৭. হেমার ধারণা

রাহাতের সাথে হেমার বহুদিন দেখা নেই, কথা নেই। হেমার ধারণা ছিল রাহাত তাকে কখনো ফোন দিলো কি দিলো না, খবর নিলো কি নিলো না, এই নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু কদিন থেকেই তার মনে হচ্ছে, বিষয়টা আসলে তেমন না। বরং রাহাত তার কাছে একটা অভ্যাসের মতো হয়ে গিয়েছিল, আর সম্ভবত সেজন্যই রাহাতকে সে কখনোই আলাদা করে অনুভব করেনি। কিন্তু রাহাতের এমন হুট করেই অনভ্যাস হয়ে যাওয়াটাকে মেনে নিতেও যেন কিছু কষ্ট হচ্ছিল তার।

গত কয়েকটা দিন খুব অস্থিরতায় কাটছে হেমার। নিজের ভেতর নানান দ্বিধা, নানান প্রশ্ন, নানান সঙ্কট। হেমার ধারণা ছিল নিজের উপর বেশ ভালো। নিয়ন্ত্রণ আছে তার। কিন্তু এবার যেন নিজেকে কিছুতেই বশে আনতে পারছে না। শুধু তা-ই না। মাথার ভেতর এলোমেলা হয়ে জট পাকিয়ে থাকা অসংখ্য ভাবনাগুলো আলাদাও করতে পারছে না। আজ সকালে ঘুম ভেঙেই হেমার মনে হলো, রাহাতের সাথে কথা বলতে পারলে হয়তো কিছুটা হলেও ভালো লাগবে তার। আচ্ছা রাহাতকে একটা ফোন দিলে কেমন হয়? খানিক দ্বিধা নিয়েই। রাহাতকে ফোন দিলো সে। কিন্তু রাহাত ফোন ধরল না। সম্ভবত ঘুমুচ্ছে সে। ঘুম থেকে উঠে নিশ্চয়ই রাহাত ফোন ব্যাক করবে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে শীতের বিকেল নেমে এলো। রাহাতের ফোন তবু এলো না। বিকেলে আরেকবার ফোন করল হেমা। কিন্তু ধরল না রাহাত। ধরল না সন্ধ্যায়ও। হেমার কেমন অস্থির লাগতে লাগল। বিষয়টাকে পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা করল হেমা, কিন্তু পারল না। ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বাড়তেই লাগল। সন্ধ্যার পর আরো বেশ কয়েকবার ফোন দিলো সে। কিন্তু রাহাতের খবর নেই। হেমার এবার মন খারাপ হয়ে গেল।

রাহাত তাকে ফোন দিলো রাত বারোটার পর। হেমার কেমন একটা অভিমান জমেছিল বুকে। সে ধরবে না ধরবে না করেও শেষে ধরে ফেলল

ফোনটা। রাহাত ঝলমলে গলায় বলল, কিরে, কাজী অফিসে পালিয়ে বিয়ে করছিস নাকি। সাক্ষী দিতে হবে?

হেমা অবাক হলো। সে বলল, বুঝলাম না।

রাহাত বলল, না। আমাকে তুই এই প্রথম এতবার ফোন করেছিস! দেখে মনে হলো ওরকম কোনো জরুরি কিছু।

হেমা স্বাভাবিক গলায় বলল, ধ্যাৎ। অনেকদিন তোর কোনো খবর নেই এইজন্য। কই ছিলি?

রাহাত বলল, নতুন অ্যালবাম করছি। সারারাত-সারাদিন একটানা স্টুডিওতে।

হেমা বলল, বাহ্। তুই তো বেশ আছিস। এনিওয়ে, কনগ্র্যাটস।

রাহাত বলল, তোর কি হয়েছে বল তো? গলাটা এমন লাগছে কেন?

হেমা বলল, কই কিছু না তো!

রাহাত বলল, আমাকে লুকাস? পারবি? চাইলে হেমার মনস্তত্ব নামে আস্ত একটা বই লিখে ফেলতে পারি। তোর ব্যাড লাক, আমাকে রিফিউজ করে ফেললি। রাহাতের চেয়ে ভালো আর কেউ তোকে বুঝবে না রে। হা হা হা।

রাহাত হাসছে। প্রাণবন্ত হাসি। সেই হাসি শুনে হেমার যে খারাপ লাগছে। তা নয়, তবে কোথায় যেন সামান্য হলেও একটা শূন্যতা রিনরিন করে বেজে গেল। হেমা বলল, তুই আমাকে বুঝতে পারিস?

রাহাত কবিতার মতো করে বলল, তার ভাষা লেখা নাই বলে, শেখা হলো পর-লিপি পাঠ, বহুপথ ঘুরে এসে দেখি, সে আমার স্বরলিপি মাঠ।

হেমা বলল, বুঝলাম না।

রাহাত বলল, তোর বুঝতে হবে না। যত কম বোঝা যায়, তত ভালো। বেশি বুঝলেই বিপদ। কী হয়েছে বল। নয়ন ভাইকে নিয়ে কোনো ঝামেলা?

হেমা বলল, না।

রাহাত বলল, তাহলে?

হেমা বলল, তোকে ওইদিন বলেছিলাম, খেয়াল করিসনি বোধহয়। বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।

রাহাত বলল, হ্যাঁ, তাই তো! আমি এত ব্যস্ত ছিলাম কটা দিন। ভুলেই গেছিলাম। আচ্ছা কি হয়েছে বল তো?

হেমা ঘটনা যতটা সম্ভব খুলে বলল। শুনে রাহাত তরল গলায় বলল, তা তোর বাবার বিয়েতে আমাকে একটু গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে দে না প্লিজ? হাজার কুড়ি টাকা দিলেই হবে। অ্যালবামটা বের করতে গিয়ে ফতুর হবার মতো অবস্থা। এখন তো কেউ আর আমায় স্পন্সর করবে না।

হেমা বলল, এ কদিনেই দেখি সিরিয়াস বিষয় নিয়েও ফান করার একটা বদ অভ্যাস তোর হয়ে গেছে।

রাহাত বলল, তা না। নিজেকে বুঝিয়েছি, যা হবার তা এমনিই হবে। আর যা না হবার, তা কখনোই হবে না। শত চেষ্টাতেও না। এইজন্য টেনশন করা ছেড়ে দিয়েছি।

হেমা বলল, এখন ভালো আছিস?

রাহাত বলল, বেশ ভালো। এই তোর জন্য মাঝে-মধ্যে বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা হয়। মনে হয় ফোন দিয়ে বলি, তোর যে অফ হোয়াইট শাড়িটা আছে না, ওটা পরে একটু বের হ। রিকশায় ঢাকা শহরটা একটু চক্কর মেরে আসি। অবশ্য সাথে সাথেই নিজের মাথার পিছে চাট্টি মেরে নিজেকে বলি, আরে ব্যাটা বদের বদ, অন্যের বউয়ের সাথে লটরপটরের ইচ্ছে যে করছ, এই দিন কিন্তু দিন নয় বাবা। একদিন তোমারও বউ হবে। অন্য কারো কিন্তু তখন তাকে নিয়েও রিকশায় হুড নামিয়ে চক্কর দিতে ইচ্ছে করবে।

রাহাত আবারো হাসছে। হেমা বলল, তুই যে ভালো আছিস এটা খুব বোঝা যাচ্ছে। ভালো থাকার একটা সুবিধা কি জানিস, অন্যের কষ্টও স্পর্শ করে না।

রাহাত বলল, এটা তো তোর মতো কথা হলো না হেমা। তোকে তো আমার সব সময় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মনে হতো রে। যে যুদ্ধের মধ্যেও নিজের কথা ভুলে হাসিমুখে অন্যের সেবা করে যাবে।

হেমা বলল, কষ্ট হচ্ছে এমন একটা ব্যাপার, যা সবার থাকে। কিন্তু সবারটা দেখা যায় না। আর আনন্দ হচ্ছে এমন একটা ব্যাপার, যা সবার নেই, কিন্তু তারপরও সবারটাই দেখা যায়।

রাহাত বলল, ব্বাপস! কি কথারে বাবা। মাথার উপর দিয়ে গেল। বুঝিয়ে বল তো।

হেমা বলল, বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। সিম্পল। ধর কোনো কারণে আমার অনেক মন খারাপ। কিন্তু সেটি নানা কারণে আমি প্রকাশ করতে পারব না। যেখানে-সেখানে বসে কাঁদতে পারব না। মন খারাপ করে থাকতে পারব না। সেটার জন্য আমাকে আমার ঘরে আসতে হবে। নির্জন কোথাও যেতে হবে। কিন্তু আমার সেই প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়েও কোনো কারণে আমার মুখটা হাসি হাসি হলো, বা হেসে ফেললাম, ওই হাসিটা কিন্তু কোনোভাবেই আমার আনন্দ প্রকাশের হাসি নয়। কিন্তু যারা দেখবে তারা ভাববে, বাহ, মানুষটা কত ভালো আছে। আনন্দে আছে। অথচ আনন্দটা কিন্তু আমার নেই।

রাহাত বলল, ওয়েল। নাও কাম টু দ্য পয়েন্ট। আঙ্কেল আন্টির এখন কী অবস্থা?

হেমা বলল, মা আলাদা বাসা নিয়েছে। আমিও আপাতত সেখানে থাকছি। যদিও গতকাল আবার আগের বাসায় এসেছিলাম। তারপর আর ফিরতে ইচ্ছে করল না। রাতটা তাই এখানেই থেকে গেছি। এখনও এখানেই আছি। মাঝখানে কিছু সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল ডিভোের্সটা বোধহয় ঠেকিয়ে দিতে পারব। কিন্তু বাবার সাথে গতকাল আবার কথা হলো, মার রিসেন্ট কিছু আচরণে প্রচণ্ড ক্ষেপে গেছেন বাবা।

রাহাত বলল, কি বলেছেন আঙ্কেল?

হেমা বলল, বাবা বলেছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাকে নোটিশ পাঠাবেন তিনি।

রাহাত বলল, কোনোভাবেই ঠেকানো যায় না?

হেমা বলল, এখন আর মনে হচ্ছে না।

রাহাত বলল, এক কাজ কর। তুই উনাদের বল, তুই নয়ন ভাইকে শীঘ্রই বিয়ে করবি। যেহেতু তোর বিয়ে। সুতরাং তোর বিয়ের আগে উনাদের ডিভোর্স হলে এটার একটা বাজে ইমপ্যাক্ট পড়বে তোর বিয়ের উপর। তাই তাদের উচিত ঘটনাটা বিয়ের পরে ঘটানো। তারপর দেখবি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর বিয়ে তো এখনই হচ্ছে না। ধর বছরখানেক কাটিয়ে দিলি। এরমধ্যে চেষ্টা করবি দুজনের আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা গ্রো করানোর। ধর বিয়ের শপিং করার জন্য বাবা-মাকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে যেতে পারিস। এই সময়টা দেখবি দুজন একসাথে সময় কাটানোর একটা সুযোগ পাবে। তারপর ধর মেয়ের। বিয়ের আয়োজন, নানান প্রিপারেশন, কেনাকাটা, আরো হাজারটা কাজ। দুজন না চাইলেও মিলে-মিশে করতে হবে। তারপর বিয়েটা হয়ে গেলেও তোর নতুন সংসার। খুব স্বাভাবিক, তখন চাইলেই হুট করে তারা ডিভোর্সটা নিবেন না। কারণ তোর নতুন সংসারে এর একটা ইমপ্যাক্ট পড়তে পারে, তাই না? সো, আই থিঙ্ক, ইট উইল বি আ গুড প্ল্যান। এফিসিয়েন্ট অ্যাজ ওয়েল।

রাহাত কথা শেষ করলেও হেমা কিছু বলল না। সে চুপ করে রইল দীর্ঘ। সময়। রাহাতের কথাগুলো শোনার সময় তার কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল। অনুভূতিটা বিয়ে সংক্রান্ত। হেমা কখনোই তার বিয়ে নিয়ে এভাবে ভাবেনি। আজ প্রথম এক ঝলকের মতো সেই ভাবনাটা উঁকি দিয়ে গেল। মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য হলেও রাহাতের কথাগুলো শুনতে গিয়ে হেমার। কেমন একটা অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি হচ্ছিল। তার অবচেতন কল্পনায় কিছুক্ষণের জন্য কিছু ছবি ভেসে উঠেও আবার মিলিয়ে গেল।

হেমার এখন মনে হচ্ছে রাহাতের বুদ্ধিটা ভালো। সে যদি এখন বাবা মাকে তার বিয়ের কথা বলে, তাহলে নিশ্চিত করেই তারা তাদের ডিভোর্সটা নিয়ে এই মুহূর্তে আর কোনো কথা বলবেন না। কিন্তু হেমা এটি কখনোই করবে না। সে চায় না কোনো কৌশল করে তাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছেটাকে আটকে রাখতে। তারা থাকলে কেবল পরস্পরকে অনুভব করে, ভালোবেসেই যেন থাকে।

রাহাতের শেষ কথাটায় তার বিয়ের কথা আছে বলেই কিনা কে জানে, হেমার একটা অস্বস্তিও হতে লাগল। অস্বস্তিটা নয়নকে নিয়ে। সেদিন চলে যাবার পর নয়নের সাথে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি হেমার। সে জানে না কেন, তার আর ফোন দিতেও ইচ্ছে হয়নি নয়নকে। বিষয়টা ঠিক তার বোঝাঁপড়ার সাথে যায় না। কিন্তু সেদিন নয়ন যাওয়ার পর পরই হেমা একা বসেছিল তার ঘরে। সারাটা দিন যেন স্তব্ধ হয়েছিল। তার তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে খানিক আগে যে কথাগুলো নয়ন তাকে বলেছিল, সেই কথাগুলো আসলেই সত্যি। তার বারবার কেবল মনে হচ্ছিল এটি বাস্তবের কোনো ঘটনা নয়। বরং সে নানান বিষয় নিয়ে এলোমেলো বলে এগুলো তার বিধ্বস্ত ও উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কষ্টপ্রসূত কল্পনা।

হেমার আর কথা বলতে ভালো লাগছিল না। সে ফোনটা রেখে দিলো। কিন্তু ফোন রাখার পরপরই আবার সেই চিন্তা, এখন কি করবে সে? এই প্রশ্নটা হেমা নিজেকে অসংখ্যবার করেছে। হেমা যে জানে না এখন তার কি করা উচিত, তা নয়। তার এখন নয়নের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো উচিত। শক্ত করে নয়নের হাতখানা ধরা উচিত। এ সবই হেমা জানে। কিন্তু কি যেন একটা তার সকল ভাবনাকে আটকে দিচ্ছে, এলোমেলো করে দিচ্ছে। নিজেকে প্রচণ্ড সংকীর্ণমনা মনে হচ্ছে তার। এতদিন নিজেকে নিয়ে একটা চাপা গর্ব তার ছিল যে সে যুক্তি দিয়ে ভাবতে জানে। সে মানুষ হিসেবে অনুদার নয়। তার চিন্তার দরজা জানালাগুলো বন্ধ নয়। কিন্তু এই প্রথম তার নিজেকে প্রচণ্ডরকম সংকীর্ণ এবং অনুদার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সবকিছু জেনে বুঝেও সে একটা নির্দিষ্ট সংস্কার থেকে বের হতে পারছে না।

এই সংস্কারটা অনেকটা গলায় আটকে থাকা মাছের চোরা কাটার মতো। এমনিতে যার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না, কিন্তু ঢোক গিলতে গেলেই একদম উঁচ হয়ে ফোটে। অনুভূতিটার জন্য হেমার মধ্যে একটা প্রবল অপরাধবোধও কাজ করছিল। সেই অরাধবোধ থেকেই কিনা, সেদিন সন্ধ্যায় সে শেষ অবধি নয়নকে ফোনও দিয়েছিল। কিন্তু নয়নের ফোন অফ। এই ফোন অফ নিয়েও হেমা তার নিজের ভেতর একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করল। সে মনে মনে খুব করে চাইছিল, নয়ন যেন ফোনটা না ধরে। কিংবা নয়নের ফোনটা যেন অফ থাকে। তাহলে? তাহলে সে ফোন কেন দিলো? দায় সারবার জন্য? নিজের কাছে নিজেকে পরিষ্কার প্রমাণ করবার জন্য?

হেমা সেইরাতে ঘুমায়নি। ঘুমায়নি পরের দু’রাতও। তবে এর মধ্যে নয়নকে আরো বারকয় সে ফোন দিয়েছিল। কিন্তু নয়নের ফোন আর খোলেনি। নয়নকে নিয়ে কোনো অস্থিরতা যে তার মধ্যে কাজ করছে না, তা নয়। কিন্তু সেটি এতটাও প্রবল নয় যে যতটা প্রবল হলে সে নয়নের খবর নেয়ার জন্য নয়নের বাসা অবধি ছুটে যেতে পারত। আজ যে সে রাহাতকে ফোন দিয়েছিল, তাও ওই নয়নের জন্য লাগা তার অস্থিরতাটার জন্যই। কিন্তু ঘটনাটা সে কোনোমতেই রাহাতকে বলতে পারছিল না। এই বিষয়টিই আসল। এই ঘটনাটি সত্যিকার অর্থেই জনে জনে বলে বেড়ানোর ব্যপার নয়।

কতক্ষণ একা বসেছিল হেমা জানে না। রাহাতের ফোনে ঘোর কাটল তার। ফোন ধরতেই রাহাত বলল, খুব মন খারাপ তোর?

হেমা কথা বলল না। রাহাত বলল, মন খারাপের কারণটা বলবি?

হেমা বলল, বলেছি তো!

রাহাত বলল, আসল কারণটা বলিসনি। এতদিনে তোকে আমি এইটুকু চিনি না বলতে চাস? আচ্ছা না বলতে চাইলেও ক্ষতি নেই। কেবল মান খারাপ করে থাকিস না।

হেমা হাসল, যদি চাইলেই মন খারাপ না করে থাকা যেত, তাহলে কত সহজ হতো সবকিছু তাই না?

রাহাত বলল, সহজ না, আরো কঠিন হয়ে যেত। ধর তোর খুব কাছের, খুব প্রিয় কোনো মানুষ খুব খারাপ একটা সময় কাটাচ্ছে। তার সেই খারাপ সময়টা নিয়ে তোর কষ্ট হচ্ছে, মন খারাপ হচ্ছে। এখন যদি এমন হতো যে তুই দুম করে সেই মন খারাপটা খেদিয়ে দিতে পারলি। তখন কি হবে বল তো? তখন তুই তার কষ্টটা আর বুঝতে পারবি না। ফলে তোকে যখন তার সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন তোর তাকে মনে হবে সবচেয়ে বেশি অদরকারি। কোনো। সম্পর্কের জন্য এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে?

রাহাতের কথায় থমকে গেল হেমা। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। আচ্ছা, রাহাত কি তার ভেতরটা দেখতে পায়? এমন সহজ করে, এমন স্পষ্টতায় সে তাকে পড়ে ফেলে কীভাবে?

রাহাত বলল, আমি জানি না কি হয়েছে। তবে নিশ্চিত করেই নয়ন ভাই সম্পর্কিত কিছু। একটা কথা বলি, শেষ কিছুদিন তাকে যেভাবে দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে মানুষটা অসম্ভব খারাপ একটা সময় পার করছে। এ সময় কোনো কিছু নিয়ে তার উপর অভিমান, কষ্ট-ক্ষোভ হলেও তা দেখাস না। তার সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা কর। তুই ছাড়া সে যে কতটা অসহায় বুঝিস?

হেমা কথা বলল না। কিন্তু তার বুকের ভেতর কি এক তোলপাড় শুরু হয়েছে। রাহাত বলল, তোকে কখনো একটা কথা বলা হয়নি। আজ বলছি। পৃথিবীর সকল মেয়েই মা হতে জন্মায়। এইজন্যই আল্লাহ তাদের এমন অসাধারণ কিছু বিষয় দিয়েছেন, যা পুরুষকে দেননি। ধর, তুই অসুস্থ হলি, তোর সবার আগে মনে পড়বে তোর মায়ের কথা। মায়ের শরীরের ঘ্রাণের কথা, আঁচলের স্পর্শের কথা, কিন্তু বাবার কথা না। এমন নয় যে তোর বাবা তোকে তোর মায়ের চেয়ে কম ভালোবাসেন। কিন্তু মায়েদের কি যেন একটা আছে। একটু স্পর্শ, একটু ঘ্রাণ, একটু মমতা, সবকিছু নিমেষেই ঠিক করে দেয়। তোকে যেটা কখনো বলা হয়নি সেটা হলো বেশিরভাগ মেয়েরাই তাদের সন্তান। হবার পরে তারা মা হয়ে ওঠে। কিন্তু খুব কম কিছু মেয়ে আছে যারা তার নিজের জন্মের পরপরই মা হয়ে যায়। সেই এতটুকুন বয়সেই তাদের কথায়, স্পর্শে, ঘ্রাণে একদম ওই মা মা ব্যাপারটা থাকে। তারা যেখানে যায়, সেখানটা একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে যায়। তুই সেই খুব অল্প কিছু মেয়েদের একজন। তোর মধ্যে একটা প্রবল মা মা ব্যাপার আছে। তুই যখন আমার কাছে থাকিস, আমার এত শান্তি লাগে। এত নির্ভার লাগে। মনে হয় কোনো চিন্তা নেই, কোনো ভয় নেই, কোনো অশান্তি নেই। এটা কেবল আর তখন হয়, যখন মার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকি। আর কখনোই না। অদ্ভুত না?

