হাঁটতে ইচ্ছে করছে আমার, খালি পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছে; জুতো খুলে লাল মাটি আর ঘাসের ওপর দিয়ে আমি হাঁটতে থাকি, জুতো জোড়া আর বইতে ইচ্ছে করছে না, রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিই। অনেক বছর আমার পায়ের নিচে ঘাস পড়ে নি, মাটি পড়ে নি, এখন আমার পায়ের নিচে ঘাস, আমার পায়ের নিচে মাটি; আমার ভালো লাগছে। কাঁঠালগাছগুলো সবুজ হতে হতে কালো হয়ে উঠেছে, কলাপাতাটিকে আমার মনে পড়ছে, মৃত্যুর সুন্দর মুখ মনে পড়ছে, সব কিছু ভালো লাগছে। আমি একটি কাঁঠালগাছের নিচে বসি, গাছটিকে ঘিরে সবুজ ছায়া, গাছের ছায়ার বাইরে পানীয়ের মতো সুন্দর রৌদ্রের আগুন। আমি একবার এমন ছায়ায় এমন আগুনে নিজের ভেতর থেকে সুখ বের করেছিলাম, আমি সেই সুখ অনুভব করছি। আমি ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ি, আমার ঘুম পাচ্ছে। একটি হলদে কাঁঠালপাতা ঝরে পড়লো আমার মুখের ওপর, আমি হাতে নিয়ে দেখি পাতাটিকে, রওশনের হাতের তালুর মতো পাতাটি, মেহেদিপরা হাতের মতো। অনন্যার হাত কেমন? আমি এখন কোথায়, কেউ জানে না, আমি জানি না। আমার ঘুম পাচ্ছে, রওশনের মতো ঘুম, অনন্যার মতো ঘুম, কাঁঠালপাতার মতো ঘুম, কলাপাতার মতো ঘুম। আমি ঘুমিয়ে পড়ি, বহুদিন আমি ঘুমোই নি। যখন ঘুম। ভাঙে আমার মনে হয় ভোর হলো, মা এখনি আমাকে ইস্কুলে যাওয়ার জন্যে ডাকাডাকি করবে; কিন্তু এখন ভোর হলো কি না আমি কার কাছে জিজ্ঞেস করবো? ভোর কি হলো, না সন্ধ্যা হচ্ছে। একটু পরেই আমি বুঝতে পারি সন্ধ্যা হচ্ছে, ভোর হচ্ছে না। আমার পায়ে জুতো নেই, আমি কী করে ফিরবো শহরে? বাসে উঠতে ইচ্ছে করছে না, আমার, কিন্তু মনে পড়ছে বাসে করে আসতে আমার ভালো লাগছিলো, মাছের গন্ধ। পাই আমি, আমার বমি আসে। আমি বাসে উঠতে পারবো না। আমি একটি বেবিট্যাক্সি নিই, শহরে এসে একটি জুতোর দোকানে ঢুকি, আমার অফিসে যাই।
আম্মু আজ রাতে ফিরবে না, খাবার টেবিলে অর্চি বলে; আমি অবাক হই অর্চি আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে বলে; তার আম্মু ফিরবে না, তাতে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, জানতেও ইচ্ছে করে না কেনো ফিরবে না, সে বোধ হয় আমার জীবনে আর উদ্দীপকরূপে কাজ করে না।
নানুর বাসায় থাকবে, অর্চি অতিরিক্ত ও প্রয়োজনীয় সংবাদটুকু দেয়।
আমি বলি, তুমি তো আগেই খেয়ে নিতে পারতে।
অর্চি বলে, আজ তোমার সাথে খেতে ইচ্ছে হলো, কতো দিন খাই না।
আমি বলি, কেননা এমন ইচ্ছে হলো তোমার?
অর্চি বলে, আমি স্টেটসে চলে যাবো যে। আমি একটু চমকে উঠি।
আমি বলি, সব কাগজপত্র পেয়ে গেছো?
অর্চি বলে, সব পেয়ে গেছি, আমরা তিন বান্ধবী এক সাথে যাবো।
আমি বলি, কবে যাবে?
অর্চি বলে, মাত্র সাত দিন সময় দিয়েছে, এর মাঝেই সব কিছু শেষ করতে হবে-ভিসা, টিকেট।
আমি বলি, ঠিক আছে, দু-তিন দিনের মধ্যেই করে দেবো।
অর্চি বলে, আমি যাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে আছি।
আমি বলি, কেননা এতো পাগল হয়ে আছো?
অর্চি বলে, দেশে আমার একদম ভালো লাগছে না।
আমি বলি, পড়া শেষ করে দেশে ফিরবে তো?
অর্চি বলে, না, আমি আমেরিকান হতে চাই; সেখানেই থাকতে চাই। আমার বান্ধবীরাও ফিরবে না।
আমি বলি, তোমার আম্মুকে বলেছে?
অর্চি বলে, না, তোমাকেই আগে বললাম।
অর্চি চলে যাবে, আমার একটু কষ্ট লাগছে; ওকে মাঝেমাঝে দেখতে পাই, সাত। দিন পর পাবো না, ওর ঘরে তখন যখন ইচ্ছে যেতে পারবো, ও রেগে উঠবে না, বলবে না, আমাকে ডিস্টার্ব কোরো না। ওর মুখটি আমি মনে করতে পারবো না; শুধু ওর। ঝাঁকড়া চুলগুলোর কথা মনে পড়বে, ওর কণ্ঠস্বর বাজবে, হঠাৎ হয়তো গাড়ির হর্ন শুনে মনে হবে অর্চির কণ্ঠ শুনছি। এ-ঘরে ফিরোজা ছিলো, সে আজ রাতে ফিরবে না, মায়ের কাছে থাকবে; হয়তো নৃতাত্ত্বিকটির সাথে থাকবে, হয়তো সারারাত থাকবে না, নৃতাত্ত্বিকটি তাকে মাঝরাতে নামিয়ে দিয়ে যাবে। ফিরোজা কি এখন নৃতাত্ত্বিকের সাথে শয্যায়? ঘরটি বেশ শূন্য লাগছে, এমন শূন্য আর কখনো লাগে নি। ফিরোজা হয়তো কাল ফিরে আসবে, পরে হয়তো আর ফিরবে না। শূন্যতা থাকবে আমার জন্যে, অসীম শূন্যতা, সহ্য করতে হবে আমাকে। কিন্তু ফিরোজার জন্যে আমার কষ্ট লাগছে না, অর্চির জন্যে লাগছে, অর্চিকে আরেকবার আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার কি। অর্চির ঘরে গিয়ে অর্চিকে দেখে আসবো? অর্চি কি বিরক্ত হবে? অর্চি কি ভাববে আমি কাঁদছি? অর্চি কি আমাকে করুণা করবে? না, অর্চিকে এখন আমি দেখতে যেতে পারি না, অর্চি আমাকে দেখে কষ্ট পাবে।
অনন্যা ফোন করে বলে, জানেন, এখন পর্যন্ত আমার মাথা ঘোরাচ্ছে।
আমি বলি, তোমার বোধ হয় হাই-সিকনেস লি-সিকনেস আর ক্লসট্রোফোবিয়া রয়েছে।
অনন্যা বলে, কোন রোগ যে আমার নেই, তাই ভাবি; আমি বেশি দিন বাঁচবো না। বেশি দিন না বাঁচতে আমার খুব ভালো লাগবে।
আমি বলি, সুন্দরের আয়ু সব সময়ই কম, সকাল থেকে দুপুর।
অনন্যা বলে, আমি তো সুন্দর নই।
আমি বলি, তুমি তা জানো না, তোমার চারপাশ জানে।
অনন্যা বলে, চারপাশ তাহলে অন্ধ।
আমি বলি, গতকাল তুমি কলেজ থেকে বেরোনোর সময় যদি দেখতে আমি গেইটে দাঁড়িয়ে আছি, তোমার কেমন লাগতো?
অনন্যা বলে, আমি একটুখানি পাগল হয়ে যেতাম, একটুখানি পিছলে পড়তাম, একটুখানি অন্ধ হয়ে যেতাম। তবে একটি কথা কী জানেন?
আমি বলি, না তো।
অনন্যা বলে, গতকাল আমার বারবার মনে হচ্ছিলো আপনাকে যদি বোরোনোর সময় দেখতে পাই, যদি আপনাকে বরোনোর সময় দেখতে পাই, আপনাকে কলেজ থেকে বেরোনোর সময় দেখতে পাই যদি!
আমি বলি, এমন মনে হচ্ছিলো কেনো?
অনন্যা বলে, মাঝেমাঝে আমার অসম্ভবকে পেতে আর দেখতে ইচ্ছে করে।
আমি বলি, আমি অসম্ভব নই।
অনন্যা বলে, অসম্ভব ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগে না। যা আমার ভালো লাগে, তাই অসম্ভব; আপনাকে আমার ভালো লাগে, তাই আপনি অসম্ভব।
আমি বলি, খুব ভালো লাগছে শুনতে।
অনন্যা বলে, আমি অসম্ভবকে ঘিরে ঘুরতে ভালোবাসি। গতকাল কলেজ থেকে ফেরার সময় আমি চারবার রিকশা নিয়ে আপনার অফিসের চারদিকে ঘুরেছি, কী যে ভালো লেগেছে।
আমি বলি, আমি তখন সাভারে একটি কাঁঠালগাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে ছিলাম।
অনন্যা বলে, অসম্ভব!
আমি বলি, সত্য।
অনন্যা বলে, তাহলে আপনি বোধ হয় আমার থেকেও বেশি অসম্ভবকে পেতে চান।
আমি বলি, আমি কিছু পেতে চাই না।
অনন্যা বলে, আপনি বোধ হয় অনেক পেয়েছেন।
আমি বলি, তোমার কলেজ কখন শেষ হয়?
অনন্যা বলে, দুটোয়।
আমি বলি, তুমি আজ কলেজের গেইটে এক ক্ষুদ্র অসম্ভবকে দেখতে পাবে।
অনন্যা বলে, আমার সুখের শেষ থাকবে না।
আমি কলেজের গেইটে গিয়ে দাঁড়াই, পাঁচ মিনিটকে আমার পাঁচবার মহাজগত ধ্বংস আর সৃষ্টির সমান দীর্ঘ বলে মনে হয় আমার মুজো ঘেমে ওঠে, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না বলে হয়; একটি ছেলে আমার কাছে দেশলাই চায়,–পাঁচ-সাত বছরেই সে হয়তো একটা দুর্দান্ত মাননীয় মন্ত্রী হবে,-আমি দেশলাই বের করে তার সিগারেট ধরিয়ে দিই, সিগারেট চাইলেও পকেট থেকে সিগারেট বের করে দিতাম। ছেলেটির মুখ থেকে ধুয়ো এসে আমার মুখে লাগে। অনন্যা বেরিয়ে আসছে দেখতে পাই, আমি একটু কেঁপে উঠি, কিন্তু অনন্যা এমনভাবে আসে যেনো সে চারদিকের কিছুই দেখছে না, শুধু আমাকে দেখছে, দেখে দেখে সুস্থ হয়ে উঠছে। আমরা একটু। হাঁটি, হাঁটতে হাঁটতে একটু দাঁড়াই, আমাদের ঘিরে শুধু রিকশা আর বেবিট্যাক্সি জটলা পাকাতে থাকে।
আমরা এখন কী করবো? আমি বলি।
অনন্যা বলে, আপনার কাঁঠালগাছটিকে দেখতে যাবো ভাবছি, কাঁঠালগাছটিকে আমি ভুলতে পারছি না।
আমি বলি, ওটা অসম্ভব কিছু নয়।
অনন্যা বলে, কিন্তু ওর ছায়ায় আমার বসতে ইচ্ছে করছে।
আমি গাড়ি নিই নি, গাড়ি নিয়ে ওর কলেজের গেইটে যেতে আমার খারাপ লাগছিলো, আমি নিঃস্ব হয়ে ওর কলেজের গেইটে যেতে চেয়েছিলাম। আমরা একটি বেবিট্যাক্সি নিই; বহু বছর পর যেনো আমি বেবিতে চড়ছি, গতকালও চড়েছিলাম তা আমার মনে পড়ছে না। অনন্যা আমার পাশে আমি ভাবতে পারছি না, বেবিটাকে আমার ডানামেলা পাখি বলে মনে হয়। ওর শাড়ির একটি পাড় উড়ে এসে আমার নাকে লাগে। অনন্যা ব্যাগ থেকে দুটি গোলাপ বের করে গোলাপ দুটির দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
অনন্যা বলে, গোলাপ দুটি এখন আমি ছুঁড়ে ফেলে দেবো, ফেলতে আমার একটু কষ্ট হবে।
আমি বলি, ছুঁড়ে ফেলে দেবে কেনো? কষ্টই পাবে কেনো?
অনন্যা বলে, উচ্চমাধ্যমিকের একটি ছাত্র প্রতিদিন আমাকে দুটি করে গোলাপ দেয়, বাসায় ফেরার সময় প্রতিদিন ছুঁড়ে ফেলে দিই।
আমি বলি, তাহলে নাও কেনো?
অনন্যা বলে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হয়, না করতে পারি না।
আমি বলি, আপার গভীর প্রেমে পড়েছে বালকটি।
অনন্যা বলে, আমি যখন কলেজে ঢুকি তখন সে দূর থেকে দেখে আমাকে, যখন বেরোই তখন দূর থেকে দেখে আমাকে।
আমি বলি, আজ তাহলে সে বাসায় ফিরে আত্মহত্যা করবে।
অনন্যা বলে, করতে পারে।
আমি বলি, কেমন দেখতে ওই বালক প্রেমিক?
অনন্যা বলে, বয়স বেশি হবে না, কিন্তু বেশ বড়োসড়ো, ওর পাশে আমাকে ওর বান্ধবীই মনে হবে। ক্লাশে আমার দিকে তাকাতে গিয়ে বারবার কেঁপে ওঠে।
আমি বলি, নিষ্পাপ প্রেম!
অনন্যা বলে, কিছুই নিষ্পাপ নয়।
আমি বলি, তুমি কি বোঝো ওই বালক তোমাকে মনে মনে ভোগ করে?
অনন্যা বলে, আমি খুব বুঝি। ঘুমোনোর আগে সে যে আমাকে ভেবে ভেবে। নিজেকে মন্থন করে, তা আমি বুঝি।
আমি বলি, সে হয়তো স্বপ্ন দেখে একদিন তুমি তার কাছে গিয়ে বলছে, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, তাকে জড়িয়ে ধরছো, সে তোমাকে জড়িয়ে ধরছে, দুজন মিলিত হচ্ছে।
অনন্যা বলে, তা আমি জানি। তবে ও-ই শুধু নয়।
আমি বলি, আর কে?
অনন্যা বলে, বুড়ো প্রিন্সিপালটিও। সে নিজেকে জেসাস ক্রাইস্ট মনে করে।
আমি বলি, অধ্যাপনা তো একরকম আত্মোৎসর্গই!
অনন্যা বলে, সে ওসব জানতোই না। আমি তাকে একদিন বলি কাউকে না কাউকে তো কাঁটার মুকুট পরতেই হয়। সে বলে, কী বললেন? আমি আবার বলি কাউকে না কাউকে তো কাটার মুকুট পরতেই হয়। তখন থেকে সে মনে করে আসছে সে-ই কাঁটার মুকুট পরেছে।
আমি বলি, প্রতিটি বদমাশের ভেতরেও একটি করে জেসাস ক্রাইস্ট রয়েছে।
অনন্যা বলে, কিন্তু ওই বুড়ো জেসাস এখন প্রত্যেক দিনই আমাকে ডেকে নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বলে, আমি আর আপনে দুইজনই কাঁটার মুকুট পরছি। সেও স্ত্রীসহবাসের সময় স্বপ্ন দেখে।
কখন যে আমরা ওই কাঁঠালগাছটিকে পেরিয়ে গেছি, খেয়াল করি নি; খেয়াল করলেও আমি চিনতে পারতাম না। আমি এক সময় বেবিঅলাকে থামতে বলি, বেবি থেকে নেমে সবুজ ঘাস আর কাঁঠালবনের দিকে আমরা হাঁটতে থাকি। অনন্যা হাঁটতে থাকে আগে আগে, এটাই আমার ভালো লাগে; মেয়েদের আগে আগে হাঁটতে আমার ভালো লাগে না। আমি হঠাৎ দেখতে পাই অনন্যার স্যান্ডলের নিচে মাটির আর ইটের টুকরো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। একেকটি মাটির টুকরোকে ইটের টুকরোকে আমার। মাণিক্য বলে মনে হচ্ছে। আমি একটি টুকরো হাতে তুলে নিই, হাতে তুলে নেয়ার সাথে সাথে তা আবার মাটিতে পরিণত হয়, আবার ইটে পরিণত হয়; কিন্তু অনন্যা। যেখানেই পা রাখে সেখানেই আমি মাণিক্যের দ্যুতি দেখতে পাই। আমি দুটি টুকরো। আমার বুকপকেটে রাখি।
অনন্যা পেছনে ফিরে জিজ্ঞেস করে, আপনি মাঝেমাঝে কী তুলছেন?
আমি বলি, মাণিক্য।
অনন্যা বলে, দেখি।
আমি টুকরোটি তার হাতে তুলে দিই, সে হেসে উঠে বলে, এ তো মাটির টুকরো।
আমি বলি, একটু আগেই এটি মাণিক্যের টুকরো ছিলো।
অনন্যা অদ্ভুতভাবে হাসে আমার দিকে চেয়ে।
রাস্তার বাঁ পাশেই একটি কাঁটাগাছ দাঁড়িয়ে ছিলো, একটু দূর থেকে আমি ওর। কাঁটাগুলো দেখেছি, একটিও পাতা নেই, কাঁটাতারের মতো কাঁটায় আবৃত গাছটি; এখন অনন্যার শাড়ির আঁচল উড়ে গিয়ে ওই কাটার ওপর পড়েছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। সেখানে লাল লাল ফুল ফুটে উঠছে। আমি হাত বাড়িয়ে ফুল কুড়োতে যাই।
অনন্যা চিৎকার করে ওঠে, করছেন কী, করছেন কী, কাঁটায় আপনার হাত ছিঁড়ে যাবে।
আমি বলি, কাটা কোথায়, লাল লাল ফুল।
অনন্যা বলে, গাছে নয়, অন্য কোথাও।
আমরা একটি কাঁঠালগাছের ছায়ায় বসি; সবুজ রত্নের মতো ছায়া ঝরে পড়ছে। অনন্যার মুখে, আমার চুলে, অনন্যার শাড়িতে, আমার মুঠোতে। অনন্যা স্যান্ডল খুলে পা দুটি একটু সামনের দিকে বাড়িয়ে বসেছে, গম্বুজের মতো হাঁটুর ওপর রেখেছে হাত দুটি, আমি তার পাঁচটি সোনালি আঙুল দেখতে পাচ্ছি। তার আঙুল থেকে কী ঝরছে? জ্যোৎস্না? এখন রাত হলে ঘাসের ওপর আলো পড়তো, আলো দেখা যেতো; এখন আলো দেখা যাচ্ছে না, তবে আলোতে ঘাসগুলো আরো সবুজ হয়ে উঠছে। অনন্যার পায়ের পাতার নিচের ঘাসগুলো সোনালি হয়ে উঠছে মনে হচ্ছে, এমন সোনালি ঘাস আমি কখনো দেখি নি; আমি একবার হাত বাড়িয়ে তার পায়ের নিচ থেকে একগুচ্ছ ঘাস। তুলে আনি।
অনন্যা চমকে পা সরিয়ে নিয়ে বলে, কী করছেন, কী করছেন?
আমি বলি, ঘাসগুলো সোনালি হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছিলো।
অনন্যা বলে, আপনি কি মাঝেমাঝে হেলুসিনেশন দেখেন?
আমি বলি, আগে কখনো দেখি নি।
অনন্যা বলে, কখন থেকে দেখছেন?
আমি বলি, আজ থেকে, সম্ভবত আজ থেকে।
অনন্যা হেসে বলে, আমার সাথে দেখা হলে প্রত্যেকেরই একটি নতুন রোগ দেখা দেয়, আমার খুব কষ্ট লাগে।
আমি বলি, আমার রোগ দেখা দেয় নি।
অনন্যা বলে, তাহলে কী?
আমি বলি, আমার রোগ সেরে যাচ্ছে।
আমি অনন্যার বা পায়ের পাতাটি আমার ডান হাতের সবগুলো আঙুল দিয়ে স্পর্শ করি; অনন্যা বলে, এ কী করছেন; কিন্তু আমি তার পায়ের পাতায় আঙুল বোলাতে থাকি। আমি একটি কবুতরের পিঠে হাত রেখেছি মনে হয় আমার; আমি তার মুখের দিকে তাকানোর সাহস করি নি, আমি জানি না সে কীভাবে তখন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে ছিলো, তার পায়ে চুমো খাওয়ার সাধ হয় আমার, আমি তার পায়ের পাতায় চুমো খাই; তার দিকে তাকাই। আমি দেখি সে চোখ খুলে ঘুমিয়ে আছে।
অনন্যা বলে, আমার কাছে মৃত্যুর মতো সুখকর মনে হলো।
আমি বলি, আমার কাছে জন্মলাভের মতো।
অনন্যা হেসে বলে, আমার ইচ্ছে হচ্ছে কাঁঠালগাছটিকে একটি বর দিই, কিন্তু বর দেয়ার শক্তি আমাদের নেই।
আমি বলি, তুমি শুধু একবার গাছটিকে ছুঁয়ে যেয়ো, তাহলে এটি চিরকাল বেঁচে থাকবে।
অনন্যা হাসতে থাকে, আমি দেখি গাছটি আরো সবুজ হয়ে উঠছে।
দু-তিনটি লোক আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেলো; খুব শান্ত নিরীহ গ্রামের মানুষ, মাছ ধরে বা খেত চষে ফিরছে।
অনন্যা বলে, এই লোকগুলো কী ভাবছে জানেন?
আমি বলি, ওরা বোধ হয় ভাবতে জানে না।
অনন্যা বলে, খুব জানে; ওরা ভাবছে আপনাকে খুন করে আমাকে যদি জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া যেতো!
সন্ধ্যায় আমাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে অনন্যা চলে যায়। আমিই নামিয়ে দিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে উল্টোপথে ফিরতে হবে, তাই সে রাজি হয় নি। আমাকেই সে নামিয়ে দিয়ে যায়। দালানটিকে আমার একটি দশতলা মাণিক্যের খণ্ড মনে হয়। একবার অর্চিকে মনে পড়ে। আমার ঘরে গিয়ে টেবিলে একটি কাগজের। টুকরো পাই;–স্যার, আপনার জন্যে বসে থেকে থেকে ছটায় বাসায় যাচ্ছি, আপনার জন্যে কেমন লাগছে,-আমার সহকারিণী মেয়েটি বোধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, পড়ে মায়া লাগলো ওর জন্যে। ওকে কি টেলিফোন করে জানাবো আমি ফিরেছি? থাক, ওর আরেকটুকু কেমন লাগুক, কেমন লাগার সময়ের মতো সুখের সময় আর হয় না; ও। আরেকটুকু সময় সুখে থাকুক। কাগজের টুকরোটি আমি ড্রয়ারে রেখে দিই। ফিরে। গিয়ে অনন্যার টেলিফোন করার কথা। অর্চিকে কি একবার টেলিফোন করবো? থাক। এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে।
টেলিফোনে অনন্যা নয়, দেবী কথা বলছেন, আপনাকে দুপুর থেকে খুঁজছি, টেলিফোন করে করে পাগল হয়ে যাচ্ছি।
আমি বলি, হারিয়ে গিয়েছিলাম।
দেবী বলেন, কিন্তু আপনাকে আমার ভীষণ দরকার, এখনি দরকার; ধার চাই না, এখনি আপনাকে চাই।
আমি বলি, কোনো দুর্ঘটনা?
দেবী বলেন, অনেকের জন্যে।
কিন্তু অনন্যার টেলিফোন? আমি তার স্বর শুনতে চাই, তার স্বর দেখতে চাই, আরেকটুকু সেরে উঠতে চাই। টেলিফোন করে আমাকে না পেলে সে কি ভয় পাবে না? সে তো সব কিছুতেই ভয় পায়। ভাববে না আমি লিফটে আটকে গেছি, আমার লিফট, উঠছে আর নামছে, আমি চিৎকার করছি; কেউ শুনতে পাচ্ছে না? আমি বেরিয়ে পড়ি, দেবী আমাকে ডেকেছেন, ধার চাইছেন না, অনেকের জন্যে দুর্ঘটনা, আমি বেরিয়ে পড়ি। দেবীর বাসায় গিয়ে আমি অবাক হই। সরাসরি আমাকে তার শয্যাকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়, আগে যা কখনো হয় নি। দেবী ভয়ঙ্কর সাজে সেজেছেন, মনেই হচ্ছে না তাঁর বয়স আটচল্লিশ, তাঁকে তনী দেবীই মনে হচ্ছে। তার পাশে এক স্বাস্থ্যবান যুবক বসে আছে। দেবী আমাকে দেখে দেবীর মতো হাসেন।
এ হচ্ছে শমশেদ মোল্লা, দেবী যুবকটির সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, জমশেদ মোল্লা সাহেবের পুত্র; আজ আমরা বিয়ে করছি।
জমশেদ মোল্লা সাহেব কোথায়? একটু চমকে একটু দুঃখ পেয়ে একটু বিবেচকের মতো আমি বলি।
তিনি সিঙ্গাপুর আছেন, দেবী বলেন, তাঁকে দরকার নেই। আপনাকে ডেকেছি আপনি সাক্ষী হবেন।
জমশেদ মোল্লা সাহেব, আমি বলি, ফিরে এসে গোলমাল করবেন না তো?
শমশেদ মোল্লা বলে, বাবারে আমি তাইলে ছিডুড়া ফালামু না? ভয় পাইয়েন না, বাবায় আমারে যমের মতন ডরায়।
যুবক খুবই বলিষ্ঠ, পিতার থেকেও, আমার সামনেই দেবীকে জড়িয়ে ধরে, দেবীর হাড় ভাঙার শব্দ যেনো আমি শুনতে পাই; দেবী তার বাহুর ভেতরে প্রজাপতির মতো পড়ে থাকে। কোনো ডানা ভেঙে গেছে কি না আমি বুঝতে পারি না; কিন্তু আমার অত্যন্ত সুন্দর লাগে ওই দৃশ্য। আবর্জনার ওপর চন্দ্রমল্লিকা পড়ে আছে দেখতে আমার। খুব ভালো লাগে। দেবীকে সে বাহু থেকে মুক্তি দেয় না, দেবী তার বাহুর ভেতর ভাঙতে থাকে; শমশেদ মোল্লা দেবীর গালে একটি কামড় দেয়ার চেষ্টা করে। কামড়টি দিতে। পারলে দেবীর গাল থেকে একশো গ্রাম মাংস উঠে আসতো। শমশেদ মোল্লা খুব উত্তেজিত, আজ রাতেই দেবীকে পাঁচ-সাতবার গর্ভবতী করে ছাড়বে।
এখন ছাড়ো, দেবী বলেন, অনেক সময় পাবে কামড় দেয়ার।
শমশেদ মোল্লা দেবীকে মুক্তি দেয়; দেবী আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, শমশেদ একটু জংলি, ওর জংলামোই আমার ভালো লাগে। দেখতে ইচ্ছে হয় গণ্ডারের নিচে কেমন লাগে।
শদশেদ মোল্লা বলে, তোমারে আইজও আমি পুরা পাই নাই। আইজ রাইতেই পাইতে চাই।
দেবী বলেন, পাইবা।
অর্চি আজ চলে যাচ্ছে, আমি অফিসে যাই নি, যেতে ইচ্ছে করে নি; ওকে বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না, ওর ঘরে যেতে আমার সাহস হচ্ছে না, দেখে যদি আমার খুব কষ্ট লাগে, যদি ওর খুব কষ্ট লাগে। ও একবার আমাকে দেখে অবাক হয়েছে, বলেছে, তুমি অফিসে যাও নি? আমি বলেছি, আজ যাবো না; ও বলেছে, আলু, অফিসে যাও, বাসায় থাকলে তুমি কাঁদবে। আমি কাঁদি নি, অনেক বছর কাদি নি; কিন্তু ফিরোজা মাঝেমাঝে কাঁদছে।
অর্চি বলছে, আম্মু, তোমার কান্না দেখে আমার হাসি পাচ্ছে।
ফিরোজা বলছে, তোমার কান্না দেখেও একদিন কেউ হাসবে।
অর্চি কোমল হয়ে বলছে, আম্মু, কেঁদো না, আমার সাথে চলল।
ফিরোজা বলছে, যাবো।
ফিরোজা আরো কাঁদছে, অর্চিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আমি ঈর্ষা করছি। ফিরোজাকে, কেঁদে সে সুখী হয়ে উঠছে, আমি সুখী হতে পারছি না। ফিরোজা আর আমি কথা বলছি না, আমাদের কথা বলার কিছু নেই; অর্চি চলে যাচ্ছে তাতে কষ্ট আমাদের ব্যক্তিগত, ফিরোজারটা ফিরোজার আমারটা আমার, দুঃখটা আমাদের মিলিত নয়। আমরা অনেক দূরে সরে গেছি, দুঃখেও আমরা এক হতেপারছি না। ফিরোজা আর সবই স্বাভাবিকভাবে করছে, অর্চি আর আমাকে খাওয়াচ্ছে, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে, তার কান্নাভরা মুখটিকে আমার সুখের মুখ মনে হচ্ছে। বিকেলে অর্চির প্লেন, আমরা অনেকেই এসেছি, আমার অফিসের সবাই এসেছে, অর্চির নানুবাড়ির সবাই এসেছে, চাচারা এসেছে। অর্চি চলে যাওয়ার সময় আমি শুধু একটি চুমো খেলাম ওর গালে, জড়িয়ে ধরতে পারলাম না, অর্চি হেঁটে হেঁটে বান্ধবীদের সাথে বিমানে গিয়ে। উঠলো। অর্চির বিমান আমার চোখ ছিদ্র করে আমার শেষ দীর্ঘনিশ্বাসের মতো পশ্চিম আকাশের দিকে উড়ে মেঘে মিলিয়ে গেলো। অর্চি কি এখন ভয় পাচ্ছে? অর্চির কি এখন ফিরে আসতে ইচ্ছে করছে? আমি একবার অন্ধকার দেখি।
আমি গাড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম ফিরোজা আসবে মনে করে। আমি আজো এমন মনে করি? অন্যরা আমার কাছে আসছে না, বুঝতে পারছি তারা সাহস পাচ্ছে না, তারা আমার বেদনাটুকু আমাকেই অনুভব করতে দিচ্ছে, সবাই ফিরোজাকে ঘিরে আছে; সে কাঁদছে, তাকে জড়িয়ে ধরে আছে কেউ কেউ। ফিরোজা খুব সুখী। আমার সহকারিণী মেয়েটি একবার এসে দাঁড়িয়েছিলো, কিছু বলতে পারে নি। আমার একটু শূন্য মনে হচ্ছে নিজেকে। সবাই যদি আমাকে ঘিরে দাঁড়াতো, আমি কেঁদে ফেলতাম, তারা আমাকে জড়িয়ে ধরতো, আমি হাল্কা হয়ে উঠতাম; কিন্তু আমাকে ঘিরে কেউ দাঁড়াচ্ছে না, জড়িয়ে ধরছে না। আমি বোধ হয় ফিরোজার জন্যে অপেক্ষা করে আছি। আমি কি গাড়িতে উঠে চলে যাবো? আমি চলে যাচ্ছি না; আমি বোধ হয় ফিরোজার জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
তুমি যাও, আমি তোমার সাথে যাবো না, ফিরোজা বলে।
আজই, না কি কখনো যাবে না? আমি বলি।
তা পরে দেখা যাবে, ফিরোজা বলে।
আমি গাড়িতে উঠি, কিন্তু আমি কোথায় যাবো? গাড়ি চলতে শুরু করেছে, ড্রাইভার যখন শহরে ঢুকে জানতে চাইবে কোথায় যাবো, আমি কী বলবো? তাকে আমি কোথায় যেতে বলবো? আমার একটু পান করতে ইচ্ছে করছে, আমি পান করবো না, মনে হবে। আমি কাতর হয়ে পড়েছি, কাতর আমাকে দেখতে আমি পছন্দ করি না। পান করলে আমি খুব সৎ হয়ে উঠি, সরল হয়ে উঠি, নিজেকে খুলে ফেলি, আমি পান করবো না। শহরে ঢুকে আমি ড্রাইভারকে ছেড়ে দিই, হাঁটতে থাকি। সন্ধ্যা বেশ গভীরভাবে নেমেছে, সন্ধ্যা কি এভাবেই নামে সব সময়, না কি আজ অন্যভাবে নেমেছে। প্রতিটি আলোর রেখাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। কোথায় যেতে পারি আমি এখন? অর্চির কি কষ্ট লাগছে? অর্চির কি ফিরে আসতে ইচ্ছে করছে। অর্চির মুখটি কেমন? অর্চি কতো বড়ো? ওর চুল কি ঝাঁকড়া, ঢেউখেলা, পিঠের ওপর ছড়ানো? ও কি কোনো দিন ফিরে আসবে? ফিরোজা কি আজ নৃতাত্ত্বিকটির সাথে থাকবে অনন্যা এখন কী করছে? তাকে প্রতিদিন দুটি গোলাপ দেয় তার এক ছাত্র। আমি একটি পানশালায় ঢুকে পড়ি; একটু পান করি। পান করতে আমার ইচ্ছে করছে না, চারপাশের সবাই খুব কষ্টে আছে। আমি কারো « মুখ দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু মনে হচ্ছে তারা খুব কষ্টে আছে, আমার থেকে অনেক কষ্টে আছে। একটি লোক বারবার কেঁদে উঠছে। তার কি মেয়ে মারা গেছে, একমাত্র মেয়ে? একটি কবি এসেছে বোধ হয় পানশালায়, সে বারবার সবার পা ধরে মাফ চাচ্ছে, তাকে ক্রুশবিদ্ধ করার জন্যে আবেদন জানাচ্ছে, কেউ তাকে ক্রুশবিদ্ধ করছে না বলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি কি তাকে ক্রুশবিদ্ধ করার ভারটি নেবো? তার কোনো ভক্ত নেই, যে ওই কাজটি করতে পারে? লোকটিকে আমার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, সে কততগুলো পচা পদ্য লিখেছে আমি জানি না, তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আমি বেরিয়ে পড়ি। একটি রিকশা নিই আমি, রিকশাটি অনন্যাদের বাড়ির রাস্তায় এসে উপস্থিত হয়, রিকশাটি বোধ হয় অনন্যার ঠিকানা জানে, অনন্যার গন্ধ শুকে শুকে এখানে এসে। গেছে। আমি রিকশা থেকে নেমে পড়ি। এখানেই তাকে নামিয়ে দিয়েছিলাম আমি? আমি রাস্তার এক কোণে দাঁড়াই, আমার একটু সুখ লাগছে, তাহলে এখানেই কোথাও অনন্যা থাকে, আমি দাঁড়িয়ে থাকি। মানুষের মুখগুলো আমার অদ্ভুত লাগতে থাকে। শহর কি দেবতায় ভরে গেছে, দেবীতে ভরে গেছে? সবাইকে আমার দেবতা আর দেবী মনে হচ্ছে। একটি লোক আমাকে সালাম দেয়, তাকে আমি চিনতে পারি না; লোকটি অবাক হয়ে সরে পড়ে। আমি রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে হাঁটতে থাকি। আমি। দেখতে পাই অনন্যা হাতের ঘড়ি দেখতে দেখতে একটি রিকশায় চলে গেলো, আমি তাকে ডাকতে চেষ্টা করি, আমার গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না।
কখন বাসায় ফিরেছি আমি জানি না, কাজের মেয়েটি দরোজা খুলে দিয়ে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। আমি আমার ঘরে গিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিই। শুধু টেলিফোন বাজছে, টেলিফোন বাজছে, পৃথিবীতে আর কিছু নেই টেলিফোনের শব্দ। ছাড়া, আমি কোনো টেলিফোন ধরছি না, পৃথিবীর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। আমি একটি বোতল বের করি, পান করতে থাকি। অর্চি কি কষ্ট পাচ্ছে তার কি ফিরে আসতে ইচ্ছে করছে? তার কি প্লেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে? আমার। ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে, মনে হচ্ছে আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছি, আমাকে ঘিরে আছে। অন্ধকার আকাশ। আমি নদীর পর নদী দেখতে পাচ্ছি, নদীর ওপর আমার ব্রিজগুলো দেখতে পাচ্ছি, মেঘবতী, যমুনা, করতোয়া, ফুলঝরি, ফুলমতি, সুরমা, একটির পর একটি ব্রিজ ধসে পড়ছে, ধসে পড়ার দৃশ্য আমার কাছে সুন্দর লাগছে। ফিরোজা কি এখন নৃতাত্ত্বিকটির বিছানায়? ফিরোজার বা স্তনটি লাফিয়ে উঠছে আমার চোখের সামনে, সেটিতে দুটি বড়ো বড়ো তিল আছে, আমার কামড়ের দাগ হয়তো মুছে গেছে। যতোই বয়স বাড়ছে ততোই সুন্দর হচ্ছে ওর স্তনযুগল। অনন্যা কী করছে, ঘুমোচ্ছে? তার ছাত্রটি? কতোগুলো গোলাপ সে ফেলেছে এ-পর্যন্ত? অনন্যা কি কখনো ঘুমিয়েছে কারো সাথে? তার ছাত্রটির সাথে? স্যার, আপনার জন্যে বসে থেকে থেকে ছটায় বাসায় যাচ্ছি, আপনার জন্যে কেমন লাগছে; লাগুক। আমি কি একবার ফোন করবো আমার সহকারিণীটিকে? অনন্যাকে না, আমি কাউকে ফোন করবো না। কলাপাতাটি কি বেঁচে আছে, মাহমুদা রহমান উদ্ধার পেয়েছেন? এখন হিন্দি ছবির যে-মেয়েটি নাচছে, তার বগলের লোমগুলো আমার ভালো লাগছে, ওর বগলের লোমে কে কে কে কে কে জিভ রাখে? অনন্যার বগলে কি লোম আছে? অনন্যা কি শেভ করে? বাঙালি। মেয়েগুলো শেভ করে, ওরা কোথায় শিখেছে কে জানে, বিচ্ছিরি লাগে; হয়তো অনন্যাও শেভ করে। মাহমুদা রহমান করত, দেবী করতো, ফিরোজাও করতো। আমাদের। কাজের মেয়েটিও বোধ হয় করে। নইলে আমার ফেলে দেয়া ব্লেডগুলো পাই না কেনো? আবদুর রহমান সাহেব কি এখনো সেই কাজের মেয়েটিকে নিয়েই থাকেন? না কি বদল করেছেন? বউ মারা যাওয়ার পর তিনি আরো ভালো আছেন; বছর বছর কাজের মেয়ে বদলাচ্ছে। তিনি আর বিয়ে করবেন না, প্রিয়তমা স্ত্রীর শোক ভুলতে পারছেন না, কাজের মেয়ে বদলাচ্ছেন, কাজের মেয়ে বদলাচ্ছেন।