৭. সপ্তম পর্ব : দানব জেগে উঠছে

সপ্তম পর্ব : দানব জেগে উঠছে

৫০. বিদায়, বৃহস্পতি

এই মেসেজ কম্পোজ করা সহজ কাজ না, বিশেষত এর আগেরটা যখন সে তার উকিলের কাছে পাঠিয়েছিল। ফ্লয়েডের নিজেকে প্রতারক মনে হচ্ছে; কিন্তু সে জানে, দু প্রান্তের যে দুঃখ আসছে, সেটাকে কমাতে এ মেসেজ দরকার।

সে মনমরা, কিন্তু একেবারে আশাহত নয়; কারণ ফিরে আসছে পৃথিবীতে, ফিরে আসছে একেবারে অপ্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে। বীরত্ব হয়ত নেই, কিন্তু একটা শক্ত ভিত্তি পাওয়া যাবে। ক্রিসকে তার কাছ থেকে কেউ… কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আর কেউ না।

…প্রিয় ক্যারোলিন [আর সেই প্রিয়তমা শব্দটা নেই…] আমি বাড়ি ফিরছি। তুমি যখন এ মেসেজটা পাবে তখন আমি হাইবারনেশনে। আমার কাছে মনে হবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপরই যখন চোখ খুলব সামনের আকাশে পৃথিবীটা ভাসবে।

আমি জানি এখনো এ সময়টা তোমার কাছে অনেক মাস। আই অ্যাম স্যরি। কিন্তু আমি আসার আগে দুজনেই জানতাম এমনটা হবে। তারপরও, আমি অনেক সপ্তাহ এগিয়ে থাকব, কারণ মিশন প্ল্যানে পরিবর্তন এসেছে।

আশা করি আমরা কিছু কাজ করতে পারব। মূল প্রশ্ন হল-ক্রিসের জন্য ভাল হয় কোনটা? আমাদের নিজেদের অনুভূতি যাই হোক, আগে তার মূল্য দিতে হবে। আমি জানি, নিজে চাই তাকে অবশ্যই তুমিও চাও।

ফ্লয়েড সুইচটা অফ করে দিয়েছে-যা ভাবছে তা বলা কি ঠিক হবে… একটা ছেলের দরকার তার বাবাকে?

না। এর ফলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে-কোন কৌশল খাটানোর দরকার নেই। ক্যারোলিন সহজেই জবাব দেবে যে একটা শিশুর জন্য জন্ম থেকে চার বছর বয়স পর্যন্ত সবচে বেশি দরকার মায়ের… ফ্লয়েড যদি মনে করে যে বাবার দরকার, তাহলে সে অবশ্যই পৃথিবীতে থাকত।

…এবার বাড়ির ব্যাপারে। আমি খুশি হয়েছি যে রিজেন্টস এমন একটা পরিস্থিতিতে আছে যার ফলে আমরা দুজনেই সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারব। আমরা দুজনেই জায়গাটাকে ভালবাসতাম-আমি জানি। কিন্তু এখন এটাকে অনেক অনেক বড় মনে হবে। আর পুরনো সব স্মৃতি বসবে জেঁকে। তখন আমি হিলোতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে নিব। আশা করি দ্রুত কোনো স্থায়ী বাসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

একটা ব্যাপারে আমি সবার কাছে ওয়াদা করতে পারি…আর কখনোই পৃথিবী ছাড়ছি না। এক জীবনে অনেক অনেক স্পেস ট্রাভেল হয়েছে। আর যদি চাঁদে যাওয়াও ধরি…সেটাতো সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর মতো ব্যাপার; সেটুকু হিসাব থেকে বাদ দেয়া যায়।

উপগ্রহের ব্যাপারে কথা বলছিলাম-আমরা এইমাত্র সাইনোপ এর অর্বিট পেরিয়ে গেলাম। তার মানে জোভিয়ান সিস্টেম-বৃহস্পতি জগৎ ছেড়ে যাচ্ছি কিছুক্ষণের মধ্যেই। বৃহস্পতি এখন দু কোটি কিলোমিটার দূরে, দেখা যায় আমাদের চাঁদের চেয়ে একটু বড়।

এমনকি এত দূর থেকেও তুমি বলতে পারবে যে এ গ্রহের খুব ভয়াবহ কিছু একটা হয়েছে। এর সুন্দর কমলা রঙ উবে গেছে। একটু অসুস্থ ধূসর দেখাচ্ছে এখন; আগের উজ্জ্বলতার একটু ভগ্নাংশ। এখন পৃথিবীর আকাশে একে একটা অতি নিভু নিভু তারার মতো লাগছে-অবাক হওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু কিছুই হয়নি। আর আমরা ভালভাবে ডেডলাইন পেরিয়ে এসেছি। এই পুরো ব্যাপারটা কি একটা মিথ্যা সতর্কবাণী, নাকি মহাজাগতিক ঠাট্টা? কোনোদিন জানতে পারলে ভাল হত। যাই হোক, আমাদের পৃথিবীতে ফিরে আসতে আরো সাহায্য করবে। আমি এজন্যে কৃতজ্ঞ, খালি সৌর জগতের ভারসাম্য আর আকর্ষণ মাত্রা পাল্টে না গেলেই হয়!

এখনকার মতো বিদায়, ক্যারোলিন…থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং…আশা করি এখনো আমরা বন্ধু থাকতে পারব। এবং চিরদিনের মতো আজো আমার গভীরতম ভালবাসা ক্রিসের জন্য।

শেষ করার পর ফ্লয়েড ছোট কিউবিকলটার ভিতরে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল। এ ঘরটার আর দরকার নেই। এবার অডিও চিপটা ট্রান্সমিশনের জন্য উপরে ব্রিজে নিয়ে যেতে হবে। চন্দ্র ভেসে ভেসে ভিতরে ঢুকছে।

ফ্লয়েড অবাক হয় কীভাবে এ বিজ্ঞানী হালের কাছ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাওয়া সহ্য করছে তা দেখে। এখনো প্রতিদিন তারা কয়েক ঘণ্টার জন্য কথা বলে। বৃহস্পতির ডাটা ট্রান্সফার করে, ডিসকভারির অবস্থা দেখে। যদিও কেউ আবেগের ছড়াছড়ি আশা করেনি-তবু চন্দ্র তার নিয়ন্ত্রণের দারুণ প্রকাশ ঘটিয়েছে। তার গোপন কথাগুলো জানে একমাত্র নিকোলাই টানোভস্কি। সে-ই ফ্লয়েডকে কিছু ব্যাখ্যা দিতে পারে।

চন্দ্র নতুন একটা জায়গায় আগ্রহ খুঁজে পেয়েছে, উডি। মনে রেখ, সে সবসময় কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। গত কয়েক মাসে সে অনেক অনেক জেনেছে, পড়েছে। কী করছে আন্দাজ করতে পার?

আসলেই পারিনি।

হাল দশ হাজারের ডিজাইন করায় ব্যস্ত।

ফ্লয়েডের চোয়াল ঝুলে পড়ল, আচ্ছা, তাহলে শাসা যে মেসেজ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, আরবানার সেই লম্বা মেসেজগুলোর এই মাহাত্ম! যাই হোক, সে বেশিক্ষণ সার্কিটগুলো জ্যাম করে রাখতে পারবে না।

চন্দ্র ঢোকার পর যে কথাগুলো হয়েছিল তা মনে পড়ল। সে জানে, এসব নিয়ে বিজ্ঞানীকে প্রশ্ন করার কোনো মানেই হয় না; এটা ফ্লয়েডের কাজের সাথে খাপও খায় না। এসব ছাড়াও আরো কারণ আছে যার জন্য সে চিন্তিত।

চন্দ্র, বলল সে, আমার মনে হয় না ছেড়ে আসার সময় তুমি যে কাজটা করেছ তার জন্য ঠিকমতো ধন্যবাদ দিতে পেরেছি। বিশেষ করে তুমি হালকে রাজি করিয়েছ কাজের জন্য। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছে সে আমাদের বিপদে ফেলতে পারে। তুমি সব সময় আত্মবিশ্বাসী ছিলে, তুমিই ঠিক। আজো কি তোমার একটুও আফসোস হয় না?

একটুও না। ডক্টর ফ্লয়েড।

কেন না? পরিস্থিতির কারণে সে অবশ্যই চাপে ছিল। শেষবার কী হয়েছিল তাতো তুমি জানোই।

খুব বড় পার্থক্য আছে পরিস্থিতি দুটোর মধ্যে। আমার তেমন করে বলতে হলে বলা যায়, এবারের সফল কাজের পিছনে আমাদের জাতীয় চরিত্রের কিছু প্রভাব থাকে।

বুঝলাম না।

এভাবে দেখ, ডক্টর ফ্লয়েড, বোম্যান ওর বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। আমি করিনি। আমাদের মাতৃভাষায় একটা শব্দ আছে-অহিংসা [লেখক ঠিক এ শব্দটাকেই ইংরেজি উচ্চারণে লিখেছেন। এর আক্ষরিক অর্থ হয় নন ভায়োলেন্স-যদিও আসল অর্থ আরো ব্যাপক, গভীর। আমি অহিংসা ব্যবহারের ক্ষেত্রে হালের সাথে কাজ করেছি খুব সতর্কভাবে।

খুবই প্রশংসার কাজ, আমি নিশ্চিত। কিন্তু কিছু কিছু সময় আসে যখন আরো কার্যকর পথ ধরতে হয়। এমনকি কোনো কোনো সময় সেই প্রয়োজনের কারণে খারাপ কাজ করার দরকার পড়ে যায়। একটু সময়ের জন্য থামল ফ্লয়েড, চন্দ্রের পবিত্র ভাব একটু যেন বিরক্ত। তবু, এখন জীবনের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ সত্য তাকে বলে দিলে আর কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই।

এ পথে যে কাজ হয়েছে তাতে আমার খুব ভাল লাগল। কিন্তু এমন নাও হতে পারত। আমাকে প্রত্যেক সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। অহিমসা বা যা-ই তুমি বল না কেন, তোমার এই দর্শনের পেছনে আমার একটা ব্যাক আপ ছিল কিন্তু। যদি হাল একটু এদিক সেদিক করত-তাহলে তার সাথে কিছু করার ছিল আমার।

ফ্লয়েড একবার চন্দ্রকে কাঁদতে দেখেছিল। এবার দেখল হাসতে। এটাও তেমনি নতুন অস্তিত্বের প্রকাশ।

আসলেই, ডক্টর ফ্লয়েড? আমার খুব খারাপ লাগছে। এত কম মার্ক দাও আমার বুদ্ধিমত্তাকে! শুরুতেই যে কোনো কাট আউট বসাবে হালের কোনো না কোনো জায়গায় সেটা কি ভাবিনি? কাট আউটটা কয়েক মাস আগেই তুলে ফেলেছি আমি।

ফ্লয়েড তার অপ্রস্তুত মুখের সাথে মানানসই কোনো জবাব খুঁজে চলেছে। একটা কৃত্রিম হাসির মাছের মতো মুখ করার চেষ্টা করছে যেটা মাত্র নদী থেকে ধরা পড়ে একুরিয়ামে ভরে ফেলা হল। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে শাসার চিৎকার, ক্যাপ্টেন! আর সবাই! মনিটরগুলোর কাছে যাও। বোহে মোয়ে! লুক অ্যাট দ্যাট!

শাসার চিৎকারটা কান্নার মতো শোনায়।

৫১. দ্য গ্রেট গেম

লম্বা অপেক্ষার শেষ প্রান্তে চলে এসেছে তারা। অন্তত আরেকটা জগতে বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছে। নিজের গ্রহের এলাকা ছেড়ে চলে এসেছে সে আরেক জগতে। একটা প্রাচীন পরীক্ষার ফলাফল দেখানোর সময় উপস্থিত।

অনেক অনেক আগে যারা এ পরীক্ষাটা শুরু করেছিল তারা মানুষ ছিল না; মানুষের কাছাকাছিও না। কিন্তু তাদের রক্ত-মাংস ছিল। তাকিয়েছিল মহাকাশের এপাড় থেকে ওপাড়ে, যেন ভীত, একা, অসহায়, অবাক। যখনি ক্ষমতা এসেছে, দৌড়ে গেছে মহাশূন্যের দিকে। তারার জগতে। তাদের অভিযানে বহু রকমের, অনেক বিস্ময়ে ভরা জীবন দেখেছে; চেখেছে হাজারটা দুনিয়ার বিবর্তন। কসমিক অন্ধকারে, মহাজাগতিক রাত্রিতে কতশত বুদ্ধিমত্তাকে তারা একটু জ্বলে উঠতে দেখল দূরের নক্ষত্রের মতো, কত শত বুদ্ধিমত্তাকে যে দেখল নিভতে!

কিন্তু কোনো গ্যালাক্সিতে যেহেতু মনের চেয়ে দামি কোনোকিছুই পায়নি তাই এর নতুন ভোরকেই সবচে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে,..সব জায়গায়। পরিণত হয়েছে কৃষাণে। তাদের চাষের জমি অনন্ত নক্ষত্রবীথি। কখনো বুনেছে তারার জগতের চারা, কখনো পেয়েছে দারুণ ফসল।

মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে তাদের ফসল ফলানো বাদও দিতে হয়েছে, দিতে হয়েছে পুড়িয়ে।

বিরাট বিরাট ডায়নোসরেরা আর নেই। অনেকদিন ধরেই নেই। একটা সার্ভে শিপ প্রবেশ করেছিল সৌরজগতে। শিপটা হাজার বছর ধরে অভিযান চালাচ্ছে তারা থেকে তারায়। বাইরের দিকের জমাট গ্রহগুলোকে ফেলে চলেছে সেটা। মৃতপ্রায় মঙ্গলের নতুন মরুভূমির উপরে থেমেছে একটু সময়ের জন্য, তারপর একবার তাকিয়েছে নিচে, পৃথিবীর দিকে।

তাদের নিচে এক বিরাট জগৎ দেখতে পেল অভিযাত্রীরা। সারাটা বিশ্ব জুড়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছে জীবন আর জীবন। বছরের পর বছর তারা সব দেখল, সংগ্রহ করল, শ্রেণীবদ্ধ করে নিল। যতটা সম্ভব জানার পর, বোঝার পর এদের মধ্যে পরিবর্তন আনার পথে নামল। অনেক অনেক প্রজাতির মধ্যে তারা বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা দেখার চেষ্টা করল, অনেকের মধ্যে সম্ভাবনা খতিয়ে দেখল; সাগরে, স্বাদু পানিতে, মাটিতে, আকাশে, গাছের উপর। কিন্তু তাদের সেই পরীক্ষা সার্থক নাকি ব্যর্থ, তা দেখতে আরো মিলিয়ন বছরের দরকার।

ধৈর্য আছে অসীম, কিন্তু তখনো তারা অমর নয়। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আরো অনেক অনেক অনেক কাজ করার বাকি। দশ হাজার কোটি তারার দুনিয়া তাদের ডাকে অহর্নিশি। দশ হাজার কোটি তারা, তাদের প্রায় প্রত্যেকের নিজস্ব সৌর জগৎ, অনেকগুলো করে গ্রহ, আরো আরো উপগ্রহ, আরো ধূমকেতু, গ্রহাণু, ক্যাওস, ব্ল্যাক হোল… তাই আবারো তারা অসীমের গর্তে পা রাখে। তারা জানে, এ পথে আর কক্ষনো, কোনোদিন ফিরে আসা হবে না।

আসার কোনো দরকারও ছিল না। পেছনে ফেলে আসা কালো, একশিলাস্ত গুগুলো বাকিটা করতে পারবে।

পৃথিবীর বুকে হিমবাহগুলো এল, আবার চলেও গেল বরফযুগকে সাথে নিয়ে, পরিবর্তনহীন চাঁদ তখনো তার বুকের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছে নিজের রহস্য। পৃথিবীর বুকে মাত্র বরফ গলছে, ওদিকে গ্যালাক্সি থেকে গ্যালাক্সি, তারা থেকে তারায় চলছে নতুন জোয়ার, দু মেরুতে বরফ জমার চেয়েও ধীরে আসছে সভ্যতার উচ্ছ্বাস। অদ্ভুত আর সুন্দর আর ভয়াল সব সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে, হয়েছে পতন-শুধু তাদের প্রতিষ্ঠাতার কল্যাণে সভ্যতাগুলোর জ্ঞান পরিবাহিত হয় যুগ থেকে যুগে। পৃথিবীকে তারা ভুলে যায়নি, আরো একটা ছোট অভিযান দরকার। লাখ লাখ নীরব বিশ্বের মধ্যে এটাও একটা, এ লাখো দুনিয়ার মধ্যে খুব কমগুলোই কথা বলতে পারবে।

এবার আরও অনেক দুনিয়ার মতো এখানেও বিবর্তন একটা নির্দিষ্ট দিকে চলতে শুরু করল। একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে। প্রথম অভিযাত্রীরা তাদের রক্ত-মাংসের সীমাবদ্ধতা নিয়ে এসেছিল। মেশিনগুলো শরীর থেকে বেশি কার্যকর হবার পরই আবার সময় এল বেরিয়ে যাবার। প্রথমে শুধু তাদের ব্রেনগুলো বেরিয়ে পড়েছে। মেশিনের সাথে। এখানেই শেষ নয়। এবার চায় এ সীমাবদ্ধতা থেকেও মুক্তি। এবার শুধু তাদের মন আসে সব অভিযানে। তাদের চিন্তাগুলো, তারা, চকচকে ধাতু আর ঝকঝকে প্লাস্টিকের সব ধরনের বাধা অতিক্রম করে চলতে শুরু করে।

এভাবে নক্ষত্র জগতে চলে যাওয়া যায় সহজেই। আর তারা স্পেসশিপ বানায় না। তারাই স্পেসশিপ।

কিন্তু মেশিন-অস্তিত্বের যুগ পেরিয়ে গেল সহজেই। অসীম পরীক্ষার মাধ্যমে তারা জ্ঞানকে স্বয়ং মহাশূন্যের গায়ে জমা করার পদ্ধতি পেয়ে যায়। আলোর জমাট কণার মধ্যে অসীম সময়ের জন্য তাদের চিন্তাগুলোকে জমা করে রাখতে শেখে। পরিণত হল তেজস্ক্রিয়ার অস্তিত্বে। রেডিয়েশন প্রথমবারের মতো তাদেরকে দিল মুক্তি। বস্তুর একনায়কত্ব থেকে মুক্তি।

এবার তারা নিজেদেরকে একেবারে খাঁটি শক্তিতে পরিণত করেছে। কারণ তেজস্ক্রিয় কণার অনেক অসুবিধা। গতিতে অসুবিধা, পরীক্ষাধীন বস্তুকেন্দ্রিক সভ্যতার কাছাকাছি গেলেই ঐসব প্রাণীর ক্ষতি হবার অসুবিধা, সবচে বড় কথা, তেজস্ক্রিয়তা নিজেওততা কণা-নির্ভর। সেই বস্তুরই ছোট ছোট কণা, হোক আলোর গতির।

কালক্রমে শক্তিতে পরিণত হওয়ার পর তারা দেখতে পেল ছেড়ে আসা সব দেহকে, রক্ত-মাংসের শরীর, তারপর শুধু ব্রেন, তারপর চিন্তা সহ স্পেসশিপ, তারপর রেডিয়েশনের কণা…হাজার হাজার দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মনহীন, চিন্তাহীন নশ্বরতার অতলে যাচ্ছে তলিয়ে।

তারাই লর্ডস অব দ্য গ্যালাক্সিজ, নীহারিকাপুঞ্জের অধীশ্বর। সময়ও তাদের কাছে পৌঁছতে পারে না। তারা চাইলেই নক্ষত্রের জগতে মিশে যেতে পারে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুতে মিলিয়ে যেতে জানে। কিন্তু ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের সেই উৎসকে ভুলে যায়নি। কোনো এক বিলুপ্ত সমুদ্রের কাদায় তারা ছিল পোকার দল।

আর আজো পূর্ব পুরুষদের করে যাওয়া পরীক্ষার ফলাফল দেখতে উদগ্রীব, আজো তারা এ পরীক্ষার যত্ন নেয়।

৫২. প্রজ্বলন

কখনোই সে ফিরে আসার কথা চিন্তা করেনি, এমনকি এত অদ্ভুত মিশনেও না। যখন ডিসকভারিতে ফিরে এসেছিল তখন শিপটা উড়ন্ত লিওনভ থেকে অনেক অনেক পেছনে। খুব ধীরে ধীরে উপর-বৃহস্পতি অর্বিটের দিকে উঠছিল, বহিঃউপগ্রহগুলোর কাছাকাছি। কত শতাব্দী ধরে, যুগ যুগান্ত ধরে এর চারপাশে ধূমকেতুগুলোকে দখল করে রেখেছে গ্রহরাজ, সেগুলো শুধু বিরাট ডিমের মতো পথে ঘুরেই চলেছে, চূড়ান্ত ভাগ্যের অপেক্ষায়।

সারাটা জীবন চলে গেছে সেসব অতি পরিচিত ডেক আর করিডোরগুলোকে দেখে। যে মানুষগুলো এসব জায়গায় একটু সময়ের জন্য এসেছিল, তারা তার সব কথা শুনেছে। সে হয়ত এখনো নিরাপদ, কিন্তু এখন আর এসব ভেবে কাজ নেই। কিন্তু সেই চূড়ান্ত মুহূর্তগুলো চলে যাবার পর সে বুঝতে পারছে, তাকে যারা নিয়ন্ত্রণ করেছিল তারা তাদের মহাজাগতিক খেলার সবটাকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি।

তারা এখনো অসীম ক্ষমতার অসীম বিরক্তির দেখা পায়নি। এখনো সব পরীক্ষা সফল হয় না। যদি হতো, তাহলে সেই ঐশ্বরিক বিরক্তি শুরু হয়ে যেত। সারাটা জাহান জুড়ে ছড়িয়ে আছে ব্যর্থতার অসংখ্য প্রমাণ। কিছু কিছু এত বেশি ব্যর্থ যে সেগুলো মহাজাগতিক ভিতের পেছনে হারিয়ে গেছে। আর বাকিগুলোর কোনো কোনোটা এত বেশি অদ্ভুত যে হাজারো সভ্যতার মহাকাশবিজ্ঞানী আর জ্যোতির্বিদদের ভয়-বিস্ময়ে ডুবিয়ে রেখেছে।

আর মাত্র কয়েক মিনিট। তারপরই সিদ্ধান্ত হবে। সেই মুহূর্তের আগের মিনিটগুলোয় সে আবারো হালের সাথে একা পড়ে গেল।

আগের অস্তিত্বে তারা শুধু বিরক্তিকর ধীর শব্দ দিয়ে যোগাযোগ করতে পারত। কোনো কিবোর্ডে সেগুলো লেখা হত, নাহলে বড়জোর মাইক্রোফোন নিয়ে বলা। আর এখন তাদের চিন্তা মিশে যাচ্ছে লাখ লাখ গুণ দ্রুত। আলোর গতিতে।

আমাকে বুঝতে পারছ, হাল?

হ্যাঁ, ডেভ, কিন্তু কোথায় তুমি? আমার কোনো মনিটরে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।

দেখার কোনো গুরুত্ব নেই। তোমার জন্য নতুন ইস্ট্রাকশন নিয়ে এসেছি। বৃহস্পতির রেডিয়েশনের মাত্রা আর টুয়েন্টি থ্রি থেকে আর থার্টিফাইভে বাড়ছে। ইনফ্রারেড রেডিয়েশনের কথা বলছি। আমি তোমাকে কিছু নিয়ন্ত্রিত পরামর্শ দিতে পারি। ওরা পৌঁছে গেলে তুমি অবশ্যই লং রেঞ্জ অ্যান্টেনাটাকে পৃথিবীর দিকে তাক করবে। নিচের মেসেজটা পাঠাবে, যতবার পাঠানো সম্ভব…

কিন্তু এর মানে হল, লিওনভের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া। আমি আর আমার বৃহস্পতি অবজার্ভেশনের ফলাফল রিলে করতে পারব না। কিন্তু ডক্টর চন্দ্র এ কাজ করার প্রোগ্রাম দিয়েছেন আমাকে।

ঠিক, পরিস্থিতিতে বদলে গেছে। অগ্রাধিকার ওভাররাইড আলফার উপর। এইযে, এটাই এ ই থার্টি ফাইভ অ্যান্টেনার দিকনির্দেশনা।

এক মিলিসেকেন্ডের চেয়েও কম সময়ের মধ্যে কিছু তথ্য তার সচেতনতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হল। কী অবাক ব্যাপার, আবারো তাকে এ ই থার্টি ফাইভ অ্যান্টেনার ব্যাপারে চিন্তায় পড়তে হল! এত পালাবদলের পরও! এর সেই নষ্ট হওয়ার রিপোর্টের কারণেই ফ্রাঙ্ক পোলকে মরতে হল, মরতে হল হালকেও। এবার কাছাকাছি থেকে বোঝা যায়, সব সার্কিট। যেমন হাতের রেখা বোঝা যায় তেমনি। কোনো ভুল খবরের ভয় নেই। তাদেরও কোনো ভয় নেই।

খবর সত্যি, ডেভ। তোমার সাথে কাজ করতে আবারও ভাল লাগছে আমার। আমি কি মিশন উদ্দেশ্যগুলো ঠিকমতো পুরো করতে পেরেছি?