হেমা কথা বলতে পারল না। তার গলার ভেতর কি জানি দলা পাকিয়ে উঠছে। সে সেটিকে আটকে রাখতে চেষ্টা করছে। শেষ অবধি পারবে কিনা কে জানে! রাহাত বলল, নয়ন ভাইয়ের কাছে তুই ঠিক এরকম একটা মানুষ। কিংবা কে জানে, হয়তো এর চেয়েও বড় কিছু। উনি অন্তর্মুখি স্বভাবের বলে হয়তো তোকে কখনো আমার মতো করে বলেননি। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় আশ্রয়ের জায়গাটা তুই। সবচেয়ে বড় ছায়া। তুই না থাকলে তিনি পুরোপুরি অসহায় একজন মানুষ তিনি।

হেমা কি বলবে! সে বলার জন্য কত কত শব্দ, কত কত বাক্য যে পাগলের মতো আতিপাতি করে খুঁজে বেড়ালো। কিন্তু পেল না।

রাহাত বলল, উনার সাথে কিছু হলেও, এটলিস্ট এই মুহূর্তে উনার থেকে দূরে সরে থাকিস না। কিছু মুহূর্ত থাকে নিজের কষ্ট, অভিমান, দুঃখগুলোকে একপাশে সরিয়ে রেখে হলেও প্রিয় মানুষটার পাশে থাকতে হয়। শক্ত করে তার হাত ধরতে হয়।

হেমা হঠাৎ ভেঙে পড়ল। এমন করে ভেঙে পড়ার মানুষ সে নয়। কিন্তু এই এতদিনে কত কত ক্ষত, কত কত কষ্ট, কত কত ভাবনা যে সে তার বুকের ভেতর সযতনে আড়াল করে রেখেছিল, তা কেবল সে নিজে জানে। সেগুলো জমে জমে বুকের ভেতর যেন আস্ত এক হিমালয় হয়েছিল। রাহাত যেন তার কথার ওমে সেই হিমালয় গলিয়ে দিলো।

রাহাত ফোন কানে চেপে ধরে চুপ করে রইল। হেমা দীর্ঘ সময় পর বলল, আমি ভালো মানুষ নই রাহাত। মানুষ কখনোই নিজেকে পুরোপুরি চিনতে পারে না। কোনো একটা বিশেষ ঘটনায়, কোনো একটা বিশেষ মুহূর্তে তার আজন্ম চেনা নিজটাও হয়ে যেতে পারে অচেনা। এতদিন ধরে সে তার নিজের সম্পর্কে যা ভেবেছে, তা এক নিমেষেই ভুল প্রমাণিত হতে পারে। আমি আমার নিজেকে এতদিন চিনতে পারিনি রাহাত। আমি একটা ভুল মানুষ। তোরা আমার আসল ভেতরটা দেখতে পাস না বলে আমাকে এত ভালো ভাবিস। কিন্তু আমি অত ভালো কেউ নই। আমি প্রচণ্ড স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক আর সংকীর্ণমনা একজন মানুষ!

রাহাত বলল, একটা ঘটনা দিয়েই তো একজন মানুষকে পুরোপুরি বিচার করা যায় না। তবে ভুল করা অপরাধ না হেমা, অপরাধ সেই ভুলের জন্য অনুশোচনা না হওয়া। অপরাধবোধ না হওয়া।

হেমা বলল, অপরাধবোধে কি কিছু বদলায় রাহাত?

রাহাত বলল, বদলায়।

হেমা বলল, কি বদলায়?

রাহাত বলল, মানুষটা সেই একই ভুল আর করবে না।

হেমা বলল, কিন্তু সেই ভুলটা করবার সুযোগ যদি ওই একবারই থাকে?

রাহাত বলল, তাহলে অন্য কোনো ভুল করবার আগে সেই ভুলটার কথা তার মনে পড়বে। সে চেষ্টা করবে যতটা সম্ভব ওটার অপরাধবোধটা মনে রাখতে।

হেমা আবার চুপ করে রইল। তারপর বলল, কোনো একটা কিছু যদি মেনে নিতে চেয়েও, মেনে নেয়ার চেষ্টা করেও মেনে নিতে না পারি, সেটা কি দোষ রাহাত?

রাহাত বলল, আমরা কি সব সময় কেবল মনের কথাই শুনি? না শোনা উচিত? আমাদের কিছু বোধের জায়গা, কিছু দায়বদ্ধতার জায়গা থাকে না? না হলে কি এই এত এত সম্পর্ক টিকত? কেউ কাউকে মেনে নিতে না পেরেই যদি হুট করে সরে যেত, তাহলে যে তার উপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার পতন কে রোধ করত?

হেমা বলল, কিন্তু যদি দ্বিধা থেকেই যায়? যদি মন খচখচ করে? তাহলে কি সেই দ্বিধা নিয়ে একটা দীর্ঘ জীবন শুরু করা উচিত?

রাহাত বলল, নিশ্চয়ই না। তবে দ্বিধার কারণটা কতটা যৌক্তিক সেটা ভেবে দেখা উচিত। একটা সম্পর্ক যেমন এমনি এমনি করে হয় না। তার শেষটাও না। সময় দরকার। আমি জানি না, নয়ন ভাইয়ের সাথে তোর এমন কি হয়েছে? তবে এইটুকু জানিস, সিদ্ধান্ত যাই হোক, সেটা এখনই নিস না। উনাকে উনার এই খারাপ সময়টা থেকে বের হতে দে। খারাপ সময়ে কাউকে ফেলে চলে যাওয়ার মতো জঘন্য কিছু আর নেই।

হেমা আবার চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎই বলল, তোকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রাহাত। আমার খুব খারাপ সময় যাচ্ছে, খুব। আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। একজন দুর্বল মানুষ অন্য একজন দুর্বল মানুষকে ধরে রাখতে পারে না। সবল করতে পারে না। আমাকে শক্ত হতে হবে। অনেক শক্ত। তুই আমাকে একটু সময় দিবি? আমি তোর সাথে কিছুটা সময় কাটাতে চাই। আমার কিছু শক্তি দরকার।

রাহাত বলল, দেব না কেন? অবশ্যই দেব।

হেমা বলল, কিন্তু এখনো তো ফজরের আজানই হয়নি। সকাল হতে তো সেই কত দেরী! ফজরের আজানের আগে তো বাসার গেটই খুলবে না। আচ্ছা, আমি আলো ফোঁটার সাথে সাথেই বের হবো। তুই বল কোথায় আসতে হবে আমাকে?

রাহাত বলল, বারান্দায়।

হেমা বলল, মানে?

রাহাত বলল, আমার সাথে দেখা করতে হলে বারান্দায় আসতে হবে।

মুহূর্তেই হেমার কি যেন মনে হলো! সে ফোন কানেই লাফ দিয়ে খাট থেকে দৌড়ে বারান্দায় এলো। বারান্দার নিচের সরু রাস্তাটায় একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে রাহাত। সে হেমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হেমা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। তার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছে না। রাহাতের পাশে একটা বাইক। রাহাত সেই বাইক দেখিয়ে ফোনেই বলল, এটা আমার নতুন গার্লফ্রেন্ড। গত সপ্তায় কিনেছি। তোর সাথে দেখা করাতে নিয়ে এলাম।

হেমাও ফোন কানে চেপে ধরেই বলল, তুই কখন এসেছিস?

রাহাত বলল, তুই প্রথমবার ফোন কেটে দেয়ার পরই। এখানে এসে তারপর তোকে ফোন দিয়েছি।

হেমা বলল, এই এতক্ষণ তুই ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমার সাথে কথা বলেছিস?

রাহাত বলল, কি করব বল?

এতরাতে তোর বাসায় ঢুকতে গেলে দারোয়ান নির্ঘাত আমাকে গুলি করত।

হেমা বলল, এখন তাহলে কি করবি?

রাহাত বলল, গেট খোলা অবধি দাঁড়িয়ে থাকব।

হেমা বলল, তারপর?

রাহাত বলল, তোকে একটা ভোর দেখাবো। তুই সেদিন রাতে আমাকে একটা অদ্ভুত ভোর দেখিয়েছিলি। তেমন একটা ভোর।

হেমা বলল, কেমন ভোর?

রাহাত বলল, নতুন ভোর। এই ভোরের আলোটা দেখলেই তোর মনে হবে কি তোর বুকের দরজা-জানালাগুলো সব একটা একটা করে খুলে গেল। সেই খোলা দরজা-জানালায় হু হু করে ঢুকে পড়ল ভোরের হাওয়া। তোর হঠাৎ করে কি মনে হবে জানিস?

হেমা বলল, কী?

রাহাত বলল, তোর হঠাৎ করেই মনে হবে তুই একটা নতুন মানুষ। এই মানুষটার ভেতরে পুরোনো কোনো দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। আর ভুল কিছু থাকলেও তা নিজের কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে খুব। সেগুলো তখন ঝেড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধা হবে না।

হেমা চুপ করে রইল। এইটুকু দূরত্বে প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা কথা বলছে ফোনে। কী অদ্ভুত! কিন্তু হেমার কাছে কেন যেন বিষয়টা অদ্ভুত লাগছে না। বরং তার কাছে মনে হচ্ছে বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক। ভোরের আলো ফোঁটা অবধি হেমা আর রাহাত সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। তারা ভোরের অপেক্ষায় আছে। একটা নতুন ভোরের। ভোর আসছে।

*

নয়ন বলল, বাবা, আমি মরে গেলে তোমার তো অনেক কষ্ট হবে তাই না?

ফখরুল আলম কিছুক্ষণ নয়নের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, এটা কেমন কথা বাবা?

নয়ন বলল, তুমি এত আপসেট হচ্ছ কেন বাবা? মানুষ তো যে কোনো সময় মরে যেতে পারে তাই না? শুধু আমি কেন? তুমিও তো মরে যেতে পারো।

ফখরুল আলম বললেন, তা ঠিক।

নয়ন বলল, তোমার অনেক কষ্ট হবে তাই না?

ফখরুল আলম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি মরে গেলে তোর কষ্ট হবে না?

নয়ন বললে, হু হবে। কিন্তু কেন কষ্ট হবে বাবা?

ফখরুল আলম বললেন, তোর বাবা মরে গেলে তোর কষ্ট হবে, এটাই তো স্বাভাবিক তাই না?

নয়ন বলল, কেন স্বাভাবিক? বাবা আর সন্তানের মধ্যে এমন কি আছে যে বাবা মারা গেলে সন্তানকে কষ্ট পেতে হবে?

ফখরুল আলম বললেন, সম্পর্ক, মায়া।

নয়ন বলল, সম্পর্ক আর মায়া তো বাবা ছেলে না হয়েও হওয়া যায়। যায় না?

ফখরুল আলম বললেন, তা যায়। তারপরও একজন বাবা জন্মের পর থেকে তার সন্তানকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেন। তাকে প্রথম চোখ মেলে তাকাতে দেখেন। প্রথম হাসতে দেখেন, বাবা বলে ডাকতে দেখেন। হামাগুড়ি দেয়া থেকে দৌড়াতে দেখেন। আরো কত কি!

নয়ন বলল, এ কারণেই মায়াটা জন্মায়, তাই না বাবা? কাছে থাকার কারণে? দীর্ঘ একটা জীবন কাছে থাকার কারণে?

ফখরুল আলম বললেন, হ্যাঁ। তা-ই হয়তো। তবে রক্তের একটা ব্যাপার তো থাকেই। বাবা-সন্তানের মধ্যে যে রক্তের সম্পর্কটা থাকে। এটার কি কোনো তুলনা হয়? ব্যাখ্যা হয়?

নয়ন বলল, ধরো হাসপাতালে কোনো একটা বাচ্চা অন্য একটা বাচ্চার সাথে বদলে গেল। বাবা-মা জানেন না যে তাদের কাছে যেই সন্তানটি রয়েছে, সেই সন্তানটি আসলে তাদের সন্তান না। সেই সন্তানটি অন্য কারো। কিন্তু তারা সেই সন্তানটিকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করলেন। এখন এই সন্তানটি কিন্তু তাদের রক্তের কেউ না। তাহলে তার প্রতি কি তাদের মায়া কম হবে বাবা? তারা কি বুঝতে পারবেন যে এই সন্তান তাদের রক্তের না?

ফখরুল আলম খানিক থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন, না। তা না। সেটা তো বোঝার কথা না।

নয়ন বলল, তাহলে? রক্ত তো আলাদা করে চেনার কিছু নেই বাবা। আসল ব্যাপার হচ্ছে মায়া। আসল ব্যপার হচ্ছে সৃষ্টি। সবাই তার সৃষ্টিকে ভালোবাসে। ধরো কেউ একটা কাগজের নৌকা বানালো, অন্য একজনের বানানো নৌকার চেয়ে হয়তো তার নৌকাটা বানানো খারাপ হয়েছে। দেখতে খারাপ হয়েছে। তারপরও কিন্তু সে তার নৌকাটাকেই বেশি ভালোবাসবে, তাই না? ধরো স্রষ্টা আমাদের সৃষ্টি করেছেন। বাবা-মা’র মাধ্যমে তিনি আমাদের পৃথিবীতে পাঠান। কিন্তু অবচেতনেই বাবা-মায়ের মধ্যে এই ভাবনাটা কাজ করে যে এই সন্তানটা তাদের দুইজনের সংমিশ্রণে সৃষ্টি, ভালোবাসায় সৃষ্টি। এই সন্তানটার মধ্যে তারা রয়েছেন। এটা সেই সন্তানের প্রতি তাদের প্রথম অ্যাফেকশন। তারপর তারা সেই সন্তানকে প্রতিদিন একটু একটু করে তৈরি করেন। নানাভাবে। সাথে তৈরি হয় মায়া। এখন তারা যদি সেই সন্তানের রক্তের বাবা নাও হয়ে থাকেন, তাদের মায়াটা, ভালোবাসাটা কিন্তু কিছু কমবে না বাবা। বাবা-মায়ের প্রতি সেই সন্তানের ভালোবাসাটাও কিন্তু সত্যিকারের কোনো বাবা-মায়ের চেয়ে কম হবে না। সেও তাদের আর সকল সন্তানের মতোই ভালোবাসবে। বাসবে না বাবা?

ফখরুল আলম বললেন, হ্যাঁ বাড়বে।

নয়ন বলল, তাহলে ওসব রক্তক্ত কিছু না। তাই না বাবা? আসল ব্যাপারটা হচ্ছে একটা ভাবনা, এই সন্তানটা আমার। তারপর হচ্ছে তাকে তার জন্মের প্রথম দিন থেকেই একটু একটু করে বড় করা। তার প্রতিটি মুহূর্ত নিজের চোখের সামনে দেখা। তাই না?

ফখরুল আলম বললেন, তুই এত কিছু কেন বলছিস?

নয়ন বলল, কারণটা বলব?

ফখরুল আলম বললেন, হ্যাঁ। বল।

নয়ন বলল, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা। অসম্ভব ভালোবাসি। এই কথাটা কখনো বলতে পারিনি। আজ বলে ফেললাম।

ফখরুল আলমে বুকের ভেতর একটা ঢেউ খেলে গেল। তিনি অতি কষ্টে সেই ঢেউ থামালেন। এতবড় ছেলের সামনে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলা কোনো কাজের কথা নয়। তিনি বললেন, বাবাকে তো ছেলে ভালোবাসবেই।

নয়ন বলল, তুমি আমার বাবা না হলেও আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। বাবা।

ফখরুল আলম বললেন, চল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।

নয়ন বলল, চলো।

মোহাম্মদপুরের এই পেছন দিকটায় বসিলা ব্রিজ পার হয়ে গেলে একটা খোলা মাঠের মতো বিস্তৃত জায়গা। বালি ফেলে ভরাট করা হয়েছে বলে অনেকেই বিকেলের দিকে ঘুরতে আসেন। নয়ন আজ ফখরুল ইসলামকে নিয়ে এসেছিল। নয়ন বলল, আচ্ছা বাবা, ধরো আমি যদি কাউকে খুন করি, তারপর আমার যদি ফাঁসি হয়ে যায়, তখন তোমার কি মনে হবে? মানে তোমার কি মনে। হবে, খুন করার পরও আমার যেন শাস্তি না হয়? নাকি তুমি চাইবে আমার ফাঁসি হোক? আমি জানি তুমি একজন সৎ ও ভালো মানুষ। তুমি সত্যি কথাটি বলবে।

ফখরুল আলম বললেন, তোর আজ কি হয়েছে বল তো বাবা? আমি প্রায়ই দেখি তুই রাতে ঘুমাস না। পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছিস। তারপর আজ কী সব উদ্ভট কথাবার্তা বলছিস! আমাকে বল তো তোর সমস্যাটা কি হচ্ছে? ওই মেয়েটাকে নিয়ে?

নয়ন বলল, কোন মেয়েটাকে নিয়ে?

ফখরুল আলম বলে, হেমা নাকি যেন নাম। সমস্যাটা কী আমাকে বল তো? এখন বিয়ে করার সময়। তুই চাইলে আমি আর তোর মা গিয়ে ওদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যেতে পারি। দেখবি বিয়েটা করলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

নয়ন হাসল। বলল, দেখলে বাবা, আমাদের মাথায় কিছু ভাবনা বছরের পর বছর ধরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এই যে সম্পর্কের ভাবনা, রক্তের ভাবনা, আরো কত কি! এই যে তুমি বললে বিয়ে করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আসলেই কি বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যায় বাবা? তোমার জীবনটা কি বিয়ে কোনোভাবে বদলে দিয়েছে? আই মিন ভালো কোনোভাবে?

ফখরুল আলম এবার আর জবাব দিলেন না। নয়ন বাবার হাত ধরল। তারপর বলল, সরি বাবা। আমি তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি।

ফখরুল আলম মলিন হাসলেন। তারা যখন বাসার সামনে এসে দাঁড়ালেন, তখন সূর্য প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। সেই ডুবে যেতে থাকা সূর্যের আলোয় নয়ন দেখল হেমা আর রাহাত দাঁড়িয়ে আছে তাদের গেটের সামনের খোলা মাঠের মতো জায়গাটায়। হেমা তাকে দেখে এগিয়ে আসল। নয়ন হেমার দিকে তাকিয়ে হাসল। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের হাসি। রাহাতের সাথে ইশারায় শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। ফখরুল আলম কি বুঝলেন কে জানে, তিনি টুপ করে বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকে গেলেন। নয়ন হেমাকে দেখে সহজ গলায় বলল, আরে, তুমি এখানে? অনেকক্ষণ?

হেমা বলল, হ্যাঁ অনেকক্ষণ। রাহাত খবর নিয়ে জানল যে তুমি বাসায় নেই। কখন ফিরবে কেউ জানে না।

নয়ন বলল, তারপরও এতক্ষণ অপেক্ষা করলে যে!

হেমা বলল, তুমি একটা কথা বলতে মনে আছে?

নয়ন বলল, কী কথা?

হেমা বলল, অপেক্ষার নামই মানবজনম।

নয়ন স্মিত হাসল। বলল, কি জানি! আজকাল সব ভুলে যাচ্ছি। বয়স হয়ে গেছে।

হেমা বলল, তোমার বয়স কত?

নয়ন বলল, বুড়োরা বয়সের হিসেব রাখে না। বয়সের হিসাব রাখে তরুণরা। কারণ তাদের বয়স খরচ হয়ে যাচ্ছে। বুড়োদের তো বয়স খরচ হবার ভয় নেই। তাদের বয়সের পুঁজির থলে শূন্য।

হেমা বলল, নাহ্। তুমি সত্যিই বড় হয়ে গেছ।

নয়ন বলল, পরিস্থিতি মানুষকে হঠাৎ করে বড় করে ফেলে। হেমা বলল, হু, জানি।

তারপর দুজনেই খানিক চুপ করে রইল। তারপর হেমা বলল, আমি তোমার সাথে খানিক সময় চাই। কোথায় বসব বলো তো?

নয়ন বলল, ছাদে যেতে পারি।

হেমা বলল, চলো।

তখন অন্ধকার নেমে আসছে। ভালো শীত পড়েছে। ছাদের ডান দিকটায় নির্জন করে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছে নয়ন আর হেমা। হেমা বলল, আমি কি তোমার হাতটা ধরব?

নয়ন হাসল। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলো। হেমা প্রথমে আলতো করে নয়নের হাতের আঙুলগুলো ছুঁয়ে দিলো। তারপর শক্ত করে মুঠো করে ধরল। ধরে রাখল অনেকক্ষণ। নয়ন দাঁড়িয়ে রইল নিশ্ৰুপ। হেমা বলল, তুমি কি আমার একটু কাছে আসবে?

নয়ন বলল, আমি তো তোমার কাছেই আছি।

হেমা ফিসফিস করে বলল, আরো কাছে।

নয়ন কোনো কথা বলল না। হেমা বলল, আমার খুব শীত লাগছে নয়ন। খুব। তুমি কি আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে?

নয়ন কোনো কথা বলল না। নড়ল না অবধি। হেমাই নয়নের কাছে এগিয়ে এলো। তারপর দু’হাতে নয়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নয়ন যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকিয়ে আছে শূন্য আকাশে। হেমা হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, আমার কষ্ট হচ্ছে নয়ন। খুব কষ্ট হচ্ছে খুব। আমি কষ্টে মরে যাচ্ছি নয়ন। আই নিড আ টাইট হাগ। উইল ইউ প্লিজ গিভ মি আ হাগ?

নয়ন বলল, তুমি কোনো অপরাধবোধে ভুগছ হেমা?

হেমা নয়নের কথার জবাব দিলো না। সে আচমকা দুইহাতে নয়নের গাল চেপে ধরল। পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল নয়নকে। তারপর নয়নের মুখটা তার আরো কাছে টেনে আনল। আরো কাছে। তারপর তার ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। নয়নের ঠোঁটে। যেন আকণ্ঠ তেষ্টায় শুষে নিতে থাকল নয়নের সকল কষ্ট, সকল আক্ষেপ, সকল বিষাদ। যেন বহু বছরের প্রার্থিত সকল ভালোবাসা সে নিংরে নিতে থাকল। তীব্র, গভীর, গাঢ়, সুদীর্ঘ চুম্বনে সে যেন পান করে নিতে থাকল। জীবন। কিন্তু নয়ন নিরুত্তাপ, নির্বিকার, নিস্পৃহ। সে দাঁড়িয়ে আছে অনুভূতিহীন নিথর পাথরের মতো। হেমা নয়নের চুল খামচে ধরে বলল, আমার স্পর্শ কি বলে নয়ন? আমার এই স্পর্শ তোমাকে কী বলে? সে কি তোমাকে এখনো। দ্বিধার কথা বলে? সে কি তোমাকে এখনো সঙ্কোচের কথা বলে? সে কি তোমাকে বলে না যে তোমাকে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, সঙ্কোচ নেই?

নয়ন তাও কোনো কথা বলল না। হেমা এবার কেঁদে ফেলল। সে বলল, নয়ন। তুমি কি জানো এই জীবনে তোমাকে যতটা তীব্র করে আমি চেয়েছি, তার চেয়ে বেশি তীব্রতায় আর কখনোই কিছু চাইনি!

নয়ন এবার কথা বলল। সে বলল, তুমি কি একটু শান্ত হবে হেমা?

হেমা বলল, না। আমি শান্ত হবো না। আমি আরো অশান্ত হবে। আমি তোমাকে আরো এলোমেলো করে দেবো। আমি তোমাকে আরো বিধ্বস্ত করে দেবো। আমি তোমাকে ভেঙে চুরমার করে দেব। তারপর আমি তোমাকে আবার নতুন করে গড়ব। একদম নতুন করে।

নয়ন বলল, একটু শান্ত হও। আমরা একটু কথা বলি?

হেমা এবার আর কিছু বলল না। সে কিছু সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর অকস্মাৎ ছেড়ে দিলো নয়নকে। তারপর নয়নের কাছ থেকে সামান্য দূরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, বলো নয়ন।

নয়ন বলল, তুমি মন খারাপ কেন করছ হেমা? তুমি মন খারাপ করার মতো কিছু করোনি। একটা সত্যি কথা বলি, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনার একটি হলো তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া। তুমি জানো নাকি অসাধারণ একজন মানুষ তুমি। মানুষ। আমি আবারো বলছি, মানুষ। সাধারণ নও, অসাধারণ মানুষ। কিন্তু হেমা মানুষ তো। আমরা সবাই মানুষের ভেতর মহামানুষ খুঁজি। কিন্তু আমরা জানি না, মহামানুষ হলে আমাদের মধ্যে আর মানবিক অনুভূতিগুলো থাকবে না। আমাদের মধ্যে যেমন ঘৃণা, হিংসা, দ্বিধা থাকবে না। তেমনি দুঃখ, কষ্ট, বিষাদও থাকবে না। আমরা মানুষ বলেই এই সাধারণ বিষয়গুলো আমাদের আছে। এগুলো না থাকলে বরং আমাদের মৃত্যু হতো। মানবিক মানুষের মৃত্যু। ধরো, আমি মহামানব হলে হয়তো আমার জীবনের এই ঘটনা নিয়ে আমি নির্বিকার থাকতাম। তুমি মহামানব হলে হয়তো এই আমাকে নিয়ে তোমার কোনো দ্বিধা থাকত না। সব শুনে তুমি টুপ করে বলে ফেলতে, এটা কোনো ব্যাপারই না নয়ন। কিন্তু দিন শেষে আমরা মানুষ হেমা। এবং আমাদের তাই থাকা উচিত। তোমার প্রতি আমার সামান্যতম রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, অভিমান নেই। যদি কিছু থেকেও থাকে, তবে স্রষ্টার প্রতি। তুমি একটুও অপরাধবোধে ভুগো না হেমা।

হেমা চুপ করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। নয়নের কথা সে শুনছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। নয়ন বলল, আমি তোমাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি হেমা। ভালোবাসাটা সেই শ্রদ্ধার একটা অংশমাত্র। এইজন্যই এই ভালোবাসাটা এত তীব্র। যে ভালোবাসা শ্রদ্ধা থেকে আসে, সেই ভালোবাসার মতো পরিপূর্ণ ভালোবাসা আর নেই। আমার নিজের ভেতর নিজেকে নিয়ে একটা বড় দ্বিধা তৈরি হয়েছে হেমা। একটা প্রচণ্ড হীনমন্যতাবোধ। এই হীনমন্যতাবোধ, এই দ্বিধা নিয়ে আমি এই অসাধারণ ভালোবাসাটার ভেতর যেতে পারব না হেমা। সারাটা জীবন আমার মনে হবে আমি কাউকে ঠকাচ্ছি। আমার জন্য তার স্বাভাবিক জীবনটাকে আমি অস্বাভাবিক করে তুলছি। আমার পরিচয় নিয়ে তার সব সময় সতর্ক থাকতে হচ্ছে। আমি তার কোনো কথায়, কোনো আচরণে আমার পরিচয়ের জন্য কোনোভাবে কষ্ট পাচ্ছি কিনা, এটা নিয়ে তাকে সব সময় সজাগ থাকতে হচ্ছে। তার সন্তানদের কোনো আচরণ নিয়ে তার মুহূর্তের জন্য মনে হতে পারে এটি কি তাহলে বংশগত সমস্যা? রক্তের সমস্যা? এটা হয় হেমা। এই রক্তের ভাবনাটা যে কী শক্ত! কী প্রবল! আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না হেমা।

হেমা বলল, এই সিদ্ধান্তটা তুমি কবে নিয়েছ? সেদিনের পর?

নয়ন বলল, হয়তো। আমি ঠিক জানি না। ঘটনাটা আমি যখন প্রথম জানি, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, আমার তোমার কাছে যাওয়া দরকার, তোমাকে বলা দরকার। হয়তো তাহলে আমি একটু শান্তি পাব। কিন্তু তারপরই আমার একটু একটু ভয় হতে থাকে। তুমি যদি বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে পার! তারপর একটা সময় মনে হলো, না নিতে পারাটাই তো স্বাভাবিক। তারপর তোমাকে হারানোর ভয়ে আর বলতে পারিনি হেমা। তারপর

নিজেকে বুঝিয়েছি। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। হ্যাঁ সেদিনের ঘটনাটা হয়তো আমাকে সিদ্ধান্তটি নিতে সাহায্য করেছে। আমি তার আগ অবধি স্বার্থপরের মতো কেবল নিজের কথাই ভাবছিলাম।

হেমা হাসল। বলল, এখন আমার কথাও ভাবছ? তাই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ?

নয়ন কথা বলল না। চুপ করে রইল। হেমা বলল, যদি এমন হয়, তোমার এই ভাবনার জন্য আমার জীবনটা এখানেই থমকে যায়? যেই মানুষটাকে তুমি এত শ্রদ্ধা করো, ভালোবাসো, সেই মানুষটাই যদি তোমার কারণে শেষ হয়ে যায়?

নয়ন খানিক ধাক্কার মতো খেলো। হেমা বলল, কখনো কখনো এমন হয় নয়ন, প্রিয়তম মানুষটার জন্য আমরা কত বড় কিছু অবলীলায় ছেড়ে দেই? ভালোবাসার মানুষটার একটু ভালো থাকার জন্য আমরা কত কিছু মেনে নেই? এমন হয় না? সব ঠিক আছে, আমি বুঝি। কিন্তু তারপরও আমার জন্য তুমি আমার সাথে থাকতে পার না নয়ন? ধরো একটা জীবনের সবগুলো দিন, সবগুলো রাত আমাদের খারাপ কাটবে, খুব খারাপ কাটবে। কিন্তু একটামাত্র দিন হয়তো এতটাই ভালো কাটবে যে সেই দিনটার জন্যই বাকি জীবনের সকল কষ্টগুলো আমরা মেনে নিতে পারব। ওই একটামাত্র দিনের জন্য? এমন হতে পারে না নয়ন?

নয়ন কথা বলল না। হেমা নয়নের হাতটা আবার মুঠো করে ধরল। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব নয়ন। ইট ক্যান বি আ হোল লাইফ। বাট আই উইল বি ওয়েটিং টিল মাই লাস্ট ব্রেথ। আই উইল।

নয়ন এবারো কোনো কথা বলল না। হেমা বলল, আমি অপেক্ষা করব বলেই যে তোমাকে আসতেই হবে, এমন নয় নয়ন। তুমি না আসলেও ক্ষতি নেই। আমি জানব, অপেক্ষার নামই মানবজনম। অপেক্ষা মানেই বেঁচে থাকা। মানুষের একটা জনম কেটে যায় কেবল অপেক্ষায় আর অপেক্ষায়। এটা সত্যি নয়ন, অপেক্ষা ছাড়া মানবজনম বৃথা।

নয়ন তেমন চুপ করেই রইল। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হেমা আর সেই চেষ্টাও করল না। সে আস্তে করে তার হাতের মুঠো থেকে নয়নের হাতটা ছেড়ে দিলো। তারপর ধীর পায়ে নেমে গেল ছাদের সিঁড়ি বেয়ে।

অন্ধকার না থাকলে সে হয়তো নয়নের চোখ দেখতে পেত। সেই চোখে তখন একই সাথে কান্না আর ক্রোধ, শূন্যতা ও শোধ।

*

পারুল বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে আছে। সে সকালে ঘুম থেকে উঠে কেবল দরজা খুলেছে। উঠানের মাঝখানে তাকিয়ে সে যেন মুহূর্তের মধ্যে জমে গেল। উঠানের মাঝখানে ফেলে রাখা একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসে আছে নয়ন। নয়নকে চিনতে মুহূর্তকাল সময় লেগেছিল পারুলের। মানুষটার সাথে তার যখন শেষ দেখা হয়েছিল তখন কেমন একটা গোছানো উজ্জ্বল মানুষ ছিল। কিন্তু এই মানুষটা যেন ঝড়ে ডানাভাঙা পাখি। যেন মেঘলা দিনের মতো ম্লান। মানুষটাকে দেখে সে তার নামও ভুলে গেল। দরজার পাল্লা ধরে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে পারুল নয়নের নামটা মনে করতে পারল। কিন্তু তারপর সে কি করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল স্বপ্ন। সে তার অবচেতন মনে সব সময় চেয়েছে এমন কোনো একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটুক। কিন্তু সে এটাও জানে, জীবন রূপকথার গল্প নয় যে সে কোনো একটা অসম্ভব কিছু চেয়ে বসল, আর তা ঘটে গেল। কিন্তু এখন তার চোখের সামনে একটা জ্বলজ্যান্ত রূপকথার গল্প। একে সে অস্বীকার করবে কি করে? এই সাত-সকালে তার বাড়ির উঠানে সেই মানুষটা? নাকি স্বপ্ন দেখছে সে?

পারুলের বিশ্বাস হচ্ছে না। সে দরজার আংটায় বার দুই হাত ঘসে পরখও করে নিলো, সে জেগে আছে কিনা! কাল রাতে তার ভালো ঘুম হয়েছে। সেদিন রায়গঞ্জে লতার নানাবাড়িতে বসে শোনা লতার কথাগুলো নিয়ে পারুল অনেক ভেবেছে। লতার কথাগুলো শুনে তার খুশি হবার কথা ছিল। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, সে তো খুশি হতে পারেনি, অধিকন্তু সারারাত কেমন মন খারাপ হয়ে রইল তার। পরদিন ভোরেও সেই মন খারাপ ভাবটা গেল না। বাড়ি ফেরার পর সেই মন খারাপ ভাবটা আরো বাড়ল। তার পরদিন সন্ধ্যায় সে বসেছিল পুকুর ঘাটে। আর ঠিক তখুনি সে তার মন খারাপের কারণটা ধরতে পারল। লতা তার জন্য যতটুক ভেবেছে, যা করেছে, তাতে সে খুবই খুশি হয়েছে। আশিকের বন্ধুর কথা শুনেও প্রথমে একটা আনন্দময় উত্তেজনাই বোধ করছিল পারুল, কিন্তু তার পরপরই কি এক অজানা মেঘ এসে ধীরে ধীরে তার সেই ভালো লাগাটা ঢেকে ফেলেছিল।

সেই সন্ধ্যায় পুকুর ঘাটে বসে পারুল যেন অজানা সেই মেঘটাকে চিনতে পারল। মেঘটার নাম নয়ন। তারপর থেকেই একটা ভয়াবহ চাপা ছটফটানিতে দিন কাটল তার। একটা শ্বাসকষ্টের মতো ব্যাপার। কিন্তু এই মুহূর্তে দরজা খুলেই চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছে পারুল তাতে তার আনন্দে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে।

পারুল ভীরু পায়ে উঠানে নামল। নয়নই কথা বলল প্রথম, সে বলল, ঘরে খাবার কিছু আছে পারুল? থাকলে দাও। আমি সারারাত কিছু খাইনি। মাঝরাতের আগে তোমাদের বাড়িতে এসেছি। কিন্তু সকলেই ঘুমিয়ে গেছে। দেখে আর জাগাইনি।

পারুল বলল, আপনে সারারাত এইখানে বইস্যা আছিলেন?

নয়ন বলল, হ্যাঁ। গ্রামে এত ঠান্ডা পড়বে বুঝিনি। আমার সাথে তেমন কোনো শীতের কাপড়ও নেই। আমার সম্ভবত জ্বর চলে আসবে। তুমি কি আমাকে একটু গরম পানি আর লেবু দিতে পারবে?

পারুল বলল, পারব না কেন? অবশ্যই পারব। আপনে একটু বারান্দায় আইস্যা বসেন। আমি পাটি লাইছা দিতেছি।

পারুল ঘরের খোলা বারান্দায় একটা পাটি বিছিয়ে দিলো। নয়ন সেই পাটিতে গিয়ে ঘরের বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে বসল। পারুল কী করবে না করবে ঠিক করতে পারছে না। মানুষটাকে দেখেই মনে হচ্ছে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। সবার আগে তাকে খাবার দেওয়া দরকার। কিন্তু ঘরে তো তেমন কিছু নেই। আব্দুল ফকির দিন দুই হলো বাড়িতে নেই। তিনি বলে গেছেন ফিরতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। দূরে কোথাও কাজে গিয়েছেন তিনি। তার সাথে গিয়েছে জুলফিকারও। বাড়িতে পারুল, তাবারন আর রতন। রতন ঘুমিয়ে আছে বাইরের ঘরে। পারুল রতনকে ডেকে তুলে কিছু টাকা হাতে দিয়ে বলল নদীর ঘাট থেকে মাছ কিনে আনতে। রতন ফেরার আগেই সে চুলায় ভাত বসাল। ডিম সেদ্ধ দিলো। পুকুরের পাশে ছোট্ট বাগান, সেখানে আব্দুল ফকির প্রতিবছরই নানান রকমের শীতের সজি চাষ করেন। এবারও করেছেন। পারুল সেখান থেকে কিছু সজিও নিয়ে এলো। তার বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করছে। নয়ন যে গরম পানি আর লেবু দিতে বলেছিল, পারুল ভুলেই গেল। তার খুব ইচ্ছা করছিল কারণে-অকারণে মানুষটার সামনে যেতে। কি হয়েছে তা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু কেমন একটা লজ্জা লজ্জা আর আড়ষ্টভাবও কাজ করছে। রান্না শেষ হতে পারুলের মনে পড়ল গরম পানি আর লেবুর কথা। সে ভারি অপ্রস্তুত বোধ করল ব্যাপারটাতে। কিন্তু লেবু, গরম পানি আর খাবার নিয়ে এসে সে দেখল নয়ন পাটিতে শুয়ে হা করে ঘুমাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কতকাল ঘুমায়নি।

নয়নের ঘুম ভাঙল দুপুরের পর। সে ভাত খেতে বসে এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলল। তারপর পারুলকে বলল, পারুল তোমার রান্নার হাত চমৎকার। আমি আমার জীবনে এত সুস্বাদু খাবার খাইনি।

পারুলের যে কি হলো! তার মনে হলো তার হাতে ধরা তরকারির চামচটা এখন পড়ে যাবে। কারণ তার হাত কাঁপছে। তার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। নয়ন বলল, তোমার বাবা কই?

পারুল বলল, আব্বায় তো বাড়িতে নাই। আপনের কপাল খারাপ, আপনে যহনই আসেন, আব্বায় বাড়িতে থাকে না।

নয়ন বলল, অসুবিধা নাই। সে যেদিন আসবে সেইদিন পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব।

পারুল বলল, আব্বার সাথে আপনের এত জরুরি কী কাজ?

নয়ন বলল, এই কাজের কথা আমি তোমাকে বলতে পারব না। এই কাজের কথা আমি তাকেই বলব।

পারুলের বুকের ভেতরটায় কেমন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে গেল। নয়ন কি এমন বলবে তার বাবাকে, যা সে পারুলকে বলতে পারবে না? পারুলের একটা রুদ্ধশ্বাস কৌতূহল হতে লাগল। খানিক লজ্জাও। সে বলল, আপনারে বাহির ঘরে একখান বিছান কইরা দেই?

নয়ন বলল, দাও। না দিলেও অসুবিধা নাই। আমি এই বারান্দায় বা উঠানেও থাকতে পারব।

পারুল বলল, না না। এইটা কেমন কথা?

নয়ন বলল, আমি যেই কয়দিন থাকব, তুমি চাইলে সেই কয়দিন আমার থাকা আর খাবারের খরচ নিতে পারো। অবশ্য এই বাড়িতে থাকা-খাওয়ার একটা অধিকার আমার আছে।

কি অধিকার নয়নের এই বাড়িতে? পারুলের বুক এবার ধকধক করে কাঁপছে। তাহলে সে যা ভাবছে তাই-ই? নয়ন বলল, আমাকে কি তোমার পাগল পাগল মনে হচ্ছে? আমার কথাবার্তা খাপছাড়া মনে হচ্ছে?

তা পারুলের যে একটু অমন মনে হচ্ছে না, তাও না। আগেরবার মানুষটা এমন ছিল না। এবার কি যেন হয়েছে মানুষটার। কিন্তু সে সেসব কিছুই বলল না। কেবল মিনমিন করে বলল, আপনে এত জরুরি কি কাজে আসছেন আব্বার কাছে?

নয়ন বলল, আমি যখন এখান থেকে যাব, তখন দেখতে পাবে। তুমি কি জানো যে চাইলে আমি তোমার আব্বাকেও আব্বা বলে ডাকতে পারি?

পারুলের এবার আর কিছুই বোঝার বাকি রইল না। তার মনে হলো তার বুকের ভেতর হাজার হাজার ঝলমলে রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে। বসন্ত বিকেলের একটা ফুড়ফুড়ে মন উতল করা হাওয়া যেন শিরশির করে তার বুকের ভেতর ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে এবার যেন একটু সাহসীই হয়ে উঠল। কিংবা বোকা। সে নিজেকে আর সামলাতে পারল না। বোকার মতো প্রশ্ন করে বসল, আপনে কি যাওনের সময় আমারেও সাথে নিয়া যাইবেন?

নয়ন একটা ধাক্কার মতো খেলো। সে প্রথমে পারুলের কথাটা বুঝতে পারল না। আগেরবার পারুল তার জন্য কি করেছে না করেছে তা যেন তার মাথায়ই ছিল না। কিন্তু এই এতক্ষণে সেসব যেন ক্রমশই ফিরে এলো। নয়ন মুহূর্তে সতর্ক হয়ে গেল। সে বলল, তোমাকে আমি কই নিয়ে যাব পারুল? আমি যখন এখান থেকে যাব, তখন তো আর আমি একা যাব না। আমাকে নিতে আসবে পুলিশ। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যেতে আসবে। তখন তুমি আমার সাথে কই যাবে?

পারুল বলল, কেন? পুলিশ আপনেরে কেন ধইর‍্যা নিয়া যাইব? আপনে কি অপরাধ করছেন?

নয়ন এই কথার জবাব দিলো না। পারুলের চোখ ছলছল করছে। সে যেন কেঁদেই দিবে। সেই ছলছলে চোখেই পারুল বলল, আপনে কি ঢাকায় কোনো অপরাধ কইরা এইখানে লুকাইতে আসছেন?

নয়ন পারুলের এই কথারও জবাব দিলো না। সে ভাবছে পারুলকে সে ঘটনাটা কি করে খুলে বলবে! সে চায়নি পারুলকে ঘটনাটা এখনই খুলে বলতে। ঘটনা খুলে বলার পর কি ঝামেলা হয় কে জানে! কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে না বললেও সমস্যা।

পারুল আবার বলল, অপরাধ করলে করছেন। আপনেরে কেউ এইখান থেইক্যা নিয়া যাইতে পারব না। আপনেরে আমি এমন জায়গায় লুকাই রাখব যে কেউ সারাজীবন খুঁইজাও পাইব না। কেউ পাইব না।

পারুলের গলায় যেন বৃষ্টির আভাস। নয়ন হঠাৎ পারুলের দিকে হাত ইশারা করে বলল, তুমি কি একটু আমার কাছে এসে বসবে পারুল?

পারুল আজ কিছুই বুঝতে পারছে না। তার সব স্বপ্ন কি আজ একদিনেই পূরণ হয়ে যাবে? কীভাবে সম্ভব? কীভাবে? সে কম্পিত পায়ে উঠে এসে নয়নের পাশে বসল। নয়ন হঠাৎ তার হাতখানা পারুলের মাথায় রাখল। তারপর গভীর মায়া জড়ানো গলায় বলল, পারুল। আমার কোনো বোন নাই। আমি যদি তোমাকে আমার বোন হতে বলি, তুমি কি অখুশি হবে?

পারুল যেন ইলেক্ট্রিকের শক খাওয়ার মতো কেঁপে উঠল। সে ঝট করে তার মাথার উপর থেকে নয়নের হাতটা সরিয়ে দিলো। তারপর বলল, আপনে এইটা কি বলতেছেন? আস্তাগফিরুল্লাহ!

নয়ন ম্লান হাসল। তারপর গাঢ় গলায় বলল, তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে পারুল। অনেক কথা। আমি জানি না, সেই সব কথা বলার সুযোগ আমি কখনোই পাব কিনা। তবে একটা কথা এখুনি তোমাকে বলে ফেলি। তোমার মতো এমন একটা অসাধারণ বোন আমার আছে, এটা আমার অনেক অনেক কষ্টের মধ্যেও একটা আনন্দ। একটা মজার বিষয় কি জানো, সেই ছোটবেলা থেকেই একটা ভাই বা বোনের জন্য যে কী হাহাকার আমার ছিল! একা একা বড় হয়েছি তো! কিন্তু দেখো, কখনো জানতামই না, তোমার মতো এমন একটা বোন আমার রয়েছে!

পারুলের লজ্জায় অপমানে যেন মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। মানুষটা কি বলছে সে জানে না। কেন বলছে তাও জানে না। তারপরও সে কাঁপা গলায় বলল, আপনের ঢাকার শহর কেউ একজন আছে, সেইটা বললেই তো হয়। এইসব আমি জানি, যারে পছন্দ হয় না, মাইয়ারাও তারে ভাই বানাই ফালায়।

নয়ন করুণ ভঙ্গিতে হাসল। তারপর বলল, পৃথিবীর অনেক সম্পর্কে মিথ্যা থাকে পারুল, কিন্তু তুমি যে আমার বোন, এতে কোনো মিথ্যা নেই। তুমি আমার সত্যিকারের বোন পারুল।

নয়ন থামলেও পারুল কোনো কথা বলল না। সে নয়নের কথার কিছুই বুঝতে পারছে না। নয়ন বলল, পারুল, আমার শরীরটা ভালো নেই। প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগেছে। তুমি কি আমাকে একটা ঘর দেখিয়ে দেবে? যেখানে আমি কটা দিন একটু থাকব? আর একটা অনুরোধ করব তোমাকে, আমার কথা কাউকে বলো না প্লিজ।

নয়নের বলার ধরনে কি যেন কি ছিল, পারুল আর কথা বাড়াল না। সে রতনকে ডেকে নয়নকে তার ঘর দেখিয়ে দিতে বলল। তারপর সারাটা দিন নিজের ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল পারুল। কী লজ্জা! কী অপমান! নিজেকে আর কোনোদিন এত ছোট মনে হয়নি পারুলের। লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে আর কখনো নয়নের সামনেই যেতে পারবে না। কিন্তু নয়নের কথার অর্থও পরিষ্কার বুঝতে পারছে না পারুল। তার কেমন ভয় ভয় লাগতে লাগল। তার মনে হতে লাগল, মানুষটা কোনো বড় অপরাধ করে আসেনি তো! কিন্তু নয়নকে দেখে তেমন কিছু মনেও হচ্ছে না। সন্ধ্যার দিকে রতন এসে বলল যে নয়ন বমি করে ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে। ঘটনা শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারল পারুল। সে দৌড়ে ছুটে গেল নয়নের ঘরে। নয়নের অর্ধেকটা শরীর তখন চৌকির বাইরে। পারুলকে দেখে নয়ন সেই অবস্থায়ই হাসল। বলল, ভয়ের কিছু নেই, ঠিক হয়ে যাব। তুমি কি রতনকে দিয়ে একটু আমার মাথায় পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে পারুল?

পারুল আঁৎকে ওঠা গলায় বলল, আপনের কি জ্বরও আসছে?

নয়ন বলল, সারারাত ঠান্ডায় বাইরে বসেছিলাম তো! ঠান্ডা থেকে জ্বর। ঠিক হয়ে যাবে।

নয়নের জ্বর ঠিক হলো না। সেই সারাটা রাত, পরের গোটাটা দিন সে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে রইল। এমনিতেই টানা না ঘুমানো, না-খাওয়া, অনিয়ম করা শরীর। তার ওপর ঢাকা থেকে এই হোসনাবাদের দীর্ঘ কষ্টকর যাত্রা, রাতজাগা। ঠান্ডার ধকল, সবকিছু মিলিয়ে শরীরটা আর নিতে পারেনি। পরদিন সন্ধ্যার পরপর একটু সুস্থবোধ করল নয়ন। চোখ মেলে তাকাতেই সে দেখল, তারপাশে উদ্বিগ্ন চোখে বসে আছে পারুল। পারুল অবশ্য নয়নকে চোখ মেলতে দেখেও কোনো কথা বলল না। নয়ন সময় নিয়ে একটু ধাতস্থ হলো। উঠে সামান্য খাবার খেলো। পারুল বলল, আপনের বাসা বাড়িতে খবর পাঠানো দরকার। আমি তো কাউরে চিনি না।

নয়ন বলল, আমি খুবই দুঃখিত পারুল যে, আমাকে নিয়ে তোমার এত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তবে তোমার কাউকে খবর দিতে হবে না। আমিই চলে যাব। তোমার বাবা আসলেই চলে যাব।

পারুল বলল, আমার আব্বার সাথে আপনের কি কাজ?

নয়ন বলল, সেটা তোমাকে বলা যাবে না পারুল। বলা গেলে আগেই বলতাম।

পারুল বলল, না। আপনের বলতেই হইব। আমার খুব ভয় করতেছে। আপনে আমার আব্বার কোনো ক্ষতি করবেন না তো?

পারুলের এই কথার কোনো জবাব দিলো না নয়ন। সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার শরীরটা ক্লান্ত লাগছে খুব। আরো খানিক বিশ্রাম দরকার। পারুলের সাথে নয়নের আবার দেখা হলো রাতে। তাবারনকে সাথে নিয়ে নয়নকে খাবার দিতে এসেছে পারুল। নয়ন ইশারায় তাবারনকে চলে যেতে বলল। পারুল কিছুটা অবাক হলেও কিছু বলল না। নয়ন বলল, তুমি তোমার বাবাকে খুব ভালোবাসো, তাই না পারুল?

পারুল চুপ করে রইল। নয়ন বলল, তোমার বাবার যদি কোনো ক্ষতি হয়, তুমি কি খুব কান্নাকাটি করবে?

পারুল বলল, এইটা কি ধরনের প্রশ্ন? আপনের আব্বার কোনো ক্ষতি হইলে আপনে কানবেন না?

নয়ন বলল, না।

পারুল আঁৎকে ওঠা গলায় বলল, কি বলেন আপনে এইসব! নিজের বাপের কোনো ক্ষতি হইলে কনব না এমন কেউ আছে?

নয়ন বলল, এই যে আমি আছি।

পারুল বলল, কেন? কানবেন না কেন?

নয়ন বলল, কারণ এই পৃথিবীতে আমি তার চাইতে খারাপ মানুষ আর দেখি নাই পারুল! পৃথিবীতে তার চেয়ে বেশি ঘৃণা আমি কাউকে করি না।

পারুল বলল, নিজের বাপরে কেউ ঘেন্না করে!

নয়ন বলল, তোমার বাবা যদি একজন জঘন্য রকমের খারাপ মানুষ হয়, তুমি তাকে ঘৃণা করবে না?

পারুল বলল, আমার আব্বারে আপনে চেনেন? চেনেন না। সে ওইরম মানুষ না।

নয়ন বলল, সে কী রকম মানুষ?

পারুল বলল, ভালো মানুষ। সে আমারে যত আদর করে, আর কোনো বাপ তার মাইয়ারে এত আদর করে না।

নয়ন বলল, তোমাকে অনেক আদর করে, ভালোবাসে বলে সে খারাপ মানুষ হতে পারে না?

পারুল বলল, না।

নয়ন বলল, ধরো কেউ একটা খুন করেছে। বা একটা মেয়েকে কোনো পুরুষ ধর্ষণ করেছে। তো সেই পুরুষটা কি কারো বাবা হতে পারে না? তারও তো তোমার মতো একটা মেয়ে থাকতে পারে, আমার মতো একটা ছেলে থাকতে পারে। কি পারে না? সেও কিন্তু তার ছেলে-মেয়েকে আদর করে। তারা অসুস্থ হলে কান্নাকাটি করে। কষ্ট পায়। কি পায় না?

পারুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হু। পায়।

নয়ন বলল, পৃথিবীর সকল অপরাধীই কারো না কারো সন্তান, কারো না কারো ভাই, বোন, স্ত্রী, স্বামী, বাবা, মা। কিন্তু সে তার সন্তানের কাছে মমতাময় এক পিতা, অথচ আরেকজনের সন্তানের কাছে সে নৃশংস এক মানুষ। ধরো, তোমার বাবা, সে তোমার কাছে একজন অসাধারণ ভালো বাবা। কিন্তু সুযোগ পেয়েই সে যদি তোমার খুব কাছের কোনো বান্ধবীর শরীরে হাত দেয়? ধর্ষণ করে? তখন? এমন হতে পারে না? হয় না?

পারুলের কান গরম হয়ে গেছে। রাগে তার হাত-পা ঘামছে। সে নয়নের কথার বিপক্ষে কোনো যুৎসই যুক্তি দিতে পারছে না। কোনো উত্তর দিতে পারছে না। আবার নয়নের কথা সে মেনেও নিতে পারছে না। একের পর এক কি নোংরা আর জঘন্য সব কথা সে বলে যাচ্ছে। নয়নের প্রতি ধীরে ধীরে একটা প্রচণ্ড বিরক্তি তৈরি হচ্ছে পারুলের। নয়ন যখন বলল যে তার বাবা সুযোগ পেলে তার বান্ধবীকেও…। পারুল আর ভাবতে পারল না। তার চোখে লতার। মুখ ভেসে উঠল। ভেসে উঠল তার বাবার মুখও। আর সাথে সাথেই যেন তার পেট গুলিয়ে বমি উঠে আসতে চাইল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ এই মানুষ কি বলছে এই সব!

পারুল বলল, আপনে মানুষটারে যত ভালো ভাবছিলাম। আপনে তার চাইতেও খারাপ। ভালো মাইনষের মনে থাকে ভালো চিন্তা। খারাপ মাইনষের মনে থাকে খারাপ চিন্তা। আপনের মনে খালি খারাপ চিন্তা। আপনের চেহারা দেইখ্যা কিন্তু এইসব বোঝনের উপায় নাই।

নয়ন বলল, একদম ঠিক বলেছ পারুল। মানুষের চেহারা দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই, ভেতরের মানুষটা কেমন! তোমার বাবার চেহারা দেখে বোঝার উপায় আছে যে তার ভেতরে কি আছে?

পারুল এবার ফুঁসে উঠল। বলল, কি আছে? আপনে বলেন, স্পষ্ট কইরা বলেন, আমার আব্বার মইধ্যে কি আছে? এইসব ফিসফিসানি অনেক শুনছি। কিন্তু পারুলের সামনে আইস্যা কেউ কোনোদিন কিছু বলনের সাহস দেখায় নাই। আপনে বলেন। বলেন।

নয়ন পারুলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন এক উদ্যত ফণা তোলা সাপ। তার সেই উদ্যত ভঙ্গির কোথায় যেন আব্দুল ফকিরের একটা স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। একটু খেয়াল করে তাকালেই বোঝা যায়। আচ্ছা, তার নিজের কোনো ভঙ্গিতেও কি এমন করে আব্দুল ফকির লুকিয়ে আছেন? তার হাসিতে? কান্নায়? রাগের কোনো বিশেষ ভঙ্গিদে কি আব্দুল ফকির স্পষ্ট হয়ে ওঠেন?

নয়ন বলল, তোমাকে বললে তুমি বিশ্বাস করবে না পারুল। কোনো সন্তানই তার বাবার সম্পর্কে এমন কুৎসিত ঘটনা মেনে নিতে পারবে না পারুল।

পারুল বলল, না। আপনে বলেন। আপনে বলেন আপনের আমার আব্বার কাছে কেন আসছেন?

নয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে আসমার ঘটনাটা পারুলকে বলল। পারুল ঘটনা শোনার পর বলল, ওই মাইয়ার কথা তো আমিও শুনছি। ঢাকায় এক বাসায় থাকত। সেইখানে মারা গেছে।

নয়ন বলল, ঠিক পারুল। আর সে মারা যাওয়ার সময় গর্ভবতী ছিল। আসমার সাপের বিষ নামাতে গিয়েই আব্দুল ফকির…।

পারুল এবার যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। সে ঝাঁঝালো গলায় বলল, এইসব আপনে কি বলতেছেন! আপনের মাথা ঠিক আছে?

নয়নকে আর কিছু বলতে না দিয়েই দরজার পাল্লায় সপাটে ধাক্কা মেরে পারুল ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সারারাত পারুল আর তার চোখের পাতা বন্ধ করতে পারল না। বাবা সম্পর্কে নানান কথা সে নানানসময়ই একটু আধটু শুনে এসেছে। কিন্তু কখনোই কেউই তাকে সরাসরি কিছু বলেনি। একটা মানুষের মধ্যে সামান্যতম বোধ থাকলেও এই কাজটি সে করতে পারে না। পারুল এসব বিশ্বাস করে না। যেই মানুষটা তার সামান্য একটু মন খারাপ দেখলেও অস্থির হয়ে যান। নিজে না খেয়ে, না পরে হলেও তার শখ পূরণ করেন। সেই এতটুকু কাল থেকে যে বাবার অসংখ্য অসাধারণ স্মৃতি পারুলের মনে আছে। সেই বাবার অমন মমতা থৈ থৈ বুকের ভেতর এমন কদর্যতা থাকা অসম্ভব। পারুল কখনোই বিশ্বাস করে না। কখনোই না। নয়নের প্রতি এক প্রবল তিক্ততায় ক্রমশই আচ্ছন্ন হয়ে উঠতে লাগল তার মন।

ভোরের আলো ফুটতে ঘুম পেল পারুলের। গভীর ঘুম। তার ঘুম ভাঙলে তাবারনের ডাকাডাকিতে। তাবারন জানাল নয়নের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। পারুলের আর ইচ্ছে হচ্ছিল না নয়নের কাছে যেতে। কিন্তু তারপরও সে গেল। আবারো জ্বর উঠেছে নয়নের। সে অচেতনের মতো পড়ে রয়েছে। পারুলের এবার দিশেহারা লাগছে। তার হঠাৎ করেই মনে হলো নয়নের নানাজানের নামই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। প্রথম যেদিন সে এ বাড়িতে এসেছিল, সেদিন তাকে নিয়ে এসেছিল তাদের গায়েরই এক মুরুব্বি হারু মুনশি। পারুল রতনকে দিয়ে হারু মুনশীকে খবর পাঠাল। হারু মুনশী খবর দিয়ে তোক পাঠালেন ফতেহপুরে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর বাড়ি। সন্ধ্যার খানিক পর লোকজন নিয়ে মনির এলো নয়নকে নিয়ে যেতে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ঘটনা শুনে কিছু বললেন না। তবে নয়নের অসুস্থতার খবর শুনে বিলকুড়ানির হাট বা রায়গঞ্জ থেকে ডাক্তার নিয়ে আসতে বললেন তিনি। নয়নের এই অসুস্থতা সহজে ছাড়ল না। তার টাইফয়েড হয়েছে। দীর্ঘ সময় সে এই টাইফয়েড জ্বরে ভুগল।

*

আব্দুল ফকির বাড়ি ফিরলেন প্রায় নয় দিন বাদে। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে আব্দুল ফকিরের সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিল না পারুলের। আব্দুল ফকির এবার গিয়েছিলেন পালরদির মেলায়। সেখানে এই সময়টায় সাতদিনব্যাপী বিশাল মেলা হয়। সেখানে সাপের খেলা দেখান আব্দুল ফকির। সাথে নানান ওষুধপথ্যও বিক্রি করেন। তিনি পালরদির মেলা থেকে পারুলের জন্য রাজ্যের জিনিসপত্র কিনে এনেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এইসব জিনিসপত্রের মধ্যে ঝুনঝুনিও রয়েছে। সেই ঝুনঝুনি দেখে পারুলের খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল যে, আব্বা, আমি কি এহনো ঝুনঝুনির পারুল আছি?

কিন্তু পারুল কিছুই জিজ্ঞেস করল না। আব্দুল ফকির যখন অতি আগ্রহ নিয়ে তাকে এইসব জিনিসপত্র দেখালেন, পারুল তখন খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বাবার সামনে বসে রইল। অন্য কোনো সময় হলে পারুল শিশুর মতো আনন্দে ফেটে পড়ত। কিন্তু এবার পারুল কিছুই করল না। আব্দুল ফকির অবাক হলেও কিছু বললেন না।

পারুল তার এই নির্লিপ্ততার কারণ জানে না। সে কি তাহলে নয়নের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে? পারুল অনেক ভেবে দেখেছে, সে নয়নের কথা বিশ্বাস করে না। কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটা হয়েছে তার। সেটির অস্তিত্ব সে স্বীকার করতে চায় না, আবার পুরোপুরি অস্বীকারও করতে পারে না। তার কি তার বাবার সম্পর্কে দ্বিধা তৈরি হয়েছে?

মায়ের প্রতি বাবার আচরণ নিঃসন্দেহে আপত্তিকরই ছিল। পারুল বাবার সাথে এই নিয়ে কথাও বলেছে। তার বাবা বলেছেন, নুরুন্নাহারের শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন, তার বেশিরভাগই নুরুন্নাহারের নিজের করা। এগুলো তার সাথে থাকা জ্বিন তাকে দিয়ে করিয়েছে। হ্যাঁ তিনিও কিছু আঘাত করেছেন। কিন্তু সেগুলো জ্বিন ছাড়ানোর জন্যই করা। তিনি যেখানেই জ্বিন ছাড়াতে যান, এই কাজটি তাকে করতে হয়। তবে আসল ব্যাপার হচ্ছে, এই আঘাত মানুষটার গায়ে লাগে না, লাগে জ্বীনের গায়ে। এটি জ্বিন ছাড়াবার প্রাচীন একটি পদ্ধতি। যখন আঘাত পেয়ে রোগী চিৎকার করে কাঁদে, তখন রোগীর কষ্ট হয় না। কষ্ট হয় জ্বীনের। আর কান্নাটাও আসলে রোগীর না। ওই কান্নাও জ্বীনের।

এইসব জিনিস পারুলও জানে। গাঁও-গ্রামে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা প্রচলিত পদ্ধতি এইগুলো। ছোটবেলা থেকেই এসবই দেখে এসেছে তারা। বাবাকে তাই আলাদা করে খুব একটা দোষও পারুল দিতে পারেনি। বরং মায়ের চিকিৎসার জন্য বাবা যখন এক কথায় আতঙ্ক হয়ে গেলেন। তারপর নিজের সাধ্যের চেয়েও বেশি করলেন। তখন বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় পারুল নুয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু নয়নের কথায় এমন লাগছে কেন পারুলের? আবার নয়নকে দেখে, তার কথা শুনে তাকে মানসিকভাবে অসুস্থই লেগেছে পারুলের। কি সব অসংলগ্ন, বিশ্রি কথাবার্তা। সবই ঠিক আছে, কিন্তু একটা বিষয়ে পারুল এখনও পরিষ্কার না, নয়ন তাদের বাড়িতে কেন আসল? কোনো গুরুতর বিষয় না থাকলে তার এভাবে আসার কথা না। কিন্তু সেই গুরুতর ব্যাপারখানা কি?

একবার ভাবল বাবার কাছে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু তারপর আর জিজ্ঞেস করা হলো না। বাবার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিল না পারুলের। তার কেবল মনে হচ্ছিল, এই বাড়ি ঘর, এই চেনা গ্রাম, চেনা মানুষ, চেনা ঘ্রাণ থেকে সে দূরে কোথাও চলে যেতে পারত! বহুদূরে কোথাও! তার আর এখানে এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। একমুহূর্তও না। তার মনে হচ্ছে এখানে থাকলে সে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। তার পাখির মতো ডানা থাকলে এই মুহূর্তে সে উড়ে উড়ে দূরে কোথাও চলে যেত। কিন্তু তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কোথাও না।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে লতার কথাগুলো মনে পড়ল পারুলের। আশিক আর তার বন্ধুটির যেন কবে আসার কথা ছিল? লতা বলেছিল মাসখানেকের মধ্যেই তারা আসবে। তা মাসখানেকের তো আর বেশি বাকিও নেই। বাকিটা দিন পারুলের গেল প্রচণ্ড অস্থিরতায়। পারুল এমনই, খানিক আগের মন খারাপের কথা সে খানিক পরের কোনো মাছরাঙা পাখির উড়ে যাওয়া দেখে ভুলে যায়। খানিক আগের কান্নার কথা সে খানিক পরের কোনো গল্পে ভুলে যায়। তার খুব লতার সাথে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু তাকে এখন সে কই পাবে?

অদ্ভুত ব্যাপার হলো লতা এলো সন্ধ্যাবেলা। পারুল খুব অবাক হলো লতাকে দেখে। আজকাল কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। লতা বলল, মা’র শরীরটা নাকি ভালো না। এইজইন্য খবর পাঠাইছিল। দেখতে আইছি। ওমা, আইস্যা শুনি মিথ্যা খবর দিয়া আনাইছে।

পারুল বলল, মিথ্যা খবর দিয়া আনাইছে কেন?

লতা বলল, আমার বিয়া দিব। ছেলে সৌদি আরব থাহে। সেই ছেলে আইছে আমারে দেখতে!

পারুল বলল, ও আল্লাহ, কি কস! কই আমি তো কিছুই জানি না!

লতা বলল, আমি জানলে না তুই জানবি! আমিই তো জানি না।

পারুল বলল, তারপর? এহন কি হইল? তুই আশিক ভাইর কথা বাড়িতে বলস নাই?

লতা বলল, মায়রে কইসি। কিন্তু সে কয়, মোবাইলে পরিচয়, মোবাইলে প্রেম, এইগুলান নাকি ভালো না। এইরকম নাকি অনেক ছেলে থাহে, মোবাইলে প্রেম কইরা মাইয়াগো ক্ষতি করে, তারপর চইলা যায়। আর খোঁজ পাওন যায় না। এদের বাড়ি-ঘর, বাপ-মা, সঠিক পরিচয়, কিছুই জানন যায় না। এই ধরনের পোলাপানের উদ্দেশ্যই নাকি খারাপ থাহে।

পারুল বলল, কথা কি সত্য নাকি লতা?

লতা হাসল। বলল, তুইও তো দেহি মায়ের মতোই কথা কস পারুল। আশিকের লগে কি আমার আইজকের পরিচয়? তারে আমি চিনি আইজ বছর ঘুইর‍্যা আসল। তার লগে কতবার দেহা হইল। কতকিছু হইল। কই? সে কি আমারে ছাইড়া পালাই গেছে?

পারুল এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, কী কী হইছে, কনা লতা!

লতা বলল, তুই ছোট মানুষ, আগে বড় হ। তারপর বলবনে।

পারুল বলল, সবকিছুই হইছে না? আমি কিন্তু বুঝি। বুঝি না তা কিন্তু না। লঞ্চের কেবিনে, তাই না লতা?

লতা পারুলের পিঠে মৃদু কিল মেরে বলল, বেশি পাইক্যা গেছস। প্রেম করস না, বিয়া হয় নাই, আগেই এত পাকলে পরে আর পাকবি কেমনে?

পারুল বলল, খাড়া। আশিক ভাইয়ের বন্ধু এইবার আসুক। পছন্দ যদি হইয়াই যায়, তহন দেখা যাইবোনে কেমনে পাকি।

পারুলের চুল মুঠি করে ধরে লতা বলল, ওরে, তলে তলে এত! মুখ দেইখ্যা তো কিছুই বোঝনের উপায় নাই।

লতা আর পারুল হাসল। পারুল হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, আচ্ছা, আসল কথথাখানই তো বললি না।

লতা বলল, কি কথা?

পারুল বলল, মানুষটার নাম কি?

লতা বলল, যার নাম, তার কাছ থেইকাই জাইনা লইস। আমার এত ঠেকা নাই সব বইলা দেওনের। আর দুইজন দুইজনরে পছন্দ হইয়া যাওনের পরত আমারে আর চিনবিই না।

আশিকের বন্ধুর নাম রাজীব। পারুল এর মধ্যে দিন কয় গিয়ে তার সাথে তার নানাবাড়িতে থেকেও এলো। মজার বিষয় হচ্ছে এই সময়টায় লতার মোবাইল ফোনে তার সাথে রাজীবের কথা হলো। প্রথম দিন মিনিট দশেক। রাজীব খুব অন্তর্মুখি স্বভাবের ছেলে। কেমন একটা লাজুক লাজুক ব্যাপারও তার মধ্যে আছে। কিন্তু ওইটুকু সময়েই রাজীবকে ভারি ভালো লেগে গেল পারুলের। সেই রাতেই সে লতাকে বলল রাজীবের সাথে কথা বলিয়ে দিতে। তা কথা হলোও। শুধু যে হলোই তা-ই নয়। তাদের কথা শেষ হতে হতে পোর রাত। এই করে করেই চারটা দিন পারুল রয়ে গেল লতার সাথে। প্রতিদিনই রাজীবের সাথে কথা হলো রাতভর। যদিও সে সকল কথার বেশিরভাগই পারুলেরই বলা। কিন্তু একটা বিষয়, এই চারটে রাত, এই অচেনা, অজানা, অদেখা দুজন মানুষকে যেন কাছে নিয়ে এলো। খুব কাছে।

রাজীবের সাথে পারুলের দেখা হলো তার পরের শুক্রবার। বৃহস্পতিবার রাতেই আবার লতার নানাবাড়ি চলে গেল পারুল। রায়গঞ্জ ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে নির্জন নদী। সেখানে খানিক গাছপালার ছোট্ট পরিত্যাক্ত ভিটে বাড়ির আড়াল। সেখানেই নদী পাড়ে বসেছিল তারা। প্রথম দেখা হলেও রাজীবের সাথে সহজ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি পারুলের। ফোনে যে দীর্ঘ সময় তাদের কথা হয়েছে, তা একটা ভূমিকা রাখলেও রাজীবের সহজতা তাদের প্রথম দেখাটাকে আরো সহজ করে দিলো।

রাজীব এমনিতেই প্রচণ্ড লাজুক ছেলে। তার ওপর ফোনে সে যাও সপ্রতিভ, বাস্তবে তার চেয়েও ঢের কম। আর পারুল তার উল্টো। তাছাড়া সুদর্শন ছেলেদের প্রতি পারুলের আসক্তি সীমাহীন। ফলে পারুল যেন ঝলমলে রোদ হয়ে গেল। আর রাজীব লাজুক ছায়া। পারুলের সাথে কথা বলতে গেলেই তার কথা জড়িয়ে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। রাজীবের এই ভয়, এই এলোমেলো ভাব, এই সঙ্কোচ, এইটুকু সময়েই পারুলের এত ভালো লেগে গেল। মজাও লাগছে খুব। রাজীবকে অপ্রস্তুত করে দিতে তার ভীষণ আনন্দ। লাগছে। সে রাজীবকে বলল, আপনে এত ভয় পান কেন?

রাজীব বলল, ভয় পাই না তো। ভয় পাব কেন?

পারুল বলল, আপনার নাক ঘামতেছে। আমার সাথে কথা বলতে গেলে আপনের গলা কাঁপতেছে।

রাজীব সাথে সাথে হাতের উল্টোপিঠে নাকের ঘাম মুছল। পারুল হায় হায় করে উঠল। সে বলল, আরে কি করেন! কি করেন?

রাজীব দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, কেন?

পারুল লাস্যময়ী ভঙ্গিতে হাসল। তারপর বলল, যেই পুরুষের নাক ঘামে, সেই পুরুষের বউভাগ্য ভালো। ঘাম যে মুইছ্যা ফালাইলেন। ঘটনা কি, ভালো বউ চান না?

রাজীব যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে গেল। পারুল বলল, আপনে হাত দেখতে জানেন?

রাজীব মিনমিনে গলায় বলল, একটু-আধটু।

পারুল টুপ করে তার হাত পেতে দিলো রাজীবের সামনে। রাজীব সসংকোচে পারুলের হাতখানা ধরল। পারুল টের পাচ্ছে, তার হাতের ভেতর রাজীবের হাত কাঁপছে। রাজীব অনেকক্ষণ সেই হাত ধরে বসে রইল। পারুল বলল, কি হইল? বলেন না কেন, কি দেখলেন?

রাজীব বলল, একটা কথা বলি পারুল?

পারুল বলল, হ বলেন।

রাজীব বলল, আপনি হাসবেন না তো?

পারুল বলল, না, হাসব না।

রাজীব বলল, আপনার হাত ধরার পর আমার মাথা আর কাজ করছে না। আমার মনে হচ্ছে আমি যা জানতাম সব ভুলে গেছি।

পারুল বলল, আপনার নাম কি?

রাজীব অবাক গলায় জবাব দিলো, রাজীব।

পারুল বলল, আমার নাম কি?

রাজীব আরো অবাক হয়ে জবাব দিলো, পারুল।

পারুল বলল, আপনে তো কিছুই ভোলেন নাই। সব মনে আছে। শুধু শুধু মিথ্যা কথা কেন বলতেছেন?

রাজীব বলল, আমি মিথ্যা কথা কেন বলব পারুল?

পারুল বলল, এই যে যাতে অনেকক্ষণ আমার হাত ধইরা বইসা থাকতে পারেন। মাইয়া মাইনষের হাত ধইরা বইসা থাকতে খুব ভালো লাগে না?

রাজীব সাথে সাথে পারুলের হাত ছেড়ে দিলো। তারপর কাঁচুমাচু গলায় বলল, বিশ্বাস করুন। আমার সেরকম কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না পারুল। আমার সত্যি সত্যি এমন হচ্ছে।

পারুল বলল, আপনে পুরুষ মানুষ না?

রাজীব কোনো কথা বলল না। পারুল বলল, আপনে বলবেন, পারুল তোমার হাত ধইরা বইসা থাকতে আমার ভালো লাগতেছিল। এইজইন্য আমি তোমার হাত ধইরা বইসা আছিলাম। তোমার কোনো অসুবিধা আছে? এইভাবে বলবেন। বুঝছেন?

রাজীব বলল, না বুঝি নাই।

পারুল বলল, থাউক, আপনার বোঝা লাগবে না। দেন, আপনের হাত দেন। আমি আপনের হাত দেইখ্যা দেই।

রাজীব ভয়ে ভয়ে তার হাত এগিয়ে দিলো পারুলকে। পারুল তার হাতের মুঠোয় রাজীবের হাতখানা নিয়ে শক্ত করে ধরল। তারপর গভীর মনোযোগে দেখতে লাগল। রাজীব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পারুলের মুখের দিকে। পারুল বলল, ওইরকম কইরা কি দেখেন?

রাজীব থতমত খেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। বলল, নাহ্। কিছু না।

পারুল বলল, এইটা বললে মাইয়া মানুষ কষ্ট পায়। আপনে বলবেন, তোমারে দেখি। আমি বলব, কেন? আমারে আবার দেখার কি হইল? আপনে বলবেন, তুমি সেইটা বুঝবা না পারুল। আমি বলব, কেন বুঝব না? আপনে বলবেন, কারণ…

পারুল তার কথা শেষ করল না। রাজীব উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করল, কি কারণ?

পারুল বলল, সেইটাও আমি বইলা দিব?

রাজীব বলল, তাহলে…

তাহলে বলেই রাজীব থেমে গেল। পরের অংশটুকু আর বলল না। যেন এইটুকু বলেই সে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে। পারুল রাজীবের হাত দেখে বলল, আপনের চরিত্রে দেখি ভালো সমস্যা আছে!

রাজীব পারুলের কথা বুঝল না। সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। পারুল বলল, আপনে তো বিয়া করবেন তিনখান। এই দেখেন বিয়ার রেখায় তিন দাগ। দেখছেন?

রাজীব খুব মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু বুঝল না কিছুই। পারুল বলল, আপনের আয়ু ভালো। বিদেশ যাত্রা আছে। পড়াশোনায় ব্রেন ভালো…।

পারুল আরো কী কী সব যেন বলছিল। কিন্তু রাজীব সেসব কিছুই শুনছিল না। পারুলকে দেখে তার একবার মনে হচ্ছিল একটি চঞ্চলা ফিঙে পাখি। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল একটি উজ্জ্বলা নদী। কখন কি ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কখন কোন পাড় ভেঙে দেয়, তা যেন নিজেই জানে না।

পারুল একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছিল। বলেই যাচ্ছিল। রাজীব আচমকা তার বা হাতখানা বাড়িয়ে পারুলের হাতে ধরা তার ডান হাতের তালুটা ঢেকে দিলো। পারুল অবাক হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। রাজীব হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, আপনি কি আর কোনো কথা না বলে শুধু আমার হাতখানা ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকবেন?

পারুল অবাক গলায় বলল, কেন?

রাজীব গম্ভীর গলায় বলল, আমি জানি না। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আপনি আপনার হাতের মুঠোয় আমার হাতটা ধরে চুপচাপ বসে থাকুন।

পারুল যেন রাজীবের গলার স্বরের গভীর ব্যাকুলতাটুকু টের পেল। সে তার হাতের মুঠোয় রাজীবের হাত ধরে বসে রইল। একদম চুপচাপ। শীতের মিষ্টি রোদে নদীর ফুরফুড়ে হাওয়ায় পারুলের মনে হলো এই জীবনে তার আর কিছু চাওয়ার নেই। এই মুহূর্তটুকু নিয়েই সে বেঁচে থাকতে পারবে তার বাকিটা জীবন।

আশিক আর লতা আসল আরো বেশ কিছুক্ষণ পর। এই পুরোটা সময় পারুল রাজীবের হাত ধরে বসে রইল। লতা আর আশিক কাছে চলে আসার পরও রাজীবের হাতখানা পারুলের ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু রাজীব আস্তে করে তার হাতখানা সরিয়ে নিলো। লতা বলল, বাব্বাহ! একদিনেই এতদূর?

পারুলের কেন যেন আর কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাজীব হাতখানা ছাড়িয়ে নিতেই তার নিজেকে এত শূন্য মনে হচ্ছিল। এত রিক্ত, এত অসহায়। এই হাতখানা হাতের মুঠোয় নেই ভাবতেই এমন লাগছে কেন তার! এই একটামাত্র দিন। এই সামান্য কিছু মুহূর্ত, কিন্তু পারুলের মনে হচ্ছে, রাজীব যেন তার জনম জনমের চেনা। রাজীবের ওই হাতখানা সে সারাজীবনের জন্য তার হাতের মুঠোতে চায়। সারাজীবন।

রাজীব আর আশিক চলে গেল সন্ধ্যায়। তাদের পৌঁছে দিতে লঞ্চে গেল লতা আর পারুলও। বড় ডাবল কেবিন। পারুল আর লতা লঞ্চ ছাড়ার আগ অবধি সেই কেবিনেই বসল। লঞ্চ ছাড়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। এর মধ্যেই দুবার ভেঁপু বাজিয়েছেন সারেং। আরেকবার ভেঁপু বাজলেই লঞ্চ ছাড়বেন তিনি। লঞ্চ ছাড়ার আগে আগে আশিককে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল লতা। সম্ভবত পারুল আর রাজীবকে খানিকটা একান্ত সময় দেয়ার জন্য। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। সময় ফুরিয়ে আসছে। চলে আসছে চলে যাবার সময়। সারাদিন কলকলে নদীর মতো প্রগলভ পারুলও এসে এই মুহূর্তে যেন হয়ে গেল শান্ত শীতল জল। ঢেউ নেই, গতি নেই, স্থির, স্তব্ধ। দুজনের বুকের ভেতরই উদ্বেল হয়ে আছে অসংখ্য কথা। কিন্তু সেই কথারা যেন ভাষা পাচ্ছে না। বুক থেকে বের হয়ে পরস্পরের কানের কাছে শব্দ হতে পারছে না। লঞ্চের শেষ ভেঁপুটা বাজল। পারুল বলল, আমি তাইলে যাই। লঞ্চ ছাইড়া দিব। আপনে ভালো থাইকেন।

রাজীব তাও কোনো কথা বলল না। পারুল উঠে দাঁড়াল। তার পৃথিবীটা যেন ক্রমশই শ্মশানের নিস্তব্ধতায় ডুবে যাচ্ছে। সেখানে ধেয়ে আসছে হাহাকারের শীতল হাওয়া। কেউ নেই, কেউ নেই। পারুল দরজা দিয়ে বের হবে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে রাজীব বলল, পারুল, আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আপনার হাতটা ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকতে। আমি যদি আপনার হাতটা ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকি। আপনার কি কোনো অসুবিধা আছে?

পারুল ঝট করে পেছন ফিরে তাকাল। তার রাজীবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই জগতে এমন অনাবিষ্কৃত অনুভূতি রয়ে গিয়েছিল, তা পারুল এই এতদিন কোনোদিন বুঝতে পারেনি। কিন্তু লঞ্চ এক্ষুণি ছেড়ে দিবে। তাকে যেতে হবে। দ্রুত, খুব দ্রুত। পারুল কম্পিত পদভারে ঘুরল। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলো রাজীবের দিকে। রাজীব তার হাতখানা ধরল। শক্ত করে। পারুলের চোখ বেয়ে বান নেমে আসছে। কিন্তু পারুল সেই বান সামলে নিলো। তার কেবল মনে হতে লাগল, রাজীব এমন কেন? এই কথা ক’টি আর কিছু সময় আগে বললে কি এমন ক্ষতি হতো? আর কিছুটা সময়?

লঞ্চ ছেড়ে দিচ্ছে। পারুল আর লতা দৌড়ে লঞ্চ থেকে নামল। তারপরের বাকিটা সময় পারুলের হাতে লেগে রইল রাজীবের ওই স্পর্শটুকু। তার কেবল মনে হতে থাকল, এই স্পর্শটুকু নিয়েই সে তার গোটাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। একটা গোটা জীবন। এমন একটু স্পর্শের জন্যই হয়তো মানুষ বেঁচে থাকে। কাটিয়ে দেয় একেকটা মানবজনম।

*

ঘটনা একইসাথে ভয়াবহ এবং বিস্ময়কর। সকালে ফজুকে ভাত দিতে গিয়ে সাপে কাটল সালেহাকে। সালেহা ভাতের পাতিলে হাত দিতেই তার হাতে ছোবল মেরেছে সাপ। সালেহা প্রথমে বুঝতে পারেনি। সে পাতিলের ভেতর উঁকি দিয়েই বিকট চিৎকারে পাতিল ছুঁড়ে ফেলল। খোলা দরজা দিয়ে পাতিল উড়ে গিয়ে পড়ল উঠানে। তারপর কয়েকটা গড়ান খেয়ে স্থির হয়ে রইল। পাতিলের ভাত ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। সাপটা তখনই কাত হয়ে থাকা পাতিলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। ভয়াবহ দৃশ্য। সালেহা চিৎকার করে জ্ঞান হারাল। তার দাঁতে খিল কবাটি লেগে গেছে। ফজু ঘটনার আকস্মিকতা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে হতভম্ব হয়ে বসে আছে। এর মধ্যে পাশের ঘরের আফলাতুন চাচী চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুললেন। মুহূর্তের মধ্যে বড়োসড়ো জটলা হয়ে গেল উঠানের মাঝখানে। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল সাপটাকে মারতে। কিন্তু ভিড়ের মধ্য থেকেই কে যেন বলল, সাপে কামড় দেওনের পর বিষ নামানোর আগে সাপ মারলে সেই বিষ আর নামে না।

অন্যজন বলল, তাইলে?

সে বলল, সাপটারে জাল দিয়া আটকাইয়া রাখ। আগে বিষ নামুক, তারপর দেখন যাইবো ঘটনা।

সাপটাকে জাল দিয়ে আটকে ফেলা হলো। ততক্ষণে আব্দুল ফকিরকে খবর দিতে লোক চলে গেছে। সালেহার জ্ঞান ফিরে আসলেও সে মৃত মানুষের মতো পড়ে আছে বিছানায়। আব্দুল ফকির আসলেন বিকেলে। তিনি প্রথমেই সাপ দেখতে চাইলেন। তারপর থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে বললেন, আপনেরা সবাই একটু ভিড় কমান। ভয়ের কিছু নাই। সালেহার কিছু হইব না। ব্যবস্থা আমি করতেছি।

ভিড় কমার পর আব্দুল ফকির ফজলুকে ডেকে গম্ভীর গলায় বললেন, ফজলু, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমারে দেখা করনের লইগ্যা খবর দিছে। আমি এহনো যাই নাই। নানান ছুঁতায় দেরি করতেছিলাম। আমার কেন জানি মনে হইতেছিল, উনি আমারে এমন কিছু বিষয়ে জিগাইব, যেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত কিছু জানি না। সেই বিষয়ে আমারে একমাত্র জানাইতে পারতি তুই। কিন্তু তুই বাইরের মাইনষেরে যেমন শত্রু মনে করস, তেমনে শত্রু মনে করস ঘরের মানুষরেও। এহন সবাইরেই যদি শত্রু মনে করস, তাইলে তোরে বন্ধু মনে করব কেডা?

ফজু কোনো কথা বলল না। আব্দুল ফকির বললেন, আমি তোরে আপন মানুষ মনে করছি। আপন মানুষ মনে কইরাই তোর জইন্য জান প্রাণ দিয়া খাটতেছি। কিন্তু তুই আমারেও বিশ্বাস করতে পারলি না। বিশ্বাস হইতেছে এমন এক জিনিস ফজলু, একবার ভাঙলে আর জোরা লাগে না।

ফজু বলল, কাকু, এইসব কথা এহন বলতেছেন! আগে তো সালেহার একটা ব্যবস্থা করেন।

আব্দুল ফকির বললেন, এইসব কথা তো এহনই কওনের কথা ফজু। আইজ তোর বাড়িতে না আসলে তো ঘটনা কিছুই আমার ধারে পরিষ্কার হইত না।

ফজু খুবই দিশেহারা বোধ করছে। আব্দুল ফকিরের আজ এই বাড়ি আসার সাথে এই ঘটনার সম্পর্ক সে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে বলল, কাকু, আমি আপনের কথার কিছুই বুঝতেছি না।

আব্দুল ফকির বললেন, সেইটাই ফজু। তুই বোঝনের আগেই অনেক বড় খেলায় নাইম্যা পড়ছস। শোন, সালেহার কিছু হয় নাই। সাপ সালেহার কাটতে আসে নাই। কাটতে আসছে তোরে। সাপ দেখছোস? এইটা সাধারণ কোনো সাপ নারে ফজলু। এইগুলান হইল যক্ষের সাপ। আগের দিনে মানুষ চোর ডাকাইতের ভয়ে, বা অন্য কোনো কারণে হাড়ি-পাতিলে ভইরা, কলসিতে ভইরা ধন-সম্পদ, সোনার গয়না এইগুলান মাটি চাপা দিয়া রাখত। তারপর দেহা গেল সে আচুক্কা মইরা গেছে। কিন্তু ওই সম্পদের খবর কাউরে বইলা যাইতে পারে নাই। শত শত বছর সেই সম্পদ রইছে মাটির নিচে। তারপর এক সময় ওই সম্পদ হইয়া গেছে যক্ষের ধন। এইসব কাহিনি শোনস নাই? মাটির তলের ধন-সম্পত্তির মালিক হইয়া গেছে আছড়া। জ্বিন পরী বা সাপ। এইগুলান বিভিন্ন ছৈল ধইরা থাকে। থাইক্যা সেই ধন-সম্পদ পাহারা দেয়। শত শত বছর সেই ধন-সম্পদ পাহারা দিতে দিতে, সেই ধন-সম্পদের উপর একটা মায়া পইর‍্যা যায় তাগো। এইজন্য কেউ জোর কইর‍্যা সেই ধন-সম্পদ নিতে আইলে, তারা তার ক্ষতি করে। আর যারে পছন্দ হয়, তারে বিভিন্ন উপায়ে সেই ধন-সম্পদের কথা জানাই দেয়। অনেকে এইরকম ঘটনাও দেখছে। মাটি কাটতে গিয়া সোনার বিরাট কলসি পাইছে, কিন্তু সেই কলসি সে নিতে পারে নাই। কারণ কলসির গলা পেঁচাইয়া আছে আজদাহা সাপ। বুঝছস ফজু?

