০৭.
সুবিনয়ের সঙ্গে যদি কখনও আমার কোনও শলাপরামর্শ থাকে তবে আমরা সাধারণত সাউথ এন্ড পার্কের ফ্ল্যাটবাড়িতে দেখা করি। কোম্পানির লিজ নেওয়া বিশাল ফ্ল্যাটবাড়ি। চারখানা মস্ত শোওয়ার ঘর, একটা বসবার, একটা খাওয়ার আর একটা পড়াশুনো করবার ঘরও আছে, তিনটে বাথরুম, গ্যাস লাইনের ব্যবস্থাসহ রান্নাঘর, টেলিফোন-কী নেই? এত ভাল বাসা ছেড়ে সুবিনয় বোকার মতো তার প্রিন্স গোলাম হোসেন শাহ রোডের পৈতৃক বাড়িতে পড়ে আছে। কোম্পানির দেওয়া এ বাসার খবর তার বাড়ির কেউ জানেও না।
বাইরের ঘরে সোফায় বসে মস্ত লম্বা দুটো ঠ্যাং সামনে ছড়িয়ে প্রায় চিতপাত অবস্থায় শুয়ে সুবিনয় আমার কাছ থেকে সব শুনল। একমনে সিগারেট খাচ্ছিল কেবল, কিছু শুনছে বলে মনে হচ্ছিল না। কিন্তু আমার কথা শেষ হতেই একটা ঝাঁকি মেরে উঠে বসল। তার পরনে কেবলমাত্র একটা আন্ডারওয়্যার আর স্যান্ডো গেঞ্জি। উঠে বসতেই তার শরীরের সব সহজাত মাংসপেশিগুলো টনটনে হয়ে উঠল। দুটো চোখে আলপিনের ডগার মতো সরু এবং তীক্ষ দৃষ্টি, ভ্রু কোঁচকানো। দশাসই বিশাল চেহারাটায় একটা উগ্র রাগ ডিনামাইটের মতো অপেক্ষা করছে।
বলল, তুই তো এর আগেও কত বার প্রীতিকে আমার চিঠি দিয়ে এসেছিস, কোনওবার এমন কথা বলেছে?
না।
তবে আজ বলল কেন? ঠিক কীভাবে বলল হুবহু দেখা তো! ঠাট্টা-ইয়ার্কি করেছে নাকি?
না, ঠাট্টা নয়। খুব সিরিয়াস।
ঠিক আছে, সে আমি বুঝব। তুই দেখা তো।
বহুকাল বাদে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে আমি রুমার দরজা খোলা থেকে শুরু করেছিলাম। রুমা দরজা খুলে খুব অবহেলার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কী খবর?
সুবিনয় বলল, আঃ, প্রীতিরটা দেখা না।
আমি একটু আহত হই মনে মনে। তারপর প্রীতির কথাবার্তা হাবভাব দেখাতে থাকি। তার ‘বেচারা’ বলার তিন রকম নিখুঁতভাবে অভিনয় করলাম। চিঠি ছিঁড়ে ফেলার ভঙ্গিটাও চমৎকার হল।
কিন্তু অত দেখল না সুবিনয়। বেরসিকের মতো অভিনয়ের মাঝখানে উঠে গিয়ে খোলা জানালার ধারে দাঁড়াল। স্যান্ডো গেঞ্জি আর মাত্র আন্ডারওয়্যার পরা অবস্থায় খোলা জানালায় দাঁড়ানো কতটা বিপজ্জনক তা ভেবে দেখবার মতো স্থিরবুদ্ধি ওর এখন আর নেই। জানালা থেকেই মুখ ফিরিয়ে অত্যন্ত গমগমে বিকট গলায় আমাকে বলল, প্রীতি তোকে মিথ্যে কথা বলেছে, তা জানিস? ম্যাসাচুসেটসে ও আমাকে বারবার উত্ত্যক্ত করত, বিয়ে করার কথা বলত। ওর কয়েকটা চিঠিতেও ছিল সে সব কথা, দেশে ফিরে আমাদের বিয়ে হবে। কিন্তু চিঠিগুলো…
আমি প্রায় নিঃশব্দে বললাম, আমার কাছে আছে।
আছে?– সুবিনয় গর্জে ওঠে।
ভয় খেয়ে বলি, আছে বোধহয়। তবে?
বলে বুনো মোষের মতো ঘরের মাঝখান অবধি তেড়ে এল সুবিনয়, সিলিং-ছোয়া বিকট দানবীয় চেহারাটা ধক ধক করছে রাগে। আবার বলল, তবে?
আমি খুব সংযত গলায় বললাম, সুবিনয়, ছেড়ে দে না। তোর তো ক্ষণা আছেই। আবার কেন হাঙ্গামায় জড়াবি?
সুবিনয় হঠাৎ অট্টহাসি হাসল। মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, পৃথিবীতে কোনও জিনিয়াস কখনও একটামাত্র মেয়েমানুষ নিয়ে থাকতে পারে না। দে নিড গার্লস এ লট অব গার্লস। বুঝলি? এক সময়ে গ্রিক ফিলজফাররা রক্ষিতাদের বাড়িতে বা বেশ্যাপাড়ায় বসে শাস্ত্রের আলোচনা করত।
মিনমিন করে বললাম, প্রীতি যখন চাইছে না তখন ছেড়ে দে।
ডোন্ট টক লাইক এ ফুল।
ভয় পাই, তবু বলি, ক্ষণাকে কেন ডিভোর্স করবি? ও তো কোনও অন্যায় করেনি!
সুবিনয় গর্জে ওঠে ফের, অন্যায় করেনি তো কী? ওকে নিয়েই আমাকে থাকতে হবে এমন কোনও কথা আছে? যা তো, দুনিয়ার সব বিবাহিত পুরুষমানুষকে জিজ্ঞেস করে আয়, তাদের মধ্যে নাইনটি পার্সেন্ট তাদের একজিস্টিং ওয়াইফকে ছেড়ে নতুন কোনও মেয়েকে বিয়ে করতে চায় কি না! যদি না চায় তো আমি কান কেটে কুত্তার গলায় ঝোলাব।
মরিয়া হয়ে বললাম, প্রীতির একজন আছে, বললাম তো। সেও বাগড়া দেবে।
সুবিনয় সোজা এসে আমার কলারটা চেপে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, বাগড়া দেবে! বাগড়া দেবে! উইল হি লিভ আপ টু দেন?
সামান্যই ঝাঁকুনি, কিন্তু সুবিনয়ের আসুরিক শক্তির দুটো নাড়া খেয়েই আমার দম বেরিয়ে গেল। একটা মানুষের শারীরিক শক্তি যে কী প্রবল হতে পারে তা সেই ঝাঁকুনিতে টের পেলাম। যদি প্রীতির সেই ছেলে বন্ধুর সঙ্গে সুবিনয়ের বাস্তবিকই কোনও শো-ডাউন হয় তো আমি নিদ্বিধায় সুবিনয়ের দিকেই বাজি ধরব।
সুবিনয় আমাকে ছেড়ে দিয়ে ফের সোফায় চিতপাত হয়ে বসল। সিগারেট ধরিয়ে ছাদের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, উপল, আই ওয়ান্ট দ্যাট চ্যাপ ফেস টু ফেস।
আমি মৃদু স্বরে বললাম, ছেলেটার দোষ কী? ও কি তোর সঙ্গে প্রীতির অ্যাফেয়ার জানে?
তা হলেও, আমি ওকে একবার হাতে পেতে চাই। প্রীতির চোখের সামনে আমি ওকে গুড়ো করে ফেলব।
সকালবেলায় পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা যে অন্যমনস্ক লম্বা, ভদ্র বৈজ্ঞানিককে রাস্তার লোকেরা হেঁটে যেতে দেখেছে সে আর এই সুবিনয় এক নয়। আন্ডারওয়্যার আর গেঞ্জি পরা এ এক অতি বিপজ্জনক প্রেমিক।
পৃথিবীর ওপরকার জামা তুলে তার শরীরের লুকোনো দাদ চুলকুনি আমি দেখতে চাই না। তবু আমার জীবন আমাকে তা দেখাবেই।
আমি বললাম, তুই কী চাস?
সুবিনয় একটা ফ্যাকাসে হাসি হেসে বলল, এ শো-ডাউন। ভেরি প্র্যাকটিক্যাল অ্যান্ড এফেকটিভ শো-ডাউন।
তুই মারধর করবি?
মারধরের চেয়ে দুনিয়াতে আর কোনও কুইক এফেকটিভ জিনিস নেই।
সুবিনয়!
কী?
ভেবে দ্যাখ।
দুর্বলরা ভাবে, শক্তিমানরা কাজে নামে। টেকনিকাল কাজের বাইরে আমি খুব একটা ভাবনা-চিন্তা করার লোক নই। প্রীতিকে আমার চাই, অ্যাট এনি কস্ট।
সেই ছেলেটাকে যদি মারিস তা হলে পুলিশ কেসে পড়ে যেতে হবে, মামলা মোকদ্দমায় গড়াবে। কে জানে, ছেলেটার হয়তো ভাল কানেকশনসও আছে, যদি থাকে তো তোর ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সুবিনয় মাথা তুলে তাকাল। মুখের এক পাশে হলুদ আলো পড়েছে, অন্য পাশটা অন্ধকার। মেদহীন মুখের খানাখন্দে আলো-আঁধারের ধারালো রেখা। চোখ স্থির। যে-কেউ দেখলে ভয়ে হিম হয়ে যাবে।
সুবিনয় বলল, ড়ু আই কেয়ার?
সুবিনয় উঠে জামা-প্যান্ট পরতে লাগল। আপনমনে কেবল বলল, আমি সহজ সরল সম্পর্ক বিশ্বাস করি। জটিলতা আমি একদম সহ্য করতে পারি না।
আশ্চর্য এই যে, আমি নিজেও জটিলতা পছন্দ করি না। পৃথিবীটা আমার কাছে খুবই সাদামাটা। সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে, মানুষ বিষয়কর্মে যায়, ছানাপোনা নিয়ে ঘর করে, শীতের পর আজও বসন্ত আসে, ঘড়ির কাঁটা ধরে আমার খিদে পায়। আমার সমস্যা একটাই, বড় খিদে পায়। কখনও নিশ্চিতভাবে খিদে মেটে না। মিটলেও, আবার খিদে পাবে বলে একটা দুশ্চিন্তা থাকে। এ ছাড়া আমার জীবন সহজ সরল। প্রীতি নেই, ক্ষণা নেই, প্রীতির প্রেমিক নেই। কেবল খিদে আছে, খিদের দুশ্চিন্তা আছে।
দিন দুই পর কালো চশমা আর নকল দাড়ি-গোঁফওলা একটা লোককে খুবই অসহায়ভাবে গোলপার্কের কাছে যোরাঘুরি করতে দেখা গেল। সকাল কি সন্ধেবেলা লোকটা রাস্তায়-ঘাটে ঘোরে, দাঁড়ায়, উপানে তাকিয়ে কী যেন দেখে, বাতাস শোকে। এতই পলকা তার ছদ্মবেশ যে এক নজরেই ছদ্মবেশ বলে চেনা যায়। তার হাবভাবে এত বেশি আত্মবিশ্বাসের অভাব যে, যে-কোনও সময়ে সে রাস্তার লোকের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারে। প্রায়ই দেখা যায়, লোকটা প্রীতিদের ফ্ল্যাটবাড়ির নীচের তলার সদর দরজার কাছে নিচু হয়ে কী খোঁজে, কিংবা দেয়ালে ঠেসান দিয়ে আকাশের চিল দেখে, কিংবা উলটো দিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খায়। আমি ঠিক জানি, সেই সময়ে লোকটাকে কেউ নাম ধাম পরিচয় জিজ্ঞেস করলে লোকটা অবশ্যই বোকার মতো একটা ভোঁ-দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত, কিংবা হয়তো ভ্যা করে কেঁদে ফেলত ভয়ে। রুমা মজুমদার একদিন বিকেলে বাসায় ফেরার সময়ে লোকটাকে ফুটপাথে উবু হয়ে বসে রুমাল দিয়ে নিজের জুতো মুছতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিল। লোকটা অতি কষ্টে একটা করোনারি অ্যাটাক থেকে বেঁচে যায় সে বার। তিন-চার দিন লোকটা ওইভাবে ঘোরাঘুরি করল এলাকাটায়। নজর রাখল। নকল দাড়ির নীচে বড্ড চুলকুনি হয়, নকল গোঁফের ক্লিপ বড্ড জোরে এঁটে বসে নাকের লতিতে। কালো চশমার অনভ্যাসে চোখ ভেপে ওঠে। এইসব অস্বস্তি নিয়েও লোকটা লেগে রইল একটানা। প্রীতিকে সে রোজই দেখতে পেল, কলেজে যায়, কলেজ থেকে ফেরে। প্রীতির প্রেমিকও রোজ সকালে একবার আসে, বিকেলে আর একবার। বিকেলে প্রেমিকটি নিজের একটি জেফির গাড়ি নিয়ে আসে, প্রীতিকে নিয়ে বেড়াতে যায় কোথায় কে জানে! রাত আটটা নাগাদ ওই একই গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়। সকালের দিকে আসে একটা লাল রঙা স্পোর্টসকারে। কখনও-সখনও সেই গাড়িতেই প্রীতি কলেজে যায়, যেদিন ক্লাস থাকে আগেভাগে। নইলে খালি গাড়ি নিয়ে প্রেমিকটি ফিরে যায়। লোকটা আরও খবর নিল, রুমা যদিও এখন আর ভলিবল খেলে না, তবু রোজ সন্ধের দিকে খানিকক্ষণ লেকে সাঁতরায়। কিংবা ওয়াই এম সি এ-তে গিয়ে টেবিল টেনিস খেলে। সন্ধের দিকে রুমা কখনওই বাসায় থাকে না। লোকটা আরও ধৈর্য ধরে দেখে দেখে জানল যে, প্রীতিদের বাসার নীচের তলায় দুটো ফ্ল্যাটের একটায় কয়েকজন মাদ্রাজি ছেলে মেস করে থাকে, তারা খুব নিরীহ। অন্য ফ্ল্যাটটায় এক স্বামী-স্ত্রী থাকে মাত্র। ওই স্বামী-স্ত্রীতে খুব ঝগড়া হয় রোজ, আবার সিনেমায় যাওয়ারও বাতিক আছে। মাদ্রাজি ছেলেরা প্রায় রাতেই বাইরে থেকে খেয়ে ফেরে বলে সন্ধেবেলা তাদের ফ্ল্যাটটাও খালি থাকে। ওপরতলায় অন্য ফ্ল্যাটটা সদ্য খালি হয়েছে, সামনের মাসে হয়তো ভাড়াটে আসবে। লোকটি যখন এইসব খবর নিচ্ছিল তখন তার ছেলেমানুষি ছদ্মবেশ এবং আত্ম-অবিশ্বাসী হাবভাব সত্ত্বেও সে ধরা পড়েনি। তবে এক দিন একটা মফস্সলের লোক আচমকা তাকে গড়িয়াহাটা কোন দিকে জিজ্ঞেস করায় সে আঁতকে উঠে জবাব না দিয়ে হুড়মুড় করে হাঁটতে শুরু করেছিল। আর একদিন দুটো ফচকে ছোকরার একজন তাকে দেখিয়ে অন্যজনকে বলেছিল, দ্যাখ ঠিক হাবুলের বাবার মতো দেখতে! তাইতে লোকটা আত্মরক্ষার জন্য কিছুক্ষণ পাগলের অভিনয় করেছিল। নিজের স্বভাববশত লোকটা এ কদিন অবসর সময়ে রাস্তায়-ঘাটে পয়সা খুঁজে বেড়াত। কত লোকের পয়সা পড়ে যায় রাস্তায়। সর্ব মোট পঁচাত্তর-পয়সা, একটা দিশি কলম, একটা আস্ত বেগুন, দুটো সিগারেট সুদ্ধু একটা সিগারেটের প্যাকেট, একটা স্টিলের চামচ, একটা মেয়েলি রুমাল আর একটা প্লাস্টিকের পুতুল কুড়িয়ে পেয়েছিল। এর মধ্যে কয়েকটা তার কাজে লেগেছিল আর কয়েকটা পরে কাজে লাগতে পারে ভেবে সে জমিয়ে রেখেছিল।
এই নকল লোকটা আমিই। রোজ রাতে সুবিনয় তার সাউথ এন্ড পার্কের ফ্ল্যাটে অপেক্ষা করত, আমি গিয়ে তাকে সারা দিনের রিপোর্ট দিতাম। গম্ভীর হয়ে সুবিনয় শুনত, আর একটা কাগজে কখন কে বেরোয়, আর কে ঢোকে তার একটা টাইম চার্ট তৈরি করত। গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার পরা তার সুবিশাল চেহারাটা খুনির মতো দেখায় রোজ।
একদিন অনেক হিসেবের শেষে সে বলল, উপল, রাত সাড়ে সাতটা থেকে আটটা হচ্ছে সবথেকে সেফ সময়। রুমা রোজই সাড়ে আটটায় ফেরে। প্রীতি আর তার লাভার ফেরে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। মাদ্রাজি ছেলেরা ন’টার আগে কমই ফেরে, দু’-একজন আগে ফিরলেও ক্ষতি নেই।
আমি আঁতকে উঠে বলি, ক্ষতি নেই কীরে? ওরা থাকলে
সুবিনয় গম্ভীর হয়ে বলে, চার-পাঁচজনকে আমি একাই নিতে পারব। খুব বেকায়দা দেখলে তুই হেল্প করবি।
তার দরকার কী?
দরকার কে বলেছে! যদি বাই চান্স ফেরে তবেই দরকারের কথা ওঠে। বাকি থাকছে একজোড়া স্বামী-স্ত্রী। এদের আচরণ আনসার্টেন। ওরা বিশেষ কোনও দিন সিনেমায় যায় না?
না। দুদিন যায় না, তারপর যায়, আবার হয়তো তিন দিন যায় না, এইরকম আর কী!
আনওয়াইজ অফ দেম। যাকগে, অত ভাবলে চলে না।
না ভাবলেও চলবে না।
সুবিনয় আমার মুখের দিকে স্থির চেয়ে বলল, প্রীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল বলে আমেরিকায় আমি একটা ছোকরাকে ঠেঙিয়েছিলাম খোলা রাস্তার ওপর। তাতে কিছু হয়নি। অত ভাবলে চলে না।
আমি অসহায়ভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
পরদিনই সুবিনয় প্রীতির ফ্ল্যাটবাড়িতে হানা দিল।
কপালটা ভালই সুবিনয়ের। সেদিন মাদ্রাজি ছেলেরা কেউ ছিল না। স্বামী-স্ত্রীও সেদিন সিনেমায় গেছে। রুমাও যথারীতি বাইরে। এবং প্রীতি আর তার প্রেমিকও সেদিন দুর্ভাগ্যবশত সাড়ে সাতটায় ফিরে এল।
সুবিনয় সিঁড়ির নীচের অন্ধকারে অপেক্ষা করছিল, আমি উলটো দিকের ফুটপাথে। প্রীতি তার প্রেমিককে নিয়ে দোতলায় উঠল দেখলাম। ঠিক তার কয়েক সেকেন্ড পর সুবিনয়ের বিশাল চেহারাটা বেড়ালের মতো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। পেছনে আমি।
ভেজানো দরজা ঠেলে সুবিনয় ঘরে ঢুকল। প্ল্যান মাফিক আমিও ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি আটকে পাল্লায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু কী ঘটছে তা দেখার সাহস আমার ছিল না। দরজার পাল্লায় পিঠ দিয়েই আমি চোখ বুজে কানে আঙুল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। টের পাই সামনে শিক শিক, চপ, মাগো, গড, ধুপ গোছের কয়েকটা আওয়াজ হল। তারপর সব চুপচাপ।
চোখের পাতা জোর করে বন্ধ করায় ব্যথা হচ্ছিল, কানে-দেওয়া আঙুল টনটন করছে, কানের মধ্যে দপ দপ আওয়াজ হচ্ছে। বেশিক্ষণ এভাবে থাকা যায় না।
তাই অবশেষে চোখ-কান খোলা রাখতে হল।
তেমন কিছু হয়নি। ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর হয়নি, লণ্ডভণ্ডও হয়নি। প্রীতি তার ঘোরানো চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার পায়ের কাছেই পড়ে আছে প্রেমিক। প্রেমিকের চশমা একটু দূরে কার্পেটের ওপর ডানাভাঙা পাখির মতো অসহায়। সুবিনয় প্রীতির সামনে কোমরে হাত দিয়ে ওয়েস্টার্নের নায়কের মতো দাঁড়িয়ে।
পুরো একখানা বিদেশি স্টিল ছবি।
সুবিনয় ডাকল, প্রীতি, হানি, ডার্লিং!
উ! স্বপ্নের ভিতর থেকে প্রীতি জবাব দিল।
তুমি কি আমাকে ভালবাসো না?
স্বপ্নের দূর গলায় প্রীতি বলল, বাসতাম। আমেরিকায়।
সুবিনয় গর্জে উঠল, আমেরিকায়? তা হলে আমরা আবার আমেরিকায় চলে যাই চলো। সেখানে তুমি আবার আমাকে ভালবাসবে।
অনেকক্ষণ ভেবে প্রীতি ওপর নীচে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, তাই যেতে হবে। এ দেশে থাকলে তোমাকে ভালবাসা অসম্ভব। নানা সংস্কার বাধা দেয়।
প্রীতির পড়ে-থাকা প্রেমিকের একখানা হাত সুবিনয় জুতোর ডগা দিয়ে নেড়েচেড়ে বলল, এ ছেলেটা কে প্রীতি? কেমন ছেলে?
প্রীতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ও একটা কাওয়ার্ড, একটা উইকলিং। এক ঘণ্টা আগেও ওকে আমি ভালবাসতাম।
এখন?– সুবিনয় গর্জন করে ওঠে।
এখন বাসি না।–প্রীতি মৃদুস্বরে বলল।
সুবিনয় কোমরে হাত রেখে টারজানের মতো হাসল। বন্য এবং সরল হাসি।
প্রীতি হাসল না। মাথা নিচু করে স্থির বসে রইল। চুলের ঘেরাটোপে মুখখানা ঢাকা।
দৃশ্যটা আমার কেন যেন বড্ড বিদেশি বলে মনে হচ্ছিল। যেন কলকাতায় নয়, নিউ ইয়র্ক বা টেক্সাসে ঘটনাটা ঘটছে। বিদেশি কোনও ছবিতে বা বইতে দৃশ্যটা কি দেখেছি বা পড়েছি? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার পেটের মধ্যে সেই স্থায়ী খিদের ভাবটা মৃদু মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
বাস্তবিক, এইসব হৃদয়ঘটিত কোনও সমস্যাই আমার নেই। আমার একটাই সমস্যা, বড় খিদে পায়। অনেকক্ষণ ধরে নানা সুস্বাদু খাবার খেয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
সুবিনয় মার্কিন প্রেমিকের মতো লম্বা এক পদক্ষেপে প্রীতির কাছটিতে পৌঁছতেই আমি চোখ বন্ধ করে কানে আঙুল দিই। তারপর অন্ধের মতো ঘুরে হেঁটে গিয়ে, হাতড়ে দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে আসি। সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকি নীচে।
ঠিক সদরের দরজায় রুমার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। তার কাঁধে একটা ব্যাগ, মুখ গম্ভীর।
বলল, কী খবর?
আমি ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে জানাই, কোনও খবর নেই।
ও আবার বলে, প্রীতি কি আপনাকে রিফিউজ করেছে!
একটু ভেবে নিয়ে আমি ওপরে-নীচে মাথা নাড়ি, করেছে।
ভেবেছিলাম, খুশি হবে। হল না। মুখখানা গোমড়া করে বলল, প্রীতি বড্ড বোকা। একজনের পর একজনের সঙ্গে ইনভলভড হয়ে যাচ্ছে। আজ ওকে একটু বকব।
আমি বললাম, প্লিজ, বকবেন না। ওর মন খুব খারাপ।
কেন?
ওর এ প্রেমটাও কেঁচে গেছে।
রুমা কিছু বলার আগেই সিঁড়িতে প্রচণ্ড ভারী পায়ের শব্দ তুলে সুবিনয় নেমে আসছিল। তার বাঁ কাঁধে একটা পাট করা চাদরের মতো প্রীতির প্রেমিক ভাঁজ হয়ে ঝুলে আছে।
রুমাকে দেখে সুবিনয় খুব স্মার্ট হেসে বলল, লোকটা নেশা করে হল্লা করছিল, নিয়ে যাচ্ছি।
দৃশ্যটা দেখে অসম সাহসী রুমাও শিউরে উঠে কাছে সরে এসে আমার একটা হাত জোরে চেপে ধরে বলল, উঃ মা গো! এ লোকটা কে?
আমি সান্ত্বনার ছলে রুমার ভেজা এলোচুলে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, কিছু ভয়ের নেই। আপনি ভয় পাবেন না। আমি তো আছি।
রুমা আমার বুকের সঙ্গে প্রায় লেগে দাঁড়িয়েছিল, এ কথা শুনে হঠাৎ ছিটকে সরে গিয়ে বলল, স্কাউড্রেল।
আমি তবু রাগ করি না। মলিন একটু হাসি। সুবিনয় গিয়ে প্রীতির প্রেমিকের জেফির গাড়ির দরজা খুলে পিছনের সিটে প্রেমিককে শুইয়ে দিয়ে নিজে হুইলে বসল। তারপর ডাকল, উপল, চলে আয়।
রুমা আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে হঠাৎ বলল, আপনি নিশ্চয়ই গুন্ডা লাগিয়েছিলেন, না? আপনি… আপনি…।
বলতে বলতে রাগে হঠাৎ রুমার ভিতরে সেই ডালমিয়া পার্কের ভলিবল খেলোয়াড়টা জেগে উঠল। তেমনি চিতাবাঘের মতো চকিত ভঙ্গি, তেমনি নিশ্চল নিবদ্ধ চোখে বলের বদলে আমার মুখের দিকে চেয়ে। তারপর হঠাৎ স্বভাবসিদ্ধ লঘু পায়ে ছুটে এসে তার প্রচণ্ড স্মাশিং-এর ডান হাতখানা তুলল।
আমারও অভিজ্ঞতা বেড়েছে। আগের বারের মতো বোকা দর্শক আমি আর নেই এখন। মাথাটা সরিয়ে নিলাম পিছনে। রুমার আঙুলের ধারালো ডগা কেবল থুতনি ছুঁয়ে গেল।
এক লাফে বাইরে এসে দৌড়ে ফুটপাথ পার হচ্ছি, রুমাও ছুটে এল, পিছন থেকে জামা টেনে ধরার চেষ্টা করল। গাড়ির দরজা খুলতে সুবিনয়ের যেটুকু সময় লেগেছিল সেটুকুর মধ্যে সে আমার গালে নখের আঁচড় বসিয়ে দিল। হাত টেনে ধরার চেষ্টা করল। চেঁচিয়ে লোকজনকে জানান দিতে লাগল, চোর! খুনে! গুন্ডা! পাকড়ো-।
সুবিনয় গাড়ি ছেড়ে দিল। লেকের একটা নির্জন ধারে এক জায়গায় গাড়িটা প্রীতির প্রেমিক সমেত রেখে দিয়ে সুবিনয় আমাকে নিয়ে ফিরতে লাগল।