৭ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ১৯৭১
বিকেলবেলা পাগলা বাবার ভেতরের ঘরে খুব মন খারাপ করে বসেছিলাম। আমার চারপাশ ঘিরে বসে ছিল লালু, মা, ঝিনু, শিমুল, ওদের মা, মোশফেকা মাহমুদ, তার মা, মাহমুদা হক, নাজমা মজিদ এবং আরো অনেকে। পাগলা বাবা পাশের ঘরে পুরুষদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি সবাইকে আজাদের মায়ের কাহিনী বলছিলাম। শুনে প্রায় সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। খানিক পরে শিমুলের একটা কথায় ভয়ানক চমকে গেলাম। গত তিনদিন থেকে নাকি আলতাফ মাহমুদ আর বদিকে রাতে রমনা থানায় আনছে না। ওদের তাহলে কি হল? আমি শিমুলকে জিগ্যেস করলাম, কার কাছে শুনলে এ কথা?
চুলু ভাইয়ের ভাবীর কাছে।
চুল্পর ভাবী ইশরাতও পাগলা বাবার কাছে আসে। তার কাছ থেকে আমরা মাঝে মাঝে রমনা থানার ছিটেফোঁটা জানতে পারি। চলুর ভাইয়ের সঙ্গে এক ডি.আই.জি. সাহেবের বেশ ভালো জানাশোনা আছে। তার মারফত রমনা থানার বন্দীদের কিছু কিছু খবর চুলুর ভাই-ভাবী পান।
ঝিনু অঝোরে কাঁদছে। আমার মা তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আমি হুম হয়ে বসে ভাবতে লাগলাম রমনা থানায় না আনার অর্থ কি? শরীফ, জামীরা যখন আলতাফ মাহমুদকে দেখে তখনই তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তবে কি আলতাফ মাহমুদ মরে গেছেন? নাকি ওরা গুলি করে শেষ করে দিয়েছে? বদিরও কি তাই হয়েছে? জামী ফিরে এসে বলেছিল বদি নাকি ভয়ানক উতলা হয়ে থাকত। খালি বলত, আমি আর বাচতে চাই না। আমি আত্মহত্যা করব। একবার সে ঘরের পাগপয়েন্টে আঙুল ঢুকিয়ে ইলেকট্রিক শক খেয়ে মরতে চেয়েছিল। আরেকবার হঠাৎ দৌড় দিয়েছিল এই আশায় যে দৌড়োতে দেখলেই খানসেনারা ওকে গুলি করবে। কিন্তু খানসেনারা খুব সেয়ানা। ওরাবুঝে গিয়েছিল চারধারে এত পাহারার মাঝখানে খালি হাতে দৌড় দেয়ার কি অর্থ। গুলি না করে কয়েকজন খানসেনা তিনদিক থেকে এগিয়ে এসে ওকে ধরে ফেলে।
রুমীকে কখনই রমনা থানায় আনে নি কেন? আনলে তবু তো ছিটেফোটা কিছু খবরও পেতাম। কোথায় রেখেছে তাকে, কিভাবে রেখেছে–ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে মাথা ঘুরে যায়। কি করব আমি? কেউ কোন খবর বের করতে পারছেনা। পাগলা বাবা আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন শিগগিরই তিনি রুমীর খবর বের করে আনবেন। কিন্তু কবে?
পাগলা বাবা ভেতরের ঘরে এলে আমরা তাকে আলতাফ মাহমুদের কথা জিগ্যেস করলাম। ঝিনু কেঁপে তার পায়ের ওপর পড়ল। ঝিনুর মা কাঁদতে লাগলেন। আমরা সবাই নিজের নিজের হারানো প্রিয়জনের কথা মনে করে কাঁদতে লাগলাম। পাগলা বাবা ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, তোরা কোথা থেকে কি সব ভুল
ভাল আবোল-তাবোল কথা শুনে মাতম করিস! আমি বলছি আলতাফ সহি-সালামতে আছে। শিগগিরই তার খবর পাবি। বাকিরাও সবাই ভালো আছে। তোরা সবাই খবর পাবি ঠিক সময়ে। আমি তো চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রাণপণে।