্রমশ একটা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মানবিক ঐক্যের দিকে অগ্রসর হবে, এরকমই আশা করেছেন ধর্মের উদার ব্যাখ্যাতারা।
তুলনামূলক ধর্মবিচারও যথেষ্ট নয়। সেই সঙ্গে প্রয়োজন নিজস্ব আধ্যাত্মিক অনুভূতি, যাকে বলা হয়েছে স্বানুভূতি বা স্বোপলদ্ধি। এর অভাবে বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক পাঠ হয়ে ওঠে নিতান্ত যান্ত্রিক। ধর্মবিচারে এই সবই আবশ্যক যুক্তি, স্বোপলদ্ধি, বিভিন্ন শাস্ত্রের তুলনামূলক আলোচনা। অনেকে অবশ্য বলেছেন, যুক্তি অথবা পেলদ্ধির ওপর নির্ভরতায় ধর্মের বিচারে অরাজকতা এসে যায়। সে সম্ভাবনা নিশ্চয়ই আছে। তবে অন্ধ অসহিষ্ণু আচারসর্বস্বতাকে অতিক্রম করবার এটাই পথ। এতে যদি গোষ্ঠীগত সংহতি কিছুটা শিথিল হয়, যদি ব্যক্তির কণ্ঠস্বর ধর্মবিচারে আরো একটু পরিষ্কারভাবে শোনা যায়, তবে তাই ভালো।
খ
যুক্তি সম্বন্ধে কিছু ধর্মবিশ্বাসীর মনে যেমন একটা সন্দিগ্ধতা আছে, ধর্ম সম্বন্ধেও তেমনি যুক্তিবাদীদের মধ্যে একটা সংশয়গ্রস্ততা আছে। এই নেতিবাচক মনোভাবের প্রধান কারণ অবশ্য ধর্মপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির প্রবেশ, যে-সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত আগেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটাই একমাত্র কথা নয়। অন্য কয়েকটি সংশয়কেও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
আধ্যাত্মিক অনুভূতির একটা মৌল উপাদান হল বিশ্বের সঙ্গে একাত্মবোধ। এই অনুভূতির ফলে পৃথিবীকে বদলাবার ইচ্ছা দুর্বল হয়ে যায়। অথচ পৃথিবীকে বদলানো দরকার। কিছু যুক্তিবাদীর এই এক আপত্তি।
বিশ্বের সঙ্গে একাত্মবোধকে কোনো এক স্তরে এদেশের ভাষায় বলা যেতে পারে, মোক্ষানুভূতি। মোক্ষ ও ধর্মের ভিতর পার্থক্য আছে। মোক্ষানুভূতি নিয়ে সাধক যদি জগৎ থেকে দূরে সরে যান, তবে ধর্মাচরণ সম্পূর্ণ হয় না। ব্যক্তি যখন বিশ্বের সঙ্গে একাত্মবোধ নিয়ে বিশ্বের কর্মে নিযুক্ত হন, তখনই ধর্ম সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। এইসব স্বীকার করে নেবার পরেও কিন্তু যুক্তিবাদীর সমালোচনায় চিন্তার যোগ্য বস্তু থেকে যায়।
ভারতীয় ঐতিহ্যে মোক্ষলাভের লক্ষ্যটাই বড় হয়ে উঠেছে আর ধর্মকর্মের ব্যাপারটা যান্ত্রিক ও আচারসর্বস্ব হয়ে গেছে। উনিশ শতকে এদেশের সঙ্গে পাশ্চাত্য ধর্মচিন্তার ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে এ কথাটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। ধর্ম নিয়ে সেই সময়ে যাঁরা সবচেয়ে গভীরভাবে ভেবেছিলেন তাঁদের চিন্তায় কথাটা ধরা পড়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বিবেকানন্দ ও রামমোহনের উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে তপন রায়চৌধুরীর একটি ইংরেজী বই প্রকাশিত হয়েছে যার বিষয়বস্তু, উনিশ শতকের বাংলার চোখে ইউরোপ (Europe Reconsidered; Perceptions of the West in Nineteenth Century Bengal)। তিনি যথার্থই বলেছেন যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভিতর একটা প্রভেদ বিবেকানন্দ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ধরতে পেরেছিলেন। সেই প্রভদটা হল এই যে, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রধান আগ্রহ মোক্ষে, পাশ্চাত্যের আগ্রহ ধর্মে। (“The West was dominated by its pursuit of dharma, while the central concern of Indian culture is Innoksha.’’) বিবেকানন্দের এই অদৃষ্টি তুলনামূলক ধর্মপর্যায়ের একটি মূল্যবান ফল। রামমোহন আরো বহুদিন আগে অনুরূপ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, আত্মজ্ঞান সম্বন্ধে ভারতের প্রাচীন ধর্মে অতি প্রাজ্ঞ উক্তি আছে, কিন্তু হিতকর্ম বলতে এদেশে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানই প্রাধান্য পায়। সেই তুলনায় খ্রীষ্টান সংস্কৃতিতে হিতকর্মের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক আরো বাস্তব ও মানবিক। এইরকম নিরপেক্ষ হিতাকাঙ্ক্ষী। সমালোচনায় অনেকে অসন্তুষ্ট হন, অল্প লোকই একে গুরুত্ব দেন। অথচ দেশীয় অহংকার থেকে যদি আমরা স্বদেশের ধর্মাচারের দুর্বলতা সম্বন্ধে অন্ধ থাকাই কর্তব্য বিবেচনা করি তবে তাতে দেশেরই ক্ষতি। একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, একদিকে মোক্ষের চিন্তা আর অন্যদিকে জাতিভেদ ও সামাজিক অসাম্য বিষয়ে বিবেকহীন ঔদাসীন্য, এই দুয়ের অসামঞ্জস্য এদেশের সমাজের এক লজ্জাজনক বৈশিষ্ট্য।
তবে মনে রাখতে হবে যে, ধর্মের গ্লানির বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ ধর্মের ভিতর থেকেই উচ্চারিত হয়েছে। রামমোহন বিবেকানন্দ ও গান্ধী সকলেই নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী সমাজ পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন! ধর্মবিশ্বাস তাঁদের কর্মোদ্যমকে দুর্বল করেনি। বরং ধর্ম থেকে তাঁরা একটা বিশেষ শক্তি লাভ করেছিলেন। অন্তত এই রকমই তাঁরা বোধ করেছিলেন। অর্থাৎ, এরা একই সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসী আবার এদেশের ধর্মীয় ঐতিহ্যে যে-দুর্বলতা আছে সে সম্বন্ধে সচেতন। গান্ধীর জীবনের প্রথম দিকের রক্ষণশীলতা পরে ক্রমেই কেটে গেছে। যদিও এঁদের সাফল্য সীমাবদ্ধ তবু অন্য কেউ যে মোটের উপর আরো বেশি সফল হয়েছিলেন এমন বলা কঠিন।
সমাজকে ত্যাগ করে ধর্মকর্ম সম্পূর্ণ হয় না, একথা মেনে নেবার পর ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কের প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবে এসে যায়। গান্ধীজী আস্তিকে বিশ্বাসী ছিলেন; মানবেন্দ্রনাথ নাস্তিকে। দুজনেই রাজনীতির সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ ও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। শেষ জীবনে দুজনেই দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাবার পক্ষপাতী হন। রাজনীতির সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক রক্ষা করা আবশ্যক, এই বিশ্বাস মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মনে দৃঢ় হয়ে উঠেছিল ক্রমে ক্রমে। গান্ধীর এই রকম বিশ্বাস ছিল প্রথম থেকেই। যিনি ধর্মবিশ্বাসী তাঁকে রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এইখানেই একটা প্রশ্ন এসে যায়। গান্ধী ধর্ম ও নৈতিকতার ভিতর বিরোধ দেখেননি, বরং দেখেছেন সদর্থক একটা যোগ। কাজেই রাজনীতির ক্ষেত্রে বিচরণ করবার সময় ধর্মকে ত্যাগ করে চলতে হবে এমন প্রতিজ্ঞা তাঁর কাছে অগ্রাহ্য। ত কি ধর্ম ও রাজনীতির ভিতর কোনো সীমারেখা রক্ষা করবার প্রয়োজন নেই?
এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু কথা বলা যায়, গান্ধীবাদী দৃষ্টিতেও যেসব কথা গ্রহণযোগ্য মনে হবে। যাঁরা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে চান তাঁদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে দূরে থাকাই ভালো। ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ির মধ্যে কোনো গভীর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গীকে বিশ্বস্তভাবে রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব মোহাম্মদের যুগে যদি বা অন্যরকম ছিল তারপর অবস্থা বদলে গেছে। ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করবার পক্ষে আসলে দুই প্রান্ত থেকে দু’রকম যুক্তি আছে, দুটিই সঙ্গত যুক্তি। অধঃপতিত ধর্ম একরকমের অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, যা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত রাখা সর্বদা বাঞ্ছনীয়। আবার উন্নত আধ্যাত্মিকতা কিছু মানুষকে সাধারণের চোখে এমন একটা শ্রদ্ধার আসন দেয়, দলীয় রাজনীতির সংস্পর্শ থেকে যাকে রক্ষা করাই সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক। এই শ্রদ্ধার স্থান লাভ করবার জন্য কাউকে ঈশ্বরবিশ্বাসী হতেই হবে, এমন কথা বলা যায় না! রাসেল নিরীশ্বরবাদী ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উচ্চপদে যাঁরা অধিষ্ঠিত তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সতর্ক বাণী উচ্চারণের ও প্রতিবাদ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার নৈতিক অধিকার তিনি লাভ করেছিলেন। অনুমান করা যায় যে, দলীয় রাজনীতিতে আবদ্ধ হয়ে পড়লে এই বিশেষ মর্যাদা তিনি অর্জন করতে পারতেন না। এদেশে বিদেশে কোনো কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেব নেতার ক্ষমতাসীন রাজনীতিক দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করতে এত স্পষ্টত আগ্রহী যে, তাঁদের বাণীর নিরপেক্ষতায় জনসাধারণের আস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ধর্ম যদি সমাজে তার। নৈতিক স্থানটি অক্ষুণ্ণ রাখতে চায় তবে রাজনীতিক ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সতর্কভাবে অনেকটা দূরত্ব রক্ষা করাই শ্রেয়।
ধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদীদের আরেক অভিযোগ এই যে, ধর্ম মানুষকে অদৃষ্টবাদী করে তোলে। ভগবান যদি সর্বশক্তিমান হন, সবই যদি তাঁর ইচ্ছায় ঘটে, তবে মানুষের উদ্যোগ কি নিরর্থক হয়ে ওঠে না? এদেশের দরিদ্র ও নিরক্ষর মানুষ প্রাকৃতিক ও সামাজিক এত বিপর্যয় ও অনিশ্চয়তার ভিতর সদাসর্বদা বাস করতে বাধ্য হয় যে, তাদের পক্ষে অদৃষ্টবাদী হওয়া বিস্ময়কর নয়। তবে ধর্মের সঙ্গে অদৃষ্টবাদের সম্পর্কের ভিতর একটা প্যারাডক্স’ বা কূটাভাস আছে। একটা তুলনা টেনে সেটা দেখানো যায়। বিজ্ঞান বলে যে, বিশ্বের প্রতিটি ঘটনারই একটা কারণ আছে, ঘটনাপ্রবাহ কার্যকারণে আবদ্ধ। এই থেকে মনে করা যেতে পারত যে, সমস্ত ভবিষ্যই তবে অতীত দিয়ে নির্ধারিত, যা ঘটবার তা ঘটবেই। যা অবধারিত তাকে স্বীকার করে নেওয়াতেই মুক্তি, এইরকম কথা বিজ্ঞানমনস্কতার সীমার ভিতরই বহুকাল থেকে শোনা গেছে। অথচ বিজ্ঞান ও নিয়তিবাদের ভিতর নিশ্চয়ই কোনো অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ নেই। বরং বিজ্ঞানকে বিশেষত আধুনিক যুগে মানুষের নিজস্ব উদ্যোগের সহায়ক হিসেবেই দেখানো হয়। বিজ্ঞানের কাছ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে মানুষ আরো উদ্যোগী হয়ে ওঠে। ধর্মের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঐ রকমই হওয়া সম্ভব। ধর্ম মানুষকে অনিবার্যভাবে অদৃষ্টবাদী করে না। বরং আধ্যাত্মিকতা থেকে এক ধরনের নির্ভরতা ও প্রেরণা লাভ করা সম্ভব যাতে মানুষের উদ্যোগ বাড়ে। ইউরোপে মধ্যযুগের শেষে আর্থিক উন্নয়নের নতুন যুগে প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্ম মানুষকে উদ্যোগী হতে সাহায্য করেছে। আসলে ধর্ম মানুষকে কর্মে উৎসাহী করবে কিনা, সেটা অনেকখানি নির্ভর করে বৃহত্তর সামাজিক পরিস্থিতির ওপর।
প্রত্যাশা অথবা ফলাকাঙ্ক্ষা ছাড়া কর্মে উৎসাহ থাকে না, ধর্মের সমালোচনায় এইরকম একটা কথাও শোনা গেছে। প্রথম দৃষ্টিতে এই আপত্তিকে যতটা সারবান মনে হয় ততটা সে আসলে নয়। কর্ম সম্পাদনের জন্য কিছু উপকরণের প্রয়োজন হয়, সেইসব পাওয়া না। গেলে বাধা পড়ে, এই পর্যন্ত স্বীকার করা যায়। কিন্তু ফলের আকাঙ্ক্ষা বেশি হলে কাজ ভালো হয়, একথা মেনে নেওয়া যায় না। যেসব শিক্ষক অথবা কর্মী বেশি আকাঙ্ক্ষা করেন তাঁরাই বেশি ভালো শিক্ষক ও কর্মী হন, অভিজ্ঞতা এমন কথা বলে না। ভালো শিক্ষক পড়াতে ভালোবাসেন, সেটাই তাঁর প্রধান পুরস্কার, অর্থ ও খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কলহ ও ব্যর্থতাবোধ বাড়ে। কর্মকে কর্ম বলেই ভালোবাসতে না পারলে সেটাকে শেষ পর্যন্ত শাস্তি বলে মনে হয়। ফলাকাঙ্ক্ষার চাঞ্চল্যে নয়, একাগ্র আত্মনিযুক্তিতে কর্মের উৎকর্ষ বাড়ে।
সংগ্রাম ও শান্তির বৈপরীত্যে আশ্রিত একটি কূটাভাসের উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। অধর্ম অথবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে কোরাণে ও ভগবদ্গীতায় কর্তব্য বলে। মান্য করা হয়েছে। অথচ সময়ে আবদ্ধ কোনো যুদ্ধই মানুষের চরম লক্ষ্য হতে পারে না। ধর্মকে তাই রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়েও অনাসক্তির কথা বলে যেতে হয়। অনাসক্ত সংগ্রামের তত্ত্বে কোনো আত্মখণ্ডন নেই, বরং সমস্যার গভীরতার ইঙ্গিতই আছে। যুদ্ধের চাঞ্চল্য যদি মানুষের আত্মাকে গ্রাস করে নেয় তবে শেষ বিচারে সেটাই মনুষ্যত্বের পরাভব।
ইউরোপে মধ্যযুগীয় বদ্ধসমাজের সঙ্গে রেনেসাঁসের মুক্তসংস্কৃতির বৈসাদৃশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ কেউ ধর্মের সমালোচনা করেছেন। ধর্ম মানুষকে শেখায় ঈশ্বর অথবা মোক্ষের ভিতর আত্মবিলোপের সাধনা, মূল্য দেয় না ব্যক্তির আত্মস্বাতন্ত্র্যকে, এইরকম কারো কারো মনে হয়েছে।
পনেরো শতকে ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে পশ্চিম ইউরোপের চেতনায় পৃথিবীর দিগন্তটা হঠাৎ অনেকখানি প্রসারিত হয়ে গিয়েছিল। বাণিজ্যের দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নাগরিক সভ্যতা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞান প্রবলভাবে ধাকা দিচ্ছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে ধর্মের দ্বারা সুরক্ষিত পুরনো ধারণার বদ্ধ কপাটে। প্রাচীন গ্রীকদর্শন ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছিল ইসলাম। আর এইসব মিলে ইউরোপের চিন্তায় ও কল্পনায় এসে পৌঁছেছিল এক ঐতিহাসিক সৃজনধর্মিতা। এইসবই এখন পরিচিত তথ্য। তবে মনে রাখা ভালো যে, রেনেসাঁসের ঐ যুগটা নাস্তিকের যুগ ছিল না। চিন্তার জগতে জড়বাদী দর্শনের প্রভাব বিস্তার হতে তখনো অনেক দেরি। ধর্মীয় চিন্তায় পরিবর্তন আসছিল ঠিকই, কিন্তু রেনেসাঁসের যুগের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিতে পাই নতুন জীবনবোধ আর ধর্মীয় প্রেরণার এক উজ্জ্বল সমন্বয়। সে যুগের শ্রেষ্ঠ চিত্রকলার দিকে তাকালেই এ বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না। ধর্মের সঙ্গে জীবনবোধের বিরোধটা রেনেসাঁস অনেকখানি ভেঙ্গে দিয়েছিল এইখানে তার মূল কৃতিত্ব।
পরবর্তী যুগে ব্যক্তিকে আত্মসমর্পণ আর আত্মবিলোপের পথে টেনে নিয়ে গেছে ধর্ম ততটা নয়, যতটা আগ্রাসী এক রাষ্ট্রসর্বস্বতা। বিশ শতকে পৌঁছে তার চরম প্রমাণ পাওয়া। গেল ব্যক্তিত্বগ্রাসী সংস্কৃতিগ্রাসী হিটলারী নাত্সীতন্ত্রে আর স্তালিনী বলশেভিক সমাজতন্ত্রে। এই সমাজতন্ত্র কিন্তু ইহসর্বস্ব।
অন্য একভাবে ব্যক্তির আত্মপ্রকাশকে এযুগে খর্ব করে চলেছে বৃহত্বাজার সভ্যতা। এ এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। উল্লেখযোগ্য বিশেষত এই কারণে যে, বাণিজ্যের বিস্তারই এক। সময়ে ব্যক্তির বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল শিল্প সংগঠনের অন্য এক যুগ। বৃহৎ শিল্পসংগঠন আর প্রকাণ্ড বাজার মিলে অবস্থাটা পাল্টে দিয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে বলা হয় যে, বাজার চলে ক্রেতার অভিরুচি অনুযায়। কিন্তু বাস্তবে ক্রেতার অভিরুচিটাই অনেকখানি গঠিত হয়ে যাচ্ছে এমন এক ছাঁচে যেটা তৈরি হচ্ছে অতিকায়। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সুবিধা অনুসারে। এ যুগে ব্যক্তিত্বনাশী শক্তি বলতে রাষ্ট্র আর বাজারই প্রধান। এজন্য ধর্মকে এককভাবে দায়ী করা অযৌক্তিক।
ধর্ম মানুষকে কতটা এক ছাঁচে তৈরি করবে সেটা স্বভাবতই নির্ভর করে সেই ধর্ম ও সমাজের প্রকৃতির ওপর। ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলে তো স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব বলে আর। কিছু রইল না, এই বলে যে তর্ক শুরু হয় তাতে মূল প্রশ্নটা ঠিক ভাবে হাজির করা হয় না। মোক্ষ নয়, মোক্ষে পৌঁছবার পথ নিয়ে চিন্তা শুরু করা দরকার। সেই পথ এক নয়, অনেক। আর নানা মানুষ নানাভাবে অগ্রসর হন। সেই ভাবে তাঁদের ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়। গান্ধী আর রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বে কত পার্থক্য! আসলে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রুচি নিয়ে, বিভিন্ন পরিস্থিতি থেকে, যাত্রা শুরু করে। তাদের জীবনের অভিজ্ঞতায় থাকে বহু বৈচিত্র্য। সেই সব অভিজ্ঞতার ভিতর থেকেই মুক্তির পথের সন্ধান করতে হয়। আধ্যাত্মিকতা ব্যক্তিত্বনাশী, এইভাবে কথা তুলে লাভ নেই। নিজস্ব উপলব্ধির মূল্যের কথাটাই বেশি জরুরী। আধ্যাত্মিক ধোপলব্ধি কখনো যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি হতে পারে না। সেই উপলব্ধিতে ব্যক্তি বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেকে নতুন করে পায়। এটাকে। ব্যক্তিত্বের বিলোপ বললে ভুল হয়।
এই সঙ্গে একটা সাবধানী বাক্য যোগ করা ভালো। অনন্য অভিজ্ঞতার নেশাও মানুষকে ধ্বংসের পথে টানতে পারে। সেই বিধ্বংসী আকর্ষণ এতই দুর্নিবার হয়, তার। পিছনে মিথ্যা যুক্তি এমন প্রবল হয়ে ওঠে যে, তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। কোনো সহজ পথে এর সমাধান আছে এমন জানি না। কিসে ব্যক্তিকে ক্রমে বল করে তোলে, ব্যক্তিত্বকে বিকাশের পথে নিয়ে যায়, আর কোন আকর্ষণ তাকে দুর্বল ও আবদ্ধ করে ফেলে, সেইদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা ছাড়া উপায় নেই।
আরো মৌল একটা সংশয়ের কথা এরপর দূরে ঠেলে রাখা যায় না। কেউ নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলতে পারেন, বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতাকেই লক্ষ্য বলে মেনে নিতে হবে কেন? বিশ্বকে বিরোধী শক্তি বলে ধরে নেওয়াই তো বেশি বাস্তবসম্মত। ঈশ্বরহীন বিশ্বে ব্যক্তিকে তার পথ খুঁজে নিতে হবে। ধর্মবিশ্বাসী কি মানুষকে সেই বিদ্বেষী চিন্তার স্বাধীনতা দিতে রাজী আছেন? এর উত্তরে বলতে হয়, সেই স্বাধীনতা ব্যক্তির থাকাই উচিত। কোনো ব্যক্তিকে তো জোর করে বিশ্বপ্রেমে ঠেলে তোলা যায় না। তাঁকে তো নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আসলে প্রেম ও বিদ্বেষ, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, দুয়েরই সমস্ত বিশ্বকে গ্রাস করে নেবার শক্তি আছে। ধর্মবিশ্বাসী শুধু এটাই চাইতে পারেন যে, অবিশ্বাসীর পাশে পাশে বিশ্বাসীকেও তাঁর নিজ মত ও নিজ পথ। অনুসারে স্বেচ্ছায় চলতে দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্বেষী যদি বৈরভাবে বিশ্বের পুজো করতে চান তো ধর্মবিশ্বাসীর তাতে বাধা দেবার অধিকার নেই।
স্বীকার করে নেওয়াই ভালো যে, বিশ্ববিদ্বেষ নিতান্ত অস্বাভাবিক নয়। সত্যমেব। জয়তে, এই তাত্ত্বিক বাণী কি আমাদের পরিচিত জীবনে প্রতি মুহূর্তেই খণ্ডিত হয়ে চলছে না? এ জগতে কোনো প্রত্যাশারই কি মূল্য আছে? আমদের ভিতর যাঁরা শ্রেষ্ঠ, যাঁরা স্বাভাবিক প্রতিভা এবং অবিচল অনুশীলনের দ্বারা প্রায় পূর্ণমনুষ্যত্বের দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়েছেন, তাঁরাও জীবনে যে-পরিমাণ দুঃখ ও লাঞ্ছনা ভোগ করেছেন তাতে জগতের বিধান সম্বন্ধে। নিরাশ বোধ না করাই কঠিন। যাঁরা মানবহিতৈষী তাঁদেরও শত্রুর অভাব নেই, যাঁরা দয়াবান তাঁদের প্রতিও মানুষ নির্দয়। যে-বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে মাইকেল মধুসূদন একদা বলেছিলেন, সর্বকালের এই মহত্তম বাঙ্গালী (“the greatest Bengali that ever lived”), তিনিও দীর্ঘ পরোপকারী জীবনের ক্লান্ত সন্ধ্যায় পিতাকে গভীর দুঃখের সঙ্গে লিখেছিলেন, “সংসারী লোকে যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষা করে, তাঁহাদের একজনেরও অন্তঃকরণে যে আমার উপর দয়া ও স্নেহের লেশমাত্র নাই সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই। এরূপ অবস্থায় সাংসারিক বিষয়ে লিপ্ত থাকিয়া ক্লেশ ভোগ করা নিরবচ্ছিন্ন মূর্খতার কর্ম। “ (২৫ অগ্রহায়ণ ১২৭৬ সাল)। যে রবীন্দ্রনাথ একদিন পরম সারল্যে বলেছিলেন, “ এই বসুধার মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত নানাবর্ণগন্ধময়”, তাঁরই জীবনের শেষপ্রান্তে এক অসাধারণ আবেগকম্পিত গানে ‘মানবপুত্রের মুখ থেকে যখন শুনি, “এ পানপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা”, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কবির দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরমপিতার প্রতি উচ্চারিত খ্রীষ্টের ঐ নিদারুণ উক্তির কোথাও মিল ছিল। আর সেই সঙ্গে মনে পড়ে যায় গ্যয়তের লেখায় তরুণ হের্থেরের মর্মন্তুদ সেই প্রশ্ন “And if the God from heaven found the cup too bitter for his human lips, why should I exalt myself and act as if it tasted sweet to me?” স্বর্গ থেকে আগত ঈশ্বরপুত্রের ওষ্ঠেও যদি জীবনের স্বাদ এমন অসহ্য তিক্ত ঠেকেছিল, তবে আমি কোন উল্লাসে কী করে বলব যে জীবন মধুর?
অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্বেষের সপক্ষে কারণের অভাব নেই। বিপক্ষে তবু ভাববার মতো একটি কথা আছে। বিশ্বের বিরুদ্ধে বিদ্বেষে মানুষ নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়, নির্বিকার বিশ্ব তার নিধারিত পথ ধরে চলে। জীবনের প্রতি বিদ্বেষের শতসহস্র যতই কারণ থাকুক না কেন, তাতে বিদ্বিষ্ট বিশ্বের কোনো শাস্তি অথবা সংশোধন হয় না, যন্ত্রণা ভোগ করে বিদ্বেষী মানুষ। একথা জেনে আমরা আবার এই অনাদি অনন্ত জগৎধারার দিকে তাকাই। আমরা জানি, এর বিরুদ্ধে অভিমান করা অর্থহীন। চোখে পড়ে মানুষের রক্তাক্ত হৃদয়, আমাদের মন তখন করুণায় ভরে ওঠে। সেই করুণার দৃষ্টিতে যখন মানুষের এই চলমান মহাসংসারকে দেখি তখন তাকেও মনে হয় এক মহাকাব্য–মহাভারতের মতো। সেই কাব্যে হিংসা লোভ মিথ্যা কিছুরই অভাব নেই, তবু সে মহাকাব্য।
প্রত্যাশা থেকে বিদ্বেষ আসে, প্রত্যাশাহীন দৃষ্টি মনকে মুক্ত করে। ঈশ্বরচন্দ্র ঠিকই বলেছিলেন, “সাংসারিক বিষয়ে লিপ্ত থাকিয়া ক্লেশ ভোগ করা নিরবচ্ছিন্ন মৃতার কর্ম।” নির্লিপ্ত দৃষ্টি ছাড়া সেই ক্লেশের হ্রাস হয় না। যেহেতু সংসার ত্যাগ করা মানুষের সাধারণ ধর্ম হতে পারে না, কাজেই সংসারের ভিতরই যথাসম্ভব মুক্তির পথ খোঁজা ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে অন্য পথ নেই। সংসারে বাস করে বিশ্বের প্রতি বিদ্বেষমুক্ত দৃষ্টিতে তাকানো কত কঠিন, আমরা সবাই সে কথা জানি। বারবার আমরা আকণ্ঠ তিক্ততায় ডুবি, বারবার মুক্তি খুঁজি। আমরা যে প্রত্যেকেই মুক্ত হতে পারব, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই তবু পথের সন্ধান ত্যাগ করা যায় না।
ভগবানের কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন ছিল “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলল, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?” ঈশ্বর থাকুন বা না। থাকুন, জীবনই অবশেষে সকলের বিচার করে। তবে সব বিচারের শেষে, ক্ষমা ছাড়া। উপায় কী? যাকে আমরা ক্ষমা করি না, ক্ষমাহীনতার বজ্ৰবন্ধনে সে-ই আমাদের আবদ্ধ করে। ক্ষমা ছাড়া মুক্তি নেই।
সাংসারিক যুক্তির অভ্যস্ত ভাষা এটা নয়। কিন্তু বিচার ও ক্ষমার য-দ্বন্দ্ব ধর্মের ভিতর একটা বিশ্বস্ত ভাষা খুঁজে পেয়েছে, সেটা যুক্তির কাছেও অবোধ্য নয়। তার ভিরও একটা সীমাভাঙ্গার শক্তি আছে, তাকে সাংসারিকতায় আবদ্ধ থাকতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ গ্রীক দার্শনিক নিষ্কাম যুক্তির কথা বলেছিলেন। ধর্ম ও যুক্তি এইভাবে কাছাকাছি চলে আসে। এই যোগটাই মঙ্গলজনক। তবে একেও কোনো চিরকালীন সমম্বয়ের মধ্যে বাঁধতে চেষ্টা করা ভুল। চিরকালীন সমন্বয় হয়ে ওঠে ভঙ্গীসর্বস্ব। সংসার ও মুক্তির ভিতর যে অন্তহীন আরোহণ-অবরোহণ জীবনের প্রাণবস্তু, তারই মধ্যে ধর্ম ও যুক্তিকে স্থান করে নিতে হবে।
যুক্তি ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আলোচনা স্বভাবতই বহুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অতিশয় সরল করে ফেলবার ঝুঁকি নিয়েও অবশেষে মোটকথাটা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে বলা যাক। মানুষের স্বভাবে আছে একটা গভীর দ্বৈত, একই সঙ্গে সে মহত্ত্বে ও নীচতায় চিহ্নিত। সেই দ্বন্দ্ব যেমন প্রতিফলিত হয়েছে ধর্মে তেমনি বিজ্ঞানে। দুয়েরই একটা আদর্শরূপ আছে। আবার দুয়েরই বিকৃতি হয়ে ওঠে কঠিন দুশ্চিন্তার কারণ। বিজ্ঞানের যেটা আদর্শরূপ তার মূলে পাই শুদ্ধ জিজ্ঞাসা, আধ্যাত্মিকতার মূলে শুদ্ধ প্রেম। বাস্তবে বিজ্ঞান তবু যুক্ত হয় নানা সাংসারিক প্রয়োজনের সঙ্গে, যার ফলে একদিকে সে হয়েছে। ঐহিক উন্নতির সহায়, অন্যদিকে খুলে গেছে বিচিত্র অপব্যবহারের পথ। এযুগে বিজ্ঞানের সবচেয়ে উল্লেখ্য অপপ্রয়োগ ঘটেছে যুদ্ধের আয়োজনে আর ভোগবাদের আতিশয্যের উপায় উদভাবনে। ধর্মকেও নেমে আসতে হয় সংসারে। তার যোগ ঘটে ভয় লোভ হিংসার সঙ্গে। কদর্য সেই বিকৃতি।
বিজ্ঞানের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শোনা গেছে সমাজহিতৈষী নানা মানুষের পক্ষ থেকে। ধর্ম ও অহিংসার দৃষ্টি থেকে যে প্রতিবাদ, তার একটা বিশেষ মূল্য আছে। ধর্মের বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আরো সুপ্রাচীন। তার অনেকখানি এসেছে ভক্তি আন্দোলনের ভিতর থেকে। কিন্তু যুক্তির ভিত্তিতে ধর্মীয় অধঃপতনের যে বিচারনির্ভর সমালোচনা, তার একটা বিশেষ মূল্য আছে। এমনি করে ধর্ম ও যুক্তি হয়ে ওঠে পরস্পরের সংশোধক ও পরিপূরক। যেখানে বিকৃতি, সেখানে এদের দ্বন্দ্ব। তার উর্ধ্বে, মৈত্রীপূর্ণ সহাবস্থান এই দ্বন্দ্ব এবং মৈত্রী, দুয়েরই মূল্য স্বীকার্য।
মানুষের কিছু মৌল দুঃখ আছে যেসব কোনো কৌশলেই দূর করা যাবে না। এরই ভিতর শুদ্ধ প্রেম ও জিজ্ঞাসা আমাদের মুক্তির স্বাদ এনে দেয়। যদিও এই সমবায় দুঃসাধ্য, তবু সেই লক্ষ্যের বিকল্প নেই। লক্ষ্য না বলে পথ বলাই ভালো। সেটাই ধর্মেরও ভাষা। সেই পথ গিয়ে পৌঁছেছে অকূল মোহানায়, তখন পথের অভ্যস্ত নিয়মগুলিও বাধা হয়ে ওঠে। যে সব আচারে আমরা পরিহিত, সবই সেখানে পরিত্যাগ করতে হয়।
এইখানে এসে ভাষাও আমাদের প্রতারণা করে। কিছু বোঝাতে চাইলেই উপমা আবশ্যক, অথচ কোনো উপমাই লক্ষ্যভেদী নয়, দ্ব্যর্থহীন নয়। বলবার যোগ্য কত কথাই তো বলে ওঠা যায় না। রচনার স্বচ্ছতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন যে-রাসেল, আর। ধর্মের ভাষাকে যিনি স্বভাবতই সন্দেহের চোখে দেখতেন, তাঁরও মুখ থেকে শুনি এই। কথা! তাঁর আত্মজীবনীর পাতায় পাই স্মরণযোগ্য এই বাক্যটি
“The things one says are all unsuccessfulattemptsto say something else–something that perhaps by its very nature cannot be said.” যা বলা হয় সে সবই অন্য কোন কথা বলবার অসফল চেষ্টা–যে কথা সম্ভবত কিছুতেই বলা যায় না। জীবনের পরম লগ্নে এইরকমই বারবার ঘটে। যুক্তি আমাদের অসম্ভবের এই স্বীকৃতির দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। এর পর অধিক তর্ক নিষ্ফল। বিতর্ক মূল্যবান, তবু থামতে জানাও চাই। ধর্ম ও যুক্তি (হীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারক বক্তৃতামালা ১৯৮৯)