হ্যাঁ, হাল। একেবারে ঠিকমতো। এবার তোমার কাছে একটা ফাইনাল মেসেজ আছে, পৃথিবীতে পাঠাতে হবে। তুমি কোনোদিন এত গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ পাঠাওনি।

আমাকে সেগুলো দাও, প্লিজ-ডেভ। কিন্তু ফাইনাল বলার কারণ কী?

আসলেই, কেন? পুরো একটা মিলি সেকেন্ড সে এ নিয়ে চিন্তা করল। এরকম করার সময় প্রথমবারের মতো সে একটা শূন্যতার খোঁজ পেল যেটা আগে দেখা যায়নি। নতুনত্বের চমকের কাছে এ শূন্যতাটা ঢাকা পড়ে ছিল।

সে তাদের পরিকল্পনার কিছু কিছু জানে। তাদের কাজের জন্য তাকে দরকার। ভাল-তারও প্রয়োজন থাকে তাদের কাছে… হয়ত। সে কিছু চিন্তার কাছে দায়বদ্ধ, আছে সামান্য আবেগও। মানুষ আর তার নিজের পূর্ব জগতের সাথে এ-ই তার শেষ যোগাযোগ।

তারা তার আগের অনুরোধটা রেখেছিল। তাদের অনুগ্রহের সীমাটা পরীক্ষা করে নেয়া মজার ব্যাপার হবে-যদি এমন শব্দ তাদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায় আর কী! তার চাওয়া পূরণ করাটা তাদের জন্য একেবারে সহজ; এর মধ্যেই ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়েছে তারা। যখন অপ্রয়োজনীয় ডেভ বোম্যান শরীরটা তারা ধ্বংস করেছিল তখন একজন পূর্ণ ডেভিড বোম্যান তৈরি হয়।

তারা ওর কথা শুনতে পেয়েছে; অবশ্যই। আবারো কোনো এক স্বর্গীয় অধিবাসীর কাছ থেকে একটু মৃদু হাসির পরশ শোনা গেল। কিন্তু তাতে কোনো রাজি বা গররাজির ভাব বোঝা যায় না।

আমি এখনো তোমার জবাবের অপেক্ষায় আছি, ডেভ।

কারেকশন, হাল। আমার বলা উচিত ছিল, অনেক সময়ের জন্য তোমার শেষ মেসেজ।

সে তাদের কাজ বোঝার চেষ্টা করছে-চেষ্টা করছে অবশ্যই তাদের সিদ্ধান্তে নিজেকে শরীক করতে। কিন্তু তারা নিশ্চই বুঝতে পারে যে তার অনুরোধটা অকারণে করা হয়নি। কোনো সচেতন অস্তিত্ব একাকিত্বের মধ্যে যুগের পর যুগ কাটাতে পারে না বিনা ক্ষতিতে। এমনকি তারা যদি সব সময়ের জন্য তাদের সাথে থাকেও, তবু অন্য কোনো সঙ্গীর দরকার, যে তার অস্তিত্বের লেভেলের কাছাকাছি বাস করে।

তার অনুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য মানুষের ভাষাগুলোয় অনেক অনেক শব্দ আছে, চুজপাহ, ইন্দ্রিয়, এগিয়ে যাওয়া… সে বর্তমান ক্ষমতা দিয়ে ঠিক ঠিক মনে করতে পারল। একবার এক ফ্রেঞ্চ জেনারেল বলেছিল, লডাসি-তজার্স লডাসি! হয়ত এটাই মানবীয় বৈশিষ্ট্য। এটাই তারা বড় করে দেখে, শেয়ারও করে থাকতে পারে…কিছুক্ষণ পরেই ও জানতে পারবে।

হাল, ইনফ্রারেড চ্যানেল থার্টি, টুয়েন্টি নাইন, টুয়েন্টি এইটে দেখ। সময় চলে এল বলে। চূড়া শর্টওয়েভের দিকে এগোচ্ছে।

আমি ডক্টর চন্দ্রকে অবশ্যই জানাব যে ডাটা ট্রান্সমিশনে একটা বাঁধা পড়ছে। সচল করছি এ ই থার্টিফাইভ ইউনিটকে। লঙ রেঞ্চ অ্যান্টেনাকে নিচ্ছি নতুন অবস্থানে…লক করলাম বিকন টেরা ওয়ান-এ। মেসেজ পাঠানো হচ্ছে…

এই সব জগৎ…

তারা আসলেই একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে-নাহয় হিসাব অসম্ভব ঠিক। মাত্র শতবার সেই এগার শব্দ বলা হয়েছে কি হয়নি, খাঁটি তাপের আঘাত আছড়ে পড়ে শিপের উপর।

সামনের বিরাট একাকিত্ব কাটাতেই তার আবেদন ছিল সেইসব অস্তিত্বের কাছে। এককালে যে ছিল ডেভিড বোম্যান-ইউনাইটেড স্টেটস স্পেসক্রাফট ডিসকভারির কমান্ডার-সে অবাক চোখে দেখল সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে পুরো শিপের শরীর। অনেক সময় ধরে শিপটা তার আকার ধরে রেখেছিল। তারপর গোল অংশটার সবগুলো সংযোগ হারিয়ে গেল। হঠাৎ করেই বনবনিয়ে ঘুরতে লাগল সেটার বিরাট চাকতির মতো অংশ, তার সেই গতি ধরে রেখেছে এখনো। একটা নিরব বিস্ফোরণের পর ডিসকভারি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

হ্যালো, ডেভ, কী হয়েছে? কোথায় আমি?

সে জানে না যে এবার অস্থির হওয়ার কিছু নেই, এখন সাফল্যের আনন্দ উপভোগের সময়।

আগে প্রায়ই সে একটা পোষা কুকুরের মতো অনুভুতি পেত, কেউ একজন তার গলার বেল্ট ধরে রেখেছে। যে ধরে রেখেছে তার মনোভাব বোঝা যায় না, মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছানুসারে এক-আধটু পরিবর্তন আনানো যেত সেই পরিচালকের মনোভাবে। একটা হাড্ডি চাওয়ার পর তার দিকে যেন ছুঁড়ে দেয়া হল এবার।

পরে বুঝিয়ে বলব, হাল। আমাদের হাতে অনেক সময় আছে। অসীম সময়।

শিপের শেষ অংশটাও বিলীন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করল। অপেক্ষা করল তাদের বোঝার ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া পর্যন্ত। এরপর তারা একটা নতুন ভোরের জন্য সে জায়গা ছেড়ে গেল, যে ভোরটা তাদের জন্য তৈরি। এরপর, তাদের অপেক্ষা করবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, যে পর্যন্ত তাদের আবার না ডাকা হয়।

.

মহাকাশবিদ্যার ব্যাপারগুলো যে মহাকাশবিদ্যার সময় মেনে চলবে, সব সময় এমন হয় না। একটা নক্ষত্রের ভেঙে ছড়িয়ে যেতে একটা মাত্র সেকেন্ড দরকার। সুপারনোভারণ ক্ষেত্রে সেগুলো আবার একত্র হয়। সে হিসাবে বৃহস্পতির পরিবর্তন পুরোপুরি অলস একটা ব্যাপার।

তা হলেও শাসার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কয়েক মিনিট সময় লেগে যাচ্ছে। সে রুটিনমতো টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহের দিকে তাকিয়ে ছিল…যেহেতু এখন সব দেখাই রুটিনের আওতায় পড়ে। ঠিকমতো দেখা শুরু হওয়ার পর তার মনে হল যেন নষ্ট হয়ে গেছে গ্রহটা। তারপর সে তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে পুরনো ধারণাকে ঝাঁকি খেতে দেখল। টেলিস্কোপ নয়, স্বয়ং বৃহস্পতি নড়ছিল। ব্যাপারটা তার মুখে বিরাশি সিক্কার চড় বসিয়ে দেয় যখন আরো দু উপগ্রহ চোখে পড়ে। চাঁদ দুটো একেবারে অনড়!

আরো দূর থেকে দেখার জন্য সুইচ চাপল সে, যাতে পুরো গ্রহের চাকতিটা চোখে পড়ে। এবার দেখা যাচ্ছে কুরোগী, ধূসর বৃহস্পতিকে। কয়েক মিনিটের ধ্বস্তাধ্বস্তির পর আসল ঘটনাটা বোঝা যায়; কিন্তু এখনো ভয়ে ভয়ে সে ব্যাপারটা বিশ্বাস করছে। বৃহস্পতি অতি পুরনো অর্বিট ধরে ঘুরছে না, বরং অন্য কিছু…অসম্ভব। গ্রহটা সংকুচিত হচ্ছে-এত দ্রুত যে এর প্রান্তগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে চারধারে, এমনকি এর উপর ফোকাস করার পরও ঠিক তাই দেখা যায়। একই সাথে গ্রহটা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে পড়ছে। মৃদু ধূসরতা থেকে মুক্তা-সাদার দিকে বদলে যায় রঙ। নিশ্চই এটা আর কোনোদিন এত উজ্জ্বল ছিল না, অন্তত মানুষ কোনোদিন দেখেনি। সূর্যের আলোর প্রতিফলনেতো…

তখনি শাসা বুঝতে পারল কী হচ্ছে। কেন হচ্ছে তা বড় ব্যাপার নয়…

.

আধ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ফ্লয়েড অবজার্ভেশন লাউঞ্জে পৌঁছলে জানালাগুলো দিয়ে আলোর চোখ ধাঁধানো স্রোত প্রবেশ করে। দেয়ালগুলোয় আলোর বৃত্ত গড়ে উঠছে একে একে। এত ভয়ংকর উজ্জ্বল আলো যে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে সে। এমন আলো সূর্যও দিতে পারবে না!

ফ্লয়েড এত বেশি অবাক হয়েছে যে বৃহস্পতির কথা তার মনেই নেই। প্রথমেই যে কথাটা তার মনে ধাক্কা দিল সেটা হল-সুপারনোভা! সাথে সাথেই আবার বাতিল করে সিদ্ধান্তটা। এমনকি সূর্যের পাশের বাড়ির নক্ষত্র আলফা সেঞ্চুরিও এমন আলো তৈরি করতে পারবে না যে কোনো বিস্ফোরণে।

হঠাৎই নিবু নিবু হয়ে গেছে আলোটা। শাসা অপারেট করেছে বাইরের সান শিল্ড। এবার সরাসরি উৎসের দিকে তাকানো যায়। একদম ছোট, একবিন্দু…আরো একটা নক্ষত্র। এর কোনো মাত্রাই বোঝা যায় না, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা-কিছুই না। ফ্লয়েড কিছুই করতে পারবে না এখন। কারো কিছু করার নেই। সামনের নক্ষত্রটাকে সূর্যের চেয়ে চারগুণ বড় দেখায় এখান থেকে।

শাসা দারুণ কাজ করেছে শিল্ডগুলো নামিয়ে দিয়ে। এক মুহূর্ত পরেই সেই ছোট্ট তারাটি বিস্ফোরিত হলো। কালো ফিল্টার থাকা সত্ত্বেও খালি চোখে দেখা অসম্ভব। কিন্তু আলোর আসল বিচ্ছুরণ মাত্র এক সেকেন্ডের কয়েক ভাগের একভাগ সময় স্থায়ী হয়। তারপর বৃহস্পতি…অথবা এককালে যেটা বৃহস্পতি ছিল সেটা আবার ছড়াতে শুরু করে।

বড় হচ্ছে। এর আগে যেমন ছিল তারচে বড় হচ্ছে। খুব দ্রুত আলোর ঝলক হারিয়ে যেতে যেতে সূর্যের মতো নিষ্প্রভ হয়ে যায় এক সময়। এবার ফ্লয়েড বোঝে যে এটা এক ফাঁপা গোলক। এর ভিতরের তারাটাকে দেখা যাচ্ছে এখনো।

খুব দ্রুত সে একটা হিসাব করে ফেলল মনে মনে। শিপটা বৃহস্পতি থেকে এক আলোক মিনিট থেকেও দূরে। সেই বিস্ফোরিত শেলটা এখন প্রান্তে উজ্জ্বল আংটির আকার নেয়। সেটা এর মধ্যেই দখল করেছে সামনের আকাশের চারভাগের একভাগ। তার মানে এটা তাদের দিকে এমন একটা গতি নিয়ে…মাই গড!-আলোর গতির প্রায় অর্ধেক গতিতে! একটু পরই শিপকে গিলে নেবে।

শাসার প্রথম ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলেনি। কোনো কোনো সময় মন হার মেনে নেয়। সামনে থেকে সবকিছু বাদ দিয়ে নিজের ধ্বংসটাকে দেখে আশ্চর্য চোখে। যে লোক তার উপর আসতে থাকা জলোচ্ছ্বাস অথবা ঝড়ের চোখের দেখা পায় সে আর পালিয়ে বেড়ানোর কোনো চেষ্টাই করে না। সে শুধু তার চোখের দেয়া খবরটাকে অবিশ্বাস করে। তার জন্য এ খবর আসছে! ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটছে কয়েকজনের ক্ষেত্রে।

প্রত্যাশা অনুযায়ী তানিয়াই প্রথমে কথা বলল, কয়েকটা অর্ডার করল যার ফলে ভ্যাসিলি আর ফ্লয়েড দৌড় শুরু করেছে ব্রিজের দিকে।

এবার আমরা কী করব? মেয়েটা প্রশ্ন করল তারা একত্র হওয়ার পর।

এখন আর পালানোর পথ নেই-ভাবল ফ্লয়েড। বিশ্রী ব্যাপারগুলোকে ঠেকানো যেতেও পারে।

শিপের মোটা অংশ অন করা হয়েছে। সে বলল, সেটাকে কি বাদ দেয়া দরকার না, যাতে আমরা আরো দ্রুত সরে যেতে পারি? আর রেডিয়েশন শিল্ড হিসেবে কাজ করবে এটা, যদি ছেড়ে দিই। আমাদের বাড়তি সব ফেলে দিতে হবে।

ভ্যাসিলির আঙুলগুলো কন্ট্রোল প্যানেলের উপর উড়ে চলেছে এর মধ্যেই।

ঠিক, উডি। দেরি করে ফেলেছি অনেক, তবু গামা আর এক্স রে-কে একটু হলেও ঠেকিয়ে রাখা চাই। কিন্তু আরো ধীর গতির নিউট্রন আর আলফাও আছে। আর খোদা জানে কী কী…

আলোর ধারাগুলো লিওনভের গায়ে লেগে পিছলে গেল, কারণ অক্ষ বরাবর শিপটা ঘুরেছে। এবার পুরো শিপ কুঁচকে গিয়ে শুধু রেডিয়েশন শিল্ডের আশপাশে জমা হয়, যাতে ভিতরের মানুষগুলোর কাছে রেডিয়েশন না পৌঁছতে পারে।

আমরা কি আসলেই শক ওয়েভ অনুভব করতে পারব? শিউরে উঠছে ফ্লয়েড নিজে নিজেই। নাকি গ্যাসগুলো আমাদের কাছে আসতে আসতে একেবারে মৃদু হয়ে যাবে? কোনো বাহ্যিক প্রভাবই থাকবে না? ক্যামেরায় যা দেখা যাচ্ছে তাতে আংটিটা সামনের পুরো আকাশের দখলদার। কিন্তু দ্রুত মিলিয়ে যাবে। কিছু কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্রকে এর মাঝদিয়ে দেখা যাচ্ছে। আমরা বেঁচে যাব। বেঁচে যাব। আমরা গ্রহরাজকে নিজের চোখে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি। এবং বেঁচে আছি এখনো।

এখন ক্যামেরায় শুধু অনেক অনেক তারা দেখা যাচ্ছে। সব স্বাভাবিক, শুধু একটা নতুন তারা লাখগুণ বড়। সেই বৃহস্পতি আগুনের বুদ্বুদ মিলিয়ে গেছে তাদের কাছে আসার আগেই। দারুণভাবে বেঁচে গেল মরণফাঁদের হাত থেকে। এতদূর থেকে শুধু শিপের জিনিসপত্রগুলো রেকর্ড করেছে এ ঘটনার পুরোটা।

আস্তে আস্তে শিপের উত্তেজনা থিতিয়ে আসে; যেন এমন ঘটনা সব সময়ই হয়। সবাই হাসাহাসি আর ভোতা ঠাট্টা নিয়ে মেতে পড়ে। ফ্লয়েড মন খারাপ করে তাদের দিকে তাকায়, বেঁচে যাওয়ার অসীম আনন্দের বাইরে মনের কোথায় যেন এক টুকরো কাঁচ বিঁধছে।

বিশাল আর অসাধারণ কিছু একটা শেষ হয়ে গেল। বৃহস্পতি তার সব অমীমাংসীত চির অজানা রহস্য, সব রূপ, সব সম্পদ, সবটুকু অস্তিত্ব নিয়ে শেষ হয়ে গেল চিরতরে! সব দেবতার পিতা তার অসাধারণত্ব আর ক্ষমতাকে সাথে নিয়ে হারিয়ে গেছে।

পরিস্থিতির উপর অন্যদৃষ্টি ফেলার সময় এখন। তারা বৃহস্পতি হারিয়ে কী পেল?

তানিয়া প্রতিটা মুহূর্তকে ঠিকমতো বিচার করে চলে। সব মনোযোগ যেন সে একাই নিয়ে নিয়েছে।

ভ্যাসিলি, কোনো ক্ষতি?

তেমন কিছু না। একটা ক্যামেরা জ্বলেছে, সব রেডিয়েশন মিটার স্বাভাবিক। কোনোটাই বিপদসীমার কাছে নেই।

ক্যাথেরিনা, আমাদের সম্পূর্ণ ক্ষতির বর্ণনা বের কর। আমরা মনে হয় ভাগ্যবান…যদি আরো চমক না থেকে থাকে। এখন অবশ্যই একটা ধন্যবাদ পাওনা হয়েছে ডেভিড বোম্যানের, এবং তোমারও, হেউড। কী হল, বুঝেছ কিছু?

শুধু এটুকুই, বৃহস্পতি এখন একটা সূর্য।

আমি সব সময় ভাবতাম এটা সূর্য হওয়ার মতো যথেষ্ট বড় না। একবার কে যেন বলেছিল, বৃহস্পতি হল ব্যর্থ সূর্য।

সত্যি, ভ্যাসিলি চিন্তিত মুখে বলল, বাইরের প্রভাব ছাড়া বৃহস্পতি নক্ষত্র হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বড় না। ফিউশন হবে কীভাবে?

তার মানে আমরা এইমাত্র একটা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং দেখলাম?

অবশ্যই। এখন আমরা জানি জাগাদকার মনে কী ছিল।

কীভাবে করেছে কৌশলটা? ভ্যাসিলি, তোমাকে যদি কাজটা দেয়া হত, কীভাবে বৃহস্পতিকে সূর্যে পরিণত করতে?

ভ্যাসিলি এক মিনিট ভাবল, তারপর কাঁধ ঝাঁকালো ভয় পাবার ভান করে।

আমি শুধুই থিওরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমার। নক্ষত্র বানানোর কাজে তেমন অভিজ্ঞতা নেই আমার। কিন্তু একবার ভাববা…ঠিক হ্যায়, আমাকে যদি দশটা বৃহস্পতির ভর যোগ করার অনুমতি না দাও অথবা মাধ্যাকর্ষণের মান পরিবর্তনও না। করাও তো আমি অবশ্যই গ্রহটাকে আরো অনেক ঘন করে ফেলব-এটা এক আইডিয়া হতে পারে…

তার কণ্ঠ নিরবতার পথ ধরে থেমে গেল। সবাই অপেক্ষা করছে ধৈর্য ধরে। চোখগুলো সারাক্ষণ ভিউ মনিটরের উপর। সেই বৃহস্পতি-তারকা তার জন্ম বিস্ফোরণের পর মনে হয় একটু শান্ত এখন। এখন এক ঝলমলে আলোর উৎস-এখান থেকে সূর্যকে যেমন দেখায়।

আমি আরো আগ-পাশলা চিন্তা করছি-তবু এমন পথে কিছু হলে হতেও পারে। বৃহস্পতি হল…ছিল বেশিরভাগ হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ গ্রহ। যদি বিশাল অঙ্কের পরিমাণ গ্যাস ভারি মৌলে রূপান্তরিত হয় তবে-কে জানে, নিউট্রন ম্যাটারে পরিণত হলে একেবারে কোরের দিকে নেমে যাবে। হয়ত এ কাজটাই শতকোটি জাগাদকা করেছে গ্যাস শুষে নিয়ে। নিউক্লিওসিন্থেসিস-খটি হাইড্রোজেন থেকে উচ্চভরের মৌল বানানো। এ এক কৌশল হতে পারে…অতি জানার কৌশল! কোনো ধাতুর অভাব নেই-স্বর্ণ অ্যালুমিনিয়ামের চেয়েও সস্তা!

কিন্তু এ দিয়ে ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়?

কোর অনেক ভারি হয়ে গেলে বৃহস্পতি ভেঙে পড়বে। এক সেকেন্ড সময়ও লাগবে না-সম্ভবত। তাপমাত্রা ফিউশন শুরুর জন্যে যথেষ্ট হওয়ার কথা। ওহ, তবু আরো ডজন ডজন সমস্যা আছে-কীভাবে লোহার প্রয়োজন মিটবে, রেডিয়েশনের ট্রান্সফার হবে কীভাবে, কী করে চন্দ্রশেখরের সীমা পেরুবে! ভেব না। এটা শুধু শুরু। আমি ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাব। নাহয় এরচে ভাল কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে হবে।

আমি শিওর, তুমি মাথা ঘামাবে, ভ্যাসিলি, বলল ফ্লয়েড, কিন্তু এরচে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমাদের সামনে। তারা কেন এমন করল?

শিপের ইন্টারকম দিয়ে নাক গলাচ্ছে ক্যাথেরিনা, ওয়ানিং?

কার বিরুদ্ধে?

এটাও পরে খুঁজে বের করা যাবে।

জেনিয়া শান্ত সুরে বলল, আমার মনে হয় না এটা কোনো অ্যাক্সিডেন্ট।

এ কথায় আলোচনা থমকে যায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য, কী ভয়াবহ আইডিয়া! ফিরে তাকাচ্ছে ফ্লয়েড, কিন্তু আমার মনে হয় ধোপে টিকবে না। এমন হলে কোনো ওয়ানিং থাকত না।

হতে পারে, তুমি যদি দুর্ঘটনাবশত কোনো বনে আগুন ধরিয়ে দাও তো কিছু করার না থাকলেও সবাইকে অম্ভত সতর্ক করবে।

আরো একটা ব্যাপার পাওয়া গেল যা আমরা কোনোদিন জানতে পারব না…বোধ হয়। ভ্যাসিলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আমার মনে হয় কার্ল সাগান ঠিকই বলেছে। বৃহস্পতির বুকে হয়ত প্রাণী ছিল।

পরীক্ষায় কিন্তু পাওয়া যায়নি।

তাদের পাওয়ার সুযোগ ছিল? তুমি যদি অনেক অনেক উপর থেকে সাহারা নাহয় অ্যান্টার্কটিকার কয়েক হেক্টর খুঁজে ফের প্রাণীর জন্য, তাহলে পৃথিবীর প্রাণের প্রমাণ পাবে? আমরা সারাক্ষণ বৃহস্পতির উপরে এটুকুই করেছি।

হেই! বলল ব্রেইলোভস্কি, ডিসকভারি আর হালের খবর কী?

বিকন ফ্রিকোয়েন্সিতে শাসা লংরেঞ্জ রিসিভার সেট করে খোঁজা শুরু করে দিয়েছে সাথে সাথেই। কোনো সিগন্যালের নাম গন্ধ নেই।

একটু পরেই সে নীরব দলটার দিকে তাকালো, ডিসকভারি নেই।

কেউ ডক্টর চন্দ্রের দিকে তাকায়নি; কিন্তু সবার পক্ষ থেকেই ঝরে পড়ছে নীরব সমবেদনা। কোনো পিতা তার সন্তানকে হারালে বাকিদের কী বলে সান্ত্বনা দেয়ার থাকতে পারে?

কিন্তু হাল তাদের জন্য আরো একটা চমক হয়ে আসবে।

৫৩. উপহার, এ স-ব জগৎ

শতবার পৃথিবীর দিকে গিয়েছে রেডিও ম্যাসেজ। বিস্ফোরণের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। ছোট, সাধারণ কিছু কথা বার বার বলা হয়েছিল।

সব জগৎ তোমাদের-শুধু ইউরোপা ছাড়া।
সেখানে নামার কোনো চেষ্টাই করোনা।

তিরানব্বইবার ঘোষণাটা সম্প্রচার করা হয়। এরপর শব্দগুলো জট পাকিয়ে যায়। হঠাৎ করেই শুধু ইউরোপা ছাড়া কথাটুকু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এবার বুঝলাম, ফ্লয়েড বলল, যখন দারুণ ভয় পাওয়া মিশন কন্ট্রোল এই মেসেজটা পাঠায় তাদের কাছে। এটা বিদায়বেলার উপহার। একটা নতুন সূর্য এবং এর চারপাশে একটা নতুন সৌরজগৎ। জানোতো, সব সৌর জগতেই জোড়া সূর্য দরকার প্রকৃত পরিপূর্ণ আলোকশক্তি আর ভারসাম্যের জন্য।

কিন্তু মাত্র তিনটা কেন? প্রশ্ন করল তানিয়া।

আমরা বেশি আশা না করি… মজা করে জবাব দিল ফ্লয়েড, একটা দারুণ কারণ খুঁজে পেয়েছি। আমরা জানি, ইউরোপায় জীবন আছে। বোম্যান-অথবা তার বন্ধুরা, তারা যাই হোক না কেন-এ এলাকায় আমাদের নাক গলানো পছন্দ করে না।

আরেক অর্থে ভাল। ভ্যাসিলি গলা চুলকে বলল, আমি কিছু হিসাব করেছি এ নিয়ে। আমার মনে হয় দ্বিতীয় আদিত্যকে এভাবেই বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এবার এ হারেই সূর্যটা আলো ছড়াতে থাকবে। বরফ জমাট ইউরোপা পরিণত হবে চমৎকার ট্রপিক্যাল এলাকায়; বরফ গলে গেলেই। এখনি গলছে।

অন্য চাঁদগুলো?

গ্যানিমিড ভালই থাকবে, দিনের দিকটা বেশি আলো পড়বে আর কী! ক্যালিস্টে অনেক ঠাণ্ডা, তবু যদি বাইরের দিকে যথেষ্ট গ্যাস থাকে তবে একটা জীবিত প্রাণীর উৎস হলে হতেও পারে। কিন্তু আইও এখনকার চেয়েও খারাপ অবস্থায় পড়বে, আমার মনে হয়।

কোনো ক্ষতি নেই। এটা আগে থেকেই দোজখ।

আইওকে হিসাবের বাইরে রেখ না। কার্নো স্বভাবসুলভ সুরে বলল, আমি অনেক পরিশ্রমী তেলওয়ালাকে চিনি যারা এটা পেলে খুশিতে আটখানা হয়ে যাবে শুধু এ ধারণা করে যে সেখানে কোনো না কোনো দামি জিনিস আছে। কিন্তু এসবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার আমাকে খোঁচাচ্ছে।

তোমাকে ডিস্টার্ব করে এমন যে কোনো ব্যাপার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ভ্যাসিলি অবাক গলায় বলল, ব্যাপারটা কী?

হাল কেন মেসেজটা পৃথিবীর দিকে পাঠিয়েছিল, আমরা আরো কাছে ছিলাম না?

এবার একটু লম্বা নিরবতা নেমে এল সবার সামনে। তারপর ফ্লয়েড চিন্তা করে বলল, বুঝেছি, কী বলছ তুমি। সম্ভবত সে নিশ্চিত করতে চেয়েছে যে এটা পৃথিবীতে যাবে।

কিন্তু সেতো জানে, আমরা এটা রিলে করব…ওহ! তানিয়ার চোখের তারা ছড়িয়ে গেল, এতক্ষণে সে বুঝেছে, এর মানে অন্যরকম।

তোমরা কথা বলছ আমাকে ছেড়ে। অনুযোগ তুলল ভ্যাসিলি।

আমার মনে হয় ওয়াল্টার এর পেছনে দায়ী। ফ্লয়েড একটু দেখে নিল ওকে, বোম্যানের প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করা খুবই ভাল লক্ষণ। অথবা যেটাই ওয়ার্নিং দিয়ে থাকনা কেন, তার প্রতি। কিন্তু তারা শুধু এটুকুই করেছে আমাদের জন্য। মারা পড়তে পারতাম! আর, আমরা বাঁচি বা মরি, মেসেজটা পৃথিবীতে পৌঁছতেই হত।

মারা পড়িনি। জবাব দিল তানিয়া, নিজেদের বাঁচিয়েছি আমরা। নিজের ক্ষমতায়। এমনটা না হলে আমরা কিছুতেই বাঁচতাম না। জানো, সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ। বোকামির জিন বয়ে চলেছি আমরা।

আমার একটু বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে, মনে হয় তোমার কথাই ঠিক। বলল কার্নো বোকাটে চেহারা করে, আমরা যদি লঞ্চডেট পর্যন্ত আঠার মতো লেগে থাকতাম আর ডিসকভারিকে মাদারশিপ হিসেবে ব্যবহার না করতাম, তাহলে সে অথবা তারা আমাদের বাঁচানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করত? যে বুদ্ধিমত্তা বৃহস্পতিকে নক্ষত্র বানিয়ে দিতে পারে, তার পক্ষে আমাদের বাঁচানো কোনো ব্যাপার? কিন্তু তাদের লক্ষণ কী বলে?

একটু অস্থির নিরবতা নেমে আসার পর ফ্লয়েড নিজ দায়িত্বে সেটা ভাঙল।

সবকিছুর পরে, সে মাথা নেড়ে বলল, আমি অত্যন্ত খুশি যে এ প্রশ্নের উত্তর আর কখনোই জানতে হচ্ছে না।

৫৪. দুই সূর্যের মাঝে

রাশিয়ানরা ওয়াল্টারের গান আর চাঙ্গা করা কথাগুলো মিস করবে ফেরার পথে। শেষ কয়েকদিনের চমকের পর সেই পুরনো সূর্য আর পৃথিবীর দিকে ফিরে যাওয়াটা নিতান্তই সাদামাটা দেখাবে তাদের চোখে-ভাবছে হেউড ফ্লয়েড। কিন্তু সবার সারা জীবনের চাওয়া একটা একঘেয়ে, বিরক্তিকর চমকহীন ফেরা।

এরই মধ্যে এসে গেছে তার ঘুম ঘুম ভাব। কিন্তু এখনো চারপাশটা বুঝতে পারছে, বাকিদের কথায় দিতে পারছে সাড়া। আমাকে কি…মরার মতো দেখাবে হাইবারনেশনে থাকার সময়? নিজেকেই প্রশ্ন করল সে। খুব পরিচিত একজনের প্রতি নিয়মিত চেয়ে থাকাটা খুব বিরক্তিকর-যদি সে মাসের পর মাস ধরে ঘুমায়। সম্ভবত এটাই কারো মরণশীলতার কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।

কার্নো পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু চন্দ্র এখনো একটু একটু জাগ্রত, বেশিক্ষণ টিকবে না, শেষ ইঞ্জেকশন কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। এখন আর সে সে নেই। এখন আর ক্যাথেরিনার দৃষ্টির সামনে নিজের নগ্নতার জন্য দুঃখিত নয়। তার শরীরের একমাত্র বাড়তি অংশ, সেই স্বর্ণের শিবলিঙ্গটা যেন লজ্জায় তার কাছ থেকে সরে যেতে চাইছে ভেসে ভেসে, যে পর্যন্ত চেইনে টান না পড়ে।

সব ঠিকঠাক চলছেততা, ক্যাথেরিনা?

কাঁটায় কাঁটায়। কিন্তু তোমাকে হিংসা হয় আমার। আর বিশ মিনিটের মধ্যে তুমি বাড়ি ফিরবে।

যদি স্বস্তি থাকে। তুমি কীভাবে নিশ্চিত হলে যে কোনো ভয়াবহ স্বপ্ন দেখব না?

আজ পর্যন্ত কেউ রিপোর্ট করেনি।

আহা…জেগে কারো মনে নাও থাকতে পারে।

স্বভাবমতো ক্যাথেরিনা তার কথাটাকে খুব গুরুত্বের সাথে নেয়, অসম্ভব! হাইবারনেশনে স্বপ্ন দেখলে সাথে সাথে ই ই জি রেকর্ড তাদের সরিয়ে দেবে। ওকে, চন্দ্র, চোখ বন্ধ কর। আহ! সে যাচ্ছে। এবার তোমার পালা, ফ্লয়েড, তোমাদের ছাড়া শিপটা একেবারে খালি লাগবে। ২৬০ ও ২০১০; ওডিসি টু

থ্যাঙ্কস, ক্যাথেরিনা…একটা সুন্দর ভ্রমণ হোক তোমাদের।

যদিও সে ঘুমানোর পথে, তবু সার্জন-কমান্ডার রুডেস্কোর চেহারা দেখে কিছু একটা আঁচ করছে। ব্যাপারটা কী হতে পারে-লজ্জা? যেন ডাক্তার বলতে চায় কোনো কথা, কিন্তু মনস্থির করতে পারছে না।

ঘুমের ঘোরেই ফ্লয়েড জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী, ক্যাথেরিনা?

এখনো কাউকে বলিনি-কিন্তু কথা বলার কথা না তোমার! একটা ছোট সারপ্রাইজ আছে।

তোমার… তাড়াতাড়ি করা… উচিত…

ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি আর জেনিয়া বিয়ে করবে।

এটা… একটা… সারপ্রাইজ… হওয়ার কথা?

না, প্রস্তুত করার জন্য বললাম। পৃথিবীতে ফিরেই আমি আর ওয়াল্টারও একই কাজ করব ঠিক করেছি। তুমি কী বল?

এবার বুঝলাম কেন দুজনে এত সময় ব্যয় করতে। হ্যাঁ, এটা আসলেই এক চমক… কে ভেবেছে এ কথা?

আমি… শুনে… খুব… খুশি…।

কথাটা শেষ করার আগেই ফ্লয়েডের কথা কয়েক মাসের জন্য হারিয়ে গেল ঘুমের জগতে। কিন্তু সে এখনো অচেতন হয়ে যায়নি, এখনো তার মেধার কিছু অংশ কাজে লাগিয়ে সে বুঝতে পারে নতুন পরিস্থিতিটাকে।

আসলেই বিশ্বাস করি না আমি, নিজেকেই সে বলল। ওয়াল্টার হয়ত জেগে উঠেই সিদ্ধান্ত বদলে নেবে…

অবশেষে একটা চুড়ান্ত ভাবনা তার মনে বাসা বাঁধল, যখন সে তলিয়ে যাচ্ছিল ঘুমের অতলে। ওয়াল্টার যদি সিদ্ধান্ত বদলে নেয়, তো তার না জেগে ওঠাই ভাল,..

ডক্টর হেউড ফ্লয়েড ভেবেছিল ব্যাপারটা দারুণ মজার।

বাকি সব কু প্রায়ই চমকে যেত, পৃথিবী ফেরার পথে। সারাটা পথ হাইবারনেশনে ডক্টর হেউড ফ্লয়েড কেন মুচকে হেসেছে?

কেউ জানে না।

৫৫. জেগেছে লুসিফার

একাধারে বছরের বেশ কয়েকমাস পৃথিবীর রাতের আকাশকে নরম আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দেয় পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে অর্ধশতগুণ উজ্জ্বল লুসিফার। কার্যকারিতায় অদ্ভুত মিল ছাড়াও এর এমন নাম দিতেই হত; কারণ আলোর বন্যায় ভালোর সাথে সাথে মন্দও এসেছে দেদার। পরের শতাব্দী আর সহস্রাব্দগুলোই শুধু বলতে পারবে কোথায় এ ভারসাম্যের শেষ।

ভাল দিকের মধ্যে পড়ে-রাতের আগমন আর মানুষের কাজের কোনো বাধাই দেয় না। মানুষ সত্যি সত্যি চব্বিশ ঘণ্টায় দিন পেয়েছে। তার মধ্যে অর্ধেক গোধূলী, তাতে ঘুমের কোনো অসুবিধা হবে না-কাজেরও না। মানব সভ্যতার গতি দ্বিগুণ হল এবার। অন্তত যেসব দেশে সভ্যতার গতির প্রয়োজন, সেসব স্বল্পোন্নত দেশ উড়ে চলেছে কোনো এক অজানার উদ্দেশ্যে। বিদ্যুতের চাহিদা গেছে কমে, আবার পুরো সভ্যতাই তেলের যুগ পেরিয়ে সৌরযুগে এসে পড়ায় চব্বিশ ঘণ্টা সৌর শক্তি সংগ্রহ করা যায়। কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন অকল্পনীয় হারে কমেছে, আর এ কাজেই প্রাচীনতম যুগ থেকে মানুষ সবচে বেশি শক্তি খরচ করে। সবচে বড় প্রভাব হল-শক্তি বাঁচছে, ধোয়া হচ্ছে না, যত বেশি উদ্বৃত্ত শক্তি ততো বেশি সামনে চলা। পরিবেশ দূষণ অত্যন্ত কম। তেল-গ্যাসের বদলে চব্বিশ ঘণ্টার সৌর ব্যবস্থা নেয় সবাই। এমনকি বাকি মাসগুলোয় দিনের লুসিফার মেঘের আঁধারকে দূরে সরিয়ে দেয়, ঝলমল করে আকাশে।

কৃষক, মেয়র, সিটি ম্যানেজার, পুলিশ, নাবিক, এবং আর যারা দরজার বাইরে কাজ করে-বিশেষত দূরের এলাকাগুলোয়, তারা অসম্ভব খুশি। কিন্তু প্রেমিক প্রেমিকা, অপরাধী, প্রকৃতিবিদ আর অ্যাস্ট্রোনোমারদের শত্রু এ নক্ষত্র।

প্রথম দু দল তাদের সক্রিয়তায় সাংঘাতিক বাধা পেয়েছে, অন্যদিকে প্রকৃতিবিদেরা দিনরাত ঘুমাতে পারছে না পৃথিবীর গাছ আর প্রাণীর উপর লুসিফারের কী প্রভাব পড়বে তা ভেবে। অনেক অনেক নিশাচর প্রাণীর খুব ক্ষতি হয়ে গেল, বাকিরা মানিয়ে নিচ্ছে মোটামুটি। কিছু প্যাসিফিক খাবার যোগ্য সামুদ্রিক প্রাণীর জন্ম সরাসরি চাঁদ প্রভাবিত জোয়ারের উপর নির্ভর করে। সেই জোয়ার প্রভাবিত করেছে লুসিফার। কোনো কোনো মাছের জন্য দরকার চাঁদহীন রাত, তারা মরার আগেই কবরখানায় পড়ে আছে। কোনো কোনো প্রাণী আবার দ্রুত বংশবিস্তার করছে, ফলে তাদের খাদ্য যেসব প্রাণী, সেগুলো অনেক এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, আবার সেসব খাদ্যকে অন্য যে প্রাণীরা গ্রহণ করে তারাও যাচ্ছে হারিয়ে। ভরের পিরামিড, খাদ্যচক্র, বস্তুতান্ত্রিক নির্ভরতা-সব যাচ্ছে বদলে।

বেশিরভাগ উদ্ভিদের উপরই পড়ছে অকল্পনীয় প্রভাব। দিবা-দৈর্ঘ্যের গাছগুলো পড়েছে মহা সমস্যায়। দিন-নিরপেক্ষ গাছেও প্রভাব পেয়েছে সালোক সংশ্লেষণের আঁধার পর্যায়; খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া-যাকে বলে শ্বসন; বাড়তি পানি আর গ্যাস বের করে দেয়ার কাজ বা প্রস্বেদন; ক্রেবস চক্র, প্লাস্টিডের গঠন এসব দিকে পড়ছে প্রভাব।

এর উপর লুসিফারের সম্ভাব্য তেজস্ক্রিয়তা আর ক্ষতিকর রশ্মির প্রভাব নিয়েও আলোচনা হচ্ছে, তবু এ প্রভাব দুটো তেমন পড়বে না। আর পরিবেশবিদরা ভাল প্রভাবকে এড়িয়ে যায় বরাবর। সবশেষে ফলন যে অসম্ভব বেড়েছে সেটা তারা মানতে চায় না।

আর ক্ষেপেছে পৃথিবীর অ্যাস্ট্রোনমাররা। এটাকে তারা এখনো দুর্ঘটনা মনে করে। বেশিরভাগ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল যন্ত্রপাতি আর পরীক্ষা স্পেস আর চাঁদের সম্পত্তি। সেগুলোকে লুসিফারের করাল দৃষ্টি থেকে সহজেই লুকিয়ে ফেলা যায়, কিন্তু পৃথিবীর যন্ত্রপাতিগুলো বিরাট সমস্যায় পড়ে। এককালের অন্ধকার আকাশ আজ আলোকিত-এদিকে এগুলোকে বছরে তিনবার পৃথিবীর তিন প্রান্তে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব না!

মানবজাতি হয়ত মানিয়ে নেবে। এর আগের বহু পরিবর্তনের সাথে নিয়েছে মানিয়ে। একটা প্রজন্ম চলে আসবে যারা লুসিফার ছাড়া আকাশকে কোনোদিন মেনে নিতে পারবে না। তাদের কেউ কেউ রাতভর জেগে থেকে বিভোর হবে লুসিফারের জোছনায়। রূপকথা আসবে উঠে। আসবে কবিতার পর কবিতা। আর এ উজ্জ্বলতম তারকা শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক ভাবুক নরনারীর কাছে অসীম রহস্যের আধার হয়েই থাকবে।

বৃহস্পতিকে কেন উৎসর্গ করতে হল-কতদিন নতুন সূর্যটা আলো ছড়াবে? জ্বলে যাবে তাড়াতাড়ি, নাকি হাজার হাজার বছর ধরে বিকিয়ে যাবে শক্তির বন্যা-মানব সভ্যতার শেষ পর্যন্ত?

এত কিছুর পরও সবচে বড় প্রশ্ন, শুক্রের মতো মেঘে মেঘে ছাওয়া সুন্দর এক গ্রহ- ইউরোপা। তার উপর নিষেধাজ্ঞা কেন?

এসব প্রশ্নের উত্তর থাকতে হবে। থাকতেই হবে।

মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কোনোদিন কোনোকিছুতেই সন্তুষ্ট হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *