৭.
শরিফার বাড়িতে রাতে পোলাও মাংস রাঁধা হয়। আতাহার সোফায় বসে হাঁক দেয়—কই, মেহমানদের ডাক, সারাদিন ঘুরছে বেচারারা। খাইয়া শুইয়া পড়ুক।
পোলাও মাংস খেতে কল্যাণীর রুচি হয় না। বিরুই চালের লাল ভাত, সর্ষে বাটা ইলিশ, চেপা শুটকির ভর্তা, কই মাছ ভাজার জন্য একটি হা-পিত্যেস তার জিভের তলে থেকে যায়। শরিফা তার বাড়ির মেহমানদের জন্য বেঁধেছে। খাবার টেবিলে বসে ‘রান্না খুব স্বাদ হয়েছে তো!’ বলে কল্যাণী দীপনকে মুখে তুলে দেয় খাবার। শরিফা তার ছেলে-মেয়েদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলে—লোপার আব্বা বলছিল মেহমানদের চায়নিজ খাওয়াইয়া দেও। তিনটা চায়নিজ রেস্টুরেন্ট হইছে ময়মনসিংহে।
কল্যাণী বলেনা—না না। চায়নিজ খাওয়াতে হবে কেন। ঘরের খাবারেই তো স্বাদ বেশি। আর চিনাদের খাবার আমার মোটেও ভাল লাগে না।
আতাহার সোফায় বসে টেলিভিশন দেখতে দেখতে কল্যাণীর উদ্দেশে বলে—আসাদ মার্কেট গেছিলেন? ভাল মার্কেট। কাপড়-চোপড়ও সস্তায় পাওয়া যায়। রিকশারে কইলেই তো নিয়া যাইতে পারে।
—আসলে মার্কেটে যাবার তেমন ইচ্ছে ছিল না।
—ও, আপনাদের শহরে তো আবার মার্কেট আছে ভাল।
—সে কারণেও না। আসলে কেনাকাটার জন্য তো ঠিক আসিনি।
—ও, সেইটা বলেন। তা, আজ কুথায় কুথায় গেলেন?
কল্যাণী খাবার টেবিলে দীপনকে খাওয়াচ্ছিল। রাতের খাবার এখনও দীপন মায়ের হাতেই খায়। এ এক অদ্ভুত শখ ওর। দীপনকে খাওয়াতে খাওয়াতেই কল্যাণী উত্তর দেয়—কালিবাড়ি, কলেজ রোড, শ্মশানঘাট…
—কালিবাড়িতে দেখলেন কী, আপনাদের বাড়ি-টাড়ি তো নাই নাকি!
—বাড়িটা নেই। কিন্তু সেই মাটি তো আছে। আর আছে একটি জামগাছ।
—জামগাছ? জামগাছ দিয়া ত করার কিছু নাই এখন। পরিবার পরিকল্পনার সরকারি অফিস-টফিস বোধ হয় হইছে। তা জায়গা জমি কি পাওয়ার কোনও…
—আমি ভিটে মাটির দাবি করতে আসিনি। এমনি দেখতে এসেছি।
—ও।
—কলেজ রোডে কী ছিল। আত্মীয়-টাত্মীয়ের বাড়ি-টাড়ি…
—না। আত্মীয় কেউ নেই তো এখানে। দূরসম্পর্কের দুই কাকা ছিলেন, তাঁরা যে কোথায় কে জানে। চিটাগাং মাসির বাড়ি ছিল। নেই আর, মেসো মাসি দুজনই মারা গেছেন। গোপীবাগে এক আত্মীয় ছিলেন, ওঁরাও শুনেছি গত বছর কলকাতায় চলে গেছেন।
—এই দেশের হিন্দুরা ত ফাঁক পাইলেই ইন্ডিয়া চইলা যায়। টাকা পয়সা এই দেশে রাখে না। যা পায় পাঠাইয়া দেয়। জমিও কেনে না, বাড়িও করে না। সবারই ইন্ডিয়া যাওয়ার তাল।
কল্যাণী মুখ নিচু করে প্লেটের পোলাও নাড়ে। আতাহার চোখ সরায় না। বলে—আপনার স্বামী আসলো না কেন?
—ওর কাজের খুব চাপ তো, তাই।
—কি চাকরি করেন ভাইসাব?
—ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার।
—তা ভাইসাব তো ওইখানেরই। নাকি এইখান থেকে যাওয়া?
—ও ওখানকারই। মেদিনীপুরের।
—উনি আপনারে একলা আসতে দিলেন?
—কে ?
—আপনার স্বামী?
—না দেবার কী আছে?
—তা অবশ্য ঠিক। কলকাতার মেয়েমানুষেরা ত একটু অন্যরকমই। ড্যাম কেয়ার, ঠিক না?
আতাহার খিক খিক করে হাসে। শরিফা আতাহারের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে—ডেসপারেট মেয়েলোক ত তুমি পছন্দ কর না মুখে কও, তলে তলে ঠিকই পছন্দ কর।
শরিফার কথায় মোটে না তাকিয়ে আতাহার জিজ্ঞেস করে—শ্মশানে কী করলেন গিয়া?
—কিছু না। দাঁড়িয়েছিলাম।
—দাঁড়াইয়াছিলেন? খালি খালি দাঁড়াইয়া থাকে বুঝি মানুষ? হা হা হা।
কল্যাণী খুব অবাক হয়ে আতাহারের মুখে তাকায়। ঠোঁট থেকে তার হাসিটি যায় না।
—আমরা তো আজমির শরীফ যাইতে চাইতেছি। দেখি সামনের বছর পারি কি না। আতাহার বুকের লোমে হাত বুলোতে বুলোতে বলে।
—শরিফাও নিশ্চয়ই যাবে?
কল্যাণী শরিফার মুখে তাকায়। স্বেদ জমেছে তার কপালে চিবুকে।
—ওর ঠিক নাই। ছেলে মেয়ে কার কাছে রাইখা যাইব! ও মনে হয় পারব না। আপনাদের বাড়ি ত সল্টলেকে। সল্টলেকটা কলকাতার উত্তর না দক্ষিণে?
—কলকাতা গেলে যাবেন। আমি ঠিকানা দিয়ে যাব।
শরিফা কল্যাণীর পাশের চেয়ারে বসে থাকে, বাচ্চা, মেহমান এবং স্বামীকে খাইয়ে পরে খাবে সে। একসঙ্গে খেতে সাধে কল্যাণী। শরিফা মাথা নেড়ে বলে—আগে খাওয়ার অভ্যাস নাই।
—আজ আমার সঙ্গে খা। অভ্যেসটা একদিনের জন্য চেঞ্জ করা যায় না?
শরিফা চোখ নামিয়ে বলে—কত অভ্যাস পাল্টাইতে হইল। নতুন কইরা অভ্যাস করলে পরে…
—বল কি পরে? কি হবে?
—না থাক। কিছু না।
—কিছু তো বটেই শরিফা। আমাকে যেন কি লুকোচ্ছিস তুই। আমাকে বুঝি পর ভাবিস?
কল্যাণী চেপে ধরে শরিফার বাম হাত। হাতটি আলগোছে ছাড়িয়ে নিয়ে শরিফা বলে—আসলে আমার ক্ষিধাই হয় নাই এখনও।
—তোর কি শরীর খারাপ?
—না। না।
—তবে কি মন খারাপ?
—মন?
শরিফা ম্লান হাসে।
আতাহারের কণ্ঠে কিছু শ্লেষ কিছু অহঙ্কার খেলা করে—আমাদের টেলিভিশন দেখছেন নাকি? ভাল নাটক হয় কিন্তু। আইজও আছে নাটক, আসেন, দেখেন। বাবরি মসজিদের খবর-টবরও কন। ওই দেশে তো আপনারা আমাদেরে কচুকাটা করতাছেন।
—আপনাদের মানে? কল্যাণী জিজ্ঞেস করে।
—আমাদের মানে মুসলমানদের আর কী।
পোলাও মাংসের ওপর যে আঙুলগুলো নড়ছিল কল্যাণীর, আর নড়ে না। ঢকঢক করে জল খায় সে। কতদিনের তৃষ্ণা তার জলের, তৃষ্ণা তবু মেটে না। দীপনের খাওয়া হয়ে গেলে শুতে যায় ঘরে। কল্যাণী হঠাৎই বলে—শরীরটা ক্লান্ত লাগছে শরিফা। তুই খেয়ে নিস। আমি বরং শুয়ে পড়ি।
শরিফা মাথা নেড়ে সায় দেয়। সম্ভবত তার স্বামী যে আড্ডার আয়োজন করছে। সেটিকে আর না বাড়তে দিয়ে ঘরে গিয়ে কল্যাণীর খিল এঁটে শুয়ে পড়াই উচিত বলে সে মনে করছে।
পরদিনও কাক-ডাকা ভোরে ওঠে কল্যাণী। উঠেই দীপনকে বলে ‘চল চল তৈরি হও’। এবারও আগের দিনের মত দীপন ভেবেছিল কল্যাণী বুঝি আজও তাকে নিয়ে রোদ্দুরে হাঁটতে যাচ্ছে। মুখ চোখ ধুয়ে শাড়ি পাল্টে সিঁথিতে সিঁদুর পরতে গিয়ে কল্যাণীর আঙুল কেঁপে ওঠে। সিঁদুর আর পরে না সে। আঙুলের লালটুকু আঙুলেই মুছে নেয়। ট্রেজার আইল্যান্ড থেকে শরিফার জন্য কিছু শাড়ি কিনেছিল কল্যাণী, বার করবে—সে মনেই ছিল না। শরিফাকে ডেকে শাড়িগুলো হাতে দিয়ে কল্যাণী বলে—এগুলো তোর জন্য। বাচ্চাদের জন্য কিছুই আনিনি। আসলে কী জানিস শরিফা, আমার মত তুইও যে বড় হয়েছিস, মেয়ে বিয়ে দিয়েছিস, এরকম মনেই হয়নি আমার। কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল তোর বয়স বোধ হয় সেই ষোল-সতেরোই আছে।
বিছানার এলো চাদরটি গুছিয়ে রেখে কল্যাণী বলে—কলকাতার ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি, কখনও গেলে আমাদের বাড়িতে যাস। তোদের খুব কষ্ট দিয়ে গেলাম, তাই না?
শরিফা হাই তুলে বলে—না না কিসের কষ্ট? নাস্তা-টাস্তা খাইয়া গেলে ভাল হইত না?
—নারে, খাওয়া-দাওয়ায় আমার মন একেবারেই নেই।
শরিফা, হঠাৎ, কল্যাণী জানে না কেন, কল্যাণীর হাত ছোঁয়। কল্যাণী চমকে ওঠে। এ কি বালিকাবেলার সেই হাত যে হাত তাকে ছুঁয়ে রাখত দিবস রজনী? হাতটি, কল্যাণী চায়, তাকে ছুঁয়ে থাকুক আরও। তাকে তিরিশ বছর আগের মত নিবিড় করে একবার জড়িয়ে ধরুক এই হাত। শরিফার হাতের ওপর কল্যাণী তার হাতখানা রাখে। হাতখানা খানিকটা কাঁপেও তার। কথা বলতে গিয়ে দেখে চোখ তার কাতর হয়, অকারণ জল চলে আসে চোখে, জল আড়াল করতে সে হাসে। বলে—হ্যাঁরে শরিফা, নদীতে আর জল হবে না? আগের মত থইথই জল?
শরিফা তার হাতটি সরিয়ে এলো চুলের গোছা পিছনে টেনে হাতখোপা করতে করতে বলে—নদীর স্বভাব কী আর আমি জানি? কল্যাণী মনে মনে ভাবে—মানুষের স্বভাবও মানুষ জানে না। ব্রহ্মপুত্রের মত তার জন্মের শহরের মানুষগুলোকেও বড় ঘোলা, বড় শীর্ণ, বড় দুঃখী মনে হয়।
কল্যাণী যখন বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ানো শরিফাকে পিছনে ফেলে রাস্তায় নামে, আলহামদুলিললাহ হিরাব্বিল আল আমিন…সুরটি হঠাৎ থেমে যায়, বোঝে সে অনেকগুলো পলক না-ফেলা চোখ তাকে যতদূর দেখা যায়, দেখছে। স্ট্যান্ডে বাস ছিলই দাঁড়ানো। এবারও জানালার কাছে দুটো সিট নেয় সে। বাস চলতে শুরু করলে দীপন জিজ্ঞেস করে—আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি মা?
—কলকাতায়।
—এই বাস কলকাতা যাবে?
—না। বাসে ঢাকা যাব। ঢাকা থেকে প্লেনে চড়ে সোজা কলকাতা। টিকিটটাও রিকনফার্ম করতে হবে।
কল্যাণী জানালায় উদাস তাকিয়ে উত্তর দেয়।
দীপন আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করে—কেন, তোমার বাড়ি দেখব না? পুকুরে সুইমিং করব, গাছে উঠে নিজের হাতে আম পেড়ে খাব ভেবে রেখেছি। ছোটবেলায় তুমি যে ঘরে ঘুমোতে, যে মাঠে খেলতে, দেখাবে না?
—এ শহরে খুব বড় ভূমিকম্প হয়ে গেছে দীপন। বাড়িঘর সব ভেঙে পড়েছে। আগের কিছুই আর নেই।
—‘লাস্ট ডেইজ অব দ্য পম্পেই’-এর মত ভূমিকম্প?
—হ্যাঁ হ্যাঁ সেরকম।
—আর গাছগুলো?
—ঝড়ে উড়ে গেছে। টর্নেডো হলে কিছু থাকে, বল?
—তুমি না শশিকান্তর রাজবাড়ি দেখাবে বলেছিলে?
—ওই যে বড় বড় শিরিষ গাছের তলে একটি গেট, ভিতরে হলুদ প্যালেস, প্যালেসের সামনে মার্বেল পাথরের শাদা একটি মূর্তি, গেটের দারোয়ান বলে দিল পারমিশন ছাড়া ভিতরে ঢোকা যাবে না—সেটিই তো শশি লজ।
—আর মুক্তাগাছার মণ্ডা? কলকাতায় কতজনকে বলে এলে মণ্ডা নিয়ে যাবে! ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে ভাল মিষ্টি!
—ওহো সে তো ভুলেই গিয়েছি!
—আর রেসকোর্স? ঘোড়ার পিঠে চড়ব না?
—রেসকোর্স তো ঢাকায়! ঢাকার কি পথঘাট চিনি?
দীপনের বিস্ময় কাটে না। খোলা হাওয়া দীপনের চুল উড়িয়ে নেয়।
—আর ব্রহ্মপুত্র? তোমার নদী? নৌকোয় ঘুরে বেড়াব না?
দীপন প্রায় লাফিয়ে ওঠে। যেন ব্রহ্মপুত্র দেখবে বলে এখনই বাস থামিয়ে তাদের নেমে পড়া উচিত।
—ব্রহ্মপুত্র? ব্রহ্মপুত্র অন্য বাঁকে চলে গেছে রে দীপন। আগের জায়গায় আর নেই।
—আগের জায়গায় নেই?
—না।
দীপনের তবু বিস্ময় কাটে না। খোলা হাওয়া যতবার এলো করে দেয় তার চুল, কল্যাণী আঙুলে আঁচড়ে দেয়।
—তুমি না দু সপ্তাহ থাকবে বলেছিলে? দীপন প্রশ্ন করে।
—খুব জরুরি একটা কাজ ফেলে এসেছি বাবা, আগে মনেই পড়েনি, না গেলে হচ্ছেই না।
—স্কুলের কাজ বুঝি?
—হ্যাঁরে।
দীপন অনেকক্ষণ চুপ থেকে কল্যাণীর গা ধরে নাড়া দেয়। —তুমি তখন কাঁদছিলে কেন মা? ওই গাছের তলায়? ওরা তোমাকে বকছিল বুঝি?
কল্যাণী দীপনকে দু হাতে নিবিড় করে জড়িয়ে বলে—ছি ছি ওরা বকবে কেন! আমার মা’র কথা খুব মনে পড়ছিল তো, তাই কান্না চলে এসেছিল। দেখলে না এক ভদ্রলোক এসেও বললেন ওঠ মা কারও বাড়িতে বস খাও দাও বিশ্রাম নাও! ভদ্রলোক দেখতে ঠিক আমার ঠাকুরদার মত।
—তোমারও ঠাকুরদা ছিল বুঝি?
—বাহ কেন থাকবে না? আমি কি আকাশ থেকে পড়েছি? তারপর ধর স্বপন, দেখেছ ও কেমন আদর-যত্ন করল? বাড়ি নিয়ে কত কিছু খাওয়াল-দাওয়াল। কত কথা বলল। তাই না দীপন? বাবাকে আর দিদিকে বলো ওরা খুব আদর করেছে তোমাকে।
দীপন মাথা নেড়ে আচ্ছা বলে।
—আর স্বপনের ছেলেটা? কী যেন নাম ওর?
—সৌখিন।
—ওর সঙ্গে খেললেও তো তুমি। খেললে না?
—হ্যাঁ।
—ওকে তোমার ভাল লাগেনি?
দীপন হেসে বলে—লেগেছে।
বাস চলছে। ত্রিশাল ছাড়িয়ে ভালুকার দিকে, বাইরের লু হাওয়া কল্যাণীর নাকে মুখে ঝাপটা দেয়। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে তার ছেলেকে ডাকে—দীপন।
ফসল উঠে যাওয়া নিঃস্ব ক্ষেত থেকে চোখ তুলে দীপন বলে—কী মা?
—তোমার শরিফা আন্টি কিন্তু তোমাকে খুব পছন্দ করেছে। বলেছে দীপন খুব লক্ষ্মী ছেলে, তোমার জন্য দেখলে না নিজের হাতে পোলাও কোরমা রেঁধেছে! তোমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবার টাকাও দিয়েছে আমার হাতে। বাবাকে বোলো ও আমাদের খুব যত্ন করেছে, কেমন?
কল্যাণীর মুখের দিকে দু চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে দীপন তাকায়। তাকিয়ে থাকে, কল্যাণী তার চুলে আবার আঙুল বুলোয়, সে ঘাড় কাত করে বলে—আচ্ছা।
শরিফা কি কিছু বলতে চেয়েছিল? কল্যাণীর বারবারই মনে পড়ে। নিশ্চয়ই সে কিছু বলবে বলে তাকে ছুঁয়েছিল, হাতটি টেনে চুলে হাতখোপা করল, কল্যাণী স্পষ্ট দেখল, শরিফা আঁচলে মুখ মুছল। ও কি সেই সঙ্গে চোখের জলও কিছু মুছল! কল্যাণীর বিশ্বাস হয় শরিফা চোখের জল মুছেছে। সেই আঠারো বছর বয়সে হরিনারায়ণ যখন দেশ ছাড়াচ্ছিলেন, শরিফা কেঁদেছিল, এবার যখন নিজেই সে আবার দেশ ছাড়ছে, শরিফা কাঁদবে না কেন? লুটিয়ে পড়ে কাঁদবার সেই বয়স হয়ত নেই কিন্তু সেই মন তো আছে, মন কি কেউ বদলাতে পারে? শরিফাকে না হয় স্বামী সংসারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, তাই বলে কি সে ভুলে গেছে সেই ধুলোখেলা? সেই খেলাধুলো? সেই ডুব সাঁতারের সারা দুপুর? দামাল দুটো মেয়ের গাছে চড়ে বেড়ানো, শহরময় ঘুরে বেড়ানো, উড়ে বেড়ানো? ক্লাসে নীলডাউন করিয়ে রাখতেন ইংলিশ টিচার, বলতেন—তোদের যা কথা আছে এর পর থেকে ক্লাসের বাইরে সেরে আসবি, ক্লাসে বসে ফিসফিস চলবে না।
বাইরে কি আর সব কথা সারা যায়! কথা বলবার সময় ইংলিশ টিচারের ঠোঁটের কোণ বেয়ে কি করে পানের রস গড়ায়, কি করে ওয়ার্ডসওয়ার্থের ড্যাফোডিল পড়াতে গিয়ে ঝিমোন তিনি, কেউ হাসলে হাহা করে তেড়ে আসেন ডাস্টার নিয়ে—দেখে হাসি কী আর জমা রাখা যায় ক্লাসের বাইরের জন্য! ভিতরেই খিলখিল হাসির সঙ্গে অনর্গল ছড়া বানানো চলত, মালবিকা নামের এক মেয়ে ছিল, মুখে মুখে ছড়া বানাতে জানত, কল্যাণীদের দুষ্ট বেঞ্চে সেও এসে যোগ দিত, ঝুটি বাঁধা চুল দুলিয়ে বলত—‘আবদুল কাদের মোল্লা, খান রসগোল্লা, ক্লাসে বসে ঘুমোন তিনি, পরীক্ষায় এবার জানি, আমরা পাব গোল্লা।’ মালবিকা সেবার ইংলিশে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিল, কাদের মোল্লা থুতনির নিচের ছাগলদাড়ি নেড়ে, মাথায় জিন্নাহ টুপি পরে একদিন ক্লাসে এলেন, মালবিকাকে ডেকে বললেন—‘মালবিকা ইংলিশে সাতাত্তর পেয়েছে। আজ ওর অনারে মিষ্টি খাওয়া হবে। তোরা সব হাততালি দে।’ শরিফার নিশ্চয়ই মালবিকার কথা মনে আছে। থাকবে না কেন? মানুষ কি মানুষকে ভুলতে পারে কখনও! বাসের লোক ভাড়া চাইতে আসে। কল্যাণী ক্লান্ত হাতে ব্যাগ খোলে। টেলিফোন ইনডেক্স, হিসেবের কাগজ, নাম ঠিকানা লেখা চিরকুট, সুটকেসের চাবি, পুরনো বিদ্যুৎ বিল, ছোট একটি চিরুনি, চুলের ক্লিপ, রুমাল, চারটে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট, পাসপোর্ট, বিমানের টিকিট সব আছে—কেবল টাকা ক’টি নেই। প্রথম দিনই খুচরো কিছু বাইরে রেখে হাজার তিনের মত হাতব্যাগের ছোট পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিল। পুরো ব্যাগ ঝেড়ে উপুড় করেও টাকা সে পায় না। অসাবধানে কোথাও হয়ত পড়ে গেছে, রাস্তায়, রিক্সায়, মাঠে, বাসে কোথাও হবে। মানুষ কী আর আটকে পড়ে কোথাও, গায়ের ওপর জাল পড়লেও ছাড়ানো যায়, এই সামান্য সমস্যাটি কী করে ঘোচানো যায় ভাবতে ভাবতে কল্যাণী তার গলায় পরা সোনার চেইনটির ওপর হাত রাখে।
khubi sundor lekha. Ami bangladesh kokhono dekhini kintu aj bideshe bose amar Hooghly jelar Baidyabati gramer 40/45 bochor ager ghotonar sathe besh mil pelam.