৭.২ ধর্ম
সনাতন ধর্মের প্রচলিত ব্যাখ্যায় এমন একটা সংশয়হীনতা আছে, যা আমার কাছে অতিপরিচিত প্রবাদের মতন জীর্ণ মনে হয়। অতএব ধর্মচিন্তার বিপরীত মেরু থেকে আলোচনা শুরু করা যাক।
বর্তমান যুগের সর্বপ্রধান ঘটনা ‘শিল্প বিপ্লব’, অর্থাৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে সমাজের বৈষয়িক ভিত্তির দ্রুত পরিবর্তন ও পুনর্গঠন। এ যুগের আরম্ভে ভারত বিদেশীর কাছে পরাজিত হয়েছে। এদেশের প্রাচীনপন্থীরা এজন্য অধর্মের অভ্যুত্থানকে দোষী করেন আবার বিদেশীরা এতে তাঁদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রমাণ পান। ধর্মের প্রভাব যদিও অস্বীকার করা ভুল, যদিও স্বীকার করা ভাল যে আধুনিক যুগের গোড়াতেই ইউরোপ ধর্মের সংস্কারে বিপুল উদ্যম নিয়ে এগিয়ে গেছে আর আমরা নব জাগরণের প্রচেষ্টায় বহু পরিমাণে বিফল হয়েছি, তবু ঐ সব তর্কের এপারে প্রত্যক্ষ সত্য এই যে, শিল্প ও বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্বের শক্তিতেই ইয়োরোপ একালে বিশ্বকে পদানত করেছে। ব্যক্তিবিশেষের হয়তো ‘দৈবশক্তি থাকে; কিন্তু সেই দৈবশক্তির সাহায্যে আজকের পৃথিবীতে কোনো দেশ দাঁড়াতে পারে না। সেজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানের শক্তি।
আমাদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস বহুভাবে বিজ্ঞানচিন্তার পরিপন্থী। অবশ্য বিজ্ঞানের সঙ্গে ‘বিশুদ্ধ ধর্মচিন্তার বিরোধ নেই, একথা বলা হয়। বিষয়টি আলোচনাসাপেক্ষ। তবু যে কথাটা দীর্ঘ আলোচনার অপেক্ষা রাখে না সেটা হলো এই যে, যাঁরা বিশুদ্ধ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করেন, তাঁরাও প্রায়শই বিচারহীন আচারের দাসত্ব মেনে নেন। প্রেমের দৃষ্টিতে সকল মানুষের মৌলিক ঐক্যের তত্ত্ব বাক্যে প্রকাশের পরও খুব কম হিন্দুই চণ্ডাল অথবা মুসলমানের সঙ্গে কায়ে ও মনে দূরত্ব রক্ষা করেন না।
আরও একটি প্রয়োজনীয় কথা আছে। যে বিজ্ঞান আধুনিক সমাজকে বহু পরিমাণে গঠিত করেছে তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ব্যবহারিক ফল লাভ! আধুনিক যুগের গোড়া। থেকেই বেকন থেকে মার্ক্স পর্যন্ত বহু চিন্তানায়ক একথা নানাভাবে বলে গেছেন। অর্থাৎ ‘বিশুদ্ধ বিজ্ঞান ও বিশুদ্ধ ব্রহ্মোপব্ধির ভিতর আমরা সমন্বয় সম্ভাবনা স্বীকার করি কি না, সেটা বিচার করাই যথেষ্ট নয়। বরং জাগতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে কোনো সমাজ স্বভাবতই নিয়তির দ্বারস্থ হয় অথবা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার সাহায্যে সেই সমস্যার সমাধানে যত্নবান হয়, সেটাই বিচার্য। আমাদের সামাজিক জীবনে এই অর্থে এখনও বিজ্ঞানের ভিত্তি দুর্বল। যিনি পেশার দিক দিয়ে বৈজ্ঞানিক, তিনিও প্রায়ই জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজ্ঞানবুদ্ধির দ্বারা চালিত হন না। তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, স্মরণীয়ভাবে, এই কথাটি বলেছেন নেহরু। আমাদের আচরিত ধর্ম, ব্যবহারিক অর্থে, বিজ্ঞান চেতনাকে অবসন্ন করে রেখেছে। এই দুর্বলতা থেকে দেশের চিত্তকে উদ্ধার করা যায়নি সনাতন ধর্মের নামে।
আধুনিক মন তাই ভগবানের প্রতি বিরূপ। অথচ এই বিরূপতাতেই আবার একটি নতুন প্রশ্নের সূচনা।
নিরাসক্ত দৃষ্টি নিয়ে জীবনের দিকে তাকালে যে ঘটনার চেহারা পালটে যায়, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে প্রাথমিক প্রতীতির জন্য ধর্মালোচনার প্রয়োজন হয় না।
জীবনের সাধারণ ও সহজগ্রাহ্য অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বোঝা যায়। যে সব ঘটনায় আমরা এই মুহূর্তে অত্যন্ত বিচলিত, সময়ের ব্যবধানে সে-সবই ভিন্ন রূপ ধারণ করে। কালের দূরত্বে যখন ঘটনাকে আমরা জৈবিক ক্রোধ ও হতাশা অথবা সাফল্যের অহংকার। থেকে মুক্ত হয়ে অবলোকন করি, তখন জ্ঞান ও অনুভবের একটা রূপান্তর ঘটে। অনাসক্তদৃষ্টিজনিত এই রূপান্তরের ফলে সত্যের কোনো হানি হয় না। বরং একথাই আমরা মনে মনে জানি যে, জীবনের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যর্থতা যদি কালের শক্তিতে এমন করে শুদ্ধ, ধৌত ও তিক্ততা থেকে মুক্ত না হতো তবে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠত।
জীবনধারণের একটা দৈনন্দিন গ্লানি আছে। আমরা প্রত্যেকেই মানুষের হৃদয়হীনতা, কপটতা, অকৃতজ্ঞতা, এমন কি অকারণ বৈরিতায় আহত। অথচ এই আহত চেতনা নিয়ে জগৎকে অথবা মানুষকে আমরা যে রূপে পাই, সেটাই তার একমাত্র অথবা সর্বাপেক্ষা সত্য রূপ নয়। জীবনকে সহনীয় ও মানুষকে গ্রহণীয় করবার জন্য জগতের অন্য একটি রূপ উপলব্ধির শক্তি অর্জন করা প্রয়োজন হয়। ধর্ম একদিন অকারণ প্রেমের শিক্ষার ভিতর দিয়ে মানুষকে এই শক্তি দান করতে চেয়েছিল। ধর্মের এই সান্ত্বনাই অগণিত মানুষের জীবনকে বহু শতাব্দী ধরে সহনীয় করেছে।
কুসংস্কারকে মনুষ্যত্ববিকাশের পথে বাধা বলে স্বীকার করা যায়, ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যায়। কিন্তু শুধু প্রাণধারণের গ্লানি থেকে জীবনকে মুক্ত করবার প্রয়োজন তবুও ফুরোয় না। যাঁরা মনে করেন যে, বৈষয়িক লাভের সাহায্যে এই প্রয়োজন পূর্ণ করা সম্ভব, তাঁরা এ বিষয়ে সত্য জানেন না। আমাদের মনের একটি অংশ আমরণ ভালোবাসা চায়। আমরা যতই ধনলাভ করি না কেন, যতই স্তাবকের দ্বারা পরিবৃত হই না কেন, তাতে ভালোবাসা লাভ হয় না। আমাদের এই চাওয়াটাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি, বিপ করতে পারি, এমন কি হনন করতে উদ্যত হতে পারি; কিন্তু তবু সে তৃষ্ণার মতনই আমরণ আমাদের সঙ্গী। মৃত্যুর মুহূর্তেও আমরা সেই তৃষ্ণার বারি কামনা করি।
অলৌকিক প্রেম অথবা করুণার শক্তিতে আমরা যখন বিশ্বাস হারাই তখনও জীবনকে বিবেকের দংশন ও ভালোবাসার পরাজয়ের অপমান থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন শেষ হয় না। এ যুগের বহু মানুষ এক বিকল্প বিশ্বাসের সাহায্যে এই অপূর্ণ বাসনার সংকট থেকে রক্ষা পেতে চাইছেন। নতুন বিশ্বাসটি হলো এই যে, আমাদের সমস্ত ব্যর্থতা ও মানুষের সকল বিচ্যুতির জন্য দায়ী মূলত ‘সমাজব্যবস্থা’ নামে একটি বস্তু। এই বিশ্বাসের জোরে মনের সঞ্চিত ক্লেশকে একটা বৃহত্তর হিংসা ও সংহতি বোধে রূপান্তরিত করা যায়। যদি সমাজব্যবস্থাকে সকল অন্যায়ের মূল কারণ হিসাবে দেখি তো অপর মানুষের প্রতি একপ্রকার তীব্র ঘৃণা অথবা সহানুভূতি বোধ করা সম্ভব হয়। অপর ব্যক্তি যদি এই সমাজব্যবস্থার ধারক হন, তবে তাঁকে ঘৃণা করা তো অপরাধ নয়ই, বরং কর্তব্য। যদি তিনি এই সমাজব্যবস্থার শিকার, তবে তাঁকে সমব্যথী হিসাবে গ্রহণ করা সহজ। নিজেকে যদি বিপ্লবী মনে করি তবে এই সমব্যথীদের সঙ্গে সংগ্রামী ঐক্য বোধ করাও স্বাভাবিক। যে-ক্রোধ অথবা অসূয়া, ক্ষুদ্র কলহরূপে, জীবনকে তিক্ত করতে পারত তা যখন সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে চালিত হয়, তখন ব্যক্তিগত হৃদয়বৃত্তির এই বৃহৎ সামাজিক রূপান্তরে একটা সিদ্ধির আস্বাদ লাভ করা যায়, যেটা অধার্মিকের পক্ষে ধমোন্মাদনার সমতুল।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক। কিন্তু সমস্ত অন্যায় ও অসুখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় হিসাবে বিশেষ একটি সমাজব্যবস্থার কল্পনা এ যুগের নতুন পৌত্তলিকতা। মধ্যযুগের পণ্ডিতেরা ভগবানের অস্তিত্বের পক্ষে বহু যুক্তির অবতারণা করেছিলেন। এইসব যুক্তিতে সূক্ষ্মবুদ্ধির পরিচয় ছিল। তবু ভগবানে বিশ্বাস, মূলত যুক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল না। বস্তুত যুক্তির দ্বারা ভগবানের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। এ যুগের বিশ্বাস, সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের সাহায্যে জীবনকে গ্লানিমুক্ত করা যাবে। এর সপক্ষেও যুক্তির বিস্তার কম হয়নি। তবু যুক্তির ওপর নির্ভরশীল নয় আধুনিক যুগের এই নতুন বিশ্বাস।
ধর্মের যেমন একটা ভয়াবহ দিক ছিল, আধুনিক যুগের এই যুক্তিহীন বিশ্বাস অথবা দুরাশারও তেমনই একটা বিপজ্জনক পরিণাম আছে। এই বিশ্বাসের যুপে আমাদের শতাব্দীতে যত মানুষ বলি হয়েছে, ধর্মান্ধতার প্রাচীন ইতিহাসেও তার তুলনা বিরল। বিজ্ঞান যেমন বিশ শতকে আমাদের সবচেয়ে বড় সহায়, বিজ্ঞানের সাহায্যে সমাজের পুনর্গঠন যেমন আজ আমাদের একটি বড় কর্তব্য, জড় জগৎ ও সমাজব্যবস্থার কাছ থেকে মাত্রাহীন প্রত্যাশাও তেমনই এ যুগের প্রধান কুসংস্কার। এরই বিকল্প রূপ-রাষ্ট্রপুজা। ঈশ্বরের মৃত্যু’কে যখন আমরা মনে মনে স্বীকার করে নিই, তখন ঘাতক যুক্তির বিরুদ্ধে মানুষের স্বভাবিক ধর্মীয় আবেগ প্রতিশোধ খোঁজে এক নতুন জড়বাদী অসহিষ্ণুতায়। এই অসহিষ্ণুতা ধর্মান্ধতার সহোদর। এর বিকৃতি ঘটে সেই ব্যক্তিপূজায়, যা বিজ্ঞানচিন্তার এমনই বিপরীত যে, তুলনায় নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাকে বৈজ্ঞানিক ও নিরাপদ বোধ। হয়।
শুধু এই কারণেই পুনরায় ধর্মে, অর্থাৎ দেশ ও কালের অতীত কোনো বিধাতায়, বিশ্বাস স্থাপনের প্রশ্ন ওঠে না। সুবিধা অসুবিধার যোগফলের ওপর বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। কিন্তু ভগবানকে যদি-বা ত্যাগ করা সম্ভব, জীবনধারণের সংগ্রামের পাশে জীব ও জগতের প্রতি একটি অকারণ করুণা ও বিস্ময়বোধকে স্থান দেওয়া ছাড়া মুক্তির উপায় নেই। এই বিস্ময়বোধের যাদুতেই জীবন প্রাত্যহিকতার স্পর্শে মলিন ও ক্রমশ অসহনীয় হয় না। এই করুশার প্রভাবেই জীবকে অস্থির অন্যায়কারী জেনেও আমরা তার ভিতর একটা বিফল অন্বেষণের বেদনা অনুভব করি। যখন জগৎকে বিস্ময়বোধের এবং জীবকে অহেতুকী প্রীতির যোগ্য বিবেচনা করা যায়, তখন উভয়ই এমন একটি নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয় যার সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধ নেই, কিন্তু নিছক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি থেকে যা। স্বতন্ত্র। এই যদি ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ের ভিত্তি হয়, তবে এই সমন্বয়ে আধুনিক মানুষের প্রয়োজন আছে।
পল্লী ও নগর (১৯৭৩)