স্ফিংস
‘আচ্ছা, বলো দেখি, সেটা কী যেটা ভোরবেলায় চারপেয়ে, দুপুরে দু-পেয়ে আর সন্ধেবেলায় তিনপেয়ে?’
এ শহরে শীত বলে কিছু নেই যেন। ঠান্ডাটা এই জানুয়ারি মাসেই অনেক কমে গেছে। তার সঙ্গে সেই চ্যাটচ্যাটে ঘামটাও ফিরেছে। সন্ধের দিকটায় তবু একটু হাওয়া দিচ্ছিল। আমরা তিনজনে বেনুদার দোকানে বসে ছিলাম। পিজি গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে কী সব হাবিজাবি জ্ঞান দিচ্ছিল। হঠাৎই ভবেশদা ধাঁধাটা জিজ্ঞাসা করলেন আমাদের।
আমি বললাম,
‘ধাঁধা? কী ব্যাপার? আগের দিন কীসের গল্প বলবেন বলেছিলেন সেটা মনে আছে তো?’
‘মনে আছে রে বাবা। তাই তো ধাঁধাটা জিজ্ঞাসা করলাম। তোমরা এর উত্তর ভাবতে থাকো। আমি ততক্ষণে সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরোনো একটা গল্প বলি, শোনো।
‘গ্রীষ্মকালের একটা দিন, খুফুর পিরামিড তৈরির হাজার বছর পরের কথা। রাজকুমার চতুর্থ তুতমোসিস গিজার মরুভূমিতে হরিণ শিকার করতে বেরিয়েছিলেন। দুপুরের দিকে মাথার ওপরের গনগনে সূর্য থেকে বাঁচতে একটা বড়ো পাথরের আড়ালে গিয়ে বসলেন। একটু পরেই ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে এল।
‘আচমকা তুতমোসিসের সামনে এসে দাঁড়ালেন দেবতা হোরাস! হোরাস তুতমোসিসকে বললেন বালির মধ্যে ডুবে থাকা তাঁরর মূর্তিটাকে বাঁচাতে। তাহলেই নাকি তুতমোসিস হবেন ভবিষ্যতের ফারাও!
‘ধড়ফড় করে উঠে বসলেন তুতমোসিস। স্বপ্ন দেখছিলেন এতক্ষণ ধরে! কিন্তু ফারাও কী করে হবেন তিনি? বাবা আমেনহোটেপের চতুর্থ সন্তান তিনি। প্রথম সন্তানেরই তো ফারাও হওয়ার কথা। যাই হোক, যে পাথরের ছায়ায় তুতমোসিস এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলেন এবারে সেটাকে ভালো করে দেখলেন। একটা মাথার আদল মনে হচ্ছে না?
‘বেশ কয়েক মাস ধরে শ্রমিকদের সাহায্যে পাথরের চারপাশের বালি সরানো সম্ভব হল। যেটা বেরিয়ে এল সেটা দেখে তুতমোসিস অবাক হয়ে গেলেন! তাঁরর সামনে বসে আছে একটা বিশাল সিংহ! তার মুখটা মানুষের। তুতমোসিস মূর্তিটার একটা ভাঙা পা সারালেন। লাল, নীল আর আর হলুদ রংও করালেন মূর্তিটার। তারপরে বসে থাকা সিংহটার দু-পায়ের মাঝখানে একটা শিলা বসালেন, যাতে লেখা হল তুতমোসিসের স্বপ্নের কথা। এখানেই এই ভগবানের নাম দেওয়া হল হোর-এম-আখেত, যার মানে হল দিগন্তের হোরাস। অবাক কাণ্ড এই যে, বাকি তিন ভাইকে টপকে তুতমোসিস ফারাও হয়ে গেলেন! ফারাও তুতমোসিসই পৃথিবীর প্রথম আর্কিয়োলজিস্ট। তুতমোসিসের বসানো সেই শিলার নাম এখন ড্রিম স্টেলা।’
অতীতের আলোকচিত্রে স্ফিংস
অ্যাসটেরিক্স কমিকসে স্ফিংসের নাক ভাঙার কাল্পনিক কাহিনি
পিজি এবারে বলল,
‘বুঝেছি। আর ওই বিশাল মূর্তিটাই হল স্ফিংস। কিন্তু স্ফিংসটা বানাল কে?’
লাক্সরের মন্দিরের বাইরে অ্যাভেনিউ অফ স্ফিংস
‘এ নিয়ে অনেক ধন্দ আছে, বুঝলে। স্ফিংসের বয়স ঠিক কত সেটা কেউ জানে না। স্ফিংস কে, কেন বানিয়েছিলেন সেটা কোথাও লেখা নেই। অনেকে ভাবে খুফুর সন্তান খাফরে, যিনি গিজার দ্বিতীয় পিরামিড বানিয়েছিলেন, তিনিই বানিয়েছিলেন স্ফিংসকে। স্ফিংসের মুখটা খাফরেরই। কেউ কেউ আবার বলে, না খাফরে না, স্ফিংস বানিয়েছিলেন খাফরের আরেক ভাই দেজাফ্রে। আবার অনেকে বলে, স্ফিংস খুফুর পিরামিডেরও আগের। তবে ইজিপ্ট দেশটা জুড়ে কিন্তু আরও অনেক স্ফিংস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কোনো মন্দির বা ফারাওয়ের সমাধির বাইরে স্ফিংসের মূর্তি রাখার চল ছিল। মিশরীয়রা ভাবত স্ফিংসই সেই মন্দিরকে পাহারা দেবে। লাক্সর আর কার্নাকের দুটো মন্দিরের মাঝের রাস্তার দু-ধারে রাখা ছিল হাজারেরও ওপরের স্ফিংস। এতগুলো একইরকম মূর্তি থাকলেও গিজার স্ফিংস বিখ্যাত ওর আকারের জন্য। লম্বায় তিয়াত্তর মিটার, উচ্চতায় কুিড় মিটার।’
আমি এবারে বললাম,
‘আচ্ছা, স্ফিংসের মুখটা এরকম ভাঙা কেন?’
‘সেটারও একটা গল্প আছে, বুঝলে। ১৩৭৮ সাল, মিশরে তখন ইসলাম ধর্ম একটু একটু করে ঢুকছে। স্থানীয় মানুষ সেই সময় স্ফিংসের পুজো করত। ওরা ভাবত এই স্ফিংসের জন্যই নীল নদে বন্যা আসে, যার জন্য নদীর দু-পাশের জমি উর্বর হয়। গিজাতে শেখ-সাইম-আল-দার নামের একজন সুফি ছিল। ইসলামে তো মূর্তিপুজোর চল নেই। এই সুফি একদিন রেগে-মেগে একটা ছেনি বাটালি নিয়ে স্ফিংসের ওপরে চড়াও হয়। ভেঙে দেয় স্ফিংসের নাকটা। তারপরে নাকি হোরাসের অভিশাপে চারপাশের গ্রামগুলো বালিতে ঢেকে যায়। গ্রামবাসীরা তখন সেই সুফিকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। স্ফিংসের ভাঙা নাকের টুকরোগুলো খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও থুতনির কাছে লেগে থাকা একটা লম্বা দাড়ি পাওয়া গিয়েছিল। সেই দাড়ির টুকরোটা এখন আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।’
‘আমাদের কলকাতা মিউজিয়ামেই তো স্ফিংস রাখা আছে, তাই না?’
‘হ্যাঁ, আছে তো। মমির ঘরটাতে ঢোকার মুখেই রাখা আছে একটা পাথরের মাঝারি স্ফিংস। তবে মিউজিয়াম ছাড়াও কলকাতার আরেকটা জায়গাতে স্ফিংস রাখা আছে, একটা নয় আবার, একজোড়া। কোথায় বলো তো? হালের ইকো পার্কের স্ফিংসটা বাদ দিয়ে বলো।’
‘কলকাতাতে আরও দুটো স্ফিংস? কোথায়? জানি না তো!’
মিউজিয়ােম রাখা স্ফিংসের দািড়
‘শুনলে অবাক হবে, রাজভবনের ছোটো গেটের ওপরে। ছ-ফুট মতন লম্বা। টেরাকোটার ওপরে চুনের প্রলেপ দিয়ে বানানো। তার মধ্যে একটা ২০০৯ সালের আয়লাতে ভেঙে যায়। এগুলো কেন বানানো হয়েছিল কেউ জানে না। আরও অবাক করা একটা জিনিস তোমাদেরকে বলি। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ১৯১৫ সালে কাঠের ওপরে আঁকা একটা কালী ঠাকুরের ছবি আছে। এই কলকাতা থেকেই গিয়েছিল সেই ছবি। ছবিতে ঠাকুরের মাথার ওপরের যে চালা থাকে তার দু-পাশে দুটো স্ফিংস আঁকা আছে!’