আব্দুল ফকির সামান্য থামলেন। তারপর বললেন, এই সাপও সেইরকম একখান সাপ। সাপ আমি দেখছি, এই সাপ তো তোর ঘরে আসনের কথা না। ঘটনা এহন আর আমার বুঝতে বাকি নাই। তায় কতবড় কলস পাইছস? কলসের পুরাটাই কি সোনায় ভর্তি? এই সাপ কিন্তু বহুবছর জিনিস পাহারা দিয়া রাখছিল। এহন সে আসছে জিনিসের খোঁজে। জিনিসের খোঁজ না পাইলে কিন্তু বিপদ ফজু।

এই ধরনের অনেক কথা ফজুও শুনেছে। দাদীজানের মুখে শুনছে, মায়ের মুখে শুনেছে। আশেপাশের ময়মুরুব্বীদের কাছে শুনেছে। এখন আব্দুল ফকিরের মুখে এই কথা শুনে ভয়ে ফজুর শিরদাঁড়া অবধি ঠান্ডা হয়ে এলো। আসলেই সাপটা আর সব সাপের মতো না। ভাতের পাতিলের ভেতর থেকে সে এমনভাবে বেরুল, যেন কোনো ভয় ডর নেই। চারপাশে এত মানুষ, তাও কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে ফণা তুলে স্থির হয়ে ফোঁস ফোঁস করছিল সাপটা। ভাবতেই ফজুর শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। আবার আব্দুল ফকির বলছেন, সালেহার কিছু হয়নি। কিন্তু ঘটনা সে চোখের সামনে দেখেছে। সালেহা ভাতের পাতিলে হাত দিলো আর কিছু একটা হলো। তারপর ভেতরে তাকিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল সে। তারপর পাতিলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ওই সাপ! কী ভয়ঙ্কর!

ফজু শুকনো গলায় বলল, আপনে বললেন সালেহার কিছু হয় নাই। কিন্তু সে তো দাঁত কবাটি দিয়া আছিল। এহনো অসুস্থ।

আব্দুল ফকির বললেন, ভয় ফজু, ভয়। কথায় আছে না, মাইনষেরে বনের বাঘে খায় না, খায় মনের বাঘে। সালেহারে মনের বাঘে খাইছে। সে ভাবছে। সাপে তারে আসলেই কামড়াইছে। এইটা চিন্তা কইরাই ডরে ফিট। আর ভাতের পাতিলে হাত দিয়া সাপ দেখলেই তো ফিট খাওনের কথা। কামড় দেওন লাগে? কিন্তু এই সাপ তো এহনই কামড়াইব না। এহন সে আইছে তার কলসির খোঁজ নিতে। ডর দেহাই গেল। এই জিনিস কিন্তু মারতে যাইস না ভুলেও। মারতে তো পারবিই না। উল্টা বিপদ ডাইক্যা আনবি। মহা বিপদ।

ফজু হঠাৎ দুই হাত বাড়িয়ে আব্দুল ফকিরের একখানা হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, বলল, এই বিপদ থেইক্যা আপনে আমারে বাঁচান আব্দুল কাকু। আমি আর এত চিন্তা ভাবনা নিতে পারতেছি না।

আব্দুল ফকির গম্ভীর গলায় বললেন, কলসি কই রাখছস?

আব্দুল ফকিরকে যতটা ভয় ফজু পায়, ঠিক ততটা বিশ্বাস সে করে না। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেও ফজু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, আব্দুল ফকিরকে সে সত্যি কথাটা বলে দিবে কিনা। আব্দুল ফকিরের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর তাই ফজু দিলো না। সে উত্তর দিলো ঘুরিয়ে। ফজু বলল, কাকু, যেইখানে কলস আছে, এই সাপ সেইখানে যাইতে পারে না?

আব্দুল ফকির গম্ভীর গলায় বললেন, পারব না কেন? পারে। তয় সে চায় যে তার কাছ থেইক্যা কলসি আনছে, সে-ই ফিরাইয়া দিয়া আসুক।

ফজু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, কথাখান কইলে আমি খুন হইয়া যাব ফইর কাকু।

আব্দুল ফকির বললেন, কি কইলে তুই খুন হইবি ফজলু?

ফজু বলল, গয়নার কলসি কার কাছে আছে, সেই কথা।

আব্দুল ফকির বললেন, কার আছে আছে গয়নার কলসি?

ফজু বলল, কলসি আমার কাছেই আছিল কাকু। কিন্তু এহন আর কলসি আমার ধারে নাই কাকু। আল্লাহ খোদার কসম দিয়া কইতেছি, কলসি এহন আর আমার ধারে নাই। তৈয়ব খার নাতি মনির, সে এই কলসির জইন্য নানান ছলছুঁতায় গ্রামের ঘরে ঘরে খোঁজ চালাইছে। কলসি আমি রাখছিলাম সলিমুদ্দি দফাদারের বাড়ির পুরান পুষ্টুনির ঘাটলার তলায়। সেইখানে গিয়া দেহি কলসি নাই। কেডা জানি কলসি উঠাইয়া নিয়া গেছে।

ফজুর কথা শুনে আব্দুল ফকির থম মেরে বসে রইলেন। এই প্রথম তিনি নিজে বিভ্রান্ত বোধ করছেন। এই ঘটনার পরও কি ফজু তার সাথে মিথ্যা কথা বলার দুঃসাহস দেখাবে? নাকি সে যা বলছে তা আসলেই সত্যি?

.

গত কিছুদিনে আব্দুল ফকিরের এই বিভ্রান্তভাব এই প্রথম না। তার সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি তৈয়ব উদ্দিন খাঁর নাতি নয়ন। এই ছেলে তার কাছে কি চায়, এই নিয়ে তিনি অনেক কিছুই ভেবেছেন, কিন্তু স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। সর্বশেষ ঘটনায় তিনি যারপর নাই উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। পালরদির মেলা থেকে ফিরে ঘটনা শুনে তো তিনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। নয়ন নাকি ঢাকা থেকে তার বাড়িতে এসে উঠেছিল। তারপর সেখান থেকে তাকে অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে যেতে হয়েছে। আব্দুল ফকির নানান কিছু চিন্তা করেছেন, কিন্তু কোনো চিন্তাতেই স্থির হতে পারেন নাই। নয়নের বিষয়টি নিয়ে একটা প্রবল অস্থিরতা তার মধ্যে কাজ করছে। কিন্তু কোনো ভাবনাকেই আরেকটা ভাবনার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা যাচ্ছে না। আব্দুল ফকিরের হঠাৎ মনে হলো, তার বয়স যেন বেড়ে গেছে। বয়স বেড়ে গেলে মানুষের শরীরের মতো মস্তিস্কও শিথিল হতে থাকে।

.

আব্দুল ফকিরের সাথে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর দেখা হলো শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর। খাঁ-বাড়ির দহলিজ ঘরে মুখোমুখি বসে আছেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আর আব্দুল ফকির। দীর্ঘ সময় দুজন মানুষ চুপচাপ বসে রইলেন। কেউ কারো সাথে কোনোপ্রকার কথা বললেন না। কিন্তু এই কথা না বলা সময় জুড়েও যেন অসংখ্য কথাবার্তা ঘুরে বেড়ালো দুজনের চারপাশে এবং দুজনই যেন সেইসব কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পেলেন। দীর্ঘ নীরবতা ভাঙলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তার শরীর যথেষ্টই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবুও যতটা সম্ভব স্থির থাকার চেষ্টা তিনি করছেন। তিনি ধীরে, একটা শব্দ থেকে আরেকটা শব্দকে আলাদা করে থেমে। থেমে বললেন, ফইর, তোমার শরীল-স্বাস্থ্য কেমন?

আব্দুল ফকির বললেন, জ্বে, আল্লাহর রহমত আর আপনের দোয়া খা সাব। মাশাল্লাহ ভালো।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমার কোনোদিন বড় কোনো রোগ হইছে? কোনো অসুখ, যাতে তুমি অনেক দিন বিছনায় পইড়া আছিলা। মনে হইছিল, এই অসুখ আর কোনোদিন ভালো হইবো না?

আব্দুল ফকির বলল, না খা সাব। তেমন কোনো অসুখ আমার হয় নাই। তয় পায়ের ঘটনায় বহুদিন বিছনায় আছিলাম।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তহন তোমার মৃত্যুচিন্তা হয় নাই?

আব্দুল ফকির বললেন, বহুবছর আগের ঘটনা, ইয়াদ নাই খাঁ সাব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, মানুষের জীবনে অসুখ-বিসুখ হওন, বিপদ আপদ আসন যে দরকার, এইটা তুমি মানো?

আব্দুল ফকির বললেন, আমার হিসাব আর আপনের হিসাব মেলব না খা সাব। আপনে বলেন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার কি মনে হয় জানো? আমার মনে হয় মানুষের জীবনে অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদ দরকার আছে। কেন দরকার আছে বলি। ধরো তুমি সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ, কোনো বিপদ-আপদ নাই। যা করতেছ, সব ঠিকঠাক। তহন একটা সময় আইস্যা তোমার মইধ্যে একটা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস চইলা আসব। তুমি তহন যা করতে ইচ্ছা করব, তাই করবা। পরিণতি নিয়া ভাববা না। কথায় বলে না, মানুষের ভালো কাজ করতে ভালো লাগে। কথা ভুল, মানুষের ভালো লাগে খারাপ কাজ করতে। অন্যায় কাজ করতে। এহন এই খারাপ কাজের মজা যদি তুমি একবার পাও। আর সেইটা করতে গিয়া যদি ব্যর্থ না হও। যদি কোনো বাধা-বিপত্তি না পাও। সবাইরে যদি তোমার অন্যায় তুমি মাইনা নেওয়াইতে পারো। তাইলে সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হয়। নিজের মইধ্যে একটা হামবড়া ভাব চইল্যা আসে। নিজেরে মনে হয় সর্বশক্তিমান। এইটা মানুষরে খারাপের চূড়ান্ত সীমানায় নিয়া যায়। যেইখান থেইকা আর ফেরনের পথ থাহে না। এইটা হইল একমুখী রাস্তা। একটা পর্যায় পর্যন্ত চইল্যা যাওনের পর আর ফিরা আসনের পথ নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সামান্য থেমে থু থু ফেললেন। তারপর আবার বললেন, কিন্তু ধরো, তোমার যদি অসুখ-বিসুখ হয়, বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত আহে। তহন তোমার মন হইব দুর্বল। একটা ভয় হইতে থাকব। এই দুর্বল মন, এই ভয় কিন্তু দরকার আছে। এইটা তোমারে পাপ হইতে, অন্যায় হইতে দূরে রাহে। সবাই বলে, মনে সাহস দরকার। আমিও তাই-ই মনে করতাম। কিন্তু গত কিছুদিন ধইরা আমার কি মনে হইতেছে জানো? আমার মনে হইতেছে, সাহসের চাইতে বেশি দরকার ভয়। একবার যদি তোমার মনের মইধ্যে থেকে ভয় চইলা যায়, তাইলেই সর্বনাশ।

আব্দুল ফকির বললেন, আপনের কি শরীল খারাপ খাঁ সাব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, একদম ঠিক ধরছ। যেইসব চিন্তা আমি আগে কহনো করি নাই। কাউরে তেঁজপাতার দাম পর্যন্ত দেই নাই। এহন আইসা। সেইসব চিন্তা আমার মইধ্যে ঢোকছে। কত যে চিন্তা। শোনো মানুষ বলে, জন্মের পর শিশুরা হইল গিয়া সব চাইতে নিষ্পাপ। তাদের জইন্য সবাইর মায়া হয়। আবার বৃদ্ধ অসহায় মানুষরেও কিন্তু দেখলে মনে হয়, আহারে! কি নিষ্পাপ দেখতে মানুষটা। তাগো জইন্যও মায়া হয়। এর কারণ কি জানো? কারণ ওই ভয়। ওই না-জানা। ধরো, একটা বাচ্চা, সে জগতের কিছুই জানে না, সে আন্ধার দেখলে ভয় পায়, অপরিচিত মুখ দেখলে ভয় পায়, জোরে শব্দ শুনলে ভয় পায়। কেন পায়? কারণ সে এইগুলান চেনে-জানে না। আবার একজন বুড়া মানুষও ভয় পায়। সে কিসের ভয় পায়? সে পায় আরেক জগতে। যাওনের ভয়। সেও সেইখানে কিছু চেনে না, জানে না। আর মাঝখানের যেই। সময়টা, যৌবনকাল, বা ধরো সুস্থ, শক্ত-সমর্থ থাহনের সময়টা, এই সময়টা মনে হয়, কোনোকিছুই কোনো ব্যাপার না। এই সময়টায় মানুষ এইজইন্য সবচাইতে বেশি সাহসী থাহে। সবচাইতে বেশি ভুল করে। অন্যায় করে। পাপ করে।

আব্দুল ফকির বললেন, জ্বে খাঁ সাব। ঠিক বলেছেন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এইজইন্যই মানুষের ভালো থাহনের লাইগা সবচাইতে বেশি দরকার বিপদ-আপদ। সবচাইতে বেশি দরকার অসুখ-বিসুখ। এইগুলান মানুষরে উপলদ্ধি দেয়। এইটা জরুরি। ধরো, তুমি প্রত্যেকদিন আসমানের দিকে তাকাইয়া হাঁটতেছ। এহন তুমি যদি উষ্ঠা না খাও, তাইলে কয়দিন পর মনে ইচ্ছা হইব আসমানের দিক তাকাইয়া আরো জোরে হাঁটতে। তারপর ইচ্ছা করব দৌড়াইতে। তারপর একদিন ধরো গাড়ি চাপায় সব শেষ। কিন্তু আগে-ভাগে যদি দুয়েকটা উষ্ঠা খাইয়া পড়ত, তাইলে কিন্তু আর উপরে চাইয়া দৌড়ানোর ইচ্ছা হইত না। এহন ধরো গাড়ির তলে পইড়া মরনের আগ মুহূর্তে যদি মনে হয়, আহারে ভুল কইর‍্যা ফালাইছি। আগেই যদি বুঝতাম। তাতে লাভ কি? সময় গেলে কি আর সাধন হয়?

আব্দুল ফকির বললেন, খা সাব কি আইজকাল এইগুলান ভাইব্যাই সময় কাটান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সময় কি কাটাব ফইর? সময় কি আর আছে? সময় কাটানোর কিছু নাই। সময় হইল এমন এক জিনিস, তুমি কাটাইলেও তার কিছু যায় আহে না, না কাটাইলেও কিছু যায় আহে না। সে কারো তোয়াক্কা করে না।

আব্দুল ফকির বললেন, আপনে কি এইসব কথা বলতেই ডাকছেন আমারে?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, একটা জিনিস খেয়াল করছ ফইর? আমি আইজকাল বাঁচাল হইয়া গেছি। সুযোগ পাইলেই খালি কথা কই। কোনো মানুষ বাঁচাল হয় জানো? যার কোনো কাজ নাই। অথর্ব লোকজন কথা বলে বেশি। কাজ করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে চায় কথা বইল্যা। আমি এহন অথর্ব মানুষের দলে।

আব্দুল ফকির বললেন, আপনে কিন্তু কথাগুলান খুব দামি বলতেছেন খাঁ সাব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমার কাছে এই কথা দামি মনে হইতেছে ফইর?

আব্দুল ফকির বললেন, জ্বে না খাঁ সাব।

তৈয়র উদ্দিন খাঁ বললেন, সেই জইন্যই জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা ফইর তুমি কি পাপপূণ্যে বিশ্বাস করো?

আব্দুল ফকির বললেন, যে করি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমার কি মনে হয় জীবনে তুমি কোনো পূণ্য করছ?

আব্দুল ফকির বললেন, জ্বে না খাঁ সাব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, পাপ? পাপ করছ?

আব্দুল ফকির বললেন, জ্বে খাঁ সাব। আমার জীবন জুইড়াই পাপ।

 তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমার ডর লাগে না?

আব্দুল ফকির বললেন, লাগে খাঁ সাব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তারপরও পাপ কর্ম বন্ধ করো না কেন?

আব্দুল ফকির বললেন, এইটা একটা নেশার মতো খা সাব। আপনে জানেন, নেশা করন খারাপ। কিন্তু এই নেশা থেইক্যা আপনে বাইর হইতে পারবেন না। নেশা করলে তার পরিণতি খারাপ হয়, এইটা সবাই জানে। তারপরও করে। অনেক বড় বড়, জ্ঞানী-গুনী মানুষও করে। করে না? এই ধরেন সামান্য বিড়ি, সিগারেটের নেশা, প্যাকেটর গায়ে ছবি থাকে, কত কি লেখা থাকে, মানুষ তারপরও করে, করে না খাঁ সাব? করে। খারাপ কাজও ওইরকম। একটা নেশা। প্রত্যেকবার করনের পর মনে হয়, এইবারই শেষ। কিন্তু পরেরবার আবার করতে ইচ্ছা হয়। নেশা হইল এমন এক জিনিস খা। সাব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তুমি একটু আমার সামনে আসো ফইর। তোমার মুখটা সামনে আনন। তোমার লগে আমার জরুরি একখান কথা আছে। আব্দুল ফকির ভারি অবাক হলেন। কিন্তু তারপরও তিনি তার আসন থেকে উঠে তার মুখখানা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখের কাছে নিয়ে এলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আব্দুল ফকিরের মুখে প্রচণ্ড জোরে চড় বসালেন। আব্দুল ফকিরের দূরতম চিন্তায়ও ছিল না যে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তাকে চড় মারতে পারেন! তার চেয়েও বড় কথা এই বয়সে, এই অবস্থায় তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হাতে এই পরিমাণ শক্তি থাকতে পারে, এটিও আব্দুল ফকিরের কাছে অচিন্তনীয় ছিল। আব্দুল ফকির ছিটকে পড়লেন ঘরের বেড়ার সাথে। তার মাথা ঠুকে গেল ঘরের টিনের বেড়ার সাথে। তিনি সেখান থেকে উঠলেন না। তার ঘোর এখনও কাটছে না। তৈয়ব। উদ্দিন খাঁ বললেন, ফইর বসো। তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।

আব্দুল ফকির অবাক করা চোখে উঠে তার আসনে বসলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তুমি রাইতে স্বপ্ন দেহো?

আব্দুল ফকির হতভম্ব গলায় বললেন, জ্বে না খাঁ সাব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমি দেহি। নানান স্বপ্ন দেহি আইজকাল। তোমারে থাপ্পড় মারছি দেইখ্যা মনে দুঃখ নিও না। গত রাইতে স্বপ্ন দেখছিলাম, তোমারে থাপ্পর মারছি, এইজইন্য স্বপ্নটা পূরণ করলাম। বুড়া মানুষ, আর কয়দিন বাঁচব বলো? তোমার তো খুব বেশি ক্ষতি হইল না। ব্যথাও বেশি পাও। নাই, লোকজনেও দেহে নাই। আবার আমার স্বপ্নটাও পূরণ করলা। কি বলো ফইর?

আব্দুল ফকির কথা বললেন না। তার হতভম্ব ভাব এখনো কাটেনি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তাছাড়া নেশা কাটনের দরকার আছে, আছে? নেশা কাটাইতে এইরম দুয়েকখান চড়-থাপ্পড় দরকার আছে। আরেকখান কথা, আইজকাল অনেক ভাবনা চিন্তা করি আমি, বুঝলা ফইর? নানান জিনিস। এর মইধ্যে একটা হইছে, মানুষের জন্ম আর মৃত্যু। চিন্তা কইরা দেখছ, জন্ম মৃত্যু কিন্তু একদম একই রকম নিয়মে হয়। এই সময়ের ঘটনাও সব এক। ধরো জন্মের সময় মানুষ অসহায় থাহে, মৃত্যুর সময়ও অসহায় থাহে, দুর্বল থাহে। বিচার বুদ্ধি কম থাহে। অন্যের উপর নির্ভরশীল থাহে। কথা ঠিক না ভুল?

