বিশুদ্ধ সমাজ বিপ্লব দেখাবে, এমন আশা যদি কারো থাকে তবে সে জীবনেও কখনো তা দেখতে পাবে না। সে শুধু মুখেই বিপ্লবী, আসল বিপ্লব সে বোঝে না। — ভ.ই. লেনিন
.
৭. লেনিন এবং স্তালিনের সম্পর্ক
– মারিয়া উলানোভা
[এই প্রতিবেদনটিকে সে সময় বলা হতো ‘লেনিন টেস্টামেন্ট এবং লেনিন আর স্তালিনের সম্পর্ক। প্রতিবেদন বা বিবৃতিটিতে লেনিনের বোন মারিয়া উলানোভার দুটি বিবৃতি ছিল যা সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রথমবার ছাপা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে গর্বাচেভ এর ‘প্রেসস্ত্রৈইকা’র সময়ে। ইউ মুরিন এবং ভি, স্তেপানভ এই দলিল দস্তাবেজগুলো সোভিয়েত জার্নাল ইজভেস্তিয়ায় ছাপানোর জন্য তৈরি করেন। স্মরণ রাখা দরকার এই দুটি স্টেটমেন্টের পেছনের ইতিহাস নেয়া হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এবং কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা কমিশনের যৌথ বর্ধিত সভায়, যে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৬ সালে।]
“বিরোধীপক্ষ ( এল.ডি. ট্রটস্কি, জি.ই. জিনোভিয়েভ, এল.বি. কামেনেভ এবং অন্যান্য) এবং বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য তাদের স্তালিনবিরোধী আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন স্তালিনকে লেখা লেনিনের শেষ চিঠিটাকে। যে চিঠিতে পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সম্পর্কে লেনিনের মতামত ফুটে উঠেছিল। উপরন্তু কেন্দ্রীয় কমিটি এই চিঠিটি পার্টি থেকে গোপন করার অভিযোগও করেছিল। জি.ই. জিনোভিয়েভ ওই বর্ধিত সভায় তার ভাষণে স্তালিন সম্পর্কে লেনিনের ৫ মার্চ ১৯২৩ তারিখের লেখার বিষয়বস্তু তুলে ধরেছিলেন। কার্যত ওই ডকুমেন্টস বর্ধিত সভায় লেনিনের বোন মারিয়া পড়ে শোনান। পার্টি কংগ্রেসের কাছে লেনিনের ১৯২২ সালের ২৫ ডিসেম্বরের চিঠিতে জাতীয়তা, স্বয়ংক্রিয় প্রার্থীপদ নিয়েও বক্তব্য ছিল। এল.বি. কামেনেভ এবং জি.ই. জিনোভিয়েভ এর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বলশেভিক দলের প্রতি কার্যত সশস্ত্র বিদ্রোহ।
বর্ধিতসভার আলোচনা লক্ষ করলে দেখা যায় ভ.ই. লেনিন, জি.ই. জিনোভিয়েভ, এল.ডি.ট্রটস্কি, এন.আই. বুখারিন এবং জে.ভি. স্তালিনের চিঠি এবং মারিয়া উলানোভার বিবৃতি কার্যত বর্ধিত সভায় স্টেনোগ্রাফারের রিপোর্টেরই অনুলিপি। –Izvestia TsK KPSS’, No. 12, 1989, below p. 200
মারিয়া উলানোভার দ্বিতীয় বিবৃতি থেকে এটা পরিষ্কার যে প্রথম বিবৃতিটি বিরোধীপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বুখারিন এবং স্তালিন লেনিনকে অনুরোধ করে লিখিয়েছিলেন। বুখারিনের ভূমিকা যে কী ছিল সেটা মারিয়ার ২৬ জুলাইয়ের প্রতিবেদনেও প্রকাশ পায়। তাতে প্রমাণিত হয় যে বুখারিনের হাতের লেখাও ছিল ওই রিপোর্টে, যা পরবর্তীতে প্রাক্তন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে।
‘কমরেড লেনিনের সাথে কমরেড স্তালিনের সম্পর্কচ্যুতি ঘটেছে কমরেড স্তালিনের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের এই পদ্ধতিগত কুৎসা অল্পসংখ্যক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের প্রভাবিত করতে পেরেছিল। আমি এটা ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করছি যে লেনিন এবং স্তালিনের সম্পর্কের পুরোটা সময়জুড়ে সময় আমি লেনিনের পাশে ছিলাম।
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন জোসেফ স্তালিনকে অনেক মূল্যবান মনে করতেন। এতটাই যে লেনিনের প্রথম এবং দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকের মাঝের সময়টাতে লেনিন সবচেয়ে নিকটজন মনে করতেন স্তালিনকেই। একেবারে অন্তরঙ্গ পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা, পরিকল্পনা সব স্তালিনকে নিয়ে করতেন।
সাধারণত তার পুরো অসুস্থতার সময়টাতে লেনিন কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য কোনো সদস্যকে ডাকতেন না। তিনি কেবলমাত্র স্তালিনকেই তার কাছে ডাকতেন এবং তার সাথেই বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। আর সে কারণেই সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এটা প্রমাণ করে যে লেনিনের সাথে স্তালিনের সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ ছিল।
লেনিনের জীবনের শেষ মাসে লেনিন এবং স্তালিনের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়েছিল বলে প্রতিপক্ষ যে অপবাদ ছড়িয়েছিল মারিয়ার প্রথম স্টেটমেন্ট তা বাতিল করে দেয়। বরং এই দুই বলশেভিক নেতার নৈকট্য এবং আন্তরিকতাকেই দৃশ্যমান করে।
১৯২৬ সালের ২১ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) কেন্দ্রীয় কমিটি এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশনে জিনোভিয়েভ তার ভাষণে বলেছিলেন : ১৯২২ সালের ২৪ ডিসেম্বরের কংগ্রেসকে লেখা লেনিনের চিঠিতে লেনিন মূলত স্তালিনের মূল্যায়ন করেছিলেন। সেই চিঠির ধারাবাহিকতায় ৪ জানুয়ারি ১৯২৩ সালের প্রবন্ধ স্বাতন্ত্র্যবাদিতা ও জাতীয়তার প্রশ্ন’ লেখা হয়।
মারিয়া উলিয়ানোভা স্তালিনের রূঢ়তা প্রশ্নে খোলাখুলিই তার মতামতে বলেন : স্তালিন এবং নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার মধ্যকার ঘটনাটি ছিল স্রেফ ব্যক্তিগত, কোনোভাবেও রাজনৈতিক নয়। কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে এটাই প্রতীয়মান হয় যে লেনিনের মারাত্মক অসুস্থতার সময়ে স্তালিন যথাযথ দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দেননি। সেই অনুসিদ্ধান্তকে বাতিল করে দেন নাদেজদা ক্রুপস্কায়া, যাকে সে সময় মনে করা হতো স্তালিনের প্রতি লেনিনের ‘হাতুড়ির ঘা’। মারিয়া বরং এটাই অনুমোদন করেন যে লেনিন সে সময় অতটা অসুস্থ ছিলেন না যতটা তিনি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। এবং যতটা বলা হতো বা মনে করা হতো।
লেনিনের জীবনের একেবারে শেষ মাস নিয়ে মারিয়া উলিয়ানোভার দ্বিতীয় বিবৃতি যা তারিখবিহীন ছিল তাতেই প্রকৃত ঘটনাবলি ভালোভাবে ফুটে ওঠে। মারিয়া অনেক গভীরভাবে বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। তিনি অনেক গভীরে যেয়ে উপলব্ধি করেছিলেন লেনিনের শেষ চিঠি, যেটিতে লেনিন নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার সাথে দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথা লিখেছিলেন। এবং ওই চিঠির রাজনৈতিক নির্দেশনাও ছিল সেরকম। লেনিনের মৃত্যুর পরে যেটাকে স্ত লিনের রাজনৈতিক লাইন মনে করা হতো।
মারিয়া লেনিন এবং স্তালিনের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন। এ থেকে আমরা এটাই পাই যে স্তালিন লেনিনের অসুস্থতাকালীন অবহেলা করেননি, বরং অন্যান্য নেতাদের তুলনায় নিয়মিত লেনিনের দেখভাল করতেন। মারিয়া মনে করেন স্তালিনের ওপর অবহেলার অভিযোগ নেহাতই অজ্ঞতাপ্রসূত এবং প্রতিহিংসাবশত।
লেনিন তার চরম অসুস্থতার সময়, যখন প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত সে সময় স্ত লিনকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন, যেন স্তালিন তাকে আত্মহত্যার জন্য পটাসিয়াম সায়ানাইড এনে দেন! মারিয়া উলিয়ানোভা মনে করেন এটা ছিল স্ত লিনের প্রতি ষড়যন্ত্রকারী লিও ট্রটস্কির আরেকটি চাতুরিপূর্ণ অভিযোগ (L. Trotsky, ‘Stalin’, Vol. 2, London, 1969, p. 199).
এই ঘটনাবলির আরেকটি মূল্যায়ন হলো পশ্চিমাদের কাছে এমনই একটি ধারণা প্রচার করা হয়েছিল যে লেনিনের কাছে স্তালিনের চেয়ে ট্রটস্কিই বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এবং তার উপরেই ন্যস্ত ছিল লেনিনবাদ প্রচারের দায়িত্ব!
ট্রটস্কিকে নিয়ে লেনিন এবং স্তালিনের কথোপকথন বিষয়ে মারিয়া সরাসরি তার জানা-বোঝার জায়গা থেকে জানান, ককেশিয়া প্রশ্নে লেনিন এবং স্তালিনের সিদ্ধান্ত যে ভিন্ন সেটা লেনিন জানতেন। (On this see the note Bolshevism and the National Question’, ‘Revolutionary Democracy’, Vol. 1, No. 2, September 1995, pp. 66-69) মারিয়া জানাচ্ছেন লেনিনের এই অসন্তোষ খুব কার্যকরভাবে স্তালিনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন মেনশেভিক মারটোভ যিনি লেনিনকেও সঠিক মনে করেছেন, স্ত লিনকেও চাননি, বরং লেনিনের সহানুভূতি কার উপর সে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, যা শেষ পর্যন্ত শত্রুদের হাতকেই শক্তিশালী করেছে।
মারিয়ার মতে লেনিন আর স্তালিনের পার্থক্য ফুটে উঠেছিল স্তালিনকে লেখা লেনিনের শেষ চিঠিতে। সেখানে লেনিন স্তালিনের উদ্ভূত ঘটনাবলির জন্য স্তালিনকে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে স্তালিন পলিট ব্যুরোর কাছে বিবৃতিও দিয়েছেন যে লেনিন যে রাজনৈতিক অগ্রগতি বিষয়ে জানাননি সেটা ডাক্তারের নির্দেশক্রমেই।
মারিয়া ইঙ্গিত দেন যে ‘আসল ভয়ের কারণ’ ছিল নাদেজদা ক্রুপস্কায় যিনি লেনিনের সাথে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। স্তালিনের উদ্যোগে ক্রুপস্কায়াকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে হাজির করা হয়, এটাই ছিল ডাক্তারের নির্দেশাবলি অনুযায়ী ক্রুপস্কায়ার সাথে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধানোর সামিল। আর দুঃখজনকভাবে এটাই উস্কে দিয়েছিল লেনিন- স্তালিন দুই নেতার সম্পর্ককে।
লেনিন তার স্তালিনকে লেখা ১৯২৩ সালের ৫ মার্চ তারিখের চিঠিতে নাদেজদাকে যে ডাক্তারের নির্দেশাবলি নিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়েছে সেটার উল্লেখ করেননি। এটা ছিল আসলে স্তালিনের উপর পলিট ব্যুরোর অভিযোগ। লেনিন দাবি করেন স্তালিন নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার সাথে তার বিবাদ মিটিয়ে ফেলেছেন এবং তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছেন।
এই সেই চিঠি যা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-এর ১২তম কংগ্রেসে ভালোভাবে প্রচারিত হয়েছিল, ১৯৫৬ সালের যে কংগ্রেস। অনুষ্ঠিত হয়েছিল কুশ্চভের অধীনে, এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত সংশোধনবাদী প্রকাশনার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছিল।
এটা এখন জানা কথা যে ক্রুশ্চভ ছিলেন সেই ১৯২০ সালের বিরোধী ট্রটস্কির দলের স্যাঙ্গাত যেটা ক্যাগানোভিচ তার স্মৃতিকথা গোপন বক্তৃতায় রাজনৈতিক অপরাধপ্রবণতা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
স্তালিনকে লেখা লেনিনের চিঠিটি নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার অনুরোধে স্থগিত করা হয় এবং ব্যক্তিগতভাবে’ M.A. Volodtheva-এর মাধ্যমে ১৯২৩ সালের ৭ মার্চ হস্তান্তর করা হয়। স্তালিন সাথে সাথে চিঠির উত্তর লেখেন, কিন্তু লেনিনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় চিঠিটি আর লেনিনকে পড়ে শোনানো হয় না, তাই যদি মনে করা হয় স্তালিন রূঢ় ছিলেন, তাহলে বুঝতে হবে সেটা স্বকল্পিত।
মারিয়া উলিয়ানোভার এই দুটি বিবৃতিই ‘পরিশিষ্ট’ হিসেবে ছাপা হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়।
.
কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) কেন্দ্রীয় কমিটি এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে লেখা এম. আই. উলায়ানোভার ১ নম্বর চিঠি। তারিখ ২৬ জুলাই, ১৯২৬
কেন্দ্রীয় কমিটি এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশন
সমসাময়িক কালে কেন্দ্রীয় কমিটির এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সংখ্যালঘুরা কমরেড স্তালিনের উপর নিয়মতান্ত্রিক আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি তারা ভাদিমির লেনিনের জীবনের শেষ মাসে লেনিন এবং স্তালিনের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে লেনিনের চিকিৎসা সংক্রান্ত ‘অবহেলা’ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল তাকেও আমলে নেননি। এই ক্ষেত্রে বরং আমি (উলায়ানোভা) আমার দায়বোধ এড়াতে পারি না। সে সময় লেনিন এবং স্তালিনের সম্পর্কের সবকিছু আর কেউ না, আমিও কাছে থেকে দেখেছিলাম। আমি এখানে দুজনের সম্পর্কের খুঁটিনাটি উল্লেখ করছি না, তবে আমার কাছে যে সব জাজ্বল্যমান প্রমাণ রয়েছে তাতে করে দুজনের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। বরং লেনিন এবং স্তালিনের সম্পর্ক নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির লোকজনই কম জানতেন। আমি সে সময় লাগাতার এই দুজনের সঙ্গে ছিলাম। তা সত্ত্বেও স্তালিনের উপর দোষারোপ করা হয়েছিল।
লেনিন সত্যি সত্যি স্তালিনকে প্রশংসা করতেন। একটা উদাহরণ দেখা যাক : ১৯২২ সালের বসন্তে লেনিনের প্রথম হার্ট অ্যাটাকের সময় এবং সে বছরেরই ডিসেম্বরে যখন তার দ্বিতীয় আক্রমণ হলো তিনি স্তালিনকে ডেকে আনালেন তার। কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। বিষয়টি এমনই যে খুব নিকটজন কেবলমাত্র তাকে দিয়েই হতে পারে, এবং তাকে অবশ্যই একজন নিবেদিতপ্রাণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী হতে হবে যার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখা যায়। মোট কথা লেনিন স্তালিনকে ডেকে আনার এবং তার সাথে কথা বলার ব্যাপারে ক্রমাগত তাগাদা দিচ্ছিলেন, স্তালিন ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে তিনি ওই সব বিষয়ে কথা বলবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন। সাধারণত কী হয়? মানুষ তার অসুস্থতার সময়ে যাকেই কাছে পায় তাকেই আপন মনে করে আঁকড়ে ধরতে চায়, কিন্তু এক্ষেত্রে লেনিন তা করেননি। তিনি তার চরম অসুস্থতাকালীন বেশিরভাগ সময়ই স্তালিনকে কাছে পেতে চাইতেন। স্তালিনের সাথেই গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ করতে চাইতেন। স্তালিন ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর আর কারো সাথে নয়!
কমরেড জিনোভিয়েভ তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন, ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে ব্লাদিমির ইলিচ লেনিন এবং জোসেফ স্তালিনের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছিল তখন লেনিন প্রায় বাকশক্তিহীন। জিনোভিয়েভ বলছেন, সেটা ছিল একান্ত ব্যক্তিগত, মোটেই রাজনৈতিক নয়। কমরেড জিনোভিয়েভ ভালো করেই জানতেন এই ঘটনা উল্লেখ করার কোনো দরকার ছিল না। ঘটনাটি ছিল লেনিনের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার নিয়োগ দেয়া এবং লেনিনের কাছে যেন রাজনৈতিক খবরাখবর না পৌঁছে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পড়েছিল কমরেড স্তালিনের ওপর, আর সেটা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় কমিটিই। স্তালিন নিশ্চিত করেছিলেন কোনোভাবেও যেন লেনিন হতাশ না হন, এবং তার শারীরিক অবস্থার যেন কোনো অবনতি না হয়। এমনকি লেনিনের পরিবার থেকেও তাকে আলাদা রাখা হয়েছিল যেন পরিবার লেনিনের দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে এমন কোনো খবরও যেন কেউ তাকে না দিতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লেনিন, যে কিনা এমনটি ঘটতে পারে ভেবে সারাক্ষণই দুশ্চিন্তা করতেন, তিনি বুঝে গেলেন তাকে আসলে নিরাপত্তার জন্য এসব জানতে দেয়া হচ্ছে না। আর এসব করছে স্তালিন। স্বভাবতই তিনি স্তালিনের উপর নাখোশ হলেন। স্তালিন এই কাজের জন্য লেনিনের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন পর্যন্ত। স্তালিনও জানতেন লেনিনকে আসলে যতটা অসুস্থ ভাবা হতো তিনি ততটা অসুস্থ ছিলেন না। এই ঘটনাটির কাগজপত্র বা দলিল-দস্তাবেজ আমার কাছে ছিল, এবং আমি তা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে হস্তান্তর করেছি।
এভাবে আমি হলপ করে বলতে পারি যে স্তালিনের সাথে লেনিনের সম্পর্ক নিয়ে সকল প্রতিপক্ষ যা বলেছেন তার সাথে বাস্তবতার বিন্দু পরিমাণে মিল নেই। এই সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ যা আমৃত্যু অটুট ছিল।
– এম উলায়ানোভা
২৬ জুলাই, ১৯২৬
Izvestia Ts.K. KPSS, 1989, No. 12, p. 196.
.
২ নম্বর
স্তালিনের সঙ্গে ম্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সম্পর্ক নিয়ে মারিয়া উলায়ানোভা
কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিতসভায় আমার লেখা দরখাস্তে আমি বলেছিলাম : লেনিন স্তালিনকে যথার্থ মূল্যায়ন করতেন। আর এটাই ঠিক। স্তালিন ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মী এবং খুব ভালো সংগঠক। কিন্তু এটা ঠিক যে এই দরখাস্তে আমি স্তালিন সম্পর্কে লেনিনের সম্পূর্ণ মনোভাব বা মতামত লিখিনি। এই দরখাস্ত লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো স্তালিন এবং বুখারিনের অনুরোধে তাদের সম্পর্কে লেনিন কী ভাবেন, কী মনে করেন তাই! হয়তো এই কথাগুলোই তাদেরকে তাদের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। এই জল্পনার ভিত্তি হয়ে উঠেছিল সেই চিঠিটি যেটি স্তালিনকে লেখা লেনিনের শেষ চিঠি এবং ওই চিঠিতে দুজনের সম্পর্কের ভাঙন নির্দেশ করা হয়েছিল। চিঠিটির তাৎক্ষণিক কারণ ছিল স্তালিনের প্রতি লেনিনের চূড়ান্ত অবমাননা করার নিজস্ব সিদ্ধান্ত যা ঘটেছিল স্তালিন নাদেজদা ক্রুপস্কায়াকে লেনিনের চিকিৎসা বিষয়ে রূঢ় কথা বলার অপবাদে। এই সময় আমার মনে হয়েছিল একেবারেই ব্যক্তিগত বিষয়কে জনসম্মুখে এনেছিলেন জিনোভিয়েভ, কামেনিয়েভ এবং অন্যরা তাদের রাজনৈতিক দলবাজির স্বার্থে । অধিকন্তু লেনিনের অন্যান্য রাজনৈতিক বিবৃতি, ঘোষণা এবং তার রাজনৈতিক উইল বা উত্তরাধিকার, তার মৃত্যুর পর স্তালিনের রাজনৈতিক লাইন সবই আমাকে নির্মোহভাবে উল্লেখ করতে হয়েছে। আর এটাকে আমি ওই ঘটনাবলির প্রতি আমার দায়িত্ব বলেই মনে করেছি। এমনকি এই কাজগুলোকে আমার অন্যতম কর্তব্য মনে হয়েছে ।
স্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নিজের ওপর দারুণ নিয়ন্ত্রণ ছিল আর তিনি তা খুব ভালোভাবে গোপনও করতে পারতেন। যে কোনো কারণেই হোক তিনি যখন ভাবলেন এই ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো জনসমক্ষে প্রচার হতে দেবেন না, আমার মনে আছে তখন তিনি কীভাবে ঘরের মধ্যে নিজেকে গোপন রাখতে পারতেন এবং সমগ্র রাশিয়ার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির লোকজন যাদেরকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না তারা এলে দরজা বন্ধ করে দিতেন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে এসে উঠতেন। তিনি ওইসব লোকদেরকে আসলেই ভয় পেতেন এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না বলে ভাবতেন। আর সেটাই তাকে আপাত রূঢ় আচরণকারী বলে প্রতীয়মান করত। তার পরও তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, সংযত করতেন এবং সেই সব কমরেডদের সঙ্গে কাজ করতেও উৎসাহী হতেন, কারণ তার কাছে কাজটাই ছিল অগ্রাধিকার এর সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নেই।
ট্রটস্কির ঘটনাটিই এধরনের সম্পর্কের স্বাতন্ত্র। এক পলিটব্যুরো মিটিংয়ে ট্রটস্কি লেনিনকে ‘গুণ্ডা’ বলে বসলেন! লেনিনের মুখটা চকের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল, কিন্তু তিনি খুব দ্রুত নিজেকে সামলালেন। এতে করে মনে হয় কিছু মানুষ তাদের স্নায়ু রক্ষা করতে পারেন না। তিনি ট্রটস্কির রূঢ়তার জবাবে কিছু একটা বললেন। এটা যে কমরেড বলেছিলেন তার মধ্যে ট্রটস্কির জন্য কোনো সহানুভূতি ছিল না। এই মানুষটির অনেকগুলো স্ববিরোধী চরিত্র ছিল যার কারণে তার সাথে সৃষ্টিশীল কোনো কাজ করে যাওয়া সম্ভব ছিল না, কিন্তু তিনি একজন মহান কর্মী এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন, এবং আমি আবারও বলছি; লেনিনের কাছে কাজই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে বারে বারে লেনিন তার সাথে যথার্থভাবে কাজ করেছেন এবং করতে চেয়েছেন, যার জন্য তাকে মূল্য দিতে হয়েছে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন ট্রটস্কি এবং অন্যান্য পলিটব্যুরো সদস্যদের সঙ্গে ব্যালান্স করাটা খুবই কঠিন ছিল, বিশেষ করে ট্রটস্কি এবং স্তালিনের মধ্যে ভারসাম্য। তারা উভয়েই অতি মাত্রায় উচ্চাভিলাষী এবং অসহিষ্ণু ছিলেন। তাদের জন্য ব্যক্তিগত দিক বাদ দিয়ে কাজের কথাই ভাবা ভালো। ফ্রন্ট থেকে লেনিনের কাছে ট্রটস্কি এবং স্তালিনের টেলিগ্রাম থেকেই বোঝা যায় তাদের মধ্যে কী ধরনের সম্পর্ক ছিল, বিশেষ করে সোভিয়েত শাসনের প্রথম বছরে।
লেনিনের কর্তৃপক্ষই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করত। তাই তাদের রাগারাগি তখন ততটা প্রকাশ্য হয়নি, যতটা হয়েছিল লেনিনের মৃত্যুর পরে। কিছু ঘটনার কারণে আমার আরও মনে হয় জিনোভিয়েভের সঙ্গেও লেনিনের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না, কিন্তু তিনি বৃহত্তর কাজের স্বার্থে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেন।
১৯২২ সালের গ্রীষ্মে লেনিন যেবার প্রথম অসুস্থ হলেন, তখন আমি একদিনও বিরতি না দিয়ে লেনিনের সাথে ছিলাম, এবং আমি খুব কাছে থেকে পলিটব্যুরোর কমরেডদের সঙ্গে লেনিনের সম্পর্ক, কাজের পদ্ধতি দেখেছিলাম।কিন্তু সে সময় আমি স্তালিন সম্পর্কে লেনিনের কিছু অসন্তুষ্টির কথাও শুনেছিলাম। সেটা বলা হয়েছিল লেনিন যখন মার্টভের অসুস্থতার খবর শুনেছিলেন তখন। তিনি মার্টভের জন্য স্তালিনকে কিছু টাকা পাঠাতে বলেছিলেন।তার উত্তরে স্তালিন বলেছিলেন : আমি একজন শ্রমিকশ্রেণির শত্রুর জন্য টাকা ব্যয় করতে পারব না, এর জন্য আপনি আপনার অন্য কোনো সম্পাদক খুঁজে নিন। এটা শুনে লেনিন খুবই আশাহত এবং রাগান্বিত হয়েছিলেন। লেনিনের আশাহত হওয়া বা রাগান্বিত হওয়ার অন্য কারণও ছিল। শোকোলোভস্কি লেনিনের একটি চিঠি স্ত লিনের সামনে পড়েছিলেন যখন লেনিন বার্লিনে ছিলেন তখনকার লেখা। তাতে করে কে এবং কারা লেনিনকে অমর্যাদা করছেন সেটা গোপনই রয়ে গিয়েছিল।
১৯২০-২১ এবং ১৯২১-২২ সালের শীতে লেনিন অসুস্থ বোধ করছিলেন। তার মাথাব্যথা বেড়েছিল, আর সে কারণে কোনো কাজ করতে পারছিলেন না। তিনি পুরোপুরি উদ্বিগ্ন ছিলেন। ঠিক কখন আমার মনে নেই, তবে কোনোভাবে ওই সময় লেনিন স্তালিনকে বলেছিলেন, সম্ভবত তিনি প্যারালাইজড হয়ে যাচ্ছেন এবং এই মর্মে স্তালিনকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যে তিনি লেনিনকে পটাসিয়াম সায়োনাইড দিয়ে সাহায্য করবে! স্তালিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু লেনিন কেন স্তালিনের কাছে এধরনের নিবেদন করতে গেলেন? কারণ তিনি জানতেন স্তালিন অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষ এবং আবেগ-টাবেগকে তুচ্ছজ্ঞান করতে পারেন। স্তালিন ছাড়া আর কাউকে এই ধরনের অনুরোধ করতে পারতেন না লেনিন।
১৯২২ সালের মে মাসে তার প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পর তিনি স্তালিনের কাছে কিছু অনুরোধ করেন। লেনিন সিদ্ধান্ত নিলেন সব কিছু তার জন্যই শেষ হতে চলেছে! এই সময় তিনি চাচ্ছিলেন স্তালিন যেন অবিলম্বে তার কাছে আসেন। লেনিনের এই অনুরোধটি এতই তাৎক্ষণিক এবং গুরুত্ববহ ছিল যে কেউ এটা অস্বীকার করতে পারবে না। স্তালিন লেনিনের কাছে মাত্র ৫ মিনিট ছিলেন, তার বেশি নয়। স্তালিন বের হয়ে এসে আমাকে (উলিয়ানোভা) এবং বুখারিনকে বলেছিলেন, লেনিন তার সেই পটাসিয়াম সায়ানাইডের ‘দাবি’তে অটল রয়েছেন! যখন স্তালিনের আগেকার প্রতিজ্ঞা পালনের সময় এল তখন স্তালিন তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন! স্তালিন এবং লেনিন একে অপরকে চুম্বন করলেন এবং স্তালিন কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন!
কিন্তু এর কিছু পরেই অর্থাৎ ওই আলাপ-আলোচনার পর আমরা এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে লেনিনের সাহস-শক্তি দুইই বেড়েছে। স্তালিন পুনরায় লেনিনের কক্ষে ফিরে এলেন এবং তাকে বললেন, ডাক্তারের সাথে আলাপ-আলোচনা করে তিনি মোটামুটি সন্তুষ্ট যে কোনো কিছুই শেষ হয়ে যায়নি, এবং সে কারণে তার প্রতিশ্রুতি (পটাসিয়াম সায়ানাইড এনে দেয়া) রক্ষা করার মতো কিছু ঘটেনি এবং সময় আসেনি। লেনিন লক্ষণীয়ভাবে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, এবং স্তালিনকে বললেন, আপনি কি ধূর্ততা করলেন? এর উত্তরে স্তালিন বললেন, যেদিন থেকে আপনি আমাকে চেনেন তখন থেকেই কি আমি ধূর্ত? এর পর তারা দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন এবং লেনিনের অবস্থার খানিকটা উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত দেখা করলেন না।
এই সময়ে অন্য যে কারো চেয়ে স্তালিনই সবচেয়ে বেশি এবং নিয়মিতভাবে লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তিনিই লেনিনের কাছে আসা প্রথম ব্যক্তিও ছিলেন। লেনিন স্তালিনের সঙ্গে খোলাখুলি মিশতেন, হাসাহাসি করতেন, কৌতুক বলে মজাও করতেন, এবং আমাকে বলতেন আমি যেন স্তালিনকে মদ দিয়ে আপ্যায়ন করি। এই সময়ে তারা দুজন আমার সামনেই ট্রটস্কির প্রসঙ্গে আলোচনা-সমালোচনা করতেন। তাতে করে আমার কাছে এটা পরিষ্কার হয় যে ট্রটস্কি সম্পর্কে স্তালিনের নেতিবাচক মনোভাবকে লেনিন সমর্থন করতেন। একবার লেনিনের কাছে ট্রটস্কিকে আমন্ত্রণ করার প্রশ্ন ওঠে। এর একটা কূটনৈতিক চরিত্র ছিল ।ট্রটস্কিকে লেনিনের ডেপুটি ‘সোভানাক্রম’ বা কাউন্সিল অব পিপলস কমিশার হিসেবে অফার দেয়ার প্রসঙ্গটিও ছিল কূটনৈতিক বিষয়। এই সময়ে কমেনেভ এবং বুখারিন লেনিনের সঙ্গে দেখা করেন, কিন্তু জিনোভিয়েভ দেখা করতে আসেননি, এমনকি তিনি কখনোই আসেননি, এবং আমি যতটুকু জানি তাতে লেনিনও কখনো তার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহ বোধ করেননি।
অসুখ থেকে সেরে উঠে লেনিন তার ব্যক্তিগত অফিস কক্ষে আবার নিয়মিত কামেনেভ, জিনোভিয়েভ এবং স্তালিনের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে শুরু করেন। এ সময় আমি তাদের এই মেলামেশা বন্ধ করতে চেয়েছিলাম। তাকে ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। তারা উল্টে আমার সাথে মস্করা করে বললেন : তারা মোটেই অফিসিয়াল কিছু আলোচনা করছেন না।
এই সময়ে লেনিন জাতীয় এবং ককেশাস প্রশ্নে স্তালিনের উপর নাখোশ হয়েছিলেন। এটা জানা গিয়েছিল স্তালিনের ট্রটস্কির বিষয়ে মনোভাব থেকে। এটা পরিষ্কার যে লেনিন অর্ডজোনিকিডজে, ডেজারঝিনিস্কি এবং স্তালিনের উপর পুরোপুরি নাখোশ হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার অসুস্থ হওয়ার পর এই প্রশ্নটি তাকে অত্যাচার করেছিল। তার পেছনে অবশ্য আরও একটি কারণ ছিল ১৯২৩ সালের মার্চ মাসের ৫ তারিখে স্তালিনকে লেখা লেনিনের সেই চিঠিটি, যার কথা আমি উপমা হিসেবে নিচে বর্ণনা করেছি। ডাক্তার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন যেন তাকে (লেনিন) কোনোভাবেই পার্টির কাজকর্ম বিষয়ে না বলা হয়। সবচেয়ে ভীতিকর ছিল লেনিনের সাথে নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার আলাপ-আলোচনা।
তিনি (ক্রুপস্কায়া) কখনো কখনো লেনিনের সাথে আলাপ-আলোচনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করতেন যাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় কথাও বেরিয়ে আসত, যদিও তা সব সময়ই ছিল অনিচ্ছাকৃত এবং মনের ভুলে। পলিটব্যুরো ডাক্তারের পরামর্শক্রমে স্তালিনকে লেনিনের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিল। একদিন জানতে পারি স্তালিন এসময় টেলিফোনে ক্রুপস্কায়াকে লেনিন এবং নাদেজদা ক্রুপস্কায়া সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে ফেলেছিলেন এবং তা যেন লেনিনের কানে না যায় সে জন্য ক্রুপস্কায়াকে নিষেধও করেছিলেন, যা তাকে (ক্রুপস্কায়া) পার্টির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। এই আলোচনা ক্রুপস্কায়াকে গভীরভাবে বিরক্ত করে। তিনি পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি করতে থাকেন। এর কিছুদিন পরে তিনি লেনিনকে এই বিষয়টা সম্পর্কে ভেঙে বলেন, এবং এটাও বলেন যে তাদের (স্তালিন এবং ক্রুপস্কায়া) পুনর্মিলন হয়েছে। এর আগে স্তালিন আসলে তাকে শান্তভাবে কিছু বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ক্রুপস্কায়া সেটা নেতিবাচক মনে করে কামেনেভ এবং জিনোভিয়েভকে বলেছিলেন : স্তালিন তার সাথে ফোনে চিৎকার চেঁচামেচি করেছে! এটা সেই ককেশিয়ার ঘটনার মতোই অনেকটা।
পরদিন সকালে স্তালিন আমাকে লেনিনের অফিস কক্ষে আমন্ত্রণ করেন। তাকে বিমর্ষ এবং অপরাধী মনে হচ্ছিল। তিনি আমাকে বললেন : “আমি সারা রাত ঘুমাতে পারিনি! লেনিন আমাকে কী ভাববেন? কী মনে করবেন আমার সম্পর্কে? নিশ্চয়ই তিনি আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাববেন। আমি তাকে আমার অন্তর দিয়ে ভালোবাসি। দয়া করে কেউ তাকে এই কথাগুলো বলুন।’ আমি স্ত লিনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলাম, কেননা আমার মনে হয়েছিল স্তালিন সচেতনভাবেই দুশ্চিন্তা করছেন। এই সময় লেনিন আমার কাছে কিছু একটা চাইলে আমি তড়িঘড়ি করে তাকে বললাম, কমরেড স্তালিন তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এবং স্তালিন আমাকে অনুরোধ করেছেন আমি যেন আপনাকে বলি যে তিনি আপনাকে ভালোবাসেন। লেনিন দ্রু কুঁচকে নিশ্চুপ রইলেন। তখন আর কি? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘আমি কি কমরেডকে আপনার শুভেচ্ছা জানাব?’ লেনিন ঠান্ডা গলায় বললেন- ‘জানাও। কিন্তু আমি তখনো বলে চলেছি- ভলোদিয়া তিনি (স্তালিন) নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান… তিনি একেবারেই বুদ্ধিমান নন’ অটলভাবে বললেন লেনিন।
আমি কিছুদিন পরে এই আলোপ-আলোচনা আর অব্যাহত রাখিনি। লেনিন এটা জেনে বসে আছেন যে স্তালিন নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার সঙ্গে খুব রূঢ় আচরণ করেছেন, যেটা কামেনেভ এবং জিনোভিয়েভও জানেন। একদিন সকালে খুব বিমর্ষ লেনিন তার স্টেনোগ্রাফারকে বললেন তাকে ডেকে আনতে। এর আগে তিনি জানতে চাইলেন ক্রুপস্কায়া ইতোমধ্যে পিপলস কমিশনারেট এর ‘_রকম্প্রোস’ এর উদ্দেশে বেরিয়েছেন কিনা। এরপর ভলোদিচেভা আসার পর দেখা গেল সেই চিঠি যেটা স্তালিনকে লেখা হয়েছিল। যা ছিল পুরোপুরি গোপন এবং ব্যক্তিগত…
শ্রদ্ধেয় কমরেড স্তালিন, আপনি টেলিফোনে খুব রূঢ় আচরণ করেছেন, তাকে বিদ্রূপ করেছেন।এমনকি সে ওই ঘটনাটি ভুলে যাওয়ার জন্য সম্মতি প্রকাশ করেছেন, কিন্তু তার পরও তার মাধ্যমে এটা কামেনেভ এবং জিনোভিয়েভের গোচরীভূত হয়েছে। আমি খুব সহজে এটা ভুলতে পারছি না যে এটা আমার বিরুদ্ধে এবং আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে, শেষ পর্যন্ত আমি মনে করি এটা আমার বিরুদ্ধে।
যা হোক আজ জানতে চাই আপনি ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে তৈরি আছেন কি না, নাকি আমাদের সম্পর্কচ্ছেদকেই শ্রেয় মনে করেন?
শ্ৰদ্ধাসহ
ভ.ই. লেনিন
৫/IIIl- ২৩
লেনিন ভলোদিচেভাকে বললেন, চিঠিটা ক্রুপস্কায়াকে না জানিয়ে স্তালিনের কাছে পাঠাতে, এবং চিঠির একটি কপি সিলগালা করা খামে ভরে যেন আমাকে দেয়া হয়। আমি ফিরে আসার পর দেখলাম লেনিন অসুস্থ অবসন্ন, কারণ ক্রুপস্কায়া কীভাবে যেন জেনে ফেলেন কিছু একটা ঘটেছে। তিনি ভলোদিচেভাকে অনুরোধ করলেন চিঠিটা যেন না পাঠানো হয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্তালিনের সঙ্গে কথা বলবেন এবং তাকে ক্ষমা চাইতে বলবেন। যেটা এখনও ক্রুপস্কায়া বলছেন, কিন্তু আমি মনে করি তিনি চিঠিটি দেখেননি এবং সেটা স্তালিনের কাছে লেনিনের ইচ্ছানুযায়ী পাঠানো হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে স্তালিন চিঠির উত্তর দেননি এবং ডাক্তার আর ক্রুপস্কায়া কেউই এইমুহূর্তে লেনিনের কাছে সেটা দিতে নিষেধ করেছিলেন। তার শরীরের যা অবস্থা তাতে করে তার কাছে এধরনের কিছু দেয়া ঠিক হবে না। এবং স্তালিন যে তাকে চিঠি দিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন সেটা আর লেনিনের জানা হলো না।
যা হোক, লেনিন যে স্তালিনের প্রতি বিরক্ত সেটা এক জিনিস আর আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি তিনি যে স্তালিনকে বলেছিলেন- ‘মোটেই বুদ্ধিমান নন’ সেটা অন্য জিনিস! সেটা বলার সময় লেনিন বিরক্ত ছিলেন না। সেটা ছিল স্তালিন সম্পর্কে তার অভিমত যা তিনি আমাকে বলেছিলেন। এই অভিমত এটা খণ্ডন করে না যে লেনিন স্ত লিনকে অত্যন্ত মূল্যবান একজন পার্টি কর্মী মনে করেন। তিনি পুরোপুরিভাবে মনে করতেন সব চেয়ে প্রয়োজনীয় হলো কে পার্টিতে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। তার পরও কিছু প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ তার ওপর থাকা উচিত বলেও তিনি মনে করতেন। এবং তিনি চাইতেন স্তালিন যেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক না থাকেন। সেটা অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে আলোচনায় প্রকাশ পেলেও তার মৃত্যুর আগে কখনোই চিঠি বা মৌখিক আদেশ আকারে পার্টির কাছে আসেনি। সৌজন্যে : ‘Izvestia Ts.K. KPSS 1989, No. 12, pp. 196-199.
.
মন্তব্য : ১৯২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) কেন্দ্রীয় কমিটির দুটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয় অসুস্থতার কারণে যেখানে লেনিন যোগ দিতে পারেননি।
পরিশিষ্ট
ভ. ই. লেনিনকে লেখা জোসেফ স্তালিনের চিঠি
৭ মার্চ, ১৯২৩
স্তালিনের পক্ষ থেকে কমরেড লেনিনকে
ব্যক্তিগত
কমরেড লেনিন,
পাঁচ সপ্তাহ আগে নাদেজদা কনস্টান্টিনোভার সঙ্গে আমার একটি কথোপকথন হয়েছিল। ওই কথোপকথনে নাদেজদাকে আমি শুধুমাত্র আপনার স্ত্রী ভাবিনি, বরং আমার সিনিয়র পার্টি কমরেড মনে করেছি। আমি তাকে টেলিফোনে যা বলেছিলাম তা অনেকটা নিম্নোক্ত বক্তব্যের মতো:
ডাক্তারদের কিছু গোপন বা নিষিদ্ধ তথ্য ছিল লেনিনকে দেয়ার জন্য। তারা মনে করতেন কমরেড লেনিনকে সুস্থ করে তোলার জন্য এগুলো বেশ ভালো। উপায়। অথচ আপনি (নাদেজদা কনস্টান্টিনোভা) সেই রুটিন অগ্রাহ্য করলেন, লেনিনের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললেন, যা গ্রহণযোগ্য ছিল না।
আমি মনে করি না ওই কথাগুলো যে কোনোভাবে রূঢ় এবং আপনার বিরুদ্ধাচারণ, বরং নাদেজদার দ্রুত নিরাময়ের উপায়ের চেয়ে আমার নেয়া পদক্ষেপগুলো বরং বেশি কার্যকর ছিল। যা হোক, নিয়মিত রুটিন পালিত হচ্ছে কি-না সেটা দেখা আমার দায়িত্ব ছিল। নাদেজদা কনস্টান্টিনোভাকে দেয়া আমার ব্যাখ্যা নিশ্চিত করেছে যে এখানে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি ছাড়া আর কিছু ছিল না।
আপনি যদি মনে করেন আমাদের সম্পর্ক রক্ষার্থে আমার ওই কথাগুলো ফিরিয়ে নেয়া উচিত সেক্ষেত্রে আমি আমার বক্তব্য ফিরিয়ে নিতে রাজি, কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমার অপরাধ কোথায়, এবং আমার কাছ থেকে আসলে কী চাওয়া হচ্ছে।
জে. ভি. স্তালিন
সৌজন্যে : ‘Ivestia TSK KPSS, 1989, No. 12. p. 193.