৭. শক্তিগুলো এক হচ্ছে
Determine the things can and shall be done, and then we shall find the way.
— Abraham Lincoln
যখন আমাদের জ্ঞানলব্ধ অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে তখন দেশ দ্রুত প্রগতির পথে ত্বরান্বিত হবে; যেখানে থাকবে উচ্চশিক্ষিত প্রশাসকমণ্ডলী; আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে রাজনীতিকদের ন্যূনতম উদার হস্তক্ষেপ।
আমার বিবেচনায় উন্নয়ন হলো একটি নিরাপত্তামূলক বিষয় যা দারিদ্র্য থেকে নিরাপত্তা দেবে। খাদ্য সংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়, সামাজিক নিরাপত্তা দেয় এবং সর্বোপরি যা জাতীয় প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে।
২০২০ সালের মধ্যে উন্নত ভারত গঠনে ৫টি ক্ষেত্রকে আমরা আমাদের প্রধান কর্মলক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছি।
পাঁচটির মধ্যে আমরা কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর জোর দিয়েছি যার আওতায় বছরে ৩৬০ মিলিয়ন টন খাদ্য ও কৃষিজাত পন্য উৎপাদনের টার্গেট হাতে নেওয়া হয়েছে। কৃষি এবং কৃষি নির্ভর খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রকল্প গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সাধন করবে যা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখবে।
দ্বিতীয় সংস্কার ক্ষেত্র হল বিদ্যুৎ। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সারাদেশে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা চালু অবশ্য জরুরী।
আমাদের তৃতীয় সংস্কারমূলক ক্ষেত্র হল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা। আমরা গবেষণা করে দেখেছি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, কেরালার মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক শিক্ষিত ও স্বাস্থ্য সচেতন, যে কারণে সে এলাকায় জন্মহার কমে এসেছে এবং সেখানকার মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। ঠিক একইভাবে তামিল নাড়তেও জন্মহার অনেক কমে এসেছে যার প্রধান কারণ হিসেবে শিক্ষাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্ধ্র প্রদেশেও শিক্ষার প্রসার ঘটায় সেখানকার জনসং রি কমেছে। জীবন যাত্রার মান আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। এই সমস্ত রাজ্যগুলোর শিক্ষা প্রবণতা বিহার ও উত্তর প্রদেশের এলাকাগুলোতে সম্প্রসারিত করা দরকার, কারণ বিহার ও উত্তর প্রদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনও অনেক বেশী।
আমাদের চতুর্থ পরিকল্পনাধীন সংস্কার ক্ষেত্র হলো তথ্য প্রযুক্তি। দ্রুত শিক্ষা বিস্তার ও উন্নত জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্য পূরণে তথ্য প্রযুক্তি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও পশ্চাৎপদ এলাকাগুলোকে দ্রুত আধুনিকায়নের আওতায় আনতে তথ্য প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করতেই হবে।
আমাদের পঞ্চম লক্ষ্য কৌশলগত ক্ষেত্রের উন্নয়ন। এক্ষেত্রে অবশ্য আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি। পরমাণু, স্পেস এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রযাত্রা আশাব্যঞ্জক।
এই পাঁচটি ক্ষেত্রে আমাদের সমন্বিত অগ্রযাত্রা আমাদের খাদ্য, অর্থনীতি, সামাজিক ও জাতীয় প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সর্বস্তরের মানুষের সংগে সরকারী অধিদপ্তর ও পরিশক প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতামূলক বন্ধন তৈরী করা দরকার। সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবেই এই পারস্পরিক যোগাযোগ দরকার। ছোট পরিবার ও অধিক কর্মশক্তির নিশ্চয়তা বিধানের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এটা কর্মসংস্থান ও সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ কৃষি ক্ষেত্রের উন্নয়ন খাদ্যসংস্থাপনের নিরাপত্তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের অগ্রগতি দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ শক্তি উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। শিল্প কারখানা ও কারিগরি উন্নয়নের পেছনে প্রকৌশলগত ও কারিগরি সহায়তা ব্যবস্থা জরুরী। মোটকথা একটি ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য এই পাঁচটি ক্ষেত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি এই পাঁচ ক্ষেত্রের একটি সমন্বিত সংস্কার করা সম্ভব হয় তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী ৩০ থেকে ৪০ কোটি লোকের জীবনযাপনের মানে অভাবনীয়ভাবে উন্নতি আসবে।
আমি টিফাক (টিআইএফসি) টিমের সংগে একটা তিন বছর কৃষি, আধুনিক শিক্ষা এবং গ্রামীণ সংযোগ ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে কাজ করেছি। একাজ করতে গিয়ে আমি চিনি, ফ্লাইঅ্যাশ এবং সুতা উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমার বিগত অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেছি। বিখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী এস কে সিনহার নেতৃত্বে টিফাঁক মধ্য বিহার ও পূর্ব ভারতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। ১৯৯৮ সালের খরিফ ঋতুতে একটি রাজ্যের ৬টি ও অন্য রাজ্যের ৯টি গ্রাম এ প্রকল্পের অধীনে আনা হয়। প্রকল্পের বিজ্ঞান পদ্ধতিতে জমির মাটি পরীক্ষা, বীজ নির্ধারণ, চাষের মৌসুম, সার নির্ধারণ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা হয়।
সে বছর বিজ্ঞানী ও স্থানীয় কৃষকদের পারস্পরিক সহযোগীতায় প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদন আড়াই টন থেকে ৫ টনে উন্নীত হয়েছিল। সে বছর আমি এবং আমার বন্ধু ওয়াই এস রাজন সেখানকার কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেছি কৃষকরা দ্রুত ফসল কাটার যন্ত্রপাতি, গুদামজাতকরণ ব্যবস্থাপনা, বাজারজাতকরণ এবং ব্যাংক লোন সংগ্রহের বিষয়ে অনেক আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ওই প্রকল্পের কাজে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, কৃষকরা যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে দলীয় পদ্ধতিতে চাষ করে তাহলে উৎপাদনের খরচ এবং সময় দুইই বাঁচে।
আরেকটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প বর্তমানে চালু রয়েছে। সেটির নাম রিচ (আরইএসিএইচ-রিলেভেন্স অ্যান্ড এক্সিলেন্স অব অ্যাচিভিং নিউ হাইটস্ ইন এডুকেশন ইনস্টিটিউশনস্)। এ প্রকল্পে ৮০ থেকে ১০০টি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সেন্টারগুলো সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠক্রম অনুসরণ করছে এবং সর্বোচ্চ সফলতা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ করছে। এ লক্ষ্য অর্জনে সেন্টারগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করছে, একে অন্যের সংগে মতামত আদান প্রদান করছে এবং প্রয়োজনে সম্মিলিত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে পাতিয়ালা, ডিব্ৰুগড়, মুম্বাই, থানজাবুর এবং সুরাটের শিল্পভিত্তিক জৈব প্রযুক্তি, আধুনিক কম্পিউটিং ও ইনফরমেশন প্রসেসিং, পেট্রোলিয়াম মজুদকরণ কারখানার নিরাপত্তা, এনভায়রোনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ কারখানার আশেপাশে গড়ে উঠছে কোর (সিওআরই–সেন্টারস্ অব রিলেভেন্স অ্যান্ড এক্সিলেন্স)।
কৃষি বিষয়ক রিচ প্রকল্পের সাফল্য দেখে উৎপাদন ও শিল্প বিষয়ক কোর প্রোগ্রামে শিল্প-কারখানাগুলো যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন কিন্তু আশে পাশের এলাকার শিল্প-কারখানার মালিকরা তাদের এলাকায় কোর প্রতিষ্ঠার মোট খরচের ৪০ শতাংশ স্বেচ্ছায় ব্যয় করতে চাইছে। কোর প্রতিষ্ঠিত হলে এর বিনিময়ে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনশক্তি পাবে, অন্যদিকে গবেষণাগারে সর্বাধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তিও তাদের কাজে লাগাতে পারবে। প্রযুক্তি উন্নয়ন ও শিক্ষাক্ষেত্রে শিল্পপতিদের অংশীদারী হবার আগ্রহে আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। সমন্বিত শিক্ষা পদ্ধতির নেতৃস্থানে প্রধান বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে ড. এম. এস. বিজয় রাঘবনকে পাওয়ায় আমরা আরও বেশী আশাবাদী হয়েছি। তার অভিনব আইডিয়া এই শিক্ষা প্রকল্পের প্রতি সবার প্রতিশ্রুতিশীল মানসিকতা গড়তে সহায়তা করেছে।
আরেকটি গ্রাম ভিত্তিক সহযোগীতামূলক প্রকল্পের উদাহরণ গড়ে উঠেছে মাদ্রাজের আইআইটির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক পি.ভি. ইন্দিরেসানকে ঘিরে। পূর্বোল্লেখিত আধুনিক ব্যবস্থাপনায় গ্রামে শহরের আধুনিক সুবিধা সৃষ্টি করে আরও বেশী কর্মসংস্থানের সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের ব্যাবধান কমানোর জন্য তার প্রোগ্রাম কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে তার প্রোগ্রামের মডেল অনুযায়ী অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হবে না। ক্রমশ গ্রামগুলো আরও উন্নত হয়ে উঠবে। বর্তমানে গ্রামগুলোকে পারস্পরিক সহযোগীতায় এগিয়ে আসার মাধ্যম হিসেবে বহু প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং গ্রামগুলোর মধ্যে সার্বিক যোগযোগের দূরত্ব কমে আসছে।
গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে আমরা পুরা নামের একটি প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। গ্রামগুলোর মধ্যে বহুমুখী সংযোগ ব্যবস্থা চালুর জন্য আমরা চারটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছি। সেগুলো হল : পদার্থ বিদ্যা, ইলেক্ট্রনিক্স, অর্থনীতি ও সমন্বিত শিক্ষা। এক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিষয় হলো তথ্যপ্রযুক্তি পরিচালিত টেলিমেডিসিন।
গত বছর মে মাসে আমি হায়দ্রাবাদের কেয়ার হাসাপাতাল পরিদর্শন। করেছিলাম। টেলিমেডিসিন সিস্টেমের উদ্বোধনী দিন উপলক্ষ্যে হাসপাতালের হল রুমে সেদিন ডাক্তার, কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞদের মিলন মেলা বসেছিল। টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে বহু দূরের রোগীকে পরীক্ষা করার ও ব্যবস্থাপত্র দেবার আয়োজন চলছিল। এ পদ্ধতিতে পাকস্থলির জটিলতা বিষয়ক কোন রোগীকে ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাফী যন্ত্রের নিচে শুইয়ে দেওয়া হবে। মজার ব্যাপার হল রোগী থাকবে বহু দূরে কিন্তু হায়দ্রাবাদে বসেই তার রোগ ডায়াগনোসিস করা হবে ইলেক্ট্রোমেডিসিন পদ্ধতিতে। ডাক্তার ও রোগী স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কথোপকথন করবে। হাই রেজুলেশন ইমেজ ট্রান্সফারের মাধ্যমে ইসিজি ডাটা এবং ক্লিনিক্যাল ইনফরমেশন সঠিক সময়ে পাঠানো সম্ভব হয়।
আমি মনিটরে বহুদূরের একটি হাসপাতালের কোন এক রোগীর পাকস্থলি ও হৎপিন্ডের জীবন্ত ছবি দেখলাম। দেখলাম দূরবর্তী সেই হাসপাতালের রোগীর চিকিৎসক ও হায়দ্রাবাদের বিশেষজ্ঞরা কীভাবে রোগীর সংকট নিয়ে আলোচনা করছেন। যেসব শহরে উন্নত চিকিৎসার ও বিশেষজ্ঞদের অভাব রয়েছে তাদের সেবা দানের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি আশাবহ পদ্ধতি। টেলিমেডিসিন পদ্ধতি অজ গ্রামেও আধুনিক চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে পারে এবং গ্রামের প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে আঞ্চলিক হাসপাতাল এবং জেলা হাসপাতালের সংগে রাজধানীর সর্বোন্নত হাসপাতালের যোগাযোগ স্থাপন করে দিতে পারে। আধুনিক স্যাটেলাইট কম্যুনিকেশন এবং তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে, প্রকৌশল বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সম্মিলন ঘটিয়ে কয়েকশ মাইল দূরের একজন রোগীকে কীভাবে চিকিৎসা করা হচ্ছে- এটা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।
এক বন্ধুর পরামর্শ অনুযায়ী আমার চোখ পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য ১৯৯০ সালে মাদুরাইয়ে অবস্থিত অরবিন্দ চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে দেখি অসংখ্য চোখের রোগী ভর্তি হবার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ লম্বা লাইন। কিন্তু লাইন লম্বা হলেও দ্রুতগতিতে তা শেষ হচ্ছিল এবং ওই লাইনে দাঁড়িয়ে আধঘণ্টার মধ্যেই ড. জি. নাচিয়ারের সাক্ষাত পেলাম। তিনি হাসপাতালে ভর্তির জন্য সুপারিশ করলেন। হাসপাতালের ভর্তি ফি দিতে গিয়ে এক বিপত্তি বাধল। আমি কাউন্টারে চেক দিতেই ক্যাশ কাউন্টারে বসা মেয়েটি তা গ্রহণে অস্বীকার করলো। বললো চেক তাদের সেখানে গ্রহণযোগ্য নয়, অথচ আমার কাছে তখন নগদ টাকা নেই। আমি আবার ডা. নাচিয়ারের কাছে ফিরে এলাম এবং আমার সমস্যা তার কাছে খুলে বললাম। ভদ্রমহিলা সহজেই আমার সমস্যা বুঝতে পারলেন এবং আমাকে ভর্তি করতে রাজী হলেন। কয়েকদিনের চিকিৎসা শেষে আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হল। এর কদিন পরে ডা. নাচিয়ারের কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম। ভদ্রমহিলা আমাকে চিনতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। হাসপাতাল ছাড়ার দিন আমার নিরাপত্তা কর্মীরা হাসপাতালে আমার খোঁজ করতে যাওয়ার পর তিনি আমার সম্পর্কে জানতে পারেন।
প্রথম ভিজিট করার পরে আমি অরবিন্দ হাসপাতালে আরও বেশ কয়েকবার গেছি। আমার চিকিৎসক ডা. নাচিয়ারের ভাই ডা. জি ভেঙ্কটস্বামী ওই হাসপাতালে কর্মরত। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। মাদুরাইয়ে গেলে প্রতিবারই ভেঙ্কটস্বামীর সংগে দেখা করি।
এবার ভেঙ্কটস্বামী ও তার কাজ সম্পর্কে একটু বলি। ২০০১ সালে অরবিন্দ হাসপাতালে শুধু বহিরাগত রোগীর সংখ্যাই ছিল ১৩ লাখ। ওই হাসপাতালের পক্ষ থেকে সে বছর ১৫শ চক্ষু ক্যাম্প করা হয় এবং প্রায় ১১ হাজার চক্ষু অপারেশন করা হয়। এ কৃতিত্বের স্বীকৃতি বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ইতিমধ্যেই তাকে দিয়েছে।
বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিখ্যাত বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এ হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নেবার জন্য আসছে।
ডা. ভেঙ্কটস্বামীর হাত দুটি স্বাভাবিক না থাকলেও তিনি অস্ত্রোপচারে অপ্রতিদ্বন্দী অবস্থানে চলে এসেছেন। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় তার হাতের কয়েকটি আঙুল আথ্রাইটিসে আক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে কুঁকড়ে যায়।
একদিন আলোচনার সময় তিনি জানালেন, একদিন দিল্লি থেকে একজন শিল্পপতি ভেঙ্কটস্বামীর কাছে এসে বললেন, আমি দিল্লিতে নতুন একটি হাসপাতাল বানাতে চাই। আপনার হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনি কি আমাকে এই নতুন হাসপাতাল তৈরীতে সহায়তা করবেন? ডা, ভেঙ্কটস্বামী তাকে বললেন, আপনার অগাধ অর্থ রয়েছে। ইচ্ছে করলে এখনই তো কাজ শুরু করতে পারেন। কেন করছেন না? শিল্পপতি বললেন, না, আমি ঠিক এই অরবিন্দ হাসপাতালের মডেলে হাসপাতালটি করতে চাই। এখানকার লোকজন, চিকিৎসকরা অত্যন্ত আন্তরিক। তারা অর্থের চেয়ে মানুষকে বেশী সম্মান করে বলেই আমার মনে হয়েছে। আমি নতুন হাসপাতালে এখানকার আবহ প্রতিস্থাপন করতে চাই।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়ও তাই মনে হয়েছে। অরবিন্দ হাসপাতালে থাকাকালীন আমি দেখেছি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সেখানকার চিকিৎসকরা কীভাবে আন্তরিকতার সংগে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে।
চিকিৎসাবিদ্যার পাশাপাশি কৃষির মত আরও অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সমন্বিত প্রয়োগ আমরা অদূর ভবিষ্যতেই দেখতে পাব। কিন্তু সমস্ত কর্মপরিকল্পনার পূর্বশর্ত হতে হবে জনকল্যাণ ও তাদের অভাব মেটানো।
সমৃদ্ধ প্রজন্ম এবং সমৃদ্ধ নিরাপত্তা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ–এই বিবেচনাবোধ ধারণ করতে পারলেই আমরা উন্নত ভারতের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বুঝতে পারবো। জনগণের শ্রম ও ঘামের সাফল্যের প্রতিনিধিত্ব করে সে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
ভারতের ১৩ জন বৈষ্ণব কবির অন্যতম তামিল মহিলা কবি আন্দাল তার তিরুপ্লাভাই কবিতায় ঈশ্বরের প্রতি আহ্বান করেছেন ঈশ্বর যেন এ ধরীত্রীতে নিনগাথা সেলভাম (সম্পদের বৃষ্টি) বর্ষণ করেন। তার এ সম্পদের বর্ষণ হতে পারে শুধুমাত্র সবাই একত্রিত হয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আলাদা আলাদাভাবে তাদের স্ব স্ব মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনার অনুমোদন করছে। তা না করে যদি কয়েকটি মন্ত্রনালয় একত্রিত হয়ে বহুমুখী পরিকল্পনা অনুমোদন করে তাহলে তার ফলাফলও হবে বহুমুখী। আরও শক্তিগুলো এক হচ্ছে বেশী মানুষ বেশী সেবা পাবে। এজন্য দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা। ঠিক একইভাবে অন্যান্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও যৌথ উদ্যোগের প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। যৌথ ও সমন্বিত উপায়ে ভারতের সর্বস্তরের উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত হলে ভারত দ্রুত উন্নত বিশ্বের সারিতে চলে আসবে।
উন্নত দেশের আরেকটি প্রধান উপজীব্য হল সে দেশের শিল্পকারখানা গুলোকে বিশ্ববাজারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সক্ষম হতে হবে। শুধু দেশের বাজারে প্রাধান্য বিস্তারের চিন্তা মাথায় রাখলে হবে না। বিশ্ববাজারের কথা চিন্তা করে এদেশের শিল্প কারখানাগুলোকে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে হবে।
জিডিপির ক্ষেত্রে এই রফতানীযোগ্য পণ্যের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। উন্নয়নের জন্য ভারতের এটা অতি অবশ্য জরুরী হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতকে প্রমাণ করতে হবে যে উন্নত দেশগুলোর মত পণ্য উৎপাদনে অভিনবত্ব আনার সক্ষমতা তার রয়েছে। এতে স্থানীয়ভাবেই আমরা বহুজাতিক পণ্য উৎপাদনে সক্ষম হব।
সত্যিকার উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য আরেকটি জিনিস দরকার। সেটি হল বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ভাষা ও শিক্ষা অর্জনের সক্ষমতা। এটি উন্নয়নের জন্য একটি মৌলিক চাহিদার পর্যায়ে চলে এসেছে। শিক্ষার মাধ্যমে একটি বিপুল শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরী করতে হবে যারা বিশ্ববাজারের সর্বশেষ প্রযুক্তি ও সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে পারে।
বর্তমানে দুঃখজনক হলেও সত্য ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও ব্যাপক ফারাক রয়ে গেছে। বহু শিক্ষার্থী আছে যারা উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করতে চায় কিন্তু সে অনুযায়ী এদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেবারেই কম। এজন্য সুদক্ষ জনশক্তি এদেশের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তথ্য প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, পরিবেশ প্রকৌশলবিদ্যা এবং প্রস্তুতকরণ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতে উচ্চশিক্ষার মান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। মুক্ত অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ শিক্ষার ক্রমাগ্রগতি মোটেও প্রতুল নয়। আরও উন্নত সমাজ ও শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে আরও শক্তিশালী ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়া দরকার।
যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে তারা নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে এসব কাজ হতে হবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে। মিশন মুড নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন এগিয়ে না আসলে সামগ্রিকভাবে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
২০০০ সালের ১৫ অক্টোবর পোন গ্রুপের বন্ধুরা আমার জন্য একটি ওয়েব সাইটের ডিজাইন করেছিল। IISc.র অধ্যাপক বলকৃষ্ণর উপস্থিতিতে পোন গ্রুপের চেয়ারম্যান এন.আর, নারায়ণমূর্তি ওই ওয়েবসাইটের উদ্বোধন করেন। আমার কয়েকজন বন্ধু ওই ওয়েবসাইটে আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন জুড়ে দিতে বলেন। সাইটে আমার তিনটি প্রশ্ন ছিল। প্রথম প্রশ্ন হল, পঞ্চাশ বছর ধরে ভারত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত। তোমরা যারা তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থী তারা উন্নত ভারত গঠনে কী কী করণীয় আছে বলে মনে করছ? দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, কখন, কবে আমি ভারতের জয়গান গাইতে পারব? তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল, বিশ্বের অন্য দেশগুলো যেখানে তাদের তৈরী পণ্যের প্রশংসা করছে সেখানে আমরা কেন বিদেশের সবকিছু পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি? আমার ওয়েব সাইটে আমি উল্লেখ করেছি উত্তরদাতাদের বয়স হতে হবে ২০ বছরের নিচে। কয়েকদিনের মধ্যে দেশের ও দেশের বাইরে থেকে শতাধিক উত্তর ও পরামর্শ পাওয়া গেল। এদের মধ্যে পাঁচটি উত্তর আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে।
চন্ডিগড়ের এক তরুণ তার উত্তরে লিখেছে, আমি বড় হয়ে একজন শিক্ষক হতে চাই (বিশেষ করে প্রকৌশলবিদ্যার অধ্যাপক হতে চাই), কারণ শিক্ষকতার বিষয়টি আমার কাছে উপভোগ্য এবং আমি বিশ্বাস করি জাতির সর্বোচ্চ সেবা করার দুটি মাধ্যম রয়েছে। হয় শিক্ষকতা নয়তো সেনাবাহিনীতে যোগদান করা। পন্ডিচেরী থেকে একটি মেয়ে লিখেছে, আমি জানি একটি ফুলে মালা গাঁথা হয় না। ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করতে গাঁথা মালার মত অগণিত মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমিও নিজেকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করতে চাই। গোয়া থেকে ২০ বছরের এক তরুণ উত্তর দিয়েছে, ইলেক্ট্রন তার সুক্ষ্ম কক্ষপথে যেভাবে ঘুরতে থাকে, আজ থেকে আমিও আমার দেশের উন্নয়নের জন্য বিরামহীনভাবে ঘুরতে থাকবো।
আমি কবে ভারতের জয়গান গাইতে পারব?–এ প্রশ্নের জবাবে আটলান্টা থেকে এক তরুণ লিখেছে, যেদিন প্রয়োজনবোধে ভারত যে কোন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে সেদিন আমি ভারতের গান গাইব। অর্থাৎ সে তরুণ বোঝাতে চেয়েছে রাষ্ট্ৰীয় শক্তির সংগে অর্থনৈতিক শক্তি মিলিত হয়েই উন্নত ভারতভূমি গড়ে তোলা সম্ভব। প্রায় ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা লিখেছে, আমাদের ভারতে ৩৫ বছরের কম বয়সের লোকের সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি। এই ৭০ কোটি জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম ও কর্মক্ষমতার পূর্ণবিকাশ ঘটিয়ে তাদের একতাবদ্ধ করতে পারলেই ভারত উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটা একটা বিশাল শক্তি।
এখন কথা হলো তরুণ মনগুলেকে কিভাবে জাগিয়ে তোলা যাবে? জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আগ্রহ কীভাবে তাদের মধ্যে সৃষ্টি করা যাবে? শুধুমাত্র সম্মিলিত ও একতাবদ্ধ একটি নবায়িত চেতনা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পুনর্জাগরণ ঘটানো সম্ভব। তারাই দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে।
দুর্নীতিহীন স্বচ্ছতা ও মূল্যায়নের শিক্ষাও আমি গান্ধীর জীবন থেকে পেয়েছি। একবার দিল্লিতে গান্ধীজির নাতি সুমিত্রা কুলকার্নির সংগে আমাকে দেখা করতে হয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সুমিত্রাজি, আপনার ঠাকুরদার এমন কোন জীবনাচরণের কথা কি আমাদের বলবেন যা আপনি সব সময় স্মরণ করেন?
তিনি উত্তর দিতে গিয়ে একটা গল্প বললেন। তিনি বললেন, আপনার মত সকলেই জানেন, তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রার্থনায় বসতেন। প্রার্থনার পর হরিজন সম্প্রদায়সহ অন্যান্যদের জন্য সাহায্য তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি জনগণের স্বেচ্ছাসেবামূলক দান গ্রহণ করতেন। গান্ধীজির সেবকদের কয়েকজন সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে সংগৃহিত ওই সাহায্য অর্থ রাতে হিসাবনিকাশ করে রাখতেন। রাতের খাবারের আগে সারাদিনে কত অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে তা গান্ধীজিকে জানানো হত। পরের দিন ওই অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার জন্য ব্যাংক থেকে লোক আসত।
একদিন ব্যাংকের লোক এসে গান্ধীজিকে বললেন, গতরাতে তিনি যে পরিমাণ অর্থের কথা জানিয়েছেন তার চেয়ে সামান্য কিছু কম পয়সা ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। কারণ সেবকদের একজন ওই পয়সা ধার হিসেবে রেখে দিয়েছেন। পরে তা ফেরত দেবার আশ্বাস দিয়ে তিনি ওই অর্থ গ্রহণ করেছেন। এটা শুনে গান্ধীজি সাংঘাতিক আঘাত পেলেন এবং বললেন, এ টাকা জনগণের। এ থেকে এক কানাকড়ি খরচ করারও অধিকার আমাদের নেই।
সাধারণ জীবনের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে এ ঘটনা নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা আজ সেই গান্ধীজির দেশেই সততা ও দুর্নীতি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে স্বচ্ছভারত গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে; যেভাবে আমাদের পূর্বসূরীরা করে গেছেন। উন্নয়নের অপরিহার্য ভিত্তি হল অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা।
স্বাধীনতার পর থেকে আমরা অগ্রগতির কথা বলে আসছি। কৃষিক্ষেত্রে আমরা এখন অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুগ্ধ উৎপাদনকারী হিসেবে বিশ্ববাজারে আমরা প্রথম শ্রেণীতে রয়েছি। এমন বহু ক্ষেত্রে আমাদের শিল্পকারখানা এগিয়ে এসেছে। এর পরেও আমরা শ শ উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ভুক্ত দেশ।
আমাদের এখন বিবেচনা করে দেখতে হবে বিশ্বের প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে। একটি দেশের প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক অবস্থান নির্ধারিত হয় তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিচার করে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্ব প্রতিযোগীতার দৌড়ে সিংগাপুর প্রথম, যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয়, হংকং তৃতীয়, তাইওয়ান চতুর্থ, কানাডা পঞ্চম, ব্রিটেন অষ্টম, ফ্রান্স তেইশতম, জার্মানি পঁচিশতম এবং ভারত উনষাটতম অবস্থানে রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল এ বিশ্বপ্রতিদ্বন্দ্বীতা নির্ধারণ করে কে? এটা আসলে শিল্প কারখানার উন্নয়নমুখীতা, উন্নত প্রযুক্তির অগ্রসরতা, সরকারের সুস্থির চালিকাশক্তির একটি সম্মিলিত ফলাফল। গড় জিডিপি অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্বে আমাদের অবস্থান দ্বাদশ পর্যায়ে। পার ক্যাপিটা জিডিপির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সাতান্নতম।
এ অবস্থান কি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য? বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে? আমি বিশ্বাস করি আমাদের এমনভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো উচিত যাতে জিডিপির ক্ষেত্রে চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে আমরা চলে আসতে পারি। একই সংগে বিশ্ব প্রতিযোগীতার দৌড়েও আমরা চতুর্থ থেকে পঞ্চম অবস্থানে শক্তিগুলো এক হচ্ছে আসতে চাই। আর এ সাফল্য অর্জনের জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি ২০২০ সাল। এ সাফল্য অর্জনের জন্য আমরা আগেই বেশ কয়েকটি পন্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছি।
এ সকল সমাজ গড়ার জন্য আমাদের একটি বলিষ্ঠ শিক্ষিত সমাজ গডে তুলতে হবে। আমি প্ল্যানিং কমিশনের এই শিক্ষিত প্রজন্ম সৃষ্টির রোডম্যাপ প্রণয়নের উদ্যোগে খুব খুশি হয়েছি।
আমরা কোত্থেকে আমাদের কার্যক্রম শুরু করব? সম্প্রতি নতুন কিছু রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। সেসব অঞ্চল থেকেই আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারি। অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলগুলোর খুব কমই উন্নতি হয়েছে। সেখানকার মানুষ অনেক পরিশ্রম করছে কিন্তু দারিদ্র তাদের ছাড়ছে না। এই চরম বঞ্চনাপূর্ণ দারিদ্র্যের পথ থেকে কে আমাদের নতুন পথের সন্ধান দেবে? কে আমাদের এ পরিস্থিতিতে রেখেছে সেটি বড় প্রশ্ন নয়। এখন আমাদের সামনে মুখ্য জিজ্ঞাসা, কে এই দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটাতে পারে?