আব্দুল ফকির কথা বললেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আরেকটা জিনিস, জন্ম হইল একধরনের মৃত্যু। ধরো সে মায়ের প্যাটে আছিল। কোনো। ভাবনা-চিন্তা আছিল না। খাওনের চিন্তা নাই, পরনের চিন্তা নাই। ঘর-বাড়ির চিন্তা নাই। নিশ্চিন্তের দুনিয়া। তোমার জন্ম হইল মানে সেই নিশ্চিন্তের দুনিয়ারতন তোমার মরন। আবার মরন মানে হইল এই চিন্তার দুনিয়ারতন তোমার মরন। তুমি যাইতেছ আরেক দুনিয়ায়। এইটা একটা চক্করের মতো। পুরা জীবনটাই একটা চক্কর। একই জিনিস বারবার বারবার ঘটে। এই যে ধরো তোমারে আমি থাপ্পড় দিলাম, এইটাও একটা চক্কর। তুমিও কোনোদিন হয়তো আমারে একখান থাপ্পড় দিছিলা, থাপ্পড় মানেই যে শুধু হাত দিয়া গালে মারন, তা না। থাপ্পড় নানানভাবে দেওন যায়। যাই হোক। সেই চক্করের কারণেই ধরো থাপ্পড় তোমার কাছে ফিরা আসলো।

আব্দুল ফকির নিজের উপর বিরক্ত। তিনি বিভ্রান্ত বোধ করছেন। এই ব্যাপারটা আগে কখনো হয়নি তার। কিন্তু গত কয়েকদিনে বার কয় এই ঘটনা ঘটল। সবচেয়ে বড় ব্যাপার তৈয়ব উদ্দিন খাঁর উদ্দেশ্য তিনি ধরতে পারছেন না। তার ধারণা ছিল তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার সাথে ফজু সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলবেন। কিন্তু তিনি সে সবের কিছুই বললেন না। এমনকি গয়নার কলসির বিষয়ও না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমার ধারণা সত্য। তোমার সম্পর্কে আমার একটা ভয় আছে। এই ভয়টা আমি কাটাইতে পারি নাই ফইর। কিন্তু শ্যাষ কিছুদিন বিছানায় শুইয়া শুইয়া খেয়াল করলাম, আমার চিন্তা-ভাবনা খোলতেছে। নানা আচানক বিষয়াদি মাথায় আসতেছে। তার মইধ্যে একটা হইছে, যেই লোক আইজ বাদে কাইল মরব, তার আর ভয় কি? মরনের চাইতে বড় আর কি আছে ফইর?

আব্দুল ফকির চুপ।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, চিন্তা-ভাবনা কইরা আরো কি বাইর করলাম জানো? কয়দিন আগে শোনলাম, ফজুর ঘরের পাতিলের ভেতর নাকি সাপ পাওন গেছে। তুমি নাকি সাপের বিষ নামাইতে আইস্যা বলছ, ওই সাপে। সালেহারে কাটে নাই। ও সাপ নাকি আলাদা কোনো সাপ। সারাদিন শুইয়া থাহি তো। ঘটনা মাথায় ঘোরে, আর চৌক্ষের সামনে পরিষ্কার হইয়া যায়। ফইর। আমার ধারণা এই কাজ তুমি ঘটাইছ। ওই সাপ ফজুর ভাতের পাতিলে রাখনের ব্যবস্থাও তুমি করছ। তোমার ধারে তো বিষদাঁত ভাঙ্গা বহুত সাপ আছে। আছে না? তো ফজুর লগে এই খেলা কেন খেলো? গয়নার কলসির খবরের জইন্য? ফজু তো বলল ওই কলসি তোমার ধারেই আছে।

আব্দুল ফকিরের জীবনে নিজেকে কখনো এত অসহায় বা বোকা লেগেছে কিনা, তা তিনি জানেন না। এই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আগের যে-কোনো তৈয়ব উদ্দিন খাঁর চেয়ে ভয়ঙ্কর। এই তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কাছে নিজেকে দুধের শিশু মনে হচ্ছে আব্দুল ফকিরের। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, ফজু তোমারে কি বলছে? গয়নার কলসি খাঁ-বাড়িতে?

আব্দুল ফকির যেন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছেন। তৈয়র উদ্দিন খাঁ বললেন, ফজু আমারে মিথ্যা বললেও তোমারে মিথ্যা বলে নাই। কলসি খাঁ-বাড়িতেই আছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ থামলেও আব্দুল ফকির কথা বলার কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। আর কখনো এমন পরাজিত, বিধ্বস্ত, অসহায় তিনি বোধ করেছেন কিনা, আব্দুল ফকির জানেন না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমারে আমি বিশেষ কোনো কাজে ডাকি নাই ফইর। তোমার এই চেহারাখান দেখার জইন্য ডাকছিলাম। এইরম চেহারা আর কেউ তোমার কহনো দেখছে কিনা জানি না। মরনের আগে একটা বড় অশান্তি থেইক্যা মুক্তি পাইলাম আমি। তোমার এই মুখোন আমার শান্তি। আর এতক্ষণ যে বললাম না, মানুষের জীবনে বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত দরকার আছে। সেই সাথে হারও দরকার আছে। খালি জেততে থাকলে সমস্যা। তুমি তোমার সারাজীবন খালি জেতছ ফইর। এইজইন্য আইজ এই ছোট্ট হারখান দিলাম। তয় যার বড় জিত আছে, তার হারও কিন্তু বড় হইব ফইর। চক্করের জীবন। ঘুইর‍্যা ফিরা তোমার জিনিস তোমার ধারেই ফেরত আইব।

বাকি সময় আব্দুল ফকির একটা কথাও বললেন না। তিনি খাঁ-বাড়ি থেকে বের হলেন সন্ধ্যার আগে আগে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মসজিদে গিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে আমোদি বেগমকে ডাকলেন। তারপর একখানা পান মুখে দিয়ে বললেন, ফজুর গয়নার কলসি কই রাখছ আমোদি বেগম?

আমোদি বেগম একটা ঝাঁকির মতো খেলেন। তারপর বললেন, কিয়ের গয়না?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নির্বিকার গলায় বললেন, ফজুর গয়না।

আমোদি বেগম বললেন, সেই গয়না আমি পাব কই?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, গয়না সালেহা তোমারে দিয়া গেছে। ফরাজিগো কল নষ্ট হওনের কথা বইলা সে কলস লইয়া আমাগো টিউবওয়েলে আসছিল পানি নিতে। আসলে পানি টানি কিছু না। ফরাজিগো কল নষ্টও হয় নাই। সে ওই ছুঁতা দিয়া পানি নেওনের নাম কইরা কলস নিয়া আইছে। সেই কলসে আছিল সেই সোনার গয়না। সে আসছে এক কলস লইয়া, গেছে অন্য কলস লইয়া। সোনার কলস তোমার কাছে জমা দিয়া, তোমারতন অন্য কলস লইয়া গেছে। বুদ্ধি ভালো। মনির যহন তল্লাশি চালাইল। সে পুরা গ্রাম তন্নতন্ন করল, প্রত্যেক ঘর। কিন্তু কলসি তার নিজের বাড়ি। নিজের বাড়ি তো আর তল্লাশি করন যায় না। এই চিন্তা তোতা কারো মাথায়ই আসব না। কি কথা ভুল বললাম?

আমোদি বেগম বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। তৈয়র উদ্দিন খাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে তার অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে এই লোক তার। ওই সুতীক্ষ্ণ চোখে তার শরীর ভেদ করে অন্তরাত্মা অবধি দেখতে পাচ্ছেন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, ফজু তোমারে এত বিশ্বাস করল, ওই কলসি তোমার ধারে রাখতে দিলো? তুমি যদি এহন না বলল, তাইলে তো আর আর কিছুই করনের থাকব না? শোনো আমোদি বেগম, যহন জিনিসটা আমার মাথায়। ঢুকল, তারপর থেইক্যা এই একখান হিসাবই আমি মিলাইতে পারি না। এই হিসাবখান আমারে খুব যন্ত্রণা দিছে। মানুষ এত বড় বিশ্বাস মানুষরে কেমনে করে?

আমোদি বেগম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো কথা বললেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমার এক অসুখ হইছে আমোদি বেগম। চিন্তা অসুখ। সারাক্ষণ মাথায় খালি চিন্তা। তোমার এই ঘটনা চিন্তা কইরা একখান। বিষয় আবিষ্কার করলাম, এই দুনিয়ায় আমার মতো মনে হয় আর কেউরে কেউ অবিশ্বাস করে নাই। তুমি আমার স্ত্রী, আমার উপর তোমার অবিশ্বাস। একটা মাইয়া আছিল, তার অবিশ্বাস। দুইটা পোলা, তাদেরও অবিশ্বাস। তাগো বাপ তাগো কোনোদিন ভালো পায় নাই। চাইরপাশের মানুষের অবিশ্বাস। কি এক আচানক অবিশ্বাসের জীবন আমার, না?

আমোদি বেগমের হঠাৎই মনে হলো, তার সামনের এই মানুষটা সেই এত বছরের চেনা পুরনো তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নন। এই মানুষটা নতুন একটি মানুষ। নতুন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমারে আরেকখান কথা বলি। আমি অনেকদিন ধইরাই বোঝার চেষ্টা করছি, ফজুর ঘটনা। ফজুর বড় ভাই নজু, নজরুল। ঢাকার শহর থাহে। সে নাকি প্রায়ই কোহিনূরের বাসায় যাইত। এই ঘটনা আমি এতদিন জানতাম না। হেইদিন নজুরে দেইখ্যা নয়ন বলল এই কথা। ঘটনা কি? মা-মাইয়া মিল্যা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছ? ফজুর লগে তোমাগো আঁতাত কীসের? যদিও আন্দাজ করতেছি, তারপরও বলল, তোমার মুখেরতনই শুনি।

আমোদি বেগম এতক্ষণে কথা বললেন। তিনি ধীর পায়ে হেঁটে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, আপনেরে এতদিন এই কথা বলনের সাহস পাই নাই। কিন্তু আইজ আপনেরে দেইখ্যা মনে হইতেছে আপনেরে বলন যায়। ফজলুর বাপ বজলু ব্যাপারীর খুনটা কোহিনুর মাইন্যা নিতে পারে নাই। তার খালি মনে হইছে, খুনটা হইছে তার কারণে। তারপর আপনে যহন এতিম পোলাপানগুলার জমিজমা দখল করলেন, ঘরবাড়ি ছাড়া করলেন। এইটাও কোহিনূর মানতে পারে নাই। তার খালি মনে হইছে, এইগুলান সব তার জইন্য হইছে। সে যদুর পারত তাগো পয়সাপাতি দিয়া সাহাইয্য করত। তার বুদ্ধিতেই নজু গ্রামে আইছে। ফজু জমিজমার লাইগ্যা মামলা-মোকদ্দমা করতে গেছে। কোহিনূর আপনেরে কোনোদিন কিছু বলব না। কিন্তু সে সারাটা জীবন চাইছে…।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হঠাৎ হাত উঁচু করে আমোদি বেগমকে থামালেন। তারপর বললেন, তুমি কোহিনূররে জানাই দিও। আর কিছু করন লাগব না। ফজুগো সব জমিন আমি ফিরাই দিতেছি। জান ফিরাই দেওনের ক্ষমতা আল্লায় আমারে দেয় নাই। সম্পদ ফিরাই দেওনের ক্ষমতা আল্লায় আমারে দিছে। আমি ফিরাই দিব।

আমোদি বেগম খুব ধীরে তার হাতখানা তুললেন। তারপর আলতো করে সেই হাতখানা রাখলেন তৈয়ব উদ্দিন তাঁর কাঁধে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অনেকটা সময় চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর তার ডান হাতখানা তুলে কাঁধের উপর রাখা আমোদি বেগমের হাতখানা স্পর্শ করলেন। আমোদি বেগম যেন এই স্পর্শের ভাষা বুঝলেন। পরস্পরের ভাষা বুঝল ভাজ পড়ে যাওয়া চামড়ার দু’জোড়া কোঁচকানো হাত। তারা পরস্পরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। শক্ত করে। তারপর সেই ভাঁজ পড়া হাতের চামড়ারা পরস্পরের রেখায় মিশে গিয়ে যেন বলে যেতে থাকল একজনমের সকল অব্যক্ত কথা। সকল অব্যক্ত ব্যথা। সকল না বলা গল্প। সেই গল্পের নামই জনম। মানবজনম।

*

সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে উঠানে। সেখানে একটা বড় সাদা মুরগি আর তার বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়েছে পারুল। তাদের সামনে চালের খুদ ছড়িয়ে দিয়েছে তাবারন। মুরগির বাচ্চাগুলো তা খুটে খুটে খাচ্ছে। একটা বাচ্চা খানিক দুর্বল। সে আর সব বাচ্চাদের সাথে সমানতালে লড়াই করে খেতে পারছে না। মা মুরগিটা খাওয়া বাদ দিয়ে কিছুক্ষণ সেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর এক পা দু’পা করে এগিয়ে এসে বাচ্চাটার কাছে দাঁড়াল। মাকে দেখেই বাচ্চাটা ঠোঁট ফাঁক করে মায়ের দিকে ঠোঁটটা বাড়িয়ে দিলো। মা মুরগিটা তার ঠোঁটে একটা দুটা খুদ নিয়ে বাচ্চাটার ঠোঁটের কাছে ধরল। বাচ্চাটা টুক করে করে নিলো চালের কণা। পারুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মা আর সেই বাচ্চাটার দিকে। পারুলকে চমকে দিয়ে আর বাচ্চাগুলোও নিমিষেই তাদের খাওয়া ছেড়ে মায়ের কাছে ছুটে এলো। মায়ের মুখের কাছে ছোটখাটো একটা ভিড় লেগে গেছে। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কত খাবার, কিন্তু কারোরই। যেন সেখান থেকে খুঁটে খাবার কোনো তাড়া নেই। সকলেই মায়ের ঠোঁট থেকে খাবে। পারুল দীর্ঘ সময় সেই বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেল পারুলের। সে উঠে অবিন্যস্ত পায়ে ঘরের ভেতর গেল। তারপর বহুদিন পরে নুরুন্নাহারের বন্ধ ঘরটা খুলে ভেতরে ঢুকল। ঘরটা। দীর্ঘদিন থেকেই বন্ধ। ভেতরে একটা ভ্যাপসা গন্ধ। কিন্তু সেই গন্ধের ভেতরই আবছা অন্ধকারে বসে রইল পারুল।

আচ্ছা, সে এমন কেন? এমন অস্থির, এমন অপরিনামদর্শী, এমন অননুমেয়? এই এতটা দিন মা নেই! কিন্তু সে কি মাকে নিয়ে সেভাবে আর কখনো ভেবেছে? মায়ের অভাব অনুভব করেছে? পারুল ভেবে দেখল, না করেনি। মা মারা গেছেন, সেই সময়টা দিন কয় বিষয়টা সে মেনে নিতে পারেনি। মায়ের জন্য কেনা শাড়িটা মা এত করে পরতে চাইলেন, কিন্তু মানুষটার সেই ইচ্ছেটাও অপূর্ণই থেকে গেল। তার কারণেই কি? এই কষ্টটা তার মধ্যে ছিল। খুব করেই ছিল। আর সেই কষ্টেই সে ডুবে ছিল বেশ কয়েকটা দিন। কিন্তু তারপর আর তার জীবনে মা কোথায়? মায়ের অভাব কোথায়? মায়ের অভাবটা তো মুহূর্তের জন্যও আর টের পায়নি সে। কেন এমন হলো? আর দশটা সন্তানের মতো সে কেন নয়? কত মানুষের মা মারা যেতে সে দেখেছে! মায়ের জন্য সেইসব মানুষের কান্না, শোক, কষ্ট দেখে পারুল বিস্মিত হয়েছে। বারকয়েক অবচেতনে এই ভাবনা তার মনেও এসেছে যে সে কি তার মায়ের জন্যও অন্যদের মতো অমন অনুভব করে? নাকি করে না? না করলে কেন করে না?

এই ভাবনাটা মা মারা যাওয়ার পরও বেশ কিছু দিন তাকে তাড়া করেছে। আসলে মা তার কাছে একটা দরজা বন্ধ ঘরের নাম কেবল। সেই ঘরের ভেতর কেউ একজন আছে, যে তার মা। এর বাইরে আর কোনো ভাবনা হয়তো সেভাবে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হয়নি বলেই কি সে মায়ের ঘরটা এমন করে বন্ধ করে রেখেছে? নিজের ভেতর অজান্তেই কি তার মনে হচ্ছে, ঠিক আগের মতোই এই বন্ধ দরজার ঘর মানেই তার মা? হয়তো এইজন্যই এতদিনেও সে আর এই দরজাটা খোলেনি। যদি দরজা খুলেই দেখে মা নেই! এই ভয়টা কিসের? মা নেই বলে কষ্টের? নাকি মার জন্য তার কষ্ট বা অভাব অনুভূত না। হওয়ার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর?

পারুল জানে না। তবে আজ এই ঘরটা শূন্য দেখে তার বুকের ভেতর এক পশলা হু হু করা হাওয়া কেমন মাতম তুলে গেল। পারুল মায়ের চৌকির তলায় রাখা ট্রাঙ্কটা খুলল। এই ট্রাঙ্কটা কখনোই ভোলা হয়নি তার। ট্রাঙ্ক ভর্তি কত কত জিনিসপত্র যে নুরুন্নাহার সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছেন। দেখে পারুল ভারি অবাক হলো। বাইরে অগোছালো ওই মানুষটা ট্রাঙ্কের ভেতরটা এমন গুছিয়ে রেখেছেন, দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। ট্রাঙ্কের ভেতরে একখানা ছোট গোল আয়না। আয়নার ফ্রেমটা পেতলের। কত বছর আগের কে জানে, কিন্তু এখনো। ঝকমক করছে তা। একটা কাঠের ছোট্ট বাক্স। বাক্সটা খুলল পারুল। বাক্সের ভেতর কত কত জিনিস যে মা জমিয়ে রেখেছেন! দুই গাছি রূপার চুড়ি, একটা নাকফুল, কানের দুল। একজোড়া মোটা বালাও রয়েছে। তবে পারুলের চোখ কাড়ল একটা নাকের নোলক। সে নোলকটা হাতের তালুতে নিয়ে দেখল। মাকে কখনোই এসব পরতে দেখেনি পারুল। সম্ভবত তার বিয়ের সময়কার জিনিস এগুলো। বিয়ে নিয়ে নুরুন্নাহারের কোনো সুখস্মৃতি কখনোই দেখেনি পারুল। কোনো আগ্রহও ছিল না বিয়ের কোনো জিনিসপত্র নিয়ে। বরং তার জীবনের সবচেয়ে অভিশপ্ত ঘটনাই যেন ছিল বিয়েটা। সারাজীবন তাই নিয়েই হাপিত্যেশ করতে দেখেছে সে। অথচ কি যত্ন করেই না তিনি এসব লুকিয়ে রেখেছিলেন তার গোপন কুঠুরিতে।

একখানা লাল টুকটুকে শাড়িও রয়েছে ট্রাঙ্কটায়। শাড়িখানা বলতে গেলে একদমই নতুন। ভেতরে ন্যাপথেলিনের সুবাস। পারুল সেই শাড়িখানা হাতে নিলো। এই শাড়িখানাও মাকে কখনোই পরতে দেখেনি পারুল। কিন্তু এত যত্ন করে কেন সব সাজিয়ে রেখেছিলেন মা? সেই প্রশ্নের উত্তরটিই যেন এই শাড়িখানা। পারুলের মনে পড়ে, সুস্থ থাকলে প্রায়ই নুরুন্নাহার বলতেন, তোর বিয়া তো দেইখ্যা মরতে পারব না। সেই কপাল লইয়া তো আর দুনিয়ায় আহি নাই। আর বাইচ্যা থাকলেই কি? মাইয়ার লাইগ্যা তো শখ-আহ্লাদ করনের কোনো ভাগ্য আল্লায় আমারে দেয় নাই। তয় তোর লইগ্যা আমার একখান জাদুর বাক্স আছে!

এই বলে নুরুন্নাহার মন খারাপ করে ফেলতেন। কেঁদেও ফেলতেন। বলতেন, আমার কপালে কি কিছু আছিল যে আমার জাদুর বাক্সভর্তি বড়োসড়ো কোনো জাদু থাকব! আছিল না। তয় মায়া আছে গো মা! সেই জাদুর বাক্সভর্তি মায়া আছে!

মা মাঝে-মধ্যে এমন এমন সব কথা বলতেন। পারুল তার আগামাথা কিছুই বুঝত না। কিন্তু আজ সেই জাদুর বাক্সখানা খুলে তার মনে হলো, সেই মায়া সে স্পর্শ করতে পারছে। এই ট্রাঙ্কের ভেতর কী যত্ন করেই না সেই মায়াদের থরে থরে লুকিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলেন। আহারে মা! মাগো!

পারুল মায়ের শাড়িখানা দু’হাতে ধরে অনেক সময় বসে রইল। সেই শাড়ির সুতোর গাঁথুনিতে গাঁথুনিতে যেন মায়ের স্পর্শ লেগে আছে। পারুল হয়তো হাত বুলিয়ে সেই স্পর্শ বোঝার চেষ্টা করল। তারপর শাড়িখানায় মুখ চেপে বসে রইল পারুল। আর ঠিক তখুনি তার মনে হলো, সে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছে। মায়ের আঁচলের ঘ্রাণ। মায়ের স্পর্শের ঘ্রাণ। মায়ার ও মমতার ঘ্রাণ।

প্রায় সারাটা দিনই পারুলের কেটে গেল মায়ের ঘরে। দুপুরেরও অনেক পরে সে নুরুন্নাহারের ঘর থেকে বের হলো। তারপর গোসল সেরে সামান্য খেয়ে যখন উঠানে চুল শুকাতে বের হলো, তখন তার হাতে নুরুন্নাহারের ট্রাঙ্কে পাওয়া সেই ছোট্ট পেতলের আয়না আর নোলকখানা। দুপুর কেবল পড়ে এসেছে, তবে শীতের দিন বলে রোদের শরীর জুড়ে এত তুলতুলে আরামদায়ক ওম! সে উঠানে একটা পাটি বিছিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। তারপর তাবারনকে ডেকে বলল নোকটা পরিয়ে দিতে।

তাবারন বলল, মরা মাইনষের জিনিস পরন ভালো না। তাইলে শইলে তার ছ্যাৎ লাগে।

পারুল বলল, লাগুক পারুল খালা। শরীলে ছ্যাৎ লাগন ভালো।

তাবারন বলল, মাইয়া মাইনষের এই শরীলখানই আসল। শরীলে ছ্যাৎ লাগলে আর তার থাকল কি? পুরুষ মাইনষের ধারে তহন আর তার এক পয়সা। দামও থাহে না।

পারুল বলল, তোমার শরীলে তো ছ্যাৎ লাগছে। তোমার দাম কি কমছে?

এই প্রশ্নে তাবারন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পারুল এই কথা কেন বলল? সে কি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে কথাটা বলেছে? তাবারন মিনমিন করে বলল, আমার শরীলের আর দাম কি? পোলা মাইয়া হইল না। বিয়া টেকল না। এই শরীলের আর দাম কি? তোমরা আবিয়্যাইত্তা মাইয়া। চেহারা ছবি ভালো। পরিবার ভালো। তোমাগো শরীলের দাম বেশি।

পারুল বলল, মাইয়া সেয়ানা হইল। যৈবতি মাইয়া। এহনও তার বিয়া শাদির কোনো ব্যবস্থা করলেন না। দামী শরীল থাইক্যাই কি হইল খালা? যৌবন থাকতে কেউ না আইলে, শরীল দিয়া কি করব? ফুল শুকাই গেলে কি আর ভ্রমর আহে?

তাবারন বলল, তওবা, তওবা। তুমি এইইগুলান কি কও পারুল? তোমার মুখে আল্লায় লাজ-শরম বলতে কিছু দেয় নাই?

পারুল বলল, লাজ-শরম দিয়া কি হইব খালা? প্যাটে খিদা রাইখ্যা যদি মুখে কন প্যাট ভরা, তাইলে কি প্যাট ভরব? এই যে আপনে জুয়ান একটা মাইয়া। কতবছর ধইর‍্যা এই বাড়িতে থাকেন। পুরুষ মানুষ ছাড়া আপনের কষ্ট হয় না?

তাবারন পারুলের মতিগতি কিছু বুঝতে পারছে না। এই মেয়েকে তার সব সময় ভয়। এ কখন কি করে ফেলে, বলে ফেলে তা সে নিজে যেমন জানে না, অন্যরাও জানে না। সবচেয়ে বড় কথা তার পিতা আব্দুল ফকির দশগ্রামের মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খান, কিন্তু মেয়ের কাছে এলেই যেন লেজ গোটানো বাঘ।

তাবারন বলল, তুমি এইগুলান কি কও পারুল?

পারুলের নাকে নোলক পরানো শেষ হয়েছে। সে নোলকটা আয়নায় দেখতে দেখতে বলল, মাইনষে কানাঘুষা করত, আপনের লগে নাকি আমার বাপের কী সব সম্পর্ক আছে! কথা সত্য? এইজইন্যই নাকি আপনের বিয়া ভাঙছে। পোলামাইয়া হয় না। আমার মায়ও নাকি এইজইন্যইও আপনের বুকে ছ্যাৎ দিছিল। তা আমার বাপের ঘটনা কি সত্য? সে নাকি আগেও বাড়িতে কাজ কামে রাইখ্যা অনেক মাইয়াগো লগে এমন করছে?

তাবারন বুকের ভেতরটা মুহূর্তেই শুকিয়ে এলো। সে তারপরও যতটা সম্ভব গলা উঁচু করে বলল, পারুল, তোমাগো বাড়ি দুইটা ডাইল ভাত খাইয়া বাইচ্চা আছি দেইখ্যা ভাইব না, যা মন চায় তাই বলবা! আমি পাড়ার বেশ্যা মাগি না পারুল। আর কার কপালে কহন কি হয়, কওন যায় না। মাইনষেরে ছোট কইরা কথা বলবা না। আল্লার মাইর, আলমের বাইর।

পারুল তাবারনের কথা গ্রাহ্য করল না। সে আয়নায় চেহারা দেখতে দেখতেই বলল, ঘরেরতন একখান লাল টিপ আনেন তো তাবারন খালা। দেহি টিপ দিয়া জোয়ান মর্দগো ধরনের লইগ্যা বড়শি পাতন যায় কিনা?

তাবারন বিড়বিড় করে কী সব বলতে বলতে উঠে গেল। সে টিপ নিয়ে এসে বসতেই পারুল বলল, আপনের উপর আমার মায়ের এত রাগ আছিল ক্যা খালা? ঘটনা কি কন তো?

তাবারন বলল, পাগল মানুষ। কার উপর কহন রাগ হইত, কওন যাইত? তুমি তো তার নিজের মাইয়া আছিলা, তোমারেও তো ছাড়ে নাই। দাও দিয়া কোপাইছে!

পারুল বলল, আমারে তো কোপাইছে আপনের লইগ্যাই। তা খালা, আইজ সারাদিন মায়ের ঘরে বইস্যা আছিলাম। বইসা থাকতে থাকতে মাথায় একখান চিন্তা আইল। দেহেন তো বিবেচনা কইরা, চিন্তাখান কেমন?

তাবারন বলল, আবার কি চিন্তার কথা বলবা, কে জানে! তোমার মায়ের মতো তোমার মাথায়ও গণ্ডগোল আছে পারুল। এহন বয়স কম টের পাও না। কিন্তু যহন পাইবা, তহন আর সময় থাকব না।

পারুল বলল, আগে তো শোনেন। বিবেচনা কইরা বলবেন, আমার বুদ্ধি কেমন?

তাবারন কোনো কথা বলল না। পারুল বলল, আমার মায় এমনে এমনে মরে নাই। তারে কেউ মারছে। যে মারছে, সে চায় নাই আমার মা সুস্থ হোক। তাতে তার অসুবিধা। যহন সে শুনছে যে আমি আমার মায়রে ঢাকা লইয়া যাব চিকিৎসা করাইতে, তহনই তার মাথাডা গেছে গরম হইয়া। এইজন্য সে আমার মায়রে খুন করছে। কি বলেন, চিন্তাটা কেমন? বিচার বুদ্ধি খাটাইয়া বলবেন।

তাবারন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। সে বলল, এইসব কি কথা বলো পারুল? তোমার মায়ের লগে এমন শত্রুতা কার থাকব? আর কেডা তারে মারতে আইব? তার ঘর আছিল ভেতরতন বন্ধ।

পারুল তাবারনকে বলল, আগে ঘরেরতন আমার লিপিস্টিকটা নিয়াসেন খালা। ঠোঁটে একটু রঙচঙ মাইখ্যা দেহি, আমারে দেখতে কেমন লাগে। বুড়া মর্দ ধরতে এইসব রং ঢং লাগে না, শরীল হইলেই হয়। কিন্তু জোয়ান মর্দ ধরতে নানান রং ঢং জানন লাগে। যান, আমার লিপস্টিকটা লইয়া আসেন।

তাবারন রাজ্যের বিতৃষ্ণা নিয়ে পারুলের দিকে তাকাল। তারপর পারুলের ঘর থেকে লিপস্টিক এনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। পারুল বলল, ও তাবারন খালা, আপনে এত তাড়াহুড়া করেন ক্যা? দুইটা কথা শুইন্যা যান। আপনের বিবেচনা কি বলে বইলা গেলেন না তো। আর আমার কথা তো এহনও শেষ হয় নাই।

তাবারন দাঁড়াল। কিন্তু কোনো কথা বলল না। পারুল সময় নিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক মাখল। তারপর আয়নায় ভালো করে দেখল। তারপর কপালে সরে যাওয়া টিপখানা ঠিক করতে করতে বলল, আমার মায়র উপর সবচাইতে বেশি রাগ আছিল আপনের। সে আপনের শরীলে আগুনের ছ্যাৎ দিছে। পুরুষের লইগ্যা মাইয়া মাইনষের শরীলে তার বুকের মতো দামী আর সোন্দর জিনিস আর কি আছে কন! আপনের তো ওই জিনিস আরো বেশি দরকার আছিল। সেই জিনিস পুইড়্যা দাগ বানাই দিলো। রাগ তো আপনের থাকবই। এতে তো দোষের কিছু নাই। ঠিক না তাবারন খালা?

তাবারন জবাব দিলো না। পারুল বাঁ হাতে তার চুল ঠিক করতে করতে বলল, চুলে তেল দিয়া দেন তো খালা। তেল দিলে এই রইদে চুল কেমন ঝকমক করব দেইখেন।

তাবারন কোনো কথা বলল না। তবে ঘর থেকে তেল এনে পারুলের পেছনে বসে চুলে তেল দিতে লাগল। পারুল আয়নায় চেহারা দেখতে দেখতে বলল, আমার ধারণা আমার মায়রে খুন করছেন আপনে। এইটা আইজকা আমার মায়ের ঘরে বইসা বইসা আমার মনে হইছে খালা। আপনে চিন্তা কইরা বলবেন, আমার বুদ্ধি কেমন। আমার বুদ্ধিমতে, আপনে সেইদিন রাইতে মায়ের ভাতের মধ্যে বিষ জাতীয় কিছু মিশাই দিছিলেন। সহজ কাম। মায় ভালো হইলে আপনের নানান সমস্যা। আরো অনেকেরই সমস্যা। সে না থাকলে অনেক সুবিধা। আর কামটাও খুবই সহজ। সহজে কঠিন সমস্যার সমাধান। কথা ঠিক কিনা বলেন? আমার বুদ্ধি কেমন?

বুকের ভেতর ধপ করে একটা বিশাল পাথর পড়ে যেন তাবারনের দম আটকে দিলো। সে হঠাৎ চিৎকার করে কান্না শুরু করল। তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বুক চাপড়াতে লাগল। পারুল অবশ্য তার জায়গা থেকে উঠল না। সে মনোযোগ দিয়ে আয়নায় তার চেহারা দেখতে লাগল। তাবারন দীর্ঘ সময় মাটিতে শুয়ে চিৎকার, চেঁচামেচি কান্নাকাটি করল। সে এই পুরোটা সময় আল্লাহর কাছে বিচার দিলো। তার নামে যারা এত বড় মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে, আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন। এমন আরো অনেক কিছু। তাবারন ভেবেছিল পারুল তাকে মাটি থেকে উঠাবে। কিন্তু পারুল তেমন কিছুই করল না। দেখে শেষ অবধি সে নিজে নিজেই উঠে বসল। খানিক শান্ত হলো। তবে তখনও গুনগুনিয়ে কেঁদে যাচ্ছিল সে।

পারুল জিনিসপত্র গুছিয়ে পাটি থেকে উঠতে উঠতে বলল, তাবারন খালা, সন্ধ্যা হইয়া গেছে, ভাত চড়ান। আর আপনের লগে মশকরা করছি। কোন মশকরা আর কোনডা আসল, তাও বোঝেন না? ওঠেন ওঠেন। ভাত চড়ান।

তাবারন বড় বড় চোখ করে পারুলের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটা এমন কেন? সে আসলেই মশকরা করেছে? নাকি? তাবারন কিছুই বুঝতে পারছে না। সে রাজ্যের বিভ্রান্তি নিয়ে ধুলোমাটি ছেড়ে উঠল। তারপর রান্না চড়াতে গেল।

পারুলের কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এই অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা পারুলের কাছে নেই। সে কি করছে, কি বলছে, তাও যেন সে জানে না। তবে পারুলের কেন যেন মনে হচ্ছে, খুব শীঘ্রই একটা বড়োসড়ো সংবাদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। সেই সংবাদটা হবে তার জন্য খুবই ভালো।

সংবাদটা এলো সন্ধ্যাবেলা। সংবাদ নিয়ে এলো লতা। রাজীব ফোন দিয়েছিল, সে পারুলকে না দেখে থাকতে পারছে না। আগামী পরশুর পরের। দিন শুক্রবার সে আবার ঢাকা থেকে আসবে। তার আগের দুই দিন যেন সে লতার সাথে তার নানাবাড়ি গিয়ে থাকে। রাজীব সত্যি সত্যি এমন কথা বলেছে। কিনা, পারুল জানে না, তবে লতা বলল, পারুলের কণ্ঠ শোনার তেষ্টায় নাকি রাজীবের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।

*

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন সেই রাতেই। গভীর রাতে শুরু হলো তার ঘাট বমি। সকাল থেকে নড়াচড়ার শক্তিও অনেকটা কমে গেল। দুপুরে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আবারো আমোদি বেগমকে ডাকলেন। তার কথা বলার শক্তিও খুব একটা নেই। তারপরও মনের জোরেই তিনি আমোদি বেগমকে পাশে বসতে বললেন। আমোদি বেগম বসলেন তার সিথানের পাশে। তৈয়ব উদ্দিন ফ্যাসফ্যাসে মৃদু গলায় বললেন, আমি বুইঝ্যা শুইন্যা একখান বড় ভুল করছি আমোদি বেগম।

আমোদি বেগম বললেন, কি ভুল?

তৈয়র উদ্দিন খাঁ বললেন, এই ভুলের নাম মনির। আমি আরো একজন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বানাই রাইখ্যা গেলাম। এইটা আমার অন্যায় হইছে। বড় অন্যায়। তারে থামানোর ক্ষমতা আমার আর নাই আমোদি বেগম।

আমোদি বেগম বললেন, কি বলেন আপনে? সে তো সহজ সরল পোলা।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সহজ-সরল বইল্যাই তারে আমি কাদামাটির লাহান মনের মতো কইরা বানাইতে পারছিলাম। সহজ-সরল না হইলে পারতাম না। কিন্তু এহন সে ফণা ধরা গোখরা সাপ। তারে সামলানোর মতো সাপুইড়া আর নাই।

আমোদি বেগম বললেন, এইসব কি বলেন আপনে?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমি ঠিক বলতেছি আমোদি বেগম। তুমি তাড়াতাড়ি ফজুর সাথে যোগাযোগ করো। তারে বলো কাজগপত্রের ব্যবস্থা করতে। আমি তারে জমি লেইখ্যা ফেরত দিব। আরেকখান কথা, আমার জমিজমার কাগজপত্র যে কিছুই নাই, তা না। কাগজপত্র কম বেশি আছে। ওইটা মইধ্যের ঘরের সিঁড়ির নিচের সিন্দুকে। আমার মাথার বালিশের নিচে সিন্দুকের চাবি আছে। যাওনের সময় চাবি নিয়া যাইবা।

আমোদি বেগম বললেন, আচ্ছা।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আরেকখান কথা, তোমরা সকলে ভাবতা আমি সাহসী মানুষ। ঘটনা ঠিক না। আমি বুদ্ধিমান মানুষ। বুদ্ধিমান মানুষ সাহসী হয় না। সাহসী হয় বোকা মানুষ। বোকা মানুষ আগপাছ বিচার-বিবেচনা না কইরা লাফ দিয়া ঝাপাই পড়ে। ঝাপাইয়া পড়ুইন্যা মানুষরে মানুষ পছন্দ করে। সাহসী মনে করে। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ নিজে ঝাপাইয়া পড়ে না। সে আগে কঠিন বিচার-বিবেচনা করে। হার জিত, লাভ-ক্ষতি ভাবে। তারপর বিপদ থাকলে অন্যরে দিয়া কাজ সারে। আমি সারাজীবন অন্যরে দিয়া কাজ সারছি। আমার সাহসী মানুষের ভান ধইর‍্যা থাকতাম। আমার সাহসের আসল ঘটনা আছিল এস্কান্দারের বাপ আলী হায়দার। আর তারপর এস্কান্দার।

আমোদি বেগম বললেন, এত কথা কেন বলতেছেন? আপনের শরীলডা ভালো না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এত কথা বলতেছি কারণ, আমি আব্দুল ফকিররে ভয় পাইতাম। খুব ভয়। এইজইন্যই তার কোনো ক্ষতি আমি করতে পারি নাই। বুদ্ধি দিয়া চেষ্টা করছিলাম, কাজ হয় নাই। বুদ্ধিমতে তার কোনো। অলৌকিক ক্ষমতায় আমার বিশ্বাস করনের কথা না। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, এই ক্ষমতা তার আছে। তারে আমি গত কাইল একখান থাপ্পড় মারছি। সে কিছু বলে নাই। কিন্তু এই না বলনের মানে সে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নিব। সেই বিশেষ ব্যবস্থা কি সেইটা আমি জানি না।

আমোদি বেগম বড় বড় চোখ করে বললেন, এইটা আপনে কি বলতেছেন?

তৈয়র উদ্দিন খাঁ বললেন, যা বলতেছি, ঠিক বলতেছি আমোদি বেগম। আর একখান কথা, মনির বুদ্ধিমান না, বলদ। এইজইন্য তারেও আমি ভয় পাইতেছি। বলদ মানুষ যদি একবার বুইঝ্যা ফালায়, তার হাতে ক্ষমতা, তাইলে সে দুনিয়াতে জাহান্নাম নামাই আনব। আমার সবকিছু লইয়া ভয় লাগতেছে আমোদি বেগম।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করেছে। তার চোখজোড়া কেমন মাছের চোখের মতো প্রাণহীন হয়ে উঠছে। তিনি হঠাৎ কাঁপা কাঁপা হাতে আমোদি বেগমের হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, একখান কথা বলতে খুব মন চাইতেছে। কিন্তু শরমে বলতে পারতেছি না।

আমোদি বেগম অবাক গলায় বললেন, কি কথা?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমারে সারাজীবন আমি কিছু দিতে পারি নাই। কিন্তু আইজ একখান জিনিস আমি তোমার ধারে চাইব। জিনিসখান তোমার আমারে দিতেই হইব। না করতে পারবা না।

আমোদি বেগম দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললেন, কি জিনিস?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমার পরানডা জ্বলে বউ। আমার পরানডা কয়লার আগুনের লাহান জ্বলে। আমার চোউখ দুইখানও জ্বলে। পুইড়্যা আমার ভেতরটা ছাড়খার হইয়া গেছে। আমারে আমার কোহিনূররে একটু দেখতে দিবা বউ? তারে খালি এক পলক দেখব বউ। তারপর চোখ দুইখান বুজব। বউ, এই কথাখান তুমি রাখবা?

আমোদি বেগমের ষাট বছরের বৃদ্ধ, সাড়বিহীন শরীরেও যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। সাড়া দিয়ে উঠল কি এক অবর্ণনীয় অনুভূতিতে। এই জনমে এই প্রথম তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তাকে বউ বলে ডেকেছেন। বউ! তার কী যে লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে লজ্জায় মাটির ভেতর ঢুকে যান তিনি। কিন্তু সেই লজ্জা কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশে। তিনি তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হাতখানা আরো শক্ত করে ধরে বললেন, আমি নজুরে দিয়া কোহিনূররে খবর পাঠাইতেছি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ভীত সন্ত্রস্ত গলায় বললেন, সে যদি না আসে? সে জেদী। বড়ই জেদী। তারে আমি শেষবারের মতো অমল বাবুরে দেখতে যাইতে দেই নাই। এই কথা তো সে ভোলে নাই!

আমোদি বেগম বললেন, সে আসব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ চোখ বুজলেন। তার মুদিত চোখের দু’কোল গড়িয়ে অবিশ্রান্ত ধারায় জল নামতে লাগল। আমোদি বেগম হাত বাড়িয়ে সেই জল মুছিয়ে দিতে লাগলেন। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমোদি বেগমের হাতখানা সরিয়ে দিয়ে বললেন, মানুষের জীবন কোনো হিসাব বাকি রাহে না বউ। সারাজীবন আমি তোমার চৌক্ষের পানি দেখছি। আইজ তার হিসাব শুরু হইল। হিসাব নিতে ভুল কইরো না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কাঁদছেন। নিঃশব্দ কান্না। সেই কান্নার জলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমোদি বেগম। তার কি মানুষটার কান্না দেখে। একটুও মায়া হচ্ছে? না হচ্ছে না। হবার কথাও না। এই মানুষটার জন্য তার বুকের ভেতর বিন্দুমাত্র মায়া নেই, মমতা নেই, ভালোবাসা নেই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আমোদি বেগম আবিষ্কার করলেন তিনি কাঁদছেন। তার হাতে মুঠোয় ধরা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হাত। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কান্নার জল। তাহলে? জীবনের হিসাব সমান হলো কি করে? তার কান্নায়, তার দুঃখে, তার অসহ্য যন্ত্রণার জল দেখে তো কেউ কখনো কাঁদেনি। কেউ না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তো ননই। বরং তাকে কাঁদিয়ে তিনি আনন্দ পেয়েছেন। তাহলে তিনি কেন কাঁদছেন? যেই মানুষটা তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহতম অনুভূতির নাম, সবচেয়ে কষ্টকর স্মৃতির নাম, সেই মানুষটার জন্য তিনি কেন কাঁদছেন? এ কী হিসাব জীবনের? জীবনের এই হিসাব বড়ই বেহিসেবী। বড়ই অদ্ভুত। এই অদ্ভুত হিসেবের খাতায় আড়ালে-আবডালে রয়ে যায় অমিমাংসিত অসংখ্য গল্প, অসংখ্য অঙ্ক। সেইসব অমিমাংসিত গল্প আর অঙ্কের নামই বোধহয় মানবজনম।

আহা, মানবজনম, প্রবল ঘৃণার ভেতরও কি অপার মমতায়ই না সে বুকের ভেতর পুষে রাখে অস্পৃশ্য, রহস্যময় প্রগাঢ় ভালোবাসা। আহা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *