৩১.
সুধাময়ী গলা তুলে বললেন রান্নাঘর থেকে, বোসস তোমরা, আমি একেবারে চা-টুকু করে নিয়ে যাই।
এই বুকচাপা বাড়িটার পুরনো ঘরে বসে,কী এক অজানিত বিস্মিত আনন্দে সুমিতার প্রাণের দুই কুল প্লাবিত হয়ে গেল। এ পরিবেশ ওর অচেনা। মানুষগুলিরও পুরো পরিচয় আগে থেকেই জেনে আসেনি। তবু, মন যেন কী এক আশ্চর্য স্রোতে আপনি গেল ভেসে।
কাছে বসে রাজেন। জানে, ওই কর্মী চিন্তাশীল মানুষটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। ভাবছে, এ কী রকম মেয়ে। বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ এসে হাজির। এখন বসে বসে মা আর ছেলের কাহিনী শুনছে।
শেষ পর্যন্ত সুমিতা বলেই ফেলল, আচ্ছা, মেজদি তো কখনও বলেনি আপনার মায়ের কথা।
রাজেন বলল, মেজদির তো খেয়ে দেয়ে আরও কাজ ছিল। আর বলবারই বা আছে কী, বলো?
কীসের? বলতে বলতে এসে পড়লেন সুধাময়ী। স্বেদবিন্দু সারা মুখে। একটু লাল হয়ে উঠেছেন। প্লেট নেই, শুধু কাপে করে চা নিয়ে এলেন। বললেন, মনে কোনও বিঘ্নি করো না মা। আমার আয়োজন নেই, সরঞ্জামও নেই। খোকা নিজে তো কিছুই দেখাশুনো করে না। সব আমাকেই করতে হয়। এই কাপে করেই চা-টুকু খাও, কেমন।
কুণ্ঠা-বিব্রত গলায় বলল সুমিতা, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে? আপনি এ সব কেন বলছেন?
না বললেও সুমিতা অবাক হত, বললেও তাই। এমনি করে চা খাওয়ার রীতি তো ওদের বাড়িতে নেই। নেই চলা ফেরার চেনা সীমানার মধ্যেও। কিন্তু এখানে, এই ঘরে, এই মানুষের কাছে, ডিশটা থাকলে যেন বাড়তি বলেই মনে হত। সব জিনিসের মানানসই আছে তো। অবাক হলেও, মন খারাপ করার কিছু নেই। এর মধ্যে অসামঞ্জস্য নেই কোথাও।
সুধাময়ী রাজেনকেও এক কাপ চা দিলেন, নিজেও নিলেন। বোঝা গেল, রান্নাঘরের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছেন। বললেন, কী বলছিলি খোকা?
রাজেন বলল, সুমিতা বলছিল, ওর মেজদির মুখে কখনও তোমার কথা শোনেনি কেন। আমি বললুম মেজদির তো খেয়ে দেয়ে আরও কাজ ছিল। মিছিমিছি তোমার কথা বলে সময় নষ্ট করবে কেন সে।
সংশয়ে হেসে তাকাল সুমিতা রাজেনের দিকে। এ কি মেজদিকে বিদ্রূপ, না শুধু এই মাকেই নাকাল করা।
সুধাময়ী বললেন, শুনলে তো কথা! আমি তো জানি সুগতা আমাকে কত ভালবাসত। মানুষ তার দশ কাজে যদি আমার কথা বলতে ভুলে যায়, তাতে কি আমি কখনও ছোট হই, না সে ছোট হয়।
রাজেনের সব কথার ভাব বোঝা দুষ্কর। বলল, আমি ছোট বড়র কথা বলিনি। বলছি, সব কথা তো সকলের জন্যে নয়, তাই বলেনি সুগতা। কিন্তু মা
বলো।
–সুমিতা হঠাৎ এক দিনের জন্যে এসেছে। ওকে তুমি কেন অকারণ এত কথা বলে বিব্রত করতে যাচ্ছ?
সুধাময়ী চমকে ফিরে তাকালেন সুমিতার দিকে। বললেন, তুমি কি মা এক দিনের জন্য এসেছ? আমার তো তা মনে হয়নি। আর কোনওদিন কি আসবে না?
কী বিচিত্র প্রশ্ন। সুধাময়ীর চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল সুমিতা। বলল, আসব না কেন?
তবে? সুধাময়ী রাজেনের দিকে ফিরে বললেন, ও তো এখানে যাত্রা থিয়েটার দেখতে আসেনি, যে হঠাৎ এক দিন এসে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কত দিনের বাঁধন ছিঁড়ে ছুটে এসেছে ও। না মা?
কী সর্বনাশ! সুধাময়ী কি অন্তর্যামী নাকি! যুগপৎ ভয়ে ও লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠল সুমিতা। ঘাড় নেড়ে না না করে উঠতে গেল। কিন্তু চোখের পাতা নামিয়ে শুধু হাসল। তাও যেন ধরা পড়ে যাওয়ার হাসি।
সুধাময়ীই আবার বললেন, তা বলে কি তুমি শুধু খোকার কাছে এসেছ, না, খোকাকেই দেখতে এসেছ। ওটা উপলক্ষ মাত্র। আসলে এদিকটা তোমাকে টেনেছে আজ।
তারপর সুমিতার আড়ষ্টতা দেখে বললেন, তোমাকে আমার বড় ভাল লাগছে মা। তোমার চোখের চাউনি, তোমার মুখ দেখে, কথা আপনি বলতে ইচ্ছে করে। আমাদের ঝগড়ার কথা বলছিলুম মা
রাজেন বাধা দিয়ে বলল হেসে, অন্য কথা বলো মা। ঝগড়ার কথা কেউ কাকে বলে নাকি আবার।
–আমার তো ওই এক কথাই আছে খোকা। যে যাই বলুক, তোর সঙ্গে আমার ঝগড়াটাই তো আসল।
তা হলে আমি বরং উঠি মা। সুমিতাকে বলল, তুমি বসো, আমি বরং আমার ঘরে গিয়ে বসি। শুধু শুধুই হয়তো ফিরে যাবে অনেকে। আর তুমিও বারে বারে বাধা পাবে মা। একটু পরে আমি আসব।
রাজেন উঠে দাঁড়াল। একটু ছায়া ঘনিয়ে এল সুমিতার চোখে। রাজেনের চলে যাওয়াটা ও চায়নি। সামনাসামনি বসে কথা বলবে দুজনে, সুমিতা শুনবে। সুধাময়ী বললেন, তোর কোনও বাধাকেই তো আমি মানিনে খোকা। সে ভয় আমি করিনে। মেয়েটা এসেছে, বোস না। ঝগড়ার কথা না হয় নাই বললুম, আমার দুঃখের কথা বলব তো।
ভীরু সংশয়ে তাকিয়েছিল সুমিতা রাজেনের দিকে। কিন্তু রাজেনের মুখে রাগবিরাগের কোনওকিছুরই ছায়া পড়েনি। বরং একটু হাসিই যেন লেগেছিল তার ঠোঁটের কোণে। বলল, এত যে দুঃখ দুঃখ করছ মা, দুঃখ তো তোমার একটি।
সুধাময়ী যেন ছেলেমানুষের মতো চোখ বড় করে হেসে বললেন, সেটা কী বল তো?
–কেন এ বাড়িটা ছেড়ে যাইনে আমি।
সুধাময়ী বললেন, সেটা একটা দুঃখ বটে। আচ্ছা, তুমিই বলো তো মা, এই বিরাট পোড়ো বাড়িটার অর্ধেক মালিক খোকা। আমি বলি, এটা তুই বিক্রি করে দে। আমি তার বদলে রাজপুরী চাইনি। আমার লোভ নেই, সাধ তো আছে। এটাই বরং রাজপুরী। রাজা নেই, এ যেন বদ্ধপুরী। তার চেয়ে সব বিক্রি করে, নতুন একটা ছোটখাটো বাড়ি করে চল আমরা একটু খোলামেলা জায়গায় যাই। তা নাকি যেতে নেই।
রাজেন হেসে ফেলল।–যেতে নেই বলিনি মা। যাওয়া চলে না। নতুন বাড়ি করতে যে অনেক টাকা লাগবে।
–এ বাড়ির অর্ধেকটা বিক্রি করলে কি টাকা পাওয়া যায় না?
যায়।
–কিন্তু তুই পারিসনে। তুই যে বিপ্লবী হয়েছিস, তাই তোর আবার বাড়িঘর কীসের, নাকি?
রাজেন গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, বিপ্লবী বলে ঠাট্টা করছ কেন মা।
–ছি খোকা! তোকে আমি কোনওদিন ঠাট্টা করিনি এ সব নিয়ে।
না-ও যদি করে থাক, আমার বিশ্বাসকে তুমি অসম্মান কর।
সুধাময়ীর চোখে শঙ্কার ছায়া। বললেন, মিছিমিছি অত বড় বড় কথা বলিসনে খোকা। তোর বিশ্বাসকে আমি অসম্মান কোনওদিনও করিনি। তা বলে যেটা আমার ফাঁকি বলে মনে হয়েছে, সেটা আমি বলব না?
–কোনটা ফাঁকি মা। বাড়ি না করাটা?
–হ্যাঁ বাবা, ওটাও একটা।
সুধাময়ীর গলার স্বর নেমে এল হঠাৎ। বললেন, কী এক নির্দয় নীতি আর আদর্শ তোর, যেন বাড়িটা একটা পাপের মতো তোর কাছে। যেন, তোর যা পথ, সে পথে চলতে গেলে ভালভাবে বাস করাটাও অন্যায়। এ বাড়ি ছেড়ে যদি তুই আজ বস্তিতে গিয়ে থাকিস, তাইতেই কি তোর উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে। তোর গোঁড়ামি কেন? তুই কুলি মজুর নোস, সন্ন্যাসীও নোস। পরকে ঠকিয়ে বড়লোকও হোসনি। সুবিধে অসুবিধের কথাও বলিসনে কখনও। যেন তোর আদর্শেই বাদ সেধেছে।
রাজেন বলল, তাও বলতে পার মা। সব জীবনে সব জিনিস তো খাটে না।
–তা হলে ভেক নিয়েছিস বল।
কীসের ভেক?
–এই ধার্মিকদের মতো ধর্মের ভেক। এ করতে নেই, ও করতে নেই। যোগীদের ভিক্ষে পাওয়ার মতো তোদের আদর্শেও ভেক না হলে চলে না?
–তোমার ওই যোগীদের মতো ভেক আছে কি না জানি নে। কিন্তু আমার আদর্শ নীতি দল সমস্ত কিছুরই একটা পরিচয় আছে।
-কী পরিচয় থোকা। তোকে চিরকালই বাউন্ডুলে হয়ে পথে পথে ঘুরতে হবে। ঘর নয়, বাড়ি নয়, স্ত্রী-পুত্র পরিবার নয়, দুঃখ দিয়ে দিয়ে মারবি নিজেকে। মরণের একী তপস্যা তোদের, খোকা…
সুধাময়ীর কণ্ঠস্বর চেপে এল। জল দেখা দিল চোখে। বললেন, জানি তোকে নিয়ে আমি আর দশটা মায়ের মতো সুখে দুঃখে ঘর করতে পারব না। তুই জেলে যাবি, হয়তো সেখান থেকে কোনওদিন আর ফিরবি না তুই। কিন্তু তোদের এ সবই যে নীতির জন্যে নীতি করা। যন্ত্রের মতো। প্রাণ দিতে হবে, তাই প্রাণ দেওয়া।
সুমিতার যত ভয় করছিল, ততই চোখ ফেটে জল আসছিল সুধাময়ীর কথাগুলি শুনে। ঘরের আবহাওয়া গম্ভীর আর ভারী হয়ে উঠেছে। মা আর ছেলেকে দেখে এখন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে উঠেছে যেন। সুধাময়ী কথা বলতে বলতে এমন জায়গায় এসে পড়বেন, কল্পনাও করতে পারেনি সুমিতা।
রাজেন বলল, তুমি যে সবই আমার বিকৃত করে দিলে মা। আমার গোটা জীবনের পেছনে কি কোনও উদ্দেশ্য নেই।
–আছে বইকী খোকা। সবাই বলে, সে একটা কিছু পেতে চায়। বাড়ির কথাটা কিছু নয়। ওটার সঙ্গে তোর মনেরই কোনও মিল না হয় নেই–তবু, মন সবার বড় জিনিস। সে যদি তৈরি থাকে, কোনও কিছুই আটকায় না খোকা। চারদিকে তোদের এত নীতির বেড়া, সে যেন কাঁটা তারের বেড়া।
কাঁটা তার নয় মা। কিন্তু নীতি কঠিন হওয়াই তো প্রয়োজন। নইলে নীতিবিচ্যুতি ঘটবে পদে পদে। সুশৃঙ্খলভাবে তাকে চালিত করতে হবে। সেখানে কোনও ফাঁক রাখলেই সব ভেসে যাবে মা।
সুধাময়ী এবার হাসলে। সুমিতাকে বললে, দেখ মা, খোকার ভয় দেখ। এ তো ভয়ের কথা, সাহসের কথা তো নয়। সুশৃঙ্খল মানে, পায়ে-বেড়ি-শেকল নয় তো রে। নীতি তো তোর আসল কাজকে তলিয়ে দেওয়ার জন্যে নয়। তোদের যেন সব পায়ে বেড়ি, পদে পদে মন্ত্র আওড়াচ্ছিস। রুক্ষ, নিষ্ঠুর, কঠোর। কিন্তু আনন্দ কই তোদের। আনন্দ ছাড়া যে কোনও কাজই হয় না।
রাজেন দৃঢ়স্বরে বলল, তুমি ও সব ধোঁয়াটে কথা বোলো না মা।
সুধাময়ী বললেন, ওরে, ধোঁয়াটে কথা নয়। আনন্দ না থাকলে মানুষের প্রাণের মহাপ্রাণী যে দম চাপা পড়ে মরেন।
রাজেন তেমনি স্বরেই বলল, ধোঁয়াটে কথাই বলছ মা। এ সব তোমার ভগবৎ প্রেম। যে কোনও বড় কাজের জন্যেই নীতি আর শৃঙ্খলা চাই।
–চাই। একটা সংসার চালাতে গেলেও নীতি-শৃঙ্খলা চাই। কিন্তু সেটা দিবানিশি রক্তচক্ষু দেখিয়ে নয়। বাধ্যতামূলক নয়। বুঝলুম, তোর ভগবৎ-প্রেম নেই, একটা প্রেম তত আছে। মানুষে প্রেম।
–মানুষে প্রেম মানে এ নয় মা, আমার উদ্দেশ্য-সিদ্ধির পথে নীতি বিচ্যুতিকে প্রেম দেখাব।
কারুর বিচ্যুতি কাটাতে গেলেও তাকে ভালবাসতে হবে। তাকে আঘাত করে নয়। যে গরিব মানুষগুলোকে নিয়ে তোর কাজ, তোর নীতি, তাদের তুই মানতে বাধ্য করতে পারিস? তাদের তুই জোর করে নিজের পথে চালাতে পারিস?
নীতিকে সে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিলে, তখন বাধ্যবাধকতা থাকবে বইকী। সুধাময়ী তীক্ষ্ণচাপা গলায় বলে উঠলেন, কখখনও না। তাদের তো তুই শাসন করিসনি, পথ দেখাস। তাদের তুই ভালবাসিস, তুই তাদের বন্ধু। এই ভালবাসাকেই আমি বলি আনন্দ। এ আনন্দ না থাকলে, তুই তোর কাজকর্মে দিশা পাবি কেন? তুই বলিস, মা, আমি দেশটাকে বুঝতে চাই, দেখতে চাই। সে শুধু আদর্শ দিয়ে। প্রাণ দিয়ে নয়? খোকা, ভয় আর ভক্তি বড় খারাপ জিনিস। আমি যে মাঝে মাঝে দেখতে পাই, তোকে অনেকে ভয় পায়, ভক্তিও কম করে না। কিন্তু তারা তোর কাছ থেকে দূরে পালিয়ে থাকতে চায়। যেটুকু আসে, সেটুকু এক ছিটে ভালবাসা বোধ হয় আছে বলেই।
রাজেন তীব্র হেসে বলল, তারা ভীরু মা?
সুধাময়ী আরক্ত হয়ে উঠলেন। কঠিন গলায় বললেন, হ্যাঁ, তারা ভীরু, মূর্খ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন। রাজেনদাদাকে তারা বোঝে না, তাদের নাকি সে ভাল করতে চায়, জীবনের সব অন্ধকার দূর করতে চায়, তাই তার কাছে আসে। রাজেনদাদা ভাবেন, লোকগুলোর আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, আমি তাদের উপায় করছি, না?
দুজনে যেন ভুলেই গেছে, কাছে বসে আছে সুমিতা। সর্বনাশ, এই কি মা আর ছেলের ঝগড়া। সুমিতা যেন মন্ত্রমুগ্ধ। একটি নিশ্বাস ফেলেও নিজের অস্তিত্ব জানাতে চায় না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছে, কখন কী একটা অঘটন না জানি ঘটে যায়।
রাজেনের মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠস্বর এই বুকচাপা ঘরটার মধ্যে গমগম করে উঠল, জানিনে মা তোমার ভালবাসার কী মানে হয়, কী তার রূপ। কিন্তু আমি জানি, নীতি নিয়ম শৃঙ্খলাকে বাদ দিয়ে ভালবাসা হয় না।
সুধাময়ী অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। বললেন, মিথ্যা। ভালবাসা ছাড়া নীতি নিয়ম কিছু নয়। সংসারের মহাপ্রাণীর কিছুই যায় আসে না তোর নিয়ম নীতিতে।
রাজেন নীরব। তার বিদ্যুচ্চকিত দৃষ্টি থির বিজুরি আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে হারিয়ে গেল শূন্যে। সারা কপালটি জুড়ে যেন স্থির বিজলি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে আছে।
সুধাময়ী যেন শিউরে উঠে ডাকলেন, খোকা।
রাজেন বলল, মা, তুমি শুধু ভালবাসা ভালবাসাই বলো।
সুধাময়ী বললেন, এ ছাড়া যে আর কিছু বুঝতে শিখিনি বাবা।
কিন্তু মা, আমি দেখি এ সংসারে হিংসা, অপমান, পীড়ন প্রতি পদে পদে। আমি দেখি, মানুষ বড় অসহায়, তারা মার খাচ্ছে পড়ে পড়ে। আমি যে শুধু জ্বলি এ সব দেখে। তোমার ভালবাসার কথা শুনলে ভয় করে আমার। ভয় করে আমি হারিয়ে যাব।
সুধাময়ীর দু চোখ জলে ভেসে গেল। বললেন, ওই জ্বলুনিই তোর ভালবাসা থোকা।
কী জানি। ভালবাসা রাত পোহালে হবে। কোনও অন্যায় আর পাপ নিয়ে আমি এগোইনি। সারা মানুষের জীবনে যে সর্বনাশ উদ্যত, তার সর্বনাশ করতে আমরা কঠোর হব, নিষ্ঠুর হব; নিয়মে নীতিতে নির্ভুল কঠিন পথ ছাড়া হবে না।
সুধাময়ী ফিস ফিস করে বলতে লাগলেন, আক্রোশ, আসল মনের কথা নয়। ঘেন্না দিয়ে কোনও বড় কাজই হয় না। তারপর সহসা চমকে উঠলেন সুমিতার দিকে তাকিয়ে। তাড়াতাড়ি ওর একটি হাত চেপে ধরে বললেন, ছি ছি, খোকা, ঝগড়ার কথা বলতে গিয়ে এ মেয়েটার সামনে ঝগড়া করে ফেললুম রে। তুমি বোধ হয় রাগ করছ মা?
সুমিতা ওর চোখের জলের লজ্জা ঢাকতে গিয়ে বলল, না না, একটুও রাগ করিনি। ভয় করছিল…
সুধাময়ী জড়িয়ে ধরলেন সুমিতাকে বুকে।–দেখলে তো আমাদের ঝগড়া। এ ছাড়া, চালডালের জন্যেও কম ঝগড়া করিনে?
রাজেনও লজ্জিত হয়ে পড়েছে অনেকখানি। সুমিতার দিকে তাকিয়ে তার মুখ কোমল হয়ে এল। বলল, হল তো মাকে দেখা? এরপর কথা বন্ধের ব্যাপারটা তো বলাই হল না। সে সব আরেকদিন হবে, আজ চলল। অনেক দেরি হয়ে গেছে। তোমার বাড়ির সবাই ভাববেন।
সুধাময়ীকে আবার প্রণাম করতে যাচ্ছিল সুমিতা। উনি ধরে ফেলে, চিবুকে আঙুল ঠেকিয়ে চুমা খেয়ে বললেন, আবার এসো মা, তোমার পথ চেয়ে থাকব।
.
৩২.
আবার সেই, দুপাশে ঘর-চাপা সরু স্যাঁতা গলিপথ। হ্যারিকেন হাতে আগে আগে রাজেন। সুমিতার ভয় নেই, হোঁচট লাগল না। আবার সেই বারান্দা। ডানদিকে ঘুরে গিয়ে, একটি ঘরের দরজা খুলল রাজেন। রাজেনের ঘর, তার গোটা সংসারটা এখানেই।
পলেস্তারা খসা, পুরনো ঘরটিতে, শ্রীহীনের মধ্যে এতখানি শ্ৰী আশা করেনি সুমিতা। একপাশে, তক্তপোশের কঠিন শয্যা। দেয়ালের দুদিকে সস্তা কাঠের শেলফ দেয়াল জুড়ে রয়েছে। তাতে শুধু বই, বই আর বই। অধিকাংশই যেন পুরনো বই। পিজবোর্ডের বাঁধাই পেরিয়ে হঠাৎ এক-আধটু রেক্সিন মরক্কোর চাকচিক্য। বৈরাগীর মাটিতে লুটোনো আলখাল্লায় এক আধ চিলতে সিল্ক বেনারসির মতো। কোথাও অগোছালো নেই, ধুলোর আস্তরণ পড়ে নেই। বোঝা যায়, সর্বদাই একটি সাবধানী পরিচ্ছন্ন হাত ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে এই শেলফে। পুরনো টেবিল, ভাঙা চেয়ার, ফাইল-পত্র, ফ্ল্যাগ, পোস্টার, সবই আছে ঘরটিতে। কিন্তু ছড়িয়ে ছত্রাকার নয়। প্রত্যেকটি জিনিস সাজানো গুছানো।
রাজেন বলল, মায়ের ঘর দেখলে, এবার ছেলের ঘরখানিও দেখে যাও।
সুমিতার সবই ভাল লাগছিল। তবু সুধাময়ীর ঘরে প্রাণের স্পন্দন। এখানে যেন কী এক কানুন দ্বারা বেষ্টিত। সেখানে সব সাজানো, এখানেও। তবু কোথায় একটি ব্যবধান রয়ে গেছে। সেখানে মেঝেতে এক ফোঁটা জল পড়লে, আঁচল দিয়ে মুছে দিতে ভাল লাগে। এখানে কোনও কিছুতে হাত দেওয়ার আগে যেন এক বার ভাবতে হবে।
সুমিতা বলল, কে এমন পরিপাটি করে রেখেছে এ ঘর।
–কে আবার! আমার সবকিছু আমিই রাখি। কারখানা ছুটির পর এখানে আসে অনেকে। কিন্তু আমি ময়লা হতে দিইনে। চারদিকে জঞ্জাল ছড়িয়ে রাখা ভাল লাগে না আমার। একেবারে কাজ করতে পারিনে নোংরা থাকলে।
কিন্তু সুমিতা দেখেছে যদিও কম, শুনেছে বেশি যে, রাজেনের-গোত্র মানুষগুলির দেহ থেকে বাসস্থান, সবই বিশৃঙ্খল। আর এ যেন রাজেনের পুজোর ঘর। বৈরাগীর আলখাল্লা বটে। সেটি ধূলিমলিন নয়। যেন সাজি মাটি দিয়ে কাঁচা। কোথাও ত্রুটি নেই। অনুষ্ঠানের সবকিছু সাজানো থরে থরে।
রাজেনের কথা শুনতে শুনতে, এক সময়ে আর চোখ ফেরাতে পারল না সুমিতা। যেন আর এক মূর্তিতে দেখছে সুমিতা রাজেনকে। চোখের দৃষ্টি তার যেন কোনও সুদূরে নিবদ্ধ। যেন ধ্যান-ভাঙা চকিত রাজেন রুদ্র সন্ন্যাসীর মতো দেখছে চারদিকে। কী এক সর্বগ্রাসী অনাচার দেখে, প্রাণ তার ফুঁসছে ভিতরে ভিতরে। জীবনে কোনও ভান নেই তার। টান নেই ঘরের, প্রেমের, কোনও মানুষের। তার শক্ত নিষ্ঠুর বিশাল কপালে আঘাত করছে ঝড়। কিন্তু ঝড়োপাখিটা তীক্ষ্ণ চোখে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার আসল ঠাঁই। অস্থির, উদ্দীপ্ত, কিন্তু মন যেন পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত। তাকে এক জায়গায় কেন্দ্র করে, নিশানা ঠিক করতে পারছে না।
অথচ বাইরে সেই বিক্ষুব্ধ অন্তরের কোনও ঢেউ খুঁজে পাওয়া যায় না। মনের মধ্যে বার বার চমকে উঠল সুমিতার। একটা সুদূর ভয় ওর প্রাণের দরজায় নাড়া দিতে লাগল। কিন্তু নিকটে ওর সমস্ত প্রাণটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। চোখ ফেটে জল আসছে ওর। দুঃখে নয়, এক বিচিত্র আশায়, আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগল সারা অন্তর।
এ কীসের অনুভূতি, জানে না সুমিতা। রাজেনকে দেখে ওর আশা মিটছে না। রাজেনকে দেখে ওর প্রাণে ভয়েরও সীমা নেই। এত সুন্দর মানুষ কাউকে দেখেনি সুমিতা। কিন্তু এত ভয়-ভয়ও কাউকে • দেখে হয়নি।
হঠাৎ রাজেনের দৃষ্টি পড়ল সুমিতার ওপর। বিদ্যুৎ চমকাল তার চোখে। বলল, কিছু বলছ সুমিত্র।
এক মুহূর্ত লাগল সুমিতার সংবিৎ ফিরে আসতে। পরমুহূর্তে আরক্ত মুখে যেন মাটিতে মিশিয়ে গেল লজ্জাবতী। ঘাড় নেড়ে জানাল, না। নির্বাক বিস্ময়ে রাজেন সুমিতার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক নিমেষ। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সুমিতা বলল নিচু গলায়, কত আর দেরি হয়েছে।
রাজেনের গম্ভীর গলা শোনা গেল, অনেক। চলো, আর নয়।
সুমিতা মুখ তুলে দেখল, বলেও রাজেন ফিরে আছে অন্যদিকে। টেবিলের উপর কী যেন দেখছে ঝুঁকে। সুমিতা ডাকল, রাজেনদা।
রাজেন ফিরল। তার মুখে নেমেছে গাম্ভীর্য। সুমিতা বলল, কী হয়েছে? আপনি কি রাগ করেছেন।
রাজেন হাসবার চেষ্টা করে বলল, না তো। রাগ করব কেন? ভাবছিলুম।
কী ভাবছিলেন?
আমার নিজের কথা ভাবছিলুম সুমিতা। শোনবার মতো কিছু নয়। চলো, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
চলুন।
বেরিয়ে এল দুজনে। রাজেন শিকল তুলে দিল দরজায়। উঠোন পার হয়ে এসে পড়ল দুজনে রাস্তায়। একেবারে ভিন্ন রাস্তা ধরে এগুল রাজেন।
সুমিতা নিজেই বলল, ওঁর কথাগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছিনে।
ওঁর অর্থাৎ সুধাময়ীর।
রাজেন বলল, তোমার খুব ভাল লেগেছে বুঝি?
একটু যেন শ্লেষের আভাস রাজেনের গলায়। সুমিতা বলল, শুধু ভাললাগা নয় রাজেনদা। এমন কথা আমি আর কখনও শুনিনি।
রাজেন বলল, শুনেছ, হয়তো এমনি করে শোননি। বাংলা দেশের সব মায়েরাই ওই কথাই তো বলে।
সুমিতা বিস্মিতব্যাকুল চোখে তাকিয়ে বলল, সত্যি! আমার মাকে তো মনেই পড়ে না। কিন্তু আর কারুর মাকে তো আমি এমন কথা বলতে শুনিনি কখনও।
রাজেন বলল, কোন মা চায় সুমিতা, ছেলে তার শুধুমাত্র বিপ্লবী আন্দোলন করুক।
দৃঢ়স্বরে বলল সুমিতা, আপনার মা তো চান।
–সেটা ভুল সুমিতা। মা তা চান না। চান না বলেই তো মায়ের এত যুক্তিতর্ক। আমি যদি আজ বিয়ে করে সংসারী হই, সব ছেড়ে দিই, তবেই মা সুখী।
সুমিতা প্রথমে মনে করেছিল, রাজেন ঠাট্টা করছে। কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল, সেখানে এক বিন্দুও ঠাট্টা নেই। সুমিতা বলে উঠল, কখখনও নয়। উনি তো আপনাকে ফিরে আসতে বলেননি। আপনার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন।
রাজেন হেসে বলল, আমি একটা নীতির দ্বারা চালিত। মা কী করে আমার ভুল শোধরাবেন।
তা হলে আপনাদের নীতিও উনি জানেন।
না, নীতির ধার ধারেন না আমার মা। সবকিছুই যাচাই করে মা তার বিশ্বাস দিয়ে।
–সে বিশ্বাস তা হলে অনেক বড় রাজেনদা। উনি ভালবাসায় বিশ্বাস করেন।
রাজেন বিক্ষুব্ধ নয়, বরং হেসেই বলল, বুঝেছি, তুমি আমার মায়ের দলে ভিড়ে গেছ। মানবকল্যাণের বিশ্বাসটা আমারও আছে। কিন্তু নীতি বিহীন নয়।
সামনেই জনমুখর বড় রাস্তা দেখা যাচ্ছে গলির ভিতর থেকে। এ গলি, সে গলি নয়। মফস্বল শহরের এ গলি এর মধ্যেই নিঝুম হয়ে এসেছে। অল্প দু-একজন পথচারীর দেখা পাওয়া যায়।
একটু নীরব থেকে বলল সুমিতা, আপনি রাজনীতি করেন, নীতি তো আপনার থাকবেই। কিন্তু আমার বড় ভয় করে রাজেনদা, আপনাদের নীতি শেষপর্যন্ত যান্ত্রিক না হয়ে ওঠে।
রাজেন বলল, যান্ত্রিক শব্দটাকে অমন করে অশ্রদ্ধা করছ কেন? সারা বিশ্বেও ওটা আজ ফেলনা নয়, বরং না হলেই চলে না।
সুমিতা চোখ নামাল রাজেনের চোখ থেকে। বড় রাস্তায় এসে পড়তেই, রাজেনের বিশ্ব উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। কেউ ছুটে এসে কথা বলে। কেউ বলে দুর থেকে। হাত তুলে ইশারা করে কেউ। রাজেনও বলে। অধিকাংশই কলকারখানার মজুর। যেন সবাই ওরা এক সংসারের মানুষ। সেলাম নমস্কারের বালাই নেই। কেউ বলে মিলের কথা, সাহেবের কথা কেউ। ইউনিয়নের বিষয়ও আলোচনা করে যায় ওর মধ্যেই। সমস্তটা জুড়ে, এ ছাড়া যেন আর কিছু নেই রাজেনের জীবনে।
সুমিতা দেখল, রাজেনও যেন স্বপ্ন দেখে জেগে জেগে। দুচোখে তার অহংকার নয়, সত্যি সত্যি যেন স্বপ্নই নেমে এসেছে। এক বিচিত্র অনুভূতি যেন ভর করেছে তার মধ্যে। মফস্বলের এই পথে, এক বিশাল বলিষ্ঠ উন্নত মানুষ মনে হচ্ছে রাজেনকে।
আবার কথা ভুলে যায়, তর্ক হারিয়ে যায় সুমিতার। এক নতুন মানুষকেই বারবার দেখে সুমিতা। যার তুলনা ও কাউকে দিয়ে পায় না।
রাজেন বলল, দাঁড়াও সুমিতা, এখান থেকে বাসে উঠতে হবে।
সুমিতা দাঁড়াল। কিন্তু চলে যাওয়ার জন্যে যেন প্রস্তুত হয়নি এখনও ওর মন। ঘরের ভিতর রাজেনের সেই মুখ ফিরিয়ে থাকাটা সংশয়ান্বিত করেছে সুমিতাকে। কেবলি মনে হচ্ছে, আমি ধরা পড়ে গেছি রাজেনের কাছে, ধরা পড়ে গেছি। কিন্তু তাতে সুমিতার কোনও লজ্জা নেই। রাজেন কি কিছু বলবে না আর ওকে। আর এক বারও কি ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করবে না, কেন এসেছিল, বললে না তো সুমিতা।
বাসটা হু হু করে আসছে ধেয়ে। কপালের আলোটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে।
কেন এসেছিল আজ সুমিতা। শুধু কি দেখতে এসেছিল ছুটে রাজেনকে। তা তো নয়, জীবনের একটা বেড়াজালকে ভেঙে, মুক্ত আকাশের তলায় এসেছিল ছুটে। ছোট মেয়েটির মতো, সব বাধা ভেঙে পাগলিনী হয়ে এসেছিল। কিন্তু মুক্ত আকাশের পিপাসা যে মেটে না কিছুতেই। এখুনি যে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না ঘরে।
কিন্তু বাইরের সংসারটা তাড়া দিচ্ছে ওকে। এবার ফিরে যেতে হবে।
বাস এসে দাঁড়াল। জল এসে পড়ল সুমিতার চোখ ফেটে। হাতল ধরতে যাচ্ছিল হাত বাড়িয়ে। হাতটি ধরে সরিয়ে আনল রাজেন। বলল, দাঁড়াও সুমিতা, পরের বাসে যেয়ো।
অসহ্য লজ্জায় ও এক বিচিত্র অনুভূতিতে চোখের জলের প্লাবনটা কিছুতেই রোধ করতে পারল না সুমিতা। কোনওরকমে প্রায় চুপিচুপি বলল, না না, থাক। আরেক দিন আসব।
রাজেন বলল, না, পরের বাসে যেয়ো। চলো, আমরা ওই রাস্তাটা ধরে যাই। সামনেই গঙ্গার ধার পড়বে, মাঠের পথ দিয়ে একটু ঘুরে যাব।
অপেক্ষাকৃত নির্জন একটি রাস্তায় পড়ে সুমিতার লজ্জাটা বেড়েই উঠল। রাজেন ওর পাশে পাশে। যেন প্রচণ্ড একটা বিস্ময়ের ধাক্কাতেই কথা হারিয়ে গেছে তার।
রাজেন বলল, বাড়ি থেকে খুব মন খারাপ করে বেরিয়েছিলে বোধ হয়।
সুমিতা নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে জানাল, না।
তবে?
তবে? তবে? কীসের তবে। কেন কেঁদেছে সুমিতা? সব কথা কি বলা যায়, না সব কারণ জানা আছে সুমিতারই। সুধাময়ী যে বললেন, সব বাঁধন ফেলে ছুটে এসেছে সুমিতা, সে কথাটিও কি মনে নেই রাজেনের।
চোখ তুলল সুমিতা। রাজেনও তাকিয়ে ছিল। চোখ নামিয়ে নিল সুমিতা।
বোঝা যায় গঙ্গা কাছেই। বাতাস ছুটছে হু হু করে নির্জন পথ দিয়ে। দু পাশে পাঁচিলের ধাক্কা খেয়ে, আবর্তিত হয়ে উঠছে।
রাজেনের আজানু-পাঞ্জাবিটা উড়ছে। খোলা বুকের বিশাল সীমানায় পড়ছে ঝাঁপিয়ে। সুমিতার সবই এলোমেলো, এলোচুল এসে পড়েছে ওর বুকের আঁচলে।
দুজনেই যেন সব জিজ্ঞাসাবাদ পার হয়ে এসেছে। তারপরেও যেন কী একটা রয়ে গেছে দুজনের মাঝখানে। তাকে প্রশ্ন করে জানা যায় না। যেন, যত দিন না জানা যাবে তত দিন দুজনে এমনি করেই চলবে, বাতাস ঠেলে এলোমেলো হয়ে। এমনি নিঃশব্দে পাশাপাশি।
সুমিতা মুখ খুলল! বলল, অনেক দিন আসব ভেবেছি পারিনি।
রাস্তার আলোয়, রাজেনের ঠোঁটের কোণে হাসিটুকু দেখা গেল। বলল, আজ পেরেছ।
আবার নীরব।
বাতাস ক্রমেই বেড়ে উঠছে। রাস্তার শেষ সীমানার মাঠ দেখা গেল। নীচেই গঙ্গা। দূর অন্ধকারে, নক্ষত্র প্রতিবিম্বে চিকচিক করছে জলধারা। বোঝা যাচ্ছে, ঢেউ নেই। জোয়ারে ভরে উঠেছে।
সুমিতার বুকের মধ্যে ধুকধুক করতে লাগল। হয়তো মেজদির কথা বলতে রাজেন হেসে উঠবে বিদ্রূপ করে। বলবে, তোমার মেজদিও এক দিন এই চেয়েছিল সুমিতা। কিংবা হয়তো জিজ্ঞেস করবে আশীষের কথা।
কিন্তু রাজেন কিছুই বলল না। শুধু সুমিতার একটি হাত তুলে নিল নিজের হাতে। বলল, অবাক হতে গিয়েও হতে পারলুম না সুমিতা। এই যেন স্বাভাবিক। মনে আমার কোনও গ্লানি নেই। কিন্তু দুঃখ পাচ্ছি এই সংশয়ে যে, জীবনের সবটা এখানেই নয়। তারপরেও অনেক থেকে যায়।
সুমিতার বুকে পশেছে বাতাস। পাগলা ঝোরা বইছে সেখানে। বলল, থাকবে কেন। জীবনের সবটা যেখানে, সেখানে তো কোনও বিধিনিষেধ নেই।
–বিধিনিষেধ নেই, বাধা আছে অনেক।
–সব বাধা ফেলেই এসেছি।
–সে কথা আমি চিরদিন মনে রাখব সুমিতা। কিন্তু আজ সবে শুরু। সুমিতা মাথা নত করে বলল, শুরু হলে, শেষও হয়। আমার শুধু একটা ভয়
–কীসের ভয় সুমিতা?
–আপনাকে বড় কঠিন মনে হয়।
–আমি কঠিন নই সুমিতা। আসলে এই বিশ্বসংসারটাই বড় কঠিন। আমাদের কাজকর্ম বিশ্বাস নীতি চিন্তা, সবই জড়িয়ে গেছে তার মধ্যে। আমার কাছে কোনও কিছুই সহজ নয়। গোটা জীবনটাই কঠিন। তুমিও কঠিন। হয়তো, এই মুহূর্তে তা বোঝা যাচ্ছে না। জীবনের ওই কঠিন জায়গাটাই আমাদের সকলের পাশ ফেলের জায়গা। ফেল করি আমরা বেশি। পাশ করা বড় দুরূহ।
সুমিতা তাকাল রাজেনের চোখের দিকে। অন্ধকারে চকচক করছে চোখ দুটি। রাজেন ওর আর একটি হাত তুলে নিয়ে বলল, কী দেখছ?
সুমিতা মুখ নামিয়ে বলল, তোমাকে।
রাজেনের চোখেও হাসি। এই মুহূর্তে রাজেনের মুখখানি যেন সুধাময়ীর মতো সকরুণ সুন্দর অথচ পৌরুষ মণ্ডিত। বলল, কবে থেকে দেখছ সুমিতা।
–বোধ হয়, প্রথম যেদিন দেখেছিলুম।
.
গেটে ঢুকতে গিয়েই মহীতোষের সামনে পড়ল সুমিতা। দু চোখ ভরা উৎকণ্ঠা নিয়ে মহীতোষ দেখলেন সুমিতাকে। এ কী ধূলিধূসর বৈরাগিনী মেয়ে। বললেন, কোথায় ছিলে রুমনো এত রাত অবধি?
বাবার কাছে কথা লুকোনো অভ্যাস কোনওদিন নেই সুমিতার। কিন্তু নিজেকে নিয়ে বড় বিব্রত ও। এমন মূর্তি কেউ কোনও দিন দেখেনি ওর। চোখেমুখে কোথাও ওর ক্লান্তি নেই। বরং কী যেন নিয়ে এসেছে চোখের চাউনিতে, ঠোঁটের হাসিতে। বলল, একটু হাওড়ায় গেছলুম।
মহীতোষের চোখেও বিস্মিত অনুসন্ধিৎসা। বললেন, হাওড়ায়? কাদের বাড়ি গেছলি?
যেন অবাধ্য বাতাসের মতো সুমিতার চোখমুখ কী একটা বলতে চাইছে। বলল, রাজেনদার সঙ্গে একটু দেখা করতে গেছলুম।
আর কোনও কথা বলবার অবসর না দিয়েই জিজ্ঞেস করল, বড়দি ফিরেছে?
মহীতোষ বললেন, ফিরেছে। কিন্তু তুমি একটু খবর দিয়ে যাওনি কেন রুমনো?
–এত দেরি হবে, বুঝতে পারিনি বাবা।
আমি সারাটা সময় বসে আছি তোমার পথ চেয়ে। আশীষ এসে বসে ছিল অনেকক্ষণ। তারপর মনে হল, যেন একটু রাগ করেই সে চলে গেছে।
রাগ করে?
–রাগ নয়, দুঃখই বলতে পার।
কথাটা শেষ হওয়ার আগে বাবার সঙ্গে আবার চোখাচোখি হয়ে গেল সুমিতার। তারপর প্রায় পালিয়ে গেল সুমিতা। মহীতোষ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ওর পথের দিকে।
পালাবারই সময় এল সুমিতার। আশীষ এলে ও চা করে দেয়। অনেকক্ষণ ধরে কথা শোনে। তারপর আশীষ জিজ্ঞেস করে, তোমার কি শরীর ভাল নেই রুমনো?
সুমিতা একটু বিব্রত হয়ে বলে, ভালই তো।
কিন্তু সর্পিল হয়ে ওঠে আশীষের কপাল। ঢুলুঢুলু চোখে একটা রুগ্ন অস্থিরতা ওঠে ফুটে। বলে, আমার কথা কি তোমার ভাল লাগে না রুমনো?
সুমিতা বলে, কথা তুমি কতটুকু বলো আশীষ। সবই তোমার যন্ত্রণা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস…
বলতে বলতে থামে সুমিতা।
আশীষ যেন ভীরু বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। কেমন যেন শক্ত হয়ে থাকে সুমিতা। আশীষ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারে না।
সুমিতাও যেন নতুন করে বিস্মিত হয়। রাজেনের কাছে যাওয়াটা যেন স্বপ্ন বলে বোধ হয় এক এক সময়। এ বাড়িতে বসে, বাবা, দিদি, আশীষ, এই সমস্ত কিছু থেকে, হাওড়া এত দূরে, মনে হয় সে পথের দূরত্বের সীমা পরিসীমা নেই। সেই বাড়ি, সেই পরিবেশ, সমস্ত কিছুই এক ভয়ংকর বেশে দেখা দেয় ওর সামনে। ভাবে, অসম্ভব, একেবারে অসম্ভব। কেমন করে যাবে ও সেখানে। জীবনের মনের, কোনও কিছুর সঙ্গেই যে রাজেনের মিল খুঁজে পায় না সুমিতা। এখানে তো কোনও দিনই পাবে না রাজেনকে। সবসময় যে রাজেনের কাছেই যেতে হবে। কিন্তু রাজেনের জীবনে ওর দাঁড়াবার জায়গাটা কোথায়।
ভাবে, আবার স্বপ্নটা দুঃস্বপ্নের মতো বিদায় নেয়। অস্থির হয়ে ওঠে রাজেনের কাছে যাবার জন্যে।
ইতিমধ্যে সুগতা এল ফিরে। সারা দেহে তার রূপের বান ডেকেছে। চলতে ফিরতে যেন টলোমলো করে। উপচে পড়তে চায়। দূর দেশ থেকে স্বাস্থ্যের রক্তাভা নিয়ে ফিরেছে গালে।
কখনও এ বাড়িতে থাকে, কখনও মৃণালের ওখানেও থাকে। মৃণালেরও স্বাস্থ্য ফিরেছে। সে একটা নতুন বাড়ি কিনতে ব্যস্ত। দুজনেই নানান জায়গায় বাড়ি দেখে ফিরছে। তারপর মধ্য কলকাতায় আশি হাজার টাকায় বাড়ি কেনা হয়ে গেল। মহীতোষও হেঁটে ডেকে ছুটোছুটি করে বাঁচেন না। ওরা দুটিতে যেন সচ্ছল আনন্দময় জীবনসাগরে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।
মৃণালকে দেখা গেল, ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করতে। আজ এখানে যায়, কাল সেখানে। সুগতা ওর নতুন বাড়িটাকে নিজের কর্মক্ষেত্র করে ফেলল প্রায়। ওরই বাড়িটা ছাত্র সঙেঘর অফিস হয়ে উঠল প্রায়।
অর্থের সঙ্গে কী একটা যোগাযোগ আছে বাইরের জীবনের। সুগতার নেতৃত্বটা প্রচারিত ছিল অনেকখানি। সেটা যেন কেঁপে উঠল হঠাৎ।
মাসখানেক পরে, হঠাৎ এক দিন পাঁচটা নাগাদ তাপসী ডাকল সুমিতাকে। ওদের বাড়ির ফোনে কে ডেকেছে সুমিতাকে। রিসিভার তুলে নিয়েই বড়দির গলা চিনতে ওর ভুল হল না। সুজাতা একটা ঠিকানা দিয়ে বলল, কাউকে না বলে এক বার চলে আয় রুমনো।
যে ঠিকানায় এল সুমিতা উধ্বশ্বাস ভয়ে, সেটা একটা নার্সিংহোম। নার্স ওকে একটা কেবিনে পৌঁছে। দিল। দেখল, সেখানে সুজাতা রয়েছে শুয়ে। গর্তে বসা দুটি অপলক করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
সুমিতা প্রায় কেঁদে চেঁচিয়ে উঠল, কী হয়েছে বড়দি।
সুজাতা বলল, বোস বলছি।
তারপর সুজাতার দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে অনেক কথা বলল, সুজাতা। আজ আর বড় ছোটর কোনও বাধা রইল না দুই বোনের। রুমনিকে ছাড়া আজ আর কাউকে ওর সবচেয়ে বড় কলঙ্কের কথা বলবার লোক পায়নি খুঁজে। সুজাতা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে জানাল সুমিতাকে সব কথা। গিরীনকে ও স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি, তাই গিরীনের দেওয়া সন্তান ধারণও সম্ভব হয়নি সুজাতার পক্ষে। মরবে না সুজাতা, এতে মানুষ মরে না। ও যেন বাবাকে একটা কিছু গুছিয়ে বলে। কেনো সুজাতার মাথায় কিছুই আসছে না।
তারপর সুমিতার দুটি হাতে নিজের মুখ চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলল সুজাতা, এ কথা কাউকে বলিসনে রুমনি, শুধু তোর রবিদাকে ছাড়া। সে ছাড়া আমার কলঙ্কের কথা বলার আর কেউ নেই।
সুমিতার মনে হয়েছিল, ও বুঝি চিৎকার করে কেঁদে উঠবে।
ডাক্তার এসে সুজাতাকে শান্ত হতে বললেন।
ফিরে এল সুমিতা। ফেরবার পথেই রবির বাড়ি গেল, পাওয়া গেল না। রবিদার দিদি বললেন, রবি দিন সাতেকের জন্যে বাইরে গেছে।
সাত দিন পরে সুজাতা বাড়ি ফিরে এল। সুমিতা বলে রেখেছিল, বড়দি আমাকে বলে গেছে, সাত দিনের জন্যে সে ছুটি নিয়ে বেড়াতে গেছে এক বান্ধবীর বাড়ি।
সেইদিনই একটা চিঠি এল, শুভবিবাহের প্রীতিভোজের। রবিদার সঙ্গে অরুণাদির বিয়ে হয়ে গেছে গতকল্য। আগামীকাল প্রীতিভোজ।
.
৩৩.
রবিদার বিয়ের প্রতিভোজের চিঠি। চিত্রার্পিতের মতো কয়েক মুহূর্ত অনড় হয়ে রইল সুমিতা। আজ পূর্ণ হয়েছে সাত দিন। আজই যে ওর যাওয়ার কথা ছিল রবিদার কাছে। নিজের সংশয়, রবিদার সংশয়, সব সংশয়ের কুয়াশা যে এক লহমায় দূর হয়ে গেছে সুমিতার চোখে। সব সংশয় পেরিয়ে ও যে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছে, বড়দি কার মূর্তি বুকে করে ফিরছে। মনে প্রাণে এই বিশ্বাসই যে ছিল সুমিতার। মনে মনে তো তৈরি করেনি। যে সত্যকে দেখেছিল বড়দির চোখে, তাকে সুমিতা সাজিয়েছিল ওর মনের ইচ্ছে দিয়ে।
মহীতোষ চলে গেছেন কাজে। সুগতা ওর নিজের বাড়িতে। কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে সুজাতা। শুয়ে আছে তার ঘরে।
বৈশাখের বাতাস ফিরছে আগুন নিয়ে।
সুমিতার মনে হল, ওরই অসহায় জীবনের সমস্ত সান্ত্বনা, সব আশা ব্যর্থ করে গোটা সংসারটা পুড়ছে রুদ্রচণ্ড-তাপে। মনে হল, রবিদার কাছে সঁপে দেওয়ার জন্যে নিজেই যেন প্রতীক্ষা করে ছিল এত দিন। বড়দিনয়, সুমিতা নিজেই সেই ছদ্মবেশিনী অভিমানিনী প্রেমিকা। যার বুক বিদীর্ণ হয়েছে অন্তরে অন্তরে, কিন্তু মুখ ফোটেনি। জীবনের ফুল আর ফলহীন পাতাবাহারের রংঝাড় যাকে বিপথে নিয়ে মেরেছে এলোপাতাড়ি। মার খেয়েও সে হৃদয়ের নির্দেশে উজানে দিয়েছে পাড়ি। কিন্তু পাড়ি দেওয়ার সব সাহসকে ভেংচে, শ্লেষ করে ওর হাতের চিঠি যেন হাসতে লাগল।
রবিদার মুখখানি মনশ্চক্ষে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল সুমিতা। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না। কিছুতেই না। চোখ ফেটে জল এসে পড়ল, এমনকী, রবিদার গলার স্বরও যেন বাজতে লাগল কানে। তবু কী এক বিচিত্র কুয়াশা ঢেকে রাখল রবিদাকে।
ঠিক এই মুহূর্তে, একেবারে পিছনেই সুজাতার ডাক শুনে চমকে উঠল সুমিতা। ওর বুকের অকূলে চিঠি লুকোতে উদ্যত হয়েই থেমে গেল।
সুজাতা বলল, কীসের চিঠি ওটা রুমনো।
রং নেই সুজাতার মুখে। রূপে ও স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা ঘিরে থাকত ওকে। সে মূর্তি শাণিত, খবরা। এখন সেই দীপ্তিটুকু শান্ত, স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে।
লুকোবার অবসর পেল না সুমিতা। সহসা কোনও মিছে কথা জোগাল না মুখে। শুধু ব্যথিত-উৎকণ্ঠায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এক নিমেষ। তারপর চিঠিটা বাড়িয়ে দিল সুজাতার দিকে।
চিঠি পড়ে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল সুজাতা। চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন পুড়িয়ে ছাই করে দিল সারা মুখখানি। নীরক্ত মুখে কল কল করে স্বেদধারা গড়িয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে একটা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
সুমিতা পালিয়ে যাবার জন্যে ছটফট করেও পালাতে পারছে না। ভয় হচ্ছে, বড়দি সামলাতে পারবে না।
একটু একটু করে যেন সুজাতা ফিরে এল নিজের কাছে। চিঠিটা রেখে দিল, টেবিলের ওপর। তারপর সুমিতার দিকে ফিরে, কাছে এসে শান্ত গলায় বলল, কাঁদিসনে রুমনো।
কথাটির মধ্যে ঘটনার সবচেয়ে মর্মান্তিক রূপটিই যেন ধরা পড়ে গেল। সুমিতা আঁচল চাপল মুখে।
সুজাতা সুমিতার পিঠে হাত রেখে কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, বিলাসকে ডেকে বল রুমনো, একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে।
সুমিতা ওর ভেজা চোখে উদ্বেগ নিয়ে বলল, কোথায় যাবে বড়দি?
সুজাতা যেন বড় শান্ত। ধীর পায়ে একটি সোফায় গিয়ে বসল। বলল, এক বার কারদেজোর অফিসে যাব।
–আজ থাক না বড়দি।
সুজাতা বলল, কোনও ভয় নেই রুমনো। শরীর আমার ভাল আছে।
সুজাতার শান্ত স্থির মূর্তির দিকে তাকিয়ে ভয়ে কেঁপে উঠল সুমিতার বুক। কাছে এসে বলল, হঠাৎ কেন যেতে চাইছ বড়দি।
সুমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল সুজাতা। স্নিগ্ধ শান্ত সেই হাসিতে যেন একটি স্বপ্নের সুদূর অস্পষ্ট। বলল, একটু কাজ আছে। শুভেন্দুকে কয়েকটি কথা বলতে হবে।
আমি যাব তোমার সঙ্গে।
কেমন যেন ক্লান্ত সুজাতা, বাধা দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। বলল, চল।
গাড়ি ডেকে নিয়ে এল বিলাস। সুজাতা কাপড় বদলে, পাউডার বুলিয়ে, কালো গগলস অটল চোখে। লিপস্টিক বুলিয়ে নিল ফ্যাকাশে ঠোঁটে। প্রতিটি মুহূর্তে সুজাতার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি লক্ষ করে দেখল সুমিতা। কী এক গভীর ভাবনায় বিভোর বড়দি। থেকে থেকে কুঁচকে উঠছে জ্বলতা। ঠোঁটের কোণে একটি সর্পিল রেখা চিকচিক করে উঠছে বিদ্যুতের মতো। যেন কী ভুলে গেছে। কী মনে পড়ছে থেকে থেকে।
কারদেজোর লিফটে ওঠবার সময় মনে হল, বড়দির মধ্যে একটি চাপা উত্তেজনা থমথমিয়ে উঠছে।
শুভেন্দুর সুসজ্জিত ঘরের কাছে এসে সুমিতা চুপি চুপি বলল, আমি ভিতরে যাব বড়দি? সুজাতা বলল, যাবি বইকী।
ঘরে ঢুকতেই শুভেন্দু এক নিমেষ স্তব্ধ হয়ে রইল। পরমুহূর্তেই প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হেল্লো, এসো।
সুমিতাকে দেখে আরও উৎসাহিত হয়ে উঠল। কিন্তু বিস্ময়ে তার রক্তাভ মুখ আরও লাল হয়ে উঠল। বলল, আসুন, আসুন।
সুজাতা বলল, আমার ছোট বোন সুমিতা।
–আই সি! চিনি তো আমি।
একটি অ্যাংলো মেয়ে সুজাতার টেবিলে কাজ করছিল। শুভেন্দু তার দিকে ফিরে বলল, ইউ মিস, ইফ ইউ কাইন্ডলি লিভ আস ফর এ ফিউ মিনিটস।
–ও, শিওরলি।
মিস তার কালো চোখের কটা চাউনি দিয়ে দুই বোনকে দেখে বেরিয়ে গেল হিল খটখটিয়ে।
সুমিতা অবাক হয়ে দেখল, শুভেন্দু এক পলকের জন্যও চোখ ফেরাতে পারছে না বড়দির উপর থেকে। ঠিক নির্লজ্জ নয়। মুগ্ধ নয়নে যেন সঁপে দিতে চাইছে।
শুভেন্দু বলল,হঠাৎ যে, আজ তো জয়েনিং ডেট নয়।
সুজাতা বলল, একটু বিরক্ত করতে এলুম।
শুভেন্দুর মুখ দপদপিয়ে উঠল। আত্মহারা সুরে বলল, সো কাইন্ড অব ইউ।
সুজাতা মুখ নামিয়ে বলল, একটা বিশেষ প্রত্যাশা নিয়ে এসেছি। শুভেন্দুর যেন বুক দুরু দুরু করছে। উত্তেজনায় কথাও বলতে পারছে না বুঝি। কোনওরকমে অস্পষ্ট গলায় বলল, উপায় থাকলে কোনও ত্রুটি হবে না।
সুজাতা বলল, তেমনি মুখ নামিয়ে রেখেই, কারদেজোর বোম্বে অফিসে আমি যেতে পারিনে কোনওরকমে?
ঠিক যতখানি চমকে উঠল সুমিতা, ততখানি শুভেন্দু। বলল, হঠাৎ?
হঠাৎ নয়, অনেক দিন থেকেই ভাবছিলুম। বলতে ভরসা পাইনি। ব্যাকুল চোখ মেলে ধরল সুজাতা শুভেন্দুর উপর। দুচোখে তার অশেষ মিনতি।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ নিস্তব্ধতা সারা ঘরে। শুভেন্দু চোখ সরিয়ে নিল সুজাতার মুখ থেকে। পেনসিল দিয়ে রাফ প্যাডের উপর হিজিবিজি কাটতে লাগল। হিজিবিজি, কেবলি হিজিবিজি। শুভেন্দুর মগজটাই যেন কাগজে দাগ ফেলছে। সুমিতারও।
সংশয় ছিল, নানান কথা জিজ্ঞেস করবে শুভেন্দু। কেন, কী হয়েছে। কিন্তু কিছুই না জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ পেনসিলটা রেখে দিয়ে বলল, ইয়েস ইউ ক্যান।
আমার সাত দিন সময় চাই। হেড অফিস থেকে ব্রাঞ্চে পাঠাতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
সাত দিন?
সুজাতা এতটা আশা করেনি। কী যে বলবে ভেবে পেল না খানিকক্ষণ। তারপরে বলল, নিশ্চয় হবে। সাত দিনের দুদিন বেশি হলেও ক্ষতি নেই। শুধু যাওয়া হলেই হয়।
শুভেন্দু যেন ফুলছে আর লাল হচ্ছে। বলল, হবে, হবে না কেন! এটা আমারই ক্ষমতার মধ্যে। অথরিটির সঙ্গে একটু কথা বলে নিতে হবে, একটা চিঠি পাঠাতে হবে বোম্বের অফিসে। যেদিন জবাব আসবে, সেইদিনই তুমি স্টার্ট করতে পারবে।
এবার যেন সুজাতার পক্ষ থেকেই কিছু বলার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। শুভেন্দু যে এমনি করে রাজি হবে, ভাবতেও পারেনি। তাড়াতাড়ি এই আবহাওয়াটা কাটাবার জন্যে বলল, অমলা আসে?
শুভেন্দু আবার আগের মতো দেখছে সুজাতাকে। বলল,হ্যাঁ আসে। তোমার কথা রোজই বলে। ওর স্বামী চলে গেছে। একলা আছে এখন।
–কোথায় আছে?
–ওই বাড়িতেই, তবে ছেড়ে দেবে দুচারদিনের মধ্যেই। পার্কসার্কাসে কোথায় একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। তুমি আসার আগেই ফোন করছিল। আজ তো শনিবার, ও টালিগঞ্জে গেছে।
রেস খেলতে গেছে অমলা।
আবার খানিকক্ষণ নীরবতা। সুজাতা বলল, কী হবে ওর, মিঃ কর?
শুভেন্দু এক বার সুমিতাকে দেখে, আবার সুজাতার দিকে ফিরে বলল, কার কী হবে, আমরা কি কেউ জানি?
সুমিতাও বুঝল, কথার ছলে এ শুধু শুভেন্দুর বড়দিকেই বিশেষ জিজ্ঞসা।
সুজাতা বলল, তা ঠিক। আমরা কেউ কিছু জানিনে।
শুভেন্দু বলল চাপা মোটা গলায়, নিজেদের কথাই আমরা জানিনে। আমি কেন কলকাতায় আছি, তুমি কেন বোম্বেতে যাচ্ছ, অমলা কেন টালিগঞ্জে গেছে।
বলে ভাবলেশহীন মুখে হঠাৎ একটু হেসে উঠে বলল, আর কেনই বা সুমিতা দেবী তোমার সঙ্গে ঘুরছেন।
আরক্ত হয়ে উঠল সুমিতা। কিন্তু এই লোকটার উপর অনেক দিন ওর যে মনটা বিরূপ ছিল, সে হঠাৎ ব্যথিত হয়ে উঠল।
সুজাতা বলল, ওকে আপনি বলার দরকার নেই। মনটা বোধ হয় ভাল ছিল না, তাই বেরিয়ে পড়েছে আমার সঙ্গে।
শুভেন্দু বলল, না না আমি কোনও কারণ জিজ্ঞেস করিনি। বলছিলুম, আমরা কেউই কিছু জানিনে।
–ওর সামনে কোনও সংকোচের কারণ নেই।
শুভেন্দুর মনের উত্তেজনা দেহেও চাপা থাকে না। বলিষ্ঠ পেশল শরীরটা তার জামা-প্যান্টের ভাঁজে ভাঁজে ছটফটিয়ে মরতে লাগল। চোখ দুটিও লাল হয়ে উঠেছে আগের তুলনায়। বলল সংকোচ করব কেন। আই অ্যাম নট এ বুট অর আনফেইথফুল, বাট আই অ্যাম এ নন বিলিভার। আমাকে তুমি একটা ঘাগি অবিশ্বাসী বলতে পারো, তার জন্যে আমার ব্যবহার নিশ্চয় তোমাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। আমাকে।
না, না…
–দেন, ইউ হ্যাভ এ গ্রেট হার্ট। করলেও আমার বলার কিছু থাকত না। আমি যা, আমি তাই। তাতে যদি তুমি দুঃখ পেয়ে থাক, আমার মুখের কথায় শুধু দুঃখ দূর হবে না। শেষ পর্যন্ত আমরা কেউ জানি বা না জানি, একটা জিনিস জানি। আমরা সবাই সুখ চেয়েছি। আমি তোমার সুখ কামনা করি।
-সুখ?
–হ্যাঁ। শান্তি পাওয়া সবচেয়ে কঠিন, ওটা কেমন করে পাওয়া যায় আমি জানিনে। আর…
–আর?
–যদি বোম্বে থেকে কখনও ফিরে আসবার ইচ্ছে হয়, আমাকে লিখতে পার।
সব বলেছে শুভেন্দু কিন্তু কেন সুজাতা চলে যাচ্ছে, এক বারও জিজ্ঞেস করল না।
পথে বেরিয়ে সুমিতা বলল, একী করলে তুমি বড়দি।
সুজাতা যেন অনেক দূর চলে গেছে নিজেকে নিয়ে। তেমনি সুদূর হেসে বলল, কী আবার করলুম?
–তুমি চলে যেতে চাইছ আমাদের ছেড়ে?
কাছে থেকেও যে অনেক দিন পালিয়ে বেড়ালুম রুমনো। নিজের কাছে থেকেও পালিয়ে বেড়িয়েছি সবসময়। এবার একটু নিজের কাছে ধরা না দিয়ে আর কিছুতেই পারব না ভাই।
বলতে গিয়েও হাসল সুজাতা। জল আসে সুমিতার চোখে। কিন্তু রাস্তার মাঝখানে সেটা ওকে ঠোঁট টিপে রোধ করতে হল।
বলল, বড়দি, একটা কথা বলব?
বল।
চলো, একটু রবিদার সঙ্গে দেখা করে আসি।
একটু চমকাল না সুজাতা। একটু চিন্তিত দেখাল। কিন্তু আশ্চর্য! কী এক সর্বনেশে শান্ত হাসি যে লেগে রয়েছে ঠোঁটে। একটু চুপ করে থেকে বলল, যেতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু একটু ভেবে দেখতে হয় রুমনো। রবি হয়তো বড় অস্বস্তি বোধ করবে।
মিথ্যে নয়। সুমিতা বলল, আমি একটু যাই বড়দি?
যাবি? যা!
এ যেন সেই সুজাতাই নয়। মনের সব দরজাগুলি সপাটে খুলে দিয়েছে। বাতাস লুটোপুটি খাচ্ছে। সেখানে। কোনও বাঁধন নেই, বাধা নেই। ভাবনা নেই, চিন্তা নেই।
সুমিতা এল রবির বাড়িতে। রবির বাড়ি নয়, অরুণাদির বাসা। রবির এইটাই ঠিকানা ছিল চিঠিতে। ভেবেছিল, এসে একটা খুব হই চই দেখবে।
কিন্তু কোনও সাড়া শব্দও নেই তো। কড়া নাড়ল। দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল অরুণা। চিনতে পারল না সুমিতাকে। বলল, কাকে চান? সুমিতা দেখল, এর মধ্যেই সিঁদুর উঠেছে অরুণার সিথেয়। মনে হয় কত দিনের বিবাহিতা মেয়ে যেন। বলল, আমার নাম সুমিতা। রবিদা আছেন? অরুণা সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে ধরল সুমিতার একটি হাত। হেসে বলল, ওমা, তুমি। তোমাদের কথা কত শুনেছি। এসো, রবি শুয়ে আছে।
একেবারে শোবার ঘরে নিয়ে গেল অরুণা সুমিতাকে। রবি প্রথম দৃষ্টিপাতে একটু অবাক হল। তারপর হেসে বলল, রুমনো সাহেবা যে!
নিমন্ত্রণ তো কাল, তোমার উপস্থিতি এত অগ্রিম কেন?
সুমিতা মনে মনে অস্থিরভাবে ভগবানকে ডাকতে লাগল। হে ভগবান, আমাকে যেন লুম। না জানিয়েই বিয়ে করে ফেললেন যে?
রবি আর অরুণা এক বার চোখাচোখি করল। বলল, তোমাকে না জানানোটা আমার বড়কাঁদিয়ো না, আমাকে কাঁদিয়ো না। হাসবার চেষ্টা করে বলল সুমিতা, খবর পেয়েই ছুটে এ অন্যায় হয়ে গেছে রুমনো সাহেবা। কিন্তু কাজটা বড় হঠাৎ হয়ে গেছে।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল সুমিতা ওর রবিদাকে। কই, কোথাও তো কোনও পরিবর্তন হয়নি। সেই মানুষ, সেই হাসি, সেই চাউনি। কবেই বা পরিবর্তন হবে। কালকেই তো রেজিস্ট্রি হয়েছে। দুজনের আলাপ পরিচয় অনেক দিনের।
অরুণা আদর যত্নের ক্রটি তো করলই না। বরং কোথায় একটা সংকোচ তাকে সুমিতার আরও কাছেই এনে দিল। দু-একবার বড়দির কথাও জিজ্ঞেস করেছে। মেজদিকে চেনে খুব বেশি, যাতায়াতও আছে। ঘনিষ্ঠতাও কম নেই দুজনার মধ্যে।
কালো অরুণা, অত্যন্ত সাদাসিধে চোখ মুখ। তবু, কালো সাধারণ অরুণার চোখে মুখে একটি আশ্চর্য অসাধারণত্ব ছিল, যেখানে মাথা নত করতেই হয়, ভালবাসতেও ইচ্ছে করে।
শেষ পর্যন্ত অরুণাকে ভালবেসেই ফিরল সুমিতা। এগিয়ে দিতে এল রবি। জিজ্ঞেস করল, রুমনো, তুমি কিছু বলতে এসেছিলে আমাকে।
আর কেন যে জিজ্ঞাসা। বড় মর্মান্তিক কথাই যে বলতে আসার কথা ছিল সুমিতার। কিন্তু সে কথা আর কোনও দিন বলার দরকার হবে না।
বলল, না, কিছু বলতে আসিনি। চিঠিটা পেয়ে না এসে পারলুম না। কিন্তু রবি এক বারও জিজ্ঞেস করল না, অরুণাকে কেমন লেগেছে সুমিতার। বলল, কাল আসছ তো?
সুমিতা ঢোঁক গিলে বলল, আসব।
কাকাবাবুকে বোলো, নিজেই যেতুম। সময় করে উঠতে পারছিনে। তারপর সুগতার কথা,অন্যান্য বিষয় আলোচনা হল।
রবি জিজ্ঞেস করল, সুজাতা চাকরি করছে?
কাঁদিয়ো না, হে ভগবান, আমাকে কাঁদিয়ো না। নিঃশব্দে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল সুমিতা।
রবি বলল, আমাকে তোমার খারাপ লাগছে না তো রুমনো।
না না, রবিদা।
–তবে তুমি বলো, কী বলতে এসেছ।
সহসা যেন কী ম্যাজিক হয়ে গেল। সুমিতার ভগবান তার চোখের জল ধরে রাখল না। বলে ফেলল বড়দির কথা, যে কলঙ্কের কথা সুজাতা শুধু রবিকেই বলতে বলেছিল। সুজাতার বোম্বে যাওয়ার কথাও বলে ফেলল।
অনেকক্ষণ চুপচাপ, রবি হেঁটে চলল সুমিতার পাশে পাশে। তারপর হঠাৎ এক সময় দাঁড়াল। সুমিতা দেখল, রবির মুখখানি যেন অনেকখানি উদাস-গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, আর নয়, এবার ফিরি রুমনো। কথাটি যে এমন হঠাৎ বলবে, ভাবতে পারেনি সুমিতা। সুমিতার বিস্ময় দেখে রবি বলল, ফিরে যাই ভাই রুমনো। অনেক দূর এসে পড়েছি। একটা কথা তোমাকে বলি, এ জীবনে আমরা কে কতখানি সুখ পেয়েছি কি দুঃখ পেয়েছি, কে কী হারিয়েছি আর পেয়েছি, সে হিসেব যেন কেউ না করি। হিসেব করে লাভ নেই, কেনো, আমরা তো যা খুশি তাই করতে পারিনে। জীবন তো অকৃপণ নয়, তার কোটি কোটি হাত বাড়ানো রয়েছে। আমরা যেন সবই নতুন করে শুরু করতে পারি।
.
এই শেষ কথা রবিদার। সুমিতার ভয়ের কোনও কারণ ছিল না। সুজাতা ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি রবিদার কথা। মাঝখান থেকে, কাছে কাছে থেকে শুধু শুধু বাবাকেই পাগল করল সুজাতা।
মহীতোষ কাঁদতে পারলেন না। কিন্তু ওঁর নীরবতার একটা সীমা ছিল বরাবর। এবারকার নীরবতা কোনও সীমা আনল না। সুজাতার যাওয়ার দিন খালি সকালবেলা বললেন, উমনো, আমাকে একটা করে চিঠি দিস, সপ্তাহে সপ্তাহে।
সুজাতা বলল, দেব বাবা।
সব ব্যবস্থাই করেছে শুভেন্দু। এমনকী, বোম্বেতে সুজাতার নিরাপদ বাসস্থান পর্যন্ত।
সবাই মিলে তুলে দিতে গেল সুজাতাকে। সুগতা, সুমিতা, মহীতোষ, চাকর বিলাস। ছিল না শুধু মৃণাল।
গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সুজাতা সুমিতাকে কাছে টেনে বলল, ছুটির সময় আমার কাছে
আসিস রুমনো। বাবাকে দেখিস।
লোকে থিয়েটার দেখতে যায় কত কী বিচিত্র ধারণা ও কৌতূহল নিয়ে। অডিটরিয়মে বসে নাটক দেখতে দেখতে মানুষ যেন কোন অন্য জগতে চলে যায়। প্রতিটি নাটকীয় মুহূর্তে মানুষ হাসিতে আনন্দে ভয়ে কেমন করে। সে তো নাটক, লেখা নাটক। নাট্যকারকে তখন দূর অদৃশ্য থেকে মনে হয় তিনি যেন এক অতিমানব। রহস্য-ঘেরা মানুষ।
তুমি বলো, ও সব ভাববাদীদের কথা ছাড়া সুমিতা। জীবনটাকে নাটক বললে, আমাদের দেশে তার খারাপ মানে হয়। যত অসামাজিক জীবগুলো যে জো পেয়ে যায়। ভাবে, তবে সংসারটা বুঝি সত্যি রঙ্গমঞ্চ। কোথায় কোন এক নাট্যকার বসে বসে আমাদের নিয়ত গড়ছেন, তিনিই আমাদের নিয়তি। তিনি যেমন গড়েছেন, আমরা তেমনি। যেমন যেমন পাঠ লিখেছেন, আমরা তেমন তেমন বলি। সবগুলো মিথুকের দল। নিজেদের অন্যায়কে, অক্ষমতাকে ঢাকবার জন্যে অকারণ এক কাল্পনিক নাট্যকারের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া। এত সহজে কি চিড়ে ভেজে? বেঁচে থাকতে হলে সুদ সমেত সব কিছুর শোধ দিয়ে যেতে হবে। অথর্বের হাতের মোয়া নয় জীবনটা। আর সাহিত্যের কথায় যদি বলল, তবে এইটুকু জানি, রঙ্গমঞ্চের নাটকটাও আমাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। যা খুশি তাই করবার অধিকার নেই নাট্যকারের, যেমন সেই আকাশের নাট্যকার নাকি করে থাকেন।
সে ঠিক কথা। কিন্তু আজ আমারও বলতে ইচ্ছে করছে জীবনটা বুঝি সত্যি নাটক। আর সেটা থিয়েটারের চেয়ে অনেক বড় নাটক। এতখানি নাটকীয়তা কোনও স্টেজের নাটকেও বোধ হয় থাকে না। বড়দির কথা তোমাকে লিখেছিলুম। শুনলে অবাক হবে, আমার বড় ভয় করছে, মেজদির সঙ্গে মৃণালদার বড় রকমের ফাটল ধরেছে। ধরেনি, ফাটল ছিল। দুজনের জীবনের আসল ভারটুকু পড়তেই ফাটলটা অনেকখানি ফাঁক হয়ে পড়েছে। আর বড়দির ব্যাপারের জের কাটতে না কাটতেই, এ ব্যাপারটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বাবা শুধু মুখের দিকে তাকাচ্ছেন আমাদের। আমি বোধ হয় বড় স্বার্থপর। বাড়িতে এই অবস্থা। লেখাপড়া আমার মাথায় উঠেছে। তার ওপরে ভাবছি, আমার কী হবে। আমি যে পাষাণে প্রাণ বেঁধেছি কিনা, তাই বড় ভয়, বড় ভয়।
এই পর্যন্ত রাজেনকে লিখে সুমিতা থামল।
.
৩৪.
প্রথমে ভাবল সুমিতা, নিজের কথাটুকু কেটে দেবে। তারপরে আবার কী ভেবে লিখলে, নিজের কথা থাক। যা লিখতে বসেছি, তাই লিখি।
বাড়িটা যে কী সাংঘাতিক রকম ফাঁকা, লিখে বোঝাতে পারিনে। দেখতে দেখতে কত দিন কেটে গেল। এক মাস আগেও তোমার কাছে গিয়েছি। কিন্তু সে যেন এক যুগ আগের কথা। কারণ আর কিছুই নয়, বড় ফাঁকা।
বাবা চলে যান বেলা দশটার মধ্যেই। বড়দি তো নেই-ই। তবু প্রতি মুহূর্তেই মনে হয়, বড়দি রয়েছে ওর ঘরেই। অচলা প্রতি দিন বড়দির ঘরটা পরিষ্কার করে রাখে। পরদাটা ঠিক তেমনি বাতাসে দোলে। একটু বেশি সরে গেলেই যেন দেখা যাবে, গালে হাত দিয়ে বসে আছে বড়দি। কয়েকদিন বড়দির ঘরে শুতে গিয়ে ফিরে এসেছি। কেবলি মনে হয়, একটা রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণা ওই ঘরটার মধ্যে অষ্টপ্রহর পাক খাচ্ছে। দেয়ালের ছবিগুলির দিকে এখন নিঃসংকোচে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ। মনে হয় ছবির চরিত্রগুলির প্রাণেও যন্ত্রণা। এ বাড়ির যা-কিছু, সব আমার চোখে বেশি করে পড়ে। আমিই এখন বেশিক্ষণ থাকি এ বাড়িতে। একলা থাকি। তবু কী আশ্চর্য! আমি যেন দেখতে পাই, দুটি অদৃশ্য করুণ চোখ নিয়ত এ বাড়ির প্রতি রন্ধ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিঃশব্দ নির্বাক, সেই চোখ শুধু করুণ নয়, বড় অসহায়।
সেই চোখ দুটি বাবার। আড়াল থেকে দেখেছি, বাবা প্রতি দিন এক বার বড়দির ঘরে যান। টেবিলের সামনে বড়দির চেয়ারটিতে বসেন একটু। কোনও কোনওদিন বিলাসকে ওইখানেই চা দিয়ে যেতে বলেন। আর কিছুই না। কথা আজকাল কমই বলেন। কিন্তু চোখের চাউনিটা একেবারে বদলে গেছে।
আজকাল বাড়ি এসে আগে একটি কথাই জিজ্ঞেস করেন আমাকে, ঝুমনো এসেছিল? এলে বলি হ্যাঁ, নইলে না।
আমার যেখানে ভয় ধরেছে, বাবার সেখানে সংশয় দেখা দিয়েছে। এই সংশয়ের বশেই বাবা আমার দিকেও যেন কেমন করে তাকান। ভাবটা, যেন পৃথিবীটার চেহারা ওঁর চোখে অন্যরকম হয়ে গেছে। কোথাও তার তল খুঁজে পান না।
আগে মেজদি একেবারেই আসত না। প্রায় ভুলেই গেছল আমাদের। এখন প্রায় রোজই আসে। কোনও কোনওদিন থেকেও যায়। বাবা যদি বলেন, মৃণাল ভাববে না? মেজদি এমনিতে চিরকালই একটু সোজা কথার মানুষ। জবাব দেয়, কী আবার ভাববে। আজকে আর ওখানে যেতে ভাল লাগছে না।
সবচেয়ে আশ্চর্য, মৃণালদাও কোনও খোঁজ নিতে আসে না। এর অর্থ, হয় দুজনের জানাজানি আছে। নয়তো কেউ কারুর খবর রাখে না। রাখলেও দুর্ভাবনা নেই।
কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় ভয়, জানাজানি কিছু বোধ হয় নেই আর ওদের। তাই যে কোনও নাটকের চেয়ে, জীবনের এই নাটকে অন্তহীন বিস্ময়। ভয়ের আগে যেদিন আমার মনে প্রথম সংশয় দেখা দিল, বড় অস্থির হয়ে পড়েছিলুম। কলেজ ছুটি হলেই তাই মেজদির বাড়ি যাচ্ছিলুম কিছুদিন ধরে। একটানা নয়, দু-একদিন বাদে বাদে। কেনো, ওরাই যদি আবার কিছু ভেবে বসে। কিন্তু আমি তো গোয়েন্দাগিরি করতে যাইনি। আমি যে না গিয়ে পারিনি। তুমি যেন ঘুণাক্ষরেও ভেব না, মেজদি মৃণালদার ব্যাপার বলে তোমাকেই বিশেষভাবে লিখছি। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমার কিছু জানাবার নেই। বড়দিকে জানাতে পারতুম। কিন্তু সে বিদেশে একলা থাকে, তাকে কোনও দুঃসংবাদই আমি দিতে চাইনি।
প্রথমটা দেখলুম, মেজদি-মৃণালদা দুজনেই ব্যস্ত। মেজদি ওর ছাত্রদের নিয়ে, মৃণালদা ব্যবসা। মৃণালদার দিদিমা মারা গেছেন। সম্পত্তি ও অর্থ যা পাওয়ার, পেয়ে গেছে সে। বাবা মায়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই। সে সব মৃণালদার বড় একটা ছিল না কোনওকালে। এ সব অবশ্য আমার চেয়ে তুমিই ভাল জানো। মৃণালদা তোমাদেরই বন্ধু। আমি এবং সবাই দেখছে সে উপার্জনে ব্যস্ত। কিন্তু খরচের ধাক্কাটাই প্রবল। আয় নেই, ব্যয় জলের মতো হচ্ছে। অথচ সে সব নাকি নতুন আয়ের জন্যেই। মৃণালদা যে ব্যবসার জন্যে কোনওদিন উঠে পড়ে লাগবে, আগে মানুষটিকে দেখে কিছুই বোঝা যায়নি।
এক সময়ে যেমন মেজদিকে নিয়ে ঘুরেছে পাগলের মতো, এত অল্পদিনের মধ্যেই, তেমনি পাগলের মতো ফিরছে ব্যবসার পিছনে। লোহার বাজার থেকে বিল্ডিং মেটেরিয়েলস এবং ইন্সিওরের ফার্ম পর্যন্ত।
মেজদি এ সব জিনিসকে কীভাবে নিয়েছে, বোঝা মুশকিল। ও শুধু স্থির গম্ভীরভাবে সব দেখছে চেয়ে চেয়ে। বাড়িতে ওর কাছে যারা আসে, তাদের সঙ্গে মৃণালদা খুব ভালভাবেই কথা বলে। ভাবখানা যেন, আমি আছি তোমাদের সঙ্গে। কাজের চাপে বড় ব্যস্ত। তাই এখন আর সর্বক্ষণ কাছে কাছে থাকতে পারিনে।
কিন্তু মেজদির দিকে চাইলেই বোঝা যায়, সেখানে যেন কী থম থম করছে। মৃণালদা মেজদির দিকে তাকিয়ে ভাল করে যেন কথাই বলতে পারে না। মৃণালদা এসেই হয়তো বেরিয়ে পড়তে চায়।
মেজদি হঠাৎ ডাকে, কোথায় চললে আবার?
মৃণালদা কেমন যেন থতিয়ে যায়। বলে, অ্যাাঁ, না, কোথাও নয়। বাড়িতেই আছি।
কিন্তু সেটা যে ছলনা, আমি তা ধরে ফেলেছি। নিজেই, ভয়ে বিস্ময়ে নিঃশব্দে বারংবার চিৎকার করেছি, কেন, কেন, কেন ওরা তো মেজদি আর মৃণালদা! ওদের মধ্যে এ কীসের ছলনা। হঠাৎ কী হল? ওরা যে দুজনকে অনেক দিন দেখে, অনেক ভেবে পরস্পর ঘর বাঁধল, সেই মাখামাখি হাসাহাসিটা এর মধ্যেই বালুর মতো ছাড়া ছাড়া লাগছে কেন।
এখন কীরকম হয়েছে জান? মেজদি যেন নীরবে শত চক্ষু মেলে মৃণালদাকে আগলে বেড়াচ্ছে। আর মৃণালদা সেই শত চক্ষু এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সবসময়েই একটা অপরাধীর ভাব। যদি ধরে নিতুম মৃণালদার সেই পুরনো অভ্যাস মদ খাওয়াটা আবার ফিরে এসেছে তাই মেজদির দুশ্চিন্তা। কিন্তু তা তো নয়। আমার মনে হয়েছে প্রাণ থেকে না হোক, মৃণালদাকে কাছাকাছি রাখার জন্যে সেই লাইসেন্স মেজদি তাকে দিয়েছে। অন্তত সেটা ওদের মাঝখানে বিশেষ কোনও বাধা নয়। যেন, এটা যে হবে, মেজদি আগে থাকতেই জানত। ও বলেছে, মদ খেলেই তো মানুষ সম্মান হারায় না। আমার সঙ্গে যাদের কাজ ও চলাফেরা, তারা যেন তোমাকে অসম্মান না করে। আমিও অসম্মানিতা না হই।
আমার কাছে যত বিস্ময় মৃণালদার এই পুনরুত্থানে, তত বিস্ময় মেজদির সম্মতিতে। কিন্তু মরুকগে আমার বিস্ময়। আসলে, ওটা যে কোনও প্রশ্নই নয়, ব্যাপার আরও গভীরে। আমি তার কিছুই বুঝিনে।
মৃণালদাকে আমি পুরোপুরি চিনিনে। শুধু জানি, তার একটি অতীত জীবন ছিল। ছাত্র-আন্দোলনের মাঝে এসে, মেজদির সংস্পর্শে এসে, মৃণালদা ত্যাগ করেছিল সে জীবন। আজ ভাবি সে কি ত্যাগ নয়? এ যেন সে মৃণালদাই নয়। অতীতটা তার ফিরে আসছে কি না জানিনে, মেজদির প্রতি সেই ব্যাকুল ভিক্ষা আর তার নেই।
মেজদির একটা আদর্শে আস্থা আছে। ও ভাবছে, কথা শুনে আমার যা মনে হয়েছে যে, মৃণালদা যেন পাপ-লিপ্ত হয়েছে। মেজদি তাকে সংশোধন করবে।…ওর চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে। দেখলেই বোঝা যায়, অষ্টপ্রহর টো-টো করে ঘোরা দস্যি মেয়ে মেজদি, প্রাণের কোথায় আঘাতে আঘাতে দীপ্তি হারাচ্ছে। ওর ফ্যানের দল রীতিমতো কুপিত। ফ্যান (Fan) বললুম বলে কিছু মনে করো না। সদর্থেই লিখছি। ঘরোয়া মিটিং বৈঠকে, নানান আলোচনায় ওকে সবাই আগের মতোই হাসিখুশি, দৃপ্তনেত্রী দেখতে চায়। তাদের নিঃশব্দ অভিশাপ নিয়ত বর্ষিত হচ্ছে মৃণালদার ওপর। এ-ও শোনা যাচ্ছে, মেজদি এবার ছাত্রফ্রন্ট ছেড়ে গ্রামের দিকে যাবে। অদ্ভুত সব জল্পনা কল্পনা চলেছে ওকে নিয়ে। কারুর সঙ্গে দুদণ্ড ঘুরে বেড়ালেই সবাই একটি করে গল্প তৈরি করে। বলে সুগতা এবার অমুকের সঙ্গে ভিড়ে পড়ল বোধ হয়।
মৃণালদাকে নিয়েও জল্পনার কল্পনার অভাব নেই। তার বাপ মায়ের ধারণা মেজদিই মৃণালদার সর্বনাশ করছে। মৃণালদার অতীত জীবনের ক্ষেত্রেও যেহেতু পদক্ষেপ ঘটেছে, সবাই বলছে, মেয়েদের পিছনে ঘোরা অভ্যাসটা নাকি সে ছাড়তে পারেনি। ওই পিছনে ঘুরতে গিয়ে সে এক সময়ে চলে এসেছিল মেজদির কাছে। কিন্তু পরিক্রমা নাকি তার স্বভাব। মাঝে সেই কবি-পত্নী চিত্রাভিনেত্রীর পিছনে তাকে দেখা গেছে। তারপরে কেতকীদির সঙ্গে। সেই কেতকীদির রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য ও অভিনয়ে বাংলাদেশে যার জুড়ি মেলা ভার। এই যদি মৃণালদার চরিত্র হয়, মেজদি কি পারবে একসঙ্গে থাকতে।
পুরুষেরা বলে রমণীর মন, সহস্র বর্ষের সখা সাধনার ধন। আর পুরুষের মন! সে-যে কোটি কোটি বর্ষের। ছকে ফেলে কারুরই বিচার চলে না। জটিল সকলেই।
তোমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর্টিস্ট বিভূতিবাবু। সে সম্প্রতি একটি পোর্ট্রেট এঁকেছে মেজদির। তারও আগে, ছেচল্লিশের এক বিরাট মিছিলের ছবি এঁকেছিল সে। সেই মিছিলের প্রথম সারিতে যে মেয়েটির ছবি আছে, সবাই বলে সেটি মেজদির। নীরব কিন্তু তীক্ষ্ণ। অতল-মগ্ন ভাবুক বিভূতিকে প্রায়ই এখন মেজদির সঙ্গে দেখতে পাই। তাকে দেখায় বড় নিরীহ। কিন্তু চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি, চোখ তার সর্বক্ষণই অস্থির। সবসময়েই যেন কীসের ঝড় ঠেলে চলেছে। সেজন্যে এলোমেলো, বহির্জীবনে বড় আত্মভোলা। তাই বোধ হয় নিরীহ দেখায়? মেজদির পোর্ট্রেটখানা ঠিক যেন দা ভিঞ্চির লুক্রেজিয়া। লুক্রেজিয়ার ইতিহাস এখানে বক্তব্য নয়, কিন্তু ঠিক যেন সেই নিষ্পলক চোখে কীসের দ্যুতি, ঠোঁটের কোণে হাসি কিংবা রাগের একটি অস্পষ্ট রশ্মি-রেখা বিচ্ছুরিত।
ভাবি, মেজদি কেন এমনি করে তাকিয়ে বসে ছিল বিভূতির সামনে।
আমি এই কেন-কেন করেই মরলুম। সব মিলিয়ে আমার ভয়ের সীমা নেই। ভাবি, এই যদি জীবনের সত্য হয়, তবে স্টেজের নাটকগুলি তার কাছে তো তুচ্ছ। এর নাটকীয়তার যে তুলনা নেই।
মেজদি যখন আসে আমাদের এখানে, রাত্রিবাস করে, তখন বড়দির ঘরে শোয়। আমার ভয় বাড়ে। আমি আর বড়দির সঙ্গে ওকে আলাদা করতে পারিনে। কিন্তু ওর সঙ্গে তো আমার বড়দির মতো ভাব নেই। তাই আমি বিশেষ কিছু বলতে পারিনে। যদি জিজ্ঞেস করি, মেজদি মৃণালদা আসবে? মেজদি এক কথায় জবাব দেয়, না, তার বেশি একটুও বলবে না।
এক দিন ওদের নতুন বাড়িতে গিয়ে দেখলুম, মেজদি নেই। মৃণালদা একলা রয়েছে বাড়িতে। অনেককিছু জিজ্ঞেস করবার জন্যে ছটফট করতে লাগলুম মনে মনে। কিন্তু কিছুই আসছিল না মুখে। জিজ্ঞেস করলুম, মেজদি কোথায়? মৃণালদা বললে, কোথাও বেরিয়েছে।
তারপর হেসে, একটু ছলনা করেই, না জিজ্ঞেস করে পারলুম না, আপনাদের কি ঝগড়া চলছে নাকি?
এক মুহূর্তে চোখখাচোখি করে মৃণালদা কেমন যেন টেনে টেনে বলল, ঝগড়া ঠিক নয়। তবে, আমার তো অনেক দোষ।
যথা?
যথা..যথা..অনেক দোষ। ধরো, তোমার মেজদির তুলনায় আমি অনেক অসৎ।
মনে হয়নি তো আগে!
সবকিছুই কি আগে বোঝা যায়। বলে, হেসে উঠে পড়ল মৃণালদা। এইদিনই প্রথম ভয়টা আমার সবচেয়ে তীব্র হয়ে উঠল।
আর লিখব না। এত বড় চিঠি তুমি কখন পড়বে, তাই ভাবছি। কিন্তু সব দেখে শুনে, আমার অস্থিরতা যে কী ভীষণ, তোমাকে লিখে বোঝাতে পারব না। এদিকে যতই দেখছি আড়ো আড়ো ছাড়ো ছাড়ো, ততই তোমার কথা আমার বেশি করে মনে পড়ছে। যত মনে পড়ছে ততই ব্যাকুল হয়ে উঠছি। আর, আর বলতে পার, কেন আমার প্রাণে এত ভয়? তুমি তো মস্ত নির্ভীক মানুষ। আমাকে একটু নির্ভয় করতে পার না?
মাকে আমার নমস্কার দিয়ে। বোলো, শিগগিরই একদিন যাব।
—সুমিতা।
.
তিন দিন আগে এসেছে সুগতা এ বাড়িতে। সাধারণত যাওয়া আসাই করে। রাত্রিটুকু থেকে দিনের বেলা চলে যায় আবার, এবার ফেরবার নাম-ই নেই।
মহীতোষ শেষ পর্যন্ত আর কথার আড়ে আড়াল দিয়ে চলতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, ঝুমনো, আমার বড় ভয় করছে মা?
সুগতা কেন দিয়ে কোনও ছলনার আশ্রয় নিল না। বলল, তা জানি, কিন্তু ভয় করে তো কোনও লাভ নেই। যা হবার তা হবেই।
মহীতোষের রেখা বহুল মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। বললেন, ঠিক বুঝলুম না ঝুমনো। মৃণালের সঙ্গে কি তোমার কোনও বিবাদ হয়েছে?
সুগতা বলল, আমি আর সেখানে যাব না বাবা।
ভীত উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন মহীতোষ, আর যাবে না? এক বছরও পূর্ণ হয়নি তোমাদের। এর মধ্যেই ।
–হ্যাঁ।
বড় কঠিন মেয়ে সুগতা। ওর চোখে জল দেখা যায় না। কিন্তু আজ দুচোখ ভেসে গেল সুগতার।
আঙুল চেপটে যাওয়া ছেলেমানুষের মতো বিকৃত হয়ে উঠল মহীতোষের মুখ। বোঝা যাচ্ছে, ঢোক গিলে তিনি চোখের জল রোধ করতে চাইছেন যেন। সুগতার মাথায় হাত রেখে ডাকলেন ঝুমনো।
রুদ্ধ গলায় বলল সুগতা, আমার ওপর রাগ কোরো না বাবা।
মহীতোষের ইচ্ছে হল চিৎকার করে ওঠেন। পারলেন না। সব চিন্তাশক্তি জট পাকিয়ে গেল মাথায়। ভাবলেন, পালিয়ে যাবেন। কিন্তু সুগতাকে বুকের কাছে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, স্থির, অকম্পিত কাঠের পুতুলের মতো।
সুমিতা ছুটে পালিয়ে গেছে বাগানে। আড়াল থেকে আর কিছু শোনবার ছিল না ওর। সব যে শেষ হয়ে গেছে, জানা হয়ে গেছে সেটুকু। ভয় ওর অমূলক ছিল না।
সুগতা বলল, বাবা, বিয়ে গড়া আর বিয়ে ভাঙার মধ্যে কোনও গৌরব নেই। কিন্তু আজকের দিনে এটা বাড়বে বই কমবে না বোধ হয়।
এ অপমান শুধু বাইরের নয়, নিজের মনের মধ্যেও পুড়ে যাচ্ছে। সব মেয়েরই যায়, যে থাকতে চায় এ সংসারে। কিন্তু এজন্যে আমি কাউকে দোষ দিতে পারব না। মৃণালকেও না। দোষ শুধু আমার। তবু ভাবি, তখন তো দোষ করার মতলব নিয়ে আমি বিয়ে করিনি। এখন দেখছি আমাদের দুজনের অনেক তফাত।
অপরিস্ফুট গলায় যেন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন মহীতোষ, কীসের তফাত ঝুমনো?
জবাব দিতে গিয়ে এক মুহূর্ত থামল সুগতা। দুজনের নিঃশব্দ কান্নার অশ্রু যেন সন্ধ্যাবেলার একটি নিস্তরঙ্গ নদী। কথাগুলি এক জীবন-সন্ধানী নৌকার মতো ভেসে চলেছে।
সুগতা বলল, বাবা, বড়দির ব্যাপার তুমি বুঝেছ। গিরীনদা ওকে ভালবেসেছিল, ও ভালবাসতে পারেনি বলেই এত দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কোনও পক্ষে সেটুকু ছিল কি না সন্দেহ। বাবা আমাকে ঘৃণা কোরো না। আমি বুঝিনি। বুঝতে পারিনি। তুমি যেভাবে মানুষ করেছ, সে জীবনটাকেও ভালবেসেছি। সেটাই বোধ হয় আমার রক্তে রক্তে। কিন্তু জীবনে আমি বিশ্বাস করেছি অন্যত্র। সেখানে আছে আমার রাষ্ট্র ও সমাজের ভাবনা। কিন্তু এ পরিবারের মেয়ের সঙ্গে ওই বিশ্বাসের কোনও মিল নেই। এই দোটানায় টলছি। এই টলোমলোলা অবস্থায় আমার সব ভণ্ডুল হয়ে গেছে। তাই হাজারো নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও এ ভুল সব মেয়েরই হতে পারত। আমাকে ক্ষমা করো। যাকে সত্য বলে জেনেছি, তাকে গ্রহণ করতে দাও।
.
৩৫.
মহীতোষের বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা থরথর করে কাঁপছিল। রক্তচাপ রোগ-দেহে, বন্ধ শিরায় শিরায় কারা যেন ধাক্কা মারছে। মনে হচ্ছিল, শরীরটা আগুন-পোড়া লোহার মতো দুমড়ে যাচ্ছে যেন। তবু নিশ্চল হয়ে অবোধ দুটি চোখে তাকিয়ে রইলেন সুগতার দিকে। ঝুমনো বলে, সত্যকে গ্রহণ করতে দাও! কী সে সত্য। কেমন তার স্বরূপ। এ সত্যের সংজ্ঞা কী?
সুগতা ডাকল, বাবা।
মহীতোষ যেন লুকোচুরি খেলছেন। চাপা গলায় বললেন, বলো ঝুমনো। আমি বুঝিনে তোমার কথা। তবু আমি না শুনে পারছিনে। কী তোমার সত্য, কাকে তুমি গ্রহণ করতে চাও।
সুগতা বুঝল, ভয় ও বেদনা গ্রাস করেছে মহীতোষকে। আর ওর নিজেকে গ্রাস করেছে অশেষ অপমানের বেদনা। শুধু কথা বলে ও শুনে কারুর প্রাণই শান্ত হবার নয়। তবু না বলে পারল না সুগতা। বাবা, আমার জীবনে যে কলঙ্ক ঘটেছে, তার চেয়ে বড় সত্য এখন আর কিছু নেই। কলঙ্কটা যে কত বড় ভয়ংকর, তাকে বাইরে থেকে বোঝবার উপায় নেই। সে আছে আমার মনের অন্ধকারে। তাই তো বার বার তোমাকে বলছি, আমার ওপর রাগ কোরো না, ঘৃণা কোরো না আমাকে।
মহীতোষ নিজেকে অবিকৃত আর শান্ত রাখবার জন্যে ভগবানকে ডাকতে লাগলেন। বললেন, ঝুমনো, বার বার ওকথাটা বোলো না। তোমাকে ঘৃণা করব, সে সাহস আমার নেই, ওটা আমার ধর্মও নয়।
সুগতা মহীতোষের বুকে হাত রেখে কথা বলতে গেল। পারল না। বাবার কথাগুলি যতই শানে, ততই যেন এক অবোধ শিশুর মতো ওর বলিষ্ঠ বুক রুদ্ধ যন্ত্রণায় টনটন করে।
একটু পরে বলল, জীবনে যেখানে আমার বিশ্বাস সেই বিশ্বাসের পথ থেকে মৃণাল অনেক দূরে। আমার সবার বড় পাপ তাকে আমি জেনেও স্বীকার করিনি। যে মত, পথ ও দর্শনে আমার প্রাণ টেনেছে, যে পথে আমি চিরকাল চলব ভেবেছি, সেই পথ যে কত কঠিন, দুরূহ, মুখে যা-ই বলি, আমার অন্তর তা মর্মে মর্মে জানে।
আমি এ দেশের নিদারুণ দারিদ্র্য, অপমান আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চেয়েছি। কত কী চেয়েছি। কিন্তু সে যে শুধু আমার মুখের কথাই হয়ে গেছে। আমার নিজের জীবনধারণে তার কোনও প্রমাণ আমি রাখিনি। নিজেকেই ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছি মৃণালের কাছে। ভেবেছি, এই ভাল, এই আমার ভাল। নিজের জন্যে আমার কোনও ভাবনার এক তিলও রইল না, পরের ভাবনা ভাববার জন্য রইল আমার সবটুকু। কী বিচিত্র! কত অ্যাবসার্ড আনরিয়েল সব চিন্তা। তা কি কখনও হয়। নিজের জন্যে কোনও ভাবনা নেই, ভাবব পরের জন্যে। প্রকৃতি তা মানবে কেন? সে-ই আমাকে শোধ দিলে। দেখলুম, মৃণাল আমার জন্যে নয়। ওকে নিজের করতে হলে এ সংসারে আর কেউ বলতে শুধু ওকেই রাখতে হয়, ওর কাছেই ওর মতো করে সব সঁপে দিতে হয়। আর কারুর ভাবনা আমার ভাবা চলে না। ভেবেছিলুম, মৃণালই আসবে আমার পথে। মৃণাল ভেবেছিল, ধীরে ধীরে এক দিন আমিই যাব ওর পথে। দুজনে এই আশা করেই এত দিন আগে বেড়েছি। এই আশার ওপরেই অপেক্ষা করছিল, আমরা দুজনকে কে কতখানি পেয়েছি।
বলতে বলতে লজ্জায় ও কান্নায় কণ্ঠরুদ্ধ হল সুগতার। ভাঙা চাপা গলায় তবু বলল, যত লজ্জাই করুক, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে তো আমি আমার সব সংকোচ, সব লজ্জা কলঙ্কের কথা বলতে পারব না। আমার সোজা কথায় তুমি বিরক্ত হওনি কোনওদিন, আজও হয়ো না। বাবা, এই আমার সত্য। এই কলঙ্ক যেমন সত্য, তাকে স্বীকার করাও আমার সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য কলঙ্কমোচন।
কিন্তু একটি নীরব প্রশ্ন বারবার মহীতোষের বুকে মাথা খুঁড়তে লাগল। আর একটি নিঃশব্দ জবাব, সুগতার লজ্জাবিষ্ট অন্তরে জবাবদিহি করতে লাগল নিজেকেই।
মহীতোষ ভাবছিলেন, বিয়ে করে একসঙ্গে বাস করার আগে কি এ সমস্যার সমাধান অসম্ভব ছিল?
সুগতা ভাবছিল, হ্যাঁ ছিল। আসলে ওটা মেয়ে-পুরুষের দেহের প্রশ্ন। দেহ যেন এ ক্ষেত্রে জীবন-মঞ্চের একটি মসলিনের পরদা। যত তার বাহার, তত তার রং। ওটা নিজের হাতে স্পর্শ করে যতক্ষণ না অন্দরে প্রবেশ করা যায়, ততক্ষণ আসল রংটা কিছুতেই বোঝা যায় না। ওটা প্রথম। তারপর পরতে পরতে, ভাঁজে ভাঁজে আছে সাজানো জীবনের অভিসন্ধি। ওই দরজাটা পার না হলে তাকে পাওয়া যায় না। যে পায় তার ভাগ্য, পরম ভাগ্য। সেটা লাখে না মিলল এক। সেটা যে অন্তরের সঙ্গে মিলন। অন্তরের মিলন দেহকে ছাড়িয়ে যায়।
কে যেন নিষ্ঠুর বিদ্রুপে হেসে প্রশ্ন করে, তবে কি দেহটা কিছুই নয় তোমাদের কাছে। শুধু মিলনের পরদা? অন্তর যাচাইয়ের জন্যে দেহটা একটি নিমিত্ত মাত্র?
ছি ছি! মেয়ে হয়ে সুগতা তা মানবে কেমন করে। দেহ কখনও ছোট নয় মেয়েদের কাছে। সুগতার বড় কলঙ্ক তো সেইখানেই। সবচেয়ে বড় জ্বালা ও যে ভালবাসেনি। ভালবাসাবাসি কিছু না বলেই মানিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। তাই কোনও মূল্য পাওয়া যেত না, সারা অন্তর ও চোখ দিয়ে মৃণালকে আগলে বেড়ালেও। ভালবাসেনি বলেই দেহটা তুচ্ছ হয়েও অপমানটা বিধে রয়েছে যন্ত্রণায়।
মহীতোষ তেমনি সুগতার মাথায় একটি হাত রেখে তাকিয়ে রইলেন অসহায়ভাবে। অনেকক্ষণ পর প্রায় চুপি চুপি বললেন, আমি কিছু বুঝিনে ঝুমনো। তোমাদের মন, জীবন সবই আমার কাছে বড় দুর্বোধ্য। উমনোকে যা বলেছি, সে সব কথা তোমাকে ঘুরিয়ে বলার কোনও মানে হয় না। প্রাণভরে আমি তোমাদের সুখী দেখতে চেয়েছি। না দেখলে প্রাণভরে যে কষ্ট তাও দু কথায় যাবার নয়। রুমনো, আমি একটু শুয়ে পড়ব এবার।
ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠল সুগতার মুখ। মহীতোষের হাত টেনে বলল, বাবা, কী রকম মনে হচ্ছে তোমার?
মহীতোষ কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। শান্তভাবে বললেন, কিছু নয়। তোমার মতো আমারও একটু কষ্ট হচ্ছে।
সুগতার সঙ্গে নিজের ঘরে এসে টেবিলের কাছে দাঁড়ালেন মহীতোষ। বললেন, ঝুমনো, একটা কথা। তবে কি তোমার রাজেনকে বিয়ে করাই উচিত ছিল?
সুগতা চমকে রুদ্ধশ্বাস হয়ে বলল, না না বাবা, সে সাহস আমার আজও নেই। কোনওকালেই ছিল না।
–তবে?
–সেই তবেটাই আমি বুঝিনে বাবা। রাজেনকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমাকে যে সবাই এত শক্ত মেয়ে বলে, আমার সেই শক্তিও রাজেনের জীবনের কঠোর ব্যাপ্তিকে ভয় পায়। ওকে বিয়ে করেও আমি কোনওদিন ওর নাগাল পাব না। এইটুকু জেনেই আমি রাজেনের ভাবনা কোনওদিন আর ভাবিনি।
সুগতার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অসহায় অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন মহীতোষ। জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তাটা দেখা যায়। সেখানে আলো-অন্ধকার ছড়িয়ে আছে হাত ধরাধরি করে। পথচারীদের দেখাচ্ছে বড় বিচিত্র! কখনও ছায়া, কায়া কখনও।
মহীতোষ বললেন, ঝুমনো, এখনও দেখি মানুষ ধন-মানের গৌরবে লালায়িত হয়ে ফিরছে! আমাদের যুগ থেকে তাকেই জানতুম সত্য বলে। তার জন্যে আমরা সংগ্রাম করেছি, সম্মান বোধ করেছি। শুধু নিজেরাই করিনি, লোকেও আমাদের সম্মান করেছে। নিজেদের মধ্যেকার বিবাদ চেপে রেখেছি নিজেদের মধ্যে। আপস করেছি পরস্পরে। কিন্তু ওই ধন, মান, যশ তাকে মন দিয়ে প্রাণ দিয়ে চেয়েছি, চেয়েছি আর পেয়েছি। কিন্তু তলে তলে আর একটা যুগ এসে গেছে চোরাবানের মতো। তাকে আমরা টেরও পাইনি। স্কুল অর্থে সে আর ধন-মানের প্রত্যাশী নয়। বোধ হয় তা সম্ভবও নয়। তবে বিবেক, বুদ্ধি, আত্মসম্মান ধন-মানের মুখ চায় না। কী এক নতুন সত্যের জন্য সে প্রাণপণ করছে, সে সত্যের চেহারা আলাদা। পুরনো সত্যগুলি বদলে যাচ্ছে একেবারে। সে এক কথায় রাজ্যপাট ছেড়ে রুদ্র সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে পড়তে চায় যেন! আমি একে চিনিনে ঝুমনো। বুঝিনে একে আমি। সে এত নিষ্ঠুর, এত কঠোর যে, জীবনের কোথাও সে সামান্যতম গোপনতাকে প্রশ্রয় দেবে না। প্রাণ না মানলে, যুক্তি না পেলে কেবলি ভাঙবে আর গড়বে, আবার ভাঙবে। একে আমি চিনিনে, চিনিনে। কিন্তু ঝুমনো
-বাবা।
–আমার বড় ভয়, সেই সত্যকে তুইও চিনিসনে। আমি তোর বাবা, তাই আমি বুঝতে পারি, তুই বড় অসহায় ঝুমনো। তুই আমার সেই ছোট মেয়েটির মতোই আজকে নিরুপায়। তোরা আমাদের এই সমাজের মেয়েগুলি কী করবি?
–ঠিক বলেছ বাবা, সত্যটার সবটুকু বুঝিনে বলেই পায়ে পায়ে আমাদের কলঙ্ক রটবে। আমরা কী করব? সত্যকে পাওয়ার জন্যে আজকে এই দুঃখ রোধ করা বোধ হয় যাবে না। তুমি শুধু আমাদের সমাজের কথা বলছ? তা বোধ নয় বাবা। ধাক্কা লেগেছে আজ ওপরে নীচে, সবখানে।
তবে? বলছিস অগৌরব। কিন্তু বিয়ে ভাঙা-গড়া যে বাড়বে।
–তাও তো বাড়বেই। যত লোভ, যত পাপ যত ভুল-ভ্রান্তি, যত মোহ ও মিথ্যে পিপাসার ক্লেদ জমেছে আমাদের সবখানে, সে কি ছেড়ে কথা কইবে? বিয়ে ভাঙা-গড়াটা তো সেখানে কিছুই নয়! সে যে কত বাড়বে তার তুলনা নেই। পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ়া, ঠাকুমা-দিদিমারাও যে বিয়ে ভাঙাগড়া করবে না তারই বা নিশ্চয়তা কী? আমাদের যুগে তাও হয়তো দেখতে হবে।
যেন ভয়ে উৎকণ্ঠায় বাকরুদ্ধ মহীতোষ বোবার মতো তাকিয়ে রইলেন সুগতার দিকে। নিচুস্বরে বললেন, ঝুমনো তোমার বড়দির কথা মনে পড়ছে আমার। সে কোথায় চলে গেল। তোমার জীবনের কথা তুমি ভাব, সুখী হও।
সুগতা চলে গেল বাইরে। ব্যাকুল ভীত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন মহীতোষ। যেন একটি ছেলেমানুষের মতো পা টিপে টিপে উঁকি দিয়ে দেখলেন দরজার দিকে। তারপর বাইরের দিকে তাকালেন। কিন্তু ঘরটা এত ছোট মনে হল যেন কিছুতেই থাকতে পারছেন না। জামা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। লোকের ভিড়ে ঘুরতে লাগলেন ধীর পায়ে। আর যত মেয়ে পড়ল সামনে, প্রত্যেককে চেয়ে চেয়ে দেখলেন। যেন অনুসন্ধান করে ফিরছেন সকলের চোখে মুখে কী আছে।
তারপর যখন একটি পার্কে এসে বসলেন, তখন ওঁর বৃদ্ধ বুকের একটি অসহায় বেদনা কিছু কিছু জমে উঠল চোখের কোণে।