‘বলেন কী! মা কালীর ছবিতেও স্ফিংস!’
কলকাতা রাজভবনের গেটের উপরে স্ফিংস
‘ইতিহাস বড়ো অদ্ভুত, স্পন্দন ভাই। এই স্ফিংসগুলোর এই কলকাতায় বসে থাকার কোনো কারণ আমি জানি না।’
পিজি এবারে বলল,
‘ভবেশদা, আমি শুনেছিলাম স্ফিংসের ভেতরে নাকি লুকোনো ঘর আছে। এটা কি সত্যি?’
কালী ঠাকুেরর ছবিতে স্ফিংস
‘কিছুটা সত্যি, বুঝলে। ১৯৮৭ সালে টোকিয়োর ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি থেকে একটা টিম এসে স্ফিংসের শরীরের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পরীক্ষা করে। ১৯৯১ সালে জন ওয়েস্ট নামের এক বিজ্ঞানী আবার স্ফিংসের পরীক্ষা করেন সিসমিক রিফ্র্যাকশন দিয়ে। দু-বারেই যে তথ্য সামনে আসে তাতে চমকে যায় সবাই! স্ফিংসের শরীরের মধ্যে দুটো ফাঁপা জায়গার আভাস পাওয়া গেছে। ওর দু-পায়ের মাঝেও মাটির নীচে দুটো ঘর আছে নাকি। কিন্তু সেগুলো খুঁড়ে দেখার পারমিশন কাউকে এখনও দেওয়া হয়নি।’
‘কেন?’
স্ফিংসের নীচের গুপ্তঘর
‘কারণ স্ফিংসের অবস্থা এখন বেশ খারাপ। কায়রো শহরের পলিউশনে মূর্তিটার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। প্রায় ২০০০ পাথরের টুকরো ছ-বছর ধরে জোড়া লাগানো হয়েছে। এখন স্ফিংসের বাঁ-কাধের রেস্টোরেশন চলছে। সংরক্ষণের সব কাজ শেষ হলে হয়তো মাটির নীচের ঘরগুলোর খোঁজ শুরু করা যাবে। ততদিন স্ফিংস নিজের রহস্য নিজের কাছেই রেখে দেবে।’
আমি এবারে বললাম,
‘আপনি বললেন স্ফিংসের উল্লেখ মিশরের কোনো প্রাচীন লেখাতেই নেই। আর এখন স্ফিংসের মুখটাও তো ভাঙা। তাহলে আসলে এটাকে কেমন দেখতে ছিল সেটা কেউ জানতেই পারবে না কোনোদিন?’
‘ভালো প্রশ্ন করেছ, স্পন্দন ভায়া। তোমাদের তাহলে একটা পাগলা লোকের গল্প বলি। আমেরিকান ইজিপ্টোলজিস্ট মার্ক লেনার। এই লোকটার গোটা জীবনের একটাই লক্ষ্য, সেটা হিল স্ফিংসের সংরক্ষণ। একসময় মার্ক লেনার বছরের পর বছর কাটিয়েছেন ইজিপ্টে। গিজার ধু-ধু মরভূমিতে স্ফিংসের দু-পায়ের মাঝখানে তাঁরবু বানিয়ে থেকেছেন একটানা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে মূর্তিটার মাথা থেকে পা অবধি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছেন। স্টিরিয়োস্কোপিক ক্যামেরা দিয়ে প্রতিটা অ্যাঙ্গল থেকে স্ফিংসের অজস্র ছবি তুলেছিলেন লেনার। পরে তিনি এই ছবিগুলো দেন আমেরিকান আর্কিটেক্ট টমাস জ্যাগারসকে। জ্যাগারস এবারে ছবিগুলোর হেল্প নিয়ে কম্পিউটারে স্ফিংসের থ্রি-ডাইমেনশনাল একটা ছবি বানিয়ে ফেলেন! যে যে জায়গাগুলো ক্ষয়ে গেছে সেখানগুলোও ভরে ফেলেন। বাকি থাকল শুধু মুখটা। লেনার এবারে জ্যাগারসকে স্ফিংসের আশেপাশের সময়কার প্রায় সব ফারাওদের মুখের ছবি দেন। অবাক করার ব্যাপার হল এই যে, সবার মুখের মধ্যে শুধু ফারাও খাপরের মুখটাই স্ফিংসের সঙ্গে একদম মিলে গেছে। এখন তোমরা একটু গুগল করলেই স্ফিংসের এই রিকনস্ট্রাকটেড ছবিটা দেখতে পাবে।’
থ্রিডি রিকনস্ট্রাকশনের পর ও বর্তমানে স্ফিংস
একটানা এতটা বলে ভবেশদা একটু থামল। তারপরে প্লাস্টিকের জগ থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে বলল,
‘উফফ, অনেক বকাও তোমরা আমাকে। স্ফিংসের গল্প তো শুনলে। এবারে বলো তো এই নামটার মানে কী?’
‘নামের মানে? সেভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি।’
‘স্ফিংস শব্দটা কিন্তু ইজিপশিয়ান নয়, গ্রিক। গ্রিকদের সঙ্গে ইজিপশিয়ানদের ব্যাবসা-বাণিজ্যের খাতিরে বেশ ভালো যোগাযোগ ছিল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই ওরা ইজিপ্টে ওই অদ্ভুত জীবের মূর্তি দেখে এসেছিল। তারপরে কখন যে স্ফিংস গ্রিক মাইথোলজির একটা অংশ হয়ে গেল সেটা কেউ জানে না।’
‘বলেন কী! গ্রিক মাইথোলজিতেও স্ফিংস!’
ইডিপাস আর স্ফিংস
‘হ্যাঁ, ঠিকই শুনছ। গ্রিক পুরাণে স্ফিংস হল একটা রাক্ষস, যার শরীরটা একটা সিংহীর, মুখটা মেয়ের, তার একজোড়া ইগলের ডানা আছে, লেজটা আবার সরীসৃপের। এই স্ফিংস নাকি থেবস নামের এক শহরকে পাহারা দেয়। শহরে যে-ই ঢুকতে যায় তাকেই স্ফিংস একটা ধাঁধা জিজ্ঞাসা করে। তার উত্তর দিতে না পারলেই স্ফিংস সেই লোকটার গলা টিপে মেরে ফেলে তাকে খেয়ে নেয়। গ্রিক শব্দ স্ফিংগো থেকে স্ফিংস শব্দটা এসেছে। স্ফিংগো মানে নিংড়ে নেওয়া।’
‘তাহলে স্ফিংসের ধাঁধার উত্তর কেউ দিতে পেরেছিল?’
‘পেরেছিল তো। ইডিপাসের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্সের নাম শুনেছি।’
‘ঠিক, এই ইডিপাস ছিলেন একজন গ্রিক বীর। ওঁর গল্প তোমাদের অন্য কোনো একসময় বলব না হয়। যাই হোক, ইডিপাস যখন থেবস শহরে ঢুকতে যান তখন স্ফিংস ওঁকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞাসা করে। ইডিপাসই প্রথম যিনি ওর উত্তরটা পেরে যান। এর পরেই পাহাড়ের চুড়ো থেকে লাফিয়ে স্ফিংস আত্মহত্যা করে।’
পিজি এবারে বলল,
‘হুম, এই ইডিপাস ভদ্রলোক দেখছি বেশ স্মার্ট ছিলেন। তা ধাঁধাটা কী ছিল?’
ভবেশদা এর উত্তর না দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগলেন। এবারে সব কিছু পরিষ্কার হল আমার কাছে!
‘বুঝেছি, বুঝেছি! আপনার প্রথমে বলা ধাঁধাটাই স্ফিংস ইডিপাসকে জিজ্ঞাসা করেছিল! সেটা কী যেটা ভোরবেলায় চারপেয়ে, দুপুরে দু-পেয়ে আর সন্ধেবেলায় তিনপেয়ে?’
‘ঠিক, এবারে বলো দেখি উত্তরটা।’
আমরা এবারে একে অন্যের মুখের দিকে চাইলাম, পিজি বলল,
‘আপনার গল্পটা শুনতে শুনতেই ভাবছিলাম উত্তরটা। কিন্তু কিছুই মাথায় আসছে না তো।’
‘হুম, তাহলে তো তোমরা স্ফিংসের খাদ্য হতে!’
‘আপনি জানেন নাকি উত্তরটা?’
‘জানি তো।’
‘কী?!’
ভবেশদা এবারে আমাদের দু-জনের খুব কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল,
‘মানুষ!!’