[৭]
হরিদ্বার যেতে হয় ডুন এক্সপ্রেসে। লখ্নৌ থেকে সন্ধ্যায় গাড়ি ছাড়ে, আর হরিদ্বার পৌঁছায় সাড়ে চারটায়।
লখ্নৌ আসার আগে যখন হরিদ্বার যাবার কথা হয় তখন আমার খুব মজা লেগেছিল। কারণ পুরী ছাড়া আমি কোনও তীর্থস্থান দেখিনি। কিন্তু লখ্নৌতে এসে আংটির ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায় আর সে রহস্যের এখনও কোনও সমাধান না হওয়ায়, আমার এখন আর লখ্নৌ ছেড়ে যেতে খুব বেশি ইচ্ছা করছিল না।
কিন্তু ফেলুদার দেখলাম উৎসাহের কোনও অভাব নেই। ও বলল, হরিদ্বার, হৃষীকেশ আর লছমনঝুলা—এই তিনটে জায়গা পর পর দেখতে দেখবি কেমন ইন্টারেস্টিং লাগে। কারণ তিন জায়গার গঙ্গা দেখবি তিন রকম। যত উত্তরে যাবি তত দেখবি নদীর ফোর্স বেড়ে যাচ্ছে। আর ফাইন্যালি লছমনঝুলায় গিয়ে দেখবি একেবারে উত্তাল পাহাড়ে নদী। তোড়ের শব্দে প্রায় কথাই শোনা যায় না।’
আমি বললাম, ‘তোমার এ সব দেখা আছে বুঝি?’
‘সেই যেবার ক্রিকেট খেলতে লখ্নৌ এলাম, সেবারই দেখা সেরে গেছি।’
ধীরুকাকা অবিশ্যি আমাদের সঙ্গে যেতে পারলেন না, তবে উনি নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের সকলকে স্টেশনে নিয়ে এলেন। কামরাতে মালপত্র রাখতে না রাখতে আরেকজন ভদ্রলোক এসে পড়লেন, তিনি হচ্ছেন ডঃ শ্রীবাস্তব। আমি ভাবলাম উনিও বুঝি ধীরুকাকার মতো ‘সি-অফ’ করতে এসেছেন, কিন্তু তারপর দেখলাম কুলির মাথা থেকে স্যুটকেস নামাচ্ছেন। আমাদের সকলেরই অবাক ভাব দেখে শ্রীবাস্তব হেসে বললেন, ‘ধীরুবাবুকে বলিয়েছিলাম যেন আপনাদের না বোলেন। উনি জানতেন আমি যাব আপনাদের সঙ্গে। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বোলেন তো!’
বাবা দেখলাম খুশি হয়েই বললেন, ‘খুব ভালই হল। আমি ভাবতে পারিনি আপনি আসতে পারবেন, তা না হলে আমি নিজেই আপনাকে বলতাম।’
শ্রীবাস্তব বেঞ্চির একটা কোণ ঝেড়ে সেখানে বসে বললেন, ‘সত্যি জানেন কী—কদিন বড় ওয়ারিড আছি। আমাকে বাইরে থেকে দেখলে বুঝতে পারবেন না। পিয়ারিলালের দেওয়া জিনিসটা এইভাবে গেল—ভাবলে বড় খারাপ লাগে। শহর ছেড়ে দুদিনের জন্য আপনাদের সঙ্গে ঘুরে আসতে পারলে খানিকটা শান্তি পাব।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে বনবিহারীবাবুও এসে পড়লেন। তাঁর মালপত্তর যেন একজনের পক্ষে একটু বেশিই মনে হল। ভদ্রলোক হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন, ‘এইবার রগড় দেখবেন। পবিত্ৰানন্দস্বামী চলেছেন এ-গাড়িতে। তাঁর ভক্তরা তাঁকে বিদায় দিতে আসছেন। ভক্তির বহরটা দেখবেন এবার।’
সত্যিই, কিছুক্ষণ পরে অনেক লোকজন ফুলের মালাটালা নিয়ে একজন মোটামতো গেরুয়াপরা লম্বা চুলওয়ালা সন্ন্যাসী এসে আমাদের পাশের ফার্স্টক্লাস গাড়িটায় উঠলেন। ওঁর সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন গেরুয়াপরা লোক উঠল—আর কিছু গেরুয়াপরা, আর অনেক এমনি পোশাক পরা লোক কামরার সামনে ভিড় করে দাঁড়াল। বুঝলাম এরাই সব ভক্তের দল।
গাড়ি ছাড়তে আর পাঁচ মিনিট দেরি, তাই আমরা সব উঠে পড়েছি, ধীরুকাকা কেবল জানালার বাইরে থেকে বাবার সঙ্গে কথা বলছেন, এমন সময় একজন গেরুয়াপরা লোক হঠাৎ ধীরুকাকার দিকে হাসিহাসি মুখ করে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল।
‘ধীরেন না? চিনতে পারছ?’
ধীরুকাকা কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো চেয়ে থেকে, হঠাৎ—‘অম্বিকা নাকি?’—বলে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন।
‘বাপ্রে বাপ!—তোমার আবার এ-পোশাক কী হে?’
‘কেন, এ তো প্রায় সাত বছর হতে চলল।’
ধীরুকাকা তখন ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অম্বিকা হল আমার স্কুলের সহপাঠী। প্রায় পনেরো বছর পরে দেখা ওর সঙ্গে।’
গার্ড হুইস্ল দিয়েছে। ঘ্যাঁ—চ্ করে গাড়ি ছাড়ার শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই শুনতে পেলাম অম্বিকাবাবু ধীরুকাকাকে বলছেন, ‘আরে, সেদিন বিকেলে তোমার বাড়ি গিয়ে প্রায় আধঘণ্টা বসে রইলাম। তুমি ছিলে না। তোমার বেয়ারা তোমাকে সে কথা বলেনি?’
ধীরুকাকা কী উত্তর দিলেন সেটা আর শোনা গেল না, কারণ গাড়ি তখন ছেড়ে দিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে প্রথমে ফেলুদা, আর তারপর বাবার দিকে চাইলাম। ফেলুদার কপালে দারুণ ভ্রূকুটি।
বাবা বললেন, ‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ।’
বনবিহারীবাবু বললেন, ‘ওই ভদ্রলোককেই কি আপনারা আংটিচোর বলে সাসপেক্ট করছিলেন?’
বাবা বললেন, ‘সে-প্রশ্ন অবিশ্যি আর ওঠে না। কিন্তু আংটিটা তা হলে গেল কোথায়? কে নিল?’
ট্রেনটা ঘটাং ঘটাং করে লখ্নৌ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে বেরোল। স্টেশনের মাথার গম্বুজগুলো ভারী সুন্দর দেখতে, কিন্তু এখন আর ও সব যেন চোখেই পড়ছিল না। মাথার মধ্যে সব যেন কীরকম গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। ফেলুদা নিশ্চয়ই মনে মনে খুব অপ্রস্তুত বোধ করছে। ও-তো সেই সন্ন্যাসীর খোঁজ নিতে নিতে একেবারে লখ্নৌ স্টেশন অবধি পৌঁছে গিয়েছিল।
কিন্তু তা হলে স্টেশনের সেই অ্যাটাচি-কেসওয়ালা সন্ন্যাসী কে? আজকে যাকে দেখলাম সে তো আর ছদ্মবেশধারী সন্ন্যাসী নয়—একেবারে সত্যিকার সন্ন্যাসী। সে কি তা হলে আরেকজন লোক? আর সেও কি ধীরুকাকার বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল? আর সেটার কারণ কি ওই আংটি, না অন্য কিছু? আর ফেলুদার গায়ে ‘খুব হুঁশিয়ার’ লেখা কাগজ কে ছুঁড়ে মেরেছিল—আর কেন?
ফেলুদার মাথাতে কি এখন এই সব প্রশ্নই ঘুরছে—না সে অন্য কিছু ভাবছে?
ওর দিকে চেয়ে দেখি ও সেই গ্রিক অক্ষরে হিজিবিজি লেখা খাতাটা বার করে খুব মন দিয়ে পড়ছে—আর মাঝে মাঝে কলম দিয়ে আরও কী সব জানি লিখছে।
বনবিহারীবাবু হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসলেন: ‘আচ্ছা, ডক্টর শ্রীবাস্তব—পিয়ারিলাল মারা যাবার আগে আপনিই বোধহয় শেষ তাঁকে দেখেছিলেন, তাই না?’
শ্রীবাস্তব একটা থলি থেকে কমলালেবু বার করে সকলকে একটা একটা করে দিতে দিতে বললেন, ‘আমি ছিলাম, ওনার বিধবা বোন ছিলেন, ওনার বেয়ারা ছিল, আর অন্য একটি চাকরও ছিল।’
বনবিহারীবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘হুঁ। ..ওঁর অ্যাটাকটা হবার পর আপনাকে খবর দিয়ে আনানো হয়?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আপনি কি হার্টের চিকিৎসাও করেন?’
‘হাড়ের চিকিৎসা করলে হার্টের যে করা যায় না এমন তো নয় বনবিহারীবাবু! আর ওঁর ডাক্তার গ্ৰেহ্যাম শহরে ছিলেন না, তাই আমাকে ডেকেছিলেন।’
‘কে ডেকেছিল?’
‘ওঁর বেয়ারা।’
‘বেয়ারা?’ বনবিহারীবাবু ভ্রূ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ। প্রীতম সিং। অনেক দিনের লোক। খুব বুদ্ধিমান, বিশ্বস্ত, কাজের লোক।’
বনবিহারীবাবু মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে কমলালেবুর একটা কোয়া মুখে পুরে দিয়ে বললেন, ‘আপনি বলেছেন পিয়ারিলাল আংটিটা দিয়েছেন প্রথম অ্যাটাকের পর। আর দ্বিতীয় অ্যাটাকের পর আপনাকে ডাকা হয়, আর সেই অ্যাটাকেই তাঁর মৃত্যু হয়।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আংটিটা দেবার সময় ঘরে কেউ ছিল কি?’
‘তা কী করে থাকবে বনবিহারীবাবু? এ সব কাজ কি আর বাইরের লোকের সামনে কেউ করে? বিশেষ করে পিয়ারিলাল কী রকম লোক ছিলেন তা তো আপনি জানেন। ঢাক বাজিয়ে নোব্ল কাজ করার লোক তিনি একেবারেই ছিলেন না। ওনার কত সিক্রেট চ্যারিটি আছে তা জানেন? লাখ লাখ টাকা হাসপাতালে অনাথাশ্রমে দান করেছেন, অথচ কোনও কাগজে তার বিষয়ে কখনও কিছু বেরোয়নি।’
‘হুঁ।’
শ্রীবাস্তব বনবিহারীবাবুর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি কি আমার কথা অবিশ্বাস করছেন?’
বনবিহারীবাবু বললেন, ‘আসলে ব্যাপারটা কী জানেন—এই আংটি দেওয়ার ঘটনার অন্তত একজন সাক্ষী রাখলে আপনি বুদ্ধিমানের কাজ করতেন। এমন একটা মূল্যবান জিনিস হাত বদল হল—অথচ কেউ জানতে পারল না।’
শ্রীবাস্তব একটুক্ষণ গম্ভীর থেকে হঠাৎ হো হো করে হেসে বললেন, ‘বাঃ বনবিহারীবাবু, বাঃ! আমি পিয়ারিলালের আংটি চুরি করলাম, আমিই ধীরেনবাবুর কাছে সেটা রাখলাম, আবার আমিই সেটা ধীরেনবাবুর বাড়ি থেকে চুরি করলাম? ওয়ান্ডারফুল!’
বনবিহারীবাবু তাঁর মুখের ভাব একটুও না বদলিয়ে বললেন, ‘আপনি বুদ্ধিমানের কাজই করেছেন। আমি হলেও তাই করতাম। কারণ আপনার বাড়িতে ডাকাত পড়াতে আপনি সত্যিই ভয় পেয়েছিলেন, তাই আংটিটা ধীরুবাবুর কাছে রাখতে দিয়েছিলেন। তারপর ধীরুবাবু আলমারি থেকে সরিয়ে সেটা আবার নিজের কাছে রেখে ভাবছেন এইবার ডাকাতের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। কী বলো, ফেলু মাস্টার? আমার গোয়েন্দাগিরিটা কি নেহাত উড়িয়ে দেবার মতো?’
ফেলুদা তার খাতা বন্ধ করে কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ‘ডাক্তার শ্রীবাস্তব যে মহাবীরকে প্রায় দুরারোগ্য ব্যারাম থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন, তার কি কোনও সাক্ষীর অভাব আছে?’
বনবিহারীবাবু বললেন, ‘না তা হয়তো নেই।’
ফেলুদা বলল, ‘আমি বিশ্বাস করি, আংটির দাম যত লাখ টাকাই হোক না কেন, একটি ছেলের জীবনের মূল্যের চেয়ে তার মূল্য বেশি নয়। শ্রীবাস্তব যদি আংটি চুরি করে থাকেন, তা হলে তাঁর অপরাধ নিশ্চয় আছে, কিন্তু এখন যারা ওঁর আংটির পিছনে লেগেছে, তাদের অপরাধ আরও অনেক বেশি, কারণ তারা একেবারে খাঁটি চোর এবং খুব ডেঞ্জারাস জাতের চোর।’
‘বুঝেছি।’ বনবিহারীবাবুর গলার স্বর গম্ভীর। ‘তা হলে তুমি বিশ্বাস করো না যে শ্রীবাস্তবের কাছেই এখনও আংটিটা আছে।’
‘না। করি না। আমার কাছে তার প্রমাণ আছে।’
কামরার সকলেই চুপ। আমি অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে চাইলাম। বনবিহারীবাবু কিছুক্ষণ ফেলুদার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ‘কী প্রমাণ আছে তা জিজ্ঞেস করতে পারি কি?’
‘জিজ্ঞেস নিশ্চয়ই করতে পারেন, কিন্তু উত্তর এখন পাবেন না—তার সময় এখনও আসেনি।’
আমি ফেলুদাকে এরকম জোরের সঙ্গে কথা বলতে এর আগে কখনও শুনিনি।
বনবিহারীবাবু আবার ঠাট্টার সুরে বললেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে সে উত্তর পাব তো?’
ফেলুদা বলল, ‘আশা তো করছি। একটা স্পাই-এর রহস্য আছে—সেটা সমাধান হলেই পাবেন।’
‘স্পাই?’ বনবিহারীবাবু অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে চাইলেন। ‘কী স্পাই?’
শ্রীবাস্তব বললেন, ‘ফেলুবাবু বোধহয় পিয়ারিলালের লাস্ট ওয়ার্ডস-এর কথা বলছেন। মারা যাবার আগে দুবার ‘স্পাই’ কথাটা বলেছিলেন।’
বনবিহারীবাবুর ভ্রূকুটি আরও বেড়ে গেল। বললেন, ‘আশ্চর্য! লখ্নৌ শহরে স্পাই?’
তারপর কিছুক্ষণ পাইপটা হাতে নিয়ে চুপ করে কামরার মেঝের দিকে চেয়ে বললেন ‘হতে পারে…হতে পারে…আমার একবার একটা সন্দেহ হয়েছিল বটে।’
‘কী সন্দেহ?’—শ্রীবাস্তব জিজ্ঞেস করলেন।
‘নাঃ। কিচ্ছু না।…আই মে বি রং।’
বুঝলাম বনবিহারীবাবু আর ও বিষয় কিছু বলতে চান না। আর এমনিতেই হরদোই স্টেশন এসে পড়াতে কথা বন্ধই হয়ে গেল।
‘একটু চা হলে মন্দ হয় না’—বলে ফেলুদা প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ল। আমিও নামলাম, কারণ ট্রেন স্টেশনে থামলে গাড়ির ভিতর বসে থাকতে আমার ইচ্ছে করে না।
আমরা নামতেই আরেকজন গেরুয়াপরা দাড়িওয়ালা লোক কোত্থেকে জানি এসে আমাদের গাড়িতে উঠে পড়ল। বনবিহারীবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘কামরা রিজার্ভড্—জায়গা নেই, জায়গা নেই।’
তাতে গেরুয়াধারী ইংরিজিতে বলল, ‘বেরিলি পর্যন্ত যেতে দিন দয়া করে। তারপর আমি অন্য গাড়িতে চলে যাব। রাত্রে আপনাদের বিরক্ত করব না।’
অগত্যা বনবিহারীবাবু তাকে উঠতে দিলেন।
ফেলুদা বলল, ‘সন্ন্যাসীদের জ্বালায় দেখছি আর পারা গেল না। এই চা-ওয়ালা!’
চা-ওয়ালা দৌড়ে এগিয়ে এল।
‘তুই খাবি?’
‘কেন খাব না?’
অন্যদের জিজ্ঞেস করাতে ওঁরা বললেন যে খাবেন না।
গরম চায়ের ভাঁড় কোনও রকমে এ-হাত ও-হাত করতে করতে ফেলুদাকে বললাম, ‘শ্রীবাস্তব চোর হলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।’
ফেলুদা ওই সাংঘাতিক গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘কেন?’
‘কারণ ওঁকে আমার বেশ ভাল লাগে—আর মনে হয় খুব ভালমানুষ।’
‘বোকচন্দর—তুই যে ডিটেকটিভ বই পড়িসনি। পড়লে জানতে পারতিস যে যে-লোকটাকে সবচেয়ে নিরীহ বলে মনে হয়, সে-ই শেষ পর্যন্ত অপরাধী প্রমাণ হয়।’
‘এ ঘটনা তো আর ডিটেকটিভ বই-এর ঘটনা নয়।’
‘তাতে কী হল? বাস্তব জীবনের ঘটনা থেকেই তো লেখকরা আইডিয়া পান।’
আমার ভারী রাগ হল। বললাম, ‘তা হলে শ্রীবাস্তব যখন প্রথম দিন আমাদের বাড়িতে বসে গল্প করছিলেন, তখন বাইরে থেকে কে ওঁকে ওয়াচ করছিল, আর চারমিনার খাচ্ছিল?’
‘সে হয়তো ডাকাতের দলের লোক।’
‘তা হলে তুমি বলছ শ্রীবাস্তবও খারাপ লোক, আর ডাকাতরাও খারাপ লোক? তা হলে তো সকলেই খারাপ লোক—কারণ গণেশ গুহ বলছিল বনবিহারীবাবুও লোক ভাল নয়।’
ফেলুদা উত্তরের বদলে চায়ের ভাঁড়ে একটা বড় রকম চুমুক দিতেই কোখেকে জানি একটা দলা পাকানো কাগজ ঠাঁই করে এসে ওর কপালে লেগে রিবাউন্ড করে একেবারে ভাঁড়ের মধ্যে পড়ল।
এক ছোবলে কাগজটা ভাঁড় থেকে তুলে নিয়ে ফেলুদা প্ল্যাটফর্মের ভিড়ের দিকে চাইতেই গার্ডের হুইসি্ল শোনা গেল। এখন আর কারুর সন্ধানে ছোটাছুটি করার কোনও উপায় নেই।
কম্পার্টমেন্টে ওঠার আগে কাগজটা খুলে একবার নিজে দেখে তারপর আমাকে দেখিয়ে ফেলুদা সেটাকে আবার দলা পাকিয়ে প্ল্যাটফর্মের পাশ দিয়ে একেবারে ট্রেনের চাকার ধারে ফেলে দিল।
কাগজে লেখা ছিল ‘খুব হুঁশিয়ার’—আর দেখে বুঝলাম এবারও পানের রস দিয়েই লেখা।
বাদশাহী আংটির রহস্যজনক আর রোমাঞ্চকর ব্যাপারটা আমরা মোটেই লখ্নৌ শহরে ছেড়ে আসিনি। সেটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে।