সিনেমাতেও এমন হয় না
এভাবেও গোল খাওয়া যায়?
ফুল টাইম হয়ে গিয়েছিল। যে কোনও সময় শেষের বাঁশি বাজত। ইনজুরি টাইমের দু’-তিন মিনিট খেলাচ্ছিল রেফারি। ঘড়ি দেখছিল বারবার। ওই সময় এই গোল কেউ খায়! যে ম্যাচ ওয়ান-অল শেষ হওয়ার কথা, সেটা কেউ এভাবে টু-ওয়ানে হারে? সব দোষ বুবাইয়ের। অপোনেন্ট অল আউট ঝাঁপাচ্ছে গোলের জন্য, তখন কেউ ওভাবে ডিফেন্স চিচিং ফাঁক করে ওভারল্যাপে যায়?
আর গেলি তো গেলি, অ্যাট লিস্ট বলটা হোল্ড তো কর! মাঝমাঠ পেরতে না পেরতেই কড়া ট্যাকলে বল কেড়ে নিল বুবলা, ‘তরুণ সংঘের’ মিডফিল্ডার। লহমায় উঠে এল উইং দিয়ে। বুবলার নিখুঁত ক্রসে নিটোল হেড রিন্টুর। গোল। টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে ওঠার গল্প শেষ। টু-ওয়ানে হেরে ছিটকে যাওয়া।
পাপ্পা আজ ডিফেন্সে থাকলে হত না এটা। ঠিক সামলে দিত। রিন্টুকে নিতেই দিত না হেডটা। ছিটকে দিত শোল্ডার-পুশে। এরিয়াল বলে পাপ্পাকে বিট করা অত সোজা নয়। আজ পাপ্পা থাকলে…।
শেষ মিনিটে হেরে যাওয়া ম্যাচের পোস্টমর্টেম চলছিল। ম্যাচ শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক পরেও নাগেরবাজারের মাঠে মুহ্যমান বসেছিল ‘দমদম ইয়ুথ স্পোর্টিং ক্লাব’-এর পাঁচ কিশোর।
যে থাকলে এই ম্যাচ এভাবে হারতে হত না বলে সমবেত আক্ষেপ, সেই পাপ্পাকে দেখা গেল এই সন্ধের মুখে মাঠের দিকে হেঁটে আসতে। কাছাকাছি আসতেই টোটো বলে ফেলল, ‘এতক্ষণে সময় হল বাবুর! তরুণ সংঘ আমাদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে যাওয়ার পর!’
টোটোর দেখাদেখি রাজাও কিছু বলতে যাচ্ছিল, থেমে গেল পাপ্পাকে দেখে। যার চোখমুখ অস্বাভাবিক রকমের থমথমে আজ। গনগনে রাগ যেন জমাট বেঁধে আছে চেহারায়।
‘কী রে… এভাবে ঝোলালি আজ… লাস্ট মিনিটে হেরে গেলাম…’, দেবা, মানে দেবাশিষ শুধু এটুকু বলেছিল। তাতেই ফেটে পড়ল পাপ্পা, ‘কী করে আসব? শালা বাড়ি থেকে আসতে দিলে তো! বাবা, ওই ডাইনিটা আর দাদার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেল আফটারনুন শো-য়ে। এই ফিরেছে একটু আগে।
‘আমি বলেছিলাম, আজ কোয়ার্টার ফাইনাল, ম্যাচটা খেলেই চলে আসব। বাবা বলল, ‘‘ওয়ার্ল্ড কাপ হচ্ছে বুঝি? পাতি পাড়ার ম্যাচ কিছু বখাটে ছোঁড়ার সঙ্গে, তা নিয়ে এত কথার কী আছে? পেলে বা মারাদোনা হবি নাকি বল পিটিয়ে?’’ ডাইনিটাও তাল দিল সঙ্গে সঙ্গে। বলল, ‘‘ফুটবল নিয়ে অত নখরা করতে হবে না, আমরা ফেরার আগে দুপুরের বাসনগুলো মেজে রাখবি। আর হ্যাঁ, কাজলের জামাকাপড়গুলো গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখবি। একটুও এদিক-ওদিক হলে মজা দেখাব।’’
দাদাও এত শয়তান, বেরনোর আগে হাসতে হাসতে বলে গেল, ‘‘পাপ্পা, গুছিয়ে রাখিস কিন্তু সব। না হলে শুনলি তো, মা ফিরে এসে মজা দেখাবে।’’ দাদার কথায় আমার মাথায় আগুন চড়ে গেল। তেড়ে গেলাম। বাবা তাই দেখে বেদম মারল। এই দ্যাখ, দাগ হয়ে গেছে গায়ে। যখন মার খাচ্ছিলাম, দাদা দাঁত ক্যালাচ্ছিল। ডাইনিটাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। আমার ইচ্ছে করছিল গলা টিপে মেরে ফেলি সব ক’টাকে।’
পাড়াতুতো টুর্নামেন্টের হারজিতের সমস্যা গৌণ হয়ে যায় নিমেষে। বন্ধুরা অসম্ভব ভালবাসে পাপ্পাকে। ওরা জানে, বাড়িতে ঘোর অশান্তিতে কাটে পাপ্পার দিনগুলো। জানে, বাড়িটার রিমোট কন্ট্রোল থাকে ওর সৎমায়ের কাছে। প্রথম স্ত্রীর কথাতেই ওঠে-বসে পাপ্পার বাবা। সৎদাদা কাজল বাড়িতে থাকে রাজার হালে। আর পাপ্পার দিন কাটে চাকরের মতো। স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির হাজারটা কাজ করতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই বাবার কাছে নালিশ ঠোকে সৎমা। আর পিটুনি খায় পাপ্পা। একটাও শখ-আহ্লাদ মেটে না ছেলেটার। আজ যেমন। সেই বাচ্চা বয়স থেকেই পাপ্পা ফুটবল বলতে অজ্ঞান। খেলেও দারুণ। অথচ আজকের ভাইটাল ম্যাচটা খেলতে পারল না।
টোটো পিঠে হাত রাখে পাপ্পার, ‘ছাড়… মন খারাপ করিস না। পরের মাসে শুনলাম বিরাটির দিকে একটা সেভেন-আ-সাইড টুর্নামেন্ট নামাচ্ছে ওখানের একটা ক্লাব। দেখিস, ওটায় ঠিক জিতব আমরা। এই তরুণ সংঘ-র সঙ্গে হিসেবটা মিটিয়ে দেব।’
পাপ্পার প্রতিক্রিয়ায় খানিক ঘাবড়েই যায় বন্ধুরা, ‘তার আগে আমাকে বাড়ির হিসেবটা মিটিয়ে ফেলতে হবে। অনেক ভেবে দেখেছি। এভাবে লাথিঝাঁটা খেয়ে থাকব না আর আমি। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়।’
রঞ্জিত উত্তেজিতভাবে বলে, ‘সত্যিই… সহ্য করা উচিতও নয়… কেলিয়ে কলাগাছ করে দেওয়া উচিত… বাড়ির কুকুর-ছাগলের সঙ্গেও লোকে এই ব্যবহার করে না… তোর বাপটা মাইরি আজব পাবলিক!’
‘যা বলেছিস!’ দেবাশিষ যোগ দেয় আলোচনায়, ‘নষ্টের গোড়া কিন্তু তোর বাবাই… না হলে তোর ওই সৎমা-র সাহস হত এভাবে অত্যাচার করার? মিলিয়ে নিস, তোর বাবাকে ভুজুং-ভাজুং দিয়ে তোর দাদার নামে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নেবে তোর সৎমা। কানাকড়িও জুটবে না তোর ভাগ্যে।’
পাপ্পা শুনছিল চুপচাপ। রাজা পাশে এসে বসল, ‘এই যে বললি বাড়ির হিসেব মিটিয়ে দিবি…মানে?’
—মানে আবার কী? হিসেব মিটিয়ে দেওয়ার যা মানে, তাই।
টোটোকে অধৈর্য শোনাল, ‘হেঁয়ালি করিস না!’
পাপ্পা তাকাল বন্ধুদের মুখের দিকে। রাজা-টোটো-বুড়ো-দেবা-রঞ্জিত… এরা তার ছোটবেলার বন্ধু। প্রাণের-মনের সব কথা একমাত্র ওদেরই বলতে পারে সে। ওদের তো বলতেই হবে সব। একা হবে না কাজটা। বন্ধুদের হেল্প লাগবেই। আপাতত অবশ্য একটাই জিনিস জানার আছে ওদের কাছে।
—তোরা কে কে গতকালের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ দেখেছিস?
.
—না না স্যার, নাকটা এরকম না। আপনি নাকটাকে একটু বোঁচা করে ফেলছেন। ওর নাকটা খাড়া, ধারালো। হ্যাঁ, চুলটা ঠিক আছে। একদম এমনটাই ঝাঁকড়া। জুলপি অবধি শুধু নামিয়ে দিন। ঠোঁটটা মনে হয় আর একটু পাতলা হবে… হ্যাঁ হ্যাঁ… এরকমই। চোখদুটো কিন্তু হচ্ছে না স্যার। বললাম না… বিকাশের চোখগুলো এমন ছোট নয়। বরং বড় বড়। ঝকমক করে একদম। হ্যাঁ স্যার… এইবার ঠিক হচ্ছে… মুখের আদলটা আসছে। গোঁফটা পারফেক্ট হয়েছে…।’
লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে ‘পোর্ট্রেট পার্লে’-র প্রক্রিয়া চলছে। অপরাধীর চেহারার বিবরণ শুনে পেশাদার শিল্পীকে দিয়ে ছবি আঁকানো হচ্ছে। যোধপুর পার্কের এক গেস্ট হাউসে দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়েছিল সপ্তাহখানেক আগে। দু’জন ধরা পড়েছে। স্বীকারও করেছে অপরাধ। জেরায় গোয়েন্দারা জেনেছেন, এই দু’জন চুনোপুঁটি লেভেলের ক্রিমিনাল। ডাকাতিটায় লিড করেছিল বিকাশ বলে একজন। মাস্টারমাইন্ড ওই বিকাশই। যে এখনও ধরা পড়েনি। ধৃত দু’জনের থেকে বিকাশের চেহারার বর্ণনা শুনে স্কেচ করা হচ্ছে।
অধরা অপরাধীর ছবি আঁকা শেষ। ডাকাতি-দমন বিভাগের ওসি এলেন। যিনি নিজের তিরিশ বছরের কেরিয়ারে অজস্র অপরাধীর ঠিকুজি-কুষ্ঠি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন, বহু দাগি আসামির ইতিহাস-ভূগোল যাঁর ঠোঁটস্থ। ওসি স্কেচটা হাতে নিলেন। অন্তত মিনিটদশেক দেখলেন একদৃষ্টিতে। যখন শেষ হল দেখা, ততক্ষণে ভুরু কুঁচকে গেছে ভদ্রলোকের। দ্রুত ফোন করলেন গোয়েন্দাবিভাগের সিআরএস (ক্রাইম রেকর্ডস সেকশন)-এ। যেখানে সযত্নে নথিবদ্ধ থাকে শহরের এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় কবে কোন অপরাধী ধরা পড়েছিল, তার সবিস্তার খতিয়ান। থাকে গ্রেফতারির সময়ের ছবি। সিআরএস থেকে একটা ছবি চেয়ে পাঠালেন তড়িঘড়ি। আঠারো বছর আগের এক মামলায় মূল অভিযুক্তের ছবি।
এসে গেছে ছবি। যা ধৃত দুই অভিযুক্তের সামনে মেলে ধরেছেন ওসি, ‘ভাল করে দ্যাখ তো… একে চিনতে পারিস কিনা।’ ছবিটায় একটু চোখ বুলিয়েই মুখ খুলল ধৃতদের একজন, ‘স্যার! এটা তো মনে হচ্ছে বিকাশেরই ছবি… ছোটবেলার ছবি।’ অন্যজনও সায় দিল, ‘হ্যাঁ স্যার, বাচ্চা বয়সের ছবি, কিন্তু এটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিকাশই!’
ওসি মৃদু হাসেন। তাকান পাশে দাঁড়ানো মধ্যতিরিশের সহকর্মী সাব-ইনস্পেকটরের দিকে, ‘স্কেচটা দেখে যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। এর নাম আদৌ বিকাশ নয়। নামটা বানিয়ে বলেছিল এদের।’
—বিকাশ নয়? তা হলে কে স্যার?
—তোমার সেই আর্লি নাইন্টিজ়ের কেসটা মনে আছে? নাইন্টিন নাইন্টি থ্রি টু বি প্রিসাইস। কলকাতার নয়, নর্থ টুয়েন্টি ফোর পরগনার মামলা। তখন বোধহয় তোমরা স্কুলে-টুলে পড়ো। আরে, দমদমের সেই কেসটা, যেটা নিয়ে তখন তুমুল হইচই হয়েছিল। ওই যে, একটা ষোলো বছরের ছেলে তার পাঁচ বন্ধুকে নিয়ে নিজের বাবা, সৎমা আর সৎদাদাকে খুন করেছিল ঠান্ডা মাথায়… মনে পড়ছে?
—কী বলছেন স্যার! ওটা মনে থাকবে না? তখন ক্লাস এইটে পড়ি। কাগজে রোজ গোগ্রাসে পড়তাম মামলাটার কথা। ছেলেটা তো প্রায় আমাদেরই বয়সি ছিল। ছবি বেরত কাগজে। সজল বারুই!
—ইয়েস… সজল বারুই। সে সময় যে ছবিগুলো বেরিয়েছিল কাগজে, সেই চেহারাটাই মনে আছে লোকের। সে সময়ের ছবিটা আর এই স্কেচটা পাশাপাশি রাখো… এত বছরেও চেহারা বিশেষ একটা পালটায়নি। একটু মাংস লেগেছে শরীরে। বাকি ফিচার্স মোটামুটি একই আছে। বিকাশটা ভুয়ো নাম। এটা মোস্ট ডেফিনিটলি সজল। সজল বারুই।
সজল বারুই মামলায় ভূমিকা অনাবশ্যক, প্রাক্-কথন অপ্রয়োজনীয়। সরাসরি ঢুকে পড়ি ঘটনায়।
সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছিল সুবল-নিয়তির। সেটা সাতের দশকের মাঝামাঝি। সুবলের কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল সদাগরি আপিসের মোটামুটি ভদ্রস্থ চাকরি দিয়ে। পাশাপাশি পৈতৃক ব্যবসাও ছিল একটা। দুয়ে মিলে রোজগার মন্দ হত না। সচ্ছল পরিবার বললে পুরোটা বলা হয় না। ‘সম্পন্ন’-ই সঠিক বিশেষণ।
নিয়তির সঙ্গে বিশেষ বনিবনা ছিল না শ্বশুর-শাশুড়ির। খিটিমিটি লেগেই থাকত। বিয়ের মাসছয়েকের মধ্যেই সুবল পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দমদমে উঠে এসেছিলেন তিন কামরার ফ্ল্যাটে। ৫, এন সি সেনগুপ্ত সরণিতে ‘শুভম অ্যাপার্টমেন্ট’-এর পাঁচতলায়। ফ্ল্যাট নম্বর ৪/এ। বিয়ের বছরখানেক পর পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন নিয়তি। নাম রাখা হয়েছিল কাজল।
সুবল চরিত্রবান পুরুষ ছিলেন, এমন ‘বদনাম’ দেওয়া যাবে না। পরনারীসংসর্গে অবিচল আগ্রহ ছিল। মিনতি নামের এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন। এবং এতটাই গভীরভাবে, যে নিয়তিকে একপ্রকার পরিত্যাগই করলেন। দেড় বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হলেন নিয়তি।
সুবল নতুন সম্পৰ্ককে বৈধতাও দিলেন। কালীঘাটে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে করলেন মিনতিকে। তবে দমদমের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন না দ্বিতীয় স্ত্রী-কে। উত্তর শহরতলির প্রত্যন্তে একটা দেড় কামরার ঘুপচি ফ্ল্যাট ভাড়া করলেন। মিনতির থাকার ব্যবস্থা হল সেখানে। সারাদিনের কাজ সেরে সুবল সন্ধেয় আসতেন। রাত কাটিয়ে দমদমে ফিরে যেতেন সকালে। মিনতির সঙ্গে বিয়ের বছরদেড়েকের মাথায় জন্ম হল সজলের। সুবলের দ্বিতীয় সন্তান। যার ডাকনাম রাখা হল পাপ্পা। সুবলের দুই ছেলে বেড়ে উঠতে লাগল যে যার মায়ের প্রতিপালনে। নিয়তির কাছে কাজল। মিনতির কাছে সজল।
’৮২-৮৩ সাল তখন। সজলের তখন কতই বা বয়স? পাঁচ-ছয় সবে। সে মায়ের সঙ্গে থাকে। সে এটা বোঝে যে তার বাবা-মা একসঙ্গে থাকে না। বাবা সপ্তাহে অন্তত তিন-চার দিন আসেই তার আর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু যখন আসে, তাকে বা মা-কে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার কথা কখনও বলে না। কেন এমনটা হয়েছে, কেন এমনটা হয়, সেটা বোঝার মতো বয়স তখনও হয়নি বালক সজলের। তার শুধু মনে হয়, বাবা-মা দু’জনের সঙ্গেই থাকতে পারলে ভারী মজা হত।
সুবল দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিলেন মিনতির শরীরী মোহে সাময়িক আচ্ছন্ন হয়ে। মোহের একটা আয়ু থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে আয়ুর ক্ষয় ঘটছিল স্বাভাবিক নিয়মেই। মিনতির কাছে আসা ক্রমশ কমিয়ে দিচ্ছিলেন সুবল। আগে সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন আসতেন। সেটা কমে দাঁড়াল হপ্তায় একদিনে। মাসিক খরচ হিসেবে যা দিতেন এতদিন, তার এক-চতুর্থাংশও দিচ্ছিলেন না আর। আর সে দেওয়াও ছিল অত্যন্ত অনিয়মিত।
বাবার ব্যবহার অদ্ভুত লাগতে শুরু করেছিল ছ’বছরের সজলেরও। ইদানীং বাবা কমই আসে। কিন্তু যখন আসে, মুখ হাঁড়ি করে থাকে সবসময়। এই তো সেদিন, সে শুধু ঘুড়ি-লাটাই কেনার জন্য পয়সা চেয়েছিল, তাতেই বাবা কী ভীষণ রেগে গিয়েছিল। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা দেখিয়ে বলেছিল, ‘এক পয়সাও দেব না। আর যদি ঘ্যানঘ্যান করিস, গায়ে ছ্যাঁকা দিয়ে দেব।’ ভয়ে আর কথা বাড়ায়নি সে। সুবলের ভাবভঙ্গি দেখে কথা বাড়াতেন না মিনতিও। যিনি তখনও জানতেন না, সুবলের সঙ্গে নিয়তির যোগাযোগ ফের স্থাপিত হয়েছে। জানতেন না, কিছুদিনের মধ্যেই কিশোর কাজলকে নিয়ে দমদমে স্বামীগৃহে ফিরতে চলেছেন সুবলের প্রথম স্ত্রী নিয়তি।
মিনতি ছিলেন নেহাতই মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই আর। দুই দাদা আছেন, যাঁরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সুবল অর্থসাহায্য কমিয়ে দেওয়ায় মিনতি অকূল পাথারে পড়লেন। সেলাইয়ের কাজ শুরু করলেন। আর এ বাড়ি-ও বাড়ি খুচরো রান্নার কাজ। নিজের এবং ছেলের পেট চালাতে পরিশ্রম করতেন উদয়াস্ত। অর্থকষ্ট ছিল তীব্র, সামর্থ্য ছিল না সজলকে কোনও ভাল স্কুলে ভরতি করানোর। স্থানীয় যে বিনে-মাইনের কর্পোরেশন স্কুলে ভরতি করিয়েছিলেন সজলকে, সেটা নামেই স্কুল। সেখানে পড়াশুনোর নামগন্ধ নেই বিশেষ। সেখানে বইখাতার থেকে ডাঙ্গুলি-পিট্টু-গুলতির চল বেশি।
সজলের যখন আট বছর, সুবল এলেন একদিন। কোনও ভূমিকা ছাড়াই মিনতিকে বললেন, ‘এই পরিবেশে থাকলে, এই থার্ড ক্লাস স্কুলে পড়লে পাপ্পার কিছুই হবে না। লাইফটা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি ঠিক করেছি, পাপ্পাকে আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখব। ভাল স্কুলে ভরতি করাব।’
ধোপে টিকল না মিনতির মৃদু প্রতিবাদ। একপ্রকার বাধ্যই হলেন ছেলেকে ছেড়ে দিতে। নিজেও বুঝতে পারছিলেন, ছেলেকে একটা ভদ্রস্থ স্কুলে পড়ানোর ক্ষমতা তাঁর নেই। হবেও না অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে। ছেলের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। ছাড়া গোরুর মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। যার-তার সঙ্গে মেশে। শাসন করার কেউ নেই। বাবার কাছে গেলে অন্তত একটা নিয়মের মধ্যে থাকবে। সুবল যখন বললেন, ‘এখানে এভাবে থাকলে ছেলেটা ক্রিমিনাল তৈরি হবে’, মুখে উত্তর জোগায়নি মিনতির। অবশ্য বাক্যটা যখন চরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারণ করছিলেন সুবল, নিজেও কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন, শব্দগুলো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে কয়েক বছরের মধ্যেই, ছেলের ‘ক্রিমিনাল’ হওয়ার বীজ বরং বপন হবে বাবার কাছেই, এবং তাতে শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটবে দ্রুত?
সুবল ছোটছেলেকে নিয়ে এলেন দমদমের ফ্ল্যাটে। প্রথম স্ত্রী নিয়তির তীব্র এবং সহজবোধ্য অনিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করেই। প্রথম দু’-তিন বছর মন্দ কাটেনি সজলের। সাজানো-গোছানো নতুন বাড়ি। নতুন স্কুল, নতুন বইখাতা। সবচেয়ে ভাল যেটা, এই নতুন বাড়িটার কাছেই একটা বড় মাঠ আছে । সেখানে সজল যায় বিকেলে ফুটবল খেলতে। খেলতে খেলতেই জুটে গেছে নতুন বন্ধু।
বাড়িতেও দিব্যি সময় কেটে যেত দাদার সঙ্গে খুনসুটি করে। কাজল, তার নতুন দাদা। তার থেকে তিন বছরের বড়। বাবা বলে দিয়েছে, দুই ভাই যেন মিলেমিশে থাকে। ঝগড়াঝাঁটি যেন না করে। ঝগড়া যে হয় না, তা নয়। তবে মিটেও যায়।
বাড়িতে একজনকে অবশ্য তার শুরু থেকেই পছন্দ হয়নি। ‘নতুন মা’। এই ফ্ল্যাটটায় আসার পর যাকে দেখিয়ে বাবা বলেছিল, ‘পাপ্পা, ইনি হলেন তোমার নতুন মা, এঁকে ‘‘মা’’ বলে ডাকবে আজ থেকে।’ পাপ্পা তো অবাক! মা তো মা-ই! তার আবার নতুন-পুরনো হয় নাকি? তা ছাড়া তার তো মা আছে। ইনি তো দাদার মা। নিজের মা ছাড়া অন্য কাউকে মা বলে ডাকা যায় নাকি? তবু পাছে বাবা বকে, এই নতুন মা-কেই ‘মা’ বলে ডাকতে শুরু করেছিল।
মায়ের জন্য শুরুর দিকটায় মন খারাপ করত খুব। কিন্তু মায়ের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেই বাবার মুখ থমথমে হয়ে যেত। বলত মায়ের কথা ভুলে যেতে। একদিন মায়ের কথা মনে পড়ছিল খুব। ‘মায়ের কাছে নিয়ে চলো’ বলে সকাল থেকে একটু বেশিই আবদার জুড়েছিল। বাবা একটা সময় ঠাস করে চড় কষিয়ে দিয়েছিল। ‘তোকে আমি শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি আর কোনওদিন যদি মায়ের সঙ্গে দেখা করার কথা শুনেছি ঘরে বন্ধ করে রেখে দেব। নেমকহারাম তৈরি হয়েছে একটা। ভিক্ষা করে খেতিস ওই মায়ের কাছে থাকলে।’
রাত্রে শুয়ে শুয়ে চোখে জল এসেছিল সেদিন। তার কি আর কোনওদিনই মায়ের সঙ্গে দেখা হবে না? সে না হয় ভিক্ষে করেই খেত। সে কি বাবাকে বলেছিল মায়ের কাছ থেকে এখানে নিয়ে আসতে? তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে এই নতুন মা কত আদর করে দাদাকে। চুল আঁচড়ে দেয়। স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। কই, কখনও তো তাকিয়েও দেখে না তার দিকে! নিজের ছেলে নয় বলেই তো? তা হলে সে-ই বা কেন ‘মা’ বলে ডাকবে সৎমাকে?
বাবার উপরও ভারী অভিমান হয় তার। বাবা কি অন্ধ? দেখতে পেল না, গত পরশু রাত্রিবেলা খাওয়ার সময় দাদার প্লেটে দুটো দরবেশ পড়ল, আর তার প্লেটে একটা। বাবারই তো আনা মিষ্টি। প্যাকেটে আরও তিন-চারটে মিষ্টি তো ছিলই। সেগুলো নতুন মা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে দিল। কেন ঢুকিয়ে রাখল, সে জানে। ওগুলো কাল দাদার টিফিনে যাবে। সে লজ্জায় বলতেও পারল না, ‘আমাকেও আরেকটা দাও।’ অথচ দরবেশ খেতে সে কী অসম্ভব ভালবাসে!
চাইলেই হত, কিন্তু তবু কেন সে চাইতে পারল না ? শুধু লজ্জায়? না কি ভয়েও? নতুন মা-কে সে ভয়ই পায়। এখানে আসার পর থেকে একদিনও তার সঙ্গে ভাল করে কথা বলেনি নতুন মা। বাবার কি এসব চোখে পড়ে না? নতুন মায়ের কথার উপরে বাবাই বা কথা বলে না কেন? বাবাও ভয় পায় এত? তা হলে সে আর কাকে নিজের কথা বলবে?
শৈশব থেকে কৈশোরের দিকে যত এগোচ্ছিল কাজল-সজল, ছেলে আর সৎছেলের মধ্যে তফাতটা বেআব্রু করে দিচ্ছিলেন নিয়তি। এবং সব দেখেশুনে, জেনেবুঝেও উদাসীন থাকছিলেন সুবল। মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত সজলের একটা ভরসাস্থল দরকার ছিল। সুবল সেই ভরসার পরিসরটুকু ছোটছেলেকে দিতে পারেননি। সৎবাবার মতো আচরণ করতেন ছোটছেলের সঙ্গে।
কীরকম?
কাজল ক্রিকেট খেলতে ভালবাসে। ক্রিকেট-কিট চাই, আবদার করল বাবার কাছে। নতুন মা-ও ইনিয়েবিনিয়ে বলল বাবাকে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বড়ছেলের জন্য ব্যাট-প্যাড-গ্লাভস-অ্যাবডোমেন গার্ড হাজির। সজল ফুটবল-পাগল। কবে থেকে বাবাকে বলছে একজোড়া স্পাইক বুট আর শিনগার্ডের জন্য। ক্রিকেট-কিটের তুলনায় অনেক কম খরচায় হয়ে যায়। অথচ সময়ই হচ্ছে না বাবার। মনে করাতে গেলে খিঁচিয়ে উঠছে বরং। অন্যায় নয়?
সজল আঁকতে ভালবাসে। ভাল আঁকে। রং-তুলিকে তার বন্ধু বলে মনে হয়। স্কুলে ড্রয়িং কন্টেস্টে সবসময় ফার্স্ট হয়। তাদের ড্রয়িং স্যার বলেছেন, ‘তোমার ট্যালেন্ট আছে আঁকায়। একটু মাজাঘষা করলে ভাল পেইন্টার হওয়ার সম্ভাবনা আছে তোমার। বোলো বাড়িতে।’ সে বলেছিল বাড়িতে, কিন্তু বাবা শুনলে তো! অথচ নতুন মা একবার বলতেই বাবা তড়িঘড়ি সুইমিংয়ে ভরতি করিয়ে দিল দাদাকে। তার সাঁতার অত ভাল লাগে না। তার ছবি আঁকতে ভাল লাগে। বাবা জানেও সেটা। পারত না তাকে একটা ড্ৰয়িং শেখার স্কুলে ভরতি করিয়ে দিতে? বলল একবারও? অবিচার নয়?
হ্যাঁ, সে পড়াশুনোয় ভাল নয় বড় একটা। টেনেটুনেই পাশ করে পরীক্ষায়। কিন্তু দাদাই বা লেখাপড়ায় কীসের দিগ্গজ? সে এইট থেকে নাইনে ওঠার পরীক্ষায় মোটেই ভাল করেনি। অঙ্ক আর ইংরেজিতে ফেল করতে করতে বেঁচে গেছে। রিপোর্ট কার্ড দেখে কী মারটাই না মারল বাবা! কিন্তু দাদার মার্কশিট দেখে শুধু বলল, ‘পড়াশুনোয় আরও মন দিতে হবে।’ অথচ ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার পরীক্ষায় একটা সাবজেক্টেও দাদা একশোয় পঞ্চাশের বেশি পায়নি। তার বেলা? যত মার বরাদ্দ শুধু তার বেলায়? অত্যাচার নয়?
বাবা-মায়ের আচরণে কাজলও দ্রুত বুঝতে শুরু করেছিল, এবাড়িতে তারই জন্য বরাদ্দ রাজার পার্ট। সৎভাই সজল হীনদরিদ্র প্রজামাত্র। ক্লাস এইট থেকে টেনের মধ্যবর্তী সময়টায় বাড়িতে ক্রমশ একা হয়ে পড়েছিল সজল। তার রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ-অভিমান উগরে দেওয়ার একমাত্র জায়গা হয়ে উঠেছিল ফুটবল মাঠের বন্ধুরা। মাঠে বিকেলের ফুটবল আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাটুকুই ছিল সজলের জীবনে একমাত্র সবুজ। বন্ধুরা শুনত পাপ্পার বাড়ির রোজনামচা। শুনত, ক্রমশ বাড়ির ‘ছেলে’ থেকে কীভাবে বাড়ির ‘চাকরে’ পরিণত হচ্ছে পাপ্পা।
চাকর ছাড়া কী? ক্লাস এইটে ওঠার পরই সজলকে বাসন মাজার কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন নিয়তি। ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাসন-মাজার লোক। ‘প্লেটগুলো একটু ধুয়ে দিস তো পাপ্পা’ দিয়ে শুরু। ক্রমে পাকাপাকিভাবে দিনরাতের বাসন মাজার কাজ ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। শুধু কি তাই? কাজলের জামাকাপড় ইস্ত্রি করা। রাতে শোবার আগে নিজের বুট পালিশ করার সময় কাজলের বুটও পরিষ্কার করে রাখা। ‘কেন, দাদা করতে পারে না নিজেরটা?’ একদিন বিরক্ত হয়ে বলে ফেলেছিল সজল। উত্তরে রে রে করে তেড়ে এসেছিল নতুন মা। ডেকে এনেছিল বাবাকে, ‘শুনে যাও, মেজাজটা শুধু দেখে যাও তোমার ছেলের। দাদার জুতোটা একটু পালিশ করে দিতে বলেছি বলে প্রেস্টিজে লেগেছে বাবুর! তোর মা তোর জুতো পালিশ করার জন্য কতজন দাসদাসী রেখেছিল রে?’
সুবল এসব ক্ষেত্রে যা করে থাকতেন, সেটাই করেছিলেন। উদ্দাম মেরেছিলেন সজলকে, ‘মুখে মুখে কথা বলার সাহস হল কোত্থেকে তোর? যা বলা হচ্ছে করবি। নয়তো দূর করে দেব বাড়ি থেকে। পচে মরবি তোর ওই ভিখিরি মায়ের কাছে।’ সজল লক্ষ করেছিল, সে যখন মার খাচ্ছিল, দাদা চুপচাপ দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিল তখন। ভাইয়ের হেনস্থায় আনন্দ যেন আর ধরছে না। একবারও বলতে পর্যন্ত এল না, ‘পাপ্পাকে আর মেরো না।’
বাড়ি, না জেলখানা এটা? বাবা লোকটা একটা কসাই। এমন বাবা থাকার থেকে না-থাকা ঢের ভাল । আর এমন সৎমা যেন চরম শত্রুরও না হয়। ডাইনি ডাইনি! রইল বাকি সৎদাদা। পাকা শয়তান একটা। সুযোগ পেলেই বাবা আর ওই ডাইনিটার কাছে চুকলি করে মার খাওয়ায় তাকে। বন্ধুরা ঠিকই বলে, বাবাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে সব সম্পত্তি দাদার নামে লিখিয়ে নেওয়ার তাল করছে ডাইনিটা। বাবার যা কিছু, সব দাদা ভোগ করবে। আর তার জীবন কাটবে এদের দয়ায়, চাকরগিরি করে। নাহ, ঢের হয়েছে! আর নয়। তিনটেকেই মেরে সে জেলখানায় থাকবে, তা-ও ভাল। কিন্তু এভাবে আর নয়।
পাড়ার ফুটবল টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালটাও তাকে খেলতে দিল না ওরা। অথচ এই ম্যাচটা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কত প্ল্যানিং করেছিল গত পরশু। ওরা তিনজন সিনেমা দেখতে গেল। সে খেলতে যেতে চেয়েছিল বলে বাবা বলল, ‘পেলে হবি? মারাদোনা হবি?’ দাদার জামাকাপড় গুছিয়ে রাখার কাজ চাপিয়ে গেল ডাইনিটা, ‘ঠিকঠাক না হলে ফিরে এসে মজা দেখাব।’ আর দাদা খ্যাকখ্যাক হাসল, ‘শুনলি তো পাপ্পা!’ পাছে সে বেরতে না পারে, বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে বেরল বাবা।
ওরা ফেরার পর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে যখন মাঠে এসেছিল সজল, তখন টিম শেষ মিনিটের গোলে হেরে যাওয়ার শোকে মুহ্যমান। সঙ্গে আক্ষেপ, ‘পাপ্পা থাকলে ম্যাচটা এভাবে হারতে হত না।’ পাপ্পার মুখে সব শুনে টোটো সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, ‘মন খারাপ করিস না…পরের মাসে বিরাটিতে একটা টুর্নামেন্ট আছে শুনছি… তখন তরুণ সংঘ-র সঙ্গে হিসেবটা মিটিয়ে দেব।’
পাপ্পার প্রতিক্রিয়ায় একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল বন্ধুরা, ‘তার আগে বাড়ির হিসেবটা মিটিয়ে দেওয়া দরকার।’
—মানে? হিসেব মিটিয়ে দেওয়া মানে?
—আগে বল, গতকাল তোরা কে কে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ দেখেছিস?
পাপ্পার প্রশ্নের উত্তরে রাজা-টোটো-বুড়োরা মাথা নেড়েছিল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ… দেখেছি তো। কেন?’
—ওই সিনটা দেখলি? কোকের ক্যানটা নিয়ে পয়সা দেওয়ার সিনটা?
‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’। আটের দশকের শেষদিকে টিভিতে শুরু হওয়া যে নিউজ় সিরিজ় প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল সেসময়। সে রাজনীতিই হোক বা খেলাধুলোর জগৎ বা বিনোদনের দুনিয়া, বিশ্বে গত সাতদিনে গুরুত্বপূর্ণ যা যা কিছু ঘটেছে, তার হরেক ঝলক প্রতি শুক্রবার রাত আটটায় উঠে আসত দূরদর্শনে। প্রণয় রায়ের স্মার্ট ঝকঝকে পরিবেশনা আলাদা মাত্রা দিয়েছিল প্রোগ্রামে। ভারতীয় টিভি-তে এই ধরনের নিউজ় সিরিজ় সেই প্রথম। বড়রাও দেখতেন, তবে বিশেষত সেসময়ের স্কুল-কলেজপড়ুয়াদের কাছে নেশার মতো হয়ে উঠেছিল ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’। শুক্রবার রাত আটটা মানেই তখন টিভি এবং প্রণয় রায়।
পাপ্পা গতকালের এপিসোডটার কথা বলছিল। সে বছরই, ’৯৩ সালে, রিলিজ় করেছিল মাইকেল ডগলাস অভিনীত হলিউড থ্রিলার ‘ফলিং ডাউন’। সুপারহিট এই ছবির একটা বিখ্যাত দৃশ্য গতকাল দেখানো হয়েছে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’-এ। একটা মাঝারি সাইজ়ের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিকের সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে বচসায় জড়িয়ে পড়েন মাইকেল। স্টোরের মালিক একটা বেসবল ব্যাট নিয়ে মারতে যান মাইকেলকে। ব্যাটটা কেড়ে নেন মাইকেল। দোকানের অর্ধেক জিনিসপত্র ওই ব্যাট দিয়েই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন। তারপর একটা কোকের ক্যান তুলে নেন দোকানে রাখা একটা শেলফ থেকে। কোকের দাম হিসেবে দোকানের ক্যাশবক্সে পঞ্চাশ সেন্ট রেখে দেন। এবং কিছুই যেন ঘটেনি, এমন একটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যান দোকান থেকে। কোকের ক্যানে চুমুক দিতে দিতে।
রাজা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ… ওটা হেব্বি ছিল। দোকানটার বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার পর কী স্মার্টলি কোকের ক্যানটা নিল। আর দামটা দিয়ে কী ক্যাজুয়ালি বেরিয়ে গেল! কিন্তু তুই ওই সিনটার কথা হঠাৎ বলছিস কেন?’
পাপ্পা হেঁয়ালি-মেশানো উত্তর দেয়, ‘ওটাও প্ল্যানের মধ্যে থাকবে।’
টোটো বলে ওঠে, ‘আরে প্ল্যানটা তো বল! কী প্ল্যান, কিসের প্ল্যান?’
.
অপরাধবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল শিশু বা কিশোরমনের অপরাধপ্রবণতা। যা নিয়ে সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত কত যে গবেষণা হয়েছে, হয়ে চলেছে নিরন্তর, তার ইয়ত্তা নেই কোনও। শিশু-কিশোরদের ‘অপরাধী’ হয়ে ওঠার নেপথ্য কারণগুলি নিয়ে যুক্তি-তর্ক-ব্যাখ্যা আছে এত, যে নির্যাসটুকু লিখতে গেলেই আস্ত একটা বই হয়ে যায়।
একটা বিষয়ে অবশ্য অপরাধ-গবেষকরা সকলেই কম-বেশি সহমত, শিশু বা কিশোরদের ঘটানো প্রতিটি অপরাধ তাদের পটভূমির বিচারে এতটাই আলাদা, চরিত্রবৈশিষ্ট্যে এতটাই ভিন্ন, যে নির্দিষ্ট কোনও কারণ বা কারণসমূহকে চিহ্নিত করা কঠিন।
কিংবদন্তিসম ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ ক্যাথরিন ব্যানহাম তাঁর বহুপঠিত প্রবন্ধ ‘Factors Contributing to Juvenile Delinquency’-তে স্পষ্ট লিখেছেন, ‘Each juvenile offense is the outcome of complexity of causes, some of whose origins date back years before the committal of the offense and other whose origins are more obviously and immediately connected with the act of delinquency. It has been shown that a different set of causes is involved in each individual case. It is impossible therefore to state the group of causes which will invariably result in any particular offence.’
সাধারণভাবে তবু কিছু ‘কমন’ কারণ উঠে আসে শিশু-কিশোরদের অপরাধমনস্কতা বিষয়ক গবেষণায়। ছোটবেলায় যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া বাচ্চাদের মধ্যে ভবিষ্যতে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা গিয়েছে বহুক্ষেত্রে। তেমনই বাবা-মায়ের অসুখী দাম্পত্য এবং তজ্জনিত অশান্তির সাক্ষী থাকা ছেলেমেয়েদেরও দেখা গিয়েছে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে। সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করা যায় আরও বহুবিধ। মা-বাবার বিচ্ছেদের সাক্ষী থাকা, অভিভাবকদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত স্নেহ-ভালবাসা না পাওয়া, সহোদর ভাইবোনের সঙ্গে সুসম্পর্কের অভাব ইত্যাদি প্রভৃতি।
কারণ চিহ্নিত করা গেলেও ক্ষেত্রবিশেষে নির্মূল করা যায় না শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা, এমন ধারণাও পোষণ করেন অনেকে। এঁদের মতে, কেউ কেউ জন্মায়ই অপরাধপ্রবণতা নিয়ে। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার জন্য কোনও কারণ বা অনুঘটকের প্রয়োজন হয় না জন্মগতভাবে অপরাধপ্রবণ শিশু-কিশোরদের।
সত্যিই কি ‘বর্ন ক্রিমিনাল’ বলে কিছু হয়? অপরাধবিজ্ঞানের জনক হিসেবে যিনি স্বীকৃত, যিনি বিজ্ঞান আর নৃতত্ত্বকে একসূত্রে বেঁধে অপরাধ-গবেষণার নয়া দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন, সেই ইতালীয় মনস্তত্ত্ববিদ সিজার ল্যামব্রোজো লিখেছিলেন, ‘many individuals are born with perverse propensities, regardless of their parents, attempts to turn them around.’
সজলের বেড়ে ওঠার দিনগুলো যেভাবে কেটেছিল, সেই নিরিখে বিচার করলে ‘বর্ন ক্রিমিনাল’-এর গোত্রে কোনওভাবেই ফেলা যায় না তাকে। একটু তলিয়ে ভাবলে বরং মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের কথা। লোভ সামলানো যায় না গল্পটির কয়েকটি অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়ার।
‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।
সেও সর্বদা মনে-মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এইজন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে। অথচ, এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময়ে যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিম্বা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না; কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে। সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।
অতএব, এমন অবস্থায় মাতৃভবন ছাড়া আর-কোনো অপরিচিত স্থান বালকের কাছে নরক।’
গল্পের ফটিকের সঙ্গে বাস্তবের সজলের অমিল বিস্তর। ফটিক মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল না। শান্তশিষ্ট ছোটভাই মাখনের উপর তার ‘দাদাগিরি’-তে মা মাঝেমাঝে রুষ্ট হতেন, এই পর্যন্তই। ফটিক স্বেচ্ছায় কলকাতায় মামার বাড়িতে এসেছিল। মামীর ঔদাসীন্য অসহনীয় বোধ হওয়ায় সে মামার বাড়ি থেকে মরিয়া যাত্রা শুরু করেছিল ‘মাতৃভবনের’ উদ্দেশে। মধ্যপথে ঘোর অসুস্থ হয়ে পড়ে ফিরতে হয়েছিল মামার বাড়িতেই। খবর পেয়ে যতক্ষণে ছুটে এসেছিলেন মা, ততক্ষণে ফটিকের ‘ছুটি’-র সময় হয়ে এসেছিল।
কোথায় ফটিক আর কোথায় সজল! আট বছর বয়স থেকে বাধ্যতই মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল সজল। ‘মাতৃভবন’ থেকে চলে আসার পর আর ফেরা হয়নি। বাবা আর সৎমায়ের নিস্পৃহতা-নিষ্ঠুরতা এবং লাগাতার অযত্ন-অনাদর-অবহেলা কিশোর সজলকে দিক্ভ্রান্ত করে তুলেছিল।
প্রেক্ষিত-পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা ঠিকই। তবু বয়ঃসন্ধির কিশোরের যে অস্তিত্ব-সংকট, পরিপার্শ্বের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার যে তাগিদ, সেই মোহনাতেই যেন অনেকটা মিশে যায় কল্পনার ফটিক আর রক্তমাংসের সজল।
‘ছুটি’ সজলেরও হয়ে গিয়েছিল, সুস্থ জীবন থেকে। তার অভিমান জমতে জমতে পরিণত হয়েছিল ক্ষোভে। ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে হতে রাগে। রাগ সঞ্চিত হতে হতে প্রতিশোধস্পৃহায়। বন্ধুদের সঙ্গে ছক কষতে বসেছিল বাড়ির ‘হিসেবটা মিটিয়ে দেওয়ার’।
—প্ল্যানটা তো বল?
—বলছি। আগে তোরা বল? তোরা সঙ্গে আছিস তো…
সমস্বরে উত্তর এসেছিল বন্ধুদের থেকে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ! বল না কী কী করতে হবে!’
সজল খুলে বলেছিল তার পরিকল্পনা। সব শুনে রঞ্জিত বলেছিল… ‘দে শালা শেষ করে, কুত্তার জীবন কাটাচ্ছিস, এবার এসপার-ওসপার। আর তোর বাবা, সৎমা আর সৎদাদাটা ফুটে গেলে ফ্ল্যাটটা তোর। সব সম্পত্তিও তোর। মিটিয়ে দে শালা হিসেব।’
—হুঁ… কিন্তু তাড়াহুড়ো করলে চলবে না, সজল বলেছিল, কী কী লাগবে, তার একটা লিস্ট করা দরকার। গ্লাভস, নারকেল দড়ি, ছুরি, ভোজালি…
—কাজটা করবি কবে?
—আমি বলব তোদের। পুজো আসছে। পাড়ার প্যান্ডেলে রাত অবধি কাজ হয়। লোক থাকে। এসময় রিস্কি হয়ে যাবে।
—তা হলে?
—পুজোটুজো মিটে যাক। শীতটা পড়ুক। সময়টা ভেবে রেখেছি অবশ্য। দাদার এখন ফার্স্ট ইয়ার। কলেজ থেকেই টিউশনিতে যায়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ন’টা। বাবার অবশ্য আরও দেরি হয় ফিরতে। তোরা ঢুকবি সাড়ে আটটা নাগাদ। ওটাই পারফেক্ট টাইম।
.
২২ নভেম্বর, ১৯৯৩। সোমবারের রাত। ঘড়িতে সাড়ে আটটা। ‘পারফেক্ট টাইম’।
শুভম অ্যাপার্টমেন্টের বসার ঘরে বসে নিয়তি টিভি দেখছেন। সজল রয়েছে ভিতরে নিজের শোবার ঘরে। পাঁচতলায় ফ্ল্যাট নম্বর ৪/এ-তে বেল বাজল ঠিক আটটা পঁয়ত্রিশে। নিয়তি দরজা খোলামাত্র রাজা-বুড়ো-দেবা-রঞ্জিত ঢুকে পড়ল ঘরে। নার্ভ ফেল করল টোটোর, নারকেল দড়ি আর গ্লাভস যে জোগাড় করেছিল। ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে গেল। ঢুকল না । ফিরে গেল বন্ধুরা ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর।
নিয়তি অবাক। এদের মুখ চেনেন। পাড়ারই বা আশেপাশের এলাকার ছেলেছোকরা। পাপ্পার বন্ধু এরা। একসঙ্গে ফুটবল খেলে। এত রাতে এভাবে সবাই মিলে হঠাৎ? হাতের ব্যাগ থেকে ওগুলো কী বার করছে ওরা? দড়ি আর ছুরি না? চিৎকার করতে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে এসে নিয়তির মুখ চেপে ধরল সজল। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গেই যে প্ল্যানমাফিক বেরিয়ে এসেছে বাইরের ঘরে।
ভিতরের দুটো বেডরুমের একটায় নিয়ে আসা হল নিয়তিকে। গলার কাছে ছুরি ধরে রইল দেবাশিষ। একটা চেয়ারের সঙ্গে নিয়তিকে বেঁধে ফেলা হল। মুখে কাপড় গুঁজে দিল রঞ্জিত। আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাওয়া সৎমায়ের চোখে চোখ রেখে সজল বলল, ‘অনেক মজা দেখিয়েছিস না এতদিন আমাকে ? আজ তোদের মজা দেখাব। তোর ডাইনিগিরি জন্মের মতো ছুটিয়ে দেব আজ!’
কলিংবেলের আওয়াজ ফের ন’টা চল্লিশে। তার আগে ঘরের গোটাতিনেক আলমারি তছনছ করা হয়ে গেছে। সঙ্গে আনা ব্যাগে বেশ কিছু গয়নাগাটি নিয়ে বেরিয়ে গেছে বুড়ো। ফ্ল্যাটে সজলের সঙ্গে রয়ে গেছে রাজা-দেবা-রঞ্জিত। এবার দরজাটা সজল খুলল। কাঁধে কলেজের ব্যাগ নিয়ে কাজল ঘরে ঢুকতেই সজল দ্রুত বন্ধ করে দিল দরজা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাজলের গলায় ভোজালি ঠেকিয়ে দিল দেবা। চেয়ারে বসিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধার কাজটা দ্রুত সারল রাজা-রঞ্জিত। সৎদাদার মুখে কাপড় গুঁজে দিতে দিতে সজল শাসাল, ‘এতদিন তো শুধু পাঁউরুটির মাখন-লাগানো দিকটাই খেয়ে এসেছিস। আজ দেখবি, সেঁকা দিকটা খেতে কেমন লাগে!’
এবার সুবলের জন্য অপেক্ষা। যিনি ফিরলেন সাড়ে এগারোটায়। এবারও দরজা খুলল সজলই। এবং ঢোকামাত্রই বসার ঘরে অপেক্ষমাণ রাজা-দেবা-রঞ্জিত মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুবলের উপর, ‘একটা শব্দ করলে পেটে ভোজালি ঢুকিয়ে দেব কিন্তু… চুপ… একদম চুপ!’
প্রাথমিক কাজ শেষ। ভিতরের দুটো ঘরে চেয়ারে বসা তিনজন। একটায় নিয়তি। অন্যটায় সুবল-কাজল। তিনজনেই হাত-পা বাঁধা এবং মুখে কাপড়-গোঁজা অবস্থায়। বাবা এবং সৎদাদার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সজল, ‘তোমাদের ব্যবস্থা একটু পরে করছি। আগে ডাইনিটাকে খালাস করে আসি।’
নিয়তি চেয়ারে বসে কাঁপছিলেন। সজল সজোরে গলা টিপে ধরল সৎমায়ের। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল নিয়তির। শ্বাসরোধ, মৃত্যু।
আরও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু অপেক্ষায় ছিল সুবল-কাজলের। প্রথমে বাবা। তারপর সৎদাদা। ছুরি-ভোজালি দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপ চালাল সজল। সঙ্গত দিল রঞ্জিতও। গলায়-বুকে-ঘাড়ে-পেটে একাধিক আঘাত ধারালো অস্ত্রের। প্রবল রক্তপাত, মৃত্যু।
মূল ‘অপারেশন’ কমপ্লিট। পুরোটাই গ্লাভস পরে, যাতে হাতের ছাপ না পাওয়া যায় কোথাও। বন্ধুদের সঙ্গে বসার ঘরে এল সজল। এবার প্ল্যানমতো একটা ডাকাতির চেহারা দেওয়া দরকার পুরো ঘটনাকে। কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে যে। একটু কিছু খাওয়া দরকার। ফ্রিজে সন্দেশ ছিল এক বাক্স। বার করে ধীরেসুস্থে মিষ্টিগুলো খেল চার বন্ধু। ভিতরের দুটো ঘরে তখন তিনটে মৃতদেহ। একটা ঘর ভেসে যাচ্ছে রক্তস্রোতে।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর সজল বলল, ‘এবার পয়সাটা রাখতে হবে। ‘‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’’-এ সেই সিনটা দেখেছিলাম না? হিরোটা দোকান ভেঙেছিল। কিন্তু কোকটার টাকা দিয়ে গিয়েছিল। এখানেও ডাকাত এসেছিল। ফ্রিজ থেকে বের করে মিষ্টি খেয়েছিল। আর মিষ্টির টাকা টেবলে রেখে গিয়েছিল… ক্লিয়ার ?’
দু’-পাঁচ টাকার নোট আর কিছু খুচরো পয়সা মিলিয়ে কুড়ি টাকার মতো জমা হল বসার ঘরের সেন্টার-টেবলে। ছুরি-ভোজালি থেকে রক্তের দাগ তেল-জল দিয়ে ধুয়ে ফেলে একেবারে সাফসুতরো করে রাখা হল সোফার উপর।
আর একটাই কাজ বাকি। সজল বলল, ‘নে, এবার বাঁধ আমাকে।’ সজলকেও চেয়ারের সঙ্গে বাঁধল রাজা-দেবা-রঞ্জিত। কিন্তু এতটাই আলতো করে, যে তিন বন্ধু বেরিয়ে যাওয়ার পরেও যাতে স্বচ্ছন্দে ভিতর থেকে দরজাটা লক করতে পারে সজল।
টিভি চলছিল। রাতটা সজল কাটাল মূলত টিভি দেখেই। ভোরের দিকে ঝিমুনি এলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ল হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। পাশের দুটো ঘরে পড়ে থাকল বাবা-সৎমা-সৎদাদার লাশ।
সজল চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করল পরের দিন দুপুর দেড়টা নাগাদ। ধাক্কা দিতে লাগল দরজায়। প্রতিবেশীরা সে আওয়াজ শুনলেন। পাপ্পা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চেঁচাচ্ছে ভিতর থেকে। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ফোন গেল দমদম থানায়। পুলিশ এসে দরজা ভাঙল। সুবল-নিয়তি-কাজলের লাশ উদ্ধার হল। মুক্ত করা হল চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় থাকা সজলকেও। যে তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে সবার দিকে। এতটাই যেন আতঙ্কগ্রস্ত, কথাই বেরচ্ছে না মুখ থেকে।
ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন একঝাঁক আইপিএস। উত্তর ২৪ পরগনার এসপি, অ্যাডিশনাল এসপি, ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ), আইজি (দক্ষিণবঙ্গ), ডিআইজি (সিআইডি)। কেসের তদন্তভার বর্তাল সিআইডি-র ওপর।
তবে সত্যি বলতে সজল যে আষাঢ়ে গল্পটা বানিয়েছিল, তাতে তদন্তকারীদের কাজটা নেহাতই সহজ হয়ে গিয়েছিল। সজল এক দুর্ধর্ষ ডাকাতদলের গল্প ফেঁদেছিল। সাতজন ঢুকেছিল। যাদের মধ্যে দু’জন প্রকাণ্ড চেহারার পাঞ্জাবি। সাতজনই হিন্দিতে কথা বলছিল। ওই দুই পাঞ্জাবি সহ সাতজনেরই মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা ছিল। সুবল-নিয়তি-কাজলকে মেরে ফেলার পর ওরা সজলকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রেখে যায়। বেরিয়ে যাওয়ার আগে তার মাথায় রিভলভারের বাঁট দিয়ে খুব জোরে মারে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরের দিন দুপুরের দিকে জ্ঞান ফিরলে সে দরজায় ধাক্কা দেওয়া শুরু করে। চিৎকার করতে শুরু করে।
এ গল্প ক্লাস ফাইভের বাচ্চাই বিশ্বাস করবে না, তো পুলিশ! কয়েকটা মাত্র প্রশ্ন করা হল সজলকে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দরজা ভিতর থেকে লক করলে কী করে? তা ছাড়া তুমি তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে, তা হলে কে লক করল? ডাকাতরা কুপিয়ে মারল দু’জনকে। গলা টিপে খুন করল আরেকজনকে। তোমার গায়ে আঁচড়টুকুও পড়ল না। এতই নরমসরম ভাবে তোমাকে বেঁধে রেখে গেল, যে ইচ্ছে করলেই তুমি দরজা লক করতে পারতে। শুধু তোমারই প্রতি এত মায়াদয়া কেন ডাকাতদের? তা ছাড়া ডাকাতি করার পর অস্ত্রশস্ত্র এত পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখে গেছে ডাকাতরা, এটাই বা কে কবে শুনেছে?
একটা প্রশ্নেরও সদুত্তর ছিল না সজলের কাছে। প্রথম দু’দিন শোকগ্রস্ত থাকার অভিনয় করে কাটাল। বয়ান বদলাল একাধিকবার। কিন্তু ওই আজগুবি গপ্পো আর সিআইডি অফিসারদের কাছে কতক্ষণ টিকবে? টিকলও না। তৃতীয় দিনেই এল স্বীকারোক্তি। সব খুলে বলল সজল।
শুভ্রশীল রায়, ডাকনাম রাজা। সমর সাহা ওরফে বুড়ো। অলোক সাহা, ডাকনাম টোটো। দেবাশিষ দে আর রঞ্জিত মণ্ডল। সবাই নাবালক। বয়স ওই ষোলো-সতেরোর মধ্যে। স্কুলপড়ুয়া সবাই। রাজা-বুড়ো-টোটো-দেবাশিষকে ধরতে এতটুকুও বেগ পেতে হল না পুলিশকে। রঞ্জিত ছিল বর্ধমানে এক আত্মীয়ের বাড়ি। তুলে আনা হল। ছুরি-ভোজালি রঞ্জিতই মধ্য কলকাতার একটি দোকান থেকে জোগাড় করেছিল এক পরিচিতের মাধ্যমে।
ষোলো বছরের এক কিশোর তারই সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে কীভাবে ছক কষেছিল বাবা-সৎমা-সৎদাদাকে হত্যার, খুনের পরে তিনটে লাশের সঙ্গে কী অবলীলায় রাত কাটিয়েছিল নির্বিকার, প্রকাশ্যে এল সব। আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) প্রেসকে বললেন, ‘The brutality is difficult to digest even for hard-boiled cops like us.’
মামলার বিবরণ কাগজে প্রকাশিত হচ্ছিল রোজ। বেরচ্ছিল মনোবিদদের নিবন্ধ। বাসে-ট্রামে-মাঠে-ঘাটে-রকের আড্ডায় তখন একটাই আলোচনা। সজল বারুই। ঘটনার ভয়াবহতায় আমূল নড়ে গিয়েছিল কলকাতা সহ পুরো রাজ্যই। বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা নিয়ে রাতারাতি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন অভিভাবকরা।
একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের সম্মিলিত পরিকল্পনা, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুন এবং প্রমাণ লোপাট। এই ছিল মামলার ধারা। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে বিশেষ কাঠখড় পোহাতে হয়নি তদন্তপর্বে। গয়নাগাটি সবই উদ্ধার হল অভিযুক্তদের কারও না কারও বাড়ি থেকে। গয়নাগুলো যে তাদের বাড়িরই, চিহ্নিত করল খোদ সজলই। একটা পলিথিনের প্যাকেটে গ্লাভস আর কাপড়ের টুকরো ফেলে দিয়েছিল রাজা, দমদমের এইচএমভি ফ্যাক্টরির ভিতরে। উদ্ধার হল সেই প্যাকেট। যে দোকান থেকে ছুরি-ভোজালি কিনেছিল রঞ্জিত, গ্লাভস আর দড়ি টোটো কিনেছিল যেখান থেকে, চিহ্নিত হল দুটোই। চার্জশিটে এতটুকু ফাঁকফোঁকর ছিল না।
জেলা আদালতের রায় বেরিয়েছিল ’৯৫ সালে। প্রায় দুই বছর ধরে চলা বিচারপর্বে একদিনের জন্যও বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত মনে হয়নি সজল আর তার পাঁচ বন্ধুকে। বিচার চলাকালীন জেল থেকে যখন আদালতে আনা হত ওদের, প্রিজ়ন ভ্যান থেকে ছয় নাবালক অভিযুক্ত নামত হাসতে হাসতে। জেলে ফিরেও যেত খোশমেজাজে, হিন্দি ফিল্মের হিট গান গাইতে গাইতে। কোনওদিন শাহরুখ খানের ‘বাজ়িগর’-এর ‘‘ইয়ে কালি কালি আঁখে’’, তো অন্যদিন সলমন খানের ‘সাজন’-এর ‘‘দেখা হ্যায় পহেলি বার…’’।
যেদিন রায় বেরিয়েছিল, উৎসুক জনতার ভিড় সামলানোর জন্য বারাসতের আদালতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছিল। সেদিনও হাসতে হাসতেই পুলিশের ভ্যান থেকে নেমেছিল সজলরা। চোখেমুখে কোনও ভয়ডরের চিহ্ন তো ছিলই না, বরং শরীরী ভাষায় ফুটে উঠেছিল একটা নেই-পরোয়া মেজাজ, ‘যা করেছি বেশ করেছি… দিক যা শাস্তি দেওয়ার।’
সজল-রঞ্জিতকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন বিচারক। বাকিদের যাবজ্জীবন কারাবাস। অলোক সাহা ওরফে টোটোর আইনজীবী প্রশ্ন তুলেছিলেন, টোটো তো ফ্ল্যাটের দরজা থেকে ফিরে গিয়েছিল। সে কেন শাস্তি পাবে? বিচারক মানেননি এ যুক্তি। বলেছিলেন, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে (১২০বি, আইপিসি) যুক্ত থাকা এবং একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের সম্মিলিত পরিকল্পনায় (৩৪ আইপিসি) শরিক হওয়ার দায় অলোক এড়াতে পারে না।
যখন বিচারক রায় পড়ে শোনাচ্ছিলেন, আসামিদের জন্য নির্দিষ্ট কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় সময় কাটিয়েছিল সজল আর তার পাঁচ বন্ধু। যখন শেষমেশ সাজা শোনানো হল, মুখে আঙুল পুরে শিস দিয়ে উঠেছিল সজল। আর হাততালি দিয়ে উঠেছিল রাজা-টোটো-বুড়ো-দেবা-রঞ্জিত। ব্যাপার দেখে কথা হারিয়ে ফেলেছিল ভিড়ে ঠাসা বিচারকক্ষ। এবং সাজা ঘোষণার পর অন্যদিনের মতোই দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে জেলে ফেরার ভ্যানে উঠেছিল ওরা ছ’জন। অন্যদিনের মতোই হিন্দি গানের লাইন গুনগুন করতে করতে! অকল্পনীয়! সিনেমাতেও কেউ কখনও দেখেনি এমনটা!
হাইকোর্টে সাজা মকুবের আবেদন জানিয়েছিল সজলরা। এক বছরের আইনি চাপানউতোরের পর হাইকোর্ট সজল আর রঞ্জিতকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল। বরাদ্দ হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাবাস। বাকি পাঁচ অভিযুক্তের কারাবাসের মেয়াদও কমেছিল। যাবজ্জীবন থেকে কমে কারও তিন বছর, কারও পাঁচ, কারও বা সাত।
শুরুর কয়েক বছর সজল ছিল দমদম সংশোধনাগারে। তারপর তাকে স্থানান্তরিত করা হয় মেদিনীপুরের সংশোধনাগারে। যেখানে সজল হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বলে, পেটে প্রবল ব্যথা হচ্ছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় কিডনির সামান্য সমস্যা ধরা পড়ে। নিয়ে আসা হয় কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। সেটা ২০০১-এর সেপ্টেম্বর। চিকিৎসাধীন থাকাকালীন এক রাতে প্ৰহরারত দুই কনস্টেবলকে বোকা বানিয়ে হাসপাতাল থেকে চম্পট দেয় সজল। ২০০৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত সে ছিল পলাতক। বহু চেষ্টাতেও সন্ধান পায়নি পুলিশ।
‘ফেরার’ থাকার এই প্রায় দেড়টা বছর কীভাবে কাটিয়েছিল সজল? হাসপাতাল থেকে পালানোর পর সজল পাড়ি দিয়েছিল মুম্বই। সেখানে টুকটাক ক্রাইম করেই হত দিন-গুজরান। মুম্বইতেই সেরে ফেলেছিল বিয়েটা। মেয়ে হয়েছিল বছরখানেক পর।
২০০২-এর শেষের দিকে কলকাতায় ফেরে সজল। মুম্বইয়ে বড্ড খরচ, পোষাচ্ছিল না আর। লেকটাউন এলাকার এক দাগি দুষ্কৃতীর দলে ভিড়ে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। হাত পাকানো শুরু করে তোলাবাজিতে। স্রেফ খুচরো তোলাবাজিতে বেশিদিন অবশ্য সন্তুষ্ট থাকতে চায়নি সজল। আর সেটাই কাল হয়েছিল। সিবিআই অফিসার সেজে সল্টলেকের একটা বাড়িতে ঢুকে ডাকাতি করল ২০০৩-এর জানুয়ারিতে। সেই মামলাতেই সপ্তাহদুয়েকের মধ্যেই নাম উঠে এল জনৈক শেখ কালামের। সোর্স মারফত খবর পেয়ে এই কালামকে ধরল পুলিশ। এবং ধরামাত্রই চেহারা দেখে বুঝতে পারল, শেখ কালামটা ভুয়ো নাম। এ সজল। প্রায় দেড় বছর ধরে ফেরার সজল বারুই!
এরপর? ফের দীর্ঘ কারাবাস। ‘দ্য জুভেনাইল জাস্টিস (কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন) অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী ২০১০ সালে সজলের আইনজীবী আদালতে জামিনের আর্জি জানালেন। বললেন, সজলের কারাবাসের ষোলো বছর অতিক্রান্ত। কিশোর বয়সে জড়িয়ে পড়েছিল অপরাধে। নিজেকে সংশোধনের একটা আইনানুগ সুযোগ প্রাপ্য বর্তমানে তেত্রিশ বছরের সজলের। আবেদন মঞ্জুর করেছিল হাইকোর্ট। ২০১০ সালের ১০ অগস্ট জামিনে জেলের বাইরে পা রেখেছিল সজল।
নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ পেয়েছিল সজল। তবে ব্যবহার করেনি সে সুযোগ। ২০১১-য় যোধপুর পার্কের এক গেস্ট হাউসে দেড় লক্ষ টাকার ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। দ্রুতই ঘটনার কিনারা করেছিল লালবাজার। দু’জন ধরা পড়েছিল। যারা কবুলও করেছিল অপরাধ, এবং যাদের জেরায় জানা গিয়েছিল, বিকাশ নামে একজন এই ডাকাতির মাস্টারমাইন্ড। পুরো ছকটা বিকাশেরই। ধৃতদের থেকে চেহারার বর্ণনা শুনে আঁকানো হয়েছিল স্কেচ। যে স্কেচ দেখে ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল ডাকাতি-দমন শাখার ওসি-র। আরে, এই ছবিটার সঙ্গে সেই ছেলেটার ছোটবেলার মুখচোখ আর ফিচার্স অনেকটা মিলে যাচ্ছে না? সেই ছেলেটা, যে নাইন্টি থ্রি-তে দমদমে নিজের বাবা-সৎমা-সৎভাইকে খুন করেছিল বন্ধুদের সঙ্গে মিলে?
ক্রাইম রেকর্ডস সেকশন থেকে সজল বারুইয়ের ছবি এনে দেখানো হয়েছিল ধৃতদের। যারা ছবি দেখেই চিনেছিল, ‘এটা বিকাশেরই ছোটবেলার ছবি… হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিকাশ!’ মিলে গিয়েছিল ওসি-র আন্দাজ, ‘যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। শরীরে একটু মাংস লেগেছে, কিন্তু বাকি চেহারাটা এতদিনেও বিশেষ পালটায়নি। বিকাশটা ভুয়ো নাম। এটা মোস্ট ডেফিনিটলি সজল। সজল বারুই।’
এই ডাকাতির মামলায় বেশ কয়েক বছর জেল খাটার পর সজল মুক্তি পেয়েছিল ২০১৭-য়। তারপর থেকে বাইরেই আছে। নতুন কোনও অপরাধে তার নাম এখনও পর্যন্ত জড়ায়নি। ষোলো বছর বয়সে যে অভাবনীয় কাণ্ড সে ঘটিয়েছিল, তাতে আজ এই প্রায় তিন দশক পরেও ‘সজল বারুই’ পরিচয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা প্রায় অসম্ভবই। অন্য কোনও নামে, অন্য কোনও পরিচয়ে নিজের মতো করে হয়তো চেষ্টা করছে সুস্থ জীবনে ফিরতে। ভাল হলেই ভাল।
.
অপরাধ-মনস্তত্ত্বের কত যে রসদ মজুত এই মামলায়! ভাবলে অবাক লাগে, সজল বারুইয়ের না হয় যথেষ্ট কারণ ছিল সুবল-নিয়তি-কাজলের সঙ্গে ‘হিসেব’ মিটিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বাকি বন্ধুদের? শুভ্রশীল-অলোক-রঞ্জিত-দেবাশিষ-সমরের? ওদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর হয়েছিল প্রচুর। লেখালেখিও হয়েছিল অনেক। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর স্কুলপড়ুয়া সব। কোনও শারীরিক-মানসিক সংকট আপাতদৃষ্টিতে নেই যাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকায়। তবু রাজি হয়ে গেল ষড়যন্ত্রে, তিনটে জলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলার পরিকল্পনায়? শুধুই বন্ধুর প্রতি ভালবাসায় হয় এটা? সম্ভব? নাকি অপরাধপ্রবণতার অঙ্কুর নিজেদের অজান্তেই ওদের কিশোরমনেও ঘাঁটি গেড়েছিল কোনও কারণে?
উত্তর মেলে না। বিদগ্ধ গবেষণায় বা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় মানবমনের সব গহনের, সব দহনের হদিশ মিললে তো হয়েই যেত। হয়েই যেত মনের পাসওয়ার্ড ‘হ্যাক’ করা।
সেটা হয় না বলেই না মন! মনের চলাচলের উপর কে আর কবে প্রভুত্ব করতে পারে? মনই কি কখনও পায় মনের সম্পূর্ণ মালিকানা?
জনপ্রিয় গানের লাইন মনে পড়ে যায়।
মন বলে আমি মনের কথা জানি না!
সুপ্রতীমবাবুর কাছে একান্ত অনুরোধ আশির দশকের কয়েকটি অমিমাংসিত কিন্তু জনমানসে প্রবল আলোড়িত কয়েকটি ঘটনা উনি গোয়েন্দাপীঠ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত করে বই হিসেবে প্রকাশ করুন। যেমন, ১) সঞ্জীব-তীর্থঙ্কর হত্যা, ২) দেবশ্রী- সত্যনারায়ণ অন্তর্ধান, ৩) ডিসি বিনোদ মেহতা হত্যা, ৪) বানতলা গণধর্ষণ ও হত্যা, ৫) বিজন সেতু গণহত্যা ইত্যাদি।