৭. হাসিমের বুড়ো দাদী

হাসিমের বুড়ো দাদী আপন গর্ভজাত ছেলের মরা মুখ দেখতে পায় নি। যে ছেলে মেয়েমানুষের মোহে পড়ে বাপ-পিতামহ চৌদ্দ পুরুষের ধর্ম ছেড়ে যেতে পারে, আপন ছেলে হলেও তার মুখ দেখা যে পাপ। পাপবোধের বিরাট বাধা জননীর অন্তরের প্রবল শোকাবেগের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলো। আপনজনের বিয়োগে শরীরের অণু পরমাণু থেকে সঙ্গীতের করুণতম মুছনার মতো যে ব্যথা ঝরে যায়, সমস্ত স্নায়ু-শিরা বিকল করে দেওয়া সে ব্যথার প্রকাশ-পথও রুদ্ধ করেছিলো সমাজ। জননী একবার জনসমক্ষে উঁহুও করতে পারে নি। পেটের ছেলে হোক, তবু তো মুসলমান। মুসলমানের জন্য চোখের জল ফেলাও পাপ। শাস্ত্রে মহত্তম পরজন্ম থেকে অক্ষয় স্বর্গবাস পর্যন্ত সবকিছুর বিধান মেলে। ‘রেলের লাইনের মতো পাতা’ শাস্ত্রীয় পথ ধরে এগুলে সিঁড়ির পর সিঁড়ি ডিঙিয়ে, স্বর্গলোকের দ্বারে পৌঁছুনো যায়–কিন্তু হৃদয়ে যে ব্যথা গুমড়ে ওঠে, জননীর অন্তরে যে শোক মাথা কুটে মরে, শরীরের কোষে যে ক্রন্দন মর্মরিত হয়–তার নেই কোনো নির্গমন পথ।

বুড়ী শৈলবালা বাড়ির পেছনের পুকুরের পশ্চিম পাড়ে গিয়ে দেখলো তার কনিষ্ঠ সন্তান হীরাধরের নিপ্রাণ দেহ শাদা চাঁদরে ঢেকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কবরখানার দিকে। তারা তার ছেলের দেহ মাটি চাপা দিলো। তাজা কবরের দিকে চেয়ে বুড়ীর মনে কি ব্যথা উথলে উঠেছিলো সে খবর কেউ জানে না, কেউ না। একবার গলা ছেড়ে ডুকরে কেঁদেও উঠতে পারে নি। শোক বুকের ভেতর জমে জমে পাথরের চাঙ্গড়ের মতো কঠিন হয়েছে। সামাজিক সহানুভূতিহীন এই যে পুত্রশোক তার কি ভার! কোনোদিন কারো কাছে বলে একটু হালকা করারও অবকাশ পায় নি। রাতের অন্ধকারে বুড়ীর দু’চোখ বেয়ে হু হু করে নেমে আসে জলের ধারা। হরিমোহনের শিশুকালের চেহারাটি চোখের সামনে ভাসে। টানা টানা চোখ, শ্যামলা গড়ন–অবিকল যেন যশোদা-নন্দন বালগোপাল। ননীময় দু’খানি ছোট্ট হাত প্রসারিত করে মা মা বলে ডাক ছেড়ে তার কোলে ওঠার জন্য ছুটে আসছে। কখনো ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে, যুবক হরিমোহন যেন বলছে, “মা, আমি হিন্দু হই, মুসলমান হই, আমি তো তোরই সন্তান। কোলে তুলে নে রে মা, কোলো তুলে নে।”

যতই দিন যাচ্ছে হরিমোহনের বিয়োগ-ব্যথা কঠিন হতে কঠিনতরো হয়ে বাজছে বুড়ীর বুকে। প্রতিদিন প্রতিরাত বেদনার নীরব সারেঙির মতো পুত্ৰশোক তার সারা শরীরে হু হু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়। মাঝে মাঝে রক্তসন্ধ্যার রাগিনী বিছানো পথের দিকে শোকার্ত দু’চোখের দৃষ্টি মেলে দিয়ে বুড়ী ভাবে, হয়তো আবার হরিমোহন শিশু হয়ে তার কোলে ফিরে আসবে, আধো আধো স্বরে মা বলে ডাকবে, নতুন স্নেহে আবার ছেলেকে বুকে বাঁধবে, দুই স্তন বেয়ে দুধের ধারা উছলে উঠবে। সন্ধ্যার কালো লোমশ অন্ধকারের প্লাবন এসে সূর্যের অস্তগিরির ওপারের সব সম্ভবের দেশে যাবার আবীরের রঙে রাঙা পথরেখা মুছে দিয়ে যায়। কালো শালের মতো আকাশে চুমকির মতো নক্ষত্রেরা জ্বলে। মুসলমান হয়ে যাওয়া ছেলের মৃত্যুশোক বুড়ো হাড় পর্যন্ত ব্যথিয়ে তোলে বুড়ীর। বেদনায় ছেয়ে যায় সমস্ত অন্তর। কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে নি… পারবে না কোনো দিন। কেউ সমবেদনা দেখায় নি, দেখাবে না। বরঞ্চ হরিমোহনের মৃত্যু যেন সমাজের মানুষের কাছে ধর্মত্যাগের দণ্ড বিশেষ। রামাই পণ্ডিত দু’একবার কথা-প্রসঙ্গে নাটমন্দিরে বসে বলেও ফেলেছে, চৌদ্দ পুরুষের ধর্ম যে এমনি করে ছেড়ে যেতে পারে, দেবতারা তাকে এমনি দুঃখ দিয়েই শাস্তি দিয়ে থাকেন।

বুড়ীর মনেও দেবতার ভয় কম নয়। কিন্তু মনের কতোটুকু তার নিজের এখতিয়ারে। সমুদ্রের মতো গভীর তলদেশ থেকে নোনা ঢেউ উঠে ছেয়ে যায় মন। দেবতা, স্বর্গ, ধর্ম সবকিছুর বিরুদ্ধে সগ্রাম করে অবচেতন মন। কখন যে হরিমোহনের ধর্মান্তরকে নিজের অজান্তে মাফ করে দেয় নিজেও বলতে পারে না। মনে মনে হরিমোহনের পক্ষ সমর্থন করে অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে লড়তে লেগে যায়।

নিজের যৌবন-দিনের কথা মনে পড়ে। তখনো শৈলবালার বিয়ে হয়নি। সারা শরীরে সঙ্গীতের রেশ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘুমের মধ্যে কে যেন সারা শরীরে সোহাগের হাত বুলিয়ে দিয়ে যেতো, স্বপ্নের মধ্যে কে আসতো? কার মুখ, কার দুটো শান্ত চোখের দৃষ্টি বিধে থাকতো বুকের ভেতর? ফর্সা গৌরবর্ণ, একহারা চেহারার সে পূজারী ব্রাহ্মণের ছেলেটি যদি একবার ইঙ্গিত করতো, যদি একবার মুখের দিকে চেয়ে হেসে কথা কইতো, এ জীবনকে কি ধন্য মনে করতো না? তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো, নয় তো শৈলবালাও কি ঘটাতো না অঘটন? ব্রাহ্মণের ছেলে কতোদিন থাকতে পারতো অচঞ্চল? একদিন তার বুকের জল কি ছলকে উঠতো না? সেও কি দু’খানা বাহু মেলে শৈলবালাকে ব্যগ্র আলিঙ্গণ করার জন্য ছুটে আসতো না? কায়স্থের মেয়ে হয়ে ব্রাহ্মণের সন্তানকে কামনা করা যদি পাপ না হয়, হিন্দু হয়ে মুসলমানের মেয়েকে চাইতে দোষটা কোথায়, বুড়ী খুঁজে পায় না। আর যদি দোষ হয়ে থাকে, সে দোষ মা-ছেলে দুজনেরই। তারই গোপন কামনা হরিমোহনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। ধর্ম মাথায় থাক, দেবতা মাথায় থাকুন, পাপী মা পাপী সন্তানের জন্য কাঁদবেই। বুড়ী এভাবেই বিচার করে।

হাফিজের মা দুধ দিতে এসে সুফিয়ার মৃত্যু-সংবাদ দিয়ে গেছে। বুড়ী কাউকে না বলে লাঠির আগায় ভর করে আস্তে আস্তে হাসিমের ঘাটার গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো। আর ভেতরে যেতে পারে না। জীবনে কোনো মুসলমানের মৃতদেহ দেখে নি। দেখার রেওয়াজ নেই। হিন্দুরা মুসলমানের মৃতদেহ দেখতে যায় না। মুসলমানেরাও দেখে না। অন্তরের টানে এতোদূর চলে এসেছিল এখন ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। হিন্দু পাড়ার কেউ না কেউ দেখে ফেলবে। হেনস্থার অন্ত থাকবে না তখন। কেন এলো বুড়ী ভেবে পায় না। মনে মনে দুর্গা নাম জপ করে। মানুষ আসছে ভেতর থেকে, মানুষ যাচ্ছে ভেতরে। ওপাড়ার অপরিচিত বউ-ঝিরাও এসে দেখে যাচ্ছে সুফিয়াকে। অথচ বুড়ীর আপনজন, নাতবউ, নিজের গর্ভের মেয়ের মতো ভালোবাসতো। কিন্তু তার একটিবার চোখের দেখা দেখার অধিকার নেই। এই প্রথম মনে মনে আকাশের ভগবানকে দোষী করলোঃ

“ভগবান, দুই ধর্ম কিয়লায় ছিরজন গুরলি?” (ভগবান, তুমি দুই ধর্ম কেন সৃষ্টি করলে?)।

আমগাছটার নীচে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ী। চোখ দুটো ছলছল করছে। যে সকল বউ-ঝি মরা সুফিয়াকে দেখে চলে যাচ্ছে তাদের দিকে বোবা দুটো চোখ বিছিয়ে রাখে। ওরা একেকবার তাকায়। কারো কারো চোখ বেয়ে মমতা ঝড়ে পড়ে। একজন বলেঃ

“পোদ্দারের বউ, নাতি-বউয়ের মরণের খবর হুনি আস্যেদে, লউয়ের টান তো থাহিত ন পাড়েদে আর। (পোদ্দার গিন্নী নাতবউয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে এসেছে। রক্তের টান তো, আর থাকতে পারে নি।)

বুড়ীর ভারী খারাপ লাগে। এমন অবস্থার মধ্যে জীবনে কোনোদিন পড়ে নি। এ খবর যদি হিন্দু পাড়ায় ছড়িয়ে যায়, তার প্রতিক্রিয়া কি হবে ভাবতেও হৃদযন্ত্রের ধুকধুকানি থেমে যেতে চায়। পুকুরের পূর্ব পাড় বেয়ে চার-পাঁচ জন লুঙ্গিপড়া মানুষের সঙ্গে ধুতি পড়া আসছে সে কে? অধর– অধর নয়তো? ভয়ে সর্বশরীরে খিল ধরে যাবার উপক্রম। আসছে এদিকে। বুড়ী মনে মনে বলে, “মা দুর্গা, আঁর কি দশা অইব?” এখন দেখে ফেলবে, খবর রাষ্ট্র হয়ে যাবে। পূর্ব পাড় পেরিয়ে উত্তর পাড়ে উঠলো ওরা। আর বেশি দূরে নয়, এক্ষুণি এসে পড়বে। দেখে ফেলবে। এদিক ওদিক তাকায়। কোথাও লুকোবার স্থান নেই। ওরা এগিয়ে আসছে। বুড়ীর বুকের ভেতর মাদল বেজে যাচ্ছে। চারা আমগাছটার পেছনে এসে শাড়িটা লম্বা করে ঘোমটা টানলো। বুড়ীকে দেখলে দেখুক যেন বুড়ী না দেখে। ধুতিপরা মানুষটি লুঙ্গিপরা চার-পাঁচজন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চারা আমগাছটার তলাতে এসেই ডাক দিলঃ

“আঁর কি দশা অইব মা দুর্গা? (মা দুর্গা, আমার কি দশা হবে?)

“হেইভা কন, ঠাউর মা না? খাড়াই ক্যা রইয়ো–আইয়ো–আইয়ো।” (ওটা কে, ঠাকুর মা না? দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন? এসো৷)

বুড়ী ঠক্ ঠক্ করে কাঁপে, এক্ষুণি বুঝি লাঠিটা হাত থেকে খসে পড়ে যাবে। বুড়ীর মুখ দিয়ে কোনো কথা সরে না। ধুতিপরা লোকটি হিমাংশু বাবু। এগিয়ে এসে বুড়ীর হাত ধরে। সস্নেহে বলেঃ

“ঠাউর মা তুই আমতলাত ক্যা? আইয়ো নাতির বউরে চাই ল শেষ বারের মত।” (ঠাকুর মা তুমি আমতলায় কেন? এসো, নাতির বউকে শেষবারের মতো দেখে নাও।)

হিমাংশুবাবুর পেছন পেছনে বুড়ী উঠোন পেরিয়ে মৃতার শয্যার পাশে চলে আসে। সুফিয়ার ফুফাতো বোন শিয়রে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিলো। বুড়ীকে দেখে রাগ করে পড়া বন্ধ করে উঠে গেলো। মেয়েদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠলো। মুর্দার ঘরে হিন্দু এসেছে, সুতরাং ফেরেস্তা আসবে না। বুড়ী কানে কম শোনে। তা ছাড়া মেয়েদের ঠারের কথা বোঝার মতো সজাগ ইন্দ্রিয়ও বুড়ীর নয়। পুরুষদের মধ্যেও দু’একজন আপত্তি করেছিলো, কিন্তু মনির আহমদ বললোঃ

“বাঁচি থাকতে চাইত যুদি পারে, মইরলেও চাইত ন পাইরত ক্যা? ওলাউঠার মরা কত মাইনষরে হিমাংশুবাবু তো নিজে হাতে ধোয়াই তারপর কবরত নামাইয়ে। তারা কি হক্কলে দোযখত যাইবো?” (বেঁচে থাকতে যদি দেখতে পারে, মরলে দেখতে পারবে না কেন? ওলাউঠার মরা কত মানুষকে হিমাংশু বাবু তো নিজের হাতে ধুইয়ে কবরে নামিয়েছে। তারা কি সবাই নরকে যাবে?)

মনির আহমদের কথার কেউ জবাব দিতে পারলো না। বাস্তবিকই গেলো ওলাউঠার সময়ে হিমাংশুবাবুকে অনেক মৃতদেহ নিজের হাতে বোয়াতে হয়েছে। পাড়ার মানুষ ভয়ে পালিয়েছিলো। কৃষক-সমিতির কর্মীরাই মৃতদেহ সৎকারের কাজ করেছে। হিন্দু-মুসলমান অত কিছু জাত বিচারের সময় ছিলো না। ছদুর বাপ গোমড়া মুখে বসে রইলো। অন্য সময়ে হলে এহেন অমুসলমানী ক্রিয়াকাণ্ডের জন্য একটা দক্ষযজ্ঞ না বাধিয়ে ছাড়তো না।

বুড়ী মৃতা সুফিয়ার মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। হলদে পাখির ছাওয়ের মতো মেয়েটি আর কোনদিন কথা বলবে না। রাতের অন্ধকারে লাঠির ঠক ঠক আওয়াজ শুনে, কেরোসিনের কুপী হাতে ‘দাদী’ বলে ডাক দিয়ে হাসি হাসি মুখ নিয়ে ঘাটার কাছ থেকে এগিয়ে নিতে আসবে না। টুনটুনি পাখির মতো মেয়েটি আর কোনদিন তেলহীন রুখু চুল মেলে দিয়ে দাওয়ার ওপর পা ছড়িয়ে বসে থাকবে না। কেন জানে না, হরিমোহনের মৃত্যুশোক যেন তিরিশ বছরের ব্যবধান এক লাফে পেরিয়ে বুকের ভেতর কাঁচা হয়ে জেগে উঠলো। জমে যাওয়া শোকের বরফের কণাগুলো বুকের ভেতর গলে যাচ্ছে। বুড়ীর তোবড়ানো গাল বেয়ে নেমে আসছে দুটো চোখের পানির ধারা। অনেক দিন অনেক দিন এ অশ্রু গোপন করে রেখেছিলো– আর পারা গেলো না। ফোয়ারার মতো বলকে বলকে উঠে আসছে–পানি নেমে আসছে দু’টি কোণ বেয়ে, বয়সের অভিজ্ঞতার হাজার রেখা আঁকা মুখের ওপর দিয়ে। বুড়ীর শক্তি নেই, ইচ্ছে করলেও এ রোদন-ধারা থামাতে পারবে না। কতদিন, কতদিন এ ক্রন্দন বুকের ভেতর আষাঢ়ের মেঘের মতো থরে থরে জমে ঘন হয়ে উঠেছে। মেঘে মেঘে ঘষা লেগে কত রাতে শোকের চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ মনের ভেতর ঝিলিক হেনেছে। সারাজীবন বুড়ী যেন এমনি করে চোখ ভরে কাঁদবার জন্য অপেক্ষা করেছিলো। জোহরা আঁচল দিয়ে কয়েকবার চোখ মুছিয়ে দিলো। কিন্তু বুড়ীর চোখ বারণ মানে না। অন্তরের কোন্ পাগলা ঝোরার উৎসমুখ যেন খুলে গেছে। বুড়ী কাঁদছে–অঝোরে কাঁদছে।

সুফিয়াকে গোসল দিতে নিয়ে গেলোলোকজন। বুড়ী ঠায় বসে রইলো। দু’চোখে বইছে ধারা। বুড়ী মনের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত যন্ত্রণা জমা করে ঝেরে দিতে চায়। শরীরের সমস্ত রক্তও বেরিয়ে যাক জল হয়ে। জন্মের মতো একবার বুক ভরে কেঁদে মরে যেতে চায়। জোহরা ন্যাকড়া জড়ানো সুফিয়ার ছেলেটিকে কোলে দিলো। ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে। একেবারে এতোটুকুন। পুতুলের মতো। বুড়ী আঁচলের খুঁটে দু’চোখ মুছে নবজাতকের দিকে তাকায়। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক, অবিকল তেমনি। হরিমোহন যেন আবার শিশু হয়ে ফিরে এসেছে। বুড়ী চেয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে আশা মিটে না। এ কি হরিমোহন নয়? তার কনিষ্ঠ ছেলে হরিমোহন কি আবার ফিরে এলো?

শিশুকে আলতোভাবে নিয়ে বুকের সঙ্গে লাগাল। শিশু প্রস্রাব করে বুড়ীর কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে দেয়। সেদিকে খেয়াল নেই। দু’হাতে শিশুকে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবে। এ কেমন করে হলো? এ কেমন করে হলো? স্বপ্ন কি কখনো সত্য হয়? তাহলে হরিমোহন কথা রেখেছে। তার কোলে আবার শিশু হয়ে ফিরে এসেছে? অস্থিসর্বস্ব হাতের আঙুলে শিশুর শরীরে হাত বুলোয়। নিজের স্তনে হাত ঘষে দেখে। হরিমোহন ফিরে এসেছে কিন্তু তার স্তনে যে দুধ নেই। শুকিয়ে দড়ির মতো হয়ে গেছে। শিশু চিৎকার করে কাঁদছে– ওঁয়া ওঁয়া! বুড়ীর মনে হচ্ছে, হরিমোহন যেন বলছে, “মা, হিন্দু হই, মুসলমান হই, আমি তো তোরই সন্তান, কোলে তুলে নে।” শিশু কাঁদছে ওয়া ওয়া। কিছুতেই কান্না থামে না। জোহরা শিশুর মুখে একটু মধু দেয়। ছোট্ট জিভ দিয়ে চুষে খায়। একটু পরে আবার কাঁদতে থাকে। জোহরা বলেঃ।

“মারে খাইয়ে জন্মের পর কেন চীকার গরে বাঘের মতন।” (জন্মের পর মাকে খেয়ে কেমন বাঘের মতো চীৎকার করে।)

সুফিয়াকে কবর দেবার পর কথা উঠলো নবজাতক শিশুটির কি হবে? হাসিম একা মানুষ। কেমন করে রাখবে শিশু? তা ছাড়া তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। জননীকে হত্যা করে পৃথিবীতে এসেছে যে শিশু তার দায়িত্ব নেওয়া কি হাসিমের কাজ? মনির আহমদের বৌটি বাঁজা। মনির আহমদ নিজেও একটি ছেলের কাঙাল। নিজের হলো না, কারো ছেলে নিয়ে পুষতে বড় শখ তার। এ পর্যন্ত হাতের কাছে কোনো ছেলে পায় নি। হাসিম তার মা-হারা শিশুটিকে যদি দেয়, অবশ্যই নেবে। বৌটি কেমন বড় বড় নিশ্বাস ফেলে। শিশুটিকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বুকের ব্যথা কিঞ্চিত শান্ত করতে পারবে। কিন্তু নিজের থেকে কিছুই বললো না। হিমাংশুবাবু হাসিমকে জিজ্ঞেস করলোঃ

“হাসিম বাই, বাইচ্চারে কি গরিবা?” (হাসিম ভাই, বাচ্চা কি করবে?)

“কি গইরগম?” (কি করবো?) এতোক্ষণ হাসিম একটি কথাও বলে নি। কলের পুতুলের মতো সব কাজ করে যাচ্ছিলো। বাচ্চার কথা ওঠায় নতুন করে তার মনে পড়লো সুফিয়া নেই। নতুন করে অনুভব করলো ছিন্নমূল গাছের মতো পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্কও শেষ হয়ে গেছে। ছল ছল চোখে চারদিকে তাকালো। বেড়ার ঘরখানির দরজা হাট করে খোলা। সে ঘরে সুফিয়া নেই। কেউ আর তার জন্য মিটিমিটি চেরাগ জ্বালিয়ে আধারাত ঘুম ভরা ঢুলুঢুলু চোখে অপেক্ষা করে থাকবে না। ক্লান্ত হয়ে ঘরে এলে মাটির সানকীতে মোটা চালের ভাপওঠা ভাত বেড়ে তালের পাখা হাতে ছুটে আসবে না। দাম্পত্য জীবনের হাজার সুখ-স্মৃতি টুকরো টুকরো ছবি হয়ে চোখের ওপর দিয়ে ভেসে গেলো। মধু জড়ানো ঘটনা, একটু হাসি, একটু পরশ। তার অস্তিত্বের চারপাশে বিবাগী হাওয়া হু হু করতে লাগলো। অন্তরের কোন গভীর তন্ত্রীতে টান লেগে চোখের কোণায় দু’ফোঁটা পানি চিক চিক করে উঠলো। লুঙ্গিতে মুছে উদ্ভ্রান্তের মতো আবার জিজ্ঞেস করলোঃ

“বাইচ্চারে কি গইরগম হিমাংশুদা?” (বাচ্চাটিকে কি করবো হিমাংশুদা?)

হাসিমের মুখের দিকে চেয়ে হিমাংশুবাবু হঠাৎ কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। মাথা নীচু করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বললেনঃ

“হাসিম বাই, যা অইবার অই গেইয়ে–অহন মাথা খারাপ গরিলে তো চইলতো নয়। আঁই কইলাম দে বাইচ্চার কি হাল অইবো? একদিনের বাইচ্চা।” (যা হবার হয়ে গেছে, এখন মাথা খারাপ করলে তো চলবে না। আমার কথা হলো একদিনের বাচ্চা, কি অবস্থা হবে?)

হিমাংশুবাবুর কথার প্রতিধ্বনি করে হাসিম বলেঃ

“হিমাংশুদা, বাইচ্চার কি হাল অইবো?” (হিমাংশুদা, বাচ্চার কি অবস্থা হবে?)

হিমাংশুবাবু বললেনঃ

“কেউরে পালিবার লায় দিলে কেন অয়?” (কাউকে পুষ্যি দিলে কেমন হয়?)

“কনে পালিব আঁর পোয়া, আঁই তো বান্যিয়ার পুত, আঁর মা তো বাদী। কনে নিব।” (কে পুষ্যি নেবে আমার ছেলে, আমি বেনের ছেলে, আমার মা তো বাদী।)।

কথা ক’টি হাসিমের সমস্ত জীবনের তিক্ততা, ক্ষোভ, বঞ্চনা, শোক এবং হাহাকার মিশে আশ্চর্যভাবে ব্যঞ্জিত হয়ে সকলের কানে বাজলো। মনির আহমদ তার কাঁধে আস্তে আস্তে হাত বুলোয়। হাতের ছোঁয়া দিয়ে সমস্ত জীবনের গ্লানি যেন শুষে নিতে চায়। হাসিমকে একটু শান্ত মনে হলে বললোঃ

“হাসিম বাই, তোঁয়ার পোয়া আই নিইয়ম, নিজের পোয়ার মতো গরি পাল্যাম।” (হাসিম ভাই, তোমার ছেলে আমি নেবো। নিজের ছেলের মতো করে পুষবো।)

তারপরে তারা তিনজন ঘরে ঢোকে। বুড়ী ন্যাকড়া জড়ানো শিশু সন্তানটিকে অস্থিচর্মসার হাতের ওপর নিয়ে পা দুটো লম্বা করে টেনে বসে আছে। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। হিমাংশু বাবু বললেনঃ

“অ ঠাউরমা, বাইচ্চারে মনির আহমদের কাছে পুষ্যইন দি ফেলাইল হাসিম বাই।” (ও ঠাকুরমা, বাচ্চাকে হাসিম ভাই মনির আহমদের কাছে পুষ্যি দিয়ে ফেললো।)

“কি কলি হিমাংশু তুই?” বুড়ী আঁতকে ওঠে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অসম্ভব, সবচেয়ে অবাস্তব কথাটি শুনেছে। ফের হিমাংশুবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ

“কি কলি হিমাংশু তুই?” কতদিন পর আঁর হীরাধর আবার আঁর কোলত ফিরি আইস্যে, কেউরে দিতাম নয়।” (হিমাংশু তুই কি বললি? কততদিন পর হীরাধর আমার কোলে ফিরে এসেছে। কাউকে দেবো না।)

দু’হাতে শিশুকে নিয়ে অতি সন্তর্পণে বুকের সঙ্গে ঠেকায়। বুড়ীর ভাবভঙ্গী দেখে মনির আহমদ বললোঃ

“ঠিক আছে, ঠিক আছে, এহন চল যাই।” (ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন চলো যাই।)

হাসিম শুধোয়ঃ

“কি, নিতা নয়, মনির আহমদ ভাই?” (কি, নেবে না, মনির আহমদ ভাই?)

“পরে নিইয়ম, তোঁয়ার দাদী এককেনা ঠাণ্ডা অউক আগে। বুড়ীর মনেতে বউত দুঃখ।” (পরে নেবো। তোমার দাদী একটু ঠাণ্ডা হোক। বুড়ীর মনে অনেক দুঃখ।

তারা বেরিয়ে এলো।

কি ভেবে মনির আহমদ শিশুটিকে নিয়ে যায় নি। বলেছে হাসিমের ঘরেই থাক। তার স্ত্রী এসে দেখে যাবে, যাতে শিশুর কোনো অসুবিধে না হয়। পাশের বাড়ির কাঠমিস্ত্রীর মেয়ে কালাসোনার হাতে দু’চার দিনের জন্য দেখাশোনার ভার দেওয়া হলো। মনির আহমদ বোঝালো, হাসিমের দাদী, যখন নিজে হাতে দেবে তখনই সে শিশুটিকে নেবে। বুড়ীকে বেজার করে নিয়ে কোনো লাভ নেই।

হাসিমের ঘর থেকে যেতে যেতে বেলা দুপুর গড়িয়ে গেলো। নিজের নাতি। তাকে এমন বিপদে ফেলে বুড়ী কি হুট করে চলে যেতে পারে? তা ছাড়া ঐ মা-হারা গোরাচাঁদ। ও যেন তার হীরাধর। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল আবার ফিরে এসেছে। অমন রক্তমাংসের ছোট পুঁটুলি গোরাচাঁদকে ফেলে বুড়ী কি চলে যেতে পারে? প্রবল হৃদয়াবেগ তাকে আটকে রেখেছিলো। ঘরে ফেরার কথা মনে হওয়ায়, ইতিমধ্যে কি কি করেছে, আগাগোড়া ব্যাপারটা মনে মনে ভেবে দেখলো। শিউরে উঠলো। একি করেছে? হাসিমের কাছে এসেছে, তার ছেলেকে কোলে নিয়েছে, এ খবর শুনলে অধর কি ঘরে ঢুকতে দেবে?

এসব কথা চিন্তা করতে করতে বরগুইনির কাঠের সাঁকোর গোড়াতে এলো। সেখানেই অধরের সঙ্গে দেখা। বুড়ী কাঁপতে লাগলো। অধরের চোখ-মুখ গম্ভীর। কোণা চোখে একবার বুড়ীর দিকে চাইলো। বুড়ী লাঠিটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। অনুমানে অধরের প্রতিক্রিয়াটা জেনে নিতে চায়। অধর কিছু বলছে না দেখে সাঁকোর দিকে পা বাড়ায়। অধর এবার জলদগম্ভীর স্বরে বললোঃ

“বরগুইনির এই পাড়ত আর ন আইস্যো।” (বরগুইনির এ পাড়ে আর আসবে না।)

বুড়ী সাহসে ভর করে জবাব দিলোঃ

“নাতি, তোরার কাছে ন আই কডে যাইয়ম?” (নাতি, তোদের কাছে না এসে কোথায় যাবো?)

বুড়ীর কথায় অধরবাবু একটুও গলেনি। বরঞ্চ বিরক্তই হয়েছে বেশী। বার বার হাসিমের কাছে না আসতে বারণ করেছে। বুড়ী যে বারণ মানতো না, তা জানতো অধরবাবু। লুকিয়ে চুকিয়ে যেতে নিজের চোখেও দেখেছে, কিছু বলে নি। কারণ কেউ যখন জানছে না, তার সম্মানহানির আশঙ্কা নেই। কিন্তু আজ অধরবাবুর মান সম্মান একেবারে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে। পাড়ার মধ্যে ছি ছি পড়ে গেছে। সারা শরীর অপমানে জ্বলছে। বুড়ীকে খুন করলেও গায়ের জ্বালা মিটবে না। অধরবাবুর ঠাকুরমা মুসলমানের ঘরে যায়, শৌচ অশৌচ জ্ঞান নেই। পাড়ার লোকে দুষবে। অসহ্য, একেবারে অসহ্য। সমাজের কর্তাব্যক্তি অধরবাবু। তার ঠাকুরমা কিনা মুসলমানের মরা দেখতে যায়। যে সর্ষে দিয়ে ভূত ছাড়ান হয়, সে সর্ষেতেই ভূত। রাগে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বুড়ীকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।

কাঠের সাঁকোর পাশে শোনালু গাছটার ওপর গিয়ে পড়ে। আর উঠতে পারে না।

হিমাংশুবাবু এসে বুড়ীকে পতনাবস্থা থেকে ওঠায়। গায়ের ধুলো ঝেড়ে দেয়। অধরের দিকে চেয়ে বলেঃ

“অধর, তুই গুরুজনের শরীরত আত দিলি”? (অধর, তুই গুরুজনের শীরের হাত দিলি?)।

হিমাংশুবাবুর মন্তব্যের কোন জবাব দিলো ন অধর। বুড়ীকে উদ্দেশ্য করে এবং হিমাংশুবাবুকে শুনিয়ে বললোঃ

“আইজখুন আর বাড়িত আইয়ন পইরত নয়, যারা আদর দেয় তারার বাড়িত থাইবা।” (আজ থেকে আর বাড়িত আসতে হবে না। যারা আদর দেখায় তাদের বাড়িতে থাকবে।)

অধর চলে যাচ্ছিলো। তার কর্তব্য সে করেছে। মুসলমান নাতির জন্য বুড়ীর দরদ উথলে উঠেছে, তার কাছেই থাকুক। অধর আর দরজা খুলে দেবে না। হিমাংশুবাবু বললোঃ ।

“এই অধর, হুন্।” (এই অধর, শোন।)

অধরবাবু ঘুরে দাঁড়িয়ে বললোঃ

“হিমাংশু, কি কবি ক’। আঁর টাইম নাই।” (হিমাংশু, কি বলবি বল। আমার সময় নেই।)

“তুই যে ঠাউরমারে ঘরত যাতি মানা করলি, কাম কি ভাল গরলি? বুড়া মানুষ, কডে থাইবে?” (তুই যে ঠাকুরমাকে ঘরে যেতে বারণ করলি, কাজটা কি ভাল করলি? বুড়ো মানুষ, কোথায় থাকবে?)

অধরবাবু স্পষ্টত বিরক্ত হয়। হিমাংশু তাকে উপদেশ দেবার কে? বললোঃ

“যেডে মনে লয় যউক, তোর যদি মনে পোড়ে তোর বাড়ি নিয়ে রাখ গৈ।” (যেখানে যেতে ইচ্ছা হয় সেখানে তিনি যেতে পারেন, তোর মনে দুঃখ লাগলে তুই নিয়ে যেতে পারিস।) কথা ক’টি ছুঁড়ে দিয়ে মিহি ধুতির কাছা সামলাতে সামলাতে হন হন করে চলে গেলো।

হিমাংশুবাবু বুড়ীকে সত্যি সত্যি নিজের ঘরে নিয়ে এলেন। তাঁর স্ত্রী সাবান মেখে স্নান করালেন। চুল আঁচড়ে বেঁধে দিলেন। মাথাটা ঘুরায় বলে চুলে জবজবে করে তিলের তেল মেখে দিলেন। হাত ধরে ভাত খাওয়াতে বসালেন। কিছুই খেতে পারলো না বুড়ী। বুকটা ধু ধু বালুচরের মতো জ্বলছে। দু’এক গ্রাস মুখে দিয়েই থালাটা সরিয়ে রাখলো। তারপর আস্তে আস্তে উঠে লাঠিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে পারে না ভালো করে। অন্তরে প্রবল ভাবের বন্যাবেগ বুড়ীকে যেন ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হিমাংশুবাবু জিজ্ঞেস করেঃ

“কি ঠাউরমা কডে যরদে?” (কি ঠাকুরমা, কোথায় যাও?)।

বুড়ী জবাব দেয় না। ঘোলা চোখ দুটো বাঁকা পথের ওপর বিছিয়ে রাখে। ঝাকড়া আমগাছটা ছাড়িয়ে কবরস্থান। কবরস্থান বাঁয়ে রেখে কাজীর পুকুরের উত্তরপাড় পেরিয়ে, কাজীদের পুরনো মসজিদটার ডান পাশেই হাসিমের ছোট্ট ঘরখানা। সে ঘরখানা টানছে। পা দুটো দুর্বল। তবু বুড়ো বয়সের জড়তার শাসন উপেক্ষা করে পা দুটো আপনা আপনিই চলছে। হিমাংশু বাবু আবার শুধোয়ঃ

ঠাডা রইদত কড়ে যাইবা, ঠাউরমা। এককেনা জিরাই লও। তারপর যেডে যাইবার যাইয়ো।” (এতো কড়া রোদের মধ্যে কোথায় যাবে ঠাকুরমা, একটুখানি বিশ্রাম কর। তারপর যেখানে যাওয়ার দরকার মনে করো যেয়ো।)

“ভাই আঁর সোনার বড় বিপদ। সোনার হেডে যাইয়ম।” (ভাই আমার সোনা বড় বিপদে পড়েছে। সোনার কাছে যাবো।)।

হাসিমকে বুড়ী সোনা বলেই ডাকে। হিমাংশুবাবুর আর কোনো কথার অপেক্ষা না করে রোদের তেজ অগ্রাহ্য করে বাঁকা পথটি বেয়ে হাঁটা শুরু করে।

বুড়ী হাসিমের ঘরে এসে আর ফিরে যায় নি। জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজটি করে ফেলেছে। একরত্তি তুলতুলে রক্তমাংসের পুতুলের মতো বাচ্চা ছেলের মুখের দিকে চেয়ে জীবনের আশিটা বছর পেছনে রেখে এলো। শরীর বড়ো দুর্বল। উঠতে পারে না, বসতে পারে না, আধা রাতে ঘুম ভেঙে যায়। কোমরের ব্যথাটা উঠলে পৃথিবী অসার লাগে। শিশুকে নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না। কখনো মুখে মধু দেয়। মোমের পুতুলের মতো বাচ্চা সরু জিহাটি দিয়ে আস্তে আস্তে চুষে খায়। কপালে কালির ফোঁটা দিয়ে দেয়। বলে- দেশে তো দুষ্ট লোকের অভাব নেই। গোরাচাঁদের ক্ষীণ কোমল শরীরে না জানি আবার নজর-টজর লেগে যায়। কাঁদলে ন্যাকড়া জড়িয়ে অস্থিচর্মসার হাতে তুলে নিয়ে দোলা দেয়। নানারকম ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে শোনায়। তার অর্ধেক বোঝা যায় অর্ধেক বোঝা যায় না। শিশু শুনবে কেন, কেঁদেই চলে। হাসিমকে ডেকে বলেঃ

“অ সোনা, নজর মেলি চা। একেবারে তোর বাপের নাহান। তোর বাপও কাইনতো। ভালা গরি চা, হেই মুখ, হেই নাক, হেই কান।” (সোনা একবার দৃষ্টি খুলে দেখ। একবারে তোর বাপের মতো। তোর বাবা এমনি করে কাঁদতো। ভালো করে দেখ। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক, সেই কান।)

ছেলে তার বাপের মতো? হাসিম সচকিত হয়। বাপকে সে ভুলে থাকতে চায়। বাপের জীবনের দিনগুলোর স্মৃতি পারলে চেতনা থেকে বাদ দিতো। ছেলে পিতামহের চেহারা নিয়ে এসেছে। সে জীবনটাও নিয়ে আসে নি তো? চোখের সামনে সামাজিক নিপীড়নের ছবি রূপ ধরে জেগে ওঠে। ইচ্ছে করেও ভুলে থাকতে পারে না।

ছোট্ট ফুটফুটে শিশুর দিকে তাকালে তার দৃষ্টি আপনা থেকেই মেদুর হয়ে আসে। কি যেন আছে শিশুর ক্ষীণ কোমল দেহে। একহাত লম্বা অবয়বের মধ্যে কি যে ছড়িয়ে আছে! চোখ ফেরাতে পারে না। ছোট্ট শিশু, ছোট্ট ঠোঁট, ছোট্ট হাত-পা। কালো পাতলা চুল। দুটি বড় বড় কালির ফোঁটার মতো চোখ কেমন অবাক হয়ে পৃথিবীর দিকে চেয়ে থাকে নিথরে। তাকালে বুকটা আপনা-আপনি কেঁপে যায় হাসিমের। সুফিয়ার চেহারাখানা ঝিলিক খেয়ে যায় চোখের পাতায়। নীরবে বুকের ভেতরে হৃদয়ের রক্ত ঝরে যায়। মন চায় না, কারো কাছে পুষ্যি দেয়। তার কাছে সুফিয়ার আমানত সুফিয়ার দেয়া উপহার, রক্তমাংসের এ সজীব পুতুল। কেমন ওঁয়া ওঁয়া করে তীক্ষ্ণ স্বরে কাঁদে। কান্নার স্বরে ঘরের জমাট বাঁধা স্তব্ধতা কেঁপে যায়। শিশুর সামনে থেকে দূরে যেতে মন চায় না। কিন্তু যেতে হয়। হাসিমের নানা ধান্ধা। বড় কঠিন পরিশ্রম করে তাকে জীবন চালাতে হয়। পূর্বের জঙ্গলে গিয়ে বাঁশ গাছ কেটে আনতে হয়। কি করে সে শিশুকে রাখবে? দাদীও বা কয়দিন থাকবে? একসময় তো হৃদয়াবেগ শুকিয়ে যাবে। হিমাংশুবাবু বুড়ীর জন্য খাবার কয়দিন পাঠাতে পারবে? হাসিম ভাত খেয়ে আঁচায় না বলে ইতিমধ্যে কুঁই কুঁই করতে লেগেছে। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে হাজার রকমের অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়েছে। মুসলমান সমাজের চালচলন হিন্দু সমাজের বোধগম্য নয়– অন্তপুরিকাদেরতো কথাই নেই। হৃদয়ের টানটা বাইরের খলু এবং অধর বাবুদের দুনিয়াতে বজায় রাখা কি এতোই সহজ? প্রিয় সংস্কারগুলো ত্যাগ করা কি সম্ভব হবে? যে বয়সে সম্ভব সে বয়স তো পেছনে ফেলে এসেছে কতো যুগ আগে। মনে মনে হাসিম ঠিক করলো ছেলেকে মনির আহমদের কাছেই দিয়ে দেবে।

বরগুইনির দু’পাড়ে জবর খবর রটেছে, পোদ্দার গিন্নী হাসিমের কাছে চলে এসেছে। বাড়াবাড়ির বটতলায় এ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। কেউ কেউ বললো, বুড়ীর নামে আটকানি থালার মতো, ডাক দিলে কথা কয়, এমন সম্পত্তি আছে। পোদ্দার মারা যাওয়ার সময় গিন্নীকে অনেক সোনা এবং রুপার টাকা দিয়ে গেছে। বুড়ী সব হাসিম কে দিয়ে যাবে। গ্রামে সহসা হাসিমের কদর বেড়ে গেলো। কেন, হাসিম বুঝতে পারে না। খলু মাতব্বর এখন হাসিমকে বেশ খাতির করে। সম্পন্ন চাষী মজু মিয়া হাসিমকে তোয়াজ করতে শুরু করেছে। বলেছেঃ

“হাসিম বাই, মগ বিলের দুইকানি জমিন আঁরে চাষ গইরতা দিবা। আঁই তালি বালি গইরতাম নয়। ঠিক ঠিক ধান দিয়ম।” (হাসিম ভাই, মগ বিলের দু কানি জমি আমাকে চাষ করতে দেবে। আমি কোন গোলমাল করবো না। ঠিক ঠিক ধান শোধ করবো।)

খলু হাসিমকে ঘরে ডেকে নিয়ে যায়। বানিয়ার পুত আর ডাকে না। হাসিম মিয়া বলে সম্বোধন করে। হাসিমের সামনেই জোহরাকে ডাক দিয়ে নিয়ে আসে। জোহরা এলে বলেঃ

“হাসিমের দাদী বুড়া মানুষ, একা থাহে, মাঝে মাঝে তুই যাই হাতের কাম কিছু গরি দিস। খবরদার, ন ছুঁইস-টুইস। কি না কি মনে পরে। বিধবা মানুষ।” (হাসিমের দাদী বুড়ো মানুষ। একা থাকে। মাঝে মাঝে তুই গিয়ে হাতের কাজকর্ম কিছু করে দিস। খবরদার, ছুঁসটুস নে। কি না কি মনে করে। বিধবা মানুষ।)

হাসিম হতবাক হয়ে তার নতুন সমাদরের কারণটা চিন্তা করে। দুষ্ট লোকে বলে খলু বছর খানেক আগে ভিক্ষুদের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরের মুর্তির গা থেকে সোনার অলঙ্কার ডাকাতি করেছে। সে খলুকে এখন হিন্দু বিধবার আচারের প্রতি শ্রদ্ধাবান হতে দেখে বিস্ময়ে থ’ বনে গেলো। ধর্মটা কিছু নয় যেন। বছর দশেক আগে খলুদের অত্যাচারেই তো পাল মশায়রা হিন্দুস্থান চলে গেলেন। হিমাংশু বাবুকে কতোবার মালাউনের বাচ্চা বলে গাল দিয়েছে। অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে স্বার্থের জন্য না করেছে এমন জঘন্য কাজ খুব কমই আছে। সে খলু কিনা আজ একজন হিন্দু বিধবার নিষ্ঠার প্রতি হঠাৎ মনোযোগী হয়ে উঠলো। তার মনের ভেতরে অভিপ্রায়টি কি, হাসিম মনে মনে চিন্তা করে।

অধরবাবু এখন খুব পস্তাচ্ছে। রাগের বসে বুড়ীকে একটা ধাক্কা দিয়েছিলো। তার যে এমন ফল হতে পারে, সে কথা স্বপ্নেও ভাবে নি। ধারেকাছে আত্মীয় স্বজনের বাড়ী ছিলো, চলে গেলেই পারতো। অথচ বুড়ী কিনা চলে গেলো হাসিমের ঘরে। অধরবাবুর মান-সম্মান বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মান-সম্মান তো গেছে। তদুপরি স্বার্থের ওপর বিরাট একটা আঘাত আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সত্যি সত্যি বুড়ী যদি আট কানি সম্পত্তি হাসিমকে লেখাপড়া করে দিয়ে দেয়, যে ক্ষতি হবে, সারা জীবন সুদের কারবার করেও পূরণ করতে পারবে না। কেন সেদিন এমন ভুলটা করলো সেজন্য রাগে, দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। বুড়ী যদি স্বেচ্ছায় না আসে। তাহলে জোর করে আনার কোনো পথই খোলা নেই। জোর করে যদি আনতে যায়, সমস্ত মুসলমান পাড়া রুখে দাঁড়াবে। কারণ বুড়ীর সম্পত্তি আছে। সে সম্পত্তি হাসিমকে যদি দেয় তাহলে তাদের চাষে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং তারা এ সুযোগ নিতে ছাড়বে না। রাতের বেলা ঘুমোতে পারে না। পাগলের মতো হয়ে গেছে। এখন লোকে তাকে দেখলে মুখ টিপে হাসে। অনেক ভেবে একখানা বুদ্ধি বার করে। অধরবাবু গিয়ে কুলপুরোত রামাই পণ্ডিতের শরণাপন্ন হয়। কালী পুজোর আগের দিন রামাই চক্রবর্তী দুপুর বেলা বুড়ীর কাছে আসে। বুড়ী তখন হাসিমের ছেলেটিকে দুধ খাওয়াচ্ছিলো দাওয়ায় একখানা মাদুর বিছিয়ে। রামাই পণ্ডিত হাসিমকে ডাকতে ডাকতে উঠোনে উঠে এলো। পণ্ডিতের গলা শুনে বুড়ীর হাত থেকে বোতলটা পড়ে গেলো। পণ্ডিত বললোঃ

“অপোদ্দার গিন্নী, উঁই এডে ক্যা?” (অপোদ্দার গিন্নী, তুমি এখানে কেন?)

বুড়ী জবাব দেয় না। শুধু মাথার খাটো চুলের ওপর দিয়ে ঘোমটাটা দীর্ঘ করে টেনে দেয়। রামাই বেশ উৎসাহের সুরে বলেঃ

“নাতি পুতরে চাইতা আইস্যদে বুঝি?” (নাতির ছেলেকে দেখতে এসেছে বুঝি?)।

বুড়ী ক্ষীণ কণ্ঠে বলেঃ

“না ঠাউর মশায়, আঁই একেবারে চলি আস্যি। অধর আঁরে উঁড়াই দিয়ে।” (না ঠাকুর মশায়, আমি একেবারে চলে এসেছি। অধর আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।)

“একেবারে চলি আস্য কডে?” (একেবারে চলে এসেছে, সে কি, কোথায়?)

“এই ঘরত। সোনা আঁরে এক কামরা ঘর ছাড়ি দিয়ে। সন্ধ্যা আহ্নিকের কন অসুবিধা ন অয়। হিমাংশু দুই বেলা ভাত দিয়া যায়। লক্ষ গরি চাও ঠাউর মশায়, একবারে অবিকল আঁর হীরাধর।” (এই ঘরে, সোনা আমাকে একটি কামরা ছেড়ে দিয়েছে। সন্ধ্যা আহ্নিকের কোন অসুবিধে হয় না। হিমাংশু দু’বেলা ভাত দিয়ে যায়। লক্ষ্য করে দেখুন ঠাকুর মশায়, একেবারে অবিকল আমার হীরাধর।) কোলের শিশুর দিকে ব্রাহ্মণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ব্রাহ্মণ তিন কদম পিছিয়ে যায়।

“চার-পাঁচ দিন রইলা পোদ্দার গিন্নী–এহন ঘরত চলল। (চার-পাঁচ দিন তো থাকলে পোদ্দার গিন্নী এখন ঘরে চলো।)

“না, আঁই আর যাইতাম নয়।” (না, আমি আর যাবো না।)।

“ন যাই কি মুসলমানের বাড়িতে থাহি যাইবা?” (না যেয়ে কি মুসলমানের বাড়িতে থেকে যাবে?) রামাই ঠোঁট দিয়ে জিভ কাটে। “ছি, ছি!”

“না, থাকতাইম নয়, বাইচ্চা একমাসের অইলে আঁই তীর্থ গইরতাম চলি যাইয়ম।” (না, থাকবো না, বাচ্চা একমাসের হলে আমি তীর্থ করতে চলে যাবো।)

“হুন, পোদ্দার গিন্নী, ঘরত চলো। অধর কিছু কইতো নয়। ধর্মের বিধান আছে প্রাচিত্তির গইরলে পাপ খণ্ডন অইবো।” (শোন পোদ্দার গিন্নী, ঘরে চলো। অধর কিছু বলবে না। ধর্মের বিধান আছে, প্রায়শ্চিত্ত করলে পাপ খণ্ডন হবে।)

বুড়ী জিজ্ঞেস করেঃ

“ঠাউর, কিয়র পাপ, কিয়র প্রাচিত্তির?” (কিসের পাপ, কিসের প্রায়শ্চিত্ত?)

“এই যে মুসলমানের বাড়িত এতো দিন থাহিলা?” (এই যে মুসলমানের বাড়িতে এতোদিন থাকলে।)

“আঁর নাতির বাড়িত রইলাম, হিথারলায় আঁর প্রাচিত্তি কি?” (আমি নাতির বাড়িতে থাকলাম, তার জন্য আবার প্রায়শ্চিত্ত কিসের?) রামাই পণ্ডিত প্রায়শ্চিত্তের কথা বলে বুড়ীকে টলাতে না পেরে অন্য সুরে কথা বলেঃ

“কাইল মা কালীর পূজা। বাড়ীর বুড়া মানুষ। উঁই ন থাহিলে পূজা অইব কেনে? মা কালির দিব্যি, চলো, চলো।” (কাল মা কালীর পূজা। বাড়ির বুড়ো মানুষ, তুমি না থাকলে চলবে কেন? মা কালীর দিব্যি, চলো৷)।

“ঠাউর, মা কালীও মাইয়া মানুষ। আঁর অবস্থা বুঝিব। আঁই চলি গেলে দুধের বাইচ্চা মারা যাইবো। তোঁয়ারা পূজা গরো আঁই হীরাধরের লই রইলাম। এই চ ঠাউর, একেবারে আইনমাইন হীরাধর।” (ঠাকুর, মা কালীও মেয়েমানুষ। আমার অবস্থা বুঝবেন। আমি গেলে বাচ্চা মারা যাবে। তোমরা পূজা করো, আমি হীরাধরকে নিয়ে রইলাম। দেখো, একেবারে অবিকল আমার হীরাধর।)।

বুড়ীর কথা শুনে ব্রাহ্মণের মাথার তালু পর্যন্ত জ্বলে উঠলো। আর একটু অপেক্ষা না করে চলে গেলো।

রামাই পণ্ডিতকে পাঠিয়েও কাজ না হওয়ায় অধরবাবু ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়লো। নানা লোক এসে নানা কথা বলে যায়। কেউ বলছে বুড়ী সাব-রেজিষ্টারের অফিসে গিয়ে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি যা আছে, সব হাসিমকে খুব শীঘ্রই দানপত্র করে দেবে। কি করবে ভেবে পায় না। চোখে অন্ধকার দেখে। প্রত্যেক দিন নতুন নতুন খবর আসে। হাসিম খলুর শরণাপন্ন হয়েছে, খলু লেঠেলদের নিয়ে অধরবাবুর চাষের জমিতে হাল বাইতে আসবে এবং পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে নিয়ে যাবে, এমন খবরও শোনা যাচ্ছে। ভাইদের নিয়ে পরামর্শ করে। কেউ উপায় বাতলাতে পারে না। পাথরের তলায় হাত পড়েছে। মান-সম্মান সে গেছে কবে। এখন সম্পত্তিগুলো বাঁচাতে পারলেই হয়। আসন্ন বিপদের সম্ভাবনায় অধরবাবুর মগজের সবগুলো কোষ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এ ক’দিনে অধরবাবু যেন অনেক বুড়িয়ে গেছে। ধনুকের মতো লিকলিকে শরীরখানা বাঁকা হয়ে গেছে। শেষে একটা উপায় আবিষ্কার করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কানা আফজলের শরণাপন্ন হওয়ার কথা মনস্থ করলো। খলু যতো কূট-কৌশলী, যতো ধূর্ত হোক না কেন, তার হাতে যতো লেঠেল থাকুক না কেন, চেয়ারম্যান কানা আফজলের কাছে খলু কিছু নয়। অধরবাবু কানা আফজলকেই গিয়ে ধরলো। শুধু হাতে নয়। বাজার থেকে সাত আট সের পানতোঁয়া, সন্দেশ, রসগোল্লা ইত্যাদি গোপনে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারপরে গিয়ে দেখা করেছে এবং আসবার সময় নগদ পনেরো শ’টি টাকা পকেটে গুঁজে দিয়েছে। অধরবাবু ভারী কেপ্পণ মানুষ। লোকে বলে প্রস্রাব করার সময়েও হিসেব নিকেশ করে। কলে হাত পড়েছে, সুতরাং টাকা না দিয়ে উপায় কি? চেয়ারম্যান কাণা আফজল পথ বলে দিয়েছে।

মনির আহমদ, হিমাংশুবাবু, মান্নানেরা সিগারেট কোম্পানীর জমি দখলের প্রতিবাদে গাঁয়ের সমস্ত কৃষককে একজোট করেছিলো। কৃষক সমিতির সদস্যরা ওপরে দরখাস্ত পাঠিয়েছে। পত্রিকার কাগজে লেখালেখি করেছে কি সব। কোম্পানীর সার্ভেয়ার শেকল দিয়ে জমি মাপজোক করতে এলে সব কৃষকেরা মিলে খেদিয়ে দিয়েছে। কোম্পানী, কৃষক সমিতির সদস্য এবং গাঁয়ের আরো কতিপয় প্রতিবাদী কৃষককে আসামী করে থানায় এজাহার করেছে। কানা আফজল, জাহেদ বকসু, অধরবাবু এরা কোম্পানীর পক্ষে সাক্ষী হয়েছে। পরের দিন পুলিশ এসে মনির আহমদ, মান্নান, হিমাংশুবাবু এবং কয়েকজন কৃষককে পিছমোড়া করে বেঁধে থানায় চালান দিলো। অন্যান্য আসামীরা আগে খবর পেয়ে পালিয়ে গেছে। তাদেরকে ধরার জন্য পুলিশ আস্তানা গাড়লো। বরগুইনির পাড়ের একশোটি ঘরে একজন পুরুষ মানুষও নেই। যারা আসামী নয়, তারাও ভয়ে দূরের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে চলে গেছে। পুলিশ, চৌকিদার, দফাদারেরা সারা গাঁয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মুর্গী, ওর খাসী জবাই করে দু’বেলা ভক্ষণ করছে।

ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেছে। অনেকেই মনির আহমদ এবং হিমাংশু বাবুকে সরে যেতে বলেছিলো। মনির আহমদ কিছু বলে নি। শুধু একটু হেসেছে। পুলিশ এসে যখন মনির আহমদকে হাতকড়ি পরালো মা এবং স্ত্রীর সামনে, হাসিমের চোখ দিয়ে আপনা-আপনি ঝর ঝর করে পানি বেরিয়ে এলো। একজন পুলিশ ঠাস করে গালে একটা চড় বসিয়ে বললো, ‘এই শালা এক নম্বর বরদমায়েশ।’ তখন হাসিমের শরীরের রোমে রোমে যেন বিদ্বেষের বিদ্যুত প্রবাহিত হলো। এমন কোনোদিন অনুভব করে নি। পুলিশ, দারোগা, দফাদার, চৌকিদার, মেম্বার, চেয়ারম্যান সকলের মাথাগুলো ফাটিয়ে দেয়ার জন্য হাতটা নিশপিশ করছিলো। মাথায় খুন চড়ে যাচ্ছিলো। অথচ যে লোকটাকে বিনাদোষে হাতকড়ি পরালো, স্ত্রী এবং মার সামনে মারলো, তার মুখে একটুও ভাবান্তর নেই। কপালের রেখাগুলো শুধু একটু কুঁচকে গিয়েছিলো। আসামীদের নিয়ে পুলিশ-দারোগা পথ দিলো। হাতকরি-পরা মনির আহমদ, একটু হেসে হাসিমের দিকে তাকিয়ে বললোঃ

“গেলাম হাসিম বাই।”

মান্নানের রক্ত গরম। সে কিছুকে পরোয়া করে না। কানা আফজলের দিকে তর্জনী বাড়িয়ে দারোগো-পুলিশের সামনেই বললোঃ

“এই কানা, খেয়াল রাখিস, আঁই যদি বাপের বাইচ্চা অই, তইলে বদলা লইয়ম।” (এই কানা, খেয়াল রাখবি, আমি যদি বাপের বাচ্চা হই, একদিন বদলা .নেবো।)

একজন পুলিশ তার পাছায় বেতের একটা বাড়ি দিয়ে বললোঃ

“শালা, হট হট।”

মনির আহমদের মা “অ পুতরে, তুই আঁরে ফেলে কডে যরদে?” (বাছা, আমাকে ফেলে তুই কোথায় যাস?) বলে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলো। বাঁজা বউটি মাথা ভাঙা টিউব-ওয়েলটার পাশে দাঁড়িয়ে, একদৃষ্টে স্বামীর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওরা আল পেরিয়ে রাস্তায় উঠলো। সিকদার পুকুরের তেঁতুল গাছটির আড়ালে চলে গেলো। অমনি যে টির কালো চোখের মণি কেঁপে বড়ো ক’টি চোখের পানির ফোঁটা নেমে এলো। গোলগাল মুখখানা চোখের পানিতে ভেসে গেলো। হাসিমেরও গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। বুকটা তার জ্বলছে।

কৃষক সমিতির কর্মীদের গ্রেফতারের পর হঠাৎ হাসিমের মনে হলো মট মট করে তার অনেক পাঁজর একসঙ্গে ভেঙে গেছে। সে যেন আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে না। পৃথিবীটা তার জন্যে মিথ্যে হয়ে গেলো। হাসিমের মতো সমাজহারা পরিচয়হারা একজন মানুষকে সমিতির কর্মীরা ভাই বলে গ্রহণ করেছিলো। তারা জেলে গেলো। হাসিম এখন কার কাছে যাবে? কি করবে? কর্মীদের সাহচর্যে, তাদের সঙ্গে আলাপে সালাপে হাসিমের ভেতরে আরেকজন নতুন হাসিম কখন জন্ম নিয়েছে টেরও পায়নি। নবলব্ধ চেতনার আলোকে সন্ধান করে দেখে, ওরা তার কতোটুকু ছিলো। মনের গভীরে রামমঙ্গল গানে শোনা একটি কলি লতিয়ে উঠলোঃ

“সীতা মৈলে সীতা পাইয়ম প্রত্যেক ঘরে ঘরে
প্রাণের ভাই লক্ষণ মৈলে ভাই বলিয়ম কারে?”

সে যেন একা ছিরাম, তার ভাইয়েরা কেউ নেই। ঘরে এসে দেখে দাদীর পাশে জোহরা বসে রয়েছে। হাসিম গায়ের জামাটা খুলে দড়ির ওপর ঝুলিয়ে রাখে। তারপর একখানা পিড়ি টেনে নিয়ে বুড়ীর পাশে বসলো। বুকের ভেতর ঢেউ ভেঙে যাচ্ছে, মুখ দিয়ে কথা সরছে না। তিনজন মানুষ বসে আছে অধোমুখে। চেরাগ বাতির স্বল্প আলোকে একের মুখে কি চিন্তা ছায়া ফেলেছে, অন্যজন পড়ে দেখতে চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ে। আঁধার আদিম হয়ে বরগুইনির দু’পাড়কে গ্রাস করে। তিনজন মানুষ নীরবে আপনাপন স্মৃতির বোঁচকা খুলে নষ্ট অনুভূতি, নিহত স্বপ্নের লাশের গায়ে হাত বুলোচ্ছে যে যার মতো করে। একজনের নিশ্বাসের শব্দে আরেকজন চকিত হয়ে ওঠে। সকলেই কথা বলতে চায়। কিন্তু বলার কথা খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের আধসেদ্ধ জীবনের কথার মুকুল বহুকাল আগেই শুকিয়ে গেছে। এমনি সময়ে ছোট্ট বেড়ালের বাচ্চার মতো শিশুটা কেঁদে উঠলো। জোহরা হাত বাড়িয়ে শিশুকে কোলে তুলে নিলো। হাসিমের বুকের ভেতর খচ্‌ খচ্‌ করছে। কাটার মতো কি একটা যেন বিধছে। শান্তি নেই, শান্তি নেই। জামাটা টেনে গায়ে জড়িয়ে বললোঃ

“জেহরা তুই দাদীর লগে বয়, আঁই এককেনা মনির আহমদ আর হিমাংশু বাবুর বাড়ির থুন ঘুরি আই।” (জোহরা, তুই দাদীর সঙ্গে বোস্। আমি একটু মনির আহমদ আর হিমাংশু বাবুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।)

বেরিয়ে গেলো হাসিম।

তার পরদিন হাসিম সন্ধ্যেবেলা বাজার থেকে ঘরে ফিরে দেখে ভেতরে জোহরা। কোলে শিশু। ব্লাউজের বোতাম খুলে স্তনের বোঁটাটি শিশুর মুখে পুরে দিচ্ছে। আপনা-আপনি হাসিমের চলা থেমে যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ডান স্তন টেনে নিয়ে বাম স্তন মুখের ভেতর পুরে দেয়। আশ্চর্য দুটি স্তন জোহরার। বাতির আলোকে দেখা যায় ঈষৎ রক্তিম, শিরাল, শেষ রেখাঁটি পর্যন্ত ভরে উঠেছে মাংসে! কালো জামের মতো কালো দু’টি কলি। হঠাৎ হাসিমের বুকের রক্তধারা নেচে ওঠে। তালে তালে রক্ত শরীরের ভেতর মাদল বাজায়। দু’টি মাংসল চুম্বক তার দু’চোখের দৃষ্টিকে ধরে রেখেছে। আধো অন্ধকারে থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার নড়ার ক্ষমতা নেই। সমস্ত জগৎ হারিয়ে গেছে দৃষ্টি থেকে। দু’টি অমৃত কলসী থেকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে রস ঝরে পড়েছে। সে অমৃত তার শরীরে প্রবেশ করছে আর সে সূক্ষ্ম চিন্ময়, গভীর জীবনের স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠেছে।

খানিকক্ষণ চোষার পর শিশুটি কেঁদে উঠলো। জোহরা ব্লাউজ ঠিক করে পরলো। মোহ ভেঙে গেলো হাসিমের। স্তনের বোঁটায় দুধ নেই। তাই শিশু কাঁদছে। জোহরার গভীর দুঃখের কথা তার মনে খুঁচিয়ে জেগে উঠলো। তিন তিনবার বিয়ে হয়েছে। একবারও পুরোপুরি স্বামীর ঘর করতে পারে নি। শিশুকে স্তন্য পান করাবার বড় সখ বুঝি তার। মনে মনে চিন্তা করলো জোহরাকে শিশুটি দিয়ে দিলে কেমন হয়। হাসিম গলা খাকারি দিলো। জোহরা শাড়ীর আঁচলটা ভালো করে টেনে দিলো মাথায়। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলোঃ

“জোহরা, দাদী কই?” (জোহরা, দাদী কোথায়?)

জোহরা জবাব দেয় না। চোখের অতল মণি দুটো একবার মাত্র তুলে হাসিমের মুখের পানে তাকালো। পরক্ষণে নামিয়ে নিলো। ভঙ্গীটি বড় সুন্দর লাগলো হাসিমের। এ দু’টো দৃষ্টিরেখা বুকের অস্থিমাংস ভেদ করে অন্তরের অতলে গিয়ে বিধছে বুঝি। জামাটা খুলে রেখে আবার জিজ্ঞেস করলোঃ

“দাদী কডে গেইয়ে ন কস ক্যা?” (দাদী কোথায় গিয়েছে বলিস না কেন?)

জোহরা ডান হাত বাম হাতে বুলোতে বুলোতে বললো ধীরে ধীরেঃ

“দাদীরে জোর গরি হরিচরণ, সাধন আর অধরবাবু পাথারিকোলা গরি লৈ গেইয়ে গৈ।” (দাদীকে হরিচরণ, সাধন আর অধরবাবু জোর করে পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে গেছে।)

কথা শুনেই হাসিম বসে পড়ে। আর কোনো স্বর বেরোয় না মুখ দিয়ে। দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরে। সুফিয়া মারা গেলো, মনির আহমদ, হিমাংশুবাবু, মান্নান জেলে চলে গেলো, দাদীকে অধরবাবু জোর করে নিয়ে গেলো। স্নেহ-মমতার ভিত্তিতে হাসিমের যে একখানা জগৎ গড়ে উঠেছিলো, যে জগতে সে হৃদয়াবেগের মূল্য পেতো, চোখের সামনেই ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো। এখন শিশু সন্তানকে নিয়ে সে কোথায় দাঁড়ায়। সারা মনে বিতৃষ্ণা ছড়িয়ে যায়। নিজের বাহুমূল দংশন করতে ইচ্ছে করে। জোহরাকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁঝালো স্বরে বললোঃ

“তুই কিয়রলাই রইয়স, তুইও যা।” (তুই কেন রয়েছিস, তুইও যা।)

“আঁই, আঁই, …।” (আমি, আমি, …) জোহরা আবার অতল কালো চোখের দৃষ্টি হাসিমের দিকে মেলে ধরে। হাসিম বলেঃ

“যা, যা কেউরে লাইগতো নয় আঁর।” (যা যা, কাউকে লাগবে না আমার।)

জোহরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায়।

তার পরদিন এলেন কেরামত ভাই। হাসিম আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। ঘটনা, দুর্ঘটনার আবর্তে পড়ে সে সাত হাত মাটির তলায় সেধিয়ে গিয়েছিলো। অনেকদিন যেন সূর্যের মুখ দেখে নি। কেরামত ভাইকে তার আশা-আকাঙ্খার প্রতীক বলে মনে হয়। লোকটাকে দেখলে বুকে কোত্থেকে বল আসে। প্রেরণা সবগুলো লোমকূেপের গোড়ায় গোড়ায় সঙ্গীতের অঙ্কুরের মতো কাপে। সব দেখলেন, সব শুনলেন। বিশেষ কিছু বললেন না। এক সময়ে উচ্চারণ করলেনঃ

“জামিন দেয় কিনা চেষ্টা করে দেখতে হবে।”

হাসিম মনে মনে বেজার হলো। গ্রামের এতোগুলো লোক জেলে পচে মরছে। কেরামত ভাই ব্যাপারটিকে এতো সহজভাবে নিলেন। না, হাসিম বরদাস্ত করবে না। বরদাস্ত করতে পারবে না। ফস করে বলে ফেললোঃ ।

“কেরামত ভাই আর কিছু ন গরিবা?” (কেরামত ভাই, আর কিছু করবে না?)

“না ভাই আর কিছু করার নেই বর্তমানে।” জবাব দিলো কেরামত।

“এই যে পঁচিশ জন ভালা মাইনষেরে জেয়লত লৈ গেল, তার পতিকার কি?” (এই যে পঁচিশ জন ভালো মানুষকে জেলে নিয়ে গেলো, তার প্রতিকার কি?)

“হাসিম ভাই, প্রতিকার এতো সহজ নয়। এই তো অত্যাচারের সবেমাত্র শুরু। জালেমেরা বনের বাঘের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, আর মজলুমেরা সকলে একজোট হয়ে যতোদিন না রুখে দাঁড়াচ্ছে কোনো প্রতিকার নেই। মনির আহমদ কিংবা হিমাংশুবাবু তো নয় শুধু, এমনি হাজার হাজার মানুষ বিনা অপরাধে জেল খাটছে।”

চুপ করে গেলো কথা শুনে। হাসিম কেরামতকে তার ব্যক্তিগত ব্যাপার জানালো। সে আর গাঁয়ে থাকতে চায় না। এখানে থাকার সমস্ত আকর্ষণ চলে গেছে। হাসিম অন্য কোথাও চলে যেতে চায়। কেরামত ভাই যেন তাকে কোথাও খেটে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। ছেলেটিকে কাউকে পুষতে দিয়ে যাবে। কেরামত বললোঃ

“আকর্ষণ থাক না থাক, সকলকে যেতে হবে। শহরের কল-কারখানা গাঁয়ের মানুষকে লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে যাবে। আজ না হয় কাল। দু’দিন আগে কিংবা পরে। কল রক্তের রস, বীর্যের ব্যঞ্জনা শুষে নিয়ে সকলকে চোচা করে ছাড়বে। ভূঁড়িওয়ালা মহাজনদের পেট মোটা হবে। হাড়ে হাড়ে আগুন জ্বলবে যেদিন, শ্রমিকেরা সেদিন জাগবে”–বিড়বিড় করে বললো, “ইতিহাসের কঠিন ইচ্ছা কার সাধ্য রোধ করে!”

হাসিম অতশততা বোঝে না। দরকারও নেই। সোজা কথা সে কাজ চায়। কেরামত ভাই যদি একখানা কাজের ব্যবস্থা করে দেন চলে যেতে প্রস্তুত। কেরামত কথা দিলো, আগামী সোমবার কালুর ঘাট যদি চলে আসে, তাহলে একখানা কাজের ব্যবস্থা করে দেবে।

হাসিম কাঙালের মতো বললোঃ

“নিশ্চয়, নিশ্চয় যাইয়ম, কেরামত ভাই।”

কেরামত ভাইকে কথা দেয়ার পর থেকে মনটা তার বার বার কাঁদছে। গাঁয়ের যেদিকে তাকায়, গাছপালা, ক্ষেত-খামার, সবকিছু একসঙ্গে করুণ মিনতি করে বলে যেন, “হাসিম, তুই ন যাইস।” শরীরের শিরায় শিরায় কান্না ফুলে ফুলে উঠছে। বরগুইনির দু’পাড়ে কতো মায়া ছড়িয়ে আছে। কাজী পুকুরের নিতল কালো জল তাকে সলিল-বাহু দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়। আশ্বিনের কাঁচা সোনার মতো ঘন মিহি রোদে শরীরের কুসুম কুসুম উত্তাপিত সোহাগ মাখিয়ে দেয়। তার বাপ-মা’র ধ্বসে যাওয়া কবর দুটো থেকে যেন দুটো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। দু’কবরের মাঝখানে একটি চারা মতো নিমের ডালে বসা শালিকটি হাসিমের চলে যাওয়ার খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সুফিয়ার কবরের মাটিগুলো এখনো তাজা। উঁচু করা মাটির নীচে তিন বছরের দাম্পত্য জীবন শাদা কাফনে ঢেকে পুঁতে দিয়েছে। অভিমানে সুফিয়া যেন মুক হয়ে বসে আছে।

সোমবার ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। হাসিম পাকাপাকি করে ফেলেছে সে যাবে। কিন্তু শিশুটির এখনো কিছু করে নি; কি করবে ভেবে পায় না। নিজের কাছ-ছাড়া করার কথা ভাবতেও কষ্ট লাগে। বুকের ভেতরটা কেঁকির মতো আওয়াজ দিয়ে ওঠে। এতোটুকুন শিশুর যে এতো মায়া, তা কি হাসিম আগে জানতো? বুকটা চুর চুর করে। এক সময়ে মনকে কঠিন করে ফেলে। ন্যাকড়া-কানি জড়িয়ে মনির আহমদের বাজা বৌটির কাছে ছেলেকে রেখে আসে। হাসিম এখন মুক্ত। মায়ার সমস্ত কোমল বাঁধন সংকল্পের ধারালো করাতে কেটে ফেলেছে। সোমবার দিন সকাল বেলাই সে চলে যাবে।

খলুর কাছে দু’ভার বাঁশ বাবদ ছ’টাকা পেতো। সন্ধ্যে বেলা টাকাগুলোর জন্য গেলো। ঘাটার কাছে ভাইপো জলিলের সঙ্গে দেখা। জলিল হাসিমকে ধরে টেনে নিয়ে আসে। তারপর বললোঃ

“হাসিম, ভিতরে ন যাইস, আজিয়া বাজার গরম।” (হাসিম ভেতরে যাস নে, আজ বাজার গরম।)

হাসিম ব্যাপার কি জানতে চায়। জলিল তাকে কদমগাছটির তলায় এনে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনায়। হাসিমের মুখখানা শুকিয়ে আসে শুনে। দারোগার সঙ্গে যে ব্যাপারটির পর জোহরা গর্ভবতী হয়েছে। এ খবর সমস্ত পাড়ায় ছড়িয়ে গেছে। খলু মাতব্বর মানুষ। তার ভীষণ ইজ্জতহানি হচ্ছে। জোহরাকে হাফেজ ডাক্তারের কাছ থেকে এনে কতকগুলো শাদা ট্যাবলেট খেতে দিয়েছিলো। জোহরা রাগবশত সেগুলো কাউকে না বলে ফেলে দিয়েছে। পরিণামের কথা একটুও চিন্তা করে নি। এখন দারোগার বীজ তার পেটে অঙ্কুর হয়ে ফুটেছে। লোকে কানাকানি করছে। আর বেশি মানুষের কানে যাবার আগে অন্নদা ডাক্তারের কাছে গর্ভপাত করাবার জন্য নিয়ে গিয়েছিলো। জোহরা নাকি শোয়া অবস্থা থেকে পালিয়ে এসেছে। মাতব্বর জোহরাকে অনেক বুঝিয়েছে কাজটা ভাল হচ্ছে না। জোহরা শুনেনি। গর্ভপাত করাতে রাজি হয় নি। মাতব্বরের ছোট বউও বুঝিয়েছে স্বভাবসুলভ গালাগাল দিয়ে। একরাতের ব্যাপার–জোহরা কি একটু এদিক সেদিক করে ফেলতে পারতো না? আশ্চর্য ফলন্ত মেয়েমানুষ, বাপের বয়েসী দারোগার বীজটা পেটে ধরে ফেললো। এখন কিনা সমাজের প্রধান মানুষটার মাথা হেট করে দিতে চায়। জোহরার মতো অমন পাঁচজন বেশ্যা মেয়েমানুষের জীবনের চাইতে মাতব্বরের ইজ্জতের দাম কি বেশি নয়? জোহরা কিছুই শুনেনি। গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। মাতব্বর খুব মেরেছে। একটু কাঁদেনি। চীৎকার করে বলেছে, দারোগার ছেলে জন্ম দিয়ে খলুর নাক-কান কাটবে। বুকে গভীর বেদনা নিয়ে ফিরে এলো হাসিম।

অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসিমের কতো কথা মনে পড়ে যায়। শুকনো পাতার শব্দ তুলে যাচ্ছে ও কে? মেয়েমানুষ? হাসিম তাড়াতাড়ি ধাওয়া করে। কাছাকাছি গিয়ে হাঁক ছাড়েঃ

“হেইভা কন?” (ওটা কে?)

“আঁই, হাসিম বাই, তোঁয়ার লগে দেখা ক্যা অয়?” (আমি হাসিম ভাই, তোমার সঙ্গে দেখা কেন হয়?)।

“জোহরা! তুই কডে যরদে?” (জোহরা! তুমি কোথায় যাচ্ছো?) শুধোয় হাসিম।

“হাসিম বাই, আঁই মইরতাম যাইরদে। আঁর মরণ পড়িব। সাড়ে বারটার রাইতের গড়ি ধইরগম।” (হাসিম ভাই, আমি মরতে যাচ্ছি। আমাকে মরতে হবে। রাত সাড়ে বারোটার গাড়ি ধরবো।) জোহরা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে।

“তুই মরিবি ক্যা?” (তুই মরবি কেন?)।

“হাসিম বাই, এনেও আঁই বাঁচিত পাইরতাম নয়। চাচার কাছেও গেলে মরণ অইব। ন গেলে বিষ খাবাই মারিব। ন জান, আঁই দারোগার জারগুয়া পেড়ত ধরগি।” (হাসিম ভাই, এমনিতে তো আমি বাঁচতে পারবো না। চাচার কাছে গেলেও মরতে হবে। না গেলে বিষ খাইয়ে মারবে। জানো না, আমি দারোগার জারজ পেটে ধরেছি?) যে কথা এতোদিন বলি বলি করেও বলতে পারে নি, আজ অসঙ্কোচে বলে ফেললো।

হাসিম খানিক চুপ করে রইলো। তারপর বললোঃ

“জোহরা! তুই আঁর লগে চল।” (জোহরা তুই আমার সঙ্গে চল।)

“কডে?” (কোথায়?) ।

“আঁই কালুরঘাটর মিলত কাম গইরতাম যাইয়ম। কেরামত বাই কাম ঠিক গরি দিব।” (আমি কালুর ঘাটের মিলে কাজ করতে যাবো। কেরামত ভাই কাজ ঠিক করে দেবে।)

“না, হাসিম বাই, কেউর লগে যাইতাম নয়। মরণে আঁরে ডাক দিয়ে। পরের খুশীর লায় মরণের থুন নিজের ইচ্ছায় মরণ বউত ভালা।” (না, হাসিম ভাই, কারো সঙ্গে যাবো না, মরণ আমাকে ডাক দিয়েছে। পরের খুশীর জন্য মরার চাইতে নিজের ইচ্ছায় মরা অনেক ভালো।)

“হুন জোহরা, বেহুদা কথা ন কইস, চল আঁর লগে চল। বাজে খেয়াল ছাড়। আঁই তোরে বিয়া গইরগম।” (শোন, জোহরা বাজে কথা বলিস না। চল আমার সঙ্গে চল, বাজে খেয়াল ছেড়ে দে। আমি তোকে বিয়ে করবো।)।

“না হাসিম বাই, তুই আঁরে বিয়া গরিত পাইরতা নয়।” (না হাসিম ভাই, তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবে না।)

“ক্যা জোহরা, ক্যা, আঁর কি দোষ?” (কেন, জোহরা কেন, আমার কি দোষ?)।

“দোষ তোঁয়ার নয়, দোষ নসিবের, আঁই যে কলঙ্কিনী জারগুয়া বাজানী।” (দোষ তোমার নয়, দোষ কপালের, আমি যে কলঙ্কিনী, জারজ ধারিণী।)

“জোহরা, হুন, কলঙ্ক তোর নয়, কলঙ্ক খল্যার। তুই ক্যা মরিবি? বেকুবের মত কাম ন গরিস। তোর কি দোষ? তুই আঁর লগে চল।” (জোহরা শোন, কলঙ্ক তোর নয়, কলঙ্ক খল্যার। তুই কেন মরবি? বেকুবের মতো তুই কাজ করবি না। তোর কি দোষ? আমার সঙ্গে চল।)

হঠাৎ জোহরা দু’হাত দিয়ে হাসিমকে কাঁকড়ার মতো জড়িয়ে ধরে। ছোট্ট মেয়েটির মতো আবদারের সুরে বলেঃ

“হাঁছা, হাঁছা হাসিম বাই, কুঁই আঁরে নিবা?” (সত্যি, সত্যি হাসিম ভাই, তুমি কি আমাকে নেবে?)

“আয় জোহরা, তোরে লগে লই যাইম আঁই। কাম গইরগম মিলত, তুই আঁরে রাধি-বাড়ি খাওয়াইস।” (হাঁ, জোহরা তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আমি মিলে কাজ করবো, তুই আমাকে বেঁধে বেড়ে খাওয়াবে।) হাসিম তার একখানা হাত জোহরার কাঁধের ওপর রাখে।

“তুই কঁড়ে যাইবা?” (তুমি কখন যাবে?) জিজ্ঞেস করে জোহরা।

“সোমবারে”, হাসিম জবাব দিলো।

“আর তো দুইদিন বাকি, যুদি মারি ফেলে?” (আরও তো দু’দিন বাকী। যদি মেরে ফেলে?)।

“জোহরা, তুই যদি নিজের ইচ্ছায় মরিত পারস নিজের ইচ্ছায় বাঁচিতও পারিবি। কি কস, ন পারিবি?” (জোহরা, যদি তুই নিজের ইচ্ছায় মরতে পারিস, নিজের ইচ্ছায় বাঁচতেও পারবি। কি বলিস, পারবি না?)।

জোহরা কালো চুলের রাশি মুখের সামনে ফেলে দিয়ে সলজ্জভাবে বললোঃ

“হ পাইরগম।” অল্প অল্প জোছনায় তাকে রহস্যময়ীর মতো লাগে। জোছনার তন্তুতে গড়া যেন সমস্ত শরীর। শাড়ীটা কাঁধের থেকে এলিয়ে পড়েছে। আধখোলা ব্লাউজের ফাঁকে এক ফালি জোছনা এসে লেগেছে। বাম স্তনের অর্ধাংশ চক চক করছে। হাসিম দু’হাতে জোহরাকে জড়িয়ে ধরে। জোহরা গভীর আশ্রয়ের নিশ্চিত খুঁটিটিকে আঁকড়ে থাকে। অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ। আসার সময় বললো হাসিমঃ

“খেয়াল রাখিস, সোমবারে মোল্লায় আজান দিবার আগে।”

“আইচ্ছা”, মুচকি হেসে জবাব দিলো জোহরা। পৃথিবীর কারো বিরুদ্ধে যেন তার কোনো নালিশ নেই।

সোমবার দিন সূর্য ওঠার আগেই পথ দিয়েছে দু’জন। কুয়াশা পড়েছে চারদিক। আকাশে শুকতারাটি দপ দপ করছে। ঘরে ঘরে ঝুঁটি দুলিয়ে মোরগগুলো বাঙ দিচ্ছে। হাসিম আর জোহরা বাকা পথটা বেয়ে গ্রামের সীমানা পেরিয়ে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে। হাসিমের বুকের ভেতর কান্নার নদী গর্জাচ্ছে। বরগুইনিরপাড় কতো সহস্র বাঁধনে যে তাকে বেঁধে রেখেছে। কদম বাড়াতে গেলে স্নায়ু-শিরা ছিঁড়ে যেতে চায়। পায়ের তলায় ভেজা ধুলিতে মিশে রয়েছে মায়ের আদর। কতোদিন এ পথ পরম বন্ধুর মতো তাকে সঙ্গ দিয়েছে। গভীর নিশীথে আপন বুকের ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে ছোট্ট বেড়ার ঘরখানিতে সুফিয়ার পায়রার মতো নরম বুকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। পথ– বোবা পথ, ভেজা ধূলোর সুড়সুড়িতে কি যেন কথা কয়। পা চলতে চায় না। বরগুইনির পাড়ের মাটি যেন কথা কয়। সহস্র লোকালয় জড়ানো-পেচানো অনন্ত তৃষ্ণার লকলকে জিহ্বার মতো বরগুইনি, তুমি কতো সুন্দরী, গেরোস্ত ঘরের বউয়ের মতো কতো স্নিগ্ধা, নটিনীর মতো কেমন ক্ষীপ্রস্রোতা! বিদায়, তোমাকে বিদায়! কাজী পুকুরের অতল কালো জল, তোমার বুক যেন অসীম স্নেহের ভাণ্ডার, তোমাকে বিদায়। হে বাপ, ঘুমিয়ে থাকো, হে মা ঘুমিয়ে থাকো, প্রিয়তমা সুফিয়া, তুমি একটিবার পাশ ফেরো ঘুমের ঘোরে; বিদায়, তোমাদের বিদায়। কুয়াশা ঢাকা সবুজ মাঠ, তোমাকে বিদায়। কাজী বাড়ির দাসত্ব, তোমাদের বিদায়। বাপের মা দাদী, তোমাকেও বিদায়।

তারা হেঁটে হেঁটে আধ মাইল পেরিয়ে এলো। বাঁ পাশের বাঁকটা ঘুরলেই চন্দ্ৰকান্তের ঘর। গলার সুর ভেসে আসছে। চন্দ্রকান্ত বোধহয় একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। কিছুদূর এগিয়ে গেলো। হাঁ, চন্দ্রকান্তই গান গাইছে।

“মাটির পিঞ্জরের মাঝে বন্দী হৈয়া রে
কান্দে হাসান রাজার মন মনিয়ারে।
পিঞ্জরের ভিতরে ময়না ছটফট ছটফট করে
মজবুত পিঞ্জর ময়না ভাঙ্গিতে না পারে।”

এবার আর চোখের জল সামলাতে পারলো না। দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর পানি নেমে আসে। সোনার মানুষ চন্দ্রকান্ত, সোনার মতো তোমার মন, বিদায়। শেষ রাতে চন্দ্ৰকান্তের গানের রেশ রেশমের চাঁদরের মতো হিম হিম হাওয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। এবার চন্দ্রকান্ত গান ধরেছে

“দূরদেশী হৈলা বুলি মায়া না ছাড়িও
আমি অভাগিনীর কতা মনেতে রাখিও।”

গ্রামের সীমানা পেরিয়ে এসেছে। পেছন দিকে চেয়ে দেখে গ্রামের গাছপালা, মাটি, ঘরবাড়ি, ঘাস, পশুপক্ষী, মানুষজন সকলে একসূরে যেন চন্দ্ৰকান্তের গান হয়ে মিনতি করছে, “আমি অভাগিনীর কথা মনেতে রাখিও।” নিনাদিত বুকের ওপর হাত রেখে বললো মনে মনে হাসিম, সোনার দেশ, তোমাকে ভুলবো না, সোনার মানুষ চন্দ্রকান্ত, তোমাকে ভুলবো না।

তারা সাতবাড়িয়ার সীমানায় এসেছে। ঐতো সে তিনকানি জমিন, যেখানে দুদু রক্ত দিয়েছে। প্রথম সূর্যের আলোতে সে রক্ত চিচিকিয়ে জ্বলবে। হঠাৎ জোহরা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ঐ জমিনের মতো সেও নিজের শরীরের চরে সকলের দখল মেনে নিয়েছে। একটিবারও কথা কয় নি, প্রতিবাদ করে নি। এই পয়লা নিজের ইচ্ছে মতো একজন পুরুষের সঙ্গে যাচ্ছে। জমিনের কি কোনো দিন চোখ ফুটবে? চিনে নেবে আপন জন। মাটি তেমন প্রাণ পাবে কোনো দিন? মমতা কি ধারালো হবে মাটির?

ওই তো ইস্টেশন। সিগন্যালের লাল আলোটা বাঘের চোখের মতো জ্বলছে। অনেক হারানো দু’জন মানুষ পরম নির্ভরতায় একে অপরের হাতে হাত রাখলো। দুটো হৃদপিণ্ডের ধ্বনি এক হয়ে বাঁশরীর সুস্বরের মতো দিগন্তের কোথায় মিলিয়ে গেলো। ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে হাঁফাচ্ছে। দু’খানা টিকিট কিনে চড়ে বসলো গাড়িতে। গার্ড সবুজ পতাকা দুলিয়ে হুইসেল দিলে ট্রেন চলতে আরম্ভ করলো। জানালা দিয়ে পূব দিকে তাকায়। নীল পাহাড়ের ঘন বনরেখার ললাটদেশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। রাঙিয়ে যাচ্ছে পূবদিক। রাঙিয়ে যাচ্ছে হাসিমের সমস্ত চেতনা। বরগুইনির জলের হৃদয়ে আলোর শান্ত সাহস খেলা করছে। ট্রেন ছুটছে পশ্চিমে ঝিক্‌-ঝিক-ঝি। সূর্যটা লাফিয়ে পশ্চিমে চলেছে যেন যুগ-যুগান্তরের সাথী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *