৭. রংধনু কী?

সপ্তম অধ্যায় – রংধনু কী? 

গিলগামেসের মহাকাব্যটি পৃথিবীর প্রাচীনতম লিখিত কাহিনির একটি। গ্রিক বা ইহুদিদের পুরাণ থেকেও যা আরো প্রাচীন। এটি সুমেরীয় সভ্যতার একটি প্রাচীন বীরোচিত পুরাণ-কাহিনি। সুমেরীয় সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায় [৫০০০ থেকে ৬০০০ বছর আগের মধ্যবর্তী সময়ে]। সুমেরীয় পুরাণে গিলগামেস ছিলেন একজন মহান বীর ও রাজা, খানিকটা ব্রিটিশ কিংবদন্তির রাজা আর্থারের মতো, যেখানে আসলেই কেউই জানেন না তাঁর অস্তিত্ব ছিল কিনা, কিন্তু তাঁকে নিয়ে বহু কাহিনির অস্তিত্ব আছে। গ্রিক বীর ওডিসিউস [ইউলিসিস] আর আরব বীর নাবিক সিন্দবাদের মতো, গিলগামেস একটি মহাকাব্যিক অভিযানে বের হয়েছিলেন, তাঁর সেই অভিযাত্রায় তিনি বহু অদ্ভুত জিনিস আর বিচিত্র চরিত্রের মানুষের দেখা পেয়েছিলেন। যাঁদের মধ্যে ছিলেন বৃদ্ধ একজন ব্যক্তি [একজন খুবই বৃদ্ধ ব্যক্তি, বহু শতাব্দী ছিল তাঁর বয়স] যাঁর নাম ছিল উটনাপাশটিম, গিলগামেসকে যিনি তাঁর নিজের সম্বন্ধে একটি গল্প বলেছিলেন। বেশ, গিলগামেসের কাছে বিষয়টি অদ্ভুত মনে হয়েছিল, কিন্তু আপনাদের কাছে সেই গল্পটি মোটেও অদ্ভুত মনে হবে না, কারণ এ ধরনের গল্প আপনার এর আগেই শুনেছেন, ভিন্ন নামের অন্য আরেকজন বৃদ্ধ মানুষকে নিয়ে। 

উটনাপাশটিম গিলগামেশকে একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন, যা ঘটেছিল বহু শতাব্দী আগে। যখন দেবতারা মানবজাতির ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কারণ তারা এত বেশি হট্টগোল করছিল যে দেবতাদের ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল। 

প্রধান দেবতা, এনলিল, প্রস্তাব করেছিলেন, পৃথিবীতে তাঁদের একটি মহাপ্লাবন পাঠানো উচিত, যা সবকিছু ধ্বংস করবে, দেবতারা রাতে শান্তিমতো ঘুমাতে পারেন, কিন্তু পানির দেবতা, ইয়া, উটনাপাশটিমকে সতর্ক করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি উটনাপাশটিমকে তাঁর বাড়ি ভেঙে ফেলে একটা নৌকা বানাতে বলেন। তবে সেটিকে অনেক বড় নৌকা হতে হবে, কারণ সেখানে তাঁকে ‘সব জীবিত প্রাণীর বীজ’ বহন করতে হবে। তিনি ঠিক সময়ের আগেই নৌকার নির্মাণকাজ শেষ করেছিলেন, এরপর প্রায় ছয় দিন আর ছয় রাত ধরে অবিরাম বৃষ্টি ঝরেছিল। এরপর যে বন্যা হয় সেটি প্রতিটি জীবসহ সবকিছুই নিমজ্জিত করেছিল, শুধুমাত্র উটনাপাশটিমের নৌকার মধ্যে নিরাপদে যারা ছিল, তাদের ছাড়া। সপ্তম দিনে বাতাসের তেজ কমে পানি শান্ত ও সমতল হয়েছিল। 

উটনাপাশটিম খুব শক্ত করে বন্ধ রাখা নৌকার একটি ছোট জানালা খুলে একটি কবুতরকে মুক্ত করে দেন, সেটি উড়ে যায় স্থলভূমি খুঁজতে, কিন্তু সেটি কিছুই খুঁজে পায় না এবং ফিরে আসে, এরপর উটনাপাশটিম সোয়ালোকে উড়িয়ে দেন, সেটিও ফেরত আসে ব্যর্থ হয়ে। অবশেষে তিনি একটি কাককে উড়িয়ে দেন। সেটি আর ফিরে আসে না, এর মানে উটনাপাশটিম বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই শুষ্ক ভূমি কোথাও-না-কোথাও আছে, আর কাকটি সেটি খুঁজে পেয়েছে। 

অবশেষে নৌকাটি পানির নিচ থেকে বের হয়ে থাকা একটি পর্বতের চূড়ায় এসে থামে। আরেকজন দেবতা, ইশতার, প্রথম রংধনু সৃষ্টি করেছিলেন দেবতাদের প্রতিজ্ঞা হিসেবে, আর কোনোদিনও এমন ভয়াবহ প্লাবন পাঠানো হবে না। সুমেরীয়দের সেই প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে এভাবে রংধনুর জন্ম হয়েছিল। 

বেশ, আমি বলেছিলাম যে গল্পটা পরিচিত মনে হতে পারে। খ্রিস্টান, ইহুদি বা ইসলামি দেশগুলোয় প্রতিপালিত হওয়া সব শিশুরা সাথে সাথেই শনাক্ত করতে পারবেন নোয়া’র [নুহের] আর্ক সংক্রান্ত আরো সাম্প্রতিক কোনো গল্প, হয়তো শুধুমাত্র একটা বা দুটি ছোট পার্থক্য ছাড়া। নৌকানির্মাতার নাম উটনাপাশটিম থেকে বদলে হয়েছে নোয়া। কিংবদন্তির বহু দেবতা রূপান্তরিত হয়েছে ইহুদিদের গল্পের একটিমাত্র দেবতায়। সব জীবিত প্রাণীর বীজ রূপান্তরিত হয়েছে ‘জীবন আছে এমনসব প্রাণী’, প্রতিটি ধরনের একজোড়ায়। অথবা, গানে যেমন করে বলা হয়েছিল, প্রাণীরা ‘জোড়ায় জোড়ায় নৌকায় ঢুকেছিল এবং গিলগামেশের মহাকাব্যও এমনকিছু বোঝাতে চেয়েছিল। বাস্তবিকভাবে, খুব স্পষ্ট যে ইহুদিদের এই নোয়ার কাহিনি উটনাপাশটিমের পুরনো কিংবদন্তির পুনঃকথন। এটি সেই লোককথা যা বহু শতাব্দী ধরে মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে, হাতবদল হয়েছে, সীমানা অতিক্রম করেছে, সাধারণত এখানে কিছু নাম আর খুঁটিনাটি বিষয় বদলেছে। আর এটি, উভয় সংস্করণই শেষ হয়েছে রংধনু দিয়ে।

গিলাগামেশের পুরাণ মহাকাব্য ও বুক অব জেনেসিস, দুটোতেই রংধনু পুরাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জেনেসিস বিশেষভাবে এটিকে নির্দিষ্ট করেছে ঈশ্বরের ধনুক হিসেবে, যা তিনি আকাশে রেখেছিলেন নোয়া ও তাঁর উত্তরসূরিদের দেয়া তাঁর প্রতিজ্ঞার স্মারক হিসেবে। 

নোয়ার কাহিনি ও আরো প্রাচীন উটনাপাশটিমের সুমেরীয় কাহিনির মধ্যে আরো একটি পার্থক্য ছিল। নোয়ার সংস্করণে মানুষের ওপর, ঈশ্বরের অসন্তুষ্টির কারণ ছিল আমরা মানুষেরা সবাই অনিরাময়যোগ্য দুষ্ট প্রকৃতির। সুমেরীয় গল্পে মানবজাতির অপরাধ, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন অপেক্ষাকৃত অনেক কম গুরুতর ছিল, আমরা শুধুমাত্র এত বেশি শব্দ করতাম যে দেবতারা শান্তিতে ঘুমাতে পারত না। আমার কাছে বিষয়টি হাস্যকর মনে হয়। আর দেবতাদের জাগিয়ে রাখা হট্টগোলপ্রিয় মানুষের কাহিনির মূল ভাবটি, পুরোপুরি স্বতন্ত্রভাবেই এটি আবির্ভূত হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলের কাছে সান্তাক্রুজ দ্বীপের চুমাশ আদিবাসীদের মধ্যে। 

চুমাশ আদিবাসীরা বিশ্বাস করত, পৃথিবীর দেবী হুটাশ একটি জাদুর গাছের বীজ ব্যবহার করে তাদের দ্বীপেই তাদের সৃষ্টি করেছিলেন [অবশ্যই তখন এর নাম সান্তাক্রুজ ছিল না, কারণ এটি হচ্ছে স্প্যানিশ নাম], যিনি স্কাই স্নেক বা আসমানি সাপকে [আমরা মিল্কি ওয়ে নামে যাকে চিনি, গ্রামে কোনো অন্ধকার রাতে যা আপনি দেখতে পারবেন স্পষ্টভাবেই, কিন্তু শহরে নয়, কারণে আলোর দূষণ সেখানে খুব বেশি] বিয়ে করেছিলেন। দ্বীপে মানুষের সংখ্যা খুব বেশি পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল এবং, ঠিক গিলগামেসের মহাকাব্যের মতো, তারা খুব বেশি হট্টগোল করতে শুরু করেছিল যা বিরক্ত করেছিল দেবী হুটাশকে। এই গোলমাল তাঁকে সারা রাত জাগিয়ে রাখছিল, কিন্তু সবাই হত্যা করার বদলে, যেমনটা করেছিলেন ইহুদি আর সুমেরীয়দের দেবতারা, হুটাশ অপেক্ষাকৃত বেশি দয়ালু ছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন কিছু মানুষকে অবশ্যই এই দ্বীপ থেকে ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে চলে যেতে হবে, যেখানে তিনি তাদের গোলমাল শুনতে পাবেন না। সুতরাং তিনি তাদের জন্য একটি সেতু নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। আর সেই সেতুটি হচ্ছে… হ্যাঁ, রংধনু! 

এই পুরাণের একটি অদ্ভুত উপসংহার আছে। যখন মানুষ এই রংধনু সেতু দিয়ে পার হচ্ছিল, যারা বেশি গোলমাল করছিল, তারা নিচে তাকিয়ে ছিল, আর তারা এতটাই ভয় পেয়েছিল যে তাদের মাথা ঘুরতে শুরু করে, তারা রংধনু থেকে পড়ে যায় সমুদ্রে, যেখানে তারা ডলফিনে রূপান্তরিত হয়েছিল। 

সেতু হিসেবে রংধনুর ধারণাটা আমরা বহু পুরাণে আমরা দেখি। পুরনো নর্স [ভাইকিং] পুরাণে, রংধনুকে দেখা হয়েছে ভঙ্গুর সেতু হিসেবে যা দেবতারা ব্যবহার করেন স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আসার জন্য। অনেক মানুষ, যেমন পারস্যে, পশ্চিম আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকায়, রংধনুকে দেখেছে একটি বিশাল সাপের মতো যা মাটি থেকে উপরে উঠে গেছে বৃষ্টি পান করার জন্য। 

আমি ভাবি, কিভাবে এইসব কিংবদন্তিগুলোর শুরু হয়েছিল? কে তাদের বানিয়েছিল, কেন কিছু মানুষ একসময় বিশ্বাস করেছিল এই সবকিছু আসলেই ঘটেছিল? এই প্রশ্নগুলো আসলেই চমৎকার তবে উত্তর দেয়া সহজ নয়, কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারব : আসলেই রংধনু কী? 

রংধনুর সত্যিকারের জাদু 

যখন আমার বয়স প্রায় দশ, শিশুদের জন্য নির্মিত একটি নাটক দেখাতে লন্ডনে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যার নাম ছিল ‘হোয়ার দ্য রেইনবো এন্ডস’ [বা যেখানে রংধনু শেষ হয়]; প্রায় নিশ্চিতভাবে এটি দেখার কোনো সম্ভাবনা আপনার নেই কারণ এটি খুব বেশি মাত্রায়, চল নেই এমন দেশাত্মবোধে পূর্ণ, যা আধুনিক মঞ্চে উপস্থাপনের যোগ্য নয়। এটির মূল বিষয় ছিল কিভাবে ইংলিশ হওয়া মানে খুব অসাধারণভাবেই বিশেষ কিছু হওয়া এবং অভিযানের ঠিক চূড়ান্ত পর্যায়ে শিশুদের রক্ষা করেন সেইন্ট জর্জ [যিনি ইংল্যান্ডের পৃষ্ঠপোষক সাধু] [ব্রিটেনের নয়, কারণ স্কটল্যান্ড, ওয়েলস আর আয়ারল্যান্ডের জন্য আলাদা পৃষ্ঠপোষক সাধু আছেন]; কিন্তু যা আমার খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে সেটি সেইন্ট জর্জ নয়, বরং রংধনুটা। নাটকে শিশুরা আসলে সেই জায়গায় যায় সেখানে রংধনু তার পা মাটিতে গেঁথেছে, আর আমরা তাদের রংধনুর মধ্যেই হাঁটতে দেখেছিলাম যেখানে এটি মাটি স্পর্শ করেছিল। খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে বিষয়টি মঞ্চস্থ করা হয়েছিল, রঙিন স্পটলাইট থেকে আলো প্রক্ষেপ করা হয়েছিল কুণ্ডলী পাকিয়ে বের হয়ে আসা পানির বাষ্পের উপর এবং শিশুরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেখানে লাফালাফি করছিল। আমার মনে আছে ঠিক সেই মুহূর্তে চকচকে শিরস্ত্রাণ পরা সেইন্ট জর্জ আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং আমরা শিশুরা বিস্মিত হয়েছিলাম যখন মঞ্চের উপর শিশুরা চিৎকার করে উঠেছিল, ‘সেইন্ট জর্জ’! ‘সেইন্ট জর্জ’! ‘সেইন্ট জর্জ! 

কিন্তু রংধনুটাই মূলত আমার কল্পনাকে আবিষ্ট করেছিল, সেইন্ট জর্জ কোনো বিষয় নয় : কত চমৎকার নিশ্চয়ই লেগেছে একটি বিশাল রংধনুর ঠিক পায়ের মধ্যে দাঁড়াতে! 

আপনারা দেখতে পাচ্ছেন নাট্যকার কোথা থেকে ধারণাটি পেয়েছেন কোনো রংধনুকে দেখলে সত্যি মনে হবে কোনো বস্তু, আকাশে ঝুলে আছে, হয়তো কয়েক মাইল দূরে। মনে হয় যেন এর পা পুঁতে রেখেছে মাটিকে, যেমন ধরুন কোনো গমের ক্ষেতে বাম পা আর এর ডান পা [যদি আপনি ভাগ্যবান হন পুরো রংধনু দেখার] হয়তো কোনো পাহাড়ের উপর আপনি অনুভব করবেন যে হয়তো সরাসরি এর ভিতরে ঢুকতে পারবেন এবং ঠিক যেখানে রংধনু মাটি ছুয়েছে সেখানে দাঁড়াতে পারবেন, সেই নাটকের শিশুদের মতো। সব পুরাণ, যা আমি আপনাদের বর্ণনা করলাম, সেগুলোরও ঠিক একই মূলভাব আছে। রংধনুকে দেখা হয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বস্তু হিসেবে, যা কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ও নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। 

বেশ, আপনি সম্ভবত সমাধান করে ফেলেছেন যে বিষয়টি আসলে সে-রকম নয়! প্রথমত, যদি আপনি কোনো রংধনুর কাছাকাছি যেতে যান, আপনি যত দ্রুত দৌড়ান-না কেন, আপনি কখনোই সেখানে পৌঁছাতে পারবেন না। রংধনু আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত- না সেটি পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়। আপনি সেটি ধরতে পারবেন না, কিন্তু এটি আসলে দৌড়ে পালাচ্ছে না, কারণ এটি মোটেও কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। এটি একটি বিভ্রম, কিন্তু চমৎকার একটি বিভ্রম আর এটি বোঝার মাধ্যমে বহু জিনিসই আমরা জানতে পারি, সেই বিষয়গুলোর কিছু নিয়ে আমি পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব। 

আলো কী দিয়ে তৈরি? 

প্রথমে, আমাদের বোঝা দরকার সেই বিষয়টি যাকে বলা হয় বর্ণালি [Spectrum]; এটি আবিষ্কার হয়েছিল রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সময়, প্রায় ৩৫০ বছর আগে, আর এটি আবিষ্কার করেছিলেন আইজাক নিউটন, যিনি খুব সম্ভবত সর্বকালের সেরা একজন বিজ্ঞানী [বর্ণালি ছাড়াও তিনি অন্য অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছিলেন, যেমন আমরা দিন আর রাতের অধ্যায়ে দেখেছি]। নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন সাদা আলো আসলে অন্য সব আলোর মিশ্রণ। একজন বিজ্ঞানীর কাছে ‘সাদা’ বলতে আসলে সেটাই ‘বোঝায়’। 

কিন্তু কিভাবে নিউটন সেটি আবিষ্কার করেছিলেন? তিনি একটি পরীক্ষা করে সেটি দেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথমে তিনি তাঁর ঘরের পুরোটা অন্ধকার করে নিয়েছিলেন, যেন কোনো আলো সেখানে ঢুকতে না পারে, তারপর তিনি পর্দার সরু একটি ছিদ্র উন্মুক্ত করেছিলেন, যেন পেন্সিলের মতো সরু সূর্যের আলোর সাদা রশ্মি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। তারপর তিনি সেই আলোকরশ্মিকে একটি প্রিজমের মধ্যে দিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিলেন, প্রিজম হচ্ছে ত্রিভুজাকৃতির একটি টুকরো কাচ। 

কোনো একটি প্রিজম যা করে সেটি হচ্ছে, এটি সরু সাদা রশ্মিটিকে সেটি বিচ্ছুরিত করে, কিন্তু বিচ্ছুরিত রশ্মি যা প্রিজম থেকে বের হয়ে আসে সেটি আর সাদা নয়, বহু রঙের রংধনুর মতো, আর নিউটন তার বানানো সেই রংধনুর একটি নাম দেন : স্পেকট্রাম বা বর্ণালি। আর সেটি কাজ করে এভাবে। 

যখন আলোকরশ্মি বাতাসের মধ্যে যায় ও কাচের ভিতরে প্রবেশ করে এটি বেঁকে যায় [অর্থাৎ এর দিক পরিবর্তন করে]। এই বেঁকে যাওয়াকে বলে আলোর প্রতিসরণ। প্রতিসরণ সবসময় কাচ দিয়ে হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, পানিও সেটি করতে পারে, আর সেটি মনে রাখা দরকার যখন আমরা রংধনু নিয়ে কথা বলছি। এই প্রতিসরণের কারণে নৌকার বৈঠাকে পানির ভিতরে রাখলে মনে হয় যেন সেটি বেঁকে গেছে। এখন মূল বিষয়টি হচ্ছে, যে কোণে আলো বেঁকে যায় বিভিন্ন রঙের আলোর ক্ষেত্রে সেটি খানিকটা ভিন্ন। অর্থাৎ এটি নির্ভর করে আলোটি কোন রঙের, তার ওপর। 

নীল আলোর তুলনায় লাল রঙ তুলনামূলকভাবে অগভীর একটি কোণ তৈরি করে। সুতরাং যদি সাদা রঙ আসলেই রঙিন আলোদের একটি মিশ্ৰণ হয়, যেমনটি নিউটন অনুমান করেছিলেন, তাহলে কী হবে যদি একটি প্রিজমের মধ্যে দিয়ে সাদা আলোকে প্রতিসরিত করানো হয়? নীল আলো লাল আলোর চেয়ে বেশি বেঁকে যাবে, সুতরাং তারা পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যাবে যখন প্রিজমের অন্যদিক দিয়ে তারা বের হয়ে আসবে। হলুদ আর সবুজ রঙগুলো এর মাঝামাঝি জায়গা থেকে বের হয়ে আসবে। আর ফলাফল হচ্ছে নিউটনের স্পেকট্রাম : রংধনুর সব কটি রঙ, ঠিক যে ক্রমানুসারে রংধনুতে রঙগুলো সাজানো থাকে – লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি। 

নিউটন কিন্তু প্রথম বিজ্ঞানী ছিলেন না যিনি প্রিজম দিয়ে রংধনু বানিয়েছিলেন, অন্যরাও একই রকম ফলাফল পেয়েছিলেন, কিন্তু তারা ভেবেছিলেন কোনো-না-কোনোভাবে প্রিজম সাদা আলোকে রঙিন করে, যেমন—এর সাথে কোনো বিশেষ রঙ যোগ করার মাধ্যমে। নিউটনের ধারণাটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, তিনি ভেবেছিলেন সাদা আলো হচ্ছে অন্য সব রঙের আলোর একটি মিশ্রণ আর প্রিজম শুধুমাত্র তাদের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আর অবশ্যই তাঁর ধারণাটি সঠিক ছিল, আর তিনি সেই ধারণাটি আরো একজোড়া চমৎকার পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণও করে দিয়েছিলেন। প্রথম, তিনি তাঁর প্রিজম নিয়েছিলেন, আগের মতোই, কিন্তু যেখান থেকে আলো বের হয়ে আসছে সেখানে একটি সরু ছিদ্রসহ পর্দা রাখেন, সুতরাং যখন নানা রঙের আলো প্রিজম থেকে বের হয়ে আসছে, তখন যেন শুধুমাত্র তাদের একটি সেই ছিদ্র দিয়ে বের হতে পারে, ধরা যাক লাল আলো, সেই ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসলো, তারপর তিনি আরো একটি প্রিজম সেই সরু লাল আলোকরশ্মির পথে রাখেন, দ্বিতীয় প্রিজমটি আলোকে যথারীতি বাঁকিয়ে দেয়, কিন্তু যেটি বের হয়ে আসে সেটি শুধুমাত্র লাল আলো। কোনো অতিরিক্ত রঙ যুক্ত হয় না, যেমনটা হওয়ার কথা ছিল যদি প্রিজমটি রঙের মতো কিছু সেখানে যোগ করত। নিউটন যে ফলাফল পেয়েছিলেন, ঠিক সেটাই তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন, তাঁর তত্ত্বটির সমর্থনে, যে সাদা আলো আসলে অন্য সব রঙের আলোর মিশ্রণ। 

তাঁর দ্বিতীয় পরীক্ষাটি আরো বেশি উদ্ভাবনী ছিল, তিনটি প্রিজম ব্যবহার করেছিলেন তিনি, এটিকে বলা হয় নিউটনের ‘এক্সপেরিমেন্টাম ক্রুসিস, ল্যাটিন যে শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা’ অথবা, যেমন আমরা বলতে পারি, ‘সেই পরীক্ষা যা আসলেই বিতর্কটি জয় করেছে।’ 

সাদা আলো নিউটনের পর্দার ছিদ্র দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে প্রথম প্রিজমের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, যা সাদা আলোকরশ্মিকে বিচ্ছুরিত করে রংধনুর রঙে, এই রংধনু রঙগুলো তারপর একটি লেন্সের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে একসাথে নিউটনের দ্বিতীয় প্রিজমের দিকে, দ্বিতীয় প্রিজমের প্রভাব ছিল সেইসব রংধনু রঙগুলোকে একত্রে জড়ো করে আবার সাদা রঙের আলো বের করে দেয়া। এটি খুব স্পষ্টভাবেই নিউটনের প্রস্তাবনাটিকে প্রমাণ করেছিল, কিন্তু আরেকটু বেশি নিশ্চিত হবার জন্য, তিনি সেই সাদা আলোকরশ্মিটিকে তৃতীয় প্রিজম দিয়ে অতিক্রম করতে দেন, সেটি আবার সাদা রঙকে রংধনুর রঙে বিচ্ছুরিত করেছিল! এর চেয়ে আর কী পরিষ্কার প্রমাণ আপনি আশা করতেন, এটি প্রমাণ করেছিল সাদা আলো আসলে অন্য সব রঙের মিশ্রণ। 

কিভাবে বৃষ্টির ফোঁটা রংধনু বানায় 

প্রিজমের ব্যাপারটা না-হয় হল, কিন্তু যখন আপনি আকাশে কোনো রংধনু দেখেন, আকাশে তো কোনো বিশাল প্রিজম ঝুলে নেই, কিন্তু সেখানে লক্ষ লক্ষ বৃষ্টির পানির ফোঁটা আছে, সুতরাং প্রতিটি বৃষ্টির পানির ফোঁটা এক একটি প্রিজম হিসেবে কাজ করে? কিছুটা এ রকমই, তবে পুরোপুরিভাবে নয়। 

আপনি যদি একটি রংধনু দেখতে চান, তাহলে সূর্যকে অবশ্যই আপনার ‘পেছনের’ দিকে থাকতে হবে, যখন আপনি ঝড়বৃষ্টির দিকে তাকাবেন। প্রতি বৃষ্টির ফোঁটা প্রিজমের চেয়ে বরং বলের মতো গোলাকৃতির হয়, আলো যখন এরকরম কোনো পানির বলকে আঘাত করে, তখন আলো প্রিজমে আঘাত করলে যেমন আচরণ করত তার চেয়ে খানিকটা ভিন্নভাবে আচরণ করে। পার্থক্য হচ্ছে বৃষ্টির একটি ফোঁটার দূরের অন্য প্রান্তটি খুব ছোট একটি আয়নার মতো কাজ করে। আর সে- কারণে সূর্যকে আপনার পেছনে দরকার, যদি আপনি কোনো রংধনু দেখতে চান। সূর্য থেকে আলো প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে ডিগবাজি খায়, এটি প্রতিফলিত হয় পেছন আর নিচের দিক বরাবর, যখন এটি আপনার চোখে এসে পড়ে। 

এটি কাজ করে এভাবে। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, সূর্য আপনার ‘পেছনে’ ও উপরে, দূরে বৃষ্টির ঝাপটা দেখছেন। সূর্যের আলো একটি বৃষ্টির ফোঁটায় পড়ে [অবশ্যই এটি অরো অসংখ্য বৃষ্টির ফোঁটার উপরও পড়বে, অপেক্ষা করুন আমরা সেই আলোচনায় আসছি]; আসুন, সেই বিশেষ বৃষ্টির ফোঁটাটিকে আমরা নাম দেই বৃষ্টির ফোঁটা ‘ক’, সাদা আলোররশ্মি যখন ‘ক’-এর উপরের পৃষ্ঠে পড়ে, সেখানে এটি বেঁকে যায়, ঠিক যেমন করে এটি ঘটে নিউটনের প্রিজমের নিকট পৃষ্ঠের [দুটি মাধ্যমের বিভেদতল, এখানে বাতাস ও পানি] উপর এবং অবশ্যই লাল আলো নীল আলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বাঁকে বা দিক পরিবর্তন করে, সুতরাং স্পেকট্রাম [বর্ণালি] এরই মধ্যে নিজেকে সাজিয়ে ফেলে এবং এই রঙিন আলোকরশ্মিগুলো বৃষ্টির ফোঁটার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে যতক্ষণ-না এটি এর দূরের পৃষ্ঠে এসে পড়ে, এখানে আসার পর আলো বাতাসে প্রবেশ করার বদলে, সেখান থেকে প্রতিফলিত হয় বৃষ্টির ফোঁটার নিকট পৃষ্ঠের দিকে, এবার নিকট পৃষ্ঠের নিচের দিকে, আর যখন সেটি সেই দিক অতিক্রম করে, তারা আবার বেঁকে যায়। আবারো নীল আলোর তুলনায় লাল আলো কম বাঁকে। 

সুতরাং, যখন সূর্যের আলো বৃষ্টির কণা ছেড়ে যখন বের হয়ে আসে, এটি তখন এর সত্যিকার বর্ণালিতে পৃথক হয়ে বিচ্ছুরিত হয়। এই পৃথক হওয়া রঙিনরশ্মিগুলো একটি বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে দুবার ঘুরপাক খেয়ে যেখানে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন সেই বরাবর ছুটে যায়। যদি আপনার চোখ ঘটনাচক্রে ওইসব রশ্মির পথে থাকে, ধরুন সবুজ রঙ, আপনি বিশুদ্ধ সবুজ আলো দেখতে পাবেন, আপনার চেয়ে খাটো কেউ হয়তো দেখবে সেই ‘ক’ বৃষ্টিকণা থেকে লাল আলো আসছে, আপনার চেয়ে লম্বা কেউ হয়তো সেখানে নীল রঙ দেখবে। 

কেউই একটিমাত্র বৃষ্টিকণা থেকে আসা পুরো বর্ণালিটিকে দেখতে পারে না। আপনারা প্রত্যেকেই যে-কোনো একটি বিশুদ্ধ রঙ দেখেন, কিন্তু তারপরও আপনি বলবেন যে আপনি একটি রংধনু দেখছেন, সব রঙ সহ। কিভাবে? বেশ, এ পর্যন্ত, আমরা শুধু একটি বৃষ্টির ফোঁটার কথা বলছি, যার নামে দিয়েছিলাম ‘ক’, কিন্তু আরো বহু মিলিয়ন সংখ্যক বৃষ্টির ফোঁটা আছে, তারা সবাই একইভাবে আচরণ করে। যখন আপনি ‘ক’-এর লালরশ্মির দিকে তাকিয়ে আছেন, তখন অন্য আরেকটি বৃষ্টির ফোঁটা, ‘খ’, যা ‘ক’-এর চেয়ে নিচে অবস্থিত, আপনি কিন্তু ‘খ’-এর লালরশ্মি দেখতে পাচ্ছেন না, সেটি আপনার পেটে গিয়ে পড়ছে, কিন্তু ‘খ’-এর থেকে বেরিয়ে আসা বর্ণালির নীল আলো আপনার চোখের উপর পড়ার জন্যে ঠিক সঠিক অবস্থানেই আছে। আর আরো অন্য বৃষ্টির ফোঁটা আছে যা ‘ক’-এর নিচে কিন্তু ‘খ’-এর উপরে, যার লাল বা নীল দুটো আলোই আপনার চোখে পড়ে না, কিন্তু তার হলুদ বা সবুজ আলো ঠিকই আপনার চোখে পড়ে, সুতরাং অনেক বৃষ্টির ফোঁটা একসাথে যুক্ত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বর্ণালি তৈরি করে, একটি রেখায়, উপরে আর নিচে। 

কিন্তু উপর-নিচ বরাবর রেখা কোনো রংধনু নয়। তাহলে রংধনুর বাকিটা কোথা থেকে আসে? ভুলে যাবেন না আরো বৃষ্টির ফোঁটা আছে, বৃষ্টির ধারার এক পাশ থেকে অন্য পাশ অবধি বিস্তৃত এবং নানা উচ্চতায় এবং অবশ্যই তারাই আপনার বাকি রংধনুটি পূর্ণ করবে। প্রতি রংধনু যা আপনি দেখছেন, প্রসঙ্গক্রমে, চেষ্টা করে একটি সম্পুর্ণ বৃত্ত তৈরি করতে, যার কেন্দ্রে থাকে আপনার চোখ; ঠিক যেমন পুরোপুরি বৃত্তাকার রংধনু আপনি কখনো কখনো দেখেন, যখন বাগানে নল দিয়ে ছিটিয়ে পানি দেন এবং পানির সেই ছিটকে পড়া প্রবাহের মধ্যে যখন সূর্যের আলো প্রবেশ করে। আপনি পুরো বৃত্তাকার রংধনু দেখতে পান না তার একমাত্র কারণ হচ্ছে মাটি বাধা দেয়। 

আর সে-কারণেই আপনি একটি রংধনু দেখেন কোনো এক সেকেন্ডের কিছু অংশ ব্যাপী, কিন্তু এর পরের সেকেন্ডের একটি অংশে, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আরো নিচে নেমে আসে। ‘ক’ নেমে আসে ‘খ’ যেখানে ছিল, তাই আপনি এখন ‘ক’-এর সবুজ আলোর বদলে নীল আলো দেখতে পান, যদিও আপনি আর ‘খ’ থেকে আসা কোনো রশ্মি দেখতে পান না [যদিও আপনার পায়ের কাছে থাকা কোনো কুকুর সেটি দেখতে পায়, আর একটি নতুন বৃষ্টির ফোঁটা, [‘গ’ যার রশ্মি আপনি আগে একেবারে দেখেননি] সেটি এখন নেমে আসে সেই জায়গায় যেখানে ‘ক’ ছিল, আর এখন আপনি লালরশ্মি দেখতে পাচ্ছেন। 

আর সে-কারণে একটি রংধনুকে দেখে মনে হয় সেটি এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে যদিও বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যা এটি তৈরি করেছে তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে এর মধ্য দিয়ে নিচে পড়তে থাকে। 

সঠিক তরঙ্গদৈর্ঘ্য? 

এবার আসুন দেখি কোনো একটি বর্ণালির সাজানো রঙগুলো, লাল থেকে কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল থেকে বেগুনি—আসলেই কী। লাল আলোর কী বৈশিষ্ট্য আছে যে প্রতিসরণের সময় এটিকে নীল রঙের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম গভীর কোণে বাঁকায়? 

আলোকে ভাইব্রেশন বা কম্পন হিসেবে ভাবা যেতে পারে : ওয়েভ অর্থাৎ তরঙ্গ। ঠিক যেমন বাতাসে কম্পন হচ্ছে শব্দ, আলো আসলে তৈরি হয় ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ভাইব্রেশন বা তড়িৎচুম্বকীয় কম্পন দিয়ে। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ভাইব্রেশন আসলে কী সেটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব না আমি, কারণ সেটি করতে অনেক সময় লাগবে ও দীর্ঘ আলোচনা হবে [আর বিষয়টি ঠিকমতো বুঝতে পেরেছি কিনা আমিও নিশ্চিত নই], কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে এখানে, যদিও আলো শব্দ থেকে খুব আলাদা, আমরা যেমন শব্দের ক্ষেত্রে বলি, আলোর ক্ষেত্রেও উচ্চ-কম্পাঙ্ক [ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য] এবং নিম্ন-কম্পাঙ্কসহ [দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য] কম্পনের কথা বলতে পারি। উচ্চ স্বরগ্রাম [বা হাই-পিচ], ট্রেবল বা সোপরানো, মানে উচ্চ-কম্পাঙ্ক কম্পন বা ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য। নিম্ন-কম্পাঙ্ক বা দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য, শব্দ হচ্ছে গভীর, নিচু খাদের, ‘বেইস’ শব্দ। এর সমতুল্য আলো হচ্ছে লাল [দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য] হচ্ছে ‘বেইস’, হলুদ হচ্ছে ‘ব্যারিটোন’, সবুজ হচ্ছে ‘টেনোর’, নীল হচ্ছে ‘আলটো’ আর বেগুনি হচ্ছে [ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য] হচ্ছে ‘ট্রেবল’। 

কিছু শব্দ আছে যেগুলো অনেক উচ্চ-স্বরগ্রামের বা হাই পিচড়, যা আমরা শুনতে পারি না। তাদের বলা হয় আল্ট্রা-সাউন্ড; বাদুড়েরা সেটি শুনতে পারে এবং এই ধরনের শব্দের প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে তারা চলাফেরা করে। এছাড়াও কিছু শব্দ আছে যার কম্পাঙ্ক অনেক কম, আমরা শুনতে পাই না : হয়তো আপনার শরীরে ‘কম্পন’ হিসেবে তা আপনি অনুভব করতে পারেন। শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে ব্যান্ড বা সীমা আমরা মানুষেরা শুনতে পাই সেটি মধ্যম কম্পাঙ্কের, আলট্রা সাউন্ড, আমাদের শোনার জন্য যা অনেক বেশি বা শ্রাব্যতার সীমানার উপরে [কিন্তু বাদুড়দের জন্য নয়] আর ইনফ্রাসাউন্ডের মাঝে, [যা আমাদের জন্য অনেক কম শোনার জন্য বা শ্রাব্যতার সীমানার নিচে, কিন্তু হাতিদের জন্য নয়]। 

আলোর ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইভাবে সত্যি। আলট্রাসাউন্ডে করা বাদুড়ের ডাকের সমতুল্য রঙ হচ্ছে অতিবেগুনি রশ্মি, আলট্রা-ভায়োলেট, যার মানে ‘বেগুনি ছাড়িয়ে’। যদিও আমরা অতিবেগুনি রশ্মি খালি চোখে দেখতে পাই না, কীটপতঙ্গরা সেটি দেখতে পায়। কিছু ফুল আছে কীটপতঙ্গদের আকৃষ্ট করার জন্যে যাদের উপর নানা দাগকাটা আর নকশা-আঁকা থাকে যেন তারা পরাগায়ন করতে আসে, যে নকশা দাগগুলো দেখতে পাওয়া যায় অতিবেগুনি রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমানায়, পতঙ্গদের চোখ সেটি দেখতে পায় না, কিন্তু সেই নকশাটিকে বর্ণালির দৃশ্যমান অংশের ভাষায় অনুবাদ করার জন্যে আমাদের বিশেষ যন্ত্রের দরকার হয়। যেমন—ইভিনিং প্রিমরোজ ফুল আমাদের কাছে হলুদ রঙের একটি ফুল, কোনো নকশা নেই, কোনো দাগ নেই, কিন্তু অতিবেগুনি রশ্মির নিচে আপনি যদি তাদের ছবি তোলেন, সেখানে আপনি বিস্ফোরিত নক্ষত্রের মতো দাগকাটা দেখতে পাবেন। 

বর্ণালি ক্রমশ আরো বেশি কম্পাঙ্কের দিকে বাড়তে থাকে, অতিবেগুনি থেকে আরো দূরে, এমনকি পতঙ্গরাও দেখতে পায় না, এক্স-রে-কে ‘আলো’ হিসেবে ভাবা যেতে পারে যার স্বরগ্রাম বা পিচ অতিবেগুনি রশ্মির থেকেও বেশি। আর গামা রে আরো বেশি উপরে। 

এই বর্ণালির অন্য দিকে, পতঙ্গরা কিন্তু লাল দেখতে পায় না, কিন্তু আমরা পারি। লালের পরে আছে ইনফ্রা-রেড [অবলোহিত], যা আমরা দেখতে পাই না, যদিও আমরা এটিকে তাপ হিসেবে অনুভব করতে পারি [আর কিছু সাপ এই ইনফ্রা-রেডের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল, যারা এটি তাদের শিকার ধরার জন্যে ব্যবহার করে]। মৌমাছিদের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে ইনফ্রা-অরেঞ্জ। ইনফ্রা-রেড থেকে আরো নিচু খাদের বা ‘বেইস নোট’ হচ্ছে ‘মাইক্রোওয়েভ’, যা আমরা রান্না করতে ব্যবহার করি। আর আরো নিচু খাদের বা গভীর ‘বেইস’ [আরো দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য] হচ্ছে রেডিও ওয়েভ। 

আর যে বিষয়টি খানিকটা বিস্ময়কর সেটি হচ্ছে যে আলো আমরা মানুষেরা আসলে দেখতে পারি, দৃশ্যমান আলোর বর্ণালি বা ‘রংধনু’, খানিকটা ‘উচ্চ-স্বরগ্রাম’ বা কম্পাঙ্কের বেগুনি আর খানিকটা ‘নিম্ন স্বরগ্রাম’ বা নিম্ন-কম্পাঙ্কের লালের মাঝামাঝি অংশ, সেটি অতি উচ্চ- কম্পাঙ্ক প্রান্তের গামা রশ্মি থেকে অতি নিম্ন-কম্পাঙ্কের রেডিওতরঙ্গের সুবিশাল বিস্তৃত পরিসরে বর্ণালি বা স্পেকট্রামের খুব সামান্য একটি অংশ। প্রায় পুরো স্পেকট্রামটি আমাদের চোখে অদৃশ্য। 

সূর্য আর নক্ষত্রেরা সব কম্পাঙ্ক বা ‘স্বরগ্রামের’ তড়িৎচুম্বকীয় রশ্মি পাম্প করে বের করে দিচ্ছে, সেই রেডিওতরঙ্গের ‘বেইস’ প্ৰান্ত থেকে গামা রশ্মির ‘ট্রেবল’ [বা উচ্চ-স্বরগ্রাম প্রান্ত]। যদিও আমরা এই সরু ব্যান্ড বা সীমানার দৃশ্যমান আলোর অংশের বাইরে কিছু দেখতে পাই না, কিন্তু আমাদের কিছু যন্ত্র আছে যা দিয়ে আমরা এইসব অদৃশ্য রশ্মির অস্তিত্ব শনাক্ত করতে পারি। 

রেডিও অ্যাস্টোনোমার বিজ্ঞানীরা সেই নক্ষত্রদের ‘ছবি’ তোলেন আলো কিংবা এক্স-রে নয়, রেডিও বা বেতারতরঙ্গ ব্যবহার করে। আর তাঁরা যে যন্ত্র ব্যবহার করেন সেটিকে বলে রেডিও টেলিস্কোপ। অন্য বিজ্ঞানীরা আকাশের ছবি তোলেন বর্ণালির অন্য প্রান্ত ব্যবহার করে, এক্স- রে সীমানায়। বর্ণালির বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে আমরা নক্ষত্র ও মহাবিশ্ব সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন জিনিস শিখতে পারি। বাস্তবতা হচ্ছে যে আমাদের চোখ বিস্তৃত পরিসরের একটি বর্ণালি বা স্পেকট্রামের শুধুমাত্র মাঝখানে একটি খুব সরু ছিদ্র দিয়ে দেখতে পারে, আর বৈজ্ঞানিক যন্ত্র দিয়ে দেখা সম্ভব সুবিশাল স্পেকট্রামের খুব সামান্য একটি অংশ আমরা দেখতে পারি মাত্র। আর এটি বিজ্ঞানের ক্ষমতার একটি চমৎকার উদাহরণ যা আমাদের কল্পনাকে উত্তেজিত করে : বাস্তবতার জাদুর একটি চমৎকার উদাহরণ। 

পরের অধ্যায়ে রংধনু নিয়ে আরো অনেক চমৎকার বিষয় আমরা শিখব। দূরের কোনো নক্ষত্র থেকে আসা আলোর বিচ্ছুরিত বর্ণালি আমাদের শুধুমাত্র নক্ষত্রেরা কী দিয়ে তৈরি সেটিই বলে না, এছাড়াও আমরা তাদের বয়স জানতে পারি। আর এই ধরনের প্রমাণগুলো, রংধনু প্রমাণ, এই মহাবিশ্বের বয়স কত আমাদের আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছিল : কখন এটির সবকিছুর সূচনা হয়েছিল? শুনলে মনে হতে পারে বিষয়টি কিভাবে সম্ভব কিন্তু পরের অধ্যায়ে সবকিছুই উন্মোচিত হবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *