[১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি রাত ১২টার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়। কারাগারের গেট দিয়ে বাইরে এলে সেনাবাহিনীর লোকজন তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করে রাখে। এসময় বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের কোনো সংবাদ বাইরে প্রকাশ না হওয়ায় তিনি বেঁচে আছেন কিনা জনগণের মনে সে বিষয়ে সন্দেহ, সংশয় ও উদ্বেগ দেখা দেয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশন হেডকোয়ার্টার কুর্মিটোলা অফিসার মেসের ১০নং কক্ষে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি অবস্থায় এই স্মৃতিকথা লেখা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবাঙালি সদস্যরা তাকে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সতর্ক পাহারায় রেখেছিল।
পাঁচ মাস পর দুঃসহ বন্দি জীবনযাপনের সময় এই খাতাটি বেগম মুজিব তাকে পাঠিয়েছিলেন। রয়েল স্টেশনারি সাপ্লাই হাউজের ৩২০ পৃষ্ঠার রুল টানা খাতাটির মাত্র ৫২ পৃষ্ঠা লেখার তিনি সুযোগ পান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হবার পরই প্রথম পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আর তখনই এই খাতাখানা দেয়া হয়। তবে মামলা চলার কারণে তিনি খুব বেশি লিখতে পারেন নাই। এটা তার লেখা শেষ খাতা।]
————-
১৯৬৬ সালের ৮ই মে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে দিন যাপন করতেছিলাম।
১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি রাত্রে যথারীতি খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি। দেওয়ানি ওয়ার্ডে আমি থাকতাম। দেশরক্ষা আইনে বন্দি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিন এডভোকেট আমার কামরায় থাকতেন। ১৭ মাস একাকী থাকার পরে তাকে আমার কাছে দেওয়া হয়। একজন সাথী পেয়ে কিছুটা আনন্দও হয়েছিল। হঠাৎ ১৭ই জানুয়ারি রাত্র ১২টার সময় আমার মাথার কাছে জানলা দিয়ে কে বা কারা আমাকে ডাকছিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখি নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল সাহেব দাঁড়াইয়া আছেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, এত রাত্রে কি জন্য এসেছেন? তিনি বললেন, দরজা খুলে ভিতরে এসে বলব। ডিউটি জমাদার দরজা খুলে দিলে তিনি ভিতরে এসে বললেন, আপনার মুক্তির আদেশ দিয়েছে সরকার। এখনই আপনাকে মুক্ত করে দিতে হবে। মোমিন সাহেবও উঠে পড়েছেন। আমি বললাম, হতেই পারে না। ব্যাপার কি বলুন। তিনি বললেন, সত্যই বলছি আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে-এখনই, কাপড় চোপড় নিয়ে চলুন। আমি আবার তাকে প্রশ্ন করলাম, আমার যে অনেকগুলি মামলা রয়েছে যার জামানত নেওয়া হয় নাই। চট্টগ্রাম থেকে কাস্টডি ওয়ারেন্ট রয়েছে, আর যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা থেকে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট রয়েছে। ছাড়বেন কি করে? এটাতো বেআইনি হবে। তিনি বললেন, সরকারের হুকুমে এগুলি থাকলেও ছাড়তে পারি। আমি তাকে হুকুমনামা দেখাতে বললাম। তিনি জেল গেটে ফিরে গেলেন হুকুমনামা আনতে।
আমি মোমিন সাহেবকে বললাম, মনে হয় কিছু একটা ষড়যন্ত্র আছে এর মধ্যে। হতে পারে এরা আমাকে এ জেল থেকে অন্য জেলে পাঠাবে। অন্য কিছু একটাও হতে পারে, কিছুদিন থেকে আমার কানে আসছিল আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়াইবার জন্য কোনো কোনো মহল থেকে চেষ্টা করা হতেছিল। ডিসেম্বর মাস থেকে অনেক সামরিক, সিএসপি ও সাধারণ নাগরিক গ্রেপ্তার হয়েছে দেশরক্ষা আইনে-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা উপলক্ষ্যে, সত্য মিথ্যা খোদাই জানে!
প্রথম খবর পাই জেলের মধ্যে ঈদের নামাজে। এই দিন বিভিন্ন ওয়ার্ডের বন্দিরা কিছু সময়ের জন্য এক জায়গায় নামাজ পড়তে জমা হয়। আমাকে দেখে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী কেঁদে ফেলে এবং বলে তাকে ২১ দিন পুলিশ কাস্টডিতে রেখেছিল। মেরে পা ভেঙে দিয়েছে। তারপর রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা করে একটু আরোগ্য লাভ করলে জেলে পাঠাইয়া দিয়েছে। আমাকে জড়াইয়া ধরে কেঁদে দিয়ে বলল, শুধু আপনার নাম বলাবার জন্য আমাকে এত মেরেছে, সহ্য করতে পারি নাই বলে যাহা বলেছে। তাহাই লিখে দিয়ে এসেছি। আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম আর বললাম, আল্লার উপর নির্ভর কর। যাহা হবার হবেই। আমাকে বলল, সরকারের কাছে দরখাস্ত করব।
ফজলুর রহমান সিএসপিও বলল, আপনাকে জড়াবার খুব চেষ্টা চলছে। আরও দুই একজন ভূতপূর্ব সামরিক বাহিনীর কর্মচারীও আমাকে বলল। এর মধ্যে মি. কামালউদ্দিন নামে একজন ভূতপূর্ব নৌ-বাহিনীর কর্মচারীর পুরানা ২০ সেল থেকে জেল গেটে যাবার সময় আমার সাথে দেখা হয়ে গেল। আমাকে আদাব করলেন। আমি বললাম, আপনাকে তো কোনোদিন দেখি নাই, আপনি কে? বলল, আমার নাম কামালউদ্দিন। পুলিশ হাজতে নিয়ে অসম্ভব মেরেছে। সমস্ত শরীর পচাইয়া দিয়েছে। সোজাভাবে শুয়ে থাকতে পারি না। পায়খানার দ্বারের মধ্যে কি ঢুকিয়ে দিয়েছিল যন্ত্রণায় অস্থির। এই দেখুন জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে জায়গায় জায়গায় পোড়াইয়া দিয়েছে : আপনার নাম লেখাইয়া নিয়েছে আমার কাছ থেকে যদিও অনেক বলেছি যে ‘শেখ মুজিবের সাথে আমার পরিচয় নাই। একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ লাইনেই উপস্থিত আছেন, টাইপ করে কাগজ দেয়, তাই পড়ে দিয়ে আসতে হয়। না পড়লে আবার মারতে শুরু করে। কি করব স্যার, লিখে দিয়ে এসেছি, তবে হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস করব। সেখানে সব বলব। মামলা সে করেছিল, খবরের কাগজে অত্যাচারের করুণ কাহিনী প্রকাশ হয়ে পড়েছিল কামাল উদ্দিনের মামলায়। এরপরে জেলে বসে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রেসনোট পড়লাম, তাতে ২৮ জনের নাম দিয়েছে। জনাব রুহুল কুদুস সিএসপি ও ফজলুর রহমান সিএসপি সহ সামরিক বেসামরিক লোকের নাম রয়েছে। তিনজন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ কর্মীর নামও দেখলাম। প্রেসনোটে লেখা ছিল এই ২৮ জন লোকই ষড়যন্ত্র করেছে। মোমিন সাহেবকে বললাম, বোধ হয় চিন্তা ভাবনা করে আমাকে বাদ দিয়েছে, কারণ আজ ১৭ মাস আমি কারাগারে বন্দি। এতবড় মিথ্যা কথা সরকার বলবে কেমন করে! তিনি ও অন্যান্য রাজবন্দিরা জানতে পেরেছিলেন বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের থেকে—যে আমাকে জড়াবার চেষ্টা চলেছে। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে আমাকে খবরও পাঠাইয়াছিল। আমার সাথে দেখা করতে এসে রেণু (আমার স্ত্রী) আমাকে বলেছিল, তোমাকে জড়াবার চেষ্টা হতেছে। জানি না খোদা কি করে। আল্লার উপর নির্ভর কর।
আমি বললাম, দেশরক্ষা আইনে জেলে রেখেছে, ১১টা মামলা দায়ের করেছে আমার বিরুদ্ধে। কয়েকটাতে জেলও হয়েছে, এরপরও এদের ঝাল পড়ল না। ৬ দফার ঝাল এতো বেশি জানতাম না। আইবি ও জেল অফিসার সামনে বসে থাকে, কথা বলা যায় না। আমার শরীরও খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল, কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, হাসপাতালে যেতে হয় নাই, তবে ভর্তি করে খাওয়া দাওয়া কন্ট্রোল করেছিল। অনেক ওজন কম হয়ে গিয়েছিল। একটু আরোগ্য লাভ করেছিলাম। তখনও ভর্তি ছিলাম যেদিন আমার মুক্তির আদেশ নিয়ে ডিপুটি জেলার রাত ১২টায় হাজির হয়েছিলেন।
ডিপুটি জেলার হুকুমনামা নিয়ে এলেন, আমাকে দেখালেন। আমি পড়ে দেখলাম, দেশরক্ষা আইন থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মোমিন সাহেব প্রথমে খুশি হয়েছিলেন পরে তিনি বুঝতে পারলেন ভিতরে কিছু কিন্তু আছে। বিছানা কাপড়গুলি বেঁধে দিল কয়েদিরা। মোমিন সাহেবকে বললাম, বাড়িতে রেণুকে খবর দিতে, আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়াছে। আমি দেখলাম, ডিপুটি জেলার ও সিপাহি জমাদার, যারা আমাকে ও মালপত্র নিতে এসেছে তাদের মুখ খুব ভার। কারো মুখে হাসি নাই। আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে, অন্য কোনো বিপদে আমাকে ফেলছে সেটা আর কিছু না, ষড়যন্ত্র মামলা’। বিদায় নিবার সময় মোমিন সাহেবকে বললাম, বোধ হয় আর আপনাদের সাথে দেখা হবে না। আপনারা রইলেন এদেশের মানুষের জন্য, আমি চললাম। খোদা আপনাদের সহায় আছেন। আমাকে যারা খানা পাকাইয়া খাওয়াতো, কাজ করে দিত, তাদের কাছ থেকেও ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়ে প্রায় ১টার সময় জেলগেটে হাজির হলাম।
বইখাতা ও খাবার জিনিসপত্র রেখে এলাম। বলেছিলাম, আপনাদের জিনিসগুলি রেখে আমার জিনিসপত্র কামালকে (আমার বড় ছেলে) খবর দিলে নিয়ে যাবে এসে। আমাকে কোথায় নিয়ে যায় ঠিক নাই।
জেলগেটে এসেই দেখি এলাহি কাণ্ড! সামরিক বাহিনীর লোকজন যথারীতি সামরিক পোষাকে সজ্জিত হয়ে দাঁড়াইয়া আছেন আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য। আমি ডিপুটি জেলার সাহেবের রুমে এসে বসতেই একজন সামরিক বাহিনীর বড় কর্মকর্তা আমার কাছে এসে বললেন, “শেখ সাহেব আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো। আমি তাকে বললাম, নিশ্চয় আপনার কাছে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আছে। আমাকে দেখালে বাধিত হব। তিনি একজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারীকে বললেন, পড়ে শোনাতে। তিনি পড়লেন, “আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হলো।” আমি বললাম, ঠিক আছে, চলুন কোথায় যেতে হবে। সামরিক বাহিনীর কর্মচারী বললেন, “কোনো চিন্তা করবেন না, আপনার মালপত্র আপনি যেখানে থাকবেন সেখানে পৌঁছে যাবে।”
আমাকে কোনো লিখিত আদেশ দিল না। আমি ডিপুটি জেলার সাহেবের কাছ থেকে টাকাগুলি বুঝে নিয়ে রওয়ানা করছি, এমন সময় ঢাকা জেলের জেলার ফরিদ আহম্মদ হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে বললেন, “আপনাকে তো আমরা ছাইড়া দিলাম।” এই ভদ্রলোকের কথায় আমার প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল এবং কড়া উত্তর দিবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। শুধু বললাম, বাজে কথার দরকার নাই। এই ভদ্রলোকের উপর রাগ করে লাভ নাই, কারণ একে আমি পূর্বের থেকেই জানতাম। এই জেলেই কয়েক বৎসর পূর্বে ডিপুটি জেলার ছিল। তখনও আমি রাজবন্দি ছিলাম। এখন জেলার হিসেবে কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। তাহার ব্যবহার সম্বন্ধে সকলেরই ধারণা আছে। নানা কারণে অন্যান্য কর্মচারী ও কয়েদিরা একে মোটেই দেখতে পারে না। আর সত্যই দ্রলোক কথা বলতেও জানে না।
আমি জেলগেটে দেখলাম ঢাকা জেলের সুপারেনটেনডেন্ট বা ডিআইজি সাহেবের রুমে আলো জ্বলছে। তিনিও এই সময় উপস্থিত হয়েছেন—বোধ হয় আমাকে ‘মুক্তি দিবার জন্য’।
জেলের লোহার দরজা খুলে দেওয়া হলো। সামনেই একটি গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। চারদিকে সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা পাহারায় রত আছেন। একজন মেজর সাহেব আমাকে গাড়িতে উঠতে বললেন। আমি গাড়ির ভিতরে বসলাম। দুই পার্শ্বে দু’জন সশস্ত্র পাহারাদার, সামনের সিটে ড্রাইভার ও মেজর সাহেব। গাড়ি নাজিমুদ্দীন রোড হয়ে রমনার দিকে চলল। আমি পাইপ ধরাইয়া রাত্রের স্নিগ্ধ হাওয়া উপভোগ করতে লাগলাম, যদিও শীতের রাত। ভাবলাম কোথায় আমার নূতন আস্তানা হবে! কোথায় নিয়ে যাওয়া হতেছে! কিছুই তো জানি না। গাড়ি চললো কুর্মিটোলার দিকে।
বহুকাল পরে ঢাকা শহর দেখছি, ভালই লাগছে। মনে মনে শেরে বাংলা ফজলুল হক, জননেতা সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দীনের কবরকে সালাম করলাম। চিরনিদ্রায় শুয়ে আছ, একবারও কি মনে পড়ে না এই হতভাগা দেশবাসীদের কথা! শাহবাগ হোটেল পার হয়ে, এয়ারপোর্টের দিকে চলেছে।
এয়ারপোর্ট ত্যাগ করে যখন ক্যান্টনমেন্ট ঢুকলাম তখন আর বুঝতে বাকি রইল না। মনে মনে বাংলার মাটিকে সালাম দিয়ে বললাম, “তোমাকে আমি ভালবাসি। মৃত্যুর পরে তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা।”
অনেক কথা মনে পড়তে লাগলো। বিশেষ করে আমার আব্বা ও মায়ের কথা। খবর পেলে এই বৃদ্ধ বয়সে দুইজনের কি অবস্থা হবে? আব্বার বয়স ৮৪ বৎসর আর মায়ের বয়স ৭৫ বৎসর। আর কতদিনই বা বাঁচবেন! দুঃখ পেয়ে আঘাত সহ্য করতে না পারলে যে কোনো অঘটন হয়ে যেতে পারে। বোধ হয় আমি আর দেখতে পাব না। এর মধ্যেই এসে পৌছলাম একটা ঘরের সামনে। এখানেও সামরিক বাহিনী পাহারা দিতেছে। দরজা খুলে দিল। আমি নেমে পড়লে আমাকে সাথে করে একটা কামরায় নিয়ে গেল। সেখানে তিনজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারী দাঁড়াইয়া আছেন। আমার সাথে কেহ কোনো আলাপ করলেন না, আমিও চুপ করে দাঁড়াইয়া রইলাম। কয়েক মিনিট পরে বললাম, শরীর ভাল না, কোথাও বসতে অনুমতি দিন। আমাকে পাশের আর একটা কামরায় নিয়ে বসতে দেওয়া হলো। কয়েক মিনিট পরে এক ভদ্রলোক এলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ষড়যন্ত্র ব্যাপার সম্বন্ধে। বললাম, কিছুই জানি না।
এর মধ্যে এক ভদ্রলোক বলিষ্ঠ গঠন, সুন্দর চেহারা, আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তিনি একজন ডাক্তার। আমার হার্ট পেট রক্তচাপ পরীক্ষা করলেন। কিছুই না বলে চলে গেলেন পাশের কামরায়। কয়েক মিনিট পরে আর একজন কর্মচারী এসে বললেন, চলুন। একটা জীপ গাড়িতে করে আমাকে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। এক কামরাবিশিষ্ট একটা দালান। সাথে গোসলখানা, ড্রেসিং রুম, স্টোর রুম আছে। দু’খানা খাট পাশাপাশি। একটা খাটে একটা বিছানা আছে। আর একটা খাট খালি পড়ে আছে। আমাকে বলা হলো আপনার মালপত্র এসে গেছে দেখে নেন। বিছানা খুলে বিছানা করে নিলাম। একজন কর্মচারী—যার নাম লেফটেন্যান্ট জাফর ইকবাল সাহেব, তিনি আমার পাশের খাটেই ঘুমাবেন সামরিক পোশাক পরে-সাথে রিভলবার আছে। লেফটেন্যান্ট সাহেব একাকী প্যাসেন্স খেলতে লাগলেন। আমি বিছানায় বসে পাইপ টানতে লাগলাম, কোনো কথা নাই। কুর্মিটোলার কোন জায়গায় আমি আছি নিজেই জানি না।
আধা ঘণ্টার মধ্যে সেই দু’জন সাদা পোশাক পরিহিত সামরিক কর্মচারী এলেন—যাদের সাথে পূর্বেই দেখা হয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো অসুবিধা আছে কিনা? এখানেই আপাতত আমাকে থাকতে হবে। আমাকে চা খেতে অনুরোধ করলেন। আমি আগ্রহের সাথে রাজি হলাম। কারণ ঘুম ভাঙাইয়া আমাকে নিয়ে এসেছে, জড়তা এখনও যায় নাই। তিনজন এক সাথে চা খেলাম। আমি বললাম, “আমাকে কেন আপনারা এনেছেন জানি না, তবে সত্য চাপা থাকবে না। অন্যায় ভাবে আমার উপর অত্যাচার করে কি লাভ হবে বুঝতে পারছি না।” একজন মনে হলো—মেজর হবে, একটু টিটকারী দিয়ে কথা বলছিলেন, এমনকি আমার স্ত্রীও জড়িত আছে এমন ইঙ্গিতও দিতে ভুল করলেন না। আমি তাহাকে লক্ষ্য করে বললাম, “দেখুন, আমার স্ত্রী রাজনীতির ধার ধারে না। আমার সাথে পার্টিতে কোনো দিন যায় নাই। সে তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাইরের লোকের সাথে মেলামেশাও করে না। আমার রাজনীতির সাথে তার সম্বন্ধ নাই।” এই সময় আমি দেখলাম আর একজন ভদ্রলোক যিনি কর্নেল হবেন বলে মনে হলো, অন্য আর একজনের দিকে চেয়ে ইশারা দিয়ে নিষেধ করল। কর্নেল ভদ্রলোকের নাম পরে জানতে পারলাম শের আলি বাজ। খুবই ভদ্র, অমায়িকভাবে আলোচনা করছিলেন। কর্নেল শের আলি বাজ যাবার সময় বলে গেলেন, থাকবার খাবার কোনো অসুবিধা হবে না। ভদ্রলোকের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। তার কথাবার্তার মধ্যে কোনো আক্রোশ খুঁজে পেলাম না। পরে জানতে পারি এর বাড়ি পেশওয়ার জেলায়।
আমি শুয়ে পড়লাম। আলো জ্বালান থাকলো। ঘুমের ব্যাঘাত তো নিশ্চয়ই হবে। তারপর মনের অবস্থা খারাপ। যাহা হউক ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, উঠতে দেরি হলো। রাত্রে যে ভদ্রলোক আমার কামরায় পাহারায় ছিলেন তিনি সকালবেলা চলে গেলে আর একজন ভদ্রলোক নাম লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদ জাফর ডিউটিতে এলেন।
দরজা জানালা বন্ধ। জানালা ও দরজার কাচগুলিকে লাল রং করে দেওয়া হয়েছে। ঘরগুলি অন্ধকার তাই আলো জ্বালাইয়া রাখতে হলো। দরজা বন্ধ থাকবে। এই কামরায়ই থাকতে হবে। কিছুই জানি না, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সময় কাটবে কি করে? বই পত্র নাই, খবরের কাগজ দেওয়া হবে না। যে অফিসার আমার পাহারায় রত থাকবেন তার উপর হুকুম আছে—পারিবারিক, রাজনৈতিক, সামরিক কোনো বিষয়ই আলাপ করতে পারবে না। তবে আবহাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে হাঁ বা না সূচক ভাষায় উত্তর দিতে বোধ হয় আপত্তি নাই। কথা বার্তা না বলে দু’জন লোক একই কামরায় নীরবে বসে থাকতে হবে। আর অফিসার ভদ্রলোকের কাজ হলো আমাকে চোখে চোখে রাখা যাতে আমি ভাগতে চেষ্টা না করি বা আত্মহত্যা করতে না পারি। ভাবতে লাগলাম এই অবস্থায় দিন কাটবে কি করে! আর কতকাল থাকতে হয় ঠিক কি? এইভাবে থাকলে যে কোনো লোক পাগল হতে বাধ্য। তবুও তো থাকতে হবে। কারণ ‘পড়েছি পাঠানের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।‘
নাস্তা, দুপুর ও রাত্রের খাবার ঠিক সময় মতো এসে হাজির হয়। তবে দু’বেলাই রুটি। মহা সমস্যা। আমি আমাশয়ের রুগি। পেটের ব্যাথাও শুরু হয়ে পড়ল। জানতে পারলাম আমি যেখানে আছি এটা অফিসার মেস। আমার ঘরটা হলো গেস্ট হাউস। অফিসাররা যা খেয়ে থাকেন আমাকেও তাই খেতে দেওয়া হয়। সমস্ত কর্মচারীই হলো পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী, তারা রুটিই খেয়ে থাকে। সাথে থাকে মাংস। রুটি মাংস ও ডাল খেয়ে আমার পক্ষে বাচা কষ্টকর। উপায় নাই। যতদিন চলে চালাতে হবে। আমার কাছে দুইখানা মাত্র বই ছিল। অন্য বইগুলি জেলখানায় রেখে এসেছি। ভুল করেছি বই না এনে। অফিসার ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, বই পড়তে আপত্তি আছে কিনা। তিনি বললেন, বই দেওয়ার হুকুম আপাতত পাই নাই। তবে আপনার কাছে থাকলে পড়তে পারেন। তিনি মাঝে মাঝে বাইরে যান। আমি যে কড়িকাঠ গুনবো সে ব্যবস্থাও নাই। কারণ কড়িকাঠও দালানে নাই। আলো জ্বালানই ছিল। সুকর্ণর পতন সম্বন্ধে বই দুটি পড়তে লাগলাম। কিন্তু মন বসছে না, নানা চিন্তা ঘিরে ধরছে। কি করব বসে বসে শুধু পাইপ খেতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম রাজনীতি এত জঘন্য হতে পারে! ক্ষমতার জন্য মানুষ যে কোনো কাজ করতে পারে। আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে কারো বিবেকে দংশন করল না। আমি তো ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি নাই। জীবনভর প্রকাশ্যভাবে রাজনীতি করেছি। যাহা ভাল বুঝেছি তাই বলেছি। বক্তৃতা করে বেড়াইয়াছি, গোপন কিছুই করি না বা জানি না। সত্য কথা সোজাভাবে বলেছি তাই সোজাসুজি জেলে চলে গিয়াছি। কাহাকে ভয় করে মনের কথা চাপা রাখি নাই। যে পথে দেশের মঙ্গল হবে, যে পথে মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তাহাই করেছি ও বলেছি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যাতে তার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারে তার জন্য আন্দোলন করেছি। বার বার জেলে যেতে হয়েছে আর মামলার আসামী হতে হয়েছে। কিন্তু মনের কথা চাপা রাখি নাই। জেলে যেতে হবে জেনেও ছয় দফা জনগণের কাছে পেশ করেছিলাম। যদিও জানা ছিল শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর আঁতে ঘা লাগবে। ঝাপাইয়া পড়বে আমার ও আমার সহকর্মীদের উপর। অত্যাচার চরম হবে, তবুও গোপন করি নাই। আজ দুঃখের সাথে ভাবছি আমাকে গোপন ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে শাসকদের একটু বাঁধলো না! এরা তো আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ভাল করে জানে। ভাবা ও চিন্তা করা ছাড়া কোনো কাজই যখন নাই যখন মনকে বললাম, ভাবো যত পারো, কিন্তু পাগল করো না। জীবনের বহু কথা মনে পড়তে লাগলো। খাতা কাগজ নাই যে কিছু লেখব। কলম আছে। কাগজ ও খাতা পাওয়ার কোনো উপায়ও নাই, আর অনুমতিও নাই।
আমাকে ছাড়া অন্য কাহাকেও গ্রেপ্তার করেছে কিনা? পূর্বে ২৮ জন গ্রেপ্তার হয়ে বিভিন্ন জেলে ছিল। ঢাকা জেলে প্রায় ২০/২২ জন ছিল। তাদেরও এখানে এনেছে কিনা? জানার উপায় নাই। কে কোথায় আছে কিছুই বলতে পারি না। পূর্বের ২৮ জন, আমি ছাড়াও নূতন গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা?
কামরার সামনে একজন রাইফেলধারী সিপাহি ও পিছনে একজন দাঁড়াইয়া আছে সর্বক্ষণের জন্য। মিলিটারি কাস্টডি কাকে বলে পূর্বে ধারণা ছিল না। প্রথম দিন এইভাবে কেটে গেল। পরের দিন একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী এলেন আমার কামরায়। তাকে আমি জানি না। তিনি আমাকে বললেন, কোনো অসুবিধা আছে কিনা? বললাম, জানলাটা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন, না হলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে কি করে? তিনি জানলা খুলে দিতে হুকুম দিয়ে চলে গেলেন। আমি সেই অন্ধকার কামরায় বসে বসে খোদাকে ডাকা ছাড়া কি করতে পারি! রাত্রে আর একজন কর্মচারী এলেন তার নাম মেজর নাইম। এরা সকলেই প্রায় থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কর্মচারী। আমি এদেরই মেসে আছি। ইনি কুমিল্লা থেকে এসেছেন, সেখানেই তার পোস্টিং, যথারীতি পরিচয় হওয়ার পরে কোনো কথাবার্তা না বলে চুপ করে বসে থাকতে হয়। পাইপ খাওয়া বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক। কয়েক টিন তামাক আমার কাছে। আছে। মাস দেড়েক চলতে পারে। ভাবলাম রেণু ও ছেলেমেয়েদের দেখা করতে দিবে না, তামাক আসবে কি করে! তাহারা নাও জানতে পারে আমি কোথায় আছি। আর জানলেও পাঠাবে কি করে? স্থির করলাম যে কয়েকদিন তামাক আছে খেতে থাকি, ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিব। বাবা-মা, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, বাড়ির স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সকলকে ছেড়ে থাকতে পারি আর তামাক ছেড়ে থাকতে পারব না! দুই দিন পরে সকালে আর একজন ভদ্রলোক এলেন সাদা পোশাক পরিহিত। বললেন দু’ একদিনের মধ্যে অফিসাররা আসবে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তারপর জনাব রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন। আমি তাকে যথারীতি ধন্যবাদ দিলাম। তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
(পাঁচ মাস পরে খাতা পেয়েছি। তাই দিন তারিখগুলি আমার মনে নাই, ঘটনাগুলি যতদূর মনে পড়ে তাই লিখে রাখছি।)
পরের দিন সকাল ১১টার দিকে দু’জন ভদ্রলোক এলেন। তাদের জানি না, শুধু বুঝলাম সামরিক কর্মচারী হবেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কিছু জানি কিনা এই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে। করাচিতে জনাব ফজলুর রহমান সিএসপিসহ নৌ-বাহিনীর কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি কিনা? ষড়যন্ত্রকারীদের অর্থ সাহায্য করেছি কিনা? ঢাকায় জনাব রুহুল কুদুস সিএসপির সাথে একসাথে গোপন সভা করেছি কিনা? চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ কর্মী মানিক চৌধুরীকে অর্থ সাহায্য করতে বলেছি কিনা? আমি বললাম, আজ ২১ মাস আমি দেশরক্ষা আইনে বন্দি। আপনারা বিশ্বাস করেন কেমন করে যে আমি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতে পারি? আমি কিছুই জানি না, কাহাকেও টাকা পয়সা দেই নাই। তাহারা চলে গেলেন, আমি খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় পড়ে রইলাম। রাত্রে খবর দেওয়া হলো মি. রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর আগামীকাল সকাল বেলা আসবেন আমার সাথে দেখা করতে।
দু’টা বই ছিল পড়ে ফেলেছি। এখন উপায় কি? সময় কাটবে কি করে? এতদিন শরীর কিছু ঠিক রেখেছিলাম এবার বোধ হয় আর পারলাম না।
পরের দিন সকাল ১০টায় মি. রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর মেসে বসে ডিউটি অফিসার লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদ জাফরকে খবর দিলেন আমাকে মেসে নিয়ে যেতে। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। সূর্যের আলো তো গায়ে লাগে নাই এই কয়দিন, তাই বের হয়ে গেলাম। এক মিনিটের বেশি সময় লাগলো না পৌছতে। রিজভী সাহেবের নাম আমি শুনেছি, কিন্তু আলাপ ছিল না। যথারীতি আলাপ পরিচয় হওয়ার পরে আমাকে নিয়ে রৌদ্রে বসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়েছে? আপনারা তো আমার সম্বন্ধে জানেন। আমি তো গোপন ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। যাহা ভাল বুঝেছি তাহাই করেছি। স্বায়ত্তশাসনের দাবী তো ১৯৪৯ সাল থেকে আমি করতে শুরু করেছি। পার্লামেন্টে প্রাদেশিক আইন সভার বাইরে ও ভিতরে আমি প্রচার করেছি। তারপর ছয়দফা প্রোগ্রাম দিয়েছি ১৯৬৬ সালে। বই ছাপাইয়াছি, বক্তৃতা করেছি। আপনারা আমাকে ও আমার সহকর্মীদের দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে রেখে কতকগুলি মামলাও দায়ের করেছেন। আমি পাকিস্তানের অমঙ্গল কামনা করি নাই। দুই অঞ্চলকে আলাদা করতেও চাই নাই। কারণ সংখ্যাগুরু অঞ্চল সংখ্যালঘুদের ভয়ে আলাদা হতে পারে না। আর এমন কোনো নজির ইতিহাসে নাই। আমি বুঝতে পেরেছি আমাকে আপনারা রাজনীতি করতে দিবেন না। ঠিক আছে আপনারা আমার একটা চিঠি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেবের কাছে পৌঁছাইয়া দিতে রাজি আছেন কিনা? কারণ যতদূর আমার জানা আছে তিনি অন্যায়ভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়ার পক্ষপাতী নন।
তাহারা বললেন, আমরা কি করব যদি অন্যান্য আসামিরা আপনার নাম বলে। আপনাকে এই মামলায় জড়িত আমরা করি নাই। অনেকেই আপনার নাম বলেছে। আপনি তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন এবং অন্যকে দিতে বলেছেন।
আমি বললাম, যাহা হবার হবে, তবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে আমার পত্রটা পৌঁছাইয়া দেন। কারণ পাকিস্তান দুই ভাগ হয়ে যাক আমি চাই নাই। যদি চাইতাম তবে প্রকাশ্যে বলতাম। তিনি ইচ্ছা করলে হস্তক্ষেপ করতে পারেন, কারণ আজ ২১ মাস আমি জেলে বন্দি। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছাড়া কারও সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় না।
তাহারা বললেন, চিঠি আমরা নিতে পারব না। তবে যদি টেপরেকর্ডে আপনি কিছু বলতে চান বলে দিবেন—আমরা তাঁকে শুনাবো। রিজভী সাহেবকে আমার বাড়িতে খবর দিতে অনুরোধ করলাম যে আমি ভাল আছি এবং এখনও বেঁচে আছি। ব্রিগেডিয়ার আকবরকে বই দিতে অনুরোধ করলে তিনি ডিউটি অফিসারকে আমাকে বই পড়তে দিতে অনুমতি দিলেন, আর সন্ধ্যার পরে এক ঘণ্টা বাইরে বেড়াবার হুকুম দিলেন।
রিজভী সাহেব বললেন, “আপনার বাড়িতে আমি নিজেই যাবে এবং আপনার স্ত্রীকে বলে আসবো যে, আপনি ভাল আছেন। অসুবিধা নাই।” বললাম, “মেহেরবানি করে এই কাজটা করলে বাধিত হব।” খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হবে না, কারণ আইনে নাই।
তাহারা চলে গেলেন, আমিও কামরায় এসে ভাবতে বসলাম মানুষ স্বার্থের জন্য কিই না করতে পারে! শুনেছিলাম ভালবাসা ও রাজনীতিতে ভাল মন্দ বলে কোনো জিনিস নাই। আমি বিগ্রেডিয়ার আকবরকে বলেছিলাম, মনে রাখবেন এদেশের লোক বিশ্বাস করবে না আর করতে পারে না যে আমি ষড়যন্ত্র করতে পারি। আমার চরিত্র সম্বন্ধে তাদের ধারণা আছে। আমাকে জড়িত করে দেশের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই করলেন। দরজা বন্ধ। ঘরের মধ্যে বসে মনে মনে ভাবলাম, রাজনীতি জঘন্য রূপ ধরেছে। এর আর শেষ নাই। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে যে কোনো পন্থায় শেষ করার পথ অবলম্বন করেছে। লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদকে হুকুম দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার আকবর আমাকে বই দিতে। তিনি আমাকে একটা বই এনে দিলেন। রাত্রের ডিউটি অফিসার মেজর নাইমও আমাকে একটা বই দিলেন। বইটা তার নিজের। মেজর নাইম কুমিল্লায় থাকতেন। ঢাকা এসেছেন কিছুদিনের জন্য আমাদের দেখাশোনা বা পাহারা দিতে। আমি বইয়ের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু পারতাম না। অনেকগুলি পাতা পড়ে ফেলেছি, কিন্তু কি যে পড়েছি মনে নাই। আবার নতুন করে পড়তে হয়েছে।
সন্ধ্যার পরে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। সমস্ত লাইট নিবাইয়া দেয়া হতো। যেখানে আমি হাঁটতাম তার দুই পাশে দুই সশস্ত্র সিপাহি পাহারায় রত থাকতেন। আর একজন অফিসার আমার সাথে হাঁটতেন। বড় দুঃখ হতো এই অফিসারটার জন্য, কারণ কথা বার্তা নাই, চুপচাপ আমার সাথে সাথে হাঁটতে হবে। সমস্ত দিন রাত্র দরজা বন্ধ। এই অবস্থায় কামরায় থাকার পরে যখন বাইরের হাওয়া গায়ে এসে লাগত তখন যে মনের অবস্থা কি হতো, কিভাবে প্রকাশ করব! বাইরের এই শীতল বাতাস আমার মনে যে কি আনন্দই না বয়ে দিত। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম না। আবার চিন্তা এসে ঘিরে ধরতো। কর্মচারীদের আলোচনায় বুঝতে পারতাম কোর্ট মার্শালে বিচার করে সকলকে ফাসি বা গুলি করে মেরে ফেলবে। সকল কিছুই সম্ভব। মনে মনে প্রস্তুত হতে চেষ্টা করছিলাম। একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাই বলতে পারেন, ‘পাকিস্তান আর্মি, এয়ারফোর্স ও নেভী আইনটা কি?’ আমার তো কোনো ধারণা নাই। আমি সাধারণ নাগরিক, সামরিক বাহিনীর কর্মচারীও না। আমাকে কি করে এই আইনে গ্রেপ্তার করা হলো।”
তিনি বললেন, আইনে আছে যদি কোনো নাগরিক সামরিক বাহিনীর কর্মচারীদের সাথে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তবে এই আইনে তাকেও গ্রেপ্তার করা যেতে পারে।
বুঝলাম, ব্যাপারটা কি। তিনি অন্য কিছু বলতে চাইলেন না। কারণ তাদের আলাপ করা নিষেধ।
দিন কি কাটতে চায়? আমি ছাড়াও আর কোনো আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে এনেছে কিনা- কোনো খবর নাই।
জনাব রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর আমার সাথে আবার দেখা করতে এলেন। বললেন, চিঠি আপনি দিতে পারেন, আমরা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছে পৌঁছাইয়া দিব।
আমি একটা খসড়া চিঠি লিখে রেখেছিলাম। তা পড়ে শোনালাম। তাহারা এই চিঠি নিতে রাজি হলেন না। বললেন, শেষের দিকে পরিবর্তন করলে নিতে পারি। বললাম, ঠিক আছে বলুন কি লিখতে হবে। ব্রিগেডিয়ার আকবর বললেন, আমি লিখে নিলাম। তারপর আর একটা কাগজে নূতন করে লিখে তার হাতে দিলাম। তারা বললেন, পিন্ডি যেয়ে চিঠি প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছাইয়া দিব। তিনি কি বলেন তা আপনাকে জানাবো।
চিঠির শেষের প্যারাটা আমাকে বাধ্য করল লিখতে। না লিখে আমার উপায় ছিল না। ইজ্জতের ভয়তেই লিখতে হলো। আমাকে মিথ্যা মামলায় আসামী করে দেশের মঙ্গল হবে না। পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের কেহ বিশ্বাস করবে না। জনগণ বলবে, আমাকে অত্যাচার করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়েছে। ৬দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। ১২টা মামলাও দায়ের করেছে। আমার সহকর্মী খোন্দকার মোশতাক, তাজউদ্দীন, আব্দুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম, আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সকলের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
রিজভী সাহেব আমার বাড়িতে যেয়ে রেণুকে খবর দিয়ে এসেছেন, আর আমার বাড়িতে যে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ স্বরূপ কিছু তামাকও নিয়ে এসেছেন। বললেন, আপনার বাড়ির সকলে ভাল আছে। আপনিও ভাল আছেন বলে এসেছি।
একটু নিশ্চিন্ত হলাম এই জন্য যে আমি যে কোথায় কি অবস্থায় আছি কেউই জানে না। একাকী কামরায় রাত্রদিন থাকা যে কি ভয়াবহ অবস্থা তাহা ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না। দিন কাটতে চায় না। বাইরে যেয়ে একটু হাঁটাচলা করবো তারও উপায় নাই। সূর্যের আলোও গায়ে স্পর্শ করার উপায় নাই। লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি নিজেরই ধুতে হয়। বিছানা নিজেরই করতে হয়। ধোপা কাপড় নিয়ে যায়, তবে ইচ্ছা মাফিক সময় লাগায়। আর আমি তো লুঙ্গিই পরি। নিজেই ধুয়ে নেই। কাপড় ধুবার সাবান যাহা ছিল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখন কি করি। গেঞ্জি তো রোজই ধুতে হয়। সাবান কোথায় পাওয়া যাবে? সাবান যখন ফুরিয়ে গেল তখন গায়ে দেওয়া সাবান দিয়েই গেঞ্জি ধুতে আরম্ভ করলাম। একদিন মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমার উপর পাহারারত ছিলেন। বললাম, সাবান পেতে পারি কেমন করে। টাকা আমার আছে, কিনবার অনুমতি থাকলে কিনে দিবার বন্দোবস্ত করলে বাধিত হব। তিনি একটি সাবান আমাকে আনাইয়া দিলেন। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম।
যেখানে থাকি সেখানকার আবহাওয়াও খুব ভয়াবহ বলে মনে হয়। মিলিটারি কাস্টডি কাকে বলা হয় তা তো পূর্বে জানতাম না। আমার থাকবার বন্দোবস্ত ভালই করা হয়েছে, কিন্তু যে খাবার দেয় তা খেতে আমার কষ্ট হয়। আমাশা রোগে অনেকদিন থেকে ভুগছি। রোজ রোজ গোস্ত ও রুটি খাই কেমন করে? পেটের ব্যথা শুরু হলো। ডাক্তার সাহেবরা আসেন ঔষধ দেন, কিছু দিন ভাল থাকি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। একদিন বললাম, রুটি আমি খেতে পারব না। আমাকে ভাত দেওয়ার বন্দোবস্ত করুন। দু’ একদিন পরেই ভাতের বন্দোবস্ত হলো। তবে গোস্ত চলল। অফিসার মেসে আমার খাবার বন্দোবস্ত, সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী-মাছ খেতে পারে না। এইভাবেই দিন চললো। তবে দিনে তিন চারবার চা খাবার বন্দোবস্ত হয়েছিল। চা না হলে আমার অসুবিধা হয়। এরপরে লেফটেন্যান্ট রাজা নসরুল্লা আজাদ কাশ্মীরের লোক, আমার কাছে ডিউটিতে আসতো। ভদ্রলোকের মনে খুবই দয়া। আমাকে খুব শ্রদ্ধা করতো। কারো কাছ থেকে কোনো দিন খারাপ ব্যবহার পাই নাই। খাবার কথা উঠলে তারা বলতো, কি করব আমরা যা খাই তাই আপনাকে দেই। আমার শরীর যে ভাল না, তা তারা বুঝতে পারতো। কোনো বদনা বা লোটা না থাকায় খুবই অসুবিধা হতো। একদিন ক্যাপ্টেন ওয়াহিদকে বললে তিনি নিজে টাকা দিয়ে একটা বদনা কিনে দিলেন।
আমিও কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি না। এই মেসে আর কোনো বন্দি আছে কিনা বুঝতে পারছি না। দরজাটা সকলেরই বন্ধ। এই কামরাটার খবর ছাড়া কিছুই জানি না। কারো কোনো চিঠি পাই না। রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে কি অবস্থায় আছে? আব্বা মা ভাই বোন কোথায় কি করছে, কেমন আছে? এমনিভাবে একাকী দিন কাটছে। কোনো খবর নাই। শরীরও দিন দিন খারাপ হতেছে। একদিন একজন কর্মচারী বলল, দিনভর বসে আর শুয়ে থাকবেন না, ঘরের ভিতর যে জায়গাটুকু আছে সেখানে হাঁটাচলা করুন। কথাটা আমার মনে ধরল। যদিও ছোট্ট কামরা, ৩ ঘণ্টা সকালে দুপুরে বিকালে আপন মনে হাটতাম। খোদা ছাড়া কেইবা সাহায্য করতে পারে! দেশের কোথায় কি হতেছে? দুনিয়ায় কি ঘটছে? কোনো কিছুর খবর নাই। কাগজ পড়া নিষেধ! রেডিও শুনতে পারব না। কারো সাথে কথা নাই। দিন কাটাও। মনে মনে ভাবতাম, আমি তো ৭/৮ বৎসর জেল খেটেছি, আমার অবস্থাই এই। আর অন্য কাহাকে এনে থাকলে তাদের অবস্থা কি হয়েছে? এনেছে অনেককে গ্রেপ্তার করে। তবে কতজন এবং তারা কারা? ২৮ জনের নাম দেখেছিলাম কাগজে। নতুন কাকেও এনেছে কিনা! দিনগুলি কি কাটতে চায়! তবুও কাটাতে হবে। বই পেয়ে একটু রক্ষা পেয়েছিলাম।
অতিথিশালায় আমি থাকি, আর মেসে অন্য কোনো হতভাগা আমার মতো আছে কিনা, খবর নেওয়ার উপায় নাই। কেহ কিছু বলে না। সন্ধ্যার পরে আলো বন্ধ করে আমাকে নিয়ে বাইরে কিছু সময় বেড়াবার হুকুম ছিল। আমি এই সময়টুকুর জন্য দিনভর অপেক্ষা করতাম। বাইরে যখন হাঁটতাম তখন দেখতে চেষ্টা করতাম কেহ আছে কিনা। একদিন দেখলাম তিনটা দরজা বন্ধ, অন্য দরজাগুলি খোলা। বুঝতে পারলাম বোধহয় আরও তিন হতভাগা এখানে আছে।
আমাকে সন্ধ্যার পরে আলো বন্ধ করে মেস এরিয়ার বাইরে একটা রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। একজন অফিসার আমার সাথে সাথে হাঁটতো আর দু’জন মিলিটারী রাস্তার দুইদিকে পাহারা দিত। কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারত না। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হতো। কয়েকদিন বেড়াবার পরে আমার একটু সন্দেহ হলো। মেস এরিয়ার মধ্যে এত জায়গা থাকতে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেওয়া হচ্ছে কেন? দু একজনের ভাবসাবও ভাল মনে হচ্ছিল না। একটা খবরও আমি পেলাম। কেহ কেহ ষড়যন্ত্র করছে। আমাকে হত্যা করতে। আমাকে পিছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। তারপর বলা হবে পালাতে চেষ্টা করেছিলাম, তাই পাহারাদার গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো জায়গাটা মেসের বাইরে। জনসাধারণ বা অন্য কাউকে দেখাতে পারবে যে আমি ভেগে বাইরে চলে গিয়াছিলাম তাই গুলি করা হয়েছে। আমি যে ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পেরেছি এটা কাহাকেও বুঝতে না দিয়ে বললাম, এরিয়ার বাইরে বেড়াতে যাবো না। ভিতরেই বেড়াব। ষড়যন্ত্রকারীরাও বুঝতে পারল যে আমিও বুঝতে পেরেছি। আমি অফিসারদের সামনেই বেড়াতাম। আর একটা খবরও পেয়েছিলাম পরে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নাকি বলে দিয়েছেন, আমার উপর যেন শারীরিক কোনো অত্যাচার না হয়। আমিও কথায় কথায় কর্মচারীদের জানাইয়া দিয়েছিলাম, আমার গায়ে যদি হাত দেওয়া হয় তবে আমি আত্মহত্যা করব। জানি ইহা একটি মহাপাপ। কিন্তু উপায় কি? মানসিক অত্যাচার যাহা করেছে তাহার চেয়ে গুলি করে মেরে ফেলা অনেক ভাল। দুই একজন ছাড়া থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সকলেই ভাল ব্যবহার করেছিল।
আমার সাথে আবহাওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিষয় কেহই আলোচনা করত না। একজন অফিসার সর্বক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখতেন। আমি কি করি, কি অবস্থায় থাকি। মাঝে মাঝে দুই একজন সাদা পোশাক পরিহিত সামরিক কর্মচারী আমার সাথে আলাপ করতে আসতেন জানবার জন্য। যাকে ইন্টারগেশন করা বলা হয়। আমার কোনো ধারণা নাই-কিছুই জানি না এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা সম্বন্ধে। তবে কথার ভিতর থেকে বুঝতে পারতাম আমার স্ত্রী সহ অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, কিছুসংখ্যক সিএসপি অফিসার, দুই একজন পুলিশ অফিসার, একজন বিখ্যাত সাংবাদিককেও জড়িত করবার চেষ্টা চলছে। কিছু সংখ্যক অতি উৎসাহী সামরিক কর্মচারী একদম পাগল হয়ে গেছে বলে মনে হয়। বিরাট কিছু একটা হয়ে গেছে। দেশকে রক্ষা করবার সমস্ত দায়িত্বই যেন তাদের উপরই পড়েছে। একটু গন্ধ পেলেই হলো, আর যায় কোথায়-একদম লাফাইয়া পড়ে অত্যাচার করার জন্য। তাদের ধারণা পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সকলেই রাষ্ট্রদ্রোহী। বুদ্ধি আক্কেল সকল কিছু পশ্চিম বাংলা থেকে চালান হয়ে ঢাকা আসে। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় পূর্ব বাংলার ব্যবসা বাণিজ্য টাকা পয়সা জমিজমা হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত। দুই একজন আমাকে কথায় কথায় বলেছে এখনও বাঙালিরা হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত এবং তাদের উপরই নির্ভরশীল। কিন্তু কোথায় যে হিন্দুদের কর্তৃত্ব আমার জানা নাই। বর্ণ হিন্দুরা প্রায় সকলেই পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলে গেছে, কিছুসংখ্যক নিম্ন বর্ণের হিন্দু আছে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেকটা কর্মচারীর ধারণা পূর্ব বাংলার লোক হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত।
কুর্মিটোলায় সামরিক বাহিনীর ১৪ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারই পূর্ব পাকিস্তানের হেডকোয়ার্টার। এখানে থাকলে বোঝা যায় যে কুর্মিটোলা একটা পাঞ্জাবি কলোনী। এখানে বাঙালি চোখে খুবই কম পড়ে। থার্ড পাঞ্জাব মেসে থাকতাম। সেখানে একজন মালি আর একজন বেয়ারা ছাড়া বাঙালি ওষুধ করতেও পাওয়া যায় না।
বাঙালি খানা এখানে পাওয়ার উপায় নাই। পাঞ্জাবি খানাই খেতে হতো আমাদের। বাবুর্চিও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি। কিভাবে যে এই খাওয়া খেয়ে বেঁচে আছি জানি না। জান বাঁচানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন তাই খেতে বাধ্য হতাম। অনেক বলেও একজন বাঙালি বাবুর্চি রাখাতে পারলাম না।
তাদের কথা, সিকিউরিটির জন্য বাঙালি বাবুর্চি রাখা যায় না। একটা আশ্চর্য ব্যাপার আমার চোখে পড়ল। এমনভাবে মাসের পর মাস এদের সাথে থাকার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। এখানে থাকবার সুযোগ পেয়ে দেখলাম বাঙালিদের তারা ব্যবহার করতে প্রস্তুত, কিন্তু বিশ্বাস করতে রাজী নয়। আর বিশ্বাস করেও না। সকলকেই সন্দেহ করে। তাদের ধারণা প্রায় সকলেই নাকি আমার ভক্ত। মনে মনে সকলেই নাকি আলাদা হতে চায়। পূর্ব বাংলায় বাঙালির মুখ দেখতে পারি নাই কয়েকমাস এ কথা কি কেহ বিশ্বাস করবে? পাঁচ মাসের মধ্যে বাংলায় কথা বলতে পারি নাই। কারণ কেহই বাংলা জানে না। ঢাকা রেডিও এরা শোনে না। হয় কলম্বাে, না হয় দিল্লী-হিন্দি উর্দু গান শোনবার জন্য। বাংলা গান এরা বোঝে না বলেই শুনতে চায় না। বাংলা গান হলেই রেডিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। একজন বাঙালি ডাক্তার দেখতে আসতেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লা। নাম মেজর সফিক (ডা.)। তিনি কখনও একাকী আমাদের কামরায় আসতেন না। সাথে ডিউটি অফিসারকে নিয়ে আসতেন। কখনও বাংলায় কথা বলতেন না। ইংরেজি বা উর্দু। আমি তার চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি পূর্ব বাংলার লোক। বাংলায় আমি কথা বললে ইংরেজি বা উর্দুতে জবাব দিতেন। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, বোধ হয় বাংলা ভুলে গেছেন তাই উর্দু বলেন। তিনি বেহায়ার মত হাসতে লাগলেন। মনে হতো ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন। পরে তার সম্বন্ধে জানলাম তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বিবাহ করেছেন। বাড়ির সাথে কোনো সম্বন্ধ নাই। নিজকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে ভয় পান। যদি কেহ মনে প্রাণে বাঙালি হয় তবে তার ভবিষ্যতের দরজা বন্ধ। এই ষড়যন্ত্র মামলা ইনকোয়ারী শুরু হওয়ার পরে যে কয়েকজন সামান্য বাঙালি কর্মচারী সামরিক বাহিনীতে আছেন তাদের অবস্থা বড় করুণ। কখন যে গ্রেপ্তার হবে কে বলতে পারে। তাই তারা ভয়ে ভয়ে দিন কাটায়।
থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কোনো বাঙালি কর্মচারী বা সিপাহি নাই। যে অফিসার মেসে আমাকে রাখা হয়েছে, সেখানে একজন বয় আছে যার উপর হুকুম আছে আমাদের কাছে আসতে পারবে না। আর একজন লোককে জানলার ফাঁক দিয়ে দেখি, মালি। তাই বাংলা কথা বলার উপায় নাই-পূর্ব বাংলার মাটিতে থেকেও-একেই বলে অদৃষ্ট! প্রাণটা আমার হাঁপাইয়া উঠছিল, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। বাংলা বই পাওয়ার উপায় নাই। অফিসার মেসের যে ছোট লাইব্রেরি আছে তাতে কোনো বাংলা বই নাই, সমস্তই প্রায় ইংরেজি ও উর্দুতে। হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি থেকে মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমাকে দু’ একখানা এনে দিতেন। ভদ্রলোকও খুব লেখাপড়া করতেন। কোনো বাংলা বই বোধ হয় সেখানে নাই। খবরের কাগজ পড়া নিষেধ, তাই বাংলা কাগজ পড়ার প্রশ্ন আসে না। যে কয়েকজন অফিসার আছেন তারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, তারাই আমার ডিউটি করতেন। বাঙালিদের বোধ হয় ডিউটি দেওয়া নিষেধ ছিল। অন্য কোনো রেজিমেন্টে বাঙালি দুই একজন থাকলেও আমার কাছে আসার হুকুম নাই।