৭.১ দুরঙা প্রজাপতি

৭.১ দুরঙা প্রজাপতি

সুবলার-বউয়ের জীবনে একটা প্রচণ্ড ঝড় বহিয়া গিয়াছে। ছেলেবেলা মা বাবা তাকে অত্যন্ত ভালবাসিত। কোনদিন তারা তার গায়ে হাত তোলে নাই। মালোদের পাড়ার মেয়েতে মেয়েতে ঝগড়া হয়, গালাগালি করে। কিন্তু পাড়ার পাঁচজনের কেউ কোনদিন তার প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করে নাই। পাড়ার মধ্যে তার নিজের একটা মর্যাদা ছিল। একটা গর্ব ছিল। আজ তাহা একেবারে খর্ব হইয়া গিয়াছে।

আজ সে দেহে মনে বিপর্যস্ত। সমস্ত শরীরে ব্যথা; এখানে-ওখানে ফুলিয়া গিয়াছে। নৌকা হইতে নামিয়া কোনো রকমে বাড়ি আসিল। কাহাকেও কিছু না বলিয়া একটা পাটি বিছাইয়া শুইয়া পড়িল। নৌকাতে অন্যান্য মেয়ে যারা ছিল, তাদের নিকট হইতে সকল প্রতিবেশীরা অগোঁণে ঘটনাটা জানিতে পারিল। সকল কথা শুনিয়া তার মা একবাটি হলুদ-বাট গরম করিয়া আনিয়া বলিল, ‘কাপড় তোল, কুনখানে কুনখানে বেদনা করে ক’। দেখি। ইস, গাও যে আগুনের মত ততা।’

আদর পাইয়া তার চোখে জল আসিয়া পড়িল।

মা তার তুই চোখ মুছাইয়া দিয়া বলিল, আ-লো নিশত্তুরি, তর নি এই দশা। তর বুকের না, পেটের না, তার লাগি তর কি!’

সুবলার বউ কোনো কথা বলিল না।

– ঐ কলিজা-খেকোকে তুই কেন আদর জানাইতে গেলি, দশজনের মাঝে তুই বেইজ্জত হইলি!

সে এবারও নিরুত্তর রহিল।

তার মা আর কথা না বাড়াইয়া, তারই কাছে শুইয়া পড়িল। বুড়া রাতের জালে গিয়াছে।

বুড়ি শুইয়া শুইয়াই তামাক টানিল, তারপর বাতি নিভাইল এবং সারারাত মেয়েকে বুকে করিয়া রাখিল। তার স্তন ফুটি শুখাইয়া দড়ির মত হইয়া গিয়াছে। মেয়ে তারই মধ্যে তার অলস স্তনদুটি ডুবাইয়া দিয়া গভীর আরাম পাইল। মা তার তোবড়ানো গালের সঙ্গে মেয়ের মসৃণ গৌরবর্ণ গালখানা মিশাইলে, মেয়ের দুই চোখ ঘুমে জড়াইয়া আসিল। শরীরের ব্যথায় মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙ্গে, আবার ঘুম আসে। এই চেতন-অচেতনের ফাঁকে ফাকে কেবলই তার মনে হইতে থাকে, এ সংসারে কেবল মা-ই সত্য, আর কিছু না।

পরের দিন তার শরীরের ফোলা কমিয়া গেল, ব্যথা কমিয়া গেল। মনও অনেকট হালকা হইয়া আসিল। মনে তখনো যেটুকু দাহ ছিল, জুড়াইবার জন্য সূতা-কাটা আর জাল-বোনাতে আত্মনিয়োগ করিল। কিন্তু পাড়াতে তার হারানো মর্যাদা আর ফিরিয়া পাইল না।

পাড়ার পাঁচজনের মুখ হইতে ঘটনাটা ভিনজাতের পাড়াতেও ছাপাইয়া পড়িল। এঘটনার পর পাড়ার যুবকদের নিকটই তার মুখ দেখাইতে লজ্জা করিত। তার উপর বামুন কায়েতের যুবকরা পর্যন্ত উঠান দিয়া যাইবার সময় তার ঘরের দিকে উঁকি মারিতে থাকিত। এভাবে লাঞ্ছিত হইয়া শেষে সে ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া রাখিত, সারাদিন আর খুলিত না। কিন্তু তবু তার নিস্কৃতি হইল না। একদিন থালা ধুইবার জন্য ঘাটে যাওয়ার সময়ে মঙ্গলার বউ তাকে পথে দেখিতে পাইয়া বলিল, ‘কি গ ভইন, বাড়ির কাছে বাড়ি, ঘরের কাছে ঘর, তবু যে দেখা পাওয়া যায় না, কারণ কি?’

‘শরীর ভাল থাকে না দিদি ৷ মধ্যে মধ্যে জ্বর জ্বর লাগে। আর বাপের জালখান পুরান হইয়া গেছে। মাছের গুতায় টিকে না। নতুন একখান জালও চাই। ঘরে কি পাঁচটা ভাই আছে না ভাই-বউ আছে। একলা আমারই ত বেবাক করন লাগে।‘

‘ত দরজা বন্ধ থাকে কিয়ের লাগি?’

সুবলার বউ ইহার কোন উত্তর দিল না।

‘তা, দুয়ার বন্ধই কর আর যাই কর ভইন, কথাখান নগরে বাজারে জানাজানি হইয়া গেছে।’

সুবলার বউ আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল, ‘কোন কথাখান, কি গ মহনের মা, কোন কথাখান।‘

—আমার কোনো দোষ নাই ভইনসকল। বাজারের লোক যারা তামসীর বাপের বাড়ি তবলা বাজায় তারা কহিয়াছে। তারা বামুন, তার কায়েত। তারা শিক্ষিত লোক। মালোদের চেয়ে তারা বুঝে শুনে বেশি। তাদের দোকান থেকে মালোর জিনিস বাকি আনে। জিয়লের ক্ষেপে, যাইবার সময় তমলুক দিয়া তাদের নিকট হইতে টাকা আনে। বিয়া-শাদিতেও টাকা ধার দেয় তারা। গ্রামের অধিক মালো তাদের বশ। তাদের কথা মালোরা কি গ্রাহ্য না করিয়া পারে। তারা যা বলিয়াছে মালোদের কাছে তা ব্রহ্মার লেখ্‌। তারা বলিতেছে, বিধবামানুষ দরজা বন্ধ করিয়া থাকে, লাজে মুখ দেখায় না, কি হইয়াছে আমরা কি তাহা বুঝিতে পারি না?

শুনিয়া সুবলার বউ স্তম্ভিত হইয়া গেল। পায়ের তলা হইতে তার যেন মাটি সরিয়া যাইতেছে। কিন্তু সন্ধিৎ হারাইল না। পড়ি পড়ি করিয়া সে বাড়ি চলিয়া আসিল।

 

ইহার পর যে-কেহ তার দিকে তাকাইত, সে চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া তার দিকে এমনি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিত যে, সেখানে তার তিষ্টিবার উপায় থাকিত না। একদিন তামসীর বাপের বাড়ির কাছে দাঁড়াইয়া যারা তবলা বাজায় গান গায়, তাদের লক্ষ্য করিয়া এমন গালি শুরু করিল যে, একঘণ্টার আগে থামিল না। পাড়ার আর আর সব মেয়ের বলিতে লাগিল, মাগো মা, রাঁড়ি যেন একবারে ‘বান্ধে খাড়া’ হইয়াছে।

সে মালোপাড়া হইতে উহাদের পাট উঠাইবাব চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু কোন পথ পাইল না। আগের মাতবররা এখন আর তেমন নাই, থাকিলে অনায়াসে একটা বিহিত করা যাইত। যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদ মালো-সমাজে বিধবাবিবাহ চালাইতে গিয়া জব্দ হইয়াছে। গ্রামের চক্রবর্তী ঠাকুর পুরোহিত দর্পণ খুলিয়া মালোদিগকে বুঝাইয়াছে, বিধবার বিবাহ দিলে নরকে যাইতে হইবে। কাজেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের কথা শিরোধার্য করিয়া রামপ্রসাদকে তাঁরা অগ্রাহ করিয়াছে। এখন আর মালো-সমাজে তার তত প্রভাব নাই। দয়ালচাঁদ আগে উচিত কথা বলিত। তাদের যাত্রা দলে সেজন্য মুনিঋষি সাজিত। শহরে যাত্রা গাহিয়া তারা তাকে বড়লোকের কাছ থেকে সোনারূপার মেডেল পাওয়াইয়াছে। ইহার পর দয়ালচাঁদও আজকাল ইহাদের দিকেই ঝুকিয়া পড়িয়াছে। এখন আর আগের মত উচিত কথা কহিবে না। কিন্তু সুবলার বউয়ের মধ্যে বিপ্লবী নারী বাস করে। সে দমিতে জানে না।

‘মহনের মা, এই গাঁওয়ের মাইয়া আমি, বিয়া হইছে এই গাওয়ে। আমি নি ডরাই বাজাইরা লোকেরে গো।’

মঙ্গলার বউ বলে, ‘তুমি মাইয়া-মানুষ। তুমি কি করতে পার ভইন।‘

‘আমি সব পারি। আর কিছু না পারি আগুন লাগাইয়া গাঁও জ্বালাইয়া দিতে পারি।’

‘গাঁওয়ের একঘরে আগুন লাগলে সহস্ৰেক ঘর পুড়া যায়। বাজাইরা পাড়া যেমুন পুড়ব মালোপাড়াও পুড়ব। তোমার ঘর পুড়ব, আমার ঘর পুড়ব। তারা যেমুন মরব, আমরাও ত মারা যামু ভইন।’

‘অপমানের বাঁচনের থাইক্যা সম্মানের মরণও ভাল। দিদি।’

কথাটা মালোর ছেলেদেরও মনে ধরিল। তিনজন লোক তবলা বাজাইয়া বেশি রাতের পর উঠিয়া বাড়ি যাইবার সময় মালোর ছেলেরা পথে পাইয়া তাহাদিগকে শুধু হাতে অনেক মার মারিল। মার খাইয়া দলের লোকজন ডাকাইয়া তারা একত্র মিলিত হইল, কি করা যায় তাহা  স্থির করার জন্য। অনেক বাদানুবাদের পর স্থির হইল তারা সামনাসামনি প্রতিশোধ নিবেন। মালোদের জানমাল বলিতে গেলে তাহাদেরই হাতে। মালোদিগকে তার হাতে না মারিয়া অন্য উপায়ে মারিবে।

সেই দিন হইতে মালোপাড়ার আকাশে একখণ্ড কাল মেঘ ভাসিয়া থাকিল। কেউ জানিল না তার ছায়া কালক্রমে কতখানি আতঙ্কের বিষয় হইয়া দাঁড়াইবে।

 

 

সেদিন কাদিরের ছেলের নূতন যে নৌকা দৌড়াইবার জন্য খলায় গিয়াছিল, সে নৌকা আর ফিরিল না। প্রতি বৎসরই এমন হয়। কোনো-না কোন গায়ের নৌকার সঙ্গে কোনো না কোন গায়ের নৌকার সংঘর্ষ লাগেষ্ট। পুরানো ঝগড়া থাকিলে তো কথাই নাই। সুযোগ দেখিয়া নৌকাখানা সটান শক্রনৌকার পেটে ঢুকাইয়া দেয়। বিদীর্ণ হইয়া যায় সে নৌকা। মারের উপকরণ নৌকাতেই প্রস্তুত থাকে। শুরু হইয়া যায় মারামারি। কত লোকের মাথা ভাঙ্গে, হাত, পা, কোমর ভাঙ্গে। কত লোক জলে পড়িয়া গিয়া আর উঠে না। প্রতিবৎসরই এমন একটা দুটা মারামারি হয়। প্রতিযোগিতার সময় প্রতি বৎসরই কোন না একটা নৌকা আর একটা নৌকার উপরে উঠিয়া পড়ে। এবৎসর উঠিল ছাদিরের নৌকার উপরে।

ছাদিরের নৌকাখানাকে বিদীর্ণ করিয়া দিল যে নৌকাখানা, ছাদিরের লোক তাদের চেনে না। ঘটনাটা চক্ষুর নিমেষে ঘটয়া গেল! একমুহূর্ত আগেও তার নৌকা ময়ূরের মত বৈঠার পেখম উড়াইয়া সর্পের গতিতে চলিতেছিল। পলক ফেলিতে দেখে তারা বিক্ষিপ্ত হইয়া জলে পডিয়া গিয়াছে।

ঘর নিস্তব্ধ! কাহারো মুখে কথা নাই। সকলে রুদ্ধ নিশ্বাসে শুনিতেছে। এবাড়ির সকলের ভাগ্যে যেন একটা ঝড় বহিয়া এখন সবকিছু স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। কেরোসিনের বাতিটা টিমটিম করিয়া ঘরটাকে আলো দিয়া রাখিয়াছে মাত্র। আসলে সব কিছুই যেন আঁধারে জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে। সকলের আগে রমু। সে তার বাপের প্রত্যেকটি কথা গিলিতেছে। বাপকে তার কাছে খুব বড় বোধ হইতে লাগিল। এতবড় একটা বিপদ ঘাড়ে লইয়া বঁচিয়া আসিল যে মানুষ, সে এত বড় যে নাগাল পাওয়া যায় না।

দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া কাদির মিয়া বলিল, ‘খোদা মেহেরবান, তোরে বাঁচাইছে। আর সব লোকের না-জানি কি গতি হইয়াছে।‘

‘জানি না বাপ। আমিই কি বাঁচতাম। জলে পইড়া দেখি, শতে বিশতে নাও। কোনটা গেল মাথার উপর দিয়া, কোনটা গেল ডাইনে দিয়া, কোনটা গেল বায়ে দিয়া। কোনটার লাগল ছিটাপানি, কোনটার লাগল বৈঠার বাড়ি। শেষে আমি দুই চক্ষে অন্ধকার দেখলাম। এমন সময় দেখলাম তারে। চিনলাম। হাত বাড়াইলাম। ঝাঁপ দিয়া পানিতে পড়ল। আমারে পাছড়াইয়া শেষে তার নাওয়ে নিয়া তুলল। ঐ যে আলুর নাও ডুববার কালে যেজন বাঁচাইছিল সেই জাল্লা ভাই।’

সকৃতজ্ঞ চোখে সকলেই আর একবার বনমালীকে দেখিল। তার উপর রমুর অসীম শ্রদ্ধা হইল।

পাড়াতে একটা কান্নাকাটির রোল উঠিবার উপক্রম হইয়া ছিল। পাড়ার যুবক বলিতে যারা ছিল সকলেই ছাদিরের নৌকাতে গিয়াছিল। এই বিপদের কথা শুনিয়া সকলেই অভিভূত হইয়া পড়িল। এমন সময় তাদের দুই একজন করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইতেছে দেখিয়া কাদির বলিল : এখন চঞ্চল হইও না, আর কতকক্ষণ বিলম্ব কর, খোদা আনিলে দেখিবে, সকলেই আসিয়া পড়িবে।

তার কথাই ঠিক হইল। এই পথে যত নৌকা আসিতেছে প্রায় সবগুলিতেই দুইজন চারিজন করিয়া তারা সকলেই প্রায় নিরাপদে ফিরিয়া আসিল।

রমুর ভাবনা হইল, যখন সকলেই আসিল, তখন নৌকাখানাও ফিরিয়া আসিলে ভাল হইত। এক সময়ে ছাদির সহসা অভিভূত হইয়া বলিল, ‘বাজান, তোমার পাঁচশ টাকা দিয়া আইলাম তিতাসের তলায়।‘ কাদির অনেক সান্তনা বাক্যে তার মনের ভার লাঘব করিলে সে বনমালীর হাত ধরিয়া বলিল, ‘তুমি ভাই হইলেও আছ, বন্ধু হইলেও আছ। চাইরটা জলচিড়া না খাওয়াইয়া ছাড়ছি না।’

কাদিরেরও মনে হইল, ঠিক কথা, ইহাদিগকে আপ্যায়ন করিতেই হইবে।

বাপ-বেটার মিলিত অনুরোধ তারা কিছুতেই এড়াইতে পারিল না।

 

রমুর মার বাপের-বাড়ি হিন্দুপাড়ার নিকটে। সে প্রশস্ত গোয়াল ঘরখানা বেশ করিয়া নিকাইয়া দিল। কলসী হইতে চিড়া বাহির করিয়া ক্ষিপ্রহস্তে কুলাতে করিয়া ঝাড়িয়া দিল। ছাদির ক্ষিপ্রহস্তে গাই দুহিয়া অনেক দুধ আনিয়া দিল। কাদির মিয়া কুমার পাড়া হইতে একদৌড়ে নিয়া আসিল একটি নূতন হাঁড়ি।

উদয়তারা তিনখানা মাটির ঢেলার উপর হাঁড়ি বসাইয়া কাঠের আগুনে দুধ জ্বাল দিতেছে। আগুনটা একেকবার কমে, আবার দপ, করিয়া বাড়িয়া উঠে। যখন বাড়িয়া উঠে তখন উদয়তারার মুখটা লাল দেখায়। যখন নিভিয়া যায়, মুখটা নিচু করিয়া ফু দেয়। তখনি সহসা জ্বলিয়া উঠে। সে আগুনে উদয়তারার মুখটা আবার লাল দেখায়। দূরে দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতেছিল জমিলা। কাদিরের একমাত্র মেয়ে সে। শেষে নিশ্চিত ভাবে চিনিয়া ফেলিল রমুর মাকে বারান্দা হইতে টানিয়া নামাইয়া কহিল, “অ ভাবী, এ যে সেই মানুষ। আমার পয়লা নাই ওরের সময় পথে যারে দেখছিলাম। ডুবাইয়া ডুবাইয়া কলসী ভরছে সেই মানুষ। যার কথা কতবার কইছি।’

সারা দিনের শ্রান্তি। ঝগড়ার ঝামেলা। তার উপর ক্ষুধা। গোয়ালঘরে বসিয়া কলাপাতায় তুধবাতাস মিশাইয়া তার সেদিন পরিতৃপ্তির সহিত ‘জলচিড়া’ খাইল। খাওয়ার পর জমিলা উদয়তারাকে টানিয়া অন্দরে নিয়া বসাইল, বলিল : বিয়ার পর আমার পয়লা নাইওর। আমি ছিলাম নৌকার ছইয়ের ভিতরে। ছইয়ের মুখ ছিল একখানা শাড়ি গুজিয়া বন্ধ করা। বাতাসে শাড়ির গোজাটা খুলিয়া গেল। তুমি তখন ঘাটে ঢেউ দিয়া জল ভরিতেছিলে। আমি তোমাকে দেখিলাম। মনে হইল যেন কতকালের চেনা। জানা নাই শোনা নাই, কি জানি কেন একজনকে দেখিয়া এত ভাল লাগে। তাই আমি বারে বারে দেখিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে দেখিলে না। পরের বারে এখানে আসিয়া বাপকে বলিয়াছিলাম, সই পাতিব। বাপ বলিল, নাম জানিনা নিশানা জানিনা, কি করিয়া খুঁজিয়া পাইব। তারপর কতবার তোমার ঘাট দিয়া নাইওরে গিয়াছি। তখন আমি পুরান। শাড়ির বেড়া নিজ হাতে খুলিয়া আতিপাতি করিয়া চাহিয়াছি, তোমাকে দেখিতে পাই কিনা। দেখিতে পাই নাই। আর কি কাণ্ড, আজ তুমি নিজে যাচিয়া আসিয়াছ। আসিয়াছ যখন, তুমি এখানে দুইদিন বেড়াও, তোমার বাড়িতে আমারে নিয়া দুইদিন রাখ।

শুনিয়া উদয়তার শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। তার জমিলা নামটা খুব ভাল লাগিল, কিন্তু সে সংসারের সম্বন্ধে এত অনভিজ্ঞ দেখিয়া বেদনাবোধ করিল।

কালোমেঘ সরিয়া গিয়া চাঁদ উঠিলে দেখিতে কেমন সুন্দর হয়; তেমনি একটা খুববড় বিপদ কাটিয়া গিয়া মনের মুখের উদয় হইলে সে মুখ কত মধুর হয়, তাহা কাদিরের বাড়িতে তখন যে না দেখিয়াছে তাহাকে কি বলিয়া বুঝানো যায়।

নৌকায় ঝগড়া মারামারির দরুণ মনে যে অস্বস্তিটুকু ছিল কাদিরের বাড়ি অতিথি হইয়া তারা তাহা  সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়া গেল। মনে স্নেহ ও প্রীতির অনুপম এক ছোপ লইয়া তারা নৌকাতে গিয়া উঠিল।

আকাশে তখন চাঁদ উঠিয়াছে। তারই আলোকে তিতাসের ছোট ছোট ঢেউগুলি চিক্‌মিক্‌ করিতেছে। সেই ঢেউ ভাঙ্গিয়া নৌকা আগাইয়া চলিল। গেল না কেবল বনমালী আর অনন্ত। গৃহকর্তার নির্বন্ধাতিশয্যে তারা আজ এখানে রহিয়া গিয়াছে।

 

পরদিন সকালে অনন্তর ঘুম ভাঙ্গিলে বাহিরে গেল। গোয়ালঘরে একপাল গরু ডাকাডাকি করিতেছে। বাছুরগুলি ছাড়া পাইয়া অকারণে লাফাইতেছে। অদূরেই বর্ষার জল থই থই করিতেছে। ছোট বড় নানা জাতের গাছগুলি কোমর-জলে আটকা পড়িয়াছে। তারই সঙ্গে এক একটা ডিঙ্গি বাঁধা। একটা খোলা জায়গাতে বাঁশের লম্বা ‘আড়া’ বাঁধিয়া তার উপর ঝুলাইয়া পাট শুকাইতে দিয়াছে। যেন খুব বড় একটা পাটের দেওয়াল বানাইয়া রাখা হইয়াছে। ভিজ পাটের গন্ধ দিগ্বিদিকে ছাইয়া ফেলিয়াছে। আকৃষ্ট হইয়া ঝাঁকে ঝাঁকে ফড়িং উড়িতেছে বসিতেছে। অনন্ত নিবিষ্ট মনে সেগুলি দেখিয়া চলিয়াছে। দেখিতে দেখিতে একখানে মোড় ঘুড়িবার সময় দেখিল রমু দাঁড়াইয়া আছে। অনন্তর মত তারও চোখেমুখে বিস্ময়। তার সঙ্গে কথা বলিবার জন্য রমুর প্রাণ ছটফট করিতেছিল। সে শুধু ভাবিতেছিল তাহাদের বাড়িতে এরা রহিয়া গিয়াছে, তাদের আপন হইয়া গিয়াছে, কি মজা। কথা বলার উপলক্ষ্য খুঁজিতে খুঁজিতে এক সময়ে রমু বলিল, ‘তুমি ফড়িং ধরনা?’

অনন্ত বলিল, ‘না।’

রমু আবার বলিল : ওই বাঁশের পুল পার হইয়া যে-বাড়ি, সে-বাড়িতে থাকে গফুর, আমার চাচাত ভাই। সে খুব ফড়িং ধরে আর আড়কাঠি বিঁধাইয়া ছাড়িয়া দেয়, তারা ছটফট করিয়া মরিয়া যায়। দেখিয়া আমার মনে বড় কষ্ট লাগে। তুমি ফড়িং ধরনা, তুমি কত ভাল।

এমন সময় রমুর মা গাদায় ফেলিবার জন্য গোয়ালঘর হইতে এক ঝুড়ি গোবর লইয়া যাইতেছিল। তারা দুইজনকে একসঙ্গে পরিচিতের মত কথা বলিতে দেখিয়া তার মাতৃহৃদয় উচ্ছসিত হইয়া উঠিল। যাইবার সময় শশী গাছ হইতে টুক্‌ করিয়া একটি শশা পাড়িয়া অনন্তর হাতে দিয়া বলিল, ‘ধর বা’জি, খাও।’

শশাটা হাতে লইয়া অনন্ত বিস্মিতভাবে চাহিয়া রহিল। রমু বলিয়া দিল, মা।

মা নাম শুনিয়াই অনন্ত তার পায়ে ঢিপ করিয়া একটা প্রণাম করিয়া আসিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *